লিখেছেনঃ শামসুজ্জোহা মানিক, আপডেটঃ July 18, 2013, 4:54 AM, Hits: 2068
শেখ হাসিনা জাতীয় ঐক্যমতের ভিত্তিতে দেশ চালাবার কথা বলেছেন। সেই ঐক্যমতের ভিত্তিটা কি? সেটা তিনি বলেন নি। ওটা বলতে হবে এ দেশের পুনর্সংগঠিত এবং নূতন বিপ্লবীদের। আমি মনে করি এ দেশের জাতীয় মুক্তি আন্দোলন ও যুদ্ধের দীর্ঘ ইতিহাসের ভিতর দিয়ে যে মূলনীতিগুলো বেরিয়ে এসেছে সেগুলো হবে আমাদের জাতীয় ঐক্যমতের মূল ভিত্তি। আমার কাছে জাতীয় ঐক্যমতের প্রশ্নটা জাতীয় ঐক্যের প্রশ্ন। আর এই জাতীয় ঐক্যের প্রশ্ন এলে আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দেখা দেয় বাঙ্গালী জাতির এবং সেই সঙ্গে এ দেশের সকল জাতিসত্তার জনগণের জাতীয় ঐক্যের নীতিটি।
জাতীয়তাবাদ আমাদের ভিত্তি। বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ আমাদের আদর্শ। কিন্তু বাংলাদেশ শুধু একটা জাতিসত্তার দেশ নয়, এখানে আছে জুম্মসহ আরও বিভিন্ন জাতিসত্তা। বিশেষত পার্বত্য চট্টগ্রামে যে জুম্ম জনতা বাস করে তাদের সকল অধিকার মেনে নিয়ে তাদের সঙ্গে সমমর্যাদার ভিত্তিতে আমাদের বাস করার কথা ভাবতে হবে। সুতরাং আমাদের বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ হবে গণতান্ত্রিক। আমাদের জাতীয়তাবাদ হবে এ দেশের সকল জাতি ও জাতিসত্তার জাতীয়তাবাদের সমন্বিত রূপ। আমরা যারা বাঙ্গালী তারা যেমন বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী হব, কারণ ওটা ছাড়া আমাদের উপায় নেই, তেমন আমরা আর সকল জাতির জাতীয়তাবাদকে আমাদের জাতীয়তাবাদের সহমর্মী, বন্ধু, সহযাত্রী করে নিব। সুতরাং আমাদের জাতীয়তাবাদ একই সাথে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ আবার সকল জাতির সমন্বিত জাতীয়তাবাদ। বস্তুত এ দেশে আমাদের জাতীয়তাবাদ হল জাতিসংঘবাদ।
জাতীয়তাবাদ আমাদের খুবই প্রয়োজন সাম্রাজ্যবাদ-আধিপত্যবাদের নবতর আগ্রাসনের এই যুগে আত্মরক্ষার হাতিয়ার করার জন্য। এটা আক্রমণের হাতিয়ার নয়। এটা আমাদের বর্ম। কাউকে, কোনো জাতিকেই আমরা আক্রমণ করব না, পদদলিত করব না, লাঞ্ছিত, নিপীড়িত, নিগৃহীত করব না। জাতি হিসাবে আমাদের অস্তিত্বকে শুধু টিকিয়ে রাখব। আর তাই আমাদের চাই জাতীয়তাবাদ। সেটা বাঙ্গালীর জন্য বাঙ্গালী, জুম্মের জন্য জুম্ম। এবং তারপরেও আমরা হব এক সমন্বিত জাতি, এক জাতিসংঘ। আমাদের জাতীয়তাবাদ তাই উগ্র কিংবা নিরঙ্কুশ আদর্শ নয়। আমরা পৃথিবীকে দেখিয়ে দিব কিভাবে জাতীয়তাবাদকে অবলম্বন করেও আমরা হয়ে উঠতে পারি গণতান্ত্রিক, মানবিক, উদার, সহনশীল এবং জাতি সমন্বয়কারী।
একই সঙ্গে এ দেশের প্রেক্ষিতে এই জাতীয়তাবাদের একান্ত প্রয়োজন মধ্যযুগীয় ধর্ম-সাম্প্রদায়িকতার আধিপত্য থেকে মুক্ত হবার জন্য। বস্তুত এ ছাড়া আজকের যুগে আমার স্বাধীনভাবে দাঁড়াতেই পারব না এবং চিরকাল অপরের দাসত্ব করে যাব। সেকিউলার চেতনা ভিত্তিক এই জাতীয়তাবাদ আমাদের মধ্যে জাতিসত্তাভিত্তিক, ভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য ভিত্তিক এমন এক ঐক্যানুভূতি জাগ্রত করবে যার বলে বলীয়ান হয়ে আমরা যে কোন অভ্যন্তরীণ ও বহির্দেশীয় প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির ষড়যন্ত্র ও আধিপত্য প্রয়াসকে চূর্ণ করতে পারব।
আধুনিক যুগের সমস্যাকে মোকাবিলা করার জন্য এবং মানবিক চেতনায় উন্নত হবার জন্য আমাদের অতীব প্রয়োজন সেকিউলার চেতনার। রাষ্ট্র, সমাজ ও রাজনীতিকে অন্ধ ও পশ্চাৎপদ ধর্মের নিগড় থেকে মুক্ত করতে না পারলে আমরা কোনো কালেই উঠে দাঁড়াতে পারব না। এবং পরলোকের কল্পনায় জীবন ও জগতের সবকিছু সাম্রাজ্যবাদ এবং দেশী-বিদেশী লুণ্ঠনকারী ও অমানবিক শক্তির হাতে ছেড়ে দিয়ে বসে থাকব। সুতরাং এক নূতন আদর্শের দীপ শিখায় সমগ্র সমাজ, রাষ্ট্র, জাতি ও প্রতিটি মানুষের অন্তর আলোয় আলোকিত করার জন্য আমাদের চাই সেকিউলার চেতনা।
আমাদের এ কথা বুঝতে হবে সেকিউলারিজমের সঙ্গে ধর্মনিরপেক্ষতার সম্পর্ক নেই। অন্তত ধর্মনিরপেক্ষতার এমন এক ধারণা দিল্লীর শূদ্র-ব্রাহ্মণ শাসকেরা দাঁড় করিয়েছে যা প্রকৃত সেকিউলার চেতনার শত্রু। অমন সর্বধর্ম সমন্বয়ের গান্ধীবাদী ধারণাকে আমাদের চিনতে হবে এ দেশের প্রগতি ও উথানের বাধা হিসাবে। ঐ ধর্মনিরপেক্ষতা ভারতের ইতিহাসে নূতন কিছুও নয়। এখানে বিস্তারিত আলোচনার অবকাশ নেই। তবু সংক্ষেপে বলি, যে সেকিউলারিজমের চর্চা আজ ভারত-রাষ্ট্রে হচ্ছে সকল ধর্মের প্রতি অমন এক আনুষ্ঠানিক সহনশীলতা হিন্দু ধর্মের ভিতরে আছে। এবং সেটা হিন্দু ধর্ম ও সমাজ হাজার হাজার বৎসর যাবৎ উপমহাদেশে অনুশীলন করেছে।
