Banner
পঞ্চম অধ্যায় : পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন : বিপ্লবী প্রজন্মের উত্থান

লিখেছেনঃ শামসুজ্জোহা মানিক, আপডেটঃ July 18, 2013, 4:56 AM, Hits: 2404

তখন মোহম্মদ ফরহাদের মাধ্যমে অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে ছাত্র নেতা কাজী জাফর আহমদের দ্বন্দ্ব তুঙ্গে। ’৬২-এর ছাত্র আন্দোলনের এবং পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নেরও অন্যতম নেতা মোহাম্মদ ফরহাদ গোপনে থেকে কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষ থেকে ছাত্র ইউনিয়নকে পরিচালনা করতেন। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন নেতা কাজী জাফর আহমদের সঙ্গে কমিউনিস্ট নেতা মোহাম্মদ ফরহাদের দ্বন্দ্বটা ছাত্র ইউনিয়নের নূতন কমিটি কাদের নিয়ে হবে এই প্রশ্নে আরও তীব্র হয়। শেষ পর্যন্ত উভয় পক্ষ ছাত্র ইউনিয়নের ঐক্যবদ্ধ কমিটি গঠনের ব্যাপারে একমত হন। তাতে ঠিক হয় আমাকে জেনারেল সেক্রেটারী করে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের নূতন কমিটি গঠন করা হবে। এবং আমার যতদূর মনে পড়ছে এই সঙ্গে প্রেসিডেন্ট হিসাবে মতিয়া চৌধুরীর নাম আসে মোহাম্মদ ফরহাদের কাছ থেকে এবং সেটা কাজী জাফর গ্রহণ করেন।

অন্তত এটাই ছিল আমার কাছে কাজী জাফর আহমদের ভাষ্য। কাজী জাফর আহমদ আমাকে প্রস্তাবটা দিলে আমি ঐ পদ নিতে অস্বীকার করি এবং রাশেদ খান মেননকে প্রেসিডেন্ট বা জেনারেল সেক্রেটারী যে কোনও একটা পদ দিয়ে পার্টির সঙ্গে সমঝোতায় যেতে বলি। কিন্তু পার্টি তাতে রাজী হয় নি। ফলে ছাত্র ইউনিয়ন দ্বিধা বিভক্ত হয়। কাজী জাফর আহমদ এই ভাঙ্গনের পর একদিন আমাকে অনুযোগ করে বলেন, ‘আপনি যদি সাধারণ সম্পাদকের পদটা নিতে রাজী হতেন তাহলে ছাত্র ইউনিয়ন ভাঙ্গত না।’

আসলে কি তাই? ভাঙ্গত। কেন ভাঙ্গত সেই কথাই এখন আমি বলি এবং কারা এর জন্য দায়ী সেটাও খুব সংক্ষেপে বলি। কারণ এই ঘটনার তাৎপর্য না বুঝলে এ দেশে কমিউনিস্ট পার্টির ভূমিকার প্রকৃত তাৎপর্যও বোঝা যাবে না। তার আগে বলে নিই কেন আমি সে দিন নেতৃত্বের জন্য অভিলাষী হই নি।

আমি জানতাম যে, বিভিন্ন কারণেই আমার সামনে যাবার সময় হয় নি। আমার কাজ হল ভিতরে থেকে একটা অগ্রগামী সামাজিক-রাজনৈতিক শক্তি গড়ে তোলা। বিশেষত আমার সময়ের তুলনায় আমার যে অগ্রগামী চিন্তা-আকাঙ্ক্ষা ছিল সেটা গণ-রাজনীতির দায়িত্ব নিলে আমার পক্ষে আর এগিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়। কারণ আমি সহজাত বুদ্ধিবশে বুঝতাম যাঁরা গণ-রাজনীতি করেন, জন-নেতা হন তাঁরা নূতন চেতনাকে সমাজে সৃষ্টি করতে বা নেতৃত্ব দিতে পারেন না সেইভাবে। আসলে তাঁরা সমাজের গড় চেতনাকে প্রতিনিধিত্ব করেন। বেশী এগোতে চাইলে তারা সমাজ ও গণ-রাজনীতি এবং গণ-আন্দোলনের মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হন। তবে যে জননেতা উচ্চাকাঙ্ক্ষী হন তিনি সমাজের ভিতর যখন উচ্চাকাঙ্ক্ষী শক্তিগুলোর অভ্যুদয় ঘটতে দেখেন তখন সেগুলোকেও প্রতিনিধিত্ব করতে চান নিজের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চেয়ে। তবে এগুলোর সঙ্গে তাঁর একটা দ্বন্দ্বও থাকে। যাইহোক, একটা বিপ্লবী রাজনীতি গড়ে তুলতে হলে প্রকাশ্য ও গোপন উভয় ধারার সমন্বয় ঘটাতে হয়। একটা বাদ দিলে অপরটা পঙ্গু হয়। আমি বেছে নিয়েছিলাম গোপন ধারাটিকে আমার কাজের প্রধান ক্ষেত্র হিসাবে। অর্থাৎ ছাত্র আন্দোলন ও সংগঠনে থেকে এবং তার যাবতীয় কাজ করেই আমি একটা নূতন অগ্রগামী ও বিপ্লবী চেতনার শক্তি গড়ে তোলার কাজটাকে আমার মূল দায়িত্ব হিসাবে বেছে নিয়েছিলাম।

১৯৬৪ সালে আমি প্রথম কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে সংযুক্ত হই। আমি যেহেতু পার্টির সঙ্গে সংযুক্ত ছিলাম সেহেতু মোহাম্মদ ফরহাদ হয়তো ভেবেছিলেন যে, আমাকে তাঁর পক্ষে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে। যদিও আমার চিন্তার কিছু স্বাতন্ত্র্য এবং কাজী জাফরের সঙ্গে আমার সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতাও তাঁর জানা ছিল। তবে আমি ছিলাম সকলেরই ঘনিষ্ঠ। কারো প্রতি ব্যক্তিগত কারণে দুর্বলতা বা বিদ্বেষ আমার ছিল না। অন্যদিকে, কাজী জাফর আহমদ জানতেন যে, আমার সহানুভূতিটা তাঁর দিকেই বেশী। এবং সেই সঙ্গে তিনি আমার বিপ্লবী চিন্তা-ভাবনা সম্পর্কেও জানতেন। ফলে এমন একটা সমঝোতা হয়তো অসম্ভব ছিল না।

তবু ছাত্র ইউনিয়ন ভাঙ্গত। কারণ কমিউনিস্ট পার্টি সেটা ভাঙ্গতে চেয়েছিল। আমি দায়িত্ব নিলে আমার সঙ্গে বিরোধটা ব্যক্তিগত রূপ না নিলেও রাজনৈতিক রূপ নিয়ে হলেও ছাত্র ইউনিয়ন ভাঙ্গত। হয়তো আমাকে তাঁরা একটা রাজনৈতিক লড়াই করতে দেবার সুযোগই দিতেন না। আমার সে কালের ছাত্র ইউনিয়নের ভিতরে কমিউনিস্ট নেতৃত্বের শক্তি ও ক্ষমতার রূপটা জানা আছে।

এখানে দীর্ঘ আলোচনা করা সম্ভব নয়। তবে সে কালে ছাত্র ইউনিয়নের ভাঙ্গনের ভিতরের ইতিহাস এবং তাৎপর্য নিয়ে নূতনভাবে আলোচনা এবং অনুসন্ধান হওয়া দরকার। কারণ আমি মনে করি এই আলোচনা এবং অনুসন্ধানের মধ্য দিয়ে বেরিয়ে আসবে ’৬২-এর ছাত্র আন্দোলনের ভিতর দিয়ে এ দেশে সে কালে বাঙ্গালী জাতির সেকিউলার, গণতান্ত্রিক এবং বিপ্লবী নেতৃত্বের শক্তির যে উত্থান সম্ভাবনা রচিত হয়েছিল ছাত্র ইউনিয়নের অকাল ভাঙ্গন দ্বারা কিভাবে সেটাকে ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়েছে সেই ইতিহাস।

এ কথাগুলো আমি খুব ভালভাবে না জেনে, না দেখে, না বুঝে শুধু অনুমান থেকে বলছি না। আমি উভয় পক্ষকে খুব কাছে থেকে দেখেছি। দেখেছি অনেক কিছু। উভয়ের সঙ্গে থেকে উভয়ের অভিযোগ শুনেছি, যাচাই করেছি। এবং কমিউনিস্ট পার্টির ছাত্র ফন্সন্টের সঙ্গে থেকে দেখেছি কিভাবে কাজী জাফরের বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচারের যন্ত্রটাকে চালু করা হয়েছে। কিভাবে চক্রান্তের জাল বিছানো হয়েছে একটা সম্ভাবনাকে ধ্বংস করার জন্য। আমি আপ্রাণ চেষ্টা করেছি ছাত্র ইউনিয়নের অনিবার্য ভাঙ্গন ঠেকানোর জন্য। আর সেখানে আমার কাছে সুস্পষ্টভাবে ধরা পড়েছে কমিউনিস্ট পার্টি কিভাবে ছাত্র ইউনিয়নকে অন্যায় ও অবৈধভাবে বিভক্ত করার কাজটাকে সম্পূর্ণ করল। হাঁ, ছাত্র ইউনিয়নকে বিভক্ত করার সম্পূর্ণ দায়-দায়িত্ব আমি সে কালের মস্কোপন্থী অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির উপর অর্পণ করি। সে কাজটা তারা করেছিল যাতে বাম আন্দোলনের ভিতর থেকে কোনো স্বাধীন এবং বিপ্লবী জাতীয়তাবাদী নেতৃত্বের শক্তির অভ্যুদয় না ঘটে সেই উদ্দেশ্যে।

ছাত্র নেতা কাজী জাফরের অনেক সীমাবদ্ধতা ছিল, ত্রুটি ছিল। আমি তাঁর অনেক জুনিয়র হওয়া সত্ত্বেও তাঁকে সেগুলো ধরিয়ে দিতাম এবং কাটিয়ে উঠতে বলতাম। কিন্তু তবু বলব আমি আমার রাজনৈতিক জীবনে ভাসানী ছাড়া নেতৃত্বের গুণাবলীর এত বেশী সমাহার আর কারো মধ্যে দেখি নি। অবশ্য ভাসানীর সঙ্গে তাঁর তুলনা চলে না। দু’জনের প্রেক্ষিতও আলাদা।

সবচেয়ে বড় কথা ১৯৬২-এর ছাত্র অভ্যুথানের উত্থান প্রক্রিয়া ও তাৎপর্য বুঝতে হবে। ’৬২-এর ছাত্র অভ্যুথানের মধ্য দিয়ে সবচেয়ে জনপ্রিয়, সবচেয়ে সম্ভাবনাময় ও সবচেয়ে উচ্চাকাঙ্ক্ষী যে নেতার উদ্ভব হয় তার জায়গাটা পরবর্তী কালে কোনো সর্বগুণে গুণান্বিত নেতার পক্ষেও নেওয়া সম্ভব ছিল না। ’৬২-এর ছাত্র আন্দোলন এমন আন্দোলন যা প্রতি বৎসর ঘটে না যে প্রতি বৎসর তা থেকে নেতা বেরিয়ে আসবে, যে নেতা জাতির দৃষ্টির কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠার সুযোগ পাবে। এমন নেতা গাছের মওসুমী ফল নয় যে, গাছে ঝাঁকুনি দিলেই টুপ করে খসে পড়বে। এটা একটা যুগের সৃষ্টি, যার পিছনে থাকে অনেক যুগের বহু মানুষের সাধনা।

না, আমাদের চাই একবারে হীরের টুকরো। অথচ ঐ হীরাটা যে, ময়লা কয়লার ভিতর থাকে, ওটাকে অনেক শ্রমে সেখান থেকে বের করে নিতে হয়, তারপর কাটতে হয় নিপুণ হাতে সেই বোধটাই আমাদের নেই। এই জাতির দুর্ভাগ্য এই যে, তার চাই সব তৈরী, তা লালন করতে জানে না, গড়ে নিতে জানে না। সেই শ্রম, মেধা, ধৈর্য, ঔদার্য, দূরদৃষ্টি তার কোথায়?

এটা বোঝা দরকার যে, ১৯৬২-তে যে প্রজন্মের উত্থান, ’৬৯-এর গণ-অভ্যুথানের মধ্য দিয়ে তাই বিকশিত, বিস্তৃত হয়ে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধে তার জায়গাটা খুঁজে নিয়েছে। ’৬২-এর ছাত্র আন্দোলনের মধ্য দিয়ে উথিত কাজী জাফর ছিলেন সেই প্রজন্মের সবচেয়ে সম্ভাবনাময় নেতা। কাজী জাফর ছিলেন ছাত্র জননেতা। এ দেশের জননেতার মধ্যে সচরাচর যেসব দোষ-গুণের সমাহার ঘটতে পারে সেসব তাঁর মধ্যেও কম-বেশী ছিল। তবু তাঁর মধ্যেই ছিল সবচেয়ে বেশী নূতন শক্তি ও তেজকে ধারণ করার ক্ষমতা।

আমার মনে আছে ১৯৬৩ অথবা ১৯৬৪-তে যখন একদিন তাঁকে পূর্ব বাংলা স্বাধীন করার লক্ষ্যে আমাদের কাজ করার প্রয়োজনের কথা বলি তখন তিনি আমার সঙ্গে একমত হন। তবে এই লক্ষ্যকে এগিয়ে নেবার ক্ষমতা তাঁর ছিল না। কারণ সেই কাজটা সেইভাবে সেই কালে কোনও জননেতার পক্ষেই করা সম্ভব বা উচিত কোনটাই ছিল না। ওটা ছিল আমার মত পিছন সারির কর্মীর কাজ। কিন্তু আমার ধারণা যে, বিপ্লবী ও জাতীয়তাবাদী চেতনার বিস্তারে তিনি যে শুধু বাধা হতেন না তাই নয় উপরন্তু জননেতা হিসাবে তিনি হতেন এটার ধারক। কারণ জননেতার সেটা বৈশিষ্ট্য। যে জননেতা যে ধারায় বেড়ে ওঠে সেই ধারার ভিতরকার প্রবলতর প্রবণতা বা শক্তিগুলোর সে সহায়ক হয় জাতীয় রাজনীতিতে তার প্রাধান্য বিস্তারের প্রয়োজনেই। হয়তো এক সময় কাজী জাফর বাধা হতেন। কিন্তু তত দিনে নূতন বেড়ে ওঠা শক্তির চাপটা এত বেশী প্রবল হত যে, হয় তিনি ঝরে যেতেন নূতন আর কাউকে জায়গাটা ছেড়ে দেবার প্রয়োজনে নয় তিনি যোগ্যতর হয়ে উঠে আরও এগিয়ে যেতেন।

কিন্তু সেসব কিছু ঘটল না। অকাল ভাঙ্গনের সুযোগ নিতে চীনপন্থী কমিউনিস্ট নেতারা বেরিয়ে এলেন। ক্রমে তাঁরা তাঁকে যেখানে নেবার সেখানে নিলেন।

