লিখেছেনঃ শামসুজ্জোহা মানিক, আপডেটঃ July 18, 2013, 4:53 AM, Hits: 1910
ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতায় আমরা দেখেছি মানুষের সভ্যতার হাজার হাজার বছরের ইতিহাস নারী নিগ্রহের ইতিহাস। পুরুষও লাঞ্ছিত হয়েছে পুরুষের হাতে; শাসকের হাতে, আক্রমণকারীদের হাতে, অত্যাচারীদের হাতে। কিন্তু সেই লাঞ্ছনা মানুষ রূপে তার মানুষের হাতে। কিন্তু নারীর লাঞ্ছনা দুইভাবে। মানুষ হিসাবে তার লাঞ্ছনা। এবং তার চেয়ে বেশী নারী হিসাবে তার লাঞ্ছনা।
সভ্যতার ভিত্তি রচনা নারীর হাত দিয়ে। সেই বিচারে বলা যায় সভ্যতার সূচনা নারীর হাতে। কৃষি, পশু পালন, মৃৎপাত্র নির্মাণ, বস্ত্র বয়ন সভ্যতার সূচনা বিন্দু হিসাবে এই সবকিছুর শৈশব কালটা কেটেছে নারীর আশ্রয়ে। কিন্তু যখনই এগুলোর আয়তন ও গতি বৃদ্ধি পেয়েছে তখন সেগুলো পুরুষের হাতে চলে গেছে। এবং পুরুষ তার দেহশক্তি, দেহতন্ত্রের বিশেষ সুবিধার সুযোগ নিয়েছে। প্রকৃতি প্রথম মেরেছে নারীকে। এরপর তার সুযোগ নিয়ে পুরুষ আরও অনেক বেশী করে মেরেছে নারীকে।
সভ্যতার নায়ক হয়েছে পুরুষ। এই সভ্যতার শক্তি পুরুষকে দিয়েছে নারীর উপর কর্তৃত্বের নির্বাধ অধিকার, যে অধিকার প্রকৃতির কোলে লালিত আদিম পুরুষের ছিল না। আর তাই আদিম পুরুষের চেয়ে সভ্য পুরুষ অনেক বেশী আদিম এবং বর্বর হতে পেরেছে। সমস্ত সভ্যতার, পৃথিবীর প্রতিটি সভ্যতার ইতিহাসের দিকে দৃষ্টি দিলেই বোঝা যাবে যত দিন গেছে তত বেশী নারীর অবস্থার অধোগতি হয়েছে। তার সব মানবিক ও সামাজিক অধিকার কেড়ে নিয়ে শুধু পুরুষের ভোগের সামগ্রী করে রাখার জন্য তাকে কোথায়ও আবদ্ধ করা হয়েছে হেরেমে। কোথায়ও তার পা লৌহকঠিন জুতায় বেঁধে তাকে পঙ্গু করা হয়েছে। কোথায়ও তার স্বাধীন সত্তাকে নির্মূল করার জন্য তাকে ডাইনী বলে পুড়িয়ে মারা হয়েছে। কোথায়ও তাকে বিধবা হলে সতীদাহের নামে চিতার আগুনে তুলে দেওয়া হয়েছে। প্রকৃতির কোলে প্রাণী জগতের নারীর যে স্বাধীন সত্তাটুকু থাকে তার স্মৃতি মুছে ফেলার জন্য হাজার হাজার বছর ধরে পুরুষের কাপালিক সাধনার অন্ত থাকে নি।
সকল ধর্মে নারীর এই দুর্গত অবস্থা কম-বেশী রয়ে গেছে। বৌদ্ধ ধর্ম অনেক মানবিক। তবু তাও নারীকে সমাধিকার দিতে পারে নি। ব্যথাতুর, করুণাময় বুদ্ধ সমাজে নারীকে সমাধিকার দিতে পারেন নি। তবু তাঁর নিজের সমাজ স্বরূপ সংঘের মঠে নারীর জন্য একটা নিরাপদ, মর্যাদার স্থান রেখে দিতে চেষ্টা করেছেন। যীশুও ছিলেন করুণাময়। তবু তিনিও নারীকে সমাধিকার দিতে পারেন নি। যদিও একটি জায়গায় ইউরোপীয় খ্রীষ্টধর্ম মানব জাতির জন্য এক অমূল্য অবদান রেখেছে তা হল এক স্বামী এক স্ত্রীর পরিবার ব্যবস্থা। এটা যে নারীর জন্য ঐ কালে এমন কি এ কালেও কত বড় পাওয়া তা যে কোনো নারী চিরকাল অনুভব করবে। আসলে তো এটা ইউরোপের বর্বর বা আধা বর্বর সমাজের প্রথা যা খ্রীষ্টধর্ম আত্মস্থ করেছে। খ্রীষ্টধর্ম ছিল আদিতে দাস আর লাঞ্ছিত-বঞ্চিত মানুষের ধর্ম। তারা এক বর্বর যুগের গৌরবময় স্মৃতি নারী-পুরুষের তুলনামূলক সাম্যের স্মৃতি ধরে রেখে মানুষের মানুষ হবার পথটি উন্মুক্ত করে গেছে।
আর সব সংসারী ধর্ম নারীর জন্য হয়ে থেকেছে ভয়ঙ্কর নিপীড়নের যন্ত্র। কম আর বেশী। কারো কৌশল অনেক নিপুণ। আসলে সব ধর্ম, মতবাদ পুরুষের। এসবই পুরুষের চোখ আর মন দিয়ে নারীকে দেখতে ও বুঝতে চেয়েছে, তাকে পুরুষের হাতে তুলে দিতে চেয়েছে যার যার মতো করে। সমাজের অবস্থা, সভ্যতার বিকাশ ও অবক্ষয় এইসব প্রতিটি ধর্ম ও মতাদর্শে প্রতিফলিত এবং সেই সঙ্গে প্রতিফলিত নারীর প্রতি সমাজ অধিপতি পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গী।
সকল ধর্ম ও মতাদর্শ সমাজ নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতিগুলোকে উপস্থিত করে। আর পুরুষবাদী সভ্যতায় সেগুলো উপস্থিত করে পুরুষ কর্তৃক নারীকে নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতিও।
একদিকে নারীর গর্ভে সন্তানের পিতৃত্ব নিশ্চিত করার প্রেরণা, অপর দিকে বহু নারী উপভোগের অন্তর্গত প্রেরণা পুরুষ চেতনাকে যে নিদারুণ বিকৃতি ও স্ববিরোধে ঠেলে দিয়েছে তার সকল দায় বহন করতে হয়েছে নারীকে। এক দিকে তার চাই সতী নারী, তার গৃহদাসী, যে শুধু তাকেই সেবা করবে, তার সন্তানকে গর্ভে ধারণ করবে এবং তাকে লালন করবে শুধু পিতার পরিচয়ে। ঐ সন্তান যখন বাইরে যাবে তখন মাতার পরিচয় রইবে না। অপর দিকে তার চাই নারী, ভিন্ন নারী যাকে ইচ্ছা হলেই সে সম্ভোগ করবে। সেটা একা হোক, দলবদ্ধভাবে হোক। নারীর সম্মতি থাকুক না থাকুক তাতে কিছুই আসে যায় না। কোনো পুরুষ-পশুও এতটা পশু হতে পারে না যতটা পুরুষ-মানুষ হতে পারে।
