কৃষক আন্দোলনঃ অভিজ্ঞতার সারসংকলন -- শামসুজ্জোহা মানিক
লিখেছেনঃ শামসুজ্জোহা মানিক, আপডেটঃ July 11, 2010, 3:18 AM, Hits: 14457
ভূমিকা
এ দেশ মূলত কৃষকের দেশ। ব্রিটিশ শাসনকালে এমন কি পাকিস্তান কালেও কৃষক ও কৃষির যে গুরুত্ব এ দেশের অর্থনীতি ও সমাজ জীবনে ছিল তা আজ আর সেভাবে নেই নগরায়নের ব্যাপ্তি এবং কৃষির পরিবর্তে অকৃষি বিভিন্ন খাতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের দ্রুততর প্রসারের কারণে। তা সত্ত্বেও কৃষির উপর অর্থনীতির নির্ভরতা এখনও যথেষ্ট এবং কৃষির উপর নির্ভরশীল গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যাধিক্য এখনও বাংলাদেশের সমাজের একটি বৈশিষ্ট্য হয়ে রয়েছে। এই প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের কৃষক আন্দোলন সম্পর্কিত আলোচনা বিশেষ গুরুত্বের দাবীদার। বিশেষত এ দেশের আধুনিকতা ও গণতন্ত্রের প্রশ্নের সঙ্গে কৃষি ও কৃষক প্রশ্ন ওতপ্রোতভাবে জড়িত হওয়ায় কৃষি ও কৃষক প্রশ্নের তাৎপর্য বোঝার গুরুত্ব অপরিমেয়। আর এই তাৎপর্য তখন আরও যথাযথভাবে বোঝা সম্ভব যখন এ দেশের কৃষক আন্দোলনগুলির সমস্যা ও বৈশিষ্ট্য বোঝা
সম্ভব হবে।
এই আলোচনায় আমি কমিউনিস্টদের মূলত অর্থনৈতিক শ্রেণী দৃষ্টি থেকে গড়ে তোলা কৃষক আন্দোলনের অভিজ্ঞতা ও সমস্যার উপর বেশী জোর দিব এবং সেখান থেকে আমার আলোচনাকে ভিন্ন দিকে এগিয়ে নিব। কারণ কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে সমাজ বিপ্লবের লক্ষ্যে এ দেশে ব্রিটিশ শাসনকালের শেষ দিক থেকে কৃষক আন্দোলন গড়ে তোলার যে উদ্যোগ নেওয়া হয় তার ব্যাপ্তি ও দীর্ঘ ঐতিহ্য আমাদের সামনে একটা মূল্যবান অভিজ্ঞতা ভাণ্ডার তৈরী করেছে। দীর্ঘকাল ধরে এ দেশে কমিউনিস্ট রাজনীতির নিয়ন্ত্রণে কিংবা প্রভাবে গড়ে ওঠা কৃষক আন্দোলনকেই মূলত কৃষক আন্দোলন হিসাবে দেখা বা বোঝা হয়েছে। এবং কৃষকের অর্থনৈতিক শ্রেণীগত দাবীর সঙ্গে এই আন্দোলনগুলি অনেক বেশী দৃঢ়ভাবে সংযুক্ত হওয়ায় এই আন্দোলনগুলির সমস্যা বোঝাটা এ দেশের কৃষক মানস ও প্রবণতা বোঝার ক্ষেত্রেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আর তখন এ দেশে কমিউনিস্ট আন্দোলনের দীর্ঘ ব্যর্থতার অনেক কারণ যেমন উদ্ঘাটিত হবে তেমন সমাজের প্রকৃত সমস্যা ও তার আধুনিকায়ন ও গণতন্ত্রায়নের সমস্যা বোঝাও অনেকখানি সহজতর হবে।
শুরুতেই বলে রাখা ভাল যে, এই আলোচনার মূল ভিত্তি আমার নিজ অভিজ্ঞতা। ষাটের দশকের শেষার্ধ থেকে আমি কৃষক অথবা কৃষক আন্দোলনের সঙ্গে দীর্ঘ সময় বিভিন্নভাবে জড়িত থেকেছি। প্রথম পর্যায়ে ’৬৬ থেকে ’৭২ পর্যন্ত গ্রামে থেকে কৃষকদের মধ্যে সংগঠন ও আন্দোলন গড়ে তোলার কাজ করি। সেই সময় আমি কমিউনিস্ট বা মার্কসবাদী রাজনীতির অনুশীলন করি। সুতরাং সেই রাজনীতির ধারায় বিশেষ করে ’৭১-এর পূর্ব পর্যন্ত আমার সেই সময়কার কৃষকের শ্রেণী সংগ্রাম গড়ে তোলার প্রয়াস চলে। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর আমি আমার অভিজ্ঞতার মূল্যায়ন থেকে কমিউনিস্ট রাজনীতি ত্যাগ করি এবং ভিন্ন ধারায় কৃষক আন্দোলন গড়ে তোলার প্রয়োজন অনুভব করি। বিভিন্ন অর্থনৈতিক ও সংস্কারমূলক উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে কৃষকদের সংগঠিত করার গুরুত্ব অনুভব করি। আমার নূতন ধারণা থেকে কৃষকদের সংগঠিত করার জন্য ১৯৭৯ থেকে নূতন করে উদ্যোগ নিই। বিভিন্ন এলাকার কাজগুলিকে সংগঠিত করার প্রয়োজনে শেষ পর্যন্ত জাতীয় পর্যায়ে একটি এনজিও গঠন করি। কিন্তু ১৯৮৬-তে সেটি ত্যাগ করে আমি দিনাজপুর জেলার খানসামা থানার গ্রামে চলে যাই। ’৮৬ থেকে ’৮৯ পর্যন্ত সেখানে গ্রামাঞ্চলের জনগণের মধ্যে বাইরের কোনও সাহায্য ছাড়া একক এবং স্থানীয় প্রচেষ্টায় গণশিক্ষা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্মাণ, সঞ্চয় ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের উন্নয়নমূলক কাজ করি। একটা পর্যায়ে সেখানে স্থানীয় কৃষক ও জনগণকে নিয়ে একটি স্থানীয় ইসুø ভিত্তিক আন্দোলনও করি। বলে রাখা ভাল যে, কোনও রাজনৈতিক দলের সঙ্গেও আমার তখন সম্পর্ক ছিল না। পুনরায় ’৯৩-’৯৪ -এ প্রায় বৎসর কাল একই এলাকায় থেকে কাজ এবং আন্দোলন করি।
এইভাবে এক দীর্ঘ সময় ধরে কৃষকদের ভিতরে থেকে এবং তাদের সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের কাজ এবং আন্দোলন করে আমার যে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা হয়েছে তা আমার এই আলোচনার মূল ভিত্তি। এবং সেই সঙ্গে বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকার কৃষক সংগঠন ও আন্দোলনের বিভিন্নমুখী সমস্যা ও প্রবণতাগুলোকেও আমি দীর্ঘকাল ধরে দেখার এবং বোঝার চেষ্টা করেছি, যেমন বোঝার চেষ্টা করেছি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ও সমাজের অভিজ্ঞতা। সুতরাং আমার আলোচনা বিশুদ্ধ তাত্ত্বিক কিংবা পুস্তক নির্ভর হবে না। বরং এক অর্থে এটা হবে এ দেশের কৃষক এবং কৃষক আন্দোলন সম্পর্কে আমার দীর্ঘ পর্যবেক্ষণ ও কাজের অভিজ্ঞতার মূল্যায়ন।
আর তাই এই আলোচনায় বার বার আমার নিজের অভিজ্ঞতা উঠে আসবে। আমার ধারণা এতে করে আমার আলোচনা অধিকতর জীবন্ত হবে। এবং এই অভিজ্ঞতা ভিত্তিক আলোচনা থেকে আমি এ দেশে কৃষক আন্দোলন সম্পর্কে প্রচলিত বিভিন্ন ধারণা বা বক্তব্য যেমন খণ্ডন করতে চেষ্টা করব তেমন আমার ভিন্ন ধারণাগুলিকেও একে একে উপস্থিত করতে চেষ্টা করব।
কৃষক আন্দোলনে নেতৃত্বের প্রশ্ন
এই প্রশ্ন দিয়ে আমি মূল আলোচনার অবতারণা করছি কৃষক সমাজ ও তার আন্দোলনের মূল এবং অগ্রণী শক্তিটাকে ধরার জন্য। আর তখন স্পষ্ট হবে কৃষক আন্দোলনের মূল অভিমুখ কোন দিকে।
১৯৬৬-তে যখন আমি তখনকার বৃহত্তর দিনাজপুরের গ্রামাঞ্চলে কৃষক আন্দোলন গড়তে যাই তখন আমার সামনে ছিল বিশেষ করে লেনিন এবং মাও-এর কৃষক আন্দোলন সংক্রান্ত বক্তব্য। লেনিন এবং মাও কৃষক আন্দোলনে সর্বহারা কিংবা ভূমিহীন ও দরিদ্র কৃষকের নেতৃত্ব গড়ে তোলার উপর যে গুরুত্ব দিয়েছিলেন সেটা ছিল আমার মাথায়। কিন্তু কৃষক সংগঠন ও আন্দোলন করতে গিয়ে আমি ভিন্ন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হই। আমি দেখতে পাই যে, কিছু সংখ্যক শিক্ষিত তরুণদের অবলম্বন করে কৃষকদের যে সংগঠন গড়ে ওঠে তাতে যারা অধিক সংখ্যায় এগিয়ে আসে তারা মধ্য কৃষক। তৎকালীন বৃহত্তর রংপুর জেলায় আমি ’৬৯ থেকে যে কৃষক আন্দোলন গড়ে তুলি (’৭১ -এর যুদ্ধের কিছু কাল পূর্ব পর্যন্ত এই আন্দোলন চলে) সেখানেও একই ঘটনা দেখতে পাই। দিনাজপুর-রংপুর উভয় জেলার সবখানেই কৃষক আন্দোলনে এই বৈশিষ্ট্য
দেখতে পাই।
যখন আন্দোলন ব্যাপ্তি পায় তখন ধীরে ধীরে কৃষকদের দরিদ্রতম অংশগুলি সহ ভূমিহীন কৃষকরাও এগিয়ে আসে দেখতাম। তবে দরিদ্র-ভূমিহীন কৃষকদের আমি যে শুধু অত্যন্ত দুর্বল ও পরনির্ভরশীল শ্রেণী রূপে দেখতে পাই তা-ই নয়, উপরন্তু তাদের মধ্যে লুম্পেন বৈশিষ্ট্যসমূহও অনেক বেশী প্রবল দেখতে পাই। এই শ্রেণী কিভাবে আন্দোলনে নেতৃত্ব দিবে আমি বুঝতে পারতাম না। তবে এদের দ্বারা নেতৃত্ব গঠনে চেষ্টার ত্রুটি করিনি। কিন্তু বাস্তবে দেখা যেত কমিটিতে যতই তাদের নাম দেওয়া যাক বা তাদেরকে সামনে আনার যতই চেষ্টা করা যাক ওটা সাধারণত কাগুজে ব্যাপার হয়ে থাকত। মিছিল, সমাবেশগুলোর সাফল্য নির্ভর করত প্রধানত মধ্য কৃষকদের অংশগ্রহণের উপর। এর সহজ কারণটাও আমার বোধগম্য হত। দিন মজুরির উপর যাদের জীবিকা নির্ভর করে, পরের দিনের আহার নির্ভর করে এক বা দুই দিন কাজে না গিয়ে মিছিল-সমাবেশ করা অনেক ক্ষেত্রে তাদের সপরিবারে অনাহারে থাকার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ফলে তারা মাঝে মাঝে অংশ নিলেও লাগাতারভাবে অংশ নিতে পারত না।
অন্যদিকে, দিন মজুরদের আর একটা গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা ছিল কাজের জন্য গ্রামীণ ধনী বা জোতদার-মহাজনদের উপর নির্ভরশীলতা। সুতরাং তৎকালীন আমাদের জোতদার বিরোধী প্রচার আন্দোলন বা জমির দাবীর ্লোগান দরিদ্র-ভূমিহীনদের তেমন একটা অনুপ্রাণিত
করত না।
গ্রামীণ ভূমিহীনদের আর একটি সমস্যা ছিল ভূমি না থাকার কিংবা অতি দারিদ্র্যের কারণে। তা হল তাদের সামাজিক মর্যাদা এবং সেই সঙ্গে আত্মমর্যাদাবোধেরও নিদারুণ অভাব। এটা তাদের শক্তি হয়ে ওঠার পথে এক বিরাট বাধা ছিল। তাছাড়া কোনও কোনও এলাকায় দেখা গেছে তাদের অনেকের স্ত্রীরা স্বামীর জ্ঞাতসারে বা সম্মতিতে অর্থের বিনিময়ে গ্রামের অবস্থাপন্ন পুরুষদের নিকট দেহ বিক্রি করত। এদের সংখ্যা কোনও কোনও এলাকায় কিন্তু কম ছিল না। এই অবস্থার সামাজিক এবং মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব বা ফলটাও সহজে অনুমেয়।
যেখানে মধ্য কৃষকদের বিভিন্ন স্তরের অংশগ্রহণের কারণে আন্দোলন তীব্রতা লাভ করত সেখানে অনেক দরিদ্র-ভূমিহীন কৃষক এগিয়ে আসত এবং তাদের মধ্য থেকে কর্মী বা নেতৃত্বের শক্তিও উঠে আসত। কিন্তু এর জন্য আন্দোলনকে তাদের নেতৃত্বে গড়ে তোলা বা পরিচালিত বলাটা সঠিক নয়। বরং আমার অভিজ্ঞতা থেকে আমি দেখতে পেতাম কৃষক আন্দোলন গড়ে ওঠে মূলত শিক্ষিত কর্মীদের নেতৃত্বে (যাদের অনেকে জোতদার, ধনী কৃষক কিংবা গ্রামীণ এলিটের সন্তান) এবং এই আন্দোলনের মেরুদণ্ড মধ্য কৃষক। এই আন্দোলনে কিছু সংখ্যক ভাল কর্মী উঠে আসত দরিদ্র কৃষকদের মধ্য থেকে। তবে একেবারে ভূমিহীন তারা খুব কম ক্ষেত্রেই হত। কিছু জমি তাদের থাকত।
তারপরেও তাদেরকে দারিদ্র্যের কারণে কম বা বেশী সময় দিন মজুরি করতে হত। তবে নিরন্তর যোগাযোগ ও তত্ত্বাবধানে থাকলেই তারা সাধারণত কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারত। নেতৃত্ব তো ভিন্ন জিনিস। সুতরাং তাদের নেতৃত্বে আন্দোলন গড়ে তোলা সম্ভব এটা আমার মনে হত না। বরং কৃষক আন্দোলনের বিকাশে মধ্য কৃষকদের অংশগ্রহণ ও ভূমিকার কথা বিবেচনা করে আমি মধ্য কৃষককে কৃষক আন্দোলনে নেতৃত্বকারী বা প্রধান শক্তি হিসাবে বিবেচনা করতাম।
আমার এই মূল্যায়ন সে কালে বাম মহলে সমালোচিত হত। ১৯৬৮-তে সিরাজ সিকদার তাঁদের এক দলিলে মধ্য কৃষক সংক্রান্ত আমার বক্তব্যকে আক্রমণ করেন যেটা আমি পড়েছিলাম। এ ছাড়া আলাউদ্দিন-মতিন প্রমুখ কমিউনিস্ট ও কৃষক নেতাও আমার বক্তব্য বা ধারণাকে ভ্রান্ত মনে করতেন। তাঁদের বক্তব্য ছিল তাঁরা দরিদ্র-ভূমিহীন কৃষকদের নেতৃত্বে কৃষক আন্দোলন গড়ছেন। যশোরের তৎকালীন কৃষক নেতা এবং কমিউনিস্ট নেতা আমজাদ হোসেনের সঙ্গেও আমার এ প্রশ্নে মতপার্থক্য হত। আমি বুঝতে পারতাম না তাঁদের অভিজ্ঞতা বা বক্তব্যের সঙ্গে আমার অভিজ্ঞতা মিলছে না কেন।
সম্ভবত তাঁরা আমাকে ব্যর্থ কর্মী হিসাবে বিবেচনা করতেন কিংবা আমাকে ‘পেটি বুর্জোয়া’ চিহ্নিত করে আমার ‘ব্যর্থতা’র কারণ বুঝতেন। তবে নেতাদের কাছে তৎকালে আমার সাধারণ পরিচয় ছিল ‘পেটি বুর্জোয়া’ জাতীয়তাবাদী।
যাইহোক, বাঙ্গালী জাতির স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আমার দৃঢ় মনোভাবের বা সঙ্কল্পের কারণে সে কালে কমিউনিস্ট নেতৃত্ব কর্তৃক আমাকে এভাবে চিহ্নিত করা বোধগম্য হতে পারে। কিন্তু কৃষক আন্দোলনের শক্তি বিন্যাস সংক্রান্ত আমার ধারণাকে তাঁরা কতটুকু বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে অস্বীকার করতেন সে প্রশ্ন আমি করতে পারি। আসলে উপরের তলার নেতার কিছু সুবিধা থাকে। বাস্তব সমস্যা তাঁদের অনেক সময় না বুঝলেও চলে। তাঁরা শুধু ‘কর্মীদের ব্যর্থতা’র উপর দায়ভার চাপিয়ে কেতাবী তত্ত্ব নিয়ে মশগুল থাকতে পারেন। অবশ্য আলাউদ্দিন আহমদ মাঠ পর্যায়ের কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। কিন্তু আমার জানা মতে তিনি যে উল্লেখযোগ্য কৃষক আন্দোলন করেছিলেন সেটা ছিল ঈশ্বরদীর নিকট রূপপুর পরমাণু গবেষণা কেন্দ্র নির্মাণের জন্য আইয়ুব সরকার কর্তৃক ভূমি অধিগ্রহণের ফলে উচ্ছেদকৃত ভূমিমালিকদের পুনর্বাসন এবং উপযুক্ত ক্ষতিপূরণের দাবীতে। এটা নিশ্চয় সামন্তবাদ উচ্ছেদের দাবীতে ভূমিহীনদের আন্দোলন ছিল না।