আমি সেই সময়ের ছাত্র আন্দোলনের একজন সক্রিয় কর্মী হিসাবে দেখেছি এবং বুঝেছি, ঐ অকাল ভাঙ্গন এ দেশের প্রগতিশীল ও বিপ্লবী আন্দোলনের কি ভয়ঙ্কর ক্ষতিটা করে দিয়ে গেছে। যে এক ঝাঁক মেধাবী ও উচ্চাকাঙ্ক্ষী তরুণের উদ্ভব হচ্ছিল যারা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে রাজনীতির দিকে ঝুঁকছিল এবং সেটা সেকালে তাদের জাতীয় রাজনীতির দিকে টেনে নিতে পারত তারা সকলে হতাশ হল। যে সর্বগ্রাসী হতাশা ও অনাস্থা সেদিন জাল বিস্তার করেছিল তাতে তারা দলে দলে ধরা পড়ল। কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গেকার রাজনীতি সচেতন, আদর্শনিষ্ঠ ও মেধাবী ছাত্রদের ব্যাপক অংশটাই রয়ে গেল পার্টির সঙ্গে। কারণ ভাঙ্গনটা তাদের কাছে রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের ফল নয়, ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বের ফল! সেখানে তারা পোষমানা হল, পঙ্গু হল। ব্যক্তিকে অবলম্বন করে যে রাজনীতিটা উঠে আসে সেটাকে আগেই শেষ করা হল। বাকী মেধাবী ছাত্ররা বসে পড়ল। তখন আর রাজনীতির দিকে নয়, বরং তাদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা ধাবিত হল সেদিকে যেদিকে গেলে সিএসপি, নানাবিধ বেসামরিক আমলা অথবা নিদেন পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হওয়া যায়। ভিন্ন এক পথ ধরে তাদের রাজনৈতিক নেতা হলেন কাজী জাফর আহমদ।

যে মেধাবী তরুণেরা জাতিকে নেতৃত্বে দিতে পারত তারা আর এল না। কিন্তু সারা দেশে ঢাকার হতাশা এতটা ছড়ায় নি। সেখানে দলে দলে তরুণ কর্মী বের হল কলেজগুলো থেকে, মফস্বলের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। তারা কৃষকের মধ্যে, শ্রমিকের মধ্যে, মধ্যবিত্তের মধ্যে, জনগণের বিভিন্ন অংশের মধ্যে গেল। এরাই হল মূলত পিকিংপন্থী কমিউনিস্ট নেতৃত্বের শ্রেণী সংগ্রামের নামে খণ্ডিত দৃষ্টিভঙ্গীর রাজনীতির সবচেয়ে বড় ভিত্তি। অনেকে সেকালের তুলনায় অনেক অগ্রগামী, এমন কি অসাধারণ মেধার অধিকারী হলেও তাদের পক্ষে জাতীয় রাজনীতির গুরুত্ব ও তাৎপর্য বোঝা সহজ ছিল না।

কারণ রাজনৈতিক জাতির সৃষ্টি গ্রামে নয়, বরং নগরে, রাজধানীতেই ঘটে। জাতি চেতনা, জাতীয়তা বোধ জাগে রাজধানী নগরকে কেন্দ্র করে। এর আগে জাতি প্রকৃতপক্ষে অসংগঠিত জাতিসত্তা মাত্র। সংগঠিত জাতি বোধ, জাতীয় রাজনীতি চেতনা গ্রাম বা মফস্বল থেকে কিভাবে উদ্ভূত হবে যদি তার কেন্দ্রে জাতির রাজধানী না থাকে, এবং রাজধানীর শক্তি না থাকে গ্রামগুলোর বিভক্ত চেতনাকে কেন্দ্রীভূত করার?

বাঙ্গালীর সচেতন ও সংহত জাতি গঠনের, তার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের আকাঙ্ক্ষার প্রকৃত স্ফুরণটা সেকালে সম্ভব ছিল কেবলমাত্র ঢাকার তরুণ বিপ্লবীদের মধ্যেই। কিন্তু ঢাকার রাজনীতিতে জাতীয়তাবাদী বিপ্লবী ছাত্র-তরুণ শক্তির পরবর্তী ঢেউ উঠতে অনেক দেরী হয়ে গেল। ’৬৮-’৬৯-এ। ইতিমধ্যে সারা দেশে বাম আন্দোলনের যে বিরাট বুনিয়াদ গড়ে উঠেছে তার স্থানিক ও জাতি খণ্ডনকারী শক্তি জাতি চেতনা এবং জাতির গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠন চেতনার শক্তির চেয়ে অনেক বেশী। সুতরাং বাম আন্দোলন হয়ে উঠল শ্রেণী সংগ্রামের নামে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার পরিবর্তে বিভক্ত করার ক্ষেত্রে পুরাতন বাম নেতৃত্বের চমৎকার হাতিয়ার। যে শ্রেণী সংগ্রাম সেকিউলার জাতি ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সহায়ক হতে পারত সেটা হল তার বিপরীতটা।

সেদিন মস্কোপন্থী কমিউনিস্ট নেতৃত্ব যদি এই অপকর্মটি না করতেন তাহলে সম্ভবত কাজী জাফর জাতির এক বিরাট প্রয়োজন তাঁর ইচ্ছায় হোক অনিচ্ছায় হোক পূরণ করতে বাধ্য হতেন। তাঁর ছিল রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষাফলে জাতীয় রাজনীতিতে নেতৃত্বে দিতে চেয়ে তিনি সে কালের প্রজন্মকে ডেকে নিতেন রাজনীতির পথে। তাঁর যে ক্যারিজমা সৃষ্টি হয়েছিল সেটা সেকালের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্রদের এক উল্লেখযোগ্য অংশকে টেনে নিতে পারত। তাহলে সারা দেশে যে বিশাল আন্দোলনটা ছড়িয়ে পড়েছিল সেটাকে কেন্দ্রীভূত করার শক্তিটা পাওয়া যেত। ফলে জাতীয় রাজনীতিতে বাম আন্দোলন হয়ে উঠতে পারত প্রধান না হলেও আওয়ামী লীগের সমান্তরাল ধারা।

যাইহোক, কাজী জাফরের বিরাট ভাবমূর্তি ধ্বংস করাই ছিল তখনকার কমিউনিস্ট পার্টির সবচেয়ে বড় প্রয়োজন। আর তাই তারা ছাত্র ইউনিয়ন ভাঙ্গতই। আমি সাধারণ সম্পাদকের পদ নিতে রাজী হলেও ভাঙ্গত। হয়তো ভাঙ্গার সিদ্ধান্তটা জানাত সম্মেলনের কমিটি গঠনের দিনে, ঠিক যেমনটা প্রকৃতপক্ষে তারা করেছিল। শেষ মুহূর্তে হলেও আমার বিরোধিতা করত।

এই ভাঙ্গনের ফলে তারা সুযোগ পেল কাজী জাফরের বিরাট ভাবমূর্তিটাকে চূর্ণ করার জন্য কমিউনিস্ট পার্টির সেই সময়ের বাস্তবতায় প্রচণ্ড শক্তিটাকে নিয়োগ করার। অবশ্য তারা সেই কাজটা শুরু করেছিল ভাঙ্গনের অনেক আগে থেকে। এবং তারা যা চেয়েছিল তা হল। কাজী জাফরের গুণাবলী, সততা ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে সর্বত্র সন্দেহ ছড়াল, অবিশ্বাস, অনাস্থা জন্মাল। ছাত্র সংগঠনের ভাঙ্গন কর্মীদের মনোবল ভাঙ্গল। ঢাকার তরুণ প্রজন্ম হতাশার গহ্বরে নিক্ষিপ্ত হল এবং কাজী জাফর তাঁর সম্ভাবনার ভিত্তিটা হারিয়ে ভুল পথে চলে গেলেন।

মস্কোপন্থী কমিউনিস্টদের অভিযোগ ছিল কাজী জাফর নেতৃত্বাভিলাষী। শেখ মুজিবও কি তাই ছিলেন না? শেখ মুজিবের অতীতটা কি আরও কলঙ্কিত হয়নি ২১ দফার অঙ্গীকার ভঙ্গ করায়? তার পরেও তাঁরা আওয়ামী লীগের অনুগামী হলেন। কিন্তু কেন? কাজী জাফরের দোষটা কিন্তু এই জায়গায়ও ছিল। তিনি আন্দোলনকে আওয়ামী লীগের অনুগামী না রেখে স্বাধীনভাবে এগিয়ে নিতে চেয়েছিলেন, যেটা ছিল সেই সময়ের দাবী। প্রকৃতপক্ষে কাজী জাফর আহমদের নেতৃত্বে ছাত্র-যুব আন্দোলনের এমন এক প্রবল ও বিরাট শক্তির উত্থান ঘটছিল যাকে নিয়ন্ত্রণ করা ঐ পার্টির পক্ষে আর সম্ভব ছিল না। কাজেই কাজী জাফরকে খর্ব করার উপর তারা সর্বশক্তি নিয়োগ করে।

এ প্রসঙ্গে আমার আলোচনার সুবিধার জন্য মোহাম্মদ ফরহাদের সঙ্গে আমার যে শেষ রাজনৈতিক বির্তক হয় সেটার মূল কথা বলি। ১৯৬৫-এর এপ্রিলে ছাত্র ইউনিয়নের দ্বিধাবিভক্তির অল্প কিছুদিন পরের কথা। তখনও পার্টির সঙ্গে আমার একটা সম্পর্ক ছিল। মোহাম্মদ ফরহাদ আমার সঙ্গে বসতে চাইলেন। দীর্ঘ আলোচনায় আমি তাঁকে আমার রাজনীতির তিনটি মূল ভিত্তি জানিয়ে দিলাম। (১) পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা, (২) বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ এবং (৩) এ দেশে সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব।

তিনি উত্তরে যা বললেন তা সংক্ষেপে বললে এই দাঁড়ায় (১) তাঁরা (পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি) পূর্ব পাকিস্তান ভিত্তিক রাজনীতিতে বিশ্বাসী নন, বরং তাঁদের রাজনীতি সমস্ত পাকিস্তান ভিত্তিক, (২) তাঁরা জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী নন, তাঁরা আন্তর্জাতিকতাবাদী, এবং (৩) তাঁরা সশস্ত্র সংগ্রামে বিশ্বাসী নন, বরং শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাজতন্ত্রে উত্তরণে বিশ্বাসী। আজ তিনি জীবিত নেই। সুতরাং এ কথাগুলো যাচাই করার উপায় নেই। তবে ঐ সময়ে পার্টির রাজনীতি যে ঐটাই ছিল সেটা সেকালের সংশ্লিষ্ট সবাই জানেন।

এরা কিন্তু হঠাৎ করে হল সবচেয়ে বড় বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদী, বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রবক্তা এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পতাকাবাহী! যুদ্ধই যারা বোঝে না এবং সর্ব চেষ্টায় যারা এ দেশে বিপ্লবী যুদ্ধ, জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের শক্তিকে নির্মূল করতে চেয়েছে তারা হয়ত মুক্তি শব্দ পর্যন্ত উচ্চারণ করতে পারে, কিন্তু তার সঙ্গে যুদ্ধ যোগ করার অধিকার তাদের কতটুকু আছে?

ছাত্র ইউনিয়ন ভাঙ্গন কালীন ঘটনাগুলোর কথা মনে হলে আমার পক্ষে আর নিরাসক্ত থাকা সম্ভব হয় না। ১৯৬৫ পরবর্তী কাজী জাফরের প্রতি আমার দুর্বলতা ছিল না। নিশ্চয় তাঁর মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা ও দূরদর্শিতার অভাব ছিল। আমি তাঁকে সব সময় ফরহাদ বা ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া)-এর সঙ্গে দ্বন্দ্বটাকে রাজনৈতিকভাবে নিতে বলতাম। কিন্তু তাঁর কাছে ছাত্র ইউনিয়ন ভাঙ্গনের সময় ও পরবর্তী সময়ে ফরহাদ বিরোধিতা এবং ব্যক্তিগত নেতৃত্বের আবেদনটাই মুখ্য হয়ে উঠেছিল। এ থেকে এল ব্যক্তিগত আক্রোশ আর জেদ। এইভাবে ফরহাদ ও কমিউনিস্ট পার্টি তাঁকে উত্যক্ত করে, খুঁচিয়ে যে ফাঁদটাতে ঠেলে দিতে চেয়েছিল তিনি ঠিক সেখানেই পা দিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে কমিউনিস্ট পার্টির ষড়যন্ত্রটা বুঝতেই তাঁর বহুদিন লেগে গেল। অবিভক্ত ছাত্র ইউনিয়নের ভিতরে দ্বন্দ্বের সমস্ত কালটাতে তাঁর মনে হল এটা তাঁর নেতৃত্বের প্রভাবের কারণে ঈর্ষান্বিত মোহাম্মদ ফরহাদের ব্যক্তিগত ষড়যন্ত্র মাত্র, যে কাজে তিনি পার্টিকে ব্যবহার করছেন। ফলে তিনি তাঁর বিরুদ্ধে যেসব ব্যক্তিগত আক্রমণ করা হত তার পিছনের রাজনৈতিক তাৎপর্য না বুঝে সেই সব আক্রমণের জবাব দেবার কাজেই নিজেকে ব্যস্ত রাখলেন। ক্রমে তাঁর মধ্যে প্রবল হল জেদ। রাজনীতির উপরে স্থান পেল ব্যক্তিগত জেদ আর আক্রোশ।

কিন্তু যে কোনো ব্যক্তির ভূমিকার মূল্যায়নের সময় তার পারিপার্শিকতাও বিচার করতে হয়। বিশেষ করে সেকালে রাশেদ খান মেনন ভাল ছাত্র এবং কর্মীর বেশী কিছু ছিলেন না। যে কোনো রাজনৈতিক প্রশ্নের গভীরে যাবার ক্ষমতা বা ইচ্ছা যেটাই হোক তাঁর মধ্যে এতটুকু দেখি নি। এঁরা ছিলেন এক সময় ফরহাদের অনুরাগী। কিন্তু কাজী জাফরের প্রতি অন্যায় আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে ধীরে ধীরে তাঁর প্রতি ঝুঁকে পড়েন। আমার ধারণা ছাত্র ইউনিয়নের ভাঙ্গনের পর যদি মেননের পরিবর্তে রাজনৈতিকভাবে কিছু সচেতন এবং আগ্রহী আর কাউকে আমরা ছাত্র ইউনিয়নকে নেতৃত্ব দেবার জন্য পেতাম তবে বিভক্তির পর এত দ্রুত কাজী জাফরের তাৎপর্যপূর্ণ রাজনৈতিক ভূমিকায় যে ছেদটি ঘটেছিল সেটি ঘটত না। কিন্তু সেই সময় নেতৃত্ব দেবার জন্য যোগ্য অন্তত আর কাউকে আমি দেখি নি। তখন আমারও কাছে প্রশ্নটা হয়ে উঠেছিল কাজী জাফরকে সামনে রেখে এবং তাঁর নেতৃত্বে গড়ে তোলা ধারাটিকে রক্ষা করার। যারা রাজনীতি সচেতন এবং নেতৃত্বের জন্য কম-বেশী যোগ্য এবং আগ্রহী এমন প্রায় প্রত্যেকেই তখন কমিউনিস্ট পার্টি এবং ফরহাদের সঙ্গে। ফলে আমি মেননকেই সমর্থন করি, কারণ তিনি ছিলেন কাজী জাফরের ভক্ত। তখনও দ্বন্দ্বটি প্রচারিত ছিল ফরহাদ- জাফরের মধ্যকার নেতৃত্বের দ্বন্দ্বের প্রতিফলন স্বরূপ। রাজনৈতিক ভিন্নতা বা প্রশ্নগুলো তখন পর্যন্ত স্পষ্ট হয়ে ওঠে নি। অন্তত আমার নিকট সমস্যাটা ছিল মস্কোপন্থী কমিউনিস্ট রাজনীতির প্রতিভূ হিসাবে ফরহাদের সঙ্গে কাজী জাফরের দ্বন্দ্বটাকে একটা যৌক্তিক রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে পরিণত করা। হাঁ, ১৯৬৪ থেকে কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে আমার সাংগাঠনিক একটা সম্পর্ক থাকলেও তার পূর্ব থেকেই আমি ছাত্র ইউনিয়নের ভিতর বিপ্লবী চিন্তার ভিত্তিতে ভিন্ন রাজনৈতিক ধারা গড়ে তোলার যে সংগোপন প্রয়াস চালিয়ে আসছিলাম সেটাকে তখন ছাত্র ইউনিয়নের নূতন কমিটিতে মেননকে সামনে রেখে এগিয়ে নিতে চেয়েছিলাম।