সভ্যতার ভিতরে লুকানো বর্বরতার সবচেয়ে বড় শিকার চিরকাল নারীরাই সবচেয়ে বেশী হয়েছে। পুরুষের বর্বরতার প্রথম পরীক্ষাটা নারীর উপরই হয়েছে, কারণ তাকে হাতের কাছেই সহজে পাওয়া যায়। তারপর ঐ বর্বরতার শিক্ষাটাকে বিস্তৃত করে যেখানে সে যেতে পারে সেখানে।
সমস্ত যুদ্ধ, আক্রমণ আর সামাজিক বিশৃঙ্খলায় নারীর অসহায় অবস্থাটাই সবচেয়ে বেশী ধরা পড়ে। শত্রুকে আঘাত করে পুরুষের যতটা না আনন্দ তার চেয়ে বেশী আনন্দ-তৃপ্তি তার শত্রু যাকে মনে তার নারীকে লাঞ্ছিত ক’রে। ১৯৭১-এ আমরা দেখেছি পাক-সেনাবাহিনীর সেই ভয়ঙ্কর বর্বরতার রূপ। সে কথা সকলের জানা। কিন্তু বাংলাদেশ হবার পর আরেক সেনাবাহিনীর সেই রূপ কি আমরা এত যুগ ধরে পার্বত্য চট্টগ্রামে দেখছি না? এক কল্পনা চাকমা? কত কল্পনা চাকমার ইতিহাস সেখানে পঁচিশ বছর ধরে রচিত হয়েছে তার কতটুকু খোঁজ আমরা রাখি? পাকিস্তানী সেনাবাহিনী, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সব বাহিনীর আগে একটি শব্দ যোগ করে দিলে বোঝা যাবে পৃথিবীর এই জাতীয় যাবতীয় সেনাবাহিনীর স্বরূপ, সেটি হল পুরুষ। হাঁ, সব সেনাবাহিনীই পুরুষ সেনাবাহিনী, পুরুষের বর্বরতার সর্বোচ্চ প্রকাশ যারা ঘটাতে পারে যে কোনো সুযোগে।
অনেকে নারীর অধিকার ও নিরাপত্তার একমাত্র রক্ষা কবচ হিসাবে খুব ঢাক-ঢোল পিটিয়ে বলেন পারিবারিক আইনের কথা, স্ত্রীর অধিকার আরও বাড়াতে, যাতে পরিবারে নারীর অধিকার নিরাপদ হয়। হাঁ, এরও প্রয়োজন আছে। কিন্তু পুরুষ শুধু কি ঘরের প্রাণী? সে যখন পরিবারের বাইরে, স্ত্রীর নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাবে তখন তাকে সামলাবে কে? বাইরে খুব জবরদস্ত পুরুষকেও দেখা আছে ঘরে মুখরা স্ত্রীর সামনে কেমন বৃষ্টিতে ভেজা মুরগীর মতো হয়ে থাকে। ঘরে না হয় সামাজিক চাপ, লোক লজ্জার ভয়, পারিবারিক আইন তাকে সামলে রাখল। কিন্তু রাস্তায়, ট্রেনে, বাসে, মাঠে, ঘাটে, কর্মস্থলে যে নারী তাকে চেনে না, জানে না কিংবা যাকে তার ভয় করার প্রয়োজন নেই তার কাছে তার কি সঙ্কোচ? নারীর অবমাননা কি শুধু ঘরে? বাসের ভীড়ে, রাস্তার ভীড়ে, নির্জন পথে, একা রাত্রিতে নারীর কি অবস্থা হতে পারে সে কথা কি আমরা ভাবি?
হাঁ, বিবেকবান পুরুষও আছে। কিন্তু সেটা তো শুধু বিবেক। সেটা তো বিবেচনা। নারীর জন্য অনুকম্পা। ঐ অনুকম্পা যার নেই? সেখানে?
সভ্যতায় এতটা কাল নারীর ইতিহাসটা হয়ে রয়েছে পুরুষের দয়ার উপর, করুণার উপর, বিবেচনার উপর নির্ভরতার ইতিহাস। ওখানে নারী দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক মাত্র, যার ভূমিকাটা নির্ভর করে প্রথম শ্রেণীর নাগরিক পুরুষের ভূমিকার উপর।
আধুনিক সভ্যতার অভ্যুদয়ের সাথে নারীর এই অবস্থা পরিবর্তনের চেতনা তীব্র হতে শুরু করেছে। যন্ত্রশক্তির যত উন্নতি হয়েছে ততই দেহশক্তির গুরুত্ব কমেছে। সেই সাথে সমাজে, সংসারে দেহশক্তির বলে প্রবল পুরুষের যে আধিপত্য এতকাল ছিল তাতেও ভাঙ্গন ধরতে শুরু করেছে। আর তাই নারীর অধিকার ও মর্যাদার চেতনা ইউরোপে সবার আগে এতটা প্রবল হয়েছে। কারণ আধুনিক শিল্প সভ্যতার উদ্ভবটা সেখানে। অন্যদিকে খ্রীষ্টীয় বিধান দ্বারা সংরক্ষিত এক স্বামী-এক স্ত্রীর পরিবার ব্যবস্থার ঐতিহাসিক ভূমিকার ফলে সেখানকার সমাজে ছিল নারীর একটা তুলনামূলক মর্যাদার অবস্থান। ইউরোপ থেকে গণতান্ত্রিক চেতনা বিকশিত হয়ে নারী-পুরুষের সমাধিকারের দাবীকে উর্ধে তুলে ধরেছে।
কিন্তু আজ ইউরোপ-আমেরিকায় এই সমাধিকারের প্রকৃত রূপটি কি হয়েছে? বিশেষত পুঁজিবাদী এবং যন্ত্র সভ্যতা আজ সবচেয়ে উন্নত ও বিকশিত রূপ নিয়েছে যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সেখানকার নারীর অবস্থা দেখলে বোঝা যায় নারী-পুরুষের সমাধিকারের বুলি সেখানে নারীকে কোন হীন অবস্থায় নিয়ে গেছে? নারী আজ সেখানে ভোগ্যপণ্যের মতো পুরুষের ভোগ্যপণ্যে পরিণত হয়েছে। অবাধ যৌনাচার কিংবা মেলামেশার অবাধ অধিকার কি নারীকে স্বাধীনতা কিংবা মর্যাদা অথবা নিরাপত্তা দিয়েছে? যৌনাচারের এত সুযোগ পুরুষের সামনে খোলা। তারপরেও কেন এত ধর্ষণ, নারী হত্যা, নির্যাতন?
