লিখেছেনঃ বাম ঐক্য ফ্রন্ট, আপডেটঃ April 16, 2020, 12:00 AM, Hits: 2642
(বৈশ্বিক দুর্যোগ করোনা মোকাবেলার জন্য গত ১৩ এপ্রিল রাজধানীর সেগুন বাগিচার স্বাধীনতা মিলনায়তনে ‘অল পার্টি মিটিং’ আয়োজন করেছিল বাম গণতান্ত্রিক জোট। সেখানে অন লাইনে যুক্ত হয়েছিলেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, ড. কামাল, মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, আ.স.ম. আবদুর রব, খালেকুজ্জামান ভুঁইয়া, মাহমুদুর রহমান মান্না, মেজর জেনারেল (অব) সৈয়দ মুহম্মদ ইব্রাহিম, নাসিরুদ্দীন আহমেদ নাসু, জোনায়েদ সাকি, মোশরেফা মিশু, ফয়জুল হাকিম লালা, টিপু বিশ্বাস, প্রমুখ। নাসিরুদ্দীন নাসু বাদে বক্তাদের সকলেই করোনা মেকাবেলায় সর্বদলীয় উদ্যোগ উদ্যোগ গ্রহণের ওপর গুরুত্ব দেন।
বাম ঐক্য ফ্রন্টের পক্ষ থেকে এই লেখাটি সেখানে পাঠ করার কথা ছিল। তবে লেখাটি আয়োজকদের দেওয়া হয়েছিল। এটি এখানে প্রকাশ করা হলো। পরবর্তীতে এই বিষয় নিয়ে আলোচনা করার আশা রয়েছে। — ইমাম গাজ্জালী)
করোনা এখন বৈশ্বিক দুর্যোগ। বিশ্বজুড়ে মৃত্যুর সংখ্যা লাখের ঘরে এসে পোঁছেছে। এই বৈশ্বিক দুর্যোগ মোকাবেলায় হিমশিম খাচ্ছে ইতালী, ফ্রান্স, স্পেনসহ ইউরোপের শক্তিধর দেশগুলো; তেল সমৃদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলিতেও বাড়ছে মৃত্যুর সংখা। নাস্তানাবুদ অবস্থায় পড়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাধর দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
এই অবস্থায় বাংলাদেশেও হানা দিয়েছে করোনা। প্রাণহানীর সংখ্যা বাড়ছে প্রতিদিন। পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। পৃথিবীর শক্তিশালী দেশ সমূহ যেখানে করোনা দুর্যোগ মোকাবেলায় ব্যর্থ, সেখানে বাংলাদেশের মত দুর্নীতিগ্রস্ত এবং অনিয়ম অব্যবস্থাপনায় নিমজ্জিত একটি রাষ্ট্রের পক্ষে, একই সঙ্গে গণবিরোধী ও গণবিচ্ছিন্ন সরকারের পক্ষে এই পরিস্থিতি মোকাবেলা করা যে সম্ভব নয়, সে ব্যাপারে মানুষের কোনো সংশয় নাই।
অপরদিকে ক্ষুদ্র কিউবার সাফল্য বিশ্ববাসীর নজর কেড়েছে। প্রমাণিত হয়েছে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক দিক থেকে যতই প্রভাবশালী হোক, মুনাফা ভিত্তিক রাষ্ট্র ও সরকার নাগরিকের সুরক্ষা দিতে পারে না।
বৈশ্বিক দুর্যোগ মোকাবেলায় সাম্রাজ্যবাদ ব্যর্থ। সাম্রাজ্যবাদের ছোট তরফের সহযোগী এবং পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে ঘনবসতি এলাকা হিসেবে বাংলাদেশ সবচেয়ে ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। আর এই ঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছে পশ্চাৎপদ ধারণা, ধর্মীয় অন্ধত্ব এবং নানান কুসংস্কার।
এছাড়া উপনিবেশিক ধাঁচের আমলাতান্ত্রিক দুর্নীতিগ্রস্ত প্রশাসন আর আওয়ামী লীগের মত দুর্বৃত্ত চরিত্রের দলের পক্ষে দুর্যোগ পরিস্থিতি সামাল দেওয়া কতটুকু সম্ভব তা মানুষ জানে।
বিশ্বজুড়ে যখন মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছিল সরকার তখন ব্যস্ত ছিল শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ উদযাপনের কর্মসূচি নিয়ে। অফিস-আদালতের সামনে, সড়কের মোড়ে মোড়ে শোভা পাচ্ছিল এলইতি বিলবোর্ডে মুজিববর্ষের ক্ষণগণনা। হাজার হাজার কোটি টাকার ব্যয়ের কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছিলো, লাখ লাখ টাকার আতশবাজী পুড়িয়ে অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করা হয়েছিল, অথচ করোনার বিপদের দিকে তাকানোর সময় ছিল না সরকারের। বিপদ যখন ঘনিয়ে আসে, সরকারের তখন টনক নড়ে। ততক্ষণে এই রোগের বিস্তার দেশের নানা জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। মানুষের জানমাল নিয়ে সরকারের প্রতিশ্রুতি ও দায়বদ্ধতা এসব ঘটনা থেকেও কিঞ্চিত অনুমান করা যায়।
পরিস্থিতি যখন ক্রমেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাচ্ছিল, সরকার তখন নাগরিকদের ঘরবন্দি থাকার ঘোষণা দেয়, কিন্তু আক্রান্তদের সঠিক চিকিৎসা সেবা দেওয়া হচ্ছে না, সন্দেহভাজনদের পরীক্ষার আওতায় এনে তাদের শরীরে ভাইরাস আছে কিনা – তা নিশ্চিত হওয়ার কাজও হচ্ছে না।
