Banner
মার্কসবাদের সংকট ও বিপ্লবের ভবিষ্যৎ — শামসুজ্জোহা মানিক

লিখেছেনঃ শামসুজ্জোহা মানিক, আপডেটঃ July 10, 2010, 5:00 PM, Hits: 17095


ওয়েব সাইটে প্রকাশের জন্য কম্পিউটারে পুনঃমুদ্রণের সময় সামান্য কয়েকটি জায়গায় কিছু সংশোধন করার বেশী মূল লেখায় হাত দেওয়া হয় নি।

লেখক ২০মে, ২০০৭

 

উৎসর্গ

অতীত বিপ্লবী আন্দোলন থেকে শিক্ষা নিয়ে যাঁরা এ দেশে আগামী সফল বিপ্লবকে অনিবার্য করে তুলবেন তাঁদের উদ্দেশ্যে।

 

প্রকাশকের কথা

উনিশ শতকের মাঝামাঝিতে মার্কসবাদ যখন একটি তত্ত্ব হিসাবে আত্মপ্রতিষ্ঠা করতে চলেছে তখন থেকে শুরু করে গত প্রায় দেড়শত বছর ধরে এ তত্ত্বের সমালোচনা হচ্ছে। সমাজ, দর্শন কিংবা অর্থনীতি তথা গোটা সামাজিক বিজ্ঞানই দু’টি ধারায় বিভক্ত হয়ে গেছে মার্কসবাদকে সামনে রেখে। কেউ দাঁড়িয়েছেন মার্কসবাদের সপক্ষে এবং কেউ দাঁড়িয়েছেন তার বিপক্ষে। যাঁরা মার্কসবাদের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন তাঁরা যে সবাই সমাজ বিপ্লবের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন এমন নয়, কিন্তু যাঁরা মার্কসবাদের বিপক্ষে দাঁড়িয়েছেন তাঁদের প্রায় সবাই ছিলেন সমাজ বিপ্লবের বিপক্ষে। শামসুজ্জোহা মানিক এক্ষেত্রে এক অনন্য সাধারণ ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্ব হিসাবে অসীম সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। আজকের যুগে মার্কসবাদ অনুসরণ করা ছাড়া কোনভাবেই সমাজ বিপ্লবের তত্ত্ব বিনির্মাণ করা যায় না  এ ধারণা চলে আসছে কয়েক যুগ ধরে। প্রগতিবাদীদের মধ্যে এটা একটা মিথ হিসাবে চেপে বসে আছে( অনেকটা অন্ধ বিশ্বাসের মত। ফলে বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বিপ্লবীদের মধ্যে নতুন কোন রাজনৈতিক কৌশল গ্রহণের কথা যখনই এসেছে তখনই এটা মার্কসবাদ বিরোধী বা সংশোধনবাদ বলে লেবেল এঁটে দিয়ে তা প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। সমাজ বিপ্লবের লক্ষ্যটি মুখ্য না থেকে মার্কসবাদ প্রতিষ্ঠার প্রশ্নটি সামনে চলে এসেছে। রাজনীতি ক্ষেত্রে এ গোঁড়া অবস্থানটি অনেক সময়ই বিপ্লবীদের অনেক পিছনে ফেলে দিয়েছে। আবার একই সাথে, এই গোঁড়া অবস্থানটিই বিপ্লবীদেরকে মারাত্মক সব পদস্খলনের হাত থেকে রক্ষা করেছে। পদস্খলনের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া আর বিপ্লব এক জিনিস নয়। বিপ্লবের ব্যাপারটা যেমন যুগে যুগে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ঘটে, তেমনই সচেতন প্রয়াশের মধ্য দিয়েও একে নিকটবর্তী করা যায় কিংবা বিপ্লবের হালটাকে ধরে ফেলা যায়। অতি উঁচু স্তরের সৃজনশক্তির সংযোগ ছাড়া এ কাজ সম্ভব নয়। ফলে সাধারণত দু’ধরনের ভবিষ্যতের জন্য অপেক্ষা করতে হয়; এক, বিপ্লবের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে বিপ্লব বিরোধী অবস্থান গ্রহণ করা; দুই, বিপ্লবী পরিস্থিতির সাথে খাপ খাওয়াতে না পেরে সংকীর্ণ একটি অবস্থান গ্রহণ করা। লেখক শামসুজ্জোহা মানিক অবশ্য এর জন্য সৃজনশক্তির অভাবকে দায়ী করেন নি, এ জন্য মার্কসবাদের মধ্যেই কিছু মৌলিক দুর্বলতাকে তিনি চিহ্নিত করেছেন। তাঁর এ দাবী কতটা সংগত তা ভবিষ্যত বলবে। তবে একথা স্বীকার না করে কোন উপায় নেই যে, মার্কসবাদ ও বিপ্লব সম্পর্কে তিনি কিছু মৌলিক প্রশ্ন তুলেছেন এবং অত্যন্ত গভীরভাবে ব্যাখ্যা করার মাধ্যমে একটি নির্দেশনা প্রদানের চেষ্টা করেছেন । লেখকের অন্য একটি ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্য হচ্ছে মার্কসবাদের কড়া সমালোচেনা সত্ত্বেও মানব সভ্যতা ও তার সমাজ বিপ্লবের ক্ষেত্রে এ তত্ত্বের ঐতিহাসিক ভূমিকার কথা তিনি একবারের জন্যও ভুলে যান নি; বরং সমাজ বিপ্লবে এ তত্ত্বের গুরুত্ব যুগ যুগ ধরে রয়ে যাবে বলে তিনি দৃঢ় আস্থা জ্ঞাপন করেছেন। তবে সবচেয়ে জোর দিয়ে তিনি যা বলেছেন তা হচ্ছে বাংলাদেশের সমাজে বিপ্লবের অনিবার্যতার কথা।

বইটা লেখার সময় ১৯৮৯ সালের ৯ নভেম্বর থেকে ২০ নভেম্বর। তখনও সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যায় নি। তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন নেতৃত্ব ও অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক দেশ মার্কসবাদের নামে যা করে চলেছিল তাতে যে কোন বিপ্লবীরই বিরক্ত না হয়ে কোন উপায় ছিল না। শামসুজ্জোহা মানিকও এর বাইরে নন। আর সে কারণেই মার্কসবাদের কোন কোন তত্ত্ব সম্পর্কে লেখকের আক্রমণটা এমন ক্ষুরধার। কেননা, লেখকের ধারণা অনুযায়ী মার্কসবাদের মধ্যে অসংখ্য ইতিবাচক দিক থাকা সত্ত্বেও এসব দুর্বলতার কারণেই জনগণের গণতন্ত্রকে হরণ করে নিয়ে রাষ্ট্রীয় আমলাতন্ত্র নিয়ন্ত্রিত সমাজ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়েছে, যা’র অনিবার্য পরিণতি ব্যাপক ধ্বংস ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না।

এ ধরনের একখানি মৌলিক গ্রন্থ প্রকাশ করতে পেরে ‘প্রাচ্য বিদ্যা প্রকাশনী’ নিজেদেরকে ধন্য মনে করছে।

লেনিন আজাদ

১৪ই জানুয়ারী, ১৯৯৩

 

কল্পস্বর্গের পতন

মার্কসবাদের সংকট শুধু বাংলাদেশেই নয়, এটা আজ সমস্ত পৃথিবী জুড়েই। এ দেশে ’৬০-এর দশকে কমিউনিস্ট আন্দোলনের ভাঙ্গন ’৭১ উত্তরকালে যে সংকট ও বিপর্যয়ে পরিণত হয়েছিল তা থেকে মার্কসবাদের মুক্তির কোনই পথ যখন দেখা যাচ্ছিল না তখন কমিউনিস্ট চীন, রাশিয়া ও পূর্ব ইউরোপে দেখা দিয়েছে কমিউনিজম ও মার্কসবাদের ক্রমবর্ধমান সংকট ও বিপর্যয়।

এতোদিন যাঁরা বাইরের কমিউনিস্ট দেশগুলির দিকে তাকিয়ে নিজ দেশে মার্কসবাদের ক্রমাগত ব্যর্থতাকেও অস্বীকার করতে এবং তুচ্ছ করতে চেয়েছেন এবং মার্কসবাদকে মনে করেছেন সকল সত্যের সার এবং নিখুঁত, নির্ভুল ও অখণ্ডনীয় দর্শন এখন তাঁদের অবিচলতা আর রক্ষা করার উপায় থাকছে না। নিজ দেশের অভিজ্ঞতা ও বাস্তবতা অস্বীকার ক’রে পরের, পরজাতি ও পরসমাজের দৃষ্টি ও মন দিয়ে যারা সবকিছুকে এমনকি নিজ দেশের জীবন ও বাস্তবতাকেও দেখতে ও বিচার করতে অভ্যস্ত আজ তাঁদের পরনির্ভর কিংবা পরাধীন চিত্ত ও দৃষ্টি আর অচঞ্চল থাকতে পারছে না। কারণ যে কেবলাকে ঘিরে তাঁদের বিশ্বাসের আরাধনা ও কর্মের সাধনা সেই কেবলাই এখন চঞ্চল এবং তা প্রতিমুহূর্তেই সারা পৃথিবীকে কাঁপিয়ে দিয়ে সশব্দে ভেঙ্গে পড়ছে একটু একটু ক’রে।

কমিউনিজমের স্বর্গরাজ্য দূরে থাক। যে সমাজতন্ত্রকে মনে করা হয়েছিল কমিউনিজমের প্রথম বা পূর্ববর্তী স্তর তা-ই এখন টিকতে পারছে না। বরং কমিউনিজমের দিকে অগ্রযাত্রার পরিবর্তে দেখা যাচ্ছে নানান তত্ত্ব ও যুক্তির আড়াল নিয়ে তা অগ্রসর হচ্ছে গণতন্ত্র এবং ব্যক্তি মালিকানা ভিত্তিক পুঁজিবাদের দিকে। রাশিয়া গণতন্ত্রের দিকেই যাত্রা করছে। সেটা এখনও নির্দিষ্ট রূপ না নিলেও কমিউনিস্ট পার্টি ও সরকার সমাজের গণতন্ত্রায়ন ঘটাচ্ছে কিছু ক’রে। এই গণতন্ত্রায়ন কতোদূর যেতে পারবে, বিভিন্ন জাতির ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়ন টিকবে কিনা সেসব প্রশ্ন এখানে অপ্রাসঙ্গিক। এখানে আমরা যে বিষয়টি বলতে চাচ্ছি, তা হ’ল সোভিয়েত ইউনিয়ন আর কমিউনিজমের দিকে এগিয়ে যাবার নামে মার্কসবাদী ব্যবস্থাকে বহাল রাখতে পারছে না।

চীনেও মার্কসবাদের অবস্থা করুণ হয়েছে। মার্কসবাদের সংকট পূর্ব ইউরোপের দেশে দেশে ছড়িয়ে পড়ছে। পোল্যান্ডে মার্কসবাদ বিরোধীরা এখন রাষ্ট্রক্ষমতায় অংশ নিয়েছে। হাংগেরী আর মার্কসবাদী বা কমিউনিস্ট রাষ্ট্র নয়। শান্তিপূর্ণ ভাবেই আজ তা মার্কসবাদকে বর্জন করেছে।

মার্কসবাদের এহেন সংকট ও বিপর্যয়ে আমেরিকার শাসকদের যেমন উল্লাসের সীমা নেই তেমন সারা পৃথিবীতে তাদের সহযোগী ও অনুসারীরা তাদের খুশী আর চাপতে পারছে না। আমাদের দেশেও আমেরিকাপন্থী, আরবপন্থী, ইরানপন্থী এতে অতিশয় উল্লসিত। এ দেশে প্রগতি ও গণ-বিরোধী শক্তিসমূহ ভাবছে মার্কসবাদের সংকট এ দেশকে হয়তো রক্ষা করবে বিপ্লব থেকে।

আর মার্কসবাদীদের বিরাট অংশই এখন মনের ভিতরে হাল ছেড়ে দিয়েছেন। তাঁরা ভাবছেন মার্কসবাদই যখন কোনও কুল পাচ্ছে না তখন আর বিপ্লব হবে কি ক’রে? তাঁরা এখন সমাজ ও রাষ্ট্র বিপ্লবের আশা পরিত্যাগ করেছেন বলাই ভালো। কারণ তাঁদের কাছে মার্কসবাদ এবং বিপ্লব বা সমাজ বিপ্লব সমার্থক। কমিউনিজমের কল্পস্বর্গের পতন তাঁদের বিপ্লবের স্বপ্নেরও পতন ঘটাচ্ছে।

 

মার্কসবাদ ও বিপ্লব

কিন্তু বাস্তবেই কি মার্কসবাদ ও বিপ্লব সমার্থক? আজকের সংকট কি বিপ্লবের সংকট, নাকি এটা নেহায়েত মার্কসবাদের সংকট?

আজকের যুগে মার্কসবাদের সংকটকে সমাজ বিপ্লবের সংকটের সঙ্গে সমার্থক ধরতে হলে বলতে হবে যে, মার্কসবাদের পূর্বে মানব সমাজে কোনও সমাজ বিপ্লব ছিল না। তেমন কথা কেউই বলবেন না। কারণ মানব ইতিহাসে মার্কসবাদ সাম্প্রতিক ঘটনা মাত্র। ১৮৪৮-এ মার্কস এবং এঙ্গেলস কর্তৃক রচিত কমিউনিস্ট ইশতেহার দ্বারা যদি তা একটি নূতন মতবাদ হিসাবে আত্মঘোষণা ক’রে থাকে তবে তার বয়স এখন দেড়শত বৎসরও হয় নি। কিন্তু এর পূর্বে মানব সমাজে ঘটেছে অসংখ্য বিপ্লব। এমনকি মার্কসবাদ কিংবা কমিউনিজমের ধারণা ছাড়াই ইউরোপ সংগঠিত করেছে বিভিন্ন জাতীয় ও গণতান্ত্রিক বিপ্লব। তবে এগুলি সাধারণভাবে মার্কসবাদ পূর্বকালে ঘটেছিল। মার্কসবাদের আবির্ভাব ও প্রসারের পর, বিশেষত ১৯১৭-তে রাশিয়ায় মার্কসীয় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের বিজয়ের পর সমস্ত পৃথিবীতে মার্কসবাদ বিপ্লবের আন্তর্জাতিক মতবাদ হিসাবে ক্রমবর্ধমান স্বীকৃতি লাভ করে।

রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পূর্ব পর্যন্ত আধুনিক পুঁজিবাদের বিশ্বজোড়া জয়যাত্রা ছিল অপ্রতিহত। বস্তুত আধুনিক পুঁজিবাদ মানবেতিহাসে এক খুব সাম্প্রতিক ঘটনা। শিল্পকে কেন্দ্র ক’রে পুঁজিবাদী অর্থনীতি ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার উত্থান ইউরোপের সাম্রাজ্য বা উপনিবেশ বিস্তারের ইতিহাসেও অপেক্ষাকৃত পরবর্তীকালের ঘটনা। পতুêগাল ও স্পেন যখন বাণিজ্য করতে গিয়ে আমেরিকা, এশিয়া ও আফ্রিকায় উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা করতে শুরু করে তখনও আধুনিক শিল্প পুঁজির উদ্ভব হয় নি। তবে ইউরোপে শিল্প পুঁজির উদ্ভবের পরিস্থিতি তখন সৃষ্টি হচ্ছিল। হস্তচালিত কারখানা শিল্পের ব্যাপক বিস্তার ও বিকাশ হচ্ছিল যা ছিল প্রাচ্য সমাজের রাষ্ট্রীয়, সামাজিক উদ্যোগ ও মালিকানায় সংগঠিত হবার পরিবর্তে ব্যক্তিগত উদ্যোগ ও মালিকানায় সংগঠিত। হস্তচালিত বা দেহশ্রম নির্ভর হলেও যন্ত্র এবং শিল্পের যতোটুকু বিকাশ স্পেন ও পতুêগালসহ পশ্চিম ইউরোপে হয়েছিল তারই জোরে পালতোলা জাহাজে ক’রে স্পেন ও পতুêগালের বণিক ও যোদ্ধারা পৃথিবীতে নূতন ও প্রচণ্ড শক্তি রূপে আবির্ভূত হ’ল। এদের পিছনে নামল হল্যান্ড, ইংল্যান্ড এবং ফ্রান্স এবং এগিয়েও গেল বিপুল বেগে।

অবশেষে অষ্টাদশ শতাব্দীতে আবিষ্কৃত হ’ল বাষ্পের শক্তি এবং স্টীম ইঞ্জিন। আর তা সমস্ত মানব ইতিহাসকে বদলে দিল। মানব জাতি প্রবেশ করল সমস্ত অতীত ইতিহাস থেকে ভিন্ন এক অধ্যায়ে যেখানে মানুষের দেহশ্রম ছাড়াই যন্ত্র দ্বারা প্রায় সমস্ত কাজ হ’তে পারে। এর প্রভাবে শুরু হ’ল এক অভূতপূর্ব বিপ্লব। ইংল্যান্ডে শুরু হয়ে তা ছড়াল ফ্রান্স, হল্যান্ড এবং প্রায় সমগ্র পশ্চিম ইউরোপে, বিশেষ ক’রে তার উত্তর অংশে। যন্ত্রের শক্তির বলে বলীয়ান হয়ে পশ্চিম ইউরোপ প্রায় সমস্ত পৃথিবীকে পদানত কিংবা নিয়ন্ত্রণ করল এবং প্রাচ্যের পুরাতন দৃঢ়বদ্ধ সমাজের সমস্ত বাধার প্রাচীর ভেঙ্গে তাকে করল তার বাজার।

 

ব্যক্তি মালিকানা ও ব্যক্তি পুঁজি নির্ভর অর্থনীতির বিস্তার

ব্যক্তি মালিকানাকে অবলম্বন ক’রে ইউরোপে শিল্পপুঁজির যে প্রচণ্ড শক্তির বিকাশ হ’ল তা বাঁধল সমস্ত পৃথিবীকে তার শাসন ও শোষণের জালে। রাষ্ট্র ও সমাজের যে নির্ধারক ভূমিকা ও মালিকানা প্রাচ্য সমাজের উৎপাদনে ছিল তা ভেঙ্গে পড়তে থাকল এবং এখানে এমন এক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উদ্ভব হ’ল যেখানে রাষ্ট্রের প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণেই ব্যক্তি মালিকানা ক্রমশ প্রাধান্য অর্জন করতে পারে।

অতীতে প্রাচ্য সমাজে উৎপাদন বা অর্থনীতির মূল নিয়ন্ত্রণ ছিল ব্যক্তি নয়, রাষ্ট্র ও সমাজের হাতে। কৃষি কিংবা পশুপালনমূলক অর্থনীতির এটা ছিল এখানে সাধারণ বৈশিষ্ট্য। উৎপাদনে ক্ষেত্র বিশেষে ব্যক্তি মালিকানা থাকলেও তা ছিল সংকুচিত হয়ে। ব্যবসাতে ব্যক্তি মালিকানা যেমন ছিল তেমন পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় মালিকানাও অনেক ক্ষেত্রে কার্যকর ছিল। এবং ব্যবসাতে ব্যক্তি মালিকানা থাকলেও ব্যবসায়ী বা বণিকদের বিশেষ কোনই স্বাধীনতা বা ক্ষমতা ছিল না, যা ছিল ইউরোপে। কারণ ইউরোপে সমগ্র অর্থনীতি ছিল ব্যক্তি মালিকানা ভিত্তিক। শুধু যে ভূমিতে পুরাতন সামন্তবাদী যুগেও সামন্তদের ব্যক্তি মালিকানা ছিল তা-ই নয়, উপরন্তু সামন্ত ব্যবস্থার পাশাপাশি যে বাণিজ্য ও হস্তচালিত কারখানা শিল্প গড়ে উঠেছিল তাও ছিল ব্যক্তিগত মালিকানা ভিত্তিক।

শিল্প বিপ্লবের পর ইউরোপ তার উন্নততর অর্থনীতির জোরে সমস্ত পৃথিবীকে ব্যক্তিগত মালিকানা ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত ক’রে নিল। ফলে ভেঙ্গে গেল প্রাচ্যের প্রাচীন রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণ এবং এই মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণ ভিত্তিক কৃষি এবং এই কৃষির সহযোগী হিসাবে গড়ে ওঠা কুটীর শিল্প ও বাণিজ্য।

এতে ক’রে প্রাচ্য সমাজ এক অভূতপূর্ব পরিস্থিতির সম্মুখীন হ’ল। কারণ পশ্চিম ইউরোপ পুরাতন পৃথিবীকে ভাঙ্গল ঠিক, কিন্তু তাকে ব্যক্তি মালিকানা দিলেও তাকে সেভাবে দিল না শিল্প ও আধুনিকতা। বস্তুত এই ব্যক্তি মালিকানা ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা প্রাচ্যকে কৃষি নির্ভর ও পশ্চাৎপদ রেখেই পশ্চিম ইউরোপের অনুরূপ একটা দুর্বলতর অর্থনৈতিক ব্যবস্থা দিল যা হ’ল পশ্চিম ইউরোপের অধীনস্থ এবং তার উপর নির্ভরশীল। এই রকম এক অর্থনীতিতে পশ্চিম ইউরোপ হ’ল প্রাচ্যসহ সমস্ত অনুন্নত পৃথিবীর কেন্দ্র। এবং পশ্চিম ইউরোপের কাজ হয়ে দাঁড়াল ব্যক্তি মালিকানাধীন শিল্প নির্ভর অর্থনৈতিক ব্যবস্থা দ্বারা প্রান্তস্থ সমস্ত অনুন্নত পৃথিবীকে স্বৈরাচারী পদ্ধতিতে শোষণ, লুণ্ঠন ও শাসন দ্বারা অবনত রাখা।

এই রকম পরিস্থিতিতে পূর্ব ইউরোপ ও এশিয়ার এক পশ্চাৎপদ রাষ্ট্র রাশিয়ায় ১৯১৭-তে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব হ’ল, যা মার্কসবাদ, সমাজতন্ত্র ও কমিউনিজমের মতবাদ দ্বারা পশ্চিম ইউরোপের শিল্পকে নয়, কিন্তু তার ব্যক্তি মালিকানাকে চ্যালেঞ্জ করল। এইভাবে পশ্চিম ইউরোপের পৃথিবীব্যাপী আধিপত্য, লুণ্ঠন ও শোষণের অভিযান প্রতিহত হ’ল এবং তার আধিপত্যের এলাকা সংকুচিত হ’তে শুরু করল। মার্কসবাদ পশ্চাৎপদ ও অনুন্নত পৃথিবীর জন্য পশ্চিম ইউরোপের আগ্রাসন থেকে আত্মরক্ষার একটা হাতিয়ার হয়ে দেখা দিল। মার্কসবাদ আধুনিক সভ্যতা ও শিল্পকে তার ভিত্তি হিসাবে নিল, কিন্তু নিল না ব্যক্তি মালিকানাকে। অর্থাৎ এই শিল্প হবে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন। এইভাবে মার্কসবাদের মাধ্যমে অনুন্নত পৃথিবী এমন এক আদর্শ পেল যার দ্বারা তা পশ্চিম ইউরোপের শিল্প, প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানকে নিবে কিন্তু তার ব্যক্তি মালিকানাকে নয়। এইভাবে প্রাচ্য এবং অনুন্নত পৃথিবী ইউরোপের শক্তি নিয়েই ইউরোপকে প্রতিরোধ করার পদ্ধতি পেল যেটা ব্যক্তি মালিকানাকে অবলম্বন ক’রে সম্ভব ছিল না।

 

প্রাচ্যে ব্যক্তি পুঁজির ভূমিকা

আধুনিক পুঁজির উদ্ভব ব্যক্তিগত মালিকানার ভিত্তিতে। সুতরাং এই ব্যক্তি মালিকানাকে প্রাধান্য দিলে এশিয়া বা প্রাচ্য সমাজ পশ্চিম ইউরোপের নিয়ন্ত্রণ ভাঙ্গতে পারে না। প্রাচ্যের উপনিবেশ কিংবা নয়া উপনিবেশে পশ্চিম ইউরোপের নিয়ন্ত্রণ ও সংযোগে শিল্প, কৃষি ও বাণিজ্যে যে মালিক শ্রেণী গড়ে উঠেছে তার স্বার্থ বাঁধা পশ্চিম ইউরোপের উপনিবেশবাদী কিংবা নয়া উপনিবেশবাদী পুঁজিপতি শ্রেণীর সঙ্গে। এই রকম এক ব্যবস্থার প্রয়োজনে ও তার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে প্রাচ্যে যে উপনিবেশিক ও নয়া উপনিবেশিক রাষ্ট্রগুলি গড়ে উঠেছে সেগুলিও এই শোষণের ব্যবস্থার সংগঠক এবং রক্ষক। সুতরাং ইউরোপের আধিপত্যের শৃংখল ভাঙ্গতে প্রাচ্যকে যে শুধু ইউরোপের হাত থেকে রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা অর্জন করতে হয় এবং ইউরোপের নিয়ন্ত্রণে কিংবা প্রভাবে সংগঠিত রাষ্ট্র কাঠামো ভাঙ্গতে হয় তা-ই নয়, উপরন্তু ইউরোপের শিল্প পুঁজিপতি শ্রেণীর সঙ্গে সম্পর্কিত হয়ে কিংবা তার নিয়ন্ত্রণে যে সম্পত্তিবান ধনিক শ্রেণী গড়ে উঠেছে তাকেও উৎখাত করতে হয় তার সমস্ত মালিকানা বাতিল করে দিয়ে।

এ ছাড়া সাধারণভাবে প্রাচ্যের উপায় নেই। কারণ প্রাচ্য সমাজে ব্যক্তি মালিকানায় এই যে নূতন সম্পত্তিবান ও ধনিক শ্রেণী গড়ে উঠেছে তার দ্বারা উন্নয়ন ও শিল্পায়নের দ্রুতগতি অর্জন অসম্ভব। প্রাচ্য সমাজের দীর্ঘ ঐতিহ্যে ব্যক্তি মালিকানার ও ব্যক্তির ভূমিকা খুব গৌণ। আধুনিক পরিস্থিতিতে এই শ্রেণীর উদ্ভব ও বিকাশ হয়েছে বাইরের প্রভাবে, আশ্রয়ে ও প্রয়োজনে। সুতরাং এই শ্রেণীর মধ্যে ইউরোপের পুঁজিপতি শ্রেণীর কিংবা সেখানকার ব্যক্তির দৃঢ়তা, উৎপাদনশীলতা, স্বাধীনতা ও দেশপ্রেম আশা করাই ভুল। এমন অবস্থায় প্রাচ্যে ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকারী বিত্তবান, সুবিধাভোগী ও পরশ্রমজীবী শ্রেণীসমূহ শ্রমজীবী কৃষক, শ্রমিক এবং অন্যান্য শ্রমজীবী ও উৎপাদক জনগণের উপর স্বৈরাচারী পদ্ধতিতে শাসন ও শোষণ করতে গিয়ে ভূমিকা নেয় পশ্চিম ইউরোপ কেন্দ্রিক পুঁজি ও রাষ্ট্রের অনুগত ভৃত্য ও দালাল হিসাবে।

কাজেই প্রাচ্যের বিত্তবান শ্রেণীসমূহ সমাজের আধুনিকীকরণ, উন্নয়ন ও স্বাধীনতার শক্তি না হয়ে পরিণত হয় সমাজের পশ্চাৎপদতা, অবনতি ও পরাধীনতার শক্তিতে। পশ্চিম ইউরোপে পুঁজিপতি শ্রেণী যেভাবে সমাজের সম্পদ হয়েছে এখানে তার পরিবর্তে ভূস্বামী, শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীরা দেখা দেয় সমাজের দায় হিসাবে।

 

মার্কসীয় সমাজতন্ত্রের ভূমিকা

সুতরাং পশ্চিম ইউরোপের শিল্পতন্ত্রের অগ্রাভিযানকে মোকাবিলা করতে গিয়ে মার্কসবাদের মাধ্যমে প্রাচ্য ও অনুন্নত পৃথিবী এমন এক হাতিয়ার পেল যা প্রাচ্যকে দিল শিল্পতন্ত্র, কিন্তু শিল্পতন্ত্রের নামে পাশ্চাত্যের অধীনতা ও দাসত্ব নয়। এটা সমাজতন্ত্র দ্বারা প্রাচ্যের নিরংকুশ স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে নূতন রূপে ফিরিয়ে আনল। কিন্তু ব্যক্তি মালিকানাহীন এই রাষ্ট্র ব্যবস্থা দ্বারা, কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ ও উদ্যোগ দ্বারা প্রাচ্য অসাধ্য সাধন করল। কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনায় সমাজতান্ত্রিক সমাজগুলি অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে বহু যুগের পশ্চাৎপদতার ব্যবধানকে অতিক্রম ক’রে আরোহণ করল আধুনিক শিল্প ব্যবস্থার উন্নত স্তরে। সমাজতন্ত্র দ্বারা এক একটা পশ্চাৎপদ, দরিদ্র সমাজ হয়ে উঠল উন্নত ও সমৃদ্ধ সমাজ। অথচ এতো স্বল্প সময়ে অবিশ্বাস্য উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন হ’ল না পশ্চিম ইউরোপের মতো সারা পৃথিবীকে লুণ্ঠন ও শোষণ এবং কোটি কোটি মানুষকে হত্যা করার।

মার্কসীয় সমাজতন্ত্র পৃথিবীর এক বিশাল অঞ্চলের বহু সংখ্যক দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিকাশে, শিল্প ও প্রযুক্তির বিকাশে অভূতপূর্ব ভূমিকা রাখল। এইসব দেশের ব্যাপক জনগণ অশিক্ষা, ক্ষুধা, অজ্ঞতা, দারিদ্র্য ও পশ্চাৎপদতাকে দ্রুতগতিতে অতীতের বিষয়বস্তুতে পরিণত করল। কিন্তু মার্কসবাদের প্রতিশ্রুত কমিউনিজম বা সাম্যবাদের শ্রেণীহীন সমাজ তাদের সামনে বাস্তব রূপ নিল না। শত প্রতিশ্রুতি ও ঘোষণা সত্ত্বেও কমিউনিজমের স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে গেল। ১৯৬০ সালে খ্রুশ্চভের নেতৃত্বাধীন সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টি ১৯৮০ সালের মধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়নে সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার এক উচ্চাকাঙ্ক্ষী লক্ষ্য ঘোষণা করল। কমিউনিজমের মূল লক্ষ্য হ’ল এমন এক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা যেখানে রাষ্ট্র বা বল প্রয়োগের সামাজিক ব্যবস্থা থাকবে না এবং প্রত্যেকে নিজ সাধ্য অনুযায়ী কাজ করবে, প্রয়োজন অনুযায়ী পাবে। কিন্তু এই লক্ষ্য অর্জন ’৮০ কেন ’৮৯-তেও সম্ভব হয় নি। খ্রুশ্চভ গেছেন সেই সঙ্গে গেছে ২০ বৎসরে সাম্যবাদ অর্জনের পরিকল্পনার কথাও। যেন এটা মার্কসবাদের কোন ব্যাপার ছিল না, বরং নেহায়েত খ্রুশ্চভ নামে এক খামখেয়ালী নেতার দিবাস্বপ্নের ব্যাপার ছিল।

