লিখেছেনঃ সামির আমিন, আপডেটঃ November 30, 2012, 4:54 AM, Hits: 6530
(সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আইজায আহমদ)
সামির আমিনঃ দেখুন, মার্কিন গোষ্ঠী – এবং মার্কিন গোষ্ঠীর বাইরে এর সহযোগীরা, ইউরোপীয় ও অন্যরা, ন্যাটোর সদস্য হিসাবে তুরস্ক – তিউনিসিয়া ও মিসরে তাদের আকস্মিক চমক থেকে যে শিক্ষা অর্জন অর্জন করেছিল: সেটা থেকে অন্যান্য আরব দেশগুলোতে একই ধরণের আন্দোলন হতে বাধা দেয়, যে আন্দোলনের সূচনা ঘটাবার উদ্যোগ তারা অর্জন করেছিল। তারা লিবিয়ায় তাদের অভিজ্ঞতার পরীক্ষা করেছিল, এবং তারা সফলভাবে লিবিয়ায় এই পরীক্ষা করেছিল, এই অর্থে যে, লিবিয়াতে, শুরুতে আমরা কোন (ব্যাপক জনপ্রিয়) আন্দোলন পাই নাই …….. গাদ্দাফির বিরুদ্ধে। আমাদের ছোট সশস্ত্র গোষ্ঠী ছিল, এবং যে কেউ তৎক্ষণাৎ প্রশ্ন করবে …… ঐ অস্ত্রগুলো কোথা থেকে আসছিল। সেগুলো -- আমরা জানি – শুরু থেকে, উপসাগরীয় অঞ্চল থেকে, পাশ্চাত্য শক্তিসমূহ ও আমেরিকার পৃষ্ঠপোষকতায়। এবং সেনাবাহিনী, পুলিশ ও অন্যদের উপর আক্রমণ করছিল। এবং একই দিনে, এমন কী পরের দিনেও নয়, যে লোকগুলি নিজেদেরকে “মুক্তি বাহিনী” , “গণতান্ত্রিক মুক্তি বাহিনী,” নামে চিহ্নিত করেছিল, তারা আত্মরক্ষার জন্য ন্যাটোকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল – প্রথমে ফরাসিদেরকে এবং এরপরে ন্যাটো, এবং এভাবে তারা তাদেরকে হস্তক্ষেপের সুযোগ করে দিয়েছিল। এই হস্তক্ষেপ এই অর্থে সফল হয়েছে যে এটি গাদ্দাফির শাসনকে ধ্বংস করেছিল। কিন্তু এই সফলতার ফলাফল কী? এই কি গণতান্ত্রিক লিবিয়া? বেশ, কারও এটি শুনে হাসবার কথা যখন কেউ জানতে পারে যে নূতন সরকারের প্রেসিডেন্ট আর কেউ না সেই একই বিচারক যিনি বুলগেরীয় নার্সদের মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করেছিলেন। কী অদ্ভুত গণতন্ত্র এটা! কিন্তু এটা দেশকে সোমালীয় ধরণের নৈরাজ্যের দিকে নিয়ে গেছেঃ যেমন, স্থানীয় ক্ষমতাসমূহ – এসবের সবগুলোই তথাকথিত “ইসলাম”-এর নামে। দেশকে ধ্বংস করে দিয়ে স্থানীয় যুদ্ধবাজদের উত্থান ঘটানো হয়েছে । যে কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেঃ দেশকে ধ্বংস করাই কি এই হস্তক্ষেপের লক্ষ্যবস্তু ছিল?