মেননের রাজনৈতিক মান সম্পর্কে আমার আস্থা না থাকলেও মেধাবী ছাত্র এবং পরিশ্রমী কর্মী হিসাবে তাঁর জনপ্রিয়তা ছিল। সর্বোপরি তিনি ছিলেন সেই সময় ‘ডাকসু’ বা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি। এবং তিনি ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের পূর্ববর্তী কমিটির সহ-সভাপতিতাছাড়া তাঁর ছিল পারিবারিক প্রতিষ্ঠা। তাঁর পিতা এক সময় পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের স্পীকার ছিলেন। কমিউনিস্ট পার্টির মোকাবিলায় দাঁড়াবার জন্য এবং নূতন ও বিপ্লবী রাজনীতিকে দাঁড় করাবার জন্য তখন আমার মনে হয়েছিল মেননকে আমাদের পক্ষে নেতৃত্বে পাওয়া দরকার। তাহলে তাঁকে সামনে রেখে নূতন রাজনীতি গড়ে তোলার জন্য একটা প্রয়োজনীয় সুযোগ পাব। অন্তত এটা ছিল আমার বিবেচনা। সুতরাং মেনন রাজনীতির তাত্ত্বিক ও মতাদর্শিক বিষয়গুলোর গভীরে যেতে না চাইলেও তিনি কাজী জাফরের দৃঢ় সমর্থক হবার কারণে আমি তাঁকে উপযুক্ত মনে করি।

আমার ধারণা ছাত্র ইউনিয়ন বিভক্ত না হলে মেননকে রাজনৈতিক প্রশ্ন বা বিষয়গুলোকে অবলম্বন করতে হত মস্কোপন্থী রাজনীতিকে প্রতিহত করার প্রয়োজনে। বিশেষত আমার মত কর্মীদের সমর্থনটা তাঁর তখন খুব প্রয়োজন হত। কিন্তু ছাত্র ইউনিয়নের অকাল ভাঙ্গন আমাকে সেই সুযোগ দেয় নি। ছাত্র ইউনিয়নের ভিতর রাজনীতির প্রশ্নগুলোকে পাশ কাটিয়ে চলা তাঁর পক্ষে সহজতর হল। এবং সম্ভব হল আইয়ুব সরকার বিরোধী আন্দোলনের গতিকে স্তিমিত করা। আমার মনে হয় ছাত্র ইউনিয়নের মধ্যে ফরহাদ-জাফর দ্বন্দ্বের এবং মেননের প্রতি আমার সমর্থনের তাৎপর্য বোঝার জন্য ছাত্র ইউনিয়নের নেতৃত্বের গতিধারার উপর কিছুটা আলোকপাত করা দরকার। ১৯৬২-তে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের কনভেনশন হয়। এর মাধ্যমে ছাত্র ইউনিয়নকে নূতনভাবে সংগঠিত করা এবং পুনরুজ্জীবিত করা হয়। মনে রাখতে হবে ১৯৫৮-তে সামরিক আইন জারীর পর ছাত্র ইউনিয়নের সাংগঠনিক অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়েছিল। ১৯৬২-এর কনভেনশনে সভাপতি নির্বাচিত হন ডা: আহমদ জামান এবং সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন কাজী জাফর আহমদ। ডা: আহমদ জামান ছিলেন মোহাম্মদ ফরহাদের বাছাই। কিন্তু তিনি ছাত্র আন্দোলন ও ছাত্র ইউনিয়নের কর্মকাণ্ডে তেমন একটা অংশ নিতেন না। এবং তিনি দেশেও বেশী দিন ছিলেন না। ১৯৬২-এর ছাত্র আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সবচেয়ে জনপ্রিয় ছাত্র নেতা হিসাবে উথিত কাজী জাফর সাধারণ সম্পাদক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন ১৯৬৩ সালের অক্টোবরে ছাত্র ইউনিয়নের কাউন্সিল সম্মেলন পর্যন্ত। কাজী জাফর আহমদ তখন আর ছাত্র না থাকায় ছাত্র ইউনিয়নের নেতৃত্বের পদ নিতে অনিচ্ছুক ছিলেন। তাতে অবশ্য তাঁর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী মোহাম্মদ ফরহাদের সুবিধা হয়। ১৯৬৩-এর অক্টোবরে ছাত্র ইউনিয়নের কাউন্সিল সম্মেলনে বদরুল হক (বর্তমানে হাই কোর্টের বিচারপতি) সভাপতি এবং হায়দার আকবর খান রনো সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচিত হন। কাজী জাফর পূর্ববর্তী কমিটির সাধারণ সম্পাদক হিসাবে পদাধিকার বলে কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সদস্য থাকেন।

বদরুল হক এবং রনো উভয়েই ছিলেন পার্টির সঙ্গে সম্পর্কিত। কিন্তু রনো ক্রমে কাজী জফরের প্রতি দুর্বল ও সহানুভূতিশীল হয়ে পড়েছিলেন। আসলে ফরহাদ-জাফরের দ্বন্দ্বটা ছিল গোপন কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে গণ-আন্দোলন ও সংগঠনের দ্বন্দ্বেরও প্রতিফলন। কাজী জাফর আহমদ এবং সেই সঙ্গে ছাত্র আন্দোলনকে সীমাবদ্ধ ও নিয়ন্ত্রণাধীন রাখতে চেয়ে পার্টির প্রতিনিধি ফরহাদ কাজী জাফরের বিরুদ্ধে ভূমিকা নেন। ১৯৬২-এর কেন্দ্রীয় কমিটিতে ফরহাদ ছিলেন কোষাধ্যক্ষ হিসাবে। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে আত্মগোপনে চলে গিয়ে তিনি ছাত্র ইউনিয়নকে পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ করতে থাকেন। আর এইভাবে দুই ব্যক্তিত্বকে কেন্দ্র করে গোপন পার্টি ধারা এবং প্রকাশ্য গণ ধারার সংঘাতটা ধীরে ধীরে বেড়ে উঠতে থাকে। ব্যক্তিত্বের সংঘাত অবশ্যই ছিল। কিন্তু সেটা ছিল ছাত্র আন্দোলনের রাজনৈতিক গতিধারা নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা পদ্ধতির প্রশ্নের সঙ্গেও সম্পর্কিত।

সেই সময় এই বাস্তবতায় আমি গণ-ধারার সঙ্গে থেকে তার ভিতর বিপ্লবী চিন্তা-চেতনা বিস্তারের জন্য সতর্ক চেষ্টা চালাতে থাকি। তাতে কাজী জাফরকে কাছে পাই। বলা যায় আমার স্বাধীনভাবে গড়ে ওঠা গণ-বিপ্লবের ভাবনার কারণে কাজী জাফরের সঙ্গে আমার ঐক্য গড়ে ওঠে। ১৯৬৩-এর কমিটির সভাপতি বদরুল হক পার্টি এবং ফরহাদের সঙ্গে থাকেন। কিন্তু সাধারণ সম্পাদক হায়দার আকবর খান রনো কাজী জাফরকে সমর্থন দিতে থাকেন। রনো ছিলেন ১৯৬২-এর ছাত্র আন্দোলনের শুরু থেকেই একজন সামনের সারির গুরুত্বপূর্ণ নেতা। সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পাবার পর তিনি কাজী জাফর এবং আমাদের ধারাকেই প্রতিনিধিত্ব করতে থাকেন। ফলে তাঁর সঙ্গেও পার্টি এবং ফরহাদের দূরত্ব সৃষ্টি হয়।

মেননের তুলনায় রনো অনেক বেশী রাজনীতি সচেতন এবং তাত্ত্বিক বিষয়গুলি সম্পর্কে আগ্রহী ছিলেন। তবে এটা ঠিক যে, রাজনৈতিক বিষয়গুলিকে রনোকেও যে অনেকদিন পর্যন্ত সামনে আনতে দেখেছি তা নয়। তবে তিনিও ক্রমে মস্কোপন্থী পার্টিকে মোকাবিলা করতে গিয়ে বিপ্লবী চিন্তা এবং চীনের প্রতি ঝুঁকে পড়েন। হায়দার আকবর খান রনোর প্রত্যক্ষ নেতৃত্বে এবং সামগ্রিকভাবে কাজী জাফর আহমদের ভাবমূর্তি ও নেতৃত্বের ছত্রছায়ায় সেই সময় আমি বিপ্লবী চিন্তা নিয়ে অগ্রসর হতে চেষ্টা করি।

কাজী জাফরের বাগ্মীতা, সাংগঠনিক দক্ষতা, সাহস ও ব্যক্তিত্বের সঙ্গে রনোর তুলনা চলে না। কিন্তু রনোর ভূমিকা কাজী জাফরের তুলনায় অনেক নিষ্প্রভ হলেও তিনি ছিলেন কাজী জাফরের গণ-ধারার প্রতিনিধিত্বকারী, যার ভিতর আমি ক্রিয়াশীল ছিলাম। তিনি সাধারণ সম্পাদক ছিলেন ১৯৬৫-এর এপ্রিলের নব গঠিত কমিটি পর্যন্ত যে কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন রাশেদ খান মেনন। এবং মেননকে সভাপতি বা সাধারণ সম্পাদক পদে পাওয়াটাকে সম্মেলনের বেশ কিছু দিন পূর্ব থেকেই আমি প্রয়োজনীয় মনে করতাম। আমার বিবেচনার যুক্তিগুলো ইতিপূর্বে উল্লেখ করেছি। এবং এটা আমার কাছে স্পষ্ট যে, ছাত্র ইউনিয়ন অকালে ভাঙ্গার ফলে কাজী জাফরের এই ভক্তটি সংগঠনের রাজনৈতিক বিকাশের পথে সবচেয়ে বড় বাধা হলেন। ছাত্র ইউনিয়নের অকাল ভাঙ্গনের ফলে মেননকে নিয়ে আমাদের যে সমস্যা হয়েছিল এবং একটা নূতন ও বিপ্লবী রাজনীতি গড়ার কাজটা যে কি পরিমাণ কঠিন হয়েছিল সেটা আর একটু স্পষ্ট করার জন্য আমার মনে হয় কিছু পুনরুক্তি হলেও মেনন এবং ছাত্র ইউনিয়নের কমিটি গঠন সম্পর্কে আর একটু আলোচনা করা দরকার।

রাশেদ খান মেনন আমার সম্ভবত এক বৎসর সিনিয়র ছিলেন। কিন্তু তাঁর রাজনৈতিক ও তাত্ত্বিক মানের প্রতি আমার আস্থা প্রথম থেকেই ছিল না। কারণ আমি দেখতাম যে, এ ধরনের কোনও আলোচনায় যে তিনি কখনও অংশ নিতেন না তাই নয় অধিকন্তু তিনি এসব পছন্দও করতেন না। কিন্তু তবু ইতিপূর্বে বর্ণিত কারণে ’৬৪-তে তাঁকে ছাড়া ছাত্র ইউনিয়নে আমাদের ধারার প্রতিনিধিত্ব করার মত আর কাউকে দেখি নি। বিশেষত আমি যখন সামনে যাব না ঠিক করেছিলাম তখন হায়দার আকবর খান রনোর পর বাধ্য হয়ে তাঁর কথা ভাবতাম।

তবে এখন আমার ধারণা কাজী জাফর তাঁকে ছাত্র ইউনিয়নের নেতৃত্বে চান নি। আর সেই কারণে তিনি আমাকে ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদকের পদ নিতে ওভাবে বলেছিলেন। অথচ তারও বেশ কিছু আগে কিন্তু তাঁর সঙ্গে আলোচনায় মেননকে এই লক্ষ্যে এগিয়ে নেবার কথা বলেছিলাম। আমার যতদূর মনে হয় কাজী জাফর আমাকে সাধারণ সম্পাদক পদ গ্রহণের প্রস্তাব দেন ১৯৬৪-এর শেষ দিকে। কারণ ’৬৫-এর প্রথমার্ধে বেশ কিছুদিন তিনি কারারুদ্ধ ছিলেন। সেই সময় ছাত্র নেতারা মাঝে মাঝে আইয়ুব সরকার কর্তৃক কারারুদ্ধ হতেন। তিনি কারামুক্ত হন ’৬৫-এর এপ্রিলে ছাত্র ইউনিয়নের বিভক্তির কিছু দিন পর। হয়তো মে বা জুনে। যাইহোক, আমি তাঁর প্রস্তাবে রাজী না হয়ে মেননকে নিয়ে ভাবতে বললেও তিনি আমাকে রাজী হবার জন্য আবার বলেন এবং জানতে চান সাধারণ সম্পাদকের পদ নিতে আমার আপত্তি কেন আর অসুবিধা কোথায়। কিন্তু তিনি আমাকে রাজী করাতে পারেন নি। আমার যতদূর মনে হয় ঐ আলোচনার পর মেননের ব্যাপারে তিনি ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নেন।

আসলে আমার নিকট ব্যক্তিগত সম্পর্ক এবং ভাল লাগালাগি এসবের অনেক ঊর্ধ্বে ছিল একটা বিপ্লবী রাজনীতি গড়ে তোলার সমস্যা। এবং আমাদের দুর্ভাগ্য যে, ১৯৬৫-এর এপ্রিলে ছাত্র ইউনিয়ন দ্বিধা বিভক্ত হলে মেনন ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন)-এর নিরঙ্কুশ নেতায় পরিণত হলেন। আর এই বক্তব্যের তাৎপর্য স্পষ্ট করতে হলে এখানে ছাত্র ইউনিয়নের ভাঙ্গন এবং কমিটি গঠন সংক্রান্ত জটিলতার উপর কিছুটা হলেও আলোচনা করতে হবে।

১৯৬৫-এর ২ এপ্রিল ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউটে অনুষ্ঠিত সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনে ছাত্র ইউনিয়নকে ঐক্যবদ্ধ রাখার শেষ চেষ্টা হিসাবে একটি আপোস প্যানেল উথাপন করা হয়। এই প্যানেল তৈরীতে ছাত্র ইউনিয়নের কিছু সংখ্যক প্রাক্তন গুরুত্বপূর্ণ নেতা এবং কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে সম্পর্কিত কিছু ব্যক্তিরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। এই প্যানেল অনুযায়ী রাশেদ খান মেননকে সভাপতি এবং সাইফুদ্দিন আহমদ মানিককে সাধারণ সম্পাদক করে ছাত্র ইউনিয়নের একটি ঐক্যবদ্ধ কমিটি পাস করা হয়। সহ-সভাপতি নামের তালিকায় এক নম্বরে স্থান ছিল মতিয়া চৌধুরীর। কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টির অনুসারীরা সম্মেলন স্থান ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউটে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে না পেরে পার্টির নির্দেশে সম্মেলন কক্ষ ত্যাগ করে চলে যায় এবং রাতে তৎকালীন ইকবাল হলের ছাদে আরেক সম্মেলন ক’রে সেখানে মতিয়া চৌধুরীকে সভানেত্রী এবং সাইফুদ্দিন আহমদ মানিককে সাধারণ সম্পাদক ক’রে পাল্টা কমিটি গঠন করে।

এর ফলে মতিয়া নেতৃত্বাধীন কমিটি পূর্ণাঙ্গ হলেও মেনন নেতৃত্বাধীন কমিটি হল ভাঙ্গা। কারণ এই কমিটির অর্ধাংশ চলে যায় মতিয়ার সভানেত্রীত্বে গঠিত সংগঠনে। ঐক্যের পক্ষে আমাদের আন্তরিকতা প্রকাশের জন্য এবং আমাদের কমিটির বৈধতা প্রদর্শনের জন্য আমরা এই অর্ধেক বা ভাঙ্গা কমিটি নিয়ে চললাম অনেক দিন। ফলে সাধারণ সম্পাদকের মত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদ রইল শূন্য। এর উপর সংগঠন হল মেননের নামে ব্র্যাকেটবন্দী। সুতরাং মেনন হলেন নিরংকুশ। এই অবস্থায় কে তাঁকে সামলাবে?

