লিখেছেনঃ শামসুজ্জোহা মানিক, আপডেটঃ July 18, 2013, 4:55 AM, Hits: 1175
আমার ধারণা একুশ বছর পর ক্ষমতায় ফিরে এসে আওয়ামী লীগ বাঘের পিঠে চড়েছে। এখন আওয়ামী লীগকে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ ও গণতন্ত্রের চেতনার কথা বলতে হবে। তার অঙ্গীকারগুলোকে তুলে ধরতে হবে। এ ছাড়া তার পথও নেই। কারণ দীর্ঘ আন্দোলনের ভিতর দিয়ে জাতির যে প্রত্যাশাগুলো প্রবল হয়ে উঠেছে সেগুলোই একুশ বছর পর লীগকে ক্ষমতায় ফিরিয়ে নিয়েছে। আর খালেদার হাতে জাতির যে প্রত্যাশাগুলো মার খেয়েছিল সেগুলো এখন নূতন শক্তিতে মাথা তুলতে শুরু করেছে। বলা যায় পঁচিশ বছরের অবসাদ ঝেড়ে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যাশাগুলো আজ নূতন করে জেগে উঠছে।
কিন্তু এই প্রত্যাশা পূরণ করার সাধ্য তার কতটুকু? আওয়ামী লীগের যে কর্মী তা দিয়ে কি জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাস্তবায়ন সম্ভব? বিগত পঁচিশ বৎসর যে সন্ত্রাস ও দুর্নীতির ধারা গড়ে উঠেছে সমাজের সর্বস্তরে তা থেকে আওয়ামী লীগ কতটুকু মুক্ত? বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আন্দোলনের সময় চট্টগ্রাম নগরে যে ব্যাপক লুটতরাজ হয়, তাতে আওয়ামী লীগ-ছাত্র লীগের কর্মী-সমর্থকদের অংশগ্রহণ থেকেও কি কর্মীদের চরিত্রের রূপটা ফুটে বের হয় না? একটা সুস্থ রাজনীতি দাঁড় করাতে ক্যাডার বা কর্মী লাগে। বাংলাদেশে সকল ধরনের ভোটের রাজনীতিতে যে ক্যাডার তৈরী হয়েছে তারা তো মূলত মাস্তান আর চাঁদাবাজ, অস্ত্রই যাদের প্রধান হাতিয়ার। এটা বিএনপি, লীগ উভয়ের জন্যই সত্য। বস্তুত হাসিনার একটা প্রধান সমস্যা হয়ে রয়েছে তাঁর নিজ দলের এই অস্ত্রধারী যুব ক্যাডারদের সংযত করা। এ পর্যন্ত তিনিন্ধন্ধন্ধন্ধ করে চলেছেন। কিন্তু কত দিন পারবেন? খালেদার শাসনের প্রথম দিনগুলোও কি এমন শান্ত-নির্ভেজাল মনে হয় নি? তারপর কি হল?
আসলে প্রকৃত ক্যাডার গড়ার পথটাই আলাদা। সেটা যেভাবেই হোক এ দেশে বামেরা করেছিল এবং যেটুকু করে আজো তারাই করে। হাঁ, জামাতের ক্যাডার আছে বৈকি! মধ্যযগীয় সন্ত্রাসী, হাত-পায়ের রগ কেটে বেড়ানো ক্যাডার! তা, হাসিনা ক্যাডার পাবেন কিভাবে? ওটা এখন চাইলেও আর হবে না। ক্ষমতায় যাওয়ার পর এখন তাঁর কাছে যারা যাবে তারা যাবে প্রধানত ক্ষমতার লোভে, ক্ষমতার সাহায্যে অর্থ-সম্পদ করায়ত্ত করার প্রয়োজনে। আর যদি কিছু ভাল কর্মী যায়ও তবে তারা কি এত কালের গড়ে তোলা লীগ কাঠামোর চাপে ভেঙ্গে যাবে না? এ দেশে ভোটের রাজনীতিতে সৎ, নিবেদিত, শৃঙ্খলাবদ্ধ ক্যাডার তৈরী হয় না। কারণ ঐ রাজনীতিটাই টাকার রাজনীতি, যে টাকা আসে অসৎ পথে। অভিজ্ঞতা কি তা-ই বলে না? লীগের অনেক ভাল নেতা-কর্মী বাদ দিয়ে শুধু টাকা এবং প্রতিপত্তির কারণে অরাজনৈতিক, অসৎ এমন কি লীগ-বিরোধী কিংবা দলবদলকারী ব্যক্তিকেও নির্বাচনে মনোয়ন দিতে হয়েছিল। এবং এঁদের অনেকে সাংসদও হয়েছেন।
এ দেশে বিগত পঁচিশ বৎসরে যে লুম্পেন সমাজ ও অর্থনীতি গড়ে উঠেছে তাতে করে লুম্পেন শ্রেণীটিই নিয়মতন্ত্র ও নির্বাচনে রাজনীতির প্রধান নিয়ামক হয়ে উঠেছে। এই পথে এই শ্রেণীর নিয়ন্ত্রণ থেকে রাজনীতিকে মুক্ত করার উপায় নেই।
অথচ ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু স্বরূপ হাসিনাকে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার প্রয়োজনে হলেও দুর্নীতি রোধের চেষ্টা করতে হবে। তা, তাঁর ছাত্র-যুব ক্যাডারদের না হয় তিনি কোনক্রমে সামলালেন। কিন্তু লীগ নেতাদের সামলাবেন কেমন করে? সামনে আবার নির্বাচন আছে পাঁচ বছর বাদে। তাতে নিশ্চয় এবার নূতন অনেকে দাঁড়াতে চাইবে। তাদের লাগবে টাকা। সে টাকা পাবে কিভাবে? তাছাড়া লীগের স্থানীয় পর্যায়ের নেতাদের অনেকেই প্রত্যক্ষভাবে ক্ষমতার বাইরে থেকেও এতকাল কিভাবে অর্থবিত্ত উপার্জনের ব্যবস্থা করে এসেছে সেটা নিশ্চয় শুধু আমার নয় বহু মানুষেরই জানা আছে। ক্ষমতার যন্ত্রটাকে এতকাল পর পেয়ে এদের ভিতর যদি পুরাতন রোগ প্রবল হয়ে উঠতে চায় তবে সেটাকে হাসিনা ঠেকাবেন কি করে? আচ্ছা, তিনি না হয় এদেরকেও সামলালেন। কিন্তু লীগের সাংসদ হয়ে যাঁরা জিতেছেন তাঁদের একেক জনের খরচের হিসাবটা কি তিনি জানেন?
আমি নিজে গত নির্বাচনের ব্যয়ের একটা জরিপের কিছু ফল দেখেছি। মফস্বলের পিছিয়ে পড়া এক জায়গায় এক সাংসদের ব্যয় হয়েছিল প্রায় এক কোটি টাকা। শুনেছি ২/৩ কোটি টাকা ব্যয় করেছিলেন এমন প্রার্থীও আছে। অবশ্য এইসব হিসাব তো অনুমান। আসলটা হয়তো শুধু প্রার্থীরাই বলতে পারবেন। এঁরা সব দলেরই হতে পারেন। আর কোটি টাকা না হোক একটা নির্বাচনী ব্যয় কত দাঁড়াতে পারে আজকালকার দিনে তা যে কেউ অনুমান করে নিতে পারেন। আমি বলছি না এঁরা সব লীগের। হয়তো তুলনায় লীগ প্রার্থীদেরই ব্যয় কম ছিল বিএনপি বা জাপা প্রার্থীদের চেয়ে। কিন্তু এই যে বিপুল অর্থ ব্যয় করে একেকজন সাংসদ হয়েছেন তাকি তাঁরা জাতীয় সংসদে আশ্রম খুলে বসবার জন্য হয়েছেন?
