লিখেছেনঃ আমজাদ হোসেন, আপডেটঃ March 20, 2019, 12:00 AM, Hits: 1499
স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা মানুষের জন্মগত। বিশেষ করে বাঙালিদের মধ্যে এই প্রবণতা প্রবল। শত শত বছরের ইতিহাস থেকে তা প্রমাণিত হবে।
পাঠান, মুঘল ও বৃটিশ বিরোধী সংগ্রামের মূলে ছিল স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা। ১৯৪৭ সনের আগস্টে বৃটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি ভারতবর্ষকে বিভক্ত করে। প্রতিষ্ঠিত হয় ভারত ও পাকিস্তান নামে দু’টি রাষ্ট্র। আসলে বৃটিশ চক্র ভাগ করে বাংলা ও পাঞ্জাবকে। বৃটিশের ভারত ভাগের এ চক্রান্তে সমর্থন দেয় কংগ্রেস। মুসলিম লীগ আগেই ভারত ভাগের দাবি তুলেছিল। তখনকার নেতা গান্ধী, নেহরু, জিন্নাহ প্রমুখ নেতা বৃটিশের ভারত ভাগের চক্রান্ত মেনে নিয়েছিলেন। তদানীন্তন পূর্ব বাংলা পাকিস্তান রাষ্ট্রের অর্ন্তগত হয়। পাকিস্তান মুসলমানদের দেশ - এই ভাবাবেগ কাটতে শুরু করে সেই ১৯৪৭ সন থেকেই। ধীরে ধীরে সেই মনোভাব বাড়তে থাকে। আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) গঠন, ১৯৫৮ সনে সেনা প্রধান আইয়ূব খানের সামরিক শাসন, প্রেসিডেন্ট পদ গ্রহণ - এসব ঘটনাকে ছাপিয়ে যে বিষয়টা সামনে আসে তা হলো - পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা। কারণ, পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী বাঙালিকে অবমূল্যায়ন করে। দুর্বল ও অপাংক্তেয় বলে মনে করতে থাকে। বাংলা ভাষাকে ঘৃণা ও কোণঠাসা করার চেষ্টা চালায়।
ভাষার প্রশ্ন পূর্ব বাংলার মানুষের সামনে আসে ১৯৪৮ সন থেকে। ৫০-এর দশক জুড়ে পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট ও বামপন্থীদের মধ্যে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা ছিল। ষাট দশকের মধ্যবর্তীকালে স্বাধীনতার চেতনার বিপুল ব্যাপ্তি ঘটে। স্বাধীনতার চেতনা ৫০-এর দশকে শুধু যে কমিউনিস্ট ও বামপন্থীদের মধ্যে ছিল তা নয় সমাজের অন্যান্য লোকদের মধ্যেও ছিল। ধীরে ধীরে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা সমাজের অন্যান্য স্তরের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ে এবং তা শক্তি অর্জন করে।
স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা যা ছিল কমিউনিস্টদের, তা কালক্রমে বুর্জোয়াদের হাতে চলে যায়। ষাটের দশকে পূর্ব বাংলার উঠতি ব্যবসায়ী ও উঠতি বুর্জোয়াদের সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানের বড় বুর্জোয়াদের দ্বন্দ্ব ছিল। এই দ্বন্দ্বকে ব্যবহার করার ক্ষেত্রে কমিউনিস্ট ও বামপন্থীদের ভূমিকায় ভুল-ত্রুটি ছিল। আওয়ামী লীগ ছয় দফা ঘোষণার মধ্যে দিয়ে সেই ভূমিকার সামনে চলে আসে।
এখানে বলে রাখা দরকার যে, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ পাকিস্তানকে বিভক্ত করতে চেয়েছিল, যাতে পাকিস্তানের শক্তি খর্ব হয়। শেখ মুজিব নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ ছিল মার্কিনপন্থী। সুতরাং আওয়ামী লীগের পক্ষে মার্কিন নীতি ও পদ্ধতি গ্রহণের ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা ছিল না। বরং তা ছিল আওয়ামী লীগের জন্য সহায়ক। কিন্তু কমিউনিস্ট, বামপন্থী, মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ও ন্যাপ - ছিল সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী। তারা গোটা ঘটনাকে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী দৃষ্টিকোণ থেকে বিচারের চেষ্টা করেছে। তারা চেয়েছিল সাম্রাজ্যবাদ মুক্ত স্বাধীন বাংলা।