এ হল কমিটিগত সমস্যা। অন্যদিকে ছিল কর্মী বা ক্যাডারগত সমস্যা। এসএম হল ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য হল থেকে আমরা প্রথম সারির নেতা বা কর্মী হিসাবে যাদেরকে ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন)-এ পেলাম অতি সামান্য সংখ্যক ব্যক্তি ছাড়া তাদের চরিত্রগত কিংবা রাজনৈতিক মান সম্পর্কে মন্তব্য করা নিষ্প্রয়োজন। এটা ছিল সত্যি একটা সংগঠন এবং তার আদর্শ বা রাজনীতির জন্য অতি দু:সময়। এই এক অরাজনৈতিক দলের নেতা হলেন রাশেদ খান মেনন। অরাজনীতির এক সমুদ্রে যেন প্রায় নি:সঙ্গ ও বিচ্ছিন্ন এক ক্ষুদ্র দ্বীপের মত অতি কষ্টে কোনক্রমে জেগে রইল এসএম হল। সত্যিই, সে এক ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কাল। সেই অবস্থা হয়ত আজও কেউ কেউ চেষ্টা করলে স্মরণ করতে পারবেন। সেই ‘মার মার কাট কাট’ দঙ্গল পরিবেষ্টিত মেননের মতিয়া গ্রুপের বিরুদ্ধে প্রচারাভিযান! তারপর তাতে ক্রমে এসে যুক্ত হল সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে প্রচারাভিযান। এটা পরিণত হল জোয়ারে। সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী এই প্রচারাভিযানের জোয়ারে তলিয়ে গেল আইয়ুব-বিরোধী আন্দোলন। বরং সেই জোয়ারে ‘আইয়ুবকে এখন বিরক্ত করা ঠিক না’ এই বক্তব্যের আড়ালে আইয়ুব সমর্থনের নৌকা তরতরিয়ে এগিয়ে গেল।

এই রকম পরিস্থিতিতে আমার জন্য রাজনীতিকে এগিয়ে নেবার কাজটা হল সুকঠিন। প্রকৃতপক্ষে ছাত্র ইউনিয়ন বিভক্ত না হলে আমি একটা রাজনৈতিক ধারা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে অনেক বেশী সফল হতাম বলে আমার ধারণা। ছাত্র ইউনিয়নের অকাল ভাঙ্গন সেই সুযোগ আর দেয় নি। প্রাগ্রসর অংশের অধিকাংশ ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া)-এর সঙ্গে চলে গেল এবং বাকীরা হতাশ হল। আর কাজী জাফরের কাছে গোটা বিরোধটা দেখা দিল তাঁর বিরুদ্ধে ফরহাদের ব্যক্তিগত চক্রান্ত রূপে। তিনি এবং তাঁর অন্ধ অনুসারীরা ভাঙ্গনের পর ব্যস্ত থাকলেন এই ভাঙ্গনের জন্য ফরহাদ ও তাঁর অনুসারীদের ব্যক্তিগতভাবে দায়ী করার কাজে। এই ভাঙ্গনের পিছনের রাজনৈতিক কারণটা কি ছিল সেটা বোঝার দিকে তারা কেউ সময় দিলেন না। রাজনীতির বিষয়গুলো আমি সামনে আনতে থাকলাম। কিন্তু কিছুদিন পর আবদুল হকরা জাফর-মেননকে সমর্থন দিতে শুরু করেন। ক্রমেই একটা গোটা পার্টিকে মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে তাঁদের যে অসহায়তা বোধ ছিল সেটা ঘুচল এবং আমার মত কর্মীদের প্রয়োজন ও ভূমিকাও তাঁদের কাছে ফুরালো।

এ কথা আমি বলব কাজী জাফর এমন এক চক্রান্তের শিকার হয়েছিলেন যার স্বরূপ মূল্যায়নের ক্ষমতা তাঁর ছিল না। এ কথা ভাবলে অবাক লাগে যে, সে কালেও আমি বুঝতাম কেন তাঁর বিরুদ্ধে চক্রান্ত হচ্ছে। এটা যে একটা উদীয়মান তরুণ নেতৃত্বের শক্তিকে লালনের পরিবর্তে ধ্বংস করার আয়োজন মাত্র এটুকু বোঝার মত বোধ-বুদ্ধি আমার ঐ বয়সেও ছিল।

কাজী জাফরের বিরুদ্ধে আমার অনেক অভিযোগ ছিল এবং আছে। কিন্তু এটা প্রকৃতপক্ষে একটা উদীয়মান সামাজিক শক্তির অপরিপক্বতা ও সীমাবদ্ধতার বিরুদ্ধে আমার অভিযোগ। কিন্তু আমার তো মনে আছে ১৯৬৩-এর প্রথম দিক থেকে ফরহাদের সঙ্গে তাঁর দ্বন্দ্ব আমাদের অনেকের কাছে যখন প্রকাশিত তখন কাজী জাফরের আচরণ। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হচ্ছিল যে, তিনি নেতৃত্ব নিয়ন্ত্রণের জন্য ফরহাদের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করছেন। আমার আজও সেকালে অনেক দিন ধরে তাঁর বিরুদ্ধে সংগোপন প্রচারগুলো মনে হয়। অথচ আমি তাকে অনেক দিন পর্যন্ত ফরহাদ বা কারো বিরুদ্ধে কিছু বলতে শুনি নি। আমি তখন তাঁর ঘনিষ্ঠ। কতটা ঘনিষ্ঠ সেটা সেকালে অনেকে জানতেন এবং কাজী জাফরও নিশ্চয় ভোলেন নি। এবং চক্রান্ত করতে চাইলে আমাকে তখন তাঁর কতটা প্রয়োজন ছিল সেটা চেষ্টা করলে হয়তো তিনি আজো কিছু স্মরণ করতে পারবেন। অথচ এই ব্যক্তিটি নিজে থেকে শেষাবধি আমাকে কখনও কিছু বলেন নি। তাঁর বিরুদ্ধে চক্রান্তের অমন অভিযোগগুলো যে প্রতিপক্ষ ওঠাত এবং সুকৌশলে ও সংগোপনে ছড়াত তার বিরুদ্ধে তাঁকে তৎপর হতে দীর্ঘকাল দেখি নি। এমন কি অনেক কনিষ্ঠ হলেও আমি যে তাঁর অমন ঘনিষ্ঠ সেই আমাকেও আমি যতদিন তাঁকে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়ে জিজ্ঞাসা করি নি এবং জানতে চাই নি ততদিন তিনি নিজে থেকে কিছু বলেন নি। না, তিনি অনেক দিন মোহাম্মদ ফরহাদের বিরুদ্ধে কিছু বলেন নি। বাইরে বা প্রকাশ্যে তো দূরের কথা আমাদের মত কর্মীদের কাছেও নয়। অন্তত কোনও চক্রান্ত করতে দেখি নি। আমি বুঝি না চক্রান্ত যে করে সে কি ঘরে বসে শুধু নিজের মনে মনে করে, নাকি তার সঙ্গে ২/৪ জন লোক লাগে?

হাঁ, তিনি চক্রান্ত করেছিলেন অনেক পরে। অন্তত আমার জানা মতে। কিন্তু সেটা ছিল পাল্টা চক্রান্ত যেটা অত্যন্ত ন্যায়সঙ্গত ও প্রয়োজনীয়। কেবল মূর্খ ও বোকারাই একটা চক্রান্তের বিরুদ্ধে পাল্টা চক্রান্ত করে না। কিন্তু সেটাও করলেন ভুলভাবে। চক্রান্তের প্রকৃত উদ্দেশ্য ও স্বরূপ না বুঝে। আমার আজো ’৬৩-এর সেই কাজী জাফরের বেদনার্ত মুখ ও কথাগুলো মনে পড়ে। সম্ভবত আমি ’৬৩-এর মাঝামাঝি সময়ে এ ব্যাপারে তাঁর সঙ্গে প্রথম কথা বলি। তখন কেন তাঁকে অভিযুক্ত করা হচ্ছে, কেন তাঁর বিরুদ্ধে অপবাদ দেওয়া হচ্ছে সেসব ব্যাকুল কণ্ঠে জানতে চাইতেন। হয় তিনি ছিলেন অতি চালাক নয় অতি বোকা। জানি না কি ছিলেন তিনি। হয়তো তিনি ছিলেন এমনই গভীর জলের মাছ যে গভীরে গিয়ে তাঁকে চেনা ও বোঝার সাধ্য আমার ছিল না।

৬৫-এর পরবর্তী কালে কাজী জাফরের সঙ্গে আমার আর সম্পর্ক থাকে নি। তাঁর প্রতি আমার আর দুর্বলতাও থাকে নি। কারণ এই সময় থেকে তিনি ভুল ধারায় চলে যান। কিন্তু তার পূর্বেকার কাজী জাফরের জন্য আমার বেদনা থেকে কখনও নিজেকে মুক্ত করতে পারি নি। এটা আসলে আমার সেই প্রজন্মের নেতৃত্বের শক্তির অসহায়তা ও ব্যর্থতার জন্য বেদনা। যে সামাজিক শক্তিটা বাঙ্গালী জনগণের জাতি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কার্যক্ষম ও নেতৃত্বকারী শক্তি হতে পারত তার ব্যর্থতার জন্য বেদনা।

না, কাজী জাফর এবং ছাত্র ইউনিয়নের ভাঙ্গন সম্পর্কে আমার কথা ফুরায় নি। এ কথাটা বলছি এ দেশের বামপন্থী রাজনীতির সংকটের একটি গুরুত্বপূর্ণ জট খোলার জন্য। বিশেষত কাজী জাফরের মূল্যায়নে ভুলের মধ্য দিয়ে প্রকৃত ইতিহাসের মূল্যায়নে যে ভুল হয় বা হয়েছে, জটটা খোলার জন্য আমি সেই ভুলের দিকে দৃষ্টিটা ফেরাতে চাই। এবং এ দেশে ষাটের দশকে কাজী জাফর এবং বাম ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে আমার বিজড়নের আরও কিছু ছবি না আঁকলে কেন আমি এ কথাগুলো বলছি তার সবটা হয়তো বোঝা যাবে না।

আসলে আমি আমাদের সমাজ, জাতি ও রাজনীতিতে যে সহজিয়া প্রবণতা আধিপত্য বিস্তার করে আছে সেটাকে আঘাত করাটা অত্যন্ত জরুরী মনে করি। আমার মনে হয়েছে যে, যে কোনো ঘটনার ফল বা পরিণতি দেখা বা বোঝাটা যথেষ্ট নয় বরং তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হল কোন প্রক্রিয়ায় অমন একটা ফল জন্ম নেয় বা পরিণতি ঘটে সেটা বোঝা। যারা কিছু তৈরী না করে শুধু ফল ভক্ষণ করতে চায় তারা ঐ গঠন বা সৃষ্টি প্রক্রিয়ার সমস্যাটাই বুঝতে চায় না। নিশ্চয় এর জন্য দায়ী আমাদের জাতি বা জনগোষ্ঠীর সহজিয়া মনোভাব। ফলে আমাদের চাই তৈরী। গ্রামের লোকের ভাষায় বলতে গেলে বলতে হয়, ‘বিনা পয়সায় পেলে বাঙ্গালী আলকাতরাও খায়।’ আমরা এই আলকাতরা শুধু নয়, সুন্দর করে প্যাকেটে সাজিয়ে এনে দিলে লোভে পড়ে বিলম্ব না করে বিষটাও খাই। যাচাই করে কিছু দেখি না। আসলে নিজেদের উপর তো কোন বিশ্বাস নেই, চারপাশের অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিলিয়ে কোনো কিছু বোঝার মত ধৈর্যও নেই, কাজেই যে খুব বেশী হাত-পা নেড়ে বা ঢাক-ঢোল-বাদ্য বাজিয়ে চীৎকার করে আমাদের কথা শোনাতে পারে আমরা ভাবি তার কথাটাই বোধ হয় সত্যি। এমনি আমাদের মনের জোর, চিন্তার ক্ষমতা! ছোটদের গল্পের সেই গৃহস্থের মত আমাদের বুদ্ধির দৌড়। দড়িতে ছাগল বেঁধে হাটে নিয়ে যাবার পথে তিন জন তিন জায়গায় পর পর দাঁড়িয়ে ওটাকে কুকুর বললেই আমাদের সব বোধ-বুদ্ধি লোপ পায়। মনে করি সত্যিই বোধ হয়! এমন কি আর যাচাইয়ের প্রয়োজনও বোধ করি না। এটা ভাবি না যে, ওটাকে ছাগল জেনেই হাটে নিয়ে চলেছি। এই তিন জন বলছে এটা কুকুর! এমন তো হবার কথা নয়! তবু আমি না হয় আর কাউকে জিজ্ঞাসা করি! না, সেই যাচাইয়ের জন্য যে বোধ-বুদ্ধি , ধৈর্য দরকার সেসব আমাদের কোথায়? ছাগলটাকে ঠগদের ভোগের জন্য কুকুর ভেবে ফেলে রেখে বাড়ী ফিরে যাই!

কাজী জাফরকে সে কালেও যারা চিনতেন জানতেন তাঁরাও যখন আজকের কাজী জাফরকেই চিরকালের কাজী জাফর বলেন তখন আমার বুকের ভিতর একটা ক্ষোভ ঠেলে ওঠে। তাঁদের এই বলাটা অবশ্য নূতন বলা নয়। সেটা তাঁরা সেকালেও অনেকেই বলতেন। অথচ আমি বহুকাল তাঁর সঙ্গে বাম নেতাদের মিলিয়ে দেখেছি। ঐসব বাম নেতাকে দেখেছি তাঁরা কর্মীদের বিকাশ ও প্রয়োজনের প্রতি কতটা নির্বিকার থাকতেন এবং অনেক ক্ষেত্রেই কতটা নির্বিবেক হতে পারতেন। আমি তো আমার জীবনে উপর তলায় এমন একজন কমিউনিস্ট এমন কি বামপন্থী জননেতা পাই নি যিনি অধ্যয়নশীলতাকে উৎসাহ দিতেন। বরং কারো কারো কাছে যে সেটা অনাকাঙ্ক্ষিত ছিল সেটা স্পষ্ট করতেন। সে কালে এক প্রখ্যাত বামপন্থী বিপ্লবী নেতার মতে বিপ্লব করার জন্য চারটা বই পড়াই যথেষ্ট। এই চারটার মধ্যে একটা অবশ্য নীহার রায়ের ‘ছোটদের রাজনীতি’বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন পড়তাম তখন একদিন তাঁকে রবীন্দ্র সাহিত্য পাঠের গুরুত্ব বলতে গিয়ে শুনতে হল, ‘রবীন্দ্রনাথের বই পড়ে কি হবে? পশ্চিম বাংলার বাঙ্গালীরা তো রবীন্দ্রনাথের বই পড়ে। তারা কি বিপ্লব করতে পেরেছে?’