মুসলমান শাসনের পূর্বকালে হিন্দু সমাজ ও ধর্মের ভিতরেও দ্বন্দ্ব-সংঘাত ছিল বৈকি। বিভিন্ন পথ ও মতের দ্বন্দ্বের কারণে। শৈব-বৈষ্ণবের দ্বন্দ্ব কখনো কখনো রক্তাক্ত সংঘাত ও যুদ্ধের রূপও নিয়েছে। তবু সেটা হিন্দু ধর্মের প্রধান দিক বা বৈশিষ্ট্য নয়। শত পথ ও মতের ভিন্নতাকে মেনে নিয়ে, অসংখ্য বর্ণজাতির স্বাতন্ত্র্য ও বিচ্ছিন্নতাকে ধারণ করে হাজার হাজার বছর ধরে হিন্দু ধর্মের যে রূপটি বিকশিত হয়েছে অহিংসা ও সহিষ্ণুতা তার মূল রূপ। অত আত্মদ্বন্দ্ব, ভিন্নতা ও গোঁজামিল নিয়ে তার সহিংস হবার উপায় কোথায় ছিল? বেশী সহিংস হতে গেলে তো সমগ্র ধর্ম ও সমাজ কাঠামো আত্মদ্বন্দ্বে ছিন্নভিন্ন হয়ে যেত। আর এইভাবে অহিংসার উপর এমন এক গুরুত্ব এসে পড়েছে যা সমগ্র সমাজকে নির্বীর্যতা ও ভীরুতার পূজারী করেছে। এই সমাজের ভীরুতা-নির্বীর্যতা শূদ্র-ব্রাহ্মণের ভিতর সবচেয়ে বেশী মূর্ত হয়েছে। বৈশ্যরাও অবশ্য ঠিক তা-ই ছিল। ক্ষত্রিয়ের বল-বীর্য সাধনা যেন এই সমাজে বহিরারোপ। সমাজতলে তা শিকড় মেলতে পারে নি। ক্ষত্রিয় যেন অনেকটাই পরগাছা এই সমাজে।
এই রকম এক সমাজে যখন প্রবল কোনো শক্তি বাহির বা ভিতর থেকে এসে নূতন ধর্ম বা বিশ্বাস দিয়েছে হিন্দু সমাজ তখন সেটাকে মেনে নিয়ে বেদ-ব্রাহ্মণের শ্রেষ্ঠত্ব ভিত্তিক নিজ বর্ণজাতির কাঠামোতে কোথায়ও সেটার জন্য জায়গা করে দিতে চেষ্টা করেছে। যখন সেটা পারে নি তখনও সেটাকে মেনে নিয়েছে। তারপর ধীর গতিতে সেটাকে আত্মস্থ করে তাকে বর্ণজাতির অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছে।
আজকের ভারত-রাষ্ট্রের রাষ্ট্রীর স্বয়ং সেবক সংঘ (আরএসএস) বা শিব সেনাকে দিয়ে হিন্দু ধর্মের এই মূল রূপকে চেনা বা বোঝা যায় না। আমরা ইউরোপের শেখানো কিছু বুলি তোতা পাখির মতো বলি, যত্রতত্র প্রয়োগ করি। আর তাই এদেরকে হিন্দু মৌলবাদী বলি। কিন্তু আরএসএস, ইত্যাকার হিন্দুত্ববাদীরা মৌল হিন্দু ধর্ম ও দর্শনকে পরিবর্তিত করে, সংস্কার করে তাকে একটা নূতন রূপ দিতে চেষ্টা করছে মাত্র। এটা এমন এক উগ্রবাদী সংস্কারের প্রয়াস যার সঙ্গে মৌলবাদ তথা মূল হিন্দু ধর্মের বিশেষ কোনও সর্ম্পক নেই। অবশ্য যদি মূল হিন্দু ধর্ম বলে কোনো বস্তু আদৌ থাকে। কারণ এটা অসংখ্য বৈপরীত্যের এক জট পাকানো সমন্বয়। কেউ যদি জট খুলতে চায় খুলুক। তবে সেটাকে মৌলবাদ বলা কেন?
যাঁরা বৌদ্ধদের লাখে লাখে বা কোটিতে কোটিতে হত্যা করে ব্রাহ্মণ শাসন কায়েমের ইতিহাস বলেন তাঁরা আসল ইতিহাসের কোনো খোঁজই রাখেন না। বলপ্রয়োগ সব সমাজেই এমন কি সবচেয়ে অহিংস সমাজেও থাকে। অমন যে অহিংস শূদ্র অথবা অস্পৃশ্য সেও কি বাইরে লাথি খেয়ে বাড়ীতে ফিরে তার বৌকে পেটায় না? হাঁ, হিন্দু সমাজেও বলপ্রয়োগ ছিল বৈকি। কিন্তু সেটা তার প্রধান দিক নয়। বরং গৌণ এক দিক। এই বলপ্রয়োগ ছিল দুর্বলের উপর। যখন সমাজের তলদেশ থেকে দুর্বল কেউ প্রতিবাদ করেছে, অথবা ভিন্ন চেতনা নিয়ে দাঁড়াতে চেয়েছে তখন তা তাকে সবলে দমন করেছে। কিন্তু সেক্ষেত্রেও তার প্রধান রূপটা ছিল সচরাচর অহিংস। যে সমাজে সমাজচ্যুত করলেই একটা ব্যক্তি, একটা পরিবার অথবা একটা গোষ্ঠী ধ্বংস হয়ে যায় ক্ষুধায়, তৃষ্ণায়, বিচ্ছিন্নতায়, সমাজের ঘৃণা আর অবজ্ঞায় সেখানে বলপ্রয়োগের প্রয়োজন কতটুকু?
তারপরেও তা অনেক ভিন্নতাকে মেনে নিয়েছে, যদি তা বর্ণজাতি কাঠামোকে, ব্রাহ্মণের কর্তৃত্বকে, শূদ্রের দাসত্বকে প্রবল আঘাতে ভাঙ্গতে না চেয়েছে। হিন্দু ধর্ম ছিল ব্রাহ্মণের কর্তৃত্ব ও বর্ণজাতিভেদ ভিত্তিক সামাজিক স্থিতির এক ধর্ম, যার রক্ষার দায়িত্বটা ছিল ক্ষত্রিয় রাজার হাতে। সবাই এখানে যার যার মতো করে জায়গা পেয়েছে। বৌদ্ধরা বর্ণজাতির উপযোগী ছিল না। বেদ, ব্রাহ্মণের আধিপত্য বিরোধী ছিল। তবু তাদের হিন্দু সমাজ প্রায় দেড় হাজার বছর মেনে নিয়েছিল। ধীরে ধীরে গ্রাস করেছে। যখন যেখানে একান্ত প্রয়োজন হয়েছে কিছু বলপ্রয়োগও করেছে। তবু সেটা মুসলমানের বলপ্রয়োগ নয়। উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপিয়ে যাঁরা ভারতে বৌদ্ধদের হত্যা আর ধ্বংস দিয়ে নির্মূল করার দায় হিন্দুদের উপর চাপিয়ে নূতন ইতিহাস লেখতে চান তাঁদেরকে প্রশ্ন করব উত্তর ভারতে দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত টিকে থাকা বৌদ্ধ বিহারগুলোকে কারা আগুন ও তরবারীর মুখে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছিল? বিহার বা মঠবাসী হাজার হাজার নিরস্ত্র, অহিংস বৌদ্ধ শ্রমণদের কারা দলে দলে হত্যা করেছিল? এমন কি চীনে বৌদ্ধদের উপর এক সময় যে নির্যাতনের স্রোত বয়ে গিয়েছিল তারও কি তুলনা ভারতে আছে?
