লিখেছেনঃ শামসুজ্জোহা মানিক, আপডেটঃ July 18, 2013, 4:56 AM, Hits: 1354
১৯৬৭ সালের একটা ঘটনা দিয়ে এই পর্বের আলোচনা শুরু করি। আমার যত দূর মনে আছে মাসটা ছিল মে অথবা জুন। তবে তার আগে তখনকার বাম আন্দোলনের অবস্থাটা একটু বলে নিই। সেই সময় বাম আন্দোলন ও সংগঠনের কর্মীদের সামনে দেখা দিয়েছিল সংকট। আওয়ামী লীগের ৬ দফা আছে। শেখ মুজিব জেলে। বামদের আছে শুধু পেশাভিত্তিক বা স্থানীয় আন্দোলনের কর্মসূচী। জাতীয় কর্মসূচী নেই। সাধারণ মানুষ বিশেষ করে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মনে ভাসানী এবং ন্যাপের প্রতি সংশয় ও অনাস্থা বাড়ছে। বিশেষ করে কোনো কর্মসূচী না দিয়ে ৬ দফার নিন্দা করায় এবং আইয়ুবের প্রতি বিরোধিতা না রাখায় সেই সময় ঢাকায় এবং সেই সঙ্গে সারা দেশেও ন্যাপ ও বামপন্থীদের প্রতি অনাস্থা বৃদ্ধি পাচ্ছিল।
তখন আমি একজন সাধারণ কর্মী হিসাবে গ্রামে কৃষক সংগঠন করছি। ১৯৬৭ সালের মাঝামাঝি সময়ে বগুড়ায় এডভোকেট গাজীউল হকের বাসায় পূর্ব পাকিস্তান কৃষক সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়। যদিও আমি তখন কৃষক সমিতির সাধারণ কর্মী ছাড়া কিছু নই তবু কৃষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক (এবং গোপন পিকিংপন্থী কমিউনিস্ট পার্টির নেতা) আবদুল হক আমাকে সভায় উপস্থিত হতে বললেন বলে আমার সেখানে যাবার সুযোগ হল। এবং সেদিন প্রথম বুঝলাম ভাসানীর অসহায়তা। আমাদের প্রজন্মের বিপ্লবীদের মত। তবে তাঁর অসহায়তা হয়তো আরেক ধরনের।
সকালে সভা আরম্ভ হল। সারা দেশ থেকে কেন্দ্রীয় কমিটির ২৫/৩০ জন সদস্য উপস্থিত।* সেখানে আছেন আবদুল হক, আবদুল মতিন, আলাউদ্দিন আহমদ প্রমুখ সেকালের বাম আন্দোলনের দিকপালগণ। সাংগঠনিক সমস্যা নিয়ে আলোচনায় যাঁরা অংশ নিচ্ছিলেন তাঁদের বক্তব্য থেকে বেরিয়ে আসছিল যে, শুধু কৃষক সংগঠন নয়, ন্যাপেরও বিকাশ নেই। সংগঠনে চলছে স্থবিরতা। আলোচনার এক পর্যায়ে আমার মনে হল কিছু বলা দরকার। কারণ আমার মনে হল সবাই স্থানীয় বা সাংগঠনিক সমস্যা নিয়ে আলোচনা করছেন, কিন্তু জাতীয় রাজনীতির প্রশ্নটা যে সংকটের কেন্দ্রবিন্দু সেটাই কারো উপলব্ধিতে আসছে না।
________________________________________________________________________________
* পূর্ব পাকিস্তান কৃষক সমিতির কাউন্সিল অধিবেশন হয় তৎকালীন বৃহত্তর সিলেট জেলার কুলাউড়ায় ৮ ও ৯ এপ্রিল ১৯৬৭-তে। গোপন পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি ১৯৬৬-এর মাঝামাঝি সময়ে দ্বিধা বিভক্ত হলেও তখন পর্যন্ত ন্যাপ এবং কৃষক সমিতি আনুষ্ঠানিকভাবে দ্বিধা বিভক্ত হয় নি। তবে এই সম্মেলনে কৃষক সমিতির নেতৃত্ব পিকিংপন্থী পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী)-এর হাতে চলে যায়। পূর্ববর্তী কমিটির সাধারণ সম্পাদক হাতেম আলী খান যিনি ছিলেন মস্কোপন্থী তাঁর পরিবর্তে এই সম্মেলনে পিকিংপন্থী নেতা আবদুল হক সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এবং মওলানা ভাসানী সভাপতি হিসাবে পুনর্নির্বাচিত হন। এই সম্মেলনের অল্প কয়েকদিন পূর্বে কৃষক সমিতির পূর্বতন কমিটির সাধারণ সম্পাদক হাতেম আলী খান এবং অন্যতম সহ-সভাপতি হাজী দানেশকে দেশরক্ষা আইনে গ্রেফতার করা হয়। হাজী দানেশ পিকিংপন্থীদের সঙ্গে ছিলেন। উভয়কে তাঁদের অনুপস্থিতিতে নব নির্বাচিত কমিটির সহ-সভাপতি পদে রাখা হয়। যাইহোক, আমার যতদূর মনে পড়ছে বগুড়ার এই সভা ছিল কুলাউড়া সম্মেলনের পর কৃষক সমিতির নব নির্বাচিত কমিটির প্রথম সভা এবং এতে মস্কোপন্থী সদস্যদের মধ্য থেকে তেমন কেউ সম্ভবত উপস্থিত ছিলেন না।