এদের সঙ্গে ছাত্র জীবনের কাজী জাফর আহমদকে মেলাই। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এসএম হলের আবাসিক ছাত্র ছিলাম। ১৯৬২-তে ভর্তি হই। তিনিও ঐ হলের আবাসিক ছাত্র ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন অনার্সে ভর্তি হই সম্ভবত তখনও তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। অথবা এমএ দেওয়া হলেও তখনও এসএম হলে থাকতেন। এবং আরও কিছুকাল ছিলেন। প্রথম বর্ষ থেকেই ছাত্র ইউনিয়নের একনিষ্ঠ কর্মী হিসাবে তাঁর মনোযোগ ও গুরুত্ব পেয়েছিলাম। আমি তখন থেকে পেয়েছিলাম আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ মনোযোগী শ্রোতা-নেতা। আমার অধ্যয়নশীলতাকে যে তিনি কি পরিমাণে পছন্দ করতেন সেটা আমি কখনই ভুলি নি। আমি তো তাঁর অন্ধ অনুরাগী কোনকালে ছিলাম না। ছাত্র জীবনে বিশেষত বিশ্ববিদ্যালয়ে এক বৎসরের নীচের শ্রেণীতে অবস্থান সে কালে কত বড় ব্যবধান সৃষ্টি করত সেটা সেকালের সকলেই জানেন। সেখানে আমি ছিলাম অনেক নীচে। প্রকৃতপক্ষে তাঁর এমএ পরীক্ষা দেবার কথা ছিল ১৯৬১ সালে। সেটা তিনি ১৯৬২-তে দেন। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাবে তিনি আমার অনেক সিনিয়র। তবে এসএম হল যা ছিল আমারও হল, সেখানে তিনি কিছুদিন ছিলেন বলে অন্তত ১৯৬২-তে তাঁকে আমার কাছে পাওয়ার সুযোগ ঘটে। যাইহোক, আমি ছিলাম অনেক জুনিয়র। তবু আমি যখন তাঁর ভুল-ত্রুটিগুলো বুঝিয়ে বলতাম এবং সেগুলো সংশোধন করতে বলতাম তখন তিনি মনোযোগ ও আগ্রহ নিয়ে শুনতেন। আমি অনেকের মত সামনে স্তুতি অথবা নিশ্চুপ থাকা আর আড়ালে গিয়ে নিন্দা-সমালোচনা করে বেড়াতাম না। সম্ভবত আমার মত তাঁর সামনাসামনি সমালোচক তিনি কখনও পান নি। অন্তত সেকালে। কিন্ত তাঁকে কখনই আমার প্রতি বিদ্বিষ্ট হতে দেখি নি। বরং একান্তে বসে যখন বলতাম তখন আমার সমালোচনা ও পরামর্শ বোঝার চেষ্টা করতেন।

কাজী জাফর খুব ভালভাবে জানতেন আমার ধ্যান-ধারণা এবং চরিত্র-বৈশিষ্ট্য। তিনি জানতেন যে, আমি তাঁর অন্ধ অনুগত কোন কালেই হব না। কিন্তু আমার পদের প্রতি বিমুখতা জানা সত্ত্বেও তাঁর ইচ্ছা হল আমি যেন অবিভক্ত ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক হই। জানি সে কালে আমার পক্ষে সেটা হওয়া উচিত বা সম্ভব ছিল না। হয়তো প্রকাশ্য রাজনীতির দায়িত্ব নিতে চাই নি বলে আমার প্রতি তাঁর আগ্রহ ও আস্থা ক্রমে ফুরিয়েছিল।

কিন্তু আমার মনে পড়ে ছাত্র জীবনে যখন আমি নূতন নূতন ভাবনা-চিন্তা তাঁকে বলতাম তিনি কি রকম আগ্রহ সহকারে শুনতেন এবং বোঝার চেষ্টা করতেন। হয়তো সব বুঝতেন না। আমিই বা কতটা বুঝতাম! কিন্তু নূতন নূতন ভাবনা-চিন্তার প্রতি এমন আগ্রহ ও বোঝার চেষ্টা আমি আর কোন নেতার মধ্যে দেখি নি। কোন নেতা নয়। না জননেতা, না ছাত্রনেতা। বরং আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি যে, বাম নেতাদের কাছে সেগুলোর সামান্য প্রকাশেই আমি তাদের সন্দেহের, ঘৃণার, অবিশ্বাসের পাত্র হয়েছি, অপমানিত হয়েছি, নির্দয় চক্রান্তের শিকার হয়েছি।

কাজী জাফরের সাংগঠনিক ক্ষমতা ও বাগ্মীতার বিষয়ে নূতন করে কিছু বলার বোধ হয় প্রয়োজন নেই। ১৯৬২-এর ছাত্র আন্দোলনের সূচনার সময় তিনি ঢাকায় অনুপস্থিত ছিলেন। সেই আন্দোলন সংগঠিত করার কৃতিত্ব মূলত মোহাম্মদ ফরহাদের। কিন্তু ঐ আন্দোলন ৩১ জানুয়ারী অথবা ১ ফেব্রুয়ারীতে এক হঠাৎ বিস্ফোরণের মত শুরু হয়ে সম্ভবত ফেব্রুয়ারীর ৭ তারিখে স্তিমিত হয়। ঐ আন্দোলনের পর কাজী জাফর ঢাকায় এসে আন্দোলনকে নূতনভাবে সংগঠিত করেন। বিশেষত কলেজের পাস কোর্স ছাত্রদের দাবীর ভিত্তিতে যে শিক্ষা আন্দোলন শুরু হয় সেটিকে তিনি নিপুণ হস্তে পরিচালনা করে তাকে এক বিশাল আইয়ুব সরকার বিরোধী ছাত্র গণ-আন্দোলনে পরিণত করেন। তাঁর অসাধারণ বাগ্মীতা ও সাংগঠনিক দক্ষতা প্রকাশ পায় ঐ আন্দোলনে।

কাজী জাফরের সেকালে যে রাজনৈতিক ও চারিত্রিক সততা ছিল সেটা ছিল তাঁর প্রতি আমার অনুরাগের এক প্রধান কারণ। আমি ইতিপূবেই উল্লেখ করেছি জাফর-মেনন-রনোর সঙ্গে ফজলুল হক এবং আমার আলোচনার কথা। বস্তুত কাজী জাফর তাঁর অন্তত তখনকার ধারণাটাই সৎভাবে প্রকাশ করে বলেছিলেন যে, আইয়ুব সরকার সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী জাতীয় বুর্জোয়াদের সরকার। আর এই ধারণা তিনি তো পেয়েছিলেন বা নিয়েছিলেন তৎকালীন পিকিংপন্থী হওয়া কমিউনিস্ট নেতাদের নিকট থেকে।

হাঁ, তাঁর সঙ্গে আমি মেলাই পিকিংপন্থী কমিউনিস্ট নেতাদের। আমার মনে আছে ন্যাপ, ছাত্র ইউনিয়ন এবং বাম রাজনীতিতে আইয়ুব সরকার বিরোধী আন্দোলনের কর্মসূচী না থাকায় ’৬৫ এবং ’৬৬ এর দিনগুলোতে আমি যখন কমিউনিস্ট নেতা আবদুল হকের সঙ্গে কথা বলতাম তখন তাঁর কথাগুলো। আমার মনে আছে আবদুল হক জোরালোভাবে আমাকে সর্মথন করতেন। প্রথম পর্যায়ে যখন কথা হয়েছিল তখনও তিনি আত্মগোপন করে ছিলেন। পরে তাঁদের কয়েকজনের উপর থেকে হুলিয়া প্রত্যাহার হলে তিনি প্রকাশ্যে আসেন। তখন তাঁর সঙ্গে প্রচুর আলোচনা হয়। এরপর তাঁরা যখন আলাদা পার্টি করলেন তখন আবদুল হক আমার ক্ষোভের উত্তরে বলতেন যে, হাঁ, পার্টি যে কেন এই বিষয়টা বুঝছে না সেটা তিনিও বুঝছেন না। এবং তিনি বারবার আমাকে আশ্বস্ত করতেন যে, তিনি পার্টিকে আইয়ুব-বিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলার বিষয় বিবেচনা করতে বলবেন। তিনি আমাকে বলতেন ‘আমি তোমার সঙ্গে একমত। আমিও এটা মনে করি। পার্টিতে আমি বিষয়টা তুলব।’

অথচ তিনিই ছিলেন ‘ডোন্ট ডিস্টার্ব আইয়ুব’ লাইনের মূল তাত্ত্বিক নেতা। আমার মনে আছে ’৬৫-এর শেষ অথবা ’৬৬-এর প্রথমে জেল থেকে ছাড়া পেয়ে আবদুল মতিনও আমার সঙ্গে একমত হতেন এবং এ ব্যাপারে পার্টিতে বক্তব্য দেবার জন্য আমি যে তাগিদ দিতাম তাতে সম্মতি জানাতেন। অবশ্য বহুকাল পর আমি শুনেছিলাম যে, তিনি ঐ সময়েই পাবনার এক কর্মীসভায় বক্তৃতায় বলেন, ‘আমাদের এখন আইয়ুব সরকারকে “ডিসটার্ব” করা উচিত নয়।’

এদের সঙ্গে আমি কাজী জাফরকে মেলাই। না, সুখেন্দু দস্তিদার বা মোহাম্মদ তোয়াহার মধ্যে এমন মিথ্যাচার বা দ্বৈততা আমি দেখি নি। তাঁরা আমার কথা শুনলেও এ ব্যাপারে মত দিতেন না। আসলে কৌশলে এড়াতেন এবং যা করার সেটাই করতেন। মোহম্মদ তোয়াহার সঙ্গে অবশ্য আমার তেমন একটা কথা হত না। তাঁর রাজনৈতিক চেতনা এবং আলোচনার মান এমন ছিল যে, তাঁর সঙ্গে আলোচনার কোন উৎসাহই আমার হত না বা ছিল না। হাঁ, তাঁরাই ছিলেন সেকালে এ দেশের বাম কমিউনিস্ট আন্দোলনের দিকপাল! আর সুখেন্দু দস্তিদার ছিলেন কৌশলী। তিনি অন্তত আমাকে মিথ্যা বলেন নি। আবার সত্যও বলেন নি। এসব বিষয়ে মতামত দিতেন না। শুধু শুনতেন।

ঐ নেতৃত্বের সঙ্গে আমি বরং রনো-মেননের মিল খুঁজে পাই। যাঁরা মুখে যে যা-ই বলুন পিকিংপন্থী কমিউনিস্ট নেতাদের দ্বারা প্রবর্তিত ‘ডোন্ট ডিসটার্ব আইয়ুব’ লাইন অনুসরণ করেছিলেন আরও অনেক দিন। সম্ভবত ১৯৬৮-এর প্রায় শেষাবধি। কিন্তু কাজী জাফর ছিলেন ভিন্ন। অন্তত সেকালে নেতৃত্ব অর্জন বা রক্ষার জন্য এই ধরনের দ্বৈততা অথবা ধূর্ততা ও প্রতারণা আমি তাঁর মধ্যে দেখি নি। হাঁ, সেটা তিনি তখনও শেখেন নি। ওটা শিখলে হয়তো এই রকম এক দেশে তিনি আরও অনেক আগে আরও অনেক উন্নতি করতে পারতেন!

যাইহোক, কাজী জাফরের মধ্যে কি করে জেদ এল এবং সেই জেদ তাঁকে কোথায় নিল সেসব আমি আমার সকল সমালোচনার মধ্যেও সেকালে দেখার এবং অনুভব করার চেষ্টা করেছি। মস্কোপন্থীরা ছিল চক্রান্তকারী অথবা এক চক্রান্তের অচেতন হাতিয়ার। তারা কাজী জাফরকে নির্মূল করতে চাইল। কিন্তু ছাত্র ইউনিয়নের অকাল ভাঙ্গনের পর যখন ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন) দাঁড়াল তখন এটা দাঁড়াল মূলত কাজী জাফরের বিপুল জনপ্রিয়তার যেটুকু তখনও অবশিষ্ট ছিল তার গুণে আর আমার মত কিছু সংখ্যক রাজনীতি সচেতন কর্মীর ঐকান্তিক চেষ্টায়।

হয়তো এসএম হলের ভূমিকাটাও একটা কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করেছিল ঐ প্রবল বিপর্যয়ের মুখেও ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন)-এর দ্রুত শক্তি নিয়ে দাঁড়াবার পিছনে। কারণ সেকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল যেমন সমগ্র দেশের ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্র তেমন এসএম হল ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আন্দোলনের মস্তিকের মূল অংশ। বিশেষত বাম ছাত্র আন্দোলনে এস এম হলকে মস্তিষ্ক বলাই সঙ্গত। আর এই হলেই আমরা ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া)-কে নির্মূল করে দিই। এই হলের আবাসিক ছাত্র ছিলেন কাজী জাফর আহমদ। তাঁর প্রভাব তো ছিলই। এমন কি এখানে কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে সংযুক্ত ছাত্রদের নিয়ে গঠিত যে গোপন সেল ছিল সেটাও ছাত্র ইউনিয়নকে ভাঙ্গার ক্ষেত্রে কমিউনিস্ট পার্টির চক্রান্তের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়।

যারা কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য নয় অথচ তার সঙ্গে সংযুক্ত এমন কমিউনিস্ট কর্মীদের নিয়ে গঠিত পার্টি সেলকে পার্টি গ্রুপ বলা হত। যাইহোক, এটা এক ধরনের সেল। এসএম হলে ছাত্রদের নিয়ে পার্টির যে গোপন সেল ছিল সেটার সম্পাদক আমি ছিলাম। ফরহাদ ও কমিউনিস্ট পার্টি ছাত্র ইউনিয়নকে ভাঙ্গতে যাচ্ছে বুঝতে পেরে আমরা এই সেলের পক্ষ থেকে রাশেদ খান মেননকে সভাপতি বা সাধারণ সম্পাদক যে কোন একটা পদ দিয়ে ছাত্র ইউনিয়নের ঐক্যবদ্ধ কমিটি গঠনের পক্ষে সর্বসম্মতিক্রমে লিখিত প্রস্তাব গ্রহণ করি যাতে সেদিন ঐ সেলের অন্যতম সদস্য সাইফুদ্দিন আহমদ মানিকও সম্মতি দেন। সেলের লিখিত প্রস্তাব তাঁর হাত দিয়ে ফরহাদের মাধ্যমে পার্টির কাছে পাঠানো হয়। পার্টি যে সেটা গ্রহণ করে নি তা ছাত্র ইউনিয়নের বিভক্তিতেই বোঝা গেল। কিন্তু ঐ হলে মস্কোপন্থী কমিউনিস্ট পার্টি আর ঢুকতে পারে নি।

সাইফুদ্দিন আহমদ মানিক ছিলেন এসএম হলের অনাবাসিক ছাত্র। তিনি মস্কোপন্থীদের সঙ্গে গেলে ঐ হলে তাঁর আর কিছুই করার ছিল না। এটা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা যে, এসএম হল-এর পার্টির ছাত্র-সেল ছাড়া ঐ সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের আর কোনও হল বা ঢাকার আর কোথায়ও থেকে কমিউনিস্ট পার্টির কোনো ছাত্র সেল পার্টির অন্যায় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে দাঁড়ায় নি এবং ঐ সিদ্ধান্তের কারণে পার্টির সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করে নি। অন্তত এমন কোনও ঘটনার কথা আমার জানা নেই। আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ কমিউনিস্ট ছাত্র কর্মীদের প্রায় সকলকেই চিনতাম। মোহাম্মদ ফরহাদ ছাত্র ইউনিয়ন সম্মেলনের মাত্র কয়েক দিন আগে ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ ও প্রতিনিধিত্বকারী কমিউনিস্ট ছাত্র কর্মীদের নিয়ে গোপন এবং গুরুত্বপূর্ণ যে সম্মিলিত সভা করেছিলেন সেখানে উপস্থিত থেকে আমি বুঝেছিলাম ছাত্র ইউনিয়নের ভিতর পার্টির প্রসার তখন কতটা বিস্তৃত ছিল এবং ছাত্র ইউনিয়নের উপর পার্টির নিয়ন্ত্রণ কি পরিমাণে শক্তিশালী ছিল!