এটা স্পষ্ট যে, নেতারা বাস করতেন তত্ত্বের কল্পলোকে। আসলে গ্রামে গ্রামে কৃষক সমিতির কমিটি গঠনের সময় শ্রেণী বিচার করে দরিদ্র ও ভূমিহীন কৃষকদেরকে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের মত গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে বসিয়ে দিয়ে, এমনকি দরিদ্র-ভূমিহীন কৃষকদের মধ্য থেকে কমিটিতে বেশীর ভাগ সদস্য নিয়ে ভাবা হত দরিদ্র-ভূমিহীন কৃষক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। অন্তত আমার ধারণা কৃষক নেতারা এমন সমস্ত কাগুজে কমিটি গঠন করে দরিদ্র-ভূমিহীন কৃষক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার গল্প ফাঁদতেন। কিন্তু আমার অভিজ্ঞতা হতে দেখেছি যে, বাস্তবে এসব কমিটি দিয়ে সাধারণভাবে কোন আন্দোলনই হয় না।
আমি নিজেও বোঝার জন্য আদিতমারী এলাকায় এমন ধরনের কয়েকটি কমিটি গঠন করে দেখেছি কী ফল হত। বাস্তবে দেখতাম মধ্য কৃষকদের অংশগ্রহণ এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ছাত্র-যুবকদের নেতৃত্বমূলক ভূমিকাই কৃষক আন্দোলনের প্রধান নিয়ামক হত। ফলে এমন সব কমিটি গঠনের পর থেকে নিষ্ত্র্নিয় এইসব কমিটিকে বাধ্য হয়ে বাতিল করে পরবর্তীতে আন্দোলনে এবং সংগঠনের কাজে সক্রিয় লোকদের নিয়ে কমিটি গঠন করতে হত। এবং কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে আমি আমার মতামত চাপাতাম না। ফলে সভায় উপস্থিত কৃষকদের ইচ্ছা অনুযায়ী কমিটি নির্বাচিত হত। আমার আর একটা গুরুত্বপূর্ণ অভিজ্ঞতা হল আন্দোলনের পূর্বে যাদের নিয়ে কমিটি গঠন করা যায় তাদের অধিকাংশই আন্দোলনের প্রক্রিয়ায় ঝরে যায় এবং আন্দোলনের সংগঠন প্রকৃতপক্ষে গড়ে ওঠে আন্দোলনের ভিতর থেকেই। অর্থাৎ আন্দোলনের পূর্বে যাদের নিয়েই কমিটি গঠন করা যাক
আন্দোলনের পর্যায়ে অনেক নূতন লোক সামনে চলে আসে। যাইহোক, যেহেতু আমার কাছে মাঠ পর্যায়ে কৃষক আন্দোলন গড়ার করণীয়টা নেতাদের কেতাবী কথাবার্তার তুলনায় অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ ছিল সেহেতু আমি বাস্তব অভিজ্ঞতাকে অগ্রাধিকার দিয়ে দরিদ্র-ভূমিহীন কৃষকদের গুরুত্ব দিলেও মধ্য কৃষকদের অবজ্ঞা করতাম না এবং নেতৃত্ব গঠনের সময় কর্মীদের শ্রেণী বিচারের তুলনায় তাদের ভূমিকা বিচারের উপরই অধিকতর গুরুত্ব দিতাম। যে কথা ইতিপূর্বে বলেছি স্বাভাবিকভাবে আমার এলাকায় কৃষক আন্দোলনে আমি যাদেরকে নেতৃত্বমূলক ভূমিকায় পেয়েছিলাম তারা সাধারণভাবে ছিল কিছু সংখ্যক জোতদার অথবা ধনী কৃষক-মধ্য কৃষক পরিবারের শিক্ষিত যুবক আর বাকীরা অধিকাংশ ছিল নিম্ন-মধ্য ও মধ্য কৃষক। তবে আমি ভাল মানের কিছু দরিদ্র ও ভূমিহীন কৃষক কর্মী পেয়েছিলাম।
অবশ্য নেতাদের দরিদ্র-ভূমিহীন কৃষক নেতৃত্ব কায়েমের বাগাড়ম্বর আমার কাছে তখন স্পষ্ট হয়েছিল যখন তাঁরা ’৬৯-’৭০ সালে কৃষক সমিতির স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী হিসাবে ‘লাল টুপি বাহিনী’ গঠন করে ভাবলেন কৃষকের সশস্ত্র বাহিনী বা গণবাহিনী গঠনের প্রাথমিক কাজ সম্পন্ন হয়েছে। বাস্তবে আন্দোলনের সঙ্গে অধিকাংশ ক্ষেত্রে সম্পর্কহীন এসব ‘লাল টুপি দল’ যে কাগুজে বাহিনী মাত্র তা আমার কাছে স্পষ্ট হলেও নেতারা দেখতাম এগুলো নিয়ে বিরাট আশা পোষণ করতেন। বলা বাহুল্য তাঁরা শ্রেণী বিচার করে প্রধানত দরিদ্র-ভূমিহীন কৃষকদের তালিকাভুক্ত করে বাস্তব আন্দোলনের সঙ্গে সম্পর্কêহীন এসব কাগুজে বাহিনী গঠন করতেন। সবচেয়ে বড় কথা পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসন ভিত্তিক কোন জাতীয় কর্মসূচী না দেওয়ায় জাতীয় আন্দোলনের নিয়ন্ত্রণ ততদিনে আওয়ামী লীগের হাতে সম্পূর্ণরূপে চলে গিয়েছিল। এমতাবস্থায় ব্যাপক জনগণের সমর্থন ও অংশগ্রহণহীন এবং জাতীয় আন্দোলন এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে স্থানীয় আন্দোলনেরও সঙ্গে সম্পর্কহীন এইসব স্বেচ্ছাসেবক দলকে আমার কাছে কাগুজে বাহিনী ছাড়া আর কিছু মনে হত না। বাস্তবে সেটা প্রমাণিত হয়েছে।
যাইহোক, আমার অভিজ্ঞতা থেকে আমি প্রধানত মধ্য কৃষককে গ্রামীণ আন্দোলনের প্রধান শক্তি হিসাবে দেখতে পেয়েছি। বহুবিধ কারণে কৃষকদের মধ্যে তারাই সবচেয়ে বেশী উদ্যমী, প্রগতিশীল এবং তেজস্বী। তবে তাদের এই দিকের বিকাশ তখনই ঘটে যখন তারা ভূমিহীন কৃষকদের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হতে পারে। তবে কৃষক আন্দোলনের নেতৃত্ব বিচ্ছিন্ন বা ক্ষুদ্র পরিসরে যে-ই দিক সামগ্রিকভাবে এটা আসে একটি সংগঠিত রাজনৈতিক সংগঠন কিংবা শিক্ষিত রাজনৈতিক কর্মীদের নিকট থেকে।
রাশিয়া, চীনের বাস্তব অভিজ্ঞতা যখন আমার নেই তখন সে প্রসঙ্গে আলোচনা করব না। তবে লেনিন বা মাও খেত মজুর বা ভূমিহীন কৃষকদের নেতৃত্ব সম্পর্কে যা-ই বলুন আমি আমাদের সমাজে তার প্রকৃত প্রতিফলন দেখতে পাইনি। সবচেয়ে গতিশীল ও অগ্রণী সামাজিক শক্তি হিসাবে তাঁরা শহরের শ্রমিক এবং গ্রামের খেত মজুরদের যেভাবে চিহ্নিত করেছিলেন আমি তার পরিবর্তে এ দেশে সমাজের আধুনিকায়ন ও বিপ্লবের প্রয়োজনে সবচেয়ে গতিশীল ও অগ্রণী সামাজিক শক্তি হিসাবে ছাত্র-যুব সমাজ এবং (প্রান্তিক সহ) মধ্য কৃষক শ্রেণীকে চিহ্নিত করতাম যা সেকালে কমিউনিস্ট নেতাদের দ্বারা নিন্দিত ও সমালোচিত হত।
যাইহোক, আমার ধারণা কৃষক আন্দোলনের প্রধান শক্তি এবং নেতৃত্ব সম্পর্কে কমিউনিস্ট পার্টির এমন বাস্তবতা বিমুখ ধারণার কারণ মতান্ধতা বা মতবদ্ধতা। এই বদ্ধতা এসেছে ব্যক্তিগত মালিকানা এবং ব্যক্তি পুঁজির বিকাশ বিরোধী দৃষ্টিভঙ্গী থেকে। মধ্য কৃষকের আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে ভূমির সম্পূর্ণ বা চূড়ান্ত জাতীয়করণ সঙ্গতিপূর্ণ নয় বলে কমিউনিস্ট নেতৃত্ব এ দেশের প্রেক্ষিতে মধ্য কৃষকের বাস্তব ভূমিকা স্বীকার করতে চাননি বা আজও চান না। তাঁদের এই দৃষ্টিভঙ্গীর কারণে কিন্তু এ দেশে ষাটের দশকে কৃষক আন্দোলনে যে, গতিশীলতা দেওয়া যেত সেটা দেওয়া যায়নি। তাঁদের আন্দোলনগুলো থেকেছে খুব ক্ষুদ্র গণ্ডীতে বা এলাকায় সীমাবদ্ধ। ’৬৯-এর গণ-অভুøত্থান যখন কৃষক অভুøত্থানে
পরিণত হয় তখন প্রকৃতপক্ষে গোপন কমিউনিস্ট পার্টির পরিচালনায় এবং প্রকাশ্যে ন্যাপের ছত্রছায়ায় গড়ে ওঠা কৃষক সমিতির সংগঠন বহির্ভূত এলাকাগুলিতে তার ব্যাপক বিস্তার ও প্রচণ্ড বিস্ফোরণ ঘটে। আর এক অর্থে নেতৃত্ববিহীন ও স্বতঃস্ফূর্ত এই কৃষক অভুøত্থানের মধ্য দিয়ে এ দেশের প্রকৃত কৃষক আন্দোলন ও আকাঙ্ক্ষার মর্মবস্তু বেরিয়ে আসে যার প্রসঙ্গে আমি পরবর্তী অধ্যায়ে যাব।
কৃষক আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য ও প্রবণতা
এবার আমি খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা প্রসঙ্গে যাব। এ ক্ষেত্রেও নিজ অভিজ্ঞতা দিয়ে আলোচনা শুরু করব। আমি ’৬৬-তে যখন কৃষক আন্দোলন করতে গ্রামে যাই তখন তৎকালীন পূর্ব বাংলার কৃষি অর্থনীতির চরিত্র নিয়ে বেশ বিতর্ক চলছিল। আবদুল মতিন, আলাউদ্দিন আহমদ প্রমুখ পাবনার কৃষক নেতৃবৃন্দ পূর্ব পাকিস্তানের কৃষির পুঁজিবাদী বা ধনতান্ত্রিক বৈশিষ্ট্যের উপর অধিকতর গুরুত্ব দিয়ে একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেন। তাঁরা কমিউনিস্ট মহলে এই বক্তব্যের কারণে তীব্রভাবে সমালোচিত হন। তাঁদের সমালোচনায় তৎকালীন কমিউনিস্ট নেতা আবদুল হক কৃষিতে সামন্তবাদের প্রাধান্যের উপর জোর দিয়ে একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেন যাতে পুঁজিবাদের বিকাশমান অস্তিত্বকে অত্যন্ত তুচ্ছ করে দেখা হয়।
আমি গ্রামে গিয়ে সামন্তবাদের অর্থনৈতিক ভিত্তিকে প্রবলরূপে দেখতে পেলাম না। জমিদারী প্রথা তো ’৫০- এই বাতিল হয়েছিল। অন্যদিকে সামন্তবাদের অবশেষ হিসাবে যে জোতদারদের কথা বলা হত তারাও যে, প্রবল প্রতাপে বিরাজ করছে তা মনে হল না। তবে সংস্কৃতির ক্ষেত্রে সামন্তবাদের শক্তিশালী অবস্থান আছে বলে মনে হত। অন্যদিকে, পুঁজিবাদের কিছু বিস্তার বা বিকাশ যে ঘটেছিল সেটাও দেখতে পেতাম। বিদুøতায়ন, বিদুøৎ চালিত সেচ ব্যবস্থা, পাওয়ার টিলার ব্যবহার, বাজার অর্থনীতির কিছুটা বিকাশ অন্তত তখনকার পশ্চাৎপদ দিনাজপুর জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে চোখে পড়ত।
তবে আমি কৃষিতে পুঁজিবাদের অস্তিত্ব মানলেও কৃষি অর্থনীতি পুঁজিবাদী হয়েছে তা যেমন মনে করতাম না তেমন এটাকে সামন্তবাদীও মনে করতাম না। পুঁজিবাদের কিছু বিকাশ হলেও সামন্তবাদের অবশেষসমূহ রয়েছে এই রকম অবস্থা বোঝাবার জন্য আধা সামন্তবাদ হিসাবে যে ব্যাখ্যাটা দেওয়া হয় আমি কাজ চালাবার জন্য সেটাকে গ্রহণ করে নিয়েছিলাম এবং অবস্থাটাকে সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করার জন্য আরও অভিজ্ঞতা ও ধারণার প্রয়োজন আছে বলে মনে করতাম। ফলে পাবনা নেতৃবৃন্দের বক্তব্য গ্রহণ না করলেও আমি আমার বিবেচনায় রেখেছিলাম। কিন্তু তাঁরা প্রবল চাপের মুখে এক সময় তাঁদের অবস্থান থেকে সরে যান। আসলে যুগটা স্বাধীন চিন্তার উপযোগী ছিল না। একদিকে মস্কোর বক্তব্য অপরদিকে পিকিং-এর বক্তব্য এ দেশের কমিউনিস্ট রাজনীতি ও তত্ত্বের প্রায় সবটা নির্ধারণ করত।
যাইহোক, আমার কাছে এসব তাত্ত্বিক বিতর্কের চেয়েও বেশী গুরুত্বপূর্ণ ছিল কৃষকদের উৎপাদনশীলতা এবং বিপুল সংখ্যাধিক্যের কারণে এ দেশের স্বাধীনতা ও বিপ্লবে তাদের ভূমিকার প্রশ্ন। আমি মূলত কৃষক অভুøত্থান ও বিপ্লবের মাধ্যমে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা যুদ্ধ গড়ে তোলার লক্ষ্য নিয়ে গ্রামে গিয়েছিলাম। সমাজতন্ত্রের লক্ষ্য এবং মার্কসবাদের বিবেচনা ও প্রেরণা নিশ্চয় ছিল। কিন্তু আমার কাছে এ দেশের বাস্তবতা বোঝা এবং তার ভিত্তিতে কর্মনীতি নির্ধারণের প্রশ্ন ছিল অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ। কারণ আমার আশু লক্ষ্য ছিল পূর্ব বাংলার বুকে বাঙ্গালী জাতির জনগণের গণতান্ত্রিক (জাতীয় জন-গণতান্ত্রিক) রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা।
আমি যখন প্রথম কৃষক আন্দোলন করতে যাই তখন স্বাভাবিকভাবে আইয়ুব সরকার বিরোধী প্রচারণার পাশাপাশি জোতদার-মহাজন বিরোধী বক্তব্যও প্রচার করতাম। এইভাবে প্রচারের মাধ্যমে ধীরে ধীরে গ্রামাঞ্চলে কৃষক সমিতি গড়ে তুলতে থাকি।
কিন্তু ’৬৬ থেকে ’৬৮ পর্যন্ত সময়টাতে সভা-সমাবেশের বাইরে গ্রামাঞ্চলে কৃষকদের কোনও তাৎপর্যপূর্ণ আন্দোলন গড়ে তুলতে পারিনি। আন্দোলন যেটা গড়ে উঠছিল সেটা শহর এবং গঞ্জের কলেজ ছাত্রদের মধ্যে। সেটা ছিল ছাত্রদের মধ্যে আইয়ুব সরকার বিরোধী আন্দোলনের বিস্তারের কাল। আমার কাজের এলাকায় গ্রামাঞ্চলের কৃষকরা আন্দোলনে প্রথম অংশ নেয় ’৬৯-এর গণ-অভুøত্থান কালে। আর তখন দেখি যে, আমার কেতাবী বিদ্যা থেকে প্রাপ্ত ধারণা অনুযায়ী কৃষক আন্দোলন জোতদার-মহাজন বা ভূস্বামী শ্রেণীর বিরুদ্ধে না হয়ে হচ্ছে প্রধানত গরুচোর, ডাকাত, অত্যাচারী, দুর্নীতিপরায়ণ এবং আইয়ুব সমর্থক বিডি চেয়ারম্যান-মেম্বার এবং বিভিন্ন সামাজিক দুবৃêত্ত ও নিপীড়কের বিরুদ্ধে। এই সঙ্গে ছিল পুলিশ এবং সীমান্ত অঞ্চলে ইপিআর-এর নির্যাতনের বিরুদ্ধে আন্দোলন। সারা দেশের চিত্রটাই ছিল মোটামুটি এমন। ’৬৯-এর কৃষক অভুøত্থান সাধারণভাবে স্থানীয় দুর্বৃত্ত ও নিপীড়ক এবং অত্যাচারী রাষ্ট্রযন্ত্রের বিরুদ্ধে চালিত হয়েছিল।
আমি ’৬৯ এর গণ-অভুøত্থানে পূর্ণভাবে আত্মনিয়োগ করি এবং জনগণের অংশগ্রহণ ও আচরণ থেকে শিক্ষা নেবার চেষ্টা করি। ’৬৯-এর গণ-অভুøত্থানের ভিতর আমরা কৃষক সমিতির পঞ্চগড় আঞ্চলিক কমিটির পক্ষ থেকে একটা প্রচারপত্র প্রকাশ ও প্রচার করি যাতে আইয়ুব সরকার এবং গরুচোর, ডাকাত সহ সমাজ বিরোধী ও অত্যাচারী এবং জোতদার-মহাজনদের বিরুদ্ধে কৃষক আন্দোলন গড়ে তোলার এবং সংগ্রাম কমিটি গঠনের আহ্বান জানাই। শ্রেণী সংগ্রাম সম্পর্কে প্রথাগত মার্কসবাদী ধারণাকেও রক্ষা করতে চেষ্টা করি জোতদার-মহাজন বিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলার প্রয়োজনের কথা বলে।
কিন্তু নেতৃত্ব যে আমার এই ধরনের বক্তব্য অপছন্দ করতেন সেটা বুঝতে আমার খুব বেশী সময় লাগেনি। আসলে শ্রেণী সংগ্রামের প্রথাগত ধারণার বাইরে তাঁরা ভিন্ন কোনও কিছুকে গ্রহণ করতে চাইতেন না। কিন্তু আমি যেটা বুঝতাম না সেটা হল জনগণের বাস্তব আন্দোলন থেকে আমরা কেন শিক্ষা নিব না এবং এ থেকে সমাজের বাস্তব চাহিদাটুকু কেন বুঝব না?
