লিখেছেনঃ শামসুজ্জোহা মানিক, আপডেটঃ July 18, 2013, 4:56 AM, Hits: 1530
সিরাজ শিকদার ছিলেন সমস্ত প্রচলিত পন্থার বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ তারুণ্যের বিদ্রোহ। সেই সময় জাতির চেতনায় একটা পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা বিস্তৃত হচ্ছিল, যা সবচেয়ে প্রবল ছিল ছাত্র-তরুণদের মধ্যে। এই প্রবল আকাঙ্ক্ষা তাদের বিপ্লবী রাজনীতিতে বিশ্বাসী করে তুলছিল।
এর পটভূমিতে ছিল ১৯৬২-এর ছাত্র আন্দোলন, যা আইয়ুব-বিরোধী গণ-আন্দোলনের সূচনা ও বিস্তার ঘটালো। ১৯৬৬-তে আওয়ামী লীগের ৬ দফা কর্মসূচী বিকশিত গণতান্ত্রিক আন্দালনকে নূতন মাত্রা দান করল। ৬ দফা ছিল বাঙ্গালীর চেতনায় বিরাট অভিঘাত। পূর্ব বাংলায় বাঙ্গালীর গণতান্ত্রিক আন্দোলন এই বার পাকিস্তানের জাতিগত নিপীড়নের বিরুদ্ধে স্বায়ত্তশাসনের দাবীকে কেন্দ্র করে নূতনভাবে দানা বাঁধতে শুরু করে। প্রথমে তার প্রভাব নগর ও শহরে সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে তা গ্রামেও বিস্তৃত হচ্ছিল। পাশাপাশি ছিল বাম গণ-আন্দোলনের ক্রমবর্ধমান বিস্তার। এই উভয় ধারার অভিঘাতে সমাজের অভ্যন্তরে নূতন নূতন শক্তি মুক্ত হচ্ছিল। ফলে দেশ এগিয়ে যাচ্ছিল একটা যুগসংক্রান্তির দিকে।
কিন্তু বাম নেতৃত্ব পূর্ব বাংলা ভিত্তিক জাতীয় কর্মসূচী দিচ্ছিল না এবং দেবার জন্য প্রস্তুতও ছিল না। আসলে তারা তখন সারা পাকিস্তান ভিত্তিক রাজনীতিকে এগিয়ে নিতে আগ্রহী ছিল; যে কারণে ১৯৬৬ সালে যখন ন্যাপ থেকে ১৪ দফা কর্মসূচী দেওয়া হয় তখন তাতে পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের কর্মসূচী থাকলেও সেটা ছিল সমগ্র পাকিস্তান ভিত্তিক রাজনীতির অধীনস্থ। অর্থাৎ ২১ দফার মত তার তাৎপর্য ও গুরুত্ব ছিল না। সেই সময় পূর্ব বাংলার বাঙ্গালীর যে স্বাতন্ত্র্য বোধ পুনরায় বিকাশ লাভ করছিল তার জন্য পূর্ব বাংলার নিজস্ব জাতীয় কর্মসূচী গ্রহণ করা উচিত ছিল, যেমন ১৯৫৪-এর নির্বাচনের পটভূমিতে যুক্তফন্সন্টের ২১ দফা ছিল। কিন্তু সেটা ন্যাপ বা বাম নেতৃত্ব বুঝতে চায় নি।
ফলে বাম নেতৃত্ব পূর্ব বাংলার জন্য নিজস্ব জাতীয় কর্মসূচী দিল না। মস্কোপন্থী নেতৃত্ব নিজে জাতীয় কর্মসূচী না দিয়ে ৬ দফাকে সমর্থন দেয়। এইভাবে তা প্রকৃতপক্ষে আওয়ামী লীগ রাজনীতির লেজুড়, অধীনস্থ বা অঙ্গীভূত যা-ই বলা যাক তা হল। কিন্তু পিকিংপন্থী ধারায় নেতৃত্বের কাজ ছিল বিকল্প জাতীয় কর্মসূচী না দিয়ে ৬ দফার বিরোধিতা করা এবং শ্রমিক-কৃষকের অর্থনৈতিক দাবী ভিত্তিক আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য অর্থনৈতিক ও ইস্যু ভিত্তিক কর্মসূচী দেওয়া। অর্থাৎ তারা জাতীয় কর্মসূচী নিজেরাও দিবে না অন্যকেও দিতে দিবে না। প্রকৃতপক্ষে, প্রতিষ্ঠিত ও পুরাতন বাম নেতৃত্ব ছিল পূর্ব বাংলার জাতীয় অধিকার এবং বাঙ্গালী জাতির রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা চেতনার বিরোধী। এ কাজে তাদের হাতিয়ার ছিল মার্কসবাদের শ্রেণীতত্ত্ব এবং চীনের প্রতি অন্ধ সমর্থন।
এই রকম অবস্থায় যে তরুণ শক্তি আওয়ামী লীগ এবং বামসহ সকল প্রচলিত ধারার প্রতি আস্থাহীন ছিল তা বাঙ্গালী জাতির স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথ হিসাবে দেখল গণ-আন্দোলন বর্জন করে সম্পূর্ণ গোপনে ও নীচ থেকে সশস্ত্র যুদ্ধ গড়ে তোলাকে। তার ধারণা ছিল এভাবে যুদ্ধ শুরু করলে জনগণ এসে তাতে যোগ দিবে। এই তরুণ শক্তির প্রতিনিধি হলেন সিরাজ শিকদার।
সিরাজ শিকদারের উত্থান বাম ধারার ছাত্র আন্দোলনের ভিতর। এই বাম ধারার নেতৃত্বের যে ধরনের কার্যকলাপের বিবরণ ইতিপূর্বে দিয়েছি তাতে সিরাজ শিকদারের উত্থান ঘটাটা মোটেই অস্বাভাবিক মনে হবার কথা নয়। এটা হল অক্ষম, পশ্চাৎপদ ও চক্রান্তকারী বাম নেতৃত্বের বিরুদ্ধে তরুণ ও প্রবল মনের প্রতিক্রিয়া। এই নেতৃত্বকে প্রচলিত গণ-আন্দোলনের ধারায় এড়িয়ে যাবার কোনও পথ তা দেখে নি। কারণ সেখানে ছিল পুরাতন বাম নেতৃত্বের বিশাল প্রভাব। সেখানে তার সামনে অগ্রসর হবার পথটা রুদ্ধ দেখতে পেল। সুতরাং বিদ্রোহী তরুণ শক্তির এই নেতা সিরাজ শিকদার এমন এক পথ উদ্ভাবন করলেন যা প্রকাশ্য এবং গণ-আন্দোলনের পথ বর্জন করল, যেটা ছিল প্রকৃতপক্ষে আরও বিপদজনক এবং ভয়ানক ক্ষতিকর। বিপ্লব যে কতগুলো লোকের শুধু তেজ, আন্তরিকতা ও সাহসের ব্যাপার নয়, এটা যে জনগণের ব্যাপক অংশের চেতনা, আকাঙ্ক্ষা ও কর্মকাণ্ডের উপর খুব বেশী নির্ভর করে তা তিনি বোঝেন নি। বিশেষত আমাদের সমাজে যেখানে অনেক হাজার বছরের জাড্য, পশ্চাৎপদতা এবং প্রতিক্রিয়া এবং বহুবিধ সমস্যার বিজড়ন সেখানে সমাজ ও রাষ্ট্র বিপ্লব অতি দুরূহ কাজ। এই রকম এক সমাজে প্রচলিত সামাজিক-রাজনৈতিক নেতৃত্বের সঙ্গে থেকে তাকে বিকশিত করতে চেষ্টা করার এবং তা না পারলে তাকে ভিতর ও বাহির উভয় দিক থেকে নি:শেষ করার এবং সেই সঙ্গে এই সমাজের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ও সমস্যাগুলোকে কাজের মাধ্যমে বুঝে নিজস্ব পথ ও পদ্ধতি নির্ধারণের দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা না নিলে যে নিজেই বিনষ্ট হতে হয় তা তিনি বোঝেন নি। তিনি এ দেশের বিপ্লবকে সহজ অঙ্কের সূত্রে ফেলে বিপ্লব করতে এবং বাঙ্গালীর স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চাইলেন।
তাঁর পথ ছিল আমাদের প্রজন্মের জন্য ধ্বংসাত্মক। তবু বলব তিনি একটা বিরাট কাজ করেছেন, সেটা হল পূর্ব বাংলার কিংবা আজকের বাংলাদেশের স্বাধীনতার চেতনাকে প্রথম সংগঠিত রূপ দান করা। এটা ঠিক যে, সেই কালটিতে আমি দীর্ঘ কাল ধরে বাঙ্গালী জাতির স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে অগ্রসর হচ্ছিলাম। কিন্তু সেকালে এটা ছিল অতি বিপদজনক এক লক্ষ্য। সুতরাং আমি অতি সন্তর্পণে ধীর গতিতে এগোতাম। খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি কিংবা উন্নত চেতনার অধিকারী এবং বিপ্লবের জন্য সঙ্কল্পবদ্ধ না হলে আমি ’৬৮-এর পূর্ব পর্যন্ত এই চিন্তা কারো কাছেই সাধারণত প্রকাশ করতাম না। আমার একটা ধারণা ছিল কমিউনিজম ও সমাজতন্ত্রের সেকিউলার ধারণা এবং গণতান্ত্রিক ও স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনের প্রভাবে এক সময় বাঙ্গালী জাতির রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চেতনা জাগ্রত হবে এবং তখন এটাকে সংগঠিত রূপ দেওয়া যাবে। তার পূর্বে আমার কাজ হল ক্ষেত্র প্রস্তুত করা।
আমি সময়ের অপেক্ষা করছিলাম। সেই সময়টা পেলাম আমি ১৯৬৮-এর প্রথম দিকে গ্রাম থেকে কয়েক দিনের জন্য ঢাকায় এসে। দেখলাম এই প্রশ্নে ঢাকায় অগ্রগামী ছাত্রদের মধ্যে ব্যাপক জনমত তৈরী হয়েছে এবং সিরাজ শিকদার এই চিন্তার প্রধান প্রবক্তা। তখন তাঁর গোপন সংগঠন পূর্ব বাংলার শ্রমিক আন্দোলন গঠিত হয়েছে অথবা তা গঠনের কাজ চলছে। পূর্ব বাংলার শ্রমিক আন্দোলন পরবর্তী সময়ে পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টিতে পরিণত হয়। সেটা ছিল এক বিস্ফোরণোন্মুখ পরিস্থিতি। সমস্ত তরুণ প্রজন্ম বাম নেতৃত্বের বিরুদ্ধে ঘৃণায় বিস্ফোরিত হচ্ছে। এবং সিরাজ শিকদারের প্রভাব প্রায় বিদুৎ গতিতে সমস্ত ছাত্র আন্দোলনে ছড়িয়ে পড়ছে। পদ্ধতিগত প্রশ্নে তাঁর সঙ্গে আমার পূর্ব থেকেই দ্বিমত ছিল। আমি বুঝলাম যে, এক মুহূর্ত দেরী নয়। এই মুহূর্তে পদক্ষেপ দিতে হবে। তখন গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে সশস্ত্র সংগ্রাম গড়ে স্বাধীন পূর্ব বাংলা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পূর্ব বাংলার বিপ্লবী কমিউনিস্ট আন্দোলন প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করি।
আমি বহুবার ভেবেছি যদি ঐ সময় আমি ঐ উদ্যোগ না নিতাম তবে কি সিরাজ শিকদারের সঙ্গে সবাই যেত? মাহবুব উল্লাহর মত কয়েকজন ছাত্র নেতা-কর্মী হয়তো যেতেন না। কিন্তু বাকীদের ঠেকিয়ে রাখা দু:সাধ্য হত। বস্তুত পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন) এর অধিকাংশই তার সঙ্গে চলে যেত।
