Banner
সিন্ধু থেকে গঙ্গা : এক সভ্যতার পথযাত্রা (প্রথম খণ্ড) — শামসুজ্জোহা মানিক ও শামসুল আলম চঞ্চল

লিখেছেনঃ শামসুজ্জোহা মানিক ও শামসুল আলম চঞ্চল, আপডেটঃ June 29, 2023, 12:00 AM, Hits: 6519

 

১ম খণ্ডের অনলাইন প্রকাশ উপলক্ষ্যে কিছু কথা

আমরা এই গ্রন্থে দক্ষিণ এশিয়া তথা সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশ কিংবা কখনও ভারতবর্ষ হিসাবে কথিত এক বিশাল ভূভাগের মানুষের সমাজ ও সভ্যতার মূল ধারার স্বরূপ অনুসন্ধানের চেষ্টা করেছি। এ কাজে আমরা খুব সতর্কতার সাথে ঐতিহাসিক তথ্যসূত্রকে ব্যবহার করেছি। বিশেষত ইতিহাস ব্যাখ্যায় আমরা সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছি প্রত্নতাত্ত্বিকভাবে প্রাপ্ত তথ্যসূত্রের উপর। যখন ঋগ্বেদ কিংবা আবেস্তার মত সুপ্রাচীন ধর্মীয় সাহিত্য থেকে প্রাপ্ত উপাদান ব্যবহার করেছি তখনও আমরা প্রত্নতাত্ত্বিকভাবে আবিষ্কৃত তথ্যসূত্রের আলোয় সেগুলিকে যাচাইয়ের চেষ্টা করেছি। এছাড়া খুব নির্ভযোগ্য সূত্র হিসাবে স্বীকৃত প্রাচীন কালের বিভিন্ন ইতিহাস লেখক, পরিব্রাজকের বিবরণীকেও আমরা গুরুত্ব দিয়েছি। এ প্রসঙ্গে মেগাস্থিনিস, হিউয়েন সাং, ফাহিয়েন, ফ্রাঁসোয়া বার্নিয়েরের মত লেখক ও পরিব্রাজকদের নাম উল্লেখযোগ্য।

এক সময় উপমহাদেশের অতীত ইতিহাস প্রায় সবটাই অজ্ঞাত এবং অন্ধকারাচ্ছাদিত ছিল। কিন্তু বিগত শতাব্দী কাল যাবৎ প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারসমূহ অতীত সম্পর্কে আমাদের জানার জগৎকে অনেক বেশী প্রসারিত করেছে। বিশেষত বিগত ২৫/৩০ বৎসরের প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারগুলি ইতিহাস সম্পর্কে আমাদের পূর্ববর্তী অনেক ধারণাকেই বদলে দিচ্ছে। আগামীতে প্রত্নতত্ত্বের নূতন নূতন আবিষ্কার আমাদের আরও অনেক ধারণাকে যে বদলে দিবে তাতে সন্দেহ নাই।

কিন্তু আমরা প্রামাণ্য তথ্যসূত্র বিশেষত প্রত্নতাত্ত্বিক তথ্যসূত্রকে অবজ্ঞা করে ইতিহাস রচনা করতে পারি না। বরং ইতিহাস অনুসন্ধানে আমাদের মূলনীতি হওয়া উচিত যেটুকু তথ্যসূত্রের সত্যতা সম্পর্কে আমরা মোটামুটি নিশ্চিত হতে পারি সেটার ব্যবহার।

অনেক দিন ধরে ২,৬০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দকে সিন্ধুর নগর সভ্যতার সূচনাকাল ধরা হচ্ছে। আমরাও এই গ্রন্থের আলোচনায় এই সময়কে সিন্ধু সভ্যতার সূচনাকাল ধরে আলোচনা করেছি। কিন্তু সাম্প্রতিক কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার আমাদের এই ধারণাকে বদলে দিতে পারে। এ প্রসঙ্গে আমরা ভারতের গুজরাট উপকূলে অবস্থিত ক্যাম্বে উপসাগরে ২০০১ সালে আবিষ্কৃত নিমজ্জিত নগরের কথা উল্লেখ করতে পারি। সংবাদপত্রে প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী ২০০১ সালে গুজরাট উপকূল থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে ক্যাম্বে উপসাগরের ৩০ থেকে ৪০ মিটার গভীরে অবস্থিত এক বৃহৎ নগরের সন্ধান সম্পর্কে আমরা প্রথম জানতে পারি। এই নগরে ভারতের সমুদ্র প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ থেকে শেষ অনুসন্ধান হয় ২০০৩-২০০৪ সালে। আমাদের জানামতে সেখানে এর পর আর কোনও অনুসন্ধান চালানো হয় নাই। সমুদ্র গর্ভে নিমজ্জিত নগরটি একটি প্রাচীন নদী খাতের দুই পাশে ৫ মাইল দীর্ঘ ও ২ মাইল প্রশস্ত এলাকা নিয়ে গঠিত। সুতরাং এটির আয়তন প্রায় ১০ বর্গমাইল। সেই তুলনায় মহেঞ্জোদাড়ো, হরপ্পা, এবং পরবর্তী কালে প্রাপ্ত রাখিগাড়ি ও গানেরিওয়ালা নগরের আয়তন অনেক কম। এগুলির আয়তন নিম্নলিখিত রূপ, যথা, মহেঞ্জোদাড়ো ২৫০ হেক্টর (৬১৮ একর), হরপ্পা ১৫০ হেক্টর (৩৭০ একর), রাখিগাড়ি ১০০ হেক্টর (২৪৭ একর)  এবং গানেরিওয়ালা ৪০ হেক্টর (৯৯ একর)।

ক্যাম্বে উপসাগরের তলদেশে প্রাপ্ত এই নগরের উপর সেখানে জলস্রোতের প্রচণ্ডতার জন্য তেমন একটা কাজ করা যায় নাই। আবার ঘোলাজলের কারণে নগরের চিত্র চোখে দেখা যায় না। ফলে উপর থেকে শব্দ তরঙ্গের সাহায্যে নগরের চিত্র (sonar image) নিতে হয়েছে। তা থেকে এবং সাগর গর্ভে নিমজ্জিত নগরের বেশ কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন থেকে এটিকে অনেকে সিন্ধু সভ্যতার বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নগর হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। রেডিও কার্বন ডেটিং পদ্ধতিতে নগর থেকে পাওয়া একটি কাঠের টুকরা থেকে সেটার যে সর্বপ্রাচীন বয়স পাওয়া গেছে তাতে তার বয়স সাড়ে নয় হাজার বছর হয়, অর্থাৎ খ্রীষ্টপূর্ব ৭ হাজার ৫ শত বছর আগের কাষ্ঠখণ্ড সেটি।
অবশ্য কাষ্ঠখণ্ডটি কোথায়ও থেকে ভেসে নগরের জায়গায় আসতে পারে। সুতরাং তার উপর নির্ভর করে নগরের বয়স সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না। তা সত্ত্বেও এটি অনুমান করা যায় যে, নগরটি যখন স্থলভূমিতে ছিল তখন ছিল হিম বা বরফ যুগ। পৃথিবীর সর্বশেষ হিম যুগ আজ থেকে ২৫ হাজার বছর আগে শুরু হয়ে প্রায় ১০ থেকে ১২ হাজার বছর আগে শেষ হয়। তবে হিম যুগ সর্বত্র পুরাপুরি শেষ হতে আরও কিছু সময় নেয়। হয়ত নয় বা সাড়ে নয় হাজার বছর আগে এটা শেষ হয়। হিম যুগে বিপুল পরিমাণ জল বরফে পরিণত হওয়ায় সমুদ্র পৃষ্ঠ তখন এখন থেকে প্রায় ৩৩০ ফুট বা ১০০ মিটার পর্যন্ত নীচে নেমে গিয়েছিল। কিন্তু হিম যুগ শেষ হলে বরফ গলে বিপুল স্থলভূমি সমুদ্রতলে চলে যায়। ফলে হিম যুগে এমন সব অঞ্চলে অনেক বসতি এবং সভ্যতা গড়ে উঠা সম্ভব যেগুলি হিম যুগের অবসানে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে সমুদ্র জলের নীচে তলিয়ে গেছে।

পাতা :

মনে করা চলে যে, এমনই একটি নগর হওয়া সম্ভব ভারতের গুজরাটের উপকূল থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে ক্যাম্বে উপসাগরের জলের ৩০ থেকে ৪০ মিটার তলদেশে সন্ধান পাওয়া নগরটি। কাঠের রেডিও কার্বন পরীক্ষা এবং হিম যুগের সমাপ্তির হিসাব দুই দিক থেকেই তার বয়স অন্তত সাড়ে নয় হাজার বছর বা তারও বেশী চিহ্নিত হয়। এখন তার প্রতিষ্ঠার সময়কে যদি আরও এক হাজার বছর পিছিয়ে দেওয়া যায় তাহলে বলতে হবে কমপক্ষে সাড়ে দশ হাজার কিংবা হয়ত এগারো হাজার বছর আগে সিন্ধু সভ্যতার সন্নিকটবর্তী স্থানে নগর সভ্যতার যাত্রা শুরু হয়। অথচ মেসোপটেমিয়া এবং মিসরের নগর সভ্যতার যাত্রা আজ থেকে প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে। হরপ্পা-মহেঞ্জোদাড়োর যাত্রা প্রায় ঐ সময় হলেও রেডিও কার্বন ডেটিং অনুযায়ী চার হাজার ছয় শত বছর আগে।

ক্যাম্বে উপসাগরের নিমজ্জিত নগর ইতিহাস ব্যাখ্যায় বহু সমস্যা সৃষ্টি করে। প্রথমত, দক্ষিণ এশিয়ায় সভ্যতার জন্ম মিসর বা মেসোপটেমিয়ার সভ্যতার তুলনায় আরও পাঁচ বা ছয় হাজার বছর আগে হয়েছে এটা মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। দ্বিতীয়ত, হরপ্পা-মহেঞ্জোদাড়োসহ বর্তমান সিন্ধু সভ্যতার সঙ্গেও নিমজ্জিত নগরের সম্পর্ক স্থাপনে জটিলতা সৃষ্টি হয়। বর্তমানে সিন্ধু সভ্যতা হিসাবে পরিচিত সভ্যতা এবং তার নগরগুলির বয়স চার হাজার ছয়শত বছর পূর্বে নেওয়া হয়। তাহলে প্রশ্ন আসবে, যদি ধরে নেওয়া হয় যে, প্রায় নয় বা সাড়ে নয় হাজার বছর আগে এটি সমুদ্র গর্ভে নিমজ্জিত হয় তাহলে নিমজ্জনের পরেও প্রায় সাড়ে চার বা পাঁচ হাজার বছর এই সভ্যতা কোথায় ছিল? হঠাৎ করে আর এক নগর সভ্যতা প্রায় সাড়ে চার-পাঁচ হাজার বছর পর কী করে কিছু অভিন্ন রূপ নিয়ে সিন্ধু সভ্যতার বর্তমান অঞ্চলে গড়ে উঠল? মাঝখানের এই সাড়ে চার বা পাঁচ হাজার বছরের ধাঁধার উত্তর কীভাবে পাওয়া যাবে?

মাঝখানের এই চার হাজার বছরের ধাঁধার উত্তর আজ অবধি আমাদের নিকট অজানা রয়েছে। কারণ ২০০১ এবং ২০০৩-৪ সালের পর ঐ নিজ্জিত নগরের উপর আর কোনও প্রত্নতাতিত্ত্বক অনুসন্ধান হয়েছে বলে আমাদের জানা নাই। শুধু তা-ই নয়, যেটুকু প্রত্ন-অনুসন্ধান হয়েছে তারও কোনও পূর্ণাঙ্গ এবং নির্ভরযোগ্য প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে বলে আমাদের জানা নাই। এমন অবস্থায় এই সমগ্র আবিষ্কার সম্পর্কে আমরা কোনও মন্তব্য করতে পারছি না, এর উপর নির্ভর করে ইতিহাস ব্যাখ্যায় যাওয়া তো দূরের কথা। আমরা জানি না কেন ভারত সরকার এবং তার প্রত্নবিভাগের দিক থেকে এই আবিষ্কার নিয়ে আর অগ্রগতি ঘটে নাই।

যাইহোক, যত গুরুত্বপূর্ণ হোক ক্যাম্বে উপসাগরের নিমজ্জিত নগর নিয়ে আমরা এই গ্রন্থে কোনও ধরনের ইঙ্গিত দিই নাই। কারণ অপর্যাপ্ত অথবা অপ্রামাণ্য কোনও সূত্রের উপর নির্ভর করে আমরা কোনও আলোচনায় যাওয়াকে সমীচীন মনে করি নাই। যে তথ্যসূত্রসমূহ প্রামাণ্য হিসাবে বিবেচিত বা গৃহীত আমাদের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ কিংবা আলোচনার ভিত্তি হচ্ছে সেগুলি।

‘সিন্ধু থেকে গঙ্গা : এক সভ্যতার পথযাত্রা’ প্রচলিত অর্থে ভারতবর্ষের ইতিহাস গ্রন্থ নয়। বরং এখানে আমরা ভারতবর্ষের সমাজ ও সভ্যতার মূল ধারার গতি এবং প্রকৃতিকে বুঝতে চেয়েছি, সেই সঙ্গে তার বিকাশধারার সমস্যাগুলিকেও বুঝতে চেয়েছি। এখানে প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখা উচিত হবে যে, উপহাদেশীয় সভ্যতার মূল সূতিকাগার হিসাবে প্রথম পর্যায়ে বৃহত্তর সিন্ধু-সরস্বতী অববাহিকা এবং পরবর্তী পর্যায়ে গঙ্গা নদী সংশ্লিষ্ট বৃহত্তর অববাহিকা বা সমভূমি অঞ্চল ভূমিকা রাখায় আমরা ভারতীয় উপমহাদেশের সভ্যতার মূলধারাকে তুলে ধরতে চেয়ে ‘সিন্ধু থেকে গঙ্গা : এক সভ্যতার পথযাত্রা’ এই নাম বেছে নিয়েছি। আলোচনার ব্যাপ্তির কারণে গ্রন্থের আয়তন বৃহৎ হচ্ছে বলে আমরা এটিকে অনলাইনে তিন খণ্ডে প্রকাশের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এখানে আমরা প্রথম খণ্ড প্রকাশ করছি। দ্বিতীয় খণ্ডের রচনা সমাপ্ত হলে সেটা প্রকাশ করা হবে। তারপরে আমরা অগ্রসর হব তৃতীয় খণ্ড রচনা এবং প্রকাশের দিকে।

আমরা এখন ১ম খণ্ড প্রকাশ করছি। সুতরাং ১ম খণ্ডে আলোচিত বিষয়বস্তুসমূহ সম্পর্কে পাঠক অবহিত হবেন। কিন্তু পরবর্তী খণ্ড দুইটির বিষয়সূচী সম্পর্কে পাঠকের কৌতূহল থাকা স্বাভাবিক। যেহেতু আমরা একটি সামগ্রিক পরিকল্পনা নিয়ে গ্রন্থ রচনায় হাত দিয়েছি সেহেতু সে সম্পর্কে একটি পূর্ব ধারণা পাঠকদেরকে দিয়ে রাখতে চাই। পরবর্তী খণ্ড দুইটি রচনার সময় বিষয়সূচীতে কিছু সংযোজন-বিয়োজন ঘটতে পারে। তবে অনুমান করি গ্রন্থ রচনার মূল ধারা অপরিবর্তিত রইবে। সুতরাং ১ম খণ্ডের প্রকাশিত এবং বাকী দুই খণ্ডের পরিকল্পিত বিষয়সূচী আমরা নিম্নে ‍উল্লেখ করছি।

পাতা :

খণ্ড – ১ : বৃহত্তর সিন্ধু উপত্যকায় সভ্যতার গতিপ্রকৃতি

বিষয়সূচী :

প্রথম অধ্যায় : বৃহত্তর সিন্ধু উপত্যকায় সভ্যতার গতিধারা

দ্বিতীয় অধ্যায় : বৈদিক ধর্ম সংস্কার আন্দোলন ও সিন্ধু সভ্যতার পতন

তৃতীয় অধ্যায় : আবেস্তান ধর্ম সংস্কার আন্দোলন

চতুর্থ অধ্যায় : সিন্ধু সভ্যতার সমাজ, ধর্ম ও রাষ্ট্রশাসন-ব্যবস্থার স্বরূপ

খণ্ড – ২ : গাঙ্গেয় সমভূমিতে সভ্যতার গতিধারা

বিষয়সূচী :

প্রথম অধ্যায় : লৌহযুগ থেকে দ্বিতীয় নগরায়ন

দ্বিতীয় অধ্যায় : গাঙ্গেয় সমভূমিতে লোকায়ত ও গণতান্ত্রিক সমাজ

তৃতীয় অধ্যায় : বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের উত্থান

চতুর্থ অধ্যায় : হিন্দু ধর্মের উদ্ভব : প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ

পঞ্চম অধ্যায় : হিন্দু ধর্মের উদ্ভবে ব্রাহ্মণের ভূমিকা

ষষ্ঠ অধ্যায় : গাঙ্গেয় সমভূমিতে সিন্ধু সভ্যতার উত্তরাধিকার

সপ্তম অধ্যায় : পশ্চিমে সিন্ধু সভ্যতার উত্তরাধিকার

খণ্ড – ৩ : উপমহাদেশে বৈদেশিক শাসন ও তার উত্তরাধিকারের কাল

বিষয়সূচী :

প্রথম অধ্যায় : মুসলিম যুগ

দ্বিতীয় অধ্যায় : ব্রিটিশ শাসনকাল

তৃতীয় অধ্যায় : ব্রিটিশ শাসন-উত্তর কাল

 

পরিশিষ্ট

 

শেষ করার পূর্বে বলি যে, ভারতবর্ষের সমাজ ও সভ্যতার মূলধারার গতি ও প্রকৃতিকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে আমরা এই গ্রন্থে প্রামাণ্য প্রত্নতাত্ত্বিক তথ্যসূত্র ব্যবহারের উপর সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছি। ফলে আমাদের গ্রন্থে প্রত্নতত্ত্বের ভাষা অগ্রাধিকার পেয়েছে। এর ফলে সাধারণ পাঠকদের অনেকে গ্রন্থ পড়ার ধৈর্য বা আগ্রহ হারিয়ে ফেলতে পারেন। কিন্তু আমরা ইতিহাসের সাধারণ পাঠকদের কাছেও আমাদের বক্তব্য কিংবা ইতিহাস সংক্রান্ত ব্যাখ্যা পৌঁছে দিতে চাই। সুতরাং আমাদের একটি পরিকল্পনা আছে মূল গ্রন্থ প্রকাশের পর যত শীঘ্র সম্ভব খণ্ড এবং বিষয়সূচী অনুযায়ী গ্রন্থটির একটি সহজ ও সংক্ষিপ্ত ভাষ্য প্রকাশ করার।

শামসুজ্জোহা মানিক
শামসুল আলম চঞ্চল

২৭ জুলাই, ২০২২

পাতা :

দক্ষিণ এশিয়ার বর্তমান রাজনৈতিক মানচিত্র

সৌজন্যে : https://www.geographicguide.com/asia/maps/south-asia.htm

পাতা :

খণ্ড – ১ : বৃহত্তর সিন্ধু উপত্যকায় সভ্যতার গতিপ্রকৃতি

বিষয়সূচী : 

পাতা :

১ম অধ্যায় : বৃহত্তর সিন্ধু উপত্যকায় সভ্যতার গতিধারা  

১-৫০

২য় অধ্যায় : বৈদিক ধর্ম সংস্কার আন্দোলন ও সিন্ধু সভ্যতার পতন

৫১-৬২

৩য় অধ্যায় : আবেস্তান ধর্ম সংস্কার আন্দোলন

৬৩-৬৫

৪র্থ অধ্যায় : সিন্ধু সভ্যতার সমাজ, ধর্ম ও রাষ্ট্রশাসন-ব্যবস্থার স্বরূপ  

৬৬-৭০

 

১ম অধ্যায় : বৃহত্তর সিন্ধু উপত্যকায় সভ্যতার গতিধারা

দক্ষিণ এশিয়া, যাকে আমরা ভারতীয় উপমহাদেশ কিংবা ভারতবর্ষ বলে জানি, তা এক সুপ্রাচীন মানব সভ্যতার পীঠভূমি। সভ্যতা শুরু হবার অনেক আগেই এই অঞ্চলে প্রাচীন মানুষ বাস করত। পাকিস্তানের পোটওয়ার মালভূমিতে আজ থেকে কুড়ি লক্ষ বৎসরেরও আগে মানুষের উপস্থিতির প্রমাণ পাওয়া যায়।  বিখ্যাত প্রত্নতাত্ত্বিক জোনাথান মার্ক কেনোয়ার মনে করেন যে, এই আবিষ্কারের ফলে ‘আফ্রিকা থেকে বহির্গমন’ মতবাদ বা Out of Africa Models দিয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় প্রস্তর নির্মিত যন্ত্রপাতি ব্যবহারকারী জনগোষ্ঠীর উপস্থিতিকে ভালভাবে ব্যাখ্যা করা যায় না।  বৃহত্তর সিন্ধু উপত্যকা, বালুচিস্তান ও থর মরুভূমির বিভিন্ন অঞ্চলে পুরাতন প্রস্তর-যুগের পাথরের যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা জনগোষ্ঠীকে প্রায় ৫,০০,০০০ বৎসর আগে থেকে শুরু করে ১২,০০০ বৎসর আগে পর্যন্ত বাস করতে দেখা গেছে।  যদি বাইরে থেকে নূতন জনগোষ্ঠী স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে প্রতিস্থাপিত করে তাহলে পাথরের প্রযুক্তি ও বসতি বিন্যাসে পরিবর্তন দেখা যায়। এই সময়ে এই রকম পরিবর্তন না ঘটাতে ধারণা করা হচ্ছে যে, এখানে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর ধারাবাহিকতা ছিল।  এরপরে আজ থেকে প্রায় নয় হাজার বৎসর আগে আফগানিস্তান, বালুচিস্তান ও সিন্ধু উপত্যকার কিছু অংশ জুড়ে কৃষি ও পশুপালন ভিত্তিক কিছু জনগোষ্ঠীকে স্থিতিশীল জীবন শুরু করতে দেখা যায়। আরো পরে ৫৫০০ খ্রীঃপূঃ থেকে ২৮০০ খ্রীঃপূঃ পর্যন্ত কৃষি, পশুপালন ও বাণিজ্য নির্ভর বিভিন্ন জনগোষ্ঠী বৃহত্তর সিন্ধু উপত্যকার পশ্চিম, উত্তর পূর্ব ও দক্ষিণ দিকে বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। প্রায় ২৬০০ খ্রীঃপূঃ-এর দিকে সিন্ধু ও ঘাগর-হাকরা (যা প্রাচীন সরস্বতী নদী) উপত্যকায় নগর সভ্যতা শুরু হয়, যাকে আমরা সিন্ধু সভ্যতা নামে চিনি। এই অধ্যায়ে প্রধানত সিন্ধু সভ্যতার বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার ও গবেষণার আরো নানা শাখায় যে সমস্ত কাজ হয়েছে বা হচ্ছে সে সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করা হবে।

-------------------------------------------------------

দেখুনঃ Bridget and Raymond Allchin, Origins of a Civilization: The Prehistory and Early Archaeology of South Asia, First published by Viking by Penguin Books India (P) Ltd., 1997, pp. 36-39.

আফ্রিকা থেকে বহির্গমন মতবাদ বা Out of Africa Model অনুযায়ী এখন থেকে প্রায় ৫০,০০০ থেকে ১,০০,০০০ বৎসর আগে আধুনিক মানুষেরা আফ্রিকা থেকে কয়েকটি ধারায় এশিয়া ও ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে। বিস্তারিত আলোচনার জন্য দেখুনঃEwen Callaway, Ancient DNA reveals secrets of human history, in, Nature, Vol. 476, August 2011, pp. 136-137; Alan R. Templeton, Out of Africa again and again, in, Nature, Vol. 416, March 2022, pp. 45-51.

কেনোয়ার বলেন,, ‘Most of the literature is focused on the issues of DNA studies and fossil hominid studies that suggest one or more waves of early hominin and later modern humans emerged in Africa and spread throughout the Old World. While this is not the place to present all of the competing arguments, there is increasing evidence to suggest that South Asia has an important role to play in this discussion. None of the “Out of Africa Models” adequately explains the presence of stone tool using hominin in South Asia at more than two million years ago as revealed at the well-dated site of Riwat, Pakistan, or other early sites such as Uttar Bani which still require further confirmation.’ দেখুনঃ Jonathan Mark Kenoyer, New Perspectives on the Indus Tradition: Contributions from Recent Research at Harappā and Other Sites in Pakistan and India, in, Sindhu-Sarasvatī Civilization: New Perspectives, ed., Nalini Rao, Published by Nalanda International, Los Angeles and D.K. Printworld (P) Ltd., New Delhi, 2014, p. 505.

দেখুনঃ Jonathan M. Kenoyer, The Archaeological Heritage of Pakistan, in, A History of Pakistan, ed., Roger D. Long, Oxford University Press, 2015, p. 4.

তবে এই বিষয়ে আরো তথ্য ও অনুসন্ধান প্রয়োজন বলে কোনোয়ার মনে করেন। দেখুনঃ Jonathan Mark Kenoyer, New Perspectives on the Indus Tradition: Contributions from Recent Research at Harappā and Other Sites in Pakistan and India, in, Sindhu-Sarasvatī Civilization: New Perspectives, ed., Nalini Rao, 2014, p. 506.

-------------------------------------------------------

১৮২৬ সালে এই উপমহাদেশে প্রাচীন শহরের ধ্বংসাবশেষ হিসাবে হরপ্পাকে প্রথম চিহ্নিত করা হয়। কিছু পরে ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি পাঞ্জাব ইংরেজদের শাসনের অধীনে আসার পর সে সময়ে প্রতিষ্ঠিত আর্কিওলোজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার পরিচালক আলেকজান্ডার কানিংহাম হরপ্পার ঢিবিটিকে পরিদর্শন করেন ও বেশ কিছু খনন কাজ চালান। কিন্তু তিনি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান হিসাবে হরপ্পার প্রাচীনত্ব বা গুরুত্ব কোনোটিই বুঝেন নাই। পরে ১৯২১ সালে প্রত্নতাত্ত্বিক খননে হরপ্পাকে তাম্র যুগের সভ্যতা হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। ১৯২২ সালে রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় সিন্ধু প্রদেশে একটি বৌদ্ধ স্তূপের নীচে একই যুগের মহেঞ্জো-দাড়ো নামে আরেকটি নগরী আবিষ্কার করেন। এরপর চল্লিশের দশকে ভারত পাকিস্তান ভাগ হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত এই উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিম অংশে সিন্ধু সভ্যতার আরো বসতি পাওয়া গেল। সেই সময়ে যাঁরা এই সব খনন কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন তাঁদের মধ্যে  জন মার্শাল, আর্নেস্ট ম্যাকে, মর্টিমার হুইলার ও এস,এম, ভাট্স্ অন্যতম।

আগে মনে করা হত মৌর্য যুগের আগে এই উপমহাদেশে কোন সভ্যতা ছিল না। হরপ্পা-মহেঞ্জো-দাড়ো আবিষ্কার হবার পর আগের ধারণা বদলে গেল এবং এই বিষয়টি প্রতিষ্ঠিত হল যে প্রাচীন মিসর ও মেসোপটেমিয়ার সভ্যতার সমান্তরালে ভারতবর্ষেও একটি সুউন্নত নগর সভ্যতা গড়ে উঠেছিল। ভারত ও পাকিস্তানের স্বাধীনতার পর আরো প্রত্নতাত্ত্বিক খননে সমস্ত পাকিস্তান জুড়ে এবং ভারতের উত্তর-পশ্চিম অংশে এই সভ্যতার বিপুল সংখ্যক বসতি পাওয়া যেতে থাকে। যতই দিন গেল ততই নূতন নূতন বসতি আবিষ্কৃত হল এবং এই আবিষ্কারগুলি প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতা সম্পর্কে সমস্ত পুরনো ধারণা ভেঙ্গে দিয়ে নূতন নূতন দিক উন্মোচিত করল। গত পঁচিশ বৎসরাধিক কাল ব্যাপী এই সভ্যতার বসতিসমূহে বহু সংখ্যক প্রত্নতাত্ত্বিক খনন ও জরিপ এই অঞ্চলে আদি মানব বসতি, স্থিতিশীল সমাজের উদ্ভব, সিন্ধু সভ্যতার নগরসমূহের উত্থান ও পরিবর্তন, এবং দক্ষিণ এশিয়া তথা ভারতবর্ষের আদি ঐতিহাসিক যুগের নগরসমূহের উত্থান সম্পর্কে আমাদের ধারণা বদলে দিয়েছে। এই সমস্ত প্রত্নতাত্ত্বিক কাজের সাথে গবেষণার অনেক শাখা যুক্ত হবার ফলে এই সভ্যতা সম্পর্কে পুরাতন বহু ধারণাগত কাঠামোও বদলে যাচ্ছে।

-------------------------------------------------------

  মেসোপটেমিয়া অর্থ হল দুই নদী ঘেরা ভূমি। প্রধানত আজকের ইরাকের ইউফ্রেটিস ও টাইগ্রীস নদী দু’টির মধ্যবর্তী অঞ্চলে প্রাচীনকালে সুমেরীয়, ক্যালদীয় ও অ্যাসিরীয় সভ্যতা গড়ে উঠেছিল। এই সবগুলিই মেসোপটেমীয় সভ্যতার অন্তর্ভুক্ত।

-------------------------------------------------------

পাতা : ১

প্রথম দিকে সিন্ধু নদীর অববাহিকা জুড়ে এই সভ্যতার বসতি পাওয়াতে এই সভ্যতাকে সিন্ধু সভ্যতা নামে অভিহিত করা হয়। এই সভ্যতার আদর্শ বসতি (Type site) হিসাবে হরপ্পা প্রথম আবিষ্কৃত হওয়াতে প্রত্নতাত্ত্বিক বা পুরাতাত্ত্বিকভাবে সিন্ধু সভ্যতা হরপ্পান সভ্যতা নামেও পরিচিত। মোটামুটি ২৬০০ থেকে ১৯০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত টিকে থাকা এই সভ্যতার এখন পর্যন্ত তিন হাজারেরও বেশী বসতি আবিষ্কৃত হয়েছে  এবং এগুলি উত্তরপূর্ব আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও ভারতের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে প্রায় ১০,০০,০০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে । বালুচিস্তানে মকরান উপকূলে ইরানের সীমান্তের কাছে সুটকাজেনদোর, সমগ্র পাকিস্তান ও ভারতের পশ্চিম উত্তর প্রদেশের আলমগীরপুর ও হুলাস, মান্দি ও শামলিনগর, এছাড়াও দিল্লীতে মন্দবালি ও ভারগড়, আফগানিস্তানের শোরতুগাই থেকে পশ্চিম মহারাষ্ট্রের দায়মাবাদ পর্যন্ত এই সভ্যতার বসতিসমূহ বিস্তৃত। প্রাচীন মিসর বা মেসোপটেমিয়ার তুলনায় এই আয়তন প্রায় দুই গুণ এবং এটি প্রাচীন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সভ্যতা। সিন্ধু নদী উপত্যকার বাইরে এই সভ্যতার বিস্তার বিবেচনা করে এখন অনেক লেখক এই সমগ্র অঞ্চলকে বৃহত্তর সিন্ধু উপত্যকা নামে অভিহিত করেন।

-------------------------------------------------------

  দেখুনঃ Akinori Uesugi, Current State of Research and Issues of Indus Archaeology, in, Current Research on Indus Archaeology, ed., Akinori Uesugi, published by Research Group for South Asian Archaeology and Archaeological Research Institute, Kansai University, 2018, p. 1.

দেখুনঃ J.S. Kharakwal, Indus Civilization: An Overview, in, Indus Civilization: Text and Context, ed., Toshiki Osada, Manohar Publishers & Distributers, New Delhi, 2006, p. 15.

পাকিস্তানের বিখ্যাত প্রত্নতাত্ত্বিক এম, রফিক মুগল ১৯৭০ সালে প্রথম এই অঞ্চলের নাম Greater Indus Valley রাখেন। দেখুনঃ M. Rafque Mughal, Further Evidence of the Early Harappan Culture in the Greater Valley: 1971-90, in, South Asian Studies 6 (1990), p. 176.

  -------------------------------------------------------

সিন্ধু সভ্যতার হরপ্পান পর্যায়ের প্রধান বসতিসমূহ ও যোগাযোগের পথ (সৌজন্যেঃ Jonathan Mark Kenoyer and Dennys Frenez, 2018)

সিন্ধু সভ্যতায় এখনো অনেক খনন বাকী আছে, বিশেষত যেটুকু উল্লম্বভাবে খনন হয়েছে সেভাবে আনুভূমিক খনন হয় নাই। ফলে সিন্ধু সভ্যতা সম্পর্কে এখনো অনেক জানার বাকী আছে। যেমন বালুচিস্তানে এখনো অনেক এলাকায় সমৃদ্ধ প্রাচীন বসতি আছে যেগুলি এখনও খনন করা হয় নাই, যেমন, কুজদার জেলায় হাজার গঞ্জি, গ্রেশা, লাকরোইয়ান, বাঘবানা, বন্দ্-এ-চাক্কি, র্কাখ্, জীদি, খোররি, গাজ, চাকু, ওয়াধ, ওয়ার নাচ, খুজদার শহর, ইত্যাদি।  এই বসতিগুলি প্রত্ন-সামগ্রী চোরদের দ্বারা ধ্বংস হচ্ছে। অন্য দিকে ভারতের হরিয়ানা ও পাঞ্জাবে প্রচুর সংখ্যক হরপ্পান বসতি আছে, যেগুলির মধ্যে অনেকগুলিই কৃষির সম্প্রসারণ ও গ্রামবাসীদের নানা কার্যকলাপের ফলে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।  সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, ইতিমধ্যে যেসমস্ত প্রত্নতাত্ত্বিক খনন ও অনুসন্ধান হয়েছে তার অনেকগুলিই এখন পর্যন্ত অপ্রকাশিত। ফলে সিন্ধু সভ্যতা সম্পর্কে অনেক কিছু অজানা থেকে যাচ্ছে।

-------------------------------------------------------

  দেখুনঃ Ghulam Farooq Baloch, Shakir Naeeir and Waheed Razaq, Archaeological Survey in Jhalawan (Khuzdar) Balochistan: A Preliminary Note, in, Ancient Pakistan, Vol. XXVI, 2015, p. 123.

দেখুনঃ Tejas Garge, Salvaging the Vanishing Harappans in Haryana, in, Purātattva, No. 35: 2004-2005, 2005, p. 94-100.

-------------------------------------------------------

পাতা : ২

সিন্ধু সভ্যতার নগর পর্যায় ২৬০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দ থেকে ১৯০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত, প্রায় ৭০০ বৎসর টিকে ছিল। এই সময় জুড়ে এই সভ্যতায় বিস্তীর্ণ অঞ্চলব্যাপী সাংস্কৃতিক মিল লক্ষ্য করা যায়, মৃৎ ও কারুশিল্পের উৎপাদনে, বাড়ী ও নগর বিন্যাস ও পরিকল্পনার ক্ষেত্রে, সীল, লিপি, ইট ও বাটখারার মাপে। এই সভ্যতা অভ্যন্তরীণ ও বহির্বাণিজ্যে, বিশালকৃতির ভবন ও আকর্ষণীয় স্থাপত্য কৌশলে, নর্দমার সাহায্যে ও অন্য উপায়ে পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থায়, জলবিদ্যা ও জল নিয়ন্ত্রণ কাঠামোয়, চিত্রকর্ম, ধাতুর মূর্তি ও অন্যান্য জিনিসপত্র, খড়িপাথর (Steatite)  ও পোড়ামাটির মূর্তি, সোনা, রূপা, তামা ও বিভিন্ন পাথরের অলংকার, বিভিন্ন ধরনের খেলনা, এবং এগুলি তৈরীতে উন্নত মানের কারিগরী বিদ্যার জন্য অনন্য ছিল। গত প্রায় পঁচিশ বছরের প্রত্নতত্ত্ব ও অন্যান্য ক্ষেত্রে প্রচুর অনুসন্ধান ও গবেষণা থেকে জানা যাচ্ছে যে, সিন্ধু সভ্যতায় সমরূপতা বা মিলের পাশাপাশি বিভিন্ন আঞ্চলিক পার্থক্য যেমন ছিল তেমন সময়ের সাথে সেখানে সাংস্কৃতিক পরিবর্তনও ঘটেছে।

-------------------------------------------------------

খড়িপাথর বা স্টীয়েটাইট এক ধরনের নরম পাথর। এগুলির উপর খোদাই করা তুলনামূলক সহজ।

-------------------------------------------------------

সিন্ধু সভ্যতার নগর পর্যায় তৃতীয় সহস্রাব্দের প্রথমার্ধে শুরু হলেও এটি ছিল আরো প্রাচীন স্থিতিশীল মানব সমাজের সভ্যতার পথে ধারাবাহিক যাত্রার ফল। প্রায় ৭০০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের দিকে আফগানিস্তান, বালুচিস্তান ও সিন্ধু নদী উপত্যকার কিছু অঞ্চলে কৃষি ও পশুপালন ভিত্তিক প্রথম স্থিতিশীল মানব বসতি দেখতে পাওয়া যায়।  এই অঞ্চলে মৃৎশিল্প-পূর্ব যুগের প্রথম স্থিতিশীল পশুপালন ও কৃষির উপর নির্ভরশীল মানব বসতি দেখতে পাওয়া যায় বালুচিস্তানের মেহরগড়ে।

-------------------------------------------------------

দেখুনঃ Jonathan M. Kenoyer, The Archaeological Heritage of Pakistan, in, ed., Roger D. Long, A History of Pakistan, 2015, p. 4.

-------------------------------------------------------

প্রাচীন পৃথিবীর প্রধান চারটি নগর সভ্যতার তুলনামূলক বিস্তার

প্রত্নতাত্ত্বিক জোনাথান মার্ক কেনোয়ার এই অঞ্চলের দীর্ঘ মেয়াদী সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে কয়েকটি যুগ (Era) ও পর্যায়ে (Phase) ভাগ করেছেন । নীচে এর তালিকা দেওয়া হলঃ

-------------------------------

দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ৫।

-------------------------------

পাতা : ৩

সিন্ধুর ঐতিহ্যঃ মূল সময়ানুপঞ্জি

খাদ্য উৎপাদন ও সংগ্রহের (Foraging) যুগ

মধ্যকালীন প্রস্তর যুগ (Mesolithic) ও

ক্ষুদ্রাকার প্রস্তর যুগ (Microlithic)

১০,০০০ থেকে ২০০০ খ্রীঃপূঃ

আদি খাদ্য উৎপাদনের যুগ

মেহ্র্গড় পর্যায়

৭০০০ থেকে ৫৫০০ খ্রীঃপূঃ

আঞ্চলিকতার (Regionalization) যুগ

আদি হরপ্পান পর্যায়সমূহ

রাবি, হাকরা, শেরি খান তারাকাই, বালাকোট, আমরি, কোট দিজি, সোথি 

৫৫০০ থেকে ২৬০০ খ্রীঃপূঃ

একীভবন (Integration) যুগ  

হরপ্পান পর্যায়

২৬০০ থেকে ১৯০০ খ্রীঃপূঃ

স্থানিকতার (Localization) যুগ

বিদায়ী হরপ্পান পর্যায়সমূহ

পাঞ্জাব, ঝুকর, রংপুর

১৯০০ থেকে ১৩০০ খ্রীঃপূঃ

 

আদি খাদ্য উৎপাদনের যুগ (৭০০০ থেকে ৫৫০০ খ্রীঃপূঃ)

বালুচিস্তানের কাছি সমভূমিতে ফরাসি প্রত্নতাত্ত্বিক জঁ ফ্রাঁসোয়া জারিজের নেতৃত্বে মেহরগড় নামে নব প্রস্তর যুগের একটি বসতি উৎখনন হবার পর সিন্ধু সভ্যতার প্রত্নতাত্ত্বিক ইতিহাসে নূতন দিগন্তের সূচনা হল। খ্রীষ্টপূর্ব অষ্টম সহস্রাব্দের শেষের দিকে এখানকার মানব গোষ্ঠীর শিকার ও সংগ্রহকারী থেকে স্থিতিশীল কৃষি সমাজে উত্তরণ ঘটতে দেখা যায়।  যদিও একই ধরনের বিকাশ সিরিয়া ও মেসোপটেমিয়ায় আরো আগে ঘটেছিল, তবুও এখানে যে সাংস্কৃতিক বিকাশ ঘটতে দেখা যায় তার দীর্ঘ ধারাবাহিকতা অন্যান্য বসতিতে খ্রীষ্টপূর্ব প্রথম সহস্রাব্দ পর্যন্ত দেখতে পাওয়া গিয়েছিল।   মেহরগড়ের অবস্থান পাকিস্তানের কাছি সমভূমিতে, বোলান নদীর নিকটবর্তী এলাকায়। আদি হরপ্পান ও নবপ্রস্তর যুগের বসতির অবশেষ বিবেচনা করলে মেহরগড় প্রায় ৫০০ একর জায়গা জুড়ে বিস্তৃত ছিল।  মেহরগড়ের প্রথম দিকে এখানকার অধিবাসীরা কাঁচা ইটের ঘরবাড়ী তৈরী করত। সেই সময়ে অর্থাৎ ৭৫০০-৭০০০ খ্রীঃপূঃ-এর (পর্ব ১ - আদি)  দিকে সবচেয়ে প্রাচীন বসতিতে লাল গিরিমাটি দিয়ে দেওয়াল রঞ্জিত করতে দেখা যায়।  পর্ব ১ এর (৭০০০-৬৫০০ খ্রীঃপূঃ) শেষের দিকে একটি কাদা-মাটির ইটের তৈরী দেওয়ালে লাল, কাল ও সাদা রং দিয়ে অলংকরণ করতে দেখা যায়। এছাড়াও কিছু মেঝেতে লাল ও সাদা আস্তরণ দিয়ে ঢাকা ছিল। একই সময়ে মানুষজনকে ছোট কক্ষে লাল গিরিমাটি দিয়ে ঢেকে বা আস্তরণ করা মেঝেতে রেখে কবর দেওয়া হত।   মৃৎপাত্রের ব্যবহার তখনও শুরু হয় নাই। এই সময়ে অর্থাৎ ৭০০০ খ্রীঃপূঃ-এর দিকে সামুদ্রিক ঝিনুকের খোলা ও পাথরের তৈরী পুতির ব্যাপক উৎপাদন দেখা গিয়েছিল।  এর উপরের স্তরে কাস্তের অংশ এবং পাথরের যাঁতাকল পাওয়া গেছে। দুই সারি বিশিষ্ট ও ছয় সারি বিশিষ্ট যব, আইনকর্ন গম (Einkorn), এমার গম (Emmer), এবং রুটির গম (Bread wheat) পাওয়াতে অনুমান করা যায় কৃষি যথেষ্ট বিস্তৃত ও বিকশিত হয়েছিল। এই সময়টি হল খ্রীষ্টপূর্ব ষষ্ট সহস্রাব্দের শেষ পর্যায়ে।

-------------------------------------------------------

  দেখুনঃ Lorenzo Costantini, Earliest Agriculture in the Kachi Plain (Mehrgarh), in, Early Harappans and Indus-Sarasvati Civilization, ed., D.P. Sharma & Madhuri Sharma, Kaveri Books, New Delhi, 2013, p. 100.

  দেখুনঃ Ute Franke, Prehistoric Balochistan: Cultural Developments in an Arid Region, in, Palaeoenvironment and the Development of Early Settlements, ed., Markus Reindel, Karin Bartl, Friedrich Lüth and Norbert Benecke, Verlag Marie Leidorf GmbH, Leidorf, 2016, p. 178.   

দেখুনঃ Jean François Jarrige, Origin of Harappan Civilization and Mehrgarh Excavations, in, Early Harappans and Indus-Sarasvati Civilization, eds., D.P. Sharma and Madhuri Sharma, Kaveri Books, New Delhi, 2013, p. 94.

প্রত্নতাত্ত্বিকরা কোন প্রত্নস্থল খননের সময় মাটির সর্বোচ্চ স্থান থেকে সর্বনিম্ন পর্যন্ত বিভিন্ন স্তরের অস্তিত্ব নির্ধারণ করেন প্রতিটি স্তরের বিশেষ গভীরতা, রঙ, বয়ন ও সাংস্কৃতিক সঞ্চয় থেকে। বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী প্রতিটি স্তরকে যথাক্রমে পর্ব ১, পর্ব ২, পর্ব ৩, ইত্যাদি হিসাবে গণনা করা হয়। কখনো উপস্তর পাওয়া গেলে এভাবে লেখা হয়, যেমন, পর্ব ১ক, পর্ব ১খ, পর্ব ১গ (Phase IA, IB and IC) ইত্যাদি। এই বিষয়ে বিস্তারিত জানার জন্য দেখুনঃ মোঃ মোশারফ হোসেন, প্রত্নতত্ত্বঃ উদ্ভব ও বিকাশ, পরিপ্রেক্ষিত বাংলাদেশ, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ১৯৯৮, পৃ-৪২-৪৩।

দেখুনঃ Aurore Didier, The use of colour in the Protohistoric pottery from Pakistani Balochistan and from Mundigak (Afghanistan): Cultural Identities and Technical Traditions, in, Annales de la Fondation Fyssen, Paris, 2011, pp. 140-141.

দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ৪১।

দেখুনঃ Jonathan Mark Kenoyer, Stone Beads of the Indus Tradition: New Perspective on Harappan Bead Typology, Technology and Documentation, in, Stone Beads of South and South-East Asia: Archaeology, Enthnography and Global Connection, ed., Alok Kanungo, Indian Institute of Technology/ Aryan Books International, New Delhi, 2017, p. 153.

-------------------------------------------------------

মেহরগড়ের দৃশ্য (সৌজন্যেঃUte Franke,2015)

পাতা : ৪

এই  বসতিতে কিছু পরে আরও বিকশিত পর্যায় দেখতে পাওয়া যায়। শিকার করা গজলা হরিণ (Gazel) ও গরুর হাড়, এবং গৃহপালিত ভেড়া এবং ছাগলের হাড় পাওয়াতে এই জনগোষ্ঠীর পরিবর্তনের ধারাটি বুঝা যায়। একই স্তর থেকে পাওয়া মোষের (Water buffalo) দু’টি হাড় প্রমাণ করে যে, এটি ছিল দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম।  এই স্তরে পাথরের তৈরী জিনিস সবচেয়ে বেশী সংখ্যক পাওয়া গেছে। এখানে পর্ব ২-এ (Megrgarh IIA)-তে সবচেয়ে প্রথমে বহু কামরায় বিভক্ত ভবন পাওয়া যায়। এখানে মৃৎশিল্প সমৃদ্ধ নব প্রস্তর যুগে (Ceramic Neolithic, Period II: 6000-5500 B.C.E.) এবং তাম্রযুগ পর্ব ৩ (Period III)-এ যথেষ্ট বড় কামরা বিশিষ্ট ভবন নির্মাণ করা হয়েছিল এবং কিছু এলাকায় চত্বর (Terrace) তৈরী করে ঢিবির ক্ষয়িষ্ণু ঢালু অংশকে শক্তিশালী করার জন্য বড় বাঁকানো উঁচু মঞ্চ বা আস্তরণ দেওয়া দেওয়াল (Revetment wall) নির্মাণ করা হয়েছিল। পর্ব ২-এ বিভিন্ন কাঠামোকে বন্যা ও ভূমি ক্ষয়ের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য এই ধরনের চত্বর ও আস্তরণ নির্মাণ থেকে এটি মনে করা যায় যে, এটি অত্যন্ত সংগঠিত সমাজ ছিল।  সেখানে প্রাপ্ত কবরস্থানে ৩২০টি কবর উন্মোচিত হয়েছে। মৃতের সাথে দেওয়া হত সুনির্মিত খোলা, পাথর ও তামার অলংকার, পাথরের তৈরী জিনিসপত্র, কখনো বিটুমিন দেওয়া ঝুড়ি, মানুষের মূর্তি ও বলি দেওয়া ছাগল।

-------------------------------------------------------

দেখুনঃ Catherine Jarrige, Jean-Francois Jarrige, Richard H. Meadow & Gonzague Quivron (eds.), Mehrgarh: Field Reports 1974-1985: From Neolithic Times to the Indus Civilization, published by the Department of Culture and Tourism, Government of Sindh, Pakistan, 1995, p. 245.

দেখুনঃ Jonathan Mark Kenoyer, Households and Neighbourhoods of the Indus Tradition: An Overview, in, New Perspectives on Household Archaeology, eds., Bradley J. Parker and Catherine P. Foster, Indiana, Eisenbrauns, 2012, p. 378.   

দেখুনঃ Ute Franke, Prehistoric Balochistan: Cultural Developments in an Arid Region, in, Palaeoenvironment and the Development of Early Settlements, ed., Markus Reindel, Karin Bartl, Friedrich Lüth and Norbert Benecke, 2016, p. 180.

-------------------------------------------------------

মেহরগড়ের নব প্রস্তর যুগের কাদা-মাটির ঘর-বাড়ীর পরবর্তী স্তরসমূহ (সৌজন্যেঃ Ute Franke, 2015)

উপরে বর্ণিত মৃৎশিল্প যুগের পরে অর্থাৎ এর উপরের স্তরে বড় আয়তাকার ঘর-বাড়ী পাওয়া গেছে যেগুলি সমানভাবে বিভিন্ন কক্ষে বিভক্ত ছিল। কিছু ছিল বর্গাকার ছোট দরজাবিহীন ঘর যেগুলিকে গুদাম ঘর বলে মনে করা হয়। এই ভবনগুলির মাঝখানে বড় কবরস্থান পাওয়া গেছে।

মেহরগড় পর্ব৩-এ পাওয়া কামরা বিশিষ্ট ঘর-বাড়ী (সৌজন্যেঃ Ute Franke, 2015)

পাতা : ৫

দক্ষিণ দিকে নব প্রস্তর যুগের খ্রীষ্টপূর্ব পঞ্চম সহস্রাব্দের আরেকটি বসতি আছে। এখানে একই ধরনের ইটের তৈরী একটি বড় আয়তাকার ভবন পাওয়া গেছে। এটি নব প্রস্তর যুগের প্রথম পর্যায়ের। ১০টি সংকীর্ণ কুঠুরিতে এটি ভাগ করা। এখানে প্রচুর পরিমাণ যব ও গমের চিহ্ন পাওয়ায় এটিকে এই যুগের শস্যাগার বলে মনে করা হয়।  এখানে তুলার বীজের চিহ্ন পাওয়াতে অনুমান করা হয় যে, এই সময়ে তুলার চাষ হত। তুলার বীজ থেকে তেল নিবার জন্য অথবা তুলা থেকে আঁশ নিয়ে সুতা বানাবার জন্য এর চাষ হতে পারে। শস্যাগারের দক্ষিণে খড়িপাথর (Steatite) কাটার কারখানা ছিল। এখানে ছিদ্র করার যন্ত্রসহ বিভিন্ন ধরনের পাথরের যন্ত্রপাতি পাওয়া গেছে। কিছু সংখ্যক খোলামকুচিও এই দালানের ভিতরে ও বাইরে ছিল। এই মৃৎপাত্রগুলির বেশীর ভাগ ছিল নাশপাতি আকৃতির। এই পাত্রগুলির কিছু কুমোরের চাকে তৈরী করা এবং কিছু হাতে থাবড়ানো। এখানে দু’টি মানুষের মূর্তিও পাওয়া গেছে। এর মধ্যে একটি বসা অবস্থায়। আরেকটি চার পা-ওয়ালা জন্তুর মূর্তি পাওয়া গেছে। এই সময়ের শেষে মেহরগড়ে রঙিন মৃৎপাত্র পাওয়া যায় মেহরগড় পর্ব ৩ (Period III)-এ। কিলি গুল মোহাম্মদ পর্ব ২-এ পাওয়া সহজ জ্যামিতিক নকশার সাথে এগুলির মিল পাওয়া যায়।  মেহরগড়ে খ্রীষ্টপূর্ব পঞ্চম ও ষষ্ঠ সহস্রাব্দে পাওয়া বিভিন্ন নমুনা থেকে কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির খুবই প্রাচীন প্রমাণ মিলে। এছাড়া বিশেষীকৃত হস্তশিল্প এবং নীলকান্তমণি (Turquoise), লাপিস লাজুলি এবং সামুদ্রিক খোলার যেসব নিদর্শন পাওয়া গেছে সেগুলির উপর ভিত্তি করে দীর্ঘ দূরত্বের বাণিজ্যের অস্তিত্ব সম্পর্কে অনুমান করা যায়। পরবর্তীকালে খ্রীষ্টপূর্ব তৃতীয় ও চতুর্থ সহস্রাব্দে বালুচিস্তান ও সিন্ধু উপত্যকায় স্থানীয় ঐতিহ্যের সাংস্কৃতিক ধারাবাহিকতাকে রক্ষা পেতে দেখা যায় বিভিন্ন বসতিতে, যেমন কিলি গুল মোহাম্মদ পর্ব ৩, টোগাউ, চানহুদাড়ো এবং ইরানের শাহ্র-ই সোখতা ও শাহদাদে। এই যুগকে একই সাথে প্রযুক্তির আবিষ্কার এবং নানামুখী কৃষি উৎপাদনের যুগ হিসাবে চিহ্নিত করা যায়।

-------------------------------------------------------

   দেখুনঃ Catherine Jarrige, et. al. (eds.), Mehrgarh: Field Reports 1974-1985: From Neolithic Times to the Indus Civilization, 1995, p. 248.

   দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ২৪৭।

-------------------------------------------------------

প্রায় ৩৫০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে মেহরগড়ে (পর্ব ৪ - Period IV) যে ধরনের বসতি শুরু হয় তা তাৎপর্যপূর্ণ। এই সময়ে ছোট ও নীচু দরজাবিশিষ্ট বসবাসের উপযোগী বাড়ী তৈরী হতে থাকে। এই স্তরে লাল, সাদা ও কাল রঙের সাহায্যে চিত্রিত বহু রঙা মৃৎপাত্র ব্যবহার হতে দেখা যায়। এখানে পর্ব ৪-এ পোড়ামাটি ও হাড়ে খোদাই করা প্রথম সীল দেখতে পাওয়া গেছে। এছাড়াও এই পর্বের শুরু থেকে এখানে সহস্রাধিক খোলামকুচি পাওয়া গেছে যেগুলির উপর খোদাই করা চিহ্ন রয়েছে।  এই ধরনের চিহ্ন একই সময়ে বালুচিস্তান ও আশেপাশের অঞ্চলে অনেক বসতিতে পাওয়া যায়। এই সময়ে মৃৎপাত্রে সাদা রঞ্জক পদার্থের ব্যবহার আশ্চর্য হবার মত। এই প্রযুক্তিতে তারা কাল খড়িপাথরকে তাপের সাহায্যে সাদা করার কৌশল রপ্ত করেছিল, যা তারা মৃৎপাত্রকে অলংকরণ করতে ব্যবহার করত।  এই সময়ে সেচের খাল তৈরী করা হয় যাতে গমসহ ও অন্যান্য ফসলের আবাদ করে কৃষির উৎপাদন ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি করে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা পূরণ করা যায়।  সেই যুগে খালের সাহায্যে কৃষিতে সেচের এই সাক্ষ্য খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।

-------------------------------------------------------

দেখুনঃ Catherine Jarrige, et. al. (eds.), Mehrgarh: Field Reports 1974-1985: From Neolithic Times to the Indus Civilization, 1995, p. 83.

দেখুনঃ J.-F. Jarrige, A. Didier and G. Quivron, Shahr-I Sokhta and the Chronology of the Indo-Iranian Regions, in, Paléorient, Vol. 37.2, p. 13.

দেখুনঃ Ute Franke, Baluchistan and the Borderlands, in, Encyclopedia of Archaeology, ed., Deborah M. Pearsall, Academic Press, New York, 2008, p. 658.

-------------------------------------------------------

মেহ্র্গড় থেকে পাওয়া লাল রঙের প্রলেপযুক্ত মসৃণ মৃৎপাত্র, পর্ব ২-বি (সৌজন্যেঃ Ute Franke, 2015)

মেহ্র্গড় থেকে পাওয়া গলার হার বা মাথার অলংকারের ক্ষুদ্র পুতি, পর্ব-৩ (সৌজন্যেঃ Ute Franke, 2015)

মেহ্র্গড় থেকে পাওয়া বহুরঙা পাত্র, পর্ব ৫ (সৌজন্যেঃ Ute Frank, 2015)

পাতা : ৬

মেহরগড়ে ৩২০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে যে সংস্কৃতি দেখতে পাওয়া যায় তার সাথে পূর্ব ইরানের শাহ্র-ই সোখতায় বসতির সূচনা, কোয়েটা উপত্যকায় মুন্ডিগক পর্ব ৩ ও ডাম্ব সাদাত পর্ব ২-এর বসতিগুলি একই পর্যায়ভুক্ত।  আরো পরে ৩২০০ থেকে ২৭০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত মেহরগড়ের শিল্পে যে অগ্রগতি দেখতে পাওয়া যায় তার সাথে সংস্কৃতিগত মিল পাওয়া যায় সিন্ধু উপত্যকায় ফয়েজ মোহাম্মদ, রহমান ধেরি ও কোট দিজির বসতিগুলির। এছাড়া মেহরগড়ের উপরের স্তরটির সাংস্কৃতিক মিল দেখতে পাওয়া যায় কোয়েটা উপত্যকার ডাম্ব সাদাত ৩-এর সাথে।  মেহরগড়ের শেষ পর্যায়ে হরপ্পান নগর পর্যায়ের অনেক উপাদানের সূচনা দেখতে পাওয়া যায়। এগুলির মধ্যে পোড়া মাটির ত্রিভূজাকৃতির পিঠাকৃতি পিণ্ড (Triangular terracotta cake), দীর্ঘ সমান্তরাল পার্শ্ব বিশিষ্ট ফলক এবং আরো অনেক জিনিস অন্তর্ভুক্ত।  হরপ্পান নগর পর্যায় শুরুর ঠিক পূর্বে ২৭০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের দিকে (পর্ব ৭সি  - Period VIIC) মেহরগড়ের বসতি পরিত্যক্ত হয়। কিন্তু এর আট কিলোমিটার দক্ষিণে নৌশারোতে হরপ্পান নগর পর্যায়ের বসতি পাওয়া যায়, যা এই অঞ্চলকে হরপ্পান অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত করে। এখানে আরো পরে দীর্ঘ বিরতির পর প্রায় ২০০০ খ্রীঃপূঃ-এর দিকে একটি কবরস্থান পাওয়া গেছে, যাকে পর্ব ৮ (Period VIII) নামকরণ করা হয়েছে। এখানকার জনগোষ্ঠী এর আগের পর্ব ৭সি-এর সরাসরি অনুগামী ছিল না।

-------------------------------------------------------

দেখুনঃ Jean François Jarrige, Origin of Harappan Civilization and Mehrgarh Excavations, in, Early Harappans and Indus-Sarasvati Civilization, Volume I, eds., D.P. Sharma and Madhuri Sharma, 2013, p. 98.

দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ৯৮।|

দেখুনঃ J.-F. Jarrige, A. Didier and G. Quivron, Shahr-I Sokhta and the Chronology of the Indo-Iranian Regions, in, Paléorient, Vol. 37.2, p. 9.

-------------------------------------------------------

মেহরগড় (পর্ব ১ থেকে ৩) থেকে পাওয়া মানুষের মূর্তি (সৌজন্যেঃ Ute Frank, 2015)

মেহরগড় থেকে পাওয়া চার্ট পাথরের ফলক (সৌজন্যেঃ Ute Frank, 2015)

পাতা : ৭

এটি খুব চমকপ্রদ যে, মেহরগড়ে খ্রীষ্টপূর্ব সপ্তম সহস্রাব্দে নবপ্রস্তর যুগে যে মানুষের মূর্তি পাওয়া যায়, তার শৈলীর বিবর্তন হয়ে ষষ্ঠ, পঞ্চম, চতুর্থ ও তৃতীয় সহস্রাব্দে ধারাবাহিকতা বজায় ছিল।  যদিও কুল্লি শৈলীর মূর্তির সাথে তৃতীয় সহস্রাব্দের মেহরগড়ের পার্থক্য আছে, তবুও তাদের ঐতিহ্য যে বেশী আলাদা নয় তা বুঝা যায়।

-------------------------------------------------------

দেখুনঃ C. Jarrige, Terracota human figurines from Nindowari, in, South Asian Archaeology 1981, ed., Bridget Allchin, Cambridge University Press, Cambridge, 1984, p. 133.

-------------------------------------------------------

আমরা সিন্ধু সভ্যতার সাংস্কৃতিক ধারাবাহিকতার গুরুত্ব বুঝার জন্য মেহরগরের উপর আলাদাভাবে আলোচনা করলাম। কারণ এখন পর্যন্ত সিন্ধু সভ্যতার ইতিহাসে মেহরগড় একটি মাইলফলক হয়ে আছে এখানকার স্পষ্ট সময়ানুক্রমিক স্তর পাওয়াতে। হরপ্পায় সবচেয়ে প্রাচীন স্তরে পাওয়া পাথরের যন্ত্রপাতির উপর সাম্প্রতিক গবেষণা থেকে ধারণা করা হচ্ছে যে, এই বসতিতে প্রাচীন প্রস্তর যুগের উপরের দিকে (Upper Palaeolithic period) বা মধ্যকালীন প্রস্তর যুগে (Mesolithic period), প্রায় ১০০০০ থেকে ৮০০০ খ্রীঃপূঃ-এর দিকে মানুষ বসতি স্থাপন করেছিল।  এই আদি যুগে জ্যামিতিক ক্ষুদ্র প্রস্তর যুগের যন্ত্রপাতি পাওয়াতে এই ধারণা করা হয়। সিন্ধুর বসতি আমরি ও আল্লাহদিনোতেও সবচেয়ে নীচের স্তরে একই ধরনের ক্ষুদ্রাকার প্রস্তর যুগের যন্ত্রপাতি পাওয়া গেছে।

-------------------------------------------------------

দেখুনঃ Jonathan Mark Kenoyer, New Perspectives on the Indus Tradition: Contributions from Recent Research at Harappā and Other Sites in Pakistan and India, in, Sindhu-Sarasvatī Civilization: New Perspectives, ed., Nalini Rao, 2014, p. 507.

-------------------------------------------------------

 

আঞ্চলিকতার যুগ (৫৫০০ থেকে ২৬০০ খ্রীঃপূঃ)

৫৫০০ থেকে ২৮০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের মধ্যবর্তী সময়ে কৃষক, পশুপালক, এবং বণিকদের বৃহত্তর সিন্ধু উপত্যকার বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়তে দেখা যায়, যা বাণিজ্যিক পথের জাল দ্বারা যুক্ত ছিল।  এই সময় থেকে এই অঞ্চলে বসতির সংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে ও নানা আঞ্চলিক সংস্কৃতি বিকাশ লাভ করতে দেখা যায়। এই দীর্ঘ যুগকে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যপূর্ণ মৃৎপাত্র ও অন্যান্য জিনিসপত্র এবং এগুলির প্রাপ্তির সময়ের উপর ভিত্তি করে অনেকগুলি স্বতন্ত্র পর্যায়ে (Phase) ভাগ করা হয়েছে। এই সময়ে প্রতিটি অঞ্চলে বিশেষীকৃত শিল্পকর্ম, ধাতুশিল্প, জহুরির শিল্পকর্ম, চীনামাটির শিল্প ও অগ্নিদগ্ধ খড়িপাথরের ব্যবহার বিকাশ লাভ করছিল। এছাড়া কাপড়, ঝুড়ি ও কাঠের কাজের শিল্পের প্রমাণ পাওয়া গেছে। হাতির দাঁতের, হাড়ের ও পোড়ামাটির জ্যামিতিক নকশা করা সীলও পাওয়া গেছে। এই সময়ে মৃৎপাত্রের উপর কুমোরের দগ্ধ-পূর্ব চিহ্ন ও দগ্ধ-পরবর্তী আঁচড়-কাটা দাগ পরবর্তী যুগের লিপির উদ্ভবের ভিত্তি রচনা করেছিল। নদীসমূহ ধরে উৎপাদিত পণ্য ও কাঁচামালের পরিবহনের ফলে ব্যাপক বাণিজ্যিক যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল। কৃষিভিত্তিক স্থিতিশীল বসতিগুলির পাশাপাশি পশুপালন, মাছ শিকার, খাদ্য সংগ্রহ এবং শিকার ভিত্তিক জনগোষ্ঠীর অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া যায়। এই আঞ্চলিকতার যুগের শেষ অংশে নগরায়নের পথে যাত্রা  করতে দেখা যায় যাকে আদি হরপ্পান সময় (Early Harappan Period) বলে অভিহিত করা হয়। এই সময়ে অনেক ভিন্ন ধরনের সামাজিক, অর্থনৈতিক, প্রযুক্তিবিদ্যাগত এবং রাজনৈতিক বিকাশ ঘটে যা পরবর্তী হরপ্পান নগর সভ্যতার ভিত্তি হিসাবে কাজ করে। এই সময়ে প্রাচীর ঘেরা বসতি, নির্দিষ্ট চিত্রিত মৃৎপাত্র, প্রাথমিক পর্যায়ের লিপির ব্যবহার এবং বাণিজ্যিক যোগাযোগ ব্যবস্থা দেখতে পাওয়া যায়।  আদি হরপ্পান সময়ে বৃহত্তর সিন্ধু উপত্যকার বিভিন্ন অঞ্চলের স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য দেখতে পাওয়া যায়। এই সময়কে মৃৎপাত্র ও বিভিন্ন জিনিসপত্রের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের উপর ভিত্তি করে যে সমস্ত সাংস্কৃতিক পর্যায়ে ভাগ করা হয়েছে সেগুলির মধ্যে প্রধান কয়েকটি হল রাবি, হাকরা, কোট দিজি ও আমরি। এছাড়াও রয়েছে আরো কিছু ক্ষুদ্র পর্যায়, যেমন, শেরি খান তারাকাই, বালাকোট ও সোথি সংস্কৃতি।

-------------------------------------------------------

দেখুনঃ Jonathan M. Kenoyer, The Archaeological Heritage of Pakistan: From the Palaeolithic to the Indus Civilization, in, A History of Pakistan, ed., Roger D. Long, 2015, p. 4.

  দেখুনঃ Jonathan Mark Kenoyer, Ancient Cities of the Indus Valley Civilization, Oxford University Press, Karachi, 1998, p. 26.

-------------------------------------------------------

নাল থেকে পাওয়া ঢাকনা বিশিষ্ট পাত্র, খ্রীঃপূঃ ৩য় সহস্রাব্দের প্রথম দিকের (সৌজন্যেঃ Ute Franke, 2015)

পাতা : ৮

হরপ্পায় প্রাপ্ত রাবি পর্যায়ের মৃৎপাত্রসমূহ হাতে তৈরী এবং আকারের বৈচিত্র্য সীমিত। কিছু পাত্রে লাল বা বাদামী আস্তরণ দেওয়া, কিছুতে লাল, বাদামী, কাল বা সাদা রং দিয়ে বহুবর্ণে নকশা করা। অন্যান্য বসতি যেমন মেহরগড় ও নৌশারোতে প্রাপ্ত মৃৎপাত্রগুলিতে স্বতন্ত্র গঠন দেখা যায় এবং তা হরপ্পায় পাওয়া রং করা শিল্প বৈশিষ্ট্য থেকে সম্পূর্ণ পৃথক।

পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশের বান্নু নদী উপত্যকায় শেরি খান তারাকাই নামে বসতিটিতে খ্রীষ্টপূর্ব পঞ্চম সহস্রাব্দের দ্বিতীয়ার্ধে শুরু হয়ে খ্রীষ্টপূর্ব চতুর্থ সহস্রাব্দ পর্যন্ত মানুষের ধারাবাহিক বসবাসের সাক্ষ্য পাওয়া যায়।  এখানকার মৃৎপাত্র পুরু, অমসৃণ ও হাতে তৈরী ছিল। এখানকার মৃৎশিল্প অনন্য ছিল যা অন্যান্য জায়গায় অপরিচিত ছিল।  তবে এখানকার দ্রব্যসমূহের সাথে সাধারণ মিল দেখতে পাওয়া যায় ইরান ও দক্ষিণ মধ্য এশিয়ার বসতিসমূহের দ্রব্যসমূহের। যা থেকে পশ্চিমের সাথে যোগাযোগের সম্ভাবনা অনুমান করা যায়। এখানে বিভিন্ন ধরনের হাড়ের যন্ত্রপাতি, এবং বিশেষভাবে বিভিন্ন ভঙ্গিমায় প্রাপ্ত নারীমূর্তিসমূহ ছিল অতুলনীয়। এছাড়াও পাওয়া গেছে শিংযুক্ত দেবতা, সাপের ফনা তোলা অবস্থায় একটি মানুষের মাথা ও একটি উভলিঙ্গ মূর্তি। পোড়া মাটির এই ধরনের শিংযুক্ত দেবতার এই মূর্তিটি এখন পর্যন্ত জানা প্রাচীনতম নিদর্শন।

-------------------------------------------------------

দেখুনঃ M. Rafique Mughal, The Cultural Patterns of Ancient Pakistan and Neighbouring Regions circa 7000 – 1500 B.C., in, Pakistan Archaeology, No. 26: 1991, p. 221.

দেখুনঃ J.R, Knox, Farid Khan and K.D. Thomas, Sheri Khan Tarakai: Excavation in Bannu Distruct, NWFP, in, Early Harappans and Indus-Sarasvati Civilization, Volume I, eds., D.P. Sharma & Madhuri Sharma, Kaveri Books, New Delhi, 2013, 83.

দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ৮৪।

-------------------------------------------------------

খ্রীঃপূঃ পঞ্চম সহস্রাব্দের শেষের দিকে দক্ষিণপূর্ব বালুচিস্তানের সবচেয়ে প্রাচীন বসতি গড়ে উঠতে দেখা যায়। অন্যদিকে উত্তর বালুচিস্তানে যোগাযোগের ব্যবস্থা গড়ে উঠতে দেখা যায়। শাহী টুম্প ১-এর মৃৎপাত্র-পূর্ব (Aceramic) সময়ের সবচেয়ে নীচের স্তর ও আরো কয়েকটি বসতির সাথে ইরানীয় মালভূমির বসতিসমূহের সংস্কৃতিগত মিল দেখা যায়।

-------------------------------------------------------

দেখুনঃ Ute Franke, Baluchistan and the Borderlands, in, Encyclopedia of Archaeology, ed., Deborah M. Pearsall, Academic Press, New York, 2008, p. 654.

-------------------------------------------------------

খ্রীষ্টপূর্ব চতুর্থ সহস্রাব্দের শেষ থেকে তৃতীয় সহস্রাব্দের শুরু পর্যন্ত  বালুচিস্তানে ও সিন্ধু উপত্যকায় বিভিন্ন ধরনের মৃৎশিল্পের শৈলী দেখতে পাওয়া যায়। এই যুগে বালুচিস্তানের প্রধানত দক্ষিণ অংশে নাল-শৈলীর মৃৎশিল্প সংস্কৃতি দেখা যায়। আর কুল্লি-শৈলীর মৃৎশিল্প ছিল খ্রীষ্টপূর্ব তৃতীয় সহস্রাব্দের শেষের দিকে, ও এটি সিন্ধু সভ্যতার নগর পর্যায়ের সমসাময়িক।  সোহ্র্ ডাম্ব বা নালে সম্প্রতি খননকাজ করার ফলে নাল-শৈলীর মৃৎপাত্র যুগের যে সময় পাওয়া যায় তা হল ৩১০০ থেকে ২৭০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দ।

-------------------------------------------------------

দেখুনঃ Akinori Uesugi, Ceramics and Terracotta Figurines from Baluchistan of the Katolec Collection, Katolec Corporation, Tokyo, 2017, p. 5.

-------------------------------------------------------

নগর-পূর্ব সিন্ধু সভ্যতার কাল (প্রায় ৩০০০-২৬০০ খ্রীঃপূঃ) (সৌজন্যেঃ Akinori Uesugi, 2018)

পাতা : ৯

খ্রীষ্টপূর্ব তৃতীয় সহস্রাব্দের শুরুর দিকে নাল-শৈলীর মৃৎশিল্পের সাথে ইরানের মালভূমি ও বালুচিস্তানের যোগাযোগের সাক্ষ্য পাওয়া যায়। নাল মৃৎপাত্র ব্যাপক দেখা যায় পুরো দক্ষিণ বালুচিস্তান জুড়ে, সিন্ধুর পশ্চিম অধিত্যকায়, দূরের বসতিগুলিতে যেমন মেহ্র্গড় ৫বি  ও ৬, মিরি কালাত ৩এ-বি ও বালুচিস্তানের দস্ত বসতিগুলিতে, শাহর-ই সোখতা ১-২ এবং টেপে ইয়াহ্ইয়ায়। যদিও এই বসতিগুলিতে আকৃতি, শিল্পের উপাদানে ও অনেকখানি কারিগরী কৌশলে আঞ্চলিক বা স্থানীয় পার্থক্য বজায় ছিল।  উত্তর নাল শৈলী দেখা গেছে মেহরগড় ৭, বালাকোট ও দক্ষিণপূর্ব বালুচিস্তানের উত্তর আদি হরপ্পান বসতিগুলিতে। কুল্লি-শৈলীর মৃৎশিল্প পাওয়া যায় দক্ষিণ বালুচিস্তানে কুল্লি নামে একটি বসতি আবিষ্কৃত হওয়ার পর। এই সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য হল ডান দিকে মুখ করা কুঁজওয়ালা ষাঁড় ও চিতা বাঘের অঙ্কিত ছবি। দক্ষিণ বালুচিস্তানের নিন্দোওয়ারিতে কুল্লি শৈলীর জিনিসপত্র পাওয়া গেছে।  এছাড়াও আরো অনেক বসতি থেকে কুল্লি মৃৎপাত্র পাওয়া গেছে, যেগুলি হল মেহি, নৌশারো, নিয়াই বুথি, আমরি ও মহেঞ্জো-দাড়ো।   কুল্লি-শৈলীর মৃৎশিল্পের যোগাযোগ ও সাংস্কৃতিক বিনিময় দেখতে পাওয়া যায় পূর্ব দিকে সিন্ধু উপত্যকা, পশ্চিম দিকে দক্ষিণ-পূর্ব ইরান ও আরবীয় উপদ্বীপের সাথে।

-------------------------------------------------------

দেখুনঃ Ute Franke, Prehistoric Balochistan: Cultural Developments in an Arid Region, in, Palaeoenvironment and the Development of Early Settlements, eds., Markus Reindel, Karin Bartl, Friedrich Lüth and Norbert Benecke, Verlag Marie Leidorf GmbH, Rahden, 2016, pp. 188,189.

দেখুনঃ Mons. Jean-Marie Casal, Nindowari: A Chalcolithic Site in South Baluchistan, in, Pakistan Archaeology, No. 3, 1966, pp. 15-19.

দেখুনঃ Akinori Uesugi, Pottary from Balochistan in Ancient Orient Museum, Tokyo, Part 2: the late third millennium BCE, in, Bulletin of of Ancient Orient Museum, Vol. XXXIII, Offprint, 2013, p. 11.

দেখুনঃ Akinori Uesugi, Ceramics and Terracotta Figurines from Baluchistan of the Katolec Collection, 2017, p. 192.

-------------------------------------------------------

সিন্ধু সভ্যতার স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান সাংস্কৃতিক ধারাবাহিকতা বিবেচনা করলে এর উৎস চতুর্থ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের প্রথমার্ধ যা আদি হরপ্পান সাংস্কৃতিক পর্ব থেকে শুরু হয়েছিল যাকে হাকরা সংস্কৃতির সীমা বলে অভিহিত করা যায়।   এই যুগ কোট দিজি পর্বের পূর্বের। আদি হরপ্পান পর্বের যে বসতিসমূহ আবিষ্কৃত হয়েছে সেগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল দক্ষিণ-পশ্চিম সিন্ধু প্রদেশে আমরি, তক্ষশিলা উপত্যকায় সরাই খোলা, ঝং ও হাথিয়াল, মধ্য পাঞ্জাবভূমিতে রাবি নদীর তীরে জলিলপুর, ইত্যাদি।  এছাড়াও উত্তর রাজস্থানে কালিবঙ্গান, হরিয়ানায় মিটাথল, সিসওয়াল ও বনওয়ালী উল্লেখযোগ্য। খ্রীষ্টপূর্বাব্দ চতুর্থ সহস্রাব্দের সমসাময়িক হাকরা সংস্কৃতির বসতিসমূহ যেমন গিরাওয়াড় (Girawad), ফারমানা ও ভিররানার নাম এখানে উল্লেখ করা যায়।

-------------------------------------------------------

দেখুনঃ Mohammad Rafique Mughal, Cultural Continuity of the Indus Valley Civilization in Sindh, Southern Pakistan, in, Studies in Heritage of South Asia, ed., Mokammal H Bhuiyan, Published by Heritage Management & Research, Dhaka, 2012, p. 230.

দেখুনঃ M. Rafique Mughal, Archaeological Field Research in Pakistan Since Independence: An Overview, in, Bulletin of the Deccan College Post-Graduate & Research Institute, Volume 49, 1990, Pune, 265.

-------------------------------------------------------

ঘাগর-হাকরা নদীর উপত্যকায় আদি হরপ্পান বসতিসমূহ (সৌজন্যেঃ Vivek Dangi, 2018)

পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের হাকরা নদী উপত্যকায় চোলিস্তান মরুভূমি অঞ্চলে প্রচুর বসতি পাওয়া গেছে। এই বসতিসমূহে মৃৎপাত্রের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য দেখা যায় বলে একে হাকরা মৃৎশিল্প সংস্কৃতি নামে অভিহিত করা হয়।  অধিকাংশ হাকরা মৃৎশিল্প দ্রব্য হাতে তৈরী। তবে কিছু কুমোরের চাকায় তৈরী পাত্রও পাওয়া গেছে।

-------------------------------------------------------

দেখুনঃ M. Rafique Mughal, Recent Archaeological Research in the Cholistan Desert, in, Harappan Civilization, ed., Gregory L. Possehl, Oxford & IBH Publishing Co., New Delhi, 1982, p. 90.

-------------------------------------------------------

পাতা : ১০

প্রায় ৩৫০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের দিকে কিছু কিছু বসতি যেমন হরপ্পা ও ধারণা করা যায় আরো বসতি যেমন মহেঞ্জো-দাড়ো, রাখিগাড়ি, ধোলাভিরা সহ অন্যান্য বসতিসমূহের উদ্ভব হতে থাকে। আঞ্চলিকতার যুগের প্রথম দিকে বিভিন্ন এলাকায় মৃৎপাত্রের যে বৈচিত্র্য দেখা গিয়েছিল, এই যুগের শেষ দিকে এই সমস্ত এলাকায় মৃৎপাত্রের ক্ষেত্রে তার পরিবর্তে একটি শক্তিশালী সাদৃশ্য দেখতে পাওয়া যায়। এই সময় কোট দিজি রীতির মৃৎশিল্প সমগ্র সিন্ধু অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। এই প্রবণতা থেকে বুঝা যায় যে, আঞ্চলিকতার যুগে বিভিন্ন জনগোষ্ঠী যারা স্বাধীনভাবে শক্তিশালী স্থানীয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য গড়ে তুলেছিল, তারা সময়ের পথ পরিক্রমায় নিজেদের মধ্যে যোগাযোগের একটি পর্যায়ে মৃৎশিল্পের রীতি ও তাতে চিত্রাংকনের ক্ষেত্রে একটি ঐক্য গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিল।

-------------------------------------------------------

দেখুনঃ Jonathan M. Kenoyer, The Archaeological Heritage of Pakistan: From the Palaeolithic to the Indus Civilization, in, A History of Pakistan, ed., Roger D. Long, 2015, p. 29.

-------------------------------------------------------

কোট দিজিতে আদি হরপ্পান পর্যায়ে পাওয়া বসতিটি অত্যন্ত উন্নত ও নিজস্ব একটি সংস্কৃতি তৈরী করেছিল, যাকে কোট দিজি সংস্কৃতি নামে অভিহিত করা হয়।  মনে করা হয় যে পরবর্তী হরপ্পানরা এখান থেকে নগর-পরিকল্পনা ও নগর-দুর্গ নির্মাণের ধারণা নিয়ে যায়।  আদি হরপ্পান যুগে কোট দিজি সংস্কৃতির বিপুল সংখ্যক বসতি দেখা যায়, তেমনি সমসাময়িক আমরি ও সোথি সংস্কৃতির বসতিগুলিতে এই সংস্কৃতির জিনিসপত্র পাওয়া যায়।  দক্ষিণ পশ্চিম সিন্ধু প্রদেশে আমরিকে একটি আদর্শ বসতি ধরে এই সংস্কৃতিকে আমরি পণ্য সংস্কৃতি বলা হয়। সোথি পণ্য সংস্কৃতির অবস্থান হল উত্তর রাজস্থানে, যার নামকরণ সোথি নামে একটি ছোট বসতি থেকে হয়েছে। এই সংস্কৃতি পূর্ব পাঞ্জাব ও হরিয়ানায় ছড়িয়ে আছে।

-------------------------------------------------------

দেখুনঃ F.A. Khan, Excavations at Kot Diji, in, Pakistan Archaeology, No. 2, 1965, p. 13.

দেখুনঃ M. Rafique Mughal, The Geographical Extent of the Indus Civilization During the Early, Mature ad Late Harappan Times, in, South Asian Archaeology Studies, ed., G. Possehl, Oxford & IBH Publishing Co. Pvt. Ltd., New Delhi, 1992, p.126.

দেখুনঃ M. Rafique Mughal, The Geographical Extent of the Indus Civilization During the Early, Mature ad Late Harappan Times, in, South Asian Archaeology Studies, ed., G. Possehl, 1992, p.126.

-------------------------------------------------------

রাবি নদীর তীরবর্তী হরপ্পায় সর্বপ্রাচীন বসতি দেখতে পাওয়া যায় যা ছেদহীনভাবে পরবর্তী নগর পর্যায়ে ধারাবাহিকতা রক্ষা করেছিল। সিন্ধু উপত্যকার গুরুত্বপূর্ণ অংশে অবস্থিত আদি হরপ্পান যুগের এই বসতিতে রাবি পর্যায়ের (Ravi Phase) সর্ব প্রথম যে মানব বসতি ছিল তাকে ৩৯০০ থেকে ২৮০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে ফেলা যায়।  রাবি পর্যায়ের শুরুর দিকে এই এলাকাটিতে বসবাসের এলাকার আয়তন ছিল দশ হেকটর । ধারণা করা হয় এই এলাকাটি গিরি খাত দিয়ে ঢিবি এবি (Mound AB) ও ঢিবি ই (Mound E) এই দু’টি পৃথক বসবাসের এলাকায় ভাগ করা ছিল। এই দুই ঢিবিতে মৃৎশিল্প ও অন্যান্য জিনিসপত্র প্রায় একই রকম ছিল। এখানে পাওয়া ফালি করা পাথর ও ঘষা পাথরের উৎপাদন, পুতির ও ঝিনুকের খোলা থেকে চুড়ির উৎপাদন দেখে অনুমান করা যায় যে, এগুলির কাঁচামালের জন্য এই বসতিটি সিন্ধু অঞ্চলে অনেক দূরের উৎসের সাথে যুক্ত ছিল। এখানে রাবি পর্যায়ে বসবাসের এলাকায় সুতা কাটা, বয়ন ও মৃৎশিল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট জিনিসপত্র পাওয়াতে ধারণা করা হয় যে, সেখানকার গৃহগুলিতে বসবাসকারী মানুষেরা শিল্পোৎপাদনের বহু ক্ষেত্রে যুক্ত ছিল এবং তারা সম্ভবত তুলনামূলকভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিল।  কোট দিজি পর্যায়ে ২৮০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের দিকে ঢিবি এবি-কে কিছুটা বড় বসতিতে পরিণত হতে দেখা যায়, যা পঁচিশ হেকটরের চেয়েও বেশী ছিল। এই বিষয়টি থেকে এটাই মনে করা যায় যে, এই সময়ে বসতিটির জনসংখ্যা যেমন তাৎপর্যপূর্ণভাবে বেড়ে যায় তেমন সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠনেও জটিলতা দেখা দেয়। ধারণা করা যায় যে, এই পর্যায়ে হরপ্পানরা সীল, বাটখারা, আঁচড়-কাটা চিহ্ন (Graffiti) ও সীলমোহরের সাহায্যে ক্ষমতা প্রয়োগ ও নিয়ন্ত্রণ করত।  আগের রাবি পর্যায়ের সময়ে বাড়ীঘরগুলি উত্তর-দক্ষিণ ও পূর্ব-পশ্চিম রাস্তাগুলির বরাবর বিন্যস্ত ছিল। বসতিগুলির পরিকল্পনা থেকে এটাই মনে করা যায় যে, সেখানে নাগরিক নিয়ন্ত্রণ ও কিছুটা সামাজিক ও অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।  ২৬০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের কিছু সময় পূর্বে উভয় ঢিবির বহিঃপরিসীমায় মজবুতভাবে কাদা-মাটির দেওয়াল নির্মাণ করতে দেখা যায়। ঢিবি দু’টির উভয় এলাকাতেই পরবর্তী হরপ্পান পর্যায়ে মানুষ বসবাস শুরু করে এবং হরপ্পান পর্যায়ের নগর প্রাচীরটি সরাসরি আদি হরপ্পান প্রাচীরের উপর গড়ে উঠে।

-------------------------------------------------------

দেখুনঃ Jonathan M. Kenoyer, The Archaeological Heritage of Pakistan: From the Palaeolithic to the Indus Civilization, in, A History of Pakistan, ed., Roger D. Long, 2015, p. 35

দেখুনঃ Jonathan Mark Kenoyer, Households and Neighbourhoods of the Indus Tradition: An Overview, in, New Perspectives on Household Archaeology, eds., Bradley J. Parker and Catherine P. Foster, Indiana, Eisenbrauns, 2012, p. 390.

 দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ৩৯২।

দেখুনঃ Jonathan M. Kenoyer, The Archaeological Heritage of Pakistan: From the Palaeolithic to the Indus Civilization, in, A History of Pakistan, ed., Roger D. Long, 2015, p. 35

-------------------------------------------------------

ভারতের হরিয়ানায় অবস্থিত আদি হরপ্পান বসতিগুলির মধ্যে ভগবানপুর, বালু, বনওয়ালী, ভিররানা, ফারমানা, কুনাল, মিটাথল ও রাখিগাড়ি অন্যতম। বনওয়ালীতে আদি হরপ্পান পর্যায়ে বাড়ীঘরের দেওয়াল প্রায় পূর্ব-পশ্চিম ও উত্তর-দক্ষিণ বরাবর তৈরী করতে দেখা গেছে।  বৃত্তাকার বা আয়তাকার (Oblong) গর্তে বাসস্থান দেখা যায় গিরাওয়াড় (Girawad), ফারমানা,  ভিররানা, প্রভৃতি বসতিতে।  এই বসতিগুলিতে হাকরা সংস্কৃতির মৃৎশিল্প দেখতে পাওয়া যায়। এই সময়ে অশ্বত্থ গাছের পাতার আকৃতি ব্যবহার চিত্রের একটি উপাদান হিসাবে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়েছিল।

-------------------------------------------------------

দেখুনঃ R.S. Bisht, Structural Remains and Town-planning of Banawali, in, Frontiers of the Indus Civilization, eds., B.B. Lal and S.P. Gupta, Books and Books, New Delhi, 1984, p. 90.

দেখুনঃ Vasant Shinde, Toshiki Osada, M.M. Sharma, Akinori Uesugi, Takao Uno, Hideaki Maemoku, Prabodh Shirvalkar, Shweta Sinha Deshpande, Amol Kulkarni, Amrita Sarkar, Anjana Reddy, Vinay Rao and Vivek Dangi, Exploration in the Ghaggar Basin and excavations at Girawad, Farmana (Rohtak District) and Mitathal (Bhiwani District), Harana, India, in, Current Studies on the Indus Civilization, Volume I, eds., Toshiki Osada and Akinori Uesugi, Manohar Publishers & Distributers, New Delhi, 2010, p. 103, 135.

দেখুনঃ J.S. Khatri & M. Acharya, Kunal Excavations: New Light on the Origin of Harappan Civilization, in, In Search of Vedic-Harappan Relationship, ed., Ashvini Agrawal, Aryan Books International, New Delhi, 2005, p. 107.

-------------------------------------------------------

পাতা : ১১

রাখিগাড়ি ভারতে অবস্থিত সিন্ধু সভ্যতার সবচেয়ে বড় বসতি। এখানে আদি হরপ্পান পর্যায়ে বৃত্তাকার ও আয়তাকার দুই ধরনেরই কাঠামো দেখা গেছে। বৃত্তাকার বসতিগুলির জন্য কীলকাকার রোদে শুকানো ইট ও আয়তাকার বসতিগুলিতে রোদে শুকানো ইট ব্যবহার করতে দেখা যায়। এখানকার একটি ঢিবিতে (আরজিআর-৬) পূর্ব-পশ্চিম বরাবর রাস্তা ও উত্তর-দক্ষিণ বরাবর গলি ছিল। এখানে একটি কক্ষে একটি ইটের আস্তরণ দেওয়া বৃত্তাকার চুলা পাওয়া গেছে, যে রকম চুলা আজও এই অঞ্চলে দুধ ফুটানোর জন্য ব্যবহার করা হয়। এখানে দুটি ঢিবিতে (আরজিআর-১ ও আরজিআর-৬) খোদাই ছাড়া সীল, চার্ট পাথরের ফলক ও বাটখারা, ইত্যাদি পাওয়া গেছে। এখানে বিপুল পরিমাণ পশুর হাড় পাওয়ায় ধারণা করা হয় এখানে পশুপালন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। এছাড়া যে সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ জিনিস পাওয়া গেছে সেগুলির মধ্যে পোড়ামাটির বাঁশি (Rattle), ষাঁড়ের মূর্তি, চুড়ি, আঁচড় কাটা খোলামকুচি, খেলনার গরুর গাড়ীর কাঠামো ও চাকা, ইত্যাদি।

-------------------------------------------------------

 দেখুনঃ Amarendra Nath, Rakhigarhi: 1999-2000, in, Purātattva, No. 31: 2000-2001, 2001, pp. 43-44.

