লিখেছেনঃ শামসুজ্জোহা মানিক, আপডেটঃ July 6, 2018, 12:00 AM, Hits: 2713
বিষয়সূচী :
১। সূচনা পর্ব : কেস-স্টাডি ঋগ্বেদ এবং কিছু প্রশ্ন
২। পাশ্চাত্য এবং ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাতিষ্ঠানিক বুদ্ধিবৃত্তির সমস্যা : সাম্রাজ্যবাদ এবং উপনিবেশবাদের ভূমিকা
৩। পাশ্চাত্য পাণ্ডিত্যের মূর্খতা কিংবা বদমায়েশী এবং উপমহাদেশীয় পাণ্ডিত্যের দাসত্ব
৪। সমাপ্তি পর্ব : বাংলাদেশ, ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে একটি সংক্ষিপ্ত তুলনামূলক পর্যালোচনা
(১) সূচনা পর্ব : কেস-স্টাডি ঋগ্বেদ এবং কিছু প্রশ্ন
মানুষ তার নিজ জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে জীবনের নিয়ম কিংবা সত্যগুলিকে সবচেয়ে ভালভাবে বুঝতে পারে। জীবনের একটা বিরাট দিক সম্পর্কে আমি কীভাবে নূতন উপলব্ধিতে পৌঁছেছি সেই বিষয় তুলে ধরবার জন্য ঋগ্বেদ পাঠ সংক্রান্ত আমার নিম্নোক্ত বিবরণ যাকে একটি কেস-স্টাডি বলা যায়।
সত্য কথা বলতে কী, ঋগ্বেদ পাঠের পূর্ব পর্যন্ত জ্ঞানী এবং পণ্ডিতদের সম্পর্কে আমার খুব উঁচু ধারণা ছিল। মানুষ মাত্র ভুল করতে পারে। সুতরাং পণ্ডিতরাও ভুল করতে পারেন বলে মনে করতাম, যা এখনও মনে করি। তবে আমার ধারণা ছিল জ্ঞানী বা জ্ঞানের সাধকরা সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী সত্যান্বেষী বা সত্য সাধক হন। সুতরাং মনে করতাম তারা যেমন সত্যকে জানবার পর সেটাকে গ্রহণ করবার সৎ সাহস রাখেন তেমন মনে করতাম মিথ্যাকে জেনেশুনে প্রতিষ্ঠিত করবার জন্য তারা কাজ করেন না। কিন্তু ঋগ্বেদ অধ্যয়ন এবং দীর্ঘকাল যাবৎ এ নিয়ে কাজ করতে গিয়ে আমার এ ধারণা পাল্টে যায়। বলা যায় এ সংক্রান্ত অভিজ্ঞতা ক্রমে আমার চিন্তার জগৎকেও অনেকাংশে উল্টেপাল্টে ফেলে। এখন মূল প্রসঙ্গে যাওয়া যাক।
ছেলেবেলা অর্থাৎ বিদ্যালয় জীবন থেকেই আমি ইতিহাসের প্রতি তীব্র আকর্ষণ অনুভব করতাম। সুতরাং ইতিহাসের বই-পত্র যেখানে যা পেতাম পড়ার চেষ্টা করতাম। এ ক্ষেত্রে আরও বেশী আকর্ষণ অনুভব করতাম বঙ্গ এবং ভারতবর্ষের ইতিহাসের প্রতি। ফলে ভারতবর্ষে ‘বহিরাগত আর্যদের আক্রমণ’ সংক্রান্ত সুপ্রসিদ্ধ এবং সুপ্রতিষ্ঠিত তত্ত্ব আমার না জানার কথা ছিল না। তাছাড়া স্কুলের পাঠ্য পুস্তকেও সে সময় এ সম্পর্কে লেখা থাকত। আর সবার মত আমিও মনে করতাম যে, আর্যরা ছিল যাযাবর, পশুপালক, শ্বেতকায়, উন্নতনাসা এবং ভারতবর্ষে বহিরাগত হানাদার। এই ধারণা নিয়ে আমি বড় হই। বহুকাল পর্যন্ত সম্পূর্ণ ঋগ্বেদ গ্রন্থ না পড়লেও তার মন্ত্রের কিছু বাছাই করা অংশ বিভিন্ন গ্রন্থে বা প্রবন্ধে পড়তাম। তা থেকে আর্যদের বর্বর মনে করতে অনেক সময় কষ্ট হলেও মনে হত এরা ছিল ‘বিশেষ ক্ষমতা’ বা ‘গুণের’ অধিকারী মানুষ, যারা বর্বর পশুপালক হলেও উন্নত চিন্তার অধিকারী হওয়ায় এভাবে উন্নত মন্ত্র রচনা করতে পেরেছিল। তবু প্রশ্ন একটা ছিল। কারণ বর্বর পশুপালকরা কীভাবে এত উন্নত সাহিত্য জ্ঞানের অধিকারী হতে পারে সেই প্রশ্ন যে কোনও বিচার-বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষের মনে আসা স্বাভাবিক। এই প্রশ্নের একটা উত্তর পেলাম ১৯৭৬-৭৭ সালে যখন আমি ভারতীয় পণ্ডিত দামোদর ধর্মানন্দ কোসাম্বির ইংরাজীতে লেখা বিখ্যাত গ্রন্থ ‘অ্যান ইন্ট্রোডাকশন টু দি স্টাডি অব ইন্ডিয়ান হিস্ট্রি’ (An Introduction to the Study of Indian History) পড়ি। কোসাম্বির মতে বহিরাগত, যাযাবর, বর্বর, পশুপালক আর্যরা ভারতবর্ষে প্রবেশের পর সিন্ধু সভ্যতাকে ধ্বংস করে এবং সেখানকার পণ্ডিতদেরকে বন্দী করে তাদেরকে দিয়ে আর্য বা বৈদিক ভাষায় মন্ত্র রচনা করায়। অর্থাৎ ঋগ্বেদ মূলত বহিরাগত আর্যদের নির্দেশে সিন্ধু সভ্যতার বন্দী পণ্ডিত বা ঋষিদের রচনা। ফলে এই সব মন্ত্র রচনায় সভ্য মন এবং জীবনের এমন ছাপ পাওয়া যায়। যেন তীব্র আবেদনময় এবং আবেগঘন মন্ত্র বা কাব্য রচনা আর বন্দী কারিগর বা মিস্ত্রীদের দিয়ে দালান বা প্রাসাদ নির্মাণ এক জিনিস! যাইহোক, তবু এমন একটা ব্যাখ্যা দিয়ে আমি আরও অনেক কাল নিজেকে তুষ্ট রাখতে পেরেছিলাম।
কিন্তু এই অবস্থার পরিবর্তন হল তখন যখন আমি ভারতবর্ষের সমাজ বিকাশের গতিধারা এবং সমস্যা বুঝবার জন্য তার শুরুর জায়গায় পৌঁছাতে চাইলাম। এ কথা জানা যে হিন্দুদের আদি ধর্মগ্রন্থ ঋগ্বেদ হচ্ছে ভারতবর্ষের সর্বপ্রাচীন লিখিত দলিল যা রচনার পর হতে আজ অবধি অপরিবর্তিত রূপে আমাদের নিকট পাঠযোগ্য হিসাবে বর্তমান আছে। অবশ্য হিন্দুদের ধর্মগ্রন্থ বেদ মোট চারটি ভাগে বিভক্ত। যথা, ঋক, সাম, যজুঃ এবং অথর্ব। এই চার বেদ মিলেই সমগ্র বৈদিক সাহিত্য। তবে মূল এবং সর্বপ্রাচীন বেদ হিসাবে ঋগ্বেদকেই সর্বাধিক মূল্য দেওয়া হয়। ঋগ্বেদের সামাজিক এবং ঐতিহাসিক গুরুত্বও অপরিমেয়। সুতরাং ভারতীয় সমাজের উৎসে পৌঁছাতে চেয়ে ঋগ্বেদ পড়তে শুরু করলাম। ১৯৯০ সাল ছিল আমার এক নূতন উপলব্ধির কাল। প্রণালীবদ্ধভাবে ঋগ্বেদ পড়তে গিয়ে সেই সময় বলা যায় আমি হতভম্বকর অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হলাম।
কোসাম্বির তত্ত্ব নিয়ে পড়তে গিয়েও আমি আমার এতকালের বিশ্বাসকে টিকিয়ে রাখতে পারছিলাম না। ঋগ্বেদ দশ মণ্ডলে বিভক্ত। আমি প্রথম মণ্ডল শেষ করলাম এই উপলব্ধি নিয়ে যে, কোসাম্বিও ঋগ্বেদকে বুঝতে ভুল করেছেন। এবং যে সকল পণ্ডিতের আর্য আক্রমণ তত্ত্বকে আমি এতকাল অভ্রান্ত জ্ঞান করতাম তারা যে সবাই ভ্রান্ত এই সিদ্ধান্ত নিয়ে আমি ঋগ্বেদের বাকী নয়টি মণ্ডলও পড়ে শেষ করলাম।
ঋগ্বেদ পড়তে গিয়ে এই বিষয় আমার কাছে স্পষ্ট হল যে, ঋগ্বেদ পশ্চাৎপদ, বর্বর, পশুপালক এবং যাযাবর মানুষদের গ্রন্থ তো নয়ই এমনকি বন্দী পণ্ডিত তথা পরাধীন মানুষদের দ্বারা লিখিত কোনও গ্রন্থও নয়। বরং ঋগ্বেদকে আমার মনে হল বিশেষ সামাজিক পটভূমিতে দাঁড়িয়ে স্বাধীন মানুষদের স্বাধীন কণ্ঠ থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে উচ্চারিত মন্ত্রসমষ্টি। শুধু তা-ই নয়, আমি এটির পিছনে দেখতে পেলাম ঋগ্বেদে সপ্তসিন্ধু হিসাবে বহুবার কথিত উত্তর-পশ্চিম ভারতবর্ষে অবস্থিত একটি সুউন্নত সভ্যতার ভিত্তিভূমিকে। সিন্ধু সভ্যতা আবিষ্কারের পর সেই ভিত্তিভূমিকে চিনতে অন্তত আমার কোনই কষ্ট হয় নাই।
সবচেয়ে বড় কথা ঋগ্বেদের কোনও মন্ত্র থেকেই আমি ঋগ্বেদ রচয়িতা ঋষি তথা আর্যদেরকে বহিরাগত মনে করবার কোনও কারণই খুঁজে পেলাম না। কারণ ঋগ্বেদের ঋষিরা ভুলেও কখনও নিজেদেরকে তথা তাদের জনগোষ্ঠীকে সপ্তসিন্ধু অঞ্চলে বহিরাগত বলেন নাই। বরং সপ্তসিন্ধু অঞ্চল যে তাদের মূল বাসভূমি সেটা তাদের মন্ত্রগুলি থেকে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হল। অবশ্য সপ্তসিন্ধু বলতে যে ঋষিরা সিন্ধু, সরস্বতীসহ শুধু সাতটি নদী অথবা সাত নদীবিধৌত অঞ্চলকে বুঝাতেন তা নয়। সেখানে আরও অনেক কয়টি ছোটখাটো নদী ছিল। তবে কুভা বা কাবুল নদী কিংবা উত্তর ভারতের বৃহৎ নদী গঙ্গার উন্নত কূলের উল্লেখ (ঋগ্বেদ : ৬/৪৫/৩১ – ‘গঙ্গার উন্নত কূলের ন্যায় পণিগণের মধ্যে উচ্চস্থানে বৃবু অধিষ্ঠান করছিলেন।’) থেকে বুঝা যায় যে ঋগ্বেদের ঋষিদের বা বৈদিক জনগোষ্ঠীর আবাস সিন্ধু-পাঞ্জাবের বাইরেও প্রায় চতুষ্পার্শ্বে আরও বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বিস্তৃত ছিল। এই সমগ্র অঞ্চল ছিল সিন্ধু সভ্যতার অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং ঋগ্বেদ পাঠে আমি নিশ্চিত হলাম যে ঋগ্বেদ রচয়িতা ঋষি বা আর্যরা সিন্ধু সভ্যতার অন্তর্ভুক্ত ভূভাগের অধিবাসী।
আমার কাছে এ বিষয়টাও প্রায় প্রথম থেকেই ধরা পড়ল যে, আর দশটি ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনের মত ঋগ্বেদও একটি ধর্ম সংস্কার আন্দোলনের ফসল, যা সিন্ধু সভ্যতার পতনের সময় সেই সভ্যতার অধিবাসীদের দ্বারা সংগঠিত হয়। এর সঙ্গে বহিরাগত যাযাবর, পশুপালক, শ্বেতাঙ্গ আক্রমণকারীদের আক্রমণের এবং ভারতবর্ষে বহিরাগতদের সভ্যতা এবং প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠার কোনও সম্পর্কই নাই। সমগ্র ঋগ্বেদ পাঠে আমি বহিরাগত আর্য এবং স্থানীয় অনার্যদের মধ্যকার যুদ্ধের কোনও চিহ্নই খুঁজে পেলাম না। বরং এটা আমার কাছে স্পষ্ট হল যে, সিন্ধু সভ্যতার সঙ্কট কালে সামাজিক পরিবর্তনের প্রয়োজনে সিন্ধু সভ্যতার অধিবাসীদের একাংশ সমাজের বিদ্যমান ধর্মের সংস্কারের প্রয়োজন অনুভব করে। ধর্ম সংস্কার করতে গিয়ে ঋগ্বেদের ঋষিরা মন্ত্র রচনা করে। এভাবে তারা পুরাতন ধর্মের পরিবর্তে একটি নূতন ধর্মের জন্ম দেয়। এটা পরিণামে একটা গৃহযুদ্ধের দিকে সমাজকে নিয়ে যায়। ধর্মের আবরণে ঋগ্বেদ মূলত সেই গৃহযুদ্ধেরই দলিল।
ঋগ্বেদ আমার কাছে কোনও গালগল্পের সমষ্টি ছিল না। কারণ তাহলে এটাকে এভাবে হাজার হাজার বৎসর ধরে টিকিয়ে রাখবার কোনও তাড়নাই একটা সুবৃহৎ সমাজ বা জনগোষ্ঠী অনুভব করত না। যে বিরাট সামাজিক সংঘাতের অভিঘাতের ফলে ঋগ্বেদের সৃষ্টি সেটাই তাকে এভাবে কালজয়ী করেছে। সুতরাং ঋগ্বেদ ধর্মগ্রন্থ হলেও তা পাঠের সময় তার পিছনের সামাজিক সংঘাতের স্বরূপ বুঝবার উপরই আমি সর্বাধিক গুরুত্ব দিলাম।
ঋগ্বেদ পড়তে গিয়ে এই সত্যও আমার নিকট স্পষ্ট হল যে, সিন্ধু সভ্যতা দাঁড়িয়েছিল বিশেষ ধরনের এবং জটিল নদী নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার উপর। আজ অবিশ্বাস্য মনে হলেও ঋগ্বেদের সাক্ষ্য অনুযায়ী জলকপাট বা স্লুইস গেট যুক্ত বাঁধ দিয়ে সিন্ধু সভ্যতার নদীগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করা হত। সভ্যতার শেষ পর্যায়ে নদী নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়তে থাকলে ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠী নদী নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার অবসান দাবী করে। কিন্তু জনগোষ্ঠীর অপর অংশ এই ব্যবস্থার পক্ষে থাকায় সভ্যতা বা সমাজ বিভক্ত হয়ে পড়ে। নদী নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ছিল বিদ্যমান ধর্মের অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং এর অবসান যারা চাইছিল তাদের জন্য বিদ্যমান ধর্মের সংস্কার ছিল অপরিহার্য। এই ধর্ম সংস্কারের ফসল হচ্ছে ঋগ্বেদ।
অনেকের নিকট সিন্ধু সভ্যতার কালে, যেটার নগর বা পরিণত পর্যায় শুরু হয়েছিল আজ থেকে প্রায় পাঁচ হাজার বৎসর পূর্বে, আজকের মত জলকপাট সংযুক্ত বাঁধ দ্বারা নদী নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার অস্তিত্বকে অবিশ্বাস্য মনে হলেও আমি মোটেই অবিশ্বাস করি নাই। কারণ ধর্মগ্রন্থ হলেও ঋগ্বেদকে আমি যেমন গাল-গল্পের সমষ্টি মনে করি নাই তেমন আজ থেকে পাঁচ হাজার বছর কিংবা তারও আগের মানুষের প্রযুক্তিগত সামর্থ্যকে অবিশ্বাস করি নাই। দৃষ্টান্ত হিসাবে তো আছেই পাঁচ হাজার বৎসর পূর্বে মিসরের পিরামিডের বিস্ময়কর এবং আপাত দৃষ্টিতে অবিশ্বাস্য মহানির্মাণ। ঐ কালে তামা ও ব্রোঞ্জের হাতিয়ার দিয়ে যদি বহুদূরবর্তী স্থানের পাহাড় থেকে পাথরের বিশাল সব চাঁই কেটে এনে মিসরের পিরামিডগুলি নির্মাণ করা সম্ভব হয়ে থাকে তবে সিন্ধু উপত্যকার নদীগুলিতেও জলকপাট সংযুক্ত বাঁধ দিয়ে সেগুলির জল প্রবাহকে নিয়ন্ত্রণ দ্বারা সিন্ধু সভ্যতায় উন্নত জলসেচ ব্যবস্থা গড়ে তুলা সম্ভব হবে না কেন? না, আমি ঋগ্বেদের ঋষিদের বর্ণিত নদী নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাকে যেমন বিস্ময়কর মনে হলেও অবিশ্বাস করি নাই তেমন সিন্ধু সভ্যতার কাল প্রেক্ষিতে সুউন্নত প্রযুক্তিগত সক্ষমতাকেও খাটো করে দেখি নাই।
যাইহোক, ঋগ্বেদ পাঠে আমার নিকট এটি স্পষ্ট হল যে, নদী নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাকে কেন্দ্র করে সিন্ধু সভ্যতায় যে বিবাদ ঘটে তা গৃহযুদ্ধে পরিণত হয় এবং এই গৃহযুদ্ধের প্রক্রিয়ায় বৈদিক পক্ষের ঋষিদের রচিত মন্ত্রের সংকলন হচ্ছে ঋগ্বেদ।
সিন্ধু সভ্যতার প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারসমূহের উপর আমার ধারণা তখনও পর্যন্ত ছিল খুব প্রাথমিক পর্যায়ের। তখনও পর্যন্ত সিন্ধু সভ্যতার যেটুকু প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার হয়েছিল সে সংক্রান্ত বইপত্র বা তথ্যাদি বাংলাদেশে ছিল না বলাই সঙ্গত। বড় জোর ১৯৭০-এর দশকের কিছু আবিষ্কার পর্যন্ত আমার জানা বা পড়া ছিল। ইতিমধ্যে যে আরও অনেক আবিষ্কার হয়েছে যেগুলি আমার ধারণাকে অনেক বেশী শক্ত ভিত্তি দান করতে পারে তা আমার জানা ছিল না। তবু আমি আমার নূতন উপলব্ধির ভিত্তিতে একটা আলোচনার সূত্রপাত ঘটাতে চাইলাম। সুতরাং ঋগ্বেদ এবং সিন্ধু সভ্যতার যোগসূত্র সম্পর্কে আমি আমার প্রাথমিক উপলব্ধি এবং সিন্ধু সভ্যতার উপর পঠিত এবং লভ্য কিছু সংখ্যক বইয়ের উপর নির্ভর করে ১৯৯০ সালে লিখলাম ‘ভারত-ইতিহাসের সূত্র সন্ধান’। অর্থাৎ ঋগ্বেদ পাঠ সম্পূর্ণ করার পর আর বেশী দেরী না করে প্রত্নতত্ত্ব সংক্রান্ত যেটুকু তথ্য হাতের কাছে ছিল তাই নিয়ে লিখতে শুরু করি। আমার লেখাটি হল তাই মূলত ঋগ্বেদের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ভিত্তিক। সেই সঙ্গে সিন্ধু সভ্যতার বৃহৎ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সঙ্গে মহাভারতের বীজ কাহিনীর সঙ্গতি দেখতে পাওয়ায় মহাকাব্য মহাভারতের প্রসঙ্গকেও এই লেখায় আনলাম।
এর পর দুই বঙ্গের পণ্ডিত মহলে বইটির পাণ্ডুলিপির ফটোকপি নিয়ে কিছু ঘোরাঘুরি করে বুঝলাম যে লাভ হবে না। ভেবেছিলাম যে আর কিছু না হোক একটা আলোচনার সূত্রপাত ঘটাতে পারব। ভাবলাম বাংলাদেশে না হোক পশ্চিম বঙ্গে অন্তত কিছু সাড়া বা উৎসাহ পাব আমার যুক্তির অভিনবত্ব এবং শক্তির কারণে। কিন্তু বুঝলাম সেখানকার অবস্থা বাংলাদেশের চেয়ে সুবিধার নয়, বরং আরও অনেক করুণ। পাশ্চাত্যের পণ্ডিতবর্গ যা বলেছে তার বাইরে চিন্তার ক্ষমতা তাদের নাই, ফলে তার বাইরে কোনও জিজ্ঞাসাও নাই।
বুঝলাম যে বাংলা ভাষায় হবে না। উভয় বঙ্গের শিক্ষিত পণ্ডিতবর্গ যাদেরকে কর্তা বা গুরু বলে ভজনা করে সেই ইংরেজ প্রভুদের ভাষায় না লিখলে হবে না। তাছাড়া ভারতবর্ষে বহিরাগত আর্য আক্রমণ তত্ত্ব যারা প্রতিষ্ঠা করেছেন কিংবা আজও প্রচার করে চলেছেন সেই পাশ্চাত্য পণ্ডিতরাও হয়ত সত্যান্বেষী জ্ঞান সাধক হিসাবে ঋগ্বেদের সঠিক ব্যাখ্যায় অনুপ্রাণিত হবেন।
এখানে উল্লেখ করা উচিত হবে যে, আমার নূতন উপলব্ধির সঙ্গে প্রথম থেকেই একমত হয়েছিলেন শামসুল আলম চঞ্চল। ঋগ্বেদ পাঠের পরই এ সংক্রান্ত প্রচুর আলোচনা তার সঙ্গে হয়। পেশায় প্রকৌশলী (যান্ত্রিক) হলেও তার ছিল বিভিন্ন বিষয়ের উপর ব্যাপক অধ্যয়ন এবং সেই সঙ্গে সিন্ধু সভ্যতার প্রত্নতত্ত্বের উপর কিছু পড়াশুনা। এবং ছিল উন্মুক্ত মন। সুতরাং তার সঙ্গে আলোচনা আমাকে খুব সাহায্য করে।
যাইহোক, ‘ভারত-ইতিহাসের সূত্র সন্ধান’ অপ্রকাশিত রয়ে গেল। এই গ্রন্থ লিখবার চাপে যেমন আমি অবসন্ন ছিলাম তেমন দুই বঙ্গ বিশেষত পশ্চিম বঙ্গে বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনার ফলাফলে আমি যথেষ্ট হতাশ এবং তিক্তও হয়েছিলাম। আর একটা লেখা লিখবার উৎসাহ, ধৈর্য এবং শক্তি আমার ছিল না। সুতরাং চঞ্চলকে ইংরাজীতে একটা প্রবন্ধ লিখবার দায়িত্ব নিতে বললাম। ভাবলাম যে ইংরাজীতে লিখে বাইরের পৃথিবীর পণ্ডিত মহলে মতামতের জন্য পাঠানো যাবে। চঞ্চল রাজী হলেন।