অবস্থাটাকে বুঝতে হবে। তখন দেশে তিনটি ছাত্র সংগঠন প্রায় সমান আয়তনের। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন), পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া) এবং পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র লীগ। ৬ দফা দেবার পর আওয়ামী লীগ যথেষ্ট বিপর্যস্ত; যে অবস্থা তা কাটিয়ে ওঠে কেবলমাত্র ’৬৯-এর গণ-অভ্যুথানের মধ্য দিয়ে। ফলে ঐ সময় ছাত্র লীগও যথেষ্ট স্তিমিত ছিল। এই সময়ে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন) সম্ভবত সর্ববৃহৎ ছাত্র সংগঠনে পরিণত হয়েছিল। আমার ধারণা সিরাজ শিকদার এই সংগঠনের বিপুল অংশকে তার সঙ্গে টেনে নিত। এর প্রভাব সম্ভবত দ্রুত গিয়ে পড়ত ছাত্র লীগেরও উপর। জাতীয়তাবাদের উথানের ঐ কালে ঠিক ঐ মুহূর্তে জাতীয় নেতৃত্বের আওয়ামী লীগ অংশ জেলে এবং বাম অংশ জাতীয় আন্দোলন বিমুখ। জাতীয় নেতৃত্বের শূন্যতার অমন একটা মুহূর্ত ছিল সিরাজ শিকদারের উথানের জন্য সম্পূর্ণ উপযুক্ত। পূর্ব বাংলার বিপ্লবী কমিউনিস্ট আন্দোলন গঠনের পর পরই ঢাকা থেকে অনেক দূরের জেলার গ্রামাঞ্চলে গিয়ে আমি বুঝেছিলাম সিরাজ শিকদারের প্রভাব তখন সারা দেশের বিভিন্ন স্থানে কি বিদ্যুৎ গতিতে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছিল।
আমার ধারণা ঐ সময় আমরা বাধা দিতে না পারলে ষাটের দশকের প্রজন্মের তরুণতর অংশের প্রায় সবটা অথবা ব্যাপকতর অংশই সিরাজ শিকদারের সঙ্গে চলে যেত। এবং তার ফলে অতি দ্রুত সিরাজ শিকদারের নেতৃত্বে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু হত। হয়তো যুদ্ধ শুরু হতে ১৯৬৯ বা ১৯৭০ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হত। কিন্তু আন্দোলনের মূল শক্তি যদি একবার গণ-আন্দোলন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে সশস্ত্র সংগ্রামের প্রস্তুতির দিকে মুখ ফেরাত তবে ভাসানী ’৬৯-এর গণ-অভ্যুথানের সূচনাকারী শক্তিটা কোথা থেকে পেতেন? ’৬৯-এর ৬ ডিসেম্বরে শুরু হয়ে এটা ’৬৯-এর ২৫ মার্চ আইয়ুব সরকারের পতন এবং জেনারেল ইয়াহিয়া কর্তৃক ক্ষমতা গ্রহণ এবং সামরিক আইন জারীর দিন পর্যন্ত স্থায়ী হয়।
সবচেয়ে বড় কথা একটা গণ-অভ্যুথানের মধ্য দিয়ে যুদ্ধ শুরু না হলে তার ফলাফলটা হত ভয়ঙ্কর। আমার ’৬৬ থেকে কৃষক আন্দোলনের অভিজ্ঞতায় দেখেছি যে, ’৬৯-এর গণ-অভ্যুথানের ঢেউ যতদিন পর্যন্ত ঢাকা থেকে গ্রামাঞ্চলে বিস্তৃত না হয়েছে ততদিন পর্যন্ত কৃষক চেতনা কত ভয়ানক পশ্চাৎপদ ছিল। আমার অভিজ্ঞতার কথা বললে বলতে পারি পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা কিংবা বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ তো দূরের কথা এমন কি ব্যাপক কৃষকদের মধ্যে আইয়ুব-বিরোধী চেতনাও জোরালো ছিল না। বরং আমি দেখেছিলাম অধিকাংশ কৃষকই ছিল আইয়ুব সরকারের সমর্থক। তাদের মধ্যে পাকিস্তান-বিরোধী চেতনা থাকার তো প্রশ্নই ওঠে না। যদিও পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণের বিরুদ্ধে কিছু ধারণা ছড়াচ্ছিল তবু তখনও সেটা ছিল খুব অস্পষ্ট ও অস্বচ্ছ। বরং কৃষক তার শত্রু দেখতে পেত একেবারে স্থানীয় পর্যায়ে এবং আইয়ুব সরকারকে ভাবত তার কল্যাণকামী। এই অবস্থাটাকে বিদ্যুৎ গতিতে বদলাতে দেখি ’৬৯-এ গণ-অভ্যুথানের ঢেউ গ্রামাঞ্চলে আছড়ে পড়লে। যখন হাজার হাজার অথবা লক্ষ লক্ষ ছাত্র গ্রামাঞ্চলে গণ-আন্দোলন শুরু করে তখন আমি কৃষক চেতনায় প্রকৃত বিস্ফোরণটা ঘটতে দেখি। হয়তো আজ অবিশ্বাস্য মনে হবে তবু আমার জানা ঘটনার কথা বলি। যেখানে উচ্চ বিদ্যালয়ও ছিল না এমন গভীর গ্রামাঞ্চলে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বালকেরা আন্দোলন এবং মিছিল শুরু করলে তাতেই এসে যোগ দিতে শুরু করে কৃষকেরা দলে দলে। সামনে শিশু ও বালক ছাত্ররা স্লোগান দিয়ে লাফাতে লাফাতে মিছিল করে যেত আর পিছনে দলে দলে বয়স্ক, বৃদ্ধ, দাড়ি শোভিত কৃষকরা লাঠি হাতে, ভার-বাঁক নিয়ে কিংবা ঝোলা হাতে অথবা খালি হাতে এসে ঐ মিছিলে যোগ দিত আর সামনের শিশু ও বালকদের অনুসরণে আইয়ুব পতনের দাবীর ধ্বনিতে চারদিক প্রকম্পিত করে এগিয়ে যেত। আর এইভাবে গোটা আন্দোলনটা দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়তে থাকে।