-------------------------------------------------------

ভারতের হরিয়ানায় বর্তমানে শুষ্ক সরস্বতী নদীর তীরে হরপ্পান বসতি ভিররানা অবস্থিত। ভিররানায় পর্ব ১এ-তে আদি হরপ্পান পর্যায়ে হাকরা মৃৎপাত্র সংস্কৃতির প্রমাণ পাওয়া যায়। এছাড়া ১বি-তে আদি হরপ্পান পর্ব ও ২এ-তে হরপ্পানে উত্তরণ কালীন (Transition Phase) সংস্কৃতি দেখতে পাওয়া যায়।

কুনাল থেকে পাওয়া আদি হরপ্পান মৃৎপাত্র (সোথি-সিসওয়াল) (সৌজন্যেঃ Vivek Dangi, 2018)

ঘাগর নদী অববাহিকায় আদি হরপ্পান পর্যায়ের বিভিন্ন আঞ্চলিক সংস্কৃতি গড়ে উঠতে দেখা যায়, যেমন হাকরা সংস্কৃতি, সোথি ও সিসওয়াল সংস্কৃতি, ইত্যাদি। সোথি ও সিসওয়াল সংস্কৃতির অনেক উপাদান বিশেষভাবে মৃৎশিল্প পরবর্তী হরপ্পান পর্যায়ে চালু ছিল। ঘাগর অঞ্চলে অবস্থিত আদি হরপ্পান বসতিগুলির অধিকাংশ অগভীর গর্তে বাসস্থান (Shallow pit dwelling complexes) তৈরী করত, যেখানে একটি বা দু’টি বসবাসের গর্ত, একটি গুদামজাতকরণের গর্ত এবং কখনো বর্জ্য রাখার গর্ত থাকত।  এগুলি সাধারণত বৃত্তাকার রীতিতে সজ্জিত থাকত। ঘাগর নদীর অববাহিকার বাইরে আদি হরপ্পান সংস্কৃতির সাথে সম্পর্কিত এই ধরনের স্থাপত্যের নিদর্শন দেখা যায় না। এখানে আদি হরপ্পান পর্যায়ে মৃৎশিল্পের যে ক্রমবিকাশ দেখা যায় তা পরবর্তী হরপ্পান পর্যায়ে ধারাবাহিকতা রক্ষা করে। ঘাগর-যমুনা নদীর অববাহিকার বিভাজক রেখায় এখন পর্যন্ত সবচেয়ে প্রাচীন যে বসতি পাওয়া যায় সেটি হল হরিয়ানায় আবিষ্কৃত কুনাল নামে বসতিটি। এখানে সর্ব প্রাচীন স্তরে পর্ব ১এ (Period 1A)-তে গর্ত-বাসস্থান দেখতে পাওয়া যায়। খুঁটির জন্য গর্তের চিহ্ন থেকে ধারণা করা যায় যে এই সব ঘরগুলিতে প্রলেপ দেওয়া বেড়ার দেওয়াল থাকত। এখানকার মৃৎপাত্রের হাকরা মৃৎশিল্প সংস্কৃতির সাথে মিল পাওয়া যায়।  হরিয়ানার আরেকটি বসতি ভিররানায়ও বৃত্তাকার গর্ত-বাসস্থান দেখা গেছে।

-------------------------------------------------------

দেখুনঃ Vasant Shinde, Regional Diversity of the Harappan Culture in the Ghaggar Basin, in, Purātattva, No. 45, 2015, p.76.

দেখুনঃ Manmohan Kumar, Harappan Settlements in the Ghaggar-Yamuna Divide, in, Current Studies on the Indus Civilization, Volume IV, eds., Toshiki Osada and Akinori Uesugi, Manohar Publishers & Distributers, New Delhi, 2011, p. 7.  

 দেখুনঃ L.S. Rao, Nandini B. Sahu, Prabash Sahu, Samir Diwan & U.A. Shastry, New Light on the Excavation of Harappan Settlement at Bhirrana, in, Puratattva, No. 35, 2004-2005, New Delhi, p. 61.

-------------------------------------------------------

কুনাল থেকে পাওয়া তামার তীরের ফলা (সৌজন্যেঃ Vivek Dangi, 2018)

আদি হরপ্পান পর্যায়ে কুনাল নামে একটি বসতিতে বৃত্তাকার গর্তে বাসস্থান (সৌজন্যেঃ Vivek Dangi)

পাতা : ১২

আদি হরপ্পান পর্যায়ে ভারতের গুজরাটে স্বতন্ত্র সংস্কৃতি নিয়ে অনেক বসতি গড়ে উঠতে দেখা যায়। এই বসতিগুলির মধ্যে লোটেশ্বর, পাদরি ও প্রভাস পাটনে (বা সোমনাথ) চতুর্থ সহস্রাব্দের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে তৃতীয় সহস্রাব্দের প্রথমার্ধ পর্যন্ত সাংস্কৃতিক স্তর পাওয়া যায়।  এখানকার এই তিনটি বসতি ছাড়াও সুরকোটডা, ধোলাভিরা, লোথাল ও নাগওয়াড়ায় (Nagwada) হরপ্পান বসতি শুরু হবার আগে অ-হরপ্পান (Non-Harappan) বা প্রাক-হরপ্পান (Pre-Harappan) তাম্র-যুগীয় সংস্কৃতির মানুষরা বাস করত।  কিছু বসতিতে যেমন, লাংঘ্নাজ (Langhnaj) ও লোটেশ্বরে মধ্যকালীন প্রস্তর যুগীয় জনগোষ্ঠীকে বসবাস করতে দেখা যায় যারা স্থানীয় তাম্র যুগীয় জনগোষ্ঠীরও আগে থেকে সেখানে বসবাস করত বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে।  ধারণা করা হয় যে, গুজরাটে অনার্ত (Anarta), প্রভাস-পূর্ব (Pre-Pravash), পাদরি পর্ব ১ ও ধোলাভিরার আদি হরপ্পান সংস্কৃতি হরপ্পান সংস্কৃতির পূর্বে অস্তিত্ব রক্ষা করেছিল। কচ্ছ, উত্তর গুজরাট ও সৌরাষ্ট্রের বিরাট অঞ্চল নিয়ে আদি হরপ্পান যুগে যে সংস্কৃতি দেখতে পাওয়া যায় তাকে পাদরি-অনার্ত সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্স নামে অভিহিত করা হয়।

-------------------------------------------------------

দেখুনঃ Rajesh S.V. and Ambika Patel, Excavated Chalcolithic Sites in Gujarat: An Appraisal, in, Purātattva, No. 37, 2007, p. 46.

দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ৩৫।

দেখুনঃ Shweta Sinha-Deshpande, The Interaction Network of Pre/Early-Harappan Gujarat, in, Purātattva, No. 36, 2005-2006, p. 30.

দেখুনঃ Prabodh Shirvalkar, Harappan Migrations: A Perspective about the Gujarat Harappans, in, Heritage: Journal Multidisciplinary Studies in Archaeology 1, 2013, p. 307.

-------------------------------------------------------

নাগওয়াড়া ও সানথ্লি (Santhly)-তে প্রাপ্ত কবরে আদি হরপ্পান মৃৎশিল্পের সাথে সিন্ধু ও বালুচিস্তানের মৃৎশিল্পের নৈকট্য দেখতে পাওয়া যায়।  এখানে মাটির  তৈরী জিনিসপত্র কবর-সামগ্রী হিসাবে দেওয়া হত। এগুলি সমাধিস্থ কবরে ও প্রতীকী পাত্র-কবরে (Symbolic pot-burial) দেখা গেছে। সৌরাষ্ট্র উপকূলব্যাপী বিভিন্ন বসতিতে ও উত্তর গুজরাটে সিন্ধুর আদি হরপ্পান বসতিগুলিতে মৃৎপাত্রের ভাংগা অংশ ও মাটির তৈরী অন্যান্য জিনিসপত্রের ধরন আদি হরপ্পান পর্যায়ে সিন্ধু এলাকা থেকে পাওয়া মৃৎশিল্পের মিল থাকাতে মনে করা হয় যে, প্রায় ৩০০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের দিকে সিন্ধুর জনগোষ্ঠীর সাথে সৌরাষ্ট্রের উপকূল ও উত্তর গুজরাটের জনগোষ্ঠীর চলাচল শুরু হয়েছিল।  মনে করা হয়, চতুর্থ সহস্রাব্দের মাঝামাঝি সময় থেকে তৃতীয় সহস্রাব্দের প্রথমার্ধ পর্যন্ত সিন্ধু ও বালুচিস্তান অঞ্চলের প্রাথমিক তাম্র যুগীয় আদি হরপ্পান বসতিগুলি আরো দক্ষিণে গুজরাটের উত্তর-পশ্চিম অংশে ছড়িয়ে পড়ে।

-------------------------------------------------------

দেখুনঃ P. Ajithprasad, SV Rajesh and Bhanu Sharma, Archaeological explorations in the Saurashtra coast of Junagadh Diatrict, Gujarat, in, Current Studies on the Indus Civilization, Volume VII, eds., Toshiki Osada and Akinori Uesugi, Manohar Publishers & Distributers, New Delhi, 2011, p. 64.  

  দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ৬৫।

দেখুনঃ P. Ajithprasad and V.H. Sonawane, The Harappa Culture in Noth Gujarat: a Regional Paradigm, in, Current Studies on the Indus Civilization, Volume IX, eds., Toshiki Osada and Hitoshi Endo, Manohar Publishers & Distributers, New Delhi, 2012, p.252.

-------------------------------------------------------

আদি হরপ্পানরা যে লাঙ্গল দিয়ে চাষাবাদ করতে পারত তার অনেক প্রমাণ পাওয়া গেছে। উত্তর রাজস্থানে অবস্থিত কালিবঙ্গানে আদি হরপ্পান পর্যায়ে ২৮০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের দিকে বসতিটির দক্ষিণ-পূর্ব দিকে শহর প্রাচীরের বাইরে চাষ করা জমি পাওয়া গেছে যেখানে জমির উপর লাঙ্গলের দ্বারা চাষের ফলে সৃষ্ট খাত বা হলরেখার পরিষ্কার চিহ্ন রয়েছে। প্রথম পর্যায়ে একটি থেকে অপর হলরেখার দূরত্ব ১.৯ সেন্টিমিটার, আবার এর পরের পর্যায়ে এর দূরত্ব ৩০ সেন্টিমিটার। এটি অত্যন্ত চমকপ্রদ যে, একই ধরনের চাষের পদ্ধতি আজও শুধু উত্তর রাজস্থানেই নয়, হরিয়ানা, পাঞ্জাব ও পশ্চিম উত্তর প্রদেশেও প্রচলিত।  এছাড়া বনওয়ালি ও হাকরা বসতিগুলিতে পোড়ামাটির লাঙ্গলের অনুরূপ জিনিস পাওয়া গেছে।

-------------------------------------------------------

 দেখুনঃ B.B. Lal, The Sarasvatī Flows On: The Continuity of Indian Culture, Aryan Books International, New Delhi, 2002, p. 99.

-------------------------------------------------------

সম্প্রতি হরপ্পায় খনন থেকে জানা গেছে যে, এখানে প্রাথমিক নগরায়ন ২৮০০-২৬০০ খ্রীঃপূঃ-এর মধ্যে কোট দিজি পর্ব জুড়ে ঘটছিল।  সাধারণভাবে গ্রহণ করা হয় যে, কোট দিজি সংস্কৃতির বস্তুসমূহ (Kot Diji type assemblage) আদি হরপ্পান সংস্কৃতির প্রধান উপাদান ছিল যা পরবর্তী হরপ্পান নগর সংস্কৃতিতে রূপান্তরিত হয়। তবে এই ধারণাটিকে নিয়ে  কিছু পণ্ডিত প্রশ্ন তুলেছেন। আদি হরপ্পান জিনিসপত্রের বিশাল অঞ্চলব্যাপী ছড়িয়ে পড়া থেকে ধারণা করা হয় যে, বৃহত্তর সিন্ধু উপত্যকাব্যাপী শক্তিশালী আন্তঃযোগাযোগ ও প্রথম দিককার জনগোষ্ঠীগুলির সাথে কারিগরী বিদ্যার বিনিময় ঘটেছিল।  বিস্তীর্ণ এলাকাব্যাপী শৈলীগত মিল থেকে প্রমিতকরণ ও কারুশিল্পের বিশেষীকরণ যে খ্রীষ্টপূর্ব তৃতীয় সহস্রাব্দের প্রথম দিকে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সেটি বুঝা যায়।

-------------------------------------------------------

দেখুনঃ Jonathan Mark Kenoyer, Indus and Mesopotamian Trade Networks: New Insights from Shell and Carnelian Artifacts, in, Intercultural Relations between South and Southwest Asia, eds., E. Olijdam & R.H. Spoor, BAR International Series 1826, 2008, p. 23.

দেখুনঃ M. Rafique Mughal, Genesis of the Indus Valley Civilization, in, Lahore Museum Bulletin, Off-print Vol. 1(1), 1988, p.49.

-------------------------------------------------------

পাতা : ১৩

 

আদি হরপ্পান বসতি বিন্যাস ও নির্মাণ কাঠামো

হরপ্পা ও কালিবঙ্গানে কোট দিজি পর্যায়ে বাড়ীগুলি রাস্তা বরাবর নির্মাণ করা হচ্ছিল এবং আদি হরপ্পান থেকে পরবর্তী হরপ্পান পর্যায়ে এই স্থাপত্যের ধারায় পরিবর্তন হয় নাই।  এই সময়ে রাস্তার ধারে নর্দমাও পাওয়া গেছে। হরপ্পায় কোট দিজি পর্যায়ে (এখানে ২৮০০ খ্রীঃপূঃ-এ এই পর্যায় শুরু হয়) ছোট কাদা-মাটির ইটের (৭ X ১৪ X ২৮ সেঃমিঃ মাপের) ব্যবহার শুরু হয়। হরপ্পায় পোড়া-মাটির ইট ব্যবহার হত এমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় নাই। যদিও পোড়ামাটির ইট কালিবঙ্গান পর্ব ১-এ নর্দমায় ব্যবহার হত।  কালিবঙ্গানের এই পর্বটি হরপ্পার কোট দিজি পর্বের সমসাময়িক। বনওয়ালীতে আদি হরপ্পান পর্যায়ে (পর্ব ১এ) নানা মাপের ইট ব্যবহার করা হলেও দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও উচ্চতার  অনুপাত ৩ : ২ : ১ বজায় ছিল।

-------------------------------------------------------

দেখুনঃ Jonathan Mark Kenoyer, Households and Neighbourhoods of the Indus Tradition: An Overview, in, New Perspectives on Household Archaeology, eds, Bradley J. Parker and Catherine P. Foster, 2012, p. 395.

দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ৩৯১।

দেখুনঃ R.S. Bisht, Dholavira and Banawali: Two Different Paradigms of the Harappan Urbis Forma, in, Purātattva, No. 29, 1998-99, p. 15.

-------------------------------------------------------

হরপ্পায় পূর্বে রাবি পর্যায়ে ঢিবি এবি ও ঢিবি ই এর চারপাশে ভারী নগর-প্রাচীর ও বসতিটির প্রান্তকে ভূমিক্ষয় থেকে রক্ষা করার জন্য যে কাদা-মাটির ইটের তৈরী উঁচু সমতলভূমি তৈরী করা হয়েছিল সেগুলির মাপ তুলনায় বড় (১০ X ২০ X ৪০ সেঃমিঃ)। এটি তাৎপর্যপূর্ণ যে, আগের রাবি পর্যায়েই ইটের মাপের এই অনুপাত ১ : ২ : ৪ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।  রহমান ধেরিতে কাদা-মাটির ইটের তৈরী আয়তাকার সীমানা প্রাচীর গড়ে উঠতে দেখা যায়। এখানে রাস্তা ও বাড়ীঘরগুলি সুষম জালির নকশায় নির্মিত হয়েছিল, এবং কমপক্ষে একটি প্রধান দরজা উত্তর ও দক্ষিণ দেওয়ালের মাঝখানে ছিল। অনেক আদি হরপ্পান বসতিতে শহর প্রাচীর দেখা গিয়েছিল, কোট দিজিতে এটি কাদা-মাটি ও পাথরের  এবং কালিবঙ্গানে এটি কাদা-মাটির তৈরী ছিল। বনওয়ালীতেও আদি হরপ্পান পর্যায়ে (পর্ব ১বি) শহর প্রাচীর দেখা যায়। এছাড়া ধোলাভিরায়ও আদি হরপ্পান পর্যায়ে নগর প্রাচীর ছিল। ভবন বা কোনো কাঠামো নির্মাণে পোড়ামাটির ইটের ব্যবহার আদি হরপ্পান কোনো বসতিতে দেখা যায় না। একমাত্র কালিবঙ্গানে পোড়ামাটির ইট দিয়ে তৈরী নর্দমার কথা জানা যায়, যা আগেই বলা হয়েছে।

-------------------------------------------------------

দেখুনঃ Jonathan Mark Kenoyer, Households and Neighbourhoods of the Indus Tradition: An Overview, in, New Perspectives on Household Archaeology, eds., Bradley J. Parker and Catherine P. Foster, 2012, p. 392.

-------------------------------------------------------

কোট দিজি পর্যায়ের কিছু বসতি যেমন, হরপ্পা, কালিবঙ্গান, রহমান ধেরি ও কোট দিজি বসতিগুলির চারপাশে দেওয়াল বা বসতির প্রান্তে আস্তরণ (revetment) দেখতে পাওয়া যায়।

 

আদি হরপ্পান থেকে হরপ্পান পর্যায়ে রূপান্তর

গুমলা নামে বসতিটিতে ও কোট দিজিতে কোট দিজি স্তরের শেষে ছাইয়ের স্তর পাওয়াতে বসতি দু’টিতে অগ্নিকাণ্ডে ধ্বংস হয়েছিল বলে মনে করা হত। কিন্তু কেনোয়ার মত প্রকাশ করেছেন যে, এগুলি ছাই ও কয়লার আঁস্তাকুড় হতে পারে অথবা বিচ্ছিন্ন অগ্নিকাণ্ড হতে পারে।   নৌশারোর উপরের স্তরে অগ্নিকাণ্ডে ধ্বংসের পরিষ্কার প্রমাণ আছে এবং এই বসতিটি কিছু সময়ের জন্য পরিত্যক্ত হয়েছিল। কিন্তু জিনিসপত্রের ঐতিহ্য ও বাড়ীঘরের বৈশিষ্ট্যে মিল থাকায় মনে করা হয় যে, একই বা একই ধরনের জনগোষ্ঠী সেখানে বসবাস করছিল।  অন্যদিকে হরপ্পায় ঢিবি ই-তে খননের সময়ে মৃৎপাত্রসমূহকে স্তরগতভাবে ও শৈলীগতভাবে আদি হরপ্পান ও হরপ্পান সময়ের অন্তর্বর্তী পর্যায়ে পাওয়া গেছে। এই মধ্যবর্তী পর্যায়ের মাটির তৈরী ধূসর চুড়ি, মানুষ ও প্রাণীর মূর্তি  প্রকারগতভাবে আদি হরপ্পান বা হরপ্পান কোনোটাই নয়। অথচ এই সময়ে আকস্মিক বিপর্যয়ের মাধ্যমে কোনো পরিবর্তন বা কোনো ছেদ দেখতে পাওয়া যায় না। ঢিবি ই থেকে এই দুই পর্যায়ের মধ্যে ধীরে পরিবর্তনের ইঙ্গিত পাওয়া যায়।  তবে কিছু আদি বা প্রাক-হরপ্পান বসতি হরপ্পান পর্যায়ে এসে পরিত্যক্ত হয়েছিল, সেগুলির মধ্যে মেহরগড়ের কথা আগে বলা হয়েছে। এছাড়াও হরপ্পা থেকে প্রায় ৭৪ কিলোমিটার (বা ৪৬ মাইল) দূরে জলিলপুর ও পোটওয়ার মালভূমিতে সরাইখোলায় আদি হরপ্পান বসতি পরিত্যক্ত হয়।

-------------------------------------------------------

দেখুনঃ Jonathan Mark Kenoyer, Households and Neighbourhoods of the Indus Tradition: An Overview, in, New Perspectives on Household Archaeology, eds., Bradley J. Parker and Catherine P. Foster, 2012, p. 395.

   দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ৩৯৫।

দেখুনঃ George F. Dales, Some Specialized Ceramic Studies at Harappa, in, Harappa Excvations 1986-1990: A Multidisciplinary Approach to Third Millennium Urbanism, ed., Richard H. Meadow, Prehistory Press, Madison, 1991, p. 65.  

দেখুনঃ M. Rafique Mughal, A Summary of Excavations and Explorations in Pakistan (1971 and 1972), in, Pakistan Archaeology, No. 8, 1972, pp. 117-118.

-------------------------------------------------------

 

আদি হরপ্পান সমাজ

রাবি ও কোট দিজি পর্যায়ে অনেক ছোট গ্রাম ও কিছু শহর গড়ে উঠলেও কোনোটাই হরপ্পার মত বড় ছিল না। পশুর ছবি যুক্ত পাথরের সীল, আদি হরপ্পান লিপি, কাদার তালে সীলের ছাপ, প্রমিত বাটখারা, ইত্যাদির ব্যবহার এই সময়ে জটিলতর হয়ে উঠা সমাজের বিকাশ বুঝতে সাহায্য করে। এই সময় দূর বাণিজ্য ও কারুশিল্প শুরু হয়। সেই সময় সমাজে এক ধরনের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার সূচনা হয়ে থাকতে পারে বলে মনে হয়।

 

আদি হরপ্পান মাপ ও বাটখারা

সুতা তৈরী, কাপড় বুনন ও পুতি তৈরী এই সময়ে শুরু হওয়াতে এটাই মনে করা যায় যে, বিভিন্ন জিনিসপত্রের প্রমিতকরণ এই সময়ে শুরু হয়।  প্রাথমিক পরীক্ষায় কোট দিজি ও রাবি পর্যায়ে পুতির প্রমিত আকার বা ওজন পাওয়া যায় নাই। তবে পুতিগুলির আকার ছোট বা লম্বা, বেলনাকার, ড্রাম আকৃতির হলেও দৈর্ঘ্য ও ব্যাসের অনুপাত একই ছিল। এছাড়াও এগুলির আকারে ধারাবাহিকতা বজায় ছিল। এটা বুঝা যায় যে, কারিগরদের এই প্রযুক্তি প্রয়োগের জন্য সূক্ষ্ম মাপ ব্যবহার করতে হয়েছিল। নরম পাথরের পুতিকে চূড়ান্ত আকৃতি ও ঘঝামাজা করার পর উচ্চ তাপে (৯০০° থেকে ১০০০° সেলসিয়াস) অগ্নিদগ্ধ করা হত ও পরে এগুলিকে সাদা বা নীল-সবুজ রঙে চকচকে করা হত। রাবি পর্যায়ে খুবই ছোট খড়িপাথরের পুতি (Microbead) তৈরী হত। এগুলি এত ছোট যে এর দৈর্ঘ্য ০.৭৫ মিলিমিটার ও ব্যাস ১.১ মিলিমিটার এবং ওজন ০.০০৩ গ্রাম। এইরকম ৬,১০০টি ক্ষুদ্র পুতির প্রয়োজন হত গলায় (৬১ সেঃমিঃ বা ২৪ ইঞ্চি) পরার জন্য।

-------------------------------------------------------

দেখুনঃ J. Mark Kenoyer, Measuring the Harappan world: Insights into the Indus order and cosmology, in, The Archaeology of Measurement: Comprehending Heaven, Earth and Time in Ancient Societies, eds., Iain Morley and Collin Renfrew, Cambridge University Press, Cambridge, 2010, p. 110.

দেখুনঃ J. Mark Kenoyer, Measuring the Harappan world: Insights into the Indus order and cosmology, in, The Archaeology of Measurement: Comprehending Heaven, Earth and Time in Ancient Societies, eds., Iain Morley and Collin Renfrew, 2010, p. 112.

-------------------------------------------------------

পাতা : ১৪

 

সীল ও লিপি

হরপ্পায় খড়িপাথরের একটি অসম্পূর্ণ সীল পাওয়া গেছে যেখানে হাতির ছবি আছে। এছাড়া হরপ্পায় একটি রাস্তার কাছে উনানে লিপির ছাপ দেওয়া পোড়ামাটির একটি সীলমোহর (Sealing) পাওয়া গেছে এবং কাছের একটি কক্ষে ছোট গর্তে একটি ছোট ঘনাকৃতি পাথরের বাটখারা (Cubical stone weight) পাওয়া গেছে।  গুজরাটের পাদরি নামে বসতিটিতে মৃৎপাত্রের গায়ে অংকিত হরপ্পান অক্ষর অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এই সমস্ত অঙ্কিত আঁচড়কাটা দাগ হরপ্পান অক্ষরের মত, যেগুলি আদি হরপ্পান পর্যায়ের সবচেয়ে উপরের স্তরে পাওয়া গেছে।

-------------------------------------------------------

দেখুনঃ Jonathan Mark Kenoyer, Households and Neighbourhoods of the Indus Tradition: An Overview, in, New Perspectives on Household Archaeology, eds., Bradley J. Parker and Catherine P. Foster, 2012, p. 392.

দেখুনঃ Vasant Shinde, Padri: The Early Harappan Site in Gujarat, in, Early Harappans and Indus-Sarasvati Civilization, eds., D.P. Sharma and Madhuri Sharma, Kaveri Books, New Delhi, 2006, p. 157.

-------------------------------------------------------

বালুচিস্তান থেকে পাওয়া পাত্র (খ্রীঃপূঃ ৪র্থ সহস্রাব্দের শেষ ও ৩য় সহস্রাব্দের প্রথম দিকের) (সৌজন্যেঃ Ute Franke, 2015)

 

বাণিজ্য ও যোগাযোগ

হরপ্পায় রাবি পর্যায়ে দূর পথের বাণিজ্যের প্রমাণ পাওয়া যায় সামুদ্রিক ঝিনুকের খোলা, তামার জিনিসপত্র এবং বাহির থেকে আনা বিভিন্ন ধরনের পাথরের পুতি, যেমন আমাজনাইট, কার্নেলিয়ান এবং লাপিস লাজুলির প্রাপ্যতার কারণে। কারণ এই জিনিসগুলি সবই দূর থেকে হরপ্পায় আসত।  হরপ্পায় রাবি পর্যায়ের শুরু থেকেই ৮০০-৯০০ কিলোমিটার দূরে দক্ষিণের উপকূলীয় অঞ্চলের সাথে যেমন তেমনি ৩০০-১০০০ কিলোমিটার দূরে আফগানিস্তান, বালুচিস্তান ও হিমালয়ের বিভিন্ন অঞ্চলের সাথে বাণিজ্যের সাক্ষ্য পাওয়া যায়।

-------------------------------------------------------

দেখুনঃ Jonathan Mark Kenoyer and Richard H. Meadow, Harappa: New Discoveries on its Oigins and Growth, in, Lahore Museum Bulletin, Vol. XII, No. 1, ed., Dr. Anjum Rehmani, 1999, p.2.

দেখুনঃ J. Mark Kenoyer, T. Douglas Price and James H. Burton, A new approach to tracking connections between the Indus Valley and Mesopotamia: initial results of strontium isotope analyses from Harappa and Ur, in, Journal of Archaeological Science 40, 2013, p. 2288.

-------------------------------------------------------

 

একীভবন যুগ (২৬০০ থেকে ১৯০০ খ্রীঃপূঃ)

এই যুগকে সিন্ধু সভ্যতা বা হরপ্পা সংস্কৃতি বলা হয়, এটিকে একীভবন যুগ বা হরপ্পা পর্যায়ও (Harappa Phase) বলা হয়ে থাকে।  আবার এটিকে নগর পর্যায় বা হরপ্পান পর্যায়ও বলা হয়। হরপ্পান পর্যায় হল সবচেয়ে সমৃদ্ধ পর্যায় যা বালুচিস্তান, সিন্ধু, সিন্ধু-সরস্বতী নদীর অববাহিকা এবং গুজরাট জুড়ে একই সময়ে তুলনামূলক সমরূপতা নিয়ে উদ্ভূত হয়েছিল।  ৫০০০ থেকে ২৬০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত বিভিন্ন অঞ্চলে যে সকল বসতি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য নিয়ে বিকাশ লাভ করছিল তা একই সাথে এই সময়ে পরিপূর্ণতা লাভ করে।  অনুমান করা যায় যে, হরপ্পান পর্যায়ে এমনভাবে একটি কেন্দ্রে এই সকল আঞ্চলিক সত্তার সমন্বয় ঘটেছিল যা সমগ্র অঞ্চলকে অনেক বিভিন্নতা ও বৈচিত্র্যের মধ্যেও বৃহত্তর পরিসরে  একটি অভিন্ন অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও আদর্শিক ব্যবস্থা দান করে। একটি তুলনামূলক সমরূপ মৃৎপাত্র শৈলী ও কিছু ধর্মীয় প্রতীক সহ অন্য ধরনের বস্তুগত সংস্কৃতি একটি তুলনামূলক সমরূপতা নিয়ে বৃহত্তর সিন্ধু উপত্যকায় ৩০০০ এরও বেশী বসতিতে ছড়িয়ে গিয়েছিল। এই যুগের নগর বা বড় শহরের মধ্যে মহেঞ্জো-দাড়ো (২৫০ হেক্টর বা ৬১৮ একর), হরপ্পা (১৫০ হেক্টর বা ৩৭১ একর), রাখিগাড়ি (১০০ হেক্টর বা ২৪৭ একর), গানেরিওয়ালা (৪০ হেক্টর বা ৯৯ একর), লাখাঞ্জোদাড়ো (সম্ভবত ৩০০ হেক্টর বা ৭৪১ একর), ধোলাভিরা (১০০ হেক্টর বা ২৪৭ একর), কালিবঙ্গান (১৪ হেক্টর বা ৩৫ একর) ও লোথাল (৭.৫ হেক্টর বা ১৯ একর) অন্যতম।  এছাড়া ছিল নৌশারো (+৪ হেক্টর বা ১০ একর)।

-------------------------------------------------------

দেখুনঃ J. Mark Kenoyer, Measuring the Harappan world: Insights into the Indus order and cosmology, in, The Archaeology of Measurement: Comprehending Heaven, Earth and Time in Ancient Societies, eds., Iain Morley and Collin Renfrew, 2010, p. 109.

সিন্ধু সভ্যতার বৈশিষ্ট্যকে এভাবে সজ্ঞায়িত করেন কিছু গবেষকঃ “A defining characteristic of the Indus Civilization, for example, is the distribution of a relatively homogeneus corpus of distinctive material culture throughout regions of India and Pakistan that were more or less materially disctinct during earlier periods." দেখুনঃ Brad Chase, P. Ajithprasad, S.V. Rajesh, Ambika Pate & Bhanu Sharma, Materializing Harappan identities: Unity and diversity in the borderlands of the Indus Civilization, in, Journal of Anthropological Archaeology 35, 2014, p. 63.     

দেখুনঃ Vasant Shinde, Regional Diversity of the Harappan Culture in the Ghaggar Basin, in, Purāttva, No. 45, 2015, p. 82.

দেখুনঃ Jonathan M. Kenoyer, The Archaeological Heritage of Pakistan: From the Palaeolithic to the Indus Civilization, in, ed., Roger D. Long, A History of Pakistan, 2015, p. 41.

-------------------------------------------------------

হরপ্পান অঞ্চলে বসতিগুলিতে আঞ্চলিক বৈসাদৃশ্য ছিল এবং এখানে তিন ধরনের ভিন্নতা দেখা যায়। ভারতের যে সমস্ত প্রদেশে হরপ্পান পর্যায়ের বসতি পাওয়া গেছে সেগুলি হল হরিয়ানা, গুজরাট, পাঞ্জাব (ভারতীয়), উত্তর প্রদেশ, রাজস্থান, চন্ডীগড়, হিমাচল প্রদেশ, দিল্লী ও জম্মু।  প্রাথমিক ধারণা পাওয়ার জন্য সিন্ধু সভ্যতার নগর ও শহরগুলি সম্পর্কে নীচে আলোচনা করা হল।

-------------------------------------------------------

 দেখুনঃ Vasant Shinde, Toshiki Osada, M.M. Sharma, Akinori Uesugi, Takao Uno, Hideaki Maemoku, Prabodh Shirvalkar, Shweta Sinha Deshpande, Amol Kulkarni, Amrita Sarkar, Anjana Reddy, Vinay Rao and Vivek Dangi, Exploration in the Ghaggar Basin and excavations at Girawad, Farmana (Rohtak District) and Mitathal (Bhiwani District), Haryana, India, in, Linguistics, Archaeology and the Human Past, ed., Toshiki Osada and Akinori Uesugi, Occasional Paper 3, Research Institute for Humanity and Nature, Kyoto, 2008, p. 77.

-------------------------------------------------------

পাতা : ১৫

 

মহেঞ্জো-দাড়ো

মহেঞ্জো-দাড়ো পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশের লারকানা জেলায় অবস্থিত। মহেঞ্জো-দাড়ো নগরটি দু’টি ঢিবির উপর প্রতিষ্ঠিত। পশ্চিম দিকে যে উঁচু নগর আছে তাকে নগরদুর্গ বলে। এটি উত্তরের সমভূমি থেকে ১২ মিটার উঁচু। এখানে ঐতিহাসিক যুগের একটি বৌদ্ধ স্তূপ ও মঠ আছে। এই ঢিবিটির চারিপাশে কাদা-মাটির ইটের তৈরী ভারী দেওয়াল বা উঁচু সমতলভূমি আছে যা এখন ক্ষয় হয়ে চারিপাশের সমভূমির সাথে মিশে গেছে। নগরদুর্গের দক্ষিণপূর্ব কোণায় একটি প্রবেশদ্বারের অস্তিত্বের কথা প্রত্নতাত্ত্বিক হুইলার উল্লেখ করেছেন। পূর্ব দিকে অবস্থিত নীচু নগরটি নীচু ঢিবির উপর অবস্থিত। এই অংশটি ৮০ হেক্টরেরও বেশী এলাকা জুড়ে বিস্তৃত। নীচু নগরে বাড়ী-ঘর ও রাস্তা সুপরিকল্পিতভাবে বিন্যস্ত। এখানে প্রধান দু’টি রাস্তার একটি পূর্ব-পশ্চিমে ও অপর রাস্তাটি উত্তর-দক্ষিণে প্রসারিত। প্রধান রাস্তাটি ৯.১৫ মিটার প্রশস্ত। এছাড়াও প্রধান রাস্তা থেকে বের হওয়া অনেক গলি আছে যেগুলি ২.২৫ মিটার প্রশস্ত। নগরটি ১২টি ব্লকে বিভক্ত ছিল যার মধ্যে ৭টিকে পরিষ্কার চিহ্নিত করা যায়। এখানে বাড়ীগুলি একটি মধ্যবর্তী উঠানের চারপাশে বিন্যস্ত ছিল।    

মহেঞ্জো-দাড়োর নগরদুর্গ বা উঁচু নগরে একটি ‘মহা-স্নানাগার’ (Great Bath) ও আরো কিছু বড় অনাবাসিক ভবন আছে। প্রত্নতাত্ত্বিকরা এগুলির যেসব নাম দিয়েছেন সেগুলির মধ্যে রয়েছে ‘শস্যাগার’ বা ’মহা-মিলনায়তন’, ‘পুরোহিতদের প্রতিষ্ঠান’ (College of Priests), ‘সমাবেশের জন্য মিলনায়তন’ (Assembly Hall) বা ‘স্তম্ভযুক্ত মিলনায়তন’ (Pillared Hall)।

মহেঞ্জো-দাড়ো সম্পর্কে এখন মনে করা হয় যে, এটিকে একটি পরিকল্পিত নগর হিসাবে অল্প সময়ে নির্মাণ করা হয়েছিল।  মহেঞ্জো-দাড়োতে কিছু বাড়ীর দেওয়ালের পুরুত্ব ও উপরে উঠার সিঁড়ির অস্তিত্ব থেকে মনে করা হয় যে সেখানকার কিছু বাড়ী দোতলা ছিল। তবে কত তলা বিশিষ্ট ছিল সেটি নিরূপণ করা না গেলেও অন্তত দোতলা হবার সম্ভাবনার দিকটি মোটামুটি স্পষ্ট।

-------------------------------------------------------

দেখুনঃ D.P. Agrawal, The Indus Civilization: An Interdisciplinary Perspective, Aryan Books International, New Delhi, 2007, p. 65.

-------------------------------------------------------

প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানের ফলে জানা যাচ্ছে যে, মহেঞ্জো-দাড়োর চারিদিকে বেশ কিছু নগর গড়ে উঠেছিল। বর্তমানে তিনটি নগর ও একটি শিল্পের কাঁচামালের উৎস সম্পর্কে জানা যাচ্ছে। এগুলি হল দক্ষিণপূর্বে চানহুদাড়ো, উত্তরপূর্বে লাখাঞ্জোদাড়ো ও উত্তরপশ্চিমে জুদার্জোদাড়ো (Juderjodaro) এবং পূর্ব দিকে রোহ্রি পাহাড়শ্রেণী। এই সমস্ত কেন্দ্রসমূহ সিন্ধু প্রদেশের মধ্যে ও বাইরে বিভিন্ন জিনিসপত্র তৈরী বা সরবরাহ করত।

-------------------------------------------------------

দেখুনঃ Qasid H. Mallah, Recent archaeological discoveries in Sindh, Pakistan, in, Current Studies on the Indus Civilization, Volume I, eds., Toshiki Osada and Akinori Uesugi, Manohar Publishers & Distributers, New Delhi, 2010, pp. 60-61.

-------------------------------------------------------

বৃহত্তর সিন্ধু উপত্যকায় প্রধান বসতিসমূহ (সৌজন্যেঃ Rajesh S.V., 2018)


সিন্ধু সভ্যতার বসতিসমূহের বিস্তার (সাদা বিন্দু) এবং খননকৃত বসতিসমূহ (লাল বিন্দু) (সৌজন্যেঃ Akinori Uesugi, 2018)

উপর থেকে দেখা মহেঞ্জো-দাড়োর নগরদুর্গে অবস্থিত ’গ্রেট বাথ’ ও সন্নিহিত ভবনসমূহ (সৌজন্যেঃ Ute Franke and Elisa Cortesi, 2015)

পাতা : ১৬

মহেঞ্জো-দাড়োয় খননকৃত কুয়ার স্তম্ভ (সৌজন্যেঃ Ute Franke, 2015)

(ক) মহেঞ্জো-দাড়োঃ একজন নৃত্যরত নারীর ব্রোঞ্জের মূর্তি; (খ) মহেঞ্জো-দাড়োঃ পোড়ামাটির নারী মূর্তি (সৌজন্যেঃ A.H. Dani and B.K. Thapar, 1996)

মহেঞ্জো-দাড়োঃ পোড়ামাটির খেলনা গাড়ী (সৌজন্যেঃ A.H. Dani and B.K. Thapar, 1996)

মহেঞ্জো-দাড়োর নগর পরিকল্পনা এবং তিনটি এলাকা (ক) ’গ্রেট-বাথ’-এর ঢিবি, (খ) ডিকে এলাকা, এবং (গ) এইচআর-এলাকার দৃশ্য। প্রতিটি এলাকাতেই বৈশিষ্ট্যপূর্ণ বৃহদায়তন ভবন আছে, এবং সবগুলি একই স্কেলে দেখানো হয়েছে (সৌজন্যেঃ Cameron A. Petrie, 2019)

পাতা : ১৭

 

হরপ্পা

হরপ্পার অবস্থান পাঞ্জাবের রাবি নদীর কাছে। হরপ্পা নগরটি কয়েকটি প্রাচীর ঘেরা এলাকা নিয়ে একটি নীচু জায়গার চারপাশে বিন্যস্ত ছিল। এই নীচু এলাকাটি বড় কোনো জলাধার হতে পারে। হরপ্পায় মোট চারটি প্রধান ঢিবি আছে। এগুলি হল এফ, এবি, ই এবং ইটি, এবং ঢিবি এবি-এর সাথে সংযুক্ত এর পশ্চিমে একটি নীচু ঢিবি। এর প্রতিটি ঢিবি কাদা-মাটির ইটের পুরু দেওয়াল দিয়ে ঘেরা ছিল। প্রতিটি নগর-প্রাচীরের ইটের তৈরী দরজা ছিল ও প্রতিটি প্রাচীরের পাশে কিছু দূর পর পর বুরুজ ছিল। এখানকার প্রধান দরজা দক্ষিণ দিকে একটি বড় বাঁকবিশিষ্ট দেওয়ালে পোড়া মাটির ইট দিয়ে নির্মাণ করা হয়েছিল। এই বাঁকা দেওয়ালটির ভিতর দিকে একটি বড় উন্মুক্ত স্থান ছিল যা বড় বাজার বা খোলা জায়গা হতে পারে। এই দরজাটি মাত্র ২.৮ মিটার চওড়া ছিল, যাতে কেবলমাত্র একটি গরুর গাড়ী চলাচল করতে পারে। এই দরজাটির উপরিভাগ সম্ভবত ঢাকা ছিল। দরজাটি থেকে পূর্ব দিকে একটি বড় রাস্তা উত্তর দিকে নগরের কেন্দ্রে চলে গেছে, যেখানে খোলা (Shell) ও আকিক (Agate) পাথরের কারখানা থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে। পশ্চিম দিকে আরেকটি কারখানা আছে যেখানে তামাশিল্পের উপস্থিতির প্রমাণ পাওয়া গেছে।

হরপ্পায় নগর পর্বের বিকাশ তিনটি উপ-পর্বে হয়েছে। এগুলি হল পর্ব ৩এ (২৬০০ খ্রীঃপূঃ - ২৪৫০ খ্রীঃপূঃ), ৩বি (২৪৫০ খ্রীঃপূঃ - ২২০০ খ্রীঃপূঃ) ও ৩সি (২২০০ খ্রীঃপূঃ - ১৯০০ খ্রীঃপূঃ)। পর্ব ৩এ-তে ঢিবি ই-এর প্রত্নতাত্ত্বিক সাক্ষ্য থেকে কেনোয়ার মনে করেন এখানে প্রাধান্যশীল অভিজাত শ্রেণীর প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। পর্ব ৩বি-তে এই প্রাধান্য পশ্চিম দিকের ঢিবি এবি-তে সরে যায়। এই সময়ে ঢিবি এফ-এ ‘শস্যাগার’ বা ‘মহা-মিলনায়তন’ Great Hall) তৈরী হয়। এই নগরটির সর্বোচ্চ বিস্তার হয় পর্ব সি অর্থাৎ ২২০০ খ্রীঃপূঃ-এর পর। কিন্তু এই সময়ে রাস্তায় ও বিভিন্ন ভবনে আবর্জনা ফেলার সাক্ষ্য পাওয়া যায়। অতিরিক্ত জনসংখ্যা ও নগরে নিয়ন্ত্রণের অভাবের জন্য এটি ঘটতে পারে।

হরপ্পায় প্রাচীন ভূমি জরিপ করে গবেষকরা বলছেন যে, এখানকার অধিবাসীরা প্রথম যখন এখানে বসতি স্থাপন করে তখন তারা সতর্কভাবে ভূমি বাছাই করে ও এখানকার সবচেয়ে উঁচু ভূমি বেছে নেয়, যাতে তারা বন্যার কবলে না পড়ে।

-------------------------------------------------------

দেখুনঃ Wayne R. Belcher and William R. Belcher, Geologic Constraints on the Harappa Archaeological Site, Punjab Province, Pakistan, Geoarchaeology: An International Journal, Vol. 15, No. 7, 2000, pp. 696-698.

-------------------------------------------------------

হরপ্পান পর্যায়ে সাধারণভাবে নগর পরিকল্পনার প্রমাণ পাওয়া যায়। যদিও নগর প্রাচীরের মাপ অথবা দিক বিবেচনায় কোনো প্রমিতকরণ দেখতে পাওয়া যায় না। প্রধান রাস্তাগুলি নগরটিকে পূর্ব থেকে পশ্চিমে এবং উত্তর থেকে দক্ষিণে ভাগ করেছে। অধিকাংশ রাস্তা ৪ থেকে ৫ মিটার চওড়া, কিছু রাস্তা আরো চওড়া। হরপ্পার মত আরো কিছু বসতির প্রধান নগর দরজা, রাস্তা ও নগর প্রাচীরের বিন্যাস থেকে মনে হয় যে, মানুষ ও গরুগাড়ীর প্রবেশ ও চলাচলের বিষয়টি অর্থাৎ ব্যবহারিক প্রয়োজনকে মাথায় রেখেই সাধারণভাবে সিন্ধুর বসতিগুলোর বিন্যাস ও পরিকল্পনা করা হত।

-------------------------------------------------------

দেখুনঃ J. Mark Kenoyer, Measuring the Harappan world: Insights into the Indus order and cosmology, in, The Archaeology of Measurement: Comprehending Heaven, Earth and Time in Ancient Societies, eds., Iain Morley and Colin Renfrew, Cambridge University Press, Cambridge, 2010, p. 120.

-------------------------------------------------------

নগরপ্রাচীরের বাইরে প্রায় ৩০ মিটার দূরে হরপ্পান যুগের একটি ছোট ঢিবি আছে। সেখানে বাড়ী, নর্দমা, স্নানের মঞ্চ এবং একটি কুয়া ছিল। কেনোয়ার মনে করেন এটি ভ্রমণযাত্রীদের বিশ্রাম ও থাকার জন্য পান্থশালা হতে পারে।  ঢিবি ই-এর দ্বিতীয় প্রধান দরজাটি অনেক জটিল এবং এটি পূর্ব দিকে প্রায় ২০০ মিটার দূরে অবস্থিত। দরজাটির প্রকৃত উন্মুক্ত স্থান মোটে ২.৬ মিটার।

-------------------------------------------------------

দেখুনঃ Jonathan Mark Kenoyer, Ancient Cities of the Indus Valley Civilization, 1998, p. 55.

-------------------------------------------------------

হরপ্পার অন্য একটি ঢিবি, যা ঢিবি এবি নামে পরিচিত। এর নিজস্ব প্রাচীর ও দরজা আছে। ঢিবি ই-এর চেয়ে এর প্রাচীর অনেক বড় ও উঁচু ছিল। এই প্রাচীরটি গোড়ায় ১৪ মিটার চওড়া ও আশেপাশের সমতল ভূমির চেয়ে ১১ মিটার উঁচু। বিভিন্ন যুগে দেওয়ালটির পশ্চিম দিকে তিনটি ছোট দরজা নির্মাণের কথা হুইলার উল্লেখ করেছেন। এর উত্তর দিকে একটি তুলনামূলক বড় দরজা ছিল যেখান থেকে সিঁড়ি নীচের দিকে তুলনামূলক নীচু প্রান্তবর্তী এলাকার দিকে নেমে গেছে। এই নীচু এলাকাটি ঢিবি এফ নামে পরিচিত।

হরপ্পায় বিভিন্ন ঢিবি বা প্রাচীর ঘেরা এলাকা নগরের বিকাশের সাথে বৃদ্ধি পেয়েছে। তারা সবাই একই সংস্কৃতির ধারক ও বাহক ছিল। সমস্ত ঢিবি থেকেই রঙিন মৃৎপাত্র, মাটির মূর্তি, উৎকীর্ণ সীল এবং নানা ধরনের অলংকার আবিষ্কৃত হয়েছে ও এক এলাকার জিনিসপত্র অন্য এলাকায় পাওয়া গেছে।  তবে এটি এখনো পরিষ্কার নয় যে, কীভাবে এই পৃথক এলাকাগুলি বিকশিত হয়েছে এবং তাদের রাজনৈতিক সংগঠনের রূপ কী ছিল।

-------------------------------------------------------

দেখুনঃ Jonathan Mark Kenoyer, Ancient Cities of the Indus Valley Civilization, 1998, p. 55.

-------------------------------------------------------

হরপ্পার কবরস্থানে পাওয়া কিছু নরকংকালের দাঁতের স্ট্রনশিয়াম বিশ্লেষণ করে জানা যাচ্ছে যে, সেখানে প্রাপ্ত বেশীরভাগ নারীই স্থানীয়, কিন্তু তাদের সাথে সংশ্লিষ্ট নিকটস্থ কবরে প্রাপ্ত বেশীরভাগ পুরুষই অস্থানীয়।  এতে মনে করা হয় যে, হরপ্পায় সিন্ধু উপত্যকা ও এর বাইরের জনগোষ্ঠীর লোকজনও বসবাস করত। তবে সাধারণভাবে লেখকরা মনে করেন যে, সিন্ধুতে পাওয়া অল্প কিছু মেসোপটেমীয় জিনিসপত্র ও শিল্পরীতি থেকে বিদেশী লোকজন সিন্ধুর নগরগুলিতে বসবাস করত এটি জোরালোভাবে বলা যায় না।  সিন্ধু ও মেসোপটেমিয়া উভয় সভ্যতার উপর আরো গবেষণা এই বিষয়টির উপর পরিষ্কার ধারণা পেতে সাহায্য করবে।

-------------------------------------------------------

দেখুনঃ J. Mark Kenoyer, T. Douglas Price and James H. Burton, A new approach to tracking connections between the Indus Valley and Mesopotamia: initial results of strontium isotope analyses from Harappa and Ur, Joirnal of Archaeological Science 40 (2013), pp. 2295-2296.

দেখুনঃ Sharri R. Clark, Deconstructing the ‘Harappan Courtiers’: A Re-evaluation of Some of the Anthropomorphic Terracotta Figurines from Harappa, in, Intercultural Relations between South and Southwest Asia, eds., E. Olijdam & R.H. Spoor, BAR International Series 1826, 2008, p. 171.

-------------------------------------------------------

হরপ্পার ১৯৯০ সালের বসতির পরিকল্পনা, খননের স্থানসমূহ দেখানো হয়েছে (সৌজন্যেঃ Jonathan Mark Kenoyer, 1991)

হরপ্পায় ঢিবি এবি-এর কাদা-মাটির ইটের তৈরী কেল্লার ছেদকৃত দৃশ্য (সৌজন্যেঃ Jonathan Mark Kenoyer, 1991; redrawn from Wheeler, 1946)

পাতা : ১৮

 

রাখিগাড়ি

রাখিগাড়ি ভারতের হরিয়ানা রাজ্যের হিসার জেলায় দৃষদ্বতী নদীর ডান বা উত্তর তীরে  অবস্থিত। এখানে আদি হরপ্পান ও হরপ্পান পর্যায়ের বসতি পাওয়া গেছে। এই বসতিটি ১৭ মিটার উঁচু। এখানকার নগরদুূর্গের ঢিবিটি (আরজিআর-২) বসতিটির পশ্চিম দিকে। এখানকার বসতির ঢিবিতে (আরজিআর-১) প্রধান রাস্তাটি উত্তর-দক্ষিণে চলে গেছে, যার সাথে পশ্চিম দিক থেকে আরেকটি রাস্তা যুক্ত হয়েছে। এখানে জহুরীর কর্মশালা (Lapidary workshop) পাওয়া গেছে। নগরদুর্গের (আরজিআর-২) ঢিবিটিতে একটি পরিবেষ্টনকারী দেওয়াল  দৈর্ঘ্যে ২৫ মিটার ও প্রস্থে ১২ মিটার) ও দক্ষিণ-পশ্চিমে পোড়া-মাটির ইটের তৈরী একটি প্রবেশ পথ পাওয়া গেছে। নগরদুর্গের মূল এলাকাতে উঁচু সমভূমি ও ইটের তৈরী কুয়া আছে। অন্য একটি ঢিবিতে (আরজিআর-৪) মঞ্চ বা উঁচু সমভূমির কাঠামো ও উত্তর-দক্ষিণে বিন্যস্ত রাস্তার অস্তিত্ব ছিল। আরেকটি ঢিবিতে (আরজিআর-৫) হাড় ও হাতির দাঁতের শিল্প কর্মের সাক্ষ্য পাওয়া গেছে। অন্য একটি ঢিবিতে (আরজিআর-৭) হরপ্পান পর্য়ায়ের কবরখানা ছিল। এখানে আয়তাকার গর্তে প্রসারিত অবস্থায় কবরস্থ (Extended burial) করার রীতি দেখা গেছে। মৃতের মাথা সামান্য উঁচু অবস্থায় উত্তর দিকে ও পূর্ব দিকে কাত অবস্থায় (পশ্চিম দিকে কাত করা অবস্থায় অল্প কিছু ব্যতিক্রম দেখা গেছে) কবরস্থ করা হত।  অধিকাংশ ক্ষেত্রে মৃতের মাথার পিছনে সমাধি-দ্রব্য হিসাবে মৃৎপাত্র ও হাড়ি দেওয়া হত।

-------------------------------------------------------

দেখুনঃ Amarendra Nath, Rakhigarhi: 1999-2000, in, Puratattva, No. 31, 2000-2001,2001, p. 45.

-------------------------------------------------------

ঘাগর অববাহিকায় খননকৃত বসতিসমূহ (সৌজন্যেঃ Vasant Shinde, Toshiki Osada, Akinori Uesugi and Manmohan Kumar, 2008)

বনওয়ালীতে পাওয়া অগ্নি-বেদীর মত বেদী এখানেও পাওয়া গেছে। এখানে চকচকে চীনা মাটির (Faience) বেলনাকার একটি সীলে কুমীর (Alligator) ও দু’টি পোড়ামাটির কবচে (Amulet) হাতির ছবি, সোনার চুলের কাঁটা (Fillet) ও পুতি, রূপা, তামা ও খোলার চুড়ি, ইত্যাদি পাওয়া গেছে।

পাকিস্তান অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নস্থলের মানচিত্র (সৌজন্যেঃ Ute Franke, 2015)

 

গানেরিওয়ালা

পাকিস্থানের পাঞ্জাবের হাকরা নদীর তীরে (যা এক সময়ে প্রাচীন সরস্বতী নদী ছিল) অবস্থিত। সম্প্রতি এর উপরের স্তর পরীক্ষা করে কালপর্ব ২৩০০-১৯০০ খ্রীঃপূঃ-এর মধ্যে পাওয়াতে ধারণা করা হচ্ছে যে এখানে হরপ্পান পর্যায়ের শেষের দিকে বসতি স্থাপন করা হয়েছিল।  এটির এখনো কোনো প্রত্নতাত্ত্বিক খনন করা হয় নাই, কেবল মাত্র উপরিভাগে জরিপ করা হয়েছে। ফলে গানেরিওয়ালা সম্পর্কে বেশী তথ্য পাওয়া সম্ভব নয়।

-------------------------------------------------------

 দেখুনঃ Jonathan Mark Kenoyer, New Perspectives on the Indus Tradition: Contributions from Recent Research at Harappā and Other Sites in Pakistan and India, in, Sindhu-Sarasvatī Civilization: New Perspectives, ed., Nalini Rao, 2014, p. 502.

-------------------------------------------------------

লাখাঞ্জোদাড়ো

সিন্ধু প্রদেশে লাখাঞ্জোদাড়ো নামে বসতিটির অবস্থান রোহ্রি পাহাড়ের উত্তর প্রান্তে সিন্ধু নদীর ডান তীরে। এই বসতিটি বেশ কিছু ঢিবি নিয়ে ১ বর্গ কিলোমিটারের চেয়ে বড় জায়গা জুড়ে বিস্তৃত।  যদিও এর অনেক অংশই পলির নীচে ঢাকা এবং উপরিভাগ আধুনিক লোকজন ও শিল্পকারখানার দখলে। এখানে খনন করে বিপুল সাংস্কৃতিক দ্রব্যসম্ভারসহ বাড়ীঘরের দেওয়াল, মেঝে, ঢাকনাযুক্ত নর্দমা, পোড়া মাটির ইটের তৈরী মঞ্চ বা উঁচু সমতল স্থান, স্নানের মঞ্চ, ও বর্গাকার কাদা-মাটির ইটের মঞ্চ পাওয়া গেছে। উৎপাদনের জন্য কর্মশালায় পাওয়া গেছে সাদা মিশ্রণ দেওয়া ক্ষুদ্রাকার পুতি (White-paste micro beads), তামার জিনিসপত্র ও তামার মূর্তি, উপরত্ন পাথরের পুতি (Semiprecious stone beads), মসৃণ করার জিনিস (Polisher) এবং বিপুল পরিমাণ বিভিন্ন প্রকারের পোড়া মাটির জিনিসপত্র। সেখানে খড়িপাথর, তামা ও পোড়া মাটির সীল, মানুষ ও পশুর মূর্তি, পুতি, চুড়ি, পিঠাকৃতি বস্তু (Cake), খেলনার গরুগাড়ীর কাঠামো ও চাকা, পাথরের বাটখারা, তামার বল্লমের ফলা, ছুরি ও দণ্ড, এবং তামার পুতির সাথে যুক্ত কার্নেলিয়ান পাথরের পুতি পাওয়া গেছে। এখানে আরো পাওয়া গেছে পোড়া মাটির ইটের তৈরী ঘরের দেওয়াল ও পোড়া মাটির টালির তৈরী মেঝে।

-------------------------------------------------------

দেখুনঃ Qasid H. Mallah, Recent archaeological discoveries in Sindh, Pakistan, in, Current Studies on the Indus Civilization, Volume I, eds., Toshiki Osada and Akinori Uesugi, Manohar Publishers & Distributers, New Delhi, 2010, p.49.

দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ৫২-৫৩।

-------------------------------------------------------

পাতা : ১৯

 

ধোলাভিরা

 ধোলাভিরা গুজরাটের কচ্ছের রানে অবস্থিত। এটি নগরদুর্গ, মধ্যবর্তী নগর, নীচু নগর ও দু’টি স্টেডিয়াম নিয়ে গঠিত। এখানে নগরদুর্গটি শহরের দক্ষিণ দিকে অবস্থিত। কালিবঙ্গান ও সুরকোটডার মত এর দু’টি সংযুক্ত উপবিভাগ আছে। নগরদুর্গের উত্তর দিকে চওড়া ও দীর্ঘ ভূমিখণ্ড আছে যেটা উৎসব বা বিশেষ অনুষ্ঠানের জন্য সর্বসাধারণের মিলনস্থান হিসাবে এবং বাৎসরিক মেলার সময় কেনাকাটার স্থান হিসাবে ব্যবহৃত হত বলে মনে করা হয়।  এখানে দুই পাশে জনসাধারণের বসার জায়গা ছিল। আরো উত্তরে প্রাচীর ঘেরা মধ্য নগর এবং পূর্ব দিকে নীচু নগর ছিল। নীচু নগর আলাদাভাবে প্রাচীর দিয়ে ঘেরা না থেকে সমগ্র নগরব্যাপীই সীমানা প্রাচীর ছিল। নগরের উত্তর দরজার পাশের দু’টি কক্ষের একটিতে বড় আকৃতির দশটি সিন্ধু লিপি বা চিহ্ন পাওয়া গেছে। এটি ধ্বসে পড়া সাইনবোর্ড বলে মনে করা হয়। কাঠের তক্তার উপর লিপিগুলি খোদাই করে জিপসাম দিয়ে ভরাট করা হয়েছিল। এই লেখাগুলো এত বড় যে (প্রায় ৩৭ সেঃমিঃ উচ্চতা ও ২৫ থেকে ২৭ সেঃমিঃ প্রশস্ত), সমস্ত নগর থেকে দেখা যেত। এটিকে এ পর্যন্ত প্রাপ্ত পৃথিবীর প্রথম সাইনবোর্ড বলা যায়।

-------------------------------------------------------

   আর,এস, বিশ্ট্ এটিকে পৃথিবীর প্রথম স্টেডিয়াম হিসাবে উল্লেখ করেছেন। দেখুনঃ R.S. Bisht, Dholavira and Banawali: Two different Paradigms of the Harappan Urbis Forma, in, Purātattva, N0. 29, 1999, pp. 31-32.  

দেখুনঃ R.S. Bisht, Dholavira: New Horizons of the Indus Civilization, in, Purāttva, Number 20: 1989-90, 1991, p. 61.

-------------------------------------------------------

এই নগরের নর্দমা ব্যবস্থা খুবই উন্নত ছিল। প্রত্নতাত্ত্বিক আর,এস, বিশ্ট্ উল্লেখ করেছেন যে, নগরদুূর্গ থেকে বৃষ্টির জল জলাধারে সংরক্ষণ করার জন্য খুবই কার্যকর ব্যবস্থা গড়ে তুলা হয়েছিল। সমস্ত নর্দমা সতর্কতার সাথে তৈরী করা হয়েছিল। পাথরের তৈরী মসৃণ মেঝে, দুই পাশে দেওয়াল ও ছাদ এবং অল্প দূর পর পর ছাদের উপর ছোট ছিদ্রের ব্যবস্থা ছিল। এগুলি যদিও বেশ সংকীর্ণ তবু সাধারণ উচ্চতার একজন মানুষ এই সব ছিদ্র দিয়ে নীচে নেমে যেতে পারে এবং নর্দমা পরিষ্কার করতে পারে। হরপ্পান পর্যায়ে সেখানকার অধিবাসীরা নগর প্রাচীরের ভিতর বিভিন্ন মাপের ষোল বা ততোধিক জলাধার তৈরী করেছিল। এই সব জলাধার থেকে নগরবাসীরা একদিকে তাদের ব্যবহার্য জলের সরবরাহ পেত আর অন্য দিকে কৃষিকাজে সেচের জন্য জল সরবরাহ হত। সেখানে খননে দু’টি জলাধারের চমৎকার নিদর্শন পাওয়া গেছে। এর একটির উত্তর দিকে অবস্থিত বাঁধ থেকে ৩১টি সিঁড়ির ধাপ নীচে তলদেশ পর্যন্ত চলে গেছে। এখানকার বাঁধ ও সিঁড়িগুলি পাথরের তৈরী এবং এগুলি অত্যন্ত উঁচু মানের কারিগরী দক্ষতার পরিচয় দেয়।  এখানে মধ্যবর্তী নগর, নীচু নগর এবং সংযুক্ত স্থানে ঘরের ময়লা নিষ্কাশন করার জন্য রাস্তার পাশে চাড়ি বা চৌবাচ্চা বসানোর প্রমাণ পাওয়া গেছে, যা সমসাময়িক অনেক হরপ্পান নগরে ছিল।

-------------------------------------

  দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ২০-২১।

-------------------------------------

 

কালিবঙ্গান

কালিবঙ্গান নগরটি পশ্চিম দিকে তুলনামূলক ছোট ঢিবির উপর নগরদুূর্গ ও পূর্ব দিকে কিছু বড় ঢিবির উপর নীচু নগর নিয়ে গঠিত। নগরের উভয় অংশই প্রাচীর ঘেরা ছিল। নগরদুূর্গটি আবার মাঝ বরাবর প্রাচীর দিয়ে উত্তর ও দক্ষিণ সমানভাবে ভাগ করা। নগরদুূর্গের দক্ষিণ অংশটি খুবই ভারী দেওয়াল ঘেরা। এখানে পাঁচ থেকে ছয়টি বড় মঞ্চ ছিল যেগুলির উপর ‘অগ্নি-বেদী’, ইট দিয়ে বাঁধানো গর্ত ছিল যার মধ্যে গবাদি পশুর হাড় ও বারশিংগা হরিণের শিঙ পাওয়া গেছে।  যদিও এটি অগ্নিবেদী নয় বরং চুলা বলে অন্য লেখকরা মত প্রকাশ করেছেন। পাশে কুয়া ও নর্দমাও ছিল। নগরদুূর্গের উত্তরের অংশে ঘরবাড়ী ছিল, যেগুলি সম্ভবত উচ্চ শ্রেণী বা শাসকশ্রেণীর ছিল। দু’টি অংশেরই পরস্পরের যোগাযোগের জন্য প্রবেশপথ ছিল। বাড়ী-ঘরগুলি কাদা-মাটির ইটের ছিল, যার মাপ ছিল ৩০ X ১৫ X ৭.৫ সেঃমিঃ। নগরের রাস্তায় কোনো নর্দমা দেখা যায় নাই। তবে ঘরের নর্দমাগুলি থেকে ময়লা রাস্তার নীচে প্রোথিত শুষে নিবার পাত্রে (Soakage jar) গিয়ে পড়ত। নগরের প্রধান দু’টি অংশ ছাড়াও নীচু নগরের পূর্ব দিকে কিছু অবকাঠামো পাওয়া গেছে যেগুলি পূজায় ব্যবহৃত হত বলে প্রত্নতাত্ত্বিক বি,বি, লাল উল্লেখ করেছেন।

-------------------------------------------------------

খননকারী বি,বি, লাল এগুলিকে অগ্নিবেদী বললেও অন্যান্য লেখকরা একে সাধারণ চুলা বলে মনে করেন।

দেখুনঃ B.B. Lal, Some Reflections on the Structural Remains at Kalibangan, in, Frontiers of the Indus Civilization, eds., B.B. Lal and S.P. Gupta, 1984, p. 57.

  দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ৫৭।

-------------------------------------------------------

কালিবঙ্গানের নগর পরিকল্পনা (সৌজন্যেঃ A.H. Dani and B.K. Thapar, 1996)

 

চানহুদাড়ো

পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশে সিন্ধু নদীর বাম তীরে চানহুদাড়ো নামে বসতিটির অবস্থান। চানহুদাড়োর বসতিটির সাথে মহেঞ্জো-দাড়োর বসতিটির কাঠামোগত ও সাংস্কৃতিক প্রচুর মিল পাওয়া যায়। এখানে বাড়ীগুলি পোড়া-মাটির ইটের তৈরী যেগুলির সাথে স্নানাগার ও নর্দমাব্যবস্থা যুক্ত ছিল। রাস্তা ও গলিগুলি বিভিন্ন ভবনের ব্লকগুলিকে আলাদা করেছিল ও নগরে সহজে প্রবেশের ব্যবস্থা করেছিল। চানহুদাড়ো সীল, কার্নেলিয়ান পাথরের পুতি ও তামা/ব্রোঞ্জের মূর্তি নির্মাণের জন্য বিখ্যাত। এখানকার কিছু পুরুষ মূর্তির সাথে মেসোপটেমিয়ার নিপ্পুরের মিল পাওয়া যায়। ব্যাপক ভিত্তিক শিল্পদ্রব্য উৎপাদনের জন্য এই বসতিটিকে আঞ্চলিক শিল্পের কেন্দ্র হিসাবে ধরা যায়, যার সাথে আঞ্চলিক ও বৈদেশিক যোগাযোগ ছিল।  হরপ্পায় পাওয়া মৃৎপাত্রের শৈলী ও মূর্তির সাথে তুলনা থেকে এখন মনে করা হয় যে, চানহুদাড়োতে হরপ্পান বসতির সময়কাল ২৪৫০ খ্রীঃপূঃ থেকে ১৯০০ খ্রীঃপূঃ পর্যন্ত ছিল।

-------------------------------------------------------

দেখুনঃ Qasid H. Mallah, Recent archaeological discoveries in Sindh, Pakistan, in, Current Studies on the Indus Civilization, Volume I, eds., Toshiki Osada and Akinori Uesugi, 2010, p. 55.

দেখুনঃ Jonathan Mark Kenoyer, Indus and Mesopotemian Trade Networks: New Insights from Shell and Carnelian Artifacts, in, eds., Intercultural Relations between South and Southwest Asia, E. Olijdam & R.H. Spoor, BAR International Series, 1826: 2008, p. 23.

-------------------------------------------------------

পাতা : ২০

মধ্য ও দক্ষিণ বালুচিস্তানের গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নস্থল সমূহ (সৌজন্যেঃ Ute Frane, 2015)

 

লোথাল

লোথাল ক্যাম্বে উপকূলীয় সমভূমিতে অবস্থিত। এখানে পাঁচটি স্তরে ধারাবাহিক বসতি পাওয়া গেছে। এই বসতিটি মাটি ও কাদা-মাটির ইটের প্রাচীর ঘেরা ছিল। এর দক্ষিণ-পূর্ব অংশটি নগরের অন্যান্য অংশ থেকে ৭ মিঃ উঁচু ছিল। এর উপরের কাঠামোগুলিকে শাসকদের বাসস্থান, ইটের মেঝেবিশিষ্ট স্নানাগার এবং গুদামঘর বা শস্যাগার বলে মনে করা হয়। নগরের পূর্ব পাশে একটি ডকইয়ার্ড আছে যা প্রাচীনকালে কৃত্রিম খাল দিয়ে নদীর সাথে সংযুক্ত ছিল। ডকইয়ার্ডের পাশে ইটের তৈরী জাহাজঘাট শহরের গোটা পূর্ব পাশ জুড়ে ছিল। ডকইয়ার্ডে অতিরিক্ত জল নিষ্কাশন করার জন্য স্পীলওয়ে এবং এর নিষ্কাশন দ্বার বন্ধ করার জন্য ব্যবস্থাও ছিল।  এর ফলে জোয়ারের জল প্রবেশে নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা এবং স্বয়ংক্রিয়ভাবে খালের পলি পরিষ্কার করা সম্ভব হত। এই ডকের প্রান্তে অনেক পাথর পাওয়া গিয়েছিল যেগুলি নোঙর হিসাবে ব্যবহৃত হত। সিন্ধুর মৃৎপাত্রে মানুষের ছবি খুবই কম আঁকা হয়েছে। তবে লোথালের পর্ব এ-তে পাওয়া হালকা হলুদ রঙের মৃৎপাত্রের ভাংগা অংশে দেখা যাচ্ছে যে কয়েকটি মানুষ হাত ধরাধরি করে নাচছে।

-------------------------------------------------------

এস, আর, রাও লিখেছেনঃ t “Automatic desilting and escape of excess water at high tide were ensured by building a spill-way in the southern embankment. Arrangements also existed for sliding a wooden door in the recesses of the spill-way which could be closed and the required water level maintained at low water to ensure floatation of boats.” দেখুনঃ S.R. Rao, Lothal: A Harappan Port Town (1955-62), Volume I, Published by the Director General, Archaeological Survey of India, New Delhi, 1979, P. 126.

দেখুনঃ S.R. Rao, Lothal: A Harappan Port Town 1955-62, Volume II, Published by the Director General, Archaeological Survey of India, New Delhi, 1985, p. 347.

-------------------------------------------------------

সিন্ধু সভ্যতায় প্রাপ্ত নগরের সংখ্যার তুলনায় শহর ও ছোট বসতিসমূহের সংখ্যা অনেক বেশী। মনে করা হয় যে, সিন্ধু সভ্যতার মোট জনসংখ্যার মাত্র ৩%-এরও কম হরপ্পান নগরগুলিতে বসবাস করত। অন্যদিকে ৯৭% এরও বেশী মানুষ ছোট হরপ্পান বসতিগুলিতে গ্রামীণ জীবন যাপন করত।  এটি অত্যন্ত চমকপ্রদ আলোচনার বিষয় হতে পারে যে, আগের আদি হরপ্পান পর্যায়ের আঞ্চলিক গঠন থেকে নগরের সাথে সাথে কীভাবে এত গ্রামীণ বসতিরও উদ্ভব হল।  বুঝার সুবিধার জন্য সিন্ধু সভ্যতার বৈশিষ্ট্য ও অন্যান্য বিভিন্ন বিষয়ের উপর আমরা আলাদাভাবে নীচে আলোচনা করেছি।

-------------------------------------------------------

 দেখুনঃ Vasant Shinde, Shweta Sinha Deshpande, Toshiki Osada and Takao Uno, Basic Issues in Harappan Archaeology: Some Thoughts, in, Ancient Asia, Vol. I, 2006, p. 66.

দেখুনঃ K.D. Thomas, J.R. Knox and Farid Khan, Technology Transfer in the 4th Millennium B.C. in Bannu Basin, in, Early Harappans and Indus-Sarasvati Civilization, Volume II, eds., D.P. Sharma & Madhuri Sharma, Kaveri Books, New Delhi, 2013, p. 445.

-------------------------------------------------------

 

হরপ্পান স্থাপত্য কাঠামো, নগর পরিকল্পনা ও বসতি বিন্যাস

হরপ্পান নগরগুলি সাধারণভাবে পরিকল্পিত। আদি হরপ্পান পর্যায়ে কোট দিজি সময়ে কোনো কোনো নগর সোজা রাস্তা, গলি ও বিভিন্ন কাঠামো পূর্ব-পরিকল্পনার মাধ্যমে গড়ে উঠেছিল। অর্থাৎ এখানে রাস্তা, বাড়ী-ঘর ও অন্যান্য কাঠামো একটি কেন্দ্রীয় ও পূর্ব পরিকল্পনার অংশ হিসাবে গড়ে উঠেছে। বসতিগুলি সামগ্রিক পরিকল্পনায় প্রায় ক্ষেত্রে আয়তাকার ও দু’টি বা ততোধিক সংখ্যক দরজাসহ ভারী সীমানা প্রাচীর বেষ্টিত। বসতির মধ্যে রাস্তা ও গলিগুলি পূর্ব-পশ্চিম-উত্তর-দক্ষিণ এই চারটি প্রধান কোণ বরাবর বিন্যস্ত হয়ে নগরকে তুলনামূলক সমান আকারের অট্টালিকাশ্রেণী বা সন্নিহিত অঞ্চলে বিভক্ত করেছে।  এই সমস্ত রাস্তার পাশে নর্দমাও থাকত যা বাড়ীঘর ও সন্নিহিত এলাকার বাইরে বর্জ্য নিষ্কাশন করত। বসতির সকল স্থানে সকল অধিবাসীর এই ধরনের সহজ প্রবেশাধিকার এবং সকল বাড়ী ও সন্নিহিত স্থানের জন্য সমান নর্দমা নিষ্কাশন ব্যবস্থা একটি অভূতপূর্ব ঘটনা ছিল।   পরবর্তী হরপ্পান ও আরো পরের যুগে এই ধরনের গঠন তার ধারাবাহিকতা রক্ষা করেছিল।

-------------------------------------------------------

দেখুনঃ Jonathan Mark Kenoyer, Households and Neighbourhoods of the Indus Tradition: An Overview, in, New Perspectives on Household Archaeology, eds., Bradley J. Parker and Catherine P. Foster, 2012, p. 400.

  দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ৪০০।

-------------------------------------------------------

হরপ্পান পর্যায়ে সুপরিচালিত নগর-প্রাচীর ও নগর-দরজা এবং নগরের ভিতর নগর-দরজা থেকে বের হওয়া উত্তর-দক্ষিণ ও পূর্ব-পশ্চিমে বিন্যস্ত প্রধান রাস্তা নির্মাণ করার সাক্ষ্য পাওয়া যায়। এই রাস্তায় যুক্ত হওয়ার জন্য ছোট গলি থাকত। সমস্ত রাস্তা ও গলিতে একটি গরু-গাড়ী বা রাস্তায় মানুষ চলাচলের ব্যবস্থা ছিল। এর ফলে সকল সন্নিহিত এলাকায় মানুষের একই রকম প্রবেশাধিকার ছিল। কেনোয়ার মনে করেন যে, সন্নিহিত এলাকার ঘন সন্নিবিষ্ট বাড়ীগুলির কারণে দিনের বেশীরভাগ সময় রাস্তায় ছায়া তৈরী হত, ফলে গ্রীষ্মের গরমের দিনগুলিতে নগর ঠাণ্ডা থাকত।

--------------------------------

  দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ৪০০।

--------------------------------

পাতা : ২১

নগর বিন্যাসের বিষয়টিকে বিবেচনা করলে সাধারণভাবে মহেঞ্জো-দাড়োকে আদর্শ হিসাবে ধরা হয়। এর পশ্চিমে নগরদুূর্গ, যাকে প্রশাসনিক কেন্দ্র বলে মনে করা হয় আর পূর্ব অংশে তুলনামূলক নীচু নগর যেখানে সর্বসাধারণ বসবাস করত। কিন্তু দেখা যায় যে, অধিকাংশ হরপ্পান নগর-পরিকল্পনা মহেঞ্জো-দাড়ো থেকে ভিন্ন ছিল। যেমন, আল্লাহদিনো, আমরি, বনওয়ালী, ধোলাভিরা, লোথাল, রোজদি, সুরকোটডা, রুপার ও হুলাসের মত বসতিগুলির নিজস্ব পরিকল্পনা ছিল।  হরপ্পায় আদি হরপ্পান বসতির উপর পরবর্তী হরপ্পান নগর গড়ে উঠাতে সেখানে পরিকল্পিত নগর নির্মাণের বাস্তবতা হয়ত ভিন্ন ছিল। সেখানে আলাদা কতগুলি ঢিবির উপর হরপ্পান বসতি গড়ে উঠেছিল। চানহুদাড়োতে ছকটা আবার ভিন্ন ছিল। সেখানে তিনটি পৃথক ঢিবিতে বসতি গড়ে উঠেছিল। ধোলাভিরায় পরিবেষ্টিত বসতির প্রায় মাঝখানে নগরদুর্গ তৈরী করা হয়েছিল। এখানে মধ্যবর্তী ও নীচু নগরও ছিল। কেবলমাত্র কালিবঙ্গানের নগর বিন্যাসকে মহেঞ্জো-দাড়োর ছকের সাথে তুলনা করা যায়।

-------------------------------------------------------

দেখুনঃ D.P. Agrawal, The Indus Civilization: An Interdisciplinary Perspective, Aryan Books International, New Delhi, 2007, p. 133.

-------------------------------------------------------

মহেঞ্জো-দাড়োতে সিঁড়িবিশিষ্ট কিছু বাড়ীর কাঠামো পাওয়াতে ধারণা করা হয় সেখানে কমপক্ষে দোতলা বাড়ী তৈরী করা হয়েছিল। বনওয়ালীতে বাড়ীর দেওয়ালের পুরুত্ব থেকে সেখানেও কমপক্ষে দোতলা বাড়ী ছিল বলে ধারণা করা হয়।

-------------------------------------------------------

 দেখুনঃ R.S. Bisht, Structural Remains and Town-planning of Banawali, in, Frontiers of the Indus Civilization, eds., B.B. Lal and S.P. Gupta, p. 95.

-------------------------------------------------------

একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল যে, সেখানে স্নানের জায়গা ও শৌচাগার থেকে ব্যবহৃত জল ও পয়ঃনিষ্কাশনের জন্য নর্দমা ব্যবস্থা গড়ে তুলা হয়েছিল। এই বর্জ্য বাড়ীর বাইরে রাস্তা ও গলির ধারে অবস্থিত গর্তে জমা হত। ধারণা করা যায় যে, এই বর্জ্য সংগ্রহ করে শ্রমিক দ্বারা শহরের বাইরে ফেলা হত। এছাড়া বাড়ী থেকে নর্দমায় ব্যবহৃত জল বড় পয়ঃপ্রণালীতে যেত। সেখান থেকে নগর-দরজার বাইরে অথবা প্রাচীরের বাইরে যেত। নৌশারোতে এই ধরনের ব্যবস্থা দেখতে পাওয়া গেছে। ধোলাভিরায় বৃষ্টির জল সংগ্রহ করার জন্য আলাদা নালা ছিল এবং এই জলকে বিশেষভাবে নির্মিত জলাধারে নিয়ে যাওয়া হত।

হরপ্পান নগরগুলিতে একটি উঠানের চারপাাশে বহুকক্ষবিশিষ্ট কাঠামো সাধারণভাবে চোখে পড়ে। এছাড়া কিছু সংখ্যক বাড়ীর জন্য জল ব্যবহারের উদ্দেশ্যে কূপ বা কুয়া নির্মাণ করা হত। ইটের আস্তরণ দেওয়া কুয়া সিন্ধুর লোকজনের আবিষ্কার বলে মনে করা হয়।  এখন পর্যন্ত  কোনো আদি হরপ্পান বা প্রাক-হরপ্পান বসতিতে কুয়া পাওয়া যায় নাই। এমন কি মেসোপটেমিয়া ও মিসরের বসতিগুলিতে কুয়া তৈরী করে অর্থাৎ ভূমিতে খাড়াভাবে খনন করে জল তোলার পদ্ধতি বাস্তবে অজানা ছিল।  মহেঞ্জো-দাড়োর কুয়ার স্তম্ভের গভীরতা ২০ মিটারের (৬৬ ফুট) চেয়েও বেশী। এখানে এই ধরনের ৭০০ টি কুয়া থাকার সম্ভাব্যতা সম্পর্কে অনুমান করা হয়। এখানকার প্রতিটি কুয়ার জলাধারের নহর বা catchment area গড়ে প্রায় ১৭ মিটার ব্যাসার্ধ বিশিষ্ট ছিল। এই ধরনের ঘনত্বের জল সরবরাহ ব্যবস্থা পৃথিবীর জল সরবরাহ ব্যবস্থার ইতিহাসে অতুলনীয়।  তারা যে পদ্ধতিতে কুয়া তৈরী করত পাকিস্তানে আজও একই পদ্ধতিতে কুয়া তৈরী করতে দেখা যায়। এটি লক্ষ্যণীয় যে, বিপাশা নদীর প্রবাহের এলাকা জুড়ে জরিপ চালানোর সময় প্রত্নতাত্ত্বিকরা সিন্ধুর ছোট গ্রাম ও শহরে একই প্রযুক্তি দিয়ে তৈরী কুয়া দেখতে পেয়েছেন।

-------------------------------------------------------

দেখুনঃ Michael Jansen, Mohenjo-Daro, Indus Valley Civilization: Water Supply and Water Use in One of the Largest Bronze Ages Cities of the Third Millennium BC, in, A History of Water A, Series III, Vol. I: Water and Urbanism, eds.,Terje Tvedt and Terje Oestigaard, Publisher: I.B. Tauris, 2014, p. 54.  

  দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ৫৪-৫৫।

দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ৫৫।

দেখুনঃ Rita P. Wright and Zenobie S. Garrett, Engineering Feats and Consequences: Workers in the Night and the Indus Civilization, in, Archaeology of the Night: Life After Dark in the Ancient World, eds., Nancy Gonlin and April Nowell, University Press of Colorado, 2017, pp. 294-295.   

-------------------------------------------------------

প্রত্নতাত্ত্বিক মাইকেল জেনসেন জানাচ্ছেন যে, মহেঞ্জো-দাড়ো নগরের উঁচু স্থানে, যাকে citadel বা ‘নগরদুর্গ’ বলা হয়, সেখানে মাত্র ৬টি কুয়া পাওয়া গেছে। এই সব কুয়া জনসাধারণের ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত ছিল। নগরদুর্গে কুয়ার গড় ব্যাস ১.৯১ মিটার আর নীচু নগরে তা ১ মিটারের চেয়ে কম।  মহেঞ্জো-দাড়োর প্রায় প্রতিটি বাড়ীর সাথে একটি স্নানাগার পাওয়া গেছে। সেখানে অগভীর গামলার মত কাঠামো অথবা মঞ্চ ছিল, যা ১ বর্গ মিটারের আকারের। এগুলি ধারালো কিনারা যুক্ত ইটের সাহায্যে তৈরী করা হয়েছিল। এগুলি একটি বহির্গমনপথের দিকে ঢালু ছিল ও এটি বাইরে রাস্তার নর্দমার সাথে যুক্ত ছিল। মনে করা হয় যে, এই ধরনের স্নানের প্রচলন শুধুমাত্র স্বাস্থ্যগত কারণেই ছিল না, এর সাথে ধর্মীয় বিশ্বাসও থাকতে পারে। প্রত্নতাত্ত্বিক মাইকেল জেনসেন মনে করেন, কৃৎকৌশল দিক ও এর বিপুল সংখ্যা বিবেচনা করলে প্রাচীন পৃথিবীতে এই স্নানের মঞ্চ একমাত্র দৃষ্টান্ত ছিল।  মেসোপটেমিয়াতেও এই কৌশল অজানা ছিল।

-------------------------------------------------------

দেখুনঃ Michael Jansen, Mohenjo-Daro, Indus Valley Civilization: Water Supply and Water Use in One of the Largest Bronze Ages Cities of the Third Millennium BC, in, eds, A History of Water A, Series III, Vol. I: Water and Urbanism, eds., Terje Tvedt and Terje Oestigaard, 2014, p. 58.

  দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ৬০।   

-------------------------------------------------------

মহেঞ্জো-দাড়োতে ‘নগরদুর্গে’ অত্যুৎকৃষ্ট অনেক কাঠামো পাওয়া গেছে। একটি জটিল ভবন যাকে priests’ college বলা হয় সেখানে কোনো কুয়া পাওয়া যায় নাই। তবে এখানে অনেক স্নানের মঞ্চ পাওয়াতে এখানে ব্যাপক জল ব্যবহার হত বলে মনে করা হয়। এছাড়াও এই এলাকায় Great Bath নামে যে চৌবাচ্চাটি পাওয়া গেছে তা আজও একটি বিশিষ্ট নির্মাণ হিসাবে টিকে আছে। এই চৌবাচ্চাটি একটি আয়তাকার ইটের তৈরী কাঠামো, যার মাপ দৈর্ঘ্যে ১২ মিটার, প্রস্থে ৭ মিটার ও গভীরতায় ২.৪ মিটার। এর ধারণ ক্ষমতা ১৬০ ঘন মিটার। এটির দুই পাশে সিঁড়ি বেয়ে নামার ব্যবস্থা আছে। এই চৌবাচ্চাটির মেঝে দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে ময়লা জল নিষ্কাশনের জন্য একটি নির্গমন পথের দিকে ঢালু করা হয়েছিল। এই ঢালুর পরিমাণ বা নতিমাত্রা (Gradient) শতকরা ১.৪-১.৭। এই জটিল সমতলত্ব (Leveling) কৌশল আশ্চর্য করার মত। জলরোধী করার জন্য এখানে বিটুমিনও ব্যবহার করার প্রমাণ পাওয়া গেছে। এই চৌবাচ্চাটি একটি অভ্যন্তরীণ উঠানের মাঝখানে করা হয়েছে যা একটি সুদৃশ্য ভবনশ্রেণী দ্বারা বেষ্টিত। এই ভবনশ্রেণীর আয়তন ১,৮০০ বর্গ মিটার। মনে করা হয় যে, এই চৌবাচ্চাটি কোনো ধর্মীয় উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হত। হয়ত এখানকার পবিত্র জল পবিত্রকরণের কাজে ব্যবহৃত হত। এখানে নগরের ‘নীচু স্থানের’ মতই একই রকম ঘনভাবে স্নানের মঞ্চ ও নোংরা জল নিষ্কাশনের জন্য নর্দমা দেখা গেছে। নগরদুর্গে অবস্থিত ভবনগুলি প্রধানত সর্বসাধারণের কাজে লাগত।

আশেপাশের বিভিন্ন কাঠামোর নানা দিক পরীক্ষা করে ধারণা করা হয় এই চৌবাচ্চাটি মহেঞ্জো-দাড়োর নগরদুর্গের মূল কাঠামোগত পরিকল্পনার ধারণার অংশ ছিল না। পরে, ২৩০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের দিকে এটি নির্মাণ করা হয়েছে মনে করা হয়।  প্রায় একই সময়ে পরবর্তী কিছু পাথরের মূর্তি পাবার কথা জেনসেন জানাচ্ছেন, যেগুলি হল তথাকথিত ‘রাজর্ষি’ বা  priest king, হাটু গেঁড়ে বসা মূর্তি, ভেড়ার মূর্তি, ইত্যাদি।  ‘গ্রেট বাথ’-টিতে পরবর্তীকালে বড় ধরনের পরিবর্তন করা হয়েছিল। চৌবাচ্চাটির উত্তর পাশে সংলগ্ন স্তম্ভবিশিষ্ট হলঘরটিতে (Pillared hall) প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে ভরাট করে ফেলা হয়েছিল। এটিকে একটি ভিত্তি হিসাবে রেখে উপরে একটি কাঠামোতে উঠার জন্য সিঁড়ির ব্যবস্থা করা হয়েছিল। শুরুতে যে উদ্দেশ্যে এই ভবনশ্রেণী তৈরী করা হয়েছিল এই সময়ে তা বাতিল করা হয় বলে মনে হয়।

-------------------------------------------------------

দেখুনঃ Michael Jansen, Mohenjo-Daro, Indus Valley Civilization: Water Supply and Water Use in One of the Largest Bronze Ages Cities of the Third Millennium BC, in, eds, A History of Water A, Series III, Vol. I: Water and Urbanism, 2014, pp. 60-63.

  দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ৬৩।

  দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ৬৩।

-------------------------------------------------------

পাতা : ২২

 সোহর ডাম্ব/ নালের পর্ব ১ থেকে ৩-এর স্থাপত্য পরিকল্পনা (সৌজন্যেঃ Ute Franke, 2016)

মহেঞ্জো-দাড়ো নগরের নোংরা জল নিষ্কাশন ব্যবস্থা দেখে এখানকার মানুষের বিপুল পরিমাণ জল ব্যবহারের বিষয়টি ধারণা করা যায়। এখানে বাড়ী, স্নানের মঞ্চ ও শৌচাগারের বহির্গমন পথ নালার সাহায্যে একটি পাত্রে পড়ত, যেখান থেকে সাধারণ নর্দমা ব্যবস্থার সাথে তা যুক্ত থাকত। পৌর পয়ঃ ব্যবস্থার সাথে সংযুক্ত করার জন্য স্নানাগার ও শৌচাগারগুলি রাস্তার ধারে তৈরী করা হত। ‘গ্রেট বাথ’ নামক চৌবাচ্চাটির জল নিষ্কাশনের জন্য একটি বড় নর্দমার ব্যবস্থা ছিল যার উচ্চতা ১.৮ মিটার যার ভিতর দিয়ে হেঁটে যাওয়া সম্ভব। এর ছাদ দু’পাশ থেকে প্রলম্বিত করে ধনুকাকৃতি (corbelled vault) করা হয়েছিল।

মহেঞ্জো-দাড়ো থেকে পাওয়া একজন ‘রাজর্ষি’-র আবক্ষ প্রস্তর মূতি (সৌজন্যেঃ A.H. Dani and B.K. Thapar, 1996)

বনওয়ালী, ধোলাভিরা, কালিবঙ্গান, হরপ্পা, লোথাল, মহেঞ্জো-দাড়ো, নৌশারো ও সুরকোটডা সহ আরো অনেক হরপ্পান বসতিকে ঘিরে সীমানা প্রাচীর দিতে দেখা যায়।  বিভিন্ন বসতিতে যে সীমানা প্রাচীর দেখতে পাওয়া যায় সেবিষয়ে পণ্ডিতরা একমত যে, এগুলি যুদ্ধের উদ্দেশ্যে ব্যবহারের জন্য তৈরী করা হয় নাই।  প্রত্নতাত্ত্বিকরা মনে করেন যে, হরপ্পায় দেওয়াল দেওয়া হয়েছিল নগরের বিভিন্ন অংশে প্রবেশ ও বের হওয়া নিয়ন্ত্রণ করার জন্য। দেওয়াল ও নগর দরজার সাহায্যে শাসকরা নগরে কারা কোন কারণে প্রবেশ করবে সেটা নিয়ন্ত্রণ করত।  সেটা অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক বা আদর্শগত যেটাই হোক না কেন। বাইরে যে সমস্ত জিনিসপত্র তৈরী হত সেগুলি নগরে প্রবেশ করতে হলে সেসবের উপর কর আদায় করা অথবা নগরে তৈরী কোনো কিছু বাইরে অন্য কোনো জায়গার উদ্দেশ্যে বের করতে হলে তার উপর শুল্ক আদায় করা হত। এছাড়াও আশেপাশের সমভূমির চেয়ে উপরে হত বলে চারিপাশে ভাঙ্গনের হাত থেকে রক্ষা করার জন্যও নগর প্রাচীর ভূমিকা রাখত। এছাড়া বন্যার হাত থেকে রক্ষার বিষয়টি তো আছেই। কোনো কোনো লেখক মনে করেন হরপ্পানরা বাস্তব  ক্ষমতা প্রকাশ করতে তাদের বসতিকে ঘিরে এই ধরনের ভারী দেওয়াল দিত।

-------------------------------------------------------

দেখুনঃ Jonathan Mark Kenoyer, Households and Neighbourhoods of the Indus Tradition: An Overview, in, New Perspectives on Household Archaeology, eds., Bradley J. Parker and Catherine P. Foster, 2012, p. 399.

দেখুনঃ P. Eltsov, Power circumscribed by space: Attempting a new model of the ancient South Asian city, in, Current Studies on the Indus Civilization, Volume VI, eds., Toshiki Osada and Akinori Uesugi, Manohar Publishers & Distributers, New Delhi, 2011, p. 63.

-------------------------------------------------------

রাবি পর্যায়ের শুরু থেকে হরপ্পার ভবন কাঠামোগুলিকে পূর্ব-পশ্চিম-উত্তর-দক্ষিণ এই চারটি প্রধান দিক বরাবর বিন্যস্ত হতে দেখা যায়। পরবর্তী কোট দিজি ও হরপ্পান পর্যায়েও এই বিন্যাস বজায় ছিল। অন্যদিকে মেহরগড়, আমরি ও নৌশারোর বসতিগুলির বিন্যাস সঙ্গতিপূর্ণ ছিল না। যদিও নৌশারো পর্ব ১ এ অনেক ঘর-বাড়ীই মোটামুটিভাবে প্রধান দিক বরাবর বিন্যস্ত ছিল। হরপ্পা ও কালিবঙ্গানে উত্তর-দক্ষিণ ও পূর্ব-পশ্চিম বরাবর রাস্তা ও গলিগুলি বিন্যস্ত ছিল।

হরপ্পানদের আরেকটি লক্ষ্যণীয় নির্মাণ হল কুয়ার জন্য বিশেষ ধরনের ইট তৈরী। হরপ্পায় ঢিবি এবি-তে একটি কুয়ার ভিতরের ব্যাস ১.২ মিটার। এখানে কীলকাকৃতির (Wedge-shaped) ইট এমনভাবে তৈরী করে বসানো হয়েছিল যে, এটি কুয়ার বেলনাকার গঠনের জন্য উপযোগী ছিল। ইটগুলি ২৬ সেঃমিঃ দৈর্ঘ্যরে ও ৩৬টি ইট লেগেছিল কুয়ার প্রতিটি বেড় তৈরী করতে।  হরপ্পায় অন্য মাপের কুয়ার জন্য ইটগুলি এমন সূক্ষ্ম মাপে তৈরী করা হয়েছিল যেন এগুলি মজবুতভাবে বসে যায়।

-------------------------------------------------------

দেখুনঃ J. Mark Kenoyer, Measuring the Harappan world: Insights into the Indus order and cosmology, in, The Archaeology of Measurement: Comprehending Heaven, Earth and Time in Ancient Societies, eds., Iain Morley and Colin Renfrew, 2010, p. 119.