হাঁ, ইউরোপীয় সভ্যতা নারী-পুরুষের সমাধিকারের নামে যেটা কায়েম করেছে সেটাও এক মুক্ত বাজার অর্থনীতি। নারী-পুরুষের সম্পর্কের ক্ষেত্রে মুক্ত বাজার অর্থনীতি। এই মুক্ত বাজার অর্থনীতিতে কোনো প্রেম নেই, সহানুভূতি নেই, করুণা নেই, শ্রদ্ধা নেই, বেদনা নেই, আনুগত্য নেই, দায়বদ্ধতা নেই। ইচ্ছা হলেই তার নারী বদলানো যায়। ইচ্ছা হলেই পুরুষ বদলানো যায়। সবই ক্ষণিকের ভাল লাগা। এই মুক্ত বাজার অর্থনীতির সবচেয়ে নির্দয় শিকার হয়েছে নারী। চারদিকে কোথায়ও তার জন্য পুরুষের ভালবাসার নির্ভরতা নেই। পুরুষের মত তার দেহ নয় যে, সে শুধু ভোগ করে চলে যাবে। তার আছে গর্ভ, যেখানে সে মানুষ-শিশুকে ধারণ করে। তার আছে মাসিকের সমস্যা। তার দেহতন্ত্রই তাকে প্রবল পুরুষের চেয়ে দুর্বল করেছে। ঐ প্রবল পুরুষ তার অধীনস্থ হয় ভালবাসার গুণে। এই ভালবাসা যখন থাকে না তখন সকলে একা। পুরুষও একা, নারীও একা। এই একাকীত্ব নিয়ে পুরুষ হয়তো বহুকাল কাটিয়ে দিতে পারে বহু নারী সম্ভোগ করে। এও এক খেলা। ইচ্ছা হলে বালুচরে খেলে যাবে ঘর বাঁধা আর ভাঙ্গার খেলা। হাঁ, সেও এক খেলা। মুক্ত বাজার অর্থনীতির পণ্য ভোগ খেলা। কিন্তু নারী? সে দাঁড়াবে কোথায়? তার নিরাপত্তা, তার মর্যাদা কে দিবে?
সমস্ত ক্ষমতা কেন্দ্র পুরুষের হাতে। সমস্ত ক্ষমতা যন্ত্র পুরুষের হাতে। অর্থনীতি, রাজনীতি, রাষ্ট্র সবকিছু পুরুষের অধীনস্থ। বলা যেতে পারে রাষ্ট্রপতি, প্রধান মন্ত্রী নারীকে করে দিলেই সমস্যা মেটে। যেমন এখন আমাদের দেশে নারী প্রধান মন্ত্রী। কিংবা শ্রীলংকায় রাষ্ট্রপতি, প্রধান মন্ত্রী দু’টো পদই এখন নারীর হাতে। কিন্তু তাতে কি হবে? ভারতবর্ষ তো দীর্ঘকাল দেবী পূজার ভূমি ছিল। দেবীদের পূজা করেছে যে পুরুষেরা তারা তো নারীর সম্পত্তির অধিকারটুকুই অতীতে দেয় নি। কালী, সরস্বতী, লক্ষ্মীর পূজা সেরে পাড়ায় বা বাড়ীতে ফিরে নারী দেবতার ঐ পুরুষ পূজারীরা কি অসহায় বিধবাকে জোর করে মৃত স্বামীর চিতার আগুনে পুড়িয়ে মারত না?
আসলে মাথার উপরে কোন্ দেবী থাকল বা নারী থাকল তা দিয়ে কি নারীর ক্ষমতাহীনতার সমস্যার সমাধান হয়? হাঁ, নারীর সকল দুর্গতির মূল তার ক্ষমতাহীনতা। পারিবারিক আইন করে পরিবারে কিছু ক্ষমতা দিলেই হল? ঘরের বাইরে যে সমাজ, বিশাল পৃথিবী পড়ে আছে সেখানে তার ক্ষমতা না থাকলে তার নিরাপত্তা, মর্যাদা থাকে কিভাবে? ওটা তখন পুরুষের বিবেচনা তথা দয়ার উপর নির্ভর করে।
আর ইউরোপ-আমেরিকায় নারীর হাতে ক্ষমতা নেই বলে নারী-পুরুষ সমাধিকার সেখানে অবাধ বাজার অর্থনীতির নারী-পুরুষ সম্পর্কের প্রেমহীন, করুণাহীন, দায়-দায়িত্বহীন নির্দয় প্রতিযোগিতায় নারীকে নিক্ষেপ করেছে, তার মানবিক সত্তাকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করছে।
আর আমরা? আমরা তো আজো মধ্যযুগের বাসিন্দা। ইউরোপ-আমেরিকায় নারী তবু তার দু:খের কথাটা বলতে পারে, বিদ্রোহ করতে পারে, ক্ষোভ জানাতে পারে। এখানে তো সে সুযোগও নেই। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এমন দৃষ্টান্তের দেশ যেমন পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি নেই তেমন নারীর এতটা স্বাধীনতা আর মর্যাদাও পৃথিবীতে আর কোথায়ও নেই। মনে আছে? ১৯৯২-এর ডিসেম্বর খালেদার শাসনামলে উন্মত্ত অভিযান চালিয়ে হাজার হাজার হিন্দুকে ঘর-বাড়ী থেকে উৎখাত করা হল। চট্টগ্রামে, ভোলায় এবং আরও বিভিন্ন জায়গায় তাদের সম্পদ লুণ্ঠন করা হল, প্রহার করা হল, তাদের নারীদের জোর করে টেনে নিয়ে যাওয়া হল। সারা দেশে বয়ে গেল পৈশাচিকতার এক অভিযান। তারপরেও তৎকালীন প্রধান মন্ত্রী খালেদা ঘোষণা করলেন বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। হাঁ, এক অতি চমৎকার দৃষ্টান্ত! কিন্তু যারা এই রকম মিথ্যা উচ্চারণ করতে পারে তাদের বিরুদ্ধে নিগৃহীত হিন্দুর কি কিছু বলার উপায় আছে? নেই। সুতরাং এ দেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এমন এক দৃষ্টান্ত যার তুলনা বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ড ঢুঁড়েও আর দ্বিতীয়টি দেখানো যায় না!