মুসলমান যখন এসেছে তখন ক্ষত্রিয়রা বাধা দিয়েছে। কারণ তারাও রাজা, শাসক, সৈনিক। আরেক দল যখন রাজ্য দখল করতে আসে তখন ক্ষত্রিয় রাজা বাধা দিবে না তো কি করবে? বাধা দিয়েছে। কিন্তু হেরে গেছে। কারণ শূদ্র-ব্রাহ্মণের দায়িত্ব নয় রাষ্ট্রকে রক্ষা করা। নূতন রাজারা এসেছে নূতন রাজধর্ম নিয়ে। ওটাও শূদ্র-ব্রাহ্মণের কাছে আর এক বর্ণজাতির নূতন তত্ত্ব মাত্র। ওটাকেও চেষ্টা করেছে হজম করতে নিজ কাঠামোতে। পারে নি যখন তখন বৌদ্ধ ধর্মকে যেমন সুদীর্ঘ কাল চেষ্টা করেছে নিজ ধর্মের সঙ্গে সমন্বিত করতে তেমন চেষ্টা করেছে সমন্বিত করতে অথবা পাশে রেখে দিয়েছে নূতন ধর্মকে। মুসলিম শাসনামলে বাবর থেকে শাহজাহান পর্যন্ত এই ধর্ম সমন্বয়ের চেষ্টার শ্রেষ্ঠ কালটা চলেছিল। আকবর সে কালে তারও ঊর্ধ্বে উঠতে চেয়েছিলেন এক নূতন মতবাদ প্রবর্তন করে, যেটার নাম দীন-এ-এলাহী। ওটা প্রকৃতপক্ষে আধুনিক ভারত-রাষ্ট্রের সেকিউলারিজমের চেয়েও উন্নততর এক চেতনা সম্ভূত। অতটা উন্নত চেতনা এ যুগেই যেখানে ভারতে দাঁড়াতে পারে না সে যুগে পারবে কিভাবে? আকবর তাই ব্যর্থ। তবু তাঁর ভিতরেও ছিল ভারতবর্ষের ধর্মীয় ও মতাদর্শিক সহিষ্ণুতার একটা প্রেরণা।
কিন্তু প্রথাগত হিন্দু ধর্ম ও সমাজের এই সহিষ্ণুতার ভিতর উন্নত মানবিক-গণতান্ত্রিক রূপ সন্ধান করে লাভ নেই। এ হল শ্রমজীবী মানুষের এক আশ্চর্য নিশ্চেতন, জড়, অন্ধ অনুগত, নির্বীর্য, ভীরু ও পশ্চাৎপদ মনকে অবলম্বন করে, কাজে লাগিয়ে গড়ে তোলা সমাজ নিয়ন্ত্রণের এক ব্যবস্থা। এর মর্মে রয়েছে সভ্য সমাজের ভিতরে আদিম বন্যতায় ধরে রেখে শূদ্র শ্রম ও সেবা আত্মসাতের এক অতীব জটিল কৌশল। আদিম গোত্র ও উপজাতীয় চেতনা ও ঐতিহ্যকে এক বিকৃত ও পঙ্গু রূপ দিয়ে, আদিম মানুষের আত্মার ধারণাকে ব্যবহার করে গোটা সমাজকে ভাগ করে ফেলা হল অসংখ্য উপজাতি-গোত্র সম বর্ণজাতিতে। এক সমতলে এসে দাঁড়াবার কোনো উপায় আর মানুষের রইল না। বর্ণজাতির কারাগার ভেঙ্গে কোনো মানুষের ব্যক্তিসত্তা নিয়ে দাঁড়াবার উপায় রইল না।
পেশা বা বৃত্তি এবং পবিত্রতা-অপবিত্রতার স্তর ভেদে ফেলে অসংখ্য বর্ণজাতি সমন্বিত এমন এক সমাজ গঠন করা হল যেখানে প্রতিটি বর্ণজাতি হল এমন এক বজ্রদৃঢ় গোষ্ঠী যা ভেঙ্গে ব্যক্তির মুক্তি অসম্ভব। ব্যক্তির মুক্তির একটাই পথ খোলা রইল, তা হল সমাজ-সংসার ত্যাগ করে সন্ন্যাসী হয়ে যাওয়া। ওটা তো ব্যক্তির সামাজিক মুক্তি নয়। ফলে হিন্দু সমাজ এক নিরঙ্কুশ গোষ্ঠীসংঘ মাত্র যেখানে ব্যক্তির অস্তিত্ব নেই। মুসলমানের এককেন্দ্রিক নিরঙ্কুশ গোষ্ঠীবাদের বিপরীতে এ হল নিরঙ্কুশ গোষ্ঠীসংঘবাদ। আর উভয় গোষ্ঠীবাদেই ব্যক্তির স্বাধীন অস্তিত্বকে নির্মূল করা হয়েছে। এক গোষ্ঠী যদি ধর্মের নামে তরবারী আর চাবুক দিয়ে ব্যক্তিসত্তাকে নির্মূল করে থাকে অপর গোষ্ঠী বা গোষ্ঠীসংঘ তবে সে কাজটা করেছে সমাজচ্যুত, বর্ণজাতিচ্যুত করে। এক গোষ্ঠী নির্মাণের অবতলের শক্তি যদি হয়ে থাকে মরুভূমি থেকে বর্বরতা নিয়ে উঠে আসা তলোয়ার হাতে বেদুঈন অপর গোষ্ঠীসংঘ নির্মাণের অবতলের শক্তি তবে অরণ্য থেকে আদিমতা নিয়ে উঠে আসা উপজাতি যে তীর-ধনুক ছেড়ে দিয়ে লাঙ্গল হাতে নিয়ে নিরস্ত্র, ভীরু, অহিংস শূদ্র হয়েছে। আর উভয় অবতলের শক্তিই শেষ পর্যন্ত অধিকার করেছে উভয় সমাজকে – সশস্ত্র, সহিংস বান্দা মালিককে, নিরস্ত্র, অহিংস শূদ্র ব্রাহ্মণকে।
একাদশ শতাব্দীতে সুলতান মাহমুদের ভারত লুণ্ঠন অভিযানের কালে সেকালের বিখ্যাত পণ্ডিত আলবেরুনী ভারতে এসে কিছু কাল অধ্যয়ন করেছিলেন এবং ভারতীয় সমাজকে বুঝতে চেষ্টা করেছিলেন। তাঁর এক অমূল্য ঐতিহাসিক মূল্যায়ন আছে প্রথাগত হিন্দু মানস সম্পর্কে। তিনি বলছেন, ‘ভারতীয়রা (হিন্দুরা) সব সময়ই বিশৃঙ্খলার মধ্যে বাস করে। তাদের কাছে যুক্তির কোনো মূল্য নেই। জনতার মধ্যে মিশে জনতার খেয়ালে আচরণ করাই এদের বৈশিষ্ট্য। আমি কেবল ভারতীয়দের অঙ্ক ও নক্ষত্রবিদ্যা সম্পর্কিত জ্ঞানেরই তুলনা করতে পারি। কিন্তু তাদের কাছে মুক্তাও যা পশুর বিষ্ঠাও তা-ই। নুড়ি-পাথরের যা মূল্য, দামী স্ফটিকেরও তা-ই। তাদের কাছে সবই সমান। কেননা এরা বিজ্ঞানসম্মতভাবে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারে না।’ হাঁ, এই ধরনের হিন্দু মানস মুক্তা আর পশুর বিষ্ঠা এই দু’টোর মধ্যে প্রভেদ করতে পারে না। তাই দু’টোকেই যত্ন সহকারে পাশাপাশি রাখে। সবচেয়ে উৎকৃষ্ট এবং সবচেয়ে নিকৃষ্ট সবই তার কাছে মূল্যবান এবং কখনও বা পূজনীয়। কোনোটারই অনাদর তার কাছে নেই। বিশেষ করে জবরদস্তি করে একবার জায়গা দখল করে বসতে পারলে তো কোন কথাই নেই। আমাদের মহাকবির ভাষায় বলতে গেলে বলতে হয়, ‘দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবে, যাবে না ফিরে/ এই ভারতের মহামানবের সাগর তীরে।’ হাঁ, কেউ ফিরবে না! সব থাকবে! দুনিয়ার সকল আপদ, উপদ্রব, জঞ্জালের এর চেয়ে নিরাপদ ভূমি পৃথিবীতে আর কোথায়? এই মন সবকিছুকেই ধারণ করতে চায়, রাখতে চায়। এক সাথে সবই পাশাপাশি রেখে দেয়। আর এইভাবে জঞ্জাল বাড়ায়। বাড়াতেই থাকে। নিজে তো পরিষ্কার করবেই না, কাউকে করতেও দিবে না। বরং তা করতে গেলেই তেড়ে আসবে। পরিষ্কার করতে দিবে কেন? তা তো সমন্বয়কারী! সর্ব জঙ্গল, সর্ব আর্জনা, সর্ব উৎকৃষ্ট ও নিকৃষ্টের সমন্বয়কারী! বিজ্ঞান গবেষণাগার থেকে মন্দিরে, মন্দির থেকে মসজিদে, মসজিদ থেকে গীর্জায় ঢুকেই তা ভাবে সেকিউলারিজম হয়ে গেল! এ এক আশ্চর্য জগাখিচুড়ি! এক আশ্চর্য জট পাকানো মন!
