Banner
ধর্ম ও শ্রেণীতত্ত্বের যাঁতাকলে বাঙ্গালী জাতি (জাতি ও জাতীয়তাবাদ বিষয়ক সংকলন)

লিখেছেনঃ শামসুজ্জোহা মানিক, আপডেটঃ July 11, 2010, 3:46 AM, Hits: 16010

 

ভূমিকা

বাঙ্গালী এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন জাতিসত্তার জাতিগত সমস্যা এবং জাতীয়তাবাদ প্রশ্ন নিয়ে আমার বিভিন্ন সময়ে লিখিত এবং একটি বাদে বিভিন্ন স্থানে প্রকাশিত কিছু সংখ্যক প্রবন্ধ ‘ধর্ম ও শ্রেণীতত্ত্বের যাঁতাকলে বাঙ্গালী জাতি’ নামক সংকলনে স্থান পেয়েছে। সুতরাং এটিকে জাতি ও জাতীয়তাবাদ বিষয়ক প্রবন্ধ সংকলন হিসাবে উল্লেখ করা যায়।

তাৎপর্য বিবেচনা করে প্রথম প্রবন্ধের শিরোনাম ‘ধর্ম ও শ্রেণীতত্ত্বের যাঁতাকলে বাঙ্গালী জাতি’ সংকলনের নাম হিসাবে বাছাই করা হয়েছে। প্রবন্ধটি পশ্চিম বাংলা ভ্রমণের সময় কলকাতা থেকে প্রকাশিত পত্রিকা ‘স্বাধীন বাংলা’-এর জন্য লেখি এবং সেটি ঐ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ‘সুভাষ ও বাঙ্গালী জাতি’ বাদে সংকলনের জন্য বাছাইকৃত আর সবগুলো লেখাই বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা-পুস্তিকায় প্রকাশিত হয়। প্রকাশের জন্য প্রথম প্রবন্ধসহ সবগুলো লেখাতেই একান্ত প্রয়োজন মনে করলে কিছু সংশোধন করলেও সেগুলির পরিমাণ খুব কম। লেখাগুলোতে প্রকাশ কালের সময় সাধারণত না দিলেও রচনা কালের সময় দেওয়া হয়েছে, যাতে পাঠকের পক্ষে লেখার কাল প্রেক্ষিত বুঝতে সুবিধা হয়।

জাতি ও জাতীয়তাবাদ সমস্যা সম্পর্কে বক্তব্য দিতে গিয়ে আমি নিজে বাঙ্গালী হওয়ায় এবং জাতি হিসাবে বাঙ্গালীর সংকট থাকায় সঙ্গত কারণে আমি বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ ও তার সমস্যাকে অগ্রাধিকার দিয়েছি। কিন্তু আমি উগ্র এবং পরজাতি নির্যাতক জাতীয়তাবাদ-বিরোধী। আমি জাতি সমন্বয়ে এবং গণতান্ত্রিক জাতীয়তাবাদে বিশ্বাস করি। বাঙ্গালীর ক্ষেত্রে যেমন আমি তার জাতিগত অধিকার ও বোধের সংরক্ষণে বিশ্বাস করি তেমন মনে করি এ দেশের সকল জাতিসত্তার অধিকার এবং জাতিগত বোধকে তাদের নিজ ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দেওয়া অপরিহার্য। এটা সংখ্যাগুরুত্ব ও লঘুত্বের প্রশ্ন নয়। এটা একটা মৌল নীতিগত প্রশ্ন।

বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ ও জাতি-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চেতনা দ্বারা অনুপ্রাণিত স্বাধীনতা যুদ্ধ দ্বারা বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলেও বিদ্যমান ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতাবাদের কারণে এখানে বাঙ্গালী জাতি ও জাতীয়তাবাদের আদর্শ ভূলুণ্ঠিত হয়েছে এবং ধর্ম ভিত্তিক সাম্প্রদায়িকতাবাদী রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশকে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। আমার লেখাগুলোতে এর ক্ষতিকর দিকগুলোকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। কিন্তু একই সঙ্গে বাংলাদেশের অন্যান্য জাতিসত্তার স্বার্থের সপক্ষে আমার চিন্তার বিশেষভাবে বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে এই গ্রন্থের দশটি প্রবন্ধের মধ্যে শেষ তিনটি প্রবন্ধে।

‘পার্বত্য চট্টগ্রামঃ অশ্রু ও রক্তে লেখা নাম’ লিখিত হয় শান্তি চুক্তির পূর্বে যখন আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রাম জন-সংহতি সমিতির শান্তি আলোচনা চলছিল সেই সময়ে অর্থাৎ ১৯৯৬-তে। এটি মাসিক ‘সমাজ চেতনা’ পত্রিকার ১৯৯৬-এর অক্টোবর-নভেম্বর যৌথ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। গারোদের উপর ‘একজন অ-গারোর দৃষ্টিতে গারো জাতিসত্তা’ এবং ‘ঘুমন্ত এক জাতির জাগরণের অপেক্ষায়’ এই লেখা দুইটি গারো পত্রিকা সহ বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। লেখা দুইটি গারো জাতির উপর আমার অধ্যয়ন এবং ১৯৯৯ সালে মাঠ পর্যায়ের গবেষণার ফল। নিবন্ধ দুইটিতে আমার জাতীয়তাবাদ সংক্রান্ত ভাবনাই শুধু প্রকাশ পায় নি অধিকন্তু প্রকাশ পেয়েছে আমার নারীবাদ সংক্রান্ত ভাবনাও।
ঢাকা, জানুয়ারী ২০০৩

 


    সূচীপত্র

     ১।   ধর্ম ও শ্রেণীতত্ত্বের যাঁতাকলে বাঙ্গালী জাতি

     ২।   বিপন্ন বাঙ্গালী ও আমাদের করণীয়

     ৩।   খণ্ডিত চেতনাঃ জাতীয়তাবাদ সমস্যা

     ৪।   বিজয় দিবসের প্রশ্ন

     ৫।   জাতীয়তাবাদ সংকট

     ৬।   বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ ও দেশের উন্নতি

     ৭।   সুভাষ ও বাঙ্গালী জাতি

     ৮।   পার্বত্য চট্টগ্রামঃ অশ্রু আর রক্তে লেখা নাম

     ৯।   একজন অ-গারোর দৃষ্টিতে গারো জাতিসত্তা

   ১০।   ঘুমন্ত এক জাতির জাগরণের অপেক্ষায়

 

ধর্ম ও শ্রেণীতত্ত্বের যাঁতাকলে বাঙ্গালী জাতি

 

এক

পূর্ব বাংলা তথা বাংলাদেশ রাষ্ট্র থেকে কয়েক দিনের জন্য বেড়াতে এসেছি পশ্চিম বাংলায়। এক জায়গায় ঘরোয়া আলোচনায় বাঙ্গালী জাতির প্রসঙ্গে কথা উঠতেই এক মার্কসবাদী যুবক বলে উঠলেন, ‘জাতির কথা তুলে কি আমাদেরকে অত্যাচারী শ্রেণীর বিরুদ্ধে অত্যাচারিত শ্রেণীর সংগ্রামকে বাদ দিতে হবে?’ বাংলা ভাষা-সংস্কৃতি এবং বাঙ্গালীর সংকট প্রসঙ্গে আলোচনায় তার কাছ থেকে যেসব কথা শুনলাম সেগুলো মার্কসবাদের শ্রেণী সংগ্রামের চিরায়ত ব্যাখ্যা মাত্র। যাইহোক, আমার চট করে মনে পড়ল পাকিস্তান কালে কমিউনিস্ট নেতারা এই ধরনের যে কথাগুলো বলতেন সেগুলো।

বুঝলাম কমিউনিস্টরা বাস্তবে যে যা-ই করুক তারা তাত্ত্বিক প্রশ্নে খুবই ধর্মপরায়ণ। তারা সারা পৃথিবীর সর্বহারা ও শ্রমজীবী মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করার যে ব্রতটা বহুকাল আগে গ্রহণ করেছিল সেখান থেকে এক চুল নড়তে রাজী নয়। তার জাতি জাহান্নামে (নরকে) যাক। ক্ষতি নেই। জাতি যদি নিগৃহীত ও অত্যাচারিত হয় তবে তাতে কী? সে ক্ষেত্রেও অত্যাচারিত জাতির সম্পত্তিবান শ্রেণীর সঙ্গে ঐক্যের বদলে বরং জোর দেওয়া হবে অত্যাচারী জাতির শ্রমজীবী ও সর্বহারা শ্রেণীর সঙ্গে ঐক্যের উপর।

পূর্ব বাংলা বা বর্তমান বাংলাদেশের কমিউনিস্টরাও এক কালে এমন একটা ব্রত নিয়েছিল বটে। সে ব্রতটা পালন করার জন্য তারা আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল। কিন্তু ‘ পেটি বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদীরা’ তাদের সে চেষ্টাকে ভণ্ডুল ক’রে পাকিস্তান নামে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রটাকে চুরমার করেছিল ১৯৭১-এ।

অনুমান করলাম আমাদের ওখানকার কমিউনিস্টরা যে চেষ্টার পরিণামে এখন ধূলপরিমাণে পরিণত হয়েছেন সেই চেষ্টা পশ্চিম বাংলায় অন্তত কিছু সংখ্যক কমিউনিস্টের মধ্যে আছে। বোঝা গেল সর্বহারার ঐক্যের নামে সকল জাতির ঐক্যের স্বপ্ন ও প্রয়াসটা পৃথিবীর আর কোনও জাতির ভিতরে থাকুক বা না থাকুক পশ্চিম বাংলার বাঙ্গালী জাতিসত্তার অন্তর্ভুক্ত কমিউনিস্টদের অনেকের মধ্যেই বেশ প্রবলভাবে রয়েছে। যেন মানব ঐক্যের দায়টা একমাত্র দুর্বল ও অত্যাচারিত জাতির, এটা সবল কিংবা অত্যাচারী জাতির নয়। কাজেই এই ঐক্যের জন্য যত ছাড় দিতে হয় সবটা দিতে হবে দুর্বল জাতি ও জনগোষ্ঠীগুলোকে। ভালই তত্ত্ব বটে!

এবার এখানে এসে বুঝলাম যে, বাঙ্গালীত্বের বোধ পশ্চিম বঙ্গে এখন পূর্বের তুলনায় জোরালো হয়েছে। কিন্তু সেই সঙ্গে এই বিষয়টাও বেশ স্পষ্ট যে, ভাষা-সংস্কৃতি এবং ভাষা ভিত্তিক জাতিবোধ যাতে শ্রেণী চেতনাকে (সর্বহারা) ছাপিয়ে উঠতে না পারে সেই বিষয়ে অনেকে বেশ সতর্ক। অর্থাৎ সর্বহারাটাই মূল পরিচয় হয়ে থাকুক এটাই তাদের অন্তরের কামনা। বাংলাভাষী সর্বহারা। তাহলে ইংরাজীভাষী সর্বহারা, চীনাভাষী সর্বহারা, রুশভাষী সর্বহারা ­ এভাবে আন্তর্জাতিকতাবাদের জায়গাটা অটুট থাকে।

আমি পাকিস্তান কালে পূর্ব বাংলার অভিজ্ঞতার চমৎকার এবং বিস্ময়কর প্রতিফলন দেখতে পাই পশ্চিম বাংলার অবস্থায়। আমরা যখন সে কালে বাঙ্গালী জাতির অধিকার প্রতিষ্ঠার কথা বলতাম তখন আমাদের কমিউনিস্ট নেতারা বলতেন জাতির অধিকার কমিউনিস্টরা অস্বীকার করে না। কিন্তু তার ভিত্তি হবে শ্রেণী সংগ্রাম। বাঙ্গালী শোষক শ্রেণী তথা পুঁজিপতি ও ভূস্বামী শ্রেণীর বিরুদ্ধে শ্রমিক-কৃষকের শ্রেণী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যে রাজনৈতিক ভিত্তি গড়ে উঠবে তার উপর নির্ভর ক’রে জাতি মুক্তির সংগ্রাম করতে হবে। কাজেই আগে শ্রেণী ভিত্তিটা তৈরী হোক। তা ঐ শ্রেণী ভিত্তি তৈরীর কাজ কখন শেষ হবে আর কখন জাতীয় সংগ্রাম শুরু করা যাবে সেসব ঠিক করতে করতেই লগ্ন চলে গেল। সময় তো কারও অপেক্ষায় বসে থাকে না। সেখানকার কমিউনিস্টদের অপেক্ষায়ও বসে থাকে নি। সময়কে ধরতে না পারলে কী হয় অথবা সময়ের স্রোতকে অন্ধের মত বাধা দিতে গেলে কী হয় তার প্রমাণ বাংলাদেশ রাষ্ট্রের কমিউনিস্ট আন্দোলনের বর্তমান মরণ দশা।

অথচ সেখানে এক কালে বাঙ্গালীত্বের চেতনা ও স্বাধিকার বোধের বিকাশে কমিউনিস্টদের অবদান কম ছিল না। কমিউনিস্ট মতাদর্শের প্রভাবে কেউ যখন লোকবাদী (Secular) এবং অসাম্প্রদায়িক হয়ে উঠত তখন স্বাভাবিকভাবে চেতনার জগতে ধর্ম-সাম্প্রদায়িক পাকিস্তানী জাতি বোধের মূল উপড়ে যেত। তখন বাঙ্গালী জাতি বোধ আপনা থেকেই মাথা তুলত। বিশেষ করে পাকিস্তানের জাতিগত নিপীড়নের ঐ কালে বাঙ্গালী জাতির স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার চিন্তা প্রবল হয়ে উঠত। আর তখন কমিউনিস্ট নেতৃত্ব চাইত ঐ চিন্তাকে দমন করে তাকে শ্রেণী সংগ্রামের দিকে চালিত করতে। বিশেষ করে ষাটের দশকে আমাদের অভিজ্ঞতায় দেখেছি কমিউনিস্ট নেতৃত্ব কী প্রবলভাবে বাঙ্গালী জাতির স্বাতন্ত্র্য বোধের বিরুদ্ধে অবস্থান নিত।

১৯৬৬-তে শেখ মুজিব ৬ দফা কর্মসূচী দিলে মস্কোপন্থী কমিউনিস্টরাও প্রথমে তাকে সমর্থন করে নি। তবে পরবর্তী সময়ে তারা তাকে সমর্থন করে। কারণ ৬ দফা কর্মসূচী বৃহত্তর পাকিস্তানের কাঠামো ভাঙ্গার কর্মসূচী ছিল না। ওটা ছিল স্বায়ত্তশাসনের কর্মসূচী। অবশ্য এ ক্ষেত্রেও কার্যকর ছিল মস্কোর আন্তর্জাতিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট কর্মনীতির প্রভাব।

কিন্তু পিকিংপন্থী কমিউনিস্ট নেতৃত্ব ছিল শুধু ৬ দফা নয়, বরং পূর্ব বাংলার বাঙ্গালীর স্বাতন্ত্র্য বোধ জাগায় এমন যে কোনও কর্মসূচীর বিরুদ্ধে। কারণ এই নেতৃত্ব ছিল তখন পিকিং-এর হুকুম-বরদার। সুতরাং তাদের জাতীয় কর্মনীতি নির্ধারিত হত পিকিং-এর আন্তর্জাতিক কর্মনীতির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে।

তবে মস্কো এবং পিকিং ­ সব পন্থার সনাতন কমিউনিস্টদের মূল জায়গায় যে মিলটা ছিল তা হল শ্রেণী সংগ্রামের মার্কসীয় তত্ত্ব। বাঙ্গালী জাতি গঠন এবং তার জাতি-রাষ্ট্র গঠনের রাজনীতির বিরুদ্ধে তাদের সবাই প্রায় এক অবস্থানে ছিল। মস্কোপন্থীরা যখন আওয়ামী লীগের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সমর্থক হল তখন তাদের বক্তব্য ছিল কমিউনিস্ট হিসাবে তাদের মূল কাজ শ্রেণী সংগ্রাম করা। সুতরাং জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে তারা নেতৃত্ব দিতে পারে না। এটা বুর্জোয়া বা জাতীয় বুর্জোয়াদের কাজ। এ ক্ষেত্রে, কমিউনিস্টদের ভূমিকা সহায়কের। তবে জাতীয় বুর্জোয়াদের দুর্বলতা দূর করার জন্য তারা ঐক্যের পাশে সংগ্রামও রাখবে। এইভাবে তারা তাদের লেজুড়বৃত্তির রাজনীতির সমর্থনে চমৎকার যুক্তি দাঁড় করিয়েছিল।

আর পিকিংপন্থীরা তো ছিল সব ধরনের ‘উগ্র’ জাতীয়তাবাদ-বিরোধী। তার উপর পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার যে ‘মহান’ (!) দায়িত্ব তাদের উপর বর্তেছিল তাতে বাঙ্গালীর জাতি-রাষ্ট্র গঠনের যে কোনও প্রয়াস ছিল তাদের কাছে অপরাধের শামিল। অবশ্য পিকিংপন্থী কমিউনিস্টদের একাংশ শেষ পর্যায়ে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার প্রশ্নকে স্বীকার করে। কিন্তু সেখানেও তাদের নেতৃত্বের অধিকাংশের প্রয়াস ছিল জাতীয়তাবাদের স্রোতের সঙ্গে থেকে তাকে শ্রেণী সংগ্রামের দিকে নিয়ে যাওয়া। অর্থাৎ জাতীয় মুক্তির সংগ্রামকে লক্ষ্যচ্যুত করা। কৌশল হিসাবে তারা অনেক সময় বলত যে, তারা জাতীয় মুক্তিতে বিশ্বাস করলেও জাতীয়তাবাদকে বিরোধিতা করে ।

বাংলাদেশে কমিউনিস্টদের মধ্যে এখন পর্যন্ত এমন একটা ধারণা আছে যে, জাতীয় মুক্তি এবং জাতীয়তাবাদ দু’টো ভিন্ন এবং পরস্পর বিরোধী ধারণা। এও কমিউনিস্টদের আশ্চর্য রকম বিভ্রান্তির প্রকাশ। অত্যাচারী শ্রেণী ও অত্যাচারিত শ্রেণীর মধ্যকার পার্থক্যটা তাঁরা সুন্দরভাবে বুঝলেও অত্যাচারী জাতি ও অত্যাচারিত জাতির মধ্যকার পার্থক্যটা কি তাঁরা আদৌ বুঝতে চান?

এই প্রশ্ন আমি এই জন্য করছি যে, মার্কসবাদীরা যখন শ্রেণী তত্ত্ব এবং শ্রেণী সংগ্রামের কথা বলেন তখন কি তারা মালিক শ্রেণীর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা এবং সর্বহারার বিরুদ্ধে পুঁজিপতির শ্রেণী সংগ্রামকে জোরদার করার প্রয়োজনের কথা বোঝান? তাহলে জাতীয়তাবাদ শব্দটাতে তাদের আপত্তি কেন? তাহলে কি নিপীড়িত জাতির জাতীয়তাবাদ আর নিপীড়ক জাতির জাতীয়তাবাদ এক জিনিস এটাই আমাদের ধরে নিতে হবে? বস্তুত নিপীড়িত জাতির ভিতর যদি জাতীয়তাবাদ তথা তার জাতি হিসাবে আত্মপ্রতিষ্ঠার প্রবল তাড়না না থাকে তবে কীভাবে তা সাম্রাজ্যবাদ- আধিপত্যবাদ অথবা শক্তিশালী ও আগ্রাসী জাতির আধিপত্য থেকে মুক্তি পেতে পারে?

কিন্তু তবু পূর্ব বাংলায় সে কালে নেতৃত্বকারী কমিউনিস্টরা জাতীয়তাবাদের সপক্ষে দাঁড়ানো তো দূরের কথা জাতির মুক্তি তথা প্রথমে স্বায়ত্তশাসন এবং পরবর্তীতে স্বাধীনতার আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে রাজী হন নি। তাহলে তাদের কাজটা কী? শ্রেণী সংগ্রাম গড়ে তোলা।

এই দৃষ্টিভঙ্গী থেকে তারা ওপার বাংলায়* গণতান্ত্রিক আন্দোলনকেও দেখেছিলেন। তাদের কাছে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন যেমন বুর্জোয়া সংগ্রাম তেমন গণতান্ত্রিক সংগ্রামও মূলত বুর্জোয়া সংগ্রাম। আমার মনে আছে জেনারেল এরশাদের সামরিক শাসন কায়েমের পর ১৯৮২-’৮৩ সালে আমি যখন সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে বেসামরিক অন্তর্বর্তী সরকার তথা তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য চেষ্টা করছিলাম তখন কয়েকজন কমিউনিস্ট নেতা আমাকে বললেন যে, গণতান্ত্রিক আন্দোলন হিসাবে এটা আসলে বুর্জোয়াদের কাজ; তবু যেহেতু বুর্জোয়ারা এ কাজটা এখন করতে পারছে না সেহেতু তাঁরা এখন তা করবেন। কারণ গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠা ছাড়া কমিউনিস্টদের নিজস্ব কাজ অর্থাৎ শ্রমজীবী মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা দুঃসাধ্য হয়। যখন বুর্জোয়ারা গণতান্ত্রিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে আসবে তখন কমিউনিস্টরা শ্রমজীবী মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য শ্রেণী সংগ্রামের কাজে আত্মনিয়োগ করবেন। অর্থাৎ তাঁরা গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেতৃত্ব ছেড়ে দিবেন।

সে কাজ তাঁরা খুব ভালভাবে ও বাংলায়** করেছেন। ভুলটি তাঁরা একবার নয় বার বার করেছেন। কিন্তু তবু তাঁদের চৈতন্যোদয় হয় না। কারণ ওটা হবার নয়। তবে সুযোগ যখন চলে যায় তখন তাঁরা দুঃখ করেন। আত্মসমালোচনা করেন। এবং নূতন সুযোগ পাবার পর পুনরায় একই ভুল করেন। আমার জানা আছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আন্দোলনের আঘাতে ১৯৯০ সালে এরশাদের পতনের পর আমার পরিচিত একজনের কাছে জনৈক কমিউনিস্ট নেতা সম্ভবত ১৯৯১ সালে আক্ষেপ করে বলেছিলেন যে, যদি তাঁরা তত্ত্বাবধায়ক সরকার আন্দোলনের তাৎপর্য বুঝে তাতে আরও গুরুত্ব সহকারে অংশ নিতেন তবে তাঁদের বিরাট লাভ হত।

-----------------------------------------------------------------------------------------------------------

*  বাংলাদেশ

** বাংলাদেশ

-----------------------------------------------------------------------------------------------------------

পূর্ব বাংলা তথা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বাঙ্গালী জাতিসত্তা ও জনগণের সৌভাগ্য যে, এই শ্রেণী তত্ত্বওয়ালা মার্কসবাদীরা সেখানকার জাতি গঠন এবং গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনের রাজনীতির পথে অতীতের মত বাধা হয়ে দাঁড়াবার অবস্থায় আর নেই।

 

দুই

কমিউনিস্টদের সকল ভ্রান্তির মূল উৎস শ্রেণী সম্পর্কে তাদের ধারণা। তারা মনে করে আদিতে সমাজে শ্রেণী ভেদ ছিল না; সব মানুষ সমান ছিল। ব্যক্তিগত সম্পত্তি এসে সমাজকে শ্রেণী বিভক্ত করেছে। মার্কসবাদের এই মৌল তত্ত্ব সম্পর্কেই আমার আপত্তি আছে। এ বিষয়ে এখানে আমার বিস্তারিত আলোচনার অবকাশ নেই। তবে এ বিষয়ে আমি আমার লেখা ‘মার্কসবাদের সংকট ও বিপ্লবের ভবিষ্যৎ’ গ্রন্থে আলোচনা করেছি। আমার বক্তব্য হল আদিম সমাজে যখন উৎপাদন ছিল না তখন সমাজে ক্ষমতা এবং দায়িত্বের পার্থক্যকে অবলম্বন করে শ্রেণী ভেদের আদি রূপ দাঁড়িয়েছিল। অর্থাৎ শ্রেণী দ্বন্দ্ব অতীতেও ছিল তবে তার রূপ ভিন্ন ছিল। একইভাবে ভবিষ্যতের সমাজেও শ্রেণী ভেদ থাকবে এবং তার ফলে শ্রেণী দ্বন্দ্বও থাকবে। তবে তার রূপ ভিন্ন হবে।

সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রায় পৌনে এক শতাব্দীর অভিজ্ঞতা থেকেও কি আমাদের এ বিষয়ে কোনও শিক্ষা নেবার নেই? কমিউনিস্ট পার্টি সর্বহারা শ্রেণীর নামে নূতন যে শাসক শ্রেণী গড়ে তোলে তা আমলা শ্রেণী ছাড়া আর কী? কমিউনিস্ট সমাজে পুঁজি বিনিয়োগ ও শোষণের দায়িত্বটা ব্যক্তির বদলে রাষ্ট্র নেয়। এইটুকুই তার ভিন্নতা বা নূতনত্ব। সব মার্কসীয় সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের অভিজ্ঞতাও কি সে কথা বলে না?

কমিউনিস্ট ব্যবস্থার বাইরে থেকে যেসব সমালোচনা এসেছে সেগুলোকে না হয় বুর্জোয়া, সাম্রাজ্যবাদী, প্রতিবিপ্লবী সমালোচনা বা অপপ্রচার বলে উড়িয়ে দেওয়া গেল। কিন্তু কমিউনিস্ট ব্যবস্থার ভিতর থেকে যেসব সমালোচনা এসেছে সেগুলি থেকেও কি কিছু শেখার নেই? যুগো্লাভিয়ার একজন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কমিউনিস্ট নেতা মিলোভান জিলাস ’৫০-এর দশকে তাঁর লেখা ‘নূতন শ্রেণী’ (The New Class) নামক বিখ্যাত গ্রন্থে কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে কীভাবে নূতন আমলা শ্রেণী গড়ে ওঠে তার জীবন্ত বর্ণনা দিয়েছেন। অন্ধত্ব না থাকলে এই ধরনের বই থেকে অনেক কিছু শেখা যায়।

যাইহোক, মার্কসবাদী সংস্কৃতিতে লালিত লোকজন শ্রেণী ধারণার ঊর্ধ্বে সহজে উঠতে পারেন না। কিন্তু তাদের এই শ্রেণীটা অত্যাচারী আর অত্যাচারিতের মধ্যে বিভাজন থেকে মূলত উদ্ভূত নয়। মার্কসবাদের শ্রেণী হচ্ছে অর্থনীতি তথা উৎপাদন প্রক্রিয়ার ফল। সুতরাং পুঁজি আর শ্রমের মধ্যে বিভাজন ও দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে তার শ্রেণী ও শ্রেণী সংগ্রামের পথ পরিক্রমা । এই পথ পরিক্রমায় মার্কসবাদী বা কমিউনিস্টরা কোনও ক্রমে সর্বহারার শ্রেণী ভিত্তি ও শ্রেণী অবিভাজ্যতা এবং শ্রেণী সংগ্রামকে দুর্বল বা ক্ষুণ্ন হতে দিবেন না। এটা মার্কসবাদীদের নৈতিক দায়িত্ব।

ভাল কথা। এইভাবে মার্কসবাদীরা অত্যাচারিতের পক্ষে দাঁড়িয়ে পৃথিবীর সকল অন্যায় আর অত্যাচারের অবসান ঘটাতে চান। তাহলে প্রশ্ন তুলব এই শ্রেণীর নিরিখে মার্কসবাদীরা নারীর মুক্তির প্রশ্নটিকে কীভাবে দেখবেন? সর্বোচ্চ থেকে সর্বনিম্ন এবং অত্যাচারী থেকে অত্যাচারিত পর্যন্ত সকল স্তর বা শ্রেণীতে অবস্থিত নারীরা যখন পুরুষদের দ্বারা নিগৃহীত হতে থাকে তখন নারীদের অবস্থানটাকে তাঁরা কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন? সেই নারীরা কোন শ্রেণীতে বা বর্গে পড়বে? পুরুষ পুঁজি যেমন নারীর উপর অত্যাচারী এবং নিপীড়ক হতে পারে তেমন পুরুষ শ্রমও কি একই ভূমিকা পালন করতে পারে না? শুধু ঘরে নয় বাইরেও শ্রমিক বা সর্বহারা পুরুষের হাতে কি নারীর লাঞ্ছনা ঘটে না? মার্কস-এঙ্গেলস নারীর প্রশ্ন স্বতন্ত্রভাবে বিবেচনা করেন নি। কারণ ঘরে ঘরে ছড়িয়ে থাকা, অসংগঠিত এবং যুদ্ধ ক্ষমতায় হীনতর নারীদের দিয়ে তাদের পক্ষে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের তত্ত্ব গড়ে তোলা সম্ভব ছিল না। অথচ মানবিকতার বিচারে কিন্তু নারীরই অগ্রাধিকার পাবার কথা।

সুতরাং মার্কস-এঙ্গেলস-এর বিবেচনায় মানবিকতার তুলনায় ক্ষমতা দখলের প্রশ্নটা অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সর্বহারা শ্রেণী চরিত্র অর্জনের তাড়নায় তাঁরা তাড়িত ছিলেন না, যেটা বাংলার কমিউনিস্টরা পার্টির জন্মলগ্ন থেকেই ছিলেন। মার্কসবাদের তত্ত্বে যে কথাই লেখা থাক লেনিন বা অন্যেরা শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বে নয়, বরং কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে ক্ষমতা দখল ক’রে একটি নূতন রাজনৈতিক আমলা শ্রেণীর একনায়কী শাসন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সর্বহারার একনায়কত্বের নামে।

তাতে কিন্তু ‘সর্বহারার’ বিশুদ্ধ শ্রেণী চরিত্র প্রতিষ্ঠার কাজটা না হলেও একটা বিরাট কাজ হয়েছিল ঐসব দেশে। তাহল ঐসব সমাজ একটা আদর্শ ভিত্তিক পার্টি এবং রাষ্ট্রের নেতৃত্বে মধ্যযুগীয় অন্ধকার থেকে দ্রুত শিল্প সভ্যতায় নিজেদের উত্তরণ ঘটাতে পেরেছিল। এ কাজে শ্রমিক-কৃষক বা শ্রমজীবী জনগণকে সংগঠিত করার জন্য মার্কসবাদী মতাদর্শ একটা বিরাট শক্তি যুগিয়েছিল। শ্রমজীবী জনগণের সাহায্যে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল ক’রে ঐ সব দেশের কমিউনিস্টরা সমাজতন্ত্রের নামে যে অর্থনীতি গঠন করেছিল তা প্রকৃতপক্ষে রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ। কিন্তু রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ সমাজকে দ্রুত একটা পর্যায় পর্যন্ত এগিয়ে নেবার পর আটকে গিয়েছিল বন্ধ্যাত্বে। ফলে সেখানে মার্কসীয় সমাজতন্ত্র থেকে সরে গিয়ে কম বা বেশী ব্যক্তি পুঁজিবাদের দিকে যাত্রা শুরু হয়েছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন তো ভেঙ্গেই গেছে এবং ব্যক্তি পুঁজিবাদের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। চীন-ভিয়েৎনাম একটা মিশ্র অর্থনীতির পথ ধরে এগিয়ে চলেছে।

 

তিন

আমার ধারণা দুই বাংলার বাঙ্গালীর অনেক সমস্যা ও সংকটের মূল কারণ দুই বিশেষ ধরনের ধর্ম। এই দুই ধর্ম যে শুধু বাঙ্গালী জাতিকে বিভক্ত ও লণ্ডভণ্ড করেছে তাই নয়, উপরন্তু তার মনোজগৎকেও আশ্চর্য রকম পশ্চাৎপদ ও প্রতিক্রিয়াশীল করেছে। শাস্ত্রীয় ইসলাম এবং হিন্দু উভয় ধর্মই পরিবর্তন বিরোধী ও অগণতান্ত্রিক। শুধু প্রকাশরূপের দিক থেকে তারা ভিন্ন। ইসলামে এক আল্লাহ্‌র প্রতি আনুগত্যের নামে সমাজ শাসকেরা পুরুষের এবং সামরিক শাসকের চরম স্বৈরতন্ত্র এবং এই স্বৈরতন্ত্রের জন্য প্রয়োজনীয় একনায়কী বিচার-বুদ্ধি ও মনোজগৎ গড়ে তোলে। এখানে পুরুষের স্বেচ্ছাচার, একনায়কী শাসকের সহিংস স্বেচ্ছাচার এবং এক ধরনের সামরিক পদ্ধতি ও শৃঙ্খলার মাধ্যমে অপরিবর্তনীয় সামাজিক অনুশাসন মানুষের মনোজগৎকে অধিকার করে থাকে, যার বাস্তব প্রকাশ যে কোনও সুযোগে ঘটতে পারে।

অন্যদিকে শাস্ত্রীয় হিন্দু ধর্ম প্রতিষ্ঠিত স্তর ভিত্তিক ঘৃণা, বর্ণজাতিভেদমূলক অসাম্য এবং অসংখ্য বিভক্তির উপর। এখানেও নারী ঘৃণিত অথবা অধিকার বঞ্চিত। তবে শাস্ত্রীয় কিংবা প্রথাগত মুসলিম মানস এবং হিন্দু মানসে পার্থক্য আছে। প্রথাগত মুসলিম মানস যেভাবে আক্রমণাত্মক এবং সক্রিয় প্রথাগত হিন্দু মানস তা নয়। হিন্দু মানস দারুণভাবে আত্মবদ্ধ, আত্মরক্ষামূলক এবং নিষ্ক্রিয়।

এই দুই সমাজে যত নীচে যাওয়া যায় পরিবর্তন বিরোধিতা ও রক্ষণশীলতা এবং সমাজ শাসকের উপর নির্ভরতা সাধারণত তত বৃদ্ধি পায়। পূর্ব বাংলায় মুসলমান ও হিন্দু এই উভয় সম্প্রদায়ের কৃষকদের মধ্যে আমার দীর্ঘ কালের আন্দোলন ও কাজের অভিজ্ঞতা থেকে আমি উভয় সম্প্রদায়ের নীচ তলায় রক্ষণশীলতার প্রবল রূপটিকে দেখতে পেয়েছি। বিশেষত মুসলিম সমাজে নীচ তলায় যে মানস-শক্তিটা অবস্থান করে তাকে এক কথায় বলা যায় আক্রমণাত্মক এবং ধর্ষক বেদুঈন মানস। কমিউনিস্টরা তাদের শ্রেণী তত্ত্বের প্রভাবে যেখানেই নীচ তলায় মুসলিম শ্রমজীবী শ্রেণীর শক্তিকে মুক্ত করতে গেছে সেখানেই তারা তার বলি হয়ে গেছে।

বস্তুত পরিবর্তন-বিরোধী ও পশ্চাৎপদ এই শ্রমজীবী জনতাকে অগ্রাধিকার দেবার কারণে শেষ পর্যন্ত পূর্ব বাংলায় কমিউনিস্টরা নিজেরাও পরিণত হয়েছে অতি রক্ষণশীল ও পশ্চাৎপদ রাজনৈতিক শক্তিতে। সেখানকার কমিউনিস্টদের যেসব কাণ্ডজ্ঞানহীন আচরণ আমি ষাটের দশক থেকে প্রত্যক্ষ করে এসেছি তার ব্যাখ্যা শুধু তাদের তত্ত্ব থেকে নয় উপরন্তু ঐ তত্ত্বের প্রভাবে পশ্চাৎপদ জনতার মধ্যে দীর্ঘ অবস্থান থেকেও আমি পাই।

এ বিষয়ে আমার এখানে দীর্ঘ আলোচনার অবকাশ নেই। তবে অন্যত্র আমি এ বিষয়ে বিশদভাবে আলোচনার চেষ্টা করেছি। বস্তুত উপর তলার শাসক শ্রেণী এবং নীচ তলার শ্রমিক-কৃষক নয়, বরং আধুনিক শিক্ষার আলোকপ্রাপ্ত মধ্য শ্রেণী হচ্ছে মুসলিম সমাজে প্রগতি ও আধুনিকতার মূল শক্তি। মার্কসবাদের শ্রেণী তত্ত্ব দিয়ে এই সমাজের বাস্তবতাকে বোঝা সম্ভব নয় বলে মুসলিম বিশ্বে মার্কসবাদ কাঙ্ক্ষিত ভূমিকা পালনে নিদারুণভাবে ব্যর্থ হয়েছে।

ভয়ানকভাবে পশ্চাৎপদ ও স্বৈরতন্ত্র শাসিত এবং শোষিত-লাঞ্ছিত শ্রমজীবী কিংবা শাসিত জনতার জন্য চোখের জল ফেলা যেতে পারে। কিন্তু তাদেরকে সমাজ পরিবর্তনের মূল বাহিনীতে পরিণত করাটা ভিন্ন ব্যাপার। সেটা সম্ভব নাও হতে পারে। বস্তুত আদর্শিক ও সাংস্কৃতিক ভাবে তাদের চেতনার জগৎকে বদলাতে না পারলে কোনও শ্রেণী সংগ্রাম দিয়েই সে কাজ করা সম্ভব নয়। আর এই পরিবর্তনের জন্য যে আধুনিক শিক্ষা-সংস্কৃতি এবং বিজ্ঞান-প্রযুক্তির প্রসার প্রয়োজন সেটা নীচ তলা থেকে নয় বরং উপর তলা থেকে প্রগতিশীল মধ্য শ্রেণী বা মধ্যবিত্তের নেতৃত্বেই ঘটতে পারে। বাংলাদেশ রাষ্ট্র সহ সমগ্র মুসলিম পৃথিবীর অভিজ্ঞতা বলে যে, এই সমাজে পরিবর্তন ও উন্নয়নের শক্তি নীচ থেকে তথা শ্রমজীবী ও উৎপাদক জনতার মধ্য থেকে উদ্ভূত হয় না, এটা আসে বাহির এবং উপর থেকে, তারপর সেটা নীচে সঞ্চারিত এবং বিস্তৃত হতে পারে।

বস্তুত এই রকম সমাজের জন্য একটি ভিন্ন মতাদর্শের প্রয়োজন। কারণ আদর্শ ছাড়া কোনও বড় ধরনের সামাজিক পরিবর্তনই সুচারুরূপে সম্পন্ন করা সম্ভব নয়। এই আদর্শের অভাবে মুসলিম সমাজগুলো যেমন সাম্রাজ্যবাদ-নয়া উপনিবেশবাদের সহজ চারণক্ষেত্র হয়ে থাকছে তেমন তার উন্নয়নও স্বচ্ছন্দ হতে পারছে না।

আমার ধারণা সমাজ পরিবর্তনের এই নিয়ম হিন্দু সমাজেও প্রযোজ্য। এখানেও নীচ তলার শ্রমজীবী জনতার পরিবর্তে উৎপাদন ঘনিষ্ঠ ও শ্রম ঘনিষ্ঠ একটি মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বিকাশ ও তার নেতৃত্বকারী ভূমিকার প্রয়োজন।

আমার এই সংক্ষিপ্ত বক্তব্য থেকে ভুল ধারণার সৃষ্টি হতে পারে। এই জন্য এটা এখানে স্পষ্ট করার প্রয়োজন মনে করি যে, আমি অত্যাচার ও শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রামের প্রয়োজনকে অস্বীকার করি না। বরং মনে করি অত্যাচার এবং শোষণ যেখানে যে রূপে থাকে সেখানে সেটার বিরুদ্ধে সেই রূপে সংগ্রামের প্রয়োজন আছে। এবং বাস্তবে এই সংগ্রাম কোনও না কোনও রূপে থাকেও। প্রকৃত কাজ হল এই সংগ্রামকে একটা অর্থবহ রূপ এবং পথ দেওয়া।

কিন্তু সমস্যা হয় তখন যখন সময়ের প্রয়োজনকে অস্বীকার ক’রে জাতি গঠন, রাষ্ট্র গঠনের মৌল করণীয়গুলোকে অস্বীকার করা হয়। আমাদের মত সমাজে প্রথাগত ধর্ম সমস্ত রকম প্রগতির পথে এক বিশাল বাধার পাহাড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার বিরুদ্ধে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যে লোকবাদী (Secular) এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনার বিকাশ ঘটাতে হবে, যা ছাড়া ভিতর থেকে জাগতিক উন্নয়নের শক্তির বিকাশ ঘটানো অসম্ভব, সেটা কীভাবে সম্ভব? শ্রেণী সংগ্রামের উপর অধিকতর গুরুত্ব আরোপ করে যে কাজটা করা সম্ভব নয় সেটা প্রমাণিত। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভিজ্ঞতার আলোয় আমরা দেখেছি শ্রমজীবী শ্রেণীকে মুক্ত করতে গেলে শাসক শ্রেণীগুলো অলোকবাদী ধর্মের অনুভূতি জাগিয়ে কীভাবে সহজেই তাদেরকে নিজ পক্ষে টেনে নেয়। ইন্দোনেশিয়া ও আফগানিস্তানে কমিউনিস্ট নিধন কিন্তু সাধারণ শ্রমজীবী জনতার ব্যাপকায়তন অংশগ্রহণের ফলেই সম্ভব হয়েছিল।

সুতরাং মূল কাজটা সমাজের নীচ তলাকে উপর এবং মধ্য তলা থেকে বিচ্ছিন্ন করা নয়, বরং লোকবাদ এবং গণতন্ত্রের সপক্ষে সমাজের উপর ও মধ্য তলায় বিভাজন ঘটানো। তাহলে বিভাজনটা নীচ তলাতেও প্রসারিত হবে। এ ক্ষেত্রে জাতি চেতনার উন্মেষও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি লোকবাদী চেতনার বিকাশের ক্ষেত্রে জাতি চেতনা আজ অবধি কত শক্তিশালী উপাদান হয়ে আছে।

মুসলিম সমাজের যে কোনও মৌলিক পরিবর্তনের অপর একটি প্রধান শর্ত হচ্ছে নারীর মুক্তি এবং সমাধিকার প্রতিষ্ঠা। বস্তুত আমার বিবেচনায় মুসলিম সমাজে গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি ভোটের রাজনীতি কিংবা বহুদলীয় রাজনীতিতে নেই। সেটা আছে নারীর অধিকারের মধ্যে। নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা মুসলিম সমাজে এমনই গুরুত্বপূর্ণ যে, নারী-পুরুষে শুধু সমভোটাধিকার দিয়ে সেখানে গণতন্ত্র ও লোকবাদ প্রতিষ্ঠার সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। সেখানে নারীর স্বতন্ত্র রাজনৈতিক-সামাজিক ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা এবং তার স্বাতন্ত্র্যের প্রতি পূর্ণ সামাজিক স্বীকৃতি প্রদানের মধ্যেই নিহিত রয়েছে সমাজ-মানসকে গণতন্ত্র ও লোকবাদের উপযোগী করে তোলার প্রধান উপায়।

আমার ধারণা হিন্দু সমাজ সম্পর্কেও আমার এই সিদ্ধান্ত প্রযোজ্য। এসব বিষয়ে এখানে দীর্ঘ আলোচনা সম্ভব নয়। তবে অন্যত্র আমি এই বিষয়গুলির উপর আলোচনা করার চেষ্টা করেছি। তবু এখানে আমার কিছু মৌল ধারণা খুব সংক্ষেপে বলছি। হয়ত পশ্চিম বাংলার পাঠক বিষয়গুলিকে নিজেদের মত সূত্রবদ্ধ করে অন্তত নূতনভাবে ভাবতে উৎসাহী হবেন।