’৮০ সালের মধ্যে সাম্যবাদ দূরে থাক, প্রত্যেকের প্রয়োজন পূরণ দূরে থাক এখন সোভিয়েত অর্থনীতি এমন এক সংকটে পড়েছে যেখানে জনগণের জীবনের মান রক্ষা করতে তাকে হিমসিম খেতে হচ্ছে। বস্তুত সোভিয়েত অর্থনীতি ও সমাজকে এই সংকট থেকে রক্ষা করার জন্যই গর্বাচভের মতো নেতার প্রয়োজন হয়েছে। শিল্প ও প্রযুক্তিতে সোভিয়েত সমাজতন্ত্র ইউরোপ, আমেরিকা, জাপানের পুঁজিবাদকে হারিয়ে দেবার বদলে বরং উল্টো নিজেই হেরে যাচ্ছে এবং পিছিয়ে যাচ্ছে পুঁজিবাদের তুলনায়। মার্কসবাদের সকল প্রবক্তা ও নেতার ভবিষ্যদ্বাণীকে মিথ্যা ক’রে দিয়ে পুঁজিবাদের শিল্প, অর্থনীতি ও প্রযুক্তি ক্রমবর্ধমান বিকাশের পথে এগিয়ে যাচ্ছে, আর অন্যদিকে উন্নয়নের এক বিরাট মান অর্জন করার পরও সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি ক্রমবর্ধমান অবক্ষয় ও সংকটের আবর্তে তলিয়ে যাচ্ছে। এই সংকট থেকে বাঁচার জন্য চীন, রাশিয়া, পোল্যান্ডসহ বিভিন্ন সমাজতান্ত্রিক দেশকে পুঁজিবাদী পৃথিবীর কাছে ঋণ ও পুঁজি বিনিয়োগের জন্য দ্বারস্থ হ’তে হচ্ছে। এখন শুরু হয়েছে সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোয় বিদেশী ব্যক্তি মালিকানায় পুঁজি বিনিয়োগ। অনেক ক্ষেত্রে দেশের ভিতরের ব্যক্তি পুঁজিকেও গড়ে উঠতে দেওয়া হচ্ছে। অর্থাৎ কমিউনিজম দূরে থাক মার্কসীয় সমাজতন্ত্রকেই রক্ষা করা যাচ্ছে না। নানান ফাঁক দিয়ে এখন ব্যক্তি অর্থনীতির স্রোত ঢুকে যাচ্ছে সমাজতন্ত্রের বুøহে এবং তার জোয়ারে ব্যক্তি মালিকানা বিরোধী মার্কসীয় সমাজতন্ত্রের কাঠামো ভেসে যাবার উপক্রম করেছে।

 

মার্কসীয় সমাজতন্ত্রে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব

মার্কসীয় সমাজতন্ত্রের অর্থনৈতিক সংকটের সঙ্গে এসে যুক্ত হয়েছে জাতিগত সমস্যা এবং রাজনৈতিক অসন্তোষ, যা রূপ নিয়েছে গণতন্ত্রের দাবীতে গণ-আন্দোলন ও অভ্যুত্থানে।

মার্কসবাদের প্রতিশ্রুতি হ’ল ব্যক্তিগত মালিকানার অবসানের সঙ্গে সমস্ত শ্রেণী বৈষম্যের অবসান যেমন হবে তেমন অবসান হবে জাতিতে জাতিতে শত্রুতা ও দ্বন্দ্বও। মার্কসবাদের মূল সূত্র অনুযায়ী ব্যক্তিগত সম্পত্তি প্রথার উদ্ভবই সমাজে শ্রেণীভেদ, শ্রেণী শোষণ ও শ্রেণী শাসনের উৎস। তাই এই ব্যক্তিগত সম্পত্তির উচ্ছেদ দ্বারাই মানব জাতি তার কল্পস্বর্গে পৌঁছতে পারবে। কার্ল মার্কস এবং ফ্রেডারিক এঙ্গেলস কমিউনিস্ট ইশতেহারে বলছেন, “এই অর্থে কমিউনিস্ট তত্ত্বকে এক কথায় প্রকাশ করা চলেঃ ব্যক্তিগত মালিকানার উচ্ছেদ।” সমাজতন্ত্র দ্বারা ব্যক্তিগত মালিকানার উচ্ছেদ করায় এমন এক সমাজ প্রতিষ্ঠিত হবে যেখানে “শ্রেণী ও শ্রেণীবিরোধ সংবলিত পুরানো বুর্জোয়া সমাজের স্থান নিবে এক সমিতি, যার মধ্যে প্রত্যেকটি ব্যক্তিরই স্বাধীন বিকাশ হবে সকলের স্বাধীন বিকাশের শর্ত।” (কমিউনিস্ট ইশতেহার)

এই একই গ্রন্থে মার্কস-এঙ্গেলস বলছেন, “যে পরিমাণে ব্যক্তির উপর অন্য ব্যক্তির শোষণ শেষ করা যাবে, সেই অনুপাতে এক জাতি কর্তৃক অপর জাতির শোষণটাও বন্ধ হয়ে আসবে। যে পরিমাণে জাতির মধ্যে শ্রেণী বিরোধ শেষ হবে, সেই অনুপাতে এক জাতির প্রতি অন্য জাতির শত্রুতাও মিলিয়ে যাবে।”

কিন্তু ইতিহাসের কী পরিহাস, মার্কস-এঙ্গেলস-এর সমস্ত সিদ্ধান্তকে নাকচ ক’রে দিয়েই বিপ্লবের প্রায় পৌনে এক শতাব্দী পর সোভিয়েতে আজ জাতিগত অসন্তোষ, দাঙ্গা ও সংঘাত আত্মপ্রকাশ করেছে। শুধু তাই নয়, সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীন রাষ্ট্রদ্বয়ের মধ্যে সীমান্ত যুদ্ধ খুব বেশী দিন আগের কথা নয়। আর চীন ও ভিয়েতনামের মধ্যে সীমান্ত সংঘর্ষ তো এখনও ঘটে। অর্থাৎ মার্কসবাদ আর যা-ই পারুক জাতিতে জাতিতে দ্বন্দ্ব ও সংঘাত মিলিয়ে দিতে পারে নি, যেমন পারে নি সমাজতান্ত্রিক সমাজেও ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির দ্বন্দ্ব এবং শ্রেণী ও শ্রেণীদ্বন্দ্বের অবসান ঘটাতে।

মার্কসবাদের প্রতিষ্ঠাতা মার্কস ও এঙ্গেলস ধারণা করেছিলেন যে, অর্থনীতি বা উৎপাদনে ব্যক্তি মালিকানার উদ্ভব থেকে সমাজে শ্রেণীভেদ শুরু হয়। মার্কসবাদের মতে এই শ্রেণীভেদের পূর্বে সমাজে ছিল সার্বিক সাম্য। সেখানে কেউ কাউকে শাসন কিংবা শোষণ করত না। এই সাম্যবাদী সমাজ সম্পর্কে ফ্রেডারিক এঙ্গেলস তাঁর বিখ্যাত রচনা “পরিবার, ব্যক্তিগত মালিকানা ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি”-তে বলছেন, “পূর্ববর্তী সকল স্তরে সমাজের উৎপাদন ছিল মূলত সমষ্টিগত এবং সেই মত ভোগদখলও হ’ত সাম্যতান্ত্রিক ছোট বড় গোষ্ঠীর মধ্যে উৎপন্ন দ্রব্যাদি প্রত্যক্ষভাবে বণ্টন ক’রে। এই সমষ্টিগত উৎপাদন অত্যন্ত সংকীর্ণ গণ্ডীর মধ্যে চলত, কিন্তু সেই সঙ্গে উৎপাদকরা তাদের উৎপাদন প্রক্রিয়া এবং উৎপন্ন বস্তুর মালিক ছিল। তারা জানত উৎপন্ন দ্রব্য কোথায় গেল, তারা নিজেরাই ভোগ করত, ঐ জিনিস তাদের হাতছাড়া হ’ত না; এবং যতদিন এই ভিত্তিতে চলে, ততদিন তা উৎপাদকদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে যেতে পারে না এবং তাদের বিরুদ্ধে কোন বিজাতীয় ভৌতিক শক্তিও দাঁড় করাতে পারে না, যা নিয়মিত এবং অনিবার্য হয়ে উঠেছে সভ্যতার যুগে।

“কিন্তু ধীরে ধীরে উৎপাদনের এই প্রক্রিয়ার মধ্যে শ্রম-বিভাগ ঢুকে পড়ল। এতে উৎপাদন ও দখলির সমষ্টিগত প্রকৃতি ক্ষুণ্ন হ’ল  কেমন ক’রে হ’ল সেটা আমরা আগে দেখেছি। ক্রমশ পণ্য উৎপাদনই হয়ে পড়ে প্রধান রূপ।”

এইভাবে এঙ্গেলস সমাজে শ্রেণীভেদের উদ্ভবের এবং শোষণেরও উদ্ভবের প্রক্রিয়ার ব্যাখ্যা দিচ্ছেন। যেহেতু শ্রম-বিভাগ দ্বারা উৎপাদনের উপর ব্যক্তিগত দখল শ্রেণীভেদ ঘটাচ্ছে সেহেতু উৎপাদনের উপায়গুলির উপর থেকে ব্যক্তিগত মালিকানার অবসান হলে সমাজ থেকে বিলুপ্ত হবে শ্রম-বিভাগ, শ্রেণীভেদ ও শোষণ। ফলে দূর হবে এক শ্রেণীর সঙ্গে আরেক শ্রেণীর দ্বন্দ্বও।

কিন্তু এই দ্বন্দ্বের কি অবসান হয়েছে মার্কসীয় সমাজতান্ত্রিক সমাজগুলিতে? আজ দেখা যাচ্ছে রাষ্ট্রযন্ত্রকে অবলম্বন ক’রে রাষ্ট্রীয় আমলাতন্ত্র তথা রাষ্ট্রীয় কর্মচারীরা এবং সেই সঙ্গে তাদের রাজনৈতিক-সামাজিক মুখপাত্র স্বরূপ কমিউনিস্ট পার্টির নেতারা শ্রমজীবী ও সাধারণ জনগণের বিপরীতে শাসক ও শোষকদের একটা নূতন শ্রেণী গঠন করেছে। এই শাসক শ্রেণীর সঙ্গে জনগণের বিভিন্ন অংশের দ্বন্দ্ব ও সংঘাত আজ আর গোপন কোন ঘটনা হয়ে থাকছে না। এতোদিনের সমস্ত সতর্ক ও লৌহ কঠিন আয়োজনকে ভেঙ্গে বাঁধভাঙ্গা জলস্রোতের মতো এখন সমাজতান্ত্রিক চীন, সোভিয়েত ও পূর্ব ইউরোপের সমাজগুলির অভ্যন্তরীণ শ্রেণী ও অন্যান্য দ্বন্দ্ব আত্মপ্রকাশ করেছে।

 

ব্যক্তি মালিকানা ও শোষণ

ব্যক্তিগত মালিকানাকেই সকল শোষণ ও শাসনের মূল কিংবা একমাত্র উৎস হিসাবে চিন্তার মধ্যেই রয়েছে ভ্রান্তি। তাই মার্কসবাদ এই সত্য ধরতে পারেনি যে, ব্যক্তিগত মালিকানাহীন সমাজ কিংবা রাষ্ট্রও হ’তে পারে শোষণ ও শাসনের একমাত্র উৎস। মার্কস বলছেন যে, উদ্বৃত্ত মূল্য আত্মসাৎ দ্বারা পুঁজিপতি শ্রেণী শ্রমিক শ্রেণীকে শোষণ করে। এইভাবে সঞ্চয় করে পুঁজি। পুঁজিবাদী রাষ্ট্র এই উদ্বৃত্ত মূল্য আত্মসাতের ব্যবস্থাকেই রক্ষার প্রয়োজনে গড়ে ওঠে।

কিন্তু এই একই কাজ কি করে না সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রও? উদ্বৃত্ত মূল্য আত্মসাৎ ছাড়া সমাজে পুঁজি সঞ্চয়ই বা হবে কিভাবে আর এই পুঁজি সঞ্চয় ছাড়া সমাজে উৎপাদন ও পুনরুৎপাদনের প্রক্রিয়াও বা কিভাবে অব্যাহত থাকবে? শ্রমিকরা যা-ই উৎপাদন করুক সবাইকে তা সমভাবে বণ্টন ক’রে দেওয়া যায় না। এই সমতার মানদণ্ড কিভাবে নির্ধারণ করা হবে সেটাও একটা প্রশ্ন। তবু ধরে নেওয়া গেল যে, এই রকম একটা বিমূর্ত আদর্শ মানদণ্ড খুঁজে পাওয়া গেল এবং সেই অনুযায়ী সমগ্র সমাজের সমস্ত কর্মী সদস্যকে সকল উৎপন্ন বস্তু সমভাবে বণ্টন ক’রে দেওয়া হল। সুতরাং কোন ব্যক্তি পুঁজিপতির যেমন পুঁজির সঞ্চয় থাকল না তেমন কোন সমাজতান্ত্রিক সমাজ বা রাষ্ট্রের হাতেও থাকল না কোন সঞ্চয়। এমন অবস্থায় সমাজে পুনরুৎপাদনের কেন্দ্রীয় শক্তি বিলুপ্ত হবে বলে পুনরুৎপাদনও আর সম্ভব হবে না। অর্থাৎ সমাজে উৎপাদন প্রক্রিয়া থেমে যাবে। কাজেই মার্কস যেটাকে শোষণ বলছেন সেটা হচ্ছে সমাজের উৎপাদন প্রক্রিয়ার অপরিহার্য এক উৎস। শোষণের প্রক্রিয়া, বস্তুত, উৎপাদনেরই প্রক্রিয়া।

সুতরাং সমস্যাটা পুঁজির সঞ্চয় কিংবা উদ্বৃত্ত মূল্য শোষণ ঠেকাবার নয়। ব্যক্তি মালিকানাধীন পুঁজিবাদে এই কাজ ব্যক্তি পুঁজিপতি করে, আর সমাজতন্ত্রে এই কাজ রাষ্ট্র করে। বরং ব্যক্তি পুঁজিবাদে অর্থনীতির কেন্দ্র ও রাষ্ট্র পরিচালনার কেন্দ্র এক হাতে কেন্দ্রীভূত হয় না বলে শ্রমজীবী বা উৎপাদক জনগণ পুঁজির পরিচালক পুঁজিপতি শ্রেণীর সঙ্গে রাষ্ট্রের পরিচালক আমলাতন্ত্রের পার্থক্য ও দ্বন্দ্বকে ব্যবহার ক’রে অনেক অধিকার অর্জন করতে পারে। এখানে পুঁজি ও রাষ্ট্র একীভূত না হওয়ায় পুঁজির সঙ্গে রাষ্ট্রের একটা দূরত্ব ও দ্বন্দ্ব থাকে। এর ফলে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার ও প্রতিষ্ঠানসমূহ বিকাশ লাভ করতে পারে। এটা ঠিক যে, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের উপর পুঁজির নিয়ন্ত্রণ থাকে। কিন্তু সেটা এককেন্দ্রীভূত পুঁজির নয়। কারণ পুঁজির থাকে বহু সংখ্যক মালিক। এই মালিকরা নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতার কারণে এবং রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় শক্তি আমলাতন্ত্রকে নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে জনগণের উপর নির্ভরশীল হ’তে বাধ্য হয়। এই অবস্থায় ব্যক্তি মালিকানা থেকে যেমন ব্যক্তিগত স্বাধীনতা ও অধিকারের ভিত্তি সংরক্ষিত হ’তে পারে তেমন রাষ্ট্রের নিরংকুশ আধিপত্যও প্রতিহত হয় বলে ব্যক্তির অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশের সুযোগ থাকতে পারে। এইভাবে গড়ে উঠতে পারে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, যা পুঁজি সঞ্চয় এবং পুনরুৎপাদনের সুফলকে শুধু পুঁজিপতি শ্রেণীর হাতে কেন্দ্রীভূত হ’তে না দিয়ে জনগণের কাছেও নিয়ে যাবার পথ ক’রে দেয়।

কিন্তু মার্কসীয় সমাজতন্ত্রে পুঁজি ও রাষ্ট্র একীভূত। সমাজ কেন্দ্র থেকে ভিন্ন কোনও অর্থনৈতিক বা উৎপাদক শ্রেণীর অস্তিত্ব বিলুপ্ত করতে গিয়ে মার্কসবাদ উৎপাদনের সমস্ত উপায়কে নিয়ে যায় রাষ্ট্রের হাতে। এঙ্গেলস তাঁর “কল্পস্বর্গ ও বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র”-এ বলছেন, “প্রলেতারিয়েত রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল ক’রে উৎপাদনের উপায়কে পরিণত করে রাষ্ট্রীয় সম্পত্তিতে।

“কিন্তু তা করতে গিয়ে প্রলেতারিয়েত হিসাবে তার আত্মাবসান ঘটে, লুপ্ত হয় সমস্ত শ্রেণী-বৈশিষ্ট্য ও শ্রেণী বৈরিতা, রাষ্ট্রের রাষ্ট্র হিসাবে যে অস্তিত্ব তা বিলুপ্ত হয়।”

মার্কসবাদী সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব দ্বারা প্রলেতারিয়েত বা সর্বহারা শ্রেণীর নামে কমিউনিস্ট পার্টি কিংবা মার্কসবাদী রাজনৈতিক দল রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল ক’রে উৎপাদনের উপায়কে পরিণত করে রাষ্ট্রীয় সম্পত্তিতে।

কিন্তু তা করতে গিয়ে সর্বহারা শ্রেণী হিসাবে তার আত্মাবসান ঘটাতে পারে কতোটুকু? কারণ সর্বহারা শ্রেণীর নেতৃত্বে এই কাজ হয় না, হ’তে পারে না। এটা সর্বহারা শ্রেণীর নামে যারা করে তারা হ’ল একদল পেশাদার বিপ্লবী বুদ্ধিজীবী কর্মী। তারা বড়জোর সর্বহারা শ্রেণীকে নিজেদের নেতৃত্বাধীনে নিয়ে এবং তাদের সহযোগিতায় তাদের নামে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করতে পারে। এরপর তারা উৎপাদনের সমস্ত উপায়কে রাষ্ট্রীয় সম্পত্তিতে পরিণত ক’রে যেটা করতে পারে সেটা হ’ল সমগ্র জনগণের উপর নিজেদের এবং রাষ্ট্রীয় কর্মচারীদের নিরংকুশ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা।

কাজেই এঙ্গেলসের ধারণা অনুযায়ী “তা করতে গিয়ে” কমিউনিস্ট পার্টির যেমন আত্মাবসান ঘটে না তেমন লুপ্তও হয় না “সমস্ত শ্রেণী বৈশিষ্ট্য ও শ্রেণী বৈরিতা, রাষ্ট্রের রাষ্ট্র হিসাবে যে অস্তিত্ব তা”। বরং মার্কসীয় সমাজতন্ত্রে যতো দিন যায় ততো শক্তিশালী ও কায়েমী হয় কমিউনিস্ট পার্টি, জনগণ থেকে বাড়ে তার দূরত্ব। সর্বহারা শ্রেণীর একনায়কত্বের নামে এই দলের ও দলীয় নেতৃত্বের একনায়কত্ব চেপে বসে জনগণের উপর এবং ক্রমেই শক্তিশালী ও নির্মম হয়। যেহেতু গণবিপ্লব দ্বারা কমিউনিস্ট পার্টিকে ক্ষমতা দখল করতে হয় সেহেতু প্রথম পর্যায়ে যে ব্যাপক গণ-অধিকার ও গণতন্ত্র থাকে, কমিউনিস্ট ব্যবস্থায় তা ক্রমেই সংকুচিত হয় এবং অবশেষে সর্বহারা শ্রেণীর একনায়কত্বের নামে কমিউনিস্ট একনায়কত্বের চাপে ও নির্মম আঘাতে বিলুপ্ত হয়। এইভাবে অধিকার হারিয়ে জনগণ পরিণত হয় দাসে।

কাজেই শ্রেণী বৈশিষ্ট্য ও শ্রেণী বৈরিতা সবই নূতনরূপে আবির্ভূত হয় ও বহাল থাকে। কিন্তু ব্যক্তি স্বাধীনতা থাকে না বলে তাকে আর ভাষায় রূপ দেবার অধিকার থাকে না কারও। অন্যদিকে থাকে না ব্যক্তিগত মালিকানা। ফলে সমস্ত উৎপাদনের উপায় এবং প্রচার মাধ্যম থাকে রাষ্ট্রের এবং পার্টির নিরংকুশ নিয়ন্ত্রণে।

এর ফলে সমাজ একসময় হারায় সৃষ্টিশীলতা। কারণ সৃষ্টিশীলতা আসে ব্যক্তির স্বাধীন চিন্তা ও উদ্যোগ বা কর্ম থেকে। কিন্তু যেখানে রাষ্ট্র অবিরামভাবে সব এক ছাঁচে ঢালাই করে সেখানে স্বাধীন ব্যক্তি এবং চিন্তা কোনটাই থাকে না। ব্যক্তির স্বাধীন চিন্তা থাকে না, উদ্যোগ থাকে না, সমাজের অভ্যন্তরে প্রয়োজনীয় প্রতিযোগিতা থাকে না। ফলে সমাজ হয় বন্ধ্যা। এই বন্ধ্যাত্ব থেকে সমাজে নেমে আসে অবক্ষয়। উদ্ভাবন ও প্রযুক্তির বিকাশ থেমে গিয়ে দেখা দেয় অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক বিশৃংখলা। আজ অধিকাংশ সমাজতান্ত্রিক দেশ এই সমস্যারই সম্মুখীন হয়েছে।

এই রকম এক সমাজে জনগণের ভাগ্যে জোটে গণতন্ত্রের বদলে স্বৈরতন্ত্র এবং রাষ্ট্রের কঠোর শাসন। কিন্তু মার্কসবাদের সূত্র অনুযায়ী সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব দ্বারা সবরকম শাসন এবং এই শাসনের যন্ত্রস্বরূপ রাষ্ট্রেরই ক্রমিক বিলুপ্তি ঘটবার কথা। “পরিবার, ব্যক্তিগত মালিকানা ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি”-তে এঙ্গেলস বলছেন, “অতএব অনন্তকাল থেকে রাষ্ট্রের অস্তিত্ব নেই। এমন সব সমাজ ছিল যারা রাষ্ট্র ছাড়াই চলত, যাদের রাষ্ট্র অথবা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার কোন ধারণাই ছিল না। অর্থনৈতিক বিকাশের একটা বিশেষ স্তরে যখন অনিবার্যভাবে সমাজে শ্রেণী-বিভাগ এল তখন এই বিভাগের জন্যই রাষ্ট্র প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ল। এখন আমরা দ্রুত পায়ে উৎপাদনের বিকাশের এমন একটি স্তরে পৌঁছাচ্ছি যখন এইসব বিভিন্ন শ্রেণীর অস্তিত্ব আর শুধু যে অবশ্য প্রয়োজনীয় থাকবে না তাই নয়, উৎপানের প্রত্যক্ষ বন্ধন হয়েই উঠবে। আগেকার স্তরে যেমন অনিবার্যভাবে তাদের উদ্ভব হয়েছিল তেমনি এখন তাদের পতনও অনিবার্য। তাদের সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রেরও পতন হবে।”

“কল্পস্বর্গ ও বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র”-এ এঙ্গেলস সমাজতন্ত্রে রাষ্ট্রের পরিণতি এভাবে কল্পনা করছেন, “রাষ্ট্র যখন অবশেষে সমগ্র সমাজের সত্যিকার প্রতিনিধি হয়ে দাঁড়ায় তখন তা নিজেকে ক’রে তোলে অনাবশ্যক। অধীনে রাখার মতো কেনো সামাজিক শ্রেণী যেই আর থাকে না, যেই শ্রেণী-শাসন এবং আমাদের উৎপাদন-নৈরাজ্যের ভিত্তিতে দাঁড়ানো ব্যক্তিগত অস্তিত্বের সংগ্রাম ও তদুদ্ভূত সংঘর্ষ ও অনাচারের অবসান হয় অমনি দমন করার মতো কিছুও আর বাকি থাকে না, এবং একটা বিশেষ পীড়ন-শক্তির, একটা রাষ্ট্রের আর প্রয়োজন হয় না। প্রথম যে কাজটার ফলে রাষ্ট্র সত্য ক’রেই নিজেকে সমগ্র সমাজের প্রতিনিধি ক’রে তোলে  সমাজের নামে উৎপাদন উপায়গুলিকে দখল করা  সেইটাই হ’ল একই কালে রাষ্ট্র হিসাবে তার শেষ স্বাধীন কাজ। সামাজিক সম্পর্কের মধ্যে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ ক্ষেত্রের পর ক্ষেত্রে অনাবশ্যক হয়ে উঠতে থাকে এবং তারপর সে নিজে থেকেই মরে যায়; লোক শাসন করার স্থানে আসে বস্তুর ব্যবস্থাপনা এবং উৎপাদন প্রক্রিয়ার পরিচালনা। রাষ্ট্রকে ‘উচ্ছেদ’ করতে হয় না, তা মরে যায়।”

এই একই গ্রন্থে এঙ্গেলস বলছেন, “সামাজিক ক্ষমতা দখল ক’রে প্রলেতারিয়েত তার দ্বারা বুর্জোয়ার হাত থেকে স্খলিত সমাজীকৃত উৎপাদন-উপায়গুলিকে পরিণত করে সাধারণ সম্পত্তিতে। এ কাজের ফলে উৎপাদনের উপায়গুলি এতদিন যে পুঁজিরূপ চরিত্র ধারণ করেছিল তা থেকে প্রলেতারিয়েত তাদের মুক্ত ক’রে তাদের সমাজীকৃত চরিত্রটার পরিপূর্ণ কাজ ক’রে যাবার স্বাধীনতা এনে দেয়। পূর্ব নির্দিষ্ট একটা পরিকল্পনায় সমাজীকৃত উৎপাদন এখন থেকে সম্ভব হয়। উৎপাদনের বিকাশের ফলে তখন থেকে সমাজে বিভিন্ন শ্রেণীর অস্তিত্ব কাল-ব্যতিক্রম হয়ে দাঁড়ায়। সামাজিক উৎপাদন থেকে যে পরিমাণে নৈরাজ্য অন্তর্ধান করতে থাকে সেই পরিমাণে মরে যেতে থাকে রাষ্ট্রের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব। মানুষ অবশেষে নিজেরই সমাজ-সংগঠনের প্রভু হবার সঙ্গে সঙ্গে যুগপৎ হয়ে দাঁড়ায় প্রকৃতির প্রভু, নিজের প্রভু  মুক্ত।”

কিন্তু বাস্তবে কি তেমন কিছু হয়েছে? মার্কসীয় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের বাহাত্তর বৎসর পর রাষ্ট্রের বিলুপ্তির পরিবর্তে সমাজতান্ত্রিক পৃথিবীতেই রাষ্ট্র সবচেয়ে নিরংকুশ, সবচেয়ে প্রবল শক্তি হিসাবে দেখা দিয়েছে। মার্কসবাদের তত্ত্বকে মিথ্যা ক’রে দিয়ে রাষ্ট্র টিকে আছে বহাল তবিয়তে।

তবে হাঁ, গণতন্ত্রের বিলুপ্তির মার্কসবাদী তত্ত্ব বাস্তবায়িত হয়েছে। তবে সেটা মার্কসবাদের ব্যাখ্যা অনুযায়ী গণতন্ত্রের ক্রমাগত পূর্ণতার ফলে তার অপ্রয়োজনীয় হওয়া দ্বারা নয়। বরং উল্টো দিক থেকে তার ক্রম সংকোচন দ্বারা গণতন্ত্র বিলুপ্ত হয়। কমিউজমে কোন শাসন থাকবে না। আর গণতন্ত্র মানে হ’ল শাসন। বুর্জোয়া গণতন্ত্র হ’ল সংখ্যালঘু বুর্জোয়ার শাসন। আর সমাজতান্ত্রিক ঘণতন্ত্র হ’ল সংখ্যাগুরু শ্রমিকের শাসন। কাজেই যখন বুর্জোয়া বিলুপ্ত হয় তখন শ্রেণী-শাসনের প্রয়োজন না হওয়ায় রাষ্ট্র যেমন বিলুপ্ত হয় তেমন বিলুপ্ত হয় শাসনের নির্দিষ্ট ব্যবস্থা গণতন্ত্রও।

“রাষ্ট্র ও বিপ্লব”-এ লেনিন বলছেন, “রাষ্ট্র প্রসঙ্গে চলতি আলোচনায় ক্রমাগত যে ভুলটা করা হয় তার বিরুদ্ধে এঙ্গেলস এখানে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন ও আগের বক্তব্যে আমরা তা কথাচ্ছলে উল্লেখ করে গেছি  যথা, ক্রমাগত ভুলে যাওয়া হয় যে, রাষ্ট্রের বিলোপ মানে গণতন্ত্রেরও বিলোপ, রাষ্ট্র শুকিয়ে মরা মানে গণতন্ত্রেরও শুকিয়ে মরা।

ঐ একই গ্রন্থে লেনিন আরও বলছেন, “গণতন্ত্র যত পরিপূর্ণ হয়, ততই তার নিষ্প্রয়োজন হয়ে ওঠার মুহূর্তটা কাছিয়ে আসে। সশস্ত্র শ্রমিকদের নিয়ে গড়া এবং সঠিক অর্থে যা আর রাষ্ট্র নয়, তেমন ‘রাষ্ট্রটা’ যতই বেশি গণতান্ত্রিক হয় ততই দ্রুত শুকিয়ে মরতে শুরু করে সর্ববিধ রাষ্ট্রপাট।”

কিন্তু বাস্তবে রাষ্ট্র ক্রমবর্ধিতভাবে গণতান্ত্রিক হবার কারণে নয় বরং ক্রমবর্ধিতভাবে স্বৈরতান্ত্রিক হবার কারণে গণতন্ত্র লোপ পায় এবং পেয়েছেও। মার্কসীয় সমাজতন্ত্রে আমরা এক সর্বশক্তিমান রাষ্ট্রসত্তাকে দেখতে পাচ্ছি। এখানে সমাজ জীবনের কোন ক্ষেত্রই রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণের বাইরে নেই। রাষ্ট্রের আমলাতন্ত্র এক প্রবল, পরাক্রান্ত শাসক শ্রেণী হিসাবে সমগ্র সমাজের উপর চেপে বসেছে। কমিউনিস্ট পার্টি হল মূলত এই শ্রেণীরই রাজনৈতিক প্রতিনিধি, যা জনগণের একটা নিরুপায়, বাধ্যতামূলক সমর্থন নিয়ে আমলাতন্ত্র এবং সেই সঙ্গে পার্টির শাসন জনগণের উপর চাপিয়ে রাখে। এই শ্রেণী রাষ্ট্রের হাতে সঞ্চিত পুঁজি বা উদ্বৃত্ত মূল্যের সিংহভাগ ভোগ করে। জনগণের ভিন্ন মত প্রকাশ করার, সংগঠিত হবার, স্বাধীন উদ্যোগ নেবার কোন গণতান্ত্রিক অধিকার নেই, থাকতেও পারে না। কারণ ব্যক্তির স্বাধীন অস্তিত্ব মানেই তো সমাজের কেন্দ্রীয় সংগঠন রাষ্ট্রের নিরংকুশ নিয়ন্ত্রণ বহির্ভূত শক্তির অস্তিত্ব। কিন্তু সেটা এই রকম সর্বাত্মক, সর্বশক্তিমান ও নিরংকুশ সমাজ-সংগঠনের শত্রু। এই ব্যক্তির স্বাধীন অস্তিত্ব কোথায়ও থাকে না ব্যক্তির স্বাধীন বা নিজস্ব অর্থনীতি বা কর্মের কোন ক্ষেত্র না থাকায়, তার স্বাধীন চিন্তা ও মত প্রকাশের নিজস্ব কোন ক্ষেত্র না থাকায়।

সুতরাং মার্কসীয় সমাজতন্ত্রে শেষ পর্যন্ত জনগণের ভাগ্যে জোটে রাষ্ট্রের বিলুপ্তির পরিবর্তে বল প্রয়োগের নিরংকুশ ক্ষমতাসম্পন্ন এক সর্বশক্তিমান, স্বৈরাচারী রাষ্ট্র, যা পুঁজিবাদী দুনিয়াতেও অজানা।