হাসিনার না হয় সৎ থাকলেও চলে। আর দীর্ঘ সংগ্রামে পোড় খাওয়া, কিংবা নিবেদিত কিছু নেতা থাকতে পারেন, যাঁরা দুর্নীতি না করে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে চাইবেন। কিন্তু বাকীরা? যে পথে তারা এ সমাজে অর্থ-বিত্ত করায়ত্ত করেছে সেই পথটা কি তা কি আমরা সবাই জানি না? এদেরকে হাসিনা কতকাল ভয় দেখিয়ে, বুঝিয়ে, দেশপ্রেম শিখিয়ে শান্ত রাখবেন? ছয় মাস, এক বৎসর, না হয় দুই বৎসর? তারপর? আগামী নির্বাচনে টাকার অভাবে যদি জিততে না পারে তবে তো তাদের আম-ছালা সবই যাবে। আর আওয়ামী লীগ দিবে তাদের নির্বাচনের খরচ? সেই টাকা পাবে কোথা থেকে? ব্যবসায়ীরা এমনিই দিবে? আমাদের দেশে কেউ এত টাকা আদর্শের জন্য দেয়? যে চুরি করে, ঘুষ খায় সে মসজিদ বানাতে পারে। তাতে তার দুই লাভ। একালে তার সামাজিক প্রতিপত্তি বাড়ে, মর্যাদা বাড়ে, লোকে খুব ভাল লোক, ঈমানদার বলে। আর তার কল্পনায় ভাসে পরকালে বেহেশতের রিজার্ভ কামরার সৌন্দর্য আর আরাম-আয়েশ, সেই সাথে শরাবন তহুরা, হূর-পরী-গেলেমান আরো কত কি! কিন্তু এরা দিবে অর্থ কোনো দলকে দেশের কল্যাণের আদর্শকে এগিয়ে নেবার জন্য?
কাজেই হাসিনা যতই দুর্নীতি রোধ করতে চাইবেন, যত বেশী শক্ত হাতে সন্ত্রাস দমন করতে চাইবেন ততই সাংসদদের এক বিরাট অংশ ভিতরে ভিতরে উস্খুস্ করতে থাকবে। হাঁ, সন্ত্রাস দমন করতে চাইলে এদের শান্ত মেজাজ বেশী দিন শান্ত থাকার কথা নয়। কারণ এ দেশে দুর্নীতি, লুণ্ঠন ও চুরির এক প্রধান হাতিয়ার হল সন্ত্রাসের শক্তি। এই সন্ত্রাসের শক্তি ছাড়া চুরি? ওটা করে সিঁদেল চোর, গাঁটকাটা। কিন্তু ধরা পড়লে মারা পড়া। আর এ চুরি এমন চুরি যে বুক ফুলিয়ে হাঁটা যায়, মানুষ রাস্তায়-ঘাটে সালাম দিতে দিশা পায় না! হাঁ, এমন চুরির মহিমা হল তার সন্ত্রাসী শক্তি ব্যবহারের ক্ষমতা। ওটা শুধু পুলিশ-আমলা দিয়ে হয় না। ওগুলোও এ দেশে চুরি আর লুটের মস্ত বড় হাতিয়ার। এগুলো রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের শক্তি। কিন্তু শুধু এতে কুলায় না। আর এগুলো অনেক নিয়মে ঠাসা। ফলে একদম ঝাড়া হাত-পা সন্ত্রাসের একটা শক্তির দরকার চুরির কাজটা বুক ফুলিয়ে করার জন্য। তাতে দু’টোই হয়, কখনো ডাকাতি, কখনো চুরি। তবু যা-ই করা যাক সালাম পাওয়া যায় এবং ইচ্ছা হলে ভোটও।
আচ্ছা, হাসিনা না হয় দল সামলালেন, সাংসদ সামলালেন। কিন্তু বেসামরিক আমলাতান্ত্রিক প্রশাসনের যে বিশাল জাল সারা দেশে বিস্তৃত হয়ে রয়েছে তার এত কালের ঘুষ আর দুর্নীতির অভ্যাস কিভাবে বদলাবেন? আর যেহেতু দলকে তিনি সামলাতে চান সেহেতু বেসামরিক আমলাতন্ত্রের উপরই তাঁর নির্ভরতা বাড়াতে হবে। তা সেখানকার অবস্থা কি? কত বিভাগ (পুলিশ, বিডিআর, প্রশাসন, কাস্টম্স্, আয়কর, এজিবি, বিদ্যুৎ, টেলিফোন ইত্যাদি। ঘুষ কোথায় নেই? দুর্নীতি কোথায় নেই? কারো এ বিষয়ে জ্ঞানাভাব থাকলে যে কোনো একটা সরকারী অফিসে, সে থানা হোক আর যা-ই হোক, একটা কাজ নিয়ে যান। কয়দিন ঘুরলেই প্রভূত জ্ঞানার্জন হবে।
এখন হাসিনা না হয় বুঝিয়ে সুঝিয়ে সমগ্র প্রশাসন বা বেসামরিক আমলাতন্ত্রের মাথাটাকে ঠিক করলেন। উপর তলার কর্মকর্তাদের না হয় দেশের ভয়াবহ পরিণতির কথা বুঝিয়ে বলাতে কাজ হল। আর সবাই যে খারাপ তা তো নয়। ভাল লোক উপরেও আছে। তবে দুর্নীতিটা শুরু হয়েছে উপর থেকে, মাথা থেকে। তা, এখন না হয় উপর তলার দুর্নীতিপরায়ণ কর্মকর্তাদের পেটটা এতই ভারী হয়েছে যে, তাঁরা ঠিক করলেন এখন দেশের এবং নিজেদের ভবিষ্যৎ স্বাস্খ্যের কথা চিন্তা করে ‘ডায়েট কন্ট্রোল’ করবেন এবং প্রতিদিন প্রাত:কালে উঠেই মন্ত্রযপ করবেন, ‘সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি, সারাদিন আমি যেন ভাল হয়ে চলি।’ তাঁরা না হয় ভালই হয়ে গেলেন সকলে। কিন্তু একটু নীচের তলায় এবং তারও নীচের তলায় যে বিশাল সংখ্যক কর্মকর্তা, কর্মচারী, কেরাণী, পিয়ন রয়েছেন সারা দেশ জুড়ে তাঁরা কি যার যার সাধ ও সাধ্য মতো বাড়ী, জমি, স্ত্রী-কন্যার অলঙ্কার, ভবিষ্যৎ সঞ্চয়ের ব্যবস্থা করার সব ফন্দি-ফিকির বাদ দিয়ে সাধু-সন্ন্যাসী হয়ে যাবেন? সীমিত বেতনের টাকা দিয়ে কি সারা মাস জাবর কাটবেন?
সমস্ত সমাজ ও রাষ্ট্রের মাথাটা এত কাল ধরে এমন এক পরিপাক যন্ত্র তৈরী করেছে যার হজম ক্ষমতা হয়ে উঠেছে দানবিক। ঐ পরিপাক যন্ত্রে যা ঢোকানো যায় তা-ই মুহূর্তে হজম হয়। এবং তা আরও আরও খাবার চায়। এখন মাথাটা যদি হঠাৎ ভাল হয়ে গিয়ে পরিপাক যন্ত্রকে বলে ‘ডায়েট কন্ট্রোল’ করতে তবে ওটা কি তা মানবে? বেশী চাপাচাপি করলে মাথাটাকেই ফেলে দিবে না?