ঠিক তেমনই এ দেশে নারীর মর্যাদা আর স্বাধীনতা। এমন তুলনা কোথায়? দিনাজপুরের ইয়াসমিনকে কারা ধর্ষণ করে হত্যা করেছিল? ওরা কি এই রাষ্ট্রের পাহারাদার পুরুষ পুলিশ নয়? নারী মুক্তি, জাতি-মুক্তির স্বপ্ন দেখা কিশোরী কল্পনা চাকমাকে কারা ধরে নিয়ে গিয়ে গুম করেছে? তারা কি এই রাষ্ট্রের আরেক পাহারাদার সেনাবাহিনীর পুরুষ সদস্য নয়? রাষ্ট্রের হাতে নারী নিগ্রহের ভুরি ভুরি দৃষ্টান্ত এ দেশে স্থাপিত হয়েছে। আর সমাজ? তার রূপ যে নারীর জন্য কত ভয়ঙ্কর তা তো সবার জানা। তারপরেও এ দেশে নারী অধিকার-স্বাধীনতা নেই এ কথা বলবে কয়জন নারী? কাজেই সব ঠিক আছে!
এ দেশে একই অপরাধে নারী-পুরুষ ভেদেই সাধারণত বিচারেরও ভিন্ন রায় হয়। কারণ বিচার পেতে অর্থের যেমন প্রয়োজন তেমন শক্তিরও প্রয়োজন। নারীর উপর এত যে নিগ্রহ এবং এসিড নিক্ষেপের প্রতিযোগিতা চলছে সারা দেশে, তার অপরাধে অপরাধী কয়টা পুরুষের কতটুকু শাস্তি হয়েছে? ঐ হিসাবগুলো একটু নিলেই বোঝা যাবে আইন যা-ই হোক ঐ আইন অনুযায়ী বিচার করার ভার যার হাতে তার লিঙ্গের উপরেও নির্ভর করতে পারে বিচারের রায়ের ধরন। বিচারকও পুরুষ। নারীর বিরুদ্ধে পুরুষের অপরাধের বিচার করবে পুরুষ আর নারী পাবে সুবিচার? এ দেশে এক ধর্ষণের প্রতিকার চাইতে আদালতে যাবে এমন মূর্খ নারী কয়জন আছে? সেখানে বছরের পর বছর ধরে বিচারের নামে পুরুষ সমাজের সামনে তাকে শতবার ধর্ষিত হতে হয়। এর আগে প্রকৃত ধর্ষণের সময় যেটুকু আড়াল-আব্রু ছিল এবার সেটুকুও রইবে না। প্রতিপক্ষ উকিলের নির্দয় জিহ্বা এবার তাকে ধর্ষণ করতে শুরু করবে দিনের পর দিন,
যতদিন বিচার চলবে ততদিন। সেই ধর্ষণ সবাই নূতন করে উপভোগ করবে, দেখবে, শুনবে, চাখবে। দর্শক, বিচারক, উপস্থিত সকলে। যদি তেমন হয়, সেটাকে মুখরোচক খাদ্যবস্তু করে দৈনিক কিংবা সাপ্তাহিকে পরিবেশনও করা হবে। পুরুষ পাঠকের রসনা তৃপ্ত হবে।
না, আব্রু তার রইবে না। যে আব্রু তাকে পুরুষ দিয়েছে সেটা কেড়ে নিতে পুরুষের কতক্ষণ লাগে? নারীর আব্রু ভঙ্গুর, যখন তখন খসে পড়ে। কারণ তার ক্ষমতা নেই।
হাঁ, এইটাই নারীর প্রকৃত সমস্যা। সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, মার্কসবাদ-লেনিনবাদ, মানবতাবাদ, মানবাধিকার ইত্যাদি যত মতবাদ পৃথিবীতে আছে সবই পুরুষের। পুরুষ শাসিত সমাজের পুরুষের। হয়তো এ সকল আদর্শ নারীর অবস্থার উন্নতি সাধন করেছে এবং আরো করবে পূর্বের তুলনায়, তবু নারীর দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকের ভূমিকাটা রয়ে যাবে ততকাল যতকাল তার নিজস্ব ক্ষমতার অবস্থানটা তৈরী না হবে।
এর এক মস্ত প্রমাণ সোভিয়েত সমাজতন্ত্রে নারীর প্রকৃত অবস্থাটা। প্রায় পঁচাত্তর বৎসর সেখানে নারীর মর্যাদা, নিরাপত্তা ও উন্নতি নিয়ে বহু ঢাক-ঢোল পেটানো হয়েছিল। আর এই ঢাক-ঢোলের কর্ণবিদারী শব্দে ঢাকা পড়ে ছিল সেখানে অসহায় অবস্থার বন্দী নারীর আর্তনাদ। ইউরোপ-আমেরিকা কিংবা আমাদের দেশের মতো নারী নিগ্রহের রূপ সেখানে ছিল না ঠিক, কিন্তু সংসারে ও সমাজে তাদের উপর পুরুষের স্বৈরতন্ত্রের যে পেষণ চলেছিল সেটা তো আর গোপন নেই। আজো চীনে নারীকে নিয়ে দাস ব্যবসার বিরুদ্ধে সেখানে সরকারকে লড়তে হচ্ছে। এসব কি বলে?