 

শ্রেণী ও রাষ্ট্র সম্পর্কে মার্কসবাদের ভ্রান্তি

শ্রেণী ও রাষ্ট্রের উদ্ভব সম্পর্কে ভ্রান্তিই মার্কসবাদের সকল সংকটের প্রধান উৎস। সুতরাং এই বিষয়টি আমাদের নিকট স্পষ্ট হওয়া দরকার। “পরিবার, ব্যক্তিগত মালিকানা ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি”-তে এঙ্গেলস রাষ্ট্র সম্পর্কে বলছেন, “অতএব রাষ্ট্র কোনক্রমেই সমাজের উপর বাইরে থেকে চাপিয়ে দেওয়া একটা শক্তি নয়; যেমন একে বলা যায় না ‘নৈতিক ধারণার বাস্তব রূপ’ অথবা ‘যুক্তির প্রতিমূর্তি ও বাস্তবতা’ যেমনটি হেগেল দাবী করেছেন। পরন্তু এটি বিকাশের একটি বিশেষ স্তরে সমাজ থেকেই উদ্ভুত; সমাজ যে নিজের ভিতরকার সমাধানহীন বিরোধগুলির মধ্যে একেবারে জড়িয়ে পড়েছে, এমন অনপনেয় দ্বন্দ্বে সে বিভক্ত যার নিরাকরণ করতে সে অক্ষম, এটি তারই স্বীকৃতি। কিন্তু যাতে এইসব বিরোধ, বিরোধী অর্থনৈতিক স্বার্থসম্বলিত শ্রেণীগুলি নিজেদের এবং সমাজকেও নিষ্ফল সংগ্রামের মধ্যে ধ্বংস ক’রে না ফেলে তাই দরকার হ’ল এমন একটি শক্তি যা আপাতদৃষ্টিতে সমাজের ঊর্ধ্বে থেকে এই সংগ্রামকে সংযত করবে, একে ‘শৃংখলার’ চৌহদ্দির মধ্যে রাখবে। এবং এই যে শক্তি সমাজ থেকে উদ্ভূত হয়ে তার ঊর্ধ্বে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে এবং ক্রমাগত সমাজ থেকে পৃথক হতে থাকে, এই শক্তি হল রাষ্ট্র।”

কিন্তু যদি আদিম সমাজে শ্রেণী কিংবা রাষ্ট্র বা তার উপাদান অন্তর্নিহিত না থাকবে তবে তো শ্রেণী ও রাষ্ট্র কোনটাই উদ্ভূত না হয়ে বাইরে থেকে চাপানোই হবে। বস্তুত শ্রেণীহীন ও বলপ্রয়োগহীন আদিম সাম্যবাদী সমাজের ধারণাই ভ্রান্ত। মার্কসবাদ মনে করে যে, আদিতে যখন ব্যক্তিগত সম্পত্তি ছিল না তখন সমাজে শোষণও ছিল না, ফলে ছিল না সমাজে কোন শ্রেণী, শ্রেণীভেদ, শ্রেণীদ্বন্দ্ব এবং বলপ্রয়োগ দ্বারা সামাজিক শৃংখলা তথা সমাজ রক্ষার জন্য কেন্দ্রীয় সামাজিক শক্তিও। মার্কসবাদের ধারণায় এই সমাজে ছিল না অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, অর্থাৎ মানুষের সঙ্গে মানুষের দ্বন্দ্ব। যে কারণে এঙ্গেলস তাঁর “পরিবার, ব্যক্তিগত মালিকানা ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি”-তে বলছেন, “গোত্র-প্রথা এমন একটি সমাজ থেকে উদ্ভূত হয়েছিল যেখানে কোন অভ্যন্তরীণ বিরোধ ছিল না। এই প্রথা কেবলমাত্র এইরূপ সমাজেরই উপযোগী ছিল। জনমত ছাড়া এর কোনো জবরদস্তি শক্তি ছিল না।”১০ কিন্তু ব্যক্তিগত সম্পত্তি এবং শ্রেণীভেদের উদ্ভবের ফলে “গোত্র-প্রথার উপযোগিতা ফুরিয়ে গিয়েছিল। শ্রমবিভাগ এবং তার পরিণাম  সমাজের শ্রেণী-বিভাগ একে ধ্বংস করল। এর জায়গায় এল রাষ্ট্র।”১১

মার্কসবাদের ভ্রান্তি এইখানে যে, তা প্রাচীন গোত্র সমাজের আধুনিক সভ্য সমাজে রূপান্তরকে দেখেছে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের বিপরীতে শুদ্ধতাবাদী ভাববাদী দৃষ্টি থেকে। তাই আদিম সমাজের ভিতরে তা কোন অভ্যন্তরীণ বিরোধ বা দ্বন্দ্ব দেখতে পায় না, ফলে দেখতে পায় না শ্রেণীভেদ এবং আদিম গোত্রেরই রাষ্ট্রে রূপান্তর বা বিকাশকে।

বস্তুত সমাজ থাকলেই সেখানে কোন না কোন রূপে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব এবং ক্ষমতার অসম বণ্টন বা ভাগ থাকে। ক্ষমতার এই বণ্টন বা ভাগ কোন না কোন রূপে দায়িত্ব বা কর্মের বিভাগ থেকে শ্রম-বিভাগ সৃষ্টি করে এবং ক্ষমতার ভেদ দেখা দেয় শ্রেণীভেদ রূপে। এটা ঠিক যে, আদিম সমাজে সভ্য সমাজের মতো ক’রে শ্রেণীভেদ স্পষ্ট ছিল না, কিংবা তা ছিল না এতো জটিল। কিন্তু আদিম সমাজেও নিশ্চয় একটা কর্তৃত্ব ছিল। সমাজের ক্ষমতা, উপজাতি বা গোত্রের ক্ষমতা একটা কেন্দ্রে কেন্দ্রীভূত হ’ত। এই কেন্দ্রে থাকত উপজাতি কিংবা গোত্রের প্রধান এবং যাদুকর, ওঝা, চিকিৎসক, দক্ষ যোদ্ধা, কারিগর ইত্যাদি। সব আদিম সমাজ নিশ্চয় এক ছাঁচে গড়া ছিল না। কোথায়ও হয় তো যোদ্ধা ও বাহুবলে বলীয়ান ব্যক্তি হ’ত সমাজনেতা, কোথায়ও হয়তো তা হ’ত যাদুকর বা ওঝা। কোথায়ও হয়তো একই ব্যক্তি একই সঙ্গে যাদুকর এবং যোদ্ধা হ’ত। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ যেমন ছিল তেমন ছিল মাতৃতান্ত্রিক সমাজও।

এখন যেভাবেই ক্ষমতাসীন হোক আদিম সমাজেও সমাজনেতারা নিশ্চয় সমাজের আর দশজন থেকে বেশী ক্ষমতার অধিকারী ছিল। যদিও তাদের ক্ষমতা ছিল সাধারণভাবে প্রাচীন ঐতিহ্য ভিত্তিক এবং সাধারণ সদস্যদের সম্মতির উপর নির্ভরশীল তথাপি এই ক্ষমতার প্রয়োগ সর্বদা ব্যক্তিনিরপেক্ষ হ’ত এটা ভাববার যেমন কারণ নেই তেমন শক্তিমানের প্রতি উপজাতি বা গোত্রের আনুগত্য কখনই বাধ্যতামূলক হ’ত না এমন বিমূর্ত ও আদর্শ চিরন্তন পরিস্থিতির কথা ভাবাটাও ভাববাদী ও যুক্তিহীন। বস্তুত ক্ষমতার দ্বন্দ্ব সেই প্রাচীন সমাজেও আজকের মতোই ছিল যদিও তার মধ্যে ছিল না এতো জটিলতা, সূক্ষ্মতা ও বুদ্ধির প্রভাব। সেখানেও যে ব্যক্তি বা ব্যক্তিবৃন্দের প্রতিভা কিংবা মনস্তাত্ত্বিক এবং দৈহিক ক্ষমতা উপজাতি বা গোত্রের সদস্যদের নিরাপত্তা বোধকে তৃপ্ত করতে পারত কিংবা তাদের মনে সম্ভ্রম ও আস্থা জাগ্রত করতে পারত সেই ব্যক্তি বা ব্যক্তিবৃন্দই যে সেই সমাজেরও নেতৃত্ব কিংবা কর্তৃত্বের আসন পেত বা দখল করত তাতে সন্দেহের কারণ নেই। এই দখল সর্বদা শান্তিপূর্ণ উপায়ে হ’ত এমন মনে করারও কারণ নেই। গোত্রের শক্তিমান কোনও ব্যক্তির সঙ্গে ক্ষমতা বা নেতৃত্ব নিয়ে গোত্র প্রধানের কখনই দ্বন্দ্ব বা লড়াই হত না এমন কথা ভাববরাই বা কি কারণ আছে? প্রাণী জগতে কর্তৃত্ব বা ক্ষমতা কিংবা সুযোগ নিয়ে যে লড়াই আমরা দেখি মানুষ কি ক’রে সেই নিয়মের বাইরে অবস্থান করবে?

সুতরাং মার্কসবাদ যখন আমাদের সম্মুখে তেমন কোন দ্বন্দ্বহীন সমাজের চিত্র অংকন করে তখন তা হয়ে ওঠে উৎকাল্পনিক, কল্পস্বর্গ।

বস্তুত মার্কসবাদের সমস্যা এইখানে যে, তা ব্যক্তিগত মালিকানার বাইরে সমাজে শ্রেণীভেদের আর কোন উৎস দেখতে পায় না। মার্কসবাদ সবকিছুকে অর্থনীতির ছকে ফেলে বুঝতে ও দেখতে চায় বলে তা ক্ষমতার সমস্যাকে সঠিকভাবে যেমন বোঝে না তেমন এর মীমাংসাও তার কাছে নেই। সুতরাং সমাজ সৃষ্টি দ্বারা যে ক্ষমতা কেন্দ্র সৃষ্টি হয় এবং ক্ষমতা কেন্দ্র যে দায়িত্ব বণ্টন দ্বারা পরিচালক ও পরিচালিত এই দুই শ্রেণীর জন্ম দেয় অর্থাৎ এটাও যে একটা শ্রমবিভাগ সৃষ্টি করে মার্কসবাদ তা মনে করে না।

এটা ঠিক যে, আদিম উপজাতীয় সমাজে আধুনিক ব্যক্তি মালিকানা ছিল না। অর্থাৎ তখনও কৃষি ও পশুপালন আবিষ্কার হয় নি। এমন অবস্থায় কৃষি জমি ও পশু দলের উপর তথা উৎপাদনের উপকরণের উপর ব্যক্তির মালিকানা থাকার কথা নয়। এমন একটা সমাজে যেখানে উদ্বৃত্ত ছিল না এবং যেখানে মানুষ নিরন্তর অভাব ও অনিশ্চয়তার মধ্যে থেকে চারপাশের বৈরী প্রকৃতি ও অন্যান্য উপজাতির বিরুদ্ধে লড়াই করতে বাধ্য হ’ত সেখানে ব্যক্তিগত মালিকানার মাধ্যমে কিংবা আর কোন ভাবে অন্যের শ্রমশক্তি শোষণ ক’রে অলসভাবে কারও বেঁচে থাকার উপায় ছিল না।

কিন্তু এমন একটা সমাজেও আজকের অর্থে না হলেও অর্থনীতি একটা ছিল। তা হ’ল শিকার ও খাদ্য সংগ্রহ নির্ভর অর্থনীতি। এই রকম ব্যবস্থাতেও খাদ্য সংগ্রহের ও নিরাপত্তার জন্য মানুষের হাতিয়ার দরকার হ’ত। ছিল পাথরের হাতিয়ার, তীর-ধনুক, বল্লম ইত্যাদি। হয়তো এগুলি ছিল গোত্রের সবার সম্পত্তি। কিন্তু কোথায়ও যে এগুলিতে ব্যক্তি মালিকানা ছিল না এমন মনে করারও কারণ নেই। তবে এটা ঠিক যে, এগুলির উপর কোনও গোত্রে কিংবা কোনও পরিস্থিতিতে ব্যক্তি মালিকানা যদি থেকেও থাকে তবে তা দিয়ে আজকের অর্থে পরশ্রম শোষণের উপায় ছিল না উদ্বৃত্ত ছিল না বলে। যা পাওয়া যেত তা দিয়ে গোটা দলের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হ’ত। এমন একটা অবস্থায় ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যের মাথা তোলার প্রশ্ন ওঠে না। কারণ চারদিকের প্রচণ্ড প্রতিকুল ও বৈরী পরিবেশে মানুষের বাঁচার প্রধান শর্তই ছিল দলবদ্ধতা এবং উপজাতি বা গোত্রের প্রতি নিঃশর্ত আনুগত্য। গোত্র থেকে বহিষ্কার বা চ্যুতির সাধারণ অর্থ তখন ছিল নিশ্চিত মৃত্যু।

তবে এমন অবস্থায় সুযোগ-সুবিধার তারতম্য হ’তে পারত। গোত্রপতি বা সমাজ নেতারা যে কিছু বেশী সুযোগ-সুবিধা পেত না বা নিত না এমন মনে করার কারণ নেই। বিশেষত যখন তখন নেতা পরিবর্তন নিশ্চয় হ’ত না। সেটা হলে দলই ভেঙ্গে পড়ে। সুতরাং দলবদ্ধতাকে রক্ষা করতে গিয়ে অনেক ক্ষেত্রে তাদেরকে অধিকতর সুযোগ-সুবিধা দিতে হ’ত। এবং সমাজের পরিচালকরাও এমন সুযোগ-সুবিধা নিজেদের কিংবা সমাজ পরিচালনার প্রয়োজনেই গ্রহণ করত।

কিন্তু যে সমাজের উৎপাদন নেই, পুনরুৎপাদন নেই, সেই সমাজে শোষণ হবে কি ভাবে? অন্তত আধুনিক সমাজের অর্থে আদিম সমাজে শ্রম শোষণ ছিল না। উৎপাদন ছিল না, সুতরাং ছিল না পুঁজি সঞ্চয় কিংবা উদ্বৃত্ত মূল্য আত্মসাতের জটিল পদ্ধতি। উৎপাদন করতে হলেই সমাজের কেন্দ্রে কিংবা কোন স্থানে সমাজের সম্পদ বা উৎপন্নের একটা অংশ জমা করতে হয়। এ ছাড়া পুনরুৎপাদনের জন্য পুঁজি পাওয়া যায় না। আদিম যে সমাজে উদ্বৃত্তই ছিল না সেই সমাজে উদ্বৃত্ত আত্মসাৎ কিংবা পুঁজি সঞ্চয় যেমন ছিল না তেমন ছিল না উৎপাদনও।

 

মার্কসবাদ ও অর্থনীতিবাদ

“কল্পস্বর্গ ও বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র”-এ এঙ্গেলস বলছেন, “আদিম পর্যায়গুলি বাদে সমস্ত অতীত ইতিহাসই হ’ল শ্রেণী সংগ্রামের ইতিহাস; সমাজের এই যুধ্যমান শ্রেণীগুলিও চিরকাল উৎপাদন ও বিনিময় পদ্ধতি অর্থাৎ তৎকালীন অর্থনৈতিক অবস্থার ফল; সমাজের অর্থনৈতিক কাঠামোটা থেকেই আসছে আসল বুনিয়াদ, যা থেকে শুরু ক’রে আমরা একটা নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক যুগের আইনী ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান তথা তার ধর্মীয়, দার্শনিক ও অন্যবিধ ভাবনার সমগ্র উপসৌধটার চূড়ান্ত ব্যাখ্যা বার করতে পারি।”১২

এই একই গ্রন্থে এঙ্গেলস আরও বলছেন, “ইতিহাসের বস্তুবাদী বোধের শুরু এই প্রতিজ্ঞা থেকে যে মনুষ্যজীবনের ভরণ-পোষণের উপায়ের উৎপাদন এবং উৎপাদনের পর উৎপাদিত বস্তুর বিনিময়-এই হ’ল সমাজ কাঠামোর ভিত্তি, এবং ইতিহাসে আবির্ভূত প্রতিটি সমাজের ধনবণ্টনের ধরন এবং শ্রেণী ও বর্গে সমাজের বিভাগ কী উৎপাদন হ’ল, কী ভাবে উৎপাদিত হ’ল এবং কী ভাবে উৎপন্নের বিনিময় হ’ল তার উপর নির্ভরশীল। এই দৃষ্টিভঙ্গী থেকে সমস্ত সামাজিক পরিবর্তন ও রাজনৈতিক বিপ্লবের শেষ কারণের সন্ধান করতে হবে মানুষের মস্তিষ্কে নয়, চিরন্তন সত্য ও ন্যায় নির্ণয়ে কোনো ব্যক্তির উন্নততর অর্ন্তদৃষ্টির মধ্যে নয়, উৎপাদন পদ্ধতি ও বিনিময়ের ধরনের পরিবর্তনের মধ্যে। তার সন্ধান করতে হবে দর্শনের মধ্যে নয় অর্থনীতির মধ্যে।”১৩

মার্কসবাদের ভ্রান্তির উৎস এঙ্গেলসের উপরোক্ত বক্তব্যেই নিহিত। এটা ঠিক যে, যাঁরা দর্শন কিংবা মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মধ্যে সমাজের যাবতীয় সূত্র সন্ধান করেন তাঁদের তুলনায় মার্কস-এঙ্গেলস ছিলেন সত্যের অনেক বেশী কাছাকাছি। কারণ মানুষের জীবনের বৈষয়িক অবস্থা ও ক্রিয়াই শেষ পর্যন্ত মানুষের চেতনাকে নিয়ন্ত্রণ ও প্রভাবিত করে। কিন্তু শুধু অর্থনীতির উপর জোর দিতে গিয়ে মার্কসবাদ হয়েছে একপেশে।

মার্কসবাদ যে শুধু অর্থনীতি থেকেই যাত্রা শুরু করে তা-ই নয়, উপরন্তু সব কিছুকেই শেষ পর্যন্ত নিয়ে যায় অর্থনীতির অধীনে। মার্কসবাদের মতে সমাজ ও তার সবকিছু অর্থনীতি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ও অর্থনীতির প্রয়োজন থেকে উদ্ভূত। “কার্ল মার্কসের সমাধি পার্শ্বে বক্তৃতা”-য় এঙ্গেলস বলছেন, “ডারউইন যেমন জৈব প্রকৃতির বিকাশের নিয়ম আবিষ্কার করেছিলেন তেমনি মার্কস আবিষ্কার করেছেন মানুষের ইতিহাসের বিকাশের নিয়ম, মতাদর্শের অতি নীচে এত দিন লুকিয়ে রাখা এই সহজ সত্য যে, রাজনীতি, বিজ্ঞান, কলা, ধর্ম ইত্যাদি চর্চা করতে পারার আগে মানুষের প্রথম চাই খাদ্য, পানীয়, আশ্রয়, পরিচ্ছদ, সুতরাং প্রাণধারণের আশু বাস্তব উপকরণের উৎপাদন এবং সেইহেতু কোনো নির্দিষ্ট জাতির বা নির্দিষ্ট যুগের অর্থনৈতিক বিকাশের মাত্রাই হ’ল সেই ভিত্তি যার উপর গড়ে ওঠে সংশ্লিষ্ট জাতিটির রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, আইনের ধ্যান-ধারণা, শিল্পকলা, এমনকি তাদের ধর্মীয় ভাবধারা পর্যন্ত এবং সেই দিক থেকেই এগুলির ব্যাখ্যা করতে হবে, এতদিন যা করা হয়েছে সেভাবে উল্টো দিক থেকে নয়।”

বস্তুর অর্থনীতির উপর এই অতিরিক্ত গুরুত্ব দিতে গিয়ে যেটি দৃষ্টির আড়াল হয়েছে সেটি হ’ল অর্থনীতি এবং বিজ্ঞান, কলা, ধর্মসহ জীবনের যাবতীয় উপকরণ সংগঠনে ও সংরক্ষণে সমাজ-সংগঠনের ভূমিকা। এমনকি যখন এই উৎপাদন ছিল না তাই ছিল না উৎপাদনের উপর সামাজিক কিংবা ব্যক্তিগত কোনও ধরনের নিয়ন্ত্রণ কিংবা মালিকানা তখনও ছিল সমাজ-সংগঠন। আর সমাজ-সংগঠন সমাজের সদস্যদের ঊর্ধ্বে একটি ভিন্ন বা পৃথক শক্তির অস্তিত্ব অনিবার্য করে। এই পৃথক শক্তিই হ’ল সমাজের কতৃêত্ব বা ক্ষমতা। এটা সমাজ থেকে উদ্ভুত। কিন্তু সমাজের সকল সদস্য একে সমভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। অর্থাৎ সবার নিকট ক্ষমতা সমভাবে বণ্টিত হয়ে থাকে না। এটি থাকে একটি প্রধান কিংবা একক কেন্দ্রে কেন্দ্রীভূত হয়ে। সমাজের সাধারণ সদস্যদের কাছ থেকে কম বা বেশী ক্ষমতা নিয়েই এই কেন্দ্র সৃষ্টি হয়। এই ক্ষমতা কেন্দ্র স্বেচ্ছামূলকভাবে সৃষ্টি বা বিকশিত নাও হ’তে পারে। এর উপর নিয়ন্ত্রণ নিতে কিংবা রাখতে পারলে সমাজ নেতাদের পক্ষে সমাজকে পরিচালনা করা সম্ভব হয়। স্বাভাবিকভাবে যারা ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করে তারা দায়িত্ব, কর্ম ও ক্ষমতার অবস্থানে সমাজের সাধারণ সদস্যদের থেকে কিছু না কিছু পরিমাণে হলেও ভিন্ন বা স্বতন্ত্র হয়। তাদের ক্ষমতাই তাদেরকে সমাজের অন্যদের থেকে একটা ভিন্নতা বা দূরত্ব দেয় যেটা সব সময় দৃশ্যমান নাও হ’তে পারে।

আমাদের বুঝতে হবে যে, যেটাকে পরবর্তী যুগের শ্রম-বিভাগ ও শ্রেণীভেদ বলা হচ্ছে সেই শ্রম-বিভাগ ও শ্রেণীভেদের ভ্রূণ কিংবা বীজ ছিল সমাজ-সংগঠনের ভিতরে ক্ষমতা ও দায়িত্বের বিভাগ ও ভেদের মধ্যে। অর্থাৎ আজকের রূপে না হলেও ভিন্ন রূপে ছিল শ্রেণী, শ্রেণীভেদ ও শ্রেণীদ্বন্দ্বও। যখন শ্রেণীভেদ ও শ্রেণীদ্বন্দ্ব উৎপাদনের উন্নত রূপকে অবলম্বনকে ক’রে দাঁড়াতে পারে নি তখন এটা দাঁড়িয়ে ছিল সমাজ-সংগঠনে নির্দিষ্ট ক্ষমতা ও দায়িত্ব বা কর্মকে অবলম্বন ক’রে।

এই আদিম উপজাতীয় বা গোত্র সমাজে সমাজপতিদের শাসন বা বলপ্রয়োগ ছিল না এমন কল্পস্বর্গীয় ধারণা আসে কিভাবে? গোত্রের শৃংখলা রক্ষার প্রয়োজনে মৃত্যুদণ্ড, প্রহার কিংবা বহিষ্কারের প্রয়োগ ছিল না এমন আদর্শ স্বর্গীয় পরিস্থিতি আমরা কল্পনা করতে পারি না। এই শাস্তি কার্যকর কিংবা প্রস্তাব করার মূল শক্তিই গোত্র প্রধান। সেখানে যতোই সামাজিক সম্মতি বা মতের গুরুত্ব থাক এটা তো শাসনেরই নামান্তর। এবং এখানে নিশ্চয়, সকলে সর্বদা একমত নাও হ’তে পারত। সুতরাং সংখ্যাগুরু সংখ্যালঘুর ব্যাপার সেখানেও ছিল। তাছাড়া সর্বদা গণতান্ত্রিক পদ্ধতি কার্যকর ছিল আদিম মানুষ সম্পর্কে এমন মহৎ ধারণার আরোপ কি ভাববাদ নয়? বলবান কিংবা ধূর্ত উচ্চাকাঙ্খীর অভাব কি শুধু সেই যুগেই ছিল? হাতীর দলে, মহিষের দলে যখন কর্তৃত্ব নিয়ে লড়াই চলে তখন আদিম সমাজে বলবান কোন পুরুষ তেমন পন্থার আশ্রয় কখনই নিত না এটা মনে করার কি কারণ আছে? আর জবরদখলকারী বলবানের কর্তৃত্ব বা নেতৃত্ব কখনই মানত না এমন সচেতন মানব সমাজ আদিম কালে সর্বদাই ও সর্বত্রই ছিল এমন শুদ্ধ চিন্তাই বা আসে কি ক’রে? তখনও যে উচ্চাকাঙ্ক্ষী ও ক্ষমতালোভী মানুষ ছিল না তেমন হ’তে পারে না। আজকের মতো ক’রে না হোক সে যুগের মতো করেই তার ক্ষমতার লোভ ও উচ্চাকাঙ্ক্ষা প্রকাশ পেয়ে থাকবে। যার পেশীবল কম ছিল কিন্তু বুদ্ধি এবং ক্ষমতার আকাঙ্ক্ষা ছিল সেও নিশ্চয় তার বুদ্ধিকে তখনকার পরিস্থিতি অনুযায়ী প্রয়োগ করত। মানুষের অন্ধ বিশ্বাস ও অলৌকিক শক্তির প্রতি বিশ্বাস, আস্থা ও ভয়কে ব্যবহার করার মতো মানুষের অভাব শুধু সে কালেই ছিল এমন নয়। এগুলোও হ’তে পারত উচ্চাকাঙ্ক্ষীর ক্ষমতা দখলের বা রক্ষার হাতিয়ার।

বাস্তবিক আদিম সাম্যবাদী সমাজ সম্পর্কে ধারণাই একটা উৎকল্পনা মাত্র। এই রকম দ্বন্দ্বহীন, “অভ্যন্তরীণ বিরোধহীন” আদিম সমাজের অস্তিত্বের কোন প্রমাণই সত্যিকারভাবে কোথায়ও পাওয়া যায় নি। শুধু যে গোত্রে গোত্রে যুদ্ধ, নরবলি এগুলি ছিল আদিম সমাজের অন্যতম বৈশিষ্ট্য তাই নয় উপরন্তু গোত্রের মধ্যেও কম কিংবা বেশী বিভিন্ন দ্বন্দ্ব তখনকার পরিস্থিতি অনুযায়ী ক্রিয়াশীল ছিল। তবে এটা ঠিক যে, আজকের দৃষ্টিতে দেখলে সেগুলির স্বরূপ বুঝতে অনেক সময় ভুল হ’তে পারে।

এটাও ঠিক যে, আধুনিক জটিল সমাজ ও তার অন্তর্গত ধূর্ত স্বার্থপরতা সেই আদিম সমাজে অকল্পনীয় ছিল। সুতরাং আমরা এটুকু বলতে পারি যে, তখন মানুষ ছিল অনেক সহজ, সরল এবং প্রকৃতির কাছাকাছি। মানুষের জীবনে তখন যে সমস্যা ছিল তা ছিল খুব বেশী রকম দৈহিক ও স্থুল। আজকের মতো এতো সূক্ষ্ম, জটিল ও মানসিক সমস্যা সে যুগে মানুষের অজানা ছিল। মানুষে মানুষে বৈরিতা ও সংঘাত সে যুগেও ছিল যদিও তার প্রকাশ-রূপ আজকের মতো ছিল না। দ্বন্দ্ব ছিল সমাজপতিদের সঙ্গে সমাজের সাধারণ সদস্যদের। দ্বন্দ্ব ছিল গোত্রের এক সদস্যের সঙ্গে আর এক সদস্যের। দ্বন্দ্ব ও সংঘাত ছিল উপজাতি গোত্রের সঙ্গে উপজাতি ও গোত্রের।

সেদিনকার উপজাতীয় সংঘাতই আজকের জাতিতে জাতিতে সংঘাত ও যুদ্ধে রূপ নিয়েছে। মার্কস-এঙ্গেলস যেভাবে দেখেছেন ব্যক্তিগত মালিকানাকে সকল নষ্টের গোড়া হিসাবে সেভাবে দেখাটা ঠিক নয়। তাই তাদের এই ধারণা ঠিক হয় নি যে, “যে পরিমাণে ব্যক্তির উপর অন্য ব্যক্তির শোষণ শেষ করা যাবে, সেই অনুপাতে এক জাতি কর্তৃক অপর জাতির শোষণটাও বন্ধ হয়ে আসবে। যে পরিমাণে জাতির মধে শ্রেণীবিরোধ শেষ হবে, সেই অনুপাতে এক জাতির প্রতি অন্য জাতির শত্রুতাও মিলিয়ে যাবে।”

এ কথা ঠিক যে, আজকের বৃহৎ ও জটিল জাতি সে দিন ছিল না। কিন্তু সেদিনকার প্রধানত রক্তবন্ধন ভিত্তিক সরল ও ক্ষুদ্র উপজাতি বা গোত্রেরই পরিবর্তিত, উন্নত, বিকশিত, জটিল ও বৃহৎ রূপ হ’ল আজকের স্থান বা ভাষাভিত্তিক জাতি। আজকের রাষ্ট্র সেদিন ছিল না। কিন্তু সেদিনকার উপজাতি কিংবা গোত্রের কেন্দ্রীয় সংগঠনই বিবর্তিত ও রূপান্তরিত হয়ে, বিকশিত হয়ে আজকের রাষ্ট্রের চেহারা নিয়েছে। সেদিনকার উপজাতীয় নেতা বা কর্তৃত্বই আজকের সরকার। সেদিনকার উপজাতীয় সংগঠনের বলপ্রয়োগের ক্ষমতাই আজকের রাষ্ট্রের বলপ্রয়োগের ক্ষমতায় রূপান্তরিত।

সেদিন বিপুলায়তন উৎপাদন ও উদ্বৃত্ত ছিল না। কিন্তু সেদিন যারা সমাজকে মেধার জোরে, বাহুবলের জোরে কিংবা মানসিক শক্তির জোরে নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করত তারাই আজকের দিনে অনেক রূপান্তর ও পরির্তনের মধ্য দিয়ে এসে পরিণত হয়েছে পুঁজিপতি, বুদ্ধিজীবী, বিজ্ঞানী, রাজনৈতিক নেতা এবং সামরিক ও বেসামরিক আমলায়।

রাষ্ট্র, জাতি এবং শাসক ও শোষক শ্রেণীর উদ্ভব কিংবা বিকাশকে আমাদের এভাবেই দেখতে হবে নতুবা মার্কসবাদের মতো বস্তুবাদের কথা বলেও ভাববাদের কবলে নিক্ষিপ্ত হ’তে হবে। এই ভাববাদ আড়াল নিয়েছে অর্থনীতিবাদের, অর্থনীতিই সবকিছুকে নির্ধারণ করে এই মতবাদের।

 

মার্কসবাদ ও ভাববাদ

দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের কথা বললেও মার্কসবাদ অন্তর্বস্তুতে ভাববাদী ও দ্বান্দ্বিকতাবিরোধী। দ্বান্দ্বিকতাকে তা ব্যবহার করে। কিন্তু তার লক্ষ্য হ’ল দ্বন্দ্বের ব্যবহার দ্বারা সমস্ত দ্বন্দ্বের চিরন্তন অবসান ঘটানো। তার আদর্শ হ’ল সামাজিক দ্বন্দ্বহীনতা। আদিম সাম্যবাদে শ্রেণীদ্বন্দ্ব ছিল না। কিন্তু এই সাম্যবাদের ভিত্তিতে ছিল অজ্ঞতা ও অভাব। শ্রম-বিভাগ ও শ্রেণীভেদ এসে মানুষের উৎপাদন শক্তির বিপুল বিকাশ ঘটিয়ে তাকে পুনরায় একটা পর্যায়ে সাম্যবাদে ফিরে যাবার পথ ক’রে দিবে। পুনরায় ফিরে আসবে শ্রম-বিভাগহীন, শ্রেণীদ্বন্দ্বহীন সাম্যবাদী সমাজ। তবে এবার তার ভিত্তিতে থাকবে জ্ঞান ও প্রাচুর্য।

