লিখেছেনঃ লুৎফা তাহের, আপডেটঃ December 5, 2008, 2:49 PM, Hits: 5537
লুৎফা তাহের, শহীদ কর্ণেল আবু তাহের বীর উত্তম-এর স্ত্রী
বঙ্গরাষ্ট্রের পক্ষে সাক্ষাৎকার গ্রহণে মোহামমদ আলী
মোহামমদ আলী ঃ কর্নেল তাহেরের সঙ্গে আপনার বিয়েটা কি পারিবারিকভাবে হয়? লুৎফা তাহের ঃ হ্যাঁ, সামাজিক ও পারিবারিক ভাবেই আমাদের বিয়ে হয়।
আলী ঃ বিয়েটার সূচনা কি ভাবে হল? তারপরের ঘটনাগুলো সম্পর্কে কিছু বলবেন কি?
লুৎফা ঃ আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের Bio-chemistry এর ছাত্র। আমরা থাকতাম ঈশ্বরগঞ্জ। আমার বাবা ডাঃ খোরশেদ উদ্দিন আহমমদ ছিলেন সরকারী ডাক্তার। তখন উনার Posting ছিল ঈশ্বরগঞ্জ। ঈশ্বরগঞ্জ ছিল ময়মনসিংহ জেলার আওতায় একটা থানা। আবার সেখানে স্টেশন মাস্টার ছিলেন তাহেরের চাচা মুনসেফ উদ্দিন আহমেদ। ঢাকা আসা-যাওয়ার পথে স্টেশনে না দাঁড়িয়ে স্টেশন সংলগ্ন তাদের বাসায় ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করি। এভাবেই তাহের পরিবারের সঙ্গে পরিচিত হয়ে পড়ি। মাস্টার সাহেবের মেয়েরা প্রায় সমসাময়িক ছিল। তাছাড়া থানা পর্যায়ের সব কর্মকর্তাদের মাঝেই চেনাজানা থাকে।
একদিন তাহেরের চাচা আমাদের বাসায় আসলেন এবং আব্বাকে বললেন তাঁর বড় ভাইয়ের ছেলে Capt. . তার জন্য উনারা পাত্রী খুঁজছেন। তবে আমাকে তাহেরের পছন্দ। যদি আব্বার সমমতি থাকে তবে প্রস্তাব দেবেন তাহেরের বাবা, মাকে ও অন্যদেরকে সঙ্গে নিয়ে এসে। আব্বা তাৎক্ষণিক উত্তর না দিয়ে বললেন, ’ভেবে দেখি।’
এর কিছু দিন পর দেখলাম তাহেরের মাকে সঙ্গে নিয়ে তাহেরের চাচা-চাচী আসলেন আমাদের বাড়ীতে। অনেকক্ষণ আলাপ করে তারা চলে গেলেন। আমিও ঢাকায় ফিরে আসলাম।
এর পরের বারে যখন বাড়ী যাই তখন তাহের সহ তার পরিবারের সদস্যরা আমাদের বাড়ীতে এসে কথাবার্তা বলে বিয়ের প্রস্তাব রাখে। সেদিন তাহেরের সঙ্গে তার বড় ভাই আবু ইউসুফ খান, তার স্ত্রী ফাতেমা ইউসুফ, তাহেরের চাচা, চাচী এসেছিলেন। মূলত আবু ইউসুফই কথা বলছিলেন আমার সঙ্গে। উনি নানান বিষয়ে আলাপ করছিলেন - মজার মানুষ মনে হলো।
উনারা চলে যাওয়ার পর আব্বা একটু চিনিতত হয়ে পড়েন যে ছেলে আর্মিতে আছে। তার মধ্যে ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে নাকি শিয়ালকোট যুদ্ধ করেছে এবং পায়েও গুলি লেগেছিলো। আমাদের এক আত্মীয় ছিলেন পাকিস্তান আর্মিতে ব্রিগেডিয়ার আলম উনার শরণাপন্ন হলেন চূড়ানত মতামতের জন্য এবং তাহেরের খোঁজ-খবর করার জন্য। উনি খোঁজ-খবর করে বলেন যে বিয়ে দিতে পারেন। সেভাবেই বিয়ে ঠিক হলো -১৯৬৯ সালের ৭ই আগস্ট।
বিয়ের বরযাত্রী ঢাকা থেকে এল, তাদের বাড়ী শ্যামগঞ্জের কাজলা গ্রাম থেকেও এলো। তাহেরের আর্মির সাথীরা এসেছিল নানান জায়গা থেকে - তারা খবর পেয়েই ছুটে এসেছে আর্মির পোষাক পরেই বন্দুকের ফাঁকা গুলির আওয়াজ করতে করতে বরের সঙ্গে তারা বিয়ের জায়গাটিতে এসেছিলো; আশে পাশের মানুষ খুব বিস্ময় ভরা দৃষ্টি নিয়ে দেখছিলো এবং মজা পাচ্ছিল।