বস্তুত ১৯৬৮-’৬৯-এর গণ-অভ্যুথানের মধ্য দিয়ে এ দেশে গণ-বিপ্লবের রূপরেখাটি প্রথম অঙ্কিত হয়। এ সম্পর্কে তৎকালীন পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির নেতারা আমার বক্তব্যগুলো এখনও কষ্ট করে স্মরণ করতে পারেন। বিশেষত ছাত্র-তরুণদের ভূমিকা এবং এ দেশে কৃষক আন্দোলনের স্বরূপ ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আমার বক্তব্যগুলো তাঁদের ভাল লাগার কথা ছিল না। আমার তো মনে পড়ে না পার্টির মূল নেতারা আমাকে কোন দিন কৃষক আন্দোলনের কর্মী হিসাবে পরিচিত করতেন। কারণ আমি যতই কৃষক আন্দোলন করি তাঁদের ছকে পড়ে না বলে সেগুলো তাঁদের কাছে কৃষক আন্দোলন ছিল না। আসলে তাঁদের কাছে আমার পরিচয় ছিল প্রাক্তন ছাত্র কর্মী বা নেতা। সাধারণত সেই পরিচয়টাই তাঁরা দিতেন। হাঁ, আমার পরিচয় ছিল ছাত্র। কারণ ওটি ছিল তাঁদের কাছে নিদারুণ ঘৃণার শব্দ। কারণ ছাত্র তাঁদের তত্ত্বের শ্রমিকের জায়গাটা বাস্তবে দখল করে নিয়েছিল। সে কালে ছাত্র শব্দটা তাঁদের কাছে কতটা ঘৃণার ছিল আশা করি চেষ্টা করলে সেটা যেমন তাঁরা আজো স্মরণ করতে পারবেন তেমন যাঁরা তাঁদের প্রভাবে যত্রতত্র এই ঘৃণা প্রকাশের অভ্যাসটি আয়ত্ত করেছিলেন তাঁরাও এখন কিছু পরিমাণে হলেও সেটা স্মরণ করতে পারবেন।
মূল প্রসঙ্গ থেকে সরার জন্য আমি দু:খিত। তবে ’৬৯-এর গণ-অভ্যুথানের একটা খণ্ডচিত্র দিলাম তার তাৎপর্যটা স্পষ্টতর করার জন্য। এই রকম যে গণ-আন্দোলনই এ দেশে জনগণকে জাগাতে পারে সিরাজ শিকদার সেটিকেই বিকল করে দিয়ে যুদ্ধ করতে চেয়েছিলেন। এর ফল হত ভয়ঙ্কর। জনগণ তখনও জাগত না। কারণ আন্দোলনের মূল বা প্রধান শক্তি ছাত্র-তরুণরা ভিন্ন পথে যেত। গণ-আন্দোলন ও অভ্যুথানের বিস্ফোরণ ঘটিয়ে জনগণের এক বিরাট জাগরণ ছাড়া শুধু যুব শক্তির সাহায্যে সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করা হলে গোটা সংগ্রামকে পাকিস্তান সরকার বিচ্ছিন্ন অবস্থায় পেয়ে ধ্বংস করত। এর ফলে ’৬৯-এর গণ-অভ্যুথানের মাধ্যমে যে শক্তিটা বেড়ে উঠছিল এবং যেটা ’৭১-এর জাতীয় মুক্তিযুদ্ধে পথ খুঁজে পেল সেটা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হত। জাতির জীবনে ভয়ঙ্কর একটা গর্ভপাত ঘটে যেত। তাতে একাত্তরের জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের শক্তিটাই শেষ হয়ে যেত। আসলে এভাবে একেবারে নীচ থেকে কোনও বিপ্লব সফল হয় না।
যাইহোক, অনিবার্য বিপদকে ঠেকাবার জন্য, আমাদের প্রজন্মের শক্তিটাকে বাঁচাবার জন্য অনেকের ভূমিকা আছে নিশ্চয়। তবে ঐ মুহূর্তে আমার ভূমিকা বিশেষভাবে নির্ধারক ও গুরুত্বপূর্ণ ছিল বলে আমার ধারণা। দীর্ঘকাল ছাত্র আন্দোলনে আমার কাজ, ছাত্রদের সঙ্গে সংযোগ, সারা দেশের বাম আন্দোলনে পরিচিতি এবং বিশেষত গ্রামে কৃষক আন্দোলন করতে যাওয়ায় আমার সে কালে একটা বিশেষ প্রভাব সৃষ্টি হয়েছিল। ঐ সময় পর্যন্ত ’৬০-এর দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমি ছাড়া আর কোন ছাত্র নেতা বা কর্মী কৃষক আন্দোলন করতে ওভাবে যায় নি। আর সময়টা
ছিল মাও সে-তুং এবং চীনের বিপ্লব পন্থার যুগ, যার মূল কথা হল কৃষক বিপ্লব। সুতরাং নেতা না হলেও বিশেষত সমগ্র বাম ছাত্র আন্দোলনে আমার একটা ভিন্ন শক্তি ছিল।
কিন্তু তবু বলব সিরাজ শিকদার আমাকে পথ দেখিয়েছিলেন। তিনি আমাকে আমার এতকালের স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সংগঠিত পদক্ষেপ দেবার জন্য একটা প্রেরণা বা ধাক্কা দিয়েছিলেন। এইসব দিক বিবেচনা করে বলব সব ভুল সত্ত্বেও সিরাজ শিকদার এ দেশে ষাটের দশকে বাঙ্গালী জাতির স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্নের প্রথম রূপকার। যার যেটা প্রাপ্য তাকে সেটা দিতেই হবে। সেই সময় তিনিই প্রথম স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কর্মসূচীর ভিত্তিতে একান্ত গোপনে হলেও জনমত সংগঠিত করার কাজ শুরু করেছিলেন। যদিও তাঁর কর্মসূচী আমার পড়া ছিল না তবু তাঁর ভূমিকার জন্যই এ কথা বলছি।
