Banner
নারী ও ধর্ম ─ শামসুজ্জোহা মানিক

লিখেছেনঃ শামসুজ্জোহা মানিক , আপডেটঃ November 23, 2021, 12:00 AM, Hits: 1744


সব ধর্মে নারীর অবস্খান কম-বেশী হীন। কিন্তু ইসলামে নারীর অবস্খান হীনতম এবং এখানে সে চরমতমভাবে দুর্ভাগা। প্রকৃতপক্ষে জন্মের পর থেকেই ইসলাম নারীর বিরুদ্ধে প্রচণ্ড ও নির্দয় জিহাদ পরিচালনা করে আসছে। এবং এই ক্ষেত্রে তা চরমভাবে নির্দয়, প্রতারণামূলক এবং ভণ্ডামিপূর্ণ।

এ ক্ষেত্রে ইসলামের সাথে হিন্দু ধর্মকে তুলনা করা যায়। কিন্তু হিন্দু ধর্ম যতখানি না একটি ধর্মীয় বিশ্বাস বা মতবাদ তার চেয়ে বেশী একটি সামাজিক ব্যবস্খা। এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল যে, হিন্দু ধর্ম একেশ্বরবাদী কোন ধর্ম নয়, ফলে এই ধর্ম নিরঙ্কুশভাবে কোন একতান্ত্রিক বা এককেন্দ্রিক চিন্তা কাঠামো কিংবা সমাজ কোনটাই গঠন করে না। এই ধর্মের ভিতরে আছে বিভিন্ন ধরনের ভিন্নমুখী এবং পরস্পর বিরুদ্ধ চিন্তা ও ব্যবস্খা। সুতরাং এই ধর্মে পরিবর্তন বা সংস্কার করা কঠিন হলেও সেটা খুব বেশী কঠিন নাও হতে পারে। ইসলামের ক্ষেত্রে এই কথা আদৌ প্রযোজ্য নয়।

ইসলাম নিরঙ্কুশভাবে একেশ্বরবাদী ধর্ম। ফলশ্রুতিতে এটা সৃষ্টি করেছে একটি নিরঙ্কুশভাবে একতান্ত্রিক মানস এবং সমাজ। ধর্মীয় অনুশাসনগুলি স্পষ্টভাবে বিবৃত এবং অপরিবর্তনীয়। খ্রীষ্টধর্ম একেশ্বরবাদী। কিন্তু তা ইসলামের মত নিরঙ্কুশভাবে একেশ্বরবাদী নয়। এখানে ঈশ্বর এবং এই ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা যীশু খ্রীষ্টের মধ্যে ক্ষমতার বিভাজন আছে। খ্রীষ্টধর্ম অনুযায়ী শেষ বিচার দিবস পর্যন্ত স্বর্গ ও পৃথিবীর যাবতীয় কর্তৃত্ব ঈশ্বর কর্তৃক যীশু খ্রীষ্টের হাতে অর্পিত রয়েছে এবং বিচার দিবসে ঈশ্বর নন বরং খ্রীষ্ট স্বয়ং মানুষের পাপ-পুণ্যের বিচার করবেন। এবং ইসলাম ধর্ম বৌদ্ধধর্মের মতন নয় যেখানে ঈশ্বর, স্বর্গ এবং নরকের ধারণার কোন স্খান নাই। এমতাবস্খায় ইসলামে নারীর সমস্যাকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করার প্রয়োজন রয়েছে, কারণ অনেক ক্ষেত্রেই ইসলামে নারীর সমস্যাকে অন্যান্য ধর্মের নারী সমস্যার সাথে মিলানো যায় না।

নারীর মুক্তির প্রশ্নটি আমার নিকট এক অর্থে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। কারণ আমি বিশ্বাস করি যে নারীর মুক্তির মধ্যেই নিহিত রয়েছে যে কোন মুসলিম সমাজে মানুষের চেতনার মুক্তি এবং ফলশ্রুতিতে মুসলিম সমাজেরও মুক্তি।