এটা কি এ কথা বলে না যে, শুধু সংসারে নয়, ঘরে নয়, সংসার ও ঘরের বাইরে যে সমাজ ও বিশাল পৃথিবীটা পড়ে আছে সেখানেও নারীর হাতে ক্ষমতা দিতে হবে? ওটা শুধু চাকুরী দিলে হয় না। শুধু অর্থনৈতিক স্বাধীনতা দিলে হয় না। নারী না হয় চাকুরী করল, ব্যবসা করল যেমন এখন বহু নারী আমাদের দেশে চাকুরী করছে। কিন্তু তারা যখন পথে হাঁটে, বাসে ওঠে সব বয়সেরই অসংখ্য পুরুষ সুযোগ পেলে তাদের কিভাবে অবমাননার শিকার করে সে খবর কয়জন রাখে? আসলে এ দেশে প্রতি মুহূর্তে পুরুষের সাধনা নারীকে ‘সাইজ আপ্’ করা, তাকে কেটেকুটে ভেঙ্গেচুরে নিজ আয়ত্তাধীন রাখা। তার স্বাধীন, ভয়হীন, মানবিক ও মর্যাদাবোধ সম্পন্ন সত্তাটাকে বিনষ্ট করা। তাকে পঙ্গু করা। সবাই হয়তো এ কথা বুঝবে না, মানবেও না। কিন্তু সাধারণ প্রতিটা নারী জানে এ দেশে নারীর সমস্যা কোথায় ও কতখানি।
অর্থনৈতিক মুক্তি? শুধু ওটা দিয়ে কি হবে? দাস-দাসীকে খুব ভাল খেতে পরতে দিলেই তার মুক্তি হয়ে গেল? ইউরোপ-আমেরিকায় ক্ষমতাবিহীন নারী-স্বাধীনতা নারী কর্তৃক পুরুষের অবাধ মনোরঞ্জনের স্বাধীনতায় পরিণত হয়েছে। ওটা আমরা দেখেছি। নারীকে ঠকানোর যে মুক্ত বাজার অর্থনীতি মার্কা বুদ্ধিটা ওখানে পুরুষ বের করেছে ওটার প্রকৃত চেহারাটাকে উলঙ্গ করে দেখিয়ে দিতে হবে সারা পৃথিবীকে।
আমাদের চাই নারী অধিকারের এমন একটা আদর্শ যে আদর্শ এমন একটা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করবে যেখানে নারীর হাতে পুরুষের মতোই ক্ষমতা যাবে। শুধু প্রধান মন্ত্রী আর রাষ্ট্রপতি পদে নারীকে বসালেই হল? ওতে কিছুই হবে না। পুরুষের যন্ত্রে একা বসে নারী পুরুষেরই প্রতিনিধি হবে। আসলে নারীর হাতে চাই রাষ্ট্র, সমাজ ও অর্থনীতিতে পুরুষের সমান অধিকার। ওটা সমান ভোটাধিকার দিয়ে হয় না। সমান আইন দিয়েও হয় না। ঐ আইনও ইউরোপ-আমেরিকার মুক্ত বাজার অর্থনীতির নারী স্বাধীনতার মতোই এক মস্ত ফাঁকি।
ঐ আইন বানায় কে? পুরুষ। ঐ আইন প্রয়োগ করে কে? পুরুষ। ঐ আইনের বদৌলতে অপরাধী বা অভিযুক্তকে ধরে আনে কে? পুরুষ। ঐ আইনের কাঠামোতে অভিযুক্তের বিচার করে কে? পুরুষ। ঐ আইনের শক্তিকে পাহারা দেয় কে? পুরুষ। সব, সব কিছু পুরুষের হাতে। আর নারী পাবে স্বাধীনতা? দয়া পেতে পারে। মর্যাদা নয়। বিচার পেতে পারে। সুবিচার নয়। ভোটাধিকার পেতে পারে। সমাধিকার নয়।
সুতরাং নারীর জন্য সবচেয়ে বেশী যেটার প্রয়োজন সেটা হল নারী অধিকারের এক নিজস্ব ব্যবস্থা। আমার মনে হয়েছে এই ব্যবস্থার আদর্শের নামকরণ হতে পারে নারীবাদ। হাঁ, এটা বহু প্রচারিত এক শব্দ। এই শব্দটাই আমি গ্রহণ করে নিচ্ছি। ইউরোপের নারীবাদ যা-ই হোক, তা নিয়েও সেখানে অনেক ভিন্নতা আছে, তবু নারীবাদ নারীর এমন এক স্বতন্ত্র অধিকারের ঘোষণা যা কোনো পুরুষতান্ত্রিক ঘোষণা দিয়ে প্রতিষ্ঠা করা যায় না। পুরুষের উপর নারীর আধিপত্যের ঘোষণা এ নয়, এ শুধু নারীর স্বাতন্ত্র্য ও মর্যাদার ঘোষণা।
আমি মনে করি নারীর একটি ভিন্ন সামাজিক সত্তা, ভিন্ন আদর্শিক অস্তিত্ব, ভিন্ন ক্ষমতা কাঠামো থাকার দরকার। সেটি সংসারে, সমাজে, পৃথিবীতে সর্বত্রই। সেখানে সে শুধু কারো মাতা নয়, কন্যা নয়, ভগিনী নয়, স্ত্রী নয়, সেখানে সে স্বাধীন এক মানুষ। কিন্তু শুধু মানুষ বললেও আমাদের এতকালের কল্পনায় গড়ে ওঠা পুরুষের রূপটি আগে ভেসে ওঠে যার পিছনে মাত্র দাঁড়িয়ে কিংবা লুকিয়ে থাকে নারী। সুতরাং নারীর জন্য নারী হিসাবেই একটা আলাদা জগৎ থাকবে। সেখানে সে মাতা হয়েও, কন্যা হয়েও, ভগিনী হয়েও, স্ত্রী হয়েও, প্রেয়সী হয়েও ওসবেরই ঊর্ধ্বের এক সত্তা। সেই সত্তা হল নারী। মানুষেরই এক রূপ। অথচ পুরুষের অধীন নয়, পুরুষের পিছন নয়। স্বাধীন । পুরুষ যেমন নারীর অধীন হবে না তেমন নারীও হবে না পুরুষের অধীন। এই স্বাধীনতা নিয়ে যেদিন নারী পুরুষের পাশে এসে দাঁড়াবে সেদিনই নারী-পুরুষের প্রকৃত সমাধিকার প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।