ইতিমধ্যে তিনি বিভিন্নভাবে সিন্ধু সভ্যতার সাম্প্রতিক কিংবা সর্বশেষ আবিষ্কার সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের কাজ শুরু করেন। সেই সময় তিনি চট্টগ্রামে টিএসপি কমপ্লেক্স লিমিটেড নামে রাষ্ট্রায়ত্ত সার কারখানায় অ্যাসিস্ট্যান্ট মেকানিক্যাল ইঞ্জিনীয়ার হিসাবে কর্মরত ছিলেন। ১৯৯২ সালে তিনি পাকিস্তান আর্কিওলজি এন্ড মিউজিয়াম্স (Pakistan Archaeology and Museums)--এর বর্তমানে সাবেক মহাপরিচালক ডঃ মোহাম্মদ রফিক মোগলের নিকট পাকিস্তান প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ থেকে এ সংক্রান্ত তথ্য এবং বইপত্র কীভাবে পাওয়া যাবে তা জানতে চেয়ে চিঠি পাঠান। তার পেশাগত পরিচয় দিয়ে তিনি যে এ ব্যাপারে কাজ করতে ইচ্ছুক সেটাও জানান। ১৯৯৩ সালের জানুয়ারীতে ডঃ মোগল সিন্ধু সভ্যতার উপর তার নিজের লিখা ১৩টি প্রবন্ধ চঞ্চলের নিকট পাঠান যেগুলি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জার্নাল এবং সংকলন গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছিল। এগুলি ছিল সিন্ধু সভ্যতার উপর অমূল্য প্রত্নতাত্ত্বিক রিপোর্ট এবং মূল্যায়ন। বাংলাদেশের মত একটা পিছিয়ে থাকা দেশের এক অজ্ঞাত-অখ্যাত এবং ইঞ্জিনীয়ারিংয়ের মত ভিন্ন পেশার গবেষকের জন্য তার এই আগ্রহ এবং উৎসাহকে চঞ্চল বা আমার পক্ষে কখনই ভুলা সম্ভব না।
যাইহোক, সিন্ধু সভ্যতার সেই সময়ের বিচারে সর্বশেষ কিংবা সাম্প্রতিক বহু পরিমাণে তথ্য দ্বারা সমৃদ্ধ হয়ে এবং আমার সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে শামসুল আলম চঞ্চল ইংরাজীতে ১৯৯৪ সালে ‘দি ইন্ডাস সিভিলাইজেশন অ্যান্ড দি এরিয়ান্স’ (The Indus Civilization and the Aryans) নামে একটি প্রবন্ধ লিখে ভারত, পাকিস্তান, ব্রিটেন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পাঁচজন পণ্ডিতের নিকট মতামতের জন্য পাঠালেন। এরা হলেন, ভারতের কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস ও সংস্কৃতির অধ্যাপক বি এন মুখার্জী, ভারতের গোয়ায় অবস্থিত মেরিন আর্কিওলজি সেন্টারের পরামর্শক ডঃ এস আর রাও, পাকিস্তানের প্রত্নতত্ত্ব ও যাদুঘরের মহাপরিচালক ডঃ মোহাম্মদ রফিক মোগল, যুক্তরাজ্যের সেন্টার ফর সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ, কেমব্রিজের অধ্যাপক এফ আর অলচিন এবং যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাউথ এশিয়া রিজিওনাল স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক গ্রেগরি এল পোশেল।
এটা ছিল প্রকৃতপক্ষে আমাদের নূতন পথে যাত্রা শুরুর ঘটনা। চঞ্চলের লেখাটি পড়ে ১৯৯৪ সালের সেপ্টেম্বরে ডঃ মোগল চঞ্চলের কাজটিকে একটি সফল প্রয়াস হিসাবে উল্লেখ করে তার অফিসিয়াল প্যাডে একটি চিঠি লিখে পাঠান। তিনি যে শুধু কাজটিকে সফল প্রয়াস বললেন তা-ই নয়, অধিকন্তু তিনি তার পত্রে এটিকে যত শীঘ্র সম্ভব প্রকাশেরও তাগিদ দেন।* এটি ছিল আমাদের জন্য বিশাল ঘটনা। কারণ সেই সময়ে ডঃ মোগল শুধু যে পাকিস্তানের প্রত্নতত্ত্ব ও যাদুঘর বিভাগের প্রধান বা মহাপরিচালক ছিলেন তা-ই নয়, উপরন্তু তিনি সিন্ধু সভ্যতার উপর একজন শ্রেষ্ঠ বিশেষজ্ঞ পণ্ডিত বা অথরিটি হিসাবে বর্তমান বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত। যারা সিন্ধু সভ্যতার প্রত্নতত্ত্ব বা পুরাতত্ত্ব সম্পর্কে একটু ভাল রকম খোঁজখবর রাখেন তারা সবাই রফিক মোগলের মর্যাদা সম্পর্কে জানেন। তিনি যে শুধু মাঠ পর্যায়ে প্রচুর খনন কাজ তথা আবিষ্কার করেছেন তা-ই নয়, উপরন্তু সিন্ধু সভ্যতার প্রত্নতত্ত্বের ক্ষেত্রে নূতন ধারণাগত কাঠামো নির্মাণেও মৌলিক ভূমিকা রেখেছেন।
----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
* এই কেস-স্টাডির জন্য ডঃ মোগলের চিঠিটির বিশেষ গুরুত্ব আছে। সুতরাং
আগ্রহী পাঠকদের জন্য এখানে সেটা পুরাটা স্ক্যান করে দেওয়া হল।
----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
স্বাভাবিকভাবে মোগলের সমর্থনসূচক পত্র আমাদের জন্য বিরাট প্রেরণাদায়ী ঘটনা ছিল। তবে চঞ্চলের প্রবন্ধ এবং চিঠির প্রেক্ষিতে অন্য পণ্ডিতদের ক্ষেত্রে আমাদের আরও কিছু অভিজ্ঞতা ঘটেছিল যেগুলির আলোচনা এখানে আপাতত অনুল্লিখিত রইল।
যাইহোক, মোগলের চিঠি যে আমাদেরকে বিরাটভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল সে কথা বলেছি। এই চিঠি পাবার পর চঞ্চল এবং আমি যৌথভাবে একটি বই লিখবার প্রয়োজন অনুভব করি। অতঃপর ‘দি ইন্ডাস সিভিলাইজেশন অ্যান্ড দি এরিয়ান্স’-কে (The Indus Civilization and the Aryans) ভিত্তি করে আমরা যৌথভাবে ‘দি এরিয়ান্স অ্যান্ড দি ইন্ডাস সিভিলাইজেশন’ (The Aryans and the Indus Civilization) নামে ইংরাজীতে একটি বই লিখি। এটি ১৯৯৫ সালে ঢাকার ‘দিন-রাত্রি প্রকাশনী’ থেকে প্রকাশিত হয়। এবার আমরা পৃথিবীর জ্ঞানের জগতের দরজায় কড়া নাড়বার মত শক্তি পেলাম। অনেক কষ্ট করে নাম-ঠিকানা যোগাড় করে পাকিস্তান, ভারত, ব্রিটেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, ফ্রান্স, জার্মানী, ইটালী এবং ফিনল্যান্ড এই ৯টি দেশের বেশ কিছু সংখ্যক প্রত্নতত্ত্ববিদ এবং ঐতিহাসিক বা পণ্ডিতের কাছে আমরা আমাদের বইটি পাঠালাম।
এরপরের অভিজ্ঞতা কিছু ব্যতিক্রম বাদে নূতন করে তেমন ইতিবাচক যে ছিল না সে কথা বলা যায়। তবে একটা লক্ষ্যণীয় বিষয় হল সাধারণভাবে পাশ্চাত্য পণ্ডিতবর্গের আমাদের বক্তব্যকে গুরুত্ব না দিবার প্রবণতা। প্রাপ্তি স্বীকারের পর কেউ কেউ চিঠির উত্তর দিয়ে বই পড়ার পর মতামত জানাতে চাইলেও সেই মতামত আর কোনও কালেই আসে নাই। তবে বেশীর ভাগ পণ্ডিত বইটা পেয়েছেন কিনা সেটাও জানান নাই। জানি না তারা বই পেয়েছিলেন কিনা। বাংলাদেশের ডাক বিভাগের উপর আস্থা রাখাও তো কঠিন। তবে বই পাবার আগে চিঠিপত্র আদান-প্রদানে যে ২/১ জন পণ্ডিত উৎসাহ দেখিয়েছিলেন এবং এমনকি জিম জি শেফার (Jim G. Shaffer)-এর মত আমেরিকান পণ্ডিত তাদের মূল্যবান লেখা পাঠিয়ে আমাদেরকে সাহায্য করেছিলেন The Aryans and the Indus Civilization পাঠাবার পর তাদের কাছ থেকেও আর কোনও চিঠি কিংবা মতামত পাওয়া যায় নাই। অবশ্য বইটা পড়বার পর আমেরিকান পণ্ডিত গ্রেগরি এল পোশেল একটা চিঠি লিখে আমাদের বই থেকে যে অনেক কিছু জেনেছেন সেটা জানিয়ে আমাদেরকে একটা সৌজন্যমূলক চিঠি দেন। কোনও মতামত না দিলেও আমাদের মত অজ্ঞাত, অখ্যাত এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক গবেষকদের প্রচলিত ধারণা-বিরুদ্ধ বই পাঠের পর তার মাপের একজন প্রাতিষ্ঠানিক পণ্ডিত কর্তৃক এটুকু জানিয়ে একটা চিঠি লিখা আমাদের বক্তব্যের জন্য ইতিবাচক না হলেও আমাদের জন্য সম্মানের ছিল। আমাদেরকে কোনও মতামত না দিলেও আন্তরিকতার সঙ্গে একটা চিঠি লিখবার কষ্টটুকু তিনি করেছিলেন।
যাইহোক, ইউরোপীয় বা পাশ্চাত্য পণ্ডিতদের দিক থেকে ইতিবাচক সাড়া না পেলেও ভারতীয় পণ্ডিতদের দিক থেকে সাড়া পাবার আশা করেছিলাম। সে দিক থেকেও যে তেমন ইতিবাচক কিছু ছিল না সে কথা বলা যায়। আমার আলোচনাকে এ প্রসঙ্গে আর দীর্ঘায়িত করতে না চেয়ে আমি এ কথা বলি যে, ইংরাজী বইটার প্রকাশ এবং কিছু প্রচারের পর এবার আমরা বাংলায় এই বিষয়ের উপর একটা বই লিখবার প্রয়োজন অনুভব করি। এরপর চঞ্চল বইপত্র সংগ্রহ এবং পন্ডিতদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলবার জন্য ২০০০ সালে ভারতের রাজধানী দিল্লীতে যান। সেখানে জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ব্রজদুলাল বা (সংক্ষেপে) বি ডি চট্টোপাধ্যায়ের পরামর্শে ভারতের বিখ্যাত বেদ পণ্ডিত এবং ‘ভেদিক হরপ্পান্স’ (The Vedic Harappans) নামে সুবৃহৎ এবং সমৃদ্ধ গ্রন্থের লেখক ভগবান সিং এবং ভারতের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের তৎকালীন মহাপরিচালক আর এস বিশ্ট্-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। আর্য আক্রমণ তত্ত্ব বিরোধিতার প্রশ্নে তারা চঞ্চলের সঙ্গে মতৈক্য প্রকাশ করেন।
অবশ্য পরবর্তী সমযে আমাদের লিখা The Aryans and the Indus Civilization পড়বার পর ভগবান সিং তার লিখিত পত্রে বইটির উপর মতামত জানাতে গিয়ে আর্যরা যে সিন্ধু সভ্যতার অধিবাসী আমাদের এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত হলেও আমরা যেভাবে ধর্মসংস্কার আন্দোলনের ফসল হিসাবে ঋগ্বেদকে দেখেছি তার প্রতি তার আপত্তি জানিয়েছিলেন। তার অভিযোগ ছিল যে আমরা সিন্ধু সভ্যতা ধ্বংসের জন্য বৈদিক আন্দোলনকে দায়ী করেছি। আসলে আমাদের ব্যাখ্যা বা বক্তব্য অনুযায়ী নদী নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার ক্রমবর্ধমান ব্যর্থতার ফলে এমনিতে সিন্ধু সভ্যতা ধ্বংসের দিকে এগিয়ে চলেছিল। তবে নদী নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার ধ্বংস সাধন দ্বারা সিন্ধু সভ্যতার ধ্বংস ত্বরান্বিত করবার ক্ষেত্রে বৈদিক আন্দোলনের ভূমিকা চলে আসে। কিন্তু তার মতো পণ্ডিতদের মতে সিন্ধু সভ্যতার শুরু থেকেই বৈদিক ঋষিরা তার প্রতিষ্ঠায় নেতৃত্বমূলক বা উদ্যোগী ভূমিকা রাখবার অংশ হিসাবে মন্ত্র রচনা করেছিলেন। The Vedic Harappans-এ তিনি এই ব্যাখ্যা বা অভিমতই দিয়েছেন। সুতরাং তিনি সভ্যতার ধ্বংসে বৈদিক ঋষিদের কোন ভূমিকা দেখতে পান নাই। বরং এর জন্য তিনি জলবায়ু পরিবর্তনকেই দায়ী হিসাবে দেখেছেন।
আমার জানা মতে ভগবান সিং একজন মার্কসবাদী। সুতরাং তাকে হিন্দুত্ববাদী বলা কঠিন। কিন্তু ভারতের হিন্দুত্ববাদীরা যারা বর্তমানে পাশ্চাত্যের ঋগ্বেদ ব্যাখ্যার বিপরীতে আর্যদেরকে সিন্ধু সভ্যতার অধিবাসী বলছেন তারা ঋগ্বেদের যে ব্যাখ্যা দিচ্ছেন সেটা মূলত এই ব্যাখ্যার অনুরূপ কিংবা কাছাকাছি। ঋগ্বেদ ব্যাখ্যার এই দৃষ্টিভঙ্গীকে আমরা হিন্দুত্ববাদী বলতে পারি। এই দৃষ্টিভঙ্গীর নিকট ঋগ্বেদের মন্ত্র রচনার পিছনে নির্দিষ্ট কাল প্রেক্ষিত এবং সামাজিক তাড়না কিংবা সামাজিক সংঘাতের স্বরূপ খুঁজবার গুরুত্ব নাই। একইভাবে এই দৃষ্টিভঙ্গীর অধিকারী পণ্ডিতরা সিন্ধু সভ্যতা ধ্বংসে বৈদিক আন্দোলন তথা বৈদিক ঋষিদের দায়কেও মানতে রাজী নন। একই কারণে তারা নদী নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা কিংবা জলকপাট এবং বাঁধ ধ্বংসের উদ্দেশ্যে দেবতাদের নিকট প্রার্থনার জন্য রচিত কিংবা এগুলির ধ্বংসের বর্ণনায় রচিত মন্ত্রগুলির সহজ অর্থ কিংবা ব্যাখ্যাকেও এড়িয়ে যেতে কিংবা অস্বীকার করতে চান। এভাবে তারা ঋগ্বেদের মূল তাৎপর্যকেই গুলিয়ে ফেলেন।
পাশ্চাত্য পণ্ডিতদের দ্বারা উদ্ভাবিত আর্য আক্রমণ তত্ত্বকে গ্রহণ না করলেও হিন্দুত্ববাদীরা ঋগ্বেদের তেমন কোনও যুক্তিসঙ্গত বা বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিতে পারেন না তাদের এই দৃষ্টিভঙ্গীর কারণে। যাইহোক, এটি একটি দৃষ্টিভঙ্গী যা ক্রমবর্ধমান প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারের ফলে বিশেষত প্রত্নতাত্ত্বিকদের দ্বারা ভারতবর্ষে বহিরাগত আর্য আক্রমণ তত্ত্ব যত বেশী প্রত্যাখ্যাত কিংবা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে তত বেশী জায়গা করবার চেষ্টা করছে। তবে এই দৃষ্টিভঙ্গীর ত্রুটি এবং অবৈজ্ঞানিকতার কারণে ঋগ্বেদের বহু ধাঁধার উত্তর এই ধারার পণ্ডিতদের পক্ষে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। ফলে তাদেরকে ঋগ্বেদের ব্যাখ্যায় প্রভূত পরিমাণে গোঁজামিল দিতে কিংবা অস্পষ্টতা রাখতে হচ্ছে। এটা একটা কারণ যার ফলে তারা আজ অবধি আর্য আক্রমণবাদীদেরকে সফলভাবে মোকাবিলা করতে পারছেন না।
এটা ঠিক যে, একটি সামাজিক সংঘাতের কালে ঋগ্বেদের মূল অংশ রচিত হলেও তাতে তার পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী কালেরও কিছু মন্ত্রের স্থান পাওয়া অস্বাভাবিক নয়। যেহেতু বৈদিক আন্দোলন প্রচলিত বা বিদ্যমান ধর্মের সংস্কারের লক্ষ্য নিয়ে সংগঠিত হয়েছিল সেহেতু এখানে প্রচলিত ধর্মের অনেক প্রথা বা নিয়মকে যে মেনে নিতে হয়েছিল সেটা বোধগম্য। কারণ সাধারণত পুরাতন ধর্মের সংস্কারের মাধ্যমে নূতন ধর্ম প্রতিষ্ঠার সময় আদি ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব এবং তার প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করেই কাজটা করা হয়। আদি ধর্মের মূল জায়গা থেকে বিদ্যমানরা সরে গেছে এমন অভিযোগ করে কিংবা এ ধরনের অজুহাত দিয়েই সচরাচর ধর্মসংস্কারকরা কাজটা করেন। স্বাভাবিকভাবে এই প্রক্রিয়ায় পুরাতন বা সনাতন ধর্মের কিছু উপাদান, উপাখ্যান এবং এমনকি কিছু সংখ্যক মন্ত্রও সংস্কারের মাধ্যমে সৃষ্ট নূতন ধর্মে জায়গা করে নিতে পারে। কিন্তু তা দিয়ে একটা সংস্কারের মধ্য দিয়ে নূতন ধর্ম প্রতিষ্ঠার বিশেষ সামাজিক এবং কাল প্রেক্ষিতকে বুঝতে ভুল করলে বুঝবার ক্ষেত্রে মারাত্মক বিচ্যুতি ঘটে। হিন্দুত্ববাদীদের ঋগ্বেদ ব্যাখ্যার ক্ষেত্রেও এই বিচ্যুতি ঘটেছে বলে আমি মনে করি। যে কারণে তারা প্রতিপক্ষের, বিশেষত আর্য আক্রমণ তত্ত্ববাদীদের, অনেক প্রশ্নের উত্তর দিতে সক্ষম নন। বস্তুত একটি সমাজের ধর্ম সংস্কার আন্দোলনের ফসল হিসাবে ঋগ্বেদকে না দেখে পাশ্চাত্যের পণ্ডিতরা যেমন ঋগ্বেদের অপব্যাখ্যা দিয়েছেন তেমন হিন্দুত্ববাদীরাও সেভাবে না দেখায় ঋগ্বেদের সঠিক ব্যাখ্যা দিতে অক্ষম হয়েছেন।
যাইহোক, দীর্ঘদিন ধরে এবং দীর্ঘ প্রস্তুতি নিয়ে চঞ্চল এবং আমি যৌথভাবে লিখলাম ‘আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা’। এতদিনে পাণ্ডুলিপি হিসাবে রয়ে যাওয়া ১৯৯০-এ লিখা ‘ভারত-ইতিহাসের সূত্র সন্ধান’ও বহুল পরিমাণে কাজে লাগল। ততদিনে আমাদের হাতে সিন্ধু সভ্যতার প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারের সমৃদ্ধ তথ্য ভাণ্ডার। একদিকে আমাদের তথ্য ভাণ্ডারের সমৃদ্ধি এবং অপর দিকে আমাদের মাতৃভাষা বাংলায় লিখিত হওয়ায় ‘আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা’ নামক গ্রন্থটি নিয়ে আমরা মোটামুটি সন্তুষ্ট হলাম।
এখানে প্রসঙ্গক্রমে বলা যায় যে, বাংলাদেশ থেকে ‘আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা’ প্রকাশের পূর্বে পশ্চিম বঙ্গ থেকে প্রকাশের চেষ্টা করে আমি ব্যর্থ হয়েছিলাম। গ্রন্থটি প্রকাশের জন্য সেখানে আগ্রহী প্রকাশক না পাবার পর এটি বাংলাদেশ থেকে প্রকাশের সিদ্ধান্ত নিই। ততদিনে (২০০২ সালে) মূলত আমার উদ্যোগে প্রতিষ্ঠা করেছি প্রকাশনী সংস্থা ‘ব-দ্বীপ প্রকাশন’। গ্রন্থটি ঢাকা থেকে ব-দ্বীপ প্রকাশন কর্তৃক প্রকাশিত হল ২০০৩ সালের জানুয়ারীতে।
আমরা এইটুকুতে থেমে থাকি নাই। ২০০৬ সালে ওয়েবসাইট ‘বঙ্গরাষ্ট্র’ প্রতিষ্ঠা করলে সেখানে ইংরাজী গ্রন্থ The Aryans and the Indus Civilization এবং বাংলা গ্রন্থ ‘আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা’ প্রকাশিত হয়। এভাবে আগ্রহী অনলাইন পাঠকদের গ্রন্থ দুইটি পাঠের সুযোগ হয়। এছাড়া চঞ্চল এবং আমার যৌথভাবে লিখা ইংরাজী প্রবন্ধ Rediscovering Indus Civilization and Aryans: Journey to Our Renaissance ওয়েবসাইট বঙ্গরাষ্ট্রে ২০১২ সালের ৯ সেপ্টেম্বর তারিখে প্রকাশিত হয় এবং পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের পণ্ডিত, অধ্যাপক এবং গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন ব্যক্তির নিকট তার কপি অথবা লিঙ্ক দেওয়া হয়। এটির বংলা ‘নূতন দৃষ্টিতে সিন্ধু সভ্যতা ও আর্যজন : আমাদের নবজাগৃতির উদ্বোধন’ বঙ্গরাষ্ট্রে ২০১৫ সালের ১৯ জুলাইতে প্রথম প্রকাশিত হয়। মোট কথা আমরা থেমে থাকি নাই। দেশে এবং দেশের বাইরে বিভিন্ন সময়ে আমরা ইতিহাসের নামে এক বিরাট মিথ্যাকে নাকচ করে ইতিহাসের সত্যকে তুলে ধরবার কাজ করে আসছি। যদি ১৯৯০ থেকে ধরা যায় তবে আমরা ২০১৮ পর্যন্ত ২৭ বৎসরের অধিকাল কিংবা প্রায় ২৮ বৎসর ধরে একটা সত্যকে প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করে আসছি।