যাইহোক, এসএম হলের ক্ষেত্রে সাইফুদ্দিন আহমদ মানিক একা হয়ে গেলেন এবং একাই তাঁকে সাধারণ সম্পাদক হিসাবে ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া)-তে যেতে হল। এসএম হলের পার্টি সেলের আর সকলে আমরা ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন)-কে সমর্থন দিলাম। এরপর আমার এতকাল যা কিছু আড়াল ছিল সব ফেলে দিয়ে ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন)-এর সপক্ষে আমার সমস্ত শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লাম।

ক্রমে এসএম হল হয়ে ওঠে সেকালে বাম আন্দোলনের এমন এক দুর্ভেদ্য দুর্গ যা পুরোটা দশক ঐভাবেই রয়ে যায়। অবশ্য তার মানে এই নয় যে, ছাত্র ইউনিয়নের ভাঙ্গনের ফলে হতাশার প্রভাব এখানে পড়ে নি। পড়েছিল। সেটা ভয়ানকভাবে পড়েছিল। সমগ্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো। যে কারণে আর এক বিপ্লবী নেতৃত্বের উত্থান ঘটতে অনেকটা সময় লেগে যায়। এসএম হল থেকেই পরবর্তী কালে (১৯৬৭-তে) উঠে আসেন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক রূপে মাহবুব উল্লাহ। অবশ্য কাজী জাফর-মেনন যদি আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন থেকে সরে না আসতেন তাহলে হয়তো এমন ক্ষতিটা হত না।

ছাত্র ইউনিয়ন বিভক্ত হলে ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন)-এর পিছনে সাধারণ ছাত্রদের যে বিরাট অংশটা এসে দাঁড়ায় সেটা সম্ভব হয় প্রধানত কাজী জাফরের ব্যক্তিগত প্রভাবের কারণে। আর এটাই তাঁর কাল হয়ে দাঁড়াল। ছাত্র নেতা মেননের মূলধন হল ব্যক্তি জাফর বন্দনা। তাঁর চারপাশে রইল কাজী জাফরের অরাজনৈতিক ভক্ত ও স্তাবকবৃন্দ। সে এক ভয়ানক অভিজ্ঞতার কাল!

যে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনটাকে আওয়ামী লীগ, ছাত্র লীগের চেয়েও এগিয়ে নেবার আকাঙ্ক্ষা থেকে কাজী জাফর ফরহাদ ও কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে সংঘাতটা বাধালেন তিনি বা তাঁর অনুসারী মেনন সেখান থেকেই সরলেন। আইয়ুব-বিরোধী সংগ্রামের হিরো এবার জিরো হবার দিকে এগিয়ে চললেন ঠিক যেমনটা তাঁর প্রতিপক্ষ চেয়েছিল। কাজী জাফরের প্রধান শত্রু ফরহাদ, কারণ তিনি তাঁকে চক্রান্তকারী আর নেতৃত্বলোভী হিসাবে সর্বত্র চিত্রিত করে বেড়িয়েছেন। আর মেননের প্রধান শত্রু ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া), কারণ তা সংগঠন ভেঙ্গেছে। এমন এক বিবাদে রাজনীতির দাঁড়াবার জায়গা কোথায়?

এই ভাঙ্গনের ফলে ধ্বংসের শক্তি মুক্ত হল। কমিউনিস্ট পার্টির অত্যন্ত শক্তিশালী নেটওয়ার্ক ছিল ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া)-এর ভিতর। ফলে সঙ্কটটা সেখানে এত তীব্র ছিল না। কিন্তু ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন) এবার দুনিয়ার যত চাটুকার, মতলববাজ, মাথা গরম আর হঠাৎ নেতা হতে চাওয়া লোকদের আখড়া হল। তারা নানান দিক থেকে জাফর-মেননকে ঘিরে ধরল। রাজনৈতিক চেতনার কর্মীরা ক্রমে পিছু হটল এবং তারাও অনেকে রাজনৈতিক ও আন্দোলনের প্রশ্নগুলো বাদ দিয়ে জাফর-মেননের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করতে থাকল। ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন) নিজেকে আইয়ুব বিরোধী ভূমিকা থেকে পুরোপুরি সরিয়ে নেয় এই সময়ে। কাজী জাফর তখন সরাসরি ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে সংযুক্ত ছিলেন না। ১৯৬৬ থেকে তিনি টংগীতে শ্রমিক আন্দোলন গড়ে তোলেন এবং শ্রমিক নেতা হিসাবে তাঁর উত্থান ঘটে। কিন্তু মেননের নেতা হিসাবে তিনিই পরিচিত ছিলেন। এবং স্বাভাবিকভাবে মেননের যাবতীয় ভূমিকার জন্য কাজী জাফরকেই সবচেয়ে বেশী দায়ী মনে করা হত। ছাত্র ইউনিয়নের বিভক্তির পর নূতন শক্তির জন্য সেটা ছিল এক ভয়ঙ্কর সময়।

তখন দেখলাম শুধু তখন নয় ভাঙ্গনের সময় থেকেই আমার জীবনে প্রথম দেখলাম এ দেশে যোগ্য নেতাদের কত ছড়াছড়ি! এদের সকলের দৃষ্টি তখন মেননের পদটির দিকে। তাদের মনে হল মেননের চেয়ে তারা অনেক যোগ্যতর। যে নিষ্কর্মা মানুষটাকে ঘর আর চেয়ার ছেড়ে নড়ানো কঠিন তখন তারও মনে হতে লাগল এ দেশের বিপ্লবের মহা বোঝাটি বহন করার মতো যোগ্য স্কন্ধ একমাত্র তারই শরীরে আছে। নূতন চর জেগেছে। চারদিকে লাঠিয়ালদের সাজ সাজ রব। তবে চর দখলেও দু’টো পক্ষ থাকে। এখানে কে যে কখন কার পক্ষে থাকে সেটাই বোঝা দুষ্কর হল। ছাত্র ইউনিয়নের ভাঙ্গনের ফলে ভাঙ্গনের যে চাকাটা সচল হল তখন সেটা ঘুরতে শুরু করেছে ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন)-এর ভিতর। এই চাকা বন্ধ করার জন্য আমার কাজ ছিল দু’টো। একদিকে রাজনৈতিক প্রশ্নগুলোকে আমার বুদ্ধি অনুযায়ী সামনে নিয়ে এসে লড়াই চালানো এবং সবাইকে তা করতে বলা এবং যে কোন ধরনের বিভক্তির বিরোধিতা করা, অন্যদিকে কাজী জাফর এবং মেননকে যতটা সম্ভব বোঝাতে থাকা। অবশ্য তখন তাঁদের পিছনে শক্ত খুঁটি। আনোয়ার জাহিদ। এবং আরও অনেক বড় ও প্রবল শক্তি আবদুল হক। আবদুল হকেরা তখন মস্কোপন্থী অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টিতে থেকেই তাদের গোপনে সমর্থন দিতে শুরু করেছে।

জানি না ঐ সময় যদি আমার সমস্ত শক্তি নিয়ে না দাঁড়াতাম তবে ১৯৬৫-এর শেষার্ধ থেকে ১৯৬৬ পর্যন্ত কালটাতে ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন)-এর আরও ভাঙ্গন ঠোকানো যেত কিনা। এটা ঠিক যে আমি ছাত্র ইউনিয়নের নেতা ছিলাম না। কিন্তু নেতা না হয়েও যে শুধু বৎসরের পর বৎসর কাজ করে যায় তারও একটা শক্তি থাকে। সেটা হল সমর্থনের শক্তি। কেউ কেউ আমার প্রতি ক্ষুব্ধ হয়েছে, আমার বৈরী হয়েছে ছাত্র ইউনিয়নকে ভেঙ্গে মহান নেতা না হতে পারার জন্য!

এই সময় কাজী জাফর আমার অনেক দূরের মানুষ হয়ে গেলেন। আমার গুরুত্ব অবশ্য তখন আর তাঁর কাছে নেই। তখন তাঁর ব্যক্তি দম্ভের জখম জায়গাগুলোয় স্তুতির প্রলেপ দরকার ছিলএকদল স্তাবক, চাটুকারের দরকার ছিল। অন্যদিকে দরকার ছিল আর একদল কমিউনিস্ট নেতার সমর্থন। দু’টোই তিনি পেলেন। চোখের সামনে দেখলাম আমার কাছের মানুষটি কিভাবে দূরের হয়ে গেল। আজ এ কথা বলতে হয় যে, আমার ভূমিকার মূল্যায়নের ক্ষমতা কিংবা ইচ্ছা কাজী জাফরের ছিল না। সেটা তাঁর সীমাবদ্ধতারই প্রমাণ।

যাইহোক, আজ যখন বহুকাল পরে অতীতের স্মৃতিগুলো ঝালিয়ে নিতে চেষ্টা করছি তখন সেকালে মেননের ভূমিকার তাৎপর্য নূতনভাবে ধরা পড়ে। কিভাবে তিনি ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন)-কে আইয়ুব-বিরোধী আন্দোলন থেকে সরিয়ে দিলেন সে কথা যখন মনে হয় তখন বুঝি মেনন আসলে তখন সজ্ঞানে বা অজ্ঞানে কি ভূমিকাটা পালন করেছিলেন! মেনন আইয়ুব-বিরোধী কোন প্রকার বক্তব্যই দিতেন না। শুধু সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে বক্তৃতা দিতেন। এ নিয়ে তাঁর সঙ্গে আমার বিতর্ক হয়। আমি কখনই তাঁকে বোঝাতে পারি নি যে, সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী আন্দোলন এবং আইয়ুব সরকার বিরোধী আন্দোলন ভিন্ন কিছু নয়। এবং আইয়ুব-বিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমেই আমাদেরকে এ দেশে সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে; কারণ এ দেশে সাম্রাজ্যবাদ তার আধিপত্য বজায় রাখছে এই সরকারের মাধ্যমেই। শুধু আমি নই, কেউই তাঁকে কখনই বোঝাতে পারে নি। আইয়ুব সরকারের বিরুদ্ধে তিনি একটি শব্দও উচ্চারণ করতেন না।

মোট কথা, ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন)-এ আইয়ুব-বিরোধী আন্দোলনটাকে নিস্তেজ বা প্রায় নির্মূল করার সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব যদি কাউকে দিতে হয় তবে সেটা মেননকেই দিতে হবে। তিনি সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধিতার নামে ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন)-এর ভিতর আইয়ুব সরকারের প্রতি দুর্বল অথবা সহানুভূতিশীল এমন এক শক্তি দাঁড় করালেন যে, কাজী জাফর তার সহজ শিকার হলেন। এইভাবে কাজী জাফরের সঙ্গে আমার এবং আমার মত আইয়ুব-বিরোধী এবং সচেতন রাজনৈতিক শক্তির বিচ্ছেদ ঘটালেন। বস্তুত আমাদের এবং কাজী জাফরের মাঝখানে বিভেদের সবচেয়ে বড় প্রাচীর তোলার কাজটা করলেন মেনন।

আসলে ঐ সময়টা ছিল মহামূল্যবান ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন)-এর জন্য। এই সময়টাকে বিনষ্ট করা দায় যদি কাজী জাফরের উপর সবটা চাপানো হয় তবে সেটা হবে ভুল। এর দায় প্রকৃতপক্ষে মেননের। এর পিছনে আনোয়ার জাহিদ এবং আবদুল হক গোষ্ঠীর অবদান ছিল। কিন্তু ছাত্র ইউনিয়নের ভিতর আইয়ুব বিরোধী রাজনীতিকে অন্তর্ঘাত করার মূল কৃতিত্ব মেননকেই দিতে হবে।

কাজী জাফর এবং ছাত্র ইউনিয়নের সেই যুগের সঙ্কটের উপর এতটা আলোচনা করলাম সেই যুগের সমস্যাটা বোঝার জন্য। আমি অনেক ভেবেছি। ঐ কালটাতে কাজী জাফর আর কি করতে পারতেন, আর কি হতে পারতেন? আমি বলেছি যে, তিনি একটা আন্দোলনের সৃষ্টি। এটা ঠিক যে, এই আন্দোলনের আকাঙ্ক্ষা ও তেজ যে, সব নেতা ধারণ করে এগিয়ে যেতে পারে তা নয়। হয়তো তারা প্রথম দিকে প্রতীক হতে পারে। কিন্তু কিছু যোগ্যতা না থাকলে তাদেরকে নূতন প্রতীক সৃষ্টি করে দিয়ে চলে যেতে হয়। কিন্তু কাজী জাফর যে তেমন অযোগ্য ব্যক্তি ছিলেন না সেটা আমি জানি। আসলে অনেক যোগ্যতাই তাঁর ছিল। বাকীটা অনেকটাই তিনি অর্জন করে নিতে পারতেন। আর একটা কথা আমাদের মনে রাখতে হবে। সেটা হল গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেতৃত্ব একটা টিম ওয়ার্ক। এবং সেটা খুব বেশী পরিমাণেই। কাজেই কাজী জাফরকে সর্বগুণে গুণান্বিত হতে হবে এই ভাবাটার মধ্যেই আছে একটা একনায়কী বা স্বৈরতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষাএ যেন মানুষের মাঝে ‘একমেবাদ্বিতীয়ম’ বা ‘লা শরীক আল্লাহ’ খুঁজতে চাওয়া। আসলে আমাদের এই বোধ, সংস্কৃতি এবং মানসিকতা আমাদের বুদ্ধি-বিবেচনার অনেক ভ্রান্তি ও বিকৃতির জন্য দায়ী।