হাঁ, এরই নাম ভারতরাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষতা বা সেকিউলারিজম। না, অমন সেকিউলারিজমের প্রয়োজন আমাদের নেই। আমাদের চাই একটি বস্তুবাদী বা ইহলোকবাদী আদর্শ। না, ইহ বললেই মনে হয় পর বলে আর একটি বস্তু আছে। ওটার কল্পনা যারা করে করুক। আমাদের প্রয়োজন যে লোক পৃথিবীতে আছে, যে লোক অস্তিত্বে আছে তাতেই মানুষের উন্নয়ন ও কল্যাণ সাধন। সুতরাং এটাকে বরং লোকবাদী বলা যাক। লোক বলতে শুধু অস্তিত্বশীল বস্তু বা জগৎকে বোঝায় না, তাকে অনুভব করে যে মানুষ, তার ভিতর দিয়ে বেড়ে উঠে যে মানুষ ঐ জগৎটাকে তার আরও উপযোগী করে নিতে চায় সেই মানুষকেও বোঝায়। মানুষই তো মানুষের সকল চেতনা, ভাবনা ও কর্মের কেন্দ্র। সুতরাং সেকিউলারিজমকে আমরা বরং লোকবাদ করতে পারি। না, এটা ইউরোপের সেকিউলারিজমও নয়। এটা একান্তই আমাদের নিজের জিনিস। ইউরোপ যে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে সেকিউলারিজমের বিশেষ রূপটি আবিষ্কার করেছিল সেই সংগ্রাম থেকে আমাদের সংগ্রাম ভিন্ন। আমাদের সমস্যাও ভিন্ন।
লোকবাদের এই নিজস্ব রূপ সন্ধানে আমাদের ইউরোপে যাবারও প্রয়োজন নেই। এমন কি এই মাটিতে, এই বাংলার মাটিতে অতীতে যুগে যুগে লোকবাদের এই রূপ আবিষ্কারের সংগ্রাম চলেছিল। মধ্যযুগের অন্ধকারের বুক ফালা ফালা করে দিয়ে বাংলার এক কবি দ্বিজ চণ্ডীদাস উদাত্ত কণ্ঠে উচ্চারণ করেছিলেন, ‘শুনহ মানুষ ভাই, সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।’ এর পরেও সেকিউলারিজমের শিক্ষা নিতে ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে ইউরোপের জ্ঞানের ভাণ্ডারীদের দুয়ারে গিয়ে কাতর স্বরে নিবেদন করতে হবে আমাদের অভাবের কথা? হাঁ, এই লোকবাদ দিয়ে আমরা মধ্যযুগকে মোকাবিলা করব, সেখান থেকে মুক্ত হয়ে বেরিয়ে আসব, আধুনিক যুগকে মোকাবিলা করব, সাম্রাজ্যবাদকে মোকাবিলা করব, অমানবিকতা-অশিক্ষা-কুশিক্ষা-কুসংস্কারকে মোকাবিলা করব এবং এক সুউন্নত কালে প্রবেশ করব। এই লোকবাদ দিয়ে আমরা ঘটাব কালান্তর শুধু এ দেশের নয়, পৃথিবীরও।
এবং আমাদের চাই গণতন্ত্র। কিন্তু গণতন্ত্রের যে রূপটি এ দেশে আজো প্রচলিত রয়েছে তা মূলত একটি লুম্পেন আমলা-ধনিকের গণতন্ত্র। এই গণতন্ত্র সীমাবদ্ধ, পঙ্গু ও অতিকেন্দ্রীভূত। সারা দেশে ছড়িয়ে আছে বেসামরিক আমলাতন্ত্রের জাল। ঐ জালে বাঁধা পড়ে আছে জাতির প্রাণশক্তি। উপর তলায় একটি কেন্দ্রীভূত সংসদ ও সরকার কাকে প্রতিনিধিত্ব করে? মূলত করে ঐ বিশাল আমলাতান্ত্রিক জালটিকে। কারণ ঐ আমলাতন্ত্র দ্বারা আবদ্ধ এক সংসদকে কেন্দ্র করে এবং আমলাতন্ত্রের মাধ্যমে সরকার রাষ্ট্র পরিচালনা করে। একই সঙ্গে এই সরকার প্রতিনিধিত্ব করে ধনিক শ্রেণীকে, যে শ্রেণীটি নির্বাচনী রাজনীতির অর্থ ও সমাজিক শক্তি যোগাবার প্রধান উৎস। আর এইভাবে নির্বাচিত সরকার আমলাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সংযুক্ত এবং প্রকৃতপক্ষে আমলাদের অধীনস্থ ধনিকদের স্বার্থকেও রক্ষা ও প্রতিনিধিত্ব করে। সামরিক-বেসামরিক আমলা এবং ধনিক উভয়ে মিলে গঠন করেছে এ দেশের লুম্পেন শাসক শ্রেণীটিকে। এই লুম্পেন আমলা-ধনিকের গণতন্ত্র কখনও জনগণের গণতন্ত্র হয়ে ওঠে না।
প্রশাসনের উপর জনগণের নিয়ন্ত্রণ নেই। জনগণের চাকর হবার কথা যাদের সেই বেসামরিক আমলারা এ দেশে হয়ে আছে জনগণের প্রভু। এই অবস্থা পরিবর্তনের জন্য চাই দেশের প্রশাসনের সর্বস্তরে জন-প্রতিনিধিদের শাসন। ডিসি, টিএনও, এসপি, ওসি-এর কোনো প্রয়োজন নেই। এদের স্বাধীন ও প্রভুত্বকারী অস্তিত্ব এ দেশে গণতন্ত্র ও জনগণের শত্রু। বেসামরিক আমলারা থাকবে প্রতিটি স্তরে জনগণের প্রতিনিধিদের হুকুমের চাকর হয়ে। অবশ্য সবাই কাজ করবে একটা কঠোর নিয়মের ভিতরে থেকে। সেখানে প্রত্যেকের দায়িত্ব ও ক্ষমতা নির্দিষ্ট করা থাকবে। নিয়মের বাইরে কেউ যেতে পারবে না। কিন্তু এই কথা আমাদের বুঝতে হবে যে, আমলাতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার অবসান ছাড়া গণতন্ত্র গণতন্ত্র নয়, এটা স্বৈরতন্ত্র ও আমলাতান্ত্রিক শাসনের রাজনৈতিক বা নির্বাচিত রূপ মাত্র। এ দেশে সামরিক আমলারা যেমন বার বার ক্ষমতা দখলের পর একটা পর্যায়ে নির্বাচনের আশ্রয় নিয়ে সামরিক আমলার শাসনকে একটা নির্বাচনী ও রাজনৈতিক আবরণ দিয়েছে মাত্র ঠিক তেমন এ দেশে এ পর্যন্ত নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকারগুলো বেসামরিক আমলাদের শাসনকে একটা নির্বাচনী ও রাজনৈতিক আবরণ দিয়েছে মাত্র।
এ দেশে গণতন্ত্রের অপর একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হল সেনাবাহিনীর আমলাতান্ত্রিক ও স্বৈরতান্ত্রিক বৈশিষ্ট্য। বিদেশী উপনিবেশবাদী ইংরেজ শাসক এ দেশ শাসনের জন্য যে সেনা কাঠামোটি গড়েছিল সেটি আজো অপরিবর্তিত রয়েছে। অথচ এই সেনা কাঠামোর ভিতর থেকে বারবার উঠে আসে আইয়ুব, ইয়াহিয়া, উঠে আসে ফারুক, রশীদ, জিয়া, এরশাদ। আবার কেউ কখনো উঠে আসবে না তার নিশ্চয়তা কি? এই সেনা কাঠামো সারা জাতির দৃষ্টির আড়ালে, সংসদেরও দৃষ্টির আড়ালে রইবে, এটা কেমন গণতন্ত্র? সেনাবাহিনী কি ভিন্ন রাষ্ট্র, নাকি ভিন্ন জাতি? জনগণের টাকা দিয়ে একদল লোক পোষা হবে, অথচ তাদের চেতনা কি, শিক্ষা কি, তারা কি করে না করে এসব জানার অধিকার থাকবে না? এটা না থাকলে তাদের পোষার দরকার কি? বাড়ীর পাহারাদাররা এ দেশে বারবার বাড়ীর মালিক হয়েছে, মালিককে চাকর বানিয়েছে। এই অবস্থার পথটা কি খোলাই থাকবে? আর তার নাম গণতন্ত্র? না, এটা কোনো গণতন্ত্রই নয়। আসলে এ দেশে আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থারই এক প্রধান বাহু হল সেনাবাহিনী। সেটা আড়ালে থাকে। প্রয়োজনে, সুযোগে সামনে আসে।
