Banner
সিন্ধু থেকে গঙ্গা : এক সভ্যতার পথযাত্রা (দ্বিতীয় খণ্ড) — শামসুজ্জোহা মানিক ও শামসুল আলম চঞ্চল

লিখেছেনঃ শামসুজ্জোহা মানিক ও শামসুল আলম চঞ্চল, আপডেটঃ July 4, 2023, 12:00 AM, Hits: 1466

 

খণ্ড : ২ - গাঙ্গেয় সমভূমিতে সভ্যতার গতিধারা-এর অনলাইন প্রকাশ উপলক্ষ্যে কিছু কথা

আমরা ‘সিন্ধু থেকে গঙ্গা : এক সভ্যতার পথযাত্রা’র দ্বিতীয় খণ্ড প্রকাশ করছি। এই খণ্ডের শিরোনাম হল ‘গাঙ্গেয় সমভূমিতে সভ্যতার গতিধারা’।

আজ অবধি সিন্ধু সভ্যতার লিপিমালার পাঠোদ্ধার না হওয়ায় আমরা প্রথম খণ্ডে যেভাবে প্রত্নতত্ত্বের সাক্ষ্যের উপর নির্ভর করতে বাধ্য হয়েছিলাম গাঙ্গেয় সমভূমিতে নগরায়ন ও সভ্যতার গতিধারা অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে প্রত্নতাত্ত্বিক সাক্ষ্যের পাশাপাশি পাঠযোগ্য বিভিন্ন দলিলপত্রের সাহায্য পাওয়ায় দ্বিতীয় খণ্ড রচনায় আমাদেরকে সেভাবে প্রত্নতত্ত্বের সাক্ষ্যের উপর নির্ভর করতে হয় নাই। এ ক্ষেত্রে প্রত্নতত্ত্বের পাশাপাশি মুদ্রা, প্রস্তরগাত্র, তাম্রফলক ইত্যাদিতে লিখিত বিভিন্ন বিবরণ এবং বিভিন্ন ঐতিহাসিক দলিল, ধর্মীয় সাহিত্য ইত্যাদি আমাদেরকে দক্ষিণ এশিয়া কিংবা ভারতবর্ষের সমাজ ও সভ্যতার গতিধারা অনুসন্ধানে বিরাটভাবে সাহায্য করেছে। সিন্ধু সভ্যতার ক্ষেত্রে লিপিমালার পাঠোদ্ধার না হওয়ায় ইতিহাস অনুসন্ধানে যতটা সীমাবদ্ধতা থাকে গাঙ্গেয় সমভূমিতে বিশেষত দ্বিতীয় নগরায়নের সূচনা কাল থেকে সেই সীমাবদ্ধতা তুলনায় অনেক কম।

অবশ্য সিন্ধু সভ্যতার লিপির পাঠোদ্ধার না হলেও এই সভ্যতার স্বরূপ উপলব্ধিতে হিন্দুদের আদি ধর্মগ্রন্থ ঋগ্বেদ আমাদের নিকট অপরিমেয় গুরুত্বের অধিকারী গ্রন্থ হিসাবে দেখা দিয়েছে। কারণ সিন্ধু সভ্যতার লিপির পাঠোদ্ধার না হলেও সিন্ধু সভ্যতার পটভূমিতে রচিত ঋগ্বেদের ভাষার অর্থ অজানা নয়। সিন্ধু সভ্যতার শেষ পর্যায়ে সভ্যতার সংকটের পরিস্থিতিতে সংগঠিত একটি ধর্মসংস্কার আন্দোলনের ফলে এই গ্রন্থের মন্ত্রগুলি রচিত। ফলে ঋগ্বেদকে দেখতে হবে একটা নির্দিষ্ট্ কাল এবং পরিস্থিতির পটভূমিতে ফেলে। তবে এ ক্ষেত্রেও ভূতত্ত্ব ও জেনেটিক বিদ্যা ইত্যাদি বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখাসহ প্রত্নতত্ত্বের সাক্ষ্যকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিবার প্রয়োজন রয়েছে। সিন্ধু সভ্যতার পটভূমিতে যখন ঋগ্বেদকে স্থাপন করা যায় তখন আমাদের নিকট ঋগ্বেদের পাশাপাশি সিন্ধু সভ্যতারও বহু রহস্য উন্মোচিত হয়। ইতিহাসের অনেক সত্য আবিষ্কারে বিশেষ করে প্রত্নতত্ত্বের সাথে ধর্মীয় সাহিত্যের এই সম্মিলিত অধ্যয়ন কোন কোন ক্ষেত্রে বিরাটভাবে সহায়ক হতে পারে। তবে বিশেষত ধর্মগ্রন্থের অধ্যয়নের ক্ষেত্রে সতর্কতার প্রয়োজন খুব বেশী। তা সত্ত্বেও নির্দিষ্ট ধর্ম তার উদ্ভবের নির্দিষ্ট কাল ও পরিস্থিতি তথা সমাজ বাস্তবতাকে প্রতিফলিত করে বলে সতর্কভাবে যাচাই-বাছাই করতে পারলে একটি ধর্মগ্রন্থ থেকেও তার সময়কার সমাজ বাস্তবতাকে অনেকাংশে অনুধাবন করা যেতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রে বিশেষভাবে সহায়ক হতে পারে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন বা সাক্ষ্য।  

আর এভাবে ইতিহাস অনুসন্ধান করতে গিয়ে আমাদের পূর্ব অর্জিত অনেক ধারণাকে বদলাতে হয়েছে। বিশেষ করে কিছু ক্ষেত্রে প্রত্নতত্ত্বের নূতন নূতন সাক্ষ্য আমাদের পূর্ববর্তী অনেক ধারণাকে বদলে দিয়েছে। যেমন হিন্দু ধর্ম সম্পর্কে আমাদের এতকালের ধারণা ছিল যে, এটি বৌদ্ধ কিংবা জৈন ধর্মেরও পূর্ববর্তী। এটাই বহুল প্রচারিত মত যে হিন্দু ধর্মের বর্ণাশ্রমভিত্তিক জাতিভেদ প্রথার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ বা প্রতিক্রিয়া হিসাবে ভারতবর্ষে বিশেষ করে বৌদ্ধ ধর্মের উদ্ভব হয়েছে। অথচ প্রত্নতত্ত্বের সাক্ষ্য আমাদেরকে সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা বলছে। অবশ্য বৌদ্ধ ও জৈন শাস্ত্রের গভীর ও পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুসন্ধানও প্রত্নতাত্ত্বিক সাক্ষ্য-প্রমাণের পক্ষেই যায়। আর সেটা হল বৈদিক ধর্মের উত্তরাধিকার ধারণ করলেও হিন্দু হিসাবে পরিচিত ব্রাহ্মণ্য ধর্মের উদ্ভব হয়েছে বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের উদ্ভবেরও অনেক পরে। অর্থাৎ যে অর্থে হিন্দু ধর্মকে সনাতন বলতে চাওয়া হয় সেই অর্থে এটা মোটেই সনাতন নয়। বরং বৌদ্ধ কিংবা জৈন ধর্মের তুলনায় এটি একটি নবীন ধর্ম মাত্র। বৈদিক ধর্মের উত্তরাধিকার থাকলেও একটি স্বতন্ত্র ধর্ম হিসাবে তুলনায় নবীন এই ধর্ম কীভাবে উদ্ভূত হয়েছে প্রামাণ্য প্রত্নতাত্ত্বিক সাক্ষ্যের ভিত্তিতে সেই বিষয়ে আমরা ‘সিন্ধু থেকে গঙ্গা : এক সভ্যতার পথযাত্রা’র দ্বিতীয় খণ্ড তথা এই খণ্ডে আলোচনা করেছি।

বস্তুত দক্ষিণ এশিয়ার সমাজ ও সভ্যতার গতি ও প্রকৃতি অনুসন্ধান করতে গিয়ে আমরা অনেক বিস্ময়কর উপলব্ধিতে পৌঁছেছি। এই গ্রন্থের ১ম খণ্ডের মত ২য় খণ্ডেও আমরা সেগুলিকে যতটা সম্ভব তুলে ধরতে চেষ্টা করেছি।

পাতা : ক

এ প্রসঙ্গে আমাদেরকে বলতে হয় যে, এই অনুসন্ধান আমাদেরকে বারবার টেনে নেয় সিন্ধু সভ্যতায়। সিন্ধু সভ্যতা সম্পর্কে আমরা অনেকাংশে সঠিক ধারণার কাছাকাছি পৌঁছাতে পারি যদি আমরা প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনাদি সম্পর্কে ধারণা লাভের পাশাপাশি মুক্তদৃষ্টিতে ঋগ্বেদ অধ্যয়ন করি এবং সেই সঙ্গে বিশেষত নিকটবর্তী গাঙ্গেয় সমভূমিতে পরবর্তী নগর সভ্যতার উত্থানকালীন ঘটনাধারার গভীরে দৃষ্টিপাত করি।

সিন্ধু সভ্যতার স্বরূপ অনুসন্ধান করতে গিয়ে আমরা এই উপলব্ধিতে পৌঁছেছি যে, পৃথিবীর আর কোনও সভ্যতার অভিজ্ঞতা দিয়ে সিন্ধু সভ্যতাকে বুঝা যাবে না। পৃথিবীর আর সকল সভ্যতা থেকে এটি সম্পূর্ণরূপে ভিন্ন ধরনের একটা সভ্যতা। বিশেষত এর গণতান্ত্রিক এবং শান্তিপূর্ণ বা অসামরিক বৈশিষ্ট্য সকল প্রত্নতাত্ত্বিকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। আর সকল সভ্যতা বা রাষ্ট্রের মত সিন্ধু সভ্যতারও আত্মরক্ষার জন্য সামরিক সামর্থ্য নিশ্চয় ছিল। তা না হলে এত বিরাট ও সমৃদ্ধ রাষ্ট্র বা সভ্যতা বৈদেশিক আক্রমণকারীদের হাত থেকে এত দীর্ঘকাল (কমপক্ষে সাতশত বৎসর) রক্ষা পেতে পারত না। কিন্তু প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন থেকে আমরা এই সামরিক সামর্থ্যের তেমন কোনও প্রকাশ ঘটতে দেখি না। অনুমান করা যায় যে, সভ্যতার প্রান্তে বহিরাক্রমণ থেকে আত্মরক্ষার জন্য সামরিক ব্যবস্থা থাকলেও অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে দমন ও পীড়নের জন্য সামরিক ব্যবস্থা সেভাবে ছিল না। এ থেকে বুঝা যায় যে, বলপ্রয়োগের মাধ্যমে অধীনস্থ সমাজের উপর সিন্ধুর রাষ্ট্র স্থাপিত নয়; বরং এখানে রাষ্ট্র ছিল সমাজ তথা জনগণের স্বশাসনের অভিব্যক্তি। এ যেন ফরাসী চিন্তাবিদ জাঁ জ্যাক রুশোর কল্পিত ‘সামাজিক চুক্তি’র বাস্তব রূপ।

যুদ্ধ ও বলপ্রয়োগ নির্ভর রাষ্ট্র না হওয়ায় আমরা অনুমান করি নারীর এতটা নিরাপত্তা, অধিকার ও মর্যাদা পৃথিবীর আর কোনও রাষ্ট্র দিতে পারে নাই যতটা সিন্ধু সভ্যতার রাষ্ট্র দিতে পেরেছিল। সিন্ধু সভ্যতার অবসান-পরবর্তী কালে গাঙ্গেয় সমভূমিতে দ্বিতীয় নগরায়ন পর্বে জৈন ও বৌদ্ধ ধর্মের সংঘে নারীর অবস্থান অনুসন্ধান করতে গিয়ে আমাদের নিকট সিন্ধু সভ্যতার এই সম্ভাব্য দিকটি উদ্ভাসিত হয়। এর সঙ্গে সিন্ধু সভ্যতার প্রত্নতাত্ত্বিক সাক্ষ্যও অবশ্য আমাদেরকে বিষয়টিকে অধিকতর গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিতে উৎসাহিত করেছে। হয়ত অধিকতর প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার এবং সিন্ধু লিপির পাঠোদ্ধার ভবিষ্যতে এমন এক সভ্যতার চিত্র আমাদের সম্মুখে উপস্থিত করবে যেখানে পুরুষ এবং নারী উভয়ের অংশগ্রহণে সমাজ এবং রাষ্ট্র পরিচালিত হত।

এভাবে দ্বিতীয় খণ্ডের আলোচনায় আপাত দৃষ্টিতে অপ্রাসঙ্গিক মনে হলেও সিন্ধু সভ্যতার প্রসঙ্গ বিভিন্ন সময়ে এসেছে। আসলে দক্ষিণ এশিয়ার সমাজ ও ইতিহাসের অনেক রহস্যের উন্মোচন অসম্ভব হয়ে থাকবে যদি আমরা সিন্ধু সভ্যতাকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে অনুধাবনের চেষ্টা না করি। অনেক বিচ্ছেদ ও সময়ের দূরত্বের পরেও দক্ষিণ এশিয়ার সমাজ ও সভ্যতার মহত্তম উত্তরাধিকার আমরা খুঁজে পেয়েছি সিন্ধু সভ্যতায়। আজ অবধি দক্ষিণ এশিয়ার সমাজ ও সভ্যতা বিভিন্ন রূপে তার গভীরে বহন করে চলেছে সিন্ধু সভ্যতার ঐতিহ্যকে। সুতরাং দক্ষিণ এশিয়ার সমাজ ও সভ্যতার গতি ও প্রকৃতি অথবা তার সমস্যাগুলিকে বুঝতে এবং একই সাথে ভবিষ্যৎ যাত্রাপথের দিশা পেতে চাইলে আমাদেরকে বার বার ফিরতে হবে সিন্ধু সভ্যতায়। শুধু তা-ই নয়, সিন্ধু সভ্যতার পতন-পরবর্তী কালে ইরান ও পশ্চিম এশিয়া এবং ইউরোপের সমাজ ও সভ্যতার বিকাশধারার উপরেও আমরা সিন্ধু সভ্যতার গভীর প্রভাব দেখতে পেয়েছি। যেমন গ্রীক ও রোমান সভ্যতা কিংবা মধ্যপ্রাচ্যের একেশ্বরবাদী ধর্মগুলির উত্থানের পিছনে আমরা সিন্ধু সভ্যতার ভাবাদর্শিক কিংবা সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার দেখতে পেয়েছি। এই বিষয়গুলিকে গ্রন্থের এই খণ্ডে সংক্ষেপে হলেও এনেছি।

অবশ্য ‘সিন্ধু থেকে গঙ্গা : এক সভ্যতার পথযাত্রা’র দ্বিতীয় খণ্ডে আমাদের অনুসন্ধানের মূল ক্ষেত্র সিন্ধু সভ্যতা পরবর্তী বৃহত্তর গাঙ্গেয় সমভূমি এবং সেই সঙ্গে সমগ্র উপমহাদেশ। এবং সেটা প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে মধ্যযুগ শুরুর প্রাক্কাল পর্যন্ত, যখন শক, হুন ইত্যাদি বৈদেশিক পশুচারী, যাযাবর ও অর্ধযাযাবরদের আক্রমণ অভিযানের কাল শেষ হয়ে নূতন আর একদল আক্রমণকারীর আক্রমণ অভিযানকে গ্রহণ করার জন্য উপমহাদেশ প্রস্তুত হচ্ছে। শক, হুন ইত্যাদি পূর্ববর্তী আক্রমণকারীরা শেষ পর্যন্ত ভারতীয় ধর্ম ও সংস্কৃতিকে গ্রহণ করে মূলত এখানকার সমাজের মূল ধারায় মিশে গেছে। কিন্তু পরবর্তী আক্রমণের ঢেউগুলি যারা পরিচালনা ক’রে এখানে নিজেদের আধিপত্য ও শাসন প্রতিষ্ঠা করেছিল তারা ইসলাম নামক এমন এক ধর্ম নিয়ে এসেছিল যা তাদেরকে উপমহাদেশের সমাজ ও সভ্যতার গতিধারায় সেভাবে মিলিত হতে দেয় নাই। এ বিষয়ে আমরা পরবর্তী খণ্ডে আলোচনার ইচ্ছা রাখি। বর্তমান খণ্ডে আমরা ইসলামী অভিযান পূর্ববর্তী কাল পর্যন্ত ভারতীয় সমাজ ও সভ্যতার গতি ও প্রকৃতির বিষয়গুলি নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করার চেষ্টা করেছি।

পাতা : খ

এখানে আর একটি বিষয় স্পষ্ট করা দরকার বলে মনে হয় যে, এই গ্রন্থের বিষয়বস্তু কিছু ক্ষেত্রে ১৯৯৫ সালে প্রকাশনী সংস্থা ‘দিনরাত্রি’ কর্তৃক প্রকাশিত আমাদের উভয়ের যৌথভাবে লিখা ইংরাজী গ্রন্থ The Aryans and the Indus Civilization এবং আরও বিশেষত ২০০৩ সালে ‘ব-দ্বীপ প্রকাশন’ কর্তৃক প্রকাশিত এবং একইভাবে আমাদের উভয়ের যৌথভাবে লিখা বাংলা গ্রন্থ ‘আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা’র মূল ধারণাগত ভিত্তিভূমির উপর প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। তবে কিছু বিষয়ে ‘আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা’য় বিস্তারিত আলোচনা হওয়ায় সেগুলির উপর আলোচনা এই গ্রন্থে কিছু ক্ষেত্রে খুব সংক্ষিপ্ত হয়েছে। এর ফলে ‘আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা’ যাঁরা পড়েছেন তাঁরা সংক্ষিপ্ত হলেও কিছু বিষয়ের পুনরুক্তি দেখতে পাবেন। যেমন আর্য কারা বা কাদেরকে বলা হত এ বিষয়ে আমরা ‘আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা’য় তুলনায় বিশদ আলোচনা করলেও এই গ্রন্থে এ সংক্রান্ত আলোচনা খুব সংক্ষেপে হলেও করেছি। এ ধরনের আরও দৃষ্টান্তের মধ্যে বৈদিক কিংবা হিন্দু ধর্মে অসুর ও দেবতার মধ্যকার পার্থক্য কীভাবে সৃষ্টি হয়েছিল সেই বিষয়ে পূর্বোক্ত গ্রন্থে যেভাবে আমরা বিশদ আলোচনা করেছিলাম এই গ্রন্থে সেভাবে আলোচনা করি নাই। সুতরাং যে সব পাঠক এই গ্রন্থ পড়বেন তাঁরা সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ের উপর আমাদের আরও কিছু বিস্তারিত আলোচনা জানতে বিশেষ করে ‘আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা’ পাঠ করতে পারেন। অবশ্য বৈদিক ধর্মের উত্থানের মত বিষয়গুলির উপর আমাদের আলোচনাকে ‘সিন্ধু থেকে গঙ্গা : এক সভ্যতার পথযাত্রা’য়্ও আমরা যথেষ্ট বিস্তারিতভাবে করার চেষ্টা করেছি।

প্রসঙ্গক্রমে বলা উচিত হবে যে, প্রায় কুড়ি বৎসর আগে লিখা ‘আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা’র সাথে সব বিষয়ে এখনকার লিখা ‘সিন্ধু থেকে গঙ্গা : এক সভ্যতার পথযাত্রা’কে মিলানো যাবে না। এখন যে আমরা তখনকার তুলনায় অনেক বেশী তথ্যসমৃদ্ধ শুধু তা-ই নয়, সময়ের সঙ্গে আমাদের চিন্তায়ও কিছু ক্ষেত্রে পরিবর্তন ঘটেছে, ঘটেঁছে পরিপূর্ণতাও। সবচেয়ে বড় কথা এই দুই গ্রন্থের প্রেক্ষিত অনেকাংশে ভিন্নও বটে। ‘আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা’-এর মত কিছু সুনির্দিষ্ট বিষয়ের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ না রেখে এই গ্রন্থে সংক্ষেপে হলেও আমরা সমগ্র উপমহাদেশের সমাজ ও সভ্যতার গতি ও প্রকৃতি এবং সেই সঙ্গে সমস্যাগুলিকে বুঝতে চেয়েছি। সুতরাং এই গ্রন্থের পরিসর অনেক বেশী বিস্তৃত। এই দুই গ্রন্থকে মিলিয়ে পড়লে পাঠক সেটা বুঝতে পারবেন বলে আশা করি।

কিন্তু পাঠক এখন আর বাজারে ‘আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা’ পাবেন না। কারণ ‘ইসলাম বিতর্ক’ নামে বিভিন্ন ইংরাজী প্রবন্ধের বাংলায় একটি অনুবাদ সংকলন প্রকাশের কারণে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সরকার ধর্মানুভূতিতে আঘাতের অভিযোগ এনে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযু্ক্তি আইনের ৫৭(২)ধারায় ২০১৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারী তারিখে আমাদের উভয়ের বিরুদ্ধে মামলা করে এবং আমাদের উভয়কে কারাগারে নেয় এবং ঐ একই দিন তল্লাশি চালিয়ে পুলিশ ‘ব-দ্বীপ প্রকাশন’-এর স্বত্বাধিকারী হিসাবে শামসুজ্জোহা মানিককে তাঁর বাসগৃহ থেকে গ্রেফতারের সময় তাঁর ব্যক্তিগত সংগ্রহে রাখা বই-পত্র এবং বাসগৃহ ও অফিসে রক্ষিত ‘ব-দ্বীপ প্রকাশন’ কর্তৃক প্রকাশিত প্রায় সকল গ্রন্থ বাজেয়াপ্ত করে নিয়ে যায় এবং প্রকাশনের অফিস ও বিক্রয় কেন্দ্র সীলগালা করে বন্ধ করে দেয়।

যাইহোক, পরবর্তী ভিন্ন ভিন্ন সময়ে আমরা উভয়ে জামিনে কারামুক্ত হই এবং শেষ পর্যন্ত বিগত ২০২০ সালের ২৩ জানুয়ারী তারিখে মামলা থেকে অব্যাহতি পাই। অবশ্য বিষয়টি এখানে প্রাসঙ্গিক নয় বলে এ নিয়ে আমরা বিস্তারিত আলোচনা করব না। তবে এটুকু উল্লেখ করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, ‘ব-দ্বীপ প্রকাশন’-এর স্বত্বাধিকারী এবং ‘ইসলাম বিতর্ক’-এর প্রকাশক শামসুজ্জোহা মানিক হলেও এবং ‘ইসলাম বিতর্ক’ কিংবা ‘ব-দ্বীপ প্রকাশন’-এর সঙ্গে শামসুল আলম চঞ্চলের সম্পর্ক না থাকলেও প্রকাশনের বিপণন কর্মকর্তা দেখিয়ে পুলিশ তাঁর বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে তাঁকে জেলে নেয়।

প্রকাশনটি আর চালু করা সম্ভব হয় নাই। সুতরাং আমাদের বর্তমান গ্রন্থে সূত্র হিসাবে বিভিন্ন সময়ে টীকায় ‘ব-দ্বাপ প্রকাশন’ কর্তৃক প্রকাশিত গ্রন্থ হিসাবে ‘আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা’র নাম উল্লেখ থাকলেও বাজার থেকে এই মুহূর্তে সেটি সংগ্রহ করা সম্ভব নয়। তবে ওয়েবসাইট ‘বঙ্গরাষ্ট্র’-এ ‘আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা’ প্রকাশিত থাকায় পাঠক সেখানে সেটি পাঠ করতে পারেন। গ্রন্থটি ‘বঙ্গরাষ্ট্র’-এর ‘গ্রন্থাগার’ বিভাগের ‘ইতিহাস বিষয়ক গ্রন্থ’-এ দেওয়া আছে। এটির লিংক:  http://www.bangarashtra.net/article/853.html

শামসুজ্জোহা মানিক

শামসুল আলম চঞ্চল

ঢাকা, ৩ সেপ্টেম্বর ২০২২

পাতা : গ

 

খণ্ড – ২ : গাঙ্গেয় সমভূমিতে সভ্যতার গতিধারা

বিষয়সূচী :

পাতা :

১ম অধ্যায় : লৌহযুগ থেকে দ্বিতীয় নগরায়ন

১-৬

২য় অধ্যায় : গাঙ্গেয় সমভূমিতে লোকায়ত ও গণতান্ত্রিক সমাজ

৭-১০

৩য় অধ্যায় : বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের উত্থান

১১-২৩

৪র্থ অধ্যায় : হিন্দু ধর্মের উদ্ভব : প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ

২৪-২৯

৫ম অধ্যায় : হিন্দু ধর্মের উদ্ভবে ব্রাহ্মণের ভূমিকা

৩০-৩৬

৬ষ্ঠ অধ্যায় : ভারতবর্ষের ধর্মগুলিতে নারীর অবস্থানের ক্রমিক  অধোগতি

৩৭-৩৮

৭ম অধ্যায় : গাঙ্গেয় সমভূমিতে সিন্ধু সভ্যতার উত্তরাধিকার

৩৯-৪২

৮ম অধ্যায় : পশ্চিমে সিন্ধু সভ্যতার উত্তরাধিকার

৪৩-৪৭

 

১ম অধ্যায় : লৌহযুগ থেকে দ্বিতীয় নগরায়ন

১৯০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে সিন্ধু সভ্যতার পতনের পর সিন্ধু সভ্যতার সরাসরি ঐতিহ্য বহনকারী বিদায়ী হরপ্পান যুগের বসতিগুলিকে আমরা ভারতবর্ষের উত্তর-পশ্চিমের বিভিন্ন অঞ্চলে আরো কিছুকাল ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে দেখি। এই সময়ে নূতন সংস্কৃতির মানুষদের কিছুটা পূর্ব দিকে ছড়িয়ে পড়তে দেখা যায়। বিদায়ী হরপ্পান পর্ব বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন সময়ে শেষ হয়েছিল। তবে ১৩০০ খ্রীঃপূঃ পর্যন্ত কিছু কিছু অঞ্চলে কিছু বসতিতে টিকে থাকতে দেখা গেছে। আমরা আগের খণ্ডে দেখেছি হরপ্পান নগর সভ্যতার পতন হলে পরবর্তী নানা সংস্কৃতির ধারা বৃহত্তর সিন্ধু উপত্যকা ও তার বাইরে ছড়িয়ে পড়েছিল। এই সংস্কৃতির যে সমস্ত ধারা পরবর্তীকালে গাঙ্গেয় সমভূমিতে ছড়িয়ে পড়েছিল ও আরো পরে এই অঞ্চলে দ্বিতীয় নগরায়নের মাধ্যমে যে নূতন সভ্যতার জন্ম দেয় এই অধ্যায়ে সেই বিষয়ে আলোচনা করা হবে।

গাঙ্গেয় সমভূমি  বলতে এখানে বৃহত্তর সিন্ধু নদী উপত্যকা থেকে পূর্বে যে সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশের অঞ্চলসমূহ রয়েছে তাকে বুঝানো হয়েছে। এর মধ্যে পড়েছে গঙ্গা নদী উপত্যকা, বিন্ধ্য মালভূমি অঞ্চল এবং কাবেরী ও গোদাবরী নদী উপত্যকা। এই বিস্তীর্ণ অঞ্চলে গত প্রায় পঁচিশ বৎসরে বিপুল প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান করা হয়েছে। এর ফলে এই অঞ্চলের প্রত্নতত্ত্ব সম্পর্কে আমাদের বর্তমান জ্ঞান আগের চেয়েও অনেক সমৃদ্ধ। পুরাতন অনেক ধারণা নাকচ করে নূতন ধারণাগত কাঠামো গড়ে তুলবার জন্য এখন আমাদের হাতে তুলনামূলক অনেক গবেষণালব্ধ উপাদান সঞ্চিত হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই আমরা আমাদের এই আলোচনায় যতটা সম্ভব সাম্প্রতিক প্রত্নতাত্ত্বিক তথ্য ও গবেষণালব্ধ অন্যান্য উপাদান ব্যবহার করার চেষ্টা করব।

সাম্প্রতিক প্রত্নতত্ত্ব থেকে জানা যাচ্ছে যে, সিন্ধু অঞ্চল থেকে গাঙ্গেয় সমভূমির দিকে অভিগমনের অনেক আগে থেকেই গাঙ্গেয় সমভূমি অঞ্চলে স্বাধীনভাবে কৃষিভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা হচ্ছিল। আমরা বালুচিস্তানে যেমন দেখেছি, খ্রীঃপূঃ অষ্টম সহস্রাব্দের শেষের দিকে মানুষ স্থিতিশীল জীবন শুরু করে কৃষি ও পশুপালন শুরু করেছিল তেমন গাঙ্গেয় উপত্যকায় প্রায় একই সময়ে ধান চাষ শুরু হয়। উত্তর প্রদেশের পূর্ব দিকে মধ্য গঙ্গা সমভূমিতে অবস্থিত এই বসতিটির নাম লহুরাদেবা। রেডিও কার্বন পরীক্ষায় এখানকার সময় পাওয়া গেছে খ্রীঃপূঃ ৭ম সহস্রাব্দ। এছাড়াও এই অঞ্চলে আরো কিছু বসতিতে খ্রীঃপূঃ ৭ম থেকে খ্রীঃপূঃ ৪র্থ সহস্রাব্দ পর্যন্ত ধান চাষের প্রমাণ পাওয়া গেছে, যেগুলি হল, কোলদিহ্ওয়া, টোকওয়া, কুনঝুন ও মালহার। লহুরাদেবায় পাঁচটি সাংস্কৃতিক পর্ব দেখা গেছে যেগুলি হল: পর্ব ১ (আদি কৃষি, প্রায় ৭০০০ খ্রীঃপূঃ থেকে ২০০০ খ্রীঃপূঃ), পর্ব ২ (বিকশিত কৃষি), পর্ব ৩ (অগ্রসর কৃষি), পর্ব ৪ (উত্তরাঞ্চলীয় কাল মসৃণ মৃৎপাত্রের অনুরূপ), এবং পর্ব ৫ উত্তারঞ্চলীয় কাল মসৃণ মৃৎপাত্র সংস্কৃতি থেকে গুপ্ত যুগ (৩০০ খ্রীষ্টাব্দ - ৫৫০ খ্রীষ্টাব্দ) পর্যন্ত। মধ্য গঙ্গা সমভূমির বাইরে আরো দক্ষিণে উত্তর বিন্ধ্য অঞ্চলে আরো যেসব বসতিতে ধান চাষের প্রমাণ পাওয়া গেছে, সেগুলি হল ঝুসি, হেতাপট্টি, চিরন্দ, তারাদিহ্, মহাগরা ও ইমলিধ খুর্দ।  যদিও কার্বন পরীক্ষা করা হয় নাই, তবু মৃৎপাত্রের ভাংগা অংশ পরীক্ষা করে মনে করা হচ্ছে যে, বিন্ধ্য ও সংলগ্ন গঙ্গা সমভূমির চোপানি-মান্ডো, কোলদিহ্ওয়া, টোকওয়া, লহুরাদেবার মত বসতিগুলিতে মৃৎশিল্প শুরু হয়েছিল খ্রীঃপূঃ ৭ম/৮ম সহস্রাব্দে। কুঁজহীন গরু পালন শুরু হয় মধ্য প্রস্তর যুগে খ্রীঃপূঃ নবম সহস্রাব্দের পরবর্তী ভাগে গঙ্গা উপত্যকায়, খ্রীঃপূঃ ষষ্ঠ সহস্রাব্দের শুরুতে নর্মদা উপত্যকায় এবং খ্রীঃপূঃ ষষ্ঠ সহস্রাব্দের শেষের দিকে বনাস-চম্বল উপত্যকায়। মৃৎপাত্রের আকৃতির বিষয় বিবেচনা করলে মধ্য গঙ্গা সমভূমিতে নবপ্রস্তর যুগ থেকে ধারাবাহিকতা রাখতে দেখা যায়। এখানে তাম্র যুগ ও লৌহ যুগে মৃৎপাত্রের ঐতিহ্যে ধীর বিবর্তন ও বিকাশ ঘটছিল।  দাক্ষিণাত্যে তাম্র যুগ পাওয়া গেছে ২২০০ থেকে ৯০০ খ্রীঃপূঃ পর্যন্ত।

------------------------------------

দেখুনঃ Rakesh Tewari, R.K. Srivastava, K.K. Singh and K.S. Saraswat, Further Excavations at Lahuradewa, District Sant Kabir Nagar (U.P.) 2005-06: Preliminary Observations, in, Purātattva, No. 36: 2005-2006, 2006, pp. 68-74.

দেখুনঃ  M.L.K. Murty, Archaeology and Human Ecology of Late Pleistocene and Early Holocene Cultures in India: Implications for Transition to Agriculture, in, Purātattva, No. 45, 2015, p. 26.

দেখুনঃ K. Panddayya, Some Observations About the Transition from Hunting-Foraging to Farming in India, in, Purātattva, No. 45, 2015, p. 102.

দেখুনঃ A.K. Prasad, Transition from the Hunting-Gathering Phase to Agro-Pastoral Mode of Subsistence in India with Special Reference to the Rock Art Sites in Southern Bihar and Adjoining Jharkhand, in, Purātattva, No. 45, 2015, p. 116.

দেখুনঃ প্রাগুক্ত নিবন্ধ, পৃঃ ১১৯।

লেখকের মন্তব্যটি গুরুত্বপূর্র্ণ, তিনি বলেছেনঃ `As far as the pottery shapes are concerned, occurrence of bowls and vases in various profiles in all the stages right from the neolithic period, indicate continuity of pottery shapes. Besides, ample existence of table wares such as dish on stands, bowl on stands and dishes etc. in Chalcolithic and early Iron Age demonstrate the development of pot making technology and food habits of the society existed in MGP (Middle Ganga Plain). The pottery traditions of MGP show gradual evolution, development and continuity in pot making.’ দেখুনঃ Kulbhushan Mishra, Ceramic Traditions of Middle Ganga Plain (From the Beginning to the Early Iron Age), in, Purātattva, No. 40, 2010, pp. 158-159.

দেখুনঃ Varada Khaladkar, Archaeological Investigations in the Middle Bhima Basin, Maharashtra: A Preliminary Report, in, Purātattva, No. 40, 2010, p. 27.

------------------------------------

সিন্ধুর নগর-উত্তর কাল (খ্রীষ্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দের প্রথম দিকে) (সৌজন্যেঃ Akinori Uesugi, 2018)

পাতা : ১

খ্রীঃপূঃ ৪০০০ থেকে খ্রীঃপূঃ ১০০০ পর্যন্ত গঙ্গা-যমুনা নদী উপত্যকা ও দক্ষিণে বিন্ধ্য মালভূমিতে কৃষি ভিত্তিক বসতিগুলিকে ছড়ানো অবস্থায় দেখা যায়। লিখিত দলিলের অভাবে এই সমাজ সম্পর্কে খুব বেশী জানা যায় না। তাদের নিজস্ব মৃৎশিল্প ও বিভিন্ন জিনিসপত্র থেকে মনে করা যায় যে তাদের আঞ্চলিক সংস্কৃতি সেই সময়ে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছিল, যা ধারাবাহিকভাবে তাম্র যুগ থেকে লৌহ যুগের সমাজে উত্তরণ ঘটাচ্ছিল। এই সময়ে যে সমস্ত স্বতন্ত্র মৃৎশিল্পের ধরনের উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায় সেগুলি হল গিরিমাটি রঙের মৃৎপাত্র (Ochre Colored Pottery), চকচকে লাল মৃৎপাত্র (Burnished Red Ware), তাম্র ভাণ্ডার (Copper hoards), চিত্রিত ধূসর মৃৎপাত্র (Painted Grey Ware - PGW), কাল প্রলেপ বিশিষ্ট মৃৎপাত্র (Black slipped ware) ও উত্তরাঞ্চলীয় কাল মসৃণ মৃৎপাত্র (Northern Black Polished Ware - NBPW) সংস্কৃতি। গাঙ্গেয় সমভূমিতে খ্রীঃপূঃ দ্বিতীয় সহস্রাব্দের শেষের দিকে কাল-ও-লাল মৃৎপাত্র সংস্কৃতির মানুষজন বসতি স্থাপন করে। তাদের বসতিগুলি বিক্ষিপ্ত ছিল ও দীর্ঘকালব্যাপী স্থায়ী ছিল না। দেখা গেছে যে, ভারতের উত্তরাঞ্চল প্রদেশের মধ্য হিমালয় অঞ্চলে সানানা-বাসেরি ও সম্পূর্ণ রামগঙ্গা উপত্যকায় বৃহৎ প্রস্তর যুগের মানুষজন চিত্রিত ধূসর মৃৎপাত্রের মানুষজনের পূর্ববর্তী ছিল।

------------------------------------

দেখুনঃ Sita Ram Dubey and Santosh Kumar Singh, Further Excavations at Pakkakot: 2014-15, in, Purātattva, No. 45, 2015, pp. 209-210.

দেখুনঃ K.P. Nautiyal, Rakesh C. Bhatt and M.S. Chauhan, Uttranchal Megaliths – Were they Co-eval or Precursor of the PGW Culture? An Assessment, in, Purātattva, No. 32: 2001-02, 2002, p. 77.

------------------------------------

দক্ষিণ এশিয়ায় লৌহ যুগ সাধারণভাবে ধরা হয় দ্বাদশ খ্রীষ্টপূর্বাব্দ সময় থেকে। কিন্তু মধ্য গঙ্গা সমভূমিতে মালহার নামে একটি প্রত্নস্থল খনন করে লোহার প্রথম ব্যবহার দেখা গেছে ১৮০০ খ্রীঃপূঃ-এ। এছাড়া উত্তর প্রদেশে রায়পুর নামে একটি প্রত্নস্থলে ১৭০০ খ্রীঃপূঃ-এর দিকে লোহা গলানোর প্রমাণ পাওয়া গেছে। এই আবিষ্কারের ফলে দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম লোহার ব্যবহারের পুরাতন ধারণা বদলে যাচ্ছে।

------------------------------------

দেখুনঃ Indudhar Dwivedi and Vimal Tiwari, Reassessment of the Archaeological Antiquity of Upper Central Ganga Plain with Reference to Data from Significant Excavated Stes and Recent Researches, in, Purātattva, No. 44, 2014, p. 170, 174.

দেখুনঃ Vibha Tripathi and Prabhakar Upadhyay, Raipur: An Early Iron Age Site in Vindhya-Kaimur Region, in, Purātattva, No. 43, 2013, p. 155.

------------------------------------

উড়িষ্যার মহানদী উপত্যকায় লৌহ যুগ থেকে আদি ঐতিহাসিক যুগের অনেক সংখ্যক বসতি পাওয়া গেছে। এখানে বদমল নামে বসতিতে খ্রীষ্টপূর্ব প্রথম সহস্রাব্দের প্রথম দিকের লৌহ যুগের বসতিতে লোহার বিভিন্ন জিনিসপত্র পাওয়া গেছে। এখানে সীমিত খননে লোহা গলানোর প্রমাণ পাওয়া না গেলেও এখান থেকে তিরিশ কিলোমিটার দক্ষিণে কুরুমপাদর নামে একটি বসতিতে লোহা গলানোর প্রমাণ পাওয়া গেছে।

------------------------------------

দেখুনঃ Pradeep K. Behera & Pranab K. Chattopadhyay, Iron Objects from the Iron Age - Early Historic Level at Badmal (Dist. Sambalpur, Orissa): Archaeometallurgical Studies, in, Purātattva, No. 35: 2004-2005, 2005, pp. 118-124.

------------------------------------

উত্তর ভারতীয় লৌহ যুগ পর্ব ১ (খ্রীষ্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দের শেষের দিকে) (সৌজন্যেঃ Akinori Uesugi, 2018)

চিত্রিত ধূসর মৃৎপাত্র সংস্কৃতির (১২০০-৮০০ খ্রীঃপূঃ) বসতি দেখা গেছে হস্তিনাপুর, অহিচ্ছত্র, পানিগ্রাহি, থাপলি, জখেরা ও গঙ্গা-যমুনা নদীর মধ্যবর্তী স্থলভাগের অন্যান্য বসতিতে। চিত্রিত ধূসর মৃৎপাত্রের যুগে কোনো বসতিই প্রাচীর ঘেরা হত না, কেবল জখেরা বসতিটিতে নদীর পাশে বড় মাটির বাঁধ ও পরিখা ছিল। সম্ভবত বন্যা প্রতিরোধের জন্য বাঁধ দিয়ে ঘেরা হয়েছিল। এই ধরনের বাঁধ প্রথম দিককার উত্তরাঞ্চলীয় কাল মসৃণ মৃৎপাত্র সংস্কৃতির (৮০০-৬০০ খ্রীঃপূঃ) বসতিগুলির চারপাশে ঘেরা হত, সম্ভবত বন্যা প্রতিরোধের জন্য। প্রায় ৫০০ খ্রীঃপূঃ-এ কোশাম্বি, রাজগীর, পাটলিপুত্র, শ্রাবস্তি ও অযোধ্যার মত বসতিগুলির চারপাশে প্রাচীর দেখা গেছে, যা যুদ্ধের জন্য আত্মরক্ষামূলক বলে মনে করা হয়। গাঙ্গেয় অঞ্চলের প্রত্নতাত্ত্বিক সাক্ষ্য থেকে জানা যায় যে, যুদ্ধ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। এই সময়ে লৌহ অস্ত্র নাটকীয়ভাবে বেড়ে যায়, বসতিসমূহের যুদ্ধের কারণে ধ্বংসের প্রমাণ পাওয়া যায় ও নগরের চারপাশে সীমানা প্রাচীর দিতে দেখা যায়।

------------------------------------

দেখুনঃ Jonathan M. Kenoyer, The Archaeological Heritage of Pakistan and the Indo-Gangetic Tradition: Early Historic Chiefdoms and States of the Northern Subcontinent, in, A History of Pakistan, ed., Roger D. Long, Oxford University Press, 2015, p. 100. 

------------------------------------

উত্তর ভারতীয় লৌহ যুগ পর্ব ২ (খ্রীষ্টপূর্ব প্রথম সহস্রাব্দের প্রথম দিকে) (সৌজন্যেঃ Akinori Uesugi, 2018)

পাতা : ২

হরপ্পান পরবর্তী (Post Harappan) কিছু সংস্কৃতির মধ্যে উজ্জ্বল লাল মৃৎপাত্র (Lustrous Red Ware) সংস্কৃতির কিছু বসতির মধ্যে উল্লেখযোগ্য বসতি হল গুজরাটের সৌরাষ্ট্রের উত্তর-পশ্চিম উপকূলে দ্বারকা নামে একটি বসতি। এখানকার প্রথম বসতি, যা প্রথম দ্বারকা নামে উল্লেখ করা হয়েছে, সেখানে ১৬শ -১৫শ খ্রীঃপূঃ-এ উজ্জ্বল লাল মৃৎপাত্রের সাথে বিদায়ী হরপ্পান অল্প মৃৎপাত্র পাওয়া গেছে।  এখানকার পরবর্তী বসতি, দ্বিতীয় দ্বারকার সময়সীমা অনুমান করা হয় ৯০০-৫০০ খ্রীঃপূঃ এবং তৃতীয় দ্বারকার সময়সীমা ২য় খ্রীঃপূঃ থেকে খ্রীষ্টীয় ৬ষ্ঠ শতাব্দী পর্যন্ত যেখানে প্রথম মন্দিরের সাক্ষ্য পাওয়া যায়। চতুর্থ দ্বারকার সময়সীমা খ্রীষ্টীয় ৭ম থেকে ৮ম শতাব্দী পর্যন্ত ও এই সময়ে দ্বিতীয় মন্দিরের সাক্ষ্য পাওয়া যায়।

------------------------------------

দেখুনঃ S.R. Rao, The Lost City of Dvārakā, Aditya Prakashan, New Delhi, 1999, pp. 36-37.

দেখুনঃ প্রাগুক্ত গ্রন্থ, পৃঃ ৩৭।

------------------------------------

উত্তর ভারতীয় লৌহ যুগ পর্ব ৩ (খ্রীষ্টপূর্ব প্রথম সহস্রাব্দের মধ্যবর্তী অংশে) (সৌজন্যেঃ Akinori Uesugi, 2018)

গুজরাটের বেট দ্বারকা দ্বীপে বিদায়ী হরপ্পান লিপি ও কিছু অ-হরপ্পান লিপি দেখা গেছে, যেগুলিকে ব্রাহ্মী লিপির মত বলে মনে করা হয়।  হরপ্পান লিপি থেকে সরল বর্ণমালার লিপির বিবর্তন এখানে দেখা যায় বলে প্রত্নতাত্ত্বিক এস, আর, রাও মনে করেন।

------------------------------------

দেখুনঃ S.R. Rao, The Lost City of Dvārakā, 1999, pp. 115-116.

------------------------------------

গঙ্গা উপত্যকায় আদি ঐতিহাসিক রাষ্ট্র ও নগর নির্মাণ হতে দেখা যায় ৬০০ খ্রীঃপূঃ-এ। আগে মনে করা হত যে, গঙ্গা-যমুনা নদী উপত্যকায় দ্বিতীয় নগরায়নের মূল কেন্দ্র ছিল যা পরে সিন্ধু উপত্যকার উত্তরাংশে ছড়িয়ে পড়ে। প্রত্নতত্ত্বের নূতন সাক্ষ্য ও দ্বিতীয় নগরায়নের বৈশিষ্ট্য থেকে মনে করা হচ্ছে যে, দ্বিতীয় নগরায়নের মূল অঞ্চল ছিল উত্তর সিন্ধু উপত্যকা ও পাঞ্জাব অঞ্চল।  উত্তর সিন্ধু উপত্যকা অঞ্চল থেকে নগরায়ন ধীরে ধীরে পূর্ব দিকে গঙ্গা-যমুনা নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চল ও ক্রমান্বয়ে দূরে গঙ্গা উপত্যকার নিম্নাঞ্চল ও গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র নদীর ব-দ্বীপ অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে।

------------------------------------

দেখুনঃ Jonathan M. Kenoyer, The Archaeological Heritage of Pakistan and the Indo-Gangetic Tradition: Early Historic Chiefdoms and States of the Northern Subcontinent, in, A History of Pakistan, 2015, p. 102.

------------------------------------

উত্তর প্রদেশে কম্পিল নামে একটি বসতিতে গিরিমাটি রঙের মৃৎপাত্র (OCP) সংস্কৃতির বসতি থেকে শুরু করে কাল ও লাল মৃৎপাত্র সংস্কৃতি (Black and Red-Ware cuture), চিত্রিত ধূসর মৃৎপাত্র (PGW)  সংস্কৃতি, উত্তরাঞ্চলীয় কাল মসৃণ মৃৎপাত্র সংস্কৃতি, কুষাণ  (খ্রীষ্টাব্দ ১ম - ২য় শতাব্দী) ও গুপ্ত যুগ (৩০০ - ৫৫০ খ্রীষ্টাব্দ), ও মধ্য যুগ  পর্যন্ত বসতির প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ পাওয়া গেছে।

------------------------------------

  ইউ-চি নামে একটি পশুচারী ও যাযাবর জাতিগোষ্ঠীর আদি বাসস্থান ছিল চীনা তুর্কিস্তানে। প্রাচীনকালে হিয়ুং-নু নামে এক দুর্ধর্ষ জাতি ইউ-চি নামে তাদের চিরশত্রু  জাতিকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করে। ইউ-চিরা বিতাড়িত হয়ে পশ্চিম দিকে এসে ব্যাকট্রিয়ান বা বাহ্লীক গ্রীকদের সেলুসিড সাম্রাজ্যকে পরাজিত করে সেখানে বসবাস শুরু করে। এই সময়ে তারা পাঁচটি শাখায় বিভক্ত হয়, যাদের একটি শাখার নাম ছিল কিউ-সুং। এই কিউ-সুং বা কুইশোয়াং থেকে কুষাণ নামটি এসেছে। কুষাণরা প্রথম খ্রীষ্টাব্দে ভারতবর্ষে প্রবেশ করে। 

ভারতবর্ষে মধ্যযুগের শুরু নিয়ে বিতর্ক আছে। অনেকে একে ৭ম শতাব্দী আবার অনেকে একে ৮৫০ খ্রীষ্টাব্দ বলে উল্লেখ করেন। মধ্যযুগের সমাপ্তিকাল অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত ধরা হয়।

দেখুনঃ D.P. Tewari, The Ceramic Traditions from Kampil Excavations, in, Purātattva, No. 44, 2014, pp. 193-197.

------------------------------------

চিত্রিত ধূসর মৃৎপাত্র ও কাল ও লাল মৃৎপাত্র সংস্কৃতি গ্রামীণ সমাজের সংস্কৃতি ছিল।  একটি বিষয় তাৎপর্যপূর্ণ যে, চিত্রিত ধূসর মৃৎপাত্র সংস্কৃতির কোনো বসতিতেই মানুষের কংকালের চিহ্ন পাওয়া যায় নাই। এতে মনে করা হয় যে, এই সংস্কৃতির বসতিগুলিতে মৃতদেহ পোড়ানো হত। তবে এখন পর্যন্ত একমাত্র ব্যতিক্রম হল উত্তর প্রদেশের অভয়পুর নামে বসতি যেখানে সাম্প্রতিক খননে এই সংস্কৃতির স্তরে মানুষের কংকাল পাওয়া গেছে।

------------------------------------

দেখুনঃ Anup Mishra and U.P. Arora, Excavations at Abhaipur 2005-06, District Pilibhit, Uttar Pradesh, in, Purātattva, No. 36: 2005-2006, 2006, pp. 81, 84.

দেখুনঃ Anup Mishra and U.P. Arora, Excavations at Abhaipur 2005-06, District Pilibhit, Uttar Pradesh, in, Purātattva, No. 36: 2005-2006, 2006, p. 84.

------------------------------------

লৌহ যুগে গাঙ্গেয় সমভূমিতে মানুষের ধর্মাচরণ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া কঠিন। লৌহ যুগে ভারতীয় উপদ্বীপে কবর ও বাসস্থান পৃথক থাকত। এই অঞ্চলে দুই হাজারেরও বেশী কবরের স্মারক পাওয়া গেছে।  বৃহৎ প্রস্তর যুগের বড় পাথর দিয়ে তৈরী সমাধির সাথে সম্পর্কিত স্মৃতিস্তম্ভ উত্তরে কাশ্মীর থেকে দক্ষিণে তামিলনাড়ু পর্যন্ত সমস্ত ভারত জুড়েই দেখা গেছে। রেডিও কার্বন পরীক্ষায় সবচেয়ে প্রাচীন বৃহৎ প্রস্তর যুগের কবর পাওয়া গেছে প্রায় খ্রীঃপূঃ ১৫ম-১৪শ শতাব্দী পর্যন্ত। ধারণা করা হয় যে এগুলি খ্রীষ্টীয় তৃতীয় শতাব্দীর শেষের দিক পর্যন্ত টিকে ছিল। এটা তাৎপর্যপূর্ণ যে বসতিগুলির একটি অল্প সংখ্যক জনগোষ্ঠীকে এই কবরগুলিতে কবর দেওয়া হত, যাদের বেশীরভাগের বয়স ১৭ থেকে ৩৫ বৎসর।  এর মধ্যে কিছু আঞ্চলিক কেন্দ্র গড়ে উঠছিল বিনিময়, বাণিজ্য ও কারিগরী শিল্প বিকাশের ফলে, তবে কোনো রাজনৈতিক কর্তৃত্ব গড়ে উঠে নাই।

------------------------------------

দেখুনঃ Hinanshu Prabha Ray, The Archaeology of Sacred Spaces in India: From Multi-Religious Sites to Monuments, in, Purātattva, No. 44, 2014, pp. 2-3.

দেখুনঃ প্রাগুক্ত নিবন্ধ, পৃঃ ৩।

দেখুনঃ প্রাগুক্ত নিবন্ধ, পৃঃ ৩।

------------------------------------

পাতা : ৩

 ওড়িশায় মধ্য মহানদী উপত্যকায় তারাপোরগড়ে (Taraporegarh) লৌহ যুগ থেকে আদি ঐতিহাসিক যুগ পর্যন্ত বৃত্তাকার প্রতিরক্ষা প্রাচীর বেষ্টিত একটি বসতি পাওয়া গেছে। অন্যান্য বসতির রেডিও কার্বন তারিখের সাথে তুলনা করে এখানকার লৌহ যুগের শুরুর সময় ৭ম - ৬ষ্ঠ খ্রীঃপূঃ হবে বলে ধারণা করা হয়। এখানে পাওয়া অনেক মৃৎপাত্রের মধ্যে আগুনে পোড়ানো পরবর্তী বিভিন্ন ধরনের চিহ্ন তাৎপর্য বহন করে। এই চিহ্নসমূহের কিছু আদি ব্রাহ্মী অক্ষরের মত চিহ্নযুক্ত জ্যামিতিক ও অ-জ্যামিতিক আকৃতি ছিল যেমন, মই, স্বস্তিকা চিহ্ন, নৌকা, ফুল, তীরের ফলা, সূর্য, ইত্যাদি।

------------------------------------

দেখুনঃ Pradeep K. Behera, Sakir Hussain and G.L. Badam, Taraporegarh: An Iron Age-Early Historic Circular Fort in the Middle Mahanadi Valley, Odisha, in, Purātattva, No. 45, 2015, p. 194.

দেখুনঃ প্রাগুক্ত নিবন্ধ, পৃঃ ১৮৬-১৮৭।

------------------------------------

উত্তর প্রদেশের পূর্বে মধ্য গঙ্গা সমভূমিতে পাক্কাকোট নামে একটি বসতিতে নবপ্রস্তর যুগ থেকে মধ্য যুগ পর্যন্ত মানুষের বসবাসের প্রমাণ পাওয়া গেছে। এই বসতিটিকে গ্রামীণ বসতি থেকে শুঙ্গ-কুষাণ যুগে সম্পূর্ণভাবে একটি নগর বসতিতে পরিণত হতে দেখা যায়। এখানে উত্তাঞ্চলীয় কাল মসৃণ মৃৎপাত্র সংস্কৃতি তিনটি পর্বে (পর্ব ৩-এঃ ৯০০ - ৬০০ খ্রীঃপূঃ, পর্ব ৩-বিঃ ৬০০ - ৪৫০ খ্রীঃপূঃ, পর্ব ৩-সিঃ ৪৫০ - ২০০ খ্রীঃপূঃ) পাওয়া গেছে। এই বসতিটিতে প্রতিরক্ষা প্রাচীর ও নজরদারীর জন্য টাওয়ার ছিল। এখানে জাহাজ ঘাট, রূপার তৈরী নৃত্যরত নারী মূর্তি ও বৌদ্ধ বিহারের কাঠামো পাওয়া গেছে। মৌর্য পূর্ব যুগের এই নৃত্যরত রূপার নারীমূর্তিটি একটি দুর্লভ আবিষ্কার, কারণ গঙ্গা সমভূমিতে এই ধরনের আর কোনো মূর্তি পাওয়া যায় নাই। যদিও অনেক মানুষের ও পশুর মূর্তি পাওয়া গিয়েছিল, যার বেশীরভাগই ভাংগা। এছাড়া আরো পাওয়া গেছে খ্রীষ্টীয় ১ম শতাব্দীর পোড়া মাটির ব্রাহ্মী লিপি খোদিত সীল ও খ্রীষ্টীয় ৩য় শতাব্দীর পোড়া মাটির ব্রাহ্মী লিপি যুক্ত সীল মোহর। পাক্কাকোটকে পাটলিপুত্র, রাজঘাট ও বৈশালীর মত অন্যান্য সমসাময়িক শহর ও নগরের সাথে যোগাযোগ রাখতে দেখা যায়।

------------------------------------

দেখুনঃ Sita Ram Dubey and Santosh Kumar Singh, Further Excavations at Pakkakot: 2014-15, in, Purātattva, No. 45, 2015, pp. 204-206.

দেখুনঃ প্রাগুক্ত নিবন্ধ, পৃঃ ২০৬-২০৭।

------------------------------------

মহারাষ্ট্রের মধ্য ভীমা অববাহিকায় দাক্ষিণাত্য অঞ্চলে তাম্র যুগের (প্রায় ২২০০-৯০০ খ্রীঃপূঃ) সংস্কৃতি দেখা যায় জরওয়ে ও উত্তর জরওয়ে, ইনামগাঁও ও সোনগাঁও-এ।  এই অঞ্চলে আদি ঐতিহাসিক এবং ঐতিহাসিক যুগের মৃৎশিল্প দেখা যায় টের, মুধনি, নাসিক, নেভাসা, ইত্যাদিতে (প্রায় খ্রীঃপূঃ ২য় শতাব্দী থেকে খ্রীষ্টীয় ৩য় শতাব্দী পর্যন্ত)।  এই অঞ্চলে আদি ঐতিহাসিক যুগে হঠাৎ বসতির সংখ্যা বৃদ্ধি ও সেই সাথে বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়তে দেখা যায়।

------------------------------------

দেখুনঃ Varada Khaladkar, Archaeological Investigations in the Middle Bhima Basin, Maharashtra: A Preliminary Report, in, Purātattva, No. 38, 2008, p. 27.

দেখুনঃ প্রাগুক্ত নিবন্ধ, পৃঃ ২৭।

------------------------------------

হরপ্পান অঞ্চলের বাইরে গাঙ্গেয় সমভূমিতে গ্রামীণ কৃষি সমাজের উত্থান ও সুদৃঢ়ীকরণ ঘটে এই অঞ্চলের নব-প্রস্তর, তাম্র ও লৌহ যুগে। এই সময়ের যে বৈশিষ্ট্যগুলি উল্লেখযোগ্য সেগুলি হল, একই ধরনের আঞ্চলিক গ্রামীণ বসতি ও আঞ্চলিক শস্যের ধরন, গরুর উপর একই ধরনের নির্ভরতা, কাঁচামাল ও শিল্পজাত দ্রব্যের বাণিজ্যিক চলাচল ও বিনিময় এবং একই ধরনের ধর্মীয় আচরণ। যদিও ধর্মীয় আচরণের বিষয়টা ততটা স্পষ্ট নয়, তবে ভারতীয় গ্রামীণ জীবনে গুরুত্ব বহন করে এমন কিছু যেমন, অগ্নি-বেদীতে উৎসর্গ প্রদান, লিঙ্গমূতির প্রতিরূপ ও পোড়ামাটির বিভিন্ন জিনিস ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া গেছে।

------------------------------------

 দেখুনঃ Dilip K. Chakrabarti, India: An Archaeological History Palaeolithic Beginnings to Early Historic Foundations, Oxford University Press, New Delhi, First Edition published in 1999, Second Edition, 2001, pp. 260-261.

দেখুনঃ প্রাগুক্ত নিবন্ধ, পৃঃ ২৬০।

------------------------------------

দেখা গেছে যে, প্রাক-উত্তরাঞ্চলীয় কাল মসৃণ মৃৎপাত্র, কাল প্রলেপ বিশিষ্ট মৃৎপাত্র (Black slipped ware) /  কাল ও লাল মৃৎপাত্র সংস্কৃতির (Black and Red-Ware cuture) সময়ে মধ্য গঙ্গা সমভূমিতে গ্রামীণ বসতিসমূহের সংখ্যাবৃদ্ধি ঘটে।

------------------------------------

দেখুনঃ Vibha Tripathi and Prabhakar Upadhyay, Anai: A Settlement in the Varuna Region, in, Purātattva, No. 36: 2005-2006, 2006, p. 97.

------------------------------------

উত্তরাঞ্চলীয় কাল মসৃণ মৃৎপাত্র সংস্কৃতি শুরু হয় সাধারণভাবে প্রায় ৮০০ খ্রীঃপূঃ-এর দিকে বহু সংখ্যক বসতিতে যেমন অযোধ্যা, ঝুসি ও গোতিহাওয়ায় (Gotihawa)। বাংলাদেশে ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা বদ্বীপ অঞ্চলে উয়ারী বটেশ্বরে - খ্রীঃপূঃ ৫ম শতাব্দীতে উত্তরাঞ্চলীয় কাল মসৃণ মৃৎপাত্র সংস্কৃতি দেখা যায় ও তিরুনেলভেলিতে (Tirunelveli) খ্রীঃপূঃ প্রায় ৯ম শতাব্দীতে এই সংস্কৃতি দেখা যায়।

------------------------------------

দেখুনঃ Dilip K. Chakrabarti, India: An Archaeological History – Palaeolithic Beginnings to Early Historic Foundations, 1999, p. 353.

------------------------------------

উত্তর ভারতীয় লৌহ যুগ পর্ব ৪ (খ্রীষ্টপূর্ব প্রথম সহস্রাব্দের শেষের দিকে) (সৌজন্যেঃ Akinori Uesugi, 2018)

পাতা : ৪

আদি ঐতিহাসিক যুগে খ্রীষ্টপূর্ব অষ্টম শতাব্দীতে গঙ্গা উপত্যকায় ও সামান্য কিছু পরে পূর্বাঞ্চলীয় উপকূল ব্যাপী শহরের বিকাশ দেখা যায়।  খ্রীঃপূঃ ষষ্ঠ শতাব্দীতে ভারতীয় উপমহাদেশ তিনটি পৃথক কিন্তু পরস্পর সম্পর্কিত এবং দীর্ঘ মেয়াদী ঘটনা দ্বারা চিহ্নিত হয়ে আছে। এগুলি হল নগরের উদ্ভব, নূতন দুই ধর্ম জৈন ও বৌদ্ধ ধর্মের উদ্ভব এবং লিপির বিকাশ। এতে কোনো সন্দেহ নাই যে, লোহার বহুল ব্যবহার খ্রীষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে গাঙ্গেয় সমভূমিতে দ্বিতীয় নগর সভ্যতা গড়ায় প্রধান ভূমিকা রেখেছিল। প্রথম দিককার মুদ্রার ব্যবহার ব্যবসা-বাণিজ্যে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। শেষ পর্যন্ত এর ফলে নগরায়নের বিকাশ ঘটে। তবে পোড়া মাটির ইট ও মুদ্রা ব্যবহারের অনেক আগেই গঙ্গা ও যমুনা নদীর অববাহিকা অঞ্চলের সমভূমিতে ছোট ছোট শহর গড়ে উঠেছিল বলে ধারণা করা যায়।  উত্তর প্রদেশের ভিটা, কোশাম্বি, শ্রিংভেরাপুর ও ঝুসিতে বিপুল পরিমাণ প্রথম দিককার মুদ্রা পাওয়া গেছে। এই শহরগুলি বাণিজ্যিক, প্রশাসনিক ও ধর্মীয় কেন্দ্র হিসাবে খ্রীষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীর দিকে বিকাশ লাভ করে।  এই প্রতিটা শহরই গঙ্গা-যমুনা নদীর সমভূমিতে অবস্থিত ও সেগুলি উত্তরাঞ্চলীয় কাল মসৃণ মৃৎপাত্র সংস্কৃতির বসতি ছিল। এটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ যে, চিত্রিত ধূসর মৃৎপাত্র সংস্কৃতি খ্রীষ্টপূর্ব প্রথম সহস্রাব্দের প্রথম অংশে গাঙ্গেয় সমভূমিতে বিশেষত উত্তরাংশে নগরায়নের সূচনার সাথে সম্পর্কিত, আর উত্তাঞ্চলীয় কাল মসৃণ মৃৎপাত্রকে খ্রীষ্টপূর্ব প্রথম সহস্রাব্দের দ্বিতীয় অংশে সমগ্র গাঙ্গেয় সমভূমি জুড়ে নগরায়নের সাথে সম্পর্কিত করা যায়।

------------------------------------

দেখুনঃ Monica L. Smith, The Role of Professionals in Daily Life and Ritual Life: An Archaeological View from the Early Historic Era of Urbanism, in, Purātattva, No. 42, 2012, p. 3.

দেখুনঃ Sanju Shukla, J.N. Pandey, Ramabhilash Shukla, Anshu Goel and C.L. Dubey, Early Coins and their Chronology in the Ganga-Yamuna Lower Doab, in, Purātattva, No. 41, 2011, p. 140.

দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ১৪০।

------------------------------------

সিন্ধু সভ্যতার উত্তরাধিকারীদের গাঙ্গেয় উপত্যকায় এসে বহুকাল অপেক্ষা করতে হয়েছে লোহার আবিষ্কারের জন্য। লাঙ্গলে লোহার ফলা ব্যবহারের ফলে অনেক ভালভাবে ও দক্ষতার সাথে জমি চাষ করা যায়। বিশেষভাবে মধ্য ভারত, পশ্চিম ভারত ও দাক্ষিণাত্যের শক্ত ও দৃঢ়বদ্ধ কাল মাটির জমিতে তাম্রযুগীয় কৃষকের পক্ষে কার্যকরভাবে চাষ করা সম্ভব ছিল না।  লাঙ্গলে লোহার ফলা ব্যবহারের ফলে দ্রত জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেল ও নগরায়নের সূচনা ঘটল।

------------------------------------

দেখুনঃ M.K. Dhavalikar, Cultural Ecology of Mauryan India, in, Purātattva, No.31: 2000-2001, 2001, p. 89.

------------------------------------

দক্ষিণ এশিয়ায় ঐতিহাসিক যুগের শুরু ৬০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের দিকে। এর কিছু পরের বিভিন্ন সাহিত্য থেকে কোনো রাজা ছাড়াই বিপুল সংখ্যক স্বাধীন রাষ্ট্রের উল্লেখ পাওয়া যায়। দক্ষিণ এশিয়ায় লিপির বিকাশ ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। মনে করা হয় যে, সর্ব প্রথম ব্রাহ্মী লিপির আদিরূপ শ্রীলংকায় খ্রীঃপূঃ ৫ম শতাব্দীতে দেখা গেছে। সম্প্রতি বলা হচ্ছে তামিল নাড়ুতে বৃহৎ প্রস্তর যুগের মৃৎপাত্রে খ্রীঃপূঃ ৬ষ্ঠ শতাব্দীতে ব্রাহ্মী লিপি দেখা গেছে।  খ্রীষ্টপূর্ব ৩য় শতাব্দীতে সম্রাট অশোকের সময়ে ব্রাহ্মী লিপি যথেষ্ট বিকশিত রূপ নেয়।

------------------------------------

দেখুনঃ P. Rajendran, Recent Archaeological Discoveries from Kerala, South-West Coast of India, (Notes and News), in, Purātattva, No. 45, 2015, p. 283.

------------------------------------

উত্তরাঞ্চলীয় কাল মসৃণ মৃৎপাত্র সংস্কৃতির বসতি গড়ে উঠেছিল গঙ্গা সমভূমিতে কোশাম্বি, শ্রাবস্তি, গনওয়ারিয়া-পিপরাওয়া/তিলৌরাকোট, রাজঘাট, বৈশালী, পাটলিপুত্র, চম্পা, রাজগীর, সোনপুর, অহিচ্ছত্র, হস্তিনাপুর, আত্রাঞ্জিখের, আগিয়াবীর, ঝুসি, নিনদৌর ও পাক্কাকোট এবং নিম্নগঙ্গা সমভূমি, মধ্য ভারত ও রাজস্থানের আরো অনেক বসতিতে।

------------------------------------

দেখুনঃ Sita Ram Dubey and Santosh Kumar Singh, Further Excavations at Pakkakot: 2014-15, in, Purātattva, No. 45, 2015, p. 210.

------------------------------------

পাঞ্জাব ও হরিয়ানায় চিত্রিত ধুসর মৃৎপাত্র সংস্কৃতির বসতির বিস্তার (সৌজন্যেঃ Vivek Dangi, 2018)

উত্তর প্রদেশের জৌনপুর জেলায় হরিহরপুরে খনন চালিয়ে প্রাক-উত্তাঞ্চলীয় কাল মসৃণ মৃৎপাত্র থেকে খ্রীষ্টীয় ১০ম শতাব্দী পর্যন্ত সাংস্কৃতিক ধারাবাহিকতা দেখতে পাওয়া যায়।  এখানে দেখা গেছে যে, উত্তরাঞ্চলীয় কাল মসৃণ মৃৎপাত্রের সময় জুড়ে প্রায় ৬০০ খ্রীঃপূঃ-এ কাশি মহাজনপদে অনেক সমৃদ্ধ কেন্দ্র ছিল, যার রাজধানী ছিল বারানসী। এটি এখনকার রাজঘাট প্রত্নস্থল।

------------------------------------

দেখুনঃ Vibha Tripathy, Excavation at Hariharpur, District Jaunpur, Uttar Pradesh, (Notes and News), in, Purātattva, No. 38, 2008, p. 207-209.

------------------------------------

পাতা : ৫

নেপালের তরাই অঞ্চলে বৌদ্ধ বসতি তিলৌরাকোট বা প্রাচীন কপিলাবস্তুতে প্রত্নতাত্ত্বিক খনন কাজ চালিয়ে চিত্রিত ধূসর মৃৎপাত্র থেকে কুষাণ যুগ পর্যন্ত বসতি থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে, যাকে ভাগ করা হয়েছে খ্রীঃপূঃ ১১শ - ৮ম শতাব্দী, খ্রীঃপূঃ ৬ষ্ঠ - ৫ম শতাব্দী, খ্রীঃপূঃ ৩য় - ২য় শতাব্দী বা মৌর্য যুগ, খ্রীঃপূঃ ২য় - খ্রীষ্টীয় ১ম শতাব্দী বা শুঙ্গ যুগ এবং খ্রীষ্টীয় ১ম - ২য় শতাব্দী বা কুষাণ যুগ হিসাবে।  খননে পূর্ব ও পশ্চিমে পরিখা, দ্বার-রক্ষীর কক্ষসহ রাজকীয় দরজা, বিভিন্ন যুগের ৬ মিটার প্রশস্ত রাস্তা, পূর্ব দিকের একটি প্রশস্ত দরজা ও পূর্ব দিকের স্তূপ, ধনুকাকৃতি স্তূপ, একটি বহুকক্ষবিশিষ্ট কাঠামো, বিভিন্ন ধরনের মৃৎপাত্র, মুদ্রা ও শিল্পের জিনিসপত্র পাওয়া গেছে। উত্তরে একটি জোড়া স্তূপও পাওয়া গেছে। খ্রীঃপূঃ ৬ষ্ঠ থেকে খ্রীষ্টীয় ২য় শতাব্দী পর্যন্ত তিনটি যুগের প্রতিরক্ষা প্রাচীর উন্মোচিত হয়েছে। এছাড়াও এই স্থানের মধ্যবর্তী অংশে খনন করে বিভিন্ন যুগের আরো কাঠামো ও জিনিসপত্র আবিষ্কৃত হয়েছে, সেগুলির মধ্যে আছে জল মজুদের জন্য চৌবাচ্চা, পোড়ামাটির চাকতির তৈরী কুয়া ও একটি অগ্নি-বেদী। এছাড়া পোড়ামাটির মানুষ ও জীবজন্তুর মূর্তি (খ্রীঃপূঃ ৪০০ থেকে খ্রীষ্টাব্দ ২০০), রূপার ছাপাঙ্কিত মুদ্রা, প্রথম দিককার ঢালাই করা প্রতীক সহ মুদ্রা, কুষাণ যুগের মুদ্রা ও শুঙ্গ ও কুষাণ যুগের মৃৎপাত্র, ব্রাহ্মী লিপি সহ পোড়ামাটির সীল, ইত্যাদি।  এখানে কাদা-মাটির প্রতিরক্ষা প্রাকারের নীচে খুঁটি ও খুঁটির গর্ত পাওয়াতে ধারণা করা হচ্ছে যে প্রাচীন শাক্য রাজ্যের রাজধানীর অস্তিত্ব গৌতম বুদ্ধের জন্মের অনেক আগেই ছিল।

------------------------------------

দেখুনঃ Mala Malla, Tilaurakot Excavation – 2014, in, Purātattva, No. 44, 2014, p. 239.

দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ২৩৯।

দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ২৪২।

------------------------------------

উপমহাদেশে যখন নগরায়নের প্রক্রিয়া চলছিল সেই সময়ে তক্ষশীলায়ও নগরায়ন শুরু হয় ও পরে এটি একটি বৃহৎ নগরে পরিণত হয়। এখানে কয়েকটি ঢিবিতে বিভিন্ন সময়ে নগর গড়ে উঠে, যার মধ্যে হাথিয়াল নামে বসতিটির ঢিবি বি হল সবচেয়ে প্রাচীন। ভারতীয় সাহিত্য থেকে জানা যায় ষষ্ঠ শতাব্দীর মাঝামাঝি গান্ধারের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন পুক্কুসাতি (বা পুষ্করসারিন), যিনি মগধের বিম্বিসারের (রাজত্বকাল ৫৪৪-৪৯২ খ্রীঃপূঃ) কাছে দূত ও পত্র পাঠিয়েছিলেন। অনুমান করা যায় সেই সময়ে গান্ধারের সাথে গাঙ্গেয় উপত্যকার কূটনৈতিক ও সাংস্কৃতিক যোগাযোগ ছিল। ৫১৬ খ্রীঃপূঃ-এ তক্ষশীলা ইরানের আকামেনীয় শাসকদের অধীনে চলে যায়। সোয়াত ও দিরের আকামেনীয় যুগের বসতিগুলিতে প্রথম বারের মত ব্যক্তিগত বসবাসের বাড়ীগুলিতে অগ্নি পূজার উপস্থিতি দেখা যায়। আকামেনীয় রাজত্বকাল আর্তাজারজেস ২ (৪০৪-৩৫৯ খ্রীঃপূঃ) পর্যন্ত টিকে ছিল। এই সময়ে তক্ষশীলায় আরামাইক লিপির প্রচলন শুরু হয়, যা সমগ্র পারস্য সাম্রাজ্যে ব্যবহৃত হত।  তক্ষশীলা শুধু জ্ঞানের কেন্দ্র ছিল না, এটি বাণিজ্য, শিল্প ও সংস্কৃতির কেন্দ্রও ছিল। এখানে বহু সংখ্যক বৌদ্ধ স্তূপ ও মঠ ছিল। তবে সবচেয়ে বিখ্যাত ছিল ধর্মরাজিকা স্তূপ, যা সম্রাট অশোকের প্রতিষ্ঠিত।

------------------------------------

দেখুনঃ Ahmad Hasan Dani, The Historic City of Taxila, First Published 1986, Published by Sang-e-Meel Publications, Lahore, 1999, p. 41.

দেখুনঃ Sir John Marshall, A Guide to Taxila, Sani Communications, Karachi, 1960, p. 11.

------------------------------------

বিহারে নালন্দা মহাবিহার থেকে প্রায় ৩ কিলোমিটার দূরে জুয়াফারদিহ্তে খনন করে জানা যাচ্ছে যে, এখানে পর্ব ১-এ ১৬০০-১২০০ খ্রীঃপূঃ-এ বসতি স্থাপন করা হয় ও পর্ব ২-এ এখানে আদি উত্তরাঞ্চলীয় কাল মসৃণ মৃৎপাত্র (১২০০-৯০০ খ্রীঃপূঃ), মধ্য উত্তরাঞ্চলীয় কাল মসৃণ মৃৎপাত্র (৯০০-৬০০ খ্রীঃপূঃ) ও উত্তর উত্তরাঞ্চলীয় কাল মসৃণ মৃৎপাত্র (৬০০-৪০০ খ্রীঃপূঃ) এবং পর্ব ৩-এ বসতি পাওয়া যায় ১০০ খ্রীঃপূঃ থেকে ১০০ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত।  এটি খুব তাৎপর্যপূর্ণ যে, উত্তরাঞ্চলীয় কাল মসৃণ মৃৎপাত্র-এর শুরুর সময় ধরা হয় সাধারণভাবে ৬০০ খ্রীঃপূঃ, কিন্তু জুয়াফারদিহ্তে পাওয়া সাক্ষ্যের সাথে তার অমিল দেখা যাচ্ছে।

------------------------------------

দেখুনঃ S.C. Saran, N.G. Nikoshey, S. Nayan, J.K. Tiwari, A. Arif and N. Saxena, Excavations at Juafardih and its identification with Kulika, in, Purātattva, No. 38, 2008, pp. 59-64.