এই সমগ্র সংগ্রামে অনেক ঘটনা আছে। বিশেষত কিছু সংখ্যক ভারতীয় পণ্ডিতের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংলাপ যেমন হয়েছে তেমন কিছু সংখ্যক পণ্ডিতের সঙ্গে পত্রালাপও হয়েছে। অনেক বিরোধিতার ইতিহাস যেমন আছে তেমন বিভিন্ন ধরনের সমর্থন এবং উৎসাহের ইতিহাসও আছে। কিন্তু যেখান থেকে যতটুকু সমর্থন পাওয়া যাক বাস্তব হচ্ছে ভারতবর্ষ তথা ভারতীয় উপমহাদেশে আর্য আক্রমণ তত্ত্বের মত একটা হাস্যকর, উদ্ভট এবং মিথ্যা তত্ত্ব আজও সমগ্র উপমহাদেশের জ্ঞানের জগৎকে অধিকার করে আছে। শুধু তা-ই নয়, এটা এখনও পৃথিবী ব্যাপী আর্য সংক্রান্ত যাবতীয় তত্ত্বের মূল ভিত্তি হয়ে আছে। অথচ বিগত প্রায় শতাব্দী কালের সমস্ত প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার ভারতবর্ষে বহিরাগত আর্য আক্রমণ তত্ত্বকে নাকচ করে দিয়েছে। বস্তুত এখন প্রত্নতত্ত্বে আর্য আক্রমণ তত্ত্বের কোনও গুরুত্বই নাই। কারণ প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারগুলি দ্বারা বেশ কিছুকাল যাবত নিশ্চিতভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে, এ ধরনের কোনও বহিরাক্রমণ বা বহিরাগমনই যে সময়টাতে আর্য অভিগমন ঘটবার কথা বলা হয় (খ্রীষ্টপূর্ব ১২০০ থেকে খ্রীষ্টপূর্ব ১৫০০ সাল পর্যন্ত সময় সীমার মধ্যে) সে সময়টাতে ঘটে নাই। শুধু তা-ই নয় বহিরাগমন ঘটলে ভারতবর্ষের উত্তর এবং পশ্চিম অঞ্চলে যে ধরনের নৃতাত্ত্বিক ছেদের প্রত্নতাত্ত্বিক চিহ্ন পাওয়া যেত সেটা সাড়ে ছয় হাজার বছর পূর্বকাল থেকে শুরু করে খ্রীষ্টপূর্ব অষ্টম শতাব্দী কাল পর্যন্ত পাওয়া যায় না। এই কারণে অনেক প্রত্নতত্ত্ববিদ ইদানীং ভারতবর্ষে আর্য বা যে নামই দেওয়া যাক এ ধরনের কোনও বহিরাগমন তত্ত্বকেও আর মেনে নিতে পারছেন না। তবু তাকে প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান ও শিক্ষার জগৎ থেকে ছুঁড়ে ফেলা যাচ্ছে না। শুধু তা-ই নয়, আজ অবধি এটাই ভারতবর্ষ তথা ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাস ব্যাখ্যার ভিত্তি হয়ে আছে। কিন্তু কেন? এখন সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজা যাক।
(২) পাশ্চাত্য এবং ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাতিষ্ঠানিক বুদ্ধিবৃত্তির সমস্যা : সাম্রাজ্যবাদ এবং উপনিবেশবাদের ভূমিকা
আধুনিক সভ্যতার উদ্ভব এবং বিস্তার মূলত পশ্চিম ইউরোপ তথা পাশ্চাত্য থেকে। মানব সভ্যতায় আধুনিক কালে যে বিপুল অগ্রগতি সাধিত হয়েছে তার জন্য সর্বাধিক কৃতিত্ব পশ্চিম ইউরোপকে দিতে হবে। শুধু যে বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন এবং আবিষ্কারের পিছনে পাশ্চাত্যের অসংখ্য জ্ঞান সাধকের নিরলস ভূমিকা রয়েছে তা-ই নয়, অধিকন্তু জনকল্যাণমুখী সমাজ ও রাষ্ট্র নির্মাণের সাধনা পাশ্চাত্যের অসংখ্য সাধক এবং যোদ্ধার জীবন ব্যাপী প্রয়াস দ্বারা সমৃদ্ধ হয়েছে। আধুনিক গণতান্ত্রিক এবং সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব এবং রাষ্ট্র চিন্তার উদ্ভবও পাশ্চাত্য থেকে। মানুষের অধিকার এবং নারী-পুরুষের সমাধিকার সংক্রান্ত আধুনিক কালের ধারণাগুলির জন্মস্থানও মূলত পাশ্চাত্য। বিজ্ঞান, প্রযুক্তি এবং জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় পাশ্চাত্যের অবদান অতুলনীয়। সুতরাং আজকের পৃথিবীর মানব জাতি তার সামগ্রিক অগ্রগতির জন্য পাশ্চাত্যের নিকট ঋণী।
কিন্তু এই ঋণ স্বীকারের সময় প্রাচ্যবাসী হিসাবে আমরা যদি আমাদের মত পাশ্চাত্য বহির্ভূত সমাজগুলির প্রতি পাশ্চাত্যের নেতিবাচক ভূমিকাকে ভুলে যাই তাহলে মারাত্মক ভুল করব। রেনেসাঁ বা নবজাগরণের মধ্য দিয়ে অলোকবাদ এবং অন্ধত্বজীবী ধর্মের শাসন থেকে মুক্ত হয়ে পশ্চিম ইউরোপ আধুনিক সভ্যতা নির্মাণের পথে যাত্রা শুরু করে। এই যাত্রাপথ তাকে বিশ্বজয়ের পথে নিল। এ ক্ষেত্রে একটি উল্লেখ্য ঘটনা হচ্ছে ১৪৯২ খ্রীষ্টাব্দে ক্রীস্টোফার কলম্বাস কর্তৃক আমেরিকা মহাদেশ আবিষ্কার। কলম্বাস স্পেনের পক্ষ থেকে আমেরিকার মাটিতে পা রাখেন। স্পেনের পথ ধরে পর্তুগাল, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ইত্যাদি ইউরোপীয় রাষ্ট্র যার যার মত করে আমেরিকা মহাদেশ দুইটির উপর দখল নিল এবং সেখানে নিজেদের উপনিবেশ স্থাপন করল। পশ্চিম ইউরোপের রাষ্ট্রগুলি এর বাইরেও ক্রমে নিজেদের উপনিবেশ তথা সাম্রাজ্য বিস্তার করল সমগ্র পৃথিবীর বিশাল ভূভাগে। আগে পিছে থাইল্যান্ড, জাপানের মত ২/৪টি দেশ বাদে প্রায় সমগ্র এশিয়া মহাদেশ, আফ্রিকা এবং অস্ট্রেলিয়া মহাদেশ পাশ্চাত্যের বিভিন্ন রাষ্ট্রের অধীনস্থ হল। এশিয়া মহাদেশে অবস্থিত বিরাট এবং সুপ্রাচীন সভ্যতার লীলাভূমি ভারতবর্ষ দুই শত বৎসরের জন্য ব্রিটেনের অধীনস্থ হল। এশিয়ার বিশাল এবং প্রাচীন সভ্যতার অধিকারী চীন দেশও কিছু কালের জন্য প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষ ভাবে বিভিন্ন ইউরোপীয় রাষ্ট্রের অধিকারভুক্ত কিংবা নিয়ন্ত্রণাধীন হল। পশ্চিম ইউরোপের পথ ধরে পূর্ব ইউরোপের রাশিয়াও পূর্ব দিকে মধ্য এবং পূর্ব এশিয়ায় তার সাম্রাজ্যের বিস্তার ঘটালো। ক্রমে তা পৌঁছালো প্রশান্ত মহাসাগরীয় উপকূল পর্যন্ত।
বিশেষত পশ্চিম ইউরোপের বিশ্বব্যাপী এই জয়যাত্রার একপাশে যেমন রয়েছে সভ্যতার জয়যাত্রা তেমন অপর পাশে রয়েছে অপরিমেয় অমানবিকতা এবং অগণিত মানুষের ধ্বংস এবং উৎসাদনের করুণ ইতিহাস। উপনিবেশিক ইউরোপীয়দের হিংস্র থাবায় দেশের পর দেশ বিরান এবং জনশূন্য হয়ে গেছে, আমেরিকার আজটেক অথবা ইনকা সভ্যতার মত সভ্যতাগুলি ধ্বংস এমনকি বিলুপ্ত হয়েছে, এবং সেই সঙ্গে পৃথিবীর বহু দেশের জাতির পর জাতি ধ্বংস এবং বিলুপ্ত হয়েছে। দূরে যাবার দরকার কী? আমাদের এই বঙ্গ বা বাংলার অভিজ্ঞতার কথাই বলা যাক। ১৭৫৭ খ্রীষ্টাব্দে পলাশীর যুদ্ধে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার নওয়াব সিরাজউদ্দৌলাকে পরাজিত করে ইংরেজরা বাংলার রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করার মাত্র কয়েক বৎসরের মধ্যে ১৭৭০ খ্রীষ্টাব্দে এক ভয়ঙ্কর মহাদুর্ভিক্ষ (বাংলা ছিয়াত্তরের মন্বন্তর) সৃষ্টি করে তাদের নিজেদেরই হিসাব অনুযায়ী (গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংসের হিসাব) তৎকালীন বাংলার তিন কোটি মানুষের মধ্যে এক কোটি মানুষের মৃত্যু ঘটালো। বহিরাগত মুসলমান আক্রমণকারীরা ভারত এবং বঙ্গে বিপুল ধ্বংস এবং হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। কিন্তু সেটা দীর্ঘ সময় ধরে এবং সেটাও প্রধানত উত্তর এবং পশ্চিম ভারতে। তাদের সকল বর্বরতা সত্ত্বেও বঙ্গে তাদের প্রায় সাড়ে পাঁচশত বৎসর শাসনকালে এমন একটি ভয়ঙ্কর দুর্ভিক্ষের কোনও উদাহরণই নাই। এমনকি ব্রিটিশ শাসনের পূর্ব পর্যন্ত বঙ্গ বা বাংলার সমগ্র অতীত ইতিহাসে উল্লেখ করবার মত একটি বড় ধরনের দুর্ভিক্ষ ঘটবার কথাও আমাদের জানা নাই।
ইংরেজ শাসকরা শুধু যে জনসংখ্যার বিপুল অংশকে ধ্বংস করল তাই নয়, অধিকন্তু উন্মত্ত লুণ্ঠন এবং বিভিন্ন কর্মনীতির মাধ্যমে বাংলার বিপুলভাবে সমৃদ্ধ কুটীর শিল্পকেও ধ্বংস করে বাংলার অর্থনীতির মেরুদণ্ডকে মূলত ভেঙ্গে ফেলল। ইংরেজ শাসনের পূর্বকাল পর্যন্ত সমগ্র পৃথিবীর বিস্ময় বাংলার মসলিন বস্ত্র অতীতের হারিয়ে যাওয়া একটি উপাখ্যানে পরিণত হল। এভাবে একটি বিপুলভাবে শিল্প ও কৃষি সমৃদ্ধ দেশকে সম্পূর্ণরূপে পশ্চাৎপদ কৃষি নির্ভর এবং শিল্পের ক্ষেত্রে বিদেশ নির্ভর তথা ব্রিটেন নির্ভর দেশে পরিণত করা হল। পুরাপুরি কৃষি নির্ভর হয়ে বঙ্গ পরিণত হল ব্রিটেনের শিল্পপণ্যের কাঁচামাল যোগাবার আর শিল্পপণ্য ক্রয় করবার মুক্ত বাজারে। ভারতবর্ষ থেকে ১৯৪৭ খ্রীষ্টাব্দে বিদায় নিবার পূর্বে ইংরেজরা বঙ্গ এবং বাঙ্গালী জাতির প্রতি আর একটি গণহত্যা উপহার দিল। সেটা হল ১৯৪৩ খ্রীষ্টাব্দে ইচ্ছাকৃতভাবে এবং কৃত্রিম উপায়ে সৃষ্টি আর একটি মহাদুর্ভিক্ষ, যাতে করে তৎকালীন বঙ্গের ৬ কোটির কিছু বেশী মানুষের মধ্যে (অবিভক্ত বঙ্গে ১৯৪১-এর লোকগণনার হিসাব অনুযায়ী জনসংখ্যা ছিল ৬,০৩,০৬,৫২৬) প্রায় ৩০ লক্ষ মানুষের মৃত্যু ঘটে। এই দুই মহাদুর্ভিক্ষের মাঝখানের কালটাতে ব্রিটিশ সভ্য শাসকরা বঙ্গকে আরও কয়েকটি ছোটখাটো এবং বিশেষত আঞ্চলিক পর্যায়ে বিভিন্ন দুর্ভিক্ষ উপহার দিয়েছিল। এই হচ্ছে বঙ্গে ব্রিটিশ সভ্যতার অনেক অবদানের একটি। কুটীর শিল্পের উৎসাদনের কথা তো ইতিপূর্বেই উল্লেখ করেছি। সেটি হচ্ছে ব্রিটিশদের অপর আরেকটি উল্লেখযোগ্য অবদান। এ দেশ এবং ভারতীয় উপমহাদেশের সমাজ ও সভ্যতার ধ্বংস এবং অধঃপতনের জন্য ব্রিটিশদের আরও অনেক অবদানের কথা বলা যায়। তবে সে সব প্রসঙ্গ এখন থাক।
পাশ্চাত্য সভ্যতার অবদানের কথা উল্লেখের সময় উপরে উল্লিখিত এই কথাগুলিও কি স্মরণে রাখা উচিত নয় বিশেষত প্রাচ্য সমাজগুলির প্রতি পাশ্চাত্যের ভূমিকার স্বরূপ মনে করবার জন্য? পাশ্চাত্য ভূমিতে না দাঁড়িয়ে একবার যদি আমেরিকার আদিবাসী রেড ইন্ডিয়ানদের ভূমিতে দাঁড়িয়ে আমরা পাশ্চাত্যের ভূমিকাকে বিচার করি তখন কোন্ সত্য সামনে চলে আসবে? বলা হয়ে থাকে ইউরোপীয়রা যাবার পূর্বে দুই আমেরিকা মহাদেশে পাঁচ থেকে দশ কোটি রেড ইন্ডিয়ান ছিল। তার মধ্যে যদি ৮০% থেকে ৯০% মানুষকে ধ্বংস করা হয়, যেটা করা হয়েছিল, তবে কয়জন টিকে থাকে? এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনসংখ্যা প্রায় ৩২ কোটি ৬৫ লক্ষ। তার মধ্যে রেড ইন্ডিয়ানদের সংখ্যা সর্বসাকুল্যে ৫০ লক্ষের কিছু বেশী। এই হচ্ছে নিজ ভূমিতে একটা জনগোষ্ঠীর বিনাশের সামান্য একটু চিত্র। সাম্রাজ্যবাদী এবং উপনিবেশবাদী চরিত্রে আবির্ভূত পাশ্চাত্য সভ্যতার এ ধরনের মানুষ ধ্বংসী, সম্পূর্ণ জনগোষ্ঠী ও জাতি বিনাশী এবং মানবতা বিরোধী কর্মকাণ্ডের উদাহরণ দিয়ে শেষ করা যাবে না। কয়টা বলব? সেগুলি এখন থাক। আজকের আলোচনার বিষয়বস্তু সেসব নয়। তবে পাশ্চাত্যের এ ধরনের ধ্বংসাত্মক ও মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডের সঙ্গেই আজকের এই আলোচনা সম্পর্কিত।
আমাদেরকে বুঝতে হবে যে, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর বাস্তবতার চাপে পাশ্চাত্যের রাষ্ট্রগুলি প্রাচ্যের দেশগুলিতে ক্রমে তাদের প্রত্যক্ষ শাসনের অবসান ঘটালেও তারা আমাদের মত সমাজ ও দেশগুলির উপর তাদের সাম্রাজ্যবাদী এবং উপনিবেশবাদী রাষ্ট্র ব্যবস্থা চাপিয়ে দিয়ে গেছে। বস্তুত বিদায় নিবার আগে তারা এখানে তাদের রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে অক্ষুণ্ন রাখবার প্রয়োজনে এখানে তাদের তৈরী অধস্তন শ্রেণীর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করেছে। এভাবে তারা বিদায় নিলেও তাদের স্বার্থ রক্ষিত হল। কথিত স্বাধীন রাষ্ট্রগুলি পাশ্চাত্যের শক্তিধর রাষ্ট্রগুলির স্বার্থের প্রয়োজনে তৈরী করে দেওয়া ছকে আবদ্ধ হয়ে পথ চলতে বাধ্য হল।
ভারতীয় উপমহাদেশের দেশগুলির দিকে দৃষ্টি দিলেই এটা স্পষ্ট হয় যে, এই দেশগুলি স্বাধীনতার ছদ্মবেশে কীভাবে সাম্রাজ্যবাদ-উপনিবেশবাদের প্রায় সকল বৈশিষ্ট্য এবং ধারাবাহিকতাকে আজ অবধি তাদের আইন-আদালত-পুলিশ-প্রশাসন এবং প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাসহ তাদের সমগ্র রাষ্ট্র ব্যবস্থা এবং অর্থনীতি, শিক্ষা এবং সংস্কৃতিসহ সকল ক্ষেত্রে বহন করে চলেছে। সাম্রাজ্যবাদ-উপনিবেশবাদের এই নবতর রূপকে নয়া উপনিবেশবাদ বলা যেতে পারে।
এটা ঠিক যে ১৯৪৭ খ্রীষ্টাব্দে ব্রিটিশ শাসকরা তাদের প্রত্যক্ষ শাসনের অবসান ঘটিয়ে এই উপমহাদেশ থেকে বিদায় নিয়েছে। ফলে ব্রিটিশদেরকে এখন আর প্রত্যক্ষভাবে এখানকার রাষ্ট্রগুলির শাসন ক্ষমতায় দেখা যায় না। কিন্তু তাতে কী? দুই শত বৎসর ধরে যে উপনিবেশিক দমন, লুণ্ঠন, শোষণ এবং শাসনের ব্যবস্থা তারা এখানে নির্মাণ করেছিল এবং যাবার সময় চাপিয়ে দিয়ে গিয়েছিল সেটাই প্রায় অপরিবর্তিত রূপে উপমহাদেশের রাষ্ট্রগুলিতে বিশেষত ভারত, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশে বিদ্যমান রয়েছে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানভুক্ত পূর্ব বঙ্গে জাতীয় মুক্তি যুদ্ধ ঘটলেও ভারতের ভূমিকা এবং আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের কারণে সেটা যেমন সম্পূর্ণতা পায় নাই তেমন পাকিস্তানের মাধ্যমে ব্রিটিশ উপনিবেশিক ব্যবস্থার যে ধারাবাহিকতা ছিল তা থেকেও এ দেশ মুক্তি লাভ করে নাই। আজকের স্বাধীন হিসাবে কথিত গণ-প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রটিও ভারত এবং পাকিস্তানের মতই ব্রিটিশ উপনিবেশিক ব্যবস্থার ধারাবাহিকতা মাত্র। অর্থাৎ রাষ্ট্রের চরিত্র বিচারে ভারতবর্ষের কোনও রাষ্ট্রই স্বাধীন তথা প্রকৃত অর্থে জাতীয় হয়ে উঠতে পারে নাই। সবই বিদেশী, বহিরাগত এবং পরশাসনমূলক আধিপত্য ও শাসনের ধারাবাহিকতা। যে আইনের শাসন আজ অবধি উপমহাদেশের জনগণের ঘাড়ের উপর চেপে বসে আছে তা প্রকৃতপক্ষে উপনিবেশিক আইনের শাসন ছাড়া আর কিছুই নয়।
এভাবে আমরা আজ অবধি পাশ্চাত্য কেন্দ্রিক বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদী এবং উপনিবেশবাদী ব্যবস্থার জালে আবদ্ধ হয়ে আছি। এক সময় ব্রিটেন ছিল পাশ্চাত্য কেন্দ্রিক বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদ এবং উপনিবেশবাদের প্রধান কেন্দ্র। ১৯৪৫ খ্রীষ্টাব্দে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সমাপ্তির পর থেকে সেই কেন্দ্র হিসাবে জায়গা নিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। উপমহাদেশে ব্রিটেনের প্রত্যক্ষ উপনিবেশিক শাসনের অবসান ঘটে ১৯৪৭ সালে। সুতরাং উপমহাদেশের প্রেক্ষিতে তা মার্কিন কেন্দ্রিক উপনিবেশবাদী-সাম্রাজ্যবাদী বিশ্ব ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত হয় ১৯৪৭ থেকে।
এখন প্রশ্ন আসা সঙ্গত যে ব্রিটিশ শাসন অবসানের এতকাল পরেও আমরা কেন পরোক্ষ রূপে বিরাজমান পাশ্চাত্য উপনিবেশিক আধিপত্যের জাল ছিন্ন করে মুক্ত হতে পারি নাই। কেন তার রাষ্ট্র ব্যবস্থা এবং আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার জঞ্জাল আজও টেনে নিয়ে চলেছি? উপমহাদেশের অন্যান্য রাষ্ট্রের প্রসঙ্গ থাক, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে একটা রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা যুদ্ধের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের কবলমুক্ত হয়ে পূর্ব বঙ্গের বুকে বাংলাদেশ-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু তারপরেও ভারতীয় উপমহাদেশের আর সকল রাষ্ট্রের মত সেই ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসনের প্রায় সকল উত্তরাধিকার আমরা আজও বহন করে চলেছি।
কিন্তু কেন? এটা ঠিক যে, পাশ্চাত্য কেন্দ্রিক যে বিশ্বব্যবস্থায় আমরা বসবাস করছি সেখানে মার্কিন কেন্দ্রিক পাশ্চাত্যের সামরিক এবং অর্থনৈতিক শক্তি একটা বড় ফ্যাক্টর পাশ্চাত্যের এই আধিপত্যমূলক ব্যবস্থা রক্ষার ক্ষেত্রে। সামরিক শক্তির জোরে যে ব্যবস্থা একবার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সামরিক শক্তি যে তার অস্তিত্ব বা স্থায়ীত্বের একটা বড় শর্ত তাতে কোনও সন্দেহ নাই। কিন্তু শুধু কি সামরিক শক্তির জোরে কিংবা শুধু অর্থনৈতিক শক্তির জোরে আমাদের মত দেশগুলিকে এতকাল পদানত রাখা যাচ্ছে? তাও আবার এত দূর থেকে এবং প্রত্যক্ষ সামরিক উপস্থিতি ব্যতিরেকেই?