“গোথা কর্মসূচীর সমালোচনা”য় কার্ল মার্কস এভাবে কমিউনিস্ট সমাজের কল্পনা করছেন, “কমিউনিস্ট সমাজের উচ্চতর স্তরে, শ্রম-বিভাগের কাছে ব্যক্তির দাসোচিত বশ্যতার এবং তারই সঙ্গে সঙ্গে দৈহিক ও মানসিক শ্রমের পারস্পরিক বৈপরীত্যের যখন অবসান ঘটেছে; শ্রম যখন আর কেবল জীবন ধারণের উপায় মাত্র নয়, জীবনেরই প্রাথমিক প্রয়োজন হয়ে উঠেছে; যখন ব্যক্তির সর্বাঙ্গীন বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে উৎপাদন-শক্তিও বেড়ে গেছে এবং সামাজিক সম্পদের সমস্ত উৎস অঝোরে বইছে  কেবল তখনই বুর্জোয়া অধিকারের সংকীর্ণ দিগন্তরেখাকে সম্পূর্ণ অতিক্রম করা সম্ভব হবে, সমাজ তার কেতনে মুদ্রিত করতে পারবে প্রত্যেকে দিবে তার সাধ্য অনুসারে, প্রত্যেকে পাবে তার প্রয়োজন মতো।”

এখন প্রশ্ন হ’ল উৎপাদনের যতোই বিকাশ হোক মানুষের প্রয়োজন বোধের কি কোন সীমা আছে? মানুষের প্রয়োজনের মানদণ্ড নির্ধারণ কে করবে আর তা করাই বা কি ভাবে সম্ভব? আসলে এ হ’ল স্বর্গরাজ্যের কল্পনা। এ হ’ল বস্তুবাদের বিপরীতে ভাববাদ। মার্কসবাদ সমাজের বিরাজমান দ্বন্দ্বের অবসান ঘটাতে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদকে ব্যবহার করেছে। এই দ্বান্দ্বিক পদ্ধতির প্রয়োগ দ্বারা তা স্বপ্ন দেখে মানুষকে সমস্ত দ্বন্দ্ব ও দুঃখ থেকে মুক্তি দানের। এইভাবে তা একটি বিমূর্ত আদর্শ পরিস্থিতি কল্পনা ক’রে নেয়। তাই মার্কসবাদে বস্তুবাদ হচ্ছে ভাববাদের হাতিয়ার।

মার্কসবাদ হ’ল নিরংকুশতার আদর্শ। তা মানুষের অতীতকে দেখে শ্রেণীদ্বন্দ্বহীন রূপে। ভবিষ্যৎকেও দেখে সেই রূপে। মাঝখানে যে শ্রেণীদ্বন্দ্ব এসেছে তা শ্রম-বিভাগ দ্বারা সৃষ্ট ব্যক্তিগত মালিকানার ফলে। ব্যক্তিগত মালিকানার অবসান হ’লে শ্রম-বিভাগ যেমন দূর হবে তেমন দূর হবে শ্রেণীদ্বন্দ্বও এবং তখন সমাজে শোষণের সঙ্গে দূর হবে শোষণের প্রয়োজনে সৃষ্ট শাসনও। সমাজ থাকবে অথচ থাকবে না শ্রম-কর্ম বিভাগ এবং শাসন, উৎপাদন থাকবে অথচ থাকবে না পুঁজির শোষণ এমন এক আদর্শ সমাজের কল্পনাই হ’ল মার্কসবাদ।

মার্কসবাদ ধরে নিয়েছে সব অর্থনীতি থেকে আসে। সুতরাং সমাজ, রাষ্ট্র সবই তা থেকে আসবার কথা। মার্কসবাদের মতে অর্থনীতির মাত্রা দ্বারা নির্ধারিত হয় একটা সমাজের রাজনীতি, ধর্ম, দর্শন, সংস্কৃতি সবই। কিন্তু যে আদিম সমাজে জটিল অর্থনীতি ও উৎপাদন নেই তার সমাজ-সংগঠন, বিশ্বাস, কর্ম এগুলোর কি ব্যাখ্যা দিবে তা? প্রাণী জগতে তো শুধু মানুষ নয়, বানর, মহিষ, হাতী, গরু, ভেড়া, পাখি, এমনকি পিঁপড়া, মৌমাছিও সমাজ গঠন করে বাঁচবার প্রয়োজনে। এই প্রয়োজন হ’ল বৈরী প্রাণী ও প্রাকৃতিক শক্তির হাত থেকে আত্মরক্ষা করা, বংশ রক্ষা করা এবং খাদ্য সংগ্রহ করা। আবার অনেক প্রাণী সমাজ-সংগঠন ছাড়াই এই প্রয়োজন পূরণ করে একক কিংবা জোড় শক্তির বলে। তবে যেখানেই সমাজ জন্ম নেয় সেখানেই সমাজ-সংগঠন থেকে জন্ম নেয় সামাজিক ক্ষমতা। এই ক্ষমতা যেমন সমাজের অংশ, সমাজের সৃষ্টি তেমন এটা সমাজের ঊর্ধ্বেও একটা শক্তি হয়ে দেখা দেয়। সমাজের ঊর্ধ্বে তার একটা অবস্থান আছে বলেই সমাজকে পরিচালনা করা সম্ভব হয়। সমাজের কেন্দ্রে অবস্থিত ব্যক্তি বা সত্তাকে অবলম্বন ক’রে এই ক্ষমতা সংগঠিত কিংবা পরিচালিত হয়। এই ক্ষমতা দ্বারা সৃষ্টি হয় বাধ্যতা ও আনুগত্য কিংবা উল্টোটাও অর্থাৎ বাধ্যতা ও আনুগত্য সৃষ্টি করে ক্ষমতাকে। অর্থাৎ ক্ষমতার কেন্দ্রীয় শক্তিই মূলত ভোগ করে এই বাধ্যতা ও আনুগত্য এবং অন্তত তার প্রাথমিক ফল।

মার্কসবাদ সমাজের বনিয়াদ হিসাবে ধরে নিয়েছে অর্থনীতিকে। কিন্তু আমরা দেখছি, যে সমাজে উৎপাদন নেই, পুনরুৎপাদন নেই সেখানেও সমাজ-সংগঠন আছে। এটা মানুষের জগতে যেমন প্রাণী জগতেও তেমন। অবশ্য এটা ঠিক যে, সমাজ-সংগঠন বৈষয়িক প্রেরণাতেই গড়ে ওঠে, যার মধ্যে অর্থনৈতিক ক্রিয়ার পূর্ব বা আদি রূপ খাদ্য সংগ্রহ, বাসস্থান নির্মাণ ইত্যাদি যেমন আছে তেমন আছে আত্মরক্ষা ও প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা, প্রজনন ইত্যাদি। আমরা প্রাণী জগৎ ও মানুষ সর্বত্রই দেখতে পাব যে, নির্দিষ্ট ধরনের সমাজ-সংগঠনও প্রভাবিত বা নিয়ন্ত্রণ করে নির্দিষ্ট ধরনের খাদ্য সংগ্রহ পদ্ধতি, আত্মরক্ষা ও প্রজনন ব্যবস্থাকে। এই দিক থেকে বিচার করলে এভাবে বলার ইচ্ছা জাগতে পারে যে, সমাজের অর্থনীতি হচ্ছে সমাজের অধিকাঠামো বা উপসৌধ আর সমাজ-সংগঠন হচ্ছে অর্থনীতির বনিয়াদ বা অবকাঠামো। কিংবা এভাবে বক্তব্য আসতে পারে যে, নির্দিষ্ট ধরনের অর্থনীতি নির্দিষ্ট ধরনের সমাজ-সংগঠনের ফল। কারণ সমাজ-সংগঠন ছাড়া অর্থনীতিই গড়ে তোলা যায় না। আর সমাজ-সংগঠন নির্দিষ্ট ভূ-প্রাকৃতিক ও জৈব পরিবেশ ও পরিস্থিতি, খাদ্য সংগ্রহ, আত্মরক্ষা, প্রজনন ও বংশরক্ষার এক জটিল প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে উদ্ভূত হয়।

প্রকৃতপক্ষে, শুধু অর্থনীতি বা শুধু রাজনীতি কিংবা সমাজ-সংগঠন কোনও একটিকে উৎস বা ভিত্তি হিসাবে চিন্তার মধ্যেই আছে গলদ। অর্থনীতি কিংবা মানুষের বৈষয়িক কর্মাদি যেমন তার সমাজ-সংগঠনকে নিয়ন্ত্রণ করে তেমন সমাজ-সংগঠনও নিয়ন্ত্রণ করে মানুষের বৈষয়িক কর্মাদিকে। সমাজ-সংগঠনের মর্ম হ’ল ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন। এটাকে আরও সহজ ক’রে আমরা বলতে পারি ক্ষমতা। এই ক্ষমতা এবং উৎপাদন উভয়েই উভয়ের একই সঙ্গে কার্য এবং কারণ। সমাজের বনিয়াদ যদি বলতে হয় তবে এই উভয়কে একত্রেই বলা উচিত।

আজকের পরিস্থিতিতে আমরা দেখব অর্থনীতি তথা উৎপাদন প্রক্রিয়া এবং রাজনীতি বা রাষ্ট্র তথা ক্ষমতা প্রক্রিয়া এই উভয়ে মানুষের জীবনের মূল নিয়ামক হিসাবে একটা ভূমিকা পালন করছে। কিন্তু শুধু এই দুইটিই নয়, প্রজনন প্রবৃত্তি বা যৌনতাও মানুষের জীবনের এক অতি শক্তিশালী অন্তর্গত প্রেরণা। বস্তুত সমাজ-সংগঠনে এটি অন্যতম নিয়ামক ও মূল উপাদান। এইভাবে আমরা দেখব মানুষ ও তার জীবন এক অত্যন্ত জটিল প্রক্রিয়ার ফল। একাধিক মৌল উপাদান নিয়েই মানুষের এই জটিল জীবন সংগঠিত। তবে নির্দিষ্ট মুহূর্তে ও নির্দিষ্ট প্রেক্ষিতে একটি উপাদানকেই আমরা সাধারণত প্রধান ভূমিকায় দেখতে পাই। তখন সেখানে সেই উপাদানের বিচার-বিশ্লেষণ ও তার উপর নিয়ন্ত্রণ লাভের বিষয়টি সর্বাধিক গুরুত্ব লাভ করে। কিন্তু তখন আমরা যদি মনে করি যে, সেটাই একমাত্র নির্ণায়ক কিংবা সর্বাবস্থায় প্রধান নির্ণায়ক কিংবা সেটিই সবকিছুর একমাত্র উৎস তাহলে আমাদের চিন্তা বা বিচার পদ্ধতিতে এক মারাত্মক ভ্রান্তির বীজ ঢুকে যায়।

বস্তুত যে কোন একটি একক বস্তু কিংবা ক্রিয়াকে কোন কিছুর একমাত্র ভিত্তি বা উৎস বলার মধ্যে কাজ করে প্রকৃতি বা বস্তু ও তার বিকাশ সম্পর্কেই ভ্রান্ত ধারণা। প্রকৃতির কোন কিছু অবিভাজ্য নয়, অখণ্ড নয়। বস্তুকণার সূক্ষ্মতম যে একককে পরমাণু বলা হয় তাও অবিভাজ্য বা অখণ্ড সত্তা নয়। একই বস্তুর মধ্যে আমরা দেখি দ্বৈত সত্তা এবং বহু সত্তাও। এই সত্তাগুলি পরস্পরকে আকর্ষণ করে বলে বস্তু ঐক্যবদ্ধ ও সংগঠিত হয়। আবার এগুলি পরস্পরকে একই সঙ্গে বিকর্ষণ বা আঘাত করে বলে বস্তু বিভক্ত হয়, ক্ষয়প্রাপ্ত কিংবা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। আমরা একে বলতে পারি বস্তুর পজিটিভ ও নেগেটিভ বৈশিষ্ট্যের পাশাপাশি অবস্থান। একই সঙ্গে একটি বস্তু সৃষ্টি হচ্ছে এবং ধ্বংস হচ্ছে। যখন যে বৈশিষ্ট্য প্রাধান্যে থাকে তখন আমরা সেটিকেই দেখতে পাই। এই প্রক্রিয়ায় বস্তু অবিরাম পরিবর্তিত হয়ে চলে। এটাই তার গতিশীলতা। বস্তুর এই গতির শক্তি তার বাইরে নয় বরং তার ভিতরেই অবস্থিত। বস্তুর অভ্যন্তরীণ ও পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার দ্বারা বস্তু ও শক্তির গতিশীলতা সৃষ্টি হয়। এর জন্য বস্তুর বাইরে আলাদাভাবে অবস্থিত কোন সচেতন শক্তি বা বিশ্বচৈতন্যের প্রয়োজন হয় না। আর এটা সম্ভবও নয়, কারণ শক্তি ও বস্তু বিচ্ছিন্ন সত্তা নয়, এক বস্তুসত্তার দুই বা ভিন্নরূপে প্রকাশ যে বস্তুসত্তা আবার বহুমাত্রিক এবং বহু উপাদান সমন্বিত। এই সত্যের স্বীকৃতিই হ’ল দ্বান্দ্বিক কিংবা দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ।

একটি একক সত্তা বা ক্রিয়াকে কোন সমগ্র সত্তার উৎস বা বনিয়াদ বললে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদকে অস্বীকার করা হয়। তাতে আসে ভাববাদ। কারণ ভাববাদ আশ্রয় করে বস্তু সম্পর্কে শুদ্ধতাবাদী এই ধারণাকে যে, সব এসেছে বিশুদ্ধ চৈতন্যময় এক অবিভাজ্য সত্তা থেকে। যে বস্তুবাদ এই চৈতন্যময় সত্তাকে অস্বীকার ক’রে অচেতন একক বস্তুসত্তাকে ধরে নেয় সকল ক্রিয়ার উৎস সেই বস্তুবাদও নিপতিত হয় এক ধরনের ভাববাদে। প্রয়োগ পদ্ধতির ক্ষেত্রে তা যতোই বস্তুবাদ তথা প্রকৃতির দ্বান্দ্বিক নিয়মকে গ্রহণ করুক অন্তর্বস্তুতে তা ভাববাদীই। অর্থনীতিকে সবকিছুর একমাত্র বা “আসল বনিয়াদ” মনে ক’রে মার্কসবাদ শুদ্ধতার পূজারী এই ভাববাদের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। “সমাজের অর্থনৈতিক কাঠামোটা থেকেই আসছে আসল বনিয়াদ”, “অর্থনৈতিক বিকাশের মাত্রাই হল সেই ভিত্তি যার উপর গড়ে ওঠে সংশ্লিষ্ট জাতিটির রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, আইনের ধ্যান-ধারণা, শিল্পকলা, এমনকি তাদের ধর্মীয় ভাবধারা পর্যন্ত” এই ধরনের বক্তব্য, তাই মার্কসবাদের ভিতরে যে ভাববাদ লুকিয়ে আছে তার মর্মবস্তু হিসাবে, সেই ভাববাদী ভ্রান্তিরই প্রকাশ।

জার্মান ভাববাদী দার্শনিক হেগেল সম্পর্কে এঙ্গেলস তাঁর “কল্পস্বর্গ ও বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র”-এ যা বলছেন তা অনেকাংশে প্রযোজ্য মার্কসবাদ সম্পর্কেও। এঙ্গেলস বলছেন, “নূতন এই জার্মান দর্শন পরিণতি পেল হেগেলের ধারায়। এ ধারায় এবং এইটেই তার বড় গুণ এই সর্বপ্রথম প্রাকৃতিক, ঐতিহাসিক, বুদ্ধিমার্গীয় সমগ্র বিশ্বই উপস্থাপিত হ’ল একটা প্রক্রিয়ারূপে অর্থাৎ, অবিরত গতি, পরিবর্তন, রূপান্তর ও বিকাশরূপে; এবং এই সমস্ত গতি ও বিকাশ যাতে একটা অখণ্ড সমগ্র হয়ে উঠছে সেই অন্তর্নিহিত সম্পর্ক সন্ধানের চেষ্টা হ’ল। কাণ্ডজ্ঞানহীন হিংসাকর্মের এক ঘূর্ণাবর্ত, পরিণত দার্শনিক বুদ্ধির কাছে যার প্রতিটি কর্মই সমান নিন্দার্হ এবং যত শীঘ্র ভোলা যায় ততই ভালো, এভাবে প্রতিভাত না হয়ে এ দৃষ্টিভঙ্গীর কাছে মনুষ্য ইতিহাস প্রতিভাত হ’ল মানুষেরই বিবর্তনের এক প্রক্রিয়ারূপে। বিচিত্র সব পন্থায় এ প্রক্রিয়ায় ক্রমপ্রগতি অনুসরণ করা ও বাহ্যত আকস্মিক সব ঘটনার মধ্যে অন্তর্প্রবাহিত নিয়মটিকে বার করার কাজ এবার বুদ্ধির।

“যে সমস্যা উপস্থিত করা হ’ল তার সমাধান যে হেগেলীয় ধারা দেয় নি, সে প্রশ্ন এখানে অবান্তর। তার যুগান্তকারী কীর্তি হল এই যে সমস্যাটিকে তিনি উপস্থিত করেছেন। এ সমস্যা এমন যে কোনো একক ব্যক্তির পক্ষে তার সমাধান দেয়া অসম্ভব। সেঁ-সিমোঁর মতো হেগেলও যদিও তৎকালের এক অতি বিশ্ব-কৌষিক মনীষা, তথাপি প্রথমত, তাঁর স্বীয় জ্ঞানের অনিবার্য সীমায় এবং তাঁর যুগের জ্ঞান ও বোধের সীমাবদ্ধ প্রসার ও গভীরতায় তিনি সীমিত। এই সীমাবদ্ধতার সঙ্গে তৃতীয় একটি সীমার কথাও যোগ করতে হবে। হেগেল ছিলেন ভাববাদী। তাঁর কাছে তাঁর মস্তিষ্কমধ্যস্থ ভাবনাগুলি সত্যকার বস্তু ও প্রক্রিয়ার ন্যূনাধিক বিমূর্ত চিত্র নয়, বরং উল্টো, বিশ্বেরও পূর্বে অনাদি কাল থেকে কোনো এক স্থানে বর্তমান এক ‘ভাবের’ (Idea) বাস্তবীভূত চিত্রই হল এই বস্তু ও তার বিকাশ। এ ধরনের চিন্তায় সবকিছুই একেবারে উল্টো ক’রে দাঁড় করান হয় এবং বিশ্বের ভেতরকার বস্তুসমূহের আসল সম্পর্কটাকে আমূল বিকৃত ক’রে দেওয়া হয়। আলাদা আলাদা বহু ঘটনাসমষ্টি সঠিকভাবে ও সপ্রতিভায় হেগেল হৃদয়ঙ্গম করলেও সদ্যবর্ণিত কারণে খুঁটিনাটিতে তাতে অনেক কিছুই রয়ে গেছে যা জোড়াতালি, কৃত্রিম, টেনেবুনে করা, অর্থাৎ ভুল। হেগেলীয় ধারাটা একটা বিপুল গর্ভপাত, তবে এ জাতের গর্ভপাত এই শেষ। বস্তুতপক্ষে একটা অন্তনির্হিত ও অনুপশম বিরোধিতায় তা পীড়িত। একদিকে তার মূল প্রতিজ্ঞা হ’ল এই বোধ যে, মানবিক ইতিহাস হ’ল একটা বিবর্তন প্রক্রিয়া, সুতরাং স্বভাবতই কোনো তথাকথিত পরম সত্য আবিষ্কারই তার বুদ্ধিমার্গীয় শেষ কথা হ’তে পারে না। অথচ অন্যদিকে এই পরম সত্যেরই মূলাধার বলে তার আত্মঘোষণা।”১৪

উপরোক্ত বক্তব্যে এঙ্গেলস যেন তাঁদেরই মতবাদের একটি সমালোচনা করেছেন। বস্তুত হেগেলীয় দার্শনিক ধারাই বস্তুবাদ ও রাজনীতির আবরণ নিয়ে এগিয়ে গেছে মার্কসবাদের মাধ্যমে। তাই হেগেলের দার্শনিক শিষ্য মার্কস ও এঙ্গেলসের মার্কসবাদ হেগেলীয় ভাববাদী দার্শনিক ধারার নূতন রূপে সম্প্রসারণ।

 

নিরংকুশ রাষ্ট্রতন্ত্রের দর্শন

বস্তুত মার্কসবাদ দেখা দিয়েছে নিরংকুশ রাষ্ট্রতন্ত্রের দর্শন হিসাবে। সব রকম রাষ্ট্রের বিলুপ্তির লক্ষ্য ঘোষণা করলেও বাস্তবে তা জন্ম দিয়েছে নিরংকুশ রাষ্ট্র। তবে এই রাষ্ট্র অতীতের কৃষি সমাজের রাষ্ট্র নয়। মার্কসবাদ মনে করেছে ব্যক্তিগত মালিকানাই সমস্ত শোষণ ও শাসনের উৎস। মনে করেছে ব্যক্তিগত মালিকানার অবসান হলে শ্রেণীভেদ ও শ্রেণীদ্বন্দ্ব যেমন দূর হবে তেমন বিলুপ্ত হবে সমাজের বলপ্রয়োগের কেন্দ্রীয় সংগঠন রাষ্ট্রও। অর্থাৎ দূর হবে মানুষ কর্তৃক মানুষকে শোষণ, শাসন ও দমন। অর্থাৎ মার্কসবাদ মানুষের বৈশিষ্ট্য বুঝতেই ভুল করেছিল। এবং ক্ষমতার ভূমিকা ও বৈশিষ্ট্য বোঝায় তার গলদ ছিল।

বস্তুত মানুষ সমাজবদ্ধ হয়েই মানুষ হয়েছে। আর সমাজবদ্ধ হ’তে গিয়েই তার যাবতীয় সামাজিক সমস্যারও উদ্ভব হয়েছে। দুইটি মানুষ যতো অভিন্ন স্বার্থ নিয়েই দাঁড়াক না কেন তাদের মধ্যে সত্তার পার্থক্যের কারণে ঐক্যের পাশে থাকে দ্বন্দ্বও। এই দ্বন্দ্ব দেখা দিতে পারে রুচির কারণে, সুবিধার আকাঙ্ক্ষার কারণে, প্রাধান্য লাভের আকাঙ্ক্ষার কারণে। আর সমাজ গঠিত হয় বহুসংখ্যক ব্যক্তি নিয়ে। ফলে এখানে দ্বন্দ্বগুলিও এক জটিল রূপ নিয়ে দেখা দেয়। সামাজিক ঐক্য একটি কর্তৃত্ব সৃষ্টি করে, যা সমাজের শৃঙ্খলা ও অস্তিত্ব রক্ষার দায়িত্ব নেয়। এই কর্তৃত্ব গঠিত হয় মানুষ দ্বারাই। সুতরাং দেখা দেয় সমস্যা। সমাজ যতো নিরংকুশ হয় ততো এই কর্তৃত্ব হয় নিরংকুশ ও স্বেচ্ছাচারী।

সমাজ যখন এক ব্যক্তি এবং সংস্থার নিরংকুশ কর্তৃত্বাধীন হয় তখন সেখানে দেখা দেয় স্বৈরতন্ত্র। তখন কর্তৃত্বকারী ব্যক্তি ও সংস্থার বাইরে আর কারও কোন অধিকার বা ক্ষমতা থাকে না। অধিকার থাকে শুধু কর্তৃত্বকারী ব্যক্তি ও সংস্থাকে দৃঢ়ভাবে ও অন্ধভাবে অনুসরণ করার।

এই স্বৈরতন্ত্র প্রতিরোধের উপায় হ’ল সমাজে প্রধান কেন্দ্রের পাশে আরও কেন্দ্র রক্ষা করা। অর্থাৎ সমাজকেন্দ্র যাতে একমাত্র শক্তি হয়ে নিরংকুশ হবার সুযোগ না পায়। সমাজে সৃষ্টিশীলতা, বিশেষত নূতন সৃষ্টির মূল শক্তি হ’ল ব্যক্তি। এই ব্যক্তির স্বাধীনতার কোনও অস্তিত্ব যদি না থাকে তবে সমাজ হারায় সৃষ্টিশীলতা, হয় বন্ধ্যা। তাছাড়া ব্যক্তির স্বাধীন অস্তিত্ব ছাড়া সমাজে গণতন্ত্রও রক্ষা পায় না। অর্থাৎ স্বৈরতন্ত্রকে প্রতিহত করতে যে বিকল্প কেন্দ্র গঠন করতে হয় তা যদি স্বাধীন ব্যক্তিবৃন্দ দ্বারা গঠিত না হয় তবে সমাজ যেমন স্বৈরতন্ত্রকে প্রতিহত ক’রে গণতান্ত্রিক হ’তে পারে না তেমন হ’তে পারে না সৃষ্টিশীলও।

যে রূপেই আমরা দেখি না কেন সমাজ দাঁড়ায় প্রথাগত শক্তির উপর। সমাজ যখন তখন যেদিক খুশী সেদিক যেতে পারে না। এটা পারে সেই তুলনায় ব্যক্তি। আর নূতন সৃষ্টি মানে ভিন্নতা, নূতনত্ব। এটা মূলত ব্যক্তিরই অবদান। ব্যক্তি অর্থাৎ ক্ষমতা-কেন্দ্র বহির্ভূত ব্যক্তির পক্ষেই সম্ভব সমাজ কর্তৃক সমর্থিত বা অনুসৃত প্রচলিত চিন্তা বা কর্মের বাইরে গিয়ে নূতন চিন্তা, নূতন কর্মধারা সৃষ্টি করা যেটা হয়ে দাঁড়াতে পারে সমাজের ভিতরে সমাজ, এবং সমাজ-সংগঠনের অধীনে সমাজ-সংগঠন সৃষ্টি। এক সময় হয়তো বহু ব্যক্তির গ্রহণ ও অংশগ্রহণ দ্বারা এই নূতন চিন্তা বা কর্মই পূর্ণাঙ্গ সামাজিক রূপ গ্রহণ করে এবং এক সময় এটা পরিণত হয় প্রথাগত সামাজিক চিন্তা ও কর্মে।

সুতরাং ব্যক্তির স্বাধীনতার উপর নির্ভর করে সমাজের অব্যাহত সৃষ্টিশীলতা ও গতিশীলতা। এই ব্যক্তি স্বাধীনতার অন্যতম প্রধান উৎসই হল ব্যক্তিগত সম্পত্তি। ব্যক্তি মালিকানা না থাকলে ব্যক্তি তার স্বাধীন অর্থনৈতিক অস্তিত্বের নিজস্ব ভিত্তি পায় না বলে ব্যক্তি স্বাধীনতাও থাকে না। অবশ্য শুধু ব্যক্তি মালিকানা ব্যক্তি স্বাধীনতার একমাত্র শর্ত নয়। একই সঙ্গে সমাজ কেন্দ্রকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ব্যক্তির মত প্রকাশ করার ও ভিন্ন সামাজিক-রাজনৈতিক সংগঠন গড়ার অধিকারও প্রয়োজন।

বিশেষত জাতি বা সমাজের কেন্দ্রীয় সংগঠন স্বরূপ রাষ্ট্রকে জনগণ কর্তৃক নিয়ন্ত্রণের প্রধান শর্তই হ’ল সমাজে ব্যক্তি মালিকানা ও ব্যক্তি স্বাধীনতার অস্তিত্ব। অর্থাৎ ব্যক্তিগত সম্পত্তির অস্তিত্ব এবং ব্যক্তির স্বাধীন মত প্রকাশ ও সংগঠন গঠনের অধিকার হচ্ছে সমাজ ও রাষ্ট্রে গণতন্ত্রের ভিত্তি।

মার্কসবাদ এই জায়গাটাতেই আঘাত করেছে নিরংকুশ সামাজিক ঐক্য ও সাম্য গড়তে চেয়ে। তাতে শেষ পর্যন্ত সমাজ যেটা লাভ করে সেটা গণতন্ত্র বা সাম্য কোনটাই নয় বরং রাষ্ট্রের নিরংকুশ স্বৈরতন্ত্র। তাই রাষ্ট্র ক্ষমতা লাভ ক’রে মার্কসবাদ দেখা দেয় নিরংকুশ রাষ্ট্রতন্ত্রের দর্শন হিসাবে।

 

উৎপাদন শক্তির বিকাশে ব্যক্তির ভূমিকা

প্রকৃতপক্ষে অতীতেও সমাজে নূতন উৎপাদন শক্তিসমূহের উদ্ভব ঘটেছে ব্যক্তির সৃজনশীলতা ও কম-বেশী স্বাধীন অস্তিত্বের ফলে। তবে প্রাচ্যে ব্যক্তি শেষ পর্যন্ত সমাজ দ্বারা অর্থাৎ সামাজিক কিংবা রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব বা শাসক শ্রেণী কর্তৃক অধিকৃত হয়েছে এবং তার কীর্তি বা সৃষ্টিও সমাজ ও রাষ্ট্রের শাসক আত্মসাৎ করেছে। এখানে সমাজ বিকাশের একটা বিশেষ পদ্ধতি অনুসৃত হয়েছে যেখানে ব্যক্তিকে একান্ত সীমিত রেখে রাষ্ট্র ও সমাজ গতিশীল থেকেছে। তবে ব্যক্তির দুর্বলতা বা সীমাবদ্ধতার জন্য প্রাচ্য সমাজ থেকেছে সুদীর্ঘকাল ধরে স্বৈরতান্ত্রিক ও কম সৃষ্টিশীলও।

এখানকার ভূ-প্রকৃতি এর জন্য যথেষ্ট দায়ী। অতীতে প্রাচ্য সমাজে কৃষির বিকাশ ও সংরক্ষণে জলসেচের যে অতীব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল এবং এই জলসেচের জন্য যে ব্যাপক ও কেন্দ্রীয় সামাজিক নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনার প্রয়োজন ছিল তা এখানে এমন সমাজ ব্যবস্থার উদ্ভব অনিবার্য করে। এখানে হাজার হাজার বৎসর ধরে ব্যক্তি সমাজসত্তার একান্ত অনুগত ও অধীনস্থ। তবে যখন কোন কারণে সমাজ নিয়ন্ত্রণ শিথিল হয়েছে, কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ ভেঙ্গেছে তখন ব্যক্তি মুক্ত হয়েছে, সমাজে নূতন নূতন চিন্তা, শক্তি ও সংগঠনের জন্ম দিয়েছে যেগুলিকে সমাজ ও রাষ্ট্র প্রয়োজনে আত্মস্থ ক’রে নূতন জীবনী শক্তি লাভ করেছে। কিংবা এই নূতন চিন্তা ও সংগঠনকে অবলম্বনকে ক’রে নূতন স্বৈরতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্র সংগঠিত হয়েছে। তাছাড়া একান্ত প্রয়োজন হলে সমাজ বাইরের সমাজ থেকেও ভিন্ন বা নূতন ধারণা কিংবা উপকরণ গ্রহণ করেছে। অর্থাৎ প্রাচ্যে সাধারণভাবে রাষ্ট্র বা সামাজিক কর্তৃত্ব হচ্ছে রাজনীতি ও অর্থনীতির প্রধান নিয়ন্তা।