আসলে বহু কিছু এখন নূতনভাবে ভাবা দরকার। সারা পৃথিবীর এবং নিজ দেশেরও এত অভিজ্ঞতার পর যখন বুদ্ধিজীবী কিংবা চিন্তাশীল ব্যক্তিরা পুরাতন বৃত্তে ঘুরপাক খান তখন দুঃখই হয়।

 

চার

পশ্চিম বাংলার কাছে আমার প্রত্যাশাটা বোধ হয় কিছু বেশী বলেই ক্ষোভটা একটু বেশী হয়। আসলে ওপার বাংলায় আমাদের মনোভূমি নির্মাণে পশ্চিম বাংলার বুদ্ধিজীবী এবং রাজনৈতিক কর্মীদের ভূমিকা খুব বেশী। এটা ঠিক যে, ভাষা আন্দোলন আমাদের মনোভূমি নির্মাণে খুব বড় ভূমিকা রেখেছিল। কিন্তু তার সঙ্গে পশ্চিম বাংলার বাঙ্গালী সমাজের বুদ্ধি চর্চাও সম্মিলিত হয়ে আমাদের মনোভূমি অনেকাংশে নির্মাণ করেছে। সুতরাং আমাদের জাতীয় চেতনার উন্মেষ ও বিকাশে পশ্চিম বাংলার বাঙ্গালীর অবদান কম নয়। তাদের অবদান ধারণ করে অনেকটা পথ এগিয়ে গিয়ে আমরা ’৭১-এর জাতীয় মুক্তি যুদ্ধ ঘটাতে সমর্থ হই।

আমাদের ওখানে অনেক ব্যর্থতার মধ্যেও একটা বিরাট লাভ শুধু পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা অর্জন নয়, বরং একটা জাতীয় যুদ্ধের মধ্য দিয়ে এই স্বাধীনতা অর্জন। বাঙ্গালীর জাতি-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য আমরা যারা ’৫০-এর দশকের শেষ দিক থেকে এবং বিশেষ করে ’৬০-এর দশকে কাজ করেছিলাম তাদের কাছে এই অর্জনের তাৎপর্য বিপুল। বাঙ্গালীর ইতিহাসের প্রথম জাতীয় মুক্তি যুদ্ধ অসমাপ্ত রয়েছে। যে লোকবাদী ও অসাম্প্রদায়িক জাতি-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন নিয়ে আমরা জাতীয় মুক্তি যুদ্ধের রাজনীতি গড়ে তুলেছিলাম সেই স্বপ্ন আজো বাস্তবায়নের অপেক্ষায় আছে। তবে আমাদের পক্ষে স্বপ্ন বাস্তবায়নের আশা করা একান্ত যুক্তিসঙ্গত। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি বাংলাদেশ রাষ্ট্র এখন দ্রুত পায়ে তার অসমাপ্ত জাতীয় মুক্তি যুদ্ধকে সম্পূর্ণ করার লক্ষ্যে এগিয়ে চলেছে।

এই সংগ্রামে পশ্চিম বাংলার বাঙ্গালী কী ভূমিকা পালন করবেন সেটা সময় বলে দিবে। তবে বাঙ্গালী হিসাবে আমি নিজে পশ্চিম বাংলায় বাঙ্গালী চেতনার উজ্জীবন ও বিকাশ কামনা করি। মনে হচ্ছে পূর্বের তুলনায় পশ্চিম বাংলার বাঙ্গালীরা যথেষ্ট ভাষা ও জাতি সচেতন হয়ে উঠছেন। তবে আমি মনে করি না শ্রেণী তত্ত্বের মোহাচ্ছন্নতা ও প্রথাগত ধর্মের প্রভাব থেকে মুক্তি ছাড়া পশ্চিম বাংলার বাঙ্গালী তেমন একটা এগোতে পারবেন।

আপাত দৃষ্টিতে পশ্চিম বাংলায় ধর্মের প্রভাব কম। এটা হিন্দু ধর্মের পরমত সহিষ্ণুতারও যে একটা প্রকাশ হতে পারে সেটা না বোঝাও ভুল হতে পারে। হিন্দু ধর্মে উগ্র গোঁড়ামি থাকলেও আক্রমণাত্মক দিকটা তেমন একটা প্রবল নয় বলে হিন্দু সমাজ-মানসকে বুঝতে অনেক সময়ই ভুল হয়। যাইহোক, এই আলোচনায় আমি এখন যাব না। কারণ একটা সংক্ষিপ্ত প্রবন্ধে এত বিষয়ের গভীরে যাওয়া সম্ভব নয়। এ প্রসঙ্গে শুধু আমার মূল ধারণাটা সংক্ষেপে বলি যে, ধর্ম শুধু বিশ্বাসের ব্যাপার নয়, বরং এটা তার চেয়েও বেশী একটা সংস্কৃতি এবং সামাজিক আচার এবং পরিচিতি-বোধের ব্যাপার হতে পারে। কাজেই আরবী নাম রেখে অথবা নামের শেষে বর্ণজাতিগত পদবী-পরিচয় রেখে দুই বাংলায়ই আমরা কতটা লোকবাদী বা সেকিউলার হতে পারি সেই প্রশ্ন করা চলে। বাস্তবটা হচ্ছে সামাজিক চাপ কিংবা রাজনীতি এমনকি ব্যক্তিগত অস্তিত্বেরও প্রয়োজনে ধর্ম বিশ্বাস করি বা না করি, আমরা উভয় বাংলাতেই যার যার ধর্ম-সাম্প্রদায়িক ভিত্তিটাকে অক্ষুণ্ন রেখে চলেছি।

এ দিক থেকে বরং অনেক কাল আগের এক বাউল সাধক লালন এ কালের কমিউনিস্ট কিংবা লোকবাদী চিন্তাবিদদের চেয়ে অনেক এগিয়ে ছিলেন। হয়ত সেটাও সময় ও পরিস্থিতির কারণে সম্ভব হয়েছিল। এক দিকে নীচ তলায় আমজনতার ভিতর প্রথাগত ধর্মের প্রভাব তখনও ততটা জোরালো হয় নি, অপর দিকে ইউরোপীয় শিক্ষা ও তত্ত্বে শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের প্রভাবটাও তখন পর্যন্ত এতটা জোরালো হয় নি। হলে কী হত বলা মুশকিল। লালন হয়ত দাঁড়াবার মত জায়গাই পেতেন না।

আসলে নূতন সমাজ, জাতি এবং রাষ্ট্র গঠনের জন্য যে প্রবল উচ্চাকাঙ্ক্ষা, তেজ এবং সাহসের প্রয়োজন বাঙ্গালী জাতির মধ্যে এক কালে সেসবেরই নিদারুণ অভাব ছিল। ওটার অভাব ছিল বলে প্রথাগত ধর্ম আর মার্কসীয় শ্রেণী তত্ত্ব এক দীর্ঘ সময় সর্ববঙ্গেই বাঙ্গালীর নূতন সমাজ, আধুনিক কালোপযোগী জাতি এবং রাষ্ট্র গঠনের কাজকে ক্ষুণ্ন করতে পেরেছিল। তবে ষাটের দশকে পূর্ব বাংলায় এমন একটা প্রজন্মের উদ্ভব ঘটেছিল যারা প্রবল তেজ, সাহস আর উচ্চাকাঙ্ক্ষা নিয়ে বাঙ্গালী জাতিসত্তার একটা আধুনিক সমাজ, লোকবাদী জাতি এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। তত্ত্বের বেড়াজাল থাকলেও তাদের গতির আঘাতে তা ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল।

ঐ প্রজন্মের শক্তির অভিঘাতে সৃষ্ট একটা জাতীয় যুদ্ধ শুধু পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় কাঠামোকে ভাঙ্গে নি, বরং যারা মূলত এই যুদ্ধের রাজনীতি গড়ে তুলেছিল তাদের মার্কসীয় মতাদর্শের কাঠামোটাকেও ভেঙ্গে ফেলেছিল। এর একটা খারাপ ফলও আছে। আদর্শহীনতার জোয়ারে অনেক শুভ ও সুন্দর ভেসে গেছে।

কিন্তু তা সত্ত্বেও আমি মনে করি সেখানকার বাঙ্গালীর অর্জন কম নয়। সবচেয়ে বড় কথা অন্তত কিছুসংখ্যক মানুষ সেখানে গড়ে উঠেছেন যাঁরা এমন অনেক কিছু ভাবতে পারেন যা অতীতে সম্ভব ছিল না। যে অর্থেই হোক একটা স্বাধীন জাতি হিসাবে সেখানে বাঙ্গালীর ভিতর যে আত্মবিশ্বাস জেগেছে তার মূল্য কম নয়। সর্বোপরি ঐতিহাসিক কাল প্রেক্ষিতে খুব অল্প সময়ের ভিতর সেখানকার জনগোষ্ঠী এমন সব ঘটনা ঘটিয়েছে যার তুলনা পৃথিবীর খুব কম দেশেই পাওয়া সম্ভব।

সকল ব্যর্থতা সত্ত্বেও ’৪৭ পরবর্তী কাল থেকে সেখানকার অভিজ্ঞতাগুলো কম সাফল্যের নয়। ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ’৫৪-এর নির্বাচনে মুসলিম লীগের নির্মূলীকরণ, ’৬৯- এর গণ-অভ্যুত্থান, ’৭১- এর জাতীয় মুক্তি যুদ্ধ, ’৯০- এর গণ -অভ্যুত্থান ­ কী বিশাল বিশাল ঘটনা একটা জনগোষ্ঠীর জীবনে ঘটেছে এত অল্প সময়ে, এবং প্রতিটি ঘটনাই তাৎক্ষণিক সাফল্যের অধিকারী।

পশ্চিম বাংলার বাঙ্গালী কি পূর্ব বাংলার ঘটনা প্রবাহ থেকে শিক্ষা নেবার ব্যাপারে আগ্রহী? আমার ধারণা যে, একটা কালে যেমন আমরা পশ্চিম বাংলা থেকে আমাদের প্রেরণা ও শিক্ষার অনেকটাই নিয়ে ’৭১-এর জাতীয় মুক্তি যুদ্ধ ঘটাতে পেরেছিলাম তেমন এখন পশ্চিম বাংলার বাঙ্গালীদেরও তাদের নিজেদের অগ্রগমনের পথ তৈরী করতে পূর্ব বাংলা বা বর্তমান বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বাঙ্গালীদের সংগ্রাম ও অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা ও প্রেরণা নেবার অনেক কিছু আছে।

তবে আমার মনে হয়েছে পশ্চিম বাংলার বাঙ্গালী পূর্ব বাংলার দিক থেকে শুধু চোখ নয় মনও অনেকটাই ফিরিয়ে রাখতে চান। বাঙ্গালী হিসাবে বাংলাদেশ রাষ্ট্র নিয়ে তাদের মনের ভিতর একটা গোপন গর্ব থাকলেও কষ্ট, ক্ষোভ এবং অভিমান অনেক বেশী। বাংলা ভাগের সঙ্গে অনেকেরই অনেক কিছু হারাবার বেদনা আছে, অনেক তিক্ততার স্মৃতি জড়িয়ে আছে। হিন্দু বাঙ্গালীর দেশ ত্যাগের প্রবাহ ওপার বাংলা থেকে আজো চলছে। যে যা-ই বলুক আমি তো জানি এর পিছনে মূল এবং সবচেয়ে বড় কারণ সেখানে বিদ্যমান ধর্ম-সাম্প্রদায়িক নির্যাতন, বৈষম্য এবং হিন্দুদের মনে নিরাপত্তা-বোধহীনতা।

আমি মনে করি বঙ্গ-ভঙ্গ বা বাংলা ভাগ জাতি হিসাবে বাঙ্গালীর অপরিমেয় ক্ষতির কারণ হয়েছে। এ নিয়ে আমার দুঃখ, ক্ষোভ এবং খেদ কম নেই। কিন্তু আমি এও মনে করি এর জন্য সবচেয়ে বেশী দায়ী হিন্দু বাঙ্গালী নেতৃত্বের শ্রেণী। হয়ত এর বীজ বোনা হয়েছিল তখন যখন নবাবী আমলে সংখ্যাগুরু হয়েও হিন্দু নেতৃত্ব (তখন বাংলায় হিন্দুরা মুসলমানদের চেয়ে অনেক বেশী সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল) বহিরাগত মুসলিম রাষ্ট্র শক্তিকে নিজেরা উৎখাত ক’রে বাঙ্গালীর রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথ না ধরে আর একদল বহিরাগত ইংরেজের কাছে ক্ষমতা তুলে দেবার জন্য ষড়যন্ত্রের পথ বেছে নিয়েছিল। বর্ণজাতিভেদ প্রথার প্রভাবে খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে থাকা সমাজের হিন্দুদের পক্ষে সে কালে রাষ্ট্র গড়ার সাধনা করা সম্ভব ছিল না বলে তারা মীর জাফরের সঙ্গে হাত মিলিয়ে নূতন আর এক পরাধীনতাকে ডেকে নিয়ে এল।

তার তাৎক্ষণিক ফল অবশ্য তাদের অনেকের জন্য ভালই হয়েছিল। ইংরেজ শাসকদের তাঁবেদারী করে জমিদারী আর নীচের দিকের সরকারী চাকুরীতে হিন্দু বাঙ্গালী বেশ জাঁকিয়েই বসেছিল। ভূস্বামী, উকিল আর চাকুরীজীবীদের নিয়ে ইংরেজদের বেশ বড় রকম একটা চাকর শ্রেণী গড়ে উঠেছিল বাংলায়।

যেটাকে বাংলার নবজাগরণ বা রেনেসাঁ বলা হয় সেটা নূতন প্রভুদের সেবার জন্য এই চাকর শ্রেণীর জাগরণ ছাড়া আর কী? এই চাকরদের প্রায় সবটাই ধার করা ইংরেজ প্রভুদের কাছ থেকে। চিন্তা বা কর্ম তাদের কোন্‌টা কতটুকু স্বাধীন ছিল? ইংরেজের অনুগত ও আশ্রিত হয়ে তারা সর্বত্র সুবিধা আদায় করে বেড়িয়েছিল। তাদের নবজাগরণ যে কত ঠুনকো তা তখন বোঝা যায় যখন দেখা যায় যে, ১৯৪৭-এ ইংরেজ প্রভুরা বিদায় নেবার সাথে সাথে পশ্চিম বাংলা এবং হিন্দু বাঙ্গালীর প্রায় সব কিছু ধ্বংস হয়ে যায়। শুধু কি দেশ ভাগ এই ধ্বংসের জন্য দায়ী? বিরাট ধ্বংস ও হত্যাযজ্ঞের চিহ্ন মুছে ’৪৭-এর পর পূর্ব পাঞ্জাবের উঠে দাঁড়াতে বেশী সময় লাগে নি। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ধ্বংসস্তূপ থেকে রাশিয়া, জার্মানী, জাপান কত অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে উঠে দাঁড়িয়েছে! কারণ তারা হিন্দু বাঙ্গালী সমাজ-নেতৃত্বের মত পরের পায়ে ভর দিয়ে পথ চলে নি। তাই পরের পাটা যখন ক্রাচের মত সরে গেছে তখন ঐ পায়ের উপর ভর দিয়ে যারা চলেছিল তাদের পতন হয়েছে।

রামমোহন, বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ যত বড়ই হোন এরা সকলেই ঐ চাকর শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত থেকেছেন। বিদ্যাসাগর কিছুটা ভিন্ন হলেও খুব বেশী ভিন্ন নন। তিনিও ঐ চাকর শ্রেণীরই বৃত্তাবদ্ধ। বস্তুত একটু মনোযোগ দিয়ে বুঝতে চাইলেই নবজাগরণের ভিতর থেকে পাশ্চাত্য এবং ব্রিটেনের চাকর তৈরীর মর্মবাণীটাকে বুঝতে অসুবিধা হয় না। প্রকৃতপক্ষে অনেক ভাল দিক থাকলেও এটাই নবজাগরণের মূল সুর।

চাকরদের এই বৃত্ত ভেঙ্গে বের হতে চেয়েছিলেন সুভাষ বসু। কিন্তু ধ্বংস হয়েছেন। বাঙ্গালীর সমাজ-জমি তাকে ধারণ করার উপযুক্ত ছিল না। যে বৃত্ত তিনি ভাঙ্গতে চেয়েছিলেন সেই বৃত্ত ভাঙ্গার কাজের শত্রু শুধু কংগ্রেস-মুসলিম লীগ ছিল না, কমিউনিস্ট পার্টিও ছিল। এরা সবাই এক বৃহত্তর চাকর শ্রেণীর নানান অংশের প্রতিনিধি।

আমার এখন মনে হয় যেটাকে হিন্দু মধ্যবিত্ত বলা হয় সেই হিন্দু বাঙ্গালী সমাজ- নেতৃত্বের উত্থান প্রক্রিয়ার মধ্যে যে পাপ ছিল তার খেসারত দিতে হয়েছে এবং আজো হচ্ছে দুই বাংলারই বাঙ্গালী জাতিকে। এঁরা যখন কমিউনিস্ট হয়েছেন তখন বোধ হয় তা হয়েছেন কৃত অন্যায় তার দুষ্কৃতির কারণে ঐ শ্রেণীর ভিতর প্রতিক্রিয়া হিসাবে যে আত্মগ্লানি জেগেছিল তা মোচনের জন্য। তাই তাঁদের মধ্যে সাহসিকতার সঙ্গে, তেজের সঙ্গে এ দেশের বাস্তবতায় নূতন সমাজ, জাতি এবং রাষ্ট্র গঠনের কাজকে এগিয়ে নেবার তাগিদ কখনই প্রবল হয় নি। তাঁরা মতান্ধ থেকেছেন। তাঁরা শুধু ত্যাগ করেছেন, সর্বহারা শ্রেণী চরিত্র অর্জনের নামে চরিত্রের শুদ্ধতা রক্ষাতেই ব্যস্ত থেকেছেন, অন্তত একটা কালে। ত্যাগের প্রয়োজন আছে। কিন্তু শুধু ত্যাগ দিয়ে কী হবে? নূতন সমাজ, জাতি এবং রাষ্ট্র গড়ার কাজটাই ছিল আসল। ত্যাগ তো তার প্রয়োজনে। অথচ তাঁরা লক্ষ্যটাকে গৌণ করে উপলক্ষ্যটাকেই মুখ্য করেছেন। পশ্চিম বাংলায় পরবর্তী কালে তাঁদের বৃহত্তর অংশ ত্যাগে ক্লান্ত হয়ে প্রচলিত ব্যবস্থার ভিতর যতটুকু পারা যায় সেটা করার পথে পা বাড়িয়েছেন। তাতে কিছু লাভ হয় নি তা নয়। সিপিআই (এম) এবং বাম ফ্রন্ট পশ্চিম বাংলার জন্য অন্তত কিছু করেছে। তার মূল্য একেবারে কম নয়। কিন্তু এখন পশ্চিম বাংলার জন্য তাদের ভূমিকা কতটা ইতিবাচক সে প্রশ্ন করা যায়।

যাইহোক, এটা ভিন্ন প্রসঙ্গ। এ কথা বলা চলে যে, সব দিক থেকে না হলেও অনেক দিক থেকেই এখন পূর্ব বাংলা পশ্চিম বাংলার চেয়ে অনেকটা এগিয়ে গেছে। অথচ এমন কোনও ভিত্তিই আমাদের তৈরী ছিল না। সৌভাগ্যক্রমে আমাদের ওপার বাংলায় ’৭১ পূর্ব পর্যন্ত ইংরেজদের চাকর শ্রেণীটা তেমন পুষ্ট ও পোক্ত ছিল না। অন্যদিকে বর্ণজাতি প্রথার প্রভাবে শত-সহস্র ভাগে বিভক্ত ও বিচ্ছিন্ন থাকায় হিন্দু সমাজ যেভাবে শিথিল, অশক্ত এবং স্থবির বা ধীরগতি হয়ে থাকে পূর্ব বাংলা বা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সমাজ তেমন নয়। তার গতি অনেক বেশী প্রবল। মুসলিম সমাজের অনেক ত্রুটি থাকলেও এই সুবিধাটুকু আমরা সেখানে ভোগ করি। এই সামাজিক গতিশীলতা চিন্তার ক্ষেত্রেও প্রতিফলিত হতে পেরেছিল বলে আমরা মার্কসবাদী তত্ত্বের সাহায্যে লোকবাদের পথে অনেকটা অগ্রসর হয়ে যখন বাঙ্গালীর জাতি-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথে পা বাড়িয়েছিলাম তখন মার্কসবাদী তত্ত্ব বাধা হয়ে দাঁড়ালে তাকেও ভেঙ্গে এগিয়ে গিয়ে ’৭১-এ জাতি-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার যুদ্ধকে অনিবার্য করতে পেরেছিলাম। এক দিকে প্রথাগত ধর্ম, অপর দিকে মার্কসীয় শ্রেণী তত্ত্ব কোনটিই আমাদের গতি রোধ করতে পারে নি।

এটা ঠিক যে, ’৭১-এ বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরবর্তী কাল থেকে ধর্মের ব্যবহার এবং আবেদন দুই-ই নূতন করে বেড়েছে। ওটাতে আওয়ামী লীগ ও তার নেতা শেখ মুজিবেরও কৌশলপূর্ণ সহায়ক ভূমিকা ছিল। বরং বলা যায় কাজটা তারাই শুরু করেছিল। এটাই স্বাভাবিক। কারণ জাতি-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার রাজনীতি বা আন্দোলন কিছুই তারা গড়ে নি। তারা ঘটনার সুযোগ নিয়েছিল মাত্র। কাজেই ভারত রাষ্ট্রের সাহায্যে ক্ষমতা হাতে পেয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে তারা ধর্ম-সাম্প্রদায়িক ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠার কাজটা শুরু করে।

পরবর্তী কালে অন্যেরা এসে কাজটাকে প্রবলতর করেছে মাত্র। কিন্তু তার বিরুদ্ধে সংগ্রামও ওপার বাংলায় একেবারে দুর্বল নয়। শাস্ত্রীয় ইসলাম ধর্মের প্রভাব একটা পশ্চাৎপদ মুসলিম সমাজে যেমনটা সচরাচর হয় তেমনটা বাংলাদেশ রাষ্ট্রে আছে সে কথা বোধ হয় বলা যাবে না। পাকিস্তান, আফগানিস্তানের পাশে দাঁড় করালেই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ভিন্নতাটা বোঝা যায়।

তবু ধর্মের সমস্যা সেখানে বেশ প্রবলভাবে আছে বলেই তো জাতীয় মুক্তি যুদ্ধকে সম্পূর্ণ করার প্রয়োজন রয়ে গেছে। আবার জাতীয় মুক্তি যুদ্ধ অসম্পূর্ণ থাকার ফলেই কিন্তু সেখানে ধর্মের সমস্যাটা রয়েছে। অর্থাৎ ধর্মের কারণে জাতি গঠন যেমন সম্পূর্ণ হতে পারে নি তেমন তার রাষ্ট্র গঠনও সম্পূর্ণ হয় নি।

বস্তুত বাঙ্গালীর ক্ষেত্রে জাতি গঠন ও জাতীয় মুক্তির প্রশ্নে এবং এমনকি সমাজ বিপ্লবের প্রশ্নেও ধর্মের সমস্যা এবং ধর্ম-বিরোধী লড়াইয়ের তাৎপর্য ও পদ্ধতি বোঝা ইউরোপের কোনও জ্ঞানতত্ত্ব দিয়েই সম্ভব নয়। বাংলায় জাতি মুক্তির মত সমাজ বিপ্লবের রূপ ও তাৎপর্যও ভিন্ন। ইউরোপীয় জ্ঞানতত্ত্বের কাঠামোবদ্ধ মাকর্সবাদীরা এই কারণে বাংলায় অনেক সময় ভাষা ভিত্তিক জাতি গঠনের কাজকে ব্যাহত করতে গিয়ে প্রতিক্রিয়ার সহায়ক হয়েছেন। প্রত্যক্ষভাবে তারা ধর্ম-বিরোধী হলেও তাদের কাজের পুরো ফল অনেক সময়ই ধর্মের পক্ষে গেছে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রে পিকিংপন্থী কমিউনিস্টদের কাজের এই ফল আমাদের স্থূল দৃষ্টিতেই ধরা পড়ে। এটা আমাদের সৌভাগ্য যে, এখন তারা সেখানে বিলুপ্তপ্রায়। ধর্মের বাইরে থেকে এবং প্রায়শ ধর্ম-বিরোধী রূপ নিয়ে যারা তার জন্য কাজ করে তারা অনেক বেশী বিপজ্জনক হতে পারে তাদের চেয়ে, যারা ধর্মের ভিতরে থেকেই তার জন্য কাজ করে।

জাতি হিসাবে পশ্চিম বাংলার বাঙ্গালী যদি উঠে দাঁড়াতে চায় তবে তাদের পূর্ব বাংলার নিকট থেকে অভিজ্ঞতার শিক্ষা না নিয়ে উপায় নেই। তা না হলে যে ভুলগুলো আমরা করেছি বা যে ভুলগুলো আমাদেরকে পার হয়ে আসতে হয়েছে সেই ধরনের ভুলগুলোর শিকার তাঁরাও অনেক সময় হতে পারেন। উভয় বঙ্গেরই পরস্পরের কাছ থেকে শিক্ষা নেবার প্রয়োজন আছে এ কথা মনে রেখেই কথাটা বলছি।

এ প্রসঙ্গে কেউ হয়ত ভাববেন যে, আমি পশ্চিম বাংলাকে স্বাধীন করার সংগ্রাম গড়ার ডাক দিতে চাচ্ছি। ভারত রাষ্ট্রভুক্ত পশ্চিম বাংলার বাঙ্গালী নিজেরা ঠিক করবেন তাঁরা কী করবেন। তবে আমি মনে করি উভয় বাংলার বাঙ্গালীর মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগ এবং সমঝোতা বাড়ানো এবং উভয়ের মধ্যে মৈত্রী ও সহযোগিতার ঘনিষ্ঠ বন্ধন গড়ে তোলা প্রয়োজন।

বিভিন্ন ধর্মে ও বর্ণজাতিতে বিভক্ত বাঙ্গালীর জাতি গঠন প্রক্রিয়া অববিকশিত ছিল বলে ১৯৪৭-এ তার অমন মহা বিপর্যয় ঘটতে পেরেছিল। বাঙ্গালী জাতিসত্তা এরপর শুধু ধর্ম-সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয় নি দুইটি রাষ্ট্রেও বিভক্ত হয়েছে। এরপর পাকিস্তানভুক্ত পূর্ব বাংলা বাদে ভারতভুক্ত আর সবখানে জাতিসত্তাগতভাবে তার পশ্চাদগমন চলেছিল। তবে এবার পশ্চিম বাংলায় এসে আমার মনে হল চেতনার জগতে অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন হচ্ছে। সময় এলে বোঝা যাবে এই পরিবর্তন পশ্চিম বাংলার বাঙ্গালীকে কোন দিকে নিবে।

কলকাতা
রচনাঃ ২৩-২৫ মার্চ, ২০০১

 


বিপন্ন বাঙ্গালী ও আমাদের করণীয়
 

এক

১৯৭১-এ বাংলাদেশের অভ্যুদয় আমাদের সামনে উপস্থিত করেছিল বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের পূর্ণতা অর্জন ও বিকাশ সাধনের করণীয়। কারণ ১৯৭১-এ বিভক্ত বাঙ্গালী জাতির একটা অংশ মাত্র তার রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিল। কিন্তু তার বাকী অর্ধাংশ তখনও রয়ে গেছে বিভক্ত এবং ভারত রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত।

১৯৪৭ সালে ধর্মীয় দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পূর্ব বঙ্গে পাকিস্তান নামে যে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বাংলাদেশ এখানে সেই রাষ্ট্রটিকে শুধু ধ্বংস করে নি সেই সঙ্গে ধ্বংস করেছে ধর্মের ভিত্তিতে রাষ্ট্র ও জাতি গঠনের যুক্তি ও নৈতিকতাও। ১৯৪৮-’৫২-এর ভাষা আন্দোলন ইসলামী রাষ্ট্র ও সম্প্রদায় চেতনার বিপরীতে বাঙ্গালী জাতি চেতনার যে বীজ বপন করেছিল তারই অংকুরোদ্‌গম ও বিকাশের একটা পর্যায়ে তার আঘাতে ১৯৭১-এ পাকিস্তান রাষ্ট্র এখানে ভেঙ্গে পড়ে। এইভাবে ১৯৪৭-এ প্রতিষ্ঠিত এক বিরাট অবৈজ্ঞানিকতা ও ভ্রান্তি সংশোধনের প্রক্রিয়া শুরু হয়।

আসলে এটা সূচনা মাত্র। মূল কাজ আরও অনেক বড় এবং আরও অনেক দূরে রয়েছে। কারণ পাকিস্তান ও ভারত প্রতিষ্ঠা এবং অখণ্ড বঙ্গের বিভক্তি দ্বারা বাঙ্গালী জাতিরও বিভক্তি ঘটেছে যাতে করে রচিত হয়েছে সাম্প্রদায়িকতার দৃঢ় ও গভীর ভিত্তি। আর এই বিভক্তির আগের ও পরের প্রক্রিয়ায় আছে বিপুল হত্যা, নির্যাতন, বর্বরতা, বিতাড়ন, ধ্বংস, তিক্ততা ও বেদনা।

১৯৭১-এ নূতন রাষ্ট্রের বাঙ্গালী নেতৃত্ব এ কথা স্বীকার করতে পারল না যে, ধর্মীয় ভিত্তিতে বাঙ্গালীর বিভক্তি একটা বিরাট ভুল এবং তা একটা জাতির নেতৃত্বের এক বিরাট ঐতিহাসিক পাপও বটে। আর এই ভুল কিংবা পাপের প্রায়শ্চিত্য তাকে করতে হয়েছে ’৭১-এ এবং ভবিষ্যতেও করতে হ’তে পারে আরও প্রাণ ও দুঃখের বিনিময়ে ­ এই উপলব্ধিও তার কাজে কিংবা কথায় প্রকাশ পায় নি।

১৯৪৭-এর ১৪ আগস্ট বাঙ্গালী জাতির ইতিহাসের এক কলংক ও গ্লানির দিন। হিন্দু কিংবা মুসলমান পরিচয় রক্ষা করতে চেয়ে বাঙ্গালী হারালো তার এক বিরাট সম্ভাবনা। ঐক্যবদ্ধ ভারত কিংবা পাকিস্তানের মতো কোনও বহুজাতিক রাষ্ট্র নয় বরং ঐক্যবদ্ধ স্বাধীন বঙ্গই হ’তে পারত বাঙ্গালীর প্রকৃত যাত্রাবিন্দু। কারণ বহুজাতিক ভারত বা পাকিস্তান শুধু যে একটা জাতি হ’তে পারে না তা-ই নয় বরং বহু জাতির বিজড়নে ও চাপে বাঙ্গালী হারাতে বাধ্য তার নিজস্ব জাতীয় অধিকার ও সম্ভাবনা যা এক সময় পূর্ব বঙ্গের বাঙ্গালীরা অনেকাংশে হারিয়েছিল এবং যা আজ পশ্চিম বঙ্গ কিংবা ত্রিপুরার বাঙ্গালীরা অনেকাংশে হারিয়েছে। তাছাড়া মোগলদের নিপীড়ক সর্বভারতীয় সাম্রাজ্য রাষ্ট্রের উত্তরাধিকার হিসাবে ব্রিটিশ শাসকরা বহু জাতিসত্তার বাসভূমি ভারত ব্যাপী যে নিপীড়ক বহুজাতিক সাম্রাজ্য-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিল সেই নিপীড়ক সর্বভারতীয় রাষ্ট্র কাঠামো ভেঙ্গে জাতিসত্তাগুলির নিজস্ব জাতি-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা ছাড়া কোনও জাতিসত্তার পক্ষেই জাতীয় মুক্তি অর্জন করা সম্ভব ছিল না। অর্থাৎ ভারতের সাম্রাজ্য-রাষ্ট্র কাঠামো ভেঙ্গে বাঙ্গালীসহ সকল জাতিসত্তার যার যার স্বাধীন জাতীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাই হ’ত সঠিক পথ।

চেতনে হোক অবচেতনে হোক হিন্দু বাঙ্গালীর ভিতরে হিন্দু চেতনা আর মুসলমান বাঙ্গালীর ভিতরে মুসলমান চেতনা কাজ করেছে এই বৃহত্তর সাম্রাজ্য-রাষ্ট্র ভাবনার পিছনে। অতীতে বহিরাগত বিজেতাদের অস্ত্র শক্তির দ্বারা বহু-জাতিসত্তার ভারতে বহু-জাতিসত্তার নিজস্ব স্বাধীন বিকাশকে পর্যুদস্ত ক’রে যে বৃহত্তর সাম্রাজ্য-রাষ্ট্র গঠিত হয়েছিল তার প্রধান ঐক্যসূত্র বা বন্ধন শক্তি ছিল বিজেতাদের অস্ত্র শক্তিই। কিন্তু তাদের শাসনের অবসানে বহু-জাতির এই বৃহত্তর রাষ্ট্র কাঠামো শুধু অভ্যন্তরীণ শাসক শ্রেণীর অস্ত্র শক্তির জোরে টিকে থাকতে পারে না। এর জন্য প্রয়োজন হল ধর্মের। বহু ভাষার এই ভারতকে একটি বৃহত্তর রাষ্ট্র কাঠামোয় ধরে রাখতে পারে বহু জাতিসত্তার ঐক্য চেতনার মূল ভিত্তি হিসাবে প্রচলিত ধর্ম। কাজেই বহু-জাতিক বৃহত্তর রাষ্ট্রসত্তা তারা প্রয়োজনে তার কাঠামোতে কোনও না কোনওভাবে ধর্মকে লালন করতে বাধ্য। মুখ্যত ধর্মের প্রভাবে ভারতের জাতিসত্তাগুলি নিজেদের স্বাতন্ত্র্যকে গৌণ ক’রে বহু-জাতিক বৃহত্তর রাষ্ট্র কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত থাকতে চাইল। মুসলমান যে মুসলিম সর্বভারতীয় সাম্রাজ্য-রাষ্ট্র চেয়েছিল তারই রূপায়ন হ’ল পাকিস্তান আর হিন্দুদের এই হিন্দু সর্বভারতীয় সাম্রাজ্য-রাষ্ট্রের রূপায়ন হল বর্তমান ভারত।

বস্তুত রাজনীতি ও রাষ্ট্র সাধনায় ধর্মের এই প্রভাব উপমহাদেশের অন্যান্য জাতির মতো বাঙ্গালীর জন্যও হয়েছে ভয়াবহ। আজকের যুগের গতিকে ধারণ করতে হলে যে চিন্তা পদ্ধতি বা চিন্তা শক্তি গড়তে হয় পশ্চাৎপদতার উৎস প্রাচীন ধর্মগুলো তার পথে এক বিরাট বাধা হয়ে আছে। বিশেষত বাঙ্গালীর আত্ম-বিভাজনের কারণ হয়ে এবং জাতি-রাষ্ট্র গঠনের পথে বাধা হয়ে ধর্ম বাঙ্গালী জাতির জন্য হয়েছে এক ভয়ংকর ক্ষতির কারণ।


দুই

১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর এক কঠিন প্রশ্নের সামনে পূর্ব বঙ্গ তথা আজকের বাংলাদেশের বাঙ্গালীকে দাঁড় করিয়েছে। তা হ’ল সে কি বাঙ্গালীর জাতীয় রাষ্ট্র গঠন করবে নাকি মুসলমানের সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গঠন করবে? রাজনীতিতে একই সঙ্গে বাঙ্গালী এবং মুসলমান হবার উপায় তার আর নেই, কারণ ধর্মীয় দ্বি-জাতিতত্ত্ব তথা ইসলাম ধর্মের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রসত্তা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বাঙ্গালীর স্বাধীন রাষ্ট্রসত্তা প্রতিষ্ঠার জন্য তাকে লড়তে হয়েছিল ১৯৭১-এ। বাঙ্গালী লড়ে নি পাকিস্তানের কাঠামোর ভিতর ছয় দফা অর্জনের জন্য, বাঙ্গালী লড়েছিল বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ ভিত্তিক স্বাধীন পূর্ব বাংলা কিংবা বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য। ১৯৬৬-তে শেখ মুজিবের ছয় দফা যেখানে ছিল ধর্মীয় রাষ্ট্র পাকিস্তানের কাঠামোর ভিতর পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের দাবী সেখানে ’৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধ সংগঠিত হয়েছিল বাঙ্গালী জাতিসত্তার স্বাধীন জাতীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে। এই দুইটি গুণগতভাবেই ভিন্ন।

অবশ্য এটা ঠিক যে, ছয় দফা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবী তুলে ধরায় তা বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদী চেতনাকে শক্তিশালী করে। কারণ সাধারণভাবে বাঙ্গালী অধ্যুষিত পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের দাবীর পিছনে ছিল পশ্চিম পাকিস্তানীদের নির্যাতন, আধিপত্য ও লুণ্ঠনের হাত থেকে এখানকার বাঙ্গালী জনগোষ্ঠীর মুক্তির প্রেরণা। এই ক্ষেত্রে ধর্মীয় চেতনা বাঙ্গালীর স্বার্থের পক্ষে আসে নি। বরং ধর্মীয় চেতনা কিংবা সাম্প্রদায়িক পরিচয়কে প্রাধান্য দিলে বাঙ্গালী জনগোষ্ঠীর স্বার্থই ক্ষুণ্ন হত। কাজেই ছয় দফা বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের দর্শনকে সচেতনভাবে তুলে না ধরলেও এবং তা পকিস্তানের কাঠামো ভিত্তিক হলেও পরোক্ষভাবে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদকে শক্তিশালী করতে বাধ্য হয়, যদিও অন্তর্বস্তুতে একই সঙ্গে সংযুক্ত ছিল পূর্ব বঙ্গের পাকিস্তান ভিত্তিক ধর্ম-সম্প্রদায়গত চেতনা। কিন্তু পূর্ব বঙ্গের স্বাধীনতার দাবী ছিল গুণগতভাবেই একটি পৃথক বস্তু, যা নাকচ করে পাকিস্তান ভিত্তিক ধর্ম-সম্প্রদায়গত চেতনাকে। স্বাধীনতা যুদ্ধের অন্তর্বস্তু ছিল ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক চেতনার বিপরীতে ও বিরুদ্ধে বাঙ্গালী জাতীয়তার চেতনা।

সুতরাং যুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর এ দেশের বাঙ্গালী জনগণের এবং তাদের রাষ্ট্রের কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায় বাঙ্গালী জাতির পুনরেকত্রীকরণকে রাষ্ট্রীয় লক্ষ্য হিসাবে স্বীকৃতি দান। এটাই যুক্তির দাবী, সুতরাং এটা নৈতিকতা হয়ে দেখা দেয়। এই দাবীকে অস্বীকার কিংবা অগ্রাহ্য করাই হয়ে দাঁড়ায় অযৌক্তিক কিংবা অনৈতিক। আর বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর তার রাষ্ট্রিক ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব এই যুক্তি বিরোধী এবং অনৈতিক কাজটিই করেছে। আর এইভাবে সৃষ্টি হয়েছে বাংলাদেশের আজকের গভীরতর পরিচয় সংকটের পটভূমি। জাতির আত্ম-পরিচয় আজ আরও সংকটাপন্ন হয়েছে জেনারেল এরশাদ কর্তৃক ইসলামকে রাষ্ট্র-ধর্ম ঘোষণা দ্বারা।

অর্থাৎ বাংলাদেশ যে বাঙ্গালী জাতিসত্তার জাতীয় রাষ্ট্র নয় বরং একটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র এই কথাটা প্রকারান্তরে বলে দেওয়া হয়েছে। আসলে এই প্রক্রিয়ার সূচনা করেছিলেন খোদ শেখ মুজিব। আমরা দেখেছি যে, ছয় দফা বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের সনদ ছিল না। তা ছিল ধর্মীয় দ্বি-জাতিতত্ত্ব ভিত্তিক পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের কর্মসূচী।

১৯৭১-এ শেখ মুজিব যুদ্ধ করেন নি। যাকে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের নেতা বলা হয় সেই শেখ মুজিব ১৯৭১-এ পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর আক্রমণের মুখে জাতিকে ফেলে রেখে তাদের কাছে ধরা দিলেন। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর পাকিস্তানের কারাগার থেকে ফিরে বাংলাদেশ নামে যে রাষ্ট্রটিকে তিনি পেলেন তাকে পূর্ণতা দেওয়ার কোনও আকাঙ্ক্ষা কিংবা ক্ষমতা তাঁর ছিল না। শেখ মুজিব বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের ধ্বনি দিলেও তার ঐতিহাসিক কর্তব্যগুলিকে পালন করতে চান নি।

আসলে তাঁর অন্তর্গত প্রেরণা মুখ্যত বাঙ্গালী ছিল না। ছিল মুখ্যত মুসলমান সাম্প্রদায়িক। সেই কারণে যুদ্ধের দ্বারা মুক্ত নূতন জাতীয়তাবাদী শক্তির চাপে ধর্মনিরপেক্ষতা কিংবা জাতীয়তাবাদের কথা বললেও সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা দ্বারা আশু ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর সহযোগী জামাতসহ বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ বিরোধী ইসলামী শক্তিগুলিকে। কেউ কেউ এটাকে শেখ মুজিবের দয়ালু মনের প্রকাশ হিসাবে দেখেন বা দেখান। কিন্তু শেখ মুজিবের এই দয়া আমরা দেখি নি বন্দী দেশপ্রেমিক এবং বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদী যোদ্ধা সিরাজ সিকদারের ক্ষেত্রে। অসংখ্য বাঙ্গালী হত্যাকারী ও দেশদ্রোহী জামাতী ও রাজাকার এবং দালালদেরকে তিনি জেলে নিয়ে জনতার রোষ থেকে রক্ষা করেছিলেন এবং পরে মুক্তি দিয়েছিলেন। সমস্ত দালালকে তিনি সাধারণ ক্ষমা দ্বারা আশ্রয় দিয়েছিলেন। কিন্তু সিরাজ সিকদার ধরা পড়লে তিনি তাকে নির্যাতন করে হত্যা করেছিলেন। তখন কিন্তু তাঁর পরাজিত শত্রুর প্রতি দয়া জাগে নি। শুধু তাই নয়, হাজার হাজার বামপন্থী ও দেশপ্রেমিক কর্মী ও মানুষের রক্তে তাঁর হাত হয়েছিল রঞ্জিত। সুতরাং ব্যাপারটা ছিল না দয়ার, বরং এটা ছিল বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ-বিরোধী ইসলামী শক্তির সুকৌশল সংরক্ষণ ও লালন। তখনও অবস্থার চাপে তাঁর পক্ষে প্রকাশ্যে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের পক্ষ ত্যাগ করে যাওয়া সম্ভব ছিল না। কিন্তু পরবর্তীতে যাতে ত্যাগ করা যায় তার আয়োজন সম্পূর্ণ করে গেলেন।