এটা আমার কাছে স্পষ্ট যে, কাজী জাফর আর এগোতে পারতেন না। আসলে তিনি দাঁড়িয়েছিলেন সমস্ত প্রতিষ্ঠিত সামাজিক শক্তির বিরুদ্ধে। একদিকে, তিনি দাঁড়িয়েছিলেন পাকিস্তানী শাসক শ্রেণীর সামরিক প্রতিনিধি আইয়ুব সরকারের বিরুদ্ধে। অপর দিকে, আইয়ুব সরকারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে তিনি অপেক্ষাকৃত পশ্চাৎপদ কিন্তু শক্তিশালী মধ্যবিত্ত শ্রেণীর দল আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠছিলেন। কিন্তু ন্যাপ ও কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বাধীন যে বাম ধারায় তিনি বেড়ে উঠেছিলেন সেটাও তাঁকে সমর্থন দেয় নি। তখন এ দেশে প্রগতিশীল ও গণভিত্তিক মধ্যবিত্তের সংগঠন ছিল ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি বা ন্যাপ এবং তার পিছনের শক্তি কমিউনিস্ট পার্টি। কিন্তু এই ন্যাপ ও কমিউনিস্ট পার্টিও তাঁর আর বেড়ে ওঠাটা চায় নি। বরং বাধা দিয়েছে। ভাসানীর কথা ভিন্ন। তিনি সবকিছু নিয়ে মাথা ঘামাতেন না। এবং সবকিছু নিয়ন্ত্রণের সাধ্যও তাঁর ছিল না।

আসলে ভাসানীর যথাযথ মূল্যায়ন যদি করা যায় তাহলে বোঝা যাবে এ দেশ কী বিরাট এক সিংহ পুরুষ জন্ম দিয়েছিল যার কোন তুলনাই অন্তত মুসলিম বাঙ্গালী সমাজে আজ অবধি নেই। সুভাষের মত অত বড় নেতা তিনি নন। কিন্তু সমগ্র বাঙ্গালী জাতিই ঠিক তাঁর ধরনের একটি নেতাও জন্ম দিতে পারে নি। হয়তো তিনি নেতা নন, পিতা। তিনি এমন এক পিতা যিনি পূর্ব বাংলার জনসমাজটিকে তাঁর সন্তানের মতো দেখতেন এবং এর বড় হওয়ার জন্য তাঁর বুদ্ধি ও সাধ্য মতো সবকিছু করতেন, কিন্তু সিন্দাবাদের গল্পের বুড়ো দৈত্যের মতো তিনি এর ঘাড়ে সওয়ার হতে চান নি। আর এই কারণে অনেক বৈপরীত্য সত্ত্বেও সংগঠনের মধ্যে তাঁর এমন এক ধরনের গণতান্ত্রিক আচরণ ছিল যার সমতুল্য এ দেশে আর কোনও জাতীয় নেতার মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায় না।

যাইহোক, কমিউনিস্ট পার্টি যা তখন ন্যাপকেও নিয়ন্ত্রণ করত কাজী জাফরকে আর উঠতে কিংবা দাঁড়াতে দিতে চায় নি। তাঁর মধ্য দিয়ে এবং তাঁকে অবলম্বন করে যে তরুণ-শক্তির অভ্যুদয় ঘটছিল সেটিকে প্রতিহত করতে চেয়েছিল। পার্টি ছিল মস্কোপন্থী। এবং তখনও এ দেশে চীনের প্রভাব আসে নি। মাও সে-তুং-এর বইপত্রও ’৬৫-এর সেপ্টেম্বরে পাক-ভারত যুদ্ধের পূর্ব পর্যন্ত এ দেশে দুর্লভ ছিল। ফলে সমগ্র বাম রাজনীতি ছিল মস্কোপন্থী কমিউনিস্ট পার্টির নিয়ন্ত্রণে। কিন্তু ছাত্র আন্দোলনের ভিতর মস্কোর তৎকালীন শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাজ পরিবর্তনের নীতির পরিবর্তে সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে সমাজ পরিবর্তনের যে ভাবনা ধীর গতিতে বিস্তৃত হচ্ছিল সেটা ’৬৪-তে এসে দানা বাঁধছিল। এর ফলে চীনের প্রভাব বাড়াটা ছিল অনিবার্য। চীন কর্তৃক বিপ্লবী পথ তুলে ধরার কারণে উদীয়মান তরুণ শক্তি তার প্রয়োজনেই অন্ধভাবে নয় বরং নিজের মত করে সেই পথটিকে গ্রহণ করত। মস্কোপন্থী পার্টি সব দিক বিবেচনা করে সেই সুযোগ দেয় নি। সুতরাং তা কাজী জাফরকে মোক্ষম সময়টিতে আঘাত করেছে এবং ছাত্র ইউনিয়নকে বিভক্ত করেছে। ফলে আইয়ুব ও পাকিস্তান বিরোধী আন্দোলনে আওয়ামী লীগ ও মুজিবের সমান্তরাল অথচ প্রাগ্রসর ধারাটি কাজী জাফরের নেতৃত্বে সুস্থিরভাবে গড়ে ওঠার সুযোগ হারায়।

কাজী জাফর তখন রাজনৈতিক শক্তির অবলম্বন হারিয়ে একা হয়ে পড়েন। এটা ঠিক যে, মেনন যদি রাজনৈতিক ব্যক্তি হতেন তবে একটা সুস্থ বিপ্লবী বা গণতান্ত্রিক জাতীয়তাবাদী রাজনীতি গড়ে তোলার পথে এগোনোর চেষ্টা করা যেত। আচ্ছা, ধরে নেওয়া গেল মেনন এই কাজে অযোগ্য। ধরে নেওয়া যাক এই কাজে আমি যোগ্যতর ছিলাম।

আমিই যদি তাঁর বদলে ছাত্র ইউনিয়নের হাল ধরতাম তবে কি হত? আমাকে কি এগোতে দেওয়া হত? বড় পদে থাকায় আমাকে চিনতে বা বুঝতে কি অসুবিধা হত?

সামাজিক-রাষ্ট্রিক শক্তি ও ষড়যন্ত্রকে অত খাটো করে দেখতে নেই। তারা আমাকে জেলে নিত। কারণ রাষ্ট্রের কাছে এসব খবর থাকে। জেলে রেখে দিত ততদিন পর্যন্ত যতদিন পর্যন্ত তারা তাদের মন মতো লোক দিয়ে ছাত্র ইউনিয়নকে এবং তার রাজনীতিটাকে পুনর্বিন্যস্ত করে নিতে না পারত। ভাঙ্গনের ফলে ঐ ভয়ঙ্কর হতাশা, তখনও মস্কোপন্থী রাজনীতি ও তার পার্টির প্রবল প্রভাব, তখনও বিপ্লবপন্থী রাজনীতি সচেতন কর্মীদের সংখ্যাল্পতা ও চিন্তার অস্বচ্ছতা, আনোয়ার জাহিদের মতো লোকের কলকাঠি নাড়া, এবং নিশ্চয় এমন একটা প্রবল শক্তিকে ব্যবহারের জন্য হঠাৎ কিংবা অন্ধ চীনপন্থী হওয়া আবদুল হকেরাও এগিয়ে আসত―হাঁ, এই সব কিছুকে হিসাবে নিতে হবে। সব মিলিয়ে, যখন আমি জেল থেকে বেরোতাম তখন দেখতে পেতাম আমার আকাঙ্ক্ষা থেকে ভিন্ন এক ছাত্র ইউনিয়নকে যেখানে আমি যে রাজনীতিতে বিশ্বাস করি সেটাকে আমার পক্ষে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়। হয়তো ছাত্র ইউনিয়নকে আবার ভাঙ্গতে হত রাজনীতির জন্য। তাতে কি হত? আরও হতাশা। এবং যতই বলি রাজনীতির কথা সবাই দায়ী করত আমাকে এবং বলত নেতৃত্বের লোভেই এসব করছি। অথবা বলত হঠকারী, মাথা গরম। আন্দোলনটা থাকত কোথায়? গুটি কয়েক হতাশ আর বিচ্ছিন্ন কর্মী নিয়ে আন্দোলন করতাম? আর আন্দোলন ছাড়া কি কর্মী বা রাজনীতি কিছুই দাঁড়ায়? আর যদি দেখতাম যে, যেহেতু সংগঠনে আমার রাজনীতিকে এখন এগিয়ে নেওয়া সম্ভব নয় সুতরাং পদত্যাগ করে আবার নীচ তলার কর্মী হতে চাইতাম তা হলে কি হত? আমার উপরে কি আর কারো আস্থা থাকত? সবাই বলতে অযোগ্য লোক, দায়িত্বজ্ঞানহীন। ফলে আমি যা বলতাম তার মূল্যও আর থাকত না। ঐ যুগে আমার মত মানুষ একা তার ভিন্ন চিন্তা এবং অনুভব নিয়ে কি খুব বেশী কিছু করতে পারত?

অন্য দিকে, নেতা হলে আমার শরীরটাও অনেক অনেক বড় হয়ে যেত। ঐ অত বড় শরীর নিয়ে পদ থেকে নেমে গেলে কি হত? আমি এই যে এতকাল ধীর গতিতে, সংগোপনে, নীরবে একটা বিপ্লবী রাজনীতি গড়ার প্রয়াস চালিয়েছিলাম এবং তার সমস্যাগুলো বোঝার চেষ্টা করেছিলাম সেসব কি আর হত? ছোট মাপের শরীর নিয়ে ধীরে ধীরে রাজনীতি গড়ার চেষ্টা করেছিলাম তাতেই এত চক্রান্ত, বাধা! অত বড় মাপের শরীরের কারণে আগেই চিহ্নত হতাম, সন্দেহের পাত্র, ভীতির পাত্র হতাম। কোথায়ও ঢুকতেই পারতাম না আমার ঐ বড় মাপের শরীরের কারণে। রাজনীতি করতে চাইলে ভিন্ন কিছু করার আন্তরিক চেষ্টা বাদ দিয়ে পোষমানা হয়ে চলতি পথের পথিক হতে হত। ঐ পথেই নেতা হতে হত যেমন কাজী জাফর বা অন্যেরা হয়েছেন। আর নয় বিপ্লবের স্বপ্নটা বাদ দিয়ে পোষমানা মধ্যবিত্ত গৃহস্থ জীবনের পথে যেতে হত। আসলে নেতা হওয়ারও সমস্যা আছে। সেটা কাজী জাফর বুঝেছেন।

যাইহোক, কাজী জাফর যদি ঐ কালে স্বাধীন সত্তা নিয়ে কমিউনিস্ট পার্টির বিরুদ্ধে না দাঁড়াতেন তা হলে ছাত্র ইউনিয়ন অন্তত সেই সময়ে সেইভাবে ভাঙ্গত না। সেক্ষেত্রে তিনি আপোস করে, নতজানু হয়ে রাজনীতি করতে চাইলে ন্যাপে যোগ দিয়ে একজন ছোটখাটো নেতা হতেন। তারপর সিঁড়ি বেয়ে ধীর গতিতে উপরে উঠতেন। উঠতেন, কারণ সে যোগ্যতা তাঁর ছিল। তবে হাতির মত একেকটা মোটা ও ভারী শরীরের ভীড় ঠেলে ন্যাপে তাঁর যোগ্য জায়গায় কখন যেতে পারতেন বা আদৌ যেতে পারতেন কিনা সেটা বলা কঠিন।

যাইহোক, সে ক্ষেত্রে তখন ছাত্র ইউনিয়ন বিভক্ত হত না। কিন্তু এটা ঠিক যে, তরুণ শক্তির যে অভ্যুদয় ছাত্র ইউনিয়নকে অবলম্বন করে ঘটছিল তাতে করে সেখানে গণতান্ত্রিক এবং বিপ্লবী চেতনার বিস্তারটা ধীর গতিতে হলেও হত। ফলে ’৬৫-এর সেপ্টেম্বরে পাক-ভারত যুদ্ধের কিছু আগে এবং বিশেষত পর থেকে চীনের সঙ্গে পাকিস্তান সরকারের সুসম্পর্কের কারণে যখন এ দেশে চীনের বইপত্র আসা শুরু করল তখন তার ব্যাপক প্রভাব তাদের উপর পড়ত। একদিকে তরুণ শক্তির উত্থান, অপর দিকে চীনের বিপ্লবী পথের প্রভাব কমিউনিস্ট পার্টিতেও পড়ত। ফলে পার্টি ভাঙ্গত এবং সেই সঙ্গে চীনপন্থী পার্টির নিয়ন্ত্রণে একটা তরুণ শক্তির বিদ্রোহের ফলে ছাত্র ইউনিয়নও ভাঙ্গত। এর ফলে যেটা হত সেটা হল সনাতন ধারায় গড়ে ওঠা কমিউনিস্ট ও বাম আন্দোলনটাই দ্বিধা বিভক্ত হত মাত্র যাতে নূতন চেতনার স্বাধীন শক্তিটা মাথা তোলার কোনও জায়গাই পেত না।

আসলে এ দেশে পিকিংপন্থী পার্টি যে ভুলগুলো করেছে সেগুলো সব উদ্দেশ্যমূলকভাবে করেছে এটা মনে করা ঠিক নয়, যেমন মস্কোপন্থী পার্টিকেও সেভাবে দোষারোপ করা ঠিক নয়। আসলে এটা একটা রাজনীতি এবং একটা বিশেষ ধারা ও পদ্ধতিতে গড়ে ওঠার ফল। পিকিংপন্থী পার্টির প্রধান নেতা তো ছিলেন সুখেন্দু দস্তিদার। তাঁর অতীত গৌরব, আজীবন ত্যাগ, সংগ্রাম এসবের মহিমাকে খাটো করে দেখা ঠিক নয়। সবাই তো আর আবদুল হকের মত মিথ্যাচারী ও কুচক্রী নয়, যদিও তাঁর অতীতটাও গৌরবের। এঁরা সবাই অনেক ভুলের ফসল। একটা নির্দয় কাল ও পরিস্থিতিরও ফসল। এই ভুল ধারায় গড়ে ওঠা পার্টিটা যখন ভাঙ্গত তখন আর একটা ভুলের জন্ম হত। যে রাজনীতিটা সুখেন্দু দস্তিদার-আবদুল হকের পিকিংপন্থী পার্টি করল সেই রাজনীতিটা হয়ে উঠত প্রকৃতপক্ষে সমস্ত বাম ধারার রাজনীতি। ফলে বাঙ্গালীর গণতান্ত্রিক জাতি-রাষ্ট্র গঠনের চেতনার যে শক্তিটা ছাত্র-তরুণদের মাধ্যমে পরবর্তী কালে এভাবে বিস্তৃত হতে পারল সেটা আর হত না।

সে কালে আমি যখন মাওপন্থার অনুসারী হই আমি অন্ধ হই নি। ওটা ছিল আমার কাছে এ দেশে বিপ্লবের জন্য একটা হাতিয়ার বা পদ্ধতি মাত্র, যার প্রয়োজন ছিল যাত্রা শুরুর জন্য। এবং আমার সামনে শুধু রাশিয়া, চীন নয়, উপরন্তু ভিয়েতনাম এবং বিশেষত কিউবারও অভিজ্ঞতার মূল্য ছিল। মোট কথা অন্ধ অনুসারী আমি ছিলাম না। ভুল ধারণা পোষণ করলেও সেটা থেকে মুক্ত হতে আমার বেশী সময় সচরাচর লাগত না। বিশেষত বাস্তব অবস্থা বোঝার উপর আমি সব সময় অনেক বেশী গুরুত্ব দিয়েছি, এমন কি তত্ত্বের চেয়েও অনেক বেশী।