এখন হাসিনা কি করবেন? এক জরাগ্রস্ত, দুর্নীতিগ্রস্ত সমাজ-রাষ্ট্র কাঠামোটাকে তিনি কিভাবে ভাল করবেন? এখন অবস্থাটা ’৭৫-এর মতো নেই যে, ক্যানটনমেন্ট থেকে ট্যাংক নিয়ে বেরিয়ে এলেই হল! ফলে সমাজে ক্রমে নূতন মেরুকরণ ঘটবে। একদিকে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের শক্তিগুলো জাগবে এবং সংগঠিত হতে থাকবে, অপর দিকে এর বিরোধী শক্তিগুলো সংগঠিত হতে থাকবে। সমস্ত রাষ্ট্র, সমাজ দু’টো বিবদমান শিবিরে বিভক্ত হবে। এবং এখানে অতীব গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে দিল্লীর ভূমিকাকে। অন্তত বিগত একুশ বৎসর দিল্লী বাংলাদেশকে নিয়ে অনেকাংশে নিশ্চিন্ত ছিল। কারণ ১৯৭৫-এর পটপরিবর্তনের পর ইসলামী সাম্প্রদায়িকতা বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদকে অপসারণ করেছিল। বস্তুত এ দেশে যে কোনো ধরনের সেকিউলার রাজনীতি বা চেতনা বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের শক্তি বৃদ্ধি করতে বাধ্য। এই সেকিউলার চেতনা থাকায় পাকিস্তান আমলে এ দেশে কমিউনিস্ট রাজনীতির প্রসার অব্যাহতভাবে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের বিকাশ ও বিস্তার ঘটিয়ে চলেছিল। কিন্তু কমিউনিস্ট রাজনীতি তার সঙ্কীর্ণ শ্রেণী সংগ্রামের তত্ত্বের কারণে একে আর এগিয়ে নিতে কিংবা ধারণ করতে পারত না বলে এটা তখন আওয়ামী লীগের হাতে চলে গিয়েছিল।
সুতরাং ধর্ম-সাম্প্রদায়িকতা এ দেশে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের সবচেয়ে বড় শত্রু। আর এটা দিল্লীর শাসকদের নিকট প্রয়োজনীয়। বাংলাদেশে সেকিউলার বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের উত্থান পশ্চিম বাংলা ও ত্রিপুরার বাঙ্গালীদের উপর যে প্রভাব ফেলবে তার পরিণতি দিল্লীর হিন্দী-কেন্দ্রিক নেতৃত্বের পক্ষে মেনে নেয়া সম্ভব নয়। সুভাষের বিরুদ্ধে তাদের ভূমিকা আমাদের জানা আছে। তখন ছিল ব্রিটিশ শাসনাধীন অখণ্ড ভারত। দ্বন্দ্ব ছিল বাঙ্গালীর সঙ্গে নেতৃত্বের প্রশ্নে। কিন্তু আজ? পশ্চিম বাংলায় যদি একবার বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদী চেতনার শক্তি প্রবল হয়ে উঠে দাঁড়ায় তা হলে কি হবে?
পশ্চিম বাংলার নিরুপায়তার ইতিহাস আমাদের পক্ষে কল্পনা করাও কঠিন। বাংলা বিভাগের পর পশ্চিম বাংলা তার শিল্পের কাঁচা মালের সরবরাহ উৎস এবং সেই সঙ্গে প্রধান বাজার হারায়। অন্যদিকে চলে লক্ষ, লক্ষ, নিযুত, নিযুত শরণার্থীর স্রোত। পূর্ব বাংলা থেকে ১৯৪৭-এ হিন্দু শরণার্থী ও উদ্বাস্তুদের যে স্রোত পশ্চিম বাংলায় প্রবাহিত হতে শুরু করে তা প্রকৃতপক্ষে শেখ হাসিনার ক্ষমতারোহণের পূর্ব পর্যন্ত অর্থাৎ ১৯৯৬ পর্যন্ত জোরালোভাবে অব্যাহত থেকেছে। এবং এখনও তা বন্ধ হয় নি।
ভারত বিভাগের পর পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আগত কয়েক নিযুত শরণার্থীকে দিল্লী সরকার পূর্ব পাঞ্জাব প্রভৃতি অঞ্চলে পুনর্বাসনের জন্য সর্বপ্রকার রাষ্ট্রীয় সহযোগিতা প্রদান করে। কিন্তু পশ্চিম বাংলায় বাঙ্গালী শরণার্থীদের জন্য সেই ধরনের সহযোগিতা কেন্দ্রীয় বা দিল্লী সরকার কোনো কালেই দেয় নি। এই বিপুল শরণার্থীর ভারে, প্রায় এক কোটি হঠাৎ আসতে থাকা মানুষের অব্যাহত ভারে পশ্চিম বাংলার সমাজ, অর্থনীতি বসে পড়ে। অখণ্ড ভারত-রাষ্ট্রের আকাঙ্ক্ষার মূল্য হিন্দু বাঙ্গালীকে দিতে হয়েছে ভয়ঙ্করভাবে।
এই প্রায় ধ্বসে পড়া অবস্থা থেকে পশ্চিম বাংলাকে টেনে তোলার কৃতিত্ব সবচেয়ে বেশী বামফ্রন্ট ও সিপি(এম) সরকারের। কিন্তু তবু আজো পশ্চিম বাংলা ভারত-রাষ্ট্রের বহু রাজ্যের তুলনায় অনেক পিছিয়ে রয়েছে। আর পশ্চিম বাংলার সমগ্র অর্থনীতির মূল নিয়ন্ত্রণ চলে গেছে অবাঙ্গালীদের হাতে। এমন কি রাজধানী কলকাতার মধ্যভাগ বা কেন্দ্রীয় কলকাতা এখন অবাঙ্গালী বিশেষত হিন্দী-উর্দূ ভাষীদের দখলে চলে গেছে। ব্যবসা, দোকান, অফিস এবং বাসগৃহ এই সবই এখানে প্রধানত হিন্দীভাষীদের হাতে। এইভাবে পশ্চিম বাংলা আজ পশ্চিমা অবাঙ্গালী পুঁজির পদানত। একদিকে দিল্লীর হাতে প্রায় সব রাজনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন, অপর দিকে পশ্চিম বাংলার অর্থনীতির উপর পশ্চিমাদের নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্য বাঙ্গালী মধ্যবিত্ত ও শ্রমজীবী জনগণের বিকাশ ও উন্নয়নকে পঙ্গু করে রেখেছে। সেই সঙ্গে পশ্চিম বাংলায় বাঙ্গালীর ভাষা-সংস্কৃতিও আজ হিন্দী-ইংরাজীর আগ্রাসনের আঘাতে মুহ্যমান। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে বাঙ্গালীর যে ঐতিহাসিক গৌরব তাকে ভিন্ন ভাষা ও সংস্কৃতির আঘাতে নিদারুণভাবে আহত ও পর্যুদস্ত করা হয়েছে। আজ বাঙ্গালী সেখানে নিজ দেশে পরবাসী।
পশ্চিম বাংলা নিরুপায়। পশ্চিম বাংলার বাঙ্গালী নিরুপায়। বিশাল ভারত-রাষ্ট্রের কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার বিরুদ্ধে সে দাঁড়াবে কিভাবে? তার পূর্ব দিকে দাঁড়িয়ে আছে বাংলাদেশ নামে যে স্বাধীন রাষ্ট্র সেটাও তো তার বৈরী। ইসলামী সাম্প্রদায়িক রাজনীতি হল তার উপজীব্য। জিয়ার আমল থেকে এই সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে একটা আবরণ দেওয়া হল বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ নামে। এই বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের প্রবক্তরা তাই প্রকৃতপক্ষে এ দেশে দিল্লীর স্বার্থের পাহারাদার।
একুশটা বৎসর কখন জিয়া, কখন এরশাদ, কখন খালেদা ছিলেন ভারত-বিরোধিতা নামে দিল্লীর মিত্র, সহযোগী, দালাল যা বলা যাক তা-ই। হাঁ, এ দেশে জামাতে ইসলামীর মতো উগ্র ইসলামী শক্তিও দিল্লীর দালাল ছাড়া আর কিছু নয়। এ দেশে দিল্লীর সবচেয়ে বড় শত্রু সেকিউলার বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের শক্তি ও চেতনা।
একুশ বৎসর পর ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধ শক্তিকে অবরুদ্ধ করে পুনরায় বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের শক্তিকে মুক্ত করেছে। এ দেশে বাঙ্গালীর পুনরুথিত সেকিউলার জাতীয়তাবাদী চেতনার ঢেউ আছড়ে পড়তে বাধ্য পশ্চিম বাংলা ও ত্রিপুরার বাঙ্গালীর চেতনায়। হয়তো ইতিমধ্যে সেটা আছড়ে পড়তে শুরু করেছে। টিভি, রেডিও, সংবাদপত্র এবং যোগাযোগ পশ্চিম বাংলা ও ত্রিপুরার আট কোটি বাঙ্গালীকে যখন এই অনুভব দিবে যে, তারা আর একা নয়, এ পাশেও বাঙ্গালী জেগেছে তখন এর প্রভাব সেখানেও কেমন হবে সেটা কি দিল্লী বোঝে না?
