লিখেছেনঃ শামসুজ্জোহা মানিক ও শামসুল আলম চঞ্চল, আপডেটঃ July 26, 2022, 12:00 AM, Hits: 2414
বিষয়সূচী :
১। ভূমিকা
২। সম্মতি ভিত্তিক গণতান্ত্রিক ও জনকল্যাণবাদী রাষ্ট্র শাসন ব্যবস্থা
৩। তুলনামূলক সামাজিক সাম্যের উপস্থিতি
৪। সভ্যতার নির্মাণ ও রক্ষায় তুলনামূলক শান্তিপূর্ণ ধারা
৫। রাষ্ট্র ও সমাজে প্রচলিত নিরীশ্বরবাদী ও লোকায়ত মতাদর্শ
৬। শেষ কথা
১। ভূমিকা
পৃথিবীর প্রতিটি জাতি বা জনগোষ্ঠীর জন্য তার অতীত গৌরবের অনুসন্ধান সেই জাতি বা জনগোষ্ঠীর উন্নত ভবিষ্যতের যাত্রাপথ নির্মাণের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষত প্রতিক্রিয়াশীল ও পশ্চাৎপদ ব্যবস্থার বাধাকে ভেঙ্গে উন্নততর ভবিষ্যৎ নির্মাণের জন্য যে প্রবল প্রেরণা দরকার তার সবচেয়ে বড় উৎস হয়ে উঠতে পারে তার অতীত ইতিহাসের হারিয়ে যাওয়া বা লুকিয়ে থাকা অধ্যায়, যা আপাতদৃষ্টিতে বিস্মৃত হলেও ঐতিহাসিক কালপরিক্রমায় নানানভাবে তার ধারাবাহিকতাকে রক্ষা করতে পারে। সুতরাং যে কোনও জাতি বা জনগোষ্ঠীর জাগরণের জন্য তার অতীত ঐতিহ্যের অনুসন্ধান খুব গুরুত্বপূর্ণ এক করণীয়। এই বাস্তবতার এক মূর্ত দৃষ্টান্ত আধুনিক ইউরোপ।
জ্ঞান ও যুক্তিচর্চার পথ হারিয়ে ধর্মান্ধতার অন্ধকারে ডুবে যাওয়া ইউরোপ তার মধ্যযুগে সংকটের একটি পর্যায়ে তার প্রাচীন গ্রীস ও রোমের ঐতিহ্যের পুনরাবিষ্কারের মাধ্যমে খ্রীষ্টীয় ১৪শ শতাব্দীতে রেনেসাঁ (Renaissance) বা পুনর্জাগরণের জন্ম দিয়েছিল। এই ঐতিহ্য ছিল প্রাচীন গ্রীসের গণতন্ত্র, দর্শন, ও রোমের রাষ্ট্রশাসনব্যবস্থা, এবং উভয়ের শিল্প ও আইন। এই সময়ে ইউরোপ তার মধ্যযুগের ধর্মাচ্ছন্নতা ও পশ্চাৎপদতার বেড়ী ভেঙ্গে শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির নূতন জোয়ারের মাধ্যমে নব-চেতনার উন্মেষ ঘটিয়েছিল। তার এই নূতন চিন্তা-চেতনা প্রকাশ পেল মধ্যযুগের শিল্প, স্থাপত্য, বিজ্ঞান আর সাহিত্যে। ১৭শ শতাব্দী পর্যন্ত ইউরোপে এর ব্যাপ্তি ছিল। রেনেসাঁর পর ইউরোপ ধারাবাহিক বিকাশের পথ ধরে শিল্প বিপ্লবের পথে এগিয়ে যায়। যে ইউরোপ সমগ্র পৃথিবীকে আধুনিকতা ও উন্নত সভ্যতার পথে নিতে নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করল সেই ইউরোপের প্রতিষ্ঠার পিছনে তাই রেনেসাঁর ভূমিকা ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, যে রেনেসাঁর পিছনে আবার নির্ধারক ভূমিকা রেখেছিল অতীতের হারিয়ে যাওয়া জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্পকলা চর্চার পুনরুদ্ধার।
একইভাবে আমরাও আমাদের রেনেসাঁ সংঘটিত করতে পারি আমাদের অতীতের এক মহত্তম ইতিহাসের পুনরাবিষ্কার ও পুনর্মূল্যায়নের মাধ্যমে, যেটা আমাদের আছে। সেটি হল সিন্ধু সভ্যতা কিংবা প্রত্নতত্ত্বের ভাষায় হরপ্পান সভ্যতা। ইউরোপে বিশেষত গ্রীসের জ্ঞানচর্চার ধারা সহস্রাধিক বৎসর কালের জন্য হারিয়ে গিয়েছিল। সে হিসাবে সিন্ধু সভ্যতা আরও অনেক বেশী কালের জন্য আমাদের নিকট ছিল মাটির নীচে চাপা পড়ে থাকা এক বিস্মৃত অধ্যায়। প্রত্নতাত্ত্বিকদের হিসাব অনুযায়ী মূলত খ্রীষ্টপূর্ব ১৯০০ অব্দে সিন্ধুর নগর সভ্যতার পতন ঘটে। অর্থাৎ প্রায় চার হাজার বৎসর কাল পূর্বে এই সভ্যতার অবসান হয়। সময়ের ব্যবধানে সঙ্গত কারণে তারপর থেকে এটি ক্রমে বিস্মৃতির অন্ধকারে হারিয়ে গিয়েছিল।
অবশেষে প্রায় একশত বৎসর আগে সিন্ধু সভ্যতা সম্পর্কে মানুষ জানতে শুরু করে। গত শতাব্দীর মূলত ২০-এর দশকে পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশে হরপ্পা ও সিন্ধু প্রদেশে মহেঞ্জো-দাড়ো আবিষ্কার হলেও অনেক কাল পর্যন্ত ব্রোঞ্জ যুগের এই সভ্যতা সম্পর্কে আমাদের ধারণা অনেক কম ছিল। কিন্তু গত সিকি শতাব্দীর চেয়ে কিছু বেশী কাল ব্যাপী সিন্ধু সভ্যতার প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান ও বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখায় বিপুল কাজ হওয়ার ফলে সিন্ধু সভ্যতা সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান ভাণ্ডার এখন আগের চেয়ে অনেক সমৃদ্ধ। এখন পর্যন্ত পাওয়া প্রত্নতাত্ত্বিক ও অন্যান্য ক্ষেত্রে গবেষণার ফল থেকে আমরা জানতে পারছি যে, সিন্ধু সভ্যতায় সমসাময়িক মিসর বা মেসোপটেমিয়ার মত বিশালাকার নির্মাণ ও কেন্দ্রীভূত বিপুল সম্পদের সাক্ষ্য না থাকলেও নগর পরিকল্পনা এবং নাগরিক জীবনের মান ও ব্যবস্থাপনার বিচারে সিন্ধু সভ্যতা ছিল অন্য সকল প্রাচীন সভ্যতা থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র এবং তুলনাবিহীন। কোনও সভ্যতা তার সাধারণ নাগরিক কিংবা অধিবাসীদের জীবনের উন্নত মান রক্ষার জন্য এতটা মনোযোগ দেয় নাই যেমনটা সিন্ধু সভ্যতা দিয়েছিল।
সিন্ধু সভ্যতা যাকে হরপ্পান সভ্যতা নামেও অভিহিত করা হয়, তার নগর সভ্যতার যুগ ২৬০০ থেকে ১৯০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত প্রায় ৭০০ বৎসর টিকে ছিল। এই সভ্যতার ব্যাপ্তি ছিল আজকের সমগ্র পাকিস্তান, ভারতের উত্তর-পশ্চিম অংশ ও উত্তর-পূর্ব আফগানিস্তানের প্রায় ১০,০০,০০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে।1 সমসাময়িক প্রাচীন মিসর বা মেসোপটেমিয়ার তুলনায় এই আয়তন দুই গুণ এবং এটি প্রাচীন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সভ্যতা। সিন্ধু সভ্যতার এখন পর্যন্ত তিন হাজারের চেয়েও বেশী বসতি আবিষ্কৃত হয়েছে।2 আজ থেকে সাড়ে চার হাজার বৎসর আগে সিন্ধুর নগর সভ্যতার সূচনা ঘটলেও এটি এই অঞ্চলের আরো অনেক প্রাচীন সাংস্কৃতিক ধারাবাহিকতাকে বহন করেছিল। নবপ্রস্তর যুগে বালুচিস্তানের মেহরগড়ে প্রায় খ্রীষ্টপূর্ব অষ্টম সহস্রাব্দ থেকে এর সাংস্কৃতিক ধারাবাহিকতা শুরু হয়ে একই সাংস্কৃতিক ধারাহিকতা আফগানিস্তান, বালুচিস্তান ও সিন্ধু নদী উপত্যকার কিছু অঞ্চলে কৃষি ও পশুপালন ভিত্তিক স্থিতিশীল মানব বসতিতে ছড়িয়ে পড়ে। প্রায় ৫৫০০ খ্রীঃপূঃ থেকে বৃহত্তর সিন্ধু নদী উপত্যকায়3 এই কৃষি ও পশুপালনভিত্তিক সমাজ ছড়িয়ে পড়ে এবং ৩৫০০ খ্রীঃপূঃ-এর দিকে কিছু বসতি যেমন হরপ্পা, এবং সম্ভবত মহেঞ্জো-দাড়ো, রাখিগাড়ি, ধোলাভিরা ও অন্যান্য বসতিগুলি আঞ্চলিক কেন্দ্র হিসাবে উদ্ভূত হয়। এই সময়ে এক ভিন্ন ধরনের সামাজিক, অর্থনৈতিক, প্রযুক্তিবিদ্যাগত এবং রাজনৈতিক বিকাশ ঘটতে থাকে, যা পরবর্তী হরপ্পান নগর সভ্যতার ভিত্তি হিসাবে কাজ করে। ৫৫০০ খ্রীঃপূঃ থেকে হরপ্পান নগর সভ্যতার শুরুর সময় পর্যন্ত অর্থাৎ ২৬০০ খ্রীঃপূঃ পর্যন্ত সময়কে সাধারণভাবে আদি হরপ্পান যুগ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়।4
-----------------------------------------------------------------
1 দেখুনঃ J.S. Kharakwal, Indus Civilization: An Overview, in, Indus Civilization: Text and Context, ed., Toshiki Osada, Manohar Publishers & Distributers, New Delhi, 2006, p. 15.
2 দেখুনঃ Akinori Uesugi, Current State of Research and Issues of Indus Archaeology, in, Current Research on Indus Archaeology, ed., Akinori Uesugi, published by Research Group for South Asian Archaeology and Archaeological Research Institute, Kansai University, 2018, p. 1.
3 সিন্ধু নদী উপত্যকার বাইরেও সিন্ধু সভ্যতার অনেক বসতি আবিষ্কৃত হওয়াতে পাকিস্তানের বিখ্যাত প্রত্নতাত্ত্বিক রফিক মুগল ১৯৭০ সালে প্রথম এই অঞ্চলের নাম Greater Indus Valley রাখেন। দেখুনঃ M. Rafque Mughal, Further Evidence of the Early Harappan Culture in the Greater Valley: 1971-90, in, South Asian Studies 6 (1990), p. 176.
4 দেখুনঃ Jonathan M. Kenoyer, The Archaeological Heritage of Pakistan: From the Palaeolithic to the Indus Civilization, in, A History of Pakistan, ed., Roger D. Long, Oxford University Press, 2015, pp. 28-29.
-----------------------------------------------------------------
দীর্ঘ দূরত্বের বাণিজ্য, বিভিন্ন ধরনের কারিগরী শিল্প, ইত্যাদির ক্রমবিকাশের ফলে বৃহত্তর সিন্ধু উপত্যকাব্যাপী বড় বসতিগুলি ক্রমশ শহর ও নগরে রূপান্তরিত হতে শুরু করে। এরই ধারাবাহিক প্রক্রিয়ায় ২৬০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের দিকে এই অঞ্চলে এক উন্নত নগর সভ্যতা গড়ে উঠে।
অনুমান করা যায় যে, হরপ্পান পর্যায়ের শুরুতে অর্থাৎ ২৬০০ খ্রীঃপূঃ-এর দিকে একটি কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক নেতৃত্বাধীনে এক বৃহৎ অঞ্চলের অধিবাসীবৃন্দ সমরূপবিশিষ্ট একটি অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও আদর্শিক ব্যবস্থায় ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। তুলনামূলক সমরূপ মৃৎপাত্র শৈলী ও বিভিন্ন ধরনের বস্তুগত সংস্কৃতি একটি তুলনামূলক সমরূপতা নিয়ে বৃহত্তর সিন্ধু উপত্যকায় ৩০০০-এরও বেশী বসতিতে ছড়িয়ে গিয়েছিল। এই সময় জুড়ে এই সভ্যতায় সাংস্কৃতিক মিল লক্ষ্য করা যায় মৃৎ ও কারু শিল্পের উৎপাদনে, বাড়ী ও নগর বিন্যাসে এবং সীল, লিপি, ইট ও বাটখারার মাপে। এই সভ্যতা অভ্যন্তরীণ ও বহির্বাণিজ্যে, বিশালাকৃতির ভবন ও আকর্ষণীয় স্থাপত্য কৌশলে, নর্দমার সাহায্যে ও অন্য উপায়ে পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থায়, জলবিদ্যা ও জল নিয়ন্ত্রণ কাঠামোয়, চিত্রকর্ম, ধাতুর মূর্তি ও অন্যান্য জিনিসপত্র, খড়িপাথর (Steatite) ও পোড়ামাটির মূর্তি, সোনা, রূপা, তামা ও বিভিন্ন পাথরের অলংকার, বিভিন্ন ধরনের খেলনা, এবং এগুলি তৈরীতে উন্নত মানের কারিগরী বিদ্যার জন্য অনন্য ছিল। এই যুগের বড় নগর বা শহরগুলির মধ্যে পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশে অবস্থিত মহেঞ্জো-দাড়ো (২৫০ হেক্টর বা ৬১৮ একর), পাকিস্তানের পাঞ্জাবে হরপ্পা (১৫০ হেক্টর বা ৩৭১ একর), ভারতের হরিয়ানায় রাখিগাড়ি (১০০ হেক্টর বা ২৪৭ একর), পাকিস্তানের পাঞ্জাবে গানেরিওয়ালা (৪০ হেক্টর বা ৯৯ একর), সিন্ধু প্রদেশে লাখাঞ্জোদাড়ো (সম্ভবত ৩০০ হেক্টর বা ৭৪১ একর), ভারতের গুজরাটে ধোলাভিরা (১০০ হেক্টর বা ২৪৭ একর), ভারতের রাজস্থানে কালিবঙ্গান (১৪ হেক্টর বা ৩৫ একর) ও গুজরাটে লোথাল (৭.৫ হেক্টর বা ১৯ একর) অন্যতম ছিল।1
-----------------------------------------------------------------
1 দেখুনঃ Jonathan M. Kenoyer, The Archaeological Heritage of Pakistan: From the Palaeolithic to the Indus Civilization, in, A History of Pakistan, ed., Roger D. Long, 2015, p. 41.
-----------------------------------------------------------------
সিন্ধু সভ্যতার হরপ্পান পর্যায়ের প্রধান বসতিসমূহ ও যোগাযোগের পথ (সৌজন্যেঃ Jonathan Mark Kenoyer and Dennys Frenez, 2018)
অন্যান্য প্রাচীন সভ্যতায় লিপির পাঠোদ্ধার হওয়ায় সেই সব সভ্যতা সম্পর্কে অনেক কিছু জানা গেছে। কিন্তু লিপির পাঠোদ্ধার না হওয়ায় সিন্ধু সভ্যতা সম্পর্কে বহু কিছু আমাদের জানার উপায় নাই। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে প্রত্নতত্ত্ব ও গবেষণার অন্যান্য শাখা থেকে পাওয়া বিপুল জ্ঞান আমাদেরকে সিন্ধু সভ্যতার বেশ কিছু অনন্য বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে সাহায্য করে। এ ছাড়া সিন্ধু সভ্যতার বহু বৈশিষ্ট্য পরবর্তীকালে ভারতবর্ষের সমাজে নানানভাবে ধারাবাহিকতা রক্ষা করায় সেগুলিও আমাদেরকে হারিয়ে যাওয়া সিন্ধু সভ্যতার বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য ও প্রবণতা সম্পর্কে ধারণা পেতে বিরাটভাবে সাহায্য করে। তবে এই আলোচনায় আমরা প্রধানত নির্ভর করব প্রত্নতাত্ত্বিক সাক্ষ্যের উপর। প্রধানত প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারসমূহ থেকে আমরা এমন এক সভ্যতার অস্তিত্ব দেখতে পাই যেখানে ছিল মূলত সকলের সম্মতির ভিত্তিতে সেযুগের মত করে গণতান্ত্রিক ও জনকল্যাণবাদী শাসনব্যবস্থার উপস্থিতি, এক ধরনের সামাজিক সাম্যের উপস্থিতি, সভ্যতা নির্মাণ ও রক্ষায় তুলনামূলকভাবে নম্র ধারার প্রাধান্য ও বল প্রয়োগের অভাব এবং রাষ্ট্র ও সমাজে নিরীশ্বরবাদ বা লোকায়ত ধারণার প্রতিষ্ঠা ও প্রয়োগ। এখন আমরা সিন্ধু সভ্যতার এই বৈশিষ্ট্যগুলি নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করব। এবং সেই সঙ্গে আগামী সভ্যতা নির্মাণে সিন্ধু সভ্যতার উত্তরাধিকারের অতুলনীয় গুরুত্ব ও তাৎপর্যকে সংক্ষেপে তুলে ধরতে চেষ্টা করব।
সিন্ধু সভ্যতার বসতিসমূহের বিস্তার (সাদা বিন্দু) এবং খননকৃত বসতিসমূহ (লাল বিন্দু) (সৌজন্যেঃ Akinori Uesugi, 2018)
২। সম্মতি ভিত্তিক গণতান্ত্রিক ও জনকল্যাণবাদী রাষ্ট্র শাসন ব্যবস্থা
সিন্ধু সভ্যতার হরপ্পান পর্যায়ের নগরগুলি সাধারণভাবে পরিকল্পিত। আদি হরপ্পান পর্যায়ে কোট দিজি (সিন্ধু প্রদেশ) সময়ে1 কোনো কোনো নগরে সোজা রাস্তা, গলি ও বিভিন্ন কাঠামো পূর্ব-পরিকল্পনার মাধ্যমে গড়ে উঠেছিল। অর্থাৎ এখানে রাস্তা, বাড়ী-ঘর ও অন্যান্য কাঠামো একটি কেন্দ্রীয় ও পূর্ব পরিকল্পনার অংশ হিসাবে গড়ে উঠেছে। বসতিগুলি সামগ্রিক পরিকল্পনায় প্রায় ক্ষেত্রে আয়তাকার ও দু’টি বা ততোধিক সংখ্যক দরজাসহ ভারী সীমানা প্রাচীর বেষ্টিত ছিল। বসতির মধ্যে রাস্তা ও গলিগুলি পূর্ব-পশ্চিম-উত্তর-দক্ষিণ এই চারটি প্রধান দিক বরাবর বিন্যস্ত হয়ে নগরকে তুলনামূলক সমান আকারের অট্টালিকাশ্রেণী বা সন্নিহিত অঞ্চলে বিভক্ত করেছে। এই সমস্ত রাস্তার পাশে নর্দমাও থাকত, যা বাড়ীঘর ও সন্নিহিত এলাকার বাইরে বর্জ্য নিষ্কাশন করত। বসতির সকল স্থানে সকল অধিবাসীর জন্য এই ধরনের সহজ প্রবেশাধিকার এবং সকল বাড়ী ও সন্নিহিত স্থানের জন্য সমান নর্দমা নিষ্কাশন ব্যবস্থা প্রাচীন পৃথিবীর একটি অভূতর্ব ঘটনা ছিল।2 এটি থেকে সেযুগে সিন্ধু সভ্যতার শাসকশ্রেণীর জনসাধারণের কল্যাণের প্রতি মনোযোগের প্রমাণ পাওয়া যায়। হরপ্পার নগর সভ্যতার পতন পরবর্তী গ্রামীণ পর্যায়, যা আমাদের নিকট বিদায়ী হরপ্পান পর্যায় হিসাবে পরিচিত, সেই পর্যায়ে এবং এমনকি আরো পরবর্তী কালেও এই ধরনের গঠনের ধারাবাহিকতাকে কম-বেশী রক্ষা পেতে দেখা গেছে।
-----------------------------------------------------------------
1 পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশে অবস্থিত কোট দিজিতে হরপ্পান পর্যায়ের শুরুর পূর্বে ২৮০০-২৬০০ পর্যন্ত যে সংস্কৃতি দেখা যায় তা কোট দিজি সংস্কৃতি নামে পরিচিত। কোট দিজি সংস্কৃতির প্রভাব পরবর্তী হরপ্পান সংস্কৃতিতেও দেখা গিয়েছিল।
2 দেখুনঃ Jonathan Mark Kenoyer, Households and Neighborhoods of the Indus Tradition: An Overview, in, New Perspectives on Household Archaeology, eds., Bradley J. Parker and Catherine P. Foster, Indiana, Eisenbrauns, 2012, p. 400.