যাইহোক, ইসলামে নারীর সমস্যাকে শুধুমাত্র ধর্মীয় কিংবা দার্শনিক প্রেক্ষিত থেকে না দেখে সেটাকে একই সঙ্গে রাজনৈতিক প্রেক্ষিত থেকেও দেখা উচিত। আর এটা সহজেই বোধগম্য যে ইসলাম কেবলমাত্র একটা সামাজিক ধর্ম নয়, অধিকন্তু একই সাথে এটা একটা রাজনৈতিক ধর্মও বটে। সেই সময় আরবে রাষ্ট্র ছিল না। এই রকম অবস্খায় মুহাম্মদ যে তার রাজনৈতিক কর্তৃত্ব এবং সেই সঙ্গে একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য ধর্মকে ব্যবহার করেছিলেন সেটাও সহজে বোধগম্য। তার লক্ষ্য অর্জনের জন্য তিনি ধর্মান্ধ সশস্ত্র যাবাবর বর্বরদেরকে যুদ্ধ ও আক্রমণের শক্তি হিসাবে সংগঠিত করেন। এভাবে এল আগ্রাসী যুদ্ধ, লুণ্ঠন, ধর্ষণ, দাস, রক্ষিতা – আর এই  সবকিছুকেই যৌক্তিকতা ও বৈধতা দেওয়া হল ধর্মীয় অনুশাসন দ্বারা। এই ধর্মের জন্ম থেকেই সর্বশক্তিমান, সবচেয়ে গৌরবমণ্ডিত এবং ক্ষমাপরায়ণ সত্তা হিসাবে আল্লাহ্র ধারণার ক্ষুধা ও রোষকে তৃপ্তি দিবার জন্য অশ্রু এবং রক্তের মহাসাগর প্রবাহিত করা হয়েছে।

সেকাল থেকে একাল পর্যন্ত পৃথিবীর অনেক পরিবর্তন হয়েছে। ফলে আগের অনেক কিছু আর নাই। তবু সেই ঐতিহ্য আজও বহমান। পৃথিবী যতই বদলাক ইসলামের পৃথিবীতে নারীর লাঞ্ছিত, বঞ্চিত, মর্যাদাহীন অবস্খা আজও অপরিবর্তিত , কারণ ধর্ম সেটাই চায়।

কাজেই নারীর বিরুদ্ধে মুহাম্মদ যে রাজনীতি শুরু করেছিলেন সেটা আজও অব্যাহত রয়েছে। কেন এই রাজনীতি শুরু করা হয়েছিল তার ফল কী হয়েছে এবং ইসলাম শাসিত সমাজে সর্বব্যাপী স্বৈরতন্ত্র চিরস্খায়ী করার পিছনে এর কী ভূমিকা রয়েছে সেটা বুঝা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই প্রশ্নগুলির উত্তর পাওয়া ছাড়া কোন মুসলিম সমাজেরই অবাধ উন্নয়নের পথ নির্মাণ করা অসম্ভব। যেহেতু ইসলামের অধীনে থেকে কোন সমাজের পক্ষেই যৌক্তিক, স্বাধীন এবং সৃষ্টিশীল মন সৃষ্টি করা সম্ভব নয় সেহেতু ভিতর থেকে অথবা স্বাধীনভাবে তার পক্ষে কোন নূতন জিনিসই গড়ে তুলা সম্ভব নয়। সুতরাং পাশ্চাত্যের দেশগুলি সহজেই মুসলিম পৃথিবীর উপর আধিপত্য করতে পারছে। এই কারণে পাশ্চাত্য এবং বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখানে ধর্মরক্ষায় এত আগ্রহী। তারা জঙ্গী ইসলামকে অপছন্দ করতে পারে কারণ এটা ধ্বংসাত্মক ক্ষমতা নিয়ে তাদের বিরুদ্ধে পরিচালিত। কিন্তু মধ্যপন্থী ইসলাম তাদের কাছে খুবই আদরণীয়। কারণ নির্বীর্যতার কারণে এই ইসলাম বাহিরে অবস্থিত পাশ্চাত্যের আধিপত্য ও শোষণকে চ্যালঞ্জ করার ক্ষমতা রাখে না। অথচ এই তথাকথিত মধ্যপন্থী ইসলাম নিজ সমাজের অভ্যন্তরে নারী এবং মুক্তচিন্তার প্রতি এতটুকু কম হিংস্র এবং আক্রমণাত্মক নয়। সুতরাং এই ক্ষেত্রে আমাদেরকে পাশ্চাত্যের রাজনীতিকেও বুঝতে হবে।

যেহেতু ইসলামে নারীর সমস্যা মূলত রাজনৈতিক সমস্যা সেহেতু এই সমস্যাকে রাজনৈতিকভাবে তথা ক্ষমতার প্রেক্ষিত থেকে বুঝতে এবং সেই মোতাবেক রাজনৈতিকভাবেই সমাধান করতে হবে। আমার মত অনুসারে রাষ্ট্র এবং সমাজের প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে নারীর জন্য স্বতন্ত্র এবং সমান রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার মধ্যেই নিহিত রয়েছে সমস্যার সমাধান। সুতরাং পুরুষ থেকে স্বতন্ত্রভাবে অথচ সমান অধিকার এবং মর্যাদার ভিত্তিতে নারী রাষ্ট্র এবং সমাজের উপর তার ক্ষমতা প্রয়োগ করবে।

আমাদের এ কথা বুঝা দরকার যে নারীর চরম অধ:পতিত এবং দাসত্বমূলক অবস্খানের উৎস হচ্ছে একটি বিশেষ চিন্তা প্রক্রিয়া যে চিন্তা প্রক্রিয়া উদ্ভূত হয়েছে নিরঙ্কুশ একত্বের ধারণা থেকে, যে ধারণা আবার উদ্ভূত হয়েছে সমাজে নিরঙ্কুশ ঐক্য প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা থেকে। এ ধরনের চিন্তা যে কোন ধরনের ক্ষমতা বিভাজনকে অস্বীকার করে। এটা চায় একটি কেন্দ্রে তথা এক হাতে সমগ্র ক্ষমতার নিরঙ্কুশ কেন্দ্রীভবন। কারণ এটাই হচ্ছে নিরঙ্কুশ ঐক্য প্রতিষ্ঠার একমাত্র উপায়। এই নিরঙ্কুশ ঐক্য প্রতিষ্ঠাকারী শক্তি হচ্ছে তলোয়ার এবং চাবুকধারী একজন পুরুষ। একজন পুরুষ মানুষকে আর সবার উপর এককভাবে নিরঙ্কুশ কর্তৃত্বের অধিকারী হতে হবে। ইসলামে দার্শনিকভাবে এই ধারণার বহি:প্রকাশ ঘটেছে আল্লাহর নিরঙ্কুশ একত্ব এবং শ্রেষ্ঠত্বের ঘোষণার মধ্য দিয়ে। আল্লাহর ধারণা হচ্ছে বিশ্বের একক সৃষ্টিকর্তা এবং শাসক তথা সর্বোচ্চ ক্ষমতার ধারণা। লা শরীক আল্লাহ (আল্লাহর কোন অংশীদার বা শরীক নাই)-এর ধারণাটি সমাজে নারীর নিরঙ্কুশ অধীনতা এবং ক্ষমতাহীনতার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। আল্লাহ হচ্ছে পুরুষ মনের সৃষ্টি। সুতরাং আল্লাহর ধারণার মাধ্যমে পুরুষ মানুষ তার নিজ শ্রেষ্ঠত্ব এবং একত্বের ধারণার প্রকাশ দেখে। বস্তুত নিরঙ্কুশ এবং সর্বোচ্চ “এক”-এর ধারণাটি  এসেছে প্রথমত প্রতিপক্ষ হিসাবে নারীকে এবং তারপর সবাইকে তার (এ ক্ষেত্রে মুহাম্মদের) নিরঙ্কুশ অধীনতায় স্খাপন করার জন্য। কিন্তু একত্বের এই ধারণার জন্য সমস্যা হচ্ছে নারীর পুরুষ থেকে স্বতন্ত্র অস্তিত্ব। নারীর স্বতন্ত্র অস্তিত্ব একত্বের ধারণার অন্ত:সারশূন্যতাকে তুলে ধরে। এটা পুরুষকে এই সত্য মনে করিয়ে দেয় যে, একত্বই সমগ্র সত্য নয়, দ্বৈততা হচ্ছে প্রকৃতির আরেক সত্য, পুরুষ হচ্ছে সমগ্রের মাত্র অর্ধাংশ, অপর অর্ধাংশ হচ্ছে নারী। সুতরাং সত্যও সমানভাবে বিভক্ত বা পৃথকীকৃত হতে পারে।

এভাবে নারীর স্বতন্ত্র এবং সমান অস্তিত্বের প্রতি স্বীকৃতি নিরঙ্কুশ একত্বের ধারণাকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে। নারীর অস্তিত্ব সর্বদাই মানুষ হিসাবে পুরুষের অসম্পূর্ণতাকে ধরিয়ে দেয়। সুতরাং সমাধান হিসাবে পুরুষের নিকট দেখা দেয় সমাজ জীবন থেকে নারীর বহিষ্কার।