এর সহজ অর্থটা হল এই রাষ্ট্রের ভিতরই নারীর একটা নিজস্ব রাষ্ট্রের প্রয়োজন আছে। না, চমকাবার কিছু নেই। এর আদি রূপটি বাড়ীতে বা সংসারে খুঁজলেই দেখতে পাওয়া যাবে। স্বামীর সংসারে থেকেও নারীর একটা আলাদা জগৎ থাকে যেখানে স্বামীরও অধিকার থাকে না যতক্ষণ তার স্ত্রী তাকে সেই অধিকার না দেয়। নারীর থাকে নিজস্ব বলয়। যেখান থেকে সে এসেছে, বাবা-মা-ভাই-বোন-আত্মীয়-স্বজন ও নিজ বান্ধবীদের একটা নিজস্ব সংযোগ। তার থেকে নিজস্ব সঞ্চয়। গ্রামের মেয়েরা কি হাঁস-মুরগী পালন ক’রে এবং আরো দশ রকমভাবে আয় ক’রে একটা নিজস্ব তহবিল সৃষ্টি করে না? এগুলো থেকে এমন একটা শক্তি সৃষ্টি হয় যা নারীকে দেয় তার সংসারে একটা আলাদা শক্তি। সেটা শুধু অর্থনীতি নয়, আরও অনেক কিছু মিলিয়ে। সেই শক্তিই সমাজে, রাষ্ট্রে চাই। আর সমাজের কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা-যন্ত্র রাষ্ট্রের ভিতরে যদি নারীর এক নিজস্ব রাষ্ট্র না থাকে তাহলে নারীর সকল অধিকার ফাঁকা বুলি মাত্র।
সমাজ-রাষ্ট্রে নারীকে অধিকার না দিয়ে শুধু পরিবারে অধিকার দিয়ে কি হবে? বরং সমাজ-রাষ্ট্রে অধিকার না পেয়ে নারীর মনুষ্যত্বের যে অবদমন ও বিকৃতি ঘটে সেটাই তো গৃহে এবং সমাজে বিস্তৃত হবে। নারীও মানুষ। মানুষের যাবতীয় ক্ষমতা ও আকাঙ্ক্ষা তার ভিতর দিয়েও মূর্ত হতে চায়। হয়তো তার প্রকাশ রূপ পুরুষের থেকে ভিন্ন। তবু তারও ক্ষমতা আছে যে ক্ষমতা সমাজে স্বাধীন ও সুস্থভাবে বিকশিত হবার সুযোগ না পেলে তা বিকৃত ও অধ:পতিত এক রূপ নিয়ে ঘরের পুরুষকে এবং অবশেষে সমাজকেও তার শিকার করতে পারে। সমাজ-রাষ্ট্রে তার পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে চায় ঘরে এবং সুযোগ পেলে বাইরেও। হাঁ, এটাই নিয়ম। এটাই হয়।
বহুকাল আগে রোকেয়া কল্পনা করেছিলেন ‘সুলতানার স্বপ্ন’-এর ‘নারীস্থান’-এ নারীর এক স্বাধীন রাষ্ট্রের। তিনি তাঁর রাষ্ট্র থেকে পুরুষকে বাদ দিতে চেয়েছিলেন। সেটা সম্ভব নয়। কারণ নারী বাঙ্গালী, জাপানী, ফরাসী কিংবা চীনার মতো আলাদা জাতি নয় যে পুরুষকে বাদ দিয়ে সেটা গড়বে। তার রাষ্ট্রটা হবে এক বৃহত্তর রাষ্ট্রেরই ভিতর। অথচ সেখানে সে স্বাধীন এবং পুরুষের সহযোগী। তবু তার একটা রাষ্ট্র চাই। একটা নারীস্থান চাই। হয়তো এটা প্রকৃত অর্থে রাষ্ট্র নয়। তবু এটা হবে নারীর ক্ষমতা-যন্ত্রের পূর্ণাঙ্গ অবয়ব। এই অবয়ব থাকবে বলে নারী-পুরুষ সমন্বিত সমাজের ক্ষমতার কেন্দ্রীভূত রূপ রাষ্ট্রের উপরেও নারীর নিয়ন্ত্রণ ও অধিকার নিশ্চিত থাকবে।
বস্তুত নারীর ক্ষমতা-যন্ত্রের উদ্ভব ও বিকাশ আমাদের এত কালের রাষ্ট্রের ধারণাটাকেও আমূল বদলে দিবে। এই রাষ্ট্র হবে নারী-পুরুষ উভয় লিঙ্গ ও সমাজ সত্তার স্বাতন্ত্র্য ও প্রভেদকে মেনে নিয়েই এক ঐক্যের নবতর রূপ। এর ফলে রাষ্ট্রের যে অতিকেন্দ্রীভূত ও এককেন্দ্রিক রূপটি আজো আমাদের পৃথিবীতে টিকে আছে সেটির অবসান হবে। আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র অবশ্য অতীতের যে কোনো স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্রের তুলনায় অনেক বেশী বিকেন্দ্রায়িত। তবু তার স্বৈরতান্ত্রিক রূপটি আজো রয়েছে প্রবল রূপে। নারীর নিজস্ব রাষ্ট্র বা ক্ষমতা কাঠামোর উদ্ভব আজকের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের রূপ ও চরিত্রকেও এতটাই বদলে দিবে যে, আজকের দৃষ্টি দিয়ে দেখলে তাকে আমাদের রাষ্ট্র হিসাবে চিনতে ভুল হতে পারে। এর একটা উপমা দেওয়া যায়, এটা হবে এক স্বামীর অধিকারহীন বহু স্ত্রী নিয়ে গঠিত পরিবারের পরিবর্তে এক স্বামী-এক স্ত্রীর সমাধিকার ভিত্তিক পরিবার।
যতই সমাধিকারের কথা বলি, এমন কি যত বড় গণ-বিপ্লবের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে নূতন রাষ্ট্র কাঠামো প্রতিষ্ঠিত হোক ঐ বিপ্লবের মধ্য দিয়ে নারীর নিজস্ব ক্ষমতা যন্ত্র গড়ে না তুললে ওটা হবে পুরুষ প্রধান সংসারের মতোই পুরুষ প্রধান এক রাষ্ট্র মাত্র। তার ভিতরে নারীর এক স্বতন্ত্র রাষ্ট্র না থাকলে নারী চিরকালের মতো সেখানেও পুরুষের দয়ার সামগ্রী থেকে যাবে। সুতরাং ঐ রাষ্ট্রের ভিতরেই আর এক রাষ্ট্রের আয়োজন রাখতে হবে। অভিন্ন সংসারে স্বামী-স্ত্রীর শত প্রেম ও মিলনের মধ্যেও যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত থাকে সেটা এই নূতন রাষ্ট্রেও থাকবে। এমন কি একই বস্তুসত্তার ভিতর যে ভিন্ন সত্তাসমূহের অস্তিত্ব থাকে তা তো আপাত দৃষ্টিতে ঐ অখণ্ড বস্তুসত্তার মধ্যেও দ্বন্দ্ব রেখে দেয়। দ্বন্দ্ব আছে বলে সব কিছু বদলায়, এগিয়েও যায়। সমাজ-সংসার-সভ্যতা সব দ্বন্দ্বের ভিতর দিয়ে এগিয়ে যায়। আবার দ্বন্দ্ব আছে বলে সমন্বয়ের প্রয়াস। ওটাও চিরকাল চলবে। ও নিয়ে আমাদের ভেবে মাথা খারাপ করার দরকার নেই। আমাদের কাজ আজকের দ্বন্দ্বের মীমাংসার পথটা বের করা। আগামী কালের মানুষ আগামী কালে নূতন সমন্বয়ের ভিতর দিয়ে বেড়ে ওঠা নূতন দ্বন্দ্ব নিরসনের পথ বের করার সাধনা করবে। তারা যখন ঐ দ্বন্দ্বের মীমাংসা দিবে তখন তার ভিতর থেকে জন্ম নিবে আর এক নূতন দ্বন্দ্ব। হাঁ, জীবন এমনই। এমনইভাবে এগিয়ে এসেছে, এমনইভাবে এগিয়ে যাবে কাল কালান্তর পার হয়ে। চিরকালের জীবনের অনন্ত আহ্বান, চরৈবেতি, চরৈবতি। এগিয়ে চলো, এগিয়ে চলো। এই নূতন কালের দিকে এগিয়ে যাবার পথটা উন্মুক্ত করা আমাদের বিপ্লবের মূল কাজ।