-----------------------------------------------------------------
হরপ্পান পর্যায়ে সুপরিচালিত নগর-প্রাচীর ও নগর-দরজা এবং নগরের ভিতর নগর-দরজা থেকে বের হওয়া উত্তর-দক্ষিণ ও পূর্ব-পশ্চিমে বিন্যস্ত প্রধান রাস্তা নির্মাণ করার সাক্ষ্য পাওয়া যায়। এই রাস্তায় যুক্ত হওয়ার জন্য ছোট গলি থাকত। সমস্ত রাস্তা ও গলিতে একটি গরু-গাড়ী বা রাস্তায় মানুষ চলাচলের ব্যবস্থা ছিল। এর ফলে সকল সন্নিহিত এলাকায় মানুষের একই রকম প্রবেশাধিকার ছিল।
নগর বিন্যাসের বিষয়টিকে বিবেচনায় নিলে সাধারণভাবে মহেঞ্জো-দাড়োকে আদর্শ হিসাবে ধরা হয়। এর পশ্চিমে নগরদুর্গ বা উঁচু নগর, যাকে প্রশাসনিক কেন্দ্র বলে মনে করা হয়, আর পূর্ব অংশে ছিল তুলনামূলকভাবে নীচু নগর, যা সর্বসাধারণের বসবাসের জন্য ছিল। দেখা গেছে যে, অধিকাংশ হরপ্পান নগর-পরিকল্পনা মহেঞ্জো-দাড়ো থেকে ভিন্ন ছিল। যেমন, আল্লাহদিনো (সিন্ধু প্রদেশ), আমরি (সিন্ধু প্রদেশ), বনওয়ালী (হরিয়ানা), ধোলাভিরা, লোথাল, রোজদি (গুজরাট), সুরকোটডা (গুজরাট), রূপার (ভারতীয় পাঞ্জাব) ও হুলাসের (উত্তর প্রদেশ) মত বসতিগুলির নিজস্ব পরিকল্পনা ছিল।1 হরপ্পায় আদি হরপ্পান বসতির উপর পরবর্তী হরপ্পান নগর গড়ে উঠাতে সেখানে পরিকল্পিত নগর নির্মাণের বাস্তবতা ভিন্ন ছিল। সেখানে আলাদা কতকগুলি ঢিবির উপর হরপ্পান বসতি গড়ে উঠেছিল।
-----------------------------------------------------------------
1 দেখুনঃ D.P. Agrawal, The Indus Civilization: An Interdisciplinary Perspective, Aryan Books International, New Delhi, 2007, p. 133.
-----------------------------------------------------------------
আকাশ থেকে দেখা মহেঞ্জো-দাড়োর নগর দূর্গে অবস্থিত ‘গ্রেট-বাথ’ ও সন্নিহিত ভবনসমূহ (সৌজন্যেঃ Ute Franke and Elisa Cortesi, 2015)
চানহুদাড়োর (সিন্ধু প্রদেশ) নগর বিন্যাসের ছকে ভিন্নতা ছিল। সেখানে তিনটি পৃথক ঢিবিতে বসতি গড়ে উঠেছিল। ধোলাভিরায় প্রাচীর পরিবেষ্টিত বসতির প্রায় মাঝখানে নগরদুর্গ বা উঁচুনগর তৈরী করা হয়েছিল। এখানে মধ্যবর্তী ও নীচু নগরও ছিল। কেবলমাত্র কালিবঙ্গানের নগর বিন্যাসকে মহেঞ্জো-দাড়োর সাথে তুলনা করা যায়।
মহেঞ্জো-দাড়োর নগর পরিকল্পনা এবং তিনটি এলাকা (ক) ‘গ্রেট-বথ’-এর ঢিবি, (খ) ডিকে-এলাকা, এবং (গ) এইচআর-এলাকার দৃশ্য। প্রতিটি এলাকাতেই বৈশিষ্ট্যপূর্ণ বৃহদায়তন ভবন আছে, এবং সবগুলি একই স্কেলে দেখানো হয়েছে। (সৌজন্যেঃ Cameron A. Petrie, 2019)
হরপ্পার ১৯৯০ সালের বসতির পরিকল্পনা, খননের স্থানসমূহ দেখানো হয়েছে (সৌজন্যেঃ Jonathan Mark Kenoyer, 1991)
মহেঞ্জো-দাড়োতে সিঁড়িবিশিষ্ট কিছু বাড়ীর কাঠামো পাওয়াতে ধারণা করা হয় সেখানে কমপক্ষে দোতলা বাড়ী তৈরী করা হয়েছিল। বনওয়ালীতেও বাড়ীর দেওয়ালের পুরুত্ব থেকে সেখানে কমপক্ষে দোতলা বাড়ী ছিল বলে ধারণা করা হয়।1
-----------------------------------------------------------------
1 দেখুনঃ R.S. Bisht, Structural Remains and Town-planning of Banawali, in, Frontiers of the Indus Civilization, eds., B.B. Lal and S.P. Gupta, Books and Books, New Delhi, 1984, p. 95.
-----------------------------------------------------------------
হরপ্পায় ঢিবি এবি-এর কাদা-মাটির ইটের তৈরী কেল্লার ছেদকৃত দৃশ্য (সৌজন্যেঃ Jonathan Mark Kenoyer, 1991; redrawn from Wheeler, 1946)
হরপ্পান নগরগুলিতে একটি উঠানের চারপাশে বহুকক্ষবিশিষ্ট কাঠামো সাধারণভাবে চোখে পড়ে। এছাড়া কিছু সংখ্যক বাড়ীর জন্য জল ব্যবহারের উদ্দেশ্যে কূপ বা কুয়া নির্মাণ করা হত। ইটের আস্তরণ দেওয়া কুয়া সিন্ধুর লোকজনের আবিষ্কার বলে মনে করা হয়। এখন পর্যন্ত কোনো আদি হরপ্পান বা প্রাক-হরপ্পান বসতিতে কুয়া পাওয়া যায় নাই। এমন কি মেসোপটেমিয়া ও মিসরের বসতিগুলিতে কুয়া তৈরী করে অর্থাৎ ভূমিতে খাঁড়াভাবে খনন করে জল তুলবার পদ্ধতি বাস্তবে অজানা ছিল।1 মহেঞ্জো-দাড়োর কুয়ার স্তম্ভের গভীরতা ২০ মিটারের (৬৬ ফুট) চেয়েও বেশী পাওয়া গেছে। এখানে এই ধরনের ৭০০ টি কুয়া থাকার সম্ভাব্যতা সম্পর্কে অনুমান করা হয়। এখানকার প্রতিটি কুয়ার জলাধারের নহর বা catchment area গড়ে প্রায় ১৭ মিটার ব্যাসার্ধ বিশিষ্ট ছিল। এই ধরনের ঘনত্বের জল সরবরাহ ব্যবস্থা পৃথিবীর জল সরবরাহ ব্যবস্থার ইতিহাসে অতুলনীয়।2 তারা যে পদ্ধতিতে কুয়া তৈরী করত পাকিস্তানে আজও একই পদ্ধতিতে কুয়া তৈরী করতে দেখা যায়। এটি লক্ষ্যণীয় যে, বিপাশা নদীর প্রবাহের এলাকা জুড়ে জরিপ চালানোর সময় প্রত্নতাত্ত্বিকরা সিন্ধু সভ্যতার ছোট গ্রাম ও শহরে একই প্রযুক্তি দিয়ে তৈরী কুয়া আবিষ্কার করেছেন।3
-----------------------------------------------------------------
1 দেখুনঃ Michael Jansen, Mohenjo-Daro, Indus Valley Civilization: Water Supply and Water Use in One of the Largest Bronze Ages Cities of the Third Millennium BC, in, A History of Water, A, Series III, Vol. 1: Water and Urbanism, eds., Terje Tvedt and Terje Oestigaard, Publisher: I.B. Tauris, 2014, p. 54 - 55.
2 দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ৫৫।
3 দেখুনঃ Rita P. Wright and Zenobie S. Garrett, Engineering Feats and Consequences: Workers in the Night and the Indus Civilization, in, Archaeology of the Night: Life After Dark in the Ancient World, eds., Nancy Gonlin and April Nowell, University Press of Colorado, 2017, pp. 294-295.
-----------------------------------------------------------------
মহেঞ্জো-দাড়ো নগরের উঁচু স্থানে, যাকে ‘নগরদুর্গ’ বলা হয়, সেখানে মাত্র ৬টি কুয়া পাওয়া গেছে। এই সব কুয়া জনসাধারণের ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত ছিল। মহেঞ্জো-দাড়োর প্রায় প্রতিটি বাড়ীর সাথে একটি স্নানাগার পাওয়া গেছে। সেখানে অগভীর গামলার মত কাঠামো অথবা মঞ্চ ছিল, যা ১ বর্গ মিটার আয়তনের। এগুলি ধারালো কিনারা যুক্ত ইটের সাহায্যে তৈরী করা হয়েছিল। এগুলি একটি বহির্গমন পথের দিকে ঢালু ছিল ও তা বাইরে রাস্তার নর্দমার সাথে যুক্ত ছিল। মনে করা হয় যে, এই ধরনের স্নান প্রচলনের পিছনে শুধুমাত্র স্বাস্থ্যগত কারণ নয়, এর সাথে ধর্মীয় বিশ্বাসও যুক্ত থাকতে পারে। প্রত্নতাত্ত্বিক মাইকেল জেনসেন মনে করেন, কৃৎকৌশলের দিক ও এর বিপুল সংখ্যা বিবেচনা করলে প্রাচীন পৃথিবীতে এই ধরনের স্নানের মঞ্চ অনন্য ছিল।1
-----------------------------------------------------------------
1 দেখুনঃ Michael Jansen, Mohenjo-Daro, Indus Valley Civilization: Water Supply and Water Use in One of the Largest Bronze Ages Cities of the Third Millennium BC, in, A History of Water, A, Series III, Vol. I: Water and Urbanism, eds., Terje Tvedt and Terje Oestigaard, 2014, p. 58.
-----------------------------------------------------------------
মহেঞ্জো-দাড়োর কথিত ‘নগরদুর্গে’ বা উঁচু নগরে অত্যুৎকৃষ্ট অনেক কাঠামো পাওয়া গেছে। এখানে এখন পর্যন্ত কেবলমাত্র ছয়টি কুয়া পাওয়া গেছে। এখানে একটি জটিল ভবন পাওয়া গেছে যাকে “priests’ college” বলা হয়, যেখানে কোনো কুয়া পাওয়া যায় নাই। তবে এখানে অনেক স্নানের মঞ্চ পাওয়ায় এখানে ব্যাপক জল সরবরাহ করা হত বলে মনে করা হয়। এছাড়াও এই এলাকায় “Great Bath” নামে যে চৌবাচ্চাটি পাওয়া গেছে তা আজও একটি বিশিষ্ট নির্মাণ হিসাবে টিকে আছে। এই চৌবাচ্চাটি একটি আয়তাকার ইটের তৈরী কাঠামো, যার মাপ দৈর্ঘ্যে ১২ মিটার, প্রস্থে ৭ মিটার ও গভীরতায় ২.৪ মিটার। এর ধারণ ক্ষমতা ১৬০ ঘন মিটার। এটির দুই পাশে সিড়ি বেয়ে নামার ব্যবস্থা আছে। এই চৌবাচ্চাটির মেঝে দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে ময়লা জল নিষ্কাশনের জন্য একটি নির্গমন পথের দিকে ঢালু করা হয়েছিল। এই ঢালুর পরিমাণ বা নতিমাত্রা (Gradient) শতকরা ১.৪-১.৭। এই জটিল সমতলত্ব (Leveling) কৌশল অবাক করার মত। জলরোধ করার জন্য এখানে বিটুমিনও ব্যবহার করার প্রমাণ পাওয়া গেছে। এই চৌবাচ্চাটি একটি অভ্যন্তরীণ উঠানের মাঝখানে করা হয়েছে, যা একটি সুদৃশ্য ভবনশ্রেণী দ্বারা বেষ্টিত। মনে করা হয় যে, এই চৌবাচ্চাটি কোনো ধর্মীয় উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হত। হয়ত এখানকার জল পবিত্রকরণের কাজে ব্যবহৃত হত। এখানে নগরের ‘নীচু স্থানের’ মতই একই রকম ঘনভাবে স্নানের মঞ্চ ও নোংরা জল নিষ্কাশনের জন্য নর্দমা দেখা গেছে। নগরদুর্গে অবস্থিত ভবনগুলি প্রধানত সর্বসাধারণের কাজে ব্যবহৃত হত বলে মনে করা হয়।
আশেপাশের বিভিন্ন কাঠামোর নানা দিক পরীক্ষা করে ধারণা করা হয় এই চৌবাচ্চাটি মহেঞ্জো-দাড়োর নগরদুর্গের মূল কাঠামোগত পরিকল্পনার অংশ ছিল না। পরে, ২৩০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের দিকে এটি নির্মাণ করা হয়েছে বলে মনে করা হয়।1 পরবর্তীতে এটির প্রচুর পরিবর্তন করা হয়। প্রায় একই সময়ের পরবর্তী কিছু পাথরের মূর্তি পাবার কথা জেনসেন জানাচ্ছেন, যেগুলি হল তথাকথিত ‘রাজর্ষি’ বা ‘preist king’ নামে পরিচিত অর্ধ-নিমীলিত চোখে একটি মানুষের মূর্তি, হাঁটু গেড়ে বসা মূর্তি, ভেড়ার মূর্তি, ইত্যাদি।2 ‘গ্রেট বাথ’-টিতে পরবর্তীকালে বড় ধরনের পরিবর্তন করা হয়েছিল। চৌবাচ্চাটির উত্তর পাশে সংলগ্ন স্তম্ভবিশিষ্ট হলঘরটিতে (Pillared hall) প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে ভরাট করে ফেলা হয়েছিল। শুরুতে যে উদ্দেশ্যে এই ভবনশ্রেণী তৈরী করা হয়েছিল এই সময়ে তা পরিত্যাগ করা হয় বলে মনে হয়।3
-----------------------------------------------------------------
1 দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ৬০-৬৩।
2 দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ৬৩।
3 দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ৬৩।
-----------------------------------------------------------------
মহেঞ্জো-দাড়ো নগরের নোংরা জল নিষ্কাশন ব্যবস্থা দেখে এখানকার মানুষের বিপুল পরিমাণ জল ব্যবহারের বিষয়টি বুঝা যায়। এখানে বাড়ী, স্নানের মঞ্চ ও শৌচাগারের বর্জ্য জল ‘পাইপ’ বা নলের সাহায্যে একটি পাত্রে পড়ত, যেখান থেকে সাধারণ নর্দমা ব্যবস্থার সাথে তা যুক্ত থাকত। পৌর পয়ঃব্যবস্থার সাথে সংযুক্ত করার জন্য স্নানাগার ও শৌচাগারগুলি রাস্তার ধারে তৈরী করা হত।
হরপ্পা ও মহেঞ্জো-দাড়োতে দেখা যাচ্ছে যে, প্রায় প্রতিটা বাড়ীতেই স্নানের ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার ব্যবস্থা ছিল। ফলে শাসকদেরকে নগরে বিশুদ্ধ জলের ব্যবস্থা করতে হয়েছে। বাড়ীর স্নানের জায়গা ও শৌচাগার থেকে ব্যবহৃত জল ও পয়ঃনিষ্কাশনের জন্য ইটের আস্তরণে তৈরী নর্দমা বা নালা ব্যবস্থা গড়ে তুলা হয়েছিল। শৌচাগারের বর্জ্য বাড়ীর বাইরে রাস্তা ও গলির ধারে অবস্থিত গর্তে জমা হত। ধারণা করা যায় যে, শ্রমিকরা এই বর্জ্য সংগ্রহ করে শহরের বাইরে ফেলত। এছাড়া বাড়ী থেকে নর্দমায় ব্যবহৃত জল বড় পয়ঃপ্রণালীতে যেত। সেখান থেকে নগরের দরজার বাইরে অথবা প্রাচীরের বাইরে যেত। হরপ্পায় খনন করে দেখা গেছে যে, প্রায় প্রতিটা বাড়ীতেই শৌচাগার ছিল। এমন কি সিন্ধুর ছোট শহর বা গ্রামেও চমৎকার নর্দমা ব্যবস্থা থাকার ফলে এ বিষয়টি স্পষ্ট যে, নোংরা জল ও পয়ঃ অপসারণ সিন্ধু সভ্যতার মানুষদের একটি দৈনন্দিন বিষয় ছিল।1 নৌশারোতে (বালুচিস্তান) এই ধরনের ব্যবস্থা দেখতে পাওয়া গেছে। ধোলাভিরায় বৃষ্টির জল সংগ্রহ করার জন্য আলাদা নালা ছিল এবং এই জলকে বিশেষভাবে নির্মিত জলাধারে নিয়ে যাওয়া হত।
-----------------------------------------------------------------
1 দেখুনঃ D.P. Agrawal, The Indus Civilization: An Interdisciplinary Perspective, 2007, p. 81.
-----------------------------------------------------------------
গবেষক হিদার এম,-এল, মিলার হরপ্পাসহ কয়েকটি নগরের, বিশেষত হরপ্পা ও মহেঞ্জো-দাড়োর, শিল্প উৎপাদনের এলাকার সাথে অনুৎপাদকদের, যেমন, ব্যবস্থাপক, প্রশাসক, ইত্যাদির সম্পর্ক অনুসন্ধান করতে গিয়ে দেখতে পান যে, উৎপাদনের এলাকার সাথে কর্তৃত্বপূর্ণ নির্দেশনার কোনো সম্পর্ক ছিল না।1 এছাড়াও বিশেষ কোনো ঢিবিতে উৎপাদনের এলাকাগুলিতে জিনিসপত্র তৈরী করার জন্য “দৈনন্দিন ব্যবহারোপযোগী” জিনিস অথবা “অভিজাত” জিনিস, এমন কোনো ভাগ ছিল না। হরপ্পান পর্যায়ে হরপ্পা ও মহেঞ্জো-দাড়োর প্রতিটি ঢিবিতেই শিল্প উৎপাদনের সাক্ষ্য পাওয়া গেছে, এবং কোনো বিশেষ ধরনের শিল্পের সাথে বিশেষ ধরনের ঢিবির সম্পর্ক পাওয়া যায় নাই।2 আবার হরপ্পান বসতিগুলিতে যে প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ ছিল সেটির পক্ষেও প্রমাণ পাওয়া যায়। হরপ্পায় পাওয়া পাথর ও খনিজের উৎস অনুসন্ধান করতে গিয়ে গবেষক র্যান্ডাল ল’ ধারণা করেন যারা হরপ্পান সভ্যতা পরিচালনা করত দুষ্প্রাপ্য ও সাধারণ উভয় ধরনের পাথরের উপর তাদের নিয়ন্ত্রণ ছিল। হরপ্পার সকল অংশে বসবাসকারী সকলে একই ধরনের ও একই উৎস থেকে পাওয়া পাথর ও খনিজ ব্যবহার করত। কেবলমাত্র ঢিবি ই ও ইটি-তে পর্ব ৩বি (হরপ্পান সময়ের মধ্যবর্তী যুগ)3 ও ৩সি (হরপ্পান সময়ের শেষ যুগ) সময় জুড়ে বসবাসকারী কারিগররা আর্নেস্টাইট পাথরের ছিদ্র করার যন্ত্র ব্যবহার করত যা দিয়ে তারা ভেসুভিয়ানাইট-গ্রোসুলার পাথরের মত শক্ত পাথরকে ছিদ্র করে পুতি বানাতে পারত।4
-----------------------------------------------------------------
1 দেখুনঃ Heather M.-L. Miller, Associations and Ideologies in the Locations of Urban Craft Production at Harappa, Pakistan (Indus Civilization), in, Archaeological Papers of the American Anthropological Association, Vol. 17, Issue 1, p. 44.
2 দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ৪০।
3 সিন্ধু সভ্যতার হরপ্পান পর্যায়, যা ২৬০০ থেকে ১৯০০ খ্রীঃপূঃ পর্যন্ত টিকে ছিল, তাকে সাংস্কৃতিক কিছু পরিবর্তনের উপর ভিত্তি করে তিনটি যুগ বা পর্বে ভাগ করা হয়েছে। এই বিষয়ে পরে আলোচনা করা হয়েছে।
4 দেখুনঃ Randall William Law, Inter-Regional Interaction and Urbanism in the Ancient Indus Valley: A Geological Provenience Study of Harappa’s Rock and Mineral Assemblage, in, Current Studies on the Indus Civilization, Volume VIII, Part 1: Text, Manohar Publishers & Distributers, New Delhi, 2011, pp. 11-13, 485-486, 502.