কিন্তু শুধুমাত্র দর্শন বা আদর্শগত কারণেই যে নারীকে বহিষ্কার করতে হয়েছে তা নয়, আরেকটি কারণ ক্রিয়াশীল ছিল যেটা চরিত্রে ব্যবহারিক। সামাজিক শক্তি হিসাবে নারীর ভূমিকা মূলত শান্তিবাদী। কিন্তু ইসলাম নিজ সম্প্রসারণের জন্য প্রধানত যুদ্ধ বা সহিংসতার পথ বেছে নেয়। সুতরাং তাকে পুরুষের সহিংস প্রবৃত্তিগুলিকে জাগ্রত ও ব্যবহার করার উপর সর্বোচ্চ জোর দিতে হয়, উদ্দেশ্য যাতে তার জাগতিক এবং ধর্মীয় আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য তারা সর্বশক্তি দিয়ে লড়াই করতে পারে। যখন যুদ্ধ এবং বলপ্রয়োগ সবকিছুর ভাগ্য নিধারণ করে তখন সেখানে নারী কী করতে পারে? তারা আর বিষয়ী বা নির্ধারক শক্তি থাকে না; বরং তারা পরিণত হয় আক্রমণাত্মক, সশস্ত্র, লুণ্ঠনকারী, সহিংস, এবং ধর্ষক পুরুষদের  তৃপ্তি মেটানোর বিষয় বা বস্তুতে। এই রকম পরিস্খিতিতে নারীদের সমাজ জীবন থেকে যতটা সম্ভব দূরে পশ্চাদপসরণ করতেই হবে। এবং তাদের পক্ষে বাড়ীর চার দেওয়ালের ভিতর আশ্রয় নেওয়া ছাড়া আর কোন উপায় থাকে না।

অন্যদিকে যেহেতু নারীরা পুরুষদের মত দৈহিক সহিংসতা লালনের উপযুক্ত নয় সেহেতু যুদ্ধ ও সহিংসতার প্রণালীবদ্ধ এবং স্খায়ী সংস্কৃতি সমাজ জীবন থেকে নারীর বহিষ্কার দাবী করে। তাদের দেহতন্ত্র এবং প্রকৃতির কারণে তারা সাধারণত পুরুষদের মত সহিংস এবং সামরিক হতে পারে না। সুতরাং সমাজে তাদের সক্রিয় এবং কার্যকর ভূমিকা থাকলে যুদ্ধ ও সহিংসতার যে কোন ধরনের চিরস্খায়ী এবং সর্বপরিব্যাপ্ত ব্যবস্খার বিকাশ বাধাপ্রাপ্ত হয়। ইসলামের প্রসার ঘটেছিল জিহাদের নামে প্রধানত অব্যাহত যুদ্ধের মাধ্যমে। সুতরাং দৃশ্যমান সমাজ জীবন থেকে নারীদেরকে বহিষ্কার করতে হয়েছিল এবং তাদেরকে সমাজের এমন এক অন্ধকার কক্ষে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল যেখানে তাদের অবস্খান হল বাহির থেকে দৃষ্টির অন্তরালে।

প্রকৃতপক্ষে ইসলামে আল্লাহ্ এবং শয়তানের মধ্যকার সম্পর্কের মধ্যে জীবন প্রক্রিয়ায় পুরুষ এবং নারী সম্পর্ক সম্পর্কে তার নিজ ধারণা প্রতিফলিত হয়েছে। সুতরাং আল্লাহ্ পুরুষের ধারণার প্রতিনিধি এবং শয়তান নারীর ধারণার প্রতিনিধি। র্কুআন এবং হাদীসের মনোযোগী পাঠ আমাদেরকে স্পষ্টভাবে এই সিদ্ধান্তে নিয়ে যায়। সুতরাং পুরুষের ধারণা শুভ এবং নারীর ধারণা অশুভের দ্যোতক। অবশ্য ইসলামে নারী এমন এক অশুভ শক্তি বা শয়তান যাকে বাদ দিলে পুরুষের অস্তিত্ব থাকে না। অনুরূপভাবে মানব শক্তিকে নিয়ে স্বেচ্ছাচারী খেলার জন্য আল্লাহ্র নিকট শয়তানও অপরিহার্য। এইভাবে ধর্মেও প্রকৃতির দ্বৈততা এবং ফলস্বরূপ বহুত্ব ভ্রান্ত এবং বিকৃতরূপে স্বীকৃত। কাজেই সব গুণ ঈশ্বর অর্থাৎ একটি সত্তার উপর অর্পিত এবং সকল দোষ শয়তান অর্থাৎ অপর একটি সত্তার উপর অর্পিত হয়েছে। এই ধরনের বিচার পদ্ধতি এই যুক্তিকে ভুলে যায় অথবা অস্বীকার করে যে যেহেতু ঈশ্বর শয়তানের স্রষ্টা সুতরাং তা নিজেই সকল দোষ বা পাপের স্রষ্টা তথা সর্বোচ্চ এবং চূড়ান্ত উৎসে পরিণত হয়। তাহলে ঈশ্বর এবং শয়তান কি একই সত্তার দুইটি দিক হিসাবে দেখা দেয় না? কিন্তু ধর্ম যুক্তির ধার ধারে না।