আমি ছাত্র ইউনিয়নের ভিতরে ও বাইরে দীর্ঘকাল ধরে একটা বিপ্লবী রাজনীতি গড়ে তোলার জন্য সচেষ্ট ছিলাম। সেটা আমার বুদ্ধি-বিবেচনা সেই বয়সে যতটুকু ছিল সেই অনুযায়ী। এবং আমার সামনে ছিল বাঙ্গালী জাতির স্বাধীন ও সেকিউলার রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য, যে কথাটা আগেই বলেছি। আমার এই লক্ষ্য নিয়ে আমি যে কমিউনিস্ট পার্টিতে দাঁড়াতে পারতাম না সেটা মোহাম্মদ ফরহাদের মাধ্যমে কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে সংযুক্তির পর আমার কাছে সুস্পষ্ট হয়েছিল। পার্টির সাহিত্য, কাজের ধারা আমাকে আকৃষ্ট করত না। অবশ্য আমার পার্টির সঙ্গে অনেক দেরীতে সংযোগ ঘটে। সেটা ’৬৪-তে। যদিও ’৬২-তেই ফরহাদের সঙ্গে আমার রাজনৈতিকভাবে প্রথম পরিচয় ঘটে। অর্থাৎ আমরা কেউ কারও প্রতি আকৃষ্ট ছিলাম না সেভাবে। সেটা যে কারণেই হোক। আমার অনুমান ’৬৪-তে ফরহাদ আমাকে পার্টিতে নেন কাজী জাফর থেকে আমাকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য এবং তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবহার করার জন্য। অথবা যে কোন কারণে হোক তখন আমাকে পাওয়া তাঁর জন্য প্রয়োজনীয় হয়েছিল। কিন্তু আমার যেটুকু মোহ ছিল ঐ স্বল্প কালটাই তা থেকে আমার মুক্তির জন্য যথেষ্ট ছিল। আসলে ঐ পার্টিতে বা তার নিয়ন্ত্রণে থেকে আমাদের পক্ষে কিছুই করা সম্ভব ছিল না। নীচ থেকে কিছু করার তো প্রশ্নই ওঠে না।

আমি একটা বিষয়ে নি:সংশয় যে, সে কালে আমি কাজী জাফরকে পেয়েছিলাম বলে, হাঁ সেটা বিভক্তির অনেক কাল পূর্ব থেকেই, আমি ঐভাবে একটা নূতন বিপ্লবী চিন্তাকে খুব ধীরে এবং সংগোপনে এগিয়ে নিতে পেরেছিলাম। কাজী জাফর কমিউনিস্ট পার্টির বদ্ধতা থেকে মুক্ত ছিলেন বলে এটা সম্ভব হয়েছিল। আবার তিনি কমিউনিস্ট রাজনীতির সঙ্গে ছিলেন কিংবা এ দেশে একটা বিপ্লবী রাজনীতির প্রয়োজন উপলব্ধি করতেন অথবা তার প্রতি বৈরী ছিলেন না বলেই এটা সম্ভব হয়েছিল। আমি যে কাজ করেছিলাম সেটা কি আমি সেকালে ছাত্র লীগে থেকে করতে পারতাম? অথবা শেখ মুজিব কি আমাকে সেটা তাঁর দলে কোনও কালে করতে দিতেন?

এ কথা ঠিক যে, কাজী জাফরের মধ্যে রাজনীতির চেয়ে আত্মপ্রতিষ্ঠার প্রবণতা প্রধান ছিল। এ দেশের গণ-রাজনীতিতে এটা একটা সাধারণ বৈশিষ্ট্যও বটে। প্রকৃতপক্ষে জনগণের ব্যাপক অংশের আদর্শ বিমুখতা ও সুবিধাবাদের প্রতিফলন ঘটে এ দেশের গণ-নেতৃত্বে। তাই বেশী আদর্শবাদীরা এ দেশে গণ-রাজনীতিতে ভূমিকা পালনে সাধারণত ব্যর্থ হয়। আমি কাজী জাফরের মধ্যকার ঐ প্রবণতাকে যতটা সম্ভব কাজে লাগিয়ে একটি বিপ্লবী আদর্শ ভিত্তিক রাজনীতির বুনিয়াদ তৈরী করতে চেয়েছিলাম। আর তাই পার্টি এবং মোহাম্মদ ফরহাদের সঙ্গে তাঁর দ্বন্দ্বটাকে একটা রাজনৈতিক খাতে প্রবাহিত করতে চেয়েছিলাম। এই জন্য মস্কোপন্থীরা ছাত্র ইউনিয়নকে বিভক্ত করার পর যখন কাজী জাফরের উপর চতুর্দিক থেকে চাপ সৃষ্টি করে তাঁকে নতজানু করতে চেষ্টা করছিল তখন আমি তাঁকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকতে বলেছিলাম। সে সময় আবদুল হকেরাও তাঁর বিরুদ্ধে ছিল। তারা সবাই চেয়েছিল ছাত্র ইউনিয়নকে পুনরায় এক করতে। ঐ রকম এক পরিস্থিতিতে পড়ে তিনি একদিন আমার সঙ্গে আলোচনা করলেন। দীর্ঘ কাল পর সব কথা মনে থাকার কথা নয়। তবে মূল বিষয়বস্তু ও কিছু কথা মনে আছে। ছাত্র ইউনিয়ন বিভক্ত হবার কিছু দিন পরের কথা। তিনি আমাকে বললেন যে, সবাই চাচ্ছে পুনরায় ঐক্য হোক। সবাই মানে অবশ্য এখানে ন্যাপ এবং কমিউনিস্ট পার্টির নেতারা, যাঁদের মধ্যে সুখেন্দু-হকও ছিলেন। এবং বাইরের সমর্থকরাও। ‘ছাত্র ইউনিয়নকে আবার এক করলে কেমন হয়? আপনি কি বলেন?’ তিনি আমার মত জানতে চাইলেন।

এটা তখন ছিল এক ভয়াবহ বিপদ। কারণ যে সিদ্ধান্তটা এসেছিল তাতে ছাত্র ইউনিয়ন পুনরায় এক করলে তার মূল নিয়ন্ত্রণ সম্পূর্ণরূপে কমিউনিস্ট পার্টির হাতে চলে যেত। আর পার্টির শক্তিটাও আমার তখন মোটামুটি ভালই জানা ছিল। আমার কাছে সুস্পষ্ট হল যে, এই প্রস্তাবে রাজী হলে তারা শুধু কাজী জাফরকে নয় সেই সঙ্গে নূতন শক্তির উত্থান সম্ভাবনাকে নির্মূল করে দিবে। আমি সেই ভয়াবহ বিপদটার কথা তাঁকে বললাম। এবং তাঁকে বললাম যে, আর ঐক্য নয়। একবার যখন তারা ছাত্র ইউনিয়ন ভেঙ্গেছে তখন তাদের সঙ্গে গেলে আমাদের সবটুকু সম্ভাবনা ধ্বংস হবে। দীর্ঘ আলোচনায় আমি বিভিন্ন দিকের উপর আলো ফেললাম। এবং তাঁকে দৃঢ়ভাবে আমার মত জানালাম যে, তাদের সঙ্গে ঐক্য করলে আমরা আর নূতন কোনও রাজনীতি দাঁড় করাতে পারব না। সেই সুযোগই তারা দিবে না। বরং আমরা শেষ হয়ে যাব। সুতরাং যেভাবে হোক যা পেয়েছি সেটাকেই আমাদের রক্ষা করতে হবে। এবং সঠিক রাজনীতি নিয়ে এগোতে পারলে আমরাই দাঁড়াব। আজকের সঙ্কট, বিপদ এসব সাময়িক। আমাদের এগোবার ক্ষমতা আছে। আর এগোতে পারলে আমরা সবখান থেকেই সমর্থন পাব।

আমি জানি না তিনি আমার কথাতে সেই সময়টাতে কতটা শক্তি পেয়েছিলেন। সেটা তিনিই জানেন। তবে আমি আজো মনে করি এ দেশে মস্কো-পিকিং-এর অন্ধ অনুসরণের ধারার বাইরে ষাটের দশকে যে বিপ্লবী গণতান্ত্রিক বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের চেতনার শক্তি বিস্তৃত ও বিকশিত হয়েছিল তার প্রাথমিক পরিপোষণ বা লালনের কাজটি ঐ দশকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত কাজী জাফরের নেতৃত্বে কিংবা তাঁকে সামনে রেখেই সম্ভব হয়েছিল। এবং এই চেতনার শক্তি ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন)-এর মধ্য থেকেই এভাবে বিকশিত ও বিস্তৃত হয়েছিল। অন্য কোথায়ও থেকে নয়।

এ কথা ভাবলে সত্যি দু:খ হয় যে, এই চেতনার শক্তির অগ্রগমনের পথে কাজী জাফর আর সহায়ক হতে পারেন নি। বরং তিনিও বাধা হলেন। বৃহৎ আন্দোলনের নেতা না হয়ে তিনি হলেন তাঁকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা এবং তাঁকে ঘিরে থাকা রনো-মেনন-মান্নান ভূঁইয়া-জামাল হায়দার এঁদেরকে নিয়ে তৈরী তাঁর অন্ধ অনুসারী এক সংকীর্ণ ও ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর নেতা। এই গোষ্ঠী তার একটা স্বাতন্ত্র্য রেখে চললেও রাজনীতিতে পিকিংপন্থী পুরাতন নেতৃত্বের সহযোগী হয়ে হল শ্রেণী সংগ্রামের নামে পূর্ব বাংলার জাতীয় কর্মসূচী ও আন্দোলন বিমুখ এবং ‘ডোন্ট ডিসটার্ব আইয়ুব’ রাজনীতির সহায়ক। এইভাবে কাজী জাফরের ইতিবাচক ভূমিকা ১৯৬৫-তে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের দ্বিধা বিভক্তির সঙ্গে মূলত শেষ হল। তারপর থেকে মেনন নেতৃত্বাধীন তাঁর অনুসারী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে ছাত্র ইউনিয়নের ভিতরকার বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদী এবং গণতান্ত্রিক ধারাকে অগ্রসর হতে হয়েছে। এক সময় (১৯৬৭) এই ধারার প্রতিনিধি হিসাবে মাহবুব উল্লাহ ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হলে ছাত্র ইউনিয়নে জাফর-মেনন ধারার পরিবর্তে এই গণতান্ত্রিক জাতীয়তাবাদী ধারার প্রাধান্য সূচিত হয়।

কিন্তু বিভ্রান্ত অন্তর্দ্বন্দ্ব ও কলহে জাতীয় রাজনীতির মূল্যবান সময়টুকু নষ্ট হতে থাকল। আওয়ামী লীগের ছয় দফার বিকল্প হিসাবে বামপন্থীদের পক্ষ থেকে গ্রহণযোগ্য জাতীয় কর্মসূচী না থাকায় সময়ের স্রোত আওয়ামী লীগের পথে যেতে থাকল। ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুথানের জোয়ারে ভেসে পুরাতন পিকিংপন্থী নেতৃত্বের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করে কাজী জাফরের গোষ্ঠীটি যখন জাতীয় রাজনীতিকে গুরুত্ব দিলেন তখন তাতে যে শুধু দেরী হয়েছে তা-ই নয়, উপরন্তু এই দেওয়াটাও ছিল ভুলভাবে।

এতদিন আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনকে তাঁরা এড়িয়ে চললেন, পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের কর্মসূচী প্রদানের দাবীকে শুধু এড়ালেন না উপরন্তু সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদ বলে পুরাতন নেতৃত্বের সঙ্গে সুর মিলিয়ে বাধা দিলেন আর এখন যখন গোটা জাতি স্বায়ত্তশাসনমূলক জাতীয়তাবাদী এবং গণতান্ত্রিক আন্দোলনের জোয়ারে ভাসতে শুরু করেছে তখন তাঁরা হঠাৎ করে হলেন স্বাধীন পূর্ব বাংলার প্রবক্তা। এই করে তাঁরা নেতৃত্বের প্রতিযোগিতায় নামলেন। কিংবা হয়ত অস্তিত্ব রক্ষার প্রতিযোগিতায় নামলেন। কারণ ছাত্র-তরুণ শক্তির প্রতিনিধি হিসাবে জাতীয় প্রশ্নকে তাঁদের পক্ষে পুরাতন নেতৃত্বের মত পাশ কাটানো আর সম্ভব ছিল না। তবে ব্যবহারিক বা বুদ্ধিমান এবং আন্তরিক হলে তাঁরা স্বায়ত্তশাসনের কর্মসূচীকে তখনও পাশ কাটাতেন না। আসলে পূর্ব বাংলার প্রশ্নে ’৬৯-এ জাফরের পক্ষে আর প্রকাশ্য আন্দোলনে ভূমিকা পালনের সুযোগ ছিল না। সেটা তিনি অনেক আগেই হারিয়েছিলেন। স্বায়ত্তশাসন-কেন্দ্রিক জাতীয় আন্দোলনের সঙ্গে থেকে সেটাকে ধাপে ধাপে এগিয়ে নিয়ে স্বাধীনতার আন্দোলন গড়ে তোলার বাস্তব সম্মত পথে না গিয়ে যখন দেখলেন যে, ঘটনা স্রোত তাঁর নাগালের বাইরে চলে গেছে তখন হঠাৎ করে চরমপন্থী কর্মসূচী দিয়ে তিনি তার উপর নিজ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চাইলেন। তাতে স্বাধীনতা আন্দোলনের লাভ হল বৈকি। কিন্তু তাঁর নয়, যেমন হয় নি ঐ দশকের বিপ্লবী প্রজন্মেরও।

আসলে বিভ্রান্তির জালে শুধু কাজী জাফর এবং তাঁর অনুসারীরা নয়, গোটা প্রজন্মও আবদ্ধ। এই বিভ্রান্তির জাল শুধু নেতৃত্বের নয় উপরন্তু মতাদর্শেরও, যে বিষয়ে আমি পরে আলোচনা করব। এইভাবে একটা প্রজন্মের সবটা নয় তবে অনেকটা সম্ভাবনা কাজী জাফরের সঙ্গে শেষ হল।

এই বিপ্লবী প্রজন্ম নেতৃত্বকারী শক্তি হয়ে উঠতে পারে নি। সেটা বিভিন্ন কারণে। কিন্তু এই প্রজন্মের বিপ্লবী চেতনার শক্তি বিকশিত ও বিস্তৃত না হলে যে এ দেশে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ হত না সে বিষয়ে আমি সুনিশ্চিত। আর আমার সমস্ত অস্পষ্টতা, ভ্রান্তি ও সীমাবদ্ধতা নিয়েও ঐ দশকে ঐ চেতনার শক্তির বিকাশে আমি যেটুকু ভূমিকা রাখতে পেরেছিলাম তার জন্য আমি কাজী জাফরের কাছে ঋণী থাকব। এবং আমি নিজেকে ঋণী ভাবি অনেকের কাছে। ষাটের দশকের বিপ্লবী প্রজন্মও ঋণী অনেকের কাছে। যাদের ভুলের মাশুল আমরা দিয়েছি তাদের কাছেও ঋণী। এমন কি মস্কোপন্থীদের কাছেও।

কারণ তাদের সবাইকে, তাদের সবার অবদান কোন না কোন রূপে না পেলে যেটুকু শিখেছি, যেটুকু এগোতে পেরেছি সেটুকু হত না। জাতি এতটা পথ অতিক্রম করে এখানে এসে পৌঁছতে পারত না। একটা সঠিক পথের দিশা একদিনে আসে না। একটা সমাজের বিপ্লব, একটা সচেতন ও উন্নত জাতি গঠন শুধু একটা ব্যক্তি বা প্রজন্মের সাধনার ফল নয়। সবাইকে, সবার সব অবদান ও ভূমিকাকে নি:শেষে নাকচ করে বড় কিছু, মহৎ কিছু করা যায় না যেভাবে সিরাজ শিকদার চেয়েছিলেন।

সাম্প্রতিক পোষ্টসমূহ