------------------------------------

বারানসী নগরের প্রাচীন অংশ, আকথায় প্রথম বসবাস ছিল খ্রীঃপূঃ প্রায় ১৮০০ থেকে ১৪৫০ পর্যন্ত। বারানসী অঞ্চলে এরপর কাশী-রাজঘাটে বসবাস শুরু হয় ৮০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে। বারানসীর বিস্তারের সাথে মূল বারানসীকে কেন্দ্র করে সহায়তাকারী আরো বসতি গড়ে উঠে, যেগুলির মধ্যে একটি হল রামনগর। রামনগরে প্রাক-উত্তরাঞ্চলীয় কাল মসৃণ মৃৎপাত্র, উত্তরাঞ্চলীয় কাল মসৃণ মৃৎপাত্র, উত্তর-উত্তরাঞ্চলীয় কাল মসৃণ মৃৎপাত্র, কুষাণ ও গুপ্ত যুগ পর্যন্ত বসতির প্রমাণ পাওয়া গেছে।

------------------------------------

দেখুনঃ Vidula Jayaswal, Antiquity of Varanasi as Revealed by Excavation at Aktha (2008-2009), in, Purātattva, No. 39, 2009, p. 145.

দেখুনঃ Vidula Jayaswal and Manoj Kumar, Excavations at Ramnagar: Discovery of Supporting Settlement of Ancient Varanasi, in, Purātattva, No. 36: 2005-2006, 2006, pp. 86-89.

------------------------------------

উত্তর প্রদেশের আগিয়াবীর নামে একটি বসতিতে যে ধারাবাহিক বসবাসের প্রমাণ পাওয়া যায় তা হল, পর্ব ১: তাম্র প্রস্তর যুগ, পর্ব ২: প্রাক-উত্তরাঞ্চলীয় কাল মসৃণ মৃৎপাত্র, লোহা সহ, পর্ব ৩: উত্তরাঞ্চলীয় কাল মসৃণ মৃৎপাত্র, পর্ব ৪: শুঙ্গ-কুষাণ পর্ব, ও পর্ব ৫: গুপ্ত ও গুপ্ত-পরবর্তী অবশেষ। এখানে শুঙ্গ-কুষাণ যুগে নগরটির প্রতিরক্ষা প্রাচীর দেখা যায়। আদি মধ্য যুগে বসতিটি পরিত্যক্ত হয়।

------------------------------------

দেখুনঃVibha Tripathi and Prabhakar Upadhyay, Excavations at Agiabir (2006-07), in, Purātattva, No. 39, 2009, pp. 52-57.

------------------------------------

মধ্য গঙ্গা সমভূমিতে অনাই নামে একটি বসতি খনন করে প্রাক-উত্তরাঞ্চলীয় কাল মসৃণ মৃৎপাত্র সংস্কৃতি (প্রায় ৯০০-৬০০ খ্রীঃপূঃ), উত্তরাঞ্চলীয় মৃৎপাত্র সংস্কৃতি (প্রায় ৬০০-২০০ খ্রীঃপূঃ) ও আদি মধ্য যুগের (প্রায় ৭০০-১০০০ খ্রীষ্টাব্দ) বসতি পাওয়া গেছে।  উত্তরাঞ্চলীয় মসৃণ মৃৎপাত্রের যুগে এই বসতিটি একটি সমৃদ্ধিশালী গ্রামে পরিণত হয়। এটি কাশি মহাজনপদের অংশ ছিল। অনাইয়ে বসতিটির চারপাশে নির্দিষ্ট দূরত্বে পরপর কুয়া থাকায় মনে করা হয় যে, প্রাচীনকালে ভ্রমণকারীরা এখানকার পথ দিয়ে যাতায়াত করত। প্রাচীনকালে ভ্রমণকারীদের জন্য কুয়া ও সরাইখানার ব্যবস্থা থাকত। এই ধরনের ব্যবস্থা কাশি মহাজনপদেও থাকার কথা।

------------------------------------

দেখুনঃ Vibha Tripathi and Prabhakar Upadhyay, Anai: A Settlement in the Varuna Region, in, Purātattva, No. 36: 2005-2006, 2006, pp. 95-97.

  দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ৯৩, ৯৭।

------------------------------------

উপরে আমরা গাঙ্গেয় সমভূমিতে সাধারণভাবে নবপ্রস্তর যুগ থেকে দ্বিতীয় নগরায়নের শুরু পর্যন্ত সংক্ষেপে আলোচনা করেছি ও সমগ্র আলোচনাকে সংক্ষিপ্ত করতে চেয়ে সাম্প্রতিক প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারগুলির উপর তুলনামূলকভাবে জোর দিয়েছি। কাজেই উপরের আলোচনা গাঙ্গেয় সভ্যতার ঐ সময়ের সমগ্র চিত্রকে তুলে ধরে না, বরং সভ্যতার একটি খণ্ডাংশকে মাত্র তুলে ধরে। 

আমরা মনে করি সিন্ধু সভ্যতার পতনের পর সিন্ধু সভ্যতায় যারা শাসক ছিল তারা প্রধানত পশ্চিম দিকে কিছু অংশ ইরানে ও আরো কিছু অংশ আরো পশ্চিমে গ্রীস ও ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে। এছাড়া সিন্ধু সভ্যতায় যারা বণিক, কারুশিল্পী, শিক্ষক ও দার্শনিক ছিল তাদের একটা অংশ পশ্চিমে গেলেও পূর্ব দিকের বসতিগুলি থেকে একটা বড় অংশ প্রথমে যমুনা-গঙ্গা নদী উপত্যকায় ও আরো কিছু পরে গাঙ্গেয় সমভূমির বিস্তীর্ণ অংশে ছড়িয়ে পড়ে। তাদের সাথে অভিবাসন করে বিপুল সংখ্যক কৃষক ও অন্য পেশার মানুষজন। গাঙ্গেয় সমভূমিতে আগে থেকেই বসবাসরত কৃষি সমাজের সাথে তাদের বৃহত্তর অংশ মিশে যায় বলে মনে করা যায়। দ্বাদশ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে লোহার ব্যবহার বৃদ্ধি পেলে ক্রমশ এই বসতিগুলিতে শিল্প, বাণিজ্য, ইত্যাদির বিকাশ ঘটবার ফলে এগুলি আয়তনে ও জনসংখ্যায় বৃদ্ধি পেতে থাকে। আমরা অনুমান করি সিন্ধু সভ্যতার নিরীশ্বরবাদের অনুসারী বণিক, কারুশিল্পী ও দার্শনিকদের উত্তরসূরিদের অনেকেই এই সময়ে পুরোপুরি স্থানীয় বা আঞ্চলিক ধর্ম দ্বারা প্রভাবিত হয় নাই। নূতন সমাজে তারা নেতৃত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছিল বলে ধারণা করা যায়। এই সমৃদ্ধ ও বৃহৎ গ্রাম ও উদীয়মান শহরগুলিতে বৈদিক ধর্মের অনুসারীরাও বসতি স্থাপন করেছিল বলে মনে হয়। 

খ্রীঃপূঃ প্রথম সহস্রাব্দের মাঝামাঝি গাঙ্গেয় উপত্যকায় নগরায়নের উদ্ভবের সাথে ধর্ম ও দর্শন চিন্তার ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক উত্থান ঘটেছিল। এই সময়ে এখানে যেমন জৈন ও বৌদ্ধ ধর্মের উত্থান ঘটেছিল তেমন বিভিন্ন গোষ্ঠী ভিত্তিক নানা ধর্ম ও দার্শনিক চিন্তার উদ্ভব ঘটেছিল। এই সমস্ত দার্শনিক চিন্তাকে সিন্ধু সভ্যতার দার্শনিক ধারার এক ধরনের ধারাবাহিকতা বলা যায়।

পাতা : ৬

 

২য় অধ্যায় : গাঙ্গেয় সমভূমিতে লোকায়ত ও গণতান্ত্রিক সমাজ

এটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ যে, খ্রীষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে ভারতবর্ষে যখন নগরায়ন প্রক্রিয়া চলতে থাকে তখন দু’টি প্রধানত নিরীশ্বরবাদী ধর্ম বৌদ্ধ ও জৈন ধর্ম প্রতিষ্ঠা লাভ করে ও সেই সময়ে আরো কিছু নিরীশ্বরবাদী ধর্মীয় ও দার্শনিক মতবাদ সমাজে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা করে নিয়েছিল। এগুলি হল আজীবিকদের মত ধর্মীয় ও অজিত কেশ কম্বলীর মত দার্শনিক সম্প্রদায়। যখন সিন্ধু সভ্যতার পতন ঘটেছে ও সিন্ধুর নগর ও গ্রামের অধিবাসীরা ক্রমান্বয়ে গাঙ্গেয় উপত্যকার বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে তখন তারা তাদের সভ্যতার শক্তি দ্বারা এই অঞ্চলের উদীয়মান কৃষি সমাজকে প্রভাবিত করতে পেরেছিল। সুতরাং সিন্ধু সভ্যতার মূলত বৈদিক ধর্মের অনুসারী ও কৃষকরা এবং শিক্ষক, দার্শনিক, কারিগরদের উত্তরসূরিদের কিছু অংশ এখানে যে নূতন কৃষি-সমাজ গড়ে তুলে সেখানে বৈদিকদের পাশাপাশি একটি শক্তিশালী অবস্থান গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিল তেমনটা ধারণা করা চলে। খ্রীঃপূঃ অষ্টম শতাব্দীর দিক থেকে সমৃদ্ধ গ্রামগুলি অল্প অল্প করে কারিগরী শিল্প ও বাণিজ্য গড়ে তুলার মাধ্যমে শহরে রূপান্তরিত হতে থাকলে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে কেন্দ্র করে নিরীশ্বরবাদী চিন্তা ছড়াতে থাকে। নিরীশ্বরবাদী চিন্তা কীভাবে প্রসার লাভ করেছিল সেটা পরিষ্কার না হলেও এটা আগের খণ্ডে আমরা আলোচনা করেছি যে সিন্ধু সভ্যতার অভিবাসীদের মধ্যে বৈদিকরা ছাড়া বাকী প্রায় সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ নিরীশ্বরবাদী বা লোকায়ত ভাবধারায় বিশ্বাসী ছিল। বুদ্ধ ও মহাবীর যে তাঁদের নিরীশ্বরবাদী ধর্ম প্রচারের জন্য আগে থেকেই প্রস্তুত একটি অনুকূল ক্ষেত্র পেয়েছিলেন তাতে কোনো সন্দেহ নাই। ফলে তাঁরা তাঁদের ধর্মীয় ও দার্শনিক চিন্তাকে লোকসমাজে গ্রহণযোগ্য করতে পেরেছিলেন।

বৌদ্ধ ও জৈন দর্শন

প্রাসঙ্গিক মনে করায় এখানে বৌদ্ধ দর্শনের উপর সংক্ষেপে আলোচনা করা হচ্ছে। বৌদ্ধ দর্শন মতে, পৃথিবীতে অপরিবর্তনীয় বলে কিছু নাই। আমাদের দেহ, সংবেদনা, উপলব্ধি, সংস্কার সবই ক্ষণস্থায়ী, সবই দুঃখময়। এসবই অনাত্ম। সারা বিশ্বে চলেছে এক অনন্ত বিরামহীন বস্তুর রূপান্তর ও পরিবর্তন। জীবন আবির্ভাব ও তিরোভাবের একটানা ছন্দ। জগতে সত্তা বলে কিছু নাই। যার জন্ম হয়েছে তার মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। জগতে শাশ্বত, সনাতন বলে কিছু নাই। বৌদ্ধদের মতে ঈশ্বর নাই। বুদ্ধ অনাথ পিণ্ডিককে বলছেনঃ  ‘এই জগৎ যদি ঈশ্বরের সৃষ্টি হত তাহলে পরিবর্তন বা বিনাশ বলে কিছু থাকত না। তাহলে দুঃখ, দুর্বিপাক, ন্যায়, অন্যায়, পবিত্র, অপবিত্র বলে কোনো জিনিস থাকত না। কারণ, এসব ঈশ্বর থেকেই আসত। সচেতন জীবে যে দুঃখ, আনন্দ, প্রেম, বিদ্বেষ দেখা যায়, এসব যদি ঈশ্বরের ক্রিয়া হত তাহলে ঈশ্বরও দুঃখ, আনন্দ, প্রেম, বিদ্বেষ অনুভব করত। আর যদি তা হয় তাহলে কি করে সে ঈশ্বর সম্পূর্ণ হয়? ঈশ্বরই যদি সৃষ্টিকর্তা হন, সকলকেই যদি স্রষ্টার নিকট নিঃশব্দে নতি স্বীকার করতে হয়, তাহলে পুণ্যাচরণের প্রয়োজন কোথায়? সকল কর্মই যদি তাঁর তৈরী হয়, তাঁর নিকট সব সমান হয়, তাহলে ন্যায় ও অন্যায় কর্ম করার অর্থ তো সমানই হবে? আর যদি বল, সুখ দুঃখের অন্য কারণ আছে, তাহলে তোমায় মানতে হবে এমন জিনিস আছে যার কারণ ঈশ্বর নন। আর তাই যদি হয় তাহলে অন্য জিনিসই বা অহেতুক হবে না কেন? ঈশ্বর যদি স্রষ্টা হন, তাহলে হয় তাঁর এই সৃষ্টির উদ্দেশ্য আছে অথবা তাঁর সৃষ্টির কোনো উদ্দেশ্য নাই। যদি তিনি উদ্দেশ্য নিয়ে সৃষ্টি করে থাকেন তাহলে তাঁকে সম্পূর্ণ বলা যেতে পারে না। কারণ উদ্দেশ্য মানেই অভাবের পূরণ। আর যদি তিনি বিনা উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করে থাকেন, তাহলে তিনি হয় বাতুল নয় দুগ্ধপোষ্য শিশু। ...’

------------------------------------

  দেখুনঃ মনোরঞ্জন রায়, দর্শনের ইতিবৃত্ত, ন্যাশনাল বুক এজেন্সী, কলিকাতা, ১৯৫৫, পৃঃ ১৯৬-২২৬।

------------------------------------

শুধু বৌদ্ধ ধর্মই নয় ভারতবর্ষে উদ্ভব হওয়া বৌদ্ধ ধর্মের সামান্য পূর্ববর্তী বা প্রায় সমসাময়িক জৈন ধর্মও নিরীশ্বরবাদী। জৈন মতে জগৎ এবং জীবন অসংখ্য দ্রব্য, গুণ এবং কর্মের পারস্পরিক কার্য ও সংঘাতের ফলে সৃষ্ট। দ্রব্য, গুণ এবং কর্মের সংঘাতের ফলেই সৃষ্টি এবং ধ্বংস হয়। কাজেই সৃষ্টিকর্তা এবং প্রলয়কর্তা হিসাবে একটি ঈশ্বরের কল্পনা জৈন দর্শনে নাই।

------------------------------------

  দেখুনঃ রমেন্দ্রনাথ ঘোষ, ভারতীয় দর্শন, বাংলা একাডিমী, ঢাকা, ১৯৮৩, পৃঃ ৮৫-৮৬।

------------------------------------

সমসায়িক অন্যান্য দর্শনচিন্তা ও তৎকালীন সমাজ

বুদ্ধের সময়ে আরো একটি শক্তিশালী দার্শনিক ধারা ছিল, যার প্রচারক ছিলেন অজিত কেশকম্বলী। অজিত কেশকম্বলী বুদ্ধের সময়ে তাঁর বস্তুবাদী দার্শনিক মতবাদ প্রচার করতেন। তাঁর মতে ভিক্ষার্থ বলিদান বা নৈবেদ্য দানে কোনো উপযোগিতা নাই, ভাল বা খারাপ কাজের কোনো ফল নাই। এই জগৎ থেকে পরবর্তী জগতে স্থানান্তর নাই। পিতা বা মাতার সেবায় কোনো উপকার নাই। পরবর্তী জীবন বলে কিছু নাই এবং শ্রমণ ও ব্রাহ্মণদের সঠিক পথে থেকে পূর্ণতাপ্রাপ্তি ঘটে না। মানুষ চারটি উপাদান দিয়ে গঠিত, যখন সে মারা যায় তখন মাটি সমষ্টিভূত মাটির কাছে ফিরে যায়, জল জলের কাছে, আগুন আগুনের কাছে ও বায়ু বায়ুর কাছে, আর অনুভূতিসমূহ মহাশূন্যে বিলীন হয়ে যায়।

------------------------------------

 দেখুনঃ A. L. Basham, History and Doctrines of the Ājīvikas: A Vanished Indian Religion, Luzac & Company Ltd., London, 1951, p. 15.

------------------------------------

গৌতম বুদ্ধের সময়ে সমাজে ব্রাহ্মণদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় দেখা গেলেও প্রধান ভূমিকা রাখতে দেখা যায় না। বৌদ্ধ সাহিত্যে ব্রাহ্মণদের ধর্মীয় পরিচয় হিসাবে বেদপন্থী বলা হয়েছে। অর্থাৎ তারা বেদের অনুসারী হিসাবে পরিচিত ছিল। হিন্দু ধর্মের চতুর্বর্ণ, যেমন, ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র নামে পরিচিত এই বর্ণসমূহের কার্যকর অস্তিত্ব ছিল না। যা ছিল বলে ধারণা করা যায় তা হল, বেদের ধর্মের অনুসারী ও বৈদিক জ্ঞানের ধারক ব্রাহ্মণরা, যারা বৃহত্তর সমাজের অংশ হিসাবে বিভিন্ন বংশ ও গোত্রে বিভক্ত ছিল। এছাড়া ছিল ক্ষত্রিয় নামে পরিচিত বিভিন্ন প্রভাবশালী গোষ্ঠীসমূহ। এর বাইরে বিপুল সংখ্যক মানুষ পেশার ভিত্তিতে বৈশ্য ও সমাজের পশ্চাৎপদ মানুষেরা শূদ্র নামে পরিচিত ছিল বলে মনে হয়।

বৌদ্ধ বা পরবর্তী যুগেও যে ব্রাহ্মণের সামাজিক মর্যাদা ছিল সেটা বৌদ্ধ সাহিত্য থেকেও জানা যায়। তবে জ্ঞানের একমাত্র অধিকারী ব্রাহ্মণরা ছিল না। আর্যজ্ঞান বা শ্রেষ্ঠজ্ঞান লাভ করার জন্য ব্রাহ্মণ হবার দরকার ছিল না। সমাজে সেই সময়ে নানা গোষ্ঠীর মানুষ ছিলেন যারা জ্ঞান সাধনা করতেন। তাদের কেউ কেউ বিভিন্ন জ্ঞানের প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত থাকতেন, আবার কেউ কেউ একাকী তাদের নূতন চিন্তা প্রচার করতে এগিয়ে আসতেন। তাঁদের মধ্যে অনেকেই কোনো নির্দিষ্ট ধর্মের অনুসারী ছিলেন না, তবে প্রায় সবাই নিরীশ্বরবাদী ছিলেন। বুদ্ধের সময়ে আজীবিক, জৈন বা নির্গ্রন্থ ধর্মের অনুসারী ও বিভিন্ন সম্প্রদায়ভুক্ত পরিব্রাজক ছিলেন যাঁরা তাঁদের চিন্তা গ্রাম থেকে গ্রামে ও দেশ থেকে দেশে পরিভ্রমণ করে প্রচার করতেন। পরিব্রাজকদের কথা যেমন বৌদ্ধ সাহিত্যে উল্লেখ আছে তেমন কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রেও উল্লেখ পাওয়া যায়। আজীবিক সম্প্রদায়ের ধর্ম দর্শন বুদ্ধের সময়ের কিছু পূর্বের দার্শনিক মক্খলী গোশালের মাধ্যমে পূর্ণতা পায়।  তবে এতে কোনো সন্দেহ নাই যে আজীবিক দর্শন চিন্তা মক্খলি গোশালের আগে অস্তিত্বশীল ছিল। আজীবিকরা নিয়তিবাদী। তাদের মতে পূর্বনির্ধারিত ভাগ্য নিয়ে মানুষ জন্ম নেয়; কিংবা এভাবেও বলা যায় যে, জন্মের সাথে মানুষের ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হয়ে যায়। সুতরাং তাদের দর্শনের মর্মকথা হল ‘মানুষের প্রচেষ্টা ফলহীন’।

------------------------------------

  ভিন্ন মতাবলম্বী ধর্মচিন্তার মানুষদের সম্পর্কে মহাবর্গে বলা হয়েছেঃ ‘এই যে অন্যতীর্থিক পরিব্রাজকগণ যাঁহাদের ধর্ম দুরাখ্যাত, ...’। দেখুনঃ প্রজ্ঞানন্দ স্থবির অনূদিত, মহাবর্গ, প্রকাশক শ্রী অধরলাল বড়ুয়া, কলিকাতা, ১৯৩৭, পৃঃ ১৭৯, ১৮০।

  দেখুনঃ রাধাগোবিন্দ বসাক (অনুদিত), কৌটিলিয় অর্থশাস্ত্র, প্রথম খণ্ড, জেনারেল প্রিন্টার্স য়্যান্ড পাবলিশার্স লিমিটেড, কলিকাতা, পঞ্চম মুদ্রণ ১৯৮৯, পৃঃ ৩০৭।

দেখুনঃ B.M. Barua, The Ajivikas, Published by the University of Calcutta, 1920, p. 4, 8.

দেখুনঃ A. L. Basham, History and Doctrines of the Ājīvikas: A Vanished Indian Religion, 1951, p. 9.

------------------------------------

পাতা : ৭

প্রাচীন ভারতীয় দর্শনের একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখার নাম সাংখ্য। আমরা মনে করি সাংখ্য মতবাদেরও উৎস সিন্ধু সভ্যতায় নিহিত। এই দর্শনেও নিরীশ্বরবাদের প্রভাব স্পষ্ট। পৌরাণিক কাহিনীতে কপিল মুনিকে সাংখ্য শাখার প্রতিষ্ঠাতা বলা হয়। সাংখ্য দর্শন সৃষ্টিকর্তা অপেক্ষা বিবর্তনতত্ত্বে বিশ্বাসী। সাংখ্য মতে এই জগৎ সৃষ্টি হয় নাই, এই জগতের কেউ স্রষ্টা নাই। জগতের ক্রমবিকাশ হয়েছে। সত্তার ধারণায় সাংখ্য ছিল দ্বৈতবাদী। পুরুষ ও প্রকৃতি উভয়ই মৌলশক্তি। পুরুষ হচ্ছে চেতনা, প্রকৃতি হচ্ছে বস্তু, প্রকৃতি জগৎ। সাংখ্য মতে পুরুষ দ্বারা ঈশ্বর বা স্রষ্টাকে বুঝায় না। পুরুষ হচ্ছে ব্যক্তির মধ্যে আশ্রয়প্রাপ্ত বা আবদ্ধ নিত্যকালের চেতনা। ব্যক্তি প্রকৃতির অংশ। প্রকৃতি নিয়ত কার্যকারণের বিধান দ্বারা পরিবর্তিত হচ্ছে।

সাংখ্য দর্শন ঈশ্বরের অস্তিত্ত্বে বিশ্বাস করে না। এতে বলা হয়েছে, ঈশ্বরকে যদি মুক্ত বলে স্বীকার করা যায়, তাহলে সৃষ্টি বিষয়ে তাঁর অক্ষমতা জন্মে। রাগাদি অভিমানই সৃষ্টি সম্বন্ধে প্রেরণা দেয়। মুক্তের এই রাগাদি অভিমান থাকতে পারে না। অতএব, ঈশ্বর যদি মুক্ত হন, তাঁর সৃষ্টি ক্ষমতা থাকে না। যদি মুক্ত হন, তিনি কোন স্বার্থে সৃষ্টিতে প্রবৃত্ত হবেন? জগৎ যদি ঈশ্বরের সৃষ্টি হয় তাহলে ঈশ্বরকে মুক্ত বলা যায় না। আর যদি ঈশ্বরকে বদ্ধ বলো, তাহলে ঈশ্বরের মুঢ়তা প্রযুক্ত সৃষ্টি ক্ষমতা থাকতে পারে না। অতএব, ঈশ্বরকে তুমি মুক্ত বা বদ্ধ কিছুই বলতে পার না, কারণ ঈশ্বর নাই।

চার্বাক ও লোকায়ত দর্শন

প্রাচীন ভারতের আরেকটি নিরীশ্বরবাদী দার্শনিক ধারা ছিল, যা চার্বাক দর্শন নামে পরিচিত ছিল। চার্বাক দর্শনের মূল কথা হলঃ লোকায়তই একমাত্র শাস্ত্র, প্রত্যক্ষই একমাত্র প্রমাণ, পৃথিবী, জল, আগুন ও বায়ুই একমাত্র উপাদান; ভোগই মানুষের একমাত্র কামনীয় বস্তু, মন বস্তুর সৃষ্টিমাত্র; পরলোক বলতে কিছু নাই; মৃত্যুই মোক্ষ। ধীষণকে চার্বাক দর্শনের প্রণেতা বলে মনে করা হয়। ধীষণের মতে ঈশ্বর বলে কোন কিছু নাই।

------------------------------------

দেখুনঃ রমেন্দ্রনাথ ঘোষ, ভারতীয় দর্শন, ১৯৮৩, পৃঃ ৩-২৮।

------------------------------------

চার্বাক দর্শনের মত লোকায়ত মতবাদও বিপক্ষের রচনা থেকে জানা ছাড়া অন্য কোনো উৎস নাই। এবং এই বিপক্ষের গোষ্ঠী হল ব্রাহ্মণ্য ধর্মের অনুসারীরা; তবে প্রাচীন বৌদ্ধ গ্রন্থে লোকায়তের উল্লেখ আছে।  তারা লোকায়তের নিরীশ্বরবাদী ভাবধারা গ্রহণ করেছে বলে মনে হয়। আরেকটি কারণে চার্বাক ও লোকায়ত দর্শনের বিরুদ্ধে ব্রাহ্মণরা ছিল। সেটা হল ব্রাহ্মণদের পূর্বসূরি বৈদিকরা সিন্ধুর যে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে তাদের ধর্ম সংস্কার আন্দোলন ও যুদ্ধ পরিচালনা করেছিল ধারণা করা যায় যে, সেই রাষ্ট্র লোকায়ত ভাবধারার পৃষ্ঠপোষক ছিল। এই বিষয়ে আমরা আগের খণ্ডে আলোচনা করেছি।

------------------------------------

  দেখুনঃ দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, লোকায়ত দর্শন, নিউ এজ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, প্রথম সংস্করণ ১৩৬৩, পুনর্মুদ্রণ ১৪১৬, পৃঃ ২২।

------------------------------------

লোকায়ত দর্শন অর্থ হল সাধারণ মানুষের দর্শন ও ইহলৌকিক দর্শন। এটি নামেই প্রকাশ করে যে, লোকায়ত হল লোক সমাজ বা জনসাধারণের মধ্যে পরিব্যাপ্ত ধ্যানধারণা।  সিন্ধুর সমাজে এমন চিন্তাধারা পরিব্যাপ্ত ছিল বলেই সেখান থেকে এই নাম এসেছে। বিপক্ষের অর্থাৎ ব্রাহ্মণ্য উৎস থেকে লোকায়তের প্রকৃত রূপ ও এর সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য তথ্য জানা অত্যন্ত কঠিন। কারণ তারা বিক্ষিপ্তভাবে লোকায়তের মতকে খণ্ডন করেছে, তা সম্পর্কে তেমন বর্ণনা করে নাই। তার পরেও যেটুকু জানা যায় সেখান থেকে লোকায়ত সম্পর্কে মোটামুটি একটা ধারণা পাওয়া যায়। খ্রীষ্টীয় চতুর্দশ শতাব্দীর লেখক মাধবাচর্যের বর্ণনা অনুযায়ী, ‘লোকায়তিকেরা ইন্দ্রিয়-প্রত্যক্ষ ছাড়া জ্ঞানের আর কোনো উৎস স্বীকার করে না, ফলে তারা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য এই জড়জগৎটি ছাড়া আর কিছুর সত্তাও মানে না, অতএব তাদের কাছে ইন্দ্রিয়ভোগ্য সুখ ছাড়া আর কোনো রকম পুরুষার্থের অর্থও থাকতে পারে না।’ বুঝা যায় বিপক্ষের লেখকরা বিদ্বেষবশত লোকায়ত দর্শনের বর্ণনার কিছু পরিবর্তন ঘটিয়েছে। পৌরাণিক কাহিনীতে যেমন বিষ্ণু পুরাণে ও মৈত্রী উপনিষদে লোকায়ত মতকে অসুরদের মত হিসাবে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। যদিও পুরাণ কাহিনী ইতিহাসের ব্যাখ্যার কোনো নির্ভরযোগ্য সূত্র নয়, তবু এ থেকে সিন্ধু সভ্যতার রাষ্ট্রের সাথে লোকায়ত মতের সংশ্লিষ্টতার ইঙ্গিত পাওয়া যায়।

------------------------------------

  দেখুনঃ দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, লোকায়ত দর্শন, পুনমুদ্রণ ১৪১৬, পৃঃ ২২।

  দেখুনঃ দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, লোকায়ত দর্শন, পুনমুদ্রণ ১৪১৬, পৃঃ ১৪।

  সমস্ত ভারতীয় ধর্মীয় সাহিত্যে ও বিশেষভাবে হিন্দু পুরাণে দেব ও অসুরের সংঘাতের বর্ণনা আছে। আমরা মনে করি সিন্ধু সভ্যতায় শেষের দিকে শাসক শ্রেণী যে বরুণ দেবতার পূজার সূচনা করে তাকে অসুর নামে অভিহিত করা হত। সুতরাং সিন্ধু সভ্যতার শাসক শ্রেণীর সাথে অসুর নামটি জড়িত হয়ে যায়। অন্যদিকে সিন্ধু সভ্যতার শেষের দিকে বাঁধ ধ্বংসের উদ্দেশ্যে সংগঠিত বিদ্রোহী বৈদিকরা দেবতা ইন্দ্রকে প্রাধান্যে এনে একটি গৃহযুদ্ধের সূচনা ঘটায়। এ থেকে পরবর্তীকালে দেব-অসুরের যুদ্ধ হিসাবে কাহিনী তৈরী হয়। এই বিষয়ে আমাদের উভয়ের লিখিত গ্রন্থ ‘আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা’র আর্য অভিগমন, সম্প্রসারণ ও ঐতিহ্য অধ্যায়ে আরো আলোচনা করা হয়েছে। দেখুনঃ শামসুজ্জোহা মানিক ও শামসুল আলম চঞ্চল, আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা, বদ্বীপ প্রকাশন, ঢাকা, ২০০৩। গ্রন্থটির লিংকঃ http://www.bangarashtra.net/article/853.html

------------------------------------

প্রাচীন ভারতবর্ষে যে লোকায়ত চিন্তাধারা একটি শক্তিশালী ধারা ছিল তা বুঝা যায় পক্ষে ও বিপক্ষে উভয় সাহিত্যে লোকায়তের উল্লেখ থেকে। তবে চমকপ্রদ বিষয় হল বৌদ্ধ যুগে ব্রাহ্মণরা লোকায়ত চর্চাও করত বলে জানা যায়। পঞ্চাল কন্যা দ্রৌপদী বলছেন, লোকায়ত বিদ্যা শিখাবার জন্য তাঁর পিতা কোনো একজন বিদ্বান আচার্যকে নিয়োগ করেছিলেন। হর্ষচরিতের এক জায়গায় জ্ঞানী ও তপস্বীদের একটি দীর্ঘ তালিকার মধ্যে বৌদ্ধ, শ্বেতাম্বর জৈন, কপিল-শিষ্য, কণাদ-শিষ্য প্রমুখের সঙ্গে লোকায়তিকের বিবরণ আছে। মিলিন্দ প্রশ্নে ভিক্ষু নাগসেন রাজা মিলিন্দকে ব্রাহ্মণ কুমারগণের ঋগ্বেদ, যজুর্বেদ, সামবেদ, অথর্ববেদ, ইতিহাস, পুরাণ, ইত্যাদির সাথে লোকায়ত শাস্ত্র শিক্ষা করার কথা উল্লেখ করেছেন (তৃতীয় বর্গ, ৩৬)। এই সমস্ত বিবরণ থেকে অনুমান করা যায় যে, প্রাচীন ভারতীয় সমাজে লোকায়ত মতের গভীর প্রভাব ছিল বলেই বিরুদ্ধবাদীদের আক্রমণ ও মিথ্যা প্রচারণার পরেও সেখানকার অনেক সত্য প্রকাশিত হয়েছে।

------------------------------------

 দেখুনঃ প্রাগুক্ত গ্রন্থ, পৃঃ ২৮।

  দেখুনঃ প্রাগুক্ত গ্রন্থ, পৃঃ ২৮-২৯।

  দেখুনঃ পণ্ডিত শ্রীমৎ ধর্মাধার মহস্থবির (অনুদিত), মিলিন্দ প্রশ্ন, মহাবোধি বুক এজেন্সি, কলকাতা, পুনর্মুদ্রণ ২০১৩, পৃঃ ১৫৭।

------------------------------------

আমরা অনুমান করি সিন্ধু সভ্যতার লোকায়ত চিন্তাধারা পরবর্তী ভারতীয় সমাজে গভীর প্রভাব রেখেছিল বলেই খ্রীষ্টপূর্ব প্রথম সহস্রাব্দের মাঝামাঝি সময়ে ভারতবর্ষে বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের মত এবং অজিত কেশ কম্বলীর মত অসংখ্য ব্যক্তি-কেন্দ্রিক গোষ্ঠীর নিরীশ্বরবাদী চিন্তাকে ধারণ করার মত সমাজভূমি তৈরী ছিল। সেই সময়কার ছোট ছোট রাজ্যগুলির শাসকরাও এই চিন্তাকে ধারণ করত বলে মনে হয়।

------------------------------------

লোকায়ত মতবাদ সম্পর্কে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের লেখকবৃন্দ কোকা আন্তোনভা, গ্রিগোরি বোন্গার্দ-লেভিন ও গ্রিগোরি কতোভ্স্কি বলেন, ‘যুক্তিবাদী এবং বস্তুবাদী ধ্যানধারণার পথে এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ অগ্রসর পদক্ষেপ সেকালে বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের, বিশেষ করে গণিত, পদার্থবিদ্যা ও প্রকৃতিবিজ্ঞানসমূহের ক্ষেত্রে, তাৎপর্যপূর্ণ অগ্রগতি ভিন্ন কল্পনা করাও অসম্ভব।’ দেখুনঃ কোকা আন্তোনভা, গ্রিগোরি বোন্গার্দ-লেভিন ও গ্রিগোরি কতোভ্স্কি, ভারতবর্ষের ইতিহাস, প্রগতি প্রকাশন, মস্কো, দ্বিতীয় সংস্করণ, ১৯৮৬, পৃঃ ২০৭।

------------------------------------

খ্রীষ্টপূর্ব প্রথম সহস্রাব্দের শেষের দিকে নগর কেন্দ্রের বিস্তার (সৌজন্যেঃ Akinori Uesugi, 2018)

পাতা : ৮

গাঙ্গেয় সমভূমিতে প্রজাতন্ত্র ও গণরাজ্যসমূহ

আমরা জানতে পারি, বুদ্ধের সময়ে বহু সংখ্যক স্বাধীন রাজ্য গড়ে উঠেছিল যেগুলির কোনো বংশানুক্রমিক কেন্দ্রীয় শাসক ছিল না। বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের গ্রন্থগুলিতে শক্তিশালী ষোলটি মহাজনপদের উল্লেখ পাওয়া যায়। এগুলি প্রজাতন্ত্র তথা গণরাজ্য বা Republic ছিল। বৌদ্ধ সাহিত্য থেকে সর্বপ্রথম গৌতম বুদ্ধের সময়ের (আনুমানিক ৫৬৩ খ্রীঃপূঃ - ৪৮৩ খ্রীঃপূঃ) এই গণরাজ্যগুলির উল্লেখ পাওয়া যায় বলে ও এই সময়ের আগে আর কোনো লিখিত দলিল না পাওয়াতে সাধারণভাবে এই ধারণা প্রচলিত যে এই গণরাজ্যগুলি ষষ্ঠ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে গড়ে উঠেছিল। কিন্তু এটাই যুক্তি সংগত যে সিন্ধু সভ্যতার শাসন কাজে নির্বাচনমূলক যে ব্যবস্থা চালু ছিল সেটাই সভ্যতার পতন পরবর্তী কালে সমাজ যখন গ্রামীণ জীবনে ফিরে গেছে তখন সেখানে এভাবে নিজেকে অভিব্যক্ত করেছে। আমরা ধারণা করি খ্রীষ্টপূর্ব অষ্টম শতাব্দীতে গাঙ্গেয় সমভূমিতে ছোট ছোট শহর গড়ে উঠতে থাকলে এই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কোনো কোনো অঞ্চলে রাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থা হিসাবে রূপ নিতে থাকে ও কিছুটা বড় অঞ্চল ব্যাপী বিস্তৃত হয়।

বৌদ্ধ সাহিত্যে উল্লেখিত মহাজনপদের মধ্যে চৌদ্দটি ছিল রাজ্য ও বাকী দু’টি প্রজাতন্ত্র। পাণিনি যিনি খ্রীষ্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে বেঁচে ছিলেন, তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ অষ্টাদ্ধয়ীতে গণরাজ্যগুলির বিভিন্ন ধরনের শাসন প্রণালী সম্পর্কে লিখে গেছেন। তিনি গণ ও সংঘ শব্দ দু’টিকে সমার্থক শব্দ বলেছেন। শাসক ক্ষত্রিয়রা দুই ধরনের সংবিধান দ্বারা চালিত হত। কিছু রাজতন্ত্র ও কিছু সংঘ বা প্রজাতন্ত্র ছিল। প্রজাতন্ত্রগুলি অল্প কিছু ব্যক্তির পরিষদ দ্বারা চালিত হত। পাণিনির মতে ক্ষত্রিয় পরিবারগুলির প্রধানদের রাজা বলা হত। আর তাদের বংশধরদের রাজন্য বলা হত। রাজন্যরা গণের শাসক শ্রেণীকে প্রতিনিধিত্ব করত। চতুর্থ শতাব্দীর লেখক কাত্যায়নও প্রায় একই অর্থে রাজন্যের কথা উল্লেখ করেছেন। এই ক্ষত্রিয় রাজাদের বংশধররা প্রজন্মের পর প্রজন্ম রাজ্য শাসন করে। মনে করা হয় যে, সংঘের সকল সদস্য রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারত না, যা শুধুমাত্র পরিচালক শ্রেণী করত। সংঘে প্রতিটি ক্ষত্রিয় পরিবারের প্রধান, যাদের রাজা উপাধি থাকত, তারা তাদের কুলকে প্রতিনিধিত্ব করত। এই গণরাজ্যগুলিতে অন্যান্য গোষ্ঠীর মানুষও অংশগ্রহণ করত। তবে ক্ষত্রিয়রাই রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকারী ছিল। কিছু ব্যতিক্রমী ক্ষেত্রে ব্রাহ্মণ ও অন্যন্য বর্ণের মানুষদের অধিকার থাকত।  গণ শব্দটি প্রশাসনের ধরন ও সংঘ রাষ্ট্রকে বুঝাত। সংঘ দিয়ে একত্রীভূত সমষ্টিও বুঝাত। জৈন সাহিত্য থেকেও প্রাচীন ভারতীয় প্রজাতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা সম্পর্কে জানা যায়। জৈন সাহিত্য আচারাঙ্গ-সূত্রে রাজা ছাড়া রাজ্য, যুবরাজ শাসিত রাষ্ট্র, দুই জন শাসক দ্বারা শাসিত রাষ্ট্র অথবা গণ-দ্বারা শাসিত রাষ্ট্র প্রভৃতির কথা বলা আছে।  এছাড়া আচারাঙ্গ সূত্রে গণের প্রধান (পুস্তক ২, উপদেশ ১, পাঠ ১০), সভাগৃহ (পুস্তক ২, উপদেশ ২, পাঠ ২), ইত্যাদির উল্লেখ আছে।

------------------------------------

  জি.পি. সিং ১৪টি kingdom ও ২টি republic-এর কথা উল্লেখ করেছেন। দেখুনঃ G.P. Singh, Republics, Kingdoms, Towns and Cities in Ancient India, D.K. Printworld (P) Ltd, New Delhi, 2003, p. xxii.

  দেখুনঃ প্রাগুক্ত গ্রন্থ, পৃঃ ৩।

  দেখুনঃ প্রাগুক্ত গ্রন্থ, পৃঃ ৪।

  দেখুনঃ প্রাযুক্ত গ্রন্থ, পৃঃ ৪।

দেখুনঃ Hermann Jacobi (Translated), Gaina Sûtras, Part I, The Secred Books of the East Series, Volume XXII, Oxford at the Clarendon Press, 1884, pp. 113, 126. 

------------------------------------

গণ ও সংঘের অর্থ অনেক ব্যাপক। এই দু’টি ভিন্ন ধরনের প্রজাতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার কথা প্রকাশ করে। যে রাষ্ট্র গণ বা একটি গোষ্ঠীর মানুষ দ্বারা পরিচালিত হয় তাকে গণ-রাজ্য বলে। উল্লেখযোগ্য গণ-রাজ্যগুলি হল লিচ্ছবি, শাক্য, মল্ল, যৌধেয় ও মালব। যে সমস্ত রাজ্য সংঘ বা কনফেডারেশন গঠন করত তাদেরকে সংঘ-রাজ্য বলত। প্রকৃতপক্ষে সংঘ বলতে একাধিক গোত্রের ও রাজ্যের কনফেডারেশনকে বুঝাত। বুদ্ধের সময়ে বৈশালীর লিচ্ছবি ও মিথিলার বিদেহদের এবং পাণিনির সময়ে ত্রিগর্ত ও শস্থ ও আলেক্জাণ্ডারের সময়ে ক্ষুদ্রক ও মালবদের প্রজাতন্ত্রসমূহের কনফেডারেসি উল্লেখ করার মত। জৈন সাহিত্য কল্প সূত্রে মহাবীরের মৃত্যুর সময়ে কাশী ও কোশলের কনফেডারেসির আঠারো জন, মল্লকীর নয় জন ও লিচ্ছবীর নয় জন রাজা নূতন চন্দ্রের দিনে প্রদীপ জ্বালানোর অনুষ্ঠান করেছিল বলে বর্ণনা আছে (মহাবীরের জীবন, পাঠ ৫, ১২৮)। দেখা গেছে অনেক সময় তারা মৈত্রী গঠন করত। কনফেডারেশন বা মৈত্রী যেটাই করুক তাদের উদ্দেশ্য থাকত সামরিক শক্তি বৃদ্ধি, নিরাপত্তা, বিভিন্ন অর্থনৈতিক সুবিধা, ইত্যাদি। তবে সকল ক্ষেত্রে তারা নিজেদের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করত। বিভিন্ন সময়ে এই গণ-রাজ্যগুলি রাজতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা গ্রহণ করত আবার কিছু রাজতন্ত্র প্রজাতান্ত্রিক ব্যবস্থা গ্রহণ করত। সেলুকাস নিকাটরের দূত গ্রীক ঐতিহাসিক মেগাস্থিনিস, মৌর্য রাজা চন্দ্রগুপ্তের সময়ে তাঁর রাজসভায় কিছুকাল ছিলেন। তিনি কিছু নগরের রাজতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা থেকে প্রজাতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় প্রত্যাবর্তনের কথা উল্লেখ করেছেন।

------------------------------------

দেখুনঃ G.P. Singh, Republics, Kingdoms, Towns and Cities in Ancient India, 2003, p. 5.

দেখুনঃ Hermann Jacobi (Translated), Gaina Sûtras, Part I, 1884, p. 266.

দেখুনঃ John W. McCrindle, Ancient India as described by Megasthenês and Arrian, Munshiram Manoharlal Publishers Pvt. Ltd., New Delhi, 2015, pp. 36, 37-38.

------------------------------------

খ্রীঃপূঃ চতুর্থ শতাব্দীতে আলেকজাণ্ডারের গ্রীক ঐতিহাসিকদের বর্ণনায় পাঞ্জাবের খছ, ক্ষুদ্রক, মালব, অগ্র-শ্রেণী, শিবী, যৌধেয় অমব্রষ্ঠ এবং সিন্ধুতে ক্ষত্রিয় ও ব্রাহ্মণ গণরাজ্যের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে যে তাদের পর্যাপ্ত অস্ত্র ছিল, ও কারো সুসংগঠিত সামরিক বাহিনী ছিল, যারা আলেকজাণ্ডারের সেনাবাহিনীকে মোকাবিলা করেছিল। তাদের রাজ্যে নারী ও পুরুষ সবারই সামরিক প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক ছিল।

অনেক লেখক গণরাজ্যগুলির শাসন কার্যে নিয়োজিত ক্ষত্রিয় পরিবার বা গোষ্ঠীগুলিকে ব্রাহ্মণ্য চতুর্বর্ণ ব্যবস্থার একটি বর্ণ ক্ষত্রিয় বলে লিখে থাকেন। তাঁরা ধরে নেন যে তখনকার সমাজ ব্রাহ্মণকেন্দ্রিক চার বর্ণে বিভক্ত ছিল। বৌদ্ধ সাহিত্য বা পাণিনির রচনা বা অন্য কোনো সমসাময়িক সাহিত্য কোনোটাই বলে না যে, ব্রাহ্মণরা এই সমস্ত গণরাজ্যের শাসন ব্যবস্থায় কোনো গুরুত্বপূর্ণ বা এমন কী অন্য কোনো ভূমিকা পালন করেছিল। পাণিনি তখনকার সমাজে রাজ্যগুলিকে দেশের নাম ও একই সাথে ক্ষত্রিয় গোত্রের নাম হিসাবে উল্লেখ করেছেন। যেমন, মগধ, কলিঙ্গ, সুরমস, কোশল, অজাদ, কুরু, সালব, প্রত্যগ্রথ, কালকূট, অস্মক সম্পর্কে বলছেন এগুলি দেশের নাম ও একই সাথে ক্ষত্রিয়দের নাম (Book IV, I, 170-173)। পাণিনি অন্ধক ও বৃষ্ণি নামে দুটি যোদ্ধা গোত্রের কথা বলেছেন যারা ক্ষত্রিয় গোত্রের (Book VI, II, 34) ছিল।  এথেকে অনুমান করার কারণ আছে যে, গণরাজ্য বা সংঘগুলি ছিল ক্ষত্রিয়দের নেতৃত্বে ও তাদের প্রাধান্যে গঠিত রাজ্য। অন্যদের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ ছিল না।  এখানে ব্রাহ্মণের ভূমিকা একেবারে ছিল না বা গৌণ ছিল বলেই মনে করার যুক্তি সংগত কারণ আছে। একটি বিষয় লক্ষ্যণীয় যে, পাণিনি ক্ষত্রিয়দের বর্ণ হিসাবে উল্লেখ করেন নাই। আমরা অনুমান করি তখনও অর্থাৎ খ্রীষ্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে ব্রাহ্মণকেন্দ্রিক চতুর্বর্ণের সূচনা ঘটে নাই।

------------------------------------

দেখুনঃ Śrīśa Chandra Vasu (Translated), The Ashádhyáyí of Páini, Indian Press, Allahabad, 1891, pp. 692-693.

দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ১১৫০-১১৫১।

এবিষয়ে ভি,এস, আগ্রাওয়ালা তাঁর  বইতে যা বলেছেন তা উল্লেখযোগ্য, তিনি বলেছেন, `It appears from this that not all the members of a Sagha were entitled to exercise political power, which was the privilege of only the governing class. It appears that the descendants of the pioneer Kshatriyas who had settled on land and founded the Janapada state, treated political sovereignty as their privilege which was transmitted in their families from generation to generation. In spite of the growth of population in a Janapada, the centre of power was not altered and the main authority continued to vest in Kshatriya hands.’ দেখুনঃ V.S. Agrawala, India as Known to Pāṇini, University of Lucknow, 1953, p. 428.

------------------------------------

এটা খুব তাৎপর্যপূর্ণ যে, বৌদ্ধ ও জৈনদের মত আজীবিকদেরও সভা ছিল, যেখানে তারা নিয়মিত মিলিত হত ও ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন করত। পোলাসপুর শহরে এই রকম ‘আজীবিকিয়া-সভা’র কথা জানা যায়।

------------------------------------

দেখুনঃ A. L. Basham, History and Doctrines of the Ājīvikas: A Vanished Indian Religion, 1951, p. 115.

------------------------------------

পাতা : ৯

বৌদ্ধ সাহিত্যে শাক্য ও কৌলিয়দের রাজ্যে প্রায় তিন ডজন নগরের কথা বলা আছে, যেগুলি বুদ্ধের সময়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এগুলির মধ্যে আছে অনুপম, ক্ষেমাবতী, কোলিয়ানগর, রামগম, শোভাবতী, অনুপিয়া, অতুমা, চতুমা, খোমাদুস্য, নালাকপন, সজ্জানেলা পজ্জনিকম, সক্করা, সপগা, শীলাবতী, শোভন, সুধম্মা, সুমনগল, উক্কনা, উলম্পা বা মেদাতালুম্পা, উত্তর, কুণ্ডিয়, ইত্যাদি।  এগুলি এখনো প্রত্নতাত্ত্বিকভাবে চিহ্নিত করা যায় নাই। তবে বেশ কিছু সংখ্যক বৌদ্ধ প্রত্নস্থল ও এগুলির সাথে সম্পর্কিত মহাজনপদের ও গণরাজ্যগুলির রাজধানী চিহ্নিত করা গেছে ও এগুলির মধ্যে কিছু প্রত্নস্থলে ব্যাপক উৎখনন হয়েছে।  সম্প্রতি ঝুসিতে খনন করে এই নগরটিকে প্রতিষ্ঠানপুর বলে মনে করা হচ্ছে।

------------------------------------

দেখুনঃ Indudhar Dwivedi and Vimal Tiwari, Reassessment of the Archaeological Antiquity of Upper Central Ganga Plain with Reference to Data from Significant Excavated Sites and Recent Researches, in, Purātattva, No. 44, 2014, p. 171.

  দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ১৭৩।

------------------------------------

প্রাচীন ভারতের মানচিত্র (সূত্রঃ https://www.pinterest.com/pin/775956210774808784/)

বুদ্ধের সময়ে দেখা যায় যে বর্তমান উত্তর প্রদেশ ও দক্ষিণ বিহার নিয়ে দু’টি বৃহৎ রাজ্য কোশল ও মগধ গড়ে উঠেছিল। উভয় রাজ্যই সম্প্রসারণ করছিল ও তাদের সীমা বৃদ্ধি করছিল। কাশী (বেনারস জেলা) কোশলের অধীনে ও অঙ্গ (পূর্ব বিহার ও উত্তর-পশ্চিম বঙ্গ) মগধের অধীনে চলে যায়। এই দুই বড় রাজ্যের উত্তরে কিছু ছোট ছোট গোত্রীয় রাজ্য ছিল যেগুলি অল্প সংখ্যক মানুষ দ্বারা শাসিত হত। এগুলির মধ্যে শাক্যরাজ্য সবচেয়ে বিখ্যাত ছিল, যারা ইতিমধ্যেই কোশলের প্রসেনজিতের করদ রাজ্য হয়েছিল ও পরে তার পুত্র বিদুদভের দ্বারা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল। এদের মধ্যে সবচেয়ে বড় প্রজাতান্ত্রিক রাজ্যসমূহ বজ্জিদের  কনফেডারেসি মগধের রাজা বিম্বিসারের পুত্র অজাতশত্রু কর্তৃক বিজিত হয়।  

অনুমান করা যায় যে, গণরাজ্যগুলি সি›ধু সভ্যতার রাষ্ট্রের ও সমাজেরও একটি বড় অংশের মূল উপাদান বস্তুবাদ এবং নিরীশ্বরবাদের ধারণাকে বহন করছিল। ফলে এই গণরাজ্যগুলি বুদ্ধ, মহাবীর, অজিত কেশকম্বলী ও সেই সময়ে আরো অন্যান্য নিরীশ্বরবাদী সম্প্রদায়ের চিন্তা প্রচারের জন্য উর্বর ক্ষেত্র হিসাবে কাজ করেছিল।

ব্রাহ্মণ্য ধর্মের দর্শন

প্রধানত বৌদ্ধ ও জৈন দর্শনের বাইরে ভারতীয় দর্শনের যে বিশাল ভাণ্ডার রয়েছে সেটাকেই ব্রাহ্মণ্য ধর্মের দর্শন বলা যেতে পারে। যদিও এর মধ্যে আছে অনেক পরস্পর বিরুদ্ধ দার্শনিক চিন্তা ও সেই সব চিন্তাকে ধারণকারী নানা সম্প্রদায়ের উপস্থিতি। এই দার্শনিক সম্প্রদায়গুলির মধ্যে সাংখ্য দর্শনের মত নিরীশ্বরবাদী দর্শনের উপস্থিতি যেমন দেখতে পাওয়া যায় তেমন বেদ, গীতা ও উপনিষদের মত ব্রাহ্মণ্য ধর্মের প্রধান গ্রন্থগুলিতে একশ্বেরবাদী চিন্তার উপস্থিতিও দেখতে পাওয়া যায়। ঋগ্বেদের  তৃতীয় মণ্ডলের পঞ্চান্ন সূক্তের প্রতিটি ঋকের শেষে বলা হচ্ছে, দেবগণের মহৎ বল একই। প্রথম মণ্ডলের ১৬৪ সূক্তে একেশ্বরবাদী চিন্তার স্পষ্ট সাক্ষ্য পাওয়া যায়। সেখানে বলা হচ্ছেঃ ‘৪। প্রথম জাতকে কে দেখেছিল যখন অস্থিরহিতা অস্থিযুক্তকে ধারণ করল? ভূমি হতে প্রাণ ও শোণিত, কিন্তু আত্মা কোথা হতে? কে বিদ্বানের নিকট এ বিষয় জিজ্ঞাসা করতে যায়? ৫। আমি অপক্কমতি মনে কিছু বুঝতে না পেরে জিজ্ঞাসা করছি। এ সকল সন্দেহ পদ দেবতাদের নিকটেও নিগূঢ়। এক বৎসরের গোবৎসকে পরিবেষ্টনার্থে মেধাবীগণ যে সপ্ত তন্তু পেতেছেন তা কি? ৬। আমি অজ্ঞান কিছু না জেনেই জ্ঞানী মেধাবীগণের নিকট জানবার জন্য জিজ্ঞাসা করছি। যিনি এ ছয় লোক স্তম্ভন করেছেন, যিনি জন্ম রহিতরূপে নিবাস করেন তিনি কি সেই এক?’ একেশ্বরবাদী চিন্তার প্রকাশ দেখতে পাওয়া যায় আরো ঋকে, যেমন, দশম মণ্ডলের বিরাশি সূক্তে বিশ্বকর্মা ঋষি বিশ্বকর্মা দেবতার উদ্দেশ্যে বলছেন, ‘২। যিনি বিশ্বকর্মা, তাঁর মন বৃহৎ, তিনি নিজে বৃহৎ, তিনি নির্মাণ করেন, ধারণ করেন, তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ এবং সকল অবলোকন করেন, ...।’ একই ঋষি আরো বলছেন, ‘সে এক প্রভু, তাঁর সকল দিকে চক্ষু, সকল দিকে মুখ, সকল দিকে হস্ত, সকল দিকে পদ, ইনি দু হস্তে এবং বিবিধ পক্ষ সঞ্চালনপূর্বক নির্বাণ করেন, তাতে বৃহৎ দ্যুলোক ও ভূলোক রচনা হয়।’ (১০/৮১/৩)

------------------------------------

  এই গ্রন্থে ঋগ্বেদের সকল উদ্ধৃতি নেওয়া হয়েছে, ঋগ্বেদ-সংহিতা, প্রথম খণ্ড, রমেশচন্দ্র দত্তের অনুবাদ অবলম্বনে, প্রকাশকঃ হরফ প্রকাশনী, কলিকাতা, দ্বিতীয় প্রকাশ, ১৯৮৭; এবং ঋগ্বেদ-সংহিতা, দ্বিতীয় খণ্ড, প্রথম প্রকাশ, ১৯৭৬, থেকে।

------------------------------------

গীতার  মূল দর্শন আসক্তিশূন্য কর্ম। এখানে কৃষ্ণ অর্জুনকে বলছেন, ‘অতএব তুমি আসক্তিশূন্য হইয়া সর্ব্বদা কর্ত্তব্য কর্ম্ম সম্পাদন কর, কারণ অনাসক্ত হইয়া কর্ম্মানুষ্ঠান করিলে পুরুষ পরমপদ (মোক্ষ) প্রাপ্ত হন।’ (৩।১৯)। একেশ্বরবাদী চিন্তার প্রকাশ গীতায়ও দেখা যায়। এক জায়গায় কৃষ্ণ অর্জুনকে বলছেন, ‘হে পার্থ, যে আমাকে যেভাবে উপাসনা করে, আমি তাহাকে সেই ভাবেই তুষ্ট করি। মনুষ্যগণ সর্ব্বপ্রকারে আমার পথেরই অনুসরণ করে অর্থাৎ মনুষ্যগণ যে পথই অনুসরণ করুক না কেন, সকল পথেই আমাকে পৌঁছিতে পারে।’ (৪।১১)।

------------------------------------

এই গ্রন্থে গীতার সকল উদ্ধৃতির উৎস শ্রীজগদীশচন্দ্র ঘোষ অনূদিত ও সম্পাদিত, শ্রীমদ্ভগবদগীতা, প্রেসিডেন্সী লাইব্রেরী, ঢাকা, ১৩৬৫ সন (বাংলা)।

------------------------------------

এভাবে ব্রাহ্মণ্য বা হিন্দু ধর্মের মূল গ্রন্থগুলিতে একেশ্বরবাদী চিন্তার প্রভাব দেখা যায়। শত পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে আসা সত্ত্বেও সিন্ধু সভ্যতার একেশ্বরবাদী চিন্তা যে পরবর্তী ভারতীয় সমাজে গভীর প্রভাব রেখেছিল এটা তারই প্রমাণ।

পাতা :১০

 

৩য় অধ্যায় : বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের উত্থান

ভারতবর্ষের ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে সাধারণভাবে যে সমস্ত উপাদান ব্যবহার করা হয়ে থাকে সেগুলি হল বিভিন্ন প্রাচীন সাহিত্য, শিলালিপি, মুদ্রা, বিদেশীদের রচনা ও সীমিত পরিমাণে প্রাপ্ত প্রত্নতাত্ত্বিক তথ্য। সাম্প্রতিককালে বিশেষভাবে গত প্রায় পঁচিশ বৎসর ধরে প্রত্নতত্ত্বের ক্ষেত্রে বিপুল কাজ হয়েছে ও এখনো অনেক কাজ হচ্ছে। যদিও প্রত্নস্থলগুলিতে উল্লম্ব খনন তুলনামূলক বেশী হবার ফলে ও আনুভূমিক খনন তেমন না হওয়াতে প্রত্নতাত্ত্বিক তথ্য প্রাপ্তি সীমিত থেকে যাচ্ছে, তার পরেও আমরা এখন ভারতবর্ষের প্রাচীন যুগের প্রত্নতাত্ত্বিক তথ্যে আগের চেয়ে অনেক সমৃদ্ধ হয়েছি। বিশেষত সাম্প্রতিক প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান পুরাতন অনেক ধারণা বদলে দিবার ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। অন্য দিকে প্রাচীন সাহিত্য ভারতবর্ষের ইতিহাস রচনায় একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করে আছে। এগুলির মধ্যে বৌদ্ধ, জৈন ও হিন্দু সাহিত্য এবং প্রাচীন বিভিন্ন গ্রন্থ উল্লেখযোগ্য। দেখা গেছে যে, প্রাচীন হিন্দু সাহিত্য বিশেষভাবে রামায়ণ, মহাভারত ও বিভিন্ন পুরাণ সাহিত্যে যে সমস্ত বিবরণ পাওয়া যায় তা নানা কাল্পনিক কাহিনী দ্বারা পূর্ণ ও পরস্পর বিরোধী। শুধু তাই নয় এই সাহিত্যগুলিকে ইতিহাসের নির্দিষ্ট ও সঠিক সময়ে ফেলা যায় না। অনেক ঘটনা বর্ণনা করার সময় অনেক ক্ষেত্রে তা এত দূর অতীতে নিয়ে যায় যে, এর প্রকৃত কাল নিরূপণ করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। এছাড়াও বিভিন্ন যুগে ব্রাহ্মণরা এই সমস্ত সাহিত্যের পরিবর্তন ঘটিয়েছে, যার শেষ পরিবর্তন সম্ভবত মধ্য যুগে ঘটেছে। এমন কি কৌটিল্যের রচনার সময় নিয়েও অনেক পণ্ডিত সন্দেহ পোষণ করেন। এক্ষেত্রে বৌদ্ধ ও জৈন সাহিত্য আমাদের কিছুটা সহায়তা করে। এছাড়া মেগাস্থিনিস ও অন্যান্য গ্রীক ঐতিহাসিকদের বিবরণ কোনো কোনো ক্ষেত্রে কিছুটা অতিরঞ্জিত হলেও সতর্কভাবে ব্যবহার করা যায়।

------------------------------------

  মহাকাব্য ও পুরাণের উপর ভিত্তি করে ইতিহাস রচনা প্রসঙ্গে মাইকেল উইটজেল বলেন, ‘‘… .. we cannot write the history of archaic and ancient India based on the legendary Epic and Purāṇic accounts that were composed during the middle ages.’দেখুনঃMichael Witzel, Indocentrism: Autochthonous visions of ancient India, in, The Indo-Aryan Controversy: Evidence and inference in Indian History, eds., Edwin F. Bryant and Laurie L. Patton, Routledge, Oxon, 2005, p. 355.

------------------------------------

ভারতবর্ষের অশোকের মত এত বড় এক রাজা যিনি বাংলা থেকে আফগানিস্তান পর্যন্ত প্রায় সমগ্র উপমহাদেশ শাসন করেছিলেন, যাঁর প্রজাহিতকর অনেক কীর্তি ছিল, কিন্তু আশ্চর্য হবার মত বিষয় যে, পুরাণ বা অন্যান্য ব্রাহ্মণ্য সাহিত্য তাঁর বিষয়ে একেবারে নীরব থেকেছে। তাঁর নাম শুধু পাওয়া গিয়েছিল মৌর্য রাজাদের তালিকায়। এছাড়া তাঁর নাম কেবল মাত্র বৌদ্ধ সাহিত্য থেকে জানা যায়। কিন্তু সেটাও ভারতবর্ষের বাইরের উৎস থেকে; শ্রীলংকা, মধ্য এশিয়া ও চীনের বৌদ্ধ কেন্দ্রগুলিতে তা সংরক্ষিত ছিল।  কারণ ত্রয়োদশ শতাব্দীতে মুসলিম আক্রমণ অভিযানে আগেই দুর্বল হয়ে যাওয়া ও টিকে থাকা অবশিষ্ট বৌদ্ধ ধর্ম ও শিক্ষা কেন্দ্রগুলি ধ্বংস হয়ে যাওয়াতে বৌদ্ধ ধর্ম এবং সেই সঙ্গে বৌদ্ধদের দ্বারা সংরক্ষিত বিপুল পরিমাণ দলিলাদি বা সাহিত্যকর্ম ভারতবর্ষ থেকে প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যায়। অশোকের সম্পর্কে আরো জানা যায় শিলা ও স্তম্ভে তাঁর ঘোষণাসমূহ পঠোদ্ধার করার পর। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে লিপি পাঠোদ্ধার হলেও বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকেই কেবল এই লিপিসমূহের সাথে তাঁর সংশ্লিষ্টতার কথা জানা যায়।

------------------------------------

দেখুনঃ Romila Thapar, Aśokan India and the Gupta Age, in, A Cultural History of India, ed., A.L. Basham, Oxford University Press, New Delhi, 1975, p. 41.

------------------------------------

আমাদের এই আলোচনার উদ্দেশ্য ভারতবর্ষের ইতিহাস রচনা নয়, বরং ভারতবর্ষের ইতিহাসের পুনর্মূল্যায়ন। এই লক্ষ্যে কাজ করতে গিয়ে আমরা প্রাচীন বৌদ্ধ সাহিত্য, জৈন সাহিত্য, পাণিনির অষ্টাদ্ধয়ী, কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র, বিদেশীদের বিবরণ যেমন মেগাস্থিনিসের বিবরণ, চীনা ভ্রমণকারীদের বিবরণ, ইত্যাদির উপর তুলনামূলকভাবে বেশী জোর দিয়েছি। একথা বলা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, যে কোনো সাহিত্যের তথ্য ব্যবহারে আমরা সতর্ক থেকেছি। আমাদের ইতিহাস ব্যাখ্যায় সবচেয়ে বেশী নির্ভর করেছি প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারসমূহের উপর।

বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের উত্থান ও সমসাময়িক সমাজ

আগে আমরা বলেছি বৌদ্ধরা সিন্ধু সভ্যতার গণতান্ত্রিক ও লোকায়ত ঐতিহ্য অনেকখানি বহন করেছে। বৌদ্ধ সঙ্ঘগুলি সেই সময়ে প্রচলিত রাজনৈতিক সভা বা সঙ্ঘের মত গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে পরিচালিত হত বলে জানা যায়।  বুদ্ধ নিজে কোনো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণে সঙ্ঘের সাথে আলোচনা করতেন। বৌদ্ধ ত্রিপিটক সাহিত্যে এর প্রমাণ পাওয়া যায়।

------------------------------------

দেখুনঃ G.P. Singh, Republics, Kingdoms, Towns and Cities in Ancient India, 2003, p. 25.

------------------------------------

জাতক ও অন্যান্য প্রাচীন বৌদ্ধ গ্রন্থ থেকে জানা যায় যে, প্রাচীন ভারতীয় সমাজে ব্রাহ্মণদের উচ্চ মর্যাদা ছিল। বুদ্ধের বাণী বুদ্ধের পরে মৌর্য-পূর্ব যুগে দুই শত বছরের মধ্যে সংকলিত হলেও অশোকের সময়ে আনুমানিক ২৪৭ খ্রীঃপূঃ-এ যে তৃতীয় বৌদ্ধ মহাসঙ্গীতি (সম্মেলন) অনুষ্ঠিত হয়, সেখানকার সংকলনই ত্রিপিটক সাহিত্য হিসাবে মোটামুটি টিকে আছে বলে ধারণা করা হয়। বৌদ্ধ ত্রিপিটক প্রাচীন ধর্মীয় সাহিত্য বলে এগুলি সতর্কতার সাথে বিচার করলে বুদ্ধের সময়ের মোটামুটি একাট সামাজিক চিত্র পাওয়া যায়। বৌদ্ধ সাহিত্যে ব্রাহ্মণের উল্লেখ থাকলেও প্রায় সকল ক্ষেত্রে আগে শ্রমণ ও ক্ষত্রিয়ের নাম ও তার পরে ব্রাহ্মণের নাম উল্লেখ দেখা যায়। যেমন, শ্রমণ-ব্রাহ্মণ বা ক্ষত্রিয়-ব্রাহ্মণ, ইত্যাদি। এতে মনে হয় সমাজে ব্রাহ্মণ শ্রেণী একক সম্মানিত শ্রেণী ছিল না। 

আমরা আগে উল্লেখ করেছি যে ক্ষত্রিয়রা সেই সময়ে ব্রাহ্মণ কেন্দ্রিক ধর্মের বাইরে আলাদা গোষ্ঠী ছিল। ব্রাহ্মণদের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, তারা বেদপন্থী বা বেদের ধর্ম পালন করত।

বৌদ্ধ ও জৈন সাহিত্যে ব্রাহ্মণ শব্দটিকে গুণবাচক অর্থেও ব্যবহার করা হয়েছে। যেমন, জৈন সাহিত্যে মহাবীরকে মহাব্রাহ্মণ আখ্যায় ভূষিত করা হয়েছে।  বৌদ্ধ সাহিত্যে বিভিন্ন জায়গায় অর্হৎগণকে ভিক্ষু, শ্রমণ ও ব্রাহ্মণ নামে অভিহিত করা হয়েছে।

------------------------------------

জৈন সাহিত্য সূত্রক্রিতাঙ্গের প্রথম পুস্তক, নবম উপদেশে অনুবাদক একে wise Brâhmana করেছেন। দেখুনঃ Hermann Jacobi (trans.), Gaina Sûtra, Part II, Oxford at the Clarendon Press, London, 1895, (The Sacred Books of the East series, ed. F. Max Muller, Vol. XLV) p. 301.

------------------------------------

বৌদ্ধ সাহিত্যে ‘ক্ষত্রিয়-কুল, ব্রাহ্মণ-কুল, বৈশ্য-কুল, শূদ্র-কুল’, এভাবে উল্লেখ দেখা যায়।  ফলে মনে হতে পারে যে, বুদ্ধের সময়ে ব্রাহ্মণ্য বা হিন্দু ধর্মের চার বর্ণের অস্তিত্ব ছিল। এটি মনে রাখতে হবে যে, সমাজ সেই সময়ে ব্রাহ্মণদের নিয়ন্ত্রণে ছিল না। এই সময়ে গণরাজ্যগুলিতে বিশেষত নগর, শহর ও বর্ধিষ্ণু গ্রামগুলির বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠী অনেকটা নিরীশ্বরবাদী ছিল, বা তাদের গোষ্ঠীগত দেবতাদের পূজার পাশাপাশি নিরীশ্বরবাদী চিন্তা দ্বারা প্রভাবিত ছিল। ব্রাহ্মণরা যেমন সংখ্যায় অনেক কম ছিল তেমন তারা সমাজের নেতৃত্বেও ছিল না। তারা কখনো স্বতন্ত্র এলাকায় বসবাস করত বলে জানা যায়। বৌদ্ধ ত্রিপিটকের অন্তর্গত মধ্যম নিকায় গ্রন্থে কোশল রাজ্যে শালা নামে এক ব্রাহ্মণ গ্রামের কথা বলা আছে।

------------------------------------

  দেখুনঃ শ্রীবেণীমাধব বড়ুয়া অনূদিত, মধ্যম-নিকায়, প্রকাশক শ্রী অধরলাল বড়ুয়া, কলিকাতা, ১৯৪০, পৃঃ ৩০৬।

  দেখুনঃ শ্রীবেণীমাধব বড়ুয়া অনুদিত, মধ্যম-নিকায়, ১৯৪০, পৃঃ ৩০৭।

------------------------------------

বুদ্ধ ঈশ্বরের অস্তিত্ব অস্বীকার করলেও বিভিন্ন দেবতা ও অপদেবতা, এমন কি কখনো বৈদিক দেবতা ইন্দ্রেরও স্বীকৃতি দিয়েছেন। অনুমান করা যায়, জনসমাজে প্রচলিত নিরীশ্বরবাদী চিন্তার পাশাপাশি বিভিন্ন দেবতার পূজাও প্রচলিত থাকাতে তাঁকে দেবতাদের এই স্বীকৃতি দিতে হয়েছে। এটাকে উপমহাদেশের প্রাচীন সমাজে বিদ্যমান বিভিন্ন ধারণার এক জটিল সহাবস্থান বলা চলে।

পাতা : ১১

গৌতম বুদ্ধ বা মহাবীর যখন নূতন ধর্মমত সৃষ্টি করলেন, তখন অন্যেরা যেমন বলে নাই তেমন তাঁরাও একথা বলেন নাই যে, তাঁরা নিজেরা পিতৃধর্ম ত্যাগ করেছেন। মধ্যম-নিকায় গ্রন্থে বুদ্ধ নির্গ্রন্থপুত্র (অর্থাৎ জৈন মতাবলম্বী) সত্যককে বলছেন, ‘অগ্নিবেশ্মন! সেই আমি পরে যখন তরুণ, নবীন, কৃষ্ণকেশ এবং ভদ্রযৌবনসম্পন্ন তখন স্নেহশীল ও অনিচ্ছুক মাতাপিতাকে কাঁদাইয়া, কেশ-শ্মশ্রু ছেদন করিয়া, কাষায় বস্ত্রে দেহ আচ্ছাদিত করিয়া আগার হইতে অনাগারিকরূপে প্রব্রজিত হই। প্রব্রজিত হইয়া কুশর কি সন্ধানে এবং অনুত্তর শান্তিবরপদ নির্ব্বাণ অন্বেষণে অরাড় কালামের নিকট উপস্থিত হই। উপস্থিত হইয়া তাহাকে বলিঃ “কালাম! আমি তোমার ধর্ম্ম-বিনয়ে ব্রহ্মচর্য্য আচরণ করিতে ইচ্ছা করি।” ... অগ্নিবেশ্মন! আমি অচিরে, অত্যল্পকালের মধ্যে সেই ধর্ম্ম অভিজ্ঞা দ্বারা সাক্ষাৎকার করিয়া তাহাতে অবস্থান করি। ...’ (মহাসত্যক-সূত্র ({৩৬}, ৮)। তার মানে বুদ্ধ কোনো ধর্ম পরিত্যাগ করেন নাই, নূতন ধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলেন মাত্র। অনুমান করা যায় বুদ্ধ বা মহাবীরের সময়ে সমাজে ব্রাহ্মণ্য ধর্ম ছাড়া প্রতিষ্ঠিত ও সুসংহত অন্য কোনো ধর্মমত ছিল না। যা ছিল তা হল সমাজের সর্বত্র পরিব্যাপ্ত লোকায়ত বা নিরীশ্বরবাদী চিন্তা। পাশাপাশি আদিম সমাজের লৌকিক দেব-দেবীর প্রতি বিশ্বাস ও পূজার প্রচলন থাকা স্বাভাবিক ছিল। বলা হয় জৈন ধর্ম প্রবর্তক মহাবীরের আগে ২৩ জন তীর্থঙ্কর এসেছিলেন। মহাবীর হলেন ২৪তম তীর্থঙ্কর। জৈন ঐতিহ্য অনুযায়ী ২৩তম তীর্থঙ্কর পার্শনাথ মহাবীরের দুই শতাব্দী আগে এসেছিলেন, যিনি একজন ঐতিহাসিক ব্যক্তি ছিলেন বলে জানা যায়। তাঁর অনুসারীরা মহাবীরের সময়ে বেঁচেছিলেন। মহাবীরের পিতামাতা পার্শ^নাথের অনুসারী ছিলেন।

------------------------------------

দেখুনঃ শ্রীবেণীমাধব বড়ুয়া অনূদিত, মধ্যম-নিকায়, ১৯৪০, পৃঃ ২৬১।

দেখুনঃ A.N. Upadhye, Jainism, in, A Cultural History of India, ed., A.L. Basham, 1975, p.101.