সুতরাং প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হলে সেনা কাঠামোকে জনগণের অধীনে ও নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। এর অর্থ হল সেনাবাহিনীকে দেশের রাজনৈতিক কর্তৃত্বাধীনে আনা। সরকার ও সংসদের মাধ্যমে সেনাবাহিনীর উপর জনগণের নিয়ন্ত্রণ কার্যকর করতে হবে এবং সেনা কাঠামোর ভিতর প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দান, আদর্শে উদ্বুদ্ধকরণের কাজ অব্যাহত রাখতে হবে। এর সহজ তাৎপর্য হল গণ-বিচ্ছিন্ন, সমাজ বিচ্ছিন্ন উপনিবেশবাদী সামরিক ব্যবস্থার অবসান ঘটাতে হবে। সেনাবাহিনীর সদস্যরা তাদের পেশাগত সামরিক দক্ষতা বৃদ্ধির পাশাপাশি দেশ ও জনগণের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে অংশ নিবে। সেনাবাহিনী হবে সমাজ ও জনগণের এক জীবন্ত অঙ্গ। এটা মূলত একটা গণ-সেনাবাহিনী গঠনের কাজ, বর্তমান সেনাবাহিনীর কাঠামোর মৌলিক পরিবর্তন সাধনের কাজ। কিন্তু জনগণের সেনাবাহিনী গঠন ছাড়া এ দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার উন্নতি সাধন কিংবা নিরাপত্তা বিধান কোনোটাই করা যাবে না।
এই গণতন্ত্রের মতোই আমাদের এক অমূল্য ভিত্তি সমাজতন্ত্র। বস্তুত সমাজতন্ত্রকে বাদ দিলে আমাদের গণতন্ত্র জনগণের গণতন্ত্রই হবে না। ওটা হবে লুটেরা, লুম্পেন আমলা-ধনিকের রাজনৈতিক স্বৈরতন্ত্র মাত্র। সমাজতন্ত্রের মূল্য কে বলে ফুরিয়েছে? সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের পতন হয়েছে বলে? সোভিয়েতের পতন সোভিয়েত বিপ্লবের পতন নয়, ওটা ঐ বিপ্লবের মধ্য থেকে যে রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদের উত্থান হয়েছিল তার পতন। আর একটা কথা, কোনো ব্যবস্থাই মানুষের জন্য চূড়ান্ত নয়। তা তার ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করে চলে যায়। কিন্তু চলে যাবার আগে শুধু যে এক উত্তরাধিকার রেখে যায় তা নয়, উপরন্তু রেখে যায় অনেক অমূল্য শিক্ষা।
সমাজতন্ত্র কি পৃথিবীতে হঠাৎ করে এসেছিল? নাকি এটা হঠাৎ রাশিয়ার জমি ফুঁড়ে উঠেছিল? আধুনিক সমাজতন্ত্রের ধারণার উদ্ভব পশ্চিম ইউরোপের মাটিতে। সেখানে নব উথিত পুঁজির যে অমানবিক, ধ্বংসাত্মক দিক দেখা দিয়েছিল তার বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া হিসাবে সেখানে নিপীড়িত মানুষের এক সংগ্রাম জেগে উঠেছিল। সমাজতন্ত্রের ধারণা সেই সংগ্রামের ফসল।
আসলে সমাজতন্ত্র শুধু এ কালের মানুষের স্বপ্ন নয়। এটা চিরকালের। কারণ সমাজতন্ত্র হল গণতন্ত্র ও সাম্যের, মানুষের সামগ্রিক কল্যাণের ভাবনার এক বিশেষ রূপ মাত্র। মানুষের ব্যক্তিস্বার্থবুদ্ধি ও লোভকে মানুষের সকল দু:খের কারণ ভেবে যুগে যুগে কালে কালে অসংখ্য মানুষ ব্যক্তিগত সম্পত্তি, সম্পদ ও ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন অথবা অতিকেন্দ্রীভবনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছে। আদিম মানুষ প্রকৃতির বিরুদ্ধে, চারপাশের বৈরিতার বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে এক সুসংহত গোষ্ঠীবদ্ধ জীবন যাপন করত এবং গোত্র বা উপজাতির মানুষদের নিজেদের ভিতর এক ধরনের সাম্য এবং সহমর্মিতার সুদৃঢ় বন্ধন ছিল। সেই এক বিস্মৃত প্রাচীন কালের স্মৃতি নিদারুণ বৈষম্যের উপর প্রতিষ্ঠিত সকল সভ্যতার মানুষকে যুগ যুগান্ত ধরে তাড়িত করেছে। প্রতিটি জনগণ বন্দিত মতবাদ অথবা ধর্ম কোনো না কোনো রূপে কম আর বেশী সেই আদিম কালের হারানো জীবনের জন্য দীর্ঘ নিশ্বাসে, সেই রকম এক জীবনে ফেরার আর্তিতে মথিত হয়েছে। সমাজতন্ত্রের মর্মবস্তু হল মানুষের সেই হারানো জীবনের জন্য আর্তি। শুধু তাই নয়, সেই হারানো জীবনের উত্তরাধিকার রক্ষার অন্তহীন প্রয়াস।
আদি খ্রীষ্টান ধর্মে আমরা সমগ্র খ্রীষ্টান সমাজে এক ধরনের সমাজতান্ত্রিক প্রেরণা দেখতে পাই। গীর্জা বা চার্চ গঠনের পর এটা সেখানে কেন্দ্রীভূত ও সংহত রূপ নেয়। বৌদ্ধ ধর্মে মঠ বা সংঘ ছিল সমাজতান্ত্রিক প্রেরণার আর এক মূর্ত রূপ। ইসলামেও আমরা সমাজতান্ত্রিক প্রেরণার এমন এক রূপ দেখতে পাই যেখানে তা সমাজে সম্পদের বৈষম্যকে সংযত করতে চেয়েছে এবং এক অখণ্ড সমাজ গড়তে চেয়ে মানুষের ভিতরকার সকল ব্যক্তিসত্তাকেই আঘাত করে আর এক চরম স্বৈরতন্ত্রের ভিতর মানুষকে নিয়ে গেছে। তবু তার ভিতরে রয়েছে মানুষের সাম্যের এক প্রেরণা। ভারতের বর্ণজাতি ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত ছিল নিদারুণ অসাম্যের ভিত্তিতে। কিন্তু নির্দিষ্ট বর্ণজাতির সদস্যদের ভিতর ছিল সেই সমাজতান্ত্রিক প্রেরণা। সভ্যতা মানুষকে যে দৃশ্যমান এবং ভয়ঙ্কর বৈষম্য ও বিভেদ দিয়েছে যুগে যুগে তার বিরুদ্ধে মানুষের সংগ্রামও চলেছে। এমন কি আধুনিক যুগের সূত্রপাতের পূর্বে পশ্চিম ইউরোপে বিশেষত জার্মানীতে সামন্ত শাসনের বিরুদ্ধে কৃষক বিপ্লবের যে জোয়ার জেগেছিল তার ভিতরেও মূর্ত হয়ে উঠেছিল সমাজতান্ত্রিক প্রেরণা। সেখানে ব্যক্তিগত মালিকানার অবসান ঘটিয়ে জমিকে করতে চাওয়া হয়েছিল সর্বসাধারণের সম্পত্তি।
