লিখেছেনঃ শামসুজ্জোহা মানিক, আপডেটঃ July 18, 2013, 4:52 AM, Hits: 1597
আমি মনে করি বাংলাদেশে একটি গণ-বিপ্লব আসন্ন ও অনিবার্য হয়ে উঠছে। এর কতকগুলো কারণ আমি ইতিপূর্বে চিহ্নিত করতে চেষ্টা করেছি। কিন্তু এই গণ-বিপ্লবের মূল সামাজিক শক্তিটার স্বরূপ আরও স্পষ্ট করা দরকার বলে আমি মনে করি। কারণ সামাজিক শক্তিসমূহের উপস্থিতিই বিপ্লবের অনিবার্যতা ঘটায় না। তা ব্যাপক সামাজিক বিস্ফোরণ, সংঘাত ও ধ্বংসেরও কারণ হতে পারে। বিপ্লবের বদলে প্রতিবিপ্লবকেও বিজয়ী করতে পারে। সুতরাং এ দেশে বিপ্লবের অনিবার্যতা যে শক্তিটা ঘটাতে পারে সেটাকে আমাদের চিনতে হবে।
এটা ঠিক যে, এই বিপ্লবে ষাটের দশকের বিপ্লবী প্রজন্মের উপস্থিতি ও ভূমিকা এই শক্তিকে সঠিক পথ ও অভিমুখ দিতে পারে। কিন্তু বিপ্লবের শক্তিটা না থাকলে শুধু পরিচালনার কিংবা অভিজ্ঞতার শক্তি থাকায় লাভ কি? আর এই শক্তি চিহ্নিত করতে হলে আমাদেরকে এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে ১৯৮৩-এর ১৪-১৫ ফেব্রুয়ারীতে যে ছাত্র অভ্যুথান ঘটে সেদিকে দৃষ্টি দিতে হবে। ঐ অভ্যুথান ছিল ১৯৬২-এর ছাত্র অভ্যুথানের প্রায় অনুরূপ ঘটনা। এই ছাত্র অভ্যুথানের মধ্য দিয়ে এরশাদের নয় বৎসর স্থায়ী সামরিক ও আধা সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে দীর্ঘ আট বৎসরের একটানা গণ-আন্দোলনের সূচনা ঘটে।
অবশ্য ১৯৬২-এর সঙ্গে ১৯৮৩-এর মৌলিক কিছু পার্থক্য ছিল। ’৬২-তে যখন ছাত্রঅভ্যুথান ঘটে তখন তার আগে ছিল কয়েক বৎসরের সামরিক শাসন। রাজনৈতিক নেতৃত্ব ছিল দীর্ঘকাল কারাগারে এবং অনুপস্থিত। অন্য দিকে ন্যাপ এবং ভাসানী বাদে আর সকল রাজনৈতিক নেতৃত্ব ’৫৪-এর নির্বাচন পরবর্তী কালে নিজেদের ভূমিকার কারণে জনগণের সকল আস্থা হারায়। ফলে ’৬২-এর ছাত্র অভ্যুথানের মধ্য দিয়ে আন্দোলনের যে তরুণ শক্তির উদ্ভব ঘটে তা ছিল স্বাধীন।
’৮৩-এর ছাত্র অভ্যুথানের সময় এই দু’টি বাস্তবতার কোনোটিই ছিল না। প্রথমত, তার মাত্র এক বৎসর পূর্বেই সামরিক শাসন কায়েম হয়েছিল। অন্যদিকে রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ থাকলেও রাজনৈতিক দল যেমন নিষিদ্ধ ছিল না তেমন তাদের কার্যক্রমও বাস্তবে সম্পূর্ণ বন্ধ ছিল না এবং ছাত্রদের সঙ্গে রাজনৈতিক নেতৃত্বের সংযোগও ছিল সজীব। দ্বিতীয়ত, বিএনপি-এর ভাবমূর্তি তখনও জনমনে রয়ে গিয়েছিল। এবং আওয়ামী লীগেরও একটা জন-সমর্থন ছিল। ফলে সব মিলিয়ে ’৮৩-তে যে ছাত্র-তরুণ শক্তির অভ্যুদয় ঘটে তার স্বাধীনভাবে বিকাশের বাস্তবতা থাকে নি। তবু এরশাদের নয় বৎসরের শাসনকালে পুরোটা সময় ছাত্র সম্প্রদায় সর্বাত্মকভাবে এরশাদ-বিরোধী ছিল। এরশাদ সমস্ত রকম প্রচেষ্টা চালিয়েও ছাত্রদের মধ্যে অনুপ্রবেশ করতে পারে নি। ছাত্র আন্দোলনের ব্যাপকতর অংশ ছিল বিএনপি পরিচালিত জাতীয়তাবাদী ছাত্র দলের নেতৃত্বাধীন। তারপর অবস্থান ছিল আওয়ামী লীগ পরিচালিত ছাত্র লীগের। এ ছাড়া ছিল বিভিন্ন বামপন্থী ক্ষুদ্রতর ছাত্র সংগঠনসমূহ যাদের সমর্থক ও কর্মী সংখ্যা কম হলেও সাহস ও জঙ্গিত্ব ছিল সবচেয়ে বেশী।
ছাত্রদের আন্দোলন ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার আন্দোলনের প্রকৃত ভিত্তি। ’৮৬-তে আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের প্রতি অঙ্গীকার ভঙ্গ করে এরশাদের অধীনে নির্বাচনে যাবার ফলে ছাত্রদের মধ্যে লীগের জনপ্রিয়তা দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এবং খালেদার নেতৃত্বে বিএনপি এর ফসলটা লাভ করে ’৯০-এ ব্যাপক ছাত্র-গণ-আন্দোলনের মুখে এরশাদের পতনের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ’৯১-এর সংসদ নির্বাচনে। ’৮৮-এর নির্বাচন সব দল বর্জন করলেও লীগের পক্ষে ’৮৬-তে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আন্দোলন থেকে সরে যাবার ফলে তার ভাবমূর্তির যে ক্ষতিটা হয়েছিল সেটা পূরণ করা সম্ভব হয় নি। বস্তুত এরশাদের নয় বৎসর শাসনের মধ্যে তার বিরুদ্ধে আট বৎসরের লাগাতার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বিএনপি নিজেকে সবচেয়ে আপোসহীন ও কার্যকর সামরিক শাসন-বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি হিসাবে জনগণের সামনে উপস্থিত করতে পারে। এবং তার সবচেয়ে বড় অর্জন এ দেশের গণ-আন্দোলনের প্রধান অগ্রবাহিনী স্বরূপ ছাত্রদের ব্যাপকতর অংশটিকে নিজের পক্ষে পাওয়া।
এরশাদ-বিরোধী তত্ত্বাবধায়ক সরকার আন্দোলনের এমন এক তাৎপর্য আছে যেটা না বুঝলে আমরা এ দেশে আগামী আন্দোলনের অভিমুখটাও বুঝতে পারব না বলে আমি মনে করি। এতকাল এ দেশে সেনাবাহিনী বারবার অভিভাবক সুলভ ভঙ্গীতে রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করেছে। ১৯৫৮-তে আইয়ুব, ১৯৬৯-এ ইয়াহিয়া, ১৯৭৫-এ জিয়া ক্ষমতা দখলের পর একটা সময়ে প্রত্যেকেই সামরিক শাসনকে কোনো না কোনো রূপে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বৈধ করে নিতে পেরেছেন। কারণ প্রায় সকল নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল ঐ সব সামরিক শাসকের অধীনে নির্বাচনে অংশ নিয়েছে। কিন্তু এ দেশের ইতিহাসে এরশাদ প্রথম সামরিক শাসক যাঁর নয় বৎসরের শাসন কোনো রাজনৈতিক বৈধতা পায় নি। শেষ পর্যন্ত তাঁকে ১৯৯০-এর ডিসেম্বরে গণ-অভ্যুথানের মুখে প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে যেতে হয়েছে।
এ এক যুগান্তকারী ঘটনা। শুধু এ দেশের জন্য নয়। আমার জানা মতে তৃতীয় বিশ্বে এই প্রথম সামরিক শাসক বা সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে আর কোনো নির্বাচনী রাজনীতির ধারা রইল না। এটা এ দেশের রাজনীতিতে আমলাতান্ত্রিক আধিপত্যের ধারার উপর এক প্রচণ্ড আঘাত। এটা ঠিক যে প্রধান বিচারপতিও আমলা। কিন্তু তিনি প্রতিনিধিত্ব করেন বেসামরিক আমলাতন্ত্রকে। ফলে এ দেশের আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রধান শক্তি সেনাবাহিনী বা সামরিক আমলাতন্ত্রের নৈতিক ও বাস্তব প্রভাব, প্রতিপত্তি ও নিয়ন্ত্রণ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আর এটা অনিবার্যভাবে শক্তিশালী করেছে জনগণের গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষা ও চেতনাকে।
বিশেষ করে এ দেশে সামরিক সরকারকে গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে হটিয়ে দিয়ে বেসামরিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের মাধ্যমে রাজনৈতিক শাসন পুন:প্রতিষ্ঠার তাৎপর্য বুঝতে হলে আমাদের সমাজ মানসে সেনাবাহিনী তথা সামরিক শক্তির গুরুত্বটা বুঝতে হবে। মুসলিম জন-মানসে সেনাবাহিনীর মর্যাদা সবচেয়ে বেশী। এটা সারা মুসলিম পৃথিবীর দিকে দৃষ্টি দিলে বোঝা যায়। অবশ্য পাশ্চাত্যের আধিপত্য ও যুগের প্রভাবে বিভিন্ন দেশে পরিস্থিতির পরিবর্তন হচ্ছে। ফলে মুসলিম সমাজেরও সনাতন বা ঐতিহ্যিক বিন্যাসটা থাকছে না। তবু প্রথাগত মুসলিম জন-মানসের অন্তর্গত বৈশিষ্ট্য হল সামরিক স্বৈরতন্ত্রের উপযোগী। এটা এক বিশেষ ধর্ম-সংস্কৃতি, মনস্তত্ত্ব এবং ঐ সমাজের বিশেষ বিকাশ প্রক্রিয়ার ফল।
পৃথিবীর অন্যান্য বহু দেশেও সামরিক কর্তৃত্ব থাকলেও মুসলিম সমাজের সঙ্গে তাদের পার্থক্যের মৌল দিকটা অবশ্যই বুঝতে পারতে হবে। বৌদ্ধ, খ্রীষ্টান কিংবা হিন্দু ধর্ম-সংস্কৃতি প্রভাবিত সকল সমাজ থেকেই মুসলিম সমাজ এই জায়গায় অনেক ভিন্ন। অন্য সব সমাজে সামরিক শক্তির এই ধর্মীয় কিংবা ভাবাদর্শিক মর্যাদাটা নেই যেটা মুসলিম সমাজে আছে। অন্যান্য সমাজে সামাজিক কর্তৃত্ব বা নেতৃত্বে একটা স্পষ্ট বিভাজন আছে। যেমন গীর্জা ও রাষ্ট্র, সংঘ ও রাষ্ট্র কিংবা ব্রাহ্মণ পুরোহিত ও ক্ষত্রিয় রাজা। ইসলামে কিন্তু তেমন কোনো বিভাজন নেই। এবং এইসব সমাজের ধর্মগুলো মূলত অরাজনৈতিক এবং সেগুলো মূলত পুর সমাজ তথা সিভিল সোসাইটি বা বেসরকারী জন-সমাজের ধর্ম। রাজা-রাষ্ট্র ধর্মগুলোকে গ্রহণ করেছে ঠিক, কিন্তু বিভাজনটা থেকে গেছে। অন্যদিকে ঐসব ধর্মের উদ্ভব ও বিকাশ প্রকৃতপক্ষে যুদ্ধের মধ্য দিয়ে হয় নি বলে এর এক সুগভীর প্রভাব জন-মানসের উপর পড়েছে। ফলে বৈষয়িক কারণে সেনাবাহিনীর আধিপত্য থাকলেও নৈতিক ও ধর্মীয় শক্তি হিসাবে তার কোনো স্বতন্ত্র মর্যাদা থাকে নি। কিন্তু ইসলামে তত্ত্বগতভাবে ও বাস্তবে ধর্ম ও রাষ্ট্র একই বিন্দুতে কেন্দ্রীভূত হওয়ায় এবং শাসক ও রাষ্ট্র জিহাদের মাধ্যমে এই ধর্মের বিস্তার অথবা সংরক্ষণ করায় ইসলামী সংস্কৃতি ও মানসে সেনাবাহিনীর যে মর্যাদা ও গুরুত্ব তার সঙ্গে তুলনীয় আর কোনো সমাজেরই সেনাবাহিনী হতে পারে না।
এটা ঠিক যে ইংরেজের দুই শত বৎসরের শাসন প্রথাগত ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্রের বিন্যাসটাকে এখানে অনেক বদলে দিয়েছে। বিদায় নেবার সময় ইংরেজ সেনাবাহিনীর নিকট নয় বরং একটি নির্বাচিত রাজনৈতিক নেতৃত্বের নিকট শাসন ক্ষমতা হস্তান্তর করে উপমহাদেশ ত্যাগ করে। ইংরেজ শাসনে গড়ে ওঠা নূতন ধরনের অর্থনীতি, রাজনীতি, রাষ্ট্র ও শ্রেণী বিন্যাস নিশ্চয় পরিস্থিতি আর এমন রাখে নি যে, মধ্য যুগের মতো করে সেনাবাহিনী তার ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও সামাজিক ভূমিকা পালন করবে। তথাপি পশ্চাৎপদ ইসলামী জন-মানসে সেনাবাহিনীর যে ঐতিহাসিক গুরুত্ব ও মর্যাদা রয়ে গেছে তার সুযোগ নিয়ে এ দেশে বারবার সেনাবাহিনী রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করে জন-সমাজের নিজস্ব গণতান্ত্রিক ভূমিকা পালনের সুযোগকে বিনষ্ট করেছে আর এইভাবে এ দেশে জন-সমাজের আত্মমর্যাদাবান, গণতান্ত্রিক ও উন্নয়নকামী চেতনার বিকাশকে বার বার বিপর্যস্ত করেছে।
এ দেশে সামরিক একনায়কী শাসনের অধীনে যে নির্বাচনমূলক রাজনৈতিক শাসনের রূপটা গড়ে উঠেছিল তা সামরিক স্বৈরতন্ত্রের বৈশিষ্ট্যকে ধারণ করেছিল প্রবলভাবে। সামরিক শাসনের দীর্ঘ বিরতির ফলে যখন সমাজ ও রাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক শক্তি ও চেতনার বিস্তার ঘটতে শুরু করে তখন পুনরায় সামরিক স্বৈরতন্ত্রের হস্তক্ষেপ ঘটে। এইভাবে পুনরায় প্রথম থেকে শুরু করতে হয়। এ হল গণতন্ত্রের শিক্ষানবিশীর নামে সামরিক স্বৈরতন্ত্রের এক নিপুণ খেলা। এ এক অন্তহীন চক্র। এই অশুভ চক্রকে ধ্বংস করার জন্য এমন একটা কর্মসূচীর দরকার ছিল যা এ দেশে সামরিক শাসনের অধীনে নির্বাচনী প্রহসনের বৈধতাকে চিরকালের জন্য বিনষ্ট করবে আর এইভাবে ঐতিহাসিকভাবে জন-মানসের ভিতরে গড়ে ওঠা সেনাবাহিনী ও সামরিক স্বৈরতন্ত্রের মর্যাদাটাকে ধ্বংস করে দিবে। বেসামরিক তত্ত্বাবধায়ক সরকার আন্দোলন সেই কাজটা করেছে। এবং এইভাবে জনগণের গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষা ও চেতনাকে নূতন মাত্রা ও গতিবেগ দিয়েছে।
ছাত্রদের আন্দোলনকে পুঁজি করে খালেদা এই গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষা ও চেতনাকে প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ পান। ফলে তাঁর সংগঠন লীগের চেয়ে বহু গুণে দুর্বল হওয়া সত্ত্বেও ’৯১-এর নির্বাচনে জয়লাভ করে ক্ষমতায় আসীন হয়। কিন্তু বিএনপি জেনারেল জিয়ার যে সামরিক উত্তরাধিকার বহন করে এবং যে রাজনীতি ধারণ করে তাতে ক্ষমতায় গিয়ে তার পক্ষে জনগণের কোনো প্রত্যাশা পূরণ করা সম্ভব ছিল না। অন্যদিকে জনগণের দীর্ঘ গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যে বিরাট প্রত্যাশা গড়ে উঠেছিল তা তার পক্ষে এই রাষ্ট্র কাঠামোর ভিতরে থেকে পূরণ করাও সম্ভব ছিল না। ফলে খালেদার শাসন ব্যর্থতা, বিশ্বাসঘাতকতা, দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের কালিমা লিপ্ত।
বস্তুত এই পরিস্থিতির সুযোগ গ্রহণ করে আওয়ামী লীগ। মাগুরার উপনির্বাচনে বিএনপি-এর কারচুপি ও সন্ত্রাস তাকে সুযোগ এনে দিল বিএনপি-এর প্রতি জনগণের আশাভঙ্গ জনিত হতাশা ও ঘৃণাকে কাজে লাগিয়ে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবীতে নূতন করে আন্দোলন গড়ে তোলার।
আমার ধারণা এবারের নির্দলীয়-নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার আন্দোলন ছিল পূর্বের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আন্দোলনের তুলনায় একটি পশ্চাৎপদ ও প্রতিক্রিয়াশীল আন্দোলন। কারণ যেভাবেই দেখা যাক রাজনীতির বিকল্প বেসামরিক আমলাতন্ত্র এবং অরাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হতে পারে না। ১৯৮৬-এর সংসদ নির্বাচনে লীগ সামরিক একনায়ক জেনারেল এরশাদের অধীনে নির্বাচনে গেল। অথচ বিএনপি-এর শাসনকালে প্রায় আড়াই বৎসর লাগাতার আন্দোলন করল একটা রাজনৈতিক সরকারের পরিবর্তে অরাজনৈতিক সরকারের অধীনে নির্বাচনের জন্য। এটি কিন্তু শেষ পর্যন্ত লীগ রাজনীতির পক্ষেও যাবে না। কারণ এতে নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থার ভাবমূর্তি ও শক্তি নিদারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে যার সুযোগ পেয়েছে এবং আরো পাবে বেসামরিক আমলাতন্ত্র এবং জনসমাজ বিরোধী শক্তি। এখানে পাঠকের অবগতির জন্য বলি যে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে বেসামরিক এবং নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারণাটা প্রথম আমি প্রবর্তন করি। ১৯৮২-এর ২৪ মার্চ জেনারেল এরশাদ কর্তৃক সামরিক অভ্যুথান ঘটিয়ে বিএনপি-এর নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তারকে ক্ষমতাচ্যুত করে ক্ষমতা দখলের পর আমি কয়েক দিনের মধ্যে অর্থাৎ মার্চের শেষাশেষি প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে বেসামরিক অন্তর্বর্তী সরকারের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর এবং এই সরকারের অধীনে নির্বাচনের মাধ্যমে পুনরায় একটি রাজনৈতিক সরকার প্রতিষ্ঠার কর্মসূচীর প্রাথমিক খসড়া তৈরী করি। আমার মনে হয়েছিল সামরিক শাসক এরশাদ পূর্ববর্তী সামরিক শাসকদের ন্যায় পুনরায় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার যে প্রহসন করবে সেটার পথ বন্ধ করার জন্য এই ধরনের কর্মসূচী কার্যকর হবে। অর্থাৎ এ দেশে সেনাবাহিনী কর্তৃক রাজনীতিতে বারবার হস্তক্ষেপের চির পুরাতন খেলাটা বন্ধ করা ছিল আমার উদ্দেশ্য।
এ বিষয়ে আমি দীর্ঘ আলোচনা করব না। খুব সংক্ষেপে বলি যে, সামরিক শাসক এরশাদ যাতে নিজের সরকারকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার হিসাবে ঘোষণার সুযোগ না পায় এবং বেসামরিক তত্ত্বাবধায় সরকার হিসাবে যে সরকার আসবে তা যাতে কোনোক্রমেই নিজ শাসনকে দীর্ঘস্থায়ী করতে না পারে সেই উদ্দেশ্যে আমি প্রথমে ‘বেসামরিক অন্তর্বর্তী সরকার’ নামকরণ করি। এবং সামরিক আমলাতন্ত্রকে প্রধান প্রতিপক্ষ হিসাবে চিন্তা করে বেসামরিক আমলাতন্ত্রকে তার বিরুদ্ধে ব্যবহারের প্রয়োজন বোধ থেকে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে বেসামরিক অন্তর্বর্তী সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নিই। অর্থাৎ রাজনীতির শক্তিকে মুক্ত করার জন্য সামরিক ও বেসামরিক আমলাতন্ত্রের মধ্যকার ঐক্য বিনষ্ট করা ছিল আমার একটা উদ্দেশ্য। ১৯৮২-এর এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ থেকেই আমি এই কর্মসূচী নিয়ে কাজ শুরু করি।