মুজিব হত্যার পিছনে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের ভূমিকা ছিল। আমি জানি না মুজিব হত্যার পিছনে দিল্লীর কোন ইন্ধন ছিল কিনা। তবে এটুকু বুঝি বাংলাদেশে বাঙ্গালীর গণতান্ত্রিক জাতি-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার যে কোন সম্ভাবনা দিল্লীকে আতঙ্কিত করার জন্য যথেষ্ট। কেন এ কথা বলছি তা একবার ভারতরাষ্ট্রের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মানচিত্রের দিকে দৃষ্টি দিলে স্পষ্ট হবে। আসাম, নাগাল্যান্ড, মেঘালয়, মণিপুর, ত্রিপুরা, অরুণাচলসহ ভারত-রাষ্ট্রের বিশাল উত্তর-পূর্বাঞ্চল উত্তপ্ত কড়াইয়ের মতো টগবগ করছে। যদি পশ্চিম বাংলায় বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের শক্তি একবার মাথা তুলে দাঁড়ায় তাহলে কি হবে?
প্রকৃতপক্ষে দিল্লীর প্রয়োজন হল বাংলাদেশে একটি ইসলামী সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের অবস্থান, যা হবে নিয়ন্ত্রণযোগ্য ও দুর্বল। তা হিন্দুর বিরোধিতা করবে; হিন্দুকে মারবে, তাড়াবে। এইভাবে তা বাস্তবে মারবে পশ্চিম বাংলাকে। কিন্তু নিজের দরজা খুলে রাখবে দিল্লীর জন্য মুক্ত বাজার অর্থনীতির নামে। উপরে প্রয়োজনে দিল্লীর বিরুদ্ধে তর্জন-গর্জন করবে। হাঁ, এমন এক বাংলাদেশ দিল্লীর জন্য প্রয়োজন।
বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদী বাংলাদেশ দিল্লীর শত্রু। আজ দেব গৌড়ের সরকার আছে। সেখানে সিপিআই(এম) ও পশ্চিম বাংলার মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুরও একটা গুরুত্ব আছে। কারণ ওটা কোয়ালিশন সরকার। কিন্তু দেব গৌড় সরকার তো আজ আছে কাল নেই এমনই এক দুর্বল সরকার। এই সরকারের পতন হলে তখন কি হবে? সবচেয়ে বড় কথা সরকার নয়, দেখতে হবে ভারত-রাষ্ট্রের কাঠামোটাকে। সেটাকে কারা এতকাল নিয়ন্ত্রণ করছে? বিদ্যমান কাঠামো যতদিন থাকবে ততদিন কারা তাকে নিয়ন্ত্রণ করবে?
এ দেশের রাষ্ট্র শাসকরা নানাভাবে বাংলাদেশের বাজারকে দিল্লীর জন্য খুলে দিয়েছে। বিশেষত খালেদার আমলে তো বাংলাদেশ দিল্লীর মুক্ত বাজারে পরিণত হয়েছিল। হাঁ, তিনি তো আবার ছিলেন মুক্ত বাজার অর্থনীতির পৃষ্ঠপোষক। তাঁর অর্থমন্ত্রী ছিলেন সাইফুর রহমান। তিনি ছিলেন এই অর্থনীতির সবচেয়ে বড় প্রবক্তা। তা এই মুক্ত বাজারটি কি বস্তু? আমাদের ঘরের সব দুয়ার খুলে দিব, পারলে দেওয়ালও ভেঙ্গে বা কাঁচা ঘর হলে বেড়া খুলে দিয়ে বলব, সব এসো, যে পারো এসে ঢুকো, করো, খাও আর আমাদেরকেও তোমাদের ঘরে যেতে দাও! কিন্তু বাইরের সকলে বিরাট শক্তি আর শরীর নিয়ে আমাদের ঘর দখল করলে আমরা যাব কোথায়? আমাদের এই ক্ষুদ্র শরীর আর শক্তি নিয়ে ওদের ঘরের কোনায়ও জায়গা পাব? দেশের নিজস্ব শিল্প, অর্থনীতির সমস্ত শক্তি ধ্বংস করে এই যে আত্মবিক্রয় ও নি:শর্ত আত্মসমর্পণ বিদেশের কাছে, প্রবল সাম্রাজ্যবাদী শক্তির কাছে এর নাম মুক্ত বাজার অর্থনীতি? প্রায় আড়াইশ বছর আগে ইংরেজরা এ দেশ দখল করে এ দেশে এমন মুক্ত বাজার অর্থনীতি কয়েম করেছিল না আমাদের তাঁতীদের বুড়ো আঙ্গুল কেটে দিয়ে?