সমাজতন্ত্র কোনো নূতন কল্পনা বা আদর্শ নয়। এটা মানুষের চিরকালের আদর্শ। যুগে যুগে তার রূপ বদলেছে মাত্র। হয়তো এটা অনেক সময় বাস্তবতা বর্জিত অবাস্তব কল্পনা হয়েছে। ভেবেছে ব্যক্তিগত মালিকানার অবসান ঘটালেই বুঝি সব সমস্যার সমাধান হবে। তা মানুষকে বোঝে নি। কিন্তু মানুষের লোভ, স্বার্থপরতার বিরুদ্ধে যে সংগ্রামের প্রয়োজন তা তুলে ধরে তার মূল্য কি অপরিমেয় নয়? এই সংগ্রাম একেবারে না থাকলে ব্যক্তি মানুষ কি দানবিক হয়ে ওঠে না? ব্যক্তি স্বাধীনতার প্রয়োজন আছে। ব্যক্তি মালিকানার প্রয়োজন আছে। ব্যক্তি-পুঁজির অস্তিত্ব ও বিকাশেরও প্রয়োজন আছে। ব্যক্তির স্বার্থবুদ্ধি ও স্বার্থগত প্রেরণারও প্রয়োজন আছে। তা না হলে সমাজ-সভ্যতা এগোয় না। এই প্রয়োজন সমাজের সামষ্টিক অগ্রগতি ও বিকাশের স্বার্থেই। কিন্তু যদি ব্যক্তি নিরঙ্কুশ হয়ে ওঠে, সবকিছু হয়ে ওঠে তবে কি সমাজ থাকে? এমন কি অতীতে যে দাস মালিকরা অন্যদের ধরে এনে দাস করত তারা কি নিজেদের মধ্যে একটা সংহতি ও সমতা রাখে নি? তা না হলে সবাই সবার সঙ্গে যুদ্ধে ও দ্বন্দ্বে ধ্বংস হত। অর্থাৎ সেখানে তাদের নিজেদের মধ্যে ছিল একটা ঐক্য ও সমতার প্রয়াস। আর এই প্রয়াসের অর্থ হল কোনো একজনের নিরঙ্কুশ হয়ে ওঠার বিরুদ্ধে সংগ্রাম। সমাজতন্ত্র হল এই সংগ্রামের এমন এক রূপ যা সমগ্র সমাজকে তার ভিতরে ধারণ করতে চায়। যখন সবকিছু নিরঙ্কুশ করতে চায়, সকলের সম্পত্তির অধিকার কেড়ে নিয়ে ভাবে সাম্য হয়ে যাবে তখন বাস্তবে তা এক ব্যক্তির দাসত্বে নিক্ষেপ করে সমগ্র সমাজকে, আর এইভাবে নবতর বর্বর অসাম্যের জন্ম দেয়। সেটা মানুষের অভিজ্ঞতার অভাবের ফল। মানুষকে চিনতে ও বুঝতে না পারার ফল। সভ্যতার সমস্যাকে বুঝতে না পারার ফল।
কিন্তু তবু সমাজতন্ত্রের ভিতরে মানুষের মনে যে আত্মত্যাগ, অন্যের জন্য, নিপীড়িতের জন্য সহানুভূতি, ভালবাসা জাগাবার প্রয়াস রয়েছে তার মূল্য চিরন্তন। এ এমন এক হাতিয়ার মানুষের হাতে দিয়েছে যা মানুষকে আরও গণতান্ত্রিক, আরও মানবিক হতে শেখাবে। ব্যক্তি এগিয়ে যাবে। কিন্তু, সে যখন সবাইকে ফেলে দিয়ে চলে যেতে চাইবে তখন তাকে কোন্ বাঁধন সকল মানুষের সঙ্গে বেঁধে রাখবে, ফলে তার অগ্রগতি হয়ে উঠবে সমাজের অগ্রগতি? যে সমাজের শক্তিকে আহরণ ও কেন্দ্রীভূত করে ব্যক্তি বড় হয়ে ওঠে, এগিয়ে যায় সেই সমাজ যদি তাকেও নিয়ন্ত্রণ করার সংগ্রামটা ছেড়ে দেয় তবে মানুষের অস্তিত্ব কি পৃথিবীতে রইবে? সুতরাং সমাজ যতদিন ছিল আছে থাকবে ততদিন সমাজতন্ত্রও ছিল আছে থাকবে। তার রূপ যেমন হোক। আর তাই গণতন্ত্রের মর্মবস্তুও প্রকৃতপক্ষে সমাজতন্ত্র।
পশ্চিম ইউরোপে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ভিতর দিয়ে মূর্ত হওয়া সমাজতান্ত্রিক ধারণাটিকে মাক্র্স-এঙ্গেল্স নিজেদের মতো করে সূত্রবদ্ধ করেন তৎকালীন ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনকে একটা পরিণতি দিতে চেয়ে। এই সূত্রকে লেনিন নিজের মতো করে বিকশিত করে, প্রয়োজনে কিছু পরিবর্তিতও করে রাশিয়ার মধ্যযুগীয় সমাজের আধুনিকায়নের পথ উন্মুক্ত করে দিয়ে যান। এই পথ ধরে সোভিয়েত সমাজতন্ত্র যেখানে পৌঁছেছিল তার ভাল, মন্দ দুই দিকই আছে। কিন্তু তার যুগান্তকারী অবদানকে আমরা অস্বীকার করব কিভাবে? ওর মধ্য থেকে, মানব জাতির মহত্তম এক ঐতিহাসিক প্রয়াসের মধ্য থেকে আমাদের প্রয়োজনীয় মর্মবস্তু ও শিক্ষাকে বের করে নিতে হবে। যে কোনো আদর্শ নিয়ে মানুষ যখন বিরাট সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং তার জন্য পরিস্থিতি তার নিকট বিরাট আত্মদান দাবী করে তখন সেই আদর্শকে নিরঙ্কুশ করার একটা প্রেরণা মানুষকে পেয়ে বসে। সেই আদর্শকে ঘিরে এমন এক কল্পস্বর্গ রচনা করতে চায় যেখানে জীবনের সব সমস্যার চূড়ান্ত সমাধান হবে। ইউরোপে বিদ্যমান সমাজতান্ত্রিক ও কমিউনিস্ট আন্দোলনকে একটা তত্ত্বগত ও যৌক্তিক রূপ দিতে গিয়ে মাক্র্স-এঙ্গেল্স এ কাজ করেছিলেন। কমিউনিজমের কল্পস্বর্গ নির্মাণ করে প্রকৃতপক্ষে মানুষের ভিতরকার সকল দ্বন্দ্বের নিষ্পত্তি খুঁজেছিলেন। এ হল মানুষের পরলোক কল্পনায় অবস্থিত স্বর্গের বিপরীতে ইহলোকেই স্বর্গ সন্ধান। এটা মানুষের চিন্তা ও আকাঙ্ক্ষার অপরিপক্কতা অথবা ভারসাম্যহীনতার প্রকাশ। এটা ভুল। তবু এর জন্য সমাজতন্ত্রের সকল অবদান ব্যর্থ হতে যাবে কেন?
এমন কি এই সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন যদি পশ্চিম ইউরোপে না থাকত তবে কি ইউরোপের বুর্জোয়া সমাজ সেখানকার মানুষের জন্য যতটা মানবিক ও কল্যাণকর হয়েছে তা হত? গণতান্ত্রিক অধিকারের এতটা বিস্তার, জন-কল্যাণবাদী রাষ্ট্রের ধারণা এসব কোথা থেকে আসত? নারীর এতটা জাগরণও কি সম্ভব হত? গীর্জা ও সামন্তবাদের নিগড় ভেঙ্গে বেরিয়ে বর্বর হয়ে উঠতে থাকা এক প্রবল পুঁজির সামনে সবাই যদি শূদ্রের মতো ষাষ্ঠাঙ্গ প্রণিপাত করে আর বান্দার মতো সেজ্দা দিয়ে পড়ে থাকত তবে ইউরোপ কি এত বড় হত? আমরা দেখতাম ভিন্ন এক ইউরোপ যেখানে পুঁজি আর রাষ্ট্রের অধিপতিরা সমস্ত ইউরোপ পূর্ণ করত ‘এরীনা’র বিভীষিকা দিয়ে যেখানে রোমের গ্ল্যাডিয়েটরের মতো শ্রমিক আর বন্দী মানুষ মৃত্যুর খেলা খেলে দর্শকদের মনোরঞ্জন করত।