আমি এই মূল প্রশ্নে ফিরে আসব, যেহেতু তারা ঠিক তার পর পরই সিরিয়ায় একই কৌশল বাস্তবায়ন করতে চেষ্টা করেছে – যা, একেবারে শুরু থেকে সশস্ত্র গোষ্ঠীসমূহের অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে দিয়ে। উত্তর দিক দিয়ে তুরস্কের মধ্য দিয়ে, বিশেষভাবে হাতয় থেকে। হাতয়ে তথাকথিত “শরণার্থী শিবিরগুলো” প্রকৃতপক্ষে শরণার্থী শিবির নয়। এখানে খুব কম সংখ্যক শরণার্থীই আছে। সেগুলো প্রকৃতপক্ষে সিরিয়ায় হস্তক্ষেপ করার জন্য ভাড়াটে সৈন্যদের প্রশিক্ষণ শিবির। আমাদের তুর্কী বন্ধুরা দালিলিকভাবেই প্রকৃত ঘটনাকে প্রকাশ করে দিয়েছেন। এবং এক্ষেত্রে তুরস্ক ন্যাটো শক্তি হিসাবে ষড়যন্ত্রের অংশ। এবং একইভাবে জর্ডান, আমি মনে করি, ইসরাইলের শুধু নিষ্ক্রিয় সমর্থন নিয়ে বরং সক্রিয় সমর্থন নিয়ে দারার মধ্য দিয়ে, দক্ষিণের সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর দক্ষিণ দিক থেকে অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছে।
সিরিয়ার দিকে দেখলে মিসরের মত একই পরিস্থিতি বিষয়গত দিক থেকে দেখতে পাইঃ যা হল, এমন এক শাসন যার অনেক, অনেক আগে বৈধতা ছিল, যখন তা জাতীয়ভাবে জনপ্রিয় শাসন ছিল। কিন্তু হাফেজ আসাদের সময়ে ইতিমধ্যেই যখন তা এই বৈধতা হারিয়েছিল তখন তা নয়া-উদারবাদ, বেসরকারীকরণ, ইত্যাদির পথে গিয়ে একই রকম সামাজিক বিপর্যয়ের পথে গেছে। তাই, একটি ব্যাপক, জনপ্রিয়, সমাজ-মুখী অভ্যুত্থানের বাস্তব ভিত্তি সেখানে আছে।
কিন্তু এই আন্দোলনকে অধিকার করে, সশস্ত্র গোষ্ঠী সমূহ দ্বারা সামরিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে, পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী শক্তি এমন এক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে যেখানে জনপ্রিয় গণতান্ত্রিক আন্দোলন …. দ্বিধান্বিত। তারা বাশার আসাদের বিরুদ্ধে তথাকথিত “প্রতিরোধ”-এ যোগ দিতে চায় না; কিন্তু তারা বাশার আসাদের শাসনকে সমর্থনও করে না। এটি বাশার আসাদকে সফলভাবে বাইরের হস্তক্ষেপকে বন্ধ রাখতে, বা সীমাবদ্ধ করতে সুবিধা প্রদান করেছিল, হোমসে ও উত্তরে তুরস্কের সীমান্তে।
কিন্তু রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসকে বিরোধিতা করে বিদেশী শক্তির সাহায্য নিয়ে সশস্ত্র গোষ্ঠীর প্রকৃত সন্ত্রাস সমস্যার সমাধান নয়। এই প্রশ্নের উত্তর হল আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে প্রকৃত জনপ্রিয় গণতান্ত্রিক আন্দোলনের লাভের জন্য এই ব্যবস্থাকে বাস্তবে পরিবর্তন করা। এটিই হচ্ছে চ্যালেঞ্জ। এবং এটি একটি প্রশ্ন যা উত্থাপিত হয়েছে। আমরা জানি না, আমি জানি না, আমার মনে হয় কেউ জানে না কীভাবে বিষয়গুলো এগোবেঃ হয় সরকার, অথবা সরকারের ভিতরের লোকজন, তা বুঝবে