এর একটা উত্তর আছে ব্রিটিশ উপনিবেশবাদীদের দ্বারা প্রবর্তিত ব্যবস্থার সুবিধাভোগী এবং অধস্তন শ্রেণীগুলির নিকট শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করার মধ্যে। এই শ্রেণীগুলিই স্বাধীনতার সাইন বোর্ড ঝুলিয়ে উপনিবেশিক ব্যবস্থা রক্ষা এবং পরিচালনার দায়িত্ব পালন করছে। এভাবে উপমহাদেশের রাষ্ট্রগুলি আজ অবধি কখনও প্রত্যক্ষভাবে এবং কখনও পরোক্ষভাবে পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদ এবং উপনিবেশবাদের আউটপোস্ট বা ফাঁড়ি হিসাবে ভূমিকা পালন করছে। অর্থাৎ এই রাষ্ট্রগুলি এখানে পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদী এবং উপনিবেশবাদী ব্যবস্থার সহায়ক শক্তি হিসাবে কাজ করছে। এবং এরই সঙ্গে বিজড়িত রয়েছে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ-উপনিবেশবাদ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত এবং রেখে যাওয়া অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এবং সেই সঙ্গে এই ব্যবস্থার সুবিধাভোগী শ্রেণীগুলি।
কিন্তু রাষ্ট্র কিংবা অর্থনৈতিক ব্যবস্থার দিকটাকে বুঝা খণ্ডিত হবে যদি একই সঙ্গে আমরা সাম্রাজ্যবাদ এবং উপনিবেশবাদের বুদ্ধিবৃত্তিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার দিকটাকে বুঝতে না পারি। অর্থাৎ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী-উপনিবেশবাদীরা এ দেশ শাসনের সহায়ক হিসাবে এমন একটি শিক্ষিত শ্রেণী গড়ে তুলেছিল যারা ব্রিটিশ শাসনকে যথার্থতা অর্থাৎ নৈতিকতা দিবার কাজ করে যাবে। সামরিক শক্তির জোরে একটা দেশ দখল করা যেতে পারে। কিন্তু শুধু সামরিক শক্তি দিয়ে একটা দেশকে দীর্ঘ কাল শাসন এবং পদানত রাখা সুকঠিন এবং এমনকি অসম্ভব হতে পারে যদি না সেই শাসনের সপক্ষে শাসিতদের মধ্যে মানসিক অনুমোদন তথা চেতনা গড়ে তুলা না যায়। অর্থাৎ শাসিতদের মধ্যে এই বোধ জাগাতে হয় যে শাসকরা সবদিক থেকেই শ্রেষ্ঠ এবং তারা শাসিতদের কল্যাণ এবং উন্নতির জন্য শাসিত জাতির শাসন ভার হাতে নিয়েছে। যদি আমেরিকা কিংবা অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের মত উপমহাদেশের জাতিগুলিকে বিলুপ্ত করে এখানে ব্রিটিশদের বাসভূমি প্রতিষ্ঠা করা যেত যেমনটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা এবং অস্ট্রেলিয়া কিংবা নিউজিল্যান্ডে করা গেছে তাহলে আর অধীনস্থ জাতি বা জনগোষ্ঠীর চেতনা বা বুদ্ধিবৃত্তি নিয়ন্ত্রণের সমস্যা নিয়ে ব্রিটিশ বা ইংরেজদেরকে ভাবতে হত না। কিন্তু ভারতবর্ষের মানুষ এত পিছিয়ে পড়া ছিল না যে তারা বিলুপ্ত হবে। সুতরাং ব্রিটিশরা তাদের বিনাশ করে ভূমি দখলের উপর গুরুত্ব না দিয়ে তাদের শ্রমশক্তি লুণ্ঠন এবং তাদের দ্বারা উৎপাদিত সম্পদ দখল বা লুণ্ঠনের উপর গুরুত্ব দিয়েছিল। তার জন্য তারা যেমন গড়ে তুলতে চেয়েছিল পরদেশী চরিত্রের লুণ্ঠনমূলক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা তেমন এই ব্যবস্থা পরিচালনা এবং রক্ষার জন্য প্রতিষ্ঠা করেছিল পরদেশী চরিত্রের দমন মূলক রাষ্ট্র ব্যবস্থা। আর সেই সঙ্গে তারা গড়ে তুলল শুধু এই উপমহাদেশের শাসন কার্যে সহায়ক শিক্ষিত শ্রেণী গড়বার জন্য নয়, অধিকন্তু উপমহাদেশের সমগ্র শিক্ষিত জনগোষ্ঠী এবং সেই সঙ্গে সমগ্র জনগোষ্ঠীকেও দাসত্বের চেতনায় ধরে রাখবার জন্য শিক্ষা ব্যবস্থা। সুতরাং ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের সহায়ক হিসাবেই তৈরী করা হল প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যবস্থা এবং এই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যবস্থার ছাঁচে ফেলে তৈরী করা হল এমন শিক্ষিত শ্রেণী যারা হবে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী-উপনিবেশবাদীদের অন্ধ অনুসারী এবং দাস। এই শিক্ষিত শ্রেণী হবে শুধু যে বাস্তবে দাস তা-ই নয়, মন এবং মননেও দাস। এভাবে এই দাসদের দিয়ে গড়ে উঠল আর একটি শ্রেণী — দাস শিক্ষিত তথা দাস বুদ্ধিজীবী শ্রেণী। এই দাস বুদ্ধিজীবীদের শীর্ষে থাকল উপমহাদেশের প্রাতিষ্ঠানিক পণ্ডিতবর্গ। ব্রিটিশ রাজনীতিক এবং ব্রিটিশ ভারতে শিক্ষানীতির প্রতিষ্ঠাতা মেকলে এমন একটা শিক্ষিত শ্রেণী গড়ে তুলবার কথাই বলেছিলেন যারা হবে রঙ এবং চেহারায় ভারতীয় কিন্তু রুচিতে ও মননে ইংরেজ বা ইউরোপীয়। বাস্তবে এরা হবে ব্রিটিশদের দাস। অভিজ্ঞতা কী বলে? এই দাসদের দ্বারাই কি উপমহাদেশের জ্ঞান বা বিদ্যা চর্চার জগৎ তথা বুদ্ধিবৃত্তির জগৎ আজ অবধি অধিকৃত নয়? আর বুদ্ধিবৃত্তিই তো মানুষকে চালিত করে।
আমাদের এই ভূখণ্ড বাংলাদেশসহ সমগ্র উপমহাদেশের বুদ্ধিবৃত্তি তথা চেতনার একটা সমস্যা তুলে ধরবার জন্য আমার এই আলোচনার অবতারণা। এই আলোচনার গভীরে যাওয়ার জন্য আমি ঋগ্বেদ প্রসঙ্গে আলোচনা করলাম, যা আমার জন্য প্রকৃতপক্ষে একটা কেস-স্টাডি। ব্রিটিশ তথা পাশ্চাত্য আধিপত্য এবং ভারতবর্ষের পরদাসত্বের মধ্যকার সম্পর্ক জ্ঞানের জগতের সত্যান্বেষাকেও কীভাবে বিপথগামী করেছে সেই সত্যকে এই কেস-স্টাডির সাহায্যে তুলে ধরতে চেয়েছি। বস্তুত এই কেস-স্টাডি যে ঘটনাকে দৃশ্যমান করে তা হল পাশ্চাত্য পাণ্ডিত্য তথা পণ্ডিতবর্গের অনেকের বুদ্ধিবৃত্তির মান কিংবা চরিত্রের স্বরূপ এবং সেই সঙ্গে উপমহাদেশের প্রতিষ্ঠিত পণ্ডিতদের এক বৃহদাংশের বুদ্ধিবৃত্তিরও সাধারণ মান কিংবা চরিত্র।
৩। পাশ্চাত্য পাণ্ডিত্যের মূর্খতা কিংবা বদমায়েশী এবং উপমহাদেশীয় পাণ্ডিত্যের দাসত্ব
বহুদিন পর্যন্ত আমি এ কথা ভেবে অবাক হতাম যে পাশ্চাত্যের অত বড় বড় পণ্ডিত কীভাবে ঋগ্বেদের সহজ সত্যকে বুঝতে পারেন নাই! প্রথম দিকে ভাবতাম যে হয়ত ভিন্ন সমাজের এবং ভাষার মানুষ বলে হয়ত ঋগ্বেদের খুব সহজবোধ্য হলেও বিষয়গুলি তাদের নিকট দুর্বোধ্য হয়েছিল, যে কারণে ঋগ্বেদের এই ভ্রান্ত ব্যাখ্যা। কিন্তু এই সিদ্ধান্ত থেকেও এই সিদ্ধান্ত চলে আসে যে পাশ্চাত্য পণ্ডিতরা যত জ্ঞানী এবং বুদ্ধিমান হোক ইতিহাসের অনেক সহজ সত্য বা ঘটনাও তারা বুঝতে পারেন না। এমনকি একটা লিখিত গ্রন্থের সহজ অর্থও তারা বুঝতে পারেন না। তখন এই প্রশ্ন আসে তাহলে তাদের সব কথাকে আমাদের অন্ধভাবে কিংবা ভক্তিবশে মেনে নিতে হবে কেন?
একইভাবে ভারতীয় সেই সব বেদজ্ঞ পণ্ডিত কিংবা ঋগ্বেদ পড়েছেন এমন পণ্ডিতদের বুদ্ধিবৃত্তির উপরও অনাস্থা আসে এই ভেবে যে ভারতীয় এবং বেদ পণ্ডিত হবার কিংবা বেদ পড়বার পরেও তারা কী করে পাশ্চাত্য কয়েক জন পণ্ডিত প্রবর্তিত এমন হাস্যকর, উদ্ভট এবং ভ্রান্ত ঋগ্বেদ ব্যাখ্যাকে নত মস্তকে মেনে নিলেন? এবং আজ অবধি মেনে চলেছেন?
এ কথা বলতে হয়ত খারাপ লাগে তবু সত্যটা বলা উচিত। আমার ক্রমে মনে হল, পাশ্চাত্য পণ্ডিতবর্গ এত মূর্খ বা মূঢ় হলে তারা কি আধুনিক সভ্যতার অধিকারী হতে পারত এবং সেই সঙ্গে তাকে ব্যবহার করে পৃথিবী ব্যাপী তাদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে পারত? বিশেষত পাশ্চাত্য পণ্ডিতবর্গের সঙ্গে আমাদের দীর্ঘ যোগাযোগের প্রক্রিয়া থেকে আমার যে উপলব্ধি জন্মালো তা অনেকের কাছে খুব রূঢ় ঠেকবে।
আমার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা থেকে যে সত্য বুঝেছি তা হল জ্ঞানের জগতও রাজনীতির বাইরে নয়। সুতরাং স্বার্থ এবং স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ধারণা জ্ঞানের জগৎকেও অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণ করে। আমার কাছে এখন এটা স্পষ্ট যে, ঋগ্বেদের ব্যাখ্যায় অন্তত শুরুতে যে উদ্দেশ্য কাজ করেছিল সেটা হচ্ছে রাজনৈতিক — আরও রূঢ়ভাবে বললে অপরাজনৈতিক। অর্থাৎ এটা নেহাতই বদমায়েশী। তা না বলতে চাইলে পাশ্চাত্যের ঐ পণ্ডিতদেরকে মূর্খ বা মূঢ় বলতে হবে। এখন মূর্খ বা বদমায়েশ যাই বলা যাক ঐসব পণ্ডিতের কাছ থেকে আমাদের শিখবার এবং তাদেরকে মেনে চলবার কোনও কারণ কি থাকে?
প্রশ্নটা উঠতে পারে যে, সত্যটাকে মানতে পাশ্চাত্যের পণ্ডিতদের সমস্যা কোথায়? বস্তুত সমস্যাটা উপনিবেশবাদ এবং সাম্রাজ্যবাদের মধ্যে। এটা সহজবোধ্য যে মানুষকে শুধু গায়ের জোরে দীর্ঘ কাল পদানত করে রাখা যায় না যদি না তার চেতনা তথা বুদ্ধিবৃত্তিকে পদানত তথা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। সুতরাং সব আধিপত্য প্রতিষ্ঠার অন্যতম পূর্বশর্ত হচ্ছে অধীনস্থদের চেতনা বা বুদ্ধিবৃত্তিকে অধীনস্থতার উপযোগী করা। ভারতবর্ষে আর্য আক্রমণ তত্ত্ব প্রতিষ্ঠাও ব্রিটিশ শাসকদের জন্য তেমন একটা প্রয়োজনীয় করণীয় ছিল যে কাজে সহায়ক হয়েছিল ব্রিটিশ এবং সেই সঙ্গে তার আধিপত্যের সহায়ক পশ্চিম ইউরোপীয় প্রাতিষ্ঠানিক পণ্ডিতবর্গ। এই তত্ত্ব প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে জার্মান পণ্ডিত ম্যাক্সমুলারের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
এই তত্ত্ব দ্বারা ব্রিটিশ শাসকরা শাসিত ভারতীয়দেরকে এটা শিখিয়েছিল যে, ভারতবাসীদের জন্য বৈদেশিক আক্রমণ, আধিপত্য এবং শাসনই চিরন্তন নিয়তি। ব্রিটিশের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার আগে হাজার বৎসরের অধিককাল যাবৎ ছিল বহিরাগত মুসলমানদের আক্রমণ এবং শাসন। অষ্টম শতাব্দীতে সিন্ধু-পাঞ্জাবে আরব মুসলমানদের আক্রমণ এবং কিছু কালের শাসন এবং একাদশ শতাব্দীর শুরুতে গজনীর সুলতান মাহমুদের ১৭ বার ভারত লুণ্ঠন অভিযানের কথা বাদ দিলেও ১২০৪ থেকে ১৭৫৭ পর্যন্ত প্রায় লাগাতার সাড়ে পাঁচ শত বৎসর বহিরাগত মুসলমানরা ভারতের অন্তত বেশীর ভাগ অঞ্চল শাসন করেছে। তার আগে আছে সাইথিয়ান বা শক, আহির, কুশান, হুন ইত্যাদি বর্বর যাযাবরদের ভারতবর্ষে আক্রমণ অভিযানের ইতিহাস। খ্রীষ্টপূর্ব প্রায় সপ্তম-অষ্টম শতাব্দী থেকে শুরু করে খ্রীষ্টীয় চতুর্থ-পঞ্চম শতাব্দী পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন যাযাবর পশুপালক এবং বর্বর উপজাতিসমূহের আক্রমণ অভিযানের ঢেউ পশ্চিম-উত্তর দিক দিয়ে ভারতবর্ষের উপর আছড়ে পড়েছিল। তারা উত্তর-পশ্চিমের বিভিন্ন অঞ্চল দখল করে বসতি স্থাপন করেছিল। ক্রমে তারা হিন্দু সমাজের অন্তর্ভুক্ত হয় এবং ভারতবর্ষের জনসমাজের মূলধারায় বিলীন হয়ে যায়।
সুতরাং ব্রিটিশদের পক্ষে এটা প্রতিষ্ঠা করা সহজ হয়েছিল যে বৈদিক আর্যরাও ভারতবর্ষে বহিরাগত এবং ঋগ্বেদে যে সব যুদ্ধের বর্ণনা পাওয়া যাচ্ছে সেগুলি মূলত অনার্য ভারতবাসী বিশেষত সিন্ধু এবং পাঞ্জাব অঞ্চলের অধিবাসী কৃষ্ণাঙ্গ ভারতীয়দের বিরুদ্ধে বহিরাগত পশুপালক এবং শ্বেতকায় যাযাবর আর্যদের যুদ্ধের বর্ণনা। ১৯২০-এর দশকে হরপ্পা নগর তথা সিন্ধু সভ্যতার নিদর্শন আবিষ্কারের পর পাশ্চাত্য এবং সেই সঙ্গে তাদের অনুগত ভারতীয় পণ্ডিতদের পক্ষে এটা বলা আরও সহজ হল যে, ঋগ্বেদে শত্রুদের যেসব পুর বা নগর ধ্বংসের কথা বলা হয়েছে সেগুলি হচ্ছে সিন্ধু সভ্যতার (প্রত্নতত্ত্বের ভাষায় হরপ্পান সভ্যতা) নগর।
এর আগে অর্থাৎ সিন্ধু সভ্যতার নিদর্শন আবিষ্কারের আগে বলা হত যে, আর্যরা আসবার আগে ভারতবাসী ছিল অসভ্য এবং বর্বর এবং বহিরাগত পশপালক আর্যরা এসে এখানে প্রথম সভ্যতা প্রতিষ্ঠা করেছে, সেই সঙ্গে দান করেছে বৈদিক ভাষা, যেটা ঋগ্বেদের ভাষা এবং সংস্কৃতের আদি রূপ। যে সকল ভাষায় ভারতবর্ষের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ কথা বলে সেগুলি যেহেতু বৈদিক বা সংস্কৃতের পরিবর্তিত কিংবা বিবর্তিত রূপ সেহেতু বহিরাগত পশুপালক আর্যরা ভারতবর্ষকে আধুনিক ভাষাগুলিকেও দান করেছে।
সিন্ধু সভ্যতা আবিষ্কারের পর ব্যাখ্যাটা একটু বদলাল। এখন বলা হল যে, সিন্ধু সভ্যতা ধ্বংস করলেও তার সঙ্গে সংমিশ্রণ ঘটিয়ে আর্যরা ভারতবর্ষকে নূতন সভ্যতা এবং সংস্কৃতি দান করেছে। বিশেষত ভাষার ক্ষেত্রে বহিরাগত আর্যদের ভূমিকার উপর জোর দেওয়া হল। কারণ বাংলা, হিন্দীসহ ভারতবর্ষের বিপুল গরিষ্ঠ মানুষের মাতৃভাষার উৎসে যেতে হলে বৈদিক বা সংস্কৃত ভাষায় যেতে হয়। এছাড়া যেহেতু বেদ হচ্ছে হিন্দুদের আদি ধর্মগ্রন্থ সেহেতু বলা হল যে, হিন্দুদের মূল ধর্মটাও বহিরাগত বিজয়ী আর্যদের দান।
অথচ সমগ্র ঋগ্বেদের কোথায়ও তার রচয়িতা ঋষিরা একটি বারের জন্যও নিজেদেরকে বহিরাগত বলেন নাই। বরং ঋষিরা বারবার সপ্তসিন্ধুকে নিজেদের আবাসভূমি হিসাবে উল্লেখ করেছেন। অর্থাৎ ঋগ্বেদের ঋষিদের দ্ব্যর্থহীন ঘোষণাকে অস্বীকার করেই পাশ্চাত্য পণ্ডিতরা তাদেরকে সপ্তসিন্ধু অঞ্চল তথা ভারতবর্ষের ভূমিতে বহিরাগত বানিয়েছিলেন। এটাকে তামাশার চূড়ান্ত ছাড়া আর কী বলা যায়?