------------------------------------

বৌদ্ধ ত্রিপিটক সাহিত্য থেকে জানা যায় প্রাচীনকালে রাজারা চক্র আবর্তন করতেন। এই জন্য রাজাদের চক্রবর্তী বলা হত। এই রকম চক্র আবর্তনকারী রাজার উল্লেখ আছে দীঘ নিকায় গ্রন্থে। সেখানে বলা হয়েছে এই চক্রটিতে সহস্র অর (Spoke), বেড় (Outer rim), চক্রনাভি (Hub) ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক জিনিস আছে (২৭ চক্কবত্তি-সিহনাদ সুত্ত, ৪, ৫)। রাজার শাসন ক্ষমতা, অনুশাসন ও ন্যায়পরায়ণতার প্রকাশ এই চক্রটির আবর্তন বা ঘুরানোর মধ্যে নিহিত থাকত। চক্রটি তার অবস্থান থেকে সরে গেলে বুঝে নিতে হবে রাজা বেশী দিন বাঁচবেন না। বুদ্ধ তাঁর নূতন ধর্ম প্রতিষ্ঠা করার জন্য প্রথমে বারানসীর সন্নিকটে পাঁচ জন ভিক্ষুককে তাঁর অনুশাসন প্রদান করেন, ধর্ম উপদেশের মাধ্যমে স্বধর্মে দীক্ষিত করার মধ্য দিয়ে ধর্মচক্র প্রবর্তন করলেন।  বৌদ্ধ ত্রিপিটক গ্রন্থ থেকে অনুমান করা যায় যে, রাজার বা শাসকের চক্র ঘুরানো বা আবর্তন করা একটি প্রাচীন ঐতিহ্য থেকে এসেছে। এটি খুব সম্ভব যে, সিন্ধু সভ্যতার নগর শাসকদের দায়িত্ব ছিল চক্র আবর্তন করা। এটি সম্ভব যে, সিন্ধু সভ্যতার বাঁধ ভিত্তিক সেচ ব্যবস্থায় বিভিন্ন এলাকায় জল নিয়ন্ত্রণ করার জন্য যে স্লুইস গেট থাকার কথা আমরা আগে উল্লেখ করেছি, সেই স্লুইস গেটটিকে সম্ভবত কোনো চক্র বা চাকার সাহায্যে জলের ভিতর উঠানো নামানো বা নিয়ন্ত্রণ করা হত। কোন গ্রাম বা অঞ্চলে কতটুকু জল সরবরাহ করা হবে, তা ঠিক করত নগর শাসকরা। ফলে সমগ্র এলাকার ফসল উৎপাদন ও সেই সাথে সমৃদ্ধি নির্ভর করত রাজার বা শাসকের ন্যায় ভিত্তিক জল বিতরণের উপর। এই চক্রের ছবি সিন্ধু সভ্যতার বিভিন্ন সীল বা ফলকে দেখা গেছে। এই কারণেই সম্ভবত রাজাদের সম্পর্কে রাজচক্রবর্তী কথাটি পরবর্তী ভারতবর্ষে প্রতিষ্ঠা পায় ও বৌদ্ধ ধর্মে ধর্মানুশাসন প্রতিষ্ঠার সাথে ধর্মচক্র প্রতিষ্ঠার বিষয়টিকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হয়েছে।

------------------------------------

দেখুনঃ Maurice Walshe (Translated), The Long Discourses of the Buddha: A Translation of the Dīgha Níkāya, Wisdom Publications, Boston, First published in 1987, pp. 396, 397.

  দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ৩৯৬।

দেখুনঃ প্রজ্ঞানন্দ স্থবির (অনুদিত), মহাবর্গ, শ্রীঅধরলাল বড়ুয়া প্রকাশিত, কলিকাতা, ১৯৩৭, পৃঃ ৮-১৪।

------------------------------------

ধর্মচক্র বা ‘ধর্মানুশাসনের চক্র’ বৌদ্ধ ধর্মের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রাচীন প্রতীকগুলির একটি। হরপ্পা উত্তর যুগে দক্ষিণ এশিয়ায় এটি প্রথম দেখা যায় অশোকের সময়ে।  বুদ্ধের মূর্তি নির্মাণ শুরু হবারও আগে ভাস্কর্যে বা চিত্রে এই চক্রের ব্যবহার শুরু হয়।

------------------------------------

 দেখুনঃ A.K. Prasad, Discovery of a unique Buddhist Dharmachakra (the Wheel of Law) independently engraved on the floor of a cave in the Rajgir Hills, Bihar, (Notes and News), in, Purātattva, No. 43, 2013, pp. 252-253.

------------------------------------

বৌদ্ধ ধর্মের বিকাশ সম্পর্কে যে সকল প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন থেকে ধারণা পাওয়া যায় সেগুলি হল স্তূপ, চৈত্য, পাথর-খোদিত স্তূপ এবং গুহা-ভাস্কর্য ও শিলালিপি।

------------------------------------

দেখুনঃ Sunil Kumar Patnaik, Excavations at Aragarh (2014-16): An Early Historic Buddhist Site, (Notes and News), in, Purātattava, Number 46, 2016, p. 224.

------------------------------------

বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের প্রত্নতাত্ত্বিক সাক্ষ্য

ভারতের বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রতিক প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারের উপর ভিত্তি করে প্রাপ্ত প্রাচীন বিভিন্ন পুরানিদর্শনের উপস্থিতি থেকে বুঝা যায় যে, খ্রীষ্টপূর্ব শতাব্দীগুলিতে জৈন ও বৌদ্ধ ধর্ম প্রাধান্য বিস্তার করেছিল।  ভারতের একটি রাজ্য উড়িষ্যায় সাম্প্রতিক খননে মৌর্য যুগ (৩২২-১৮৫ খ্রীঃপূঃ) থেকে বৌদ্ধ ধর্মের পর্যাপ্ত অবশেষ পাওয়া গেছে। এছাড়াও বৌদ্ধ ধর্মের ধারাবাহিক বিকাশ দেখতে পাওয়া যায় উত্তর ও দক্ষিণ ভারতে খননকৃত বিভিন্ন বসতিতে। মৌর্য সম্রাট অশোক (রাজত্বকাল ২৬৮ - ২৩১ খ্রীঃপূঃ) আশি হাজার বৌদ্ধ স্মারক নির্মাণ করেছিলেন যেগুলির মধ্যে ছিল স্তম্ভ, পাথর খোদিত ভাস্কর্য, স্তূপ, চৈত্য ও মঠ। এই ধরনের চর্চা কুষাণ (খ্রীষ্টাব্দ ১ম - ২য় শতাব্দী), সাতবাহন (খ্রীঃপূঃ প্রথম শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে আনুমানিক ২২৫ খ্রীষ্টাব্দ), বাকাটক (২৫৫ - ষষ্ঠ শতকের প্রথমার্ধ), পাল (৭৫০ - ১১৬১ খ্রীষ্টাব্দ), ভৌমকার (অষ্টম শতকের প্রথমার্ধ থেকে দশম শতাব্দী), ইত্যাদি পরবর্তী বিভিন্ন রাজবংশ অনুসরণ করেছিল।

------------------------------------

  উড়িষ্যা সম্পর্কে বলা হচ্ছেঃ `Orissa is as a land of religions. In the pre-Christian era Jainism and Buddhism were prominent. However, in the early centuries of the Christian era Brahmanism began to flourish in Orissa.’ দেখুনঃ D.K. Nayak, A Study of Group-Information of the Temples of Orissa, in, Purātattva, No. 32: 2001-02, 2002, p. 117.

দেখুনঃ Sunil Kumar Patnaik, Buddhist Monuments in South-Eastern India: A Study of Forms and Patronage, in, International Review of Social Research 2019; 9(1), p. 38.

------------------------------------

ভারতবর্ষের বহু জায়গায় অশোকের অনুশাসনগুলি বৌদ্ধ কীর্তিগুলির কাছাকাছি ছিল।  সারনাথ (উত্তর প্রদেশ), অমরাবতী (অন্ধ্র প্রদেশ), সাঁচি (মধ্য প্রদেশ) ও বৈরাট (রাজস্থান) হল এই ধরনের দৃষ্টান্ত। এছাড়াও বহু ক্ষেত্রে মৌর্য যুগে স্তূপ ও চৈত্য অশোকের পৃষ্টপোষকতায় নির্মাণ করা হয়েছিল। গুজরাটের জুনাগড়ে লাখা মেদি নামে একটি বৌদ্ধ স্তূপ পাওয়া গেছে, যা অশোকের সময়ে তৈরী বলে মনে করা হয়। এছাড়া মৌর্য যুগের ইটের তৈরী অনেক বৌদ্ধ স্তূপ পাওয়া গেছে। প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ থেকে ধারণা করা হয় যে, জৈন ও ব্রাহ্মণ্য ধর্মের কেন্দ্র হিসাবে বিখ্যাত হবার অনেক আগেই মহারাষ্ট্রের গিরনার অঞ্চল বৌদ্ধদের কাছে একটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল। তবে সমাজে বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের প্রভাব বিস্তারের আগে থেকেই লোহার ব্যবহার ও নগরায়ন ঘটেছিল। ফলে এই দুই ধর্মের জন্য একটি সামাজিক ভিত্তি তৈরী হয় বলে মনে হয়। কারণ গ্রামীণ সমাজের চেয়ে নগরবাসীদের কাছে এই দুই ধর্ম বেশী জনপ্রিয় হয়েছিল বলে ঐতিহাসিক তথ্যসমূহ সাক্ষ্য দেয়।

------------------------------------

দেখুনঃ Nayanjot Lahiri, Revisiting the Cultural Landscape of Junagadh in the Time of the Mauryas, in, Purātattva, No. 41, 2011, p. 124.

  দেখুনঃ প্রাগুক্ত নিবন্ধ, পৃঃ ১২৪-১২৫.

দেখুনঃ Nayanjot Lahiri, Revisiting the Cultural Landscape of Junagadh in the Time of the Mauryas, in, Purātattva, No. 41, 2011, p. 129.

------------------------------------

পাতা :১২

সাধারণভাবে উত্তরাঞ্চলীয় কাল মসৃণ মৃৎপাত্রের সংস্কৃতিকে দুই ভাগে ভাগ করলে প্রথম ভাগে প্রায় ৬০০-৩০০ খ্রীঃপূঃ-এ লোহার ব্যবহার সীমিত থাকতে দেখা যায়, দ্বিতীয় ভাগে প্রায় ৩০০-১০০ খ্রীঃপূঃ-এ লোহার ব্যবহার যথেষ্ট বেড়ে যায়। এই তথ্য থেকে বুঝা যায় যে বিভিন্ন ধরনের কারিগরী কাজ যেমন কাঠ মিস্ত্রীর কাজ, ধাতুর শিল্প ও রাজমিস্ত্রীর কাজ এই সময়ে বেড়ে গিয়েছিল ও অন্য দিকে যুদ্ধ ও শিকারের মত কর্মতৎপরতাও বেড়ে গিয়েছিল। উত্তর ভারতে বিভিন্ন বসতিতে লোহার ব্যবহার হিসাব করে দেখা গেছে যে, মোট লোহার জিনিসের ৩৬.৫% যুদ্ধ ও শিকারের সাথে সম্পর্কিত, ৩৫.৫% বিভিন্ন ধরনের কারিগরী কাজের যেমন কাঠ মিস্ত্রীর, ধাতু শিল্পীর ও রাজ মিস্ত্রীর কাজের সাথে সম্পর্কিত, ১৮% গৃহের কাজের জিনিসপত্র ও মাত্র ১০% কৃষির কাজের সাথে সম্পর্কিত।

------------------------------------

দেখুনঃ Mohammad Nazrul Bari and Mohamad Ajmal Shah, Iron and Second Urbanism in North India: A Myth or Reality, (Notes and News), in, Purātattva, No. 45, 2015, p. 275-278.

------------------------------------

কলিঙ্গ রাজ্যে শিশুপালগড়ের সমসাময়িক তালাপদ (Talapada) নামে আদি ঐতিহাসিক বসতি পাওয়া গেছে, যেখানে প্রতিরক্ষা প্রাকার ছিল। শিশুপালগড়ে প্রতিরক্ষা প্রাকারের নির্মাণ কাল ধরা হয় খ্রীঃপূঃ ৬ষ্ঠ/৫ম শতাব্দী। তালাপদ বসতিটি খ্রীষ্টাব্দ ৩য় শতাব্দীতে পরিত্যক্ত হয়।

------------------------------------

দেখুনঃ Rabindra Kumar Mohanty, Monica L. Smith and Sikhashree Ray, Archaeological Investigations at the Early Historic Town of Talapada, 2014, in, Purātattva, No. 46, 2016, pp. 164-165.

------------------------------------

প্রথম দিককার বৌদ্ধ বসতিসমূহ (সৌজন্যেঃ Sunil Kumar Patnaik, 2019)

গাঙ্গেয় সমভূমিতে বেশীরভাগ নগর সীমানা প্রাচীর বেষ্টিত ছিল। এই নগরগুলি হল কৌশাম্বি, রাজগীর, শ্রাবস্তি (উত্তর প্রদেশ), বৈশালী (বিহার), অহিচ্ছত্র, আত্রাঞ্জিখের, ভিটা, মথুরা, পাটলিপুত্র, সঙ্খ, রাজঘাট, ইত্যাদি। মেসোপটেমিয়া, মিসর ও মধ্যআমেরিকায় নগরায়নের প্রাথমিক স্তরে ঘরের ও ধর্মীয় কাঠামোতে যে পরিবর্তন দেখা যায় তার তুলনায় গাঙ্গেয় সভ্যতায় তা অনেক পরিমিত। মৌর্য যুগের আগে এখানে ব্যক্তিগত জিনিসপত্র, বিরাট আয়তনের শিল্পকর্ম ও তারিখ নির্ধারণ করা যায় এমন উৎকীর্ণ লিপি পাওয়া যায় না। কিন্তু এখানে প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখননে বিস্তৃত নগর প্রাচীর পাওয়া গেছে।  অন্যান্য নগরগুলির প্রতিরক্ষা প্রাচীর মাটি, ইট বা পাথরের হলেও প্রাচীন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় নগরীর একটি ও একটি সাম্রাজ্যের রাজধানী পাটলীপুত্রের চারপাশে কাঠের বেড়া দিয়ে ঘেরা হয়েছিল। অনুমেয় যে এটি যুদ্ধের প্রতিরক্ষার জন্য যথেষ্ট দুর্বল ছিল। গাঙ্গেয় সভ্যতায় এই বিষয়টি ধাঁধার মত যে, এখানকার বেশীরভাগ প্রতিরক্ষা প্রাচীরের কেল্লা ও দেওয়াল অতিরিক্ত বিশালাকৃতির, কিন্তু এর সামগ্রিক বিন্যাসে প্রশস্ত খোলা জায়গা ও অপ্রতিরোধ্য এলাকা থাকায় মনে করা হয় যে এগুলি যুদ্ধের জন্য অথবা প্রাকৃতিক বিপদ প্রতিরোধের জন্যও অনুপযোগী ছিল। আরেকটি তথ্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ যে, উত্তর ভারতের ইতিহাসে যুদ্ধের যুগের সময়ের সাথে এই কেল্লাগুলির নির্মাণের সম্পর্ক পাওয়া যায় না, যেমন, তুলনামূলক স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে প্রতিরক্ষা প্রাচীর তৈরী করতে দেখা গেছে, আবার যুদ্ধের সময়গুলিতে প্রতিরক্ষা প্রাচীরগুলি দেখা যায় নাই বা অব্যবহৃত ছিল। এ থেকে মনে করা হয় যে, প্রাচীন ভারতবর্ষে প্রতিরক্ষা প্রাচীরের ভূমিকা মূলত কর্তৃত্ব ও ক্ষমতার সাথে সম্পর্কিত ছিল।

------------------------------------

দেখুনঃ P. Eltsov, Power circumscribed by space: Attempting a new model of the ancient South Asian city, in, Current Studies on the Indus Civilization, Volume VI, eds., Toshiki Osada and Akinori Uesugi, Manohar Publishers & Distributors, New Delhi, 2011, pp. 41-51.

দেখুনঃ প্রাগুক্ত নিবন্ধ, পৃঃ ৫১।

দেখুনঃ প্রাগুক্ত নিবন্ধ, পৃঃ ৫১।

দেখুনঃ প্রাগুক্ত নিবন্ধ, পৃঃ ৪৬।

দেখুনঃ প্রাগুক্ত নিবন্ধ, পৃঃ ৪৬।

  দেখুনঃ প্রাগুক্ত নিবন্ধ, পৃঃ ৫১।।

------------------------------------

পাতা : ১৩

দেখা গেছে যে, বৌদ্ধ মঠ ও বিহারগুলির বহু সংখ্যকই নগর প্রতিরক্ষা প্রাচীরের বাইরে থাকত। বাংলাদেশের মহাস্থানগড়ের নগর প্রতিরক্ষা প্রাচীরের বাইরে বিখ্যাত ভাসু বিহারের অবস্থান ছিল। এছাড়া তক্ষশীলায়ও বহু সংখ্যক মঠ, বিহার ও স্তূপের বেশীর ভাগই নগর প্রতিরক্ষা প্রাচীরের বাইরে নির্মাণ করা হত।

আমরা আগের পর্বে দেখেছি যে, আদি হরপ্পান ও হরপ্পানরা তাদের বসতির চারপাশে প্রাচীর নির্মাণ করত। এমনকি এর বাইরে দক্ষিণ রাজস্থানে বালাথল ও গিলুন্দের মত কিছু আহর সংস্কৃতির গ্রামীণ বসতিতে সীমানা প্রাচীর দেখা গেছে। প্রাচীর তৈরীর এই ধারাবাহিকতা আদি ঐতিহাসিক যুগ পর্যন্ত টিকে ছিল। এটি একটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় যে, হরপ্পান ও আদি ঐতিহাসিক মানুষজন প্রায় ক্ষেত্রে নগরদুর্গ, সীমানা দেওয়াল বা দুর্গ নির্মাণ করত সমগ্র বসতিটিকে পরিবেষ্টন ও রক্ষা করার জন্য। কিন্তু মধ্য যুগে এসে এই মহৎ ঐতিহ্য আর দেখা যায় নাই। তখন দুর্গ তৈরী করা হত শুধুমাত্র রাজা ও রাজপরিবারকে রক্ষা করার জন্য। এছাড়াও মধ্যযুগের দুর্গগুলি কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ স্থানে তৈরী করা হত।

------------------------------------

দেখুনঃ J.S. Kharakwal, D.P. Agrawal and Diwa Bhatt, The Archaeology of Banasur Fort, Lohaghat, in, Purātattva, No. 34: 2003-2004, 2004, p. 160.

দেখুনঃ প্রাগুক্ত নিবন্ধ, পৃঃ ১৬০।

------------------------------------

ওড়িশার আদি ঐতিহাসিক যুগের নগর শিশুপালগড় এই উপমহাদেশে সবচেয়ে সুষমভাবে পরিকল্পিত নগরগুলির মধ্যে একটি ছিল। কেল্লা সহ এর চারিপাশে প্রাচীর ঘেরা ছিল। এই ধরনের কেল্লা অন্যান্য আদি ঐতিহাসিক নগর যেমন আদম, আত্রাঞ্জিখের, বালিরাজগড়, শ্রাবস্তি, তিলৌরা-কোট, ও অন্যান্য বসতিতে ছিল। শিশুপালগড় নগরটির কেন্দ্রে বেশ কিছু সংখ্যক স্তম্ভ দেখা যায়, যা ধনুকাকৃতির কাঠামোর সাথে সম্পর্কিত বলে মনে করা হয়। এখানে একটি চৈত্য ভবন থাকতে পারে বলে মনে করা হয়।

------------------------------------

দেখুনঃ Monica L. Smith, The Role of Professionals in Daily Life and Ritual Life: An Archaeological View from the Early Historic Era of Urbanism, in, Purātattva, No. 42, 2012, pp. 5-8.

------------------------------------

উত্তর প্রদেশের সিদ্ধার্থ নগর জেলায় পিপরাহওয়া ও গনওয়ারিয়া নামে দু’টি প্রত্নস্থলকে গৌতম বুদ্ধের জন্মস্থান কপিলাবস্তু হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। এটি শাক্যদের রাজধানী ছিল। পিপরাহওয়ায় পাওয়া একটি স্তূপকে শাক্যদের নির্মাণ করা স্তূপ বলে মনে করা হয়। বৌদ্ধ সাহিত্য মতে কুশিনারায় বুদ্ধকে দাহ করার পর তাঁর দেহাবশেষ থেকে একটি অংশ গনওয়ারিয়ায় রাখা হয়। পিপরাহওয়ায় একটি বড় স্তূপ ও তার পূর্ব, উত্তর, দক্ষিণ ও পশ্চিমে চারটি মঠের অবশেষ ছড়ানো আছে। এখানকার স্তূপের কাঠামোগত পর্যায় চিহ্নিত করা গেছে ও দেখা গেছে যে স্তূপের প্রথম পর্বটি উত্তরাঞ্চলীয় কাল মসৃণ মৃৎপাত্রের সময়কার প্রায় খ্রীঃপূঃ ৫ম-৪র্থ শতাব্দীর। আদি স্তূপটি কাঁচা মাটির তৈরী ছিল, কেবল বুদ্ধের দেহাবশেষ রাখার কক্ষটি পোড়া মাটির ইটের তৈরী ছিল। দ্বিতীয় কাঠামোগত পর্যায়ে স্তূপ ও মঠ নির্মাণে প্রচুর পোড়া মাটির ইট ব্যবহার হয়েছিল। এই প্রত্নস্থলটি খ্রীষ্টীয় ৪র্থ শতাব্দীর শুরু বা খ্রীষ্টীয় ৩য় শতাব্দীর শেষ চতুর্থাংশে বিপর্যয়কর আগুন লাগার পর পরিত্যক্ত হয়।

------------------------------------

দেখুনঃ B.R. Mani and Praveen Kumar Mishra, Further Excavations (2012-13) at Piprahwa, Ganwaria and Tola Salargarh, District Siddharth Nagar, Uttar Pradesh, in, Purātattva, No. 43, 2013, pp. 141-142.

  দেখুনঃ প্রাগুক্ত নিবন্ধ, পৃঃ ১৪২.

------------------------------------

উত্তর প্রদেশের অহিচ্ছত্রে গিরিমাটি রঙের মৃৎপাত্র (OCP) পর্ব, প্রাক-চিত্রিত রঙিন মৃৎপাত্র পর্ব, আদি চিত্রিত রঙিন মৃৎপাত্র পর্ব, উত্তর চিত্রিত রঙিন মৃৎপাত্র পর্ব (৮০০- ৩০০ খ্রীঃপূঃ), মিত্র-পঞ্চাল পর্ব (৩০০খ্রীঃপূঃ- ৩০০ খ্রীষ্টাব্দ), গুপ্ত পর্ব (৩০০ খ্রীষ্টাব্দ- ৫৫০ খ্রীষ্টাব্দ), গুপ্ত-পরবর্তী পর্ব (৫৫০-৮৫০ খ্রীষ্টাব্দ) ও আদি মধ্য যুগের (৮৫০-১২০০ খ্রীষ্টাব্দ) বসতি পাওয়া গেছে।  এখানে মিত্র-পঞ্চাল পর্বে (Trench ACT II) অনেক কুয়ার শ্রেণী দেখতে পাওয়া যায়।

------------------------------------

দেখুনঃ Bhuvan Vikrama and Elora Tribedy, Investigating Activities and Spatial Use at Early Historic Site Ahichchhatra, Uttar Pradesh: An Ethno-Archaeological Approach, (Notes and News), in, Purātattva, No. 46, 2016, p. 203.

দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ২০৫-২০৬।

------------------------------------

প্রাচীন ভারতবর্ষে লোহার নানা ধরনের যন্ত্রপাতি ব্যবহারের ফলে কারিগরী শিল্পে যেমন সুবিধা হল তেমন কৃষিতেও হল। লোহার লাঙ্গলের ফলা ব্যবহারের ফলে অনেক জমি কৃষির অধীনে এল। মধ্য ভারত, পশ্চিম ভারত ও দাক্ষিণাত্যের কাল শক্ত মাটি যা আগের তাম্রযুগের কৃষকরা ঠিকমত চাষ করতে পারত না, তা কৃষির অধীনে এল।  এভাবে অনেক নূতন এলাকা চাষাবাদের অধীনে এল ও জনসংখ্যা বাড়তে থাকে, ফলে নূতন গ্রাম ও শহরের সংখ্যাও বাড়তে থাকে। মৌর্য যুগে পাটলিপুত্র (বিহারে, বর্তমান পাটনা) এই অঞ্চলে সবচেয়ে বড় নগরে পরিণত হল। তখন এর জনসংখ্যা  ২,৭০,০০০ এবং নগরটির আয়তন ২২০০ হেক্টর হয়েছিল।

------------------------------------

  তখন সব জায়গায় কৃষিতে লোহার ব্যবহার শুরু হয়েছিল এমনটা সঠিক নয়। বহু জায়গায় তখনো কাঠের লাঙ্গলের ব্যবহার চালু ছিল। এবিষয়ে আলোচনার জন্য দেখুনঃ Mohammad Nazrul Bari and Mohamad Ajmal Shah, Iron and Second Urbanism in North India: A Myth or Reality, (Notes and News), in, Purātattva, No. 45, 2015, p. 275-278.

দেখুনঃ M.K. Dhavalikar, Cultural Ecology of Mauryan India, in, Purātattva, No. 31: 2000-2001, 2001, p. 89.

দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ৮৯।

------------------------------------

ললিতগিরি মহাস্তূপ (সৌজন্যেঃ Sunil Kumar Patnaik, 2019)

পাতা :১৪

দাক্ষিণাত্যে নব-প্রস্তর ও তাম্র যুগে উপকূলব্যাপী, যেখানে প্রচুর বৃষ্টিপাত হত সেখানে মানুষজনকে বসতি স্থাপন করতে দেখা যায় নাই। কিন্তু আদি ঐতিহাসিক যুগে এই সব অঞ্চলে অনেক শহর ও গ্রাম গড়ে উঠে। সেই সময়ে সোপারা (প্রাচীন সুপরকা) সবচেয়ে বড় বন্দর হিসাবে আবিভর্‚ত হয়েছিল। এছাড়া কর্ণাটকে বানভাসি (প্রাচীন বৈজয়ন্তি) ও অন্ধ্রপ্রদেশে কোন্ডাপুর সমৃদ্ধিশালী বাণিজ্যকেন্দ্র হিসাবে বিকাশ লাভ করে। উত্তর ও মধ্য ভারতেও বসতির বিস্তার খুব দ্রুত ঘটতে থাকে। চিত্রিত ধূসর মৃৎপাত্রের যুগে (প্রায় ১০০০ - ৬০০ খ্রীঃপূঃ) বসতির সংখ্যা ছিল প্রায় ৪০০, আর উত্তরাঞ্চলীয় কাল মসৃণ মৃৎপাত্রের যুগে (৬০০ খ্রীঃপূঃ - ২০০ খ্রীঃপূঃ) বসতির সংখ্যা বেড়ে দুই হাজারের উপরে হয়ে যায়।

------------------------------------

  দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ৮৯।

------------------------------------

বিহারে জুয়াফারদিহ্তে খনন করে দেখা গেছে যে, সর্বপ্রথম কাঁচা মাটির স্তূপ তৈরী করা হয় খ্রীঃপূঃ প্রায় ৫ম শতাব্দীর দিকে। এটির সর্বাধিক ব্যাস ৯.৮০ মিটার ও সর্বাধিক উচ্চতা ০.৯৭ মিটার। এটি এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত সবচেয়ে প্রাচীন বৌদ্ধ স্তূপ। এর পর আরো দু’টি পর্যায়ের স্তূপ পাওয়া গেছে, যেগুলি আকারে বড়। এই তিনটি স্তূপের নির্মাণের সময় পাওয়া গেছে প্রায় ৬০০-৪০০ খ্রীঃপূঃ। আগে মনে করা হত যে, ৪০০ খ্রীঃপূঃ-এ পিপড়াওয়াহর মাটির তৈরী স্তূপটি সবচেয়ে প্রাচীন। যদিও বিভিন্ন সাহিত্য থেকে মনে করার যুক্তিসংগত কারণ ছিল যে, স্তূপ নির্মাণ প্রাক-বৌদ্ধ যুগ থেকে প্রচলিত ছিল। এটি এখন প্রত্নতাত্ত্বিকভাবে প্রমাণিত হল।

------------------------------------

দেখুনঃ S.C. Saran, N.G. Nikoshey, S. Nayan, J.K. Tiwari, A. Arif and N. Saxena, Excavations at Juafardih and its identification with Kulika, in, Purātattva, No. 38, 2008, pp. 68-72.

দেখুনঃ S.C. Saran, N.G. Nikoshey, S. Nayan, J.K. Tiwari, A. Arif and N. Saxena, Excavations at Juafardih and its identification with Kulika, in, Purātattva, No. 38, 2008, pp. 68-72.

দেখুনঃ Bhaskar Deotare, Gurudas Shete, Reshmasawant Vaishali Kathale and Satish Naik, Discovery of Structural Stupa at Bhon District, Maharashtra, in, Purātattva, No. 37, 2007, p. 177.

  বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের শুরুরও আগে ভারতবর্ষে চৈত্য ও স্ত‚প নির্মাণের প্রচলন ছিল। এই বিষয়ে বিবরণ পাওয়া যায় শ্রীলংকার লেখক S. Paranavitana -এর লেখা The Stūpa in Ceylon গ্রন্থে। তিনি বলেন,, ‘Though the stūpa is best known as the centre of a popular Buddhist cult, it was not an invention of the Buddhists. The oldest canonical writings of the Buddhists contain references to the existence, in the life time of the Great Teacher, of shrines designated by the term caitya (P. cetiya), which is well known as a synonym of stūpa. Caitya does not exclusively mean a stūpa, and the references in the Buddhist books make it clear that some of the pre-Buddhist cityas were sacred trees used for worship. Some, however, of these caityas were undoubtedly stūpas. … …

Indian tradition knew of a number of universal (cakravartin) monarchs who, it was believed, lived a long time before the advent of the Buddha, and some of the caityas which existed before the rise of Buddhism were possibly built over the remains of these monarchs who, though called universal, must actually have ruled over a portion of Northern India. Jainism, a religion founded by an older contemporary of the Buddha, had, in early times, its own stūpas which, from an architectural point of view, did not differ much from the Buddhist stūpas of the same age. Actual remains of pre-Buddhist stūpas have been found at some places in North India; and it is, therefore, clear that both the Buddhists as well as the Jainas adopted the stupa from earlier cults and gave it a new significance in keeping with the tenets of their - respective religions.’ দেখুনঃ S. Paranavitana, The Stūpa in Ceylon, printed at the Ceylon Government Press, Colombo, 1946, reprinted 1988, pp. 2-3.

------------------------------------

লংগুড়ি মহাস্তূপ (সৌজন্যেঃ Sunil Kumar Patnaik, 2019)

ওড়িশা উপকূলবর্তী এলাকায় জরিপ চালিয়ে ২০টি আদি ঐতিহাসিক বৌদ্ধ বসতি ও প্রায় ৫০টি ঐতিহাসিক বসতি চিহ্নিত করা হয়েছে। সাম্প্রতিক জরিপে দয়া নদীর উপত্যকায় উভয় পাশে শিশুপালগড়, ধৌলি, কুরকিমুন্ডিয়া, লবণগিরি ও আরাগড় পাহাড়ে বৌদ্ধ কাঠামো বিশেষভাবে স্তূপের বিকাশ দেখতে পাওয়া যায়।  অশোক পরবর্তী কালে অনেক বৌদ্ধ প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিল, বিশেষভাবে ললিতগিরি, ধৌলি, জুয়াগড় ও আরাগড়ে। ওড়িশা বৌদ্ধ ধর্মের বড় ধরনের সম্প্রসারণ হয়েছিল খ্রীষ্টীয় ৫ম-১৩শ শতাব্দীতে। এই সময়ে জয়পুর জেলার পর্বতশ্রেণীতে  বিস্ময়কর প্রকাণ্ড মঠ নির্মাণ করা হয়েছিল।

------------------------------------

দেখুনঃ Sunil Kumar Patnaik, Excavations at Aragarh (2014-16): An Early Historic Buddhist Site, (Notes and News), in, Purātattva. No. 46, 2016, p. 223.

দেখুনঃ Himanshu Prabha Ray, The Archaeology of Sacred Spaces in India: From Multi-Religious Sites to Monuments, in, Purātattva, No. 44, 2014, p. 6.

------------------------------------

উত্তর প্রদেশে মধ্য গঙ্গা সমভূমিতে পাক্কাকোটের কথা আগে বলা হয়েছে। সাম্প্রতিক খননে নবপ্রস্তর যুগ থেকে মধ্য যুগ পর্যন্ত বসতির প্রমাণ পাওয়া যায়। এখানে প্রায় দেড় কিলোমিটার ব্যাপী ছড়ানো ৪টি ঢিবিতে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক পর্যায় পাওয়া গেছে।  পাক্কাকোটে নগরায়ন শুরু হয় পর্ব ৩-বি-এর সময়ে (৬০০ - ৪৫০ খ্রীঃপূঃ)। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য কেন্দ্র ছিল। এখানকার নগরায়নের সাথে বৌদ্ধ ধর্মের সম্পর্ক ছিল বলে মনে করা হয়। এখানে বৌদ্ধ চৈত্য ও মঠ পাওয়া গেছে, যেখানে প্রতি সারিতে ৬টি করে দুই সারিতে মোট ১২টি কক্ষ ছিল। মঠের এই ভবনগুলি পরবর্তীকালে আদি মধ্য যুগের শেষের দিকে শৈব ধর্ম সম্প্রদায়ের দখলে চলে যায়।

------------------------------------

দেখুনঃ Sita Ram Dubey and Santosh Kumar Singh, Further Excavations at Pakkakot: 2014-15, in, Purātattva, No. 45, 2015, pp. 206-207.

  দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ২১০।

  দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ২০৬, ২১০।

------------------------------------  

আরাগড় স্তূপ (সৌজন্যেঃ Sunil Kumar Patnaik, 2019)

পাঞ্জাবের সমভূমিতে সংঘলে পাওয়া প্রধান স্তূপ (সৌজন্যেঃ Sandrine Gill, Himanshu Prabha Ray, 2015)

পাতা :১৫

উত্তর প্রদেশের মাদার দিহ্ নামে একটি প্রত্নস্থলে উত্তরাঞ্চলীয় কাল মসৃণ মৃৎপাত্রের যুগ থেকে গুপ্ত ও গুপ্ত-উত্তর যুগ পর্যন্ত বসবাসের প্রমাণ পাওয়া গেছে। এখানে স্তূপের কাঠামো কুষাণ যুগের ছিল।  এই ধরনের কাঠামো উত্তর প্রদেশের সারনাথে ও উড়িষ্যার (ওড়িশা) উদয়গিরিতে দেখা গেছে।

------------------------------------

দেখুনঃ A.K. Dubey, Sachin Kumar Tiwary, Chandrashekhar and Kanhaiya Lal Yadav, Excavation at Madar Dih (Manarardih), Mungra Badashahpur, District Jaunpur, Uttar Pradesh, in, Purātattva, No. 43, 2013, pp. 173, 178-183.

------------------------------------

মহারাষ্ট্রের ভনে সবচেয়ে প্রাচীন স্তূপ পাওয়া গেছে খ্রীঃপূঃ ৩য় শতাব্দীতে। মহারাষ্ট্রে এর পরের স্তূপগুলি পৌনি, মনসার, তের সোপারা ও আদমে অবস্থিত। ভনের স্তূপটি কাঠামোগতভাবে ও কারিগরী দিক দিয়ে মধ্য প্রদেশের কসরাভাদ ও নাভাদাতোলির সাথে মিলে। ভন থেকে পাওয়া প্রত্নতাত্ত্বিক সাক্ষ্য থেকে বুঝা যায় যে, এই বসতিটি প্রাক-সাতবাহন যুগের একটি সমৃদ্ধিশালী বসতি ছিল, যেখানে বিভিন্ন ধরনের শিল্প গড়ে উঠেছিল। এটি প্রাচীন বাণিজ্য পথের মধ্যে থেকে আঞ্চলিক বাণিজ্য কেন্দ্র হিসাবে গড়ে উঠেছিল।

------------------------------------

দেখুনঃ Bhaskar Deotare, Gurudas Shete, Reshmasawant Vaishali Kathale and Satish Naik, Discovery of Structural Stupa at Bhon District, Maharashtra, in, Purātattva, No. 37, 2007, pp. 177-184.

------------------------------------

মহারাষ্ট্রের ঔরঙ্গাবাদে আদি ঐতিহাসিক যুগের কিছু বৌদ্ধ গুহা আছে। এছাড়া মহারাষ্ট্রের পিটালখোরায়ও বৌদ্ধ গুহা আছে।

------------------------------------

দেখুনঃ Ajit Kumar and M. Mahadevaiah, Early Historic Artifacts from Paal, District Aurangabad, Maharashtra, (Notes and News), in, Purātattva, No. 45, 2015, pp. 300-301.

------------------------------------

সারনাথ একটি গুরুত্বপূর্ণ বৌদ্ধ তীর্থস্থান হিসাবে পরিচিত। সাম্প্রতিক খননে এখানে প্রাক-মৌর্য  বসতি পাওয়া গেছে যা রেডিওকার্বন পরীক্ষায় ৩৮৫ খ্রীঃপূঃ-এর বলে জানা গেছে এবং এখানে ৪র্থ শতাব্দী থেকে খ্রীষ্টীয় ৬ষ্ঠ শতাব্দী পর্যন্ত বসতির ধারাবাহিকতা ছিল।  এখানে মূলগন্ধাকুটি মন্দির, ধর্মরাজিকা স্তূপ ও ধনুকাকৃতি চৈত্য আছে। এখানকার প্রত্নতাত্ত্বিক সাক্ষ্য থেকে জানা যাচ্ছে যে, সারনাথের বসতিতে শিল্প উৎপাদন ও কারখানা ছিল যা খ্রীষ্টীয় ১২শ শতাব্দী পর্যন্ত ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছিল।

------------------------------------

মৌর্য যুগের শুরু ৩২২ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে।

দেখুনঃ B.R. Mani, Sachin Kr. Tiwary and S. Krishnamurthy, Evidence of Stone Sculpturing Workshop at Sarnath in the Light of Recent Archaeological Investigations, in, Purātattva, No. 45, 2015, pp. 197-203.

------------------------------------

ছত্তিসগড়ের ডমরু নামে একটি বসতিতে মৌর্য যুগ (৩২২-১৮৫ খ্রীঃপূঃ) থেকে উত্তর মধ্য যুগ পর্যন্ত ধারাবাহিক বসবাসের প্রমাণ পাওয়া গেছে। এখানে পাওয়া গেছে পর্ব-১:  মৌর্য যুগ (উত্তরাঞ্চলীয় মসৃণ মৃৎপাত্র), পর্ব-২: শুঙ্গ - কুষাণ যুগ, পর্ব-৩: মঘস (Maghas) - সাতবাহন যুগ, পর্ব-৪: গুপ্ত যুগ ও পর্ব-৫: পরবর্তী গুপ্ত পর্ব/ শরভপুরিয়া/ পাণ্ডুবংশিয়া/ কালাচুরি। এখানে উত্তরাঞ্চলীয় কাল মসৃণ মৃৎপাত্র যুগে (৬০০ খ্রীঃপূঃ - ২০০ খ্রীঃপূঃ) বৌদ্ধ ধর্মের প্রথম দিককার কেন্দ্র ছিল।  এখানে খনন করে ১৬টি বৃত্তাকার পাথরের কাঠামো পাওয়া গেছে। কাছাকাছি বিখ্যাত দু’টি বৌদ্ধ বসতি সিরপুর ও মালহার থাকাতে মনে করা হচ্ছে এগুলি নৈবেদ্যের জন্য নির্মিত স্তূপ। এই কাঠামোগুলি ১ম-৫ম খ্রীষ্টাব্দ-এর। এছাড়াও উৎকীর্ণ বুদ্ধপদ পাওয়া গেছে যেগুলিকে খ্রীষ্টীয় ২য়-৩য় শতাব্দীর বলে ধরা হয়।  এখানে একটি কুষাণ যুগের তামার মুদ্রায় দেখা যাচ্ছে যে, কুষাণ রাজা কণিষ্ক (সিংহাসন আরোহণ করেন ৭৮ খ্রীষ্টাব্দে) আগুনের সামনে দাঁড়িয়ে দেবতার উদ্দেশে নৈবেদ্য দিচ্ছেন। প্রথম দিককার স্তূপ ও অন্যান্য বৌদ্ধ অবশেষ থেকে ধারণা করা হচ্ছে যে ডমরু মালহারের আগে দক্ষিণ কোশলে হীনযান বৌদ্ধ ধর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র ছিল।

------------------------------------

দেখুনঃ Shivakant Bajpai, Rahul Kumar Singh, Vrassottam Sahoo and Jeetendra Sahoo, Further Excavation at Damroo, District Balodabazar-Bhatapara, Chhittisgarh (2014-15), (Notes and News), in, Purātattva, No. 46, 2016, pp. 217-218.

  দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ২২০।

------------------------------------

সাম্প্রতিক জরিপ থেকে প্রমাণিত হয়েছে যে, আফগানিস্তানের বল্খ্ ও বামিয়ান থেকে বাণিজ্য পথ যেখানে সিল্ক রুট উত্তর ভারত হয়ে গঙ্গা উপত্যকায় তাম্রলিপ্তিতে (তমলুক) সংযুক্ত ছিল ও তারপর ওড়িশার বৌদ্ধ বসতিগুলি যেমন লংগুড়ি, রাধানগর, ললিতগিরি, ধৌলি, আরাগড়, জৌগড় ও দক্ষিণ ভারতের বৌদ্ধ বসতিগুলি যেমন কলিঙ্গপটনম, সালিহুনদাম, শংকরাম, তথালকোণ্ডা বভিকোণ্ডা, নাগার্জুনকোণ্ডা ও কাবেরিপট্টনমের সাথে সংযুক্ত ছিল। প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখননে প্রমাণ হয়েছে যে, ওড়িশায় মৌর্য যুগ থেকে যথেষ্ট সংখ্যক বৌদ্ধ বসতি ছিল এবং উত্তর ও দক্ষিণ ভারতে ধীর প্রক্রিয়ায় বৌদ্ধ ধর্ম ছড়িয়ে পড়ে। আদি ঐতিহাসিক যুগের (২য় খ্রীঃপূঃ - ৩য় খ্রীষ্টাব্দ) এই নূতন আবিষ্কার ভারতবর্ষে সভ্যতা বিকাশের ক্ষেত্রে নূতন দৃষ্টিভঙ্গির সূচনা করছে।

------------------------------------

দেখুনঃ Sunil Kumar Patnaik, Excavations at Aragarh (2014-16): An Early Historic Buddhist Site, (Notes and News), in, Purātattva. No. 46, 2016, p. 223.

------------------------------------

সবচেয়ে প্রাচীন বৌদ্ধ পাহাড় কাটা গুহা দেখা যায় খ্রীঃপূঃ ৩য় শতাব্দীতে বিহারে বোধগয়া থেকে ২৫ কিলোমিটার উত্তরে বরাবর পাহাড়ে। এগুলি অশোক ও তার প্রপৌত্র দশরথের রাজত্বকালে নির্মাণ করা হয়। এই গুহাগুলি বৌদ্ধ ও আজীবিক সন্ন্যাসীদের থাকার জন্য তৈরী করা হয়েছিল। পাহাড় কাটা গুহাগুলি প্রাথমিকভাবে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের বর্ষাকালের তিন মাস থাকার জন্য তৈরী করা হয়েছিল, যাকে বর্ষাবাস বলা হত। প্রার্থনা কক্ষগুলি অর্ধবৃত্তাকার নকশায় ধনুকাকৃতির ছাদ দিয়ে তৈরী করা হয়েছিল।

------------------------------------

দেখুনঃ B.R. Mani, Dazu Grottoes and Indian Rock-Cut Sculptures: A Comparative Survey, in, Purātattva, No. 42, 2012, p. 44.

------------------------------------

মৌর্য যুগে (৩২২ - ১৮৪ খ্রীঃপূঃ) ভারতবর্ষে পাহাড় কেটে স্থাপত্য নির্মাণের ঐতিহ্যের সূচনা হয়। গয়ার কাছে বিহারে নাগার্জুনি পাহাড় ও বরাবর পাহাড়ে আজীবিকদের জন্য সবচেয়ে প্রথম গুহা কাটা হয়।  এখানে একটি উৎকীর্ণ লিপি থেকে জানা যায় যে, এগুলি অশোকের প্রপৌত্র দশরথের সময়ে কাটা হয়েছিল। যা মৌর্য পরবর্তী যুগে ওড়িশা ও পশ্চিম মহারাষ্ট্র অঞ্চলে উদয়গিরি ও খণ্ডগিরি পাহাড়ে শুরু হয়। ওড়িশার পাহাড় কাটা গুহাগুলি খারবেল রাজত্বের সময়কার ও সেগুলি জৈনদের জন্য উৎসর্গ করা হয়েছিল। পশ্চিম মহারাষ্ট্রের প্রথম দিককার পাহাড় কাটা গুহাগুলি সাতবাহন শাসকদের সময়ে (খ্রীঃপূঃ প্রথম শতকের দ্বিতীয়ার্ধ - ২২৫ খ্রীষ্টাব্দ) তৈরী করা হয়েছিল ও সেগুলি বৌদ্ধদের জন্য উৎসর্গ করা হয়েছিল।

------------------------------------

দেখুনঃ Ajit Kumar, Buddhist Caves of Western Maharashtra with Specific Reference to Early Sculptural Art, in, Purātattva, No. 46, 2016, p. 54.

  খারবেল খ্রীষ্টপূর্ব প্রথম শতকের দ্বিতীয়ার্ধে সিংহাসনে আরোহণ করেন।

  দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ৫৪।

------------------------------------

চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য (৩২৪ - ৩০০ খ্রীঃপূঃ) তাঁর রাজত্বের শেষের দিকে জৈন ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন বলে কথিত আছে। এই সময়ে বার বৎসর ব্যাপী এক তীব্র খরা হয়েছিল। তিনি জৈন সন্ন্যাসী ভদ্রবাহুর সাথে কর্ণাটকের শ্রাবণবেলগোলা যান ও সেখানে তিনি জৈন পদ্ধতিতে ধীরে অনশনের মধ্য দিয়ে স্বেচ্ছামৃত্যু বরণ করেন। প্রমাণ আছে যে, তাঁর পুত্র বিন্দুসার আজীবিকদের পৃষ্টপোষকতা করতেন।

------------------------------------

দেখুনঃ M.K. Dhavalikar, Cultural Ecology of Mauryan India, in, Purātattva, No. 31: 2000-2001, 2001, p. 89.

দেখুনঃ Romila Thapar, Aśokan India and the Gupta Age, in, A Cultural History of India, ed., A.L. Basham, Oxford University Press, New Delhi, 1975, p. 41.

------------------------------------

পাতা :১৬

সর্বাধিক বিস্তারের সময়ে মৌর্য সাম্রাজ্য (সূত্রঃ https://en.wikipedia.org/wiki/Maurya_Empire#/mediaFile:Maurya_Empire,_c.250_BCE_2.png)

সম্প্রতি অন্ধ্রপ্রদেশে ভদ্দমানায় একটি স্তম্ভে একটি উৎকীর্ণ লিপি ও কিছু জৈন স্তূপের নিদর্শন পাওয়া গেছে। এখান থেকে মনে করা হয় যে, দক্ষিণ ভারতে বৌদ্ধ ধর্ম প্রবেশের আগেই জৈন ধর্ম প্রবেশ করেছিল।

------------------------------------

দেখুনঃ M.K. Dhavalikar, Cultural Ecology of Mauryan India, in, Purātattva, No. 31: 2000-2001, 2001, pp. 89-90.

------------------------------------

অশোকের কিছু অনুশাসন পাওয়া গেছে সন্নাতিতে, যা একটি গুরুত্বপূর্ণ ও সমৃদ্ধ বৌদ্ধ বসতি ছিল। মৌর্য যুগের পর সাতবাহন যুগেও কর্ণাটকের সন্নাতিতে বৌদ্ধ স্মারক পাওয়া গেছে।

------------------------------------

দেখুনঃ A. Sundara, The Traditional date of Asoka Maurya: Archaeological Evidences – A Consideration, in, Purātattva, No. 31: 2000-2001, 2001, p. 99-100.

------------------------------------

বৌদ্ধ মঠ, ললিতগিরি (সৌজন্যেঃ Sunil Kumar Patnaik, 2019)

অশোকের সময়ে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা সমগ্র ভারতবর্ষব্যাপী মঠ নির্মাণ করেছিলেন। এই মঠগুলি নগর বা শহরের কাছে অবস্থিত ছিল ও বেশীরভাগ ছিল নদীতীরবর্তী অথবা পাহাড়ের ঢালুতে। এগুলি রাষ্ট্রের ও জনগণের সমর্থন ও পৃষ্টপোষকতার উপর টিকে ছিল।  বৌদ্ধ গ্রন্থগুলিতে মঠ তৈরীতে শ্রেষ্ঠী বা বণিকদের সহযোগিতার কথা বলা আছে।

------------------------------------

দেখুনঃ Sunil Kumar Patnaik, Buddhist Monuments in South-Eastern India: A Study of Forms and Patronage, in, International Review of Social Research 2019; 9(1), p. 40.

------------------------------------

ভারতবর্ষে গ্রীকদের পরে যে যাযাবর আক্রমণকারীরা অনুপ্রবেশ করে তারা হল শক জনগোষ্ঠী। এই আক্রমণকারীরা প্রধানত তিনটি বড় গোত্রে এসেছিল, তারা হল মাসাজেটি (Massagetae), সাকারৌকে (Sacaraucae) ও দাহি (Dahae)। খ্রীঃপূঃ দ্বিতীয় শতাব্দীতে তাদের বাসস্থান ছিল কাসপিয়ান সাগর ও জাক্সার্টেস (Jaxartes) নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলে। তারা পাঞ্জাব ও তক্ষশীলা অধিকার করে। শকরা ভারতবর্ষে স্থিতিশীল হবার পরে বৌদ্ধ, জৈন ও ব্রাহ্মণ্য সকল ধর্মের প্রতি সহনশীল ও সহানুভূতিশীল ছিল। তবে সম্ভবত রাজনৈতিক সুবিধার কারণে তারা বিশেষভাবে বৌদ্ধ ধর্মকে পৃষ্টপোষকতা ও উৎসাহ দান করত, যা পাঞ্জাব ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে তাদের অনেকের দ্বারা স্বীকৃত হয়েছে।

------------------------------------

দেখুনঃ Sir John Marshall, A Guide to Taxila, 1960, p. 27.

------------------------------------

সস্প্রতি মথুরার কাছে যমুনা নদীর অপর পাড়ে বহু সংখ্যক বসতিতে (১০৫টি কুষাণ যুগের বসতি) প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান চালিয়ে কুষাণ ও পরবর্তী যুগের বেশ কিছু বসতিতে বৌদ্ধ ধর্মের দেব-দেবীর মূর্তি, মঠ, উন্মুক্ত মন্দিরের অবশেষ ও ব্রাহ্মণ্য ধর্মের মন্দিরের অবশেষ, মূর্তি, ইত্যাদি পাওয়া গেছে।

------------------------------------

দেখুনঃ Vinay Kumar Gupta, Archaeological explorations in Trans-Yamuna Region of Mathura, in, Purātattva, No. 43, 2013, pp. 216-231.

------------------------------------

পাতা : ১৭

কুষাণ যুগে কণিষ্ক কুষাণ সাম্রাজ্যের বিস্তার ঘটিয়েছিলেন আমু দরিয়ার অপর পার থেকে গঙ্গা উপত্যকা পর্যন্ত, সম্ভবত বিহার ও পূর্ব মালওয়া ও আশেপাশের অঞ্চল জুড়ে। এছাড়াও তাঁর নিয়ন্ত্রণে ছিল কাশগড়, ইয়ারখন্দ ও খোটান সহ চীনা তুর্কিস্তান। কণিষ্ক বৌদ্ধ ধর্মের বড় ধরনের সমর্থক ছিলেন। তবে তাঁর মুদ্রায় বৌদ্ধ, ইরানীয়, গ্রীক বা গ্রীক প্রভাবিত এবং হিন্দু দেব-দেবীর ছবি উৎকীর্ণ থাকত। এই সময়ে বণিকদের পথ ধরে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা মধ্য এশিয়া জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিলেন।

------------------------------------

দেখুনঃ Dilip K. Chakrabarti, India: An Archaeological History – Palaeolithic Beginnings to Early Historic Foundations, 1999, p. 271-272.

------------------------------------

মহারাষ্ট্র অঞ্চলে এক হাজারেরও বেশী পাহাড়-কাটা গুহা পাওয়া গেছে। এগুলিকে দু’টি সময়ানুক্রমিক ভাগে ভাগ করা যায়, প্রথম পর্যায় প্রায় ৩০ খ্রীঃপূঃ থেকে ২৩০ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত, ও পরবর্তী ভাগটি খ্রীষ্টীয় ৪র্থ থেকে ৭ম শতাব্দী পর্যন্ত। প্রথম পর্যায় সাতবাহন ও পশ্চিমের ক্ষত্রপ পর্বের সমসাময়িক এবং হীনযান বৌদ্ধধর্মের সাথে সংশ্লিষ্ট ও দ্বিতীয় পর্যায়টি গুপ্ত-বকাতক-চালুক্যের আদি পর্ব-রাষ্ট্রকূট পর্বের সমসাময়িক ও মহাযান বৌদ্ধধর্মের সাথে সংশ্লিষ্ট। প্রকারভেদ অনুসারে এই গুহাগুলির মধ্যে চৈত্য কক্ষ ও বিহার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। মহাযান বৌদ্ধ ধর্মের সময়ে অজন্তা ও ইলোরার ধনুকাকৃতির চৈত্য কক্ষ নির্মাণের আরো আগের চৈত্য কক্ষ নির্মাণের ধারাবাহিকতা ছিল।

------------------------------------

দেখুনঃ Ajit Kumar, Buddhist Caves of Western Maharashtra with Specific Reference to Early Sculptural Art, in, Purātattva, No. 46, 2016, p. 54.

  দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ৫৫।

------------------------------------

বৌদ্ধ মঠ, উদয়গিরি (সৌজন্যেঃ Sunil Kumar Patnaik, 2019)

সাতবাহন যুগে মহারাষ্ট্রে বৌদ্ধদের অনেক পাহাড় কাটা গুহা ও কিছু বসবাসের বসতি পাওয়া গেছে। পশ্চিম মহারাষ্ট্রে এই সমস্ত পাহাড় কাটা গুহার অনেকগুলিকেই বাণিজ্য পথের সাথে সংযুক্ত থাকতে দেখা গেছে। মহারাষ্ট্রের শিরওয়ালে ১৫টি হীনযান বৌদ্ধ ধর্মের গুহা পাওয়া গেছে। এগুলির একটি গুহা কেটে তৈরী করা চৈত্য খ্রীষ্টীয় ২য় শতাব্দীর বলে জানা গেছে। এই গুহাগুলির কাছে শিরওয়ান বসতিটিতে ব্যবসায়ী ও বণিকদের বসতি থাকা সম্ভব বলে মনে করা হয় যারা এই চৈত্য গুহা দান করেছিল।

------------------------------------

দেখুনঃ P.P. Joglekar, Sushama G. Deo, S.N. Rajaguru, Riza Abbas and Savita N. Ghate, A Preliminary Report on the Early Historic Site at Shirwal in Satara District, Maharashtra, in, Purātattva, No. 34: 2003-2004, 2004, p. 127.

  দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ১৩০-১৩১।

------------------------------------

গৌতম বুদ্ধের ভাস্কর্য তৈরী শুরু হয় মহাযান বৌদ্ধ ধর্ম বিকাশের সাথে খ্রীষ্টীয় ৩য়-৪র্থ শতাব্দীর মধ্যে। এর পরে বজ্রযান বৌদ্ধ ধর্ম শুরু হয়। বুদ্ধের ভাস্কর্যের সাথে অন্যান্য আরো ছোটখাট বৌদ্ধ দেব-দেবীর মূর্তি মঠ ও মন্দিরের বিভিন্ন অংশে ও স্তূপের অর্ধবৃত্তাকার অংশে ও অর্ধবৃত্তাকার গুহার সামনে রাখা হত। এই ধরনের নির্মাণ খ্রীষ্টীয় ৯ম শতাব্দী পর্যন্ত চলেছিল। এর পর ব্রাহ্মণ্য ও জৈন দেব-দেবী ও মন্দির নির্মাণ প্রাধান্যে চলে আসে।

------------------------------------

দেখুনঃ B.R. Mani, Dazu Grottoes and Indian Rock-Cut Sculptures: A Comparative Survey, in, Purātattva, No. 42, 2012, p. 45.

------------------------------------

দেখা গেছে যে, কোনো নির্দিষ্ট সময়ে বৌদ্ধ স্থানগুলির মধ্যে শৈলীগত এক ধরনের মিল পাওয়া যায়। এটা সম্ভব হয়েছিল বৌদ্ধ শ্রমণ বা ভিক্ষু, পরিব্রাজক, বণিক ও শিল্পীরা এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় ভ্রমণ করত বলে। এই ধরনের ভ্রমণের কথা বিভিন্ন বৌদ্ধ স্থানগুলিতে প্রাপ্ত উৎকীর্ণ লিপিতে থেকে জানা যায়। এই ধরনের ভ্রমণের ফলে বিস্তীর্ণ অঞ্চলে সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রভাব পড়ে যা সমাজ জীবনের নানা ক্ষেত্রে প্রতিফলিত হয়।

------------------------------------

দেখুনঃ Ajit Kumar, Buddhist Caves of Western Maharashtra with Specific Reference to Early Sculptural Art, in, Purātattva, No. 46, 2016, p. 56.

------------------------------------

খ্রীষ্টপূর্ব প্রথম শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে চেদি রাজবংশের রাজা খারবেল (খ্রীঃপূঃ প্রথম শতকের দ্বিতীয়ার্ধে সিংহাসনে আরোহণ করেন) কলিঙ্গের সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনি জৈন ধর্মের অনুগামী ছিলেন। কুমারী পর্বত বা উদয়গিরি পাহাড়ে জৈন সন্ন্যাসীদের বসবাসের জন্য তিনি কিছু গুহা খনন করেন।

---------

  দেখুনঃ দিলীপকুমার গঙ্গোপাধ্যায়, ভারত-ইতিহাসের সন্ধানে, সাহিত্যলোক, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ ২০০০, তৃতীয় পরিবর্ধিত ও পরিমার্জিত নতুন সংস্করণ ২০১১, পৃঃ ৪০৫-৪০৮।

---------

ভারতের হরিয়ানায় বিভিন্ন স্থানে প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানে অনেক সংখ্যক বৌদ্ধ স্তূপ থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে, যেগুলির মধ্যে থনেসরে ব্রহ্মসরোবরের কাছে, ও সুঘ, চনেতি, অগ্রোহা, অসন্ধ, হাথিন, ভুনা, ভাদাস, অমিন, খোখারাকোট ও আদি বদরি উল্লেখযোগ্য। এগুলির বেশীরভাগই কুষাণ-শুঙ্গ যুগের (২০০ খ্রীঃপূঃ - ২০০ খ্রীষ্টাব্দ)।

------------------------------------

দেখুনঃ Arun Kesarwani & S.K. Vashist, Buddhist Stupas in Haryana: New Evidence, in, Purātattva, No. 33:2002-03, 2003, pp. 88-92.

------------------------------------

অন্ধ্রপ্রদেশের উত্তর উপকূলব্যাপী প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানে মৌর্য, সাতবাহন, ইক্ষাবকু ও বিষ্ণুকুণ্ডিন রাজত্বকালে খ্রীঃপূঃ ৩য় শতাব্দী থেকে খ্রীষ্টীয় ৭ম শতাব্দী পর্যন্ত বৌদ্ধ ঐতিহ্যের বসতি পাওয়া গেছে। এখানে প্রায় ১৪০টি বৌদ্ধ বসতি পাওয়া গেছে।

------------------------------------

 দেখুনঃ Jyoti Chandra, Buddhist Remains in District Visakhapatnam (Andhra Pradesh), (Notes and News), in, Purātattva, No. 33: 2002-03, 2003, p.134.

------------------------------------

পাতা : ১৮

ভারতের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলের আদি ঐতিহাসিক বসতিগুলি আকামেনীয়, সাসানীয় ও হিন্দু শাহি-দের রাজত্বে ছিল, যেগুলির বেশীরভাগই বসতি, বৌদ্ধ স্তূপ ও মঠ। বৌদ্ধ স্তূপ ও মঠগুলি সমভূমিতে ও পাহাড়ের ঢালুতে, ও উপত্যকার উপরে থাকত, যেগুলির মধ্য দিয়ে বাণিজ্য পথ অতিক্রম করে যেত। পেশোয়ার সমভূমিতে ১২২৮টি বহুস্তর বিশিষ্ট প্রত্নস্থল পাওয়া গেছে। এই অঞ্চলের উৎখননকৃত কিছু স্তূপ বিখ্যাত, যেমন, পেশোয়ার অঞ্চলে তখত্-ই-বাহি, শাহ্রি বাহ্লোল ও শাহ্জি-কি-ধেরি ও পোটওয়ার মালভূমিতে মনিকিয়ালা (Manikyala)।

------------------------------------

দেখুনঃ Dilip K. Chakrabarti, India: An Archaeological History – Palaeolithic Beginnings to Early Historic Foundations, 1999, p. 279.

  দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ২৭৯-২৮০।

------------------------------------

মহারাষ্ট্রের নাসিকে বেশ কিছু গুহা আছে যেগুলিকে গৌতমীপুত্র বিহার বলে। এগুলির মধ্যে হীনযান-বৌদ্ধ ধর্মের সময়ের (খ্রীঃপূঃ ১ম শতাব্দী - খ্রীষ্টীয় ৩য় শতাব্দী) সবচেয়ে অভিনব ও গুরুত্বপূর্ণ গুহা হল গুহা ৩। গুহা ৩-এ চৈত্য কক্ষ ও বিহার আছে। এটি ১২৪ থেকে ১৩০ খ্রীষ্টাব্দ-এর মধ্যে নির্মাণ করা হয়েছিল।

------------------------------------

দেখুনঃ Ajit Kumar, A Stylo-Chrono Appraisal of the Torana in Nasik Cave 3, (Notes and News), in, Purātattva, No. 41, 2011, pp. 191-196.

------------------------------------ 

পশ্চিম দাক্ষিণাত্যে বৌদ্ধ স্থাপত্যের সাক্ষ্য পাওয়া যায় খ্রীষ্টীয় প্রথম শতাব্দীতে। আর ৬ষ্ঠ থেকে ৭ম শতাব্দীতে সোপার, কল্যাণ ও বরুচের সমুদ্র বন্দরের সাথে ও মধ্য দেশে উজ্জয়িনের সমৃদ্ধিশালী বাণিজ্যপথের যোগাযোগের ফলে ইলোরা, ঔরঙ্গাবাদ ও কানহেরির মত বৌদ্ধ গুহাগুলির বিকাশ ঘটে।

------------------------------------

দেখুনঃ Sunil Kumar Patnaik, Buddhist Monuments in South-Eastern India: A Study of Forms and Patronage, in, International Review of Social Research 2019; 9(1), p. 38.

------------------------------------

কাশ্মীরের লাদাখে বেশ কিছু পাথরের গায়ে ও পাহাড়ের গুহায় অনেক চিত্র ও উৎকীর্ণ লিপি পাওয়া গেছে যেগুলি প্রাগৈতিহাসিক, আদি ঐতিহাসিক ও পরবর্তী ঐতিহাসিক বলে মনে করা হয়।  লাদাখে প্রথম ব্রাহ্মী ও খরোষ্ঠী উৎকীর্ণ লিপিসহ বৌদ্ধদের শিলায় খোদাই খ্রীষ্টীয় ২য় শতাব্দী থেকে শুরু হয়। এখানে পাথরের গায়ে পার্বত্য ছাগলের (Ibex) ছবির সাথে ধর্মীয় নৈবেদ্যের দৃশ্য সম্পর্কিত করা হয় ও মনে করা হচ্ছে যে খ্রীষ্টীয় যুগের শুরুর দিকে এখানকার যাযাবররা কুষাণদের প্রভাবে সামাজিক নিয়মে প্রবেশ করছিল। কুষাণরা বৌদ্ধ ধর্মপ্রচারকদের যেমন এখানে এনেছিল তেমন সিল্ক পথের বাণিজ্য কেন্দ্রগুলির সাথে বিনিময় ও একই সাথে বাণিজ্যকে উৎসাহিত করেছিল। এছাড়া লাদাখের যন্সকরে (Zanskar) সানি মঠে গোল গম্বুজবিশিষ্ট কনিষ্কের স্তূপ কুষাণদের উপস্থিতির প্রমাণ বহন করে। এছাড়াও সিন্ধু উপত্যকার উপরের অংশে অনুসন্ধান করে অনেক বৌদ্ধ স্তূপের চিহ্ন পাওয়ায় এই অঞ্চলে বৌদ্ধ ধর্মের ছড়িয়ে পড়ার বিষয়টি স্পষ্ট হয়। এছাড়া সমগ্র লাদাখে বৌদ্ধদের কাদা-মাটির ফলকে রঙিন ও খোদিত লিপি সহ সারদা লিপি পাওয়া গেছে। এগুলি খ্রীষ্টীয় ৮ম-১২শ শতাব্দীর বলে মনে করা হয়।

------------------------------------

দেখুনঃ B.R. Mani, Kushan Rock Art along the Indus from Leh to Batalik, in, Purātattva, No. 31: 2000-2001, 2001, p. 109.

দেখুনঃ B.R. Mani, Dazu Grottoes and Indian Rock-Cut Sculptures: A Comparative Survey, in, Purātattva, No. 42, 2012, p. 45.

দেখুনঃ B.R. Mani, Kushan Rock Art along the Indus from Leh to Batalik, in, Purātattva, No. 31: 2000-2001, 2001, pp. 109-110.

দেখুনঃ Laurianne Bruneau, A Preliminary Study of Rock Art of the Western Himalayas, in, Purātattva, No. 37, 2007, pp. 109-110.

দেখুনঃ Laurianne Bruneau, Influence of the Indian Cultural Area in Ladakh in the 1st Millennium AD: The Rock Inscription Evidence, in, Purātattva, No. 41, 2011, pp. 186-187.

------------------------------------  

হুনরা ভারতবর্ষে প্রবেশ করে বৌদ্ধদের বিপুল সংখ্যক মঠ ধ্বংস করে। পরবর্তীকালে তারা এখানে স্থিতিশীল হলে ধীরে ধীরে ভারতীয় ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়। হুন শাসক তোরমান শাহি (শাসনকাল প্রায় ৫০০-৫১৫ খ্রীষ্টাব্দ) সল্ট পর্বতে অবস্থিত একটি বৌদ্ধ মঠকে অনুদান প্রদান করেছিলেন বলে জানা যায়, যা এই ধরনের দানের একমাত্র সরাসরি সাক্ষ্য ছিল।  সাধারণভাবে হুনদের দ্বারা এই ধরনের পৃষ্টপোষকতা ছিল দুর্লভ। পরে তার পুত্র মিহিরকুল শৈব ধর্মের প্রতি উগ্র অনুগত হয়ে পড়েন।

------------------------------------

দেখুনঃ Ahmad Hasan Dani, The Historic City of Taxila, First Published 1986, Published by Sang-e-Meel Publications, Lahore, 1999, p. 6.

দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ৬।

------------------------------------

তামিল নাড়ুতে কোড়ুমনল (Kodumanal) নামে একটি বসতিতে উত্তরাঞ্চলীয় কাল মসৃণ মৃৎপাত্রের সাথে আরো কিছু সাংস্কৃতিক স্তর পাওয়া গেছে যেখান থেকে ব্রাহ্মী ও আঁচড় কাটা চিহ্ন যুক্ত মৃৎপাত্র ও ছাপাঙ্কিত মুদ্রা পাওয়া গেছে। এটি একটি আদি ঐতিহাসিক বসতি ও এখানে সর্বপ্রাচীন স্তর খ্রীঃপূঃ ৬ষ্ঠ শতাব্দীর বলে জানা যায়।

------------------------------------

দেখুনঃ K. Rajan, Early Writing System: Some issues and interpretations, in, Purātattva, No. 46, 2016, p. 143.

------------------------------------

লিপির উদ্ভবের সাক্ষ্য থেকে দেখা যায় যে, ভারতবর্ষে সিন্ধু সভ্যতার পরবর্তী কালের লিপির প্রাচীনত্ব প্রায় খ্রীঃপূঃ ৮ম/৭ম শতাব্দীতে যার সাথে গাঙ্গেয় উপত্যকায় উত্তরাঞ্চলীয় কাল মসৃণ মৃৎপাত্র সংস্কৃতির সূচনাকে মিলানো যায়।

------------------------------------

দেখুনঃ Dilip K. Chakrabarti, India: An Archaeological History – Palaeolithic Beginnings to Early Historic Foundations, 1999, p. 291.

------------------------------------

এই বিষয়টি স্বীকৃত যে, ব্রাহ্মী লিপি থেকে সকল ভারতীয় লিপির উদ্ভব হয়েছে। এই লিপি প্রথম দেখা যায় খ্রীঃপূঃ ৬ষ্ঠ শতাব্দীতে, এবং ভারতের বিভিন্ন জায়গায় খ্রীষ্টীয় ২য় - ৩য় শতাব্দী পর্যন্ত এর ধারাবাহিকতা ছিল।  ভারতে আদি ঐতিহাসিক যুগের সমস্ত ব্রাহ্মী লিপির ভাষা প্রাকৃত ছিল। কিন্তু তামিল নাড়ুতে লিপি একই থাকলেও ভাষা তামিল ছিল। উত্তর ভারতে অশোকের সমস্ত অনুশাসন আদি প্রাকৃত ভাষায় ছিল। সেগুলি প্রধানত পাথরে খোদিত হয়েছিল। ভারত জুড়ে আদি ঐতিহাসিক বা বৌদ্ধ স্থানগুলিতে খনন করে মৃৎপাত্রের গায়ে খোদিত ব্রাহ্মী লিপি তেমন পাওয়া যায় নাই।  অন্য দিকে তামিল-ব্রাহ্মী লিপি বিভিন্ন মাধ্যমে যেমন, পাথরে, ধাতুর জিনিসে ও মৃৎপাত্রে খোদিত হত। দক্ষিণ ভারতে তামিল-ব্রাহ্মী গুহা-লিপিগুলির বেশীরভাগই জৈন সাধুদের প্রতি উৎসর্গীকৃত ছিল।

------------------------------------

দেখুনঃ K. Rajan, Early Writing System: Some issues and interpretations, in, Purātattva, No. 46, 2016, p. 147.

দেখুনঃ K. Rajan, Early Writing System: Some issues and interpretations, in, Purātattva, No. 46, 2016, p. 147.

  দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ১৪৮।

------------------------------------

উজবেকিস্তানে আমুদরিয়া নদীর উত্তর পাড়ে কামপিরটেপা নামে একটি নগর বসতিতে ধ্বংসপ্রাপ্ত গ্যালারীর পুনর্নির্মিত দেওয়ালে খোদিত খরোষ্ঠী লিপি পাওয়া গেছে যার সময় ধরা হয়েছে খ্রীঃপূঃ ২য় শতাব্দীর প্রথম অংশ বা মধ্যভাগে।  কণিষ্ক ১-এর রাজত্বকালে এখানে বৌদ্ধ উপাসনার স্থান নির্মাণ করা হয়।

------------------------------------

দেখুনঃ E.V. Rtveladze, A Preliminary Report on the Discovery of Kharoshthi Inscriptions at the City-Site of Kampyrtepa (Uzbekistan), in, Purātattva, No. 38, 2008, pp. 127-134.

------------------------------------

পাতা : ১৯

দক্ষিণ বিহারে প্রত্যন্ত শৈলাশ্রয়ে (Rock shelter) সম্প্রতি খরোষ্ঠী, খরোষ্ঠী-ব্রাহ্মী, ব্রাহ্মী ও শংখ শিলালেখ পাওয়ায় এটিকে ভারতীয় ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার বলে মনে করা হচ্ছে। এগুলিকে খ্রীঃপূঃ ২য় শতাব্দী থেকে খ্রীষ্টীয় ৯ম শতাব্দীর মধ্যে ফেলা হয়েছে। এখানে খ্রীঃপূঃ ১ম শতাব্দীর খরোষ্ঠী লিপির প্রাপ্তি পূর্ব ভারতে পাওয়া সর্বপ্রাচীন খরোষ্ঠী লিপি।

------------------------------------

দেখুনঃ A.K. Prasad, Discovery of Kharoshti and Kharoshti-Brahmi Rock Inscriptions in the Chotanagpur Hills of Southern Bihar, in, Purātattva, No. 40, 2010, pp. 127, 133-134.

------------------------------------

বিহারের জোগিয়ায় তিনটি চিত্রিত শৈলাশ্রয় পাওয়া গেছে যা বৌদ্ধরা মঠ হিসাবে ব্যবহার করত। এগুলি খ্রীষ্টীয় ২য় শতাব্দী থেকে ১০ম শতাব্দী পর্যন্ত ব্যবহৃত হয়েছিল।

------------------------------------

দেখুনঃ A.K. Prasad, Important Discoveries of Prehistoric Rock Paintings, Ancient Inscriptions and Stone Age Tools in Southern Bihar and Adjoining Jharkhand, in, Purātattva, No. 34: 2003-2004, 2004, p. 80.

------------------------------------

বিহারের নালন্দা জেলায় রুখাই গড়ে প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান চালিয়ে উত্তরাঞ্চলীয় কাল মসৃণ মৃৎপাত্র থেকে আদি মধ্য যুগ পর্যন্ত ধারাবাহিক বসতি পাওয়া গেছে। শুঙ্গ-কুষাণ যুগে বসতিটি সম্পূর্ণ বিকশিত হয়। এই বসতিটি বৌদ্ধ পরিব্রাজকরা বিশ্রামের জন্য ব্যবহার করত বলে ধারণা করা হয়। এখানে একটি বৌদ্ধ মঠ থাকতে পারে বলে প্রত্নতাত্ত্বিকরা মনে করা করেন, যা সীমিত খননে জানা যায় নাই।  এখানে পাল-সেন যুগের (৭৫০ - ১২৩০ খ্রীষ্টাব্দ) কিছু সংখ্যক কাল পাথরের বৌদ্ধ ভাস্কর্যের ভগ্নাংশ ছড়ানো অবস্থায় পাওয়া গেছে।

------------------------------------

দেখুনঃ G.K. Lama, Recent Archaeological Investigations at Rukhaegarh, District Nalanda, Bihar, (Notes and News), in, Purātattva, No. 45, 2015, pp. 303, 307.

------------------------------------

গুপ্ত রাজত্বকালে নালন্দা মহাযানী বৌদ্ধ ধর্মের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র ছিল। গুপ্ত রাজত্বের সময়ে সারনাথ ও মথুরা যেমন নামকরা শিল্পকেন্দ্র ছিল তেমন পাল যুগে নালন্দা শিল্পকলার জন্য বিখ্যাত ছিল।

------------------------------------

দেখুনঃ G.K. Lama, Brahmanical and Buddhist Sculptures in district – Nalanda (Based on archaeological explorations: 2012-14), (Notes and News), in, Purātattva, No. 44, 2014, p. 299.

------------------------------------

মহারাষ্ট্র ও অন্ধ্রপ্রদেশের নানা স্থানে বহু জৈন নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে। এগুলির অনেকগুলিই সাতবাহন যুগের (খ্রীষ্টপূর্ব প্রথম শতকের দ্বিতীয়ার্ধ - ২২৫ খ্রীষ্টাব্দ)।  সাতবাহন যুগে মহারাষ্ট্র ও অন্ধ্রপ্রদেশে বৌদ্ধ ধর্ম যে একটি শক্তিশালী অবস্থানে ছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায় মহারাষ্ট্রের পিটালখোরা, নাসিক, কার্লা, কানহেরি, জুন্নার, মাহার, কোল, ভাজা ও কোলাপুর এবং অন্ধ্রপ্রদেশের ঘন্টকশাল, জগ্গয্যপেটা, অমরাবতী ও ভট্টিপ্রোলুতে অসংখ্য বৌদ্ধ নিদর্শনের সন্ধান পাওয়ায়। দক্ষিণ ভারতের প্রাচীন বৌদ্ধ গুহাগুলির প্রায় সবগুলিই এই সময়ে নির্মিত হয়।

------------------------------------

  দেখুনঃ দিলীপকুমার গঙ্গোপাধ্যায়, ভারত-ইতিহাসের সন্ধানে, ২০১১, পৃঃ ৪২৯।

  দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ৪২৯-৪৩০।

------------------------------------

মধ্য প্রদেশের দেউর কোথারা নামে প্রত্নস্থলে শুঙ্গ যুগের (খ্রীষ্টপূর্ব ২০০ থেকে খ্রীষ্টীয় প্রথম শতাব্দী) পাথরের ও ইটের তৈরী চারটি বড় ও পঞ্চাশটি মধ্যম আকৃতির বৌদ্ধ স্তূপ, মঠ, শৈলাশ্রয়, শিলা-চিত্র ও উৎকীর্ণ লিপি পাওয়া গেছে। এছাড়াও ভৈনসাহি, জট্ঠা ও কারাকাছা নামে কয়েকটি গ্রামের বাইরে দুন্ডি গাধি নামে একটি স্তূপের নিদর্শন পাওয়া গেছে।

------------------------------------

দেখুনঃ A.K. Singh, Buddhist Stupa Complex at Deour Kothara and Dundi Gadhi and the Monuments in its Neighbourhood, (Notes and News), in, Purātattva, No. 38, 2008, p. 202-204.