-----------------------------------------------------------------
মহেঞ্জো-দাড়ো থেকে পাওয়া ইউনিকর্ণ সীল (সৌজন্যেঃ Cameron A. Patrie, Danika Parikh, Adam S. Green and and Jennifer Bates, 2017)
সিন্ধু সভ্যতার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পাওয়া সীল মোহর (সৌজন্যেঃ Cameron A. Patrie, Danika Parikh, Adam S. Green and and Jennifer Bates, 2017)
বিস্তীর্ণ অঞ্চলব্যাপী ছড়ানো বসতিগুলিতে বিভিন্ন জিনিসের এক ধরনের সমরূপতা থেকে এটাই মনে করা যায় যে, এখানকার শাসকরা কঠোর নিয়ন্ত্রণের উপর জোর দিত। তারা আদর্শিকভাবে রক্ষণশীল ছিল বলেই মনে করার যুক্তি সঙ্গত কারণ আছে। সবচেয়ে বেশী যে কয়টি জিনিসের বৈশিষ্ট্য সমগ্র বৃহত্তর সিন্ধু উপত্যকায় প্রায় একই রকম ছিল সেগুলি হল সীল, লিপি ও ওজন। অনুমান করা যায় যে, সিন্ধুর শাসকরা এই কয়টি জিনিসের অভিন্নতার উপর সবচেয়ে জোর দিয়েছিল। এবং সম্ভবত এর উপর জোর দিয়ে একটি বিধান আরোপ করে একটি শক্তিশালী ও কেন্দ্রীভূত শাসন ব্যবস্থা বজায় রেখেছিল। সিন্ধু সভ্যতার বসতিসমূহের বিস্তার ও বিন্যাস থেকে অনুমান করা যায় যে, নগরসমূহের নিজেদের মধ্যে যেমন যোগাযোগ ছিল তেমন নগরগুলির সাথে ছোট বসতিগুলিরও যোগাযোগ ছিল। ছোট বসতিগুলি যেগুলি ৪০ হেক্টরের চেয়েও ছোট, দেখা গেছে যে সেগুলি স্থানীয় প্রেক্ষিতে নিঃসন্দেহে নগর ছিল ও স্থানীয় প্রশাসনিক ও ক্ষমতা কাঠামোতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখত।1 উদাহরণ হিসাবে উত্তর রাজস্থানে কালিবঙ্গানের নাম বলা যেতে পারে, যা বর্তমানে একটি শুকনো নদীর তীরে অবস্থিত ও বৃহৎ নগর রাখিগাড়ি ও হরপ্পা থেকে বেশ কয়েক শত কিলোমিটার দূরত্বে ছিল। হরপ্পান নগর পর্যায়ে কালিবঙ্গান উঁচু ও নীচু নগর উভয়ই আলাদাভাবে প্রাচীর ঘেরা ছিল ও হরপ্পান সংস্কৃতির জিনিসপত্র ও মৃৎপাত্র ছাড়াও স্থানীয় শৈলীর মৃৎপাত্র এখানে পাওয়া গেছে। সিন্ধু সভ্যতায় অনেক ছোট বসতিতে কৃষকরা বসবাস করত, তেমনি আবার কিছু ছোট বসতিতে বিশেষীকৃত উৎপাদনের প্রমাণ পাওয়া গেছে। সিন্ধু সভ্যতার বড় নগরগুলির সাথে এর পশ্চাদভূমিতে থাকা অসংখ্য গ্রামের একটি বিশেষ সম্পর্ক ছিল বলে সাম্প্রতিক গবেষণায় জানা যাচ্ছে। গুজরাটে পাওয়া হরপ্পান বসতিগুলির মধ্যে কমপক্ষে পনেরোটি বসতির চারপাশ ভারী দেওয়াল দিয়ে ঘেরা ছিল।2 সিন্ধু সভ্যতার বহু সংখ্যক ছোট বসতিতে কখনো একবার কখনো একাধিকবার বসবাসের প্রমাণ পাওয়া গেছে। এগুলি সাধারণত নীচু ঢিবির উপর হত। ছোট বসতিগুলি অনেক সময় পরিত্যক্ত হত আবার সেখানে পুনরায় বসতি স্থাপন করা হত। কৃষিতে যে কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ ছিল না তা বুঝা যায় বিভিন্ন অঞ্চলে ও বিভিন্ন বসতিতে শস্য উৎপাদনের ভিন্ন কৌশল ব্যবহৃত হত বলে এবং সম্ভবত যে ধরনের উদ্বৃত্ত উৎপাদন হত সেটা থেকেও।3
-----------------------------------------------------------------
1 দেখুনঃ Cameron A. Petrie, Diversity, variability, adaptation and ‘fragility’ in the Indus Civilization, in, The Evolution of Fragility: Setting the Terms, ed., Norman Yoffee, McDonald Institute for Archaeological Research, University of Cambridge, Cambridge, 2019, p. 115.
2 দেখুনঃ Rajesh S.V., Prabhin Sukumaran and K. Krishnan, Scenario of Chalcolithic Site Surveys in Gujarat, in, Pakistan Heritage, Volume 7, eds., Shakirullah and Ruth Young, Research Journal of the Department of Archaeology, Hazara University, Mansehra, 2015, p. 2.
3 দেখুনঃ Cameron A. Petrie, Diversity, variability, adaptation and ‘fragility’ in the Indus Civilization, in, The Evolution of Fragility: Setting the Terms, ed., Norman Yoffee, 2019, p. 118.
-----------------------------------------------------------------
সিন্ধু সভ্যতায় দেখা যায় বড় নগরগুলি কাছাকাছি আয়তনের। যেমন মহেঞ্জো-দাড়ো, গানেরিওয়ালা, হরপ্পা, রাখিগাড়ি ও লাখাঞ্জোদাড়োর আয়তন কাছাকাছি। অন্যান্য সভ্যতায় সাধারণত দেখা যায় রাজধানী অন্যান্য নগরের চেয়ে অনেক বড় হয়। এক্ষেত্রেও সিন্ধু সভ্যতা ব্যতিক্রম। মহেঞ্জো-দাড়ো বা অন্য কোনো নগর যেটাই রাজধানী হয়ে থাকুক কোনোটাই সাধারণভাবে সিন্ধু সাম্রাজ্যের ক্ষমতার অতিরিক্ত কেন্দ্রীভবনের প্রতি ইঙ্গিত করে না। অথচ এখানে কেন্দ্রীয়ভাবে কঠোর নিয়ন্ত্রণও ছিল, নতুবা এত দূর বিস্তৃত ভূ-ভাগে এই ধরনের সমরূপতা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব ছিল না।
একটি বিষয় লক্ষ্যণীয় যে, সিন্ধুর বেশীর ভাগ নগরই ৭০০ বা ৬০০ বৎসর টিকে ছিল। এর মধ্যে শাসন ব্যবস্থায় বড় ধরনের পরিবর্তনের প্রমাণ পাওয়া যায় না। এখানে আবার ব্যক্তি শাসক বা রাজবংশের উপস্থিতির প্রমাণও পাওয়া যায় না। অন্য দিকে মেসোপটেমিয়ার অনেক নগরই এক বা দুই শতাব্দী টিকে ছিল এবং শাসক ও রাজবংশ শেষ হয়ে যাবার সাথে সাথে সেগুলি পরিত্যক্ত হয়।
সিন্ধুর পাঁচটি প্রধান নগর (৮০ হেক্টরের উপরে) যেমন, মহেঞ্জো-দাড়ো, হরপ্পা, রাখিগাড়ি, ধোলাভিরা ও গানেরিওয়ালার মধ্যে দূরত্ব ২৮০ থেকে ৮৩৫ কিলোমিটার। তবে লাখাঞ্জোদাড়োর অবস্থান মহেঞ্জো-দাড়ো থেকে প্রায় ১৫০ কিলোমিটার দূরত্বে।1 কচ্ছের রানের দ্বীপে অবস্থিত ধোলাভিরা ছাড়া সব নগরই অনেক দূরত্বে ভিন্ন পাললিক ভূমিতে অবস্থিত। এগুলির মধ্যে সংখ্যা ও বিস্তার পরিষ্কারভাবে মেসোপটেমিয়ার উত্তর আদি রাজবংশ, আক্কাদীয় ও উর ৩ পর্বের নগরসমূহের সাথে বৈসাদৃশ্যপূর্ণ। ধরে নেওয়া হয় যে, সিন্ধুর বড় নগরগুলি তাদের চারপাশের ১,০০,০০০ থেকে ১,৭০,০০০ বর্গ কিলোমিটারের কৃষিজ পশ্চাদভূমি নিয়ে আঞ্চলিক রাজধানী হিসাবে কাজ করত। যদি সমসাময়িক মেসোপটেমিয়া ও সিরিয়ার নগরগুলির সাথে তুলনা করা যায় তাহলে এটি অনেক বড় আয়তনের। যেমন, পশ্চিম সিরিয়ার এবলা মাত্র ১৫০ থেকে ২০০ বর্গ কিঃমিঃ কৃষিভূমির উপর প্রভাব বিস্তার করত।2
-----------------------------------------------------------------
1 পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশে সিন্ধু নদীর ডান তীরে অবস্থিত লাখাঞ্জোদাড়ো নগরটি এখনও পর্যাপ্ত খনন না হওয়ায় এটি সম্পর্কে বেশী কিছু বলা সম্ভব নয়। এই নগরটির বেশীরভাগ অংশ পলির নীচে, এবং উপরিভাগ আধুনিক লোকজন ও শিল্পকারখানা দিয়ে দখল হয়েছে। দেখুনঃ Qasid H. Mallah, Recent archaeological discoveries in Sindh, Pakistan, in, Current Studies on the Indus Civilization, Volume I, eds, Toshiki Osada and Akinori Uesugi, Manohar Publishers & Distributers, New Delhi, 2010, p. 49 এবং Rita P. Wright, Konar Sandal South, Nindowari, and Lakhan Jo Daro – Beyond the Limits of a Known World, in, South Asian Archaeology and Art: Contextualizing Material Culture in South and Central Asia in Pre-Modern Times, eds., Verena Widorn, Ute Franke & Petra Latschenberger, Brepols Publishers n.v., Turnhout, 2016, p. 32.
2 দেখুনঃ Massimo Vidale, Heterarchic Powers in the Ancient Indus Cities, in, Journal of Asian Civilizations, ed, Dr. Ghani-ur-Rahman, Vol. 41, No. 2, Taxila Institute of Asian Civilizations, Islamabad, 2018, p. 29.
-----------------------------------------------------------------
মহেঞ্জো-দাড়ো বা হরপ্পায় যে সমস্ত বড় ভবন পাওয়া গেছে সেগুলি কোনোটাই মেসোপটেমিয়া বা মিসরের প্রাসাদ বা ভবনগুলির মত প্রকাণ্ড নয়। এই ভবনগুলির নকশা বা এখানে প্রাপ্ত জিনিসপত্র থেকে এই ভবনগুলি কি কাজে ব্যবহৃত হত তা বুঝা যায় না, যেমন মেসোপটেমিয়া বা মিসরের ক্ষেত্রে বুঝা যায়। তবে এখানে যে রাজপ্রাসাদ বা মন্দির ছিল না সেটি স্পষ্ট।
মিসরে ফারাও-এর অধীনে কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্র উদ্ভূত হয়েছিল। একেবারে প্রথম থেকেই রাজা ও তার সভাসদদের কেন্দ্র করে রাজধানী থেকে এই শাসন ব্যবস্থা প্রদেশ ও গ্রাম পর্যন্ত প্রসারিত ছিল। বিপুল সম্পদ রাজপ্রাসাদে কেন্দ্রীভূত হত। এখানে রাজধানী, ঘর-বাড়ী, জনবসতি, সবকিছুর বিন্যাসে ক্ষমতা ও সম্পদের চূড়ান্ত রকম অসম বন্টন প্রতিফলিত হতে দেখা যায়।
মেসোপটেমিয়া বা মিসরে দেখা যায় যে, অসংখ্য ধরনের বাটখারা বা ওজন ব্যবহৃত হত। অথচ সিন্ধু সভ্যতায় ব্যবহৃত বাটখারা সমূহ প্রমিতকৃত (Standardized) ছিল, যা প্রাচীন পৃথিবীতে তুলনাহীন।1 এই ধরনের প্রমিত (Standard) বাটখারা গাঙ্গেয় উপত্যকায় ৩০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের দিকে প্রচলিত ছিল বলে জানা যায়। একই ধরনের বাটখারা কিছু দিন আগে মেট্রিক পদ্ধতি চালু হবার আগে পর্যন্ত এই উপমহাদেশের দেশগুলিতে ব্যবহৃত হত।2 প্রথম সাতটি বাটখারা প্রথমটি থেকে দ্বিগুণ হত, যেমন ১ঃ২ঃ৪ঃ৮ঃ১৬ঃ৩২ঃ৬৪। প্রত্নতাত্ত্বিকরা প্রতিটি খননকৃত বসতিতে চার্ট পাথরের তৈরী ঘনাকৃতির এই সমস্ত বাটখারা পেয়েছেন এবং সমস্ত বাটখারাই সিন্ধুর প্রমিত বাটখারা পদ্ধতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল। ভারী বাটখারাগুলি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক কেন্দ্র বা বড় বসতিতে পাওয়া গেছে। তবে প্রতিটি গ্রামীন বসতিতেই ছোট বাটখারাগুলি সব মাপেরই পাওয়া গেছে। ঘনাকৃতির বাটখারা ছাড়াও অন্যান্য ধরনের বাটখারা পাওয়া গেছে, যেগুলি একই প্রমিত পদ্ধতি মেনেছিল।
-----------------------------------------------------------------
1 দেখুনঃ Jonathan Mark Kenoyer, Ancient Cities of the Indus Valley Civilization, Oxford University Press, Karachi, 1998, p. 98.
2 যেমন দুই বঙ্গেই কিছু দিন আগেও ওজনে ষোল ছটাকে এক সের চালু ছিল।
-----------------------------------------------------------------
হরপ্পায় পোড়ামাটির ইটের ব্যবহার দেখা গেছে হরপ্পান পর্যায় শুরুর সময় থেকেই। এই সময় পোড়ামাটির ইটের মাপ ছিল ৭X১৪X২৮ সেঃমিঃ, যা ১ঃ২ঃ৪ এই অনুপাত রক্ষা করেছে। এটি অত্যন্ত আশ্চর্যজনক যে, ইটের মাপের এই নির্দিষ্ট অনুপাত বাড়ী-ঘরের কক্ষের মাপ, বাড়ী-ঘরের সামগ্রিক পরিকল্পনায় এবং বৃহৎ আয়তনের ভবনগুলির মাপের অনুপাতেও ব্যবহার করা হয়েছিল। একটি বিষয় স্পষ্ট যে, প্রমিতকরণের ক্ষেত্রে হরপ্পানরা মাপের চেয়েও অনুপাত রক্ষার উপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখেছিল। গবেষক মিশেল ডানিনো দেখিয়েছেন যে, অনেক বসতির ক্ষেত্রে (যেমন, মহেঞ্জো-দাড়ো, কালিবঙ্গান ও ধোলাভিরা) উঁচু নগর বা নগরদুর্গগুলির দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ সূক্ষ্মভাবে ২ঃ১ অনুপাতে বিন্যস্ত ছিল।1 কালিবঙ্গানের রাস্তাগুলি ১ঃ২ঃ৩ঃ৪ অনুপাতে বিন্যস্ত ছিল, যেখানে একক ছিল ১.৮ মিটার।
-----------------------------------------------------------------
1 দেখুনঃ Michel Danino, Metrology and Linear Measurements, in, History of Ancient India: Protohistoric Foundations, Volume: II, eds., Dilip K. Chakrabarti and Makkhan Lal, Published by Vivekananda International Foundation, New Delhi & Aryan Books International, New Delhi, 2014, p. 312.
-----------------------------------------------------------------
এটি একটি তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় যে, যদিও হরপ্পানরা পাথরের প্রচুর পরিমাণ ব্যবহার করত, কিন্তু সিন্ধু উপত্যকার সমভূমিতে প্রতি ক্ষেত্রে তারা জনপ্রতি কম ওজনের পাথর পরিবহন করত।1 হরপ্পায় সবচেয়ে বড় যে বৃত্তাকার পাথর (Ringstone) পাওয়া গেছে সেটির ওজন ১৩৫ কেজি, যা দুই জন মানুষ বহন করতে পারত। সিন্ধু সভ্যতা এত বড় বড় ভবন ও কাঠামো তৈরী করেছে অথচ তার সবচেয়ে বড় নির্মাণ সামগ্রী বহন করতে দুই জনের বেশী জনবলের দরকার হয় নাই। প্রাচীন পৃথিবীর অন্যান্য সভ্যতাগুলি বিশেষভাবে মিসর থেকে এর পার্থক্য হল ভবন তৈরীতে বা রাজকীয় কাজে দীর্ঘ দূরত্ব থেকে বড় বড় পাথর আনতে সিন্ধু ব্যতীত অন্য সকল সভ্যতায় বহু মানুষের শ্রম প্রয়োজন হত।
-----------------------------------------------------------------
1 দেখুনঃ Randall Law, Moving Mountains: The Trade and Transport of Rocks and Minerals Within the Greater Indus Valley Region, in, Space and Spatial Analysis in Archaeology, eds., Elizabeth C. Robertson, Jeffrey D. Seibert, Deepika C. Fernandez, and Marc U. Zender, University of Calgary Press, Calgary, 2006, pp. 306-308.
-----------------------------------------------------------------
মিসর বা মেসোপটেমিয়ার সাথে সিন্ধুর সবচেয়ে দৃশ্যমান যে পার্থক্য তা হল সিন্ধুতে মৃতের সাথে বিপুল পরিমাণ বহনযোগ্য সম্পদ সমাহিত করা হত না এবং স্থায়ী কোনো বৃহদায়তন স্থাপত্যও তৈরী করা হত না।
সিন্ধু সভ্যতার বসতিগুলির বহির্বাণিজ্যের প্রমাণ পাওয়া যায় মেসোপটেমিয়া, ওমান, বাহরাইন, আরব আমিরাত, মধ্য এশিয়ার বিভিন্ন এলাকায়। পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলে বহু পরিমাণ হরপ্পান বাটখারা পাওয়াতে ওমান, বাহরাইন ও মেসোপটেমিয়ার সাথে সিন্ধু সভ্যতার বাণিজ্যের বিষয়টি ধারণা করা যায়। মেসোপটেমিয়ায় পাওয়া একটি সুপরিচিত লিপিতে বলা হয়েছে যে, আক্কাদের রাজধানী আগেডে মেলুহা (মেসোপটেমিয়ার কিউনিফর্ম পাঠে সিন্ধু সভ্যতার এলাকাকে মেলুহা বলা হয়েছে) থেকে আসা জাহাজ ভিড়ত। এ থেকে সিন্ধু সভ্যতার সাথে মেসোপটেমিয়ার বাণিজ্যিক সম্পর্কের বিষয়টি লিখিতভাবে সমর্থিত হয়।
সিন্ধু অঞ্চলে বিনিময়ের ফলে মেসোপটেমিয়া থেকে আনা কোনো জিনিসপত্র প্রত্নতাত্ত্বিকরা পান নাই। তবে মেসোপটেমিয়ার পুস্তক থেকে জানা যায় যে, সোনা, পশম, সুগন্ধী ও অন্যান্য পচনশীল জিনিসপত্র সিন্ধু অঞ্চলে আসত। একটি তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল যে, সিন্ধু সভ্যতায় তুলনামূলকভাবে সীমিত পরিমাণে সম্পূর্ণভাবে উৎপাদিত ‘বিদেশী’ জিনিসপত্র পাওয়া গেছে।
সিন্ধু সভ্যতার মানুষের নৃতাত্ত্বিক পরিচয় জানার চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু তাদের সঠিক ও গ্রহণযোগ্য পরিচয়ের বিষয়টি আজও অমীমাংসিত রয়ে গেছে। সম্প্রতি রাখিগাড়ি থেকে পাওয়া একটি কংকালের ডিএনএ পরীক্ষা করে যে ফল পাওয়া গেছে সে বিষয়ে বিভিন্ন পণ্ডিত প্রশ্ন তুলেছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য মত হল যে, সিন্ধু সভ্যতার বসতিগুলিতে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর মধ্যে শুধুমাত্র তুলনামূলক অল্প জনগোষ্ঠীকে কবর দেওয়ার ফলে কংকালের বৈশিষ্ট্য সমগ্র বসতিটির বা হরপ্পান জনগোষ্ঠীর নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য প্রকাশ করে না। ফলে একটি বা দুইটি কংকালের ডিএনএ-র ফলাফল সমগ্র বসতিটির জনগোষ্ঠীকে প্রতিনিধিত্ব করে না।1 আমরা অনুমান করি আজকে দক্ষিণ এশিয়ার উত্তর এবং পশ্চিমাঞ্চলে যে জনগোষ্ঠীসমূহ বসবাস করে সিন্ধু সভ্যতার সময়েও প্রায় কাছাকাছি নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন জনগোষ্ঠী সেখানে বসবাস করত।
-----------------------------------------------------------------
1 সিন্ধু সভ্যতার নগরগুলির কবরস্থানে পাওয়া নরকংকাল প্রসংগে কেনোয়ারের মত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলছেন, ‘Only a small proportion of the urban population practiced burial as the Harappan cemeteries are relatively small compared to the large populations present in the cities.’ দেখুনঃ Jonathan Mark Kenoyer, New Perspectives on the Indus Tradition: Contributions from Recent Research at Harappā and Other Sites in Pakistan and India, in, Sindhu-Sarasvatī Civilization: New Perspectives, ed., Nalini Rao, Published by Nalanda International, Los Angeles and D.K. Printworld (P) Ltd., New Delhi, 2014, p. 521.