এই ধরনের চিন্তা প্রক্রিয়ায় সত্য নিরঙ্কুশ এবং অবিভাজ্য একক সত্তা। সুতরাং কোন কিছু নিরঙ্কুশ অর্থে হয় ভাল নয় মন্দ, হয় গ্রহণযোগ্য নয় অগ্রহণযোগ্য, হয় সঠিক নয় ভুল, হয় কালো নয় সাদা। কাজেই কর্তৃত্বের সঙ্গে যে কোন ধরনের পার্থক্যই হচ্ছে শয়তানী। এখানে তুলনামূলক বা আপেক্ষিক বিচার কাজ করে না। চিন্তার প্রক্রিয়ায় ক্ষমতার পৃথকীকরণ বা বিভাজনের কোন অস্তিত্ব নাই। সবকিছুই একমেরুভূত, একরৈখিক, এককেন্দ্রিক। সুতরাং যুক্তি নাই, সহিষ্ণুতা নাই এবং নাই কোন দ্বান্দ্বিকতা। এইরকম অবস্খায় ইসলামী মন মুক্ত ও স্বচ্ছন্দভাবে বিচরণ করতে বা ক্রিয়াশীল হতে পারে না। ফলশ্রুতিতে সমগ্র ইসলামী পৃথিবী মানসিক প্রতিবন্ধী হয়ে আছে।

ইসলামী মন হচ্ছে আগ্রাসী এবং নিরঙ্কুশবাদী পুরুষের মন। ইসলামী পৃথিবী হচ্ছে আগ্রাসী এবং নিরঙ্কুশবাদী পুরুষের পৃথিবী। নারী যেহেতু এই ধরনের মন এবং বিশ্বব্যবস্খার জন্য সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক শক্তি সেহেতু তারা এখানে কোন সম্মানজনক এবং দর্শনীয় স্খান পেতে পারে না। কাজেই ঐ মন এবং বিশ্ব-ব্যবস্খাকে ধ্বংস করতে হলে পুরুষদেরকে বাধ্য করতে হবে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে স্বতন্ত্র অস্তিত্ব এবং সমান মর্যাদাসহ নারীর অবস্খানকে মেনে নিতে। এইভাবে ইসলামের অধীনস্খ চেতনার মুক্তি নিহিত রয়েছে এই সত্যের স্বীকৃতির মধ্যে যে একই প্রজাতির অন্তর্ভুক্ত হলেও নারী পুরুষ থেকে স্বতন্ত্র এটি সত্তা। সমাজ এবং সভ্যতা নির্মাণে নারী এবং পুরুষ উভয়ের সমান ভূমিকা থাকতে পারে, কিন্তু তা সত্ত্বেও অনেক বিষয়ে প্রকৃতি তাদেরকে ভিন্নভাবে গড়েছে। সুতরাং সকল ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকা অভিন্ন বা এক নয়। কিন্তু মানব প্রজাতি রক্ষা ও সেই সঙ্গে সভ্যতা নির্মাণে উভয়ই সমভাবে অপরিহার্য। অধিকন্তু আমাদেরকে এ কথা বুঝতে হবে যে পুরুষ এবং নারীর মধ্যকার সম্পর্ক সবচেয়ে মৌলিক ও প্রাথমিক সামাজিক সম্পর্ক। সুতরাং যে কোন সমাজের চেতনা এবং কাঠামো গঠনে এই সম্পর্কের প্রচণ্ড ভূমিকা রয়েছে।