আজ আমার সে কালের সাহসটা ভাবলে নিজেরই অবাক লাগে। আমি কৃষক সমিতির কেন্দ্রের নেতা তো নই-ই, এমন কি যে বৃহত্তর দিনাজপুর জেলায় আমি কৃষক সমিতি গড়ছিলাম সেখানকারও নেতা নই। অর্থাৎ জেলার নেতাও আমি নই। বৎসর খানেক আগে কৃষক আন্দোলন করতে গ্রামে গিয়েছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। আজকের মতো সেশন জট সেকালে ছিল না। যাঁরা চারপাশে বসে ছিলেন তাদের তুলনায় আমি কচি ছেলে ছাড়া কিছু নই। আলোচনা কিছু দূর এগোতেই আমি কথা বললাম। দীর্ঘ সময় নয়। অল্প সময়। সব কথা মনে নেই। তবে মূল কথাগুলো মনে আছে। আমি যা বললাম, তার মূল কথাগুলো এই রকম, ‘আন্দোলন ছাড়া সংগঠন গড়ে ওঠে না। আর আন্দোলন করার জন্য দরকার কর্মসূচীর। জাতীয় আন্দোলন গড়ে তোলা ছাড়া জাতীয় সংগঠন গড়ে তোলা যায় না। আর এই জাতীয় আন্দোলনের জন্য প্রয়োজন একটা জাতীয় কর্মসূচীর। শুধু স্থানীয় বা ইস্যুভিত্তিক কর্মসূচীতে স্থানীয়ভাবে আন্দোলন ও সংগঠন হতে পারে। কিন্তু জাতীয় কর্মসূচী না থাকলে সেগুলোও এগোয় না। আওয়ামী লীগের ৬ দফার সমালোচনা থাকতে পারে। কিন্তু স্বায়ত্তশাসনের দাবীতে আওয়ামী লীগের একটা জাতীয় কর্মসূচী আছে। কিন্তু আমাদের কোনো জাতীয় কর্মসূচী নেই। আমাদের এমন কোনো জাতীয় কর্মসূচী নেই যেখানে পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের দাবীসহ জনগণের বিভিন্ন অংশের দাবী স্থান পেতে পারে। আর এই ধরনের কোনও জাতীয় কর্মসূচী নেই বলে আমাদের আন্দোলন ও সংগঠনেরও বিকাশ নেই।’
এরপর আমি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিপ্লবী ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনে জাতীয় কর্মসূচীর গুরুত্বের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে দক্ষিণ ভিয়েতনাম জাতীয় মুক্তি ফন্সন্টের কর্মসূচীর উদারহণ দিলাম যা তার কিছু দিন আগে পড়েছিলাম। আমি বললাম, ‘যেমন দক্ষিণ ভিয়েতনামে জাতীয় মুক্তি ফন্সন্টের একটা জাতীয় কর্মসূচী আছে যেখানে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর দাবীগুলোকে যেমন তুলে ধরা হয়েছে তেমন সমগ্র জাতির মুক্তির দাবীকেও রাখা হয়েছে এবং জাতির প্রশ্নটাকেই সবচেয়ে বেশী গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। যেমন সেখানে ১নং কর্মসূচীতে আছে আমেরিকার সৈন্য প্রত্যাহার সংক্রান্ত দাবী।’
অনেক কাল পর এখন কর্মসূচীটা ভালভাবে মনে নেই। তবে তখন মনে ছিল। তার ৩ কি ৪ নং দফায় অথবা আরো পরে ভূমি সংস্কার সংক্রান্ত একটা নমনীয় কর্মসূচী ছিল। ভুমি সংস্কারের কর্মসূচী পর্যন্ত উল্লেখ করতেই আব্দুল হক আঙ্গুল উঁচিয়ে আমাকে তীব্র কণ্ঠে ধমক দিয়ে বললেন, ‘তুমি ভুল বলছ! দক্ষিণ ভিয়েতনাম জাতীয় মুক্তি ফন্সন্টের ১ নং কর্মসূচী কৃষি বিপ্লব!’