এভাবে ব্রিটিশ তথা ইউরোপীয়রা ভারতবর্ষের জন্য বহিরাগত আর্য আক্রমণ তত্ত্বকে তাদের উপনিবেশিক এবং সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্য প্রতিষ্ঠা ও রক্ষার জন্য একটি চমৎকার সহায়ক জ্ঞানতাত্ত্বিক হাতিয়ার হিসাবে দেখতে পেল। এটা এমন এক তত্ত্ব যা দিয়ে ভারতীয় উপমহাদেশবাসীর আত্মমর্যাদাবোধের জাগরণকে অনেক সহজেই দমিত করা যায়।
এ তত্ত্ব দিয়ে ব্রিটিশ শাসকরা সহজেই এ কথা বুঝাতে পারল যে পরাধীনতা বা পরদাসত্ব যেহেতু ভারতবাসীদের চিরন্তন ইতিহাস সেহেতু তাদের পরাধীন থাকতে অসুবিধা কোথায়? সবচেয়ে বড় কথা অসভ্য ভারতবাসীকে তারা যে সভ্য করবার ব্রত নিয়ে এসেছে সেই কথাটাও তারা তখন বড় গলায় বলবার সুযোগ পেয়েছে। আর তারা তো সারাক্ষণ চীৎকার করে সবাইকে বলত যে, তারা পৃথিবী ব্যাপী তাদের উপনিবেশ বা সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছে লুণ্ঠন করবার উদ্দেশ্য নিয়ে নয়, বরং অসভ্য পৃথিবী এবং বিশেষত অসভ্য প্রাচ্যকে সভ্য করবার মিশন নিয়েই তাদের এই উপনিবেশ বা সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা। যেন তাদের এই মহান ব্রত (!) নিয়েই উপনিবেশের ‘অসভ্য’ জাতিগুলিকে উৎসাদন অথবা লুণ্ঠন করেছে। সুতরাং ভারতবর্ষের জন্য বহিরাগত আর্য আক্রমণ তত্ত্বের এই প্রচার ছিল খুব জরুরী। বিশেষত ভারতবর্ষ যখন ছিল ব্রিটিশ রাজমুকুটের মধ্যমণি। ব্রিটিশদের সবচেয়ে সমৃদ্ধ উপনিবেশ হিসাবে তারা ভারতবর্ষকে এই পদবীই দিয়েছিল। এমন কামধেনু বস্তুত ব্রিটিশদের জন্য সারা পৃথিবীর আর কোথাওই ছিল না।
আর্য আক্রমণ তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদ-উপনিবেশবাদের জন্য আর একটি কারণে অত্যাবশ্যক ছিল। সেটা হচ্ছে ঋগ্বেদের সঠিক ব্যাখ্যা ইউরোপীয় শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদী শ্রেষ্ঠত্বের ধারণার মর্মে আঘাত করে। এবং এটা সভ্যতা প্রতিষ্ঠায় ইউরোপের বিশেষ ভূমিকার দাবীদার হবার কোনও জায়গাই রাখে না। কারণ তখন এই সত্য বেরিয়ে আসে যে, আর্য বা যে নামই দেওয়া যাক মূলত সিন্ধু সভ্যতার অধিবাসীরাই সিন্ধু সভ্যতা ধ্বংসের পর্যায়ে হোক আর ধ্বংসের অব্যবহিত পরবর্তী কালে হোক মধ্য এশিয়া এবং সমগ্র ইউরোপে অভিগমন করে সেখানে নূতন সভ্যতা প্রতিষ্ঠা করে। তার প্রমাণ হল সমগ্র ইউরোপ ব্যাপী ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা-পরিবার হিসাবে কথিত বৈদিক তথা সংস্কৃত ভাষা থেকে উদ্ভূত ভাষাগুলির আধিপত্য। যেমন গ্রীক, লাতিন, ফরাসী, ইংরাজী, স্পেনীয়, রুশ ইত্যাদি। এ থেকে এটা নিশ্চিত করে বলা যায় যে, সিন্ধু সভ্যতার অধিবাসীদের একাংশ সুদূর ইউরোপ পর্যন্ত অভিগমন করে সেখানে তাদের মূল তথা বৈদিক ভাষার সঙ্গে স্থানীয় বিভিন্ন ভাষার সংমিশ্রণে নূতন নূতন ভাষার বিকাশ যেমন ঘটায় তেমন সিন্ধু সভ্যতার অভিজ্ঞতাকে ভিত্তি করে গ্রীক এবং রোমান সভ্যতার মত সভ্যতাগুলিকেও প্রতিষ্ঠা করে। সুতরাং ঋগ্বেদের সঠিক ব্যাখ্যা ইউরোপের বর্ণবাদী এবং সাম্রাজ্যবাদী-উপনিবেশবাদী দম্ভকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দেয়। তখন যে ভারতবর্ষকে তারা পদানত করে এখানকার মানুষদেরকে সভ্যতা শিখাবার দম্ভ করছিল সেই ভারতবর্ষের কাছে তাদের নিজেদেরই সভ্যতার ঋণ স্বীকার করতে হয়। শুধু তা-ই নয়, সভ্যতায় ভূমিকা রাখবার বিচারে ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠত্বকে মেনে নিতে হয়। কারণ সে ক্ষেত্রে তাদের নিজেদেরকেই বরং ভারতীয় সভ্যতার উত্তরাধিকারী হিসাবে মেনে নিতে হয়। এরপর এই উপমহাদেশকে পদানত করে রেখে সভ্যতা শিখাবার যুক্তি কিংবা নৈতিক জায়গাটা থাকে কোথায়?*
----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
* ঋগ্বেদ কিংবা সিন্ধু সভ্যতার প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারগুলি নিয়ে এখানে বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ না থাকায় এখানে সেই বিষয়গুলি নিয়ে সেভাবে আলোচনা করি নাই। বাংলা ভাষায় শামসুল আলম চঞ্চল এবং আমার যৌথভাবে লিখা গ্রন্থ ‘আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা’য় এসব বিষয়ে বিশদ আলোচনা ও ব্যাখ্যা আছে। এটি ২০০৩-এর জানুয়ারীতে মুদ্রিত আকারে প্রকাশিত হয়েছিল ব-দ্বীপ প্রকাশন কর্তৃক। কিন্তু আমার সম্পাদনায় ব-দ্বীপ প্রকাশন থেকে ‘ইসলাম বিতর্ক’ নামে ইংরাজী থেকে বাংলায় অনূদিত একটি প্রবন্ধ সংকলন প্রকাশের কারণে ধর্মানুভূতিতে আঘাত হানার অভিযোগ এনে ব-দ্বীপ প্রকাশনের স্বত্বাধিকারী হিসাবে বাংলাদেশ সরকারের নির্দেশে পুলিশ আমাকে ২০১৬ খ্রীষ্টাব্দের ১৬ ফেব্রুয়ারী তারিখে তথ্য ও প্রযুক্তি আইনের ৫৭ (২) ধারায় গ্রেফতার করে এবং কম্পিটার, মোবাইল ও দলিলপত্রসহ বিপুল সংখ্যক বই জব্দ করার পাশাপাশি ব-দ্বীপ প্রকাশনের কার্যালয় এবং বিপণন কেন্দ্র সিলগালা করে দেয়। আমি সাড়ে আট মাস জেল হাজত বাসের পর আদালতের নির্দেশে ২০১৬ খ্রীষ্টাব্দের ৩১ অক্টোবর জামিনে মুক্ত হই। এখানে উল্লেখযোগ্য যে ব-দ্বীপ প্রকাশনের সঙ্গে কোন প্রকার আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক না থাকলেও শামসুল আলম চঞ্চলকেও পুলিশ ব-দ্বীপ প্রকাশনের বিপণন কর্মকর্তা হিসাবে দেখিয়ে গ্রেফতার করে। এই লেখার সময় পর্যন্ত তিনিও জামিনে মুক্ত আছেন এবং আমার মত নিয়মিতভাবে মামলায় আদালতে হাজিরা দিয়ে চলেছেন। অবশ্য ইসলাম বিতর্ক গ্রন্থের মুদ্রকও একই মামলায় কারাবন্দী হয়েছিলেন। তিনিও বর্তমানে আমাদের মত জামিনে থেকে মামলার অভিযুক্ত হিসাবে আদালতে হাজিরা দিয়ে চলেছেন। যাইহোক, দেড় বৎসরেরও অধিককাল পর আদালতের নির্দেশে পুলিশ ব-দ্বীপ প্রকাশনের কার্যালয়ের সিলগালা করা তালা খুলে দিলেও প্রকাশন বন্ধ হয়ে গেছে। অবশ্য জব্দ করা বইপত্র, কম্পিউটার এবং গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র শাহবাগ থানা জব্দ করে রেখে দিয়েছে। কাজেই এখন আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা বাজারে পাবার উপায় নাই। তবে এটির অনলাইন সংস্করণ ‘বঙ্গরাষ্ট্র’-এ গ্রন্থাগার বিভাগে দেওয়া আছে। আগ্রহী পাঠক সেটি পাঠ করতে পারেন। — লেখক
----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
ব্রিটিশ এবং পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদী-উপনিবেশবাদী পণ্ডিতরা ঋগ্বেদের অপব্যাখ্যা করে আর্য তত্ত্বকে তাদের ‘বর্ণ’ ও ‘জাতি’গত শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার সপক্ষে জ্ঞানতাত্ত্বিক হাতিয়ার করল। সুতরাং ঋগ্বেদের কদর্থ করে তারা আর্যদেরকে শ্বেতাঙ্গ ‘রেস’ (Race) বা রক্তগত ও বর্ণগত জাতি হিসাবে প্রতিষ্ঠা করতে চাইল। অথচ বৈদিক বা ভারতীয় ঐতিহ্য সে কথা বলে না। শুধু বৈদিক এবং হিন্দু সাহিত্য নয়, জৈন কিংবা বৌদ্ধ সাহিত্যও এটা স্পষ্টভাবে বুঝায়, আর্য শব্দটি মূলত একটি মর্যাদা সূচক সম্ভাষণ কিংবা পরিচিতি মূলক শব্দ। সাধারণত সভ্য, ভদ্র, ন্যায় বা নীতি নিষ্ঠ, সম্মানিত, শ্রেষ্ঠ কিংবা কখনও ধার্মিক বুঝাতে বেদের কাল থেকেই আর্য শব্দের ব্যবহার ছিল। অর্থাৎ জাতি অর্থে নয়, বরং গুণবাচক অর্থে আর্য শব্দের ব্যবহার ছিল। অথচ ইউরোপীয় পণ্ডিতরা এটাকে ‘রেসিয়াল’ (Racial) অর্থে ব্যবহার করা শুরু করল। তারা তো বিজয়ী। কাজেই পরাজিত এবং পরাধীন ভারতের আর সব সম্পদের মত তাদের নিজেদের প্রয়োজনে ঋগ্বেদেরও দখল নিয়ে যেমন খুশী ব্যাখ্যা দিল।
সুতরাং তাদের নিকট একটা জনগোষ্ঠীর সভ্যতা, ভদ্রতা এবং মর্যাদা সূচক আর্য (সংস্কৃত উচ্চারণ আরিয়) সম্বোধন কিংবা পরিচিতি তাদের নিকট হয়ে গেল রেসিয়াল পরিচয়ে চিহ্নিত ‘এরিয়ান’ (Aryan)। এবং এভাবে আর্যত্বের দখলদার হয়ে তারা নিজেদেরকে প্রকৃত ‘এরিয়ান’ বা খাঁটি আর্য ঘোষণা করল। এক সময় পশ্চিম ইউরোপে এই আর্যত্বের অনেক দাবীদার হল। এবং শেষ পর্যন্ত হিটলারের নেতৃত্বে ‘একমাত্র বিশুদ্ধ আর্য রক্তের’ দাবীদার হল জার্মান জাতি। জার্মানির রাষ্ট্র ক্ষমতা হাতে নিয়ে হিটলার এই তত্ত্বকে তার হাতিয়ার ক’রে এবং ‘বিশুদ্ধ এরিয়ানদের’ বিশ্বব্যাপী আধিপত্য প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় ঘোষণা ক’রে একটা বিশ্বযুদ্ধই বাধিয়ে দিলেন। বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞের অভিজ্ঞতার পর অবশ্য এরিয়ান রেস নিয়ে ইউরোপীয়দের মাতামাতি বন্ধ হয়েছে। কিন্তু তাতে কী? ভারতবর্ষের জন্য তাদের বহিরাগত আর্য আক্রমণ তত্ত্ব বহাল রইল।
সিন্ধু সভ্যতা আবিষ্কারের পর থেকে প্রায় শতাব্দী কাল পূর্ণ হতে চলেছে। নূতন নূতন আবিষ্কারগুলি আর্য আক্রমণ তত্ত্বকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে চলেছে। বস্তুত প্রত্নতাত্ত্বিক পণ্ডিতদের নিকট বর্তমানে এই ধরনের কোনও আক্রমণ তত্ত্বের কিংবা পাশ্চাত্য কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ঋগ্বেদের হাস্যকর ব্যাখ্যারও কোনও মূল্য নাই। হয়ত তারা সবাই ঋগ্বেদের ব্যাখ্যা দিতে পারছেন না। তবে ঋগ্বেদের ব্যাখ্যার কাজটা মূলত বেদ পণ্ডিত এবং বিশেষত উপমহাদেশের সমাজতত্ত্ববিদ কিংবা ঐতিহাসিকদের। কিন্তু উপমহাদেশের বিশেষত ভারতের মূল ধারার তথা প্রাতিষ্ঠানিক পণ্ডিতরা ঋগ্বেদের হাস্যকর পাশ্চাত্য ব্যাখ্যার উপর নির্ভর করে আজ অবধি ইতিহাস ব্যাখ্যা দিয়ে চলেছেন। সবচেয়ে দুঃখজনক হল এখনও প্রাতিষ্ঠানিক পাঠ্যপুস্তকসমূহে হাস্যকর এবং উদ্ভট আর্য আক্রমণ তত্ত্ব লিখা হচ্ছে।
এটা নিশ্চয় বিস্ময়কর যে, ভারতীয় পণ্ডিতরা আজ অবধি এই তত্ত্বকে জ্ঞানচর্চার মূলধারা তথা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার জায়গা থেকে বিদায় দিতে পারেন নাই। ফলে আজ অবধি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় ভারতে আর্য আক্রমণ তত্ত্বের মত একটা উদ্ভট এবং হাস্যকর তত্ত্ব জাঁকিয়ে বসে আছে। অথচ কোনও ধরনের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন এই তত্ত্বের সমর্থনে কোনও কালে যেমন ছিল না তেমন আজও নাই।
প্রশ্ন হওয়া উচিত, কেন ভারতীয় প্রাতিষ্ঠানিক বুদ্ধিবৃত্তির এমন দৈন্যদশা। এটা নিশ্চয় লক্ষ্যণীয় যে, আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার সাবেক মহাপরিচালক বি বি লালের মত প্রত্নতাত্ত্বিকরা আর্য আক্রমণ তত্ত্বকে প্রত্যাখ্যান করে নূতন দৃষ্টি থেকে ভারতবর্ষের অতীত ইতিহাসের পুনর্মূল্যায়নের প্রয়োজন তুলে ধরছেন।* কিন্তু সেগুলি ভারতীয় মূলধারার পণ্ডিতদের কর্ণকুহরে প্রবেশ করছে বলে মনে হয় না। ইদানীং কালে মিশেল ড্যানিনোর মত পাশ্চাত্য পণ্ডিতরা আর্য আক্রমণ তত্ত্বকে নাকচ করছেন অখণ্ডনীয় তথ্য-প্রমাণের উপর দাঁড়িয়ে অত্যন্ত ধারালো এবং কখনও কখনও আক্রমণাত্মক ভাষাতেই।** সত্যকে তুলে ধরবার জন্য কিছু সংখ্যক মানুষের যে অদম্য মনোবল, তেজ, সাহস এবং বলিষ্ঠতা পাশ্চাত্যকে এক সময় বড় করেছে এরা হলেন তার যথাযথ উত্তরাধিকারী। এরা হলেন পশ্চিম ইউরোপের সত্যান্বেষী জ্ঞানচর্চার প্রকৃত উত্তরাধিকারী, যারা পাশ্চাত্যের সাম্রাজ্যবাদী-উপনিবেশবাদী তথা মূলধারার প্রাতিষ্ঠানিক দৃষ্টিভঙ্গীর নিকট আত্মসমর্পণ করেন নাই। এরা ভারতের মাটি খুঁড়ে যে অতীতকে খুঁজে পেয়েছেন তাকে তাদের বলিষ্ঠ লেখনীতে যেভাবে তুলে ধরছেন তা থেকেও মূল ধারার তথা প্রাতিষ্ঠানিক ভারতীয় পণ্ডিতরা বিশেষ কিছু শিখছেন বলে মনে হয় না। আজও মূলধারার তথা প্রাতিষ্ঠানিক ভারতীয় পণ্ডিতরা আর্য আক্রমণ তত্ত্বের মত একটা হাস্যকর এবং ফালতু তত্ত্বকে শিরোধার্য করে রেখে নিজেদের দৈন্যদশাকে প্রদর্শন করে চলেছেন।
----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
* দ্রষ্টব্য : B. B. Lal, Let not the 19th Century Paradigms Contunue to Haunt Us. Publshed in, Puratattva, November 37, 2007, Bulletins of the Indian Archaeological Society, New Dellhi.
** Michel Danino, Flogging a Dead Horse. In, Puratattva, November 37, 2007, Bulletins of the Indian Archaeological Society, New Dellhi.
আরও দ্রষ্টব্য :
Michel Danino, Email: micheldanino@gmail.com, The Harappan Heritage and the Aryan Problem. In, Man and Environment, vol.xxviii (2003) no. 1. pp. 21-32
----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
পুনরায় প্রশ্ন আসা উচিত কেন তাদের এই দৈন্যদশা। ইতিপূর্বে যে কথা বলেছিলাম সেটারই জের ধরে বলতে হয়, এরা ব্রিটেনের উপনিবেশিক দাস বুদ্ধিজীবীদের উত্তরাধিকারী মাত্র, যারা উত্তর উপনিবেশিক কালে উপনিবেশিক ব্যবস্থার জ্ঞানতাত্ত্বিক বা বুদ্ধিবৃত্তিক পাহারাদার এবং একই সঙ্গে এই ব্যবস্থার সুবিধাভোগী। অর্থাৎ এরা স্বাধীন মানুষ নয়। কারণ প্রভুরা যা শিখিয়েছে তাকে বিরোধিতা করার তো প্রশ্নই উঠে না এমনকি তার বাইরে গিয়ে স্বাধীনভাবে বিচার করবার ক্ষমতাও এদের নাই। এরা হল ব্রিটিশ উপনিবেশবাদীদের তৈরী চাকরবাকর শ্রেণীর বুদ্ধিজীবী। এই চাকরবাকররাই আজ অবধি উপমহাদেশের সর্বত্র যেমন জাঁকিয়ে বসে আছে তেমন বুদ্ধিবৃত্তির ক্ষেত্রেও কথাটা প্রযোজ্য। রাষ্ট্রটা যেমন পরাধীনতার উত্তরাধিকারী, বুদ্ধিবৃত্তি বা পাণ্ডিত্যেরও তেমন একই দশা। আসলে সাম্রাজ্যবাদ-উপনিবেশবাদের আউটপোস্ট বা ফাঁড়ি রক্ষায় এখানকার মূলধারার সাধারণ বুদ্ধিজীবী-পণ্ডিতরা হল পাশ্চাত্য উপনিবেশবাদের বুদ্ধিবৃত্তিক সেনা। যেহেতু এদের ভূমিকা পাশ্চাত্যের অধস্তনের বা অধীনের সুতরাং এদেরকে আমরা বুদ্ধিবৃত্তিক বা ইনটেলেকচুয়াল ক্ষেত্রে উপনিবেশবাদী প্রভুদের এ দেশীয় পদাতিক সৈনিক বা ‘নেটিভ ফুট সোলজার্স্’ বলতে পারি। বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে এরা এখানে সাম্রাজ্যবাদী-উপনিবেশবাদী ব্যবস্থা রক্ষার জন্য লড়াই করে। এরা এ দেশে উপনিবেশিক বিদ্যাচর্চা তথা উপনিবেশিক জ্ঞানতত্ত্বের প্রচারকে অব্যাহত রাখে। এভাবে উপনিবেশিকতার ধারাবাহিকতা রক্ষাকারী রাষ্ট্রের সহায়ক হিসাবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির মাধ্যমে এরা এ দেশের অভ্যন্তরে উপনিবেশিক ব্যবস্থা সংরক্ষণের লক্ষ্যে চিন্তার জগৎকে নিয়ন্ত্রণ করে।
আমার এই আলোচনায় অনেকে ভাবতে পারেন যে, আমি সাম্রাজ্যবাদ-উপনিবেশবাদের নামে পাশ্চাত্যের সবকিছুকে নাকচ করছি। সেটা আমি করি না। বিজ্ঞান-প্রযুক্তির যে অগ্রগতি তারা ঘটিয়েছে কিংবা আজও ঘটিয়ে চলেছে সেখান থেকে আমাদের যেমন শিখবার এবং নিবার অনেক কিছু আছে তেমন তাদের জ্ঞানচর্চার আরও যেসব শাখা আছে সেগুলি থেকেও আমাদের অনেক কিছু নিবার আছে। পাশ্চাত্য মানবিকতার ক্ষেত্রে যে ভূমিকা বা অবদান রেখেছে সেগুলি থেকেও আমাদের শিখবার কিংবা নিবার আছে। কিন্তু আমাদের সর্বদা রাখতে হবে বিচারশীল মন, ‘ক্রিটিক্যাল মাইন্ড’। বিশেষত মানুষ এবং সমাজ সম্পর্কে, মানুষের ইতিহাস সম্পর্কে পাশ্চাত্যের মূলধারার জ্ঞানতত্ত্বের মধ্যে সাম্রাজ্যবাদী-উপনিবেশবাদী যে ধারা কখনও নগ্ন এবং কখনও সংগুপ্ত থাকে সে সম্পর্কে আমাদের সদা সতর্ক থাকতে হবে। এ ছাড়া সামাজিক প্রেক্ষিতগত কারণে তাদের জ্ঞানতত্ত্বের অনেক কিছুই আমাদের জন্য অপ্রয়োজনীয় এবং এমনকি ক্ষতিকর হতে পারে। তবে পাশ্চাত্যের জ্ঞানতত্ত্বকে বিচারের সময় বিশেষত এই কারণে আমাদের আরও বেশী করে সদাসতর্ক থাকতে হবে যেহেতু পাশ্চাত্য আজও তার সাম্রাজ্যবাদী এবং উপনিবেশবাদী বিশ্বব্যবস্থার সংরক্ষক হয়ে আছে। একদা পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলি অস্ত্রের বলে যে বিশ্বব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিল আজও তারা সেই ব্যবস্থার উত্তরাধিকারকে ধারণ করে আছে। অন্যদিকে, আমরাও আজ অবধি তাদের তৈরী সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত হয়ে আছি তাদের রাষ্ট্র এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে গ্রহণ এবং রক্ষা ক’রে। এভাবে আমাদের উভয়ের মধ্যকার প্রভু এবং ভৃত্যের সম্পর্ক অটুট রয়েছে।
মনে রাখতে হবে প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যের মধ্যে সম্পর্কের প্রশ্নে আজও আমাদের পৃথিবীটা মোটা দাগে ‘আমরা আর তারা’ হয়ে আছে। একদিকে প্রাচ্য এবং অপর দিকে পাশ্চাত্য এই বিভাজনটাকে অস্বীকার করবার কোনও উপায় নাই। পাশ্চাত্যের উপনিবেশবাদী আধিপত্য প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে একদা প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মধ্যে যে দ্বন্দ্বের সূত্রপাত হয়েছিল তার সমাপ্তি ঘটেছে এটা মনে করবার কোনও বাস্তবতাই নাই। এ কথা ঠিক যে, পাশ্চাত্যের দেশ বা শক্তিগুলির মধ্যে প্রকৃতির নিয়মেই বিভিন্ন দ্বন্দ্ব ও বিরোধ যেমন আছে তেমন প্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ বা শক্তিগুলির মধ্যেও বিভিন্ন দ্বন্দ্ব ও বিরোধ আছে। কিন্তু এই সকল দ্বন্দ্ব ও বিরোধকে বড় করে দেখতে গিয়ে আমরা যেন প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যের দ্বন্দ্ব ও বিরোধকে ঝাপসা করে না ফেলি। বস্তুত বিশ্ব পরিসরে আজও দ্বন্দ্বটা প্রধানত পাশ্চাত্যের সঙ্গে তথা পশ্চিম ইউরোপ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের মত দেশগুলির সঙ্গে বাকী পৃথিবীর দেশগুলির দ্বন্দ্বকে ঘিরে আবর্তিত।
চীন-ইন্দোচীনের মত কিছু সংখ্যক দেশ পাশ্চাত্যের আধিপত্যের জাল ছিন্ন করে বেরিয়ে এলেও আমাদের মত অধিকাংশ দেশই এই আধিপত্যের জালে আবদ্ধ হয়ে আছে। এর নেতৃত্বে এক সময় ব্রিটেন থাকলেও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর থেকে এর নেতৃত্বে আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। বিশ্বসাম্রাজ্যবাদী এই আধিপত্যের জাল ছিন্ন করবার প্রথম শর্ত হচ্ছে আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিকে সাম্রাজ্যবাদী এবং উপনিবেশবাদী আধিপত্যের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করা। পাশ্চাত্যের তৈরী করে দেওয়া যে বৃত্তের মধ্যে এখানে জ্ঞানচর্চা আবদ্ধ হয়ে ঘুরপাক খাচ্ছে সেই বৃত্তকে ভেঙ্গে ফেলা। এর জন্য অপরিহার্য হল যে চাকরবাকর শ্রেণীর বুদ্ধিজীবী এবং পণ্ডিতরা বাংলাদেশসহ সমগ্র উপমহাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিতে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে আছে তাদের আধিপত্যকে অস্বীকার এবং উৎখাত করা। কারণ আগে আমাদের চেতনাকে মুক্ত করতে হবে। দাসত্ব থেকে মুক্তির প্রথম শর্ত হচ্ছে দাসত্বের চেতনা থেকে মুক্তি।