’৬৯-এর গণ-অভুøত্থান থেকে যে কৃষক অভুøত্থান জেগে ওঠে তার মূল এলাকাগুলির দিকে যদি নজর দেওয়া যায় তবে এ দেশে কৃষক তথা গণ-আন্দোলনে কমিউনিস্ট রাজনীতির ভূমিকার তাৎপর্য বোঝা অতটা কঠিন নাও হতে পারে। এটা সবার জানা যে, এই আন্দোলন ও অভুøত্থানের সূচনা মওলানা ভাসানীর হাতে এবং কিছুদিন পর্যন্ত এর প্রধান চালিকা শক্তি ছিল বামপন্থী ছাত্ররা। কিন্তু, এটা নিশ্চয় খুব তাৎপর্যপূর্ণ যে, যেসব এলাকায় কমিউনিস্ট পার্টি বা পার্টিগুলোর শক্তিশালী নেটওয়ার্ক ছিল সে সব এলাকায় গ্রামাঞ্চলে গণ-আন্দোলন তথা কৃষক আন্দোলন তেমন কোনও ব্যাপ্তি বা মাত্রা নেয়নি। সামান্য কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া এগুলি ছিল কৃষক অভুøত্থান বহির্ভূত এলাকা। কৃষক অভুøত্থান সবচেয়ে প্রচণ্ড হয় তৎকালীন বৃহত্তর ময়মনসিংহ, ঢাকা জেলায়। কিন্তু এইসব এলাকায় কমিউনিস্ট পার্টি ছিল না বা থাকলেও তার ভিত্তি ছিল অত্যন্ত দুর্বল। অবশ্য আমার মূল কাজের এলাকা বর্তমান পঞ্চগড় জেলায় কৃষক আন্দোলন অভুøত্থানের দিকে মোড় নেয় যা ইয়াহিয়ার সামরিক শাসনের পর দমিত হয়।
কিন্তু এটা নিশ্চয় লক্ষণীয় যে, তৎকালীন পাবনা, কুষ্টিয়া ও যশোর অঞ্চলে সামান্য ব্যতিক্রম ছাড়া গ্রামাঞ্চলে তেমন কোনও উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেনি। আর এই অঞ্চলগুলিতে ছিল কমিউনিস্ট পার্টির শক্তিশালী নেটওয়ার্ক এবং কৃষক ভিত্তি।
এটাই স্বাভাবিক। কারণ কৃষকের শ্রেণী সংগ্রাম হবে সামন্ত শ্রেণীর বিরুদ্ধে। গরু-চোর, ডাকাত, সমাজ-বিরোধী এবং নিপীড়ক অথবা রাষ্ট্রযন্ত্রের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্য কৃষকের আন্দোলনকে কি কমিউনিস্টরা প্রকৃত কৃষক আন্দোলন বলবে? এতে কৃষকের ভূমির প্রশ্ন কিংবা সামন্তবাদ বিরোধী সংগ্রামের চেতনা কোথায়? বরং অনেক ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে যে, গরু-চোর, ডাকাত, দুবৃêত্ত, চেয়ারম্যান-মেম্বার কিংবা পুলিশ ও রাষ্ট্রযন্ত্রের বিরুদ্ধে জোতদার, ব্যবসায়ী, এবং দরিদ্র-ভূমিহীন সহ সকল শ্রেণীর কৃষক ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে। হাঁ, অনেক ক্ষেত্রে ধনী কৃষক বা জোতদারও কৃষকের রুদ্ররোষের শিকার হয়েছে। কিন্তু সেটা তাদের অর্থনৈতিক শ্রেণী পরিচয়ের কারণে নয়, বরং তাদের সমাজ-বিরোধী, উৎপাদন-বিরোধী ও তীব্র নিপীড়ক আচরণের কারণে। এদের অনেকে ছিল ডাকাত কিংবা চোর-ডাকাতের পৃষ্ঠপোষক বা রক্ষক কিংবা ছিল গ্রামীণ দুর্বৃত্ত ও নিপীড়ক।
আমার বিবেচনায় ’৬৯-এর গণ-অভুøত্থানের মধ্য দিয়ে এ দেশের কৃষক সর্ব প্রথম তার প্রগতিশীল ও বিপ্লবী ভূমিকা এমন ব্যাপক আয়তনে ও মাত্রায় এত দৃঢ় ও তীব্রভাবে ব্যক্ত করেছে। এ ছিল কৃষকের মহান অভুøত্থান, নেতৃত্বের অভাবের কারণে যার চরিত্র ছিল একান্তই স্বতঃস্ফূর্ত। হাঁ, এরও একটা নেতৃত্ব ছিল বৈকি, তবে সেটা কোনও রাজনৈতিক দল বা কমিউনিস্ট পার্টি ছিল না, ছিল সাধারণ ছাত্র সমাজ।
কিন্তু আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি, এ দেশের কমিউনিস্ট পার্টির ব্যাপক সংখ্যক সদস্য যেমন ’৬৯-এর গণ-অভুøত্থানে যথাযথ অংশ নেয়নি তেমন তার যথাযথ মূল্যায়নেও আগ্রহী হয়নি। কারণ তাদের ধারণা বা তত্ত্ব অনুযায়ী এটা শ্রেণী অভুøত্থান ছিল না। এই অভুøত্থানে শ্রমিকরা তাদের শ্রেণীগত বিভিন্ন অর্থনৈতিক দাবী নিয়ে অংশগ্রহণ করলেও কৃষকদের অংশগ্রহণের চরিত্র হয়ে পড়েছিল অনেক বেশী রাজনৈতিক। শহরে ছাত্র ও মধ্যবিত্তের আন্দোলন এবং গ্রামে কৃষকের আন্দোলনের তীব্র ও সহিংস রাজনৈতিক চরিত্র আইয়ুব সরকারের পতন ত্বরান্বিত করে বলে আমার ধারণা।
কমিউনিস্ট দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে ’৪৬-এর তেভাগাও কিন্তু উন্নত বা অগ্রগামী কৃষক আন্দোলন ছিল না। কারণ এই আন্দোলন কৃষকের ভূমির উপর অধিকারের দাবীতে হয়নি, হয়েছিল বর্গা আবাদের ফসলের ভাগ বৃদ্ধির দাবীতে। বরং মুসলিম লীগের জমিদারী উচ্ছেদের দাবী ছিল তুলনায় অনেক বেশী অগ্রগামী এবং এটা ছিল সেই সময় কৃষকের দাবী। উপরন্তু তেভাগা আন্দোলন সেই মুহূর্তে ব্রিটিশ-বিরোধী জাতীয় আন্দোলনকে বিভক্ত করেছিল কিনা সেই প্রশ্নও করা যায়। এ দেশের কৃষক আন্দোলনে এক গৌরবময় ঐতিহ্য নির্মাণে তার ভূমিকা স্মরণ করেই এই প্রশ্ন করা যায়। তবে কৃষকদের শ্রেণীগত, গণতান্ত্রিক এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনা বৃদ্ধিতে তেভাগা আন্দোলনের ঐতিহাসিক ভূমিকাকে খাটো করে দেখার কোনও অবকাশ নেই।
কিন্তু আমার বিচারে তেভাগার তুলনায় প্রায় সম্পূর্ণ অসংগঠিত ও নেতৃত্বহীন হলেও ’৬৯-এ গ্রামাঞ্চলে কৃষক গণ-অভুøত্থান ছিল অনেক ব্যাপক বিস্তৃত, জনগণের তথা কৃষকের অংশগ্রহণে অনেক বেশী সমৃদ্ধ, অনেক বেশী সংঘাতময় ও সহিংস এবং অনেক বেশী রাজনৈতিক চরিত্র বিশিষ্ট কৃষক আন্দোলন। আসলে ’৬৯-এর গণ-অভুøত্থান হয়েছিল বলে ’৭১-এর জাতীয় মুক্তি যুদ্ধ সম্ভব হয়েছিল। এটা ছিল ’৭১-এর জাতীয় যুদ্ধের প্রথম মহড়া।
এই কারণে হয়ত সনাতন বা ঐতিহ্যিক বাম কমিউনিস্ট নেতৃত্ব ’৬৯-এ সংঘটিত কৃষক অভুøত্থানের প্রতি নিরাসক্ত ছিলেন। তাঁরা তো তেভাগার অর্থনীতিবাদী কৃষক আন্দোলনের ঐতিহ্যের ধারক, যে অর্থনীতিবাদ তাদেরকে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের সংগ্রামের পরিবর্তে অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধা আদায়ের সংগ্রামের আবর্তে তলিয়ে দিয়ে সেখানেই তাদের সর্বোচ্চ পরিমাণ মনোযোগ, শ্রম ও শক্তি নিয়োজিত করে। তেভাগার ঐতিহ্য তাঁদের যেখানে নেবার সেখানেই কিন্তু তাঁদের নিয়েছে। অর্থনৈতিক শ্রেণী সংগ্রামের উপর অধিকতর জোর দিতে গিয়ে তাঁরা জাতীয় আন্দোলনকে বিভক্ত ও দুর্বল করার কাজ করেছেন। সেটা ’৪০-এর দশকের তেভাগার সময় করেছেন, ষাটের দশকেও করেছেন। যখন ’৬৯-এর গণ-অভুøত্থানের উত্তাপ সমগ্র সমাজে ছড়িয়ে গেল তখন তাঁরা তাকে শুদ্ধ শ্রেণী সংগ্রামে খাতবাহিত করতে চাইলেন। ’৬৯-এ তাঁরা প্রায় বসে থাকলেন। যখন ’৭১ ঘনিয়ে এল তখন তাঁরা সশস্ত্র জাতীয় সংগ্রামকে অগ্রাহ্য করে সশস্ত্র শ্রেণী সংগ্রাম গড়তে গিয়ে গোপন সশস্ত্র পন্থার আশ্রয় নিলেন। প্রকাশ্য অর্থনৈতিক শ্রেণী সংগ্রামের মাধ্যমে তাঁদের কাঙ্ক্ষিত শ্রেণী অভুøত্থান ও শ্রেণীযুদ্ধ সম্ভব ছিল না বলে তাঁদেরকে গণ-সংগঠন ও গণ-আন্দোলন বর্জন করেই সে পথে যেতে হল। এভাবে বস্তুত একটা দীর্ঘ বিরতি দিয়ে তেভাগার ঐতিহ্য জেগে উঠল। এবং এটা নিশ্চয় তাৎপর্যপূর্ণ যে, চারু মজুমদারের পথ অনুসরণ করে যেসব অঞ্চলে কৃষক আন্দোলন সশস্ত্র পন্থার নামে সন্ত্রাসবাদের পথে হারিয়ে গেল সে অঞ্চলগুলির অধিকাংশই ছিল তেভাগা আন্দোলনের প্রভাব বলয়ের ভিতরে। এভাবে এ দেশে কমিউনিস্টদের শ্রেণী সংগ্রাম যেখানে জাতির গণ-অভুøত্থান কিংবা জাতীয় যুদ্ধে পরিণত হয় না সেখানে ’৬২-তে ছাত্র আন্দোলন থেকে জেগে ওঠা গণ-আন্দোলন এবং তার ধারাবাহিকতায় ’৬৯-এর গণ-অভুøত্থান ’৭১-এ জাতির জাতীয় মুক্তি যুদ্ধে পরিণত হয় যা প্রকৃতপক্ষে উপমহাদেশের প্রথম সাফল্য চিহ্নিত জাতীয় বিপ্লব। এই জাতীয় বিপ্লবে কমিউনিস্টদের এক উল্লেখযোগ্য অংশ গৌরবময় ভূমিকা পালন করলেও সনাতন নেতৃত্ব এবং কমিউনিস্টদের এক বৃহৎ অংশের ভূমিকা কারও অজানা নয়। জাতি যখন স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ শুরু করল তখন তাঁরা শ্রেণী শত্রু খতম এবং জোতদারদের ভূমি দখল শুরু করলেন যুদ্ধের ফলে সৃষ্ট শূন্যতার সুযোগ নিয়ে।
অবশ্য আমি এ দেশে কমিউনিস্টদের ভূমিকার গৌরবময় দিকটিকে অস্বীকার করছি না। তাঁরা ছিলেন সবচেয়ে ত্যাগী, আদর্শবান এবং সর্বাপেক্ষা সংগঠিত রাজনৈতিক শক্তি। কৃষক ও জনগণের মধ্যে তাঁদের সংগ্রামগুলো সমাজে যে গতিশীলতা সৃষ্টি করেছিল ’৬৯-এর গণ-অভুøত্থান কিংবা ’৭১-এর জাতীয় যুদ্ধ শুরুর পিছনে তার ভূমিকা কম ছিল না। কিন্তু জাতীয়তাবাদী এবং গণতান্ত্রিক প্রশ্নের তুলনায় অর্থনৈতিক শ্রেণী প্রশ্নের উপর অতিরিক্ত গুরুত্ব দেবার কারণে জাতীয় আন্দোলনের মূল স্রোতের সঙ্গে থেকে তাকে নিয়ন্ত্রণ ও খাতবাহিত করার পরিবর্তে তা থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করেছিলেন। এর ফলে কখনও তাঁরা নিজেদেরকে নিষ্ত্র্নিয় অবস্থায় নিক্ষেপ করেছিলেন। যখন তাঁরা জোর করে নিজেদের পথে অগ্রগতি ঘটিয়ে তাঁদের কল্পিত বিপ্লব ঘটাতে চেয়েছেন তখন তাঁরা সন্ত্রাসবাদের ভ্রান্ত পথে চলে গেছেন। আমি তাঁদের এই ভুলের উৎসটিকে চিহ্নিত করতে চাচ্ছি যেটা হল তাঁদের মতাদর্শিক অন্ধত্ব বা দাসত্ব যা তাঁদেরকে নিজ দেশ ও বাস্তবতার পরিবর্তে ভিন্ন দেশের বাস্তবতা উদ্ভূত প্রয়োগের অভিজ্ঞতা ও তত্ত্বের অন্ধ অনুশীলনে আবদ্ধ করে রেখেছিল। ফলে তাঁরা অভিজ্ঞতা থেকে শিখে পথ পরিবর্তন করেননি। আসলে কাজ করতে গেলে কিছু না কিছু ভুল হয়। কোনও ভুল হয় না তার যে কিছু করে না। সুতরাং ভুল করাটা দোষের নয়; দোষের হচ্ছে ভুল থেকে শিক্ষা না নেওয়া।
যাইহোক, ’৬৯-এর কৃষক অভুøত্থান সম্পর্কে আমার মূল্যায়ন হল এটা ছিল অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এবং সেই সঙ্গে অর্থনীতির ফলাফল বিচারে সমাজের উৎপাদনশীলতা-বিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে কৃষকের গণ-অভুøত্থান। সুতরাং অর্থনীতির ফলাফল বিচারে এটাকে কৃষকের পুঁজি গঠনের সহায়ক আন্দোলন হিসাবেও চিহ্নিত করা যায়। সেই জন্য গ্রামীণ নিপীড়কদের সঙ্গে গরু-চোর, ডাকাত জাতীয় পুঁজি গঠনের শত্রুরা এই আন্দোলনের আঘাতের লক্ষ্যবস্তু হয়েছিল। একই সঙ্গে এর মধ্যে যে গণতান্ত্রিক মর্মবস্তু ছিল তা তাকে গ্রামীণ নিপীড়কদের পাশাপাশি নিপীড়ক ও স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্রযন্ত্রের বিরুদ্ধে নিয়ে গিয়েছিল। সুতরাং এই বিজাতীয় রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বাঙ্গালীর যে স্বায়ত্তশাসন ও জাতীয়তাবাদী আন্দোলন গড়ে উঠেছিল সেটার সঙ্গে এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে কৃষকের আবেগ ও তেজ সংযুক্ত হয়েছিল এবং এর ফলে লাভবান হয়েছিল আওয়ামী লীগের ৬ দফা আন্দোলন এবং সেই সঙ্গে বামপন্থী ছাত্র-তরুণদের গড়ে তোলা স্বাধীনতা আন্দোলনও। বামপন্থী ছাত্রদের প্রতিনিধিত্বকারী প্রকাশ্য রাজনৈতিক শক্তি ন্যাপের দিক থেকে বলিষ্ঠ জাতীয় কর্মসূচী না থাকায় সমগ্র জাতীয় আন্দোলনের নিয়ন্ত্রণ ৬ দফা কর্মসূচী প্রদানকারী আওয়ামী লীগের হাতে চলে যায়।
ষাটের দশকে সামন্তবাদের অবশেষ উচ্ছেদের কর্মসূচী নিয়ে অর্থাৎ জোতদারদের হাত থেকে জমি নিয়ে কৃষকদের মধ্যে বণ্টনের উদ্দেশ্যে আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য কমিউনিস্ট কর্মীরা ব্যাপক প্রয়াস চালায়। তৎকালীন দিনাজপুর জেলায় আমার অভিজ্ঞতার কথা বলেছি। ১৯৬৯-এর ২৫ মার্চ ইয়াহিয়ার সামরিক শাসন কায়েমের পর রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের কারণে আমার মূল কাজের এলাকায় কৃষক আন্দোলনকে আর এগিয়ে নেওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। ফলে তখন আমি কৃষক আন্দোলন গড়ার উদ্দেশ্যে তৎকালীন রংপুর জেলার আদিতমারী এলাকায় কাজ শুরু করি। বর্তমানে এটি লালমণিরহাট জেলার একটি থানা। এখানে ১৯৬০ সালে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেবার পর কয়েক মাস থেকে একটি ক্লাব প্রতিষ্ঠা করি। আমি চলে আসার পর এটি পাটগ্রাম থেকে লালমণিরহাট পর্যন্ত কয়েক থানা ব্যাপী সমগ্র অঞ্চলের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের প্রধান কেন্দ্রে পরিণত হয়। এর মধ্য দিয়ে কিছু সংখ্যক তরুণ রাজনৈতিক কর্মী তৈরী হয়। আমি তাদের নিয়ে সেখানে কৃষক আন্দোলন গড়ি। কিন্তু সেখানেও ভূমির দাবীতে কৃষক আন্দোলনকে রূপ দিতে পারিনি। কৃষক বরং পশ্চিম পাকিস্তানী শোষণ এবং স্থানীয় পর্যায়ে অত্যাচারী ও সমাজ-বিরোধীদের বিরুদ্ধে বক্তব্যকে বেশী গুরুত্ব দিত। প্রথমত, আমি দেখতে পেতাম ভূমি সংস্কারের প্রশ্নে কৃষক জোতদারদের প্রতি যে তেমন ঘৃণা অনুভব করত তা নয়। প্রচারের মাধ্যমে ঘৃণা জাগানো গেলেও সেটা ব্যাপক আয়তন ও তীব্রতা নিত না। দ্বিতীয়ত,কৃষকরা জোতদারদের হাতে যে খুব বেশী জমি আছে তা মনে করত না। ফলে মনে করত ভূমি সংস্কার হলেও তাদের সমস্যার সমাধান হবে না।