বিয়ের পর ঢাকায় এসে উঠলাম তাহেরের বড় ভাই আবু ইউসুফের বাসায় কলাবাগানের বশিরুদ্দীন রোডে। ওখানে উনার স্ত্রী তখন ইডেনে পড়েন; আরও থাকে তাহেরের ছোট ভাই আনোয়ার হোসেন। সেও তখন ঢাকা versity ÌZ Bio-chemistry তে পড়ে। বিয়ের ১৫ দিন পর তাহেরের promotion হলো Capt গু_গ্গক Major র্যাংকে এবং posting হলো আটক ফোর্টে। পশ্চিম পাকিস্তানের রাওয়াল পিণ্ডি ও পেশোয়ারের মাঝামাঝি জায়গায় এ cantonment এলাকাটি অবস্থিত। তাহের চাকুরীতে যোগ দিতে চলে গেল। এদিকে আবু ইউসুফ খানও সৌদি এয়ার ফোর্সে চাকুরী নিয়ে চলে গেলেন সৌদি আরব।
আমরা তখন এ বাসা ছেড়ে টিকাটুলিতে চলে গেলাম। সেখানে ছিলেন তাহের ও ইউসুফ ভাইয়ের কমন বন্ধু মজুমদার আবদুল হাই - উনি ছিলেন চাকুরী সূত্রে পশ্চিম পাকিস্তানে। বাসাটি খালি ছিল বিধায় আমরা সব ছাত্রের দল সাময়িক ভাবে উনার বাসায় গিয়ে উঠলাম। আমার পরীক্ষা প্রায় শেষের দিকে, মানে বিয়ের ৪ মাস পর নভেম্বরের মাঝামাঝি হঠাৎ তাহের পশ্চিম পাকিস্তান থেকে কোন খবর না দিয়েই চলে আসলো টিকাটুলীর বাসায়। আমরা তো অবাক! কারণ আমারই পরীক্ষা শেষে চলে যাওয়ার কথা ÔSurprise দিলাম’ - তারপর নানান আলাপের পর বলল যে, কমাণ্ডো higher training -এ সে একাই বাঙ্গালী officer হিসাবে select হয়েছে। Training হবে আমেরিকার আটলান্টা ও জর্জিয়াতে। খুব tough training. ৬ মাস মেয়াদ। কথা হল আমার পরীক্ষা শেষ হলে আমিও আমেরিকাতে তার সঙ্গে যোগ দেব।
এর মধ্যে ১০ দিনের জন্য এসেছিলো। আমরা নানান জায়গায়বেড়ালাম তার পর সে চলে গেল। আমাদের মাঝে লম্বাGap হলো। আমেরিকার Commando training এত কঠিন, ব্যস্ততাময় ছিল যে আমার যাওয়ার পরিকল্পনা বাতিল করতে হল। কারণ আমাকে সে সময় দিতে পারবে না শুধু Hotel এ বসে
Bored হবো এই ভেবে। পরে সিদ্ধানত হয় যে তাহের training শেষে ২ মাসের ছুটি নিয়ে London আসবে যেখানে তার বোন শেলী ও আমার ভাই শেখ রফি আহমেদ আছে। ওখানে আমরা বেড়িয়ে, ছুটি কাটিয়ে গাড়ী কিনে By Road -এ পশ্চিম পাকিস্তানে যাব।
১৯৭০-এর জুনে আমি চলে গেলাম London -এ । তাহের আসলো। আমরা London -এর চারপাশ ঘুরে ঘুরে কাটালাম। আমার ভাই ছিল Oxford -এ। পদার্থবিদ্যা নিয়ে PhD করছিলেন। ওখানে বেশী থাকা হতো কারণ তাহের আমার ভাইয়ের সান্নিধ্য খুব পছন্দ করতো।
তারপর By Road -এ আর পশ্চিম পাকিস্তানে আসা হলো না। Plane -এই আসলাম। প্রথমে রাওয়ালপিণ্ডি তাহের আমাকে রাখে তার বড় ভাই আরিফুর রহমান এর বাসায় উনি Planning Commission -এ চাকুরী করতেন। উনি ও উনার স্ত্রী থাকতেন। ওখানে দিন ১৫ থাকার পর তাহেরের কর্মস্থান আটক ফোর্টে চলে যাই। ওখানে বেশ ভালই কাটছিলো। একজন মাত্র বাঙ্গালী officer ছিল নামCapt. আনোয়ার যিনি পরবর্তী কালে “হেল কমাণ্ডো” নামক একটা বই লিখেছিলেন। ছিলেন পরবর্তীতে প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফ ও স্ত্রী, ছিলেন পরবর্তী কালের সেনা অধিনায়ক জিয়াউল