আবার বলি এর অর্থ এই নয় যে, পাশ্চাত্যের সবকিছুকে নাকচ করতে হবে। অন্যদিকে স্বদেশ অভিমুখী হতে গিয়ে, অতীতের গৌরবময় ঐতিহ্যের উপর দাঁড়াতে গিয়ে অতীতের সবকিছুকে আমরা যেন বিনা প্রশ্নে গ্রহণ না করি। অতীতের অনেক জঞ্জালকেই ঝেড়ে ফেলতে না পারলে আমরা যেমন মানসিক এবং বাস্তব স্বাধীনতা অর্জন করতে পারব না তেমন আধুনিক যুগের চ্যালেঞ্জকে মোকাবিলা করে আমাদের নিজস্ব উন্নত সভ্যতাও গড়তে পারব না। এর জন্য প্রয়োজন এমন এক রাজনৈতিক এবং সামাজিক বিপ্লব সংগঠনের যা একদিকে যেমন বর্তমানের উপনিবেশিক উত্তরাধিকারের সঙ্গে আমাদের ছেদ ঘটাবে অপর দিকে তেমন অতীতের পশ্চাৎপদতা এবং প্রতিক্রিয়াশীলতার উত্তরাধিকারের সঙ্গেও ছেদ ঘটাবে।
৪। সমাপ্তি পর্ব : বাংলাদেশ, ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে একটি সংক্ষিপ্ত তুলনামূলক পর্যালোচনা
ঋগ্বেদ পাঠ এবং তার মূল্যায়ন সম্পর্কে আমাদের দুইজনের (চঞ্চল এবং আমার) প্রায় আটাশ বৎসরের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে এখানে তিনটি দেশ সম্পর্কেই খুব সংক্ষেপে হলেও আমার কিছু মূল্যায়ন তুলে ধরব। প্রথমেই বলে রাখা ভাল যে এক ঋগ্বেদ পাঠ দিয়েই একটা সমাজের সবকিছুকে বুঝা যেমন যায় না তেমন বুদ্ধিবৃত্তির সবকিছু সম্পর্কে মূল্যায়ন করাও ঠিক নয়। তবে সত্যের কাছাকাছি যাওয়া যেতে পারে বৈকি। এটা হল হাড়িতে চড়ানো একটা বা দুইটা ভাত টিপে হাড়ির ভাতের অবস্থা বুঝবার চেষ্টার মত। তাতে হয়ত অনেক সময় বুঝতে ভুল হতে পারে। তবে রাঁধতে যে জানে তার ভুলটা যে সচরাচর বেশী একটা হয় না সেটা বলা যায়।
অবশ্য বিশেষত আমার নিজ অভিজ্ঞতার আরও অনেক দিক আছে যেগুলি আমার এই মূল্যায়নে সহায়ক ভূমিকা রেখেছে। তবে সমগ্রে পৌঁছানোর জন্য এ ক্ষেত্রে আমি একটি খণ্ড দিয়েই শুরু করতে চেয়েছি। সেটা হচ্ছে ঋগ্বেদ পাঠ। বিশেষত ঋগ্বেদের বিষয়টা আমার কাছে পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদী এবং উপনিবেশবাদী জ্ঞানচর্চার স্বরূপ এবং সেই সঙ্গে তার অধীনে গড়ে উঠা উপমহাদেশের জ্ঞানচর্চার অন্তর্গত সমস্যা বুঝবার ক্ষেত্রে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি সূত্র হিসাবে কাজ করেছে। সুতরাং ঋগ্বেদ পাঠের অভিজ্ঞতাকে কেস-স্টাডি হিসাবে ধরে নিয়ে আমি পাশ্চাত্যের উপনিবেশিক আধিপত্যের পটভূমিতে উপমহাদেশের জ্ঞানচর্চা এবং বুদ্ধিবৃত্তির সমস্যার মর্মে পৌঁছাতে চেয়েছি।
একটা মানুষের জীবনে আটাশ বৎসর খুব কম সময় নয়। এই আটাশ বৎসরে নানানভাবে নানান দেশের পণ্ডিতদের সঙ্গে চঞ্চলের এবং আমার যোগাযোগ-মতবিনিময় হয়েছে। অন্যসব বিষয়ের প্রসঙ্গ থাক। শুধু ঋগ্বেদ প্রসঙ্গেই সীমাবদ্ধ থাকা যাক। ঋগ্বেদ নিয়ে কাজ করতে গিয়ে যেসব অভিজ্ঞতা হয়েছে সেগুলি অনেক সময় শুধু বিস্ময়কর নয়, উপরন্তু অভাবিতও।
প্রথমে আসা যাক পাকিস্তানের ডঃ মোহাম্মদ রফিক মোগলের কথায়। বাংলাদেশের মত পিছিয়ে থাকা দেশের অখ্যাত-অজ্ঞাত লেখক চঞ্চলের লিখা প্রথম প্রবন্ধটাকে তার মত একজন বিশ্ববিখ্যাত পুরাতাত্ত্বিক পণ্ডিতের কি কোনও গুরুত্ব দিবার কথা ছিল? বিশেষত তিনি যখন জানতেন যে চঞ্চল বাংলাদেশের একটি কারখানার সহকারী প্রকৌশলী (যান্ত্রিক) মাত্র। এই আলাচনার শুরুর দিকে বলেছি যে, চঞ্চল তখন চট্টগ্রামের টিএসপি ফ্যাক্টরির সহকারী যান্ত্রিক প্রকৌশলী বা এসিস্ট্যান্ট মেকানিক্যাল ইঞ্জিনীয়ার। এই পরিচয় ডঃ মোগল জেনেছিলেন তার নিকট পাঠানো চঞ্চলের প্রথম চিঠি থেকেই। অর্থাৎ চঞ্চলের পেশাগত এবং প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাগত দিকটা জানা থাকা সত্ত্বেও তার নিকট তার গুরুত্বপূর্ণ পুরাতাত্ত্বিক লেখাগুলি পাঠাতে যেমন তার দ্বিধা হয় নাই তেমন পরবর্তী সময়ে চঞ্চলের পাঠানো প্রবন্ধ পাঠের পর সমর্থন জানাতেও তার এতটুকু দ্বিধা কিংবা সমস্যা হয় নাই।
আমরা আশা করেছিলাম ভারত এবং ইউরোপের পণ্ডিতদের কাছ থেকে উৎসাহপূর্ণ সাড়া, যার কোনওটাই প্রকৃতপক্ষে সেই সময় ঘটে নাই। এরপর চঞ্চল এবং আমি উভয়ে যৌথভাবে ইংরাজীতে বই লিখবার পর সেটা সারা পৃথিবীর কিছু সংখ্যক প্রত্নতাত্ত্বিক এবং ইতিহাসবিদ পণ্ডিতের নিকট পাঠাই। এছাড়া আমরা উভয়ে বিভিন্নভাবে বিভিন্ন দেশের পণ্ডিতদের সঙ্গে মতবিনিময়ের চেষ্টা করি। চঞ্চল যেমন দিল্লীতে তেমন আমি নিজে পশ্চিম বঙ্গের পণ্ডিত মহলে কিছু কথা বলেছি।
এই সমগ্র ঘটনাধারায় মোগল এক অনন্যসাধারণ ভূমিকা পালনকারী হিসাবে উদ্ভাসিত হয়েছেন। তিনিও তো প্রচলিত ধারার জ্ঞানচর্চার সীমায় আবদ্ধ তথা একজন প্রাতিষ্ঠানিক পণ্ডিত। বিশেষত পণ্ডিতরা দেখেছি নিজ প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষেত্রের বাইরে জানলেও সে বিষয়ে সেভাবে কথা বলতে চান না। এটা ভারতীয় জ্ঞানচর্চার একটা সাধারণ বৈশিষ্ট্য বলে আমার ধারণা হয়েছে। জানি না মোগল বেদ অধ্যয়ন করেছিলেন কিনা। কিন্তু তিনি অন্তত প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বেদ-ভাষ্যকার বা বেদ-পণ্ডিত নন। অথচ তিনি সিন্ধু সভ্যতার উপরে তার যে জ্ঞান তা দিয়েই আমাদের বক্তব্যের সারবত্তা সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পেরেছিলেন। শুধু তাই নয়, তিনি তার জন্য উচ্ছ্বসিত ভাষায় চঞ্চলকে অভিনন্দনের পাশাপাশি লেখাটিকে প্রকাশের তাগিদও দিয়েছিলেন। সত্যি বলতে কি এই আবেগ, এই সাহস এবং এই ঔদার্যের পরিচয় ভারতীয় কোনও পণ্ডিতের নিকট থেকেই আমরা আজ পর্যন্ত পাই নাই। যদি আমাদের ইতিহাস ব্যাখ্যা কোনও দিন প্রতিষ্ঠা পায়, যেটা পাবে বলে আমি মনে করি, তবে সে ক্ষেত্রে মোগলের এই ভূমিকাও অক্ষয় হয়ে থাকবে।
পাকিস্তানের অনেক সমালোচনা আমার আছে। আমি দ্বি-জাতিতত্ত্বের কঠোর সমালোচনা করি। পাকিস্তান আমলে এ দেশে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার রাজনীতি গড়ায়ও আমার ভূমিকা আছে। সব ধর্মের মত ইসলাম ধর্মেরও সমালোচনা আমার আছে। বিশেষত ইসলামকে আমি সভ্যতা এবং মানবিকতার জন্য খুবই ক্ষতিকর ধর্ম মনে করি। স্বাভাবিকভাবে এই ধর্মের অনুসারী সমাজের ভিতর থেকে মুক্ত মন এবং মানবিক গুণাবলীর উন্মেষ বা বিকাশের সুযোগ খুব কম থাকে। ধর্ম অন্ধবিশ্বাসের বিষয়। ফলে প্রবল ধর্মবিশ্বাসীরা বিচার-বুদ্ধি বা ‘ক্রিটিক্যাল মাইন্ড’-এর অধিকারী হয় না। ইসলাম ধর্ম উগ্র হবার কারণে এ ক্ষেত্রে মুসলমানরা সাধারণত আরও পিছিয়ে থাকে অন্যান্য ধর্মবিশ্বাসীদের তুলনায়। পাকিস্তান উগ্র ইসলামীদের রাষ্ট্র। সুতরাং সেখানে বিচার-বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষের অভাব থাকা আরও স্বাভাবিক।
কিন্তু মোগল আমাদেরকে ভিন্ন অভিজ্ঞতা দিয়েছেন। একদিকে তিনি প্রত্নতত্ত্ববিদ। সুতরাং যে লেখার আলোচ্য বিষয়ে প্রত্নতত্ত্ব থাকলেও ঋগ্বেদের ব্যাখ্যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে সে লেখা সম্পর্কে তিনি অভিমত নাও দিতে পারতেন। অন্যদিকে, ঋগ্বেদ হিন্দুদের আদি ধর্মগ্রন্থ। সুতরাং মুসলিম সমাজের মানুষ হিসাবে ঋগ্বেদ সংক্রান্ত বক্তব্যকে তিনি অপছন্দ করতে কিংবা এড়াতে চাইতে পারতেন। কারণ হয়ত তিনি মনে করতে পারতেন যে, ঋগ্বেদকে সিন্ধু সভ্যতার অধিবাসীদের সৃষ্টি বলে আমরা ভারতবর্ষের শুধু নয়, হিন্দুদেরও গৌরবকে তুলে ধরতে চেয়েছি।
কিন্তু তিনি আমাদেরকে বলিষ্ঠভাবে সমর্থন জানাতে দ্বিধা করেন নাই। এভাবে তিনি পাকিস্তানের ভিতরে লুক্কায়িত শক্তির এমন একটি জায়গাকে দেখিয়েছেন যা বর্তমান ভারত-রাষ্ট্রের নাই। অর্থাৎ যে পাকিস্তানের আমরা কঠোর সমালোচনা করি যত ক্ষুদ্র হোক তার বাইরেও যে আর একটা পাকিস্তান আছে যার শক্তিমত্তাকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না মোগলের ভূমিকা আমাদের নিকট সেই সত্যকে উন্মোচিত করেছে। মোহাম্মদ রফিক মোগল তো পাকিস্তানের জ্ঞানের জগতের ছোটখাটো কোনও মানুষ না যে তাকে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেওয়া যাবে। তিনি সেখানকার মূলধারার পাণ্ডিত্যের একজন প্রতিনিধিত্বকারী ব্যক্তি, যিনি সেখানকার প্রত্নতত্ত্ব বিষয়ক রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ পদাধিকারী ছিলেন। অর্থাৎ তার সমর্থন মানে সেখানকার স্ট্যাবলিশমেন্টেরও এক ধরনের সমর্থন। এতখানি সাহস কি ভারতের স্ট্যাবলিশমেন্টে থাকা কেউ দেখাতে পেরেছেন? একই সঙ্গে পুরাতত্ত্বে তার আছে আন্তর্জাতিক খ্যাতি। স্ট্যাবলিশমেন্টে থেকে এমন প্রথা কিংবা প্রতিষ্ঠান বিরোধী ভূমিকা আমার জানামতে কোনও ভারতীয় পণ্ডিতই নিতে পারেন নাই।
ভারতের প্রত্নতাত্ত্বিকরা বেশ কিছু কাল ধরে আর্য আক্রমণ তত্ত্বকে মানতে পারছেন না। কিন্তু সেটাও তারা সাধারণত সাহস এবং দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে পারেন না। বরং বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে গাঁইগুঁই করে প্রশ্ন তুলতে তারা পছন্দ করেন। এখানে মিশেল ড্যানিনোর মত ইউরোপীয় পণ্ডিতদের সঙ্গে তাদের পার্থক্য। প্রত্নতাত্ত্বিক সাক্ষ্যের উপর দাঁড়িয়ে ফরাসী প্রত্নতত্ত্ববিদ ড্যানিনো যে স্পষ্ট এবং ধারালো ভাষায় পাশ্চাত্য এবং ভারতীয় মূলধারার পণ্ডিতদের আর্য আক্রমণ তত্ত্বকে উপনিবেশিক পণ্ডিতদের তত্ত্ব হিসাবে চিহ্নিত করে প্রত্যাখ্যান করেছেন সেটা থেকে ভারতীয় প্রাতিষ্ঠানিক পণ্ডিতদের শিখবার আছে বলে আমি মনে করি।
যাইহোক, মোগলের ঘটনা সম্ভবত আর একটা সত্যকে উন্মোচিত করেছে সেটা হচ্ছে মুসলিম সমাজের ভিতরের শক্তি, যেটা অনেক সময় বুঝা যায় না বা সহজে ধরা যায় না। বিষয়টা নিয়ে আমি অনেক ভেবেছি। বিশেষত উভয় বঙ্গের হিন্দু এবং মুসলিম এই উভয় সমাজ সম্পর্কে আমার অনেক অভিজ্ঞতা থেকে আমার বেশ কিছু উপলব্ধি জন্মেছে যার কিছু সাম্প্রতিক কালে দৃঢ়বদ্ধ হয়েছে।
পশ্চিম বঙ্গ সম্পর্কে আমার কিছু অভিজ্ঞতার কথা বলেছি। সেখানে সাধারণত দুই ধরনের অভিজ্ঞতা হয়েছে। এক হচ্ছে হিন্দু ধর্ম এবং ঐতিহ্যে বিশ্বাসী হিন্দুদের সম্পর্কে অভিজ্ঞতা। এরা এমনই অন্ধ বিশ্বাসী এবং ইতিহাস, সমাজ, ধর্ম সম্পর্কে এদের জ্ঞান এবং উপলব্ধি এতই কম অথবা খণ্ডিত যে এদের সম্পর্কে মন্তব্য না করাই সঙ্গত। আর একটা হচ্ছে কম্যুনিস্ট বা মার্কসবাদী ঘরানার বুদ্ধিজীবী এবং পণ্ডিতদের সম্পর্কে অভিজ্ঞতা। এখনকার কথা বলতে পারব না তবে তেরো-চৌদ্দ বছর আগে পর্যন্ত আমার অভিজ্ঞতার কালটাতে পশ্চিম বঙ্গের বুদ্ধিচর্চার জায়গাটা প্রধানত এদের নিয়ন্ত্রণেই ছিল। এদের অধিকাংশেরই ভয় হচ্ছে আমাদের ব্যাখ্যা দ্বারা ভারতের হিন্দুত্ববাদীরা উৎসাহিত হবে। সত্যকেও তাদের এমনই ভয়! হয়ত এই কারণে অতীত জানতেও তাদের অনেকের এত ভয়। কী জানি তাতে যদি অতীতের গৌরবের কিছু বেরিয়ে আসে! একজন উচ্চশিক্ষিত প্রকাশকের কথা আমার এখনও মাঝে মাঝে কানে বাজে, ‘অতীত জেনে কী হবে?’ বাংলাদেশে কখনই কোনও শিক্ষিত মানুষের কাছ থেকে এমন হতভম্বকর উক্তি শুনেছি বলে আমার মনে হয় না। যাইহোক, পশ্চিম বঙ্গে আমার অভিজ্ঞতা থেকে মনে হয়েছে তারা সাধারণভাবে আমাদের ঋগ্বেদের মূল্যায়ন নিয়ে অখুশী এবং মনে মনে ভীতও। কারণ তাদের ভয় এতে হিন্দুত্ববাদীরা বা বিজেপি শক্তি পাবে।
অথচ ঋগ্বেদ সংক্রান্ত আমাদের বক্তব্য যে হিন্দুত্বকেও নাকচ করে সেই বোধটুকুও তাদের সাধারণত হয় না। আমাদের ব্যাখ্যায় সিন্ধু সভ্যতার পতনের জন্য বৈদিক উত্থানের প্রতিক্রিয়ার দিকটা উঠে আসে, যে কারণে ভারতের হিন্দুত্ববাদী পণ্ডিতদের দিক থেকেও আমরা সেভাবে সমর্থন পাই নাই। আমাদের নিকট এ বিষয় সহজবোধ্য যে, বৈদিক আন্দোলন এবং যুদ্ধ সিন্ধু সভ্যতার পতনোন্মুখ নদী নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার ধ্বংসকে ত্বরান্বিত করেছিল। এটা ছিল মূলত নদী নিয়ন্ত্রণ বিরোধী ধর্মীয় আন্দোলন। নদী নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার চূড়ান্ত ধ্বংস দ্বারা তা সিন্ধু সভ্যতার খাদ্য উৎপাদনের প্রধান ভিত্তিকে ধ্বংস ক’রে সিন্ধু সভ্যতারও ধ্বংস সাধন করে। সুতরাং সভ্যতার বিচারে বৈদিক আন্দোলনের ভূমিকা ছিল প্রতিক্রিয়াশীল তথা সভ্যতা বিরোধী। বর্তমান হিন্দু ধর্ম বৈদিক ধর্মের উত্তরাধিকারকে ধারণ করেই গড়ে উঠেছে। সুতরাং হিন্দু ধর্মের ভিতরে রয়েছে সভ্যতা বিরোধী চেতনা এবং সংস্কৃতির গভীর প্রভাব। একটু খোলা মন নিয়ে দেখলে হিন্দু ধর্ম এবং সমাজের সভ্যতা বিরোধী প্রতিক্রিয়াশীলতার দিকটাকে বুঝতে ভুল হয় না।
হিন্দু কম্যুনিস্টরাও এর বাইরে নয়। হিন্দু সমাজের সহজাত দুর্বলতা, ভীরুতা, সঙ্কীর্ণতা এগুলিকে কাটিয়ে ঊর্ধ্বে উঠবার ক্ষমতা তাদের মধ্যেও খুব কমেরই হয়। বিশেষত চিন্তার ক্ষেত্রে এদের নিদারুণ দারিদ্র্য আমার কাছে ধরা পড়েছে। পাশ্চাত্য জ্ঞানতত্ত্বকে প্রশ্ন করবার সাহস হওয়া তো দূরের কথা তার বাইরে যাবার সাহসও তাদের মধ্যে আমি খুব কম দেখেছি। কখনও পাশ্চাত্য বুর্জোয়া জ্ঞানতত্ত্বের বিপরীতে দাঁড়াতে চাইলে তারা অন্ধভাবে পাশ্চাত্যের মার্কসবাদী জ্ঞানতত্ত্বকে আঁকড়ে ধরে থাকতে চায়। সেখানেও কাজ করে অন্ধ ভক্তিবাদ। নিজ সমাজ-জমির উপর দাঁড়িয়ে স্বাধীনভাবে এবং বিচারশীল মন নিয়ে দেখবার সাহস বা ক্ষমতা কোনটাই এদের নাই। আসলে অন্য সকল অন্ধবিশ্বাসীর মত এরাও অন্ধবিশ্বাস নিয়ে বাঁচতেই স্বস্তিবোধ করে। পশ্চিম বঙ্গের মূলধারার কিংবা প্রাতিষ্ঠানিক বুদ্ধিজীবী ও পণ্ডিতদের সম্পর্কে আমার মূল্যায়ন হল এরা খুব বেশী সংখ্যায়ই ব্রিটিশদের রেখে যাওয়া চাকরবাকরদের অধস্তন পুরুষ। জ্ঞানতত্ত্বে এরা হল পাশ্চাত্যের চাকরবাকর।
যাইহোক, আমি এবার দৃষ্টি দিই বাংলাদেশের দিকে। সত্যি কথা বলতে কি দুই বঙ্গের মধ্যে এ বঙ্গের নিকট আমার প্রত্যাশা প্রথম থেকে অনেক দিন পর্যন্তই কম ছিল। সিন্ধু সভ্যতা সম্পর্কে যারা কিছু ধারণা রাখতেন তাদের অধিকাংশের ধারণা ছিল খুব অস্পষ্ট। বিশেষত ঋগ্বেদ পড়া মানুষ খুঁজে পাওয়া আরও কঠিন ছিল। সম্ভবত আমাদের সঙ্গে আলোচনার কিংবা আমাদের বাংলা গ্রন্থ প্রকাশের পর এখানে ঋগ্বেদ পাঠের প্রতি কিছু সংখ্যক মানুষের মধ্যে আগ্রহ দেখা দেয়।
তবে এখানে সিন্ধু সভ্যতা এবং ঋগ্বেদ সংক্রান্ত বিষয়গুলি নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে আমরা ক্রমশ একটু একটু করে ঢাকাসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, সাংবাদিক, লেখক এবং গবেষকদের মধ্যে অনেকের আগ্রহ এবং কারো কারো সমর্থন পেতে শুরু করি। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করা উচিত প্রত্নতত্ত্ববিদ ডঃ নাজিমুদ্দীন আহমেদের নাম। তিনি পাকিস্তান কালে অবিভক্ত পাকিস্তানের প্রত্নতত্ত্ব এবং যাদুঘরের পরিচালক হিসাবে কাজ করেছিলেন। তিনি সিন্ধু সভ্যতার প্রত্নতাত্ত্বিক খননে মাঠ পর্যায়ে কাজ করেছিলেন বলে তিনি আমাকে বলেছিলেন। আমার যতদূর মনে পড়ে তিনি আমাকে জানিয়েছিলেন যে, তিনি মোগলের সঙ্গেও মাঠ পর্যায়ে কাজ করেছিলেন। বাংলাদেশ হবার পর তিনি বাংলাদেশের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের প্রধান হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া তিনি ছিলেন বাংলাদেশে ইউনেস্কোর কালচারাল হেরিটেজ প্রজেক্টের ন্যাশনাল প্রজেক্ট অ্যাডভাইজার। আমাদের সঙ্গে তার যখন পরিচয় হয় তখন তিনি চাকুরী হতে অবসরপ্রাপ্ত। ডঃ নাজিমুদ্দীন আমাদের ইংরাজী বইটা পড়ে খুব খুশী হয়েছিলেন। বাংলা বইটাও (আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা) তিনি পড়েছিলেন। তবে তার পূর্বে ‘আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা’র প্রত্নতত্ত্ব বিষয়ে লিখবার ক্ষেত্রে তার কিছু পরামর্শ আমাদের জন্য ছিল খুব গুরুত্বপূর্ণ। বলা যায় সেটা আমাদের জন্য দিকনির্দেশক হিসাবে কাজ করেছিল। মোট কথা তিনি ছিলেন আমাদের বক্তব্যের দৃঢ় এবং উৎসাহী সমর্থক। তিনি চেয়েছিলেন আমরা যাতে একটা সেমিনারের আয়োজন করি যেখানে তিনি আমাদের তত্ত্বের সমর্থনে বক্তব্য দিবেন। আমাদের দুর্ভাগ্য, সে ধরনের কোনও আয়োজন করতে পারার আগে তিনি মৃত্যু বরণ করেন। তার মৃত্যুর পর অনেকগুলি বৎসর কেটে গেছে।
বিশেষত ‘আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা’ প্রকাশের পর বাংলাদেশে আমরা যে ধরনের সাড়া পাই তা ছিল আমার নিকট অভাবনীয়। কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় বাংলা এবং ইংরাজী দৈনিক সংবাদপত্রে ‘আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা’র উপর রিভিউ বা সমালোচনা প্রকাশিত হয়। এগুলির মধ্যে বাংলা দৈনিক প্রথম আলো এবং ইংরাজী দৈনিক নিউ এজের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ইংরাজী দৈনিক নিউ এজ (The New Age)-এ এটাকে এতই গুরুত্ব দেওয়া হয় যে, এটির উপসম্পাদকীয় পৃষ্ঠায় এই গ্রন্থের উপর ২২ মে, ২০০৪ তারিখে সাংবাদিক ও লেখক Syed Fattahul Alim কর্তৃক লিখিত Rig-Veda reveals secrets of Indus Civilization শিরোনামে একটি কিছু দীর্ঘ নিবন্ধ প্রকাশ করা হয়। বহুল প্রচারিত বাংলা দৈনিক ‘প্রথম আলো’য় ২০ আগস্ট ২০০৪ তারিখে ‘মিথ ও মিথ্যা বনাম ইতিহাস’ শিরোনামে গ্রন্থটির একটি রিভিউ প্রকাশিত হয় যাতে জোরালো এবং প্রাঞ্জল ভাষায় আমাদের বক্তব্যকে তুলে ধরা হয়। রিভিউটি লিখেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোহাম্মদ আবদুল হাই। বিস্ময়কর ব্যাপার হল তিনি আমাদের কাছ থেকে এ বই পান নাই। কারও কাছে বইটা দেখে চেয়ে নিয়ে পড়ে তিনি এত মুগ্ধ হন যে, নিজ উদ্যোগে প্রথম আলোয় একটি রিভিউ লিখেন। পরবর্তী সময়ে তার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়।