-------------------------------------------------------

হরপ্পান নগরগুলির রাস্তা যথেষ্ট প্রশস্ত হত গরুগাড়ী প্রবেশ ও চলাচল ও মানুষের চলাচলের উপযোগী করে। হরপ্পায় নগরের রাস্তায় গরুর গাড়ী চলাচলের দাগ পাওয়া গেছে। একই ধরনের গরুর গাড়ীর চাকার দাগ ফারমানায় পাবার কথা জানা যায়।  হরপ্পায় সবচেয়ে প্রাচীন খেলনার পোড়ামাটির গরুগাড়ীর ভগ্নাংশ পাওয়া গেছে রাবি পর্যায়ে ও সবচেয়ে প্রাচীন খেলনার গরুগাড়ীর চাকা পাওয়া গেছে গিরাওয়ারের প্রথম স্তরে। সমস্ত সিন্ধু উপত্যকায় কোট দিজি পর্যায় থেকে পোড়ামাটির খেলনা গরুগাড়ী ও চাকা পাওয়ায় অনুমান করা যায় যে, এই সময় থেকে শুরু করে সমগ্র হরপ্পান পর্যায়ে গরুগাড়ী একটি গুরুত্বপূর্ণ বাহন হিসাবে কাজ করছিল।

-------------------------------------------------------

দেখুনঃ Vasant Shinde, Toshiki Osada, Akinori Uesugi and Manmohan Kumar, A Report on Excavations at Farmana 2007-08, in, Linguistics, Archaeology and the Human Past, Occational Paper 6, eds., Toshiki Osada and Akinori Uesugi, Indus Project, Research Institute for Humanity and Nature, Kyoto, 2008, p. 30.

-------------------------------------------------------

প্রাচীন পৃথিবীর অধিকাংশ বসতিতে সামগ্রিক বসতি পরিকল্পনার খুব কম প্রমাণ পাওয়া যায়। সাধারণত দেখা যায় যে, প্রধান সড়কের দু’পাশে ঘরবাড়ী বিন্যস্ত থাকে, আর এই সড়কটি কোনো মন্দির বা গুরুত্বপূর্ণ বাড়ীতে গিয়ে শেষ হয়। এক্ষেত্রে হরপ্পান সভ্যতা ব্যতিক্রম ছিল।

দেখা গেছে যে হরপ্পান পর্যায়ে বসতি বিন্যাসে পরিবর্তন ঘটেছিল। এর বসতিসমূহ দক্ষিণ দিকে সমুদ্র উপকূলের দিকে যেমন ছড়িয়ে পড়েছিল তেমনি পূর্ব দিকে যমুনা অববাহিকায়ও ছড়িয়ে পড়েছিল।

-------------------------------------------------------

দেখুনঃ Man Mohan Kumar and I.J. Nagpal, Dispersal of Settlements in Haryana from Early Harappan to Late Harappan Period, in, Purātattva, No. 34: 2003-2004, 2004, p. 26.

-------------------------------------------------------

পাতা : ২৩

 

নর্দমা ও নোংরা জল নিষ্কাশন ব্যবস্থা

সিন্ধু সভ্যতায় স্নানের ব্যবস্থার কথা আগে বলা হয়েছে। হরপ্পা ও মহেঞ্জো-দাড়োতে দেখা যাচ্ছে যে, প্রায় প্রতিটা বাড়ীতেই স্নানের ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার ব্যবস্থা ছিল। ফলে শাসকদেরকে নগরে বিশুদ্ধ জলের ব্যবস্থা করতে হয়েছে। নর্দমা ব্যবস্থা গড়ে তুলা হয়েছিল বাড়ীতে ব্যবহৃত নোংরা জলকে ইটের আস্তরণে তৈরী নর্দমার সাহায্যে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তার মাধ্যমে নগরের বাইরে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করার মাধ্যমে। মহেঞ্জো-দাড়ো ও হরপ্পায় পোড়ামাটির ক্রমশঃ সরু হওয়া নির্গমন নলের সাহায্যে বাড়ীর বাইরে রাস্তায় জল বের করার ব্যবস্থা থাকত। হরপ্পায় খনন করে দেখা গেছে যে, প্রায় প্রতিটা বাড়ীতেই শৌচাগার ছিল। এমন কি সিন্ধুর ছোট শহর বা গ্রামেও চমৎকার নর্দমা ব্যবস্থা থাকার ফলে এবিষয়টি বুঝা যায় যে, নোংরা জল ও পয়ঃ অপসারণ সিন্ধুর মানুষজনদের একটি দৈনন্দিন বিষয় ছিল।

-------------------------------------------------------

দেখুনঃ D.P. Agrawal, The Indus Civilization: An Interdisciplinary Perspective, Aryan Books International, New Delhi, 20077, p. 81.

-------------------------------------------------------

মহেঞ্জো-দাড়োতে ইটের সাহায্যে পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার জাল গড়ে তুলা হয়েছিল। এই নর্দমাগুলি বেশীরভাগ ক্ষেত্রে বাড়ীর পাশ দিয়ে সাধারণভাবে কাঁচা রাস্তার ধারে বসানো হয়েছিল। এগুলি আলগা ইট দিয়ে ঢাকা থাকত যাতে নর্দমাগুলি পরিষ্কার করা যায়। এই নর্দমাগুলির ঢালুর পরিমাণ বা নতিমাত্রা ছিল প্রতি মিটারে ২ সেন্টিমিটার।  যেখানে বক্রতার প্রয়োজন সেটি এমনভাবে করা হত যে, যেন পয়ঃ বা নোংরা জল প্রবাহের সময় ঘর্ষণজনিত ক্ষয় কমানো যায়। যেখানে একটি নর্দমা দীর্ঘ দূরত্ব পার হত অথবা একাধিক নর্দমা এক জায়গায় মিলিত হত, সেখানে ইটের তৈরী একটি গর্ত (Cesspit) তৈরী করা হত। এভাবে কঠিন বস্তু সঞ্চিত হয়ে জমাট বাঁধা থেকে নর্দমাকে রক্ষা করা হত। এভাবে নোংরা জল কিছুটা উঁচু স্তরে ইট নির্মিত গর্তের উপর প্রবাহিত হত, এটাকে পূর্ণ করে অপর পাশে কিছুটা নীচু স্তরে প্রবাহিত হত। তরলে থাকা কঠিন বস্তু ধীরে ধীরে তলানীতে সঞ্চিত হত। পরে গর্ত থেকে মইয়ের সাহায্যে নীচে নেমে সঞ্চিত পদার্থ পরিষ্কার করা হত। ধারণা করা হয় যে, এই গর্তগুলি (Cesspit) কাঠের ঢাকনা দিয়ে ঢাকা থাকত। ঢাকনা যুক্ত নর্দমা ও গর্ত ছাড়াও উন্মুক্ত শুষে নিবার গর্তও (Soakpit) ছিল, বিশেষত যেখানে ছোট গলিগুলি বড় রাস্তার সাথে যুক্ত হত সেখানে। এখানকার জমে থাকা ময়লা সময়ে সময়ে পরিষ্কার করা হত।

-------------------------------------------------------

দেখুনঃ Michael Jansen, Mohenjo-Daro, Indus Valley Civilization: Water Supply and Water Use in One of the Largest Bronze Ages Cities of the Third Millennium BC, in, A History of Water A, Series III, Vol. I: Water and Urbanism, eds., Terje Tvedt and Terje Oestigaard, 2014, p. 64.

-------------------------------------------------------

আগে বলা হয়েছে যে, বাড়ীঘরগুলি থেকে সংকীর্ণ ঢালু পথে পয়ঃ বা নোংরা জল রাস্তার ধারে থাকা নর্দমায় পড়ত, আবার কখনো বড় পাত্রে পড়ত। কখনো খাড়া পোড়ামাটির ঘন সন্নিবিষ্ট নলের সাহায্যে উপরের তলা বা ছাদ থেকে নোংরা জল বের করার জন্য ব্যবহৃত হত। এই বিষয়টি পরিষ্কার যে, নোংরা জলের পথ (Chute), শুষে নিবার গর্ত, কঠিন পদার্থ সঞ্চিত করার গর্ত (Cesspit) এবং নর্দমাগুলি থেকে নির্গত তীব্র দুর্গন্ধ সৃষ্টি হত। কেবলমাত্র জলের উচ্চ প্রবাহ নিশ্চিত করে ও নিয়মিত পরিষ্কার করেই যে এই সমস্যা থেকে নাগরিকরা মুক্ত থাকত তাতে কোনো সন্দেহ নাই। এই কাজে নিশ্চয়ই বিপুল সংখ্যক জনবল নিয়োজিত ছিল।

 

পশুপালন ও পশু শিকার

যে সমস্ত পশুকে গৃহপালিত বলা যায় সেগুলি হল কুঁজওয়ালা গরু (zebu cattle বা Bos-indcus), মোষ (Bublus bublis), ভেড়া (Ovis arise), ছাগল (Capra hircus), শুয়োর (Sus domesticus), গাধা (Equus asinus), ঘোড়া (Equus caballus), উট (Camelus dromedaries), হাতি (Elephas maximus), ও মুরগি (Gallus gallus)।  হরপ্পান পর্যায়ের বসতিগুলিতে যত পশুর হাড় পাওয়া গেছে তার শতকরা ৪০ থেকে ৭০ ভাগ হল গরু। মহেঞ্জো-দাড়োতে দেখা গেছে যে, খাদ্য হিসাবে গরু, ভেড়া ও মুরগির পর শুয়োর সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করেছিল।  কিছু পশুকে গাড়ী টানার কাজে, কিছু পশুকে লাঙ্গল টানার কাজে, কিছু পশুকে মাংস ছাড়াও দুধের উৎস হিসাবে ও কিছু পশুকে কম্বল বানাবার লোমের উৎস হিসাবে ব্যবহার করা হত। এছাড়া পশুর হাড় থেকে বিভিন্ন যন্ত্রপাতি ও অলংকার তৈরী করা হত।

-------------------------------------------------------

দেখুনঃ Sajjan Kumar, Domestication of Animals in Harappan Civilization, Research India Press, New Delhi, 2014, p. 163.

দেখুনঃ   দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ১৬৩

-------------------------------------------------------

গৃহপালিত পশু ছাড়াও প্রতিটি হরপ্পান বসতিতে শতকরা ১০ থেকে ৪০ ভাগ বন্য পশুর হাড় পাওয়া গেছে।  এ থেকে কিছু লেখক মনে করেন যে, হরপ্পান বসতিগুলিতে শিকারী জনগোষ্ঠীও সম্ভবত বসবাস করত। শিকার করার উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা বহু পরিমাণ তীরের ফলা ও বর্শা পাওয়াতেও এই রকম মনে করা হয়।  এমনও হতে পারে যে, হরপ্পান নাগরিকরা শিকারীদের কাছে এইসব যন্ত্রপাতি বিক্রী করত ও বিনিময়ে তাদের কাছ থেকে শিকার করা বন্য পশুপাখী কিনত। হরিয়ানার বসতি ফারমানাকে ঘিরে ছোট ছোট বসতিতে অনুসন্ধান চালিয়ে দেখা গেছে যে, এই বসতিগুলি কৃষি ও পশুপালনের উপর ভিত্তি করে টিকে ছিল।  ফারমানা বসতিটির অর্থনৈতিক ভিত্তিতে আশেপাশের উর্বর ও আবাদযোগ্য ভূমি বড় ভূমিকা রেখেছিল। হরিয়ানার ভিররানায় বিপুল সংখ্যক গরুর হাড়ে কাটার চিহ্ন থেকে সেখানে প্রচুর পরিমাণ গরু খাওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়।  গুজরাটের ছোট বসতি বাগাস্রায় প্রাপ্ত ছাগল, ভেড়া, গরু ও মোষের দাঁতের স্ট্রনশিয়াম আইসোটোপ পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে, ছাগল ও ভেড়া সেখানকার অধিবাসীরা খাবার পূর্ব পর্যন্ত সেখানে পুষত, আবার গরু ও মোষ তারা পশুপালনকারীদের কাছ থেকে কিনত অথবা গরু ও মোষের খাবার তারা অন্য জায়গা থেকে কিনত।  তবে আশেপাশে পশুপালনকারী বিভিন্ন জনগোষ্ঠী থাকাতে এটাই মনে হয় যে, বাগাস্রার মানুষজন তাদের কাছ থেকে খাদ্য হিসাবে গরু ও মোষ কিনত। হরপ্পানদের কংকালের দাঁতের তুলনামূলক ভাল স্বাস্থ্যের জন্য তাদের খাদ্যের বৈচিত্র্য ছিল বলে ধারণা করা হয়, তারা চাষের মাধ্যমে ফলানো ফসল যেমন, গম, যব, মটরশুটি (Field pea), তিল, ও সম্ভবত চাল, ভুট্টা এবং জোয়ারের পাশাপশি যথেষ্ট পরিমাণ বন্য জীবজন্তু ও উদ্ভিদ খেত।

-------------------------------------------------------

  দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ১৬৫।

  দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ১৬৫।

দেখুনঃ Rajiv Mann and Vivek Dangi, Site Catchment of Farmana: A Harappan Site in the Ghaggar Basin, in, Harappan Studies: Recent Researches in South Asian Archaeology, Volume 1, eds., Manmohan Kumar and Akinori Uesugi, Aryan Books International, New Delhi, 2014, p. 87.

দেখুনঃ Arati Deshpande-Mukherjee, A Preliminary Report on the Archaeozoological Studies of the Harappan site at Bhirrana, District Fathebad, Haryana, in, Purātattva, No. 42, 2012, pp. 204-211.

দেখুনঃ Brad Chase, David Meiggs, P. Ajithprasad and Philip A. Slater, Patoral land-use of the Indus Civilization in Gujarat: faunal analyses and biogenic isotopes at Bagasra, in, Journal of Archaeological Science 50, 2014, p. 12.

দেখুনঃ Brian E. Hemphill, John R. Lukacs & K.A.R. Kennedy, Biological Adaptations and Affinities of Bronze Age Hrappans, in, Harappa Excavations 1986-1990: A Multidisciplinary Approach to Third Millennium Urbanism, ed., Richard H. Meadow, Prehistory Press, Madison, 1991, p. 170.

-------------------------------------------------------

হরপ্পান পর্যায়ে ঘোড়ার ব্যবহার দেখা যায় না। যদিও বিভিন্ন বসতিতে পাওয়া হাড় ও মাটির তৈরী মূর্তি থেকে অনেক লেখক দাবী করেন যে, সিন্ধু সভ্যতায় ঘোড়ার প্রচলন ছিল, কিন্তু এই দাবী গ্রহণযোগ্য হয় নাই। রিচার্ড মিডো ও অজিতা প্যাটেল ঘোড়ার উপস্থিতির বিষয়ে যে মন্তব্য করেছেন তাকে পণ্ডিত মহলে গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করা হয়। তাঁরা বলেন যে, দক্ষিণ এশিয়ায় ঘোড়া খ্রীঃপূঃ দ্বিতীয় সহস্রাব্দের প্রথম চতুর্থাংশের দিকে  এসেছিল এবং সম্ভবত এমন কি তৃতীয় সহস্রাব্দের শেষের দিকেও হতে পারে। এটা বুঝা গেছে খ্রীঃপূঃ দ্বিতীয় সহস্রাব্দের প্রথম দিকে পিরকে প্রাপ্ত মূর্তির সাক্ষ্য ও সোয়াত উপত্যকায় পাওয়া রঙিন খোলামকুচি থেকে।  এ থেকে ধারণা করা যায় যে, ঘোড়ার ব্যবহার সিন্ধু সভ্যতার একেবারে শেষের দিকে সীমিত পরিমাণে শুরু হয়েছিল, যা বিদায়ী হরপ্পান  পর্যায়ে কিছু বাড়তে পারে।

------------------------------------------------------- 

দেখুনঃ Richard Meadow and Ajita Patel, Comment on ‘Horse Remains from Surkotada’, in, The Aryan Debate, ed., Thomas R. Trautmann, Oxford University Press, New Delhi, 2005, p. 246.

হরপ্পান পর্যায় শেষ হবার পর প্রত্নতাত্ত্বিক বস্তুসমূহের মধ্যে হরপ্পান পর্যায়ের ধারাবাহিকতা থাকায় নগর পরবর্তী পর্যায়কে বিদায়ী হরপ্পান বলা হয়ে থাকে। বিদায়ী হরপ্পান বা Late Harappan নামকরণটি সম্পর্কে রফিক মুগল বলেন, `… Most of the scholars explain the later changes in the Harappan materials with specific reference to the sites such as Cemetery H, Jhukar, Mitathal B, etc. As a compromise to various terminologies, the ‘Late Harappan’ with reference to the principal and best known sites yielding distinctive materials is used here to express (a) chronological position of such ‘late’ materials, (b) cultural continuity with the Harappan Civilization, and (c) character of specific archaeological materials. The term ‘Late Harappan’ is thought to be a neutral one as compared to the ‘post-urban’ because it does not impose interpretive or conceptual bias, or an opinion of an individual. The Late Harappan terminology is certainly widely used and understood very well by the scholars of South Asian archaeology. Moreover, it is found less confusing than the other unacceptable terms such as post-urban.’ দেখুনঃ M. Rafique Mughal, The Decline of the Indus Civilization and the Late Harappan Period in the Indus Valley, in, Lahore Meseum Bulletin, off Print Vol. III, No. 2, July-Dec. 1990, pp. 9-10.  

-------------------------------------------------------

পাতা : ২৪

 

খাদ্য হিসাবে মাছ

বিভিন্ন হরপ্পান বসতি থেকে বিপুল পরিমাণ মাছের কাঁটা পাওয়াতে ধারণা করা যায় যে, হরপ্পানদের খাদ্য তালিকায় মাছ একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল। বালাকোট থেকে খাদ্য হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে এমন হাড় বা কাঁটার অর্ধেকই মাছের কাঁটা। হরপ্পা ও বালাকোটে নদী ও সমুদ্র উভয়েরই মাছ পাওয়া গেছে। হরপ্পা থেকে চার ধরনের মাগুর জাতীয় মাছ (Catfish), বিভিন্ন ধরনের স্বাদু জলের কার্প, শোল (Snakehead) ও কাঁটাযুক্ত বাইন জাতীয় মাছ (Spiny eel) খাওয়া হত বলে জানা যায়। হরপ্পা থেকে জানা যায় যে, কিছু বাড়ীঘরের মানুষজন প্রচুর মাছ খেত, অন্যদিকে কিছু বাড়ীতে কম মাছ খেত।  প্রত্নতাত্ত্বিক খননে হরপ্পায় সামুদ্রিক মাগুর জাতীয় মাছের কাঁটা পাওয়াতে অনুমান করা যায় যে, বাণিজ্যের মাধ্যমে উপকূলীয় অঞ্চল থেকে হরপ্পায় সামুদ্রিক মাছ আসত।  মাছ ধরার জন্য ব্যবহৃত তামার তৈরী বড়শি পাওয়া গেছে মহেঞ্জো-দাড়ো, হরপ্পা, রাখিগাড়ি, লোথাল, পাদরি, চানহুদাড়ো সহ আরো বসতিতে। এছাড়াও বিভিন্ন জিনিসের গায়ে উৎকীর্ণ ছবি থেকে মাছ ধরার জাল ও মাছ ধরার দৃশ্য পাওয়া যায়। গুজরাটের বিভিন্ন বসতিতে খাদ্য হিসাবে সামুদ্রিক ও মিঠাজলের ঝিনুক খাওয়ার প্রমাণ পাওয়া গেছে।

-------------------------------------------------------

দেখুনঃ Sajjan Kumar, Domestication of Animals in Harappan Civilization, 2014, p. 172.

দেখুনঃ William R. Belcher, Fish Resources in an Early Urban Context at Harappa, in, Harappa Excavations 1986-1990: A Multidisciplinary Approach to Third Millenium Urbanism, ed., Richard H. Meadow, Prehistory Press, Madison, 1991, p. 114.

দেখুনঃ Arati Deshpande-Mukherjee and Vasant Shinde, Evaluating the Role of the Molluscan Shell Assemblage Recovered from Padri, A Coastal Harappan Settlement in Gujarat, India, in, Archaeomalacology: Shells in the Archaeological Record, eds, Katherine Szabó, Catherine Dupont, Vesna Dimitrijević, Luis Gómez Gastélum & Nathalie Serrand, BAR International Series 2666, Archaeopress, Oxford, 2014, p. 29.

-------------------------------------------------------

 

কৃষি

হরপ্পা সভ্যতা শুরুর সাথে কৃষিতে বড় কোনো পরিবর্তনের সাক্ষ্য পাওয়া যায় না, বরং তারা স্থানীয় জলের প্রাপ্যতার উপর ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য অনুযায়ী আগেকার বহুমুখী চাষাবাদের ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছিল।  হরপ্পান পর্যায়ে রুটির গম, যব, তিল, জোয়ার, মটরশুটি, তরমুজ, খেজুর, সর্ষের বিভিন্ন প্রজাতি, ধান, ভুট্টা, এবং তুলা চাষ হত।   বিভিন্ন হরপ্পান বসতি থেকে শস্য দানা ও শস্যের আঁশ পাওয়া গেছে। হরপ্পান পর্যায়ে আঁশ হিসাবে শন গাছের (Flax plant – Linum usitatissimum L.) ব্যবহার দেখতে পাওয়া যায় নৌশারো, মিরি কালাত (মকরান, বালুচিস্তান) ও বালাথলে (রাজস্থান)।  উত্তর-পশ্চিম ভারতের মাসুদপুর  ১ ও মাসুদপুর ৭-এ সিন্ধু সভ্যতার অধিবাসীরা ধান, দেশী জোয়ার (Millet) এবং গম, যব, অন্যান্য রবি শস্যের সাথে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ডাল খেত।

-------------------------------------------------------

দেখুনঃ Dorian Q. Fuller and Marco Madella, Issues in Harappan Archaeobotany: Retrospect and Prospect, in, Protohistory: Archaeology of the Harappan Civilization, eds., S. Settar and Ravi Korisettar, Published by Manohar in association with Indian Council of Historical Research, 2000, p. 367.

দেখুনঃ Sajjan Kumar, Domestication of Animals in Harappan Civilization, 2014, p. 168.

দেখুনঃ Dorian Q. Fuler, The spread of textile production and textile crops in India beyond the Harappan zone: an aspect of the emergence of craft specialization and systematic trade, in, Current Studies on the Indus Civilization, Volume I, eds., Toshiki Osada and Akinori Uesugi, 2010, p. 7.

দেখুনঃ Cameron A. Petrie, Danika Parikh, Adam S. Green and Jennifer Bates, Looking beneath the Veneer. Thoughts about Environmental and Cultural Diversity in the Indus Civilization, in, Walking with the Unicorn: Social Organization and Material Culture inn Ancient South Asia, ed., Dennys Frenez et al., 2017, p. 458.

-------------------------------------------------------

সম্প্রতি জানা যাচ্ছে যে, সিন্ধু সভ্যতায় পাটের ব্যবহার হত। হরপ্পায় খনন করার সময়ে খোলামকুচির কিনারার গায়ে পাটের আঁশ থেকে তৈরী চটের কাপড়ের ছাপ পাওয়া গেছে।  এছাড়াও গুজরাটের রোজদিতে পাটের বীজের অবশেষ পাওয়া গেছে।

-------------------------------------------------------

দেখুনঃ Rita P. Wright, David L. Lentz, Harriet F. Beaubien, and Christine K. Kimbrough, New evidence for jute (Corchorus capsularis L.) in the Indus Civilization, in, Archaeological and Anthropological Sciences, 4(2), 2012, pp. 137, 139, 142.

-------------------------------------------------------

হরপ্পানদের অর্থনৈতিক ভিত্তি ছিল কৃষি, পশুপালন ও শিল্পোৎপাদন। কৃষিতে যে তাদের  লাঙ্গলের ব্যবহার ছিল তা বুঝা যায় এখানকার বসতিগুলিতে জনসংখ্যা দেখে। কারণ এত জনসংখ্যাকে লাঙ্গল ভিত্তিক কৃষির উৎপাদন ছাড়া ধারণ করা সম্ভব ছিল না। কালিবঙ্গানে আদি হরপ্পান পর্যায়ে চাষ করা খেতের চিহ্ন পাওয়াতে এই বিষয়টি এখন সন্দোতীত যে, হরপ্পানরা লাঙ্গল ভিত্তিক চাষাবাদ জানত। এছাড়াও পোড়া মাটির লাঙ্গলও হরপ্পান বসতি থেকে পাওয়া গেছে। লেখকরা মত প্রকাশ করেন যে, সিন্ধুর কৃষকরা বহুমুখী শস্যের (Multi-cropping) প্রচলন করেছিল ও সময়ের সাথে সাথে শস্যের বহুমুখীকরণ (Crop diversification) বেড়ে গিয়েছিল।  মনে করা হয় যে, একই জমিতে একাধিক ফসল ফলানো হত অথবা একই জমি একাধিক ঋতুতে ব্যবহৃত হত। হরপ্পা ও গুজরাটের গ্রাম-আকারের বিভিন্ন ছোট বসতি থেকে প্রত্ন-উদ্ভিদ বিজ্ঞানের (Archaeobotanical) তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে যে, ঐ সমস্ত অঞ্চলে শীতকালীন শস্য প্রাধান্যশীল ও গ্রীষ্মকালীন শস্য প্রাধান্যশীল কৌশল গ্রহণ করা হত।  আগে হরপ্পা ও মহেঞ্জো-দাড়োতে একটি বড় কাঠামোকে শস্যাগার বলে মনে করা হত। কিন্তু সেখানে শস্য মজুদের কোনো সাক্ষ্য না পাওয়াতে মনে করা হয় যে, এটি গুদাম বা ‘মহা-মিলনায়তন’ হতে পারে। তবে সিন্ধুর বসতিগুলিতে শস্য মজুদের জন্য গর্ত দেখা গেছে। তাছাড়া পাথরের আস্তরণ দেওয়া পাত্রও পাওয়া গেছে। নগর, শহর ও গ্রাম মিলিয়ে সিন্ধু সভ্যতায় পাওয়া এত বিপুল সংখ্যক বসতিতে (এখন পর্যন্ত জানা তিন হাজারের চেয়েও বেশী) বাস করা বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠীর খাদ্য যোগান দিবার জন্য কৃত্রিম সেচ ব্যবস্থা ভিত্তিক কৃষি গড়া ছাড়া যে সম্ভব ছিল না সেটি অনুমান করা যায়। এই বিষয়ে নীচে আলোচনা করা হল।

-------------------------------------------------------

দেখুনঃ Cameron A. Petrie, Diversity, variability, adaptation and ‘fragility’ in the Indus Civilization, in, The Evolution of Fragility: Setting the Terms, ed., Norman Yoffee, McDonald Institute for Archaeological Research, University of Cambridge, Cambridge, 2019, p. 118.

  দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ১১৮।

-------------------------------------------------------

 

হরপ্পান শিল্প ও প্রযুক্তি

আগের আদি হরপ্পান পর্যায়ে যে সমস্ত কারিগরী বিশেষীকরণ দেখা গিয়েছিল সেগুলিই আরো জটিল ও আরো নূতন আবিষ্কৃত কারিগরী প্রক্রিয়া ও নূতন কাঁচামাল সংগ্রহের মাধ্যমে হরপ্পান পর্যায়ে বিকাশ লাভ করে। এই সময় বৃহত্তর সিন্ধু উপত্যকা অঞ্চলে এক ধরনের সমরূপতা দেখা গেলেও কিছু অলংকার ও মৃৎপাত্রের ধরনে আঞ্চলিক ভিন্নতা ছিল। যেমন হরপ্পা ও মহেঞ্জো-দাড়োর স্বতন্ত্র শৈলীর মৃৎপাত্র ছিল যা বালুচিস্তান, গুজরাট কিংবা গাঙ্গেয় অঞ্চলের স্থানীয় মৃৎপাত্র শৈলী থেকে ভিন্ন।  অধিকাংশ বসতিতে মৃৎপাত্র ও পাথরের যন্ত্রপাতি তৈরী ও ধাতুর কাজ করা হত। কারণ দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনে এগুলি কাজে লাগে। এছাড়া অন্যান্য শিল্পের ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, কাঁচামালের উৎসের কাছে কোনো বসতিতে কাঁচামাল প্রক্রিয়াজাত করা হত। যেমন, সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চলে ঝিনুক বা শামুকের খোলা প্রক্রিয়াজাত করা হত। আবার অন্যদিকে অনেক দূরে তামার খনির কাছে তামা গলিয়ে পিণ্ড আকারে অথবা এর সাথে টিন মিশিয়ে ব্রোঞ্জের পিণ্ড তৈরী করে হরপ্পান নগরে আনা হত। আংশিকভাবে প্রক্রিয়াজাত করে ঝিনুকের খোলা, আকিক পাথর, খড়িপাথর ও তামা সিন্ধুর নগরগুলিতে আনার পর এগুলি দিয়ে অলংকার, যন্ত্রপাতি অথবা অন্য কোনো বস্তু তৈরী করা হত। সিন্ধুতে কাঁচামাল হিসাবে সবচেয়ে বেশী যে জিনিসটির ব্যবহার দেখা গেছে সেটি হল খড়িপাথর। যে সমস্ত শিল্পে স্থানীয় কাঁচামাল ও সহজ প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয় দেখা গেছে যে, সে সমস্ত শিল্পে সিন্ধু উপত্যকা জুড়ে ভিন্নতা দেখা যায়, অন্যদিকে যে সমস্ত শিল্পে অস্থানীয় কাঁচামাল ও খুবই জটিল প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয় দেখা গেছে যে, সেই সমস্ত শিল্প যথেষ্ট প্রমিত (Standardized)।  এছাড়াও যে সমস্ত শিল্পে স্থানীয় কাঁচামাল কিন্তু জটিল প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়, যেমন পাথরের চুড়ি অথবা রঙিন মৃৎপাত্র, সেক্ষেত্রে এর উপযোগিতার উপর প্রমিতকরণ নির্ভর করত। হরপ্পান বসতিগুলিতে যে সমস্ত বিষয়ে শিল্প গড়ে উঠতে দেখা যায় সেগুলি হল কাল রং করা লাল আস্তরণ দেওয়া মৃৎপাত্র, খোদাই কাজ করা খড়িপাথরের সীল, ঘনাকৃতির বাটখারা, পাথরের জিনিসপত্র, উপ-রত্ন পাথর ও রত্নের পুতি, মাটির মূর্তি, বিভিন্ন জিনিস থেকে তৈরী চুড়ি (মাটি, খোলা, তামা, চীনামাটি ও পাথর), ইত্যাদি। দেখা গেছে যে, কিছু বসতি কোনো বিশেষ ক্ষেত্রে বিশেষীকৃত কারখানা গড়ে তুলেছে। যেমন, বালাকোটে ঝিনুকের খোলার তৈরী জিনিসের বিপুল পরিমাণ নমুনা পাওয়া গেছে।

-------------------------------------------------------

দেখুনঃ Jonathan Mark Kenoyer, Ancient Cities of the Indus Valley Civilization, 1998, p. 149.

দেখুনঃ প্রাগুক্ত, ১৫০।

দেখুনঃ George F. Dales and Jonathan Mark Kenoyer, Shell Working at Ancient Balakot, Pakistan, in, Expedition, Winter 1977. p. 14.

-------------------------------------------------------

খোলা কাটতে ও প্রক্রিয়াকরণ করে চুড়ি, চামচ, কোনো কিছুতে খোচিত করতে, পুতি ও অন্যান্য বিভিন্ন ধরনের জিনিস বানাতে হরপ্পানরা খুবই জটিল প্রযুক্তি ব্যবহার করত।  এই ধরনের জিনিস মহেঞ্জো-দাড়ো ও হরপ্পায় খুবই পরিচিত ছিল। এছাড়াও গুজরাটের হরপ্পান বসতি যেমন রংপুর, লোথাল, নাগেশ্বর, কুনটাসি, নাগওয়াড়া, শিকারপুর, ধোলাভিরা, জেখাদা, বাগাস্রা ও বেট দ্বারকাতে এই ধরনের জিনিস পাওয়া গেছে।

-------------------------------------------------------

 দেখুনঃ Arati Deshpande-Mukherjee and Vasant Shinde, Evaluating the Role of the Molluscan Shell Assemblage Recovered from Padri, A Coastal Harappan Settlement in Gujarat, India, in, Archaeomalacology: Shells in the Archaeological Record, eds., Katherine Szabó, Catherine Dupont, Vesna Dimitrijević, Luis Gómez Gastélum & Nathalie Serrand, BAR International Series 2666, Archaeopress, Oxford, 2014, p. 19.    

দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ১৯।

-------------------------------------------------------

পাতা : ২৫

সিন্ধুর কারিগররা নূতন বস্তু তৈরীতে অসাধারণ সৃষ্টিশীল ছিল বলে গবেষক হিদার মিলার মন্তব্য করেছেন। বিশেষ ধরনের খড়িপাথর (Sintered talcose) ও সিলিকেট জাতীয় বস্তুর (Siliceous materials) জন্য এটি বিশেষভাবে সত্য।  অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে যে, যে সমস্ত কৃত্রিম জিনিস তারা তৈরী করেছে সেগুলি দুর্লভ প্রাকৃতিক জিনিসের মত। তারা বিভিন্ন বস্তুকে উচ্চ তাপে রূপান্তরিত করে তার মূল্যবৃদ্ধি করত। শুধু তাপ দিয়ে নয় অন্যভাবেও তারা বিভিন্ন জিনিসের মূল্য বৃদ্ধি করত। যে গুণগুলি তারা ঐ সমস্ত জিনিসে আরোপ করত সেগুলি হল রং ও উচ্চ আলো প্রতিফলন ক্ষমতা এবং কোনো ক্ষেত্রে শব্দ তৈরীর ক্ষমতা।  দেখা গেছে যে, সবচেয়ে মূল্যবান জিনিসগুলি কৃত্রিমভাবে তৈরী করা, এবং ফলে তার রং ও অবস্থার রূপান্তর ঘটানো হয়েছে। পাথরের চুড়ি (Stoneware bangle) সবচেয়ে মূল্যবান জিনিসগুলির মধ্যে একটি বলে গবেষকরা মনে করেন, যা বিশেষভাবে আগুনের ধারকের মধ্যে উচ্চ তাপে  তৈরী করা হত। এই বিষয়টি গবেষকদের আশ্চর্য করেছে যে, মিসর ও মেসোপটেমিয়ায় যেখানে লাপিস লাজুলি উচ্চ মূল্যের জিনিস ছিল সেখানে সিন্ধুতে তা অব্যবহৃত বা কম ব্যবহৃত হয়েছে।  অথচ লাপিস লাজুলি বাণিজ্যের মাধ্যমে বালুচিস্তান ও আফগানিস্তানে পাওয়া যেত, তেমন আমু দরিয়া (অক্সাস) অঞ্চলে অবস্থিত বসতি শোরতুগাই থেকে আনা যেত। নীলকান্তমণি (Turquoise) ও লাপিস লাজুলির প্রতি সিন্ধুর মানুষদের তুলনামূলক নির্লিপ্ততা দেখে প্রত্নতাত্ত্বিক জঁ-ফ্রাঁসোয়া জারিজ মন্তব্য করেছেন যে, ‘তারা এগুলি পছন্দ করত না, কারণ তারা এগুলি নিয়ে খেলতে পারত না।’  তার মানে যে জিনিসগুলির তাপের মাধ্যমে প্রক্রিয়াকরণের ফলে রং, আলো প্রতিফলন ক্ষমতা বা কাঠিন্যে পরিবর্তন ঘটে না সেগুলির প্রতি সিন্ধুর মানুষদের আগ্রহ ছিল না।

-------------------------------------------------------

 দেখুনঃ Heather M.-L. Miller, Issues in the Determination of Ancient Value Systems: The Role of Talc (Steatite) and Faience in the Indus Civilization, in, Intercultural Relations between South and Southwest Asia, eds., E. Olijdam & R.H. Spoor, BAR International Series 1826, 2008, p. 153.

  দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ১৫৪।

  দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ১৫২।

  দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ১৫৫।

-------------------------------------------------------

সোহর ডাম্ব/ নালের পর্ব ৩ থেকে পাওয়া অশ্বত্থ গাছের পাতার ছবিযুক্ত অগভীর মৃৎপাত্র (সৌজন্যেঃ Ute Franke, 2016)

সিন্ধুর মুৎপাত্র বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ছিল এর রঙের বিষয়বস্তু ও গঠনের অতুলনীয় শৈলীর জন্য। এই বৈশিষ্ট্যপূর্ণ মৃৎপাত্র ছড়ানো ছিল বিস্তীর্ণ অঞ্চলে পশ্চিমে সুটকাজেনডোর থেকে পূর্বে আলমগীরপুর, উত্তরে শোরতুগাই থেকে দক্ষিণে নাগেশ্বর পর্যন্ত।  সিন্ধুর নগরগুলিতে বেশীরভাগ রঙিন মৃৎপাত্রের গায়ে লাল প্রলেপ দেওয়া থাকত এবং তারপর কাল রং দিয়ে নকশা করা থাকত। কিছু বৃহদাকৃতির জালার (Storage vessel) বাইরে ও ভিতরে উভয় দিকে কাল প্রলেপ দেওয়া হত। প্রায় ২৬০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের দিকে ফুল ও জ্যামিতিক চিহ্নের সারি কিনারা থেকে শুরু হয়ে পাত্রের নীচের অংশে থাকত। এই নকশাগুলির মধ্যে অশ্বথ গাছের পাতা, মাছের আঁশ ও পরস্পর ছেদকারী বৃত্ত অন্যতম। এই নকশাগুলির উৎস আগের যুগের (৩৩০০-২৬০০ খ্রীঃপূঃ) সংস্কৃতিতে দেখতে পাওয়া যায়।

-------------------------------------------------------

দেখুনঃ Vivek Dangi and Akinori Uesugi, A Study on the Harappan Painted Pottery from the Ghaggar Plains, in, Puratattva, No. 43, 2013, p. 195.

-------------------------------------------------------

ফারমানা থেকে পাওয়া উপরত্ন পাথরের পুতি (সৌজন্যেঃ Vasant Shinde, Toshiki Osada, Akinori Uesugi and Manmohan Kumar, 2008)

পাথরের ঘনত্ব, জলাভেদ্যতা, সমরূপতা ও সিলিকেট সমৃদ্ধির বিষয়টি বিবেচনা করলে হরপ্পানরা পুথিবীতে প্রথম পাথর থেকে বানানো জিনিসপত্র (Stoneware) তৈরী করেছিল।  কিছু নমুনা পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে, এই ধরনের ঘন কাল পাথরের জিনিসপত্র হরপ্পান যুগের দুই সহস্র বৎসর পরে চীনে হান বংশের সময়ে তৈরী হয়েছিল।  এই ধরনের ব্যতিক্রমী পাথরের চুড়ি মহেঞ্জো-দাড়ো ও হরপ্পা উভয় স্থানেই পাওয়া গেছে। সিন্ধুর বসতিগুলিতে পাথরের ও চকচকে চীনামাটির (Faience) জিনিসপত্র তৈরীর বিশেষীকৃত কারখানা গড়ে উঠেছিল। সিন্ধুর বসতি থেকে চকচকে চীনামাটি দিয়ে চুড়ি, পুতি, আংটি, কবচ, মুদ্রার মত চাকতি (Token), জীবজন্তুর ছোট মূর্তি, ছাপ দেওয়ার সীল ও ছোট পাত্র পাওয়া গেছে। এই ধরনের চুড়ির দুষ্প্র্রাপ্যতা, এর জটিল ও অনন্য উৎপাদন প্রণালী, কিছু চুড়িতে লিপি উৎকীর্ণ থাকা, উৎপাদনের কঠোর নিয়ন্ত্রণ এবং শুধুমাত্র হরপ্পা ও মহেঞ্জো-দাড়োর মত বড় নগরে পাওয়ায় মনে করা হয় যে, এই সমস্ত চুড়ি সামাজিক ক্রিয়াকলাপের সাথে যুক্ত ছিল।

-------------------------------------------------------

দেখুনঃ George F. Dales, Some Specialized Ceramic Studies at Harappa, in, ed, Richard H. Meadow, Harappa Excvations 1986-1990: A Multidisciplinary Approach to Third Millennium Urbanism, 1991, pp. 67-68.

  দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ৬৮।

দেখুনঃ George F. Dales, Some Specialized Ceramic Studies at Harappa, in, ed, Richard H. Meadow, Harappa Excvations 1986-1990: A Multidisciplinary Approach to Third Millennium Urbanism, 1991, p. 68.

-------------------------------------------------------

পাতা : ২৬

রাজস্থান অথবা দূরবর্তী ওমানের খনিগুলি থেকে তামা গলিয়ে ও সাথে টিন, দস্তা ও অন্যান্য ধাতু মিশিয়ে পিণ্ডাকৃতি করে বণিক বা অন্যান্য যাযাবর গোষ্ঠীর মাধ্যমে সিন্ধুর কারিগরদের কাছে এসে পৌঁছাত। সাম্প্রতিক গবেষণা থেকে জানা যাচ্ছে যে, তামা ও ব্রোঞ্জের জিনিসপত্র তৈরীতে সিন্ধু সভ্যতার কারিগরদের সম্পর্কে আগে যে ধারণা ছিল তারা তার চেয়ে অনেক বেশী পরিমাণে তামা ও ব্রোঞ্জের জিনিস তৈরী করত। তারা তামার সংকর ধাতু তৈরী করে ব্রোঞ্জ ও এমনকি পিতলও তৈরী করেছে বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। কুনটাসি ও ফারমানায় পাওয়া কিছু জিনিসের বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে যে, তারা তামার সাথে যথেষ্ট অনুপাতে দস্তার মিশ্রণ দিয়েছিল যা সঠিক পিতল বলে বিবেচনা করা যায়।  তামা, ব্রোঞ্জ বা তামার সংকর ধাতু দিয়ে তারা যন্ত্রপাতি, অস্ত্র, সূঁচ, পিন, চুড়ি, পুতি, আংটি ও কবচ বানাত।

-------------------------------------------------------

দেখুনঃ Brett C. Hoffman, Indus Copper and Bronze: Traditional Perspectives and New Interpretations, in, Walking with the Unicorn: Social Organization and Material Culture in Ancient South Asia, eds., Dennys Frenez, Gregg M. Gamison, Randall W. Law, Massimo Vidale and Richard H. Meadow, Archaeopress Publishing Limited, Oxford, 2018, pp. 260-261.

-------------------------------------------------------

সিন্ধু অঞ্চলে যে সুতা তৈরী ও কাপড় বোনা হত তার অনেক রকম প্রমাণ পাওয় যায়। হরপ্পায় চীনা মাটির মৃৎপাত্রের ভিতরের গায়ে কাপড়ের ছাপ দেখা গেছে। এছাড়া মহেঞ্জো-দাড়োতে সুতার কাপড়ের অবশেষ পাওয়া গেছে। তামার যন্ত্রপাতির উপর সুতা ও কাপড়ের অনেক নমুনা পাওয়া গেছে। এখন পর্যন্ত তাঁতের কোনো চিত্র উৎকীর্ণ অবস্থায় পাওয়া যায় নাই। তবু পরোক্ষ বিভিন্ন জিনিসপত্র থেকে মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে যে, সিন্ধু অঞ্চলে তাঁতের ব্যবহার ছিল।

-------------------------------------------------------

দেখুনঃ Jonathan Mark Kenoyer-, Ancient Cities of the Indus Valley Civilization, 1998, p. 159.

-------------------------------------------------------

ফারমানা থেকে পাওয়া হাড়ের যন্ত্রপাতি (সৌজন্যেঃ Vasant Shinde, Toshiki Osada, Akinori Uesugi and Manmohan Kumar, 2008)

সিন্ধু সভ্যতায় পুতি শিল্প অন্যতম একটি প্রাচীন শিল্প ছিল। মেহরগড়ে মৃৎপাত্র আবিষ্কার হওয়ার শতাধিক বৎসর আগে পুতির সুন্দর অলংকার তৈরী হত। এগুলি মূল্যবান রত্ন, খোলা ও এমনকি তামার তৈরী হত। সিন্ধুর বসতিগুলির প্রায় প্রতিটাতেই পুতি তৈরীর কিছু না কিছু প্রমাণ পাওয়া গেছে। সিন্ধুর নগর পর্যায়ে পুতি তৈরী একটি অত্যন্ত বিশেষীকৃত শিল্প হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। এই সময়ে পুতি তৈরীতে নূতন কাঁচামাল ও নূতন কৃৎকৌশল প্রয়োগ করতে দেখা যায়। কৃত্রিম তাপের সাহায্যে দুর্লভ পাথর থেকে এক ধরনের সরু ছিদ্র করার ড্রিল তৈরী করা হয়। ঘাগর উপত্যকার ফারমানায় পাথরের পুতি তৈরীতে যে সমস্ত কাঁচামাল ব্যবহার করা হত সেগুলি হল খড়িপাথর, কার্নেলিয়ান, জ্যাসপার, আকিক, ক্যালসেডনি, লাপিস লাজুলি, আমাজোনাইট, চুনাপাথর ও সিল্টস্টোন।  এর মধ্যে খড়িপাথরের পুতি সবচেয়ে বেশি ছিল।

-------------------------------------------------------

দেখুনঃ Akinori Uesugi, Manmohan Kumar and Vivek Dangi, Indus Stone Beads in the Ghaggar Plain with a Focus on the Evidence from Farmana and Mitathal, in, Walking with the Unicorn: Social Organization and Material Culture in Ancient South Asia, eds., Dennys Frenez, Gregg M. Gamison, Randall W. Law, Massimo Vidale and Richard H. Meadow, 2018, p. 571.

-------------------------------------------------------

 

জ্যোতির্বিজ্ঞান ও বিজ্ঞান

মহেঞ্জো-দাড়ো সহ কয়েকটি নগরের কাঠামোর সামান্য সরে যাওয়া সহ উত্তর-দক্ষিণ ও পূর্ব-পশ্চিম অক্ষ বরাবর ভবন ও রাস্তা নির্মাণ থেকে ধারণা করা যায় যে হরপ্পানরা সূর্যের ও নক্ষত্রের অবস্থান ভিত্তিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের তথ্য ব্যবহার করত। প্রাথমিক নির্মাণের পর তারা অনেক সময় প্রয়োজন অনুযায়ী কিছু পরিবর্তন করত। প্রায় ২৩০০ খ্রীঃপূঃ-এ এখনকার মত ধ্রুবতারা আকাশের নক্ষত্র সমূহের ঘূর্ণনের কেন্দ্র ছিল না। এই স্থানে কিছুটা অনুজ্জ্বল নক্ষত্র ড্রাকোনিস অবস্থান করত। তখন তারা নক্ষত্রের উদয় ও অস্তকে বা সূর্যের উদয়-অস্তের গতিপথ পর্যবেক্ষণ করে দিক ঠিক করত বলে মনে করা হয়।   কিছু লেখক উল্লেখ করেছেন যে, কৃত্তিকা নক্ষত্রপুঞ্জকে ভিত্তি করে মহেঞ্জো-দাড়োর রাস্তার দিক নির্ধারণ করা হয়।  এছাড়াও বলা হয় যে, মহেঞ্জো-দাড়োর অজানা চক্রাকার পাথর Ringstone) ক্যালেন্ডারের কাজে ব্যবহার করা হত। ধারণা করা হয় যে, ধোলাভিরার বহিঃপ্রাচীর ক্যালেন্ডার ও গ্রহ নক্ষত্র পর্যবেক্ষণের উদ্দেশ্যে মানমন্দির হিসাবে ব্যবহৃত হত।

-------------------------------------------------------

দেখুনঃ Jonathan Mark kenoyer, Ancient Cities of the Indus Valley Civilization, 1998, p. 52.

দেখুনঃ Michel Danino, Metrology and Linear Mesurements, in, History of Ancient India: Protohistoric Foundations, Vol. II, eds., Dilip K. Chakrabarti and Makkhan Lal, Vivekananda International Foundation, New Delhi, 2014, p. 310.

দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ৩১০।

-------------------------------------------------------

আরেকটি মত হল যে, কোট দিজি পর্যায় ও পরবর্তী হরপ্পান পর্যায়ে সেখানকার স্থপতিরা সূর্যের গতিপথের মাধ্যমে অথবা আরো জটিল পদ্ধতি রোহিনী (বা আলডেবারান) অথবা কৃত্তিকা নক্ষত্রপুঞ্জের উদয় দেখে দিক নির্ণয় করত।  মহেঞ্জো-দাড়ো খননে দেখা গেছে যে বিভিন্ন সময়ে যে রাস্তা বা বাড়ীঘর তৈরী করা হয়েছিল সেগুলি বিভিন্ন দিক অনুসরণ করেছে, প্রথম রাস্তা তৈরী করার শতাধিক বৎসর পর নগরের উপকণ্ঠে নতুন রাস্তা বা বাড়ীঘর গড়ে তুলা হত কিছুটা ভিন্ন দিকে। মনে করা হয় যে শতাধিক বৎসর পরের স্থপতিরা যখন দিক নির্ণয় করত সেই সময়ে পৃথিবীর কক্ষের কোণে কিছুটা পরিবর্তনের কারণে একই নক্ষত্রের অবস্থান পরিবর্তন হওয়ায় ও সূর্যের অবস্থান পরিবর্তন হওয়ায় এমনটা ঘটত।

-------------------------------------------------------

 দেখুনঃ Jonathan Mark kenoyer, Ancient Cities of the Indus Valley Civilization, 1998, p. 52.

দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ৫২।

-------------------------------------------------------

কালিবঙ্গানে এমন একটি পোড়ামাটির জিনিস পাওয়া গেছে যেটাকে সময় মাপার উদ্দেশ্যে তৈরী বলে মনে করা হয়।  এটি ৭ সেন্টি মিটার উচ্চতার ও ৭ সেন্টি মিটার ব্যাসের।

-------------------------------------------------------

দেখুনঃ Michel Danino, Metrology and Linear Mesurements, in, History of Ancient India: Protohistoric Foundations, Vol. II, eds., Dilip K. Chakrabarti and Makkhan Lal, 2014, p. 310.

-------------------------------------------------------

পাতা : ২৭

 

সিন্ধুর বসতিগুলিতে পাওয়া অন্যান্য জিনিস

সিন্ধুর বসতিগুলিতে সাধারণভাবে চুলা বা উনুনের আশেপাশে পাওয়া পোড়া মাটির তিন কোনা পিঠাকৃতি পিণ্ডর (Triangular terracotta cake) ব্যবহার সম্পর্কে দীর্ঘ দিন অস্পষ্টতা ছিল। এগুলিকে রান্নার কাজে ব্যবহার হত বলে এখন মনে করা হয়, যার ভিতর দিয়ে তাপ পরিবহন হত।  মেহরগড়ে একই কাজে নুড়ি পাথরের ব্যবহার দেখা গিয়েছিল, কিন্তু নৌশারোতে হরপ্পান পর্যায় শুরু হলে সম্পূর্ণভাবে তিন কোনাকৃতির পোড়ামাটির পিঠাকৃতি পিণ্ড ব্যবহার হতে দেখা যায়। হরপ্পায় চুল্লির মুখের কাছে বহু সংখ্যক কম আগুনে পোড়ানো পিঠাকৃতি পিণ্ড পাওয়া গেছে, আঙ্গুলের ছাপযুক্ত আলুর আকৃতির এই জিনিসকে মুষ্টিকা বলা হয়েছে। এটি চুলার ভিতরে বাতাস প্রবেশের জন্য ও একই সাথে কার্যকরভাবে ভিতরে তাপ ধরে রাখার জন্য ব্যবহৃত হত বলে খননকারীরা মনে করেন।

-------------------------------------------------------

 দেখুনঃ Ute Franke and Elisa Cortesi, Baluchistan and the Indus Civilization, in, Lost and Found: Prehistoric Pottery Treasures from Bauchistan, eds., Ute Franks and Elisa Cortesi, Meseum of Isamic Art, Pergamon Museum, Berlin, 2015, p. 343.

দেখুনঃ George F. Dales and J. Mark Kenoyer, The Harappa Project 1986-1989: New Investigation at an Ancient Indus City, in, Harappan Civilization: A Recent Perspective, 2nd ed., ed., Gregory L. Possehl, Oxford & IBH Publishing Pvt. Ltd., New Dehi, 1993, p. 490.

-------------------------------------------------------

সিন্ধুর বসতিগুলিতে প্রচুর খেলার জিনিস পাওয়া গেছে। মহেঞ্জো-দাড়ো ও হরপ্পায় ঘনাকৃতির পাশা খেলার ঘুটি পাওয়া গেছে। এগুলি পোড়ামাটির বিভিন্ন আকারের, নানা ধরনের পাথর, ও অন্যান্য জিনিসের তৈরী।  আজকের লুডোর ঘুটির মত এগুলির গায়ে বিভিন্ন বিন্যাসে এক থেকে ছয় পর্যন্ত বিন্দু দেওয়া থাকত। হরপ্পায় কেবলমাত্র একটি ঘুটি পাওয়া গেছে যার বিন্যাস আজকের ঘুটির সাথে মিলে যায়। এছাড়াও বহুসংখ্যক দণ্ডাকার ঘুটি ও অন্যান্য দণ্ডাকার জিনিস পাওয়া গিয়েছিল। এগুলি বেশীরভাগই হাতির দাঁতের, ও কিছু হাঁড়ের তৈরী পোড়ামাটির ও পাথরের বল ও মার্বেল, ঘর্ঘর শব্দ করা পোড়ামাটির খেলনা বা বাঁশি (Rattle), ইত্যাদি। সেখানে অনেক পোড়ামাটির মানুষের মূর্তি বিশেষত ন্রাী মূর্তি পাওয়া গেলেও মানুষের মূর্তিগুলিকে খেলনা হিসাবে ধরা হয় না, বিশেষভাবে খেলনার জন্য তৈরী করা হত বলে মনে করা হয় না।  তবে মানুষের মূর্তির চেয়েও বেশী সংখ্যক পশু-পাখীর মূর্তি পাওয়া গেছে। এগুলির মধ্যে বেশীরভাগই ষাঁড়ের মূর্তি, বাকীগুলির মধ্যে মোষ, ভাল্লুক, গণ্ডার, হাতি, খরগোস, কুকুর, শুয়োর, বিভিন্ন ধরনের পাখী, ইত্যাদি। আশ্চর্য হবার মত বিষয় যে, সেখানে কোনো গাভীর মূর্তি পাওয়া যায় নাই।  এছাড়া পাওয়া গেছে লেজের দিকে ছিদ্র সহ বড় পেটওয়ালা ভিতরে ফাঁপা পাখী যা বাঁশি হিসাবে ব্যবহার হত। আরো পাওয়া গেছে নীচে চাকাযুক্ত পশু বা পাখী ও বিভিন্ন আকৃতির চাকাওয়ালা গাড়ীর কাঠামো। ছোটদের খেলার জন্য আরেকটি জিনিস পাওয়া গেছে, যা হল ঘষে ক্ষয় করে চাকতির আকৃতি দেওয়া প্রচুর পরিমাণ খোলামকুচি।

-------------------------------------------------------

দেখুনঃ Elke Rogersdotter, Split Appearance. Patchy and Coherent Features in Fragments of Gameplay, Mohenjo-daro, Sindh, in, Iranian Journal of Archaeological Studies 2: 1, 2012, p. 92.

দেখুনঃ Elke Rogersdotter, in, The Forgotten: an Approach on Harappan Toy Artefacts, University of Umeå, Umeå, 2006, p. 41.

  দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ৪১।

-------------------------------------------------------

হরপ্পা থেকে পাওয়া দুটি খেলনার গরুর গাড়ী (সৌজন্যেঃ Randall Law, 2006)

ফারমানা থেকে পাওয়া পোড়ামাটির প্রাণীর রঙিন মূর্তি (সৌজন্যেঃ Vasant Shinde, Toshiki Osada, Akinori Uesugi and Manmohan Kumar, 2008)

 

সিন্ধুর ভাষা ও লিপি

সিন্ধু সভ্যতার লোকজন কোন ভাষায় কথা বলত তা আজও অজানা। বিভিন্ন লেখক এই বিষয়ে বিভিন্ন মত প্রকাশ করেন। লেখকদের মধ্যে অনেকে এটিকে আর্য বা ইন্দো-আর্য ভাষা আবার কেউ কেউ দ্রাবিড় ভাষা বলে মনে করেন। বিভিন্ন স্থানের নাম ও সিন্ধুর ভৌগোলিক অঞ্চলে নদীর নাম থেকে মনে করা হয় সিন্ধুর নগর সভ্যতার সময়ে অনেক ভাষা পরিবার চালু ছিল। কিছু ভাষাতত্ত্ববিদ মনে করেন সেখানে দ্রাবিড়, মুণ্ডারী (অস্ট্রো-এশিয়াটিক), ইন্দো-আর্য, ভোট-চীনা ও নবপ্রস্তর যুগের অজানা ভাষা প্রচলিত ছিল।  বৃহত্তর সিন্ধু উপত্যকার বিভিন্ন অঞ্চলে এই ভাষাগুলি ব্যবহার হয়ে থাকতে পারে বলে তারা মনে করেন। ধবলিকর মনে করেন, হরপ্পান এমনকি আদি হরপ্পান পর্যায়ে প্রাকৃত ভাষা জনপ্রিয় ভাষা হিসাবে প্রচলিত ছিল।  আমরা মনে করি বৃহত্তর সিন্ধু উপত্যকাব্যাপী সবার ভাষা এক ছিল না। আজকের উত্তর-পূর্ব আফগানিস্তান, সমগ্র পাকিস্তান ও ভারতের উত্তর-পশ্চিম অংশের মানুষজন যেমন বিভিন্ন ভাষায় কথা বলে তেমনি হরপ্পান যুগেও বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষা ছিল। কিন্তু সিন্ধু সভ্যতার শাসকরা সমগ্র অঞ্চলকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে গিয়ে সিন্ধুর সর্বজনীন লিপির মতই একটি সর্বজনীন ভাষাও প্রচলন করেছিল। আমরা অনুমান করি, যে ভাষায় ঋগ্বেদ লিখা হয়েছিল সেই ভাষা ছিল বৃহত্তর সিন্ধু উপত্যকার জনসাধারণের জন্য একটি সর্বজনীন ভাষা। আপাতত আমাদের সুবিধার জন্য এই ভাষাকে বৈদিক হিসাবে অভিহিত করতে পারি। এই বিষয়ে আমরা পরবর্তী অধ্যায়ে আরো আলোচনা করেছি।

-------------------------------------------------------

  প্রত্নতাত্ত্বিক বি,বি, লাল হরপ্পানদের ভাষা হিসাবে দ্রাবিড় ভাষা হবার সম্ভবনা নাকচ করেন। তিনি মনে করেন হরপ্পানদের ভাষা বৈদিক ভাষা ছিল। দেখুনঃ B.B. Lal, How Deep are the Roots of Indian Civilization? Archaeology Answers, Aryan Books International, New Delhi, 2009, pp. 96, 114-126.  

দেখুনঃ Jonathan Mark Kenoyer, The Indus Script: Origins, Use and Disappearance, in, Dialogue of Civilization: Comparing Multiple Centers, ed., Hui Zhao, Shanghai Guji Press, Shanghai, 2020, p. 249.

দেখুনঃ M.K. Dhavalikar, Linguistic Archaeology: The Harappan Language, in, Purātattva, No. 45, 2015, p. 71.

-------------------------------------------------------

পাতা : ২৮

সিন্ধুর লোকজন লিপি ব্যবহার করত, যেগুলি মূলত টিকে আছে সীলে, মৃৎপাত্রে ও অন্যান্য স্থায়ী জিনিসপত্রে যেমন, পাথর, পোড়ামাটি ও তামার উপর। সিন্ধু লিপির উৎস দেখতে পাওয়া যায় আদি হরপ্পান সময়ে ৩৩০০-২৮০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দ সময়ে, হরপ্পা, রহমান ধেরি, মেহরগড় ও নৌশারোর মত বসতিগুলিতে। ক্রমবিকাশের একটি পর্যায়ে এটি চূড়ান্ত রূপ নেয় ২৬০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের দিকে এবং সমগ্র অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। সিন্ধুর নগর, গ্রাম ও বাণিজ্যিক বসতিগুলিতে সীল ও লিপি ব্যবহার হত। সিন্ধু লিপির পাঠোদ্ধার এখনো সম্ভব হয় নাই, যদিও অনেকেই এর উপরে কাজ করেছেন বা করে চলেছেন।  অধিকাংশ উৎকীর্ণ লিপি অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত, যা গড়ে ৫টি অক্ষর নিয়ে গঠিত। আর সবচেয়ে দীর্ঘটি ২৬টি অক্ষর নিয়ে গঠিত। প্রায় ৪০০ স্বতন্ত্র চিহ্ন পাওয়া গেছে, যদিও অনেক লেখক ভিন্ন মত পোষণ করেন। লেখকরা একমত যে, সিন্ধু লিপি ডান থেকে বাম দিকে লিখিত হত, তবে তুলনামূলক দীর্ঘ কিন্তু দুর্লভ কিছু ক্ষেত্রে পরবর্তী লাইনে বাম থেকে ডানে লেখা হত যা boustrophedon পদ্ধতি নামে পরিচিত।  সিন্ধু লিপিকে শব্দ-স্বর (Logosyllabic ev Morphemic) মনে করেন অনেক লেখক, যাতে একটি চিহ্নের সাহায্যে একটি শব্দ বা একটি স্বর বা শব্দ প্রকাশ করা যায়।  বাহরাইন, পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চল, ইরান ও মেসোপটেমিয়ায় পাওয়া সিন্ধু লিপিযুক্ত সীল পাওয়ায় মনে করা হয় যে, সিন্ধু লিপি একাধিক ভাষায় লেখার জন্য ব্যবহার হয়ে থাকতে পারে।  এছাড়াও এই লিপি সিন্ধু সভ্যতার ৭০০ বছরে পরিবর্তন হয়েছে এমন প্রমাণ পাওয়া যায়। হরপ্পায় খনন থেকে এটি পরিষ্কার যে, সময়ের সাথে লিপির পরিবর্তন হয়েছিল এবং এখানে শেষের দিকে নূতন ভাবে লিপির ব্যবহার দেখা যায়।  লিপির আঞ্চলিক পার্থক্য যেমন দেখা গেছে তেমন কিছু অঞ্চলে লিপিকে একেবারে ভিন্নভাবে ব্যবহার করতে দেখা গেছে।

-------------------------------------------------------

যে সকল পণ্ডিত সিন্ধু লিপির পাঠোদ্ধারের জন্য কাজ করেছেন বা করছেন তাঁরা হলেন এস,আর, রাও, ইরাবর্তম মহাদেবম, আসকো পারপোলা, ফ্র্যাংক বোগটে, বি.কে. ওয়েলস্ ও অন্যরা।

দেখুনঃ Iravartham Mahadevan, The Indus Script: Texts, Concordance and Tables, Published by the Director General, Archaeological Survey of India, New Delhi, 1977, pp. 10-11.

  দেখুনঃ Jonathan Mark Kenoyer, Ancient Cities of the Indus Valley Civilization, 1998, p. 71.

এস, আর, রাও মনে করেন সিন্ধু লিপি শব্দ-স্বর নয় ও ভাবলেখও (Ideographic) নয়। তাঁর মতে এটি প্রাথমিক পর্যায়ে আংশিক একস্বরবিশিষ্ট শব্দ (Syllabic) এবং আংশিক  বর্ণানুক্রমিক (Alphabatic)। উত্তর হরপ্পান এবং হরপ্পান পরবর্তী পর্যায়ে এটি বর্ণানুক্রমিক লিপিতে পরিণত হয়। দেখুনঃ S.R. Rao, New Light on Indus Script and Language, in, Frontiers of the Indus Civilization, ed., B.B. Lal & S.P. Gupta, 1984, p. 194.

দেখুনঃ Jonathan Mark Kenoyer, The Indus Script: Origins, Use and Disappearance, in, Dialogue of Civilization: Comparing Multiple Centers, ed., Hui Zhao, Shanghai Guji Press, Shanghai, 2020, pp. 240, 249, 254.

দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ২৩৮, ২৪০।

দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ২৪০।

-------------------------------------------------------

হরপ্পায় রাভি ও কোট দিজি পর্যায়ে লিপির বিকাশ (সৌজন্যেঃ Jonathan Mark Kenoyer, 2020)

লিপিসমূহ খোদিত থাকত বেশীরভাগই সীল বা বিভিন্ন ধরনের উৎকীর্ণ বা ছাঁচে তৈরী ফলকে। মেসোপটেমিয়ায়, মিসরে বা ভূমধ্যসাগরের ঈজীয় অঞ্চলে লিপির ব্যবহার প্রথম দিকে অর্থনৈতিক কাজে ছিল যার সংখ্যাগত চিহ্ন দিয়ে তালিকা বা হিসাব দেখানো হত। এটি সিন্ধুতে অনুপস্থিত ছিল।  সিন্ধুতে এখন পর্যন্ত পাওয়া প্রায় শতকরা ৮০ ভাগ লিপি উৎকীর্ণ হয়েছে সীলে, সীলের ছাপে বা সীল মোহরে। এর ফলে মনে করা হয় যে, সিন্ধু লিপি প্রধানত অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক কাজে ব্যবহৃত হত। অন্যান্য সভ্যতায় অর্থনৈতিক হিসাবের কাজ বিভিন্ন ফলকে করা হত, যা সিন্ধুতে দেখা যায় নাই। কেনোয়ারও মনে করেন যে, অন্যান্য সভ্যতায় লিপিকে যেভাবে ব্যবহার করা হত, সিন্ধু সভ্যতায় সেভাবে ব্যবহার করা হয় নাই।

-------------------------------------------------------

দেখুনঃ Lorenz Rahmstorf, Control Mechanisms in Mesopotamia, the Indus Valley, the Aegean and Central Europe, c. 2600-2000 BC, and the Question of Social Power in Early Complex Societies, in, Beyond Elites: Alternatives to Hierarchical Systems in Modelling Social Formations, International Conference at the Ruhr-Universität Bochum, Germany, October 22-24, 2009, Volume 2, Verlag Dr. Rudolf Habelt GmbH, Bonn, 2012, p. 313.

দেখুনঃ Jonathan Mark Kenoyer, The Indus Script: Origins, Use and Disappearance, in, Dialogue of Civilization: Comparing Multiple Centers, ed., Hui Zhao, Shanghai Guji Press, Shanghai, 2020, p. 238.

-------------------------------------------------------

হরপ্পায় পর্ব ৩-এ দাগাঙ্কিত মজুদ করার পাত্র (সৌজন্যেঃ Jonathan Mark Kenoyer, 2020)

সিন্ধুু লিপি খড়িপাথরের সীল এবং বিভিন্ন ধরনের বস্তুতে বা ফলকে অথবা মৃৎপাত্রের গায়ে আঁচড়-কাটা দাগ (Graffiti) হিসাবে খোদিত হত। মনে করা হয় যে, লিপির কাজ ছিল পণ্যের বা বিভিন্ন দ্রব্য বিনিময়ের ক্ষেত্রে মালিকানা চিহ্নিত করা ও সামাজিক-রাজনৈতিক অথবা ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের ঘটনা লিপিবদ্ধ করা। প্রত্নতাত্ত্বিকরা সবচেয়ে সাধারণ ধরনের লিপি পেয়েছেন মৃৎপাত্রে আঁচড়-কাটা দাগ হিসাবে। সিন্ধুর লিপি হরপ্পান পর্যায়ের শেষে ১৯০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের দিকে বাম থেকে ডান দিকে লেখা শুরু হয়েছিল বলে জানা যায়।  রোসেটা পাথরের মত একটি দ্বিভাষিক উৎকীর্ণ লিপি না পাওয়া পর্যন্ত সিন্ধু লিপি অপঠিতই রয়ে যাবে বলে মনে হয়।

-------------------------------------------------------

দেখুনঃ Deo Prakash Sharma and Madhuri Sharma, Glimpses of Harappan Archaeology (circa 2700-2000 B.C.), Bharatiya Kala Prakashan, Delhi, 2006, p. xxvii.

-------------------------------------------------------

পাতা : ২৯

হরপ্পা পর্ব ৩-এ পাওয়া সীল (সৌজন্যেঃ Jonathan Mark Kenoyer, 2020)

 

সীল ও সীলমোহর

সীল সাধারণভাবে ছাপ দেওয়ার জন্য ব্যবহৃত হত। এগুলি কোনো জিনিস বা দলিলে প্রশাসনিক বা ব্যক্তিগত পদমর্যাদার চিহ্ন হিসাবে ছাপ দেওয়ার কাজে ব্যবহৃত হত। মনে করা হয় যে, সামাজিকভাবে শক্তিশালী ভূমি মালিক বা বণিকরা সীল ব্যবহার করত। কিছু সীলে ধর্মানুষ্ঠানের ও ধর্মীয় বর্ণনামূলক ছবি থাকাতে কিছু লেখক মনে করেন কিছু সীল ধর্মের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা ব্যবহার করত।  সাধারণভাবে বিপুল পরিমাণ পণ্যের জন্য ও দীর্ঘ দূরত্বের বাণিজ্যে সম্পদশালী লোকজন এই সীলগুলি ব্যবহার করত। সীল ভিত্তিক প্রশাসনিক প্রযুক্তি প্রথম ব্যবহার করা হয় খ্রীঃপূঃ সপ্তম সহস্রাব্দে মধ্যপ্রাচ্যে, নিজ গোষ্ঠীর মালিকানাধীন গুদাম থেকে জিনিসপত্র পুনর্বণ্টন করার জন্য। উত্তর সিরিয়ায় নবপ্রস্তর যুগের গোষ্ঠীর লোকজনের যৌথ গুদামঘরের ভবনের মধ্যে কাদা-মাটির সীল মোহর পাওয়া গেছে, সেখানে সীল রাখা হত ব্যক্তিগত ঘরে।  সিন্ধু সভ্যতার বসতিগুলিতে বিভিন্ন ধরনের ছাপ মারা সীল অনেক পাওয়া গেলেও মধ্যপ্রাচ্যের মত সীল মোহর তেমন পাওয়া যায় নাই। এ থেকে মনে করা হয় যে, সিন্ধু সভ্যতায় সীল অন্য উদ্দেশ্যে ববহৃত হত, যা অন্যান্য অঞ্চল থেকে ভিন্ন। সিন্ধু সভ্যতার আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনা, প্রশাসনিক ও মজুদের প্রযুক্তি অন্যান্য সভ্যতা থেকে ভিন্ন ছিল। সিন্ধুর বসতিগুলির একটি বিষয় লক্ষ্যণীয় যে, সিন্ধুর প্রশাসনিক কাজে ছাপ মারা সীলে লিপি মূল বিষয় ছিল, সীলের পশুর ছবি বা অন্যান্য ছবি নয়।  কাদা-মাটির প্রায় সব সীল মোহরে লিপি ভালভাবে পড়া যায়, কিন্তু পশুর ছবি প্রায় ক্ষেত্রে চেনা যায় না অথবা সেখানে আদৌ কোনো ছবি নাই। এ থেকে মনে করা হয় যে, সিন্ধুর প্রশাসনিক ব্যবস্থায় লিপি কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করত, আর ছবির ভূমিকা গৌণ ছিল, অথবা এমন হতে পারে যে, এটি সরাসরি দেখে চিহ্নিত করতে ব্যবহৃত হত।  সিন্ধু সভ্যতায় মধ্যপ্রাচ্যের তুলনায় খুবই কম সীল মোহর পাওয়াতে গবেষক ডেনিস ফ্রেনেজ মনে করেন এখানে জাহাজীকৃত পণ্যের মোড়কের নিরাপত্তার জন্য সীল মোহর ব্যবহৃত হত না, বরং সিন্ধু সভ্যতায় নির্দিষ্ট কক্ষ ও পণ্য পরিবহনের আধারের অভ্যন্তরে যে সমস্ত জিনিসপত্র থাকত সেগুলি নিয়ন্ত্রণ ও প্রবেশ নথিভুক্ত করার জন্য কাদা-মাটির সীল মোহর ব্যবহৃত হত।  তিনি আরো বলেন যে, এগুলি দৈনন্দিন খাদ্য ব্যবস্থাপনায় ব্যবহৃত হত না।

-------------------------------------------------------

  দেখুনঃ Jonathan Mark Kenoyer, The Indus Script: Origins, Use and Disappearance, in, Dialogue of Civilization: Comparing Multiple Centers, ed., Hui Zhao, 2020, p. 250.

দেখুনঃ Dennys Frenez, Mirrored signs. Administrative and scriptorial information in the Indus Civilization clay sealings, in, Studies on Indus Script, Conference on Indus Script, Mohenjodaro 2020, published by National Fund for Mohenjodaro, Government of Sindh, 2020, p. 21.

দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ২৯।

দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ২৯।

দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ২৯, ৩৪।

-------------------------------------------------------

(a) হরপ্পা: একটি সীলে জন্মদৃশ্য দেখানো হয়েছে; (b) মহেঞ্জো-দাড়ো: একটি সীলে গাছের দুইটি কাল্পনিক মাথা দেখানো হয়েছে; (c) মহেঞ্জো-দাড়ো: একটি সীলে গাছ দেবতা ও অন্যান্য দৃশ্য দেখানো হয়েছে; (d) মহেঞ্জো-দাড়ো: একটি সীলে একজন শিং-বিশিষ্ট দেবতাকে যোগ-আসনে বসার ভঙ্গিতে দেখা যাচ্ছে (সৌজন্যেঃ A.H. Dani and B.K. Thapar, 1996)

পাতা : ৩০

বেশীরভাগ চৌকোনা ছাপ দেওয়া সীলে জীবজন্তুর ছবি থাকত। ধারণা করা হয় এই চিহ্নগুলি কোনো ক্ল্যান বা গোত্রের টোটেমের চিহ্ন ছিল। এই রকম কম পক্ষে দশটি টোটেমের প্রতীক পাওয়া যায়, যেগুলি হল ইউনিকর্ন বা প্রধানত একশৃঙ্গবিশিষ্ট প্রাণী, কুঁজবিশিষ্ট ষাঁড়, হাতি, গণ্ডার, মোষ (Water buffalo), ছোট শিংবিশিষ্ট কুঁজহীন ষাঁড়, ছাগল, কৃষ্ণসারমৃগ (Antelope), কুমির ও খরগোস।  এগুলির মধ্যে ইউনিকর্নের চিত্রাঙ্কিত ছবি সবচেয়ে বেশী সীলে দেখতে পাওয়া যায়, যা মোট সীলের শতকরা প্রায় ৬০ ভাগ।  সাধারণভাবে এক শিং বিশিষ্ট এবং দুই বা ততোধিক প্রাণীর অংশ দিয়ে এই কল্পিত ইউনিকর্ন ছবি অংকন করা হয়েছে। যে বসতিতে সীল পাওয়া গেছে তার প্রায় প্রতিটা থেকেই ইউনিকর্নের চিত্রাঙ্কিত সীল পাওয়া গেছে। সীলের উপরে সিন্ধু লিপি খোদাই করা থাকত। সহস্রাধিক হরপ্পান সীলে ইউনিকর্নের অঙ্কিত ছবি থাকাতে মনে করা হয় যে সিন্ধুর মানুষের উপর এর আদর্শগত বড় ধরনের গুরুত্ব ছিল।  দেখা গেছে যে, ইউনিকর্ন সীল অঙ্কনে হরপ্পান পর্যায়ের বিভিন্ন বসতিতে যেমন শৈলীগত পাথর্ক্য ছিল তেমন হরপ্পান পর্যায়ের বিভিন্ন উপ-পর্যায় বা পর্বেও পার্থক্য ছিল।  যেমন পর্ব ৩এ-তে (২৬০০-২৪৫০ খ্রীঃপূঃ) ইউনিকর্ন সীলের উৎপাদন যথেষ্ট সীমিত ছিল। পর্ব ৩বি-তে (২৪৫০-২২০০ খ্রীঃপূঃ) এই জাতীয় সীল উৎপাদন তুলনামূলকভাবে সম্প্রসারিত হয়, বিশেষভাবে হরপ্পা ও মহেঞ্জো-দাড়োর বাইরে কালিবঙ্গান ও লোথালের মত বসতিগুলিতে। পর্ব ৩সি-তে (২২০০-১৯০০ খ্রীঃপূঃ) ইউনিকর্ন সীল উৎপাদন সর্বোচ্চ পরিমাণে দেখা যায়।

-------------------------------------------------------

দেখুনঃ Jonathan Mark Kenoyer, Ancient Cities of the Indus Valley Civilization, 1998, p. 83..  

দেখুনঃ Vijay Kumar, Flora and Fauna in Harappan Civilization, Research India Press, New Delhi, 2014, p. 158.

দেখুনঃ Asko Parpola, Unicorn Bull and Victory Parade, in, Walking with the Unicorn: Social Organization and Material Culture in Ancient South Asia, eds, Dennys Frenez et.al., 2018, p. 435.

দেখুনঃ Gregg M. Jamison, The Organization of Indus Unicorn Seal Production. A Multi-faceted Investigation of Technology, Skill, and Style, in, Walking with the Unicorn: Social Organization and Material Culture in Ancient South Asia, eds, Dennys Frenez et. al., 2018, pp. 280-281.

-------------------------------------------------------

গুজরাটের বাগাসরায় পাওয়া সীল (সৌজন্যেঃ Akinori Uesugi, 2018)

সিন্ধুর ছোট বসতিগুলি থেকে বিভিন্ন জিনিসপত্রের সাথে সীল ও সীল মোহর পাওয়া একটি শক্তিশালী সাক্ষ্য যে দীর্ঘ দূরত্বের বাণিজ্য ও যোগাযোগ ব্যবস্থার সাহায্যে স্থানীয় এলাকাগুলির সাথে একীভূতকরণ সম্ভব হয়েছিল, যা সিন্ধুর নগর সভ্যতার বৈশিষ্ট্য ছিল।

-------------------------------------------------------

দেখুনঃ Cameron A. Petrie, Danika Parikh, Adam S. Green and Jennifer Bates, Looking beneath the Veneer. Thoughts about Environmental and Cultural Diversity in the Indus Civilization, in, Walking with the Unicorn: Social Organization and Material Culture in Ancient South Asia, ed., Dennys Frenez et. al., 2017, p. 465.

-------------------------------------------------------

হরপ্পায় লিপি খোদাইকৃত সীলগুলি হয় আবর্জনার স্তূপে অথবা রাস্তায় পরিত্যক্ত অবস্থায় পাওয়া গেছে। কোনো কবরে সমাধি-সামগ্রী হিসাবে কখনই সীল দেওয়া হত না। এ থেকে সীলের ব্যবহার সম্পর্কে ধারণা করা হয় যে, সীলের মালিকের ব্যবহারের সময় শেষ হলে এগুলির কোনো উপযোগিতা থাকত না। অর্থাৎ চলতি কোনো কাজে সীল ব্যবহার হত, যার উপযোগিতার একটা সময়সীমা থাকত।  এর পর এগুলি ফেলে দেওয়া হত। মহেঞ্জো-দাড়ো, হরপ্পা ও ধোলাভিয়ায় খনন থেকে দেখা গেছে যে, এগুলি ক্ষয় হয়ে যাবার পর কোথায়ও গচ্ছিত রাখা অবস্থায় বসতির অনেক জায়গায় পাওয়া গেছে ও বসতিটির একটি এলাকা থেকে অন্য এলাকায় স্থানান্তরের সময়ে জায়গা ভরাট করার কাজে ব্যবহার হয়েছিল।  তবে সবচেয়ে বেশী সংখ্যায় সীল পাওয়া গেছে নগরের প্রধান দরজার আশেপাশে ও কিছু নির্দিষ্ট বাড়ীতে, যেগুলি কর্মশালা বা গুদামঘর হতে পারে।

-------------------------------------------------------

দেখুনঃ Richard H. Meadow and Jonathan Mark Kenoyer, The ‘Tiny Steatite Seals’ (Incised Steatite Tablets) of Harappa: Some Observations on Their Context and Dating, in, South Asian Archaeology 1997, Volume I, eds, Maurizio Taddei and Giuseppe De Marco, Istituto Italiano per L’Africa e L’oriente, Rome, 2000, p. 16.

দেখুনঃ Jonathan Mark Kenoyer, The Indus Script: Origins, Use and Disappearance, in, Dialogue of Civilization: Comparing Multiple Centers, ed., Hui Zhao, 2020, p. 250.

-------------------------------------------------------

মহেঞ্জো-দাড়ো থেকে পাওয়া ইউনিকর্ন সীল (সৌজন্যেঃ Cameron A. Patrie, Danika Parikh, Adam S. Green and and Jennifer Bates, 2017)

হরপ্পায় খোদাইকৃত লিপিযুক্ত খড়িপাথরের প্রচুর ফলক পাওয়া গেছে পর্ব ৩বি-এর মাঝামাঝি, ২৩৫০-২৩০০ খ্রীঃপূঃ-এর দিকে। এই সময়ে হরপ্পায় তাৎপর্যপূর্ণ নগরায়ন ঘটে, যেমন ঢিবি ই-এর পূর্ব অংশে বড় ধরনের পুনর্নির্মাণ করা হয় ও ঢিবি এফ-এ ‘শস্যাগার’ নির্মাণ করা হয়।  একই সময়ে মেসোপটিমিয়ায় আক্কাদীয় সাম্রাজ্যের বিকাশ ও সমৃদ্ধি ঘটে।

----------------------------------------

  দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ১৭।

-----------------------------------------

সীলে ও সীল মোহরে গাছের ছবিও থাকত। কিন্তু হরপ্পান বসতিগুলিতে পাওয়া সীলে গাছের ছবি দুর্লভ। যেগুলি পাওয়া গেছে তার বেশীর ভাগই হরপ্পা থেকে পাওয়া।  যে সমস্ত গাছের ছবি অঙ্কিত দেখা যায় সেগুলি হল অশ্বত্থ (Pipal), কলা, বাবলা (Acacia), ইত্যাদি। শিল্প উপাদানে সবচেয়ে বেশী বৈচিত্র্যপূর্ণ সীল পাওয়া গেছে মহেঞ্জো-দাড়ো, হরপ্পা ও ধোলাভিরার মত বড় বসতিগুলিতে।

-------------------------------------------------------

দেখুনঃ Vijay Kumar, Flora and Fauna in Harappan Civilization, 2014, p. 74.

দেখুনঃ Jonathan Mark Kenoyer, The Indus Script: Origins, Use and Disappearance, in, Dialogue of Civilization: Comparing Multiple Centers, ed., Hui Zhao, Shanghai Guji Press, Shanghai, 2020, pp. 250-251.

-------------------------------------------------------

সিন্ধু সভ্যতার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পাওয়া সীল মোহর (সৌজন্যেঃ Cameron A. Patrie, Danika Parikh, Adam S. Green and and Jennifer Bates, 2017)

পাতা : ৩১

বুনো ষাঁড়ের ছবি অংকিত কিউনিফর্ম লিপিতে সিন্ধু শৈলীর সীল মেসোপটেমিয়ায়, সিন্ধু লিপি সহ উপসাগরীয় বৃত্তাকার সীল ও অন্যান্য সংকর জাতীয় সীল ইরান ও মধ্য এশিয়াতে পাওয়া গেছে।  দক্ষিণ-পূর্ব ইরানের কোনার স্যান্ডাল দক্ষিণ নামে একটি বসতিতে একটি সাদা মার্বেল পাথরের নলাকার সীল (Cylinder seal) পাওয়া গেছে যেটি বহু ব্যবহারে ক্ষয় হয়ে যাওয়ার পরেও সেখানে সিন্ধুর কয়েকটি প্রাণীর ছবি উৎকীর্ণ হওয়ার বিষয়টি বুঝা যায়। এর গায়ে দুর্লভ কিন্তু বৈশিষ্ট্যসূচক সিন্ধুর চিত্রাঙ্কন থাকায় ধারণা করা যায় যে, সিন্ধুর বণিক বা কারুশিল্পীরা অথবা এখানকার পরিবারগুলি সিন্ধুর জনগোষ্ঠীর সাথে আনুষ্ঠানিক বন্ধনে আবদ্ধ ছিল।  ইরানের এই অঞ্চলটি তামার আকরিকের ভাণ্ডার ছিল।

-------------------------------------------------------

দেখুনঃ Dennys Frenez, Michele Degli Esposti, Sophie Méry & Jonathan Mark Kenoyer, Bronze Age Salūt (SR1) and the Indus Civilization: recent discoveries and new insights on regional interaction, in, Proceedings of the Seminar for Arabian Studies, Volume 46, Archaeopress Publishing Ltd., Oxford, 2016, pp. 116-117.

দেখুনঃ Massimo Vidale and Dennys Frenez, Indus Components in the Iconography of a White Marble Cylinder Seal from Konar Sandal South (Kerman, Iran), in, South Asian Studies, Volume 31, No 1, 2015, p.151.

-------------------------------------------------------

ধোলাভিরা থেকে পাওয়া সীল (সৌজন্যেঃ Rajesh S.V., 2018)

কানমের থেকে পাওয়া সীল মোহর (সৌজন্যেঃ Rajesh S.V., 2018)

লোথাল থেকে পাওয়া সীল (সৌজন্যেঃ Rajesh S.V., 2018)

ফারমানা, বনওয়ালী ও মহেঞ্জো-দাড়ো থেকে পাওয়া সীল (সৌজন্যেঃ Rajesh S.V., 2018)

বৃহত্তর সিন্ধু উপত্যকায় সীলে পরিবর্তনের চিত্র (সৌজন্যেঃ Akinori Uesugi, 2018)

পাতা : ৩২

 

বাটখারা ও মাপ

সিন্ধু সভ্যতার বাটখারাগুলি প্রমিতকৃত ছিল যা প্রাচীন পৃথিবীতে তুলনাহীন, যেখানে মেসোপটেমিয়া বা মিসরে দেখা যায় যে অসংখ্য ধরনের বাটখারা ব্যবহৃত হত।  এই ধরনের প্রমিত বাটখারা গাঙ্গেয় উপত্যকায় ৩০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের দিকে প্রচলিত থাকতে দেখা যায়। একই ধরনের বাটখারা কিছু দিন আগে মেট্রিক পদ্ধতি চালু হবার আগে পর্যন্ত এই উপহাদেশের দেশগুলিতে ব্যবহার হত। প্রথম সাতটি বাটখারা প্রথমটি থেকে দ্বিগুণ ওজনের হত, যেমন ১ : ২ : ৪ : ৮ : ১৬ : ৩২ : ৬৪। সবচেয়ে প্রচলিত বাটখারা হল ১৬শ অনুপাতের ও এটির ওজন ছিল ১৩.৭ গ্রাম। সবচেয়ে বড় বাটখারাটি মহেঞ্জো-দাড়োতে পাওয়া গেছে যার ওজন ১০,৮৬৫ গ্রাম, যা গুঞ্জবীজের ওজনের প্রায় ১,০০,০০০ গুণ। প্রত্নতাত্ত্বিকরা প্রতিটি খননকৃত বসতিতে চার্ট পাথরের তৈরী ঘনাকৃতির এই বাটখারা পেয়েছেন এবং সব বাটখারাই সিন্ধুর প্রমিত ওজন পদ্ধতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল। ভারী বাটখারাগুলি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক কেন্দ্র বা বড় বসতিতে পাওয়া গেছে। তবে প্রতিটা গ্রামীণ বসতিতেই সব মাপেরই ছোট বাটখারাগুলি পাওয়া গেছে। এছাড়া ঘনাকৃতির বাটখারা ছাড়াও একপাশে ছেঁটে বা ক্ষয় করে কমানো গোলকাকৃতি (Truncated spherical) বাটখারাও অনেক বসতিতে পাওয়া গেছে, যেগুলি একই প্রমিত পদ্ধতি মেনেছিল। এগুলি সাধারণত আকিক পাথরের (Agate) বা রঙিন বিশেষ ধরনের পাথরের (Jasper) তৈরী। এছাড়াও বেলনাকার ও মোচাকৃতির অল্প কিছু বাটখারা পাওয়া গেছে। হরপ্পায় খননকালে নগরের প্রধান দরজার কাছে সবচেয়ে বেশী পরিমাণ বাটখারা পাওয়া গেছে। এথেকে ধারণা করা হয় যে, বাইরে থেকে নগরে প্রবেশের সময় জিনিসপত্র ওজন করে শুল্ক নির্ধারণ ও আদায় করা হত। হরপ্পান এই বাটখারাগুলি প্রায় সকল ক্ষেত্রেই যথেষ্ট নির্ভুলতার সাথে তৈরী করা হত, যা সমসাময়িক অন্যান্য সভ্যতায় দেখা যায় নাই। মহেঞ্জো-দাড়োর ক্ষেত্রে দেখা গেছে যে, এগুলির একক মাপে পরিবর্তন হয় নাই।

-------------------------------------------------------

 দেখুনঃ Jonathan Mark Kenoyer, Ancient Cities of the Indus Valley Civilization, 1998, p. 98.

-------------------------------------------------------

ধোলাভিরা থেকে পাওয়া চার্ট পাথরের বাটখারা (সৌজন্যেঃ Michel Danino, 2014)

গুজরাটের কচ্ছ জেলায় হরপ্পান বসতি কোটাডা ভাদলিতে (Kotada Bhadli) আকৃতির উপর নির্ভর করে ঘনাকৃতি ও একাপশে ছাঁটা গোলকাকৃতি সহ আট ধরনের বাটখারা পাওয়ার কথা জানা যায়।

-------------------------------------------------------

দেখুনঃ Tejal Ruikar, Prabodh Shirvalkar and Y.S. Rawat, Exchange and Economy as Reflected from the Weights at the Harappan Site of Kotada Bhadli, Kachchh, Gujarat, in, Heritage: Journal of Multidisciplinary Studies in Archaeology 3, 2015, p. 726.

-------------------------------------------------------

দৈর্ঘ্যরে মাপ নেওয়ার জিনিস প্রত্নতাত্ত্বিক খননে খুবই কম সংখ্যায় পাওয়া গেছে। হরপ্পায় একটি ব্রোঞ্জোর দণ্ডের দাগ কাটা টুকরা থেকে ধারণা করা হয় সেটি একটি মাপার স্কেল হতে পারে। এটিতে চারটি ভাগ করা আছে, যার প্রতিটি ভাগ ০.৩৭ ইঞ্চি বা ০.৯৩ সেঃমিঃ। মহেঞ্জো-দাড়োতে পাওয়া খোলার একটি ফলকে পাঁচটি দাগ কাটা আছে, যা ১.৩২ ইঞ্চি বা ৩.৩৫ সেঃমিঃ। এই স্কেলগুলি হরপ্পানরা বিশেষ কোনো কাজে ব্যবহার করত বলে মনে করা হয়। তারা অন্য কোনো মাপের পদ্ধতি বা স্কেল ব্যবহার করত বলে কোনোয়ার মনে করেন।  তিনি মনে করেন হাতের মাপই দক্ষিণ এশিয়ায় এখনো প্রচলিত যা সিন্ধু সভ্যতার স্থাপত্যেও ব্যবহৃত হত। যেমন, চার আঙ্গুলের প্রস্থ বা অঙ্গুলাতে প্রায় ৭ থেকে ৯ সেঃমিঃ হয়, কুনুই থেকে মধ্যমার অগ্রভাগ পর্যন্ত এক হাত হয়, ইত্যাদি। হরপ্পায় পোড়া-মাটির ইটের প্রথম ব্যবহার দেখতে পাওয়া যায় পর্ব ৩এ শুরু হবার পরে। এখানকার পোড়া-মাটির ইটের মাপ ৭ X ১৪ X ২৮ সেঃমিঃ, যা ১ : ২ : ৪ অনুপাত রক্ষা করেছে। এটি অত্যন্ত আশ্চর্যজনক যে, ইটের মাপের এই নির্দিষ্ট অনুপাত বাড়ী-ঘরের কক্ষের মাপ, বাড়ী-ঘরের সামগ্রিক পরিকল্পনায় এবং বৃহৎ আয়তনের ভবনগুলির অনুপাতেও ব্যবহার হয়েছিল।  একটি বিষয় স্পষ্ট যে, প্রমিতকরণের ক্ষেত্রে হরপ্পানরা মাপের চেয়েও অনুপাত রক্ষার উপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখেছিল।  গবেষক মিশেল ডানিনো দেখিয়েছেন যে, অনেক বসতির ক্ষেত্রে (যেমন, মহেঞ্জো-দাড়ো, কালিবঙ্গান ও ধোলাভিরা) উঁচু নগর বা নগরদুর্গগুলি দৈর্ঘ্য ও প্রস্থে সূক্ষ্মভাবে ২ : ১ অনুপাতে বিন্যস্ত হয়েছিল।  কালিবঙ্গানের রাস্তাগুলি ১ : ২ : ৩ : ৪ অনুপাতে বিন্যস্ত ছিল, যেখানে একক ছিল ১.৮ মিটার। এর প্রমাণ আছে যে, এই অনুপাত নবপ্রস্তর যুগ বা আদি হরপ্পান পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।

-------------------------------------------------------

দেখুনঃ J. Mark Kenoyer, Measuring the Harappan world: Insights into the Indus order and cosmology, in, The Archaeology of Measurement: Comprehending Heaven, Earth and Time in Ancient Societies, eds, Iain Morley and Colin Renfrew, 2010, p. 117.

  দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ১১৮।

দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ১২০।

দেখুনঃ Michel Danino, Metrology and Linear Measurements, in, History of Ancient India: Protoistoric Foundations, Volume: II, eds., Dilip K. Chakrabarti and Makkhan Lal, Published by Vivekananda International Foundation, New Delhi & Aryan Books International, New Delhi, 2014, p. 312.

দেখুনঃ Michel Danino, Metrology and Linear Measurements, in, History of Ancient India: Protoistoric Foundations, Volume: II, eds., Dilip K. Chakrabarti and Makkhan Lal, 2014, p. 312.

-------------------------------------------------------

ধোলাভিরার ক্ষেত্রে দেখা গেছে যে, নগরটি সামগ্রিকভাবে কোনো ভুল ছাড়াই ৫ : ৪ (বা ১.২৫) অনুপাত রক্ষা করেছে। একই অনুপাত রক্ষা করেছে নগরদুর্গে অবস্থিত দুর্গটি (Castle)। এছাড়াও এই দুর্গটির ও মধ্যবর্তী নগরের দৈর্ঘ্যরে অনুপাত এবং মধ্যবর্তী নগরের সাথে নগরের দৈর্ঘ্যরে অনুপাত পাওয়া গেছে ৯ : ৪ (বা ২.২৫)।  এখানকার ভূমির অসমতার পরেও এই ধরনের নির্ভুলতা আশ্চর্যজনক। অন্যান্য বসতিতেও এই ধরনের বিভিন্ন অনুপাতের প্রয়োগের কথা ডানিনো জানিয়েছেন।

-------------------------------------

  দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ৩১৩।

-------------------------------------

ধোলাভিরা থেকে পাওয়া পাথরের বাটখারা (সৌজন্যেঃ Rajesh S.V., 2018)

পাতা : ৩৩

 

আঞ্চলিক ও বহির্বাণিজ্য এবং যোগাযোগ

আদি হরপ্পান পর্যায় থেকে হরপ্পান পর্যায়ে আসার পর সিন্ধু সভ্যতার বসতিসমূহ উত্তর অঞ্চল থেকে দক্ষিণে আরব সাগর উপকূল অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে।  দক্ষিণ বালুচিস্তানের পাহাড়ী জনগোষ্ঠীতে বিকশিত কুল্লি সংস্কৃতিতে খ্রীষ্টপূর্ব তৃতীয় সহস্রাব্দের দ্বিতীয়ার্ধে শুরু হওয়া শক্তিশালী হরপ্পান প্রভাব আদি হররপ্পান পর্যায়েই শুরু হয়েছিল।  প্রাপ্ত সাক্ষ্য থেকে জানা যায় যে, হরপ্পান পর্যায়ে দক্ষিণে বালুচিস্তানের পথ দিয়ে দক্ষিণ ও পূর্ব ইরান ও মেসোপটেমিয়ার সাথে যোগাযোগ গড়ে উঠেছিল। বালুচিস্তানের পাহাড়ী জনগোষ্ঠীর উপর কুল্লি সংস্কৃতির প্রভাব বৃদ্ধিকে পূর্ব-পশ্চিম যোগাযোগকে সম্পর্কিত করা যায়।  বালুচিস্তানে মেহরগড়, সিবরি, নৌশারো অথবা দাউদা ডাম্ব (Dauda Damb) এবং কেয়েটায় বিভিন্ন আবিষ্কার থেকে এই বিষয়টি লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, অলটিন টেপে (Altyn Tepe) ও মধ্য এশিয়ার অন্যান্য বসতিগুলিতে হরপ্পান প্রভাব ছিল।  নৌশারো পর্ব ৪-এর সাংস্কৃতিক উপাদান যদিও অপ্রতুল, তার পরেও এই বসতিটির সাথে তৃতীয় সহস্রাব্দের দ্বিতীয়ার্ধের মধ্য এশিয়ার ব্রোঞ্জ যুগের সাথে সম্পর্ক দেখতে পাওয়া যায়।  প্রত্নতাত্ত্বিক সাক্ষ্যে দেখা গেছে যে, ২০০০ খ্রীঃপূঃ-এর দিকে বালুচিস্তানের কাচি-বোলান অঞ্চলে কিছু গোষ্ঠী বসতিস্থাপন করে যাদের সাথে স্পষ্টত আমু দরিয়া সভ্যতার যোগাযোগ ছিল।  বিশেষত হরপ্পান সভ্যতার আঞ্চলিকতার সময় শুরু হলে সিন্ধু সভ্যতার পশ্চিম অঞ্চলে সম্ভাব্য যোগাযোগের বিষয়টি কোনো কোনো লেখক উল্লেখ করেছেন।

-------------------------------------------------------

দেখুনঃ M. Rafique Mughal, The Geographical Extent of the Indus Civilization During the Early, Mature ad Late Harappan Times, in, South Asian Archaeology Studies, ed., G. Possehl, Oxford & IBH Publishing Co. Pvt. Ltd., New Delhi, 1992, p. 129.

দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ১২৯-১৩০।

দেখুনঃ Jean-François Jarrige and M. Usman Hasan, Funerary Complexes in Baluchistan in the Light of Recent Discoveries at Mehrgarh and Quetta, in, South Asian Archaeology 1985, eds., Karen Frifelt and Per Sfrensen, Curzon Press, The Riverdale Company, Copenhagen, 1989, p. 165.

দেখুনঃ Jean-François Jarrige, Harappan Occupation at Nausharo, in, Early Harappans and Indus-Sarasvati Civilization, Volume II, eds., D.P. Sharma and Madhuri Sharma, Kaveri Books, New Delhi, 2013, p. 517.

দেখুনঃ J.-F. Jarrige, A. Didier and G. Quivron, Shahr-I Sokhta and the Chronology of the Indo-Iranian Regions, in, Paléorient, Vol. 37.2, p. 26.

দেখুনঃ Jean-François Jarrige, Harappan Occupation at Nausharo, in, Early Harappans and Indus-Sarasvati Civilization, Volume II, eds., D.P. Sharma and Madhuri Sharma, 2013, p. 518.

-------------------------------------------------------

হরপ্পার সবচেয়ে কাছের পাথরের উৎস হল ১২০ কিলোমিটার উত্তর-উত্তরপূর্বে কিরানা পাহাড়ে। এছাড়া বাকী সমস্ত পাথরের উৎস সিন্ধু অববাহিকার চারপাশে থাকা পাহাড়সমূহ ও সন্নিহিত ভূমিতে বা এরও বাইরে।  হরপ্পার মত বসতিগুলিতে যেখানে সমস্ত পাথর দূরবর্তী অঞ্চল থেকে আনতে হত, সেখানে দেখা যায় যে চার্ট পাথর বা স্ফটিক পাথরের (Quartzite) মত সাধারণ কিন্তু প্রয়োজনীয় পাথরের সরবরাহের উপরেও নিয়ন্ত্রণ ছিল। সেই সময় যেহেতু ঘোড়া বা উট ব্যবহারের খুবই সীমিত সাক্ষ্য পাওয়া যায়, তাতে অনুমান করা যায় যে দূর থেকে ভারী জিনিসপত্র পরিবহনের জন্য নৌকা ও গরুগাড়ী, এবং পাহাড়ী পথে মালামাল পরিবহনের জন্য ছাগল বা ভেড়ার ব্যবহার ছিল।  দেখা গেছে গরু বা গরুগাড়ী পাহাড়ী পথে উপযুক্ত নয়। অনেক ক্ষেত্রে মানুষও একা বা সমষ্টিগতভাবে মালামাল পরিবহন করত। হরপ্পায় শান দিবার পাথর (Grindingstone) ও চার্ট পাথরের পরিমাণই সবচেয়ে বেশী ছিল। চার্ট পাথরের প্রধান উৎস ছিল সিন্ধুর রোহ্রি পাহাড়শ্রেণী। এটি একটি তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়  যে, যদিও হরপ্পানরা পাথরের ব্যবহার প্রচুর পরিমাণে করত, তথাপি সিন্ধু উপত্যকার সমভূমিতে প্রতি ক্ষেত্রে জনপ্রতি কম পরিমাণে পাথর পরিবহন করা হত।  হরপ্পায় সবচেয়ে বড় যে বৃত্তাকার পাথর (Ringstone) পাওয়া গেছে সেটির ওজন ১৩৫ কেজি, যা দুইজন মানুষ বহন করতে পারে।  সিন্ধু সভ্যতা এত বড় বড় ভবন ও কাঠামো তৈরী করেছে অথচ তার সবচেয়ে বড় নির্মাণ সামগ্রী বহন করতে দুই জনের বেশী জনবলের দরকার হয় নাই। প্রাচীন পৃথিবীর সভ্যতাগুলি বিশেষভাবে মিসর থেকে এর পার্থক্য হল দীর্ঘ দূরত্বে বড় বড় ভবন তৈরীতে বা রাজকীয় কাজে দীর্ঘ দূরত্ব থেকে পাথর আনতে বহু মানুষের শ্রম প্রয়োজন হত।

-------------------------------------------------------

 দেখুনঃ Randall Law, Moving Mountains: The Trade and Transport of Rocks and Minerals Within the Greater Indus Valley Region, in, Space and Spatial Analysis in Archaeology, eds., Elizabeth C. Robertson, Jeffrey D. Seibert, Deepika C. Fernandez, and Marc U. Zender, University of Calgary Press, Calgary, 2006, pp. 306-308.

  দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ৩০৫।

  দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ৩০৪।

-------------------------------------------------------

সিন্ধু সভ্যতায় লাপিস লাজুলি পাথরের উৎস ছিল আফগানিস্তানের বাদাখশান অঞ্চল। এছাড়াও শুধু সিন্ধু অঞ্চল নয়, সমসাময়িক প্রাচীন নিকট প্রাচ্যের মানুষজনের জন্যও এই অঞ্চল একমাত্র উৎস ছিল।  আর্নেস্টাইটের মত শক্ত পাথর যা দিয়ে পুতি তৈরী করার পাথর ছিদ্র করা হত, সেটি উত্তর গুজরাট থেকে সংগ্রহ করা হত বলে মনে করা হয়।   বিভিন্ন কাঁচামালের উৎসের জন্য হরপ্পানরা শুধুমাত্র বণিকদের না পাঠিয়ে দূরবর্তী আবাসনস্থল বা উপনিবেশ গড়ে তুলেছিল। এগুলির মধ্যে আফগানিস্তানের কোচা ও আমু দরিয়া নদীর সঙ্গমস্থলে শোরতুগাই একটি ছিল। এখানকার ভবন নির্মাণের কৌশল, মৃৎপাত্রের নকশা, সীল, পুতি ও অন্যান্য জিনিস হরপ্পানদের মত ছিল। এছাড়াও উপসাগরীয় বাণিজ্যের পূর্বাঞ্চলীয় প্রবেশপথটি নিয়ন্ত্রণ করার জন্য বালুচিস্তানের মকরান উপকূলে সোকটা-কোহ ও সুটকাজেনডোর নামে সিন্ধুর দু’টি দূরবর্তী আবাসস্থল বা দুর্গ গড়ে তুলা হয়েছিল।  মিরি কালাত নামে পাকিস্তানের কেচ মকরানে পরবর্তীকালে আরো একটি সিন্ধু বসতির চিহ্ন পাওয়া গেছে।

-------------------------------------------------------

দেখুনঃ Randal Law, Evaluating Potential Lapis Lazuli Sources for Ancient South Asia Using Sulfur Isotope Analysis, in, ‘My Life is like the Summer Rose’ Maurizio Tosi e l’ Archaeologia come modo di vivere, Papers in honour of Maurizio Tosi for his 70th birthday, eds., C.C. Lamberg-Karlovsky and B. Genito, BAR International Series 2690, 2014, pp. 426-427.

দেখুনঃ Randall William Law, Inter-Regional Interaction and Urbanism in the Ancient Indus Valley: A Geological Provenience Study of Harappa’s Rock and Mineral Assemblage, in, Current Studies on the Indus Civilization, Volume VIII, Part 2: Appendices and References, Manohar Publishers & Distributers, New Delhi, 2011, pp. 552-553.

দেখুনঃ E. Cortesi, M. Tosi, A. Lazzari and M. Vidale, Cultural Relationships beyond the Iranian Plateau: The Helmand Civilization, Baluchistan and the Indus Valley in the 3rd Millennium BCE, in, Paléorient, Vol.34.2, 2008, p. 8.

দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ৮।

-------------------------------------------------------

পাতা : ৩৪

দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ার মানচিত্র (অন্তর্নিবিষ্ট ছবি: বাহরাইন) (সৌজন্যেঃ Eric Olijdam, 2008)

গুজরাটে বেশ কিছু বসতি অভ্যন্তরীণ ও সমুদ্র বাণিজ্য উভয়ের সংযোগ রক্ষার কাজে ভূমিকা পালন করত বলে মনে করা হয়। এগুলি কৃষি, প্রাকৃতিক ও সমুদ্র সম্পদ অভ্যন্তরীণ হরপ্পান বসতিগুলিতে সরবরাহ করত। কচ্ছ উপসাগরের দক্ষিণ উপকূলে কুনটাসি, বাগাস্রার মত বসতিগুলি, একই উপসাগরের উত্তর উপকূলের সেবাকিয়া (Sevakiya), শিকারপুর, ছোট রানের (Little Rann) উপকূলে কানমের (Kanmer), সুরকোটডা ও নাগওয়াড়া, এবং বড় রানের (Greater Rann) তীর ধরে ধোলাভিরা, পাবুমথ (Pabumath), নের ও জুনিকুরান, এবং ক্যাম্বে উপসাগরে লোথাল গুজরাটের বাণিজ্য পথ ও সম্পদ ব্যবস্থাপনায় সহযোগী ভূমিকা রেখেছিল। এইসব বসতি প্রাচীরঘেরা ছিল ও সাগরের বা উপসাগরের সাথে ছোট নদী দিয়ে যুক্ত ছিল। লোথালে জাহাজের ডক পাওয়ার কথা আগে বলা হয়েছে। কচ্ছ উপসাগরের কুনটাসিতে ও সরনে (ধোলাভিরার কাছে) জাহাজ ঘাট বা জেটি পাওয়ার কথা জানা যায়।  অনুমান করা হয় লোথাল ও ধোলাভিরা সমুদ্র বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করত।

-------------------------------------------------------

দেখুনঃ Y.S. Rawat, Coatal Sites: Possible Port Town of Harappan time in Gajarat, in, Port Town of Gujarat, eds., Sara Keller and Michael Pearson, Primus Books, Delhi, 2015, pp. 207-208.

দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ১৮৯।

-------------------------------------------------------

শাহর-ই সোখটা ও প্রধান প্রাগৈতিহাসিক কেন্দ্রসমূহ সহ মধ্য এশিয়ার মানচিত্র (সৌজন্যেঃ E. Cortesi, M. Tosi, A. Lazzari and M. Vidale, 2008)

সিন্ধু সভ্যতার বসতিগুলির সাথে মেসোপটেমিয়া, ওমান, বাহরাইন, আরব আমিরাত ও মধ্য এশিয়ার বিভিন্ন এলাকার বহির্বাণিজ্যের প্রমাণ পাওয়া যায়। পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলে বহু পরিমাণ হরপ্পান বাটখারা পাওয়াতে ম্যাগান (মেসোপটেমিয়ার কিউনিফর্ম পাঠে ওমান উপদ্বীপকে ম্যাগান নামে উল্লেখ করা হয়েছে), দিলমুন (পারস্য উপসাগরে বাহরইন অঞ্চল) ও মেসোপটেমিয়ার সাথে সিন্ধু সভ্যতার বাণিজ্যের বিষয়টি ধারণা করা যায়। মেসোপটেমিয়ায় পাওয়া একটি সুপরিচিত লিপিতে বলা হয়েছে যে, আক্কাদের রাজধানী আগেডে (Agade) মেলুহা (সিন্ধু সভ্যতাকে বলা হত) থেকে আসা জাহাজ ভিড়ত। যা থেকে বুঝা যায় যে, সিন্ধু সভ্যতার সাথে মেসোপটেমিয়ার বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল। মেসোপটেমিয়ার কিছু লিপি পাঠে বলা হয়েছে মেলুহা থেকে মূর্তি আমদানী করা হত। যদিও এটি পরিষ্কার নয় যে এগুলি পোড়ামাটির মূর্তি ছিল কীনা। সিন্ধু শৈলীর মূর্তি কেবলমাত্র মেসোপটেমিয়ার নিপ্পুরের উর ৩ স্তরে পাওয়া গেছে, যেগুলির সাথে চানহুদাড়ো ও অন্যান্য বসতির অল্প কিছু মূর্তির মিল পাওয়া যায়।  আগে মনে করা হত মেসোপটেমিয়ার সাথে বাণিজ্য শুরু হয় ২৬০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে। কিন্তু সাম্প্রতিক গবেষণায় মেসোপটেমিয়ার সময়ানুপঞ্জির পরিবর্তন হয়েছে ও তা প্রায় ২০০ বৎসর এগিয়ে নেওয়া হয়েছে। ফলে এখন বলা হচ্ছে সিন্ধুর সাথে মেসোপটেমিয়ার বাণিজ্যের শুরু সম্ভবত ২৪৫০ খ্রীঃপূঃ-এর দিকে।  বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক সাক্ষ্য প্রমাণ থেকে একথা জানা যায় যে, সিন্ধুর বণিকরা মেসোপটেমিয়াতে বসবাস করত।  স্বতন্ত্র চিত্রাঙ্কিত ও লিপি যুক্ত সিন্ধুর সীল মেসোপটেমিয়ার নগরগুলিতে পাওয়া গেছে। এ থেকে বুঝা যায় যে, সেখানে সিন্ধুর সংস্কৃতি গ্রহণের ধারা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছিল।  এছাড়া বিভিন্ন জিনিসপত্র যেমন কার্নেলিয়ান পাথরের পুতি উর ও কিশের রাজকীয় সমাধিতে পাওয়া গেছে। মেসোপটেমিয়া ও পশ্চিম ইরানে নানা ধরনের জিনিসপত্র পাওয়া গেছে, যেমন, সিন্ধু-শৈলীর ঘনাকৃতি পাথরের বাটখারা, খোলার চুড়ি ও বানরের বিভিন্ন মূর্তি। ধারণা করা যায় যে, এগুলি সিন্ধু উপত্যকায় তৈরী হত ও বাণিজ্যের মাধ্যমে মেসোপটেমিয়াতে গিয়েছিল। কিছু জিনিস যেমন কার্নেলিয়ানের দীর্ঘ পুতি তৈরীর কারিগরী দিক বিবেচনা করে কোনোয়ার মনে করেন যে, সিন্ধুর যে সমস্ত কারিগর মেসোপটেমিয়ায় বসবাস করত এগুলি তাদের তৈরী।

-------------------------------------------------------

দেখুনঃ Sharri R. Clark, Deconstructing the ‘Harappan Courtiers’: A Re-evaluation of Some of the Anthropomorphic Terracotta Figurines from Harappa, in, Intercultural Relations between South and Southwest Asia, eds., E. Olijdam & R.H. Spoor, BAR International Series 1826, 2008, pp. 166-167.

দেখুনঃ Jonathan Mark Kenoyer, Indus and Mesopotemian Trade Networks: New Insights from Shell and Carnelian Artifacts, in, Intercultural Relations between South and Southwest Asia, eds., E. Olijdam & R.H. Spoor, BAR International Series, 1826: 2008, p. 23.

  দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ২৩।

দেখুনঃ Maurizio Tosi, The Harappan Civilization beyond the Indian Sucontinent, in, Harappan Civilization: A Recent Perspective, ed., Gregory L. Possehl, 1993, p. 369.

দেখুনঃ Jonathan Mark Kenoyer, Indus and Mesopotemian Trade Networks: New Insights from Shell and Carnelian Artifacts, in, Intercultural Relations between South and Southwest Asia, eds., E. Olijdam & R.H. Spoor, BAR International Series, 1826: 2008, pp. 25-26.

-------------------------------------------------------

পাতা : ৩৫

সিন্ধু অঞ্চলে প্রত্নতাত্ত্বিকভাবে বিনিময়ের ফলে মেসোপটেমিয়া থেকে আনা কোনো জিনিসপত্র পাওয়া যায় নাই, তবে মেসোপটেমিয়ার পুস্তক থেকে জানা যায় যে, সোনা, পশম, সুগন্ধী ও অন্যান্য পচনশীল জিনিসপত্র সিন্ধু অঞ্চলে আসত। প্রথম মেসোপটেমীয় রাজা সারগনের সময়ে (২৩০০ বা ২২৫০ খ্রীঃপূঃ)  মেলুহা-র (Meluḫḫa) নাম পরিষ্কার উল্লেখ পাওয়া যায়, যা বালুচিস্তান বা সিন্ধু ছাড়া অন্য কোনো অঞ্চল নয়। ২৩৫০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের দিকে মেসোপটেমিয়ার উরে যে সিন্ধু অঞ্চল থেকে জিনিসপত্র আমদানী হচ্ছিল তার প্রচুর প্রমাণ পাওয়া যায়।  উর ২ ও ৩-এর কিছু লিপি পাঠ থেকে জানা যায় যে, আক্কাদীয় যুগে (প্রায় ২৩৫০-২১৫০ খ্রীঃপূঃ) ’মেলুহার পুত্রেরা’ অর্থাৎ সিন্ধু সভ্যতার লোকেরা মেসোপটেমীয়দের সাথে বসবাস করত, সম্ভবত গ্রামে বা ছিটমহলের মত এলাকায়।

-------------------------------------------------------

 দেখুনঃ Julian Reade, The Indus-Mesopotamia Relationship Reconsidered, in, Intercultural Relations between South and Southwest Asia, eds., E. Olijdam & R.H. Spoor, BAR International Series, 1826 (2008), p. 14.

দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ১৪।

দেখুনঃ Sharri R. Clark, Deconstructing the ‘Harappan Courtiers’: A Re-evaluation of Some of the Anthropomorphic Terracotta Figurines from Harappa, in, Intercultural Relations between South and Southwest Asia, eds., E. Olijdam & R.H. Spoor, BAR International Series 1826, 2008, pp. 160, 167.

-------------------------------------------------------

সিন্ধু সভ্যতার প্রচুর জিনিসপত্র ওমান উপদ্বীপের উপকূলব্যাপী ও অভ্যন্তরে পাওয়া গেছে। এগুলি হল ব্যবহারোপযোগী ও ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের কাজে ব্যবহৃত মাটির জিনিসপত্র, অলংকার, সীল, বাটখারা ও সম্প্রতি পাওয়া ছোটদের পোড়ামাটির খেলনা।  সিন্ধু সম্পর্কিত মৃৎপাত্র পাওয়া গেছে ওমানের রা’স আল-জিনয্ (Ra’s al-Jinz), সালুট (Salūt) ও বাটে (Bat), রা’স আল-খাইমাহ্র (Ra’s al-Khaymah-সংযুক্ত আরব আমিরাতের সর্ব উত্তরের আমিরাত) শিমলে (Shimal), আবু ধাবির হিলি উত্তর (Hili North), হিলি এবং উম্ আন্-নারে (Umm an-Nar), এবং বাহ্রাইনের কাল’আত আল-বাহরাইন (Qal’at al-Bahrain), সার (Saar), আ’আলি (Saar) এবং মদিনাত ইসায় (Madinat Isa)।

-------------------------------------------------------

 দেখুনঃ Sophie Méry, Michele Esposti, Dennys Frenez & Jonathan Mark Kenoyer, Indus Potters in central Oman in the second half of the third millennium BC. First results of a technological and archaeomeric study, in, Proceedings of the Seminar for Arabian Studies, Volume 47, Archaeopress, Oxford, 2017, p. 163.

দেখুনঃ Akinori Uesugi, A Note on the Interregional Interactions between the Indus Civilization and the Arabian Peninsula during the Third Millennium BCE, in, Decades in Deserts: Essays on Near Eastern Archaeology in honour of Sumio Fujii, eds., S. Nakamura, T. Adachi, M. Abe, Rokuichi Syobon, Japan, 2019, p. 341.   

-------------------------------------------------------

মধ্য ওমানের সালুট নামে একটি স্থানের নিকটে একটি পাথরের বৃত্তাকার উঁচু স্তম্ভ Salūt ST1 খনন করে সেখানে সম্প্রতি ২২ মিটার ব্যাস বিশিষ্ট একটি স্তম্ভ পাওয়া গেছে। এটির মাঝখানে পাথরের আস্তরণ দেওয়া একটি কুয়া আছে। এটির সময়কাল ২৪০০-২০০০ খ্রীঃপূঃ-এর মধ্যে। এই স্তম্ভটির চারপাশে ১১ থেকে ১৩ মিটার চওড়া ও ৩ মিটার গভীর একটি বড় গর্ত আছে। এই প্রধান গর্তটির সাথে দুটি অতিরিক্ত খাল যুক্ত হয়েছে। প্রত্নতাত্ত্বিকরা ধারণা করছেন যে, এই সমস্ত জিনিস জল ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণ এবং সম্ভবত ব্যাপক ভিত্তিক কৃষিকাজে ও মানুষজনের জল সরবরাহের জন্য ব্যবহৃত হত।  এখানে সিন্ধু সভ্যতার প্রচুর মৃৎপাত্র ও অন্যান্য জিনিস পাওয়া গেছে। সালুট উম্ আন-নার (Umm an-Nar) পর্বের বসতি ছিল। উম্ আন-নার শৈলীর মৃৎপাত্রের সাথে সিন্ধু শৈলীর কিনারা (জরস) পাওয়াতে মনে করা হচ্ছে যে, মধ্য ওমানের সালুটে সিন্ধুর মৃৎশিল্পী বা সিন্ধু-প্রশিক্ষিত মৃৎশিল্পীদের একটি ছোট গোষ্ঠী বাস করত।  এই মৃৎশিল্পীরা অন্যান্য মৃৎপাত্রও তৈরী করত বলে মনে করা হয়। এছাড়াও আরব আমিরাত ও ওমানের বিভিন্ন বসতিতে বহু সংখ্যক উম্ আন-নার শৈলীর মৃৎপাত্রের সাথে সিন্ধু শৈলীর কিনারা পাওয়া গেছে। উম্ আন-নার সমাধি থেকে পাওয়া বৈচিত্র্যপূর্ণ ও নানা পরিমাণের সিন্ধু সভ্যতার জিনিসপত্র পাওয়াতে গবেষকরা মনে করছেন যে, সিন্ধু অঞ্চল ও ওমান উপদ্বীপের মধ্যে সবচেয়ে বেশী বিনিময় ঘটেছিল ২৪০০ খ্রীঃপূঃ থেকে ২১০০ খ্রীঃপূঃ পর্যন্ত। এই বাণিজ্য সিন্ধু সভ্যতার শুরু এমনকি আরো আগে ২৮০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের দিকে শুরু হয়েছিল এবং সিন্ধু সভ্যতার সমাপ্তি পর্যন্ত অর্থাৎ ওমানের ওয়াদি সুক পর্বের (Wadi Suq period) শুরু পর্যন্ত বজায় ছিল।  গবেষণায় দেখা গেছে যে, ২৫০০ থেকে ২১০০ খ্রীঃপূঃ-এর মধ্যে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ওমানে পাওয়া সব অথবা প্রায় সব পাতলা ধূসর রঙিন (Fine grey painted) অথবা খোদিত মৃৎপাত্র এবং পাতলা লাল বা হলুদ রঙে রঞ্জিত (Fine red or buff painted) বা খোদিত মৃৎপাত্র বালুচিস্তানের মকরানের দস্ত উপত্যকায় তৈরী।  এটা ঠিক যে, ওমান উপদ্বীপে এগুলি অনুকরণ করে তৈরী করা হত, কিন্তু আমদানীর তুলনায় তা খুবই কম ছিল।

-------------------------------------------------------

Stone tower থেকে ST হয়েছে।

দেখুনঃ Dennys Frenez, Michele Degli Esposti, Sophie Méry & Jonathan Mark Kenoyer, Bronze Age Salūt (SR1) and the Indus Civilization: recent discoveries and new insights on regional interaction, in, Proceedings of the Seminar for Arabian Studies, Volume 46, Archaeopress Publishing Ltd., Oxford, 2016, p. 110.

দেখুনঃ Sophie Méry, Michele Esposti, Dennys Frenez & Jonathan Mark Kenoyer, Indus Potters in central Oman in the second half of the third millennium BC. First results of a technological and archaeomeric study, in, Proceedings of the Seminar for Arabian Studies, Volume 47, Archaeopress, Oxford, 2017, p. 179.

  দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ১৬৩, ১৮০।

দেখুনঃ S. Méry, M.J. Blackman, A. Didier, R. Besenval, A centre of production and diffusion for fine grey pottery in the third millennium: the pottery workshops of the Dasht Plain (Makran, Pakistan) and the Oman peninsula, in, Archäologische Mitteilungen aus Iran und Turan, Dietrich Reimer Verlag, Berlin, 2015, p. 194.

-------------------------------------------------------

 কার্নেলিয়ান পাথরে ছিদ্র করার প্রযুক্তি কেবলমাত্র সিন্ধুর কারিগরদের হাতে ছিল, যা তারা ২৬০০ খ্রীঃপূঃ-এর দিকে আবিষ্কার করেছিল। তারা আর্নেস্টাইট নামে কঠিন একটি পাথরের সাহায্যে কার্নেলিয়ান পাথরের লম্বা পুতিতে ছিদ্র করত। এই ধরনের পাথরের পুতি সালুট, বাট ও ওমান উপদ্বীপের অন্যান্য বসতি থেকে পাওয়া গেছে।  গবেষণাগারে পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে, সালুটে পাওয়া কার্নেলিয়ান পুতি গুজরাটের কার্নেলিয়ান পাথর থেকে তৈরী। বাটে সমাধি ১৫৫-তে পাওয়া খুবই লম্বা উভয় দিকে মোচাকৃতির একটি কার্নেলিয়ান পুতি (৭.৭ সেন্টি মিটার দীর্ঘ) গবেষণাগারে পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে, এর ভিতরের ছিদ্রটি সিন্ধুর সরু আর্নেস্টাইট ড্রিল দিয়ে করাটাই সম্ভব।  এখনকার আবিষ্কার ও গবেষণা থেকে এই বিষয়টি ক্রমশই পরিষ্কার হচ্ছে যে, ওমানের অভ্যন্তরে সিন্ধুর জিনিসপত্রের উপস্থিতি স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সাথে কেবলমাত্র আংশিক বাণিজ্য ছিল না, বরং সিন্ধুর বণিক ও শিল্পীদের সাথে সরাসরি বিনিময় ছিল, যারা ওমানের উপকূলীয় ও অভ্যন্তরের বসতিগুলিতে উপস্থিত ছিল এবং সম্ভবত বসতি গড়েছিল।  সেখানে তারা একটি শক্তিশালী বণিক সম্প্রদায় গড়ে তুলেছিল। এছাড়াও ওমানের অভ্যন্তরে সিন্ধুর বাইরের কাঁচামাল দিয়ে তৈরী কিন্তু যন্ত্রপাতি ও কৌশল সিন্ধুর এমন সিন্ধুর সীল পাওয়াতে এই ধারণাটি আরো শক্তিশালী হয় যে, বৃহত্তর সিন্ধু উপত্যকার বণিক ও কারিগররা ওমানের অভ্যন্তরের বসতিগুলিতে বাস করত ও সেখানে কাজও করত। এমনকি সিন্ধুর শিশুদের খেলার জিনিসও সেখানে পাওয়ায় এই ধারণা জোরালো হয়। সামগ্রিকভাবে এই সমস্ত সাক্ষ্য ও অন্যান্য তথ্য থেকে গবেষকরা এটা মনে করছেন যে, সিন্ধুর বণিকরা সমন্বিত বৈশি^ক ক্রয়-বিক্রয় কৌশলের আদিরূপ বাস্তবায়ন করেছিল। তারা আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য থেকে স্থানীয় প্রবণতা অনুযায়ী বিদেশী সহায়তাকারী তৈরী করে উৎপাদন ও বিতরণের মাধ্যমে এক উদ্যোগী বাণিজ্যিক সুযোগ গ্রহণ করেছিল এবং উচ্চ আন্তর্জাতিক চাহিদার ভিত্তিতে কৌশলগত কাঁচামালের সর্বোচ্চ ব্যবহার করেছিল।

-------------------------------------------------------

দেখুনঃ Dennys Frenez, Michele Degli Esposti, Sophie Méry & Jonathan Mark Kenoyer, Bronze Age Salūt (SR1) and the Indus Civilization: recent discoveries and new insights on regional interaction, in, Proceedings of the Seminar for Arabian Studies, Volume 46, 2016, pp. 114-115.

দেখুনঃ Jonathan Mark Kenoyer and Dennys Frenez, Stone Beads in Oman During the 3rd to 2nd Millennia BCE: New Approaches to the Study of Trade and Technology, in, BEADS: Journal of the Society of Bead Researchers, 30, 2018, p. 70.

দেখুনঃ Dennys Frenez, Michele Degli Esposti, Sophie Méry & Jonathan Mark Kenoyer, Bronze Age Salūt (SR1) and the Indus Civilization: recent discoveries and new insights on regional interaction, in, Proceedings of the Seminar for Arabian Studies, Volume 46, 2016, p. 118.

গবেষক ডেনিস ফ্রেনেজ লিখেছেনঃ `Overall, this evidence, combined with other information about the organization of the Indus Civilization external trade in Middle Asia, allows proposing the possible implementation by the Indus merchants of an early prototype of coordinated «global marketing strategy», defined as an entrepreneurial strategy that takes commercial advantage from regional particularities by creating foreign subsidiaries to manufacture and distribute a product according to the local trends and/or to maximize the exploitation of strategic raw materials with high international demand.’ Dennys Frenez, The Indus Civilization Trade with the Oman peninsula, in, In the Shadow of the Ancestors: The Prehistoric Foundations of the Early Arabian Civilization in Oman, eds., Dennys Frenez & Roman Garba, Second expanded edition, Published by the Ministry of Heritage and Culture, Sultanate of Oman, Muscat, 2018, p. 396.   

-------------------------------------------------------

পাতা : ৩৬

সিন্ধুর হরপ্পান পর্যায়ে ধোলাভিরার সমাধি-স্তূপের মত সমাধি-স্তূপ বাহরাইনে ২২০০-২০০০ খ্রীপূঃ-এর দিকে দেখা গেছে।  তবে এর মধ্যে মানুষের কংকাল পাওয়া গেছে, যা ধোলাভিরায় পাওয়া যায় নাই। বাহরাইনে ধোলাভিরা ধরনের সমাধি-স্তূপ পাওয়াতে মনে করা হয় যে, হরপ্পান ব্যবসায়ীরা বাহরাইন ও ফৈলাকায় শক্তিশালী অবস্থান গড়ে তুলেছিল ও তাদের মৃতের অন্তেষ্টিক্রিয়ার পদ্ধতি ও স্থাপত্য কৌশল নিয়ে গিয়েছিল।

-------------------------------------------------------

দেখুনঃ R.S. Bisht, How Harappans Honoured Death at Dholāvīrā, in, Sindhu-Sarasvatī Civilization: New Perspectives, ed., Nalini Rao, 2014, p. 303-306.

দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ৩০৪-৩০৬।

-------------------------------------------------------

ইন্দো-ইরানীয় সীমান্তবর্তী প্রত্নস্থল সমূহ (সৌজন্যেঃ J.-F. Jarrige, A. Didier and G. Quivron, 2011)


ওমান উপদ্বীপের আদি ব্রোঞ্জ যুগের প্রধান বসতিসমূহ ও মধ্য এশিয়ার সমসাময়িক বসতিসমূহ (সৌজন্যেঃ Sophie Mérry, Michele Esposti, Dennys Frenez & Jonathan Mark Kenoyer, 2017)

ইরানের হালিল নদী উপত্যকায় কোনার স্যান্ডাল দক্ষিণ নামে একটি বসতি থেকে সিন্ধু শৈলীর সীল, পুতুল জাতীয় ভাস্কর্য ও গোলকাকার বাটখারা পাওয়াতে সিন্ধু সভ্যতার সাথে এই বসতিটির যোগাযোগের প্রমাণ মিলে।  কোনার স্যান্ডাল দক্ষিণে সিন্ধু-শৈলীর বাটখারা ও বিশেষভাবে গোলকাকার বল প্রচুর পরিমাণে পাওয়া গেছে। কোনার স্যান্ডাল দক্ষিণে বেলনাকার একটি সীলে বহু ব্যবহারে ক্ষয় হয়ে যাওয়া সিন্ধু শৈলীর চিত্র পাওয়াতে মনে করা হচ্ছে যে, এখানকার সাথে সিন্ধুর বণিক ও কারিগরদের পারিবারিক বন্ধন থেকে থাকবে।  নিন্দোওয়ারি থেকে ক্যালসাইট পাথরের বল (বাটখারা) পাওয়াতে কুল্লি, হালিল নদী উপত্যকা ও সিন্ধুর মধ্যে যোগাযোগের বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয়। এছাড়া লাখানঞ্জোদাড়োতেও একই ধরনের সাদা পাথরের বল পাওয়া গেছে। মধ্য এশিয়ার অঞ্চলগুলিতে যেমন, দক্ষিণ তুর্কমেনিস্তান, উজবেকিস্তান ও উত্তর আফগানিস্তানের বসতিগুলিতে নানা ধরনের প্রত্নতাত্ত্বিক বস্তু পাওযা গেছে। এগুলি থেকে জানা যাচ্ছে যে, হরপ্পান সভ্যতার অনেক জিনিসপত্র এইসব অঞ্চলে আমদানী হত। এছাড়া এইসব অঞ্চলে সিন্ধু সভ্যতার প্রভাবও দেখা গেছে। অন্য দিকে মধ্য এশিয়ার এই অঞ্চলগুলি থেকে কিছু জিনিসপত্র সিন্ধু সভ্যতার বসতিগুলিতেও পাওয়া গেছে। মধ্য এশিয়ার অলটিন ডেপে থেকে পাওয়া সিন্ধু সভ্যতার হাতির দাঁতের নানা জিনিস থেকে জানা যায় যে, অভিজাত মানুষদের বাড়ীঘর সাজাতে ও পুরোহিতদের কবরে এগুলি ব্যবহার হত।  তৃতীয় সহস্রাব্দের শেষের দিকে ব্যাকট্রিয়া ও মার্জিয়ানার (BMAC- ব্যাকট্রিয়া- মার্জিয়ানা আর্কিওলোজিক্যাল কমপ্লেক্স) জিনিসপত্রের সীমিত উপস্থিতি ইরানীয় মালভূমি ও সিন্ধু উপত্যকায় এবং পারস্য উপসাগরীয় বিভিন্ন বসতিতে, যেমন, সুসা, টেপে ইয়াহ্ইয়া, শাহ্দাদ, খিনামন, হিসার, জিরোফ্ট, হরপ্পা, মহেঞ্জো-দাড়ো ও টেল আবরাকের মত বসতিগুলিতে দেখতে পাওয়া যায়। তবে সিন্ধু সভ্যতায় পাওয়া বিদেশী জিনিসপত্র তুলনামূলকভাবে দুর্লভ।  ব্যাক্ট্রিয়া ও মারজিয়ানার সাথে সিন্ধু সভ্যতার যোগযোগের বিষয়টি স্পষ্ট। এমন কি ২০০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের দিকে সিন্ধু সভ্যতার বসতিগুলিতে মধ্য এশিয়ার (ব্যাকিট্রয়া ও মার্জিয়ানার) কিছু গোষ্ঠীর উপস্থিতির প্রমাণ পাওয়া গেছে।  মধ্য এশিয়ার বসতিগুলিতে সিন্ধু বা সিন্ধু সভ্যতা সম্পর্কিত অনেক জিনিসপত্র পাওয়াতে (সিন্ধুতে পাওয়া জিনিসপত্রের চেয়ে বেশী) এটা মনে করা যেতে পারে যে, প্রাথমিক স্তরে সিন্ধুর অধিবাসীরা এই সম্পর্কের উদ্যোক্তা ছিল, অথবা সম্পর্কটা এমন ছিল যে, সিন্ধু থেকে মধ্য এশিয়ামুখী যোগাযোগটা প্রাধান্যশীল ছিল। পরবর্তীতে মধ্য এশিয়াতে ব্যাকট্রিয়া-মার্জিয়ানা (BMAC) বিকাশ লাভ করলে এই সম্পর্কটিকে মধ্য এশিয়া থেকে সিন্ধুর দিকে বেশী পরিমাণে ঝুঁকতে দেখা যায়। এটা তখনই ঘটেছিল যখন দ্বিতীয় সহস্রাব্দের শুরুর দিকে সিন্ধু সভ্যতায় ক্ষয় শুরু হচ্ছিল।

-------------------------------------------------------

দেখুনঃ Rita P. Wright, Konar Sandal South, Nindowari, and Lakhan Jo Daro – Beyond the Limits of a Known World, in, South Asian Archaeology and Art: Contextualizing Material culture in South and Central Asia in Pre-Mordern Times, eds., Verena Widorn, Ute Franke & Petra Latschenberger, Brepols Publishers n.v., Turnhout, 2016, p. 31.

দেখুনঃ Massimo Vidale and Dennys Frenez, Indus Components in the Iconography of a White Marble cylinder Seal from Konar Sandal South (Kerman, Iran), in, South Asian Studies, Vol. 31, No. 1, Routledge, 2015, p. 151.

দেখুনঃ A. Bakri, Prehistoric Contacts between Central Asia and India, Transactions of Margiana Archaeological Expedition, Volume 6, eds., N.A. Dubova, E.V. Antonova, P.M. Kozhin, M.F. Kosarev, R.G. Muradov, R.M. Sataev & A.A. Tishkin, Moscow, 2016, p. 423.

দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ৪৩০।

দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ৪৩১।

দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ৪৩৪।

-------------------------------------------------------

পাতা : ৩৭

প্রধান মধ্য এশীয় প্রত্নস্থল ও ভারতীয় প্রত্নস্থল সমূহ (সৌজন্যেঃ A. Bakry, 2016)

মধ্য এশিয়ার অলটিন ডেপেতে সিন্ধু লিপি যুক্ত সীল প্রাপ্তি থেকে গবেষক আর,এ, কার্টার মনে করেন যে, দক্ষিণ মধ্য এশিয়ার অলটিন ডেপের মানুষজন যে প্রাক-দ্রাবিড় ভাষায় কথা বলত সেটা দ্রাবিড়ভাষী হরপ্পান মানুষজনের উপনিবেশ স্থাপনের কারণে সম্ভব হয়েছিল।  যদিও হরপ্পানরা আদৌ দ্রাবিড় ভাষায় কথা বলত কীনা সেটা এখনো প্রমাণিত নয়।

----------------------------------------

  দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ৪৩১-৪৩২।

----------------------------------------

শাহর-ই সোখতা ১-৩এ থেকে পাওয়া সীল (১ থেকে ৫) ও নৌশারো ১ থেকে পাওয়া পোড়া মাটির সীল (৬ থেকে ১২) (সৌজন্যেঃ J.-F. Jarrige, A. Didier and G. Quivron, 2011)

বাহরাইনের সার (Saar) নামে একটি বসতিতে প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানে জানা যাচ্ছে যে, খ্রীষ্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দের প্রথম দিকে হরপ্পান পর্যায়ের শেষের দিকে সৌরাষ্ট্রের বসতিগুলির সাথে সেখানকার বাণিজ্য যোগাযোগ গড়ে উঠে।  এই যোগাযোগ বিদায়ী হরপ্পান পর্বেও টিকে ছিল। সার থেকে প্রাপ্ত মৃৎপাত্রের অনুরূপতা পাওয়া যায় সোরাথ হরপ্পানের শেষ পর্যায়ের সাথে, এবং সবচেয়ে বেশী মিল পাওয়া যায় রোজদি পর্যায় গ (২০০০ - ১৭০০ খ্রীঃপূঃ), লোথাল পর্যায় খ (২০০০ - ১৮০০ খ্রীঃপূঃ), এবং রংপুর পর্ব ২ খ-গ (১৯০০- ১৫০০ খ্রীঃপূঃ)-এর সমসাময়িক সৌরাষ্ট্রের বিভিন্ন বসতিসমূহের সাথে।

-------------------------------------------------------

দেখুনঃ R.A. Carter, Saar and its external relations: new evidence for interaction between Bahrain and Gujarat during the early second millennium BC, in, Arabian archaeology and epigraphy, Munksgaard, 2001:12, pp. 183-201.  

  দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ১৮৫।

-------------------------------------------------------

হাতির দাঁতের তৈরী সিন্ধু-শৈলীর চিরুনি (ক) রাস আল-জিনয্, এবং (খ) বাটের কবরস্থানের গর্ত থেকে পাওয়া (সৌজন্যেঃ Dennys Frenez, 2018)

সিন্ধুর দীর্ঘ ও অতি-দীর্ঘ উভয় পাশে মোচাকৃতি কার্নেলিয়ান পাথরের পুতি (ক) সালুট এসটি১, এবং (খ) বাটের সমাধি ১৫৫ থেকে পাওয়া (সৌজন্যেঃ Dennys Frenez, 2018)

পাতা : ৩৮

যোগাযোগের জন্য ডাঙায় দুই চাকাওয়ালা গাড়ী ব্যবহার হত যা গরু বা অন্য কোনো প্রাণী দিয়ে টানা হত।  এছাড়া অভ্যন্তরীণ যোগাযোগের জন্য নদীপথে নৌকাও একটি গুরুত্বপূর্ণ বাহন ছিল। কোনো কোনো মূল্যবান জিনিস নিরাপদে রাখা বা সতর্ককতার সাথে পরিবহন করার জন্য বড় পাত্রের মধ্যে আরেকটি পাত্র রাখা হত। এই রকম পাত্র পাওয়া গেছে সিন্ধু প্রদেশের পুঞ্জের ভানভ্রো (Poonger Bhanbhro) বসতিটিতে যেখানে সাদা চাকতির পুতি রাখতে দেখা গেছে।

-------------------------------------------------------

দেখুনঃ Jonathan Mark Kenoyer, Carts and wheeled vehicles of the Indus Civilization: New evidence from Harappa, Pakistan, in, Current Studies on the Indus Civilization, Volume VI, eds., Toshiki Osada and Akinori Uesugi, Manohar Publishers & Duistributers, New Delhi, 2011, p. 15.

দেখুনঃ Qasid H. Mallah, Recent archaeological discoveries in Sindh, Pakistan, in, Current Studies on the Indus Civilization, Volume I, eds., Toshiki Osada and Akinori Uesugi, 2010, p. 60.

-------------------------------------------------------

গনুর ডেপের রাজকীয় সমাধিক্ষেত্র থেকে পাওয়া হাতির দাঁতের চিরুনি (সৌজন্যেঃ A. Bakry, 2016)

অলটিন ডেপে থকে পাওয়া সিন্ধু ধরনের দুটি সীল (সৌজন্যেঃ A. Bakry, 2016)

ত্তর গনুরের দক্ষিণে একটি কক্ষ থেকে পাওয়া হরপ্পান ধরনের সীল (সৌজন্যেঃ A. Bakry, 2016)

মাটির তৈরী ইঁদুর ধরার ফাঁদ (স্কেল জানা যায় নাই), ১. মুন্ডিগক; ২. মহেঞ্জো-দাড়ো (সৌজন্যেঃ E. Cortesi, M. Tosi, A. Lazzari and M. Vidale, 2008)

হরপ্পা থেকে পাওয়া ঈগল পাখীর ছবি সম্বলিত সীলের সাথে গনুর ডেপ থেকে পাওয়া সীলের তুলনামূলক দৃষ্টান্ত (সৌজন্যেঃ A. Bakry, 2016)

পাতা : ৩৯

পাথরের তৈরী ভেড়ার মূর্তি, গনুর ডেপে (বাম পাশেরটি) ও মহেঞ্জো-দাড়ো (ডান পাশেরটি) থেকে পাওয়া (সৌজন্যেঃ A. Bakry, 2016)


গনুর ডেপে থেকে পাওয়া বানরের মূর্তি (সৌজন্যেঃ A. Bakry, 2016)

    

মহেঞ্জো-দাড়ো থেকে পাওয়া পাথরের মূর্তির ভগ্নাংশ (বাম পাশের ছবি), গনুর ডেপের রাজকীয় মন্দির থেকে পাওয়া পুনর্নির্মিত পাথরের মূর্তি (ডান পাশের ছবি) (সৌজন্যেঃ A. Bakry, 2016)

পোড়ামাটির নারী মূর্তি। ১, শাহর-ই সোখ্তা ২ থেকে পাওয়া মূর্তি; ২-৬, মেহরগড় ৭ থেকে পাওয়া মূর্তি; ৭-৮, মুন্ডিগক থেকে পাওয়া মূর্তি; ৯-১১, ডাম্ব-সাদাত ২-৩ থেকে পাওয়া মূর্তি (সৌজন্যেঃ J.-F. Jarrige, A. Didier and G. Quivron, 2011)

 

হরপ্পান পর্যায়ের সময়ানুক্রমিক বিভাগ

হরপ্পান পর্যায় ২৬০০ থেকে ১৯০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত টিকে থাকলেও একে কয়েকটি উপ-পর্যায়ে (Sub-phase) বা পর্বে (Period) ভাগ করা হয়েছে। এই ভাগ করা হয়েছে মৃৎশিল্প ও অন্যান্য নিদর্শনের শৈলীতে, সীল ও লেখায়, এবং স্থাপত্যের বাহ্যিক গঠনে পরিবর্তনের উপর ভিত্তি করে।  ধারণা করা যায় যে, হরপ্পান পর্যায়ের দীর্ঘ ৭০০ বৎসর ব্যাপী হরপ্পা, মহেঞ্জো-দাড়োর মত নগরগুলির সামাজিক-রাজনৈতিক সংগঠন একই রকম ছিল না। ২২০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের দিকে সমরূপ বিশিষ্ট হরপ্পান সভ্যতাকে নানা আঞ্চলিক সত্তায় ক্রমবর্ধমানভাবে বিভক্ত হয়ে যেতে দেখা যায়। একই সময়ে কাছি/ বোলান এলাকার বসতিগুলি ও বালুচিস্তানের অভ্যন্তরীণ বসতিগুলির পারস্পরিক যোগাযোগ শক্তিশালী হচ্ছিল, যেমন নৌশারো পর্ব ৪-এ অনেক কুল্লি শৈলীর উপাদান দেখা গিয়েছিল।  হরপ্পা ও অপর একটি ছোট বসতি নৌশারোর রঙিন মৃৎপাত্র পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে, হরপ্পান পর্যায়ব্যাপী রঞ্জিত নকশা ও মৃৎপাত্রের শৈলীতে তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন হয়েছিল। মৃৎপাত্রের উপর গবেষণা করে জি, কুইভ্রন দেখিয়েছেন যে, হরপ্পান পর্যায়ে সময়ের সাথে সাথে মৃৎপাত্রের গঠন ও নকশার বিষয়বস্তু ও শৈলীর পরিবর্তন দেখতে পাওয়া যায়।  এই সমস্ত বৈশিষ্ট্যের স্বাতন্ত্র্য বিবেচনা করে তিনি হরপ্পান পর্যায়কে তিনটি অবস্থা বা stage-এ ভাগ করেন। তাঁর এই পর্যবেক্ষণ গুরুত্বপূর্ণ যে, এই তিনটি অবস্থার মধ্যে প্রথম অবস্থায় মৃৎপাত্রের বৈশিষ্ট্যে সবচেয়ে সমরূপতা দেখতে পাওয়া যায়।  এই সময়কার নকশার সংগ্রহ তুলনামূলকভাবে রক্ষণশীল। মৃৎপাত্রগুলি রঙে ও উৎকর্ষে পরবর্তী অবস্থাগুলির চেয়ে উৎকৃষ্টতর। দ্বিতীয় অবস্থায় পূবের্র আলংকারিক ঐতিহ্য ধারাবাহিকতা রাখলেও অঙ্কিত ছবিগুলি কম অনমনীয় হতে শুরু করেছিল। আগের অবস্থার লক্ষ্যণীয় সমরূপত্ব অন্তর্ধান করতে শুরু করেছিল এবং শৈলীগত ভিন্নতা ঘটছিল। তৃতীয় অবস্থা হল মৃৎপাত্রের ক্ষেত্রে আঞ্চলিক শ্রেণীতে বিভক্ত হবার সময়। এই সময় মৃৎপাত্রের শৈলীতে আরো বৈচিত্র্যপূর্ণ সংগ্রহ দেখতে পাওয়া যায়।

-------------------------------------------------------

দেখুনঃ Jonathan Mark Kenoyer and Richard H. Meadow, Harappa: New Discoveries on its Oigins and Growth, in, Lahore Museum Bulletin, Vol. XII, No. 1, ed., Dr. Anjum Rehmani, 1999, p. 4.

দেখুনঃ Jean-François Jarrige, Harappan Occupation at Nausharo, in, Early Harappans and Indus-Sarasvati Civilization, Volume II, eds., D.P. Sharma and Madhuri Sharma, Kaveri Books, New Delhi, 2013, p. 517.

দেখুনঃ Gonzague Quivron, The Evolution on the Mature Indus Pottery Style in the Light of the Excavations at Nausharo, Pakistan, in, East and West, Volume 50, No. 1/4 (December 2000), pp. 147-153.

দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ১৭৮।

-------------------------------------------------------

হরপ্পায় পর্ব ৩বি এর মধ্যবর্তী সময়ে বা ২৩৫০-২৩০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে নগরের তাৎপর্যপূর্ণ পুনরারম্ভ দেখা যায়, যার মধ্যে ঢিবি ই-এর পূর্ব দিকে বড় ধরনের পুনর্নির্মাণ হয়, যার মধ্যে ঢিবি এফ-এ ’শস্যাগার’-এর নির্মাণ হতে পারে বলে মনে হয়।

-------------------------------------------------------

দেখুনঃ Richard H. Meadow and Jonathan Mark Kenoyer, The ‘Tiny Steatite Seals’ (Incised Steatite Tablets) of Harappa: Some Observations on Their Context and Dating, in, South Asian Archaeology 1997, Volume I, eds., Maurizio Taddei and Giuseppe De Marco, Istituto Italiano per L’Africa e L’oriente, Rome, 2000, p. 17.

-------------------------------------------------------

পাতা : ৪০

 হরপ্পায় ঢিবি ই ও ইটি-তে ইটের দেওয়াল ও নগর-দরজা এলাকায় পুনর্নির্মিত কাঠামো পরীক্ষা করে দেখা যায় যে, সময়ের সাথে সাথে ইটের মাপেও পরিবর্তন হয়েছে।  নগর-দরজার এলাকার প্রথম দিককার সময় ধরা হয় প্রায় ২৪৫০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দ (পর্ব ৩বি)। এখানকার ইটগুলির মাপ ছিল ৭ X ১৪ X ২৮ সেঃমিঃ। কিন্তু ২০০০ থেকে ১৯০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের (পর্ব ৩সি) দিকে দেওয়াল নির্মাণে আরো ছোট ইট ব্যবহৃত হতে থাকে, যেগুলির মাপ প্রায় ৫ X ১২ X ২৪ সেঃমিঃ।  তবে এই সময়ে মাপে পরিবর্তন হলেও সামগ্রিক অনুপাত একই ছিল। সম্প্রতি হরপ্পায় খনন করে সর্বশেষ স্তরে, যা প্রায় ২২০০-১৯০০ খ্রীঃপূঃ-এর মধ্যে, তুলনামূলকভাবে বেশী বর্ণনামূলক শিল্প দেখতে পাওয়া যায়। কেনোয়ার মনে করেন, বহু শত বৎসর নগর সভ্যতায় বসবাসের পর সেখানে সেই সময়ে নির্দিষ্ট ধর্মীয় ছবি, উপকথার বর্ণনা ও পূজার দৃশ্য খোদিত করার ও সেগুলিকে বৈধতা প্রদান করার দরকার হয়ে পড়েছিল।

-------------------------------------------------------

দেখুনঃ J. Mark Kenoyer, Measuring the Harappan world: Insights into the Indus order and cosmology, in, The Archaeology of Measurement: Comprehending Heaven, Earth and Time in Ancient Societies, eds., Iain Morley and Colin Renfrew, 2010, pp. 118-119.

  দেখুনঃ প্রগুক্ত, পৃঃ ১১৮-১১৯।

এই বিষয়ে কোনোয়ার বলছেন, `… recent excavations at Haṛappā indicate that examples of narrative art are found more commonly in the latest levels of the site, dating to around 2200-1900 BCE. This pattern suggests that after several hundred years of urbanism, there was an urgent need to depict and thereby legitimize specific religious figures, narrative myths and scenes of worship. It is from these images that we can begin to understand the complexity of Haṛappan ideology and the mythology that accompanied it.’ দেখুনঃ Jonathan Mark Kenoyer, New Perspectives on the Indus Tradition: Contributions from Recent Research at Haṛappā and Other Sites in Pakistan and India, in, Sindhu-Sarasvatī Civilization: New Perspectives, ed., Nalini Rao, 2014, p. 521.

-------------------------------------------------------

সময়ের সাথে হরপ্পান-শৈলীর মৃৎপাত্রে রঞ্জিত করায় পরিবর্তন (সৌজন্যেঃ Akinori Uesugi, 2019)

 

মৃতদেহের সৎকার

হরপ্পান পর্যায়ে বিভিন্ন ধরনের মৃতদেহের সৎকার পদ্ধতি চালু ছিল। মৃতের কবর দেওয়া হত বসতি থেকে দূরে এবং সকল মৃতকে কবর দেওয়া হত না। কেবলমাত্র কোনো নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর লোকজনের মধ্যে মৃতদেহ কবর দেওয়ার প্রথা ছিল। বাকিদের হয় পোড়ানো হত অথবা অন্য পদ্ধতিতে সৎকার করা হত। মহেঞ্জো-দাড়োতে এখন পর্যন্ত কোনো কবরস্থান পাওয়া যায় নাই। এখানকার জনসংখ্যা আনুমানিক ৮০,০০০ ছিল। হরপ্পায় যে কবরস্থান পাওয়া গেছে তা সেখানে বসবাসরত মোট জনসংখ্যার (আনুমানিক ৪০,০০০) তুলনায় ছোট ও প্রাপ্ত কংকালের সংখ্যাও তুলনায় কম। এ থেকে মনে করা হয় যে, কেবলমাত্র সেখানে বসবাসরত একটি জনগোষ্ঠীর মানুষকে কবর দেওয়া হত। মৃৎপাত্র ও অন্যান্য জিনিসপত্র বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে যে, হরপ্পার কোনো একটি অভিজাত গোষ্ঠীকে এটি প্রতিনিধিত্ব করত এবং হরপ্পার সমগ্র জনগোষ্ঠীকে নয়।

-------------------------------------------------------

 দেখুনঃ J. Mark Kenoyer, T. Douglas Price and James H. Burton, A new approach to tracking connections between the Indus Valley and Mesopotamia: initial results of strontium isotope analyses from Harappa and Ur, Journal of Archaeological Science 40 (2013), p. 2288.

-------------------------------------------------------

মৃতদেহ সৎকারের পদ্ধতির মধ্যে ছিল কবরস্থ ও দাহ করা। সাধারণভাবে আয়তাকার বা ডিম্বাকৃতি গর্তে, মাথা উত্তর দিকে রেখে তারা কবর দিত। এই সব কবরে অল্প ক্ষেত্রে কোনো আস্তরণ দেওয়া হত। হরপ্পা, কালিবঙ্গান ও লোথালে ইটের আস্তরণ দেওয়া কবর দেখা গেছে। কবরে উৎসর্গীকৃত জিনিসপত্রের মধ্যে ছিল বিপুল সংখ্যক পাত্র (সম্ভবত এতে খাদ্য ও জল দেওয়া হত) এবং ব্যক্তিগত ব্যবহার্য জিনিসপত্র যেমন, অলংকার, তামার তৈরী আয়না, ইত্যাদি। সেখানে কাঠের তৈরী কিছু কফিনও পাওয়া গেছে। এছাড়া দাহ পরবর্তী পাত্র-সমাধিও (Post cremation pot burial) মৃতদেহ সৎকারের একটি পদ্ধতি ছিল। হরপ্পানদের সমাধিতে কোনো মূর্তি, সীল বা খোদিত জিনিস ও উচ্চ মূল্যের জিনিস যেমন তামার যন্ত্রপাতি, সোনা ও কার্নেলিয়ান পাথরের পুতি সাধারণভাবে সমাধি-বস্তু হিসাবে দেওয়া হত না।

-------------------------------------------------------

 দেখুনঃ Jonathan Mark Kenoyer, New Perspectives on the Indus Tradition: Contributions from Recent Research at Harappā and Other Sites in Pakistan and India, in, Sindhu-Sarasvatī Civilization: New Perspectives, ed., Nalini Rao, 2014, p. 523.

-------------------------------------------------------

বনওয়ালী থেকে পাওয়া কার্নেলিয়ান পাথরের পুতি (সৌজন্যেঃ Vivek Dangi, 2018)

হরিয়ানায় সাম্প্রতিক উৎখননে কিছু সংখ্যক হরপ্পান পর্যায়ের সমাধিস্থল পাওয়া গেছে। এগুলি হল বেদওয়া-২, পুথি সেমান (Puthi Seman) -১, ভৈনি সুরজন-২, ভৈনি ভারো-৩ (রোহতক জেলায়) ও মাধওয়ালা-২ (ফতেহাবাদ জেলায়)। এই সমাধিস্থলগুলি ঘাগর অববাহিকার উপরের অঞ্চলে অবস্থিত। এটা খুব আশ্চর্যের বিষয় যে, পুথি সেমান-১ ছাড়া এই সমাধিস্থলগুলির সাথে বসতি পাওয়া যায় নাই, যেমন হরপ্পা, কালিবঙ্গান, ফারমানা বা ধোলাভিরার সাথে সমাধিক্ষেত্র পাওয়া গেছে।

-------------------------------------------------------

 দেখুনঃ Vivek Dangi, Akinori Uesugi, Manmohan Kumar, Vasant Shinde and Appu, Bedwa: A Mature and Late Harappan Necropolis in the Upper Ghaggar Basin, in, Harappan Studies: Recent Researches in South Asian Archaeology, Volume 1, eds., Manmohan Kumar and Akinori Uesugi, Aryan Books International, New Delhi, 2014, p. 148-149.

-------------------------------------------------------

পাতা : ৪১

ঘাগর নদী অববাহিকায় বেদওয়া সমাধিস্থলটি (Burial site) হরপ্পান পর্যায়ের শেষে বা বিদায়ী হরপ্পান পর্যায়ের প্রথম দিককার।  এখানে মৃতদেহের মাথা উত্তর দিকে উত্তর-দক্ষিণ বরাবর ও দেহ তাদের পিঠের উপর রাখা হত। মাথার কাছে থাকত সমাধি-দ্রব্য, যেগুলি সাধারণত মৃৎপাত্র হত। এখানে হরপ্পান স্তরে কিছু পাত্রে ছাই ও মানব দেহের হাড়ের খণ্ডাংশ পাওয়া গেছে।  হরপ্পান পর্যায়ে যে মৃত দেহ দাহ করা হয়ে থাকত এটি তার প্রমাণ। বেদওয়া ছাড়াও ঘাগর নদী অববাহিকায় পুথি সেমান নামে আরো একটি সমাধিস্থল পাওয়া গেছে। এতে অনুমান করা হয় যে, উভয় সমাধিস্থলটিই ফারমানা বসতিটির অন্তর্ভুক্ত ছিল।  বেদওয়া ও পুথি সেমান উভয় সমাধিস্থল ফারমমানা থেকে প্রায় ৩ কিঃমিঃ দূরে। একটি তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল যে, ঘাগর অববাহিকায় মৃতের সাথে অলংকার বা অস্ত্র রাখা হত না, যা যমুনা সমভূমিতে অবস্থিত সানৌলি নামে প্রত্নস্থলে পাওয়া গিয়েছিল।  এটি একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় যে, বেদওয়ার আশেপাশের গ্রামে হিন্দুদের মধ্যে এখনো মৃতের তিন ধরনের সৎকার পদ্ধতি প্রচলিত আছে। প্রথম পদ্ধতিতে শব দাহের পর হাড় ও ছাই সংগ্রহ করা হয় ও জলে ডুবানো হয়, দ্বিতীয় পদ্ধতিতে শবদেহ দাহ করার পর কোনো হাড় সংগ্রহ করা হয় না, তৃতীয় পদ্ধতিতে সন্ন্যাসীদের, বিশেষত নাথ সন্ন্যাসীদের কবর দেওয়া হয়।  সানৌলিতে পাওয়া সমাধিতে প্রচুর সমাধি-দ্রব্য পাওয়া গিয়েছিল। সেখানে কার্নেলিয়ান ও সোনার পুতির অলংকার এবং অস্ত্র সামগ্রীর মধ্যে তামার তৈরী ছোরা অন্তর্ভুক্ত ছিল। ফারমানার সাথে সংশ্লিষ্ট যে সমাধিস্থলটি পাওয়া গেছে (৯০০ মিটার দূরে), সেখানে তিনটি পদ্ধতিতে কবর দিবার কথা জানা গেছে। সেখানে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও প্রতিকী কবর দিবার প্রমাণ পাওয়া গেছে।  প্রাথমিক পদ্ধতিতে মাথা উত্তরে রেখে দেহকে আঁকাবাকাভাবে রাখা হত। সমাধির সাথে বিভিন্ন জিনিস যেমন, মণি-রত্ন, পাত্র, ইত্যাদি দেওয়া হত। মাধ্যমিক পদ্ধতিতে মৃতদেহকে কোনো উন্মুক্ত স্থানে রাখা হত, এরপর অবশিষ্ট হাড়গুলি আনুষ্ঠানিকতার পর কোনো গর্তে রাখা হত। সবচেয়ে বেশী সংখ্যক এই পদ্ধতিতে কবর দিতে দেখা গেছে। কবরস্থানে পাওয়া একটি অনেক বড় গর্তে কোনো হাড় ছিল না, কিন্তু কিছু পাত্রের ভাংগা অংশ ছিল। এটিকে প্রতিকী কবর হিসাবে খননকারীরা চিহ্নিত করেছেন। একই ধরনের প্রতিকী কবর সানৌলিতেও পাওয়া গেছে। ফারমানায় খননকারীরা লক্ষ্য করেছেন যে, কিছু কবরে মৃতদেহকে উত্তর-দক্ষিণ বরাবর আবার কিছু কবর উত্তর পশ্চিম-দক্ষিণ পূর্ব বরাবর রাখা। এতে তাঁরা মনে করছেন যে, এগুলি ভিন্ন জনগোষ্ঠীর লোকজনের কবর দিবার ভিন্ন প্রথা হতে পারে।  আবার কিছু কবরে বেশী পরিমাণ ও দামী সমাধি-দ্রব্য থাকাতে ও কবরের বৈশিষ্ট্য থেকে সেগুলি ধনীদের অথবা সমাজে তাদের অবস্থান উঁচু ছিল বলে মনে করা হয়।

------------------

  দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ৯৩।

দেখুনঃ Vasant Shinde, Toshiki Osada, M.M. Sharma, Akinori Uesugi, Takao Uno, Hideaki Maemoku, Prabodh Shirvalkar, Shweta Sinha Deshpande, Amol Kulkarni, Amrita Sarkar, Anjana Reddy, Vinay Rao and Vivek Dangi, Exploration in the Ghaggar Basin and excavations at Girawad, Farmana (Rohtak District) and Mitathal (Bhiwani District), Harana, India, in, Current Studies on the Indus Civilization, Volume I, eds., Toshiki Osada and Akinori Uesugi, 2010, p. 89.

দেখুনঃ প্রাগুক্ত, যৃঃ ৯১।

দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ৯১।

দেখুনঃ Vivek Dangi, Akinori Uesugi, Manmohan Kumar, Vasant Shinde and Appu, Bedwa: A Mature and Late Harappan Necropolis in the Upper Gaggar Basin, in, Harappan Studies: Recent Researches in South Asian Archaeology, Volume 1, eds., Manmohan Kumar and Akinori Uesugi, 2014, p. 250.

দেখুনঃ Vasant Shinde, Toshiki Osada, Akinori Uesugi and Manmohan Kumar, Harappan Necropolis at Farmana in the Ghaggar Basin, Special Report No. 4, 2010, Indian Archaeological Society, New Delhi, 2009, pp. 19-20.

দেখুনঃ Vasant Shinde, Toshiki Osada, Akinori Uesugi and Manmohan Kumar, A Report on Excavations at Farmana 2007-08, in, Linguistics, Archaeology and the Human Past, Occational Paper 6, eds., Toshiki Osada and Akinori Uesugi, Indus Project, Research Institute for Humanity and Nature, Kyoto, 2008, p. 76-78.    

----------------

আর,এস, বিশ্ট্ ধোলাভিরা ও কচ্ছ অঞ্চলে মৃতের জন্য কাঠামো নির্মাণের কথা বলেছেন। ধোলাভিরার পশ্চিমে কবরস্থানে একটি কবর ও কিছু আংশিক কবর (Fractional burial) ছাড়া সব সমাধি কাঠামোই মানুষের হাড় ছাড়া, কিন্তু প্রধানত মৃৎপাত্রের মত সমাধি-দ্রব্য ছিল।  কিছু ক্ষেত্রে একটি বা দুটি পুতি ও সামান্য সোনা ছিল। এখানে সবচেয়ে বেশী পাওয়া গেছে সমাধির আয়তাকার কাঠামো। এগুলি প্রতীকী ছিল, ফলে এখানে একটি বা দুটি পাত্র ছাড়া মানুষের হাড় পাওয়া যায় নাই। এখানে ছয়টি গোলকাকার সমাধি-স্তূপ পাওয়া গেছে, যেগুলির মধ্যে সমাধি-স্তূপ-১ ও সমাধি-স্তূপ-২-এ প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান করা হয়েছে। এখানে সমাধি-স্তূপ-১-এ মৃৎপাত্রের সাথে খড়িপাথরের গলার হার, একটি সোনার চুড়ি ও অন্যান্য বিলাসদ্রব্য পাওয়া গেছে। সমাধি-স্তূপ-২ মানুষের ধ্বংসের কারণে কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। উভয় স্তূপের জন্য পাথর কেটে গভীর ও প্রশস্ত কক্ষ তৈরী করা হয়েছিল এবং দুই স্তরে কাদা মাটির ইট দিয়ে বৃত্তাকার কাঠামো বানানো হয়েছিল। সমাধি-স্তূপ-২-এর উচ্চতা ৩.৩৫ মিটার ও ব্যাস ২৫ থেকে ২৮ মিটার ছিল। এটি নিশ্চয়ই প্রকৃত মাপ নয়, সহস্রাধিক বৎসর ধরে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে তা এই পর্যায়ে এসেছে। সমাধি-স্তূপ-২ থেকে ৭৫ মিটার দূরে সমাধি-স্তূপ-১ অবস্থিত। এটি সমাধি-স্তূপ-২-এর চেয়ে তুলনায় বড়, ২.৯ মিটার উঁচু ও ৩৩ মিটার ব্যাস-বিশিষ্ট। গোলকাকার সমাধি-স্তূপ তৈরীর মাধ্যমে মৃতকে প্রতীকী সম্মানিত করার এই ধারণাটি ২৬০০-২৫০০ খ্রীঃপূঃ বা তারও আগে শুরু হয়েছিল বলে মনে করা হয়।  অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মানুষের মৃতদেহকে সম্ভবত দাহ করে পরে এভাবে সমাধি-স্তূপ তৈরী করে সম্মানিত করার জন্য এই পদ্ধতি অন্য কোনো হরপ্পান বসতিতে দেখা যায় নাই।  এটি খুব চমকপ্রদ যে, ঐতিহাসিক ভারতবর্ষে বৌদ্ধ ও জৈনদের মধ্যে কোনো সম্মানিত ব্যক্তির মৃত্যুর পর দাহ করে সেই ছাই সংরক্ষিত করে স্তূপ নির্মাণ করার প্রথা দেখা যায়। এটি যে সিন্ধু সভ্যতার আঞ্চলিক কোনো প্রথা থেকে এসেছিল তাতে কোনো সন্দেহ নাই।

---------------

দেখুনঃ R.S. Bisht, How Harappans Honoured Death at Dholāvīrā, in, Sindhu-Sarasvatī Civilization: New Perspectives, ed., Nalini Rao, 2014, p. 269.    

  দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ২৮৪-২৯৭।

---------------

 

কারা সিন্ধু সভ্যতার মানুষ ছিল?

 সিন্ধু সভ্যতার মানুষ কারা ছিল এই প্রশ্ন প্রতত্নত্ত্ব ও নৃতত্ত্বের সাহায্যে জানার চেষ্টা করা হয়েছে, কিন্তু তাদের সঠিক ও গ্রহণযোগ্য পরিচয়ের বিষয়টি আজও অমীমাংসিত রয়ে গেছে। মনে করা হয় সিন্ধু সভ্যতার অন্তর্ভুক্ত ছিল এমন সব অঞ্চলে আজকের কালে যেমন বিভিন্ন পেশার ও বিভিন্ন নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর মানুষের সমাবেশ ঘটেছে তেমন এই বৈশিষ্ট্য থেকে সিন্ধু সভ্যতার শহর ও গ্রামগুলির বেশী পার্থক্য ছিল না।  সম্প্রতি রাখিগাড়ি থেকে পাওয়া কংকালের নমুনার ডিএনএ পরীক্ষা করা হয়েছে। আগে উল্লেখ করা হয়েছে যে সিন্ধু সভ্যতায় বসতিগুলিতে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর মধ্যে শুধু তুলনামূলক অল্প জনগোষ্ঠীকে কবর দেওয়া হত।  সুতরাং ডিএনএ পরীক্ষার ফলাফল সিন্ধু সভ্যতার সমগ্র জনগোষ্ঠীকে প্রতিনিধিত্ব করে না। আমরা অনুমান করি আজকে দক্ষিণ এশিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে যে জনগোষ্ঠীসমূহ বসবাস করে সিন্ধু সভ্যতার সময়েও প্রায় কাছাকাছি নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন জনগোষ্ঠী বসবাস করত। তাদের ভাষাও আজকের মত একই ছিল না। তবে ধারণা করা যায় সিন্ধুর রাষ্ট্র বৃহত্তর সিন্ধু উপত্যকায় বসবাসকারী সকল জনগোষ্ঠীকে একই রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে ঐক্যবদ্ধ রাখার জন্য একটি সাধারণ ভাষা ও একই ধরনের লিপি প্রচলিত করে। অভিন্ন লিপি প্রবর্তনের বিষয়ে প্রত্নতাত্ত্বিকভাবে জানা গেলেও ভাষার বিষয়টা এখন পর্যন্ত অনুমান সাপেক্ষ। তবে স্থলপথে হাঁটা ও গরুর গাড়ী ও জলপথে নৌকার মাধ্যমে যোগাযোগের ঐ যুগে এত দূরব্যাপী ছড়ানো বসতিগুলিকে ঐক্যবদ্ধ রাখার কঠোর চেষ্টা থাকলেও বিভিন্ন অঞ্চলে ভিন্নতা সর্বক্ষেত্রে রোধ করা সম্ভব হয় নাই, যেটা আমরা প্রত্নতত্ত্ব থেকে জানতে পারি।

-------------------------------------------------------

দেখুনঃ Jonathan Mark kenoyer, Ancient Cities of the Indus Valley Civilization, 1998, p. 52.

দেখুনঃ Jonathan Mark Kenoyer, New Perspectives on the Indus Tradition: Contributions from Recent Research at Harappā and Other Sites in Pakistan and India, in, Sindhu-Sarasvatī Civilization: New Perspectives, ed., Nalini Rao, 2014, pp. 521-523.

-------------------------------------------------------

পাতা : ৪২

 

হরপ্পান পর্যায়ে আঞ্চলিক সাংস্কৃতিক পার্থক্য

এত দিন মনে করা হত যে, হরপ্পান নগর পর্যায়ে সমগ্র হরপ্পান সাম্রাজ্যে সমরূপতা ছিল, সেই ধারণা এখন বাতিল করা হয়েছে।  এর কারণ হল আদি হরপ্পান পর্যায়ে যে সমস্ত আঞ্চলিক সংস্কৃতি বিকাশ লাভ করেছিল সেই সব সংস্কৃতি বিভিন্ন অঞ্চলে পরবর্তী হরপ্পান পর্যায়ের সাংস্কৃতিক উপাদান গড়ায় ভূমিকা রেখেছিল। যেমন গুজরাটের সৌরাষ্ট্র অঞ্চলে আঞ্চলিক হরপ্পান যে সংস্কৃতিকে সোরাথ হরপ্পান নামে চিহ্নিত করা হয় তা পাদরি নামে বসতিটির আগের পর্ব থেকে উদ্ভূত হয়েছিল। এছাড়া রোজদি নামে হরপ্পান পর্যায়ের বসতিটির সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য সিন্ধু-বালুচিস্তান অঞ্চল থেকে কিছুটা ভিন্ন। সিন্ধু-বালুচিস্তান অঞ্চলে আদি হরপ্পান পর্যায়ে যে অঞ্চল জুড়ে আমরি-কোট দিজি সংস্কৃতি ছিল সেটাই হরপ্পান পর্যায়ে এসে সেই অঞ্চলে প্রাধান্যশীল হয়ে উঠে।

-------------------------------------------------------

দেখুনঃ Vasant Shinde et al., Exploration in the Ghaggar Basin and excavations at Girawad, Farmana (Rohtak District) and Mitathal (Bhiwani District), Haryana, India, in, Linguistics, Archaeology and the Human Past, Occasional Paper 3, ed., Toshiki Osada and Akinori Uesugi, Research Institute for Humanity and Nature, Kyoto, 2008, p. 79.

-------------------------------------------------------

হাকরা-ঘাগর সংস্কৃতির বসতিসমূহের বিস্তার (লাল বিন্দু সমূহে খনন করা হয়েছে) (সৌজন্যেঃ Vivek Dangi, 2018)

ঘাগর নদীর অববাহিকায় সেখানকার হরপ্পান নগর পর্বে সিসওয়াল-সোথি সংস্কৃতির ধারাবাহিকতা দেখতে পাওয়া যায়।  হরপ্পা ও মহেঞ্জো-দাড়োতে যে রঙিন মৃৎপাত্র দেখতে পাওয়া যায় সেখান থেকে এখানকার রঙিন মৃৎপাত্রের বৈশিষ্ট্য ভিন্ন ছিল। মূলত রঙিন মৃৎপাত্রের ক্ষেত্রেই ঘাগর অববাহিকার আঞ্চলিক সংস্কৃতির ভিন্নতা প্রতিফলিত হয়েছে।  এখানকার মৃৎশিল্প প্রধানত চোলিস্তান মরুভূমির হাকরা মৃৎপাত্র সংস্কৃতির দ্বারা প্রভাবিত। ঘাগর অববাহিকার সমাধিগুলির একটি বৈশিষ্ট্য হল এখন পর্যন্ত পাওয়া এখানকার সমাধিগুলিতে সমাধি-বস্তু হিসাবে শুধুমাত্র মৃৎপাত্র দেওয়া হত কোনো অলংকার বা অস্ত্র দেওয়া হত না।

-------------------------------------------------------

  দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ৭৯-৮০।

দেখুনঃ Vasant Shinde, Regional Diversity of the Harappan Culture in the Ghaggar Basin, in, Purātattva, No. 45, 2015, pp. 77, 82.

-------------------------------------------------------

তবে বলা হচ্ছে যে, আঞ্চলিক পার্থক্য সবচেয়ে বেশী স্পষ্ট শস্য নির্বাচনের ক্ষেত্রে। এছাড়া বসতির বিন্যাস ব্যবস্থায় এবং বিশেষ ধরনের কিছু জিনিসের ব্যবহার, যেগুলির মধ্যে লক্ষ্য করার মত ছিল মূর্তি, মৃৎপাত্র ও সীল।  এই সাংস্কৃতিক পার্থক্যের জন্য জলবায়ুগত পার্থক্য নিশ্চয়ই কাজ করেছে। যেমন, সিন্ধুর মানুষজন কোথায়ও শুষ্ক উত্তপ্ত মরুভূমি, কোথায়ও শুষ্ক উত্তপ্ত তৃণভূমি এবং কোথায়ও শুষ্ক শীত ও উত্তপ্ত গ্রীষ্মের সাথে উষ্ণ ও নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে বসবাস করত।  তারা হিমালয় ও সুলায়মান পর্বতশ্রেণীর পার্শ্বদেশে বসবাস করত যেখানে তারা শীতকালে বরফ পেত। এখনকার বৃষ্টির তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে যে, সিন্ধু সভ্যতার উত্তর ও উত্তরপূর্ব অঞ্চলে গ্রীষ্ম মৌসুমের গড় বৃষ্টিপাতের প্রাধান্য দেখা গেছে।

-------------------------------------------------------

দেখুনঃ Cameron A. Petrie, Danika Parikh, Adam S. Green and Jennifer Bates, Looking beneath the Veneer. Thoughts about Environmental and Cultural Diversity in the Indus Civilization, in, Walking with the Unicorn: Social Organization and Material Culture inn Ancient South Asia, ed., Dennys Frenez et al., 2017, p.453.

  দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ৪৫৬।

-------------------------------------------------------

সিন্ধুর বিভিন্ন বসতিতে, বিশেষভাবে বিভিন্ন অঞ্চলে সীলের ক্ষেত্রে শৈলীগত ও চিত্রাঙ্কনে পার্থক্য দেখা গেছে।  হরপ্পান মূল ভূমি থেকে পূর্ব অঞ্চলের বসতিসমূহে, যেমন, কালিবঙ্গান ও বনওয়ালীতে চিত্রাঙ্কনে পার্থক্য লক্ষ্যণীয়। এছাড়াও লোথালে পাওয়া সীলের সাথে বৃহত্তর সিন্ধু উপত্যকার সীলের রীতিতে পার্থক্য দেখা যায়।

-------------------------------------------------------

দেখুনঃ Marta Ameri, Regional Diversity in the Harappan World: The Evidence of the Seals, in, Connections and Complexity: New Approaches to the Archaeology of South Asia, eds., Shinu Anna Abraham, Praveena Gullapalli, Teresa P. Raczek and Uzma Z. Rizvi, Left Coast Press Inc., Walnut Creek, 2013, pp. 369-370.

-------------------------------------------------------

সিন্ধু সভ্যতায় মৃৎপাত্রের আঞ্চলিক শৈলী (সিন্ধুর নগর পর্যায়ের আদি ও মধ্যবর্তী পর্বসমূহ, প্রায় ২৬০০-২৩০০ খ্রীঃপূঃ) (সৌজন্যেঃ Akinori Uesugi)


সিন্ধু সভ্যতার নগর পর্যায়ের শেষ পর্বে আঞ্চলিক মৃৎপাত্রের শৈলী (প্রায় ২৩০০-১৯০০ খ্রীঃপূঃ) (সৌজন্যেঃ Akinori Uesugi)

পাতা : ৪৩

 

হরপ্পান পর্যায়ের সমান্তরাল অন্যান্য স্বতন্ত্র সংস্কৃতি

দক্ষিণ বালুচিস্তানে কুল্লি সংস্কৃতি (Kulli Complex) নামে একটি সংস্কৃতি ২৬০০ খ্রীঃপূঃ-এর দিকে একটি আঞ্চলিক শৈলী হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে।  এর কোনো কোনো এলাকাতে হরপ্পান প্রভাব দেখা গিয়েছিল, তাতে করে বুঝা যায় যে হরপ্পান সীমা পশ্চিম দিকে প্রসারিত হচ্ছিল। ২৪০০ খ্রীঃপূঃ-এর দিকে স্থানীয় ঐতিহ্যের সাথে এর একত্রীকরণ ঘটে। সিন্ধুর সুস্পষ্ট বৈশিষ্ট্য নিয়ে সিন্ধু উপত্যকার পশ্চিমাঞ্চলে খুব বেশী বসতি নাই। তবে যা আছে তাদের উপস্থিতি তাৎপর্যপূর্ণ। কিন্তু দেখা যাচ্ছে যে, তৃতীয় সহস্রাব্দের মাঝামাঝি সময়ে কোয়েটার দক্ষিণে অনেক বসতি আকস্মিক পরিত্যক্ত হয়, যার কারণ আজও অজানা।  অন্য দিকে উত্তর কুল্লি বা কুল্লি-হরপ্পান বসতিগুলি, যা আকর্ষণীয় স্থাপত্যের জন্য পরিচিত ছিল, প্রায় ক্ষেত্রেই পুরাতন বসতির চিহ্ন না রেখে নূতন ভিত্তির উপর বসতি নির্মাণ করেছিল।  খ্রীঃপূঃ তৃতীয় সহস্রাব্দের শেষের দিক থেকে শুরু করে আরব উপদ্বীপের কিছু অংশ নিয়ে যে বিরাট যোগাযোগের অঞ্চল গড়ে উঠেছিল, ১৯০০ বা ১৮০০ খ্রীঃপূঃ-এর দিকে তার সমাপ্তি ঘটে। এই সময়ে দক্ষিণপূর্ব ইরানের বিস্তীর্ণ অঞ্চল, বালুচিস্তান ও বৃহত্তর সিন্ধু উপত্যকা শেষ পর্যন্ত পরিত্যক্ত হয়।

-------------------------------------------------------

  দেখুনঃ Ute Franke, Prehistoric Balochistan: Cultural Developments in an Arid Region, in, Palaeoenvironment and the Development of Early Settlements, eds., Markus Reindel et a.l, 2016, p. 193.

  দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ১৯৩।

  দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ১৯৩।

-------------------------------------------------------

হরপ্পান পর্যায়ে বরা (Bara) সংস্কৃতি নামে ভারতের কয়েকটি অঞ্চলে একটি স্বতন্ত্র সংস্কৃতি দেখা যায়। যদিও বরা সংস্কৃতিকে একটি অ-নাগরিক সংস্কৃতি হিসাবে বিবেচনা করা হয়, এটি প্রাক- ও আদি হরপ্পান প্রবণতা নিয়ে হরপ্পান পর্যায়ে টিকে ছিল।  এটিকে অন্যান্য সমসাময়িক জনগোষ্ঠীগুলির সাথে শক্তিশালী বাণিজ্যিক ও সংস্কৃতিগত সম্পর্ক রাখতে দেখা যায়। এই সংস্কৃতি একটি শক্তিশালী সাংস্কৃতিক অবশেষ রেখেছিল। এখানকার মৃৎশিল্প পর্যাপ্ত রঞ্জিত, যা তাদের সৌন্দর্য্যবোধ সম্পর্কে ধারণা দেয়। এই সংস্কৃতির বসতিগুলির মধ্যে ভারতের চণ্ডিগড়ে খনন করা সংঘল অন্যতম, যেখানে বিদায়ী হরপ্পান থেকে আদি মধ্যযুগ পর্যন্ত সাংস্কৃতিক ধারাবাহিকতা দেখতে পাওয়া যায়।  এছাড়া রূপনগরে (বা রূপার) সাম্প্রতিক খননে হরপ্পান ও বরা সংস্কৃতিকে একসাথে সহাবস্থান করতে দেখা যায়।  তবে বরা সংস্কৃতি শেষের দিকে এখানে প্রাধান্যশীল হয়। এই সংস্কৃতির সময়ানুক্রম ধরা হয় কমপক্ষে ২৩০০ খ্রীঃপূঃ (পাঞ্জাবের মহরানায় প্রাপ্ত সাক্ষ্য) বা ২১০০-২০০০ খ্রীঃপূঃ (বরায় প্রাপ্ত সাক্ষ্য) থেকে প্রায় ১৫০০ খ্রীঃপূঃ (সংঘলে প্রাপ্ত সাক্ষ্য) বা প্রায় ১০০০ খ্রীঃপূঃ (হরিয়ানার ভগবানপুরে প্রাপ্ত সাক্ষ্য) পর্যন্ত।

-------------------------------------------------------

দেখুনঃ G.B. Sharma, Excavations at Sanghol: Harappa-Bara Phase, in, Harappan Studies: Recent Researches in South Asian Archaaeology, Volume 1, eds., Manmohan Kumar and Akinori Uesugi, Aryan Books International, New Delhi, 2014, p. 59.

  দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ১।

দেখুনঃ V.N. Prabhakar and Shahida Ansari, Recent Archaeological Investigations of the Harappan Site of Rupnagar, Punjab, in, Purātattva, No. 45, 2015, p. 163.

দেখুনঃ K.C. Nauriyal, Chronological Assessment of the Bara Culture, in, Purātattva, No. 35: 2004-2005, 2005, p. 92.

-------------------------------------------------------

রাজস্থানে হরপ্পান সভ্যতার সমসাময়িক কয়েকটি ব্রোঞ্জ যুগের সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল। এইগুলি হল আহর (Ahar) বা বনাস (Banas), গনেশ্বর-যোধপুর সহ আরো কিছু সংস্কৃতি, যেগুলি হরপ্পান নগরায়ন প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। দক্ষিণ রাজস্থানে তামা ও সাজিমাটির (Soap-stone) খনি ও সোনার মজুদ পাওয়া গেছে। ধারণা করা হয় যে, গনেশ্বরের মানুষেরা তামা গলানোর কাজ ও টিনের খাদ মিশিয়ে ব্রোঞ্জ তৈরীর কাজ করত ও এগুলি পিণ্ড আকারে হরপ্পানদের সরবরাহ করত।   আহর সংস্কৃতির মানুষেরা দক্ষিণ রাজস্থান থেকে ধাতু, শস্য, খড়িপাথর ও সোনা এবং উত্তর রাজস্থান থেকে তামা বা ব্রোঞ্জের পিণ্ড অথবা তৈরী জিনিসপত্র হরপ্পানদের সরবরাহ করত।

-------------------------------------------------------

দেখুনঃ J.S. Kharakwal, Indus Civilization: An Overview, in, ed, Toshiki Osada, Indus Civilization: Text and Context, Manohar Publishers & Distributors, New Delhi, 2006, pp. 42-45, 53.

  দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ৫৩।

-------------------------------------------------------

উত্তর গুজরাটে অনার্ত (Anarta) নামে একটি সংস্কৃতি স্বাধীনভাবে বিকাশ লাভ করেছিল, যা হরপ্পান পর্যায়ের আগেই ছড়িয়ে পড়েছিল ও হরপ্পান পর্যায়ে পাশাপশি টিকে থেকে হরপ্পান পরবর্তী পর্যায়ে অস্তিত্ব রক্ষা করেছিল। অনার্ত/পাদরি সাংস্কৃতির বিস্তার অনেক বড় ছিল। এই সংস্কৃতির প্রভাব উত্তর গুজরাটে, ক্যাম্বে উপসাগরের তীর জুড়ে ভবনগর ও আমরেলি জেলায় ও কচ্ছ অঞ্চলের বসতিগুলি যেমন সুরকোটডা, কানমের ও কোটাডা ভাদলি থেকে বুঝা যায়।  উত্তর গুজরাটের অনার্ত সংস্কৃতির পাশাপশি গুজরাটের সৌরাষ্ট্র অঞ্চলে সোরাথ হরপ্পান নামে হরপ্পান পর্যায়ের সমসাময়িক আরো একটি সংস্কৃতি দেখা যায়। এটি একটি তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় যে, কচ্ছ উপসাগরের তীরে বাগাস্রা (Bagasra) নামে একটি বসতিতে হরপ্পান পর্য়ায়ে হরপ্পান সংস্কৃতির জিনিসপত্র এবং অনার্ত ও সোরাথ হরপ্পান সংস্কৃতির জিনিসপত্র স্তরবিন্যস্ত অবস্থায় (Stratigraphic context) পাওয়া গেছে।  গুজরাটের অন্য কোনো বসতিতে একই সাথে তিনটি সংস্কৃতির স্তরবিন্যস্ত অবস্থান দেখা যায় নাই। লোথাল ও রংপুরের মত সৌরাষ্ট্রের দু’টি গুরুত্বপূর্ণ বসতিতে হরপ্পান ও সোরাথ হরপ্পান সংস্কৃতির জিনিসপত্র পাওয়া গিয়েছিল। একটি বিষয় স্পষ্ট যে, লোথাল, সুরকোটডা, সোমনাথ (প্রভাস পাটন), রোজদি, নাগওয়াড়া (Nagwada), ইত্যাদি বসতিতে হরপ্পান সংস্কৃতির জিনিসপত্রের, প্রধানত মৃৎপাত্রের পাশাপাশি ভিন্ন সংস্কৃতির জিনিসপত্র পাওয়া গেছে।

-------------------------------------------------------

দেখুনঃ Prabodh Shirvalkar, Pre and Early Harappan Culture of Western India, Agam Lala Prakashan, Delhi, 2013, p. 130.

দেখুনঃ V.H. Sonwane, P. Ajithprasad, K.K. Bhan, K. Krishnan, S. Prathapachandran, Abhijit Majumdar, Ajita K. Patel and Jaya Menon, Excavations at Bagasra – 1996-2003: A Preliminary Report, in, Man and Environment, Volume XXVIII, No. 2 (July-December 2003), p. 48.

দেখুনঃ P. Ajithprasad and V.H. Sonawane, The Harappa Culture in North Gujarat: a Regional Paradigm, in, Current Studies on the Indus Civilization, Volume IX, eds., Toshiki Osada and Hitoshi Endo, Manohar Publishers & Distributers, New Delhi, 2012, p. 223.

-------------------------------------------------------

গুজরাটের সৌরাষ্ট্র অঞ্চলে জয়ডাক বা পিথাড় (Jaidak/Pithad) নামে একটি বড় বসতিতে (১১ হেক্টরের চেয়েও বেশী আয়তনের) যে স্থাপত্য কাঠামো পাওয়া গেছে তার পরিকল্পনা ও বিন্যাসে হরপ্পান বৈশিষ্ট্য থাকেলেও সেখানকার জিনিসপত্রে হরপ্পান প্রবণতা দেখা যায় না।

-------------------------------------------------------

  দেখুনঃ P. Ajithprasad, Jaidak (Pithad): a Sorath Harappan site in Jamnagar district, Gujarat and its architectural features, in, Current Studies on the Indus Civilization, Volume II, eds., Toshiki Osada and Akinori Uesugi, Manohar Publishers & Distributers, New Delhi, 2010, p. 89.

-------------------------------------------------------

হরপ্পান পর্যায়ে সময়ের সাথে মৃৎপাত্রের ঐতিহ্যে ক্রমবিকাশ ও বৈশিষ্ট্যের আঞ্চলিক বিভাজন বিবেচনা করলে সংস্কৃতির সমরূপতা ও বৈচিত্র্য উভয়ই এক সাথে ছিল একথা বললে সঠিক বলা হয়।

-------------------------------------------------------

   হরপ্পান পর্যায়ে মৃৎপাত্রের ধরন ও শৈলীর মিল ও ভিন্নতা বিবেচনা করে গোনজাগ কুইভ্রন মন্তব্য করেন - `In fact, both homogeneity and diversity are correct terms to characterize the Mature pottery tradition which shows a gradual evolution leading, in course of time, to different forms representing regional groupings.’ Gonzague Quivron, The Evolution on the Mature Indus Pottery Style in the Light of the Excavations at Nausharo, Pakistan, in, East and West, Volume 50, No. 1/4 (December 2000), p. 178.  

-------------------------------------------------------

পাতা : ৪৪

 

সমসাময়িক অন্যান্য সভ্যতার সাথে তুলনামূলক আলোচনা

সিন্ধু সভ্যতা মেসোপটেমিয়ার আক্কাদীয় ও উর ৩ পর্বের আদি রাজবংশের শেষ পর্যায়ের (Late Early Dynastic) ও মিসরের পুরাতন রাজ্য ও প্রথম মধ্যবর্তী পর্বের (First Intermediaate period) সমসাময়িক ছিল।  সিন্ধু সভ্যতা সমসাময়িক এই দুই সভ্যতা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ছিল, এর বিকাশ প্রক্রিয়ায়, এর রাষ্ট্রীয় ও শাসন ব্যবস্থায়, ধর্মীয় আদর্শে ও আরো অনেক কিছুতে। মিসরে যেমন আদি পর্বে শাসকদের ও তাদের আদর্শ সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায় হাতির দাঁতের তৈরী অঙ্কিত ফিতা (Tag) ও খোদিত পাথরের গদি (Pallet) থেকে, তেমন সিন্ধু সভ্যতায় কোন ব্যক্তি বা কোন গোষ্ঠী প্রথম দিকে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিকাশে ভূমিকা রেখেছিল তা জানা যায় না।  তবে সাম্প্রতিক বিপুল প্রত্নতাত্ত্বিক তথ্য বিশ্লেষণ করে সিন্ধুর অর্থনীতি, সমাজ ও শাসনকার্য সম্পর্কে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করা হচ্ছে।

-------------------------------------------------------

দেখুনঃ Jonathan Mark Kenoyer, Wealth and socioeconomic hierarchies of the Indus Valley civilization, in, Order, Legitimacy, and Wealth in Ancient States, eds., Janet Richards and Mary Van Buren, Cambridge University Press, 2000, p. 93.

-------------------------------------------------------

সিন্ধু সভ্যতার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিকের প্রতি লেখকরা আলোকপাত করেছেন, সেটা হল সভ্যতা নির্মাণে ও তার রক্ষায় যুদ্ধ ও বলপ্রয়োগের অপ্রধান ভূমিকা পালন। যুদ্ধে ব্যবহৃত জিনিসপত্র যেমন বড় তরবারি, বর্ম, ঢাল, শিরস্ত্রাণ, ইত্যাদি বসতিগুলিতে এমন কি যাকে নগরদুর্গ বলা হয় সেখানেও পাওয়া যায় নাই।  যে সমস্ত অস্ত্র পাওয়া গেছে সেগুলি শিকারের জন্য বা রান্না বা পশুর মাংস কাটার জন্য ব্যবহৃত হত। এছাড়া এমন কোনো ছবি বা দৃশ্য কোনো কিছুতে উৎকীর্ণ করা হয় নাই যেখানে যুদ্ধের ছবি বা বন্দী বা ধৃত অবস্থায় কোনো মানুষকে দেখানো হয়েছে। এমন কি এমন কোনো ব্যক্তির ছবি উৎকীর্ণ করা হয় নাই যা থেকে সেই ব্যক্তিকে রাজা, শাসক বা ক্ষমতাবান বলে মনে হয়। এখন পর্যন্ত পাওয়া একটি মাত্র চিত্রাঙ্কিত ফলকের উপর যে ছবিকে যুদ্ধের ছবি বলে মনে করা হয় তা দুইজন ব্যক্তির মধ্যে লড়াইয়ের দৃশ্য মাত্র।

-------------------------------------------------------

দেখুনঃ B.B. Lal, Some Reflections on the Structural Remains at Kalibangan, in, Frontiers of the Indus Civilization, eds., B.B. Lal & S.P. Gupta, 1984, p. 55.

-------------------------------------------------------

সিন্ধু সভ্যতার নগর ও শহরগুলির বেশীরভাগই উঁচু প্রাচীর ঘেরা থাকত। এই সব প্রাচীরে একটি বা দু’টি প্রবেশ-দ্বার থাকত। আগে মনে করা হত যে, এই প্রাচীর যুদ্ধে প্রতিরক্ষার জন্য তৈরী করা হয়েছিল। কিন্তু এগুলির বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য পরীক্ষা করে এখন পণ্ডিতরা মত প্রকাশ করেছেন যে, এগুলি যুদ্ধে প্রতিরক্ষার জন্য তৈরী করা হয় নাই। লেখকরা মনে করেন নগর প্রাচীরের সবচেয়ে প্রধান ভূমিকা ছিল নগরে প্রবেশ ও বের হওয়া নিয়ন্ত্রণ করা, বন্যা প্রতিরোধ ও ক্ষমতা প্রদর্শন।

অন্য দিকে মেসোপটেমিয়া ও মিসরে সভ্যতা নির্মাণে যুদ্ধ ও বলপ্রয়োগ প্রধান ভূমিকা পালন করেছিল। এখানকার নগর ও শহরগুলিতে পাওয়া যুদ্ধাস্ত্র, বিভিন্ন জিনিসে উৎকীর্ণ যুদ্ধ, যুদ্ধ জয়ের ও যুদ্ধবন্দীর ছবি থেকে বুঝা যায় যে সেখানে সভ্যতা নির্মাণে ও তার রক্ষায় যুদ্ধ ও বলপ্রয়োগের প্রাধান্য ছিল। এছাড়াও সেখানে রাজা বা শাসকের ছবিও উৎকীর্ণ হতে দেখা যায়। এই দুই সভ্যতার নগরগুলিতে যে সমস্ত নগর-প্রাচীর দেখা যায় তার মূল উদ্দেশ্যই ছিল যুদ্ধের প্রতিরক্ষা।

মেসোপটেমিয়ার উরুক পর্ব ৪-এর সময়ে একটি সীল মোহরে দেখা যায় এক ব্যক্তি শাসকের পোশাকে কর্তৃত্বপূর্ণ ভঙ্গীতে বেঁধে রাখা বন্দীদের দেখছে।  যুদ্ধে সুমেরীয়রা যে খুবই নিষ্ঠুর ছিল তার প্রত্নতাত্ত্বিক সাক্ষ্য পাওয়া যায়। বেশীরভাগ যুদ্ধবন্দীদের তারা সাথে সাথে হত্যা করত এবং বাকীদের আজীবনের জন্য দাস করে রাখত। শত্রুদের অধিকৃত শহরগুলি শুধু লুঠ করা হত না, বাড়ীঘর পোড়ানো হত বা মাটির সাথে মিশিয়ে ফেলা হত। যারা বেঁচে থাকত তারা বিভিন্ন জায়গায় পালাত। মিসরে রাষ্ট্র নির্মাণের সূচনা থেকেই যুদ্ধ ও বল প্রয়োগের প্রমাণ পাওয়া গেছে।  খ্রীষ্টপূর্ব চতুর্থ সহস্রাব্দে ঊর্ধ্ব ও নিম্ন মিসর একত্রীকরণ এবং মিসরে আদি রাষ্ট্র গঠনের সময়ে হায়ারাকোনপোলিসে (Hierakonpolis) রাজা নরমারের ফলকে কিছু ছবি আঁকা আছে। সেখানে মৃত শত্রুদের এবং লোকজন অথবা বসতিসমূহের পরাভূত অবস্থা দেখানো হয়েছে। এই রাজার রাজদণ্ডের মাথায় কিছু ছবি ও চিহ্নে যুদ্ধবন্দী ও যুদ্ধে লুন্ঠিত দ্রব্য দেখানো হয়েছে। রাজা স্করপিয়নের রাজদণ্ডের মাথায়ও বিজিত মানুষদের ছবি ছিল। যদিও সেই সময়ের যুদ্ধে ধ্বংসপ্রাপ্ত কোনো স্তর পাওয়া যায় নাই তবু এই বিষয়ে প্রত্নতাত্ত্বিকরা নিশ্চিত যে, যুদ্ধের মাধ্যমে মিসরে আদি রাজবংশের সুদৃঢ়করণ এবং প্রথম রাজবংশের আদিতে নিম্ন নুবিয়া ও দক্ষিণ প্যালেস্টাইনে মিসরীয় রাষ্ট্রশক্তির সম্প্রসারণ হয়।  এরপর সমগ্র মিসরীয় সভ্যতার নানা সময়ে যুদ্ধের সাথে সম্পর্কিত প্রচুর ছবি এবং হায়ারোগ্লিফিক লিপিতে এসবের বর্ণনা পাওয়া যায়।

-------------------------------------------------------

 দেখুনঃ Lorenz Rahmstorf, Control Mechanisms in Mesopotamia, the Indus Valley, the Aegean and Central Europe, c. 2600-2000 BC, and the Question of Social Power in Early Complex Societies, in, Beyond Elites: Alternatives to Hierarchical Systems in Modelling Social Formations, International Conference at the Ruhr-Universität Bochum, Germany, October 22-24, 2009, Volume 2, Verlag Dr. Rudolf Habelt GmbH, Bonn, 2012, p. 316.

দেখুনঃ Kathryn A. Bard, The Emergence of the Egyptian State (C,3200-2686 BC), in, The Oxford History of Ancient Egypt, ed., Ian Shaw, Oxford University Press, Oxford, 2000, pp. 61-88.

-------------------------------------------------------

সিন্ধু সভ্যতার ৭০০ বৎসরের কালপর্বে কোনো বসতিতেই ধ্বংসের বা অগ্নিকাণ্ডের এমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় নাই। তবে ২৬০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের শুরুতে অর্থাৎ আদি হরপ্পান পর্যায় থেকে হরপ্পান পর্যায়ে পরিবর্তনের সময়ে কয়েকটি বসতিতে আগুনে পুড়ানোর চিহ্ন পাওয়া গেছে, যা থেকে মনে করা হয় যুদ্ধের কারণে এই সমস্ত বসতি শত্রুপক্ষ আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছে। কালিবঙ্গানে এই সময়ে ঘরের দেওয়ালে ফাটলের চিহ্ন দেখা গেছে। এগুলি ভূমিকম্পের কারণে হয়েছিল বলে মনে করা হয়। বনওয়ালীতে বিভিন্ন ভবনে ফাটলের চিহ্ন এবং গুমলাতে ধ্বংসের প্রমাণ পাওয়া গেছে। প্রত্নতাত্ত্বিক এসমস্ত সাক্ষ্য থেকে আদি হরপ্পান থেকে হরপ্পান পর্যায়ে পরিবর্তনের সময়ে কিছু বসতিতে যুদ্ধের সম্ভাবনার বিষয়টি নাকচ করা যায় না। তবে এটা ঠিক যে, সমগ্র সিন্ধু সভ্যতার ব্যাপ্তি ও বসতির সংখ্যার তুলনায় এই সব দৃষ্টান্ত খুবই কম। ফলে এই দৃষ্টান্তসমূহ সভ্যতার সামগ্রিক প্রবণতাকে প্রকাশ করে না।

যদিও সুমেরীয়রা শিল্পকলায় দক্ষ ছিল, তবু বিভিন্ন তথ্য থেকে তাদের এক নিষ্ঠুর ও নির্মম সভ্যতা সম্পর্কে জানা যায়। প্রত্নতাত্ত্বিকরা উরের রাজকীয় সমাধি থেকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ মানুষের, সম্ভবত রাজা বা রাজপুত্রদের কবর থেকে বিপুল সংখ্যক মানুষের কংকাল পেয়েছিলেন। এই কবরগুলিতে এ সমস্ত নারী-পুরুষকে সেখানেই হত্যা করা হয়েছিল বলে অনুমান করা হয়। সম্ভবত তারা রাজার দাস-দাসী ছিল। এধরনের একটি কবরের প্রবেশপথে তামার শিরস্ত্রাণ ও বল্লম সজ্জিত পাহারারত ভঙ্গিতে মৃতদেহ রাখা হয়েছিল। একজন রাণীর সমাধিতে তার সামনে সম্ভবত রাজপ্রাসাদের পরিচারিকা বা দাসীদের কবর দেওয়া হয়েছিল। এখানে আরো ছিল হার্পসহ একজন হার্পবাদক এবং আনত অবস্থানে দু’জন পরিচারকের দেহ।  এসব বিবরণ থেকে রাজা বা রাণীর মৃত্যুর পর তাদের সেবক-সেবিকা বা দাস-দাসীদের ভয়ংকর পরিণতি কল্পনা করা যাবে। মৃত্যু পরবর্তী কাল্পনিক জগতে শাসকদের সেবা করবার জন্য যে তাদের হত্যা করার ধর্মীয় প্রথা ছিল তাতে কোনো সন্দেহ নাই। যদিও উরের রাজকীয় সমাধিকে (প্রায় ২৫০০ খ্রীঃপূঃ) রাজার সেবকদের ইচ্ছাকৃত বলীর একমাত্র প্রমাণ পাওয়ার কথা বলা হয়।  প্রাচীন চীনেও বিভিন্ন সময়ে এই ধরনের নিষ্ঠুর প্রথা থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে। সেখানে রাজার সমাধিতে শতাধিক দাসদাসীকে হত্যা করে কবর দিবার ঘটনাও জানা গেছে। এই ধরনের নিষ্ঠুর প্রথার প্রচলন বৃহত্তর সিন্ধু উপত্যকায় দেখা যায় না। যুদ্ধ ও বল প্রয়োগের প্রাধান্য ছাড়া সমাজে এই রকম প্রথার প্রচলন সম্ভব নয় সেটি স্পষ্ট।

-------------------------------------------------------

দেখুনঃ John Elder, Archaeology and the Bible, Robert Hale Limited, London, 1961, p.39.

দেখুনঃ Sharri R. Clark, Deconstructing the ‘Harappan Courtiers’: A Re-evaluation of Some of the Anthropomorphic Terracotta Figurines from Harappa, in, Intercultural Relations between South and Southwest Asia, eds., E. Olijdam & R.H. Spoor, BAR International Series 1826, 2008, pp. 167-168.

-------------------------------------------------------

পাতা : ৪৫

ধর্মীয় ক্ষেত্রে সুমেরীয়দের মধ্যে সাকার দেবতার পূজা (অর্থাৎ প্রতিমা পূজা) এবং বহুদেবতাবাদ প্রচলিত ছিল। রাষ্ট্রীয় দেবতার মূর্তি হত বৃহদাকার। এছাড়া প্রায় বাড়ীগুলিতেই ছোট মূর্তি পাওয়া গেছে, যেগুলি গৃহদেবতা বা বিভিন্ন গোষ্ঠীর নিজস্ব দেবতার প্রতিমা বলে মনে হয়। সিন্ধু সভ্যতায়ও মূর্তি পাওয়া গেছে। কিন্তু সেগুলি কোনোটাই খুব বড় আকৃতির নয়। এমনকি এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত বড় নগর মহেঞ্জো-দাড়োতেও যে সব মূর্তি পাওয়া গেছে সেগুলির কোনোটাকেই দেবতার মূর্তি বলে চিহ্ণিত করা যায় নাই। এছাড়া মাথায় ও অন্যান্য জায়গায় অলংকারযুক্ত খুবই ছোট পোড়া মাটির নারী মূর্তি সিন্ধু সভ্যতার বিভিন্ন জায়গায় পাওয়া গেলেও সেগুলির সাথে রাষ্ট্রীয় দেবতা বা শাসক শ্রেণীর ধর্মের কোনো সংশ্লিষ্টতা দেখা যায় না।   

সিন্ধু সভ্যতায় প্রত্নতাত্ত্বিকরা কোনো রাজার সমাধি, মন্দির বা রাজপ্রাসাদ খুঁজে পান নাই। যেসব বড় ভবনের কাঠামো পাওয়া গেছে সেগুলি ধনীদের বাসস্থান বা গণমিলনায়তন বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বলে মনে করা হয়। কিন্তু এককভাবে কোনো ভবনই তত বড় ও জাঁকজমকপূর্ণ ছিল না যাতে করে তাকে রাজপ্রাসাদ বা মন্দির বলে চিহ্নিত করা যায়। যে সব কবর পাওয়া গেছে সেগুলির মধ্যে কিছু সংখ্যককে অন্যগুলির তুলনায় বেশী বা উন্নতমানের জিনিসপত্র, যেমন মৃৎপাত্র, অলংকার, পাথর বা ব্রোঞ্জের অস্ত্র ইত্যাদি থেকে ধনীর সমাধি বলে চিহ্নিত করা যায়, কিন্তু রাজার সমাধি হিসাবে কোনোটিকেই চিহ্নিত করা যায় না। বড় বাড়ীগুলি নগরের এক জায়গায় কেন্দ্রীভূত না হয়ে সমস্ত নগর বা শহরব্যাপী সমভাবে ছড়ানো ছিল। একইভাবে ধাতুর তৈরী জিনিসপত্র, যা সে যুগে ধনীদেরই কেবল ব্যবহার করার কথা, শহরের কোনো বিশেষ স্থানে না থেকে সমস্ত শহরব্যাপী পাওয়া গেছে।  এ থেকে বুঝা যায় যে, নগরে শাসক থাকলেও তাকে কেন্দ্র করে ধনীরা অবস্থান করত না বরং সমস্ত নগরে ছড়িয়ে থাকত, এমনকি নগর বা শহরের নীচু স্তরের মানুষদের বাড়ীর কাছেও। এগুলি হরপ্পান সভ্যতায় তুলনামূলক সাম্য ও গণতন্ত্র থাকার সম্ভাবনাকে প্রকাশ করে। ধনী ও দরিদ্রের তুলনামূলক পার্থক্যহীনতার প্রমাণ পাওয়া গেছে হরপ্পান যুগের নরকংকালের উপর গবেষণা চালিয়ে। অন্যান্য সভ্যতায় এটি একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য যে একই সমাজের উঁচু শ্রেণীর মানুষেরা নীচু শ্রেণীর তুলনায় অপুষ্টিজনিত সমস্যায় কম ভুগে ও দৈর্ঘ্যে অধিকতর লম্বা হয়। খুবই আশ্চর্য হবার মত বিষয় যে, হরপ্পান সভ্যতায় এই ধরনের পার্থক্য দেখা যায় নাই।  বিপুল জন-অধ্যুষিত এই সভ্যতায় এই ঘটনা সমাজের সর্বস্তরে সমৃদ্ধিকে নির্দেশ করে।

-------------------------------------------------------

দেখুনঃ Jim G. Shaffer, Harappan Culture: A Reconsideration, in, Harappan Civilization: A Recent Perspective, ed., Gregory L. Possehl, 1993, pp. 41-50.

দেখুনঃ Kenneth A.R. Kennedy, Skulls, Aryans and Flowing Drains: The Interace of Archaeology and Skeletal Biology in the Study of the Harappan Civilization, in, Harappan Civilization: A Contemporary Perspective, ed., Gregory L. Possehl, 1982, p. 358.

-------------------------------------------------------

অন্যদিকে, মিসরে ও মেসোপটেয়িায় সব যুগেই রাজার সমাধি চিহ্নিত করা গেছে অন্যান্য সমাধি থেকে এর বৃহদাকার কাঠামো নির্মাণ ও সমাধিতে পাওয়া মূল্যবান সামগ্রী থেকে। মিসরের রাজারা, যাদের ফারাও বলা হত, সমগ্র সভ্যতার শক্তিকে নিয়োজিত করেছিল তাদের মৃত্যু পরবর্তী কল্পিত জীবনের সুখের জন্য বিশাল বিশাল পিরামিড তৈরী করায়। মেসোপটেমিয়ায় রাজপ্রাসাদ বড় হত। মন্দিরগুলি প্রথম দিকের তুলনায় পরের যুগগুলিতে সমাজের শক্তি ও সম্পদ বৃদ্ধির সাথে বড় হতে থাকে। সে সময়ে মন্দির বা জিগগুরাটগুলি তৈরী করা হত বিশালায়তনে। সিন্ধু সভ্যতায় ধনী-দরিদ্র সবাই নগর বা শহরে দালানবাড়ীতে বসবাস করত এবং এখানকার প্রাচীর ঘেরা বসতিগুলিতে বস্তি বা কুড়েঘরের অস্তিত্ব পাওয়া যায় নাই। প্রত্নতাত্ত্বিকভাবে এর প্রমাণ পাওয়া গেছে। কিন্তু মেসোপটেমিয়ার নগরগুলিতে দরিদ্ররা থাকতে পারত না বলে ধারণা করা হয়। মনে করা হয় যে, নগরের বাইরে ঝুপড়ি বা কাঁচা বাড়ীঘর তৈরী করে তারা থাকত।  মিসর বা মেসোপটেমিয়া উভয় সভ্যতায় রাজা ও ধনীদের বাড়ীঘরগুলি নগরের নির্দিষ্ট স্থানে কেন্দ্রীভূত হত। তুলানমূলক কম ধনীদেরগুলি দূরে নগরের প্রান্তীয় এলাকায় অবস্থান করত। তাছাড়া ধাতুর তৈরী জিনিসপত্রও ধনীদের বাড়ীঘরগুলিতেই কেন্দ্রীভূত থাকত। এসব প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ থেকে এই সিদ্ধান্তে আসা যায় যে, এইসব সভ্যতায় ক্ষমতা ও সম্পদ একটি কেন্দ্রে কেন্দ্রীভূত থাকত এবং সমাজে ব্যাপক অসাম্য ছিল।

-------------------------------------------------------

দেখুনঃ Susan Pullock, Ancient Mesopotamia, Cambridge University Press, Cambridge, 1999, pp. 46-52

-------------------------------------------------------

উরের সমাধি ও কবরসমূহ (সৌজন্যেঃ J. Mark Kenoyer, T. Douglas Price & James H. Burton, 2013)

সিন্ধুর সাথে মিসর বা মেসোপটেমিয়ার সবচেয়ে দৃশ্যমান যে পার্থক্য তা হল সিন্ধু সভ্যতায় মৃতের সাথে বিপুল পরিমাণ বহনযোগ্য সম্পদ সমাহিত করা হত না ও স্থায়ী এমন কোনো বৃহদায়তন স্থাপত্য তৈরীতে সম্পদের ব্যবহার করা হত না যার কোনো অর্থনৈতিক মূল্য নাই।  মেসোপটেমীয় সভ্যতায় যে সামাজিক-অর্থনৈতিক বিপুল বৈষম্য ছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায় সেখানকার উর নগরে রাজকীয় কবরখানা থেকে প্রাপ্ত তথ্যে, যা নীচে দেখানো হলঃ

-------------------------------------------------------

দেখুনঃ Jonathan Mark Kenoyer, Wealth and socioeconomic hierarchies of the Indus Valley civilization, in, Order, Legitimacy, and Wealth in Ancient States, eds., Janet Richards and Mary Van Buren, Cambridge University Press, 2000, p. 108.

দেখুনঃ C.C. Lamberg-Karlovsky and R. Wright, The Tigris and Euphrates Valley (3000-1500 BC), in, History of Humanity: Scientific and Cultural Development, 1996, Vol. II, p. 174.

-------------------------------------------------------

রাজকীয় কবর

৫টি

অত্যন্ত বড়, সম্পদে পূর্ণ, উৎসর্গীকৃত (নিহত) দাস-দাসীসহ

ধনী, রাজকীয় নয়

২০টি

পর্যাপ্ত ধাতুর জিনিসপত্র, মূল্যবান পাথর, অন্যান্য সম্পদ

ধনী, সাধারণ

৪৩৫ টি

কিছু ধাতুর জিনিসপত্র

সাধারণ   

৮২৫ টি  

মৃৎপাত্র

রাজকীয় কবরখানায় ‘সাধারণ’ মানুষের কবরে যদি শুধু মৃৎপাত্র পাওয়া যায়, তাহলে যাদের রাজকীয় কবরখানায় কবর দিবার সুয়োগ হত না তাদের অবস্থা অনুমান করা যায়।

সিন্ধু থেকে মাথায় টায়রা বা এক ধরনের মুকুট শোভিত পোড়া মাটির নারী মূর্তি দেখতে পাওয়া যায়। একটি বিষয় লক্ষ্যণীয় যে, সিন্ধুর কবরস্থানে অলংকার পাওয়া গেলেও কোনো কবরস্থানেই সেই ধরনের অলংকার বা মুকুট দেখতে পাওয়া যায় নাই। অন্য দিকে মেসোপটেমিয়ার কাছাকাছি ধরনের যে সমস্ত টায়রা বা মুকুট শোভিত নারী মূর্তি দেখতে পাওয়া গেছে, একই ধরনের মুকুট বা টায়রা মেসোপটেমিয়ার কবর থেকেও পাওয়া গিয়েছিল। এতে করে অনেক লেখক মনে করেন যে, সিন্ধুতে এই ধরনের মাথায় পরার টায়রা কেবল মূর্তিতেই খোদিত করা হত।

-------------------------------------------------------

দেখুনঃ Sharri R. Clark, Deconstructing the ‘Harappan Courtiers’: A Re-evaluation of Some of the Anthropomorphic Terracotta Figurines from Harappa, in, Intercultural Relations between South and Southwest Asia, eds., E. Olijdam & R.H. Spoor, BAR International Series 1826, 2008, p. 171.

-------------------------------------------------------

পাতা : ৪৬

সিন্ধু সভ্যতায় দেখা যায় বড় নগরগুলি কাছাকাছি আয়তনের। যেমন মহেঞ্জো-দাড়ো, গানেরিওয়ালা, হরপ্পা, রাখিগাড়ি ও লাখাঞ্জোদাড়োর আয়তন কাছাকাছি। সাধারণত দেখা যায় রাজধানী অন্যান্য নগরের চেয়ে অনেক বড় হয়। এ ক্ষেত্রেও সিন্ধু সভ্যতা ব্যতিক্রম। মহেঞ্জো-দাড়ো বা অন্য কোনো নগর যেটাই রাজধানী হয়ে থাকুক কোনোটাই সাধারণভাবে সিন্ধু সাম্রাজ্যের ক্ষমতার অতিরিক্ত কেন্দ্রীভবনের প্রতি ইঙ্গিত করে না।

একটি বিষয় লক্ষ্যণীয় যে, সিন্ধুর বেশীর ভাগ নগরই ৭০০ বা ৬০০ বৎসর টিকে ছিল। এর মধ্যে শাসন ব্যবস্থায় বড় ধরনের পরিবর্তনের প্রমাণ পাওয়া যায় না। অন্যদিকে মেসোপটেমিয়ার অনেক নগরই এক বা দুই শতাব্দী টিকে থাকত এবং শাসক ও রাজবংশ শেষ হয়ে যাবার সাথে সাথে সেগুলি পরিত্যক্ত হত।  যেমন, আগেদ, উরে উর পর্ব ৩, দুর শারুক্কিন (Dur Sharrukkin), ইত্যাদি। আবার সহস্রাধিক বৎসর টিকে থাকার দৃষ্টান্তও আছে, যেমন, উরুক। সিন্ধুর পাঁচটি প্রধান নগর (৮০ হেক্টরের উপরে) যেমন, মহেঞ্জো-দাড়ো, হরপ্পা, রাখিগাড়ি, ধোলাভিরা ও গানেরিওয়ালার মধ্যে দূরত্ব ২৮০ থেকে ৮৩৫ কিলোমিটার। কচ্ছের রানের দ্বীপে অবস্থিত ধোলাভিরা ছাড়া সব নগরই অনেক দূরত্বে ভিন্ন পাললিক ভূমিতে অবস্থিত। তবে লাখাঞ্জোদাড়োর অবস্থান মহেঞ্জো-দাড়ো থেকে প্রায় ১৫০ কিলোমিটার দূরে।  এগুলির সংখ্যা ও বিস্তার পরিষ্কারভাবে মেসোপটেমিয়ার উত্তর আদি রাজবংশ, আক্কাদীয় ও উর ৩ পর্বের নগরসমূহের সাথে বৈসাদৃশ্যপূর্ণ।  ধরে নেওয়া হয় যে, সিন্ধুর প্রতিটি বড় নগর মোটামুটি ১৫০-২০০ কিঃমিঃ ব্যাসার্ধের জায়গায় প্রভাব বিস্তার করত ও তাদের চারপাশের ১,০০,০০০ থেকে ১,৭০,০০০ বর্গ কিলোমিটারের কৃষিজ পশ্চাদভূমি নিয়ে আঞ্চলিক রাজধানী হিসাবে কাজে করত। যদি সমসাময়িক মেসোপটেমিয়া ও সিরিয়ার নগরগুলির সাথে তুলনা করা যায় তাহলে এটি অনেক বড় আয়তনের। যেমন এবলা মাত্র ১৫০ থেকে ২০০ বর্গ কিঃমিঃ কৃষিভূমি নিয়ন্ত্রণ করত।  মহেঞ্জো-দাড়ো বা হরপ্পায় যে সমস্ত বড় ভবন পাওয়া গেছে সেগুলি কোনোটাই মেসোপটেমীয় বা মিসরের প্রাসাদ বা বড় ভবনগুলির মত প্রকাণ্ড নয়। এই ভবনগুলির নকশা বা এখানে প্রাপ্ত জিনিসপত্র থেকে এই ভবনগুলি কি কাজে ব্যবহার হত তা বুঝা যায় না, যেমন মেসোপটেমিয়া বা মিসরের ক্ষেত্রে বুঝা যায়।

-------------------------------------------------------

দেখুনঃ Cameron A. Petrie, Diversity, variability, adaptation and ‘fragility’ in the Indus Civilization, in, The Evolution of Fragility: Setting the Terms, ed., Norman Yoffee, McDonald Institute for Archaeological Research, University of Cambridge, Cambridge, 2019, p. 125.

দেখুনঃ Rita P. Wright, Konar Sandal South, Nindowari, and Lakhan Jo Daro – Beyond the Limits of a Known World, in, South Asian Archaeology and Art: Contextualizing Material Culture in South and Central Asia in Pre-Modern Times, eds., Verena Widorn, Ute Franke & Petra Latschenberger, Brepols Publishers n.v., Turnhout, 2016, p. 32.

দেখুনঃ Cameron A. Petrie, Diversity, variability, adaptation and ‘fragility’ in the Indus Civilization, in, The Evolution of Fragility: Setting the Terms, ed., Norman Yoffee, McDonald Institute for Archaeological Research, University of Cambridge, Cambridge, 2019, p. 111.

দেখুনঃ Massimo Vidale, Heterachic Powers in the Ancient Indus Cities, in, Journal of Asian Civilizations, ed., Dr. Ghani-ur-Rahman, Vol. 41, No. 2, Taxila Institute of Asian Civilizations, Islamabad, 2018, p. 29.

দেখুনঃ Cameron A. Petrie, Diversity, variability, adaptation and ‘fragility’ in the Indus Civilization, in, The Evolution of Fragility: Setting the Terms, ed., Norman Yoffee, McDonald Institute for Archaeological Research, University of Cambridge, Cambridge, 2019, p. 115.

-------------------------------------------------------

মিসরে ফারাও-এর অধীনে কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্র উদ্ভূত হতে দেখা যায়। একেবারে প্রথম থেকেই রাজা ও তার সভাসদদের কেন্দ্র করে রাজধানী থেকে এই শাসন ব্যবস্থা প্রদেশ ও গ্রাম পর্যন্ত প্রসারিত ছিল। বিপুল সম্পদ রাজপ্রাসাদে কেন্দ্রীভূত হত। রাজধানী, ঘর-বাড়ী, জনবসতি সবকিছুর বিন্যাসে ক্ষমতা ও সম্পদের চ‚ড়ান্ত রকম অসম বন্টন প্রতিফলিত হতে দেখা যায়। কিন্তু সিন্ধু সভ্যতায় এই ধরনের কেন্দ্রীভবন দেখা যায় না।


স্থানিকতার যুগ (১৯০০ - ১৩০০ খ্রীঃপূঃ)

বিদায়ী হরপ্পান পর্বসমূহ

হরপ্পান পর্যায়ের রাষ্ট্র ব্যবস্থা ১৯০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের দিকে ভেংগে পড়ে ও বিকেন্দ্রীভূত হয়ে যায়। অনেক নগর পরিত্যক্ত হলেও কিছু নগরে বসবাসের ধারাবাহিকতা বজায় ছিল। তবে এই সময়ে নগরগুলি ছোট হয়ে যায়। কিছু ক্ষেত্রে মানুষজনকে নূতন জায়গায় বসতি স্থাপন করতে দেখা যায়।  এই সময়ে তাদের মধ্যে যোগাযোগ কমে যায় ও বাণিজ্য পুনর্গঠিত হতে দেখা যায়। বিদায়ী হরপ্পান পর্যায়ে ঘনাকৃতির চার্ট পাথরের বাটখারা, সিন্ধু লিপির ব্যবহার এবং বর্গাকার সীল মোহরের ব্যবহার আর দেখা যায় নাই। এই সময়ে মৃৎপাত্রের গায়ে ছবির বিষয়বস্তুতে ও কৃষির ধরনে পরিবর্তন হয়েছিল।  অনুমান করা যায় যে, হরপ্পান পর্যায়ের পরে সিন্ধুর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও আদর্শিক ক্ষেত্রে বড় ধরনের পরিবর্তন হয়েছিল।  এই পরিবর্তন সিন্ধু উপত্যকার উত্তর অংশে এবং ঘাগর-হাকরা সমভূমির উত্তর অংশে ঘটছিল। সিন্ধু সভ্যতার রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে পরিবর্তন হলেও সিন্ধু ও পাঞ্জাবে বড় নগরগুলি ও বসতিসমূহের স্তরবিন্যাসের ধারাবাহিকতা থাকার সাক্ষ্য পাওয়া যায়।  এছাড়া পাঞ্জাব, হরিয়ানা, পশ্চিম উত্তর প্রদেশ, ও উত্তর রাজস্থানে বসতির সংখ্যা বেড়ে যায়। গুজরাটে লক্ষ্যণীয়ভাবে তা স্থিতিশীল থাকতে দেখা যায়।  সামগ্রিকভাবে বলা যায় যে, সিন্ধুর বেশীরভাগ নগর পরিত্যক্ত ও নূতন এলাকায় ছোট ছোট বসতিতে পুনর্বিন্যস্ত হলেও এই সভ্যতা তার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বজায় রেখেছিল।

-------------------------------------------------------

দেখুনঃ Gregory L. Possehl, Harappan Civilization: A Contemporary Perspective, in, Harappan Civilization: A Recent Perspective, ed., Gregory L. Possehl, 1993, p. 25.

দেখুনঃ Jonathan M. Kenoyer, The Archaeological Heritage of Pakistan: From the Palaeolithic to the Indus Civilization, in, A History of Pakistan, ed, Roger D. Long, 2015, p. 61.

  দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ৬০।

দেখুনঃ G.L. Possehl, Transformation of the Harappan Civilization, in, Early Harappans and Indus-Sarasvati Civilization, Volume I, eds., D.P. Sharma and Madhuri Sharma, Kaveri Books, New Delhi, 2006, p. 216.

এবিষয়ে প্রত্নতাত্ত্বিক গ্রেগরি পোসেলের মস্তব্য গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেছেনঃ  “The abandonement of the cities can be documented and it is equally certain that there was continuity of settled life in outlying regions and within smaller settlements. The civilization did not end as a cultural tradition.” দেখুনঃ Gregory L. Possehl, Indus Civilization in Saurashtra, B.R. Publishing Corporation, Delhi, 1980, p. 10.

-------------------------------------------------------

কিছু কিছু বসতিতে দেখা গেছে যে হরপ্পান পর্যায় সমাপ্তির পর বিদায়ী হরপ্পান পর্যায়ে আবার আদি হরপ্পান সংস্কৃতিতে ফিরে গেছে। এমন দেখা গেছে নৌশারোতে যেখানে আদি ও হরপ্পান পরবর্তী বসতি ছিল। সেখানে হরপ্পান পর্যায় শেষ হলে তা পুনরায় আদি হরপ্পান সংস্কৃতিতে ফিরে যায়।

-------------------------------------------------------

দেখুনঃ Marta Ameri, Regional Diversity in the Harappan World: The Evidence of the Seals, in, Connections and Complexity: New Approaches to the Archaeology of South Asia, eds., Shinu Anna Abraham, Praveena Gullapalli, Teresa P. Raczek and Uzma Z. Rizvi, Left Coast Press Inc., Walnut Creek, 2013, p. 356.

-------------------------------------------------------

বিদায়ী হরপ্পান পর্যায়ের শুরু ১৯০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে হয়ে বেশীরভাগ অঞ্চলে ১৩০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে এই পর্যায়ের সমাপ্তি ঘটলেও গঙ্গা-যমুনা অঞ্চলের উপরের দিকে একে ১০০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত টিকে থাকতে দেখা যায়। এই সময়ে স্থানীয়ভাবে বাণিজ্য ও বিনিময় চালু থাকতে দেখা যায় তিনটি প্রধান অঞ্চলে। উত্তর পাঞ্জাব তখনো ঘাগর-হাকরা নদী উপত্যকার উত্তরাংশ ও গঙ্গা-যমুনা সমভূমির উপরের অংশের সাথে যুক্ত ছিল। সিন্ধুতে সিন্ধু উপত্যকার দক্ষিণ অঞ্চল আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল হিসাবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল এবং গুজরাট ও কচ্ছ অঞ্চল তৃতীয় অঞ্চল হিসাবে টিকে থাকে। প্রতিটি অঞ্চলই আলাদা সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে টিকে ছিল। গুজরাটে চার শ’ ঊনচল্লিশটি বিদায়ী হরপ্পান সংস্কৃতির বসতি পাওয়া গেছে।

-------------------------------------------------------

দেখুনঃ Rajesh S.V., Prabhin Sukumaran and K. Krishnan, Scenario of Chalcolithic Site Surveys in Gujarat, in, Pakistan Heritage, Volume 7, eds., Shakirullah and Ruth Young, Research Journal of the Department of Archaeology, Hazara Universsity, Manshra, 2015, p. 3.

-------------------------------------------------------

পাতা : ৪৭

আরব উপদ্বীপের সার, কালা’আত আল-বাহরাইন, টেল আবরাক, ও শিমলের মত বসতিগুলিতে সিন্ধুর বিভিন্ন ধরনের মৃৎপাত্র বিশেষভাবে বড় মজুদের পাত্র খ্রীষ্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দের মোটামুটি প্রথম দিকে পাওয়া গেছে।  এ থেকে মনে করা হচ্ছে যে গুজরাটের সোরাথ হরপ্পান বসতি যেমন রোজদি, লোথাল বা অন্যান্য বসতি থেকে এই সমস্ত মৃৎপাত্র সেখানে যেতে পারে। বাহ্রাইনের হামাদ শহরের কারজাখান কবরস্থানে পাওয়া একটি বড় পাত্রে রোজদি ও লোথালের মত ময়ূরের ছবি ও আস্তরণ দেওয়ার ঘটনা উভয় অঞ্চলের যোগাযোগ থাকার সম্ভাবনাকে জোরালো করে।  এছাড়াও ওমানে পাওয়া কিছু মৃৎপাত্রের উৎস বাইরে বলে মনে করা হয়, যেগুলির সাথে সোরাথ হরপ্পান মৃৎপাত্রের মিল আছে।

-------------------------------------------------------

দেখুনঃ Rita P. Wright, Perspective from the Indus: Contexts of Interaction in the Late Harappan/Post-Urban Period, in, Fifty years of Emirates Archaeology: Proceedings of the Second International Conference on the Archaeology of the United Arab Emirates, eds, D.T. Potts and P. Hellyer, Motivate Publishing, Abu Dhabi, 2012, pp. 106, 110.

  দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ১০৭-১০৮।

-------------------------------------------------------

সিন্ধুর নগরগুলির ক্ষয়ের অনেক কারণ আছে বলে লেখকরা মনে করেন। কোনো কোনো বসতিতে বন্যার সাক্ষ্য পাওয়া গেছে, যেমন, সিন্ধু প্রদেশের চানহুদাড়ো ও গুজরাটের লোথালে। অন্যদিকে পাঞ্জাবের হরপ্পায় বন্যার প্রমাণ পাওয়া যায় না।  ঘাগর-হাকরা নদী শুকিয়ে যাওয়ার ফলে পাকিস্তানের চোলিস্তান ও ভারতের থর মরুভূমি অঞ্চলে বিপর্যয়কর প্রভাব পড়ে। এখানকার মানুষেরা বাসস্থান পরিত্যাগ করতে বাধ্য হয়। অন্যদিকে সিন্ধু ও এর উপনদীগুলি প্রবাহিত হতে থাকায় এর তীরে মানুষেরা বসবাস করতে থাকে। যে বিষয়গুলিকে সিন্ধু সভ্যতার পতনের জন্য দায়ী করা হয় সেগুলি হল জলবায়ুর পরিবর্তন, রোগব্যাধি, বন্যা, পরিবেশগত বিপর্যয়, অর্থনৈতিক সম্পদ ফুরিয়ে যাওয়া এবং বহিরাগত আক্রমণ।  বিভিন্ন লেখক এইগুলির মধ্যে কোনো কোনোটিকে বেশী গুরুত্ব দেন। তবে আমরা মনে করি কৃষিতে জলসেচের উদ্দেশ্যে বৃহত্তর সিন্ধু উপত্যকার নদীগুলিতে জলকপাটযুক্ত বাঁধ দিবার ফলে যেমন  এক সময় বিশাল অঞ্চলব্যাপী সিন্ধু সভ্যতার বিস্ময়কর উত্থান ঘটেছিল তেমন এক সময় নিয়ন্ত্রিত বা আবদ্ধ নদীগুলিতে পলি সঞ্চয়ের ফলে নদীর গতিপথ পরিবর্তন, কোথায়ও জলাবদ্ধতা ও বন্যা, কোথায়ও খরা ইত্যাদি সিন্ধু সভ্যতার পতনের মূল কারণ হিসাবে কাজ করেছিল। সিন্ধু সভ্যতার পতন সংক্রান্ত আলোচনায় এটি একটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যা নিয়ে আমরা কিছু পরে আলোচনা করব।

-------------------------------------------------------

দেখুনঃ Mohammad Rafique Mughal, Cultural Continuity of the Indus Valley Civilization in Sindh, Southern Pakistan, in, Studies in Heritage of South Asia, ed., Mokammal H. Bhuiyan, Hertage Management & Research, Dhaka, 2012, p. 232.

-------------------------------------------------------

 

সেমেট্রি এইচ (Cemetery H) পর্যায়

সিন্ধু উপত্যকার উত্তরাংশ, পাঞ্জাব ও গঙ্গা-যমুনার মধ্যবর্তী ভূভাগ নিয়ে সেমেট্রি এইচ সংস্কৃতি প্রাধান্যশীল ছিল। পাকিস্তানী পাঞ্জাবের চোলিস্তানে সেমেট্রি এইচ ধরনের বসতিগুলি হরপ্পান বসতিগুলির উপরে গড়ে উঠেছিল। এই অঞ্চলে রফিক মুগল পঞ্চাশটি বসতি থাকার কথা উল্লেখ করেছেন।  সিন্ধু সভ্যতার ক্ষয়ের পর হরপ্পায় মৃতদেহ কবরস্থ করার পদ্ধতিতে পরিবর্তন হয়। তখন মৃতদেহ উন্মুক্ত রেখে পচনের পর এর হাড়গুলি একটি বড় পাত্রে রেখে কবরস্থ করা হত। মৃতের করোটি ও অন্যান্য হাড় একটি বড় পাত্রে রাখার পর সাথে ছোট কিছু পাত্র দেওয়া হত নৈবেদ্য হিসাবে। মৃতের কবরস্থ করার পদ্ধতিতে পরিবর্তন হলেও স্থাপত্য ও অন্যান্য ঐতিহ্যে হরপ্পান থেকে বিদায়ী হরপ্পানে ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে দেখা যায়।

-------------------------------------------------------

 দেখুনঃ M. Rafique Mughal, The Protohistoric Settlement Patterns in the Cholistan Desert, in, South Asian Archaeology 1987, Part 1, eds., Maurizio Taddei, Istituto Italiano per Il Medio ed Estremo Oriente, Rome, 1990, p. 151.

দেখুনঃ Jonathan M. Kenoyer, The Archaeological Heritage of Pakistan: From the Palaeolithic to the Indus Civilization, in, A History of Pakistan, ed., Roger D. Long, 2015, pp. 60-61.

-------------------------------------------------------

ঘাগর-হাকরা অববাহিকায় বিদায়ী হরপ্পান বসতিসমূহ (সৌজন্যেঃ Vivek Dangi)

বিদায়ী হরপ্পান পর্বে পাঞ্জাবে সেমেট্রি এইচ পর্বের নূতন আকৃতি, ভিন্ন আস্তরণের প্রক্রিয়া ও রঙিন নকশার সাথে হরপ্পান মৃৎপাত্রের গঠনের ধারাবাহিকতা বজায় ছিল, যেমন নৈবেদ্যের আধার (Offering stand), বড় পাত্র (Jar) ও কুঁজা বা জলাধারের মত বিভিন্ন আকৃতির দানি (Vase)।  এই সময়ে লাল আস্তরণের উপর কাল নকশার স্বতন্ত্র রঙিন মৃৎপাত্র ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করে। চকচকে চীনামাটি এবং সম্ভবত কাঁচ তৈরীর পদ্ধতি উদ্ভাবন এবং শক্ত পাথরের উপর পুতি ছিদ্র করার প্রযুক্তির প্রয়োগ থেকে এই সময়ের সৃষ্টিশীল পরিবেশের বিষয়টি সম্পর্কে ধারণা করা যায়।  এই সময়ে প্রসারিত অবস্থায় কবর (Extend burial) দিবার পদ্ধতি থেকে পরিবর্তিত হয়ে বড় শবাধারে দ্বিতীয় পর্যায়ভুক্ত কবর (Secondary burial) দিবার পদ্ধতি চালু হয়। এ থেকে সেই সময়ে আদর্শগত পরিবর্তনের বিষয়টি অনুমান করা যায়। তবে এই পরিবর্তন সমগ্র উত্তরাঞ্চলে দেখা যায় নাই।

-------------------------------------------------------

 দেখুনঃ M. Rafique Mughal, Jhukar and the Late Harappan Cultural Mosaic of the Greater Indus Valley, in, South Asian Archaeology 1989, ed., Catherine Jarrige, Prehistory Press, Madison, 1992, p. 217.

দেখুনঃ Jonathan M. Kenoyer, The Archaeological Heritage of Pakistan: From the Palaeolithic to the Indus Civilization, in, A History of Pakistan, ed., Roger D. Long, 2015, p. 61.

-------------------------------------------------------

চোলিস্তান এলাকায় বিদায়ী হরপ্পান পর্যায়ের সেমেট্রি এইচ সম্পর্কিত প্রত্নস্থলসমূহ (প্রায় ২০০০-১৫০০ খ্রীঃপূঃ) (সৌজন্যেঃ M. Rafique Mughal, 1990)

পাতা : ৪৮

 

ঝুকর পর্যায়

পাকিস্তানের নিম্ন সিন্ধু উপত্যকায়, সিন্ধু প্রদেশের বিদায়ী হরপ্পান সংস্কৃতিকে ঝুকর সংস্কৃতি বা ঝুকর পর্যায় নামে অভিহিত করা হয়।  ঝুকর, মহেঞ্জো-দাড়ো, চানহুদাড়ো, আমরি ও লোহুমজো-দাড়োতে এই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য পাওয়া গেছে। তবে ঝুকর সংস্কৃতি সবচেয়ে ভালভাবে প্রতিনিধিত্ব করে চানহুদাড়োতে পাওয়া জিনিসপত্র, যাকে হরপ্পান সভ্যতার ধারাবাহিকতা হিসাবে মনে করা হচ্ছে।  চানহুদাড়োতে এই পর্যায়ে সাংস্কৃতিক পরিবর্তন বিদেশীদের উপস্থিতির জন্য ঘটে নাই। বরং হরপ্পান নগর সভ্যতার পতনের ফলে তার সাংস্কৃতির প্রভাব কমে গেলে বসতিটিতে সামাজিক-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তনের ফলে আগে থেকেই অস্তিত্বশীল স্থানীয় সংস্কৃতির মিশ্রণ ঘটার ফলে এই সাংস্কৃতিক পরিবর্তন ঘটেছিল।

-------------------------------------------------------

দেখুনঃ M. Rafique Mughal, Jhukar and the Late Harappan Cultural Mosaic of the Greater Indus Valley, in, South Asian Archaeology 1989, ed., Catherine Jarrige, 1992, p. 213.

দেখুনঃ Heidi J. Miller, Foreign-style Objects and the Jhukar Culture at Chanhu-daro, in, Intercultural Relations between South and Southwest Asia, eds., E. Olijdam and R.H. Spoor, BAR International Series 1826, 2008, p. 296.

  দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ২৯৬-২৯৭।

-------------------------------------------------------

সিন্ধুর নগর পর্যায় পরবর্তী মৃৎপাত্রের শৈলী (প্রায় ১৯০০-১৫০০ খ্রীঃপূঃ) (সৌজন্যেঃ Akinori Uesugi, 2018)

ঝুকর শৈলীর মৃৎপাত্রের বৈশিষ্ট্য ছিল লাল আস্তরণে কালর নকশা, যার সাথে অতিরিক্ত লাল বা বাদামী ও সাদা রঙ বা আস্তরণ। সবচেয়ে সাধারণ নকশা হত অর্ধবৃত্তাকার রেখার গুচ্ছ বা রেখার ফাঁস (Loop), মাছের মত বর্ধিত লজেন্স আকৃতির সারি, লাল বিন্দু সহ বৃত্ত, পুরু রেখাযুক্ত পাতার নকশা, থালার কিনারায় রেখার ফাঁস, বর্গাকৃতি, আড়াআড়ি ছেদকারী রেখা (Cross) এবং বহু আঁকাবাঁকা রেখা।  এই সময়ে হরপ্পান সংস্কৃতির কিছু বৈশিষ্ট্যে ধারাবাহিকতা রাখতে দেখা গেলেও সিন্ধু লিপি ও চার্ট পাথরের বাটখারা আর ব্যবহার হয় নাই, তেমনি বিশেষ রীতির নারীমূর্তিও দুর্লভ হয়েছিল। এই সময়ে বর্গাকার সীলের পরিবর্তে পিছনে উঁচু করা বৃত্তাকার সীল পাওয়া গেছে। ঝুকরের মত বৃত্তাকার সীল পাওয়া গেছে গিলুন্দ (রাজস্থান), ও বালুচিস্তানের বসতিগুলিতে, ইরান ও উপসাগরীয় অঞ্চলে।  সীলমোহরের ব্যাপক ব্যবহার থেকে মনে করা যায় যে, এই সময়ে ব্যাপক পরিসরে বাণিজ্য গড়ে উঠেছিল। এছাড়া বাণিজ্য পণ্য যেমন পুতি ও চকচকে চীনামাটির উৎপাদন বেড়ে গিয়েছিল।  সিন্ধু সভ্যতার পতন পরবর্তী পর্যায়ে যখন বস্তুগত সংস্কৃতি ও বাসস্থানের অবস্থানে পরিবর্তন ঘটছিল তখনো সিন্ধু অঞ্চল বা নিম্ন সিন্ধু উপত্যকা কোনো সময়েই সম্পূর্ণভাবে পরিত্যক্ত হয় নাই।  দেখা গেছে যে, শতকরা পঞ্চাশ ভাগ হরপ্পান ধরনের মৃৎপাত্র ঝুকরের বিভিন্ন স্তরে পাওয়া গেছে। এজন্য বলা হয় যে, ঝুকর সংস্কৃতি হরপ্পান সংস্কৃতির বেশীরভাগই বহন করছিল। এর ফলে মনে করা হয় এটি একটি উদীয়মান মৃৎপাত্র শৈলীর সংস্কৃতি হিসাবে আবির্ভূত হয়েছিল।

-------------------------------------------------------

 দেখুনঃ M. Rafique Mughal, Jhukar and the Late Harappan Cultural Mosaic of the Greater Indus Valley, in, South Asian Archaeology 1989, ed., Catherine Jarrige, 1992, p. 215.

দেখুনঃ Jonathan M. Kenoyer, The Archaeological Heritage of Pakistan: From the Palaeolithic to the Indus Civilization, in, A History of Pakistan, ed., Roger D. Long, 2015, p. 63.

দেখুনঃ M. Rafique Mughal, The Decline of the Indus Civilization and the Late Harappan Period in the Indus Valley, in, Lahore Museum Bulletin, off Print Vol. III, No. 2, July-Dec. 1990, pp. 3-4.

দেখুনঃ Mohammad Rafique Mughal, Cultural Continuity of the Indus Valley Civilization in Sindh, Southern Pakistan, in, Studies in Heritage of South Asia, ed., Mokammal H. Bhuiyan, Hertage Management & Research, Dhaka, 2012, p.

  এই বিষয়ে রফিক মুগল বলেন, ‘The new evidence changed our understanding and perspective of the Late Indus / Harappan Cultural period in the lower or Southern Indus Valley. It was found that the Indus ceramics as known from Mohenjo-daro and other cities were present in all the layers at Jhukar and found mixed with the new or modified forms of pottery which are lebeled as “Jhukar” in the literature. It was also observed that fifty percent of the total pottery types of the Mature Harappan period occurred in all the layers assigned to three phases of Jhukar namely, Early Middle and Late. There were less than ten percent new pottery types but all these types were found associated with 80% of the Mature Harappan or Indus pottery. The evidence was almost conclusive to establish for the first time that the Jhukar culture is only a pottery style emerging in association with the continuing Mature Indus ceramic tradition without any break or sudden change in cultural continuity in Sindh.’ দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ২৩৪।

-------------------------------------------------------

 

পিরক পর্যায়

 বালুচিস্তানের কাছি সমভূমিতে পিরক নামে একটি বসতিতে আরো একটি বিদায়ী হরপ্পান সংস্কৃতি দেখতে পাওয়া যায়। এখানকার স্থাপত্য শৈলী এবং এমন কি মৃৎপাত্রের শৈলীতেও স্থানীয় সংস্কৃতির ছাপ দেখতে পাওয়া যায়, যা হরপ্পান যুগ শুরু হওয়ার আগেই এই অঞ্চলে দেখা গিয়েছিল।  পিরকের মৃৎপাত্র ও মূর্তি নির্মাণের শৈলী কাছি সমভূমি ও বালুচিস্তানের বাইরে সিন্ধু উপত্যকার অন্য কোথায়ও ছড়ায় নাই। আগেকার মেহরগড় ও নৌশারোতে পাওয়া সীলমোহরের মত এখানে জ্যামিতিক নকশাযুক্ত বর্গাকার ও বৃত্তাকার সীলমোহর পাওয়া গেছে। ধানের সূচনা ও ঘোড়ার উপস্থিতি এবং ব্যাক্ট্রিয়ান আরোহী সহ দুই কুঁজ-বিশিষ্ট উটের মূর্তি থেকে এখানকার নূতন ধরনের খ্যাদ্যাভাস ও পরিবহন ব্যবস্থা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। ঘোড়া ও উটের ব্যবহার থেকে আফগানিস্তান ও মধ্য এশিয়ার সাথে এই অঞ্চলের সম্পর্কের বিষয়টিও ধারণা করা যায়।

-------------------------------------------------------

দেখুনঃ Jonathan M. Kenoyer, The Archaeological Heritage of Pakistan: From the Palaeolithic to the Indus Civilization, in, A History of Pakistan, ed., Roger D. Long, 2015, p. 63.

-------------------------------------------------------

পাতা : ৪৯

 

গান্ধার কবর সংস্কৃতি

সিন্ধু উপত্যকার উত্তরাংশে, বিশেষভাবে সোয়াত, দির ও চিত্রলে কবরস্থান সহ ছোট বসতিতে গান্ধার কবর সংস্কৃতি দেখা যায়। গান্ধার কবর সংস্কৃতি উত্তর-পশ্চিম পাঞ্জাবের সল্ট পর্বতশ্রেণী পর্যন্ত বিস্তার লাভ করলেও আরো দক্ষিণে বা পূর্বে গঙ্গা-যমুনা অঞ্চলে ছড়ায় নাই। এখানে বিপুল পরিমাণ কবর-সামগ্রী সহ কিছু কবর ও অল্প কবর-সামগ্রী সহ আরো কবর পাওয়া গেছে। কবরে পাওয়া অধিকাংশ মৃৎপাত্র ছিল ঘসা ধূসর মৃৎপাত্র (Burnished grey wares) যা সিন্ধু বা গাঙ্গেয় অঞ্চল থেকে সম্পূর্ণ পৃথক। সোয়াতের কাটেলাইয়ে সমাধির সাথে ঘোড়ার উপস্থিতি থেকে এখানে উচ্চ শ্রেণীর মানুষের কবর দিবার প্রথা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।

 

উজ্জ্বল লাল মৃৎপাত্র (Lustrous Red Ware) পর্যায়

গুজরাটে বিদায়ী হরপ্পান পর্যায় ছোট ছোট বসতিতে কোনো আঞ্চলিক কেন্দ্র ব্যতিরেকে ছড়িয়ে পড়েছিল। বসতিগুলি খুবই ছোট হওয়াতে মনে করা হয় যে, এই সময় পশুপালন নির্ভর সমাজ বিকাশ লাভ করেছিল। সৌরাষ্ট্র ও গুজরাটের মূলভূমিতে যেখানে নদী বা জলের উৎস ছিল ও যেখানে ঋতুভিত্তিক পশুচারণভূমি ছিল সেই সব জায়গায় এই উজ্জ্বল লাল মৃৎপাত্র সংস্কৃতি ছড়িয়ে পড়েছিল।  বৈশিষ্ট্যপূর্ণ হরপ্পান সংস্কৃতি যেমন সীল ও বাটখারা এই সময়ে অপ্রচলিত ছিল। যদিও হরপ্পান অন্যান্য সংস্কৃতিতে ধারাবাহিকতা ছিল যেমন, মৃৎপাত্র ও অলংকারের শৈলীতে। হরপ্পান মৃৎপাত্রের পাশাপশি উজ্জ্বল লাল মৃৎপাত্রের ব্যবহারে প্রায় ১৪০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত ধারাবাহিকতা ছিল। ১৪০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের পরে অধিকাংশ বসতিতে ছেদ ঘটতে দেখা যায়। সেখানে ৬০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের দিকে উত্তরাঞ্চলীয়/ উত্তরভারতীয় কাল মসৃণ মৃৎপাত্র (Northern Black Polished Ware - NBPW) নামে অন্য একটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যপূর্ণ মৃৎপাত্রের শৈলী প্রচলিত হতে দেখা যায়। এই সময়কে আদি ঐতিহাসিক পর্বে ফেলা হয়।

-------------------------------------------------------

দেখুনঃ Jonathan M. Kenoyer, The Archaeological Heritage of Pakistan: From the Palaeolithic to the Indus Civilization, in, A History of Pakistan, ed., Roger D. Long, 2015, p. 65.

-------------------------------------------------------

বিদায়ী হরপ্পান অনেক বসতিই পরবর্তীকালে অন্য অ-হরপ্পান (Non-Harappan) সংস্কৃতির বসতিতে রূপান্তরিত হয়েছিল। যেমন চিত্রিত ধূসর মৃৎপাত্র (Painted Grey Ware - PGW) সংস্কৃতি, ইত্যাদি। চিত্রিত ধূসর মৃৎপাত্র হল আদি লৌহ যুগের সংস্কৃতি এবং এটি সরাসরি আদি ঐতিহাসিক যুগের উত্তরাঞ্চলীয় কাল মসৃণ মৃৎপাত্রের (NBPW) পূর্বসূরি। পাকিস্তানের চোলিস্তানে চিত্রিত ধূসর মৃৎপত্রের বসতি পাওয়া গেছে ফোর্ট আব্বাস ও ইয়াজমানের মাঝখানে ১৬০ কিলোমিটার রেখা ধরে।  এই বসতিগুলির উপস্থিতি রাজস্থানের চিত্রিত ধূসর মৃৎপত্রের সমসাময়িক, যা প্রায় খ্রীষ্টপূর্ব প্রথম সহস্রাব্দের প্রথম দিকের। এই সময়ের অনেক আগেই হাকরা নদী সম্পূর্ণ শুকিয়ে গিয়েছিল। প্রতি ঋতুতে ঘাগর নদী থেকে এই অঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকা বন্যা-বিধৌত হত বলে এখানে এই বসতিগুলি গড়ে উঠেছিল বলে মনে হয়।

-------------------------------------------------------

দেখুনঃ M. Rafique Mughal, The Protohistoric Settlement Patterns in the Cholistan Desert, in, South Asian Archaeology 1987, Part 1, eds., Maurizio Taddei, Istituto Italiano per Il Medio ed Estremo Oriente, Rome, 1990, p. 153.

-------------------------------------------------------

গুজরাটের কচ্ছ অঞ্চলে কানমের (Kanmer) নামে বসতিতে বিদায়ী হরপ্পানরা আগের হরপ্পানদের সীমানা প্রাচীর কিছুকাল ব্যবহার করেছিল তাদের প্রতিরক্ষার জন্য। পরে এটি পরিত্যক্ত হয় ও তারা এটি থেকে পাথর নিয়ে নিজেদের ঘরবাড়ী বানায়।  ভগবানপুর ও আরো কিছু বসতিতে খনন চালিয়ে বিদায়ী হরপ্পান ও চিত্রিত ধূসর মৃৎপাত্র সংস্কৃতির যোগসূত্র পাওয়া পাচ্ছে। তাদের মধ্যে সময়ানুক্রমিক বিভাজন দেখা যায় নাই।  যেমন, হরিয়ানার ফারমানার চারপাশে ছোট বসতিগুলিতে আদি হরপ্পান, বিদায়ী হরপ্পান, চিত্রিত ধুসর মৃৎপাত্র ও ঐতিহাসিক যুগের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন পাওয়া গেছে।  বিদায়ী হরপ্পান পর্যায়ে পূর্ব দিকে সম্প্রসারণের প্রবণতা ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছিল।  আগে সিন্ধু সভ্যতার ক্ষয়ের পর থেকে আদি ঐতিহাসিক যুগ পর্যন্ত এই মধ্যবর্তী সময় সম্পর্কে তেমন প্রত্নতাত্ত্বিক তথ্য ছিল না বলে এই যুগকে ‘অন্ধকার যুগ’ নামে অভিহিত করা হত। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলিতে বিপুল পরিমাণ প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান ও এই যুগ সম্পর্কিত তথ্য পাওয়াতে এই যুগ সম্পর্কে অনেকটা আলোকপাত করা সম্ভব হচ্ছে। দেখা যাচ্ছে যে, দক্ষিণ এশিয়ায় বৈচিত্র্যপূর্ণ সামাজিক গোষ্ঠীসমূহের যোগাযোগের মাধ্যমে খ্রীষ্টপূর্ব সপ্তম সহস্রাব্দে মেহরগড় থেকে সূচিত সাংস্কৃতিক ধারাবাহিকতাকে পরবর্তী গাঙ্গেয় উপত্যকার ঐতিহ্যের সাথে যুক্ত করা যায়।  এই সাংস্কৃতিক ধারাবাহিকতার মধ্যে বাস্তুসংস্থানগত (Ecologically) কারণে প্রত্নতাত্ত্বিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ স্থানীয় পর্যায়ে ছেদ ঘটেছিল। এই সাংস্কৃতিক ছেদ সিন্ধু উপত্যকা থেকে বিভিন্ন এলাকার মানুষজনের, পশ্চিম দিকে, পূর্ব ও দক্ষিণপূর্ব দিকে নানা জায়গায় স্থান পরিবর্তনের ফলে ঘটেছিল।

-------------------------------------------------------

দেখুনঃ J.S. Kharakwal, Y.S. Rawat and Toshiki Osada, Preliminary observations on the excavation at Kanmer, Kachchh, India 2006-2007, in, Current Studies on the Indus Civilization, Volume III, eds., Toshiki Osada and Akinori Uesugi, Manohar Publishers & Distributers, New Delhi, 2010, p. 18, 22.

দেখুনঃ Jim G. Shaffer & Diane A. Lichtenstein, Migration, Phililogy and South Asian Archaeology, in, Aryan and Non-Aryan in South Asia: Evidence, Interpretation and Ideology, eds., Johannes Bronkhorst & Madhav M. Deshpande, Department of Sanskrit and Indian Studies, Harvard University, 1999, p. 255.

দেখুনঃ Rajiv Mann and Vivek Dangi, Site Catchment of Farmana: A Harappan Site in the Ghaggar Basin, in, Harappan Studies: Recent Researches in South Asian Archaeology, Volume 1, eds., Manmohan Kumar and Akinori Uesugi, Aryan Books International, New Delhi, 2014, pp. 70, 73.

দেখুনঃ Man Mohan Kumar and I.J. Nagpal, Dispersal of Settlements in Hayana from Early Harappan to Late Harappan Period, in, Purātattva, No. 34: 2003-2004, 2004, p. 27.

দেখুনঃ Jim G. Shaffer & Diane A. Lichtenstein, Migration, Phililogy and South Asian Archaeology, in, Aryan and Non-Aryan in South Asia: Evidence, Interpretation and Ideology, eds., Johannes Bronkhorst & Madhav M. Deshpande, 1999, pp. 255-256.

-------------------------------------------------------

পাতা : ৫০

 

দ্বিতীয় অধ্যায়

বৈদিক ধর্ম সংস্কার আন্দোলন ও সিন্ধু সভ্যতার পতন

আগের অধ্যায়ে প্রত্নতাত্ত্বিক সাক্ষ্য ও অন্যান্য গবেষণার ভিত্তিতে সিন্ধু সভ্যতার উত্থান, বিস্তার, পতন ও পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন অঞ্চলে নানা সাংস্কৃতিক পরিবর্তন নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এই আলোচনার সময়ে সিন্ধু সভ্যতার বস্তুগত সংস্কৃতি সম্পর্কে মোটামুটি একটা ধারণা পাওয়া গেছে। কিন্তু সেখানকার লিপির পাঠোদ্ধার না হওয়ায় এবং সেখানকার শাসকরা নিজেদের সাথে সম্পর্কিত কোনো কীর্তি নির্মাণ না করায় সিন্ধু সভ্যতা সম্পর্কে বহু কিছু স্পষ্টভাবে জানার উপায় নাই। বিশেষত সেখানকার মানুষ কারা ও তাদের ভাষা কী ছিল, তাদের শাসনপদ্ধতি ও রাষ্ট্রদর্শন কী ছিল, কীভাবে তারা এত দূর ব্যাপী নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছিল, কীভাবে তাদের পতন ঘটল ও পরবর্তী ভারতীয় সমাজ ও অন্যান্য সভ্যতার উপর তাদের প্রভাবের প্রকৃতি কী রকম ছিল তা আজও অস্পষ্ট রয়ে গেছে। আমরা এই অধ্যায়ে কীভাবে সিন্ধু সভ্যতার পতন ঘটল সেই প্রশ্নের উত্তর পাবার চেষ্টা করব।

এটি অত্যন্ত চমকপ্রদ বিষয় যে, হিন্দুদের সবচেয়ে প্রাচীন গ্রন্থ ঋগ্বেদ সিন্ধু সভ্যতার অজানা অনেক প্রশ্নের উত্তর পেতে বিরাটভাবে সাহায্য করে। সিন্ধু সভ্যতার সাথে ঋগ্বেদকে মিলাতে পারলে সিন্ধু সভ্যতার শেষ পর্যায়ের সামাজিক সংকট ও ফলস্বরূপ পতনের কারণ অনুসন্ধানের জন্য তা এক অমূল্য উৎস হিসাবে কাজ করে।

হিন্দুদের ধর্মগ্রন্থ ঋগ্বেদকে আর্যদের সর্বপ্রাচীন গ্রন্থ হিসাবে বিবেচনা করা হয়। ঋগ্বেদ বিভিন্ন ঋষিদের রচিত মন্ত্রের সংকলন। ঋগ্বেদের রচনাকালকে আমরা সিন্ধু সভ্যতার শেষ পর্যায়ে বিশেষত তার পতনের কালকে মনে করি। ঋগ্বেদের ঋষিরা একটি নিদিষ্ট সামাজিক পটভূমিতে ঋগ্বেদের মন্ত্রসমূহ রচনা করেছেন। আমরা মনে করি সিন্ধু সভ্যতার শেষ পর্যায়ে সমাজের ভিতর প্রবল সংকট এবং তজ্জনিত সামাজিক ক্ষোভ থেকে সিন্ধু সভ্যতার শেষ পর্যায়ে প্রচলিত ধর্মকে সংস্কার করতে চেয়ে যে আন্দোলন ঘটেছিল তারই দলিল হল ঋগ্বেদ। এ কথা জোর দিয়ে বলা যায় যে, পৃথিবীর অন্যান্য ধর্ম সংস্কার আন্দোলনের মতই ঋগ্বেদ একটি ধর্ম সংস্কার আন্দোলনের ফসল। আমরা আগের অধ্যায়ে দেখেছি সিন্ধু সভ্যতার সূচনা পর্বে সমগ্র অঞ্চল ব্যাপী যে সমরূপতা নিয়ে সভ্যতার যাত্রা শুরু হয়েছিল মধ্যবর্তী পর্যায় থেকে শুরু করে শেষ পর্যায় পর্যন্ত তাকে নানা আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্যে বিভক্ত হতে দেখা যায় এবং শাসন ব্যবস্থায়ও কিছু পরিবর্তন হয়েছিল বলে প্রত্নতাত্ত্বিকরা মনে করেন। এছাড়া হরপ্পায় প্রথম পর্বের (পর্ব ৩এ, ২৬০০ খ্রীঃপূঃ - ২৪৫০ খ্রীঃপূঃ) শেষে সেখানে নগর ব্যবস্থায় ক্ষয় ও মেরামতের অভাবে দুর্দশাগ্রস্ত হবার প্রমাণ পাওয়ার কথা জানা যায়।  যদিও পরবর্তী পর্বে (পর্ব ৩বি, ২৪৫০ খ্রীঃপূঃ - ২২০০ খ্রীঃপূঃ) সেখানে আবার পুনরায় বাড়ীঘর নির্মাণ, নর্দমা ব্যবস্থার উন্নয়ন, নূতন করে প্রাচীর ও গেট নির্মাণ, ইত্যাদি কাজ হবার প্রমাণ দেখা গেছে। সিন্ধু সভ্যতার শেষের দিকে সেখানকার সমাজে ধর্মের প্রভাবও বেড়ে যায় বলে বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক সাক্ষ্য থেকে জানা যায়। এখন প্রশ্ন হল সিন্ধু সভ্যতার মধ্যবর্তী পর্যায় এবং শেষের দিকে কি ঘটেছিল যার ফলে সেখানে সংকট তৈরী হয়েছিল এবং সিন্ধু সভ্যতার শেষ পর্যায়ে একটি ধর্ম সংস্কার আন্দোলন সংঘটিত হয়েছিল।

-------------------------------------------------------

  হরপ্পায় প্রত্নতাত্ত্বিক খনন থেকে কেনোয়ারের পর্যবেক্ষণ গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেছেন, ‘The initial Period 3A habitation deposits on the southern edge of Mound E are followed by a period of civic decay and disrepair. The street drains became clogged and sewage flowed in the street, the wall and gateway became eroded and non-functional, and carcasses of animals were left lying in the street or dumped into abandoned rooms along the street.’ দেখুনঃ Jonathan Mark Kenoyer, Urban Process in the Indus Tradition: A Preliminary Model from Harappa, in, Harappa Excavations 1986–1990: A Multidisciplinary Approach to Third Millennium Urbanism, ed., Richard H. Meadow, 1991, p. 55.   

-------------------------------------------------------

 এখন পর্যন্ত পাওয়া সিন্ধু সভ্যতার মোট বসতির সংখ্যা তিন হাজারের চেয়েও বেশী। হরপ্পা, মহেঞ্জো-দাড়ো, রাখিগাড়ি, গানেরিওয়ালা, লাখাঞ্জোদাড়ো ও ধোলাভিরার মত বড় বসতি ও কালিবঙ্গান, বনওয়ালী, নৌশারো, লোথাল, ইত্যাদি মাঝারী বসতিগুলির বাইরে বাকী সমস্ত বসতি ছিল গ্রামীণ। সুতরাং সিন্ধু সভ্যতায় গ্রামেই যে বেশী মানুষ বাস করত তাতে সন্দেহ নাই। সিন্ধু সভ্যতার দীর্ঘকাল ব্যাপী ও বিস্তৃত অঞ্চলে এত বিপুল সংখ্যক বসতিতে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর খাদ্যের ব্যবস্থা করা নিশ্চয়ই কৃষিতে বিপুল উৎপাদন ছাড়া সম্ভব ছিল না। আর কৃষিতে বিপুল খাদ্য উৎপাদন কেবল কৃত্রিম সেচব্যবস্থা দ্বারাই সম্ভব।  আমরা মনে করি সিন্ধু সভ্যতায় প্রায় সকল নদীর উপর আড়াআড়ি বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে জল সঞ্চয় করে খালের সাহায্যে সঞ্চিত জলকে বিভিন্ন অঞ্চলের কৃষিভূমিতে সরবরাহ করা হত। সিন্ধু সভ্যতার রাষ্ট্র যেমন এই বাঁধ ভিত্তিক সেচ ব্যবস্থার নির্মাতা ছিল তেমন তা এই সম্পূর্ণ বিষয়টির পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ করত।

প্রত্নতাত্ত্বিকরা মনে করেন যে, সিন্ধু সভ্যতায় প্রধানত দুই ধরনের সেচ ব্যবস্থা ছিল, (ক) একটি কুয়ার জল উত্তোলন করে, ও অপরটি (খ) বন্যা ও বর্ষজীবী খালের প্রবাহের মাধ্যমে।  সিন্ধুর প্রত্নতত্ত্ব বা জলবিদ্যা থেকে সিন্ধু সভ্যতায় সেচ ব্যবস্থার কথা এখনো সরাসরি জানা যায় নাই। ঐতিহাসিক ও প্রাগৈতিহাসিক যুগে পাঞ্জাবে ও আশেপাশের অঞ্চলে কুয়ার জল উঠিয়ে সেচ দিবার কথা জানা যায়। সিন্ধু সভ্যতায় এর ব্যবহার থাকা সম্ভব। তবে বালুচিস্তান ও সিন্ধু প্রদেশে এমন কিছু পুরাতাত্ত্বিক সাক্ষ্য পাওয়া গেছে যা থেকে নদীতে বাঁধ নির্মাণ করে কৃষিতে সেচ দিবার প্রমাণ পাওয়া যায়। সর্বপ্রথম অরেল স্টেইন ও অন্যরা বালুচিস্তানের পাহাড়ী এলাকায় গবরবন্দ্ (Gabarband) নামে এক ধরনের বাঁধের কথা উল্লেখ করেছেন। ‘গবর’ একটি পারসী শব্দ যার অর্থ সাধারণভাবে জরথুস্ত্র কর্তৃক প্রবর্তিত তথা জরথুস্ত্রীয় ধর্মের উপাসক।  আমাদের নিকট এই ধর্ম পার্সী বা আবেস্তান ধর্ম নামে পরিচিত।  আর ‘বন্দ’ অর্থ বাঁধ। গবরবন্দ অর্থ দাঁড়াচ্ছে জরথুস্ত্রীয় ধর্মের অনুসারীদের বাঁধ। খুব মজবুতভাবে পাথর দিয়ে তৈরী এই বাঁধগুলি পাহাড়ী ছোট ছোট নদীতে দেওয়া হত। তাঁর বর্ণনা অনুযায়ী এগুলির উচ্চতা কখনো ১০ থেকে ১৫ ফুটও হত। প্রচুর পলি ও জল ধরে রাখার ফলে এর সাহায্যে ফসল ফলানো হত। অনেক লেখক মনে করেন এগুলি নব-প্রস্তর-তাম্র যুগের। মর্টিমার হুইলারও এই গবরবনদের কথা উল্লেখ করেছেন।  ওয়াল্টার এ, ফেয়ারসার্ভিস হাব নদীর উপরের অংশে একটি আমরি বসতির নিকটে লাস বেলায় এই রকম বাঁধের সাক্ষ্য পাওয়ার কথা উল্লেখ করেছেন, যা পাশ্ববর্তী পাহাড় থেকে আসা বাৎসরিক বৃষ্টির জল ও পলি ধারণ করে কৃষি কাজে ব্যবহার করার জন্য জন্য তৈরী করা হয়েছিল।  তিনি ও,এইচ,কে, স্পেটের কথা উল্লেখ করেছেন যিনি দক্ষিণ-পশ্চিম সিন্ধু প্রদেশে এবং মারির মরূদ্যানের প্রান্তে একটি হরপ্পান গ্রামে বসবাসকারীদের বাঁধ ভিত্তিক সেচ ব্যবস্থা ছিল বলে উল্লেখ করেছেন। এছাড়াও করাচি অঞ্চলে হাসান ওয়ালি নামে একটি হরপ্পান বসতির কাছে পাথর ও মাটি দিয়ে তৈরী প্রাচীন বাঁধের কথা ফেয়ারসার্ভিস উল্লেখ করেছেন।  রবার্ট রেইকস্ ও রবার্ট ডাইসন বড় আকৃতির পাথরের টুকরা দিয়ে তৈরী এই গবরবন্দ্ সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন যে, এগুলি তৈরীতে বহু সংখ্যক মানুষের চেয়ে প্রকৌশল দক্ষতার সাক্ষ্য ছিল বলে মনে হয়।  গুজরাটে ধোলাভিরার চারপাশে ছড়িয়ে থাকা বৃষ্টিজলের মনহার নামে খালের তিনটি জায়গায় ও মনসার নামে খালের দুইটি জায়গায় আড়াআড়িভাবে বাঁধ দেওয়ার সাক্ষ্য পাওয়া গেছে।  এই বাঁধ দিবার উদ্দেশ্য ছিল ধোলাভিরার বসতির জলাধারে জল সংরক্ষণ করা। বিশ্ট্ উল্লেখ করেছেন, জলপ্রবাহের আড়াআড়ি এই বাঁধ দিবার অভিজ্ঞতা ও কৃৎকৌশল বালুচিস্তান ও সিন্ধুর কোহিস্তান থেকে গুজরাটে অভিবাসীরা নিয়ে এসে থাকতে পারে। এখানে মাটির তলদেশের পাথর (Basal rock) কেটে একটি বড় জলাধার তৈরী করা হয়েছিল।মেহরগড়ে যদিও কোনো বাঁধ পাওয়ার বিষয়টি বলা হয় নাই, তবু জলসেচের নালার সম্ভাব্য সাক্ষ্য থেকে সেখানে কৃষির উচ্চ ফলন ও ফলশ্রুতিতে জনসংখ্যার বৃদ্ধির জন্য বাঁধ ভিত্তিক সেচ ব্যবস্থার পক্ষে অনুমান করা হয়।  মনে করা হয় এই কৃত্রিম খালটি খ্রীষ্টপূর্ব চতুর্থ সহস্রাব্দের মাঝামাঝি সময়ে তৈরী করা হয়েছিল।  বৃহত্তর সিন্ধু উপত্যকাব্যাপী সেচের জন্য নির্মিত খাল এখনো পাওয়া যায় নাই, ধারণা করা যায় গত শতাব্দীতে এগুলির অংশ বিশেষ যেটুকু দৃষ্টিগ্রাহ্য ছিল, এখন সেগুলি সম্পূর্ণ মুছে গিয়ে থাকবে। তবে অরেল স্টেইন দক্ষিণ পাঞ্জাবের বাহাওয়ালপুর ও বিকানর জেলার মধ্যে আড়াআড়িভাবে একটি খালের গতিধারার সাথে হরপ্পান বসতিসমূহের এক রেখা বরাবর অবস্থান দেখতে পেয়েছিলেন।১০

-------------------------------------------------------

দেখুনঃ L.S. Leshnik, Land Use and ecological factors in prehistoric North-West India, in, South Asian Archaeology, ed, Norman Hammond, Published by Gerald Duckworth & Company Ltd., London, 1973, pp. 72-73.

দেখুনঃ E. Balfour, The Cyclopaedia of India and of Eastern and Southern Asia, Vol. I, Third Edition, London, 1885, p. 1158.

দেখুনঃ Sir Mortimer Wheeler, The Indus Civilization, Cambridge University Press, 1968, Third Edition, pp.10-11.

দেখুনঃ Walter A. Fairservis, "The Harappan Civilization - New Evidence and More Theory," in, American Museum Novitates, Published by the American Museum of Natural History, New York, No. 2055, 1961, p. 5.

  দেখুনঃ Walter A. Fairservis, Jr., Allahdino: An Excavation of a Small Harappan Site, in, Harappan Civilization: A Recent Perspective, ed., Gregory L. Possehl, 1993, p. 107.

দেখুনঃ Robert L. Raikes and Robert H. Dyson Jr., The Prehistoric Climate of Baluchistan and the Indus Valley, in, American Anthropologist 63(2/1), 1961, p. 266.

দেখুনঃ R.S. Bisht, "Dholavira and Banawali: Two Different Paradigms of the Harappan Urbis Forma," in, Puratattva, No. 29, 1999, pp. 26-28.

  দেখুনঃ Jonathan Mark Kenoyer, "Households and Neighborhoods of the Indus Tradition: An Overview," in, New Perspectives on Household Archaeology, eds, Bradley J. Parker and Catherine P. Foster, 2012, p. 381.

দেখুনঃ Ueli Brunner, Notes on gabarbands in Balochistan, in, Archäologische Mitteilungen aus Iran und Turan, 38, 2006, p. 104.

 ১০ দেখুনঃ L.S. Leshnik, Land Use and ecological factors in prehistoric North-West India, in, South Asian Archaeology, ed., Norman Hammond, Published by Gerald Duckworth & Company Ltd., London, 1973, p. 70.

-------------------------------------------------------

পাতা : ৫১

প্রত্নতাত্ত্বিকরা দক্ষিণ-পূর্ব বালুচিস্তানে এক শ’র মত গবরবন্দ্ বা বাঁধ পাওয়ার কথা উল্লেখ করেছেন।  এগুলির মধ্যে কিছু বাঁধ বিশাল আকৃতির। বালুচিস্তানের কালাতে জরিপ পরিচালনার সময়ে যৌথ জার্মান-পাকিস্তানী প্রত্নতাত্ত্বিক মিশন চারটি বড় বাঁধ ও বহুসংখ্যক বসতি পাওয়ার কথা জানিয়েছে, যেগুলির সময়কাল খ্রীষ্টপূর্ব চতুর্থ সহস্রাব্দের শেষে ও তৃতীয় সহস্রাব্দে।  এগুলি সবগুলিই কৃষি জমিতে সেচের উদ্দেশ্যে তৈরী করা হয়েছিল। ১৯০৭ সালে প্রকাশিত বালুচিস্তান জিলা গেজেটিয়ারে বালুচিস্তানের পার্বত্যময় ঝালাওয়ান নামে অঞ্চলে, কালাতের কাছে সুরাব থেকে দক্ষিণে হাব নদীর উপত্যকা পর্যন্ত ও পশ্চিমে মাশ্কে (Mashkae) পর্যন্ত বহু সংখ্যক গবরবন্দ থাকার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।  সেখানে বলা হয়েছে যে,  স্থানীয় ঐতিহ্য অনুযায়ী এগুলি জরথুস্ত্রের ধর্মের মানুষজন তৈরী করেছিল। এই সব বাঁধের উজানে বিশাল এক জলাধার তৈরী হত, ফলে সেখান পলি ও কাদামাটি জমত। তখন এই জমি হত কৃষির জন্য খুবই উর্বর। কিছু বাঁধের পাশে নালার সাহায্যে জলকে কৃষি জমিতে নেওয়ার প্রমাণ পাওয়া গেছে। কিছু বাঁধে অতিরিক্ত জল উপচে ভাটির দিকে চলে যাবার জন্য মাঝখানে কিছুটা অংশ নীচু করে একটি বা দুটি স্পীলওয়ে তৈরী করা হত। এই সমস্ত বাঁধের কয়েকটির কাছাকছি আদি হরপ্পান ও কিছু বাঁধের কাছে হরপ্পান বসতি পাওয়া গেছে। এতে ধারণা করা যায় যে, এই বাঁধগুলি আদি হরপ্পান ও হরপ্পান পর্যায়ে তৈরী করা হয়েছিল।

-------------------------------------------------------

দেখুনঃ Ueli Brunner, Notes on gabarbands in Balochistan, in, Archäologische Mitteilungen aus Iran und Turan, 38, 2006, p. 103.

  দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ১২৩।

দেখুনঃ Baluchistan District Gazetteer Series, Jhalawan, Text and Appendices, Volume VI-B, Bombay, 1907, pp. 57-58.

-------------------------------------------------------

সিন্ধু প্রদেশের কোহিস্তানে ফ্যাং নামে স্থানে সবচেয়ে প্রাচীন বাঁধের কাঠামো পাওয়া গেছে। এটি পাঁচটি বাঁধ নিয়ে গঠিত হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড়টি ১২৬ মিটার দীর্ঘ ও ৭.৮ মিটার উচ্চতার। এর আয়তন ৪০,০০০ ঘন মিটারের চেয়েও বেশী। এটিকে মোটামুটি কোট দিজি পর্বে (৩০০০-২৮০০ খ্রীঃপূঃ) আদি হরপ্পান পর্যায়ে ফেলা হয়। গবেষক উয়েলি ব্রুনের এটিকে পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন বাঁধ বলে উল্লেখ করেছেন।

-------------------------------------------------------

দেখুনঃ Ueli Brunner, Notes on gabarbands in Balochistan, in, Archäologische Mitteilungen aus Iran und Turan, 38, 2006, p. 104.

-------------------------------------------------------

বক্কর বুথি নামে ২.৫ হেক্টর আয়তনের একটি হরপ্পান বসতির প্রায় এক কিলোমিটার দূরে কনরাচ (Kanrāch) নদীর উপর নির্মিত দুদ্দার (Duddar) বাঁধের উপর এখানে আলোচনা করা যায়।  দুদ্দার বাঁধটি খ্রীষ্টপূর্ব তৃতীয় সহস্রাব্দে তৈরী করা হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। বক্কর বুথি বসতিটি ২৪০০- ২২০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের মধ্যে বিকাশ লাভ করেছিল ও এরপর বসতিটি পরিত্যক্ত হয়। এই বসতিটির কাছে আরো দু’টি ছোট বাঁধের কথা জানা যায়। এগুলি আদি হরপ্পান পর্যায়ের বলে মনে করা হয়। বিশালাকৃতির এই দুদ্দার বাঁধটির উপরের দিকে দৈর্ঘ্য ২৭০ মিটার। ১৮০ মিটার পর এটি প্রায় ৫০° বাঁক নিয়েছে ও আরো প্রায় ৯০ মিটার পর্যন্ত চলে গেছে। পূর্ব পাশে এটির উচ্চতা প্রায় ১০ মিটার ও পশ্চিম পাশে প্রায় ১৩ মিটার। পশ্চিম পাশে এর ঢাল বা অবনতি ২৪° ও পূর্ব দিকে কিছুটা খাড়া হয়ে অবনতি ১২° দেখা গেছে। এই বাঁধটি একটি পুরাতন নদীর তলদেশে তৈরী করা হয়েছিল। ব্রুনের হিসাব করে দেখিয়েছেন যে, এই বাঁধটি তৈরী করতে ১,০০,০০০ ঘন মিটার পাথর, মাটি, ইত্যাদি লেগেছিল।  এর নির্মাণ পদ্ধতিও জটিল বলে ব্রুনের মন্তব্য করেছেন। বহনযোগ্য পাথর দিয়ে স্রােতধারার দিকে ও এর আড়াআড়িভাবে অনেকগুলি দেওয়াল তৈরী করা হয়েছিল। এর ফলে শতাধিক ফাঁকা গর্ত তৈরী হয়েছিল। চারিপাশে যা কিছু ছিল সেগুলি দিয়ে এই গর্তগুলি পূরণ করা হয়। হিসাব করে তিনি দেখান যে, যদি একজন শ্রমিক দিনে এক ঘন মিটারের মত আয়তনের কাজ করতে পারে, তাহলে অনুমান করা যায় যে, ৫০০ লোকের বাঁধটি সম্পূর্ণ তৈরী করতে ২০০ দিন লেগেছিল। অর্থাৎ বক্কর বুথির লোকজনের এই বাঁধ তৈরী করতে প্রায় এক বৎসর লেগেছিল।

-------------------------------------------------------

  দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ১১০-১১৩।

২  দেখুনঃ Ueli Brunner, Notes on gabarbands in Balochistan, in, Archäologische Mitteilungen aus Iran und Turan, 38, 2006, p. 112.

  দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ১১২।

-------------------------------------------------------

গবেষক ব্রুনের কিনরি নদীর উপর ২০০ মিটার দীর্ঘ কিনরি বাঁধের কথাও আলোচনা করেছেন।  এই বাঁধটি উত্তর-পশ্চিমে একটি পর্বতের ঢালু ও দক্ষিণ-পূর্ব দিকে একটি পাহাড়ের মধ্যবর্তী ফাঁকা স্থান পূরণ করেছে। এই পাহাড়টির উপর একটি কুল্লি সংস্কৃতির বসতি আছে। দুদ্দার বাঁধের সাথে এই বাঁধটির মিল আশ্চর্য হওয়ার মত। বাঁধটি গোড়ায় ২৫ মিটার প্রশস্ত ও ৫.৫ মিটার উচ্চতার। এই বাঁধটির উদ্দেশ্য ছিল জল ধরে রাখা ও কৃষিতে কাজে লাগানো, ফলে সম্পূর্ণ বন্ধ্যা জমিকে উর্বর ক্ষেত্রে পরিণত করা। এখানে অনেক তীর্যক দেওয়াল দেখতে পাওয়া যায়। ধারণা করা যায় যে, পাহাড়ের উপর এই বসতিটি এবং বাঁধ, দেওয়াল ও উর্বর ক্ষেত্র সকলে একই সময়ে অস্তিত্বশীল ছিল এবং যাকে খ্রীষ্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দের দ্বিতীয়ার্ধে ফেলা যায়।

----------------------------------------------

  দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ১১৮-১২০।

----------------------------------------------

দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে দেখা বালুচিস্তানে একটি হরপ্পান বসতির কাছে অবস্থিত দুদ্দার বাঁধ। উর্বর ক্ষেত্র থেকে বুঝা যায় যে, বাঁধের উভয় পাশে পলি সঞ্চিত হয়েছিল (সৌজন্যেঃ Ueli Brunner, 2006)

পাতা : ৫২

লনদানি (Landani) নামে খ্রীষ্টপূর্ব তৃতীয় সহস্রাব্দের শেষের দিকের একটি বসতির নিকটবর্তী কোট গৌরবন্দ্ নামে আরো একটি বাঁধের কথা জানা যায়।  এই বসতিটি পরিকল্পনায় ও ভবনগুলির স্তরবিন্যাসে সুসংগঠিত ছিল । বিশালাকার এই বাঁধটি দৈর্ঘ্যে ১৫০ মিটারের চেয়েও বেশী। এখন বাঁধটি ধ্বংস হয়ে গেছে ও পশ্চিমের অংশটি ধুয়ে গেছে। জলের বিপরীত পাশে বাঁধটিতে দুটি দেওয়াল আছে, যেগুলি ৪-৭ মিটার প্রশস্ত। এর মধ্যবর্তী অংশ সব ধরনের জিনিস দিয়ে পূর্ণ করা হয়েছে। জলের দিকে ১.৫ মিটার প্রশস্ত ও ৩-৪ মিটার উঁচু পাথরের চৌকোনা টুকরা দিয়ে তৈরী দেওয়াল (Ashlar wall) নির্মাণ করা হয়েছিল। পাথরের টুকরাগুলি তেমন ভালভাবে বসে নাই। এর মধ্যবর্তী অংশ ১২ মিটার প্রসারিত, এর মধ্যবর্তী অংশও আলগা নানা জিনিস দিয়ে পূর্ণ করা হয়েছে। বাঁধের মধ্যবর্তী অংশ থেকে জলের দিকে নামার জন্য প্রায় ১২টি ধাপ দেখতে পাওয়া যায়।

----------------------------------------

  দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ১২৩-১২৪।

----------------------------------------

দুদ্দার বাঁধের হাতে আঁকা ছবি ও ছেদকৃত দৃশ্য (সৌজন্যেঃ Ueli Brunner, 2006)

দুদ্দার বাঁধের ভিতরের দেওয়াল, এবং ভিতরে কক্ষের একাংশ (সৌজন্যেঃ Ueli Brunner, 2006)

পীর মুনাঘরায় (Pīr Munaghara) সারুন (Sārūna) নদীর জলকে ধরে রাখার জন্য যে বাঁধ দেওয়া হয়েছিল তাতে পূর্ব দিকে ছোট একটি আয়তাকার সুরঙ্গ বাঁধটিকে ছিদ্র করেছে বলে ব্রুনের জানিয়েছেন।  এটিকে তিনি স্লুইস হিসাবে উল্লেখ করেছেন। এছাড়াও দক্ষিণ দিকে আরেকটি স্লুইস থাকার কথাও তিনি জানিয়েছেন। এই বাঁধটির নিকটে একটি শৈলশিরায় একটি দুর্গপ্রাচীর ঘেরা বসতি আছে যা খ্রীষ্টপূর্ব তৃতীয় সহস্রাব্দের। ব্রুনের স্লুইসের সাথে সংশ্লিষ্ট কোনো গেটের কথা উল্লেখ করেন নাই। এর অস্তিত্ব বহু আগেই বিলুপ্ত হয়েছে বলে ধারণা করা যায়। হরপ্পান যুগের মানুষদের নির্মাণ করা এই বাঁধটিতে স্লুইস থাকাতে অনুমান করা যায় যে, এখানে জলপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য একটি গেট বা কপাট থাকাটা স্বাভাবিক, তা না হলে সব সঞ্চিত জল এই স্লুইস দিয়ে ভাটিতে চলে যাবে ও বাঁধ নির্মাণের উদ্দেশ্য ব্যর্থ হবে।

-----------------------------------

দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ১২৪।

-----------------------------------

বালুচিস্তানে হরপ্পান যুগে নির্মিত কিনরি বাঁধ। ভূমিক্ষয়ের ফলে বাঁধের একটি অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে (সৌজন্যেঃ Ueli Brunner, 2006)

পীর মুনাঘরা বাঁধ, সারুন উপত্যকা, খ্রীঃপূঃ ৩য় সহসাব্দের প্রথম দিকের (সৌজন্যেঃ Ute Franke, 2015)

পাতা : ৫৩

ব্রুনের ব্যবহারের উদ্দেশ্যের উপর ভিত্তি করে বালুচিস্তানে তাঁর পরীক্ষা করা কয়েক ধরনের বাঁধের কথা উল্লেখ করেছেন।  এর মধ্যে সবচেয়ে বেশী সংখ্যক প্রতিবন্ধক বাঁধ (Barrage dam) মোট ৭টি, পরিবেষ্টক বাঁধ (Enclosure dam) ৬টি ও প্রতিরোধের জন্য নির্মিত বাঁধ (Protection dam) মাত্র ১টি। বাঁধ নির্মাণে নির্দিষ্ট কোনো পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়েছে এমন প্রমাণ তিনি পান নাই। তবে দুদ্দার বাঁধের নির্মাণ কৌশল খুবই শক্তিশালী বলে হরপ্পানরা এই কৌশল গ্রহণ করেছিল বলে তিনি মন্তব্য করেছেন।  হরপ্পান বসতি লোহরিতেও বাঁধ ভিত্তিক সেচ ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে।

---------------------------------

  দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ১৩০।

  দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ১৩২।

--------------------------------

আমরা দেখেছি, বালুচিস্তানে নদীতে আড়াআড়ি বাঁধ নির্মাণ করে উজানে যে বিপুল জলাধার তৈরী হয় সেখান থেকে খাল দিয়ে বিভিন্ন জমিতে জল নিবার ব্যবস্থা করা হত। এছাড়া এই সঞ্চিত জল নির্দিষ্ট খাতে রাখার জন্য অথবা যাতে আশেপাশে অপ্রয়োজনীয় এলাকা প্লাবিত না করে সেই জন্য প্রতিরোধকারী দেওয়ালও নির্মাণ করা হত। এই সব বাঁধের সাথে অতিরিক্ত জল ভাটিতে নিবার জন্য বাঁধের উপরের অল্প অংশে কিছুটা নীচু করে রাখা হত যা স্পীলওয়ের কাজ করত। বাঁধের নীচের দিকে আয়তাকার ছিদ্র রাখা হত যা স্লুইস হিসাবে কাজ করত। অনুমান করা যায় সেখানে জল প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য স্লুইস গেটও থাকত। স্লুইস গেট যে সিন্ধু সভ্যতার অধিবাসীদের কাছে অজানা ছিল না সেটা আমরা লোথালের ডকইয়ার্ডের জল নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা থেকে এবং হরপ্পার নর্দমায়  ব্যবহার হতে দেখেছি।

-------------------------------------------------------

হরপ্পায় কিছু নর্দমায় স্লুইস গেট থাকার কথা কেনোয়ার জানাচ্ছেন, ‘Some drains appear to have been provided with wooden sluice gates or perhaps a grill to keep people from secretly entering into the walled city.’ দেখুনঃ Jonathan Mark Kenoyer, Ancient Citie of the Indus Valley Civilization, 1998, p. 61.

-------------------------------------------------------

বরাগ বাঁধের হাতে আঁকা ছবি ও ছেদকৃত দৃশ্য (সৌজন্যেঃ Ueli Brunner, 2006)

এখন বেশীর ভাগ গবেষক একমত যে, খ্রীষ্টপূর্ব চতুর্থ সহস্রাব্দের শেষে ও তৃতীয় সহস্রাব্দ জুড়ে বালুচিস্তানের জলবায়ু মোটামুটি এখনকার মতই ছিল। ফলে সেখানকার জলবায়ু এখনকার মতই প্রচণ্ড রকম শুষ্ক ও গরম ছিল এবং সেখানে কম বৃষ্টিপাত হত। মেহরগড়ে নদীবিধৌত বনাঞ্চলে পরাগ রেণুর উপর গবেষণা চালিয়ে দেখা গেছে যে, এখন থেকে কমপক্ষে ৯,০০০-৬,০০০ বৎসর আগের সময় জুড়ে এখনকার তুলনায় আর্দ্র অবস্থা ছিল।  ব্রুনের মনে করেন কিনরি বাঁধটি এই সময়ে তৈরী করা হয়েছিল।  এছাড়াও একটি খুব চমকপ্রদ বিষয় তিনি উল্লেখ করেছেন। গবেষণায় দেখা গেছে রবি মৌসুমের খাদ্য হিসাবে ব্যবহৃত শস্যের পরাগরেণুর বর্ণালী খরিফ মৌসুমের শস্যের মত।  এই আবিষ্কার থেকে বুঝা যায় যে, হরপ্পান পর্যায় শুরু হবার অনেক আগে থেকেই সেচ ব্যবস্থার উপর নির্ভর করে বছরে দুই বার শস্য ফলানো হত, ফলে বিপুল কৃষি উৎপাদন হত।

----------------------------------

  দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ১৩২।

দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ১৩২।

দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ১৩২।

---------------------------------

মকরান উপকূলে আকাশ থেকে নেওয়া ছবিতে বর্তমান সমুদ্র তীরের সমান্তরালে বিভিন্ন জায়গায় প্রাগৈতিহাসিক উঁচু সৈকত দেখতে পাওয়া যায়।  এগুলি কৃষিতে জলসেচের জন্য নির্মিত বাঁধের অবশেষ হতে পারে। উপগ্রহ থেকে নেওয়া ছবি ও ভূমি-ভিত্তিক জরিপের সাহায্যে জানা গেছে যে, শতদ্রু (সুতলেজ) নদী এক সময়ে ঘাগর নদীতে পড়ত, যা এখন সিন্ধু নদীতে পড়ছে।  এছাড়া শতদ্রু নদী থেকে অসংখ্য খাল বের হবারও প্রমাণ পাওয়া গেছে।  মহাভারতে উল্লেখ আছে যে, ঋষি বসিষ্ঠ যখন নিজেকে শতদ্রু নদীতে নিক্ষেপ করলেন তখন তা শত ধারায় বিভক্ত হল। এটি যদিও রূপক বর্ণনা তবু এ থেকে নদীটি থেকে বের হওয়া অনেক খালের অস্তিত্বের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। এছাড়াও পণ্ডিতরা প্রমাণ পেয়েছেন যে, যমুনা নদী এখন যে ধারায় প্রবাহিত হচ্ছে প্রাচীন কালে সেখান থেকে পশ্চিম দিকে প্রবাহিত হত ও চৌটাং (প্রাচীন দৃষদ্বতী) নদীর ধারায় গিয়ে পড়ত এবং শেষে হাকরা নদীর ধারায় গিয়ে মিলিত হত। বাহাওয়ালপুরে ভূপৃষ্ঠের অনেক অবনতি এবং প্রাচীন খালের চিহ্ন দেখা যায় - যেগুলি বিপাশা-শতদ্রু সংযোগ নদীর শুকিয়ে যাওয়া বিভিন্ন প্রবাহ থাকার সাক্ষ্য দেয়।  সে সময়ে ঘাগর, যমুনা (চৌটাং-এর ধারায়), শতদ্রু ও নাইওয়াল নদী মিলে যে ধারা তৈরী হয়েছিল তা পাঞ্জাবে এক বিশাল জলধারা তৈরী করে যা সেযুগে সরস্বতী নামে সুপরিচিত ছিল।

-------------------------------------------------------

দেখুনঃ Robert L. Raikes, The End of the Ancient Cities of the Indus, in, Ancient Cities of the Indus, ed., Gregory L. Possehl, Vikas Publishing House Pvt. Ltd., New Delhi, 1979, pp. 301-302.

দেখুনঃ Prem Kishore Saint, Paleohydrology of the Sindhu-Sarasvatī Civilization River Systems, in, Sindhu-Sarasvatī Civilization: New Perspectives, ed., Nalini Rao, 2014, p. 550.

দেখুনঃ D.P. Agrawal and R.K. Sood, Ecological Factors and the harappan Civilization, in, Harappan Civilization: A Contemporary Perspective, ed., Gregory L. Possehl, Oxford & IBH Publishing Co., New Delhi, 1982, p. 226.

এল,এস, লেশনিক উল্লেখ করেন যে, “… The present Indus hydrography hardly holds out much promise in this regard, for traces of ancient irrigation canals, still partially visible in the last century are now wholly erased.” L.S. Leshnik, Land Use and ecological factors in prehistoric North-West India, in, South Asian Archaeology, ed., Norman Hammond, Published by Gerald Duckworth & Company Ltd., London, 1973,p. 70.

-------------------------------------------------------

পাতা : ৫৪

সম্প্রতি সরস্বতী নদীর প্রাচীন খাতের অধিকাংশই আবিষ্কৃত হয়েছে। এতে জানা যাচ্ছে যে, হিমালয়ের হিমবাহ থেকে উৎপত্তি হয়ে দক্ষিণে কচ্ছের রান হয়ে এর একটি জলধারা ক্যাম্বে উপসাগরে গিয়ে পড়ত। ক্যাম্বে উপসাগরে বিপুল পরিমাণ পলি সঞ্চয় হিমালয় থেকে উৎপত্তি হওয়া কোনো মহা-নদী দ্বারাই সম্ভব হতে পারে বলে পণ্ডিতরা মনে করেন। হিমালয় থেকে ক্যাম্বে উপসাগর পর্যন্ত এই নদী ১৬০০ কিলোমিটার পর্যন্ত দীর্ঘ ছিল। সরস্বতী নদী হরিয়ানা থেকে পাঞ্জাব ও রাজস্থান হয়ে কচ্ছের রান পর্যন্ত ডান ও বাম উভয় তীরে ৩০০ কিলোমিটার করে পলি ছড়িয়ে দিয়েছিল। কৃত্রিম উপগ্রহের প্রতিচ্ছবি থেকে সরস্বতী নদীর খাত হিমালয় থেকে গুজরাট পর্যন্ত তার সমস্ত গতিপথে গড়ে ৩ থেকে ৮ কিলোমিটার প্রশস্ত হিসাবে দেখা গেছে। এটি প্রমাণ করে যে, সরস্বতী নদী প্রাচীনকালে সিন্ধু নদীর চেয়েও প্রশস্ত ছিল। গুজরাটে সরস্বতী নদীর একটি সম্ভাব্য খাত সম্পর্কে মনে করা হয় যে, তা নাল সরোবর ধরে এগিয়ে সমুদ্র তীর ধরে প্রবাহিত হয়ে লোথাল ছাড়িয়ে রংপুর ও প্রভাস পটনের  (সোমনাথ) দিকে গেছে। তার ফলে দক্ষিণ অংশে ধোলাভিরা, সুরকোটডা ও লোথাল সরস্বতী নদীর একটি ধারা বরাবর অবস্থান করত বলে ধারণা করা হয়।

ঋগ্বেদে সরস্বতী নদীকে পবিত্র নদী বলা হয়েছে। এখন এই নদী নারা-ওয়াহিন্দা-হাকরা-ঘাগর নামে পরিচিত যার অনেকটাই শুকিয়ে গেছে। এই ধারা উপরের অংশে ঘাগর, সরস্বতী ও দৃষদ্বতী এবং মধ্যবর্তী ও নীচের অংশের একটি ধারা পূর্ব নারা খান নামে টিকে আছে। মনে করা হয় যে, ঘাগর নদী আদি হরপ্পান ও হরপ্পান পর্যায়ে প্রবাহমান ছিল কিন্তু চিত্রিত ধুসর মৃৎপাত্রের (PGW) পর্যায়ে তাকে আর প্রবাহিত হতে দেখা যায় না।  এসব বিষয় পর্যবেক্ষণ করে পণ্ডিতরা মনে করেন যে, উত্তর ও পশ্চিম রাজস্থানে ভূস্তরে পরিবর্তনের ফলে নদীর পরিবর্তিত স্রােতধারা আদি হরপ্পান পর্যায় থেকেই সেখানকার সমাজের উপর প্রভাব ফেলে। পাঞ্জাবেও ভূ-গঠনগত তথ্য থেকে জানা যায় যে, রাবি, বিপাশা ও শতদ্রু সব নদীর গতিপথেই বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটেছিল। দূর অতীতে রাবি আরো দক্ষিণে, মুলতানের কিছু নীচে বেলাব ও ঝিলাম-এর সঙ্গমস্থান থেকে প্রবাহিত হত। এক সময়ে বিপাশা নদী শতদ্রুতে সংযুক্ত না হয়ে একা সিন্ধু নদীতে গিয়ে পড়ত। উপগ্রহ থেকে পাওয়া ছবি থেকে এইসব প্রাচীন নদীপথের পরিষ্কার চিহ্ন দেখতে পাওয়া যায়। উপগ্রহ থেকে সিন্ধু, পাঞ্জাব, হরিয়ানা, রাজস্থান ও গুজরাটে বহু সংখ্যক তরঙ্গিত ধুসর ছায়া দেখতে পাওয়া যায় যা প্রাচীন খাল বা পরিত্যাক্ত খাল বলে বুঝা যায়।  এছাড়া ভূমি-ভিত্তিক জরিপে সিন্ধু প্রদেশে সিন্ধু নদী থেকে বেরিয়ে আসা খালের মত অনেক ভূ-অবনতি দেখতে পাওয়া যায়, যেগুলি এখন একেবারে শুকনা। দক্ষিণাঞ্চলের প্রধান নদীগুলি হল লুনি, বনস, সবরমতি, মাহি, নর্মদা, তাপ্তি ও গোদাবরি। কাথিয়াওয়াড় মালভূমিতেও প্রাচীন যুগের অনেক শুকনা খাতের চিহ্ন দেখা গেছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এগুলি ৬০ মিটার পর্যন্ত চওড়া।

-------------------------------------------------------

  এবিষয়ে ভিন্ন মতও আছে। অনেকে মনে করেন প্রাচীন ঘাগর-হাকরা সিন্ধু সভ্যতার সময়ে বর্ষজীবী জলধারা ছিল না। তবে আমরা মনে করি চোলিস্তান ও সন্নিহিত অঞ্চলে জনবসতির বিকাশ ও পরিত্যাগের সময় বিবেচনায় নিলে এই যুক্তি গ্রহণযোগ্য হয় না। আলোচনার জন্য দেখুনঃ Cameron A. Petrie, Ravindra N. Singh, Jennifer Bates, Yama Dixit, Charly A.I. French, David A. Hodell, Penelope J. Jones, Carla Lancelotti, Frank Lynam, Sayantani Neogi, Arun K. Pandey, Danika Parikh, Vikas Pawar, David I. Redhouse, and Dheerendra P. Singh, Adaptation to Variable Environments, Resilience to Climate Change: Investigating Land, Water and Settlement in Indus Northwest India, in, Current Anthropology, Volume 58, Number 1, 2017, p. 12.

দেখুনঃ Prem Kishore Saint, Paleohydrology of the Sindhu-Sarasvatī Civilization River Systems, in, Sindhu-Sarasvatī Civilization: New Perspectives, ed., Nalini Rao, 2014, p. 543.

-------------------------------------------------------

উপরের বর্ণনায় প্রাচীন যুগের প্রবাহমান জলধারার বা খালের চিহ্ন হিসাবে থেকে যাওয়া অসংখ্য খাত থেকে এই বিষয়টি অনুমান করা যায় যে, এগুলি আদি হরপ্পান ও হরপ্পান পর্যায়ের মানুষ কর্তৃক সেচের উদ্দেশ্যে নির্মিত খাল। এছাড়াও যমুনা নদীর খাত পরিবর্তন হয়ে পূর্ব দিকে সরে যাওয়া এবং শতদ্রু নদীর স্রােতধারা হাকরা-ঘাগর থেকে সরে গিয়ে পশ্চিমে সিন্ধু নদীর সাথে মিলিত হওয়াতেও আমরা অনুমান করতে পারি যে, নদীতে বাঁধ দিবার ফলেই এগুলি দীর্ঘকাল পর গতিপথ পরিবর্তন করে। আমাদের অনুমান আরো জোরালো হয় তখন যখন আমরা দেখি যে, হরপ্পান পর্যায়ে সরস্বতী নদী (অর্থাৎ আজকের ঘাগর-হাকরা নদী) প্রবাহমান ছিল, কিন্তু হরপ্পান সভ্যতা ক্ষয়ের পর ঘাগর-হাকরা বা সরস্বতী নদী শুকিয়ে যায়।

প্রত্নতাত্ত্বিক খননে মহেঞ্জো-দাড়োর দক্ষিণে আমরি এবং চানহু-দাড়োতে ব্যাপক বন্যার সাক্ষ্য পাওয়া গেছে।  মহেঞ্জো-দাড়োতে বহু-স্তর বিশিষ্ট পলির এবং বহু স্তরে ঘর-বাড়ীর পুনর্নির্মাণ থেকে পণ্ডিতরা অনুমান করেন যে, সেখানে কমপক্ষে পাঁচ বার দীর্ঘ মেয়াদী ও ব্যাপক ক্ষতিকর বন্যা হয়েছিল। এই বন্যার স্থিতি ও অনুপস্থিতির চক্রটি ১০০ বছরের বেশী হতে পারে। এই বন্যার ফলে মহেঞ্জো-দাড়োর উজানে বিশাল এক হ্রদ সৃষ্টি হয়। পণ্ডিতরা মনে করেন, ভূমিকম্পের কারণে ভূ-উন্নতি ঘটেছিল, ফলে সিন্ধু নদীর প্রবাহ রুদ্ধ হয়, যার ফলশ্রুতি হল মহেঞ্জো-দাড়োর দীর্ঘ মেয়াদী বন্যা।

-------------------------------------------------------

দেখুনঃ George F. Dales, The Decline of the Harappans, in, Ancient Cities of the Indus, 1979, p. 309.

  দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ৩১১।

-------------------------------------------------------

মহেঞ্জো-দাড়োতে কমপক্ষে পাঁচ বার হওয়া এই বন্যা মহেঞ্জো-দাড়োর দক্ষিণে সিন্ধু নদীতে দেওয়া বাঁধের ফলে হয়েছিল বলে বলে ধারণা করা যায়। প্রচলিত মত অনুযায়ী ভূমিকম্পের ফলে মহেঞ্জো-দাড়োর উজানে ভূমির উচ্চতা বৃদ্ধি একই স্থানে পাঁচবার হবার যুক্তি সংগত কারণ নাই। মহেঞ্জো-দাড়োর উজানে হ্রদ সৃষ্টির মত সিন্ধু ও শতদ্রু নদীর উপরের অংশে ভূ-তত্ত্ববিদরা হ্রদ থাকার বিষয়ে প্রমাণ পেয়েছেন। রবার্ট রেইকস্ তাঁর লেখায় বালুচিস্তানের মকরান উপকূলে প্রাগৈতিহাসিক যুগে ভূপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন যে, এই উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে বালুচিস্তানের নিন্দোওয়ারী জলের উৎস থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় ও ফলে বসতিটি পরিত্যক্ত হয়।

-------------------------------------------------------

দেখুনঃ Robert L. Raikes, The End of the Ancient Cities of the Indus, in, Ancient Cities of the Indus, 1979, p. 303.

-------------------------------------------------------

এক দল গবেষক প্রত্ন-জলবায়ুবিদ্যা (Archaeoclimatology) ব্যবহার করে দেখিয়েছেন যে, হরপ্পা অঞ্চলে সিন্ধু অববাহিকার উপরের অংশে নদীগুলিতে প্রায় ৩৫০০ খ্রীঃপূঃ-এর দিকে শীতকালীন বৃষ্টিপাত ও জলপ্রবাহ বেড়ে গিয়েছিল, যার ফলে কৃষির বিকাশ ঘটেছিল।  এরপর ২১০০ খ্রীঃপূঃ-এর দিকে নদীর প্রবাহ কমে যাওয়া শুরু করে কিন্তু শীতকালীন বৃষ্টিপাত বেড়ে যায়। গবেষণায় আরো দেখা গেছে যে, ২০০০ খ্রীঃপূঃ-এর দিকে হরপ্পা বসতিটির ঠিক সংলগ্ন অঞ্চলে রাবি নদীর উত্তর দিকে সরে যাওয়ার মধ্য দিয়ে বিভিন্ন খালের প্রবাহ পথের পুনর্বিন্যাস ঘটে।

-------------------------------------------------------

 দেখুনঃ Rita P. Wright, Reid A. Bryson & Joseph Schuldenrein, Water supply and history: Harappa and the Beas regional survey, in, Antiquity 82, 2008, pp. 37, 38, 43-45.

দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ৪৫।

-------------------------------------------------------

একটি বিষয় তাৎপর্যপূর্ণ যে, বৃহত্তর সিন্ধু উপত্যকায় নদীর গতিপথ পরিবর্তন, বাঁধের উপস্থিতি, দীর্ঘ জলাবদ্ধতা বা হ্রদ সৃষ্টি, বন্যা, নদীর শুকিয়ে যাওয়া এসবই প্রধানত হরপ্পান পর্যায়ে বা এর শেষের দিকে ঘটেছে। এ থেকে এই ধারণা আরো দৃঢ় হয় যে, সমস্ত ঘটনাই নদীর প্রবাহের পথে মানুষ কর্তৃক কৃষিতে সেচের উদ্দেশ্যে বাঁধ নির্মাণের ফলে ঘটেছিল।  আবার কৃষিতে এই কৃত্রিম বাঁধ ভিত্তিক সেচব্যবস্থার উপর নির্ভরশীল কৃষিব্যবস্থার ফলেই সিন্ধু সভ্যতার সমৃদ্ধি ঘটে ও এতে বিপুল সংখ্যক বসতিতে বিপুল সংখ্যক মানুষের খাদ্যের যোগান দেওয়া সম্ভব হয়েছিল।

আগে যেমন দেখেছি হরপ্পান নগরগুলিতে ব্যবহৃত জল ও পয়ঃনিষ্কাশনের জন্য এক সমন্বিত ও জটিল ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হয়েছিল, যার জন্য নিঃসন্দেহে ছিল ব্যাপক পরিকল্পনা, এবং ছিল এগুলি নির্মাণে কারিগরী সামর্থ্য ও সমস্ত ব্যবস্থাকে সচল রাখার জন্য রক্ষণাবেক্ষণ করার মত মানসিকতা।  গবেষক হিদার মিলার মন্তব্য করেছেন যে, সিন্ধু উপত্যকায় ছোট নালা-ভিত্তিক সেচ ব্যবস্থাকে গড়ে তুলার জন্য একই ধরনের কারিগরী জ্ঞান ও ব্যবস্থাপনাগত সামর্থ্য থাকা প্রয়োজন ছিল। হরপ্পান কৃষকরা বাৎসরিক বন্যাকে কাজে লাগাতে বা নদীর প্রবাহ থেকে জল নিবার জন্য ছোট আকারের নালা-ভিত্তিক সেচ ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল বলে তিনি মনে করেন।  যদিও তাঁর ধারণা বড় আকারের খাল-ভিত্তিক সেচ-ব্যবস্থা থাকার সম্ভাবনা কম।

-------------------------------------------------------

দেখুনঃ Heather M.-L. Miller, Water Supply, Labor Requirements, and Land Ownership in Indus Floodplain Agricultural Systems, in, Agriculture and Irrigation in Arachseology, ed., Charles Stanish and Joyce Marcus, Cotsen Institute of Archaeology Press, Los Angeles, p. 107.

  দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ১০৮।

-------------------------------------------------------

আমরা মনে করি সিন্ধু সভ্যতার বিপুল সংখ্যক বসতিতে বাসকারী এত মানুষের গ্রাসাচ্ছাদন ও সমৃদ্ধি উন্নত সেচ ব্যবস্থা ছাড়া সম্ভব ছিল না। এই সেচ ব্যবস্থা কেবলমাত্র নদীতে বাঁধ দিয়ে ও খালের সাহায্যে কৃষিভূমিতে জল সরবরাহ করার মাধ্যমে সম্ভব হয়েছিল।

আমরা উপরের আলোচনায় দেখেছি, সমগ্র বালুচিস্তান জুড়ে ও পশ্চিম সিন্ধু প্রদেশে প্রবাহমান নদীর উপর বাঁধ পাওয়া গেছে। এই বাঁধগুলি হরপ্পান ও তারও আগের যুগে তৈরী করা হয়েছিল জল সঞ্চিত করে কৃষির উৎপাদন বৃদ্ধি করার জন্য। এই বাঁধগুলি নদীর উপর আড়াআড়িভাবে নির্মাণ করা হয়েছিল। আমরা অনুমান করি, বৃহত্তর সিন্ধু উপত্যকার অন্যান্য অঞ্চলেও একইভাবে নদীগুলিকে বাঁধভিত্তিক সেচ ব্যবস্থার আওতায় আনা হয়েছিল। ধারণা করা যায় যে, বৃহত্তর সিন্ধু উপত্যকার অন্যান্য অঞ্চলে যে সমস্ত বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছিল তার সবগুলিই বাৎসরিক প্রবল ঢলে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে অথবা দীর্ঘকাল পলি সঞ্চয়ের ফলে এগুলি পলির তলায় চাপা পড়ে গেছে বলে এগুলির আর কোনও চিহ্ন পাওয়ার সহজ উপায় নাই। তবে এই অঞ্চলে ব্যাপক ভিত্তিক অনুসন্ধান পরিচালনা করলে কিছু বাঁধের অবশেষ পাওয়া যেতে পারে।

পাতা : ৫৫

 আমাদের অনুমান সমগ্র সিন্ধু সভ্যতার প্রাণশক্তির উৎস ছিল এই বাঁধভিত্তিক সেচব্যবস্থা। সভ্যতার সূচনায় শান্তিপূর্ণ পদ্ধতিতে ও সকলের সম্মতিতে এই বাঁধভিত্তিক নদীনিয়ন্ত্রণব্যবস্থা গড়ে তুলা হয়। কিন্তু তাকে রক্ষা করার জন্য ও এলাকাভিত্তিক জলবণ্টন নিয়ন্ত্রণ করার জন্য রাষ্ট্র কিছু কঠোর নিয়ম বেঁধে দিয়েছিল বলে মনে হয়। ধারণা করা যায় বিভিন্ন খালের মাধ্যমে সিন্ধুর রাষ্ট্র জলবণ্টন নিয়ন্ত্রণ করত। বৃহত্তর সিন্ধু উপত্যকায় বাঁধের অবশেষ পাওয়া না গেলেও কিছু খালের অবশেষ বা চিহ্ন পাওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। সেখানে উপগ্রহ থেকে পাওয়া ছবিতে সিন্ধু, পাঞ্জাব, হরিয়ানা, রাজস্থান ও গুজরাটে প্রাচীন খাল বা পরিত্যক্ত খালের তরঙ্গিত ধূসর ছায়া দেখতে পাওয়ার কথা বলা হয়েছে। এছাড়াও অরেল ষ্টেইন পাঞ্জাবে হরপ্পান বসতিসমূহের সমান্তরাল একটি খাল থাকার কথা উল্লেখ করেছিলেন। আমরা মনে করি এই সমস্ত বাঁধের সাথে জল প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য স্লুইস গেট থাকত যাতে অতিরিক্ত জল ভাটিতে ছেড়ে দেওয়া যায়, আবার বিভিন্ন খালের মুখেও জলপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য স্লুইস গেট থাকত যার ফলে প্রতিটি খালে কতটুকু জল সরবরাহ করা হবে তা নিয়ন্ত্রণ করা যায়।  নদীর প্রবাহের পথে বাধা সৃষ্টি করা হলে দীর্ঘকাল পর পলি সঞ্চয় জনিত সমস্যা সৃষ্টি হওয়া সম্ভব। এর ফলে স্লুইস গেট অকার্যকর হতে পারে ও জল সরবরাহে সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। আমরা অনুমান করি নদীনিয়ন্ত্রণ ভিত্তিক সেচ ব্যবস্থার ফলে এক সময় পলি সঞ্চিত হওয়ায় সেচ ব্যবস্থায় সংকট শুরু হয় ও কৃষির উৎপাদন কমে যায়।

-------------------------------------------------------

  মেগাস্থিনিস পরবর্তীকালে ভারতবর্ষে প্রধান খাল থেকে শাখা খালে সমপরিমাণ জল সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য ¯øইস সমূহ রাষ্ট্র কর্তৃক পরিদর্শন করার কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, ‘Of the great officers of state, some have charge of the market, others of the city, others of the soldiers. Some superintend the rivers, measure the land, as is done in Egypt, and inspect the sluices by which water is let out from the main canals into their branches, so that every one may have an equal supply of it.’ দেখুনঃ John W. McCrindle, Ancient India as described by Megasthenês and Arrian, Munshiram Manaharlal Publishers Pvt. Ltd., New Delhi, Reprinted 2015, P. 86.  

আমরা অনুমান করি মেগাস্থিনিসের সময়ে রাষ্ট্র কর্তৃক কৃষিভূমিতে খালের মাধ্যমে জলসেচের জন্য স্লুইসের সাহায্যে এই নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি সিন্ধু সভ্যতার ঐতিহ্য থেকে এসেছিল।

-------------------------------------------------------

শত শত বৎসর ব্যাপী নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার মাধ্যমে জলসেচের অপর একটি কুফলকে আমাদের হিসাবে নেওয়া দরকার, সেটি হল ভূমির লবণাক্ততা বৃদ্ধি, যার ফল আবার ফলন হ্রাস। একই জমিতে দীর্ঘকাল জলসেচের মাধ্যমে চাষাবাদে এই সমস্যা দেখা দিতে পারে।  যেখানে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয় সেখানে এই সমস্যা কম হতে পারে, কারণ বৃষ্টির জল নদীর জলবাহিত লবণকে ভূমি থেকে ধুয়ে নিয়ে যায়। শীতকালে যেসব অঞ্চল বরফাচ্ছাদিত হয় সেইসব অঞ্চলের জন্যও ভূমির লবণাক্ততার এই সমস্যা কম হতে পারে। কারণ বরফ যখন গলে তখন ভূমিতে সঞ্চিত লবণাক্ততাকে বরফগলা জল ধুয়ে নিতে পারে। কিন্তু শুষ্ক অঞ্চলে জলসেচের মাধ্যমে কৃষিকাজের ক্ষেত্রে এই সমস্যা থেকে যায়।

-------------------------------------------------------

প্রাচীন মেসোপটেমিয়ায় একই ভূমিতে দীর্ঘকাল জলসেচের ফলে লবনাক্ততা বৃদ্ধি ও এর ফলে ফসল উৎপাদন কমে যাবার কথা গবেষকরা উল্লেখ করেছেন। গবেষক সুসান পোলোক বলছেন, ‘Irrigation has also led to unintended modifications of the landscape. Today large areas of alluvial Mesopotamia appear as vast, salty waste-lands, defying attempts to grow by all but the most salt-tolerant plants. This salinization can be traced to the waters of the Tigris and Euphrates, which contain very small amounts of salts derived from the sedimentary rock through which they flow in their northern reaches. Over the millennia these salts have accumulated in the groundwater, which has become very highly saline. The saline groundwater becomes a problem when the water table rises with repeated application of irrigation water, floods, or heavy rain. At that point, the salts, too, rise through capillary action and accumulate in the upper layers of the soil. The propensity towards salinization is exacerbated by the low gradient of the land and generally poor drainage.’ দেখুনঃ Susan Pollock, Ancient Mesopotamia: The Eden that Never Was, Cambridge University Press, Cambridge, 1999, p. 37.  

-------------------------------------------------------

সিন্ধু সভ্যতার অন্তর্ভুক্ত অঞ্চলের দিকে দৃষ্টি দিলে আমরা সহজেই এই বিশাল শুষ্ক অঞ্চলে সুদীর্ঘ কালব্যাপী কৃত্রিম জলসেচের পারণতিতে ভূমির লবণাক্ততার ফলাফল সম্পর্কেও ধারণা করতে পারি। ভূমির লবণাক্ততা বৃদ্ধি জমির ফলনশক্তি হ্রাস করতে বাধ্য। অর্থাৎ একদিকে নদীর স্রােতধারা নিয়ন্ত্রণের ফলে নদীখাতে পলিসঞ্চয়, এবং অপর দিকে সঞ্চিত জলরাশি দ্বারা সুদীর্ঘ কাল সেচের ফলে ভূমির লবণাক্ততা বৃদ্ধি সিন্ধু সভ্যতাকে গভীর সঙ্কটে ফেলে। এভাবে যে নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ছিল সভ্যতার প্রাণশক্তির উৎস তা-ই পরিণত হল তার বিপর্যয় ও ধ্বসের কারণে।

এই রকম পরিস্থিতিতে বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের মধ্যে বাঁধভিত্তিক সেচ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ক্ষোভ তৈরী হতে থাকে। তারা তাদের সকল কষ্ট ও দুর্গতির জন্য বাঁধকে দায়ী করে এবং সমস্যা সমাধানের জন্য বাঁধকে ধ্বংস করতে চায়। এই সময়ে বাঁধের নির্মাতা সিন্ধু সভ্যতার শাসকশ্রেণীও দ্বিধা বিভক্ত হয়ে যায়। তাদের একটি পক্ষ বিরোধী পক্ষকে অর্থাৎ বাঁধের বিরুদ্ধ পক্ষকে সমর্থন দেয় ও অপর পক্ষ বাঁধের পক্ষে থাকে। এই সমগ্র প্রক্রিয়াটি সেই যুগের প্রেক্ষিতে বিবেচনায় নিলে দীর্ঘকাল ধরে ঘটেছিল বলে ধারণা করা যায়।

তবে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে আমাদের বিবেচনায় নিতে হবে। সেটি হল সিন্ধু সভ্যতার নির্মাতারা নিরীশ্বরবাদী কিংবা ধর্মমুক্ত চেতনার অধিকারী হলেও জনসাধারণের একটি পশ্চাৎপদ অংশ নানান ধরনের ধর্মবিশ্বাস ও প্রথা দ্বারা প্রভাবিত ছিল। এরা যে কোনও বৃহৎ শক্তি বা নির্মাণকে অলৌকিক রূপ দিতে চাইত। সুতরাং তাদের কল্পনায় নদীর যেমন দৈব শক্তি থাকতে পারত তেমন তারা নদীকে আবদ্ধকারী বাঁধেরও দৈব শক্তি তথা দেবতার অস্তিত্ব কল্পনা করতে পারত। এভাবে নদীনিয়ন্ত্রণব্যবস্থা যে তাদের ধর্মবিশ্বাসের অংশে পরিণত হয়েছিল ঋগ্বেদ সেই সাক্ষ্যই দেয়। নদীনিয়ন্ত্রণব্যবস্থার সংকট বৃদ্ধির সঙ্গে রাষ্ট্রে শাসকদেরও সম্ভবত  তার সপক্ষে জনমত রক্ষার জন্য এই ধরনের ধর্মবিশ্বাসকে কম বা বেশী পৃষ্ঠপোষকতা দিতে হয়েছে। কিন্তু নদীনিয়ন্ত্রণব্যবস্থার সংকট বৃদ্ধি পাচ্ছিল। ফলে বৃদ্ধি পাচ্ছিল সভ্যতার সংকট। এমন অবস্থায় সমাজে ধর্মের প্রভাব যেমন বৃদ্ধি পাচ্ছিল তেমন শাসকদেরও ধর্মকে পৃষ্ঠপোষকতা বা সমর্থন করার প্রয়োজন বৃদ্ধি পাচ্ছিল। এভাবে সমাজে জনসাধারণের এক বৃহৎ অংশের মধ্যে ধর্মের প্রভাব বিস্তৃত হয় বলে আমরা ধারণা করি।

এই রকম অবস্থায় বিদ্যমান ধর্মবিশ্বাসের অংশ হওয়ায় নদীনিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে জনমতকে নিতে হলে বিদ্যমান ধর্মের সংস্কারের প্রয়োজন দেখা দেয়। এর ফলে দেবতায় উন্নীত বাঁধের দেবতা বা দেবতাসমূহ অপদেবতা বা দানব রূপে চিত্রিত হবে। তখন নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ধ্বংসের আন্দোলনে যোগদানের সপক্ষে জনগণের অন্তত একটি বৃহৎ অংশ ধর্মীয় দৃষ্টি থেকেও যৌক্তিকতা ও প্রেরণা খুঁজে পাবে। এটা বুঝা যায় যে, নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার বিপর্যয়ের ফলে সভ্যতার এক বৃহৎ অঞ্চল ভয়ানকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল এবং এর ভার সবচেয়ে বেশী বহন করতে হয়েছিল নগরবাসীদের তুলনায় গ্রামীণ কৃষকদেরকে।

বিশেষত এই কৃষকদের চাওয়াকে ভাষায় রূপ দিতে এগিয়ে আসে বিদ্যমান ধর্মের পুরোহিত শ্রেণীর একটা অংশ। তারা আর সব নূতন ধর্ম প্রবতর্কের মত বিদ্যমান ধর্মকে এমনভাবে সংস্কার করে যে, পুরাতন ধর্মের ভিতর থেকেই ক্রমশ নূতন একটি ধর্ম বেরিয়ে এল। ঋগ্বেদ হল পুরাতন ধর্মের ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত সেই নূতন ধর্মের মন্ত্রসমূহের সংকলন।

আমরা ঋগ্বেদ থেকে এমন অসংখ্য মন্ত্র পাই যেখানে ইন্দ্র কর্তৃক বৃত্রকে হত অথবা বধ করার কথা বলা হয়েছে। এখানে বলে রাখা ভাল যে, ঋগ্বেদে বৃত্র অর্থ জলরোধক করা হয়েছে। ঋগ্বেদের ঋষিদের রচিত মন্ত্রসমূহ থেকে জানা যায়, ঋগ্বেদের প্রধান দেবতা ইন্দ্র বৃত্রকে বধ করার ফলে বহুকাল অবরুদ্ধ করে রাখা নদীসমূহের জল ভাটিতে বা নিম্নপথে প্রবাহিত হয়েছিল। তবে একবার বাঁধ ধ্বংস করলে সেচ ব্যবস্থা অকার্যকর হয়ে যায়, ফলে সেচের উপর নির্ভরশীল বসতি বা বসতিসমূহের লোকজনের স্থানান্তর গমন করা ছাড়া উপায় থাকে না। এর ফলে সভ্যতারও পতন ঘটে। বালুচিস্তানে হরপ্পান যুগের বক্কর বুথি নামে একটি বসতির কাছে নির্মিত দুদ্দার বাঁধের ক্ষতিগ্রস্ত হবার সাথে বসতিটির লোকজনের স্থানান্তর গমনের সম্ভাবনার কথা গবেষক উয়েলি ব্রুনের উল্লেখ করেছেন।

-------------------------------------------------------

বালুচিস্তানের হরপ্পান যুগের বসতি বক্কর বুথি থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে কনরাচ নদীর ডান দিকে দুদ্দার বাঁধ নামে একটি বাঁধ সম্পর্কে গবেষক উয়েলি ব্রুনেরের পর্যবেক্ষণ গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলছেন, ‘The natural preconditions in this area were, thus, reasonably favourable: There was a perennial river with regular floods and a furtile plain. With the construction of the Duddar Dam the soil of the plain received enough water to grow a yield. Bakkar Buthi and the Duddar Dam are built on the same level of an earlier landscape. They form a functional unit and most likely belong to the same time period, namely the second half of the 3rd millennium BC.

Based on the geomorphic situation in the area the following assumptions can be made. The eclipse of this sustainable agaricultural system must have come suddenly and as a catastrophic event, when the narrow rocky ridge between the artificial lake and the low-lying second meander to the immediate west of Bakkar Buthi was eroded. At once the whole lake water poured down this new and steep river bed. The top layer of fine sediments in the lake area was dissected by gullies and the fertile silt was partly washed away, leaving a rugged surface similar to the badlands. Probably this large-scale damage could not be restored until the next crop season, although the most prominent structure, the gabarband, was still intact. So, the inhabitants might eventually have left this formally fertile oasis. Such an exodus might coincide quite well with the archaeological evidence that Bakkar Buthi flourished only between 2400-2200 BC and that it was left without any obvious reason.’  দেখুনঃ Ueli Brunner, Notes on gabarbands in Balochistan, in, Archäologische Mitteilungen aus Iran und Turan, pp. 113-114.    

-------------------------------------------------------

পাতা : ৫৬

বৈদিক আন্দোলনের মূল বিষয় ছিল প্রতিপক্ষের বাঁধ তথা নদীনিয়ন্ত্রণব্যবস্থা ধ্বংস করা। বৃত্র বা বাঁধ কর্তৃক নদীর জল দীর্ঘকাল রুদ্ধ করে রাখা ও অবশেষে ইন্দ্র কর্তৃক বৃত্র ধ্বংস করে অবরুদ্ধ জলকে প্রবাহিত করার বিষয়টি বিভিন্ন মন্ত্রে নানা উপমা ও রূপক ব্যবহার করে বর্ণনা করা হয়েছে। বিষয়টিকে স্পষ্ট করার জন্য নীচে ঋগ্বেদের  কয়েকটি মন্ত্রের উল্লেখ করা হলঃ

-------------------------------------------------------

  এই গ্রন্থে ঋগ্বেদের সকল উদ্ধৃতি নেওয়া হয়েছে, রমেশচন্দ্র দত্ত অনুদিত, ঋগ্বেদ-সংহিতা, প্রথম খণ্ড, হরফ প্রকাশনী, কলকাতা, ১৯৭৬, এবং রমেশচন্দ্র দত্ত অনুদিত, ঋগ্বেদ-সংহিতা, দ্বিতীয় খণ্ড, হরফ প্রকাশনী, কলকাতা, ১৯৭৬ থেকে।

-------------------------------------------------------

‘২। যখন যজ্ঞান্নপ্রিয় ইন্দ্র জল বর্ষণ করে নদীপ্রতিরোধকারী বৃত্রকে হত করলেন, তখন তিনি ধারাবাহী জলের মধ্যে পর্বতের ন্যায় অচল হয়ে লোকদের সহস্ররূপে রক্ষা করে প্রভূত বলপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। ... ৬। জল রুদ্ধ করে যে বৃত্র অন্তরীক্ষের উপরিপ্রদেশে শয়ান ছিল এবং অন্তরীক্ষে যার ব্যাপ্তি অসীম, হে ইন্দ্র! যখন তুমি সে বৃত্রের হনুদ্বয় শব্দায়মান বজ্রদ্বারা আঘাত করেছিলে তখন তোমার শত্রু বিজয়িনী দীপ্তি বিস্তৃত হয়েছিল এবং তোমার বল প্রদীপ্ত হয়েছিল।’ (১/৫২)

‘হে ইন্দ্র! তুমি বৃত্র কর্তৃক সমাচ্ছাদিত নদী সকলের প্রকাণ্ড বারিরাশি উন্মুক্ত করেছ; তুমি জলরাশি মুক্ত করেছ। তুমি সে সমস্ত নদীকে নিম্নপথে প্রবাহিত করেছ; তুমি বেগবান জলরাশিকে সমুদ্রে নিয়ে গিয়েছ।’ (৬/১৭/১২)

‘যখন বার বার সোম পান করে ইন্দ্র মত্ত হন তখন তিনি গ্রহণ করবার উপযুক্ত উত্তম উত্তম ধন গ্রহণ করতে থাকেন। তিনি তখন বৃষ্টিবর্ষণকারী বজ্রকে ধারণপূর্বক জলের রোধকর্তা বৃত্রকে পরাজয় করেন।’ (৯/১০৬/৩)

‘৮। হে ইন্দ্র! অতি চমৎকার ও অপ্রতিহত গতিযুক্তা সাত নদী আছে, তুমি সে নদীযোগে শত্রুপুরী ভেদ করে সিন্ধু পার হলে। তুমি দেব মনুষ্যের উপকারার্থে নবনবতি নদীর পথ পরিষ্কার করে দিয়েছ। ৯। তুমি জলসমূহের আচ্ছাদন খুলে দিয়েছ, তুমি একাকী উল্লিখিত জল আনার জন্য মনোযোগী হয়েছিলে। হে ইন্দ্র! বৃত্রবধ উপলক্ষ্যে তুমি যে সকল কার্য করেছ তা দিয়ে সকল সংসারের শরীর পোষণ করেছ।’ (১০/১০৪)

‘৬। হে ইন্দ্র! তুমি বৃত্রনিধনকারী, বজ্রদ্বারা বৃত্রকে বধ করেছ, দেববিরোধী সে বৃত্র যখন বৃদ্ধি পাচ্ছিল, তখন দুর্ধর্ষ তুমি বজ্রদ্বারা তার সকল মায়া নষ্ট করলে। হে ধনশালী! তৎপর তুমি বাহুবলে বলী হলে। ... ৮। ইন্দ্রের আজ্ঞায় যে সকল জল প্রবাহিত হল, সেই সর্ব প্রথম জলগুলি অতি দূরে গিয়েছিল, সে জলদের অগ্রভাগই বা কোথায়? মস্তকই বা কোথায়? হে জলগণ! তোমাদের মধ্যস্থান বা চরম সীমা কোথায়? ৯। হে ইন্দ্র! বৃত্র যখন জলদের গ্রাস করেছিল, তুমি তাদের মোচন করে দিলে। তখনই জলগুলি সর্বত্র বেগে ধাবিত হল। ইন্দ্র ইচ্ছাপূর্বক যখন জল মোচন করে দিলেন, তখন সে পরিশুদ্ধ জল সকল আর স্থির থাকতে পারল না। ১০। জলগণ যেন কামাতুর হয়ে একত্র মিলনপূর্বক সমুদ্রে চলল, শত্রুপুরধ্বংসকারী এবং শত্রুজর্জ্জরকারী ইন্দ্র চিরকালই এ জলের প্রভু হয়ে আছেন।’ (১০/১১১)

‘৪। ইন্দ্র জন্মমাত্র শত্রু দমন করেছিলেন, তিনি যুদ্ধের অভিসন্ধি করে আপনার পুরুষকার বৃদ্ধির দিকে মনোযোগ দিলেন। তিনি বৃত্রকে ছেদন করলেন, জলসমূহ মোচন করে দিলেন, উত্তম উদ্যোগ করে বিস্তীর্ণ স্বর্গলোককে স্তম্ভযুক্ত করলেন অর্থাৎ উন্নতভাবে সংস্থাপিত রাখলেন। ... ৬। ইন্দ্র নানা শব্দ করছিলেন, শত্রুদের নিধন করছিলেন, তাঁর বলবিক্রম ঘোষণা করবার জন্য জল সকল নির্গত হল। বৃত্র অন্ধকারে পরিবেষ্টিত হয়ে জল ধারণ করে রেখেছিল, তীক্ষ্ণতেজা ইন্দ্র বলপূর্বক সে বৃত্রকে ছেদন করলেন। ৭। ইন্দ্র ও বৃত্র পরষ্পর স্পর্ধাপূর্বক প্রথমে নানা বীরত্ব করতে লাগলেন এবং মহারোষে যুদ্ধ করতে লাগলেন। বৃত্র নিধন হলে গাঢ় অন্ধকার নষ্ট হল।’ ... (১০/১১৩)

এই ঘটনাটিকে বর্ণনা করার জন্য ঋগ্বেদে নানা উপমা ও রূপক ব্যবহার করায় কোনও কোনও ক্ষেত্রে উপমা থেকে বাস্তব ঘটনা বুঝতে বেগ পেতে হয়। সিন্ধু সভ্যতা শান্তিপূর্ণ ছিল বলে ধর্মের সংস্কার সাধন করে জনসাধারণকে যুদ্ধের পক্ষে নিতে গিয়ে গৌণ বা আঞ্চলিক যুদ্ধ দেবতা ইন্দ্রকে প্রাধান্যে আনা হয়। স্বাভাবিকভাবে প্রাচীন যুগে ধর্মবিশ্বাসী মানুষ কোনো বড় বা কঠিন কাজ সম্পন্ন করলে তার কৃতিত্ব কোনো দেবতাকে দিত। অথবা দেবতার নামে সেই কাজ সম্পন্ন করত। বৈদিক পক্ষের যোদ্ধাদের বাঁধ ধ্বংস ও শত্রুর প্রতীকী নগর বা বসতি ধ্বংস ও শত্রু নিধনও তাই দেবতা ইন্দ্রের নামে করা হয়েছিল।

ঋগ্বেদের বিভিন্ন জায়গায় বৃত্রকে অহি বলা হয়েছে। অহি অর্থ হল সাপ। আমরা আগের অধ্যায়ে দেখেছি বালুচিস্তানে পাওয়া কিছু বাঁধ কিছুটা বাঁকাভাবে অনেকটা ইংরাজী ‘এল’ আকৃতি করে নির্মাণ করা হয়েছিল। হতে পারে ভূমির উপর সাপের মত এই বাঁকাভাবে অবস্থান থেকে তাকে সাপের মত লাগত বলে কখনো কখনো বৃত্রকে অহি বলা হয়েছে। আবার এমনও হতে পারে যে, আরো প্রাচীন কোনো সাপ বা অহি কেন্দ্রিক উপকথা থেকে ঋগ্বেদে বাঁধের জন্য অহি নাম গ্রহণ করা হয়েছে। তবে অহি আর বৃত্র যে একই তা বুঝা যায়। যেমন,

‘ইন্দ্র অতিবৃহৎ এক জলপূর্ণ মেঘের মস্তক বিদীর্ণ করলেন। অহি অর্থাৎ বৃত্রকে বধ করলেন, সপ্ত সিন্ধু বইয়ে দিলেন। হে দ্যাবাপৃথিবী! দেবতাদের সাথে আমাদের রক্ষা কর।’ (১০/৬৭/১২)

‘২। হে মনুষ্যগণ! যিনি অহিকে বিনাশ করে সপ্তসংখ্যক নদী প্রবাহিত করেছিলেন ... তিনিই ইন্দ্র ...’ (২/১২/৩)।

‘১। বজ্রধারী ইন্দ্র প্রথমে যে পরাক্রমের কর্ম সম্পাদন করেছিলেন, তাঁর সে কর্মসমূহ বর্ণনা করি। তিনি অহিকে (মেঘকে) হনন করেছিলেন, তৎপর বৃষ্টি বর্ষণ করেছিলেন, বহনশীল পর্বতীয় নদী সমূহের (পথ) ভেদ করে দিয়েছিলেন। ২। ইন্দ্র পর্বতাশ্রিত অহিকে হনন করেছিলেন; ত্বষ্টা ইন্দ্রের জন্য সুদূরপাতী বজ্র নির্মাণ করেছিলেন; তারপর যেরূপ গাভী সবেগে বৎসের দিকে যায়, ধারাবাহী জল সেরূপ সবেগে সমুদ্রাভিমুখে গমন করেছিলেন। ৩। ইন্দ্র বৃষের ন্যায় বেগের সাথে সোম গ্রহণ করেছিলেন; তিন প্রকার যজ্ঞে অভিযুত সোম পান করেছিলেন; মঘবান সায়ক বজ্র গ্রহণ করেছিলেন; ও তা দিয়ে অহিদিগের মধ্যে প্রথম জাতকে হনন করেছিলেন। ৪। যখন তুমি অহিদিগের মধ্যে প্রথম জাতকে হনন করলে, তখন তুমি মায়াবীদিগের মায়া বিনাশ করার পর সূর্য ও ঊষাকাল ও আকাশকে প্রকাশ করে আর শত্রু রাখলে না। ৫। জগতের আবরণকারী বৃত্রকে ইন্দ্র মহাধ্বংসকারী বজ্র দ্বারা ছিন্নবাহু করে বিনাশ করলেন, কুঠারছিন্ন বৃক্ষস্কন্ধের ন্যায় অহি পৃথিবী স্পর্শ করে পড়ে আছে। ৬। দর্পযুক্ত বৃত্র আপনার সমতুল্য যোদ্ধা নাই মনে করে মহাবীর ও বহুবিনাশী ও শত্রুবিজয়ী ইন্দ্রকে যুদ্ধে আহ্বান করেছিলেন। ইন্দ্রের বিনাশকার্য হতে রক্ষা পেল না। ইন্দ্রশত্রু বৃত্র নদীতে পতিত হয়ে নদীসমূহকে পিষ্ট করে ফেলল। ৭। হস্ত-পদ-শূন্য বৃত্র ইন্দ্রকে যুদ্ধে আহ্বান করল, ইন্দ্র তার সানু তুল্য প্রৌঢ় স্কন্ধে বজ্র আঘাত করলেন; যেরূপ পুরুষত্বহীন ব্যক্তি পুরুষত্ব সম্পন্ন ব্যক্তির সাদৃশ্য লাভ করতে বৃথা যত্ন করে, বৃত্রও সেরূপ বৃথা যত্ন করল; বহুস্থানে ক্ষত হয়ে বৃত্র ভূমিতে পড়ল। ৮। ভগ্নকূলকে অতিক্রম করে নদ যেরূপ বয়ে যায়, মনোহর জল সেরূপ পতিত বৃত্রদেহকে অতিক্রম করে যাচ্ছে; বৃত্র জীবদ্দশায় নিজ মহিমাদ্বারা যে জলকে বদ্ধ করে রেখেছিল, অহি এখন সে জলের নীচে শয়ন করল। ... ১২। হে ইন্দ্র! যখন সেই এক দেব বৃত্র তোমার বজ্রের প্রতি আঘাত করেছিল, তখন তুমি অশ্বপুচ্ছের ন্যায় হয়ে আঘাত নিবারণ করেছিলে; তুমি গাভী জয় করেছ, সোমরস জয় করেছ এবং সপ্তসিন্ধু প্রবাহ ছেড়ে দিয়েছ।’ (১/৩২)

‘এ মদকর সোমে আনন্দিত হয়ে ইন্দ্র হস্তে বজ্রধারণ করে জলের আবরক অহিকে ছেদন করেছিলেন। তখন প্রীতিকর জলরাশি পক্ষীগণ যেরূপ কুলায়াভিমুখে যায়, সেরূপ সমুদ্র অভিমুখে গমন করতে লাগল।’ (২/১৯/২)

‘২। বস্তুত হে ইন্দ্র! স্তোতৃবর্গ স্তোত্রদ্বারা সূর্যের ন্যায় তোমাতে সমস্ত বল অর্পণ করেছেন। হে ঋষীজ সোমপায়ী ইন্দ্র! তুমি বিষ্ণুর সাথে মিলিত হয়ে সে বলদ্বারা বারিনিরোধক অহি বৃত্রকে বধ করেছ।’ (৬/২০/২)

‘... যে অহি আপনাকে বলবান মনে করে জল পরিবেষ্টন করে অবস্থিতি করেছিল, সে অহিকে তুমি প্রবুদ্ধ হয়ে বিনাশ করেছ। ’ (৩/৩২/১১)

‘৪। ... তুমি বারিরাশি নিরোধ করে শয়ান অহিকে সংহার করেছ এবং বারিরাশিকে সমুদ্রে পতিত হবার নিমিত্ত বিমুক্ত করেছ। ৫। তুমি নিরুদ্ধ বারিরাশিকে সর্বত্র প্রবাহিত হবার নিমিত্ত বিমুক্ত করেছ।’ (৬/৩১)

পাতা : ৫৭

উপরের সুক্তগুলি থেকে এটি পরিষ্কার যে, অহি বৃত্রেরই আরেক নাম, যা বৃত্রের মতই নদীর জলকে রোধ করেছিল। বৃত্র বা বাঁধ যেমন নদীর জলের মধ্যে শয়ান করে আছে বলে প্রাচীন মানুষের মনে হত তেমনি অহির ক্ষেত্রেও শয়ান করার কথা বলা হয়েছে। যেমন, ‘হে ধনবান ইন্দ্র! তুমি জলবিশিষ্ট দেশ সমূহকে লক্ষ্য করে, যে অহি শয়ন করেছিল, তাকে বজ্রদ্বারা ছিন্ন করেছ।’ (৪/১৭/৭), ‘হে ইন্দ্র! ... তুমি জলাভিমুখে পরিশয়ান অহিকে বধ করেছ, সকলের প্রীতিদায়িকা নদী সকল খনন করেছ।’ (৪/১৯/২), ‘... যিনি বল প্রকাশকারী অহিনামক শয়ান দানবকে বিনাশ করেছিলেন, তিনিই ইন্দ্র।’ (২/১২/১১), ইত্যাদি।

এছাড়াও এই প্রসঙ্গে আরো মন্ত্র পাওয়া যায়, ‘হে ইন্দ্র! যেহেতু তুমি দীপ্তিমান জলের আবরণকারী, দীপ্তিরহিত ও শয়ান বৃত্রকে যুদ্ধে নিহত করেছ। অতএব তুমি যুদ্ধকালে অশে^র ন্যায় জল ছেড়ে দিয়েছ।’ (৩/৩২/৬), ‘হে ইন্দ্র! তুমি অতৃপ্ত, শিথিলাঙ্গ, অজ্ঞান, অজ্ঞানভাবাপন্ন, সুপ্ত ও গমনশীল জলকে আচ্ছাদন করে শয়ান বৃত্রকে পৌর্ণমাসীর দিবসে বজ্রদ্বারা বধ করেছ।’ (৪/১৯/৩)

কখনও কোনো মন্ত্রে রূপক অর্থে বৃত্র দ্বারা অবরুদ্ধ জলাধারকে মেঘ বলা হয়েছে, আবার বৃত্র কর্তৃক রুদ্ধ জলকে গাভী বলা হচ্ছে। যেমন,

‘৮। হে ইন্দ্র! পূর্বকালে সকলের অগ্রে তুমি যে সকল বীরত্ব করেছিলে, তা আমি বর্ণনা করেছি। জলের জন্য তুমি মেঘ বিদীর্ণ করেছ, গাভীকে স্তোতার পক্ষে অনায়াসলভ্য করে দিয়েছ।’ (১০/১১২/৮)

‘ইন্দ্র পর্বতাশ্রিত অহিকে হনন করেছিলেন; ত্বষ্টা ইন্দ্রের জন্য সুদূরপাতী বজ্র নির্মাণ করেছিলেন; তারপর যেরূপ গাভী সবেগে বৎসের দিকে যায়, ধারাবাহী জল সেরূপ সবেগে সমুদ্রাভিমুখে গমন করেছিল।’ (১/৩২/২)

‘ইন্দ্র স্বকীয় বল দ্বারা জলশোষক বৃত্রকে বজ্র দ্বারা ছেদন করেছিলেন; এবং গাভীসমূহের ন্যায় বৃত্র দ্বারা অবরুদ্ধ জগতের রক্ষণশীল জলসমূহ ছেড়ে দিয়েছিলেন।’ (১/৬১/১০)

একটি সূক্তে বৃত্রকে দানব বললেও হস্তপদহীন বলা হচ্ছে, যা বাঁধ সম্পর্কেই প্রযোজ্য। যেমন,  ‘হস্ত-পদ-শূন্য বৃত্র ইন্দ্রকে যুদ্ধে আহ্বান করল’ (১/৩২/৭)

বৃত্র বা বাঁধ যারা নির্মাণ করেছিল তারা ছিল সিন্ধু সভ্যতার নির্মাতা ও সিন্ধুর রাষ্ট্রের পরিচালক। তারা বাঁধ বা বৃত্র নির্মাণ করে বৃহত্তর সিন্ধু উপত্যকায় নদীনিয়ন্ত্রণব্যবস্থার প্রবর্তক ছিল। তারা স্বাভাবিকভাবে ছিল শক্তিমান ও বিপুল সম্পদের অধিকারী। তাই বিরোধী বৈদিক পক্ষ তাদেকে বলছে ‘সেই বৃত্রের অনুচরেরা পৃথিবী আচ্ছাদন করেছিল এবং হিরণ্য ও মণিদ্বারা শোভমান হয়েছিল।’ (১/৩৩/৮)

বৃত্রের পক্ষের মানুষদের অর্থাৎ যে সমস্ত নগর, শহর ও বসতি বাঁধের পক্ষে ছিল তারা শক্তিশালী ছিল। বৈদিক পক্ষের যোদ্ধাদের যে একটি শক্তিশালী প্রতিপক্ষের সাথে লড়াই করতে হয়েছিল তার সাক্ষ্য ঋগ্বেদ দিচ্ছে। তাই তারা ছিল বৃত্রের ভয়ে ভীত। যেমন, ‘স্তোতৃগণ বৃত্রের ভয়ে স্তোত্র রচনা করেছে, সে স্তোত্র বৃহৎ আহ্লাদজনক, বলযুক্ত এবং স্বর্গের সোমপান স্বরূপ; তখন স্বর্গরক্ষক মরুৎগণ মানুষের জন্য যুদ্ধ করে এবং মানুষগণকে পালন করে ইন্দ্রকে প্রোৎসাহিত করেছিলেন।’ (১/৫২/৯)

‘১৪। যখন সমস্ত দেবগণ অহির দীপ্তি হতে পালিয়েছিলেন এবং তাঁরা মৃগরূপী অহি হতে ভয় পেয়েছিলেন। ১৫। তখন আমার ইন্দ্র বৃত্রাসুরের নিবারক হয়েছিলেন, অজাতশত্রু বৃত্রহা ইন্দ্র পৌরুষ প্রয়োগ করেছিলেন।’ (৮/৯৩)

বৃত্রের নগর থাকার কথাও বলা হচ্ছে, যার অর্থ হল বৃত্রের পক্ষের নগর। এই সমস্ত নগরের শাসকরা বৃত্রকে রক্ষা করতে চেয়েছিল। এই সমস্ত নগরের শাসক বা রাজাদের দায়িত্ব ছিল বাঁধের রক্ষণাবেক্ষণ করা ও বাঁধের জল প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করে বিভিন্ন এলাকার কৃষিজমি ও বসতিতে খালের মাধ্যমে সরবরাহ করা। যেমন,

‘ইন্দ্রের কার্যসাধনকারী বজ্র শত্রুকে লক্ষ্য করে পতিত হয়েছিল। ইন্দ্র তীক্ষ্ণ ও শ্রেষ্ঠ আয়ুধ দ্বারা বৃত্রের নগর সমূহ বিবিধরূপে ভেদ করেছিলেন; তার পরে তিনি বজ্র দ্বারা বৃত্রকে আঘাত করেছিলেন এবং তাকে সংহার করে আপন উৎসাহ সম্যকরূপে বৃদ্ধি করেছিলেন।’ (১/৩৩/১৩)

ঋগ্বেদ থেকে জানা যায়, নৌকা চলে এমন নদীতে বাঁধ দেওয়া হয়েছিল। যেমন, বলা হচ্ছে, ‘প্রকৃতি অনুসারে জল প্রবাহিত হল; কিন্তু বৃত্র নৌকাগম্য নদী সমূহের মধ্যে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হল; তখন ইন্দ্র স্থিরসংকল্প বৃত্রকে অতিবলযুক্ত প্রাণসংহারক আয়ুধদ্বারা কয়েক দিনে হনন করলেন।’ (১/৩৩/১১)

বাঁধ বা বৃত্রের কারণে বৃহত্তর সিন্ধু উপত্যকার নদীগুলির জলপ্রবাহ যে বহুকাল রুদ্ধ ছিল তার সম্পর্কে ঋগ্বেদে বলা হয়েছে, ‘হে হরিবান ইন্দ্র! যখন তুমি বদ্ধ এ নদীগণকে বহুকাল অবরোধের পর প্রবাহিত হবার জন্য মোচন করেছিলে, ...’ (৪/২২/৭)

বৈদিক যুদ্ধ যে বহুকাল চলেছিল তার সাক্ষ্য ঋগ্বেদ থেকে পাওয়া যায়। যেমন. ‘যারা আমাদের সাথে বহুকাল যুদ্ধ করছে, সেই শত্রুকাঙ্খীদেরও তুমি বেদনা ও দুঃখ প্রদান কর।’ (১/৩৩/১৫)

আমরা দেখেছি প্রত্নতাত্ত্বিকরা বালুচিস্তানে পাওয়া কিছু বাঁধে জলপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য স্লুইসের অস্তিত্বের কথা জানিয়েছেন। যেহেতু সিন্ধু সভ্যতায় স্লুইস গেটের ব্যবহার অজানা ছিল না তাই জল প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সেখানে স্লুইস গেট থাকা অসম্ভব কিছু না। অন্যদিকে ঋগ্বেদ থেকে বৃত্র বা বাঁধের দ্বার থাকার কথাও বলা হচ্ছে। বৃত্রে এই দ্বার বা নির্গমণ দ্বার বাঁধের মধ্যে নির্মিত স্লুইস গেট হওয়া সম্ভব। নীচে কয়েকটি সূক্তে এই দ্বার থাকার বিবরণ পাই, যেমন,

‘হে সোম! ইন্দ্রের সাথে তোমার বন্ধুত্ব হবার পর, ইন্দ্র তোমার সাহায্যে মনুষ্যদের জন্য জল প্রবাহিত করেছেন, বৃত্রকে বধ করেছেন, সপ্ত সিন্ধুকে প্রেরণ করেছেন, এবং বদ্ধদ্বার উদ্ঘাটিত করেছেন।’ (৪/২৮/১)

‘হে ইন্দ্র! তুমি মেঘকে বিদীর্ণ করে জলনির্গম মার্গ উন্মুক্ত করেছ, তুমি রুদ্ধ জলসকলকে মুক্ত করেছ।’ (৫/৩২/১)

উপরে ‘জলনির্গম মার্গ’ বলতে জল বহির্গমনের পথ বুঝানো হয়েছে। এরকম ঋগ্বেদে আরও বর্ণনা আছে যা থেকে মনে করার যুক্তি সংগত কারণ আছে যে, ঋগ্বেদের ঋষিরা বাঁধ ধ্বংস ও স্লুইস গেট খুলে দিবার কথা উল্লেখ করেছেন। অনেক ক্ষেত্রে এই সব বর্ণনায় নানা রূপক ব্যবহার করা হয়েছে।  অনেক ক্ষেত্রে স্লুইস গেট ধ্বংসেরও বিবরণে রূপকের ব্যবহার করা হয়েছে।

-------------------------------------------------------

আমাদের উভয়ের লিখিত গ্রন্থ ’আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা’-য় ঋগ্বেদে ইন্দ্র কর্তৃক বাঁধ ধ্বংসের বিবরণে রূপকের ব্যবহার সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা আছে। দেখুনঃ শামসুজ্জোহা মানিক ও শামসুল আলম চঞ্চল, আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা, বদ্বীপ প্রকাশন, ঢাকা, ২০০৩, পৃঃ ১৩০-১৩৩। বিদেশী পণ্ডিতদের লিখা বিভিন্ন ইংরাজী প্রবন্ধের বাংলা অনুবাদের সংকলন গ্রন্থ ‘ইসলাম বিতর্ক’ প্রকাশের কারণে ধর্মানুভূতিতে আঘাতের অভিযোগ এনে ২০১৬ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সরকারের নির্দেশে পুলিশ ‘ব-দ্বীপ প্রকাশন’ বন্ধ করায় এবং পুলিশ কর্তৃক প্রকাশনের প্রায় সকল গ্রন্থ বাজেয়াপ্ত হওয়ায় এখন ‘আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা’ বাজারে পাওয়া যায় না। তবে গ্রন্থটি ‘বঙ্গরাষ্ট্র’-এ প্রকাশিত রয়েছে। দেখুন : http://www.bangarashtra.net/article/853.html

-------------------------------------------------------

ঋগ্বেদ থেকে মনে হয় বৃহত্তর সিন্ধু উপত্যকায় সম্ভবত প্রায় সকল নদীতেই বাঁধ দেওয়া হয়েছিল। নীচে এই রকম কিছু মন্ত্রের উল্লেখ করা হল,

‘হে মনুষ্যগণ! ... যিনি সাতটি নদীকে প্রবাহিত করে দিয়েছিলেন ... তিনিই ইন্দ্র।’ (২/১২/১২)।

‘ইন্দ্র অতিবৃহৎ এক জলপূর্ণ মেঘের মস্তক বিদীর্ণ করলেন। অহি অর্থাৎ বৃত্রকে বধ করলেন, সপ্ত সিন্ধু বইয়ে দিলেন।’ (১০/৬৭/১২)

নীচের ঋকে নদী সম্পর্কে বহুবচন ব্যবহার করা হয়েছে,

‘হে ইন্দ্র! তুমি আকাশের জন্য পৃথিবীকে দর্শনীয়া করেছ; তুমি প্রবাহিত নদী সকলের পথ গমনযোগ্য করেছ।’ (২/১৩/৫)

‘হে ইন্দ্র! তুমি বৃত্র কর্তৃক সমাচ্ছাদিত নদী সকলের প্রকাণ্ড বারিরাশি উন্মুক্ত করেছ; তুমি জলরাশি মুক্ত করেছ। তুমি সে সমস্ত নদীকে নিম্নপথে প্রবাহিত করেছ; তুমি বেগবান সলিলরাশিকে সমুদ্রে নিয়ে গিয়েছ।’ (৬/১৭/১২)

এমন হতে পারে যে, প্রথমে সিন্ধু ও সরস্বতীর উপনদীগুলিকে আগে বাঁধ দেওয়া হয়েছিল। এর দ্বারা মূল সিন্ধু ও সরস্বতী নদীতে জলপ্রবাহ কমে যাওয়ায় মূল সিন্ধু ও সরস্বতী নদীতে বাঁধ দেওয়া সম্ভব হয়েছিল। সম্ভবত এই কারণে মহেঞ্জো-দাড়োর উজানে হ্রদ পাওয়ার কথা ভূতত্ত্ববিদরা বলেছেন। আবার শতদ্রু নদীর উপরের অংশে হ্রদ পাওয়ার কথা জানা যায়। এই নদীর প্রবাহ আগে সরস্বতী নদীতে গিয়ে পড়ত।

আমরা ঋগ্বেদে বহু সংখ্যক বৃত্রের কথাও পাই। যেমন বলা হচ্ছে,

‘১। হে ইন্দ্র! আমি পুত্রের সাথে শত্রুজয়ার্থে তোমার অগ্রে অগ্রে গমন করি, সমস্ত দেবগণ আমার পশ্চাতে আগমন করেন। ... ২। তোমাকে অগ্রে মদকর সোমরূপ অন্নদান করছি, অভিযুত সোম তোমার হৃদয়ে নিহিত হোক। তুমি আমার দক্ষিণপাশের্^ সখারূপে অবস্থান কর, অনন্তর আমরা দুজনে বহুসংখ্যক বৃত্র বধ করব।’ (৮/১০০)

‘হে ইন্দ্র! তুমি শুদ্ধ আমাদের ধন দাও। তুমি শুদ্ধ হব্যদায়ীকে রত্ন দাও, তুমি শুদ্ধ বৃত্রগণকে বধ করে থাক, ...’ (৮/৯৫/৯)

পাতা : ৫৮

এছাড়াও ‘বৃত্রদের’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে ১০/৮৩/৭, ১০/৮৯/১৮, ৯/৮৮/৪, ইত্যাদি ঋকে।

বাঁধ নির্মাণের ফলে বাঁধের উজানে নদীতে অনেক বৎসর পর পলি জমায় নিশ্চয়ই বাঁধকে ক্রমাগত উঁচু করতে হয়েছিল। আবার এমনও হতে পারে আরও বেশী সংখ্যক নদীতে বাঁধ নির্মাণ করা হচ্ছিল। হতে পারে উভয় অর্থেই ঋগ্বেদে বৃত্রের বৃদ্ধি পাওয়ার কথা বলা হচ্ছে। যেমন, ‘হে ইন্দ্র! তুমি বৃত্রনিধনকারী, বজ্রদ্বারা বৃত্রকে বধ করেছ, দেববিরোধী সে বৃত্র যখন বৃদ্ধি পাচ্ছিল, তখন দুর্ধর্ষ তুমি বজ্রদ্বারা তার সকল মায়া নষ্ট করলে।’ (১০/১১১/৬)

গবেষক উয়েলি ব্রুনের বালুচিস্তানে কনরাচ নদীর ডান দিকে আড়াআড়িভাবে নির্মিত দুদ্দার বাঁধের কথা বলেছেন, যা নদীর স্রোতের আড়াআড়ি ও এর লম্বভাবে স্রাতের দিকে বহু সংখ্যক প্রাচীর বহনযোগ্য পাথর দিয়ে তৈরী করা হয়েছিল। আড়াআড়ি প্রাচীরের মাঝখানের খালিস্থান বিভিন্ন ধরনের জিনিস দিয়ে পূর্ণ করা হয়েছিল।  বালুচিস্তানে অবস্থিত কিনরি নদীর উপর কুল্লি সংস্কৃতির বসতির কাছে অবস্থিত কিনরি নামে আরেকটি বাঁধের একই ধরনের নির্মাণ সম্পর্কে ব্রুনের উল্লেখ করেছেন। প্রাচীন যুগের মানুষের মনে বাঁধের সাথে লম্বভাবে নির্মিত পাথরের তৈরী বহু সংখ্যক এই প্রাচীরকে বাঁধের বা বৃত্রের সন্ধি মনে করা অস্বাভাবিক নয়। তাই সম্ভবত ঋগ্বেদের ঋষি বলছেন,

-------------------------------------------------------

  এই বাঁধটির নির্মাণ কৌশল সম্পর্কে উয়েলি ব্রুনের বলছেন, ‘The construction method is rather complecated. Many walls built up by manageable stones run in the direction of the waterflow and at a right angle to it, thus forming hundreds of cavities. These were filled with all kind of debris from the surroundings. Where the chamber wall reaches the surface, especially on the west side, the wall inclines to a 45° angle in order to form the surface.’ দেখুনঃ Ueli Brunner, Notes on gabarbands in Balochistan, in, Archäologische Mitteilungen aus Iran und Turan, p. 111.      