------------------------------------

মধ্য প্রদেশের বিদিশায় জৈন ধর্মের প্রাচীন জিনিসপত্রের মধ্যে কিছু খোদিত ছবি ও উৎকীর্ণ লিপি থেকে ধারণা করা হয় যে, খ্রীষ্টীয় ৪র্থ শতাব্দীতে বিদিশা জৈন ধর্মের শিক্ষা কেন্দ্র ছিল।

------------------------------------

দেখুনঃ Kiran Kumar Thaplyal and Phool Chand Jain ‘Premi’, An Inscribed Image of Tirthaṅkara Ṛishabha from Mandi Dweep, (Notes and News), in, Purātattva, No. 45, 2015, pp. 314-415.

------------------------------------

মহারাষ্ট্রের ঔরঙ্গাবাদ ও পিটালখোরায় প্রাচীন বৌদ্ধ গুহা ছিল। পিটালখোরায় পাওয়া উৎকীর্ণ লিপিতে পৈথান বা প্রতিষ্ঠানের নাম পাওয়া যায় যা সাতবাহনদের প্রাচীন রাজধানী ছিল।

------------------------------------

দেখুনঃ Ajit Kumar and M. Mahadevaiah, Early Historic Artifacts from Paal, District Aurangabad, Maharashtra, (Notes and News), in, Purātattava, Number 45, 2015, p. 300-301.

------------------------------------

উত্তর মহারাষ্ট্রের অনার্ত গিরিদুর্গে তারনমাতা মন্দিরে অনেক বৌদ্ধ মূর্তি ছিল। এখানকার তরঙ্গ পাহাড়ে পাওয়া বৌদ্ধ মূর্তিগুলির মধ্যে ছিল তারা, অবলোকিতেশ্বর পদ্মপানি, ধ্যানী বুদ্ধ, ইত্যাদি। তারা মূর্তিটির সময়কাল খ্রীষ্টীয় ৮ম-৯ম শতাব্দী। এখানকার গুহাটি ছিল বড় আকারের একটি প্রাকৃতিক শৈলাশ্রয়। গুহার সামনে একটি মণ্ডপের কাঠামো ১১শ-১২শ শতাব্দীতে তৈরী হয়েছিল। এখানকার তারনমাতা মন্দিরটির বৌদ্ধ তারা মূর্তি ১৮শ-১৯শ শতাব্দীর তৈরী। এছাড়া এখানে একটি ছোট স্তূপ আছে যেখান থেকে বুদ্ধের পদ্মাসন ভঙ্গিতে দু’টি বড় আকারের পোড়ামাটির মূর্তি পাওয়া গেছে যেগুলিকে তুলনা ক’রে খ্রীষ্টীয় ৪র্থ শতাব্দীর বলে মনে করা হয়।

------------------------------------

দেখুনঃ Y.S. Rawat, Hill Fort of Anarta: Discovery of a Unique Early Historical Fort with Cave-Dwellings, Buddhist Idols and Remains at Taranga in North Gujarat, in, Purātattva, No. 39, 2009, pp. 96-101. 

------------------------------------

পাতা : ২০

ছত্তিসগড় প্রাচীন যুগে কোশল রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ভারতের ছত্তিসগড় রাজ্যের সিরপুর নামে একটি প্রত্নস্থলে বিপুল সংখ্যক বৌদ্ধ মূর্তি পাওয়াতে বুঝা যায় যে আদি মধ্য যুগে, বিশেষভাবে ৬ষ্ঠ থেকে ৮ম শতাব্দীর মধ্যে, ওড়িশা, পশ্চিম বঙ্গ ও বিহারের ধার ঘেঁসে তান্ত্রিক বৌদ্ধ ধর্মের বড় কেন্দ্র অবস্থিত ছিল। এই সময়ে ছত্তিসগড়ের ইতিহাসে দেখা যায় যে বৌদ্ধ মঠগুলি শুধু ধর্মীয় শিক্ষার কেন্দ্র ছিল না, সেগুলিতে ব্রোঞ্জের মূর্তি ঢালাইয়েরও কারখানা গড়ে উঠেছিল। এখানে জৈন ও বিষ্ণু মূর্তিও পাওয়া গিয়েছিল। এই অঞ্চলে শিব ও বিষ্ণু মন্দির ছাড়াও বৌদ্ধ ও জৈন বিহারও ছিল। দেখা গেছে যে, বৌদ্ধ মঠগুলিকে কেন্দ্র করে নানা বিষয়ে শিক্ষার কেন্দ্র হিসাবে গড়ে উঠত। বিশেষত প্রতিটি মঠের প্রতিষ্ঠাতারা ছিলেন প্রসিদ্ধ শিক্ষাগুরু। এমনকি এখনো তিব্বত ও মঙ্গোলিয়ার প্রসিদ্ধ শিক্ষকরা হলেন এক বা একাধিক মঠের প্রতিষ্ঠাতা, যেগুলি প্রতিটি হল গভীর শিক্ষা ও বিপুল পাণ্ডিত্যের  কেন্দ্র।

------------------------------------

দেখুনঃ Prabhat Kumar Singh, Bronze Images of Female Buddhist Deities from Sirpur, in, Purātattva, No. 38, 2008, p. 157.

দেখুনঃ Th. Stcherbatsky, Buddhist Logic, Vol. 1, Motilal Banarsidass Publishers Private Limited, Delhi, First Indian Edition, Delhi 1993, pp. 33-34.

------------------------------------

গান্ধারের রাজধানী তক্ষশীলা বুদ্ধের যুগেরও আগে থেকে জ্ঞানের কেন্দ্র ছিল। তক্ষশীলার উত্থানের সময়কে গাঙ্গেয় সমভূমিতে দ্বিতীয় নগরায়নের সাথে সংযুক্ত করা যায়। এটি একটি জনবহুল নগরীতে পরিণত হয়, ও পূর্ব ও পশ্চিমের সাথে বাণিজ্যিক যোগাযোগ গড়ে উঠে। আরো পরে মগধ থেকে বহু সংখ্যক ছাত্র উত্তর ভারতের দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে তক্ষশীলার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে পড়তে যেত।

------------------------------------

দেখুনঃ Ahmad Hasan Dani, The Historic City of Taxila, 1999, p. 40.

  দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ৪২-৪৩।

------------------------------------

বামিয়ান, আফগানিস্তান। গুহার উত্তর পূর্ব দেওয়াল, চিত্রসমূহের পুনর্নির্মাণ (সৌজন্যেঃ Deborah Klimburg-Salter, 2001)

গান্ধার অঞ্চলে গ্রীক, শক, পার্থিয়ান ও কুষাণ রাজাদের ধারাবাহিক পৃষ্টপোষকতায় অযুত সংখ্যাধিক বৌদ্ধ স্তূপ, মন্দির ও মঠ তৈরী হয়েছিল। চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাং উল্লেখ করেছেন যে, কেবলমাত্র গান্ধার অঞ্চলেই এক হাজার মঠ (যার অর্ধেক ধ্বংসপ্রাপ্ত) ও এগুলির সংখ্যা উদায়ন অঞ্চলে চৌদ্দশতের কম নয়।

------------------------------------

 দেখুনঃ Sir John Marshall, A Guide to Taxila, 1960, p. 17.

------------------------------------

কুষাণ যুগে খ্রীষ্টীয় ২য়-৩য় শতাব্দীর দিকে কাশ্মীরের বৌদ্ধ মন্দিরগুলির শান বাঁধানো পোড়ামাটির টালিতে নূতন স্থাপত্যের অলংকরণের বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। এর প্রভাব গান্ধারের শিল্পেও পড়েছিল।

------------------------------------

দেখুনঃ B.R. Mani, Concentric Circles: Kushan Structural Riddle in Kashmir, (Notes and News), in, Purātattva, No. 38, 2008, p. 202-204.

------------------------------------

সম্রাট অশোক (রাজত্বকাল ২৬৮ - ২৩১ খ্রীঃপূঃ) সারিপুত্রের সম্মানে বিহারের নালন্দায় একটি স্তূপ ও প্রথম বিহার নির্মাণ করেছিলেন। তখনো এটি জ্ঞানের কেন্দ্র হয়ে উঠে নাই। খ্রীষ্টীয় তৃতীয় শতাব্দীর শেষের দিকে গুপ্ত রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা শ্রীগুপ্ত চীনা সন্ন্যাসীদের জন্য নালন্দা থেকে চল্লিশ যোজন দূরে চীনা বিহার (Cīna-vihāra) প্রতিষ্ঠা করেন, যা ছিল নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্বসূরি। পশ্চিম থেকে আসা হুনদের ব্যাপক ধ্বংসকাণ্ডে তক্ষশীলাসহ অন্যান্য বৌদ্ধ মঠ ও শিক্ষাকেন্দ্রগুলি নির্মূল হলে গান্ধারের অপর অঞ্চলের (TransGandhara) বৌদ্ধ সন্ন্যাসী হু রাজবংশের (Hu Rājavaṁśa) অনুরোধে গুপ্ত রাজাদের সময়ে নালন্দা প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি খ্রীষ্টীয় ৫ম শতাব্দীতে প্রতিষ্ঠিত হয়ে বৌদ্ধ জ্ঞানের কেন্দ্র হয়ে উঠে ও দূর-দূরান্ত থেকে যেমন শ্রী-লংকা, ইন্দোনেশিয়া, কোরিয়া ও চীন থেকে জ্ঞানানুসন্ধানী মানুষজন ও পৃষ্টপোষকরা আসতে থাকে। এটিতে বিশাল আবাসিক ভবন আর মঠ, মন্দির ও ১০,০০০ আবাসিক ছাত্র থাকত। এর নয়তলা গ্রন্থাগারে প্রায় ৯০ লক্ষ গ্রন্থ সংরক্ষিত ছিল বলে জান যায়। এটি খুব আশ্চর্য যে, ছাত্রদের কাছ থেকে বেতন নেওয়া হত না, অথচ এটি ভালভাবে চলত। বিভিন্ন উৎস থেকে জানা যায় যে, রাজারা কখনো ১০০ বা কখনো ২০০ গ্রামের আয় দান করতেন, এছাড়া আশেপাশের গ্রামের মানুষজন চাল, মাখন ও দুধ সরবরাহ করত।

------------------------------------

দেখুনঃ Lokesh Chandra, Nalanda University, in, Purātattva, No. 46, 2016, pp. 176-177.

  দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ১৭৭।

দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ১৭৮-১৮১।

দেখুনঃ Bijoy Kumar Choudhary, Identifying the Surroundings of Nalanda Mahavihara, in, Purātattva, No. 38, 2008, p. 91.

  দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ৯১।

------------------------------------

পাতা : ২১

নালন্দা ছাড়াও বিহারে ওদন্তপুরি মহাবিহার, তেলহারে (Telhara) তিলাস-অকিয় (Tilas-akiya) মহাবিহার ও ঘোসরাওয়ানে (Ghosrawan যশোবর্মাপুর বিহার বিখ্যাত ছিল।

------------------------------------

১  দেখুনঃ Bijoy Kumar Choudhary, Identifying the Surroundings of Nalanda Mahavihara, in, Purātattva, No. 38, 2008, p. 101.

------------------------------------

ভারতের ছত্তিসগড় রাজ্যে সিরপুর নামে একটি বসতির বৌদ্ধ-বিহারে আদি মধ্য যুগের দেব-দেবীর মূতি, নৈবেদ্যের জন্য তৈরী স্তূপের অনুকৃতি পাওয়া গেছে, যার সময়কাল খ্রীষ্টীয় ৬ষ্ঠ থেকে ৮ম শতাব্দী পর্যন্ত।  এটি সমসাময়িক কালে একই সাথে ওড়িশা, পশ্চিম বাংলা ও বিহারের তান্ত্রিক বৌদ্ধ ধর্মের কেন্দ্র ছিল। এই সময়ে সিরপুরে বিপুল সংখ্যক ব্রোঞ্জের মূর্তি পাওয়াতে বুঝা যায় যে এটি শুধু ধর্মীয় শিক্ষার কেন্দ্র ছিল না, ভাস্কর ও স্থপতিদেরও কেন্দ্র ছিল। বৌদ্ধ মঠগুলি ব্রোঞ্জ মূর্তির ঢালাইয়ের কারখানা হিসাবেও কাজ করেছিল। বৌদ্ধ ধাতু শিল্প পাল রাজত্বকালে মগধে সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছায় ৯ম শতাব্দীর শেষ থেকে ১১শ শতাব্দী পর্যন্ত। কিন্তু ছত্তিসগড়ে পাল যুগের আগে পাণ্ডুবংশী রাজত্বকালে ধাতুশিল্প বিকাশ লাভ করে। সিরপুর খনন থেকে জানা যায় যে, এখানে রাজপরিবারের লোকজন বসবাস করত, ও এখানে বৌদ্ধ ও জৈন বিহার ও শিব ও বিষ্ণু মন্দির ছিল।

------------------------------------

দেখুনঃ Prabhat Kumar Singh, Bronze Images of Female Buddhist Deities from Sirpur, in, Purātattva, No. 38, 2008, pp. 150-151, 157-158.

  দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ১৫৭-১৫৮।

------------------------------------

বিহারের নালন্দা জেলায় চান্দিমৌ নামে পাল যুগের একটি বসতিতে বিভিন্ন জিনিসপত্রের মধ্যে পোড়ামাটির একটি ছোট বৌদ্ধ স্তূপ, সীল মোহর, ফলক, ইত্যাদি পাওয়া গেছে। কিছু সীল মোহরে বুদ্ধের ভূমিস্পর্শ ভঙ্গিতে ছবি ও বৌদ্ধ ধর্মের কথা উৎকীর্ণ আছে। একটি সীল মোহরের ভগ্নাংশের উপরের অংশে দুই বাহু যুক্ত অবলোকিতেশ্বর ও নীচের অংশে একটি চার বাহু যুক্ত বসে থাকা দেবীর ছবি উৎকীর্ণ আছে। পাথরের ভাস্কর্যের মধ্যে একটি স্তম্ভমূলে সপ্তরত্না, চার বাহু যুক্ত বিষ্ণু ও একটি চারকোনা অংশে বিষ্ণু, তারা, ভূমিস্পর্শ মুদ্রায় বুদ্ধ, বৌদ্ধ দেবী মারিচী, প্রভৃতি সারিব্ধভাবে উৎকীর্ণ আছে। খননে প্রাপ্ত জিনিসের উপর ভিত্তি করে মনে করা হচ্ছে যে, এই বসতিটি পাল যুগের ছিল। এখানে একটি বৌদ্ধ মন্দিরের সাথে বারটি নৈবেদ্যের জন্য নির্মিত বৌদ্ধ স্তূপের ভগ্নাবশেষ পাওয়া গেছে।

------------------------------------

দেখুনঃ Niraj Kumar Sinha & Jalaj Kumar Tiwari, Excavations at Chandimau 2000-01, (Notes & News), in, Purātattva, No. 36: 2005-2006, 2006, pp. 211-213, 216.

------------------------------------

পশ্চিম বঙ্গের পুরুলিয়া জেলার বলরামপুর দশম শতাব্দীতে জৈনদের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল ছিল। পরিত্যক্ত মন্দির, স্থাপত্য নিদর্শন ও ভাস্কর্যের অবশেষ থেকে প্রমাণ পাওযা গেছে যে, এই অঞ্চলে আদি মধ্য যুগে জৈনরা সমৃদ্ধিশালী ছিল। এই অঞ্চলে সিরগি নামে একটি বসতিতে জৈন ভাস্কর্য অষ্টপদতীর্থ ও একটি চুমুখ পাওয়ায় বুঝা যায় যে এখানে জৈনদের তীর্থস্থান ছিল। মূর্তিগুলির ধরন ও বৈশিষ্ট্য থেকে এগুলিকে একাদশ ও ত্রয়োদশ শতাব্দীর মধ্যে ফেলা হয়। ব্রাহ্মণদের কিছু দেবতার মূর্তি যেমন বিষ্ণুর মূর্তি পাওয়া গেলেও প্রত্নতাত্ত্বিকভাবে দেখা গেছে যে এই অঞ্চলে ব্রাহ্মণদের অবস্থান গৌণ ছিল।

------------------------------------

দেখুনঃ Shubha Majumder, Recent Explorations at Balarampur (Purulia district, West Bengal), (Notes and News), in, Purātattva, No. 46, 2016, p. 240.

  দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ২৩৬-২৪০।

------------------------------------

মধ্য প্রদেশের গোয়ালিয়র জেলায় খ্রীষ্টীয় দ্বাদশ শতাব্দীর সাতটি জৈন মন্দির, ইতস্তত বিক্ষিপ্ত অসংখ্য স্থাপত্য ও ভাস্কর্যের ভগ্নাংশ থেকে অনুমান করা হয় যে এখানে আরো মন্দির ছিল।

------------------------------------

দেখুনঃ Arvind K. Singh, Investigations of the Ruins of Jain Temples at Chait in District Gwalior, Madhya Pradesh, in, Purātattva, No. 44, 2014, pp. 144-145, 157.

------------------------------------

ধারণা করা হয় আমু দরিয়া অঞ্চলের ইউ-চি শাসকরা খ্রীঃপূঃ ২য় শতাব্দীতে চীনা সম্রাটের কাছে কিছু বৌদ্ধ গ্রন্থ উপহার দিয়েছিল। এই সময়ে বৌদ্ধরা নিশ্চিতভাবে চীনে গিয়ে থাকবে। চীনা বিবরণীতে বুদ্ধের সোনার মূর্তি ১২১ খ্রীঃপূঃ-এ আনা হয়েছিল বলে উল্লেখ আছে। চীনা পরিব্রাজকরা যেমন ভারতে এসেছিলেন তেমন ভারতীয় পরিব্রাজকরাও বিভিন্ন সময়ে চীনে গিয়েছিলেন।

------------------------------------

দেখুনঃ B.R. Mani, Dazu Grottoes and Indian Rock-Cut Sculptures: A Comparative Survey, in, Purātattva, No. 42, 2012, p. 44.

------------------------------------

বিহারে বকরাউর নামে একটি প্রত্নস্থলে সুজাতাগড় স্তূপ নামে পরিচিত একটি বৌদ্ধ স্তূপ উন্মোচিত হয়েছে। এটি খ্রীষ্টীয় ৭ম থেকে ১০ম শতাব্দীর মধ্যে নির্মাণ করা হয়েছিল।

------------------------------------

দেখুনঃ P.K. Mishra, Bakraur – A Repository of Rich Archaeological Property, (Notes and News), in, Purātattva, No. 38, 2008, p. 199-200.

------------------------------------

৫০০ খ্রীঃপূঃ থেকে ৩০০ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত বৌদ্ধ ধর্মের প্রত্নস্থলগুলির উপর গবেষণা করে পণ্ডিতরা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন যে, বৌদ্ধ ধর্মের মঠগুলি স্থায়ী বসতির আশেপাশে গড়ে উঠত যেগুলি দীর্ঘ দূরত্বের বাণিজ্য পথের সাথে সংযুক্ত ছিল।

------------------------------------

দেখুনঃ Sunil Kumar Patnaik, Buddhist Monuments in South-Eastern India: A Study of Forms and Patronage, in, International Review of Social Research 2019; 9(1), p. 40.

------------------------------------

বৌদ্ধ ধাতুর শিল্পকর্ম মগধে সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছায় ৯ম শতাব্দীর শেষ থেকে ১১শ শতাব্দী পর্যন্ত, পাল আমলে।

------------------------------------

১  দেখুনঃ Prabhat Kumar Singh, Bronze Images of Female Buddhist Deities from Sirpur, in, Purātattva, No. 38, 2008, pp. 157-158.

------------------------------------

খ্রীষ্টীয় পঞ্চম শতাব্দীতে হুনরা বৌদ্ধদের বিপুল সংখ্যক মঠ ও তাতে রক্ষিত বিপুল সংখ্যক পাণ্ডুলিপি ধ্বংস করে ও পুড়িয়ে দেয়। হিউয়েন সাং বলেন যে, মিহিরকুল গান্ধার অঞ্চলে ১৬০০ বৌদ্ধ নির্মাণ ধ্বংস করেন। হুনরা তক্ষশীলাও ধ্বংস করেছিল।

দেখা গেছে যে একটি নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক যুগে বৌদ্ধ প্রত্নস্থলগুলিতে শিল্পের উপাদান, অলংকরণ ও ধরনে সামষ্টিক মিল রয়েছে। এর কারণ হল বৌদ্ধ ধর্মের পুরোহিত, বণিক, কারিগর, পরিব্রাজক, ইত্যাদি এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ভ্রমণ করার ফলে তাদের পরস্পরের মধ্যে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ থাকত।

------------------------------------

এই বিষয়ে অজিত কুমার বলছেনঃ `Sculptures should be dated relying on their style rather than external parameters. A stylo-chronological index can be evolved, if, alongwith palaeography, some other parameters like architectural style, epigraphical contents, etc., are employed. This style index can be judiciouslt used as a comparative parameter to sequence and date sculptures within a site or other contemporary cave sites in Western Indian caves. This same index can be judiciously extended on a wider landscape to other contemporary Buddhist sites as well. Such comparative extension is based on the fact that nearly all early historic Buddhist sites were in constant touch with each other by the movements of clergy, traders, craftsmen, pilgrims, et al. and hence shared generic similarities in motif, ornaments and style during a given period.’ দেখুনঃ Ajit Kumar, A Stylo-Chrono Appraisal of Pitalkhora Sculptures, in, Purātattva, No. 35: 2004-2005, 2005, pp. 135-136.

------------------------------------

পাতা : ২২

বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের উত্থান ও বিকাশ পর্যায়ে ধর্মীয়-সামাজিক পরিস্থিতি

উপরে উল্লেখিত প্রত্নতাত্ত্বিক তথ্য সমূহের সাক্ষ্য থেকে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যায়। সেটি হল, খ্রীষ্টপূর্ব যুগে ভারতে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের ধ্বংসাবশেষ, মন্দির ও মূর্তির চেয়েও বৌদ্ধ ও জৈনদের মন্দির, স্তূপ ও চৈত্য সংখ্যায় অনেক বেশী ছিল ও সেগুলি প্রাধান্য বিস্তার করেছিল। শুধু তাই নয় খ্রীষ্টপূর্ব প্রথম সহস্রাব্দের মধ্য থেকে কিছু কিছু করে শুরু হয়ে মৌর্য-পূর্ব যুগ পর্যন্ত যখন বৌদ্ধ স্তূপ, চৈত্য বা অন্যান্য ধর্মীয় কাঠামো দেখা যাচ্ছে তখনো হিন্দুদের কোনো ধর্মীয় কাঠামো বা মূর্তি দেখা যায় না। যখন খ্রীষ্ট পূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীতে প্রথম হিন্দু মন্দির ও অন্যান্য ধর্মীয় বস্তু দেখা গেল তখন সারা ভারতবর্ষ জুড়ে বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের অসংখ্য স্মারককে ছড়িয়ে পড়তে দেখা যাচ্ছে।

ভারতবর্ষের একটি অসাধারণ বৈশিষ্ট্য হল ভিন্ন ধর্মমত ও ভিন্ন চিন্তার প্রতি সহনশীলতা ও কখনো তা ধারণ করা, যা সিন্ধু সভ্যতার যুগ থেকে আদি মধ্য যুগ পর্যন্ত বহমান ছিল। এই কারণে দেখা যায় বরাবর গুহা আজীবিক ও বৌদ্ধদের, ইলোরায় গুহা বৌদ্ধদের ও শৈবদের ব্যবহারের জন্য নির্মিত হয়েছিল।

অনেকে বলে থাকেন সম্রাট অশোক বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করার আগে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের অনুসারী ছিলেন। আবার কেউ কেউ বলেন তিনি আগে শৈব ধর্মের অনুসারী ছিলেন। তাঁর রূপনাথ ঘোষণাকে বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণের জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ ঘোষণা হিসাবে বলা হয়। সেখানে তিনি বলেছেন, , ‘Those gods who during that time (i.e., his pre-conversion time) had been un-mingled (with men) in Jumbudvîpa have now been made (by me) mingled (with them).’   অর্থাৎ ‘যে সমস্ত দেবতারা সেই সময়ে জম্বুদ্বীপে অমিশ্রিত ছিল তারা এখন মিশ্রিত হয়েছে (আমার দ্বারা)।” এই বাক্য দ্বারা এ কথা বুঝায় না যে, তিনি হিন্দু বা ব্রাহ্মণ্য বা শৈব ধর্ম ত্যাগ করেছেন। আমরা মনে করি অশোক তাদের মতই নিরীশ্বরবাদে বিশ্বাসী ছিলেন যেমন সেই সময়ে ভারতবর্ষে বসবাসরত বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠী ছিল। এখানে জম্বুদ্বীপ বলতে আমু দরিয়া সহ সম্পূর্ণ ভারতবর্ষ বুঝানো হয়েছিল। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য যে জৈন ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন তার কারণ আমরা ধারণা করি সেই সময়ে ভারতবর্ষে বিপুল সংখ্যক মানুষ জৈন ধর্মের অনুসারী ছিল। অর্থাৎ এটা অনুমান করা যায় যে, সেই সময়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের অনুসারী ছিল। এবং সম্ভবত এই দুই ধর্মের দ্রুত বিকাশ ঘটছিল।

------------------------------------

দেখুনঃ K.P. Jayaswal, Proclamation of Aśoka as a Buddhist, and his Jambudvîpa, in, The Indian Antiquary: A Journal of Oriental Research, Vol. LXII.-1933, eds., Charles E.A.W. Oldham, S. Krishnaswami Aiyangar and Devadatta Ramkrishna, Swati Publications, Delhi, 1986, p. 167. 

  দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ১৬৭।

------------------------------------

জানা যায় বুদ্ধের মৃত্যুর অল্প দিন পর অজাতশত্রুর রাজত্বকালে রাজগীরের শতপর্ণী গুহায় প্রথম বৌদ্ধদের কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়।

সিন্ধু সভ্যতা পতনের প্রায় দেড় হাজার বৎসর পর গঙ্গা সমভূমিতে বিভিন্ন ব্যক্তি ও মতাদর্শকে কেন্দ্র করে তাদের ছোট ছোট গোষ্ঠী গড়ে তুলতে দেখা যায়। যাঁদের মধ্যে আমরা পূরণ কশ্যপ, মক্খলি গোশাল, অজিত কেশ কম্বলী, পকুধকাত্যায়ণ, সঞ্জয় বেলট্ঠপুত্র, নিগণ্ঠ নাত পুত্রের  মত ব্যক্তিবর্গের নাম দেখতে পাই। তাঁদের বহু সংখ্যক অনুসারীর কথা দীঘ নিকায় থেকে জানা যাচ্ছে। এছাড়া বৌদ্ধ সাহিত্য থেকে অনুমান করা যায় যে আরো অসংখ্য গোষ্ঠী ছিল যাদের সাধারণভাবে অন্যতীর্থিক পরিব্রাজক, বুদ্ধমতবিরোধী পরিব্রাজক, ইত্যাদি বলা হয়েছে। জৈনদের সম্পর্কে বলা হয়েছে নির্গ্রন্থ পরিব্রাজক, নির্গ্রন্থ সম্প্রদায়ভুক্ত সন্ন্যাসী, নির্গ্রন্থ উপাসক, ইত্যাদি। গৌতম বুদ্ধের আগে থেকে যে শ্রমণ, ভিক্ষু, ইত্যাদি নামে বিভিন্ন ধর্ম গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত অনুসারী ছিল তা বৌদ্ধ সাহিত্য থেকে স্পষ্ট বুঝা যায়। বুদ্ধ বারানসীর কাছে প্রথম যে পাঁচ জন ভিক্ষুকে তাঁর নূতন ধর্মে দীক্ষিত করেছিলেন তাঁরা আগে থেকেই ভিক্ষু ছিলেন।

------------------------------------

  দেখুনঃ রাজগুরু শ্রীধর্ম্মরত্ন মহাস্থবির (অনুদিত), মহাপরিনিব্বান সুত্তং, প্রকাশিকা শ্রী অন্নপূর্ণা বড়ুয়া, ১৯৪১, পৃঃ ১৩৬।

দেখুনঃ Maurice Walshe (Translated), The Long Discourses of the Buddha: A Translation of the Dīgha Níkāya, 1987, pp. 91-92.

------------------------------------

আমরা দেখতে পেয়েছি যে, সিন্ধু নগর সভ্যতা অবসানের সোয়া এক কিংবা দেড় হাজার বৎসর পর বৃহত্তর গাঙ্গেয় সমভূমিতে যখন দ্বিতীয় নগর সভ্যতার উত্থান ঘটছে কিংবা ঘটতে যাচ্ছে সেই সময়ে মহাবীরকে কেন্দ্র করে জৈন ধর্মের এবং গৌতম বুদ্ধকে কেন্দ্র করে বৌদ্ধ ধর্মের উত্থান ঘটে। অর্থাৎ ভারতবর্ষের বুকে দ্বিতীয় নগরায়ন এবং জৈন ও বৌদ্ধ ধর্মের উত্থান যেন দুইটি সমান্তরাল প্রক্রিয়া। এখন প্রশ্ন, এই দুই সমান্তরাল ঘটনার মধ্যে যোগ কী ধরনের হতে পারে? অর্থাৎ একদিকে যখন চলছে দ্বিতীয় নগর সভ্যতা গঠনের আয়োজন তখন জন্ম অথবা বিকাশ লাভ করছে অহিংসার আদর্শ নির্ভর দুইটি ধর্ম। এটাই কি স্বাভাবিক না যে, দ্বিতীয় নগরায়নের পর্যায়ে অহিংসার চেতনা নির্ভর যে আদর্শের সামাজিক প্রয়োজন ছিল তা পূরনের জন্য এই ধর্ম দুইটির জন্ম?

এটা ঠিক যে, সিন্ধু সভ্যতার অহিংসা চেতনা এই ধর্ম দুইটিতে প্রভাব ফেলেছে বলে মনে করা যায়। কিন্তু বৌদ্ধ এবং আরও বিশেষ করে জৈন ধর্মে অহিংসার উপর যতটা গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে সিন্ধু সভ্যতায় ততটা গুরুত্ব দেওয়া হত বলে মনে হয় না। সেখানে অহিংসার চর্চা মানুষের প্রতি প্রযোজ্য ছিল। যে কারণে প্রত্নতত্ত্বের সাক্ষ্য থেকে সিন্ধু সভ্যতার মানুষদের মধ্যে মাছ এবং গরু-ছাগল-মোষ ইত্যাদি প্রাণীর মাংস ভক্ষণের প্রমাণ পাওয়া যায়। ঋগ্বেদও বিশেষত গবাদি পশুর মাংস ভক্ষণের জনপ্রিয়তার সাক্ষ্য দেয়।

সুতরাং জৈন ও বৌদ্ধ ধর্মে সকল জীবের প্রতি অহিংসার আবেদনের কারণ সিন্ধু সভ্যতার ঐতিহ্যে না খুঁজে আমাদেরকে অন্যত্র খুঁজতে হবে। এমনকি পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে মানুষের প্রতিও অহিংসার চর্চার যে প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল সেটার মধ্যেও আমাদেরকে অহিংসার সামাজিক তাগিদ সৃষ্টির কারণ খুঁজতে হবে।

আমাদেরকে এটা বুঝতে হবে যে, নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার ধ্বংস এবং সিন্ধু সভ্যতার পতন সেখানকার জনজীবনে ভয়ঙ্কর বিপর্যয় ঘটিয়েছিল। সিন্ধু সভ্যতায় ঠিক কয় কোটি মানুষের বাস ছিল তার হিসাব আমাদের কাছে নাই। কিন্তু সেটা কোটির উপরে এবং এমনকি কয়েক কোটিও হতে পারে বলে আমরা অনুমান করি। সভ্যতা ধ্বংসের প্রক্রিয়ায় এই বিপুল জনসংখ্যার বেঁচে থাকাদের অধিকাংশই যে যেদিকে পারে অভিগমন করে। আমরা এ সম্পর্কে পূর্বেও বলেছি। যেহেতু বৃহত্তর গাঙ্গেয় অববাহিকা অঞ্চল ছিল সিন্ধু সভ্যতার নিকটবর্তী এবং একই সঙ্গে উর্বর অঞ্চল সেহেতু সিন্ধু সভ্যতার জনসংখ্যার বৃহত্তর অংশ যে এখানে অভিবাসন করেছিল সেটাই স্বাভাবিক মনে হয়।

যারা এসেছিল তারা যে শুধু নিজেদের চিরচেনা বাসভূমি হারিয়েছিল তা-ই নয়, উপরন্তু তারা হারিয়েছিল নিজেদের চিরচেনা সমাজ শৃঙ্খলা এবং সনাতন সামাজিক নেতৃত্বও। বিরাটায়তন স্থানান্তরের প্রক্রিয়ার অনিবার্য পরিণতি ছিল বিরাট সামাজিক বিশৃঙ্খলা। শুধু যে দীর্ঘস্থায়ী অন্তর্কলহ ও যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়েছিল তা-ই নয়, উপরন্তু অভিগামীদের একাংশ বেঁচে থাকার তাগিদে চারদিকের অরণ্যের আবেষ্টনের মধ্যে আশ্রয় নিয়ে কৃষির পরিবর্তে পশু শিকার এবং খাদ্যসংগ্রহ নির্ভর জীবনে চলে গিয়েছিল। এটা হল সভ্য জীবন পরিত্যাগ পূর্বক আদিম জীবনে প্রত্যাবর্তন। যদি ভারতবর্ষে মধ্য এশিয়ার মত বিস্তীর্ণ পশুচারণ ভূমি থাকত তবে হয়ত তারা যাযাবর পশুচারী হতে পারত। কিন্তু ভারতবর্ষের ভূপ্রকৃতিতে অস্থির-অনিশ্চিত জীবনে তারা তার পরিবর্তে সম্ভবত শিকারী জীবনকে বেছে নিতে অনুপ্রাণিত কিংবা বাধ্য হয়েছিল।

সুতরাং একদিকে যুদ্ধ ও হিংসা, অপর দিকে আদিম শিকারী জীবনে প্রত্যাবর্তন গঙ্গা সমভূমিতে স্থিতিশীল কৃষি জীবন পুনর্গঠন এবং পরিণতিতে দ্বিতীয় নগর সভ্যতা গঠনের সামনে যে বাধা সৃষ্টি করেছিল তার পরিপ্রেক্ষিতে অহিংসার আদর্শ নির্ভর ধর্ম দুইটির উত্থানকে দেখা দরকার বলে মনে হয়। তাহলে আমরা বুঝব কোন ধরনের সামাজিক তাগিদ থেকে এই ধর্ম দুইটির প্রায় সমকালে উত্থান এবং এভাবে বিস্তার।

এই দুই ধর্মের প্রভাবে সমাজে যুদ্ধের শক্তি যেমন অনেকখানি নিয়ন্ত্রিত ও সংযত হল তেমন পশু শিকারী আদিম জীবনে মানুষের প্রত্যাবর্তনের প্রবণতাকেও রোধ করা সম্ভব হল। মহাবীর খ্রীষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীর এবং বুদ্ধ খ্রীষ্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীর। অর্থাৎ খ্রীষ্টপূর্ব ১৯ শতক থেকে ঐ সময় পর্যন্ত উপমহাদেশের সমাজ বাস্তবতা আমরা অনেকটা অনুমান করতে পারি। আরও লক্ষ্যণীয় যে, জৈন ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা মহাবীর এবং বৌদ্ধ ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা বুদ্ধ উভয়ের জন্ম দুই ক্ষত্রিয় তথা যোদ্ধা গোত্রে। প্রজাতান্ত্রিক হলেও মহাবীর এবং বুদ্ধের উপজাতি বা গোত্র ছিল ক্ষত্রিয় অর্থাৎ যোদ্ধা। এটা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা যে পৃথিবীর দুই অহিংসাবাদী ধর্মের উত্থান দুই যোদ্ধা শাসক পরিবার থেকে।

এটা আর একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার দিকে ইঙ্গিত দেয়। সেটা হল সমাজে ক্ষত্রিয় তথা যোদ্ধা শ্রেণীর নেতৃত্বমূলক অবস্থান, যেটা সিন্ধু সভ্যতায় অকল্পনীয় ছিল। অর্থাৎ সিন্ধু সভ্যতার পতনের পরবর্তী হিংসা বা যুদ্ধের কালে সামাজিক নেতৃত্ব ক্রমে যোদ্ধাদের হাতে চলে গিয়েছিল। তবে এই যোদ্ধারা ব্রাহ্মণ্য ধর্মের বর্ণাশ্রম ভিত্তিক ক্ষত্রিয় ছিল না। এ সম্পর্কে আমাদের আরও বিস্তারিত আলোচনা আছে কিছু পরে।

যাইহোক, সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত শ্রেণী তথা নেতৃত্বকারী শ্রেণী থেকেই নূতন আদর্শের ব্যবস্থা সাধারণত উদ্ভূত হয়। কারণ সমাজ সাধারণত এই শ্রেণী থেকে আগত ব্যক্তিদের প্রতিই তার আনুগত্য বা আস্থা দিতে চায়। বিভিন্ন ধর্মের দিকে দৃষ্টি দিলেও আমরা সাধারণত এই বৈশিষ্ট্য দেখতে পাই। অবশ্য যীশু খ্রীষ্ট এর ব্যতিক্রম। কিন্তু ইহুদী ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা মোশি, ইসলামের প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মদ, জৈন ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা মহাবীর কিংবা বৌদ্ধ ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা বুদ্ধ ছিলেন সমাজের নেতৃত্বকারী শ্রেণী থেকে আগত।

মহাবীর এবং বুদ্ধ অহিংসার যে বার্তাই দিন তাঁদের উত্থান প্রমাণ করে যে, সিন্ধু সভ্যতায় যা-ই থাকুক তাঁদের সময়ে ভারতবর্ষে ক্ষত্রিয় বা যোদ্ধা শ্রেণীর নেতৃত্ব বা প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু নূতন করে সভ্যতা নির্মাণের জন্য যুদ্ধের শক্তিকে নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল। অন্যদিকে, ভারতবর্ষের দিগন্ত বিস্তারী অরণের পশু শিকার জীবনের আকর্ষণ রোধ করারও প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল। সুতরাং নূতন কালের সামাজিক চাহিদা পূরণের তাগিদ থেকে নেতৃত্বকারী যোদ্ধা শ্রেণী থেকে আগত দুই ব্যক্তির নেতৃত্বে এই দুই অহিংসা মতাদর্শভিত্তিক ধর্মের প্রতিষ্ঠা বলে আমরা ধারণা  করি।

অবশ্য অহিংসার প্রশ্নে এই দুই ধর্মের মধ্যে পার্থক্য আছে। জৈন ধর্ম বৌদ্ধ ধর্মের তুলনায় চরমপন্থী। জৈনরা মাছ বা প্রাণী হত্যা দূরের কথা তাদের মাংসও খায় না। বৌদ্ধরা নিজেরা হত্যা না করলেও মৃত মাছ বা পশুর মাংস আহার করে। বুদ্ধ নিজেও মৃত পশুর রন্ধনকৃত মাংস খেতেন। তবে আহারের উদ্দেশ্যে সে পশুর মৃত্যু ঘটানো যেত না। অর্থাৎ ব্যাধি বা দুর্ঘটনায় কোনও পশুর মৃত্যু হলে তিনি তার রান্না করা মাংস খেতেন। আরও কিছু বিষয়ে দুই ধর্মের মধ্যে কিছু পার্থক্য আছে। তবে মূল জায়গায় উভয়ের মিল আছে সেটা হচ্ছে মানুষ এবং সকল প্রাণীর প্রতি অহিংসার নীতি অনুসরণ।

পাতা : ২৩

 

৪র্থ অধ্যায় : হিন্দু ধর্মের উদ্ভবঃ প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ

সাধারণভাবে একটি ধারণা প্রচলিত যে, হিন্দু ধর্ম অনেক প্রাচীন। তা পাঁচ হাজার বছর বা তার চেয়েও পুরনো। কিন্তু প্রত্নতত্ত্বের সাক্ষ্য থেকে আমরা দেখতে পাই যে, ব্রাহ্মণ্যবাদী ধর্ম বা হিন্দু ধর্মের কিছু উপাদান খ্রীষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে কিছু করে দেখা গেলেও সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আরো অনেক পরে, খ্রীষ্টীয় দ্বিতীয় বা তৃতীয় শতকের পরে।

হিন্দু ধর্মের উত্থান ও বিকাশ পর্যায়ের প্রত্নতাত্ত্বিক সাক্ষ্য

হিন্দু ধর্মকে অনেক প্রাচীন বলে বলা হলেও এই ধর্মের মন্দির ও দেব-দেবীর মূর্তি পাওয়া গেছে বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের তুলনায় বেশ পরে। আগের অধ্যায়ে আমরা দেখেছি বৌদ্ধ স্তূপ প্রথম দেখা যায় খ্রীঃপূঃ ৫ম শতাব্দীতে। এর পর মৌর্য যুগ (৩২০-১৮০ খ্রীঃপূঃ) থেকে সমস্ত ভারত জুড়ে বহু সংখ্যক বৌদ্ধ স্তূপ, চৈত্য ও মঠ নির্মাণ হতে থাকে। 

অন্যদিকে ভারতবর্ষে প্রথম হিন্দু মন্দির ধরা হয় বেসনগরে (বিদিশা, মধ্য প্রদেশ) ও নাগরী (চিত্তৌরগড় জেলায়) খ্রীষ্টপূর্ব যথাক্রমে ২য় শতাব্দী ও ১ম শতাব্দীর দু’টি উপবৃত্তাকার মন্দিরকে। গঙ্গা উপত্যকার বাইরে দক্ষিণ ভারতে হিন্দু ধর্মের স্মারক পাওয়া গেছে। এগুলির মধ্যে চিত্তুর জেলার গুড়িমল্লমে খ্রীঃপূঃ ২য়-১ম শতাব্দীর শিব-লিঙ্গ এবং বীরপুরমে (কৃষ্ণ উপত্যকায়) খ্রীষ্টীয় ১ম শতাব্দীর মন্দিরসমূহ উল্লেখযোগ্য।  এই আদি হিন্দু মন্দিরগুলির ধর্ম স্থানে গার্হস্থ, স্থানীয় ও আঞ্চলিক ধর্ম বিশ্বাস বৈচিত্র্যপূর্ণ ধারায় স্থান করে নিয়েছিল। দেখা গেছে যে, ব্রাহ্মণ্য ঐতিহ্যের ধারায় অন্তর্ভুক্ত হবার প্রক্রিয়ায় না গিয়ে এগুলি স্থানীয় ও আঞ্চলিক ধর্ম বিশ্বাসের অনেক কিছুরই ধারাবাহিকতা বজায় রেখে স্বাধীন ধর্মীয় ধারা হিসাবে টিকেছিল।

------------------------------------

দেখুনঃ Himanshu Prabha Ray, The Archaeology of Sacred Spaces in India: From Multi-Religious Sites to Monuments, in, Purātattva, No. 44, 2014, pp. 6-7. 

দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ৭।

দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ৬।

------------------------------------

বরাহ প্রতিকৃতি সহ হুন রাজা তোরামান খোদিত লিপি, এরান, মধ্য প্রদেশ, ভারত (সৌজন্যেঃ Madhuvanti Ghose, 2003)

এটি খুব তাৎপর্যপূর্ণ যে, ভারতীয় প্রথম দিককার শিল্পকর্মে হিন্দু দেবতাদের খুব কম প্রতিরূপ দেখতে পাওয়া যায়। প্রত্নতাত্ত্বিক খননে সাতবাহনের সময়ে (খ্রীঃপূঃ ১ম শতাব্দীর শেষার্ধ থেকে খ্রীষ্টীয় ২য় শতাব্দী)  মহারাষ্ট্রের পাল নামে একটি বসতিতে গণেশের মূর্তি পাওয়া গেছে। উৎকীর্ণ লিপি থেকে পরবর্তী যুগের বণিকদের মধ্যে গণেশের পূজার প্রচলনের কথা জানা যায়। টের (মহারাষ্ট্রে) নামে একটি বসতি থেকে পোড়া মাটির গণেশের মূর্তি ও নৈবেদ্যের উদ্দেশ্যে তৈরী পোড়া মাটির লজ্জা গৌরীর মূর্তি পাওয়া গিয়েছিল। টের সাতবাহনের সময়ে একটি বাণিজ্য কেন্দ্র ছিল ও এই মূর্তিগুলি খ্রীষ্টীয় ১ম থেকে ২য় শতাব্দীর মধ্যে। ধারণা করা হয় যে, বণিকরা এক স্থান থেকে অন্য স্থানে বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে ভ্রমণের সময়ে সাথে গণেশের ছোট মূর্তি বহন করে থাকবে। মহারাষ্ট্রের বিদর্ভ অঞ্চলে বাকাটক রাজত্বকালে সমৃদ্ধি দেখা যায়। এখানে কাঠামো নির্মিত মন্দির ও ব্রাহ্মণ্যধর্মের মূর্তি বাকাটকের সময়ে শুরু হয় বলে মনে করা হয়। এই যুগে বিদর্ভে মূর্তির মাধ্যমে ব্রাহ্মণ্য দেব-দেবীদের ধারণার প্রথম সূচনা হয়। এখানে পাহাড় কাটা মন্দির, কাঠামো নির্মিত মন্দির ও ভাস্কর্য পাওয়া যায় অজন্তা, মনধাল, রামতেক, মনসার ও ওয়াসিমে।

------------------------------------

দেখুনঃ Ajit Kumar and M. Mahadevaiah, Early Historic Artifacts from Paal, District Aurangabad, Maharashtra, (Notes and News), in, Purātattava, Number 45, 2015, p. 298.

  দেখুনঃ দিলীপকুমার গঙ্গোপাধ্যায়, ভারত-ইতিহাসের সন্ধানে, ২০১১, পৃঃ ৪১৫-৪১৬।

দেখুনঃ Ajit Kumar and M. Mahadevaiah, Early Historic Artifacts from Paal, District Aurangabad, Maharashtra, (Notes and News), in, Purātattava, Number 45, 2015, p. 299.

দেখুনঃ Kanchana B. Bhaisare, V.S. Shinde and P.S. Joshi, Saurajyaramya: Vidarbha of the Vakataka Times, (Notes & News), in, Purātattava, Number 44, 2014, pp. 254-256.

দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ২৫৫।

------------------------------------

মহারাষ্ট্রের সোলাপুর জেলায় ওয়াকভ নামে একটি প্রত্নস্থলে মধ্যযুগের (যাদব পর্বের) একটি মন্দির আছে। পূর্ব দিক ছাড়া এই শিব মন্দিরটির চারপাশে প্রাচীন বসতি ছিল। এখানে শিবলিঙ্গ হিসাবে মাঝখানে একটি বড় পাথর আছে, যা যাদব যুগের বলে মনে করা হয়। অনুমান করা হয় যে, এটি স্থানীয় বা পশ্চাৎপদ মানুষদের দেবতা ছিল যা পরে শৈব ধর্মের দেবতায় রূপান্তরিত হয়।

------------------------------------

দেখুনঃ P.P. Joglekar and Maya Patil-Shahapurkar, A Priliminary Report on the Excavation at Wakav, Solapur District, Maharashtra (2010-2011), in, Purātattva, No. 41, 2011, pp. 159-161.

------------------------------------

উত্তর প্রদেশের উন্নাও জেলায় সনচানকোটে কিছু ঢিবির উপর অনুসন্ধান চালিয়ে শুঙ্গ-কুষাণ যুগের (২০০ খ্রীঃপূঃ - ২০০ খ্রীষ্টাব্দ) একটি স্তূপ, একটি চৈনিদেবীর মন্দির ও একটি মহাবীরের মন্দির পাওয়া গিয়েছিল।  এছাড়া একই যুগের একটি মুদ্রায় নন্দীর সাথে শিবের ছবি ও বৃত্তাকার পোড়ামাটির সীলে শিবের ছবির বাম পাশে একটি ত্রিশূল ও ডান পাশে একটি ধ্বজের ছবি উৎকীর্ণ ছিল।

------------------------------------

দেখুনঃ D.P. Tewari and D.K. Srivastava, Excavations at Sanchankot, District Unnao, U.P. (2004-05), (Notes and News), in, Purātattva, No. 35: 2004-2005, 2005, pp. 188-189.

------------------------------------

পাতা : ২৪

হরিয়ানার নৌরঙ্গাবাদে খনন চালিয়ে যৌধেয় যুগের মুদ্রা, সীল, সীল মোহর  ও অন্যান্য জিনিসপত্র পাওয়া গেছে। এই অঞ্চল তাদের পূর্বে কুষাণদের অধিকারে ছিল। তাদের মুদ্রা, সীল ও সীল মোহর ছাড়া সকল ক্ষেত্রে বস্তুগত সংস্কৃতি কুষাণদের মত ছিল।  যৌধেয়রা ছিল প্রাচীন গোত্রীয় রাজ্য। তারা যমুনা নদীর পশ্চিমে বসবাস করত। তারা সামরিক শক্তির সাহায্যে খ্রীষ্টীয় ২য়-৩য় শতাব্দীর দিকে যমুনা ও শতদ্রু নদীর মাঝখানের অঞ্চল থেকে কুষাণদের বিতাড়িত করে। যৌধেয়রা যুদ্ধ দেবতা কার্তিকেয়ের পূজারী ছিল, যা তাদের মুদ্রা থেকে বুঝা যায়। কৌটিল্য তাদেরকে আয়ুধজীবী সংঘগুলির একটি হিসাবে বলেছেন।

------------------------------------

দেখুনঃ P.B.S. Sengar, Excavations at Naurangabad, Haryana – 2000-01, (Notes and News), in, Purātattva, No. 35: 2004-2005, 2005, pp. 194-195.

------------------------------------

পশ্চিম বঙ্গের ২৪ পরগনা জেলার চন্দ্রকেতুগড়ে খ্রীষ্টীয় ১ম-২য় শতাব্দীর দু’টি লিপি উৎকীর্ণ পোড়া মাটির জিনিস পাওয়া গেছে। এগুলির পাঠোদ্ধার করে ও মন্দিরের অবশেষ থেকে মনে করা হয় যে এগুলি ভগবত ধর্মমতের সর্ব প্রাচীন প্রমাণ।

------------------------------------

দেখুনঃ Himanshu Prabha Ray, The Archaeology of Sacred Spaces in India: From Multi-Religious Sites to Monuments, in, Purātattva, No. 44, 2014, p. 7.

------------------------------------

সাতবাহনদের (খ্রীঃপূঃ প্রধম শতকের দ্বিতীয়ার্ধ - ২২৫ খ্রীষ্টাব্দ) সম্পর্কে বলা হয় যে, তারা বৈদিক ধর্মের কঠোর অনুসারী ছিল। এটা শুধু তাদের রাজবংশের ব্যক্তিগত নামে প্রকাশ পেত না, নানা যজ্ঞক্রিয়ায় তাদের বিপুল পরিমাণ ব্যয় থেকেও তা বুঝা যেত। এগুলির পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দেওয়া আছে ননেঘাট উৎকীর্ণ লিপিতে যেখানে রাজা সাতকর্নি ও তার রাণী নাগনিকার বিপুল অর্থব্যয় ও মূল্যবান উপঢৌকন প্রদান সম্পর্কে বলা হয়েছে। রাজা সাতকর্নির সময়ে (১২৮ - ১১০ খ্রীঃপূঃ) অন্ধ্র প্রদেশ (তেলেঙ্গানা ও আশেপাশের অঞ্চল), উত্তর কর্নাটক, বিদর্ভ ও দক্ষিণ মহারাষ্ট্র সাতবাহনদের অধীনে ছিল।  সাম্প্রতিক উৎখননে মহারাষ্ট্রের মনসারে পাওয়া দু’টি ইটের তৈরী তারা আকৃতির শিব মন্দির সাতবাহনদের শাসনামলে খ্রীষ্টীয় ২য় শতাব্দীতে নির্মাণ করা হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়।

------------------------------------

দেখুনঃ A.K. Sharma, Star Shaped Temples of Mansar, (Notes and News), in, Purātattva, No. 38, 2008, p. 195.

------------------------------------

বিহারের ছোটনাগপুর মালভূমি ও ঝাড়খণ্ড অঞ্চলের প্রত্যন্ত বনাঞ্চলে ৯৬টি গুহা/শিলাশ্রয় আবিষ্কৃত হয়েছে। এখানে প্রাগৈতিহাসিক ও ঐতিহাসিক বহুসংখ্যক ছবি ও দুর্লভ খরোষ্ঠী, খরোষ্ঠী-ব্রাহ্মী, ব্রাহ্মী ও শংখ লিপি উৎকীর্ণ আছে। একটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ চিত্রে শকদের (বা ইউ-চি) পোশাকে কিছু মানুষের ছবি (দীর্ঘ কোট, পায়জামা, বুট জুতা ও লম্বা টুপি) আছে যারা স্থানীয় একটি ধর্মানুষ্ঠান পালন করছে বলে দেখা যাচ্ছে। পোশাক, লিপি ও বর্ণনা থেকে মনে হয় যে, মানুষটি একজন বণিক বা ভ্রমণকারী ছিল যারা উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিম থেকে এসেছে। কিছু প্রাচীন বিবরণ থেকে জানা যায় যে এই ভ্রমণকারী বা বণিকরা মগধের স্থানীয় কিছু পূজা পালন করত। শিলালেখ গবেষণা করে জানা যায় যে, প্রাচীন বনের মধ্য দিয়ে চলা বাণিজ্যপথ পাটলিপুত্র/বুধগয়া থেকে প্রাচীন সমুদ্র বন্দর তাম্রলিপ্তির (পশ্চিম বঙ্গের মেদিনীপুর জেলার তমলুক) ও গান্ধারের সংযোগ এই অঞ্চল দিয়ে হত এবং বণিক বা ভ্রমণকারীরা এই গুহা বা শৈলাশ্রয়ে বিশ্রাম গ্রহণ করত।

------------------------------------

দেখুনঃ A.K. Prasad, Discovery of Pictorial-cum-Epigraphic Depictions of Performing Local Rituals of the Ancient Magadha by the Traders/Travellers from Gandhara Region, (Notes and News), in, Purātattva, No. 36: 2005-2006, 2006, p. 235.

------------------------------------

উত্তর প্রদেশের কোপিয়া নামে একটি বসতিতে ৩২টি পোড়া মাটির মূর্তি পাওয়া গেছে যেগুলির বেশীরভাগই কুষাণ যুগের (খ্রীষ্টীয় ১ম - ২য় শতাব্দী)। ছাঁচে তৈরী একটি মূর্তিকে শুঙ্গ যুগের (খ্রীঃপূঃ ২য়-১ম শতাব্দী) বলে ধরা হয়েছে। একটি নারী মূর্তিকে বৌদ্ধ দেবী হারিতি অথবা পার্বতীর বলে মনে করা হয়, যেহেতু এই ধরনের মূর্তি উত্তর ভারতীয় বসতিগুলিতে কুষাণ যুগে সাধারণভাবে পাওয়া যেত। অপদেবতার মত দেখতে কাঁচা হাতের তৈরী এই মূর্তিগুলিকে খ্রীষ্টীয় যুগের শতাব্দীগুলিতে উত্তর-পশ্চিম থেকে আসা বিভিন্ন উপজাতি বা গোত্রের অভিগমনের সাথে সম্পর্কিত বলে মনে করা হয়।

------------------------------------

দেখুনঃ A.K. Kanungo and V.N. Misra, Excavation at Kopia: A Preliminary Report, in, Purātattva, No. 34: 2003-2004, 2004, p. 121.

------------------------------------

খ্রীষ্টপূর্ব কয়েক শতাব্দী থেকেই মথুরা শিল্পকলার একটি বড় কেন্দ্র ছিল। কুষাণ যুগে (খ্রীষ্টীয় ১ম-২য় শতাব্দী) এটি যথেষ্ট সমৃদ্ধ হয়েছিল আর গুপ্ত যুগে (খ্রীষ্টীয় ৪র্থ-৬ষ্ঠ শতাব্দী) চরমোৎকর্ষ লাভ করে। এটি ব্রাহ্মণ্য ধর্ম, বৌদ্ধ ধর্ম ও জৈন ধর্মেরও কেন্দ্র ছিল। মথুরার কনকালি-টিলায় খনন করে বেশ কিছু সংখ্যক জৈন মূর্তি উন্মোচিত হয়েছে, যেখানে একটি জৈন স্তূপের অবশেষ পাওয়া গেছে। এটি প্রমাণিত যে, মথুরার তৈরী শিল্পের অনেক জিনিসপত্র সারনাথ, শ্রাবস্তি, কৌশাম্বি, ও কুশিনগরে নিয়ে যাওয়া হত। কনিষ্কের (সিংহাসনে আরোহণ করেন ৭৮ খ্রীষ্টাব্দে) রাজত্বের তৃতীয় বৎসরে মথুরার বেলে পাথরের তৈরী ‘বেধিসত্ত্ব’ মূর্তি সারনাথে নেওয়া হয়েছিল। কনিষ্কের সময়ে মথুরার লাল বেলে পাথরের আরো একটি বোধিসত্ত্ব মূর্তি শ্রাবস্তিতে নেওয়া হয়েছিল।

------------------------------------

দেখুনঃ Kiran Kumar Thaplyal and Phool Chand Jain ‘Premi’, An Inscribed Image of Tirthaṅkara Ṛishabha from Mandi Dweep, (Notes and News), in, Purātattva, No. 45, 2015, pp. 312-314.

------------------------------------

অযোধ্যায় মনিপর্বতের কাছে রনোপালি মন্দিরে খ্রীঃপূঃ ১ম শতাব্দীতে ব্রাহ্মী লিপিতে সবচেয়ে প্রাচীন সংস্কৃতে লিখিত আছে যে, শুঙ্গ সম্রাট পূষ্যামিত্র তাঁর জীবনে দুইবার অশ্বমেধ যজ্ঞ সম্পন্ন করেছেন।

------------------------------------

দেখুনঃ B.R. Mani, A Decade of Crumbling Heritage: Ayodhya (1995-2005), in, Purātattva, No. 37, 2007, pp. 140-141.

------------------------------------

মধ্য প্রদেশে কালাচুরি, চনডেল্লা ও গহদাবলের সময়ে বেশ কিছু মন্দির নির্মাণ করা হয়েছিল। এগুলি হল, গধবে (এলাহাবাদ) গহদবল মন্দির, চুনারে (রেওয়া) শৈব মঠ ভবন, বাঘেদে (রেওয়া) শিব মন্দির, দিওর কোঠারায় (রেওয়া) দেবী মন্দির, চৌরাঘটে ও ধাকারার (রেওয়া) মন্দির, রাম নগরে (চিত্রকুট) শৈব মঠ, ভৈরামপুরে (চিত্রকুট) ভৈরাম বাবা মন্দির, ইতাহ দেবীপুরে (চিত্রকুট) জালপ মন্দির।

------------------------------------

দেখুনঃ A.K. Singh, Buddhist Stupa Complex at Deour Kothara and Dundi Gadhi and the Monuments in its Neighbourhood, (Notes and News), in, Purātattva, No. 38, 2008, p. 203-204.

------------------------------------

কালাচুরি (৬০০-১৬০০ খ্রীষ্টাব্দ) ছিল মধ্য ভারতের একটি শাসক বংশ যারা শিল্পকলা, সাহিত্য ও বৃহদায়তন ভবন নির্মাণে পৃষ্টপোষকতা করত। কালাচুরি শাসকরা সাধারণভাবে শৈব ধর্মের প্রতি অনুগত ছিল। কালাচুরিদের সময়ে মধ্য প্রদেশে মন্দির নির্মাণের প্রাচীনত্বকে ৬০০-৭০০ খ্রীষ্টাব্দে নেওয়া যায়।

------------------------------------

দেখুনঃ A.K. Singh, Reflections on the Shikharas of Kalachuri Period Temples in Eastern Madhya Pradesh, in, Purātattva, No. 35: 2004-2005, 2005, pp. 143-145.

------------------------------------

পাতা : ২৫

     

অষ্টম শতকে নির্মিত দুর্গা মন্দির, আইহোল (সৌজন্যেঃ Himanshu Prabha Ray, 2004)

ভারতে দিল্লীর কাছে পুরান কিলা নামে একটি প্রত্নস্থলে মৌর্য যুগ থেকে মোগল যুগ পর্যন্ত ধারাবাহিক বসতি পাওয়া গেছে। এখানে শুঙ্গ যুগে (খ্রীঃপূঃ ২য় -খ্রীষ্টীয় ১ম শতাব্দী) পোড়া মাটির যক্ষী মূর্তি ও গুপ্ত যুগে (৩০০ - ৫৫০ খ্রীষ্টাব্দ) পোড়া মাটির গজ-লক্ষ্মীর পদক পাওয়া গেছে।

------------------------------------

দেখুনঃ Vasant Kumar Swarnkar and Vishnu Kant, Excavations at Purana Qila, 2013-14, (Notes and News), in, Purātattva, No. 44, 2014, pp. 320-323.

------------------------------------

 দেখা গেছে কিছু হিন্দু মন্দির বৌদ্ধ স্তূপ বা বৌদ্ধ ধর্মের ঢিবি বা কাঠামোর উপরে তৈরী করা হয়েছিল। এরকম একটি ঘটনা দেখা যায় গুজরাটের বেট দ্বারকা দ্বীপে আদিনারায়ণ মন্দিরের ক্ষেত্রে। এটি বৌদ্ধ স্তূপের ঢিবির উপর তৈরী বলে ধারণা করা হয়।

------------------------------------

দেখুনঃ A.S. Gaur, Sundaresh & K.H. Vora, Archaeology of Bet Dwarka Island: An Excavation Report, Aryan Books International, New Delhi, 2005, p. 5.

------------------------------------ 

পাকিস্তানের পাঞ্জাবের বাহাওয়ালপুর অঞ্চলে সম্পূর্ণ ধ্বংসপ্রাপ্ত দমন বিহার নামে কুষাণ যুগের (খ্রীষ্টীয় ১ম - ২য় শতাব্দী) স্তম্ভাকৃতি একটি বৌদ্ধ স্তূপ পাওয়া গেছে। এর গঠন শৈলী ও পরিকল্পনা অন্যান্য পরিচিত স্তূপের গঠন থেকে ভিন্ন ছিল। ১৮৮১ সালের পরিমাপ হিসাব করে বের করা হয়েছে যে, এটির স্তম্ভের উচ্চতা ধ্বংসপ্রাপ্ত হবার পরেও ৫৩ ফুট (১৬.২ মিটার) ছিল, যা বিংশ শতাব্দীতে সম্পূর্ণ ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে।

------------------------------------

দেখুনঃ Farzand Masih, Damana Vehara and Sankhya Philosophy, in, Purātattva, No. 45, 2015, pp. 212-216.

------------------------------------

পাকিস্তানের কিশোর পর্বতশ্রেণীর কাছে বিলোট কাফির কোট নামে একটি প্রত্নস্থল প্রতিরক্ষা প্রাচীর ঘেরা ছিল এবং সেখানে ৮টি হিন্দু মন্দির পাওয়া গেছে। মন্দিরগুলির নির্মাণের সময় সপ্তম থেকে দশম শতাব্দীর মধ্যে।

------------------------------------

দেখুনঃ Farzand Masih, Bilot Kafir Kot: A Splendour of Gandhara Nagara Temple Architecture, in, Purātattva, No. 38, 2008, pp. 74-75.

------------------------------------

পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশের ডেরা ইসমাইল খান জেলায় উত্তর কাফির কোটে কিছু হিন্দু মন্দির আছে, যেগুলি খ্রীষ্টীয় ৬ষ্ঠ থেকে ৯ম শতাব্দীর মধ্যে। এখানে নিঃসন্দেহে খ্রীষ্টীয় ১ম ও ৫ম শতাব্দী থেকে ৬ষ্ঠ শতাব্দী পর্যন্ত গান্ধার অঞ্চলে ব্যবহৃত বৌদ্ধ অলংকরণ ও স্থাপত্যের ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা ছিল।

------------------------------------

দেখুনঃ Farzand Masih, Damana Vehara and Sankhya Philosophy, in, Purātattva, No. 45, 2015, p. 222.

------------------------------------

ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন সময়ে হিন্দু ধর্ম বা ব্রাহ্মণ্য ধর্ম বিকাশ লাভ করেছিল। ওড়িশায় ব্রাহ্মণ্য ধর্ম বিকাশ লাভ করতে থাকে খ্রীষ্টীয় যুগের প্রথম শতাব্দীগুলিতে।  এই সময় থেকে মূর্তি তৈরী হতে থাকে ও মন্দির নির্মাণ শুরু হয়।

------------------------------------

দেখুনঃ D.K. Nayak, A Study of Group-Information of the Temples of Orissa, in, Purātattva, No. 32: 2001-02, 2002, p. 17.

------------------------------------

৩৪০ খ্রীষ্টাব্দের দিকে কুষাণদের আরেকটি শাখা হিন্দুকুশের দক্ষিণ হয়ে পাঞ্জাব পর্যন্ত আসে। তারা ছোট কুষাণ বা কিদার কুষাণ নামে পরিচিত। পঞ্চম শতাব্দীর মাঝামাঝি হুনদের দ্বারা পরাজিত হওয়া পর্যন্ত তারা শাসন করছিল। কিদার কুষাণদের সময়ে তক্ষশীলায় কয়েকটি প্রভাব দেখা যায়। একটি হল সাসানীয় প্রভাব, ব্রাহ্মী লিপি দ্বারা খরোষ্ঠী লিপির চূড়ান্ত প্রতিস্থাপন ও হিন্দু ধর্মের দেবতা যেমন, শিব, বিষ্ণু, দুর্গা ও কার্তিকেয়র ধীর অনুপ্রবেশ। এই সময়ে গুপ্ত শিল্পকলার নমুনা তক্ষশীলায় পাওয়া গেছে। এই সময়ে সেখানকার ধর্মরাজিকা স্তূপে আকস্মিক আগুন লাগে। এর পরে তক্ষশীলায় অনেক বৌদ্ধ মঠ নির্মাণ করা হয়। মনে করা হয় যে, কিদার কুষাণরা ক্রমশ অ-বৌদ্ধ ভারতীয় ধর্ম অর্থাৎ হিন্দু ধর্মের প্রভাবে আসছিল, তবে এর পরেও তারা অনেক চুনবালির ভাস্কর্য নির্মাণ করেছিল। মিহিরকুলের উত্তরাধিকারী প্রবরসেনের (Pravarasena) পরবর্তী হুন শাসক হন খিনখিলা বা নরেন্দ্রাদিত্য। তিনি (শিব) ভুতেশ্বরের নামে মন্দির উৎসর্গ করেন ও ব্রাহ্মণদের খাদ্যের জন্য স্থায়ী বৃত্তিদানের ব্যবস্থা করেন।

------------------------------------

 দেখুনঃ Ahmad Hasan Dani, The Historic City of Taxila, 1999, pp. 74-75.

  দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ৭৫।

  দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ৭৬।

------------------------------------

পাতা : ২৬

মহারাষ্ট্রের বিদর্ভ অঞ্চলে সাতবাহনদের (খ্রীঃপূঃ প্রথম শতকের দ্বিতীয়ার্ধ - ২২৫ খ্রীষ্টাব্দ) পতনের পর বাকাটকদের (২৫৫ খ্রীষ্টাব্দ - খ্রীষ্টীয় ষষ্ঠ শতকের প্রথমার্ধ) শাসন শুরু হয়। বাকাটকের যুগে বিদর্ভ অঞ্চলে সমৃদ্ধি দেখা যায়। এটি প্রত্নতাত্ত্বিকভাবেও বুঝা যায়। এই সময়ে কালিদাসের বিখ্যাত সাহিত্য রঘুবংশ লিখিত হয়। বাকাটক রাজা প্রবর সেনের রাজত্বকালে আশেপাশের অঞ্চলে রাজত্ব বিস্তার হয়। প্রবর সেন কিছু সংখ্যক বৈদিক যজ্ঞ করেছিলেন যার মধ্যে চারটি অশ্বমেধ যজ্ঞ ছিল। বাকাটক বংশের শেষ রাজা ছিলেন হরি সেন। তাঁর সময়ে অজন্তার সমৃদ্ধি ঘটে ও তা এর চূড়ায় পৌঁছায়। বাকাটকদের সময়ে ব্রাহ্মণ্য ও বৌদ্ধ ধর্মের নানা ধরনের ভাস্কর্য তৈরী করা হত। উন্নত ভাস্কর্যের মধ্যে মনসার শিবের উল্লেখ করা যায়। কাঠামোর সাহায্যে তৈরী মন্দির ও ব্রাহ্মণ্য মূর্তি বাকাটকদের সময়ে সূচনা হয়, যা এর আগে বা পরে বিদর্ভ অঞ্চলে কখনো দেখা যায় নাই।

------------------------------------

দেখুনঃ Kanchana B. Bhaisare, V.S. Shinde and P.S. Joshi, Saurajyaramya: Vidarbha of the Vakataka Times, (Notes and News), in, Purātattva, No. 44, 2014, pp. 254-255. 

  দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ২৫৫।

------------------------------------

ওড়িশার কালাহান্ডি জেলায় ডিউন্ডিতে মন্দিরের ভগ্নাংশ ও শিলা কাটা ভাস্কর্যের খণ্ডিত অংশ থেকে মনে করা হচ্ছে এগুলি গুপ্ত উত্তর ও আদি মধ্য যুগের সময়কার।

------------------------------------

দেখুনঃ Sakir Hussain and Dina Krishna Joshi, Archaeology of Kalahandi district: Finds from Kachimdola and Deundi, (Notes and News), in, Purātattva, No. 44, 2014, p. 261.

------------------------------------

রাজস্থানের আলওয়ার জেলায় পরানগর নামে একটি প্রত্নস্থলে প্রায় ডজনের মত হিন্দু ও জৈন ধর্মের মন্দির ছিল বলে জানা যায়। এখানকার সমৃদ্ধ শিল্প ও স্থাপত্যগুলি ছিল প্রতিহার যুগের (অষ্টম শতকের মধ্যভাগ থেকে ১১শ শতাব্দী)।

------------------------------------

দেখুনঃ Ambika Dhaka, Rare Sculptures of Kubera from Paranagar, (Notes and News), in, Purātattva, No. 44, 2014, p. 263.

------------------------------------

৬ষ্ঠ থেকে ১৩শ শতাব্দী সময়ে হিন্দু মন্দির সমূহের কাঠামো চারিপাশ ও উচ্চতা উভয় দিকে সম্প্রসারিত হয়। এর ফলে পুণ্যার্থীরা মন্দিরে প্রবেশ করতে পারত। সপ্তম শতাব্দীর দিকে দক্ষিণ ভারতের মন্দিরে তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন দেখা গেল এবং ক্রমে তা এক জটিল প্রতিষ্ঠানে পরিণত হল। এই যুগে বৌদ্ধ ও জৈন মঠ ও মন্দিরেরও বিকাশ ঘটেছিল।

------------------------------------

দেখুনঃ Himanshu Prabha Ray, The Archaeology of Sacred Spaces in India: From Multi-Religious Sites to Monuments, in, Purātattava, Number 44, 2014, p. 8.

------------------------------------

ভারতবর্ষের ইতিহাসে আদি মধ্য যুগ ধরা হয় প্রায় ৬০০ থেকে ১২০০ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত। প্রত্নতাত্ত্বিকভাবে ভারতবর্ষে ষষ্ঠ থেকে ত্রয়োদশ শতাব্দী পর্যন্ত শহর ও নগরগুলো পরিত্যক্ত হবার প্রমাণ পাওয়া যায়। এই সময়ে দীর্ঘ দূরত্বের বাণিজ্য কমে গিয়েছিল, তবে যোগাযোগ বজায় ছিল। খ্রীষ্টীয় ৬ষ্ঠ শতাব্দীতে গুপ্ত রাজবংশের পতনের পরে এই বিনগরায়ন ঘটেছিল বলে ধারণা করা হয়। হিউয়েন সাং খ্রীষ্টীয় সপ্তম শতাব্দীতে ভারতবর্ষে এসেছিলেন। তাঁর লেখায় বিপুল সংখ্যায় বৌদ্ধ স্থাপত্য ও বসতির ধ্বংস ও নগর পরিত্যক্ত হবার বিবরণ পাওয়া যায়।

------------------------------------

দেখুনঃ Jason Hawkes, Chronological Sequences and the Problem of Early Medieval Settlement in India, in, Purātattva, No. 44, 2014, p. 209.

দেখুনঃ A.P. Jamkhedkar, Apropos ‘The Urban Decay in Indian History’, in, Purātattva, No. 40, 2010, pp. 5-6. 

------------------------------------

উত্তর প্রদেশে মধ্য গঙ্গা সমভূমিতে আগিয়াবীর নামে একটি বসতিতে তাম্র যুগ থেকে গুপ্ত/উত্তর-গুপ্ত যুগ পর্যন্ত বসবাসের ধারাবাহিকতা দেখা গেছে। গঙ্গা নদীর তীরে এর অবস্থান হওয়াতে দীর্ঘ দূরত্বের বাণিজ্য এখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। শুঙ্গ-কুষাণ যুগে বসতিটিতে বিকশিত নগরায়ন দেখা যায়। বসতিটির সমৃদ্ধি গুপ্ত যুগের প্রথম পর্যায় পর্যন্ত দেখা যায়। গুপ্ত যুগের পরবর্তী পর্যায়ে এখানকার উৎকষতা হ্রাস পায়। গুপ্ত যুগের পরে বসতিটি পরিত্যক্ত হয়। মধ্য গঙ্গা সমভূমিতে গুপ্ত যুগের পরে অনেক বসতি আকস্মিক পরিত্যক্ত হয়েছিল। আগিয়াবীরে কিছু কাঠামো যেমন মন্দিরের দরজার চৌকাঠের পাথরের বাজু ও অম্বিকা, গণেশ, সূর্য ও একমুখী শিবলিঙ্গের ভাংগা অংশ ১০ম-১২শ শতাব্দী পর্যন্ত পড়ে ছিল। এথেকে মনে হয় যে, আদি মধ্য যুগে এই বসতিটির বাণিজ্যিক কাজকর্মে বিপর্যয় হলেও এর ধর্মীয় গুরুত্ব অনেক দিন পর্যন্ত টিকে ছিল।

------------------------------------

দেখুনঃ Vibha Tripathi and Prabhakar Upadhyay, Further Excavations at Agiabir (2005-06), in, Purātattva, No. 37, 2007, pp. 127-128.