-----------------------------------------------------------------
আমরা আরো অনুমান করি সিন্ধু সভ্যতায় বসবাসকারী সকল জনগোষ্ঠী একই ভাষায় কথা বলত না। তবে সিন্ধুর রাষ্ট্র বৃহত্তর সিন্ধু উপত্যকায় বসবাসকারী সকল জনগোষ্ঠীকে একই রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে ঐক্যবদ্ধ রাখার জন্য একটি সাধারণ ভাষা ও একই ধরনের লিপি প্রচলন করে। সিন্ধু সভ্যতার সর্বত্র একই লিপিমালার ব্যবহার অবশ্য প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারসমূহ দ্বারা সমর্থিত। তবে স্থল পথে হাঁটা ও গরুর গাড়ীর মাধ্যমে ও জলপথে নৌকার মাধ্যমে যোগাযোগের ঐ ধীর গতির যুগে এত দূরব্যাপী ছড়ানো বসতিগুলিকে ঐক্যবদ্ধ রাখার কঠোর চেষ্টা থাকলেও বিভিন্ন অঞ্চলে ভিন্নতা সর্বক্ষেত্রে রোধ করা সম্ভব হয় নাই, যেটা আমরা প্রত্নতত্ত্ব থেকে জানতে পারি।
সিন্ধু সভ্যতা তার সমসাময়িক দুই সভ্যতা মেসোপটেমিয়া ও মিসরের সভ্যতা থেকে বহু বিষয়েই সম্পূর্ণ ভিন্ন ছিল। মিসরের হায়ারোগ্লিফিক ও মেসোপটেমিয়ার কিউনিফর্ম লিপির পাঠোদ্ধার হওয়ায় এবং জলবায়ু ও ভূপ্রাকৃতিক কারণে অনেক প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান টিকে যাওয়ায় এই দুই সভ্যতা সম্পর্কে অনেক কিছু জানা যায়। কিন্তু সিন্ধু সভ্যতার লিপির পাঠোদ্ধার এখনো না হওয়ায় সিন্ধু সভ্যতা সম্পর্কে জানবার অনেক বাকী আছে।
হরপ্পান পর্যায় ২৬০০ থেকে ১৯০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত টিকে থাকলেও একে কয়েকটি উপ-পর্যায়ে (Sub-phase) বা পর্বে (Period) ভাগ করা হয়েছে। এই ভাগ করা হয়েছে মৃৎশিল্প ও অন্যান্য নিদর্শনের শৈলীতে, সীল ও লেখায়, এবং স্থাপত্যের বাহ্যিক গঠনে পরিবর্তনের উপর ভিত্তি করে।1 এই পর্বগুলি হল, পর্ব ৩এ (২৬০০-২৪৫০ খ্রীঃপূঃ), পর্ব ৩বি (২৪৫০-২২০০ খ্রীঃপূঃ) ও পর্ব ৩সি (২২০০-১৯০০ খ্রীঃপূঃ)।
-----------------------------------------------------------------
1 দেখুনঃ Jonathan Mark Kenoyer and Richard H. Meadow, Harappa: New Discoveries on its Origins and Growth, in, Lahore Museum Bulletin, Vol. XII, No. 1, ed, Dr. Anjum Rehmani, 1999, p. 4.
-----------------------------------------------------------------
প্রত্নতাত্ত্বিকরা ধারণা করেন, হরপ্পান পর্যায়ের দীর্ঘ ৭০০ বৎসর ব্যাপী হরপ্পা, মহেঞ্জো-দাড়োর মত নগরগুলির সামাজিক-রাজনৈতিক সংগঠন একই রকম ছিল না। ২২০০ খ্রীষ্ট পূর্বাব্দের দিকে সমরূপ বিশিষ্ট হরপ্পান সভ্যতাকে নানা আঞ্চলিক সত্তায় ক্রমবর্ধমানভাবে বিভক্ত হয়ে যেতে দেখা যায়। গবেষক জি, কুইভরন দেখিয়েছেন যে, এই তিনটি অবস্থার মধ্যে প্রথম অবস্থায় মৃৎপাত্রের বৈশিষ্ট্যে সবচেয়ে সমরূপতা দেখতে পাওয়া যায়।1 এই সময়কার নকশা তুলনামূলকভাবে রক্ষণশীল। মৃৎপাত্রগুলি রঙে ও উৎকর্ষে পরবর্তী অবস্থাগুলির চেয়ে উৎকৃষ্টতর। সম্প্রতি হরপ্পায় খনন করে সর্বশেষ স্তরে, যা প্রায় ২২০০-১৯০০ খ্রীঃপূঃ-এর মধ্যে, তুলনামূলকভাবে বেশী বর্ণনামূলক শিল্প দেখতে পাওয়া যায়। বিখ্যাত প্রত্নতাত্ত্বিক জোনাথান মার্ক কেনোয়ার মনে করেন, বহু শত বৎসর নগর সভ্যতায় বসবাসের পর সেখানে সেই সময়ে নির্দিষ্ট ধর্মীয় ছবি, উপকথার বর্ণনা ও পূজার দৃশ্য খোদিত করার ও সেগুলিকে বৈধতা প্রদান করার প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল।2 কেনোয়ারের এই মন্তব্য হরপ্পান সভ্যতার শেষ পর্যায়ে সিন্ধুর রাষ্ট্র ও সমাজের তুলনামূলকভাবে ধর্মের দিকে ঝুঁকে পড়ার প্রবণতার প্রতি ইঙ্গিত করে।
-----------------------------------------------------------------
1 দেখুনঃ Gonzague Quivron, The Evolution on the Mature Indus Pottery Style in the Light of the Excavations at Nausharo, Pakistan, in, East and West, Volume 50, No. 1/4 (December 2000), p. 178.
2 দেখুনঃ J. Mark Kenoyer, Measuring the Harappan world: Insights into the Indus order and cosmology, in, The Archaeology of Measurement: Comprehending Heaven, Earth and Time in Ancient Societies, eds, Iain Morley and Colin Renfrew, Cambridge University Press, 2010, p. 521.
-----------------------------------------------------------------
দেখা গেছে যে, সিন্ধু সভ্যতার নগরগুলি অল্প সময়ের মধ্যে, প্রায় ২৬০০-২৫০০ খ্রীঃপূঃ-এর মধ্যে বৃহদায়তন হয়ে যায়। এ থেকে বুঝা যায় যে ছোট ও মধ্যম আকারের বসতি থেকে বৃহৎ নগরায়ন তুলনামূলক দ্রুততার সাথে ঘটেছে। কিন্তু এটি আজও পরিষ্কার না যে, ঠিক কোথায় এবং কীভাবে এই সভ্যতা প্রথম এর আকার নিয়েছিল ও বট গাছের মত তার ছায়ার তলায় ব্যাপক ধ্বংসাত্মক কোনও যুদ্ধ ছাড়াই এত বিশাল এলাকায় আঞ্চলিক বিভিন্ন বৈচিত্র্যপূর্ণ সংস্কৃতিকে অন্তর্ভুক্ত করেছিল, এবং প্রায় একই রকম সামাজিক-অর্থনৈতিক কাঠামোগত বৈশিষ্ট্য নিয়ে বিকাশ লাভ করেছিল।
এটি অনুমেয় যে, সিন্ধু সভ্যতায় রাষ্ট্র শাসনে কঠোর নিয়ন্ত্রণ না থাকলে ভৌগোলিকভাবে এত দূর ব্যাপী বিস্তৃত অঞ্চলে সমরূপতা আনা এবং রক্ষা করা সম্ভব হত না। মহেঞ্জো-দাড়ো এখন পর্যন্ত পাওয়া খননকৃত সব চেয়ে বড় নগর হলেও অন্যান্য নগর যেমন হরপ্পা, রাখিগাড়ি বা গানেরিওয়ালার সাথে আয়তনে বেশী পার্থক্য না থাকায় এই সভ্যতার শাসনব্যবস্থায় কিছু ক্ষেত্রে কঠোর কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণের পাশাপশি এক ধরনের বিকেন্দ্রীকরণের সমন্বয় ছিল বলে মনে হয়। অনুমান করা যায় যে, সিন্ধু সভ্যতা একজন ব্যক্তি বা ব্যাপক নিয়ন্ত্রণকারী সীমাবদ্ধ গোষ্ঠীর বদলে কোনো কাউন্সিল বা পরিষদ দ্বারা পরিচালিত হত যেখানে জনগণের ভিতর থেকে আসা বিভিন্ন গোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা থাকত, এবং এর মাধ্যমে সামাজিক ক্ষমতা বণ্টিত হত। এই পরিষদ রাজনৈতিক ও আদর্শিক বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিত। সিন্ধু সভ্যতার প্রত্নতাত্ত্বিক বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য থেকে কিছু সংখ্যক গবেষক সেখানে শাসন ব্যবস্থায় রাজার পরিবর্তে কাউন্সিল ও সভা থাকার সম্ভাবনার কথা বলেছেন যেখানে সমাজের একটি বৃহৎ অংশের প্রতিনিধিত্ব খাকত।1
-----------------------------------------------------------------
1 এই প্রসঙ্গে গবেষক লোরেঞ্জ রাহমস্টর্ফ-এর মন্তব্য উল্লেখযোগ্য। তিনি বলেছেনঃ ‘For the Indus valley the lack of any clearly identifiable and recurring inscription of the name of a single person, and the apparent participation of many individuals in the sealing practice, together with the ubiquitous distribution of weights in settlements, suggests a corporate organisation where hierarchically organized structures were not strongly pronounced, or at least not visible to the archaeologist. It seems that instead of single individuals, or a restricted group of individuals equipped with far-reaching means of control, in the Indus civilization we should envisage councils and assemblies in which a considerable proportion of the community was represented – for example “elders” – and shared social power.’ দেখুনঃ Lorenz Rahmstorf, Control Mechanisms in Mesopotamia, the Indus Valley, the Aegean and Central Europe, c. 2600-2000 BC, and the Question of Social Power in Early Complex Societies, in, Beyond Elites: Alternatives to Hierarchical Systems in Modelling Social Formations, International Conference at the Ruhr-Universität Bochum, Germany, October 22-24, 2009, Volume 2, Verlag Dr. Rudolf Habelt GmbH, Bonn, 2012, p. 322.
এছাড়াও প্রয়াত প্রত্নতাত্ত্বিক ও গবেষক গ্রেগরি পোসেলও সিন্ধু সভ্যতায় রাজার বদলে বহু সংখ্যক কাউন্সিল বা সমাজনেতাদের সভা দ্বারা শাসিত হত বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেনঃ ‘Indus peoples were ruled by a series of ‘Councils’ or gatherings of leaders, rather than a king.’ দেখুনঃ G. L. Possehl, The Indus Civilization. A Contemporary Perspective, Walnut Creek: Rowman & Littlefield Publishers 2002, p. 57.
-----------------------------------------------------------------
আমরা যখন সিন্ধু সভ্যতাকে অন্য সকল সভ্যতার সাথে তুলনা করি তখন দেখতে পাই যে, সিন্ধু সভ্যতা প্রাচীন পৃথিবীর অন্য সভ্যতাগুলি থেকে ভিন্ন ধরনের বৈশিষ্ট্য আমাদের সামনে তুলে ধরে। প্রত্নতত্ত্বের সাক্ষ্যসমূহ এই বৈশিষ্ট্যগুলির মধ্যে একটির দিকে বিশেষভাবে নির্দেশ করে, সেটি হল সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী বংশানুক্রমিক শাসকের ও সেই সাথে নিরংকুশ শাসন ক্ষমতার অনুপস্থিতি। এটা স্পষ্ট যে, এখানে শুধু এককেন্দ্রিক রাষ্ট্র শাসনের অভাব ছিল না, সেই সাথে ছিল রাষ্ট্র শাসনে সেই যুগের মত করে গণতন্ত্রের উপস্থিতি। প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনাদির সাক্ষ্য অনুযায়ী, এখানকার শাসকদের মধ্যে সমকালীন মিসর, ব্যাবিলন কিংবা চীনের নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী শাসকদের মত নিজেদের কীর্তিকে স্মরণীয় রাখার কিংবা নিজেদেরকে জাহির করার প্রবণতা দেখা যায় না, এমন কি সেটা মৃত্যু-পরবর্তী কল্পিত জীবনের জন্যও নয়। এর ফলে এই ধারণা আমাদের মনে দৃঢ়বদ্ধ হয় যে, এখানে এমন কোনো পদ্ধতি সমাজ ও রাষ্ট্রে প্রচলিত ও প্রতিষ্ঠিত ছিল যার ফলে শাসকের অতিরিক্ত ক্ষমতাধর হবার উপায় ছিল না। এটি সেযুগে এক অতুলনীয় শাসন ব্যবস্থার উপস্থিতিকে তুলে ধরে। এছাড়া নগর ও অন্যান্য বসতিগুলির রাস্তা, বাড়ীঘর ও সামগ্রিক বসতি বিন্যাস থেকে এটা স্পষ্ট যে, সেখানকার শাসকরা সেই যুগের মত করে সামাজিক মর্যাদা নির্বিশেষে সকল স্তরের জনসাধারণের কল্যাণের প্রতি মনোযোগী ছিল।
সিন্ধুতে নগর পরিকল্পনা ও বিন্যাসে অতিকেন্দ্রীভবনের অভাব, সম্পদ ও ক্ষমতার বৈষম্যের তুলনামূলক অনুপস্থিতি, শাসক বা রাজাদের জীবিতকালে স্তুতির জন্য তাদের বৃহৎ শিল্পকর্ম বা মৃত্যু পরবর্তী কল্পিত সুখের জন্য জাঁকজমকপূর্ণ সমাধির অনুপস্থিতি, প্রত্নতাত্ত্বিকভাবে বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্রের সাক্ষ্য না থাকা, অথচ অন্যান্য সভ্যতার চেয়েও অনেক বড় ও বিস্তীর্ণ অঞ্চলব্যাপী এক ধরনের সমরূপতা, বিকেন্দ্রীকরণের পাশে সমাজে কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণের স্পষ্ট সাক্ষ্য, নগরের সকল অংশে জনসাধারণের অবাধ প্রবেশাধিকার, বসতি বিন্যাসে সমাজের সকল স্তরের মানুষের কল্যাণের প্রতি শাসকদের দৃষ্টি – এই সকল কিছুকে এক সাথে বিবেচনায় নিলে সিন্ধুর রাষ্ট্র ও সমাজ জনকল্যাণমূলক ও গণতান্ত্রিক ছিল এবং তা আইন সভা ও পরিষদ জাতীয় জন-প্রতিনিধিত্বমূলক কোনও প্রতিষ্ঠান দ্বারা শাসিত হত এমন সিদ্ধান্তে যাওয়া ছাড়া আমাদের সামনে আর কোনও বিকল্প থাকে না।
সিন্ধু সভ্যতা ধ্বংসের অনেক পরবর্তী কালের ভারতবর্ষে ষোলটি জনপদসহ যে সমস্ত জনপদে প্রজাতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার বিবরণ পাওয়া যায় তা যে সিন্ধু সভ্যতার শাসনব্যবস্থার ধারাবহিকতা ছিল সেই অনুমান একান্তই যৌক্তিক। এছাড়াও ভারতবর্ষের গ্রামীণ সমাজে শাসন ব্যবস্থার স্থানীয় রূপ হিসাবে যে পঞ্চায়েত ব্যবস্থাকে বৃটিশ পূর্ব কাল পর্যন্ত টিকে থাকতে দেখি সেটিও মূলত সিন্ধু সভ্যতার আঞ্চলিক শাসন ব্যবস্থার ধারাবাহিক রূপ বলে ধারণা করা যায়।
৩। তুলনামূলক সামাজিক সাম্যের উপস্থিতি
সিন্ধু সভ্যতার প্রেক্ষিতে প্রাচীর ঘেরা ভিন্ন এলাকা আর কিছু বড় কাঠামো ছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রে প্রকৃতপক্ষে আর্থ-সামাজিক বৈষম্য অনেক সীমিত। সিন্ধু সভ্যতায় যে সমস্ত কবর পাওয়া গেছে সেগুলি থেকে নজর কাড়ে এমন কোনো রাজপ্রাসাদ বা রাজার বা ধনী মানুষের সমাধি পাওয়া যায় নাই, যেমন প্রাচীন মোসোপটেমিয়া, মিসর বা চীনের সভ্যতায় পাওয়া যায়।1 মিসর ও মেসোপটেমিয়ায় সব যুগেই রাজার সমাধি চিহ্নিত করা গেছে অন্যান্য সমাধি থেকে এর বৃহদাকার কাঠামো নির্মাণ ও সমাধিতে পাওয়া মূল্যবান সামগ্রী থেকে। মিসরের রাজারা, যাদের ফারাও বলা হত, সমগ্র সভ্যতার শক্তিকে নিয়োজিত করেছিল তাদের মৃত্যু পরবর্তী কল্পিত জীবনের সুখের জন্য বিশাল বিশাল পিরামিড তৈরী করার মধ্য দিয়ে।
-----------------------------------------------------------------
1 দেখুনঃ Jonathan M. Kenoyer, The Archaeological Heritage of Pakistan: From the Palaeolithic to the Indus Civilization, in, A History of Pakistan, ed, Roger D. Long, 2015, p. 38;
Bridget and Raymond Alchin, Origins of a Civilization: The Prehistory and Early Archaeology of South Asia, Viking Books India (P) Ltd., 1997, p. 187.
-----------------------------------------------------------------
হরপ্পা, রাখিগাড়ি, লোথাল, রূপার, কালিবঙ্গান ও ফারমানায় (হরিয়ানা) যে সীমিত সংখ্যক কবর উৎখনন করা হয়েছে, সেগুলির মধ্যে ধনবৈষম্য পরিষ্কারভাবে প্রতিফলিত হয় নাই।1 এগুলিতে মৃৎপাত্র ও কিছু ব্যক্তিগত জিনিসপত্র যেমন অলংকার হিসাবে চুড়ি, পুতি, ইত্যাদি ছিল। তার মানে কবরগুলিতে মৃতদেহের সাথে যে সমস্ত জিনিসপত্র দেওয়া হত সেগুলি থেকে বুঝা যায় যে, সমাজে ধনবৈষম্য প্রকট ছিল না।
-----------------------------------------------------------------
1 দেখুনঃ Cameron A. Petrie, Diversity, variability, adaptation and ‘fragility’ in the Indus Civilization, in, The Evolution of Fragility: Setting the Terms, ed., Norman Yoffee, 2019, p. 121.
-----------------------------------------------------------------
সিন্ধু সভ্যতার প্রধান নগরগুলির যেগুলিতে মোটামুটি প্রত্নতাত্ত্বিক খনন করা হয়েছে, সেগুলি হল হরপ্পা, মহেঞ্জো-দাড়ো, রাখিগাড়ি ও ধোলাভিরা। এই সমস্ত নগরের প্রধান রাস্তাগুলি মোটামুটি সোজাভাবে নগরের একপ্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে চলে গেছে। প্রধান রাস্তাগুলি থেকে লম্বালম্বিভাবে শাখা রাস্তা বা গলি চলে গেছে। এই সমস্ত রাস্তার দুই পাশে ঘরবাড়ী বিন্যস্ত ছিল। প্রাচীন পৃথিবীর অধিকাংশ বসতিগুলিতে সামগ্রিক বসতি পরিকল্পনার খুব কম প্রমাণ পাওয়া যায়। সাধারণত দেখা যায় যে, প্রধান সড়কের দু’পাশে ঘরবাড়ী বিন্যস্ত থাকত, আর এই সড়কটি কোনো মন্দির বা গুরুত্বপূর্ণ ভবনে বা রাজপ্রাসাদে গিয়ে শেষ হত।
হরপ্পান পর্যায়ে ভবনের কাঠামোগুলি পূর্ব-পশ্চিম-উত্তর-দক্ষিণ এই চারটি প্রধান দিক বরাবর বিন্যস্ত থাকত। হরপ্পা ও কালিবঙ্গানে উত্তর-দক্ষিণ ও পূর্ব-পশ্চিম বরাবর রাস্তা ও গলিগুলি বিন্যস্ত ছিল। হরপ্পান নগরগুলির রাস্তা যথেষ্ট প্রশস্ত হত গরুগাড়ী ও মানুষের চলাচলের উপযোগী করে। হরপ্পা ও ফারমানায় নগরের রাস্তায় গরুর গাড়ী চলাচলের দাগ পাওয়া গেছে। বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক সাক্ষ্য থেকে ধারণা করা যায় যে, হরপ্পান পর্যায়ে গরুর গাড়ী একটি গুরুত্বপূর্ণ বাহন ছিল।
আগে বলা হয়েছে যে, প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখননে এখন পর্যন্ত কোনো নগর বা অন্য কোনো বসতিতে রাজা বা শাসকের বাসগৃহ বা প্রাসাদ হিসাবে চিহ্নিত করা যায় এমন কোনও ভবন পাওয়া যায় নাই। এছাড়াও নগরগুলিতে সকল নাগরিকের জন্য ঢাকনাযুক্ত ড্রেন বা অন্য কোনোভাবে পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা ও সকল নাগরিকের জন্য পাকা বাসগৃহ ছিল। মহেঞ্জো-দাড়োতে উঁচু ঢিবিতে অবস্থিত ঘরের একটি কাঠামোকে অনেকে শাসকের বাড়ী বলে মনে করেন। কিন্তু এর পক্ষে জোরালো কোনো সাক্ষ্য পাওয়া যায় না। কারণ সেখানে কোনো মূল্যবান জিনিসপত্রের ব্যfপক উপস্থিতি ছিল না। এই সমস্ত এবং আরো সাক্ষ্য থেকে সিন্ধু সভ্যতায় স্তর বিন্যস্ত সামাজিক শ্রেণীর উপস্থিতির প্রমাণ থাকলেও বংশানুক্রমিক শাসকের উপস্থিতি ও লক্ষ্যণীয় কোনো সামাজিক বৈষম্য থাকার সপক্ষে প্রমাণ নাই। অলংকার, সীল, বাটখারা ও ছোট ছোট মূর্তির উপস্থিতি কিছু সামাজিক বৈষম্য প্রকাশ করলেও তা অন্যান্য সভ্যতার মত প্রবল নয়।
সিন্ধু সভ্যতায় ধনী-দরিদ্র সব নগরবাসীর সবাই নগর বা শহরে দালানবাড়ীতে বসবাস করত এবং এখানকার প্রাচীর ঘেরা বসতিগুলিতে বস্তি বা কুড়েঘরের অস্তিত্ব পাওয়া যায় নাই। প্রত্নতাত্ত্বিকভাবে এটা প্রমাণিত। কিন্তু মেসোপটেমিয়ার নগরগুলির অভ্যন্তরে দরিদ্ররা থাকতে পারত না বলে ধারণা করা হয়। মনে করা হয় যে, নগরের বাইরে ঝুপড়ি বা কাঁচা বাড়ীঘর তৈরী করে তারা থাকত।1 এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করা যায় যে, প্রাচীন ঐতিহাসিক যুগে ভারতবর্ষে বিভিন্ন নগরকে বেষ্টন করে যে সীমানা প্রাচীর দেখা গেছে সেগুলি নগর বা বসতিটিতে বসবাসকারী সকল নাগরিকের জন্য নির্মাণ করা হত, শুধুমাত্র শাসক শ্রেণীর জন্য করা হত না। এই মহৎ বৈশিষ্ট্য ভারতবর্ষে আদি ঐতিহাসিক যুগ পর্যন্ত টিকে ছিল। কিন্তু মুসলিম শাসনাধীন কাল যেটা সাধারণভাবে মধ্যযুগ হিসাবে পরিচিত সেই কালে দুর্গ তৈরী করা হত কেবল রাজা ও রাজ পরিবারকে রক্ষা করার জন্য।2 ধারণা করা যায় যে, প্রাচীন ঐতিহাসিক যুগে ভারতবর্ষের এই প্রবণতা সিন্ধু সভ্যতার ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা।
-----------------------------------------------------------------
1 দেখুনঃ Susan Pullock, Ancient Mesopotamia, Cambridge University Press, Cambridge, 1999, pp. 46-52.