আমি জানি না রোকেয়ার মতো করে নারীর এমন রাষ্ট্রের কল্পনা আর কোনো নারীবাদী ইতিহাসে করেছেন কিনা। তবে আমি মনে করি রোকেয়ার স্বপ্নের ভিতর লুকিয়ে আছে আগামী যুগের ইতিহাসের এক আশ্চর্য অনুভব। যাইহোক, নারীবাদ একান্তই নারীর নিজস্ব এক আদর্শ। ওটা নারীর নিজস্ব কল্পনা, নিজস্ব ব্যবস্থা। তবু ওটা একা নারীর নয়। ওটা পুরুষেরও। এতকাল সমস্ত পুরুষবাদী আদর্শের পিছনে নারীর কি কোনো ভূমিকা ছিল না? প্রতিটি ধর্ম, মতাদর্শ, রাষ্ট্র, সমাজ, সভ্যতা গড়ায়? ছিল। সেটা ছিল সহযোগীর কিংবা অনুগামীর। নারীবাদেও পুরুষের ভূমিকা হবে তেমন সহযোগীর কিংবা অনুগামীর।
সুতরাং নারীবাদের রূপ কি হবে, তা নারীকে কোন্ অধিকারগুলো কিভাবে দিবে, পুরুষের রাষ্ট্র ও সমাজের সঙ্গে তার সম্পর্ক কি হবে সেসব মূলত নারীরাই নির্ধারণ করবে তাদের নিজেদের সংগ্রাম, প্রয়াস ও অভিজ্ঞতার শিক্ষার মধ্য দিয়ে। ওটা নিয়ে এখন আমাদের ভেবে কাজ নেই। আমাদের কাজ হল নারীকে তার জন্য স্বতন্ত্র জায়গাটুকু ছেড়ে দেওয়া। এতকাল তো সমাজ-রাষ্ট্রে পুরুষই সব জায়গা একা দখল করে রেখেছে। নারী নিজের মতো করে ভাবার অবকাশ পেল কোথায়? আজ তাকে ভাবার জায়গাটা, দাঁড়াবার জায়গাটা ছেড়ে দেওয়াই আগামী সমাজ ও রাষ্ট্র বিপ্লবের এক প্রধান করণীয়।
আমি জোর দিয়ে বলতে চাই নারীর প্রকৃত সমস্যা পুরুষের পক্ষে কখনই নারীর মতো করে অনুভব করা সম্ভব নয়। নারী পুরুষের সম্পর্ক মানুষের সবচেয়ে মৌলিক, সবচেয়ে প্রাথমিক সম্পর্ক। আর এই সম্পর্কের মৌল সত্যটা কি? সেটা শরীর। দু’টো শরীরের ভিন্নতা। এমন দু’টো শরীর যারা পরস্পরের পরিপূরক অথচ ভিন্ন দেহতন্ত্রের অধিকারী। আর এখানে এই সম্পর্কের ক্ষেত্রে পুরুষের জন্য নারীর সমস্ত শরীরে ছড়িয়ে থাকে যৌনতা। এই সম্পর্কের ক্ষেত্রে পুরুষ আঘাতকারী, নারী সেই আঘাত গ্রহণকারী। পুরুষের পৌরুষ তার আঘাতে। সেখানেই তার আনন্দ, তৃপ্তি, গৌরব। এটা নারীর জন্য আনন্দেরও হতে পারে, বেদনারও হতে পারে, গৌরবেরও হতে পারে, অগৌরবেরও হতে পারে। এ এক বিচিত্র, জটিল সম্পর্ক, যার রহস্য জীবনের মতো, সৃষ্টির মতো, ধ্বংসের মতো অনন্ত, অসীম। পুরুষের জন্য নারীর শরীরে ছড়িয়ে আছে যে যৌনতা তা নারীর জন্য বয়ে আনতে পারে শুধু সুখ নয়, দু:খও। সেটা হতে পারে এমন এক দু:খ যা কোনো দিন কোনো পুরুষের শরীরের ভিতর থেকে উঠে আসে না। এক পুরুষের দরদী মন ব্যথিত হতে পারে মাত্র। কিন্তু বেদনাটা নারীর।
নারী-পুরুষের অনেক ঐক্যের দিক আছে। উভয়ে অনেক বিষয়ে সমান ক্ষমতারও অধিকারী। তারপরেও উভয়ের মধ্যে এমন এক ভিন্নতা রয়েছে যাকে অস্বীকার করার ফলে নারীর অবদমিত অবস্থাটা তৈরী হয়। পুরুষের দৃষ্টি অনুযায়ী নারী নিজের সমতা বা মুক্তির পথ খুঁজতে গিয়ে অধিকতর নিপীড়ন ও অবদমনের মধ্যে নিজেকে নিয়ে যায়। অথচ নারী পুরুষ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক সত্তা। অভিন্ন মানুষ হয়েও সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের মানুষ। আবার বলি নারী-পুরুষের সম্পর্কের ক্ষেত্রে নারীর জন্য সমস্যাটা মূলত তার শরীর। হাঁ, এটা প্রাকৃতিক, কিন্তু এই প্রাকৃতিক সত্যকে আমাদের বুঝতে হবে, চিনতে হবে। স্বীকার করতে হবে এই সত্যের অস্তিত্বকে। এই প্রাকৃতিক সত্যের মধ্যে রয়েছে সমাজ-সংসার-সভ্যতা নির্মাণের পর পুরুষের হাতে নারীর পরাজয় ও নিগ্রহের আদি কারণ। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অভূতপূর্ব বিকাশ প্রকৃতির আদিম এই সত্যের উপরেও আরেক সত্যকে প্রতিষ্ঠা করতে চায়। সেটা হল মানুষের সত্য। বিজ্ঞান সে দিকে এগিয়ে যাচ্ছে আজ অবিশ্বাস্য গতিতে, ঝড়ের গতিতে। কারণ বিজ্ঞান তো মানুষেরই সৃষ্টি। মানুষই যে আজ নবতর মুক্তি চাইছে।
নারীর বিশ্বব্যাপী জাগরণ এবং নারীবাদী সমাজ ও রাষ্ট্র বিপ্লব আসন্ন এবং অনিবার্য। এই বিপ্লবের রূপ কি হবে, আমাদের আজো জানা নেই। তবে সেটা যে মানব সভ্যতার চেহারাটাকে আমূল বদলে দিবে তাতে সন্দেহ নেই।