দ্বি-জাতিতত্ত্ব নাকচ করার যৌক্তিক পরিণতি স্বরূপ বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের পূর্ণতার যে করণীয় আমাদের সামনে উপস্থিত হয়েছে তাকে আমরা কিভাবে সম্পাদন করতে পারি এই প্রশ্নটিকে যেমন তিনি আনলেন না বরং পাশ কাটালেন তেমন বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের স্থান যাতে মুসলিম সাম্প্রদায়িকতাবাদ এসে নিতে পারে সেই কাজ তিনি করলেন সুকৌশলে। আসলে ১৯৪৭-এর বাংলা ও বাঙ্গালীর বিভক্তি এবং ধর্মীয় দ্বি-জাতিতত্ত্বকে শেখ মুজিব কোনও দিনই নিন্দা কিংবা নাকচ করেন নি। তিনি বরং খুব সূক্ষ্মভাবে ও সন্তর্পণে মুসলিম সাম্প্রদায়িক চেতনাকে লালন করেছিলেন। তাই পাকিস্তান আমলের হিন্দু বিরোধী শত্রু সম্পত্তি আইনকে তিনি স্বাধীন বাংলাদেশে অর্পিত সম্পত্তি আইন নাম দিয়ে বহাল রাখলেন এবং ধর্মনিরপেক্ষতা ও বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের কথা বলেও মুসলিম রাষ্ট্রের প্রতিনিধি হিসেবে ১৯৭৪-এ পাকিস্তানের লাহোরে অনুষ্ঠিত ইসলামী সম্মেলন সংস্থা (ও আই সি)-এর সম্মেলনে যোগ দিলেন।

 

তিন

কেউ হয়তো বলবেন যে, অখণ্ড স্বাধীন বঙ্গের ধ্বনি দেওয়া শেখ মুজিবের জন্য হ’ত হঠকারী। কারণ, প্রতিবেশী বিরাট শক্তি ভারত এতে ক্ষুব্ধ ও রুষ্ট হ’ত। সুতরাং কৌশলগতভাবে এই বক্তব্য দেওয়া হ’ত ভুল। কিন্তু আসলে প্রশ্নটা কৌশলের নয়, নৈতিকতার। এই নৈতিকতা দাবী করে সংযুক্ত বঙ্গ কিংবা বাঙ্গালীর পুনরেকত্রীকরণকে। এই পুনরেকত্রীকরণের বক্তব্য কিভাবে দেওয়া হবে এবং সেই লক্ষ্যে কিভাবে অগ্রসর হওয়া যাবে সেটা হচ্ছে কৌশলের ব্যাপার। কিন্তু মূল নীতিকে অস্বীকার করা কিংবা পাশ কাটানো হচ্ছে নির্জলা সুবিধাবাদ ও নীতিহীনতা।

আর নীতিহীনতার আধিপত্য, নীতিহীন সুবিধাবাদের আধিপত্য আজ বাংলাদেশের সমগ্র অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনকে অধিকার ক’রে সর্বগ্রাসী সংকটের এই পর্যায়ে এনে দাঁড় করিয়েছে আমাদেরকে। সবই যদি আমরা রিলিফ সামগ্রী হিসাবে পেতে চাই তবে অবশ্য এর চেয়ে ভালো পরিণতি হ’তে পারে না। একটা জাতীয় যুদ্ধের মাঝখানে আমাদের তৎকালীন জাতীয় নেতৃত্বের নীতিহীন কারসাজিতে বাঙ্গালী জাতিসত্তার স্বাধীন ও শক্তিশালী অস্তিত্ব ও বিকাশ বিরোধী ভারত রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপে রিলিফ হিসাবে যে স্বাধীনতা আমরা পেয়েছি সেই স্বাধীনতার নেতাদের কাছ থেকে অবশ্য আমরা প্রকৃত জাতীয়তাবাদী চিন্তা, চেতনা বা চরিত্র কিছুই আশা করতে পারি না।

শুধু জিয়াউর রহমানকে দোষ দিয়ে কী লাভ? তিনি তো শেখ মুজিবের অন্তর্গত ভাবপ্রেরণাকে বাস্তবে রূপ দিয়েছেন বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের ঘোষণা দ্বারা। বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ হচ্ছে অন্তর্বস্তুতে মুসলমান বাঙ্গালীদের স্বতন্ত্র জাতীয়তা তথা সাম্প্রদায়িকতার ঘোষণা। এইভাবে শেখ মুজিব বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের করণীয় সম্পাদন না করলেও তার বিকাশের পথে আনুষ্ঠানিকভাবে এবং প্রকাশ্যে যে বাধা স্থাপন করেন নি জিয়াউর রহমান তা করলেন বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের বিপরীতে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ উপস্থিত ক’রে। এর দ্বারা তিনি জাতিকে তলিয়ে দিলেন তার পরিচয়ের ক্ষেত্রে এক বিরাট সংকটের আবর্তে। এই সংকট পূর্বেও ছিল। কিন্তু তা দূরীকরণের প্রক্রিয়া চলছিল। বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ চিন্তার ক্ষেত্রে তার কাংঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারত নিজস্ব গতিতে। এইবার গতি ব্যাহত হল এবং ভাষা ভিত্তিক জাতীয় চেতনাকে সুকৌশলে আবদ্ধ করা হল ধর্মীয় চেতনার জালে এবং ক্রমশ বাংলাদেশকে পরিণত করা হ‘ল একটি পুরোপুরি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে।

জেনারেল জিয়া সংবিধানে ‘বিসমিল্লাহ্‌ হির রাহ্‌মানির রাহীম’ এবং ‘সর্বশক্তিমান আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ সংযোজন করে বুঝিয়েছেন যে, বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ কি বস্তু। কিন্তু জেনালের এরশাদ তাতেও তুষ্ট হন নি। তিনি ইসলামকে রাষ্ট্রীয় ধর্ম করেছেন। অর্থাৎ বাংলাদেশটা কাদের রাষ্ট্র ও দেশ সেটা তিনি একেবারে বেআব্রু ক’রে বলে দিয়েছেন। এরশাদ তাঁর বহু বক্তৃতায় বলেছিলেন যে, রাষ্ট্র-ধর্ম বাংলাদেশকে নূতন পরিচয় দিয়েছে। সরকারী দলের নেতারা বলেছেন যে, এতে করে ভারতের বাঙ্গালীদের সঙ্গে আমাদের পার্থক্য নিশ্চিত ও নির্ধারিত হ’ল।

কিন্তু কেন এই পার্থক্যের প্রয়োজন? প্রয়োজনটা কার? বাংলাদেশের নাকি ভারতের? বঙ্গের পূর্বাঞ্চলের বাঙ্গালী জনগণ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা দ্বারা পাকিস্তানের দখলমুক্ত হয়েছে। কিন্তু বঙ্গের পশ্চিমাঞ্চলের বাঙ্গালী জনগণ তো একটা নিপীড়ক বহু-জাতিক কিংবা সাম্রাজ্য-রাষ্ট্র ভারতের নিয়ন্ত্রণমুক্ত হয় নি। বঙ্গের পূর্বাঞ্চলের জনগণ আংশিকভাবে হলেও জাতি-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথে পদক্ষেপ দিতে পেরেছে। কিন্তু পশ্চিমাঞ্চলের বাঙ্গালী জনগণ আজও তা পারে নি। পশ্চিম বঙ্গে বাঙ্গালী জাতির উপর অ-বাঙ্গালী শাসক শ্রেণীর যতোই শোষণ ও নিপীড়ন চলুক যদি বঙ্গের পূর্বাঞ্চল এই বাংলাদেশে বাঙ্গালী সমাজ বাঙ্গালী না হয়ে তার কাছে দেখা দেয় বৈরী সাম্প্রদায়িক মুসলমান রূপে তবে পশ্চিম বঙ্গের বাঙ্গালী জাতি কোন সাহস ও ভরসায় বিশাল ভারত রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে তার জাতীয় স্বাধীনতার পতাকা তুলবে? সুতরাং ইসলামকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ধর্ম ঘোষণা করা হলে ভারতের প্রধান মন্ত্রী রাজীব গান্ধী এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী বুটা সিং তার সপক্ষে অনুকূল প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। তাঁদের মতে এতে ভারতের অসুবিধার কিছু নেই এবং এটা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার।

বস্তুত আজকের বাংলাদেশে ধর্মীয় চেতনার লালন ও সংরক্ষণ এবং রাজনীতি ও রাষ্ট্র শাসনের সঙ্গে এর বিজড়ন সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন ভারতের অবাঙ্গালী শাসক গোষ্ঠীর। এখানে ইসলামী মূল্যবোধের জাগরণ ও প্রসারের প্রয়োজন বাঙ্গালীর জন্য কেন হবে? এই ভূ-রাজনৈতিক অঞ্চলে যার স্বার্থ বাঙ্গালীর জাগরণ ও উত্থান দ্বারা সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হবে সেই ভারত রাষ্ট্রই যে এখানে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের বিপরীতে ইসলামী চেতনার লালন ও সংরক্ষণ চাইবে সবচেয়ে বেশী করে সেটাই কি সঙ্গত নয়?

ভারতের বুকে ব্রিটিশের যে সাম্রাজ্যটি ছিল ১৯৪৭-এ ব্রিটিশ সেটাকে ধর্মের ভিত্তিতে ভারত ও পাকিস্তান এই দুই ভাগে বিভক্ত ক’রে রেখে গিয়েছিল। এই ব্রিটিশের সাম্রাজ্য-রাষ্ট্রের এক উত্তরাধিকারী ভারত আর এক উত্তরাধিকারী পাকিস্তানকে ভেঙ্গে এখানে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে যে ভূমিকা নিয়েছিল তার একটা উদ্দেশ্য ছিল এই যে, যাতে এই রাষ্ট্রটি প্রকৃত স্বাধীন ও জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্র বা জাতি-রাষ্ট্র হিসাবে সংগঠিত না হয়। ভারত সরকার তার হস্তক্ষেপ দ্বারা এ দেশের নেতৃত্ব ও রাষ্ট্র কাঠামো এমনভাবে সংগঠিত করেছে যাতে এই রাষ্ট্র ভারত রাষ্ট্রের সাম্রাজ্যিক বা আধিপত্যবাদী স্বার্থের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে না পারে। এটা তো ঠিক যে, সাম্রাজ্যিক বা বহু-জাতিক রাষ্ট্র কাঠামো থেকে বেরিয়ে এসে বাংলাদেশ উপমহাদেশের সমস্ত আবদ্ধ জাতিসত্তার জন্য একটা অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত হয়েছে। সুতরাং এর জন্ম ও উত্থানকে নিজ ইচ্ছামতো রূপদান করা ভারত রাষ্ট্রের জন্য অত্যাবশ্যক ছিল।

ভারত রাষ্ট্রের দেওয়া পথ ধ’রে এ দেশে শেখ মুজিব যে যাত্রা শুরু করেছিলেন সেই পথ ধরেই বর্তমান পর্যায়ে পৌঁছেছেন এরশাদ। বাংলাদেশের এই দশা শুধু আধিপত্যশীল ভারত রাষ্ট্রেরই কাম্য তা-ই নয়, উপরন্তু এটা বর্তমান পৃথিবীর সাম্রাজ্যবাদী শিল্পোন্নত রাষ্ট্রগুলোর জন্যও কাম্য কিংবা লাভজনক। লুণ্ঠক ও শোষক জাতিগুলির বিপরীতেই তৃতীয় বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেরও অবস্থান। বাঙ্গালী জাতি যদি উন্নত হয়ে পৃথিবীর বুকে মাথা তোলে তবে শোষণ ও নিয়ন্ত্রণের যে আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা বর্তমানে বলবৎ আছে তার ভারসাম্য বিনষ্ট হবে। আসলে এই ভারসাম্য ভেঙ্গেই তো বাঙ্গালী জনগণকে জাতি হিসাবে উঠে দাঁড়াতে হবে। কাজেই বিশ্ব পরিসরে স্থিতাবস্থার সুবিধাভোগী শক্তিগুলো কেন বাঙ্গালীর উত্থানকে চাইবে?

বাস্তবিক, বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের দাবী, এর পরিপূর্ণতা ও বিকাশের দাবী আজ উপমহাদেশগত পরিস্থিতিতে শুধু বহু জাতিসত্তা ভিত্তিক রাষ্ট্রসত্তা বিরোধী দাবী নয় এটা একই সঙ্গে বিশ্ব পরিস্থিতিতে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী দাবীও বটে। পৃথিবীর সকল জাতি ও জনগণের মুক্তি, ঐক্য ও সমতার লক্ষ্যে বাঙ্গালী জাতি এগিয়ে যেতে পারে জাতি হিসাবে উঠে দাঁড়িয়েই। যে শক্তি দ্বারা বাঙ্গালী জাতি ভাঙ্গতে পারে সাম্রাজ্যবাদ ও আধিপত্যবাদের শৃংখল সেই শক্তি অর্জন করার প্রধান পথই হল তার প্রকৃত জাতীয় পরিচয়কে দৃঢ়ভাবে ধারণ করা এবং তাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরা।


চার

বাংলাদেশের বাঙ্গালী জনগণ যদি বাঙ্গালীর পুনরেকত্রীকরণের আহ্বান দেয় তবে কি পশ্চিম বঙ্গ ও ত্রিপুরা বা ভারতভুক্ত বাঙ্গালী জনগণ তাতে সাড়া দিবে? সাড়া দেওয়া না দেওয়া তাদের ব্যাপার। এটা বাংলাদেশের জনগণকে দিতে হবে নিজেদের প্রয়োজনে। বাঙ্গালী হওয়া এবং থাকবার প্রয়োজনে। বাঙ্গালী হিসাবে উন্নত ও বিকশিত হবার প্রয়োজনে। আসলে পূর্ব বঙ্গের বাঙ্গালী আজ যেটা পারে সেটা হ’ল পশ্চিম বঙ্গের বাঙ্গালীর কাছে পুনরেকত্রীকরণের বাস্তবতা উপস্থিত করা। এটা করতে পারে এখানে বাঙ্গালী তার নিজের বাঙ্গালী চেতনা ও সংস্কৃতির বিকাশ ঘটিয়ে, বাঙ্গালী হিসাবে উঠে দাঁড়িয়ে।

এর জন্য প্রথম প্রয়োজন রাষ্ট্র এবং রাজনীতিকে ধর্মের প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত করা। এছাড়া আমরা কোনও দিনই প্রকৃত বাঙ্গালী হ’তে পারব না। এবং অনবরত দোল খাব জাতীয়তাবাদ ও ধর্মের মধ্যে। এ অবস্থায় ধর্ম দাঁড়িয়ে থাকবে জাতীয়তাবাদের বিপরীতে এবং অবিরাম আঘাত করবে জাতীয়তাবাদকে। এর ফলে জাতীয়তাবাদের যে শক্তির বলে আজকে আমরা উন্নয়ন ও উত্থানের পথে এগিয়ে যেতে পারি সেই শক্তির অভাবে পড়ে থাকব অন্ধকারে এবং অবক্ষয়ে। অজাগতিক ও পরলৌকিক ধর্ম এ দেশে ব্যক্তি মানুষকে যতোই সান্ত্বনা দিক তা জাতিকে যেমন সঠিক পরিচয় দিতে পারে না তেমন দিতে পারে না উজ্জীবনের পথ। অবৈজ্ঞানিক ও প্রথাগত ধর্মের দাবী হল অন্ধ বিশ্বাস, যুক্তিহীন ও প্রমাণহীন বিশ্বাস। এই বিশ্বাস সর্বস্বতা নিয়ে আমরা আজকের যুগে আমাদের এই পর্বত প্রমাণ সমস্যাকে মোকাবিলা করব কিভাবে, মুক্ত করব কিভাবে এ দেশ ও জাতিকে বৃহৎ ও সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রসমূহের আধিপত্য, নিয়ন্ত্রণ ও শোষণ থেকে? কিংবা কিভাবে উৎখাত করব এইসব বিদেশী শক্তির সঙ্গে হাত মিলিয়ে এ দেশের অভ্যন্তরীণ যেসব শক্তি রাষ্ট্র ও সমাজের উপর তলায় অবস্থান ক’রে সমগ্র জাতি ও সমাজের প্রাণরস নিংড়ে নিচ্ছে তাদেরকে? অন্ধ বিশ্বাস দ্বারা মার খাওয়ার কিংবা কষ্ট সহ্য করার ক্ষমতা অর্জন করা যেতে পারে, কিন্তু আজকের উন্নত দেশগুলোর সমান হবার যোগ্যতা অর্জন করা সম্ভব নয়। প্রতিযোগিতার এই পৃথিবীতে আমরা কিভাবে উঠে দাঁড়াব যদি আমাদের যুক্তি, বুদ্ধি, জ্ঞান এবং নৈতিকতার শক্তিকে আমরা অবিরামভাবে বাড়িয়ে যেতে না পারি? সেগুলোই তো আমাদেরকে এনে দিবে বাস্তব শক্তি, বাস্তবে উন্নতির শক্তি।

তাছাড়া জাতীয় চেতনা যদি না থাকে তবে আমাদের সামাজিক সংহতি রূপ নিবে কিভাবে? আমাদের সামাজিক সংহতি তখনই দৃঢ়বদ্ধ হবে যখন আমাদের মধ্যে দেখা দিবে জাতীয় চেতনা। অন্যান্য নৈতিক ধারণা ও মূল্যবোধের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে এই জাতীয় চেতনা আমাদেরকে দিতে পারে এমন বিপুল ও প্রবল শক্তি যার বলে বলীয়ান হয়ে বহু পিছন থেকে যাত্রা শুরু করেও আমরা দ্রুত বহু পথ অতিক্রম ক’রে আজকের অগ্রসর জাতিগুলির উন্নতির স্তরকে ধরতে পারি অল্প সময়েই। আর জাতীয় চেতনার বিকাশের জন্যও আমাদেরকে প্রথাগত ধর্মের অবৈজ্ঞানিক ও অন্ধ শক্তির নিয়ন্ত্রণমুক্ত হ’তে হবে।

মানুষের চিন্তা বা চেতনার গলদ বা দুর্বলতাই সকল বৈষয়িক দুর্বলতার প্রধান উৎস। অর্থাৎ চিন্তার শক্তিই মানুষের উন্নতির প্রধান উৎস। এইজন্য খুব কম প্রাকৃতিক সম্পদের অধিকারী দেশ জাপান কিংবা সুইজারল্যান্ড হয়ে উঠতে পারে সবচেয়ে উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশগুলোর একটি আর বিপুল উর্বরতা ও প্রচুর প্রাকৃতিক সম্পদের অধিকারী দেশ বাংলাদেশ দেখা দেয় পৃথিবীর সবচেয়ে দরিদ্র ও দুস্থ একটি রাষ্ট্র হিসাবে।

এ দেশে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে দাঁড় করানো হয়েছে ইসলামকে। এইভাবে অনেক কষ্টে আমরা যে জাতীয় আত্মপরিচয় খুঁজে পাচ্ছিলাম এবং তাকে অবলম্বন ক’রে পৃথিবীর বুকে শক্ত পায়ে উঠে দাঁড়াবার প্রয়াস পাচ্ছিলাম সেটাকে আরও দূরে ঠেলে দেওয়া হয়েছে এবং ক্রমশ বাংলাদেশকে পরিণত করা হয়েছে একটি ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে।

মনে রাখতে হবে আপেক্ষিক অর্থে হলেও বাঙ্গালী জাতিসত্তা একটা অখণ্ড ও অবিভাজ্য সত্তা। বাঙ্গালীত্বের বিচারে, বাঙ্গালী জাতিসত্তার ঐতিহাসিক বিকাশধারার বিচারে এটাই নৈতিক ও যৌক্তিক। বাঙ্গালী নিজেকে বিভক্ত বা খণ্ডিত করতে পারে না। এটা করতে পারে প্রচলিত ধর্মের মতো কোনও বাইরের শক্তি। অর্থাৎ বাঙ্গালীত্বের বিভক্তির জন্য প্রয়োজন প্রচলিত ধর্মের মতো কোনও বাইরের শক্তির হস্তক্ষেপ বা আঘাত। বাঙ্গালী রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে এক হোক বা না হোক নৈতিক বিচারে তা এক অবিভাজ্য ও অখণ্ড সত্তা। সুতরাং এক অর্থে বাঙ্গালীত্বই একটা নৈতিকতা গড়ে তোলে। যদি প্রচলিত ধর্ম এই বাঙ্গালীত্ব অর্জনে বা বাঙ্গালী সত্তা প্রতিষ্ঠায় বাধা হয় তবে তার সম্পর্কে আমাদেরকে ভিন্নভাবে ভাবতে হবে। কারণ প্রচলিত ধর্ম তখন দেখা দেয় নীতিবিরোধী রূপে, নৈতিকতাহীন রূপে।

আজকের বাংলাদেশের যাবতীয় সংকট, সমস্যা ও অস্থিরতার একটি প্রধান কারণ জাতীয় জীবনের অনৈতিকতা। আত্মপরিচয় হারিয়ে, জাতীয় গৌরব বোধ হারিয়ে জাতি আজ স্রোতে ভাসা কচুরীপানার মতো শিকড়হীন ভাসছে এবং অস্থিরতার ঘূর্ণিপাকে ঘুরছে, ডুবছে। জাতিকে যারা গৌরবহীন ও ঠিকানাহীন, শিকড়হীন করছে তারা জাতির বিভ্রান্তি, অসচেতনতা, বিশৃংখলা ও দুস্থতার সুযোগ নিয়ে যার যার আখের গুছিয়ে নিচ্ছে।

সুতরাং আজ সকল অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে মুক্তির লক্ষ্যে বলিষ্ঠ পদক্ষেপ দিতে হলে আমাদেরকে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের পতাকা দৃঢ়ভাবে ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে হবে। অবশ্য এই জাতীয়তাবাদ পরজাতির নির্যাতিত জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে পরিচালিত হবে না, যেমনটা হয়ে আসছে মুজিব থেকে এরশাদ পর্যন্ত সকল শাসকের চাকমাসহ সংখ্যালঘু জাতিসত্তাসমূহের বিরুদ্ধে নির্মম নির্যাতন ও উৎসাদনের কর্মনীতি দ্বারা। সকল জাতির শান্তিপূর্ণ ও স্বাধীন সহাবস্থান দ্বারা উন্নত পৃথিবী গড়ে তোলাই হবে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের লক্ষ্য। এই বিচারে আমরা জাতি হয়ে হব আন্তর্জাতিক এবং আমাদের জাতীয়তাবাদ হবে আন্তর্জাতিকতাবাদের এক বিশেষ প্রকাশ বা রূপ।

অবশ্য আমাদের জাতীয় উন্নয়ন ও বিকাশের সমস্যাগুলিকে মীমাংসা করতে হলে শুধু বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদকে দৃঢ়ভাবে ধরলেই হবে না সেই সঙ্গে অনেক মৌলিক ও গুরুত্বপূর্ণ করণীয় আছে যেগুলি সম্পাদন না করে আমরা আমাদের দেশের বিরাজমান গভীর সংকট দূর করতে পারব না। এগুলির মধ্যে নারীর মুক্তি ও অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং সামরিক ও বেসামরিক আমলা ও ধনীদের দ্বারা স্বৈরতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার বিপরীতে জনগণের স্বশাসনের ব্যবস্থা ভিত্তিক গণতন্ত্র তথা জনগণের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।

কিন্তু এই সমস্ত করণীয়কে সম্পাদন করা হবে যে ক্ষেত্রটিতে সেটি কি? সেটি কি একটি নিছক রাজনৈতিক বা ভৌগোলিক সীমারেখা নাকি তার চেয়েও বেশী করে একটি বিশেষ চেতনা যেটিকে আমরা বলি দেশ বা জাতি চেতনা? ভূমিগত দেশ এ ক্ষেত্রে কোনও দেশ নয় যদি তার সঙ্গে বিশেষ জনগোষ্ঠীর নির্দিষ্ট পরিচয় সংযুক্ত না হয় যে পরিচয় গড়ে ওঠে সুদীর্ঘ ইতিহাস ও ঐতিহ্য দ্বারা। এই দেশকে তার চেতনায় সঠিকভাবে লালন না করে কোনও জাতিই পৃথিবীতে বড় হয় না, হতে পারে না।

আমাদের রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতি ভাবনা ও কর্ম দেশ-কাল নিরপেক্ষ বা বিচ্ছিন্ন হয়ে গড়ে উঠতে পারে না। তার জন্য চাই দেশ বা জমি। এটাকে অবলম্বন করেই এই ভাবনা ও কর্ম বিকশিত হয়। ভাবনা রূপ নেয় কর্মে এই জমিতেই। এই জমি কি আমরা শুধু ’৭১-এ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা দ্বারাই পেয়েছি? ’৭১-এর পূর্বে আছে ’৫২। ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন কি একটা জাতির দীর্ঘ ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে ধারণ করে না? শেষ পর্যন্ত আমরা প্রায় হাজার বছরের এক ইতিহাস ও ঐতিহ্যের জমি পাচ্ছি যে জমি হচ্ছে ভাষাকে অবলম্বন করে গড়ে ওঠা আমাদের বাঙ্গালী জাতিসত্তা। বাঙ্গালী জাতিসত্তার এই ঐতিহাসিক চেতনা ও তার বিকাশের কর্তব্যকে ধারণ ও লালন করাই আজ আমাদের মুক্তির উপায়। অতীতে শুধু সাধারণ বাঙ্গালী জনগণের জন্য বিজাতীয় এবং হিন্দু উচ্চবর্ণের সেন শাসকেরা এই জাতিসত্তার বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করে নি কিংবা ইংরেজ সেনাপতি-শাসক ক্লাইভের বিজয় দ্বারাই এই জাতিসত্তার বিকাশ খর্ব হয় নি। বিদেশী ও বিজাতীয় মুসলমান হানাদার এবং সেনাপতি-শাসক বখতিয়ার খলজীর আগ্রাসী তলোয়ারও এই জাতিসত্তার বিকাশকে নিদারুণভাবে ব্যাহত করেছে। সব বৃহৎ ঘটনাই ইতিহাসে গভীর ছাপ রাখে। এইসব বৈদেশিক ও বিজাতীয় আগ্রাসন ও বিজয় আমাদের জাতিসত্তার ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে প্রভাবিত ও নিয়ন্ত্রণ করেছে নানানভাবে। কিন্তু তাই বলে এই বিজেতাদের বিজয় কর্ম মাথায় তুলে নাচবার মতো দাসসুলভ মূঢ়তা যেন আমাদেরকে পেয়ে না বসে।

ইতিহাস থেকে আমরা শিক্ষা নিব। কিন্তু ইতিহাসের ভারবাহী গাধা আমরা হব না। ইতিহাস যেসব আবর্জনা অথবা অনাকাঙ্ক্ষিত ও অপ্রয়োজনীয় বোঝা আমাদের উপর চাপিয়েছে সেগুলোকে ছুঁড়ে ফেলার সাহস এবং শক্তি আমাদের অর্জন করতে হবে। বাঙ্গালীর জাতীয় গৌরবের প্রয়োজনে সেন এবং ক্লাইভদেরকে যেমন ছুঁড়ে ফেলতে হয় ইতিহাসের ডাস্টবিনে ঠিক তেমনই আমাদেরকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে হবে বখতিয়ার খলজী ও তার উত্তরাধিকারীদেরকেও ইতিহাসের ডাস্টবিনে। এটাই আমাদের নিজস্ব স্বাধীন জাতীয় চেতনা ও পরিচয়কে বিকশিত ও শক্তিশালী করার পথ। এই পথ ধরেই আমরা স্বাধীন বাঙ্গালীর নিজস্ব সুসংহত সমাজ ও সংস্কৃতি সংগঠিত করতে পারব যা আমাদেরকে দিবে বাঙ্গালীর সুসংহত রাষ্ট্র সংগঠনের যোগ্যতা ও অধিকার। আর এইভাবে যে বাঙ্গালী জাতি বিকশিত হবে সেটা পুরাতন ঐতিহ্যের ভিত্তির উপর সংগঠিত হলেও প্রকৃত পক্ষে সেটা পুরাতন ও পরাধীন বাঙ্গালী জাতি না হয়ে হবে এক নূতন স্বাধীন বাঙ্গালী জাতি। নূতন যুগের সমস্যা ও দায়িত্বকে মোকাবিলা করতে গিয়ে পৃথিবীর বুকে উঠে দাঁড়াবে এক নূতন বাঙ্গালী জাতি যা পুরাতনের গর্ভ থেকে জন্ম নিলেও তা আবদ্ধ থাকবে না প্রাচীন ঐতিহ্যের সংকীর্ণ গণ্ডীতে এবং তার নূতন জীবন চিহ্নিত হবে নূতন যুগের ও নূতন জন্মের বৈশিষ্ট্যসমূহ দ্বারা। তাই এই নূতন বাঙ্গালী জাতি দ্বারা আগামী দিনে যে নূতন ও অখণ্ড স্বাধীন বঙ্গের অভ্যুদয় ঘটবে তা হবে শাশ্বত বঙ্গের নব রূপায়ন।

আগামী দিনের এই বাঙ্গালী ও তার অখণ্ড স্বাধীন বঙ্গের অভ্যুদয়ের লক্ষ্যকে অর্জন করতে হলে আমাদের আজ বাঙ্গালীর স্বাধীনতা যুদ্ধের আদর্শ ও ভাবপ্রেরণার পুনরুজ্জীবন ঘটাতে হবে। অর্থাৎ সাম্প্রদায়িকতা ও সাম্প্রদায়িক শক্তিসমূহের কবল থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করে তাকে পরিণত করতে হবে বাঙ্গালী জাতির স্বাধীন জাতীয় রাষ্ট্রে। সকল বাঙ্গালীর অখণ্ড জাতীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথে বাংলাদেশ হোক সূচনা বিন্দু।

রচনাঃ ১৯৮৯

 


খণ্ডিত চেতনাঃ জাতীয়তাবাদ সমস্যা

আমাদের চেতনা খণ্ডিত। কারণ আমরা জাতি হিসাবে খণ্ডিত। স্বদেশ ও স্বজাতিকে খণ্ডায়নের মাধ্যমেই আমরা এ পর্যন্ত এগিয়েছি। আমাদের জাতীয়তাবাদও তাই খণ্ডিত। এই খণ্ডিত জাতীয়তাবাদ পশ্চিম বঙ্গ ও ত্রিপুরাসহ ভারত রাষ্ট্রভুক্ত বাঙ্গালী জাতির অপর অংশকে বর্জন করেই দাঁড়াতে চায়। তাই আমরা যখন বাংলাদেশ রাষ্ট্রে নিজেদেরকে বলি বাঙ্গালী জাতি তখন আমাদের মন থেকে পৃথক করে রাখি বাঙ্গালী জাতিসত্তার অপর অংশকেই যাকে ১৯৪৭-এ ধর্ম-সাম্প্রদায়িক পরিচয়ের ভিত্তিতে আমরা আমাদের সত্তা থেকে পৃথক করেছিলাম। যখন এই রাষ্ট্রের বাঙ্গালীকে বলা হয় বাংলাদেশী জাতি তখন ’৪৭-এর এই ধর্ম-সাম্প্রদায়িক বিভক্তিকেই যৌক্তিক ও নৈতিক ভিত্তি দিতে চাওয়া হয় মাত্র।

বাস্তবে কিন্তু এই ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার ইতিহাস এ দেশে ’৪৭-এই শুরু হয় নি। এটা আরও বহু প্রাচীন। ভারতবর্ষ কোনও কালেই একটা দেশ বা জাতি ছিল না। ব্রিটিশ পূর্বকালে এখানে ধর্ম-সম্প্রদায় এবং বর্ণজাতি চেতনার বাইরে প্রকৃতপক্ষে তেমন কোনও সামাজিক পরিচিতি-বোধ জনগণের মধ্যে ছিল না। এখানে উল্লেখযোগ্য মাত্রায় ভাষা ভিত্তিক জাতি চেতনা তো ছিলই না এমন কি স্থানিক বা রাষ্ট্রীয় জাতি চেতনা বা জাতীয়তা বোধও ছিল না। ছিল মুসলমান ও হিন্দু, ছিল পাঠান, মোগল, সৈয়দ, শেখ, আশরাফ - আতরাফ এবং ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, কায়স্থ, কামার, কুমার, শূদ্র, কাহার, বাগদী, বাউরী ইত্যাদি ধর্ম-সাম্প্রদায়িক এবং উপজাতি, গোত্র ও বর্ণজাতি মূলক গোষ্ঠী চেতনা। এর সঙ্গে যুক্ত হত কখনও বংশ বা পরিবার পরিচয়, কখনও জায়গা যেমন গ্রাম, নগর কিংবা প্রদেশ বা রাষ্ট্রের পরিচয় কিংবা কখনও ভাষা ও আরও অন্যান্য পরিচয়। এই সবকিছুকে ভেদ করে ভাষা ভিত্তিক জাতীয়তা বোধ এই উপমহাদেশে অতীতে কোনও কালেই খুব একটা প্রবল হয়ে উঠতে পারে নি। এমন কি মারাঠা উত্থানের মত ঘটনা যা ছিল মোগল রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে মারাঠা জাতির বিদ্রোহের ঘটনা এবং যা ছিল যথেষ্ট পরিমাণে অভিন্ন ভাষা, সংস্কৃতি ও স্থান ভিত্তিক জাতীয়তাবাদের নূতন উদ্ভবের সূচনাও তাও ভারতীয় উপমহাদেশের বর্ণজাতি ব্যবস্থা নির্ভর ও ব্রাহ্মণ কেন্দ্রিক ধর্মীয় প্রভাবকে অতিক্রম করে স্পষ্টভাবে জাতীয়তাবাদী হয়ে উঠতে পারে নি। তা তখনও নিজেকে আজকের রাজনৈতিক জাতি অর্থে জাতি হিসাবে চিনতে পারে নি। তা পারলে মারাঠা জাতি তার বিজয় অভিযানের সময় নিজেও এই চেতনা ভারতবর্ষে ছড়িয়ে দিতে বাধ্য হ’ত।

এ উপমহাদেশে ইংরেজরা একটা সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিল। এইভাবে তারা তুর্কী ও মোগলদের জায়গা নিল। মোগল এবং তৎপূর্বে তুর্কীরাও এবং সেই সঙ্গে তাদের পার্শ্বচর হিসাবে আফগানরা অস্ত্র শক্তির জোরে ভারতবর্ষে একটা সাম্রাজ্য-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিল। এই সাম্রাজ্য-রাষ্ট্রের অধিপতিরা নিজেরা ছিল বহিরাগত এবং তারা নিজেরাও ছিল না এক ভাষা ও এক দেশের। তুর্কী, তাতার, পাঠান, ইরানী, আরব ইত্যাদি জাতির সমন্বয়ে গঠিত হয়েছিল বিদেশী মুসলমান শাসক শ্রেণী। তাদের ঐক্যের মূল সূত্রই ছিল ইসলাম ধর্ম। তাদের ধর্মীয় ভাষা ছিল আরবী, রাষ্ট্র-ভাষা ছিল ফার্সী এবং তারা দৈনন্দিন কাজ চালাবার জন্য বা নিজেদের মধ্যে ভাব বিনিময়ের প্রধান মাধ্যম হিসাবে আরবী, ফার্সী ও তুর্কী এবং হিন্দী ভাষার পূর্ব রূপ উত্তর ভারতীয় হিন্দুস্তানী ভাষার সাহায্য নিয়ে গড়ে তুলেছিল উর্দূ ভাষা যেটা আসলে হিন্দুস্তানী ভাষার বহিরাগত ও উপনিবেশিত মুসলমান রূপ।

মোগল কিংবা মুসলিম মধ্য যুগে এ উপমহাদেশে যেমন ভাষা ভিত্তিক বা কোনও ধরনের বৃহত্তর জাতি চেতনা ছিল না তেমন এটা ছিল না হিন্দু কিংবা বৌদ্ধ যুগেও। প্রাচীন যুগের মৌর্য সাম্রাজ্য ছিল ঐতিহাসিক কালের প্রথম সর্বভারতীয় সাম্রাজ্য-রাষ্ট্র। প্রায় সোয়া দুই হাজার বৎসর আগে এই সাম্রাজ্য যে আয়তন নিয়ে প্রতিষ্ঠিত ছিল তার সমতুল্য মোগল এবং ব্রিটিশ ভারতীয় সাম্রাজ্য ছাড়া আর কোনও সাম্রাজ্যই ছিল না। মোগলরাও এত বিশাল এলাকায় তাদের বিজয় ও অধিকারকে সম্ভবত এভাবে সম্পন্ন করতে পারে নি। কিন্তু মৌর্য ভারত একটা রাষ্ট্র হলেও তা একটা জাতির জন্ম দেয় নি। অসংখ্য জাতি, বর্ণজাতি বা ঈথঢ়য়প, উপজাতি বা ঞড়মদপ এবং বিভিন্ন ধরনের জনগোষ্ঠীকে এক সাম্রাজ্য-রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত করতে পারলেও সেগুলিকে এক ভাষা কিংবা সংস্কৃতি ভিত্তিক জাতিতে পরিণত করার ক্ষমতা যেমন মৌর্য সাম্রাজ্যের হয় নি তেমন তাদের মধ্যে এক অভিন্ন জাতি চেতনা জাগ্রত করার ক্ষমতাও তার হয় নি।

সুতরাং মগধ কেন্দ্রিক এই সামরিক শক্তির সম্প্রসারণের ক্ষমতা যখন ফুরিয়ে এসেছে ভারতবর্ষ তখন ফিরে গেছে প্রায় পূর্বাবস্থায়, তার অসংখ্য আঞ্চলিক রাষ্ট্রীয় বিভাজনে। পরবর্তীকালে গুপ্ত ইত্যাদি এবং তুর্কী, পাঠান, তাতার বা মোগলরা এখানে উত্তর ভারত ও দিল্লীকে কেন্দ্র করে সাম্রাজ্য রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিল।

তুর্কী-মোগলরা এই উপমহাদেশকে বলত হিন্দুস্তান এবং এর অধিবাসীদেরকে বলত হিন্দু। হিন্দু শব্দটা এসেছে সিন্ধু নদী থেকে। ভারতের বাইরে পশ্চিমের মানুষদের কাছে ভারতবাসীর পরিচয় ছিল সিন্ধু নদী এলাকার অধিবাসী হিসাবে হিন্দু। এই হিসাবে বহিরাগত বিজয়ী তুর্কী-মোগলরা ভারতের সকল জাতি ও ধর্মমতের মানুষকে বলল হিন্দু এবং হিন্দুদের বাসস্থান ভারতকে বলল হিন্দুস্তান বা হিন্দুস্থান। কাজেই হিন্দু নামটাও বিদেশীদেরই দেওয়া। এটা ঠিক যে, উপমহাদেশের বিভিন্ন ভাষা, জাতি ও উপজাতির মধ্যে বিভিন্ন ধরনের ধর্মমত ও ধর্মীয় বিশ্বাস এবং রীতিনীতি থাকলেও ব্যাপক সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠী ছিল বেদ-ব্রাহ্মণ কেন্দ্রিক, বর্ণজাতি ভিত্তিক এবং পৌত্তলিক। পরে এই ধর্মীয় সামাজিক ধারার লোকদেরই সাধারণ পরিচয় হয়ে দাঁড়াল হিন্দু হিসাবে। অবশ্য সেই অর্থে হিন্দু ধর্ম অন্য ধর্মের মত নয়। কারণ এখানে শুধু যে বিভিন্ন দেবতার স্থান আছে তাই নয় সেই সঙ্গে আছে একেশ্বরবাদ, সাকারবাদ, নিরাকারবাদ এবং আরও বিভিন্ন ধরনের মতবাদ।

ব্রিটিশ পূর্বকালে বহিরাগত মুসলিম শাসকদের নিজেদের ঐক্যের বন্ধন ছিল মূলত ইসলাম ধর্ম। এই ধর্ম দ্বারা তারা এ দেশের পরাধীন অমুসলিম জনগোষ্ঠী থেকে নিজেদের স্বাতন্ত্র্য ও শ্রেষ্ঠত্ব রক্ষা করত এবং সেই সঙ্গে নিজেদের বিভিন্ন ভাষা ও জাতিগোষ্ঠীর মধ্যকার ঐক্যও। সুতরাং বিদেশী-বিজাতি-বিধর্মী তুর্কী-মোগলদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের অস্ত্র হিসাবে ভারতীয় বিভিন্ন জাতিসত্তা ও জনগোষ্ঠীর মধ্যে ভারত ভিত্তিক ধর্ম হিসাবে হিন্দু ধর্ম কিংবা বেদ ও ব্রাহ্মণ কেন্দ্রিক ধর্ম মাথা তুললে অবাক হবার কিছু নেই। এই সঙ্গে ইসলাম ও মুসলমানদের ধর্মীয়-রাজনৈতিক-সামাজিক অগ্রাভিযানকে প্রতিরোধ করার জন্য উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন ধর্মীয় আন্দোলনও সংগঠিত হয়েছিল। বহিরাগতদের আগ্রাসন ও শাসন যখন ধর্মীয় রূপ নিয়ে চেপে থাকে তখন তার বিরুদ্ধে স্থানীয় জনগণের প্রতিরোধ সংগ্রামেরও কোনও না কোনও ধরনের ধর্মীয় রূপ নেওয়া স্বাভাবিক।

কিন্তু ব্রিটিশ শাসকরা এই উপমহাদেশে খ্রীষ্টান ধর্ম-সম্প্রদায় হিসাবে আসে নি। তারা ধর্মে খ্রীষ্টান হলেও ধর্মীয় পরিচয় ছিল তাদের গৌণ দিক। বরং তারা এসেছিল মূলত ব্রিটিশ জাতি পরিচয় নিয়ে। এই উপমহাদেশ কিংবা দেশে তাদের শাসনও ছিল না পরলোকবাদী ধর্মের পরিচয়ে চিহ্নিত হয়ে। বরং তা ছিল প্রধানত ব্রিটিশের ইহলোকবাদী ও ভাষা ভিত্তিক রাজনৈতিক জাতি পরিচয় দ্বারা চিহ্নিত।

ব্রিটিশ শাসকরা ভারতবর্ষে জাতীয়তাবাদের যে ধারণা নিয়ে এল তা এখানকার মাটিতে বিকৃত রূপ নিয়ে হ’ল ভারতীয় সাম্রাজ্য ভিত্তিক বা উপমহাদেশ ভিত্তিক জাতীয়তাবাদ। এর দ্বারা অস্বীকৃত হ’ল ভারতবর্ষে ভাষা ভিত্তিক বিভিন্ন জাতিসত্তার স্বাধীন বিকাশ সম্ভাবনা। ব্রিটিশ শাসক-জাতির বিপরীতে সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশের সমস্ত জাতি ও উপজাতিকে এক জাতি ভাবতে চাওয়া হল।

এই ধরনের ভ্রান্ত জাতি চেতনা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শাসকদের স্বার্থের অনুকূল ছিল। কারণ প্রথমত, উপমহাদেশ ব্যাপী পূর্বতন মোগল সাম্রাজ্য-রাষ্ট্রের উত্তরাধিকারী ব্রিটিশ শাসকদের উপমহাদেশ ব্যাপী সাম্রাজ্য-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ও রক্ষায় এটা একটা নৈতিক সমর্থন যোগাবে। দ্বিতীয়ত, এর ফলে ভারতের জাতিসত্তাগুলি নিজস্ব স্বাধীন ও স্বতন্ত্র বিকাশের পথ অনুসরণ না করায় তাদের গতিশীলতা ও শক্তি ব্রিটিশের বিরুদ্ধে চালিত না হয়ে এক জায়গায় জট পাকিয়ে নিজেদের পরস্পরের বিরুদ্ধে চালিত হতে বাধ্য হবে। তৃতীয়ত, জাতিসত্তা ভিত্তিক জাতীয়তাবাদের বিকাশ না হওয়ায় বহু জাতি ভিত্তিক ভারতীয় জাতীয়তার মূল বন্ধন হিসাবে প্রথাগত ধর্ম ক্রিয়াশীল হবে। ফলে উপমহাদেশে দুই প্রধান প্রথাগত ধর্ম ইসলাম ও হিন্দুকে পরস্পরের বিরুদ্ধে ব্যবহার দ্বারা ব্রিটিশের শাসনকে দীর্ঘস্থায়ী করা সম্ভব হবে। কাজেই ভারতীয় জাতীয়তাবাদের ধারণার বিকাশ সাধনে ব্রিটিশ শাসক, পণ্ডিত ও লেখক এবং তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠা ভারতীয় বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিকরা সকলেই ভূমিকা নিল।

ভারতবর্ষকে এক দেশ ও জাতি করতে গিয়ে তার অতীত ইতিহাস ও ঐতিহ্যে ঐক্য বা অখণ্ডতা সন্ধান করতে হ’ল। স্বাভাবিকভাবে সেখানে আছে কখনও কখনও বিভিন্ন বৃহত্তর সাম্রাজ্য-রাষ্ট্রের অবস্থান। কিন্তু এইসব সাম্রাজ্য-রাষ্ট্রের আয়তনও পরিবর্তনশীল। এবং এগুলোও সব যুগে থাকে নি। বরং ভারত ব্যাপী একটি বৃহৎ রাষ্ট্র প্রায় সময়ই থাকে নি। সর্বভারতীয় রাষ্ট্র সত্তার এই পরিবর্তনশীলতার মধ্যে অপরিবর্তনীয় সত্তা হিসাবে যেটা পাওয়া গেল সেটা মূলত তার সংস্কৃতির একটি মূল কিংবা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসাবে প্রথাগত ধর্ম ­ বেদ ও ব্রাহ্মণ কেন্দ্রিক বর্ণজাতি ভিত্তিক হিন্দু ধর্ম। অন্যদিকে ভারতীয় বৃহত্তর রাষ্ট্র কাঠামোয় বৈদেশিক বা বহিরাগত শক্তি হিসাবে দেখা গেল মুসলিম বহিরাগত শাসকদেরকে যারা পূর্ববর্তী বহিরাগত বিজয়ীদের মত হিন্দু সমাজে বিলীন হয় নি। কয়েক শত বৎসরের এই শাসনে এ উপমহাদেশের মানুষের মনে সঙ্গত কারণেই ক্ষোভ ও বেদনার কারণ কম ছিল না। সুতরাং বৃহত্তর অমুসলিম এবং সাধারণ অর্থে হিন্দু জনগোষ্ঠী ঐক্যবদ্ধ ভারতীয় জাতি হতে গিয়ে ব্রাহ্মণ কেন্দ্রিক হিন্দু ধর্ম ও ঐতিহ্যকে তার জাতীয়তা বোধের ভিত্তি হিসাবে পেতে চাইল।

এরই বিপরীতে ছিল মুসলমান ভারতীয়দের মুসলিম জাতীয়তাবাদ যারা ভারতবর্ষে বৈদেশিক মুসলিম আধিপত্য ও পীড়নে খুঁজে পেত তৃপ্তি ও গৌরবের সামগ্রী। সঙ্গত কারণেই শুধু ভারতবর্ষের প্রাচীন সংস্কৃতি নয় এমন কি ভাষা ভিত্তিক জাতীয়তার উপাদানসমূহও এই ধারণার কাছে মর্যাদা পেতে পারে না। কারণ এই ধারণার অবলম্বন হ’ল আরব-ইরানের ইসলামী গৌরব কাহিনী।

১৯৪৭-এ ব্রিটিশ তাই মূলত দুইটি ভারতবর্ষ রেখে দিয়ে গিয়েছিল। একটি হিন্দু ভারতবর্ষ যা হল বর্তমান ভারত রাষ্ট্র, অপরটি মুসলিম ভারতবর্ষ যার নাম হল পাকিস্তান।

এমন অবস্থায় প্রথাগত ধর্ম এবং এই ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতাই যে সমগ্র উপমহাদেশে সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সবচেয়ে মৌল উপাদান ও নির্ধারক শক্তি হিসাবে ভূমিকা পালন করবে সেটাই স্বাভাবিক। এই উপমহাদেশে লোকবাদ বা সেকিউলারিজম ও বিজ্ঞান মনস্কতা তাই অনেকাংশে বাইরের বা উপরের আবরণ। তার ভিতরেই বা নীচেই আছে গভীর প্রথাগত ধর্ম বিশ্বাস কিংবা পরলোকবাদী ধর্মীয় অনুভূতি ও চেতনা এবং প্রথাগত ধর্ম কেন্দ্রিক সংস্কৃতি। পাকিস্তান ইসলাম ধর্মের প্রতি তার অঙ্গীকারকে সজোরে ও স্পষ্টভাবে ঘোষণা করে। কিন্ত বর্তমান ভারত রাষ্ট্র হিন্দু ধর্মের প্রতি তার অঙ্গীকারকে অনুক্ত রাখলেও সেটাই তার মর্মবস্তুতে গাঁথা থাকে। আজ ভারত রাষ্ট্রে হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থানে চমকিত হবার কিছু নেই। কারণ কংগ্রেসও মূলত তাই। কংগ্রেস সাম্প্রদায়িক হলেও কৌশলী ও নমনীয়। কিন্তু ভারতে জাতিগত চেতনার বিকাশ ও বিস্তার দ্বারা যখন বৃহত্তর ভারত রাষ্ট্র হুমকির সম্মুখীন হবে তখন বিভিন্ন জাতিসত্তার জনগণের ঐক্যের অনুভূতি রক্ষা করার জন্য ব্রাহ্মণ কেন্দ্রিক এবং বর্ণজাতিমূলক হিন্দু ধর্মের আশ্রয় জোরেশোরে নেওয়া ছাড়া উপায় কী?