এই অর্থনীতির নামে তৃতীয় বিশ্বের যেটুকু শক্তি-সম্ভাবনা আছে ইউরোপ, আমেরিকা সেটুকু হরণ করে নিবে। মুক্ত বাজার কেন? পণ্য ও পুঁজির অবাধ প্রবাহ ও প্রতিযোগিতার জন্য। খুব ভাল কথা। এতে আমাদের দেশে ইউরোপ-আমেরিকার উন্নত পুঁজি ও প্রযুক্তি আসবে। কিন্তু আমাদের পুঁজি ও প্রযুক্তি কি আছে যা আমরা চালান দিব সেখানে? আমাদের আছে মানুষ। হাঁ, তৃতীয় বিশ্বের আছে মানুষ। আর প্রযুক্তি-পুঁজি সকলেরই পিছনের শক্তিটা কি মানুষ নয়? ইউরোপ-আমেরিকা তাদের উন্নততর প্রযুক্তি ও পুঁজি চালান দিয়ে এ দেশের উন্নতি ঘটাবে। অর্থাৎ তাদের মানুষগুলো ওখান থেকেই এসব দেশের সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করবে। আর এভাবে এখানে থাকবে। এর মানে তো মানুষেরই ঢোকা। সে মানুষ সর্বদা সশরীরে থাকে না, কিন্তু থাকে তার নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার মাধ্যমে।
ঠিক আছে, এ নিয়ন্ত্রণ মেনে নিলাম। কারণ অবাধ বা মুক্ত বাজার অর্থনীতি নাকি খুব ভাল জিনিস! তা, এই বাজারের মূল প্রেরণা বা চালিকা শক্তিটা কি মানুষ নাকি অন্য গ্রহের প্রাণী? যদি মানুষই হয়ে থাকে তবে ইউরোপ-আমেরিকার রাষ্ট্রীয় সীমার বিধিনিষেধ উঠিয়ে দিয়ে মানুষের প্রবেশ ও চলাচলও অবাধ করা হোক। হাঁ, মুক্ত বাজার অর্থনীতিতে শুধু পুঁজি ও পণ্য কেন মানুষেরও অবাধ প্রবাহ হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তো এখন এই অর্থনীতি তত্ত্বের সবচেয়ে বড় প্রবক্তা এবং এখন পৃথিবীরও হর্তাকর্তা। তা-ই এখন এটা নিজ দেশে সর্বপ্রথম প্রয়োগ করুক। সেখানে তো এখনও বিপুল জায়গা পড়ে আছে। তা, পৃথিবীর যে ছয়শ কোটি মানুষ আছে তার মধ্য থেকে অন্তত দুইশ কোটি মানুষকে সেখানে যেতে দেওয়া হোক। তৃতীয় বিশ্বের বোঝাটা হাল্কা হোক। আর পঞ্চাশ কোটি মানুষ না হয় পশ্চিম ইউরোপে ঢুকুক। কানাডা, অষ্ট্রেলিয়া অবশ্য খালি পড়ে আছে। ওগুলো এখন খালিই থাক! তৃতীয় বিশ্বে লোক তো আবার বাড়বে। পঞ্চাশ, একশ বছর পরে মুক্ত বাজার অর্থনীতির মহিমায় সেখানেও ঢোকা যাবে!
না, এখানে মুক্ত বাজার অর্থনীতি নেই। পুঁজি ও পণ্যের বেলায় রাষ্ট্রের সীমান্তের প্রয়োজন নেই, আর যত প্রয়োজন মানুষের বেলায়! তৃতীয় বিশ্বের সঙ্গে ইয়ার্কি করার আর জায়গা পায় না? আর কত কাল ওরা আমাদের বোকা বানাবে?
যদি মুক্ত বাজার এতই ভাল জিনিস তবে উপনিবেশবাদ খারাপ কি ছিল? ওরা সশরীরে উপস্থিত থাকত ও নিয়ন্ত্রণ করত বলে? এখনও কি সেই কাজই করছে না পণ্য, পুঁজি ও প্রযুক্তির বলে? তারা কি উপস্থিত থাকছে না, নিয়ন্ত্রণ করছে না, আধিপত্য করছে না, শাসন করছে না?
হাঁ, মুক্ত বাজার অর্থনীতিতে আমাদের দেশের খুব উন্নতি হবে! অনেক শিল্প হবে গার্মেন্টসের মতো। সারা দেশ না হয় আগামী পঞ্চাশ বা একশ বছরে ঢাকা হবে। অবস্থাটা কি দাঁড়াবে? ঢাকার অবস্থা এখন কেমন? একটু বৃষ্টি হলেই ম্যানহোলের যাবতীয় মলমূত্র পায়ে মেখে অফিসে আর ঘরে ঢোকা। সেগুলোকে সব জায়গায় মাখামাখি করে বেড়ানো। এটাই হবে সারা দেশে। সারা দেশে ট্যাফিক জ্যাম। সারা দেশে কিছু দালানের পাশে বিশাল বিশাল বস্তি গড়ে উঠবে। এখনই মানুষ সর্বত্র গিজ গিজ করছে। তখন তো পা ফেলারও জায়গা থাকবে না। সর্বত্র মানুষ চলবে ফিরবে, ডাস্টবিনের পাশে গড়াগড়ি খাবে। আমাদের দেশের শিল্প-বাণিজ্য সব হিন্দীভাষী আর ইংরাজীভাষী আর কিছু জাপানীভাষীর নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে। হাঁ, কিছু খুব বড় বাঙ্গালী লুম্পেন ব্যবসায়ী তাদের কারো কারো পার্টনার হবে। বিদেশীরা আসবে, আমাদের দারিদ্র্য দেখে দু:খ প্রকাশ করবে, আমাদের ইতরামি আর মর্যাদাহীনতা দেখে পরিহাস করবে, কিছু শিল্প, রাস্তা, দালান দেখে প্রশংসায় উচ্ছ্বসিত হবে, সার্টিফিকেট দিবে আমাদের জ্ঞানের-গুণের, সস্তায় আমাদের নারীদের উপভোগ করে রেখে যাবে এইড্স্। এ দেশ থেকে মুক্ত বাজার অর্থনীতির কল্যাণে ভারত-রাষ্ট্রে, মধ্যপ্রাচ্যে বা আরো দূর দেশে আমাদের নারী ও শিশুরা চালান যাবে আরও ব্যাপক হারে। লাখ লাখ নারী বোম্বাই, দিল্লী, আরও সব বড়-ছোট নগরে পতিতালয়ে বিক্রি হবে। চালান যাওয়া নারী ও শিশুদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কেটে নেওয়ার ব্যবসাটা আরও চমৎকার রমরমা হয়ে জাঁকিয়ে বসবে। আমাদের নিজস্ব কিছুই থাকবে না। না স্বাধীনতা, না সার্বভৌমত্ব, না আত্মনিয়ন্ত্রণ, না মর্যাদাবোধ। হাঁ, এর নাম মুক্ত বাজার অর্থনীতি, যার বদৌলতে আমাদের এখান থেকে নিরাপদ দূরত্বে বসে ইউরোপ-আমেরিকাসহ বিদেশের আধিপত্যবাদীরা সব লুট করে নিয়ে যাবে।
এটা কি সাম্রাজ্যবাদ নয়? ইউনিবেশবাদ নয়? সাম্রাজ্যবাদ বুঝি সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক শিবিরের পতনের সঙ্গে সঙ্গে বিদায় নিয়েছে? ভাবখানা এই যে, সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক শিবির এতদিন জোর করে টিকিয়ে রেখেছিল সাম্রাজ্যবাদকে। ঐ শিবিরও গেছে আর সেই সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদ, নয়া উপনিবেশবাদ সব গেছে! এখন পাশ্চাত্য সারা পৃথিবীতে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের চাষে আত্মনিয়োগ করেছে! ঐ যে বললাম সামাজ্যবাদই তো আর নেই! কারণ সোভিয়েতের বাধাটাই তো আসলে সাম্রাজ্যবাদকে টিকিয়ে রেখেছিল! ফলে পাশ্চাত্য পৃথিবীতে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের চাষাবাদ করতে চাইলেও পারছিল না!