বর্গাচাষীরাও তেভাগা জাতীয় আন্দোলনের প্রতি সাধারণভাবে উৎসাহিত হত না। জমির স্বল্পতার কারণে তারা বর্গা চাষে জমি পাওয়াকেই বরং ভাগ্যের ব্যাপার মনে করত। তবে মহাজনদের চড়া সুদের বিরুদ্ধে আন্দোলন কৃষকদের মধ্যে মোটামুটি সাড়া জাগিয়েছিল। অবশ্য মহাজনী শোষণ-বিরোধী আন্দোলনের সাফল্যের পথে একটা সমস্যা ছিল যে, মহাজনরা ঋণ দেওয়া বন্ধ করলে কৃষকরা অভাবের সময় ঋণের বিকল্প উৎসের অভাবে বিপন্ন হয়ে পড়ত। তবে আদিতমারীতে কৃষক আন্দোলনের আর্থ-সামাজিক কিছু ফল ফলেছিল। কৃষকদের সংগঠিত শক্তির উদ্ভবের ফলে তাদের মর্যাদা যেমন বেড়েছিল তেমন আত্মবিশ্বাসও বেড়েছিল। ফলে আন্দোলনের কেন্দ্রীয় এলাকায় দরিদ্র-ভূমিহীন সহ কৃষকদের উপর নির্যাতন ও শোষণের তীব্রতা হ্রাস পায়। এবং জোতদার-মহাজনদের কাছ থেকে তারা কিছু সুবিধা আদায়ে সমর্থ হয়।
এই আন্দোলনে দেখেছি কৃষকরা ভূমি সংস্কারের তাড়না থেকে কৃষক সংগঠন ও আন্দোলনে যতটা আগ্রহী হত তার চেয়ে অনেক বেশী আগ্রহী হত সামাজিক ন্যায় বিচার, ইউনিয়ন পরিষদ থেকে সুযোগ-সুবিধা লাভ এবং সামাজিক শক্তি হিসাবে ভূমিকা পালনের তাগিদ থেকে। এর মধ্যে অর্থনৈতিক সুবিধা লাভের প্রয়োজনও কাজ করত। তবে সেটা জোতদারী প্রথা উচ্ছেদের ব্যাপক গণ আকাক্ষা জন্ম দিতে ব্যর্থ হয়েছিল। সুতরাং সেখানে আমি যে সব আন্দোলন করি সেগুলো সামাজিক অত্যাচার-নিপীড়ন ও জুয়া জাতীয় সমাজ-বিরোধী কার্যকলাপ বিরোধী এবং কিছু সীমিত অর্থনৈতিক দাবীর আন্দোলনে সীমিত ছিল। এর সঙ্গে ছিল পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা এবং কৃষক-শ্রমিক রাজ কায়েমের প্রচার আন্দোলন।
আমি যখন ঐ এলাকায় যাই তখন হিন্দু সম্প্রদায়ের করুণ অবস্থা দেখতে পেয়েছিলাম। বদ মাতব্বর এবং দুবৃêত্তদের চাপে হিন্দু গ্রামগুলো উচ্ছেদ হয়ে যাচ্ছিল। হিন্দুদের উপর অত্যাচার ছিল কখনও ভয়ানক। এই অবস্থায় আমরা সেখানে এই অত্যাচারের বিরুদ্ধে এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সপক্ষে যে আন্দোলন গড়ি তার ফল হয় সুদূর প্রসারী। হিন্দু কৃষকরা ব্যাপক সংখ্যায় আমাদের সংগঠন ও আন্দোলনে যোগ দিতে থাকে। এমনও হয়েছে যে, হিন্দু কৃষকরা দলে দলে লাঠি, ছোরা, বল্লম নিয়ে আমাদের জঙ্গী মিছিলে যোগ দিয়েছে। হিন্দুদের দেশত্যাগ এই সময় খুব কমে যায় এবং তাদের উপর অত্যাচারের মাত্রা অঞ্চল ব্যাপী হ্রাস পায়। দুর্বৃত্তরা পিছু হটে। এমনও ঘটনা ঘটেছে একটা হিন্দু গ্রাম থেকে বহিরাগত দুবৃêত্তরা বাস উঠিয়ে চিরকালের জন্য এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যায়। মার্কসীয় কিংবা অর্থনৈতিক বিচারের পটভূমিতে ফেললে এগুলোকে কতটা কৃষকের শ্রেণী আন্দোলন বলা যাবে তা বলা কঠিন। এগুলোকে বরং রাজনৈতিক চরিত্র বিশিষ্ট সামাজিক আন্দোলন বলাই অধিকতর সঠিক যদিও কৃষকরাই ছিল এসব আন্দোলনের বাহিনী। আর এই আন্দোলনের মেরুদণ্ড গঠন করেছিল প্রধানত মধ্য ও প্রান্তিক কৃষক।
কিন্তু কৃষক আন্দোলনের ক্ষেত্রে আমার অভিজ্ঞতা হল জাতীয় রাজনীতির সঙ্গে সংযুক্ত না হলে এটা বেশী দূর এগোয় না এবং বিস্তৃত হয় না, বরং প্রতিপক্ষের আক্রমণে আন্দোলন ভেঙ্গে পড়ে কিংবা একটা সময়ে জনগণও নিরাসক্ত হয়ে পড়ে। আওয়ামী লীগের ৬ দফার জোয়ার তখন সারা দেশকে প্লাবিত করছিল। ন্যাপের পক্ষ থেকে এই ধরনের জাতীয় কর্মসূচী না থাকায় জাতীয় রাজনীতি ও আন্দোলনের উপর আমাদের নিয়ন্ত্রণ সেই সময় হারিয়ে যায়। ’৭০-এর একটা পর্যায়ে একটা হাটের তোলা-গাণ্ডি বিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে এলাকার সমাজ-বিরোধী, দুর্বৃত্ত এবং বদ মাতব্বরদের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে আমি এবং আঞ্চলিক জনৈক কৃষক নেতা বেঁচে গেলেও আমাদের এক কৃষক কর্মী নিহত হন। উক্ত এলাকার ইউনিয়ন পরিষদের অত্যাচারী ও দুষ্কৃতকারী চেয়ারম্যান ছিল এই আক্রমণের পিছনের নায়ক। বস্তুত এই ঘটনার পর আমাদের পক্ষে আর আন্দোলনকে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব হয়নি। জাতীয় রাজনীতিতে আমাদের বিচ্ছিন্নতা আমাদের শক্তিকে এলাকায়ও খর্ব করতে থাকে।
এই রকম একটা পর্যায়ে আমি পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টিতে ভারতের চারু মজুমদারের পন্থা অনুযায়ী শ্রেণীশত্রু খতমের মাধ্যমে কৃষকের সশস্ত্র অভুøত্থান ঘটানো এবং এইভাবে গণবাহিনী গঠন করে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা অর্জনের জন্য জাতীয় যুদ্ধ শুরুর প্রয়োজন তুলে ধরি। আমি তখন পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি করতাম যার নেতা তখন ছিলেন আবদুল মতিন এবং আলাউদ্দিন আহমদ। পার্টির ভিতরে তখন চারু মজুমদারের লাইনের প্রতি সমর্থন প্রবল হয়ে ওঠে। অবশ্য পার্টি নেতৃত্বের সঙ্গে আমার দৃষ্টিভঙ্গীর একটা মৌলিক পার্থক্য ছিল। কারণ আমি ছিলাম জাতীয় মুক্তি যুদ্ধের জন্য কৃষকের সশস্ত্র শ্রেণী সংগ্রামের সমর্থক। যাইহোক, এটা (চারু মজুমদারের লাইনের প্রতি সমর্থন) ছিল তখন কৃষক আন্দোলন সম্পর্কে নেতৃত্বের কেতাবী দৃষ্টিভঙ্গীর প্রতি প্রতিক্রিয়া। জোতদারদের বিরুদ্ধে কৃষকের অভুøত্থান গড়ে উঠছে না। অথচ তাঁরা সেটাকেই কর্মীদের উপর জোর করে চাপিয়ে দিচ্ছেন এবং বাস্তব কৃষক আন্দোলনকে অগ্রাহ্য করছেন। এখন তাঁদের তথা তত্ত্বের পথে কৃষক অভুøত্থান হচ্ছে না, অথচ স্বাধীনতা বা জাতীয় বিপ্লবের জন্য (আমার দৃষ্টি অনুযায়ী) কিংবা কৃষি বিপ্লবের জন্য (পার্টি নেতৃত্বের দৃষ্টি অনুযায়ী) কৃষকের সশস্ত্র সংগ্রাম ও গণবাহিনী গঠন করার বিকল্প নেই। এই অবস্থায় কমিউনিস্ট পার্টির ধারায় অর্থনৈতিক শ্রেণী সংগ্রামকে সশস্ত্র পর্যায়ে এগিয়ে নিতে গিয়ে গণ-আন্দোলন বর্জন করা ছাড়া উপায় থাকে না। যেহেতু প্রকাশ্যে শ্রেণী অভুøত্থান হচ্ছে না সেহেতু গোপনে সশস্ত্র শ্রেণী সংগ্রামের বিকাশ ঘটাবার একটা পথ হিসাবে এল চারু মজুমদারের লাইন।
পার্টি নেতৃত্ব এই লাইন ঠেকাবার আপ্রাণ চেষ্টা করলেন। কারণ তাঁরা যেমন চাননি বাঙ্গালীর স্বাধীনতা যুদ্ধ গড়ে তুলতে তেমন কৃষক বিপ্লবের জন্যও তাঁদের প্রকৃত তাড়না ছিল না। ঘটনাধারা প্রমাণ করেছে যে, সঙ্কীর্ণ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা এবং তত্ত্বের সীমিত প্রয়োগের বাইরে তাঁদের কোনও বৃহৎ স্বপ্ন বা আকাঙ্ক্ষা ছিল না। কিন্তু তাঁরা দেশের বাস্তবতার প্রতি চোখ বন্ধ করে বসে থেকে সময় কাটাতে পারেন। তত্ত্বের প্রতি অন্ধ আনুগত্য রেখে যেটুকু হয় সেটুকু নিয়ে তুষ্ট থাকতে পারেন, কিন্তু ব্যাপক সাহসী ও উদ্যমী তরুণ কর্মীরা সেটা মানবে কেন? ফলে কর্মীদের চাপে এক সময় তাঁদেরকে চারু মজুমদারের রাজনীতি গ্রহণ করতে হয়।
পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি ১৯৭১-এর জানুয়ারীতে এই রাজনীতি গ্রহণ করে। তার বেশ কিছুদিন পূর্বে সুখেন্দু-হক-তোয়াহা নেতৃত্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী)ও এই রাজনীতি গ্রহণ করতে বাধ্য হয় তরুণ কর্মীদের চাপে। এই পার্টি প্রধানত যশোর অঞ্চলে ক্রিয়াশীল এবং শক্তিশালী ছিল। এই পার্টি পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা কিংবা জাতীয় বিপ্লবে বিশ্বাস করত না। কিন্তু এটা তাৎপর্যপূর্ণ যে, স্বাধীনতা সমর্থক পূর্ব বাংলা এবং স্বাধীনতা-বিরোধী পূর্ব পাকিস্তান উভয় পার্টির অবস্থান জাতীয় মুক্তি যুদ্ধের প্রশ্নে প্রায় অভিন্ন হল। উভয় পার্টির নেতৃত্ব আওয়ামী লীগ বিরোধিতা এবং শ্রেণীশত্রু খতমের মাধ্যমে জাতীয় মুক্তি যুদ্ধকে বিভক্ত ও দুর্বল করার কাজে লিপ্ত রইলেন। স্থান-কাল-পরিস্থিতি নিরপেক্ষভাবে তাঁরা তাঁদের সশস্ত্র শ্রেণী সংগ্রাম চালাতে থাকলেন। তাঁদের তত্ত্ব অনুযায়ী দরিদ্র-ভূমিহীন কৃষকদের এই গোপন সশস্ত্র সংগ্রামে বেশ কিছু সংখ্যায় জমায়েত করতেও সক্ষম হলেন কিছু সময়ের জন্য। প্রকাশ্য গণ-আন্দোলনে যেটা সম্ভব হচ্ছিল না সেটা কিছু এলাকায় সম্ভব হল। কিন্তু কৃষক অভুøত্থান ঘটল না। তবু কিছু মুক্ত এলাকা গড়ে উঠল। কোথায়ও কোথায়ও এইসব এলাকা পাকিস্তানী সেনাবাহিনী-রাজাকারদের আক্রমণেরও শিকার হল। কোথায়ও কোথায়ও আওয়ামী লীগ পরিচালিত মুক্তিবাহিনী-মুজিববাহিনীর আক্রমণও হল। স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর আওয়ামী লীগ সরকারের আক্রমণে একে একে এলাকাগুলো চূর্ণ হল। ক্রমে নির্ভেজাল সন্ত্রাসবাদে কমিউনিস্ট পার্টি পরিচালিত কৃষক আন্দোলনের মূল ধারা হারিয়ে গেল। তবে তার আগে তা সমাজ ও রাষ্ট্রকে প্রবল ধাক্কা দিয়ে গেছে। কমিউনিস্ট রাজনীতির এ দেশের প্রেক্ষিতে সমাজ-অনুপযোগিতার কারণে এক অর্থে তা ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু তার পূর্বে তা যে ধাক্কা দিয়ে গেছে আমার বিবেচনায় সেটা ১৯৭১-এর জাতীয় মুক্তি যুদ্ধকে অনিবার্য করায় অতীব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এই সঙ্গে এই ঘটনাও অস্বীকার করার উপায় নেই যে, বামপন্থী কমিউনিস্টদের এক বৃহৎ অংশ মুক্তি যুদ্ধে অংশ নেয়।
যাইহোক, চারু মজুমদারের লাইন ছিল এ দেশে সনাতন মার্কসীয় এবং আরও বিশেষ করে চীনা ধারায় কৃষকের শ্রেণী সংগ্রামের মাধ্যমে বিপ্লব করতে চাওয়ার রাজনীতির অনিবার্য পরিণতি। কৃষক সংগ্রামকে যে পথে তার নির্ধারিত লক্ষ্যে নিতে চাওয়া হয় তা যখন পারা যায় না তখন এক বিকৃত ও গোপন পথে সেই লক্ষ্যে নিতে চাওয়া হয়।
এটা সত্যি দুর্ভাগ্যজনক যে, পিকিংপন্থী কমিউনিস্ট নেতৃত্ব তাঁদের বদ্ধ দৃষ্টির কারণে সমাজের গতিধারা থেকে শিক্ষা না নিয়ে বরং সেটাকে প্রতিহত করতে চেষ্টা করেন তাঁদের সীমিত শক্তি দিয়ে। বস্তুত যত বহু সংখ্যক শিক্ষিত কমিউনিস্ট কর্মীই কৃষক আন্দোলনে আত্মনিয়োগ করুক তাদের কৃষক আন্দোলনগুলিতে সারা দেশের কৃষকদের এক অতি ক্ষুদ্র অংশই সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিল। হয়ত সেটা সমগ্র কৃষক জনসংখ্যার ১/২ শতাংশের বেশী ছিল না। অথচ ’৬৯-এর গণ-অভুøত্থানে সারা দেশব্যাপী বিশাল আয়তনে কৃষকেরা অংশ নিয়েছিল। ’৭১-এর ২৫ মার্চের পূর্ব পর্যন্ত আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে পাকিস্তানী রাষ্ট্রযন্ত্রের বিরুদ্ধে গণ-আন্দোলনের যে বিশাল জোয়ার উঠেছিল তাতেও কৃষকদের বিপুল অংশগ্রহণ ঘটে। ’৭১-এর যুদ্ধের শুরুতেও কৃষকদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের তাৎপর্য ছিল অপরিমেয়। কিন্তু তাঁরা এসব থেকে শিক্ষা নেবার তাগিদ অনুভব করেননি। এসব তাঁদের কাছে ছিল পেটি বুর্জোয়া কিংবা উগ্র জাতীয়তাবাদী আন্দোলন যার সঙ্গে কৃষকের শ্রেণী স্বার্থের সম্পর্ক নেই। অথচ কৃষক যে পেটি বুর্জোয়া এটা তাঁদেরই তত্ত্বের কথা। তাঁদের তত্ত্বের যুক্তি অনুযায়ীও যে, পেটি বুর্জোয়ারা পেটি বুর্জোয়া আন্দোলন করবে এটাও তাঁরা মানেননি। বরং তাঁদের মুষ্টিমেয় অনুগতদের নিয়ে এই বিশাল সংখ্যক ‘পেটি বুর্জোয়াদের’ ঠেকাতে চেয়েছেন। কিছু সংখ্যক এলাকায় কিছু সংখ্যক কর্মী ও সমর্থক পরিবেষ্টিত হয়ে থেকে তাঁরা সমগ্র দেশের বাস্তবতাকে ক্ষুদ্র করে এবং নিজেদের ক্ষুদ্র শক্তিকে বিরাট করে দেখেছেন। যেন তাঁদের গ্রামটাই দেশ। জাতীয় রাজনীতি যে ক্ষুদ্র এলাকার বাস্তবতার চেয়ে অনেক বেশী শক্তিশালী সে কথা তাঁদের কখনও বোঝানো যেত না। তাঁরা ভাবতেন যে, তাঁদের ঐ সব ক্ষুদ্র এলাকায় তাঁরা চীনের অভিজ্ঞতার পুনরাবৃত্তি ঘটাবেন এবং তার শক্তিতে সারা দেশের বাস্তবতাকে উল্টে দিবেন। এলাকা ভিত্তিক কৃষক সংগঠন ও আন্দোলন করে কিংবা সুদীর্ঘ আত্মগোপনে থেকে অথবা তত্ত্বাচ্ছন্ন থেকে তাঁদের দৃষ্টিটা এমনই সঙ্কীর্ণ ও খণ্ডিত হয়েছিল। ব্যাপারটা যেন এমন যে, একদল গ্রাম্য মোড়ল ‘ভিলেজ পলিটিক্স্’ দিয়ে জাতীয় রাজনীতির ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে এবং জাতীয় নেতৃত্বকে উৎখাত করে নিজেরা জাতীয় নেতা হতে চাইছে!