কিন্তু বিপ্লবী প্রজন্মকে লালন ও রক্ষা করার সাধ্য আমার ছিল না। কিছু অভিজ্ঞতার পর আমার মনে হল একা আমরা বেশী দূর এগোতে পারব না এবং সিরাজ শিকদারের প্রভাব ধীরে ধীরে বাড়তে থাকবে যেটা পুনরায় একটা গর্ভপাতের ঘটনা ঘটাতে পারে। এবং সর্বোপরি জাতীয় রাজনীতিতে কার্যকরভাবে ভূমিকা পালনের সুযোগ চাইছিলাম। আমার মনে হল ন্যাপ এবং বাম আন্দোলনের নেতৃত্বের একটা অবলম্বন আমাদের দরকার। ’৬৮-এর নভেম্বরে পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি গঠিত হলে সেই সুযোগ পেলাম। এইভাবে ন্যাপের ছত্রছায়ায় গড়ে ওটা গণ-সংগঠনগুলোর বিশাল যন্ত্রটা আমাদের বিপ্লবী প্রজন্মের হাতে চলে এল। নেতৃত্ব যতই চক্রান্ত করুক, যতই বাধা দিক বাঙ্গালী জাতি এবং জনগণের স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চেতনা এবং সেই সঙ্গে জনগণের সশস্ত্র সংগ্রামের চেতনা যা ছাড়া এই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না তা আমরা সারা দেশে বিস্তৃত করতে থাকলাম। এই চেতনার শক্তিই ’৬৯-এর গণ-অভ্যুথানের ভিতর দিয়ে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত এগিয়ে গেল।
এই জন্য সমস্ত সমালোচনার পরেও বলব দেবেন-মতিন-আলাউদ্দিন সেদিন এক অর্থে একটা প্রজন্মকে রক্ষা ও লালনও করেছেন। অন্তত একটা পর্যায় পর্যন্ত এর ঐতিহাসিক মূল্যও একেবারে ফেলনা নয়।
সিরাজ শিকদার সম্পর্কে একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করে তার প্রসঙ্গ শেষ করব। ১৯৬৮-এর এপ্রিলে পূর্ব বাংলার বিপ্লবী কমিউনিস্ট আন্দোলন গঠনের পর আমি জানতে পারলাম যে, সিরাজ শিকদার পূর্ব বাংলার শ্রমিক আন্দোলন গঠন করেছে।* এর আগে তার গণ-আন্দোলন বিরোধী চিন্তা এবং স্বাধীন পূর্ব বাংলা সংক্রান্ত বক্তব্য দাঁড় করাবার কথা শুনেছিলাম। কিন্তু সংগঠন গঠনের কথা অন্তত আমার জানা ছিল না। যখন জানলাম যে, সিরাজ শিকদার সংগঠন গঠন করেছে তখন আমি তাদের সঙ্গে ঐক্য আলোচনার প্রয়োজন উপলব্ধি করি এবং তাদেরকে গণ-রাজনীতিতে নেবার একটা শেষ চেষ্টা করি। আমাদের পক্ষ থেকে প্রস্তাব পাঠালে তারা বৈঠকে সম্মত হয়। আমাদের সংগঠনের পক্ষ থেকে মাহবুব উল্লাহ এবং আমি এই বৈঠকে উপস্থিত থাকি এবং সেখানেই নুরুল হাসান তার স্বরূপ উদঘাটন করে। সে বৈঠকের বিবরণ এখানে অপ্রয়োজনীয়। তবে এটুকু বলা যায় যে, তারা মূলত আমাদের অপমান করার জন্যই ঐ বৈঠকে রাজী হয়েছিল। তাদের অভিযোগ ছিল যে, আমরা তাদের বক্তব্য চুরি করেছি। সুতরাং গোটা বৈঠকটা একটা তিক্ততাপূর্ণ বিতর্কে পর্যবসিত হয় এবং ব্যর্থ হয়।
_____________________________________________________________________________________________________________________
* ‘১৯৬৮ সনের ৮ জানুয়ারী তারিখে তিনি (সিরাজ শিকদার) তাঁর সহযোগীদের নিয়ে “পূর্ব বাংলার শ্রমিক আন্দোলন” গঠন করেন।’ আমজাদ হোসেন, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের রূপরেখা। পৃ: ৬৩
_____________________________________________________________________________________________________________________
সেই দিন আমি সিরাজ শিকদারের মধ্যে একদল অন্ধ স্তাবক পরিবেষ্টিত ভবিষ্যতের এক ভয়ঙ্কর নির্মম, আত্মম্ভরী, চক্রান্তকারী, নিরঙ্কুশ একনায়ক ও স্বেচ্ছাচারী নেতার স্পষ্ট চিত্র দেখতে পেয়েছিলাম। এবং এও জানতাম যে তার বিনাশ হবে। কারণ ঐ প্রক্রিয়ায় সাফল্য তো আসেই না বরং একদল নিষ্ঠুর মানুষের জন্ম হয় এবং তারা সব সহই ধ্বংস হয়। এটা প্রকৃতপক্ষে মানুষগুলোরও দোষ নয়। এটা একটা প্রক্রিয়ার দোষ। আর এটাও একদিনে আসে না। বিদ্যমান সমাজ, রাষ্ট্র এবং সামাজিক-রাজনৈতিক নেতৃত্বের নীচতা, শঠতা, চক্রান্ত আর নৃশংসতার পেষণে যুবশক্তির ভিতর যে ভয়ঙ্কর হতাশা আর ক্রোধ জন্ম নেয় তার ভিতর থেকে উঠে আসে এই প্রক্রিয়া। আর এতে যারা যায় তারাও অমন হয়ে যায়। লাঞ্ছিত জনগণকে সঙ্গে নিয়ে এগোতে না চাইলে মহৎ আকাঙ্ক্ষা থাকলেও মানুষ অমন হয়ে যায় শুধুমাত্র জোর-জবরদস্তি করে পরিবর্তন ঘটাতে চেয়ে। এই নির্দয় রূপের কারণে আমি কোনও দিন স্তালিনকে মনের ভিতরে গ্রহণ করতে পারি নি। নবম শ্রেণীর ছাত্র অবস্থায় যে দিন মাও সে-তুং-এর ‘শত ফুল ফুটতে দাও’ পড়ি সেদিন থেকে আমার অন্তরে এ কালের পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ বিপ্লবী নেতা হয়ে রয়েছিলেন মাও সে-তুং। মার্কস, এঙ্গেলস, লেনিন এঁদের কাছ থেকে আমি বিপ্লবের পদ্ধতি শিখতে চাইতাম। এঁদের সকলেরই মূল্য ছিল আমার কাছে। কিন্তু মাও আমাকে দিয়েছিলেন এমন একটা দর্শন যা আমি এঁদের কারো কাছে পাই নি। আর তাই মাওকেই আমার হৃদয়ের সবচেয়ে কাছের সমাজতন্ত্রী নেতা মনে হত। হাঁ, যেদিন আমি ‘শত ফুল ফুটতে দাও’ পড়ি সেদিন থেকে বিপ্লব প্রয়াস আমার কাছে চিরকালের জন্য হয়ে থেকেছে বিষাক্ত আগাছা আর কাঁটা গাছ নির্মূল করে শত ফুল ফোটাবার সাধনা।