উপমহাদেশে রাজনীতি ও রাষ্ট্র সাধনায় ধর্মের এই নিয়ন্ত্রণ এক জায়গায় প্রথম বিপর্যস্ত হয়েছে। তা হ’ল বাংলাদেশ। এটা ঠিক যে, এখানকার শাসকগোষ্ঠী আপাত দৃষ্টিতে এই বিপর্যয় ও ভাঙ্গনকে মেরামত করেছে। সেই সঙ্গে এটাও ঠিক যে, ১৯৭১-এ বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা কোনও লোকবাদী ও ভাষা ভিত্তিক জাতীয়তাবাদী চেতনা ও রাজনীতির সচেতন ও সুশৃংখল প্রয়াসের অনিবার্য পরিণতি নয়। ১৯৪৭-এ যারা মুসলমান ‘জাতি’ হিসাবে নিজেদেরকে শুধু হিন্দু বাঙ্গালী থেকে নয় অধিকন্তু বাঙ্গালী চেতনা থেকেও বিচ্ছিন্ন করে নিয়েছিল এবং বাংলা ভাষাতে কথা বললেও যাদের কাছে বাঙ্গালী পরিচয় ছিল তুচ্ছ কিংবা গৌণ বিষয় ’৫২-তে তারাই নিজেদেরকে বাঙ্গালী জাতিসত্তা হিসাবে আবিষ্কার করল। এবং তারপর পশ্চিম পাকিস্তানীদের সঙ্গে স্বার্থগত সংঘাতের কারণে একবার মুসলমান একবার বাঙ্গালী এবং কখনও একসঙ্গে উভয়ই থেকে এগিয়ে গেল ১৯৭১ পর্যন্ত।

পাকিস্তানী না হলে তাদেরকে কি ভারতীয় কিংবা হিন্দু হতে হবে এই ভয় ও প্রশ্ন তাদেরকে সর্বদা সংশয়ান্বিত করেছে। দ্বি-জাতিতত্ত্ব খারাপ হয়ে থাকলে বুঝি অখণ্ড ভারত প্রতিষ্ঠা করাই করণীয় হয়ে দেখা দেয় এমনভাবেই চিন্তা মোড় নিতে চেয়েছে। কিন্তু এই বোধ খুব কমই জেগেছে যে, ভারতবর্ষ একটা জাতি নয়, একটা দেশ নয়। এটা শুধু বহু ভাষা, সংস্কৃতি, ধর্ম, জাতি, উপজাতি ও জনগোষ্ঠীর সমন্বয়ে একটা বিশাল উপমহাদেশ নয়, বরং এটাকে মহাদেশ বলাই অধিকতর সঙ্গত। বস্তুত এটা এতই বিচিত্র যে,এটা যেন নিজেই একটা পৃথিবী। কিন্তু তা সত্ত্বেও ধর্মীয় দ্বি-জাতিতত্ত্বকে নাকচ করলে তার জায়গা যে ভাষা ভিত্তিক জাতীয়তাবাদ নেয় এই বোধ না জেগে এটাই জাগতে চেয়েছে যে, সেই জায়গা নেয় অখণ্ড ভারত। আসলে উপমহাদেশীয় কাঠামোতে জাতীয়তাবাদের শক্তির বিকাশ খুবই বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে। সুতরাং ’৭১ পূর্বকালে ভাষা ভিত্তিক রাষ্ট্র চেতনা এ দেশে কোনও দৃঢ় যুক্তি ও নৈতিক ভিত্তি লাভ করে নি।

ষাটের দশকে এবং ’৭০-’৭১-এ ছাত্র-তরুণরা স্বাধীন পূর্ব বাংলার যে দাবী তুলেছিল তার পিছনে যে অনিবার্য ঐতিহাসিক ও সামাজিক কারণই কাজ করুক এই দাবী রূপ নিয়েছিল প্রধানতই আবেগ নির্ভর আকাঙ্ক্ষা ও কর্মে। তবু এর আঘাতে পাকিস্তান ভেঙ্গেছে। এবং ইতিহাসে এই প্রথম ভারতবর্ষে কোনও সমাজ নিজেকে মূলত ভাষা ভিত্তিক এবং লোকবাদী জাতি হিসাবে চিন্তা করার জন্য একটা স্থান বা ঝহথধপ পেল। অন্তত এ যুগে এসেও ভাষা ভিত্তিক জাতীয়তাবাদের অভাবে এই উপমহাদেশ যে সমাজ পরিবর্তনের ক্ষেত্রে বড় ধরনের কোনও ইতিবাচক পদক্ষেপ দিতে পারছে না সেই অবস্থার পরিবর্তনের সূচনা ঘটাবার একটা ক্ষেত্র পাওয়া গেছে।

ভারতবর্ষে হাজার হাজার বৎসর ধরে পরলোক, জন্মান্তরবাদ, কর্মফলবাদ এবং অলৌকিক শক্তির প্রতি বিশ্বাস নির্ভর বিভিন্ন ধর্মের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশিষ্ট সমাজ গবেষক ও চিন্তাবিদ বিনয় ঘোষ ধর্মকে ভারতীয় সমাজের সবচেয়ে শক্তিশালী ইনস্টিটিউশন বা প্রতিষ্ঠান বলেছেন। বাংলায় ইউরোপের মত রেনেসাঁ বা নবজাগরণ না হবার কারণ এবং সমাজের পরিবর্তনের পথে প্রধান বাধা হিসাবে তিনি ধর্মকেই দেখতে পেয়েছেন। “বাংলার নবজাগৃতি” একটি অতিকথা’ নামক প্রবন্ধে বিনয় ঘোষ বলছেন,‘হিন্দু ধর্ম চাতুর্বর্ণের উপর প্রতিষ্ঠিত এবং হিন্দু সমাজ “বর্ণাশ্রমী সমাজ”। হিন্দু সমাজের এই ভিত আজ পর্যন্ত কোনো সংস্কারক অথবা কোনো শাসক ভাঙ্গতে পারেন নি, বৌদ্ধ, জৈন, হিন্দু, মুসলমান অথবা খ্রীষ্টান ইংরেজরা কেউ না। সংস্কারকদের মানবতার বাণী, রাষ্ট্রীয় আইন-কানুন, শিক্ষার অগ্রগতি ইত্যাদির ফলে তার গায়ে খানিকটা আঁচড় লেগেছে ঠিকই, কিন্তু ভিত্তিতে ফাটল ধরে নি। বর্তমান বিংশ শতাব্দীর সত্তরের দশকেও বোঝা যায়, এ কথা কতখানি সত্য।’

এই একই প্রবন্ধে তিনি আরও বলছেন, ‘যুগে-যুগে কত শত-শত যুধিষ্ঠির এসেছেন গিয়েছেন কিন্তু বর্ণভেদের আঁকাবাঁকা পথে হিন্দু সমাজের প্রবাহ তার জন্য খাত বদলায় নি। সে কালের সমাজের যা-হোক একটা শাসন ছিল, এ কালে তাও নেই। এ কালে টাকা যার সমাজ তার। নিম্নবর্ণের চেয়ে উচ্চবর্ণের ক্ষেত্রে এ কথা অনেক বেশী সত্য। এ কালের ব্রাহ্মণরা যদি অজস্র অপকর্ম করে অঢেল টাকা উপার্জন করতে পারেন, তাহলে সেই টাকার জোরে তিনি তাঁর ব্রাহ্মণত্ব অনেক বেশী বজায় রাখতে পারেন এবং বর্ণশ্রেষ্ঠ রূপে তাঁর দাপট অন্যদের উপর জাহির করতেও পারেন। ব্রিটিশ আমলে হিন্দু সমাজে এই ঘটনাই ঘটেছে। কুলবৃত্তি ত্যাগ করে ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়-বৈশ্যরা কেউ জাতিচুøত হন নি, বরং প্রচুর অর্থ উপার্জন করে সমাজে তাদের কুলগত আধিপত্য আরও মজবুত করে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। কুলগত বর্ণের সঙ্গে বিত্তগত বর্ণ মিশে এক বিচিত্রবর্ণ সামাজিক প্রতিপত্তির বিকাশ হয়েছে সমাজে ব্রিটিশ আমলে। সমাজের কুলগত জাতিবর্ণগত গড়নের কোনো পরিবর্তন হয় নি, যে জন্য এ দেশে ‘রেনেসাঁস’ হয় নি।’ (বিনয় ঘোষ, বাংলার নবজাগৃতি; প্রকাশকঃ ওরিয়েন্ট লংম্যান; দ্বিতীয় সংস্করণঃ আষাঢ় ১৩৯১)

এটা ঠিক যে, ব্রিটিশ শাসনামলে ভারতে এবং বিশেষত বঙ্গে হিন্দু ধর্ম ও সমাজ সংস্কারের আন্দোলন কম হয় নি। কিন্তু নীচের প্রতি ধাবিত স্তর ভিত্তিক ঘৃণা এবং অপরিবর্তনীয় কুল-মর্যাদা ভিত্তিক বর্ণজাতিভেদ প্রথাকে কেউ ভাঙ্গতে পারে নি। কারণ প্রথাগত হিন্দু ধর্মের মূল গ্রন্থ বেদে কিংবা বিভিন্ন তত্ত্বকথায় যা-ই লেখা থাক জন্ম ও রক্তগত পবিত্রতার ধারণার উপর প্রতিষ্ঠিত ব্রাহ্মণ বর্ণজাতি হ’ল হিন্দু সমাজের কেন্দ্রীয় শক্তি, এবং ব্রাহ্মণকে কেন্দ্র করে বর্ণজাতি কাঠামোতে প্রথাগত হিন্দু সমাজ সংগঠিত। কাজেই ব্রাহ্মণ্যবাদ এবং বর্ণজাতি ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়লে প্রথাগত হিন্দু ধর্ম কিংবা সমাজ থাকে না। এমন অবস্থায় ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন ভাষা ও সংস্কৃতির জাতিগুলির মধ্যে এক রাষ্ট্র গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় ঐক্যের সূত্র আর থাকে না। তাই ভারতীয় ঐক্যের প্রয়োজনেই হিন্দু জন-মানস সজ্ঞানে হোক আর অজ্ঞানে হোক বর্ণজাতি ভিত্তিক হিন্দু ধর্মকে সংরক্ষণ করতে বাধ্য হয় আর এইভাবে সংরক্ষণ করতে বাধ্য হয় বহু হাজার বৎসরের প্রাচীন ভারতীয় সমাজের মূল গড়নটি, যে কুলগত ও বর্ণজাতিগত গড়নের কথা বিনয় ঘোষ বলেছেন। এর ফলে রক্ষা পায় অনেক হাজার বৎসরের সামাজিক জাড্যও।

অবশ্য এটা ঠিক যে, বহু প্রাচীন কাল থেকে ভারতবর্ষের নির্দিষ্ট প্রেক্ষিতে সমাজের ঐক্য রক্ষা ও সমাজ বিকাশের প্রয়োজনেই এই বর্ণজাতি ভিত্তিক ব্যবস্থা এবং ব্রাহ্মণতন্ত্র গড়ে উঠেছিল। যে যুগে ভারতবর্ষে ভাষার শক্তি কিংবা বস্তুগত এবং যান্ত্রিক শক্তি বৃহত্তর সামাজিক ঐক্য প্রতিষ্ঠা কিংবা রক্ষার উপযোগী হয় নি সে যুগে এখানে এই ব্যবস্থা গড়ে উঠে সুদীর্ঘ কাল তার সমাজ ও সভ্যতা রক্ষাকারী ভূমিকা পালন করেছে। ভারতবর্ষের জনগণের জন্য যতই দুঃখের কারণ হোক এই ব্যবস্থা এই উপমহাদেশে সভ্যতার অস্তিত্বের একটি প্রধান শর্ত ছিল বলেই এখানে তা এত দীর্ঘস্থায়ী হয়েছে। আধুনিক কালে এসে যখন ভাষা কিংবা জাতিসত্তা ভিত্তিক জাতীয়তাবাদ বা Nationalism এবং সেই সঙ্গে অন্যান্য বস্তুগত ও প্রযুক্তিগত উপসরণসমূহ সমাজের ঐক্য প্রতিষ্ঠা ও রক্ষার দায়িত্ব নিতে পারছে কেবলমাত্র তখনই প্রথাগত ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের এই ভূমিকা শেষ হওয়ায় তা মৃত্যু বরণ করতে পারে।

কিন্তু ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে সমস্যা হয়েছে এইখানে যে, তা এক জাতির দেশ নয় বরং বহু জাতির ভূভাগ। সুতরাং জাতীয়তাবাদ ভারতকে ঐক্যবদ্ধ না করে বহু ভাগে বিভক্ত করে। যে তামিল ভাষার এক বর্ণ কিংবা বাক্যও বাঙ্গালী বোঝে না সেই তামিল ভাষার মানুষের সঙ্গে বাঙ্গালী এক রাষ্ট্রে এক জাতি হতে চাইতে পারে একমাত্র তখনই যখন সে ভাষার বাইরে অধিকতর শক্তিশালী কোনও ভাবাদর্শিক বন্ধন বা ঐক্যসূত্র খুঁজে পায়। কাজেই এ কালে এসে প্রথাগত ধর্ম যতই ক্ষতিকর ও অপ্রয়োজনীয় হয়ে দেখা দিক ভারতীয় ঐক্যের প্রয়োজনেই তা ভারতীয় সমাজ মানসকে অধিকার করে থাকতে এবং এইভাবে সকল মৌলিক সংস্কার ও বিপ্লব প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করতে বাধ্য।

বস্তুত হিন্দু জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত ভারতবর্ষের জন্য যেমন এই কথা সত্য তেমন মুসলিম জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত ভারতবর্ষের জন্যও এই একই কথা প্রযোজ্য। অর্থাৎ এই উপমহাদেশে সমাজ ও রাষ্ট্র সংগঠনে যুগ যুগ ধরে হিন্দু ও ইসলাম এই উভয় পরস্পর বিরোধী ধর্মের ভূমিকাই অতীব গুরুত্বপূর্ণ। বস্তুত সামগ্রিকভাবে এই উপমহাদেশে আধুনিক যুগের যাবতীয় লোকবাদী, বৈজ্ঞানিক, রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তন এই ধর্মীয় ভিত্তিকে মূলত অক্ষত রেখেই তার উপর সংগঠিত হচ্ছে। সুতরাং সমগ্র উপমহাদেশই সর্বদা আত্মঘাতী ও আত্মক্ষয়ী অন্তর্দ্বন্দ্ব বা স্ববিরোধে ভুগছে।

প্রাচীন প্রথাগত ধর্মের পরলোকবাদ, নিয়তিবাদ, অলৌকিক শক্তি কর্তৃক নিয়ন্ত্রণবাদ এবং হিন্দু ধর্মের বর্ণজাতিবাদ ইত্যাদির সঙ্গে লোকবাদ, যুক্তি ও বিজ্ঞানের সম্পর্ক আর যাই হোক সঙ্গতির বা ঐক্যের নয়। কাজেই প্রথাগত ধর্মের প্রভাবে আটকে থেকে এই উপমহাদেশের বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন জাতির মানুষ যে আধুনিক কালের প্রতিযোগিতায় হেরে যাবে, মার খাবে, বৈদেশিক বিভিন্ন উন্নত রাষ্ট্রীয় ও অর্থনৈতিক-সামাজিক শক্তির শোষণ, নিয়ন্ত্রণ, আধিপত্য ও লুণ্ঠনের সহজ শিকার হবে তাতে আশ্চর্যের কি আছে? প্রাচীন ধর্মীয় প্রভাবে মানবিকতা, সাম্য, সহনশীলতা, জিজ্ঞাসা, মুক্ত চিন্তা, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও সংস্কৃতির স্বাভাবিক ও স্বচ্ছন্দ বিকাশ অসম্ভব হয়ে থাকছে। প্রথাগত ধর্মের লালন ও প্রভাবের ফলে উপমহাদেশ আজও টেনে চলেছে হাজার হাজার বৎসরের পশ্চাৎপদতার জের যার ফলে এখানকার বিভিন্ন রাষ্ট্রে এক বিশেষ ধরনের শাসক ও অধিপতি শ্রেণী রাষ্ট্র ক্ষমতা ও সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করছে। এই শ্রেণী উপমহাদেশের পশ্চাৎপদতার প্রত্যক্ষ ফলভোগী। সুতরাং উপমহাদেশে বৈদেশিক আধিপত্য ও শোষণ, লুণ্ঠন কার্যকর কিংবা রক্ষা করার এরাই প্রধান মাধ্যম।

বাংলাদেশে পাকিস্তান বা ভারত রাষ্ট্রের মত বহু জাতিকে নিয়ন্ত্রণে রাখবার জন্য শাসক শ্রেণীর বা রাষ্ট্র পরিচালকদের ধর্মকে রাজনীতিতে লালনের প্রয়োজন হয় না। এটা এখানে হয় তার বিপরীত প্রয়োজন থেকে। অর্থাৎ বাঙ্গালী জাতিকে খণ্ডিত রাখবার প্রয়োজন থেকে। যাতে বাঙ্গালী জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়ে একটা অখণ্ড জাতীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে না পারে তার জন্য এখানে এখন মূলত প্রয়োজন ধর্ম চর্চার। জনগণকে পশ্চাৎপদ সামাজিক অবস্থায় ধরে রাখার জন্য এ দেশের বর্তমান রাষ্ট্র শাসকদের নিকট যেমন রাজনীতিতে ধর্ম চর্চার প্রয়োজন রয়েছে তেমন বাঙ্গালী জাতিসত্তাকে বিভক্ত রাখার জন্যও এর প্রয়োজন রয়েছে। এইভাবে বর্তমান শাসকরা প্রথাগত ধর্ম ও সাম্প্রদায়িকতার অব্যাহত চর্চা দ্বারা বাঙ্গালীর চেতনাকে খণ্ডিত রাখছে।

এতে লাভ কার? আগে নিঃসন্দেহে সবচেয়ে বেশী এবং প্রত্যক্ষ লাভ ছিল ইসলামাবাদ ও দিল্লীর। এখন অন্তত প্রত্যক্ষ লাভ ইসলামাবাদের নেই যদিও পরোক্ষ লাভ আছে। কারণ ইসলাম ধর্ম ভিত্তিক বহু-জাতিক রাষ্ট্র পাকিস্তান এ দেশের রাজনীতিতে ইসলাম চর্চা দ্বারা মানসিক শক্তি ও নৈতিক সমর্থন লাভ করে। কিন্ত সেটা তার জন্য পরোক্ষ লাভের বিষয়। এ ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষভাবে সবচেয়ে বেশী লাভ এখন দিল্লীর শাসকদের। কারণ তাদেরকে পশ্চিম বঙ্গকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। যদি কোনও কারণে কোনও দিন পশ্চিম বঙ্গ পূর্ব বঙ্গের পথ গ্রহণ করে তবে আসামসহ সমগ্র পূর্ব ভারত ভৌগোলিক কারণেই ভারত রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। এমন অবস্থায় বাংলাদেশে খণ্ডিত জাতীয়তাবাদের প্রয়োজন আজ সবচেয়ে বেশী দিল্লীর শাসকদের। সুতরাং এ দেশে যারা ধর্মীয় রাজনীতি ও সাম্প্রদায়িকতার চর্চা এত উৎসাহের সঙ্গে করছে তারা কাদের স্বার্থে এই কাজ করছে সে প্রশ্ন তোলার সময় এসেছে।

রচনাঃ ৩-৪ এপ্রিল, ১৯৯০

 


বিজয় দিবসের প্রশ্ন

এক

১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের ইতিহাসে বিজয় দিবস হিসাবে চিহ্নিত। ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর হ’তে ১৯৯১-এর ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত আমরা ২১টি বিজয় দিবস দেখেছি। এবারের ১৬ ডিসেম্বরের মধ্য দিয়ে একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কুড়িটি বৎসর পূর্ণ হয়েছে। ইতিহাসে এই সময় অতি নগণ্য হলেও একটি জাতির জীবনে এটি একেবারে কম সময় নয়। এই সময়টিতে একটি জাতি হিসাবে আমাদের অর্জন কতোটুকু সেই প্রশ্ন তাই মনে জাগা স্বাভাবিক। বিশেষত চারদিকের দারিদ্র্য, অরাজকতা, দুর্নীতি ও ব্যর্থতার বিপুল আয়তন আমাদের সাফল্যগুলিকে যেভাবে পরাভূত করে চলেছে তাতে এই প্রশ্ন আজ আরও বড় হয়ে দেখা দেয়। আমাদের প্রত্যাশার অপূর্ণতা আমাদের মনে এই প্রশ্ন জাগায় ১৬ ডিসেম্বর আমাদেরকে কী দিয়েছে এবং এটা কোন অর্থে বিজয় দিবস, কার বিজয় দিবস?

এইসব প্রশ্নের উত্তর পাবার জন্য আমরা এই প্রশ্নে আসি, যে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য এ দেশের জনগণ লড়াই করেছিল তার মূল প্রেরণা কী ছিল? তা কি একটি ভূ-খণ্ডের জনগোষ্ঠীর স্বায়ত্তশাসনের দাবী থেকে স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ক্রমবিকশিত প্রেরণা, নাকি তার চেয়েও বেশী একটি জাতি হিসাবে আত্মপ্রতিষ্ঠা ও আত্মবিকাশের প্রেরণা? স্বায়ত্তশাসনের প্রেরণা অবশ্যই ছিল। কিন্তু সেটা কি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের প্রেরণা, নাকি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে বসবাসকারী বাঙ্গালী জনগোষ্ঠীর বাঙ্গালী জাতি হিসাবে আত্মপ্রতিষ্ঠার প্রেরণা যা পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর আক্রমণ অভিযান পরিচালনার সঙ্গে সঙ্গে একটি জাতির জাতীয় স্বাধীনতা যুদ্ধে রূপান্তরিত হয়ে যায়?

এটা ঠিক যে, এই স্বাধীনতা যুদ্ধের একটি দীর্ঘ পটভূমি আছে। ১৯৫০ এবং ’৬০-এর দশক দুইটিতে মওলানা ভাসানী এবং বামপন্থীদের স্বায়ত্তশাসন ও পরবর্তী সময়ের স্বাধীনতার দাবী, ১৯৬৬-তে শেখ মুজিবের ৬ দফা এবং ১৯৬৯-এ ছাত্রদের ১১ দফা দাবী নিঃসন্দেহে স্বাধীনতা যুদ্ধের পটভূমি রচনা করেছে। বিশেষত ৬ দফা এখানে একটি বিশিষ্ট ও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

কিন্তু আমাদের সামনে যেটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায় সেটা হ’ল কেন ’৭১-এর মুক্তি যুদ্ধ পাকিস্তান রাষ্ট্রের কাঠামোর মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার কিংবা স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার অর্থাৎ বাঙ্গালী মুসলমান সম্প্রদায়ের জন্য একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার যুদ্ধ না হয়ে বাঙ্গালী জাতির স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার যুদ্ধে পরিণত হ’ল? আমরা এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাই ১৯৪৮- ’৫২-এর ভাষা আন্দোলনের মধ্যে।

বস্তুত ভাষা আন্দোলন ছিল একটি জনগোষ্ঠীর ভাষা ভিত্তিক জাতিসত্তা হিসাবে নিজেকে খুঁজে পাবার প্রথম সফল প্রয়াস। ১৯৪৭-এ যে জনগোষ্ঠী নিজের ভাষা ভিত্তিক জাতিসত্তার পরিচয়কে অস্বীকার ক’রে ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে একটি ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিল তারাই আত্মবিকাশের প্রয়োজনে নিজেদের ভুল সংশোধনের প্রক্রিয়া শুরু করে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রায় সাথে সাথে। বাঙ্গালী জনগোষ্ঠীর উপর বিজাতীয় ভাষা উদূêকে জোর করে চাপিয়ে দেবার চেষ্টার বিরুদ্ধে ১৯৪৭-এ এই চেতনা জাগ্রত হতে শুরু করে এবং ১৯৪৮-এ প্রতিবাদের মাধ্যমে এই চেতনা আত্মপ্রকাশ করে এবং ১৯৫২-এর আত্মদানের মাধ্যমে তা এক অপ্রতিরোধ্য শক্তিতে পরিণত হয়। ১৯৫২-এর বিদ্রোহ ও রক্তদান পাকিস্তানের ধর্মীয় পরিচয়ের খোলা ভেঙ্গে প্রধানত মুসলিম জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত এই বঙ্গে আত্মপরিচয় সচেতন একটি জাতিসত্তার জন্ম দিল। আত্মপরিচয় বোধহীন মুসলিম সম্প্রদায়ভুক্ত বাঙ্গালী জাতিসত্তা একটি বিরাট ঐতিহাসিক ঘটনার মধ্য দিয়ে পরিণত হ’ল আত্মপরিচয় সচেতন বাঙ্গালী জাতিতে। চেতনার জগতে জাতি হিসাবে তখনও তা শিশু, কিন্তু তখন তার জন্ম হয়ে গেছে। পরবর্তীতে নূতন চেতনার এই শিশুই বিকাশের বিভিন্ন স্তর পার হয়ে চলেছে।

তবে কি ’৫২-ই জাতি হিসাবে বাঙ্গালীর জন্মের লগ্ন? একটি ঘটনা বা যুদ্ধের মধ্য দিয়ে একটা রাষ্ট্রের জন্ম হ’তে পারে, কিন্তু একটা জাতির জন্ম এভাবে হয় না, হ’তে পারে না। এটা ঠিক যে, ’৫২ বাঙ্গালীকে জাতিসত্তা হিসাবে আত্মসচেতন করেছে, কিন্তু এই সচেতনতার পটভূমি রচিত হয়েছে সহস্র বৎসর ধ’রে। সহস্র বৎসর বা ততোধিক সময় ধরে বাঙ্গালীর আজকের বাঙ্গালী হয়ে উঠবার উপাদানসমূহ ক্রিয়াশীল থেকেছে। এই দীর্ঘ সময় ধরে বাঙ্গালী হিসাবে তার বিকাশ ঘটেছে, তার ভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য তাকে গড়ে তুলেছে। কিন্তু যেটার অভাব ছিল সেটা হ’ল বাঙ্গালী হিসাবে নিজেকে চিনতে পারার এবং বাঙ্গালী হিসাবে আত্মপ্রতিষ্ঠা অর্জনের জন্য যথাযথ প্রয়াসের।

১৯৪৮-’৫২-এর ভাষা আন্দোলন এই অভাব পূরণ করেছে। এর পরের ইতিহাস তাই সমস্ত জটিলতার মধ্যেও সহজ ও সরল হয়ে থেকেছে। শত সহস্র বাধাকে অতিক্রম করে বাঙ্গালী জাতির আত্মপ্রতিষ্ঠা ও আত্মবিকাশের আয়োজন এগিয়ে চলেছে। কারও পিতৃত্বে কিংবা মাতৃত্বে আজকের এই জাতির উত্থান খুঁজে লাভ নেই। এই জনগোষ্ঠীর হাজার বৎসরের ইতিহাস ও সমাজ প্রক্রিয়া এই জাতির মাতা এবং পিতা এবং ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন এই জাতির সচেতন জাতি হিসাবে আত্মপ্রতিষ্ঠার প্রয়াসের সূচনা বিন্দু। এভাবে দেখলেই আমরা আজকের অনেক জটিল প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাব এবং আজ যে সমস্যা ও সংকটের গোলক-ধাঁধায় ঘুরে মরছি তা থেকে বেরিয়ে আসার পথ পাব।

 

দুই

অনেকে ’৫২-এর ভাষা আন্দোলনের পরিবর্তে ১৯৬৬-এর ৬ দফার মধ্যে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার আয়োজনের সূচনা বিন্দু খুঁজে পেতে চান। এটা ঠিক যে, ৬ দফা কর্মসূচী ভাষা আন্দোলনের বাঙ্গালী চেতনাকে নাকচ করে নি। বরং তাকে ভিতরে ধারণ করেই দাঁড়াতে পেরেছিল। কিন্তু ৬ দফার মর্মবাণী পাকিস্তান ও তার ধর্মীয় ভাব-প্রেরণাকে কখনই নাকচ করে নি। সেই বিচারে এটি ১৯৪০-এর লাহোর প্রস্তাবের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ।

পাকিস্তান দাবী যেমন ধর্মীয় রাজনীতিকে তার মূল ভিত্তি হিসাবে গ্রহণ করলেও আরবকে কেন্দ্র করে সমস্ত মুসলিম পৃথিবীর জন্য একটি অখণ্ড রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবী নিয়ে দাঁড়ায় নি, বরং শুধুমাত্র ভারতীয় মুসলমান জনগোষ্ঠীর জন্য একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবী নিয়ে দাঁড়িয়েছিল, ৬ দফা তেমন পাকিস্তানের কাঠামোর মধ্যে বাঙ্গালী মুসলমান জনগোষ্ঠীর স্বায়ত্তশাসনের দাবী নিয়ে দাঁড়িয়েছিল। অর্থাৎ ৬ দফা ১৯৪৭-এর ১৪ আগস্টের ধর্মীয় পরিচয় ভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা এবং ধর্ম ভিত্তিক রাজনীতি দ্বারা বাঙ্গালী জাতিসত্তার বিভক্তির মাধ্যমে বাঙ্গালী মুসলমান সম্প্রদায়ের জন্য স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মর্মবস্তুকে নাকচ করে নি। ৬ দফা বাঙ্গালী সত্তাকে নাকচ করে নি, যেমন পাকিস্তান দাবী ভারতীয় মুসলমানদের ভারতীয় সত্তাকে নাকচ করে নি। কিন্তু পাকিস্তানের মতই মর্মগতভাবে ৬ দফা যে ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে ছিল তা হ’ল পূর্ব বঙ্গের বাঙ্গালী মুসলিম জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় পরিচয় ও ধর্ম ভিত্তিক রাজনীতি। তাই ৬ দফার মূল অবলম্বন পাকিস্তান কাঠামোর বাইরে যেতে পারে নি।

’৫২-এর ভাষা আন্দোলনকে যাত্রা-বিন্দু হিসাবে ধরে পরবর্তী স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনসমূহ এবং ৬ দফা কর্মসূচীকে বাঙ্গালী জাতিসত্তার বিকাশ ও আত্মপ্রতিষ্ঠার বিভিন্ন স্তর হিসাবে ধরলে ১৯৭১-এর মুক্তি যুদ্ধের তাৎপর্য এক রকম হয় আর ’৫২-কে এড়িয়ে গিয়ে এই সব আন্দোলন কিংবা ৬ দফাকে আজকের বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার যাত্রা -বিন্দু হিসাব ধরলে ১৯৭১-এর মুক্তি যুদ্ধের তাৎপর্য আর এক রকম হয়। প্রথমটির তাৎপর্য হ’ল ভাষা ভিত্তিক একটি জাতিসত্তার লোকবাদী (ঝপধৎলথড়) ও গণতান্ত্রিক জাতি হিসাবে আত্মপ্রতিষ্ঠার আয়োজন এবং দ্বিতীয়টির তাৎপর্য হ’ল একটি ধর্ম ভিত্তিক রাজনৈতিক ও ভাবাদর্শিক-সাংস্কৃতিক কাঠামোর ভিতরে থেকে একটি অঞ্চলের মুসলিম জনগোষ্ঠীর আত্মপ্রতিষ্ঠার আয়োজন। প্রথমটির ক্ষেত্রে যেটি ঘটে সেটি হ’ল বাংলা ভাষাভাষী জাতি হিসাবে বাঙ্গালী জাতির একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা এবং দ্বিতীয়টির ক্ষেত্রে যেটি ঘটে সেটি হ’ল প্রয়োজনে একটি অখণ্ড পাকিস্তানকে ভেঙ্গে দুইটি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করা এবং যে নামই দেওয়া যাক পূর্ব বঙ্গের বুকে অপর একটি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করা। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে কোনটি ঘটেছে?

যাঁকে স্বাধীনতা যুদ্ধের মূল নেতা বলা হয় সেই শেখ মুজিবুর রহমান কোনটি করেছেন? সঙ্গতভাবেই প্রশ্ন আসে যদি বাঙ্গালী জাতিসত্তার একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা মনে ছিল তবে শেখ মুজিবুর রহমান কেন যুদ্ধ শুরুর মুহূর্তে পাকিস্তানী হানাদার সেনাবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করলেন? ১৯৭১-এর ৭ মার্চের ভাষণে কি তিনি সত্যই বাঙ্গালীর স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ডাক দিয়েছিলেন? নাকি তার মধ্যেও সংগুপ্ত ছিল ৬ দফার ভিত্তিতে আন্দোলনকে এগিয়ে নেবার প্রেরণা, যে প্রেরণা প্রয়োজনে দুইটি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করবে অথবা অখণ্ড পাকিস্তানের কাঠামোর ভিতর বাঙ্গালী মুসলমানের জন্য অধিকতর সুযোগ-সুবিধা এনে দিবে?