যাইহোক, বাংলা ও ইংরাজী আরও পত্র-পত্রিকায় এটির রিভিউ প্রকাশ করা হয। সব জায়গার রিভিউ প্রকাশে আমার বা চঞ্চলের ভূমিকা ছিল না। অর্থাৎ উদ্যোগ বা উৎসাহ ছিল প্রধানত অন্যদের। এভাবে বাংলাদেশে ‘আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা’ সমাদৃত হয়। অবশ্য প্রাতিষ্ঠানিক জায়গাগুলিতে নয়। যেমন বিশ্ববিদ্যালয় বা পাবলিক লাইব্রেরী। যদিও ব্যক্তিগত পর্যায়ে এসব প্রতিষ্ঠানের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বইটি পড়ায় কিংবা নিজেদের সংগ্রহে রাখায় উৎসাহী ছিলেন। অর্থাৎ প্রতিষ্ঠানের সমস্যাটা কোথায় সেটা আমাকে বুঝার চেষ্টা করতে হয়েছে।
যাইহোক, সামান্য কিছু ব্যতিক্রম বাদে সব মিলিয়ে বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা আমার জন্য ইতিবাচক। শুধু যে মুসলিম সমাজে উৎসাহী সমর্থন এবং সহযোগিতা পেয়েছি তা-ই নয়, এখানে হিন্দুদের ভিতরেও পশ্চিম বঙ্গের তুলনায় বেশী ইতিবাচক সমর্থন এবং সহযোগিতাও পেয়েছি। এ প্রসঙ্গে প্রয়াত হিন্দু নেতা প্রেমরঞ্চন দেবের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ‘আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা’র প্রচারে তার ছিল উৎসাহী এবং উদ্যাগী ভূমিকা। বাংলা দৈনিক প্রথম আলো এবং ইংরাজী দৈনিক নিউ এজ বাদে অন্যান্য দৈনিকে রিভিউ প্রকাশ হয়েছিল তার উদ্যোগে। প্রসঙ্গক্রমে বলা উচিত হবে যে, বইটি প্রকাশের পর আলোচনা এবং প্রচারের জন্য তিনি কিছুসংখ্যক কপি নিয়ে পশ্চিম বঙ্গে যান। অবশ্য সেখানে তিনি উৎসাহ ব্যঞ্জক সাড়া না পেয়ে ফেরৎ আসেন। কিন্তু বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা ছিল ভিন্ন। সব মিলিয়ে এখানে বইটি অন্তত একটি বোদ্ধা মহলে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল।
স্বাভাবিকভাবে প্রসঙ্গক্রমে পুনরায় পশ্চিম বঙ্গের অভিজ্ঞতা চলে আসে। ২০০৩ সালে ‘আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা’ প্রকাশের বেশ কিছু দিন পর(২০০৪ সালের অক্টোবর-নভেম্বর) আমি নিজে সেটার কয়েকটা কপি নিয়ে কলকাতায় যাই। উদ্দেশ্য এর ভিত্তিতে আরও কিছু মত বিনিময় করা এবং সম্ভব হলে সেখানে রিভিউ করানো। যারা পড়েছিলেন এবং ব্যক্তিগত পর্যায়ে মত দিয়েছিলেন এমন ২/১ জন ব্যক্তির মতের অবশ্য বিশেষ কোনও গুরুত্ব নাই। কোনও সংবাদপত্র রিভিউ করার গুরুত্ব বোধ করে নাই। তবে একজন গবেষক আমার কাছ থেকে একটা বই নিয়ে ‘বারোমাস’ নামে কলকাতার একটা নামী লিট্ল ম্যাগাজিনে রিভিউ করার জন্য দেন। ২০০৫ সালের শারদীয় সংখ্যায় গ্রন্থ সমালোচক বা লেখক বিষ্ণুপ্রিয়া বসাক মনে হয় বইটা ভালভাবে না পড়ে শুধু গালাগালি করার জন্য মনের ঝাল মিটিয়ে একটা রিভিউ লিখেন। শুধু বুঝলাম যে সিন্ধু সভ্যতা তথা ভারতের গৌরবময় অতীত তুলে ধরবার জন্য লেখকের এত আক্রোশ। হয়ত তাকে বইটাকে গালাগালি দেওয়ার জন্য লিখতে বলা হয়েছিল। তবে বিষ্ণুপ্রিয়ার সমালোচনা পড়ে আমার মনে হয়েছিল বইটা ভালভাবে পড়বার প্রয়োজনও তিনি বোধ করেন নাই। ফলে আমাদের যুক্তি খণ্ডন করবার চেষ্টা না করে নিরর্থকভাবে আমাদেরকে আক্রমণ করেছিলেন। সমালোচক হয়ত মনে করেছিলেন যে বইটা বিজেপি বা হিন্দুত্ববাদীদের পক্ষে যায়। হয়ত তার কাছে হিন্দুত্ব এবং অতীত ভারতবর্ষের ইতিহাস এক জিনিস। সুতরাং অতীতের যদি কিছু গৌরবময় কিংবা ইতিবাচক দিক থাকে তবে সেটাকেও নাকচ ক’রে পারলে তার ইতিহাস-ঐতিহ্যের সবকিছুকে ঘৃণা এবং তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করতে হবে এবং যা কিছু বিদেশী তাকে নিয়ে গৌরবে বুক ফুলিয়ে বেড়াতে হবে।
আমি ভুল হতে পারি। তবে আমার অনুমান লেখক নিজে কিংবা যারা তাকে দিয়ে ‘বারোমাসে’ রিভিউ বা সমালোচনা লিখিয়েছিল তারা কম্যুনিস্ট বা মার্কসবাদী হবে। কারণ দুই বঙ্গের মূলধারার কম্যুনিস্টরা যাদেরকে দেশদ্রোহী বুর্জোয়া হিসাবে ঘৃণা এবং গালিগালাজ করে বেড়ায় তাদের কারও চেয়ে যে দেশপ্রেমহীনতায় তারা নিজেরা এতটুকু কম নয় সেটা আমার খুব ভালভাবে জানা আছে। পাকিস্তান আমলে আমি কম্যুনিস্ট রাজনীতির সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত ছিলাম। ওটাকে আমি খুব কাছে থেকে দেখেছি বললেও কম বলা হয়, বরং খুব গভীরে থেকে দেখেছি বলাই সঙ্গত। এ থেকে এ দেশে কম্যুনিস্ট রাজনীতির নেতৃত্ব এবং মূলধারায় যারা থাকেন তাদের মানসিক গড়নটা আমার খুব ভালভাবে জানা আছে। সমস্যাটা হয়ত শুধু মার্কসবাদ কিংবা কম্যুনিস্ট আদর্শের নয়, সমাজেরও। কারণ আরও তো দেশ আছে যেগুলিতে মার্কসবাদী বা কম্যুনিস্টরা রাষ্ট্র ও সমাজ বিপ্লব ঘটিয়ে এবং সাম্রাজ্যবাদ-উপনিবেশবাদের শৃঙ্খল চূর্ণ করে দেশকে মধ্যযুগ থেকে আধুনিক যুগে এবং পরাধীনতা থেকে উপনিবেশিকতার শৃঙ্খলমুক্ত স্বাধীনতায় নিয়ে এসেছে। সুতরাং আমাদের সমাজের অন্তর্গত সমস্যাকেও আমাদের বুঝতে চেষ্টা করা উচিত।
এই সমাজের প্রভাবটা মার্কসবাদীদেরও কীভাবে প্রভাবিত করে সেটা বুঝা যায় তাদের মানসিক গড়নের উপর সমাজের প্রভাব দেখলে। আর সেখানে চলে আসে ধর্মের বিষয়টা। বঙ্গ এবং উপমহাদেশের প্রেক্ষিতে ইসলাম এবং হিন্দু এই দুই ধর্ম। এই দুই ধর্ম দ্বারা এই উপমহাদেশের মুসলমান এবং হিন্দু সমাজ এবং জনমানস গভীরভাবে প্রভাবিত। সুতরাং এই দুই সমাজ এবং জনমানসের অনেক সমস্যাকে বুঝতে হলে এ্ই দুই ধর্মের বৈশিষ্ট্য এবং সমস্যাগুলিকে বুঝতে হবে বলে আমি মনে করি। প্রসঙ্গক্রমে এখানে সে বিষয়ে সামান্য কিছু ইঙ্গিত দিলেও এটা ভিন্ন আলোচনার বিষয়। সুতরাং এই আলোচনায় খুব প্রয়োজন না হলে সে দিকটাতে যাবার চেষ্টা করব না।
এবার পশ্চিম বঙ্গের বুদ্ধিবৃত্তির একটা সমস্যা তুলে ধরে আমি বর্তমান আলোচনাকে সমাপ্তির দিকে নিব। পশ্চিম বঙ্গে আমি যখনই পণ্ডিত কিংবা উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত মহলে ইতিহাস বা এই ধরনের কোনও বিষয়ে আলোচনা করতে গেছি তখন প্রায়শ আমাকে একটা প্রশ্ন শুনতে হত, ‘আপনি কোন “ডিসিপ্লিনের” মানুষ?’ বিশেষত সিন্ধু সভ্যতা কিংবা বেদ প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গেলে প্রায় ক্ষেত্রেই এ ধরনের প্রশ্ন শুনতে হত। আমি কোন প্রতিষ্ঠানে আছি এটা জানবার পরও তাদের এই প্রশ্ন শুনতে হত। আমি কয়েক বৎসর গবেষণা প্রতিষ্ঠানে থাকায় তারা অনেকে হয়ত সেটা জানতেন। তা জানুন বা না জানুন এই প্রশ্ন প্রায়শই আসত। তার মানে প্রশ্নকর্তা জানতে চাইতেন আমি কোন বিষয়ে উচ্চশিক্ষা লাভ করেছি। কিংবা আমার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বা বিদ্যাচর্চা কোন বিষয়ের উপর। আমি নিজে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র ছিলাম। সুতরাং সেটাই বলতাম। তারপর তারা আমার সঙ্গে আলোচনায় আসতেন।
বাংলাদেশে আমি কখনও এ ধরনের প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছি বলে মনে পড়ে না। সেটা যে পর্যায়ে যাদের সঙ্গেই আলোচনা করি না কেন। প্রসঙ্গক্রমে যদি কখনও অনেক আলাপের মধ্যে সে বিষয় উঠত তবে ভিন্ন কথা। কিন্তু প্রত্নতত্ত্বের ছাত্র না হয়ে কিংবা প্রাচীন ভারতের ইতিহাস অথবা বেদ-উপনিষদের ছাত্র না হয়েও আমার সীমা অতিক্রম করেছি কিনা সেটা নিয়ে কারও মাথা ব্যথা দেখি নাই। সুতরাং কেউ আমার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বিষয় নিয়ে সেভাবে জানতে আগ্রহী হতেন না। বরং তাদের আগ্রহের বিষয় হত আমার বা আমাদের বক্তব্য। সেটাই তারা নানানভাবে বুঝতে বা জানতে চাইতেন। অথচ পশ্চিম বঙ্গে এটা একটা সাধারণ প্রশ্ন বিশেষত পণ্ডিত মহলে। সেটা হচ্ছে আমি কোন ‘ডিসিপ্লিনের’ অথবা কোন ‘ডিসিপ্লিন’ থেকে আসা মানুষ। বারবার এই প্রশ্ন আমাকে প্রথম দিকে অবাক করলেও পরে এর কারণটা স্পষ্ট হয়। এই কারণে যাবার জন্য গল্পের মত শুনাবে এমন একটা ঘটনার কথা বলি। মানুষের তত্ত্বজ্ঞানের উৎস বাস্তব। আমি সেই বাস্তব থেকে এখন এমন একটা তত্ত্বজ্ঞানে যেতে চেষ্টা করি।
ঘটনাটা ১৯৭১ সালে যুদ্ধের সময়কার। সেই সময় আমি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে তৎকালীন পূর্ব বঙ্গের জাতীয় মুক্তি যুদ্ধ সংগঠিত করবার জন্য দুই বঙ্গের বিস্তীর্ণ অঞ্চল ভ্রমণ করি। এমনই একটা ভ্রমণে আমি তৎকালের এপার বঙ্গ থেকে পশ্চিম বঙ্গে প্রবেশ করি। পায়ে হেঁটেই দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হচ্ছিল। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্ত পাড়ি দিয়ে পশ্চিম বঙ্গে পা দিবার অল্প পর সীমান্তবর্তী এলাকার স্থানীয় গ্রাম্য একজন লোক আমার সঙ্গী হন। চেহারা দেখে সব বুঝবার কথা নয়। তবে তাকে দেখে এবং তার কথা শুনে তাকে আমার একজন নিতান্ত সাধারণ গ্রামবাসী মনে হয়েছিল। যাইহোক, তার উদ্দেশ্য ছিল গল্প করতে করতে হাঁটা। কথা তিনিই বলছিলেন। আমি মাঝে মধ্যে হুঁ হাঁ করছিলাম। অল্পক্ষণ পরই তিনি মুসলমানদের তীব্র সমালোচনা করে কথা বলতে থাকলেন। এবং পূর্ব পাকিস্তানের হিন্দুরা যে বোকার মত লোভ করে পূর্ব পাকিস্তানে পড়ে ছিল সে কথা বললেন। ‘এখন বোকা এবং লোভী হিন্দুরা ঠেলা বুঝছে। কতবার বলেছি তোরা মুসলমানদের সঙ্গে থাকতে পারবি না। মুসলমানের দেশ পাকিস্তান ছেড়ে তোরা ভারতে চলে আয়। মুসলমানদের সঙ্গে কি থাকা যায়? যায় না। এখন বুঝ্ ঠ্যালা!’ ইত্যাদি, ইত্যাদি। বেশ কিছুক্ষণ তার কথা চলল। প্রায় সবটা জুড়ে থাকল মুসলমানদের বিরুদ্ধে তীব্র সমালোচনা এবং নিন্দা।
আমার তাতে কোনও সমস্যা ছিল না। তার অনেক অভিযোগ যে সত্য সেটা আমি জানতাম। সব সত্য না হলেই বা কী? আমার কী যায় আসে তাতে? কিন্তু বিপদ বাধল তখন যখন তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘অনেক ক্ষণ তো আলাপ করলাম। কিন্তু দাদা, আপনার নামটাই তো জানা হল না।’ আমি একটা বাংলা নাম বললাম। শুনে খুব একটা তৃপ্ত হলেন না। এবার জানতে চাইলেন, ‘আপনার জাত কী?’ এবার আমি প্রমাদ গুনলাম। কারণ এতক্ষণ ধরে মুসলমানদের গুষ্টি উদ্ধার করে যে সব কথা বলেছেন তাতে আমি যদি আমার মুসলমান পরিচয় বলি তবে তিনি লজ্জা পেতে পারেন। আর আমি যদি বলি ‘আমি কোনও জাত মানি না’ তাহলে তিনি মানবেন না। আর যদি বলি আমার কোনও ধর্ম বিশ্বাস কিংবা ধর্ম নাই সেটাও আসলে হাস্যকর হবে। ধর্মীয় পরিচয়ে আমার ভয় পাবার কারণ ছিল না। কিন্তু এতটা পথ একত্রে চলার পর তাকে লজ্জায় ফেলতে চাইলাম না। একটা নির্দোষ মিথ্যার আশ্রয় নিলাম। সুতরাং বললাম, ‘হিন্দু।’ উত্তরে তিনি বললেন, ‘তা তো আমি জানি। কিন্তু শুধু হিন্দু বললে তো হবে না। হিন্দু হলেও একটা জাত আছে না?’ এইবার বুঝলাম আমাকে বর্ণজাতির কাঠামোতে ফেলে স্বস্তি পেতে চাইছেন। বেশী বড়ও না, আবার বেশী ছোটও না, মাঝামাঝি এমন একটা জাত বুঝাতে তখন আমি বললাম, ‘আমি কায়স্থ।’ যতদূর মনে পড়ে আমার বাংলা নামের শেষে ‘রায়’ পদবী উল্লেখ করে তাকে নিশ্চিন্ত করলাম। এবার তিনি স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন, ‘হ্যাঁ, তাই বলেন।’ এরপর বেশীক্ষণ আর আমরা একত্রে হাঁটি নাই। তার গন্তব্য আসাতে তিনি চলে গেলেন। আমি আমার পথে গেলাম আমার গন্তব্যের দিকে। সেটা আরও দূরে।
আমার মনে হয় উপরে বর্ণিত ঘটনার মধ্য থেকে হিন্দু মানসের একটা চমৎকার চিত্র বেরিয়ে আসে। পবিত্রতা-অপবিত্রতার ধারণা ভিত্তিক এবং অপরিবর্তনীয় পেশা ও মর্যাদা ভিত্তিক বর্ণজাতির কাঠামোতে না ফেললে হিন্দু সমাজকে যেমন সঠিকভাবে বুঝা যাবে না তেমন তার মানস অবতলের গভীরেও প্রবেশ করা যাবে না। সভ্যতার বিশেষায়ন বা স্পেশিয়ালাইজেশনের বাস্তবতার সঙ্গে তার বর্ণজাতিভেদ ভিত্তিক চেতনার সংমিশ্রণে এমন এক বুদ্ধিবৃত্তিক অচলায়তন সৃষ্টি হয় যেখানে জ্ঞানের এক শাখা থেকে আর এক শাখায় সাহসী এবং স্বচ্ছন্দ বিচরণ অসম্ভব অথবা অসম্ভবপ্রায় হয়ে থাকে। বাস্তবে অপরিবর্তনীয় বর্ণজাতি কাঠামোর অনেক কিছুকে এখন আর না মানলেও হিন্দু মন অজস্র বিভাজনের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত বর্ণজাতির কাঠামোকে আজ অবধি অতিক্রম করতে কিংবা ভাঙ্গতে পারে নাই। সুতরাং হিন্দুদের এত প্রচণ্ড রক্ষণশীলতা। এই রক্ষণশীলতার কারণেও একবার জোর করে তাদের উপর প্রতিষ্ঠান হোক, আর যা-ই হোক একটা কিছু চাপিয়ে দিতে পারলে তারা আর সেটা থেকে বের হতে চায় না। বরং সেটাকেই আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকতে চায়।
সুতরাং পশ্চিম বঙ্গে আমি কেন এত ডিসিপ্লিনের প্রশ্ন শুনতাম সেটা বোধহয় এখন বুঝা যায়। একটা অনড়, অপরিবর্তনীয় কাঠামোতে রেখে হিন্দু মন সবকিছুকে বুঝতে চায়। কম্যুনিস্ট বা মার্কসবাদী হলেও তাতে বিশেষ কিছু হেরফের হয় না। তার মানস জগতে কাজ করে হিন্দু ধর্ম তথা সমাজের এই কাঠামোগত চেতনা। এটাকে হয়ত প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোও বলা চলে। এই কাঠামো আবার অপরিবর্তনীয় পেশা এবং অলঙ্ঘনীয় পবিত্রতা-অপবিত্রতা তথা অলঙ্ঘনীয় শ্রেষ্ঠত্ব এবং নীচতার ধারণার ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। একটা অনমনীয়, অপরিবর্তনীয় এবং অলঙ্ঘনীয় ছকে সে যেমন আবদ্ধ থাকতে পছন্দ করে তেমন সবকিছুকে এমন একটা ছকে ফেলে দেখতেই তার পছন্দ। যে কথা বললাম, সেখানে আবার থাকতে হবে উচ্চতা-নীচতা, মর্যাদা-অমর্যাদা বা বেশী মর্যাদা, কম মর্যাদা এবং শ্রেষ্ঠত্ব-হীনতার স্থায়ী এবং অপরিবর্তনীয় স্তরবিন্যাস। আমি তো প্রাচীন ইতিহাসের ছাত্র নই, তার উপর নই প্রতিষ্ঠিত বেদ পণ্ডিত। সবচেয়ে বড় কথা, প্রথমত আমি পরিচয়ে মুসলমান, দ্বিতীয়ত কোনও পাশ্চাত্য বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচীন ভারতের ইতিহাস বিষয়ক নামী অধ্যাপকও আমি নই, সুতরাং আমাকে বা আমাদের বক্তব্যকে তারা গুরুত্ব দিবে কেন?
এ প্রসঙ্গে আর একটা প্রশ্ন জাগে সেটা হচ্ছে পাশ্চাত্য দ্বারা উদ্ভাবিত আর্য আক্রমণ তত্ত্বের প্রতি হিন্দু চেতনার কোনও ধরনের অনুমোদন আছে কিনা। প্রশ্নটা আসা স্বাভাবিক। কারণ যে কথা একটু আগেই বলেছি হিন্দু ধর্ম এবং সমাজ বর্ণজাতিভেদমূলক এমন এক স্তরবিন্যস্ত বিভাজনের উপর প্রতিষ্ঠিত যেখানে এক বর্ণজাতি থেকে অপর বর্ণজাতির ব্যবধান অলঙ্ঘনীয়। এই ধরনের সমাজ বিন্যাসের শীর্ষে থাকে সবচেয়ে পবিত্র এবং সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ বর্ণজাতি হিসাবে ব্রাহ্মণ, ধর্ম চর্চার একচ্ছত্র অধিকার এবং সেই সঙ্গে জ্ঞান চর্চারও মূল দায়িত্ব যার হাতে। পবিত্রতা এবং শ্রেষ্ঠত্বের বিচারে তার নীচে অবস্থান করে ক্ষত্রিয়, যার হাতে থাকে রাষ্ট্রশাসন এবং যুদ্ধের দায়িত্ব। তত্ত্বগতভাবে তার নীচে আছে বৈশ্য। বাকীরা শূদ্র। তারা সবার নীচে।
প্রকৃতপক্ষে সমগ্র শ্রমজীবীই শূদ্র, সুতরাং অপবিত্র, নীচ এবং ঘৃণিত। আসলে ব্রাহ্মণসহ সমগ্র উচ্চবর্ণের নিকট সমগ্র সাধারণ ভারতবাসী অপবিত্র এবং ঘৃণিত শূদ্র ছাড়া আর কিছু নয়। অবশ্য আর একদল আছে, তারা হল অস্পৃশ্য। তারা সর্বাপেক্ষা অপবিত্র, সুতরাং সর্বাপেক্ষা ঘৃণিত। তাদের ছোঁয়া বা স্পর্শ এমনকি ছায়া পর্যন্ত অপবিত্র। এরা মূলধারার হিন্দু সমাজেরও বাইরে অবস্থান করে। এখন এদের দলিতও বলা হয়।
সুতরাং এটা বলা ভুল হবে না যে, হিন্দু উচ্চবর্ণের সংখ্যাল্প মানুষরা পাশ্চাত্য কর্তৃক উদ্ভাবিত বহিরাগত এবং শ্বেতাঙ্গ আর্য আক্রমণ তত্ত্বকে সংখ্যাগুরুর উপর নিজেদের বর্ণজাতিগত শ্রেষ্ঠত্ব এবং আধিপত্য রক্ষায় সহায়ক হিসাবে দেখতে পায়। কাজেই নিজেদেরকে ‘বহিরাগত, শ্বেতাঙ্গ এবং বিজয়ী আর্যদের’ বিশুদ্ধ বংশধর ভেবে নিলে লাভ ছাড়া ক্ষতি কী? বহুকাল ধরে অবশ্য আর্যদের সম্পর্কে শ্বেতকায়, উন্নত নাসা ইত্যাদি রেসিয়াল বা জাতিবাদী পরিচয় আর দেওয়া হয় না। বিশেষত দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর থেকে ইউরোপীয়রা আর্যদের উপর এ ধরনের গুণ বা বৈশিষ্ট্য আরোপ করার ব্যাপারে সতর্ক হয়ে গেছে। এখন তারা ভাষাতত্ত্বের উপর জোর দেয়। এখন আর্যদের সম্পর্কে বলা হয় যে তারা ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর মানুষ, যারা ইউরোপ কিংবা মধ্য-এশিয়ার কোনও অজ্ঞাত স্থান থেকে বিজয়ীর বেশে ভারতবর্ষে প্রবেশ করেছিল। তাতে অবশ্য বর্ণহিন্দুদের সমস্যা নাই। বৈদিক কিংবা ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাভাষীদের শ্রেষ্ঠত্ব কিংবা বিজয়ের ব্যাপারটা তো ঠিক রইল! আর পশ্চিম বঙ্গ বলা যাক কিংবা ভারত বলা যাক সেখানকার জ্ঞানের জগতকেও প্রধানত উচ্চবর্ণের হিন্দুরাই নিয়ন্ত্রণ করে।
এখন আর একটু ভাবা যাক। হিন্দুরা সাড়ম্বরে ঋগ্বেদকে তাদের মূল বা আদি ধর্মগ্রন্থ হিসাবে ঘোষণা করে। সেক্ষেত্রে ধর্মীয়ভাবেই বেদ চর্চার অধিকারী উচ্চবর্ণের হিন্দু, বিশেষত ব্রাহ্মণদের ঋগ্বেদের অর্থ একেবারে না বুঝবার কারণ ছিল না বা নাইও। সুতরাং এটাই প্রত্যাশিত যে অন্তত বেদ-পণ্ডিত এবং যারা বেদ পাঠ করেছেন তারা প্রথম থেকেই পাশ্চাত্য পণ্ডিতদের ঋগ্বেদের কদর্থ করার বিরুদ্ধে সোচ্চার হবেন। এটা ঠিক, সবাই যে পাশ্চাত্য পণ্ডিতদের ব্যাখ্যা মেনে নিয়েছিলেন তা নয়। তবে তাদের সংখ্যা এমনই নগণ্য এবং সর্বোপরি তাদের কণ্ঠস্বর আর্য আক্রমণ তত্ত্ববাদীদের ঢক্কা নিনাদে এমনইভাবে চাপা পড়ে থেকেছে যে সাধারণ ইতিহাস পাঠকরা কখনই সে সম্পর্কে জানতে পারেন নাই।
বরং উপমহাদেশের বহু সংখ্যক বেদ-পণ্ডিতসহ বিপুল সংখ্যক সমাজ এবং ইতিহাস বিষয়ক পণ্ডিত এবং লেখক ঊনবিংশ শতাব্দীর পাশ্চাত্য পণ্ডিতদের প্রবর্তিত তত্ত্বের সুরে সুর মিলিয়ে আর্য আক্রমণ তত্ত্বের অভ্রান্ততা প্রচার করে বেড়িয়েছেন। পরিতাপের বিষয় যে, আজও তাদের সংখ্যা কম নয়। ঠিক আছে, অন্যদের ভুল না হয় মেনে নেওয়া গেল। যাদের ধর্মগ্রন্থ ঋগ্বেদ নয়, ফলে এটার চর্চা যাদের করবার কথা নয় তারা না হয় পাশ্চাত্য পণ্ডিতদের ভ্রান্ত ব্যাখ্যা দ্বারা বিভ্রান্ত হতে পারেন। কিন্তু যারা ঋগ্বেদকে তাদের ধর্মগ্রন্থ হিসাবে দাবী করেন এবং তা পাঠ বা চর্চা করেন তাদের কেন ঋদ্বেদের অর্থ এবং তাৎপর্য নিয়ে এতকাল ধরে এত বিভ্রান্তি? ঋগ্বেদে স্পষ্ট ভাষায় বলা কথাগুলির অর্থ বুঝতেও কি এতই কষ্ট হয়?