আসলে আমাদের বুঝতে হবে সাম্রাজ্যবাদ যেমন ছিল তেমন আছে। তবে তার রূপ এবং কৌশল বদলেছে। এখন তার অন্য দেশ নূতন করে দখল করে খবরদারী করার, সেখান থেকে সোনা, রূপা, কাঁচা মাল লুট করে আনার দরকার নেই। সেখানে সৈন্য-সামন্ত নিয়ে শাসন চালাবার ঝামেলা করার দরকার নেই। ওসব আর সম্ভবও নয়। এমন কি নয়া উপনিবেশবাদী কৌশলে অন্য দেশের শ্রমিকের শ্রমশক্তি লুণ্ঠনের প্রয়োজনও কমে আসছে। নিজ দেশে তার বেঢপ কলকারখানারও দরকার ফুরিয়ে আসছে। আর কিছু দিন পর পাশ্চাত্যের রাস্তাঘাট, ম্যানহোল পরিষ্কার করার জন্য প্রাচ্য কিংবা তৃতীয় বিশ্বের শ্রমিকেরও দরকার হবে না। ওসব কাজ রোবট করবে। হাঁ, মানুষ এমন যুগে প্রবেশ করেছে যখন দৈহিক শ্রমশক্তির ভূমিকা আরও কমে যাচ্ছে। অতীব জটিল এক প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানের যুগে মানুষ প্রবেশ করেছে। আর এই যুগের হালটা ধরা আছে পাশ্চাত্যের হাতে। এই প্রযুক্তি নিয়ন্ত্রণের মূল শক্তিটা কী? কম্পিউটার, ইন্টারনেট, যাবতীয় জটিল যন্ত্রপাতি আর প্রযুক্তির বিশাল জটিল যে নেটওয়ার্ক গড়ে উঠেছে তার উপর নিয়ন্ত্রণের মূল শক্তি কোন্টা, গা-গতরের জোর নাকি মেধা! হাঁ, এই যুগের মূল চালিকা শক্তি হল মেধা। আজ সাম্রাজ্যবাদ এই মেধা লুণ্ঠন ও নিয়ন্ত্রণের এক নূতন আয়োজন করেছে মুক্ত বাজার অর্থনীতির নামে। সে তার অপ্রয়োজনীয় ও বাড়তি পুঁজি, কারখানা সব চালান করে দিবে, পণ্য উৎপাদনের ঝামেলা চাপিয়ে দিবে তৃতীয় বিশ্বের ঘাড়ে। তৃতীয় বিশ্ব অনায়াসলব্ধ শিল্প বিপ্লবের এমন সুযোগপ্রাপ্তি দেখে আহ্লাদে আটখানা হয়ে খুশীতে নাচবে। প্রায় সব ভোগ্যপণ্য এবং আরও অনেক কিছু উৎপন্ন হবে তৃতীয় বিশ্বে, প্রাচ্যে। কিন্তু উৎপন্ন যাবে পাশ্চাত্যে।
কিন্তু কিসের জোরে? মেধার জোরে। পাশ্চাত্যে আরও আরও উন্নতির জন্য নিত্য নূতন আবিষ্কার করবে। তার জন্য চাই তার বিশাল মগজ বাহিনী। সেটাই তা গড়ছে সেখানে। ঐ বাহিনীর জাল ছড়িয়ে থাকবে সারা পৃথিবীতে। সকল দেশের মেধা টেনে নিবে। পুঁজিটা তো তার। আর পুঁজির সবচেয়ে বড় শক্তি আজ নূতন নুতন আবিষ্কারে। সুতরাং নিয়ন্ত্রণ থাকছেই। কিন্তু যেটা মুক্ত বাজার অর্থনীতির কল্যাণে তা প্রাচ্য থেকে টেনে নিবে সবচেয়ে বেশী তা হল মেধা। প্রয়োজন না হলে পণ্যও নিবে না অনেক দেশ থেকে। শুধু নিবে মেধা। হাঁ, যে মেধার কল্যাণে মানুষ মানুষ হয়েছে, বড় হয়েছে, সভ্যতা নির্মাণ করেছে, শিল্প বিপ্লব, সমাজ বিপ্লব, রাষ্ট্র বিপ্লব করেছে সেই মেধা, সারা পৃথিবীর মেধা নিজের নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিবে।
চিরকাল মানুষের মেধার ভূমিকা ছিল। কিন্তু যে যুগে আমরা প্রবেশ করেছি সেখানে শ্রমশক্তি, দেহশক্তির তুলনায় মেধার গুরুত্ব ও ভূমিকা তুলনাহীনভাবে বেশী। আগামী কয়েক দশকের ভিতর আমরা দেখতে পাব সমস্ত পৃথিবীর রাজনীতি, রাষ্ট্র, অর্থনীতি, সংস্কৃতি এবং সমগ্র জীবনযাপন পদ্ধতিকে এই মেধাশক্তি কিভাবে বদলে দিয়েছে। মেধা বিপ্লবটার নামই পাশ্চাত্য দিয়েছে প্রযুক্তি বিপ্লব। আগামী যুগে পুঁজিপতিদের চেহারাটাও ভিন্ন হবে। পুঁজিও মূলত মেধাবীদের হাতে চলে যাবে।
হাঁ, আমাদের সব শ্রেষ্ঠ মেধা তারা নিয়ে যাবে। এখানে এত প্রতিকূলতার মধ্যে তারা থাকতেই পারবে না। আর পাশ্চাত্যও এই অবস্থাই রক্ষা করতে চাইবে। তারা সেখানে গিয়ে হবে পাশ্চাত্যের দাসানুদাস। অবশ্য ভাল বেতনের বিনিময়ে। খুব সুখ ভোগ করবে! তবে পাশ্চাত্য প্রভুদের চেয়ে তাদেরকে অনেক বেশী শ্রম করতে হবে। রোম, গ্রীসের দাসেরা, ভারতের শূদ্রেরা, মিসরের ফাল্লারা, বাংলার চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কৃষকেরা যেমন তাদের প্রভুদেরকে সব শ্রম আর আনুগত্য দিয়ে সেবা করে যেত তেমন এরাও পাশ্চাত্য মেধা-প্রভুদের সেবা করে যাবে। ঐ প্রভুদের দিন কাটবে তুলনায় অনেক আয়েশে। কিন্তু এরা পরিশ্রম করবে অকাতরে, করতে বাধ্য হবে; গবেষণা ও শ্রম দিয়ে পাশ্চাত্য মেধা-প্রভুর শক্তি বাড়াবে। নাম হবে অবশ্য পাশ্চাত্য মেধার। প্রাচ্যের এরা তো ভাড়াটে মাত্র। তারপর ঐ সমাজেই হারিয়ে যাবে।
আর আমরা? হাঁ, এখানেও মাঝারি কিসিমের মেধারা থাকবে। তারা কেউ বিজ্ঞান, কেউ সমাজ, কেউ শিল্প-বাণিজ্য, প্রশাসন ইত্যাদি নানা বিষয়ে কাজ করবে, গবেষণা করবে, মতামত প্রচার করবে। আজকে যেমন করছে তেমনই। তবে এইসব মেধার মূল্য এবং শক্তি আজকের তুলনায় অনেক বেশী হবে ভবিষ্যতে। এরা হবে পাশ্চাত্যের সেবাদাস। এখানেই থেকে পাশ্চাতাকে সেবা করে যাবে। আর এদের মাধ্যমে পাশ্চাত্য সবকিছু পাবে, তথ্য, ধারণা, গবেষণালব্ধ ফলাফল। এইভাবে এরা এ দেশে থেকে পাশ্চাত্যকে যোগাবে মেধাশিল্পের কাঁচামাল। আর এদের মাধ্যমে পাশ্চাত্য নিয়ন্ত্রণ করবে এ দেশের জনমত, সমাজ ও রাষ্ট্রকে।