সমাজতন্ত্র ইউরোপকে বাঁচিয়েছে, উৎপাদনশীল গণতান্ত্রিক পুঁজিকে বাঁচিয়েছে। সেটা তার সংগ্রামী, প্রতিবাদী চেতনা দিয়ে, প্রয়াস দিয়ে, অভিজ্ঞতা দিয়ে।
পশ্চিম ইউরোপের সমাজতন্ত্র আমাদের চাই না। লেনিনও সেটা নেন নি। যেমন মাও নেন নি কারোটাই। তবু সবাই নিয়েছে নিজেদের মতো করে। আমরাও নিব। সেটা বিপ্লব ও নূতন সমাজ নির্মাণের এক অফুরন্ত প্রেরণা, কতকগুলো অমূল্য অভিজ্ঞতা। এ দেশে যে বুর্জোয়া অর্থনীতি গড়ব সেটা কিভাবে সম্ভব? একদল লোক ক্ষমতা দখল করে যখন দেখবে হাত বাড়ালেই বাড়ী-গাড়ী-সুখ-সম্ভোগের আয়োজন করা যায় তখন তাদের সামলাবে কে? মনে আছে? ১৯৭২-এ লীগ নেতা-কর্মীদের লুটপাটের অভিযোগের জবাবে মুজিবের সেই উক্তি যে, এতকাল তাঁর লোকেরা কষ্ট করেছে, এখন যদি তারা একটু সুখ ভোগ করে তবে তাদের চোখ টাটায় কেন? না, কিছুই কওয়া লাগে না। ’৭২-এ সবাই মিলে যা করেছে তা-ই করবে।
গড়ব বুর্জোয়া অর্থনীতি অথচ নেতা-কর্মীরা তাতে ভাগ বসাতে যাবে না এমন আদর্শ যদি না থাকে তবে হবে আরেক লুম্পেন অর্থনীতি ও সমাজ। এর জন্য চাই এমন এক দৃঢ় বিপ্লবী আদর্শ যার বলে বলীয়ান হয়ে নেতা-কর্মী, বিপ্লবী পার্টি হবে লালনকারী। আরো ভালভাবে বললে বলতে হয় তাদের ভূমিকা হবে মাতা, মায়ের মতো। মা হল বাবার চেয়েও বড়। পিতৃত্ব পুরুষের মাতৃত্ব। এই জন্য মায়ের উপমা দিচ্ছি। সন্তানের জন্য মায়ের দান, ভূমিকা বাবার চেয়েও অনেক বেশী। আপন রক্তে গড়া শিশুকে সে দেয় আপন বুকের দুধ। তাকে পরম যত্নে, আদরে, শাসনে বড় করে তারপর ছেড়ে দেয় পৃথিবীর পথে। প্রাণী জগতের দিকেও একবার দৃষ্টিটা দিই না! ঐ যে মা এতকিছু করে তা কি শুধু প্রতিদানের আশায়? তার জন্য সবচেয়ে বড় প্রতিদান তার আপন সন্তানের কল্যাণ, সে কল্যাণ অনন্ত কালের। সব মায়ের অন্তরের চিরকালের আকুতি, কামনা, প্রার্থনা, ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে।’
আমার দৃষ্টিতে একালের বিপ্লবীও হবে ঐ মায়ের মতো। আপন রক্ত দিয়ে, শ্রম দিয়ে, ত্যাগ দিয়ে, প্রয়োজনে সকল বর্বরতা ও হিংস্রতা দিয়ে আপন সন্তান সম নূতন সমাজ-শিশুকে তা লালন ও রক্ষা করবে। মহীয়সী মা যেমন তার সন্তানের সম্পত্তির ভাগীদার হবার জন্য উদগ্রীব কলাকৌশল করে বেড়ান না তেমন এই বিপ্লবীও এই সমাজের নূতন অর্থনীতিতে ভাগ বসাবার জন্য ছুটাছুটি করবে না। তা গড়ে দিবে। ক্ষমতায় থাকবে, কিন্তু ক্ষমতার অপব্যবহার করে বাড়ী, জমি, কল-কারখানা, গোপন ব্যাংক ব্যালান্সের মালিক হবে না। তার শিশু সন্তান সম সমাজ যেদিন বড় হবে সেদিন তার কাজ ফুরাবে।
আমি মনে করি সমাজতন্ত্র মানুষকে এমনই এক প্রেরণা দিতে পারে যা আর কোনো আদর্শই পারে না। এর পিছনে আছে সারা পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষের রক্ত আর আত্মদানের ইতিহাস। নিজ অর্থ-বিত্ত ও সুখ-ভোগের জন্য ব্যস্ত না থেকে নিপীড়িত-লাঞ্ছিত-বঞ্চিত মানুষের মুক্তির স্বপ্ন দেখে পৃথিবীর দেশে দেশে এত যে মানুষ প্রাণ দিল তা কি এতই মূল্যহীন, ফেলনা? সোভিয়েত শিবিরের পতনের সঙ্গে সঙ্গে ইউরোপের, রাশিয়ার, চীনের, ভিয়েতনামের, দুই আমেরিকার, এশিয়ার, আফিন্সকার এত মানুষের এতকালের সংগ্রামের কোনো মূল্য থাকবে না? তাহলে যুগ যুগান্তের মানুষের মহৎ সংগ্রাম, আত্মদানের মূল্যটা রইল কি? এ দেশেও মনি সিং, ইলা মিত্র, আনোয়ার, কম্পরামের মতো অসংখ্য বীর আর সংগ্রামী আজীবন সাধনা দিয়ে আমাদের দাঁড়াবার যে জায়গাটুকু তৈরী করে দিয়ে গেছেন সেটাকেও ছেড়ে দিব? ঐ জায়গাটুকু না পেলে আমরা যে চেতনার জগতে এতটা পথ পাড়ি দিয়ে আসতে পেরেছি সেটা কেমন করে সম্ভব হত? ভুলের সমালোচনা থাকবে। সেটা অনেক সময় নিষ্করুণও হয়। চিকিৎসক কি প্রয়োজনে অস্ত্রোপচার করে না? কিন্তু সেটা কি রোগী মারার জন্য?
সমাজতন্ত্র আমাদের চাই। ওটা কোটি কোটি মানুষের মহা সাধনায় গড়া এক মহাশক্তি যাকে হৃদয়ে ধারণ করে আমরা ঐ মহাশক্তির অধিকারী হতে পারি। ঐ মহাশক্তি আমাদের সকল ক্ষুদ্র স্বার্থবুদ্ধি, সঙ্কীর্ণ লোভ-লালসার ঊর্ধ্বে উঠে দাঁড়াবার শক্তিটা দিতে পারে। ওটা পারে বিপ্লবের দুর্জয় সাহস এনে দিতে। সমাজতন্ত্র যারা ছেড়েছে তারা ছাড়ুক। তাদের হয়তো প্রয়োজন ফুরিয়েছে। তাছাড়া এই ছাড়ার প্রয়োজনও ছিল। নতুবা এক ভ্রান্ত কিংবা অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়া ধারণার কাঠামো থেকে মুক্তি সম্ভব ছিল না। এর ফলে সমাজতন্ত্রের নূতন ও উন্নততর রূপ আবিষ্কারের পথ মুক্ত হয়েছে। এই পথ ধরে আমরা এগিয়ে যাব।
আর আমরা যে সমাজ গড়ব তা কি পুঁজির অবাধ প্রতিযোগিতার নামে সমস্ত মানুষকে এক নির্দয় ধ্বংসের খেলায় নামাবার জন্য? মানুষের কিছু মৌলিক দায়িত্ব, কিছু নিরাপত্তা বিধানের দায়িত্ব কি রাষ্ট্রের নেই? যদি রাষ্ট্র সে দায়িত্ব না নেয় তবে সে রাষ্ট্রের প্রয়োজনটা কি? আমাদের দেশে পুলিশ ঘুষ খায়, সরকারী কর্মচারীরা দুর্নীতি করে। ওটা কি শুধু স্বভাব দোষে করে, নাকি বাধ্য হয়েও করে? রাষ্ট্র বা সমাজ তাদের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার কতটুকু দায়িত্ব নেয়, কি দায়িত্ব নেয় তাদের সন্তানদের শিক্ষা-চিকিৎসার? কাজেই চুরি যদি করে, ঘুষ যদি খায় তবে তাদের শাসন করতে চাইলেই বা তারা মানবে কেন?