ভারত রাষ্ট্র বাঙ্গালীর স্বাধীনতার যুদ্ধকে তার প্রয়োজনে ব্যবহার করেছিল। এবং আওয়ামী লীগকে হাতে পেয়ে এ দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের গতিধারাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছিল। কিন্তু বঙ্গের পূর্বাঞ্চলে বাঙ্গালী জাতির একটি স্বাধীন জাতীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা কি ভারত রাষ্ট্রের স্বার্থের অনুকূলে ছিল? উপমহাদেশে ভাষা ভিত্তিক একটি জাতিসত্তার এই ধরনের কোনও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা কি বহু-জাতিক ভারত রাষ্ট্রের কাঠামোর জন্য বিপজ্জনক হয়ে দেখা দেয় না? শুধু যে বাঙ্গালী জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত পশ্চিম বঙ্গের সামনেই এটি একটি বিকল্প পথ উপস্থিত করে তা-ই নয়, উপরন্তু তা উপমহাদেশের সকল জাতিসত্তার নিজ নিজ ভাষা, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ভিত্তিতে নিজস্ব বিকাশ সম্ভাবনাকে জীবন্ত করে তোলে।

সুতরাং ভারত সরকারের জন্য যা প্রয়োজনীয় ছিল তা-ই তারা করেছিল। তাই স্বাধীনতা যুদ্ধ নিজস্ব গতিতে বেড়ে উঠতে পারে নি এবং পশ্চিম রণাঙ্গনে ভারতীয় সেনাবাহিনী পশ্চিম পাকিস্তানের ভিতরে এগিয়ে গেলেও ভারত সরকার পশ্চিম পাকিস্তান দখলের সম্ভাবনাকে মূর্ত না ক’রে পূর্ব পাকিস্তানে বিজয় অর্জনের উপর নিজ মনোযোগ নিবদ্ধ করে এবং ১৬ ডিসেম্বর পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী কর্তৃক ভারতীয় সেনাবাহিনীর নিকট আত্মসমর্পণের মাধ্যমে বাঙ্গালীর জাতীয় স্বাধীনতা যুদ্ধের উপর দ্রুত যবনিকাপাত করে।

বস্তুত ভারত সরকারের প্রয়োজন ছিল একটি শক্তিশালী পাকিস্তান ভেঙ্গে দুইটি দুর্বল পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করা। বাংলাদেশের বিগত কুড়ি বৎসরের ইতিহাস প্রমাণ করেছে ভারত সরকারের এই প্রয়োজন পূরণ হয়েছে কি না এবং হলে কতটুকু হয়েছে।

কিন্তু এটাই সত্য যে, এ দেশের ব্যাপক জনগণ স্বাধীনতার যুদ্ধ সংগঠিত করেছিল আর একটি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার জন্য নয়, কারণ এই যুদ্ধের আবেগ ও প্রেরণার উৎস ১৯৪০-এর লাহোর প্রস্তাব কিংবা ৬ দফায় ছিল না, এটা ছিল মূলত ’৫২-এর বিদ্রোহ ও আত্মদানে এবং বাঙ্গালীর হাজার বৎসরের আত্মবিকাশ প্রক্রিয়ায়। বিশেষত যে হাজার হাজার ছাত্র ও তরুণ এই স্বাধীনতা যুদ্ধের মূল চালিকা শক্তি হিসাবে কাজ করেছিল বিভিন্ন ঐতিহাসিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক কারণে তাদের আকাঙ্ক্ষা ও আবেগের রূপদানকারী নেতৃত্ব ইতিহাসের মঞ্চে সেই সময় আবিভূêত না হলেও বাঙ্গালীর হাজার বৎসরের ইতিহাস ও ’৫২-এর ভাষা আন্দোলনের তারাই ছিল শ্রেষ্ঠ ফসল এবং ’৭১-এর যুদ্ধ তাদের কারণেই বাঙ্গালীর স্বাধীনতা যুদ্ধ, বাঙ্গালীর জাতীয় মুক্তি যুদ্ধ হয়ে উঠেছিল। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাস জাতির এই স্বপ্ন, আবেগ ও আত্মদান কোনও যৌক্তিক পরিণতি নিতে পারে নি। বাঙ্গালী জাতির স্বাধীনতা যুদ্ধের আবেগ প্রথম বাঙ্ময় হবার পরই বুকের ভিতরে চাপা পড়ে গেছে। যে আবেগ জাতিকে জাতি করে তোলে সেই আবেগকে আঘাতে আঘাতে চূর্ণ করার সব আয়োজন ক্রমাগত এগিয়ে গেছে। তাই যুদ্ধের পর জামাত-রাজাকারদের ক্ষমা করে দেবার মধ্যে শেখ মুজিবের মহৎ হৃদয় কিংবা ভুল খুঁজে লাভ নেই। এটা করা হয়েছিল ’৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধের মধ্যে নেতৃত্বের নিয়ন্ত্রণের বাইরে যে লোকবাদী ও জাতীয়তাবাদী বাঙ্গালী চেতনা ও আকাঙ্ক্ষার বিকাশ হচ্ছিল তার বিপরীত ধর্মীয় ধারাকে সমাজ ও রাজনীতির মধ্যে রক্ষা ও লালনের প্রয়োজন থেকে।

এই একই কারণে স্বাধীনতার পর মুক্তি যুদ্ধের মধ্য দিয়ে উত্থিত সাধারণ ও ব্যাপক মুক্তি যোদ্ধাদের সমন্বয়ে নূতন জাতীয় সেনাবাহিনী গঠন না করে মুক্তি যোদ্ধাদের নিরস্ত্র ও ছত্রভঙ্গ করে দেওয়া হ’ল এবং পাকিস্তানের কাঠামো থেকে আগত প্রথাগত পেশাদার সেনাবাহিনীকে মূলত তার পূর্বতন কাঠামো ও শৃঙ্খলা সহ নূতন রাষ্ট্রে রক্ষা করা হ’ল। যে রক্ষীবাহিনী গড়া হ’ল সেটাও মুক্তি যুদ্ধের যোদ্ধাদের কোনও ধারাবাহিক ও সংগঠিত রূপ নয়, বরং এটা ছিল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের দলীয় সশস্ত্র বাহিনী স্বরূপ। তাই এটা মুক্তি যোদ্ধাদের আবেগ ও আকাঙ্ক্ষা ধারণ করল না, বরং তা হ’ল প্রতিপক্ষীয় রাজনৈতিক শক্তি ও বিরোধীদের বিরুদ্ধে পরিচালিত সন্ত্রাস, নির্যাতন ও হত্যার হাতিয়ার।

এই সমস্তই ছিল স্বাধীনতা যুদ্ধে রক্তপাত ও আত্মদানের মধ্য দিয়ে যে বাঙ্গালী সত্তার জাগরণ ও বিকাশ হচ্ছিল তার বিপরীতে যুদ্ধের প্রধান নিয়ন্ত্রণকারী নেতৃত্বের পার্থক্য ও দ্বন্দ্বের এক প্রকাশ। তবু শেখ মুজিব আত্মদ্বন্দ্বকে অতিক্রম করতে পারেন নি। তাই বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদকে অস্বীকার না করে মুখে হলেও স্বীকৃতি দিয়েছেন এবং প্রয়োজনে ব্যবহার করেছেন। কিন্তু এক অমীমাংসেয় দ্বন্দ্বের শিকার শুধু জাতি হয় নি, তিনি নিজেও হয়েছিলেন। তাঁকে নিজ জীবন দিয়ে এই দ্বন্দ্বকে একটা পরিণতির দিকে এগিয়ে যেতে দিতে হয়েছে।

পরবর্তীতে বাঙ্গালীর মুক্তি যুদ্ধের যোদ্ধা জেনারেল জিয়াউর রহমান এসে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের তত্ত্ব হাজির করে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে এই দ্বন্দ্বের একটা মীমাংসা দিয়েছেন। এই তত্ত্বের মর্মবস্তু বাঙ্গালী মুসলমানের স্বতন্ত্র জাতীয়তা অর্থাৎ ইসলামী সাম্প্রদায়িকতার ঘোষণা ছাড়া আর কিছু নয়। এইবার বাংলাদেশ কোনও রাখঢাক না করে স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান রূপে আত্মপ্রকাশ করল। বিষয়টিকে স্পষ্ট করার জন্য সংবিধানে প্রয়োজনীয় সংশোধনীসমূহ আনা হ’ল।

মুক্তি যোদ্ধা জিয়াউর রহমান কি এমন এক জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠার জন্য ’৭১-এ প্রতিরোধ যুদ্ধে অস্ত্র তুলে নিয়েছিলেন? আসলে ভুলটা যদি হয়ে থাকে তবে ’৭১-এ পাক বাহিনীর আক্রমণ অভিযানের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের সময়ই হয়েছিল। তখন যদি জাতি বাঙ্গালীর স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য অস্ত্র নিয়ে না দাঁড়িয়ে বাংলাদেশী ‘জাতির’ অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তানী ‘জাতির’ স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য অস্ত্র তুলে নিত তবে হয়ত এ দেশের ইতিহাসটা ভিন্ন রকম হতে পারত। কিন্তু ইতিহাসের সত্য এই যে, ’৭১-এ এ দেশের বাঙ্গালী জনগোষ্ঠী যে আবেগ নিয়ে যুদ্ধ করেছিল সেই আবেগে ধর্মের কোনও স্থান ছিল না, বরং বাঙ্গালী হয়ে ওঠার এক দুর্মর ও প্রচণ্ড আবেগই অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে এমন এক বিশাল যুদ্ধে সমগ্র জাতিকে মহাপ্লাবনের মতো ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল।

ইতিহাসের সত্যের বিরুদ্ধে দাঁড়াবার মূল্য জিয়াকেও দিতে হয়েছে প্রাণের বিনিময়ে। এবং অবশেষে ’৮২-তে ক্ষমতা দখল করে সেনাপতি এরশাদ ’৭১-এর বিপরীত ধারাকে পূর্ণ প্রতিষ্ঠা দিয়ে মুক্তি যুদ্ধের সকল আবেগ ও ভাবপ্রেরণার অবসান ঘটিয়েছেন।

আত্মপরিচয় বিভ্রান্ত জাতির মধ্যে আত্মগৌরব বোধ খুঁজে লাভ নেই। যেখানে জাতির সামনে জাতি হিসাবে বৃহত্তর ও মহত্তর কোনও আদর্শ বা প্রেরণা থাকে না সেখানে প্রতিটি ব্যক্তির সামনে ব্যক্তিগত অর্থ, বিত্ত, ভোগ ও নিরাপত্তার প্রশ্নই কি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দেখা দেয় না? যার পরিণতি হ’ল গ্ল্যাডিয়েটরের মত প্রতিটি ব্যক্তি কর্তৃক প্রতিটি ব্যক্তির বিরুদ্ধে এক নিষ্করুণ ও আত্মঘাতী লড়াইয়ে লিপ্ত হওয়া। জাতি যখন সামনে নেই তখন তার উন্নতির প্রশ্নও কেন সামনে আসবে?

জাতিগত বোধ ও প্রেরণা ছিল বলেই জাপান ও জার্মানী দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে গুঁড়িয়ে গেলেও অবিশ্বাস্য দ্রুত গতিতে অদম্য জাতিরূপে পুনরায় পৃথিবীর বুকে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। পৃথিবীর উপর সামরিক ও রাজনৈতিকভাবে প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষা চূর্ণ হলেও অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগতভাবে এই দুইটি জাতি আজ প্রবলভাবে শক্তিধর হয়ে উঠেছে। জাতি হিসাবে তাদের আত্মবোধি ও প্রাণ শক্তিকে ধ্বংস করা সম্ভব হয় নি বলেই শেষ পর্যন্ত তারা পৃথিবীতে বিজয়ী হ’ল। আর জাতি হিসাবে সবটুকু খুইয়ে আমরা ক্রমেই একটি হতদরিদ্র ও ভিক্ষুক জাতিতে পরিণত হয়েছি। অথচ আমাদের সম্পদ ও সম্ভাবনা কম ছিল না এবং আজও একেবারে কম নয়।

ধর্মীয় সত্তা ও জাতীয় সত্তা যখন পরস্পর বিরোধী শক্তিরূপে দ্বন্দ্বযুদ্ধে অবতীর্ণ হয় তখন শুধু যে জাতির বিভ্রান্ত জাতিগত চেতনার কারণেই জাতির উন্নতির পথ রুদ্ধ হয় তাই নয়, উপরন্তু ধর্মীয় চেতনার প্রাধান্যের কারণেও জাতির জাগতিক ক্ষেত্রে উন্নতির পথ রুদ্ধ হয়। পরলোকবাদী ধর্মীয় চেতনা ইহলোকে উন্নতি সাধনার পরিপন্থী হওয়ায় এবং মানুষের মনোযোগকে মৃত্যু পরবর্তী জগতে উন্নতি সাধনার স্বপ্নলোকে ঠেলে দেয় বলে এই ধর্মকে মূল উপজীব্য করলে জাতির বৈষয়িক ও ইহলৌকিক উন্নয়ন সাধনার বিষয়টি গৌণ হয়ে যায়। বস্তুজগতে জাতি ও জনগোষ্ঠীর উন্নয়নের জন্য যে মেধা চালনা, কঠোর শ্রম এবং একাগ্রতার প্রয়োজন হয় জাতি আর সেদিকে মনোযোগ দেবার প্রেরণা বোধ করে না। পরলোককে সামনে রেখে ইহলোকে বেঁচে থাকার জন্য যেটুকু করা একান্ত প্রয়োজনীয়, বাধ্য হয়ে সেইটুকুই করে। এমন অবস্থায় কি আজকের যুগে মর্যাদাবান জাতি হিসাবে মাথা তুলে দাঁড়ানো সম্ভব? অনুন্নয়ন ও পশ্চাদগতির অন্ধকারে তলিয়ে গিয়ে, প্রতিযোগিতার পৃথিবীতে সর্বত্র মার খেয়ে বাইরের সমাজের সাহায্য ভিক্ষা ও ঋণের উপর নিরুপায়ভাবে নির্ভর করে থাকা ছাড়া জাতির আর কী করণীয় থাকে? এই অবস্থাই কি আজ বাংলাদেশের নয়?

সুতরাং এই প্রশ্ন করা যাক, ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর আমাদেরকে কী দিয়েছে? এটি কি বাঙ্গালী জাতির বিজয়ের দিন? যদি তাই হয় তবে সেই বিজয় কোনখানে এবং কতটুকু? যদি তার সীমাবদ্ধতা থাকে তবে তা কোনখানে এবং কতটুকু? এবং এই প্রশ্ন আসে ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন যদি মুক্তি যুদ্ধের উৎসমুখ বা যাত্রা বিন্দু হয় তবে ১৬ ডিসেম্বর মুক্তি যুদ্ধকে যৌক্তিক পরিণতি দিয়েছে নাকি জাতি হিসাবে তার আত্মপ্রতিষ্ঠার প্রয়াসের একটি পর্যায়ে পৌঁছে দিয়েছে মাত্র? সেই হিসাবে কি ১৬ ডিসেম্বরের মূল্য ২১ দফার ঘোষণা, ৬ দফার ঘোষণা, ’৬৮-’৬৯-এর গণ-অভুøত্থান, ১১ দফার ঘোষণা এবং ’৭১ ­ এর ২৫শে মার্চ রাত্রিতে প্রতিরোধ যুদ্ধের সূচনার মতই একটি ঐতিহাসিক পর্যায় মূলক? সেই দিক থেকে দেখলে ’৫২-এর ভাষা আন্দোলনের দ্বারা সূচিত বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে আমরা একটি পর্যায়ের বেশী কতটুকু এগোতে পেরেছি? এবং বাঙ্গালী জাতির আত্মপ্রতিষ্ঠা ও আত্মবিকাশের এক বিশাল কর্মযজ্ঞ কি এখনও ভবিষ্যতে অবস্থিত নয়?

রচনাঃ ২৬ ডিসেম্বর, ১৯৯১

 


জাতীয়তাবাদ সংকট

এক

প্রতিটি জাতির বিকাশের পিছনে দীর্ঘ ইতিহাস ক্রিয়াশীল থাকে। বাঙ্গালী জাতির বিকাশের পিছনেও তেমন আমরা এক দীর্ঘ ইতিহাস খুঁজে পাব যা দিয়ে ব্যাখ্যা করা সম্ভব হবে আজকের বাঙ্গালী জাতির বিকাশ কিংবা উত্থান প্রক্রিয়াকে।

ভাষাতত্ত্বের বিচারে বাঙ্গালী জাতির উদ্ভবের প্রক্রিয়াকে খ্রষ্টীয় নবম বা অষ্টম শতাব্দী কাল পর্যন্ত নেওয়া হলেও সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিচারে বাঙ্গালীর জাতি গঠন প্রক্রিয়ায় রয়েছে তারও পূর্ববর্তী অনেক শত কিংবা কয়েক সহস্র বৎসরের ঘটনা প্রবাহ। বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর পারস্পরিক লেনদেন, মিশ্রণ, ঐক্য এবং সংঘাত ও বিরোধিতার এক সুদীর্ঘ জটিল প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ক্রমেই একটি জাতিসত্তার উদ্ভবের শর্তগুলি পূরণ হয়েছে। ক্রমেই বিকশিত হয়ে বাঙ্গালী জাতিসত্তা মোটামুটি অভিন্ন এক রূপ নিয়েছে যাকে বিভিন্ন পার্থক্য ও পরিবর্তনের মধ্যেও চেনা যায়।

এইভাবে বাঙ্গালী জনগোষ্ঠী তার নিজের মধ্যকার বিভিন্ন অঞ্চলগত, উপভাষাগত, ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক এবং উপজাতীয় ও বর্ণজাতিগত পার্থক্যকে তার ভিতরে ধারণ করেও একটি সামগ্রিক ভাষিক ও সাংস্কৃতিক কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত হয়ে একটি অখণ্ড ও অবিভক্ত জাতিসত্তারূপে বিকাশ লাভ করেছে। সুতরাং ভূ-খণ্ডগত সংযোগ বা সংলগ্নতা বাঙ্গালী জাতিসত্তার প্রধান কিংবা মূল নির্ণায়ক নয়। তাহলে ভূমি সংলগ্ন আসাম কিংবা বিহার অথবা উড়িষ্যার জনগোষ্ঠী বা জাতিসত্তার সঙ্গে মিলিত হয়ে বাঙ্গালী জনগোষ্ঠী একটি অভিন্ন জাতিসত্তায় পরিণত হ’তে পারত কিংবা ভূমি সংলগ্ন সমগ্র ভারত একটি অখণ্ড জাতিসত্তার বিকাশ ঘটাতে পারত। সুতরাং এটা দেখা যায় যে, বাঙ্গালী জাতিসত্তার উদ্ভব ও বিকাশে তার বাসভূমির ভূমিগত সংলগ্নতা এবং বৈশিষ্ট্য কাজ করলেও সেটাই তার প্রধান কিংবা একমাত্র কারণ নয়, যদিও এ বিষয়ে কোনই সন্দেহ নেই যে, এই ভূভাগের বিশেষ প্রাকৃতিক ও ভূমিগত বৈশিষ্ট্য এই জাতিসত্তার বিশেষ বিকাশ ধারা এবং বৈশিষ্ট্যকে প্রভাবিত এমন কি অনিবার্যও করেছে।

উপরোক্ত আলোচনার উদ্দেশ্য হ’ল এ কথা বলা যে, বাঙ্গালী জাতি শুধু একটি ভূ-খণ্ডে বসবাসকারী জনগোষ্ঠী নয়। বরং এ ক্ষেত্রে যে বিষয়টি অনেক বেশী গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনার যোগ্য সেটি হ’ল বাঙ্গালী জাতির পরিচয়ের সবচেয়ে বড় মানদণ্ড হিসাবে তার অভিন্ন ভাষিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস, সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বিকাশ ধারা এবং বৈশিষ্ট্য। বিশেষত ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক বিচারে আমরা ভারতীয় উপমহাদেশে এমন একটি জাতিসত্তাকে খুঁজে পাই যা অন্য সকল জাতিসত্তা থেকেই অনেক ভিন্ন।

এই জাতিসত্তার বিকাশ ধারার একটি বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয়। তা হ’ল তার ইতিহাসের দীর্ঘ কাল যাবৎ তার নিজস্ব রাষ্ট্রের প্রায় অনুপস্থিতি। এটা ঠিক যে, তার সহস্র বৎসরের ইতিহাসে আমরা বারো ভূঁইয়ার মত বিভিন্ন আঞ্চলিক স্বাধীন রাজন্যবর্গের উপস্থিতি দেখতে পাই। কিন্ত তারা ছিল ক্ষুদ্র অঞ্চল ভিত্তিক এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাদেরকে বহিরাগত রাষ্ট্রীয় বা রাজনৈতিক কর্তৃত্বের নিকট পরাজয় বরণ করতে কিংবা তার অধীনস্থ হ’তে হয়েছিল।

জাতিসত্তা হিসাবে বাঙ্গালীর আত্মবিস্মৃতি কিংবা চেতনার অভাব যেমন একদিকে বাঙ্গালীর রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা ও উদ্যোগকে ক্ষুদ্র আঞ্চলিক গণ্ডী অতিক্রম করতে দেয় নি তেমন তাকে বৈদেশিক রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের অধীনস্থ হ’তে বাধ্য করেছে। সেন যুগ হ’তে শুরু ক’রে মুসলিম আধিপত্য এবং ব্রিটিশ আধিপত্যের যুগ পর্যন্ত বাঙ্গালী জাতিসত্তার এই আত্মবিস্মৃতি পরিলক্ষিত।

এই রকম অবস্থায় বাঙ্গালী জাতিসত্তার বিকাশ সুদীর্ঘ সময় ধরে বহিরাগত কিংবা বৈদেশিক শক্তির শাসনাধীনে ঘটেছে। বৈদেশিক শাসনাধীনে বাঙ্গালী জাতিসত্তা যে বৃহত্তর ও ঐক্যবদ্ধ রাজনৈতিক কাঠামো পেয়েছে তার প্রভাবে থেকে নিজ ভাষা ও সংস্কৃতিতে একটা বৃহত্তর ঐক্য অর্জন করেছে। এটা ঠিক যে, বৈদেশিক শাসনাধীনে কোনও জাতিসত্তার বিকাশ স্বাভাবিক, সুস্থ ও বেগবান হ’তে পারে না। কিন্তু বাঙ্গালী জাতিসত্তার ঐতিহাসিক দুর্বলতায় এই বিকাশ ধারা ছিল অনিবার্য। তবু এই অবস্থায় থেকেও যে, একটি ভূভাগের সমগ্র জনগোষ্ঠী একটি বিশেষ ভাষা ও সংস্কৃতিকে অবলম্বন করে বাঙ্গালী জাতিসত্তা হিসাবে তার আত্মবিকাশকে অনিবার্য ও অপ্রতিরোধ্য করতে পেরেছে এই ঘটনা বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির ধারক হিসাবে বাঙ্গালী জনগোষ্ঠীর অদম্য জীবনীশক্তি ও সম্ভাবনারই পরিচায়ক।

নিজস্ব রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা যে কোনও আত্মসচেতন জাতিসত্তার আত্মপ্রতিষ্ঠা ও আত্মবিকাশ প্রেরণার অনিবার্য ফল। কারণ রাজনৈতিক স্বাধীনতা তথা নিজস্ব রাষ্ট্র ছাড়া কোনও জাতিসত্তাই স্বাধীনভাবে বিকাশ লাভ করতে পারে না। সুতরাং এ কথা বললে ভুল হবে না যে, জাতিসত্তা হিসাবে বাঙ্গালীর আত্মচেতনার কার্যকর বিকাশ একটা খুব সাম্প্রতিক ঘটনা।

এটা ঠিক যে, ১৯০৫-এর বঙ্গ-ভঙ্গ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে জাতিসত্তা হিসাবে বাঙ্গালীর আত্মচেতনার একটা প্রকাশ ঘটেছিল। কিন্তু বঙ্গের বিভক্তির বিরুদ্ধে তখন বাঙ্গালীর যে চেতনার প্রকাশ ঘটে সেই চেতনায় একই সঙ্গে ক্রিয়াশীল ছিল ভারত ভিত্তিক জাতীয়তা বোধের প্রাধান্য। যে বাঙ্গালী জনগোষ্ঠী তখন এই আন্দোলনের পুরোধা ছিল তা এক বৃহত্তর ভারতীয় জনগোষ্ঠীর অংশ হিসাবে নিজেকে দেখতে চেয়েছিল।

এরই প্রমাণ পাওয়া যায় ১৯৪৭-এ ভারত ও পাকিস্তান এই দুই রাষ্ট্রে ভারত বিভাগের মধ্যে। ১৯০৫-এ বঙ্গ বিভাগের বিরুদ্ধে যে হিন্দু বাঙ্গালী নেতৃত্ব আন্দোলন গড়ে তুলেছিল তাদের উত্তরাধিকারীরা স্বাধীন বঙ্গের পক্ষে না গিয়ে ১৯৪৭-এ একটি বৃহত্তর ভারত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পক্ষেই গেল।

মুসলমান বাঙ্গালী নেতৃত্বও কী চেয়েছিল তা প্রকাশিত হয়েছে ১৯৪৭-এ পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মধ্যে। অর্থাৎ স্বতন্ত্র ও স্বাধীন জাতিসত্তা হিসাবে বাঙ্গালীর চেতনার জাগরণ তখনও হয় নি। এর জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে ১৯৫২ পর্যêন্ত। এবং ঘটনাটি ঘটে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত পূর্ব বঙ্গেই প্রথম। ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলনের বিস্ফোরণ একটি স্বতন্ত্র ও স্বাধীন জাতি হিসাবে বাঙ্গালীর আত্মপ্রতিষ্ঠা ও আত্মবিকাশ প্রক্রিয়ার সূচনা ঘটাল। এই পথ ধরেই এল ১৯৭১। ১৯৭১-এর জাতীয় মুক্তি যুদ্ধ পূর্ব বঙ্গের বুকে পাকিস্তানকে উচ্ছেদ করল এবং বাংলাদেশ নামক একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করল।


দুই

আজ মুক্তি যুদ্ধের দুই দশক পর এই প্রশ্ন করা যাক বাংলাদেশ নামে যে রাষ্ট্রটি দাঁড়িয়ে আছে সেটি কি বাঙ্গালী জাতিসত্তার হাজার বছরের বিকাশ প্রক্রিয়ার একটা পরিণতি কিংবা তা কি ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে জাগ্রত একটা জাতির স্বপ্ন ও আবেগের বাস্তবায়িত রূপ, না কি তা ভিন্ন কোনও কিছু?

আজ বাঙ্গালীর পরিচয় কোনখানে? স্থান কোনখানে? সরকারীভাবে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের স্থান নিয়েছে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ। এইভাবে রাষ্ট্রের ভূ-খণ্ডগত নাম ব্যবহার করে একটা জাতির সহস্র বৎসরের ইতিহাসকে মুছে ফেলার চেষ্টা হয়েছে। আসলে ১৯৪৭-এ ধর্মের ভিত্তিতে বাঙ্গালী জাতিসত্তার যে বিভক্তি ঘটেছিল বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ সেই ধর্ম ভিত্তিক বিভক্তিকে নৈতিক ও আদর্শিক ভিত্তি দান করতে চেষ্টা করে। কারণ আজকের বাংলাদেশ খণ্ডিত বঙ্গ তথা ধর্ম ভিত্তিক পূর্ব পাকিস্তানের নূতন নামকরণ মাত্র। বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ তাই প্রকৃত অর্থে পূর্ব পাকিস্তানী জাতীয়তাবাদ।

সুতরাং বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের যাত্রাবিন্দু যদি কোনটাকে ধরতে হয় তবে সেটা ১৯৪৭-এর ১৪ আগস্ট ছাড়া আর কী? অবশ্য সেখানেও প্রশ্ন আসে ১৯৪৭-এর ১৪ আগস্ট তো বাঙ্গালী মুসলমানের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করে নি, বরং তা ভারতীয় মুসলমানের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করেছিল যে স্বপ্নের রূপায়ন হ’ল পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র। তাহলে কি বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ ’৪৭-এর আগস্টের বাস্তবতাকেও খণ্ডিত করে নি? তাহলে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের অবলম্বন কোনখানে?

তা ’৪৭-এর ভাবপ্রেরণাকে সঠিকভাবে ধারণ করে না। তা ’৫২-এর ভাবপ্রেরণাকেও ধারণ করে না। কারণ ’৫২-এর ভাষা আন্দোলনের মর্মবস্তুই হ’ল বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ। তবে কি ’৭১-এর মুক্তি যুদ্ধ তার অবলম্বন?

১৯৭১-এর বাঙ্গালীর মুক্তি যুদ্ধের মূল প্রেরণাই তো ছিল জাতি হিসাবে বাঙ্গালীর স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। বাঙ্গালীর হাজার বছরের বিকাশ ধারা ও জাতীয় আবেগকে বাদ দিলে ’৭১-এর মুক্তি যুদ্ধই থাকে না। যেমন ভাষা আন্দোলনকে বাদ দিলেও ’৭১-এর মুক্তি যুদ্ধকে খুঁজে পাওয়া যায় না।

তাহলে জাতীয় মুক্তি যুদ্ধের সমাপ্তি এটা কী দিল? বাংলাদেশ রাষ্ট্রে বাঙ্গালীর ঐতিহাসিক বিকাশ ধারা কতটুকু প্রবাহিত? ’৫২ ও ’৭১-এর বিদ্রোহ ও আত্মদান আমাদেরকে যা দিয়েছে তা কি এই রাষ্ট্র এবং জাতীয়তাবাদ যে রাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় ধর্ম হ’ল ইসলাম এবং যে জাতীয়তাবাদের ভিত্তি হ’ল বাংলাদেশ নামে বাঙ্গালী জাতিসত্তার একাংশের একটি খণ্ডিত রাষ্ট্র?

তবে কি আমরা ধরে নিব ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ নামে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর একটা জাতির জন্ম হ’ল যার নাম হ’ল বাংলাদেশী জাতি? অর্থাৎ এর আগে এ দেশে কোনও জাতি ছিল না? তাহলে প্রশ্ন করতে হয় ’৭১-এর জাতীয় মুক্তি যুদ্ধ করল কে?

এ কি এক ভয়ংকর আত্মঘাতী পরিস্থিতির সম্মুখীন আজ আমরা হয়েছি! জাতিসত্তা হিসাবে বাঙ্গালীর ঐক্য ও অখণ্ডতার বাস্তবতাকে অস্বীকার করতে চেয়ে আমরা কীভাবে নিজেদের অস্তিত্বের ভিত্তিকেই হারিয়েছি! আমাদের কোনও অতীত নেই। তাই আমাদের কোনও ভিত্তি নেই, অবলম্বন নেই। তবে কি আমাদের শুধু বর্তমান আছে? বর্তমান যে একটা আছে তা তো দেখাই যাচ্ছে। কিন্তু অতীত ছাড়া বর্তমান যখন থাকে না, থাকতে পারে না তখন আমাদেরও নিশ্চয় একটা অতীত কোথায়ও আছে। সেটা আমাদের না হলেও অন্য কারও অতীতকেই আমাদের অতীত হিসাবে আমরা নিশ্চয় নিয়েছি। সেটা কি তবে পাকিস্তান? তবে কি আমাদের উল্টোরথের যাত্রায় আমরা সেখানেই ফিরে যাচ্ছি? কিছুটা তো ফেরা হয়েছে। বাকীটাও পূর্ণ করার প্রক্রিয়াই কি আজ চলছে না?

তাহলে কি বাংলাদেশ রাষ্ট্র ’৭১-এর মুক্তি যুদ্ধের বিরুদ্ধেই দাঁড়িয়ে গেছে? অর্থাৎ যে ভিত্তির উপর তা দাঁড়িয়ে আছে তাকে ধ্বংস করেই কি তা পূর্ণতা ও সার্থকতা পেতে চাইছে? তবে কি বাঙ্গালীর হাজার বছরের বিকাশ ধারা, ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ’৭১-এর জাতীয় মুক্তি যুদ্ধ এই সবই অবাস্তব কল্পনা মাত্র যেগুলি ইতিহাসে কখনও না ঘটলেও সেগুলিকে আমরা কল্পনা করে নিই? এইসব কোনও কিছুই যদি না থাকে তবে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটিরও অস্তিত্বের নৈতিক ভিত্তিই বা কী করে থাকে? শেষ পর্যন্ত কি তবে বাংলাদেশ নামক রাষ্টটিও একটি অলীক কল্পনায় পরিণত হয় না? যদি তা এখনও না হয়ে থাকে তবে এই প্রক্রিয়ার দাবী কিন্তু তাকে অলীক কল্পনায় পরিণত করারই।

রচনাঃ ১৬ মার্চ, ১৯৯২

 


বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ ও দেশের উন্নতি

বাঁচার জন্যও মানুষের চাই প্রেরণা। এ ছাড়া মানুষের বাঁচাটা হয়ে ওঠে মৃত্যুর সমান। আমরা যখন মানুষ বা জাতির উন্নতির বিষয়টিকে বিবেচনায় আনি তখন তাতে অনিবার্যভাবে অন্তর্ভুক্ত হয় মানুষ বা জাতির উন্নতির প্রেরণা। এই প্রেরণা একটা চেতনা বা উপলব্ধির ব্যাপার।

এখানে বাংলাদেশে কোথায়ও একটা নিদারুণ সংকট আছে যে কারণে একটা স্বাধীনতা যুদ্ধের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হবার এতগুলো বৎসর পরেও দেশটা পশ্চাৎপদতা ও দারিদ্র্যের অন্ধকারে আজ অবধি ডুবে আছে। সম্পদের সীমাবদ্ধতা থাকলেও তা এত কম নয় যে, দেশটা উন্নতি করতে পারে না। এ দেশের তুলনায় অনেক কম সম্পদ নিয়েও পৃথিবীর বহু দেশ উন্নত হয়ে উঠেছে। জাপান বহু উল্লেখিত একটা দৃষ্টান্ত।

এ দেশে বিদেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা অনুদান হিসাবে এসেছে। অর্থনীতির হিসাবে সেগুলো দিয়ে এ দেশের উন্নয়নের বিরাট মান অর্জন করবার কথা। কিন্তু দেশটা সত্যিই যেন এক তলাবিহীন ঝুড়ি যাতে যা-ই দেওয়া যায় সব হারিয়ে যায়।

আসলে কি হারায়? ঢাকার মত কিছু নগরের দিকে দৃষ্টি দিলে বোঝা যায় দেশের ভিতরের এবং বাইরের সব সম্পদ কোথায় যায়। এ দেশ রসাতলে গেলেও কিছু লোকের উন্নতিটা কিন্তু থেমে নেই। তারা টাকা করে, বাড়ী-গাড়ী করে, উন্নত ও প্রাচুর্যময় জীবন যাপন করে। সুতরাং দেশ না এগোক তারা এগোচ্ছে। ব্যাপক সংখ্যাগুরু মানুষ দারিদ্র্য, অশিক্ষা-অর্ধশিক্ষা আর পশ্চাৎপদতায় গড়াগড়ি খেলেও মুষ্টিমেয়র উন্নতির পথ বন্ধ হয়ে নেই।

তাই মুষ্টিমেয়র উন্নতি হলেও দেশের উন্নতি হয় না। জাতির উন্নতি হয় না। এই যে এক চরম বৈপরীত্য আমাদের সমাজ জীবনে দেখা দিয়েছে তার কারণ কি? কারণটা সহজ। ব্যক্তি হিসাবে আমাদের উন্নতির প্রেরণা আছে কিন্তু জাতি হিসাবে নেই। সবাই সবার সঙ্গে যখন উন্মত্ত প্রতিযোগিতায় নামে যে প্রতিযোগিতার লক্ষ্যে দেশ নেই, সমাজ নেই, জাতি নেই, শুধু আছে নিজ আর নিজের পরিবার তখন সেই প্রতিযোগিতায় শুধু মুষ্টিমেয় শক্তিশালী আর ভাগ্যবান টিকে যায়, বাকী সবাই যারা দুর্বল তারা অবিরাম হেরে যায়। যেহেতু তারাই দেশের সংখ্যাগুরু, শ্রমিক, কৃষক ও শ্রমজীবী হিসেবে তারাই দেশের উৎপাদন ও উন্নয়নের মূল চালিকা শক্তি সেহেতু তারা যখন হেরে যায় তখন হেরে যায় দেশের উৎপাদন, উন্নয়ন আর ভবিষ্যৎও।

এ দেশের দুর্ভাগ্য এখানে যে, ’৭১-এ যারা এ দেশে একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার নেতৃত্ব দিয়েছিল এবং যারা আজ অবধি বিভিন্ন সময় এই রাষ্ট্রের নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বে অধিষ্ঠিত থেকেছে তারা দেশের সামনে থেকে দেশ এবং জাতির সামনে থেকে জাতিকে কেড়ে নিয়েছে। কারও ভুলে, কারও লোভে ও প্রতারক মনোবৃত্তিতে, কারও দেশদ্রোহিতায় জাতির সমানে থেকে জাতির প্রশ্ন, জাতির গৌরববোধ ও আত্মচেতনা হারিয়ে গেছে। নানান প্রশ্ন তুলে, নানান চাতুরী করে ’৭১-এর মুক্তি যুদ্ধের ভাবপ্রেরণা ও আদর্শকেই বিতর্কিত করা হয়েছে। এদের কূটকৌশলে দেশ আজ আর আদর্শ নয়, প্রেরণার উৎসভূমি নয়। ইতিহাস বিহীন, ঐতিহ্য বিহীন, তা আজ এক ভৌগোলিক সীমানা বা ভূখণ্ড মাত্র। নিজেদের ব্যক্তিগত আয়-উন্নতির জন্য একটা দেশ দরকার, জনগণ দরকার, কিছু লোক প্রয়োজনমত যাকে ব্যবহার করবে কোন রকম দায়-দায়িত্ববোধ ছাড়াই।

এই বাস্তবতায় দেশ ও জাতির উন্নতির প্রশ্ন অবান্তর। সুতরাং যাঁরা দেশের উন্নতি আন্তরিকভাবে চান তাঁদের আজ সবচেয়ে বড় দায়িত্ব হ’ল দেশের সামনে দেশ, জাতির সামনে জাতিকে ফিরিয়ে আনা। বাঙ্গালী জাতির হাজার বৎসরের ইতিহাস- ঐতিহ্যকে বাদ দিয়ে এই কাজ করা কি সম্ভব? ’৭১-এর জাতীয় স্বাধীনতা যুদ্ধের আদর্শকে ভূলুণ্ঠিত করে কি এই কাজ করা সম্ভব? এর সহজ ও স্পষ্ট উত্তর হ’ল সম্ভব নয়।

কোনও ব্যক্তির উন্নতি রুদ্ধ করার সহজ পথ হ’ল তার উন্নতিকামী চেতনা ও প্রেরণাকে বিনষ্ট করা। তেমনইভাবে কোনও জাতির উন্নতি রুদ্ধ করারও সহজ পথ হ’ল জাতি হিসাবে তার চেতনা ও প্রেরণাকে বিনষ্ট করা। বাঙ্গালী জাতির চেতনা ও প্রেরণাকে বিনষ্ট করার কাজ যারা এ দেশে করেছে তারা ইচ্ছায় হোক অনিচ্ছায় হোক বাংলাদেশের উন্নতির সম্ভাবনাকে বিনষ্ট করার কাজই করেছে। সুতরাং দেশ ও জাতিকে নিয়ে যাঁরা বাঁচতে চান, উন্নতি করতে চান তাঁদের আজ জাতির প্রশ্নটিকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে হবে।

সে কাজ করতে গেলে ’৭১-এর শরণাপন্ন হওয়া ছাড়া আমাদের উপায় কোথায়? ’৭১ আজ অবধি এক বিরাট বিভাজন রেখা হয়ে আছে এ দেশে। এই রেখার এক পাশে আছে কোটি কোটি বাঙ্গালী জনগণ যাদের ব্যাপক অংশই শ্রমজীবী ও উৎপাদক জনগোষ্ঠী, বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী জনগোষ্ঠী, এবং এই রেখার অপর পাশে আছে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ বিরোধী ’৭১-এর ঘাতক-দালাল এবং তাদের অনুসারী প্রচ্ছন্ন ও নগ্ন সাম্প্রদায়িকতাবাদীরা। ’৭১ আমাদের আশার আলো। আবার ’৭১ আমাদের বেদনাও। ’৭১-এ বাঙ্গালী জাতি পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে ধ্বংস করেছিল। তাই তা আশার আলো। কিন্তু ’৭১-এ পাকিস্তান ধ্বংস হলেও পাকিস্তানের আদর্শ ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতাবাদ ধ্বংস হয় নি। এটাই আমাদের ব্যর্থতা এবং বেদনার কারণ।

রাষ্ট্র ও রাজনীতির ভিতরে লুকিয়ে থাকা সাম্প্রদায়িকতাবাদ ও তার শক্তিগুলো ’৭১-এ পরাজিত হয় নি বলেই বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হলেও বাঙ্গালী জাতির জীবনে বিপর্যয়ের ঘন অন্ধকার নেমে এসেছে। জাতির বিপর্যস্ত চেতনার সঙ্গে তলিয়ে গেছে জাতির উত্থান ও উন্নতির সম্ভাবনাও। এই দৃষ্টিকোণ থেকেই আমাদের এ দেশের উন্নয়ন প্রশ্নকে দেখতে হবে।

রচনাঃ ৩১ মার্চ, ১৯৯৩

 


সুভাষ ও বাঙ্গালী জাতি

অবশেষে ভারত রাষ্ট্রে সুভাষ বসুর নূতন করে মূল্যায়ন শুরু হ’ল। শুধু পশ্চিম বাংলার মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু নয় অধিকন্তু ভারত রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় সরকারও ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলন ও যুদ্ধে সুভাষ বসুর অবদান স্বীকার করেছেন।

ইতিহাস এমনই। অথবা এমনই মানুষের মন। আজ যাকে কালো করা হয় একদিন তাকেই সাদা করার প্রয়োজন দেখা দিতে পারে। কিংবা উল্টোটা। আজ যারা সুভাষের উজ্জ্বল ভাবমূর্তি তুলে ধরছেন একদিন তাঁরাই সকলে মিলে তাঁর ভাবমূর্তিতে কলঙ্ক কালি মাখিয়ে বেড়িয়েছেন।

ক্ষোভের কথা। তবু সত্য। অর্ধ শতাব্দী লাগল তাদের সত্য উপলব্ধি করতে। তার মানে কি এই নয় যে, অর্ধ শতাব্দীরও অনেক বেশী কাল আগুয়ান ছিলেন সুভাষ এইসব নেতা এবং রাজনৈতিক শক্তির তুলনায়? হাঁ, ক্ষোভ জাগে এ কথা মনে হলে যাদের কারণে একদিন সুভাষ বসু ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনকে একটি পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা যুদ্ধে পরিণত করতে পারেন নি আজ তারা তাঁকে স্বীকৃতি দিচ্ছে। একি সুভাষকে আত্মসাৎ করার প্রয়াস?

তবে সুভাষকে নিয়ে বাঙ্গালী হিসাবে আমার খুব গৌরব। হাজার বছরের ইতিহাসে গৌরব করার মত বাঙ্গালী বীর কয়জন আছে? মোগল যুগের ঈসা খাঁ, প্রতাপাদিত্যের মত কয়েকজন রাজা বা ভূঁইয়ার নাম আমরা জানি। তাঁরা বীর ছিলেন বটে। তবে সেটা বিরাট আয়তনের কিছু নয়। কারণ, তাঁদের এলাকা যেমন ছোট ছিল, দৃষ্টিটাও তেমন। বৃহৎ রাষ্ট্র গঠন তাঁদের স্বপ্নের মধ্যে ছিল না। জাতি-রাষ্ট্র চেতনা তো নয়ই। ব্রিটিশ শাসন কালে তীতুমীর, ফকির মজনু শাহ্‌-এর মত বীরও আমাদের ইতিহাসে আছে। কিন্তু তাঁদের প্রসঙ্গেও ঐ একই কথা। আরও পরবর্তীকালের ক্ষুদিরাম, প্রফুল্ল চাকী, বাঘা যতীন, সূর্য সেন, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, কল্পনা দত্তের মত বীররাও আমাদের ঐতিহ্যকে সমৃদ্ধ করেছেন।

যাঁদের ইতিহাস জ্ঞান ইউরোপ পর্যন্ত তাঁরা হয়ত ভাববেন যে, মধ্যযুগে জাতি চেতনা কিংবা জাতি-রাষ্ট্র ভাবনা আবার কি জিনিস? কিন্তু ইতিহাসের যাত্রাটা ইউরোপ থেকে নয়। এবং পৃথিবীর ইতিহাসের আবিষ্কারও ইউরোপ থেকে নয়। এইজন্য আমরা অনেক হাজার বছরের ইতিহাসে দেখি অনেক দেশেই যুগ যুগ ধরে জাতি ভাবনাও ছিল। হয়ত সেটা আধুনিক কালের মত করে নয়। তবু ছিল। সেই চেতনার প্রকাশ আমরা দেখতে পাই চীনে, জাপানে, পারস্যে এবং আরও অনেক দেশে। হয়ত রাজা ও রাজতন্ত্রকে কেন্দ্র করে জনগোষ্ঠীর জাতি চেতনা ও স্বাতন্ত্র্য বোধ মূর্ত হত সে যুগে। তবু সেটা ছিল।

একটা দৃষ্টান্ত দিলেই এ কথার তাৎপর্য বোঝা যাবে। চেঙ্গিস খানের সেনাবাহিনী চীনাদের পরাজিত করার পর প্রায় একশত বৎসর চীনে মোঙ্গলদের আধিপত্য ছিল। কিন্তু এক সময় চীনারা বিদেশী মোঙ্গলদের পরাজিত করে তাদের শাসন উচ্ছেদ করে। শুধু তাই নয় প্রায় শত বৎসরের মোঙ্গলদের আধিপত্যকে স্মরণ করিয়ে দেয় এমন সকল চিহ্ন তারা মুছে ফেলার জন্য মোঙ্গলদের দ্বারা নির্মিত স্থাপত্যসহ সকল নির্মাণ ধ্বংস করে দেয়।

তবু জাতি চেতনা আধুনিক কালের সৃষ্টি! অর্থাৎ ইউরোপের সৃষ্টি, তাই তো? এ কথাটা কারা বলেছে? ইউরোপীয়রা। কেন? কারণ আধুনিক যুগের পূর্বে তাদের নিজেদের মধ্যেই এই ধরনের জাতি চেতনা ছিল না। অবশ্য রোমের ব্যাপারটা, এমনকি গ্রীকদের মধ্যেও এক ধরনের জাতীয়তা বোধের ব্যাপারটাকে এত সহজে বোধ হয় ব্যাখ্যা করা যায় না। তবু এটা চীনাদের মত নয়, বা নয় পারস্য বা জাপানের মত।

যাইহোক, জাতীয়তাবাদ নিয়ে পণ্ডিতী তর্ক চালিয়ে আমি মূল প্রসঙ্গ থেকে সরতে চাই না। সুতরাং বাংলার কথাতেই আসি। এই বাংলায় ভাষা-সংস্কৃতি ভিত্তিক জাতীয়তা বোধ পূর্বকালে যে সেভাবে ছিল না সেটা আমরা জানি। যদিও গৌড়ীয় পরিচয়টাও একেবারে অবজ্ঞাত ছিল না, তবু সেটা দৃঢ়বদ্ধ ছিল না। সুতরাং আমরা গৌরব করতে হলে ঐ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বীরদের নিয়ে গৌরব করি। উপায় কী? উপরের তলায় রাজারা সিংহাসন নিয়ে আর রাজ্য বিস্তারের জন্য যুদ্ধ করত। আর নীচ তলায় নদী বিধৌত বাংলায় আমাদের স্মরণকালের পূর্বসূরিদের বীরত্বের দৌড় তো ছিল চর দখলের কাজিয়া পর্যন্ত। হয়ত নদীর দুই তীরের দুই গ্রাম কিংবা দুই গোষ্ঠীর চর দখলের কাজিয়া।

বৃহৎ স্বপ্ন, বৃহৎ জাতি বা সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন ওসব কোন কালেই বা কয়জন দেখেছে? আর দেখলেও এই সমাজ জমিতে তারা দাঁড়াবার মত অত প্রশস্ত জায়গা কিংবা মজবুত স্থানটা কোথায় পাবে? জলকাদাময় নরম পলির মতই তো আমাদের পূর্ব প্রজন্মের মন। বড় কিছু ধারণ করবে কিভাবে?