এখন বুঝুন কৃষি বিপ্লব আবার একটা কর্মসূচী নাকি? কৃষি বিপ্লব বলতে ভূমি সংস্কার কর্মসূচীর বিশেষ রূপ ও বৈশিষ্ট্যকে বোঝানো হয়। যাইহোক, আমি তবু সাহস সঞ্চয় করে বললাম, ‘আমি ঠিকই বলেছি। আমি কর্মসূচী পড়েছি।’ আবদুল হক পুনরায় বললেন, ‘না, তুমি ভুল বলেছ। আামি ওটা পড়েছি। দক্ষিণ ভিয়েতনাম মুক্তি ফন্সন্টের ১ নং কর্মসূচী কৃষি বিপ্লব।’
এমন পরিস্থিতি হবে জানলে আমি আমার সঙ্গে কর্মসূচীর বইটা নিয়েই যেতাম, কারণ ওটা আমার বাসস্থানে ছিল। কিন্তু বইটা ছিল না বলে আমার কথা ওখানেই শেষ। অবশ্য থাকলেও কোনো লাভ হত বলে মনে করি না। যাইহোক, আমি শুধু অবাক হলাম এ কথা ভেবে যে, আমার মূল বক্তব্যকে কেউই গুরুত্ব দিলেন না। আমি ভুল বলছি! সুতরাং সব প্রসঙ্গ ফুরালো। কিন্তু আমি যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টা আলোচনায় নিতে চাইলাম সেটা হল একটা জাতীয় কর্মসূচীর প্রয়োজন। সেটাই কেউ বুঝলেন না। সেদিন সেখানে যাঁরা উপস্থিত ছিলেন তাঁদের সবাই না হোক অনেকে আজো বেঁচে আছেন। সম্ভবত কারোরই সেদিন আমি যা বলেছিলাম তার কিছুই মনে নেই। কারণ হয়তো আমার সব কথাই তাঁদের কাছে অপ্রাসঙ্গিক ছিল। প্রাসঙ্গিক মনে হলে তো তারা আমার বক্তব্যের খেই ধরে কিছু বলতেন!
যাইহোক, আমি অপমানিত বোধ করে এবং মন:ক্ষুণ্ণ হয়ে ‘হংস মধ্যে বক যথা’র মত বসে রইলাম। আর কোনও কথা বলি নি সেখানে। দুপুরের দিকে মওলানা ভাসানী সভায় এসে বক্তব্য দিলেন। বেশী সময় বলেন নি। কিছু কথা বলেই তিনি ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বললেন, ‘আমি এতদিন কি করেছি? আমার কি কোনও আন্দোলন আছে? লোকে কি এমনিই কয় ভাসানী আইয়ুবের দালাল?’ আরও কিছুক্ষণ কথা বললেন তিনি। কিন্তু কর্মসূচীর ব্যাপারে কিছু বললেন না। তিনি উঠে গেলে দুপুরের আহারের জন্য বিরতি হল। কিন্তু বিস্ময়কর হল ভাসানীর বক্তব্য নিয়ে বিরতির আগে বা পরেও কেউ কোনো আলোচনা করারই প্রয়োজন বোধ করলেন না।
তাঁর সেই উক্তি ‘লোকে কি এমনিই কয় ভাসানী আইয়ুবের দালাল!’ আমার মনে আজো গেঁথে আছে। সেই ক্ষুব্ধ, ক্রুদ্ধ, ব্যথিত কণ্ঠ এখনও আমার কানে বাজে। সেটা যেন ছিল খাঁচায় বন্দী এক অসহায় সিংহের ক্রুদ্ধ, ক্ষুব্ধ গর্জন যাকে মুক্ত করার কেউ ছিল না।
তাঁর সেই উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে আমি বুঝলাম ভাসানী আইয়ুবের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে যাচ্ছেন। সেটা কিভাবে কখন তা বুঝি নি। তার জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছিল আরো দেড় বৎসর।