যে মেধার শক্তিতে মানুষ মানুষ হয়, জাতি জাতি হয়, পৃথিবীকে বদলায়, স্বাধীনতা আনে, তাকে রক্ষা করে, উন্নয়ন করে সেটা যখন পরাধীন হয়ে যাবে, চলে যাবে তখন আমাদের রইবে কি? আমাদের উন্নতি? আড়াইশ বছর ধরে পাশ্চাত্যের অধীনতায় থেকে আমরা তো অনেক উন্নতি করলাম! আজ তার চেহারাটা কি? আরও হাজার বছর পরও এমনই অথবা আরও করুণ বেদনার জন্য আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে কাঁদতে হবে, আর তাদের অতীতের স্বার্থান্ধ, লুম্পেন পূর্ব পুরুষদের উদ্দেশ্যে ঘৃণার থুতু ছিটাতে হবে।
এই যে সাম্রাজ্যবাদের নবতর রূপ, যার কথা আমি বললাম, আগামী কিছু কাল পর এটা আরও স্পষ্ট হবে। হাঁ, এও এক উপনিবেশবাদ। এটাকে নয়া উপনিবেশবাদ বললে শ্রমশক্তি লুণ্ঠনের সেই কালটার কথা মনে হতে পারে। তা দিয়ে সবটা বোঝা যায় না। সাম্রাজ্যবাদের এই নবতর লুণ্ঠনের মূল কাজ হবে কিংবা হয়ে উঠছে শ্রমশক্তি লুণ্ঠনের তুলনায় অনেক ব্যাপক ও প্রবল রূপে মেধা লুণ্ঠন। আপাতত এটার নাম দেওয়া যাক মেধা উপনিবেশবাদ। প্রযুক্তি বিপ্লবের পরিচয়ে যে মেধা বিপ্লব চলছে তাতে উপনিবেশবাদের এই নামের কথা আপাত ভাবা যাক। পণ্ডিতেরা পরে না হয় আরও উপযুক্ত কোনো নাম দিয়ে এটাকে চিহ্নিত করবেন।
আর এই মেধা উপনিবেশবাদের যুগের সবচেয়ে বড় শক্তি হয়ে উঠছে বুদ্ধিজীবী। বিজ্ঞানী, গবেষক, প্রকৌশলী, চিকিৎসক, লেখক, সাংবাদিক, অধ্যাপক, বড় আমলা ইত্যাকার নানান পেশার বুদ্ধিজীবীরা। এরা সবচেয়ে বড় শক্তি হতে পারে উন্নতির, ফলে অবনতিরও। বুদ্ধিজীবীরা জাতির সবচেয়ে বড় বন্ধু যেমন হতে পারে তেমন সবচেয়ে বড় শত্রুও হতে পারে। এদের সম্পর্কে তাই আজ সতর্কতার সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন। আবদুল গাফফার চৌধুরীর মতো যারা খুব সাজিয়ে গুছিয়ে নানান অভিমত দিয়ে জনমতকে প্রভাবিত করতে চেষ্টা করে তাদের শুধু কথা শুনলে হবে না দেখতে হবে তারা আসলে কি? তাদের অতীত কি? দেশের সঙ্গে, দেশের মানুষের সঙ্গে কর্মের সূত্রে তাদের সংযোগ কতটুকু? তারা যে কথাগুলো বলে সেগুলো কোন্ অভিজ্ঞতার উপর দাঁড়িয়ে বলে? হাঁ, এ কালে এদেরকেই সবচেয়ে সন্দেহ করতে হবে। সবচেয়ে বেশী বাজিয়ে, পরখ করে, যাচাই করে দেখতে হবে বুদ্ধিজীবীদের। আর আমাদের দেশের বুদ্ধিজীবীদের ব্যাপকতর অংশের চরিত্রই তো জানা আছে!
না, মুক্ত বাজার অর্থনীতির প্রয়োজন আমাদের নেই। আমাদের জাতি ও জনগণের রাষ্ট্রীয় সীমানা এবং রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সার্বভৌমত্ব যে কোনো মূল্যে আমাদের রক্ষা করতে হবে। বাইরের পুঁজি, প্রযুক্তি, জ্ঞান সব কিছু আমরা নিব। আর এসব পাশ্চাত্য দিবে। আমরা যেমন অপ্রয়োজনীয় বা বাড়তি জিনিস বিদায় দিই, পারলে সস্তায় বিক্রি করি, কেনার লোক না পেলে দান করি, তাও না পেলে ফেলে দিই ওরাও তেমন ওদের অপ্রয়োজনীয় হওয়া বা বাড়তি পুঁজি, প্রযুক্তি, জ্ঞান সব বিদায় দিতে পারলে বাঁচে। ওসব পাওয়া তেমন কোনো সমস্যা নয়। আমাদের দরকার হলে নিব। কিন্তু কোনো কিছুই অবাধে নিব না। আমরা দেখে, শুনে, বুঝে, বিচার করে যা নেবার নিব। আর সর্বশক্তি নিয়োগ করে আমাদের নিজ মেধার বিকাশ সাধন করব। আর আজকের যুগে এটাই পুঁজির সবচেয়ে বড় শক্তি। তাই আমাদের দেশের মেধা বাইরে পাচার হতে দিব না।
এটা কি জোর করে করা যাবে? আজকের যুগে কি জোর করে মেধা ধরে রাখা যায়? তার জন্য প্রয়োজন আদর্শ, জাতিবোধ, দেশাত্মবোধ। এই নূতন আদর্শের প্রয়োজন আজ আমাদের সব থেকে বেশী। আর আদর্শ মানে শুধু কথা নয়। এটা তার চেয়েও অনেক বেশী। আমাদের চাই এক নূতন ও উন্নততর মূল্যবোধ, জীবনাচরণ, কর্মপদ্ধতি, যা আমাদেরকে উন্নততর মানুষ, সমাজ ও জাতিতে পরিণত করবে। এই আদর্শের বলে বলীয়ান হয়ে আমরা, হাঁ, এই আমরাই পৃথিবীর সবচেয়ে দরিদ্র এক দেশ পৃথিবীর সুউন্নত এক মহাশক্তিধর রাষ্ট্র, সমাজ ও জাতি হতে পারি। ওর জন্য আয়তন লাগে না, রাশিয়া, আমেরিকার মতো খনিজ সম্পদ লাগে না। লাগে সঙ্কল্প, লাগে আদর্শ, লাগে তেজ, লাগে মেধা। জাপানের দিকে দৃষ্টি দিলেই বোঝা যায় মানুষের অসাধ্য কিছু নেই। চীনের দিকে দৃষ্টি দিলেও সেটা বোঝা যায়। আজকের ভিয়েতনামের দিকে দৃষ্টি দিলেই বোঝা যায় আমাদের পক্ষেও ঐ অসাধ্য সাধন করা সম্ভব। কিউবার দিকে দৃষ্টি দিলে বোঝা যায় আমরা ক্ষুদ্র ভূখণ্ড হয়েও পৃথিবীর যে কোনো শক্তিকে মোকাবিলা করে দাঁড়িয়ে থাকতে পারি। আর দিল্লীকে ভয়? ’৬৮-’৬৯-এর গণ-অভ্যুথান, ’৭১-এর মতো এক জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ এবং সুভাষ-ভাসানীর উত্তরাধিকার নিয়ে আমরা পাব ভয়? না, দিল্লীর গায়ে পড়ে ঝগড়ার কোনো প্রয়োজন নেই। আমাদের না খোঁচালে আমরা কিছুই বলব না। তবে তাদের সম্পর্কে আমাদের সদা সতর্ক থাকতে হবে। আর মনে রাখতে হবে দিল্লীর যে কোনো চক্রান্তের বিরুদ্ধে পশ্চিম বাংলা, ত্রিপুরার বাঙ্গালী জনগণ হতে পারে আমাদের জন্য এক বিরাট রক্ষা প্রাচীর।