’৭১-এর জাতীয় মুক্তি যুদ্ধের সময় এই নেতাদের আচরণের কথা মনে হলে আজও ক্ষোভ সংবরণ করা কঠিন হয়। আমার দুঃখটা এই জায়গায় যে, বাঙ্গালী জনগণের স্বাধীন জাতীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য যে পার্টির পিছনে এত শ্রম, শক্তি ও নিষ্ঠা উৎসর্গ করেছিলাম কোনও কৌশলেই, কোনও চাপেই এবং কোনও আবেদনেই তাকে ’৭১-এ জাতির স্বাধীনতা যুদ্ধে নিতে পারিনি।
আসলে সমস্যাটা হয়েছে নিজ সমাজের বৈশিষ্ট্য ও সমস্যাগুলোকে না বুঝে ভিন্ন সমাজ ও দেশের অভিজ্ঞতা এবং ধারণাকে বিজ্ঞান নাম দিয়ে সর্বজনীন মার্কসীয় কিংবা কমিউনিস্ট সত্য হিসাবে জোর করে চাপিয়ে দিতে চাওয়ার কারণে। আর বদ্ধ দৃষ্টির কারণে মার্কসবাদীরা আজও এই সমাজের কতকগুলো বাস্তব এবং ঐতিহাসিক সমস্যা ও বৈশিষ্ট্য বুঝতে চান না বলে এত অভিজ্ঞতার পরেও তাঁরা কৃষক আন্দোলনের সঠিক ও নিজস্ব গতিধারা সৃষ্টি করতে পারেননি।
এখন আমি এ দেশের কৃষক আন্দোলনের সমস্যা বোঝার জন্য এ দেশের কৃষক মানসকেও আলোচনায় নিব।
কৃষক মানস ও কৃষক আন্দোলন
কৃষক আন্দোলন করতে গিয়ে আমি কৃষক মানসের বৈশিষ্ট্য ও প্রবণতার গুরুত্ব অনুভব করতে বাধ্য হই। গ্রামে যাবার পূর্ব পর্যন্ত আমার ধারণা ছিল কৃষকের অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমস্যা ও দাবী নিয়ে প্রচার ও আন্দোলন করলে কৃষককে জাগানো যাবে। বিশেষ করে ভূমিভিত্তিক সামাজিক কর্তৃত্ব হিসাবে যে জোতদার ও গ্রামীণ ধনিক শ্রেণী রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করলে কৃষকের শ্রেণী চেতনা জেগে ওঠে এমন একটা ধারণা সঙ্গত কারণে আমার ভিতরেও ছিল। ব্যাপারটা যে অত সহজ নয় তা আমি কৃষকদের মধ্যে কাজ করতে গিয়ে প্রথম উপলব্ধি করি। জোতদার-মহাজনদের শোষণের বিরুদ্ধে কথা বললেই কৃষকের শ্রেণী ঘৃণা যেমন জেগে নাও উঠতে পারে তেমন এই শোষণের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করলেই যে, সেটা ব্যাপক কৃষক দ্বারা সমর্থিত ও বিস্তৃত হয় ব্যাপারটা তেমনও নয়।
ইতিপূর্বে আমি আমার তৎকালীন দিনাজপুর ও রংপুর জেলায় কৃষকদের মধ্যে জোতদার বিরোধী প্রচার আন্দোলনের ঈপ্সিত ফল লাভে ব্যর্থতার কথা উল্লেখ করেছি। আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি কৃষকরা সাধারণত ভূমিভিত্তিক এবং অর্থ-ক্ষমতার অধিকারী সামাজিক কর্তৃত্বের উপর নির্ভরশীল থাকে। শুধু জোতদার নয় উপরন্তু গ্রামের সচ্ছল ও প্রতিষ্ঠিত পরিবার ও ব্যক্তিদের প্রতি কৃষকের আনুগত্য প্রবল দেখতে পেতাম। এই আনুগত্য দুর্বল করা যেত না তা নয় তবে সেটা ব্যাপক কোনও আয়তন নিত না। আর নিলে সেখানেও দেখতে পেতাম গ্রামীণ কর্তৃত্বের একটা ক্ষুদ্র অংশ হলেও তার সমর্থন ও অংশগ্রহণের প্রয়োজন হয়। যেমন, যে গ্রামে বা এলাকায় আমরা কোনও প্রভাবশালী পরিবারের সদস্য বা ছেলেকে কৃষক আন্দোলন বা সংগঠনে পেতাম সেখানে কৃষক সংগঠন ও আন্দোলন জোরালো হত। যেখানে তেমন ঘটনা ঘটত না সেখানে কৃষক সংগঠন ও আন্দোলন থাকত অনেকটা ম্রিয়মাণ। অর্থাৎ কৃষক সংগঠন ও আন্দোলনের স্থানিক কেন্দ্র অনেকাংশে গঠন করত গ্রামীণ কর্তৃত্বকারী শ্রেণীর একটা অংশ তা সে যত ক্ষুদ্র হোক না কেন। কৃষক আন্দোলনের ব্যাপ্তির সঙ্গে এই অংশের প্রভাবও বিস্তৃত হত আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী কৃষকদের পাশাপাশি। অর্থাৎ মধ্য কৃষকের ব্যাপক অংশগ্রহণও প্রধানত নির্ভরশীল ছিল সংখ্যায় খুব অল্প হলেও গ্রামাঞ্চলের ক্ষমতাবান ও প্রতিষ্ঠিত কিছু পরিবার বা তাদের সদস্যদের অংশগ্রহণের উপর। এবং এরপর সেটা বিস্তৃত হত নীচের দিকে।
অবস্থাপন্ন ঘরের শিক্ষিত ছেলেরা যখন ভূমি সংস্কার কিংবা অন্যান্য দাবীর সমর্থনে নামত কিংবা নেতৃত্বমূলক ভূমিকা নিত তখন সাধারণত কৃষকরা ভরসা পেত। তবে আগেই বলেছি সেখানেও এটা তেমন কোনও বৃহৎ ব্যাপ্তি এবং তীব্রতা নিত না। তার একটা সহজ ও বোধগম্য কারণ হল গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামোর উপর তলা থেকে কৃষকের ভূমিভিত্তিক কর্মসূচীর সমর্থনে তেমন ধরনের আগমন খুব কম ঘটত। ফলে এটা কিছু সংখ্যক প্রতিষ্ঠিত পরিবারের শিক্ষিত ছেলেদের আদর্শগত বিশ্বাসের ব্যাপার হয়ে থাকত এবং এই রাজনীতির অনুসারী কৃষকদের মধ্যেও ব্যাপারটা তেমন হয়ে থাকত। যেন ব্যাপারটা এমন যে, ভূমি বণ্টন এবং সমাজতন্ত্রের মাধ্যমে সমতা প্রতিষ্ঠিত হবার ব্যাপারটা মন্দ নয়। কিন্তু এই চেতনার বিস্তার ব্যাহত হত ক্ষমতাবান ও সম্পত্তিবান শ্রেণীর উপর সাধারণ কৃষকের নির্ভরতা ও আনুগত্যের কারণে।
এর পিছনে ধর্মের যে একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে সেটা ক্রমে আমার ধারণায় স্পষ্ট হতে থাকে। সে কালে উপলব্ধিটা যে পরবর্তী কালের মত এত স্পষ্ট ছিল তা নয়; তবে আমি প্রশ্নের সম্মুখীন হই।
আমি পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ উভয় আমলেই আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি হিন্দু এবং মুসলমান এই উভয় সম্প্রদায়ের কৃষকদের মধ্যে চেতনাগত ও আচরণগত এমন অনেক প্রভেদ আছে যেগুলোকে তুচ্ছ করার উপায় নেই। একই জাতির এবং বৃহত্তর ভাষা ও সংস্কৃতির কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় উভয়ের মধ্যে অনেক মিল থাকলেও প্রভেদের জায়গাটাও কম নয়। পাকিস্তান আমলে কৃষক আন্দোলন সংগঠনের ক্ষেত্রে আমি সঙ্গত কারণে মুসলমান কৃষকদের উপর বেশী জোর দিতাম। কিন্তু আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করতাম যাদের প্রতি আমার মনোযোগ সবচেয়ে কম সেই হিন্দু কৃষকরা সংখ্যায় ও সামর্থেø অনেক হীনবল হলেও উৎসাহ, সমর্থন ও অংশগ্রহণ আপেক্ষিকভাবে তাদের বেশী। মুসলমান কৃষকরা নগদ বা দ্রুত ফল লাভে যতটা উদগ্রীব থাকত হিন্দু কৃষকদের ততটা উদগ্রীব মনে হত না। তাদের ধৈর্য, আদর্শবোধ, সহিষ্ণুতা, এবং সংগ্রাম ও ত্যাগের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ মুসলমান কৃষকদের তুলনায় অনেক বেশী শক্তিশালী দেখেছি। এ ধরনের অনেক অভিজ্ঞতা আমার আছে যেগুলোর উল্লেখ করে আমি আমার আলোচনাকে বেশী ভারাক্রান্ত করতে চাই না। এবং সর্µোপরি যেটা বলা দরকার তা’হল মুসলিম কৃষক চেতনায় অনেক বেশী স্থূলতা ও পশ্চাৎপদতার সঙ্গে আমি দেখতে পেয়েছি মুসলিম সামাজিক কর্তৃত্বের প্রতি মুসলিম কৃষকদের আনুগত্যের ব্যাপকতা। অন্যদিকে বিশেষভাবে লক্ষণীয় মুসলিম কৃষকদের তুলনায় হিন্দু কৃষকদের মধ্যে সামাজিক অনৈক্যের প্রবলতা যার সহজবোধ্য একটি প্রধান কারণ হল তাদের মধ্যকার বর্ণজাতি প্রথা ভিত্তিক ভেদ ও ভিন্নতা।
এইসব অভিজ্ঞতা থেকে কৃষক মানস গঠনে বিভিন্ন উপাদানের পাশাপাশি ধর্মের গুরুত্বের ব্যাপারটা আমার চেতনায় আসে যেটা নিয়ে আমি সে কালে ভাবতে শুরু করি। তবে কৃষক আন্দোলনের নেতৃত্ব আমার এ ধরনের চিন্তা বা জিজ্ঞাসাকে সে কালে তো বটেই পরবর্তীকালেও আদৌ পাত্তা দেননি। তাঁদের কাছে কৃষক একটা স্বয়ংসম্পূর্ণ ধারণা যা অর্থনীতির নির্দিষ্ট নিয়মে ক্রিয়াশীল যেখানে ভূ-প্রকৃতি, ধর্ম, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ইত্যাদি বিষয়ের কোনও তাৎপর্যপূর্ণ অথবা মৌলিক ভূমিকা থাকতে পারে না। অথচ কৃষক মানস ও আচরণ গঠনে এই প্রতিটি উপাদানের ভূমিকা কতখানি গুরুত্বপূর্ণ তা আমি আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি।
বিশেষত ধর্মের প্রসঙ্গে আমার অভিজ্ঞতা এখানে কিছুটা তুলে ধরা আমার পরবর্তী আলোচনার জন্য সহায়ক হতে পারে। আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি যখন কৃষক আন্দোলন কিংবা কৃষকদের মধ্যে সংগঠনের ফলে গ্রামাঞ্চলে প্রচলিত সামাজিক নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বের নিয়ন্ত্রণ আলগা হতে শুরু করে তখন তারা ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের উপর গুরুত্ব বাড়িয়ে দেয়। মসজিদে নামাজ পড়া এবং রোজার মাসে নিয়মিত রোজা রাখা ইত্যাদির জন্য তারা কৃষক সংগঠক ও কর্মীদের উপর প্রবল চাপ সৃষ্টি করে। সাধারণভাবে আমি এই চাপ আমার সব কর্ম এলাকাতেই দেখেছি। পাকিস্তান আমলে বিশেষত তৎকালীন রংপুর জেলার আদিতমারীতে কৃষক সংগঠন ও আন্দোলন করতে গিয়ে এ ব্যাপারে প্রবল সমস্যার সম্মুখীন হই। আমরা ধর্মের বিরুদ্ধে কোনও বক্তব্য না দিলেও আমাদের নাস্তিকতার দায়ে অভিযুক্ত করা হত। সেখানে জোতদার শ্রেণী এবং সামাজিক নেতৃত্ব শুক্রবার জুম্মার নামাজে সবার উপস্থিতির জন্য প্রবল চাপ সৃষ্টি করে। যারা নামাজ পড়বে না তাদের উপর নানাভাবে চাপ সৃষ্টির পাশাপাশি সামাজিকভাবে বয়কটের হুমকিও দেওয়া হয়। মসজিদে তারা প্রচলিত বৈষম্যমূলক ব্যবস্থার সপক্ষে ধর্মীয় যুক্তি শোনাত। মজার ব্যাপার হল এ ক্ষেত্রে যিনি মূল নেতা এবং উদ্যোক্তা ছিলেন তিনি ছিলেন দুর্নীতিগ্রস্ত এবং ব্যভিচারে অভ্যস্ত এক প্রভাবশালী ব্যক্তি যিনি এক সময় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন।
সাম্প্রতিককালে দিনাজপুরের খানসামায়ও দেখেছি বিদ্যমান সামাজিক কর্তৃত্ব তাদের গণবিরোধী, প্রতিক্রিয়াশীল এবং দুর্নীতিগ্রস্ত স্বার্থ এবং নিয়ন্ত্রণ টিকিয়ে রাখার জন্য কিভাবে ধর্ম ও মসজিদকে ব্যবহার করে। মসজিদ এবং ধর্মের মাধ্যমে তারা জনগণকে সবচেয়ে সহজে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে বলে এদিকে তাদের এত সতর্ক দৃষ্টি, এটা হচ্ছে আমার মূল্যায়ন। সাধারণ মানুষও ধর্মের আবেদনের সামনে দুর্বল হয়ে পড়ে। এইভাবে শাসক ও শাসিত ধর্মের মাধ্যমে এমন এক সম্পর্কে আবদ্ধ থাকে যা সামাজিক ব্যবস্থাকে বিরাটভাবে শক্তি যোগায়। এই অবস্থার একেবারে কোনও পরিবর্তন ঘটানো যায় না আমি তা বলি না। কিন্তু কাজটা সহজসাধ্য নয়। তবে আমি এখানে মূল একটা সমস্যার দিকে দৃষ্টিটা নিতে চাইছি, যেটা আমাদের মত মুসলিম সমাজের কৃষক আন্দোলনের এবং সেই সঙ্গে সমাজ পরিবর্তনেরও সমস্যা বোঝার ক্ষেত্রে সহায়ক হবে বলে ধারণা করি।
এখন আমি কৃষক মানস ও আন্দোলনের আন্তঃসম্পর্ক প্রসঙ্গে আমার ধারণা সংক্ষেপে উপস্থিত করতে চেষ্টা করব। এবং এই প্রসঙ্গে আমাদের মত মুসলিম সমাজে কৃষক আন্দোলনের সমস্যার দিকটিকে উদ্ঘাটিত করতে চেষ্টা করব। এ দেশে ব্রিটিশ শাসনকালে ফজলুল হকের নেতৃত্বাধীন প্রজা সমিতি বা প্রজা পার্টি জমিদার-মহাজনদের বিরুদ্ধে ব্যাপক জনমত গঠন করে। মহাজনী ও জমিদারী শোষণ উচ্ছেদের দাবীতে প্রজা পার্টির নেতৃত্বে কৃষক আন্দোলন গড়ে উঠেছিল। তবে সেটা ছিল নিয়মতান্ত্রিক ও নির্বাচনমুখী। ফলে তার জঙ্গী চরিত্রের অভাব ছিল। ব্রিটিশ শাসক শ্রেণী নির্বাচনের মাধ্যমে দেশ শাসনের যে সীমিত সুযোগ দেয় সে পথে ঐ কৃষক আন্দোলনের মূল ধারা প্রবাহিত হয়েছিল। ফলে সংঘাত ছিল সংযত। তা সত্ত্বেও জমিদারী ব্যবস্থা উচ্ছেদের দাবী এবং তার প্রতি ব্যাপক কৃষক সমাজের সমর্থন ছিল তাৎপর্যপূর্ণ।
কিন্তু এই সঙ্গে একটি বিষয় নিশ্চয় অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ যে, এ দেশের কৃষকদের অধিকাংশ যেমন মুসলমান সম্প্রদায়ভুক্ত ছিল তেমন জমিদারদের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই ছিল হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত। বাংলা প্রাদেশিক মুসলিম লীগ জমিদারী উচ্ছেদের দাবীকে তার কর্মসূচীর অন্তর্ভুক্ত করে নিলে প্রজা পার্টি মুসলিম লীগে যোগদান করে। কিন্তু এটা সারা ভারতীয় মুসলিম লীগের কর্মসূচী ছিল না। এটা নিশ্চয় লক্ষণীয় যে, বর্তমানে পাকিস্তান যে অঞ্চল নিয়ে গঠিত সেখানকার জমিদারদের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ ছিল সেখানকার সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষকদের মতই মুসলমান সম্প্রদায়ভুক্ত। সেখানে কৃষকদের পক্ষ থেকে এমন কোনও দাবী উত্থিত হয়নি।