ঘটনা এইটুকু নয়। আরো আছে। সেটাও বলি। বিরতির সময় আব্দুল হক আমাকে বাইরে ডেকে নিয়ে গেলেন। তিনি যে অমন একটা নির্জলা মিথ্যা বলে আমাকে ধমক দিয়ে থামালেন তার জন্য তাঁর মধ্যে কোনও লজ্জা বা সঙ্কোচ বোধ ছিল না। সেটা তাঁর মধ্যে কোন কালেই দেখি নি। যাইহোক, আমাকে তিনি রাস্তায় নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বললেন, ‘দেখলে তো মানিক! বুড়োর মাথা একেবারে খারাপ হয়ে গেছে। Out of desperation একটা কিছু করে নিজেও ডুববে, আমাদেরকেও ডোবাবে। Desperate হয়ে একটা কিছু করলেই হল! সংগঠন কোথায়? সংগঠন ছাড়া কি আন্দোলন হয়? আগে সংগঠন করতে হবে, তারপর না আন্দোলন!’
আমি আবার আন্দোলনের জন্য আমার পূর্বেকার যুক্তি তুলে ধরলাম। অবশ্য এবার দক্ষিণ ভিয়েতনাম কর্মসূচীর প্রসঙ্গ বাদে। কথার এক পর্যায়ে বললাম, ‘জাতীয় কর্মসূচী ছাড়া আমরা পূর্ব বাংলায় জাতীয় বিপ্লব কিভাবে করব?’
সব কথা আজ এতকাল পরে মনে থাকার কথা নয়। তবে পূর্ব বাংলায় বিপ্লব এবং এখানে একটা স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জাতীয় আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য কর্মসূচীর প্রয়োজনের কথা যখন আমি পুনরায় জোর দিয়ে বললাম তখন তিনি যে কথা বললেন সেটা আমার প্রায় সবটা আজো মনে আছে।
এইবার তাঁর উত্তর, ‘পূর্ব বাংলা স্বাধীন করার জন্য জাতীয় কর্মসূচীর প্রয়োজনটা কোথায়? কেন গ্রামে যাবে! এলাকায় এলাকায় সংগঠন করবে। এইভাবে সংগঠন যখন গড়ে উঠবে তখন আন্দোলনও গড়ে উঠবে। এইভাবে কৃষকের অর্থনৈতিক দাবীতে কৃষক আন্দোলন গড়ে উঠবে। গ্রামে গ্রামে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়বে। তারপর সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু হবে। গ্রামে মুক্ত এলাকা গড়ে উঠবে। এইভাবে সব গ্রাম মুক্ত হলে শহর ঘেরাও হবে। তারপর শহরও মুক্ত হবে। তাহলে বাকী রইল কি? আমরা তো আর বর্ডার পার হয়ে বিপ্লবকে পশ্চিম পাকিস্তানে ঠেলে নিয়ে যেতে পারব না! তাহলে কি হল? পূর্ব বাংলা তো এমনিতেই স্বাধীন হয়ে গেল! পূর্ব বাংলাকে স্বাধীন করার জন্য আবার আলাদা কর্মসূচীর দরকার কি?’ আরও কিছুক্ষণ তিনি তাঁর কথা বলে চললেন। এরপর তাঁর কথার উত্তর দেবার বা তাঁর সঙ্গে আর কোন আলোচনা করার প্রয়োজন আমি বোধ করি নি।
প্রকৃতপক্ষে, আবদুল হকের উপরোক্ত বক্তব্যের মধ্যে ছিল এ দেশের পিকিংপন্থী কমিউনিস্ট রাজনীতির নির্যাস। বস্তুত মস্কো-পিকিং সব দলেরই শ্রেণী সংগ্রামের রাজনীতি ও কর্মনীতি ছিল একই ধারায় গড়ে তোলা।