এবং বাস্তব সংস্কারের দিকে অগ্রসর হবে, আলোচনার চেয়েও বেশী কিছু করে, জনগণের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সাহায্যে শাসন ব্যবস্থাকে পুনর্বিন্যস্ত করে, অথবা বিস্ফোরণকে নিষ্ঠুরভাবে মোকাবিলা করার পথ ধরে রাখবে যা এখন পর্যন্ত করে চলেছে। তারা যদি এই পথে চলতে থাকে, এক সময়ে তারা পরাজিত হবে, কিন্তু তারা পরাজিত হবে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির উপকারের জন্য।
এখন, সাম্রাজ্যবাদের প্রকৃত লক্ষ্য কী, সিরিয়ায় এবং এই অঞ্চলে? এটা কোনভাবেই গণতন্ত্র আনার জন্য নয়। এটা সমাজকে ধ্বংস করার জন্য ঠিক যেমনভাবে লিবিয়ার সমাজকে ধ্বংস করা হয়েছে। আপনি যদি ইরাকের উদাহরণ ধরেন, তারা কী করেছে? তারা সাদ্দামের প্রকৃত একনায়কতন্ত্র উচ্ছেদ করে তিনটি আরও কুৎসিত একনায়কতন্ত্র বসিয়েছেঃ দুটি ধর্মের নামে, শিয়া ও সুন্নি, একটি তথাকথিত “নৃগোষ্ঠী”-র নামে, কুর্দিরা, যেগুলো এমন কী সাদ্দাম হোসেনের একনায়কতন্ত্রের চেয়েও বেশী কুৎসিত। তারা প্রথাবদ্ধ হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে দেশটাকে ধ্বংস করে দিয়েছে – এছাড়া এর জন্য আমার অন্য কোন শব্দ নাই।
লক্ষ লক্ষ মানুষের উপর মানবিক বোমা বর্ষণের পাশাপাশি সরকারের লোকজনের উপর প্রণালীবদ্ধভাবে হত্যাকাণ্ড পরিচালনা হয়েছিলঃ বিজ্ঞানী, ডাক্তার, প্রকৌশলী, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, এমন কী কবিসহ কাউকে ছাড় দেওয়া হয় নাই, এবং এভাবে জাতির প্রকৃত সেরা অংশকে ধংস করা হয়েছে। যা হল দেশকে ধ্বংস করা। সাম্রাজ্যবাদের সিরিয়ায় এটাই লক্ষ্য। তথাকথিত “সিরিয়ার মুক্তি বাহিনী” তাদের কর্মসূচী হিসাবে কী দাবী করে? এটাই যে আমাদের আলাউইদের (সিরিয়ার একটি সংখ্যালঘু ধর্মীয় গোষ্ঠী), ড্রুজদের (সিরিয়া, লেবানন, ইসরাইল ও জর্ডানে বসবাসরত সংখ্যালঘু ধর্মীয় গোষ্ঠী), খ্রীষ্টানদের, শিয়াদের নির্মূল করতে হবে। আপনি যদি এই চারটি সংখ্যালঘু গোষ্ঠীসমূহকে যোগ করেন আপনি সিরিয়ার ৪৫% জনগণকে পাবেন। এ দিয়ে কী মনে হয়? এ দিয়ে কি গণতন্ত্রকে বুঝায়? এ দিয়ে বুঝায় সর্বাধিক পরিমাণ কুৎসিত একনায়কতন্ত্র আর দেশের ধ্বংস সাধন।
এখন এতে কার আগ্রহ থাকবে? তিনটি মিত্রপক্ষের সাধারণ স্বার্থ আছে এখানে, যথা, আমেরিকা, ইসরায়েল, এবং উপসাগরীয় দেশগুলো। আমেরিকা। কেন? কারণ এই অঞ্চলের সমাজগুলির ধ্বংস সাধন পরবর্তী ধাপের প্রস্তুতির জন্য সর্বোত্তম পন্থা, যা হল ইরানের ধ্বংস সাধন। এটার প্রয়োজন কিছু সংখ্যক বিপজ্জনক দেশের উত্থান রোধ করা আর সম্ভব হলে তাদেরকে পিছিয়ে দেওয়ার জন্য। বিপজ্জনকগুলো হল চীন ও রাশিয়া (এবং সম্ভাবনাময় হলেও যদি দুষ্টু হয়ে থাকে তবে ভারতও, কিন্তু ভারত দুষ্টু নয়, কিছু সময়ের জন্য)। এটাই হচ্ছে লক্ষ্য। এটা বুঝা যায় যে, ইরানসহ মধ্যপ্রাচ্যের সমাজগুলির ধ্বংস সাধন করে আমেরিকা এই লক্ষ্য অর্জন করতে চায়। ইস্রাইলেরও লক্ষ্য হচ্ছে লুম্পেন উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় রেখে সমাজগুলির ধবংস সাধন করা।