কিন্তু ইউরোপের অবস্থাটা ভিন্ন। ইউরোপে উৎপাদন শক্তির বিকাশ যে শুধু ব্যক্তি দ্বারা হয়েছে তা-ই নয় উপরন্তু এই ব্যক্তি বেড়ে উঠে এক সময় সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করেছে এবং কেন্দ্রীয় সামাজিক সংগঠন বা রাষ্ট্রকে রূপ দিয়েছে নিজের প্রয়োজন অনুযায়ী। এই ব্যক্তিই গ্রীস ও রোমে সভ্যতার উদ্ভব ঘটিয়েছে এবং সংগঠিত করেছে দাস সমাজ ও রাষ্ট্র। এই ব্যক্তির অর্থনীতি এবং তার ধর্মীয়-সামাজিক সংগঠনের সবল অস্তিত্ব রাষ্ট্রকে তথা কেন্দ্রীয় সামাজিক সংগঠনকে ইউরোপে কখনই এশিয়ার মতো নিরংকুশ বা সর্বশক্তিমান হ’তে দেয় নি। গ্রীস ও রোমে যখন দাস শ্রমভিত্তিক গণতন্ত্র ধ্বংস হ’ল তখনও সেখানে স্বৈরতন্ত্র এশিয়ার মতো প্রবল হ’তে পারে নি। এমনকি ইউরোপ যখন দাস শ্রমভিত্তিক উন্নত নগর সভ্যতা থেকে পিছিয়ে গেল অধিকতর পশ্চাৎপদ কৃষি সমাজে, ভূমি দাসত্বভিত্তিক সামন্ত সমাজে তখনও ইউরোপে রাষ্ট্র ও রাজতন্ত্র এশিয়ায় তার প্রতিপক্ষের মতো নিরংকুশ বা স্বৈরতান্ত্রিক হ’তে পারে নি।

ইউরোপের এই পটভূমিতেই আধুনিক কালের শুরুতে এসে ব্যক্তি মালিকানা ভিত্তিক উৎপাদন ব্যবস্থা মোড় নেয় শিল্প উৎপাদনের দিকে এবং অবশেষে সংগঠিত করে আধুনিক পুঁজিবাদকে, ব্যক্তি মালিকানাভিত্তিক শিল্প ব্যবস্থাকে। আর সামন্তবাদী শাসক শ্রেণীর বিকেন্দ্রায়িত এবং বহুর শাসনের মধ্যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার যে ভ্রূণ ছিল তা বিকশিত ও রূপান্তরিত হয়ে পূর্ণাঙ্গ রূপ নিয়েছে বুর্জোয়াদের নেতৃত্বে আধুনিক গণতন্ত্রে।

গণতন্ত্রেই আমরা ব্যক্তির পূর্ণ ভূমিকা পাই। আর এই ব্যক্তি প্রধানত শাসন বা ক্ষমতা কিংবা রাষ্ট্রের ফসল নয়, তা প্রধানত অর্থনীতি বা উৎপাদনের ফসল। সমাজের বলপ্রয়োগের ক্ষমতা নির্ভর কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রের মূল শক্তি হ’ল আমলাতন্ত্র। সুতরাং যে ব্যক্তি রাষ্ট্রের সংগঠনের ভিতর থেকে উদ্ভূত হয় সে হয়ে ওঠে মূলত আমলাতন্ত্রের প্রতিনিধি বা আমলাতান্ত্রিক এবং রাষ্ট্রযন্ত্র বা আমলাতন্ত্রের মূল বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী সে হয়ে ওঠে কম বা বেশী স্বৈরতান্ত্রিক।

সুতরাং গণতন্ত্রের ব্যক্তির উদ্ভব ঘটে মূলত রাষ্ট্রের কিংবা কেন্দ্রীয় সমাজ-সংগঠনের বাইরে ব্যক্তির স্বাধীন উৎপাদন বা অর্থনীতির মধ্য থেকে কিংবা তার প্রভাব বলয় থেকে। কিন্তু এই স্বাধীন ব্যক্তি-অর্থনীতি ও তার প্রভাব বলয় থেকে উদ্ভূত হ’তে গিয়ে ব্যক্তিকে নিজ নিয়ন্ত্রণে নিতে হয় রাষ্ট্র তথা সমাজের বলপ্রয়োগের কেন্দ্রীয় সংগঠনকে। নতুবা এই ব্যক্তির উত্থান সম্ভব হয় না কিংবা তাকে গ্রাস করে রাষ্ট্র।

কিন্তু ব্যক্তি রাষ্ট্রকে নিজ নিয়ন্ত্রণে নিতে গিয়ে রাষ্ট্রের সঙ্গে একীভূত হলেও পরিণতিতে স্বৈরতন্ত্রই ফিরে আসে। কাজেই গণতন্ত্রে ব্যক্তি রাষ্ট্রকে নিয়ন্ত্রণ যেমন করে তেমন রাষ্ট্র থেকে নিজের স্বাতন্ত্র্য বা দূরত্বও রক্ষা করে। এরই পদ্ধতি হ’ল একদল পেশাদার রাজনীতিকের মাধ্যমে রাষ্ট্রকে নিয়ন্ত্রণে রাখা। নির্বাচনের মেয়াদ ও নির্দিষ্ট পদ্ধতির দরুণ এই রাজনীতিকরা রাষ্ট্রের স্থায়ী শক্তি সামরিক ও বেসামরিক আমলাতন্ত্রের সঙ্গে একীভূত হ’তে পারে না। এই রাজনীতিকরা রাষ্ট্র ও উৎপাদনের মধ্যে একটা সেতু হিসাবে কাজ করে। তবে তারা আমলাতন্ত্রকে যতটা প্রতিনিধিত্ব করে তার চেয়ে বেশী প্রতিনিধিত্ব করে ব্যক্তির অর্থনীতি ও উৎপাদনের শক্তিকে। এবং যেহেতু সংখ্যাগুরু শ্রমজীবী জনগণের সমর্থন বা ভোট নিয়েই তাদেরকে ক্ষমতায় যেতে হয় সেহেতু তারা ব্যক্তি অর্থনীতি ও পুঁজির প্রতিনিধিত্ব যেমন করে তেমন একই সঙ্গে প্রতিনিধিত্ব করে শ্রমজীবী জনগণ তথা শ্রমের শক্তিকেও। এইভাবে গণতন্ত্রে ব্যক্তি-অর্থনীতি ও রাষ্ট্রের দ্বন্দ্ব ও ঐক্যের প্রক্রিয়ায় উভয়ের মাঝখানে তৃতীয় একটা শক্তি হিসাবে বিকাশ লাভ করে পেশা ভিত্তিক রাজনীতি।

গণতন্ত্রের অন্যতম শর্ত ব্যক্তিগত মালিকানার প্রতি মার্কসবাদের আপত্তি এইখানে যে, এর দ্বারা থেকে যায় শ্রেণীভেদ ও শোষণ এবং শাসন। কিন্তু আমরা দেখেছি যে, শোষণ হ’ল উৎপাদন প্রক্রিয়ার এক অপরিহার্য ফল। আর শাসন হ’ল সমাজ প্রক্রিয়ার এক অপরিহার্য ফল। উৎপাদনের সঙ্গে শোষণ এবং সমাজ-সংগঠনের সঙ্গে শাসন এমনইভাবে জড়িত যে, সব রকম শোষণ ও শাসনের চূড়ান্ত অবসান ঘটাবার দাবী করলে সমস্ত উৎপাদন প্রক্রিয়ার অবসান ঘটিয়ে আদিম জৈব সত্তায় প্রত্যাবর্তন এবং সমাজ-সংগঠন বাতিল ক’রে প্রাকৃতিক বিশৃংখলা ও বিচ্ছিন্নতায় বিলীনতার দাবী করতে হয়।

উদ্বৃত্ত মূল্যের তত্ত্ব নিঃসন্দেহে মার্কসের এক ঐতিহাসিক আবিষ্কার। এ দ্বারা তিনি ব্যক্তি পুঁজিপতির শোষেণের পদ্ধতি উদঘাটন করেছেন। কিন্তু এটা একই সঙ্গে প্রযোজ্য স্বয়ং মার্কস প্রকল্পিত সাম্যবাদী সমাজের ক্ষেত্রেও। সেখানেও এই একই কাজ করবে সমাজের শাসক শ্রেণী সমাজের নামে। বাস্তবে মার্কসের প্রকল্পিত সাম্যবাদই বিগত বাহাত্তর বৎসর ধরে প্রয়োগ হয়ে আসছে সোভিয়েত ইউনিয়নে*। অর্থাৎ মার্কসবাদের শ্রেণীহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা, রাষ্ট্রের বিলুপ্তি, শোষণ উচ্ছেদ এসব কিছুই না হয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় আমলা শ্রেণীর পরিচলনায় সমাজের কেন্দ্রীয় সংগঠন রাষ্ট্র কর্তৃক জনগণের শ্রমে সৃষ্ট উদ্বৃত্ত মূল্য শোষণ বা আত্মসাতের পদ্ধতি।

-------------------

* গ্রন্থটি যে সময় লেখা হয় সেই সময়ের হিসাব অনুযায়ী। - লেখক

-------------------

সুতরাং আমাদের উৎকল্পনার পিছনে না ছুটে বাস্তবটাকে খোলা চোখে দেখে সত্যকে গ্রহণ করার শক্তি অর্জন করা উচিত। শ্রেণীদ্বন্দ্বহীন সমাজ কোন দিন ছিল না, কোন দিন হবেও না। তবে হাঁ, দ্বন্দ্বের রূপ পরিবর্তন সম্ভব। সমাজের দ্বন্দ্বগুলোকে পুরাতন, প্রতিক্রিয়াশীল ও অমানবিক রূপ থেকে নূতন, প্রগতিশীল ও মানবিক রূপে নেওয়া সম্ভব। দ্বন্দ্বগুলোকে একটা নিয়ন্ত্রিত ও ভারসাম্যপূর্ণ খাত দেওয়া সম্ভব। ক্ষমতা ও সম্পদের একটা ভারসাম্যপূর্ণ বন্টন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব যাতে ক’রে সমাজে ধন ও ক্ষমতা বৈষম্য অসংযত হয়ে উঠে মানুষের দুঃখের কারণ না হয়।

রাষ্ট্র কোন না কোন রূপে বলপ্রয়োগের বাস্তবতা রক্ষা করে। কারণ রাষ্ট্র হচ্ছে সমাজের বলপ্রয়োগের বৈধ ক্ষমতা ভিত্তিক কেন্দ্রীয় সংগঠন। অর্থাৎ রাষ্ট্র যতোই গণতান্ত্রিক হোক তার মর্মমূলে থাকে একটা স্বৈরতা, একনায়কত্ব। কিন্তু গণতন্ত্রে এই রাষ্ট্র নিরংকুশ হ’তে পারে না বলে এই স্বৈরতন্ত্র বা একনায়কত্বও নিরংকুশ হ’তে পারে না, বরং রাষ্ট্রের একনায়কত্ব কিংবা বলপ্রয়োগের স্বেচ্ছাচারী ক্ষমতা হয় যথেষ্ট সংকুচিত ও নিয়ন্ত্রিত। রাষ্ট্রের স্থায়ী শক্তি স্বরূপ প্রশাসন ও সেনাবাহিনী সমন্বিত আমলাতন্ত্রকে বিভক্ত ও কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণে রেখে রাষ্ট্রের স্বৈরতার শক্তিকে জনগণের কল্যাণে নিয়োজিত করা সম্ভব।

এই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আমলারা শাসক শ্রেণীর অংশ হলেও তারা তাদের ক্ষমতাকে নিজ ইচ্ছা মতো প্রয়োগ করতে পারে না। অন্যদিকে রাজনীতিকরা নির্বাচনে নির্দিষ্ট মেয়াদে ক্ষমতা পরিচালনা করলেও তারা যেমন স্থায়ী রাষ্ট্রীয় শক্তি নয় তেমন তাদের শাসনও নিরংকুশ হবার পথ পায় না। অর্থাৎ এই ব্যবস্থায় রাজনীতিকরা স্থায়ী এবং নিরংকুশ শাসক হ’তে পারে না। এইভাবে গণতন্ত্র শাসনের স্বৈরাচারী রূপকে করে সংযত এবং শাসক শ্রেণীকেও করে পরিবর্তনশীল ও নমনীয়। গণতন্ত্র কারও নিরংকুশ ও চিরস্থায়ী শাসক হবার পথ রোধ ক’রে সমাজে শান্তিপূর্ণ উপায়ে পরিবর্তনের যে প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখে তা সমাজে নিরংকুশ ও স্থায়ী শাসক শ্রেণীর অস্তিত্বও অসম্ভব করে।

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় পুঁজির শোষণও হয় নিয়ন্ত্রিত ও সংযত। আর সবচেয়ে বড় কথা, সমাজে পুঁজির সঞ্চয় দ্বারা যে উৎপাদন ও উন্নয়ন সংগঠিত হয় তার সুফল জনগণের কাছে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয় রাষ্ট্রশাসনে রাজনৈতিক প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের একটা নিয়ন্ত্রণ কার্যকর থাকার ফলে। এটা ঠিক যে, রাজনীতিকদেরকে বা জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদেরকে অর্থশক্তির বলে পুঁজিপতি শ্রেণী নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। কিন্তু এটা একক ও নিরংকুশ নিয়ন্ত্রণ হ’তে পারে না। কারণ পুঁজির মালিক একজন হ’তে পারে না। এবং পুঁজিপতিদের মধ্যে থাকে দ্বন্দ্ব ও প্রতিযোগিতা, যাকে ব্যবহার করা সম্ভব। অন্যদিকে, সমর্থনের জন্য, ক্ষমতায় যাবার জন্য রাজনীতিকরা জনমতের উপরেও নির্ভরশীল হ’তে বাধ্য হয়। জনমতকে সংগঠিত ও প্রভাবিত করতে গিয়ে জনগণকে সংগঠিত করতে হয়। ফলে শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্র শাসনে সংগঠিত জনমতের প্রভাব ভালোভাবেই পড়ে।

 

আমাদের সমাজে রাষ্ট্রের ভূমিকা

ব্যক্তি মালিকানা ও গণতন্ত্রের প্রশ্নে আমাদের মতো সমাজে দেখা দেয় উন্নয়নের এক জটিল সমস্যা। আমরা আগেই বলেছি যে, আমাদের মতো সমাজে ব্যক্তি মালিকানা সমাজের উৎপাদন বৃদ্ধি, উৎপাদন শক্তির বিকাশ এবং গণতন্ত্র ও জনগণের কল্যাণে প্রয়োজনীয় ভূমিকা পালন করতে পারে না। এই পুঁজি এ দেশে ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসনামল থেকে এ পর্যন্ত আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে থেকে স্বৈরাচারী পদ্ধতিতে সংগঠিত হয়ে সম্পূর্ণ লুটেরা ও গণবিরোধী চরিত্র অর্জন করেছে। ফলে তা প্রকৃতপক্ষে গণতান্ত্রিক না হয়ে হয় স্বৈরাতান্ত্রিক। তা পালন করছে দেশদ্রোহী ভূমিকা। এই পুঁজি আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রের অধীনে থেকে নয়া উপনিবেশবাদী বিদেশী শক্তিসমূহের এ দেশ লুণ্ঠনের হাতিয়ার হিসাবে ভূমিকা পালন করছে।

সুতরাং বাংলাদেশের মতো দেশে পশ্চিম ইউরোপের মতো ক’রে ব্যক্তি মালিকানায় শিল্প বিকাশ ও আধুনিকায়নের স্বপ্ন দেখে লাভ নেই। ব্যক্তির পরিবর্তে প্রধানত রাষ্ট্রকেই  এ দেশে এ ক্ষেত্রে নেতৃত্ব ও উদ্যোগ নিতে হবে, যদিও সেই রাষ্ট্রটি নয়া উপনিবেশবাদীদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত বর্তমান আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্র হবে না।

বস্তুত ইউরোপ কিংবা রাশিয়া, চীনের বর্তমান সমস্যা আর আমাদের সমস্যা অনেকাংশেই ভিন্ন। আমাদের দেশের সমস্যা মূলত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির নূতনতর আবিষ্কার কিংবা উদ্ভাবনের নয় বরং উন্নত সমাজগুলি যেসব বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত আবিষ্কার ও উদ্ভাবনকে ব্যবহার করে উন্নত হয়েছে সেইসব আবিষ্কার ও উদ্ভাবনকে আত্মস্থ ও ব্যবহার ক’রে উন্নত হওয়া। কেন্দ্রীভূত সামাজিক নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা দ্বারা অর্থাৎ প্রধানত রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় উদ্যোগেই কেবলমাত্র এই কাজটি আমরা সবচেয়ে দ্রুতগতিতে ও সবচেয়ে সহজে সম্পন্ন করতে পারি। অর্থাৎ পশ্চিম ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা বা জাপান যে পদ্ধতিতে উন্নত হয়েছে, শিল্পায়িত হয়েছে সেই পদ্ধতি আমাদের জন্য নয়। অনেক পূর্ব থেকে অনুকূল পরিস্থিতিতে সেখানে ব্যক্তির উদ্যোগে যে সৃজনশীল ও উৎপাদনশীল সমাজিক-অর্থনৈতিক ক্রিয়া সংগঠিত হয়েছিল সেটা এখন আমাদের পক্ষে সেভাবে সংগঠিত করা সম্ভব নয়। এই পথ আমাদের জন্য দুঃখ, গ্লানি ও দাসত্বই বয়ে আনছে। আমাদের পশ্চাৎপদতা ও দারিদ্র্য দ্বারা আমরা বিদেশীদের আধিপত্য, লুন্ঠন ও শোষণের সহজ শিকার হয়ে থাকছি। এখন আমাদের সামনে প্রধান দায়িত্ব তাই উন্নত পৃথিবীর অর্জিত জ্ঞান, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় তথা কেন্দ্রীভূত সামাজিক নিয়ন্ত্রণে নিয়ে কঠোর শ্রম ও সাধনা দ্বারা আমাদের সমাজের রূপান্তর ও উন্নতি সাধন করা।

ব্যক্তির মালিকানার তুলনায় রাষ্ট্রীয় মালিকানা, ব্যক্তির স্বাধীন উদ্যোগের তুলনায় রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ এবং ব্যক্তির অধিকারের তুলনায় রাষ্ট্রীয় অধিকারের সীমানার অধিকতর বিস্তার আমাদের সময়ের ও সমাজের দাবী। অর্থাৎ প্রয়োগ পদ্ধতির বিচার আমাদের জন্য প্রয়োজন হ’ল এক ধরনের সমাজতন্ত্র। কমিউনিজমের কল্পস্বর্গের দাবী নয়, এটা নেহায়েত আমাদের সমাজের আধুনিকায়ন ও উন্নয়নের প্রাথমিক দাবী। অর্থাৎ সমাজতন্ত্র দ্বারা বিশেষ করে অর্থনীতি ও উৎপাদনের ক্ষেত্রে একটা ব্যাপক জাতীয়করণ ও রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ এবং কঠোর সামাজিক ও রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ দ্বারাই সমাজকে দ্রুত শিল্পায়িত ও উন্নত করতে হবে।

কিন্তু এইখানেই প্রশ্ন আসে যে, এর ফলে কি আমাদেরও পরিণতি রাশিয়া, চীনের মতো আমলাতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র এবং একটা পর্যায়ে আর্থ-সামাজিক বন্ধ্যাত্ব হবে না?

এই বিপদ প্রতিরোধের উপায়ও আছে। সেটা হ’ল শ্রমজীবী জনগণের উৎপাদনের ক্ষেত্রে ব্যক্তি মালিকানার অবস্থান রক্ষা করা। যারা নিজেরা শ্রম করবে তাদের ক্ষেত্রে ব্যক্তি মালিকানা রক্ষা করতে হবে। এর ফলে কৃষক, কারিগর, ক্ষুদ্র শিল্পমালিক, দোকানদার, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর ব্যক্তিগত মালিকানা থাকবে। উৎপাদন শক্তির দ্রুত বিকাশের স্বার্থে ব্যক্তিগত মালিকানার ভিত্তিতেই এই ক্ষেত্রে সমবায় ও যৌথ উদ্যোগকে উৎসাহিত করতে হবে। বস্তুত রাষ্ট্রীয়, সামাজিক উদ্যোগে যখন ব্যাপক শিল্পায়ন ও উন্নয়ন দ্বারা উন্নত অর্থনীতি ও সর্বাধুনিক প্রযুক্তিকে সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়া যাবে তখন প্রত্যক্ষ শ্রমের ক্ষেত্রের এই ব্যক্তি মালিকানাই নূতন অবস্থায় এসে ক্রমশ বিস্তার করবে স্বীয় উদ্যোগ ও অধিকারের সীমানা। অর্থাৎ আমাদের জন্য প্রয়োজনীয় এমন এক সমাজতন্ত্র যা মার্কসীয় সমাজতন্ত্রের মতো নিরংকুশ হবে না, কারণ তার লক্ষ্য হবে না কমিউনিজমের কল্পস্বর্গীয় শ্রেণীহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা। বরং এর লক্ষ্য হবে একটি গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠা। তাই এই সমাজতন্ত্রকে আমরা বলতে পারি গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র।

এ দেশে এই গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা বিপ্লব ছাড়া সম্ভব নয়। কারণ প্রচলিত আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্র এবং সম্পত্তি ব্যবস্থার অবসান জণগণের বলপ্রয়োগ ছাড়া সম্ভব নয়। এই সমাজতন্ত্র শুধু অর্থনীতিতে জাতীয়করণ দ্বারা একটা কেন্দ্রীভবন ঘটাবে না, রাজনীতিতেও তা ক্ষমতার একটা কেন্দ্রীভবন ঘটাবে। কাজেই পুরাতন রাষ্ট্রের ধ্বংস দ্বারা নূতন যে রাষ্ট্রটি সংগঠিত হবে তা হবে সেই নূতন রাষ্ট্রের স্বৈরশক্তি বা একনায়কত্বের প্রয়োগ। কিন্তু তা মার্কসীয় সমাজতন্ত্রের মতো নিরংকুশ হবে না। এই একনায়কত্বকে আমরা বলতে পারি জনগণের গণতন্ত্রের একনায়কত্ব। এই একনায়কত্ব শ্রমজীবী ও উৎপাদক জনগণের অংশগ্রহণ দ্বারা গড়ে ওঠায় এটা তাদেরকে দিবে গণতন্ত্র। কিন্তু জনগণের শত্রু এবং আজকের শাসক আমলা ও ধনিকদেরকে দিবে একনায়কত্ব ও স্বৈরতার পেষণ।

বস্তুত বিপ্লবটাই একটা একনায়কত্ব। স্বৈরতান্ত্রিক পদ্ধতিতে শাসন ও শোষণকারী শ্রেণীসমূহের উচ্ছেদ সাধনের জন্য এটা পাল্টা স্বৈরতন্ত্রের প্রয়োগ। একটা একনায়কত্ব বা স্বৈরতন্ত্রকে পাল্টা একনায়কত্ব বা স্বৈরতন্ত্র ছাড়া পরাভূত ও ধ্বংস করা যায় না। সুতরাং আমাদের দেশেও বর্তমান স্বৈরতান্ত্রিক আমলা-ধনিক শাসক ও শোষক শ্রেণীর বিরুদ্ধে একই পদ্ধতির প্রয়োগ ছাড়া উপায় কোথায়?

আজকের সমাজের যে ছাঁচ দ্বারা অব্যাহত গতিতে তৈরী হচ্ছে দেশদ্রোহী ও স্বৈরাচারী আমলা, প্রতারক রাজনীতিক, লুণ্ঠক বিত্তবান, নীতিহীন বুদ্ধিজীবী, অন্ধত্বজীবী ধর্মনেতা এবং নারী ধর্ষণকারী ও সন্ত্রাসী পুরুষবাদীসহ যাবতীয় মানবতা ও গণ-বিরোধীরা সেই ছাঁচটিকে অবশ্যই নির্দয় আঘাতে চূর্ণ-বিচূর্ণ করতে হবে। এই ছাঁচের রক্ষক ও সুবিধাভোগীরা কি এটা শান্তিপূর্ণভাবে করতে দিবে? তাদের প্রতিরোধ ও আক্রমণের শক্তিকে ধ্বংস করেই আজকের শাসন ও শোষণের স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থাটিকে ধ্বংস করতে হবে।

এটা ঠিক যে, সব রকম শাসন ও শোষণ উচ্ছেদ হয় না। কিন্তু আজকের বর্বর ও স্বৈরতান্ত্রিক শাসন ও শোষণের তুলনায় আগামী গণতান্ত্রিক সমাজ শাসন ও শোষণহীনই হবে। কারণ শাসন ও শোষণের আজকের বর্বর ও অমানবিক রূপের অবসানের সঙ্গে তা হবে জনগণেরই আত্মসংযম, আত্মশৃংখলা, আত্মসঞ্চয় ও আত্মবিকাশের এক বিশেষ সামাজিক ব্যবস্থা।

আজকের আমলা-ধনিক শ্রেণীর শাসন ও শোষণের অবসান দ্বারা যে গণতান্ত্রিক সমাজ যাত্রা শুরু করবে তা ক্রমেই বিকশিত হবে। অর্থাৎ বিপ্লবের সময় যা থাকবে স্বৈরতন্ত্র ও একনায়কত্ব রূপে বিপ্লবের পর তা ক্রমেই সংকুচিত ও নিয়ন্ত্রিত হবে। এক সময় গণতান্ত্রিক অধিকারের সীমানা অবারিত হবে, যেমন অবারিত হবে ব্যক্তিগত মালিকানার সীমানা। ততো দিনে সমাজ কঠোর রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণে শিল্পায়ন, শিক্ষা ও প্রযুক্তির উন্নত ভিত্তি অর্জন ক’রে নিবে যার উপর দাঁড়িয়ে সমাজের নূতন ব্যক্তি ও গোষ্ঠীসমূহ উদ্ভাবন, আবিষ্কার, সৃষ্টি ও উৎপাদনশীলতার ক্রমবর্ধমান স্ফূরণ দ্বারা সমাজকে ক্রমিক বিকাশের পথে এগিয়ে নিবে।

এটা ঠিক যে, বিপ্লব দ্বারা পুরাতন আমলাতন্ত্র ধ্বংস হলেও রাষ্ট্রের অপরিহার্য নিয়মেই নূতন একটা আমলাতন্ত্র গড়ে উঠবে। কিন্তু তা নিরংকুশ স্বৈরতন্ত্রের জন্ম অনিবার্য করবে না। কারণ একদিকে থাকবে সকল স্তরে জনগণের স্বশাসন ভিত্তিক শাসন ব্যবস্থা যা জনগণের নির্বাচিত রাজনৈতিক কর্তৃত্বকে দিবে আমলাতন্ত্রের উপর দৃঢ় নিয়ন্ত্রণ। এই ব্যবস্থায় আমলাতন্ত্রের ভূমিকা হবে খুব সীমিত। জনগণের রাজনৈতিক প্রতিনিধিদের একান্ত অধীনস্থ ও সহযোগী হয়েই তা কাজ করবে। তাছাড়া বিকেন্দ্রীভূত শাসন ব্যবস্থায় এই আমলাতন্ত্রও হবে বিকেন্দ্রীভূত ও দুর্বল। অন্যদিকে, সমাজে প্রত্যক্ষ উৎপাদন বা শ্রমের ক্ষেত্রে ব্যক্তি মালিকানার অবস্থানের ফলে বিপ্লবী রাজনৈতিক নেতৃত্বের জন্য থেকে যাবে বিকল্প অর্থনৈতিক ও সামাজিক ভিত্তি। সামাজিক রূপান্তরের কাজ সমাধা হবার পর ব্যক্তি-অর্থনীতি ও তার আনুষঙ্গিক উপকরণসমূহ যখন হবে বিকাশমান তখন সেগুলিকে অবলম্বন ক’রে বিপ্লবী রাজনৈতিক নেতৃত্ব নিজেদেরকে করবে অধিকতর গণতান্ত্রিক ও উদার। অর্থাৎ তখন সমাজে স্বাভাবিক পন্থায় বিকাশ লাভ করবে অধিকতর উদারতা ও গণতন্ত্র। যদি পুরাতন হয়ে যাওয়া বিপ্লবী নেতৃত্ব সময়ের এই দাবী পূরণ করতে না পারে তবে শান্তিপূর্ণ উপায়েই নির্বাচনের পদ্ধতি দ্বারা জনগণ তাকে সরিয়ে দিয়ে ক্ষমতায় আনবে অধিকতর গণতান্ত্রিক ও উদার নেতৃত্বকে।

মার্কসীয় সমাজতন্ত্রের সমস্যা এইখানে যে, তা সব রকম ব্যক্তি স্বাধীনতা ও ব্যক্তি মালিকানাকেই বিলুপ্ত করে বলে সমাজে রাষ্ট্রের বাইরে ভিন্ন কোন সামাজিক শক্তির স্বাধীন ও বৈধ অস্তিত্বের ভিত্তি থাকে না। ফলে সমাজ হয় নিরংকুশভাবে এককেন্দ্রিক। এই এককেন্দ্রিক সমাজের লক্ষ্য হ’ল সবকিছুকে এক ছাঁচে ঢালাই করা। অর্থাৎ একতন্ত্র হ’ল তার বৈশিষ্ট্য। এই রকম এক সমাজে বিপ্লবী রাজনৈতিক নেতৃত্ব সমাজের শিল্পায়ন ও পরিবর্তনের পর রাষ্ট্রীয় মালিকানার এবং রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের বাইরে বিকল্প কোন ক্ষেত্র বা ভিত্তি পায় না বলে রাষ্ট্রের্‌ স্থায়ী শক্তি ও মূল ভিত্তি আমলাতন্ত্রের উপর নির্ভরশীল এবং তার সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হয়ে শেষ পর্যন্ত পরিপূর্ণ আমলাতান্ত্রিক ও স্বৈরতান্ত্রিক হয়ে উঠতে বাধ্য হয়।

 

ব্যক্তি ও সমাজ

সুতরাং আমরা এমন এক পরিস্থিতির সম্মুখীন হচ্ছি যেখানে ব্যক্তি ও সমাজের সঠিক সম্পর্ক নির্ধারণের সমস্যা দেখা দেয়। সমাজ ছাড়া ব্যক্তি যেমন অচল তেমন ব্যক্তি ছাড়া সমাজ সংগঠিতই হতে পারে না। কিন্তু আমরা দেখেছি যে, সমাজ একটা কেন্দ্রিকতা ও কেন্দ্রীয় ক্ষমতার উদ্ভব ঘটায় যা সকল ব্যক্তির ক্ষমতা কম বা বেশী পরিমাণে আত্তীকরণ করে। এই কেন্দ্রই শেষ পর্যন্ত হরণ করতে পারে সকল ব্যক্তির সমস্ত ক্ষমতা। এটা বাস্তবে হয়ে দাঁড়ায় কেন্দ্রের ব্যক্তি কর্তৃক সকলের ক্ষমতা হরণ। এই অবস্থাকে প্রতিরোধ করার উপায় হল সমাজে একাধিক ক্ষমতা কেন্দ্র সৃষ্টি করা যেগুলো প্রধান বা কেন্দ্রীয় ক্ষমতা কেন্দ্রের অধীনে ক্রিয়াশীল থাকবে। এক্ষেত্রে প্রধান কেন্দ্র একমাত্র কেন্দ্র না হয়ে হয় বহু কেন্দ্রের সমন্বিত রূপ। তাছাড়া ক্ষমতা যাতে এক বিন্দুতে বা এক ব্যক্তির হাতে নিরংকুশ ভাবে কেন্দ্রীভূত হতে না পারে তার জন্য ক্ষমতার বিভাজন বা পৃথকীকরণ ঘটাতে হয়। ক্ষমতার পৃথক বা বিভক্ত শাখা বা সংস্থাগুলি সমন্বিত হয়ে একটা কেন্দ্র সৃষ্টি করে, যা নিরংকুশভাবে একক নয়। আমরা গণতন্ত্রে এমন ব্যবস্থা পাই।