মস্কোপন্থীদের সঙ্গে পিকিংপন্থীদের মূল একটি পার্থক্য ছিল সশস্ত্র সংগ্রামের প্রশ্নে। সশস্ত্র সংগ্রামের ধারণাটি পিকিংপন্থী নেতৃত্ব গ্রহণ করেছিলেন তখন যখন দেখলেন যে, ছাত্রদের মধ্যে সশস্ত্র বিপ্লবের চেতনায় উদ্বুদ্ধ এক নূতন প্রজন্মের স্বাধীনভাবে অভ্যুদয় ঘটছে। তখন তাঁরা সেটাকে ব্যবহার করে নিজেদের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চাইলেন। যে নেতৃত্বের জায়গা তাঁরা পুরাতন পার্টিতে পাচ্ছিলেন না সেই জায়গাটা পাবার জন্য তাঁরা বিপ্লবী তরুণ প্রজন্মের ঘাড়ে চাপলেন। মূল নেতৃত্ব যাঁরা নির্ধারণ করতেন তাঁদের সম্পর্কে আমি এ ছাড়া আর কোনও ব্যাখ্যা খুঁজে পাই না।
যে বিশেষণই আজ আমরা এঁদের সম্পর্কে প্রয়োগ করি ভাসানী ছিলেন এঁদের হাতে বন্দী। এইটুকু না বুঝলে তাঁর সমস্যাটা বোঝা যাবে না। এবং বোঝা যাবে না আমাদের প্রজন্মের সমস্যাও।
প্রকৃতপক্ষে ভাসানীকে আমি কাছে থেকে দেখেছি ১৯৬৮-’৬৯-এর গণ-অভ্যুথানের পর থেকে ১৯৭০ পর্যন্ত। তারপর ১৯৭২-এর প্রথম কিছুদিন। সাম্প্রদায়িক বক্তব্য দেওয়ায় আমি তাঁর কাছ থেকে দূরে সরে যাই এবং ন্যাপ থেকেও। সব কমিউনিস্ট নেতৃত্বকেই তাঁর দেখা ছিল। বোধ হয় কারো উপর তাঁর তেমন একটা আস্থা ছিল না। তবে তিনি তাদের ত্যাগ ও নিষ্ঠার কারণে তাদের শ্রদ্ধা করতেন। কিন্তু শুধু ত্যাগ আর আদর্শ নিষ্ঠা দিয়ে যে দেশ মুক্তির রাজনীতি হয় না এটা কমিউনিস্টরা না বুঝলেও তিনি বুঝতেন। মস্কোপন্থীদের সঙ্গে তাঁর কি ধরনের সম্পর্ক ছিল তা আমি বুঝি নি বা জানি নি। কিন্তু পিকিংপন্থী কমিউনিস্টদের যেটুকু আমি চিনেছিলাম এবং বুঝেছিলাম সম্ভবত তাঁর চেনা এবং বোঝাটা ছিল আরও অনেক বেশী। তবু হয়তো তাঁদের কথায় তিনি অনেক দিন চলেছিলেন। হয়তো বা তাঁদের প্রভাবেও তিনি ১৯৬৫-তে পাক-ভারত যুদ্ধের সময় ঐভাবে আইয়ুবকে সমর্থন দিয়েছিলেন। যোগ্য মনে না করলেও কমিউনিস্টদের প্রতি তাঁর হয়তো আস্থাও ছিল যে, এরা অনেক জানে কিংবা দেশের জনগণকে ভালবাসে। হয়তো একটা আশা ছিল এরা শেষ পর্যন্ত বাস্তবতা বুঝবে। তাঁকে কাছে থেকে দেখেছি। একত্রে ঘুরেছি। তাঁর অনেক কথা শুনেছি। কর্মীদের প্রতি, মানুষের প্রতি তাঁর মনের প্রকাশটাও দেখেছি। আসলে কি তিনি সব বুঝতেন? সবকিছু তিনি বুঝতেন না। কিন্তু তাঁর এমন এক প্রখর অনুভব ছিল যা অনেক বিদ্যা, বুদ্ধি আর জ্ঞানের চেয়েও বড়। তাঁর সম্পর্কে বলতে গিয়ে আমার একটা উপমার কথা মনে হয়। এক প্রাচীন বটগাছ তার স্নেহের বিশাল ছায়া নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সব আশ্রিতকে রোদ আর বৃষ্টি থেকে আড়াল দিতে। যে যখন আশ্রয় চেয়েছে তার ছায়ার নীচে গেছে। তারপর চলে গেছে। তা কাউকে ধরে রাখে নি। সেই এক প্রাচীন বিশাল বটবৃক্ষের মত নির্লিপ্ত ভাসানী তাঁর ছায়ার নীচে সকলের আসা আর যাওয়া দেখে গেছেন। বৃক্ষের বেদনা দেখা যায় না।