------------------------------------

ভারতবর্ষব্যাপী আদি ঐতিহাসিক যুগে বিনগরায়নের সময়ে কোথায়ও কোথায়ও গ্রামীণ বসতির সম্প্রসারণ ঘটতে দেখা গেছে। এই সময়ে মহারাষ্ট্রের মধ্য ভীমা অববাহিকায় বসতির সম্প্রসারণ লক্ষ্য করা যায়। এই বসতিগুলির বেশীরভাগই ছোট ছিল, প্রায় ১-৩ হেক্টরের মত, কেবলমাত্র অল্প সংখ্যক বসতি ৫ হেক্টর বা তার বেশী ছিল।

------------------------------------

দেখুনঃ Varada Khaladkar, Archaeological Investigations in the Middle Bhima Basin, Maharashtra: A Preliminary Report, in, Purātattva, No. 38, 2008, p. 37.

------------------------------------

ছত্তিসগড়ে তারিঘাট নামে একটি বসতিতে প্রাক-কুষাণ থেকে কালাচুরি যুগ পর্যন্ত সাংস্কৃতিক পর্যায় পাওয়া গেছে। এখানে গুপ্ত যুগের সমসাময়িক সরভাপুরিয়া বংশের শাসন ছিল। সেই সময়ে যে সমস্ত জিনিসপত্র পাওয়া যায় সেগুলি থেকে তাদের বিষ্ণু ধর্ম বিশ্বাস ছিল বলে বুঝা যায়। এরপর কালাচুরি পর্বে এখানে পাওয়া ফলকে গণেশ, উমা-মহেশ্বরের মূর্তির ভগ্নাংশ ছিল।

------------------------------------

দেখুনঃ J.R. Bhagat, Atula Kumar Pradhan and Deepti Goswami, Excavation at Tarighat, Chhattisgarh (2012-2013), in, Purātattva, No. 43, 2013, pp. 192-193.

------------------------------------

ভারতের পশ্চিম বঙ্গের বর্ধমান জেলায় আদি মধ্য যুগ ও মধ্য যুগের বসতি সমূহের উপর প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান চালিয়ে খ্রীষ্টীয় নবম থেকে পঞ্চদশ শতাব্দী পর্যন্ত মঙ্গলকোট এলাকায় তিনটি মন্দির ও সংযুক্ত কাঠামো/ মন্দির ও একটি বৌদ্ধ স্তূপ পাওয়া গেছে।  পাল-সেন যুগের কিছু মূর্তি, যেগুলির মধ্যে একটি ধ্যানী-বুদ্ধ ও দু’টি বিষ্ণু মূর্তি উল্লেখ করার মত। মঙ্গলকোট এলাকায় আদি মধ্য যুগের ব্রাহ্মণ্য ও জৈন ধর্মের কিছু চমৎকার ভাস্কর্য ছিল। এছাড়া অন্যান্য অঞ্চলে বৌদ্ধ স্তূপ, বৌদ্ধ, জৈন ও ব্রাহ্মণ্য ধর্মের মূর্তি পাওয়া গেছে।

------------------------------------

দেখুনঃ R.K. Chattopadhyay, Rajat Sanyal and Sharmila Saha, An Archaeological Study along the Damodar-Ajay Interfluve in West Bengal (Circa AD Ninth to Fifteenth Centuries), in, Purātattva, No. 36: 2005-2006, 2006, pp. 118-129.

------------------------------------

তামিলনাড়ুর নিম্ন কাবেরী নদী উপত্যকায় লৌহ যুগ, আদি ঐতিহাসিক ও মধ্য যুগের বসতি পাওয়া গেছে। এখানকার মধ্য যুগের কিছু বসতিতে ভক্তি আন্দোলনে উল্লেখিত দেবরাম মন্দির পাওয়া গেছে। এছাড়া কিছু বসতিতে মধ্য যুগের বুদ্ধের মূর্তি পাওয়া গেছে। এখানে অম্বল নামে বসতিতে মধ্য যুগের মন্দির আছে যা শিবের প্রতি উৎসর্গীকৃত, যাকে ব্রহ্মপুরীশ্বরার (Brahmapuriswarar) বলে। এই গ্রামের পশ্চিমে একটি প্রাচীন বিষ্ণু মন্দির আছে।

------------------------------------

দেখুনঃ V. Selvakumar, K. Mathivanan, V. Parandaman, Jaseera Majeed, A. Raja, R. Santhanam, R. Karthikeyan and G. Manikandan, Iron Age-Early Historic and Medieval Settlements in the Lower Kaveri Valley: A Preliminary Report of the Archaeological Excavation at Ambal (2015-16), District Nagapattinam, Tamil Nadu, in, Purātattva, No. 46, 2016, pp. 168-173.

------------------------------------

পাতা : ২৭

ঝাড়খণ্ডের বেনীসাগর নামক স্থানে কিছু মন্দির আছে যেগুলি শৈব ধর্মের অনুসারী হিন্দুদের ও খ্রীষ্টীয় ৯ম শতাব্দীর তৈরী। এগুলির মধ্যে পঞ্চায়তন মন্দিরটি গুরুত্বপূর্ণ। এখানে যে সমস্ত মূর্তি পাওয়া গেছে সেগুলি হল সূর্য, ভৈরব, অগ্নি, বায়ু ও কুবেরের।

------------------------------------

দেখুনঃ T.J. Baidya, N.K. Sinha and R. Dehuri, Further Excavations at Benisagar in Jharkhand, (Notes and News), in, Purātattva, No. 39, 2009, pp. 205-209.

------------------------------------

উত্তর প্রদেশের ফতেহপুর সিকরি অঞ্চলের চারিপাশের ২৫ কিলোমিটার দূরত্ব পর্যন্ত অনুসন্ধান চালিয়ে অনেকগুলি গ্রামে খ্রীষ্টীয় ২য় থেকে ৯ম শতাব্দীর প্রচুর ভাস্কর্য, মন্দির ও অন্যান্য প্রত্নবস্তু পাওয়া গেছে। এই স্থানগুলিতে জৈন মন্দির ও বহু সংখ্যক শৈব, বৈষ্ণব ও শাক্ত মন্দির তৈরী করা হয়েছিল, যেগুলিকে সমসাময়িক শাসকরা পৃষ্ঠপোষকতা দান করতেন।  প্রত্নতাত্ত্বিক খননে সিকরি অঞ্চলের বীরছাবিলি টিলাতে পর্ব ১-এ খ্রীষ্টীয় ৬ষ্ঠ-৭ম শতাব্দীর লাল বেলে পাথরের তৈরী একটি ভাংগা অম্বিকা মূর্তি পাওয়াতে ধারণা করা হয় যে এখানে গুপ্ত যুগের শেষের দিকে জৈন মন্দির ছিল। এখানে পর্ব ২-এ ৯ম থেকে ১১শ শতাব্দীতে বিপুল পরিমাণ জৈন তীর্থঙ্কর ও অন্যান্য অধীনস্থ দেব-দেবীর মূতি ছিল। এই পর্বে একটি জৈন মন্দিরও ছিল।

------------------------------------

দেখুনঃ D.V. Sharma, V.N. Prabhakar, A. Pradhan and K.A. Kabui, Excavation at Birchhabili Tila, Sikri, in, Purātattva, No. 31: 2000-2001, 2001, p. 56.

দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ৫৭-৬১।

------------------------------------

গুজরাটের পবাগধ পাহাড়ে মৌলিয় মালভূমিতে হিন্দু ও জৈন মন্দির নির্মাণ করা হয়েছিল। এগুলির মধ্যে শৈব ধর্মের পশুপত মতের পশুপতিনাথ মন্দিরটি সবচেয়ে পুরনো যা খ্রীষ্টীয় দশম বা একাদশ শতাব্দীর। জৈনদের দিগম্বর মতের তিন ধরনের মন্দির আছে যেগুলি খ্রীষ্টীয় ১১শ-১২শ শতাব্দীর তৈরী। বলা হয় যে চালুক্য রাজা বীরধাবলের মন্ত্রী বস্তুপাল ও তেজপাল (১২২০-৪০ খ্রীষ্টাব্দ) পবাগধ পাহাড়ে মহাবীরস্বামীর (মহাবীরের) একটি সর্বতোভদ্র ধরনের মন্দির তৈরী (Sarvatobhadra type temple) করেছিলেন। কাঠামোগত ও সাহিত্যের সাক্ষ্য থেকে ধারণা করা যায় যে পবাগধ গুজরাটের একটি গুরুত্বপূর্ণ জৈন কেন্দ্র ছিল।

------------------------------------

দেখুনঃ V.H. Sonawane, Excavations at Champaner: A First World Heritage Site of Gujarat, in, Purātattva, No. 39, 2009, p. 69.

------------------------------------

পশ্চিম বঙ্গের বাঁকুড়া জেলায় বিষ্ণুপুর অঞ্চলে আদি মধ্য যুগ ও মধ্য যুগের হিন্দু, বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন পাওয়া গেছে। হিন্দু মূর্তিগুলির মধ্যে বিষ্ণু, শিব, শক্তি, সূর্য, গণপতি ও অন্যান্য গৌণ দেব-দেবী যেমন, বরাহি, পার্বতী, মনসা, ইত্যাদি ছিল। জৈন মূর্তিগুলির মধ্যে ছিল তীর্থংকর ও শ্মশানদেবী। বৌদ্ধ মূর্তি যদিও দুর্লভ ছিল, তা কিছু সংখ্যক বোধিসত্ত্ব ও মহাযান তান্ত্রিক ধর্মের ছিল।

------------------------------------

 দেখুনঃ Rupendra K. Chattopadhyay, Paromita Bose and Dipshikha Acharya, Archaeological Sequence of a Region: Bishnupur/Vishnupur Sub-Division, District Bankura, West Bengal, in, Purātattva, No. 39, 2009, 88-89.

------------------------------------

ওড়িশায় বুদ্ধপাড়ায় সোমনাথ মন্দির গঙ্গা যুগে খ্রীষ্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষ চতুর্থাংশে তৈরী করা হয়েছিল।  এই মন্দিরটি কলিঙ্গ ধরনের শিল্পের এক চমৎকার নিদর্শন। এই মন্দিরের ধরন দেখে ধারণা করা যায় যে এটি কোনার্কের সূর্য মন্দিরের পরে তৈরী হয়েছিল।

------------------------------------

দেখুনঃ Ratnakar Moahapatra, Somanath Temple at Buddhapada, (Notes and news), in, Purātattva, No. 44, 2014, pp. 243, 248.

------------------------------------

ভারতের মধ্য প্রদেশের উজ্জয়িনে খ্রীষ্টীয় ১৪শ-১৬শ শতাব্দীর শ্রী চন্দ্রপ্রভা দিগম্বর জৈন মন্দির নামে একটি জৈন মন্দিরে ২৫টি ধাতুর ও ১৫টি পাথরের মূর্তি পাওয়া গেছে।  সবচেয়ে প্রাচীন ধাতুর জৈন মূর্তি পাওয়া গেছে গুজরাটের আকোটায় খ্রীষ্টীয় প্রায় ৫ম শতাব্দীর।

------------------------------------

দেখুনঃ Arvind Kumar Singh and Navneet Kumar Jain, Jaina Bronze Images from Ujjain, in, Purātattva, No. 39, 2009, p. 107.

দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ১০৭-১০৮।

------------------------------------

দেখা গেছে যে, ব্রাহ্মণ্য ধর্মের কিছু দেব-দেবী মহাযানী বৌদ্ধ ধর্মের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল যেমন, সরস্বতী, গণেশ ও সপ্তমাতৃকা। ব্রাহ্মণ্য দেব-দেবী যেমন, সূর্য, বিষ্ণু, কুবের ইত্যাদি বৌদ্ধ ধর্মে মারিচী, লোকেশ্বর, জম্ভল, ইত্যাদি হিসাবে প্রবেশ করেছিল।

------------------------------------

দেখুনঃ G.K. Lama, Brahmanical and Buddhist Sculptures in district – Nalanda (Based on archaeological explorations: 2012-14), (Notes and News), in, Purātattva, No. 44, 2014, p. 299.

------------------------------------

বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মে লিপির ব্যবহার ও সংস্কৃত লিপির উদ্ভব

বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের লিখিত দলিলসমূহের সাথে হিন্দু ধর্মের লিখিত দলিলসমূহের তুলনা করলে দেখা যায় যে, জৈন ও বিশেষভাবে বৌদ্ধ ধর্ম লিখিত দলিলের প্রতি উচ্চতম সম্মান প্রদর্শন করেছে। সম্ভবত এই কারণে বৌদ্ধ ও জৈনরা তুলনামূলক উন্নত হস্তলেখ শিল্প সমৃদ্ধ পাণ্ডুলিপির ঐতিহ্য গড়ে তুলেছিল। ভারতে আনুশাসনিক পালি লিপির ব্যবহার তুলনামূলকভাবে দুর্লভ। যেগুলি পাওয়া গেছে সেগুলি ধর্মীয় বিষয়ের সাথে সম্পর্কিত। যেমন, সারনাথে দু’টি শিলালেখ উল্লেখ করছে ‘চার মহৎ সত্য’ এবং ‘বৌদ্ধ ধর্মমত’।

------------------------------------

দেখুনঃ Richard Salomon, Indian Epigraphy: A Guide to the Study of Inscriptions in Sanskrit, Prakrit, and the other Indo-Aryan Languages, Munshiram Manoharlal Publishers Pvt. Ltd., New Delhi, 1998, p. 8.

দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ৮০।

------------------------------------

এটি খুব কৌতূহলোদ্দীপক বিষয় যে, প্রাচীন সংস্কৃত লিপির উদ্ভবের সাধারণভাবে স্বীকৃত সময় বিবেচনা করলে উৎকীর্ণ লিপি হিসাবে সংস্কৃতের প্রথম ব্যবহার হয়েছিল কেবলমাত্র খ্রীষ্টপূর্ব প্রথম শতাব্দীতে, যেমন অযোধ্যা (উত্তর প্রদেশ) এবং রাজস্থানের ঘোসুণ্ডি ও হাথিবাদা শিলালিপি। সংস্কৃত লিপির এই দৃষ্টান্তগুলি ছাড়া খ্রীষ্টীয় প্রথম ও দ্বিতীয় শতাব্দীতে শক ক্ষত্রপ ও কুষাণদের প্রথম দিকে মথুরায় অনেকগুলি দলিল পাওয়া গেছে যেগুলি সংস্কৃত বা সংস্কৃতের কাছাকাছি ভাষায় লেখা হয়েছে। এটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ যে, খ্রীষ্টীয় চতুর্থ শতাব্দীতে প্রথম দিককার গুপ্ত সম্রাটদের শাসনামলে মর্যাদাপূর্ণ লিপির ভাষা হিসাবে সংস্কৃত উপমহাদেশে চূড়ান্তভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। এই চূড়ান্ত রূপ দেখা যায় রাজা সমুদ্রগুপ্তের (চতুর্থ শতাব্দীর মধ্য থেকে শেষ পর্যন্ত) উৎকীর্ণ লিপিতে, এলাহাবাদ স্তম্ভ লিপিতে। এই সময় থেকে উত্তর ভারতে গুপ্তদের ও তাদের প্রতিবেশীদের ও সামন্তদের সকল উৎকীর্ণ লিপি সঠিক ও প্রমিত সংস্কৃতে লেখা হতে থাকে। কিছু পরে দক্ষিণ ভারত এবং অন্যত্রও একই ধরনের বিকাশ দেখা গিয়েছিল।

------------------------------------

দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ৮৬।

দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ৯২।

------------------------------------

পাতা : ২৮

গাঙ্গেয় উপত্যকায় গরুর মাংস ভক্ষণের প্রত্নতাত্ত্বিক সাক্ষ্য

আমরা আগের পর্বে দেখেছি যে, সিন্ধু সভ্যতায় গরুর মাংস প্রধান একটি খাদ্য উপাদান ছিল। প্রত্নতাত্ত্বিক সাক্ষ্য থেকে জানা যায় সেই সময়ে অন্যান্য পশুর মাংসের চেয়েও গরুর মাংস বেশী জনপ্রিয় ছিল। পরবর্তীকালে গাঙ্গেয় উপত্যকায় আদি লৌহ যুগ ও লৌহ যুগের কিছু বসতি থেকে প্রধান খাদ্য তালিকায় গরু থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে, তেমনি পরবর্তী বিভিন্ন যুগে গুপ্ত ও উত্তর গুপ্ত যুগ পর্যন্ত প্রধান খাদ্য তালিকায় গরু থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়। এ থেকে মনে হয় গরুর মাংসই অন্তত গুপ্ত ও গুপ্ত-উত্তর যুগ পর্যন্ত জনসমাজে সবচেয়ে পছন্দের মাংস ছিল। যদিও প্রাচীন বসতিগুলিতে পশুর হাড়ের উপর তুলনামূলক কম কাজ হয়েছে, তবু সাম্প্রতিক কালে এর উপর কিছু কাজ হওয়াতে ভারতবর্ষে মানুষের সাধারণ খাদ্যাভ্যাসের উপর আমাদের ধারণা অতীতের চেয়ে সমৃদ্ধ হচ্ছে।

মহারাষ্ট্রের লৌহ যুগের একটি বসতি চাচন্ডিতে মোষ, গরু ও ছাগল খাদ্য হিসাবে ব্যবহার করার প্রমাণ পাওয়া গেছে।

------------------------------------

দেখুনঃ Jason D. Hawkes, Riza Abbas, Gurudas Shete and Michael Willis, A Newly Discovered Early Iron Age Settlement at Chachondi, District Amravati, Maharashtra, in, Purātattva, Number 46, 2016, p. 124.

------------------------------------

হরিয়ানায় মদিনা নামে চিত্রিত ধূসর মৃৎপাত্র সংস্কৃতির একটি বসতি থেকে ১৪০০-১২০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের দিকে গরু, মোষ, ভেড়া, ছাগল ও শুওরের মাংস খাদ্য হিসাবে ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে গরুর ব্যবহার সবচেয়ে বেশী ছিল।

------------------------------------

দেখুনঃ P.P. Joglekar, Manmohan Kumar and V.S. Shinde, A Preliminary Report of Faunal Remains from Madina Rohtak District, Haryana, (Notes and News), in, Purātattva, No. 38, 2008, p. 222-225.

------------------------------------

উত্তর প্রদেশের মাদার দিহ্ থেকে উত্তরাঞ্চলীয় কাল মসৃণ মৃৎপাত্র পর্ব, শুঙ্গ-কুষাণ যুগ (খ্রীঃপূঃ ২য় থেকে খ্রীষ্টীয় ২য় শতাব্দী) এবং গুপ্ত (৩০০ খ্রীষ্টাব্দ - ৫৫০ খ্রীষ্টাব্দ) ও উত্তর গুপ্ত যুগের খাদ্যাভ্যাস সম্পর্কে দেখা যায় যে, এই তিনটি যুগেই প্রধান খাদ্য গরু ছিল।  এরপর ছিল মোষ, যা কেবল গুপ্ত ও গুপ্ত-উত্তর যুগে দেখা গেছে। সব যুগে গরুর পরে খাদ্য তালিকায় ছিল ভেড়া ও ছাগল। প্রত্নতাত্ত্বিক খননে প্রাপ্ত পশুর হাড়ে খাবার উদ্দেশ্যে কাটার চিহ্ন থেকে এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে।

------------------------------------

দেখুনঃ P.P. Joglekar, Anil Kumar Dubey, Chandrashekhar and Sachin Kumar Tiwary, Animal Remains from Madar Dih, District Jaunpur, Uttar Pradesh, (Notes and News), Purātattva, Number 43, 2013, pp. 265-266.

------------------------------------

উত্তর প্রদেশের আগিয়াবীর নামে একটি বসতিতে প্রাক-উত্তরাঞ্চলীয় কাল মসৃণ মৃৎপাত্র ও উত্তরাঞ্চলীয় কাল মসৃণ মৃৎপাত্রের যুগে (৬০০ খ্রীঃপূঃ - ২০০ খ্রীঃপূঃ) অন্যান্য প্রাণীর চেয়েও গরু ও মোষ খাবার হিসাবে ব্যবহারের সবচেয়ে বেশী প্রমাণ পাওয়া গেছে।

------------------------------------

দেখুনঃ Arati Deshpande-Mukherjee, P.K. Thomas, Purushottam Singh and A.K. Singh, Faunal Remains from Agiabir, Dt. Mirzapur, Uttar Pradesh, (Notes and News), in, Purātattva, No. 36: 2005-2006, 2006, p. 249.

------------------------------------

উত্তর প্রদেশের সিসওয়ানিয়ায় চারটি সাংস্কৃতিক স্তর পাওয়া গেছে। এগুলির মধ্যে পর্ব ১: উত্তারাঞ্চলীয় কাল মসৃণ মৃৎপাত্র পর্ব (খ্রীঃপূঃ প্রায় ১০ম-৯ম শতাব্দী), পর্ব ২: উত্তরাঞ্চলীয় কাল মসৃণ মৃৎপাত্র পর্ব (খ্রীঃপূঃ প্রায় ৯ম-৩য় শতাব্দী), পর্ব ৩: শুঙ্গ যুগ (খ্রীঃপূঃ প্রায় ২য়-১ম শতাব্দী) ও পর্ব ৪: কুষাণ যুগ (খ্রীষ্টীয় প্রায় ১ম-৩য় শতাব্দী)। এখানে প্রতিটি স্তরে বিভিন্ন প্রাণীর হাড়ের মধ্যে সবচেয়ে বেশী পরিমাণ গরুর হাড় পাওয়া গেছে এবং হাড়ে কাটার চিহ্ন থেকে বুঝা যায় যে খাদ্য হিসাবে গরু ও আরো অনেক প্রাণীর মাংস খাওয়া হত।

------------------------------------

দেখুনঃ B.R. Mani, Excavations at Siswania (District Basti, U.P.): 1995-1997, in, Purātattva, No. 34: 2003-2004, 2004, pp. 101, 104.

------------------------------------

কোনো বসতিতে পশুর হাড় প্রাপ্তির উপর সাম্প্রতিক অনেক তথ্য যোগ হচ্ছে। কিন্তু আগেকার প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখননগুলিতে বেশীরভাগ বসতিতে প্রাপ্ত পশুর হাড়ের উপর অনুসন্ধান তেমন না হওয়াতে আমাদের হাতে পর্যাপ্ত তথ্য নাই। তবে সাধারণভাবে এ কথা বলা যায় যে, গাঙ্গেয় সমভূমিতে লৌহ যুগ থেকে শুরু করে উত্তর গুপ্ত যুগ পর্যন্ত গরুর মাংস খাবার ব্যপারে সম্ভবত নিষেধাজ্ঞা ছিল না। শুধু তাই নয় প্রাচীন ভারতীয় ভেষজশাস্ত্রের উপর বিখ্যাত গ্রন্থ চরকসংহিতায় বিভিন্ন অসুখে গরুর মাংসের স্যুপ ও চর্বি খাবার পরামর্শ দেওয়া আছে। এথেকে অনুমান করা যায় যে, সেই সময়ে ব্রাহ্মণ গরুর মাংস খাবার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে নাই।

------------------------------------

দেখুনঃ Baba Mishra, U.S. Kar, M.P. Singh Deo and Ranvir Singh, Early Historical Budigarh, Odisha and its Ethnomedicinal Environment: A Preliminary Investigation, in, Purātattva, No. 44, 2014, p. 141.

------------------------------------

আবার এমন হতে পারে কোনো বসতিতে শুধুমাত্র ব্রাহ্মণরা গরুর মাংস খেত না, বাকী জনগোষ্ঠী তা খেত এবং গরুর উপর তখনো পবিত্রতার ধারণা আরোপ করা হয় নাই। এই সম্ভাবনাও প্রবল যে, ব্রাহ্মণদের নেতৃত্বে গড়ে উঠা চতুর্বর্ণের ব্যবস্থা তখনো সমাজে দৃঢ়মূল হয় নাই। আমাদের এখনকার জ্ঞান থেকে এটি নিশ্চিত করে বলার কোনো উপায় নাই।

পরবর্তী ভারতীয় গ্রামীণ হিন্দু সমাজে বৌদ্ধ ও জৈন দেব-দেবীর আত্মীকরণ

সিন্ধু সভ্যতার পরবর্তী কালের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায় যে, ভারতবর্ষের সাধারণ মানুষ যে কোনো শক্তির প্রতীককে পূজা করত। যখন তারা হিন্দু ধর্মের অধীনস্থ হয় তখন তারা হিন্দু ধর্মের দেব-দেবীর মূর্তিগুলির সাথে বৌদ্ধ ও জৈনদের পরিত্যক্ত মূর্তিগুলিকেও ব্রাহ্মণ্য ধর্মের মূর্তির সাথে পূজা শুরু করে। প্রত্নতাত্ত্বিকরা এমন কিছু ঘটনার কথা উল্লেখ করেছেন। 

কিছু বসতিতে দেখা গেছে যে, প্রাচীন বৌদ্ধ মূর্তি ও নৈবেদ্যের জন্য নির্মিত স্তূপকে স্থানীয় গ্রামবাসীরা হিন্দু দেবতা হিসাবে পূজা করছে। এমন দেখা গেছে ওড়িশায় আরাগড়ের আশেপাশের গ্রামবাসীদের বৌদ্ধ মূর্তিকে পূজা করতে।  আরো দেখা গেছে যে, পশ্চিম বঙ্গের পুরুলিয়া জেলার বলরামপুর অঞ্চলের বাঁশগড় ও সাসানদিহিতে গ্রামের লোকেরা জৈন মূর্তিগুলিকে অন্যান্য দেবতার সাথে ব্রাহ্মণ্য দেবতা হিসাবে পূজা করছে।

------------------------------------

দেখুনঃ Sunil Kumar Patnaik, Excavations at Aragarh (2014-16): An Early Historic Buddhist Site, (Notes and News), in, Purātattva. No. 46, 2016, p. 226.

দেখুনঃ Shubha Majumder, Recent Explorations at Balarampur (Purulia district, West Bengal), (Notes and News), in, Purātattva, No. 46, 2016, pp. 237, 238.

------------------------------------

দক্ষিণ বিহারে নালন্দা মহাবিহারের আশেপাশের গ্রামগুলিতে অনুসন্ধান করে দেখা গেছে যে, তারা আধুনিক কোনো মন্দিরে বা খোলা জায়গায়, যাকে তারা স্থান বলে, সেই জায়গায় শৈব, বৈষ্ণব ও বৌদ্ধ ধর্মের মূর্তির সাথে জৈনদের মূর্তি রেখেছে। দেখা গেছে যে, বৌদ্ধদের মূর্তিগুলিকেও তারা হিন্দু দেব-দেবী হিসাবে পূজা করছে।

------------------------------------

দেখুনঃ Bijoy Kumar Choudhary, Identifying the Surroundings of Nalanda Mahavihara, in, Purātattva, No. 38, 2008, p. 101.

------------------------------------

উত্তর গুজরাটের তরঙ্গ পাহাড়ে তারনমাতা ও ধরানমাতা মন্দিরের বৌদ্ধ মূর্তিগুলিকে স্থানীয় গোত্রীয় মানুষদের দ্বারা তাদের স্থানীয় দেবী ও তাদের সহযোগী দেব-দেবী হিসাবে পূজা করতে দেখা গেছে।

------------------------------------

দেখুনঃ Y.S. Rawat, Hill Fort of Anarta: Discovery of a Unique Early Historical Fort with Cave-Dwellings, Buddhist Idols and Remains at Taranga in North Gujarat, in, Purātattva, No. 39, 2009, p. 101.

------------------------------------

পাতা : ২৯

 

৫ম অধ্যায় : হিন্দু ধর্মের উদ্ভবে ব্রাহ্মণের ভূমিকা

আমরা আগের অধ্যায়ে দেখেছি কিভাবে গাঙ্গেয় সমভূমিতে বৈদিক আন্দোলনের উত্তরসূরিরা প্রায় দেড় হাজার বছর পরে দ্বিতীয় নগরায়ন শুরু হলে সিন্ধু সভ্যতার অভিবাসী অন্যান্য জনগোষ্ঠীর সাথে সমাজে জায়গা করে নিয়েছে। তারা তখন সমাজে নিজেদের ব্রাহ্মণ হিসাবে পরিচয় দিয়েছে ও ক্ষত্রিয় নামে পরিচিত একটি শক্তিশালী ও সমাজে নেতৃত্বদানকারী সংখ্যাগুরু একটি গোষ্ঠীর সাথে নিজেদের অবস্থান করে নিয়েছে। এই কথা মনে রাখতে হবে যে, খ্রীষ্টপূর্ব ষষ্ঠ-পঞ্চম শতাব্দীতে সমাজে ব্রাহ্মণের নেতৃত্ব ছিল না। তবে সমাজে স্বতন্ত্র অস্তিত্বশীল জাতি বা গোত্র হিসাবে ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় ছিল। বৈশ্য ও শূদ্র সম্ভবত তাদেরকেই বলা হত যারা বিভিন্ন পেশাগত গোষ্ঠী গঠন করেছিল। বণিক, কৃষক, কারিগর — এদের সম্ভবত বৈশ্য বলা হত। আবার ধাঙর, গোঘাতক বা কশাই - এই ধরনের পেশার অধিকারীদের শূদ্র বলা হত। কিন্তু ক্ষত্রিয়, বৈশ্য বা শূদ্র কেউই ব্রাহ্মণের নিয়ন্ত্রণে ছিল না। তবে সম্ভবত এমন প্রথা ছিল যাতে করে শূদ্ররা শহর বা গ্রামের প্রান্তে বসবাস করে। মধ্যম নিকায় গ্রন্থে এই জন্যই সম্ভবত বলা হয়েছে ‘দক্ষ গোঘাতক বা গোঘাতক-অন্তেবাসী’। আরেকটি বিষয় মনে হয় যে, একটি গোত্র বা গোষ্ঠীর সাথে অপর গোত্রের আন্তঃ-বিবাহ ছিল না, যার কথা গ্রীক ঐতিহাসিক আরিয়ান উল্লেখ করেছেন । সেই সময়ে ব্রাহ্মণের নেতৃত্বাধীনে বর্ণাশ্রম ভিত্তিক চার বর্ণে সমাজের বিভাজনের অস্তিত্বও ছিল না। সেই সময়ে উত্তর ভারতের অনেক জনপদ যেমন ক্ষত্রিয় শাসিত ছিল তেমন তারা সমাজে নেতৃত্বদানকারী শ্রেণী হিসাবে সংখ্যাগুরুও ছিল। বৌদ্ধ সাহিত্য, পাণিনির রচনা ও প্রত্নতত্ত্ব এই সাক্ষ্যই দেয়। প্রাচীন ভারতের এই জনপদগুলিতে ব্রাহ্মণদের তাৎপর্যপূর্ণ কোনো ভূমিকা থাকার বিবরণ পাওয়া যায় না।

------------------------------------

  স্মৃতিপ্রস্থান-সূত্র (১০), ৭ এবং মহাসত্যক-সূত্র (৩৬), ১৭। দেখুনঃ শ্রীবেণীমাধব বড়ুয়া (অনূদিত), মধ্যম-নিকায়, পৃঃ ৬১, ২৬৮।

দেখুনঃ John W. McCrindle, Ancient India as described by Megasthenês and Arrian, p. 218.

------------------------------------

হিন্দু ধর্মের উত্থানের সময়কাল

আগের অধ্যায়ে প্রত্নতত্ত্বের আলোকে দেখেছি যে, ভারতবর্ষে আমরা যাকে হিন্দু ধর্ম বলি সেই ব্রাহ্মণ কেন্দ্রিক হিন্দু ধর্মের বিকাশ হয়েছে অনেক পরে, খ্রীষ্টীয় যুগ শুরু হবার পরে ধীর প্রক্রিয়ায় ও প্রায় গুপ্ত যুগে এসে তা দ্রুত সমাজে ছড়িয়ে পড়ে ও দৃঢ় ভিত্তি পায়।

সাতবাহনদের (খ্রীঃপূঃ প্রথম শতকের দ্বিতীয়ার্ধ - ২২৫ খ্রীষ্টাব্দ) সময় থেকেই বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের পাশাপশি কিছু পরিমাণে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের পৃষ্টপোষকতা দেখা যায়। খ্রীষ্টীয় তৃতীয় শতাব্দীর মাঝামাঝি শক শাসক উয়িমা-কাদফিসেসের প্রভাব ও গুরুত্বের কারণে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের উত্থান শুরু হয়।  খ্রীষ্টীয় চতুর্থ শতাব্দীর শেষের দিক থেকে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের শক্তিশালী উত্থান দেখতে পাওয়া যায়, যা যাগযজ্ঞে ও দেবতা ও দেবীদের অন্তর্ভুক্তির মধ্য দিয়ে প্রকাশ পায়। গুপ্ত যুগে পরবর্তী দুইশ’ বৎসর এই প্রক্রিয়া ধারাবাহিকভাবে চলতে থাকে। এই সময়ে শিব, বিষ্ণু, সূর্য ও মহাসেনের পূজা শাসক ও জনসাধারণের মধ্যে জনপ্রিয় হয়। ব্রাহ্মণ্য ধর্মের এই উত্থানের পিছনে গুপ্ত রাজাদের সবচেয়ে বেশী ভূমিকা ছিল। সমুদ্রগুপ্ত ও কুমারগুপ্ত অশ্বমেধযজ্ঞ সম্পন্ন করেছিলেন, যা পূর্বের শাসকরা আগেই বাদ দিয়েছিল। ব্রাহ্মণ্য ধর্মে নূতন দেব-দেবীদের জনপ্রিয় করার জন্য পুরাণসমূহ রচনা হতে শুরু করে উয়িমা কাদফিসেসের সময়ে প্রায় ২৫০ খ্রীষ্টাব্দ-এ। গুপ্ত যুগে খ্রীষ্টীয় চতুর্থ শতাব্দী থেকে আরো উদ্যমে অনেক পুরাণ নূতন করে রচনা হয়, যা আরো অনেক দিন পর্যন্ত চলেছিল।

------------------------------------

দেখুনঃ R.G. Bhandarkar, A Peep into the Early History of India, D.B. Taraporevala Sons and Co., Bombay, 1920, pp. 62-63.

দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ৫৩।

দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ৫৩।

  ঐতিহাসিক ভাণ্ডারকরের এবিষয়ে মন্তব্যটি গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেছেনঃ ‘… But now the necessity of glorifying the different gods and goddesses whose worship was rising in favour and of firmly inculcating other religious duties had been felt; and new Purâṇas were composed having the framework of the old but with new matter introduced on every occasion. … Most of the existing Purâṇas, perhaps all, were written to promote the worship the particular deities.’ দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ৬৬-৬৮।

------------------------------------

ইতিহাসে দেখা যায় যে, রাষ্ট্রের পৃষ্টপোষকতা ছাড়া কোনো ধর্মই সেভাবে প্রতিষ্ঠা পায় নাই। বৌদ্ধ ধর্ম তখনই প্রায় সমগ্র ভারতবর্ষে একটি শক্ত ভিত্তি পেয়েছিল যখন সম্রাট অশোক (২৬৮ - ২৩১ খ্রীঃপূঃ) নিজে বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেন ও তার শাসনাধীন সকল অঞ্চলে বৌদ্ধ ধর্ম প্রসারে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। দক্ষিণ ভারতে প্রথম সাতবাহন শাসকদের (খ্রীঃপূঃ প্রথম শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধ  - ২২৫ খ্রীষ্টাব্দ) ব্রাহ্মণ্য ধর্মকে বিশেষ গুরুত্ব সহকারে পৃষ্ঠপোষকতা করতে দেখা যায়। তারা নিজেরাও বৈদিক যজ্ঞ পালন করতেন। এরপর বাকাটক শাসকরা (২৫৫ - ষষ্ঠ শতকের প্রথমার্ধ) ব্রাহ্মণ্য ধর্মের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেন। কিন্তু এই দুই শাসকই প্রধানত দক্ষিণ ভারতে কেন্দ্রীভূত থাকাতে সমগ্র ভারতে এর তেমন প্রভাব তখনো পড়ে নাই। কিন্তু খ্রীষ্টীয় চতুর্থ শতাব্দীতে গুপ্ত রাজবংশের প্রতিষ্ঠা হলে ও গুপ্ত রাজারা ব্রাহ্মণ্য ধর্ম প্রতিষ্ঠা ও বিস্তারে বিশেষ মনোযোগ দিলে সেই সময় থেকে ক্রমশ ভারতব্যাপী হিন্দু ধর্মের প্রসার হয়।

বৈদিক ধর্মের সাথে হিন্দু ধর্মের পার্থক্য

সাধারণভাবে এই ধারণা প্রচলিত যে, হিন্দু ধর্ম বৈদিক ধর্মের উত্তরসূরি, এবং উভয় ধর্ম মোটামুটি একই। কিন্তু এটি একটি ভুল ধারণা। হিন্দু ধর্ম বৈদিক ধর্ম থেকে উদ্ভূত  হলেও হিন্দু ধর্ম সম্পূর্ণরূপে একটি ভিন্ন ধর্ম। এটা ঠিক যে, বৈদিক ধর্মের বেদ সমূহ, যেমন, ঋগ্বেদ, সামবেদ, যজুর্বেদ ও অথর্ববেদ হিন্দুদেরও পবিত্র গ্রন্থ। কিন্তু বৈদিক দেব-দেবীরা যেমন, ইন্দ্র, বরুণ, মিত্র, ঊষা, অশ্বিদ্বয়, অগ্নি, মরুৎগণ, ইত্যাদি হিন্দুদের পূজনীয় দেব-দেবী নয়। হিন্দুদের দেব-দেবী হল শিব, বিষ্ণু, কালী, গণেশ, লক্ষ্মী, সরস্বতী, ইত্যাদি। এই দেব-দেবীদের বেশীরভাগেরই নাম আবার বৈদিক সাহিত্যে পাওয়া যায় না।

হিন্দুরা মৃতদেহ দাহ করে। কিছু অঞ্চলে তারা সবার মৃতদেহ দাহ করলেও শিশুদের ও নাথ সন্ন্যাসীদের মৃতদেহ কবর দেয়। তবে এটি সাধারণ প্রথা নয়। ঋগ্বেদে মৃতদেহ দাহ ও কবর উভয় প্রথার কথাই উল্লেখ আছে। এ রকম একটি মন্ত্র নীচে দেওয়া হলঃ

‘হে স্বপ্রকাশ অগ্নি! যে সকল পিতৃলোক অগ্নি দ্বারা দগ্ধ হয়েছেন, কিংবা যাঁরা অগ্নি দ্বারা দগ্ধ হন নি, যাঁরা স্বর্গ মধ্যে স্বধার দ্রব্য প্রাপ্ত হয়ে আমোদ করে থাকেন, তাঁদের হয়ে তুমি আমাদের এ সজীব দেহকে তোমার ও তাদের অভিলাষ পূর্ণ করতে প্রবৃত্ত কর।’ (১০/১৫/১৪)

কিংবা, মৃতদেহ মাটির নীচে স্থাপন করা বা কবর দিবার ইঙ্গিত পাওয়া যায় এমন একটি মন্ত্রে বলা হচ্ছে, ‘১১। হে পৃথিবী! তুমি এ মৃতকে উন্নত করে রাখ, এঁকে পীড়া দিও না। এঁকে উত্তম উত্তম সামগ্রী, উত্তম উত্তম প্রলোভন দাও। যেরূপ মাতা আপন অঞ্চলের দ্বারা পুত্রকে আচ্ছাদন করেন তদ্রূপ তুমি একে আচ্ছাদন কর। ১২। পৃথিবী উপরে স্তূপাকার হয়ে উত্তমরূপে অবস্থিতি করুন। সহস্রধূলি এ মৃতের উপর অবস্থিতি করুক। তারা এর পক্ষে ঘৃতপূর্ণ গৃহস্থরূপ হোক, প্রতিদিন এ স্থানে তারা এর আশ্রয় স্থানস্বরূপ হোক।’ (১০/১৮/১১-১২)

এছাড়া মৃতদেহ দাহ করার প্রথার উল্লেখও ঋগ্বেদে পাওয়া যায়, যেমন, ‘হে অগ্নি! এ মৃতব্যক্তিকে একেবারে ভস্ম করো না, একে ক্লেশ দিও না, এর চর্ম বা এর শরীর ছিন্ন ভিন্ন করো না। হে জাতবেদা! যখন এর শরীর তোমার তাপে উত্তমরূপে পক্ব হয় তখনই এঁকে পিতৃলোকদের নিকট পাঠিয়ে দাও। ২। হে অগ্নি! যখন এর শরীর উত্তমরূপে পক্ব করবে, তখনই পিতৃলোকদের নিকট এঁকে দেবে। যখন ইনি পুনর্বার সজীবত্ব প্রাপ্ত হবেন, তখন দেবতাদের বশতাপ্রাপ্ত হবেন।’ (১০/১৬/১-২)

এছাড়া শ্মশানের উল্লেখ পাওয়া যায় ইন্দ্র দেবতার উদ্দেশ্যে রচিত ১/১৩৩/১ ও ১/১৩৩/৩ মন্ত্রে।

 বৈদিক যুগে কোনো মূর্তি পূজার প্রচলন ছিল না। ঋগ্বেদে পুত্তলিকা বা মূর্তির কথা উল্লেখ থাকলেও সেটা যে পূজার উদ্দেশ্যে ছিল না তা স্পষ্ট। যেমন ইন্দ্র দেবতার উদ্দেশ্যে রচিত নীচের মন্ত্রে বলা হচ্ছেঃ

‘দৃঢ়, নব ও ক্ষুদ্র দ্রুপদে স্থিত পুত্তলিকাদ্বয়ের ন্যায় তোমার পিঙ্গলবর্ণ অশ্বদ্বয় যজ্ঞে শোভা পায়।’ (৪/৩২/২৩)

অথবা, সোম প্রভৃতি দেবতার উদ্দেশ্যে রচিত মন্ত্রে দেখা যায়, ‘হে সূর্যা! তোমার পতিগৃহে যাবার পথে সুন্দর পলাশ তরু, সুন্দর শাল্মলীবৃক্ষ আছে অর্থাৎ ঐ কাষ্ঠে নির্মিত এর মূর্তি উৎকৃষ্ট সুবর্ণের ন্যায় শোভা।’ (১০/৫/২০)

অন্যদিকে হিন্দুদের পূজাই হয় দেব-দেবীর প্রতিমা নির্মাণ করে, সেটা স্থায়ী বা অস্থায়ী যাই হোক না কেন। কিন্তু স্ববিরোধিতাপূর্ণ মনে হলেও এটিই ঘটনা যে, হিন্দুদের পুরোহিত ব্রাহ্মণরা এই প্রতিমাকে সামনে রেখেই বৈদিক মন্ত্র পাঠ করে। এটা হচ্ছে হিন্দুদের পূজার পদ্ধতি।

পাতা : ৩০

বৈদিক ধর্মে সামাজিক পবিত্রতা-অপবিত্রতার ভিত্তিতে ও জন্মগতভাবে গড়ে উঠা চতুর্বর্ণ প্রথা ছিল না। ঋগ্বেদ এবিষয়ে পরিষ্কার সাক্ষ্য দেয়। ঋগ্বেদের একজন ঋষি বলছেন, ‘দেখ, আমি স্ত্রোত্রকার, পুত্র চিকিৎসক ও কন্যা প্রস্তরের উপর যব-ভর্জন-কারিণী। আমরা সকলে ভিন্ন ভিন্ন কর্ম করছি।’ (৯/১১২/৩)

কিন্তু হিন্দু ধর্মে ব্রাহ্মণের শ্রেষ্ঠত্বের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠা বর্ণ প্রথা একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হিসাবে কাজ করছে। এখানে তত্ত্বগতভাবে এবং বাস্তবেও পিতার কর্ম পুত্র করে। বর্ণ প্রথায় হিন্দু সমাজে আমরা দেখতে পাই সবচেয়ে উঁচু এবং পবিত্র বর্ণ হিসাবে ব্রাহ্মণ, তার পরের ধাপে ক্ষত্রিয় ও পরের দুই ধাপে যথাক্রমে বৈশ্য ও শূদ্র বর্ণকে। তত্ত্বগতভাবে এই চার বর্ণ থাকলেও বাস্তবে এখানে বহু বর্ণ রয়েছে। বর্ণ ব্যবস্থায় প্রত্যেকটি মানুষ কোন বর্ণের হবে সেটা জন্মসূত্রে ঠিক হয়ে থাকে। জন্মগতভাবে তার পেশা বা কর্মও ঠিক করা থাকে। এর ফলে পূজার পৌরোহিত্য কেবল ব্রাহ্মণদের কাজ, অন্য কেউই তা করতে পারে না। এখন আর ক্ষত্রিয় নাই, তার বদলে আছে কায়স্থ ও আরো এই ধরনের কিছু বর্ণ। যদিও আধুনিক শিক্ষা ও সভ্যতার প্রভাবে এখন বর্ণ ব্যবস্থা অনেকটা দুর্বল হয়েছে তবু হিন্দু সমাজ আজ অবধি বর্ণ ব্যবস্থার কাঠামো ভেঙ্গে বের হতে পারে নাই।

ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের ৯০ সূক্ত, যা পুরুষসূক্ত নামে পরিচিত, সেখানে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় বা রাজন্য, বৈশ্য ও শূদ্র এই চতুর্বণের যে উল্লেখ পাওয়া যায়, তা অনেক পরের বলে পণ্ডিতরা একমত পোষণ করেন। ভাষাতাত্ত্বিক পণ্ডিতরা পুরুষসূক্তের মন্ত্রের ভাষা পরীক্ষা করে নিশ্চিত হয়েছেন যে, ঋগ্বেদের মন্ত্র হলেও এই মন্ত্রের ভাষা বৈদিক নয়, বরং অনেক পরবর্তী কালের সংস্কৃত ভাষায় এই মন্ত্রটি রচিত। অর্থাৎ বেদ পরবর্তী কালের ব্রাহ্মণরা বর্ণাশ্রমভিত্তিক জাতিভেদ প্রথাকে ধর্মীয় বৈধতা দিবার উদ্দেশ্যে পরবর্তী কালে রচিত মন্ত্রটিকে ঋগ্বেদের অন্তর্ভুক্ত করেছে। সুতরাং পুরুষসূক্ত প্রকৃতপক্ষে ঋগ্বেদে একটি প্রক্ষেপ মাত্র। যাইহোক, পণ্ডিতরা একমত যে, ঋগ্বেদের সময়ে চতুর্বর্ণভিত্তিক জাতি বিভাগ ছিল না। অন্যদিকে, সেই সময় বর্তমান কালের হিন্দু দেব-দেবীগণ এবং প্রতিমা পূজা-পদ্ধতিও ছিল না।

হিন্দু ধর্মের আর একটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল গরুর উপর পবিত্রতার ধারণা আরোপ। এবং এই ধর্মে গো-মাংস ভক্ষণ নিষিদ্ধ। খ্রীষ্টীয় তৃতীয় শতাব্দীতে সংকলিত হিন্দুদের ধর্মীয় গ্রন্থ মনুসংহিতায় গোবধ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু বেদ থেকে জানা যায় যে বৈদিক ধর্মে গো-মাংস ভক্ষণ প্রচলিত ছিল। ইন্দ্রের উদ্দেশ্যে রচিত একটি মন্ত্রে দেখা যায়, ‘হে ইন্দ্র! যখন অন্ন কামনাতে তোমার উদ্দেশ্যে হোম করা হয়, তখন তারা শীঘ্র শীঘ্র প্রস্তরফলক সহযোগে মাদকতাশক্তিযুক্ত সোমরস প্রস্তুত করে, তুমি তা পান কর। তারা বৃষভসমূহ পাক করে, তুমি তা ভোজন কর।’ (১০/২৮/৩)

------------------------------------

  সেখানে বলা হয়েছে, ‘কলিযুগে অষ্টক প্রভৃতি শ্রাদ্ধ কর্মে কখনও গোবধ করবেন না।’ (আশ্রম ধর্ম, ১৭৬)। দেখুনঃ চৈতালী দত্ত (অনুদিত),  মনুসংহিতা, নবপত্র প্রকাশন, কলকাতা, ২০১৫, পৃষ্ঠাঃ ১২১।

  উইলসন ঋগ্বেদের ইংরাজী অনুবাদে এই ঋকটিকে এভাবে অনুবাদ করেছেনঃ ‘(Vasukra speaks:) Thy worshippers express with the stone fast flowing exhilarating Soma-juices for thee, thou drinkest them: they roast bulls for thee, thou eatest them, when thou art invoked, Maghavan, to the sacrificial food.’ (X/28/3)

দেখুনঃ H.H. Wilson (trans.), Rig-Veda Sanhitá, Part of the Seventh and the Eighth Ashțaka, Trübner & Co., London, 1888, p. 74.  

------------------------------------

এখানে বৃষভসমূহ অর্থাৎ ষাঁড়সমূহ রান্না করার কথা বলা হয়েছে, যা ইন্দ্র ভক্ষণ করবে। প্রকৃতপক্ষে দেবতার নামে মানুষই যে তা খাবে তাতে কোনো সন্দেহ নাই।

 ইন্দ্র প্রভৃতি দেবতার উদ্দেশ্যে রচিত আরেকটি মন্ত্রে বলা হচ্ছেঃ ‘১৩। হে বৃষাকপিবনিতে! তুমি ধনশালিনী ও উৎকৃষ্ট পুত্রযুক্তা এবং আমার সুন্দরী পুত্রবধূ। তোমার বৃষদের ইন্দ্র ভক্ষণ করুন তোমার অতি চমৎকার, অতি সুখকর হোমদ্রব্য তিনি ভক্ষণ করুন। ইন্দ্র সকলের শ্রেষ্ঠ। ১৪। আমার জন্য পঞ্চদশ এমন কি বিংশ বৃষ পাক করে দাও, আমি খেয়ে শরীরের স্থ‚লতা সম্পাদন করি, আমার উদরের দু’পার্শ পূর্ণ হয়। ইন্দ্র সকলের শ্রেষ্ঠ।’ (১০/৮৬)

------------------------------------

উইলসনের ইংরাজী অনুবাদ এই রকমঃ  ‘13. [Vṛishákapi speaks:] O mother of Vṛishákapi, wealthy, possessing excellent sons, possessing excellent daughters-in-law, let Indra eat thy bulls, (give him) the beloved and most delightful ghí; Indra is above all (the world).

14. [Indra speaks:] The worshippers dress for me fifteen (and) twenty bulls: I eat them and (become) fat, they fill both sides of my belly; Indra is avove all (the world).’ (10/86)  

------------------------------------

গরু বা ষাঁড়ের মাংস খাবার এই রকম আরো মন্ত্র ঋগ্বেদে পাওয়া যায়। যেমন, ‘হে ইন্দ্র! যে অস্ত্র ক্ষেপণ করে পাপাত্মা রাক্ষসকে বিদীর্ণ করলে, তোমার সে নিক্ষেপযোগ্য অস্ত্র কোথায় রইল? যেরূপ গোহত্যাস্থানে গাভীগণ হত হয় সেরূপ তোমার ঐ অস্ত্রদ্বারা নিহত হয়ে বন্ধুদ্বেষী রাক্ষসগণ পৃথিবীতে পতিত হয়ে শয়ন করে।’ (১০/৮৯/১৪)

------------------------------------

  উইলসন এর অনুবাদ করেছেন এভাবেঃ  ‘Where was thy (shaft), Indra, (which ought) to be hurled (against thy enemies) when thou didst cleave the Rákshasas hastening to war, and when the Mitrakrús lay on the ground there in confusion like cattle at the place of immolation?’ (10/89/14) 

------------------------------------

এখানে ঋগ্বেদের অনুবাদক টীকায় বলেছেন যে, গোহত্যা প্রথা বিশেষরূপে প্রচলিত ছিল, নচেৎ গোহত্যার জন্য ভিন্ন স্থান নির্ধারিত থাকা সম্ভব নয়।

গরু ও ষাঁড় আহুতি প্রদানের উল্লেখ পাওয়া যায় এই ঋকে, ‘হে অগ্নি! আমরা তোমাকে হৃদয়দ্বারা সংস্কৃত ঋক রূপ হব্য প্রদান করছি। বলশালী বৃষভ ও ধেনুগণ তোমার নিকট পূর্বোক্তরূপ হব্য হোক।’ (৬/১৬/৪৭)

------------------------------------

  উইলসন এর অনুবাদ করেছেনঃ ‘We offer to thee, Agni, the oblation sanctified by the heart, and (identified) with the sacred verse: may the vigorous bulls and the cows be (as such an oblation) to thee.’ (6/16/47)

------------------------------------

আরো ঋকে বলা হচ্ছেঃ

‘[ঋষি বলছেন] যে সকল ব্যক্তি দৈবকর্মের অনুষ্ঠান না করে এবং কেবল তাদের নিজেদের উদর পূরণ করে স্ফীত হয়ে উঠে, আমি যখন তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে যাই তখন হে ইন্দ্র! তোমার নিমিত্ত পুরোহিতদের সাথে একত্র স্থূলকায় বৃষকে পাক করি এবং পঞ্চদশ তিথির প্রত্যেক তিথিতে সোমরস প্রস্তুত করে থাকি।’ (১০/২৭/২)

হিন্দু বা ব্রাহ্মণ্য ধর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ হল গৃহ্য-সূত্র। সেখানকার সাংখ্যায়ন গৃহ-সূত্রে বলা হয়েছে,

‘১। যদি সেই ছয় ব্যক্তির যে কোনো একজনের অর্ঘ গ্রহণ প্রাপ্য, তার সাক্ষাতের জন্য যাও, তাকে প্রস্তুত করতে বল একটি গরু, একটি ছাগল, অথবা যে ধরনের খাদ্য সে সেখানে সবচেয়ে ভাল মনে করে।

২। অর্ঘ যেন মাংস ছাড়া না হয়।’ (সাংখ্যায়ন গৃহ্য-সূত্র, ২য় অধ্যায়, ১৫ খণ্ড)

------------------------------------

গৃহ্য-সূত্রের ইংরাজী অনুবাদে এভাবে বলা হয়েছে, ‘1. Should any one of the six persons (mentioned in the Srauta-sûtra and in the Sûtras 4-9) to whom the Arghya reception is due, visit (him), let him make (ready) a cow, a goat, or what (sort of food) he thinks most like (thereto).

2. Let the Arghaya not be without flesh.’

দেখুনঃ Hermann Oldenberg (trans.), The Grihya-Sûtra, Part I, Oxford at the Clarendon Press, 1886, in, The Sacred Books of the East Series, ed. F. Max Müller, Vol. XXIX, p. 87.

------------------------------------

পাতা : ৩১

এছাড়াও ষাঁড় বা গরুকে বলি দিবার কিংবা খাবার আরো উদাহরণ আছে, যেমন,

‘১। সেই শলাকা-বিদ্ধ ষাঁড়টি (যাকে রুদ্রের জন্য বলি দেওয়া হয়েছে)।

২। যা বলিদানকারীকে স্বর্গীয় পুরষ্কার এনে দেয়, গরু, পুত্র, ধন, সুনাম, দীর্ঘ জীবন।

... ... ...

১৫। এইভাবে গরু-বলি ঘোষণা করা হল।

১৬। এটি দুধ-ভাতের নৈবেদ্যের সাথে সংযুক্ত হল; (এই অনুষ্ঠানসমূহ) বিশেষ অনুষ্ঠানাদির সময় উপযুক্ত না হলে বাদ দেওয়া হবে।

১৭। বলির সময়ে বলির উপঢৌকন হল বলির বয়সের সমান একটি গরু।’ (পারষ্কর গৃহ্য-সূত্র, ৩য় কাণ্ড, ৮ খণ্ডিকা)

------------------------------------

  ইংরাজী অনুবাদে এভাবে বলা হয়েছে,  ‘1. The spit-ox (sacrificed to Rudra).

2. It procures (to the sacrificer) heavenly rewards, cattle, sons, wealth, renown, long life.

… … …

15. Thereby (also) the cow-sacrifice has been declared.

16. (It is combined) with (the offering of) milk-rice; (the rites) not corresponding (to that special occasion) are omitted.

17. The sacrificial fee at that (sacrifice) is a cow of the same age (as the victim).’

দেখুনঃ প্রাগুক্ত গ্রন্থ, পৃঃ ৩৫১, ৩৫৩।

------------------------------------

 খাদির গৃহ্য-সূত্রে একটি বিস্তারিত বিবরণ আছে গরু বলির পদ্ধতির উপর। সেখানে বলা হচ্ছেঃ

‘১। মধ্যকালে (আশ্তকা) একটি গরু বলি দেওয়া হয়।

২। অগ্নির পূর্ব দিকে গরুটিকে তার রাখা উচিত, পশ্চিম দিকে মুখ করে, এবং এই স্তবক উচ্চারণ করে বলি (আগ্য) দিতে হবে, ‘কি, হে পশুরা।’

৩। আহুতি দিবার পর তার আবৃত্তি করতে হবে (গরুর উপর স্তবকটি), “তোমার প্রতি”।

৪। তার উপর জল ছিটাতে হবে, যার মধ্যে যব আছে (নির্দিষ্ট হিসাবে), “আশ্তকার প্রতি সম্মত হয়ে আমি তোমাকে জল ছিটাই!”

৫। তার উপর জল ছিটানোর পর এবং একটি জ্বলন্ত কাষ্ঠখণ্ড নিয়ে তাকে প্রদক্ষিণ করে, সে পান করার জন্য (গরুটিকে) প্রক্ষনি জল দিবে।

৬। (অগ্নি থেকে) উত্তর দিকে যেয়ে সে হত্যা করবে (গরুটিকে), যার মাথা পশ্চিম দিকে ঘুরানো থাকবে, পাগুলি উত্তর দিকে থাকবে।

৭। এটিকে হত্যা করার পর, সে বলি (আগ্য) দিবে এই স্তবকটি সহ, “যদি এই পশু।”

৮। তার স্ত্রী এর শরীরের বিভিন্ন রন্ধ্র সমূহ পরিষ্কার করবে।

৯। গরুর দেহটি উন্মুক্ত করার পর, দু’টি পবিত্রকারী জিনিস (যেমন, ঘাসের পাতা) ছুরিটির নীচে স্থাপন করতে হবে, সে নাড়ি-ভুড়ি বের করবে।

১০। বলির জন্য পবিত্র গাছের দ্বিধাবিভাজিত একটি শাখার সাথে ধরে ও আরেকটি শাখার সাথে সে এটিকে ঝলসাবে।

১১। যখন এটি থেকে ফোঁটা পড়া বন্ধ হয়ে যাবে, সে গরুটিকে টুকরা করে কাটবে।

... ... ...

 ৩০। তখন এক পূর্ণ পাত্র খাবার রান্না হবে।’ (খাদির গৃহ্য-সূত্র, ৩য় পটল, খণ্ড ৪)

------------------------------------

  গৃহ্য-সূত্রের ইংরাজী অনুবাদে এভাবে দেওয়া আছেঃ

  1. On the middle (Ashtakâ) a cow (is sacrificed).
  2. He should place that (cow) to the east of the fire, facing the west, and should sacrifice (Âgya) with (the verse), ‘What, O beasts.’
  3. After having made that oblation he should recite over (the cow the verse), ‘May to thee.’
  4. Let him sprinkle it with water in which barley is, with (the formula), ‘Agreeable to the Ashtakâ I sprinkle thee!’
  5. Having sprinkled it and carried a fire-brand round it, he should give the Prokshani water (to the cow) to drink.
  6. Going in a northern direction (from the fire) he should kill (the cow), the head of which is turned to the west, the feet to the north.
  7. After it has been killed, he should sacrifice (Âgya) with (the verse), ‘If the beast.’
  8. His wife should wash the apertures of its body.
  9. After (the cow’s body) has been opened, so that two purifiers (i.e. grass-blades) have been put under (the knife), he should have the omentum drawn out.
  10. Seizing it with one branch and with another forked branch of a sacrificially pure tree he should roast it.
  11. When it has been seized to drop, he should hew (the cow) to pieces.

30.     A full vessel at (that of) a mess of cooked food.’

দেখুনঃ প্রাগুক্ত গ্রন্থ, পৃঃ ৪১৭-৪১৮, ৪২০।

------------------------------------

ব্রাহ্মণ্য সাহিত্যে এই রকম আরো বিবরণ পাওয়া যায়। সকল বৈশিষ্ট্য থেকে এমন ধারণাই দৃঢ়মূল হয় যে, হিন্দু ধর্ম বৈদিক ধর্মের উত্তরাধিকার নিয়ে উদ্ভূত হলেও এটি সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি ধর্ম। নিম্নের আলোচনা থেকে আমরা দেখতে পাব যে, প্রত্যেকটি ধর্মই সেই সমাজেরই পটভূমি ও পুরাতন ধর্মের ঐতিহ্য থেকে উদ্ভূত হয়ে একটি সম্পূর্ণ নূতন ধর্ম হিসাবে আবির্ভূত হয়।

ইসলাম, খ্রীষ্টান ও ইহুদী ধর্মের বিকাশ প্রক্রিয়া

কৌতূহলোদ্দীপক বিষয় যে, পৃথিবীর সকল ধর্মই ব্যতিক্রমহীনভাবে একইভাবে জন্ম ও বিকাশ লাভ করেছে। সেটা আজকের যুগের প্রধান ধর্মগুলি, যেমন, শিখ, ইসলাম, খ্রীষ্টান ও ইহুদী ধর্মের জন্যও প্রযোজ্য। অর্থাৎ সকল ধর্মই যে সমাজে এবং যে কালে উদ্ভূত হয়েছে সেই ধর্ম সেই সমাজের এবং সেই কালের বৈশিষ্ট্য বহন করেছে। এটাই সত্য যে, নূতন ধর্ম প্রচারক বা প্রচারকরা সমাজের সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য এবং সাধারণ মানুষের ভাষায় তার বা তাদের নূতন ধর্মকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছে। এর ফলে কোনো ধর্মেরই তার সমাজ ও কাল প্রেক্ষিত থেকে ভিন্ন হবার উপায় নাই। হিন্দু ধর্মও এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম নয়।

পাতা : ৩২

ইসলামের বিকাশ প্রক্রিয়া পর্যলোচনা করলে দেখতে পাব যে, সপ্তম শতাব্দীতে আরবের মক্কা ও তার আশেপাশের এলাকার প্রচলিত ধর্ম বিশ্বাস, সামাজিক প্রথা, লোক কাহিনী, ইত্যাদি ইসলামকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। ইসলামের প্রচারক মুহম্মদ আরবের মক্কা নগরের একটি প্রভাবশালী গোত্র কুরাইশ থেকে এসেছিলেন। সেই সময়ে সেখানকার অন্যান্য গোত্রের মত কুরাইশরাও মূর্তি পূজারী ছিল। ইসলামকে একেশ্বরবাদী ধর্ম হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়ে মুহম্মদ মক্কার জনপ্রিয় দেবতা আল্লাহকে তার নূতন ধর্মের একমাত্র দেবতা বা ঈশ্বর হিসাবে হিসাবে ঘোষণা করলেন। মক্কার কা’বা মন্দির ছিল এমন একটি মন্দির, যেখানে প্রধান দেবতা হিসাবে আল্লাহর মূর্তি থাকলেও আশেপাশে বসবাসকারী বিভিন্ন গোত্র তাদের নিজস্ব দেবতার মূর্তি সেখানে স্থাপন করত এবং তাদের পূজা করত। এছাড়া বছরে একদিন মন্দিরটিকে কেন্দ্র করে সাত বার প্রদক্ষিণ করা হত ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতার অংশ হিসাবে, যাকে হজ্জ বলা হত। সেই সময়ে সেখানে বাৎসরিক মেলা বসত ও দূর দূরান্ত থেকে বিভিন্ন গোত্রের লোকজন ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে আসত এবং সেখানে বিভিন্ন খেলার প্রতিযোগিতা ও কবিতা পাঠের আসর অনুষ্ঠিত হত। মক্কা ও এর আশেপাশে মূর্তি পূজারী বিভিন্ন গোত্র ছাড়াও একেশ্বরবাদী বিভিন্ন গোত্র, যেমন ইহুদী ও খ্রীষ্টানরা বসবাস করত। একেশ্বরবাদী নূতন ধর্ম প্রচার করতে গিয়ে মুহাম্মদকে যেমন সেসময়ে আরবে বসবাসরত মূর্তি পূজারী জনগোষ্ঠীর ধর্মগুলি থেকে বিভিন্ন উপাদান নিতে হয়েছে তেমন আরব সমাজে তৎকালে বিদ্যমান একেশ্বরবাদী ধর্মগুলি থেকেও বহু উপাদান গ্রহণ করতে হয়েছে। যেমন ইসলামের ধর্ম মন্দির মসজিদে উপাসনার উদ্দেশ্যে আহবান করার জন্য সুর করে যে আবৃত্তি করা হয় সেটা ইহুদী ধর্ম থেকে এসেছে। এছাড়াও ইহুদী ও খ্রীষ্টান ধর্মের উপবাস বা রোজা, প্রার্থনার পদ্ধতি, ইত্যাদি গ্রহণ করা হয়েছে। খ্রীষ্টান ও ইহুদী ধর্ম থেকে সৃষ্টিতত্ত্ব, পুরুষ ও নারী সৃষ্টির কাহিনী, মৃত্যু ও পুনরুত্থানের কাহিনী, ফেরেশতার ধারণা, বিভিন্ন লোক কাহিনী, পয়গম্বর বা ধর্ম প্রচারকদেরও ইসলামে গ্রহণ করা হয়েছে। এই সব কিছুই মুহম্মদ গ্রহণ করেছিলেন, তার ধর্মীয় কাঠামোতে। ফলে তিনি ইহুদী ও খ্রীষ্টান ধর্মের গ্রন্থ তোরাহ (বা তাওরাত) এবং বাইবেলকে যেমন আল্লাহ্ প্রেরিত গ্রন্থ বলে দাবী করলেন তেমন তাদের ধর্ম প্রচারক যীশু এবং মোশি বা মুসার ঈশ্বরকে মুহম্মদ আল্লাহ্ বলে দাবী করলেন। কুরআনে বলা হচ্ছেঃ

------------------------------------

  ইহুদী ধর্মের পবিত্র গ্রন্থ হল হিব্রু বাইবেল বা তনখ। তনখের অন্তর্গত তিনটি গ্রন্থ, যেগুলি হল তোরাহ্, নেবি’ইম ও কেতুবিম।

------------------------------------

‘তাওরাত (ইহুদীদের ধর্মগ্রন্থ) অবতীর্ণ করিয়াছিলাম; উহাতে ছিল পথ-নির্দেশ ও আলো; নবীগণ, যাহারা আল্লাহ্র অনুগত ছিল তাহারা য়াহূদীদিগকে তদনুসারে বিধান দিত, আরও বিধান দিত রাব্বানীগণ এবং বিদ্বানগণ, কারণ তাহাদিগকে আল্লাহ্র কিতাবের রক্ষক করা হইয়াছিল এবং তাহারা ছিল উহার সাক্ষী। ... ...’ (সূরা মায়িদা ৫/৪৪)

অর্থাৎ কুরআন অনুসারে আল্লাহ্ ইহুদীদের ধর্মীয় গ্রন্থ তাওরাত বা তোরাহ্ রচনা করেছিলেন। ইহুদীরা তাদের ঈশ্বরকে ইয়াওয়েহ্ বলে। কিন্তু মুহম্মদ ইহুদীদের একেশ্বরবাদী ধর্মীয় ঐতিহ্য গ্রহণ করতে গিয়ে দাবী করলেন যে তাদের ঈশ্বরও আল্লাহ্। একইভাবে খ্রীষ্টানদের ধর্মীয় গ্রন্থ বাইবেলকেও তিনি দাবী করলেন আল্লাহ্ প্রেরিত বলে। এবিষয়ে কুরআনে বলা হচ্ছেঃ

‘৪৬। মারয়াম-তনয় ’ঈসাকে তাহার পূর্বে অবতীর্ণ তাওরাতের সমর্থকরূপে উহাদের পশ্চাতে প্রেরণ করিয়াছিলাম এবং তাহার পূর্বে অবতীর্ণ তাওরাতের সমর্থকরূপে এবং মুত্তাকীদের জন্য পথের নির্দেশ ও উপদেশরূপে তাহাকে ইনজীল (খ্রীষ্টানদের বাইবেল) দিয়াছিলাম; উহাতে ছিল পথের নির্দেশ ও আলো।

৪৭। ইনজীল অনুসারীগণ যেন আল্লাহ্ উহাতে যাহা অবতীর্ণ করিয়াছেন তদনুসারে বিধান দেয়। আল্লাহ্ যাহা অবতীর্ণ করিয়াছেন তদনুসারে যাহারা বিধান দেয় না, তাহারা সত্যত্যাগী।’ (সূরা মায়িদাঃ ৫/৪৬-৪৭)

কুরআন থেকে জানা যায় যে, এই ধরনের আয়াত অবতীর্ণ হবার ফলে মুহম্মদের বিরুদ্ধে সেসময়ে ইহুদী ও খ্রীষ্টানরা সমালোচনা মুখর ছিল। এগুলি ছাড়াও স্থানীয় কিছু লোক কাহিনী ও প্রথাকে তিনি তাঁর ধর্মের অঙ্গীভূত করলেন। এই প্রথাগুলির মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল বছরে একদিন কা’বা মন্দিরের চারপাশে আনুষ্ঠানিক প্রদক্ষিণ বা হজ্জ, যার কথা আগে বলা হয়েছে। এভাবে মক্কাকে কেন্দ্র করে তৎকালীন আরবের ধর্মীয় ও সামাজিক পটভূমি থেকে ঐতিহ্যিক ধারাবাহিকতা বহন করে মুহম্মদ যে ধর্ম সৃষ্টি করলেন তা হল সম্পূর্ণ নূতন এক ধর্ম।

ইসলামের উদ্ভবে আর একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সাধারণত আলোচনার বাইরে থেকে যায়, সেটা হচ্ছে পার্শবর্তী পরাক্রমশালী পারস্য সাম্রাজ্যের ধর্ম আবেস্তান ধর্মের প্রভাব। দক্ষিণে ইয়েমেনসহ আরবের কিছু অঞ্চল বিভিন্ন সময়ে সরাসরি অথবা পরোক্ষভাবে পারস্য বা ইরানের অধীনে কিংবা প্রভাবাধীনে ছিল। স্বাভাবিকভাবে ইরানের ধর্মতত্ত্বও আরবের ইসলামের উপর প্রভাব ফেলেছে।

আবেস্তান ধর্মের সৃষ্টিতত্ত্ব ঈশ্বর অহুর ময্দা এবং তার প্রতিপক্ষ অশুভ শক্তি অঙ্গ্রা মইন্যুর মধ্যকার দ্বন্দ্বমূলক সম্পর্কের ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। ঈশ্বর অহুর ময্দা শুভ ও সুন্দর হিসাবে যা কিছু সৃষ্টি করে তার বিরোধিতা এবং ক্ষতিসাধনের চেষ্টা করাই হচ্ছে অঙ্গ্রা মইন্যুর কাজ। অহুর ময্দা সর্বশক্তিমান ঈশ্বর হলেও এই দ্বন্দ্বে কখনও তার হার এবং অঙ্গ্রা মইন্যুর জয় হয়। এভাবে এক দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে ঈশ্বর অহুরা ময্দা তার বিশ্বসৃষ্টির পরিকল্পনাকে এগিয়ে নিয়ে যায়। শুভ ও অশুভের মধ্যকার এই দ্বন্দ্বতত্ত্বের প্রভাব আমরা দেখতে পাই ইসলামের আল্লাহ্ এবং শয়তানের মধ্যকার দ্বন্দ্বমূলক সম্পর্কের মধ্যে। তবে আবেস্তান ধর্মের দ্বন্দ্বতত্ত্বের সঙ্গে ইসলামের দ্বন্দ্বতত্ত্বের পার্থক্যের একটা বড় জায়গা হল অশুভ শক্তির সর্বোচ্চ রূপ অঙ্গ্রা মইন্যু ঈশ্বর অহুরা ময্দার সৃষ্টি না হলেও ইসলামের অশুভ শক্তি শয়তান স্বয়ং আল্লাহর সৃষ্টি। যদিও দর্শনগতভাবে এই পার্থক্যের গুরুত্ব অপরিমেয় তথাপি আবেস্তান ধর্ম এবং ইসলামের মধ্যকার শুভ ও অশুভের মধ্যকার এই দ্বন্দ্বমূলক সম্পর্কের মিল তাৎর্যপূর্ণ। এটা বুঝা যায় যে, মানুষকে ঘিরে ইসলামের আল্লাহর পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য আল্লাহ ও শয়তানের মধ্যকার দ্বন্দে¦র তত্ত্ব ইসলাম নিয়েছে আবেস্তান ধর্ম থেকে। এভাবে আমরা ইসলামের গঠনে আরবের কিংবা পার্শবর্তী সমাজগুলির ধর্ম ও সংস্কৃতিকে বিভিন্নভাবে ভূমিকা রাখতে দেখি।

বাইজেন্টাইন রোমান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত প্যালেস্টাইন অঞ্চলে আজ থেকে প্রায় দুই হাজার বছর আগে যীশু খ্রীষ্টের দ্বারা খ্রীষ্ট ধর্মের প্রতিষ্ঠা ও প্রচারেও একই প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে দেখা যায়। সেই সময়ে ইহুদী সমাজ থেকে উঠে আসা যীশু ইহুদীদের ঐতিহ্য ধারণ করেই তার নূতন ধর্মমত প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ইহুদী ধর্মের নবী মোশি বা মুসার ব্যবস্থা বা আইন পালন করার জন্য ইহুদী ধর্ম থেকে ‘পথভ্রষ্টদের’ আহবান করলেন। বাইবেলের নূতন নিয়মে ধর্ম প্রচারের এই বিষয়টি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়ঃ

------------------------------------

  এই গ্রন্থে বাইবেলের উদ্ধৃতি নেওয়া হয়েছে, বাইবেল, পুরাতন ও নতুন নিয়ম, বাংলাদেশ বাইবেল সোসাইটি, ঢাকা, থেকে।

------------------------------------

‘পর্বের মধ্যে যীশু ধর্ম্মধামে গেলেন, এবং উপদেশ দিতে লাগিলেন। তাহাতে যিহূদীরা আশ্চর্য্য জ্ঞান করিয়া কহিল, এ ব্যক্তি শিক্ষা না করিয়া কি প্রকারে শাস্ত্রজ্ঞ হইয়া উঠিল? যীশু তাহাদিগকে উত্তর করিয়া কহিলেন, আমার উপদেশ আমার নহে, কিন্তু যিনি আমাকে পাঠাইয়াছেন, তাঁহার। যদি কেহ তাঁহার ইচ্ছা পালন করিতে ইচ্ছা করে, সে এই উপদেশের বিষয়ে জানিতে পারিবে, ইহা ঈশ্বর হইতে হইয়াছে, না আমি আপনা হইতে বলি। যে আপনা হইতে বলে, সে আপনারই গৌরব চেষ্টা করে; কিন্তু যিনি আপনার প্রেরণকর্ত্তার গৌরব চেষ্টা করেন, তিনি সত্যবাদী, আর তাঁহাতে কোন অধর্ম্ম নাই। মোশি তোমাদিগকে কি ব্যবস্থা দেন নাই? তথাপি তোমাদের মধ্যে কেহই সেই ব্যবস্থা পালন করে না। ... ...’ (বাইবেল, নতুন নিয়ম, যোহন লিখিত সুসমাচার, ৭, ১৪-১৯)        

  অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে যে, যীশুকেও সমসাময়িক ইহুদী সমাজের উপর দাঁড়িয়ে এবং ইহুদীদের নবী মোশির উত্তরাধিকার ধারণ করেই তাঁর নূতন ধর্মমত প্রচার করতে হয়েছে। তিনি যে নূতন ধর্মমত প্রচার করেন, তাকে পুরাতন ইহূদীদের ধর্মের সংস্কার হিসাবে বিবেচনা করে নূতন নিয়ম হিসাবে প্রতিষ্ঠা করেন যীশুর মৃত্যুর পরে তাঁর অনুসারীরা। এভাবে খ্রীষ্ট ধর্ম একটি নূতন ধর্ম হিসাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে।

এভাবে দেখা যায় যে, প্রতিটি ধর্মই তার উত্থানের সময়কার সমাজ ও কাল প্রেক্ষিতে ঐ সমাজেরই পুরাতন ধর্ম, প্রথা, বিশ্বাস, ইত্যাদির ধারাবাহিকতা থেকে নূতন ধর্ম হিসাবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। হিন্দু ধর্মের ক্ষেত্রে দেখা যায় যে তা একই প্রক্রিয়ায় বৈদিক ধর্ম থেকে বিকাশ লাভ করেছে। তবে হিন্দু ধর্মে ধর্ম প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে কোনো বিশেষ একজনকে চিহ্নিত করা যায় না। বরং এখানে অনেক ব্যক্তির ভূমিকা আছে বলে বুঝা যায়। এবিষয়টি অনুমান করা যায় যে, ঋগ্বেদ রচনার পরবর্তীকালে বেদ সমূহের রচনাকারী ঋষিরা বা তাদের উত্তরাধিকারীরা নিজেদের ব্রাহ্মণ হিসাবে সমাজে পরিচিত করে। পরে অত্যন্ত ধীর প্রক্রিয়ায় ব্রাহ্মণের শ্রেষ্ঠত্বের ধারণার উপর প্রতিষ্ঠিত চতুর্বর্ণ ভিত্তিক জাতিভেদ প্রথা সহ আরো অনেক পরিবর্তন ও স্থানীয় নূতন উপাদান অন্তর্ভুক্তির মধ্য দিয়ে হিন্দু ধর্ম গঠন হয়। বৈদিক ধর্ম থেকে হিন্দু ধর্মের উত্তরণকালটা অনেক দীর্ঘ ও প্রক্রিয়াটি অনেক জটিল বলে অনুমান করা যায়। হিন্দু ধর্মের উদ্ভব প্রক্রিয়াটি বুঝার জন্য বৌদ্ধ সাহিত্য, ব্রাহ্মণ্য সাহিত্য, জৈন সাহিত্য ছাড়াও প্রধানত প্রত্নতত্ত্বের সাহায্য নেওয়া যায়।

পাতা : ৩৩

হিন্দু ধর্মের বিকাশ প্রক্রিয়া ও ব্রাহ্মণের ভূমিকা

বৈদিক আন্দোলনের সফলতার পর সিন্ধু সভ্যতার পতন হলে হরপ্পান নগর-শহর ও গ্রামের অনেক মানুষই ক্রমে ক্রমে পূর্ব দিকে বসতি স্থাপন করতে থাকে ও গাঙ্গেয় সমভূমিতে উদীয়মান কৃষি সমাজের সাথে মিশে যায় এবং নূতন সমাজ গঠন করতে শুরু করে। এই সমাজ গঠন প্রক্রিয়াটি নিঃসন্দেহে ধীর ছিল। এই সমাজে সিন্ধু সভ্যতার উত্তরাধিকারীরা যেমন, বৈদিক ও কৃষকদের বড় অংশ ও বণিক, কারিগর, শিক্ষক, দার্শনিক, ইত্যাদি বসতি স্থাপন করে। বৈদিকরা নিজেদের নূতন পরিচয় ব্রাহ্মণ দিলেও তারাও কৃষিকাজের সাথে যুক্ত হয়েছিল বলে ধারণা করা যায়। বৌদ্ধ জাতক গ্রন্থে ব্রাহ্মণদের কৃষিকাজ করার কথা বলা আছে (২১১: সোমদত্ত জাতক)।  মেগাস্থিনিস ও আরিয়ান দু’জনেই ভারতে দার্শনিকদের সবচেয়ে বেশী মর্যাদার কথা উল্লেখ করেছেন। আর আরিয়ান বলেছেন যে এই দার্শনিকরা শারীরিক শ্রম করে না (The Indika of Arrian, XI)।  মেগাস্থিনিস ভারতে দার্শনিকদের দু’টি বিভাগ হিসাবে শ্রমণ ও ব্রাহ্মণদের সম্পর্কে বলেছেন। আমরা যদি মেগাস্থিনিস ও আরিয়ানের বক্তব্যকে সঠিক ধরি তাহলে এটাই মনে করতে হবে যে, ভারতবর্ষে মেগাস্থিনিসের সময়ে খ্রীঃপূঃ ৪র্থ শতাব্দীতে সংখ্যায় ক্ষুদ্র হলেও ব্রাহ্মণরা একটি সামাজিক শক্তি হিসাবে অস্তিত্ব রাখতে শুরু করেছিল। তবে ব্রাহ্মণের অধীনে তখনো কোনো বর্ণ ভিত্তিক সমাজ গড়ে উঠে নাই। তাহলে মেগাস্থিনিস যে সাতটি বর্ণ বা caste-এর উল্লেখ করেছেন তারা কারা? মেগাস্থিনিস যে সাতটি বর্ণের উল্লেখ করেছেন তারা হল, পর্যায়ক্রমে - প্রথম দার্শনিক, দ্বিতীয় কৃষক, তৃতীয় পশুপালক ও পশুশিকারী, চতুর্থ কারিগর, পঞ্চম যোদ্ধা, ষষ্ঠ তত্ত্বাবধায়ক ও সপ্তম রাজার উপদেষ্টা ও করনির্ধারক। আরিয়ান ইণ্ডিকা গ্রন্থে বলেছেন যে, বর্ণসমূহের মধ্যে আন্তঃবিবাহ নিষিদ্ধ ছিল।  বৌদ্ধ সাহিত্যে বর্ণের কথা উল্লেখ আছে। অনুমান করা যায় বিভিন্ন জায়গায় বর্ণ বলতে গোষ্ঠী বুঝানো হয়েছে। যেমন দীঘ নিকায়-এ বলা হয়েছে চারটি বর্ণের কথা, যেমন ক্ষত্রিয়, ব্রাহ্মণ, বণিক ও কারিগর (৩ অম্বত্থ সুত্ত, ১.১৪; ২৭ অগ্গন্ন সুত্ত, ৫) । আবার এই গ্রন্থে তাদেরকে শ্রেণীও বলা হয়েছে (৯ পোত্থপাদ সূত্ত, ৩৬)।  মধ্যম নিকায় গ্রন্থে ক্ষত্রিয়-কুল, ব্রাহ্মণ-কুল, বৈশ্য-কুল, শূদ্র-কুল - এভাবে বলা আছে (৪ মহাযমক বর্গ, ক্ষুদ্র-অশ্বপুর-সূত্র (৪০), ৫)।  দীঘ নিকায় গ্রন্থেও ব্রাহ্মণ, বৈশ্য ও শূদ্রের কথা বলা হয়েছে (২৭ অগ্গন্ন সূত্ত, ২৭-৩০)। কিন্তু কোথায়ও বলা হয় নাই কিংবা কোনো ইঙ্গিত নাই যে বণিক-কারিগর বা বৈশ্য-শূদ্ররা ব্রাহ্মণ নিয়ন্ত্রিত কিংবা ব্রাহ্মণের অধস্তন ছিল। বৌদ্ধ সাহিত্যে প্রায় সর্বক্ষেত্রেই ক্ষত্রিয়-ব্রাহ্মণ কিংবা ‘শ্রমণ-ব্রাহ্মণ’ এভাবে উল্লেখ আছে। অর্থাৎ ক্ষত্রিয় বা শ্রমণের নাম আগে উল্লেখ আছে। জৈন সাহিত্যেও বহু ক্ষেত্রে ‘শ্রমণ ও ব্রাহ্মণ’ এভাবে বলা আছে। উত্তরাধ্যায়নসূত্রে বলা হয়েছে, ‘কারো কাজের মাধ্যমে কেউ একজন ব্রাহ্মণ, অথবা একজন ক্ষত্রিয়, অথবা একজন বৈশ্য, অথবা একজন শূদ্র হতে পারে’ (উপদেশ ২৫, ৩৩)। জৈন সাহিত্যের অনেক জায়গায় ক্ষত্রিয় বা ব্রাহ্মণের সাথে আরো নাম এমনভাবে আছে যে, বুঝা যায় ব্রাহ্মণের একক ধর্মীয় বা সামাজিক কর্তৃত্ব তখনো শুরু হয় নাই। যেমন, সূত্রক্রিতাঙ্গ গ্রন্থে বলা হয়েছে, ‘ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বুক্কস, শিকারী, বণিক, শূদ্র ও অন্যরা যারা কর্মে অভ্যস্ত’ (উপদেশ ৯, ২)।

------------------------------------

  দেখুনঃ শ্রীঈশানচন্দ্র ঘোষ (অনূদিত), জাতক, দ্বিতীয় খণ্ড, করুণা প্রকাশনী, কলকাতা, চতুর্থ মুদ্রণ, ১৪০৮, পৃঃ ১০৪-১০৫।

দেখুনঃ John W. McCrindle, Ancient India as described by Megasthenês and Arrian, p. 214.