এখন আমি মুসলিম পৃথিবীর দিকে দৃষ্টি দিব। রাশিয়া, চীন এমনকি পশ্চিম ইউরোপেও আমরা যে ধরনের কৃষক আন্দোলন দেখেছি তেমন ধরনের কোনও আন্দোলন কি মুসলিম দেশগুলোতে সাধারণভাবে ঘটতে দেখা গেছে? না। বরং এসব দেশে ভূমি সংস্কারের ক্ষেত্রে উদ্যোগসমূহ রাষ্ট্র বা সরকার থেকে এসেছে। এমন কি প্রতিক্রিয়াশীলতার অভিযোগে অভিযুক্ত ইরানের শাহ্-এর উদ্যোগে ইরানে ভূমি সংস্কার হয়। অবশ্য শেষ পর্যন্ত তিনি টেকেননি। আফগানিস্তানে ভূমি সংস্কার করতে গিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলকারী কমিউনিস্ট নেতৃত্ব এমন বৈরী জনগণ দ্বারা আক্রান্ত হয় যা তাদেরকে শেষ পর্যন্ত ধ্বংস করে। বর্তমান পাকিস্তানে যে ভূমি সংস্কার হয় তার কৃতিত্ব মূলত আইয়ুব সরকারের।
আমার অভিজ্ঞতা থেকে আমি যেটা বুঝেছি সেটা হচ্ছে সাধারণভাবে মুসলিম কৃষক মানস যেমন অত্যন্ত পশ্চাৎপদ ও প্রতিক্রিয়াশীল তেমন সে তার সনাতন সামাজিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বের সঙ্গে গভীর আনুগত্যের বন্ধনে জড়িয়ে থাকে। ইসলামী সংস্কৃতি, বিশ্বাস, আচার-অনুষ্ঠান এমন এক শৃঙ্খলায় সমগ্র সমাজকে বেঁধে রাখে যেখানে বাস্তব শ্রেণীগত পার্থক্যও জনগণকে তেমন একটা পীড়া দেয় না বা শাসক শ্রেণী থেকে শাসিত জনগণের মানসিক দূরত্ব সৃষ্টি করে না। অর্থনীতি ও সম্পদে যতই পার্থক্য থাক সেটা যে অলৌকিক শক্তি দ্বারা নির্ধারিত মনে করা হয় শুধু তা-ই নয় উপরন্তু শাসককে দূরের বা খুব ভিন্ন শক্তিও মনে করা হয় না। মসজিদে নিয়মিত নামাজে সকলের কাতারবন্দী হওয়া এবং বিভিন্ন ধর্মীয় নিয়ম ও অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পারস্পরিক বন্ধন শ্রেণী বৈষম্যকে অনুভবের জগতে তীব্র হতে দেয় না। শুধু যে শাসিত শাসকের সঙ্গে আনুগত্যের বন্ধনে আবদ্ধ থাকে তা-ই নয়, উপরন্তু শাসক নিজেও শাসিতের পশ্চাৎপদ এবং প্রথাগত চিন্তা ও আচরণ দ্বারা এমনভাবে নিয়ন্ত্রিত থাকতে বাধ্য হয় যে, তার পক্ষেও এমন কিছু করা অসম্ভব কিংবা দুঃসাধ্য হয় যা ইসলামের মৌল রীতি-নীতিকে আঘাত করে কিংবা সমাজের মৌল বিন্যাসে আঘাত করে।
এই সমাজে প্রথাগতভাবে সমাজ মানস নিরঙ্কুশভাবে স্বৈরতান্ত্রিক। ফলে সমাজ বা রাষ্ট্র শাসক এই মানসিকতার প্রতিভূ। কিন্তু তার স্বৈরতন্ত্রও ইসলামী সমাজের কাঠামোবদ্ধ। অর্থাৎ চরম স্বৈরতান্ত্রিকতা সত্ত্বেও যা খুশী করার ক্ষমতা তারও একান্ত সীমিত।
আফগানিস্তানের বাদশাহ্ আমানুল্লাহ্র পরিণতির কথা আমরা স্মরণ করতে পারি যিনি সমাজের আধুনিকায়ন ঘটাতে গিয়ে সিংহাসনচুøত হয়েছিলেন।
এই রকম সমাজে শাসকের পরিবর্তন ঘটতে পারে, তবে সেটা উপর তলা থেকে ঘটে। শাসকের অত্যাচার-পীড়ন সীমা ছাড়িয়ে গেলে কিংবা সামাজিক সঙ্কটের তীব্রতায় গণ-বিদ্রোহও ঘটতে পারে। তবে সেটাও ঘটে প্রচলিত সামাজিক- রাজনৈতিক কর্তৃত্বের একাংশের নেতৃত্বে এবং গোটা ব্যাপারটা থাকে ইসলামী সমাজ কাঠামোর অনুবর্তী। এই সমাজে শাস্ত্রীয় এবং প্রথাগতভাবে কেউ-ই স্বাধীন মানুষ নয়। এখানে সবাই বান্দা অর্থাৎ দাস। আল্লাহ্র বান্দার নামে একটি নির্দিষ্ট ব্যবস্থার বান্দা বা দাস। এই দাসেরা সমাজের ভিতর থেকে শুধু নিজ শক্তি বলে উন্নয়ন বা পরিবর্তনের শক্তি সৃষ্টি করতে পারে না যেমন ইতিহাসের কোনও সমাজের দাসেরা পারেনি। তবে দৈহিক দাসত্বের চেয়ে মানসিক দাসত্ব আরও ভয়ঙ্কর। এবং এই দাসত্বের শক্তি অনেক বেশী।
বস্তুত এই সমাজে পরিবর্তন কিংবা আধুনিকায়নের শক্তি ভিতর থেকে উদ্ভূত হবার পথ পায় না বলে বৈদেশিক আধিপত্য কিংবা ভিন্ন সমাজের প্রভাব পরিবর্তন কিংবা আধুনিকায়নের শক্তি গড়ে তোলে। ব্যাপারটা মেনে নিতে যত খারাপ লাগুক সেটা এমন। এর সঙ্গে মার্কস- এর সর্বহারা শ্রেণীর কিংবা মাও-এর কৃষকের ভূমিকা মেলাবার চেষ্টাটা পণ্ডশ্রম ছাড়া আর কিছু নয়।
প্রকৃতপক্ষে বাইরের হস্তক্ষেপে বা প্রভাবে ইসলামী সমাজের চিরায়ত বিন্যাস ভেঙ্গে পড়তে থাকে এবং এ ক্ষেত্রে পাশ্চাত্যের প্রভাবে সৃষ্ট আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণী এক নূতন পরিবর্তনের শক্তি হিসাবে ধীরে ধীরে সমাজের ভিতর জায়গা করে নিতে থাকে। তবে অধিকাংশ দেশে রাষ্ট্র ক্ষমতার অধিকারী বা রাষ্ট্রের মূল প্রতিষ্ঠান হিসাবে পাশ্চাত্য প্রভাবে প্রভাবান্বিত সেনাবাহিনী আধুনিকায়নের শক্তি হিসাবে আবির্ভূত হয়। আমাদের দেশে ব্রিটিশ প্রবর্তিত নির্বাচনমূলক জনপ্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থার ফলে যে প্রাথমিক গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে এবং এর মাধ্যমে মধ্যবিত্ত শ্রেণী রাজনীতি ও জনমত গঠনে যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে তার কারণে এখানে সেনাবাহিনীর ভিতর প্রগতিশীল পরিবর্তনের শক্তির সমাবেশ ঘটে না। এই সমাবেশ সাধারণত রাজনৈতিক দল বা দলগুলোতে ঘটে। ফলে রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ প্রগতিশীলতার পরিবর্তে প্রতিক্রিয়ার শক্তি বৃদ্ধি করে।
আমাদের দেশে যে মধ্যবিত্ত শ্রেণী বিকাশ লাভ করেছে ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও পুঁজিবাদের প্রতি তার সমর্থন অনেক বেশী প্রবল। অন্যদিকে তা সাধারণভাবে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির সমর্থক যেহেতু এর মাধ্যমে রাষ্ট্রশাসনে তাদের অংশগ্রহণের সুযোগ থেকেছে। এ দেশে ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রণে এমন মধ্যবিত্ত শ্রেণী গড়ে উঠেছে যারা প্রচলিত আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার দ্রুত বা ব্যাপক পরিবর্তন চায় না। সমাজতলে অবস্থিত জনগণের পরিবর্তন বিরোধী মানসকে তারা যতটা সম্ভব ধীরে-সুস্থে পরিবর্তনের পথে এগিয়ে নেবার পক্ষপাতী যেটা পাশ্চাত্য আধিপত্য এবং তার বাজার স্বার্থের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। যারা র্যাডিক্যাল তথা আমূল পরিবর্তনবাদী, স্বাপ্নিক এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষী তারা সমাজের ধীরগতি, আংশিক এবং বিদেশ অনুবর্তী পবির্তনের পরিবর্তে দ্রুত, আমূল এবং স্বাধীন পরিবর্তনের আয়োজন করতে গিয়ে সমাজের মূল স্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়। কারণ তারা মধ্যবিত্তের এক সংখ্যালঘু এবং সমাজের অতি ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ মাত্র।
সংখ্যালঘু সংখ্যাগুরুতে পরিণত হতে পারে বৈ কি। কিন্তু সমাজতল নিদারুণভাবে পশ্চাৎপদ, পরিবর্তন বিমুখ হবার কারণে তারা সেখানে তেমন কোনও সমর্থন সৃষ্টি করতে পারে না। এবং সর্বোপরি তাদের এক বিরাট সমস্যা হল সমাজ মানসের নিদারুণ অলোকবাদী বা সেকিউলারিজম-বিরোধী অবস্থান। প্রথাগত ইসলামী সমাজ-মানস লোকবাদী দৃষ্টিভঙ্গী ও আচরণের প্রতি অসহিষ্ণু ও আক্রমণাত্মক কিংবা তীব্রভাবে অশ্রদ্ধাশীল। অথচ আধুনিকায়ন ও গণতন্ত্রের জন্য সমাজে লোকবাদী চেতনার গুরুত্ব অপরিমেয়।
এ দেশে ছাত্রদের বাইরে জনগণের মধ্যে বামপন্থী রাজনীতি প্রসারের পিছনে সবচেয়ে বড় সহায়ক শক্তি ছিলেন মওলানা ভাসানী। কমিউনিস্টদের প্রতি সমাজের এবং কৃষকদেরও ভীতি বা ঘৃণা ছিল। কিন্তু মওলানা ভাসানীর মত বিরাট ধর্মীয় নেতা বা পীর এবং প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে থাকার কারণে তাদের গোপন কমিউনিস্ট পরিচয়ের অসুবিধা কিছুটা কাটানো যেত। কিন্তু ’৬৯-’৭০ থেকে কমিউনিস্টরা যখন স্বাধীনভাবে এগিয়ে যেতে থাকে তখন তারা জনবিচ্ছিন্নতাকে অনিবার্য করতে থাকে। আসলে তাদের কমিউনিস্ট পরিচয় নিয়ে স্বাধীনভাবে দাঁড়াতে চাওয়া, গণ সংগঠন ও আন্দোলন বর্জন করে সম্পূর্ণ গোপন ও সশস্ত্র আন্দোলনকে নির্ভর করা পরস্পর সম্পর্কিত। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কমিউনিস্ট আন্দোলনের অগ্রগতির ঐ কালে এ দেশের বিপ্লবী কমিউনিস্টদের স্বাধীনভাবে এগোতে চাওয়া অবশ্য অস্বাভাবিক কিছু ছিল না।
বাংলাদেশ-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর একত্রিশ বৎসরের প্রকাশ্য কমিউনিস্ট রাজনীতির ক্রম অবক্ষয়ের অভিজ্ঞতা থেকে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে। এ ছাড়া যারা প্রকাশ্যে লোকবাদী বা সেকিউলার তাদের জনবিচ্ছিন্নতার দিকেও আমরা দৃষ্টি দিতে পারি। তবে সমস্যাটা হয় কমিউনিস্ট বা মার্কসবাদী রাজনীতির পরিচয় নিয়ে গেলে। কারণ তার স্পষ্ট এবং জোরালো লোকবাদী আদর্শিক পরিচয়ের কারণে কোনও কৌশল কাজ করে না।
পাকিস্তান আমলে ভাসানীর সাফল্যের একটা বড় কারণ ছিল রাজনীতিকে ধর্মাশ্রিত না করেও ইসলামকে তাঁর গণমুখী ও প্রগতিশীল রাজনীতি ও আন্দোলনের (যেটা সংযুক্ত ছিল শ্রেণী সংগ্রাম ও সমাজতন্ত্রের সঙ্গে) স্বার্থে ব্যবহার করতে পারা। তিনি এইভাবে বাম রাজনীতির সঙ্গে ইসলামের এক বিস্ময়কর সম্মিলন ঘটিয়েছিলেন। শেখ মুজিবও রাজনীতির সঙ্গে ইসলামকে আর একভাবে সংযুক্ত রেখেছিলেন।
বস্তুত আওয়ামী লীগের আজ অবধি কর্মকাণ্ডের দিকে তাকালে ইসলামের সঙ্গে রাজনীতির সমন্বয় বা যোগ সাধনের দিকটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আওয়ামী লীগ তত্ত্বগতভাবে সেকিউলারিজমের কথা বললেও ইসলাম ধর্মের আবেদনকেও ব্যবহার করে। বিএনপি, জামায়াতের সঙ্গে তার পার্থক্যটা এই জায়গায় যে, তা তাদের মত উগ্র কিংবা মৌলবাদী নয়। এটা বিস্ময়কর মনে হলেও বাস্তব যে, পাকিস্তান আমলের চেয়েও এখন সমাজ ও রাজনীতিতে প্রথাগত ইসলামের প্রভাব প্রবলতর। এর একাধিক কারণ আছে বলে আমার ধারণা। এ দেশের কৃষক আন্দোলনের সমস্যা বোঝার জন্য এর উপর আলোচনা করার প্রয়োজন আছে বলে খুব সংক্ষেপে তার উপর আলোকপাত করতে চাই।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল মুসলিম পরিচয়ের ভিত্তিতে। কিন্তু তা সত্ত্বেও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর ইসলামের রাজনৈতিক আবেদন হ্রাস পেতে থাকে। এর সবচেয়ে বড় কারণ ছিল পাকিস্তানী অবাঙ্গালী মুসলিম শাসক শ্রেণীর শাসন, শোষণ ও বঞ্চনার কারণে বাঙ্গালী জাতির জাতীয়তাবাদী অনুভূতির জাগরণ। ফলে ইসলামের পরিচয়ের ভিত্তিতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হলেও মধ্যবিত্ত এবং জনমনেও রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসাবে ইসলামের অবেদন ্লান হতে থাকে। এই হাতিয়ার নিয়ে তখন মুসলমান বাঙ্গালীর পক্ষে অবাঙ্গালী পশ্চিমাদের আধিপত্যের বিরুদ্ধে লড়াই করা সম্ভব ছিল না। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, ইসলামের আবেদন ছিল না। ছিল, তবে সেটা সাময়িকভাবে জাতীয়তাবাদের আড়াল নিয়ে ছিল। যখন বাংলাদেশ-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ফলে ভিন্ন জাতির মুসলমানদের আধিপত্য শেষ হল তখন ইসলাম ধর্মের আড়ালে থাকার প্রয়োজনও শেষ হল। এর সঙ্গে অবশ্য ভারত বিরোধিতাও আছে। কিন্তু সেটা যতটা জাতীয়তাবাদ থেকে তার চেয়ে বহুগুণে বেশী ধর্ম-সাম্প্রদায়িকতাবাদ থেকে। কারণ বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ ভারতীয় জাতীয়তাবাদের বিকল্প হিসাবে কম শক্তিশালী নয়। বরং এটার শক্তি অনেক বেশী এবং এটা জাতি-রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশের পরিচয় সঙ্কট সৃষ্টি করে না, যেটা বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ করে যার মর্মে আছে ইসলামী পরিচয় বোধের প্রাধান্য। কাজেই মূল ব্যাপার হচ্ছে ইসলামী বা মুসলমান সমাজে রাষ্ট্রকেও ইসলামী বা মুসলমান হতে হয়। মুসলমান হয়ে যেটুকু ‘সেকিউলার’ হওয়া যায় সেটুকু তা হতে পারে বৈ কি!