2 দেখুনঃ J.S. Kharakwal, D.P. Agrawal and Diwa Bhatt, The Archaeology of Banasur Fort, Lohaghat, in, Purātattva, No. 34: 2003-2004, 2004.
-----------------------------------------------------------------
মিসর বা মেসোপটেমিয়া উভয় সভ্যতায় রাজা ও ধনীদের বাড়ীঘরগুলি নগরের নির্দিষ্ট স্থানে কেন্দ্রীভূত হত। তুলনামূলকভাবে কম ধনীদেরগুলি দূরে নগরের প্রান্তীয় এলাকায় অবস্থান করত। তাছাড়া ধাতুর তৈরী জিনিসপত্রও ধনীদের বাড়ীঘরগুলিতেই কেন্দ্রীভূত থাকত। প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনাদি থেকে এই সিদ্ধান্তে আসা যায় যে, এইসব সভ্যতায় ক্ষমতা ও সম্পদ একটি কেন্দ্রে কেন্দ্রীভূত থাকত এবং সমাজে ব্যাপক অসাম্য ছিল।
সিন্ধুর নগর পরিকল্পনা ও নগর বিন্যাস ও অন্যান্য প্রত্নতাত্ত্বিক সাক্ষ্য থেকে বুঝা যায় যে, এই সভ্যতার শাসকরা সাধারণ নাগরিকদের সুযোগ-সুবিধার প্রতি মনোযোগী ছিল ও নাগরিক সকল সুযোগ-সুবিধা সেই যুগের মত করেই নিশ্চিত করত। সিন্ধু সভ্যতায় সকল নাগরিকের সুযোগ-সুবিধা ও কল্যাণের প্রতি শাসকদের এই মনোযোগ ও সচেতন দৃষ্টি আমাদের বিস্ময় জাগায়। শাসকদের এই ধরনের কল্যাণ-চিন্তা আধুনিক যুগের পূর্ব পর্যন্ত কোথায়ও দেখতে পাওয়া যায় না। সার্বিক বিচারে তাই সিন্ধু সভ্যতাকে প্রাচীন পৃথিবীর মহত্তম সভ্যতা বললে সঠিক বলা হয়।
হরপ্পা ও মহেঞ্জো-দাড়োর পৃথক প্রাচীর ঘেরা ঢিবি বা ধোলাভিরার নগরদুর্গে বসবাসকারী মানুষজন অভিজাত শ্রেণীর বা ক্ষমতাবান ছিল বলে মনে করা হয়। অবশ্য শহরের নীচু অংশেও ধনী, অভিজাত ও বণিকশ্রেণীর মানুষজন বসবাস করত। এটি তাৎপর্যপূর্ণ যে, মহেঞ্জো-দাড়োতে সবচেয়ে বেশী ধাতুর জিনিসপত্র, যা সেযুগে ধনীদেরই ব্যবহার করার কথা, শুধুমাত্র উঁচু ঢিবিতে বা নগর দুর্গে অবস্থিত এর বড় ভবনগুলির মধ্যে পাওয়া যায় নাই। হরপ্পাতেও একই ধরনের প্রবণতা দেখা গেছে। এখানে ধাতুর জিনিসপত্র একটি বিশেষ এলাকাতে না থেকে তুলনামূলকভাবে সমানভাবে ছড়ানো ছিল।1 আল্লাহদিনো নামে বসতিটিতেও সমস্ত বসতি জুড়ে বিভিন্ন এলাকায় যেমন, ভবনের ভিতরে, ভবনের বাইরে (রাস্তায়, নর্দমায় ও আবর্জনার স্তূপে) ধাতুর জিনিসপত্র দেখা গেছে।2
-----------------------------------------------------------------
1 দেখুনঃ Jim G. Shaffer, Harappan Culture: A Reconsideration, in, Harappan Civilization: A Recent Perspective, ed., Gregory L. Possehl, Oxford & IBH Publishing Co. Pvt. Ltd., New Delhi, 1993, pp. 41-50.
2 দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ৪৭।
-----------------------------------------------------------------
সিন্ধুর বেশ কিছু সংখ্যক বসতিতে পাওয়া ছোট ছোট মূর্তিগুলিকে অনেক লেখক পূজার উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত বলে মনে করেন। এই মূর্তিগুলি সিন্ধু সভ্যতার মত ক্ষমতাশালী ও বিশালায়তন একটি সভ্যতার শাসকদের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় বলে এগুলি সিন্ধুর রাষ্ট্রের পূজার মূর্তি হতে পারে না বলে আমরা মনে করি। এগুলি সাধারণভাবে খেলার উদ্দেশ্যে নির্মিত পুতুল হওয়া সম্ভব। আবার এটা হতে পারে যে, এই মূর্তিগুলির কিছু সংখ্যক নির্দিষ্ট কোনো গোষ্ঠীর পূজার উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হত। আরেকটি বিষয় স্পষ্ট্ যে, সিন্ধু সভ্যতায় সামাজিক স্তর বিন্যাস থাকলেও ঐতিহাসিক ভারতের মত বর্ণ বা পবিত্রতা-অপবিত্রতার ভিত্তিতে জাতিভেদ প্রথা ছিল না। বরং এখানে নাগরিক সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্তির বিচারে ও ধন-সম্পদের মালিকানার বিচারে এক ধরনের সামাজিক সাম্য ছিল বলে ধারণা করা যায়। এই ধরনের সামাজিক সাম্য প্রাচীন মেসোপটেমিয়া বা মিসরের নগর সভ্যতায় কল্পনা করা যেত না। পরবর্তী কালের ঐতিহাসিক ভারতেও কোনও বিচারেই আমরা আর সামাজিক সাম্যের এতটা প্রকাশ দেখতে পাই না।
সিন্ধু সভ্যতায় শুধু বড় নগরগুলিতেই যে মূল্যবান জিনিসপত্র পাওয়া গেছে তাই নয়, তুলনামূলকভাবে ছোট বসতিগুলিতেও কখনও কখনও সমৃদ্ধিশালী ও অভিজাত শ্রেণীর ব্যবহৃত জিনিসপত্র পাওয়া গেছে। যেমন, আল্লাহদিনো, বালাকোট (বালুচিস্তান), আমরি, কোট দিজি ও নৌশারোর মত ছোট বসতিগুলিতে (এগুলি ২ থেকে ৫ হেক্টর আয়তনের) খনন করার সময়ে বহু ধরনের জিনিসপত্র পাওয়া গেছে।1 ভৌগোলিকভাবে বিশাল অঞ্চলব্যাপী ছড়ানো নগরগুলির বাইরে এই সমস্ত বসতি বিভিন্ন জিনিসের উৎস হিসাবে কাজ করত এবং নগরগুলির সাথে বাণিজ্যিক যোগাযোগ রক্ষা করত।
-----------------------------------------------------------------
1 দেখুনঃ Jonathan Mark Kenoyer and Richard H. Meadow, Harappa: New Discoveries on its Origins and Growth, in, Lahore Museum Bulletin, Vol. XII, No. 1, ed., Dr. Anjum Rehmani, 1999, p. 5.
-----------------------------------------------------------------
আগে বলা হয়েছে যে, সিন্ধু সভ্যতায় প্রত্নতাত্ত্বিকরা কোনো রাজার সমাধি, মন্দির বা রাজপ্রাসাদ খুঁজে পান নাই। যে সমস্ত বড় ভবনের কাঠামো পাওয়া গেছে সেগুলিকে ধনীদের বাসস্থান বা গণমিলনায়তন বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বলে মনে করা হয়। কিন্তু এককভাবে কোনো ভবনই তত বড় ও জাঁকজমকপূর্ণ ছিল না যাতে করে তাকে রাজপ্রাসাদ বা মন্দির বলে চিহ্ণিত করা যায়। যে সব কবর পাওয়া গেছে সেগুলির মধ্যে কিছু সংখ্যককে অন্যগুলির তুলনায় বেশী বা উন্নতমানের জিনিসপত্র, যেমন মৃৎপাত্র, অলংকার, পাথর বা ব্রোঞ্জের অস্ত্র ইত্যাদি থেকে ধনীর সমাধি বলে চিহ্ণিত করা যায়, কিন্তু রাজার সমাধি হিসাবে কোনোটিকেই চিহ্ণিত করা যায় না। বড় বাড়ীগুলি নগরের এক জায়গায় কেন্দ্রীভূত না হয়ে সমস্ত নগর বা শহরব্যাপী সমভাবে ছড়ানো ছিল। একইভাবে ধাতুর তৈরী জিনিসপত্র, যা সে যুগে ধনীদেরই কেবল ব্যবহার করার কথা, নগরের কোনো বিশেষ স্থানে না থেকে সমস্ত নগরব্যাপী পাওয়া গেছে। এ থেকে বুঝা যায় যে, নগরে শাসক থাকলেও তাকে কেন্দ্র করে ধনীরা অবস্থান করত না, বরং সমস্ত নগরে তারা ছড়িয়ে থাকত, এমনকি নগরের নীচু স্তরের মানুষদের বাড়ীর কাছেও। এই সমস্ত সাক্ষ্য হরপ্পান সভ্যতায় তুলনামূলক সাম্য ও গণতন্ত্র থাকার সম্ভাবনাকে প্রকাশ করে। ধনী ও দরিদ্রের তুলনামূলক পার্থক্যহীনতার প্রমাণ পাওয়া গেছে হরপ্পান যুগের বহু সংখ্যক নরকংকালের উপর গবেষণা চালিয়েও। অন্যান্য সভ্যতার এটি একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য যে একই সমাজের উঁচু শ্রেণীর মানুষেরা নীচু শ্রেণীর তুলনায় অপুষ্টিজনিত সমস্যায় কম ভুগে ও দৈর্ঘ্যে অধিকতর লম্বা হয়। খুবই আশ্চর্য হবার মত বিষয় যে, হরপ্পান সভ্যতায় এই ধরনের পার্থক্য দেখা যায় নাই।1 বিপুল জন-অধ্যুষিত এই সভ্যতায় এই ঘটনা এক ধরনের সামাজিক সাম্য এবং একই সঙ্গে সমাজের সর্বস্তরে সমৃদ্ধিকে নির্দেশ করে।
-----------------------------------------------------------------
1 দেহগত নৃবিজ্ঞানী (Physical anthropologist) কেনেথ কেনেডি এ প্রসংগে বলছেনঃ ‘… High ranking individuals enjoy a greater potential to attain their full ontogenetic development, hence are taller in stature, and tend to suffer less from abnormalities of nutritional stress than do individuals of subordinate social status within the same society. However, observations of Harappan skeletal series from five major sites, which comprise about 350 individuals, have not revealed significant differences in patterns of growth and development as would be recognized by lines of arrested growth in long bones and hyper-palsia or dental enamel. Osseons malformations suggestive of nutritional stress are absent as well. Nor are there any striking differences in incidences of dental attrition and common dental pathologies such as caries, abscess, malocclusion and ante-mortem tooth loss in Harappan skeletons. In short, the Harappan skeletal series is aberrant when compared with series from other archaeological sites for which archaeological data suggest a significant development of social stratification. This negative evidence from the Harappan sample should not be interpreted to mean that a social hierarchy was absent in Harappan culture. Rather, biological observations suggest that social control may have been exercised by the Harappan elite in a way that did not evoke the usual dietary stress so often imposed elsewhere upon an urban proletariat. The absence of royal tombs in Harappan centers may be significant in this connection.’ দেখুনঃ Kenneth A.R. Kennedy, Skulls, Aryans and Flowing Drains: The Interface of Archaeology and Skeletal Biology in the Study of the Harappan Civilization, in, Harappan Civilization: A Contemporary Perspective, ed., Gregory L. Possehl, Oxford & IBH Publishing Co., New Delhi, 1982, p. 290.
------------------------------------------------------------------
৪। সভ্যতার নির্মাণ ও রক্ষায় তুলনামূলক শান্তিপূর্ণ ধারা
সিন্ধু সভ্যতার নগর বা শহরগুলির বেশীরভাগই উঁচু প্রাচীর ঘেরা থাকত। এই সব প্রাচীরে একটি বা দু’টি প্রবেশ-দ্বার থাকত। বনওয়ালী, ধোলাভিরা, কালিবঙ্গান, হরপ্পা, মহেঞ্জো-দাড়ো, নৌশারো ও সুরকোটডা সহ আরো অনেক হরপ্পান বসতিকে ঘিরে সীমানা প্রাচীর দিতে দেখা যায়। মহেঞ্জো-দাড়ো নগরটির প্রতিটি প্রধান ঢিবি কাদা-মাটির ইটের তৈরী প্রকাণ্ড প্রাচীর দিয়ে ঘেরা ছিল, যার গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় প্রবেশপথ থাকত। যেহেতু সেই যুগে মহেঞ্জো-দাড়োর চারিপাশের সমতলভূমি বর্তমান স্তরের চেয়ে কমপক্ষে সাত মিটার নীচু ছিল, তাই সমতলভূমি থেকে ’নীচু নগরের’ ভবনসমূহের গড় উচ্চতা ৯-১০ মিটার ছিল এবং ’নগর দুর্গের’ ছিল ১০-১২ মিটার।।1 ’নগর দুর্গ’ পুরু প্রাচীর দিয়ে ঘেরা ছিল ও ভিতরের দিকে মাটি ভরাট করে তার উপরে ভবনসমূহের কাঠামো নির্মাণ করা হয়েছিল। ’নীচু নগর’ও একইভাবে কৃত্রিমভাবে তৈরী উঁচু সমতলভূমিতে নির্মাণ করা হয়েছিল বলে মনে করা হয়।2 ‘নীচু নগরের’ একটি অংশের (এইচআর এলাকা) চারপাশে ক্ষয় হয়ে যাওয়া কাদা-মাটির ইটের তৈরী পুরু প্রাচীর পাওয়া গেছে। ১৯৮৭ সালের প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখননে ’নীচু নগর’ থেকে পূর্ব দিকে এক মাইলেরও বেশী দূরে রাস্তা ও বাড়ী আবিষ্কার হওয়াতে, মনে করা হয় যে, এটি উপশহরের অংশ অথবা এমন কি মূল শহরের অংশও হতে পারে।
-----------------------------------------------------------------
1দেখুনঃ Michael Jansen, Mohenjo-Daro, type site of the earliest urbanization process in South Asia: ten years of research at Mohenjo-Daro, Pakistan and an attempt at a synopsis, in, South Asian Archaeology 1993, eds., A. Parpola and P. Koskikallio, Suomalainen Tiedeakatemia, Helsinki, p. 269.
2 দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ২৭০।
-----------------------------------------------------------------
হরপ্পার বসতিটির প্রতিটি প্রধান ঢিবি কাদা-মাটির ইটের তৈরী প্রকাণ্ড দেওয়াল দিয়ে ঘেরা থাকত। হরপ্পান পর্যায়ে ঢিবি ই-তে আগের পর্যায়ের কাদা-মাটির ইটের দেওয়ালের উপর পোড়া ইটের প্রকাণ্ড দেওয়াল তুলা হয়েছিল।1 চারপাশের প্রাচীর কাদা-মাটি ও পোড়া-মাটি উভয় ইট দিয়ে তৈরী করা হয়েছিল। গবেষণায় প্রমাণ হয়েছে যে, হরপ্পা ও মহেঞ্জো-দাড়ো উভয় নগরই উঁচু সমভূমিকে বহুবার পুনর্নির্মাণ করে গড়ে উঠেছিল।2 ঢিবি ই-এর দক্ষিণ প্রান্তে কাদা-মাটির তৈরী একটি প্রকাণ্ড দাঁড়ানো দেওয়াল থাকার সাক্ষ্য আছে যা বসতিটির প্রান্তে প্রাকৃতিক ভূমিতল থেকে তৈরী করা হয়েছিল। প্রবেশ পথের কাছে নগরের কাদা-মাটির দেওয়াল ৯ মিটার পুরু ছিল। যদিও দেওয়াল ও প্রবেশ পথটি ব্যপক ক্ষয়প্রাপ্ত হয়েছে, দেওয়ালের প্রশস্ততা এবং দেওয়ালের পড়ে যাওয়া অংশ থেকে হিসাব করে ধারণা করা হয় যে, দেওয়ালটি তিন থেকে চার মিটার উঁচু ছিল।3 হরপ্পার ঢিবি এবি নামে বসতিটির চারপাশে যে প্রাচীর ঘেরা ছিল তা ঢিবি ই-এর চেয়েও পুরু,। এই প্রাচীরের ভিত্তিতে ১৪ মিটার ও উপরের দিকে ক্রমশ কমে গিয়ে সমতলের উপরে ১১ মিটার হয়েছিল। হরপ্পায় ঢিবি এবি ও ই সবচেয়ে উঁচু, যা চারিপাশের পাললিক সমভূমি থেকে প্রায় ১৭ মিটার উঁচু।4
-----------------------------------------------------------------
1 দেখুনঃ Jonathan Mark Kenoyer, Urban Process in the Indus Tradition: A Preliminary Model from Harappa, in, Harappa Excavations 1986-1990: A Multidisciplinary Approach to Third Millennium Urbanism, ed., Richard H. Meadow, Monographs in World Archaeology No. 3, Prehistory Press, Madison, 1991, p. 50.
2 দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ৫০।
3 দেখুনঃ Jonathan Mark Kenoyer, Ancient Cities of the Indus Valley Civilization, 1998, p. 55.
4 দেখুনঃ Wayne R. Belcher and Willian R. Belcher, Geologic Constraints on the Harappa Archaeological Site, Punjab Province, Pakistan, in, Geoarchaeology: An International Journal, Vol. 15, No. 7, 2000, p. 684.
মর্টিমার হুইলার ঢিবি এবি-কে নগর দূর্গ বলেছেন ও আশেপাশের সমভূমি থেকে এর উচ্চতা ৪৫ – ৫০ ফুট হিসাবে উল্লেখ করেছেন। দেখুনঃ Sir Mortimer Wheeler, The Indus Valley Civilization, Third Edition, Cambridge University Press, London, 1968, p. 29.
-----------------------------------------------------------------
গুজরাটে অবস্থিত ধোলাভিরার নগর দুর্গ আশপাশের প্রাকৃতিক ভূমি থেকে দক্ষিণ ও পশ্চিমে যথাক্রমে ১৫ মিঃ ও ১৮ মিঃ উঁচু।1 এছাড়াও গুজরাটে হরপ্পান যুগে কমপক্ষে ১৫টি বসতির চারপাশে ভারী প্রাচীর দিয়ে ঘেরা থাকতে দেখা যায়। এই অঞ্চলের দুইটি ছোট বসতি বাগাসরার আয়তন প্রায় ২ হেক্টর ও শিকারপুরের আয়তন ৫ হেক্টর হলেও হরপ্পান সভ্যতার শুরু থেকেই এখানে পুরু দেওয়াল দিয়ে ঘেরা হয়েছিল। এই সীমানা প্রাচীর গোড়ায় বাগাসরায় ৭ মিটার ও শিকারপুরে ১০ মিটার পুরু।2
-----------------------------------------------------------------
1 দেখুনঃ R.S. Bisht, Dholavira: New Horizons of the Indus Civilization, in, Puratattva, No. 20: 1989-90, p.74.
2 দেখুনঃ Brad Chase, P. Ajithprasad, S.V. Rajesh, Ambika Patel and Bhanu Sharma, Materializing Harappan identities: Unity and diversity in the borderlands of the Indus Civilization, in, Journal of Anthropological Archaeology 35, 2014, p. 66.