হক। তাহেরের কমাণ্ডিং officer ছিলেনCol. সোলায়মান। উনি তাহেরকে খুব আদর করতেন। মাঝে মাঝে আমাদের জন্য পার্টির আয়োজন করতেন। আটক ফোর্টে আমরা খুবই আনন্দে দিনগুলি কাটিয়েছি। এর মধ্যে ১৯৭০ সনের নির্বাচন শেষ হয়ে গেছে। আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভ করেছে। পশ্চিম পাকিস্তানীদের মনোভাব দেখে তাহেরের মনে হলো যে যদিও আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভ করেছে তাথাপি পাকিস্তানীরা কখনো ক্ষমতা ছেড়ে দেবে না। এর মাঝেই তাহেরের চিনতা-চেতনা আমি একটু একটু করে বুঝতে শুরু করছি - দেশের জন্য সে কি করতে চায়, তার আর্মিতে যোগদানের উদ্দেশ্য কি, ইত্যাদি।
আলী ঃ এখানে একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করি, যে আপনি একজন student হিসেবে বিয়ে করলেন, তারপর যখন দেখলেন একজন সামরিক কর্মকর্তা এভাবে রাজনীতির কথা বলছে, তাতে আপনার মনে বিরোধ জাগে নি?
লুৎফা ঃ আসলে বিয়ের পর যখন ঢাকায় এলাম তার কয়েক দিনের মধ্যে বুঝতে পারলাম, দেখতে লাগলাম তাহের তার ভাইদের নিয়ে রাজনীতির আলাপ করছে। আমি আলোচনার মাঝে উঠে যেতে চাইলে বলতো “তোমারও এখন থেকে এসব শোনা দরকার” - ঠাট্টা করে বলতো - “একজন সদস্য বাড়লো।”
আলী ঃ কত সালে এটা?
লুৎফা ঃ এটা ১৯৬৯ সালে আমার বিয়ের পর পর। তাদের আলোচনা থেকেই আমি জানতে পারি এ বাড়ীতেই সিরাজ সিকদারের পার্টির কার্যক্রম চলছে - তাহের সামরিক ও রাজনৈতিক প্রশিক্ষক, তার দুই ভাই আবু সাঈদ খান ও আনোয়ার হোসেন সিরাজ সিকদারের সর্বহারা পার্টির সক্রিয় সদস্য। পার্টির কর্মকাণ্ড আলোচনা হতো তাতে পূর্ববাংলার স্বাধীনতার কথা আলোচনা হতো। এসব শুনে আমি ভীত হই নাই বা চমৎকৃত হই নাই, কারণ আমি ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে তখন পরিচিত হয়েছি। আমি ছাত্র ইউনিয়ন করতাম। অনেক মিছিল-মিটিং করতাম। ’৬৯-এর আন্দোলন, ১১ দফার আন্দোলনে আমরা অনেক অংশ গ্রহণ করেছি সক্রিয়ভাবে। তারপর আমার বাবার বাড়ীর পারিবারিক পরিবেশও ছিল রাজনৈতিকভাবে সচেতন। আমার বাবা সে যুগের কমিউনিস্ট আন্দোলনে জড়িত ছিলেন - মণি সিংহের বন্ধু স্থানীয় ছিলেন। আমার বাবা ছিলেন একজন ভাষা সৈনিক, উদার মন মানসিকতার ধারক।
এ ধরনের আবহাওয়ায় বেড়ে উঠায় তাহেরদের এই সব কর্মকাণ্ডে ভীত হই নাই, বরং রোমাঞ্চকর এক অধ্যায়ের যেন ইশারা দেখেছি। তাই যখন দেখি একজন সামরিক ব্যক্তি হয়ে তাহের এমন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য তৈরী হচ্ছে - যা নাকি জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণ - এটাই অনিবার্য বলে ভেবেছি।
যখন পশ্চিম পাকিস্তানে গেলাম তখন আমার তো অখণ্ড অবসর। তাহের যখন অফিসে চলে যেত তখন হয়ত কোন বিপ্লবী বই বা যারা সংগ্রাম করে নিজেদের অধিকার আদায় করেছে সে সম্বন্ধে জানার জন্য বই পড়তে দিয়ে যেত। বই পড়া শেষ হলে আবার আলোচনা করতে হতো। কোন সময় কিছু লিখতে বলতো ইত্যাদি।
আলী ঃ সাধারণ কি বই পড়তেন?