দ্বিতীয়ত, ওয়াহাবী, ফরায়জী ইত্যাদি আন্দোলন এবং সবশেষে পাকিস্তান আন্দোলনের মাধ্যমে এ দেশে মুসলিম সম্প্রদায়ভুক্ত জনগণের ইসলামীকরণ হতে থাকে। বস্তুত ইতিপূর্বে এ দেশের আমজনতার উপর মৌল ইসলামের প্রভাব খুব সামান্যই ছিল। এর সঙ্গে ছিল হিন্দু প্রতিবেশীদের সঙ্গে সুদীর্ঘ কাল একত্র বসবাস করার প্রভাব এবং সেই সঙ্গে ইংরেজ শাসনের লোকবাদী বা সেকিউলার বৈশিষ্ট্যের প্রভাব। ফলে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর ইসলামের প্রভাব শক্তিশালী হতে সময় লেগেছে। তবে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের পাশাপাশি ধর্মীয় উগ্রতা পাকিস্তান আমলেও ক্রমবর্ধমান ছিল। আইয়ুবের সামরিক শাসন প্রতিষ্ঠার পর রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় এটা যথেষ্ট শক্তি অর্জন করে। এর একটা প্রকাশ ’৭১-এও ঘটেছিল। যুদ্ধের ভিতর হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর মুসলমান সম্প্রদায়ের একাংশ যেভাবে দেশব্যাপী লুটতরাজ, বিতাড়ন ও আক্রমণে মেতে উঠেছিল সেই অভিজ্ঞতা যাদের আছে তাদের সমস্যাটা বুঝতে কষ্ট হবার কথা নয়।
তৃতীয়ত, উগ্র ইসলামী চেতনার ক্রম প্রসারের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ আমার বিবেচনায় গ্রামীণ লোক সংস্কৃতির নিদারুণ অবক্ষয়। মৌল ইসলামে সঙ্গীত, নৃত্য, অভিনয় ইত্যাদি নিষিদ্ধ অথবা অনাকাঙ্ক্ষিত। অথচ গ্রামীণ সংস্কৃতির এগুলি ছিল অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। এ দেশের মুসলিম আমজনতা ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালী, জারি, বাউল এবং আরও অজস্র সঙ্গীত নিয়ে মেতে থাকত। এছাড়া ছিল যাত্রা। বিশেষত বাউল জাতীয় লোক সঙ্গীতের উদারতা ও মানবিকতার প্রভাব উগ্র ইসলামী চেতনার বিকাশের পথে বিরাট প্রতিবন্ধক ছিল। সংস্কৃতির প্রভাব মানুষের সুকুমার বৃত্তি ও চেতনাকে উন্নত করত বলে ধর্মীয় উগ্রতা যেমন সংযত হত তেমন মানুষ হত অনেক বেশী সহনশীল। কিন্তু রেডিও, টেলিভিশনের ব্যাপক বিস্তার এবং বর্ধমান নগরায়নের ফল লোক সংস্কৃতির উপর ধ্বংসাত্মক হয়েছে। এই অবস্থা সমাজের নীচ তলায় এমন এক শূন্যতা সৃষ্টি করেছে যা শাস্ত্রীয় ইসলামী সংস্কৃতির ব্যাপক বিস্তারের সহায়ক হয়েছে।
চতুর্থত, ধর্মীয় প্রভাব বৃদ্ধির অপর একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হল বাংলাদেশ-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর ব্যাপক লুণ্ঠন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে দ্রুত বিরাট উচ্চ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উত্থান। সম্পদ বৃদ্ধির প্রধান উপায় হয়েছে উৎপাদনশীলতার পরিবর্তে লুণ্ঠন, দুর্নীতি ও সন্ত্রাস। এই অবস্থায় অনুৎপাদক ও লুটেরা শ্রেণীর জন্য শাস্ত্রীয় ইসলামকে ব্যবহার করা অত্যন্ত লাভজনক হয়েছে। কারণ এর সাহায্যে পশ্চাৎপদ জনমানসকে নিয়ন্ত্রণ করা এবং জনগণের উপর পীড়নকে সহনীয় করা অনেক সহজতর। জনমানসের পশ্চাৎপদতা ও ভাগ্য নির্ভরতা এবং তাদের উপর নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতার প্রচণ্ড শক্তির কারণে শাস্ত্রীয় ইসলাম এ ক্ষেত্রে সমাজ ও রাষ্ট্রের নেতৃত্ব-কর্তৃত্বকারী শক্তির জন্য খুব লাভজনক হয়ে দেখা দেয়।
এই সামগ্রিক অবস্থা প্রগতিশীল কৃষক আন্দোলনের জন্য সহায়ক নয়। অবশ্য এ দেশে ব্রিটিশ আমল এমন কি পাকিস্তান আমলের আর্থ-সামাজিক অবস্থাও আর সেইরূপ নেই। আমূল পরিবর্তন না হলেও প্রচুর পরিবর্তন হয়েছে। এইসব পরিবর্তনের ফলে ভূমি নির্ভর প্রথাগত সামাজিক কর্তৃত্বের শক্তি হ্রাস পেয়েছে এবং আধুনিকায়ন ও যন্ত্রের প্রভাব কৃষিতেও অনেকটা প্রসারিত হয়েছে। কিন্তু জনগণ ও কৃষকের মানস জগতে ধর্মের শক্তি হ্রাস পায়নি, বরং কোনও কোনও ক্ষেত্রে তা বৃদ্ধি পেয়েছে। এই অবস্থা বিজ্ঞান, আধুনিকায়ন এবং গণতন্ত্রের জন্য মোটেই অনুকূল নয়। কারণ মানুষের মানস জগৎ তার আচরণ ও কর্মকাণ্ডকে বিপুলভাবে নিয়ন্ত্রণ করে। তাই মানুষকে শুধু অর্থনীতি দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। মানুষের অনেক কাজই অর্থনীতির স্থূল নিয়মবহির্ভূত।
যাইহোক, শ্রেণী সংগ্রামের অর্থনীতিবাদী দৃষ্টিভঙ্গীর অসারতা সম্পর্কে ধারণা পাবার জন্য আমি এ দেশের কৃষক আন্দোলনের ঐতিহ্যিক এলাকার দিকে একটা দৃষ্টি দিব। আর তা থেকে কৃষক আন্দোলনের ক্ষেত্রে কৃষকের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও বাস্তবতা এবং মন-মানসিকতা অর্থনীতির বাস্তবতার চেয়ে কত শক্তিশালী সেটা স্পষ্ট হবে। ইংরেজ শাসনকালে এ বাংলায় তেভাগা কৃষক আন্দোলনের প্রধান এলাকাগুলো ছিল তৎকালীন দিনাজপুর, রংপুর, রাজশাহী, যশোর জেলা। এছাড়া কৃষক আন্দোলন শক্তিশালী হয়েছিল তৎকালীন ময়মনসিংহ জেলার নেত্রকোনা মহকুমায়। কিন্তু দিনাজপুর, রংপুরে আন্দোলনের মূল শক্তি ছিল রাজবংশীরা। এরা মূলত কোচ উপজাতি উদ্ভূত নিম্নবর্ণের হিন্দু। হিন্দু কৃষি সমাজে এদের আগমন খুব বেশী কাল পূর্বে এমনটা মনে হয় না। দিনাজপুরের কোনও কোনও এলাকায় (বিশেষত উত্তরাঞ্চলে) এদের তাচ্ছিল্য করে পলিয়া বলা হত। এদের সাধারণ পদবী ছিল বর্মণ। এছাড়া বিশেষ করে দিনাজপুরে ছিল সাঁওতাল উপজাতি যারা তেভাগা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। দিনাজপুর-রংপুরে আন্দোলন বিকাশ লাভ করলে মুসলমান কৃষকরা তাতে ব্যাপক সংখ্যায় অংশ নেয়।
রাজশাহীর কৃষক আন্দোলন ব্যাপক বিস্তৃত ছিল না। সীমিত এলাকায় সাঁওতালদের ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। যশোরের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে তেভাগা আন্দোলন বিস্তার লাভ করে। এখানে এই আন্দোলনের মূল ভিত্তিটা অন্তত প্রথম পর্যায়ে নির্মাণ করেছিল নমশূদ্র হিন্দুরা যারা নিম্ন বর্ণের হিন্দু। যতদূর মনে হয় হিন্দু সমাজ কাঠামোয় এদের প্রবেশও খুব বেশী প্রাচীন ছিল না। উপজাতীয় কিছু বৈশিষ্ট্য এদের মধ্যেও দেখতে পাওয়া যেত। তবে যশোর অঞ্চলে মুসলমান কৃষকদের ব্যাপক অংশগ্রহণ ঘটতে থাকে দ্রুত গতিতে। ফলে সমগ্র যশোর-কুষ্টিয়া অঞ্চলে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে কৃষকদের মধ্যে আন্দোলনের দ্রুত
বিস্তার ঘটে। অন্যদিকে ময়মনসিংহে কৃষক আন্দোলনের মূল ভিত্তি ছিল হাজং উপজাতির কৃষকদের মধ্যে। অর্থাৎ উপজাতি সংস্কৃতি ও সমাজ ব্যবস্থার প্রভাব যে সব এলাকায় বেশী, আন্দোলন দেখা যাচ্ছে সাধারণভাবে সে সব এলাকায় বেশী শক্তিশালী হয়েছিল। এবং কৃষক আন্দোলনের বিস্তার ঘটেছিল মূলত উপজাতি বা অত্যন্ত পশ্চাৎপদ কৃষক জনগোষ্ঠীকে কেন্দ্র করে। একটু উন্নত বা সংহত হিন্দু বা মুসলমান কৃষকদের অংশগ্রহণ পরে ঘটেছিল অথবা কম ছিল। সম্ভবত যশোর অঞ্চল এর ব্যতিক্রম। এখানে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে কৃষকদের মধ্যে কৃষক আন্দোলনের ব্যাপক, গভীর ও দ্রুত প্রসার লক্ষণীয়।
আর এই প্রসঙ্গে আসে সংস্কৃতির প্রভাবের কথা যা মানুষের মানস জগৎকে নির্মাণ এবং প্রতিফলিত করে। মনে রাখতে হবে এ বাংলায় কুষ্টিয়া-যশোর ছিল বাউল আন্দোলনের প্রধান কেন্দ্র বা মূল এলাকা। বাউল সাধক ও গায়কদের উদারনৈতিক ও মানবতাবাদী বৈশিষ্ট্য সর্বজনবিদিত। এক সময় বৈষ্ণব আন্দোলনও এই অঞ্চলে শক্তিশালী ছিল। সম্ভবত এই সব বিভিন্ন মানবতাবাদী ও উদারনৈতিক আন্দোলনের গভীর প্রভাবে পুষ্ট হয়ে এই অঞ্চলটি আজ অবধি দেশে আমূল পরিবর্তনবাদী বা প্রগতিশীল আন্দোলনের শক্তিশালী ভিত্তিভূমি হয়ে আছে।
আমি এবার পাকিস্তান আমলের অভিজ্ঞতায় আসি। ষাটের দশকে বামপন্থী কৃষক আন্দোলন শক্তিশালী ছিল যেসব জেলায় সেগুলোর মধ্যে তৎকালীন দিনাজপুর, রংপুর, পাবনা, কুষ্টিয়া এবং যশোর জেলার নাম উল্লেখযোগ্য। এছাড়া রাজশাহীরও আত্রাই থানাকে কেন্দ্র করে শক্তিশালী কৃষক আন্দোলন গড়ে ওঠে। তবে সেটা ছিল ক্ষুদ্র এলাকা ভিত্তিক। অথচ কৃষক আন্দোলন যেসব অঞ্চলে বিস্তৃত হয়েছিল সেগুলির তুলনায়ও অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং বৃহৎ ভূস্বামী বা জোতদারদের নিপীড়ন অনেক বেশী প্রবল ছিল যেসব অঞ্চলে সেগুলির মধ্যে তৎকালীন ফরিদপুর, বরিশাল জেলার নাম করতে পারি। এত বৃহৎ ও বহু সংখ্যক জোতদার কৃষক আন্দোলনের এলাকাগুলোতে সচরাচর দেখা যেত না। এ ছাড়া রাজশাহীর বিভিন্ন অঞ্চলে এবং পাবনা, ময়মনসিংহ, নোয়াখালী, কুমিল্লার চরাঞ্চলে বৃহৎ জোতদারদের দেখা যেত যাদের অনেকের মালিকানায় বা নিয়ন্ত্রণে হাজার হাজার বিঘা জমি থাকত। দেশের বিভিন্ন চরাঞ্চলে এই সব বৃহৎ ভূস্বামী বা জোতদারের এবং তাদের লাঠিয়াল বাহিনীর দাপট ও নির্যাতন এখনও অতীতের বস্তু হয়নি। কিন্তু এই সব এলাকায় কৃষক আন্দোলন অনুপস্থিত বা নিতান্ত দুর্বল ছিল। অধিকাংশ এলাকাতেই কৃষক সমিতির কোনও নামগন্ধই ছিল না।
দিনাজপুরে বেশ কিছু বৃহৎ জোতদার ছিল। কিন্তু কৃষক আন্দোলন যে সব এলাকায় শক্তিশালী হয়েছিল সে সব এলাকায় বড় জোতদার খুব কম ছিল। রংপুরে কৃষক আন্দোলনের এলাকায় বৃহৎ জোতদার আরও কম দেখেছিলাম। বলা যায় এই সব এলাকায় খুব বড় ভূমিমালিকানা যেমন কম ছিল তেমন মধ্য কৃষকের প্রাধান্য ছিল।
আর তৎকালীন বৃহত্তর যশোর জেলা সম্পর্কে আমার যে অভিজ্ঞতা তা হল এটি ব্যাপকভাবে মধ্য কৃষক অঞ্চল এবং বড় জোতদার সেখানে কম ছিল। জোতদারদের সামাজিক প্রভাবও সেখানে খুব কম দেখতাম। অথচ তার পাশের জেলা ফরিদপুর ছিল বিরাট বিরাট জোতদার অধুøষিত যেখানে কৃষক সংগঠন ও আন্দোলন ছিল অত্যন্ত দুর্বল।
ইতিপূর্বে উল্লেখ করেছি যশোর-কুষ্টিয়া অঞ্চলে বাউল আন্দোলনের প্রভাবের কথা। দিনাজপুর-রংপুর অঞ্চলে ছিল ভাওয়াইয়া গানের ব্যাপক জনপ্রিয়তা। অবশ্য শুধু পল্লী সঙ্গীত দিয়ে কিংবা পল্লী সংস্কৃতির কিছু প্রকাশ দিয়ে কৃষক আন্দোলনের এলাকা গঠনকে ব্যাখ্যা করা যায় না। কারণ পল্লী সঙ্গীত, যাত্রা, পালা ইত্যাদি এক সময় সারা দেশেই জনপ্রিয় ছিল। যেমন নদী বিধৌত ও চরাঞ্চলগুলোতে জারি, সারি ও ভাটিয়ালী গানের ব্যাপক চল ছিল। কিন্তু এই অঞ্চলগুলো ছিল অত্যন্ত ভাঙ্গন প্রবণ। প্রতি বৎসর নদীর ভাঙ্গনে হাজার হাজার মানুষ অবিরাম গৃহহারা ও ভূমিহারা হত এবং আজও হয়। যদিও সেতু, রাস্তা ও বাঁধ নির্মাণের কারণে ইদানীং অতীতের তুলনায় ভাঙ্গন প্রবণতা অনেক হ্রাস পেয়েছে তবু নদী-ভাঙ্গন আজও বাংলাদেশের একটি বৈশিষ্ট্য হয়ে আছে। এই ভাঙ্গনের ফলে যেমন ধনী-দরিদ্র একাকার হয় তেমন কৃষকের জমির সঙ্গে দৃঢ়ভাবে আবদ্ধ কৃষক চরিত্র গঠনেরও অবকাশ থাকে না। কৃষক ও জনগোষ্ঠীর চরিত্র হয় অনেকটা যাযাবর এবং অস্থিতিশীল এবং সেই সঙ্গে খুব বেশী ভাগ্যবাদী। হয়ত এ দেশের বৃহত্তর অঞ্চলে স্থিতিশীল কৃষক আন্দোলন গড়ে ওঠার পথে এই অবস্থাও প্রতিবন্ধক হিসাবে কাজ করেছে।
যাইহোক, বহুবিধ কারণের মধ্যে কৃষকের মানস গঠনে সংস্কৃতির যে গভীর প্রভাব আছে সেটিকে হিসাবে না নিয়ে উপায় নেই। এটি সমাজ কাঠামো নির্মাণের ক্ষেত্রেও অসাধারণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কারণ এর মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠে মানুষের মূল্যবোধ ও বিশ্বদৃষ্টি যা তার সমগ্র আচরণকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। আর তাই সংস্কৃতি শব্দকে আমি এখানে সঙ্কীর্ণ অর্থে ব্যবহার করছি না। এমন কি ধর্মও এর অন্তর্ভুক্ত, সমাজ গঠনে যার ভূমিকা অপরিমেয়।
আমি আমার নিজ অভিজ্ঞতায়ও দেখেছি কৃষক আন্দোলনের উপর সংস্কৃতির প্রভাব কত গভীর হয়। তৎকালীন রংপুর জেলার আদিতমারীকে কেন্দ্র করে আমি যে কৃষক আন্দোলন গড়েছিলাম তার কোষকেন্দ্র বা নিউক্লিয়াস গঠন করেছিল একটি ক্লাব যার কথা আমি প্রথম দিকে উল্লেখ করেছিলাম। অবশ্য এই ক্লাব শুধু নাটক, সঙ্গীত এবং পাঠাগার আন্দোলনের কেন্দ্র ছিল না। রাস্তা নির্মাণ থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের উন্নয়ন কাজেও তার ভূমিকা ছিল। কৃষক আন্দোলনের ভিত্তি নির্মাণে সাংস্কৃতিক ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের গুরুত্ব সম্পর্কে আমার এই অভিজ্ঞতাকে আমি নূতন করে পরীক্ষা করতে চেষ্টা করি ’৭৯ থেকে পরবর্তী কালে। এবং সর্বশেষে দিনাজপুরের খানসামায় ব্যষ্টিক পর্যায়ে বা ‘মাইক্রো লেভেল’-এ আমি এই পরীক্ষা করি।
এবার আমি আমাদের মত মুসলিম সমাজে কৃষক বিপ্লব কিংবা সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে সমাজ বিপ্লবের রাজনীতির গুরুতর সমস্যার দিকে দৃষ্টি দিব।
ইসলামী সমাজে বিপ্লবের সমস্যা
সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনের জন্য সশস্ত্র সংগ্রাম বা সশস্ত্র বিপ্লব নির্ভর করে মূলত সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার চরিত্র ও বৈশিষ্ট্যের উপর। যে ব্যবস্থা সহিংসতা বা বলপ্রয়োগের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত তাকে শুধু অহিংস বা শান্তিপূর্ণ উপায়ে পরিবর্তিত করা সম্ভব এটা অভিজ্ঞতা ও যুক্তি কোনওটা দিয়ে প্রতিষ্ঠা করা যায় না। তবে বিতর্ক থাকতে পারে পাল্টা সহিংসতা বা বলপ্রয়োগের মাত্রা বা পরিমাণ নিয়ে। অবশ্য সমাজ বা রাষ্ট্র ব্যবস্থা পরিবর্তনের জন্য বিপ্লবী সহিংসতার মাত্রা অনেক সময় বহুবিধ ঘটনা বা উপাদানের কারণে অনেক কম বা নামমাত্রও হতে পারে। যেমন যখন আন্তঃরাষ্ট্রীয় যুদ্ধের মাধ্যমে একটা রাষ্ট্রের রাষ্ট্রিক-সামাজিক ব্যবস্থার প্রতিরক্ষার শক্তি যথেষ্ট পরিমাণে ভেঙ্গে পড়ে তখন তার চরিত্র যত বর্বর হোক তার নিদারুণ দুর্বলতার কারণে বিপ্লবী সহিংসতার নিম্নতম প্রয়োগ প্রয়োজনীয় হতে পারে।