  দেখুনঃ প্রাগুক্ত গ্রন্থ, পৃঃ ২১৮।

দেখুনঃ Maurice Walshe (Translated), The Long Discourses of the Buddha: A Translation of the Dīgha Níkāya, 1987, pp. 114, 408.

দেখুনঃ প্রাগুক্ত গ্রন্থ, পৃঃ ১৬৬।

দেখুনঃ শ্রীবেণীমাধব বড়ুয়া (অনুদিত), মধ্যম-নিকায়, শ্রীঅধরলাল বড়ুয়া প্রকাশিত, কলিকাতা, ১৯৪০, পৃঃ ৩০৬।

দেখুনঃ Hermann Jacobi (Translated), Gaina Sûtras, Part II, The Secred Books of the East Series, Volume XLV, Oxford at the Clarendon Press, 1895, p. 140.

দেখুনঃ প্রাগুক্ত গ্রন্থ, পৃঃ ৩০১।

------------------------------------

তবে সেই সময়েও ব্রাহ্মণের অহংকার ধরা পড়ে যখন একজন প্রভাবশালী ব্রাহ্মণ পোক্খরাসাতির ছাত্র অম্বত্থ, যে বেদ বিদ্যার ছাত্র ছিল, মন্ত্র জানত ও তিনটি বেদে পারদর্শী ছিল, রীতি ও ধর্মানুষ্ঠানের ব্যাখ্যাকারী ছিল, গৌতম বুদ্ধের সাথে দেখা করে দম্ভভরে বলেছিল, ক্ষত্রিয়, বণিক ও কারিগর এই তিন বর্ণ ব্রাহ্মণের অধস্তন।

------------------------------------

  দীঘ নিকায়ের অম্বত্থ সূত্তে অম্বত্থ এভাবে বলছে, “Reverend Gotama, there are four castes: the Khattiyas, the Brahmins, the merchants and the artisans. And of these four castes three – the Khattiyas, the merchants and the artisans – are entirely subservient to the Brahmins. … …” (3 Ambaṭṭha Sutta, 1.5), দেখুনঃ Maurice Walshe (Translated), The Long Discourses of the Buddha: A Translation of the Dīgha Níkāya, 1987, p. 114.  

------------------------------------

দার্শনিকদের দুই বিভাগ ব্রাহ্মণ ও শ্রমণদের মধ্যে ব্রাহ্মণদের সবচেয়ে সম্মানিত ও তাদের মতামতকে মেগাস্থিনিস বেশী সংগতিপূর্ণ বলেছেন।  বুঝা যায় যে, ব্রাহ্মণরা ছাড়া অন্যরা যেমন, বৌদ্ধ, জৈন, আজীবিক ও অন্যান্য নিরীশ্বরবাদী চিন্তার অনুসারীরা খ্রীষ্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতে সুসংবদ্ধ ধর্মীয় গোষ্ঠী হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে নাই। ধারণা করা যায় সিন্ধু সভ্যতা পতনের অব্যবহিত পরে বৈদিক ঋষিরা ঋগ্বেদ ছাড়াও সামবেদ ও যজুর্বেদ রচনা ও সংকলন করে এবং আরও কিছু পরে অথর্ববেদের মন্ত্রসমূহ রচনা করে। অনুমান করা যায় যে, বেদসমূহ সংকলন করার জন্য বৈদিক ঋষিদেরকে সেই সময়ে একটি কেন্দ্রে মিলিত হতে হয়েছে এবং সিন্ধু উপত্যকার বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাসরত ঋষিদের মন্ত্রসমূহে যাতে অসংগতি না থাকে সেটি নিশ্চিত করতে হয়েছে। এই কাজটি তারা সিন্ধু উপত্যকা অঞ্চলে সম্পাদন করেছিল বলে মনে হয়।

------------------------------------

দেখুনঃ John W. McCrindle, Ancient India as described by Megasthenês and Arrian, p. 98.

------------------------------------

পরবর্তীকালে বৈদিক ঋষিদের উত্তরসূরিরা নিজেদের পরিচয় ব্রাহ্মণ হিসাবে দেওয়া শুরু করে ও এই চর্চা গুরু-শিষ্যের মাধ্যমে ও বংশপরম্পরায় অব্যাহত রাখে। এর পর ধীর প্রক্রিয়ায় তারা পূর্ব দিকের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়লে বেদকে কেন্দ্র করে ও বংশ পরম্পরায় চর্চার মাধ্যমে তুলনামূলক দৃঢ়বদ্ধ একটি সামাজিক গোষ্ঠী হিসাবে শত শত বৎসরের নানা বিরূপ পরিবেশ ও পরিস্থিতিতে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষা করে।

অন্য দিকে সিন্ধু সভ্যতার লোকায়ত বা নিরীশ্বরবাদী ধারার অনুসারীরা সিন্ধু সভ্যতার পতনের অব্যবহিত পর গঙ্গা উপত্যকায় নূতন কোনো মতাদর্শিক ধারা গড়ে তুলতে পারে নাই। বুদ্ধের সময়ে ব্রাহ্মণরা রাজাদের পুরোহিত হত। এমন বর্ণনা পাওয়া যায় কোশলরাজ প্রসেনজিতের পুরোহিত ব্রাহ্মণ অগ্নিদত্ত সম্পর্কে। এছাড়া কাশিরাজ ব্রহ্মদত্তের পুরোহিত ব্রাহ্মণের কথাও জানা যায়। বৌদ্ধ সাহিত্যে ব্রাহ্মণ দ্বারা মন্দিরকে পূজা করার কথা বলা হয়েছে। বর্ণনাটি এই রকম, ‘একদা বুদ্ধ ভিক্ষুসঙ্ঘসহ বারানসীতে যাইবার সময়ে পথিমধ্যে তোদেয়্য গ্রামে এক পুরাতন মন্দির দেখিয়া তথায় অপেক্ষা করিলেন। কিয়ৎক্ষণ পরে একজন ব্রাহ্মণ আসিয়া সেই মন্দিরকে ভক্তিভরে পূজার্চনা করিয়া ভক্তিভরে প্রণাম করিলেন। তখন বুদ্ধ তাঁহাকে মন্দিরের ঐতিহাসিক তত্ত্ব বিশ্লেষণ করিয়া বলিলেন যে, এই মন্দির কাশ্যপবুদ্ধের স্মৃতিরক্ষার্থে নির্মিত হইয়াছিল। জনসাধারণ এখানে পূজার্চনা করিয়া প্রভূত পুণ্য সঞ্চয় করে। ...’ (বুদ্ধবগগো - (১৪), আখ্যানভাগঃ একশ’ পঁচানব্বই-  ছিয়ানব্বই)।

------------------------------------

দেখুনঃ গিরিশচন্দ্র বরুয়া, ধম্মপদ, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, দ্বিতীয় প্রকাশ ১৯৭৭, প্রথম পুনর্মূদ্রণ ১৯৯৬, পৃঃ ৩২৬।

দেখুনঃ প্রজ্ঞানন্দ স্থবির (অনুদিত), মহাবর্গ, শ্রীঅধরলাল বড়ুয়া প্রকাশিত, কলিকাতা, ১৯৩৭, পৃঃ ৪৬৪।

দেখুনঃ গিরিশচন্দ্র বরুয়া, ধম্মপদ, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, দ্বিতীয় প্রকাশ ১৯৭৭, প্রথম পুনর্মূদ্রণ ১৯৯৬, পৃঃ ৩২৮।

------------------------------------

উপরের আলোচনায় আমরা দেখতে পেয়েছি বৌদ্ধ যুগে ও তার পরেও ব্রাহ্মণরা সমাজে একটি গুরুত্বপূর্ণ ও অনেকটা দৃঢ়সংবদ্ধ ধর্মীয় গোষ্ঠী হিসাবে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষা করছিল। অনুমান করা যায় যে বৌদ্ধ, জৈন ও অন্যান্য নিরীশ্বরবাদী গোষ্ঠী সংখ্যার বিচারে অনেক বেশী ছিল ও সমাজের গুরুত্বপূর্ণ অংশ যেমন বণিক, কারিগর ও কৃষকদের বড় অংশ তাদের অনুসারী ছিল। অনেক পণ্ডিত মত প্রকাশ করেন যে ভারতের উত্তর-পূর্ব এলাকা যাকে বৌদ্ধ ভারত বলা হয় সেখানে বৈদিক প্রভাব অনেক পরে প্রবেশলাভ করেছে।  সাহিত্য ও প্রত্নতত্ত্বের সাক্ষ্য থেকে মনে হয় যে বিশেষভাবে বৌদ্ধ ও জৈনরা সমাজে সেই সময়ে অর্থাৎ খ্রীঃপূঃ পঞ্চম শতাব্দী থেকে খ্রীঃপূঃ দ্বিতীয়/ প্রথম শতাব্দী পর্যন্ত ক্রমবর্ধমানভাবে প্রভাবশালী হচ্ছিল।

------------------------------------

  দেখুনঃ দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, লোকায়ত দর্শন, পুনর্মুদ্রণ ১৪১৬, পৃঃ২৮।

------------------------------------

সিন্ধু সভ্যতার পতনের পর বৈদিক ঋষিদের উত্তরসূরিরা গাঙ্গেয় অঞ্চলে বসতি স্থাপন করলে যাজন ও অধ্যাপনা ছাড়াও তাদের একটি অংশ কৃষি কাজ শুরু করে। এই সময়ে ব্রাহ্মণের কৃষিকাজের সাথে যুক্ত হবার কথা জানা যায়। পরবর্তীকালে সমাজে ব্রাহ্মণদের ভিত্তি দৃঢ় হলে ও তাদের নেতৃত্বে চতুর্বর্ণ ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠিত হলে কৃষিকাজকে তারা ব্রাহ্মণের জন্য গর্হিত বলে ঘোষণা করে। এর প্রমাণ পাওয়া যায় মনু সংহিতায়, যা খ্রীষ্টীয় ৩য় শতাব্দীর সংকলন ও রচনা বলে মনে করা হয়।

পাতা : ৩৪

 তখন সমাজে ‘বর্ণ’ শব্দটির ব্যবহার হয়ে থাকতে পারে বলে মনে হয়। তবে সেই সময়ে বর্ণ শব্দটি ভিন্নার্থে ব্যবহৃত হত বলে মনে হয়। সেই সময়ে ক্ষত্রিয়, ব্রাহ্মণ, বণিক, কারিগর, বৈশ্য, শূদ্র, ইত্যাদি নামে গোত্রগত ও পেশাগত গোষ্ঠী স্বাধীনভাবে অস্তিত্বশীল ছিল। সম্ভবত তাদের মধ্যে আন্তঃবিবাহ ছিল না। এই ব্রাহ্মণ তখনো বাকী সমস্ত বর্ণসমূহের উপরে নেতৃত্বের জায়গায় যায় নাই। অর্থাৎ ব্রাহ্মণকেন্দ্রিক চতুর্বর্ণের ধারণা তখনো প্রতিষ্ঠিত হয় নাই। তখন সম্ভবত সমাজের সকলে গরুর মাংস খেত, যার প্রমাণ বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণ্য সাহিত্যে অজস্র আছে। মধ্যম নিকায়-এ বলা হচ্ছে, ‘দক্ষ গোঘাতক বা গোঘাতক-অন্তেবাসী গাভী বধ করিয়া, উহার দেহ অংশাশীভাবে বিভক্ত করিয়া, তাহা ক্রিয়ার্থ চৌরাস্তায় অবস্থিত থাকে, ...’ (স্মৃতিপ্রস্থান-সূত্র (১০), ৭) এবং ‘যেমন কোন দক্ষ গোঘাতক কিংবা গোঘাতক-অন্তেবাসী তীক্ষè গোকাটা ছুরি দ্বারা গো-কুক্ষি পরিকর্ত্তন করে, ...’ (মহাসত্যক-সূত্র (৩৬), ১৭)।  দীঘ নিকায়-এ বলা হচ্ছে, ‘যেমন দক্ষ কশাই বা তার সহকারী একটি গো হত্যা করে, দেহটি বিভক্ত করে চৌরাস্তায় বসে থাকে ...’ (২২ মহাসতিপত্থন সুত্ত, ৬)।  ব্রাহ্মণরা যে সেই সময়ে ষাঁড় বলি দিত তার প্রমাণ পাওয়া যায় দীঘ নিকায় গ্রন্থে। সেখানে বলা হয়েছে কূটদন্ত নামে একজন ব্রাহ্মণকে মগধের রাজা বিম্বিসার একটি গ্রাম দান করেছিলেন, যে ব্রাহ্মণ একটি যজ্ঞের পরিকল্পনা করেছিল যেখানে সাত শত ষাঁড় বলি দিবার জন্য প্রস্তুত করা হয়েছিল (৫ কূটদন্ত সূত্ত, ১)।

------------------------------------

দেখুনঃ শ্রীবেণীমাধব বড়ুয়া (অনুদিত), মধ্যম-নিকায়, শ্রীঅধরলাল বড়ুয়া প্রকাশিত, কলিকাতা, ১৯৪০, পৃঃ ৬১, ২৬৮।

দেখুনঃ Maurice Walshe (Translated), The Long Discourses of the Buddha: A Translation of the Dīgha Níkāya, 1987, p. 338.

দেখুনঃ Maurice Walshe (Translated), The Long Discourses of the Buddha: A Translation of the Dīgha Níkāya, Wisdom Publications, Boston, First published in 1987, p. 133.

------------------------------------

আমরা দেখতে পাই যে, ভারতবর্ষের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চল খ্রীষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দী থেকে বিভিন্ন সময়ে উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে আগত বিদেশীদের অধিকারে চলে যায়। প্রথমে খ্রীষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে পারসিকদের ও পরে আলেকজাণ্ডারের মাধ্যমে খ্রীষ্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দী থেকে গ্রীকদের অধিকারে যাওয়া শুরু হয়। এরপর কুষাণরা ভারতবর্ষে প্রবেশ ক’রে উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে উত্তর ভারতের বড় অংশ অধীনস্থ করে নেয়। কুষাণরা ছিল যাযাবর গোষ্ঠী, যাদের চীনা উৎস থেকে ইউ-চি বলা হয়। তারা প্রথমে হিন্দুকুশ পর্বতের উত্তরাঞ্চলে বসতি গড়ে। খ্রীঃপূঃ দ্বিতীয় শতাব্দীতে এই প্রক্রিয়া চলেছিল। আমু দরিয়ার দক্ষিণ ও উত্তর উভয় অংশের ইউ-চিরা পাঁচটি ক্ষুদ্র রাজ্যে বিভক্ত ছিল। কাদফিসেস ১ হলেন প্রথম প্রধান রাজা যিনি এই ক্ষুদ্র রাজ্যগুলিকে এক করেছিলেন। তিনি এরপর কাবুল অঞ্চল ও গান্ধার দখল করেন ও তার পশ্চিমে ও উত্তর-পশ্চিমে পার্থিয়ানদের আক্রমণ করেন। উয়িমা কাদফিসেসের অধীনে কুষাণ সাম্রাজ্য আরো বিস্তৃত হয়, যিনি একদিকে সিন্ধুর ব-দ্বীপ অঞ্চল  ও অন্য দিকে মথুরা পর্যন্ত অধিকার করেন। উয়িমার পরই কণিষ্ক ক্ষমতায় আসেন ও ভারতের বিস্তৃত অঞ্চল দখল করেন।

------------------------------------

দেখুনঃ Dilip K. Chakrabarti, India: An Archaeological History – Palaeolithic Beginnings to Early Historic Foundations, 1999, p. 271.

------------------------------------

ভারতের উত্তর পশ্চিম দিক থেকে প্রথম বিদেশীদের মধ্যে ইরানীয় আকামেনিয়রা সিন্ধু উপত্যকার আংশিক অধিকার করেছিল। আলেকজাণ্ডারের বাহিনী পাঞ্জাবের বিপাশা নদী পর্যন্ত এলেও ফিরে যেতে বাধ্য হয়। খ্রীঃপূঃ দ্বিতীয় শতাব্দীতে ব্যাক্ট্রিয়া থেকে গ্রীকরা পাঞ্জাব দখল করে। এরপর খ্রীষ্টীয় প্রথম শতকের প্রথম দিকে পূর্ব ইরান ও আফগানিস্তানের সিস্তান অঞ্চল থেকে আগত পার্থিয়ানরা উত্তর-পশ্চিম ভারতের কিছু অংশ অধিকার করেছিল। ভারতবর্ষে বড় ধরনের বিদেশী আক্রমণাভিযান ঘটে খ্রীষ্টপূর্ব প্রথম শতাব্দীতে চীন সীমান্ত অঞ্চল থেকে যাযাবর ইউ-চি গোত্র কাসপিয়ান সাগর তীরবর্তী অঞ্চল হয়ে ও কাসপিয়ান সাগরে ইতিমধ্যে বসবাসরত শকদের দলে দলে ভারতবর্ষে প্রবেশ করার মধ্য দিয়ে। ইউ-চিরা উত্তর ভারতে ও শকরা পশ্চিম ভারতের কচ্ছ ও কাথিয়াওয়াড় অঞ্চলে বসতি গাড়ে। এদের মধ্যে ইউ-চি বা কুষাণরা কনিষ্কের নেতৃত্বে উত্তর ভারতে তাদের রাজত্ব বিস্তার করে, যার পূর্ব সীমা ছিল মথুরা ও বারানসী।  

গুপ্তরাজাদের রাজত্বকালের শেষের দিকে খ্রীষ্টীয় পঞ্চম শতাব্দীতে হুনদের অনুপ্রবেশ ঘটে। এই সময়ে বেশ কয়েকটি ঢেউয়ে হুনরা ভারতবর্ষের উত্তর-পশ্চিম অংশ দিয়ে প্রবেশ করেছিল। ষষ্ঠ ও সপ্তম শতাব্দীতে ভারতবর্ষের উত্তরাঞ্চলে অনেক ছোট ও বড় রাজবংশের উদ্ভব ঘটে। এগুলির মধ্যে অল্প কিছু শাসক বংশ সম্পর্কে গুপ্ত পূর্ব যুগ থেকে বিভিন্ন উৎসে উল্লেখ আছে। এছাড়া বহু বংশ পরিচয়ের শুরু এমন সব নাম দিয়ে যেগুলিকে সংস্কৃত ভাষার নয় বলে বুঝা যায়। তারা বহিরাগত বলে মনে করা যায়।  তাদের মধ্যে অনেকেই হুনদের সাথে সম্পর্কিত। ষষ্ঠ শতাব্দীর শেষের দিকে গুর্জর নামে নূতন জনগোষ্ঠীর উপস্থিতির কথা জানা যায় যাদের নামে গুজরাট নামকরণ হয়েছে। তারা অনেক গুরুত্বপূর্ণ রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা। মনে করা হয় গুর্জররা হুনদের পিছন পিছন ভারতবর্ষে প্রবেশ করেছিল। দক্ষিণ রাশিয়ার স্তেপভূমির প্রাচীন জনগোষ্ঠী খাজর (Khazars) ও গ্রুজ (Gruz) নামে ককেশাসের জর্জিয়ানদের সাথে তাদের সম্পর্কিত করা হয়।  মধ্য এশিয়ার আরো কিছু অচেনা গোত্র হুনদের পরে ভারতবর্ষে এসেছিল। ষষ্ঠ শতাব্দীর প্রথম দিকে হুন শাসক তোরমান ও মিহিরকুলের কথা জানা যায়। তোরমান আংশিক উত্তর প্রদেশ, মধ্য প্রদেশ, গুজরাট, রাজস্থান, পাঞ্জাব ও কাশ্মীর শাসন করেছিলেন।  তোরমানের পুত্র মিহিরকুল শৈব ধর্মের প্রতি অনুরক্ত ছিলেন।

------------------------------------

দেখুনঃ A.L. Basham, Medieval Hindu India, in, A Cultural History of India, ed., A.L. Basham, Oxford University Press, New Delhi, 1975, p. 52.

দেখুনঃ প্রাগুক্ত নিবন্ধ’, পৃঃ ৫২-৫৩।

দেখুনঃ Madhuvanti Ghose, The Impact of the Hun Invasions: A Nomadic Interlude in Indian Art, in, Bulletin of the Asia Institute 2003, New Series, Vol. 17 (2003), p.145.

------------------------------------

এই বিদেশী হানাদাররা ভারতে প্রবেশ করবার সময়ে এখানকার বিপুল সংখ্যক নগর-শহর, বৌদ্ধ মঠ ধ্বংস করে এবং অগণিত মানুষকে হত্যা করে। এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশী ধ্বংস এবং হত্যা করে হুনরা। সেই সময়ে সমৃদ্ধ জনপদ, নগর, শহর ও বাণিজ্য কেন্দ্রগুলির অধিবাসীরা ছিল প্রধানত বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী। অর্থাৎ প্রধানত বণিক ও কারিগররা বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী ছিল, যারা প্রধানত শহর ও নগরে বসবাস করত। বিদেশী হানাদারদের শহর-নগর ও বৌদ্ধ মঠগুলির ধ্বংসকাণ্ডের ফলে একদিকে যেমন বৌদ্ধ ধর্মের উপর প্রচণ্ড আঘাত আসে তেমনি শহর, নগর ও বাণিজ্য কেন্দ্রগুলি ধ্বংস বা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়াতে বৌদ্ধ ধর্মের প্রধান পৃষ্টপোষক শ্রেণী হিসাবে বণিক ও কারিগররা ছত্রভংগ এবং অনেকাংশে ধ্বংস হয়ে যায়। এর ফলে বৌদ্ধ ধর্মও প্রচণ্ডভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।   

প্রায় সকল বিদেশী আক্রমণকারীই এই কাজ করে যে, যে দেশে তারা আক্রমণ ও দখল করে সেখানে তারা সাধারণত সবার প্রথমে প্রতিষ্ঠিত সামাজিক নেতৃত্বকে ধ্বংস করে দেয়। ভারতবর্ষ দখলের শুরুতে সবাই কম-বেশী এই কাজ করেছে। সেই সময়ে প্রধানত বৌদ্ধরা ও অনেক জায়গায় জৈনরা সামাজিক নেতৃত্বে থাকায় ও তাদের মঠ ও মন্দিরসমূহ বৃহদায়তন ও সমৃদ্ধ জনপদের সাথে থাকায় বিদেশী আক্রমণে এই দুই ধর্ম বিশেষভাবে বৌদ্ধ ধর্ম প্রচণ্ডভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। জৈন ধর্মের তুলনায় বৌদ্ধ ধর্মের বেশী ক্ষতি হবার কারণ সম্ভবত ভারতবর্ষের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে বৌদ্ধ ধর্মের প্রাধান্য ছিল। ফলে বৌদ্ধরা তুলনামূলকভাবে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিদেশী এই সকল হানাদার ধ্বংসকাণ্ড পরিচালনা করার পর এদেশে বসবাস ও শাসনের প্রয়োজন মনে করলে নূতন সামাজিক নেতৃত্ব তৈরী করা বা খুঁজে নিবার প্রয়োজন অনুভব করে। এখানে সেই সময়ে সামাজিক শূন্যতা পূরণ করতে এগিয়ে আসে ব্রাহ্মণ শ্রেণী।

বিদেশী যাযাবর ও পশুচারী জনগোষ্ঠীর স্রোতের মত ভারতবর্ষে প্রবেশ এখানকার কৃষি সমাজকে বিপদাপন্ন করে তুলে। বিশেষভাবে তাদের পশুদের দ্বারা ফসলের জমি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়াটাই স্বাভাবিক ছিল। এমনটা ধারণা করা চলে যে, বিদেশী আক্রমণাভিযানে শহর ও শহরের উপর নির্ভরশীল জনগোষ্ঠী যেমন বণিক ও কারিগররা ও সেই সাথে তাদের পৃষ্টপোষকতায় সমৃদ্ধিপ্রাপ্ত বৌদ্ধ ও জৈন ধর্ম ক্ষতিগ্রস্ত হলেও গ্রামসমাজে ব্রাহ্মণ টিকে থাকায় গ্রামীণ কৃষি সমাজকে রক্ষায় এগিয়ে আসে ব্রাহ্মণ। বিপুল সংখ্যক বহিরাগতদের কৃষি সমাজে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য ব্রাহ্মণ তার নেতৃত্বে বর্ণ ভিত্তিক কাঠামোয় তাদেরকে সংগঠিত করে।

উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলের গ্রামীণ সমাজে ব্রাহ্মণদের শক্তিভিত্তি পূর্ব থেকেই যথেষ্ট দৃঢ় ছিল বলে অনুমেয়। কারণ সিন্ধু সভ্যতার নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বৈদিক শক্তির বিদ্রোহ মূলত পাঞ্জাব-হরিয়ানার অঞ্চলকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল বলে মনে হয়। এই বিদ্রোহের পরিণতিতে কৃত্রিম নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ধ্বংস হলে প্রকৃতি নির্ভর কৃষি ব্যবস্থায় সমাজ ফিরে যায়। কৃষিজীবীদের এক বৃহৎ অংশ যেমন এই আন্দোলনে ছিল তেমন নূতনভাবে কৃষি ব্যবস্থা প্রবর্তিত হলে এরা তার ভিত্তিতে সমাজের পুনর্গঠনে বৈদিক নেতৃত্বের সহায়ক হয় বলে ধারণা করা চলে। স্বাভাবিকভাবে সিন্ধু সভ্যতা-উত্তর গ্রামীণ জনগোষ্ঠী, বিশেষত কৃষকদের ভিতর বৈদিক ঋষি এবং পরবর্তী কালে ঋষিদের উত্তরসূরি হিসাবে আবির্ভূত ব্রাহ্মণদের শক্তিভিত্তিকে হিসাবে নিয়ে ব্রাহ্মণদের ভূমিকাকে আমাদের বিচার করা উচিত হবে। বৈদিক আন্দোলন-পরবর্তী কালে যখন উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে নগর সভ্যতা পুনর্গঠিত হচ্ছিল তখন নাগরিক জীবনে বৌদ্ধদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হলেও গ্রামে কৃষকদের মধ্যে তখনও ব্রাহ্মণদের যথেষ্ট প্রভাব ছিল বলে অনুমান করা যায়। এই অবস্থায় বৈদেশিক হামলার মুখে উদীয়মান নগর সভ্যতা ধ্বংস হতে থাকলে সেই শূন্যতা পূরণের সুযোগ লাভ করে ব্রাহ্মণরা।

ব্রাহ্মণরা চতুর্বর্ণের কাঠামো গড়ে তুলে ও বিদেশী শাসক ও অন্যান্য আক্রমণকারী যারা ভারতবর্ষের সমাজে জায়গা করে নিচ্ছিল তাদের নেতৃত্বদানকারী অংশটিকে ক্ষত্রিয় মর্যাদায় অভিষিক্ত করে নূতন সমাজ গঠন করতে থাকে। কিন্তু এই ক্ষত্রিয় বুদ্ধ বা মহাবীরের সময়কার ক্ষত্রিয় নয়। এই ক্ষত্রিয় হল ব্রাহ্মণ দ্বারা অভিষিক্ত রাজন্য বা যোদ্ধা বর্ণ। কাজেই এই ক্ষত্রিয়কে ব্রাহ্মণের নেতৃত্ব মেনে নিতে হল। ব্রাহ্মণরা বহিরাগতদের অনেককে শূদ্র ও বৈশ্যের মর্যাদাও দিয়েছিল। এই নূতন সমাজ মূলত গ্রামীণ সমাজ ছিল, কারণ ব্রাহ্মণের শক্তি ছিল প্রধানত গ্রামে, শহরে নয়। শহর হল কারিগর ও বণিকদের স্থান, সেখানে তখনো কিছু হলেও বৌদ্ধ ও জৈন ধর্ম টিকে ছিল। যাইহোক ব্রাহ্মণরা সমাজের কারিগর, বণিক, ইত্যাদি বৃত্তিধারী শ্রেণীকে বৈশ্য অভিধায় তার সমাজের অন্তর্ভুক্ত করে নেওয়া শুরু করে। কিন্তু তখনো বনে-জঙ্গলে ও পশ্চাৎপদ অঞ্চলে বসবাসকারী বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠী বাস করত, যারা তখনো কৃষি সমাজের অন্তর্ভুক্ত হয় নাই। ব্রাহ্মণ এখানে স্থায়ী হওয়া ও ক্ষত্রিয়ত্বে উন্নীত বিদেশীদের সাহায্য নিয়ে বল প্রয়োগের মাধ্যমে এই সমস্ত বনবাসী জনগোষ্ঠীর এক বৃহৎ অংশকে কৃষি সমাজের অধীনে নিয়ে আসে বলে আমরা ধারণা করি। কারণ ব্রাহ্মণ নিজে যেমন তেমন এখানকার অন্যান্য জনগোষ্ঠী সাধারণভাবে যুদ্ধ ও বলপ্রয়োগে অভ্যস্ত ছিল না। এই কাজটা সহজেই বহিরাগত যোদ্ধা জনগোষ্ঠীকে দিয়ে করানো গেল। অনুমান করা যায় গুপ্ত যুগ শুরু হবার আগে থেকেই এই প্রক্রিয়া চলছিল, যখন ভারতব্যাপী শক, কুষাণ ও হুনদের ধারাবাহিক আক্রমণে বণিক ও কারিগরদের কেন্দ্র করে গড়ে উঠা শহর ও নগরগুলি এবং একই সাথে মূলত বৌদ্ধদের মঠ-বিহার এবং বিদ্যালয়-বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক স্থাপনাগুলি ছিল প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত।

এখন প্রশ্ন হল গরুর উপর ব্রাহ্মণের পবিত্রতা আরোপের কারণ কী? সমাজের এত প্রিয় খাবারকে নিষিদ্ধ করার পিছনে অবশ্যই গুরুতর কারণ ছিল, যা ব্রাহ্মণকে এই সিদ্ধান্তে আসতে বাধ্য করেছে। আমরা দেখেছি খ্রীঃপূঃ ২য় বা ১ম শতাব্দী থেকে শুরু করে প্রায় ৪র্থ ৫ম শতাব্দী পর্যন্ত ভারতবর্ষের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চল হয়ে প্রায় অব্যাহত ধারায় বিদেশী যাযাবররা প্রবেশ করেছে ও বিপুল ধ্বংসকাণ্ড চালিয়েছে। এক সময়ে এই সমস্ত পশুচারী যাযাবর এখানে বসতি স্থাপন করে ও বেশ কিছু অঞ্চলের শাসন ক্ষমতা নিয়ে নেয়। সব মিলিয়ে প্রায় ছয় বা সাত শত বৎসর ধরে শক, কুষাণ, হুনরা ঢেউয়ের পর ঢেউয়ে ভারতবর্ষে এসে বসতি স্থাপন করে।

পাতা : ৩৫

আগেই বলা হয়েছে বৌদ্ধরা মূলত শহর কেন্দ্রিক ছিল এবং তাদের মূল শক্তিভিত্তি ছিল কারিগর ও বণিকরা। একদিকে তাদের মঠ-বিহার-বিদ্যালয় ধ্বংস ও অন্য দিকে নগরগুলি ধ্বংসের ফলে তাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক ভিত্তি দুর্বল হয়ে যায়। ব্রাহ্মণের এই ধরনের ধর্মীয় কেন্দ্র না থাকাতে ব্রাহ্মণ সেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় নাই। ধর্ম রক্ষা ও চর্চার জন্য বৌদ্ধ কিংবা জৈনদের মত তাদেরকে সংসার-ত্যাগী প্রতিষ্ঠান গড়তে হয় নাই। সংসারী জীবন যাপন করায় তারা বংশপরম্পরায় তাদের ধর্ম রক্ষা ও চর্চা করতে পারত। হামলা হলে তারা তাদের বাসস্থান ছেড়ে দূরবর্তী গ্রাম কিংবা সাময়িকভাবে অরণ্যেও আশ্রয় নিতে পারত। নগরে কেন্দ্রীভূত না হয়ে তারা গ্রামাঞ্চলে ছড়ানো ছিল বলেও মনে হয়। কারণ নগরগুলি ছিল সাধারণত বৌদ্ধদের কেন্দ্র যেখানে নাগরিক সমাজ বিশেষত বণিক ও কারিগররা ছিল বৌদ্ধ ধর্মের পৃষ্ঠপোষক এবং অনুসারী। সুতরাং সামাজিক নেতৃত্ব গড়ে উঠেছিল বৌদ্ধ প্রতিষ্ঠানসমূহকে কেন্দ্র করে।

এই বাস্তবতায় বিদেশীরা এখানে প্রতিষ্ঠিত শক্তিকে ধ্বংস করে নূতন শক্তি গড়ে তুলবার প্রয়োজনে ব্রাহ্মণকে ব্যবহার করে বলে মনে হয়। ব্রাহ্মণও সমাজের এই ব্যাপক শূন্যতা পূরণের জন্য ও বিদেশী শাসকদের বৈধতা দিবার জন্য এগিয়ে আসে। বিদেশী শাসকদের বৈধতা দিবার জন্য তাদের যে বংশ তালিকা ব্রাহ্মণরা তৈরী করত তাতে দেখানো হত যে নূতন শাসকরা প্রাচীন কাল থেকে ক্ষত্রিয় বংশধর ছিল।  

ব্রাহ্মণকে নিজেদের নেতৃত্ব ও নূতন পরিস্থিতিতে কৃষি সমাজ গঠন করতে গিয়ে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে হয়েছিল। এগুলির মধ্যে প্রথমটি হল চতুর্বর্ণ ব্যবস্থায় বিদেশী শাসকদের ক্ষত্রিয় হিসাবে মর্যাদা দেওয়া ও স্রাতের মত পরবর্তীতে যারা আসত তাদের বৃহত্তর অংশকে ভারতীয় কৃষি সমাজের অন্তর্ভুক্ত করার জন্য বৈশ্য হিসাবে মর্যাদা দেওয়া। আর দ্বিতীয়টি হল স্থানীয় আদিম জীবনে অভ্যস্ত মানুষদেরও অন্তর্ভুক্ত করতে চেয়ে তাদের শূদ্রের মর্যাদা দেওয়া।

কিন্তু শক, কুষাণ ও হুনদের মত যাযাবর গোষ্ঠীর মানুষদের পক্ষে বংশানুক্রমিক পশুচারী যাযাবর জীবন ত্যাগ করে রাতারাতি কৃষি সমাজে প্রবেশ খুব সহজ হবার কথা নয়। আক্রমণাভিযান ও স্থানীয় নগর-শহর, ইত্যাদি ধ্বংসের পর এখানে যারা শাসন করতে চেয়েছে, আক্রমণকারী যাযাবরদের সেই নেতৃত্ব স্বাভাবিকভাবে সমাজের পুরনো ও প্রতিষ্ঠিত নেতৃত্ব ধ্বংস করে তাদের অনুগত নূতন নেতৃত্ব  তৈরী করতে চাইবে। এছাড়া এখানকার শাসক হবার পর তাদের স্থিতিশীল জীবনের আরাম-আয়েস ও একই সাথে শাসন ক্ষমতা রক্ষা করার জন্য তাদের সাথে আসা যাযাবর ও পশুচারীদেরকেও স্থিতিশীল জীবনে নিতে চাইবে। বিশেষ করে নূতন শাসকদের দরকার রাজস্ব, যা তখন কৃষি থেকে ছাড়া অন্যভাবে আসার পথ তারা নিজেরাই ধ্বংস করেছে শহর ও নগর ধ্বংস ক’রে বণিক ও কারিগরদের ভিত্তিকে ধ্বংস ও তাদের ছত্রভংগ ক’রে। ফলে তাদের কৃষির উপর নির্ভর করা ছাড়া উপায় ছিল না। তাছাড়া তারা যাযাবর ও পশুপালক হওয়ায় অল্প সময়ে তাদের পক্ষে নগর সভ্যতা গড়াও সম্ভব নয়। এই কারণে তারা সমাজের ধ্বংস থেকে মোটামুটি রক্ষা পাওয়া ব্রাহ্মণের সহযোগিতা নিল কৃষি সমাজে তাদের অন্তর্ভুক্তি ও সমাজকে পুনর্গঠন ও পরিপুষ্ট করার জন্য।

এই সুযোগ ব্রাহ্মণরা নিল তাদের নেতৃত্বে সমাজ নির্মাণের প্রয়োজনে। এটাও অনুমান করা চলে যে, ব্রাহ্মণরা বিদেশী যোদ্ধা ও যাযাবরদের কৃষি সমাজের অন্তর্ভুক্ত করার পর তাদের সাহায্য নেয় স্থানীয় শিকার ও খাদ্য সংগ্রহে অভ্যস্ত জনগোষ্ঠীগুলিকে কৃষি সমাজের অধীনে আনার জন্য। কারণ ব্রাহ্মণের পক্ষে স্থানীয় অরণ্যচারী মানুষদের কৃষি সমাজে অন্তর্ভুক্ত করা অনেক কঠিন ছিল। অনুমান করা যায় ব্রাহ্মণরা বিদেশী যোদ্ধা ও যাযাবরদেরকে এ কাজে লাগায়। বনাঞ্চলে চলমান শিকারী জীবনে থাকতে অভ্যস্ত এই সব মানুষদেরকে স্থিতিশীল কৃষি জীবনে আনা সহজ ছিল না। বন্যা, খরা বা অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগে ধারাবাহিক ফসলহানি হলে তাদের চিরচেনা বন্য জীবনে ফিরে যাবার সম্ভাবনা ছিল প্রবল।

একদিকে বিদেশী যাযাবর ও পশুচারী মানুষ ও অন্য দিকে স্থানীয় শিকার ও খাদ্য সংগ্রহকারী জনগোষ্ঠী উভয়ের পক্ষে তাদের অভ্যস্ত জীবন পরিত্যাগ সহজ হবার কথা নয়। নূতন শাসকরা নিশ্চয়ই চেয়েছিল বিশেষত ধারাবাহিকভাবে বাইরে থেকে আসা যাযাবর ও পশুচারী জনগোষ্ঠী তাড়াতড়ি কৃষি সমাজে প্রবেশ করুক। আমরা ধারণা করি এই পরিস্থিতিতে ব্রাহ্মণ একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নেয়, তা হল গো হত্যা নিষিদ্ধ করা ও গরুর উপর পবিত্রতা আরোপ করা। আমরা অনুমান করি এটা ব্রাহ্মণ শুরু করে যাযাবর বিদেশী হানাদাররা ভারতবর্ষের উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে প্রবেশ করার শুরু থেকেই। অর্থাৎ খ্রীঃপূঃ দ্বিতীয় বা প্রথম শতাব্দী থেকে শুরু করে চতুর্থ, পঞ্চম ও ষষ্ঠ শতাব্দী পর্যন্ত এই প্রক্রিয়া চলে। এই প্রক্রিয়ায় ব্রাহ্মণরা বিভিন্ন আঞ্চলিক ও বহিরাগত যাযাবরদের দেবতাদেরকে তাদের ধর্মের অঙ্গীভূত করে নেয়। এর অর্থ দাঁড়ায় যত বেশী সংখ্যায় পশ্চাৎপদ ও বিদেশী হানাদাররা ভারতবর্ষে প্রবেশ করেছে তত চতুর্বর্ণ ভিত্তিক ব্রাহ্মণ্য ধর্মের ভিত্তি দৃঢ় হয়েছে। এভাবে ব্রাহ্মণ বিদেশী যাযাবর ও ভারতীয় পশ্চাৎপদ পশু শিকারী ও খাদ্য সংগ্রহকারী জনগোষ্ঠীকে নিয়ে ভারতবর্ষে যে কৃষি সমাজ গঠন করল তা হল চরিত্রে পশ্চাৎপদ। এর ফল দাঁড়াল ব্রাহ্মণকে হতে হল পশ্চাৎপদ কৃষি সমাজের নেতা।

এটা খুব তাৎপর্যপূর্ণ যে, খ্রীষ্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দী থেকে গ্রীকরা ভারতবর্ষে প্রবেশ করলেও তারা প্রধানত হিন্দু বা ব্রাহ্মণ্য ধর্ম কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত হয় নাই। তারা প্রধানত বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করত।  এর দু’টি পরস্পরযুক্ত কারণ হতে পারে। প্রথমত তারা এখানকার নগরগুলিতে ব্যাপক ধ্বংসকাণ্ড পরিচালনা করে নাই। ফলে শক-হুনদের অভিযানের মত এখানকার নগরকেন্দ্রগুলি ধ্বংস না হওয়াতে শহরবাসী কারিগর, বণিক, ইত্যাদি গোষ্ঠীগুলি রক্ষা পায়। দ্বিতীয়ত, তারা শক-হুনদের মত যাযাবর ও বর্বর না হয়ে নিজেরা আগে থেকেই নগরবাসী হওয়াতে ভারতের প্রধানত নগরবাসীর ধর্ম বৌদ্ধ ধর্মকে গ্রহণ করতে সুবিধা হয়েছিল।

------------------------------------

  ভারতবর্ষে আসার পর গ্রীকরা প্রথম দিকে তাদের পুরাতন ধর্মীয় আচার-বিশ্বাস অনুসরণ করত। কিন্তু এখানে দীর্ঘদিন থাকার ফলে তারা ক্রমশ ভারতীয় ধর্ম গ্রহণ করে। মিলিন্দ প্রশ্নে (মিলিন্দপঞ্হ) বলা আছে শ্রমণ নাগসেনের কাছে গ্রীক রাজা মিনান্ডার বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষিত হন। রাজা মিনান্ডার অসংখ্য চৈত্য ও বিহার নির্মাণ করেছিলেন। শুধু রাজা মহারাজারা নন, গ্রীকদের মধ্যে অনেকেই যে বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায়। খ্রীষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে সোয়াত উপত্যকার গ্রীক প্রশাসক থিওডোরাস বুদ্ধের দেহাবশেষ রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন। থিওডোরাসের প্রায় সমসাময়িক মহাধর্মরক্ষিত নামে একজন গ্রীক শ্রমণ ছিলেন যিনি রাজা দুট্টথগামণির মহাস্তপ নির্মাণ উপলক্ষ্যে অলসন্দ শহর থেকে শ্রীলংকায় গিয়েছিলেন। থিওডোরাস ও মহাধর্মরক্ষিতের কিছু পরবর্তী এক গ্রীক মেরিডর্ক তক্ষশিলা থেকে কিছু দূরে একটি বৌদ্ধ স্তূপ নির্মাণ করেন। খ্রীষ্টীয় প্রথম-দ্বিতীয় শতাব্দীর সময়ে পশ্চিম ভারতের নাসিক, কার্লা ও জুন্নারে পাওয়া কিছু উৎকীর্ণ লিপিতে স্থানীয় বৌদ্ধ চৈত্য ও বিহারের উদ্দেশ্যে গ্রীক জনসাধারণের দানের কথা বলা আছে। তারা সকলেই জন্মসূত্রে গ্রীক ছিলেন। তাদের মধ্যে একজন ছাড়া বাকী সকলে ভারতীয় নাম পর্যন্ত গ্রহণ করেছিলেন। তবে সকল গ্রীক যে শুধু বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন এমন নয়। কিছু ক্ষেত্রে বৈষ্ণবধর্মের প্রতি অনুরাগের কথাও জানা যায়। দেখুনঃ দিলীপকুমার গঙ্গোপাধ্যায়, ভারত-ইতিহাসের সন্ধানে, আদি পর্বঃ প্রথম খণ্ড, সাহিত্যলোক, কলকাতা, দ্বিতীয় পুনমুদ্রণ, ২০১৫, পৃঃ ৩৮০। 

------------------------------------

আমরা দেখেছি গুপ্ত যুগে এসে রাষ্ট্রীয় পৃষ্টপোষকতায় ব্রাহ্মণ্য ধর্ম চূড়ান্ত রূপ লাভ করে। যাকে আমরা হিন্দু ধর্ম বলি সেই সময়ে তা সমস্ত ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়ে। হুনদের আক্রমণে শহর, নগর ও মঠ ধ্বংসের ফলে ও সেই সাথে বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের মূল ভিত্তি কারিগর ও বণিকসহ নাগরিক সমাজের যে ক্ষতি হয় সেটা তারা আর পূরণ করতে পারে নাই। এমনকি বৌদ্ধ পাল রাজারা (৭৫০ - ১১৬১ খ্রীষ্টাব্দ) পূর্বাঞ্চল থেকে ভারতবর্ষের বিস্তীর্ণ এলাকা শাসন করলেও ইতিমধ্যে পশ্চাৎপদ কৃষি সমাজ প্রাধান্যশীল হওয়াতে বৌদ্ধ ও জৈন ধর্ম আর প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারে নাই। এই ঘটনাটি খুব তাৎপর্যপূর্ণ যে, খ্রীষ্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দী থেকে ভারতবর্ষে নগরগুলিকে পরিত্যক্ত হতে দেখা যায়, যা ত্রয়োদশ শতাব্দী পর্যন্ত চলেছে। এই সময়ে এখানে গ্রামীণ সমাজ প্রাধান্যশীল হওয়াতে অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন যে, তখন ভারতবর্ষ সামন্ত যুগে প্রবেশ করেছিল। আমাদের অনুমান, ভারতবর্ষব্যাপী হিন্দু ধর্মের বিস্তার ও দৃঢ় ভিত্তি পাবার সাথে ব্যাপক হারে এই নগর পরিত্যাগ বা বিনগরায়ন সম্পর্কিত। 

সমাজে ব্রাহ্মণের ইতিবাচক ভূমিকাও ছিল। প্রায় পাঁচ শত বৎসর ব্যাপী বিদেশী যাযাবরদের আক্রমণাভিযানে উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম ভারতের অসংখ্য নগর, শহর ও বৌদ্ধদের শিক্ষাকেন্দ্রগুলি ধ্বংস হলে ভারতীয় সভ্যতার যে অপূরণীয় ক্ষতি হয়, তা অনেকটা ব্রাহ্মণের কারণে কিছুটা হলেও রক্ষা পেয়েছিল। ব্রাহ্মণরা ভারতবর্ষের গ্রামীণ সমাজে অনেকটা ছড়িয়ে থেকে অবস্থান করায় এই ধ্বংস থেকে রক্ষা পায়। ফলে তারা প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতার ধারাবাহিকতাকে বিদেশী হানাদারদের হাত থেকে রক্ষায় কিছুটা হলেও সমর্থ হয়।

ব্রাহ্মণ ভারতবর্ষে কৃষি সমাজ গঠন করতে গিয়ে সমাজকে পশ্চাৎপদতায় ধরে রাখলেও এখানে যে সমাজ নির্মাণ হল তা পরবর্তী বহিরাগত মুসলিমদের ক্রমাগত আক্রমণাভিযান ও ধ্বংসেও সেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হল না। এর জন্য ভারতবর্ষের গ্রামভিত্তিক স্বশাসিত কৃষি সমাজ বা পঞ্চায়েত ব্যবস্থাও বড় ভূমিকা রেখেছিল। বহিরাগত মুসলিম শাসকরা আক্রমণ ও দখল করার পর তাদের নিজেদের স্বার্থেই এখানকার কৃষি ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে নাই। কারণ তাদের সৈন্যদের বেতন দেওয়া ও এখানে যে রাষ্ট্র তারা গঠন করেছে সেই রাষ্ট্রকে রক্ষা করার জন্যই তাদের রাজস্বের প্রয়োজন ছিল। এই রাজস্বের প্রধান উৎস ছিল কৃষি। সুতরাং কৃষিকে রক্ষা করার প্রয়োজন থেকেই তারা এখানকার পঞ্চায়েত ব্যবস্থা ও সেই সাথে এখানকার জনপ্রিয় ধর্মগুলিকে রক্ষা করেছে কিংবা রক্ষা করতে বাধ্য হয়েছে।  অবশ্য তার আগে তারা বৌদ্ধ ধর্মের মত কেন্দ্রীভূত ও প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের স্থাপনাসমূহকে ধ্বংস করেছে। এ প্রসঙ্গে বখতিয়ার খলজী কর্তৃক নালন্দা বিহার ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ধ্বংসসাধন বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তবে প্রাথমিক ধ্বংসলীলার পরবর্তী কালে তাদের শাসনকে স্থিতিশীলতা দিবার প্রয়োজনে তারা প্রজাসাধারণের মধ্যে জনপ্রিয় ধর্মগুলির প্রতি অনেক ক্ষেত্রে সহিষ্ণুতা প্রদর্শন করেছে। এ প্রসঙ্গে জৈনদের প্রতি মোগল শাসকদের মনোভাব উল্লেখ করা যায়।

মোগল সম্রাট আকবর জৈন শিক্ষক হিরবিজয়কে অত্যন্ত সম্মান করতেন।  জৈন ধর্মে পশু হত্যা নিষিদ্ধ বলে কিছু মোগল শাসক জৈনদের উৎসব পজ্জুসনের সময়ে যে সমস্ত অঞ্চলে জৈনরা থাকত সেই সমস্ত অঞ্চলে পশু হত্যা নিষিদ্ধের ফরমান জারী করেছিল।  দিল্লী ও আহমদাবাদের গুরুত্বপূর্ণ জৈন পরিবাররা চমৎকার জৈন মন্দির নির্মাণ করেছিল ও মোগল দরবারে তাদের প্রভাব ছিল। মোগল যুগে জৈনরা রাজস্থানের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখত বলে জানা যায়।

------------------------------------

দেখুনঃ A.N. Upadhye, Jainism, in, A Cultural History of India, ed., A.L. Basham, 1975, p. 102.

দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ১০২।

------------------------------------

উপরের আলোচনায় আমরা দেখতে পেয়েছি যে, হিন্দু ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা ব্রাহ্মণরা বেদকে প্রাধান্যে রেখে বৃহত্তর সমাজ গঠন করতে গিয়ে ভারতবর্ষের স্থানীয় ও অস্থানীয় নানা দেবতা, ধর্মমত, পূজাপদ্ধতি, লোককাহিনী ও বিশ্বাসকে তাদের ধর্মের অন্তর্ভুক্ত করেছে। এর ফলে ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে হিন্দু ধর্মের বিভিন্ন দেবদেবীর পূজার প্রথা দেখতে পাওয়া যায়। এত বৈচিত্র্য ধারণ করেও এই জনগোষ্ঠী হিন্দু ধর্মভুক্ত হতে পারে বেদের অভ্রান্ততা স্বীকার, ব্রাহ্মণের শ্রেষ্ঠত্বের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ ও ব্রাহ্মণ তাদেরকে বর্ণাশ্রমভিত্তিক যে ‘জাতি’ কাঠামোতে অন্তর্ভুক্ত করেছে সেটি স্বীকার করার মধ্য দিয়ে। তবে হিন্দু ধর্ম সম্পর্কে এ কথা বলা যায় যে, এটি খুব স্থির কোনো ধর্ম নয়। ফলে যুগে যুগে তার মধ্যেও কিছু না কিছু পরিবর্তন ঘটেছে। গুপ্ত যুগে এসে হিন্দু ধর্ম হিসাবে পরিপূর্ণ প্রতিষ্ঠা পেলেও ধীর প্রক্রিয়ায় পরবর্তীকালেও তার ভিতর পরিবর্তন ঘটেছে এবং এখনো ঘটে চলেছে।

পাতা : ৩৬

 

৬ষ্ঠ অধ্যায় : ভারতবর্ষের ধর্মগুলিতে নারীর অবস্থানের ক্রমিক অধোগতি

এটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় যে, খ্রীষ্টীয় শতাব্দী শুরু হবার কয়েক শত বৎসর পর থেকে জৈন, বৌদ্ধ ও হিন্দু ধর্মে নারীর যে নীচু অবস্থান দেখা যায় আদিতে তা ততটা ছিল না। সীমিত সাক্ষ্যপ্রমাণ থাকলেও এই বিষয়টি পরিষ্কার যে, ভারতর্ষের প্রধান এই তিনটি ধর্মেই শুরুর দিকে যখন জৈন ও বৌদ্ধ ধর্ম প্রতিষ্ঠা লাভ করছিল ও বৈদিক ধর্ম সমাজে টিকেছিল সেই সময়ে নারীর ধর্মীয় কাজে তুলনামূলক বেশী অংশগ্রহণের প্রমাণ পাওয়া যায়, যা পরবর্তীকালে আর দেখা যায় নাই। এই অধ্যায়ে আমরা এই ঘটনার তাৎপর্য ও কারণ অনুসন্ধানের চেষ্টা করব। 

আমরা প্রথম খণ্ডে দেখেছি, সিন্ধু সভ্যতার পশ্চাৎপদ অংশের প্রতিনিধিত্বকারী শক্তি ছিল বৈদিকরা। অথচ বৈদিক যুগে ঋষিরা নারীদের তুলনামূলক যে মর্যাদা দিয়েছেন তা অবাক করবার মত। ঋগ্বেদে পুরুষ ঋষিদের পাশাপাশি কয়েকজন নারী ঋষির নামও পাই যাঁরা বেদের মন্ত্র রচনা ও সংকলন করেছিলেন। পঞ্চম মণ্ডলের আটাশ সূক্তের রচয়িতা হলেন বিশ্ববারা নামে একজন নারী ঋষি। এছাড়া অত্রি ঋষির কন্যা অপালা ঋষির রচিত অষ্টম মণ্ডলের ৯১ সূক্তটি এবং ১০ম মণ্ডলের ৪০ নম্বর সূক্তটির রচয়িতা ঘোষা নামে আরেকজন নারী ঋষি। ঘোষা ঋষি হলেন কক্ষীবানের কন্যা। ঋগ্বেদের আরেকটি সূক্তের রচয়িতা হলেন ইন্দ্রাণী ঋষি (১০/১৪৫)। নারীরা যে ধর্মীয় অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে পারত তারও উল্লেখ পাওয়া যায় ঋগ্বেদ থেকে। ঋগ্বেদের একটি ঋকে বলা হচ্ছে, ‘হে ইন্দ্র! তোমার সেবক এবং পাপদ্বেষী যজমান দম্পতি তোমার তৃপ্তির অভিলাষে অধিক পরিমাণে হব্যদান করতঃ তোমার উদ্দেশ্যে বহুসংখ্যক গোধন লাভের জন্য যজ্ঞ বিস্তার করছে’ (১/১৩১/৩) এবং ‘হে অগ্নি! তুমি বলশালী, পরিণীত দম্পতি ধর্মকর্ম দ্বারা জীর্ণ হয়ে একত্রে তোমাকে প্রচুর হব্য প্রদান করছে।’ (৫/৪৩/১৫)। বুঝা যাচ্ছে, বৈদিক যুগে স্বামী-স্ত্রী উভয়েই যজ্ঞ অনুষ্ঠান করতে পারত। অবিবাহিতা কন্যারা যে পিতামাতার সম্পত্তির অধিকারী হতে পারত তাও ঋগ্বেদ থেকে জানা যায়। যেমন গৃৎসমদ ঋষি রচিত ২য় মণ্ডলের ১৭ সূক্তে বলা হচ্ছে, ‘হে ইন্দ্র! যাবজ্জীবন পিতামাতার সাথে অবস্থিতা দুহিতা যেমন আপনার পিতৃকুল হতেই ভাগ প্রার্থনা করে সেরূপ আমি তোমার নিকট ধন যাচ্ঞা করি। সে ধন তুমি সকলের নিকট প্রকাশিত কর এবং সে ধনের পরিমাণ কর ও তা সম্পাদন কর।’ (২/১৭/৭)। এছাড়াও বিধবা নারীদের যে পুনর্বিবাহ হত তাও ঋগ্বেদ সমর্থন করে। একটি ঋকে দেবরের সাথে বিধবা নারীদের বিবাহের উল্লেখ আছে, ‘যেরূপ বিধবা রমণী শয়নকালে দেবরকে সমাদর করে,’ (১০/৪০/২)। ঋগ্বেদের রচনাকাল সিন্ধু সভ্যতার ক্ষয়ের সময়ে, যখন নদীনিয়ন্ত্রণব্যবস্থায় বিপর্যয়ের কারণে রাষ্ট্র ও সমাজে নানা সংকট দেখা দিয়েছে ও বিপুল সংখ্যক মানুষ ছত্রভঙ্গ হচ্ছে ও স্থানান্তরগমন করছে। ক্ষুদ্র পরিসরে কিছু যুদ্ধও সেই সময়ে ঘটেছিল। এই রকম পরিস্থিতিতে সাধারণত নারীর অবস্থানের অধোগতি ঘটে। সেটা নিশ্চয়ই ঘটেছিল। কিন্তু এত বিপর্যয় ও বিশৃঙ্খলার পরেও ঋগ্বেদে নারীর তুলনামূলক উন্নত অবস্থান বিস্ময় জাগায়। অনুমান করা যায় যে, সিন্ধু সভ্যতায় সামাজিক প্রক্রিয়ায় নারীর অংশগ্রহণ ও তুলনামূলক মর্যাদা ছিল বলেই ঋগ্বেদে নারীর সামাজিক ও ধর্মীয় ক্ষেত্রে তুলনামূলক উচ্চ অবস্থান ও অংশগ্রহণ দেখতে পাওয়া যায়। এই প্রসঙ্গে বলা যায় যে, সিন্ধু সভ্যতার যে সমস্ত বসতিতে মানুষের মূর্তি পাওয়া গেছে, সেই সমস্ত বসতিতে নারী মূর্তির সংখ্যাধিক্য তাৎপর্যপূর্ণ। হরপ্পায় প্রত্নতাত্ত্বিক খননে নারী মূর্তি শতকরা ৭০ ভাগ পাওয়া গিয়েছিল। এগুলি যদি খেলার ছলেও তৈরী হয়ে থাকে তাহলেও নারী মূর্তির এই সংখ্যাধিক্য থেকে সমাজে নারীর গুরুত্ব সম্পর্কে ধারণা করা যায়। এই মূর্তিগুলি থেকেও সামাজিক বাস্তবতার এক ধরনের বহিঃপ্রকাশ ঘটা অসম্ভব নয়।

ঋগ্বেদে যেহেতু রাষ্ট্রীয় বিষয়াদি নিয়ে আলোচনা নাই, সেহেতু রাষ্ট্র শাসনে নারীদের অবস্থান কী রকম ছিল তা সেখান থেকে জানবার উপায় নাই। এক্ষেত্রে আমরা সিন্ধু সভ্যতার ঐতিহ্যকে প্রাচীন ভারতবর্ষের সমাজে যে ধর্মগুলি প্রধান ধারা হিসাবে বহন করেছিল সেই সমস্ত ধর্মের গ্রন্থসমূহ থেকে ধারণা পাবার চেষ্টা করতে পারি। এই ক্ষেত্রে জৈন ধর্ম ও বৌদ্ধ ধর্ম আমাদেরকে বহুল পরিমাণে সাহায্য করে।

বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায় যে, গৌতম বুদ্ধের সময় থেকেই নারীদের ভিক্ষু হবার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। যদিও নারীর অংশগ্রহণের বিষয়ে প্রথম দিকে বুদ্ধের সমর্থন ছিল না। বিনয় সূত্র থেকে জানা যায় যে, যখন বুদ্ধের পিতা মারা যান তখন তাঁর সৎ মা ও মাসী মহাপ্রজাপতি পাঁচশত রাজকীয় নারীসহ কপিলাবস্তুতে বুদ্ধের কাছে গিয়েছিলেন সংঘে যোগদানের অনুমতি প্রার্থনা করার জন্য। তাঁদের তিন বার অনুরোধের পরেও বুদ্ধ সম্মতি দেন নাই। এথেকে মনে হয় নারীদের সংঘে অংগীভূত হতে গেলে যে কঠোর নিয়ম কানুন-পালন করতে হয়, তা তিনি চান নাই। এরপর বুদ্ধ কপিলাবস্তু থেকে অনেক দিনের পদযাত্রায় বৈশালীতে পৌঁছালেন। ইতিমধ্যে মহাপ্রজাপতি তাঁর মস্তক মুণ্ডন করলেন ও ভিক্ষুণীর বেশ ধারণ করলেন। তাঁর সাথে পাঁচ শত রাজকীয় নারীও একই কাজ করল ও তারা সবাই বৈশালীতে পৌঁছালেন। সেখানে পৌঁছে বিহারের প্রবেশপথে বসে তিনি কাঁদতে লাগলেন। দীর্ঘ পথযাত্রায় তাঁদের পা ফুলে গিয়েছিল ও পা থেকে রক্ত পড়ছিল। বুদ্ধের অনুসারী আনন্দ তাঁদের দেখে তাঁদের সাথে কথা বললেন ও তাঁদের ইচ্ছা জানলেন। আনন্দ বুদ্ধের কাছে গিয়ে তাঁকে অনুরোধ করলেন সংঘে যোগদানের অনুমতি দিবার জন্য। কিন্তু বুদ্ধ তা দিতে অস্বীকার করেন। একাধিকবার অনুরোধের পর বুদ্ধ অস্বীকার করলে আনন্দ শেষে বলেন, ‘আপনি কি এই জন্য অনুমতি দিচ্ছেন না যেহেতু নারীদের পুরুষদের মত নির্বাণ লাভের জন্য সমান আত্মিক শক্তি নাই?’ উত্তরে বুদ্ধ বলেন, ‘না, আনন্দ, নারীরা পুরুষদের সমান নির্বাণ লাভের শক্তির অধিকারী।’ এরপর বুদ্ধ মহাপ্রজাপতিকে আটটি শর্ত পালন করার সাপেক্ষে ভিক্ষুণী হবার অনুমতি দিলেন। এই আটটি শর্ত গুরুধর্ম নামে পরিচিত। এই শর্তের একটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হল যে কোনো ভিক্ষুণী যে কোনো ভিক্ষুককে অবশ্যই সম্মান দেখাবে যদিও সে তার চেয়ে বয়সে অনেক ছোটও হয়। যদিও একটি ঘটনার প্রেক্ষিতে বুদ্ধ এই শর্তটিকে কিছুটা সংশোধন করেন এবং বলেন যে, যদি সেই ভিক্ষু সম্মান পাবার উপযোগী হয়। এতে কোনো সন্দেহ নাই যে, এই ধরনের শর্ত নারীদের জন্য অসম্মানজনক ছিল। এইভাবে ভিক্ষু সংঘ গঠন হবার প্রায় সাত বা আট বৎসর পরে ভিক্ষুণী সংঘ তৈরী হয়। বৌদ্ধ সাহিত্যে বুদ্ধের সময়ে অনেক নারী ভিক্ষুণীর নাম জানা যায়। তাঁদের মধ্যে ছিলেন সুমনগালা, মথিকা, বসন্তী, সুমেধা, উৎপলাবর্ণা। এছাড়া সমাজে যৌনকর্মী হিসাবে পরিচিত কাশীর আর্থকাশী, উজ্জয়ীনের পদ্মাবতী ও বৈশালীর আম্রপালীর নাম উল্লেখযোগ্য যাঁরা বৌদ্ধ সংঘে মর্যাদার সাথে স্থান পেয়েছিলেন। বুদ্ধ মনে করতেন নারীরাও নির্বাণ লাভ করতে পারে। অশোকের কন্যা ভিক্ষুণী সংঘমিত্রা শ্রীলংকায় যান বৌদ্ধ ধর্ম প্রচার করতে। এথেকে বুঝা যায় অশোকের সময়েও বৌদ্ধ সংঘে নারীদের অংশগ্রহণ ছিল। এটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ যে, বৌদ্ধ ধর্মের ঐতিহ্য অনুসারে গৌতম বুদ্ধের আবির্ভাবের আগেও প্রাচীনকালে যে সমস্ত বহু সংখ্যক বুদ্ধের আগমন ঘটেছিল বলা হয়ে থাকে সেই সময়েও ভিক্ষুণী সংঘের অস্তিত্ব ছিল।

জৈন ধর্মেও নারী ভিক্ষুর অস্তিত্বের কথা জানা যায়। শুধু তাই নয়, জৈন সাহিত্য তাদের সংখ্যা একই মর্যাদার পুরুষদের চেয়েও বেশী ছিল বলে উল্লেখ করেছে। মহাবীরের সময়ে চৌদ্দ হাজার শ্রমণ, এক লক্ষ ঊনষাট হাজার অনুসারী (Lay voteries) ও সাত শত পুরুষ শিষ্য থাকার উল্লেখ আছে। অন্যদিকে চন্দনা নামে একজন নারীর নেতৃত্বে ছত্রিশ হাজার মঠবাসিনী ভিক্ষুণী (Nun) এবং সুলসা ও রেবতীর নেতৃত্বে তিন লক্ষ আঠারো হাজার নারী অনুসারী (Lay voteries) থাকার উল্লেখ আছে (কল্প সূত্র; পঞ্চম উপদেশ; ১৩৫, ১৩৭)।  শুধু তাই নয়, মহাবীরের আগেও ভারতবর্ষে ধর্মীয় সংগঠনগুলিতে নারীদের অংশগ্রহণের প্রমাণ পাওয়া যায়। জৈন সাহিত্য থেকে মহাবীরের আগে পর্যায়ক্রমে আরো তেইশজন তীর্থংকরের উল্লেখ পাওয়া যায়। অনুমান করা যায় যে, এই তীর্থংকরেরা আরো প্রাচীনকালের। হতে পারে যে, তাঁরা সিন্ধু সভ্যতার সময়কালের বা তার আগের বা পরের। কল্প সূত্রে তেইশতম তীর্থংকর অর্হৎ পার্শ বা পার্শনাথের সময়েও ভিক্ষুণী ও নারী অনুসারীর কথা পাওয়া যায়। কল্প সূত্রে পার্শনাথের সময়ে পুরুষ শ্রমণের চেয়ে ভিক্ষুণী ও নারী অনুসারীর সংখ্যা বেশী ছিল বলে উল্লেখ আছে। সেখানে উল্লেখ আছে, ষোল হাজার শ্রমণ, এক লক্ষ চৌষট্টি হাজার অনুসারী ও এক হাজার পুরুষ শিষ্য ছিল। অন্য দিকে একই সময়ে পুষ্পকুলার নেতৃত্বে আটত্রিশ হাজার ভিক্ষুণী ও সুনন্দার নেতৃত্বে তিন লক্ষ সাতাশ হাজার নারী অনুসারী ও দুই হাজার নারী শিষ্যা থাকার কথা বলা আছে (কল্প সূত্র; ১৬২, ১৬৪, ১৬৬)। বাইশতম তীর্থংকর অরিষ্টনেমির সময়ে আঠারো হাজার শ্রমণ, এক লক্ষ ঊনসত্তর হাজার পুরুষ অনুসারী ও পনেরো হাজার পুরুষ শিষ্য ছিল। অন্য দিকে একই সময়ে আর্য যক্ষিণী নামে এক নারীর নেতৃত্বে চল্লিশ হাজার ভিক্ষুণী ও মহাসুভদ্রার নেতৃত্বে তিন লক্ষ ছত্রিশ হাজার নারী অনুসারী থাকার কথা জানা যায়। এছাড়া সেই সময়ে তিন হাজার নারী শিষ্যা থাকার কথাও পাওয়া যায় যারা পূর্ণতা অর্জন করেছিল (কল্প সূত্র; ১৭৭, ১৭৯)। জৈন ধর্মে চব্বিশ জন তীর্থংকরের মধ্যে সর্বপ্রথম তীর্থংকর অর্হৎ ঋষভ বা ঋষভদেবের সময়েও পুরুষদের তুলনায় নারীদের সংখ্যাধিক্য লক্ষ্য করবার মত। তাঁর সময়ে চুরাশি হাজার শ্রমণ, তিন লক্ষ পাঁচ হাজার অনুসারী ও কুড়ি হাজার শিষ্য ছিল। অথচ তাঁর সময়ে ব্রহ্মীসুন্দরী নামে এক নারীর নেতৃত্বে তিন লক্ষ ভিক্ষুণী, সুভদ্রার নেতৃত্বে পাঁচ লক্ষ চুয়ান্ন হাজার নারী অনুসারী ও চল্লিশ হাজার নারী শিষ্য থাকার কথা জানা যায় (কল্প সূত্র; ২১৫, ২১৭, ২২৪)। উপরে বর্ণিত নারীদের সংখ্যা অতিরঞ্জিত হলেও সেই যুগে জৈন ধর্ম ও তার পূর্বসূরি ধর্মীয় মতাদর্শিক গোষ্ঠীসমূহের সংঘ তথা গণের মধ্যে নারীদের বিপুল সংখ্যায় অংশগ্রহণ খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। এটা ঠিক যে, জৈন ধর্মের অন্তর্ভুক্ত নারীদের নির্দিষ্ট কিছু নিয়ম পালন করতে হত ও তারা সংখ্যায় অনেক হলেও জৈন মঠে তাদের মর্যাদাগত অবস্থান গৌণ ছিল। তাদের দীর্ঘকাল ভিক্ষুদের অধীনে থাকতে হত। বুঝা যায় যে, অনেকটা বৌদ্ধদের মতই মঠে তাদের অবস্থান সম্মানজনক ছিল না। এর পরেও বৌদ্ধ ধর্মের মত জৈন ধর্মের সাহিত্য থেকে এমন কোনো উল্লেখ পাওয়া যায় না যেখানে নারী ভিক্ষুণী বা সাধ্বীদের জন্য জৈন গণে কোনো সমস্যা সৃষ্টি হয়েছিল। বৌদ্ধ সংঘে নারীদের সংখ্যা তুলনামূলক কম ছিল। সেই হিসাবে জৈন গণে বা মঠে নারীদের সংখ্যা বেশী ছিল।

------------------------------------

দেখুনঃ Hermann Jacobi (Translated), Gaina Stras, Part I, Kalpa Sûtra, The Secred Books of the East Series, Volume XLV, Oxford at the Clarendon Press, 1895, p. 267, 268.