আমাদের যেমন পুঁজিবাদের প্রয়োজন আছে তেমন সমাজতন্ত্রেরও প্রয়োজন আছে। এ হল ব্যষ্টি ও সমষ্টি উভয়ের প্রয়োজনের প্রতি স্বীকৃতি। ব্যক্তি ও সমাজ কাউকেই আমাদের নিরঙ্কুশ করার প্রয়োজন নেই। বরং উভয়ের এক ভারসাম্যপূর্ণ অন্বয় সাধন হোক আমাদের বিপ্লবের লক্ষ্য, যে বিপ্লব সৃষ্টি করবে নূতন ব্যক্তি, নূতন সমাজ। সুতরাং গণতন্ত্রের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে থাকবে আমাদের সমাজতন্ত্র। এটা আমাদের জনগণের গণতন্ত্র বা সংক্ষেপে জন-গণতন্ত্র। এই রণধ্বনি দিয়ে পুনরায় দাঁড়াতে হবে।
ঐ রণধ্বনি যখন পুনরায় বাতাস বিদীর্ণ করে আকাশে উথিত হবে তখন পুরাতন যুগের এবং এ যুগেরও সকল আত্মবিশ্বাস হারা, পথহারা, কোণঠাসা বিপ্লবী সমাজতন্ত্রীরা আবার উঠে দাঁড়াবে। এই প্রসঙ্গে আমার এক হাতির তাৎপর্যপূর্ণ গল্প মনে পড়ছে। এটা গল্প। তবু এর মধ্যে আছে জীবনের এক গভীর সত্য।
এক বীর রাজার এক অত্যন্ত প্রিয় হাতি ছিল। ঐ হাতির পিঠে চড়ে রাজা বহু যুদ্ধ জয় করেছিলেন। বুড়ো হয়ে গেলে হাতির আর সেই তেজ রইল না। কিন্তু তার প্রতি রাজার এত মমতা ছিল যে, তাকে ফেলে না দিয়ে হাতিশালে রেখে দিলেন। হাতির মাহুত আর সব হাতির মতো তারও দেখাশুনা করত। কিন্তু সব সময় যত্নটা তেমন হত না। একদিন গরম কালে খুব পিপাসার্ত হয়ে হাতিটা পানি খাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে উঠল। কিন্তু মাহুত ছিল না। কাছে ছিল এক পুকুর। পানি খাওয়ার জন্য হাতি পুকুরের পাড় বেয়ে নেমে অল্প পানির কাদামাখা জায়গাটা পার হয়ে বেশী পানির জায়গায় গিয়ে পানি খেল। কিন্তু ততক্ষণে কাদার গভীরে তার পা ডুবে গেছে। এরপর আর কোনো ক্রমে সেই হাতি উঠতে পারে না।
রাজা এ খবর পেয়ে ছুটে এসে তাঁর প্রিয় হাতির দুর্দশা দেখে সবাইকে হুকুম দিলেন হাতিকে পুকুর থেকে টেনে তোলার জন্য। শত শত লোক রশিদড়ি দিয়ে নানা কায়দা-কসরত করেও কাদায় আটকা পড়া হাতিকে আর তুলতে পারল না। শুধু টানলেই তো হবে না। হাতির ক্ষতি না হয় সেদিকেও তো লক্ষ্য রাখতে হবে! সুতরাং কোনো বুদ্ধিই কাজে লাগল না। এভাবে কয়েকদিন চেষ্টার পর হঠাৎ মাহুতের মাথায় এক বুদ্ধি এল। সেটা সে রাজাকে বলল। রাজার মনে হল, ঠিক আছে শেষ চেষ্টা করা যাক। তিনি তাঁর সৈনিকদের হুকুম দিলেন পুকুর পাড়ে গিয়ে ঢাক-ঢোল-কাড়া-নাকাড়া দিয়ে রণবাদ্য বাজাতে। রণবাদ্যের গুরুগুরু ধ্বনি বেজে উঠতেই মৃত প্রায় হাতির শরীরে সহসা জেগে উঠল নূতন প্রাণের স্পন্দন। তার পানিতে প্রায় ডোবা শরীরটাকে সে ঝাঁকিয়ে তুলতে চাইল। তারপর এত লোকের এত বিপুল চেষ্টায়ও যা হয় নি সেটাই হল। প্রবল শক্তি দিয়ে ধীরে ধীরে তার পাগুলোকে একে একে কাদার বাঁধন ছিঁড়ে উঠিয়ে আনল এবং ধীরে ধীরে পুকুর পাড় বেয়ে শক্ত জমিতে উঠে এসে দাঁড়াল। ঐ রণবাদ্য তার হারানো স্মৃতি ফিরিয়ে তাকে পরিণত করেছিল এক প্রবল পরাক্রান্ত রণহস্তীতে।
ইংরাজীতে এটাকে বলে কন্ডিশন্ড্ রিফ্লেক্স্। কতকগুলো শব্দ বা ভাষা দিয়েও মানুষের চেতনার কাঠামো গড়ে ওঠে। সমাজতন্ত্র ও বিপ্লব এমনই দু’টো শব্দ যা এই দেশে এক সময় লক্ষ লক্ষ মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছে। হাজার হাজার কর্মী এই ধ্বনির মহিমায় লড়াইয়ের ময়দানে ছুটে গেছে, আত্মাহুতি দিয়েছে। নিশ্চয় তাদের ধারণায় অনেক ভুল ছিল।
ভুল? ওটা কার না হয়? যে কিছুই করে না একমাত্র সেই নিষ্কর্মার ভুল হয় না। যে কিছুই না ক’রে এবং খুব নিখাদ, বিশুদ্ধ থাকার দেমাগ ক’রে অন্যের আত্মদানে তৈরী সমাজের সর-মাখন খেয়ে যেতে পারে এবং আরও খাওয়ার জন্য নিত্য নূতন ফন্দিফিকির করতে পারে এই রকম নিষ্কর্মা, আত্মপরায়ণ সুযোগ সন্ধানীর চেয়ে কি ভুল করা এই সংগ্রামী মানুষগুলোর মূল্য অনেক বেশী নয়? এরা কি চুরি, ডাকাতি করার জন্য অমন এক কঠিন পথ বেছে নিয়েছিল?
ওরা ভুল করেছিল বলে না আমরা শিখেছি, জেনেছি কোন্টা ভুল, কোন্টা করা উচিত নয়! যাদের হৃদয়ে এক মহৎ আর্তি ছিল তাদের সমাজ থেকে নিক্ষেপ করে সমাজ কি কোনোদিন মহৎ কিছু অর্জন করতে পারবে? তারা শ্রেণীশত্রু খতমের পথ বেছে নিয়েছিল। ওটা কি তারা অন্যের অর্থ-সম্পদ আত্মসাৎ করে বাড়ী-গাড়ী-আরাম-আয়েশ করার জন্য করেছিল? তারা হঠকারিতা করেছিল। তারা কি সেটা সখ করে করেছিল? মানুষ কি সখ করে ওসব করে? পথ জানা থাকে না, চেনা থাকে না বলে একটা সমাজকে অনেক অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে আসতে হয়। এই অভিজ্ঞতা নিব আর যারা সেগুলোকে নিজেদের সাধনা দিয়ে, বঞ্চনা দিয়ে আর জীবন দিয়ে তৈরী করে তাদেরকে নিব না? এর সঙ্গে আত্মসাতের পার্থক্য কি?
ওরা ভুল করেছিল। তার শাস্তিও কম পায় নি। বরং যারা এই সমাজে আকণ্ঠ অন্যায় আর পাপে নিমজ্জিত তাদের কয়জনের কি শাস্তিটা হয়েছে? এরা কি কম মানুষ খুন করেছে? এরা লুটতরাজ করে, অন্যের বাড়ী-জমি জবর দখল করে লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি টাকা করেছে। এই সমাজে যাবতীয় দুষ্কর্মের এরাই হোতা। অথচ এরাই আজ এ সমাজ-রাষ্ট্রের অধিপতি। এদেরই কাছে শুনতে হয় ন্যায়-নীতির বাণী। এদের কথা বলতে গিয়ে জীবনানন্দ দাশের ছোট্ট অনুপম কবিতাটার কথা মনে পড়ে।
অদ্ভূত আঁধার এক এসেছে এ পৃথিবীতে আজ,
যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশী আজ চোখে দেখে তারা,
যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই, প্রীতি নেই, করুণার আলোড়ন নেই
পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া।
যাদের গভীর আস্থা আছে আজো মানুষের প্রতি
এখনো যাদের কাছে স্বাভাবিক বলে মনে হয়
মহৎ সত্য বা রীতি, কিংবা শিল্প অথবা সাধনা
শকুন ও শেয়ালের খাদ্য আজ তাদের হৃদয়।
এমনই এক অদ্ভূত আঁধারের এই দেশ! এই আঁধারের হোতাদের বিতাড়নের জন্য আর এক বিপ্লবের প্রয়োজন। আর এই বিপ্লবের প্রয়োজনে ঐ বিপ্লবীদেরকেও পুনরায় ডাক দিতে হবে। এদের এই জাতি হারাতে পারে না। তবে তাদের ভুলগুলো সংশোধন করে নিতে হবে, ভুলগুলো কোথায় কি কারণে হয়েছিল তা বুঝে নিতে হবে। তা না হলে বার বার ঐ একই ভুল করার প্রবণতা রইবে। কিন্তু ঐ প্রবণতাও বেশী থাকে সাধারণত গুটি কয়েক নেতার ভিতর যারা ভুলগুলোর জন্য সবচেয়ে বেশী দায়ী। তাদের এমন একটা দম্ভ, অহঙ্কার আর জেদ গড়ে ওঠে যা থেকে খুব সৎ না হলে কেউ মুক্ত হতে পারে না। কিন্তু বাদবাকী আর সবাই? যারা কর্মী? যারা এত মৃত্যু আর ধ্বংসের পরেও টিকে আছে, তাদেরকে জাতি হারাতে যাবে কোন দু:খে? অনেকে হয়তো ভুল থেকে বেরিয়ে আসবে না। তারা সেখানেই থাকবে। যদি সৎ হয়, বুদ্ধিমান হয় শিখবে। না হয় ওখানেই শেষ হবে। তাদের কোনো প্রয়োজন নেই। সুতরাং আমি মনে করি আমাদের বিপ্লব ও জাতি গঠনের প্রয়োজনে জাতীয়তাবাদ, লোকবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র এই সব কয়টি আদর্শই আমাদের চাই। কিন্তু আমি মনে করি আমাদের আর একটি আদর্শের প্রয়োজন আছে যা ছাড়া আমাদের সকল প্রয়াস খণ্ডিত আর তাই ব্যর্থ হবে। সেটি হল নারী মুক্তির আদর্শ।