একাধিক কেন্দ্র থাকে বলে ব্যক্তি বিভিন্ন কেন্দ্রকে অবলম্বন করে নিজের স্বাধীন অস্থিত্বের ভিত্তিকে রক্ষা করতে পারে। সমাজে বাস করার প্রয়োজনে কেন্দ্রীয় সামাজিক নিয়ন্ত্রণ মেনে নিতে হয়। তবে সেটা হয় মূলত স্বেচ্ছামূলক । আমরা আগে বলেছি যে, সমাজের কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণের একটা জবরদস্তি বা স্বৈরতান্ত্রিক রূপও থাকে। তবে গণতন্ত্রে তা হয় নিয়ন্ত্রিত, সংযত। এটাকে নিরংকুশ স্বৈরতন্ত্র না বলে তুলনামূলক বা নিয়ন্ত্রিত স্বৈরতন্ত্রও বলা যায়।

আমাদের বুঝতে হবে যে, নিরংকুশ ব্যক্তি স্বাধীনতা কখনই সম্ভব নয়। যেটা সম্ভব সেটা হ’ল তুলনামূলক এবং প্রয়োজনীয় স্বাধীনতা লাভ করা। আসলে স্বাধীনতা তো প্রয়োজনের স্বীকৃতি। এখন প্রশ্ন, কে এই প্রয়োজনের মানদণ্ড নির্ধারণ করবে? এবং এই মানদণ্ডও তো অপরিবর্তনীয় কিছু নয়। সুতরাং ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির, গোষ্ঠীর এবং সমাজ তথা সমাজ-কেন্দ্রের সঙ্গে ব্যক্তি ও অন্যান্য কেন্দ্রের একটা দ্বন্দ্ব বা সংগ্রামও থাকবে অব্যাহত।

এই সংগ্রামকে ভয় পাবার কিছু নেই। এটাই মানব সত্তার অনিবার্যতা। এটাকে আইন করে অবৈধ ঘোষণা করা যেতে পারে। কিন্তু তাতে সংগ্রাম থেমে যায় না। তা আশ্রয় নেয় গোপনীয়তায়, অবৈধতায়। ফলে পরিবর্তনের সুস্থ, শান্তিপূর্ণ ও বৈধ পথ না থাকায় ষড়যন্ত্র, রক্তপাত ও সহিংসতা সমাজকে অধিকার করে।  সুতরাং প্রয়োজন হল দ্বন্দ্ব ও সংগ্রামের আত্মপ্রকাশের বৈধ ও নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থা রাখা।

বস্তুত নিরংকুশ ব্যক্তিতন্ত্র কিংবা নিরংকুশ সমাজতন্ত্র কোনটিই আদর্শ নয়। এক সময় ইউরোপে পুরাতন সামন্তবাদী রাষ্ট্র ও সমাজের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে উদীয়মান নূতন ব্যক্তি নিরংকুশ অধিকার দাবী করেছিল। এই ব্যক্তির আঘাতে ইউরোপের পুরাতন সমাজ ভেঙ্গে পড়ছিল। ফলে জনগণের জীবনে বিশৃঙ্খলা ও দুঃখও দেখা দিয়েছিল। ব্যক্তির স্বার্থপরতা, লোভ ও নির্বিবেক মুনাফাবৃত্তি শুধু ইউরোপ নয় সমস্ত পৃথিবীর মানুষের জন্যও অনেক দুঃখর কারণ হয়ে দেখা দিয়েছিল। সুতরাং মার্কসবাদ একে বিনাশ করতে চেয়েছিল। তাই তা দিয়েছে কমিউনিজমের নামে নিরংকুশ সমাজতন্ত্র তথা নিরংকুশ রাষ্ট্রতন্ত্র।

কিন্তু প্রকৃত পথ ব্যক্তির বিনাশের নয়, তাকে সংযত করার। গণতন্ত্র হ‘ল সেই পদ্ধতি যা ব্যক্তিকে যেমন সংযত করে তেমন সংযত করে রাষ্ট্রকেও। উভয়কে সংযত বা নিয়ন্ত্রণ করে সমাজ ও ব্যক্তির সম্পর্কের মধ্যে একটা ভারসাম্যপূর্ণ ছন্দ রক্ষা করা গণতন্ত্রের একটি মূল কাজ। এই ভারসাম্য মানে সর্বদা উভয়ের সম-গুরুত্ব বা সম-অধিকার নয়। পরিস্থিতির প্রয়োজনে কখনও ব্যক্তির উপর সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হয় আবার কখনও এই গুরুত্ব দিতে হয় রাষ্ট্রের উপর। কখনও ব্যক্তির অধিকারের সীমানা প্রসারিত হয়ে রাষ্ট্রকে সংকুচিত করতে পারে আবার কখনও রাষ্ট্র ব্যক্তিকে সংকুচিত করতে পারে। কিন্তু ব্যক্তি বা রাষ্ট্র কেউ-ই অপরের বৈধ অস্তিত্বকে সম্পূর্ণভাবে বিলুপ্ত করবে না।

সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীন ও পূর্ব ইউরোপের বিভিন্ন সমাজতান্ত্রিক দেশ সমাজতন্ত্র দ্বারা উন্নত শিল্পভিত্তি ও জীবনের মান অর্জন করার পর গণতন্ত্রের পথে যাত্রা করতে চাচ্ছে। সমাজে যে স্থবিরতা ও সংকট সেখানে দেখা দিয়েছে তা সেখানে ব্যক্তি পুঁজি ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার উত্থান ও বিকাশ অনিবার্য করছে। এছাড়া অন্তত শিল্প ব্যবস্থা টিকতে বা বিকাশ লাভ করতে পারে না। শিল্প দাবী করে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্রমাগত বিকাশ, সমাজের উৎপাদনশীলতা এবং মানবিক মেধা ও চিন্তাশীলতার স্বাধীন বিকাশ। তাই এটা শুধু সমাজতন্ত্রের সমস্যা হয়ে দেখা দেয় নি, যেখানে শিল্পায়ন ব্যাপক আয়তন লাভ করেছে সেখানেই গণতন্ত্র অপ্রতিরোধ্য শক্তি হয়ে উঠেছে। স্পেন, পতূêগাল, দক্ষিণ কোরিয়া এই বাস্তবতাকেই তুলে ধরেছে। অর্থাৎ শেষ পর্যন্ত শিল্প বিকাশ স্বৈরতন্ত্র বিরোধী।

কিন্তু আমরা দেখেছি যে, এই রকম কোনও উন্নত শিল্প ও প্রযুক্তিগত ভিত্তি আমাদের সমাজের নেই। এবং এখানে রাষ্ট্র আমলাতান্ত্রিক। এই আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্র তার নিয়ন্ত্রণে রেখেছে ব্যক্তি মালিকানা ভিত্তিক ধন-সম্পত্তি অর্জনের ব্যবস্থা। এই রাষ্ট্র গড়ে উঠেছে মূলত ব্রিটিশ উপনিবেশবাদীদের দ্বারা। ব্রিটিশ এবং পাকিস্তান চলে যাবার পর এটি একটি নয়া উপনিবেশিক ব্যবস্থা আমাদের উপর চাপিয়ে রেখেছে। অর্থাৎ এই আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সামরিক ও বেসামরিক আমলা অধিপতিরা এমন একটি ব্যবস্থা চালু রেখেছে যেখানে বিদেশী নয়া উপনিবেশবাদী উন্নত রাষ্ট্রগুলির সহযোগী হিসাবে একদল ধনিক এখানকার জনগণকে শোষণ ও লুণ্ঠন করতে পারে। এটা প্রকৃতপক্ষে আমলা, ধনিক এবং  বিদেশী নয়া উপনিবেশবাদীদের যৌথ শোষণ। এমন অবস্থায় এ দেশের ব্যক্তি মালিক বা পুঁজিপতিরা  আমলাদের এবং বিদেশীদের সহযোগী হয়ে এ দেশের জনগণকে স্বৈরাচারী পদ্ধতিতে লুণ্ঠন করে মাত্র। এই পুঁজি দেশপ্রেমহীন, দায়িত্বহীন ও অনুৎপাদক। সুতরাং এই পুঁজি দ্বারা শিল্পায়ন ও উন্নয়ন হ’তে পারে না।

এ দেশে রাষ্ট্রীয় সামরিক ও বেসামরিক আমলারা রাষ্ট্রকে মূলত নিজ নিয়ন্ত্রণে রেখে রাষ্ট্রের স্বৈরশক্তির ব্যবহার দ্বারা নিজেরা যেমন ব্যক্তি মালিকানায় অর্থ-বিত্ত আত্মসাৎ করে তেমন রাষ্ট্রযন্ত্রের বাইরে একদল ধনিক বা পুঁজিপিতি সৃষ্টি ও রক্ষা করে যারা তাদের এই অর্থ-বিত্ত আত্মসাতের সহযোগী। এই রকম আমলা শ্রেণীই এ দেশে বিদেশীদের নিয়ন্ত্রণের প্রধান হাতিয়ার হিসাবে কাজ করে। উপনিবেশবাদীদের সৃষ্টি এই আমলাতন্ত্র এ দেশের শিল্পায়ন ও উন্নয়নের পথে সবচেয়ে বড় বাধা। এ দেশে বর্তমান নয়া উপনিবেশবাদীদের বাজার ব্যবস্থা রক্ষা করা এদের কাজ। এ দেশে ততোটুকু উন্নয়ন হয় যতোটুকু উন্নয়ন এখানে বিদেশীদের পণ্য বিক্রির জন্য প্রয়োজনীয়। চরম গণ-বিরোধী, দেশদ্রোহী ও  স্বৈরতান্ত্রিক চরিত্রের জন্য এ দেশের রাষ্ট্রীয় আমলাতন্ত্র নয়া উপনিবেশবাদী বিদেশী শক্তিসমূহের উপর নির্ভরশীল হ’তে বাধ্য হয়।

সুতরাং এ দেশে উন্নয়ন ও শিল্পায়নের একটি প্রধান পূর্বশর্তই হচ্ছে বর্তমান রাষ্ট্রীয় আমলাতন্ত্র ও ধনিকদের উৎখাত সাধন। এর অর্থ হচ্ছে একদিকে যেমন সম্পত্তি ব্যবস্থায় এবং অর্থনীতিতে প্রয়োজনীয় জাতীয়করণ দ্বারা বর্তমান ধনিক শ্রেণীর মালিকানার অবসান আরেকদিকে তেমন সামরিক ও বেসামরিক আমলাদের হাত থেকে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব জনগণের বিপ্লবী রাজনৈতিক নেতৃত্ব কর্তৃক দখল। এই অবস্থায় বর্তমান আমলাতন্ত্রের শক্তি ধ্বংস হবে। রাষ্ট্র পরিচালনা ও রক্ষার প্রয়োজনে জনগণের রাজনৈতিক প্রতিনিধিরা একটি নূতন প্রশাসন ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলবে যেখানে সরকারী আমলা বা কর্মচারীদের ক্ষমতা এবং অবস্থান হবে খর্ব ও সংকুচিত। রাষ্ট্রের সকল স্তরে জনগণের নির্বাচিত রাজনৈতিক প্রতিনিধিদের নেতৃত্ব, নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনায় সংগঠিত হয়ে এই কর্মচারীরা বা আমলারা হবে জনগণের রাজনৈতিক নেতৃত্বের আজ্ঞাবহ। অর্থাৎ এ দেশে গণতান্ত্রিক বিপ্লব বর্তমান রাষ্ট্রীয় আমলা এবং এই আমলার সহযোগী রাজনীতিকদের শাসন উৎখাত ক’রে প্রতিষ্ঠা করবে মুক্ত ও স্বাধীন জনগণের প্রতিনিধি নূতন ও বিপ্লবী রাজনীতিকদের এক গণতান্ত্রিক শাসন। এইভাবে বিপ্লবী রাজনীতিকরা এ দেশকে মুক্ত করবে নয়া উপনিবেশবাদী নিয়ন্ত্রণ ও শোষণ, আমলা শাসন এবং ধনিক শোষণ থেকে এবং এ দেশে জাগাবে সমাজ ও শিল্প বিপ্লবের এক নূতন ও বিশাল জোয়ার।

গণতন্ত্রের নামে এ দেশে আমলা শাসকেরা একদল সহযোগী ও অনুগত রাজনীতিক সাথে নিয়ে যে প্রহসন চালায় গণতান্ত্রিক বিপ্লব সেই প্রহসনেরও অবসান ঘটাবে। বস্তুত এ দেশে আমলা নিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্র ব্যবস্থায় গণতন্ত্রের নামে নির্বাচন দ্বারা যে ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে সেটা এ দেশে নয়া উপনিবেশবাদ ও আমলাতন্ত্রের নিয়ন্ত্রণ রক্ষা ও গণশক্তির উত্থানের বিরুদ্ধে এক অত্যন্ত কার্যকর হাতিয়ার হিসাবে কাজ করছে। রাজনৈতিক ব্যবস্থার চেয়ে আমলাতন্ত্র এবং তার সশস্ত্র অংশ সেনাবাহিনী অনেক বেশি শক্তিশালী। রাষ্ট্র শাসনের পুরো ব্যবস্থাই মূলত আমলাতান্ত্রিক। উপজেলা থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত মূলত বেসামরিক আমলারাই জনগণের উপর প্রশাসন পরিচালনা করে আর সেনাবাহিনী বা সামরিক আমলা এই শাসনকে রক্ষা করে, সময়ে সময়ে পরিচালনা ক্ষমতাও দখল করে নেয়। এমন অবস্থায় বহুদলীয় নির্বাচন পদ্ধতিতে জনগণের রাজনৈতিক প্রতিনিধিদের দ্বন্দ্ব ও প্রতিযোগিতাকে ব্যবহায় ক‘রে আমলাতন্ত্র খুব সহজেই জনগণকে বিভক্ত ও বিভ্রান্ত করে। এই ধরনের রাজনৈতিক ব্যবস্থার সংগঠিত আমলাতন্ত্রের বিপরীতে জনগণ বিভক্ত ও বিশৃংখল হয়ে যায়। রাজনৈতিক সংগঠনসমূহ দ্বারা জনগণের এক অংশকে আরেক অংশের বিরুদ্ধে ব্যবহার ও নিয়োগ ক’রে আমলাতন্ত্র জনগণের প্রকৃত গণতন্ত্রকেই অসম্ভব ক’রে রাখে, জনগণের উন্নয়ন, উত্থান বিকাশ হয়ে থাকে অসম্ভব এবং এর ফলে নয়া উপনিবেশবাদীরাও আমলা ও ধনিকদের মাধ্যমে এ দেশের জনগণকে শোষণ ও নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।

বস্তুত এই ধরনের গণতন্ত্র জনগণের গণতন্ত্র নয়। এটা আমলা ও ধনিকদেরই গণতন্ত্র। এটা আমলাদের স্বৈরাচারী শাসন ও শোষণের সঙ্গে ধনিক এবং ধনিকদের একটা অংশ হিসাবে রাজনীতিকদেরকে সংযুক্ত করে মাত্র। সুতরাং আমলা নিয়ন্ত্রণাধীন এই নির্বাচনমূলক শাসন ব্যবস্থাকে গণতন্ত্র না বলে রাজনৈতিক স্বৈরতন্ত্র বলাই সঠিক যেখানে আমলা ও তাদের সঙ্গে রাজনীতিক ও ধনিকদের স্বৈরতন্ত্র কার্যকর হয় নির্বাচন ও গণতন্ত্রের আবরণে।

এমন অবস্থার পরিবর্তন সম্ভব কেবলমাত্র একটি গণবিপ্লব দ্বারা যেখানে জনগণের পাল্টা বিপ্লবী বলপ্রয়োগ ও স্বৈরতন্ত্র দ্বারা আমলা-ধনিকদের বলপ্রয়োগের ব্যবস্থা ও স্বৈরতন্ত্রকে উৎখাত করা হবে। এমন একটা অবস্থায় গণ-বিপ্লবের প্রাথমিক পর্যায়ে অবাধ বহুদলীয় গণতন্ত্র কার্যকর হবে এমন মনে করার কারণ নেই। ক্ষমতাচুøতদের ক্ষমতা পুনর্দখলের সমস্ত সম্ভাবনাকে ধ্বংস করতে গিয়ে তাদের অনেক অধিকারই হরণ করতে হবে। নূতন শাসন ব্যবস্থা গড়ে উঠবে ভিত্তিমূল থেকে। গ্রাম ও মহল্লা পর্যায় থেকে শুরু ক’রে ইউনিয়ন, উপজিলা, জিলা, বিভাগ ও কেন্দ্র পর্যন্ত সকল পর্যায়ে জনগণের নির্বাচিত রাজনৈতিক প্রতিনিধিরা দেশে শাসন করবে। তবে এই ব্যবস্থায় আমরা প্রথম পর্যায়েই যদি রাষ্ট্রের উপর তলায় ব্রিটিশ, আমেরিকান বা পশ্চিম ইউরোপীয় ধরনের সংসদ গড়তে যাই তবে আমরা ব্যর্থ হব। প্রথমেই দুর্বল অবস্থায় আমরা নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে উৎসাহিত করতে পারি না। প্রথম পর্যায়ে তুলনামূলকভাবে একটা এককেন্দ্রিক সংগঠন বা রাজনৈতিক ব্যবস্থা দ্বারা রাষ্ট্র পরিচালনা অত্যাবশ্যক। নতুবা নূতন সমাজ ও রাষ্ট্র সংগঠনের জন্য, দেশের দ্রুত সার্বিক উন্নয়নের জন্য যে প্রচণ্ড গতি ও দৃঢ়তা দরকার সেটা আসতেই পারবে না প্রাথমিক পর্যায়েই কলহ ও কোন্দলের জন্য, অনাকাঙ্ক্ষিত প্রতিযোগিতার জন্য, যাকে অব্যাহতভাবে শক্তি যোগাবে দেশের ভিতরের ও বাইরের বিভিন্ন প্রতিবিপ্লবী ও গণ-বিরোধী শক্তি।

অবশ্য এটা ঠিক যে, স্তর ভিত্তিক স্বায়ত্তশাসন ও নির্বাচনমূলক শাসন ব্যবস্থার ফলে নীচতলা থেকে ক্রমশ একটি বহুদলীয় শাসন ব্যবস্থা গড়ে উঠতে থাকবে। এক সময় এই ব্যবস্থাই বিকশিত হয়ে আপেক্ষিক এককেন্দ্রিক পরিচালনা ব্যবস্থাকে শন্তিপূর্ণভাবে অপসারিত করে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত করবে বহুদলীয় নির্বাচনমূলক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে। ততোদিনে সমাজ অর্জন করবে উন্নত অর্থনীতি, শিক্ষা, সংস্কৃতি ও জীবনের ভিত্তি। একদিনে থাকবে না আজকের আমলা-ধনিক শ্রেণীর শাসন, শোষণ ও নিয়ন্ত্রণ, আর একদিকে থাকবে না সমাজের পশ্চাৎপদতা, দারিদ্র্য, অশিক্ষা ও সংকট। ফলে তখন জনগণের গণতন্ত্র হবে জনগণের জন্য ক্রমবর্ধমানভাবে অর্থবহ ও কল্যাণময়। এইভাবে আমাদের সমাজে এমন এক গণতান্ত্রিক বিপ্লব প্রয়োজন এবং অনিবার্যও যা এখানে আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিপরীতে জনগণের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা দ্বারা জনগণকে ক্রমবর্ধমানভাবে এনে দিবে সমৃদ্ধি, অধিকার ও শক্তি।

এ কথা আমাদের ভোলা উচিত নয় যে, ইউরোপ, আমেরিকা বা জাপানের ব্যক্তিপুঁজি কিংবা গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানসমূহের বিকাশ যেমন একদিনে হয় নি তেমন এর জন্য একটা প্রয়োজনীয় পারিপার্শ্বিক অবস্থা সেখানে কম বা বেশী ছিল। শত শত বৎসর ধরে তারা তুলনামূলক বা আপেক্ষিক অনুকূল সামাজিক, ভৌগোলিক পরিস্থিতিতে অসংখ্য সংগ্রাম, চেষ্টা ও অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে আজকের স্তরে পৌঁছেছে। শক্তির ধর্ম অনুযায়ী তারা পৃথিবীর দুর্বল স্থান বা দেশগুলির শূন্যতা পূরণ করেছে এবং নিজেদের প্রভুত্ব, নিয়ন্ত্রণ ও শোষণ প্রতিষ্ঠা করেছে। এমন অবস্থায় আমাদের মতো পিছিয়ে থাকা দেশ বা সমাজের উত্থান তাদের স্বার্থের  বিরুদ্ধে যায়। সুতরাং তারা আমাদের পশ্চাৎপদতাকে রক্ষা করার প্রয়োজনে এ দেশের দেশদ্রোহী, গণদ্রোহী শক্তিগুলিকে রাষ্ট্র ও সমাজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে চেষ্টা করে। শুধু ইউরোপ, আমেরিকা বা জাপানের কথাই বা বলি কেন চীন বা সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো দেশও নিজ জাতীয় বা রাষ্ট্রীয় স্বার্থে আমাদের দেশে বিভিন্ন সময়ে এমন সব শক্তিকে সমর্থন ও সহযোগিতা করেছে যারা এ দেশের জাগরণ ও উত্থানের শত্রু। বাঙ্গালীর স্বাধীনতা ও স্বাধিকার আন্দোলন এবং যুদ্ধের সময় চীনের বাঙ্গালী জাতি-বিরোধী ভূমিকা আমরা নিশ্চয়ই ভুলি নি। কাজেই আমাদের এটা মনে রাখতে হবে যে, যে সব উন্নত জাতি বা রাষ্ট্রের স্বার্থ আমাদের বর্তমান অবস্থাকে রক্ষা করার সঙ্গে সংযুক্ত তাদের সঙ্গে আমাদের একটা দ্বন্দ্ব থাকে। সুতরাং পশ্চিম ইউরোপ, আমেরিকা, জাপানের মতো শক্তিগুলি যদি আমাদের এখানে স্থিতাবস্থা রক্ষা করতে চায় কিংবা এ দেশে তাদের নয়া উপনিবেশিক স্বার্থকে নিশ্চিত করতে চায় তবে তাতে অবাক হবার কিছু নেই।

কিন্তু তার মানে এই নয় যে, সেই ভয়ে আমরা উন্নত হবার জন্য সংগ্রাম করব না। অবশ্যই বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, শিল্প, সংস্কৃতি ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সর্বোচ্চ বিকাশকে আমাদের আয়ত্ত করতে হবে। কিন্তু এর জন্য যে আমাদের ইউরোপ, আমেরিকা বা জাপানের পথ ধরতে হবে বা তাদেরকে নকল করতে হবে তা নয়। কিংবা তাদের সর্বোচ্চ পর্যায়কে আমরা যদি একবারে ধরতে চাই কিংবা সেখান থেকেই যাত্রা শুরু করতে চাই নিজস্ব বুনিয়াদ তৈরী না করে তা হলেও আমরা ভুল করব। সেটা করলে বরং আমরা যে তিমিরে আছি সেই তিমিরেই থাকব। অর্থাৎ আমাদের আত্মবিকাশের নিজস্ব পথ আমাদের উদ্ভাবন করতে হবে। পুঁজিবাদ, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র সকলের বিকাশ ও সংকটের অভিজ্ঞতা থেকেই আমাদেরকে শিক্ষা নিয়ে এই পথ উদ্ভাবন করতে হবে। আমাদের এই নিজস্ব পথই হচ্ছে গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র কিংবা জনগণের গণতন্ত্র। এটা যেমন মার্কসীয় সমাজতন্ত্র নয় তেমন পশ্চিম ইউরোপ, আমেরিকার গণতন্ত্রও নয়। পশ্চিমের গণতন্ত্র আমরা চাইলেও এখন অর্জন করতে পারব না। তবে আমাদের লক্ষ্য হবে কঠোর আত্মনিয়ন্ত্রণ, শ্রম ও সংগ্রাম দ্বারা একটি শিল্পোন্নত, মানবিক ও গণতান্ত্রিক সমাজ সংগঠিত করা, যা পশ্চিমের গণতান্ত্রিক সমাজের কাছাকাছি হলেও বাস্তবে তা হবে এইসব সমাজের চেয়েও আরও অনেক উন্নত ও গণতান্ত্রিক।

পশ্চিম ইউরোপ, আমেরিকা বা জাপানের গণতান্ত্রিক সমাজে এখনও অনেক সীমাবদ্ধতা ও দুর্বলতা আছে। সেই সব দেশের অনেকগুলিতেই এখনও আছে রাজতন্ত্রের মতো পশ্চাৎপদ ও প্রতিক্রিয়াশীল ব্যবস্থা। অধিকাংশ দেশেই আমলাতন্ত্র এখনও যথেষ্ট শক্তিশালী এবং স্বৈরাচারী। জনগণের স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন অধিকাংশ সমাজেই যথেষ্ট পরিমাণে নেই। এবং সর্বোপরি এই সব সমাজ পুরুষতান্ত্রিক। নারী এখানে এখনও বাস্তবে অনেকাংশে অধিকারহীন এবং পুরুষ দ্বারা অবজ্ঞাত, বঞ্চিত ও শাসিত। কিন্তু আমরা যে গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণ করব তা যেমন জনগণকে দিবে পূর্ণ গণতন্ত্র তেমন নারীকে দিবে পূর্ণ অধিকার, নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা। রাষ্ট্র যাতে সমাজের অর্ধাংশ নারীকে প্রতিনিধিত্ব করতে বাধ্য হয় সেইজন্য রাষ্ট্রের সমস্ত ক্ষমতাযন্ত্রের উপর নারীর নিয়ন্ত্রণকে করা হবে সুপ্রতিষ্ঠিত ও নিশ্চিত। সুতরাং ইউরোপের গণতন্ত্র কিংবা মার্কসীয় সমাজতন্ত্র থেকে আমরা যে শিক্ষাই নিই আমাদের পথ একান্তই আমাদের নিজস্ব।

 

মার্কসবাদের অবদান

মার্কসবাদ আজ বিপন্ন। গভীর ও প্রতিকারহীন সংকট আজ তাকে ঘিরে ধরেছে। এটা এখন পরিণত হয়েছে এক ক্ষয়িষ্ণু আদর্শে। তা সত্ত্বেও মানব ইতিহাসে তা এক বিরাট ভূমিকা পালন করেছে যে কথা ইতিপূর্বে আমরা বলেছি। মানুষকে স্বর্গরাজ্যের সন্ধান দিতে চেয়ে তা শিল্প সাধনা ও শ্রমের যে পথ দেখিয়েছিল সেই পথ ধরে এগিয়ে স্বর্গরাজ্য না পেলেও পশ্চাৎপদ পৃথিবীর বিশাল ভূ-ভাগের অবনত ও ক্ষুধাকাতর মানুষ উঠে এসেছে আধুনিক, শিল্পোন্নত, সমৃদ্ধ ও গৌরবময় এক পৃথিবীতে। এইভাবে যে মানুষ ছিল অন্ধ সে হয়েছে চক্ষুষ্মান। চক্ষুষ্মান হয়েছে বলেই তার আজ আরও সম্মুখে এগিয়ে যাবার স্পর্ধা।

সর্বহারা শ্রেণীর প্রতি এক প্রকার দেবত্ব আরোপ ক’রে মার্কসবাদ নিপীড়িত ও শ্রমজীবী মানুষকে যে মর্যাদা ও অগ্রাধিকার দিয়েছে তার প্রভাবে পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষের এক অভূতপূর্ব নবজাগরণ সংগঠিত হয়েছে। শুধু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিকাশ দ্বারাই আজকের পৃথিবীর উন্নত গণতান্ত্রিক পরিবেশ এভাবে গড়ে ওঠে নি। এর জন্য মার্কসবাদ ও কমিউনিস্ট আন্দোলনের ভূমিকাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। এমন কি মার্কসবাদ ও সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের ব্যাপ্তি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিকাশেও বিপুলভাবে সাহায্য করেছে। সেই সঙ্গে সাহায্য করেছে গণতান্ত্রিক শক্তির বিকাশেও। পুঁজিবাদীরা যেমন একদিকে কমিউনিস্ট ও সমাজতান্ত্রিক আদর্শের প্রভাব থেকে নিজ সমাজের শ্রমজীবী জনগণকে মুক্ত রাখতে গিয়ে তাদেরকে অনেক সুযোগ-সুবিধা দিতে এবং তাদের অনেক অধিকার মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে তেমন আরেক দিকে শ্রমকিদের শ্রমকে সহজবোধ্য করতে কিংবা শ্রমের উপর নির্ভরতা কমাতে গিয়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্রমবর্ধমান বিকাশ ঘটাতে বাধ্য হয়েছে। উপরন্তু মার্কসীয় সমাজতান্ত্রিক শিবিরের অভুøদয় ও শক্তিবৃদ্ধি পৃথিবীতে এমনই এক প্রযুক্তিগত প্রতিযোগিতা অনিবার্য করেছে যেখানে ব্যক্তি পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্র কারোরই পিছিয়ে থাকার উপায় থাকে নি। এই প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে যেতে চায় না বলেও আজ মার্কসীয় সমাজতান্ত্রিক শিবিরের মার্কসবাদী দল ও সরকারগুলো বিভিন্নভাবে মার্কসবাদ বর্জনের প্রক্রিয়া শুরু করেছে। উন্নত জীবনের জন্য এই যে আকাঙ্ক্ষা মার্কসবাদ মানুষের মনে জাগাতে পেরেছে যার বলে বলীয়ান হয়ে সে তার এগিয়ে যাবার পথে বাধা হয়ে ওঠা মার্কসবাদকে পরিত্যাগের সাহস অর্জন করতে পারছে এটাও মার্কসবাদের কম সাফল্য নয়। শুধু মার্কসবাদের ভ্রান্তি ও অন্ধত্বকে দেখলে সেটাও হবে আর এক ভ্রান্তি। সকল ত্রুটি ও ভ্রান্তির পাশে তার বিপুল, বিস্ময়কর ও মহৎ অবদান স্বীকার করে নিয়েই আজ আমাদের নূতন পথে যাত্রা শুরু করতে হবে।

এটা ঠিক যে, শুধু আমাদের দেশে নয়, বরং এই উপমহাদেশেই মার্কসবাদ প্রধানত ব্যর্থ। শুধু তাই নয়, এখানে মার্কসবাদ বিপ্লবের জন্যও যথেষ্ট ক্ষতিকর হয়েছে। ব্রিটিশ আমলে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি মার্কসবাদের প্রভাবে যেমন অন্ধ রুশপন্থী হয়েছে এবং নিজ উপমহাদেশের বাস্তবতাকে বুঝতে ও সঠিক ভূমিকা পালন করতে পারে নি তেমন পাকিস্তান আমলে পূর্ব বঙ্গে বিপ্লবপন্থী কমিউনিস্টরাও অন্ধ চীনপন্থী হয়েছে এবং প্রযোজনীয় ভূমিকা পালন করতে ব্যর্থ হয়েছে।

এর জন্য শুধু এ দেশের কমিউনিস্টদের অন্ধত্বকে ও বুদ্ধিহীনতাকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। আসলে মার্কসবাদ এই উপমহাদেশ ও এ দেশের পরিস্থিতির জন্য উপযোগী না হওয়াতেই একে যে যেভাবেই আঁকড়ে ধরুক না কেন ব্যর্থতা ছাড়া সাফল্য পায় নি।