যেহেতু, সিরিয়া যদি চার বা পাঁচ ভাগে ভাগ হয়ে যায় তাৎপর্যহীন, নতজানু, ছোট ছোট রাষ্ট্রে তবে এটি সহজেই ইসরাইলের উপনিবেশীকরণ প্রক্রিয়ার আরও সহজ সম্প্রসারণের পথ করে দিবে। এটি উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলোরও লক্ষ্য। সত্যি, এটা প্রায় প্রহসনের মত যে গণতন্ত্রের সংগ্রামের নেতা হিসাবে কাতারের আমীর এবং সৌদী আরবের রাজা আজ ওবামা, সারকোজি, এবং ক্যামারনের মত পশ্চিমাদের সাথে দাঁড়িয়ে। এতে কেউ কেবল হাসতে পারে। কিন্তু তাদের ইসলামের নামে এই অঞ্চলে আধিপত্য – এই “নামে,” যেহেতু অবশ্যই ইসলামের সম্ভাব্য ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যা থাকবে – তা মূলত মিসরের মত দেশসমূহের ধ্বংসেরই ইংগিত দেয়। যদি মিসর তার নিজের পায়ে দাঁড়ায় তবে উপসাগরীয় আধিপত্যের কী পরিণতি হতে পারে সেটা অনুমান করা যায়। আপনারা জানেন, নাসেরের সময়ে, নাসেরের দিনগুলিতে উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলি কী অবস্থায় ছিল। সুতরাং তাদের মধ্যে স্বার্থের এই অভিন্নতা সাধারণভাবেই বিদ্যমান।
এবং তারা সমর্থিত হচ্ছে, সমাজের ভিতর থেকে, মুসলিম ব্রাদারহুড দ্বারা। সুতরাং, আমি একথা দিয়ে শেষ করব। আমাদের মুসলিম ব্রাদারহুডকে দেখতে হবে ”ইসলামী” দল হিসাবে নয়। সংগঠন, দল, এগুলোর বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ এবং বিচারের মানদণ্ড তারা “ইসলামী” অথবা তারা “লোকবাদী” তা দিয়ে নয়, বরং তারা প্রতিক্রিয়াশীল না প্রগতিশীল তা দিয়ে। এবং যখন আমরা মুসলিম ব্রাদারহুডকে দেখি, সমস্ত প্রকৃত বিষয়গুলোতে, তখন আমরা দেখি যে, তারা শ্রমিকশ্রেণীর ধর্মঘটের বিপক্ষে, তারা দরিদ্র কৃষকদের প্রতিরোধের বিপক্ষে, তারা বেসরকারীকরণের পক্ষে, তারা সরকারী পরিসেবাকে ভেংগে ফেলার পক্ষে, যার মানে হল তারা চরম প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলির সাথে সম্পূর্ণভাবে ঐক্যবদ্ধ। এটি একটি প্রতিক্রিয়াশীল দল যা ইসলামকে মুখোশ হিসাবে ব্যবহার করছে। এটাই বাস্তব সত্য।
এটাই সাম্রাজ্যবাদীদের ও মধ্যপ্রাচ্যের সমাজের ভিতর থেকে তাদের অভ্যন্তরীণ মিত্রদের, প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিসমূহের, কৌশলগত লক্ষ্য সম্পর্কে বৈশ্বিক চিত্র।
(সামির আমিন একজন মিসরীয় মার্কসবাদী অর্থনীতিবিদ। আইজায আহমদ একজন ভারতীয় মার্কসবাদী সমালোচক। এটি ইংরাজী সাক্ষাৎকারের দুই অংশের ভিডিওর দ্বিতীয় অংশের বাংলায় ভাষান্তর। -- বঙ্গরাষ্ট্র )