-----------------------------------------------------------------
এবিষয়ে পণ্ডিতরা একমত যে, এগুলি যুদ্ধে প্রতিরক্ষার কাজে ব্যবহারের জন্য তৈরী করা হয় নাই। অনেকে মনে করেন যে, নগরের বিভিন্ন অংশে প্রবেশ ও বের হওয়া নিয়ন্ত্রণ করার জন্য হরপ্পায় দেওয়াল দেওয়া হয়েছিল। দেওয়াল ও নগর দরজার সাহায্যে শাসকরা নগরে কারা কোন কারণে প্রবেশ করবে সেটা নিয়ন্ত্রণ করত। সেটা অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক বা আদর্শগত যেটাই হোক না কেন। বাইরে যে সমস্ত জিনিসপত্র তৈরী হত সেগুলি নিয়ে নগরে প্রবেশ করতে হলে সেসবের উপর কর আদায় করার জন্য অথবা নগরে তৈরী কোনো কিছু বাইরে অন্য কোনো জায়গার উদ্দেশ্যে বের করতে হলে তার উপর শুল্ক আদায় করা হত। এছাড়াও বসতিটি আশেপাশের সমভূমির চেয়ে উপরে হত বলে চারপাশে ভাঙ্গনের হাত থেকে রক্ষা করার জন্যও নগর প্রাচীর ভূমিকা রাখত। এছাড়া বন্যার হাত থেকে রক্ষার বিষয়টি তো আছেই। কোনও কোনও গবেষকের মতে সিন্ধুর রাষ্ট্রের ক্ষমতা বা শক্তি এবং মর্যাদার প্রকাশ হিসাবে বসতিগুলির চারপাশে এই ভারী সীমানা প্রাচীর নির্মাণ করা হত।1 আমাদের ধারণা এ ধরনের ভারী এবং সুবৃহৎ সীমানা প্রাচীরের মূল উদ্দেশ্য ছিল মনস্তাত্ত্বিক। অর্থাৎ সভ্যতার ক্ষমতা ও মর্যাদা প্রকাশের পাশাপাশি শান্তিপূর্ণভাবে জনচেতনা নিয়ন্ত্রণের জন্য যে সকল পদ্ধতি ছিল তার একটা ছিল এ ধরনের প্রাচীর নির্মাণ। কারণ নগরে শুধু প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য এত ভারী সীমানা প্রাচীর নির্মাণ করার দরকার ছিল না।
-----------------------------------------------------------------
1 গবেষক পি, এলট্সভ মনে করেন সিন্ধু সভ্যতার বিশালাকার ও উঁচু সীমানা প্রাচীর ও অন্যান্য ভারী কাঠামো নির্মাণ প্রাচীন যুগের মানুষের মনে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলত। তিনি মনে করেন, হরপ্পানরা বাস্তব ক্ষমতা প্রকাশ করতে তাদের বসতিকে ঘিরে এই ধরনের ভারী দেওয়াল দিত। তিনি বলছেন, ‘The ethos of power in the Harappan civilization thus was materialized predominantly in the construction of walls and mud-brick platforms.’ দেখুনঃ P. Eltsov, Power circumscribed by space: Attempting a new model of the ancient South Asian city, in, Current Studies on the Indus Civilization, Volume VI, ed., Toshiki Osada and Akinori Uesugi, Published by Manohar Publishers & Distributers, New Delhi, 2011, p. 63.
-----------------------------------------------------------------
যদিও প্রধান বসতিগুলি কাদামাটির ইটের ভারী দেওয়াল দিয়ে ঘেরা ছিল, কিন্তু সেখানকার অধিবাসীদের মধ্যে বড় ধরনের কোনো সংঘাত বা যুদ্ধের প্রমাণ পাওয়া যায় না, যা অন্যান্য সভ্যতাগুলিতে সাধারণ বিষয় ছিল।1 মনে করা হয়, প্রাচীর ঘেরা এই উঁচু ঢিবিগুলি বা নগরদুর্গগুলিতে বসবাসকারী ক্ষমতাবানরা সিন্ধুর শাসকশ্রেণী গঠন করেছিল যারা বহু দূর ব্যাপী বিস্তৃত সমগ্র সভ্যতার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও আদর্শিক দিক নিয়ন্ত্রণ করত। এছাড়া তারা নগরের শিল্প উৎপাদনের বিষয়টিও নিয়ন্ত্রণ করত।
-----------------------------------------------------------------
1 দেখুনঃ Jonathan M. Kenoyer, The Archaeological Heritage of Pakistan: From the Palaeolithic to the Indus Civilization, in, A History of Pakistan, ed, Roger D. Long, 2015, p. 38.
-----------------------------------------------------------------
মহেঞ্জো-দাড়োর নগর দূর্গের প্রাচীরের বহির্গাত্রে উপর থেকে নীচের সমভূমি পর্যন্ত নেমে যাবার একটি বৃহৎ সিড়ির সন্ধান পাওয়া গেছে।1 এ থেকেও এ ধরনের প্রাচীর নির্মাণের উদ্দেশ্য যে শত্রুর আক্রমণ প্রতিরোধ করা ছিল না তা সহজেই বুঝা যায়।
-----------------------------------------------------------------
1 দেখুনঃ Sir Mortimer Wheeler, The Indus Valley Civilization, 1968, p. 44.
-----------------------------------------------------------------
সিন্ধু সভ্যতার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক প্রত্নতাত্ত্বিকভাবে জানা যায়। তা হল, সভ্যতা নির্মাণ ও তার রক্ষায় যুদ্ধ ও বল প্রয়োগ অপ্রধান ভূমিকা পালন করেছিল। যুদ্ধে ব্যবহৃত জিনিসপত্র যেমন বড় তরবারি, বর্ম, ঢাল, শিরস্ত্রাণ, ইত্যাদি সিন্ধু সভ্যতার বসতিগুলিতে পাওয়া যায় নাই। এমনকি এগুলি নগরের উঁচু অংশ যাকে নগর দুর্গ বলা হয় সেখানেও পাওয়া যায় নাই।1 যে সমস্ত অস্ত্র পাওয়া গেছে প্রত্নতাত্ত্বিকরা ধারণা করেন যে, সেগুলি শিকারের বা রান্নার কাজে অথবা পশুর মাংস কাটার জন্য ব্যবহৃত হত। এছাড়া এমন কোনো ছবি বা দৃশ্য কোনো কিছুতে উৎকীর্ণ করা হয় নাই যেখানে যুদ্ধের দৃশ্য আছে অথবা বন্দী বা ধৃত অবস্থায় কোনো মানুষকে দেখানো হয়েছে। এখন পর্যন্ত পাওয়া একটি মাত্র চিত্রাঙ্কিত ফলকের উপর যে ছবিকে যুদ্ধের ছবি বলে মনে করা হয় তাতে একজন মাত্র ব্যক্তির সাথে অপর ব্যক্তির লড়াইকে দেখানো হয়েছে। এমন কি এমন কোনো ব্যক্তির ছবি উৎকীর্ণ করা হয় নাই যা থেকে সেই ব্যক্তিকে রাজা, শাসক বা ক্ষমতাবান বলে মনে হয়।
-----------------------------------------------------------------
1 দেখুনঃ B.B. Lal, Some Reflections on the Structural Remains at Kalibangan, in, Frontiers of the Indus Civilization, eds., B.B. Lal & S.P. Gupta, 1984, p. 55.
-----------------------------------------------------------------
প্রাচীন মেসোপটেমিয়া, মিসর ও চীনে সভ্যতা নির্মাণ ও রক্ষায় যুদ্ধ প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। এখানকার নগর ও শহরগুলিতে পাওয়া যুদ্ধাস্ত্র, বিভিন্ন জিনিসে উৎকীর্ণ যুদ্ধের, যুদ্ধ জয়ের ও যুদ্ধবন্দীদের ছবি থেকে বুঝা যায় যে সেখানে সকল যুগে যুদ্ধের প্রাধান্য ছিল। এছাড়াও সেখানে রাজা বা শাসকের ছবিও উৎকীর্ণ হতে দেখা যায়। এই তিন সভ্যতার নগরগুলিতে যে সমস্ত নগর-প্রাচীর দেখা যায় তার মূল উদ্দেশ্যই ছিল যুদ্ধের প্রতিরক্ষা। এছাড়াও যুদ্ধে সুমেরীয়রা যে খুবই নিষ্ঠুর ছিল তার প্রত্নতাত্ত্বিক সাক্ষ্য পাওয়া যায়। বেশীরভাগ যুদ্ধবন্দীকে তারা সাথে সাথে হত্যা করত এবং বাকীদের আজীবনের জন্য দাস করে রাখত। শত্রুদের অধিকৃত শহরগুলি শুধু লুঠ করা হত না, বাড়ীঘর পোড়ানো হত বা মাটির সাথে মিশিয়ে ফেলা হত। যারা বেঁচে থাকত তারা বিভিন্ন জায়গায় পালাত। মিসরেও রাষ্ট্র নির্মাণের সূচনা থেকেই যুদ্ধ ও বল প্রয়োগের প্রমাণ পাওয়া গেছে। খ্রীষ্টপূর্ব চতুর্থ সহস্রাব্দে ঊর্ধ্ব ও নিম্ন মিসর একত্রীকরণ এবং মিসরে আদি রাষ্ট্র গঠনের সময়ে হায়ারাকোনপোলিসে (Hierakonpolis) রাজা নরমারের ফলকে কিছু ছবি আঁকা আছে। সেখানে মৃত শত্রুদের এবং লোকজন অথবা বসতিসমূহের পরাভূত অবস্থা দেখানো হয়েছে। এই রাজার রাজদণ্ডের মাথায় কিছু ছবি ও চিহ্নে যুদ্ধবন্দী ও যুদ্ধে লুন্ঠিত দ্রব্য দেখানো হয়েছে। রাজা স্করপিয়নের রাজদণ্ডের মাথায়ও বিজিত মানুষদের ছবি ছিল। যদিও সেই সময়ের বসতিতে যুদ্ধে ধ্বংসপ্রাপ্ত কোনও স্তর পাওয়া যায় নাই তবু এই বিষয়ে প্রত্নতাত্ত্বিকরা নিশ্চিত যে, যুদ্ধের মাধ্যমে মিসরে আদি রাজবংশের সুদৃঢ়করণ এবং প্রথম রাজবংশের আদিতে নিম্ন নুবিয়া ও দক্ষিণ প্যালেস্টাইনে মিসরীয় রাষ্ট্রশক্তির সম্প্রসারণ হয়।1 এরপর সমগ্র মিসরীয় সভ্যতার নানা সময়ে যুদ্ধের সাথে সম্পর্কিত প্রচুর ছবি এবং হায়রোগ্লিফিক লিপিতে এসবের বর্ণনা পাওয়া যায়।
-----------------------------------------------------------------
1 দেখুনঃ Kathryn A. Bard, The Emergence of the Egyptian State (C,3200-2686 BC), in, The Oxford History of Ancient Egypt, ed., Ian Shaw, Oxford University Press, Oxford, 2000, pp. 61-88.
-----------------------------------------------------------------
সিন্ধু সভ্যতার ৭০০ বৎসরের সময়কালে কোনো বসতিতেই ধ্বংসের বা অগ্নিকাণ্ডের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় নাই। তবে ২৬০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের দিকে অর্থাৎ আদি হরপ্পান পর্যায় থেকে হরপ্পান পর্যায়ে পরিবর্তনের সময়ে কয়েকটি বসতিতে আগুনে পুড়ানোর চিহ্ণ পাওয়া গেছে, যা থেকে মনে করা হয় যুদ্ধের কারণে এই সমস্ত বসতি শত্রুপক্ষ জ্বালিয়ে দিয়েছে। কালিবঙ্গানে এই সময়ে ঘরের দেওয়ালে ফাটলের চিহ্ন দেখা গেছে। এগুলি ভূমিকম্পের কারণে হয়েছিল বলে মনে করা হয়। বনওয়ালীতে বিভিন্ন ভবনে ফাটলের চিহ্ণ ও গুমলাতে (খাইবার পাখতুনখাওয়া, পাকিস্তান) ধ্বংসের প্রমাণ পাওয়া গেছে। প্রত্নতাত্ত্বিক এই সমস্ত সাক্ষ্য থেকে আদি হরপ্পান থেকে হরপ্পান পর্যায়ে পরিবর্তনের সময়ে কিছু বসতিতে যুদ্ধের সম্ভাবনার বিষয়টি নাকচ করা যায় না। তবে এটা ঠিক যে, সমগ্র সিন্ধু সভ্যতার ব্যাপ্তি ও বসতির সংখ্যার তুলনায় এই সব দৃষ্টান্ত খুবই কম। ফলে এই সমস্ত দৃষ্টান্ত সভ্যতার সামগ্রিক প্রবণতাকে প্রকাশ করে না।
সিন্ধু সভ্যতা ছাড়া প্রাচীন পৃথিবীতে আর এমন কোনও সভ্যতার দৃষ্টান্ত নাই যা শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠা ও রক্ষা করা হয়েছে। পরবর্তীকালের ঐতিহাসিক যুগেও ভারতবর্ষে শাসকদের মধ্যে যুদ্ধে অপরাপর জনগোষ্ঠীর প্রতি অপ্রয়োজনীয় নিষ্ঠুরতা, সাধারণ মানুষদের জীবন ও সম্পদের ধ্বংসসাধন খুব্ কমই দেখা গেছে। কলিঙ্গে সম্রাট অশোকের আক্রমণের সময় ধ্বংস ও হত্যাযজ্ঞ ঘটলেও তা সাধারণ প্রবণতা ছিল না। এবং এটাও নিশ্চয় লক্ষ্যণীয় যে, শত্রুপক্ষের সাধারণ সৈনিক এবং নিরীহ জনগণের মৃত্যু ও দুঃখের শোকে ভারাতুর হয়ে সম্রাট অশোক (রাজত্বকল : খ্রীঃপূঃ ২৭৩ – ২৩২) যুদ্ধবাদী রাষ্ট্রনীতি পরিত্যাগ করেন এবং শান্তিবাদী বৌদ্ধধর্ম প্রচার ও প্রসারে আত্মনিয়োগ করেন। মুসলিম আগ্রাসনের পূর্ব কাল পর্যন্ত সময়ে ভারতবর্ষে যেসব গণহত্যা এবং ধ্বংসযজ্ঞ সংঘটিত হয়েছিল সেগুলির ক্ষেত্রে সর্বাধিক ভূমিকা রেখেছিল মধ্য এশিয়ার তৃণপ্রান্তর থেকে উঠে আসা শক-হুন ইত্যাদি বহিরাক্রমণকারী পশুচারী ও যাযাবর জনগোষ্ঠী।
৫। রাষ্ট্র ও সমাজে প্রচলিত নিরীশ্বরবাদী ও লোকায়ত মতাদর্শ
সিন্ধু সভ্যতা প্রসঙ্গে আরেকটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উপর আলোকপাত করা প্রয়োজন। সেটি হল সিন্ধু সভ্যতার রাষ্ট্রে ধর্মের ভূমিকা ও অবস্থান। প্রত্নতাত্ত্বিক সাক্ষ্য থেকে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় যে, সিন্ধু সভ্যতার সমগ্র ব্যাপ্তি কালের অন্তত প্রথম দিকের ৩০০/৪০০ বৎসর রাষ্ট্র ও সমাজে নিরীশ্বরবাদ ও লোকায়ত বা বস্তুবাদী ধারণার প্রবল প্রভাব ছিল। অর্থাৎ প্রত্নতত্ত্বের সাক্ষ্য অনুযায়ী আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হই যে, শাসকরা নিরীশ্বরবাদ অনুশীলন করত ও সমাজে এই ধারণা প্রচার করত। সিন্ধু সভ্যতা পরবর্তী কালের ভারতবর্ষের ঐতিহাসিক গতিধারাও আমাদের এই সিদ্ধান্তকে অধিকতর দৃঢ়বদ্ধ করে। এই বিষয়ে নীচে আলোচনা করা হল।
সিন্ধু সভ্যতার বিভিন্ন বসতিতে ছোট ছোট মানুষের আকৃতির অনেক পোড়া মাটির মূর্তি বিশেষত নারী মূর্তি পাওয়া গেছে। ছোট ছোট পোড়া মাটির মানুষের মূর্তি বা বিভিন্ন সীল বা মৃৎপাত্রের গায়ে উৎকীর্ণ ছবিকে কোনোভাবেই সিন্ধু সভ্যতার মত এত বড় ও শক্তিশালী একটি সভ্যতার রাষ্ট্রের ধর্মের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ বলে মনে করা যায় না। এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় যে মূর্তি পাওয়া গেছে তা হল মহেঞ্জো-দাড়োতে পাওয়া কথিত ‘রাজর্ষি’র মূর্তি, যা মাত্র ১৭.৫ সেন্টি মিটার (৭ ইঞ্চির মত) উচ্চতা বিশিষ্ট। এর সাথে ধর্মের সংশ্লিষ্টতার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় নাই। হরপ্পার খননে মানুষের ও পশুর প্রচুর পোড়ামাটির মূর্তি পাওয়া গেছে। কিন্তু এগুলির কোনোটিই সরাসরি কবরস্থানে পাওয়া যায় নাই, অথবা কোনো ধর্মীয় প্রথা বা বিশেষ কোনো উদ্দেশ্যে এগুলি তৈরী হয়েছিল এমন প্রমাণ পাওয়া যায় না।1 কিছু মূর্তি তৈরীতে প্রেরণা হিসাবে দেবতা বা দেবীর নরত্বমূলক ধারণা ছিল বলে প্রত্নতাত্ত্বিকরা মনে করেন।
-----------------------------------------------------------------
1 দেখুনঃ George F. Dales, Some Specialized Ceramic Studies at Harappa, in, Harappa Excavations 1986-1990: A Multidisciplinary Approach to Third Millennium Urbanism, ed, Richard H. Meadow, Prehistory Press, Madison, 1991, pp. 65-66.
-----------------------------------------------------------------
সিন্ধু সভ্যতায় পাওয়া সীলে বিভিন্ন প্রাণীর ছবি ও অন্যান্য ছবি উৎকীর্ণ থাকত। তবে সমগ্র সিন্ধু উপত্যকা জুড়ে যে চিহ্নটি সীলের মধ্যে উৎকীর্ণ অবস্থায় সবচেয়ে বেশী পাওয়া গেছে তা হল ইউনিকর্ণ নামে প্রধানত এক শিং-বিশিষ্ট ও দেহ অনেকটা ষাঁড়ের মত কিন্তু একাধিক প্রাণীর বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য নিয়ে উৎকীর্ণ একটি কাল্পনিক প্রাণীর ছবি। সীল যেহেতু রাষ্ট্রীয় কাজে ব্যবহৃত হত বলে মনে করা হয়, কাজেই সীলে অংকিত এই ইউনিকর্ণ নামে কল্পিত প্রাণীটির ছবির ব্যবহার নিশ্চয়ই গুরুত্ব বহন করে। তবে এটি পূজার উদ্দেশ্যে যে ব্যবহার হত না তেমনটাই মনে হয়।
আমরা অনুমান করি সীলে যে সমস্ত প্রাণীর ছবি আঁকা হয়েছে সেগুলি বণিক বা কারিগরদের বিভিন্ন গোত্র বা গোষ্ঠীর টোটেম বা প্রতীক হওয়া সম্ভব। ইউনিকর্ণ ছাড়াও যৌগ বা একাধিক প্রাণীর মিশ্রণ কিছু সীলে আছে । যেমন, ২-মাথা, ৩-মাথা বা ৪-মাথা বিশিষ্ট প্রাণী বা বিভিন্ন প্রাণী দেহের বিভিন্ন অংশ নিয়ে গঠিত যৌগ ছবি বণিক বা কারিগরদের বিভিন্ন গোষ্ঠীর কনফেডারেসি বা ঐক্য বুঝাতে ব্যবহার করা হয়েছে বলে মনে হয়। আবার কিছু বসতিতে পাওয়া মোষের শিং-বিশিষ্ট দেবতার ছবি বিভিন্ন আঞ্চলিক বিশ্বাসকে প্রতিফলিত করেছে বলে ধারণা করা যায়।
বিভিন্ন সীল বা ফলকে যে সমস্ত চিহ্ন বা ছবিকে অনেকে সিন্ধুর ধর্মের সাথে সংশ্লিষ্ট বলে মনে করেন, তার অনেক কিছুই আদৌ রাষ্ট্রের ধর্মের বিষয় ছিল না। অনুমান করা চলে যে, এগুলি সমাজের নীচ তলায় বিদ্যমান জনগোষ্ঠীর অথবা অন্যান্য বিভিন্ন গোষ্ঠীর ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রকাশকে অল্প পরিসরে অনুমোদন দিতে গিয়ে সিন্ধুর রাষ্ট্র সেই সব জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় কিছু প্রকাশকে মেনে নিয়েছিল। ফলে সীলের লিপিকে নিয়ন্ত্রণ করলেও সীলে কী ছবি অঙ্কিত হবে তা রাষ্ট্র নির্ধারণ করত না। রাষ্ট্র কর্তৃক নির্ধারিত লিপির সাথে ছবিকে অন্তর্ভুক্ত করত বিভিন্ন বণিক বা কারিগর শ্রেণী। এই জন্য আমরা পণ্যের গায়ে বা কোনো গুদাম ঘরের জন্য ব্যবহৃত সীল মোহরে লিপি দেখতে পেলেও সীলের ছবি তেমন একটা দেখতে পাই না।1
-----------------------------------------------------------------
1 দেখুনঃ Dennys Frenez, Mirrored signs. Administrative and scriptorial information in the Indus Civilization clay sealings, in, Studies on Indus Script, Conference on Indus Script, Mohenjodaro 2020, published by National Fund for Mohenjodaro, Government of Sindh, 2020, p. 29.