কী অবলীলায় স্থিতিশীল সভ্য জীবনের মানুষদেরকে পশুপালক, যাযাবর এবং বহিরাগত বলে দেওয়া হল! ঋগ্বেদের বর্ণনা অনুযায়ীই যারা ছিল গঙ্গাসহ বৃহত্তর সপ্তসিন্ধু ভূভাগের নগর ও গ্রামের অধিবাসী, কৃষি ও বাণিজ্যের সঙ্গে সম্পর্কিত, যারা একটা সভ্য সমাজের সকল গুরুত্বপূর্ণ বৃত্তির সঙ্গে সংযুক্ত এবং এমনকি যারা ‘শতদাঁড়যুক্ত’ জাহাজে (ঋগ্বেদ - ১/১১৬/৫) সাগর পাড়ি দিয়ে বাণিজ্য করত, ইউরোপীয় পণ্ডিতদের কলমের খোঁচায় তারা সেসব কিছুই বাদ দিয়ে পশুপালক এবং যাযাবর অশ্বারোহী হয়ে ভারতবর্ষ আক্রমণ অভিযানে নামল! সমগ্র ঋগ্বেদে যারা একটি বারও নিজেদেরকে বহিরাগত বলেন নাই, বরং নিজেদের আবাস ভূমি হিসাবে সপ্তসিন্ধুকে তুলে ধরেছেন কলমের খোঁচায় সেই ঋষিদের আবাস ভূমি কেড়ে নিয়ে তাদেরকে বানানো হল বহিরাগত ভবঘুরে! আর হিন্দু পণ্ডিতরাও প্রায় সবাই এতকাল ঋগ্বেদ ও তার রচয়িতাদের সম্পর্কে সেসব হাস্যকর, উদ্ভট এবং হতভম্বকর মিথ্যাচারকে নির্বিবাদে মেনে নিলেন! কিন্তু কেন?
যারা ঋগ্বেদকে তাদের ধর্মগ্রন্থ হিসাবে দাবী করেন তাদের কেন ঋগ্বেদের অর্থ এবং তাৎপর্য নিয়ে এতকাল ধরে এত বিভ্রান্তি? এ কি শুধু বুদ্ধির দোষ কিংবা জ্ঞানতাত্ত্বিক ভ্রান্তি, নাকি একটু আগেই যে দিকে ইঙ্গিত করেছি তার পুনরুক্তি করে বলব পাশ্চাত্যের মত তাদেরও নিজস্ব কিছু স্বার্থগত প্রেরণা কাজ করেছে এত বড় এক মিথ্যার বিরুদ্ধে না দাঁড়াবার পিছনে?
এই আলোচনা শেষ করার পূর্বে বৈদিক এবং হিন্দু ধর্মের পার্থক্য সম্পর্কে যারা তেমন একটা ধারণা রাখেন না তাদের সুবিধার জন্য এখানে এ কথা বলে রাখা উচিত হবে যে, আমরা যেন বৈদিক ধর্ম এবং হিন্দু ধর্মকে এক করে না দেখি। যদিও হিন্দুরা বেদ বা ঋগ্বেদকে তাদের আদি ধর্মগ্রন্থ বলেন এবং বেদের উত্তরাধিকারকে স্বীকার করেন বাস্তবে তারা কিন্তু বহু বিষয়েই বৈদিক ধর্ম থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। যেমন হিন্দু ধর্মে প্রতিমা পূজা থাকলেও ঋগ্বেদ বা বৈদিক ধর্মে প্রতিমা পূজার জায়গা নাই। হিন্দু ধর্মের প্রধান দেব-দেবীরাও বৈদিক ধর্ম বা ঋগ্বেদের দেবতা থেকে ভিন্ন। শুধু তা-ই নয়, বর্ণাশ্রম ভিত্তিক তথা ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র এই চার বর্ণ ভিত্তিক জাতিভেদ প্রথা বর্তমান হিন্দু ধর্ম এবং সমাজের মূলভিত্তি হলেও বৈদিক ধর্মে এর কোনও স্থান ছিল না। ঋগ্বেদ পড়লে যেমন সেটা বুঝা যায় তেমন ঋগ্বেদের এক ঋষিও দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানাচ্ছেন, ‘দেখো, আমি স্তোত্রকার, পুত্র চিকিৎসক, কন্যা প্রস্তরের উপর যব-ভর্জন-কারিণী। আমরা সকলে ভিন্ন ভিন্ন কর্ম করছি।’ (৯/১১২/৩)।
বৈদিক আন্দোলনের অনেক পরবর্তী কালে বৈদিক সমাজ বর্ণজাতিভেদ ভিত্তিক হিন্দু সমাজে পরিণত হলে বর্ণজাতিভেদ প্রথাকে ধর্মের অঙ্গীভূত করে নেওয়া হয়। যেহেতু ঋগ্বেদকে ব্রাহ্মণ বা বর্ণ হিন্দুরা বাস্তবে সাধারণভাবে না মানলেও মৌখিকভাবে এবং তত্ত্বগতভাবে কিংবা নৈতিকভাবে তাদের মূল ধর্মগ্রন্থ হিসাবে ঘোষণা করে সেহেতু বেদ রচনার পরবর্তী কালে বর্ণাশ্রম প্রথার সমর্থনে ‘পুরুষ দেবতা’ নামে রচিত একটি সূক্তকে ঋগ্বেদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এটি ঋগ্বেদের শেষ অর্থাৎ দশম মণ্ডলের নব্বই নম্বর সূক্ত। বর্তমান কালের ভাষাতাত্ত্বিক পণ্ডিতরা সকলে এটিকে সংস্কৃত ভাষায় অর্থাৎ অবৈদিক ভাষায় রচিত মন্ত্র বলেন। সংস্কৃত ভাষা বৈদিক ভাষা থেকে আগত হলেও এটি বৈদিক ভাষার পরবর্তী এবং রূপান্তরিত রূপ। অর্থাৎ ‘পুরুষ দেবতা’ নামে মন্ত্রটি প্রকৃতপক্ষে অবৈদিক এবং পরবর্তী কালের রচনাকার কর্তৃক ঋগ্বেদে প্রক্ষিপ্ত একটি মন্ত্র মাত্র, যার সঙ্গে বৈদিক সমাজ কিংবা ধর্মের কোনও সম্পর্ক নাই।
বর্ণাশ্রম ভিত্তিক জাতিভেদ প্রথাকে ধর্মীয় বৈধতা দানের উদ্দেশ্যে পরবর্তী কালে ব্রাহ্মণ পণ্ডিতরা যে এ কাজ করেছিলেন সেটা স্পষ্ট। সুতরাং এ কথা বলাই যুক্তি সঙ্গত যে ধর্মীয় বিধানের অলঙ্ঘনীয়তার কারণে পরবর্তী কালে বেদের মন্ত্র পরিবর্তন করতে না পারলেও উচ্চবর্ণের হিন্দু বিশেষত ব্রাহ্মণরা তাদের শ্রেণী স্বার্থে ইচ্ছামত ঋগ্বেদ তথা বেদের অর্থ কিংবা ব্যাখ্যা দান করেছে। ধর্মীয় বা শাস্ত্রীয় বিধানে অন্য ধর্মাবলম্বীদের তো প্রশ্নই উঠে না এমনকি শূদ্রদের জন্যও বেদ পাঠ নিষিদ্ধ। তবে ধর্মীয় বিধানে ক্ষত্রিয় এবং বৈশ্যের জন্য বেদ পাঠ নিষিদ্ধ না হলেও বাস্তবে ব্রাহ্মণরা সুদীর্ঘ কাল তাদের জন্যও বেদ পাঠ নিষিদ্ধ করে রেখেছিল। সবচেয়ে বড় কথা দেব-দেবীর পূজা তথা ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পরিচালনার অধিকারী ব্রাহ্মণ হওয়ায় এবং পূজায় বেদের মন্ত্রপাঠ অপরিহার্য হওয়ায় ধর্মগ্রন্থ হিসাবে বেদ পাঠ বা চর্চার অধিকার বা সুযোগও ব্রাহ্মণের একচেটিয়া অধিকারে চলে গিয়েছিল। সুতরাং বেদের যা খুশী অর্থ করতে কিংবা যেভাবে সুবিধা সেভাবে ব্যাখ্যা করতে ব্রাহ্মণদের সমস্যা কী? উচ্চবর্ণের অন্য বর্ণজাতিগুলিও নিম্নবর্ণের উপর নিজেদের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক আধিপত্য রক্ষায় সহায়ক হিসাবে ব্রাহ্মণদেরকে দেখেছে। ফলে এরা সবাই মিলে বর্ণজাতিভেদমূলক ব্যবস্থাকে কেন্দ্র করে ব্রাহ্মণদের নেতৃত্বে নিজেরা যেমন ঐক্যবদ্ধ হয়েছে তেমন ঘৃণিত অবস্থানে রেখে দিয়ে নিম্নবর্ণের বিপুল সংখ্যাগুরু শ্রমজীবী জনগোষ্ঠী অর্থাৎ বাকী সমাজকেও ঐক্যবদ্ধ করেছে। জন্মগতভাবে পাওয়া হীন এবং ঘৃণিত অবস্থান পরিবর্তনের লড়াই না করে নিম্নবর্ণের মানুষরাও ভাগ্যলিপি বা পূর্বজন্মের কৃত পাপের ফল বলে নির্বিবাদে সেটাকে মেনে নিয়েছে হাজার হাজার বছর ধরে। ধর্মের এমনই গুণ! এই বাস্তবতায় বর্ণজাতিবাদের সুবিধা ভোগকারী একটা শ্রেণীর স্বার্থ ব্রিটিশ এবং পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদী-উপনিবেশবাদী স্বার্থের সঙ্গে মিলে গেলে তারা কোন্ দুঃখে ঐ স্বার্থের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ তত্ত্বের বিরুদ্ধে দাঁড়াবে?
আসলে ব্রাহ্মণকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠা হিন্দু ধর্মের জাত-পাতের বিভাজন তথা চতুর্বর্ণ (ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এবং শূদ্র) ভিত্তিক জাতিভেদ প্রথা নিকৃষ্টতায় শ্বেতবর্ণজাতিবাদ কিংবা ইউরোপীয় রেসিজমের চেয়ে কোন অংশে কম নয়। ফলে বহিরাগত আর্য আক্রমণ তত্ত্ব ব্রাহ্মণকেন্দ্রিক উচ্চ বর্ণজাতিসমূহের অন্তর্গত বর্ণজাতিগত দম্ভকে যে তৃপ্ত করবে সেটা স্বাভাবিক। সম্ভবত এটাও একটা কারণ যার জন্য ঋগ্বেদ এবং প্রত্নতত্ত্বের সব সাক্ষ্য-প্রমাণ বহিরাগত আর্য আক্রমণ তত্ত্বকে নাকচ করলেও পশ্চিম বঙ্গ কিংবা ভারত আজ অবধি এই হাস্যকর তত্ত্বের বিরুদ্ধে বৃহদায়তনে কোনও সামাজিক জাগরণ ঘটাতে অক্ষম হচ্ছে। হিন্দু বর্ণজাতিবাদ বা জাত-পাতের বিভাজন যে তত্ত্বের মধ্যে নিজের ছায়া দেখতে পায় সেই তত্ত্ব যতই মিথ্যা এবং ভারতবর্ষের প্রতি অমর্যাদাসূচক হোক তার বিরুদ্ধে ঘৃণার জাগরণ ঘটানোও কঠিন নয় কি?
এই রকম একটা সমাজ থেকে বড় কী হতে পারে? মাঝে মাঝে চিন্তা করে অবাক হই বিরাট ও প্রবল পুরুষ সুভাষচন্দ্র বসু ঐ সমাজের গর্ভ থেকে কী করে জন্ম নিয়েছিলেন! বুঝা যায় জন্ম নিতে পারলেও এই কারণে তিনি সফল হতে পারেন নাই। কারণ স্বদেশে পায়ের নীচে কোনও শক্ত জমি পান নাই। শুধু বিদেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে কতটুকু কী করা যায়?
যাইহোক, পশ্চিম বঙ্গ থেকে অন্তত এই মুহূর্তে আমি তেমন কিছু আশা করি না। এখন পর্যন্ত ভারতের দিক থেকেও আশা করবার মত তেমন কিছু দেখি না। আপাত দৃষ্টিতে ভারতে জ্ঞানচর্চার ব্যাপকতা থাকলেও সাধারণভাবে সেগুলি পাশ্চাত্য জ্ঞানতত্ত্বের বিভিন্ন শাখা-প্রশাখার টীকাভাষ্য ছাড়া আর কিছু না। স্বাধীনভাবে চিন্তার অক্ষমতা এবং মৌলিক চিন্তার অভাব ভারতের জ্ঞানচর্চায় প্রকটভাবে দৃশ্যমান। স্বাধীন এবং মৌলিক চিন্তাগুলি সেখানে দাঁড়াবার মত সুযোগ খুব সামান্যই পায় অথবা সেগুলি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রচলিত ধারার জ্ঞানচর্চার জঙ্গলে পথ হারায়।
উপমহাদেশ তথা ভারতবর্ষে আর্য আক্রমণ তত্ত্বের বিরুদ্ধে আমাদের দীর্ঘ লড়াই যে বিষয়টিকে আমার নিকট স্পষ্ট করেছে সেটা হচ্ছে সাধারণভাবে ভারতীয়দের নিস্তেজতা এবং আত্মমর্যাদা বোধের অভাব। একই সঙ্গে স্পষ্ট হয়েছে ইতিহাসের সত্যকে গ্রহণে ইউরোপ বা পাশ্চাত্যের অনীহা। প্রত্নতত্ত্ব দ্বারা ভারতবর্ষে আর্য আক্রমণ তত্ত্ব নাকচ হবার এত কাল পরেও সেটাকে রক্ষা করতে চেয়ে এবং ঋগ্বেদ যে ভাষায় লেখা হয়েছিল সেই ভাষাভাষী মানুষদের যদি আর্য বলা যায় তবে সেই আর্যরা যে ভারতবর্ষ থেকে ইউরোপ যায় নাই সেটা প্রমাণের জন্য এখনও ইউরোপীয় পণ্ডিতদের চেষ্টার অন্ত নাই। সুতরাং সিন্ধু সভ্যতার বাইরে তথা ভারতবর্ষের বাইরে আর্য তথা ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর উৎস খুঁজবার নানান হাস্যকর চেষ্টা আজ অবধি অব্যাহত রয়েছে।
এমনই এক হাস্যকর তত্ত্ব নিয়ে অল্প কিছুদিন আগেও তারা খুব মাতামাতি করলেন। তারা প্রাচীন আনাতোলিয়া বা তুরস্কের কুরগানের এক ক্ষুদ্র পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠীকে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর আদি পুরুষ তথা আদি আর্য হিসাবে চিহ্নিত করে কিছুদিন খুব শোরগোল তুললেন। কম্পিউটারে অঙ্ক কষে তার নিখুঁত (!) প্রমাণও হাজির করলেন! কিছুদিনের মধ্যে কুরগান তত্ত্বের এই ধাপ্পা ফুটো বেলুনের মত চুপসেও গেছে। তবু তারা সত্যটাকে স্বীকার করবে না। অর্থাৎ এত কিছুর পরেও ইউরোপের মূলধারা ভারতবর্ষের কাছে বর্তমান ইউরোপীয়দের ভাষা, সভ্যতা ও সংস্কৃতির জন্মগত উত্তরাধিকারের ঋণ স্বীকার করতে রাজী নয়। কারণ তাদের রয়েছে সাম্রাজ্যবাদী-উপনিবেশবাদী দম্ভ।
এদের পাশে রাখা যাক চাকরবৃত্তিধারী ভারতীয় পণ্ডিতদের ধারাকে। চরম মিথ্যাচারপূর্ণ এবং উপমহাদেশের জন্য চরম অগৌরবের একটা হাস্যকর এবং উদ্ভট তত্ত্বকে স্পর্ধার সাথে এবং চরম ঘৃণাভরে ছুঁড়ে ফেলবার মত সাহসও আজ অবধি ভারতের এই চাকরবাকরদের হল না। কারণ এরা যে রাজনীতি করেন না, বরং বিশুদ্ধ (!) জ্ঞান চর্চা করেন! সুতরাং জ্ঞানতত্ত্বের আড়ালে পাশ্চাত্যের অপরাজনীতিও এদের কাছে বিশুদ্ধ জ্ঞানের সাধনা! এরা যে আজও এদের ব্রিটিশ এবং পাশ্চাত্য প্রভুদের আত্মমর্যাদা বোধহীন খাঁটি চাকরবাকর এবং তাদের ‘রেসিস্ট’ রাজনীতির তল্পিবাহক রয়ে গেছে এই একটা ঘটনা থেকেই সেটা প্রমাণ হয়।
পাকিস্তান সম্পর্কে এক মোগলকে দিয়ে মূল্যায়ন করা ঠিক নয়। তবু তার সম্ভাবনা এবং শক্তির জায়গাটাকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ধর্মের কারণে দাসত্ব (বান্দাত্ব) এবং বর্বরতার চেতনা দ্বারা মুসলিম সমাজ খুব বেশী প্রভাবিত হলেও মুসলমানের থাকে প্রবল সাহস এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষা, কিছু ক্ষেত্রে তীব্র আত্মমর্যাদা বোধ। সেগুলির ধাক্কায় হঠাৎ কখন সে গাঝাড়া দিয়ে জেগে উঠে বিদ্যমান সব ধারণা কিংবা ব্যবস্থাকে লণ্ডভণ্ড করে ফেলে সেটাকে অনেক সময় আগে থেকে বুঝা যায় না। দৃষ্টান্ত তো আছেই তুরস্কের কামাল পাশা কর্তৃক খেলাফত উচ্ছেদের ইতিহাস। একাত্তরে বাংলাদেশের অভিজ্ঞতার কথাও বলা যায়। তবে পাকিস্তান এখনও খুব বেশী ধর্মাচ্ছন্ন। এটা তাকে চিন্তার ক্ষেত্রে খুব বেশী পিছিয়ে রেখেছে। চিন্তায় অগ্রগমন না হলে বাস্তবে অগ্রগমন ঘটবে কী করে?
আমার অভিজ্ঞতা থেকেই আমি শেষ পর্যন্ত যে উপলব্ধিতে পৌঁছেছি তা হল চিন্তার জগতে ভারতবর্ষে বাংলাদেশই সবচেয়ে এগিয়ে আছে। এখানে অনেক সমস্যা আছে। সেটা সামাজিক ক্ষেত্রে এবং চিন্তার জগতেও। সেসব সমস্যার অনেকগুলিই পর্বত প্রমাণ। যেমন ধর্মের সমস্যা। তা সত্ত্বেও চিন্তার জগতে সেগুলিকে অতিক্রম করবার আকাঙ্ক্ষা এবং স্পর্ধাও যত সামান্যই হোক উপমহাদেশে এখানেই সর্বাপেক্ষা দৃশ্যমান। আর এ কথাও তো সত্যি, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টি থেকে এবং যুক্তি ও প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ সহকারে ইতিহাসের নামে পাশ্চাত্যের প্রতিষ্ঠিত ভুয়া তত্ত্বকে এখানেই আমরা সাহসের সঙ্গে নস্যাৎ করেছি এবং দিয়েছি ঋগ্বেদের যৌক্তিক ব্যাখ্যা। এবং সেটার সমর্থনে এখানে শিক্ষিত মহলের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ নানানভাবে আমাদেরকে সমর্থন যুগিয়েছে, উৎসাহ দিয়েছে। যাইহোক, সামগ্রিক বিচারে সমগ্র বঙ্গ এবং উপমহাদেশের মধ্যে এখন আমি বাংলাদেশ থেকেই নবজাগরণের সূচনার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশী দেখতে পাই। বিশেষ করে ঋগ্বেদ অধ্যয়ন এবং তার প্রকৃত মর্মার্থ প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টাকে কেন্দ্র করে আমার যে দীর্ঘ অভিজ্ঞতা সেটা আমাকে এই উপলব্ধিতে পৌঁছাতে প্রভূত পরিমাণে সাহায্য করেছে।
রচনা : ৩১ জানুয়ারী-২৮ ফেব্রুয়ারী, ২০১৮