যে চিন্তা ছিল কমিউনিস্ট ও বামপন্থীদের তা চলে গেল আওয়ামী লীগের অনুকূলে। এটা সঙ্গে সঙ্গে যায় নি। ১৯৬৬ সনে আওয়ামী লীগ ছয় দফা ঘোষণা করে। এর পরে, বিশেষ করে ১৯৬৮-৭০ সনে স্বাধীনতা আন্দোলনের ভারসাম্য তাদের দিকে চলে যায়। ওই সময়ে পূর্ব বাংলার ছাত্র-যুব সমাজ দু’টি অংশে বিভক্ত হয়ে যায়। একাংশ স্বাধীনতার সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতাকে যুক্ত ক’রে বিষয়টি এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে, আরেক অংশ আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত হয় - সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদকে গ্রহণ করে। আওয়ামী লীগ তখনই শক্তি অর্জন করে যখন পূর্ব বাংলার উঠতি বুর্জোয়ারা তাদের সমর্থন জানায়।
অপরদিকে ভাসানী-ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি স্বাধীনতার দাবিতে সোচ্চার বক্তব্য দিলেও তা তেমন গুরুত্ব পায় না। উঠতি বুর্জোয়ারা এদের ওপর আস্থা স্থাপন করতে পারে না। মওলানা ভাসানী নেতৃত্বাধীন ন্যাপ পেটি বুর্জোয়া ও জাতীয় বুর্জোদের যে স্বার্থ তুলে ধরেছিল তা যথার্থ ছিল। পেটি বুর্জোয়া ও জাতীয় বুর্জোয়ারা ভাসানী-ন্যাপকে সমর্থনও করেছিল। কিন্তু ভাসানী-ন্যাপ থেকে কমিউনিস্টদের সরে যাওয়া, কমিউনিস্ট পার্টির বিভক্তি, ন্যাপের বিভক্তি, ছাত্র ইউনিয়নের বিভক্তি, কমিউনিস্ট ও বামপন্থীদের নির্বাচন বর্জন, অর্থাৎ দলাদলি-বিভক্তি প্রগতি শক্তিকে পঙ্গু করে ফেলে। এই অবস্থায় পূর্ব বাংলার উঠতি বুর্জোয়ারা প্রগতিশীল শক্তির ওপর আস্থা হারায়। তারা মুজিবুর রহমানের ওপর আস্থা স্থাপন করে। ১৯৭০ সনের নির্বাচনে মুজিব নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের বিজয় তাদের আস্থা শক্তিশালী করে। পূর্ব বাংলা স্বাধীনতার পথে এগিয়ে যায়। নেতৃত্বে থাকে আওয়ামী লীগ। এর নেতৃত্বে যে বাংলাদেশ হলো তা বাঙালির বাংলাদেশ হলো না। হলো মুসলমানদের বাংলাদেশ বা মুসলিম বাংলা।
প্রগতিশীল শক্তি (ন্যাপ, ছাত্র ইউনিয়ন, কৃষক সমিতি, শ্রমিক সংগঠন ইত্যাদি) চেয়েছিল সাম্রাজ্যবাদী ও সামন্তবাদী শোষণমুক্ত এক নতুন বাংলাদেশ। অপরদিকে মুজিব - আওয়ামী লীগ ছিল সাম্রাজ্যবাদী-সামন্তবাদী শোষণের পক্ষে, সাম্রাজ্যবাদ বিশেষ করে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে যুক্ত। শেষ পর্যন্ত রুশ-ভারতের সহায়তা নিয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধে জয়ী হলো আওয়ামী লীগ। তারা স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্র ক্ষমতায় বসে। প্রগতির শক্তি মার্কিন ও ভারতের সাহায্য ছাড়া দেশ স্বাধীন করতে চেয়েছিল। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ফলে (যারা সাম্রাজ্যবাদ ও সামন্তবাদ বিরোধী ছিল না) আজও দেশে সাম্রাজ্যবাদী ও সামন্তবাদী শোষণ নানাভাবে রয়েছে, অর্থাৎ সকল দেশী ও বিদেশী শোষণ এখনো বিদ্যমান। প্রগতির শক্তি বিজয়ী হলে সাম্রাজ্যবাদ ও সামন্তবাদী শোষণ মুক্ত কৃষক-শ্রমিক-মধ্যবিত্ত-ছাত্র জনতার এক নতুন বাংলাদেশ বিশ্বসভায় মাথা তুলে দাঁড়াত।
ইতিহাসে বিজয়ী শক্তিই শেষ পর্যন্ত প্রভাব বিস্তার করে।
১৩ ফেব্রুয়ারী, ২০০৯
অনলাইন ঃ ১৩ মার্চ, ২০০৯