রাজা লক্ষ্মণ সেন বাঙ্গালী ছিলেন কি না সন্দেহ। সিরাজউদ্দৌলার বাঙ্গালী হবার মতই তাঁরও বাঙ্গালী হবার ব্যাপার। দুইজনই ভিন্ন ভাষা ও সংস্কৃতির উত্তরাধিকারী। তবু এ দেশের ভাগ্যের সঙ্গে তাঁদেরও ভাগ্য জড়িয়ে গিয়েছিল অনেকাংশেই। সুতরাং তারা জাতি হিসাবে বাঙ্গালীর আদি পুরুষ না হয়েও আদি পুরুষ হয়েছেন। অন্তত বাঙ্গালী না হয়েও তাঁরা বাংলার হয়েছিলেন। এখন তাঁদের সুকীর্তি বলা যাক, কুকীর্তি বলা যাক, সফলতা বলা যাক, ব্যর্থতা বলা যাক তার ফল ভোগও করতে হয়েছে এই জাতিসত্তাকে। সিরাজউদ্দৌলা প্রায় ৬৭ হাজার সৈন্য নিয়ে লড়তে গেলেন রবার্ট ক্লাইভের মাত্র ৩ হাজারের কিছু বেশী সৈন্যের সঙ্গে। অবশেষে সন্ধ্যা হতেই পলাশীর রণক্ষেত্র ছেড়ে পালালেন। আর রাজা লক্ষ্মণ সেন রাজধানী নবদ্বীপে ১৯ ঘোড় সওয়ার তুর্কীর প্রবেশ এবং প্রাসাদ আক্রমণের খবর শুনেই রাাজপ্রাসাদের খিড়কির দুয়ার দিয়ে পালালেন বউ-ছেলেমেয়ে সাথে নিয়ে।

রাজা লক্ষ্মণ সেন কেন পালিয়েছিলেন সেটা নিয়ে আমি অনেক ভেবেছি। তিনি ছিলেন বহু যুদ্ধ জয়ী বীর। বয়স তখন আশির উপর। তা হোক। তিনি পালালেন কেন? আমি অনুমান করি সিরাজ যে কারণে পালিয়ে ছিলেন সেই কারণে তিনিও পালিয়েছিলেন। বুঝেছিলেন, যে শত্রু রাজধানী পর্যন্ত বিনা বাধায় ঢুকতে ও এত অল্প শক্তি নিয়ে প্রাসাদ আক্রমণ করতে পারে তা একা নয়। নিজ রাষ্ট্রের ভিতরকারই এক বড় অংশ তাঁর শত্রুর পক্ষে চলে গেছে। ওখানেও হয়ত মীর জাফর ছিল যার নাম আমরা জানি না। তবে নামে কি আসে যায় যদি রাষ্ট্রের বড় অংশ ঠিক করে যে, এবার তারা রাজা বদল করবে, শক্তিমান আক্রমণকারীর কাছে বিনা প্রতিরোধে রাষ্ট্র ক্ষমতা হস্তান্তর করবে?

বাংলাদেশ রাষ্ট্রে বাস করে দল বদলের ব্যাপারটা তো আমরা খুব ভাল বুঝি। আজ আওয়ামী লীগ, কাল বিএনপি, পরশু জাতীয় পার্টি। তারপর দিন আওয়ামী লীগের উত্থান দেখলে পুনরায় আওয়ামী লীগে যোগদানের হিড়িক পড়ে যায়। যখন যে দল ক্ষমতায় আসে অথবা ক্ষমতার দ্বারপ্রান্তে উপস্থিত হয় পূর্ব দল পরিবর্তন করে সেই দলে যোগদানের হিড়িক পড়ে যায়। হয়ত আদি বাঙ্গালীর অন্তত এক বিরাট কাল জুড়ে এটাই বৈশিষ্ট্য। বাংলার মাটিতে কিছুকাল বসবাস করে মীর জাফরও এ বৈশিষ্ট্য আত্মস্থ করতে সময় নেন না।

প্রায় সোয়া এক কিংবা দেড় হাজার বৎসর পূর্বের রাজা শশাঙ্ক, কিংবা রাজা গোপালের দিকে তাকিয়ে ভাবি এঁরা কোন বাঙ্গালীর আদি পুরুষ? অন্তত নির্বাচিত রাজা গোপালকে নিয়ে আমার খুব গর্ববোধ। শশাঙ্ক বীর ছিলেন। কিন্তু কতটা গণমুখী ছিলেন, কতটা উদার ও মানবিক ছিলেন জানি না। তবে বোধিবৃক্ষ ধ্বংসের মত তাঁর কিছু কীর্তি জেনে তাঁকে নিয়ে গৌরব করতে সংকুচিত হই। কিন্তু রাজা গোপালকে নিয়ে সেই সঙ্কোচ থাকে না। আমার কাছে মনে হয় আদি বাঙ্গালীর শ্রেষ্ঠ বীর নায়ক, জন-নায়ক রাজা গোপাল। তাঁর উত্তরাধিকারী দেবপাল, ধর্মপাল বীর হিসাবে আরও বড়। কিন্তু আদি বাঙ্গালীর এক গৌরবময় ও দীর্ঘস্থায়ী বৃহৎ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা রাজা গোপালকে নিয়ে আজকের বাঙ্গালীর গৌরবের অনেক কিছু আছে বলে আমি মনে করি।

হয়ত রাজা গোপালের পর বাঙ্গালীর ইতিহাসে এমন আর এক বিরাট স্বপ্ন ও সম্ভাবনা নিয়ে সুভাষ বসু আবির্ভূত হয়েছিলেন। কিন্তু এত বৃহৎ স্বপ্ন ও সম্ভাবনাকে ধারণ করার জমিটা কোথায়? সমগ্র ভারতবর্ষের বহু জাতি সমন্বিত জনগোষ্ঠী তাঁকে ধারণ করতে চায় নি। কারণ তিনি ছিলেন বাঙ্গালী এবং তিনি ছিলেন আমূল পরিবর্তনবাদী। হাঁ, সে কালের সর্বশ্রেষ্ঠ বিপ্লবী। কিন্তু বাঙ্গালী জাতিও তাঁকে ধারণ করে নি। কংগ্রেসী বাঙ্গালী, মুসলিম লীগপন্থী বাঙ্গালী, কমিউনিস্ট বাঙ্গালী এরা সবাই তাঁর বৈরী। মুসলিম লীগ ইংরেজের সহযোগী হয়ে খণ্ডিত ভারতবর্ষের ক্ষমতার অংশ প্রত্যাশী। কংগ্রেস যুদ্ধের পরিবর্তে আপসে ক্ষমতার হস্তান্তরকামী। আর কমিউনিস্ট পার্টি ব্রিটিশের বিরুদ্ধে বাংলা ও ভারতবর্ষের জনগোষ্ঠীর বৃহত্তর ঐক্য প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে শ্রেণী সংগ্রামের নামে বাংলা ও ভারতবর্ষকে বিভক্ত করার সাধনায় লিপ্ত।

সুভাষ যে দাঁড়াবেন তার জমিটা কোথায়? হয়ত সুভাষের এক বড় ভুল ছিল বাঙ্গালীর জাতিগত পরিচয়কে গৌণ করে ভারতীয় পরিচয়কে মুখ্য করা। বাঙ্গালীর স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রয়াসকে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে সমন্বিত না করে শুধু অখণ্ড কিংবা বৃহত্তর ভারত প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে সে কালে বাঙ্গালী ছিল বিভোর। বৃহত্তর ও ঐক্যবদ্ধ ভারত গড়তে গিয়ে রাজনীতি ও রাষ্ট্র সাধনায় বাঙ্গালী ক্রমে হিন্দু এবং মুসলমান হয়ে গেল। এটাই স্বাভাবিক। কারণ বহু জাতির উপমহাদেশ ভারতবর্ষের ঐক্যের মূল ভিত্তি ধর্ম হতে বাধ্য ছিল।

বাংলা ও বাঙ্গালীকে ঘিরে যে রাজনীতি ও রাষ্ট্র চিন্তা ছিল তা প্রকৃতপক্ষে চিত্তরঞ্জন দাশের মৃত্যুর সঙ্গেই ফুরিয়েছিল। এক খণ্ডিত ও পঙ্গু নবজাগরণ রাজনীতিতে বাঙ্গালীর স্বতন্ত্র জাতীয়তা বোধের যে ক্ষীণ ধারা জাগিয়েছিল সেটা শেষ হল চিত্তরঞ্জন দাশের অকাল মৃত্যুর সঙ্গে। বঙ্গ-ভঙ্গ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বিস্ফোরিত চেতনার এমন অকাল মৃত্যু প্রমাণ করে যে, ঐ চেতনার নেতৃত্বের শক্তি কত অক্ষম, ক্লীব ও পঙ্গু!

আসলে চিত্তরঞ্জন দাশ যে আকঙ্ক্ষাকে প্রতিনিধিত্ব করছিলেন তাকে ধারণ করার মত সমাজ জমি ছিল না। তাকে ধারণ করবে কে? উচ্চবর্গের যে ভদ্রলোকরা রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করত তারাই তখন বাঙ্গালী জাতির স্বাতন্ত্র্যকে বাদ দিয়ে শুধু ভারত ভিত্তিক রাজনীতি করতে আগ্রহী। এ হ’ল হিন্দু বাঙ্গালী এলিট নেতৃত্বের সে কালের প্রবণতা। আর এদের পিছনেই তো ছিল আমজনতা। সুতরাং এই হিন্দু বাঙ্গালী ভদ্রলোকদের অস্বীকার করে সুভাষেরও ভিন্ন কিছু করা সম্ভব ছিল না। বাঙ্গালী জাতির রাষ্ট্‌্র প্রতিষ্ঠার তাগিদকে প্রাধান্য দিয়ে ভারতবর্ষের মুক্তির রাজনীতি করার কাল সেটা ছিল না। তখন হিন্দু ও মুলমান বাঙ্গালীর মধ্যে এমন এক দ্বন্দ্ব ও বিভেদের বিকাশ ঘটছিল যার কারণে উভয়েরই প্রয়োজন ছিল আত্মশক্তি বৃদ্ধির জন্য বাংলার বাইরের ‘জাতভাইদের’ সাহায্যের।

হাঁ, ইংরেজ খুব সফল। ১৯০৫ থেকে শুরু বঙ্গ-ভঙ্গ আন্দোলনের পরিণামে ১৯১১-তে বঙ্গ-ভঙ্গ রদ হল বটে, কিন্তু হিন্দু ও মুসলমানের ভিতরকার ভঙ্গ আর রদ হ’ল না। ওটা পূর্বেও ছিল। কিন্তু একবার বঙ্গ ভঙ্গ করে এবং ঢাকাকে আসাম এবং মুসলিম সংখ্যাগুরু পূর্ব বঙ্গের রাজধানী করে মুসলিম বাঙ্গালীর চেতনায় সহজ উন্নতির যে কল্পতরু রোপণ করা হ’ল তা আর শুকিয়ে মরল না। বরং বাড়তেই থাকল।

বাঙ্গালীর ভিতর এমন দ্বন্দ্বের ক্রমবিকাশে লাভটা হল হিন্দী ও উর্দূভাষী ‘জাতভাই’ নেতাদের। কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের। এবং এর জন্যও বাংলার রাজনীতির নেতৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ যাদের হাতে ছিল দায়ী করতে হবে প্রধানত তাদেরকেই। এই নেতৃত্ব ছিল হিন্দু ভদ্রলোকদের হাতে। এই হিন্দু ভদ্রলোকরা যখন বাংলায় সংখ্যাগুরু এবং জনসংখ্যায় ক্রমবর্ধমান মুসলমান বাঙ্গালীদের ভয়ে ভারতের ‘জাতভাইদের’ শরাণপন্ন হয়ে বাঙ্গালীর জাতি ভিত্তিক রাজনীতি পরিত্যাগ করে সর্বভারত ভিত্তিক রাজনীতি শুরু করল তখন বাংলায় সংখ্যাগুরু হলেও অর্থ-সম্পদ ও শিক্ষায় দুর্বল ও পশ্চাৎপদ মুসলমানরা পাকিস্তান ভিত্তিক রাজনীতির দিকে ঝঁুকল। পাকিস্তানও হচ্ছে ভারত। তবে ওটা মুসলিম ভারত। অর্থাৎ এমন ভারত যেখানে মুসলমান সম্প্রদায় সংখ্যাগুরু।

বাঙ্গালী ও বাংলার এই বিভক্তির জন্য নিশ্চয় হিন্দু ও মুসলমান উভয় নেতৃত্বই দায়ী। তবে বেশী দায়ী কি হিন্দু নেতারা নয়? কারণ তাদের হাতেই তো সমগ্র বাঙ্গালী জাতির নেতৃত্ব ছিল এক দীর্ঘ সময় পর্যন্ত। যদি অখণ্ড ভারত ভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চিন্তা না ক’রে অখণ্ড বাংলা ভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চিন্তা সেদিন বাঙ্গালী নেতৃত্ব করত তবে বাংলা ও বাঙ্গালীর এমন বিপর্যয়টা হয়ত হত না। অবশ্যই ভারতের স্বাধীনতার প্রশ্নটাও সেই সঙ্গেই রাখা যেত। সে ক্ষেত্রে ভারত হতে পারত একটা রাষ্ট্রসংঘ বা জাতিসংঘ।

কিন্তু ভীরু, হৃস্বদৃষ্টি, নির্জীব এবং সংকীর্ণচেতা হিন্দু ভদ্রলোকবৃন্দ এবং তাদের নেতৃত্ব সেদিন গান্ধী-নেহরুকে পিতা-নেতা মেনে বাংলা ভাগটাকেই অনিবার্য করার কাজে সহায়ক হলেন। এভাবে তারা জিন্নাহ্‌-সোহ্‌রাওয়ার্দীর রাজনীতিরও সহায়ক হলেন। যদি সেদিন বাংলা একটা স্বাধীন রাষ্ট্র হত তবে সেখানে লোকবাদী জাতি-রাষ্ট্র ও সমাজ গড়ার জন্য একটা লড়াই করার মত জায়গা পাওয়া যেত।

অবশ্য প্রশ্ন, লড়াইটা করবে কে? কমিউনিস্টরা? যাদের কাছে দেশ-কাল নেই, নিজ সমাজ ও জাতির প্রতি আনুগত্য নেই, নিজ জাতি ও স্বদেশ-স্বজনের দুঃখের বদলে আন্তর্জাতিক দুঃখ ও বেদনায় যাদের মন মুহ্যমান ও ভারাতুর থাকে, মস্কোর হুকুম-বরদার হয়ে যারা এ দেশে বিপ্লবের ‘সহি বড় খাবনামা’ রচনা করে তারা করবে লড়াই? আসলে হিন্দু-মুসলমান বাঙ্গালী ভদ্রলোকদের সবারই মতিচ্ছন্নতার যুগ ওটা।

শুধু বাংলায় নয় গোটা ভারতেও হিন্দু-মুসলমানে ক্ষমতার দ্বন্দ্বে গোটা ভারতবর্ষের মতিচ্ছন্নতার কাল ওটা। ঐ দ্বন্দ্বের আবর্তে ভারত যে একটা জাতির দেশ নয়, বরং বহু জাতির উপমহাদেশ এই বোধটাই তলিয়ে গেল।

অথচ ইংরেজ শাসন পুর্বকালের দিকে দৃষ্টি দিলেই ইতিহাসের অভিমুখটাকে চিহ্নিত করতে কষ্ট হবার কথা নয়। মোগল শাসনের শেষ পর্বে ভারতবর্ষে বিচ্ছিন্নতা প্রবণতাই যে শুধু মাথা চাড়া দিচ্ছিল তা-ই নয়, উপরন্তু জাতি-রাষ্ট্র গঠনের সূচনাও ঘটছিল। মারাঠা ও শিখ উত্থান তার প্রমাণ। অবশ্য এটা ছিল তখনও অনেকখানি অসচেতন প্রয়াস। তবু ভারতের বিভিন্ন জাতিসত্তা ও জনগোষ্ঠীর স্বাতন্ত্র্য বোধ ও উত্থান প্রয়াস তখন স্পষ্ট হয়ে উঠছিল বিভিন্ন বিদ্রোহ, যুদ্ধ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রয়াসের মধ্যে। শুধু রাজবংশের পরিচয় আর রাজ্য গঠন পদ্ধতি দিয়ে তার বিচার করলে ভুল হবে। তাতে সব সময় সত্যকে বোঝা যায় না। যেমন ইংল্যান্ডে জাতি-রাষ্ট্র গঠনের সূচনা কালেও জার্মানী থেকে রাজা আনা হয়েছিল। কাজেই দেখতে হয় সমাজের অবতলের শক্তি ও গতিধারাকেও। এই গতিধারার দিকে দৃষ্টি দিলে বোঝা যায় ভারতবর্ষে বিভিন্ন জাতি-রাষ্ট্র গঠনের কাজটা চলছিল। কিন্তু ইংরেজের বিজয় ও পুনরায় আর একটি সর্বভারতীয় সাম্রাজ্য-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা জাতি-রাষ্ট্র গঠনের এই প্রক্রিয়াকে মাঝপথে ভণ্ডুল করে দেয়।

সবচেয়ে বড় ক্ষতি হল তখন যখন জাতির বদলে ধর্ম-সম্প্রদায় বোধ ভারতবর্ষের একই সঙ্গে ঐক্য ও বিভাজনের শক্তি হয়ে দাঁড়ালো। ইংরেজের বিরুদ্ধে ভারতের জাতিসংঘ দাঁড়ালো না। বরং দাঁড়াতে চাইল ধর্ম-সম্প্রদায় এবং ­ ধর্ম-সম্প্রদায়সংঘ ─ হিন্দু  মুসলমান এই দুইটি সম্প্রদায়ের সংঘ। হিন্দু ও মুসলমান এই দুই সম্প্রদায়ের পরিচয়কে সামনে এনে তাদের মধ্যে ঐক্য ঘটাতে গিয়ে লেগে গেল লড়াই। সেটাই স্বাভাবিক। এই দুই ধর্মে মিলন ঘটিয়ে যাঁরা হিন্দু-মুসলমানে মিলনের স্বপ্ন দেখে এসেছেন তাঁদের সদিচ্ছার প্রতি অশ্রদ্ধা না জানিয়ে বলছি যে, তাঁরা কল্পস্বর্গেই বাস করেছেন। কারণ তাঁরা এই দুই ধর্মকেই ভালভাবে বোঝেন নি এবং আরও বোঝেন নি ভারতবর্ষে এই দুই ধর্মের বিকাশ প্রক্রিয়া, ভূমিকা ও সংঘাতের তাৎপর্য।

আমার ধারণা ইংরেজ বাংলা ও ভারতবর্ষে এত সহজে আধিপত্য বিস্তার করতে পেরেছিল এই দুই ধর্ম এবং সম্প্রদায়ের দ্বন্দ্বকে ব্যবহার করে। এবং এই দুই সম্প্রদায়ের দ্বন্দ্বের কারণেও এখানে ইংরেজ বিরোধী সংগ্রামটা বেশী প্রবল এবং সহিংস না হয়ে আপসের চোরাবালিতে হারিয়ে গেছে। ফলে সুভাষের পথ নয়, বরং গান্ধী-নেহ্‌রু-জিন্নাহ্‌র পথ ধরে ভারতবর্ষ এগিয়ে গেছে।

সুভাষ বসু আপস নয় স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধের পথ দেখিয়েছিলেন। স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করলে কতখানি অর্জন হতে পারে তা আমরা বাংলাদেশ রাষ্ট্রে বাস করে অনুভব করি। ’৭১-এ জাতীয় স্বাধীনতা যুদ্ধ না করে আমরা যদি আপসের মাধ্যমে পাকিস্তানের হাত থেকে বাংলাদেশ রাষ্ট্র্র পেতাম তবে কি হ’ত? আমরা আর একটা পাকিস্তান পেতাম মাত্র। হাঁ, শেষ পর্যন্ত এক অর্থে বাংলাদেশও পাকিস্তান হয়েছে। খণ্ডিত ও ক্ষুদ্র পাকিস্তান। বিশেষ করে ১৯৭৫-এর পটপরিবর্তনের পর বেশী রাখঢাক না করে পাকিস্তানকে ফিরিয়ে আনা হয়েছে।

তবু পাকিস্তান কালটাকে আর ঠিক সেই রূপে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয় নি। আজকের পাকিস্তান রাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের তুলনা করলে সেটা স্পষ্টভাবে বোঝা যায়। বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকে আজ অবধি এত কাল ধরে সেকিউলার বা লোকবাদী এবং গণতান্ত্রিক রাজনীতির জন্য যে লাগাতার আন্দোলন চলছে, বিরাট বিরাট রাজনৈতিক উলটপালট হয়েছে তার পিছনের শক্তিটা এসেছে বাঙ্গালীর জাতি চেতনার প্রকাশ স্বরূপ ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ষাটের দশকে বাঙ্গালীর স্বাধীন, লোকবাদী ও গণতান্ত্রিক-সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন এবং ’৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধ থেকে। ১৯৭১-এ যে যুদ্ধ হয় তা কিন্তু মুসলমান সম্প্রদায়ের একটা সম্প্রদায়গত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য হয় নি। তা হয়েছিল বাঙ্গালী জাতির এক স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য। অর্থাৎ ’৭১-এর মর্মে ছিল বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ, যার মর্মে আবার ছিল লোকবাদ বা ‘সেকিউলারিজম’।

আমাদের দুর্ভাগ্য যে, ’৭১-এ সংঘটিত স্বাধীনতা যুদ্ধের নেতৃত্ব চলে যায় আওয়ামী লীগের হাতে এবং নিয়ন্ত্রণ ছিল তৎকালীন ভারত সরকারের হাতে, যারা এখানে বাঙ্গালীর একটি প্রকৃত জাতি-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা চায় নি। দিল্লীর ভূমিকা স্পষ্ট। কেন সেটাও স্পষ্ট। পূর্ব বাংলার বুকে বাঙ্গালী জাতির একাংশের একটি লোকবাদী ও অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলে তার প্রভাবটা ভারত রাষ্ট্রভুক্ত বাঙ্গালী জাতির অপরাংশের উপর কেমন হত সেটা বোঝার জন্য খুব বেশী বুদ্ধির দরকার হয় না। এবং মুজিবের ব্যাপারটাও বুঝতে অসুবিধা হয় না। তাই মুজিব পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ না করে ধরা দেন।

আমরা বিবেচনায় মুজিবের অবদান ৬ দফা পর্যন্ত, যা ছিল স্বায়ত্তশাসনের কর্মসূচী এবং সেটাও লাহোর প্রস্তাবের আলোকে। অর্থাৎ ধর্মীয় দ্বি-জাতিতত্ত্বের বলয় তা ভেদ করে নি। প্রকাশ্য রাজনীতিতে সেকালে সেটা করা সম্ভবও ছিল না। সুতরাং ৬ দফার চেয়ে উন্নততর কর্মসূচী না থাকায় সে কালে সেটারই প্রয়োজন ছিল। কিন্তু মুজিব তো স্বায়ত্তশাসন পর্যন্ত; এবং সেটা পাকিস্তানের ধর্ম-সাম্প্রদায়িক ও রাজনৈতিক কাঠামোর মধ্যেই সীমিত।

কিন্তু জাতির স্বাধীনতার রাজনীতি এবং জাতীয় স্বাধীনতা যুদ্ধ ভিন্ন জিনিস। গুণগতভাবেই এটা ভিন্ন। আর তাই এ যুদ্ধে আওয়ামী লীগ এলেও তার মূল এবং প্রধান নেতা শেখ মুজিব আসেন না। তিনি বাড়ীতে বসে থেকে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর হাতে ধরা দেন।

আর আমি দাঁড় করাতে চেষ্টা করি সুভাষের পাশে মুজিবকে। কিন্তু তা কি পারা যায়? সুভাষ অন্তরীণ বা বন্দী অবস্থা থেকে পালিয়ে যান ভারতবর্ষের স্বাধীনতা যুদ্ধ সংগঠিত করা জন্য। আর মুজিব পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা যুদ্ধ পরিচালনা করার দায়িত্ব এড়াতে বাড়ী বসে থাকেন বন্দী দশা বরণ করার জন্য। আর মিথ্যা ও ফাঁকির এ দেশে সেই সত্য ঢাকার জন্য এত কাল ধরে মিথ্যার বাদ্য বাজানো হচ্ছে। এই মিথ্যার বাদ্যে মোহিত হবার মত মানুষের অভাব দুই বাংলাতেই নেই। দুর্ভাগ্য বাঙ্গালী জাতির! এ জাতি কি এতটাই মেধাশূন্য! এ জাতির বুদ্ধিজীবীরা আসলে কি বুদ্ধিমান নাকি বুদ্ধি ব্যবসায়ী মাত্র, যারা বুদ্ধির বাজারে চাহিদা অনুযায়ী মাল কেনাবেচা করে তেমন বুদ্ধিজীবী ?

রাজা গোপালের পর বাংলার শ্রেষ্ঠ বীর নায়ক হিসাবে আমি দেখি সুভাষকে। আর সুভাষের পর আমি যাকে দেখি তিনি হলেন ভাসানী। পরনির্ভর এবং পরের মুখে ঝাল খাওয়া বাঙ্গালী যেমন সুভাষের মূল্যায়ন করতে পারে না তেমন ভাসানীরও নয়।

পুর্ব বাংলায় বা বাংলাদেশ রাষ্ট্রে তো সুভাষের মুল্যায়ন আজো হবে না। কারণ সুভাষ হলেন হিন্দু(!)। আরবী- ফার্সী একটা নাম লাগানো থাকলে না হয় তাঁকে নিয়ে টানাহেচড়া করা যেত। কিন্তু সুভাষ বসু! না, ওটা চলে না। যাক, তবু পশ্চিম বাংলার লোকনেতারা তাকে স্বীকৃতি দিচ্ছেন অর্ধশতাব্দীরও পর।

কিন্তু এ বাংলায় তো ভাসানীরও সঠিক মূল্যায়ন আজ অবধি হয় নি। অসংখ্য বৈপরীত্য দিয়ে ঠাসা এই মানুষটা যে পাকিস্তান ভাঙ্গা এবং জাতীয় যুদ্ধ সংগঠনের পিছনে কত বড় শক্তি ছিলেন সেটাই বোঝা হল না আজ অবধি। এটা ঠিক যে ভাসানীর মধ্যে খুব বেশী বৈপরীত্য ছিল। লোকবাদ-জাতীয়তাবাদ যেমন ছিল, ইসলাম-সাম্প্রদায়িকতাবাদও তেমন ছিল। এ তো এই বাংলার মুসলমান জনগোষ্ঠীরই বৈশিষ্ট্য। বিপুল বৈপরীত্যে পূর্ণ, আবেগপ্রবণ ও হুজুগে এবং নিদারুণভাবে পশ্চাৎপদ এক জনগোষ্ঠী যা কেবল জাতি হয়ে উঠছে তার ভিতর থেকে উঠে আসা নেতা যদি জনগোষ্ঠীর এই বৈপরীত্য কিছূ পরিমাণে হলেও ধারণ না করতেন তবে কী করে তার এত বড় জননেতা হতেন এবং এই জাতিকে তাঁর কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে নিতেন?

একটা জাতীয় যুদ্ধকে অনিবার্য করে তার আঘাতে পাকিস্তান ভেঙ্গে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় তাঁর কৃতিত্ব কম ছিল না। ’৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান না হলে কি ’৭১-এ স্বাধীনতা যুদ্ধ হত? হত না। আর এই ’৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান গড়ার কৃতিত্ব তাঁর চেয়ে বেশী আর কোন নেতার? স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রথম মহড়াটা তিনি জাতিকে দিয়ে করিয়ে নেন ’৬৮-’৬৯-এর উত্তাল জনজোয়ারের দিনগুলোতে। এ দিক থেকে দেখলে তিনি সুভাষের তুলনায় সফল। সুভাষ যুদ্ধ শুরু করলেও তার মধ্য দিয়ে ভারতবর্ষ স্বাধীন করতে পারেন নি। করতে পারলে কিন্তু আমরা ভিন্ন ভারতবর্ষ পেতাম এবং ভিন্ন বাংলাও।

আমার সুভাষকে নিয়ে দুঃখ এবং গৌরব দুই-ই আছে। শুধু তাঁর ব্যর্থতার জন্য যে দুঃখ তা নয়, উপরন্ত দুঃখ তাঁর প্রতি আত্মবিস্মৃত বাঙ্গালী জাতির উপেক্ষার কারণেও। এত বড় বীর এবং রাষ্ট্রনায়ক বাঙ্গালীর ইতিহাসে হাজার বছরেও আর জন্মায় নি। হাঁ, ঐ কারণে তাঁকে নিয়ে আমার গৌরব। যে কংগ্রেসী এবং কমিউনিস্টদের কারণে এক কালে তিনি স্বদেশে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করতে পারেন নি আজ যখন তাদের মধ্য থেকেই তাঁর অবদানকে স্বীকার করা হয় তখন হৃদয়ে মিশ্র অনুভূতি জাগে। তবু ভাল যে, তাঁরা এত কাল পর সত্যটাকে স্বীকার করছেন। তবে তাঁদের পাপের প্রায়শ্চিত্তের ব্যাপারটাও বোধ হয় নৈতিকভাবে এসে পড়ে এই সঙ্গে। সেই প্রায়শ্চিত্ত কি তাঁরা করবেন? করলে কীভাবে?
রচনাঃ ১৯৯৬

 


পার্বত্য চট্টগ্রামঃ অশ্রু আর রক্তে লেখা নাম

অবশেষে কল্পনা চাকমা অপহরণ ঘটনা তদন্তে সুপ্রীম কোর্টের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, যারা এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত তদন্ত কমিটি তাদের খুঁজে বের করবে এবং ভবিষ্যতে যাতে এই ধরনের ঘটনা আর না ঘটে সে ব্যাপারে পদক্ষেপ দিবে ।*

---------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------

* তদন্ত্র কমিটি রিপোর্ট জমা দিলেও এই নিবন্ধ সংকলনে প্রকাশের সময় তথা ২০০৩ পর্যন্ত তা প্রকাশ করা হয় নি। - লেখক

---------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------

হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সাংগঠনিক সম্পাদক প্রতিবাদী তরুণী কল্পনা চাকমা অপহৃত হয়েছে গত ১২ জুন জাতীয় নির্বাচনের পূর্ব রাত্রিতে। অভিযোগ রয়েছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একজন অফিসারের নেতৃত্বে একদল সশস্ত্র ব্যক্তি তাকে বাড়ী থেকে জোর করে ধরে নিয়ে যায়। তারপর কল্পনা চাকমা হারিয়ে গেছে।

পার্বত্য চট্টগ্রামে বিগত দুই দশকের অধিক কাল ধরে এমন বহু কল্পনা চাকমা হারিয়ে গেছে। তাদের কথা এত কাল কেউ শোনে নি। বলতে দেওয়াও হয় নি। সংবাদপত্র চুপ করে থেকেছে। দেশের কোথায়ও প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর প্রায় শোনা যায় নি। পার্বত্য চট্টগ্রাম যে এ দেশেরই একটা অংশ, যেখানে বাস করে ভিন্ন জাতিসত্তার লক্ষ লক্ষ মানুষ সমস্ত রকম মানবিক ও গণতান্ত্রিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে, এই সত্যকে অস্বীকার করতে চাওয়া হয়েছে নানানভাবে। পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা ইত্যাদি জাতিসত্তার জনগণ, যারা জুম্ম নামেও পরিচিত, তারা কখন কোন অবস্থায় অস্ত্র ধরতে এবং ভারতের ত্রিপুরার শরণার্থী শিবিরগুলোতে দলে দলে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিল, সেই সত্যকে ঢেকে রাখতে চাওয়া হয়েছে নানান মিথ্যা আর কল্পকথার জাল বিস্তার করে। দিনের পর দিন, বৎসরের পর বৎসর এক ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সরকারের যুদ্ধ অভিযানের পাশাপাশি চলেছে মিথ্যা প্রচার-অভিযান। এবং তার চেয়েও বড় কথা, পার্বত্য চট্টগ্রামকেই রাখতে চাওয়া হয়েছে সমস্ত জাতির দৃষ্টির আড়ালে। একদিকে অবিরাম মিথ্যা প্রচার করা হয়েছে সেখানকার অবস্থা এবং জনগণের সংগ্রাম সম্পর্কে, অপরদিকে সেখানকার মানবতার আর্তনাদকে নীরবতার ঢাকনা দিয়ে চেপে রাখা হয়েছে।

কিন্তু অবশেষে মিথ্যার সৌধ ধ্বসে পড়েছে। কল্পনা চাকমার অপহরণ জাতির বিবেককে এক বিরাট ঘা মেরে জাগিয়েছে। কল্পনা চাকমা অপহরণ এমন এক সময়ে ঘটেছে যখন দেশের রাজনীতিতে বড় রকম পরিবর্তনের সূচনা হয়েছে। বাঙ্গালী জনগণের সুদীর্ঘ গণতান্ত্রিক আন্দোলনের একটা পর্যায়ে বিএনপি-এর প্রতারণাপূর্ণ ও স্বৈরাচারী শাসনের অবসান ঘটে এবং নির্বাচনের মাধ্যমে ২১ বৎসর পর আওয়ামী লীগ পুনরায় ক্ষমতায় ফিরে আসে। এমন এক সন্ধিক্ষণে কল্পনা চাকমার অপহরণ পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যাকে জাতির দৃষ্টির সম্মুখে নিয়ে এসেছে। সহসা এত কালের নীরবতা ভেঙ্গে বাঙ্গালী জনগণের কণ্ঠ যুক্ত হ’ল জুম্ম জনগণের প্রতিবাদী কণ্ঠের সঙ্গে। সমগ্র জাতি জানতে শুরু করেছে এবং আরও জানবে কী ভয়ঙ্কর অত্যাচার সয়ে এসেছে এতটা কাল পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি সন্তান জুম্ম জনগোষ্ঠী, যারা আমাদেরই ভাই ও বোন। তাদের অপরাধ একটাই ­ তারা ভিন্ন ভাষা, ধর্ম আর সংস্কৃতির মানুষ। এই অপরাধে মাটি ভেজানো হয়েছে তাদের অশ্রু আর রক্তে। ক্রমে পার্বত্য চট্টগ্রাম হয়ে উঠেছে অশ্রু আর রক্তের নাম। সেই নাম এক সময়ে হয়ে উঠেছে প্রতিরোধের নাম।

 

পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা

এটা অত্যন্ত দুঃখজনক যে, পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জাতিসত্তাসমূহের সমস্যা যে একটা জাতীয় সমস্যা সে কথা স্বীকার করতে আমাদের এত দীর্ঘ সময় লেগেছে। পাকিস্তান আমল থেকেই তাদের উপর নির্যাতন ও উৎসাদনের কর্মনীতি পরিচালিত হয়। কাপ্তাই জল বিদ্যুৎ প্রকল্প হাতে নেবার পিছনেও মুখ্যত এই কর্মনীতিই ক্রিয়াশীল ছিল কিনা সেই প্রশ্ন করা যায়। আমাদের প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য কাপ্তাই বাঁধ দিয়ে ’৬০-এর দশকে প্রায় এক লক্ষ জুম্মজনকে তাদের বাসস্থান থেকে উৎখাত করা হয় এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের বিপুল পরিমাণ চাষযোগ্য জমিকে পানির নীচে তলিয়ে দেওয়া হয়। পাকিস্তান আমলে তাদের কথা বলবার কেউ ছিল না। পার্বত্য চট্টগ্রামবাসীদের দুঃখের কথা লেখার দায়ে* তরুণ ছাত্র মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমাকে আইয়ূব সরকার আড়াই বৎসর কারাগারে আবদ্ধ করে রাখে। তবু পাকিস্তান আমলে ব্রিটিশ আমলে প্রবর্তিত আইন দ্বারা সেখানে সংখ্যালঘু জাতিসত্তার কিছু অধিকার সংরক্ষিত রাখা হয়েছিল। বহিরাগতদের বসতি স্থাপন শুরু হলেও তখনও সেখানে তাদের পক্ষে স্থানীয় অধিবাসীদের জমি দখল বা ক্রয় আজকের মত সহজসাধ্য ছিল না। এই প্রক্রিয়া প্রণালীবদ্ধভাবে ও ব্যাপকভাবে শুরু হয় বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর থেকে। পাকিস্তান আমলেও তাদের জন্য যে ভূমি সংরক্ষণ আইন ছিল সেটিও রাখা হ’ল না। ১৯৭২-এর সংবিধানে পার্বত্য চট্টগ্রামে জুম্ম জনগোষ্ঠীর স্বাতন্ত্র্য ও আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের প্রতি সামান্যতম স্বীকৃতিও দেওয়া হ’ল না।

----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
* মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণ প্রসঙ্গে একটা বড় লেখা লিখেছিলেন। পুলিশ সেটা চট্টগ্রামের পাথরঘাটাস্থ বান্ডেল রোডের পাহাড়ী ছাত্রাবাস ‘বিন্দু নিলয়’ তল্লাশী করে পায়; ফলে রাষ্ট্রবিরোধী অভিযোগে অভিযুক্ত করে তাঁকে নিবর্তনমূলক আইনে আটক করে। - লেখক

------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------

১৯৪৭ থেকে এ যাবৎ কাল পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি সন্তানদের ইতিহাস হ’ল কখনও ইসলাম, কখনও বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ আবার কখনও বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের নামে নির্মমভাবে নির্যাতিত ও উৎখাত হবার ইতিহাস। এই সুদীর্ঘ সময়েই তাদের জন্য কে কথা বলেছে, কয়জন বলেছে? এটা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক যে, পাকিস্তানীদের জাতিগত নিপীড়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে যে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তার সরকারগুলোই একটা ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীকে এভাবে উৎপীড়ন ও উৎখাত করার পথ বেছে নিয়েছে। বাংলাভাষীদের সংখ্যার তুলনায় অতি ক্ষুদ্র এক জনগোষ্ঠী যারা এ দেশের জনসংখ্যার এক শতাংশেরও কম তারা কখন কোন্‌ অবস্থায় অস্ত্র হাতে তুলে নিতে বাধ্য হয়েছে সে কথা আজ আমাদের ভাবতে হবে। ’৭২ থেকে এ পর্যন্ত কতজন পাহাড়ী বা জুম্ম নারীকে ধর্ষণ করা হয়েছে, কতজন নিরপরাধ জুম্মজনকে হত্যা করা হয়েছে তার হিসাব কি নেওয়া হয়েছে? ’৭২ সাল থেকে পাহাড়ীদের গ্রামগুলো বাংলাভাষী বহিরাগত বসতিস্থাপনকারীরা সশস্ত্র পুলিশ, বিডিআর-এর প্রহরায় ঘেরাও করত এবং সেখানে চালাত গণধর্ষণ, প্রহার ও লুট। এই প্রক্রিয়ার পরিণতিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম জন-সংহতি সমিতির নেতৃত্বে পাহাড়ী জনগণ ১৯৭৫ সালে আত্মরক্ষার জন্য অস্ত্র তুলে নেয়। ঠিক যেমনটি ১৯৭১-এ বাঙ্গালী জনগণ অস্ত্র তুলে নিয়েছিল পাক হানাদার বাহিনীর নির্যাতনের বিরুদ্ধে। এইভাবে প্রণালীবদ্ধ ধর্ষণ, হত্যা, প্রহার, লুট, বিতাড়ন জন্ম দিল জুম্ম জনতার প্রতিরোধ যুদ্ধের। এ বড়ই অসম প্রতিরোধ যুদ্ধ। এক দিকে ৪/৫ লক্ষ মানুষের এক ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী, যারা ঐতিহ্যিকভাবে নিরীহ, শান্তিপ্রিয়, সরল ও পশ্চাৎপদ; অপর দিকে উন্নত অস্ত্রসজ্জিত সেনাবাহিনী, বিডিআর, পুলিশ, আনসার, ভিডিপি ইত্যাদি সব মিলিয়ে লক্ষাধিক সশস্ত্র শক্তির উপস্থিতি।

জেনারেল জিয়ার আমলে পার্বত্য চট্টগ্রামের আধিবাসী পাহাড়ীদের উৎখাত এবং সেই এলাকা বাংলাভাষীদের দ্বারা অধ্যুষিত করার লক্ষ্যে বহিরাগতদের বসতি স্থাপনের পরিকল্পিত পদক্ষেপ প্রথম দেওয়া হয়। জেনারেল এরশাদের আমলেও এই বসতি স্থাপন পরিকল্পনাকে এগিয়ে নেওয়া হয়। সরকারের উদ্যোগে ১৯৭৬ থেকে ১৯৮৪ পর্যন্ত সময়ে তিনটি বৃহৎ আকারের অভিবাসন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হয়। এই পরিকল্পনা অনুযায়ী সরকারী উদ্যোগে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে হাজার হাজার পরিবারকে পার্বত্য চট্টগ্রামে অভিবাসন করা হয়। তাদের বিনা খরচে জমি, বাড়ী দেওয়া হয়। তাছাড়া তাদের জন্য থাকে রেশনসহ অন্যান্য বহুবিধ সুবিধা। সর্বাত্মক রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে পরিচালিত এই বহিরাগত অভিবাসন প্রক্রিয়ার ফলে ভূমি সন্তান জুম্মদের সঙ্গে বহিরাগত বাংলাভাষীদের সংখ্যাগত ভারসাম্যে মারাত্মক পরিবর্তন ঘটে। ১৯৬১ সালে লোক গণনা অনুযায়ী, পার্বত্য চট্টগ্রামে বাংলাভাষী মুসলমানদের সংখ্যা ছিল ১২ শতাংশ। ১৯৭৪-এ এই সংখ্যা বেড়ে হয় ১৯ শতাংশ। ১৯৮১ সালে তা হয় ৩৮ শতাংশ এবং ১৯৯১ সালে ৪৪ শতাংশ। এই হারে বৃদ্ধি চলতে থাকলে শতাব্দীর শেষে পার্বত্য চট্টগ্রামে এই সংখ্যা পরিণত হওয়ার কথা ৫৬ শতাংশে। আর এইভাবে সুপরিকল্পিতভাবে নির্যাতন ও অভিবাসনের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামের সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠীকে সংখ্যালঘুতে পরিণত করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তাদের করতে চাওয়া হয়েছে নিজ ভূমিতে পরবাসী।

এই প্রক্রিয়ায় বহু পাহাড়ীকে হত্যা করা হয়। কারারুদ্ধ করা হয়। লোগাং-এর মত অনেক ক’টি গ্রামে গণহত্যা পরিচালনা করা হয়। বহু নারীকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যরা ধরে নিয়ে যায় এবং ধর্ষণ এবং বাধ্যতামূলকভাবে ধর্মান্তরিত করে বলে অভিযোগ রয়েছে। এই একই অভিযোগ রয়েছে অভিবাসনকারী বাংলাভাষীদের বিরুদ্ধেও। এইসব ঘটনার কোনটারই তদন্ত হয়েছে বলে জানা যায় নি। প্রতিকারের তো প্রশ্নই উঠে না। অবশ্য লোগাং গণহত্যার একটা তদন্ত হলেও প্রকৃত সত্যকে জনসমক্ষে তুলে ধরা হয় নি।

 

চাই সমস্যার দ্রুত সমাধান

পার্বত্য চট্টগ্রামের ঘটনাবলী জাতি হিসাবে আমাদের বিবেককে বিরাট প্রশ্নের সম্মুখীন করে। এটা কি বিস্ময়কর নয় যে, পাকিস্তান আমল থেকে এ পর্যন্ত এ দেশেরই ভূমি সন্তানদের প্রতি কি নিদারুণ অবজ্ঞা আর অবহেলা প্রদর্শন করা হয়েছে? এ দেশের প্রগতিশীল রাজনীতিকরা পর্যন্ত খুব কমই তাদের স্বার্থে কথা বলেছেন। বুদ্ধিজীবীদের কাছ থেকে আমরা বহু কথা শুনলেও এ দেশেরই এক কোণে সুদীর্ঘ কালের পরিচালিত বৈষম্য ও বর্বর নিপীড়নের বিরুদ্ধে তাদের কণ্ঠ হতে সুদীর্ঘ কাল কোনও কিছু উচ্চারিত হতে শুনি নি।

আসলে এই বর্বরতার সমাজে দুর্বলরা সবখানে সবদিক থেকে মার খায়। সংখ্যালঘুরা দুর্বল আর তাই তারা সব ধরনের নিপীড়ন আর বৈষম্যের শিকার। হিন্দুরাও মার খায় সেই কারণে। কিন্তু তারা সাধারণত নীরব থাকে। থাকতে না পারলে তারা নীরবে দেশ ছেড়ে চলে যায়। সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলো যখন তখন সুযোগ পেলে তাদের উদ্দেশ্যে উচ্চারণ করে ‘দেশ ছাড়ো’ ধ্বনি। ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের মতো নিগৃহীত হয় জাতিগত সংখ্যালঘুরা। তাদের সমস্যা আরও বেশী। তারা দেশের এক কোণে পড়ে থেকে সবার অজান্তে নিগৃহীত হয়। শিক্ষায়-সম্পদে পশ্চাৎপদ, নিরীহ-শান্তিপ্রিয় এবং অবিশ্বাস্য রকম সরল ও সত্যভাষী এই আদিবাসীরা বোবা পশুর মত মার খেতে খেতে এক সময় প্রতিবাদ আর প্রতিরোধে বিস্ফোরিত হয়। আর তাই সেখানে কল্পনা চাকমার মতো সাহসী নারীর জন্ম হয়। এবং অবশেষে বাঙ্গালী জাতিরও বিবেকের ঘুম ভাঙ্গে।

কল্পনা চাকমাকে নিয়ে অনেক কথা লেখা হয়েছে। বুদ্ধিজীবীসহ অনেকে অনেক বিবৃতি দিয়েছেন। বিভিন্ন সংগঠন এগিয়ে এসেছে। ঘটনার তদন্তে কমিটিও গঠন হয়েছে। কামনা করব তদন্তের মাধ্যমে সত্য উদঘাটিত হবে। সুতরাং কল্পনাকে নিয়ে এখানে বেশী কথা বলব না। শুধু বলব কল্পনা চাকমা অপহরণ এ দেশে সুদীর্ঘ কালের ধর্মীয় কিংবা জাতিগত সংখ্যালঘু নিপীড়নের একটা প্রকাশ মাত্র। এই একই সঙ্গে বেরিয়ে আসে এ দেশে নারীর প্রকৃত অবস্থা। কল্পনা চাকমাকে নিয়ে সেনাবাহিনীর ২৪ পদাতিক ডিভিশন যে ব্যাখ্যাই দিক, সত্যটা অনুমান করতে কষ্ট হবার কথা নয়। গত ২১ বৎসর ধরে সেনাবাহিনী সেখানে যা করেছে তার কিছু বিবরণ যাদের জানা আছে তারা সহজেই ঘটনা অনুমান করতে পারবেন। এই সঙ্গে বিভিন্ন সংবাদপত্রে সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মীদের বিবরণ থেকেও ঘটনা অনুমান করা যায়। গত ২৪ জুলাই ১৯৯৬ তারিখে কল্পনা চাকমা প্রসঙ্গে ২৪তম পদাতিক ডিভিশন সংবাদপত্রে যে বিবৃতি দেয় তা কিন্তু একটা বিষয় জাতির কাছে স্পষ্ট করে দিয়েছে, সেটা হ’ল পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনা শাসন চলছে। রাজনৈতিক কর্তৃত্ব কিংবা বেসামরিক শাসন কর্তৃত্বের কাছে সেখানে শাসনভার থাকলে বিবৃতিটা তাদের কাছ থেকে আসত। এটা সত্যি খুবই দুর্ভাগ্যের যে, পার্বত্য চট্টগ্রামে আজও সেনাতন্ত্র চলছে। সেনা শাসন যে কোনও সভ্য গণতান্ত্রিক দেশের জন্য কলঙ্কের ও লজ্জার। পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনা শাসন বাংলাদেশের জন্যও কলঙ্কের।

বাংলাদেশের শাসক শ্রেণী পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা সৃষ্টি করে বাইরের পৃথিবীতেও দেশের কলঙ্কের বোঝা বাড়িয়েছে। বিশেষত কল্পনা চাকমার অপহরণ ঘটনা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। একদিকে অভ্যন্তরে ক্রমবর্ধমান জনমত, অপর দিকে আন্তর্জাতিক চাপ পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার দ্রুত সমাধান সরকারের জন্য জরুরী করে তুলেছে।

 

সমাধান কোন্‌ পথে?