-----------------------------------------------------------------
কালিবঙ্গানে কিছু কাঠামোকে প্রত্নতাত্ত্বিক বি,বি, লাল অগ্নি-বেদী বলে উল্লেখ করেছিলেন। তবে পরবর্তী অনেক প্রত্নতাত্ত্বিক ও গবেষক এগুলিকে কারিগরের ব্যবহৃত চুলা হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। গবেষক ও তাপ-প্রযুক্তিবিদ্যা বিশারদ (Pyrotechnologist) হিদার মিলার উল্লেখ করেন যে, সিন্ধুর সাংস্কৃতিক কোনো বস্তুতে এমন কোনো প্রতীক বা ছবি নাই যা দিয়ে মনে করা যায় যে সেখানে আগুনকে পূজা করা হত। তিনি বলেন যে, কালিবঙ্গানের তথাকথিত ‘অগ্নি-বেদী’ সিন্ধুর অন্যান্য বসতিতে পাওয়া রান্নার চুলা ও মৃৎপাত্র উৎপাদনের উনানের সাথে পর্যাপ্ত প্রমাণসহ মিলে যায়।1
-----------------------------------------------------------------
1 দেখুনঃ Heather M.-L. Miller, Issues in the Determination of Ancient Value Systems: The Role of Talc (Steatite) and Faience in the Indus Civilization, in, Intercultural Relations between South and Southwest Asia, eds., E. Olijdam & R.H. Spoor, BAR International Series 1826, 2008, pp. 154-155.
-----------------------------------------------------------------
বিভিন্ন বসতিতে সাম্প্রতিক প্রত্নতাত্ত্বিক খননের ফলে, বিশেষভাবে হরপ্পায় ব্যাপক খননের পর, মনে করা হচ্ছে যে, হরপ্পান পর্যায়ের তৃতীয় বা শেষ পর্বের শুরুতে অর্থাৎ ২২০০ খ্রীঃপূঃ-এর দিকে সিন্ধু সভ্যতায় ধর্মের সাথে সংশ্লিষ্টতা বেড়েছিল।
সিন্ধু সভ্যতার প্রত্নতাত্ত্বিক সাক্ষ্য ও অন্যান্য বৈশিষ্ট্য থেকে এই সিদ্ধান্তে আসা যায় যে, সিন্ধু সভ্যতার শাসকরা কোনো ধর্মকে সাধারণভাবে পৃষ্টপোষকতা দান করত না ও নিজেরা কোনো ধর্ম পালন করত না। আরো সঠিকভাবে বললে তারা নিরীশ্বরবাদী ছিল। প্রত্নতত্ত্ব থেকে মনে হয় সিন্ধু সভ্যতার সূচনা পর্বে প্রথম ৩০০ থেকে ৪০০ বৎসর এই প্রবণতা জোরালো ছিল। পরবর্তীকালে ২৩০০ থেকে ২২০০ খ্রীঃপূঃ-এর দিকে রাষ্ট্র ধর্মের দিকে কিছুটা ঝুঁকে যায় বলে প্রত্নতত্ত্ব থেকে ধারণা করা যায়। এই সময়ে মহেঞ্জো-দাড়ো ও হরপ্পায় কিছু ক্ষেত্রে নূতন ধর্মীয় উপাদান যুক্ত হওয়া থেকে এই বিষয়টি বুঝা যায়। সেই সময়ে সিন্ধু সভ্যতায় সংকট শুরু হওয়ার ফলে সিন্ধুর রাষ্ট্র ধর্মের দিকে ঝুঁকে পড়েছিল বলে আমরা অনুমান করি। তার পরেও সিন্ধু সভ্যতার পুরোটা সময় এর সমগ্র অঞ্চলে ধর্মীয় উপাদান খুব বেশী যুক্ত না হওয়াতে আমরা মনে করি সিন্ধু সভ্যতার রাষ্ট্র তার ৭০০ বৎসর ব্যাপী লোকায়ত ধারাকে একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারা হিসাবে রক্ষা করেছিল।
হরপ্পান পর্যায়ে মৃতদেহের বিভিন্ন ধরনের সৎকার পদ্ধতি চালু ছিল। মৃতের কবর দেওয়া হত বসতি থেকে দূরে এবং সকল মৃতকে কবর দেওয়া হত না। সামান্য সংখ্যক লোকজনের মৃতদেহ কবর দেওয়ার প্রথা প্রচলিত ছিল। বাকিদের হয় দাহ করা হত অথবা অন্য পদ্ধতিতে সৎকার করা হত।
আগেই বলা হয়েছে যে, সিন্ধু সভ্যতার বিশাল অঞ্চলে আবিষ্কৃত হরপ্পা, মহেঞ্জো-দাড়ো, রাখিগাড়ি বা ধোলাভিরার মত বড় নগর, যেগুলিতে ব্যাপক ভিত্তিক বা আংশিক উৎখনন হয়েছে, সেগুলিতে এমন কোনো কাঠামো পাওয়া যায় না যাকে সিন্ধু রাষ্ট্রের মন্দির হিসাবে চিহ্নিত করা যায় এবং যা এই শক্তিশালী ও এক ধরনের কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্রের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
সিন্ধুর মত বৃহৎ ও শক্তিশালী রাষ্ট্রের ধর্ম থাকলে তার বস্তুগত প্রকাশ হত অনেক বড় ও দৃষ্টি আকর্ষণকারী, এখানে পাওয়া ক্ষুদ্র মূর্তি ও ছোট ছোট ছবি হত না। যেমন সিন্ধুর রাষ্ট্রের শক্তি ও ক্ষমতার প্রকাশ দেখতে পাওয়া যায় সিন্ধু সভ্যতার নগর ও বসতিগুলিকে বেষ্টনকারী প্রয়োজনের চেয়েও অনেক পুরু ও ভারী দেওয়াল থেকে। একইভাবে বালুচিস্তানে হরপ্পান যুগে কৃষিতে সেচের উদ্দেশ্যে নদীর মধ্যে আড়াআড়িভাবে নির্মিত যে সমস্ত বাঁধ এখনো টিকে আছে সেগুলির এত বৎসর পরেও অবাক করা ভারী নির্মাণের অবশেষকে সেই যুগে সিন্ধুর রাষ্ট্রের ক্ষমতার প্রকাশ হিসাবে বিবেচনা করা যায়।1
-----------------------------------------------------------------
1 গবেষক উয়েলি ব্রুনের বালুচিস্তানে কিছু বড় ও ভারী নির্মাণের বাঁধ পাওয়ার কথা বর্ণনা করেছেন। দেখুনঃ Ueli Brunner, Notes on gabarbands in Balochistan, in, Archäologische Mitteilungen aus Iran und Turan, 38, 2006, p. 103, 104, 118-120, 123-124.
-----------------------------------------------------------------
দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে দেখা বালুচিস্তানে একটি হরপ্পান বসতির কাছে অবস্থিত দুদ্দার বাঁধ। উর্বর ক্ষেত্র থেকে বুঝা যায় যে বাঁধের উভয় পাশে পলি সঞ্চিত হয়েছিল। (সৌজন্যেঃ Ueli Brunner, 2006)
সিন্ধু সভ্যতা পতনের প্রায় দেড় হাজার বৎসর পরে ঐতিহাসিক ভারতবর্ষে বিদ্যমান বৈদিক ধর্মের পাশাপাশি লোকায়ত ও নিরীশ্বরবাদী চিন্তার একটি শক্তিশালী ধারা দেখতে পাওয়া যায়। সেই সময়ে ভারতবর্ষের অন্য দুইটি প্রধান ধর্ম বৌদ্ধ ও জৈন ধর্ম আত্মা ও জন্মান্তরে বিশ্বাস করলেও মূলত নিরীশ্বরবাদী ছিল। বুদ্ধের সমকালের আজীবিক সম্প্রদায় সম্পর্কে জানা যায়, যারা নিয়তিবাদী হলেও নিরীশ্বরবাদী ছিল। বুদ্ধের সময়ের পর অনেক কাল পর্যন্ত তারা যথেষ্ট শক্তি ও প্রভাব নিয়ে ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে টিকে ছিল।1 অজিত কেশ কম্বলী ও চার্বাক সম্প্রদায়ের দর্শনচিন্তাও নিরীশ্বরবাদী ছিল। এছাড়া বস্তুবাদী লোকায়ত মতবাদ যে জন-সমাজে শক্তিশালী ধারা ছিল সেটা জানা যায়।2
-----------------------------------------------------------------
1 মৌর্য যুগের শাসকরা যে আজীবিকদেরকে গুরুত্ব দিতেন তার প্রমাণ পাওয়া যায়। গয়ার কাছে বিহারে নাগার্জুনি পাহাড় ও বরাবর পাহাড়ে আজীবিক সন্ন্যাসীদের থাকার জন্য সবচেয়ে প্রথম গুহা কাটা হয়। এখানে একটি উৎকীর্ণ লিপি থেকে জানা যায় যে, এগুলি অশেোকের প্রপৌত্র দশরথের সময়ে কাটা হয়েছিল। দেখুনঃ Ajit Kumar, Buddhist Caves of Western Maharashtra with Specific Reference to Early Sculptural Art, in, Purātattva, No. 46, 2016, p. 54.
এছাড়া প্রমাণ আছে যে, চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের পুত্র বিন্দুসার আজীবিকদের পৃষ্টপোষকতা করতেন। দেখুনঃ Romila Thapar, Aśokan India and the Gupta Age, in, A Cultural History of India, ed., A.L. Basham, Oxford University Press, New Delhi, 1975, p. 41.
2 লোকায়ত দর্শন অর্থ হল সাধারণ মানুষের দর্শন বা ইহলৌকিক দর্শন। লোকায়ত হল লোকসমাজ বা জনসাধারণের মধ্যে পরিব্যপ্ত ধ্যান-ধারণা। প্রাচীন ভারতবর্ষে লোকায়ত চিন্তাধারা যে একটি শক্তিশালী ধারা ছিল তা বুঝা যায় পক্ষে ও বিপক্ষে উভয় সাহিত্যে লোকায়তের উল্লেখ থেকে। তবে চমকপ্রদ বিষয় হল বৌদ্ধ যুগে ব্রাহ্মণরা লোকায়ত চর্চা করত। পঞ্চাল কন্যা দ্রৌপদী বলছেন, লোকায়ত বিদ্যা শিখাবার জন্য তাঁর পিতা কোনও একজন বিদ্বান আচার্যকে নিয়োগ করেছিলেন। হর্ষচরিতের এক জায়গায় জ্ঞানী ও তপস্বীদের একটি দীর্ঘ তালিকার মধ্যে বৌদ্ধ, শ্বেতাম্বর জৈন, কপিল-শিষ্য, কণাদ-শিষ্য প্রমুখের সঙ্গে লোকায়তিকের বিবরণ আছে। মিলিন্দ প্রশ্নে ভিক্ষু নাগসেন রাজা মিলিন্দকে ব্রাহ্মণ কুমারগণের ঋগ্বেদ, যজুর্বেদ, সামবেদ, অথর্ববেদ, ইতিহাস, পুরাণ, ইত্যাদির সাথে লোকায়ত শাস্ত্র শিক্ষা করার কথা উল্লেখ করেছেন (মিলিন্দ প্রশ্ন, তৃতীয় বর্গ, ৩৬)। এই সমস্ত বিবরণ থেকে অনুমান করা যায় যে, প্রাচীন ভারতীয় সমাজে লোকায়ত মতের গভীর প্রভাব ছিল বলেই বিরুদ্ধবাদীদের আক্রমণ ও মিথ্যা প্রচারণার পরেও অনেক সত্য প্রকাশিত হয়েছে। এবিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার জন্য দেখুনঃ দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, লোকায়ত দর্শন, নিউ এজ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, প্রথম সংস্করণ ১৩৬৩, পুনর্মূদ্রণ ১৪১৬, পৃঃ ২২, ২৮-২৯।
-----------------------------------------------------------------
বালুচিস্তানে হরপ্পান যুগে নির্মিত কিনরি বাঁধ: ভূমিক্ষয়ের ফলে বাঁধের একটি অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। (সৌজন্যেঃ Ueli Brunner, 2006)
আমরা মনে করি পশ্চাৎপদ ও গ্রামীণ সমাজ থেকে নিরীশ্বরবাদ ও লোকায়তের মত উন্নত বস্তুবাদী দর্শনের বিকাশ ঘটতে পারে না। কেবল দীর্ঘকাল স্থায়ী উন্নত, গণতান্ত্রিক ও পরমতসহিষ্ণু নাগরিক সভ্যতার আবেষ্টনে রক্ষিত একটি সমাজে এই ধরনের দর্শন চিন্তা বিকাশ লাভ করতে পারে। সিন্ধু সভ্যতায় লোকায়ত ও নিরীশ্বরবাদের ধারা প্রবল ও শক্তিশালী ছিল বলেই সভ্যতা ধ্বংসের অনেক পরবর্তী কালেও ভারতর্ষের সমাজে এর অবশেষ হিসাবে আবির্ভূত হতে পারে বৌদ্ধ ও জৈন ধর্ম এবং অন্যান্য জনপ্রিয় বিভিন্ন ব্যক্তি ও গোষ্ঠীকেন্দ্রিক নিরীশ্বরবাদী দর্শনচিন্তা।
অপর দিকে, এক সময় প্রাচীন ভারতবর্ষ ব্যাপী প্রবল প্রভাব বিস্তারকারী দুই প্রধান ধর্ম বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মবিশ্বাসে অহিংসাকে এতটা গুরুত্ব দিবার ব্যাপারটাও খুব তাৎপর্যপূর্ণ। বুঝা যায় এমন এক প্রবল সামাজিক পটভূমি থেকে এই ধর্ম দুইটি উঠে এসেছে যেখানে সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনার প্রধান পদ্ধতি ছিল অহিংসা তথা রক্তপাত ও বলপ্রয়োগ বিমুখতা। আর তখন আমাদের চোখের সামনে উদ্ভাসিত হয় সিন্ধু সভ্যতা। ধ্বংসের বহু পরবর্তী কালেও বৃহত্তর ভারতীয় সমাজে সিন্ধু সভ্যতার সংস্কৃতি ও চেতনা তার যে গভীর প্রভাব রেখেছিল তার ফলশ্রুতি হিসাবে এখন আমরা চিনতে পারি বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মকে। সিন্ধু সভ্যতা ধ্বংসের বহু পরবর্তী কালে এই ধরনের নিরীশ্বরবাদী ও অহিংসার চেতনা-ভিত্তিক ধর্মের উত্থান নিয়ে এখন আমাদের নূতনভাবে ভাববার সময় এসেছে।
সভ্যতার বস্তুগত রূপ ধ্বংস হলেও তার সংস্কৃতি তথা ভাবগত রূপ যে সহসা ধ্বংস হয় না বরং বহুকাল ধরে রেখে চলে জনসমাজে তার প্রভাব তার প্রমাণ হচ্ছে চার্বাক, লোকায়ত, সাংখ্য ইত্যাদি দর্শন চিন্তা এবং সেই সঙ্গে বৌদ্ধ ও জৈন ধর্ম কর্তৃক একদিকে অহিংসার প্রতি গুরুত্ব দান, অপর দিকে, আত্মায় বিশ্বাসনির্ভর ধর্ম হওয়া সত্ত্বেও ঈশ্বর বিশ্বাসের প্রতি উপেক্ষা। আমরা এখন ধারণা করতে পারি সিন্ধু সভ্যতার পতন পরবর্তী কালে সেখানকার অধিবাসীদের যে বৃহৎ অংশ প্রধানত নিকটবর্তী উর্বর গাঙ্গেয় সমভূমিতে অভিবাসন ঘটায় তারা নগর সভ্যতা হারালেও তাদের নূতন জীবনে নিয়ে এসেছিল সিন্ধু সভ্যতার ভাষা এবং সংস্কৃতিকে। তারই কিছু প্রকাশ ঘটতে দেখি পরবর্তী ঐতিহাসিক কালের গতিধারায়।1 জীবনের উলট-পালট এবং সেই সঙ্গে সময়ের গতিধারায় অতীতের অনেক কিছু হারিয়ে গেছে। কিন্তু তারপরেও সিন্ধু সভ্যতা উপমহাদেশের মানুষের জীবনে নানানভাবে জীবিত হয়ে থেকেছে। সময় এবং পরিস্থিতির চাপে তার বহুকিছু পরিবর্তিত এবং ধ্বংসপ্রাপ্ত হলেও সবটুকু নয়। একটু মনোযোগ দিয়ে নিরীক্ষণ করলে আমরা আজও তাকে দেখতে পাব আমাদের জীবনে।
-----------------------------------------------------------------
1 সিন্ধু সভ্যতার সংস্কৃতির যে বহু কিছু পরবর্তী ভারতবর্ষের সমাজ বহন করে চলেছে, তার কিছু এখানে প্রাসঙ্গিক মনে করায় উল্লেখ করা হল। জৈন, বৌদ্ধ, হিন্দু ও শিখ ধর্ম ভারতবর্ষের সমাজে উদ্ভব ও বিকাশ লাভ করেছে বলে এই ধর্মগুলি সমাজের প্রচলিত ও জনপ্রিয় অনেক সাংস্কৃতিক উপাদান অঙ্গীভূত করে নিয়েছে। যেমন মেহরগড়ে আদি হরপ্পান স্তরে প্রায় ৪০০০-৩৫০০ খ্রীঃপূঃ-এ স্তর ৩-এ এবং নৌশারোতে প্রায় ২৮০০-২৬০০ খ্রীঃপূঃ-এ পাওয়া কিছু নারী মূর্তির চুলের সিঁথিতে সিঁদুর হিসাবে লাল রঙের রঞ্জক পদার্থের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। সিঁদুর ভারতীয় সধবা হিন্দু নারীদের সাধারণভাবে ব্যবহার করতে দেখা যায়, যা জৈন, বৌদ্ধ ও শিখ ধর্মাবলম্বীদের মধ্যেও প্রচলিত। দেখুনঃ Jonathan M. Kenoyer, The Archaeological Heritage of Pakistan: From the Palaeolithic to the Indus Civilization, in, A History of Pakistan, ed., Roger D. Long, 2015, p. 30.
মহেঞ্জো-দাড়োতে বৌদ্ধ ও হিন্দু ধর্মে প্রচলিত অভিবাদনের ভঙ্গিতে পোড়ামাটির মানুষের মূর্তি পাওয়া গেছে, যা নমস্কারের ভঙ্গি হিসাবে পরিচিত। অন্যকে সম্মান জানানোর একই ভঙ্গি জৈন ও শিখ ধর্মেও প্রচলিত। দেখুনঃ B.B. Lal, The Sarasvatī Flows On: The Continuity of Indian Culture, Aryan Books International, New Delhi, 2002, p. 127.