রাজনৈতিক বিচারে আমি তখন একজন ব্যক্তি মাত্র। সুতরাং বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন ছাত্র নেতা-কর্মী, বুদ্ধিজীবী এবং রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে নিয়ে এই কর্মসূচীর ভিত্তিতে আন্দোলন সংগঠিত করার কাজ চালাই। প্রথম পর্যায়ে যাঁদের সহযোগিতা পাই তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন নঈম জাহাঙ্গীর (এরশাদের ক্ষমতা দখলের পর গ্রেফতারী পরোয়ানা থাকায় আত্মগোপন করতে বাধ্য হন এবং পরে কারারুদ্ধ হন। বর্তমানে ঐক্য প্রক্রিয়া নামে রাজনৈতিক দলের প্রধান নেতা এবং বাম গণতান্ত্রিক ফন্সন্টের অন্যতম নেতা), আমানুল্লাহ কবীর (সাংবাদিক নেতা, তখন ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন), আলাউদ্দিন আহমদ (পূর্বতন পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির নেতা। সেই সময় মোহাম্মদ তোয়াহা নেতৃত্বাধীন সাম্যবাদী দলের অন্যতম নেতা ছিলেন), আবদুল মতিন (পূর্বতন পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির সম্পাদক। বর্তমানে ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা এবং জাতীয় কৃষক সমিতির সভাপতি) এবং আবুল বাশার (পূর্বতন পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও নেতা। শ্রমিক নেতা। বর্তমানে ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা)। অবশ্য যোগাযোগ ও আলোচনা, কর্মসূচী বিতরণ ইত্যাদি বিএনপি, আওয়ামী লীগসহ (জামাতের মতো চরম প্রতিক্রিয়াশীল দল বাদে) প্রায় সকল উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক দল, নেতা এবং ছাত্র সংগঠন নেতাদের মধ্যে করি। বিশেষত ছাত্র নেতা-কর্মীদের মধ্যে এই চিন্তা বিস্তারের উপর সর্বাধিক গুরুত্ব দিই। এই নূতন ধারণা বিস্তারের জন্য ১৯৮২ থেকে ১৯৮৬ পর্যন্ত সময়ের এক বিরাট অংশ জুড়ে আমাকে নিদারুণ শ্রম করতে হয়।
একটা সম্পূর্ণ নূতন ধারণা বা ‘কনসেপ্ট’ এত সহজে এ দেশের রাজনীতিতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে? বিনা শ্রমে কিছু হয়? আর ধারণার পিছনে তত্ত্বগত উপলব্ধি না থাকলে সেটা কেউ বেশী দিন ধরে রাখতে পারে? না, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ধারণা ওয়ার্ল্ড ব্যাংক বা বিদেশী কনসালটেন্সির ফসল নয়। যাঁরা সকল ধারণা ও তত্ত্বের জন্য বিদেশের দিকে তাকিয়ে থাকেন তাঁরা নিজ সমাজে বিদেশের স্বার্থ ও নিয়ন্ত্রণকে প্রতিষ্ঠা বা রক্ষা করেন মাত্র। সহজে সবকিছু পেতে চেয়ে তাঁরা দেশ ও জাতিকে রসাতলে পাঠাবার ব্যবস্থা করেন। অবশ্য এদের একটা অংশ তার বিনিময়ে সমাজের সর-মাখন অনায়াসে বা স্বল্পায়াসে আত্মসাতের ব্যবস্থাটা পাকাপোক্ত করে। এখন পর্যন্ত তাদেরই আধিপত্য চলছে। তবে আশা করি তাদের দিন শেষ হয়ে আসছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার আন্দোলন এ জাতির মানস জগতের অভ্যন্তরে এমন একটি পুনর্বিন্যাস ঘটিয়েছে এবং এমন একটি বড় রকম ভাঙচুর ঘটিয়েছে যা এ দেশে গণ-বিপ্লবের শক্তিকে বিজয়ের জন্য প্রস্তুত করছে এমনটা অনুমান করি।
এ প্রসঙ্গে আমাকে বলতে হবে যে, এই বিশেষ লগ্নটিতে আলাউদ্দিন আহমদ এক ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেন। কারণ চিন্তা এবং কাজের ক্ষেত্রে আমার যে ভূমিকাই থাকুক আলাউদ্দিন আহমদ যদি তাঁর রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠা দিয়ে সেই সময় আমাকে সহায়তা না দিতেন তবে আমার পক্ষে সম্ভবত ঐ চিন্তাকে রাজনৈতিক মহলের ভিতর অতটা এগিয়ে নেওয়া সম্ভব হত না। অতীতের জন্য তাঁর প্রতি আমার যত কঠোর সমালোচনাই থাকুক আমি মনে করি তাঁর ঐ সময়ের ভূমিকা দ্বারা তিনি এ দেশের রাজনীতিকে সামরিক আধিপত্যের রাহুগ্রাস মুক্ত করার ক্ষেত্রে অমূল্য অবদান রেখেছিলেন। এবং এই ভূমিকা পালন করে তিনি অতীতের ভুলের দায় থেকেও নিজেকে বিরাটভাবে মুক্ত করেছেন। আরও বহু ব্যক্তির মধ্যে আমি আমানুল্লাহ কবীরের ভূমিকাও এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করা দরকার বলে মনে করি। কারণ ’৮২-এর এপ্রিল মাস থেকে সূচিত বেসামরিক অন্তর্বর্তী সরকারের পূর্ণাঙ্গ কর্মসূচী তৈরী ও তার ভিত্তিতে আলোচনার প্রক্রিয়া তাঁর অংশগ্রহণে পূর্ণতা পায় এবং প্রথম দিকে বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও বুদ্ধিজীবী প্রতিনিধিদের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় তাঁর বাসায়। সামরিক শাসন প্রতিষ্ঠার পর পরই সেটা সেই সময় ছিল ঝুঁকিপূর্ণ।
যাইহোক, এই কর্মসূচী পরবর্তী কালে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার কর্মসূচী নাম পায়। অবশ্য প্রথমে ছাত্রদের দ্বারা বেসামরিক অন্তর্বর্তী সরকারের দাবী প্রকাশ্যে উথাপিত হবার পর বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতৃত্ব ক্রমে এটিকে গ্রহণ করে এবং পরবর্তী কালে এর নাম দেয় নির্দলীয়, নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার। এবং অবশেষে ১৯৯০-এর ডিসেম্বরে গণ-অভ্যুথানে এরশাদের পতন হলে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের নেতৃত্বে গঠিত বেসামরিক এবং নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর হয় এবং ১৯৯১-এ এই সরকারের অধীনে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
এটা এখানে বলা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, পরবর্তী কালে আমার উপলব্ধি হয় যে, শুধু প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারণা না দিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধিদের নেতৃত্বেও ঐ সরকার গঠনের পথটা খোলা রাখা উচিত ছিল। বাস্তবে হয়তো প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠিত হত, যেমনটা
হয়েছিল। কিন্তু অন্তত একটা বিকল্প রাজনৈতিক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার পথটা খোলা রাখা উচিত ছিল। কর্মসূচীতে বিকল্পটা রাখলে বিকল্প রাজনৈতিক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার চেতনাটা অন্তত আন্দোলনের ভিতর দিয়ে বিকশিত হওয়ার স্থান বা ‘স্পেস’ পেত। আর এটা একটা সমস্যা যে, সমাজে যে কোনো ধারার সূচনা লগ্নে যে চিন্তাটা প্রথমে প্রাধান্য পায় সাধারণত সেটা পরবর্তী সময়ে নির্ধারক শক্তিতে পরিণত হয়। অর্থাৎ আমার ভুলটা হল এইখানে যে, আমি রাজনৈতিক আন্দোলনের মাধ্যমে শুধু সামরিক আমলাতন্ত্রের সঙ্গে বেসামরিক আমলাতন্ত্রের দ্বন্দ্ব সৃষ্টি ও বৃদ্ধি করে সমাজের ভিতর থেকে স্বাধীন ও নূতন রাজনৈতিক শক্তির উথানের স্থানটা তৈরী করতে চেয়েছিলাম। আমার এটা বোঝা উচিত ছিল যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার আন্দোলনের ভিতর প্রথমেই যদি রাজনৈতিক শক্তির নেতৃত্বের বিকল্প জায়গাটা রাখা না যায় তবে সেটা পরে আর হয় না। আন্দোলন একবার অভিমুখ পেয়ে গেলে লক্ষ্যে পৌঁছবার পূর্বে আর সহজে দিক পরিবর্তন করতে পারে না। ফলে একটা দীর্ঘ রাজনৈতিক আন্দোলন হল সামরিক সরকারকে একটা রাজনৈতিক সরকার দ্বারা স্থানচ্যুত করার পরিবর্তে একটা অরাজনৈতিক ও বেসামরিক আমলাতান্ত্রিক সরকার দ্বারা স্থানচ্যুত করার জন্য। যদিও রাজনৈতিক দলগুলো তত্ত্বাবধায়ক সরকার কার নেতৃত্বে গঠিত হবে সেটা প্রথমে বলে নি তবু নির্দলীয়, নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার দাবীর স্বাভাবিক পরিণতিতে একজন রাজনৈতিক ব্যক্তির পরিবর্তে একজন বেসামরিক আমলার নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হল।
তবু সেই সময় সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে জনসমাজের শক্তি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তার একটা ঐতিহাসিক ভূমিকা ছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকার আন্দোলন এ দেশে সামরিক স্বৈরতন্ত্র, সেনাবাহিনীর অভিভাবক সুলভ আচরণ এবং তার প্রতি সমাজের মর্যাদা ও ভীতিপূর্ণ আনুগত্যকে মারাত্মক আঘাত হেনেছে। এর একটা ফল হল ক্ষমতাচ্যুত সামরিক শাসক এরশাদের কারাগারে স্থান লাভ। কারারুদ্ধ জেনারেল এরশাদ জনসমাজের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে চাওয়া সকল সামরিক দম্ভ ও ঔদ্ধত্যের পরিণতির দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করছে।
কিন্তু আওয়ামী লীগ করেছে ভুলটা এমন এক সময় যখন খালেদার শাসনকে সামরিক বা আধা সামরিক শাসন বলা যায় না, যদিও সামরিক শাসনের একটা ঐতিহ্য বা উত্তরাধিকার বিএনপি-তে রয়েছে। কিন্তু সেটা অবশ্যই তার প্রধান দিক নয়।
আওয়ামী লীগ হঠাৎ করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের এত মহিমা খালেদার শাসনামলে বুঝল। কিন্তু জেনারেল এরশাদের শাসনামলে তার বুঝতে দেরী হল। ১৯৮৬-এর নির্বাচনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আন্দোলনের প্রতি সকল অঙ্গীকার ভঙ্গ করে আওয়ামী লীগ একটা সামরিক স্বৈরাচারের অধীনে নির্বাচনে গেল। বস্তুত ঐ নির্বাচনের পূর্বে আওয়ামী লীগ হঠাৎ ঐভাবে ডিগবাজী না দিলে এরশাদ সরকারের পতন হয়তো অনেক আগেই হত। ’৯০ পর্যন্ত হয়তো অপেক্ষা করতে হত না। এর দায়টা কে নিবে? একটা তিক্ত অভিজ্ঞতা এবং গণবিচ্ছিন্নতা অনুভব করেই তা ১৯৮৮-এর নির্বাচনে আর ভুলটা করল না। কিন্তু নির্দলীয়, নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের তাৎপর্য না বুঝে সেই ফর্মুলাটা প্রয়োগ করল একটা রাজনৈতিক শাসনামলে এসে। বড্ড দেরীতে এবং বড্ড ভুল জায়গায়। এটা হচ্ছে চৈত্র মাসের ‘মসলা’ পৌষ মাসে বলার মতো।
গল্পটা অনেকে হয়তো জানেন। আবার অনেকে হয়তো জানেন না। এই রকম একটা গুরু গম্ভীর আলোচনার মাঝখানে এই গল্প হয়তো অনেকের ধৈর্যচ্যুতি ঘটাবে। তবু আওয়ামী লীগের এই আন্দোলন প্রসঙ্গ আমার এই গল্পের উপমা খুব বেশী মনে হয়। সেই জন্য উপমাটা উল্লেখ করলাম। কিন্তু গল্পটা না জানলে যেমন পাঠক এর রসাস্বাদন করতে পারবেন না তেমন এই উপমার তাৎপর্যও হৃদয়ঙ্গম করতে পারবেন না। সুতরাং সংক্ষেপে গল্পটা বলিই।
এক মৌলবী এক গ্রামে ওয়াজ (ইসলাম ধর্মীয় সভায় বক্তৃতা) করতে গেছেন। সঙ্গে তাঁর এক শিষ্য ছোট মৌলবী। ওয়াজে মৌলবী সাহেব বললেন যে, মেয়েমানুষের কাপড় পুরুষ মানুষের গায়ে দেওয়া হারাম। অর্থাৎ নিষিদ্ধ বা পাপ কাজ। সুতরাং শাড়ী দিয়ে তৈরী কাঁথা গায়ে দেওয়াও পাপ। সময়টা ছিল চৈত্র মাস।
এরপর একদিন বড় মৌলবী আর এক গ্রামের ওয়াজ অনুষ্ঠানে নিজে যেতে না পারায় তাঁর শিষ্যকে আমন্ত্রণ রক্ষার জন্য সেখানে যেতে বললেন। সেখানে শিষ্য মৌলবী তার গুরুর সেই মস্লাটা বলল। তবে মাসটা ছিল পৌষ। এখন সেকালের গ্রাম। তারপর সাধারণ কৃষকদের গ্রাম। লেপ, কম্বল পাবে কোথায়? সবাই শুধু পুরাতন ও ব্যবহারের অযোগ্য শাড়ী দিয়ে কিংবা পুরাতন শাড়ী-লুঙ্গি জোড়া দিয়ে বানানো কাঁথা গায়ে দিয়ে রাত্রে শীত নিবারণ করে। এখন ঐ মস্লা শোনার পর আর ছোট মৌলবীকে কাঁথা দিবে কে? নিজেরা না হয় বাধ্য হয়ে পাপ করে। তাই বলে মৌলবী সাহেবকে কাঁথা দেবার স্পর্ধা করবে? সুতরাং ছোট মৌলবী সারা রাত শীতের ঠেলায় কাঁপতে কাঁপতে বসে কাটাল।
এই দুর্গতির কথা বড় মৌলবীকে বলতে তিনি অট্টহাসি হাসলেন, তারপর বললেন, ‘আরে আহাম্মক! আমি যেটা বলেছিলাম সেটা তো চৈত্র মাসের মস্লা। তুই চৈত্র মাসের মস্লা পৌষ মাসে দিলে কষ্ট তো পেতেই হবে।’ হাঁ, আওয়ামী লীগের এই ভূমিকা মনে হলে আমার ঐ গল্পই মনে হয়। না, এটা একটা গল্পের উপমা মাত্র। আর এই দু’টো জিনিস আদৌ এক নয়। তবু এই রকম একটা তাৎপর্য আমি দেখতে পাই আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আন্দোলনের মধ্যে।
আওয়ামী লীগ এবার সামরিক আমলাদের পরিবর্তে বেসামরিক আমলাদেরকে এ দেশের রাজনীতির অভিভাবক করার কাজটাকে সংবিধানেরও অন্তর্ভুক্ত করার ব্যবস্থা করে দিল। ১৯৯০-এ এরশাদের পতনের ফলে সামরিক আধিপত্যের এবং সেই সঙ্গে রাজনীতিতে সামরিক অভিভাবকত্বের অবসান হল। কিন্তু ১৯৯৬-তে সংবিধান সংশোধনের ফলে তার পরিবর্তে রাজনীতির অভিভাবক হল বেসামরিক আমলারা। প্রধান বিচারপতিও তো একজন বেসামরিক আমলা। ১৯৯০-এর ঘটনাটার প্রেক্ষিত ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। সামরিক নিয়ন্ত্রণের তুলনায় সেটা ছিল এক বিরাট অগ্রগমন। কিন্তু বেসামরিক আমলাতন্ত্রের অভিভাবকত্বে একবার রাজনৈতিক শাসন প্রতিষ্ঠার পর পুনরায় বেসামরিক আমলাতন্ত্রকে এ দেশের রাজনীতির অভিভাবক করাটা হল রাজনীতির পশ্চাদগমন।
এবারকার বিএনপি-এর স্বৈরশাসনের প্রধান ভিত্তি কি ছিল? সেটা কি বেসামরিক আমলাতন্ত্র নয়? পুলিশ কি? প্রশাসন কি? প্রকৃতপক্ষে বিএনপি-এর কিছু সংখ্যক মন্ত্রী ও নেতা বেসামরিক আমলাতন্ত্রের সঙ্গে জোট বেঁধে যা কিছু করার করেছে। বিএনপি-এর যে সাংগঠনিক দুর্বলতা ছিল তা পূরণ করেছে বেসামরিক আমলাতন্ত্র দিয়ে। শুধু কিছু বেসামরিক আমলা বদলালে হল? যে ব্যবস্থাটা বিএনপি-এর দুষ্কৃতির সহযোগী এমন একদল লোক তৈরী করে দেয় সেই ব্যবস্থা ঠিক রেখে আওয়ামী লীগ করবে ভিন্ন কিছু? বস্তুত এ দেশে সুস্থ রাজনীতির বিকাশের পথে প্রধান কাঠামোগত বাধা হচ্ছে আমলাতন্ত্র, সেটা সামরিকও হতে পারে বেসামরিকও হতে পারে। বেসামরিক আমলাতন্ত্রের অধীনে গণতন্ত্রের শিক্ষানবিশীর ব্যবস্থাটা তো ইংরেজ শাসকরাই এ দেশে প্রথম চালু করে। সেটা গত শতাব্দীর ’৮০-এর দশকে। একশত বৎসরেরও বেশী সময় পার হয়ে গেল। ওটা আর সাবালক হল না। ঐ চির অবোধ গণতন্ত্র-শিশু আসলে প্রতিবন্ধী। যে শক্তি নিজে আমলাতান্ত্রিক ফলে স্বৈরতান্ত্রিক সে গড়বে গণতন্ত্র! যে মর্যাদাটা এ দেশে অন্তত কোনো আন্দোলন দিয়ে বেসামরিক আমলাতন্ত্রকে এভাবে দেওয়া হয় নি সেটা এবার লীগ-আন্দোলন দিয়ে করা হল। প্রতি পাঁচ বৎসর অন্তর একবার করে প্রতিবন্ধী রাজনৈতিক গণতন্ত্র-শিশুর মেডিক্যাল চেক আপ সারবে অরাজনৈতিক বেসামরিক আমলাতন্ত্র-ডাক্তার। নির্দল ঠিক করবে দল কোন নিয়মে চলবে। একটা অধিকতর প্রতিনিধিত্বমূলক জাতীয় রাজনৈতিক সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন না করে এবং নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করার কাজটা বাদ দিয়ে লেগে পড়া হল সরকারের রাজনৈতিক ধারাবাহিকতা বিনষ্ট করার জন্য। সেটা করা হলও। এভাবে রাজনীতিকরাই রাজনীতির মর্যাদা নষ্ট করল।
আসলে আওয়ামী লীগ বেসামরিক আমলাতন্ত্রের কাছে নিজেকে বিএনপি-এর তুলনায়ও বেশী প্রিয় করতে চেয়েছে। আর এই আমলাতন্ত্রই তো লীগের আন্দোলনের বিজয়কে সহজতর করেছে। অবশ্য এর একটা সুফল কুফল যা-ই বলা যাক আছে। এর ফলাফলটা যখন জনসমাজ উপলব্ধি করবে তখন গণতান্ত্রিক শক্তির উপর লীগ তার নিয়ন্ত্রণ হারাবে। অবশ্য বেসামরিক আমলাতন্ত্রের সাহায্য নিয়েই এখন লীগ সরকার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার শক্তি বৃদ্ধির জন্য প্রশাসন থেকে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ এবং স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা গড়ে তোলার আইন প্রণয়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। সেটা হলেও কম লাভ নয়। তবে দেখা যাক শেষ পর্যন্ত কি হয়।