আসলে পার্বত্য চট্টগ্রামকে সমস্যায় পরিণত করেছে বিগত সরকারগুলোর অদূরদর্শী কিংবা অমানবিক ও স্বৈরতান্ত্রিক কর্মনীতি ও দৃষ্টিভঙ্গী। পাকিস্তান আমলের প্রসঙ্গ এখানে আর নাই বা তুললাম। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর প্রথমে তাদের উপর জোর করে বাঙ্গালী পরিচয় চাপিয়ে দিতে চাওয়া হয়। অথচ এটা ছিল সম্পূর্ণ অন্যায়। বরং বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের জন্য সেটাই গৌরবের হ’ত যদি তার সঙ্গে এ দেশের সকল জাতিসত্তার স্বাতন্ত্র্য, সহাবস্থান ও সমমর্যাদার প্রতি স্বীকৃতি দেওয়া হ’ত। এই সত্য ভুলে যাওয়া হয়েছিল যে, বাংলাদেশ শুধু বাঙ্গালীর নয়, এ দেশে বসবাসকারী জুম্ম বা পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ীসহ সকল জাতিসত্তার রাষ্ট্র। অর্থাৎ একক জাতির জাতীয়তাবাদ না হয়ে আমাদের আদর্শ হওয়া উচিত বহুত্ববাদী বা সম্মিলিত জাতীয়তাবাদ। পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার দূরপ্রসারী রাজনৈতিক সমাধানের একটি অপরিহার্য পূর্বশর্ত হ’ল এ দেশে বাঙ্গালী জাতিসত্তা এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন জুম্ম জাতিসত্তাসহ সকল জাতিসত্তার সহাবস্থান ও সমঅধিকারের মৌলনীতিকে স্বীকৃতি দান করা। পার্বত্য চট্টগ্রামবাসীর সুদীর্ঘ সংগ্রাম আমাদের এই শিক্ষা দিয়েছে।

একই সঙ্গে এই সংগ্রাম বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের স্বরূপ উন্মোচন করেছে। এটা স্পষ্ট করেছে যে, এই জাতীয়তাবাদ বাঙ্গালী ও জুম্মসহ সকল জাতিসত্তার লোকবাদী ও গণতান্ত্রিক চেতনা বিরোধী। বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদীদের যুক্তি হ’ল বাংলাদেশ শুধু বাঙ্গালীর নয়, অন্যান্য জাতিসত্তারও দেশ। সুতরাং বাংলাদেশের সকল জাতিসত্তার মিলনের জন্য প্রয়োজন বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের। এবং সেই সঙ্গে এই জাতীয়তাবাদ ধারণ করে সংখ্যাগুরু মুসলমান সম্প্রদায়ের স্বাতন্ত্র্য ও বৈশিষ্ট্য। আপাত দৃষ্টিতে নিরীহ ও উদার এই জাতীয়তাবাদের প্রবক্তারা বিগত একুশ বৎসর ধরে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদকে এমন এক দুইধারী তলোয়ার হিসাবে ব্যবহার করেছে যা একদিকে অসাম্প্রদায়িক, লোকবাদী এবং গণতান্ত্রিক বাঙ্গালী চেতনাকে আঘাত করেছে, অপর দিকে আঘাত করেছে অবাঙ্গালী সংখ্যালঘু জাতিসত্তাসমূহের অস্তিত্ব ও মর্যাদাকে।

বহু অভিজ্ঞতার পর আজ আমাদের আত্মবিচার করতে হবে। ভুল আর অন্যায়ের বোঝা বাড়ানো যাবে না। উগ্র বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ যেমন পরিত্যাজ্য তেমন পরিত্যাজ্য উগ্র সাম্প্রদায়িক ও ভিন্ন জাতিদ্বেষী বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদও। এই উভয় জাতীয়তাবাদের আবরণে এত কাল প্রকৃতপক্ষে যে উগ্র সাম্প্রদায়িকতাবাদী চেতনা ও সংস্কৃতির লালন ও বিকাশ ঘটানো হয়েছে এখন তার অবসান ঘটাবার কাজ শুরু করতে হবে। বাংলাদেশকে পরিণত করতে হবে ভাষা, জাতিসত্তা ও ধর্মবিশ্বাস নির্বিশেষে এ দেশের অধিবাসী সকলের সমঅধিকার ভিত্তিক গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্রে। সমাজের সকল বিবেকবান মানুষ চাইবেন সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানে আন্তরিক হবে। আন্তরিকতা থাকলে যে এ ধরনের সমস্যা সমাধান করা যায় তার দৃষ্টান্ত তো আমাদের প্রতিবেশী পশ্চিম বঙ্গেই আছে। দার্জিলিং জেলায় গোর্খা বা নেপালীদের স্বায়ত্তশাসনের অধিকার আদায়ে কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের মত এত রক্ত ঝরাতে ও সংগ্রাম করতে হয় নি। পশ্চিম বঙ্গের বাম ফ্রন্ট সরকার দার্জিলিং-এ গোর্খাদের আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবী মেনে নিয়ে সমস্যার শান্তিপূর্ণ মীমাংসা করেছিল। আমাদের দেশে সরকারগুলো অতীতে বাহুবলে সমস্যা সৃষ্টি করেছে এবং বাহুবলেই সমস্যার সমাধান করতে চেয়েছে। ওই পথ এ দেশে আর যাদের ক্ষেত্রেই সফল হয়ে থাকুক, পার্বত্য চট্টগ্রামে জুম্ম জনগোষ্ঠীর বেলায় যে সফল হবে না তা যদি এখনও উপলব্ধি করা না যায় তবে সেটা হবে বোকার স্বর্গে বাস করার শামিল।

পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা সমাধানের জন্য অত্যাবশ্যক হ’ল জুম্ম জনগোষ্ঠীর স্বাতন্ত্র্য ও জাতিগত অধিকারের প্রতি স্বীকৃতি দান এবং বাংলাদেশে তাদের মর্যাদার সঙ্গে বসবাস ও রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডে অবাধে অংশগ্রহণের অধিকার প্রদান। এর জন্য দু’টো বিষয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, পার্বত্য চট্টগ্রামকে স্বায়ত্তশাসন প্রদান করতে হবে। বস্তুত জুম্ম জনগোষ্ঠীর জন্য স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠা ছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। কিন্তু এটি একটি পদক্ষেপ মাত্র। দ্বিতীয়টিও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। সেটি হ’ল জুম্ম জনগণ যাতে ধর্মীয় নির্যাতনের শিকার না হন এবং দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসাবে নিজেদের অনুভব না করেন সেই জন্য বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় আদর্শে সেকিউলার বা লোকবাদী নীতি পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে। বস্তুত স্বায়ত্তশাসনের অধিকার এবং সেই সঙ্গে সেকিউলার এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা বাংলাদেশে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণকে মর্যাদা ও নিরাপত্তার সঙ্গে বাস করার অধিকার দিতে পারে।

এটা ঠিক যে, পূর্ববর্তী সরকারগুলো ইচ্ছাকৃতভাবে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যাকে অনেক জটিল করেছে। বিশেষত বাইরে থেকে সেখানে কয়েক লক্ষ বাংলাভাষী মুসলমান নিয়ে গিয়ে অবস্থাটাকে জটিলতর করা হয়েছে। সেই সঙ্গে আছে দীর্ঘ উৎপীড়নের ইতিহাস। তবু সরকার চাইলে এবং আন্তরিক হলে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান সম্ভব। পার্বত্য চট্টগ্রাম জন-সংহতি সমিতির সঙ্গে অস্ত্রবিরতির মেয়াদ দফায় দফায় বাড়ছে। কিন্তু আলোচনার নামে কালক্ষেপণ করে লাভ নেই। অবিলম্বে ফলপ্রসূ আলোচনা শুরু করতে হবে।

পার্বত্য চট্টগ্রামকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় সমস্যা হিসাবে নিয়ে কয়েকটি পদক্ষেপ দিতে হবে। প্রথমত, তদন্তের নামে কল্পনা চাকমা অপহরণ ঘটনা যাতে দীর্ঘসূত্রতার আবরণে ঢাকা না পড়ে তার ব্যবস্থা করতে হবে এবং দ্রুত দায়ী ব্যক্তিদের খুঁজে বের করে কঠোর ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করতে হবে। শুধু তাই নয়, সেখানে জুম্ম জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে এত কাল যেসব অপকীর্তি করা হয়েছে সেগুলোর উপর শ্বেতপত্র প্রকাশ করতে হবে এবং এসব ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সেনা নিয়ন্ত্রণ প্রত্যাহার করতে হবে এবং সেখানে বেসামরিক, গণতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। বিশেষত সেখানে এত কাল যেসব অন্যায় হয়েছে সেগুলো যাতে দেশবাসী অবাধে জানতে পারে সেই জন্য সেখানে সকল মানবাধিকার কর্মêী, সাংবাদিক ও অন্যদের অবাধ চলাফেরার অধিকার দিতে হবে। সর্বোপরি, পার্বত্য চট্টগ্রামের স্বায়ত্তশাসন যা সেখানকার জনগণের প্রাণের দাবী তা অবিলম্বে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে পদক্ষেপ দিতে হবে; এবং পদক্ষেপ দিতে হবে সেকিউলার বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে যাতে এ দেশের ধর্ম ও মতবাদ নির্বিশেষে সকল সম্প্রদায় ও ব্যক্তি সমমর্যাদা ও অধিকার নিয়ে বাস করতে পারে। আজ আমাদের উপলব্ধি করতে হবে, পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনতার সংগ্রাম শুধু তাদের একার সংগ্রাম নয়। এই সংগ্রাম এ দেশের সকল নিপীড়িত ও লাঞ্ছিত নারীর মুক্তি অর্জন ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। এই সংগ্রাম সকল নির্যাতিত মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার অর্জনের সংগ্রাম। এই সংগ্রাম বাংলাদেশকে একটি গণতান্ত্রিক ও সেকিউলার রাষ্ট্র ও সমাজ হিসাবে গড়ে তোলার সংগ্রাম। আর তাই বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক শক্তির পক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগোষ্ঠীর অধিকার আদায়ের সংগ্রামকে পাশ কাটিয়ে যাবার কোন উপায় নেই।

রচনাঃ ১৯৯৬
 

তথ্যসূত্রঃ

১. Mohiuddin Ahmad, Islamisation of the Hill Tracts : A Case of Majority Chauvinism, The Daily Star, Dhaka, June 29, 1996.

২. নীলোৎপল চৌধুরী, প্রসঙ্গঃ কল্পনা চাকমা সম্পর্কিত সেনাবাহিনীর ভাষ্য, দৈনিক ভোরের কাগজ, ঢাকা , জুলাই ২৮, ১৯৯৬।

 


একজন অ-গারোর দৃষ্টিতে গারো জাতিসত্তা

আলোচনার শুরুতে আমি বলে নিই যে, যদিও গারো জনগোষ্ঠীর সদস্যগণ নিজেদের মান্দি, মান্দে বা আচিক নামে অভিহিত করেন তথাপি অ-গারো লোকেরা এই শব্দের সঙ্গে তেমন একটা পরিচিত না হওয়ায় এবং মান্দি, মান্দে ও আচিক এই তিনটির কোনটি গারোদের জন্য সুনির্দিষ্টভাবে এবং এককভাবে প্রযোজ্য হওয়া উচিত এ নিয়ে গারোদের মধ্যে এখন পর্যন্ত তেমন একটা ঐক্যমত গড়ে না উঠায় আমি গারো শব্দই ব্যবহার করছি।

লক্ষণীয় যে, আমি গারো শব্দের পর উপজাতি বা ট্রাইব শব্দ ব্যবহার না করে জাতিসত্তা ব্যবহার করেছি যা মূলত ইংরাজী ন্যাশনালিটি-এর সমার্থক হিসাবে ব্যবহার করতে চেয়েছি। প্রথমত, উপজাতি বা ট্রাইব যে ধারণা প্রদান করে গারো জাতিসত্তা অন্তত বাংলাদেশে সেই ধারণার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ বলে আমি মনে করতে পারছি না। কারণ, উপজাতি সমাজের অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন এখন গারোদের মধ্যে সামান্য অবশিষ্ট আছে বলে মনে হয়। পরিবর্তন বহু বিষয়ে হয়েছে । এমন কি সমাজ গঠনেও। যা আছে তাকে অতীতের অবশেষ বলা যায়। হয়ত বলা হবে মাতৃতান্ত্রিক পরিবার ব্যবস্থা, সন্তানদের মাতৃগোত্র অনুযায়ী পরিচয় প্রথা এখনও যথেষ্ট শক্তিশালী। সম্পত্তির স্বাভাবিক উত্তরাধিকার এখনও মাতৃ বা নারী সূত্রে। এছাড়া ছেলেদের অনেকেই এখনও বিয়ে করে স্ত্রীর বাড়ীতে গিয়ে ওঠে।

কিন্তু এগুলি উপজাতি সমাজের নয়, বরং একটি মাতৃতান্ত্রিক সমাজের বৈশিষ্ট্য হতে পারে। আর গোত্রগত কিছু বিধিবিধান থাকলে যদি সেটা জাতিসত্তা বা জাতি না হয়ে উপজাতি বা ট্রাইব হওয়া বোঝায় তবে ভারতবর্ষের হিন্দুদের জাতি না বলে উপজাতি বা ট্রাইব বলা উচিত। তবে সেক্ষেত্রে হিন্দুদের বাঙ্গালী বা ভারতীয় পিতৃতান্ত্রিক উপজাতির সদস্য বলতে হয়। উপজাতির স্তরে পড়ে নেই উপরন্তু জাতি-রাষ্ট্র গঠন করেছে এমন বহু সমাজেও পিতৃতান্ত্রিক গোত্র এবং পরিবার ব্যবস্থার শক্তিশালী অস্তিত্ব আছে।

যাইহোক, উপজাতি থেকে জাতিসত্তা এবং এমন কি রাজনৈতিক জাতিরও উদ্ভব ঘটতে পারে। ইতিহাসে এক বা একাধিক উপজাতি থেকে এমনটা বহু কাল ধরে ঘটেছে। সুতরাং সমাজ বিকাশের স্তর বিবেচনায় আমার মতে গারো জনগোষ্ঠী একটি জাতিসত্তা। বাংলাদেশে এটি একটি সংখ্যালঘু জাতিসত্তা। বিশেষ করে বৃহত্তর ময়মনসিংহের কিছু অঞ্চলে স্মরণাতীত কাল থেকে বাস করে আসায় এবং প্রতিবেশী সংখ্যাগুরু বাঙ্গালী জাতিসত্তার তুলনায় উপজাতীয় কিংবা গোষ্ঠীগত সামাজিক ঐতিহ্য ও প্রথাকে অধিকতর পরিমাণে সংরক্ষণ করায় গারোদেরকে আদিবাসী জনগোষ্ঠী বা জাতিসত্তাও বলা যায়। প্রতিবেশী অন্যান্য জাতিসত্তা থেকে তাদের সামাজিক স্বাতন্ত্র্য ও পার্থক্য বিবেচনা করে সহজভাবে বোঝার জন্য তাদেরকে একটি জাতি বলতেও আমার আপত্তি নেই, যদিও সেটা হয়ত ইংরাজী নেশন-এর সমার্থক হবে না।

যাইহোক, বাংলাদেশ এবং ভারতের মেঘালয়ের সকল গারো বৃহত্তর একটি জাতিসত্তার অন্তর্ভুক্ত। এখানে ভাষার পার্থক্য কিছু আছে, ধর্মের পার্থক্যও কিছু আছে। অধিকাংশ খ্রীষ্টান হলেও সবাই নয়। প্রাচীন সাংসারেক ধর্মালম্বীও কিছু আছে। অবশ্য বাংলাদেশে তুলনায় খুব কম। মেঘালয়ে তুলনায় বেশী। বাংলাদেশে খুব সামান্য সংখ্যক হিন্দু ধর্মাবলম্বী গারো আছে। আবার খ্রীষ্টান ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে ক্যাথলিক, ব্যাপ্টিস্ট ইত্যাদি বিভিন্ন বিভাজন আছে। এতক্ষণ ধরে আমি গারো জাতিসত্তা সম্পর্কে আমার বক্তব্য বলার ক্ষেত্র তৈরী করলাম। এখন গারো জাতিসত্তা সম্পর্কে আমার সাম্প্রতিক কিছু ভাবনা ও প্রশ্ন উপস্থিত করব কিছু বিষয়ে ভাবার জন্য। এই সঙ্গে বলে রাখি এখানে খুব সংক্ষেপে কিছু প্রশ্ন এবং বক্তব্য উত্থাপন করায় কিছু বিষয় অস্পষ্ট থেকে যেতে পারে। তবু আমি গারো সমাজ সম্পর্কে আমার সাম্প্রতিক অনুসন্ধান থেকে উঠে আসা কিছু উপলব্ধির বিষয় এইসব প্রশ্ন ও বক্তব্যের মধ্য দিয়ে উপস্থিত করার লোভ সামলাতে পারছি না।

 

এক অমিত শক্তিধর জাতিসত্তার ইতিবৃত্ত

সাম্প্রতিক কালের অনুসন্ধানে আমি গারো জাতিসত্তার ইতিহাস যেটুকু জেনেছি তাতে এক আশ্চর্য শক্তিশালী জনগোষ্ঠীর ইতিহাস আমাকে বিস্ময়াভিভূত করেছে। গারো জাতিসত্তার নিজস্ব লিপি না থাকায় তার ইতিহাস ছিল মৌখিক। বিভিন্ন লোকগাথা , সঙ্গীত ও আচার-অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে তাদের অনেক হাজার বছরের ইতিহাস নানান রূপে সংরক্ষিত হয়েছিল এতকাল। ইদানীং কালে সেগুলো কিছু লেখা হয়েছে এবং সেগুলো থেকে ইতিহাস ব্যাখ্যার চেষ্টা আছে। বলা যায় মীথ অথবা পৌরাণিক উপাখ্যান কিংবা উপকথার আড়ালে লুকিয়ে থাকা ইতিহাসকে বোঝার বা পুনর্গঠনের চেষ্টা রয়েছে এসবে।

স্বাভাবিকভাবে বিভিন্ন জন এটা বিভিন্ন ভাবে করেন। আমিও চেষ্টা করেছি আমার মত করে গারো জাতিসত্তার ইতিহাসকে বুঝতে। আর তখন আমি দেখতে পেয়েছি মাতৃতন্ত্র ও পিতৃতন্ত্রের এক বিশাল ও সুদীর্ঘ ঐতিহাসিক দ্বন্দ্ব কীভাবে গারো সমাজের বিভিন্ন গল্পকথার মধ্যে লুকিয়ে আছে। এছাড়া বাঙ্গালীর বিভিন্ন লোককাহিনী এবং হিন্দু পৌরাণিক কাহিনীও আমাদের এই ঐতিহাসিক দ্বন্দ্বকে বুঝতে সাহায্য করে।

বিভিন্ন গারো উপকথা থেকে পণ্ডিতরা অনুমান করেন গারো জাতিসত্তা আদিতে তিব্বত থেকে বিভিন্ন পথ ধরে অভিগমন করে উত্তর বঙ্গ, বৃহত্তর আসাম, মিয়ানমার বা বার্মা ইত্যাদি বহু দেশ হয়ে শেষ পর্যন্ত গারো পাহাড় এবং সংলগ্ন অঞ্চলগুলোতে অভিবাসন করে। এ প্রসঙ্গে আমার মনে হয়েছে গারোরা তিব্বত অথবা অন্য কোথা থেকে মূলত এসেছে সেটা বড় কথা নয়। এমন কি গারো জাতিসত্তা আদৌ এক উৎসজাত কোনও একটি উপজাতি বা নৃগোষ্ঠী কিনা সেই প্রশ্নও আমার মনে জেগেছে।

প্রথমত, অবিমিশ্র Race বা নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর ধারণা ভুল। তথাপি কিছু মোটা বা প্রশস্ত বর্গ বা গ্রুপে মানব গোষ্ঠীকে ফেলা যায়। যেমন মোঙ্গলীয়, ককেশীয়, নিগ্রোয়েড ইত্যাদি। কিন্তু আমার মনে হয়েছে গারো সমাজের নৃগোষ্ঠীগত বৈশিষ্ট্যের তুলনায় সমাজ-কাঠামোগত ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ, আর তা হল মাতৃতন্ত্র। এই মাতৃতন্ত্রের এমন তুলনা ভারতবর্ষে আছে কিনা আমার জানা নেই। এমন কি খাসিয়ারাও এমনভাবে মাতৃতান্ত্রিক নয় বলে আমার মনে হয়েছে।

গারো জনগোষ্ঠীর বিশাল অঞ্চল ব্যাপী অভিগমন বা মাইগ্রেশন-এর ইতিহাস পড়তে গিয়ে আমি যে চিত্র দেখতে পাই তা মূলত কোনও নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর নয়, বরং মাতৃতন্ত্রের অভিগমন বা মাইগ্রেশন। বিশাল অঞ্চলে মাতৃতন্ত্রের পরাজয় ঘটে চলেছিল পিতৃতন্ত্রের হাতে। সুতরাং মাতৃতন্ত্র পিছু হটে চলেছিল। কিন্তু আত্মসর্মপণ করে নি। অবশেষে তা আশ্রয় নেয় মেঘালয়ের দুর্গম, দুর্ভেদ্য গারো পাহাড়ে এবং গারো পাহাড়কে কেন্দ্র করে প্রাচীন উত্তর ময়মনসিংহ, গোয়ালপাড়াসহ সংলগ্ন অঞ্চলগুলোতে।

এইভাবে কয়েক হাজার বৎসর ধরে পিতৃতন্ত্র প্রভাবাধীন সমাজগুলোর আক্রমণ ও আগ্রাসন প্রতিহত করে মাতৃতন্ত্র দৃঢ় অবস্থান নিয়ে টিকে থাকে প্রায় আধুনিক কালের সূচনার সময় পর্যন্ত। পিতৃতান্ত্রিক বাঙ্গালী সমাজের অনেক লোককাহিনীর কামরূপ-কামাখ্যা মূলত সেই গারো ভুখণ্ড যেখানে গেলে নাকি ডাকিনী নারীরা পুরুষদের মন্ত্রবলে ভেড়া বানিয়ে রাখত। মাতৃতন্ত্র বিদ্বেষী ও ধ্বংসকারী পিতৃতন্ত্র মাতৃতন্ত্রের প্রতি তার ভীতি ও ঘৃণা প্রকাশের জন্য এইসব গালগল্প তৈরী করত। স্বামীর পায়ের নীচে স্ত্রীর স্বর্গ যেখানে নেই, নারী ধর্ষণ ও দলনের মধ্যে যে সমাজের পুরুষেরা ঘৃণা, লজ্জা ও অসম্মান ব্যতীত গৌরবের কিছু দেখে না তেমন এক সমাজের প্রতি নারী-দ্রোহী পুরুষতন্ত্রের ঘৃণা ও ভয় এমন সব গল্পের মাধ্যমে প্রকাশ পাবে সেটাই স্বাভাবিক।

 

মাতৃতন্ত্র ও পিতৃতন্ত্রের দ্বন্দ্ব

খুব সংক্ষেপে বললে নারীর হাতে কৃষির উদ্ভব। এ কথা সমাজতত্ত্বের ছাত্রদের জানা যে, আদিতে কৃষি ছিল বাড়ীর আশপাশে এবং মূলত নারীরা সেটা করত। আমরা এটাকে উদ্যান বা বাগিচা চাষ বলতে পারি যেখানে গর্ত করে বীজ বপন করা হত। কৃষি যন্ত্র বলতে কাঠ বা পাথরের সূঁচালো বা ধারালো বস্তু। বস্তুত জুম চাষ এই বাগিচা চাষের রকমফের মাত্র। বলার সুবিধার জন্য আমি লাঙ্গল চাষের পূর্বের সব কৃষিকে জুম নামে অভিহিত করছি। যদিও আজকালকার জুমের সঙ্গে পাহাড়ের গাছ কাটা ও পোড়ানো এবং চাষের জমি স্থানান্তরের সম্পর্ক আছে তবু যে কোনও ধরনের আদি বাগিচা চাষ পদ্ধতিকে এক ধরনের জুম চাষ বলা যায় বলে আমার ধারণা। যাইহোক, জুম চাষের সঙ্গে সহজ হাতিয়ার ব্যবহার এবং ক্ষুদ্রায়তন কৃষির সম্পর্ক আছে। এই কৃষির যুগটা ছিল মাতৃতন্ত্রের যুগ। আমার ধারণা, যে নারীরা জুম বা বাগিচা পদ্ধতিতে বাড়ীর আশপাশে প্রথম কৃষি প্রবর্তন করেন তাঁরাই ধীরে ধীরে উৎপাদন ব্যবস্থা তথা অর্থনীতিকে ব্যবহার করে সমাজে নিজেদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক কর্তৃত্ব নিরংকুশ বা দৃঢ়বদ্ধ করেন। এইভাবে মাতৃতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। সুতরাং সভ্যতার ঊষা লগ্ন কেটেছে নারীর কোলে। লাঙ্গল আবিষ্কার মাতৃতন্ত্রকে ধ্বংস করে। এবার মানব সমাজ ক্ষুদ্রায়তন কৃষি থেকে বৃহদায়তন কৃষিতে প্রবেশ করে। লাঙ্গল চালাবার জন্য প্রয়োজনীয় দেহশক্তি, বেশী পরিমাণ জমিতে শ্রমদানের জন্য বেশী সময়ের প্রয়োজন, বাড়ী থেকে দূরে দীর্ঘ সময় শ্রমদান ইত্যাদি বিষয় নারীর তুলনায় পুরুষের গুরুত্ব বাড়িয়ে দেয়। সুতরাং লাঙ্গল-চাষ মাতৃতান্ত্রিক সমাজের অবসান অনিবার্য করে।

লাঙ্গলের সঙ্গে এল জল সেচ, এল বিপুল খাদ্য উৎপাদন, ফলে অনেক বেশী উদ্বৃত্ত উৎপাদন। এর ফলে সমাজে যেমন শ্রম বিভাগের জটিলতা ও বৈচিত্র্য বাড়ল তেমন সভ্যতার বিকাশ সহজতর ও অনিবার্য হল। মানব সমাজ উপজাতি সমাজ থেকে উঠে এল রাষ্ট্রে। অর্থাৎ লাঙ্গল চাষের সঙ্গে রাষ্ট্রের উদ্ভব জড়িত। যেমন এর সঙ্গে আছে নিয়মিত সেনাবাহিনী ও যুদ্ধেরও কম বেশী বিজড়ন। এই যুদ্ধের সংগঠন ও চরিত্র আদিম সমাজের যুদ্ধের সংগঠন ও চরিত্র থেকে ভিন্ন। আদিম সমাজে যুদ্ধ দ্বারা এক গোষ্ঠী আরেক গোষ্ঠীকে বিতাড়িত করত অথবা হত্যা করত অথবা পরাজিত ও বন্দী করে নিজ গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত করত। এখন মানুষ শিখল যুদ্ধ দ্বারা শুধু শত্রু সম্পত্তি ও জায়গা অধিকার করতে নয়, উপরন্তু পরাজিত শত্রুকে বন্দী ও অধীনস্থ করে তার শ্রমশক্তি জবরদস্তিমূলকভাবে ভোগ করতে।

গারো সমাজ অতীতে কখনও প্রকৃত অর্থে রাষ্ট্র গড়ে নি। যখন কেউ গড়েছে তখন সে বা তারা আর গারো থাকে নি। এমন কি গারো সমাজে উপজাতীয় ব্যবস্থাধীনেও কোনও কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব বা কর্তৃত্ব ছিল না। তাই গারো পাহাড় অঞ্চলে ঊনবিংশ শতাব্দীতে (১৮৭২-’৭৩) ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর চূড়ান্ত দখল কায়েমের পূর্ব পর্যন্ত প্রতিটি গারো গ্রাম ছিল কোনও কোনও গারো পণ্ডিতের ভাষায় একেকটি স্বাধীন প্রজাতন্ত্র (মিল্টন এস, সাংমা, হিস্ট্রী এন্ড কালচার অফ দি গারো)। এটুকু সহজে অনুমেয়, কয়েক হাজার বৎসর ধরে চারপাশের পিতৃতন্ত্রের প্রবল চাপে শেষ পর্যন্ত মাতৃতন্ত্রও তার আদি রূপে থাকতে পারে নি। তার সমাজ সংগঠনে পুরুষের প্রাধান্য কিছু করে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছিল, যা মাতৃতন্ত্রের শক্তি হ্রাস করছিল। এর প্রমাণ মেলে গারো সাংসারেক ধর্মে যেখানে পুরোহিত বা পূজারী পুরুষ। তাছাড়া গ্রাম প্রধান হিসাবে যাকে ধরা হত সেই আকিং নক্‌মাও ছিল পুরুষ। আমার অনুমান এসব মাতৃতন্ত্রের আদি কিংবা নির্ভেজাল রূপের ক্ষয়ের সাক্ষ্য দেয়। সম্ভবত গারো সমাজে মাতৃতন্ত্রের পতন বিদেশী শক্তির হাতে গারো জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিক পতনের অনেক পূর্বেই শুরু হয়েছিল।

তবু সব মিলিয়ে মাতৃতন্ত্র টিকে ছিল। তার একটা ফল হিসাবে রাষ্ট্র ছিল না। তার বদলে ছিল স্বাধীন গ্রাম সমাজ। লাঙ্গল চাষও ছিল না, ছিল জুম চাষ।

অতীতে যখন আজকের উন্নত প্রযুক্তি ছিল না তখন নারী তার কিছু দেহ বৈশিষ্ট্যের কারণে খুব বেশী দূরে স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারত না। গর্ভধারণ ও সন্তান পালনের জন্য তার শ্রমদান ও সময় দানের ক্ষেত্রও ছিল গৃহ কেন্দ্রিক এবং গৃহের নিকবর্তী এলাকা ভিত্তিক। সুতরাং নারীর নেতৃত্বে বৃহৎ সমাজ গঠন ছিল অসম্ভব। ব্যক্তি-নারী হয়ত নেতৃত্ব দিতে পারত, কিন্তু সমষ্টি-নারীর পক্ষে সেটা সম্ভব ছিল না। এই অবস্থায় নারী-সমাজের নিয়ন্ত্রণাধীনে যে সমাজ গঠিত হত তা একটি গ্রাম বা ক্ষুদ্র এলাকা ভিত্তিক হবে সেটাই ছিল স্বাভাবিক। তাই নারীর নিয়ন্ত্রণাধীন বা মাতৃতন্ত্রাধীন গারো রাষ্ট্র (?) ছিল একটি করে একক গ্রাম। এই গ্রাম শাসনও ছিল গণতান্ত্রিক। তাই মিল্টনের মত গবেষকের মতে এই গ্রাম স্বাধীন প্রজাতন্ত্র।

অর্থাৎ গারো সমাজ ছিল অসংখ্য স্বাধীন গ্রামের সমষ্টি যার কোনও কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব বা কর্তৃত্ব ছিল না। তাহলে অসংখ্য খণ্ডে খণ্ডিত গারো সমাজকে কোন শক্তি একটি অখণ্ডতা বা ঐক্যের অনুভূতি দান করেছিল? কিছু রীতিনীতি ও বিশ্বাস, যার মর্মে ছিল মাতৃতন্ত্র। মাতৃতন্ত্র তাদের অন্যদের থেকে স্বতন্ত্র এবং নিজেদের মধ্যে ঐক্যবদ্ধ করেছিল।

ভাষার নৈকট্য থাকলেও সব গারোর ভাষা যে অভিন্ন বা কাছাকাছি তা কিন্তু নয়। অঞ্চল ভেদে, গোষ্ঠী ভেদে ভাষার কিছু পার্থক্য ছিল এবং আজও আছে। কিন্তু অধিকাংশ গারোর ভাষা মোটামুটি কাছাকাছি এবং পরস্পরের বোধগম্য। তবে ‘আতং’ এবং ‘মেগাম’ গোষ্ঠী দুইটির ভাষা ভিন্ন। তবু ‘আতং’ এবং ‘মেগামরাও’ গারো।

আমার ধারণা গারো স্বাতন্ত্র্যের মূল রহস্য অন্যদের তুলনায় মাতৃতন্ত্রের প্রতি তার অনেক বেশী দৃঢ় আনুগত্যের ভিতর। খাসিয়ারাও এতটা মাতৃতন্ত্রী নয়। আমার অনুমান সমগ্র অঞ্চলে মাতৃতন্ত্রের অবক্ষয় গারো সমাজেই সবচেয়ে শেষে শুরু হয়েছে।

আমার আর একটা অনুমান যে, যে প্রাচীন মানুষরা জুম বা বাগিচা চাষের মাধ্যমে প্রথম কৃষি আবিষ্কার এবং কৃষি-সমাজ প্রতিষ্ঠা করেছিল গারোরা তাদের প্রত্যক্ষ উত্তরাধিকারী। অর্থাৎ গারো সমাজের পিছনে সম্ভবত আছে হাজার হাজার এমনকি হয়ত লক্ষ বৎসরের কৃষি আবিষ্কার এবং সেই সঙ্গে প্রাথমিক পর্যায়ের কৃষি ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা গঠনের প্রয়াসের ইতিহাস। সম্ভবত এই ইতিহাস সবচেয়ে বেশী তারা ধারণ করে বলে গারোরা এত রক্ষণশীলতা এবং দৃঢ়তার সঙ্গে সাম্প্রতিক কাল পর্যন্ত জুম চাষকে লালন করেছে এবং লাঙ্গল চাষে যায় নি। অর্থাৎ জুম চাষ করলেই সমাজ মাতৃতন্ত্রী হবে এমন নয়। যারা জুম চাষের প্রথম উদ্ভাবক ও সংগঠক সম্ভবত তারাই ছিল মাতৃতন্ত্রী। অন্যরা ছিল আদিম শিকারী ও খাদ্য সংগ্রহকারী গোষ্ঠী মাত্র যারা পরবর্তী কালে বিদ্যমান জুম চাষ গ্রহণ করে নিয়েছিল। এরা অন্যের উদ্ভাবিত পদ্ধতি গ্রহণকারী বলে সম্ভব ও প্রয়োজন হলে এরা সহজে লাঙ্গল নির্ভর কৃষি পদ্ধতিও গ্রহণ করে নিয়েছিল। আর তাই এরা জুম চাষ করলেও পিতৃতন্ত্রী রয়েছে বা হয়েছে। শুধু বাংলাদেশ বা ভারত নয়, পৃথিবীর বহু দেশে জুম চাষ নির্ভর পিতৃতান্ত্রিক জনগোষ্ঠী আছে। বাংলাদেশে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, মুরং ইত্যাদি জনগোষ্ঠীর অনেকে এখনও জুম চাষ নির্ভর অর্থনীতিতে থাকলেও তারা পিতৃতান্ত্রিক। চাকমা নারীদের পৈত্রিক সম্পত্তির উত্তরাধিকারও নেই।

তাই গারো জনগোষ্ঠী শুধু খাদ্যোৎপাদনের ব্যবস্থা হিসাবে জুম চাষকে আঁকড়ে থাকে নি, তারা মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থাকে রক্ষার জন্যও এত দীর্ঘ কাল এমনকি সমভূমি অঞ্চলে বসবাস করেও জুম চাষকে আঁকড়ে ছিল। সম্ভবত এখন পর্যন্ত সাধারণভাবে গারো কৃষকরা লাঙ্গল নির্ভর কৃষিতে তাদের প্রতিবেশী বাঙ্গালী কৃষকদের মত দক্ষ নয়।

সহজ-সরল মাতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থা রক্ষায় গারোরা কতখানি দৃঢ় ছিল তা আরও ঘটনায় বোঝা যায়। জুম চাষে উৎপন্ন তূলা বা অন্যান্য ফসলের বিনিময়ে পার্শ্ববর্তী পিতৃতান্ত্রিক সমাজ থেকে তারা যুদ্ধের লৌহাস্ত্র এবং কুড়াল-দা ইত্যাদি সংগ্রহ করত। কিন্তু নিজেরা কর্মকার হয় নি। সভ্যতার সেই স্তরে প্রবেশকে তারা সযত্নে এড়িয়ে গেছে যে স্তরে প্রবেশ করলে বর্বর পিতৃতন্ত্র এবং তার আনুষঙ্গিক নারী দলন এবং নারীর ক্ষমতা হরণ সমাজের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হয়ে দেখা দিবে।

গারো সমাজের অস্তিত্ব মাতৃতন্ত্র ও পিতৃতন্ত্রের ঐতিহাসিক দ্বন্দ্ব ও সংঘাতকে সুদীর্ঘ কাল অব্যাহত রেখেছে। এই দ্বন্দ্ব-সংঘাত নানানভাবে প্রভাব ফেলেছে পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ও সভ্যতার স্মৃতিতে এবং গল্প-কাহিনীতে। হিন্দু পৌরাণিক কাহিনী পরশুরামের মাতৃহত্যার উপাখ্যানের আড়ালে মাতৃতন্ত্র ও পিতৃতন্ত্রের সংঘাতের ইতিহাস লুকিয়ে আছে বলে আমি অনুমান করি। ব্রহ্মপুত্র নদী বিধৌত অববাহিকা ব্যাপী বিশাল অঞ্চলে লাঙ্গল চাষের সঙ্গে জল সেচ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা, মাতৃতন্ত্রের উচ্ছেদ এবং পিতৃতন্ত্র প্রতিষ্ঠা যে সম্পর্কিত ছিল পরশুরামের মাতৃহত্যার কাহিনী থেকে সেটা অনুমান করা যায়। পরশুরাম কুঠার দ্বারা মাতৃহত্যা করে অভিশাপ মুক্ত হবার জন্য তিব্বতের মানস সরোবরে ্নান করেন এবং অতঃপর সেখান থেকে লাঙ্গল দিয়ে রেখা টেনে এনে ব্রহ্মপুত্র নদী প্রবাহিত করেন মেঘনা নদী পর্যন্ত। অনুমান করি কুঠারের সাহায্যে মাতৃহত্যা ধাতব অস্ত্র ব্যবহারের সাহায্যেও মাতৃতন্ত্র উচ্ছেদ বোঝায়। যাইহোক, এটি স্পষ্ট যে, পিতৃতন্ত্র শান্তিপূর্ণভাবে মাতৃতন্ত্র উচ্ছেদ করে নি। তাকে যুদ্ধ করে মাতৃতন্ত্রকে পরাজিত এবং লাঙ্গল নির্ভর কৃষি ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে হয়েছিল।