আগে উল্লেখ করা হয়েছে যে, সিন্ধু সভ্যতার নগরগুলির অল্প সংখ্যক অধিবাসীকে কবর দিবার প্রথা প্রচলিত ছিল বলে প্রত্নতাত্ত্বিক কেনোয়ার মনে করেন। তাঁর মতে বাকী মৃতদেহের অন্য পদ্ধতিতে সৎকার করা হত। আমরা মনে করি অধিকাংশ মানুষদের মৃতদেহ সৎকারের পদ্ধতি হিসাবে দাহ করা হত, যার প্রত্নতাত্ত্বিক সাক্ষ্য পাওয়ার উপায় নাই। আমাদের ধারণা সিন্ধু সভ্যতার এই ঐতিহ্য ধর্মসম্প্রদায় নির্বিশেষে সমগ্র পরবর্তী ভারতীয় সমাজ গ্রহণ করেছিল।
-----------------------------------------------------------------
৬। শেষ কথা
এই আলোচনার শুরুতে আধুনিক সভ্যতার পথযাত্রায় ইউরোপের ভূমিকার কথা বলতে গিয়ে আমরা রেনেসাঁ বা নবজাগরণের কথা বলেছিলাম। আর সে প্রসঙ্গে এসেছে বিশেষ করে প্রাচীন গ্রীসের জ্ঞান-বিজ্ঞান ও দর্শন চর্চার পুনরাবিষ্কারের প্রসঙ্গ। বস্তুত যদি ইউরোপ তার অতীতের গর্ভে রক্ষিত এমন জ্ঞান-ভাণ্ডারের সন্ধান না পেত তবে তার রেনেসাঁ ঘটাত কীভাবে? শূন্য থেকে কি যাত্রা হয়? বিস্মৃতির অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়া গ্রীসের জ্ঞান-ভাণ্ডার কিংবা গ্রীস ও রোমের শিল্পকলা এবং গণতন্ত্র ও প্রজাতন্ত্রের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের পুনরাবিষ্কার ধর্মের গণ্ডীর বাইরে গিয়ে ইউরোপকে নূতন করে সভ্যতা ও সংস্কৃতি নির্মাণে অনুপ্রাণিত করেছে। ধর্মের অন্ধত্ব ও সামন্ততান্ত্রিক স্বৈরতা থেকে মুক্তি পেতে এবং সভ্যতার পথে নূতন করে যাত্রা শুরু করতে গিয়ে ইউরোপের বহু মানুষকে অনেক মূল্য দিতে হয়েছে। ব্রুনোর মত জ্ঞানসাধককে খ্রীষ্টান চার্চের নির্দেশে আগুনে পুড়িয়ে মারা হয়েছে এবং জ্ঞানসাধক গ্যালিলিওকে আমৃত্যু বন্দী করে রাখা হয়েছে।
কিন্তু কোনোভাবেই ইউরোপের নবজাগরণকে ঠেকিয়ে রাখা যায় নাই। আর এখানেই গুরুত্ব অতীতের। আসলে আমাদের সামনের দিকের যাত্রার অনেক শক্তিই সঞ্চিত থাকে সেখানে। সেগুলিকে খুঁজে বের করে নিতে হয়। সেগুলির সন্ধান সবসময় যে পাওয়া যায় তা নয়। তখন হয়ত আমাদের বিচ্যুতি হয়, অনেক অনাবশ্যক মূল্য দিতে হয়।
আধুনিক সভ্যতা ও গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্র সংগঠনের জন্য আমাদের যে রেনেসাঁর প্রয়োজন সেটা সংগঠনে সিন্ধু সভ্যতার গুরুত্ব কতখানি হতে পারে সেটা আমরা আমাদের নিজেদের অতীত অভিজ্ঞতা থেকেও সহজে বুঝতে পারি। ইউরোপে যখন রেনেসাঁ চলছে প্রায় সমকালে ভারতীয় উপমহাদেশে বহিরাগত মুসলিম শাসন এবং ইসলামকে প্রতিহত করার জন্য যে আন্দোলনগুলি হচ্ছিল সেগুলি মূলত ধর্মের আশ্রয় নিয়েছিল। এর জন্য বিভিন্ন ধর্মসংস্কার আন্দোলন হয়। মহারাষ্ট্রে এই আন্দোলনের ফলে হিন্দু সমাজের যে জাগরণ ঘটে তার ফলে মারাঠা রাষ্ট্র-নায়ক শিবাজীর (১৬৩০ - ১৬৮০) উত্থান ঘটে। প্রায় সমসময়ে পাঞ্জাবে হিন্দুধর্মের সংস্কারের মাধ্যমে নানক (১৪৬৯ – ১৫৩৯) শিখ নামে এক নূতন ধর্মের জন্ম দেন। এর পরবর্তী সময়ে পাঞ্জাব ও সন্নিহিত অঞ্চলে মোগল রাষ্ট্রকে উচ্ছেদ করে এক শক্তিশালী শিখ রাষ্ট্রও প্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলায় এই সময় চৈতন্য (১৪৮৬ খ্রীঃ – ১৫৩৩ খ্রীঃ) জাতিভেদ-ভিত্তিক হিন্দুধর্মের সংস্কার ঘটিয়ে বৈষ্ণব ধর্ম প্রবর্তন করেন। তবে পরবর্তী সময়ে এটি হিন্দু ধর্মে বিলীন হয়।
অন্যদিকে, এই আন্দোলনগুলি বহিরাগত সৈরতান্ত্রিক রাজতান্ত্রিক শাসন উচ্ছেদ করলেও নিজেরাও অধঃপতিত হল নূতন ও স্বদেশী হলেও স্বৈরতান্ত্রিক রাজতান্ত্রিক শাসনে। মহারাষ্ট্রে তাই শিবাজী হলেন সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী রাজা এবং পাঞ্জাবে শিখ গুরু গোবিন্দও প্রতিষ্ঠা করলেন রাজতন্ত্র। এই দুই রাজতন্ত্রই হল ধর্মাশ্রিত। একটি হিন্দু, অপরটি শিখ।
এটা লক্ষ্যণীয় যে, প্রায় সমকালে ষোড়শ শতাব্দীতে ইউরোপে ধর্মসংস্কার আন্দোলন হলেও সেখানেই সেটা সীমাবদ্ধ থাকে নাই। বরং ধর্মের গণ্ডী ভেঙ্গে বেরিয়ে ইউরোপ বস্তুবাদ ও লোকবাদ চর্চার দিকে এগিয়ে গেছে। সেই সঙ্গে সেখানে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার আকাঙ্ক্ষা সর্বত্র বিস্তৃত হয়েছে। ক্রমে রাষ্ট্র থেকে ধর্মচর্চাকে বহিষ্কার করা হয়েছে। ধর্ম হয়েছে সেখানে ব্যক্তির বিশ্বাস-অবিশ্বাসের ব্যাপার। সেই সঙ্গে ক্রমে দেশের পর দেশে সামন্ত ও রাজকীয় শাসনের পরিবর্তে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে গণতান্ত্রিক ও প্রজাতান্ত্রিক শাসন।
এমনটা সম্ভব হয়েছিল। কারণ রেনেসাঁর মাধ্যমে অলৌকিকতায় বিশ্বাসনির্ভর ধর্মের গণ্ডী ভেঙ্গে ইউরোপ জাগতিকতা ও যুক্তিনির্ভর জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং সামন্তবাদ ও রাজকীয় রাষ্ট্রশাসনের পরিবর্তে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র চর্চার পথে পা বাড়াতে পেরেছিল। আর এ ক্ষেত্রে তা সবচেয়ে বেশী ঋণী প্রাচীন গ্রীস ও রোমের জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং গণতন্ত্র চর্চার উত্তরাধিকারের নিকট।
মধ্যযুগে ভারতে যখন একটা জাগরণ ঘটছে তখনও ভারত সম্পূর্ণরূপে ধর্মাচ্ছন্ন এবং সেই সঙ্গে মধ্যযুগীয় স্বৈরতান্ত্রিক ও রাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র-শাসনের ঐতিহ্য শাসিত। রামায়ণ ও মহাভারতের মত ঐতিহ্যবাহী গ্রন্থসমূহ রাম কিংবা যুধিষ্ঠিরের মত যে সব আদর্শ চরিত্র তাদের নিকট তুলে ধরে সেগুলি সবই ধর্মাশ্রিত এবং বংশগত ধারায় রাজকীয়। ধর্মমুক্ত এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র-শাসনের জগৎ তার নিকট প্রায় অজানা এক বিষয়। সুতরাং এক অন্ধবিশ্বাস-নির্ভর ধর্মকে মোকাবিলা করতে তাকে হাত বাড়াতে হয়েছে আর এক অন্ধবিশ্বাস-নির্ভর ধর্মের দিকে, এক রাজকীয় স্বৈরতাকে মোকাবিলা করতে তাকে হাত বাড়াতে হয়েছে আর এক রাজকীয় স্বৈরতার দিকে। এর জন্য তাকে করতে হয়েছে ধর্মসংস্কার, অথবা জন্ম দিতে হয়েছে নূতন ধর্মকে, যেটাও ঘটে প্রকৃতপক্ষে পুরাতন ধর্মের সংস্কারের মাধ্যমে, এবং সেই সঙ্গে যেখানে সম্ভব হয়েছে সেখানে প্রতিষ্ঠা করতে হয়েছে নূতন রাজ শাসন, যেমনটা হয়েছে মহারাষ্ট্রে কিংবা পাঞ্জাবে। এই অবস্থায় লোকবাদ বা জাগতিকতা এবং গণতন্ত্র অভিমুখী তার রেনেসাঁ হবে কী করে? সেটা হয় নাই।
অতীত ঐতিহ্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা আমরা বুঝি যখন ব্রিটিশ উপনিবেশবাদীদের হাত ধরে আধুনিক যুগ বঙ্গ তথা উপমহাদেশে আসছে তখনকার ব্রাহ্মধর্ম প্রতিষ্ঠার ঘটনা দিয়েও। বাংলায় আধুনিক ধর্মমুক্ত এবং যুক্তি-নির্ভর যুগ চেতনাকে বরণ করতে গিয়ে বাংলায় রামমোহন রায় হিন্দুধর্মের সংস্কার ঘটালেন। ব্রাহ্মধর্ম এবং ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বঙ্গ বা বাংলার হিন্দু সমাজ নিজেকে আধুনিক সমাজ ও সভ্যতার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে চেষ্টা করলেও সেটা কতটা পেরেছে সেই প্রশ্ন করা চলে। আধুনিক যুগে এসেও হিন্দু বাঙ্গালী ধর্মের গণ্ডী অতিক্রম করে তার সমাজ ও রাজনীতির উত্তরণ ঘটাতে পারল না। কারণ তেমন কোনও উত্তরাধিকারের সন্ধান তখনও তার সামনে ছিল না। তাই যেন ইউরোপের অনুকরণে এখানে ধর্মসংস্কার তথা রিফর্মেশন হল কিন্তু ইউরোপের এনলাইটেনমেন্ট বা আলোকায়ন আর হল না, হল না সেখানকার দেশে দেশে সংগঠিত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র-বিপ্লবের সমতুল্য্ কোনও ঘটনাও।
যাইহোক, ইউরোপ অনেক আগে রেনেসাঁ ঘটিয়ে আধুনিক ও গণতান্ত্রিক সমাজ ও সভ্যতার পথে তার যে জয়যাত্রা ঘটাতে পেরেছে ভারতবর্ষ সেটা যে পারে নাই সেটা স্পষ্ট হয় ইউরোপের পাশে ভারতকে রাখলে। ইউরোপ বহুকাল আগে ধর্ম ও সামন্তবাদী স্বৈরতার শাসন থেকে নিজেকে মুক্ত করে জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা এবং গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্র বিপ্লবের পথ ধরে তার জয়যাত্রা ঘটাতে পেরেছে। এই বাস্তবতা থেকে ভারতীয় উপমহাদেশ আজও কত দূরে! ইউরোপীয় এবং ব্রিটিশ গণতন্ত্রের অনুকরণে ভারতের মত দেশে গণতন্ত্রের চর্চা হলেও তা কতটা পঙ্গু আর কতটা সুস্থ ও প্রবল সেই প্রশ্ন করা চলে। জনসমাজের দারিদ্র্য, পশ্চাৎপদতা এবং অসংখ্য ধরনের সামাজিক বিকার ও বিকৃতির প্রভাব ভারত, বাংলাদেশসহ উপমহাদেশের প্রতিটি দেশেই দৃশ্যমান। অর্থাৎ ব্রিটিশ উপনিবেশবাদীদের রাজনৈতিক শাসনের অবসান হলেও উপমহাদেশ আজ অবধি তার মানুষদের জীবনে প্রকৃত স্বাধীনতার ছোঁয়া এনে দিতে পারে নাই। কেন, সেই প্রশ্ন কি করা উচিত নয়?
প্রায় দুইশত বৎসর স্থায়ী ব্রিটিশ শাসন অবসানের পর ৭৫ বৎসর পার হয়েছে। এই সময়ে যে অগ্রগতি হয়েছে সেটা নিয়ে তুষ্টির কারণ নাই। কারণ যুগের ধারায় এটুকু একান্ত স্বাভাবিক, এবং এমনকি অনিবার্য বললেও বেশী বাড়িয়ে বলা হয় না। বস্তুত ধর্ম এবং ধর্মের পাশাপাশি পাশ্চাত্য তথা ব্রিটিশ প্রবর্তিত যে আর্থ-সামাজিক এবং রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে আমরা টেনে নিয়ে চলেছি তার মধ্যেও আমাদের অনেক সমস্যা ও সঙ্কটের মূল নিহিত রয়েছে কিনা সেই প্রশ্ন আজ করতে হবে।
এ প্রসঙ্গে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে আমাদের বুঝতে হবে। সেটা হচ্ছে আধুনিক ইউরোপের মর্মে যে রেনেসাঁ আছে তার মর্মে আবার আছে গ্রীস এবং রোম। এই দুই সভ্যতাই ছিল প্রধানত যুদ্ধ এবং দাসতন্ত্র নির্ভর। গ্রীসের যুদ্ধ এবং দাসতন্ত্র নির্ভরতা রোমে চরম পরিণতি লাভ করেছিল। বলা যায় অগণিত মানুষের রক্ত, ঘাম ও অশ্রু প্রবাহিত করে এই দুই সভ্যতার জয়যাত্রা। এই বাস্তবতা অবশ্যই সেখানকার জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা এবং মানুষের মন-মনন তথা সংস্কৃতির উপর প্রভাব ফেলেছিল, ফলত প্রভাব ফেলেছিল গণতন্ত্র-ভাবনার উপরেও। আর তাই গ্রীস ও রোমের সভ্যতার মর্মে অবস্থিত নির্মমতা ও অমানবিকতার ছায়াপাত হয়েছিল রেনেসাঁর মাধ্যমে জাগ্রত আধুনিক ইউরোপেও। সুতরাং পৃথিবীর দেশে দেশে ইউরোপের যুদ্ধাভিযান ও লুণ্ঠন, উপনিবেশ স্থাপন, জাতির পর জাতির বিনাশ সাধনের পিছনে দেখতে পারতে হবে গ্রীস ও রোমের উত্তরাধিকারকেও।
এমন কোনও উত্তরাধিকার কি সিন্ধু সভ্যতা আমাদের সামনে উপস্থিত করে? একদিকে, তার লোকায়ত দর্শন তথা লোকবাদী বা জাগতিক বিশ্বদৃষ্টি, অপরদিকে, জনকল্যাণবাদী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার বহিঃপ্রকাশ আজ আমাদের বিস্ময়াভিভূত করে। অন্তত সিন্ধু সভ্যতার সূচনার কালে ঘোড়ার ব্যবহার মানুষের আয়ত্তে আসে নাই। সেই ধীর গতির যুগে এত বিশালায়তন সভ্যতাকে মহাকায় বলা ছাড়া উপায় নাই। সেই মহাকায় সভ্যতার সম্পদের বিপুলতা সম্পর্কেও সন্দেহ করার কারণ নাই। শুধু নগর বিন্যাস নয়, অধিকন্তু গবেষকরা বহু সংখ্যক ধনী ও দরিদ্রের কঙ্কালের উপর গবেষণা চালিয়ে তাদের শরীরে পুষ্টিমানের তুলনামূলকভাবে সমতার যে চিত্র আমাদের সামনে উপস্থিত করেন তা থেকেও আমরা বুঝি যে, এটা শুধু যে সভ্যতার নৈতিক মান বা আদর্শকে উপস্থিত করে তা-ই নয়, অধিকন্তু এটা সভ্যতার সমৃদ্ধি তথা খাদ্যসহ সম্পদের প্রাচুর্যকেও নির্দেশ করে। অর্থাৎ শুধু যে সমাজ বা রাষ্ট্র তার সকল নাগরিকের অন্ন সংস্থানের প্রতি দায়বদ্ধ এবং মনোযোগী ছিল তা-ই নয়, অধিকন্তু এই অন্ন সংস্থানের সামর্থ্যও তার ছিল। বুঝা যায় যে, বিশালায়তনে বিস্তৃত সিন্ধু সভ্যতা খাদ্যোৎপাদনেও ছিল বিপুলভাবে সমৃদ্ধ।
এই বাস্তবতা সভ্যতার শান্তিপূর্ণ রূপ বা অহিংসার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হতে পারে। কারণ নাগরিকরা এমন একটি জনকল্যাণবাদী রাষ্ট্রশাসনে থাকতে পছন্দ করেছে। কিন্তু এ কথা কি সভ্যতা বহির্ভূত বিভিন্ন সমাজ বা জনগোষ্ঠীর প্রতি প্রযোজ্য? তাদের কারও কি কখনও লোভ হয় নাই এমন একটি সমৃদ্ধ জনপদকে লুণ্ঠনের? অবশ্যই সমাজ বা সভ্যতার অন্তর্ভুক্তরা শান্তিপ্রিয় বা অহিংস হলেও বহির্ভূতরা সবা্ই তা ছিল না। সুতরাং বহিরাক্রমণ থেকে আত্মরক্ষার প্রয়োজনে সিন্ধু সভ্যতাকে সামরিক সক্ষমতাও যে রাখতে হয়েছিল তাতে সামান্য সন্দেহের কারণ নাই। অর্থাৎ নম্র হলেও সিন্ধু সভ্যতা ছিল পরাক্রান্ত। আর তাই বহিরাক্রমণকারীদের দ্বারা ধ্বংসাত্মক যুদ্ধে তার পতনের প্রমাণ পাওয়া যায় নাই।
ঘাম তথা শ্রম ছাড়া সভ্যতা নির্মিত হতে পারে না। সুতরাং এত বিশালায়তন ব্যাপী সিন্ধু সভ্যতা নির্মাণের পিছনেও বিপুল সংখ্যক মানুষের শ্রম নিশ্চয় ছিল। কিন্তু আর সব সভ্যতার মত রক্ত এবং অশ্রু সেখানে কতটা ছিল সেই প্রশ্ন করা যায়। প্রত্নতাত্ত্বিক সাক্ষ্য থেকে এটা স্পষ্ট যে, যুদ্ধ বা বলপ্রয়োগ যদি থেকেও থাকে তবে তার ভূমিকা ছিল খুব গৌণ এবং সমগ্র সভ্যতা প্রতিষ্ঠিত ছিল মূলত স্বেচ্ছাসম্মতির ভিত্তিতে। বিনিময়ে বস্তুগত প্রাপ্তিও নিশ্চয় কম-বেশী সবার ছিল। সেই সঙ্গে ছিল অন্তত সর্বাধিক সংখ্যক মানুষের জন্য সম্মান, নিরাপত্তা ও মানবিক অধিকারের প্রাপ্তি। এ ছাড়া একটা মহাকায় সভ্যতা শান্তিপূর্ণভাবে এতটা কাল অতিক্রম করতে পারত না।
হ্যাঁ, এক সময় সিন্ধু সভ্যতার পতন হয়েছে। সেটাও প্রত্নতত্ত্বের সাক্ষ্য অনুযায়ী বহিরাক্রমণে নয় এবং খুব ধ্বংসাত্মক গৃহযুদ্ধেও নয়। এ নিয়ে প্রত্নতাত্ত্বিকদের নানা মত আছে। যেমন জলবায়ু পরিবর্তন এবং অন্যান্য কারণে বিভিন্ন নদীর ঘনঘন গতিপথ পরিবর্তন ও সিন্ধু সভ্যতার বৃহত্তম নদী সরস্বতীর মৃত্যু, সুদীর্ঘ কালস্থায়ী খরা ও বৃহৎ অঞ্চলের মরুকরণ, বন্যা ইত্যাদি। এবং এগুলির ফলে সিন্ধু সভ্যতা ধ্বংসপ্রাপ্ত হলে তার বেশীর ভাগ অধিবাসী সভ্যতার মূলভূমি পরিত্যাগ করে অন্যত্র অভিগমন করতে বাধ্য হয়। তবে সেই আলোচনার স্থান এটা নয়। সুতরাং সে প্রসঙ্গে এখানে আমরা যাব না।1
-----------------------------------------------------------------
1 এ বিষয়ে আমাদের বিস্তারিত আলোচনার জন্য দেখুন আমাদের উভয়ের যৌথভাবে রচিত গ্রন্থ “আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা”। Link : http://www.bangarashtra.net/article/853.html
-----------------------------------------------------------------
মানুষের যেমন মৃত্যু হয় সভ্যতারও তেমন মৃত্যু হয়। কিন্তু মৃত্য হয় বলে একটা সভ্যতার শ্রেষ্ঠত্ব কিংবা মহিমা খর্ব হতে পারে না। তার ভূমিকা দিয়ে তাকে বিচার করতে হবে। সে দিক থেকে দেখলে সিন্ধু সভ্যতাকে মানবেতিহাসের অতুলনীয় সভ্যতা বলতে হবে।
চার হাজার বছরের ঘুম ভেঙ্গে আজ যখন সিন্ধু সভ্যতা আমাদের সামনে একটু একটু করে হলেও জেগে উঠছে তখন আমরা আর সব সভ্যতা থেকে বহু বিষয়েই সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী সভ্যতার সন্ধান পাচ্ছি। আবিষ্কারের এখনও আরও অনেক বাকি আছে। তা সত্ত্বেও যেটুকু আমরা জেনেছি সেটুকুই আমাদেরকে অভিভূত ও অনুপ্রাণিত করার জন্য যথেষ্ট। অস্ত্র, চাবুক ও ধর্মের শাসন ব্যতিরেকে যে এমন মহিমান্বিত সভ্যতা নির্মাণ করা সম্ভব তার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে দেখা দিয়েছে সিন্ধু সভ্যতা। বিশেষত পাশ্চাত্যের আধিপত্যাধীনে থেকে তার কাছ থেকে আমরা যা কিছু শিখেছি, জেনেছি এবং পেয়েছি তার বাইরেও যে আরও বহুকিছু শিখবার, জানবার এবং পাবার আছে সেটা আমরা জানছি সিন্ধু সভ্যতার আবিষ্কার থেকে।
ইউরোপ তার মত করে যে রেনেসাঁ সংগঠিত করেছিল আমাদেরও তেমন এক নূতন রেনেসাঁ সংগঠিত করতে হবে আমাদের মত করে। আর সেই রেনেসাঁ সংগঠনে প্রকাণ্ড ও পরাক্রান্ত কিন্তু একই সাথে নম্রতার পথচারী সিন্ধু সভ্যতা আমাদের জন্য হয়ে উঠতে পারে অন্ধকার সাগরে পথ দেখাবার বাতিঘর। সিন্ধু সভ্যতায় প্রত্যাবর্তন সম্ভব কিংবা কাঙ্ক্ষিত কোনোটাই নয়। কারণ কাল, পরিস্থিতি সবই ভিন্ন। কিন্তু সিন্ধু সভ্যতা থেকে আমরা পেতে পারি আমাদের ভবিষ্যৎ পথযাত্রার দিশা তথা শিক্ষা এবং প্রেরণা, যেমনটা একদা ইউরোপ পেয়েছিল প্রাচীন গ্রীস ও রোমের সভ্যতা থেকে।