------------------------------------

পাতা : ৩৭

জৈন ও বৌদ্ধ সাহিত্য থেকে তাদের সংঘ সমূহে নারীর অংশগ্রহণের প্রমাণ  থেকে আমাদের দৃঢ় ধারণা সিন্ধু সভ্যতার রাষ্ট্র ও সমাজে নারীর গুরুত্বপূর্ণ অংশগ্রহণ ছিল। সভ্যতা ধ্বংসপ্রাপ্ত হলেও সভ্যতার বস্তুগত ও ব্যবহারিক নানা দিক ধর্মে ভিন্ন রূপে আত্মপ্রকাশ করে। সিন্ধু সভ্যতার রাষ্ট্র শাসনের উদ্দেশ্যে গঠিত পরিষদ বা সভা সমূহকে যেমন পরবর্তী ভারতবর্ষে প্রজাতান্ত্রিক ক্ষুদ্র রাজ্যসমূহে শাসন পদ্ধতির রূপ হিসাবে কার্যকর হতে দেখা গিয়েছিল বলে আমরা ধারণা করি তেমন জৈন ও বৌদ্ধ সংঘেও রাষ্ট্রশাসনের এই পদ্ধতি ভিন্ন রূপে কার্যকর হয়েছিল বলে আমরা ধারণা করি। এ যেন ভিন্ন কাল ও পরিস্থিতিতে সিন্ধু সভ্যতার রাষ্ট্রের ভাবপ্রেরণার ধর্মের মধ্য দিয়ে পুনরুজ্জীবন। আজীবিকদের সংঘসমূহ কীভাবে পরিচালিত হত তা জানা না গেলেও ধারণা করা যায় সেগুলিও জৈন বা বৌদ্ধ সংঘ সমূহের মতই পরিচালিত হত।

যাইহোক, এই দুই ধর্মের সংঘে নারীর অংশগ্রহণ ও প্রাচীন ভারতীয় বিভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠীসমূহের ঐতিহ্যে নারীদের প্রাচীন সংঘসমূহে অংশগ্রহণ আমাদের এমন একটি ধারণার দিকে ইংগিত করে যে, সিন্ধু সভ্যতার পরিষদসমূহে নারীর প্রতিনিধিত্ব তথা অংশগ্রহণ থাকত। ঋগ্বেদের কিছু সংখ্যক মন্ত্রের নারী রচয়িতা থাকার ঘটনা সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে নারীর অংশ গ্রহণের সপক্ষে পরোক্ষ হলেও ইঙ্গিত দেয়। 

এমন হতে পারে যে, সিন্ধু সভ্যতার প্রথম পর্যায়ে নারীদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে নদীনিয়ন্ত্রণব্যবস্থায় সংকট শুরু হলে সমাজ ও রাষ্ট্রে যখন ধর্ম ও যুদ্ধের গুরুত্ব বৃদ্ধি পেতে থাকে তখন হয়ত সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে নারীর গুরুত্ব কমতে শুরু করে। সিন্ধু সভ্যতায় অহিংস মতাদর্শের উপর জোর দিবার সাথে নারীর প্রধানত অহিংস বৈশিষ্ট্য অনেকখানি সামঞ্জস্যপূর্ণ। যুদ্ধ নির্ভর সমাজে নারীর প্রাধান্য সম্ভব নয়।

মহাবীর ও গৌতম বুদ্ধের সময়ে সংঘে নারীদের যে অংশগ্রহণ ছিল পরবর্তী সময়ে তা কমে যায়। খ্রীষ্টপূর্ব ২য় শতাব্দী থেকে খ্রীষ্টীয় ৫ম শতাব্দী পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে শক, কুশাণ ও হুনদের মত বহিরাগত পশুপালক ও যাযাবর জাতিসমূহের উত্তর-পশ্চিম ভারতে আক্রমণ, ধ্বংস ও লুন্ঠনের সাথে স্বাভাবিকভাবে ঐ অঞ্চলের বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের সংঘসমূহের নারীদের উপর বিপর্যয়কর আঘাত এসেছিল। কারণ এই ধরনের বিদেশী হানাদারদের আক্রমণের প্রধান লক্ষ্যবস্তুই হয় আক্রান্ত জনপদের সম্পদ এবং নারী। এই সমস্ত হানাদার বিশেষত হুনরা ভারতবর্ষের ঐ অঞ্চলের অনেক নগর ও সমৃদ্ধ জনপদ ধ্বংস করেছিল। তবে ঐ সময়ে মধ্য, দক্ষিণ ও পূর্ব ভারতের জনপদসমূহ রক্ষা পেয়েছিল। কিন্তু প্রায় ছয়/ সাত শত বৎসর এই ব্যাপক ভিত্তিক বৈদেশিক আক্রমণ, ধ্বংস ও লুন্ঠনে ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের বাণিজ্যের যেমন ক্ষতি হয়েছিল তেমন বিপুল সংখ্যক মানুষের ঐ অঞ্চল থেকে বাস্তুচ্যুত হয়ে স্থানান্তর গমনের ফলে অন্যান্য অঞ্চলের সামাজিক স্থিতিশীলতা ও ভারসাম্যও ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল বলে ধারণা করা যায়।

আমরা আগে আলোচনা করেছি যে, উত্তর-পশ্চিম ভারতবর্ষে শক, কুষাণ ও হুনদের মত বিদেশী হানাদারদের আক্রমণাভিযানে বৌদ্ধ ও জৈন ধর্ম সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল তাদের ধর্মীয় কেন্দ্র হিসাবে মঠ বা বিহার থাকাতে ও সেগুলি প্রধানত শহরে অবস্থিত হওয়াতে। মঠের মত একটি কেন্দ্রে সমাবেশ ঘটায় উভয় ধর্মের নারীদের উপর আঘাত বিদেশী হানাদারদের জন্য সহজতর হয়েছিল। ভারতবর্ষে এই উভয় ধর্মে নারীদের ভিক্ষুণী সংঘে অংশগ্রহণ কমে যাওয়া ও অবশেষে বিলুপ্ত হওয়ার এটি একটি প্রধান কারণ। তবে ভারতবর্ষের অন্যান্য অঞ্চলে জৈন ধর্মের শ্বেতাম্বর মতের অনুসারীদের মধ্যে নারীদের তুলনামূলক সংখ্যাধিক্য ছিল।

আগের অধ্যায়সমূহে আলোচনায় আমরা দেখিয়েছি যে, উত্তর-পশ্চিম ভারতে ধারাবাহিক বিদেশী হানাদারদের আগ্রাসনে ভারতবর্ষের নগরকেন্দ্র সমূহ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের বিশেষ করে বৌদ্ধ ধর্মের ভিত্তি দুর্বল হলেও ব্রাহ্মণকে কেন্দ্র করে হিন্দু ধর্ম ক্রমশ ভারতবর্ষের গ্রামীণ সমাজে দৃঢ় ভিত্তির উপর দাঁড়াতে শুরু করে। এটি গুপ্ত যুগের আগে শুরু হয় ও গুপ্ত যুগে অনেকটা পূর্ণাঙ্গ রূপ নেয়। একই সাথে সমাজে যুদ্ধেরও প্রাধান্য বৃদ্ধি পায়। এই সমস্ত কারণও কাজ করেছিল বৌদ্ধ ও জৈন সংঘসমূহে নারীদের অংশগ্রহণ কমে যাওয়ার পিছনে। দেখা যায় যে, জৈন ধর্মে এর পরেও কিছু অংশগ্রহণ থাকলেও বৌদ্ধ ধর্মের সংঘসমূহে নারীর অংশগ্রহণ আর থাকে নাই। জৈন ধর্মে যেটুকু নারীর অংশগ্রহণ ছিল তাতে দ্বিতীয় আঘাত আসে বহিরাগত মুসলিম হানাদারদের কাছ থেকে।

অষ্টম শতাব্দীতে (৭১২ খ্রীষ্টাব্দ) আরব মুসলিমদের সিন্ধু আক্রমণ ও বিজয়ের পর ভারতবর্ষে বেশ কিছু কালের জন্য মুসলিম অগ্রাভিযান থেমে থাকে। পরবর্তী কালে সুলতান মাহমুদ কর্তৃক একাদশ শতাব্দীর সূচনা থেকে (১০০০ খ্রীষ্টাব্দ থেকে ১০২৭ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যবর্তী সময়ে) ১৭ বার ভারত আক্রমণ ও লুণ্ঠন অভিযান হলেও দেশ দখলের উদ্দেশ্যে মুসলিম আগ্রাসন হতে আরও কিছু সময় লাগে। সেটা শুরু হয় দ্বাদশ শতাব্দীর শেষ দিক থেকে। এরপর অব্যাহত ধারায় বহিরাগত মুসলিম হানাদারেরা ভারতবর্ষে আক্রমণাভিযান পরিচালনা করে। তারা ব্যাপক ধ্বংস, সম্পদ লুন্ঠন, নারী ধর্ষণ ও অপহরণ এবং দাসকরণের পদ্ধতি অবলম্বন করে। প্রথম দিকে উত্তর-পশ্চিম ভারতে সীমাবদ্ধ থাকলেও ক্রমে তারা ভারতবর্ষের বৃহত্তর অংশ অধিকার করে। ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রথমে বখতিয়ার খলজীর বিহারে নালন্দা বৌদ্ধ বিহার ধ্বংস ও বাংলা বিজয়ের মধ্য দিয়ে মুসলিমদের শাসন ভারতবর্ষে মোটামুটি স্থায়ী ও সর্বব্যাপী রূপ নেয়। মুসলিম বিজয়ের পর ভারতবর্ষে জৈন ও বৌদ্ধ ধর্মে নারীর যেটুকু অংশ গ্রহণ ছিল তার পরিপূর্ণ ও স্থায়ী বিলুপ্তি ঘটে।

মনে করা হয় খ্রীষ্টীয় একাদশ শতাব্দী পর্যন্ত শ্রীলংকায় ভিক্ষুণী সংঘ অস্তিত্বশীল ছিল। কিছু দেশে মহাযান ও বজ্রযান বৌদ্ধধর্মে ভিক্ষুণী সংঘ ধারাবাহিকভাবে চলে আসলেও শ্রীলংকায় থেরবাদী বৌদ্ধধর্মে ১১শ শতাব্দীর পর আর ভিক্ষুণী সংঘের প্রমাণ পাওয়া যায় না। কেবলমাত্র ঊনবিংশ শতাব্দীর পরে কিছু দেশে নারীদের আগ্রহে পুনরায় বৌদ্ধ ধর্মে ভিক্ষুণী সংঘ চালু হয়েছে। মাঝখানে দীর্ঘ বিরতির পর গত বিংশ শতাব্দী থেকে ভারতে জৈন ধর্মেও নারীদের কিছুটা এগিয়ে আসতে দেখা যাচ্ছে।

আগের আলোচনায় আমরা দেখিয়েছি যে, হিন্দু ধর্মের উদ্ভবের প্রক্রিয়া খ্রীষ্টপূর্ব দ্বিতীয় বা প্রথম শতাব্দী থেকে শুরু হলেও তা মোটামুটি রূপ নেয় খ্রীষ্টীয় তৃতীয়/ চতুর্থ শতাব্দীর দিকে। গুপ্ত যুগে বিশেষভাবে রাষ্ট্রীয় পৃষ্টপোষকতায় তা মোটামুটি আজকের হিন্দু ধর্মের রূপ নেয়। এই সময়েই হিন্দু ধর্মের আইনগ্রন্থ মনুসংহিতা চূড়ান্তভাবে সংকলিত হয়। মনুসংহিতায় অনেক প্রাচীন উপাদান সংকলিত হলেও তা গুপ্তযুগে আজকের চূড়ান্ত রূপ নিয়েছে বলে মনে করা যায়। হিন্দু ধর্মকে বুঝার জন্য মনুসংহিতা একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল। মনুসংহিতা থেকে সেই যুগে অর্থাৎ খ্রীষ্টীয় শতাব্দীর শুরু থেকে আদি মধ্যযুগব্যাপী হিন্দু ধর্মে নারীর সামাজিক অবস্থান বুঝা যায়। মনুসংহিতায় নারীকে পারিবারিক জীবনের বাইরে অন্য কোনো কাজে অংশগ্রহণ করতে নিষেধ করা হয়েছে। এমনকি বৈদিক যুগে নারীকে ধর্মীয় কাজে অংশ গ্রহণ করতে দেখা যায়, যেমন স্বামী-স্ত্রীর যজ্ঞ সম্পাদন করা। কিন্তু মনুসংহিতায় তাও নিষেধ করা হয়েছে। যেমন বলা হয়েছে, ‘স্ত্রীলোকের স্বামী ভিন্ন পৃথক যজ্ঞ নেই। স্বামীর অনুমতি ছাড়া কোনো ব্রত এবং উপবাস নেই। কেবলমাত্র স্বামীর সেবা করেই স্ত্রীলোক স্বর্গে যেতে পারেন।’ (মনুসংহিতা; ৫, ১৫৫) । এছাড়া নারীর অবস্থা বুঝার জন্য মনুসংহিতার এই বিধানগুলি যথেষ্ট, ‘কী বালিকা, কী যুবতী, কী বৃদ্ধা গৃহে থাকাকালীন কোনো কাজই স্বতন্ত্রভাবে করতে পারবেন না।’ (৫, ১৪৭)। ‘বাল্যকালে স্ত্রীলোক পিতার বশে, যৌবনে স্বামীর বশে এবং স্বামীর মৃত্যু হলে পুত্রের বশে থাকবেন। পুত্র না থাকলে স্বামীর স্বপিণ্ডের বশে, স্বামীর স্বপিণ্ড না থাকলে পিতৃস্বপিণ্ডের বশে এবং পিতৃস্বপিণ্ড না থাকলে রাজার বশে থাকবেন। অর্থাৎ স্ত্রীলোক কখনোই স্বাধীনভাবে অবস্থান করবেন না।’ (৫, ১৪৮)।

------------------------------------

এই গ্রন্থে মনুসংহিতার সকল উদ্ধৃতি নেওয়া হয়েছে, চৈতালী দত্ত (সম্পাদনা ও ভাষান্তর), মনুসংহিতা, নবপত্র প্রকাশন, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ ২০০৮, দ্বিতীয় মুদ্রণ ২০১৫ থেকে।

------------------------------------

হিন্দু ধর্মে নারীর এই অধোগতির কারণের মধ্যে যেমন লুকিয়ে আছে ভারতবর্ষে বিদেশী হানাদারদের দীর্ঘকালব্যাপী আক্রমণাভিযান, লুন্ঠন ও নারীনিগ্রহ তেমন হিন্দু ধর্মের রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক নেতৃত্বে এখানে থেকে যাওয়া বৈদেশিক হানাদারদের উত্তরাধিকারও। আগে আমরা বলেছি, হিন্দু সমাজের নেতা ব্রাহ্মণ ভারতীয় সমাজে মিশে যাওয়া শক, কুশান ও হুনদের মত বিদেশী শাসকদের ক্ষত্রিয়ত্বের মর্যাদা দিয়ে চতুর্বর্ণভিত্তিক সমাজ গঠন করেছিল। স্বাভাবিকভাবে, পশুচারী ও যাযাবর পশ্চাদভূমি থেকে আসা এই সমস্ত হানাদার জনগোষ্ঠীতে নারীর উচ্চ অবস্থান আশা করা অনুচিত। সুতরাং তাদের নেতৃত্ব হিন্দু ধর্মে নারীর অধোগতির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল বলে ধারণা করা যায়।

কিন্তু ভারতবর্ষের দক্ষিণ ও পূর্ব অংশে তখনো বহিরাক্রমণ ঘটে নাই। সুতরাং সেই সময়ে এই অঞ্চলে বাইরের প্রভাব মুক্ত থেকেছে। তবে বাস্তব পরিস্থিতি বিবেচনা করলে দেখা যাবে যে, শতশত বৎসর ধরে উত্তর-পশ্চিম ভারতে এই বহিরাক্রমণ ভারতবর্ষের অন্যান্য অঞ্চলে ব্যাপকভাবে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছিল। এই বহিরাগতরা দীর্ঘকালব্যাপী উত্তর-পশ্চিম ভারতে যে ব্যাপক লুন্ঠন ও ধ্বংসযজ্ঞ চালায় তাতে ঐ অঞ্চল থেকে বিপুল সংখ্যক মানুষ অন্যান্য অঞ্চলে স্থানান্তরগমন করে, বিশেষভাবে মধ্য, পূর্ব ও দক্ষিণ ভারতে। হুনদের আক্রমণে ও ব্যাপক ধ্বংসকাণ্ডে উত্তর-পশ্চিম ভারতের বৌদ্ধ বিহার ও মঠসমূহ বিশেষভাবে তক্ষশীলার জ্ঞানকেন্দ্রসমূহ ধ্বংস হয়ে গেলে বহু বৌদ্ধ ভিক্ষু ও শ্রমণ পূর্ব ভারতে অভিগমণ করেছিল। সেই সময়ে গুপ্ত রাজাদের পৃষ্টপোষকতায় খ্রীষ্টীয় পঞ্চম শতাব্দীতে তাদের জন্য নালন্দার মঠ ও বিহার প্রতিষ্ঠিত হয়, যা পরে জ্ঞানের কেন্দ্র হয়ে উঠে। অনুমান করা যায় যে, ধ্বংসকাণ্ড যেহেতু প্রধানত নগরে হয়েছিল, ঐ অঞ্চলের নগরসমূহ থেকে বৌদ্ধ ভিক্ষু ছাড়াও বণিক, কারিগর, শিল্পী ও অন্যান্য পেশাজীবীর মানুষ পূর্ব ও দক্ষিণ ভারতে অভিগমণ করেছিল। এর ফলে বিপুল সংখ্যায় আগত ছিন্নমূল ও উদ্বাস্তু মানুষদের ক্রমবর্ধমান চাপে এই সমস্ত অঞ্চলের সামাজিক স্থিতিশীলতাও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কথা। এই অস্থিতিশীলতার পরিস্থিতি যেমন ভারতবর্ষের অন্যন্য অঞ্চলে বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মে নারীর সামাজিক ও ধর্মীয় অবস্থার অধোগতি ঘটিয়েছিল তেমন একইভাবে ক্রমবিকাশমান হিন্দু ধর্মেও নারীর অবস্থার অধোগতিকে ক্রমবর্ধমান শক্তি যুগিয়েছিল বলে মনে হয়।

পাতা : ৩৮ 

 

৭ম অধ্যায় : গাঙ্গেয় সমভূমিতে সিন্ধু সভ্যতার উত্তরাধিকার

ভারতবর্ষের মত পৃথিবীর কোনো সভ্যতারই এত দীর্ঘ সাংস্কৃতিক ধারাবাহিকতা নাই। আজকের মিসর বা ইরাকের কেউ তাদের প্রাচীন সভ্যতার স্মৃতি ধরে রাখতে পারে নাই। প্রাচীন মিসরের ‘মৃতের গ্রন্থ’ বা মোসোপটেমিয়ার ‘গিলগামেশের উপকথা’ অথবা প্রাচীন মিসরের ফারাও রামেসিস ২ বা  ব্যাবিলনীয় রাজা হাম্মুরাবির লিখিত দলিল ঐসব অঞ্চলে আজকের দিনে বিস্মৃত বিষয় মাত্র। কেবলমাত্র ঊনবিংশ শতাব্দীতে এসে পণ্ডিতরা তাদের লিখিত দলিল আবিষ্কার ও পাঠোদ্ধারের পরেই আমরা তাদের সম্পর্কে জানতে পেরেছি। এই দিকটি বিবেচনা করলে ভারতবর্ষের দীর্ঘ সাংস্কৃতিক ধারাবাহিকতার ঐতিহ্য অতুলনীয়। ভারতবর্ষের পরে সভ্যতার পথে যাত্রা শুরু করে চীনও তার সভ্যতার ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছে।

আমরা দেখেছি এখন থেকে প্রায় নয় হাজার বৎসর আগে মেহ্রগড়ে স্থিতিশীল জীবন ও কৃষির সূচনা হয়ে তার ধারাবাহিকতা সিন্ধু সভ্যতা বা হরপ্পান সভ্যতায় চূড়ান্ত রূপ নেয় ও সিন্ধু সভ্যতার পতনের পরেও বিদায়ী হরপ্পান পর্যায়ে তার ধারাবাহিকতা বজায় রাখে। বিদায়ী হরপ্পান থেকে প্রায় সোয়া এক হাজার বৎসর পরে গঙ্গা সমভূমিতে যে দ্বিতীয় নগরায়ন শুরু হয় তাতেও যে সিন্ধু সভ্যতার ধারাবাহিকতা বজায় ছিল তা আমরা দেখেছি।

আগের আলোচনায় দেখানো হয়েছে যে, সিন্ধু সভ্যতার রাষ্ট্র পরিচালনার গণতান্ত্রিক বৈশিষ্ট্য এবং রাষ্ট্র কর্তৃক অনুসৃত ও সাধারণ সমাজে প্রচলিত ও জনপ্রিয় লোকবাদী ও নিরীশ্বরবাদী ধারণাসমূহকে প্রাচীন ঐতিহাসিক ভারতবর্ষের সমাজ উত্তরাধিকার সূত্রে বহন করেছিল। এই বাস্তবতার প্রতিফলন ঘটেছে সেই সময়ে বিভিন্ন জনপদে জনপ্রতিনিধিত্বমূলক সভা ও পরিষদের মাধ্যমে এবং বৌদ্ধ, জৈন, আজীবিক ও অন্যান্য আরো বহু নিরীশ্বরবাদী ধর্মমতের বহুল প্রসারের মাধ্যমে। এছাড়া বৌদ্ধদের ধর্মীয় সংগঠন পরিচালনায় গণতন্ত্রের চর্চাও যে সিন্ধু সভ্যতার রাষ্ট্র শাসনের ঐতিহ্য থেকে এসেছিল সেটি ধারণা করা যায়। অবশ্য জৈন ধর্মের আদি সংঘসমূহে গণতান্ত্রিক পদ্ধতির প্রয়োগ দেখা যায় না।  তবে এ কথা বলা চলে যে, সিন্ধু সভ্যতার রাষ্ট্র পরিচালনার পদ্ধতি ও তার সমাজের ভাবধারা প্রাচীন ভারতীয় সমাজে ভিন্ন রূপে হলেও সঞ্চারিত হয়েছে।

------------------------------------

 দেখুনঃ Sukumar Dutt, Early Buddhist Monachism 600 B.C. – 100 B.C., Kegan Paul, Trench, Trubner & Co., Ltd., 1924, p. 139.

------------------------------------

জৈন ও বৌদ্ধ ধর্মমতের মত আজীবিকরাও প্রাচীন ভারতীয় ঐতিহ্য থেকে এসেছিল। পঞ্চম জৈন আগম যা ভগবতী সূত্র নামে পরিচিত সেখানে আজীবিক মতের অনুসারী গোশালের ছয়টি অতীত পুনর্জন্মের কথা বলা আছে যেখানে বর্তমান পুনর্জন্মপ্রাপ্ত মন্খলি-পুত্র বা মখ্খলিপুত্র হিসাবে পরিপূর্ণতা লাভ করেছিল। সেই অনুযায়ী আজীবিক মতের প্রতিষ্ঠাতা ধর্মনেতাদের সাতটি বংশানুক্রমিক অনুক্রম পাওয়া যায়। জৈন ও বৌদ্ধ উভয় সূত্র অনুযায়ী আজীবিক মতের সূচনা হয়েছিল নন্দ ভচ্ছ বা এণেজ্জগার (Eṇejjaga) মাধ্যমে বহুকাল আগে।  যাইহোক, আজীবিকদের দর্শনের মূল নীতি হল নিয়তি। গোশাল ছিলেন দৃঢ়ভাবে নিয়তিবাদী, যিনি নিয়তিকে বিশ্বের সকল কিছুর প্রেরণা হিসাবে প্রচার করতেন এবং সমস্ত ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য পরিবর্তনের একমাত্র কারণ বলে মনে করতেন। আজীবিকরা মনে করতেন সমস্ত অগ্রগতি ও পরিবর্তন সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রিত।  এমন হতে পারে যে, বিশ্বের সবকিছুই পূর্ব নির্ধারিত আজীবিকদের এই ধারণাটি সিন্ধু সভ্যতার রাষ্ট্রের কোনো একটি ধারণা বা দর্শন দেড় হাজার বৎসর পরে চরম রূপ নিয়েছে। হতে পারে যে, আজীবিক দর্শনের পিছনে এমন সামাজিক বাস্তবতা ক্রিয়াশীল ছিল যেখানে সমাজ ও রাষ্ট্র জীবনের বহুকিছু পূর্বপরিকল্পিত তথা পূর্বনির্ধারিত। যেমন বসতিসমূহের পরিকল্পনায় তেমন লিপি, ওজন, সীল, মাপ ও দৈর্ঘ্যরে অনুপাতে দৃঢ় কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ এবং অভিন্নতা রক্ষা করতে হয়েছে। অর্থাৎ কিছু বিষয়কে সিন্ধু সভ্যতার শাসকদের পূর্ব থেকে নির্ধারণ করতে হয়েছিল এবং সেইসব ক্ষেত্রে নাগরিকদের রাষ্ট্রীয়-সামাজিক বিধান লঙ্ঘন করে ভিন্ন কিছু করা ছিল অচিন্তনীয়।

------------------------------------

দেখুনঃ B.M. Barua, The Ajivikas, Part I, Published by the University of Calcutta, 1920, p. 5.

  দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ৭।

দেখুনঃ A.L. Basham, History and Doctrines of the Ājīvikas: A Vanished Indian Religion, 1951, pp. 224-228.

------------------------------------

সিন্ধু সভ্যতার যে সমস্ত বিষয় পরবর্তীকালে ভারতীয় সমাজে কম-বেশী প্রতিফলিত হতে দেখা গেছে তার মধ্যে সিন্ধু সভ্যতার শাসকদের অনাড়ম্বর জীবন, প্রদর্শনকামী প্রবণতার অনুপস্থিতি ও প্রজাসাধারণের প্রয়োজনের প্রতি শাসকদের মনোযোগ লক্ষ্যণীয়।

গত সিকি শতাব্দীকাল ধরে বহু সংখ্যক বসতিতে প্রত্নতাত্ত্বিক খননের ফলে এবিষয়ে লেখকরা একমত যে, গাঙ্গেয় সমভূমিতে দ্বিতীয় নগরায়ন এবং পরবর্তী সভ্যতা সিন্ধু সভ্যতার উত্তরাধিকার বহন করছে। প্রত্নতাত্ত্বিকভাবে এর অনেক প্রমাণ পাওয়া যায়। এই অধ্যায়ে আমরা মূলত প্রত্নতত্ত্বের আলোকে ও আগের পর্বে আলোচিত আমাদের কিছু সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে গাঙ্গেয় সমভূমিতে, আরো সঠিকভাবে বললে সমগ্র ভারতবর্ষে, সিন্ধুর উত্তরাধিকারের নানা বিষয়ে আলোচনা করব।

পরবর্তী যুগে গাঙ্গেয় সমভূমিতে নদীতে বাঁধ ভিত্তিক সেচব্যবস্থা

সিন্ধু সভ্যতায় আমরা দেখেছি বালুচিস্তানে ও সিন্ধুর কিছু অঞ্চলে নদীকে বাঁধ দিয়ে কৃষিতে অধিক উৎপাদনের জন্য কাজে লাগানো হত। ঋগ্বেদের সাহায্যে দেখানো হয়েছে সিন্ধু সভ্যতায় সব অঞ্চলেই বাঁধ ভিত্তিক নদীনিয়ন্ত্রণব্যবস্থা কার্যকর করা হয়েছিল, ফলে এখানে ফসল উৎপাদন বেড়ে যায় ও বহু সংখ্যক মানুষকে এই সভ্যতা ধারণ করতে পারে। সিন্ধু সভ্যতার এই বাঁধ ভিত্তিক নদী নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাকে আমরা প্রত্নতাত্ত্বিকভাবে গাঙ্গেয় উপত্যকায় কিছু কিছু অঞ্চলে ক্ষুদ্র পরিসরে ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে দেখি। উত্তর মহারাষ্ট্রে তারনমাতা মন্দিরের নীচে যে একটি বর্ষজীবী জলধারা আছে সেখানকার সংকীর্ণ অংশে আড়াআড়ি বাঁধ ছিল। এটি সম্ভবত কৃষিতে সেচের জন্য তৈরী করা হয়েছিল। এই জলধারা বরাবর দু’টি পাথরের ভারী দেওয়াল দেখা যায় যা এই বাঁধটির প্রতিরক্ষার জন্য ছিল বলে মনে হয়।  মৌর্য যুগে গুজরাটে বাঁধ তৈরীর ইতিহাস পাওয়া যায়। রুদ্রদমনের জুনাগড় লিপি থেকে জানা যায় যে, চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য সুদর্শন হ্রদ তৈরী করেন, যার সময় আনুমানিক খ্রীঃপূঃ ৪র্থ শতাব্দীর শেষ চতুর্থাংশে। মধ্য ভারতে সুপরিচিত বৌদ্ধ বসতি সাঁচির চারপাশে ১৬টি বাঁধের কথা উল্লেখ আছে।

------------------------------------

দেখুনঃ Y.S. Rawat, Hill Fort of Anarta: Discovery of a Unique Early Historical Fort with Cave-Dwellings, Budhist Idols and Remains at Taranga in North Gujarat, in, Purātattva, No. 39, 2009, pp. 102-103.

  দেখুনঃ প্রাগুক্ত নিবন্ধ, পৃঃ ১০৩।

------------------------------------

কুনাল জাতকে (সংখ্যা ৩৫৬) বলা হয়েছে যে, শাক্য ও কোলিয়র দু’টি গোষ্ঠী রোহিনী নদীতে দেওয়া বাঁধ থেকে জল নিবার জন্য লড়াই করেছিল। বুদ্ধ যখন জানলেন, তিনি সেখানে গিয়ে ধর্ম প্রচার করলেন ও তাদের লড়াই থামালেন।

------------------------------------

দেখুনঃ M.K. Dhavalikar, Cultural Ecology of Mauryan India, in, Purātattva, No.31: 2000-2001, 2001, p. 87.

------------------------------------

মেগাস্থিনিস ভারতবর্ষে প্রধান খাল থেকে শাখা খালগুলিতে জল প্রবাহ স্লুইসের সাহায্যে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য রাষ্ট্রীয় পরিদর্শনকারীর কথা উল্লেখ করেছেন। এর ফলে খ্রীঃপূঃ ৪র্থ শতাব্দীতে ভারতবর্ষে সিন্ধু সভ্যতার মত স্লুইস গেটের সাহায্যে জল প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করার পদ্ধতির কথা পাওয়া যায়।

------------------------------------

দেখুনঃ John W. McCrindle, Ancient India as described by Megasthenês and Arrian, p. 86.

------------------------------------

পাতা : ৩৯

বুদ্ধের সময়ে বিভিন্ন জায়গায় অনেক খাল কাটা হয়েছিল। রাজা খারবেলের হাতিগুম্ফা (ওড়িশা) শিলালিপিতে বলা আছে যে, খ্রীঃপূঃ ৫ম শতাব্দীতে একজন নন্দ রাজা কর্তৃক একটি বড় প্রাচীন খাল খনন করা হয়েছিল। খারবেল খ্রীঃপূঃ ১ম শতাব্দীতে শাসন করেছিলেন। মগধের একজন নন্দ রাজা কলিঙ্গ (ওড়িশা) বিজয় করেন, যিনি বহুসংখ্যক বাঁধ নির্মাণ করেছিলেন, পুরনোগুলি মেরামত করেছিলেন, উদ্যান পুনর্নির্মাণ করেছিলেন ও জলাশয় ও হ্রদ তৈরী করেছিলেন। তিনি মগধ (মধ্য বিহার) থেকে একটি খালকে প্রসারিত করেছিলেন, যা শুরুতে একজন নন্দ রাজা তিন শত বৎসর আগে তাঁর রাজধানী তোশালী পর্যন্ত খনন করেন।

------------------------------------

দেখুনঃ M.K. Dhavalikar, Cultural Ecology of Mauryan India, in, Purātattva, No. 31: 2000-2001, 2001, p. 87.

------------------------------------

মৌর্য সম্রাট চন্দ্রগুপ্তের সময়ে গুজরাটের জুনাগড়ে সোনারেখা নদীতে আড়াআড়িভাবে একটি বাঁধ নির্মণের কথা জানা যায়।  এই বাঁধের উজানে এর ফলে একটি বড় হ্রদ তৈরী হয় যা সুদর্শন হ্রদ নামে পরিচিত। ধারণা করা যায় যে এটি মানুষজনের কৃষিতে জলসেচ, গৃহস্থালি কাজ ও আরো নানা রকম প্রয়োজনে ব্যবহার করার জন্য তৈরী করা হয়েছিল।

------------------------------------

দেখুনঃ Nayanjot Lahiri, Revisiting the Cultural Landscape of Junagadh in the Time of the Mauryas, in, Purātattva, No. 41, 2011, p. 117-123.

------------------------------------

প্রাচীন ভারতে সেচের উদ্দেশ্যে নির্মিত খালের প্রত্নতাত্ত্বিক সাক্ষ্য খুব কম পাওয়া গেছে। কৃষিক্ষেত্রে জল সরবরাহের জন্য যে সমস্ত স্থানে পাওয়া গেছে তার মধ্যে ভারতে মহারাষ্ট্রের ভনে আদি ঐতিহাসিক যুগে পাওয়া ইটের তৈরী একটি খাল থেকে সেই সময়ে কৃষিতে জল সরবরাহের প্রমাণ পাওয়া যায়।  ভন প্রত্নস্থলটি প্রাক-সাতবাহন বা মৌর্য যুগের।

------------------------------------

দেখুনঃ Bhaskar Deotare, Gurudas Shete, Reshma Sawant and Satish Naik, Ancient Irrigation Canal: Evidence from the Purna Basin, Vidharbha Region of Maharashtra, (Notes and News), in, Purātattva, No. 38, 2008, pp. 211-215.

------------------------------------

মধ্য ভারতের বিদিশায় আরেকটি খাল আবিষ্কার করা হয়েছে, যা মৌর্যদের আঞ্চলিক রাজধানী ছিল। এই খালটি ৬০ মাইল অথবা আরো বেশী দীর্ঘ হতে পারে। এর পাশে চুন শুরকির সাহায্যে আস্তরণ দেওয়া হয়েছিল। জলের শক্তি কমানোর জন্য দেওয়ালের নীচের দিকে ঢালু ছিল, যা পোড়া ইটের চুন শুরকির সাহায্যে বসানো হয়েছিল।

------------------------------------

দেখুনঃ M.K. Dhavalikar, Cultural Ecology of Mauryan India, in, Purātattva, No.31: 2000-2001, 2001, p. 87.

------------------------------------

প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানে সারনাথে প্রত্নস্থলের খুব কাছে বরুণ নদীর সাথে যুক্ত হওয়া একটি খালের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। এই নালার পাশে অসংখ্য বসতি দেখা যায়, যা থেকে মনে করা হয় যে এটি কৃত্রিমভাবে তৈরী করা হয়েছিল। গঙ্গার সাথে সারনাথ যুক্ত ছিল এই নালার মাধ্যমে। চুনার থেকে সারনাথে এই খালের মাধ্যমে শুধু কারখানার কাঁচামাল আসত না, সেই সাথে মানুষের দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় জল সরবরাহ হত ও কৃষিতে সেচ দেওয়া হত। এই নালাটির পাশে কোটওয়া নামে একটি বসতি খনন করে এটির খ্রীঃপূঃ ২য় শতাব্দী থেকে খ্রীষ্টীয় ১২শ শতাব্দী পর্যন্ত ধারাবাহিকতা পাওয়া গেছে। এ থেকে এই নালাটির খননের সময় সম্পর্কে অনুমান করা যায়।

------------------------------------

দেখুনঃ B.R. Mani, Sachin Kr. Tiwary and S. Krishnamurthy, Evidence of Stone Sculpturing Workshop at Sarnath in the Light of Recent Archaeological Investigations, in, Purātattva, No. 45, 2015, pp. 200-201, 203.

------------------------------------

খ্রীষ্টীয় প্রথম শতাব্দীতে শ্রীলংকায় ব্যাপক ভিত্তিক সেচব্যবস্থা নির্মাণের সাক্ষ্য পাওয়া যায়। বাসভের রাজত্বকালে (৬৭-১১১ খ্রীষ্টাব্দ) বারটি জলাধার ও খাল নির্মাণের কথা জানা যায়। এগুলির বেশীরভাগই অনুরাধাপুর অঞ্চলে পাওয়া গেছে। এগুলি নির্মাণে জলবিদ্যা ও ত্রিকোণমিতির ব্যাপক প্রয়োগের প্রমাণ ছিল। শ্রীলংকায় খ্রীষ্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দী বা তারও আগে জলাধার থেকে জল প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য স্লুইসের বিকল্প হিসাবে ভালভ্ পিট ব্যবহার করা হয়েছিল।

------------------------------------

  শ্রীলংকার লেখক কে,এম, ডি সিলভা লিখেছেন,  ‘The earliest projects were no doubt directed more at conserving than at diverting water on any large scale. But by the first century AC, large-scale irrigation works were being built. The reign of Vasabha (67-111) is regarded as a period of prolific activity and he is credited with the construction of twelve reservoirs and canals. Most of these that can be identified are located in the Anuradhapura area. The construction of tanks, canals and channels which this involved exhibited an amazing knowledge of trigonometry and the design of the tanks a thorough grasp of hydraulic principles.

… …

… A British engineer working in Sri Lanka in the late nineteenth century and early twentieth century pointed out that the Sinhalese were the ‘first inventors of the valve pit’ (bisokotuva) counterpart of the sluice which regulates the flow of water from a modern reservoir or tank. He went to claim that the engineers of the third century BC or earlier who invented it had done their work with a sophistication and mastery that enabled their successors of later centuries merely to copy the original device with only minor adaptations or changes, if any.’ দেখুনঃ K.M. de Silva, A History of Sri Lanka, Vijitha Yapa Publications, Colombo, Second Sri Lankan Reprint 2008, pp. 33-34. 

------------------------------------

শাসকদের জনকল্যাণের প্রতি মনোযোগ

ঐতিহাসিক ভারতবর্ষের শাসকদের মধ্যে প্রজাদের সুযোগ-সুবিধা ও কল্যাণের প্রতি মনোযোগ দিবার বিষয়টি জানা যায়। ৬০০ -২০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের মধ্যে হস্তিনাপুর, রুপার, উজ্জয়িন, মথুরা, নাসিক, নেভাসা, ইত্যাদি প্রত্নস্থল খনন করে প্রত্নতাত্ত্বিকরা বহুসংখ্যক পোড়ামাটির চাকতির কুয়া পাওয়ার কথা জানিয়েছেন।  এগুলির কিছু শুষে নিবার গর্ত হিসাবে ও বাকীগুলি প্রকৃত কুয়া হিসাবে তৈরী করা হয়েছিল। অশোকের উৎকীর্ণ লিপি থেকে জানা যায় যে, প্রতি  আট ক্রোশ পরপর রাস্তা বরাবর কুয়া তৈরী করে পানীয় জলের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। প্রত্নতাত্ত্বিকভাবে জানা যায় যে, মৌর্য যুগে ও তার দুই শত বৎসর পরেও জনসাধারণের জন্য পর্যাপ্ত সংখ্যক কুয়া বিশেষত চাকতির কুয়া তৈরী করা হয়েছিল। অনুমান করা যায় প্রাচীন ভারতের শাসকদের জনসাধারণের সুবিধার প্রতি এই ধরনের দৃষ্টি সিন্ধু সভ্যতার ঐতিহ্যেরই ধারাবাহিকতা।

------------------------------------

দেখুনঃ Bhaskar Deotare, Gurudas Shete, Reshma Sawant and Satish Naik, Ancient Irrigation Canal: Evidence from the Purna Basin, Vidarbha Region of Maharashtra, (Notes and News), in, Purātattva, No. 38, 2008, p. 212. 

------------------------------------

পাতা : ৪০

অন্যান্য ক্ষেত্রে সিন্ধু সভ্যতার ধারাবাহিকতা

গাঙ্গেয় সমভূমিতে বা ভারতবর্ষে সিন্ধু সভ্যতার শুধু সাংস্কৃতিক ধারাবাহিকতা দেখা যায় নাই, আশ্চর্য হবার মত বিষয় হল প্রাচীন গান্ধারে হরপ্পানদের সাথে তাৎপর্যপূর্ণ নৃতাত্ত্বিক মিলও দেখা যায়।

------------------------------------

  এই বিষয়ে কেনেথ কেনেডি বলছেনঃ `A recent study by Hemphill, Lukacs and Kennedy (1991) supports the thesis that ancient Ghandhārans and Harappans share significant similarities in craniometric, odontometric and discrete trait variables.’ দেখুনঃ Kenneth A.R. Kennedy, Have Aryans been identified in the prehistoric skeletal record from South Asia? Biological anthropology and concepts of ancient races, in, The Indo-Aryans of Ancient South Asia: Language, Material Culture and Ethnicity, ed., George Erdosy, Munshiram Manoharlal Publishers Pvt. Ltd., New Delhi, 1995, p. 49. 

------------------------------------

 মেসোপটেমিয়া ও মিসরে অনেক ধরনের বাটখারা ব্যবহৃত হত। কিন্তু সিন্ধু সভ্যতায় একই ধরনের প্রমিতকৃত বাটখারা ব্যবহৃত হত। সিন্ধু সভ্যতার বাটখারার ওজন পদ্ধতি ৩০০ খ্রীঃপূঃ-এর দিকে গাঙ্গেয় সমভূমিতে প্রথম দিককার রাজ্যগুলিতে ব্যবহার হতে দেখা গিয়েছিল। শুধু তাই নয় কিছু দিন আগে ম্যাট্রিক পদ্ধতি চালু হবার পূর্ব পর্যন্ত পাকিস্তান, ভারত ও বাংলাদেশের মত এই উপমহাদেশের দেশগুলির বাজারে একই ধরনের ওজন পদ্ধতি চালু ছিল।

------------------------------------

দেখুনঃ Jonathan Mark Kenoyer, Ancient Cities of the Indus Valley Civilization, 1998, p. 98.

------------------------------------

একটি গবেষণায় মহেঞ্জো-দাড়োর নগর-পরিকল্পনায় দূরত্বের মাপের সাথে খ্রীষ্টপূর্ব প্রথম সহস্রাব্দের শেষের দিকে তক্ষশীলার সিরকপ ও নেপালের কাঠমণ্ডু উপত্যকায় প্রাচীন শহর থিমির পরিকল্পনায় মাপের মিল পাওয়া গেছে। এটি খুব আশ্চর্যজনক যে, মহেঞ্জো-দাড়োতে বসতির বিভাগগুলির ব্লকসমূহে যে পরিমাপ ব্যবহার করা হয়েছে একই ধরনের পদ্ধতি সিরকপ ও থিমিতে ব্যবহার করা হয়েছিল। এটি চমকপ্রদ যে, মহেঞ্জো-দাড়োর বিভিন্ন ব্লকে যে ৯.৬ মিটার মাপ ব্যবহার করা হয়েছিল, সিরকপের প্রধান রাস্তায়ও একই মাপ দেখা গেছে। নেপালের শহর থিমি লিচ্ছবি সময়কালে (খ্রীষ্টীয় ২য় - ৯ম শতাব্দী) টিকে ছিল। সেখানকার প্রধান রাস্তা ৯.৬ মিটার প্রশস্ত ছিল।  নগর পরিকল্পনার ক্ষেত্রে মাপের এই ধরনের মিল থেকে বুঝা যায় যে, সিন্ধু সভ্যতার নগর পরিকল্পনা ও দৈর্ঘ্যের মাপ পরবর্তীকালে ভারতীয় সমাজে ধারাবাহিকতা রক্ষা করেছিল।

------------------------------------

  খ্রীষ্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীর রচনা কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে দৈর্ঘ্যের মাপ হিসাবে অঙ্গুল, হস্ত, দণ্ড, রজ্জু, ইত্যাদির উল্লেখ আছে। গবেষকদ্বয় মোহন পন্ট ও শুজি ফুনো দেখান, ১৯২ সেন্টিমিটারে এক দণ্ড ও মহেঞ্জো-দাড়োর মাপের ক্ষেত্রে দণ্ডের ৫ গুণ ও ১০ গুণ যথাক্রমে ৯.৬০ মিটার ও ১৯.২০ মিটার ব্যবহার করা হয়েছে। তাঁরা বলছেন, , ‘The preceding analysis of the settlement of Thimi, Sirkap and Mohenjodaro demonstrates that the units of rajju and its half as standard modular measures are common to all the three towns. We know from other standard of measures of Indus culture that they employed decimal as well as binary system. If the decimal system is adopted, danda is the one tenth of a rajju. The unit of danda is demonstrated in Thimi. The larger modules found in these settlements are close enough to prove that there is continuity in the survey and planning tradition from Mohenjodara to Sirkap and Thimi. It is therefore not a simple coincidence that the Main Street of all the three cities has the same width of 5 danda (9.6 m).’ দেখুনঃ Mohan Pant and Shuji Funo, The Grid and Modular Measures in The Town Planning of Mohenjodaro and Kthmandu Valley: A Study on Modular Measures in Block and Plot Divisions in the Planning of Mohenjodaro and Sirkap (Pakistan), and Thimi (Kathmandu Valley), in, Journal of Asian Architecture and Building Engineering, May 2005, p. 57.

------------------------------------

সিন্ধু সভ্যতার সাংস্কৃতিক অনেক উপাদান পরবর্তীকালে ভারতবর্ষের সমাজের অঙ্গীভূত হয়েছে। বিশেষভাবে এখানকার ধর্মগুলির অনুসারীরা যেমন, বৌদ্ধ, জৈন, হিন্দু ও শিখ ধর্মাবলম্বীরা কিছু ঐতিহ্য বহন করেছে। যেমন মেহরগড়ে আদি হরপ্পান স্তরে প্রায় ৪০০০-৩৫০০ খ্রীঃপূঃ-এ স্তর ৩-এ এবং নৌশারোতে (বালুচিস্তান) প্রায় ২৮০০-২৬০০ খ্রীঃপূঃ-এ কিছু নারী মূর্তিতে সিঁদুর হিসাবে চুলের সিঁথিতে লাল রঙের রঞ্জক পদার্থের উপস্থিতি পাওয়া গেছে।  সিঁদুর ভারতীয় সধবা হিন্দু নারীদের সাধারণভাবে ব্যবহার করতে দেখা যায় যা বৌদ্ধ, জৈন ও শিখ ধর্মের সধবা নারীদের ক্ষেত্রেও প্রচলিত। মহেঞ্জো-দাড়োতে বৌদ্ধ ও হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে প্রচলিত অভিবাদনের ভঙ্গিতে পোড়ামাটির মানুষের মূর্তি পাওয়া গেছে, যা নমস্কারের ভঙ্গি হিসাবে পরিচিত।  অন্যকে সম্মান জানানোর একই ভঙ্গি জৈন ও শিখ ধর্মাবলম্বীদের মধ্যেও প্রচলিত। এ বিষয়ে একথাই বলা যায় যে, এই ধর্মগুলি পূর্বের সামাজিক ও ধর্মীয় সংস্কৃতি, প্রথা ও নিয়ম ধারণ করেছিল, যেগুলির মধ্যে কিছু কিছু স্মরণাতীত কাল ধরে বাহিত হয়েছিল।

------------------------------------

 দেখুনঃ Jonathan M. Kenoyer, The Archaeological Heritage of Pakistan: From the Palaeolithic to the Indus Civilization, in, (ed.), Roger D. Long, A History of Pakistan, 2015, p. 30.

B.B. Lal, The Sarasvatī Flows On: The Continuity of Indian Culture, Aryan Books International, New Delhi, 2002, pp. 82-83.

B.B. Lal, The Sarasvatī Flows On, p. 127.

দেখুনঃ B.B. Lal, The Sarasvatī Flows On, p. 127.

------------------------------------

আগে যেমন বলেছি, জৈন ও বৌদ্ধ ধর্মের বহু কিছুই সিন্ধু সভ্যতার উত্তরাধিকার বহন করছে। অর্থাৎ জৈন ও বৌদ্ধ ধর্মের সংঘ-ব্যবস্থাকে ও তাদের দর্শনকে বুঝতে পারলে সিন্ধু সভ্যতার রাষ্ট্র শাসনব্যবস্থাকেও অনেকটা বুঝতে পারা যেতে পারে। সিন্ধু সভ্যতার রাষ্ট্রের অনেক উপাদান কিংবা বৈশিষ্ট্য ভারতবর্ষে গাঙ্গেয় উপত্যকায় ঐতিহাসিক যুগে এসে ধর্মের মাধ্যমে সামাজিক জীবনে অভিব্যক্ত হয়েছে বলে ধারণা করা যায়। যদিও ধর্মের কাঠমোতে গিয়ে সেখানে অনেক পরিবর্তন হয়েছে, অনেক ক্ষেত্রে চরমপন্থার দিকে গেছে ও বহু ক্ষেত্রে অধোগতিও হয়েছে। আমরা অনুমান করি বৌদ্ধ সংঘে যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা দেখতে পাওয়া যায় তা সিন্ধু সভ্যতায় পরিষদের মাধ্যমে পরিচালিত গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার ঐতিহ্য বহন করেছে। জৈন কিংবদন্তী অনুযায়ী তাদের প্রথম তীর্থংকর ঋষভদেবের সময় থেকে শুরু করে মহাবীরের সময়ে বর্ণিত প্রতিটি সংঘে ভিক্ষুণী, নারী অনুসারী, ইত্যাদি বিভিন্ন স্তরে পুরুষের তুলনায় নারীর সংখ্যাধিক্য তাৎপর্যপূর্ণ। একই সাথে বৌদ্ধ সংঘেও নারীর অংশগ্রহণ ছিল। যে কথা ইতিপূর্বে বলেছি তার পুনরুক্তি করে বলি আমাদের অনুমান এই দুই ধর্মের সংঘে নারীর অংশগ্রহণ সিন্ধু সভ্যতার রাষ্ট্র ও সমাজ শাসনের ঐতিহ্য থেকে এসেছিল। 

জৈন ও বৌদ্ধ ধর্মে অহিংসার প্রতি খুবই গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সেখানে সকল জীবের প্রতি অহিংসার কথা বলা হয়েছে। ভারতবর্ষের সকল ধর্মে অহিংসার প্রতি কম-বেশী গুরুত্ব প্রদান তাৎপর্য বহন করে। আমাদের অনুমান, অহিংসার এই ধারণাটি সিন্ধু সভ্যতায় বিদ্যমান অহিংসার ধারণা থেকে এসেছে। তবে সিন্ধু সভ্যতায় এই অহিংসা ছিল শুধুমাত্র মানুষের প্রতি, সকল জীবের প্রতি নয়। সিন্ধুর বসতিসমূহে যথেষ্ট পরিমাণ পশু-পাখীর হাড় ও মাছের কাঁটা পাবার সাক্ষ্য থেকে এ বিষয়টি বুঝা যায়। ঋগ্বেদও আমাদের এই সিদ্ধান্তকে সমর্থন করে। সুতরাং আমরা ধারণা করি জৈন ও বৌদ্ধ ধর্মে সিন্ধু সভ্যতার অহিংস দর্শন চরম রূপ নিয়েছে, যেখানে সকল প্রাণী হত্যাকে অনুৎসাহিত কিংবা নিষিদ্ধ করা হয়েছে।   

তবে অহিংসার প্রতি গুরুত্ব দিলেও পরবর্তী ভারতবর্ষে প্রধান ধর্মীয় নেতৃত্ব এসেছে ক্ষত্রিয় গোষ্ঠীসমূহ থেকে, যারা পূর্ব থেকেই যোদ্ধা গোষ্ঠী হিসাবে পরিচিত ছিল। কারণ সিন্ধু সভ্যতার পতনের পর সমাজে যুদ্ধ প্রাধন্যে এসেছিল। আর সেই পরিস্থিতিতে ক্ষত্রিয়দেরই সমাজের নেতা হওয়া স্বাভাবিক ছিল।

আরেকটি বিষয় খুবই তাৎপর্যপূর্ণ যে, ভারতবর্ষে জৈন ও বৌদ্ধ ধর্মে ব্রহ্মচর্যকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এছাড়া ব্রাহ্মণ তরুণদের শিক্ষালাভের সময়ে গুরুগৃহে থাকাকালীন ব্রহ্মচর্য পালন করতে হত। ব্রহ্মচর্য অর্থ হল নারী বা পুরুষের জন্য ইন্দ্রিয় সংযমপূর্বক জীবনযাপন। জৈন ও বৌদ্ধ ধর্মে শ্রমণ ও ভিক্ষুদের অবিবাহিত থাকতে হত। ভারতবর্ষের বাইরে খ্রীষ্টধর্মে ধর্মীয় নেতাদের অবিবাহিত থাকা বা ব্রহ্মচর্য পালন প্রচলিত আছে। জৈন ও বৌদ্ধ ধর্মের এই প্রথার সাথে সিন্ধু সভ্যতার কোনো যোগসূত্র থাকতে পারে। হয়ত সিন্ধু সভ্যতার রাষ্ট্রক্ষমতার যারা প্রধান নিয়ন্ত্রক ছিল তাদের ব্রহ্মচর্য পালন করতে হত।

তিব্বতে বৌদ্ধ ধর্ম লামাতন্ত্রের রূপ নিয়েছিল। এখানকার বৌদ্ধ ধর্মের একটি বৈশিষ্ট্য হল এখানে দালাই লামা একই সাথে আধ্যাত্মিক ও রাষ্ট্রের শাসক ছিলেন। তিনি ছিলেন তিব্বতের রাষ্ট্রের ঐক্যের প্রতীক। ১৬৪২ থেকে ১৭০৫ এবং ১৭৫০ থেকে চীনের তিব্বত অধিকারের পূর্ব পর্যন্ত অর্থাৎ ১৯৫১ সাল পর্যন্ত, দালাই লামা বা তার প্রতিনিধি তিব্বতের রাষ্ট্রের প্রধান ছিলেন। যদিও কোনো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে তাঁর আনুষ্ঠানিক ভূমিকা থাকত না। সেগুলি তাদের নিজস্ব লামা দ্বারা পরিচালিত হত। প্রতিটি দালাই লামাকে অবিবাহিত থাকতে হত। তার অধীনে সেনাবাহিনীও থাকত।

পাতা : ৪১

গঙ্গা উপত্যকা ও ইরানে সিন্ধু সভ্যতার বিস্তার না হবার কারণ

সিন্ধু সভ্যতার উপর আলোচনার সময়ে আমরা দেখেছি সিন্ধু সভ্যতার বসতিসমূহ সিন্ধু-সরস্বতী নদী উপত্যকার সমভূমিতেই কেবলমাত্র গড়ে উঠেছিল। কিন্তু গঙ্গা নদী উপত্যকা ধরে কিংবা পশ্চিমে ইরানে বিস্তার লাভ করে নাই। ঋগ্বেদে গঙ্গা নদীর কথা বলা আছে, আবার সিন্ধু সভ্যতার কিছু বসতি যমুনা ও গঙ্গা নদীর অববাহিকাতেও পাওয়া গেছে। অথচ এত উর্বর ভূমি থাকার পরেও এবং গঙ্গা নদী অববাহিকার সাথে যোগাযোগ থাকলেও সিন্ধু সভ্যতার শাসকরা সেখানে তেমন একটা যায় নাই। বরং বলা যায় তাদের যোগাযোগটা পশ্চিমের সাথে বেশী ছিল। আফগানিস্তান, মধ্য এশিয়া, ওমান, বাহরাইন, আরব আমিরাত ও মেসোপটেমিয়ার সাথে যোগাযোগ ও বাণিজ্যের অনেক প্রমাণ পাওয়া যায় যা আগে বলা হয়েছে। এমন কি ওমান, বাহরাইনের মত কিছু অঞ্চলে তাদের বসতি বা উপনিবেশ স্থাপন করতেও দেখা যায়। অথচ সিন্ধু-সরস্বতী অববাহিকা থেকে মাত্র ৩/৪ শত মাইল দূরে অবস্থিত গঙ্গা নদী উপত্যকায় সিন্ধুর নগর সভ্যতার বিস্তার না ঘটাবার পিছনে নিশ্চয়ই তাদের গুরুতর কোনো কারণ ছিল। সিন্ধু সভ্যতাকে প্রতিহত করার মত কোন সভ্যতা বা রাষ্ট্র এখানে ছিল না। সুতরাং সিন্ধু সভ্যতার শাসকরা চাইলেই এখানে তাদের সভ্যতার সম্প্রসারণ ঘটাতে পারত। তার পরিবর্তে তারা এখানে কিছু সংখ্যক বসতি স্থাপন করেছিল যেগুলিকে বাণিজ্য কেন্দ্র কিংবা যোগাযোগের কেন্দ্র ছাড়া আর কিছু বলা যায় না। কিংবা এগুলি হয়ত সিন্ধু সভ্যতার রাষ্ট্রের বাইরে নিকটবর্তী অঞ্চলে নজরদারির জন্য আউটপোস্ট হিসাবে ব্যবহার করা হত। যেটাই হোক সিন্ধু সভ্যতার সঙ্কটের সময়ে এত নিকটবর্তী এবং একই সঙ্গে উর্বর অঞ্চলে সভ্যতার সম্প্রসারণ না ঘটাবার কারণ নিশ্চয় ছিল। আমাদের অনুমান সিন্ধু সভ্যতার মূল ভিত্তি নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার ভিতরে এর কারণ অনুসন্ধান করতে হবে।

সিন্ধু সভ্যতা তার সূচনা থেকেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাকে ভিত্তি করে। এই নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার সাথে তারা গড়ে তুলেছিল রাষ্ট্র শাসন ও সমাজ নিয়ন্ত্রণের জন্য সুনির্দিষ্ট কিছু নীতি, আদর্শ, দর্শন, প্রথা, আইন, ইত্যাদি। অর্থাৎ সিন্ধু সভ্যতার প্রায় সকল বৈশিষ্ট্যই তার নির্মাতারা গড়ে তুলেছে নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাকে প্রতিষ্ঠিত ও সচল রাখার জন্য। তার অহিংস তথা শান্তিপূর্ণ ধারা, তার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রশাসনব্যবস্থা, তার পূর্বপরিকল্পিত বসতিসমূহ, প্রায় সবই সিন্ধু সভ্যতার শাসকরা গড়ে তুলেছিল নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাকে প্রতিষ্ঠিত ও কার্যকর করতে গিয়ে। প্রত্নতাত্ত্বিকভাবে আমরা জানি তারা একটি একক লিপি চালু করেছিল বৃহত্তর সিন্ধু উপত্যকার সকল অঞ্চলে। আমাদের অনুমান বৃহত্তর অঞ্চলব্যাপী ঐক্যের প্রয়োজনে তারা একটি একক ভাষাও চালু করেছিল। ফলে বৃহত্তর সিন্ধু উপতকায় ছড়িয়ে থাকা সকল অঞ্চলকে নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হয়েছিল। এই ভাষাটি হতে পারে বৈদিক ভাষা, যে ভাষায় সিন্ধু সভ্যতার পতনের সময়ে ঋগ্বেদের মন্ত্রসমূহ রচিত হয়েছিল। মানুষের সমাজকে নিয়ন্ত্রণ ও ঐক্যবদ্ধ রাখার জন্য ভাষার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আর ভাষার লিখিত রূপ হল লিপি, যার অভিন্নতার উপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারলে সময়ের সাথে ও অঞ্চল ভেদে ভাষার পরিবর্তনের সম্ভাবনাকে অনেকটা কমিয়ে আনা যায়, এক অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর সাথে অন্যান্য অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর মানসিক দূরত্ব কমিয়ে আনা যায়। ফলে ঐ যুগে এত বড় অঞ্চলব্যাপী বিস্তৃত সভ্যতাকে মূলত শান্তিপূর্ণভাবে সাত শত বৎসরব্যাপী ঐক্যবদ্ধ রাখা গিয়েছিল। 

আগের আলোচনায় আমরা বলেছি, সিন্ধু সভ্যতার নির্মাতারা বৃহত্তর সিন্ধু উপত্যকার প্রায় সমস্ত নদীতে বাঁধ দিয়ে কৃত্রিম সেচব্যবস্থা চালু করে। মূল নদীতে বাঁধ নির্মাণ করার সাথে তারা ছোট ছোট খাল তৈরী করে সেখানকার আবদ্ধ জল বিভিন্ন এলাকায় বিতরণ করত। জলের প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য মূল নদীতে তারা যেমন স্লুইস গেট তৈরী করত, তেমনি খালসমূহের মুখেও স্লুইস গেট তৈরী করত। বৃহত্তর সিন্ধু উপত্যকায় সিন্ধু ও সরস্বতী নদীর মত বৃহৎ নদীগুলিকে প্রথমে বাঁধ দেওয়া সম্ভব ছিল না। এজন্য তারা প্রথমে এই দুই নদীর উপনদীসমূহে বাঁধ দেয়। এর ফলে মূল নদীতে জলপ্রবাহ যথেষ্ট কমে গেলে ও নিয়ন্ত্রণযোগ্য হলে সিন্ধু ও সরস্বতীর মত বড় নদীগুলিতে বাঁধ দেওয়া তুলনামূলকভাবে সহজ হয়েছিল বলে ধারণা করা যায়। ঋগ্বেদ এই সাক্ষ্য দেয় যে, বৃহত্তর সিন্ধু উপত্যকার সকল নদীতে বাঁধ দেওয়া হয়েছিল।

একটি ধারণা প্রচলিত যে, গঙ্গা নদী বিধৌত উত্তর ও মধ্য ভারতে গভীর বন থাকায় লোহার আবিষ্কার ও তার ব্যবহারের পূর্বে এখানে ব্যাপকায়তনে কৃষি এবং পরিণতিতে নগর সভ্যতার বিস্তার ঘটানো সম্ভব ছিল না। অর্থাৎ এই ধারণা অনুযায়ী ব্রোঞ্জের হাতিয়ার দিয়ে ভারী গাছ কাটা সম্ভব ছিল না। ফলে লৌহযুগের আগে গাঙ্গেয় সমভূমিতে সভ্যতার বিস্তার ঘটে নাই।

কিন্তু গাঙ্গেয় উপত্যকার সব জায়গায় গভীর বন ছিল এমন মনে করা যায় না। এছাড়া উত্তর ভারতের গ্রীষ্মকালের দাবদাহের সময় আগুন লাগিয়ে অরণ্যের বড় বড় এলাকাকে পুড়িয়ে চাষযোগ্য করা যেতে পারত। সর্বোপরি সমকালীন ব্রোঞ্জ যুগে মিসরীয়রা ব্রোঞ্জের হাতিয়ার দিয়ে পাহাড় কেটে পাথরের বিশাল বিশাল চাঁই দিয়ে যদি পিরামিড গড়তে পারে তবে গাঙ্গেয় সমভূমির গভীর অরণ্যকে কেন ব্রোঞ্জের হাতিয়ার দিয়ে কাটা যাবে না?  সুতরাং সঙ্গত কারণে প্রশ্ন আসবে যে, গঙ্গা নদী সিন্ধু-সরস্বতী উপত্যকা থেকে অনেক কাছে হওয়া সত্ত্বেও কেন সিন্ধু সভ্যতার অধিবাসীরা সেখানে সিন্ধু সভ্যতার সম্প্রসারণ ঘটালো না?