এই অবস্থায় ঘরবন্দি থাকার ভয়াবহ সংকটে পড়েছেন শ্রমজীবী ও স্বল্প আয়ের মানুষ, যাদের কাছে করোনার চেয়ে ক্ষুধা বেশি ভয়ঙ্কর। ক্ষুধার জ্বালা সইতে না পেরে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। ত্রাণের দাবিতে বিক্ষোভ হয়েছে দিনাজপুর ও জামালপুরে। এভাবে খাদ্য ও ঘরভাড়ার সংস্থান না করে স্বল্প আয়ের মানুষকে ঘরবন্দি করার ঘোষণা শুধু অন্যায় নয়, অপরাধও বটে।
সরকার প্রণোদনা দিচ্ছে। প্রণোদনায় অর্থ ভারী করছে মালিকদের পকেট। আর বরাবরের মত শুভকরের ফাঁকিতে পড়ছে শ্রমিকরা।
৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার প্রণোদনার মধ্যে ৩০ হাজার কোটি টাকায় প্যাকেজ দিচ্ছে ক্ষতিগ্রস্ত শিল্প ও সার্ভিস সেক্টরে, স্বল্পসুদের প্যাকেজের অর্ধেক সুদ ভর্তুকি দেবে সরকার। একইভাবে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে ২০ হাজার কোটি টাকা প্রদান করা হচ্ছে। এক্সপোর্ট ডেভেলপমেন্ট ফান্ডের সুবিধা ৩.৫ বিলিয়ন ডলার থেকে বাড়িয়ে ৫ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করা হচ্ছে।
আর সুদের হার ২.৭৩% থেকে কমিয়ে ২ শতাংশে নামিয়ে আনা হচ্ছে। গামেন্টস শিল্পেও ৫ হাজার কোটি টাকার আপৎকালীন প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া কৃষক ও ক্ষেতমজুরদের জন্য স্বল্পসুদে ৫ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী। ওই অর্থ প্রকৃত কৃষক ও কৃষিশ্রমিকরা পাবে কিনা তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন কৃষি অর্থনীতিবিদরা। সরকারি দলের ক্যাডার ও গ্রামীন টাউট বাটপাড়দের প্রভাব বলয় অতিক্রম করে কৃষক ক্ষেতমজুরদের কাছে পৌঁছানো আসলেই দুঃসাধ্য। এ ছাড়া অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর প্যাকেজে কোনো ঘোষণা নাই।
অপরদিকে সরকারের সীমিত পর্যায় যে ত্রাণতৎপরতা শুরু হয়েছে সেখানে শ্রমজীবীদের বড় অংশই থাকছে হিসাবের বাইরে। এ ছাড়া সরকারের ও দলের দুর্বৃত্তরা যে ত্রাণের সামগ্রী লুটপাটে মেতে উঠেছে সে খবর গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চাপা থাকছে না। সবমিলে সরকার দুর্যোগ মোকাবেলায় অসফল। খাদ্য ও আনুমানিক সহায়তা ছাড়া ঘরবন্দি স্বল্প আয়ের মানুষ এখন নিরুপায় ও দিশেহারা, এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য সর্বদলীয় উদ্যোগ গ্রহণের দাবি হল শ্রেণী সমন্বয়ের স্লোগান। এসব দাবি গণক্ষেত্রে থেকে শাসক শ্রেণীকে সুরক্ষা দেবে। শাসক শ্রেণীর ক্ষমতাসীন অংশকে জনরোষের বিপদ থেকে রক্ষা করবে।
ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সময় থেকে আজ পর্যন্ত এ ধরনের পরিস্থিতিতে কমিউনিস্টরা বহুবার সর্বদলীয় ঐক্য গড়ে তোলায় উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। সেই প্রবণতার বিরুদ্ধে মতাদর্শিক অবস্থান গ্রহণ করা জরুরি।
আমরা মনে করি কোভিড-১৯ ভাইরাস সংক্রমণের ভয়াবহতা থেকে উত্তরণের জন্য শাসকশ্রেণীর (ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতাবহির্ভুত) বিরুদ্ধে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলা জরুরি। শাসকদের ভ্রান্তি, সীমাবদ্ধতা, অন্যায় ও অপরাধগুলো জনগণের সামনে ধৈর্য সহকারে তুলে ধরা দরকার।
মানুষের মধ্যে যে ক্ষোভ ধূমায়িত হয়ে উঠছে, তাকে ভাষা দিতে বামপন্থী কমিউনিস্টদের কাজ করা দরকার।
আমাদের দাবি
১। রাজধানীসহ দেশের সকল জেলা-উপজেলায় করোনা চিকিৎসায় পর্যাপ্ত ব্যবস্থা গ্রহণকরা। চিকিৎসকদের পর্যাপ্ত কিট ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম প্রদান কর। সন্দেহ হলেই পরীক্ষার আওয়ায় আনার ব্যবস্থা কর।
২। গার্মেন্টস শ্রমিক, পাটকল শ্রমিকসহ সকল প্রতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিক এবং স্বল্প আয়ের মানুষের খাদ্য ও ঘরভাড়ার সংস্থান নিশ্চিত কর। পরবর্তী ঘোষণা না আনা পর্যন্ত এই প্রণোদনা অব্যাহত রাখতে হবে।
৩। গণ রেশন ব্যবস্থা চালু কর। ত্রাণ লুটপাট প্রতিরোধ কমিটি গঠন কর, খোদ-কৃষক ও ক্ষেতমজুরদের হাতে প্রণোদণার অর্থ পৌঁছানোর ব্যবস্থা গ্রহণ কর।
৪। শাসক শ্রেণীর (ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতাবহির্ভূত) বিরুদ্ধে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোল।
(বাম ঐক্য ফ্রন্টের পক্ষ থেকে প্রচারিত)