ইসলামের অধীনস্খ চেতনাকে যুক্তিবাদী চেতনায় পরিণত করার জন্য নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা অত্যাবশ্যক। সমাজকে সহিষ্ণু করার এটাই একমাত্র উপায়। স্বভাবগতভাবেই নারী পুরুষের চেয়ে অধিকতর সহিষ্ণু। প্রকৃতি তাদেরকে এভাবে সৃষ্টি করেছে। সুতরাং সমাজ তাদের কাছ থেকে সহিষ্ণুতার শিক্ষা অধিকতর সহজে লাভ করবে। তাছাড়া এর থেকে পুরুষ এই সত্য মেনে নিতে  শিখবে যে সে-ই একমাত্র এই বিশ্বের মালিক নয়, বরং জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তার সঙ্গে সহযোগিতা এবং প্রতিযোগিতা করার জন্য সমান মর্যাদার অধিকারী তার স্বাধীন প্রতিপক্ষ রয়েছে। নারী এবং পুরুষের মধ্যে ক্ষমতার বিভাজন দ্বারা সৃষ্ট এই বস্তুগত বা সামাজিক ভিত্তি মানসিক বিকাশের পথ তৈরী করবে।

দার্শনিক অথবা আদর্শিক সংগ্রামের প্রয়োজন অবশ্যই রয়েছে। কিছু সংখ্যক মানুষকে সে কাজ করতে হবে। কিন্তু যে সমাজে প্রত্যেকটা মানুষকে ধরে নেওয়া হয় আল্লাহর বান্দা বা দাস হিসাবে সেই রকম এক সমাজে কতজন মানুষ প্রকৃতপক্ষে লোকবাদী কিংবা নাস্তিক হতে পারে? প্রকৃতপক্ষে এটা একটা দাস সমাজ। ধর্মীয় অনুশাসন দ্বারা প্রতিটি মানুষ এখানে ব্যবস্খার দাস। এই ব্যবস্খা মুক্ত চিন্তা দূরে থাক যে কোন ধরনের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে এবং গোটা ব্যবস্খাটা প্রতিষ্ঠিত চরম রকম স্বেচ্ছাচারী শাসন কিংবা স্বৈরতন্ত্রের উপর। যে সমাজের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ চিন্তা পর্যন্ত করতে পারে না, ভিন্ন কোন ধারণাকে সহ্য করতে পারে না, চরমভাবে ভাগ্যবাদী এবং কাল্পনিক অলৌকিক সর্বোচ্চ কর্তৃত্বের ভয়ে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে থাকে সেই রকম এক সমাজে আমরা কী করে তাদের কাছ থেকে কুসংস্কার এবং অন্ধ বিশ্বাস নির্ভর ধর্মের বিরুদ্ধে লড়াই আশা করতে পারি? এখানে মুক্ত চিন্তার ধার কে ধারে? যারা সত্যি সত্যিই মুক্তভাবে চিন্তা করে তাদের সংখ্যা কতজন? ধর্মের বিরুদ্ধে কথা বলা এখানে বিপদ ডেকে আনতে পারে। এই মাটিতে জন্ম নিয়েছিলেন এক মহান দার্শনিক আরজ আলী মাতুব্বর। কিন্তু এতকাল পরেও এমনকি কয়জন শিক্ষিত মানুষ তার নাম জানে? বিপুল গরিষ্ঠ জনগণের চাপে মুক্ত চিন্তা মাথা তোলার কোন অবকাশ এখানে পায় না। সমাজ জমির গভীরে কোন প্রগতিশীল শক্তির শিকড় প্রবেশ করতে পারে না।

সুতরাং একমাত্র উপায় হিসাবে আমি দেখি এমন এক রাজনৈতিক ব্যবস্খার প্রতিষ্ঠাকে যেখানে নারীরা পুরুষদের সমান অংশীদার হিসাবে রাষ্ট্র ও সমাজের উপর তাদের নিজস্ব ক্ষমতা প্রয়োগ করবে। আর এইভাবে ভেঙ্গে পড়বে ‘লা শরীক আল্লাহ্’ (ঈশ্বরের কোনও অংশীদার নাই) ঘোষণার মধ্য দিয়ে মূর্ত এককেন্দ্রিক চিন্তা প্রক্রিয়ার গোটা ভিত্তিটাই।