কিন্তু সেদিন আমরা সিরাজ শিকদারের ব্যাপকতর উত্থান প্রতিহত করতে পারতাম না যদি আমরা বিকল্প ও উন্নততর কর্মসূচী না দিতাম, যে কর্মসূচীর কেন্দ্রীয় বিষয়টি সিরাজ শিকদারের কর্মসূচীর মত অথচ তার সঙ্গে জনগণের অংশ গ্রহণের বিষয়টি নিশ্চিত করা হল। অর্থাৎ আমরা সিরাজ শিকদারের ভ্রান্ত ও বিপদজনক পথের উত্থান ঠেকাতে সেদিন তার কর্মসূচীরই মর্মবস্তু স্বাধীনতার লক্ষ্য গ্রহণ করলাম। এরই ফলে তার বিপদজনক উত্থান প্রতিহত হল। অথচ আমাদের নেতারা সেদিন ৬ দফার ভিতরে স্বায়ত্তশাসন এবং বাঙ্গালীর স্বাধিকারের যে মর্মবস্তু ছিল সেটিকে প্রতিহত করতে চাইলেন। তাঁরা পূর্ব বাংলার বৃহত্তর জনগণের দাবীসমূহের কেন্দ্রে স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধিকারের মর্মবস্তুকে রেখে যদি একটা পূর্ণাঙ্গ জাতীয় কর্মসূচী দিতেন তবে কিন্তু তাঁদেরকে মুজিব ঠেকাবার সাধনা করতে হত না। যেমন আমরা সিরাজ শিকদারের স্বাধীনতার দাবীর সমালোচনা বা নিন্দা করে বেড়াই নি। আমরা তাঁর পদ্ধতির সমালোচনা করেছি সব সময় এবং একই সাথে আমাদের বিকল্প পদ্ধতি দিয়েছি। ফলে প্রকৃতপক্ষে ষাটের দশকে তাঁর আর উত্থান সম্ভব হয় নি।
হাঁ, সিরাজ শিকদার যেমন আমাদের প্রজন্মকে একটা ‘পুশ’ বা ধাক্কা দিয়েছিলেন তেমন শেখ মুজিব তাঁর ৬ দফা কর্মসূচী দিয়েও সমগ্র জাতীয় রাজনীতি তথা জাতিকে একটা ‘পুশ’ বা ধাক্কা দিয়েছিলেন। আমাদের প্রজন্মের পক্ষে যেটা করা সম্ভব ছিল সেকালে তারা সেটা করেছিল। সাথে সাথে তারা সিরাজ শিকদারের সৃষ্টি করা সেই ধাক্কা বা অভিঘাতকে নূতন গতিবেগে পরিণত করেছিল। কিন্তু বামপন্থী জাতীয় নেতৃত্ব ৬ দফার ধাক্কা বা অভিঘাতের ফলে যে গতিবেগ সৃষ্টি হল সেটাকে প্রতিহত করার কাজেই সর্বশক্তি নিয়োগ করল। তারা আর এ থেকে শিক্ষাও নিল না এবং এটা থেকে যে গতির সৃষ্টি হল তাকে বৃহত্তর জনগণের মুক্তি আন্দোলনের পথে চালিত করার চেষ্টাও করল না। ২১ দফার অভিজ্ঞতাও তারা তখন ভুলে গেছে। ১৯৫৩-এর ডিসেম্বরে যখন যুক্তফন্সন্টের ২১ দফা দেওয়া হয় তখন সেটা শুধু বাঙ্গালীর স্বাধিকার প্রশ্নকেই গুরুত্ব দেয় নি, সেই সঙ্গে কৃষক-শ্রমিকসহ জনগণের বিভিন্ন স্তরের গুরুত্বপূর্ণ দাবীগুলোকেও সন্নিবেশ করেছিল। অথচ সেই সময়ে ১৯৬৬-এর সময়ের তুলনায় জাতি সব দিক থেকে কতটা পিছিয়ে ছিল সেটা সহজেই অনুমেয়। তবু এমন একটা যুগোপযোগী কর্মসূচী তখন এল। আসলে ২১ দফার তুলনায় ৬ দফা অনেক বেশী পশ্চাৎপদ এবং খণ্ডিত। শুধু তাই নয় ৬ দফার একটা ক্ষতিকর দিকও ছিল যার বিষময় ফল জাতি আজ অবধি ভোগ করছে। এই কথা কেন বলছি তা একটু ব্যাখ্যা করার জন্য প্রথমে আমি ২১ দফার কিছু তাৎপর্যপূর্ণ দিক খুব সংক্ষেপে তুলে ধরব।
২১ দফায় কি ছিল? তার ১নং কর্মসূচীই ছিল বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবী। ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলনের পটভূমিতে সেটাই ছিল সেই মুহূর্তে বাঙ্গালী জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আন্দোলনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দাবী। আমি পাঠকের চিন্তার জন্য ২১ দফা কর্মসূচীর কয়েকটি তাৎপর্যপূর্ণ দফা এখানে তুলে দিচ্ছি।
১. বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করা হইবে।
২. বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদারী ও সমস্ত খাজনা আদায়কারী স্বত্ব উচ্ছেদ ও রহিত করিয়া ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে উদ্বৃত্ত জমি বিতরণ করা হইবে এবং উচ্চ হারের খাজনা ন্যায়সঙ্গতভাবে হ্রাস করা হইবে এবং সার্টিফিকেট যোগে খাজনা আদায়ের প্রথা রহিত করা হইবে।