------------------------------------------------------

‘ইন্দ্র ক্ষিপ্রকারী, সকলের ঈশ্বর এবং অপরিমিত বলশালী। হে ইন্দ্র! তুমি এ বৃত্রকেই বজ্র প্রহার কর, গরুর ন্যায় বৃত্রের শরীরের সন্ধিগুলি তির্যক অবস্থিত বজ্র দ্বারা কর্তন কর, যেন বৃষ্টি এবং জল বিচরণ করতে পারে।’ (১/৬১/১২)

ঋগ্বেদ পড়লে এই বিষয়টি বুঝা যায় যে, ঋগ্বেদের ঋষিরা ইন্দ্রকে প্রাধান্যে আনে বাঁধ ধ্বংস করার জন্য। সিন্ধু সভ্যতার মত শান্তিপূর্ণ সভ্যতায় বহু মানুষ বাঁধের কারণে তাদের দুর্দশার জন্য ক্ষুব্ধ থাকলেও শান্তিপূর্ণ পথে বিশ্বাসী ও অভ্যস্ত সাধারণ মানুষকে যুদ্ধের মনস্তত্ত্ব তৈরী করতে ঋষিদের অনেক বেগ পেতে হয়েছিল। অন্যদিকে, যে কথা ইতিপূর্বে বলেছিলাম বাঁধ ব্যবস্থা তাদের ধর্মবিশ্বাসের অংশ হওয়ায় তার বিরুদ্ধে দাঁড়াতেও বিদ্যমান ধর্মের সংস্কারের প্রয়োজন হয়েছিল। তাদেরকে এজন্য প্রাচীন কিন্তু গৌণ কিংবা আঞ্চলিক যুদ্ধ দেবতা ইন্দ্রকে প্রাধান্যে আনার জন্য যেমন অনেক মন্ত্র রচনা করতে হয়েছে, তেমন দীর্ঘকাল ধরে জনসাধারণের মধ্যে যুদ্ধের উপযোগী মনস্তত্ত্ব তৈরী করার জন্য নূতন মন্ত্র রচনা ও সেসব প্রচার করতে হয়েছে। ঋগ্বেদের তৃতীয় মণ্ডলের ৩৭ নং সূক্ত থেকে বৃত্র বা বাঁধ ধ্বংসের জন্য যে ইন্দ্রের পূজার প্রবর্তন করা হচ্ছে সে সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়।

‘১। হে ইন্দ্র! বৃত্র বিনাশকর বল লাভের জন্য ও শত্রু সেনার অভিভবের জন্য তোমাকে প্রবর্তিত করছি। ২। হে শতক্রতু! স্তোতাগণ তোমার মন চক্ষু প্রীত করে আমাদের অভিমুখে প্রেরণ করুক। ৩। হে শতক্রতু! আমরা গর্বিত শত্রুদের অভিভবকর যুদ্ধে সমস্ত স্তুতিদ্বারা তোমার নাম কীর্তন করব। ৪। ইন্দ্র সকলের স্তুতি যোগ্য, অপরিমিত তেজবিশিষ্ট এবং মনুষ্যদের স্বামী, আমরা তার স্তুতি করছি। ৫। হে ইন্দ্র! বৃত্রকে বিনাশ করবার জন্য এবং যুদ্ধে ধন লাভের জন্য বহু লোকের আহূত ইন্দ্রকে আহ্বান করছি। ৬। হে শতক্রতু! তুমি যুদ্ধে শত্রুদের অভিভবকারী হও, বৃত্রকে বিনাশ করবার জন্য আমরা তোমাকে প্রার্থনা করছি। ৭। হে ইন্দ্র! যারা ধনে, যুদ্ধে, বীরসমূহে ও বলে আমাদের অভিমানী শত্রু তাদের পরাজয় কর। ৮। হে শতক্রতু! আমাদের আশ্রয় দানের জন্য অতিশয় বলবান, দীপ্তিযুক্ত, স্বপ্ননিবারক সোম পান কর। ৯। হে শতক্রতু, পঞ্চজনে যে সকল ইন্দ্রিয় আছে, আমি সেগুলি তোমারই বলে জানি। ১০। হে ইন্দ্র! প্রভূত অন্ন তোমার নিকট গমন করুক, শত্রুদের দুর্ধর্ষ ধন আমাদের প্রদান কর। আমরা তোমার উৎকৃষ্ট বল বর্ধিত করব। ১১। হে শক্র! নিকট অথবা দূরদেশ হতে আমাদের অভিমুখে এস। হে বজ্রবান ইন্দ্র! তোমার যে উৎকৃষ্ট স্থান আছে সেখান হতে এ যজ্ঞে এস।’ (৩/৩৭)

ইন্দ্র ও অগ্নি দেবতা সম্পর্কে বলা হচ্ছে, ‘তোমাদের কল্যাণকর নামদ্বয় একত্রিত করেছ, হে বৃত্রহন্তৃদ্বয়! তোমরা বৃত্রবধের জন্য সঙ্গত হয়েছিলে।’ (১/১০৮/৩)

উপরের মন্ত্র থেকে এটা স্পষ্ট যে, বৃত্র বধ তথা বাঁধ ধ্বংসের জন্য দেবতা ইন্দ্রকে প্রবর্তন করা হচ্ছে বা প্রাধান্যে আনা হচ্ছে। পূর্বে ইন্দ্র যখন একটি গৌণ দেবতা ছিল তখন তা সম্ভবত বৃহত্তর সিন্ধু উপত্যকার কোনও অঞ্চলের বা কোনও গোত্রের দেবতা ছিল। প্রায় ২৬০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের দিকে সিন্ধুর সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করার পর সিন্ধুর শাসক শ্রেণী সকল অঞ্চলের সমরূপতা আনার জন্য এবং সম্ভবত লোকায়ত  মতবাদ জনসমাজে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য আঞ্চলিক সকল ধর্ম বিশ্বাস ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যকে অবদমিত করলে ইন্দ্রের পূজাও সীমিত হয়ে পড়ে। সিন্ধুর শাসকরা সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার শুরু থেকে নিরীশ্বরবাদ ও লোকায়ত মতের অনুশীলন করলেও ৩০০/৪০০ বৎসর পরে কিংবা কিছু আগে নদীতে বাঁধের কারণে কিছু করে সংকট শুরু হলে সমাজে ধর্মের প্রভাব ক্রমশ বৃদ্ধিশীল হতে থাকে। ইতিপূর্বে যে কথা বলেছিলাম তার পুনরাবৃত্তি করে বলি ক্রমশ জনপ্রিয় হতে থাকা এই ধর্মকে সিন্ধুর শাসক শ্রেণীও কিছুটা অনুমোদন দিতে শুরু করে। আরো পরে সিন্ধু সভ্যতার শেষের দিকে বাঁধ ভিত্তিক নদীনিয়ন্ত্রণব্যবস্থা একেবারে অকার্যকর হলে ফলস্বরূপ জলাবদ্ধতা, মরুকরণ, নদীর গতিপথ পরিবর্তন ইত্যাদি কারণে বাঁধের বিরুদ্ধে জনমত প্রবল হয়ে যায়। ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ বাঁধকেই সকল দুঃখ-দুর্দশা ও কষ্টের কারণ বলে মনে করতে থাকে। এই পরিস্থিতিতে বৃত্র বা বাঁধ ধ্বংসের প্রয়োজনে ঋগ্বেদের ঋষিদের সিন্ধু সভ্যতার শেষ পর্যায়ে রাষ্ট্র কর্তৃক অনুমোদিত প্রচলিত ধর্মকে সংস্কার করতে হয়। তবে সেই সময়েও যে শাসকরা অনেকটা নিরীশ্বরবাদী ছিল তারও ইঙ্গিত ঋগ্বেদে আছে। যেমন, ঋগ্বেদের অনেক জায়গায় শত্রু পক্ষকে যজ্ঞহীন বা যজ্ঞরহিত (১/১০২/২, ৭/৮৩/৭, ১০/৪৯/১), দেবহীন, ব্রতরহিত (৯/৪১/২), নাস্তিক (৯/১০৪/৬), ইত্যাদি বলা হয়েছে। তবে অনেক ক্ষেত্রে শত্রুপক্ষকে যজ্ঞ অনুষ্ঠান করতে দেখা যাচ্ছে, আবার অনেক জায়গায় তাদের ভিন্ন পূজাপদ্ধতির কথাও বলা হচ্ছে।

-------------------------------------------------------

  লোকায়ত নামে প্রাচীন ভারতবর্ষে একটি বস্তুবাদী মতবাদ প্রচলিত ছিল। আমরা অনুমান করি এটি সিন্ধু সভ্যতা থেকে আগত। বিশেষভাবে সিন্ধু সভ্যতার শাসকরা এই মত ধারণ করত ও জনসমাজে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। পরে এই বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে।

-------------------------------------------------------

আমরা উপরের আলোচনায় বলেছি যে, ঋগ্বেদের ঋষিরা সিন্ধু সভ্যতার রাষ্ট্র কর্তৃক অনুমোদিত ধর্মের পুরোহিত শ্রেণী থেকে আগত, যারা সিন্ধু সভ্যতায় নদীনিয়ন্ত্রণব্যবস্থা অকার্যকর হলে ও ফলে জলসংকটে কৃষি ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হলে ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলের বসতিসমূহের অধিবাসীদের ক্ষোভ ও জনমতকে প্রতিনিধিত্ব করে প্রচলিত ধর্মকে সংস্কার করে বিদ্রোহের সূচনা ঘটায়। অর্থাৎ প্রচলিত ধর্মের সংস্কারের উদ্দেশ্য ছিল বাঁধ ধ্বংসের জনমনস্তত্ত্ব তৈরী ও যুদ্ধের পক্ষে জনমত তৈরী করা।

ঋগ্বেদে বলা আছে বৈদিক পক্ষ বহু সংখ্যক শত্রু নগর ধ্বংস করেছিল। এখানে যে যুদ্ধ হয়েছিল তার কৃতিত্ব তারা স্বাভাবিকভাবে দেবতা ইন্দ্রকে দিয়েছিল। নীচের মন্ত্রসমূহ থেকে এ বিষয়ে জানা যায়,

‘শোভনকর্ম ইন্দ্র যশ কামনা করে, সুনির্মিত (অসুর) গৃহ সকল বলদ্বারা বিনাশ করে পৃথিবীর সমান বৃদ্ধি প্রাপ্ত হয়ে, জ্যোতিষ্কদের আবরণ রহিত করে, যজমানের উপকারার্ধে বহনশীল বৃষ্টিজল দান করেন।’ (১/৫৫/৬)

‘হে বজ্রিন! তুমি পুরুকুৎসের সহায় হয়ে যুদ্ধ করে সেই সপ্ত নগর ধ্বংস করেছ, ...’ (১/৬৩/৭)

এটা ঠিক যে, ইন্দ্রের পরিচিতি মূলত বাঁধ ধ্বংসের সাথে শত্রু নগরেরও ধ্বংস সাধন। ফলে ইন্দ্র কর্তৃক শত্রু পক্ষের বহু নগর ধ্বংসের বর্ণনা থেকে এমন ধারণা হতে পারে যে, শুধু শত্রু পক্ষেরই নগর ছিল, বৈদিক পক্ষের নগর বা উন্নত বাসগৃহ ছিল না। ঋগ্বেদ পরিষ্কার সাক্ষ্য দিচ্ছে যে, বৈদিক পক্ষেরও নগর ও সুনির্মিত বাসগৃহ ছিল। এছাড়াও ঋগ্বেদের ঋষিরা যে নাগরিক পটভূমি থেকে আগত সেটা ঋগ্বেদ মনোযোগ সহকারে পড়লেই বুঝতে পারা যায়। যেমন, নীচের কিছু মন্ত্রে দেখি,

‘হে মরুৎগণ! তোমাদের নিত্য প্রসিদ্ধ বল যেন আমাদের পরাভূত না করে। আমাদের ধন যেন ক্ষীণ না হয়, আমাদের নগর ক্ষীণ না হয়। ...’ (১/১৩৯/৮)

অগ্নি দেবতার উদ্দেশ্যে রচিত এই মন্ত্রে বলা হচ্ছে, ‘যে সকল ব্যক্তি তোমার প্রভাব অবগত হয়ে নিরন্তর তোমাকে আহ্বান করে এবং হব্য ও স্ত্রোত্রদ্বারা তোমার বল রক্ষা করে, তাঁরা যে পুরীতে বাস করেন, তা শত্রুগণের দুর্গম্য।’ (৫/১৯/২)

‘ইন্দ্র হব্যদাতা দিবোদাসকে শম্বরের পাষাণ নির্মিত শত সংখ্যক পুরী প্রদান করেছিলেন।’ (৪/৩০/২০), ইত্যাদি।

আমাদের অনুমান বাঁধের উজানে পলি জমার ফলে নদীনিয়ন্ত্রণব্যবস্থায় সংকট শুরু হয়েছিল বাঁধ ভিত্তিক নদীনিয়ন্ত্রণব্যবস্থা চালুর সম্ভবত ৩০০ থেকে ৪০০ বৎসরের মধ্যে, যা আগেই বলা হয়েছে। অর্থাৎ সিন্ধু সভ্যতার সূচনা ২৬০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দ থেকে থেকে ৩০০ থেকে ৪০০ বৎসর পরে। তবে এরও আগে কোনও কোনও অঞ্চলে কিছু করে সংকট শুরু হতে পারে। যেমন হরপ্পায় পর্ব ৩এ-এর (২৬০০-২৪৫০ খ্রীঃপূঃ) শেষ পর্যায়ে নগর ব্যবস্থায় ক্ষয় ও দুর্দশার প্রমাণ পাওয়ার কথা জানা যায়, যা হরপ্পান পর্যায়ের শুরুর প্রায় আড়াই শত বৎসর পরে। নদীনিয়ন্ত্রণব্যবস্থায় সংকট স্বাভাবিকভাবে ফসলের উৎপাদনে প্রভাব ফেলে ও মানুষের জীবন যাত্রায় সংকট সৃষ্টি হয়। সিন্ধু সভ্যতা নির্মাণের শুরুতে সিন্ধুর রাষ্ট্র ও সমাজে লোকায়ত মতাদর্শ প্রতিষ্ঠিত থাকার জোরালো সম্ভাবনার কথা আগে বলা হয়েছে। কিন্তু নদীনিয়ন্ত্রণব্যবস্থায় সংকট শুরু হলে পূর্ব থেকে সমাজে অবদমিত ধর্ম ক্রমশ গুরুত্ব পেতে শুরু করে। কারণ বস্তু জগতে সমস্যা সমাধানের পথ না পেলে ভাব-জগতের কাল্পনিক শক্তির কাছে মানুষের আশ্রয় খুঁজা অস্বাভাবিক নয়। বিশেষত প্রাচীন কালে যখন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে মানুষ অনেক পিছিয়ে ছিল এবং জগৎ ও জীবন সম্পর্কে বহু প্রশ্নের উত্তর তাদের নিকট অজানা ছিল সেই রকম কালে দীর্ঘস্থায়ী সংকটের সময়ে সমাজে ধর্মের প্রাধান্য লাভ ছিল স্বাভাবিক। সিন্ধু সভ্যতার সমাজেও এমন ঘটেছিল বলে মনে করা যায়। কিন্তু সিন্ধু সভ্যতার রাষ্ট্র তখনও লোকবাদী ধারা বজায় রেখেছিল বলে মনে হয়। এখানে ধর্মের ধারাটি গড়ে উঠেছিল রাষ্ট্রের শাসনক্ষমতার বাইরে একটি পুরোহিত শ্রেণীর মাধ্যমে। সমাজে ক্রমশ বৃদ্ধিশীল এই ধর্মের নেতৃত্ব দেয় সমাজ থেকে উঠে আসা একটি পুরোহিত শ্রেণী, যাদেরকে রাষ্ট্র পরে অনুমোদন দিয়েছিল, কিন্তু যারা রাষ্ট্র-ক্ষমতার অংশ ছিল না।

ঋগ্বেদ থেকেও এই বিষয়টি বুঝা যায় যে, ঋগ্বেদের ঋষিরা সিন্ধু সভ্যতার রাষ্ট্র ক্ষমতার অংশ ছিল না। এছাড়া এই ঋষি বা পুরোহিত শ্রেণীর যে কোনো কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ছিল না তাও ঋগ্বেদ থেকে স্পষ্ট। সিন্ধু সভ্যতার পুরোহিত শ্রেণী রাষ্ট্র শাসনের অংশ না হওয়ার কারণে ঋগ্বেদে রাষ্ট্রশাসনব্যবস্থা সম্পর্কে তেমন ইঙ্গিত পাওয়া যায় না। আমরা আর একটি বিষয় সম্পর্কে অনুমান করি যে, সিন্ধু সভ্যতার রাষ্ট্র যে ধর্মকে অনুমোদন দিয়েছিল তারও কোনও কেন্দ্র ছিল না। সম্ভবত এই কারণে রাষ্ট্র অনুমোদিত বা প্রচলিত ধর্মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে গড়ে উঠা বৈদিক আন্দোলনেরও কোনো কেন্দ্র পাওয়া যায় না।

পাতা : ৫৯

বৃহত্তর সিন্ধু উপত্যকায় ক্রমশ রাষ্ট্র অনুমোদিত বৃদ্ধিশীল ধর্মের অংশ হয়ে যায় নদী নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে নির্মিত বাঁধ। ফলে বাঁধের উপরেও দেবত্ব আরোপ করা হয়। সিন্ধু সভ্যতায় সংকট শুরু হলে নদীনিয়ন্ত্রণব্যবস্থার জন্য নির্মিত বাঁধ সকল দুর্গতি ও দুঃখের মূল হিসাবে সাধারণ মানুষের কাছে প্রতিভাত হয়। মানুষের কষ্ট ও দুর্গতি হয়ত কয়েক শত বৎসর ধরে চলছিল এবং নদীনিয়ন্ত্রণব্যবস্থার সংস্কার করেও মানুষের জীবনকে পূর্বের অবস্থায় আর ফিরানো যাচ্ছিল না। ফলে সিন্ধু সভ্যতার শেষ পর্যায়ে জনমতের একটা বড় অংশ বাঁধের ধ্বংস চাচ্ছিল। ক্ষতিগ্রস্ত জনসাধারণের জনমতের প্রবল চাপের সাথে সংহতি প্রকাশ করে সিন্ধু সভ্যতার বিভিন্ন বসতির স্থানীয় ধর্মীয় ঋষিরা বা পুরোহিতরা বাঁধ ধ্বংসের জন্য প্রচলিত ধর্মকে সংস্কার করার উদ্যোগ নেয়। তারা যুদ্ধের পক্ষে ও বাঁধ ধ্বংসের জন্য মনস্ততত্ত্ব তৈরীর জন্য প্রাচীন দেবতা ইন্দ্রকে প্রাধান্যে আনে। তারা বাঁধ ধ্বংসের জন্য মন্ত্র রচনা করে জনমত তৈরী করে। তাদের পক্ষে ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলের কিছু সংখ্যক স্থানীয় ‘রাজা’ বা শাসক এসেছিল বলে ধারণা করা যায়। এক সময়ে যুদ্ধ শুরু হলে বৈদিক পক্ষ ক্রমে বহু সংখ্যক বাঁধ ধ্বংস করতে সমর্থ হয়। ঋগ্বেদ পাঠে বুঝা যায় যে, ঋগ্বেদের মন্ত্রসমূহের মূল প্রেরণাই হল প্রধানত বাঁধ ধ্বংসের জন্য জনমত তৈরী করা। এভাবে বহু সংখ্যক বসতিতে ক্রমে শাসনক্ষমতার বাইরে গড়ে উঠা প্রচলিত ধর্মের সংস্কার করে ঋগ্বেদের ঋষিরা অর্থাৎ সিন্ধু সভ্যতার বিদ্রোহী পুরোহিতরা। এভাবে তারা বৃহত্তর সিন্ধু উপত্যকায় বাঁধ ধ্বংস করতে গিয়ে একই সমাজের বাঁধের পক্ষের মানুষদের অর্থাৎ শাসকদের বিরুদ্ধে একটি গৃহযুদ্ধের সূচনা ঘটায়।   

যদিও ঋগ্বেদ বৃহত্তর সিন্ধু উপত্যকায় ব্যাপক একটি গৃহযুদ্ধের সাক্ষ্য দেয়, কিন্তু সিন্ধু সভ্যতার শেষ পর্বে সেখানকার বসতিগুলিতে যুদ্ধের সপক্ষে প্রত্নতাত্ত্বিক কোনও প্রমাণ পাওয়া যায় না। এতে মনে হয় যে, সিন্ধু সভ্যতার মত একটি শান্তিপূর্ণ সভ্যতায় সামান্য সংঘাত ও ক্ষুদ্র আকারে ধ্বংসকাণ্ডও জনমানসে বড় একটি যুদ্ধের রূপকল্প তৈরী করেছিল। ফলে পৃথিবীর অন্যান্য সভ্যতায় যুদ্ধের সাথে যে ব্যাপক হত্যাকাণ্ড পরিচালিত হত, আগুনে জ্বালানো হত এবং বিপক্ষের বাড়ীঘর ও নগরসমূহ মাটির সাথে মিশিয়ে দেওয়া হত, সিন্ধু সভ্যতায় সেটা ঘটে নাই। হয়ত বিপক্ষের সামান্য কিছু মানুষ হত্যা ও নগরের বা বসতির অল্প কিছু ক্ষতি সাধনই বিপুল সংখ্যক শত্রু সৈন্য হত্যা ও শত্রুর বহু সংখ্যক নগর ধ্বংসের বিবরণ হিসাবে ঋগ্বেদে স্থান পেয়েছে। তাছাড়া এমনও হতে পারে যে, ঋগ্বেদে পুর অর্থ এখন যেভাবে নগর করা হচ্ছে তার পরিবর্তে যে কোনও বসতি বুঝাতেও ঋগ্বেদে পুর শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। অর্থাৎ কালের ধারায় শব্দের অর্থ সম্পর্কে ধারণা বদলের ফলে যে কোনও বসতি ধ্বংসকে নগর ধ্বংস করা হতে পারে। ফলে যে কোনও ধরনের কিছু সংখ্যক বসতি ধ্বংসকেও হয়ত পুর বা নগর ধ্বংস হিসাবে এখন মনে করা হচ্ছে। মোট কথা ঋগ্বেদে যুদ্ধকে যত বড় করে দেখানো হয়েছে বাস্তব যুদ্ধ তত বড় ছিল না, যদিও সংকটজীর্ণ নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার চ‚ড়ান্ত ধ্বংসে তার ভূমিকা ছিল যথেষ্ট বড়।

আগের অধ্যায়ে প্রত্নতাত্ত্বিক সাক্ষ্য থেকে দেখানো হয়েছে যে, সিন্ধু সভ্যতার প্রথম পর্বের শেষ পর্যায়ে অর্থাৎ ২৪৫০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের দিকে হরপ্পায় সংকট শুরু হয়েছিল ও সমগ্র সভ্যতায় আগের যে সমরূপতা ছিল সেখানে বিশেষভাবে ২২০০ খ্রীঃপূঃ-এর দিক থেকে নানা আঞ্চলিক সংস্কৃতি তুলনামূলকভাবে প্রাধান্য পেতে শুরু করে। এই সময়ের কিছু পরে সভ্যতায় ধর্মের প্রভাবও বেড়ে গিয়েছিল বলে প্রত্নতাত্ত্বিকভাবে জানা যাচ্ছে। উল্লেখ করার মত পরিবর্তনগুলি হল, ধর্মের সাথে সংশ্লিষ্ট মহেঞ্জো-দাড়োর বিখ্যাত চৌবাচ্চা বা ‘গ্রেট-বাথ’, যা ২৩০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে নির্মাণ করা হয় বলে মনে করা হয়। এছাড়াও এই চৌবাচ্চাটিতে পরবর্তীতে অনেক পরিবর্তন করা হয়েছিল ও চৌবাচ্চাটির উত্তর পাশে অবস্থিত স্তম্ভ-বিশিষ্ট হলঘরটিতে (Pillard Hall) প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে ভরাট করে ফেলা হয়েছিল। মনে করা হয় যে, শুরুতে যে উদ্দেশ্যে এই ভবনশ্রেণী তৈরী করা হয়েছিল পরবর্তীতে তা পরিত্যাগ করা হয়। হরপ্পায় ২৩৫০ - ২৩০০ খ্রীঃপূঃ-এ (পর্ব ৩বি-এর মধ্যবর্তী সময়ে) তাৎপর্যপূর্ণ পুনর্নির্মাণ হতে দেখা যায়, যার মধ্যে ঢিবি এফ-এর ‘শস্যাগার’ নির্মাণ করা হয়েছিল বলে মনে করা হয়। এছাড়া সময়ের সাথে সেখানে ইটের মাপেও পরিবর্তন দেখা যায়। হরপ্পায় শেষ পর্বে (২২০০ - ১৯০০ খ্রীঃপূঃ) নির্দিষ্ট কিছু ধর্মীয় ছবি, উপকথার বর্ণনা ও পূজার দৃশ্য খোদিত করার প্রবণতা দেখা যায়। এই সমস্ত দৃষ্টান্ত ছাড়াও সিন্ধু সভ্যতার মৃৎশিল্পের শৈলীতে কিছু পরিবর্তন দেখা গিয়েছিল যা আগে আলোচনা করা হয়েছে। প্রথম পর্বে (২৬০০-২৪৫০ খ্রীঃপঃ) সীলে ছবির ব্যবহার কম দেখা গেছে, কিন্তু দ্বিতীয় পর্ব (২৪৫০-২২০০ খ্রীঃপূঃ) থেকে সীলে লিপির সাথে ছবির ব্যবহার বেড়ে যায়। এছাড়াও দেখা গেছে যে, প্রথম পর্বে সীলে কল্পিত প্রাণী ইউনিকর্ন উৎকীর্ণ ছবি সীমিত পরিমাণে পাওয়া গেছে। কিন্তু দ্বিতীয় পর্বে এর ব্যবহারও বেড়ে যায়। ছবির ব্যবহারের বৃদ্ধির সাথে জনমানসে ধর্মের প্রভাব বৃদ্ধির সম্পর্ক থাকতে পারে বলে মনে হয়।

এই সমস্ত সাক্ষ্য থেকে এটি স্পষ্ট যে, সিন্ধু সভ্যতার শাসকরা সভ্যতার শুরুর দিকে নিরীশ্বরবাদ বা লোকায়ত দর্শনের ধারণাকে রাষ্ট্রশাসনে ধারণ করলেও সভ্যতায় সংকট শুরু হলে তারা সেখান থেকে কিছুটা সরে যায়। বিশেষভাবে গ্রামীণ কৃষক ও সাধারণ মানুষ ধর্মের দিকে ঝুঁকে যেতে থাকে। যদিও শাসকরা শেষ পর্যন্ত লোকায়ত মতকে প্রধান ধারা হিসাবে রক্ষা করেছিল বলে প্রত্নতাত্ত্বিক সাক্ষ্য-প্রমাণে মনে হয়। কারণ সিন্ধু সভ্যতার শেষ পর্যায়েও ধর্মের সাথে সংশ্লিষ্ট এমন কোনও কিছু যেমন, মন্দির, বৃহৎ মূর্তি, ইত্যাদি নির্মাণ যুক্ত হয় নাই যা এই শক্তিধর ও মহাকায় রাষ্ট্রের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।

 কোনো মন্দির বা রাজপ্রাসাদ পাওয়া না গেলেও কিছু লেখক বড় ভবনকে পূজা ও ধর্মানুষ্ঠানের স্থান হিসাবে বিবেচনা করেন।  আমরা অনুমান করি সিন্ধু সভ্যতায় সংকটের কালে রাষ্ট্রের আনুকূল্যে কিন্তু রাষ্ট্রের বাইরে ধর্মের বিকাশ ঘটছিল। এমন সম্ভাবনার কথা আমরা আগে বলেছি যে, সিন্ধু সভ্যতার মধ্যবর্তী পর্যায় থেকে রাষ্ট্রের বাইরে যে ধর্ম ও তার সাথে সংশ্লিষ্ট পুরোহিত শ্রেণী গড়ে উঠে রাষ্ট্র তাকে এক ধরনের অনুমোদন দেয়। কোনও কোনও সময়ে রাষ্ট্র সীমিত পরিসরে ধর্মকে কিছুটা জায়গাও দিতে পারে। এমনটা মনে হয় মহেঞ্জো-দাড়োর ‘গ্রেট বাথ’-এর নির্মাণ থেকে। তবে পুরোহিত শ্রেণী কখনও রাষ্ট্র শাসনের অংশ ছিল না। ঋগ্বেদও তার সাক্ষ্য দেয়। ঋগ্বেদ থেকে মনে হয় বরুণ ছিলেন সিন্ধু সভ্যতার উদীয়মান ধর্মের প্রধান দেবতা, যাকে সিন্ধুর রাষ্ট্র আনুকূল্য দিচ্ছিল। ঋগ্বেদে এভাবে বলা হচ্ছে, ‘সর্বজ্ঞানী অসুর বরুণ দ্যুলোককে স্তম্ভিত  করেছেন, পৃথিবীর বিস্তারের পরিমাণ করেছেন, সমস্ত ভুবনের সম্রাটরূপে আসীন হয়েছেন। বরুণের এ সকল কর্ম অনেক।’ (৮/৪২/১)

-------------------------------------------------------

দেখুনঃ Jonathan M. Kenoyer, The Archaeological Heritage of Pakistan: From the Palaeolithic to the Indus Civilization, in, A History of Pakistan, 2015, p. 56.

  স্তম্ভযুক্ত।

-------------------------------------------------------

‘বৃষ্টি যেরূপ যব, শস্য সিক্ত করে সেরূপ অখিল ভুবনের অধিপতি বরুণ সমগ্র ভূমিকে আর্দ্র করেন।’ (৫/৮৫/৩)

বরুণ যে একজন প্রভাবশালী ও গুরুত্বপূর্ণ দেবতা ছিল তা ঋগ্বেদ থেকে বুঝা যায়। ঋগ্বেদের অনেক জায়গায় বরুণের গুরুত্ব থাকার ফলে অনুমান করা যায় যে সিন্ধু সভ্যতায় আগে বরুণকেন্দ্রিক ধর্ম কাঠামো প্রাধান্যশীল হয়ে উঠেছিল। সিন্ধুর রাষ্ট্র এই বরুণের ধর্মকে অনুমোদন দিয়েছিল। ঋগ্বেদ থেকে মনে হয় পূর্বকালে বরুণ জলের দেবতা ছিল। এই বিষয়ে আর বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ না থাকায় আমরা এটুকু বলতে পারি যে, সিন্ধু সভ্যতার বরুণকেন্দ্রিক ধর্ম কাঠামোর মধ্য থেকে আসা ঋষিরা ধর্ম সংস্কার আন্দোলনের প্রক্রিয়ায় ক্রমশ বরুণের প্রাধান্যকে হ্রাস করে ও ইন্দ্রকে প্রাধান্যে আনে। এই ধর্ম সংস্কারের উদ্দেশ্য ছিল বাঁধ বা বৃত্র ধ্বংস করা।

ঋগ্বেদ থেকে এই বিষয়টি পরিষ্কার যে, পুরোহিতরা অর্থাৎ ঋষিরা রাষ্ট্র শাসনে অংশগ্রহণ করত না বলে বিদ্রোহী ঋষিরা যারা ঋগ্বেদের মন্ত্রসমূহ রচনা করেছিলেন তারা সিন্ধু সভ্যতার আইন, শাসনপদ্ধতি, ইত্যাদি বিষয়ে নীরব থেকেছেন। অথচ ঋগ্বেদে বৈদিক পক্ষের নগর থাকার কথা বলা হয়েছে, বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে সমুদ্র যাত্রার কথা বলা আছে, বণিক, কারিগর, ইত্যাদির কথা বলা হয়েছে। এমন কি একটি ঋকে ’সুশাসক নগরপতির’ উল্লেখ আছে (১/১৭৩/১০)। ঋগ্বেদের ঋষিরা যে নাগরিক পটভূমি থেকে এসেছেন ঋগ্বেদ মনোযোগ দিয়ে পড়লে সেটাও বুঝা যায়।    

এছাড়া বৈদিক পক্ষ যে কৃষি (১/১১৭/২১, ৪/৫৭, ১০/১০১/৩, ইত্যাদি), বাণিজ্য ও সমুদ্র বাণিজ্য (১/২৫/৭, ১/৪৮/৩, ১/৫৬/২, ইত্যাদি), কারুশিল্প (৪/২/১৪, ইত্যাদি), বয়ন (২/৩/৬, ইত্যাদি), ধাতু শিল্প (৬/৩/৪, ৯/১১২/২, ইত্যাদি), চিকিৎসাবিজ্ঞান (১/১১৭/৪) ও অস্ত্রপচার (১/১১৬/১৫), জ্যোতির্বিজ্ঞান (১/২৫/৮, ১/১৬৪/১২, ১/৮৪/১৫, ইত্যাদি), শিক্ষা ব্যবস্থা (১/১১৬/১৩) ও রাষ্ট্রের ধারণার (১/১১৬/২৫, ৭/৮৪/২)  সাথে পরিচিত ছিল সেটা ঋগ্বেদ থেকে জানা যায়। এছাড়াও ঋগ্বেদে উন্নত সাহিত্য ও দর্শনচিন্তার যে প্রকাশ দেখা যায় তা কোনও গ্রামীন সমাজের পটভূমি থেকে আসা মানুষদের থাকতে পারে না।

ঋগ্বেদ থেকে একটি বিষয় পরিষ্কার যে, সিন্ধু সভ্যতার শাসকেরা সভ্যতার শুরুতে কৃষির উৎপাদন বাড়াবার জন্য নদীতে বাঁধ দিয়ে নদীনিয়ন্ত্রণব্যবস্থা চালু করে। শুরুতে ছোট ও প্রধানত উপনদীগুলিতে বাঁধ দিলে যখন সিন্ধু বা সরস্বতীর মত প্রধান নদীগুলিতে জলপ্রবাহ কমে নিয়ন্ত্রণাধীন হয়, তখন এই নদীগুলিতেও তারা বাঁধ দেয়। ঋগ্বেদ বৃহত্তর সিন্ধু উপত্যকার সকল নদীতে বাঁধ দিবার বিষয়টিকে সমর্থন করে। বাঁধ দিবার ফলে বহু বৎসর পরে নদীতে ক্রমশ পলি জমে নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা অকার্যকর হলে ফসলের উৎপাদনও হ্রাস পেতে থাকে। এভাবে মেরামত করে সম্ভবত আরো কয়েক শত বৎসর নদীনিয়ন্ত্রণব্যবস্থাকে কোনোক্রমে চালু রাখে। হরপ্পায় প্রথম পর্বের শেষে নগর জীবনে যে সমস্যা ও সংকটের প্রমাণ পাওয়া যায় সেটা নদীনিয়ন্ত্রণব্যবস্থায় সংকট থেকে হতে পারে বলে মনে হয়। পরের পর্বে তারা সংকট কাটিয়ে উঠে নূতন উদ্যমে নাগরিক জীবন শুরু করেছিল এমন প্রমাণ প্রত্নতাত্ত্বিক খননে জানা যায়। মহেঞ্জো-দাড়োতেও সিন্ধু সভ্যতার ৭০০ বৎসর সময় জুড়ে অনেক বার বাড়ীঘরের পুনর্নিমাণের প্রমাণ পাওয়া যায়।  এই সমস্ত প্রত্নতাত্ত্বিক সাক্ষ্য থেকে মনে হয় যে, সিন্ধু সভ্যতার বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন সময়ে নদীনিয়ন্ত্রণব্যবস্থায় সংকট দেখা দিয়েছিল, যা পরে সেখানকার শাসকরা মেরামত করে পুনরায় সেচব্যবস্থাকে চালু করতে সমর্থ হয়েছিল। বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন সময়ে নদীনিয়ন্ত্রণব্যবস্থায় সাময়িক কিছু সংকটের ফলে রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ দুর্বল হবার পাশাপাশি সমাজের মধ্যে কিছু না কিছু অসন্তোষ সৃষ্টি হবার কথা। হয়ত এই সমস্ত স্বল্পস্থায়ী সংকটের কারণে বিভিন্ন আঞ্চলিক প্রবণতা ক্রমশ প্রাধান্যে আসছিল, যার প্রত্নতাত্ত্বিক সাক্ষ্য পাওয়া যায় বিশেষভাবে মৃৎপাত্রের শৈলী ও অন্যান্য বস্তুগত সাংস্কৃতিক  ক্ষেত্রে।

-------------------------------------------------------

দেখুনঃ Michaël Jansen, Mohenjo-Daro, city of the Indus Valley, in, Endeavour, Volume 9, Issue 4, 1985, p. 166.

-------------------------------------------------------

পাতা : ৬০

তবে শেষ পর্যন্ত নদীনিয়ন্ত্রণব্যবস্থাকে আর মেরামতযোগ্য করা যাচ্ছিল না। বিশেষভাবে নদীর গতিপথ পরিবর্তন ও পলি সঞ্চয়জনিত কারণে বাঁধ অকার্যকর হবার ফলে। বিভিন্ন অঞ্চলে এজন্য জলকষ্টও হচ্ছিল। এভাবে দীর্ঘকাল জলকষ্টের জন্য ক্ষুব্ধ জনসাধারণ বাঁধকে তাদের সকল কষ্ট ও দুঃখের জন্য দায়ী করেছিল বলে ধারণা করা যায়। এই জন্য বাঁধ ধ্বংসের জন্য জনমত প্রবল হল। কিন্তু সমাজের প্রচলিত ধর্মীয় কাঠামোতে বাঁধ-দেবতার অবস্থান থাকায় বাঁধকে ধ্বংস করতে গিয়ে প্রচলিত ধর্মকে সংস্কার করার প্রয়োজন দেখা দেয়। এই কাজের নেতৃত্বে এগিয়ে আসে সিন্ধু সভ্যতারই শেষ পর্যায়ে যে সকল ঋষি বা পুরোহিত প্রচলিত ধর্মের অনুসারী ছিল তাদেরই একটি অংশ। এই ঋষিরাই সিন্ধু সভ্যতার শেষ পর্যায়ে প্রাধান্যশীল বরুণের ধর্মের কাঠামো থেকে বেরিয়ে অপ্রধান দেবতা ইন্দ্রকে প্রাধান্যে নিয়ে আসে।

ঋগ্বেদ যে একটি ধর্ম সংস্কার আন্দোলনের দলিল এবং সমাজের একই জনগোষ্ঠীর মধ্যে গৃহযুদ্ধ তা ঋগ্বেদের বহু মন্ত্র থেকে বুঝা যায়। বিশেষভাবে বৈদিক পক্ষের নামের সাথে বৈদিকদের বিরোধী পক্ষের নামের আশ্চর্য রকম মিল দেখতে পাওয়া যায। যেমন, অহি (বৃত্রের অপর নাম, ১/১০৩/২, ২/১২/১১, ৪/১৭/১), অহীশুব (ইন্দ্র কর্তৃক হত, ৮/৩২/২) ও অহির্বুধ্ন্যা (বৈদিক দেবতা, ১/১৮৬/৫, ২/৩১/৬); অর্বুদ (ইন্দ্র কর্তৃক বিনাশপ্রাপ্ত, ২/১১/২০, ২/১৪/৪) ও অর্বুদ (১০ মণ্ডল ৯৪ সুক্তের ঋষি); কবষ (ইন্দ্র কর্তৃক অনুপূর্বরূপে জলে নিমজ্জিত, ৭/১৮/১২) ও কবষ (ঋগ্বেদের ১০ মণ্ডলের ৩০ থেকে ৩৪ সূক্তের ঋষি), কৃষ্ণ (ইন্দ্র কর্তৃক হত, ১/১৩০/৮) ও কৃষ্ণ (১০ মণ্ডলের ৪৪ নম্বর সূক্তের রচয়িতা ঋষি); চিত্ররথ (ইন্দ্র কর্তৃক হত, ৪/৩০/১৮) ও চিত্র  (বৈদিক রাজা, ৮/২১/১৭-১৮); তুগ্র (ইন্দ্র কর্তৃক হত, ৬/২৬/৪) ও তুগ্র  (বৈদিক যুগ্ন দেবতা অশি^দ্বয়ের প্রিয়পাত্র। তার পুত্র ভুজ্যু অশি^দ্বয় কর্তৃক রক্ষাপ্রাপ্ত, ১/১১৬/৩-৫); ত্রিশিরা (ইন্দ্র প্রেরিত ত্রিত কর্তৃক হত, ১০/৮/৮) ও ত্রিশিরা (১০ মণ্ডল, ৮ সূক্তের রচয়িতা ঋষি); পুরু (অগ্নি দেবতা কর্তৃক পরাজিত, ৭/৮/৪) ও পুরু (বৈদিক রাজা, তার পুত্র ইন্দ্র কর্তৃক রক্ষাপ্রাপ্ত, ৮/৩/১২); বিশ্বরূপ  (বৈদিক দেবতা ত্বষ্টার পুত্র; ইন্দ্র কর্তৃক হত, ২/১১/১৯, ১০/৮/৯) ও বিশ্বকর্মা  (বৈদিক দেবতা ও একই নামের একজন বৈদিক ঋষি, ১০/৮১ এবং ১০/৮২ সূক্ত); বৃহদ্রথ (ইন্দ্র কর্তৃক ভগ্ন, ১০/৪৯/৬) ও বৃহদুক্থ (১০ মণ্ডলের ৫৪-৫৬ সূক্তের ঋষি); বৃষশিপ্র (’হে ইন্দ্র ও বিষ্ণু! ... সংগ্রামে বৃষশিপ্র নামক দাসের মায়াকে বিনষ্ট করেছ’, ৭/৯৯/৪) ও বৃষভ (যুদ্ধে ইন্দ্র কর্তৃক সাহায্যপ্রাপ্ত একজন রাজা, ৬/২৬/৪); বৃষয় (অগ্নি ও সোম কর্তৃক বৃষয়ের পুত্র হত, ১/৯৩/৪) ও বৃষণশ্চ  (বৈদিক রাজা, ১/৫১/১৩), বৃষাগির (বৃষাগিরের পুত্রগণ ১ মণ্ডলের ১০০ নং সূক্তের ঋষি); মান্যমান (ইন্দ্র কর্তৃক মান্যমানের পুত্র দেবক হত, ৭/১৮/২০) ও মান্য (৮ মণ্ডল, ৬৭ সূক্তের ঋষি); শ্রুত (ইন্দ্র কর্তৃক জলে আনুপূর্বরূপে নিমজ্জিত, ৭/১৮/১২) ও শ্রুতর্ষ  (দেবতা অশ্বিদ্বয় কর্তৃক রক্ষাপ্রাপ্ত, ১/১১২/৯); সহবসু (ইন্দ্র কর্তৃক হত, ২/১৩/৮) ও সহদেব (বৃষাগিরের পুত্র, ঋষি, ১ মণ্ডর ১০০ সূক্ত); ইত্যাদি।

সুতরাং বৈদিক পক্ষ ও বৈদিকদের শত্রু পক্ষের নাম দিয়েও বুঝা যায় যে, ঋগ্বেদে যে যুদ্ধের কথা বলা হয়েছে তা একই জনসমাজে সংঘটিত একটি গৃহযুদ্ধ ছাড়া কিছু নয়।  আগেই বলা হয়েছে প্রত্নতাত্ত্বিকরা সিন্ধু সভ্যতার শেষ পর্যায়ে যুদ্ধে ধ্বংসের কোনও প্রমাণ পান নাই। অন্যদিকে ঋগ্বেদে ইন্দ্র কর্তৃক বৃত্র বধ তথা বাঁধ ধ্বংসের বিবরণে সবচেয়ে বেশী গুরুত্ব দেওয়াতে একথা মনে করা যায় যে, বৈদিক যুদ্ধের মূল উদ্দেশ্য ছিল বাঁধ ধ্বংস। যেহেতু বাঁধের উপরে বেশী ক্ষোভ ছিল ফলে বাঁধ ধ্বংস হলে বৈদিক পক্ষ যুদ্ধে বিজয়ী হয়েছিল বলে মনে হয়। আর বাঁধ ধ্বংস হয়েছিল সম্ভবত উজানে অবস্থিত নদীগুলিতে। এর ফলে উজান থেকে আসা জল প্রবাহের তোড়ে এমনিতেই দক্ষিণ তথা ভাটির দিকের বাঁধসমূহ ভেঙ্গে গিয়েছিল। হয়ত এই কারণে ঋগ্বেদে একথা বলা হয়েছে, ’রাজা ইন্দ্র বৃত্রকে পূবর্, পশ্চিম ও উত্তর দেশে বধ করেছেন’ (৩/৫৩/১১)। সম্ভবত উভয় পাঞ্জাবে আর হরিয়ানায় বাঁধ ধ্বংস করা হয়েছিল। কিন্তু বালুচিস্তান, সিন্ধু প্রদেশ ও গুজরাটে বাঁধ ধ্বংস করা হয় নাই। অথবা হলেও তা অত্যন্ত সীমিত পর্যায়ে ঘটেছিল। এছাড়া ঋগ্বেদ থেকে মনে হয় বৈদিক আন্দোলন প্রধানত উভয় পাঞ্জাব ও হরিয়ানায় কেন্দ্রীভূত ছিল। যদিও বৃহত্তর সিন্ধু উপত্যকায় অবস্থিত নদীসমূহের নাম ও তাদের ব্যবহারের উল্লেখ থেকে মনে হয় ঋষিরা সমগ্র বৃহত্তর সিন্ধু উপত্যকার ভূমিকে তাদের নিজস্ব ভূমি হিসাবে মনে করেছেন। যেমন, ‘হে অগ্নি। তুমি  দৃষদ্বতী, আপষা ও সরস্বতী তীরস্থিত মনুষ্যের গৃহে ধন বিশিষ্ট হয়ে দীপ্ত হও।’ (৩/২৩/৪), ‘১১। ঊষাদেবীর চ‚র্ণীকৃত শকট বিপাশ নদীর তীরে পড়ে থাকল তিনি দূরদেশে অপসৃত হলেন। ১২। হে ইন্দ্র! তুমি সম্পূর্ণজলা তিষ্টমনা সিন্ধুকে পৃথিবীতে প্রজ্ঞা দ্বারা সংস্থাপিত করেছিলে, ...’ (৪/৩০), দ্রুতগামী নদীসকল কোন অনিষ্ট উৎপাদন না করে, মধুরসের সাথে আমাদের নিকট আসুন। জ্ঞানী উপাসক বিপুল ধনের নিমিত্ত আনন্দদায়ক সপ্ত মহানদীকে  আহ্বান করেন।’ (৫/৪৩/১), ‘সপ্ত সপ্ত জন শক্তিমান মরুৎ এক এক জনে আমাকে এক শত করে প্রদান করুন; আমি যেন যমুনা নদীর তীরে প্রসিদ্ধ ধেনুধন লাভ করি; আমি যেন অশ্বধন লাভ করি।’ (৫/৫২/১৭), ‘এ ঐশ্বর্যশালী রথবীতি গোমতী তীরে  বাস করেন এবং পর্বতের প্রান্তভাগে তাঁর গৃহ অবস্থিত আছে।’(৫/৬১/১৯), ‘হে মরুৎগণ! রসা, সরস্বতী, অনিতভা ও কুভা নামক নদী সকল  এবং সর্বত্র গমনশীল সিন্ধু নদী তোমাদের যেন বিলম্ব উৎপাদন না করে। জলময়ী সরযু  যেন তোমাদের নিরুদ্ধ করে না রাখে;’ (৫/৫৩/৯), ‘গঙ্গার উন্নত কূলের ন্যায় পণিগণের মধ্যে উচ্চস্থানে বৃবু অধিষ্ঠান করেছিলেন।’ (৬/৪৫/৩১), ‘সরস্বতী, সরযু এবং সিন্ধু এ সকল মহাতরঙ্গশালিনী নদী রক্ষা করতে আসুন।’ (১০/৬৪/৯). ‘নদীগণের মধ্যে শুদ্ধা গিরি অবধি সমুদ্র পর্যন্ত গমনশীলা একা সরস্বতী নদী অবগত হয়েছিলেন, ...’ (৭/৯৫/২), ইত্যাদি।

-------------------------------------------------------

বর্তমান লেখকদ্বয়ের রচিত ‘আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা’ গ্রন্থে বৃহত্তর সিন্ধু উপত্যকায় সংঘটিত এই গৃহযুদ্ধের বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। দেখুনঃ শামসুজ্জোহা মানিক ও শামসুল আলম চঞ্চল, আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা, বদ্বীপ প্রকাশন, ঢাকা, ২০০৩, পৃঃ ২৮-৩৭, ১২১-১৪৪। ‘আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা’র অনলাইন লিংক : http://www.bangarashtra.net/article/853.html

   সিন্ধু নদীর পশ্চিম দিকের (কাবুল প্রদেশের) একটি শাখা। এখন এর নাম গোমাল।

এই তিনটি সিন্ধু নদীর পশ্চিম দিকের অর্থাৎ কাবুল প্রদেশের শাখা। কুভাকে এখন কাবুল নদী বলে।

  সরযু নদী পাঞ্জাবের কোনো নদী।

-------------------------------------------------------

একটি বিষয় মনে রাখা দরকার যে, ঋগ্বেদ থেকে সিন্ধু সভ্যতার সব কিছু আশা করা অনুচিত। কারণ ঋগ্বেদ সিন্ধু সভ্যতার একটি ঐতিহাসিক পর্যায়ের একটি খণ্ডিত অংশকে মাত্র প্রতিনিধিত্ব করেছে, সমগ্র সিন্ধু সভ্যতাকে নয়। বস্তুত বাঁধ ধ্বংসের প্রয়োজনে বৈদিক ধর্ম সংস্কারের মাধ্যমে আঞ্চলিক ও গৌণ অনেক উপাদানকে যেমন ঋগ্বেদে আনা হয়েছে তেমন বাইরেরও অনেক কিছুকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ঋগ্বেদের গ্রামীণ পটভূমির প্রাধান্য সম্পর্কে সাধারণভাবে ধারণা করা হয় যে, ঋগ্বেদের ঋষিরা গ্রামীণ পটভূমি থেকে এসেছিলেন। আমরা আগে বলেছি যে, ঋগ্বেদের ঋষিরা সিন্ধু সভ্যতার নাগরিক পটভূমি থেকে এসেছিলেন। তবে দীর্ঘকাল ব্যাপী শাসকদের বিরুদ্ধে বৈদিক সংস্কার আন্দোলন সংগঠিত করতে গিয়ে শক্তিশালী প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধতা ও আক্রমণের ফলে তাদেরকে শহর ত্যাগ করে গ্রামে আশ্রয় নিতে হতে পারে। এছাড়াও সম্ভবত সেখানে বহুকাল থাকতে হয়েছিল। ফলে তাদের অনেক রূপক বর্ণনায় ও আকাঙ্খায় গ্রামীণ পটভূমির ছাপ ধরা পড়ে।

তাছাড়া বৈদিক আন্দোলনের পটভূমি বিচারের সময় আমাদের নদীনিয়ন্ত্রণব্যবস্থার বিপর্যয়ের প্রধান ভুক্তভোগী কৃষক তথা গ্রামীণ জনসমাজের সংকট ও ক্ষোভের বিষয়টিকে বিবেচনায় নিতে হবে। অনুমেয় যে নগরবাসীদের তুলনায় গ্রামীণ কৃষিজীবীরা ছিল এই ব্যবস্থার বিপর্যয়ের সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী। ফলে বৈদিক আন্দোলনের মূল ভিত্তি গঠিত হয়েছিল প্রধানত তাদের সমর্থনে। স্বাভাবিকভাবে যারা ঋগ্বেদ রচয়িতা সেই ঋষিদের মন্ত্র রচনাতেও এই বাস্তবতার ছাপ পড়বে।

আমরা উপরে নদী নিয়ন্ত্রণ ভিত্তিক সেচ ব্যবস্থার বিষয়ে বর্ণনা করতে গিয়ে সিন্ধু সভ্যতার পতনের কারণ কিছুটা বর্ণনা করেছি। সেখানে আমরা বলেছি যে, অনেক শতাব্দী রক্ষণাবেক্ষণের পরেও বাঁধ ভিত্তিক সেচ ব্যবস্থা আর কার্যকর থাকছিল না। ফলে কোথায়ও জলাবদ্ধতা আবার কোথায়ও জলাভাবে মরুকরণ ঘটছিল ও নদীর গতিপথ পরিবর্তন হচ্ছিল। মহেঞ্জো-দাড়োর মত আরো কিছু বসতি বার বার বন্যার কবলে পড়ছিল, অন্যদিকে পাঞ্জাবের চোলিস্তান এলাকায় নদীর গতিপথ পরিবর্তনের ফলে মরুকরণ দেখা দেয়।

অনেক লেখক মনে করেন যে, খ্রীঃপূঃ দ্বিতীয় সহস্রাব্দের প্রথম দিকে জলবায়ুগত পরিবর্তন হলে শুষ্কতা শুরু হয়, যা সিন্ধু সভ্যতার পতনের কারণ হয়।  কিন্তু এই তত্ত্বের দুর্বলতার কারণে এটি সর্বজনগ্রাহ্য হয় নাই। কোনো কোনো লেখক মনে করেন যে, এটি একটি সরলীকৃত মত, যেখানে একটি স্থানিক জলবায়ুগত পরিবর্তনকে সমগ্র সিন্ধু সভ্যতার পতনের জন্য দায়ী করা হয়েছে।

-------------------------------------------------------

দেখুনঃ Gurdip Singh, The Indus Vallley Culture, in, Ancient Cities of the Indus, ed., Gregory L. Possehl, 1979, p. 241.

  গবেষকদ্বয় ডোরিয়ান ফুলার ও মার্কো মেডেলার এ প্রসঙ্গে বক্তব্যটি গুরুত্বপূর্ণ। তাঁরা বলেনঃ `There is a growing discomfort with simplistic environmentally determined understandings of change. When environmental data are confronted with the archaeological evidence for change, which begins in some areas c. 2200 BC and continues through the second millennium BC, it is no longer possible to attribute a single collapse of the Harappan Civilization to a single episode of climatic change. The picture seems to be less unitary and interpretations should allow for more locally articulated explanations of the changes in relation to regional variables during the late third and and second millennium BC.’ দেখুনঃ Dorian Q. Fuller and Marco Madella, Issues in Harappan Archaeobotany: Retrospect and Prospect, in, Protohistory: Archaeology of the Harappan Civilization, eds., S. Settar and Ravi Korisettar, Published by Manohar in association with Indian Council of Historical Research, 2000, p. 366.

-------------------------------------------------------

পাতা : ৬১

সম্প্রতি ভিররানায় প্রাপ্ত পশুর দাঁতের ফসফেটের অক্সিজেন আইসোটোপের উচ্চ বিশ্লেষণ (High resolution oxygen isotope) থেকে জানা যাচ্ছে যে, শস্যের বৈশিষ্ট্যে পরিবর্তন হওয়ায় হরপ্পানদের খাদ্যাভাসে পরিবর্তন তাদের পতনের জন্য দায়ী।  সম্প্রতি হরপ্পার কবরস্থান থেকে পাওয়া নমুনার জীব-প্রত্নতত্ত্ব গবেষণা থেকে কিছু গবেষক জানাচ্ছেন যে, হরপ্পায় নগর-উত্তর পর্বে সময়ের সাথে সংক্রমণ ও সংক্রামক রোগ ও ব্যক্তি পর্যায়ে সংঘাত বেড়ে গিয়েছিল।  তারা পুরা-রোগবিদ্যার (Paleopathology) সাক্ষ্যকে হরপ্পায় জলবায়ুগত পরিবর্তন ও আর্থ-সামাজিক বিপর্যয়ের ফল বলে মনে করেন। ২০০৭ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত ভারতের উত্তর-পশ্চিম অংশে গবেষণা পরিচালনা করে একদল গবেষক জানাচ্ছেন যে, ২২০০ থেকে ২১০০ খ্রীঃপূঃ-এর দিকে মৌসুমী বৃষ্টিপাত দুর্বল হয়ে পড়ে। এই জলবায়ু ও পরিবেশগত পরিবর্তনের সঙ্গে কিছু অঞ্চলের মানুষদের খাপ খাইয়ে নিতে হয়েছিল।  গুজরাটের কানমের নামে বসতিতে গবেষণা চালিয়ে প্রায় একই ধরনের সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন গবেষকরা। তারা জানিয়েছেন যে, জলবায়ুগত পরিবর্তনের ফলে বিদায়ী হরপ্পান পর্যায়ে নূতন ধরনের উদ্ভিদের ব্যবহার দেখা যায় যা আগে ছিল না।  তবে গবেষকরা হরপ্পান সভ্যতা ক্ষয়ের জন্য তীব্র শুষ্ক জলবায়ুকে কারণ মনে করেন না।  অন্যান্য কারণ থাকলেও সিন্ধু সভ্যতার পতনের প্রধান কারণ হিসাবে সিন্ধু সভ্যতার শাসকরা কৃষিক্ষেত্রে জল সরবরাহ করার জন্য নদীতে বাঁধ নির্মাণের ফলে নদীর গতিপথ পরিবর্তন, জলাবদ্ধতা, বিভিন্ন এলাকায় মরুকরণ ইত্যাদি বলে আমরা মনে করি।

-------------------------------------------------------

 গবেষকরা বলছেনঃ `Our study suggests that other cause like change in subsistence strategy by shifting crop patterns rather than climate change was responsible for Harappan collapse.’  দেখুনঃ Anindya Sarkar, Arati Deshpande Mukherjee, M.K. Bera, B. Das, Navin Juyal, P. Morthekai, R.D. Deshpande, V.S. Shinde & L.S. Rao, Oxygen isotope in archaeological bioapatites from India: Implications to climate change and decline of Bronze Age Harappan Civilization, in, Scientic Reports 6, 26555; doi: 10.1038/srep26555, 2016, p. 1.

দেখুনঃ Gwen Robbins Schug, K. Elaine Blevins, Brett Cox, Kelsey Gray & V. Mushrif-Tripathy, Infection, Disease, and Biosocial Processes at the End of the Indus Civilization, in, PLoS ONE 8(12): e84814. Doi: 10.1371/journal.pone.0084814, pp. 1, 9-11.

দেখুনঃ Cameron A. Petrie, Ravindra N. Singh, Jennifer Bates, Yama Dixit, Charly A.I. French, David A. Hodell, Penelope J. Jones, Carla Lancelotti, Frank Lynam, Sayantani Neogi, Arun K. Pandey, Danika Parikh, Vikas Pawar, David I. Redhouse, and Dheerendra P. Singh, Adaptation to Variable Environments, Resilience to Climate Change: Investigating Land, Water and Settlement in Indus Northwest India, in, Current Anthropology, Volume 58, Number 1, 2017, p. 18.

দেখুনঃ Anil K. Pokharia, Jeewan Singh Kharakwal, R.S. Rawat, Toshiki Osada, C.M. Nautiyal and Alka Srivastava, Archaeobotany and Archaeology at Kanmer, a Harappan site in Kachchha, Gujarat: evidence for adaptation in response to climatic variability, in, Current Science, Vol. 100, No. 12, 2011, p. 1844.

দেখুনঃ Marco Madella and Dorian Q. Fuller, Palaeoecology and the Harappan Civilization of South Asia: a reconsideration, in, Quarternary Science Review 25, 2006, p. 1298.

-------------------------------------------------------

তবে সিন্ধু সভ্যতার পতনের কারণ যাই হোক না কেন সভ্যতাটি শেষের দিকে সংকটে পড়েছিল। ক্ষয়িষ্ণু ও সংকটে আপতিত সিন্ধু সভ্যতার শেষ পর্যায়ে বৈদিক পক্ষের মানুষেরা বাঁধ ধ্বংস ও ছোট আকারে সীমিত কিছু যুদ্ধের মধ্য দিয়ে এক সময়ে একটি শক্তিশালী কিন্তু পতনোন্মুখ সভ্যতার পতনকে ত্বরান্বিত করে। বস্তুত একটা পর্যায়ে সংকটের কারণে সভ্যতা এমনিতেই ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু বৈদিকরা সিন্ধু সভ্যতার প্রাণশক্তির উৎস বাঁধব্যবস্থা ধ্বংস করে দিলে কৃষির ভিত্তি ধ্বংস হওয়ায় নূতন করে তারা আর সভ্যতা গড়তে যেমন পারল না তেমন সভ্যতার অর্থনৈতিক ভিত্তি ধ্বংস হবার ফলে সিন্ধু সভ্যতার রাষ্ট্রও ধ্বংস হল।

 এরপর কিছুকাল রাষ্ট্রহীন ও কেন্দ্রীয় নেতৃত্বহীন মানুষদের বড় অংশ নূতন নূতন অঞ্চলে অভিগমন করল। কিছু অংশ সেখানকার আগের বসতিগুলিতে বসবাস করতে থাকে। তবে তাদের জীবনযাত্রায় যেমন আগের সমৃদ্ধি আর থাকে নাই, তেমন কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থা না থাকায় সিন্ধুর সীল, লিপি, বাটখারা, ইত্যাদি ব্যবহারের আর প্রয়োজন থাকে নাই। ফলে এগুলির ব্যবহার বিদায়ী হরপ্পান হরপ্পান পর্যায়ে আর দেখা যায় না। অন্যদিকে বাঁধ ধ্বংস হওয়ার ফলে সেচভিত্তিক কৃষিব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ায় সেখানকার বহু সংখ্যক বসতি পরিত্যক্ত হয় ও সেখানকার অধিবাসীরা বিভিন্ন দিকে অভিগমন করতে থাকে। এর মধ্যে একটি বড় অংশ নিকটবর্তী পূর্ব দিকের গাঙ্গেয় উপত্যকায় অভিবাসন করে, সেখানকার পূর্ব থেকে যাতায়াত ও যোগাযোগের সূত্র ধ’রে। বৈদিকদেরও প্রধান অংশ পূর্ব দিকে অভিবাসন করেছিল বলে ধারণা করা যায়। তাদের উত্তরসূরিরা ব্রাহ্মণ্য ধর্ম প্রতিষ্ঠা করে।

আবার শাসকশ্রেণীর প্রধান অংশ যারা বাঁধ ভিত্তিক নদীনিয়ন্ত্রণব্যবস্থার পক্ষে ছিল তারা এবং জনসংখ্যার অপর এক বৃহদাংশ পশ্চিম দিকে অভিগমন ক’রে ইরান, সিরিয়া, আনাতোলিয়া ও ক্রমশ আরো পশ্চিমে গ্রীস সহ ইউরোপের বিভিন্ন অংশে বসতি স্থাপন করে। পরের অধ্যায়ে আমরা দেখিয়েছি যে, সিন্ধু সভ্যতার শেষ পর্যায়ে বৈদিক সংস্কার শুরু হলে শাসক শ্রেণীর আনুকূল্য প্রাপ্ত পুরোহিতরা যারা বাঁধ ভিত্তিক নদীনিয়ন্ত্রণব্যবস্থার পক্ষে ছিল তারাও একই সময়ে বৈদিক সংস্কারকে মোকাবিলা করতে গিয়ে প্রচলিত ধর্মকে সংস্কার করে ও পরে ইরানে অভিবাসন করলে সেখানে এই নূতন ধর্ম নিয়ে যায়। এই ধর্মকে আমরা জরথুস্ত্রীয় ধর্ম বা আবেস্তান ধর্ম বলে জানি।  তবে উপমহাদেশে এই ধর্ম ও ধর্মাবলম্বীরা পার্সী হিসাবে সমধিক পরিচিত।

পাতা : ৬২

 

তৃতীয় অধ্যায়

আবেস্তান ধর্ম সংস্কার আন্দোলন

এটি খুব তাৎপর্যপূর্ণ যে, প্রাচীন ইরানীয়দের ধর্মগ্রন্থ আবেস্তায় উল্লেখিত বহু নাম ও বিবরণ থেকে ধারণা করা যায় যে, আবেস্তা ও ঋগ্বেদ একই পটভূমি থেকে উদ্ভূত হয়েছে। আবেস্তার ভাষাও ঋগ্বেদের খুব কাছাকাছি। আমরা এখানে এই বিষয়টি দেখতে পাব যে, সিন্ধু সভ্যতার শেষ পর্যায়ে নদীনিয়ন্ত্রণব্যবস্থায় বিপর্যয়ের কারণে সমাজে সংকট প্রবল আকার ধারণ করলে একদিকে যেমন ঋগ্বেদের ঋষিদের নেতৃত্বে বৈদিক ধর্ম সংস্কার আন্দোলন শুরু হয়, বিপরীত দিকে তেমন যে সমস্ত ঋষি বা ধর্ম নেতারা শেষ পর্যন্ত সিন্ধু সভ্যতার রাষ্ট্রের আনুকূল্যপ্রাপ্ত ধর্মের পক্ষে ছিল তাদের নেতৃত্বে অপর একটি ধর্ম সংস্কার আন্দোলন সংগঠিত হয়।

এই ধর্মের গ্রন্থের নাম আবেস্তা হওয়াতে এই ধর্ম আবেস্তান ধর্ম নামেও পরিচিত। জরথুস্ত্রের নেতৃত্বে এই আন্দোলন হয় বলে এই ধর্ম জরথুস্ত্রীয় ধর্ম নামেও পরিচিত। এবং যে কথা একটু আগেই বলেছি, এটি পার্সী ধর্ম হিসাবেও পরিচিত। সিন্ধু সভ্যতার পতনের সাথে সামগ্রিক নদীনিয়ন্ত্রণ ভিত্তিক সেচ ব্যবস্থার বিপর্যয় হলে বিদ্রোহী বৈদিক পক্ষ ক্রমে গাঙ্গেয় সমভূমিতে স্থানান্তর গমন করে। অন্যদিকে আবেস্তান বা জরথুস্ত্রীয় ধর্মের অনুসারীরা পশ্চিম দিকে ইরানে অভিগমন করে।    

সম্ভবত এইজন্য পশ্চিমে সিন্ধু সভ্যতার সবচেয়ে স্পষ্ট উপস্থিতি দেখতে পাওয়া যায় ইরানে। প্রাচীন ইরানীয়দের ভাষা বৈদিক ভাষার অনেক নিকটবর্তী।  প্রাচীন ইরানীয়দের জরথুস্ত্রীয় ধর্মের গ্রন্থ আবেস্তা থেকে এর সপক্ষে বহু সংখ্যক দৃষ্টান্ত দেওয়া যায়। ধর্মগ্রন্থ আবেস্তাকে একাধিক বিপর্যয় ও পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে আসতে হয়েছে। সিন্ধু সভ্যতার পতন এবং বালুচিস্তান হয়ে ইরানে অভিগমন ও অভিবাসন নিঃসন্দেহে একটি বড় ধরনের বিপর্যয় ছিল। কিন্তু আবেস্তার জন্য আরও অনেক বড় ও মারাত্মক বিপর্যয় ঘটে গ্রীক বিজয়ী আলেকজান্ডারের হাতে ৩৩১ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে পারস্য সম্রাট ৩য় দারিউসের পরাজয় এবং পারস্য সাম্রাজ্যের পতন হলে। পারস্য জয়ের পর আলেকজান্ডার আবেস্তার বিশাল সংগ্রহকে লুণ্ঠন ও ধ্বংস করেন। একটা রাষ্ট্রের সমান্তরালে কেন্দ্রীভূত ধমীয় প্রতিষ্ঠান হিসাবে আবেস্তান ধর্মের বিকাশ ও প্রতিষ্ঠা আলেকজান্ডারের ধ্বংসাত্মক ভূমিকা পালনকে সহজতর করেছিল। তথাপি পারসিকরা স্বাধীন রাষ্ট্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার পর বিভিন্নভাবে লিপিবদ্ধ ও স্মৃতিতে সংরক্ষিত মন্ত্রগুলিকে সংকলিত করে আবেস্তাকে পুনর্বিন্যস্ত করে। আবেস্তার উপর পরবর্তী ভয়ঙ্কর আঘাত আসে মুসলিম আরব বিজয়ের পর। এই সময় ইরানীদেরকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণে বাধ্য করা হয়। যে সকল ইরানী তাদের পিতৃপুরুষের ধর্ম ত্যাগে রাজী হয় নাই তাদের মধ্যে জীবিতরা পালিয়ে ভারতে এসে বিশেষত মুম্বাইসহ উপকূলীয় অঞ্চলগুলিতে আশ্রয় নেয়। এদের দ্বারা রক্ষিত হয়ে আবেস্তার যেটুকু অংশ টিকে আছে আমরা সেটুকুকেই আজকের আবেস্তা হিসাবে দেখতে পাচ্ছি।

-------------------------------------------------------

এই বিষয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে ঐক্যমত রয়েছে। গবেষক ওকটোর স্কেয়ারভপ্ বলেন, ‘Old Avestan is extremely archaic by Indo-Iranian standards, its grammar being largely identical with that of the oldest Ṛgveda. More specifically, it has preserved the old aspect system, with a living opposition between the present/ imperfect and the aorist, and the old injunctive has preserved its old functions. It is therefore commonly, and justly, assumed that the Old Avestan texts were composed by authors who lived not only many centuries later than the separation of the Indian and Iranian tribes and who still knew well the poetical language of the common Indo-Iranian period.’ দেখুনঃ P. Oktor Skærvø, The Avesta as source for the early history of the Iranians, in, The IndoAryans of Ancient South Asia: Language, Material Culture and Ethnicity, ed., George Erdosy, Munshiram Manoharlal Publishers Pvt. Ltd., New Delhi, 1997, p. 161.

-------------------------------------------------------

সুতরাং আবেস্তান ধর্ম কিংবা ধর্মগ্রন্থ আবেস্তার বিচারর সময় আমরা যেন আবেস্তা রচনার সময় থেকে তার একাধিক বিরাট বিপর্যয়ের কথা মনে রাখি। এ প্রসঙ্গে আর একটু উল্লেখ করা যায় যে, আবেস্তান ধর্মের প্রবর্তক জরথুস্ত্রের মৃত্যু তার শত্রুদের হাতে হয়েছিল বলে জানা যায়। আমরা অনুমান করি বৈদিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে পাল্টা একটা ধর্মসংস্কার আন্দোলন করার সময় তাকে বৈদিক পক্ষ হত্যা করে।

আসলে সিন্ধুর প্রচলিত ধর্ম সিন্ধুর শান্তিপূর্ণ ঐতিহ্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হওয়ায় পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে যখন বিশেষত বৈদিক সংস্কারের মাধ্যমে যুদ্ধ ও হিংসা প্রাধান্যে এসেছে তখন বৈদিক পক্ষকে মোকাবিলা করার জন্য নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার পক্ষাবলম্বনকারী পুরাতন ধর্মীয় শক্তির অনুসারীদের জন্যও পুরাতন বা প্রচলিত ধর্ম অনুপযোগী হয়ে পড়েছিল। সুতরাং তাদের নিকটও যুদ্ধকে প্রাধান্য দানের উপযোগী ধর্মের প্রয়োজন হয়েছিল। এই প্রয়োজন পূরণের জন্য পুরাতন ধর্মে যে সংস্কার সাধন দরকার ছিল সেটা জরথুস্ত্র করেছিলেন বলে আমরা ধারণা করি। এভাবে সিন্ধু সভ্যতার পরিবর্তিত পরিস্থিতি সমান্তরালে দুইটি পরস্পর বিরোধী ধর্মের জন্ম দেয়। তবে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বৈদিক ধর্ম যেখানে হল বিকেন্দ্রীভূত সেখানে আবেস্তান ধর্ম হল কেন্দ্রীভূত। রাষ্টের প্রয়োজনে এবং সমান্তরালে যেমন একজন নেতা তথা সংস্কারকের নেতৃত্বে আবেস্তন ধর্মের জন্ম তেমন প্রকৃতপক্ষে রাষ্ট্রের অস্তিত্ব এবং পৃষ্ঠপোষকতা হারাবার সাথে তার মৃত্যুও হল।

আবেস্তাকে নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে এখানে আর একটি কথা বলে রাখা উচিত হবে যে, শুরুতে যে ভাষায় আবেস্তা লিখা হয়েছিল সে ভাষায় এটা আর রক্ষিত হয় নাই। সামাজিক, রাজনৈতিক বিপর্যয়, স্থান পরিবর্তন ইত্যাদি যেমন আবস্তার ধর্মানুসারীদের ভাষায় অনেক পরিবর্তন ঘটিয়েছে তেমন তাদের আদি ধর্মগ্রন্থেও অনেক পরিবর্তন ঘটিয়েছে। সেটা ভাষার ক্ষেত্রেও। অর্থাৎ আবেস্তার মূল ভাষাও আর অপরিবর্তিত আছে এ কথা মনে করার কারণ নাই। এ দিক থেকে আবেস্তান ধর্ম বৈদিক ধর্ম থেকে অনেক বেশী দুর্ভাগ্য পীড়িত। তা সত্ত্বেও ঋগ্বেদ এবং আবেস্তাকে যখন পাশাপাশি রেখে পাঠ করা যায় তখন একই ভূমির সন্তান হিসাবে দুইটিকেই চেনা যায়।  তবে দুইটি পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত।

বিশেষত সিন্ধু সভ্যতার পটভূমিতে রেখে আমরা যখন আবেস্তা এবং ঋগ্বেদকে বিচার করি তখন আমাদের কাছে এটি আরও স্পষ্ট হয় যে, যে ভাষায় ঋগ্বেদ লিখা হয়েছে সেই একই ভাষায় শুরুতে আবেস্তাও লিখা। কেন্দ্রীভূত প্রতিষ্ঠানের আশ্রয় না নিয়ে ব্রাহ্মণদের কুলগত বা বংশগত আশ্রয় এবং বিশেষত গ্রামীণ সমাজের পৃষ্ঠপোষকতা নিয়ে চার হাজার বছর কাল যেভাবে ঋগ্বেদ রক্ষা পেয়েছে রাষ্ট্র এবং কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠানের আশ্রয়ে বিকশিত ও রক্ষিত আবেস্তা তার সেই আশ্রয় হারিয়ে শত্রুশক্তির আক্রমণের মুখে কিংবা বৈরী পরিস্থিতিতে আর সেভাবে নিজেকে রক্ষা করতে সমর্থ হয় নাই।

আবেস্তার অন্তর্গত ভেনদিদাদে জরথুস্ত্রীয় ধর্মের ঈশ্বর বা প্রধান দেবতা অহুর মযদা কর্তৃক নির্মিত ষোলটি খাঁটি বা পবিত্র ভূমি বা দেশের কথা বলা হয়েছে। এই ষোলটি ভাল দেশের প্রথমটি হল আইরিয়ান বয়েজ (Airyana Vaêgô), ষষ্ঠ হল হরয়ো (Harôyu), দশম হল হরহ্বৈতি (Harahvaiti) ও পঞ্চদশ হল সপ্ত নদীর দেশ বা হপ্ত হিন্দব (Hapta hindava) বা সপ্ত-সিন্ধু।  আর্য ব্রজ থেকে আইরিয়ান বয়েজ-এ রূপান্তর ঘটেছে বলে ধারণা করা যায়। ব্রজ অর্থ দেশ। কাজেই আইরিয়ান বয়েজ আর্য দেশের রূপান্তর হওয়াই স্বাভাবিক। আবেস্তার অনেক জায়গায়ও দেশ হিসাবে আইরিয়ানেম বয়েজ-এর নাম গর্বভরে বলা হয়েছে, যা আর্য ব্রজের রূপান্তর। প্রাচীন ইরানীয় ভাষায় স-এর উচ্চারণ হ-এর মত। সুতরাং হরয়ো নামটি সরযু থেকে পরিবর্তিত হয়েছে। আমরা জানি যে, সরযু সিন্ধু উপত্যকায় অবস্থিত একটি নদীর নাম। একই ভাবে হরহ্বৈতি যে সরস্বতী নাম থেকে রূপান্তরিত এটি স্পষ্ট। এছাড়া হপ্ত হিন্দব যে সপ্ত সিন্ধু থেকে এসেছে সেটিও স্পষ্ট। সরযু ও সরস্বতীর মত নদীর নাম থেকে যেমন তেমন সর্ব প্রথম দেশ আর্য ব্রজ এবং সপ্ত সিন্ধু নাম থেকে বুঝা যায় যে, সিন্ধু সভ্যতার উজ্জ্বল স্মৃতি তারা তখনো বহন করছে। আবেস্তার ভেনদিদাদে আইরিয়ান বয়েজকে উচ্চ খ্যাতি বা যশের বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

-------------------------------------------------------

  দেখুনঃ James Darmesteter (Translated), The Zend Avesta, Part I, The Vendȋdâd, Second Edition, Oxford: At the Clarendon Press, 1895, (The Secred Books of the East Series, Vol. IV), pp. 2-9.

  সেখানে এভাবে বলা হয়েছে, `… the Aiiryana Vaêgô of high renown.’ দেখুনঃ প্রাগুক্ত গ্রন্থ, পৃঃ ১৫।

-------------------------------------------------------

আবেস্তা সম্পর্কে আলোচনার সময়ে একথা মনে রাখা দরকার যে, যে আবেস্তাকে আমরা এখন দেখছি তা তার আদি রূপে নাই। বর্তমান আবেস্তা প্রাচীন ধর্মগ্রন্থের বিভিন্ন বিক্ষিপ্ত অংশকে সংগ্রহ করার পর সংকলন করে বর্তমান রূপ দেওয়া হয়েছে। সুতরাং আবেস্তায় বর্ণিত বিভিন্ন নাম বা ঘটনা পরবর্তীকালে পরিবর্তিত হয়ে আমাদের হাতে এসেছে। তারপরেও আবেস্তা থেকে সিন্ধু সভ্যতার স্মৃতি ও অনেক বৈদিক নাম পাওয়া যায়। আরেকটি কথা মনে রাখা দরকার যে, সপ্ত-সিন্ধুকে আবেস্তায় অনেক গুরুত্বের সাথে বলা হয়েছে। এছাড়াও আবেস্তায় তার ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা জরথুস্ত্র আর্য অঞ্চলের বা দেশের গৌরব নিয়ে মন্ত্রোচ্চারণ করেছেন। সেখানে আর্য দেশের কথা অনেকবার বলা হয়েছে।

পাতা : ৬৩

আবেস্তার ঈশ্বর বা সর্বোচ্চ দেবতা হলেন অহুর ময্দা (Ahura Mazda)। এটি যে, অসুর ময্দা থেকে রূপান্তরিত তা স্পষ্ট।  আমরা মনে করি সিন্ধু সভ্যতার শেষ পর্যায়ে রাষ্ট্র শাসনে কিছুটা ধর্মের প্রভাব শুরু হলে যখন বরুণকে প্রধান দেবতায় রূপান্তরিত করা হয় সেই বরুণকেই আবেস্তান ধর্ম সংস্কারকরা প্রধান দেবতা করে নেয়। পুরাতন ধর্মকাঠামোতে ইন্দ্র প্রভৃতি বৈদিক দেবতার সঙ্গে বরুণের নাম ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত থাকায় পুরাতন ধর্মের সংস্কারের প্রয়োজনে বরুণকে বরুণ নামে অভিহিত না করে অহুর ময্দা নামে অভিহিত করা হল। এইভাবে আবেস্তানরা বৈদিকদের মত বরুণের মর্যাদা না নামিয়ে তাকে ভিন্ন নামে রক্ষা করল। হতে পারে যে, অহুর ময্দা অসুর মস্তক থেকে আগত। যার অর্থ হতে পারে অসুর শ্রেষ্ঠ কিংবা সর্বোচ্চ অসুর। যেহেতু ঈশ্বর অর্থে তা সর্বোচ্চ অসুর সেই হেতু তাকে শুধু বাস্তব পৃথিবীর নয়, অধিকন্তু সব অসুর বা দেবতারও স্রষ্টা বলা হচ্ছে।   

ঋগ্বেদে যেমন শত্রুপক্ষকে সাধারণভাবে অসুর বলা হচ্ছে, বিপরীতভাবে আবেস্তায় শত্রুপক্ষকে দয়েব বা দয়েবদের সৈনিক বা অনুসারী বা দয়েব-পুজারী বলা হচ্ছে। দয়েব যে দেব থেকে রূপান্তরিত তাতে সন্দেহ নাই। আবেস্তায় দয়েব বা দেব পক্ষের সাথে সংঘাত ও যুদ্ধের বিবরণ আছে। সেখানে দেব পক্ষ বা বৈদিকদের প্রতি প্রবল ঘৃণা প্রকাশ করা হয়েছে। আবেস্তার একটি জায়গায় বলা হচ্ছে:

‘৫৫(১৩৭)। হে বাস্তব পৃথিবীর সৃষ্টিকর্তা, হে পবিত্র! কোথায় সেই দয়েবরা? কোথায় তারা দয়েবদের আহুতি দেয়? কি সেই স্থান যেখানে দয়েবদের সৈনিকেরা একসাথে ছুটে যায়, যেখানে দয়েবদের সৈনিকেরা ছুটে আসে? কি সেই স্থান যেখানে তারা একসাথে ছুটে যায় তাদের বহু পঞ্চাশগুণ, তাদের বহু শত ও তাদের বহু সহস্র, তাদের বহু শত ও তাদের বহু অযুত, তাদের বহু অযুত ও তাদের অযুতের অযুত?’ (ভেনদিদাদ, ফারগার্ড ৭)

আবেস্তার ওরমায্দ্ ইয়াস্ত্-এ বলা হচ্ছেঃ

-------------------------------------------------------

আবেস্তার ওরমায্দ্ ইয়াস্তের এই অংশটুকু নেওয়া হয়েছেঃ James Darmesteter (Translated), The Zend Avesta, Part II, The Sȋrôzahs, Yasts, and Nyâyis, Oxford: At the Clarendon Press, 1883, (The Secred Books of the East Series, Vol. XXIII), p. 22.

-------------------------------------------------------

‘আমি নিজেকে ময্দার পুজারী হিসাবে, জরথুস্ত্রের অনুসারী হিসাবে স্বীকার করি, যে দয়েবদের ঘৃণা করে ও অহুরের আইনকে পালন করে।’

আবেস্তায় স্থানের নাম থেকে যেমন তেমন সিন্ধু সভ্যতার শেষ পর্যায়ে বৈদিক ধর্ম সংস্কার আন্দোলনের বিরুদ্ধে আবেস্তানদের নানা বিবরণ থেকে আমরা দৃঢ়ভাবে মনে করি যে, আবেস্তানরা সিন্ধু সভ্যতার ঐতিহ্য থেকে আগত। অর্থাৎ সিন্ধু সভ্যতার সংকটের সময়ে বৈদিক পক্ষ ধর্ম সংস্কার আন্দোলন শুরু করলে সিন্ধু সভ্যতার শাসকদের একটি অংশ অপর একটি ধর্ম সংস্কার আন্দোলন শুরু করে। এই ধর্ম সংস্কার আন্দোলনই আবেস্তান ধর্ম সৃষ্টি করে। ইতিপূর্বে যে কথা বলেছি তার পুনরুক্তি হলেও এ কথা দৃঢ়তার সাথে বলি, আবেস্তান ধর্মের উদ্ভব সপ্ত সিন্ধু অঞ্চলে এবং এর সময় সিন্ধু সভ্যতার পতনের সময়ে। এই বিষয়ে নীচে আরো আলোচনা করা হয়েছে।    

ঋগ্বেদের অনেক দেবতাকে আবেস্তার দেবতা হিসাবে পাওয়া যায়। যেমন, মিত্র, বায়ু, অপাং নপাৎ, যম (আবেস্তার ইম), ইত্যাদি। আবার আবেস্তার অনেক নাম ঋগ্বেদেও পাওয়া যায়। যেমন, আবেস্তার বহুমনো বা বসুমনো ও ঋগ্বেদের বসুমনা, আবেস্তার যাতু ও ঋগ্বেদের যাতুষ্ঠির ও যাতুধান, আবেস্তার হওম অর্থাৎ সোম ও ঋগ্বেদের সোম, আবেস্তার যযাত ও ঋগ্বেদের যযাতি। আবেস্তার অঙ্গ্রা মইন্যু হল অপদেবতা। তাকে সকল অশুভের জন্য দায়ী করা হয়েছে। আবেস্তায় ইন্দ্র অপদেবতা বা পাতাল নিবাসী অশুভ শক্তি হলেও অহুর ময্দার প্রধান প্রতিপক্ষ হল অঙ্গ্রা মইন্যু। অঙ্গিরা থেকে অঙ্গ্রা ও সম্ভবত মন্যু থেকে মইন্যু। ঋগ্বেদে মন্যু দেবতা বা অপদেবতা যে কোনোটাই হতে পারে বলে মনে হয়। ঋগ্বেদের ৭/৮৬/৬ ঋকে ঋষি বসিষ্ঠ বলছেনঃ ‘হে বরুণ! সে পাপ নিজের দোষে নয়। এ ভ্রম বা সুরা বা মন্যু বা দ্যূতক্রীড়া বা অবিবেকবশত ঘটেছে। কনিষ্ঠকে জ্যেষ্ঠেও বিপথে নিয়ে যায়, স্বপ্নেও পাপ উৎপন্ন হয়’। ১০ মণ্ডলে মন্যু দেবতার উদ্দেশ্যে রচিত দুইটি সূক্ত আছে। ১০ মণ্ডলের অন্য একটি ঋকে বলা হচ্ছেঃ ‘হে মন্যু অর্থাৎ ক্রোধের অধিষ্ঠাত্রী দেবতা।’ তার উদ্দেশ্যে এমনভাবে স্তুতি করা হচ্ছে যেন তাকে ইন্দ্রের সমার্থক বলে মনে হয়। সংস্কৃত অভিধানে  মন্যু শব্দের অর্থ বলা হচ্ছে - মন, ভাব, আত্মা, ক্রোধ, ঘৃণা, তেজ, ইত্যাদি। আবেস্তায় ‘মইন্যু’ অসৎ নীতি ও ভাব অথবা অশুভ মন-আত্মা ইত্যাদি অর্থে ব্যবহার হয়েছে বলে মনে হয়। কারণ আবেস্তার ঈশ্বর তথা সর্বোচ্চ দেবতা অহুর ময্দার বিরোধিতা করাই অঙ্গ্রা মইন্যুর কাজ। ঋগ্বেদে বৈদিক আন্দোলনের সূচনাকারী হিসাবে অঙ্গিরা ঋষি বা ঋষিগণের নাম পাওয়া যায়। আমরা মনে করি, বৈদিক আন্দোলন সূচনা করার জন্য অঙ্গিরা ঋষি কিংবা অঙ্গিরা ঋষিগোষ্ঠীর প্রতি আবেস্তান পক্ষের যে ঘৃণা তা থেকে অহুর মযদার প্রধান শত্র বা প্রধান অশুভ শক্তি হিসাবে অঙ্গ্রা মইন্যু শব্দ ব্যবহার হয়েছে। ইসলামে যেমন আল্লাহ্ এবং শয়তানের সম্পর্ক আবেস্তান ধর্মে অনেকটা তেমন অহুর মযদা এবং অঙ্গ্রা মইন্যুর মধ্যকার সম্পর্ক। আমরা ধারণা করি আবেস্তান ধর্ম থেকে ইসলাম তার আল্লাহ এবং শয়তানের মধ্যকার দ্ব›দ্বমূলক সম্পর্কের তত্ত্ব নিয়েছে।

-------------------------------------------------------

  এই গ্রন্থে সংস্কৃত বা বৈদিক শব্দের জন্য মনিয়ার-উলিয়ামের অভিধান ব্যবহার করা হয়েছে। দেখুনঃ Monier Monier-Williams, A Sankrit-English Dictionary, Motilal Banarsidass Publishers Private Limited, Delhi, Reprnted 1995, p. 786.

-------------------------------------------------------

আবেস্তায় প্রধান দেবতা অহুর ময্দার প্রিয় সৃষ্টি এবং শক্তিশালী দেবতা হিসাবে মিথ্রকে দেখতে পাই। মিথ্র নামের সাথে ঋগ্বেদের মিত্রের নামের মিল তাৎপর্যপূর্ণ। ঋগ্বেদে মিত্রকে লোকপতি বলা হয়েছে। ৮/২৫ সূক্তে মিত্র সম্পর্কে বলা হয়েছেঃ

‘১৬। লোকপতি মিত্র বহুসংখ্যক প্রধান দ্রব্য এ প্রকারে দর্শন করেন। মিত্র ও বরুণের মধ্যে আমরা তোমাদের জন্য তাঁরই ব্রত পালন করব। ১৭। পরে সাম্রাজ্যবিশিষ্ট বরুণের পুরাতন গৃহ প্রাপ্ত হব, অতিশয় প্রসিদ্ধ মিত্রের ব্রতও লাভ করব।’

ঋগ্বেদের মিত্রের সাথে আবেস্তার মিথ্রকে মিলানো যেতে পারে। আবেস্তায় বলা হচ্ছেঃ

‘৬। আমরা মিথ্রের উদ্দেশ্যে আহুতি দিই। তিনি বিস্তীর্ণ চারণভূমির অধিপতি, সত্যবাদী, সভাসমূহের প্রধান। সহস্র কর্ণ, সুন্দর আকৃতি, দশ সহস্য চক্ষু ও পূর্ণ জ্ঞান বিশিষ্ট এ মিথ্র বলবান, নিদ্রাহীন ও চিরজাগ্রত।

৭। সকল দেবতার মধ্যে যাঁকে অহুর ময্দা সবচেয়ে গৌরবান্বিত করে সৃষ্টি করেছেন সকল দেশের প্রভু সেই মিথ্রের উদ্দেশ্যে আমরা আহুতি দিই। সুতরাং মিথ্র এবং অহুর এই দুই মহান দেবতা আমাদের সাহায্যার্থে আগমন করুন।’ (নিয়াইস, ২: মিহির নিয়াইস)

আবেস্তার আরেকটি জায়গায় বলা হচ্ছেঃ

‘মিথ্র, যিনি বিস্তীর্ণ চারণভূমির প্রভু, আমাদের দেশসমূহের সকল উৎকর্ষতা বৃদ্ধি করেন, এবং তাদের সমস্যাসমূহকে হ্রাস করেন; শক্তিশালী অপাম নপাৎ আমাদের দেশ সমূহের উৎকর্ষতা বৃদ্ধি করেন এবং তাদের সমস্যাসমূহকে হ্রাস করেন।’ (ফারবারদিন ইয়াস্ত্, ২৪, ৯৫)

আবেস্তায় মিথ্রের সম্পর্কে বলতে গিয়ে এ কথা বলা হয়েছে যে, তিনি বিস্তৃত চারণভূমির অধিপতি, যিনি আর্য জাতিসমূহকে সুখপ্রদ ও ভাল আবাসস্থল দেন (মিহির ইয়াস্ত, ১, ৪), যিনি সত্য কথা বলেন, যিনি পরিষদসমূহের প্রধান (মিহির ইয়াস্ত, ২,৭), ইত্যাদি। কিছু জায়গায় মিথ্র ও অহুরকে একসাথে বলা হয়েছে, যেমন, “আমরা মিথ্র ও অহুরকে আহুতি দিই, যাঁরা মহান, নশ্বর ও পবিত্র দেবতা; ...। আমরা মিথ্রকে আহুতি দিই যিনি সকল দেশের অধিপতি।” (মিহির ইয়াস্ত, ৩৫, ১৪৫)

ঋগ্বেদের একটি গুরুত্বপূর্ণ দেবতা বায়ুকেও আবেস্তায় পাওয়া যায়। আবেস্তায় বায়ু (Vayu) একটি গুরুত্বপূর্ণ দেবতা। এখানে বলা হচ্ছেঃ

‘রাম হ্বাস্ত্রের (Râma Hvâstra) প্রতি, বায়ুর প্রতি যারা উচ্চতম স্তরে কাজ করে এবং অন্য জীবের চেয়ে যারা উৎপীড়িত করতে অধিক শক্তিশালী।’ (১৫। রাম ইয়াস্ত, ০)

এছাড়াও, বায়ু সম্পর্কে আরো দেখিঃ

‘আমরা তোমার প্রতি আহুতি দিই, হে মহান বায়ু! আমরা তোমার প্রতি আহুতি দিই, হে শক্তিশালী বায়ু!

আমরা বায়ুর প্রতি আহুতি দিই, মহত্তমের মধ্যে মহত্তম; আমরা বায়ুর প্রতি আহুতি দিই, শক্তিশালীদের মধ্যে শক্তিশালী।’ (১৫। রাম ইয়াস্ত, ১১, ৫৭)

আবেস্তায় ইম (Yima) নামের উল্লেখ পাওয়া যায়, যা ঋগ্বেদের যম-এর রূপান্তর বলে মনে হয়। ঋগ্বেদে যম নামে দেবতা ও ঋষি পাওয়া যায়। তবে ঋগ্বেদের যম পৌরাণিক যম নয়, ঋগ্বেদের যম পুণ্যকর্মের পুরষ্কারবিধাতা। আবেস্তায় ইম সম্পর্কে নীচের বিবরণটি উল্লখযোগ্যঃ

‘আমরা বিবনঘন্টের পুত্র, পবিত্র ইমের ফ্রবাশিকে পূজা করি; এই সাহসী ইমের, যার ইচ্ছায় পশু-পাখীর দল ছিল; দয়েবদের কারণে দুর্দশার বিরুদ্ধে দাঁড়াবার জন্য, জলাভাবের বিরুদ্ধে যা চারণভূমিসমূহকে নষ্ট করে, এবং মৃত্যুর বিরুদ্ধে যা অদৃশ্যভাবে চলে।’ (ফারবারদিন ইয়াস্ত, ২৯, ১৩০)

আবেস্তার এই বিবনঘন্ট (Vȋvanghant) যে ঋগ্বেদের বিবস্বানের অপভ্রংশ তা অনুমান করা যায়। আবেস্তায় বিবনঘন্টের পুত্র ইম, অন্য দিকে ঋগ্বেদে বিবস্বানের পুত্র যম (১০/৫৮/১)।

পাতা : ৬৪

ঋগ্বেদে দেবী ঊষার নামে মন্ত্র রচনা করা হয়েছে। সেখানে ঊষা সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘তিনি রথ যোজিত করেছেন; এ সৌভাগ্যবতী ঊষা দূর হতে সূর্যের উদয় স্থানের উপরস্থ দিব্যলোক হতে শত রথ দ্বারা মানুষের নিকট আসছেন।’ (১/৪৮/৭)।  আবেস্তায় ‘কবি ঊষা’ সম্পর্কে বলা হচ্ছেঃ ‘সে কবি ঊষার রথ বহন করেছিল; তার ডানার উপর ঘোড়াকে ছুটায়, ভার-বহনকারী উটকে ছুটায়, নদীর জলকে প্রবাহিত করে।’ (বহরাম ইয়াস্ত, ১৪, ৩৯)

আবেস্তায় দয়েবদের কাছ থেকে চক্রের ঘুর্ণন কেড়ে নিবার কথা বলা হয়েছে। আবেস্তায় বিষয়টি এভাবে বলা হয়েছেঃ

‘৮৭। আমরা গয় মরেতানের ফ্রবাশিকে পুজা করি, যে প্রথম অহুর ময্দার চিন্তা ও শিক্ষাকে শ্রবণ করেছিল; অহুর যাদের আর্য জাতিসমূহের বংশধারা, বীজ গঠন করেছিলেন।

আমরা পবিত্র জরথুস্ত্রের ধর্মানুরাগ ও ফ্রবাশিকে পূজা করি।

...               ...               ...                ...                 ...