আমার ধারণা আওয়ামী লীগ যদি সংসদের ভিতরে ও বাইরে থেকে বিএনপি-এর দু:শাসনের বিরুদ্ধে এবং একটি জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠার দাবীতে আন্দোলন গড়ে তুলত তবে তার ফল লীগের পক্ষেই যেত। ১৯৯৬-এর ১৫ ফেব্রুয়ারী বিএনপি-এর একদলীয় প্রহসনের নির্বাচনে প্রমাণিত হয়েছে যে, বিএনপি কতখানি গণ-বিচ্ছিন্ন হয়েছিল। এবং প্রধান বিচারপতি হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ১৯৯৬-এর ১২ জুন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয় পুনরায় সেটা প্রমাণ করে। ওটা লীগ নেতৃত্বে পরিচালিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আন্দোলনের ফল এটা আমি মনে করি না। বরং তত্ত্বাবধায়ক সরকার আন্দোলনের সাফল্য ছিল জনমনে বিএনপি-এর স্বৈরশাসন ও ব্যর্থতার বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়ার ফল। একটা রাজনৈতিক সরকারের বিরুদ্ধে এই ধরনের একটা অরাজনৈতিক সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন করতে গিয়ে আওয়ামী লীগ জাতীয় পার্টি ও জামাতে ইসলামীর সঙ্গেও ঐক্য করতে বাধ্য হয়। এরও একটা চড়া দাম আছে বৈকি! সব মিলিয়ে এই ধরনের একটা দূরদর্শিতাহীন
আন্দোলনের মূল্য লীগকে দিতে হবে এটা আমার উপলব্ধি। সেটা কখন কিভাবে তাকে দিতে হবে তা সময় এলেই বোঝা যাবে।
এটা খুব লক্ষণীয় যে, বিগত আন্দোলনের তুঙ্গ মুহূর্তেও ব্যাপক ছাত্র সম্প্রদায় বিএনপি-এর ছাত্র দলেই ছিল। এ দেশে এই প্রথম এমন এক আন্দোলন হল যাতে সরকারের পতন বা পরাজয় যা-ই বলা যাক হল অথচ তাতে ছাত্রদের অংশগ্রহণ ছিল খুব সীমিত। এটা কিন্তু অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা।
এর অর্থ হল বিগত আন্দোলনে ছাত্রদের ব্যাপকতর অংশ যেমন লীগকে সমর্থন দেয় নি তেমন বিএনপি-কেও দেয় নি। বিএনপি কি তার ছাত্র সংগঠনকে লীগ-জাপা-জামাত মৈত্রীর আন্দোলনের বিরুদ্ধে নামাতে পারত না? সেটা হত বিএনপি-এর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। এটা এমন এক শক্তিকে মুক্ত করতে পারত যেটা বিএনপি-এর বিরুদ্ধেই দাঁড়িয়ে যেতে পারত। রাজনীতি ছাড়া ব্যাপক ছাত্ররা কেন অরাজনৈতিক তত্ত্বাবধায়ক সরকার দাবীর বিরুদ্ধে অবস্থান নিবে? সেই রাজনীতি দেওয়া সম্ভব ছিল না বলে খালেদা তাঁর ছাত্র-যুব শক্তিকে মাঠে না নামিয়ে বরং পরাজয়টাকেই মেনে নিয়েছেন।
এ দেশের ইতিহাসে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি একটিই ইতিবাচক ভূমিকা পালন করেছে সেটা হল এরশাদের সামরিক শাসনকে বৈধতা অর্জন করতে না দেওয়া। অবশ্য এটা এক নেতিবাচক কাজের ইতিবাচক ফল। তার সেই ভূমিকা শেষ করার পর বাকীটা ছিল তার বাড়তি সময়। এবং ১৯৯৬-এ তার সরকারের পতন ও নির্বাচনে পরাজয়ের সঙ্গে তার ভূমিকা এ দেশের রাজনীতিতে শেষ হবার পথে পা বাড়িয়েছে। জানি না বাকীটা কিভাবে শেষ হবে।
এটা তাৎপর্যপূর্ণ যে, প্রধান বিচারপতি হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ১৯৯৬-এর ১২ জুন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সাফল্য খুব সীমিত। শেষ পর্যায়ে সারা দেশব্যাপী তত্ত্বাবধায়ক সরকার দাবীতে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ার পরেও ১২ জুন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মাত্র ৩৭% ভোট লাভে সমর্থ হয়। অর্থাৎ ভোট প্রদানকারীদের বাকী ৬৩% রয়ে গেছে লীগের বিরুদ্ধে। এবং এই ৩৭% এর সবটাই লীগ রাজনীতির সমর্থক এমন মনে করার কারণ নেই। জনগণের ব্যাপক অংশ যে পরিবর্তন কামনা করছিল তার ফলে লীগ-বিরোধী ভোটারদের এক বড় অংশ এবার লীগকে ভোট দেয়। অন্যদিকে লীগের অতীত শাসনামলের স্মৃতি এবং বিগত নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আন্দোলনকালে লীগ কর্মী-সমর্থকদের ভাঙচুর ও সন্ত্রাসী কার্যকলাপও ভোটারদের এক উল্লেখযোগ্য অংশকে বিএনপি-এর দিকে ঠেলে দেয়। মনে রাখতে হবে এ দেশে বিএনপি-এর রাজনীতির উথানের সবচেয়ে বড় কারণ ১৯৭২-’৭৫ কালে লীগ শাসনের দুর্নীতি, সন্ত্রাস ও ব্যর্থতা।
তবে একুশ বছর পর ক্ষমতায় ফিরে এসে শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন লীগ সরকার বিগত চার মাস সময়ের ভিতর ক্রমেই জনমনে প্রত্যাশা জাগাচ্ছে। সন্ত্রাস ও দুর্নীতি রোধের প্রয়াস, আচরণে তুলনামূলক সংযম, সাম্প্রদায়িকতা বিরোধিতা, বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ ও মুক্তিযুদ্ধের ভাবপ্রেরণার প্রতি সমর্থন ইত্যাদি এ দেশের রাজনীতিতে লীগের মর্যাদাকে বৃদ্ধি করছে। তবে সবচেয়ে বড় কথা এর ফলে সমাজ অভ্যন্তরে পরিবর্তনের যে শক্তিগুলো এতদিন ধরে বেড়ে উঠছিল সেগুলো নূতন গতিবেগ লাভ করবে। এর এক বিরাট প্রভাব গিয়ে পড়বে ছাত্র-যুব শক্তির উপর। সঙ্গত কারণে এর ফল প্রবলভাবে অনুভূত হবে জাতীয়তাবাদী ছাত্র দলে যেখানে এখন পর্যন্ত এ দেশের ছাত্র-যুব শক্তির বৃহত্তর অংশটির অবস্থান রয়েছে।
এটা স্বাভাবিক যে, সমাজের সবচেয়ে স্পর্শকাতর, প্রবল, সংগঠিত ও অগ্রগামী শক্তি হিসাবে ছাত্র-যুব শক্তি এই পরিবর্তনের মুখে তার নিজ ভূমিকায় পুনরায় ফিরে যাবে। এটি সময়ের ব্যাপার মাত্র।
বিশেষত প্রধান মন্ত্রী হাসিনার সরকার ১৯৭৫-এ মুজিব ও তাঁর পরিবার এবং কারাগারে বন্দী চার নেতাসহ সকলের হত্যার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে যে মুহূর্তে পদক্ষেপ দিয়েছে, হত্যাকারীদের বন্দী করতে শুরু করেছে সেই মুহূর্ত থেকে দেশ নূতন মেরুকরণের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আবদুর রহমান বিশ্বাস কর্তৃক সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল নাসিমসহ কিছু সংখ্যক পদস্থ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ এবং তাঁদের বরখাস্ত করার ঘটনা যার ফলাফল সেনাবাহিনীর ভিতর নিদারুণ হয়েছে।
সব মিলিয়ে হাসিনা বাঘের পিঠে সওয়ার হয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার শক্তিসমূহের নবতর উত্থান, সামরিক ও বেসামরিক আমলাতন্ত্রের ভিতরকার দ্বন্দ্ব ও সঙ্কট, দেশের রাজনীতি ও ছাত্র আন্দোলনে নবতর মেরুকরণের অনিবার্যতা, সেকিউলার ও বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদী রাজনীতির পুনরুথানে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক শক্তির আতঙ্ক ও প্রতিক্রিয়া এবং এ দেশে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদী রাজনীতির পুনরুথানে দিল্লীর প্রতিক্রিয়া এই সমস্ত ঘটনা দেশকে দ্রুত মেরুকরণ ও সংঘাতের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। সমাজে এমনিতেই সঞ্চিত হয়ে আছে নিদারুণ ক্ষোভ ও অসন্তোষ। জনগণের ব্যাপক দারিদ্র্য এবং লক্ষ লক্ষ শিক্ষিত যুবকের বেকারত্ব একটা বিরাট বিস্ফোরণের শক্তি এমনিতে সৃষ্টি করে রেখেছে।
সুতরাং সামনে এগিয়ে আসছে এক বিরাট বিস্ফোরণ। এই বিস্ফোরণে দেশের সার্বভৌমত্ব নিদারুণভাবে খর্ব হতে পারে। দিল্লীর প্রয়োজন অনুযায়ী এ দেশে একটি দুর্বল ও নিয়ন্ত্রণযোগ্য ইসলামী সাম্প্রদায়িক সরকার প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। রাষ্ট্রটিকে পুরোপুরি ইসলামিকও ঘোষণা করা হতে পারে। ফলে বাইরে থাকবে তার দিল্লী ও হিন্দু বিরোধিতার আবরণ, যেটি প্রকৃতপক্ষে হবে পশ্চিম বাংলার জনগণের প্রতি বিরোধিতা। কিন্তু গোটা দেশ বাস্তবে পরিণত হবে ভারত-রাষ্ট্রের অবাধ বাজার ও তাঁবেদারে। অথবা প্রয়োজন বোধ করলে দিল্লী এখানে একাধিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা করে দিবে দেশটিকে বিভক্ত করে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণাধীন রাখার জন্য। না, এ দেশকে পুরোপুরি দখল করার প্রয়োজন তার নেই। বরং সেটা হবে এক উটকো ঝামেলা। প্রকৃতপক্ষে দিল্লীর জন্য প্রয়োজন এখানে নিয়ন্ত্রণযোগ্য একটা দুর্বল কিন্তু ইসলামী সাম্প্রদায়িকতাবাদী রাষ্ট্র ও সরকার যাতে করে এখানে অবাধ বাজার প্রতিষ্ঠা করা যায় অথচ এখানকার সাম্প্রদায়িকতার কারণে ভারত-রাষ্ট্রভুক্ত বাঙ্গালী জাতি মাথা তুলে দাঁড়াবার সুযোগ না পায়। অন্যদিকে দিল্লীর প্রয়োজন এই ভূখণ্ড ব্যবহার করে আসামসহ উত্তর পূর্বাঞ্চলে জাতীয় স্বাধীনতা যুদ্ধগুলোকে দমন করে সেখানে তার অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত ও সুদৃঢ় করা।
মোট কথা বাংলাদেশে একটি সামাজিক-রাজনৈতিক বিস্ফোরণ অনিবার্য। এই বিস্ফোরণের পরিণতিতে জাতি হিসাবে বাঙ্গালীর সম্ভাবনা বিনষ্ট হবে যদি এখানে বিপ্লব না হয়। একটি সমাজ ও রাষ্ট্র বিপ্লব এ দেশের জনগণ ও বাঙ্গালী জাতিকে রক্ষা করতে পারে একটি সম্ভাব্য ধ্বংস ও বিপর্যয়ের হাত থেকে।
বিপ্লবের কথা বললেই যেমন ভয় পাওয়ার কিছু নেই তেমন রাশিয়া, চীন, ভিয়েতনামের অভিজ্ঞতার আলোয় এটাকে দেখতে চাওয়ারও কারণ নেই।
এমন কি আমরা যদি মনে করি যে, ’৭১-এর অভিজ্ঞতার পুনরাবৃত্তি ঘটবে তাহলেও সেটা হবে ভুল। তার প্রেক্ষিতই ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। তখন ছিল এক বিদেশী-বিজাতীয় শাসক শ্রেণী। এক ভয়ঙ্কর বর্বর এবং দুর্ধর্ষ সমরশক্তি ও মনোবলের অধিকারী এক বিজাতীয় সেনাবাহিনী ছিল আমাদের শত্রু, যাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য প্রয়োজন ছিল সমগ্র জাতি ও জনগোষ্ঠীর সুদৃঢ় ঐক্য এবং সেই সঙ্গে কর্মপদ্ধতিও ছিল ভিন্ন।
এখন রাষ্ট্র ও সমাজের রূপ ও চরিত্র যেমন হোক আমাদের একটা নিজস্ব রাজনৈতিক ভূখণ্ড রয়েছে যেখানে দ্বন্দ্ব-সংঘাত মূলত নিজেদেরই ভিতর। এই জনগোষ্ঠীর সকল সবলতা, দুর্বলতা নিয়েই সকল পক্ষের অবস্থান। এখানে জয় হবে মূলত সেই পক্ষের যার মনোবল, নৈতিক বল, মেধা এবং জন-সমর্থন বেশী হবে। বিপ্লব তো সমাজের পশ্চাৎপদতা ও প্রতিক্রিয়ার শক্তির বিরুদ্ধে। আজকের যুগে যেখানে উন্নত চেতনা ও মেধার অগ্রযাত্রা অপ্রতিহত সেখানে পশ্চাৎপদতা ও প্রতিক্রিয়ার শক্তির জয়ের বাস্তবতা কতটুকু? সুতরাং বিপ্লবের জয় অনিবার্য। অবশ্য বিপ্লবের একটা পর্যায়ে প্রতিবিপ্লবের সপক্ষে বহি:শক্তির হস্তক্ষেপ ঘটতে পারে। কিন্তু বিপ্লবী সামাজিক শক্তির সংহতি ঘটলে এই হস্তক্ষেপকেও পরাস্ত ও চূর্ণ করা সম্ভব।
সমাজ বিপ্লব অবশ্যই বলপ্রয়োগের প্রয়োজন অস্বীকার করে না। যে সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা বলপ্রয়োগের মাধ্যমে সংগঠিত হয়েছে তাকে শুধু শান্তিপূর্ণভাবে পরিবর্তন করা সম্ভব এমন ধারণাটা প্রচার করতে পারে শুধুমাত্র প্রতারক, মতলববাজ কিংবা ভীরু, কাপুরুষ অথবা নির্বোধ। কিন্তু বলপ্রয়োগের ধরনটা নির্ভর করে প্রতিপক্ষ কিংবা প্রচলিত ব্যবস্থার সংরক্ষক শাসক বা কর্তৃত্বকারী শক্তিগুলোর ভূমিকার উপর। সুতরাং বিপ্লব তার বলপ্রয়োগের ব্যবস্থা গড়বে মূলত আত্মরক্ষার জন্য, পাল্টা বলপ্রয়োগের প্রয়োজনে। ধ্বংস, হত্যা, বলপ্রয়োগ কোনো বিপ্লবের মূল লক্ষ্য হতে পারে না। বরং এগুলোর প্রয়োজন যথাসাধ্য কমানোটাই তার লক্ষ্য হওয়া উচিত। মনে রাখতে হবে পৃথিবীটা অনেক বদলেছে। আমরা কম্পিউটার ও ইলেকট্রনিক প্রযুক্তির যুগে বাস করছি। আমাদের দেশও নিশ্চয় আড়াই শ’, দুইশ’, একশ’ এমন কি পঁচিশ বছর আগের পর্যায়েও আর নেই। সুতরাং যে কোনো বিপ্লব চিন্তায় আমাদের নূতন সামাজিক পরিস্থিতির কথা মনে রাখতে হবে।
আর আপাত দৃষ্টিতে যাদের বৈরী মনে হয় তারাও কি সব সময় বৈরী থাকে? এটাও অনেক সময় নির্ভর করে বিপ্লবী নেতৃত্বের ভূমিকা ও পরিচালনা যোগ্যতার উপর। অনেকেই প্রচলিত কাঠামোর ভিতর বাধ্য হয়ে যায়। কিংবা সেখানে থেকে প্রতিক্রিয়াশীল ভূমিকা পালন করে। কিন্তু উন্নত বিকল্প দেখতে পেলে নিজেদের ভূমিকা ও অবস্থান বদলাতে আকাঙ্ক্ষী হতে পারে।
আসলে মানুষের সকল সম্ভাবনার সর্বোচ্চ ব্যবহার প্রচেষ্টা বিপ্লবের প্রেরণার অন্তর্ভুক্ত থাকা উচিত। তাহলে দেখা যাবে বিপ্লব কত সহজসাধ্য হয়ে ওঠে। হাঁ, এর জন্য ধৈর্য, সহনশীলতা ও মানবিকতাকে সাহস, তেজ ও বুদ্ধির সঙ্গে সমন্বিত করতে পারতে হবে। প্রয়াস ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অর্জিত প্রতিটি অভিজ্ঞতাকে যথাযথভাবে বুঝতে পারতে হবে। আমার অভিজ্ঞতাও সে কথা বলে। আমি পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করতে গিয়ে আলাউদ্দিন আহমদের তিক্ত সমালোচনা করেছি। কিন্তু এই ব্যক্তিই কি আবার ’৮০-এর দশকের প্রথম দিকটায় এক বিরাট ভূমিকা পালন করেন নি? সামরিক শাসনের অধীন যে কোনো নির্বাচন প্রতিহত করার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এ দেশে গণতান্ত্রিক শক্তির যে এক বিস্ময়কর নূতন যাত্রা শুরু হয় এক ঐতিহাসিক ক্রান্তিলগ্নে সেই যাত্রার পথটা যাঁরা সচেতনভাবে ও বলিষ্ঠভাবে তৈরী করে দিয়েছেন তিনি কি তাঁদের একজন নন? আসলে সংগ্রামের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত মানুষকে ধ্বংস করা নয় বরং তার মনুষ্যত্বের শক্তির বিকাশ সাধন। মনুষ্যত্বের শত্রুর ক্ষমা নেই। কিন্তু আমরা কিভাবে বলব কার ভিতরে মনুষ্যত্ব আছে কিংবা নেই? এবং কোনটা মনুষ্যত্ব এবং কোনটা নয়? সেটাও সংগ্রাম ঠিক করে দেয়। ঘটনার ভিতর দিয়ে চিহ্নিত হয়। আর সেক্ষেত্রেও মনে রাখতে হবে নির্ভেজাল বা বিশুদ্ধ কোনো মানুষই নয়, কোনো সমাজ, রাষ্ট্র, শ্রেণী, জাতি কোনো কিছুই নয়। সুতরাং নিরঙ্কুশ গুণ বা দোষ কারো উপর আরোপের প্রয়োজন নেই। সংগ্রামের লক্ষ্য হওয়া উচিত মানবিক গুণের ক্রমবর্ধমান বিকাশ এবং দোষের ক্রমবর্ধমান সঙ্কোচন। আর সমালোচনা তো সংগ্রামেরই একটা ধরন বা রূপ মাত্র।
সকল মতান্ধতা ও বিপ্লব সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণার মোহ কাটিয়ে বুঝতে হবে আমাদের বিপ্লবের মূল কাজ হল একটি উন্নত, আধুনিক ও গণতান্ত্রিক সমাজ, রাষ্ট্র ও জাতি গঠন করা। সব শাসন-শোষণ উচ্ছেদের কমিউনিস্ট কল্পলোকে বিচরণ করে লাভ নেই। আমাদের প্রয়োজন শাসন ও শোষণের যে বর্বর, পশ্চাৎপদ ও স্বৈরতান্ত্রিক রূপ সমাজে রয়েছে তা থেকে সমাজকে মুক্ত করা। এরপর কি শাসন-শোষণ থাকবে না? সব শাসন অবসানের কল্পলোকের কল্পনার মতোই সব শোষণ অবসানের একটা কল্পস্বর্গীয় ধারণা মার্কসবাদ দিয়েছিল। ওটা থেকে আমাদের মুক্তি চাই । আসলে আমাদের প্রয়োজন এমন এক শাসন ও শোষণের রূপ প্রতিষ্ঠা যা হবে উন্নত জনগণের আত্মশাসন ও আত্মশোষণের রূপ মাত্র। শাসন তো নিয়ন্ত্রণের এক নাম। সেটা ছাড়া কি সমাজ থাকে না চলে? আর শোষণ তো সামাজিক উৎপন্নের উদ্বৃত্ত সঞ্চয়। এই উদ্বৃত্ত সঞ্চয় ছাড়া পুনরুৎপাদনের শক্তিটা কোথা থেকে আসবে? ওটা ব্যক্তি করলেই যত দোষ আর সমাজ বা রাষ্ট্রের নামে রাজনৈতিক ও আমলা শ্রেণী করলে দোষণীয় নয়? সমস্ত সভ্যতা প্রতিষ্ঠিত এই উদ্বৃত্ত সঞ্চয় ও তার পুনর্বিনিয়োগের উপর। আমাদের যেটা প্রয়োজনীয় সেটা হল এই সঞ্চয় এবং পুনর্বিনিয়োগের ফলটা যাতে জনগণের কাছে ফিরে আসে তার নিশ্চয়তা বিধান করা। এটা এক নিরন্তর সংগ্রামের প্রয়োজনকেই তুলে ধরে মাত্র। সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্র তথা জনগণের গণতন্ত্রের দায়িত্ব সেটা। এটা জনগণের আত্মশাসন প্রতিষ্ঠার ব্যাপার। সুতরাং আমাদের বিপ্লবের ধ্বনি হোক পরশাসনের অবসান চাই, আত্মশাসনের প্রতিষ্ঠা চাই। এটা চাই ব্যক্তির ক্ষেত্রে, রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে, সমাজের ক্ষেত্রে।
বস্তুত আত্মশাসন এক নিরন্তর শ্রম, প্রয়াস ও সংগ্রামের কাজ। এটা সমাজ ও রাষ্ট্রের কর্তৃত্বকারী শ্রেণী উপর জনগণের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা ও রক্ষার সংগ্রামকে যেমন বোঝায় তেমন প্রতিটি ব্যক্তির নিজের প্রবৃত্তির উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকেও বোঝায়। অর্থাৎ আমি এটাকে একই সঙ্গে রাজনৈতিক ও নৈতিক এক সংগ্রামের ধারণা হিসাবে উপস্থিত করতে চাই।