আমার মনে হয় না তিনি ১৯৫৭-এর তিক্ত অভিজ্ঞতার পর পরীক্ষিত কমিউনিস্টদের ছাড়া আর কাউকে বিশ্বাস করতেন। কমিউনিস্টদের যোগ্যতায় তাঁর বিশ্বাস ছিল না। এইজন্য বহুবার যোগ্য মুজিবের কথা বলতেন। কিন্তু মুজিব তাঁর বিশ্বাসের মর্যাদা রাখেন নি। সুতরাং পরীক্ষিত কমিউনিস্ট ছাড়া তিনি আর কাউকে বিশ্বাস যেমন করেন নি তেমন দ্বিতীয় আর কোনও মুজিবও তৈরী করেন নি।
আমার ধারণা যদি কমিউনিস্টরা চাইত তাহলে তিনি পূর্ব বাংলার জনগণের জন্য জাতীয় কর্মসূচী দিতেন ’৬৬-তে অথবা ’৬৭-তেই। আগের কথা বলতে পারব না। কিন্তু ’৬৭-এর মে অথবা জুনের ঐ সভার অভিজ্ঞতা থেকে আমি বুঝেছি যে, ভাসানী তখন বুঝেছিলেন বামপন্থীরা আর যা-ই হোক এ দেশে কোনো জাতীয় আন্দোলন গড়বে না। তাই সেই আন্দোলনের কর্মসূচীও তারা দিবে না। আর সেটা তাঁর পক্ষে একা দেওয়াও সম্ভব নয়।
আমার মনে হয় যখন তিনি বুঝেছিলেন কমিউনিস্টরা জাতীয় আন্দোলন চায় না তখন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন এবং অপেক্ষা করেছিলেন। কি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন সেটা বোঝা যায় তখন যখন তিনি আবদুল হকের মত নেতাদের ডোবাবার জন্য কোনও জাতীয় কর্মসূচী ছাড়াই আইয়ুব সরকারের পতন ঘটাবার জন্য ’৬৮-এর ৬ ডিসেম্বর গণ-অভ্যুথান অভিমুখী আন্দোলনের সূচনা ঘটালেন। তাঁর মত দূরদর্শী ও অভিজ্ঞ নেতার এটা না বোঝার কথা নয় যে, এই আন্দোলন মুজিবকেই দেশের একচ্ছত্র নেতায় পরিণত করবে এবং ৬ দফাকে একমাত্র কর্মসূচীতে। তিনি সম্ভবত জানতেন যে, জাতীয় কর্মসূচী ছাড়া জাতীয় নেতা হওয়া যায় না। কিন্তু এই কর্মসূচী কমিউনিস্টদের কারণে তাঁর পক্ষে দেওয়া সম্ভব ছিল না। তাই একটা গণ-অভ্যুথান ঘটিয়ে মুজিবকে পরিণত করলেন বাঙ্গালীর জাতীয় নেতায়। মুজিবকে মাঠটা ছেড়ে দিলেন তিনি জাতীয় রাজনীতিতে। ভাসানী সেদিন গণ-অভ্যুথান না ঘটালে কি কিছু হত না? সামাজিক শক্তি তৈরী হলে তা পথ করে নেয়। ৬ দফা স্বায়ত্তশাসনের আকাঙ্ক্ষাকে একটা রূপ দিয়েছিল। অন্যদিকে বামপন্থী তরুণ প্রজন্মের যে বিরাট শক্তিটা স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র সংগ্রামের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে বেড়ে উঠছিল তা ভিতরে ভিতরে ফুঁসছিল মাথা তোলার জন্য। সুতরাং আজ হোক কাল হোক আন্দোলন হত। কিন্তু তার রূপ এমন হত না যেমনটা হল ’৬৯-এর গণ-অভ্যুথানে। আর এখানেই ইতিহাসে ব্যক্তির ভূমিকা।
আমার ধারণা ’৭০-এর নির্বাচন বর্জনও তিনি করলেন এই কারণে। কমিউনিস্টরা ন্যাপ থেকে বেরিয়ে গেলেও কিংবা নির্বাচন বর্জন করলেও তাঁর হিসাবটা সম্ভবত কমিউনিস্টদের মত ছিল না।