লুৎফা ঃ কিউবা, ফরাসী বিপ্লব, রুশ বিপ্লব ইত্যাদি। সে যা করতে চেয়েছে তাতে কোন দিন হস্তক্ষেপ করি নি। পূর্ণ সমর্থন দিয়েছি - সংসারের কি হবে তা ভেবে দেখি নি। তাহেরের ভাইদেরও দেখতাম তার প্রতি তাদের অবিচল বিশ্বাস।
আলী ঃ ছাত্র ইউনিয়নের মতিয়া গ্রুপের রাজনীতির সাথে আপনি জড়িত ছিলেন। কিন্তু সিরাজ সিকদারের রাজনীতি ও মনিসিংহ-মতিয়াদের রাজনীতির মধ্যে বিরোধ ছিল। তো এই দ্বন্দ্বটা আপনার মধ্যে কাজ করত না বা মনে হত না এটা হঠকারিতা হচ্ছে?
লুৎফা ঃ তখন তো ছাত্র রাজনীতিতে মূলত পশ্চিম পাকিস্তানী শাসক কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃৃতিক বিভেদ ও বৈষম্যগুলি তুলে ধরা হতো। এ নিয়ে রাজপথে আন্দোলন হতো। সে সময়ের রাজনৈতিক দর্শনে স্বায়ত্তশাসিত পূর্ব পাকিস্তানের কথা শোনা গেলেও স্বাধীন বাংলাদেশের ধারণা সপষ্টভাবে গড়ে ওঠে নি।
আর স্বাধীন বাংলার রূপ তো সশস্ত্র বিপ্লবের পথ - এ ধারণার ফলে কিছু দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়েছিল। তবে একটি নিপীড়িত জাতির মুক্তি লক্ষ্যে তাহেরের কাজ করা, তাহেরের আজন্ম লালিত স্বপ্ন যা তার কথায় ও কাজে দেখেছি - তাহের নিজকে এবং পরিবারকে সে লক্ষ্যে চালিত করেছে, যেমন তাহের মনে করেছে রাজনৈতিক ও সামরিক জ্ঞানে সজ্জিত নেতৃত্বই বাঙ্গালী জনগোষ্ঠীকে শোষণ-মুক্তির পথ দেখাতে পারে। সে সচেতনতা থেকেই তার পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগদান - ১৯৭১ সনে সশস্ত্র মুক্তি সংগ্রাম কালে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান ছিল একই সচেতনতার ফল।
তাহের তার পরিকল্পিত সোনার বাংলার চিত্র দেখেন ১৯৬৭ সাল থেকে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন এলিট কর্মকর্তা হয়ে ১৯৬৯ সালে পূর্ব বাংলার শ্রমিক আন্দোলনের কর্মীদের সশস্ত্র স্বাধীনতা আন্দোলন সংগঠিত করার লক্ষ্যে সামরিক প্রশিক্ষণ প্রদান করতো। যেমন, ধরুন তাহের যখন তার সোনার বাংলার রূপ বলতো এইভাবে ঃ নদীমাতৃক দেশ আমাদের - নদীপথগুলা থাকবে সোজা, দু’পাশে থাকবে উঁচু ও প্রশস্ত বাঁধ, বাঁধের পাড়ে সারি সারি গাছ, তার পাশে রেল লাইন, রাস্তা, তারপর সারি সারি বসত-বাড়ী, পিছনে থাকবে সব আবাদী জমি। কমিউন সিস্টেমে জমি চাষ হবে - সবাই ভাগ করে ফসল তুলবে ঘরে - বিকেলে ছেলেমেয়েরা পার্কে খেলাধূলা করবে, বৃদ্ধরা যাবে বিনোদন কেন্দ্রে - খেলা হবে, বিনোদন হবে, সন্ধ্যায় সারাদিনের কাজের তালিকা পেশ করবে Community leader - এর কাছে। আমাকে বলতো তোমাকে একটা কাজ দেয়া যায় - গেলুস রান্না - গেলুস হলো এক ধরনের খিচুড়ী - কর্মশিবিরে যারা কাজ করবে তাদের খাওয়ার জন্য।