মার্কসবাদ আন্তর্জাতিকতাবাদের দর্শন হলেও বাস্তবে হয়েছে জাতীয়তাবাদের বিভিন্ন পশ্চাৎপদ কিংবা পরাধীন জাতির উত্থান ও স্বাধীনতা অর্জনের হাতিয়ার। তা সমগ্র মানব জাতিকে এক করতে চাইলেও তা জাতির সীমানা ভাঙ্গতে পারে নি, বরং পশ্চাৎপদ জাতির আত্মরক্ষার ও আত্মোন্নতির হাতিয়ার হয়েছে। কারণ মার্কসবাদের ধারণা হ’ল যে, পুঁজির জাতীয়করণ বা সামাজিকীকরণ এবং শিল্পের অবাধ ও বিপুল বিকাশ দ্বারা মানুষ পৌঁছাবে কমিউনিজমে। সুতরাং এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য সমাজতান্ত্রিক সমাজ বা রাষ্ট্রগুলো প্রাণপাত ক’রে কমিউনিজম অর্জন করতে না পারলেও বাস্তবে অর্জন করেছে শিল্প, প্রযুক্তি, শিক্ষা ও সংস্কৃতির বিপুল বিকাশ। এক্ষেত্রে মার্কসবাদ মানুষকে যুগিয়েছে একটা ধর্মীয় প্রেরণা। তবে প্রচলিত ধর্ম যেখানে মানুষের দৃষ্টিকে নিবদ্ধ করে আলোকে ও পরলোকে ফলে মানুষের চিন্তাশক্তি, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিকাশের পথে আরোপ করে দুর্লংঘ্য বাধা সেখানে মার্কসবাদ মানুষের দৃষ্টিকে নিবদ্ধ করে ইহলোকে ও জীবনের উন্নতির দিকে। কিন্ত এই উন্নতি ব্যষ্টির আত্মপরায়ণ সংকীর্ণ উন্নতি নয়। সমগ্র সমাজের সমষ্টিগত উন্নতি হচ্ছে মার্কসবাদের লক্ষ্য। আর এই সমষ্টিগত উন্নতির জন্য বিপুল সংখ্যক কর্মী ও নেতার যে জীবনব্যাপী কঠোর ও নির্মম সাধনা, সংগ্রাম, কষ্ট ও আত্মত্যাগ প্রয়োজন হয় মার্কসবাদ তার জন্য এক ধরনের ধর্মীয় প্রেরণা সঞ্চার করেছে।

এইভাবে এক ধরনের ভাববাদ ও ধর্মীয় শক্তি ভিতরে নিয়ে আধুনিক কালে মার্কসবাদ পশ্চাৎপদ জাতিগুলির উত্থানের হাতিয়ার হওযায় তার ভূমিকা হয়েছে মুখ্যত জাতীয়তাবাদী। আন্তর্জাতিকতাবাদী হয়েই  তা হয়েছে বিভিন্ন অবনত জাতির উন্নতি ও স্বাধীনতার অমিত শক্তিধর হাতিয়ার। অর্থাৎ প্রকৃত পক্ষে আধুনিক যুগে পশ্চাৎপদ সমাজগুলির বিপ্লব মূলত জাতীয়তাবাদী। যদিও মার্কসবাদ নিজে গণতান্ত্রিক নয় তথাপি অনুন্নত জাতিগুলির  অর্থনৈতিক ও শিল্প বিকাশ ঘটিয়ে ভবিষ্যৎ গণতান্ত্রিক বিপ্লব কিংবা পরিবর্তনের জন্য তা অন্তত ক্ষেত্র প্রস্তুত করে দেয়। এর লক্ষণ আমরা আজ মার্কসীয় সমাজতান্ত্রিক পৃথিবীতে দেখছি।

অর্থাৎ আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, সর্বমানবিক ও আন্তর্জাতিকতাবাদী এবং জাতিগত পার্থক্যবিরোধী মার্কসবাদ শেষ পর্যন্ত হয়েছে জাতীয়তাবাদের অচেতন অস্ত্র। এই জন্য তাকে জাতীয়তাবাদের অচেতন অস্ত্র বলছি যেহেতু তা মর্মগতভাবে জাতীয়তাবাদ বিরোধী।

অবশ্য আন্তর্জাতিকতাবাদী মার্কসবাদ শুধু জাতীয়তাবাদের অচেতন অস্ত্র হয় নি। সর্বহারা শ্রেণীর একনায়কত্ববাদী মার্কসবাদ এক অর্থে পুঁজিবাদী গণতন্ত্রেরও অচেতন অস্ত্র হয়েছে। এটা শুধু আজ সমাজতান্ত্রিক পৃথিবীতে গণতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষা জাগ্রত হবার জন্য নয়। বরং এই আকাঙ্ক্ষা জাগার পিছনে অর্থনৈতিক বন্ধ্যাত্ব ও সংকট, অধিকতর উন্নত জীবনের আকাঙ্ক্ষা, স্বৈরতন্ত্রের চাপ ইত্যাদি ছাড়াও কাজ করেছে পশ্চিমের উন্নত গণতান্ত্রিক সমাজগুলির প্রভাব।

মার্কসবাদের উদ্ভব পশ্চিম ইউরোপে। মার্কস-এঙ্গেলস ধারণা করেছিলেন শিল্প বিকাশ ও শ্রমিকের সংখ্যাবৃদ্ধির অনিবার্য ফল হচ্ছে সমাজতন্ত্র ও কমিউনিজম। তাঁরা মনে করতেন যে, শ্রমিকদের নেতৃত্বে শিল্পোন্নত পুঁজিবাদী দেশে সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক বিপ্লব প্রথমে হবে, এবং এই বিপ্লব অনিবার্য। কিন্তু এই বিপ্লব যাতে সঠিকভাবে সম্পন্ন হয় সেইজন্য তাঁরা শ্রমিকদেরকে সচেতন ও সংগঠিত করার উপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেন। মার্কস-এঙ্গেলসের মূল হিসাবই ছিল ভুল। তাই সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব পশ্চিম ইউরোপের শিল্পোন্নত দেশে আগে বা পরে কোন দিনই আর হয় নি। এটা বরং হয়েছে রাশিয়া, চীনের মতো পূর্বের অনুন্নত ও কৃষিভিত্তিক সমাজে। কিন্তু পশ্চিম ইউরোপে সমাজতন্ত্রের প্রেরণায় যে প্রচণ্ড শ্রমিক আন্দোলন বিস্তার লাভ করেছিল তা আমলাতন্ত্র ও ব্যক্তি পুঁজিবাদকে অধিক থেকে অধিকতর গণতন্ত্রের দিকে যেতে বাধ্য করেছে। সংগঠিত শ্রমিক আন্দোলনের চাপকে নিজের পক্ষে ব্যবহার ক’রে পশ্চিম ইউরোপে গণতন্ত্রের রাজনৈতিক-সামাজিক শক্তি পুঁজি কিংবা রাষ্ট্রের স্বৈরতন্ত্রকে ক্রমাগত পিছু হটতে বাধ্য করেতে পেরেছে। উপরন্তু মার্কসবাদ ও মার্কসীয় নিরংকুশ সমাজতন্ত্রকে গ্রহণ না করেও এই গণতান্ত্রিক শক্তি পশ্চিম ইউরোপে সমাজতন্ত্রকেও ব্যবহার করেছে জনগণের উন্নয়ন ও গণতন্ত্রের স্বার্থে। এইভাবে অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশের মাধ্যমে পশ্চিম ইউরোপে উদ্ভব ঘটেছে কল্যাণ রাষ্ট্রের।

 

উপমহাদেশীয় পরিস্থিতিতে মার্কসবাদের দুর্বলতা

পৃথিবীর বহু দেশে মার্কসবাদ বিরাট ভূমিকা পালন করতে পারলেও ভারতীয় উপমহাদেশে তার সাফল্যের তুলনায় ব্যর্থতার ভাগই অনেক বেশী। ভারতীয় উপমহাদেশে মার্কসবাদী আন্দোলনের ইতিহাস দীর্ঘ দিনের। ১৯২০-’২১ থেকে তা এ পর্যন্ত কম ঘটনাবহুল নয়। পশ্চিম বঙ্গ, কেরালা, ত্রিপুরার মতো কিছু প্রদেশ বা অঞ্চলে তা নির্বাচনের মাধ্যমে শাসন ক্ষমতায়ও গেছে। কিন্তু ভারতীয় রাষ্ট্র ক্ষমতাকে প্রভাবিত করার মতো তেমন কোনও ঘটনা সেটা হয় নি। তাছাড়া মার্কসবাদী ধারায় সংগঠিত কৃষক, শ্রমিক ও ছাত্র-তরুণদের সশস্ত্র সংগ্রামও উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থানে কম-বেশী কিছু হয়েছে। অন্ধ্র, পশ্চিম বঙ্গ এবং পাকিস্তান আমলে পূর্ব বঙ্গ এবং স্বাধীন বাংলাদেশে সশস্ত্র মার্কসবাদী আন্দোলন কখন কখন প্রবল হয়েছে। কিন্তু সাফল্যের পথে তা বেশীদূর অগ্রসর হ’তে পারে নি।

এর কারণ হ’ল উপমহাদেশীয় পরিস্থিতির সঙ্গে মার্কসবাদ খাপ খায় নি। এখানকার সামাজিক পরিস্থিতির প্রয়োজন মার্কসবাদ পূরণ করতে পারে নি। বস্তুত ভারতীয় উপমহাদেশে হাজার হাজার বৎসর ধ’রে সমাজ ও অর্থনীতি গঠনে ধর্ম এবং ধর্মীয় বিশ্বাস ভিত্তিক সামাজিক শ্রম-কর্ম বিভাগের যে একটি কেন্দ্রীয় ভূমিকা রয়েছে মার্কসবাদের অর্থনীতিবাদ দ্বারা সেটাকে বোঝা সম্ভব নয়।

এই উপমহাদেশে হাজার হাজার বৎসর ধ’রে সমাজ সংগঠনে ও সমাজ নিয়ন্ত্রণে ধর্ম এক অতীব শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান হয়ে আছে। একদিকে হিন্দু ধর্ম আর একদিকে ইসলাম ধর্ম এই উপমহাদেশে সব রকম সামাজিক প্রগতির বিরুদ্ধে এবং স্থিতাবস্থার পক্ষে অত্যন্ত শক্তিশালী ভূমিকা পালন করছে। কিন্তু ধর্মই আবার উপমহাদেশের তুলনামূলক অখণ্ডতা বা ঐক্যের সবচেয়ে বড় শক্তি। ধর্মীয় অনুভূতির ঐক্যের মধ্যেই আছে ভারতবর্ষের বিভিন্ন ভাষাভাষী জাতিসত্তাসমূহের মধ্যে ঐক্যের মূল ভিত্তি। এ ক্ষেত্রে পরস্পর বিরোধী দুই ধর্ম হিন্দু ও ইসলাম ভারতীয় উপমহাদেশকে দুই বৃহৎ খণ্ডে বিভক্ত করেছিল। ভারত ও পাকিস্তান হ’ল এই ধর্মীয় বিভক্তির রাষ্ট্রীয় রূপ লাভ। অর্থাৎ উপমহাদেশে বহুজাতিসত্তা ভিত্তিক রাজনীতি কিংবা রাষ্ট্রসাধনা অনিবার্যভাবে আত্মসমর্পণ করে ধর্মের কাছে।

এই অবস্থায় উপমহাদেশে রাজনীতি ও রাষ্ট্রসাধনাকে ধর্মের পশ্চাৎপদতা, অন্ধত্ব ও প্রতিক্রিয়াশীলতা থেকে মুক্ত করার প্রধান শক্তিই হচ্ছে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ। কিন্তু মার্কসবাদ জাতীয়তাবাদের এই গুরুত্ব বোঝে না। মার্কস-এঙ্গেলসের বক্তব্য হ’ল, “মেহনতীদের দেশ নেই।” (কমিউনিস্ট ইশতেহার)। তাঁদের আহ্বান কোন বিশেষ দেশের শ্রমিক শ্রেণীর প্রতি নয়। তাঁদের আহ্বান হ’ল, “দুনিয়ার মজদুর এক হও!” (কমিউনিস্ট ইশতেহার)। কাজেই মার্কসবাদীদের মূল কাজ হ’ল অর্থনীতি ভিত্তিক শ্রেণী সংগ্রাম গড়ে তোলা। এমতাবস্থায় ব্রিটিশ শাসনামলে বড় জোর উপনিবেশবাদ বিরোধী সংগ্রামে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি অংশ নিয়েছিল। কারণ সেটা তাদের দর্শন অনুযায়ী আন্তর্জাতিক পুঁজিবাদকে আঘাত করে। কিন্তু ভারতের জাতিসত্তাগুলির স্বাতন্ত্র্য ও স্বাধীন বিকাশের প্রশ্নকে তারা গুরুত্ব দেয় নি বা বিষয়টি চিন্তাই করে নি। তারা যেখানে উপমহাদেশীয় রাষ্ট্র পরিসরে বৃহত্তর শ্রেণী সংগ্রামের ক্ষেত্র পাচ্ছে সেখানে  সেটা পরিত্যাগ ক’রে কেন ক্ষুদ্রতর জাতীয় পরিসরের মধ্যে আশ্রয় নিবে? এ ছাড়া তাদের ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতি অন্ধ আনুগত্য, যেটা দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ কালে তাদেরকে করেছিল সোভিয়েতের মিত্র হিসাবে ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের সহযোগী। এই সময় ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামকে পরিত্যাগ ক’রে তারা জনগণ থেকে অধিকতর বিচ্ছিন্ন হয় এবং স্বাধীনতার শক্তি হিসাবে ভাবমূর্তি হারায়।

পাকিস্তান আমলেও আমরা পূর্ব বঙ্গের কমিউনিস্টদের এই ভুলের পুনরাবৃত্তি করতে দেখি। বস্তুত এটার একটা গুরুত্বপূর্ণ কারণই হ’ল মার্কসবাদে জাতীয়তাবাদের তাৎপর্যহীনতা। বরং এখানে জাতীয়তাবাদ অনাকাঙ্ক্ষিত। তবু সাধারণভাবে সেই সব সমাজ মার্কসবাদকে অবলম্বন ক’রেই জাতীয় বিপ্লব সম্পন্ন করতে পেরেছে যেসব সমাজে জাতিসত্তা ও জাতি চেতনা সংহত ও বলিষ্ঠ শক্তি হিসাবে দীর্ঘ ঐতিহ্যের উপর প্রতিষ্ঠিত। রাশিয়া, চীন, ভিয়েতনাম, কিউবা ইত্যাদি দেশের জাতিসত্তার আত্মচেতনা বিপ্লবের পূর্ব থেকেই এক দৃঢ়বদ্ধ শক্তি।

কিন্তু এই উপমহাদেশে ভাষাভিত্তিক জাতি চেতনা বিভিন্ন ধর্মের প্রভাবে এবং সেই সঙ্গে বর্ণজাতি ব্যবস্থার প্রভাবে কখনই দৃঢ় ভিত্তির উপর দাঁড়াতে পারে নি। এগুলির প্রভাবে এখানে ভাষাভিত্তিক জাতিসত্তাও সংহত, ঐক্যবদ্ধ ও বলিষ্ঠ রূপ নিতে পারে নি। এই রকম অবস্থায় ভারতীয় উপমহাদেশে ভাষাভিত্তিক জাতিসত্তার সংহতি ও বিকাশের স্বার্থে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ হয়ে ওঠে আধিপত্যকারী ধর্ম ও বর্ণজাতি প্রথার বিরুদ্ধে এক প্রচণ্ড শক্তিশালী হাতিয়ার। অর্থাৎ এখানে যুগ যুগান্তের সামাজিক জাড্য ও প্রতিক্রিয়ার নিয়ন্ত্রণ থেকে জনগণকে মুক্ত করতে হলে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের জাগরণ ও প্রতিষ্ঠা অপরিহার্য। জাতীয় বিপ্লবের অচেতন অস্ত্র মার্কসবাদ দ্বারা সেটা সম্ভব নয়। যে ভূভাগে জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ও বিকাশের উপর নির্ভর করে সমাজ বিপ্লব ও জনগণের মুক্তি সেখানে মার্কসবাদ অচল।

তাছাড়া উপমহাদেশের সমাজ বিকাশের ধারাকে মার্কসবাদ দ্বারা ব্যাখা করার উপায় থাকে নি এখানে সমাজ-সংগঠনে ধর্মের বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কারণে। এখানকার অর্থনীতি বা উৎপাদন ব্যবস্থা ছিল ধর্মীয় বিশ্বাস নির্ভর বর্ণজাতি ব্যবস্থা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। ব্রিটিশ শাসনামলের পূর্ব পর্যন্ত ভারতবর্ষে উৎপাদন ব্যবস্থা পরিচালিত হ’ত মূলত সামাজিক শ্রম-কর্ম বিভাগের বর্ণজাতিভেদমূলক ব্যবস্থার ভিত্তিতে। শুধু যে হিন্দু সমাজ বর্ণজাতি প্রথা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ছিল তা-ই নয়, এমনকি মুসলমান সমাজও এর প্রভাব এড়াতে পারে নি। ইসলাম ধর্ম এই ধরনের দৃঢ়বদ্ধ সামাজিক বিভাগকে তত্বগতভাবে অনুমোদন করে না বলে হিন্দুদের মতো তা মুসলমানদের মধ্যে ততো প্রবল হ’তে পারে নি। কিন্তু যতো নীচে যাওয়া গেছে এই ব্যবস্থার প্রভাব ততো গভীর হয়েছে। এবং মুসলমান শ্রমজীবী জনগণের পক্ষে সাধারণভাবে এই ব্যবস্থার জাল ভেদ ক’রে মুক্ত হওয়ার সম্ভব হ’ত না। মোগল আমলে ভারতে আগত বিখ্যাত ফরাসী চিকিৎসক-পর্যটক ফঁ্রাসোআ বার্নিয়ের মুসলমান শিল্পী-কারিগরদেরকেও বর্ণজাতি ব্যবস্থার কঠোর বন্ধনে আবদ্ধ দেখতে পেয়েছিলেন। মুসলিম রাষ্ট্রশক্তি পর্যন্ত এই ব্যবস্থার সংরক্ষক ছিল। বার্নিয়ের তাঁর ভ্রমণ বৃত্তান্তে বলছেন, “সূচিশিল্পী যে, সে তার পুত্রকেও সূচিশিল্পে শিক্ষা দেয়; স্বর্ণকার যে, সে তার পুত্রকে করে স্বর্ণকার এবং শহরের বৈদ্য যে, সে তার পুত্রকেও বৈদ্য করতে চায়। সমধর্মী শিল্পীগোষ্ঠীর মধ্যেই সকলে বিবাহাদি করে। এই সামাজিক বিধি হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের কারিগররা কঠোরভাবে পালন করে। এর কোনরকম ব্যতিক্রম আইনের চোখে পর্যন্ত নিষিদ্ধ।”১৫

উপমহাদেশের প্রায় সর্বত্রই বর্ণজাতিভেদ প্রথা সেদিন পর্যন্ত ছিল সার্বজনীন বাস্তবতা। নযমুল করিম তাঁর সমাজতত্ত্বের গবেষণা গ্রন্থ Changing Society in India and Pakistan-এ বলছেন, “সুতরাং আমরা দেখছি, বাংলায় (ভারতের অন্য সব অঞ্চলের মতোই) মুসলমান সম্প্রদায়ের ভিতরে বিভিন্ন গোষ্ঠী এবং শ্রেণী কম বা বেশী হিন্দুদের বর্ণজাতি ব্যবস্থার মতো ক’রে সংগঠিত হয়েছিল।”১৬ এই একই গ্রন্থে ১৯১৪ সালে প্রকাশিত J. Talke-এর Islam in Bengal থেকে আমরা যে উদ্ধৃতি পাই সেখানে Talke বলছেন, “বস্তুত অনেক ক্ষেত্রেই পেশাগত গোষ্ঠীগুলো এতো স্বতন্ত্র যে, তারা কখনও নিজেদের মধ্যে বিবাহ কিংবা একত্রে আহার করবে না।”১৭ (পৃষ্ঠাঃ ১৩৩) এটা বঙ্গে মুসলমান সম্প্রদায়ের অবস্থা সম্পর্কে বর্ণনা।

অর্থাৎ বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকেও আমরা বঙ্গে মুসলমানদের মধ্যে বর্ণজাতিভেদ প্রথার গভীর প্রভাব দেখতে পাই। এটা ঠিক যে, এই বর্ণজাতিভেদ প্রথা হুবহু হিন্দু সম্প্রদায়ের মতো মুসলমান সম্প্রদায়ের ভিতরে ছিল না। কারণ বর্ণজাতিভেদের মূল দার্শনিক ও ধর্মীয় ভিত্তি জন্মান্তরবাদ ও কর্মফলবাদের কোন স্বীকৃতি ইসলাম ধর্মে নেই। কিন্তু তা সত্ত্বেও মুসলমান সম্প্রদায় বর্ণজাতিভেদ ব্যবস্থাকে গ্রহণ ক’রে নিয়েছিল একটা ব্যবহারিক সামাজিক ব্যবস্থা হিসাবে। এর প্রধান কারণ হ’ল বর্ণজাতিভেদ প্রথা শ্রম-কর্ম ভিত্তিক শ্রেণীভেদের একটা নির্দিষ্ট ভারতীয় রূপ। এই প্রথাকে অবলম্বন ক’রে এই উপমহাদেশে সমাজ ও রাষ্ট্র শাসন এবং শ্রম শোষণের মূল পদ্ধতি তথা সমাজ, অর্থনীতি ও সভ্যতার বিকাশের মূল পদ্ধতি গড়ে উঠেছিল। তাই ব্রিটিশ পূর্ব কালে এই ভূভাগে সব শাসক শ্রেণীই এটাকে হয় ব্যবহার করেছে নয় মেনে নিয়েছে। কেবলমাত্র ব্রিটিশ শাসনামলে আধুনিক যন্ত্র সভ্যতার আঘাত একে অর্থনীতির বা উৎপাদন ব্যবস্থার ক্ষেত্রে গুঁড়িয়ে দেয়। কিন্তু হিন্দু সম্প্রদায়ের সমাজ জীবনে বর্ণজাতিভেদের সামাজিক-ধর্মীয় প্রভাব আজও শেষ হয় নি।

বর্ণজাতিভেদ ভিত্তিক সামাজিক পরিস্থিতিতে ভারতের শ্রমজীবী জনগণ ছিল মূলত নিরস্ত্র ও অহিংস। কারণ বর্ণজাতিভেদ ভিত্তিক হিন্দু ধর্মের বিধান শ্রমজীবী শূদ্র জনগণের জন্য অস্ত্র ধারণ নিষিদ্ধ করেছিল। বস্তুত ক্ষত্রিয়ের বাইরে অন্য কোন জাতিবর্ণ বা গোষ্ঠীর পক্ষে যুদ্ধ করা ছিল অসিদ্ধ। সুতরাং হাজার হাজার বৎসর ধরে ব্যাপক ভারতীয় জনগণ থেকেছে অসামরিক ও যুদ্ধবিমুখ। কিন্তু বিপ্লব তো সশস্ত্র বা সামরিক পদ্ধতিতে ক্ষমতা দখল দ্বারা সমাজের পরিবর্তন সাধনের ব্যাপার। এ ক্ষেত্রে এ দেশের শ্রমজীবী জন-মানস সহায়ক হয় নি। শ্রমিক ও কৃষককে অবলম্বন ও ভিত্তি ক’রে সশস্ত্র সংগ্রাম গড়তে গিয়ে এই উপমহাদেশে মার্কসবাদীরা বার বার ব্যর্থ হয়েছে। বাস্তবে তারা যেটা করেছে সেটা হ’ল সংস্কারবাদ। সামান্য কিছু সশস্ত্র প্রচেষ্টা উল্লেখ্য অগ্রগতি ঘটাতে পারে নি।

পূর্ব বঙ্গে বা বর্তমান বাংলাদেশের পরিস্থিতি অবশ্য কিছুটা ভিন্ন। এ দেশে সংখ্যাগুরু জনসংখ্যা মুসলমান এবং ব্রিটিশ আমলে দীর্ঘকাল ব্যাপী বিভিন্ন ধর্মীয়-সামাজিক আন্দোলনের প্রভাবে মুসলমান শ্রমজীবী জনগণের ভিতর থেকে বর্ণজাতিভেদেমূলক ব্যবস্থার প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ অনেক পূর্বেই মূলত নির্মূল হয়েছে। ইসলাম ধর্মে বর্ণজাতিভেদের কোন স্থান না থাকায় এটা সহজে করা গেছে। তবু এখানে সাধারণ মানুষের চেতনায় বর্ণজাতিভেদ ভিত্তিক অহিংস ও নিরস্ত্র সমাজের একটা প্রভাব যেমন থেকেছে তেমন এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ইসলামী ব্যবস্থার প্রবল প্রভাব।

 

ইসলামের মোকাবিলায় মার্কসবাদের অসহায়তা

মার্কসবাদ আন্তর্জাতিকতাবাদী। কিন্তু ইসলাম আপাতদৃষ্টিতে তার চেয়েও কঠোরভাবে আন্তর্জাতিকতাবাদী। বির্মূত আন্তর্জাতিকতাবাদী কিছু হ’তে পারে না। তাই মার্কসবাদ বিভিন্ন জাতির জাতীয় বিপ্লবের হাতিয়ার হ’তে গিয়ে সেইসব জাতির জাতীয়তাবাদের হাতিয়ার হিসাবে দেখা দিয়েছে। তা সত্ত্বেও মার্কসবাদ কোন নির্দিষ্ট জাতির দর্শন বা হাতিয়ার হিসাবে গড়ে না ওঠায় তা নির্দিষ্ট কোন জাতির জাতীয়তাবাদের বাহন বা হাতিয়ার নয়।

কিন্তু ইসলামের আন্তর্জাতিকতাবাদ হ’ল সমস্ত অনারব জাতির আরবকরণ ভিত্তিক। ইসলামের আন্তর্জাতিকতাবাদ সুনির্দিষ্টভাবে, কঠোরভাবে এবং নিরংকুশভাবে আরব কেন্দ্রিক। সমগ্র পৃথিবীকে ইসলামে দীক্ষিত করা এবং সেই সঙ্গে আরব করা তার লক্ষ্য। তাই তার উপাসনা শুধু কাবা বা আরব কেন্দ্রিক নয়, তার ধর্মচর্চাও হয় বাধ্যতামূলকভাবে আরবী ভাষায়। ইসলামের বিজয় অভিযান বিশাল ভূভাগে শুধু ইসলামকে প্রতিষ্ঠা করে নি, সেই সঙ্গে আরবের ভাষা ও সংস্কৃতিকেও প্রতিষ্ঠা করেছে বিশাল জনগোষ্ঠীর আরবকরণ দ্বারা। মূল আরব ভূ-খণ্ডের বাইরে সিরিয়া, ইরাক, প্যালেস্টাইন এবং মিসর, সুদান থেকে মরক্কো, মৌরিতানিয়া পর্যন্ত প্রায় সমগ্র উত্তর আফ্রিকার জনগোষ্ঠীকে ইসলামের প্রসার আরব জাতিভুক্ত করে নিয়েছে। যেখানে আরবকরণ হয় নি সেখানেও অনারবদের ইসলাম গ্রহণের সাথে নাম পরিবর্তন ক’রে আরবী ভাষায় নামকরণ করা হয়। সুতরাং ইসলাম সবাইকে আরব জাতিভুক্ত ও ইসলাম ধর্মভুক্ত করেই তার কঠোর ও অখণ্ড আন্তর্জাতিক আরব সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে চায়। অর্থাৎ ইসলাম মর্মমূলে আরব জাতীয়তাবাদী।

এমন অবস্থায় আন্তর্জাতিকতাবাদী হয়ে মার্কসবাদ ইসলামের আরব কেন্দ্রিক আন্তর্জাতিকতাবাদের বিকল্প হয়ে দেখা দেয় নি। এ ক্ষেত্রে বরং নিজ ভাষা ও সংস্কৃতি ভিত্তিক জাতীয়তাবাদই হ’তে পারে আমাদের মতো অনারব ও মুসলিম সমাজে ধর্মীয় আদর্শের বিকল্প। অর্থাৎ এখানে প্রধানত ভাষাভিত্তিক জাতি চেতনার জাগরণ ঘটিয়েই আগ্রাসী আরব জাতীয়তাবাদের আদর্শিক বাহন ইসলামের বিকল্প শক্তি সৃষ্টি করা যায়।

মার্কসবাদ মানবিক কোন বিভেদে বিশ্বাস করে না। তা বিশ্বাস করে সাম্যে। ইসলামেও আল্লাহ্‌র দৃষ্টিতে সব মানুষকে সমান ঘোষণা করা হয়েছে। ব্যক্তিগত সম্পত্তির স্বীকৃতি ইসলামে থাকলেও তা ধন বৈষম্যকে সংযত রাখার চেষ্টা করে। সুতরাং এ ক্ষেত্রে ইসলামী সমাজে মার্কসবাদের বিশেষ আবেদন থাকে না। যদি প্রয়োজন হয় তবে জাতীয়করণ ইসলামের নামেও হ’তে পারে। কারণ ইসলামে ব্যক্তিগত সম্পত্তি কোন অলংঘনীয় ও পবিত্র সত্তা নয়। বরং কোর্‌আনে একাধিকবার বলা হয়েছে, “আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে যাহা কিছু আছে তাহা আল্লাহ্‌রই।” (৫৩-সূরা নাজমঃ ৩১-আয়াত)১৮

কিংবা “আসমান ও জমিনে যাহা কিছু আছে সমস্ত আল্লাহরই।” (৩-সূরা আল ইমরানঃ ১০৯-আয়াত)

কিংবা বলা হয়েছে, “আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সার্বভৌম ক্ষমতা আল্লাহ্‌রই।” (৯-সূরা তাওবাঃ ১১৬-আয়াত)
অর্থাৎ ইসলামেও আল্লাহ্‌র নামে রাষ্ট্রীয়করণ কিংবা সমাজতন্ত্র সম্ভব। এই কাজ বিভিন্ন সময়ে হয়েছে লিবিয়া, আলজিরিয়া, মিসর, সিরিয়া, ইরাক ইত্যাদি আরব মুসলিম দেশে। তাই এইসব সমাজে মার্কসবাদের প্রয়োজন হয় না। ইসলাম এবং আরব জাতীয়তাবাদের নামে এবং ইসলাম রক্ষা ক’রেই তারা সেই কাজ করতে পারে। সব রাষ্ট্রে ইসলামের নামে সমাজতন্ত্র না হলেও অন্তত এর জন্য ইসলামকে আঘাত করতে হয় নি।

বস্তুত ইসলাম যেখানে সাম্য দেয় নি সেই জায়গাটিকে চিহ্নিত করতে না পারলে ইসলামের নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় সফলভাবে আঘাত করা কখনই সম্ভব নয়। শুধু ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদকে অবলম্বন করেও বিশেষ লাভ হবে না যদি এই দিকটা বোঝা না যায়।

এই বিষয়টি বোঝা খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে, ইসলাম যে সাম্য দিয়েছে তা হ’ল পুরুষের সঙ্গে পুরুষের সাম্য। পুরুষ এবং নারীর সমতা ইসলামের আদর্শ বহির্ভূত। কোর্‌আনে বলা হয়েছে, “পুরুষ নারীর কর্তা, কারণ আল্লাহ্‌ তাহাদের এককে অপরের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করিয়েছেন এবং পুরুষ তাহাদের ধন-সম্পদ ব্যয় করে।” (৪-সূরা নিসাঃ ৩৪-আয়াত)। পুরুষ নারীর তুলনায় শ্রেষ্ঠ। সুতরাং একজন পুরুষ একত্রে চারজন পর্যন্ত স্ত্রী রাখতে পারে। যুদ্ধ দ্বারা কিংবা অর্থ দ্বারা নারীকে দাসী ক’রে রাখা যাবে যে কোনও সংখ্যায় এবং পুরুষ প্রভু তাদেরকে শয্যাসঙ্গিনী হ’তে বাধ্য করতে পারবে। কোর্‌আনে বলা হচ্ছে, “যাহারা নিজদিগের যৌন অঙ্গকে সংযত রাখে তবে নিজদিগের পত্নী অথবা অধিকারভুক্ত দাসীগণের ক্ষেত্রে অন্যথা করিলে তাহারা নিন্দনীয় হইবে না।” (২৩-সূরা মু’মিনূনঃ ৫-৬ আয়াত)।