আর এই বিপ্লব প্রসঙ্গে আমি পুনরায় ভিন্ন সমাজ পরিস্থিতিতে উদ্ভূত ধারণা থেকে এ দেশের বিপ্লবপন্থীদের মুক্ত হতে বলব। আমি ইতিপূর্বে বলেছি আমাদের দেশে বিপ্লবের মূল শক্তি আধুনিকতার আলোকপ্রাপ্ত মধ্য শ্রেণী বা মধ্যবিত্ত, বিশেষত ছাত্র-যুব শক্তি। যত দিন পর্যন্ত এ দেশে এই শ্রেণীর তাৎপর্য বোঝা না যাবে ততদিন পর্যন্ত এ দেশে বিপ্লব এক সুদূর পরাহত কল্পনা হয়ে রইবে। আর এটা বুঝতে হলে আমাদের দেশের বাস্তব সমাজ পরিস্থিতিটা বুঝতে হবে। যাঁরা শ্রেণী সংগ্রামের ধারণার যান্ত্রিক প্রয়োগ করে এ দেশে এতকাল শ্রমিক-কৃষকের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক আন্দোলন করে এসেছেন এবং তাদেরকে দিয়ে এ দেশে সমাজ পরিবর্তনের অগ্রণী শক্তির ভূমিকা পালন করাতে চেয়েছেন তাঁরা যে এক অর্থে শুধু পণ্ডশ্রম করেছেন তা নয় উপরন্তু এ দেশে ঐ পদ্ধতিতে জনগণের জাগরণ ঘটাতে গিয়ে এক নিদারুণ প্রতিক্রিয়া ও প্রতিবিপ্লবের শক্তিকেও মুক্ত করেছেন। এর কারণ হল তাঁরা এ দেশে জন-মানসে প্রচলিত ধর্ম-সংস্কৃতির প্রভাব ও শক্তিটা বোঝেন নি এবং বোঝেন নি এই ধর্ম-সংস্কৃতির ভয়ঙ্কর ক্ষতিকর দিকটা। ফলে তারা সমাজের যে স্তর ও শ্রেণীগুলোর ভিতর ধর্ম-সংস্কৃতির প্রভাব ও শক্তি সবচেয়ে বেশী তাদের জাগাতে ও সচল করতে গিয়ে সমাজের সবচেয়ে পশ্চাৎপদ এবং সেই হেতু সবচেয়ে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলোকে মুক্ত করেছেন।
এই বিষয় আমাদের বুঝতে হবে যে, মুসলিম সমাজে উদারনৈতিক মানস যত উপরে যাওয়া যায় তত বেশী এবং যত নীচে যাওয়া যায় তত কম। অবশ্য আমি সাধারণ নিয়মটার কথাই বলছি। এর ফলে যে কোনো পরিবর্তন বিরোধী শক্তি সমাজের অবতলে সবচেয়ে প্রবল। কিন্তু একেবারে শীর্ষে যে শাসক শ্রেণী বা গোষ্ঠীটি অবস্থান করে তার উদারনৈতিকতা কোনো ব্যাপকতর রূপ পেতে পারে না জনগণের পশ্চাৎপদ ও প্রতিক্রিয়াশীল মানসকে ব্যবহার ক’রে ক্ষমতা রক্ষার প্রয়োজনের কারণে। এই কারণে মুসলিম সমাজে প্রগতি ও পরিবর্তনের প্রকৃত শক্তিটি অবস্থান করে মধ্যবর্তী অবস্থানে। অর্থাৎ মধ্যবিত্ত হল এই সমাজে প্রগতির সবচেয়ে বড় শক্তি। অন্তত তার মধ্যে প্রগতিশীলতার সম্ভাবনা ও উপাদানের উপস্থিতি সবচেয়ে বেশী যেটাকে সঠিকভাবে সংগঠিত করা বা রূপ দান করা সহজতর। বিশেষত আধুনিক শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রভাবে এই শ্রেণী থেকেই এ দেশে বিপ্লবের মূল কিংবা সূচনার শক্তির উদ্ভব সম্ভব হয়। আর কৃষক-শ্রমিক ? শ্রমের বিচারে তাদের ভূমিকা নিশ্চয় সবচেয়ে প্রগতিশীল ও গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু চেতনাকে বাদ দিয়ে শুধু শ্রমশীলতাকে দেখলেই হবে? তাহলে চাষের লাঙ্গল টানে যে গরু তারও শ্রমশীলতা দিয়েই সমাজে তার ভূমিকা বিচার করতে হয়। মানুষকে আমি গরুর সঙ্গে তুলনা করছি না। বরং এটুকু বলতে চাই মানুষের ভূমিকা গরুর তুলনায় অপরিমেয়ভাবে বেশী। সুতরাং তার ভূমিকাটা ভাল যেমন হতে পারে অপরিমেয়ভাবে তেমন একই রকমভাবে মন্দ ও ক্ষতিকরও হতে পারে।
এ দেশে গোলমালটা হয়েছে এই জায়গায়। বিশেষ ধর্ম-সংস্কৃতি মুসলিম মানসকে সুকুমার বৃত্তি, তুলনামূলক বিচার ক্ষমতা এবং সহিষ্ণুতা থেকে বঞ্চিত করেছে। তার মানস অবতলে যে সত্তাটি বাস করে তা হল লুণ্ঠনপরায়ণ, হিংস্র, সহিংস, ধর্ষক বেদুঈন। ইসলাম এটিকে যেমন নিয়ন্ত্রণের একটি পদ্ধতি দিয়েছে তেমন এটিকে সংরক্ষণও করেছে তার বিস্তার ও যুদ্ধাভিযানের প্রয়োজনে। প্রথমে হয়তো কিছু বোঝা যায় না। উপরে মারূদ্যান অথবা সভ্যতার একটা আবরণ থাকে। কিন্তু সেই আবরণ খসতে সময় নাও লাগতে পারে। আর তখন হঠাৎ ঘুর্ণিঝড়ের মতো ধ্বংস ও লুণ্ঠনের ভয়াল শক্তিটা বেরিয়ে এসে সবকিছু তছনছ করে দিতে পারে।
এটা সবার জন্য প্রযোজ্য নয়। শিক্ষা অথবা উন্নত সংস্কৃতির প্রভাব যেসব ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর উপর পড়ে তাদের অবস্থাটা ভিন্ন। সমাজতলে ধর্মাচ্ছন্ন ও সংস্কৃতি বঞ্চিত যে ব্যাপক জনগোষ্ঠী বাস করে তাদের দিয়েই সমস্যার উৎসটাকে বুঝতে হবে। বস্তুত দেড় হাজার বৎসর ধরে এমন এক বেদুঈন সংস্কৃতি ও মানস লালনের ঐতিহ্য বহমান যার স্বরূপ না বুঝে বিপ্লবের রণনীতি ও রণকৌশলগুলো গ্রহণের মর্মন্তুদ ফল দিতে হয়েছে বহু দেশের বিপ্লবীদেরকে। এটা তাৎপর্যপূর্ণ যে, এই সমাজের মূল আর্থ-রাজনৈতিক ক্ষমতা যে শ্রেণী বা গোষ্ঠীগুলোর হাতে থাকে তারা বরং জনগণের পশ্চাৎপদ ও অসহিষäু মানস থেকে তুলনামূলকভাবে মুক্ত থাকে। কারণ সমাজ-অর্থনীতি-রাষ্ট্র পরিচালনার অভিজ্ঞতা ও প্রয়োজন তাদের বাস্তব বুদ্ধিসম্পন্ন হতে বাধ্য করে। এই ক্ষমতাসীন শ্রেণীর মধ্যে ব্যক্তি মালিকানার অবস্থান সবচেয়ে শক্তিশালী বলে ব্যক্তিসত্তার অস্তিত্বও এখানে সবচেয়ে শক্তিশালী। এদের সহযোগী হিসাবে মোল্লা বা ধর্মীয় শ্রেণী সমাজ নিয়ন্ত্রণের ভাবাদর্শিক শক্তি হিসাবে ভূমিকা পালন করে। আর সমাজতলে অবস্থান করে প্রকৃত বিচারে বর্বর বেদুঈন যার ভাবাদর্শিক প্রতিনিধি মোল্লারা। এটা ঠিক যে সমাজ নিয়ন্ত্রণে শাসক ও মোল্লার ভিতর এক সুদৃঢ় ঐক্যের বন্ধন থাকে। কিন্তু এই বন্ধন শাসক শ্রেণীর ভিতর ব্যক্তিসত্তার জাগরণের শক্তিটিকে দমিত ক’রে তাকে পশ্চাৎপদ জন-মানসের প্রতিনিধিত্বকারী করে রাখে। এখন যে সব দেশে কমিউনিস্টরা প্রথমেই অর্থনৈতিক কাঠামোতে হাত দিয়ে বিশেষত ব্যক্তি মালিকানার উচ্চ ও মধ্যবর্তী স্তরকে ধ্বংস করতে গেছে সেখানে দু’টো ঘটনা ঘটিয়েছে। প্রথমত, সমাজতলের জনগণকে পুরোপুরি মোল্লা শ্রেণীর হাতে ছেড়ে দিয়েছে যা আরও পশ্চাৎপদ ও প্রতিক্রিয়াশীল। দ্বিতীয়ত, পুরাতন সামাজিক-অর্থনৈতিক কর্তৃত্বের সঙ্গে ধর্মীয় কর্তৃত্বের যে একটি দ্বন্দ্বও থাকে সেটাকে না বাড়িয়ে বরং উভয়ের ঐক্যটাকে দৃঢ়তর করেছে।
অনুমান করি আফগানিস্তানে এমন একটি ঘটনা ঘটেছিল। তুরস্কে কামাল আতাতুক্র্ প্রথমে ধর্মীয় শক্তিকে আঘাত করেছিলেন। এ ক্ষেত্রে তুর্কী জাতীয়তাবাদের যথাযথ ব্যবহার তাঁকে বিপুলভাবে সাহায্য করে। জাতীয়তাবাদের আবেদন জাগাতে না পারলে তিনি ব্যর্থ হতেন। মার্কসবাদী বা কমিউনিস্টদের সমস্যা ছিল যে, ব্যক্তি মালিকানা এবং জাতীয়তাবাদ কোনোটাই তাদের নেই এবং তারা প্রথমেই অর্থনৈতিক সংস্কার দ্বারা সমাজতলে অবস্থিত শ্রমজীবী জনগণের শক্তিটাকে মুক্ত করতে যায় যেটা ভয়ঙ্করভাবে প্রতিক্রিয়াশীল, আক্রমণাত্মক এবং পশ্চাৎপদ। বস্তুত এটা হল সহিংস বেদুঈন মানস শক্তি, যা যে কোনো মানবিকতা ও প্রগতির শত্রু।
আর একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় লক্ষণীয়। সেটা হল মুসলিম মানস মূলত সহিংস অর্থাৎ সামরিক। আর তাই সেনাবাহিনী বা সামরিক শক্তি মুসলিম সমাজের নেতৃত্বের স্বাভাবিক শক্তি। সমস্ত মুসলিম সমাজের এটা একটা সাধারণ বৈশিষ্ট্য, যদিও পাশ্চাত্য এবং অন্যান্য সমাজের প্রভাবে ও চাপে এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটছে। কিন্তু ঐতিহ্যিকভাবে এই সমাজে পরিবর্তনের শক্তি উদ্ভূত হয় সেনাবাহিনী থেকে। কারণ সেনাবাহিনীই সমগ্র সমাজ ও রাষ্ট্রের সকল কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রীয় শক্তি। এটা সমাজের সবচেয়ে শক্তিশালী ও প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠান। মোল্লারাও প্রকৃতপক্ষে এর অধীনস্থ। কিন্তু আমাদের দেশে সেনাবাহিনীর এই ঐতিহাসিক ভূমিকাটা নষ্ট হয়েছে ব্রিটিশ শাসনের ফলে। এই শাসনের ফলে পুর সমাজ বা সিভিল সোসাইটির প্রতিনিধিত্বকারী শক্তি হিসাবে রাজনৈতিক দলের উদ্ভব ঘটে। এটা সেনাবাহিনীর বিপরীতে মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে একটা স্বতন্ত্র ও স্বাধীন ভূমিকা পালনের সুযোগ করে দেয়। ব্রিটিশ হস্তক্ষেপে এ দেশে এমন এক রাষ্ট্র বিন্যাস ঘটেছে যেখানে সেনাবাহিনীর পক্ষে প্রগতিশীল নেতৃত্বমূলক ভূমিকা পালন করা সম্ভব নয়। ফলে এখানে সেনাবাহিনী রাজনৈতিক সংগঠনের তুলনায় অধিকতর প্রতিক্রিয়াশীল ও পশ্চাৎপদ ভূমিকা পালন করতে বাধ্য হয়। সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ এ দেশকে পিছনে ঠেলে দেয়। যাইহোক, শ্রমিক, কৃষক এবং সাধারণ শ্রমজীবী জনগণের পশ্চাৎপদ অবস্থানটিকে বুঝতে না পারা এ দেশে সকল বিপ্লব প্রয়াসের ব্যর্থতার একটি প্রধান কারণ হয়ে রয়েছে। অথচ এদের বাদ দিয়েও বিপ্লব বা সমাজ পরিবর্তন সম্ভব নয়। আপাত দৃষ্টিতে অসাধ্য কিংবা অতি দুরূহ এক ধাঁধার উত্তর পাওয়ার মতো মনে হলেও এটার উত্তর এমন কিছু কঠিন নয় যদি নিজ সমাজ বাস্তবতা এবং তার ঐতিহাসিক সমস্যাগুলোকেও বোঝা যায়।
এবং এটা খুব চিত্তাকর্ষক আলোচনা হতে পারে যদি আমরা হিন্দু সমাজের সমস্যাকেও একটু গভীরভাবে বোঝার চেষ্টা করি। আমি আগেই বলেছি এখানে আমি এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব না। কারণ এ বিষয়ে স্বতন্ত্রভাবে দীর্ঘ আলোচনা হওয়া দরকার। সুতরাং আমি শুধু একটা নূতন দিক থেকে সমাজ বিশ্লেষণ এবং সামাজিক শক্তিগুলোর ভূমিকা ও ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার স্বরূপ উদ্ঘাটনের প্রয়োজন দেখাবার জন্য একটা আলোচনার সূত্রপাত করতে চাইছি মাত্র। যাইহোক, আশ্চর্যজনক মনে হলেও হিন্দু সমাজের সমস্যাটাও কিন্তু উল্টোভাবে মুসলিম সমাজের মতো। সেটা হল সমাজতলে অবস্থিত শ্রমের শক্তিটা সবচেয়ে পশ্চাৎপদ, পরিবর্তন বিমুখ এবং সেই হেতু সাধারণত সব রকম প্রগতির বিরোধী। তবে এর ধরনটা মূলত অহিংস এবং নিষ্ক্রিয়তাবাদী। অর্থাৎ পদ্ধতিতে মুসলমানের বিপরীত। তবে ফলাফল প্রায় এক।
হাজার হাজার বৎসর ধরে হিন্দু সমাজে যে সকল প্রগতিশীল আন্দোলন কিংবা পরিবর্তন প্রয়াস হয়েছে তার প্রধান শক্তি এবং ক্ষেত্রও কিন্তু এক বিচারে মধ্য শ্রেণী। বিশেষত কারিগর, ব্যবসায়ী এবং ক্ষত্রিয়দের মধ্যবর্তী অংশ। এমন কি আমরা যদি আড়াই হাজার বছর পূর্বে বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের উত্থান কালে উপস্থিত হই তাহলে এমন দু’টো নাগরিক ধর্মের উত্থান দেখতে পাব যার দুইজন উদগাতাই ক্ষত্রিয় প্রজাতান্ত্রিক জাতিসত্তা থেকে আগত। বুদ্ধ জন্ম নিয়েছিলেন শাক্য উপজাতিতে এবং মহাবীর জন্ম নিয়েছিলেন জ্ঞাত্রিক উপজাতিতে। এ দু’টো উপজাতিই ছিল ক্ষত্রিয়।
মনে রাখতে হবে যে, পরবর্তী কালের বর্ণজাতি দিয়ে যেন আমরা সে কালের বর্ণজাতিগুলোকে বোঝার চেষ্টা না করি। তখনও ব্রাহ্মণ্য নিয়ন্ত্রণ সর্বত্র প্রতিষ্ঠিত হয় নি এবং বর্ণজাতি ব্যবস্থাও পরবর্তী কালের মতো দৃঢ়বদ্ধ রূপ নেয় নি। কিন্তু তবু বর্ণজাতি ব্যবস্থা প্রবল হয়ে উঠছিল। এবং এই জিনিসটা আমাদের বোঝা দরকার যে, হিন্দু ধর্ম বা ব্রাহ্মণ্য ধর্মের মূল বিন্যাসটা প্রতিষ্ঠিত রাজতন্ত্র, ব্রাহ্মণ পুরোহিত এবং শূদ্র কৃষকের দৃঢ় ঐক্যের উপর। এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ এবং লক্ষণীয় যে, বৌদ্ধ এবং জৈন উভয় ধর্মীয় আন্দোলন মূলত নাগরিক সমাজের মধ্যে সীমিত থেকেছে। জৈন আন্দোলনের প্রভাবটা বেশী ছিল ব্যবসায়ীদের মধ্যে। অন্যদিকে বৌদ্ধ আন্দোলনের প্রভাব ব্যবসায়ী, কারিগর এবং বিভিন্ন নাগরিক বৃত্তিজীবী এবং খুব বিস্ময়কর মনে হলেও ক্ষত্রিয় সৈনিক বা যোদ্ধাদের বড় অংশের মধ্যে ছিল। ভারতবর্ষে এক সময় বৌদ্ধ ধর্ম এতটা বিস্তৃত হয় যে, তা রাজানুকূল্য লাভ করতেও সক্ষম হয়।
অনেক রাজা, সম্রাট বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ছিলেন। স্বাভাবিকভাবে গ্রামে কৃষকদের মধ্যেও এর প্রভাব পড়েছিল। কিন্তু কৃষকের ব্যাপক অংশ শূদ্র হিসাবে থেকে গিয়েছিল বর্ণজাতির ব্যবস্থাধীনে। এই শূদ্র কৃষক এবং গ্রামীণ জনগণ ছিল ব্রাহ্মণ্য হিন্দু ধর্ম এবং সেই সঙ্গে রাজতন্ত্রের মূল ভিত্তি। আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আমাদের মনে রাখতে হবে যে, হিন্দু সমাজে শূদ্র কারিগরদের মর্যাদা শূদ্র কৃষকদের মতই সর্বনিম্নে। এবং এই অবস্থা আজো কম বেশী রয়ে গেছে। এ দেশেও। কারো কৌতূহল হলে গ্রামাঞ্চলে হিন্দু তাঁতী, কামার, কুমার প্রভৃতি বৃত্তিজীবীর বর্ণজাতিগত মর্যাদার নিম্ন অবস্থান লক্ষ্য করতে পারবেন। নিশ্চয় অবস্থাটা পঞ্চাশ বৎসর আগের মতো নেই। কিন্তু এটা একটা এমন সমাজ কাঠামোগত এবং সেই সঙ্গে সাংস্কৃতিক ব্যবস্থা যার প্রভাবটা থেকে যেতে পারে খুব গভীরে। কারণ এর সঙ্গে সম্পর্কিত রয়েছে একটা ধর্ম বিশ্বাস ও বোধ। ফলে বাস্তব জীবনের প্রয়োজনে অনেক পরিবর্তনকে মেনে নিলেও মনের গভীরে বা অবতলে আনুগত্য রয়ে যায় ঐতিহ্যিক শিক্ষাটার প্রতি, যাকে ধর্মগ্রন্থগুলো সংরক্ষণ করে। এ ক্ষেত্রে রামায়ণ, মহাভারতের মতো গ্রন্থগুলোর ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। প্রকৃতপক্ষে বেদ নয় বরং রামায়ণ, মহাভারত, গীতা এবং অন্যান্য পুরাণ গ্রন্থগুলো হল আম হিন্দু জনতার ধর্মগ্রন্থ। বেদ হল ব্রাহ্মণের শ্রেষ্ঠত্বের প্রতীক।
যাইহোক, হিন্দু সমাজে মৌল বিভাজন ব্রাহ্মণ পুরোহিত এবং শূদ্র কৃষকে। অন্যান্য বিভাজন এ দু’টোর মধ্যবর্তী বা পার্শ্ববর্তী কিংবা নিম্নবর্তী। অবশ্য ব্রাহ্মণের স্থান শীর্ষে। প্রকৃতপক্ষে হিন্দুধর্ম হল এমন এক সমাজ ও উৎপাদন ব্যবস্থার ধারক যেখানে শূদ্র কৃষক ফসল উৎপাদন করবে এবং প্রয়োজনীয় সেবা দিবে আর ব্রাহ্মণ পুরোহিত সেই ফসলের ভাগ খাবে এবং সেবা নিবে, বিনিময়ে শূদ্র কৃষকের মানসিক বা মনস্তাত্ত্বিক প্রয়োজন (তার ভাগ্য নির্ভরতা, আত্মা, দেবতা ইত্যাদিতে বিশ্বাস, কাল্পনিক বিভিন্ন অলৌকিক শক্তিকে তুষ্ট করার আকাঙ্ক্ষা) পূরণ করবে। রাজা আসবে এই ব্যবস্থাকে রক্ষা করার জন্য। কিংবা বহিরাক্রমণ থেকে রক্ষা করার জন্য। কিন্তু তা ধর্মীয় বা সামাজিকভাবে ব্রাহ্মণের অধীন বা নীচে। বণিক আসবে বিনিময় ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার জন্য। তার মর্যাদা খুব কম তবে কৃষকের উপরে। কারিগর আসবে সমাজ-সভ্যতার কারিগরী প্রয়োজন পূরণের জন্য। সেও শূদ্র। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে তার মর্যাদা কৃষকের চেয়েও কম। অর্থাৎ বিজ্ঞান-প্রযুক্তির মর্যাদা এই সমাজে সবচেয়ে কম। বস্তুত সভ্যতাকে নিম্ন মাত্রায় ধরে রাখার ব্যবস্থা হল হিন্দু ধর্ম।
হিন্দু ধর্মে সমাজকে তত্ত্বগতভাবে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র এই চার বর্ণে ভাগ করা হয়েছে। কিন্তু ওটা হল একটা কাগুজে ভাগ। বাস্তবে অসংখ্য উপবর্ণ কিংবা ‘জাত’ বা ‘জাতি’তে এই সমাজ বিভক্ত। গোটা সমাজ পবিত্রতা-অপবিত্রতা এবং কর্ম বা বৃত্তিগত বিভাজনের উপর প্রতিষ্ঠিত। প্রকৃতপক্ষে ব্রাহ্মণের বিচারে সে নিজে ছাড়া আর সবাই শূদ্র। কারণ তার পবিত্রতাই সবচেয়ে বেশী। যদিও ব্রাহ্মণের ভিতরেও পবিত্রতা ও শ্রেষ্ঠত্বের স্তরভেদ আছে তবু তার নীচে আর সবাই তার তুলনায় অপবিত্র। ক্ষত্রিয়সহ আর সব বর্ণজাতিকে সেই অপবিত্রতার পরিমাণের স্তর বিন্যাসে ফেলা হয়েছে, যার সবচেয়ে নীচে শূদ্র তথা শ্রমজীবী জনগণের অবস্থান। এর বাইরেও একটা স্তর আছে, সেটা হল অস্পৃশ্য বা অচ্ছুৎ। গান্ধী এদের নাম দিয়েছেন হরিজন। ঐতিহ্যিকভাবে সমাজ কাঠামো এবং শহর ও গ্রাম সমাজেরও বাইরে তাদের অবস্থান। যেমন চণ্ডাল, মেথর, ডোম, চর্মকার ইত্যাদি। অর্থাৎ তত্ত্বগতভাবে চতুর্বর্ণ কাঠামোর বাইরে থাকলেও অস্পৃশ্যরা গঠন করেছে হিন্দু সমাজের পঞ্চম বর্ণ। তবে যতো বর্ণেই ভাগ করা হোক প্রতি বর্ণে রয়েছে অসংখ্য স্তর এবং বিভাজন। এগুলোর মধ্যে বিবাহ, একত্র আহার নিষিদ্ধ। শেষ বিচারে হিন্দু সমাজে বর্ণ দু’টি ব্রাহ্মণ এবং শূদ্র। যাদের ভিতরে আবার সহস্র সহস্র ‘জাতি’।