তো এই সব তন্ময় হয়ে শুনতাম। এ রকম বিষয়ে কথা শুনতে কার ভাল না লাগে। আমেরিকায় কমাণ্ডো উচ্চতর training শেষে লণ্ডনে ২ মাস ছুটি কাটিয়ে আমরা পশ্চিম পাকিস্তান পৌঁছলাম। তখন সবে নির্বাচন শেষ হয়েছে। তাহেরের কর্মস্থল আটক ফোর্ট। খুব সুন্দর জায়গায়, উপরে উঁচু পাহাড়, নীচে সিন্ধু নদ। ওখানে married officer - দের quarter খালি না থাকায় আমি কয়েকদিন রাওয়ালপিণ্ডিতে তাহেরের বড় ভাই আরিফুর রহমান ভাইয়ের বাসায় কাটাই; তার কিছুদিন পর তার কর্মস্থলে চলে যাই। ওখানকার Commanding Officer Col সোলায়মান তাহেরকে অত্যনত পছন্দ করতো। একমাত্র বাঙ্গালী officer ছিল একজন Capt .. আনোয়ার হোসেন। ঘুরে বেড়াতাম প্রচুর। তাহের সরাসরি পাকিস্তানী শাসকদের প্রতি তার বিদ্বেষের কথা সবাইকে বলতো। আমাকে উর্দূতে কথাবার্তা বলতে মানা করতো। তাহেরের কম্পানির আয়ত্তাধীন ছিল জিয়াউল হক (পরে সেনাপ্রধান), পারভেজ মোশারফ (পরে প্রেসিডেন্ট) আরও অনেকsmart, young officer . তারা এ সব কথা শুনে অবাক হতো যে সেনাবাহিনী থেকে সরাসরি এ সব কথাবার্তা তাহের বলছে - কর্নেল সোলায়মান তাহেরকে খুব পছন্দ করতেন। উনিও বলতেন তাহের পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন করার কথা চিনতা করে। তাকে সকলকেই রাজনৈতিকভাবে সচেতন একটু বিপ্লবী এ রকমই ভাবত। Capt আনোয়ার তো তাহেরকে আগে থেকে জানতো। সেই ১৯৬৭ সালে Cap . আনোয়ারকে তাহের বলেছিল “কমাণ্ডোতে যোগ দিয়ে ভালই করেছ, তবে জেনে রাখ দেশটাকে স্বাধীন করতে হবে।”
তাহের প্রকাশ্যেই বলতো আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পেয়েছে; কিন্তু পাকিস্তানী শাসকরা বাঙ্গালীদের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দেবে না। এদিকে পূর্ব পাকিস্তানে কিন্তু নানা বিক্ষোভ চলছে। ভোটের রায় এবং ক্ষমতা যেন আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের পক্ষে যায় তার জন্য জনগণ রাজপথে আন্দোলন করছে। এদিকে তাহের দেখতে পেল ১৯৭১ জানুয়ারী-ফেব্রুয়ারীতে পাকিস্তানী সেনা পূর্ব পাকিস্তানে পাঠাচ্ছে। বাঙ্গালীদের পাঠানো হচ্ছে না। তাহের বলল যে, “অবস্থা খুব ভাল নয় - পাকিস্তানীরা ক্ষমতা ছেড়ে দেবে না সহজেই।” একটা যুদ্ধাবস্থা দেশে। এর মধ্যে শোনা গেল মিছিলে আসাদ গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছে - তাতে পূর্ব পাকিস্তানে আন্দোলন আরও বেগবান হচ্ছে। তাহের বললো আমাকে, “তুমি দেশে চলে যাও, সময় মত আমি যোগ দেব।” আমি তখন সনতান সম্ভবা। বললো, “যদি দেশে যুদ্ধবিগ্রহ লাগে তবে তোমাকে এ অবস্থায় নিয়ে পালানো কষ্ট হবে।” কথামত আমি ১৯৭১ সালের ৯ ই ফেব্রুয়ারীতে ঢাকায় আসলাম।