নারী-পুরুষে সমাধিকার নেই। তাই নারীর স্থান নির্দেশ করা হয়েছে গৃহে এবং তাদেরকে কঠোরভাবে পর্দার অন্তরালে থাকতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কোর্‌আনে নারীদের জন্য পর্দা ব্যবস্থার বিশদ আদেশ আছে। এ ছাড়া হাদীসে এ সম্পর্কে আরও বিশদ আদেশ ও বিধিনিষেধ দেওয়া হয়েছে।

হাদীসে আমরা দেখতে পাই ইসলামের নবী মোহাম্মদ বলছেন, “নারী জাতি আড়ালে থাকার বস্তু; আড়াল হইতে বাহির হইলেই শয়তান তাহার প্রতি উঁকি মারে।” (বোখারী শরীফ)। “একাকী কোন নারীর সঙ্গে নরের সাক্ষাৎ হইলেই শয়তান তাহাদের তৃতীয় জন হয়।” (বোখারী শরীফ)। কিংবা “নারী শয়তানের আকৃতিতে সম্মুখে আসে এবং শয়তানের আকৃতিতে চলিয়া যায়।”১৯ (বোখারী শরীফ)।

সুতরাং ইসলামে মানুষের যে সমতা আছে বলা হয় সেটা নারী-পুরুষে নেই। বরং সেটা আছে পুরুষে পুরুষে। অর্থাৎ ইসলামের মানুষ মূলত পুরুষ, নারী নয়।

তাই ইসলামের জগতে সেই আদর্শই ইসলামের বিকল্প ও শ্রেষ্ঠ আদর্শ হিসাবে আবেদন সৃষ্টি করতে পারে যা নারীর সমাধিকার ও মুক্তির উপর দিবে বিশেষ গুরুত্ব। কিন্তু মার্কসবাদ অর্থনৈতিক শ্রেণীর বাইরে সমাজে আর কোন ভাগ দেখতে পায় না। তার মানবতা বোধ তাকে নারীমুক্তির সমর্থক করেছে। কিন্তু তার উপর বিশেষ গুরুত্ব দেবার ব্যাপার মার্কসবাদে নেই। শ্রমিক শ্রেণী কিংবা শ্রমজীবী জনগণের বাইরে নারীর স্বতন্ত্র অস্তিত্ব মার্কসবাদ দেখে না। তার প্রতি স্বতন্ত্র গুরুত্ব দিলে সর্বহারা শ্রেণীর একত্ব বা অবিভাজ্যতা বিনষ্ট হয়। এইভাবে দ্বৈত সত্তার অস্তিত্ব ও ভূমিকা বুঝতে কিংবা স্বীকার করতে না চাওয়ায় নিরংকুশ ঐক্য বা একত্বের পূজারী হয়ে মার্কসবাদ হয়েছে একতান্ত্রিক। আর নিরংকুশ একতান্ত্রিক হয়ে মার্কসবাদ শেষ পর্যন্ত পুরুষতন্ত্রই।

ইসলামও নিরংকুশ একতন্ত্রী। তার ধারণা সব এসেছে এক থেকে। এক আল্লাহ্‌ সমস্ত সৃষ্টির উৎস। আবার আল্লাহ্‌র সৃষ্টি এক আদম সমস্ত মানুষের উৎস। নারীর সৃষ্টিও পুরুষ থেকে। আদি মানবী হাওয়ার সৃষ্টি আদি মানব আদমের পাঁজরের হাড় থেকে। এটাই ইসলামের সৃষ্টিতত্ত্ব। হাদীসে বলা হয়েছে, অর্থাৎ নবী বলছেন, “নারী (সর্বপ্রথম নারী, হাওয়া) (আদি মানব) আদমের পাঁজরের (ঊর্ধ্বতম) হাড় হইতে সৃষ্টি।” (বোখারী শরীফ)। কোর্‌আনে বলা হয়েছে, “হে মানব! তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে ভয় কর যিনি তোমাদিগকে এক ব্যক্তি হইতেই সৃষ্টি করিয়াছেন ও যিনি তাহা হইতে তাহার সংঙ্গিনী সৃষ্টি করেন...।” (৪-সূরা নিসাঃ ১-আয়াত)।” তিনি তোমাদিগকে সৃষ্টি করিয়াছেন একই ব্যক্তি হইতে। অতঃপর তিনি তাহা হইতে তাহার সঙ্গিনী সৃষ্টি করিয়াছেন।” (৩৯-সূরা যুমারঃ ৬-আয়াত)।

আল্লাহ্‌ এক। তার সৃষ্টি মানুষ পুরুষ রূপে এক। অর্থাৎ আল্লাহ্‌র একত্ব পুরুষের একত্বে প্রতিফলিত। নারীর সৃষ্টি পরে এবং পুরুষ থেকে। মানুষ এসেছে স্বর্গ থেকে। আল্লাহ্‌র কাছ থেকে। শেষ পর্যন্ত আবার ফিরে যাবে সেখানে। তবে এই আসা এবং যাওয়ার মাঝখানে আছে শয়তানের ষড়যন্ত্র ও কুপ্রভাব। অর্থাৎ প্রকৃতির দ্বৈততা বা দ্বন্দ্ব প্রতিফলিত আল্লাহ ও শয়তানের সম্পর্কের মধ্যে। শয়তানের প্রয়োজন হ’ল মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের পরীক্ষার পর তার স্বর্গে প্রত্যাবর্তনের জন্য। অর্থাৎ সৃষ্টির অনিবার্য দ্বন্দ্ব বা দ্বৈততাকে মেনে নিতে হয় বস্তুজগতে। কিন্তু কল্পনার জগতে একে করা হয় অস্বীকার। তাই ধারণা করা হয় সব এসেছে এক থেকে, দ্বন্দ্বহীনতা থেকে এবং ফিরে যাবেও সেখানে। আর বস্তুজগতে যে দ্বন্দ্ব ও দ্বৈততা আছে তা ঘৃণ্য। তাই এই দ্বন্দ্ব ও দ্বৈততার প্রতীক শয়তানও ঘৃণ্য।

এই জায়াগায় একতন্ত্রী ধর্ম ইসলামের সঙ্গে মার্কসবাদের বড় মিল। তাই তার শ্রেণী এসেছে শ্রেণীহীন সমাজ থেকে। আদিম সাম্যবাদে সব মানুষ ছিল এক। সেখানে ছিল না এঙ্গেলসের ভাষায় “অভ্যন্তরীণ বিরোধ”। এই বিরোধ দেখা দিল শ্রেণীভেদ থেকে। ব্যক্তিগত সম্পত্তির মালিক সৃষ্টি দ্বারা শ্রেণীভেদ এল আদিম সাম্যবাদে মানুষের যে অজ্ঞতা, পশ্চাৎপদতা ও দারিদ্য ছিল তা দূর করার জন্য। তারপর যখন সমাজে উৎপাদন শক্তির বিপুল বিস্তার ঘটবে তখন এক সময় শ্রেণীভেদের প্রয়োজন শেষ হবে, ফলে মানুষ ফিরে যাবে উচ্চতর সাম্যবাদে। তাই মার্কসবাদের স্বর্গ হ’ল সাম্যবাদ। মার্কসবাদের ঈশ্বর হ’ল “সর্বহারা শ্রেণী”। বস্তুত তা হ’ল মানুষের একত্ব সম্পর্কে ধারণা। এটা হ’ল এক অখণ্ড মানবসত্তা। দ্বন্দ্বহীন মানবসত্তা। এই মানবসত্তা সর্বহারা শ্রেণীর রূপ ধ’রে মানুষকে ফিরিয়ে নিবে সাম্যবাদে। কাজেই ব্যক্তিগত সম্পত্তিভিত্তিক মালিক শ্রেণী ও শ্রেণীভেদ হ’ল মার্কসবাদের শয়তান।

সুতরাং দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ প্রয়োগ করলেও মার্কসবাদের অন্তর্গত প্রেরণা বস্তুবাদ নয় বরং ভাববাদ এবং এক ধরনের একত্ববাদী ধর্ম, যদিও এই ধর্ম শিল্প যুগের ধর্ম। তাই এতে সর্বশক্তির আধার অলৌকিক ঈশ্বরের আরাধনা ও পরলোকের অনন্ত সুখময় স্বর্গের ধ্যান না রেখে রাখা হয়েছে অখণ্ড মানবসত্তার ধ্যান, যা শুদ্ধ ও অবিভাজ্য মানবতার ধ্যানেরই নামান্তর এবং ইহলোকেই সমগ্র মানবসত্তার অনন্ত সুখ ও উন্নয়নের সাধনা।

বস্তুত যে কোন নিরংকুশ একত্বের ধারণা স্বৈরতন্ত্রের জন্ম দিতে বাধ্য। সব এক হলে অর্থাৎ শুধু এক থাকলে দ্বন্দ্ব থাকে না। নিরংকুশ এক মানে নিয়মহীন। যেহেতু দুই হলেই দেখা দেয় দ্বন্দ্ব ফলে দেখা দেয় দ্বন্দ্বকে সংযত রাখতে গিয়ে ঐক্যের প্রয়াস সেহেতু গড়ে ওঠে নিয়ম, শৃঙ্খলা, সংযম ও সহিষ্ণুতা। নিরংকুশ একের ক্ষেত্রে নিয়ম, শৃংখলা এসব অর্থহীন। তাই সব একতান্ত্রিক দর্শন বা চিন্তাই জন্ম দেয় অসংযত, অসহিষ্ণু একনায়কতন্ত্র বা স্বৈরতন্ত্রকে। প্রকৃতির দ্বৈততাকে সমাজ জীবনে অস্বীকার বা জোর ক’রে চাপা দিতে গিয়ে অবলম্বন করতে হয় একের স্বৈরতাকে।

এই একের স্বৈরতন্ত্র দ্বারা ইসলাম সমাজ জীবনে নারী-পুরুষ সম্পর্কের ক্ষেত্রে পুরুষের যে স্বৈরতন্ত্র সৃষ্টি করে মার্কসবাদ তার সমাধান দিতে পারে না। ইসলামের নিরংকুশ এক আল্লাহ্‌র ধ্যানের মতো মার্কসবাদের সর্বহারা শ্রেণীর নামে নিরংকুশ এক ও অবিভাজ্য মানবসত্তার ধ্যান মানুষের দ্বৈত সত্তাকে অস্বীকার করে বলে নারীর স্বতন্ত্র অবস্থান শেষ পর্যন্ত দেখতে পায় না। তাই ইসলামের মতো উগ্র ও অসহিষ্ণু পুরষতন্ত্র না হলেও শেষ পর্যন্ত মার্কসবাদও পুরুষতন্ত্রই।

একতন্ত্র যেমন ইসলামকে নারী-পুরুষ সম্পর্কের ক্ষেত্রে করেছে একনায়কী বা স্বৈরতন্ত্রী তেমন সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রেও করেছে একনায়কী বা স্বৈরতন্ত্রী। আমরা ইতিপূর্বেই দেখেছি যে, নিরংকুশ একক সত্তার কোন নিয়ম প্রয়োজন হয় না। এই সর্বশক্তিমান সত্তার কোন প্রতিপক্ষ থাকে না যার সঙ্গে সম্পর্ক নির্ধারণের প্রয়োজনে দেখা দেয় নিয়ম বা শৃংখলা। একত্বের উপর এই নিরংকুশ গুরুত্ব আরোপ সমাজ জীবনে সমাজের ঐক্যের কেন্দ্রীয় শক্তিকে দেয় নিরংকুশ এককেন্দ্রিকতা ও ক্ষমতা, যা দেখা দেয় কেন্দ্রীয় একমাত্র শাসকের নিরংকুশ স্বৈরতন্ত্র ও একনায়কত্ব রূপে। বিশ্বাসের আল্লাহ্‌র বাস্তব রূপ বা প্রতিনিধি হিসাবে দেখা দেয় সমাজ শাসক। আল্লাহ্‌র একত্ব ও সর্বশক্তিমানতা ক্ষুদ্র ও মূর্ত রূপে প্রতিফলিত হয় সমাজ শাসকের নিরংকুশ একনায়কত্ব ও স্বৈরতন্ত্রের মধ্যে। ইসলামী সমাজের শাসকরা নিজেদের নিরংকুশ ও প্রতিকারহীন স্বৈরতন্ত্রকে চালায় আল্লাহ্‌র একত্বের নামেই। সমাজ মানসে ইসলামের প্রভাবে যে একতান্ত্রিক চিন্তা পদ্ধতি গড়ে ওঠে তার সঙ্গে এই এক ব্যক্তির স্বৈরতন্ত্র চমৎকার খাপ খায়। আর তাই ইসলামী জগতে মার্কসবাদের সর্বহারা শ্রেণীর একনায়কত্বের প্রয়োজন হয় না। সেখানে তার পরিবর্তে আছে আল্লাহ্‌র একনায়কত্বের ধারণা এবং সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও ধর্মীয় জীবনে তার অব্যাহত চর্চা। সর্বহারা শ্রেণীর একনায়কত্ব যেমন কার্যকর হয় কমিউনিস্ট পার্টি ও তার নেতার মাধ্যমে আল্লাহ্‌র একনায়কত্ব তেমন কার্যকর হয় রাষ্ট্র ও তার শাসকের মাধ্যমে।

এমন এক অবস্থায় ইসলামে আবদ্ধ চেতনার কাছে মার্কসবাদের প্রয়োজন কেন হবে? মার্কসবাদ ইহলোকেই শুদ্ধ ও অনন্ত সুখময় স্বর্গরাজ্য প্রতিষ্ঠার যে প্রতিশ্রুতি দেয় ইসলাম যদি শুধু পরলোক চর্চা না ক’রে তার সঙ্গে ইহলোকে বৈষয়িক উন্নতির প্রতিও স্বীকৃতি দেয় তাহলেই তো আর ইসলামী চেতনার কাছে মার্কসবাদের কোনই আবেদন থাকে না। যদিও তেমন কোন বৈষয়িক উন্নতির ব্যবস্থা ইসলাম অনুমোদন করে না তবু ইসলাম বৈষয়িক প্রেরণা খারিজও করে নি। কঠোর ধর্মীয় অনুশাসন ও বিশ্বাসের উগ্রতা দ্বারা জ্ঞান-বিজ্ঞান সাধনা ও মননশীলতাকে তা কঠোরভাবে বেঁধে রাখলেও অপরের সাধনা দ্বারা সৃষ্ট উন্নত বৈষয়িক উপকরণকে ইসলাম গ্রহণ, দখল কিংবা আত্মসাৎ করতে জানে। সুতরাং ইসলাম রাষ্ট্রীয় স্বৈরতন্ত্র দ্বারা অর্থনৈতিক উন্নয়নের একটা পথ দিতে পারে। এই পথেই এগিয়ে যাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের ইসলামী রাষ্ট্রগুলি। এই পথে যতোই সীমাবদ্ধতা বা দুর্বলতা থাক মার্কসবাদ সেখানে অসহায়। ইসলামের প্রতিরোধ শক্তি ভাঙ্গবার ক্ষমতা মার্কসবাদের চিন্তা পদ্ধতিতেই নেই বলে ইসলামের জগতে মার্কসবাদ ব্যর্থ।

 

বিপ্লবের অনিবার্যতা

আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, এ দেশের বাস্তবতায় মার্কসবাদের পক্ষে বিপ্লব করা সম্ভব ছিল না বলেই তা এখানে ব্যর্থ হয়েছে। অথচ মার্কসবাদের আন্তর্জাতিক প্রভাব ও ভূমিকা আমাদের দেশে সুদীর্ঘকাল ধরে বিপ্লবী শক্তিকে আটকে রেখেছিল এবং তার বিকাশের পথ রুদ্ধ করে রেখেছিল। এমন একটি অবস্থায় মার্কসবাদের আন্তর্জাতিক বিপর্যয় আমাদের দেশের বিপ্লবের জন্য এখন আশীর্বাদ হয়ে দেখা দিবে।

এ দেশের সমাজ বিপ্লব লোকবাদ, ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ, জনগণের গণতন্ত্র এবং নারীর মুক্তিকে অবলম্বন ক’রে দাঁড়াবে। লোকবাদ ব্যতিরেকে অন্য সকল ক্ষেত্রে মার্কসবাদ প্রতিবন্ধক হয়ে ছিল। বিশেষত আমলাতন্ত্র এ দেশে মূল ও প্রধান শাসক শ্রেণী হলেও মার্কসবাদ ব্যক্তিগত সম্পত্তির বাইরে শাসক শ্রেণী বোঝে না বলে এই আমলাতন্ত্র বিরোধী সংগ্রামের সঠিক পদ্ধতিও তার অজানা। শুধু তাই নয়, বাস্তবে মার্কসবাদ নিরংকুশ আমলাতন্ত্রের দর্শন অর্থাৎ শ্রেণী বিচারে মার্কসবাদের ভিত্তি হ’ল রাষ্ট্রীয় আমলা শ্রেণী।

এমন অবস্থায় এ দেশে এ যাবৎকাল মার্কসবাদ প্রকৃতপক্ষে সমাজ বিপ্লবের প্রতিবন্ধক শক্তি হিসাবে ভূমিকা পালন করেছে। সুতরাং আজ যে প্রতিক্রিয়ার শক্তিসমূহ এ দেশে মার্কসবাদের সংকটে আনন্দিত তাদের আনন্দের কোনই কারণ নেই। আর যাঁরা মার্কসবাদকে বিপ্লবের সমার্থক ধরে নিয়ে সমাজ বিপ্লব সম্পর্কেই হতাশ হয়েছেন তাঁদেরও হতাশ হবার কারণ নেই। বরং বিপ্লবের নবতর ও উজ্জ্বলতর সম্ভাবনায় আজ এ দেশের সকল বিপ্লবপন্থী, দেশপ্রেমিক ও প্রগতিশীল শক্তির নূতন উদ্যোগ নেবার সময় এসেছে।

অসংখ্য দুঃখ জর্জরিত ও বিপুল সংকট পীড়িত এই দেশে বিপ্লব ছাড়া মুক্তির পথ নেই। তাই সমাজ বিপ্লব আমাদের অনিবার্যতা। কিন্তু সমাজ বিপ্লব করতে গিয়ে আমাদের সমাজ বিপ্লব সম্পর্কে মার্কসবাদী সনাতন ধারণা বর্জন করতে হবে। আজকের যুগে সমাজ বিপ্লব সম্পর্কে একটা ধারণা হয়েছে যে, ব্যক্তি মালিকানার সম্পূর্ণ উচ্ছেদ ছাড়া সমাজ বিপ্লব হয় না। কারণ ধারণা করা হয় যে, এ ছাড়া শোষণ উচ্ছেদ হয় না। আমরা দেখেছি ব্যক্তি মালিকানা উচ্ছেদ দ্বারাও শোষণ উচ্ছেদ হয় না। বরং শোষণের দায়িত্ব ব্যক্তির বদলে গ্রহণ করে রাষ্ট্র বা সরকার। সুতরাং সমাজ বিপ্লবের এই ধারণা আমাদেরকে বদলাতে হবে।

আমরা দেখেছি যে, ধনিক শ্রেণীর ক্ষেত্রে এ দেশে ব্যক্তি মালিকানা উচ্ছেদ করতে হবে। কিন্তু সেটা সব রকম শোষণ চিরতরে উচ্ছেদের জন্য নয়। কারণ সেটা অসম্ভব। বরং এটা এই জন্য যে, এ ছাড়া আমরা বর্তমান স্বৈরতন্ত্রী শাসক ও শোষকদের উচ্ছেদ করতে পারব না, যারা এ দেশের পশ্চাৎপদতা ও দারিদ্যের, অশিক্ষা ও অজ্ঞতার প্রধান কারণ হয়ে আছে।

এটা করতে গিয়ে আমাদের জাতীয়করণের আশ্রয় নিতে হবে। ফলে আমাদের বিপ্লবে সমাজতান্ত্রিক বৈশিষ্ট্য দেখা দিবে। কিন্তু এই বিপ্লব প্রকাশ রূপের দিক থেকে সমাজতান্ত্রিক হলেও তার মর্ম হবে গণতান্ত্রিক। এর অভিমুখ হবে সাম্যবাদ নয়, বরং একটি বিকশিত, শিল্পোন্নত ও উদার গণতান্ত্রিক সমাজ। সুতরাং এই বিপ্লব ধনিক শ্রেণীর ব্যক্তি মালিকানা উচ্ছেদ করলেও মেহনতী মানুষের ব্যক্তি মালিকানা সংরক্ষণ করবে। একইভাবে এই বিপ্লব বর্তমান স্বৈরাচারী আমলা-ধনিক শ্রেণীর প্রতি একনায়কত্ব প্রয়োগ করলেও জনগণের জন্য তা সংরক্ষণ করবে ব্যক্তি স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র।

আমাদের নূতন গণতান্ত্রিক বিপ্লব শ্রেণী সংগ্রামকে অস্বীকার করবে না। বরং নারী, শ্রমিক ও কৃষকসহ নির্যাতিত, দরিদ্র, মেহনতী ও উৎপাদক জনগোষ্ঠীকে অবলম্বন করেই এই বিপ্লব স্বৈরাচারী শাসক ও শোষক আমলা-ধনিক শ্রেণীর বিরুদ্ধে সংগ্রাম পরিচালনা করবে। এই সংগ্রামের মাধ্যমে এই শাসক ও শোষকদের উচ্ছেদ দ্বারা শ্রেণী সংগ্রাম শেষ হবে আমরা এমন মনে করব না। কারণ এর দ্বারা শ্রেণী সংগ্রামের বর্তমান রূপের অবসান হবে মাত্র। কিন্তু আগামী সমাজে নূতন রূপে শ্রেণী সংগ্রাম আবির্ভূত হবে। আমাদের উচিত হবে এই াস্তবতাকে মেনে নেওয়া এবং এই শ্রেণী সংগ্রাম যাতে সমাজের ক্রমবর্ধমান বিকাশ এবং উৎপাদক, শ্রমজীবী ও দুর্বলতর মানুষের কল্যাণ ও মুক্তির স্বার্থে ব্যবহৃত হয় সেই দিকে লক্ষ্য রাখা।

মানুষের সব সমস্যার চিরন্তন সমাধান সন্ধান করা আমাদের কাজ হওয়া উচিত নয়। মানুষের যে সমস্যাগুলো আজ তার জীবনকে দুঃখ পীড়িত করছে আমাদের কাজ হ’ল সেগুলির সমাধান সন্ধান করা। বিপ্লব সম্পর্কে প্রথাগত ধারণা মুক্ত হ‘লে আমরা দেখব যে, আমাদের জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব হবে এই সমাজের জন্য প্রকৃতপক্ষেই এক বিশাল বিপ্লব। এর দ্বারা আমরা কমিউনিজম এবং শ্রেণী শাসন, শোষণ ও দ্বন্দ্বহীন সমাজের স্বর্গরাজ্য লাভ না করলেও আমরা যে অতুøন্নত, গৌরবময় এবং বলিষ্ঠ এক গণতান্ত্রিক ও মানবিক সমাজ লাভ করব তা হবে আজকের এই বিকৃত, দুঃখ জর্জর ও গ্লানিপূর্ণ সমাজের তুলনায় এক স্বর্গরাজ্যই। তবে এই স্বর্গরাজ্য কল্পনার কোন নিরংকুশ ও স্বপ্নময় স্বর্গরাজ্য নয়। তাই মানুষ তার বিভিন্ন দুঃখ, বেদনা ও নূতন সব সমস্যা নিয়েই হবে এই তুলনামূলক স্বর্গরাজ্যের অধিবাসী। তখনকার মানুষ জীবনের সমস্যাকে মোকাবিলা করবে তাদের মতো করেই। যে উন্নত জীবন আমাদের সাধনা দ্বারা আগামী যুগের মানুষ অর্জন করবে, তার সমস্যাকে আগামী যুগের মানুষ সমাধান করার সংগ্রামও করবে তাদের মতো করে। এইভাবে মানুষ এগিয়ে যাবে বিকাশের পথ ধরে। আমাদের বিপ্লব তাই পৃথিবীর কিংবা মানুষের কোন শেষ সমাধান নয়। আমাদের বিপ্লব হবে মানুষের অনন্ত অগ্রযাত্রার পথে এক নূতন গতিশীলতার সূচনা মাত্র। আজ আমাদের সমাজে ও যুগে মনুষ্যত্ব ও চেতনার অগ্রগতির পথে যে বিরাট বাধার পাহাড় দাঁড়িয়ে আছে এই বিপ্লব তাকে ভেঙ্গে, গুঁড়িয়ে দিয়ে মনুষ্যত্ব ও চেতনার বিকাশ ও অগ্রগমনকে সহজতর করবে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির জগতে মানুষ যে অসাধ্য সাধন করেছে ও করবে আমাদের বিপ্লব তার সুফলকে মুষ্টিমেয় বিকৃত মানুষের হাত থেকে মুক্ত করে নিয়ে দিবে সমাজের সকল মানুষের হাতে। এর ফলে সমাজের সবচেয়ে অবনত ও সবচেয়ে দুর্বলও লাভ করবে মনুষ্যত্ব ও চেতনার অমেয় অধিকার।

পুরাতন বিপ্লবের স্বপ্ন ভেঙ্গে গেছে। তাতে ক্ষতি কি? যে সমাজের জড় দেহে বিপ্লবের স্পর্শ ছাড়া প্রাণের স্পন্দন জাগবে না সেই সমাজে বিপ্লবের প্রয়োজন তো শত স্বপ্নের ব্যর্থতাতেও ফুরায় না। স্বপ্নের বিপ্লব না থাকুক বাস্তবের বিপ্লব দিয়েই আমরা এই জাতির অবদমিত গণশক্তির ঘুম ভাঙ্গাব। জনগণের বিপ্লব পারে এ দেশে অসাধ্য সাধন করতে। গণ-বিপ্লবের প্রচণ্ড শক্তির আঘাত দ্বারাই আমরা এ দেশের হাজার হাজার বৎসরের পরদাসত্ব, পরনির্ভরতা, গ্লানি, অজ্ঞতা আর পশ্চাৎপদতার শৃংখল চূর্ণ-বিচূর্ণ করে অভুøদয় ঘটাতে পারি এক নবীন, প্রাণবন্ত ও উন্নত জাতির। এই জাতির অভুøদয় শুধু এ দেশের ইতিহাসকেই বদলাবে না সেই সঙ্গে তা মানব জাতিকে দিবে মুক্তির ও প্রগতির এক নূতন পথের সন্ধান। সমস্ত পতন ও ব্যর্থতার বাধাকে চূর্ণ করে ইতিহাস এই অনিবার্য বিপ্লব ও তার বিজয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে অভ্রান্ত পদক্ষেপে। তারই লক্ষণ ফুটে উঠছে আজ সারা সমাজ দেহে। এ দেশে বিপ্লব শুধু অনিবার্য নয়, তা আসন্নও। এই আসন্ন বিপ্লবের যোদ্ধা বাহিনী সংগঠিত করাই আজ এ দেশে সকল বিপ্লবীর সবচেয়ে বড় দায়িত্ব। বিপ্লবের দায়িত্ব পালন করতে বিপ্লবীরা মানব ইতিহাসে কোন কালেই ভয় পায় নি। তাই তারা আজও ভয় পাবে না।
________________

সূত্র নির্দেশ

১। কার্ল মার্কস-ফ্রেডারিক এঙ্গেলস, রচনা সংকলন, দ্বিতীয় খণ্ড, প্রথম অংশ, প্রগতি প্রকাশন, মস্কো। পৃষ্ঠাঃ ৩২১

২। এই গ্রন্থে উদ্ধৃত সকল বড় অক্ষর মূল লেখকের।

৩। ফ্রেডারিক এঙ্গেলস, কল্পস্বর্গ ও বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র, বিদেশী ভাষায় সাহিত্য প্রকাশালয়, মস্কো। পৃষ্ঠাঃ ৭৪

৪। কার্ল মার্কস ফ্রেডারিক এঙ্গেলস, রচনা সংকলন, দ্বিতীয় খণ্ড, প্রথম অংশ, প্রগতি প্রকাশন, মস্কো। পৃষ্ঠাঃ ৩২০

৫। ফ্রেডারিক এঙ্গেলস, কল্পস্বর্গ ও বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র, বিদেশী ভাষায় সাহিত্য প্রকাশালয় মস্কো। পৃষ্ঠাঃ ৭৪-৭৫

৬। ঐ, পৃষ্ঠা ৭৯-৮০

৭। ভ. ই. লেনিন, রচনা সংকলন, দ্বিতীয় ভাগ, প্রগতি প্রকাশন, মস্কো। পৃষ্ঠাঃ ২৩৪-২৩৫

৮। ঐ, পৃষ্ঠাঃ ২৫৫

৯। কার্ল মার্কস-ফ্রেডারিক এঙ্গেলস, রচনা সংকলন, দ্বিতীয় খণ্ড, প্রথম অংশ, প্রগতি প্রকাশন, মস্কো। পৃষ্ঠাঃ ৩১৭

১০। ঐ, পৃষ্ঠাঃ ৩১৬

১১। ঐ, পৃষ্ঠাঃ ৩১৬

১২। ফ্রেডারিক এঙ্গেলস, কল্পস্বর্গ ও বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র, বিদেশী ভাষায় সাহিত্য প্রকাশালয় মস্কো। পৃষ্ঠাঃ ৫৫-৫৬

১৩। ঐ, পৃষ্ঠাঃ ৫৭

১৪। ঐ, পৃষ্ঠাঃ ৫৩-৫৪

১৫। বিনয় ঘোষ, বাদশাহী আমল। পৃষ্ঠাঃ ১৫৪ (“বাদশাহী আমল” গ্রন্থটি বিনয় ঘোষ কর্তৃক ফঁ্রাসোআ বার্ণিয়েরের ভ্রমণ বৃত্তান্তের বাংলা ভাবানুবাদ”)- লেখক।

১৬। “We therefore find that there are groups and classes of people among the Muslim population in Bengal (as in the rest of India) who are organised more or less like the Hindu castes.” A.K. Nazmul Karim, Changing Society in India and Pakistan. Page: 123

১৭। “In fact, in many instances, the functional groups have become so distinct that they will never intermarry, not even dine together.” John Talke. “Islam in Bengal.” The Muslim World, Vol. iv. 1914, P.12

১৮। এই গ্রন্থে কোর্‌আনের সমস্ত উদ্ধৃতি ইসলামিক ফাউন্ডেশন কর্তৃক প্রকাশিত কোর্‌আনের বাংলা অনুবাদ গ্রন্থ “আল কুর্‌আনুল করীম”, একাদশ মুদ্রণঃ ডিসেম্বর ১৯৮৭ থেকে গৃহীত।

১৯। বোখারী শরীফ (বাংলা তরজমা ও বিস্তারিত ব্যাখ্যা) মাওলানা শামছুল হক ও মাওলানা আজিজুল হক কর্তৃক অনূদিত, হামিদিয়া লাইব্রেরী, চকবাজার, ঢাকা-১১ কর্তৃক প্রকাশিত, দ্বিতীয় সংস্করণ, ১৩৮৪ বাংলা। পৃষ্ঠা ২১২

বঙ্গরাষ্ট্র-এ প্রথম প্রকাশের সময় ২০মে, ২০০৭

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
Archive
 
সাম্প্রতিক পোষ্টসমূহ