তবু আমি মনে করি দিল্লীর ভূমিকা সম্পর্কে সতর্ক থাকতে হবে। আওয়ামী লীগের নবতন উথানের সুযোগ নিয়ে যখন নূতন নূতন সামাজিক শক্তি উঠে দাঁড়িয়ে সমাজকে নূতন দিকে এগিয়ে নিতে চাইবে তখন প্রতিক্রিয়ার শক্তিগুলো জোট বাঁধবে এবং দিল্লীও তাদেরকে মদদ যোগাতে পারে। সব মিলিয়ে অনিবার্য হয়ে উঠবে একটা সংঘাত। সেটা দেশকে নিয়ে যাবে আর এক গণ-বিপ্লবের দিকে। এবার সেই গণ-বিপ্লব সফল হবে এমন আশা করা যায়। ’৭১-এ যা ব্যর্থ হয়েছিল বাম নেতৃত্বের মতিচ্ছন্নতা, দিল্লীর ষড়যন্ত্র, লীগের নীতিহীন ও সুবিধাবাদী চরিত্রের কারণে এবার আর সেই ব্যর্থতার সম্ভাবনা কম। কারণ জাতি এখন পূর্বের তুলনায় অনেক বেশী পরিপক্ব।
আমি এ কথা বলি না যে, আওয়ামী লীগের চরিত্রে পরিবর্তন ঘটেছে এবং তার নেতৃত্বে এবার দ্বিতীয় বিপ্লব হবে। আওয়ামী লীগ অতীতে যে শ্রেণীর প্রতিনিধি ছিল এখনও তা-ই আছে। যে লুম্পেন বুর্জোয়া ও মধ্যবিত্ত শ্রেণী এ দেশের সমাজ-রাষ্ট্র-অর্থনীতিতে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে আছে আওয়ামী লীগও মূলত সেই শ্রেণীর এক বৃহৎ অংশেরই প্রতিনিধি। কিন্তু আওয়ামী লীগ একটা চেতনাকে ধারণ করতে আজ বাধ্য হচ্ছে। সমাজের ভিতর এমন কি লুম্পেন শ্রেণীর ভিতরও যে যন্ত্রণা, যে পরিবর্তন আকাঙ্ক্ষা জন্ম নিয়েছে ও বিকাশ লাভ করছে আওয়ামী লীগ আজ তাকেও ধারণ করছে। সমস্ত সমাজ চাইছে একটা পরিবর্তন। কারণ যে পথে এই সমাজ-রাষ্ট্র গড়ে উঠেছে, নগর গড়ে উঠেছে, শ্রেণীগুলো গড়ে উঠেছে সেই পথটা এখন সকলের জন্য অসহনীয় হয়ে উঠেছে। এভাবে মানুষ বাঁচবে কিভাবে? সবাই তো আর ইউরোপ, আমেরিকায় বাড়ী, জমি কিনতে পারবে না, টাকা পাচার করতে পারবে না। আর অমর্যাদা, অসম্মানের একটা আলাদা কষ্ট আছে, যেটা এই লুম্পেন শ্রেণীর ভিতরেও আছে। সারা পৃথিবীর কাছে জাতি হিসাবে অবমাননা, বাইরের পৃথিবী ও সমাজের কাছে সারাক্ষণ মাথা হেঁট করে থাকা, ভিন দেশের সমাজে কোনক্রমে মুখ গুঁজে পড়ে থাকা - এই অসম্মান, অমর্যাদা থেকেও অনেকে বাঁচতে চাইছে। এ থেকে বেরোবার ক্ষমতা তাদের নেই। কিন্তু আকাঙ্ক্ষা আছে। এর জন্য যে সাহস, কষ্ট সহিষ্ণুতা, দীর্ঘ প্রস্তুতি ও সংগ্রাম প্রয়োজন সেসব তাদের নেই বলে তারা নিজেরা সে পথ তৈরী করতে পারে না। কিন্তু আকাঙ্ক্ষা আছে বৈকি! সবার না থাক, অনেকের আছে। আর সব কিছুই এখন চরমে পৌঁছেছে। আর কত? দেশের রাজধানী ঢাকা তো এখন জনসংখ্যার ভয়াবহ চাপ, যান জট, জলাবদ্ধতা, বায়ু দূষণ, সন্ত্রাস সব মিলিয়ে এক দমবন্ধ নগর।
এ দেশের পূর্ব পুরুষদের লুম্পেন চরিত্র ও সুবিধাবাদের পরিণাম এই। আর যুবকেরা এখন সন্ত্রাস, মাস্তানী করে তাদের পিতাদের দুষ্কৃতি, দুর্নীতি, চরিত্রহীনতার প্রতিশোধ নিচ্ছে। তাদের পিতারাই এখন নিজেদের পাপের শিকার। এখন ফিরতে হবে। ফেরার সময় হয়েছে। একদল ফিরতে চাইবে। আর একদল বাধা দিবে। কারণ তারা অভ্যস্ত হয়ে গেছে পাপে। মাদকাসক্তের মতো। অথবা তারা ঐ পথ ধরে উপরে, আরো উপরে উঠতে চায়। ফলে সংঘাত হবে। তবু সমাজ ফিরতে চায়। ফেরার পথটা তা তৈরী করতে পারবে না। ওটা বিপ্লবীদের কাজ। বিপ্লবীরা কাজটা নূতন করে শুরু করলে অনেকে, বিরাটতর অংশই আসবে, যোগ দিবে। তখন তাদের চরিত্রেরও পরিবর্তন হবে সংগ্রামের ভিতর দিয়ে। হাঁ, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার চেয়েও অনেক বড় শিক্ষা পায় মানুষ সংগ্রামের ভিতর দিয়ে। সংগ্রামই মানুষের সবচেয়ে বড় শিক্ষক। ঐ সংগ্রাম অধ:পতিত, আফিমের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকা প্রাচীন চীনা জাতিকে বদলেছে। ঐ সংগ্রাম পৃথিবীর সব জাতিকে বদলেছে। আমাদেরকেও বদলাবে।
আওয়ামী লীগের কাজ আওয়ামী লীগ করছে, করবে। তাকে সর্বদা শত্রু মনে করার দরকার নেই। আবার বন্ধুও তা সব সময় হবে না। কোথায়ও তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম থাকবে। আবার কোথায়ও তার সঙ্গে অলিখিত হলেও ঐক্য থাকবে। তবে একটা কর্মসূচী আজ তুলে ধরতে হবে জাতির সামনে।
দেশের নির্বাচিত সরকার হিসাবে আওয়ামী লীগের সামনেও সেটা থাকবে। ঐ কর্মসূচীর ভিত্তিতে ঐক্যের ডাক দিতে হবে সবাইকে। আবার বলি আওয়ামী লীগের কাছ থেকে বেশী প্রত্যাশার প্রয়োজন নেই। সবকিছু তার কাছ থেকে আশা করা ভুল। তা কখনো এরশাদের জাতীয় পার্টিকে নিবে কখনো আর কাউকে। প্রচলিত ধর্মের আবেদনও রাখবে। সেগুলোকে সমর্থন করার প্রয়োজন যেমন নেই তেমন ঐগুলোর জন্যই যদি তাকে সর্বদা প্রধান শত্রু ভাবা হয় সেটাও হবে মস্ত ভুল। বুঝতে হবে এই কাঠামোর মধ্যে থেকে তার পক্ষে বেশী দূর যাওয়া সম্ভব নয়। তবে সমালোচনা রাখতে হবে বৈকি! তার সব ভুলের। সংগ্রামও থাকবে সেগুলোর বিরুদ্ধে। কিন্তু মূল কাজ নূতন বিপ্লবের রাজনীতিকে দাঁড় করানো। আর এই রাজনীতিই আজ জাতীয় ঐক্যের মূল ভিত্তি।