ঢাকায় এসে উঠলাম আমার ফুফাতো বোন হালিমা ও তার স্বামী জুনাবুল ইসলামের বাসায়। ঢাকায় এসেও ঈশ্বরগঞ্জ যেতে পারছি না। কারণ লাগাতার হরতাল শুরু হয়েছে। গাড়ী, যানবাহন সব বন্ধ। বেশ কয়েকদিন পর যখন গাড়ী চলতে শুরু করেছে তখন আমি বাবার বাড়ীতে আসলাম - তাহের রইল পাকিস্তানে। তাহেরকে বদলী করা হলো খাড়িয়া ক্যান্টমেন্টে - ওখান থেকে কোয়েটাতে ইনফেনট্রি ট্রেনিং-এর জন্য পাঠিয়ে দিল।
আমি ঈশ্বরগঞ্জ ও শ্বশুরের বাড়ী কাজলায় যাওয়া আসা করি। মার্চ মাস এসে গেলো। ঢাকার খবর প্রতিনিয়ত বিবিসি ও আকাশবাণীর খবরে পাই। রেডিওয়ের খবর শুনলে মনে হয় সব পরিস্থিতি স্বাভাবিক ঢাকার। এরই মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমান ভাষণ দিলেন রেসকোর্স ময়দানে ৭ই মার্চ। ইনি যখন পাকিস্তানের সাথে আলোচনা চালানো নিরর্থক মনে করে জাতির উদ্দেশ্যে ঐতিহাসিক ভাষণ রাখলেন তখন তাতে তিনি স্বাধীনতার জন্য লড়াইয়ে সকলকে প্রস্তুত থাকতে আহ্বান জানান। এরপরেই দেখলাম গ্রামে-গঞ্জে তরুণ যুবকরা সংগঠিত হতে শুরু করেছে। আলোচনা হতে থাকে যে গ্রামে গ্রামে পাক-আর্মি আসবে এবং আন্দোলকারীদের ধরে নিয়ে যাবে। ছেলেপেলেরা রাস্তায় বেরিকেড দিয়ে, রেল লাইন তুলে - প্রতিবাদ করছে অবরোধ করছে যেন পাক-আর্মি এসব স্থানে আসতে না পারে।
তারপরই ২৫শে মার্চের হত্যাযজ্ঞ শুরু হল। শুনা গেল ঢাকার পথে পথে লাশ - যেখানে যাকে পেয়েছে নির্বিচারে হত্যা করেছে পাক আর্মি। এদিকে পাকিস্তান থেকে চলে আসার পর থেকে তাহেরের কোন খবর পাচ্ছি না - বড়ই দুশ্চিনতায় দিন কাটছে। এরই মাঝে শহর থেকে গ্রামে লোকজন চলে আসতে শুরু করেছে। তাদের কাছ থেকে সব ভয়াবহ খবর পাচ্ছি। এর মধ্যে ময়মনসিংহ ও ঢাকা থেকে আমাদের আত্মীয়-স্বজনের ২৫/২৬ জন সদস্য পাক-আর্মির ভয়ে আমাদের ঈশরগঞ্জ বাড়ীতে এসে উঠলো - সর্বত্রই এক ভয়জনক অবস্থা। আমার ভাইয়েরা তাদের বন্ধুবান্ধ নিয়ে পাক আর্মিকে প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে নানান পরিকল্পনা করছে। আকাশবাণীর খবরে শুনলাম ইণ্ডিয়ান বর্ডার খুলে দিয়েছে সে দেশের সরকার। দলে দলে শরণার্থীরা বিশেষ করে হিন্দুরা চলে যাচ্ছে। এ সব পরিস্থিতির মাঝে ১৯৭১ এর ৬ই এপ্রিল রাত্রে আমার মেয়ের জন্ম হল। পরিস্থিতি এমন হয়ে উঠলো যে আমার আব্বা আমাকে আর সেখানে রাখা নিরাপদ মনে করলো না। শুনলাম জয়দেবপুরে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেনারা বিদ্রোহ করেছে। এরই মাঝে রেডিও-এর নব ঘোরাতে ঘোরাতে আব্বা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের প্রচার বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে মেজর জিয়ার ঘোাষণা শুনে আমাদেরকে আর ঈশ্বরগঞ্জ রাখা সমীচিন মনে করেন নি।