এই প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে আছে সম্ভবত সিন্ধু সভ্যতার রাষ্ট্র নির্মাণের একটি নির্দিষ্ট পদ্ধতির ভিতর। আমাদের ধারণা নদীতে বাঁধ দিয়ে কৃষিতে কৃত্রিম সেচব্যবস্থা সিন্ধু সভ্যতার শুধু জীবনীশক্তির উৎস ছিল না, তার সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত ছিল আদর্শগত বিষয়ও। অর্থাৎ যে অঞ্চলে সিন্ধু সভ্যতার অধিবাসীরা বা আরো সঠিকভাবে বললে তার শাসকরা নদীনিয়ন্ত্রণব্যবস্থা প্রয়োগ করতে পারে নাই সেখানে তারা সেভাবে বসতি স্থাপন করে নাই। সিন্ধু ও সরস্বতী নদীর উপনদীসমূহের উপর প্রথমে বাঁধ নির্মাণ করে মূল এই দুই নদীর জলপ্রবাহ কমে গেলে যেভাবে এই দুই নদীর উপরেও বাঁধ দেওয়া সম্ভব হয়েছিল, গঙ্গার ক্ষেত্রে তা সম্ভব হয় নাই। এর প্রধান কারণ গঙ্গার মত বড় নদীতে বাঁধ দিবার আগে তার উপনদীসমূহে বাঁধ দিতে হত। কিন্তু গঙ্গার সিন্ধু বা সরস্বতীর তুলনায় বহুসংখ্যক উপনদী নাই যেখানে বাঁধ দেওয়া সম্ভব। দ্বিতীয় কারণ হতে পারে, গাঙ্গেয় সমভূমি অঞ্চলটিতে বৃহত্তর সিন্ধু উপত্যকার চেয়েও বৃষ্টিপাতের পরিমাণ অনেক বেশী। ফলে এখানে নদীতে আড়াআড়িভাবে কোনো বাঁধ নির্মাণ করলে তা অল্প সময়েই বর্ষাকালে সৃষ্ট বন্যায় ধুয়ে যেতে পারত। অর্থাৎ জলবায়ু ও ভূপ্রকৃতি কোনোটাই গঙ্গা নদী উপত্যকায় বাঁধ নির্মাণের উপযোগী ছিল না। যে আদর্শ পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে সিন্ধু সভ্যতা গড়ে উঠেছিল সেটা গাঙ্গেয় উপত্যকায় ছিল না বলেই একটা সময়ে বৃহত্তর সিন্ধু উপত্যকায় সংকট দেখা দিলেও সেখানে তার সম্প্রসারণ ঘটানো হয় নাই।

আমরা অনুমান করি ইরানে সিন্ধু সভ্যতার সম্প্রসারণ না হওয়ার একটি প্রধান কারণ দূরত্ব। এছাড়া সেখানে সিন্ধু বা সরস্বতী নদী উপত্যকার মত এমন কোনো বৃহৎ নদী বিধৌত ভূমি ছিল না যেখানে নদীনিয়ন্ত্রণব্যস্থার উপর ভিত্তি করে নগর ও কৃষির পশ্চাদভূমি গড়ে তুলা যায়। অর্থাৎ বৃহত্তর সিন্ধু উপত্যকায় যে আদর্শ ভূপ্রকৃতি ও কৃষির পশ্চাদভূমি ছিল তা সেখানে ছিল না। এর ফলে সিন্ধু সভ্যতায় মধ্যবর্তী পর্যায়ে সংকট দেখা দিলেও বিকল্প এলাকায় তারা অভিগমন করে সেখানে নগর সভ্যতা গড়ে তুলে নাই বা তুলতে পারে নাই।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হল, সিন্ধু সভ্যতার পতনের পর কেন দেড় হাজার বৎসরের কাছাকাছি সময় লাগল গাঙ্গেয় অববাহিকায় আরেকটি নগর সভ্যতার সূচনা ঘটাতে? আমরা জানি ভারতবর্ষে ঘোড়ার ব্যবহার শুরু হয়েছিল সিন্ধু সভ্যতার পতনের পর্যায়ে। তখন তা খুবই সীমিত পর্যায়ে ছিল বলে অনুমান করা যায়। পরে আস্তে আস্তে এর ব্যবহার বাড়তে থাকে। আরো আগে কিছু ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া গেলেও ভারতবর্ষে লোহার তুলনামূলক ব্যবহার শুরু হয় খ্রীষ্টপূর্ব দ্বাদশ শতাব্দী থেকে। খ্রীষ্টপূর্ব অষ্টম থেকে ষষ্ঠ শতাব্দীর দিকে এসে তা আরো বাড়তে থাকে। এর সাথে ভারতবর্ষে দ্বিতীয় নগরায়নের সূচনার সময়কাল মিলে যায়। এই সময়ে যুদ্ধও তুলনামূলকভাবে বেড়ে যায়।

আমরা আগের খণ্ডে দেখেছি সিন্ধু সভ্যতার একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল মূলত যুদ্ধ বিমুখতা বা অহিংসা। নিশ্চয়ই অহিংসা ছিল রাষ্ট্র ও সমাজের আদর্শও। এই অহিংস আদর্শের কারণে সিন্ধু সভ্যতার শাসকরা বাঁধভিত্তিক নদীনিয়ন্ত্রণব্যবস্থা বাস্তবায়ন ও সাত শত বৎসর মোটামুটি রক্ষা করতে পেরেছিল। বাঁধভিত্তিক জলসেচব্যবস্থা সচল ও কার্যকর রাখা ছিল অত্যন্ত স্পর্শকাতর বিষয়। কারণ প্রতিটি অঞ্চলে প্রয়োজন অনুযায়ী ও ন্যায্য জলসরবরাহ নিশ্চিত করা ছিল শাসকদের দায়িত্ব। এর ব্যতিক্রম হলে এবং কোনো এলাকার জনসাধারণ ন্যায্য জলসরবরাহ থেকে বঞ্চিত হলে বিদ্রোহ ঘটা স্বাভাবিক ছিল। এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার মানুষ ক্ষুব্ধ হয়ে বাঁধও ধ্বংস করতে পারত। বাঁধ ভিত্তিক নদীনিয়ন্ত্রণব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করার জন্যই সিন্ধু সভ্যতার নির্মাতাদের সমাজে অহিংসাকে আদর্শয়ায়িত করতে ও যুদ্ধকে যতটা সম্ভব অনুৎসাহিত করতে হয়েছে। যে সমাজ যুদ্ধনির্ভর সেখানে তাই এর ব্যাপক প্রয়োগ আর সম্ভব ছিল না। যুদ্ধরত গোষ্ঠীর আক্রমণ ও ধ্বংসের সহজ লক্ষ্যবস্তু হওয়া সম্ভব নদীর জলকপাটযুক্ত এই বাঁধসমূহ। আমরা জানি গাঙ্গেয় উপত্যকায় সভ্যতা নির্মাণের প্রক্রিয়া যুদ্ধ নির্ভর ছিল। প্রত্নতত্ত্বের সাক্ষ্যপ্রমাণও তাই বলে, যা আমরা আগে আলোচনা করেছি। এই কারণে সিন্ধু সভ্যতার ভাবধারা ও সমাজ সংগঠন দিয়ে সেখানে আর একটি সভ্যতা গড়া সম্ভব ছিল না। যুদ্ধের যুগে এসে সিন্ধু সভ্যতার রাষ্ট্র ও সমাজ দর্শন অচল হয়ে গেল। তাই এখানে নূতন যুগের মানুষকে নূতনভাবে সমাজ সংগঠন গড়তে হয়েছিল ও নূতন সমাজ নেতৃত্ব গঠন করতে হয়েছিল। যা ছিল অনেকটা যুদ্ধ নির্ভর ।

অন্য সব সভ্যতার মতই সমাজনিয়ন্ত্রণের উপর সিন্ধুর শাসকরা খুবই জোর দিয়েছিল বলে ধারণা করা যায়। কিন্তু এখানে নিয়ন্ত্রণ ছিল আরো কঠোর ও তার প্রয়োগ ছিল প্রধানত মনস্তাত্ত্বিকভাবে। যার ফলে রাষ্ট্র ও সমাজ রক্ষণশীল হয়েছিল। যেটা প্রত্নতাত্ত্বিকভাবেও ধারণা করা যায়। সহজে তারা বাইরের কিছু সেটা চিন্তা হোক আর বস্তু হোক গ্রহণ করে নাই। যার ঐতিহ্যিক ধারাবাহিকতা আজও ভারতবর্ষ বহন করছে।

পাতা : ৪২

 

৮ম অধ্যায় : পশ্চিমে সিন্ধু সভ্যতার উত্তরাধিকার

আগে দেখেছি সিন্ধু সভ্যতার পতনের পর সেখানকার অধিবাসীদের একটি বড় অংশ যেমন পূর্ব দিকে গাঙ্গেয় সমভূমিতে বসতি স্থাপন করে তেমনি সেখান থেকে অপর একটি অংশ পশ্চিমে চলে যায়। প্রত্নতত্ত্ব থেকে অনুমান করা যায় যে, এই উভয় অভিবাসন ধীর প্রক্রিয়ায় ঘটেছিল। কারণ সিন্ধু সভ্যতার বহু সংখ্যক বসতি যেমন তাৎক্ষণিকভাবে পরিত্যক্ত হয় নাই, তেমন সেখানকার বহু সংখ্যক মানুষজন দীর্ঘকাল আশেপাশেই গ্রামীণ জীবনে চলে গিয়েছিল। সিন্ধু সভ্যতা যখন টিকে ছিল তখন থেকেই পূর্বে গাঙ্গেয় উপত্যকার সাথে যেমন তেমনি পশ্চিমের নানা অঞ্চল যেমন, আফগানিস্তান, ইরান, মধ্য এশিয়া, আরব উপদ্বীপ ও মেসোপটেমিয়ার সাথে সিন্ধু সভ্যতার মানুষজনের বাণিজ্যিক ও অন্যান্যভাবে যোগাযোগ ছিল। কাজেই পূর্ব যোগাযোগের সূত্র ধরে পশ্চিমের বিশাল ভূভাগে অভিবাসন করা তাদের জন্য কঠিন কোনো বিষয় ছিল না। আমরা অনুমান করি এই অভিবাসন ছিল অনেকটা ধীর ও দীর্ঘ সময় ব্যাপী। আফগানিস্তান, ইরান, মধ্য এশিয়া, আরব উপদ্বীপ ও মেসোপটেমিয়ায় প্রত্নতাত্ত্বিক নানা প্রমাণ থেকে সেখানে সিন্ধু সভ্যতার সংস্কৃতির প্রভাব দেখা যায়। এছাড়া প্রাচীন ইরানীয়দের ধর্মগ্রন্থ আবেস্তার মত সাহিত্য থেকেও প্রাচীন ইরানে সিন্ধু সভ্যতার প্রবল প্রভাব ধারণা করা যায়।

ইহুদী ও খ্রীষ্টান ধর্মে সিন্ধু সভ্যতার উত্তরাধিকার

ইরানে যেমন সিন্ধু সভ্যতার অভিবাসীদের সেখানকার ধর্মীয় উত্তরাধিকার বহন করতে দেখা যায় তেমনি ইহুদী ধর্মেও সপ্ত সিন্ধু অঞ্চলের ধর্মীয় প্রথা বহন করতে দেখা যায়। সিন্ধু সভ্যতার পতনের প্রায় সাত শত বৎসর পরে দ্বাদশ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের দিকে মিসরে ইহুদী ধর্মের প্রবর্তক মোশির আগমন ঘটে। আবেস্তান ধর্মের মত ইহুদী ধর্মও একেশ্বরবাদী। তবে আবেস্তান ধর্মে অহুর ময্দার একক কর্তৃত্বের সাথে যেমন অন্যান্য দেবতার জায়গা আছে সেটা ইহুদী ধর্মে নাই।  ইহুদী ধর্মে অগ্নিতে আহুতি দিবার উল্লেখ আছে। তনখ (Tanakh) ইহুদীদের পবিত্র গ্রন্থ যা খ্রীষ্টানরা তাদের বাইবেলের সাথে সংযুক্ত করে বাইবেল (পুরাতন নিয়ম) হিসাবে নামকরণ করেছে। সেখানে অগ্নিতে আহুতি দিবার বিবরণ পাওয়া যায়ঃ

’পরে সদাপ্রভু মোশিকে ডাকিয়া সমাগম-তাম্বু হইতে এই কথা কহিলেন, তুমি ইস্রায়েল-সন্তানগণকে কহ, তাহাদিগকে বল, তোমাদের কেহ যদি সদাপ্রভুর উদ্দেশ্যে উপহার উৎসর্গ করে, তবে সে পশুপাল হইতে অর্থাৎ গরু কিংবা মেষপাল হইতে আপন উপহার লইয়া উৎসর্গ করুক।

‘সে যদি গোপাল হইতে হোমবলির উপহার দেয়, তবে নির্দোষ এক পুংপশু আনিবে; সদাপ্রভুর সম্মুখে গ্রাহ্য হইবার জন্য সমাগম-তাম্বুর দ্বারসমীপে আনয়ন করিবে। পরে হোমবলির মস্তকে হস্তার্পণ করিবে; আর তাহা তাহার প্রায়শ্চিত্যরূপে তাহার পক্ষে গ্রাহ্য হইবে। পরে সে সদাপ্রভুর সম্মুখে সেই গোবৎস হনন করিবে, ও হারোণের পুত্র যাজকগণ তাহার রক্ত নিকটে আনিবে, এবং সমাগম-তাম্বুর দ্বারসমীপে স্থিত বেদির উপরে সেই রক্ত চারিদিকে প্রক্ষেপ করিবে। আর সে ঐ হোমবলির চর্ম খুলিয়া তাহাকে খণ্ড খণ্ড করিবে। পরে হারোণ যাজকের পুত্রগণ বেদির উপরে অগ্নি রাখিবে, ও  অগ্নির উপরে কাষ্ঠ সাজাইবে। আর হারোণের পুত্র যাজকেরা সেই বেদীর উপরিস্থ অগ্নির ও কাষ্ঠের উপরে তাহার খণ্ড সকল এবং মস্তক ও মেদ রাখিবে। কিন্তু তাহার অন্ত্র ও পদ জলে ধৌত করিবে; পরে যাজক বেদির উপরে সে সমস্ত দগ্ধ করিবে; ইহা হোমবলি, সদাপ্রভুর উদ্দেশ্যে সৌরভার্থক অগ্নিকৃত উপহার।’ (বাইবেল। পুরাতন নিয়ম। লেবীয় পুস্তক। হোমবলির নিয়ম। ১;১-৯)   

বাইবেলের আদিপর্বের পূজাপদ্ধতি, বিভিন্ন কাহিনী এবং নাম থেকে ইসরাইলীয়দের সিন্ধু সভ্যতা থেকে অভিগামী জনগোষ্ঠীর পরবর্তী বংশধর বলে অনুমান করা যায়। যেমন বাইবেলে আদি মানব মানবীর স্বর্গ থেকে পতনের জন্য সর্প বা অহিকে দায়ী করা হয়েছে। ধারণা করা যায় যে, নদীনিয়ন্ত্রণব্যবস্থার অকার্যকরতার কারণে অহি সম্পর্কে, যা বৃত্রেরই অপর নাম, সপ্ত সিন্ধু অঞ্চলে যে উপকথা প্রচলিত হয়েছিল তার প্রভাব এই অঞ্চলের বহু জনগোষ্ঠী অনেক কাল পর্যন্ত বহন করে পরবর্তীকালে কাছাকাছি নানা কাহিনীর জন্ম দেয়। বৈদিক ঋষিরা এটাকে একভাবে ও আবেস্তায় এই কাহিনীকে ভিন্নভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। এটা অনুমান করা যায় যে, সপ্ত সিন্ধু অঞ্চলে বাঁধ ধ্বংসের পরবর্তী কালে নদীতে বাঁধ নির্মাণ জনিত সমস্যা ও এর ব্যর্থতার জন্য এবং এর ফলে দীর্ঘকাল ধরে মানুষের দুঃখ কষ্টের জন্য এবং এর ফলে সংঘটিত গৃহযুদ্ধ ও সভ্যতা ধ্বংসের জন্য উভয় পক্ষই বাঁধের উপর ক্ষুব্ধ ছিল। ফলে পুরাতন অহি লোক কাহিনী বা মিথ নূতন তাৎপর্য ও আবেদন নিয়ে উভয় পক্ষেরই পৌরাণিক সাহিত্যে জায়গা করে নিয়েছে।

কাহিনী ছাড়াও ইহুদীদের তনখ বা বাইবেলের পুরাতন নিয়মে কিছু নাম পাওয়া যায় যেগুলি সংস্কৃত নাম বা শব্দের কাছাকাছি। যেমন বাইবেলের পুরাতন নিয়মে এদন (Eden < Edn) সংস্কৃত উদ্যান শব্দ থেকে রূপান্তর হতে পারে। সংস্কৃতে উদ্যান শুধু বাগিচা নয় রাজকীয় বাগিচাকে বা রাজ-বাগিচাকেও উদ্যান বলা হয়। বাইবেল অনুসারে আদম-হাওয়া সৃষ্টির পর ঈশ্বর প্রথমে তাঁদেরকে এদনে স্থান দিয়েছিলেন। সংস্কৃত মৎস্য শব্দ থেকে মোশি নামের উৎপত্তি হতে পারে। মোশির ভাই ও তাঁর অধীনে প্রধান যাজক হারোণের নাম বরুণ থেকে রূপান্তর বলে মনে হয়। এটি বলা হয় যে, আব্রাহাম (আরবী ইব্রাহিম)-এর পূর্ব নাম অব্রাম। এটি সংস্কৃত অপরাম থেকে রূপান্তরিত হওয়া সম্ভব। অপ থেকে আরবী শব্দ আব্-এর উৎপত্তি। আব্ অর্থ জল। সংস্কৃত অপ শব্দের অর্থও জল। একইভাবে আদি মনু থেকে আদম নামের উৎপত্তি হতে পারে। ভারতবর্ষের পুরাণ সাহিত্যে মনু বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছেন। পৌরাণিক কাহিনীতে উল্লেখিত মহাপ্লাবনের সময় মনু তাঁর নৌকায় রক্ষা পেয়েছিলেন। আমরা অনুমান করি এই মনু উপাখ্যান থেকে ইহুদীদের তনখ ও খ্রীষ্টানদের বাইবেলের নোয়ার মহাপ্লাবনের উপাখ্যানের উৎপত্তি হয়েছে। সম্ভবত মনুর নৌ হিব্রু উপাখ্যানে নোহ-তে  (নোয়া) পরিণত হয়েছে।

 পরবর্তীকালে উদ্ভূত বা বিকশিত সকল নিরাকার ও একেশ্বরবাদী চিন্তা ও ধর্মের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ উৎস সপ্তসিন্ধু অঞ্চল বা সিন্ধু সভ্যতা বলে আমরা মনে করি। অনেকে এখান থেকে সরাসরি এই ধারণার মূল কাঠামো বাইরে নিয়ে গেছে। আবার কেউ কেউ এই ধারণা দেখে তাকে সুবিধাজনক মনে করে বা বাধ্য হয়ে গ্রহণ করেছে। এই বিষয়টি বুঝা দরকার যে, নিরাকার দেবতা ও একেশ্বরবাদী ধারণা কোনো পশ্চাৎপদ এবং যাযাবর জনগোষ্ঠীর পক্ষে সৃষ্টি করা সম্ভব না। একেশ্বরবাদী ও নিরাকার দেবতার ধারণা কোন পরিস্থিতিতে ও কিভাবে সপ্তসিন্ধু অঞ্চলে বিকশিত হয়েছিল তা আমরা পূর্বে আলোচনা করেছি। বস্তুত এটা একটা সভ্যতার বিশেষ পরিস্থিতিতে বিশেষ ধারায় উদ্ভব ও বিকাশের ফল মাত্র। ফলে এটা অন্য সমাজ তার প্রয়োজন হলে গ্রহণ করতে পারে, কিন্তু এর সৃষ্টি আর কারো পক্ষে করা সম্ভব ছিল না এর সৃষ্টির জন্য প্রয়োজনীয় সকল শর্ত পূরণ না হওয়ায়। ফলে মানব সমাজের আর কোনোখানে যেখানে সিন্ধু সভ্যতার কোনো না কোনো  ধরনের যোগসূত্র এবং গভীর প্রভাব ছিল না এমন কোনো প্রাচীন সমাজে নিরাকার দেবতার উপাসনা জন্ম নিতে পারে নাই।

------------------------------------

একেশ্বরবাদ ও নিরাকার দেবতার উত্থান সম্পর্কে আমাদের উভয়ের লিখিত গ্রন্থ আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতায় বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। দেখুনঃ শামসুজ্জোহা মানিক ও শামসুল আলম চঞ্চল, আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা, বদ্বীপ প্রকাশন, ঢাকা, ২০০৩, পৃঃ ১১৭-১২০। লিংক : http://www.bangarashtra.net/article/853.html

------------------------------------

এই বিষয়টি বুঝা দরকার যে, সামাজিক ভিত্তি না থাকলে কোনো একজন ব্যক্তি চাইলেও একেশ্বরবাদ কিংবা নিরাকার দেবতার ধারণা প্রবর্তন করতে পারে না। সামাজিক ভিত্তি না থাকায় মিসরের ফারাও ইখ্নাটন সূর্য বা আটন দেবতাকে একমাত্র উপাস্য হিসাবে প্রবর্তন করে তাঁর নূতন ধর্মমত প্রচার করলেও তিনি সেটা প্রজাদেরকে গ্রহণ করাতে পারেন নাই। পরে ব্যর্থতা নিয়ে তিনি মৃত্যু বরণ করেন।

সুতরাং আমরা ধারণা করতে পারি যে, মোশি যে ইসরাইলীয় গোত্রসমূহের মধ্যে তাঁর নিরংকুশ ও নিরাকার একেশ্বরবাদী ধর্ম প্রবর্তন করেন তাদের মধ্যে এই ধর্মের উপাদান আগে থেকেই ভালভাবে বিদ্যমান ছিল। তবে আগের নিরাকার ও একেশ্বরবাদী চিন্তার মধ্যে যেমন প্রধান দেবতা বরুণের অধীনে আরো অনেক দেবতা ছিল, ইহুদী ধর্মে সেখান থেকে সংশোধন করে ইয়াহ্ওয়েহ্-কে একমাত্র দেবতা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করা হল। এটা ধারণা করা যায় যে, ইসরাইলীয় গোত্রসমূহের প্রধান দেবতাকেই একমাত্র উপাস্য দেবতা করা হয়। 

মিসরে ইসরাইলীয় বা ইহুদী গোত্রসমূহের আগমন ইতিহাস থেকে স্পষ্ট নয়। হিক্সস্ নামে এক যাযাবর জনগোষ্ঠী আনুমানিক ১৬৭০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে মিসর দেশ জয় করেছিল এবং এক শত বৎসরের কাছকাছি সময় ধরে সেখানে রাজত্ব করেছিল। সেখানে তারা প্রথম ঘোড়ার ব্যবহার প্রচলন করে। তারা সিন্ধু সভ্যতার আর্য বংশোদ্ভূত হওয়া বিচিত্র নয়। ধারণা করা যায় যে, অনেক জনগোষ্ঠী যেহেতু সিন্ধু সভ্যতা থেকে পশ্চিম দিকে অভিযাত্রা করেছিল, তাদের অনেকেই নূতন ভূপ্রকৃতি ও পরিবেশে টিকে থাকবার জন্য যাযাবর জীবন বেছে নিতে বাধ্য হয়েছিল।  

এটি তাৎপর্যপূর্ণ যে, হিক্সস্দের পর মিসরে ২২ ও ২৩তম রাজবংশের ফারাওদের মধ্যে (খ্রীষ্টপূর্ব ৯৪৫-এর পর থেকে) শশঙ্ক নাম খুব বেশী দেখা যেত। শশঙ্ক নাম স্পষ্টতই আর্য বা সংস্কৃত শশাঙ্ক শব্দ থেকে উদ্ভব হয়েছিল। হিকসসদের শাসনের পরে মিসরে ইখ্নাটন নামে একজন মিসরীয় ফারাও (শাসনকাল ১৩৮০ থেকে ১৩৬২ খ্রীষ্টপূর্বাব্দ) মিসরে প্রথম একেশ্বরবাদী ধর্ম প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন। ধারণা করা যায় এর পিছনে সিন্ধু সভ্যতার একেশ্বরবাদী চিন্তার প্রভাব প্রেরণা হিসাবে কাজ করেছিল। ইখ্নাটনের প্রায় শতাব্দী কাল পরে প্রায় ১২শ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে মিসরে মোশির আবির্ভাব ঘটে। 

প্রাচীন সভ্যতাগুলির পতনের পর সামগ্রিকভাবে সভ্যতার বস্তুগত শক্তি যখন কমে এল তখন বৃহত্তর সামাজিক ঐক্য এবং নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব নিতে ধর্ম এগিয়ে এল। সুতরাং নিরাকার একেশ্বরবাদের প্রাধান্যও সূচিত হল। সভ্যতা তথা সমাজের বস্তুগত শক্তির অবক্ষয়ের সঙ্গে সর্বত্র বিস্তার লাভ করতে থাকল একেশ্বরবাদী ধর্মগুলি যেগুলি পূর্বের তুলনায় অনেক বেশী পরিমাণে নিরংকুশ একত্ব এবং একনায়কী স্বৈরতার সহায়ক হল।

পাতা : ৪৩

অনুমান করা চলে যে, সিন্ধু সভ্যতার নদীনিয়ন্ত্রণব্যবস্থা ধ্বংসের মাধ্যমে সভ্যতা ধ্বংসের জন্য অবৈদিক পক্ষ বৈদিক প্রতিপক্ষের ধর্মসংস্কারকে দায়ী করেছিল। কারণ ধর্ম সংস্কারের ফলে বৈদিক শক্তির পক্ষে যুদ্ধ করা ও নদীনিয়ন্ত্রণব্যবস্থাকে ধ্বংস করা সম্ভব হয়েছিল। সুতরাং বিভিন্ন অবৈদিক জনগোষ্ঠী যখন বাধ্য হয়ে দেশ ত্যাগ করে বিদেশের মাটিতে অপরিমেয় দুঃখ-কষ্ট-লাঞ্ছনা এবং বিভিন্ন দুর্বিপাকে পড়েছিল তখন তাদের অনেকের মনে বরুণকেন্দ্রিক ধর্মের নমনীয়তা ও গণতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া ঘটতে পারে। হয়ত তারা ভেবেছিল আরো দেবতা ছিল বলে বরুণের ধর্মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা সম্ভব হয়েছিল ঐ সমস্ত দেবতাকে অবলম্বন করে। অর্থাৎ সামাজিক ঐক্য রক্ষার নিরংকুশ এবং নিশ্ছিদ্র ব্যবস্থা হিসাবে নিরংকুশ ঈশ্বর ধারণা প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনবোধ দূর দেশে অভিগামীদের কিছু অংশের মধ্যে প্রবল হয়ে উঠতে পারে। এর একটা প্রকাশ মোশির ধর্ম সংস্কারে দেখতে পাই।

ইসলামে সিন্ধু সভ্যতার উত্তরাধিকার

ইসলামেও এই প্রেরণাকে আমরা কাজ করতে দেখি। ইসলামে বিভক্তির বিরুদ্ধে সামাজিক ঐক্যের প্রশ্নটিকে সামনে এনে নিরংকুশ একেশ্বরবাদের সপক্ষে যুক্তি উপস্থিত করতে দেখা গেছে। র্কুআনে যুক্তি দেওয়া হচ্ছেঃ ’যদি আল্লাহ্ ব্যতীত বহু ইলাহ্  থাকিত আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে, তবে উভয়ই ধ্বংস হইয়া যাইত’ (২১ সূরা আম্বিয়াঃ ২২ আয়াত)। কিংবা ’আল্লাহ্ কোন সন্তান গ্রহণ করেন নাই এবং তাঁহার সহিত অপর কোন ইলাহ্ নাই; যদি থাকিত তবে প্রত্যেক ইলাহ্ স্বীয় সৃষ্টি লইয়া পৃথক হইয়া যাইত এবং একে অপরের উপর প্রাধান্য বিস্তার করিত’ (২৩ সূরা মুমিনুনঃ ৯১ আয়াত)।

------------------------------------

  আরবী ইলাহ্ অর্থ উপাস্য।

------------------------------------

ইসলামেও আমরা সপ্তসিন্ধুর নিরাকারবাদী ধর্মের প্রভাব দেখতে পাই। ইহুদী ধর্মের মত নিরংকুশ একেশ্বরবাদ এখানে প্রবল রূপ নিয়েছে। আবেস্তান ধর্মের অহুর ময্দা এবং অঙ্গরা মইন্যুর দ্বন্দ্বতত্ত্ব ইসলামে অনেকাংশে প্রতিফলিত হয়েছে আল্লাহ্ ও শয়তানের দ্বন্দ্বে।

মধ্যপ্রাচ্যে সেমিটিক ভাষা এবং ধর্মের উত্থান ও বিকাশে সপ্তসিন্ধুর জনগোষ্ঠীর যোগাযোগ ও অভিগমন প্রধান ভূমিকা পালন করেছে বলে আমরা ধারণা করি। কারণ প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনাদি থেকে এখন জানা যাচ্ছে যে, সিন্ধু সভ্যতা তার হরপ্পান পর্যায় থেকেই দক্ষিণ ইরান, দক্ষিণ মেসোপটেমিয়া, আরব উপদ্বীপের দক্ষিণ সমুদ্রোপকূল এবং পারস্য উপসাগর সহ বিস্তীর্ণ অঞ্চলে যোগাযোগ ও প্রভাব গড়ে তুলেছিল। সেখানে তারা বসতিও স্থাপন করেছিল। সিন্ধু সভ্যতার এই বিস্তীর্ণ যোগাযোগ ও বসতি স্থাপন সম্পর্কে আমরা আগে আলোচনা করেছি।

------------------------------------

  এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে আমাদের উভয়ের লিখিত গ্রন্থ আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতায়। দেখুনঃ শামসুজ্জোহা মানিক ও শামসুল আলম চঞ্চল, আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা, পৃঃ ২০৮, ২০৯। লিংক : http://www.bangarashtra.net/article/853.html

------------------------------------

আমরা অনুমান করি সপ্তসিন্ধু অঞ্চল থেকে যে সমস্ত অধিবাসী বাইরে গিয়েছিল, তারা যে শুধু ধর্মকে বাইরে নিয়ে গিয়েছিল তাই নয় সেই সঙ্গে তাদের ভাষা ও সংস্কৃতিকেও নিয়ে গিয়েছিল। বিশেষ করে ভাষার প্রশ্নে বলা যায় যে, সকলে এক ভাষাভাষী ছিল না, যদিও পরিণত হরপ্পান পর্যায়ে সংস্কৃত বা বৈদিক ভাষা সপ্তসিন্ধু অঞ্চলে যোগাযোগের জন্য তাদের প্রধান ভাষা হবার সম্ভাবনা প্রবল। কিন্তু আরব সাগরের দূরবর্তী উপকূলের বসতিগুলি থেকে আরো পশ্চিম ও উত্তরের সঙ্গে যোগাযোগের প্রয়োজনে স্বাভাবিকভাবে তাদের একটি নূতন ভাষা গড়ে তুলতে হয়েছিল বলে ধারণা করা যায়। নিকটে ছিল উন্নত মেসোপটেমীয় সভ্যতা এবং মিসর ছিল কিছুটা দূরে। তাদের সাথে যোগাযোগ গড়ে উঠার ফলে মূলভূমি থেকে এতদূরে দুইটি উন্নত সভ্যতার ভাষা ও সংস্কৃতির প্রভাবকে তাদের অস্বীকার করা সম্ভব ছিল না। বিশেষ করে সপ্তসিন্ধু অঞ্চলের ভাষা যে এখানে পরিবর্তিত হবে এটাই স্বাভাবিক। মূলভূমির দূরত্বের কারণে এখানে বিভিন্ন ভাষার মিশ্রণে একটি নূতন ভাষার উদ্ভব ঘটেছে বলে অনুমান করা যায় যেখান থেকে সেমেটিক ভাষাগোষ্ঠীর বিকাশ ঘটেছে বলে মনে হয়।

পশ্চিম এশিয়ায় সিন্ধু সভ্যতার উত্তরাধিকার

১৯০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের আগে এশিয়া মাইনরের মধ্য অঞ্চলে আর্য যথা ইন্দো-ইউরোপীয় জনগোষ্ঠীর উপস্থিতির কথা জানা যায়। অ্যাসিরীয় বণিকদের নথিতে স্থানীয় হিটাইট (Hittite) রাজপুত্রদের নাম উল্লেখ আছে যারা তাদের নগর রাষ্ট্রগুলিতে শাসন করত। এই ব্যক্তি-নামগুলি আর্য নাম হতে পারে। কিছু ফলকে হুরিয়ান ও অ্যামোরাইট নামেরও উল্লেখ আছে। এইসব নামের মধ্যে পিৎখন (Pitkhana) ও তাঁর পুত্র অনিত্ত (Anitta)-এর নাম আর্য ভাষা থেকে উদ্ভূত বলে অনুমান করা হয়। একই নাম পাওয়া যায় বোঘাজকোয় (Boghazkoi)-এ প্রাপ্ত হিটাইট বিবরণীতে কুশ্শর (Kushshar) নগরের দুই রাজা পিৎখনশ ও অনিত্তশ নামে। এখানে বলা হয়েছে যে পিৎখন নেশা (Nesha) এবং কনেশ (Kanesh) দখল করেছিলেন এবং অনিত্ত হত্তুশ (Hattusha) এবং অন্যান্য স্থান ধ্বংস করেন।

বোঘাজকোয় সহ অনেক স্থানে হিটাইট বিবরণী পাওয়া গেছে। এগুলি আদি হিটাইট রাজ্যকালে (১৭০০-১৫০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের মধ্যে) পড়েছে। এখানে এবং অন্যান্য স্থানে প্রাপ্ত হিটাইট ভাষা আর্য ভাষার সাথে ঘনিষ্টভাবে সম্পর্কিত। এগুলি কিউনিফর্ম লিপিতে এবং হায়ারোগ্লিফিক চিহ্নে লিখিত।

মিটানী রাজ্যের জনসাধারণ প্রধানত হুরিয়ান হলেও এখানকার পরবর্তীকালের রাজাদের নাম আর্য ভাষার ছিল। এর কালপর্ব হল ১৫০০ খ্রীঃপূঃ থেকে ১৪৫০ খ্রীঃপূঃ পর্যন্ত। এই নামগুলির মধ্যে তুশরত্ত (Tushratta) ও তাঁর পুত্র মত্তিওয়াযা (Mattiwaza) উল্লেখযোগ্য। মিটানীদের মধ্যে আর্যদের দেবতা মিত্র, বরুণ, ইন্দ্র ও নাসত্যদ্বয়ের নাম প্রচলিত থাকায় অনুমান করা যায় তারা বৃহত্তর সিন্ধু-সরস্বতী উপত্যকা থেকে অভিবাসী হওয়া আর্যদের উত্তর পুরুষ।            

কুঁজওয়ালা ষাঁড় ভারতীয় উপমহাদেশের স্থানীয় ও এর উপস্থিতি ৭,০০০  খ্রীষ্টপূর্বাব্দ থেকে গৃহপালিত হিসাবে দেখতে পাওয়া যায়। এই কুঁজ-বিশিষ্ট ষাঁড়ের ছবি বা মূর্তি সিরিয়া ও আনাতোলিয়ায় বিভিন্ন সময়ে দেখতে পাওয়া যায়। তবে সবচেয়ে বেশী তাৎপর্যপূর্ণ হল সিন্ধু সভ্যতার শেষ পর্যায় থেকে বিদায়ী হরপ্পান পর্যায়ের একেবারে শেষ পর্যন্ত কুঁজ-ওয়ালা ষাঁড়ের ছবি বা মূর্তি পাওয়া। যেমন, ইরানের ব্যাক্ট্রিয়া-মার্জিয়ানা প্রত্নতাত্ত্বিক সংস্কৃতির (২৩০০ - ১৬০০ খ্রীঃপূঃ) উত্তরের পথ ধরে খ্রীঃপূঃ তৃতীয় ও দ্বিতীয় সহস্রাব্দের সীমার দিকে কিছু বসতিতে এই ধরনের মূর্তি পাওয়া গেছে।  প্রত্নতাত্ত্বিকভাবেও অনেক সাক্ষ্য পাওয়া যাচ্ছে যেগুলি থেকে ধারণা করা যায় যে, সিন্ধু সভ্যতার সাংস্কৃতিক ধারাবাহিকতা পশ্চিমে ইরান ও পশ্চিম এশিয়া ও এমন কি ইউরোপেও প্রভাব বিস্তার করেছিল।

------------------------------------

দেখুনঃ Aleksandr Andreyevich Semenenko, The Spread of Zebu Cattle from South Asia to the East Mediterranean Region as a Marker of Indo-European Population Dispersal, in, Bulletin Social-Economic and Humanitarian Research, No. 2(4), 2019, p. 3.

  দেখুনঃ প্রাগুক্ত নিবন্ধ, পৃঃ ৭।

------------------------------------

তবে যেভাবে ইউরোপে সিন্ধু সভ্যতার অভিবাসীদের অভিগমনে ভাষা ও সংস্কৃতিগত ব্যাপক প্রভাব দেখা যায়, পশ্চিম এশিয়ায় সেভাবে ঘটে নাই। এর কারণ হিসাবে আমরা অনুমান করি প্রাচীন মেসোপটেমিয়ার সভ্যতার সাথে মিথষ্ক্রিয়ার মাধ্যমে গড়ে উঠা সেমিটিক ভাষার প্রবল প্রভাবের ফলে সেখানে অভিগামীরা তার ভিতর বিলীন হয়েছে। এছাড়াও শক্তিশালী মেসোপটেমীয় সভ্যতা এবং রাষ্ট্রের অবস্থান অভিগামী সিন্ধু সভ্যতার জনগোষ্ঠীর প্রবাহকে যথেষ্ট পরিমাণে বাধাগ্রস্ত করেছিল বলে মনে হয়। অন্য দিকে ইউরোপে সিন্ধু সভ্যতার অভিগামীদের প্রভাব রোধ কিংবা আত্মস্থ করার মত কোনো উন্নত সভ্যতা না থাকায় ইউরোপ সহজে সিন্ধু সভ্যতার অভিগামীদের প্রভাবে আর্যকৃত হয়েছে।

পাতা : ৪৪

ইউরোপে সিন্ধু সভ্যতার উত্তরাধিকার

বৈদিক বা সংস্কৃত ভাষার সাথে ইউরোপীয় ভাষাগুলির মিল থেকেই ইউরোপীয় পণ্ডিতরা একসময় ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা পরিবারের ধারণা গড়ে তুলেছিলেন। তাঁরা দেখান যে, ভারতবর্ষের প্রাচীন ও পরবর্তীকালে মৃত ভাষা সংস্কৃতের সাথে গ্রীক, ল্যাটিন, জার্মান, স্লাভিক, বাল্টিক প্রভৃতি ইউরোপীয় ভাষা ও প্রাচীন ইরানীয়দের ভাষার আশ্চর্য রকমের মিল পাওয়া যায়। সংস্কৃতের সাথে এই উপমহাদেশের বাংলা, হিন্দী, মারাঠী, অসমীয়, ইত্যাদি ভাষার প্রচুর মিল থাকাতে সমগ্র উপমহাদেশের ভাষাও ইন্দো-ইউরোপীয় পরিবারভূক্ত বলে ধরা হয়।

সংস্কৃত এক থেকে দশ ও শত শব্দের সাথে ইউরোপীয় ভাষাগুলির মিল দেখতে পাওয়া যায়। যেমন, সংস্কৃত - এক, আবেস্তান - অয়েব (aeva), ফার্সী - যক, গ্রীক - ওইস (ois), ল্যাটিন - অয়েকুস (aequu-s), ফরাসী - আঁ (un), ইংরাজী - ওয়ান (one)। সংস্কৃত - দ্বি, গ্রীক - দুও (duo), গথিক - টোয়াই (twai), প্রাচীন ইংরাজী - টোয়া (twa), ফরাসী - দো (deux), ইংরাজী - টু (two)। সংস্কৃত - ত্রি, গথিক - থ্রেইস (threis), জার্মান - দ্রাই (drei)), ল্যাটিন - ত্রেস (tres), ত্রিয়া (tria), গ্রীক - ত্রেইস (treis), ত্রিয়া (tria), ইংরাজী - থ্রি (three)। সংস্কৃত - ষষ্, জার্মান - জেক্স্ (sechs), ল্যাটিন - সেক্স (sex), গ্রীক - হেক্স (hex), প্রাচীন ইংরাজী - সিয়েক্স (siex), ফরাসী - সিস্ (six), ইংরাজী - সিক্স (six)। এইভাবে, বাংলা - দশ, সংস্কৃত - দশন, জার্মান - সেন (zehn), ল্যাটিন - দেসেম (decem), গ্রীক - দেকা (deka), ফরাসী - দিস (dix), ইংরাজী - টেন (ten)। বাংলা - শত, সংস্কৃত - শতম, আবেস্তান - সতম, ল্যাটিন - সেন্টাম (centum)। বাংলা মানব বা মানুষ অর্থে সংস্কৃত - মনু, মানব, মনুষ্য, ডাচ - ম্যান (man), জার্মান - মান (mann), প্রাচীন ইংরাজী - ম্যান (mann), ইংরাজী - ম্যান (man)। বাংলা - পিতা, সংস্কৃত - পিতৃ, গ্রীক - পতের (pater), ল্যাটিন - পতের (pater), জার্মান - ফাটার (vater), প্রাচীন ইংরাজী - ফয়েডার (foeder), ইংরাজী - ফাদার (father)। বাংলা - মাতা, সংস্কৃত - মাতৃ, ডাচ - মোয়েডার (moeder), ল্যাটিন - মতের (mater), জার্মান - মুটার (mutter), প্রাচীন ইংরাজী - মোডোর (modor), ইংরাজী - মাদার (mother)। এভাবে সংস্কৃতের আমি, ভাই বা ভ্রাতা, কন্যা বা দুহিতা, বিধবা, প্রভৃতি অসংখ্য সংস্কৃত শব্দের সাথে ইউরোপীয় ভাষার মিল দেখতে পাওয়া যায়।

------------------------------------

  ভাষাতত্ত্বের উপর বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে, আমাদের উভয়ের লেখা ’আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা’ গ্রন্থে। দেখুনঃ শামসুজ্জোহা মানিক ও শামসুল আলম চঞ্চল, আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা, পৃঃ ১১-১৪। লিংক : http://www.bangarashtra.net/article/853.html

------------------------------------

আজকের ইউরোপের ভাষাগুলির আর্যকরণ দেখে মনে হওয়া স্বাভাবিক যে, ইউরোপে অভিগামী সিন্ধু সভ্যতার অভিবাসীরা বিপুল সংখ্যায় গিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসংখ্যায় পরিণত হয়েছিল। কিন্তু এটাই মনে হয় যে, সপ্তসিন্ধুর উন্নত সভ্যতা ও সংস্কৃতির অধিকারী আর্যরা স্থানীয় সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠীর সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের মিশ্রণ ও মিথষ্ক্রিয়ার মাধ্যমে তাদেরকে আর্য ভাষা ও সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত করে নেয়। দেশ ও কালের দূরত্ব, দীর্ঘ যাযাবর জীবন অথবা ভিন্ন জীবন যাত্রা ইত্যাদির কারণে ইউরোপে অভিবাসী আর্যরা তাদের আদি সভ্য জীবন ও বাসভূমির অনেক স্মৃতিই হারিয়ে ফেলেছিল। তাদের সংস্কৃতি ও ধর্ম বিশ্বাস ও ভাষায়ও অনেক পরিবর্তন ঘটেছিল। কিন্তু এত কিছুর পরেও সমগ্র ইউরোপব্যাপী আর্য ভাষা ও সংস্কৃতির প্রবল প্রভাব অবাক করার মত। তবে অনেক ক্ষেত্রেই যে একটি শান্তিপূর্ণ সভ্যতার অধিকারী জনগোষ্ঠী নূতন পরিবেশে যুদ্ধ-নির্ভর হয়ে উঠতে পারে তার প্রমাণ খ্রীষ্টপূর্ব প্রথম সহস্রাব্দের মাঝামাঝি সময়ের প্রাচীন গ্রীক ও কিছুটা পরের রোম সভ্যতা।

প্রাচীন গ্রীস এবং রোমের দেব-দেবীদের নামগুলি থেকে আমরা বৈদিক তথা সিন্ধু সভ্যতার সাথে মিল দেখতে পাই। যেমন, দেবতা দ্যৌ (যার নাম ঋগ্বেদে অনেকবার উল্লেখ আছে) থেকে গ্রীক দেবতা জিউস, ল্যাটিনদের জু(পিতার) এবং জার্মানদের তিউ ও যিও দেবতার উৎপত্তি হয়েছে। মরুৎগণ দেবতা বা মরুৎ নাম থেকে ল্যাটিনদের যুদ্ধদেবতা মার্স এসেছে। প্রাচীনকালে আগুন উৎপন্ন করার জন্য একটি পদ্ধতি ছিল দু’টি কাঠের মাঝখানে একটি কাঠ ক্রমাগত ঘুরানো বা মন্থন করা। সেজন্য অগ্নিকে প্রমন্থ নামেও অভিহিত করা হত। প্রাচীন গ্রীকদের ধর্মে যে দেবতা মানুষের কল্যাণের জন্য স্বর্গ থেকে অগ্নি চুরি করে এনেছিলেন, সেই প্রমিথিউস নাম ‘প্রমন্থ’-এর রূপান্তর বলে পণ্ডিতরা মনে করেন। অগ্নির আর একটি নাম ‘ভরণু’। মনে করা হয় গ্রীকদের অগ্নিদাতা ও সদাচার নিয়ন্তা দেবতা ‘ফোরোনিউস’ এবং রোমানদের ‘ভানকান’ দেবতার নাম ‘ভরণু’ থেকে এসেছে। এছাড়া ধারণা করা হয় ঋগ্বেদে বর্ণিত আর্যদের দেবী অহনা নাম থেকে গ্রীক দেবী এথেনা নামের উৎপত্তি হয়েছে। এভাবে প্রাচীন ভারতীয় বা বৈদিক আরো দেব-দেবীর নাম পাওয়া যায় যেগুলির সাথে গ্রীক বা রোমানদের দেব-দেবীর নামের মিল রয়েছে। 

বলা হয়ে থাকে ইন্দো-ইউরোপীয় অর্থাৎ আর্য জনগোষ্ঠী প্রাচীন গ্রীস ও রোমে গিয়ে বসতি স্থাপন করে। তারা কয়েকটি ঢেউয়ে রোম ও গ্রীসে গিয়েছিল। এমন কি রোমে উন্নত সংস্কৃতি ও সভ্যতা বিস্তারের জন্য এট্রাসকানদের ভূমিকাকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হয়। এট্রাসকানরা এশিয়া মাইনরের লিডিয়া (বর্তমান মধ্য-পশ্চিম তুরস্কের মধ্যে পড়েছে) অঞ্চল থেকে রোমে অভিবাসন করে। এছাড়া কিংবদন্তী অনুযায়ী ইওলিয়ান, ডোরিয়ান, একিয়ান, আইয়োনিয়ান, প্রভৃতি নামে আর্য জনগোষ্ঠী গ্রীসে বসতি স্থাপন করেছিল। প্রাচীন গ্রীস ও রোমের ভাষা, সংস্কৃতি ও সভ্যতা নির্মাণে এই সকল আর্য জনগোষ্ঠীর প্রধান ভূমিকা ছিল। আমরা মনে করি তারা ছিল বিভিন্ন নামে পূর্ব দিক থেকে যাওয়া উন্নত ভাষা, সংস্কৃতি ও সভ্যতা বহনকারী সিন্ধু সভ্যতার অভিগামী জনগোষ্ঠী। পার্সী ধর্মগ্রন্থ আবেস্তা এবং হিন্দুদের ধর্মগ্রন্থ ঋগ্বেদ থেকে এটা স্পষ্ট যে, সিন্ধু সভ্যতার অধিবাসীরা নিজেদেরকে আর্য নামে অভিহিত করত। শত শত বা হাজার বছর বিভিন্ন অঞ্চলে ও বিভিন্ন পরিবেশে বাস ক’রে তারা নূতন পরিচিতি অর্জন করে।  

এই আর্যদের একটা অংশ গ্রীসে অভিবাসন করে। এটাই যুক্তিযুক্ত মনে হয় যে, তাদের দিয়ে আজ থেকে প্রায় আড়াই হাজার বৎসর আগে গ্রীসের এথেন্সে গণতন্ত্রের সূচনা হয়। এই গণতন্ত্র ছিল খুব অল্প মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ, যারা ছিল জমির মালিক, কৃষক, নাবিক, ইত্যাদি। তবে এথেন্সে রাজার ক্ষমতা হ্রাস ও গণতন্ত্র বেশ কিছু ধাপে হয়েছিল। এথেন্সে রাজার ক্ষমতা প্রথম হ্রাস পায় প্রধান সেনানায়কের নিয়োগের ফলে প্রায় খ্রীষ্টপূর্ব সপ্তম শতাব্দীর শুরুর দিকে। এর কিছু পরে রাজার বদলে রাজপ্রতিনিধি নিযুক্ত হয়, যাদেরকে আর্কন বলা হত। সেই সময়ে রাজা একেবারে ক্ষমতাচ্যুত হয় নাই, কিন্তু তার ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। অভিজাত বংশীয়রাই প্রথম দিকে এথেন্সের শাসন পরিচালনা করত। সমাজে শৃঙ্খলা বজায় রাখা ও অপরাধের শাস্তি বিধান করা নির্বাচিত সংসদের কাজ ছিল। এথেন্সে একটি পর্যায়ে প্রবল সামাজিক সংকট দেখা দিলে ৫৯৪ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে সোলনকে আর্কন হিসাবে নির্বাচন করা হয়। তিনি সমাজের এই সংকটে তাঁর জ্ঞান ও প্রজ্ঞা দিয়ে প্রকৃত গণতন্ত্রের ভিত্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এথেন্সের পরে গ্রীসের নানা অঞ্চলে আরো নগররাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা গড়ে উঠে। খ্রীষ্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীর শেষের দিকে বহুসংখ্যক নগররাষ্ট্রে গণতন্ত্র দেখা গিয়েছিল।

------------------------------------

দেখুনঃ H.B. Cotterill, Ancient Greece, Oracle Publishing Ltd., London, 1996, First published in 1915, p. 139.

------------------------------------

মনে করা হয় যে, ৫০৯ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে এট্রাসকান নেতৃত্বকে উচ্ছেদের মধ্য দিয়ে প্রাচীন রোমে প্রজাতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা চালু হয়। সেই সময়ে প্রজাতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় কেবলমাত্র অভিজাত শ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব থাকত। কিংবদন্তীর উপর ভিত্তি করে রোমান ইতিহাসে লুসিয়াস জুনিয়াস ব্রুটাসকে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য কৃতিত্ব দেওয়া হয়। যদিও সন্দেহ করা হয় যে, তিনি আদৌ প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন কীনা। এরপর রোম পাবলিয়াস ভ্যালেরিয়াসের ব্যক্তিগত শাসনে আসে। শান্তির সময়ে সদয়, যুদ্ধে তার শত্রুদের প্রতি উদার, রোমকে তার ক্ষমতার কেন্দ্রে রাখার বিষয়ে সংকল্পবদ্ধ হিসাবে তিনি পরিচিত ছিলেন। কিংবদন্তীর উৎস থেকে জানা যায় ভ্যালেরিয়াস জনসাধারণকে ক্ষমতা দিবার জন্য এমন সমস্ত অসাধারণ আইন করেছিলেন যা তাঁর আগে কখনোই তারা পায় নাই। তিনি জনসাধারণের জন্য জনপ্রিয় সেনাবাহিনী প্রতিষ্ঠিত করেন। জনসাধারণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে যে উৎপীড়ক শাসক হতে চেষ্টা করবে তার জন্য মৃত্যুদণ্ডের শাস্তির বিধান করেছিলেন। তিনি একই রকম শাস্তির বিধান রেখেছিলেন তাদের জন্য যারা নাগরিকদের কার্যস্থান অন্যায়ভাবে অধিকার করার চেষ্টা করবে। তিনি মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত নাগরিকদের পুনর্বিচার চাওয়ার অধিকার দিয়েছিলেন। তিনি কনসাল হিসাবে পরিচিত প্রধান ম্যাজিষ্ট্রেটের অধীন থেকে রাজস্ব-বিভাগকে অপসারিত করার নির্দেশ দিয়েছিলেন ও কুইসটর নামে পরিচিত অসামরিক সরকারী কর্মচারীর উপর তার দায়িত্বভার অর্পণ করেছিলেন, যারা প্রজাতন্ত্রের আর্থিক পরিচালক হয়েছিল। এই আর্থিক পরিচালকদের নিজস্ব কার্যালয় শনির মন্দিরে ছিল। তিনি একটি প্রথার উদ্বোধন করেন যেখানে একজন কনসালকে পরিষদে প্রবশ করার সময়ে অবশ্যই তার কুঠার ও তার আনুষ্ঠানিকভাবে প্রাপ্ত তার দণ্ড সমূহকে ত্যাগ করতে হত এবং জনসাধারণের সামনে নীচে নামাতে হত।

------------------------------------

দেখুনঃ Robert Payne, Ancient Rome, Published by ibooks, inc, New York, 2001, pp. 36-37.

------------------------------------

পাতা : ৪৫

 রোমের গণতন্ত্রের পথ কন্টকমুক্ত ছিল না। সেখানে অনেক যুদ্ধ, বিদ্রোহ আর বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে। পাবলিয়াস ভ্যালেরিয়াস জনসাধারণকে নূতন ক্ষমতা দিবার ফলে আরো নূতন ক্ষমতা মানুষকে আকৃষ্ট করল। আগে ক্ষমতা ছিল উচ্চ মধ্য শ্রেণীর হাতে। এখন দরিদ্ররা, যেমন কৃষক, খামারের কর্মী, কারিগর, ক্ষুদ্র ভূমির মালিকরা তাদের স্বাধীনতা দাবী করতে লাগল। এভাবে ধীর ও শ্রমসাধ্য প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে রোমান পরিষদে দরিদ্র জনসাধারণ বিশেষ স্থান নিতে পারল। এমনকি এথেন্সও, যাকে জনসাধারণের সরকার প্রতিষ্ঠার উৎসভূমি বলে মনে করা হয়, সেখানেও গণতন্ত্র এত দূর পর্যন্ত যেতে পারে নাই। এই দরিদ্র মানুষদের পরিষদ যা ৪৭১ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে কার্যকর হয়েছিল, জনসাধারণের বৃহত্তর অংশকে ধারণ করত। রোমানদের গণতন্ত্র প্রায় পাঁচ শত বৎসর টিকে ছিল।

------------------------------------

  দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ৩৯।

------------------------------------

তবে গ্রীস ও রোমের গণতন্ত্র প্রসঙ্গে এ কথা মনে রাখতে হবে যে, সিন্ধু সভ্যতার গণতন্ত্রের সঙ্গে এই গণতন্ত্রকে পুরাপুরি মিলানো যাবে না। কারণ গ্রীস ও রোমের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত ছিল দাস ব্যবস্থার ভিত্তির উপর। দাসরা ছিল বহিরাগত বিজয়ীদের অধীন শ্রমদাস ও সেবাদাস। সুতরাং এই গণতন্ত্র তাদের জন্য নয়। বুঝা যায় সিন্ধু সভ্যতার অভিবাসীরা তাদের ঐতিহ্যের অনেক কিছু বর্জন করে নূতন রূপে তাদের সমাজের বিন্যাস ঘটিয়েছে। স্থান ও কালের পরিক্রমায় একটা অহিংস জনগোষ্ঠী নিজেদের জন্য যেমন হোক অন্যান্য জনগোষ্ঠীর প্রতি সহিংস এবং নির্দয় হতে দ্বিধা করে নাই।

এটি খুব তাৎপর্যপূর্ণ যে, পৃথিবীর যে সমস্ত অঞ্চলে অভিবাসীরা গিয়েছিল সেখানে তারা সিন্ধু সভ্যতার ক্ষয়ের প্রায় দেড় হাজার বৎসর পরে নূতন করে নগর সভ্যতা গড়ে তুলে। খ্রীষ্টপূর্ব ষষ্ঠ থেকে পঞ্চম শতাব্দীর মধ্যে ভারতবর্ষে গাঙ্গেয় উপত্যকায় নগরায়ন শুরু হয় ও সিন্ধু সভ্যতার লোকায়ত, অহিংস ও গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যকে আংশিক ধারণ করে প্রধান দুইটি ধর্ম বৌদ্ধ ও জৈন ধর্ম বিকাশ লাভ করে। আবার এই অঞ্চলেই সিন্ধু সভ্যতার রাষ্ট্র শাসনের প্রজাতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য ধারণ করে কিছুকালের জন্য প্রজাতান্ত্রিক কিছু সংখ্যক ক্ষুদ্র রাষ্ট্র গড়ে উঠে। যদিও জৈন ধর্মের সংঘে সেভাবে গণতন্ত্র কাজ করত বলে মনে করা হয় না, তথাপি কিংবদন্তী অনুযায়ী সেই সময়ে হিন্দু ধর্ম ছাড়া প্রাচীন ভারতীয় সকল ধর্মীয় গোষ্ঠীর মধ্যে সংঘ গড়ে উঠেছিল। সংঘ গঠনের ধারণাটি সিন্ধু সভ্যতার রাষ্ট্র ও সমাজের সর্বত্র সংঘ বা পঞ্চায়েত প্রথার ঐতিহ্য থেকে এসেছে বলে আমরা মনে করি।

পশ্চিমে ইরানে নগর সভ্যতা শুরু হয় খ্রীষ্টপূর্ব সপ্তম-ষষ্ঠ শতাব্দীতে। সেখানেও সিন্ধু সভ্যতার অধিবাসীরা অভিগমন করেছিল বলে আমরা আগে বলেছি। এরপর গ্রীস ও রোমে নগর সভ্যতা শুরু হয় খ্রীষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে, যারা সিন্ধু সভ্যতার ঐতিহ্যকে ধারণ করেছিল এ কথা আমরা বলেছি। সিন্ধু সভ্যতার গণতান্ত্রিক ধারণা ও সেখানকার লোকায়ত দর্শনের প্রভাব পড়েছিল গ্রীস ও রোমের রাষ্ট্রশাসনে ও সেখানে গড়ে উঠা দর্শনচিন্তার মধ্যে। তারই প্রকাশ দেখতে পাওয়া যায় বিশেষত প্রাচীন গ্রীসের যুক্তিবাদ ও বিজ্ঞানচেতনার মধ্যে। সভ্যতার পতন হলেও বহুকাল তার সংস্কৃতির ধারাবাহিতা টিকে থাকতে পারে। যেমন সিন্ধু সভ্যতার পতনের পর অনেক উপকথা ও কাহিনী পরবর্তী বিভিন্ন সমাজে পরিবর্তিত রূপে ছড়িয়ে পড়েছিল। প্লেটোর রিপাবলিকে রাষ্ট্র শাসনে দার্শনিকদের প্রতিনিধিত্বের যে কথা পাওয়া যায় তা সিন্ধু সভ্যতার স্মৃতি থেকে এসেছিল বলে ধারণা করা যায়।

সিন্ধু সভ্যতা পরবর্তী অন্যান্য সভ্যতা নির্মাণে দীর্ঘ বিরতির কারণ

সিন্ধু সভ্যতার পতনের পর সেখান থেকে অভিগামীদের নূতন অঞ্চলে বসতি স্থাপন করার পর তাদের আরেকটি নগর সভ্যতা গড়তে প্রায় দেড় হাজার বৎসর কেন লেগেছিল সেটি একটি প্রশ্ন। সিন্ধু সভ্যতা থেকে অভিগামীরা শুধু যে নিকটবর্তী গঙ্গা উপত্যকায় আর একটি নগর সভ্যতা নির্মাণে দীর্ঘ সময় নিয়েছে তা-ই নয়, গ্রীস, রোমের মত দূর দেশেও তাদের নূতন করে সভ্যতা গড়তে এই সময় লেগেছে। আসলে অহিংসাকে প্রাধান্য দিয়ে যেভাবে সিন্ধু সভ্যতা গড়ে উঠেছিল সেভাবে সভ্যতা গড়বার যুগ শেষ হয়েছে লোহা ও ঘোড়ার ব্যবহার প্রবর্তনের পর। সিন্ধু সভ্যতার যুগ মূলত পায়ে হেঁটে এবং নৌকায় যাতায়াতের যুগ। সেই সঙ্গে ছিল তার ভূ-প্রকৃতির রক্ষাব্যূহ। উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমে হিমালয় এবং পার্বত্যভূমির আড়াল তাকে যেমন দিয়েছিল সুরক্ষা তেমন দক্ষিণে ছিল সাগর। পশ্চিমে বালুচিস্তানের ঊষর এবং মরুপ্রায় পাহাড়ী ভূমিও তার জন্য ছিল সহায়ক। পূর্বদিকে গাঙ্গেয় অববাহিকায় কোনও সভ্যতা গড়ে উঠে নাই। এবং সেটা ছিল অরণ্যাচ্ছাদিত। পশ্চিম এশিয়া কিংবা মধ্য এশিয়া থেকে পায়ে হেঁটে দীর্ঘ দূরত্বের পথ পার হয়ে সিন্ধু সভ্যতার উপর আক্রমণ করার মত কোনও শক্তি তখন ছিল না। ফলে বহিরাক্রমণ থেকে সিন্ধু সভ্যতা অনেকাংশে নিরাপদ ছিল। সভ্যতার অভ্যন্তরে ছিল শান্তিপূর্ণ এবং অহিংসায় অভ্যস্ত বা বিশ্বাসী সমাজ এবং সুদীর্ঘ কাল রাষ্ট্রও ছিল ব্যাপক জনগণের স্বেচ্ছাসম্মতির ভিত্তিতে পরিচালিত। সুতরাং সভ্যতাকে অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহকে সেভাবে মোকাবিলা করতে হয় নাই। প্রত্নতত্ত্ব থেকে আমরা অনায়াসে এই সিদ্ধান্ত নিতে পারি। 

অবশ্য সভ্যতার প্রান্তসীমার বাইরে থাকা ছোট ছোট উপজাতির অস্তিত্ব ছিল বলে মনে করার কারণ আছে। তাদের দিকে থেকে আক্রমণকে মোকাবিলার জন্য সিন্ধু সভ্যতার প্রান্তে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ছিল বলে আমরা মনে করি। এর মানে হল সভ্যতা তার প্রান্তসীমায় যুদ্ধের জন্য সদাপ্রস্তুত সেনা মোতায়েন রাখত। হয়ত বংশপরম্পরায় এইসব সেনাদল তাদের দায়িত্ব পালন করত। এরা হয়ত অনেক পরবর্তী কালের ক্ষত্রিয়দের পূর্বসূরি। হতে পারে ক্ষত্রিয় নামেই তারা পরিচিত ছিল।

সীমান্তে প্রতিরক্ষার জন্য যারা থাকত তাদের যে নামই থাকুক পায়ে পথ হাঁটার সেই কালে তারাই যথেষ্ট ছিল ছোট ছোট দলে আসা পাথর, তামা বা ব্রোঞ্জের হাতিয়ারধারী আক্রমণকারীদেরকে মোকাবিলা করার জন্য। বিশেষত মধ্য এশিয়ার পশুচারী, যাযাবর, অর্র্ধ-যাযাবরদের পক্ষে তাদের পশুপাল নিয়ে বিশাল সংখ্যায় ঘোড়ার পিঠে চেপে দক্ষিণ এশিয়ার উপর আক্রমণ করার কাল তখনও আসে নাই।

এর জন্য পশুচারী যাযাবরদেরকে অপেক্ষা করতে হয়েছে লোহা এবং ঘোড়ার ব্যবহার আয়ত্ত করা পর্যন্ত। এটা ঠিক, সিন্ধু সভ্যতার শেষ পর্যায়ে যে, যুদ্ধে ঘোড়ার ব্যবহার ছিল ঋগ্বেদ স্পষ্টভাবে তার সাক্ষ্য দেয়। তবে তার ব্যাপক ব্যবহার হতে আরও অনেককাল অপেক্ষা করতে হয়েছে। একই কথা প্রযোজ্য লোহার ব্যবহার সম্পর্কে। যুদ্ধে লৌহাস্ত্র এবং অশ্বের ব্যবহার যুদ্ধকে প্রচণ্ড শক্তি ও গতি দান করে। এখন যাযাবর যোদ্ধা বাহিনীর পক্ষে বিপুল সংখ্যায় হাজার মাইল দূরত্বের পথ পার হওয়াও অনেক সহজ। এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সিন্ধু সভ্যতা এমনিতেই অকার্যকর হয়ে পড়ত।

বিশেষ করে যুদ্ধে অশ্বের গতি যোগ করায় যে কোনও শত্রুর পক্ষে নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ধ্বংস করা খুব সহজ কাজ হয়ে পড়ে। কারণ নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার প্রাণশক্তি প্রধানত জলকপাট বা স্লুইস গেটে নিহিত। জলকপাটকে অতর্কিত আক্রমণে ধ্বংস করা সহজ হতে পারত। সুতরাং যুদ্ধে অশ্ব ব্যবহার শুরুর পর ন্দীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার উপর নির্ভর করে আর কোনও সভ্যতা নির্মাণ করা সম্ভব ছিল না।

অবশ্য সিন্ধু সভ্যতার নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ধ্বংসের জন্য বহিরাক্রমণের প্রয়োজন হয় নাই। একদিকে দীর্ঘকালের পলি সঞ্চয়, নদীর গতিপথ পরিবর্তন, লবণাক্ততা এবং অবশেষে সামাজিক বিপ্লবের মাধ্যমে অবশিষ্ট অকার্যকর বাঁধ ও জলকপাট ধ্বংসের মধ্য দিয়ে নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার অবসান হল এবং সেই সঙ্গে এই ব্যবস্থার উপর নির্ভর করে গড়ে উঠা নগর সভ্যতারও অবসান হল।   

 আমাদের ধারণা সিন্ধু সভ্যতা যে অহিংস মতাদর্শের ভিত্তিতে গড়ে উঠেছিল, পরবর্তীকালে ঘোড়া ও লোহার ব্যবহার শুরু হওয়ায় ও যুদ্ধের প্রাধান্য দেখা দেওয়ায় সেই মতাদর্শ দিয়ে আর একটি সভ্যতা গড়ে তুলা সম্ভব ছিল না। এর পরেও বৃহত্তর গঙ্গা উপত্যকায় দ্বিতীয় নগরায়নের সূচনা কালে সিন্ধু সভ্যতার ভাবপ্রেরণায় অনুপ্রাণিত জৈন ও বৌদ্ধ ধর্মের উত্থান তাৎপর্যপূর্ণ। অর্থাৎ ভারতবর্ষ যখন দ্বিতীয়বার নগর সভ্যতা নির্মাণ করতে গেছে তখন তার সামনে ধ্রুব নক্ষত্রের মত জ্বলে উঠে পথ দেখিয়েছে সিন্ধু সভ্যতার ভাবপ্রেরণা। কিন্তু নূতন পর্যায়ের নগরায়ন এবং রাষ্ট্র গঠনের পথ মোটেই দীর্ঘ মেয়াদে শান্তিপূর্ণ হল না। যুদ্ধের মধ্য দিয়ে প্রজাতন্ত্রগুলির অবসান এবং বংশীয় রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হল। মৌর্য বংশের শাসনকালে আফগানিস্তান থেকে শুরু করে বাংলা পর্যন্ত প্রায় সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ায় এক মহারাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হল মূলত যুদ্ধের মধ্য দিয়ে। 

পাতা : ৪৬

সিন্ধু সভ্যতার অহিংস নীতির সমস্যা

মৌর্য সম্রাট অশোক আনুমানিক ২৬১ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে কলিঙ্গ (বর্তমান কালের ওড়িশা) রাজ্য আক্রমণ করে জয়লাভ করেন। দুই দিনের যুদ্ধে কলিঙ্গ পক্ষের প্রায় দেড় লক্ষ সৈনিক নিহত হয়। এছাড়া আহতও ছিল বিপুল সংখ্যক সৈনিক। কলিঙ্গের বহু সংখ্যক অসামরিক নাগরিকও এই যুদ্ধে নানানভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বলা হয় অশোকের প্রায় দশ হাজার সৈনিক নিহত হয়। যুদ্ধের নির্মমতার অভিজ্ঞতা অশোকের মনে এমনই প্রভাব বিস্তার করে যে, এরপর তিনি যুদ্ধ ও হিংসার পথ পরিবর্তন করে শান্তির পথ হিসাবে বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেন এবং বাকী জীবন বৌদ্ধ ধর্মের প্রচার, প্রসার এবং জনকল্যাণমূলক কাজে আত্মনিয়োগ করেন।

এত বড় বিজয় সত্ত্বেও বিরাট আকারের রক্তপাতের ঘটনা কোনও বিজয়ীর মনকে এভাবে পরিবর্তিত করে এমন দৃষ্টান্ত কি পৃথিবীর ইতিহাসে দ্বিতীয়টি আছে? আমাদের জানা মতে, নাই। কারণ এমন চেতনার সামাজিক ভিত্তি ভারতবর্ষের বাইরে আর কোথায়ও নাই। বুঝা যায় এই চেতনার উৎস রয়েছে হারিয়ে যাওয়া সিন্ধু সভ্যতার ভিতরে। বিলুপ্ত হলেও এই সভ্যতার স্মৃতি অজস্র উপায়ে উপমহাদেশের জন-চেতনাকে প্রভাবিত করেছে। সুতরাং যুদ্ধ-নির্ভর এক পরাক্রান্ত রাষ্ট্রের অধিপতি হওয়া সত্ত্বেও এই ভূমির সন্তান অশোক এক যুদ্ধের ঘটনার অভিঘাতে সমাজের গভীরে বহমান চেতনার স্রোতে শেষ পর্যন্ত নিজেই ভেসে গেছেন।

সমাজ জীবনে অহিংসা নীতির মূল্য আছে। কিন্তু সমাজের প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা হিসাবে রাষ্ট্রকে যদি বাস্তবতা-নিরপেক্ষভাবে অহিংসা নীতির অনুসারী করতে চাওয়া হয় তবে তার ফল কি চূড়ান্ত বিচারে ভালো হতে পারে?

ততদিনে লৌহাস্ত্রধারী তীব্র গতিশীল অশ্বারোহী বাহিনীর অভিযানের কাল শুরু হয়েছে। সুতরাং পৃথিবীর যাবতীয় যাযাবর পশুপালক জনগোষ্ঠী সভ্য ও স্থিতিশীল জনগোষ্ঠীগুলির জন্য মূর্তিমান আতঙ্ক হয়ে উপস্থিত হয়েছে। এখন মধ্য এশিয়ার পশুপালক হিংস্র ও লুঠেরা যাযাবরদের লোভাতুর দৃষ্টি ভারতবর্ষের সমৃদ্ধ সভ্য সমাজের প্রতি। সভ্যতার অধিকারী পূর্ববর্তী ইরানীয় কিংবা গ্রীক আক্রমণকারীদের মনে সভ্যতার প্রতি যেটুকু শ্রদ্ধাপূর্ণ মনোভাব বা সমীহা ছিল এসব পশুপালক যাযাবর যোদ্ধাদের মনে তার কিছুই অবশিষ্ট ছিল না। তাদের লক্ষ্যবস্তু ছিল ভারতবর্ষের বিস্তীর্ণ ভূমি, সম্পদ এবং নারী। সম্রাট অশোকের মৃত্যুর পর আরও কিছু কাল মৌর্য সাম্রাজ্য টিকলেও সেটা ভেঙ্গে পড়লে উত্তর-পশ্চিমের পথ ধরে শক-হুন ইত্যাদি অশ্বারোহী পশুচারীদের আক্রমণের ঢেউগুলি শত শত বৎসর ধরে আফগানিস্তানসহ সমগ্র উত্তর-পশ্চিম ভারতবর্ষকে লণ্ডভণ্ড করল। সভ্য ইউরোপ কিংবা চীনও এমন বিপদের বাইরে থাকল না। তারপরেও তারা তাদের মত করে এই বিপদকে মোকাবিলা করে দাঁড়াল। এইসব দেশের অভিজ্ঞতা সকলের জন্য শিক্ষণীয় হতে পারে। তারা কীভাবে শেষ পর্যন্ত আত্মরক্ষা করল?

চীন ছিল প্রধানত বৌদ্ধ ধর্ম প্রভাবিত। অথচ তার প্রতিরোধ ছিল বিস্ময়কর। বিশেষত মোঙ্গল শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে বহুসংখ্যক বৌদ্ধ শ্রমণকেও নেতৃত্ব দিতে দেখা যায়। বলা হয়ে থাকে ত্রয়োদশ শতাব্দীতে মোঙ্গল অভিযানে চীনের দশ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে প্রায় দুই কোটিই নিহত হয়েছিল। মোঙ্গল নেতা চেঙ্গিস খান ১২০৫ সালে চীনে ছোটখাটো আক্রমণ দিয়ে যে যুদ্ধাভিযানের সূত্রপাত করেন তা ক্রমে প্রবলতর হল এবং চীনের জন্য ধ্বসাত্মক রূপ নিল। চীনে মোঙ্গল শাসন ছিল খুব নিষ্ঠুরতাপূর্ণ। অবশেষে বহু সংখ্যক বিদ্রোহের পরিণতিতে ঝু-র নেতৃত্বে গণ-বিপ্লবে মোঙ্গল শাসন উৎখাত হয়। বিজয়ী ঝু ১৩৬৮ খ্রীষ্টাব্দে নিজেকে চীনের সম্রাট ঘোষণা করেন।

পরাজিত মোঙ্গল শাসকদের প্রতি চীনাদের নিষ্ঠুরতাও ছিল উল্লেখযোগ্য। পরাজিত ও ক্ষমতাচ্যুত শাসক মোঙ্গলদের একজনকেও চীনারা বাঁচিয়ে রাখে নাই বলে জানা যায়। চীনাদের বিবেচনায় অসভ্য ও বর্বর মোঙ্গল শাসনের প্রতি ঘৃণা এতটাই তীব্র ছিল যে, মোঙ্গলরা তাদের শাসনকালে চীনে যা কিছু নির্মাণ করেছিল চীনারা সেগুলির সবই নিশ্চিহ্ন করে দেয়। এমনকি মোঙ্গলদের তৈরী কোনও স্থাপনা, গৃহ বা প্রাচীর ধ্বংস করার পর মাটি খুঁড়ে মাটির তলায় ভিত্তি হিসাবে থাকা ইট বা পাথর যা কিছু ছিল সবই উপড়ে ফেলে দিয়েছিল। অর্থাৎ চীনারা তাদের বিবেচনায় বিদেশী এবং বর্বরদের শাসনের কোনও চিহ্ন পর্যন্ত সমগ্র চীনে একটিও রাখে নাই।

অথচ মজার ব্যাপার আজকের ঐক্যবদ্ধ চীন চেঙ্গিসের নেতৃত্বে মোঙ্গল বিজয়ের ফল। এর পূর্বে আজকের চীন এক রাষ্ট্র হতে পারে নাই। বরং পরস্পর দ্বন্দ্বে লিপ্ত কয়েকটি স্বাধীন রাজ্যে বিভক্ত ছিল। বিভক্ত রাজ্যগুলির রাজনৈতিক সীমানাকে চূর্ণ করে আজকের চীনের অখণ্ডতার উত্তরাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য কৃতিত্ব দিতে হবে মোঙ্গলদেরকে। সকল নেতিবাচক দিক সত্ত্বেও এটা চীনের জন্য মোঙ্গল আক্রমণ ও বিজয়ের ইতিবাচক ফল।

চীন বহিরাক্রমণকারী মোঙ্গলদের কাজের ইতিবাচক ফলকে আত্মস্থ করলেও তাদেরকে আত্মস্থ করে নাই; বরং তাদেরকে বর্জন বা বহিষ্কার করেছে।

 ইউরোপের অভিজ্ঞতাও চীনের প্রায় অনুরূপ। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে ১২৩৩ থেকে ১২৪০ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত অনেক কয়টি মোঙ্গল অভিযানে পূর্ব ইউরোপের রাশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চল বা রাজ্য মোঙ্গল বাহিনী দ্বারা আক্রান্ত এবং অধিকৃত হয়। এইসব মোঙ্গল আক্রমণে রাশিয়ার বিপুল ক্ষয়-ক্ষতি হয়।

কিন্তু মোঙ্গল আধিপত্যকে ব্যবহার করে মস্কোর গ্র্যান্ডপ্রিন্স রাশিয়ার ঐক্যসাধনের প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নেন। প্রায় আড়াইশ’ বছর পর ১৪৮০ খ্রীষ্টাব্দে মস্কোর ইভান ৩ এর নেতৃত্বে রুশ বাহিনী উগরা নদীর তীরে মোঙ্গল বাহিনীকে পরাজিত করে মোঙ্গল শাসন উচ্ছেদ করে। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, রুশ বাহিনী যাদেরকে পরাজিত করেছিল তারা ছিল গোল্ডেনহোর্ড হিসাবে কথিত মোঙ্গলদের যে অংশ শেষের দিকে ইসলামে ধর্মান্তরিত হয়েছিল তারা। এরা সাধারণত তাতার হিসাবে পরিচিত। ১৫৫২ খ্রীষ্টাব্দে ভয়ঙ্কর ইভান বা Ivan the Terrible কাযান ও আস্ট্রাখানে চূড়ান্ত বিজয়ের মাধ্যমে রাশিয়ার ভূমি থেকে অবশিষ্ট মোঙ্গলদের বিতাড়িত করেন। তিনি এদের উপর ব্যাপক ধ্বংসলীলা পরিচালনা করেন। কাযান দখল করার পর সেখানকার মুসলিম জনসাধারণকে বিতাড়িত করেন, মসজিদগুলিকে চার্চে রূপান্তরিত করেন ও আশেপাশের অঞ্চলের তাতারদের খ্রীষ্টান হতে চাপ প্রয়োগ করেন। চার বৎসর পর ১৫৫৬ খ্রীষ্টাব্দে আরো দক্ষিণ-পূর্বে তাতারদের অধীনস্থ আস্ত্রাখানকে দখল করে নেন। এর ফলে সমস্ত ভোলগা নদী অঞ্চল রাশিয়ানদের অধীনে চলে যায়।  

পশ্চিম ইউরোপের স্পেনে মুসলিম আরবরা ৭১১ খ্রীষ্টাব্দে প্রথম আক্রমণ অভিযান পরিচালনা করে। সাত বৎসর সময়ের মধ্যে তারা সমগ্র স্পেন জয় করে। প্রায় আটশত বৎসর স্পেনে তাদের শাসন স্থায়ী হয়। খ্রীষ্টান স্পেনীয় প্রতিরোধ বাহিনীর নিকট ১৪৯২ খ্রীষ্টাব্দে মুসলিম আরবদের শেষ দুর্গ গ্রানাডার পতনের মধ্য দিয়ে পশ্চিম ইউরোপে মুসলিম শাসনের অবসান ঘটে। স্পেনীয়রা মুসলিম শাসনকালের কিছু সংখ্যক স্থাপত্য নিদর্শন রাখলেও মুসলিমদের অস্তিত্ব রাখল না। স্পেনের প্রতিটি মুসলিমকে হয় খ্রীষ্টান হতে হয়েছিল, নয় স্পেন পরিত্যাগ করে যেতে হয়েছিল অথবা মৃত্যু বরণ করতে হয়েছিল। নির্ধারিত সময়ের পর প্রতিটি জীবিত মুসলিমকে স্পেনের খ্রীষ্টানরা হত্যা করেছিল। এভাবে খ্রীষ্টান স্পেন তার বিবেচনা অনুযায়ী তার অতীতের আটশ’ বছরের  পরাধীনতার ঐতিহ্যের সঙ্গে ছেদ ঘটিয়েছিল।

কিন্তু ভারতবর্ষ বা দক্ষিণ এশিয়ার অভিজ্ঞতা ভিন্ন। শক-হুন ইত্যাদি পশুচারী যাযাবর আক্রমণকারীদের হামলায় আফগানিস্তানসহ উপমহাদেশের পশ্চিম ও উত্তরের বিস্তীর্ণ ভূভাগের জৈন ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী অধ্যুষিত রাষ্ট্র এবং জনপদসমূহ ধ্বংসপ্রাপ্ত হল। জৈন কিংবা বৌদ্ধ সমাজ থেকে এমন কোনও শক্তি উঠে এল না যা তাদেরকে সামরিকভাবে প্রতিহত করতে কিংবা উৎখাত এবং বহিষ্কার করতে পারে। অথচ ভারতবর্ষের বাইরে চীনসহ বহু দেশ অহিংস বৌদ্ধ কিংবা শান্তিবাদী খ্রীষ্টান ধর্মাবলম্বী হওয়া সত্ত্বেও যুদ্ধকে যুদ্ধ দিয়ে মোকাবিলায় সক্ষম হল। বুঝা যায় ভারতীয় সমাজে সিন্ধু সভ্যতার অহিংস চেতনার প্রভাবের গভীরতা এত বেশী ছিল যে, এখানে সমাজের আত্মরক্ষার জন্য যুদ্ধ চর্চারও যে অপরিহার্যতা রয়েছে সেই বোধ অনেকাংশে লোপ পেয়েছিল। এটা অবশ্যই ভারতীয় সমাজের অতিরিক্ত রক্ষণশীলতার ফল। একটা সমাজের ব্যাপকতর অংশ যদি প্রয়োজনেও নিরস্ত্র এবং যুদ্ধ বা হিংসা বিমুখ হয় তবে সেই সমাজ টিকতে পারে কীভাবে? স্বাধীনভাবে বাঁচতে পারার তো প্রশ্নই উঠে না।

বিদ্যমান জৈন ও বৌদ্ধ সমাজ তথা তার নেতৃত্বের ধ্বংস এবং ব্যর্থতার সুযোগ নিতে এগিয়ে এল এতদিন অনেকটা কোণঠাসা হয়ে থাকা ব্রাহ্মণ গোষ্ঠী। তারা চতুর্বর্ণ বিভাগের কাঠামোতে ফেলে বহিরাক্রমণকারীদের ভারতীয় সমাজে আত্মীকরণের পথ বেছে নিল। বিশেষত যোদ্ধা এবং বিজয়ীদেরকে ক্ষত্রিয় মর্যাদায় অভিষিক্ত ক’রে তাদের হাতে রাষ্ট্র পরিচালনা এবং যুদ্ধের দায়িত্ব দিল। এ বিষয়ে আমরা পূর্বে আলোচনা করায় এখানে আর পুনরুক্তি করব না।

ব্রাহ্মণদের ভূমিকা ব্যবহারিক দিক থেকে যৌক্তিক মনে হতে পারে। কিন্তু এর ফলাফল দক্ষিণ এশিয়ার সমাজের জন্য শেষ বিচারে কতটা শুভ হয়েছে তা বলা কঠিন। কারণ এই ঐতিহ্য যে কোনও প্রবল বহিরাক্রমণকারী কিংবা অনুপ্রবেশকারীর প্রতি সামাজিক বশ্যতা দানের মনস্তত্ত্ব গড়ে তুলে। একদিকে সমাজের বর্ণাশ্রম ভিত্তিক বিভাজন সমাজকে গতিহীন ও শক্তিহীন করল, অপর দিকে, ধর্মীয় বিধান অনুযায়ী যুদ্ধের দায়িত্ব জন্মগত সূত্রে ক্ষত্রিয়দের হাতে দিয়ে বাকী সমাজকে শুধু নিরস্ত্র নয়, অধিকন্তু নির্বীর্যতার পূজারীও করা হল। সর্বোপরি বিদেশী হানাদার ও দখলদারদের ক্ষত্রিয় মর্যাদা দিয়ে ধর্মীয় বিধান অনুযায়ী তাদের হাতে রাষ্ট্র ও যুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্ব তুলে দিয়ে অত্যন্ত ক্ষতিকর একটা ঐতিহ্য প্রতিষ্ঠা করা হল।  

এই ঐতিহ্যের ধারায় একবার ঘাড়ের উপর জোর-জবরদস্তি করে কিছু চাপিয়ে দিতে পারলেই হল। তখন সেটার বিরুদ্ধে দাঁড়ানো মানে সমাজের সাধারণ আকাঙ্ক্ষা ও চেতনার বিরুদ্ধে দাঁড়ানোও হয়ে উঠতে পারে। এই মনস্তত্ত্বের অধীনে থাকা সমাজে অন্যায়কারী হলেও প্রবলতর শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধের জন্য সামাজিক চেতনা গড়ে উঠবে কী করে? হিন্দু ধর্মের মাধ্যমে সিন্ধু সভ্যতাসহ উপমহাদেশের সভ্যতার সুপ্রাচীন ও মহিমান্বিত ঐতিহ্যের অনেক কিছু হয়ত রক্ষা পেতে পারে। কিন্তু সেটা তো প্রধানত পড়ে পড়ে মার খেয়ে টিকে থাকার শক্তি দিতে পারে। সেটা কি কাঙ্ক্ষিত  হতে পারে? কালের গতির সাথে তাল মিলিয়ে অন্যান্য সমাজের পাশাপাশি মাথা উঁচু করে এগিয়ে যাওয়া তো ভিন্ন ব্যাপার!

পাতা : ৪৭

 

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
Archive
 
সাম্প্রতিক পোষ্টসমূহ