আমি মনে করি আমাদের বিপ্লবে নারীবাদ হতে পারে বিশ্বব্যাপী নারী বিপ্লবের সূচনা। ইউরোপ-আমেরিকাসহ সারা পৃথিবীতে নারী মুক্তির যে চেতনাটা নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকল মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছে তা বিশ্বব্যাপী এক নূতন ধরনের, অভূতপূর্ব বিপ্লবের সূচনাকে অনিবার্য করছে। কত কাল আদিম পুরুষ তার পায়ের নীচে নারীকে দাবিয়ে রাখবে? এই নারী বিপ্লবের সূচনাটা হতে পারে এই দেশে। হাঁ, বাংলার মাটি হতে পারে নূতন বিশ্ব বিপ্লবের সূতিকাগার। এই বিপ্লবকে রোধ করবে এমন শক্তি কার আছে? সমস্ত পৃথিবীর সকল মুক্তিকামী মানুষ এই বিপ্লবকে সমর্থন করতে এগিয়ে আসবে। পৃথিবীর ছয়শ’ কোটি মানুষের ভিতর তিনশ কোটি নারীর কয়টি নারী এর বিরুদ্ধে দাঁড়াবে? আর সব পুরুষই কি এখনো বর্বর যুগে পড়ে থাকতে চায়? তাদেরও কি অনুভব নেই, দু:খ নেই, বেদনা নেই? মনুষ্যত্বের, নারীত্বের যুগ যুগ ধরে চলে আসা এত অপরিমেয় বেদনার অন্তহীন স্রোত তাদেরও কি ব্যথাতুর করে না? তাহলে পৃথিবীতে কেন এত বিপ্লব হয়েছে? নারীর মুক্তির জন্য যুগ যুগ ধরে কেন এত পুরুষেরও এত প্রাণপাত সাধনা? সুতরাং পৃথিবীর কোটি কোটি পুরুষও ভাববে এই বিপ্লবকে নিজেদের বিপ্লব।
না, নারীর ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা শুধু মানবিকতার দাবী নয়, এটা কালেরও দাবী। এটা কালের অনিবার্যতা, যা বিজ্ঞানের বিকাশের মধ্য দিয়ে মূর্ত হয়ে উঠছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রচণ্ড বিকাশ মানুষের হাতে সৃষ্টির পাশাপাশি ধ্বংসেরও যে বিপুল ক্ষমতা এনে দিচ্ছে তার সামনে মানুষ নিজেই অসহায় হয়ে পড়ছে। ধরাপৃষ্ঠে মানুষের অস্তিত্ব বিলোপের জন্য আজ মানুষই যথেষ্ট।
স্নায়ুযুদ্ধের আপাত অবসানের ফলে এই মুহূর্তে বিশ্বব্যাপী পরমাণু যুদ্ধের সম্ভাবনা নেই। কিন্তু তাতে নিশ্চিন্ত হবার কারণ নেই। পারমাণবিক ধ্বংসের বিপুল ক্ষমতাটা মানুষের হাতে রয়ে গেছে। শুধু তাই নয়, উপরন্তু পরমাণু প্রযুক্তিও গুটি কয়েক রাষ্ট্রের হাতে থাকার দিন শেষ হয়ে আসছে। সেদিন বেশী দূরে নেই যেদিন পরমাণু অস্ত্রের প্রযুক্তি বহু সংখ্যক মানুষের করায়ত্ত হবে। বিপুল ধ্বংস ক্ষমতাসম্পন্ন পরমাণু কিংবা অন্যবিধ অস্ত্র নির্মাণ প্রযুক্তি হয়ত আজকের রিমোট কন্ট্রোল বোমার চেয়ে খুব বেশী জটিল ও কঠিন আর থাকবে না। ব্যাপক বিস্তৃত এই প্রযুক্তি সেদিন রাষ্ট্রের বাইরেও বিভিন্ন গোষ্ঠীর হাতে যে যাবে না তা কে বলতে পারে? ব্যাপক ধ্বংস ক্ষমতার অধিকারী হয়ে তখন কোনও রাষ্ট্র বা গোষ্ঠী কোনও বৃহৎ নগর, অঞ্চল এমন কি পৃথিবী ধ্বংসের আয়োজন যে করবে না তা কি করে বলা যায়? হয়ত পঞ্চাশ থেকে একশত বৎসরের মধ্যে মানুষ সাধারণভাবে এই ধ্বংস ক্ষমতার অধিকারী হবে।
এই যে ভয়ঙ্কর ধ্বংসের ক্ষমতাকে মানুষ করায়ত্ত করছে তাকে সামলাবে কে? পুরুষ? যে পুরুষ শুধু যে এই ধ্বংস ক্ষমতার স্রষ্টা তাই নয় উপরন্তু যে নিজেই ধ্বংস ও আক্রমণের প্রবণতার প্রধান প্রতিনিধিত্বকারী তার পক্ষে কি এই ধ্বংস ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণ বা সংযত করা সম্ভব? প্রাকৃতিকভাবে পুরুষ প্রধানত আক্রমণাত্মক। তার বিপরীতে নারী প্রধানত আত্মরক্ষাত্মক। উভয়ের মধ্যেই বিপরীত গুণ বা বৈশিষ্ট্য থাকে বৈকি তবে সেটা গৌণ দিক। দেহতন্ত্রের ভিন্নতার কারণে পুরুষের ভিতর আক্রমণাত্মক, ধ্বংসাত্মক প্রবণতা নারীর রক্ষামূলক ও সৃষ্টিশীল প্রবণতার তুলনায় অনেক প্রবল। এটা ঠিক, সমাজ ও সভ্যতা পুরুষের এই ধ্বংসের শক্তিকে সংযত করার পন্থাও দিয়েছে। কিন্তু তারপরেও সমাজ ও সভ্যতার ইতিহাস যুদ্ধ ও রক্তপাতে ভরপুর। এবং এক সময় মানুষ নিজের ধ্বংসের শক্তির হাতে নিজেই যে কোনও সময় নির্মূল হতে পারে পৃথিবী থেকে।
এ থেকে মানুষকে ফেরাবে কে? যে কিনা নিজেই ধ্বংসের শক্তি, যার মৌল প্রবণতা ধ্বংসাত্মক সে একা ধ্বংসের শক্তিকে রোধ করবে? সেটা যে অসম্ভব তা ক্রমেই মানুষের চৈতন্যে আসবে। সুতরাং সমাজ, সভ্যতা ও রাষ্ট্রের ক্ষমতায় পুরুষ নিজ অস্তিত্বের প্রয়োজনেও নারীকে যথাযথ অংশ দিতে বাধ্য হবে। হয়ত বিশ্বব্যাপী সেই যুগের দিকে অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশের বিপ্লব এক গৌরবময় ভূমিকা রাখবে। কালের অনিবার্যতা আমাদের বিপ্লবের নারীবাদী রূপের মাধ্যমে মূর্ত হতে পারে মাত্র।
সুতরাং আমি মনে করি আমাদের জাতীয় ঐক্যের মূল ভিত্তি হবে জাতীয়তাবাদ, লোকবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র এবং নারীবাদ।