যদিও আমি একজন সামরিক কর্মকর্তার স্ত্রী - আমার স্বামী পাকিস্তানী - যেহেতু আমার আসার পর থেকে তার কোন খবর পাচ্ছি না তাই ভরসা রাখা গেল না। আমি ছোট মেয়েকে ৭ দিনের নিয়ে তাহেরের চাচীর সঙ্গে শ্বশুর বাড়ী চলে গেলাম। কাজলা গ্রামটা অনেক ভিতরে। আমাদের ভাবনা ছিল ওখানে কখনও আর্মিরা যাবে না। এদিকে আব্বার পরিবারও আরও ভিতরে গ্রামে সরে গেল। ভাইয়েরা সুসং দুর্গাপুর দিয়ে ইণ্ডিয়ায় চলে গেছে যুদ্ধ করবে বলে। কাজলা গিয়ে দেখি স্বামীর ভাইয়েরাও সব যুদ্ধে চলে গেছে। ওখানেও লোকে লোকারণ্য। চেনা-জানা কত মানুষ ছুটতে ছুটতে এক গভীর গ্রামে এসে উপস্থিত।
এখানে এসে কাজ হলো সন্ধ্যার পর উঠানে পার্টি বিছিয়ে আকাশবাণী, স্বাধীন বাংলা বেতার খবর শুনা সবাইকে নিয়ে। কি অনিশ্চিত পরিবেশ। এর মধ্যে এই প্রথম তাহেরের একটা চিঠি পেলাম। তার মাকে লেখা। লিখেছে, “গ্রামে নিশ্চয়ই অনেক লোকের সমাগম। স্কুল খুলে এ সময়টাতে ব্যস্ত থাকতে পারে তোমার বৌমা।” সময় মত আমি আসবো। আমরা অত্যনত আনন্দিত হলাম এই প্রথম খবর। প্রতিদিনের মত আকাশবাণীর খবর শুনছি - হঠাৎ কানে এল পাকিস্তান থেকে ৪ জন ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তা পাকিস্তান থেকে পালিয়ে ভারতে এসেছে। তারা বাংলাদেশ প্রবাসী সরকারের সাথে আছে। নিরাপত্তার স্বার্থে তাদের নাম বলা হলো না। আমাদের ধারণা তাহের এদের মাঝেই আছে। এটা জুলাই মাসের প্রথমদিকে। এর ২/৩ দিনের মাঝে দেখি সারাগায়ে চাদর মুড়িয়ে ২ জন লোক এসে সন্ধ্যার পর হাজির - দেখি তাহেরের ভাই আবু সাঈদ, আমার ভাই সাব্বির আহমেদ। তারা এসেছে ১১ নং সেক্টরের বকশিগঞ্জ যুদ্ধক্ষেত্র থেকে। তাদের কাছ থেকে জানলাম তাহের ১১ নং সেক্টরের তূরায় অবস্থান করছে - আমাদেরকে নেওয়ার জন্য তাদেরকে পাঠানো হয়েছে। আমাদেরকে কালই পালাতে হবে। কারণ আর্মিরা তাহেরের অবস্থান জেনে ফেলেছে।
আমার শাশুড়ী-শ্বশুরের বন্ধুস্থানীয় একজন; নাম খোদা নেওয়াজ খান। তাকে ডেকে পরামর্শ করে তার সঙ্গে আমাকে পাঠালেন, আমার সঙ্গে তাহেরের ২ বোন ডালিয়া, জুলিয়া সহ আমরা রওনা দিলাম সামান্য কিছু জিনিস নিয়ে। উনি প্রথমে উঠলেন আমাদেরকে কলমাকান্দা থানার বুরবুরা সুনাই নামক গ্রামে উনার এক আত্মীয় বাড়ীতে। বাড়ীটি শনির হাওরের কাছে চারিদিকে পানি আর পানি।
অনলাইন: ৫ ডিসেম্বর, ২০০৮