১৯৫৭-তে তিনি পশ্চিম পাকিস্তানকে আস্সালামু আলায়কুম বা চির বিদায় জানাতে চেয়েছিলেন। ’৫৭-তে শেখ মুজিবসহ আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের বেশীর ভাগ অংশ সেদিন তাঁকে এবং ২১ দফাকে পরিত্যাগ করল। ষাটের দশকের শেষার্ধে ’৬৬-তে মুজিব ৬ দফা দেবার পর তিনি সেই কাজটা করিয়ে নিতে চাইলেন শেষ পর্যন্ত মুজিবকে দিয়ে। ষাটের দশকের বিপ্লবী প্রজন্ম যেমন আওয়ামী লীগের ফেরার পথটা একভাবে বন্ধ করেছিল তেমন তিনিও সেই কাজটা করেছিলেন আর একভাবে। তবে তাঁরটা সম্ভবত ছিল সচেতন। ’৬৯-এর গণ-অভ্যুথানের সূচনাটা তাই তাঁর দ্বারা। এ ক্ষেত্রে বামপন্থী তরুণ প্রজন্ম এবং শ্রমিক ও মধ্যবিত্তের এক বৃহৎ অংশ হল তাঁর বাহিনী। একবার আন্দোলন শুরু হলে নেতৃত্ব গেল ছাত্রদের হাতে। এল ১১ দফা। আন্দোলন গণ-অভ্যুথানে পরিণত হল। মুজিব জেল থেকে বের হলেন। তারপর আন্দোলনের নিয়ন্ত্রণ চলে গেল মুজিবের হাতে। কিন্তু মুজিব তখন স্রোতের শিকার। ৬ দফা যে স্রোতের মুখটাকে মুক্ত করেছিল সেটা রুদ্ধ হল বা স্তিমিত হল মুজিব ও আওয়ামী লীগ নেতাদের বন্দী করার পর। কিন্তু ৬ দফার ধাক্কায় সমাজের অবতলে বিভিন্ন দিক থেকে বিশাল শক্তি মুক্ত হতে শুরু করে। অন্যেরা না বুঝলেও ভাসানী বুঝেছিলেন।। তাঁর ছিল অসাধারণ অনুভব শক্তি। তার প্রকাশ আমি নানাভাবে দেখেছি। এই অনুভব শক্তি নিয়ে মুহূর্ত এসেছে বুঝতে পেরে আইয়ুবকে আর সময় দেন নি। তারপর ৬ দফা নামে রইল। মুজিবের পক্ষে চাইলেও আর ফেরা সম্ভব নয়। আর তাঁর পক্ষে ২১ দফার পরিণতির পুনরাবৃত্তি ঘটানো সম্ভব নয়। পাকিস্তানের প্রধান মন্ত্রী পদের স্বপ্নটাও স্বপ্নই রইবে! তাঁকে হতে হবে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধান মন্ত্রী!
আজ যখন নির্মোহভাবে অতীতের দিকে দৃষ্টি ফেরাই তখন এই বিষয়টা স্পষ্ট হয়ে আসে যে, এ দেশে ষাটের দশকের বিপ্লবী জাতীয়তাবাদী প্রজন্মের প্রকৃত অভিভাবক-নেতা ছিলেন ভাসানী। কিন্তু উভয়ের মাঝখানে কমিউনিস্ট নেতৃত্বের যে প্রাচীরটা দাঁড়িয়েছিল তাকে ভাঙ্গা সম্ভব হয় নি বলে উভয়ের জীবন্ত সম্মিলন ঘটে নি।
ভাসানীর ভূমিকার ঐতিহাসিক তাৎপর্য এবং এ দেশে বিপ্লবী তরুণ প্রজন্মের সঙ্কটটা আরও স্পষ্ট করার জন্য সে কালে আমার অভিজ্ঞতা এবং আমার নিজের কিছু ভূমিকা ও সমস্যা আরও একটু বিশদ করার প্রয়োজন বোধ করছি। তাহলে হয়তো পাঠকের কাছে স্পষ্ট হবে ভাসানীর সঙ্কটটা ঠিক কোথায় ছিল এবং সেই সঙ্গে আমাদের প্রজন্মেরও। ইতিপূর্বে আবদুল হকের যে বক্তব্য উদ্ধৃত করেছি তা সেই যুগের পিকিংপন্থী কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্ব যাঁরা গড়ে তুলেছিলেন তাঁদের বুদ্ধিবৃত্তি বা চেতনার মানটাকে প্রতিফলিত করে। এই সঙ্গে আবদুল হকের নির্লজ্জ মিথ্যাচার ঐ নেতৃত্বের মূল নিয়ন্ত্রণ যাদের হাতে ছিল তাদের চরিত্র প্রতিফলিত করে।