৪. কৃষির উন্নতির জন্য সমবায় কৃষি ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হইবে ও সরকারী সাহায্যে সকল প্রকার কুটির ও হস্তশিল্পের উন্নতি সাধন করা হইবে।
৭. খাল খনন ও সেচের ব্যবস্থা করিয়া দেশকে বন্যা এবং দুর্ভিক্ষের কবল হইতে মুক্ত করিবার ব্যবস্থা করা হইবে।
১৪. জননিরাপত্তা আইন ও অর্ডিন্যান্স প্রভৃতি কালাকানুন রদ ও রহিত করত: বিনা বিচারে আটক বন্দীকে মুক্তি দেওয়া হইবে ও রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের প্রকাশ্য আদালতে বিচার করা হইবে এবং সংবাদপত্র ও সভা সমিতি করিবার অধিকার অবাধ ও নিরঙ্কুশ করা হইবে।
১৫. বিচার বিভাগকে শাসন বিভাগ হইতে পৃথক করা হইবে।
১৯. লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পূর্ব বঙ্গকে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন ও সার্বভৌমিক করা হইবে এবং দেশরক্ষা, পররাষ্ট্র ও মুদ্রা ব্যতীত আর সমস্ত বিষয়ে (অবশিষ্ট ক্ষমতাসমূহ) পূর্ব বঙ্গ সরকারের হাতে আনয়ন করা হইবে এবং দেশরক্ষা বিভাগের স্থল বাহিনীর হেড কোয়ার্টার পশ্চিম পাকিস্তানে ও নৌবাহিনীর হেড-কোয়ার্টার পূর্ব পাকিস্তানে স্থাপন করা হইবে এবং পূর্ব পাকিস্তানে অস্ত্র নির্মাণের কারখানা নির্মাণ করত: পূর্ব পাকিস্তানকে আত্মরক্ষায় স্বয়ংসম্পূর্ণ করা হইবে। আনসার বাহিনীকে স্বতন্ত্র বাহিনীতে পরিণত করা হইবে।
২০. যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা কোন অজুহাতেই আইন পরিষদের আয়ু বাড়াইবে না। আইন পরিষদের আয়ু শেষ হওয়ার ছয় মাস পূর্বেই মন্ত্রিসভা পদত্যাগ করিয়া নির্বাচন কমিশনের মারফত স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা করিবে।
বস্তুত ’৬৬-এর ৬ দফা কি ’৫৩-’৫৪-এর ২১ দফার ১৯নং দফা থেকে মূলগতভাবে ভিন্ন কিছু? কিন্তু ২১ দফায় যে সামগ্রিক জাতীয় ও গণতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গী ছিল ৬ দফায় কি তা ছিল? আমি ৬ দফার বিবরণ এখানে দিলাম না। তবে কোনও পাঠকের কৌতূহল হলে ২১ দফা ও ৬ দফা কর্মসূচী দুইটিকে মিলিয়ে দেখতে পারেন।*
______________________________________________________________________________
* গুরুত্বের কথা বিবেচনা করে এবং পাঠকের সুবিধার্থে এই গ্রন্থের পরিশিষ্টে যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা, আওয়ামী লীগের ৬ দফা, ন্যাপের ১৪ দফা এবং ছাত্র ইউনিয়নের ১১ দফা কর্মসূচী পূর্ণাঙ্গরূপে দেওয়া হয়েছে।
______________________________________________________________________________
প্রকৃতপক্ষে ৬ দফা এমন এক কর্মসূচী যা শুধু উদীয়মান মধ্যবিত্তের দাবী তুলে ধরে। যেন মধ্যবিত্তই হচ্ছে সমগ্র জাতি। এখানে কৃষকের কর্মসূচী নেই, শ্রমিকের নেই, নারীর নেই। পূর্ব বাংলার সমগ্র জনগণের জাগরণের কর্মসূচী নেই। ফলে যে মধ্যবিত্ত সমগ্র সমাজের উপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠাকারী ছিল তা ৬ দফার মাধ্যমে সমগ্র জনগণের উপর তার আধিপত্য ও নিয়ন্ত্রণকে আরও নিরঙ্কুশ করতে চাইল। যে মধ্যবিত্ত এই আন্দোলনের মাধ্যমে জাতীয় আন্দোলনের নেতৃত্বকারী শক্তি হল তার উপর শ্রমজীবী, উৎপাদক ও নিপীড়িত জনগণের পাল্টা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থাটা আর গড়ে উঠল না। ফলে মধ্যবিত্তই হল জাতি আর জনগণ হল তার ছায়া, তার অন্ধ অনুসরণকারী মাত্র। এইভাবে ৬ দফা হল প্রকৃতপক্ষে জাতিখণ্ডনকারী। যদিও তা কেন্দ্রীয় বিষয়টিকে সঠিকভাবে ধরল, তবু। এইভাবে শ্রম বিমুখ, উৎপাদনশীলতা বিমুখ, গণ-বিমুখ এক মধ্যবিত্ত রাজনীতি হয়ে উঠল জাতির রাজনীতি। এ কর্মসূচী তার মুখের কথায় এমন কি আকাঙ্ক্ষায়ও যা-ই হোক এটা চরিত্রে হয়ে ওঠে অনুৎপাদক, সুবিধাবাদী, দুর্নীতিপরায়ণ এবং লুটেরা ফলে লুম্পেন। ক্ষমতায় যাবার পূর্বে এই চরিত্রটা হয়তো প্রবল হয় না। কিন্তু ক্ষমতায় গেলে সেটাই প্রাধান্য বিস্তার করে।