তত্ত্বের ‘বর্ণ’ এবং বাস্তবের ‘জাতি’ এই উভয়কে মেলাবার জন্য বিনয় ঘোষণ ‘জাতিবর্ণ’ শব্দটা ব্যবহার করেছেন। আমিও অন্যত্র তা করেছি। তবে এখন আমার মনে হয় ‘বর্ণ’ ভেদের একটা তত্ত্বগত কাঠামোকে অবলম্বন করে বাস্তবে যে ‘জাতি’ ভেদ ব্যবস্থার উদ্ভব ঘটেছে তাকে বোঝাবার জন্য ‘বর্ণজাতি’ শব্দের প্রয়োগটাই অধিকতর উপযুক্ত। আমার অনুমান ভারতবর্ষের বিশাল অরণ্যাঞ্চল থেকে পশু শিকারী অথবা খাদ্য সংগ্রহকারী আদিম অসভ্য উপজাতিগুলোকে সভ্যতা এবং কৃষি ব্যবস্থায় শান্তিপূর্ণভাবে টেনে নেবার জন্য শত শত বা হাজার হাজার বৎসর ধরে ব্রাহ্মণরা যে জটিল কলাকৌশল উদ্ভাবন করেছিল তার ফল হল বর্ণজাতিভেদ ভিত্তিক এবং বেদ-ব্রাহ্মণ কেন্দ্রিক হিন্দু ধর্ম ও সমাজ। এই ধর্ম যোদ্ধা উপজাতিকে এমন এক পদ্ধতিতে দাস বানিয়েছে যেখানে যুদ্ধের প্রয়োজন খুব কমই হয়েছে।
আসলে ভারতবর্ষের ভূ-প্রকৃতি এমন যে, এখানে বলপ্রয়োগে ব্যাপক হারে দাস সৃষ্টির উপায় ছিল না। চারদিকে অরণ্য, পাহাড়, পর্বত, নদীর বিস্তার। সুতরাং পালাবার অজস্র পথ ছিল। তাছাড়া ভারতবর্ষে ৫/৬ হাজার বছর বা তারও আগে থেকে সভ্যতা নির্মাণে প্রধানত শান্তিপূর্ণ পদ্ধতি অনুশীলনের এমন এক ঐতিহ্য গড়ে উঠেছিল যার প্রভাব সর্বদাই কমবেশী থেকে গেছে। ব্রাহ্মণরাও এই ঐতিহ্যকে অনেকাংশে ধারণ করেছে। এই কারণে কৌশলটাই মুখ্য।
এবং সহজে খাদ্য লাভ এবং স্থিতিশীল জীবনের আশায় অরণ্যচারী আদিম উপজাতি এই সমাজের ফাঁদে খুব সহজেই পা দিয়েছে। কারণ প্রথমে তার বলবীর্য, সাহস ও অস্ত্র বাদে আর প্রায় কিছু তাকে বিসর্জন দিতে হয় না। তার উপজাতীয় ধর্ম বিশ্বাস ও ঐতিহ্যের অনেক কিছু এই সমাজ সংরক্ষণ করে। প্রথমে হারায় তার শৌর্য-বীরত্ব। তারপর শতাব্দীর পর শতাব্দীর দীর্ঘ সময় ধরে প্রায় সবকিছু। শুধু থাকে তার অরণ্যের কোলে অর্জিত আদিম ভীরুতা আর ভিন্ন উপজাতি বা গোষ্ঠীর প্রতি বৈরিতা ও ঘৃণা। সভ্যতায় সংরক্ষিত এই আদিম মানুষ পরিণত হয় এমন এক শ্রমদাসে যার সবচেয়ে বড় গৌরব তার দাসত্বকে রক্ষা করায়। কারণ সেটা তার ধর্ম।
সব সমাজের দাসের মতো অপুষ্টি, কুসংস্কার আর ব্যাধিতে ভোগা এই মানুষগুলো শ্রমের চাপে স্বল্পায়ু হত। বিশেষত ভারতবর্ষের মতো ভূ-ভাগের জলবায়ুতে মানুষের মৃত্যুর হাত এমনিতেই খুব বেশী ছিল। ফলে শ্রমজীবী মানুষের ব্যাপক মৃত্যুর ফলে সৃষ্ট শূন্যতা পূরণের জন্য শূদ্র শ্রমের এক অব্যাহত সরবরাহের ভাণ্ডার দরকার ছিল। ভারতবর্ষের ব্যাপক অরণ্যাঞ্চল ছিল সেই ভাণ্ডার। হয়তো অনেক ক্ষেত্রে পঞ্চম বর্ণের দরজাটা পার হতে পারলে প্রবেশাধিকার পাওয়া যেত চতুর্বর্ণের শূদ্র কাঠামোতে। পঞ্চম বর্ণের অস্তিত্বটিকে আমার কাছে তাৎপর্যপূর্ণ মনে হয়। এটা হয়তো হিন্দু সমাজ এবং এই সমাজের নিকট চরমভাবে ঘৃণিত পিশাচ, রাক্ষস ইত্যাদি নামে অভিহিত আদিম উপজাতিগুলোর মধ্যবর্তী স্তর। এটাকে হয়তো সেতুও বলা যায়। হয়তো এই সেতু দিয়ে আদিম উপজাতিগুলোকে ধীর প্রক্রিয়ায় হিন্দু সমাজে প্রবেশ করতে হত। অর্থাৎ হিন্দু সমাজের নীচ তলায় প্রবেশের আগে এখানেই হয়তো বর্ণজাতির শিক্ষাটাকে প্রথম আত্মস্থ করতে হত। এবং এই পঞ্চম বর্ণের মানুষেরাই হয়তো অরণ্যচারী আদিম উপজাতীয় মুক্ত মানুষদের কাছে পৌঁছে দিত হিন্দু সমাজের বার্তা ও শিক্ষা।
ব্রাহ্মণ সম্ভবত উপজাতির সবাইকে পঞ্চম কিংবা চতুর্থ বর্ণে ঠেলে দেয় নি। তা হলে উপজাতীয় সংগঠনটা তো অটুট রইবে। ওটা অটুট থাকলে উপজাতীয় নেতৃত্বও অটুট রইবে। ফলে অসহায় শূদ্র সৃষ্টিও দু:সাধ্য হবে। সুতরাং এটা স্বাভাবিক যে, পঞ্চম বা চতুর্থ বর্ণে স্থান পেয়েছে উপজাতির সাধারণ সদস্যরা। কিন্তু তার নেতৃত্বের প্রবল শক্তি থাকলে তাকে ব্রাহ্মণেরা আত্মস্থ করে নিয়েছে বর্ণজাতির উচ্চতর কাঠামোতে। এমন কি কিছু ক্ষেত্রে হয়তো ব্রাহ্মণ-বর্ণজাতিভুক্তও করেছে উপজাতি নেতৃত্বের শক্তিকে, বিশেষত যারা ছিল উপজাতীয় যাদুকর কিংবা ওঝা ইত্যাদি। এটা বোঝা সহজ যে, উপজাতির কাঠামো ভাঙ্গতে না পারলে উপজাতিকে বর্ণজাতি কাঠামোতে আত্মস্থ করা অনেক সময়েই সম্ভব নয়। আর এর সহজ অর্থ হল উপজাতিকে শূদ্র কাঠামোভুক্ত করতে হলে প্রথমে তাকে নেতৃত্বহীন করতে হবে। যেহেতু সেটাও বলপ্রয়োগে করা সম্ভব ছিল না সেহেতু এই নেতৃত্বকে বাইরে থেকে উপজাতি-গোত্র ব্যবস্থার মতো দেখতে এক (বর্ণজাতি) ব্যবস্থার অবয়ব দেখিয়ে আত্মস্থ করে নিতে হয়েছে বর্ণজাতির উচ্চতর কাঠামোতে। এইভাবে উপজাতিকে নেতৃত্বহীন ও বিভক্ত করে সবাইকে উপজাতি সদৃশ বর্ণজাতি ভেদ-ভিত্তিক হিন্দু সমাজভুক্ত করাটা দু:সাধ্য হয় নি। মাঝখান থেকে গেছে উপজাতি সমাজের তুলনামূলক সাম্য, ভ্রাতৃত্ব এবং শৌর্য-বীর্য ও গতিশীলতা।
বৌদ্ধ ধর্ম ছিল এমন এক দাসত্বের হাত থেকে ভারতবর্ষকে বাঁচাবার জন্য প্রাচীন কালের মধ্য শ্রেণীর কিংবা বলা যাক মধ্য বর্ণজাতির প্রয়াস। যখন শূদ্র-ব্রাহ্মণের ধর্ম নিরঙ্কুশ হয়েছে ভারতবর্ষ অন্ধকার যুগে তলিয়ে গেছে। এটা খুব লক্ষণীয় যে, ১৯৪৬-এ তেভাগা আন্দোলন যেসব জেলায় হয়েছিল সেগুলোতে প্রধানত উপজাতীয় জনগোষ্ঠী ছিল এই আন্দোলনের মেরুদণ্ড। তৎকালীন দিনাজপুর-রংপুরে এই আন্দোলনের মূল শক্তি ছিল সাঁওতাল এবং রাজবংশী। রাজবংশীরা কোচ উপজাতি বংশোদ্ভূত এবং হিন্দু সমাজে তাদের আগমন ছিল যথেষ্ট সাম্প্রতিক। ফলে হিন্দু ধর্মের সামাজিক-সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যগুলো তখনও তাদের মধ্যে দৃঢ়বদ্ধ হয় নি আর সাঁওতালেরা তো পুরোপুরিই উপজাতীয় পর্যায়ে এবং হিন্দু ধর্মের বাইরে ছিল। রাজশাহীতেও এই আন্দোলনের মূল শক্তি ছিল সাঁওতাল। যশোর অঞ্চলেও তেভাগা আন্দোলন ব্যাপকতা লাভ করে। এখানে নমশূদ্ররা ছিল আন্দোলনের প্রাথমিক শক্তি। অন্যদিকে মুসলমান কৃষকরাও এই আন্দোলনে ব্যাপকভাবে যোগ দেয়।
কিন্তু যশোর-কুষ্টিয়ার একটা ইতিহাস আমাদের মনে রাখতে হবে। সেটা হল এই অঞ্চল ছিল অতীতে বৈষäব ও বাউল আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্র, যার গভীর প্রভাব এই সমগ্র অঞ্চলে পড়েছে। ফলে এখানে প্রথাগত বা শাস্ত্রীয় ইসলাম বা হিন্দু ধর্ম কোনোটাই তার শক্ত ভিত্তি অন্যান্য অঞ্চলের মতো তৈরী করতে পারে নি। বিশেষত মানবতাবাদী বাউল আন্দোলনের প্রভাব এখান থেকে বিস্তৃত হয়েছে উত্তর বঙ্গসহ বৃহত্তর বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে। যাইহোক, নমশূদ্রের ব্যাপারে বলা দরকার যে, এরা উপজাতীয় বৈশিষ্ট্যকে যথেষ্ট পরিমাণে ধারণ করেছে। সম্ভবত এরাও উপজাতীয় সমাজ থেকে অল্প কাল পূর্বে হিন্দু সমাজে প্রবেশ করেছিল। এরপর মণি সিং যাদের নিয়ে আন্দোলন করে অত খ্যাতিমান হয়েছিলেন সেই হাজংদের কথাটাই বলা যাক। হাজংরা কি ছিল? তারাও উপজাতি।
এর ব্যতিক্রম যে নেই বা ঘটে নি তা নয়। আমি শুধু আন্দোলনের মূল শক্তিটাকে চিহ্নিত করতে চাচ্ছি। আসলে হিন্দু বা মুসলমান কৃষক বা শ্রমজীবী যে সাধারণভাবে সামাজিক পরিবর্তনের অগ্রণী শক্তি হিসাবে ভূমিকা পালন করতে পারে না এটা ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা। এমন কি নকশালবাড়ী অভ্যুথান দিয়ে ভারতে যে রাজনীতির এক নূতন ও সশস্ত্র ধারা সৃষ্টি হল তারও মূল শক্তি সাঁওতাল। কৃষক বললে কৃষক, মজুর বললে মজুর। কিন্তু মূল শক্তিটা ছিল সাঁওতাল। নকশালবাড়ীর কৃষক অভ্যুথান যেটাকে বলা হয় সেটা ছিল প্রকৃতপক্ষে সাঁওতাল অভ্যুথান। মার্কসবাদী ভদ্রলোকরা শ্রেণী সংগ্রাম এবং কৃষক বিপ্লবের রঙ মাখিয়ে ওটাকে নির্ভেজাল কৃষক অভ্যুথান হিসাবে দেখিয়েছেন। এবং আজ ভারত-রাষ্ট্রের বিহার বা অন্ধেন্স যে সশস্ত্র সংগ্রাম চলছে তারও মূল শক্তিভিত্তি কিন্তু উপজাতি বা উপজাতিজ জনগোষ্ঠী যারা হিন্দু সমাজ কাঠামো বহির্ভূত। এদের অনেকে অস্পৃশ্য বা হরিজন কিংবা দলিত। ভারত রাষ্ট্রের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের অভিজ্ঞতাও এই ধরনের মূল্যায়নের পক্ষেই যায়।
অবশ্য ভারতের অন্যান্য অঞ্চল থেকে পশ্চিম বাংলার একটা স্বাতন্ত্র্য আছে। এখানে বাম আন্দোলন দীর্ঘ দিন যাবৎ শক্তিশালী। সশস্ত্র নকশালপন্থী আন্দোলনও সেখানে এক সময় শক্তিশালী হয়েছিল। কিন্তু পশ্চিম বাংলায় বাম আন্দোলনের প্রধান ভিত্তি পূর্ব বাংলা থেকে আগত উদ্বাস্তুরা। এদের একটা বড় অংশ ইংরেজ শাসনামলে গড়ে ওঠা বিপ্লবী চেতনার প্রভাবকে বহন করে নিয়ে গিয়েছিল। সেই সঙ্গে ব্যাপক স্থানচ্যুতি ও অভিগমন হিন্দু ধর্মের ঐতিহ্যগত প্রভাবকে নিদারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। হঠাৎ দেশ ত্যাগে সামাজিক কাঠামোর বিপর্যয়ের ফলে ধর্মীয় বা ভাবাদর্শিক কাঠামোটাও অনেকাংশে বিপর্যস্ত হয়। এবং এত কিছুর পরেও নকশাল আন্দোলনের প্রধান ভিত্তি কিন্তু গ্রামাঞ্চল এবং কৃষক ছিল না বরং শহরাঞ্চল এবং মধ্যবিত্ত ও ছাত্র-যুবকরা ছিল।
বস্তুত মূলধারার কিংবা প্রথাগত হিন্দু কিংবা মুসলিম জন-মানস না বুঝলে এই সমাজে কিছুই করা সম্ভব নয়। কিছু পুনরাবৃত্তি হতে পারে জেনেও হিন্দু-মুসলিম এই উভয় সমাজের সমস্যার স্বরূপ স্পষ্টতর করার প্রয়োজনে আরও কিছু আলোচনা করতে চাই। আর তা করতে গিয়ে বলতে হয় যে, প্রতিটি সমাজ, সভ্যতা, ধর্মের বহু দিক বা রূপ থাকে। তা না হলে তা দাঁড়ায় না বা টেকে না। সুতরাং হিন্দু ও মুসলিম উভয় ধর্মের তা আছে। কিন্তু উভয় ধর্মে একটি রূপের প্রাধান্য বা শক্তি এত বেশী যে, অন্য রূপগুলো অনেকাংশে বহুরূপীর মুখোসের মতো। হিন্দু সমাজেও পৌরুষ ও বীরত্বের সাধনা ছিল বৈকি। ক্ষত্রিয় বর্ণজাতির কাজ ছিল যুদ্ধ সাধনা করা। কিন্তু সমাজ অবতলের শক্তি ক্ষাত্র নয় বরং তার বিপরীতটা। বরং এটা মনে হয় যে, সমাজ অবতলে বা ভিত্তিমূলে যে শূদ্র কৃষক রয়েছে তার মনটি কৃষি সভ্যতার ঊষাকালের স্তরটিতেই আটকা পড়ে আছে যখন নারী আদিম আরণ্য ও বর্বর জীবন থেকে মানুষকে মুক্ত করছে। খুব বিস্ময়কর মনে হলেও এটা বাস্তব যে, উপরের ব্রাহ্মণ্য ধর্মের পিতৃতন্ত্রের পরিবর্তে এই স্তরে ভাবাদর্শের ক্ষেত্রে মাতৃতন্ত্রের আধিপত্য রয়েছে। বাস্তবে না হলেও মানসলোকে। আর তাই সমাজতলের ধর্মের দেবতারা প্রধানত নারী। কালী, চণ্ডী, মনসা, শীতলা বা আরও অজস্র দেবীরা হল নিম্নবর্ণের জনসমাজের দেবতাদের প্রধান রূপ। বাঙ্গালী হিন্দুর সবচেয়ে জনপ্রিয় দেবী দুর্গার উদ্ভব ও উত্থানও সমাজের নীচ তলা থেকে।
আসলে এ এক বিচিত্র আত্মদ্বন্দ্ব, স্ববিরোধ। উপর তলার পুরুষতন্ত্রের বিপরীতে নীচ তলার নারীতন্ত্রের সাধনা। কিন্তু উভয়ই বিকৃত, খণ্ডিত আর তাই পঙ্গু। এবং শেষ পর্যন্ত নীচ তলার এই পঙ্গু নারীই সমাজ অধিতলকেও অধিকার করেছে। অরণ্য কোলে নারীর যে শৌর্য, বীরত্ব ও স্বাধীনতা ছিল সেটা তো গেছেই সেই সঙ্গে পুরুষের শৌর্য ও বীরত্বকেও পঙ্গু ও হরণ করার সাধনা নিরন্তর চলেছে। তবু এর ভিতর নারীর শক্তি উপাসনার রূপটিকে অবলম্বন করে শৌর্য ও বীরত্বের সাধনার একটা প্রয়াস নীচ তলায় বহমান থেকেছে বৈকি, যার প্রকাশ ঘটেছে বিশেষত কালী উপাসনায়। কিন্তু সেটা শুধু এক হতমান, পঙ্গু সামাজিক আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ মাত্র। ফলে তা নিদারুণ বিকৃতিতেও নিয়ে গেছে। তান্ত্রিক কাপালিক সাধনা তার এক রূপ। বস্তুত হিন্দু সমাজের এই পৌরুষহীন ও শৌর্যহীন নারীতন্ত্র শেষ পর্যন্ত সমাজকে পুরোপুরি অধিকার করেছে।
ফলে এই সমাজে বীরত্ব অনেকটাই ব্যক্তিগত ব্যাপার হয়ে থেকেছে। যখন বীরত্বকে গোষ্ঠীগত বা সংগঠিত রূপ দেওয়া হয়েছে তখন তার পৌরুষের পরিবর্তে কাপুরুষতার দিক প্রবল হয়ে উঠতে চেয়েছে। অতীত কালে হিন্দু কিংবা ভারতীয় সেনাবাহিনীর যুদ্ধের বিবরণগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়লে বোঝা যাবে সংগঠিত শক্তি হিসাবে হিন্দুর দুর্বলতা কতটা। অথচ ব্যক্তিগতভাবে ক্ষত্রিয় বা হিন্দু যোদ্ধাদের অনেকেই ছিল অসীম সাহসী।
আসলে সমাজ শক্তি যখন সংগঠিত রূপ নেয় তখন সমাজের মূল প্রবণতা ও বৈশিষ্ট্য, মন-মানসিকতা সেখানে সাধারণত প্রবল হয়ে ওঠে। হিন্দু মানস মূলত অরণ্যচারী আদিম মানুষের প্রতিফলন, যা অরণ্য জীবনের শক্তি, সাহস, সহিংসতা, উপজাতীয় গণতন্ত্র ও ব্যক্তিগত মর্যাদাবোধ হারিয়ে কৃষিকে অবলম্বন করে নিরস্ত্র, অহিংস ও কাপুরুষ হয়েছে, ভাগ্যবাদী হয়েছে, সমাজ শাসকের অন্ধ অনুগত হয়েছে। এই অবস্থাকে রক্ষা করতে গিয়ে ব্রাহ্মণ এবং উচ্চ বর্ণের সকল হিন্দুও সাধারণভাবে তাই হয়েছে। অসংখ্য বিভাজন এবং স্তরবিন্যস্ত ঘৃণার উপর প্রতিষ্ঠিত বর্ণজাতিভেদমূলক এক সমাজের জন্য এমন পরিণতিই অনিবার্য।
প্রথাগত ইসলামী সমাজে আর এক ধরনের চরম রূপের অবস্থান। বেদুঈন জীবনে যে এক ধরনের গণতন্ত্র এবং ব্যক্তির আত্মমর্যাদাবোধ ও স্বাধীনতাপ্রিয়তা ছিল সেগুলো সব গেছে। শুধু তার সহিংস ও আক্রমণাত্মক পৌরুষ, স্বৈরতান্ত্রিক সামরিক শাসকের প্রতি অন্ধ অনুগত সহিংসতার শক্তি লালিত হয়েছে। এই শক্তিকে সংরক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণের এক আশ্চর্য পন্থা ইসলাম দিয়েছে। হাঁ, এই নিয়ন্ত্রণ থাকে ইসলামী শাসকের হাতে যা স্বৈরতন্ত্রী, পুরুষ ও সামরিক। এই ধর্মে নারীকে সামাজিকভাবে সম্পূর্ণ অস্বীকার করা হয়েছে। কারণ তার সামাজিক অস্তিত্ব পুরুষের নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ববাদ, স্বৈরতন্ত্র ও সহিংসতার সাধনার পথে সবচেয়ে বড় বাধা। এও এক বিকৃত, খণ্ডিত ও পঙ্গু পৌরুষ সাধনা। সুফীরা দেশে দেশে একে সংযত করতে চেয়েছে বৈকি। কিন্তু সেটা তো মৌল ধর্ম নয়। জিহাদ হল এই ধর্মের প্রাণশক্তির সবচেয়ে বড় উৎস। এই জিহাদ চলে সমস্ত সমাজে, প্রতিটি ব্যক্তির অন্তর লোকে। সারাক্ষণ, যারা জীবন। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে। এই কারণে ব্যক্তি মুসলমান ভীরু হতে পারে, কিন্তু তার সংগঠিত রূপ যে কোনো মুহূর্তে জিহাদী জোশে বলীয়ান হতে পারে। প্রতিপক্ষ তার শুধু এক কাফের লাগে। সেটা যে কেউ হতে পারে। মুসলমানও হতে পারে। হিন্দুর সমাজচ্যুতি বা বর্ণজাতিচ্যুতি ঘোষণার মতো এও এক ঘোষণার ব্যাপার মাত্র। হাঁ, হিন্দু ধর্ম যদি ক্ষমতাচ্যুত নিরঙ্কুশ নারীর কৃষি ধর্ম হয়ে থাকে তবে ইসলাম হল স্বৈরাচারী ক্ষমতার অধিকারী নিরঙ্কুশ পুরুষের ক্ষাত্র ধর্ম।
মার্কসবাদ হেফ্জ করে এই দুই ধর্ম অধ্যুষিত দেশ বা ভূভাগে কেউ বিপ্লব করবে? তাহলেই হয়েছে। আমি বরং অবাক হই এ কথা ভেবে যে, এত দীর্ঘ অভিজ্ঞতার পরেও কেন কৃষক ও শ্রমিক আন্দোলনের নেতা বা কর্মীরা এই সত্যকে আজো উপলব্ধি করতে পারেন নি সমগ্র উপমহাদেশে। বিশেষত যখন এ দেশের বর্তমান বিভিন্ন কমিউনিস্ট বা মার্কসবাদী পার্টির কৃষক বা শ্রমিক আন্দোলন কিংবা তার পদ্ধতিগত সমস্যা নিয়ে বক্তব্য-বিশ্লেষণ পড়ি তখন বিস্মিত হই তাদের চিন্তা-চেতনার দৈন্য দেখে। তবে অসাধারণ তাদের জাবর কাটার ক্ষমতা! অথবা আবর্জনা প্রসবের ক্ষমতা! যুগের পর যুগ পার হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু তারা একই কথা বলে যাচ্ছে। একই সমাজ বিশ্লেষণ, কৃষক-শ্রমিকের ভূমিকা! সত্যি, মতান্ধতা মানুষকে এমনইভাবে মানসিক প্রতিবন্ধী করতে পারে যে, সমস্ত জীবন বাস্তবে বসবাস করার পরেও বাস্তবকে কিছুই বোঝার ক্ষমতা থাকে না!