এই রকম এক নেতৃত্বের সঙ্গে আমাদের দশকের তরুণ কর্মী বিশেষত ছাত্রদের একটা সংঘাত বা দূরত্ব থাকাটাই স্বাভাবিক ছিল। বিশেষত আমার মত মানুষের জন্য সমস্যাটা ছিল ভয়ঙ্কর।
খুব সংক্ষেপে বললে বলতে হয় আমি যান্ত্রিক বা অন্ধ দৃষ্টিভঙ্গীর অধিকারী ছিলাম না। আমি আন্তর্জাতিকতাবাদ এবং নিপীড়িত শ্রেণীর সংগ্রামে বিশ্বাসী ছিলাম। কিন্তু এই শ্রেণী সংগ্রামকে আমি জাতির মুক্তি সংগ্রাম থেকে ভিন্ন কিছু ভাবতাম না। সমগ্র জাতি যেখানে নিপীড়িত সেখানে জাতিও আমার কাছে শ্রেণী হয়ে উঠত। বস্তুত আমার বিবেচনার কেন্দ্রে ছিল হাজার বছরের লাঞ্ছিত-লুণ্ঠিত বাঙ্গালী জাতির একটা নিজস্ব রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সঙ্কল্প, যা হবে সমাজতান্ত্রিক অথচ গণতান্ত্রিক।
আমার এই মানসিকতায় আমার পক্ষে অন্ধ হওয়া কঠিন ছিল। আমার সমাজ ও ইতিহাস চেতনা আমাকে এ দেশে সশস্ত্র বিপ্লবের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করতে শিখিয়েছিল। কিন্তু এই বিপ্লবের পথটা আমার কাছে স্পষ্ট ছিল না। শুধু বুঝতাম বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতার মডেল সামনে রেখে কাজটা শুরু করতে হবে আর তাহলে আমাদের নিজেদের বিপ্লবের মডেলটাও বেরিয়ে আসবে।
পুরাতন নেতারা তাঁদের পুরাতন অভিজ্ঞতা থেকে যে কর্মপদ্ধতি নির্ধারণ করতেন তার প্রতি আমার আস্থা ছিল না। আমি বুঝতাম একবার যে পথে এ দেশে বিপ্লব হয় নি ঠিক সে পথে আর বিপ্লব হবে না। কর্মপদ্ধতির পরিবর্তন দরকার। যেহেতু আমার জানা ছিল না সুনির্দিষ্ট পদ্ধতিটা কি হওয়া উচিত সেহেতু আমার ভিতরে একটা সংশয়, জিজ্ঞাসা রয়েই গিয়েছিল। কিছু প্রশ্নে আমার স্পষ্ট ধারণা জন্মালেও নেতারা সেসব বুঝতেন না বা গ্রহণ করতেন না। ভাবতাম যে কাজের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে বিপ্লবের সঠিক পথ বেরিয়ে আসবে এবং বিপ্লবের প্রয়োজনেই সবাই সে পথ গ্রহণ করবে।
আমার এই সংশয় এবং জিজ্ঞাসা আমার কর্মকাণ্ডেও প্রতিফলিত হত। হয়তো চেনা ও পুরাতন পথের বাইরে পথ খুঁজতাম বলে আমি যেমন নেতৃত্বের আকাঙ্ক্ষী ছিলাম না তেমন অন্যেরাও আমাকে তার জন্য যোগ্য মনে করতেন না।
তবে ছাত্র জীবনে একবার নেতৃত্বে যাবার সুযোগ পেয়েছিলাম। সেটা ১৯৬৫-এর এপ্রিলে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন দ্বিধা বিভক্ত হবার কিছু পূর্বে। আর এই ঘটনার বিবরণ দিতে গিয়ে আমি ষাটের দশকের প্রজন্মের সংকটের উৎসটাতে পৌঁছতে চাই।