এই কারণে পাশ্চাত্যের অনুরূপ গণতন্ত্র এবং নির্বাচনমূলক ব্যবস্খা আমাদের সমস্যার কোন সমাধান দিতে পারে না। সেখানে রাষ্ট্র শাসনে নারী এবং পুরুষকে সরলভাবে সমান করে দেখা হয়। সুতরাং মানব প্রজাতির প্রজনন এবং লালন প্রক্রিয়ায় নারীর যে বিশেষ এবং অনন্য ভূমিকা রয়েছে তার স্বীকৃতি স্বরূপ নারীর জন্য বিশেষ অধিকার এবং সুবিধা পাশ্চাত্যের ক্ষমতা কাঠামোতে সংরক্ষিত হয় নাই। কিন্তু তাদের অবস্থা আমাদের অবস্থা থেকে ভিন্ন। এমনকি তাদের ধর্ম ও সংস্কৃতির অনেক কিছুই আমাদের থেকে বিরাটভাবে ভিন্ন। সুতরাং আমাদের সমস্যার জন্য ভিন্ন সমাধান প্রয়োজনীয়।

এই বাস্তবতা না বুঝে অনেক মুসলিম দেশেই পাশ্চাত্য গণতন্ত্র এবং নির্বাচনমূলক ব্যবস্খাকে অনুকরণ করার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু তাতে করে নারীর অবস্খায় উল্লেখযোগ্য কোন উন্নতি তো ঘটেই নাই অধিকন্তু মুসলিম পৃথিবীর কোথায়ও প্রকৃত কোন লোকবাদী ও গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা যায় নাই। বরং মুসলিম পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশে সংখ্যাগুরু ভোটারদের সমর্থন নিয়ে পরিচালিত শাসন ব্যবস্খা সাধারণভাবে জনগণের এবং বিশেষভাবে নারীর অবস্খার ক্রমিক অবনতি ঘটিয়েছে। আর সবচেয়ে করুণ থেকেছে নারীর অবস্খা। যেহেতু নারী হচ্ছে মানবতার জননী সেহেতু মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন কোন সমাজই এখানে জন্ম নিতে পারে না। তাদের মানবেতর অবস্খা তাদেরকে বাধ্য করে কেবলমাত্র একটি মানবেতর কিংবা অমানবিক সমাজের জন্ম দিতে। সুতরাং আমাদের জন্য প্রয়োজন হচ্ছে রাষ্ট্র শাসনকার্যে নারীর নিজস্ব ক্ষমতার প্রতিষ্ঠা।

কাজেই কেবলমাত্র নারীর ক্ষমতা, রাষ্ট্র ও সমাজে স্বতন্ত্র ও সমান সত্তা হিসাবে নারীর অধিষ্ঠান চেতনাকে ধর্মের নিগড় মুক্ত করতে পারে, যুক্তি-বুদ্ধির বিকাশের জন্য ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে পারে এবং সমাজকে মানসিক প্রতিবন্ধ থেকে মুক্ত করতে পারে। ধর্ম এবং অন্যান্য বিধিব্যবস্খা দ্বারা সৃষ্ট পুরুষ আধিপত্যের পুরাতন বিশ্বকে ভেঙ্গে ফেলতে হবে। সুতরাং মানব জাতির ইতিহাসে এটা হবে এক নূতন বিপ্লব। আজ আমাদেরকে তার জন্য লড়াই করতে হবে।

(নিবন্ধটি ‘সাতরং’ নামক ওয়েব সাইটের সম্পাদক নন্দিনী হোসেনকে তার লিখিত ‘পুরুষ রচিত ধর্মে বিকলাঙ্গ নারী’ নিবন্ধের প্রশংসায় পত্রের আকারে ইংরাজীতে লেখা হয়। ২৩ জুন, ২০০৮ তারিখে তার নিকট পাঠানো পত্রটি ওয়েব সাইট সাতরং, মুক্তমনা এবং বঙ্গরাষ্ট্রে প্রকাশিত হয়। এটির বাংলা অনুবাদ করা হল। তবে এখানে এটিকে নিবন্ধ হিসাবে প্রকাশের জন্য পত্রের সম্বোধন সূচক অংশগুলি বাদ দেওয়া হয়েছে। – বঙ্গরাষ্ট্র)

 

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
Archive
 
সাম্প্রতিক পোষ্টসমূহ