শ্রমিকদের সম্পর্কে আলাদাভাবে কিছু বলি নি। তারা ঐ কৃষকেরই আর একটু উন্নত এবং সংগঠিত রূপ। এবং এর ফলে আরও অনেক বৃহদায়তনে প্রতিক্রিয়ার শক্তি হিসাবেও ভূমিকা পালন করার ক্ষমতা রাখে। আমাদের দেশে শ্রমিক আন্দোলনের লুম্পেন বৈশিষ্ট্য এতটাই প্রবল এবং উগ্র হয়ে উঠেছে যে ওটাকে এখন আর চিনতে এতটুকু কষ্ট হয় না। বাংলাদেশের পঁচিশ বৎসরের শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাস হল যখন যে সরকার আসে ব্যাপক শ্রমিকদের সেই সরকারের দলে যোগদানের ইতিহাস। ট্রেড ইউনিয়ন বা শ্রমিক নেতাদের অধিকাংশই রাজনৈতিক আনুগত্য পরিবর্তনে এতটাই দক্ষতা অর্জন করেছে যে, সরকার বদল হলেই দল বদলে তাদের আর সময় লাগে না।
যাইহোক, মূল সমস্যাটা কৃষকের মধ্যে নিহিত। কারণ এটা কৃষকের দেশ। কৃষককে বুঝলে জাতি বা সমাজকে বোঝা অনেক সহজ হয়। এই কারণে কৃষক এবং গ্রামীণ জনগণের বৈশিষ্ট্যগুলো নির্ণয় করা যে কোনো সমাজ পরিবর্তনের কর্মীর জন্য অত্যন্ত জরুরী। আমি ইতিপূর্বে কতকগুলো সামষ্টিক বা ম্যাক্রো অভিজ্ঞতার দৃষ্টান্ত দিয়েছি এ দেশের সমস্যাটা বোঝার জন্য। আর কৃষক এবং গ্রাম সম্পর্কে আমার অভিজ্ঞতা যে বাস্তবে শুধু পাকিস্তান আমলে সীমাবদ্ধ তা নয়। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পরেও আমি কৃষক ও গ্রামের সঙ্গে দীর্ঘকাল সংযোগ রক্ষা করেছি আমার নিজের মতো করে। অর্থাৎ কোনো রাজনৈতিক দলে না থেকেও। এরশাদ এবং খালেদা জিয়ার শাসনকালে দুইবার কয়েক বৎসর গ্রামে পড়ে থেকে কৃষক ও গ্রামীণ জনগণের মধ্যে কাজ করেছি এবং আন্দোলনও করেছি। যদিও সেটা অতি ক্ষুদ্র পরিসরে। এরশাদের আমলে গ্রামে জনগণের মধ্যে প্রায় দুই বৎসর কাজ করার পর সামাজিক দুর্বৃত্ত, চেয়ারম্যান-মেম্বারদের এক চক্রের বিরুদ্ধে গ্রামীণ জনগণকে নিয়ে একটা আন্দোলন করতে বাধ্য হই। আন্দোলনটা হয় ১৯৮৮-তে আমার নিজ এলাকা দিনাজপুর জেলার একটি থানার গ্রাম এলাকায়। ঐ একই থানায় ১৯৯৪-তে আমি যে আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ি সেটা করতে হয়ে প্রাক্তন প্রধান মন্ত্রী খালেদা জিয়ার বড় বোন তৎকালীন মহিলা সাংসদ (বর্তমান সংসদেরও সাংসদ) খুরশীদ জাহান হক (চকোলেট)-এর পোষ্য দুর্নীতিবাজ এক মাস্তানের নেতৃত্বাধীন সাম্প্রদায়িক, লুটেরা, সন্ত্রাসী ও ফতোয়াবাজদের এক চক্রের বিরুদ্ধে।
এই আন্দোলন করতে গিয়ে বিএনপি-এর কামড় অনুভব করেছি। এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে অনেক কিছু নূতন করে চিনেছি এবং বুঝেছি। এ দেশে বুদ্ধিবৃত্তি ও সাংবাদিকতাকে যারা নিয়ন্ত্রণ করে তাদের অনেকের স্বরূপ দেখেছি। আবার কারও কারও অকুণ্ঠ সমর্থন ও সহানুভূতি পেয়েছি। এই আন্দোলনে ওয়ার্কার্স পার্টির পলিট ব্যুরোর সদস্য এবং দিনাজপুরের এক কালীন কৃষক নেতা মাহমুদুল হাসান মানিকের নেতৃত্বে দিনাজপুর জেলার ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা-কর্মীদের যে অকুণ্ঠ সমর্থন ও সহযোগিতা পেয়েছি তা কখনই ভোলা সম্ভব নয়।
এগুলো আমার নিজের সাম্প্রতিক কালের ব্যষ্টিক বা মাইক্রো পর্যায়ের অভিজ্ঞতা। আমার অতীতের সামষ্টিক ও ব্যষ্টিক অভিজ্ঞতা এবং বর্তমানের ব্যষ্টিক অভিজ্ঞতা আমার নিজের এই অভিজ্ঞতাগুলো দিয়ে আমি এ দেশের এবং উপমহাদেশের অন্যান্য অভিজ্ঞতাকে বোঝার চেষ্টা করেছি। আর তা থেকে আমার যে সামগ্রিক মূল্যায়ন হয়েছে তা-ই এখানে খুব সংক্ষেপে উপস্থিত করলাম।
মুসলিম ও হিন্দু উভয় সমাজে বিপ্লবের সাধারণ রূপ সাংস্কৃতিক। তবে সেটা অবশ্যই রাজনৈতিক বিপ্লবকে বাদ দিয়ে নয়। আমি মনে করি এই উভয় সমাজে ব্যক্তিকে মুক্ত করার জন্য বিপ্লবের প্রয়োজন সবচেয়ে বেশী। আর এই ব্যক্তিকে মুক্ত করার জন্য প্রয়োজন সমাজকে মুক্ত করার। এখানে সাধারণভাবে সবাই বিকৃত, পঙ্গু। সুতরাং মূল কাজটা হল নূতন ব্যক্তি ও সমাজ সৃষ্টির। তবে সেটা তো আর বিদেশ থেকে মানুষ এনে করা সম্ভব নয়। সুতরাং এই সমাজ ও তার মানুষগুলোকেই বদলাবার কাজটা বিপ্লবের কাজ।
আমাদের দেশে মধ্য শ্রেণীকে উপরের তলার আমলা-ধনিকদের নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্য থেকে মুক্ত করা এবং একই সঙ্গে নীচ তলার শ্রমজীবী জনগণের পশ্চাৎপদ চেতনার শক্তির নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্য থেকে মুক্ত করাটা বিপ্লবের সাফল্যের এক প্রধান শর্ত। কিন্তু একই সঙ্গে এই পশ্চাৎপদ জনগণের শ্রম ও উৎপাদনশীলতার সঙ্গে মধ্য শ্রেণীকে সংযুক্ত করাটা বিপ্লবের সাফল্যের অন্যতম প্রধান শর্ত।
এ দেশে গণ-বিপ্লব করতে গিয়ে যদি শ্রমিক-কৃষক কিংবা সাধারণ মানুষের শক্তিটাকে নূতন চেতনায় দীক্ষিত এবং সঠিক পদ্ধতিতে সংগঠিত না করেই মুক্ত করা যায় তবে সেটা বিপ্লবের পরাজয় ও ধ্বংসকে অনিবার্য করবে। কারণ এই শক্তি অনিবার্যভাবে বিপ্লবের শক্তিকে অপসারণ করে তার জায়গায় ভয়ঙ্কর বর্বরতা, পশ্চাৎপদতা কিংবা প্রতিক্রিয়ার শক্তিকে ক্ষমতাসীন করবে। এই কারণে এই স্তরে শ্রেণী সংগ্রামের প্রধান রূপ হবে সাংস্কৃতিক বা আদর্শিক। অর্থনৈতিক সংগ্রাম কিংবা অন্যান্য পেশাগত দাবী বা কর্মসূচী থাকবে বৈকি। তা না হলে শুধু আদর্শ বা সংস্কৃতি জনগণকে অনুপ্রাণিত করবে কেন? ওটা না হয় পরলোকবাদ বা অলোকবাদ করতে পারে। কারণ যে সত্তাকে দেখা যায় না তার প্রতি আনুগত্য প্রদান করে যে স্বর্গকে দেখা যায় না সেখানে অনন্ত সুখভোগের আশা তা দিতে পারে। কিংবা অলৌকিক শক্তির কল্পনার নিকট থেকে নগদ নারায়ণ লাভের একটা প্রত্যাশাও থাকে। সুতরাং সেখানে কল্পনার আর এক লোকে অর্থনৈতিক এবং বৈষয়িক লাভালাভের বিষয়টা অন্তর্ভুক্ত থাকে। কিন্তু একটি লোকবাদী আদর্শ বা সংস্কৃতি তো সেটা দিতে পারবে না। সুতরাং তাকে লোকেই, বাস্তব জীবনেই বৈষয়িক লাভালাভের পথটাও উপস্থিত করতে হবে। তাছাড়া জনগণের অর্থনৈতিক-সামাজিক মুক্তির কর্মসূচীর ভিত্তিতে সমগ্র জনগণকে একটি ঐক্যবদ্ধ মোর্চায় সংগঠিত করার প্রশ্নটিও অতীব গুরুত্বপূর্ণ এ ক্ষেত্রে।
আমি মনে করি আমাদের দেশে এনজিও-গুলো এমন একটা প্রয়োজন আংশিকভাবে পূরণ করছে। অবশ্য বৈদেশিক নির্ভরতা এবং সেই সঙ্গে আদর্শহীনভাবে বৈষয়িক প্রেরণা সর্বস্বতার কারণে এনজিও বিপ্লবী কর্মপদ্ধতির মডেল হতে পারে না। এই মডেলের অপর একটি সমস্যা হল রাষ্ট্রের আমলাতন্ত্রের উপর নির্ভরতা। তবে এই মডেলের ভিতর থেকে বিপ্লবীদের অনেক কিছু শিক্ষণীয় আছে বৈকি! আর এ দেশে এনজিও-দের সমালোচনার সময় উগ্র ধর্মীয় শক্তির ব্যাপক উত্থান প্রতিরোধে তাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাটা কিন্তু স্মরণ করা উচিত। একমাত্র মতান্ধ ব্যক্তিরাই শুধুমাত্র নেতিবাচকভাবে এ দেশে এনজিও পদ্ধতির সমালোচনা করতে পারে।
হাঁ, এটা আমার নিজ অভিজ্ঞতা থেকেও বলছি। আমি বৈদেশিক সাহায্য নির্ভর একটি জাতীয় এনজিও সংগঠিত করে তার মাধ্যমে অর্জিত ফলাফল যেমন পর্যবেক্ষণ করে দেখেছি (১৯৮০ থেকে ১৯৮৬ পর্যন্ত) তেমন ওটা সম্পূর্ণ বাদ দিয়ে সম্পূর্ণ স্বাধীন ও স্বনির্ভরভাবে গ্রামীণ জনগণের মধ্যে উন্নয়ন ও সাংস্কৃতিক বা আদর্শিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে তার ফলাফলও পর্যবেক্ষণ করে দেখেছি (১৯৮৬ থেকে ১৯৮৯ এবং ১৯৯৩ থেকে ১৯৯৪)। এবং আমি দেখেছি প্রথমটার সঙ্গে আন্দোলনকে সংযুক্ত করা যায় না, কিন্তু দ্বিতীয়টি জনগণকে সামাজিক-রাজনৈতিক আন্দোলনে নিয়ে যায়। ভারতবর্ষে গান্ধী রাজনৈতিক আন্দোলনের ভিতর এমন একটি বিকল্প মডেল দিতে চেষ্টা করেছিলেন এবং তার সাফল্য ফেলনা নয়। সেখান থেকেও আমরা অনেক শিক্ষণীয় এবং গ্রহণযোগ্য উপাদান নিতে পারি আজকের যুগের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে।
যাইহোক, আমার অভিমত হল রাজনৈতিক আন্দোলন হবে মধ্য শ্রেণী বা মধ্যবিত্তের এবং ছাত্র-যুব শক্তির আন্দোলনের প্রধান রূপ। এখানে সাংস্কৃতিক আন্দোলন থাকবে বৈকি। তবে এর রাজনৈতিক দিককেই প্রধান হতে হবে। কারণ এই শ্রেণীকে ক্ষমতা দখল করতে হবে। অতীতের তুলনায় নগরায়ন ও আধুনিকায়নের যথেষ্ট বিস্তারের ফলে এবং সর্বোপরি বৈদেশিক রাজনৈতিক ও সামরিক শক্তির আধিপত্য না থাকার ফলে এখন মধ্য শ্রেণীর পক্ষে প্রধানত নিজ শক্তিতে ক্ষমতা দখল করা সম্ভব। কিন্তু মনে রাখতে হবে লুম্পেন আমলা-ধনিক ও প্রতিক্রিয়াশীল শাসক শ্রেণীর সহযোগী হিসাবে যে কোনো মুহূর্তে পশ্চাৎপদ সংস্কৃতি ও চেতনায় আচ্ছন্ন আম জনতা উঠে দাঁড়াতে পারে! সুতরাং এই আম জনতাকে ক্ষমতা দখলের প্রধান শক্তি নয় বরং সহায়ক শক্তি হিসাবে পেতে হবে। আর এর সহজ অর্থ হল বিপ্লবী মধ্য শ্রেণীকে অতি অবশ্যই শ্রমজীবী জনগণকে সংগঠিত করতে হবে। সেটা ক্ষমতা দখলের হাতিয়ার প্রথমে সেই অর্থে হবে না। কিন্তু ক্ষমতা দখলের পর ক্ষমতা সংরক্ষণের হাতিয়ার হবে।
অনেকের কাছেই বিস্ময়কর মনে হতে পারে। তবু বলি এ দেশে রাজনীতির উপর পশ্চাৎপদ আম জনতার এক ধরনের নিয়ন্ত্রণের যে পদ্ধতি উপনিবেশবাদী ইংরেজ শাসক শ্রেণী প্রতিষ্ঠা করে দিয়ে গেছে পাশ্চাত্য পদ্ধতির সেই বহুদলীয় তথাকথিত গণতন্ত্র এবং নির্বাচনের রাজনীতিটা মধ্য শ্রেণীর রাজনীতি ও সংস্কৃতির জাগরণ ও উথানের এক বড় বাধা। এটা সামরিক শাসকরাও বোঝে। এই পদ্ধতি এক দিকে মধ্য শ্রেণীকে বিভক্ত ও আত্মদ্বন্দ্বে জর্জরিত করে, অপর দিকে লুম্পেন ও প্রতিক্রিয়াশীল আমলা-ধনিকতন্ত্র এবং আম জনতার পশ্চাৎপদতার মধ্যে এমন এক দৃঢ় ঐক্য প্রতিষ্ঠা করে যার ফলে মধ্য শ্রেণীর ভিতর থেকে স্বাধীন, দেশপ্রেমিক, উৎপাদনশীল ও প্রগতিশীল শক্তির জাগরণ বা উত্থান অসম্ভব হয়ে থাকে। এই পদ্ধতিতে প্রতিক্রিয়াশীল শাসক শ্রেণী পশ্চাৎপদ আম জনতার সাহায্য নিয়ে রাজনীতিকে প্রতিক্রিয়াশীলতার অধীনস্থ করে রাখে। বস্তুত এ দেশে লুম্পেন রাজনীতির উথানের এক প্রধান পদ্ধতি হল পাশ্চাত্য পদ্ধতির বহু দলীয় নির্বাচনের রাজনীতি।
এটা ঠিক যে, জাতির প্রাথমিক রাজনৈতিক শিক্ষার জন্য বহুদলীয় রাজনীতির প্রয়োজন এক সময় ছিল। বিশেষত পরাধীনতার কালে এর গুরুত্ব ছিল। কিন্তু স্বাধীনতার পর থেকে আজ অবধি এটা উন্নত সমাজ ও জাতি গঠনের পথে বাধা হিসাবে প্রমাণিত হয়েছে। সুতরাং বিপ্লবীদের কাজ হল এ দেশে লুম্পেন আমলা-ধনিকতান্ত্রিক কাঠামোর অবসান ঘটিয়ে একটি প্রকৃত গণতান্ত্রিক কাঠামো প্রতিষ্ঠা করা। আর সেটা করতে গেলে শুধু আমলাতান্ত্রিক শাসন কাঠামো ভেঙ্গে মুক্ত হলে হবে না, একই সঙ্গে পাশ্চাত্য পদ্ধতির বহু দলীয় গণতন্ত্রের নামে লুম্পেন ধনিকের লুণ্ঠনবৃত্তি এবং আম জনতার পশ্চাৎপদতার যে নিয়ন্ত্রণ রাজনীতির উপর রয়েছে তা থেকে সমাজ, রাষ্ট্র ও রাজনীতিকে মুক্ত করতে হবে।
এর অর্থ হল পাশ্চাত্য পদ্ধতির বহু দলীয় রাজনৈতিক শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তে জাতীয় ঐক্যের ভিত্তিতে একটি গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা এ দেশে প্রকৃত ও উন্নত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার একমাত্র পথ। বিপ্লবের মাধ্যেমে এই জাতীয় ঐক্যের শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে সাংস্কৃতিক বিপ্লবে পরিণত করতে হবে। অবশেষে সাংস্কৃতিক বিপ্লবকে পরিপূর্ণ সামাজিক-রাজনৈতিক বিপ্লবে পরিণত করে একটা নূতন ও গণতান্ত্রিক সমাজ, জনগণ, জাতি ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। অর্থাৎ এটা হল সমগ্র সমাজ, জনগণ ও জাতির রূপান্তর বা পরিবর্তন সাধনের পদ্ধতি। আর এই সমগ্র পদ্ধতির ভিতর থাকতে হবে বিপ্লবকে কয়েকটি স্তর বা পর্যায়ে ভাগ করার ক্ষমতা। আর এটি বুঝতে হবে যে, বর্তমান সময়ে শ্রেণী সংগ্রামের প্রধান রূপটি সাংস্কৃতিক বা আদর্শিক এবং অপ্রধান রূপটি অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক।
কিন্তু বিপ্লব প্রসঙ্গে আমাদের একটি গুরুতর প্রশ্নের উত্তর পেতে হবে। কারণ প্রায় সকল মুসলিম সমাজের মতো আমাদের সমাজেও সমাজতলের সহিংসতার শক্তি নিয়ন্ত্রণের সমস্যাটি বিপ্লবের সামনে অতীব গুরুত্বপূর্ণ এক সমস্যা হয়ে আছে। একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলন ও অত:পর সাংস্কৃতিক বিপত্মবের মধ্য দিয়ে নূতন ভাবাদর্শিক ও বাস্তব কাঠামো নির্মাণের পরই মাত্র আমরা গণশক্তিকে মুক্ত করে গণ-বিপ্লবকে সম্পূর্ণতা দিতে পারব। কিন্তু সহিংসতার অন্ধ ও ধ্বংসাত্মক শক্তিকে প্রতিপক্ষ বা শত্রু যে প্রথমেই ব্যবহার করতে চেষ্টা করবে না তার নিশ্চয়তা কি? আর তা থেকে বিপ্লবী শক্তির আত্মরক্ষার পথ কি?