৮৯। যে প্রথম পুরোহিত ছিল, প্রথম যোদ্ধা, ভূমির প্রথম লাঙ্গল চাষকারী; যে প্রথম দয়েব ও শীতল হৃদয়ের মানুষের কাছ থেকে চক্রের ঘুর্ণনকে কেড়ে নিয়েছিল; ...’ (ফারবারদিন ইয়াস্ত, ২৪)

বৌদ্ধ সাহিত্যে চক্রের ঘুর্ণনের অধিকারকে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে উল্লেখ করা হয়েছে, যা রাজাদের অধিকারে থাকত। আমরা আগে আলোচনা করেছি যে, সিন্ধু সভ্যতায় নদী থেকে শাখা খালে জল সরবরাহ করার জন্য বাঁধের মধ্যে যে স্লুইস গেট ছিল তা চক্র দ্বারা খোলা বা বন্ধ করার ক্ষমতা স্থানীয় পর্যায়ের শাসকদের হাতে থাকত। আবেস্তায় শত্রুপক্ষ দয়েবদের কাছ থেকে চক্রের ঘুর্ণন কেড়ে নিবার উল্লেখ খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। এখানে বৈদিকদের সাথে বৈদিক বিরোধীদের যুদ্ধকে প্রকাশ করে।  

আবেস্তায় অযি দহাকের (Azi Dahâka) কথা অনেকবার উল্লেখ আছে। অযি যে ঋগ্বেদের অহি বা বৃত্রের রূপান্তর সে বিষয়ে লেখকরা একমত। ঋগ্বেদে যেমন বৃত্রের তিন মস্তকের কথা বলা আছে তেমনি আবেস্তাতেও অযি দহাকেরও তিনটি মাথার কথা বলা আছে। এখানে আরো বলা হয়েছে যে, এই অযি দহাকের তিনটি মুখ, ছয়টি চোখ ও যা অত্যন্ত শক্তিশালী ও যাকে অঙ্গ্রা মইন্যু সৃষ্টি করেছে বস্তুগত পৃথিবীর বিরুদ্ধে, সৎ নীতি পূর্ণ পৃথিবীকে ধ্বংস করার জন্য (আবান ইয়াস্ত, ৯, ৩৪)। আবান ইয়াস্তে এক শত জানালা-বিশিষ্ট, এক সহস্র স্তম্ভ-বিশিষ্ট সুনির্মিত এক প্রাসাদের কথা বলা হয়েছে (আবান ইয়াস্ত, ২৩, ১০১) যা ঋগ্বেদের সহস্র স্তম্ভ-বিশিষ্ট ভবনের কথা মনে করিয়ে দেয়। এগুলি সবই সিন্ধু সভ্যতার স¥ৃতি থেকে আসা বলে মনে হয়।

আবেস্তায় হুস্রবাহ (Husravah) নামে এক রাজার কথা বলা আছে যিনি আর্য জাতিসমূহকে একত্রিক করেন (আবান ইয়াস্ত, ১৩, ৪৯)। হুস্রবাহ যে সুশ্রবা থেকে এসেছে তাতে সন্দেহ নাই। আবেস্তায় হপ্তরিঙ্গ নক্ষত্রের নাম উল্লেখ আছে, যা ঋগ্বেদের সপ্তর্ষি নক্ষত্রের নামের রূপান্তর।

সিন্ধু সভ্যতার কিছু স্মৃতি আবেস্তায় পাওয়া যায়। যেমন, সিন্ধু সভ্যতার পরিষদ বা সভা যার উল্লেখ ঋগ্বেদেও পাওয়া যায়। আবেস্তায় বলা হয়েছে এভাবে, ‘তাদের উজ্জ্বলতা ও গৌরবের মধ্যে একজন মানুষ জন্ম নিয়েছিলেন যিনি পরিষদ ও সভার প্রধান ...’ (ফারবানদিন ইয়াস্ত, ১, ১৬)

ঋগ্বেদ থেকে যেমন জানা যায় বৃত্র কর্তৃক জলকে দীর্ঘকাল রুদ্ধ করে রাখা হয়েছিল তেমন আবেস্তাতেও প্রবাহমান জল দীর্ঘকাল এক স্থানে স্থির হয়েছিল বলা হয়েছে। ফারবারদিন ইয়াস্তে বলা হয়েছে, ‘আমরা বিশ্বাসীদের ভাল, শক্তিশালী ও উপকারী ফ্রবাশিদের (Fravashi) পূজা করি, যারা ময্দার তৈরী জলদের সুন্দর পথ দেখিয়েছিল, যারা প্রবাহিত না হয়ে দীর্ঘকাল এক জায়গায় দাঁড়িয়েছিল।’ (ফারবারদিন ইয়াস্ত, ১৪, ৫৩)

আবেস্তাও ঋগ্বেদের মত জলের জন্য যুদ্ধের কথা বলছে। যেমন,

৬৪। আমরা বিশ্বাসীদের ফ্রবাশিকে পুজা করি যারা ভাল, শক্তিশালী, উপকারী, যারা মহৎ, যারা শক্তিশালী, যারা দ্রুতগামী, যারা বেশী ক্ষমতাশালী, যারা বেশী বিজয়ী, যারা আরও বেশী আরোগ্যকারী, যারা এত কর্মক্ষম যে কথায় প্রকাশ করা যায় না; যারা মিয়াযদাদের মধ্যে দশ সহস্র করে ছুটে যায়।

৬৫। এবং যখন জলগণ বৌরু-কশ সাগর থেকে উপরে উঠে আসে, হে স্পিতম জরথুস্ত্র! ময্দার গৌরবের সাথে, তখন সামনে ভীতিজনক ফ্রবাশিরা আসে, বহু শত, বহু সহস্র, বহু অযুত।

  ৬৬। তাদের নিজেদের আত্মীয়দের জন্য, তাদের নিজেদের স্বায়ত্তশাসিত নগরের জন্য, নিজেদের শহরের জন্য, তাদের নিজেদের দেশের জন্য জল অন্বেষণ করতে থাকল এবং এভাবে বলতে থাকলঃ আমাদের দেশ জলের উত্তম সঞ্চয় এবং পূর্ণ আনন্দে ভরে উঠুক।

৬৭। তারা যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ল তাদের নিজেদের স্থানে ও ভূমিতে, প্রত্যেকে তার নিজের স্থান ও বাসগৃহে যেখানে সে থাকত (অতীত কালে); তারা সাহসী যোদ্ধার মত দেখতে, তারা সজ্জিত ও সতর্ক, যে সম্পদ সে সঞ্চিত করেছিল তার জন্য যুদ্ধ করে।

৬৮। এবং তাদের মধ্যে যারা জল আনতে বিজয়ী হয়েছিল, তাদের নিজেদের আত্মীয়দের জন্য, তাদের নিজেদের স্বায়ত্তশাসিত নগরের জন্য, তাদের নিজেদের শহরে, তাদের নিজেদের দেশে, এরূপ বলেঃ আমাদের ভূমি উন্নত ও বর্ধিত হোক।’ (ফারবারদিন ইয়াস্ত, ২২)

আবেস্তা ও ঋগ্বেদ থেকে একটি বিষয় পরিষ্কার যে, সপ্ত সিন্ধু অঞ্চলে প্রচলিত বিভিন্ন লোককথা ও সমাজে প্রচলিত কাহিনীকে উভয়েই তাদের প্রয়োজন ও প্রেক্ষিত অনুযায়ী ব্যবহার করেছে ও ব্যাখ্যা করেছে। উভয় ধর্মের উপাখ্যানে বহু কিছুর মত আমরা অহি ও বৃত্রঘ্নের বর্ণনা পাই। ঋগ্বেদের মত আবেস্তায়ও অহি ঘৃনিত, যেখানে তাকে বলা হচ্ছে অযি। আর বৃত্র বধকারী হিসাবে যেখানে ঋগ্বেদে বলা হচ্ছে বৃত্রঘ্ন, সেখানে আবেস্তায় বেরেথ্রঘ্ন (Verethraghna) হচ্ছে অহুর ময্দার সৃষ্ট। বেরেথ্রঘ্ন যে বৃত্রঘ্নের অপভ্রংশ সেটি পরিষ্কার। সেখানে বলা হচ্ছেঃ ‘১। আমরা বেরেথ্রঘ্নের প্রতি আহুতি দিই, যে অহুর ময্দার সৃষ্ট। ... ২। বেরেথ্রঘ্ন, যে অহুর ময্দার তৈরী, তার কাছে প্রথমে এসেছিল, শক্তিশালী , সুন্দর বাতাসের আকৃতিতে ছুটে এসেছিল, ময্দার সৃষ্ট; সে ভাল গৌরব বহন করেছিল, ময্দা কর্তৃক সৃষ্ট, যা ছিল স্বাস্থ্য ও শক্তি উভয়ই।’ (১৪। বহরাম ইয়াস্ত, ১)

ঋগ্বেদে যেমন পূজার উদ্দেশ্যে অগ্নিতে আহুতি দিতে দেখা যায়, তেমনি আবেস্তায়ও জরথুস্ত্র ধর্মের অনুসারীরা অগ্নিতে আহুতি দিত।

আবেস্তা থেকে সপ্তসিন্ধু অঞ্চলের নদীর নামের মিল, আর্য ভূমি বা দেশের জন্য গৌরববোধ, নিজপক্ষ ও শত্রুপক্ষের নামের মিল, ঋগ্বেদের দেবতাদের সাথে নামের মিল, ঋগ্বেদের মত এখানেও জলের জন্য যুদ্ধের বর্ণনা - এই সমস্ত বিবরণ থেকে এবিষয়টি স্পষ্ট যে প্রাচীন ইরানীয়রা বা আবেস্তানরা সিন্ধু সভ্যতা থেকে আগত জনগোষ্ঠী। আমরা আগের আলোচনায় দেখিয়েছি যে, সিন্ধু সভ্যতার শেষ পর্যায়ে নদী নিয়ন্ত্রণের উপর ভিত্তি করে কৃষিতে জলসেচ ব্যবস্থা অকার্যকর হবার ফলে যে জনঅসন্তোষ শুরু হয় তার প্রেক্ষিতে বৈদিক ধর্ম সংস্কার অন্দোলনের সূচনা ঘটে। বিপরীতভাবে সিন্ধু সভ্যতার শাসকশ্রেণীর সেই অংশটি যারা সিন্ধু সভ্যতার সূচনাকালীন লোকায়ত ধারাকে সিন্ধু সভ্যতার মধ্যবর্তী পর্যায়ের পরে নদীনয়ন্ত্রণব্যবস্থার সংকট শুরু হলে ক্রমশ ধর্মের দিকে ঝুঁকে যাবার ফলে সমাজে ও কখনো রাষ্ট্রে নানা ধর্মীয় উপাদান অন্তর্ভুক্ত করছিল, তারা অপর একটি ধর্ম সংস্কার আন্দোলন শুরু করে। আমরা অনুমান করি সেই সময়ে জরথুস্ত্রের নেতৃত্বে বৃহত্তর সিন্ধু উপত্যকায় এই আন্দোলন ঘটে। দৃশ্যত বৈদিকদের বিজয় হলে তথা নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ধ্বংস হলে, এই অংশটি পশ্চিমে ইরানে চলে গিয়ে বসতি স্থাপন করে ও নিজেদের ধর্মমত প্রতিষ্ঠিত করে। কাজেই আবেস্তান ধর্মের প্রতিষ্ঠা সপ্তসিন্ধু অঞ্চলে হলেও সম্ভবত তার বিকাশ ও সংহত রূপ লাভ ঘটে ইরানে।

আবেস্তা ও ঋগ্বেদ বৃহত্তর সিন্ধু উপত্যকায় একই ঘটনার প্রেক্ষিতে দুইটি পৃথক ধর্মীয় আন্দোলন থেকে রচিত হলেও ইতিহাস থেকে দেখা যায় পরবর্তী সমাজ ও রাষ্ট্রে এর সুদূরপ্রসারী ফলাফল বিপরীত হয়েছিল। সিন্ধু সভ্যতা পতনের প্রায় দেড় হাজার বছর পর জরথুস্ত্র ধর্মের অনুসারী আবেস্তানরা ইরানে একটি কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্র গঠন করেছিল। সেখানে তারা একটি শক্তিশালী সাম্রাজ্য গড়ে তুলে। অন্যদিকে বৈদিক আন্দোলনকারীদের উত্তরাধীকারীরা একই সময়ে ভারতবর্ষে কোনো কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্র গঠন করতে পারে নাই। বৈদিক আন্দোলন শুরু থেকেই ছিল কেন্দ্রীয় নেতৃত্বহীন, যার প্রধান ও তাৎক্ষণিক লক্ষ্য ছিল বৃত্র বা বাঁধ ধ্বংস করা। এই উদ্দেশ্য পূরণের জন্য তারা দেবতা ইন্দ্রকে প্রাধান্যে নিয়ে এসেছিল। পাশাপাশি অন্য দেবতাদেরকেও তারা পূজা করেছে, আর যখন যে দেবতার উদ্দেশ্যে স্তোত্র রচনা করেছে তখন মনে হয় যেন সেই দেবতাই সবচেয়ে ক্ষমতাবান ও শ্রেষ্ঠ। যখন বাঁধ ধ্বংস হল তখন ইন্দ্রেরও আর প্রয়োজন থাকল না। একই সাথে অন্যান্য দেবতাদেরও গুরুত্ব কমে গেল। বিজয়ী বৈদিকরা পরবর্তীকালে শুধু যে কেন্দ্রীভূত শাসন ব্যবস্থা নির্মাণ করতে অপারগ হল তাই নয়, তারা নিজেরা জ্ঞানে ও শিক্ষায় অগ্রসর হলেও তারা মূলত সমাজের পশ্চাৎপদ শ্রেণী কৃষকদের নেতা হল।

পরবর্তী ঐতিহাসিক ভারতবর্ষে বৈদিকদের উত্তরাধিকারী ব্রাহ্মণরা সমাজ গঠনে কখনো নেতৃত্ব দিলেও কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্র গঠন করতে পারে নাই। অনেক পরে গুপ্ত যুগে এসে ব্রাহ্মণরা রাষ্ট্র গঠন করে। তবে তার যেমন খুব বেশী কাল স্থায়িত্ব ছিল না তেমন মৌর্য যুগের মত সমস্ত ভারতবর্ষব্যাপী তাদের সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে পারে নাই। অর্থাৎ ইতিহাস থেকে ব্রাহ্মণদেরকে বিভক্তির শক্তি হিসাবে দেখা যায়। তাদের অনেক দেবতা আছে, কিন্তু দেবতাদের ভূমিকা বিকেন্দ্রীভূত। সেখানে এক ধরনের ঐক্য থাকলেও সেটা যথেষ্ট ভঙ্গুর ও অনিশ্চিত। ধর্মের এই বাস্তবতার প্রভাব পড়ে সামাজিক নেতৃত্¦েরও উপর। সম্ভবত আদি হরপ্পান বা প্রাক-হরপ্পান যুগের বিকেন্দ্রীভূত এবং বিচ্ছিন্ন-বিভক্ত সমাজে ফিরে যাওয়া ছিল বৈদিক আন্দোলনের একটি ফল। আজকের হিন্দুদের মধ্যেও একই প্রবণতার ধারাবাহিকতা দেখতে পাওয়া যায়। সমাজের বিচ্ছিন্নতার শক্তিকে তারা আজও ধারণ করে।  এই বৈশিষ্ট্য বৃহৎ রাষ্ট্র গঠন বা রক্ষার জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।

অন্যদিকে সমাজে আবেস্তার ভূমিকা ছিল বিপরীত। সিন্ধু সভ্যতা পতনের কালে জরথুস্ত্রের নেতৃত্বে যে ধর্ম সংস্কার আন্দোলন হয় তার প্রধান দেবতা ছিল অহুর ময্দা। এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল সিন্ধু সভ্যতার কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্রকে বৈদিকদের আক্রমণ থেকে রক্ষা করা। ফলে আবেস্তায় কেন্দ্রীকরণ ও ঐক্যের উপর প্রবল জোর দেখতে পাওয়া যায়। পরবর্তীকালে বৈদিকরা যেমন ইন্দ্রের গুরুত্ব কমিয়েছিল, আবেস্তানরা তাদের দেবতা অহুর ময্দার গুরুত্ব কমায় নাই। যতদিন জরথুস্ত্রের ধর্ম টিকে ছিল আবেস্তানরা অহুর ময্দাকেই সর্বশ্রেষ্ঠ দেবতা তথা ঈশ্বর হিসাবে রেখে দিয়েছিল। পাশাপশি অন্যন্য দেবতা ছিল অহুর ময্দার আজ্ঞাধীন।

পাতা : ৬৫

 

চতুর্থ অধ্যায়

সিন্ধু সভ্যতার সমাজ, ধর্ম ও রাষ্ট্রশাসন-ব্যবস্থার স্বরূপ

এই অধ্যায়ের শুরুতে বলি যে, এখানে আমরা মূলত পূর্ববর্তী আলোচনাগুলির ভিত্তিতে সিন্ধু সভ্যতার সমাজ, ধর্ম এবং রাষ্ট্রশাসন ব্যবস্থা সংক্রান্ত বিষয়ে মূল্যায়নে যাবার চেষ্টা করব। প্রত্নতত্ত্বের সাক্ষ্য থেকে সিন্ধু সভ্যতার হরপ্পান পর্যায়ে এসে সর্বপ্রথম রাষ্ট্র পরিচালনায় রাজনৈতিক গঠন লক্ষ্য করা যায়। তবে এখানে বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্র বা অতি-কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্র গঠন যে হয় নাই প্রত্নতত্ত্বের সাক্ষ্য থেকে সেটিও বুঝা যায়। এখানে নজর কাড়ে এমন কোনো রাজপ্রাসাদ বা রাজার বা ধনী মানুষের সমাধি পাওয়া যায় নাই, যেমন পাওয়া যায় প্রাচীন মেসোপটেমিয়া, মিসর বা চীনের সভ্যতার বসতিগুলিতে।  শুধু তাই নয় এখানকার সমাধি বা কবর থেকে তাৎপর্যপূর্ণ বৈষম্যেরও সাক্ষ্য পাওয়া যায় না। সিন্ধু সভ্যতার নগরগুলিতে যে স্তরবিন্যস্ত সামাজিক শ্রেণী ছিল তা বুঝা যায় নগরের বিন্যাস ও সংগঠন থেকে। এছাড়াও আরো অনেক উপাদান যেমন, অলংকার, সীল, বাটখারা ও দৃশ্যত ‘ধর্মীয় বস্তু’ থেকে অনেক লেখক এই রকম মনে করেন। তবে সিন্ধু সভ্যতার মতো এত বৃহৎ অঞ্চলব্যাপী বিস্তৃত একটি শক্তিশালী সভ্যতার শাসক শ্রেণীর ক্ষমতা ও দৃষ্টিভঙ্গীর সাথে এই সব ক্ষুদ্র তথাকথিত ‘ধর্মীয় বস্তু’ বা প্রতীক সামঞ্জস্যপূর্ণ বলে আমরা মনে করি না। এখানে সামাজিক স্তরবিন্যাস থাকলেও সেটি যে বর্ণ বা জাতিভেদ মূলক ব্যবস্থা ছিল না এ ব্যাপারে লেখকরা একমত। এখানকার নগর পরিকল্পনা ও ঘরবাড়ীর বিন্যাস থেকে এটাই মনে করা যায় যে, এখানে সামাজিক স্তর বিন্যাস থাকলেও ধনী-দরিদ্রের খুব বেশী পার্থক্য না থাকাতে এক ধরনের সামাজিক সাম্য ছিল, যা প্রাচীন মিসর বা মেসোপটেমিয়ার সমাজ থেকে একেবারে ভিন্নতর। হরপ্পা ও মহেঞ্জো-দাড়োর পৃথক প্রাচীর ঘেরা ঢিবি বা ধোলাভিরার নগরদুর্গে বসবাসকারী মানুষজন অভিজাত শ্রেণীর বা ক্ষমতাবান ছিল বলে মনে করা হয়। যদিও শহরের নীচু অংশেও ধনী, অভিজাত ও বণিকশ্রেণীর মানুষজন বাস করত। দেখা গেছে যে, মহেঞ্জো-দাড়োতে সবচেয়ে বেশী ধাতুর জিনিসপত্র উঁচু ঢিবিতে এর বড় বড় ভবনগুলির মধ্যে পাওয়া যায় নাই, তেমন হরপ্পাতেও একটি বিশেষ এলাকাতে না থেকে ধাতুর জিনিসপত্র তুলানামূলক সমানভাবে ছড়িয়ে ছিল। আল্লাহদিনো নামে বসতিটিতেও সমস্ত বসতি জুড়ে বিভিন্ন এলাকায় যেমন, ভবনের ভিতরে, ভবনের বাইরে (রাস্তায়, নর্দমায় ও আবর্জনার স্তূপে) ধাতুর জিনিসপত্র দেখা গিয়েছিল।  যদিও প্রধান বসতিগুলি কাদা-মাটির ইটের ভারী দেওয়াল দিয়ে ঘেরা ছিল, কিন্তু সেই সব অধিবাসীদের মধ্যে বড় ধরনের কোনো সংঘাত বা যুদ্ধের সাক্ষ্য পাওয়া যায় না, যা অন্য সভ্যতাগুলিতে সাধারণ বিষয় ছিল।  ধারণা করা হয় যে, প্রাচীর ঘেরা এই সমস্ত উঁচু ঢিবিগুলি বা নগরদুর্গে বসবাসকারী ক্ষমতাবানরা সিন্ধুর শাসকশ্রেণী গঠন করেছিল যারা বহু দূরব্যাপী বিস্তৃত সমগ্র সভ্যতার অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও আদর্শিক দিক নিয়ন্ত্রণ করত। এছাড়াও তারা নগরের অন্যান্য অংশে বসবাসকারী শিল্প উৎপাদনের বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করত।

-------------------------------------------------------

 দেখুনঃ Jonathan M. Kenoyer, The Archaeological Heritage of Pakistan: From the Palaeolithic to the Indus Civilization, in, ed., Roger D. Long, A History of Pakistan, 2015, p. 38; Bridget and Raymond Alchin, Origins of a Civilization: The Prehistory and Early Archaeology of South Asia, Viking Books India (P) Ltd., 1997, p. 187.

দেখুনঃ Jim G. Shaffer, Harappan Culture: A Reconsideration, in, Harappan Civilization: A Recent Perspective, ed., Gregory L. Possehl, Second Revised Edition, Oxford & IBH Publishing Co. vt. Ltd., 1993, p. 47.

দেখুনঃ Jonathan M. Kenoyer, The Archaeological Heritage of Pakistan: From the Palaeolithic to the Indus Civilization, in, A History of Pakistan, ed, Roger D. Long, 2015, p. 38

-------------------------------------------------------

সিন্ধু সভ্যতার বসতিগুলিতে কখনো কখনো বড় ধরনের ধনিকশ্রেণী বা তাদের ব্যবহৃত জিনিসপত্র দেখতে পাওয়া যায়। যেমন, আল্লাহদিনো, বালাকোট, আমরি, কোট দিজি ও নৌশারোর মত ছোট বসতিগুলিতে (এগুলি ২ থেকে ৫ হেক্টর আয়তনের) খনন করার সময়ে বহু ধরনের জিনিসপত্র পাওয়া গেছে।

-------------------------------------------------------

 দেখুনঃ Jonathan Mark Kenoyer and Richard H. Meadow, Harappa: New Discoveries on its Oigins and Growth, in, Lahore Museum Bulletin, Vol. XII, No. 1, ed., Dr. Anjum Rehmani,1999, p. 5.

-------------------------------------------------------

গবেষক হিদার এম,-এল, মিলার হরপ্পা সহ কয়েকটি নগরের, বিশেষত হরপ্পা ও মহেঞ্জো-দাড়োর, শিল্প উৎপাদনের এলাকার সাথে অনুৎপাদকদের, যেমন, ব্যবস্থাপক, প্রশাসক, ইত্যাদির সম্পর্ক অনুসন্ধান করতে গিয়ে দেখতে পান যে, উৎপাদনের এলাকার সাথে কর্তৃত্বপূর্ণ নির্দেশনার কোনো সম্পর্ক ছিল না।  এছাড়াও বিশেষ কোনো ঢিবিতে উৎপাদনের এলাকাগুলিতে জিনিসপত্র তৈরী করার জন্য ‘দৈনন্দিন ব্যবহারের’ অথবা ‘অভিজাত’, এমন কোনো ভাগ ছিল না। হরপ্পান পর্যায়ে হরপ্পা ও মহেঞ্জো-দাড়োর প্রতিটি ঢিবিতেই শিল্প উৎপাদনের সাক্ষ্য পাওয়া গেছে, এবং কোনো বিশেষ ধরনের শিল্পের সাথে কোনো নিদিষ্ট ঢিবির সম্পর্ক পাওয়া যায় নাই।  আবার হরপ্পান বসতিগুলিতে যে প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ ছিল সেটির পক্ষেও প্রমাণ পাওয়া যায়। হরপ্পায় পাওয়া পাথর ও খনিজের উৎস অনুসন্ধান করতে গিয়ে গবেষক র‌্যান্ডাল ল’ ধারণা করেন যারা হরপ্পান সভ্যতা পরিচালনা করত দুষ্প্রাপ্য ও সাধারণ উভয় পাথরের উপর তাদের নিয়ন্ত্রণ ছিল। হরপ্পার সকল অংশে বসবাসকারী সকলে একই ধরনের ও একই উৎস থেকে পাওয়া পাথর ও খনিজ ব্যবহার করত। কেবলমাত্র ঢিবি ই ও ইটি-তে পর্ব ৩বি (২৪৫০ খ্রীঃপূঃ - ২২০০ খ্রীঃপূঃ) ও ৩সি (২২০০ খ্রীঃপূ - ১৯০০ খ্রীঃপূঃ) সময় জুড়ে বসবাসকারী কারিগররা আর্নেস্টাইট পাথরের ছিদ্র করার যন্ত্র ব্যবহার করত যা দিয়ে তারা ভেসুভিয়ানাইট-গ্রোসুলার পাথরের মত শক্ত পাথরকে ছিদ্র করে পুতি বানাতে পারত।

-------------------------------------------------------

 দেখুনঃ Heather M.-L. Miller, Associations and Ideologies in the Locations of Urban Craft Production at Harappa, Pakistan (Indus Civilization), in, Archaeological Papers of the American Anthropological Association, Vol. 17, Issue 1, p. 44.  

দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ৪০।

দেখুনঃ Randall William Law, Inter-Regional Interaction and Urbanism in the Ancient Indus Valley: A Geological Provenience Study of Harappa’s Rock and Mineral Assemblge, in, Current Studies on the Indus Civilization, Volume VIII, Part 1: Text, Manohar Publishers & Distributers, New Delhi, 2011, pp. 11-13, 485-486, 502.

-------------------------------------------------------

বিস্তীর্ণ অঞ্চলব্যাপী ছড়ানো বসতিগুলিতে বিভিন্ন জিনিসের এক ধরনের সমরূপতা থেকে এটাই মনে করা যায় যে, এখানকার শাসকরা কঠোর নিয়ন্ত্রণের উপর জোর দিত। তারা আদর্শিকভাবে রক্ষণশীল বলেই মনে করার যুক্তি সংগত কারণ আছে। সবচেয়ে বেশী যে কয়টি জিনিসের বৈশিষ্ট্য সমগ্র বৃহত্তর সিন্ধু উপত্যকায় প্রায় একই রকম ছিল সেগুলি হল সীল, লিপি ও বাটখারা। অনুমান করা যায় যে, সিন্ধুর শাসকরা এই কয়টি জিনিসের অভিন্নতার উপর সবচেয়ে জোর দিয়েছিল। আগেকার এই ধারণাটি এখন আর সমর্থিত নয় যে, সিন্ধুর শাসকরা ইটের মাপের অনুপাত বজায় রাখার উপর জোর দিয়ে ভবন নির্মাণের একটি বিধান আরোপ করে একটি শক্তিশালী ও কেন্দ্রীভূত শাসন ব্যবস্থা বজায় রেখেছিল।  সিন্ধু সভ্যতার বসতিসমূহের বিস্তার ও বিন্যাস থেকে অনুমান করা যায় যে, নগরসমূহের নিজেদের মধ্যে যেমন যোগাযোগ ছিল তেমন নগরগুলির সাথে ছোট বসতিগুলির যোগাযোগ ছিল; এটা সিন্ধুর রাষ্ট্র, সমাজ, রাজনীতি ও অর্থনীতি বুঝতে সাহায্য করে। ছোট বসতিগুলি যেগুলি ৪০ হেক্টরের চেয়েও ছোট, দেখা গেছে যে সেগুলি স্থানীয় প্রেক্ষিতে নিঃসন্দেহে নগর ছিল ও স্থানীয় প্রশাসনিক ও ক্ষমতা কাঠামোতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখত।  উদাহরণ হিসাবে উত্তর রাজস্থানে কালিবঙ্গানের (প্রায় ১১.৫ হেক্টর) নাম বলা যেতে পারে যা বর্তমানে একটি শুকনা নদীর তীরে অবস্থিত ও বৃহৎ নগর রাখিগাড়ি ও হরপ্পা থেকে বেশ কয়েক শত কিলোমিটার দূরত্বে ছিল। হরপ্পান নগর পর্যায়ে কালিবঙ্গান উঁচু ও নীচু নগর উভয়ই আলাদাভাবে প্রাচীর ঘেরা ছিল ও হরপ্পান সংস্কৃতির জিনিসপত্র ও মৃৎপাত্র  ছাড়াও স্থানীয় শৈলীর মৃৎপাত্র এখানে পাওয়া গেছে। সিন্ধু সভ্যতায় অনেক ছোট বসতিতে কৃষকরা বসবাস করত (যেমন, লোহারি রাঘো ১, মাসুদপুর ১ ও মাসুদপুর ৭), তেমন আবার কিছু ছোট বসতিতে বিশেষীকৃত উৎপাদনের প্রমাণ পাওয়া গেছে (যেমন, চানহুদাড়োতে পুতি, বাগাসরা বা ঘোলা দোরোতে চুড়ি, ইত্যাদি)।  হরিয়ানার মাসুদপুর ১ (স্থানীয় নাম সম্পলিয়া খেরা) ও মাসুদপুর ৭ (স্থানীয় নাম ভিমওয়াড়া জোধা) নামে গ্রামীণ দু’টি বসতির কিছু বৈশিষ্ট্য থেকে এই বসতিগুলির মানুষজনের দৈনন্দিন ব্যবহারিক প্রবণতা বুঝা যায়। এই দু’টি বসতি এই অঞ্চলের সবচেয়ে বড় বসতি রাখিগাড়ি থেকে যথাক্রমে ১২ ও ১৬ কিলোমিটার দূরে। দেখা গেছে যে, এখানে প্রচুর পরিমাণ হরপ্পান বিভিন্ন জিনিসপত্র পাওয়া গেলেও এখানে ধ্রুপদী হরপ্পান (Classic Harappan) মৃৎপাত্রের  বদলে হরিয়ানা হরপ্পান মৃৎপাত্র পাওয়া গেছে।  অর্থাৎ এখানকার মৃৎপাত্র উৎপাদনকারী ও ব্যবহারকারী উভয়ে ধ্রুপদী হরপ্পান মৃৎপাত্র বর্জন করেছে। এটি থেকে বৃহৎ হরপ্পান নগর রাখিগাড়ির সাথে তার পশ্চাদভূমির গ্রামসমূহের সম্পর্ক বুঝতে সাহায্য করে। গুজরাটে পাওয়া হরপ্পান বসতিগুলির মধ্যে কমপক্ষে পনেরোটি বসতির চারপাশে ভারী দেওয়াল দিয়ে ঘেরা ছিল।  সিন্ধু সভ্যতায় বহু সংখ্যক ছোট বসতিতে কখনো একবার আবার কখনো একাধিকবার বসবাসের প্রমাণ পাওয়া গেছে। এগুলি সাধারণত নীচু ঢিবির উপর হত। ছোট বসতিগুলি অনেক সময় পরিত্যক্ত হত আবার পুনরায় বসতিস্থাপন হত। কৃষিতে যে কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ ছিল না তা বুঝা যায় বিভিন্ন অঞ্চলে ও বিভিন্ন বসতিতে শস্য উৎপাদনের ভিন্ন কৌশল থাকার জন্য এবং সম্ভবত যে ধরনের উদ্বৃত্ত উৎপাদন হত সেটা থেকেও।  সিন্ধুর প্রেক্ষিতে প্রাচীর ঘেরা ভিন্ন এলাকা আর কিছু বড় কাঠামো ছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রে প্রকৃতপক্ষে আর্থ-সামাজিক বৈষম্য অনেক সীমিত। হরপ্পা, রাখিগাড়ি, লোথাল, রূপার, কালিবঙ্গান ও ফারমানায় যে সীমিত সংখ্যক কবর উৎখনন করা হয়েছে, সেগুলির মধ্যে বৈষম্য পরিষ্কারভাবে প্রতিফলিত হয় নাই।  এগুলিতে মৃৎপাত্র ও কিছু ব্যক্তিগত জিনিসপত্র যেমন অলংকার হিসাবে চুড়ি, পুতি, ইত্যাদি ছিল।

-------------------------------------------------------

 দেখুনঃ J. Mark Kenoyer, Measuring the Harappan world: Insights into the Indus order and cosmology, in, The Archaeology of Measurement: Comprehending Heaven, Earth and Time in Ancient Societies, eds., Iain Morley and Collin Renfrew, 2010, p. 118.

দেখুনঃ Cameron A. Petrie, Diversity, variability, adaptation and ‘fragility’ in the Indus Civilization, in, The Evolution of Fragility: Setting the Terms, ed., Norman Yoffee, McDonald Institute for Archaeological Research, University of Cambridge, Cambridge, 2019, p. 115.

দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ১১৬।

দেখুনঃ Danika Parikh and Cameron A. Petrie, Urban-Rural Dynamics and Indus Ceramic Production in Northwest India: a Preliminary Analysis of the Pottery from Masud I and Masupur VII, in, Man and environment in Prehistoric and Protohistoric South Asia: New Perspectives, eds., Vincent Lefèvre, Aurore Didier and Benjamin Mutin, Brepols Publishers n.v., Turnhout, 2015, p. 227.

দেখুনঃ Rajesh S.V., Prabhin Sukumaran and K. Krishnan, Scenario of Chalcolithic Site Surveys in Gujarat, in, Pakistan Heritage, Volume 7, eds., Shakirullah and Ruth Young, Research Journal of the Department of Archaeology, Hazara Universsity, Manshra, 2015, p. 2.

দেখুনঃ Cameron A. Petrie, Diversity, variability, adaptation and ‘fragility’ in the Indus Civilization, in, The Evolution of Fragility: Setting the Terms, ed., Norman Yoffee, 2019, p. 118.

  দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ১২১

-------------------------------------------------------

পাতা : ৬৬

 দেখা গেছে যে, সিন্ধুতে নগরগুলি অল্প সময়ের মধ্যে, প্রায় ২৬০০-২৫০০ খ্রীঃপূঃ-এর মধ্যে, বৃহদায়তন হয়ে যায়। এটি থেকে বুঝা যায় যে ছোট ও মধ্যম আকারের বসতি থেকে বৃহৎ নগরায়ন তুলনামূলক দ্রুততার সাথে ঘটেছে।  কিন্তু আজও পরিষ্কার না যে, ঠিক কোথায় এই সভ্যতা প্রথম এর আকার নিয়েছিল ও বট গাছের মত তার ছায়ার তলায় আঞ্চলিক বিভিন্ন বৈচিত্র্যপূর্ণ সংস্কৃতিকে এনেছিল, যা প্রায় একই রকম সামাজিক-অর্থনৈতিক কাঠামো ও কাঠামোগত বৈশিষ্ট্য নিয়ে বিকাশ লাভ করেছিল।  সিন্ধু সভ্যতার রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ ও  বিস্তার সম্পর্কে বুঝার জন্য গুজরাটের দুটি ছোট হরপ্পান বসতি শিকারপুর ও বাগাস্রা সম্পর্কে আলোচনা করা যেতে পারে। হরপ্পান সভ্যতার অন্তর্ভুক্ত হবার আগে এই দু’টি বসতিতে কৃষি ও পশুপালনের সাথে সংশ্লিষ্ট মানুষেরা অনেকটা অস্থায়ীভাবে বসবাস করত।  সেখানকার অধিবাসীরা অনার্ত নামে মৃৎশিল্পের স্থানীয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বহন করছিল। প্রায় ২৬০০ খ্রীঃপূঃ-এর দিকে এই বসতি দু’টি হরপ্পান সভ্যতার অন্তর্ভুক্ত হবার পর দেখা গেল যে সেখানে অনার্ত মৃৎশিল্পের জনপ্রিয়তা হ্রাস পেল ও এর বদলে ধ্রুপদী হরপ্পান মৃৎশিল্পের পাশাপাশি সোরাথ হরপ্পান মৃৎশিল্পও প্রচলিত হল। বাগাস্রার আয়তন প্রায় ২ হেক্টর ও শিকারপুরের আয়তন প্রায় ৫ হেক্টর। ছোট বসতি হওয়া সত্ত্বেও হরপ্পান সভ্যতার শুরুতেই বাগাস্রায় সীমানা প্রাচীর দিয়ে ঘেরা হল, যা গোড়ায় ৭ মিটার পুরু ও শিকারপুরে ১০ মিটার পুরু। হরপ্পান সভ্যতা যতদিন টিকে ছিল উভয় বসতিতেই মানুষেরা স্থানীয় জিনিসপত্রের পাশাপশি হরপ্পা ও মহেঞ্জো-দাড়োর সংস্কৃতির জিনিসপত্র ব্যবহার করছিল। সেই সময়ে তাদেরকে হরপ্পান সংস্কৃতির কিছু অলংকার তৈরী করতেও দেখা গেল। তাদেরকে হরপ্পান সীলও ব্যবহার করতে দেখা গেল যার মধ্যে সিন্ধু লিপি সহ কিছু বিখ্যাত ইউনিকর্ন চিহ্নযুক্ত সীলও ছিল। শিকারপুরে বিপুল সংখ্যক রোহ্রি পাহাড়ের চার্ট পাথরের ফলক পাওয়া গেছে, যা গুজরাটের অন্য কোনো হরপ্পান বসতিতে পাওয়া যায় নাই।  এই সমস্ত বিষয় থেকে বুঝা যায় যে, এখানকার অধিবাসীরা বাণিজ্যের মাধ্যমে বৃহত্তর সিন্ধু সভ্যতার সাথে যুক্ত ছিল। বাগাস্রা ও শিকারপুরের চারপাশে যে কাদা-মাটির ইটের প্রাচীর ঘেরা ছিল সেই ইটগুলি ধ্রুপদী হরপ্পান ইটের মাপের অনুপাত ১ : ২ : ৪ অনুযায়ী ছিল। বিভিন্ন সময়ে এই প্রাচীর মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণও করা হয়েছিল। অর্থাৎ এখানে শাসন ব্যবস্থাও কার্যকর ছিল। বিশালাকৃতির ও ভারী সীমানা প্রাচীরের মধ্যে সেখানকার বাড়ীগুলির মধ্যে যেমন অত্যন্ত ধনীর বাড়ী ছিল না তেমন মন্দির বা সমাধিও ছিল না, যেগুলিকে সাধারণত প্রাচীন সভ্যতাগুলির রাজনৈতিক কর্তৃত্বের সাক্ষ্য হিসাবে গ্রহণ করা হয়।  এই হেঁয়ালিপূর্ণ বিষয় থেকে এটাই মনে করা যায় যে, সিন্ধু সভ্যতার সমাজ সংগঠন অন্যান্য সমসাময়িক সভ্যতা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ছিল।

-------------------------------------------------------

দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ১১০-১১১।

দেখুনঃ R.S. Bisht, Harappan Civilization (1921-2013): An Overview, in, Purātattva, No. 43, 2013, p. 22.

দেখুনঃ Brad Chase, P. Ajithprasad, S.V. Rajesh, Ambika Patel and Bhanu Sharma, Materializing Harappan identities: Unity and diversity in the borderlands of the Indus Civilization, in, Journal of Anthropological Archaeology 35, 2014, pp. 65-66.

দেখুনঃ Charusmita Gadekar, S.V. Rajesh and P. Ajithprasad, Shikarpur lithic assemblage: New questions regarding Rohri chert blade production, in, Journal of Lithic Studies, vol. 1. nr. 1, Published by the School of History, Classics and Archaeology, University of Edinburg, 2014, pp. 146-148.

  দেখুনঃ Brad Chase, et. al., Materializing Harappan identities: Unity and diversity in the borderlands of the Indus Civilization, in, Journal of Anthropological Archaeology 35, 2014, pp. 65-66.

-------------------------------------------------------

মহেঞ্জো-দাড়ো এখন পর্যন্ত পাওয়া খননকৃত সব চেয়ে বড় নগর হলেও অন্যান্য নগর যেমন হরপ্পা, রাখিগাড়ি বা গানেরিওয়ালার সাথে আয়তনে বেশী পার্থক্য না থাকায় এই সভ্যতার শাসনব্যবস্থা বিকেন্দ্রীভূত বলে মনে হয়। কিন্তু এই কথাটি মনে রাখা দরকার যে, কেন্দ্রীভূত ব্যবস্থা ছাড়া ভৌগোলিকভাবে এত দূর ব্যাপী বিস্তৃত অঞ্চলে এই ধরনের সমরূপতা নির্মাণ করা সম্ভব হত না। কিছু লেখক মনে করেন সিন্ধু সভ্যতায় একজন ব্যক্তি বা ব্যাপক নিয়ন্ত্রণকারী সীমাবদ্ধ গোষ্ঠীর বদলে কোনো কাউন্সিল বা পরিষদ দ্বারা পরিচালিত হত যেখানে জনগণের বেশ কিছু অংশ যেমন বয়োজ্যেষ্ঠরা প্রতিনিধি হিসাবে থাকত, এবং এর মাধ্যমে সামাজিক ক্ষমতা বণ্টিত হত।  এই পরিষদ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিত।  দক্ষিণ মেসোপটেমিয়ার প্রান্তের নগরগুলিতে খ্রীঃপূঃ তৃতীয় সহস্রাব্দের প্রথম দিকে (আদি রাজবংশ ১-এর সময়, প্রায় ২৯০০-২৭৫০ খ্রীঃপূঃ ) এক ধরনের আদি গণতন্ত্রের অস্তিত্ব দেখতে পাওয়া যায়। সেখানে একটি কেন্দ্রীয় মিলন স্থানে একত্রিত হয়ে সম্মতির মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেওয়া হত। এই ধরনের সভা হত সম্ভবত নিপ্পুরে যেখানে বিভিন্ন নগর থেকে সভার সদস্যরা আসত। পরবর্তীকালে নিপ্পুর দক্ষিণ মেসোপটেমিয়ার ধর্মীয় কেন্দ্র হয়ে যায়। সেখানে দুটি আইন সভা বা কাউন্সিলের কথা জানা যায়, একটি হল নগরের বয়োজ্যেষ্ঠদের নিয়ে আর অন্যটি হল পুরুষ নাগরিকদের সভা।  খ্রীঃপূঃ  তৃতীয় সহস্রাব্দে পশ্চিম সিরিয়ার এবলাতে ও খ্রীঃপূঃ দ্বিতীয় সহস্রাব্দের প্রথম দিকে আনাতোলিয়ার কারুম কানেসে পরিষদ থাকার সাক্ষ্য পাওয়া গেছে।

-------------------------------------------------------

দেখুনঃ Lorenz Rahmstorf, Control Mechanisms in Mesopotamia, the Indus Valley, the Aegean and Central Europe, c. 2600-2000 BC, and the Question of Social Power in Early Complex Societies, in, Beyond Elites: Alternatives to Hierarchical Systems in Modelling Social Formations, International Conference at the Ruhr-Universität Bochum, Germany, October 22-24, 2009, Volume 2, Verlag Dr. Rudolf Habelt GmbH, Bonn, 2012, p. 322.

  এই বিষয়ে গবেষক লোরেঞ্জ রাহমস্টর্ফ-এর মন্তব্য গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলছেন, খ্রীঃপূঃ তৃতীয় সহস্রাব্দে সিন্ধুর মত ঈজীয় অঞ্চলেও সম্পদের ব্যাপক বৈষম্য ছিল না। সম্পদের বৈষম্য ও সামাজিক স্তরবিন্যাসের প্রকাশ থাকলেও তা মেসোপটেমিয়ার চেয়ে অনেক কম ছিল। সিন্ধুর মত সেখানেও রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত পরিষদে নেওয়া হত বলে মনে করা হয়। দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ৩২২।

দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ৩১৬-৩১৭।

-------------------------------------------------------

সিন্ধুতে নগর পরিকল্পনা ও বিন্যাসে জনকল্যাণমুখিতা ও ভারসাম্য, সম্পদ ও ক্ষমতায় বৈষম্যের তুলনামূলক অভাব, শাসক বা রাজাদের জীবিতকালে স্তুতির জন্য তাদের বৃহৎ শিল্পকর্ম বা মৃত্যু পরবর্তী কল্পিত সুখের জন্য জাঁকজমকপূর্ণ সমাধির অনুপস্থিতি, প্রত্নতাত্ত্বিকভাবে বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্রের সাক্ষ্য না থাকা, অথচ অন্যান্য সভ্যতার চেয়েও অনেক বড় ও বিস্তীর্ণ অঞ্চলব্যাপী এক ধরনের সমরূপতা, বিকেন্দ্রীকরণের সাথে সমাজে নিয়ন্ত্রণের স্পষ্ট সাক্ষ্য — সকল কিছুকে এক সাথে বিবেচনায় নিলে সিন্ধুর রাষ্ট্র ও সমাজ গণতান্ত্রিক ছিল এবং তা আইন সভা ও পরিষদ দ্বারা শাসিত হত এমন ধারণা সঠিক বলে আমরা মনে করি।

আগেই বলা হয়েছে যে, সিন্ধু সভ্যতার এত বিশাল এলাকা জুড়ে বিস্তৃত অঞ্চলব্যাপী হরপ্পা, মহেঞ্জো-দাড়ো, রাখিগাড়ি বা ধোলাভিরার মত বড় নগর, যেগুলিতে ব্যাপক ভিত্তিক বা আংশিক উৎখনন হয়েছে, সেখানে এমন কোনো কাঠামো পাওয়া যায় না যাকে সিন্ধু রাষ্ট্রের মন্দির হিসাবে চিহ্নিত করা যায় এবং যা এই শক্তিশালী ও এক ধরনের কেন্দ্রীভূত সভ্যতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।

পোড়া মাটির মানুষের মূর্তি আদি হরপ্পান পর্যায়ের বেশীরভাগ বসতিতে ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছিল, কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে হরপ্পান পর্যায়ের দিকে যাত্রার সময় ক্রমশই এগুলি দুর্লভ হয়ে যাচ্ছিল।  অনেক লেখক আদি হরপ্পান পর্যায়ে কোট দিজি, বুরজাহোম, গুমলা, রহমান ধেরি, সরাই খোলা ও লেওয়ানে মৃৎপাত্রের গায়ে বা অন্যান্য জিনিসে আঁকা মোষের বা ষাঁড়ের শিং-এর মত শিং-বিশিষ্ট ছবিকে শিং-বিশিষ্ট দেবতা (Horned deity) বলে অভিহিত করেন।  সরাই খোলায় দেখা যাচ্ছে যে, শিং-এর মাঝ দিয়ে একটি গাছ গজাচ্ছে, কালিবঙ্গানে একটি অসম্পূর্ণ খোলামকুচিতে একই ধরনের গাছ শিং-এর পাশে দেখা যাচ্ছে, কোট দিজিতে মাথাটি পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে যেখানে শিং-এর মাঝখান দিয়ে ছয়-পাপড়ি বিশিষ্ট একটি ফুল দেখা যাচ্ছে, লেওয়ানে একটি অসম্পূর্ণ মাথাতে শিং-এর মাঝখানে তিনটি পাপড়ি দেখা যাচ্ছে। ভিররানায় যথেষ্ট সংখ্যক পোড়ামাটির শিং-এর ভগ্নাংশ ও বাঁকানো শিং-ওয়ালা পশুর মাথা পাওয়া গেছে।  মনে করা হয় যে, এগুলি ধর্মের সাথে সংশ্লিষ্ট ও পুরোহিতরা ধর্মানুষ্ঠান করার সময় এগুলি মাথায় বা কপালে পরত।

-------------------------------------------------------

দেখুনঃ Bridget and Raymond Allchin, The Rise of Civilization in India and Pakistan, Selectbook Service Syndicate, New Delhi, 1983, pp. 162-165.  

দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ১৬২-১৬৫।

দেখুনঃ L.S. Rao, Stylised Terracotta Animal Head with Horns from Bhirrana – Identification and Significance, in, Purātattva, No. 35: 2004-2005, 2005, pp. 69-73.

-------------------------------------------------------

এখানে যে সমস্ত মূর্তি পাওয়া গেছে সেগুলি খুবই ক্ষুদ্রাকৃতি। আর এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় যে মূর্তি পাওয়া গেছে তা মহেঞ্জো-দাড়োতে পাওয়া ‘রাজর্ষি’র মূর্তি, যা মাত্র ১৭.৫  সেন্টিমিটার উচ্চতাবিশিষ্ট। এগুলির সাথে ধর্মের সংশ্লিষ্টতার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় নাই। হরপ্পায় খননে প্রচুর মানুষের ও পশুর পোড়ামাটির মূর্তি পাওয়া গেছে। কিন্তু এগুলির কোনোটাই সরাসরি কবরস্থানে পাওয়া যায় নাই, অথবা কোনো ধর্মীয় প্রথা বা বিশেষ কোনো উদ্দেশ্যে তৈরী হয়েছিল এমন প্রমাণ পাওয়া যায় না।  তবে এগুলির মধ্যে কিছু মূর্তি তৈরীতে প্রেরণা হিসাবে দেবতা বা দেবীর নরত্বমূলক ধারণা ছিল বলে প্রত্নতাত্ত্বিকরা মনে করেন।

-------------------------------------------------------

দেখুনঃ George F. Dales, Some Specialized Ceramic Studies at Harappa, in, Harappa Excavations 1986-1990: A Multidisciplinary Approach to Third Millennium Urbanism, ed., Richard H. Meadow, 1991, pp. 65-66.

-------------------------------------------------------

পাতা : ৬৭

খুবই অলংকার সমৃদ্ধ ক্ষুদ্র আকৃতির কিছু নারীমূর্তি নবপ্রস্তর যুগ থেকে শুরু করে হরপ্পান পর্যায়ের বিভিন্ন বসতিতে পাওয়া গেছে। সীলে খোদিত ছবিগুলির তুলনায় এগুলিকে খুবই অপটু হাতের বলে মনে করা যায়। ১৯৮৬ থেকে ১৯৮৯ পর্যন্ত হরপ্পায় খননের সময় ৪৯৭টি মানুষের আকৃতির মূর্তি পাওয়া গেছে, যার মধ্যে ৩৯৩টি (৭৯.১%) নারীমূর্তি ও ৭৩টি (১৪.৭%) পুরুষমূর্তি ও ৩১টি (৬.২%) ভাংগা বলে নারী-পুরুষ নির্ধারণ করা যায় নাই।  এত বেশী সংখ্যক নারীমূর্তি পাওয়া তাৎপর্যপূর্ণ। তবে সবচেয়ে বেশী মূর্তি পাওয়া গিয়েছিল সমাধি এলাকায়, যা পুরু আবর্জনার স্তর দিয়ে ঢাকা ছিল। আর গুরুত্বপূর্ণ হল একটিও সমাধির সাথে পাওয়া যায় নাই। সকল হরপ্পান বসতিতে এই সব মূর্তি পাওয়া যায় নাই। যেমন, সুরকোটডায় প্রত্নতাত্ত্বিক খননে একটিও পোড়ামাটির নারীমূর্তি পাওয়া যায় নাই।  তেমনি পাওয়া যায় নাই কালিবঙ্গান ও লোথালে। গবেষক ভগবান সিং এগুলিকে মৃৎশিল্পীদের শিশুদের খেলার ছলে বানানো বলে মনে করেন।  এক সময়ে এগুলিকে মাতৃদেবীর মূর্তি বলে মনে করা হত। এগুলি সিন্ধু সভ্যতার রাষ্ট্রীয় ধর্মের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ বলে মনে করার কারণ নাই। তবে সমগ্র সিন্ধু উপত্যকা জুড়ে যে চিহ্নটি সীলের মধ্যে উৎকীর্ণ অবস্থায় সবচেয়ে বেশী পাওয়া গেছে তা হল ইউনিকর্ন নামে প্রধানত এক শিং-বিশিষ্ট ও দেহ অনেকটা ষাঁড়ের মত কিন্তু একাধিক প্রাণীর বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য নিয়ে উৎকীর্ণ এই কাল্পনিক প্রাণী। সীল যেহেতু রাষ্ট্রীয় কাজে ব্যবহার হত বলে ধারণা করা যায়, সুতরাং সীলে অংকিত এই ইউনিকর্ন নামে কল্পিত প্রাণীর ছবি সহ সীলে উৎকীর্ণ অন্যান্য প্রাণীর ছবিগুলিকে গুরুত্ব দিবার প্রয়োজন আছে।

-------------------------------------------------------

দেখুনঃ George F. Dales and J. Mark Kenoyer, The Harappa Project 1986-1989: New Investigation at an Ancient Indus City, in, Harappan Civilization: A Recent Perspective, 2nd edition, ed., Gregory L. Possehl, Oxford & IBH Publishing Pvt. Ltd., New Delhi, 1993, p. 502.

দেখুনঃ Jagat Pati Joshi, Excavation at Surkotada 1971-72 and Exploration in Kutch, Published by the Director General, Archaeological Survey of India, New Delhi, 1990, p. 61.

এই বিষয়ে ভগবান সিং-এর মন্তব্য গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেছেনঃ `But Mother Goddesses have not been attested from all the Harappan sites. A large number of those found at Mohenjo-daro appear to be playfully made by the children of potters. It is also to be noted that the Mother Goddess was not the supreme deity of the Harappans. Symbolic representations of the Vedic deities on seals, all of which are male, tell an opposite story. Male domination is evident from other features as well. … … Female representations are missing from the seals and sealings.’ দেখুনঃ Bhagwan Singh, The Vedic Harappans, Aditya Prakashan, New Delhi, 1995, P. 425.

-------------------------------------------------------

একটি সীলে যোগাসনে বসা একজন মানুষের মূর্তিকে অনেকে একজন দেবতার বিশেষত পরবর্তীকালে হিন্দুদের দেবতা শিবের অনুরূপ বলে মনে করেন।  আর একটি সীলে দেখা যায় যে একজন ব্যক্তি নীচু একটি আসনে যোগ সাধনার ভঙ্গিতে বসা, তার মাথায় মোষের শিং-এর মত আকৃতির শিং বসানো ও পাশে বন্য ছাগল অংকিত। এছাড়া এই ব্যক্তিটি বন্য জীবজন্তু দ্বারা বেষ্টিত। অনেক লেখক সীলে উৎকীর্ণ এই ব্যক্তিটিকে হিন্দুদের ‘পশুপতি’ বা গৃহপালিত পশুকুলের অধিপতি শিব বলে মনে করেন। অনেক ক্ষেত্রেই শিং দুইটির মাঝখান থেকে পল্লবিত গাছের পাতা দেখা যায়। এছাড়াও শিবলিঙ্গের মত পাথরের বস্তু কিছু বসতিতে পাওয়া গেছে বলে কোনো কোনো প্রত্নতাত্ত্বিক উল্লেখ করেছেন। অন্য ধরনের কতগুলি সীল ও কবচে মানুষের কিছু ছবি উৎকীর্ণ করা আছে যাদের মাথায় শিং ও লম্বা লেজ, যেগুলি নারী বা পুরুষ উভয়েরই আছে। এইগুলির কোনোটার পিছনে পা  ও গরুর খুরের মত খুর আছে। অন্য একটি সীলে একজন যোগীর ছবির পিছনে সাপের ছবি আছে। আরো কিছু সীলে মনে করা হয় যেন গাছ-দেবতার ছবি, আবার কিছু সীলে অশত্থ গাছের ছবি উৎকীর্ণ। অনেকে একটি সীলে এক জোড়া বাঘের সাথে এক ব্যক্তির মল্লযুদ্ধের ছবিটিতে মেসোপটেমিয়ার উপকথার প্রভাব দেখতে পান।  এছাড়া শিংবিশিষ্ট দেবতা, যার পা ও লেজ ষাঁড়ের মত মেসোপটেমিয়ার উপকথার ষাঁড়-মানবের কথা মনে করিয়ে দেয়। আরেকটি ছবিতে এক সারি দীর্ঘ চুলবিশিষ্ট সাতটি মানুষ অশ্বত্থ গাছের সামনে দাঁড়ানো, এর মাঝখানে একটি শিংবিশিষ্ট মূর্তি দাঁড়ানো। শিংবিশিষ্ট মানুষসহ ছবিকে সাত ঋষি বা সপ্তর্ষি বলে ধরা হয়। এছাড়াও কিছু যৌগ প্রাণীর ছবি সীলে দেখতে পাওয়া যায়, যেমন প্রাণীদেহের সামনের অংশ মানুষের কিন্তু পিছনের অংশ বাঘের, এছাড়া ষাঁড়-হাতি, ভেড়া-ষাঁড়-হাতি ও সিংহ-হাতি উল্লেখ করা যায়। সীলে উৎকীর্ণ লিপিতে, কবচে বা তামার ফলকে এই ধরনের ছবিকে অনেক লেখক হরপ্পানদের ধর্ম বিশ্বাসের সাথে সম্পর্কিত করেন। এমনকি এগুলির সাথে পরবর্তী ভারতীয় ধর্মের যোগসূত্র দেখান।  কালিবঙ্গানে হরপ্পান পর্যায়ের শুরু থেকে অগ্নি-বেদীর মত অনুমিত সাতটি কাঠামো পাওয়া গেছে যা ধর্মীয় উদ্দেশ্যে নির্মিত বলে প্রত্নতাত্ত্বিক বি,বি, লাল মনে করেন।  এই বেদীগুলি প্রকৃতপক্ষে কাদা-মাটির আস্তরণ দেওয়া গর্ত। এই গর্তগুলির মধ্যে ছাই, কয়লা, মাটির একটি কেন্দ্র স্তম্ভ ও পোড়ামাটির পিঠাকৃতি বস্তু পাওয়া গেছে। কালিবঙ্গানের নীচু শহরের কিছু আবাসিক ভবনে এই ধরনের গুরুত্বপূর্ণ কাঠামো পাওয়ার কথা বি,বি, লাল জানিয়েছেন। উত্তর-দক্ষিণ বরাবর বসানো অগ্নি-বেদীর এই সংখ্যাটির সঙ্গে আজকের হিন্দুদের পূজার বেদীর সংখ্যার মিল দেখানো হয়। এখানে পূজারীকে পূর্ব দিকে মুখ করে বসতে হত। অনেকে মনে করেন যে, সেখানে অগ্নি-উপাসনা প্রচলিত ছিল। এটিকে ইন্দো-আর্য বা আর্যদের প্রথা বলে ধরা হয়।

-------------------------------------------------------

দেখুনঃ Bridget and Raymond Allchin, The Rise of Civilization in India and Pakistan, 1983, pp. 213-217.

দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ২১৩-২১৭।

দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ২১৩-২১৭।

  দেখুনঃ B.B. Lal, Some Reflections on the Structural Remains at Kalibangan, in, Frontiers of the Indus Civilization, eds., B.B. Lal & S.P. Gupta, 1984, p. 57.

-------------------------------------------------------

বি,বি, লাল যে কাঠামোকে অগ্নি-বেদী বলছেন, তাকে অনেক প্রত্নতাত্ত্বিক ও গবেষক কারিগরের চুলা হিসাবে চিহ্নিত করেন। গবেষক ও তাপ-প্রযুক্তিবিদ্যা বিশারদ (Pyrotechnologist) হিদার মিলার মন্তব্য করেন যে, সিন্ধুর সাংস্কৃতিক কোনো বস্তুতে এমন কোনো প্রতীক বা ছবি নাই যা দিয়ে মনে করা যায় যে সেখানে আগুনকে শ্রদ্ধা বা পূজা করা হত। তিনি বলেন যে, কালিবঙ্গানের তথাকথিত ‘অগ্নি-বেদী’ সিন্ধুর অন্যান্য বসতিতে পাওয়া রান্নার চুলা ও মৃৎপাত্র উৎপাদনের উনানের সাথে পর্যাপ্ত প্রমাণসহ মিলে যায়।

-------------------------------------------------------

হিদার মিলারের মন্তব্য এখানে উল্লেখ করার মত। তাঁর ভাষায়ঃ `… … There is no clear symbols or scenes of the veneration of fire in the Indus cultural material. The so-called ”fire-alters“ of Kalibangan are identical to well-documented cooking hearths and pottery-production kilns found at other sites. As a pyrotechnologist, I would like to believe the Indus people valued fire and its uses, but certainly there is no archaeological evidence to show that they held it in religious veneration.’ দেখুনঃ Heather M.-L. Miller, Issues in the Determination of Ancient Value Systems: The Role of Talc (Steatite) and Faience in the Indus Civilization, in, Intercultural Relations between South and Southwest Asia, eds. E. Olijdam & R.H. Spoor, BAR International Series 1826, 2008, pp. 154-155.

-------------------------------------------------------

এই অগ্নি-বেদী বা চুলা ছাড়াও আয়তক্ষেত্রাকার একটি গর্তের কথা জানা যায় যার মাপ ১.২৫ X ১ মিটার ও এতে পোড়া-মাটির ইটের আস্তরণ দেওয়া। এই গর্তগুলির মধ্যে গবাদি পশুর হাড় ও বারশিঙা হরিণের শিং (Antler) পাওয়াতে এটাকে পশুবলীর উদ্দেশ্যে নির্মিত কাঠামো বলে মনে করা হয়।  কালিবঙ্গানে পাওয়া একটি ত্রিভূজাকৃতির পোড়ামাটির পিঠাকৃতি বস্তুর একপাশে উৎকীর্ণ একটি ছবিকে দেবতার ছবি বলে মনে করা হয়, যার অন্য দিকে দেখা যায় এক ব্যক্তি সম্ভবত একটি দড়িতে বেঁধে একটি পশু টেনে নিয়ে যাচ্ছে। এটি থেকে পশুবলীর ইঙ্গিত পাওয়া যায় বলে অনেকে ধারণা করেন।

-------------------------------------------------------

দেখুনঃ B.B. Lal, Some Reflections on the Structural Remains at Kalibangan, in, Frontiers of the Indus Civilization, eds., B.B. Lal & S.P. Gupta, 1984, p. 57.

-------------------------------------------------------

সাম্প্রতিক প্রত্নতাত্ত্বিক খননের ফলে, বিশেষভাবে হরপ্পায় ব্যাপক খননের পর, মনে করা হচ্ছে যে, হরপ্পান পর্যায়ের তৃতীয় বা শেষ পর্বের শুরুতে অর্থাৎ ২২০০ খ্রীঃপূঃ-এর দিকে সিন্ধু সভ্যতায় ধর্মের সাথে সংশ্লিষ্টতা বেড়েছিল। হরপ্পায় খননে দেখা গেছে যে, মাথায় বিশেষ ধরনের টায়রা, টিকলি বা মুকুট খোচিত নারীমূর্তি প্রথম পাওয়া যায় পর্ব ৩সি-তে অর্থাৎ ২২০০ খ্রীঃপূঃ-এর দিকে, হরপ্পার বিশেষ কিছু এলাকায়। হরপ্পার পশ্চিম ও দক্ষিণ অংশে ঢিবি এফ, এবি ও কবরস্থান এলাকায় এগুলি পাওয়া গেছে, কিন্তু পূর্ব দিকের অংশে ঢিবি এ ও ইটি-তে এগুলি পাওয়া যায় নাই।  কবরস্থানে এগুলি পাওয়া গেছে আবর্জনা হিসাবে। ৩সি-এর নীচের স্তরগুলিতে অর্থাৎ ২৬০০-২২০০ খ্রীঃপূঃ-এর মধ্যে এই ধরনের মূর্তি একটিও পাওয়া যায় নাই।  এই ধরনের মূর্তি হরপ্পান সভ্যতা পতনের পরবর্তী পর্যায়েও অর্থাৎ ১৯০০-১৮০০ খ্রীঃপূঃ-এর দিকে হরপ্পায় তৈরী করা হত, যা বসতিটির সব এলাকায় পাওয়া গেছে।

-------------------------------------------------------

 দেখুনঃ Sharri R. Clark, Deconstructing the ‘Harappan Courtiers’: A Re-evaluation of Some of the Anthropomorphic Terracotta Figurines from Harappa, in, Intercultural Relations between South and Southwest Asia, eds., E. Olijdam & R.H. Spoor, BAR International Series 1826, 2008, p. 166.

  দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ১৬৩-১৬৬।

-------------------------------------------------------

আমরা মনে করি সীলে যে সমস্ত প্রাণীর ছবি আঁকা হয়েছে সেগুলি বণিক বা কারিগরদের বিভিন্ন গোত্র বা উপজাতি বা গোষ্ঠীর টোটেম বা প্রতীক হওয়া সম্ভব। যৌগ বা একাধিক প্রাণীর মিশ্রণ কিছু সীলে আছে। যেমন, ইউনিকর্ন প্রতীকটি অথবা ২-মাথা, ৩-মাথা বা ৪-মাথা বিশিষ্ট প্রাণী বা বিভিন্ন প্রাণী দেহের বিভিন্ন অংশ নিয়ে গঠিত যৌগ ছবি বণিক বা কারিগরদের বিভিন্ন গোষ্ঠীর কনফেডারেসি বা ঐক্য বুঝাতে ব্যবহার হয়েছে।  অথবা মোষের শিং-বিশিষ্ট দেবতার ছবি বিভিন্ন আঞ্চলিক বিশ্বাসকে প্রতিনিধিত্ব করেছে।

-------------------------------------------------------

এস,আর, রাও এই ধরনের ছবিকে ঋগ্বেদে উল্লেখিত পঞ্চ জনপদ বা দশ রাজার কনফেডারেসির সাথে মিলাবার চেষ্টা করেছেন। দেখুনঃ S.R. Rao, Dawn and Devolution of the Indus Civilization, Aditya Prakashan, New Delhi, 1991, pp. 317-318.

-------------------------------------------------------

পাতা : ৬৮

সিন্ধু সভ্যতার প্রত্নতাত্ত্বিক সাক্ষ্য ও অন্যান্য বৈশিষ্ট্য থেকে আমরা মনে করি সিন্ধু সভ্যতার শাসকরা কোনো ধর্মকে লালন করত না। আরো সঠিকভাবে বললে তারা নিরীশ্বরবাদী ছিল। বিভিন্ন সীল বা ফলকে ধর্মের সাথে সংশ্লিষ্ট যে চিহ্ন সম্পর্কে উপরে আলোচনা করা হয়েছে, আমরা মনে করি প্রথমত, তার অনেক কিছুই আদৌ ধর্মের বিষয় ছিল না। দ্বিতীয়ত, এগুলি সমাজের নীচ তলায় বিদ্যমান জনগোষ্ঠীর অথবা অন্যান্য বিভিন্ন গোষ্ঠীর ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রকাশকে অনুমোদন দিতে গিয়ে সিন্ধুর রাষ্ট্র অল্প পরিসরে কিছু প্রকাশ মেনে নিয়েছিল। ফলে সীলের লিপিকে নিয়ন্ত্রণ করলেও সীলে কী ছবি অঙ্কিত হবে তা তারা নির্ধারণ করত না। রাষ্ট্র কর্তৃক নির্ধারিত লিপির সাথে ছবিকে অন্তর্ভূক্ত করত বিভিন্ন বণিক বা কারিগর শ্রেণী। এইজন্য আমরা সীল মোহরে লিপি দেখতে পেলেও সীলের ছবি তেমন একটা দেখতে পাই না, যা আগে উল্লেখ করা হয়েছে। সিন্ধুর মত বৃহৎ ও শক্তিশালী রাষ্ট্রের ধর্ম থাকলে তার প্রকাশ অনেক বড় আয়তনে হত, ক্ষুদ্র মূর্তি বা ছবিতে হত না। আমরা সিন্ধুর রাষ্ট্রের শক্তির প্রকাশ দেখতে পেয়েছি বৃহদায়তন ভবন ও সিন্ধুর বসতিগুলিকে বেষ্টনকারী অত্যন্ত ভারী ও উঁচু প্রাচীর থেকে। আগের আলোচনায় দেখেছি বালুচিস্তানে হরপ্পান যুগের যে সমস্ত বাঁধ এখনো টিকে আছে সেগুলির এত বৎসর পরেও ভারী নির্মাণের অবশেষ অবাক করার মত। হরপ্পান পর্যায়ে বৃহত্তর সিন্ধু উপত্যকায় কৃষিতে সেচের জন্য যে বাঁধের কথা আমরা আগে বলেছি, সেটাও হয়ত সিন্ধু সভ্যতার শক্তি প্রকাশের জন্য মহা-নির্মাণ হওয়া অসম্ভব ছিল না।     

সিন্ধু সভ্যতার শাসকদের অন্যান্য প্রাচীন সভ্যতার শাসকদের মত নিজেদের কোনো মূর্তি বা ছবি তৈরী, মৃত্যু পরবর্তী কল্পিত জীবনের জন্য কবরে বা অন্য কোথায়ও স্মারক নির্মাণ, জীবিত অবস্থায় নিজেদের বৃহৎ বাসগৃহ বা প্রাসাদ নির্মাণ, ইত্যাদি করতে দেখা যায় না। এর ফলে সিন্ধু সভ্যতায় ব্যক্তি শাসকের উপস্থিতি প্রত্নতাত্ত্বিকভাবে বুঝার উপায় নাই। কিন্তু সেখানে শাসক নিশ্চয়ই ছিল নতুবা কীভাবে এত দূর ব্যাপী এত কিছুতে সমরূপতা নিয়ে একটি সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছিল।  

সিন্ধু সভ্যতার প্রাণশক্তির উৎস ছিল নদীনিয়ন্ত্রণব্যবস্থা। অর্থাৎ সিন্ধু সভ্যতার বিপুল সংখ্যক অধিবাসীর খাদ্যের ব্যবস্থা করার জন্য সেখানকার শাসকশ্রেণী নদীসমূহে বাঁধ দেয় ও কৃষিভূমিতে জলসেচের ব্যবস্থা করে। কিন্তু এই নদীনিয়ন্ত্রণব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে খাল বা নালার সাহায্যে বিভিন্ন এলাকার কৃষিভূমিতে প্রয়োজন অনুযায়ী জল সরবরাহ একটি জটিল কাজ ছিল। কারণ জল সরবরাহে ন্যায্যতা নিশ্চিত করা ও জল বণ্টনে আঞ্চলিক অসন্তোষ দূর করা রাষ্ট্রের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব ছিল। এই জন্য রাষ্ট্রকে এক ধরনের কঠোর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে হয়েছিল। সমগ্র বৃহত্তর সিন্ধু উপত্যকার এলাকা জুড়ে এমন কি গ্রামীণ ছোট বসতিগুলিতে সিন্ধু সভ্যতার অভিন্ন লিপি, সীল ও বাটখারা থেকে বুঝা যায় যে মূলত এই তিনটিই ছিল সিন্ধু সভ্যতার রাষ্ট্র শাসকদের নিয়ন্ত্রণের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। সিন্ধু সভ্যতার শাসকরা যেহেতু শান্তিপূর্ণ পদ্ধতিতে শাসন করেছে বলে প্রত্নতাত্ত্বিকভাবে বুঝা যায়, সেই কারণে জনসাধারণকে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যম অন্যান্য সভ্যতার মত প্রধানত বলপ্রয়োগ না হয়ে প্রধানত আদর্শিক ও মনস্তাত্ত্বিক হওয়া উচিত। একদিকে শ্রেণীবৈষম্যের তীব্রতা না থাকা এবং জনগণের চাহিদার প্রতি রাষ্ট্রের মনোযোগ, অপরদিকে রাষ্ট্রপরিচালনায় জনমতের প্রতিফলনের সুযোগ থাকায় এই রাষ্ট্রে বলপ্রয়োগের ভূমিকা এমনিতেই যথেষ্ট গৌণ ছিল বলে প্রত্নতত্ত্বের সাক্ষ্য থেকেও আমরা ধারণা করতে পারি। তারপরেও জনগণকে নিয়ন্ত্রণের জন্য এবং সমাজে নিয়ম ও শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য জনমানসকে নিয়ন্ত্রণের উপর রাষ্ট্রকে গুরুত্ব দিতে হয়েছিল। এটা মূলত মনস্তাত্ত্বিক  নিয়ন্ত্রণের বিষয়।

এই মনস্তাত্ত্বিক নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি হতে পারে বৃহৎ ও বিশালাকার নির্মাণ, উঁচু ও ভারী প্রাচীর, নদীতে নির্মিত বৃহদাকার ও উঁচু বাঁধ, ইত্যাদি দ্বারা জনচেতনাকে প্রভাবিত বা অভিভূত করা। আমরা দেখেছি সিন্ধু সভ্যতার শাসকরা জনগণকে শাসন করার জন্য যেমন বলপ্রয়োগের পথ গ্রহণ করে নাই তেমন আবার অন্যান্য সভ্যতার মত মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ধর্মকেও ব্যবহার করে নাই। সব যুগে প্রতিটি রাষ্ট্রই তার নাগরিকদের শাসন করার উদ্দেশ্যে জনমানসকে নিয়ন্ত্রণের জন্য কোনো না কোনো পদ্ধতি অবলম্বন করে। সিন্ধু সভ্যতা জনমানসকে নিয়ন্ত্রণের জন্য যে পদ্ধতি গ্রহণ করেছিল বলে আমরা মনে করি তার বস্তুগত প্রকাশ হল প্রধানত বৃহদাকার নির্মাণ, সুপরিকল্পিত ও সুনিয়ন্ত্রিত নগর বিন্যাস ও নগর জীবন এবং তার অধীনস্থ সকল বসতি ও নাগরিকের ব্যবহারের জন্য লিপি, সীল ও বাটখারা নির্ধারণ করে দেওয়া। প্রত্নতাত্ত্বিকভাবে জানা সিন্ধু সভ্যতার বস্তুগত সংস্কৃতি থেকে এর সপক্ষে প্রমাণ পাওয়া যায়। বাটখারা তৈরী সম্পর্কে মিশেল ড্যানিনো বলছেন যে, অন্যান্য সভ্যতার চেয়েও এখানে যথেষ্ট নিখুঁতভাবে বেশীরভাগ বাটখারা তৈরী করা হত, যাতে সমগ্র সময় জুড়ে কোনো পরিবর্তন হত না।  কিন্তু জনমানসকে শুধু বস্তুগত বিষয় দিয়ে কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। এর সাথে দরকার হয় ভাবগত বা আদর্শিক বিষয়ও।

-------------------------------------------------------

 এই বিষয়ে মিশেল ড্যানিনো বলছেন, ‘The weights are in the great majority of cases made with considerable accuracy, much more so than in other countries in that period. The unit does not change during the whole occupation of the site [Mohenjodaro].’ দেখুনঃ Michel Danino, Metrology and Linear Measurements, in, History of Ancient India, Volume II, Protohistoric Foundations, eds., Dilip K. Chakrabarti and Makkhan Lal, 2014, p. 311.

-------------------------------------------------------

আমাদের ধারণা লোকায়ত মতাদর্শ সিন্ধুর রাষ্ট্র কর্তৃক পৃষ্টপোষকতাপ্রাপ্ত ও অনুমোদিত মতাদর্শ ছিল যা আবার লোকসমাজ তথা জনসাধারণের মধ্যে বিপুল জনপ্রিয় ছিল। এজন্যই সম্ভবত পরবর্তীকালে লোকায়ত অর্থ  হয়েছে লোক সমাজ বা জনসাধারণের মধ্যে পরিব্যাপ্ত ধ্যান-ধারণা। লোকায়ত ছিল বস্তুবাদী মতাদর্শ। সিন্ধুর সমাজের ঐক্যের জন্য আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার ছিল বলে ধারণা করা যায়, তা হল ভাষা। আমাদের ধারণা সিন্ধু সভ্যতায় প্রচলিত একটি সাধারণ লিপির মতই একটি সাধারণ ভাষা প্রচলিত ছিল। এটি ছিল সিন্ধু সভ্যতার রাষ্ট্রভাষা, যা অন্যান্য আঞ্চলিক ভাষার পাশাপাশি বৃহত্তর সিন্ধু উপত্যকার সকল অঞ্চলে ব্যবহৃত হত। সিন্ধু সভ্যতার ব্যাপক ভূভাগের উচ্চবর্গ সহ এক বিরাট সংখ্যক জনগোষ্ঠী যে এই ভাষা ব্যবহার করত তার প্রমাণ ঋগ্বেদের ভাষা। তার আদি নাম কী ছিল বা হতে পারে সেই বিতর্কে না গিয়েও আমরা এ কথা বলতে পারি যে, সিন্ধু সভ্যতার ব্যাপক সংখ্যক মানুষের নিকট বোধগম্য ভাষা না হলে সেই ভাষায় রচিত একটি ধর্মীয় আন্দোলনের মন্ত্রসমূহ বা গ্রন্থ জনপ্রিয় হতে পারত না। সুতরাং আমরা যৌক্তিকভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারি যে, বাঁধভিত্তিক নদীনিয়ন্ত্রণব্যবস্থা ধ্বংসের জন্য বিস্তীর্ণ অঞ্চলব্যাপী ছড়ানো বৈদিক আন্দোলনের মন্ত্র রচনায় যে ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে সেটা সেই সময়ে বৃহত্তর সিন্ধু উপত্যকায় সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসাধারণের ব্যবহৃত কিংবা বোধগম্য ভাষা ছিল। একই সঙ্গে আমরা এই সিদ্ধান্তও নিতে পারি যে, এই বিশাল অঞ্চলে একটা প্রবল রাষ্ট্রের প্রবল ভূমিকা ও পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া একটা ভাষা এভাবে বিস্তার লাভ করতে পারত না। অর্থাৎ ঋগ্বেদ যে ভাষায় রচিত হয়েছিল সেটা গরিষ্ঠ জনগণের ভাষা হবার পাশাপাশি একই সঙ্গে ছিল রাষ্ট্রভাষা। এই ভাষার নাম আদিতে যা-ই থাক আপাতত আমাদের সুবিধার জন্য বিশেষত ঋগ্বেদ এই ভাষায় রচিত হওয়ায় আমরা এটাকে বৈদিক ভাষা হিসাবেই অভিহিত করব। অবশ্য এমনও হতে পারে যে, যেভাবে বৈদিক ও আবেস্তান সাহিত্যে আর্য শব্দের প্রতি উচ্চ মর্যাদা প্রদান করা হয়েছে তাতে এই ভাষা আর্য ভাষা হিসাবে কথিত হত। তবে সেটা এখনও প্রমাণ সাপেক্ষ। সুতরাং আমাদের সুবিধার জন্য এখন আমরা সিন্ধু সভ্যতার মূল ভাষাকে বৈদিক ভাষা হিসাবেই অভিহিত করতে পারি।

আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, সিন্ধু সভ্যতার শাসকরা জনমানসকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য বস্তুগত উপাদান ব্যবহারের পাশাপাশি ভাবগত উপাদানকেও ব্যবহার করেছিল। তবে অন্যান্য সভ্যতার মত একদিকে বলপ্রয়োগ ও নির্মমতা জনিত ভীতি বা ত্রাস সৃষ্টি এবং অন্যদিকে অলৌকিক শক্তিতে বিশ্বাসনির্ভর ধর্মের আবেদনকে ব্যবহার করতে হয় নাই। এর বিপরীতে সিন্ধু সভ্যতায় শাসনের মূল পদ্ধতি ছিল মানুষের মনস্তত্ত্ব নিয়ন্ত্রণ। ফলে এখানে শাসকদের জনসাধারণের সম্মতি ও মতামতকে গুরুত্ব দিতে হয়েছে ও স্বেচ্ছাসম্মতি ভিত্তিক শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা ও রক্ষা করতে হয়েছে। এই অবস্থায় এখানে শাসকদের নিকট একটা পর্যায় পর্যন্ত ধর্মের প্রয়োজন হয় নাই।

আমরা আগে বলেছি যে, নগর ও বসতিগুলিতে বাড়ীঘরের বিন্যাসে অতি-কেন্দ্রীভবনের অভাব, রাজপ্রাসাদের মত ভবন না পাওয়া ও প্রত্নতাত্ত্বিকভাবে ব্যক্তি শাসকের উপস্থিতির সাক্ষ্য না থাকা, রাজধানী বলে বুঝা যায় অন্যান্য নগরের তুলনায় এমন খুব বড় নগর না থাকা, ইত্যাদি থেকে সিন্ধু সভ্যতায় অন্যান্য সভ্যতার মত রাজার বা সম্রাটের মত বংশানুক্রমিক শাসনের বদলে জনগণের প্রতিনিধিত্বমূলক শাসন ব্যবস্থা ছিল বলে আমরা মনে করি। এই শাসনব্যবস্থা স্বেচ্ছাসম্মতির ভিত্তিতে কোনো পরিষদ বা কাউন্সিলের মাধ্যমে পরিচালিত হত এমনটাই যুক্তিসম্মত বলে মনে হয়। এমন হতে পারে মহেঞ্জো-দাড়ো বা এই রকম কোনো বড় নগর সিন্ধুর রাষ্ট্রের রাজধানী ছিল। হতে পারে মহেঞ্জো-দাড়োর উঁচু নগরে অবস্থিত সমাবেশ গৃহ বা ‘অ্যাসেম্বলি হল’-এ পরিষদের প্রতিনিধিরা মিলিত হত। অনুমান করা যায় সেখানে নির্দিষ্ট সময়ে অন্যান্য নগর থেকে জনপ্রতিনিধিরা আসত এবং রাষ্ট্রশাসন ও অন্যান্য বিষয়ে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করত। এই সিদ্ধান্তই তারা যার যার নগরে নিয়ে যেত ও তার বাস্তবায়ন করত। এমন হতে পারে সিন্ধু সভ্যতার প্রধান পাঁচটি নগর যেমন মহেঞ্জো-দাড়ো, হরপ্পা, রাখিগাড়ি, ধোলাভিরা ও গানেরিওয়ালার প্রতিনিধি নিয়ে একটি পরিষদ গঠিত হয়েছিল। তবে গানেরিওয়ালা সম্পর্কে এখন বলা হচ্ছে যে, এটি সিন্ধু সভ্যতার সূচনাকালে অর্থাৎ ২৬০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে নির্মাণ না হয়ে পরবর্তীকালে নির্মিত হয়।  সেক্ষেত্রে লাখাঞ্জোদাড়ো নগরও হতে পারে এই পাঁচটি নগরের একটি।

-------------------------------------------------------

এই বিষয়ে কেনোয়ার বলেন, ‘The recent dating of the upper levels at the site of Ganwerīwīlā, Cholistan between 2300-1900 BCE, indicates that this settlement was occupied during the final phases of the Haṛappan period.’ দেখুনঃ Jonathan Mark Kenoyer, New Perspectives on the Indus Tradition: Contributions fro Recent Research at Haṛappā and Other Sites in Pakistan and India, in, Sindhu-Sarasvatī Civilization: New perspectives, ed., Nalini Rao, p. 502.

-------------------------------------------------------

অবশ্য এমনও হতে পারে যে, সিন্ধু সভ্যতার জনপ্রতিনিধিরা নির্দিষ্ট সময় অন্তর পর্যায়ক্রমে যখন যে বৃহৎ নগরে একত্র হত তখন সেটাই রাষ্ট্রের রাজধানী হিসাবে কার্যকর হত। পরবর্তী ঐতিহাসিক কালেও আমরা ভারতীয় রাষ্ট্রের এমন একটি বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে  পরিচিত। রাজা বা সম্রাট যখন যে নগর বা শহরে অবস্থান করত তখন সেটাই রাষ্ট্রের রাজধানী হিসাবে ভূমিকা রাখত। আমরা মোগল শাসনকালেও দেখেছি সম্রাটদের সঙ্গে রাজধানীও চলমান হত। তাদের সঙ্গে শুধু যে সেনাবাহিনী, সরকারী বিভিন্ন দপ্তর এবং কর্মচারীরা থাকত তা-ই নয়, উপরন্তু বিভিন্ন পেশার হাজার হাজার মানুষও এই বিশাল সেনা ও প্রশাসনিক বাহিনীর বিভিন্ন প্রয়োজন পূরণের জন্য স্ত্রীপুত্র সঙ্গে নিয়ে যেত। বলা বাহুল্য সঙ্গে থাকত গাধা ইত্যাদি ভারবাহী পশুর পিঠে কিংবা গরু বা ঘোড়ায় টানা গাড়ীতে যার যার খাদ্যসামগ্রী, তৈজসপত্র, অস্থায়ীভাবে বাসের জন্য তাঁবু ইত্যাদি। বলা যায় সম্রাটের সঙ্গে যেন সমগ্র রাজধানী চলত। মুসলিম-পূর্ব যুগেও যে এমন একটা বাস্তবতা ছিল সে সম্পর্কে আমরা জানতে পারি। সিন্ধু সভ্যতায় অবস্থাটা ঠিক এ রকম না হলেও এই অবস্থার একটা আদিরূপ হয়ত ছিল সেখানে। পরবর্তী কালের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী রাজা বা সম্রাটকে ঘিরে রাজধানীর চলমান দশায় হয়ত তার একটা ছায়াপাত হয়েছিল।

সিন্ধু সভ্যতায় প্রতিনিধিত্বমূলক শাসন ব্যবস্থার কথা কোনো কোনো গবেষক উল্লেখ করেছেন। যেমন, প্রয়াত প্রত্নতাত্ত্বিক ও গবেষক গ্রেগরি পোসেল সিন্ধু সভ্যতায় রাজার বদলে বহু সংখ্যক কাউন্সিল বা সমাজনেতাদের দ্বারা শাসিত হত বলে মত প্রকাশ করেছেন।  এছাড়া গবেষক লোরেঞ্জ রাহমস্টর্ফ-এর মতে সিন্ধুর সীলে একজন ব্যক্তিকে পরিষ্কারভাবে চিহ্নিত করা যায় ও বহুবার উল্লেখিত হয়েছে এমন নাম না পাওয়ায় এবং সীলের প্রক্রিয়ায় দৃশ্যত বহু ব্যক্তির অংশগ্রহণ ও একই সাথে বসতিগুলিতে বাটখারার সর্বব্যাপী ব্যবহার প্রত্নতাত্ত্বিকদের কাছে শাসন ব্যবস্থায় স্তরবিন্যস্ত সাংগঠনিক কাঠামোর জোরালো উপস্থিতির প্রমাণ করে না। তিনি বলেন যে, সিন্ধুতে এক জন শাসকের পরিবর্তে সীমিত সংখ্যক ব্যক্তির সমন্বয়ে গঠিত পরিষদ ও কাউন্সিলের দ্বারা পরিচালিত হত যার মাধ্যমে সমাজের বড় অংশের প্রতিনিধিত্ব থাকত।

-------------------------------------------------------

তিনি বলেছেন, ‘Indus peoples were ruled by a series of ‘Councils’ or gatherings of leaders, rather than a king.’ দেখুনঃ G. L. Possehl, The Indus Civilization. A Contemporary Perspective, Walnut Creek: Rowman & Littlefield Publishers 2002, p. 57.

তাঁর ভাষায়, ‘For the Indus valley the lack of any clearly identifiable and recurring inscription of the name of a single person, and the apparent participation of many individuals in the sealing practice, together with the ubiquitous distribution of weights in settlements, suggests a corporate organisation where hierarchically organized structures were not strongly pronounced, or at least not visible to the archaeologist. It seems that instead of single individuals, or a restricted group of individuals equipped with far-reaching means of control, in the Indus civilization we should envisage councils and assemblies in which a considerable proportion of the community was represented – for example “elders” – and shared social power.’ দেখুনঃ Lorenz Rahmstorf, Control Mechanisms in Mesopotamia, the Indus Valley, the Aegean and Central Europe, c. 2600-2000 BC, and the Question of Social Power in Early Complex Societies, in, Beyond Elites: Alternatives to Hierarchical Systems in Modelling Social Formations, International Conference at the Ruhr-Universität Bochum, Germany, October 22-24, 2009, Volume 2, Verlag Dr. Rudolf Habelt GmbH, Bonn, 2012, p. 322.

-------------------------------------------------------

পাতা : ৬৯

ঋগ্বেদে অনেকবার পঞ্চজনপদ, পঞ্চজন, পঞ্চ কৃষ্টি, পঞ্চ ক্ষিতি, পঞ্চশ্রেণী, ইত্যাদির উল্লেখ পাওয়া যায়। যেমন, ‘পঞ্চজনপদের যে মনুষ্য আছে, তারা কেউ কখন আমার দৃষ্টি অতিক্রম করতে পারে না।’ (১০/১১৯/৬), ‘সূর্য যেমন নিজ তেজের দ্বারা বৃষ্টিবারি বিস্তারিত করেন, সেরূপ সে তার্ক্ষ্য পক্ষী অতি শীঘ্র পঞ্চজনপদের মনুষ্যকে অন্নদ্বারা পরিপূর্ণ ভাণ্ডার করে দিলেন।’ (১০/১৭৮/৩), ‘হে অগ্নি! আমরা তোমার প্রদত্ত অশ্ব ও অন্নদ্বারা প্রভূত সামর্থ্য লাভ করে সমস্ত লোককে অতিক্রম করে উঠব এবং আমাদের অতিপ্রভূত ও অন্যের অপ্রাপ্য ধনরাশি সূর্যের ন্যায় পঞ্চ কৃষ্টির  উপর দীপ্যমান হবে।’ (২/২/১০),  ‘তুমি বিস্তীর্ণ ছয়লোককে নিয়মিত করেছ এবং তুমি (ইন্দ্র সম্পর্কে) পঞ্চজনের পালয়িতা।’ (২/১৩/১০), ‘পঞ্চশ্রেণী লোকের মধ্যে যে অন্ন আছে, সর্সপরী শীঘ্র তা আমাদের অধিক পরিমাণে দান করুন।’ (৩/৫৩/১৬), ‘সূর্য যেরূপ তেজ দ্বারা জল দান করেন, সেরূপ দধিক্রা দেব বল দ্বারা পঞ্চকৃষ্টিকে বিস্তৃত করেছেন।’ (৪/৩৮/১০), ‘হে ইন্দ্র! মানবগণের মধ্যে যে কিছু বল ও ধন আছে এবং পঞ্চ ক্ষিতিতে যে কিছু অন্ন আছে, অখিল মহৎ বলসহকারে সে সকল আমাদের প্রদান কর।’ (৬/৪৬/৭), ‘ইন্দ্র, পৃথিবী, পূষা, ভগ, অদিতি ও পঞ্চজন আমাদের বাসভূমি বর্ধিত করুন।’ (৬/৫১/১১), ‘ত্রিলোকব্যাপিনী, সপ্তাবয়বা, পঞ্চশ্রেণীর সমৃদ্বিবিধায়িনী সরস্বতী দেবী যেন প্রতিযুদ্ধে লোকের আহ্বানযোগ্যা হন।’ (৬/৬১/১২), ‘যখন পঞ্চজনপদের মনুষ্য তাঁর উদ্দেশ্যে যজ্ঞ করল তখন তিনি সুকঠিন মেঘের দিকে উদ্গত হয়ে সে মেঘ ভেদপূর্বক জল আনলেন।’ (১০/৪৫/৬), ‘৪। ... হে পঞ্চজনপদের লোকসকল! তোমরা অন্নভোজনকারী এবং যজ্ঞে অধিকারী, তোমরা আমার হোমকার্যে এসে অধিষ্ঠান কর। ৫। পৃথিবীতে উৎপন্ন যে পঞ্চজনপদের লোক আছে, ...’ (১০/৫৩), ইত্যাদি।

-------------------------------------------------------

   কৃষ্ ধাতু অর্থে কর্ষণ করা বা চাষ করা। কৃষ্টি অর্থে চাষ কার্য। পঞ্চ কৃষ্টি অর্থে পাঁচটি কৃষি প্রধান জনপদ।

-------------------------------------------------------

ঋগ্বেদের ঋষিদের মধ্যে কোনো মন্ত্রে আঞ্চলিকতার ছাপ পাওয়া যায় না। বিশেষভাবে ঋষিদের ব্যবহৃত নদীর নাম থেকে ধারণা করা যায় যে, বৈদিক যুদ্ধ সিন্ধু সভ্যতার উত্তর অংশের কিছু এলাকায় বিশেষভাবে পাঞ্জাব ও হরিয়ানায় সীমাবদ্ধ থাকলেও ঋগ্বেদের ঋষিরা সমগ্র বৃহত্তর সিন্ধু উপত্যকাকে তাদের চেতনায় ধারণ করেছিলেন। এই কারণে এই ধারণাই দৃঢ় হয় যে, পঞ্চ জনপদ, পঞ্চকৃষ্টি, পঞ্চ ক্ষিতি, ইত্যাদি বৃহত্তর সিন্ধু উপত্যকা এবং পঞ্চজন, পঞ্চ শ্রেণী, ইত্যাদি এর সমগ্র জনগোষ্ঠীকে বুঝাতে ব্যবহার করা হয়েছিল। এমন হতে পারে রাজধানীতে যেমন অন্য চারটি বড় নগরের প্রতিনিধিরা আসত ও কোনো সভাগৃহে মিলিত হত তেমন প্রতিটি নগর ও শহর স্থানীয় পর্যায়ে প্রশাসনিক কেন্দ্র হিসাবে কাজ করত এবং সেখানে কাছাকাছি অবস্থিত ছোট শহরগুলির প্রতিনিধিরা কোনো সভাগৃহে মিলিত হত। এভাবে ছোট শহরগুলি আশেপাশে অবস্থিত গ্রামসমূহের প্রতিনিধিদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করত। আবার গ্রামগুলিতে স্থানীয় প্রতিনিধিরা মিলিত হত। এভাবে কেন্দ্র থেকে গ্রাম পর্যন্ত একটি স্তরবিন্যস্ত পরিষদ বা কাউন্সিল ভিত্তিক প্রতিনিধিত্বশীল ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল।

সিন্ধু সভ্যতায় এত দূরব্যাপী সীল, লিপি ও বাটখারা সহ অন্যান্য ক্ষেত্রে সমরূপতা আনার জন্য স্থল পথে পায়ে হাঁটা, গরু বা গাধা টানা বাহন ও জল পথে নৌকায় যোগাযোগের সেই যুগে এই স্তর-বিন্যস্ত ব্যবস্থা একটি গুরুত্বপূর্ণ শাসন পদ্ধতি ছিল বলে মনে হয়।

সম্ভবত শুরু থেকেই এইভাবে পাঁচটি নগরের অর্থাৎ বৃহত্তর সিন্ধু উপত্যকার পাঁচটি অঞ্চলের প্রতিনিধিদের নিয়ে পরিষদ গঠন করে রাষ্ট্র পরিচালনা করা হত বলে বৃহত্তর সিন্ধু উপত্যকার এই ভূমিকে পঞ্চজনপদ বলা হত। কারণ ঋগ্বেদে এই কথাটাই বেশী ব্যবহার হতে দেখা যায়। বৃটিশ শাসনের পূর্বকাল পর্যন্ত ভারতীয় গ্রামীণ সমাজে জনগণের স্থানীয় স্বশাসন পদ্ধতির যে রূপ পঞ্চায়েত  নামে পরিচিত তা সিন্ধু সভ্যতায় প্রচলিত রাষ্ট্র থেকে গ্রাম পর্যন্ত যে শাসন ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল তার ধারাবাহিকতাকে ধারণ করে বলে আমরা ধারণা করি।

-------------------------------------------------------

পঞ্চায়ত থেকে পঞ্চায়েত শব্দের উৎপত্তি। পঞ্চ অর্থ পাঁচ। আয়ত অর্থ মনিয়ার-উইলিয়ামস্-এর সংস্কৃত-ইংরাজী অভিধানে বলা আছে, stretched, lengthened, extended, spread over, directed towards, ইত্যাদি। অর্থাৎ আয়ত অর্থ প্রসারিত বা ব্যাপ্ত বলা যায়। সুতরাং পঞ্চায়ত অর্থ হচ্ছে পঞ্চ বা পাঁচ জনের মধ্যে যা পরিব্যাপ্ত।  

-------------------------------------------------------

সিন্ধু সভ্যতার গণতান্ত্রিক ও প্রজাতান্ত্রিক শাসনের ছাপ যে তার শেষ পর্যায়ে বিকাশপ্রাপ্ত ধর্মের উপরেও পড়েছিল তার মূর্তিমান প্রমাণ যেন নিরাকার দেবতার পূজারী বৈদিক ও আবেস্তান ধর্ম দুইটি। সিন্ধু সভ্যতায় কোনও স্থায়ী রাজা শাসন করত না। এই অবস্থায় রাষ্ট্র থাকলেও জনগণের নিকট শাসনের রূপ ছিল বিমূর্ত। ফলে রাজকীয় মূর্তি যেমন নাই তেমন তার অলৌকিক প্রতিপক্ষ হিসাবে অতিমানবীয় ক্ষমতা সম্পন্ন মানুষের রূপধারী কোনও দেবতা কিংবা ঈশ্বরও নাই। সম্ভবত বরুণ নামে কোনও এক দেবতা দেখা দিয়েছিল প্রধান দেবতা হিসাবে, যার উদ্দেশ্যে পূজা এবং মন্ত্রপাঠ ইত্যাদি হচ্ছিল বলে ঋগ্বেদ থেকে ধারণা করা যায়। সেই সঙ্গে ছিল আরও বহু দেবতা, এবং হয়ত বরুণের অধীনস্থ হিসাবে তাদেরও পূজা হচ্ছিল বিভিন্ন জনগোষ্ঠী কিংবা অঞ্চলের গোষ্ঠীগত বা আঞ্চলিক দেবতা হিসাবে। কিন্তু কারোরই মূর্তি পূজা প্রচলিত হয়েছিল বলে মনে হয় না। যে কথা একটু আগেই আমরা বলেছি এটা ক্ষমতা বা Power তথা রাষ্ট্র ক্ষমতার বিমূর্ততার ফল। এর ফলে সিন্ধু সভ্যতায় যখন এবং যেভাবেই ধর্ম বিকাশ লাভ করুক তা সমাজ বাস্তবতাকে আর একভাবে প্রতিফলিত করেছে। পৃথিবীর আর কোনও প্রাচীন সভ্যতায় শাসন ক্ষমতার বিমূর্ততার এমন বাস্তবতা ছিল না বলে আর কোথায়ও থেকে নিরাকার ঈশ্বর কিংবা নিরাকার দেব-দেবীর পূজার ধারণা বিকাশ লাভ করে নাই।

সুতরাং সিন্ধু সভ্যতার বাস্তবতা থেকে উদ্ভূত বৈদিক এবং আবেস্তান এই দুই ধর্মের ঈশ্বর কিংবা দেবতার ধারণা অশরীরী ক্ষমতার ধারণাকে অবলম্বন করেই দাঁড়িয়েছে। বিশেষত রাষ্ট্র ক্ষমতা কোনও বিশেষ ব্যক্তিতে স্থায়ীভাবে কেন্দ্রীভূত এবং মূর্ত না হওয়াতে এই অবস্থা। অনেক পরাবর্তী কালে বৈদিক ধর্ম থেকে উদ্ভূত ব্রাহ্মণ্য তথা হিন্দু ধর্ম এই জায়গা থেকে সরে গিয়ে মূর্ত দেব-দেবীর তথা প্রতিমা পূজার জায়গায় চলে যায়। তবে সেটা সিন্ধু সভ্যতার পতনের অনেক পরে বৈদিক ধর্মের গর্ভ থেকে জন্মপ্রাপ্ত হলেও পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে নূতন ধর্ম হিসাবে হিন্দু ধর্মের জন্ম ও বিকাশের ফল। প্রজাতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রশাসনের পরিবর্তে ক্রমবর্ধমান যুদ্ধের মধ্য দিয়ে প্রাধান্যে আসা বংশগত রাজতন্ত্রের ছায়ায় তার উত্থান ও বিকাশ।

হিন্দু ধর্ম সংক্রান্ত যে কোনও আলোচনার সময় আমাদেরকে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে হিসাবে নিতে হবে। সেটা হল যে বৈদিক ধারা থেকে তা এসেছে তার একজন কোনও প্রতিষ্ঠাতা বা প্রফেট নাই। ঋগ্বেদ থেকে প্রাচীন ঋষি বা ঋষিগণ হিসাবে অঙ্গিরা নামে একজন ব্যক্তি কিংবা তার কুল যে প্রথম বৈদিক আন্দোলনের সূচনা করেন সেটা বুঝা যায়; কিন্তু তাঁরা তাকে পূর্ণ রূপ দিয়ে যেতে পারেন নাই। ফলে বহুসংখ্যক ঋষিকে কেন্দ্র করে একটি মোটামুটি সমন্বিত আন্দোলন হিসাবে বৈদিক আন্দোলন গড়ে উঠেছিল। সকলের মধ্যে ঐক্যের মূল সূত্র ছিল নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার বিরুদ্ধতা। তাদের আগমনও এক নির্দিষ্ট ধর্মের ভিতর থেকে। এর ফলে নির্দিষ্ট কেন্দ্র না থাকলেও বা একজন ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে আন্দোলন গড়ে না উঠলেও এক ধরনের সমন্বয়ও সেখানে ঘটেছিল।

এই রকম বাস্তবতায় কেন্দ্রহীন এক ধর্মের ছায়ায় গড়ে উঠা হিন্দু ধর্মের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব, ফলত স্ববিরোধ ও বিশৃঙ্খলা আরও অনেক বেশী। তার পরেও বেদ এবং বেদচর্চার অধিকারী বা দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্রাহ্মণদের প্রতি সমাজের আনুগত্য হিন্দু ধর্মকে এক ধরনের সংহতি  বা ঐক্য দান করেছে। যাইহোক, হিন্দু ধর্মের উত্থান সম্পর্কে পরবর্তী পর্যায়ে আমরা আলোচনা করব।

পাতা : ৭০

 

 

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
Archive
 
সাম্প্রতিক পোষ্টসমূহ