প্রকৃতপক্ষে এ দেশে সাম্রাজ্যবাদ ও পাকিস্তানের সহযোগী যে মুৎসুদ্দি শ্রেণীটি গড়ে উঠেছিল এবং চরিত্র বিচারে যেটি মুৎসুদ্দি বুর্জোয়া ছিল রাষ্ট্রক্ষমতা হাতে পেয়ে সেই শ্রেণীই পরিণত হয় লুম্পেন বুর্জোয়ায়। কারণ ক্ষমতায় যাবার পূর্বে তাদের তবু একটা রাখঢাক থাকে, জনগণের কাছে যাবার প্রয়োজন থাকে, লুটের সুযোগ সেভাবে থাকে না। কিন্তু ’৭১-এর ১৬ ডিসেম্বরের পর রাষ্ট্র ক্ষমতা হাতে পাবার পর লুণ্ঠন, দুর্নীতি, চুরির পথে আর কোনও বাধা থাকে নি। বস্তুত তখন রাষ্ট্রযন্ত্র হয়ে ওঠে যে কোনও উপায়ে সম্পদ অর্জনের সর্বশ্রেষ্ঠ হাতিয়ার।
এইভাবে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর বিগত পঁচিশ বৎসর ধরে যে শ্রেণীটি বাংলাদেশ শাসন করেছে আমলা - ধনিকদের সেই সম্মিলিত শ্রেণীটিকে আমরা লুম্পেন বুর্জোয়া হিসাবে অভিহিত করতে পারি। অর্থাৎ আমার বিচারে এ দেশে মুৎসুদ্দি বুর্জোয়া রাষ্ট্র ক্ষমতা হাতে পেয়ে লুম্পেন বুর্জোয়াতে পরিণত হয়েছে।
সুতরাং কথাটা অনেকের শুনতে খারাপ লাগলেও আমি বলতে বাধ্য যে, বাঙ্গালী জাতি ও জনগণের বৃহত্তর চেতনার জগতে নূতন জাগরণের সুত্রপাত ঘটাবার ক্ষেত্রে একটা বিরাট অভিঘাত সৃষ্টি করলেও আওয়ামী লীগের ৬ দফা প্রকৃতপক্ষে একটি লুম্পেন বুর্জোয়া সৃষ্টির কর্মসূচী।
বস্তুত সিরাজ শিকদারের রাজনীতি একটা ভয়ানক ক্ষতিকর ও অপরিপক্ব গর্ভপাত ঘটাতে পারত। সেটাকে রোধ করা গেছে বিকল্প কর্মসূচী ও রাজনীতি দিয়ে। কিন্তু মুজিবের ৬ দফার অপূর্ণ ও খণ্ডিত কর্মসূচীর বিকল্প হিসাবে কোনও পূর্ণাঙ্গ জাতীয় কর্মসূচী না দিয়ে শুধু সীমাবদ্ধ গণ-আন্দোলনের আড়ালে গোপনে স্বাধীনতার কর্মসূচী রাখায় ’৭১-এর জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ হল ঠিকই কিন্তু তা আর পরিণতিতে পৌঁছতে পারল না। এই মুক্তিযুদ্ধের জঠরে জন্ম নিল একটি জাতির শিশুর পূর্ণাঙ্গ অবয়ব। কিন্তু ভূমিষ্ঠ হবার মুহূর্তটিই হয়তো ছিল তার মৃত্যুর মুহূর্ত। আমার ধারণা ’৭১-এর জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের সময়টাই বাঙ্গালী জাতির ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ সময়। এই সময়েই তার ইতিহাসে বাঙ্গালী জাতি প্রথম নিজের সত্তাকে পরিপূর্ণরূপে উপলব্ধি করার অবকাশ পেল। এটি ছিল তার ইতিহাসের প্রথম গণ-বিপ্লব। পৃথিবীর সকল প্রথম গণ-বিপ্লব ব্যর্থ হয়। একাত্তরও এক অর্থে ব্যর্থ। এবং আমার ধারণা পাকিস্তান আমলে বামপন্থীরা সঠিক জাতীয় কর্মসূচী দিতে পারলেও প্রথম গণ-বিপ্লব ব্যর্থ হতই। বহুবিধ কারণেই তা ব্যর্থ হত। জাতির পূর্ব অভিজ্ঞতার অভাব ও দুর্বলতা, নেতৃত্বেরও পূর্ব অভিজ্ঞতার অভাব, আন্তর্জাতিক শক্তিসমূহের ভূমিকা এবং বিশেষত তিন দিক পরিবেষ্টনকারী ভারত-রাষ্ট্রের ভূমিকা - এ সবের কারণে প্রথম বিপ্লব ব্যর্থ হত। তবে দ্বিতীয় আর একটি গণ-বিপ্লবের জন্য হয়তো খুব বেশী দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হত না। জাতিকে এতটা মূল্য দিতে হত না।
তবু বলব ৬ দফা ছিল পাকিস্তানের কাঠামো থেকে মুক্তির ক্ষেত্রে এক অগ্রযাত্রা। প্রকাশ্য রাজনীতিতে জাতীয় কর্মসূচীর অনুপস্থিতির অভাবটা তা পূরণ করেছে। এই ৬ দফার চাপকে ব্যবহার করে আমরা সেকালে বাম ধারার গণ-আন্দোলনকে স্বাধীনতার লক্ষ্যে জনযুদ্ধের চেতনার বিস্তার ও বিকাশের জন্য ব্যবহার করতে পেরেছিলাম। বামপন্থী আন্দোলনের অভিভাবক-নেতা হিসাবে পূর্ব বাংলা ভিত্তিক একটা পূর্ণাঙ্গ জাতীয় কর্মসূচী দিতে না পারার দায়িত্বটা ভাসানীর উপরেও এসে পড়ে বৈকি! তবে তাঁর সঙ্কট ও সীমাবদ্ধতা কোথায় ছিল তা আমি ইতিপূর্বে বলেছি। প্রকৃতপক্ষে ভাসানীর ঐতিহাসিক ভূমিকার মূল্যায়ন এবং তাঁর সঙ্কটটা আরও একটু ব্যাখ্যা না করলে আমার ধারণা আমরা অনেক কিছু বুঝতে ভুল করব। এটা আগামী দিনের পথ নির্দেশেও একটা বাধা হয়ে থাকবে। ভাসানীর আকাঙ্ক্ষা ও তাঁর প্রতি কমিউনিস্টদের দৃষ্টিভঙ্গীটার গভীরে গেলে সম্ভবত এ দেশে কমিউনিস্ট রাজনীতির ভ্রান্তি ও সীমাবদ্ধতার একটা উৎসমূল আমরা খুঁজে পেতে পারি। সুতরাং ভাসানীর উপর আরও আলোচনা দিয়ে আরও গভীরে যাবার চেষ্টা করব, যে গভীরে গেলে দেখতে পাব যে তত্ত্বটা নিয়ে আমরা সেকালে বিপ্লব করতে চেষ্টা করেছিলাম তারই সীমাবদ্ধতা এবং তার ভিতর সঙ্কটের উৎস এবং ব্যাধির বীজ।