এর সহজ পথ হল জনগণকে সংগঠিত করার পাশাপাশি নারী শক্তির জাগরণ ঘটানো। হাঁ, বুঝতে হবে যে, যে নিরঙ্কুশ পুরুষবাদী ‘ভায়লেন্সের’ শক্তিটা সমাজে বিরাজমান তার উত্থান সম্ভব হয়েছে নারীকে নিরঙ্কুশভাবে দমন করে এবং সমাজ জীবন থেকে বিতাড়ন করে। সুতরাং যে মুহূর্তে নারী ঘরে বাইরে সবখানে ঐ ‘ভায়লেন্সের’ শক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়াবে সেই মুহূর্তে ঐ শক্তির অগ্রমণের পথটা বন্ধ হবে। কারণ মনে রাখতে হবে পুরুষ স্বয়ম্ভূ নয়। ঘরে তার মাতা, স্ত্রী, ভগ্নী বা কন্যা আছে। সাংস্কৃতিক বিপ্লব তাই প্রধানত নারীকে ভিত্তি করে দাঁড়াবে এবং এটা সম্ভব যে, সামগ্রিক বিচারে আমাদের সমাজে বিপ্লবের প্রধান রূপ হবে নারীবাদী।
এই একই কথা প্রযোজ্য প্রথাগত হিন্দু সমাজ সম্পর্কেও। ইতিপূর্বে আমি হিন্দু ধর্মকে ক্ষমতাচ্যুত অথচ নিরঙ্কুশ নারীর কৃষি ধর্ম বলেছি। বস্তুত এটা সমাজ বাস্তবতাকে বুঝতে গিয়ে একটা উপমার ব্যবহার। আর সেই উপমার মধ্যে রয়েছে নারীর নারীত্ব এবং মনুষ্যত্ব অবদমনের নির্দয় সত্য। প্রকৃতপক্ষে আদিম সমাজের নারীর অধিকার ও মর্যাদা কেড়ে নিয়ে শুধু তার প্রতীকী অধিকার ও মর্যাদা রাখা হয়েছে দেবী রূপের মাধ্যমে। কারণ আদিম চেতনায় নারী ছিল ভূমির উর্বরতা শক্তির, ফসল উৎপাদন শক্তির প্রতীক। আর এটা ভুলে গেলে চলবে কেন কৃষির উদ্ভব নারীর হাত দিয়ে! পশু পালন, বস্ত্র বয়ন ইত্যাদি ক্ষেত্রে নারীর অস্তিত্বের স্মৃতি অনেকাংশে মুছে ফেলা সম্ভব হলেও কৃষির ক্ষেত্রে নারীর অস্তিত্বের স্মৃতি মুছে ফেলা পুরুষের পক্ষে অত সহজ হয় নি। তাই আধুনিক কাল পর্যন্ত প্রায় সব সমাজে ফসল বা শস্য উৎপাদনের সঙ্গে নারীকে জড়িয়ে বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠানের উপস্থিতি কম বেশী রয়ে গেছে। কারণ কৃষি বড় বেশী প্রকৃতি নির্ভর। আর সেখানে মানুষ বার বার ফেরে তার সভ্যতার শৈশবের কালটাতে। হয়তো সে ফেরা ক্ষণিকের কিংবা প্রতীকী মাত্র।
সভ্য সমাজ ও আদিম সমাজের এক জটিল মিশ্রণ বা বিজড়নের কারণে হিন্দু সমাজে নারীর প্রতীকী ব্যবহারের এত ছড়াছড়ি। কিন্তু বাস্তবে এই সমাজে নারীর বিরুদ্ধে চলেছে সর্বাত্মক জিহাদ যার সর্বোচ্চ প্রকাশ ঘটেছে পুরুষের বহু বিবাহ, পৈত্রিক সম্পত্তিতে নারীর অধিকারহীনতা ও সতীদাহ প্রথায়। বস্তুত নারীকে এই সমাজে অবতলে তলিয়ে দিয়ে তার জায়গায় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে পুরুষকে। আর এইভাবে পুরুষই হয়েছে নারী। অর্থাৎ পুরুষের এক নির্বীর্য, কাপুরুষ, পঙ্গু, বিকৃত ও অধ:পতিত প্রকাশ সেটা। ইসলামের আশ্চর্য পরিপূরক হিন্দু ধর্ম। তবে পদ্ধতিটা ভিন্ন। মুসলিম সমাজে নারীকে সমাজ অবতলে পাঠিয়ে গিয়ে ভায়লেন্ট পুরুষকেই একমাত্র সত্য করা হয়েছে এবং নারীকে তার আদলে ও আকাঙ্ক্ষায় গড়তে চেয়ে নারীর মনুষ্যত্বপূর্ণ নারীত্বকে বিনষ্ট করা হয়েছে পুরুষের মনুষ্যত্বপূর্ণ পৌরুষের মতোই। অন্য দিকে হিন্দু সমাজে নারীকে সমাজ অবতলে পাঠিয়ে দিয়ে পুরুষ তার জায়গাটা নিয়ে নারীর রূপেই নিজেকে তুলে ধরতে চেয়েছে। আর এইভাবে উভয়ের মনুষ্যত্বময় নারীত্ব ও পৌরুষের বিনষ্টির কারণ হয়েছে। অবশ্য এটা মনে রাখতে হবে যে, হিন্দু সমাজের পদ্ধতিটা ইসলামের মতো সহজ-সরল নয়। বরং অত্যন্ত জটিল, ফলে বহুমাত্রিকও। আর এই কারণে তার মূল রূপ বা মূল বৈশিষ্ট্য কিংবা প্রবণতাকে বুঝতে কিংবা চিনতে ভুল হতে পারে।
হিন্দু সমাজের এই মূল বৈশিষ্ট্যের কারণে নারীকে মুক্তি দিতে না পারলে সমাজতল থেকে পুরুষেরও বল-বীর্যবান, সাহসী, বৌদ্ধিক ও মানবিক শক্তির মুক্তি অসম্ভব হযে থাকবে। অর্থাৎ উভয় সমাজেই সামাজিক মুক্তিটা প্রকৃতপক্ষে নারীর মুক্তির উপর নির্ভর করছে। সব সমাজের জন্যই এটা কম বেশী সত্য। তবে মুসলিম ও হিন্দু এই উভয় সমাজের জন্য সবচেয়ে বেশী সত্য।
নিশ্চয় মুসলিম বা হিন্দু কোনো সমাজেরই অবস্থাটা আর আগের মতো পুরোপুরি নেই। বাংলাদেশেও নারী-পুরুষ সম্পর্কের ক্ষেত্রে অনেক পরিবর্তন এসেছে। আইনে অনেক অধিকার দেওয়া হয়েছে যে অধিকারগুলো এই সমাজ বা ধর্ম অস্বীকার করে রেখেছিল। বহু বিবাহ এখন অনেক কঠিন। ভারতে হিন্দু আইনে ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয়েছে। বিশেষত আধুনিক শিক্ষা এবং যুগের প্রভাব অনেক পরিবর্তনকে অনিবার্য করেছে। কিন্তু এই সব আইন এবং পরিবর্তনের প্রকৃত ভূমিকাটা অনেকাংশে প্রলেপের মতো। এসব কোনো কিছু পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রে নারীর প্রকৃত হীন ও অনিশ্চিত অবস্থাটাকে তেমন একটা বদলাতে পারে নি। এভাবে সমাজের মানস অবতলে নারীর অবস্থানের মৌলিক পরিবর্তন ঘটে না, ঘটতে পারে না।
বাংলাদেশে সংসদে নারীর জন্য ত্রিশ আসনের কোটা রাখা হয়েছে। আপাত দৃষ্টিতে মনে হতে পারে যে, এটা নারী অধিকারের প্রকাশ। কিন্তু এই মহিলা সাংসদরা কাদের ভোটে নির্বাচিত হয়? পুরুষ সাংসদদের দ্বারা নির্বাচিত হয়ে তারা নারীর শক্তি ও স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করবে? এরা তো পুরুষ সংসদের অলঙ্কার কিংবা আবরণী মাত্র। এই নিয়ম প্রকৃতপক্ষ নারীর মর্যাদা ও অধিকারের প্রতি অবমাননা।
যে কথা আগেই বলেছিলাম নারীর একটা রাষ্ট্র চাই। অর্থাৎ তার চাই নিজস্ব ক্ষমতা যন্ত্র। সেটা বিস্তৃত হবে উপরে সংসদ থেকে নীচে জেলা, থানা বা উপজেলা, ইউনিয়ন হয়ে গ্রাম পর্যায় পর্যন্ত। হাঁ, প্রতিটি স্তরে নারীদের নিজস্ব প্রতিনিধিত্ব থাকতে হবে। নারীদের দ্বারা নির্বাচিত হয়ে তারা নারীদেরকে, সমাজের অর্ধেক অংশ নারীদেরকে প্রতিনিধিত্ব করবে। তারা নারীদের স্বার্থের সংরক্ষক হবে। এরই প্রতিফলন ঘটতে হবে সেনাবাহিনী, প্রশাসন, পুলিশ, বিচার থেকে শুরু করে রাষ্ট্র ও সমাজের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে।
বিশেষ করে প্রতিটি মুসলিম সমাজে নারীর অবস্থা সবচেয়ে দুর্গত। এবং এই সমাজের পশ্চাৎপদতা ও দুর্গতির সবচেয়ে বড় কারণ এটা। আর তাই সব মুসলিম সমাজে উন্নয়নের প্রয়োজনে প্রথম পদক্ষেপ দিতে হয়েছে নারীর দুর্গত অবস্থার পরিবর্তন ঘটাবার জন্য। তুরস্কে কামাল আতাতুর্কও তা-ই করেছিলেন। আর তিনিই ইসলামী জগতের ভিতর থেকে স্বাধীনভাবে অগ্রযাত্রার প্রথম সূচনাকারী। যে সব দেশে ইউরোপীয় শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সে সব দেশে তারাই নারীর অবস্থার পরিবর্তন যতটা হোক করে গেছে।
কিন্তু এসবই তো সাময়িক এবং ভঙ্গুর আবরণ। বিশেষ ধর্মের মাধ্যমে যে চেতনাটা সমাজ অবতলে, প্রতিটি মানুষের মানস অবতলে লালিত হয় সেটা কিন্তু এই পরিবর্তন বিরোধী। সুতরাং যখন পরিবর্তনের প্রথম উচ্ছ্বাসটা কেটে যায় কিংবা সমাজ ও রাষ্ট্রে সঙ্কট দেখা দেয় তখন সমাজ- মনে যে প্রতিক্রিয়া জাগে তা তাকে পূর্বের চিরচেনা অবস্থানটাতে ফিরিয়ে নিতে চায়। তখন শুরু হয় উল্টো যাত্রা। আজ মুসলিম পৃথিবীর দিকে তাকালে সেই উল্টো যাত্রার রূপটাকে চিনতে কি কষ্ট হয়? নারীর হাতে ক্ষমতা না দিয়ে এই সমাজে মানবিক শক্তির মুক্তি নেই। এই সমাজের মুক্তির মূল চাবিটাই হল নারীর ক্ষমতা। যত কাল সেই ক্ষমতাটা নারীকে দেওয়া না হবে তত কাল মুসলিম সমাজে যে কোনো মুক্তি এক সুদূর পরাহত কল্পনা হয়ে রইবে। ফলে আধুনিক যুগের দায় পরিশোধের জন্য আমাদেরকে অবিরামভাবে পাশ্চাত্যকে প্রভু মেনে ওদের পায়ে পড়তে হবে। ওদের কাছে ঋণগ্রস্ত হয়ে থাকতে হবে। ঋণ তো শুধু অর্থ নয়। জ্ঞান, বুদ্ধি, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি সবকিছুই ঋণ হতে পারে। আর ঐ মহাজনের চক্রবৃদ্ধি হারে ঋণের সুদটা শুধতে গিয়ে আমাদের কিছুই রইবে না, ঐ এক অলোকবাদী ধর্ম ছাড়া!
বিপ্লবের মধ্য দিয়ে নূতন গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রাকে সহজ ও স্বচ্ছন্দ করার জন্য প্রথম থেকেই নারীর নিজস্ব ক্ষমতা কাঠামো গড়ে তোলার প্রয়োজন অপরিমেয়। প্রকৃতপক্ষে জাতীয় ঐক্যের গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার ভিতর স্বৈরতন্ত্রের বিকাশ সম্ভাবনা রোধের এবং গণতন্ত্র রক্ষার সবচেয়ে বড় শক্তি হচ্ছে নারীবাদী বিপ্লবী আদর্শ। বিপ্লবী রাজনৈতিক নেতৃত্বই তো আগামী সমাজের সংগঠক। ফলে তা তার নিজ আদলে গড়বে আগামী সমাজকে। আর এই কারণে তার ভিতরে যদি গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো রক্ষা করা না যায় তবে তা একটি গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্র গড়তে ব্যর্থ হবে। আর বিপ্লবী নেতৃত্বে নারীর স্বতন্ত্র অবস্থান ও ভূমিকা গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্র নির্মাণের সবচেয়ে বড় রক্ষাকবচ হবে। গণতন্ত্রের মূল একটি বৈশিষ্ট্য হল দ্বৈততা বা বহুত্ব। সেটা সবচেয়ে কার্যকরভাবে রক্ষিত হবে এই পদ্ধতিতে।
প্রকৃতপক্ষে আমাদের গণতন্ত্রের ধারণাকে হতে হবে পাশ্চাত্য ধারণার আধিপত্য মুক্ত এবং স্বাধীন। আর এই কারণে তা জাতীয় – জাতীয়তাবাদী। আমাদের গণতন্ত্রও তাই জাতীয় গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদী গণতন্ত্র। এই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার দায়িত্বই ন্যস্ত হবে জাতীয় ঐক্যের কর্মসূচীর ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত একটি জাতীয় সরকারের হাতে। এই সরকারকে আমি এখানে বলেছি জাতীয় ঐক্যের সরকার।
জাতীয় ঐক্যের সরকার বা গণতন্ত্রের কথা বলায় অনেকে হয়তো পুনরায় বাকশালের প্রসঙ্গ তুলবেন। সে প্রসঙ্গে ইতিপূর্বে আলোচনা করেছি। তবে যেহেতু জাতীয় ঐক্যের গণতন্ত্রের প্রয়োজন তুলে ধরায় বাকশাল প্রসঙ্গে কথা উঠতে পারে সেহেতু কিছু পুনরুক্তি হবে জেনেও বলি যে, বাকশাল তেমন গণতন্ত্রের একটা ধারণা উপস্থিত করেছিল বৈকি। কিন্তু আগেই বলেছি যে, ওভাবে কিছুই হয় না। ওটা গণতন্ত্রও ছিল না, সমাজতন্ত্রও নয়। কারণ বাইরের রূপ কিংবা নাম বা সাইন বোর্ড দেখলেই তো হবে না। ওটা কিভাবে তৈরী হয়েছিল, কাদের নিয়ে হয়েছিল সেটাও তো দেখতে হবে। মাটি দিয়ে আম বানিয়ে তাতে আমের রঙ্ মাখিয়ে দিলেই আম হল?
মুজিবের প্রকৃত ভূমিকা ছিল নেতিবাচক। পাকিস্তান ধ্বংসের জন্য প্রয়োজনীয় একটা প্রকাশ্য কর্মসূচী এ দেশের বিপ্লবীদের দরকার ছিল। নিজেরা তা দেয় নি বা দিতে পারে নি। মুজিবের দেওয়া ৬ দফাটাকে ভিন্নভাবে ব্যবহার করে সে কাজটা করিয়ে নিয়েছিল। পাকিস্তান ভাঙ্গার পর মুজিব তার প্রতিশোধ নিয়েছেন বৈকি! সকল রকম বিপ্লবীকে ছত্রভঙ্গ, বিপর্যস্ত কিংবা ধ্বংস ক’রে। ঐটুকুর জন্য সাম্রাজ্যবাদ এবং এ দেশের প্রতিক্রিয়ার শক্তির কাছে তাঁর প্রয়োজন ছিল। যখন বিপ্লবীরা পরাস্ত হল তখন তাঁর নেতিবাচক ভূমিকার প্রয়োজন শেষ হল। সুতরাং তাঁর প্রয়োজনও ফুরালো সবার কাছে। তারপর কে তাঁকে বাঁচিয়ে রাখবে? যারা তাঁকে বিপ্লবীদের ধ্বংসের জন্য বাঁচিয়ে রেখেছিল কাজ সারা হলে তারাই তাঁকে মারল। মাঝখানে থাকল ঐ বাকশাল। হাঁ, ঐ রকম একটা কিছু হলে ভাল হত। কিন্তু সেটা মুজিবের হাত দিয়ে? করতে চাইলেই করা যায়? ৬২ রকম রোগ সারানো, ‘ওষুধের’ মতো একটা কিছু দিয়ে বললেই হল এটা ওষুধ? ওটা মানুষের সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র সম্পর্কে যাদের কোনো ধারণা নেই তাদেরকে বোঝানো যেতে পারে। কিন্তু মানুষের ব্যবস্থা কি শুধু ফর্মুলা যে, যে কোনো এক জায়গা থেকে নিয়ে এসে একটা কমিটি খাড়া করে দিলেই হল? মানুষ লাগে না? ঐ ফর্মুলার জন্য মানুষ গড়ার পদ্ধতি লাগে না? এ দেশের কমিউনিস্ট বিপ্লবীদেরকে যত গালগালিই করি ঐ রকম এক একজন মানুষ তৈরী করা মুজিববাদীদের কর্ম নয়। পাথর চিপলেই রস বের হয়? খুব বেশী জোর করলে গুঁড়ো হয়ে বালি বের বের হবে। ভিতরে বস্তু লাগে। সেই রস-বস্তু না থাকলে রস আসবে কোথা থেকে?
কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের প্রতি সমালোচনা ও হল বিপ্লবীদের আত্মসমালোচনা। কিন্তু দেশের মুক্তির পথটা অনেকাংশেই বেরিয়ে আসবে ভ্রান্তিতে আবদ্ধ এই চেতনার ভিতর থেকে, সাহসী, আত্মত্যাগী, সৎ এবং হাজার হাজার বছরের মানুষের মহৎ সংগ্রাম ও সাধনার উত্তরাধিকার দিয়ে গড়া এই আকাঙ্ক্ষার চেতনার ভিতর থেকে। আমার সমালোচনার উদ্দেশ্য, আঘাতের উদ্দেশ্য এদেরকে নাকচ করা নয়। এদের ভুলটা নাকচ করা এবং এদের মহৎ, তেজস্বী ও সাধক চেতনাকে মুক্ত করা এক ভ্রান্তির কাঠামো থেকে।
ভাষা আন্দোলন এ দেশের বাঙ্গালী জাতিকে একতাবদ্ধ করেছিল। সেই ঐক্যের প্রতীক হয়ে উঠেছিল আওয়ামী লীগ। ১৯৪৯ সালে গঠিত হয়ে ১৯৫৭ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ছিল বাঙ্গালীর ঐক্যের সবচেয়ে বড় শক্তি। অবশ্য পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন হয়ে সোহরাওয়ার্দী-মুজিবের ভূমিকার ফলে ১৯৫৬-তেই সেই ঐক্য বিনষ্টের পথ তৈরী হয়। সোহরাওয়ার্দী-মুজিবের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের প্রধান অংশ আওয়ামী লীগের আদর্শ ও রাজনীতি পরিত্যাগ করলে ১৯৫৭ সালে ভাসানী আওয়ামী লীগ ত্যাগ করে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি গঠন করেন। এইভাবে সোহরাওয়ার্দী-মুজিব বাঙ্গালী জাতির ঐক্য বিনষ্ট করেন। বাঙ্গালী মুৎসুদ্দি ও লুম্পেন মধ্যবিত্তের এবং তাদের অনুসারী জনতার নেতা হলেন সোহরাওয়ার্দী-মুজিব। বাঙ্গালী প্রগতিশীল ও আদর্শনিষ্ঠ মধ্যবিত্ত ও জনগণের নেতা হলেন ভাসানী। বাঙ্গালীর নেতৃত্বের ঐ আত্মবিক্রয় ও সুবিধাবাদী নীতিহীনতার কাছে আত্মসমর্পণের বিরুদ্ধে স্বাধীন চেতনার যে পতাকাটি ভাসানী তুলে ধরেছিলেন সেই পতাকা এ দেশে সকল প্রগতিশীল ও বামপন্থীর প্রতীক হয়ে থেকেছে।
বাঙ্গালীর বিবেকের সর্বশ্রেষ্ট কণ্ঠ হয়ে থেকেছেন যে ব্যক্তি তিনি হলেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। সকল সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও তিনি এ সমাজের মহত্তম ঐতিহ্যের ধারক এবং নেতা। বামপন্থীরা তাঁর আশ্রয়ে ও নেতৃত্বে লালিত হয়েছে। এ দেশের সকল স্বাধীন ও বিপ্লবী চেতনা প্রকৃতপক্ষে তাঁর উত্তরাধিকারকে বহন করে।
প্রায় চল্লিশ বৎসর আগে এ দেশের বাঙ্গালী জাতির জীবনে যে ঐতিহাসিক বিভক্তি ঘটে আজ অবধি এ জাতি তার জের টেনে চলেছে। কিন্তু চল্লিশ বৎসরে দেশের ইতিহাস ও বাস্তবতায়ও অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। বহু কিছুই আর আগের মতো নেই। ভাসানীর সূচিত কিংবা লালিত ধারাটি আপাত দৃষ্টিতে লুপ্ত। কিন্তু কবির ভাষায় বলতে হয় ‘যে নদী মরুপথে হারালো ধারা/জানি হে, জানি তাও হয় নি হারা।’ এটি হল আদর্শের ধারা। অবশ্য এই আদর্শের ধারা যে একেবারে লুপ্ত তাও কিন্তু নয়। আজো এ দেশের প্রকাশ্য বামপন্থী বা কমিউনিস্ট সংগঠনগুলো কোনো না কোনো রূপে এই আদর্শের ধারাকে রক্ষা করছে। তাদের অনেক ভ্রান্তির মধ্যেও এই সত্যকে অস্বীকার করার উপায় নেই।
আর আওয়ামী লীগ ১৯৫৭-তে আদর্শ পরিত্যাগের মাধ্যমে যে ধারার সূত্রপাত করে সেটাও আর আগের রূপে নেই। সেখানেও অনেক পরিবর্তন হয়েছে। যদিও ওসব তার কৌশলগত পরিবর্তন, চরিত্রগত নয়। তবু তার ভিতরেও একটা পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা জন্ম নিয়েছে বৈকি। দীর্ঘ অভিজ্ঞতা, বিপর্যয় নিশ্চয় তার চেতনার জগতেও অনেক পরিবর্তন আনছে। অন্তত একটা পরিবর্তনকে বরণ করার উপযোগী তাকে করছে। আর এইভাবে সমগ্র জাতিই এক বিরাট পরিবর্তনের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে।
যে কথা ইতিপূর্বে বলেছিলাম একটা জাতির জাতি হয়ে উঠতে অনেক মূল্য দিতে হয়। মুসলমান বাঙ্গালীর ভিতর এই জাতি চেতনা অতীতে কোন্ কালে ছিল? আর শুধু মুসলমান কেন? হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে বাঙ্গালী জাতিসত্তার ভিতর প্রকৃতপক্ষে এই চেতনা অতীতে কোনো কালে ছিল না। ভারতবর্ষের মাটিতে অতীতে কোনো কালে জাতি চেতনা দাঁড়াবার জন্য কোনো শক্ত জমি পায় নি। উপরে ছিল রাজবংশ অথবা রাজা। যার পরিচয়ে ছিল ভূখণ্ড বা প্রজাবৃন্দের রাজনৈতিক পরিচয়। কিন্তু নীচে ছিল বর্ণজাতি, গোষ্ঠী এবং সর্বোপরি ধর্মগত পরিচয়ের বিভাজন। এগুলোই ছিল এখানে ‘জাতি’। প্রকৃতপক্ষে সুদীর্ঘ কালের ইতিহাসে এ দেশে জনগণের ঐক্যের সবচেয়ে বড় শক্তি হয়ে থেকেছে অলোকবাদী চেতনা উদ্ভূত ধর্ম। আর এর ফলে এই ধর্মকে কেন্দ্র করে এখানে ঐক্য এবং বিভেদের শক্তিগুলো সমাজে সবচেয়ে বেশী ক্রিয়াশীল থেকেছে। ফলে একটি প্রকৃত লৌকিক চেতনা যেমন দাঁড়াতে পারে নি তেমন অভিন্ন ভাষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে রাষ্ট্র ও রাজনীতি ভাবনা সমন্বিত হয়ে একটি জাতিবোধও কেনো কালে এই উপমহাদেশে দৃঢ়ভাবে দাঁড়াতে পারে নি।
কে বলেছে এই জাতিবোধ আধুনিক কালের দৃষ্টি? ইউরোপের পণ্ডিতদের শেখানো বিদ্যা আর বুদ্ধি নিয়ে যাঁরা ইউরোপের অধ্যায় থেকে আধুনিক কালের ইতিহাসের পথে যাত্রা শুরু করতে চান তাঁরাই অমন চেতনা নিয়ে ইতিহাসকে বিচার করেন। আসলে এ হল বুদ্ধিবৃত্তির জগতে ইউরোপের দাসত্ব। চীন কি ছিল? জাপান কি ছিল? ভিয়েতনাম কি ছিল? এমন কি আরবদের ভিতর ইসলাম-পূর্ব কাল থেকেই আরব হিসাবে যে গৌরব ও স্বাতন্ত্র্য বোধ ছিল তার খবর কি আমরা রাখি? ইরানের অভিজ্ঞতা কি বলে? যখন ইরান ইসলামী আরবের তরবারীর শক্তির কাছে হেরেছে তখন তা ইসলাম গ্রহণ করেও সুন্নী আরব থেকে নিজ স্বাতন্ত্র্য রক্ষার জন্য ক্রমশ শিয়া ধর্মমত দাঁড় করিয়েছে।
কিন্তু দুর্ভাগা এই ভারতবর্ষে কোনো কালে জাতি বোধ ছিল না। তা, জাতি বোধ আসবে কোথা থেকে? এখানকার ‘জাতি’ তো ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, কায়স্থ, বৈদ্য, শূদ্র, চণ্ডাল, ডোম, শেখ, সৈয়দ, মোগল এবং আরও সব অসংখ্য ভাগ, উপ-ভাগ! ভারতবর্ষের এত বিভাজনের মধ্য দিয়ে এ দেশে বৃহত্তর জাতি বোধ জাগার উপায় ছিল না বলে শেষ পর্যন্ত একটি ভাবাদর্শ হিসাবে অলৌকিক বিশ্বাস নির্ভর ধর্মকে এসে নীচ তলায় ঐক্য রক্ষার দায়িত্বটা নিতে হয়েছে আর এর উপর ভিত্তি করে উপরে দাঁড়িয়ে থেকেছে রাজনৈতিক ঐক্য ও বিভাজন তথা রাজবংশগুলোর রাজ্য প্রতিষ্ঠা, বিস্তার ও পারস্পরিক প্রতিযোগিতার ইতিহাস।
এককেন্দ্রিক ও ঐক্যবদ্ধ ভারত-রাষ্ট্র মানে নীচ তলায় সেই ধর্মের শক্তিকে অবলম্বন করে ঐক্য রক্ষার প্রয়াসের অনিবার্যতা। বাংলাদেশের সৌভাগ্য যে, ভারতবর্ষের কয়েক হাজার বৎসরের ঐ অশুভ চক্র ভেঙ্গে বেরোতে পেরেছে। হাঁ, সেও ছিল এক ভুলের মধ্য দিয়ে আসা। সেই ভুল ছিল পাকিস্তান আন্দোলন। এক ধর্ম-সাম্প্রদায়িক আন্দোলন, যা ছিল ইংরেজ উপনিবেশবাদীদের এ দেশের জনগণের স্বাধীনতা আন্দোলনকে, বিভক্ত ও বিপথগামী করার হাতিয়ার। তবু মুসলিম লীগের পাকিস্তান আন্দোলন ভারতবর্ষের বিপুল ক্ষতি সাধন করে এক বিরাট কল্যাণও করেছে। সেটা হল অখণ্ড ভারত-রাষ্ট্র গড়ার স্বপ্নকে ভাঙ্গা।
মুসলিম লীগও মুসলমান ভারতীয়দের জন্য এক অখণ্ড ভারত-রাষ্ট্র গড়তে চেয়েছিল। পাকিস্তান হল মুসলমান সম্প্রদায়ের সেই অখণ্ড, কেন্দ্রীভূত ভারত-রাষ্ট্রের রূপায়ন। কিন্তু পাকিস্তান হয়েছে যুগ যুগান্তের আলোকবাদ-ভাগ্যবাদ নির্ভর চেতনার হাত থেকে ভারতবর্ষের মুক্তির পথটা খুলে দেবার জন্য ইতিহাসের অচেতন হাতিয়ার। এই অর্থে ইংরেজও ভারতবর্ষের চরম ক্ষতিটা করতে চেয়ে অচেতনভাবে এক বিরাট উপকারও করে দিয়ে গেছে। জিন্নাহর ক্ষমতা লোভ এবং ইংরেজের কূটিলতা ও ধূর্ত স্বার্থবুদ্ধি একত্র হয়েই এই উপকার করেছে। এবং অবশ্যই নেহরুরও ক্ষমতা লোভ তাদের সেই সুযোগ করে দিয়েছে।
পাকিস্তান ও ভারত-রাষ্ট্র এই উভয় রাষ্ট্রে যদি ভারত বিভক্ত না হত তবে কি হত? প্রথমে থাকত হিন্দু ও মুসলমান এই উভয় ধর্ম-সম্প্রদায়ের দ্বন্দ্ব আর সেহেতু তাদের ঐক্য বা সমন্বয়ের অন্তহীন প্রয়াস। দ্বিতীয়ত, যেহেতু ভারতকে এক অখণ্ড ও কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্রে ধরে রাখার জন্য জাতিসত্তাগুলোর স্বাতন্ত্র্যকে অস্বীকার করতে হত সেহেতু বিভিন্ন ভাষা ও সংস্কৃতির লৌকিক কাঠামোকে দুর্বল করার জন্য ঐক্যের ভাবাদর্শিক কাঠামো হিসাবে প্রচলিত ধর্মগুলোকে অবলম্বন করতে হত। ফলে ভারতের রাষ্ট্রীয় ঐক্য ও অখণ্ডতাকে রক্ষা করতে গিয়ে লোকবাদী ও বিজ্ঞান চেতনাকে বিসর্জন দিতে হত কিংবা এটাকে অধীনস্থ করতে হত অলোকবাদী ও অবিজ্ঞান চেতনার ধারক ধর্মগুলোর। আজ ভারত-রাষ্ট্রের দিকে দৃষ্টি দিলে এই সত্য বুঝতে এতটুকু কষ্ট হয় না। সংখ্যাগুরুর ধর্ম হিসাবে তা হিন্দু ধর্মের উপর জোর দিতে বাধ্য। কিন্তু ইসলামকেও তা যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে সংরক্ষণ করতে বাধ্য হচ্ছে। এমন কি ’৪৭-এ ভারত ভাগের অমন এক তিক্ত অভিজ্ঞতার পরও। ভরত ভাগ না হলে এটা আরও অনেক বেশী পরিমাণে তা করতে বাধ্য হত। পাকিস্তান বিভিন্ন জাতির মধ্যে ঐক্যানুভূতি জাগ্রত করতে গিয়ে ইসলামকে ব্যবহার করেছিল। সেখানে তা আজও তা-ই করছে। ইসলাম ছাড়া পাকিস্তানের বিভিন্ন জাতির মধ্যে এককেন্দ্রীভূত রাষ্ট্র রক্ষার আর কোনো শক্তিশালী ভিত্তি নেই।
যাইহোক, ভারতবর্ষের রাজনৈতিক বিভাজনটা দরকারী ছিল। জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে সেটা সম্ভব ছিল না প্রচলিত ধর্মের দোর্দণ্ড প্রতাপের ফলে, যা এ দেশকে মধ্যযুগের অন্ধকারে ধরে রাখার হাতিয়ার মাত্র। জাতীয়তাবাদ মাথা তুলতে পারে নি বলে প্রচলিত ধর্ম ইতিহাসের অচেতন হাতিয়ার হয়ে কাজটা করেছে। বস্তুত ভারতবর্ষ ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্র হলে হিন্দু ও ইসলাম এই উভয় ধর্মের সংঘাত ও ঐক্যের প্রয়াসে সর্বনাশটা হত লোকবাদী চেতনার। ভারত বিভাগের মধ্য দিয়ে লোকবাদী চেতনার উথানের জায়গাটা সৃষ্টি হয়েছে অন্তত বাংলাদেশের এই ভূখণ্ডে। কারণ লোকবাদকে দু’টো ধর্মের ঐক্যবদ্ধ শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করার পরিবর্তে একটি ধর্মের আধিপত্যের বিরুদ্ধেই লড়তে হয়েছে এ দেশে। এটা ঠিক যে ভারত ভাগের ফলে অপরিমেয় মূল্য দিতে হয়েছে ভারতবর্ষের মানুষকে, বাংলার মানুষকেও। কোটি কোটি মানুষকে মূল্য দিতে হয়েছে সমগ্র ভারতবর্ষে। লক্ষ লক্ষ মানুষ নিহত হয়েছে, লক্ষ লক্ষ নারী ধর্ষিত হয়েছে। সুবিপুল অশ্রু আর রক্তের স্রোতে মাটি ভিজেছে। এই সবই সত্য। কিন্তু ইতিহাসের গতি অন্ধ। মানুষ যদি চক্ষুষ্মান না হয়, ফলে তাকে সঠিক পথ দিতে না পারে তবে তার রথচক্র মানুষের উপর দিয়েই ওভাবে চলে যায়। ওটার কাছে মানুষের ক্রন্দনের কি মূল্য! অন্ধ, বধির দেবতা কি শোনে, না দেখতে পায়?
ভারতবর্ষের মাটিতে কোনো একটি জাতির প্রচলিত ধর্মের নিগড় ভেঙ্গে বেরিয়ে জাতি চেতনাকে অবলম্বন করে দাঁড়াবার জন্য একটা স্থান বা ‘স্পেস্’ দরকার ছিল। কারণ তা ছাড়া লোকবাদী চেতনা দাঁড়াবার জন্য প্রকৃতপক্ষে কোনো ভিত্তি পেত না। পাকিস্তান আন্দোলন মুসলমান বাঙ্গালীকে এমন একটা ভূখণ্ড দিয়েছিল যেটা ইসলাম ধর্মের পরিচয়ের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হলেও তাকে অন্যান্য জাতির সঙ্গে ঐক্য প্রয়াসে নিজের জাতি বোধ ও লোকবাদী চেতনার বিকাশের পথটা রুদ্ধ করতে হয় নি। বরং সকল মুসলমানকে নিয়ে এক অখণ্ড রাষ্ট্র রক্ষার স্বপ্নটা ভাঙ্গতে তার দেরী হয় নি। তার মাতৃভাষা বাংলার উপর হাত পড়ার সাথে সাথেই তার মোহমুক্তি ঘটেছে। হাঁ, মুসলমান বাঙ্গালী তার বাঙ্গালী পরিচয় বাদ দিয়ে মুসলমান বা পাকিস্তানী হতে রাজী ছিল না। তাই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সাথে সাথেই সে বাংলা ভাষাকে শক্ত করে ধরতে চেয়েছে উর্দূর আধিপত্য ও আগ্রাসনের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে চেয়ে। ওটা ১৯৪৭-এই বোঝা গিয়েছিল। ১৯৪৭-এর ১৪ই আগস্টের পর থেকেই উর্দূকে বাঙ্গালীর উপর চাপানো এবং বাংলা ভাষাকে অবজ্ঞা করার বিরুদ্ধে যে ক্ষোভ ও প্রতিবাদ জাগে সেটা ১৯৪৮-এই ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটায়। ১৯৫২-তে এই আন্দোলন ছাত্র-গণ-অভ্যুথানের রূপ পায়। এবং প্রকৃতপক্ষে পাকিস্তানের ধর্মীয় ভাবাদর্শটি ঐ অভ্যুথানের আঘাতে শেষ পর্যন্ত মৃত্যু বরণ করে।
ভাষা আন্দোলন এ দেশে যে লোকবাদী গণতান্ত্রিক ও জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটায় ভাসানী সেই আন্দোলনকে একটা সংহত রূপ দান করেন একটা লোকবাদী ও অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল গঠনের ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করে। তিনিও মুসলিম লীগের পাকিস্তান আন্দোলনের মধ্য দিয়েই এসেছিলেন। তা সত্ত্বেও রাজনৈতিক সাম্প্রদায়িকতাবাদের কাঠামো মুক্ত হতে তাঁর বেশী সময় লাগে নি। ১৯৪৯-এ পাকিস্তান মুসলিম লীগ পরিত্যাগ করে আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা করলেও ১৯৫৫-তেই মুসলিম শব্দ বাদ দিয়ে সংগঠনের নাম করলেন আওয়ামী লীগ। আসলে এ দেশের মুসলমান পরিচয়ধারী বাঙ্গালীর বাঙ্গালী জাতি হবার যে ঐতিহাসিক অনিবার্যতা ছিল সকল সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও তিনি সেটিকে প্রবলভাবে ধারণ করেছিলেন। ভারতবর্ষের বিশাল কাঠামো থেকে মুক্ত হয়ে পাকিস্তানের অধীনে বাঙ্গালী যে ভূখণ্ডটি লাভ করল সেটি মূল পাকিস্তান থেকে বহু দূরে। এবং এটাকে সেখান থেকে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে স্বাধীন করে নিতে পারলে লোকবাদী বাঙ্গালী জাতির উত্থান সম্ভব। ২১ দফার চেতনার উপর দাঁড়িয়ে পাকিস্তান থেকে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার কৌশলগত প্রথম উচ্চারণটা তিনিই করেন ১৯৫৭-তে। সেটা ছিল ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে অর্জিত চেতনার প্রথম সংহত আত্মঘোষণা। এই চেতনার বিরুদ্ধেই দাঁড়ান ১৯৪৬-এর ‘গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং’-এর নায়ক হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং তাঁর শিষ্য শেখ মুজিবুর রহমান।
সোহরাওয়ার্দী শুধু পাকিস্তান আন্দোলনের অন্যতম নেতা ছিলেন না, কলকাতায় হত্যাযজ্ঞ সমাধা করে তিনি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠাকে অনিবার্য করেন। অবশ্য একট পর্যায়ে অবিভক্ত স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে শরৎ বসুর সঙ্গে তাঁর একটা সমঝোতা হয়। কিন্তু এত কাল অখণ্ড ভারত আর পাকিস্তান আন্দোলনের গতিধারা সৃষ্টি করে হঠাৎ তার মোড় ঘোরাতে চাইলেই তা আর পারা যাবে কেন? আর ‘গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং’-এর পর হিন্দু-মুসলমান বাঙ্গালীর ঐক্যের ভিত্তিটাই বিনষ্ট হয়েছিল। বরং অনিবার্য হয়েছিল পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা।
তবু অখণ্ড ও এককেন্দ্রিক ভারত-রাষ্ট্রের পরিবর্তে পাকিস্তানটাই ঐ সময় দরকার ছিল। অখণ্ড ভারত-রাষ্ট্র ছিল একটা বিষ। পাকিস্তান ছিল আর এক বিষ। বিষ দিয়ে বিষ ক্ষয়ের জন্য পাকিস্তানের প্রয়োজন ছিল। ভারত ভাগ হবার পর পাকিস্তান নামে বিষটাকে ছুঁড়ে ফেলা উচিত ছিল। ভাসানী সেটা চেয়েছিলেন। কিন্তু সোহরাওয়ার্দী-মুজিব ঐ বিষ জাতিকে খাওয়ালেন। কারণ বিশেষত সোহরাওয়ার্দী নিজেই ছিলেন ঐ বিষ। সুতরাং পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর বাঙ্গালীর উচিত ছিল জিন্নাহর মতো তাঁকেও বর্জন করা। সেটা পারে নি বলে তার মূল্য দিতে হয়েছে বাঙ্গালীকে। এবং আজও তা দিয়ে চলেছে। এ হল বুদ্ধিভ্রংশতার পরিণতি।
আসলে জাতি হবার বুদ্ধি বা চেতনাটাও একদিনে হয় না। অনেক বিচিত্র, অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক এমন কি অনেক সময় আত্মঘাতী অনেক অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়েই একটা জাতিকে জাতি হয়ে উঠতে হয়। তারপরেও জাতি হওয়া যায় না যদি তার ভিতর জাতি হবার সঙ্কল্প কোথায়ও না থাকে। যদিও আমরা ধর্ম-সাম্প্রদায়িকতার পরিচয়ের ঊর্ধ্বে উঠে এখনও জাতি হয়ে উঠতে পারি নি তথাপি জাতি হয়ে ওঠার দিকে আমাদের অগ্রগমন কম নয়। ’৭১-এর জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ ছিল এই জাতি হয়ে ওঠার পথে এক প্রথম সফল এবং যুগান্তকারী পদক্ষেপ, যা ছিল ভাষা আন্দোলন এবং ১৯৬৮-’৬৯-এর গণ-অভ্যুথানের অনিবার্য পরিণতি। ’৭১ এক অর্থে ব্যর্থ। কিন্তু আর এক অর্থে সফল। কারণ আমরা যুদ্ধ করে ধর্ম-সাম্প্রদায়িক রাষ্ট পাকিস্তানকে পরাজিত করার মাধ্যমে বাঙ্গালী জাতির একটা নিজস্ব রাজনৈতিক ভূখণ্ড পেয়েছি। এখন তার রাজনীতি, রাষ্ট্র ও সংস্কৃতির পুনর্বিন্যাস করতে পারলে আমরা এক উন্নত জাতি হিসাবে, লোকবাদী ও গণতান্ত্রিক জাতি হিসাবে পৃথিবীর বুকে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারব। এটা প্রকৃতপক্ষে আমাদের রাজনীতির পুনর্বিন্যাসের ব্যাপার। আর এই পুনর্বিন্যাসের জন্য সবচেয়ে বড় প্রয়োজন আমাদের বুদ্ধিবৃত্তির তথা চেতনার পুনর্বিন্যাস সাধনের। তখন দেখা যাবে পুরাতন অনেক বিতর্ক তার প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছে এবং বাঙ্গালী ’৫২-এর ভাষা আন্দোলনের সেই লগ্নটিকে তার নূতন পথের যাত্রা বিন্দু হিসাবে ফিরে পেয়েছে যখন বাঙ্গালী জাতি সকল ভেদাভেদের ঊর্ধ্বে এক ঐক্যবদ্ধ শক্তি হয়ে উঠেছিল তার আত্মবিকাশের প্রয়োজনে।
সোহরাওয়ার্দী-মুজিব সৃষ্ট বিভক্তিটিও সেদিন অর্থহীন ও প্রাসঙ্গিকতাহীন হয়ে যাবে। ফলে বিএনপি, জামাত, জাতীয় পার্টি এ সব রাজনীতিও অপ্রাসঙ্গিক হবে জাতির জীবনে। এবং অবশ্যই কমিউনিস্ট রাজনীতিও। এবং পরিণতিতে অর্থহীন ও অপ্রাসঙ্গিক হবে বাঙ্গালী ও বঙ্গের রাষ্ট্রীয় বিভাজনও। হাঁ, এ দেশে আজ আমাদের প্রয়োজন হল সমগ্র রাজনীতির পুনর্বিন্যাস সাধন করা। তার জন্য প্রথমে প্রয়োজন আমাদের সমগ্র বুদ্ধিবৃত্তির পুনর্বিন্যাস সাধন করা।