কিন্তু গারো সমাজ যত সীমাবদ্ধ অঞ্চলেই হোক সুদীর্ঘ কালব্যাপী পিতৃতন্ত্রের আক্রমণ ও আগ্রাসনকে মোকাবিলা করেছিল। একটি মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থাকে রক্ষার জন্য যুদ্ধটা কিন্তু প্রধানত গারো পুরুষদেরকেই করতে হয়েছিল। কারণ, এই কাজ প্রধানত পুরুষদের। মাতৃতন্ত্রী হলেও গারো যোদ্ধা পুরুষদের শৌর্য-বীর্য কম ছিল না। ইংরেজরা তাদের নৃমুণ্ড শিকারী বলেছে। তাদের আক্রমণের ভয়ে আশপাশের পিতৃতান্ত্রিক সমাজের মানুষরা সন্ত্রস্ত থাকত বলে জানা যায়। যতো দূর জানা যায় গারো গ্রামগুলোর মধ্যেও পারস্পরিক আক্রমণ ও যুদ্ধ লেগে থাকত।

অবশ্য আমার অনুমান মাতৃতন্ত্রের কারণে গারোদের পক্ষে খুব বেশী যুদ্ধ নির্ভর হবার উপায় ছিল না। হয়ত আদিম কিছু বিশ্বাস ও রীতির কারণে কিছু ক্ষেত্রে নৃমুণ্ড কেটে আনা হত, এছাড়া আত্মরক্ষার প্রয়োজনে যুদ্ধ করতে হত। কিন্তু গারো সমাজ প্রতিবেশী অন্যান্য সমাজের তুলনায় একটি শান্তিপ্রিয় সমাজ ছিল বলে আমি অনুমান করি। আমার আরও অনুমান গারো সমাজকে হাজার হাজার বৎসর ধরে প্রায় অব্যাহতভাবে সবচেয়ে বড় যে যুদ্ধ করতে হয়েছে তা হল তার মাতৃতন্ত্রকে রক্ষার জন্য যুদ্ধ।

তবে যুদ্ধটা ছিল খুব অসম। কারণ, শুধু সংস্কৃতি বা আদর্শ দিয়ে উন্নততর প্রযুক্তির আক্রমণকে প্রতিহত করা যায় না। আধুনিক কালের পূর্ব পর্যন্ত গারো পাহাড়ের দুর্গমতা এবং প্রাকৃতিক আনুকূল্যকে ব্যবহার করে গারো পাহাড়কে ঘিরে মাতৃতন্ত্রের একটা বলয় রক্ষা করা গিয়েছিল। কিন্তু এক সময় ব্রিটিশ সেনাবাহিনী বন্দুক নিয়ে এবং গারো পাহাড়ের মরণব্যাধি ম্যালেরিয়া যা বহিরাগত অ-গারোদের জন্য ছিল মৃত্যু দূত স্বরূপ তার বিরুদ্ধে কুইনাইন ঔষধ নিয়ে গারো পাহাড়ে প্রবেশ ক’রে ভারতবর্ষে ক্ষয়িষ্ণু মাতৃতন্ত্রের শেষ দুর্গের পতন ঘটাতে সক্ষম হল।

এবার মাতৃতান্ত্রিক সমাজ পরিপূর্ণরূপে পিতৃতান্ত্রিক সভ্যতার অধীনস্থ হল। ইতিপূর্বে আমার অনুমানের কথা বলেছি যে, মাতৃতন্ত্রে তার অনেক আগে থেকে ক্ষয় ঘটছিল। এ প্রসঙ্গে সাংসারেক ধর্মের কথা উল্লেখ করেছি যাকে আদি গারো ধর্ম বলা হয়। অথচ এর পুরোহিত নারী নয়, পুরুষ।

ধর্মে যেহেতু সমাজ ব্যবস্থার একটা প্রতিফলন ঘটে সেহেতু এ থেকে মাতৃতন্ত্রের দুর্বল বা ক্ষয়িষ্ণু অবস্থার প্রকাশ দেখতে পাওয়া যায়। সম্ভবত আদি মাতৃতন্ত্রে সাংসারেক ‘থরম’* ছিল না। বাইরের পিতৃতান্ত্রিক ধর্মের প্রভাবে এই ধর্মের উদ্ভব ও প্রসার গারো সমাজে ঘটেছিল এমন সম্ভাবনাকে আমি উড়িয়ে দিচ্ছি না।
---------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
* এটা স্পষ্ট যে, ধর্মের গারো প্রতিশব্দ থরমের উদ্ভব এভাবেঃ ধর্ম > ধরম > থরম।
---------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------

মাতৃতন্ত্রের অবক্ষয়ের নমুনা হিসাবে আমি ইতিপূর্বে গ্রাম প্রধান হিসাবে কথিত আকিং নকমার কথা উল্লেখ করেছি। অর্থাৎ পরিবারে নারীর প্রাধান্য থাকলেও সমাজে পুরুষ প্রধান্যে এসেছে। এই কারণে গ্রামের অন্যান্য নক্‌মা বা গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরাও ছিল পুরুষ। তবে নক্‌মা বা গ্রাম প্রধান যে-ই হোক সমাজ ছিল গণতান্ত্রিক। গ্রামের সবাই একত্রে বসে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিত।

যাইহোক, অনুমান করি মাতৃতন্ত্র অনেক আগে থেকে দুর্বল হয়ে ভেঙ্গে পড়ছিল কিছু করে। ব্রিটিশ শাসন ছিল মাতৃতন্ত্রের উপর পিতৃতন্ত্রের শেষ বিরাট আঘাত। এর একটা ফল হল বিস্ময়কর দ্রুত গতিতে পিতৃতান্ত্রিক খ্রীষ্ট ধর্মের প্রসার।

 

মাতৃতন্ত্রের ভবিষ্যৎ

এই অবস্থায় গারো সমাজ ও মাতৃতন্ত্রের ভবিষ্যৎ কী? অন্তত বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে আমার সামনে এই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এখানে গারো জনগোষ্ঠীর এখন আর নিজস্ব এবং নির্দিষ্ট ভূ-খণ্ড নেই। তার গ্রামগুলোও ছিন্নভিন্ন। পাকিস্তান আমল থেকে গারোদের উপর সংখ্যাগুরু মুসলমান সম্প্রদায়ের দিক থেকে যেসব নির্যাতন ও আক্রমণ হয়েছে সেসবের উল্লেখ আমি এখানে নাই বা করলাম।

গারো সমাজের নিজস্ব সামাজিক নেতৃত্ব আছে বলেও মনে হয় না। একদিকে ইউরোপ কেন্দ্রিক খ্রীষ্টান মিশনারী চার্চ এবং অপর দিকে খ্রীষ্টান এনজিও এখন গারো সমাজের মূল নিয়ন্ত্রণ হাতে রেখেছে। খ্রীষ্টানদের মধ্যকার চার্চগত বিভিন্নতা বা পার্থক্য আবার গারোদের মধ্যে বিভাজন ও অনৈক্য বৃদ্ধি করেছে।

গারো সমাজকে আমার বর্তমানে নেতৃত্বহীন ও অনকেটা বিশৃঙ্খল বা এলোমেলো হয়ে পড়া বলে মনে হয়েছে। অবশ্য এটাও সত্য যে, গারো সমাজকে চিনতে ভুল করা বিশেষ করে আমাদের পক্ষে খুব স্বাভাবিক। কারণ, আমরা পিতৃতন্ত্রের দৃষ্টিতে সমাজকে বিচার করি। তার সঙ্গে জড়িত আছে সমাজের ঐক্য ও শৃঙ্খলা বলতে কেন্দ্রীয় একক কর্তৃত্বমূলক ব্যবস্থার উপস্থিতির ধারণা। কিন্তু এই ধরনের কোনও কেন্দ্রীয় কর্তৃত্ব ছাড়াই গারো সমাজ কয়েক হাজার বৎসর সংগঠিত ও সুশৃঙ্খল ছিল বলে তা পিতৃতন্ত্রের সকল আক্রমণ প্রতিহত করে এত কাল টিকেছিল।

কিন্তু তবু গারো সমাজকে আমার বিশৃঙ্খল মনে হয়েছে। তা পুরাতন শৃঙ্খলা অনেকাংশে হারিয়েছে। কিন্তু নূতন, উন্নততর ও নিজস্ব শৃঙ্খলা সেভাবে গড়তে পারে নি। তার মধ্যে লক্ষ্যহীনতাও কাজ করছে। গারোদের অনেকে গারো সমাজের দুর্গতির জন্য মাতৃতন্ত্রকে দায়ী করছেন। কিন্তু সামাজিক বিষয়ে গারো নারীদের সাধারণভাবে উদাসীন মনে হয়েছে। অনেক গারো পুরুষও সামাজিক ক্ষেত্রে গারো নারীদের ভূমিকা চান না। হয়ত ভাবছেন জীবন যুদ্ধে জয়ী হতে হলে পিতৃতান্ত্রিক হতে হবে।

কিন্তু এ প্রসঙ্গে আমার মনে প্রশ্ন জেগেছে পিতৃতন্ত্র হলে কি গারো জাতিসত্তার স্বতন্ত্র অস্তিত্ব থাকবে? গারোরা খ্রীষ্টান হওয়ায় এমনিতেই তাদের বাঙ্গালীকরণ চলছে খ্রীষ্টান বাঙ্গালী ছেলে বা মেয়ে বিয়ের মাধ্যমে। চারপাশের আবেষ্টন বাংলা ভাষার। সুতরাং সবাই ক্রমে বাংলা ভাষায় অভ্যস্ত হচ্ছে। এরপর যখন মাতৃতন্ত্রের সম্পূর্ণ অবসান ঘটবে তখন গারো স্বাতন্ত্র্য এবং পরিচয় থাকবে কি? গারো জনগোষ্ঠী কি পুরোপুরি বাঙ্গালী হবে না? বাঙ্গালী জাতিসত্তা গঠনের ইতিহাসের দিকে একটু মনোযোগ সহকারে দৃষ্টি দিলে বোঝা যাবে যে, বহু বিচিত্র জনগোষ্ঠী বাংলা ভাষাকে গ্রহণ করে বাঙ্গালী নামে খুব নূতন একটা পিতৃতান্ত্রিক জাতিসত্তার বিকাশ ঘটিয়ে চলেছে আজও। বৃহত্তর দিনাজপুর-রংপুরের রাজবংশী বা পূর্বতন কোচরা এর সর্বশেষ দৃষ্টান্ত। সম্ভবত একই কথা খাটে হাজংদের ক্ষেত্রেও কিছু পরিমাণে।

যে সমস্ত গারো নারী বা পুরুষ পিতৃতন্ত্রের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্ব দেখছেন তাদেরকে বাঙ্গালী সমাজের দুর্গত অবস্থাটা বিবেচনা করতে বলব। পিতৃতান্ত্রিক বাঙ্গালী বাংলাদেশের কেমন উন্নতি ঘটিয়ে চলেছে? দ্বিতীয়ত, যারা গারোদের সংখ্যাল্পতার জন্য হতাশ তাদেরকেও ভাবতে বলব সংখ্যার তুলনায় গুণগত মানের দিকটা। বাঙ্গালী সংখ্যায় পৃথিবীতে যে স্থানে আছে উন্নতির বিচারে তার ধারে কাছে আছে কি?

গারো জাতিসত্তা নিয়ে আমার বিশেষ আগ্রহ ও ভাবনার একটা কারণ আছে। তা হল আমি মনে করি লাঙ্গল নির্ভর বৃহদায়তন কৃষি এবং নগর সভ্যতার বিকাশ থেকে এ পর্যন্ত ছয় সাত হাজার বৎসর পিতৃতন্ত্র যে ভয়ঙ্কর বর্বরতা ও ধ্বংসের শক্তি বিকশিত করেছে পরমাণু প্রযুক্তির মাধ্যমে তা এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে। একদিকে প্রযুক্তির প্রচণ্ড বিকাশ নারীর দেহগত অনেক সীমাবদ্ধতা দূর করেছে এবং করছে, ফলে কিছু দৈহিক সুবিধার কারণে উদ্ভূত পুরুষ প্রাধান্যের অনিবার্যতাকে অপ্রাসঙ্গিক করছে, অপর দিকে পুরুষের ধ্বংসপ্রবণ চরিত্র-বৈশিষ্ট্য পরমাণু প্রযুক্তির এই অগ্রগতির কালে পুরুষের হাত থেকে সমাজ ও সভ্যতার একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণের অবসানও অনিবার্য করছে। এমন একটা সমাজ আসতে হবে যেখানে নারী ও পুরুষের মধ্যে ক্ষমতার সমবণ্টন হবে। নতুবা মানব জাতি আত্মঘাতী পরমাণু যুদ্ধে বিলুপ্ত হবে। যে পুরুষ তার মেধা ও দেহশক্তি বলে সভ্যতাকে এই স্তরে এনে দাঁড় করিয়েছে এখন তাকে চূড়ান্ত ধ্বংসের দিকে নেওয়াই তার নিয়তি। কারণ, পুরুষ তার সকল বর্বরতা, নিষ্ঠুরতা, দেহশক্তি ও ধূর্ততা দিয়ে সভ্যতাকে এভাবে দাঁড় করিয়েছে। এই প্রবৃত্তিগুলোকে সংযত করার ক্ষমতা তার জন্য সহজাত নয়। ঐ কাজ মূলত নারীর। সমাজ, রাষ্ট্র ও সংস্কৃতির জগতে নারীর বিশেষ মর্যাদা ও স্বাধিকার না থাকলে পুরুষের এই ধ্বংস প্রবণতা অপ্রতিরোধ্য হয়ে সমাজ ও সভ্যতার ধ্বংস ঘটাবে।

অর্থাৎ আমার মনে হয়েছে মানুষের সমাজ ও সভ্যতা এখন নূতন আর একটি স্তরে উন্নীত হবার অপেক্ষায়। বিগত ছয়, সাত হাজার বৎসরের সভ্যতার যে ভয়ঙ্কর নির্যাতনকারী ও দলনকারী রূপ রয়েছে তা থেকে এখন তার মুক্তির প্রয়োজন। তলোয়ার ও চাবুকের শাসন থেকে মানুষের সভ্যতার মুক্তি চাই। কাজটা সম্পূর্ণ না হলেও অনেকাংশে, হয়ত বা এখন প্রধানত নারীর। উন্নত পৃথিবীতে নারীবাদ নিয়ে যে বিতর্ক উঠছে তার পিছনে এমন একটা আর্তি কাজ করছে। মুক্তি তো শুধু নারী খুঁজছে না, পুরুষও খুঁজছে। আসলে প্রয়োজনটা মানব সমাজের, মানব জাতির।

গারো সমাজ কি পিতৃতন্ত্রের পথ ধরে এখন সমাজ ও সভ্যতার শিখরে আরোহণ করতে চায়? সেটা বোধ হয় আর সম্ভব নয়। কারণ, ঐ দৌড় প্রতিযোগিতায় তা অনেক দেরীতে যোগ দিয়েছে। গারো সমাজ যত উন্নতি করুক এ পথে তার অবস্থান হবে খুবই পিছনে। তবে এ পথে আমি গারো সমাজেরই বিলুপ্তির সম্ভাবনা দেখি। যদি তা হয় তবে আমার মতে তাতে ক্ষতিটা গারো সমাজের যতটা তার চেয়ে অনেক বেশী মানুষের আগামী সমাজ ও সভ্যতার। কেননা, আগামী যে গণতান্ত্রিক পৃথিবী গড়ে উঠতে পারে তার আবির্ভাবে নারীর ভূমিকা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ বলে আমি ধারণা করি। হয়ত প্রচলিত অর্থে তা মাতৃতান্ত্রিক নয়। তবে এক অর্থে তা হবে মাতৃতন্ত্রের এক ধরনের পুনর্গঠন। সেখানে নারী-পুরুষের মধ্যে ক্ষমতার এমন ভারসাম্যপূর্ণ বণ্টন ঘটবে যাতে করে কিছু ক্ষেত্রে নারীর প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হবে বলে আমি ধারণা করি। বর্তমান পিতৃতান্ত্রিক সভ্যতার সঙ্গে তুলনায় আমার এটাকে এক ধরনের মাতৃতান্ত্রিক সভ্যতা বলতে ইচ্ছা করে। জানি না তার রূপ কেমন হবে। তবে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি মানব সমাজ সেদিকে যাচ্ছে। গারো সমাজ লাঙ্গল আবিষ্কারের পর গড়ে ওঠা বর্বর পিতৃতান্ত্রিক সভ্যতা থেকে বহু দূরে সরে গিয়ে সর্ব প্রযত্নে রক্ষা করে চলেছিল মাতৃতন্ত্রকে। সভ্যতার এক ভয়ঙ্কর পর্বের কয়েক সহস্র বৎসরের নির্দয়তা, হিংস্রতা ও কদর্যতার গ্লানি থেকে তা মুক্ত। কৃষি আবিষ্কারের পর তা এক জায়গায় থেমে ছিল। সভ্যতা এখন নূতন করে নারীর আশ্রয় নিয়ে নূতনতর সৃষ্টিশীলতার স্তরে যেতে চাইছে যেখানে মানুষ মানুষের উপর আর ঐভাবে নির্দয় হবে না। সুউন্নত প্রযুক্তির আবিষ্কার ও ক্রমবিকাশ এই নির্দয়তাকে শুধু অপ্রয়োজনীয় নয় অধিকন্তু অসম্ভবও করছে।



উপসংহার

আমি যতটুকু বুঝেছি তাতে মনে হয়েছে গারো সমাজের পুনর্জাগরণের জন্য তার জাতীয় স্বাতন্ত্র্য বোধকে জাগাবার প্রয়োজন আছে। এই স্বাতন্ত্র্যের মর্মে আছে তার ঐতিহ্যিক মাতৃতন্ত্র। তবে, মাতৃতন্ত্রকে পুরাতন রূপে ফিরিয়ে আনা বা রক্ষা করা সম্ভব নয়। তাকে আধুনিক যুগোপযোগী করার কথা ভাবতে হবে। অর্থাৎ মাতৃতন্ত্রেরও পুনর্গঠনের প্রয়োজন আছে। এছাড়া গারো সমাজের পক্ষে উন্নত জাতি হিসাবে উঠে দাঁড়ানো সম্ভব নয় বলে আমার ধারণা। সেটা বাংলাদেশ বা মেঘালয় কোথায়ও নয়।

এদিক থেকে দেখলে আমি জাতীয়তাবাদী। গারোর জন্য আমি গারো জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী। যেমন আমি বাঙ্গালীর জন্য বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী। তবে আমি একই সঙ্গে জাতি সমন্বয়বাদেও বিশ্বাসী। আমি মনে করি আমরা সকল জাতির স্বাতন্ত্র্য ও অধিকার সম্পর্কে শ্রদ্ধান্বিত হয়ে একটি জাতিসংঘ গঠন করতে পারি। জাতিসংঘ তো এখন এক আন্তর্জাতিক বাস্তবতা। এটাকে কি অন্যান্য পর্যায়েও আমরা অনুসরণ করতে পারি না? প্রতিটি ব্যক্তির স্বাতন্ত্র্যকে স্বীকৃতি দিয়ে যদি সমাজ বা জাতি গঠন করা যায় তবে প্রতিটি জাতির স্বাতন্ত্র্যকে স্বীকৃতি দিয়ে কেন জাতিসংঘ বা রাষ্ট্রসংঘ গঠন করা যাবে না, যেমন ইউরোপীয় ইউনিয়ন করেছে?

যাইহোক, গারো সমাজের বিস্ময়কর যে শক্তি আমি তার মাতৃতন্ত্রে দেখেছি, সেদিকে দৃষ্টি দিয়ে আমি গারো জাতির বিপুল সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎকে দেখতে পাই। হয়ত এটা আমার চাওয়া। আমি জানি না মানুষের আগামী নূতন ও উন্নততর সভ্যতা নির্মাণে গারো জাতির কাছ থেকে কোনও দিশা আসবে কি না।

রচনাঃ ১৯৯৯

 


ঘুমন্ত এক জাতির জাগরণের অপেক্ষায়

 

এক

যে জাতির নারীরা ছিল স্বাধীন, কর্তৃত্বকারী এবং ক্ষমতা ও অপরিমেয় মর্যাদার অধিকারী এবং যে জাতির নারীরা এবং সেই সঙ্গে নারী অনুগত এবং নারীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল বলদৃপ্ত পুরুষ যোদ্ধারা ছিল প্রতিবেশী পিতৃতান্ত্রিক বা পুরুষতান্ত্রিক সমাজগুলোর জন্য ত্রাস স্বরূপ সেই এক কালের প্রবল গারো জাতি কি হারিয়ে যাচ্ছে? ব্রিটিশ শাসন কালের পূর্বে সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতাব্দীতেও বর্তমান ভারতের মেঘালয় রাজ্যের গারো পাহাড় ছাড়াও বর্তমান বাংলাদেশের বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলা এবং ভারতের অন্তর্ভুক্ত আসাম রাজ্যের গোয়ালপাড়া, কামরূপ জেলাসহ এক বৃহৎ অঞ্চলে ছিল মাতৃতান্ত্রিক গারো জাতির বসবাস। এই অঞ্চলের মধ্যমণি স্বরূপ ছিল অজেয় গারো বাসভূমি গারো পাহাড়। দীর্ঘ দিন ধরে গারো জনগোষ্ঠী চতুর্দিকের পিতৃতান্ত্রিক সমাজগুলোর চাপে মেঘালয় রাজ্যের গারো পাহাড়কে কেন্দ্র করে একটি অঞ্চলে কেন্দ্রীভূত হয়েছে। এখন ভারতের মেঘালয় রাজ্যে তারা সংখ্যাগুরু জাতিসত্তা হিসাবে নিজেদের অস্তিত্ব কিছুটা নিরাপদে বজায় রাখতে পারলেও বাংলাদেশে তাদের অস্তিত্ব নিদারুণভাবে সঙ্কটাপন্ন। বিশেষত বর্তমান টাঙ্গাইল জেলার মধুপুর এলাকাসহ বৃহত্তর ময়মনসিংহের উত্তরের অনেক এলাকায় এক সময় গারোরা সংখ্যাগুরু হলেও বর্তমানে তারা নিদারুণভাবে সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়েছে।

ব্রিটিশ শাসন পূর্বকালে পিতৃতান্ত্রিক হিন্দু এবং মুসলমান জমিদার এবং রাজশক্তির আক্রমণ ও আগ্রাসন যেমন মাতৃতান্ত্রিক গারো সমাজের শক্তি হ্রাস করেছিল তেমন পিতৃতান্ত্রিক ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ গারো সমাজের শক্তি হ্রাসে নানানভাবে ভূমিকা রেখেছিল। কিন্তু গারোদের উপর ভয়ঙ্করভাবে দুযোর্গ নেমে আসে ১৯৪৭ সালে উগ্র নারী-বিদ্বেষী এবং পিতৃতান্ত্রিক তথা পুরুষবাদী ইসলাম ধর্ম ভিত্তিক পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর। বিদেশী সাম্রাজ্যবাদী এবং পিতৃতান্ত্রিক ব্রিটিশ সরকার মাতৃতন্ত্রী গারো ঐতিহ্য ও স্বার্থ রক্ষার ব্যবস্থা না করে বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার বিস্তীর্ণ এলাকার গারো জনগণকে ধর্ম-সাম্প্রদায়িক এবং উগ্র পুরুষতন্ত্রী পাকিস্তান রাষ্ট্রের নিকট জিম্মি করে দিয়ে গেল। এরপর আসামসহ বিভিন্ন অঞ্চলের মুসলমান বাঙ্গালীরা লাখে লাখে স্রোতের মত ঢুকেছে গারো জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে। তারা গারোদের জমি দখল করেছে, পতিত ভূমিতে বিনা বাধায় আবাস ও আবাদ করেছে এবং ব্যাপক নির্যাতন ও জবরদস্তির মাধ্যমে হিন্দু বাঙ্গালী এবং হাজং জাতিসত্তার মত গারোদেরকেও বিতাড়িত করেছে স্বভূমি থেকে। এইভাবে এ দেশের গারোদেরকে স্বদেশে পরবাসী করা হয়েছে।

 

দুই

বর্তমান বাংলাদেশ রাষ্ট্রের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে পার্বত্য চট্টগ্রামের কয়েকটি ক্ষুদ্র জাতিসত্তার অস্তিত্বও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকে হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়ে। এই জাতিসত্তাগুলি মাতৃতন্ত্রী না হলেও উগ্র পিতৃতন্ত্রী এবং নারী নিগ্রহী নয়। চাক্‌মা, মারমা, ত্রিপুরা ইত্যাদি এগারো ক্ষুদ্র জাতিসত্তা অধ্যুষিত পার্বত্য চট্টগ্রামে পাকিস্তান সরকার এইসব জাতিসত্তার উৎসাদনের জন্য বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রম শুরু করে। ’৫০-’৬০-এর দশকে কাপ্তাই হ্রদ নির্মাণ এমন একটি বৃহৎ কার্যক্রম। এর পাশাপাশি চলে মুসলমান বাঙ্গালী অভিবাসনের ধীর এবং সতর্ক প্রক্রিয়া। ১৯৭১-এ বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর এই অঞ্চলের বাঙ্গালী এবং ইসলামীকরণের উদ্দেশ্যে দাঙ্গা-হাঙ্গামা, লুণ্ঠন ও ধর্ষণের কার্যক্রম জোরালোভাবে শুরু করা হয়।

অবশেষে পার্বত্য চট্টগ্রাম জন-সংহতি সমিতির নেতৃত্বে পার্বত্য চট্টগ্রামের এগারো জাতিসত্তা সমন্বিত জুম্ম জনগণ আত্মরক্ষার্থে সশস্ত্র প্রতিরোধ সংগ্রাম শুরু করে। জুম্ম জনগণ যারা সমগ্র বাংলাদেশের জনসংখ্যার এক শতাংশও নয় তাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের বিভিন্ন সরকার কর্তৃক চালানো হয় সামরিক অভিযানের পাশাপাশি লক্ষ লক্ষ মুসলমান বাঙ্গালী অভিবাসনের মাধ্যমে আদিবাসীদেরকে উৎসাদনের অভিযান। একুশ-বাইশ বছর সুদীর্ঘ প্রতিরোধ যুদ্ধের পর অবশেষে ’৯৭-এর ২ ডিসেম্বর জুম্ম জনগণ প্রথম বিরাট বিজয় অর্জন করে শান্তি চুক্তিতে বাংলাদেশ সরকারকে স্বাক্ষর দানে বাধ্য করতে পারার ফলে।

শান্তি চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশের জনসংখ্যার .৫০%-এর কিছু বেশী জনসংখ্যা হলেও জুম্ম জনগোষ্ঠী নিজেদের স্বতন্ত্র জাতিগত স্বীকৃতি আদায় করে। এ চুক্তিতে জুম্ম জনগণ এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন অর্জন না হলেও এমন কিছু অধিকার অর্জিত হয়েছে যা জুম্ম জনগণ এবং পার্বত্য চট্টগ্রামকে বাংলাদেশের রাষ্ট্র ও সমাজ কাঠামোতে স্বাতন্ত্র্য, বিশেষ মর্যাদা এবং আংশিক স্বায়ত্তশাসন প্রদান করেছে। একদা যে দলের নেতা জুম্মদের স্বতন্ত্র জাতি পরিচয় মুছে ফেলে দম্ভ এবং ঔদ্ধত্য ভরে তাদেরকে বাঙ্গালী হবার হুকুম দিয়েছিলেন সেই দলের সেই নেতারই কন্যার সরকার অবশেষে জুম্ম জনগণের স্বতন্ত্র জাতিসত্তাগত পরিচয়কে মেনে নিতে এবং আইনগত স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়েছে। এর তাৎপর্য যুগান্তকারী। এক ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী চূড়ান্ত বিপর্যয় এবং বিলুপ্তির মুখে রুখে দাঁড়িয়ে শুধু নিজেদের জন্য বিজয় অর্জন করে নি উপরন্তু একই রকম ভাবে বিপন্ন সকল দুর্বল অথবা ক্ষুদ্র, নিগৃহীত এবং ন্যায়বান জাতিসত্তা কিংবা জনগোষ্ঠীর অধিকার আদায়ের সংগ্রামের জন্য এক বিরাট প্রেরণার উৎসে পরিণত হয়েছে।

 

তিন

সামাজিক ব্যবস্থায় গারো সমাজ এখন কতটা মাতৃতান্ত্রিক বা নারীতান্ত্রিক সন্দেহ। কারণ পারিবারিক কিছু রীতি-নীতি এবং সম্পত্তির উত্তরাধিকার প্রথায় গারোদের মধ্যে এখন পর্যন্ত মাতৃতন্ত্র কিছু পরিমাণে টিকে থাকলেও ধর্মীয় এবং সামাজিক ব্যবস্থায় গারোরা এখন সাধারণভাবে পিতৃতান্ত্রিক তথা পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত হয়েছে বললে ভুল হবে না। বাংলাদেশে গারোরা এখন প্রায় সকলে খ্রীষ্ট ধর্মাবলম্বী। খ্রীষ্টধর্ম একটি সেমিটিক পুরুষতান্ত্রিক ধর্ম। এটা ইহুদী ধর্ম এবং বিশেষ করে ইসলাম ধর্মের মত অতটা উগ্র এবং আক্রমণাত্মক না হলেও এটা একটা পুরুষতান্ত্রিক ধর্ম। অন্যদিকে গারো সমাজের পরিবারে মেয়েদের স্বাধীনতা এবং মর্যাদা এখন পর্যন্ত অনেকাংশে থাকলেও সমাজ জীবনে তা কতটা আছে সন্দেহ। কারণ সামাজিক ক্ষেত্রে মেয়েদের নেতৃত্বমূলক ভূমিকা দেখা যায় না। বস্তুত সামাজিক ভূমিকা কিংবা নেতৃত্বের বিচারে অন্যান্য পিতৃতান্ত্রিক সমাজের সঙ্গে মাতৃতান্ত্রিক গারো সমাজের পার্থক্য নির্ণয় করাটা কঠিন। পরিবারে এবং ক্ষুদ্র পরিসরে যে মেয়েদেরকে স্বচ্ছন্দ, সাবলীল ও সতেজ দেখা যায় তাদেরকেই সমাজে এবং বৃহৎ পরিসরে যথেষ্ট রকম কুণ্ঠিত, দ্বিধান্বিত ও নিস্তেজ দেখা যায়। মাতৃতন্ত্রের তথা নারীর বিশ্ব পরিসরে যে পরাজয় ঘটে চলেছে তা থেকে যে গারো সমাজও দূরে নেই এই অবস্থা তার প্রমাণ।

অবশ্য গারো সমাজ মাতৃতন্ত্রকে এখনো পুরোপুরি পরিত্যাগ করে নি। কিন্তু সুদীর্ঘকাল ধরে চারদিকের পিতৃতন্ত্র বা পুরুষতন্ত্রের প্রবল আক্রমণ ও আগ্রাসনের ফলে এত কাল মাতৃতন্ত্র বা নারীতন্ত্রের যে সঙ্কোচন, পশ্চাদপসরণ ও ক্ষয় ঘটে চলেছিল তা এখন প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে। হয়তবা মাতৃতন্ত্রের শেষ চিহ্নটুকু মুছে যাওয়াই এখন বাকী আছে এবং সেই সঙ্গে গারো সত্তারও।

গারো সমাজের অবক্ষয়ের দিকে তাকিয়ে আমার মনে প্রশ্ন জাগে তার অস্তিত্ব রক্ষার উপায় কী? সেটা কি মাতৃতন্ত্রের চূড়ান্ত অবসান এবং পিতৃতন্ত্রের চূড়ান্ত প্রতিষ্ঠা? কিন্তু আমার মনে পুনরায় প্রশ্ন জাগে মাতৃতন্ত্রের সম্পূর্ণ অবসান ঘটলে কি গারো জাতিসত্তার অস্তিত্ব থাকবে? তাছাড়া নারীর ভিতর মনুষ্যত্বের যে মহিমা আমি দেখতে পাই তার কারণে আমি গারো জাতিসত্তার মাতৃতন্ত্রের ভিতরেও মনুষ্যত্বের এক মহিমা দেখতে পাই। সুতরাং আমার নিকট গারো জাতিসত্তার অস্তিত্ব ও মর্যাদার প্রশ্ন শুধু একটি জাতিসত্তার অস্তিত্ব ও মর্যাদা রক্ষা এবং প্রতিষ্ঠার প্রশ্ন হয়ে দেখা দেয় না, উপরন্তু এটা মাতৃতন্ত্র তথা নারীতন্ত্রকে কোন না কোন রূপে রক্ষা এবং প্রতিষ্ঠা করার প্রশ্ন হয়েও দেখা দেয়।

অবশ্য আমি এ কথা বলি না যে, আদিম স্তরে পড়ে থেকে গারো জাতির আপন মহিমা এবং শ্রেষ্ঠত্ব রক্ষা করা সম্ভব। এমনকি এভাবে তার অস্তিত্বই রক্ষা করা সম্ভব নয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে গারো সমাজ তার আদিম মাতৃতন্ত্রের স্তরেও পড়ে নেই। গারো মাতৃতন্ত্র অনেকাংশে ভেঙ্গে পড়েছে। অথচ তা পুরোপুরি ধ্বংসও হয় নি। এমন অবস্থাই কিন্তু মাতৃতন্ত্র বা নারীতন্ত্রের পুনর্সংগঠনের উপযুক্ত অবস্থা। প্রথাগত মাতৃতন্ত্র একটি পশ্চাৎপদ এবং এ কালের জন্য অনুপযোগী ব্যবস্থা। সুতরাং তাকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টাটা অর্থহীন এবং ক্ষতিকরও। কিন্তু মাতৃতন্ত্রের একটা পুনর্সংগঠনের প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি। কারণ আমি মনে করি আধুনিক নারীবাদ বা নারীতন্ত্র অপরিহার্য।

আমার এ সংক্রান্ত ধারণা আমি বিভিন্ন জায়গায় ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছি বিভিন্ন সময়ে। সুতরাং কিছু পুনরুক্তি হবে। তবু পাঠকের প্রয়োজনে আমার ধারণাটা খুব সংক্ষেপে বলার চেষ্টা করছি।

আমার ধারণা পুরুষ মূলত ধ্বংস, গতি এবং বর্বরতার শক্তি, আর নারী মূলত সৃষ্টি, স্থিতি, লালন এবং করুণার শক্তি। মানুষের উৎস যে মূলত নারী শুধু তাই নয়, উপরন্তু মানুষের মানবিকতারও উৎস মূলত নারী। মূলত নারীর প্রয়োজনে মানবিকতার উদ্ভব ও বিকাশ। বলবান পুরুষ শক্তির নিকট প্রেম, করুণা, বিবেচনা এসবের প্রয়োজন কতটুকু? যে নারী মানব শিশুকে আপন গর্ভে শুধু ধারণ করেন না, তাকে জন্মের পর থেকে লালন করেন, তার জন্য তিনি যে এক নিরাপদ, নিশ্চিত ও মানবিক পৃথিবীর সন্ধান করবেন তা-ই তো একান্ত স্বাভাবিক।

নারী এবং পুরুষ কে শ্রেষ্ট এ বিতর্কে না গিয়ে বলা যায় উভয়ের প্রয়োজন এবং অপরিহার্যতা আছে। সমস্যাটা দেখা দেয় তখন যখন একের মূল্য ও ভূমিকাকে তুচ্ছ করে অপরকে নিরংকুশ করা হয়। তাই উভয়ের সম্পর্ক এবং ক্ষমতার মধ্যে ভারসাম্য বা সুষমতার প্রয়োজন আছে। পিতৃতান্ত্রিক বা পুরুষতান্ত্রিক সভ্যতার সংকটটা এই জায়গায় যে, তা নারীর কিছু দৈহিক সীমাবদ্ধতার সুযোগ নিয়ে তাকে পুরুষের বর্বরতা, ভোগ, সম্ভোগ ও শোষণের শিকার করেছে। বিশেষত পুরুষের বীরত্ব ও ক্ষমতা যখন নিরংকুশভাবে নারীর নিয়ন্ত্রণমুক্ত হয় তখন তা বর্বর হয়ে দেখা দেয়। নারীকে অস্বীকার ক’রে, লাঞ্ছিত ক’রে পুরুষের যে পৌরুষ তা পৈশাচিক পাশবিকতা মাত্র। এই বর্বরতা ও পৈশাচিকতা থেকে মুক্তি মনুষ্যত্বের দাবী।

মাতৃতান্ত্রিক গারো সমাজের আদিমতায় ফেরা আর সম্ভব নয়। কিন্তু গারো সমাজের মাতৃতন্ত্রের যে মহত্ত্ব, যে মানবিকতা ছিল এবং আজও আছে সেখানে ফেরা ছাড়া নূতন ও উন্নততর মানবিকতা প্রতিষ্ঠার আর কোন পথ আমাদের সামনে আছে বলে আমি মনে করি না। এ যেন পুরুষের সমস্ত শৌর্য-বীর্য, জ্ঞান-গরিমা এবং শক্তি নিয়ে বিনয়ের সঙ্গে, নম্রতার সঙ্গে নারীর কাছে ফেরা। কত হাজার বৎসর পূর্বে একদা নারী কৃষি আবিষ্কারের মাধ্যমে সভ্যতার পথে মানব সমাজকে চলতে শিখিয়েছিল। তারপর এক সময় লাঙ্গল আবিষ্কারের পর সভ্যতার ক্রমবর্ধমান শক্তির বলে বলীয়ান হয়ে পুরুষ নারীকে অস্বীকার ক’রে, দলন ক’রে চলেছে। অন্য মানুষকে দলন ক’রে, প্রতরণা ক’রে, বন্দী ক’রে উদ্ধত, ধূর্ত এবং হৃদয়হীন পুরুষ যে নির্বিবেক সভ্যতা নির্মাণ করেছে সেই নির্বিবেক সভ্যতার শিক্ষাটা সে সর্বাগ্রে এবং সর্বাপেক্ষা বেশী প্রয়োগ করেছে নারীকে দলিত, দমিত ও বঞ্চিত করে।

অনেক হয়েছে! এ থেকে পুরুষকে, মানুষের সমাজ ও সভ্যতাকে ফিরতে হবে। পুরুষের আর উপায়ও নেই এছাড়া। কারণ পরমাণু এবং উন্নত প্রযুক্তির এ সভ্যতার স্তরে ধ্বংসপ্রবণ পুরুষের কর্তৃত্ব আত্মধ্বংসের নামান্তর হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ক্লান্তæ, বিপর্যস্তপুরুষ শক্তি আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য মানবিক এক ব্যবস্থার কাছে যে ব্যবস্থায় পুরুষের পাশে নারী এসে ক্ষমতা, মর্যাদা এবং গুরুত্ব নিয়ে সমাজ ও সভ্যতার হাল ধরবে। ধ্বংসের শক্তিকে সৃষ্টির শক্তির নিয়ন্ত্রণাধীন করতে গিয়ে পুরুষকে নারীর নিয়ন্ত্রণ যথেষ্ট পরিমাণে মেনে নিতে হবে। সমাজ ও সভ্যতার নেতৃত্ব ও কৃর্তত্বে নারীর অংশগ্রহণ এক নূতন বাস্তবতা হয়ে দেখা দিবে। যেমনটাই হোক সমাজ ও সভ্যতার উপর থেকে পুরুষের স্বেচ্ছাচারী, একচ্ছত্র এবং নিরংকুশ আধিপত্য ও ক্ষমতার অবসান হচ্ছে নূতন কালের আসন্ন অনিবার্যতা। নারীবাদ হচ্ছে আগামী সভ্যতার এক মৌল এবং অনিবার্য বৈশিষ্ট্য যেখানে নারী তার স্বমহিমায় পুরুষের পাশাপাশি সমাজ ও সভ্যতার অন্যতম নিয়ামক হয়ে দেখা দিবে।

 

চার

গারো জাতির যে সার্বিক বিপর্যয় বাংলাদেশে ঘটে চলেছে তা থেকে মুক্তির পথ কোনটা সে সম্পর্কে গারোদেরকে ভাবতে হবে। তাদের অনেকে সেটা ভাবছেন। অনেক অধিকার সচেতন গারো নারী এবং পুরুষ প্রশ্ন তুলছেন, আলোচনা করছেন, সোচ্চার এবং সংগঠিত হচ্ছেন, সভা-মিছিল করছেন, প্রতিবাদ করছেন, আন্দোলন করছেন। নির্বিবেক এক পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ও সভ্যতার আক্রমণ, নির্যাতন, আগ্রাসন ও আধিপত্য বিস্তার যখন গারো সমাজের অস্তিত্ব বিলুপ্ত করতে চলেছে তখন তা ফিরে এবং রুখে দাঁড়াতে চাইছে বলে মনে হচ্ছে। পুরুষতান্ত্রিক ধর্ম, সভ্যতা ও সংস্কৃতির যা কিছু এত কাল নির্বিচারে গ্রহণ করা হয়েছিল সেগুলি সবই এখন বিচারের কাঠগড়ায় জেরার সম্মুখীন হচ্ছে একে একে। আমি মনে করি অন্যায়, অবিচার এবং বঞ্চনার বিরুদ্ধে দীর্ঘ কাল নিপীড়িত, বিলীয়মান এবং ঘুমন্ত এক জাতিসত্তার জাগরণের এ সবই লক্ষণ। ঘুমন্ত এক বল-বীর্যবান জাতি, কৃষি আবিষ্কারের মাধ্যমে মানুষকে সভ্যতার পথে চলতে শেখানো আদি নারীদের, মাতাদের কালজয়ী ঐতিহ্যের প্রতি অনুগত ও অনুরক্ত এক পরাক্রান্ত অথচ ঘুমন্ত জাতি কি সত্যি জাগছে? যদি জাগে তবে তা কোন পথে যাবে? তার জাগরণ এই দেশ এবং পৃথিবীর চেহারায় বা সভ্যতার চরিত্রে কি সত্যি কোনও পরিবর্তন এনে দিবে? এনে দিলে তার রূপ কি হবে? আর এই পরিবর্তন আনতে গিয়ে গারো জাতিসত্তা কি নৃতাত্ত্বিক ‘জাতি’ থেকে রাজনৈতিক ‘জাতিতে’ পরিবর্তিত হবে? সময় এসব প্রশ্নের উত্তর দিবে।

রচনাঃ ২৮ নভেম্বর ১৯৯৯

 

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
Archive
 
সাম্প্রতিক পোষ্টসমূহ