পাকিস্তান আমলে দীর্ঘ ও বর্বর সামরিক-আধাসামরিক শাসন এবং জাতিগত নিপীড়ন সমাজ ও রাষ্ট্রের শান্তিপূর্ণ পরিবর্তনের পথ সাধারণভাবে রুদ্ধ করে রেখেছিল। সুতরাং বাঙ্গালীর জাতিগত মুক্তি ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য সশস্ত্র সংগ্রামের লক্ষ্যাভিমুখী রাজনীতি ও বিপ্লবী আদর্শের প্রয়োজন ছিল তীব্র। বিশেষত একটা পশ্চাৎপদ সমাজের দ্রুত আধুনিকায়নের প্রয়োজনে বিপ্লবী আদর্শের গুরুত্ব ছিল অপরিমেয়। সে কালে এই ধরনের আদর্শ হিসাবে বিশ্ব পরিসরে প্রসারমান মার্কসবাদ বা কমিউনিজম এ দেশে ষাটের দশকে দ্রুত বিস্তার লাভ করে। মূলগতভাবে কমিউনিস্ট রাজনীতি সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার পরিবর্তন এবং সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অনুসারী। এই বিপ্লব হয় শ্রমজীবী জনগণের উপর নির্ভর করে এবং তত্ত্বগতভাবে শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বে। সুতরাং কমিউনিস্টদের নিকট শ্রমিক ও জনগণের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ কৃষকদের সংগঠিত করার গুরুত্ব তাদের আদর্শের কারণেই অপরিমেয়। এই কাজ তারা তাদের সাধ্য ও বুদ্ধি মত করেছিল।
তাদের আন্দোলন ও কাজের ফলে সমাজতলে যে ধাক্কা লাগে তাতে সমাজের শক্তিসমূহ গতিশীল হতে শুরু করে। এই গতিশীলতার ফলটা কিন্তু ততটা তাদের পক্ষে যায় না যতটা যায় সমাজের স্থিতাবস্থার শক্তির পক্ষে। ফলে জেগে ওঠে ইসলামের কাঠামোবদ্ধ শক্তিগুলো। কারণ সমাজতল তথা আমজনতা সমাজে নূতন চেতনার শক্তির অভুøদয় ও পুষ্টি ঘটাতে অক্ষম থাকে। এর সবচেয়ে বড় কারণ ইসলামের সুদৃঢ় নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা যা সমাজের চেতনা, সংস্কৃতি ও আচরণকে গভীর ও প্রবলভাবে নিয়ন্ত্রণ করে। এর ফলে সমাজ থেকে যে রাজনীতির শক্তি জেগে ওঠে তা প্রবলভাবে ধর্মাশ্রিত হতে পারে। তবে বিদেশী শাসনকালে জাতীয়তাবাদের প্রভাবের ফলে ধর্মীয় অনুভূতি ততটা প্রবল না হতে পারে। কিন্তু সেটা কমিউনিস্ট রাজনীতির স্পষ্ট ও সক্রিয় লোকবাদের ধারার বিপরীতে বা সমান্তরালে এমন একটা রাজনীতির ধারার উত্থান ঘটায় যার বাইরের আবরণ এক ধরনের লোকবাদী এবং উদারনৈতিক হলেও অন্তর্বস্তু হয় ইসলামী। বিদেশী শাসনের অবসানের পর এই অন্তর্বস্তু উদারনৈতিক আবরণকে অপসারিত করতে কিংবা তাকে অধীনস্থ করতে পারে। বিশেষ করে উদারনৈতিক হিসাবে কথিত সংস্কারবাদী রাজনৈতিক নেতৃত্বের ব্যর্থতা ও সামাজিক সংকটের বৃদ্ধি ঘটলে সমাজ সমস্যার সমাধান হিসাবে ইসলামী পুনর্জাগরণ বিকল্প হয়ে দেখা দিতে পারে। ইসলামের ইতিহাসে একটা চক্র আবর্তিত হতে দেখা যায়। মৌলবাদী ইসলামের উত্থানের মাধ্যমে একটা উগ্র ইসলামী শক্তি সাম্য ও ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতা দখল করে। কিন্তু ক্ষমতায় যাবার পর ব্যবহারিক প্রয়োজনে এবং ক্ষমতা ও সম্পদের প্রভাবে ধীরে ধীরে তা ইসলামী রীতিনীতি পালন বা প্রয়োগের ক্ষেত্রে তুলনামূলকভাবে নমনীয় হতে থাকে। কিন্তু নূতন করে নির্যাতন, শোষণ ও বৈষম্য বৃদ্ধি এবং বিভিন্ন সঙ্কটের কারণে এক সময় পুনরায় আর একটি মৌলবাদী উত্থান দেখা দেয় যা আদি ইসলামের তুলনামূলক সাম্য ও অনাড়ম্বরতার যুগে সমাজকে ফিরিয়ে নেবার প্রতিশ্রুতি দেয়। এটা এখানে উল্লেখ করা দরকার যে, ইসলামের এই সাম্যের আবেদনের কারণেও কমিউনিজমের সাম্যের আবেদন ইসলামী সমাজে তেমন কোনও সাড়া জাগাতে ব্যর্থ হয়েছে।
আমার ধারণা ধর্মের বিষয় না বুঝলে ইসলামী সমাজের কোনও সমস্যারই সঠিক সমাধান খুঁজে পাওয়া যাবে না। এমন কি এটা হিন্দু সমাজের জন্যও প্রযোজ্য। আসলে এই উভয় সমাজের কাঠামো ও মানস গঠনে অর্থনীতি কিংবা উৎপাদন ব্যবস্থা যে ভূমিকাই পালন করুক ধর্মের ভূমিকা কম গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং অনেক ক্ষেত্রে বেশী। বস্তুত এই উভয় সমাজের কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠান বা শক্তি হচ্ছে দুই বিশেষ ধরনের ধর্ম। প্রধানত এই ধর্মকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে সমাজের গড়ন বা কাঠামো। সুতরাং সমাজ পরিবর্তনের প্রশ্ন ধর্মের সঙ্গে সম্পর্কিত। তবে এখানে এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ নেই। আমি শুধু কৃষক আন্দোলনের সমস্যা আলোচনা করতে গিয়ে প্রাসঙ্গিক বিষয়গুলো আলোচনা করতে চেষ্টা করছি।
আর এই প্রসঙ্গেই আসে কৃষক বিপ্লব কিংবা সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে সমাজ পরিবর্তনের রাজনীতির সঙ্কট। উন্নত সংস্কৃতি ও আধুনিক শিক্ষার অভাব, পশ্চাৎপদ অর্থনীতি ও প্রযুক্তির অবস্থান ইত্যাদি কারণে ইসলামী সমাজে কৃষকের মৌল চেতনা অত্যন্ত পশ্চাৎপদ এবং সেহেতু প্রতিক্রিয়াশীলও। এই মৌল চেতনার পরিবর্তন না ঘটিয়ে যখন শুধু ভূমি সংস্কার কিংবা অর্থনৈতিক ব্যবস্থা পরিবর্তনের জন্য বিপ্লব বা সহিংস উপায়ে সমাজ পরিবর্তনের রাজনীতি প্রচার করা যায় তখন তা বিপ্লবী রাজনীতির জন্য করুণ পরিণতি বয়ে আনতে পারে। সমাজ পরিবর্তনের জঙ্গী শক্তি যখন সমাজ অভ্যন্তর থেকে শক্তিগুলোকে মুক্ত করতে থাকে তখন প্রকৃতপক্ষে বোতলে আবদ্ধ জিন্ ছিপি মুক্ত হয়ে বেরিয়ে আসে। ইরান, সুদানের অভিজ্ঞতার দিকেও আমরা দৃষ্টি দিতে পারি যেখানে কমিউনিস্টরা সুদীর্ঘকাল ব্যাপকভাবে জনগণের মধ্যে কাজ করেছিল। বিশেষত ইরানে কমিউনিস্টদের শ্রমিক ও কৃষকদের মধ্যে সুদীর্ঘকাল ব্যাপী নিরলস চেষ্টার কথা সুবিদিত। ইরানে শাহ্ বিরোধী গণ-অভুøত্থানের ক্ষেত্র প্রস্তুত করার কৃতিত্ব তাদের কম নয়। তারা সুদীর্ঘকাল ধরে অপরিসীম শ্রম করে, নির্যাতন সয়ে জনগণকে সংগঠিত করেছিল। কিন্তু সমাজ যখন গণ-অভুøত্থানে জেগেছে তখন সবটুকু কাজের ফল চরমপন্থী বা মৌলবাদী ইসলামী শক্তির হাতে চলে গেছে। আজ সুদানেও ইসলামী উগ্রপন্থী বা মৌলবাদীদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত।
ইসলামী সমাজে বিপ্লবের সমস্যা বোঝার জন্য এটা বোঝা দরকার যে, শাস্ত্রীয় ইসলাম নিরঙ্কুশভাবে এককেন্দ্রিক। তার নিরঙ্কুশ এককেন্দ্রিক বিশ্ব ও সমাজ চেতনা ‘লা শরীক আল্লাহ্’ এই ঘোষণায় প্রতিফলিত। অর্থাৎ শাস্ত্রীয়ভাবে কিংবা প্রথাগতভাবে এই সমাজ চেতনায় দৃঢ়মূল রয়েছে নিরঙ্কুশ একের শাসন, যার অর্থ হল এটি নিরঙ্কুশভাবে একনায়কতান্ত্রিক। সমাজ ও রাষ্ট্র শাসনে ঐক্যমত থাকতে পারে তবে সেটা গণতান্ত্রিক নয়। কারণ এখানে ব্যক্তির স্বাধীনতা, তার ভিন্ন মত পোষণ ও প্রকাশের স্বাধীনতা এবং ভিন্ন জীবনাচরণের স্বাধীনতা থাকে না। তাই শাস্ত্রীয়ভাবে ইসলামী সমাজ ব্যক্তিসত্তাহীন। এটা সম্পূর্ণরূপে গোষ্ঠীবাদী।
অন্যদিকে, এটা বোঝা দরকার যে, এই সমাজ নিরঙ্কুশভাবে পুরুষতান্ত্রিক। অর্থাৎ পুরুষ এই সমাজের সর্বময় নিয়ন্তা। যুগের ধারায় ভিন্ন সমাজ ও ব্যবস্থার চাপে এই সমাজে আধুনিক কালে যেসব পরিবর্তন এসেছে আমি তার কথা বলছি না। আমি বলছি শাস্ত্রীয় ইসলাম এবং প্রথাগত ইসলামী সমাজের মৌল বৈশিষ্ট্যের কথা। সে কথা বলতে গিয়ে আরও বলতে হয় যে, এই সমাজের মর্মে আছে জেহাদ বা ধর্মযুদ্ধের চেতনা। যাঁরা ইসলামী শাস্ত্র ও ইতিহাস সম্পর্কে খোঁজ-খবর রাখেন তাঁরা জানেন জেহাদ ইসলামে কতটা গুরুত্বপূর্ণ। ধারণাগত ও আচরণগতভাবে এর গুরুত্ব অপরিমেয়, কারণ প্রধানত জেহাদের মাধ্যমে ইসলামের প্রসার ও বিজয়।
সুতরাং শাস্ত্রীয় ইসলামের মর্মে আছে এক নিরঙ্কুশ জেহাদী সামরিক পুরুষ। শুধু রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক পরিবর্তন ঘটাতে গিয়ে বিপ্লবী প্রয়াস ইসলামী সমাজের মর্মে অবস্থিত এই জেহাদী সামরিক পুরুষ শক্তিকে জাগায়। অর্থাৎ বিপ্লবী রাজনীতির প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে প্রবলতর হয়ে ওঠে ইসলামের কাঠামো রক্ষক একনায়কী সামরিক পুরুষ শক্তি। প্রগতিশীল গণ-আন্দোলন বা কৃষক আন্দোলন পরিবেষ্টিত হয় ব্যাপক কৃষক দ্বারা সমর্থিত প্রবলতর জেহাদী ইসলামী পুনর্জাগরণবাদী শক্তি দ্বারা কিংবা এই শক্তির সঙ্গে ঐক্যবন্ধনে আবদ্ধ তুলনায় নমনীয় বা উদারনৈতিক কিন্তু বিপ্লব-বিরোধী শক্তি দ্বারা। এটাকে কাজে লাগাবার শক্তির অভাব হয় না। ইন্দোনেশিয়ায় সেনাবাহিনী ইসলামী মৌলবাদী শক্তির সঙ্গে সমন্বিতভাবে কমিউনিস্টদের ধ্বংস করেছিল প্রায় দশ লক্ষ মানুষের রক্ত স্রোত প্রবাহিত করে। আফগানিস্তানে মৌলবাদীদের সমর্থনে নেমেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং পাকিস্তান। পাকিস্তান আমলে কৃষক-শ্রমিক আন্দোলনের ফলে উগ্র ইসলামী শক্তির এই ধরনের জাগরণ সেভাবে সম্ভব হয়নি। সেটার প্রধান কারণ বিজাতীয় মুসলিম আধিপত্যের বিরুদ্ধে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদী চেতনার প্রাবল্য। এই প্রসঙ্গে আমার একটা অভিজ্ঞতার কথা বললে হয়ত আমার এই বক্তব্যের তাৎপর্য আরও স্পষ্ট হবে। সম্ভবত ১৯৭০-এর ঘটনা। আমরা আদিতমারী থেকে সাত মাইল দূরবর্তী লালমণিরহাটে মিছিল করে যাচ্ছিলাম। লালমণিরহাটের কাছাকাছি আসতে কৃষকের বিভিন্ন দাবীভিত্তিক ্লোগানের এক পর্যায়ে কৃষকরা এত উত্তেজিত হয়ে পড়ে যে, সব ্লোগান বাদ দিয়ে তারা ্লোগান দিতে শুরু করল ‘নারায়ে তকবীর আল্লাহু আকবর’। সবচেয়ে মজার ব্যাপার এর পরেই তারা ধ্বনি তুলল ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’। জোশের চোটে তাদের মধ্যে তখন নারায়ে তকবীর এবং পাকিস্তান এসে গিয়েছিল। বোঝা যায় যে, এটা তাদের দীর্ঘকালের অভ্যাস ও চেতনার প্রতিফলন। অথচ তারা ছিল স্বাধীন পূর্ব বাংলার সমর্থক। দুই ্লোগান বন্ধ হল তখন যখন আমরা ধ্বনি তুললাম ‘শ্রমিক-কৃষক অস্ত্র ধরো, পূর্ব বাংলা স্বাধীন করো’! এরপর সবাই আর সব ্লোগান ছেড়ে বা গৌণ করে বিপুল উৎসাহে স্বাধীন পূর্ব বাংলা প্রতিষ্ঠার সংকল্প ঘোষণা করে চলল, এবং ধর্মীয় ্লোগান আর কখনও আসেনি। এর জন্য কাউকে কিছু বলতেও হয়নি। এটা বহু সংখ্যক অনুরূপ ঘটনার মধ্যে একটা ক্ষুদ্র ঘটনার উল্লেখ যা তৎকালে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের বিপুল তাৎপর্যকে কিছুটা হলেও অনুভব করতে সাহায্য করতে পারে। অর্থাৎ পাকিস্তান আমলে জাতীয়তাবাদ ছিল উগ্র ও আক্রমণাত্মক ধর্মীয় চেতনার বিকাশের বিরুদ্ধে এক প্রবল শক্তি। কিন্তু তা সত্ত্বেও ’৭১-এ পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর ছত্রছায়ায় শুধু জামায়াত-রাজাকারের কর্মকাণ্ডে নয়, উপরন্তু হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর কৃষক ও সাধারণ জনগণের এক উল্লেখযোগ্য অংশের আক্রমণ ও নির্যাতনের ভিতরেও এই ধরনের সহিংস এবং আক্রমণাত্মক চেতনার প্রকাশ ঘটতে দেখা যায়।
এ বিষয়ে সন্দেহ নেই যে, পাকিস্তানের ভূ-রাজনৈতিক ও আদর্শিক কাঠামো ধ্বংসের জন্য জাতীয় মুক্তি যুদ্ধের অপরিহার্যতা ছিল। আর এই যুদ্ধের চেতনা বিস্তারের জন্য এ দেশে সশস্ত্র বিপ্লবের রাজনীতির প্রচার ও প্রসারের গুরুত্ব ছিল অপরিমেয়। অবশ্য শুধু কৃষক বিপ্লবের রাজনীতি নয়, পূর্ব বাংলার বুকে বাঙ্গালী জাতির স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য যুদ্ধের রাজনীতিও বামপন্থী জাতীয়তাবাদীরা এ দেশে প্রতিষ্ঠা ও বিস্তার করে। এই রাজনীতির মূল শক্তি ছিল ষাটের দশকের বামপন্থী ছাত্র-যুব সমাজ। তারাই অবশ্য সেকালে কৃষক আন্দোলন সংগঠনেরও প্রধান শক্তি হয়ে উঠেছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও বাম রাজনীতির মূল নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতে ছিল না। তারা নেতৃত্বের শক্তি ছিল না। নেতৃত্ব যাদের হাতে ছিল সেই ঐতিহ্যিক কমিউনিস্ট নেতারা তাঁদের তত্ত্ব এবং চীনের প্রতি আনুগত্যের কারণে বাঙ্গালীর জাতীয় মুক্তির প্রশ্নকে কখনই গুরুত্ব দেননি। কিন্তু তা সত্ত্বেও স্বাধীনতাকামী তরুণ প্রজন্মের প্রবল তেজকে রোধ করার সাধ্য কারো হয়নি। তারা তাদের জ্ঞান-বুদ্ধি মত জাতীয় মুক্তির সঙ্গে, বাঙ্গালীর স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের সঙ্গে শ্রেণী সংগ্রাম ও কৃষক বিপ্লবকে সমন্বিত করতে চেষ্টা করেছিল। নেতৃত্বের কারণে সেটা সঠিকভাবে সমন্বিত না হলেও এই বিপ্লবী রাজনীতির অভিঘাতে সমাজে যে তীব্র জাতীয়তাবাদী আবেগ এবং গতিশীলতার সঞ্চার হয় তা ক্রমবর্ধমান ও প্রাধান্যকারী শক্তি হিসাবে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে সশস্ত্র সংগ্রামের দিকে ঠেলে দেয়। শান্তিপূর্ণ ও নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনে বিশ্বাসী আওয়ামী লীগ ৬-দফার কাঠামোতে জাতীয় আন্দোলনকে সীমাবদ্ধ রাখতে ব্যর্থ হয়ে সময়ের দাবীকে মেনে নিল। আর এইভাবে ’৭১-এর জাতীয় মুক্তি যুদ্ধ শুরু হলে আওয়ামী লীগ তাতে নেতৃত্ব দিল। সুতরাং যুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত এ দেশের স্বাধীনতা বামপন্থী জাতীয়তাবাদীদের নিকট খুব বেশী রকম ঋণী, বিশেষত বামপন্থী ছাত্র-যুব শক্তির নিকট। আওয়ামী লীগের ৬-দফার ভূমিকা স্বীকার করে নিলেও এই সত্যকে অস্বীকার করার কোনও বাস্তব যুক্তি নেই। এক অর্থে এটা এ দেশের সকল ধরনের বামপন্থার যুগান্তকারী সাফল্য। এবং নিশ্চয় বিপ্লবী কৃষক আন্দোলনেরও সাফল্য।
কিন্তু এ দেশে বিপ্লবী কৃষক রাজনীতির যে ঐতিহাসিক ভূমিকা ছিল স্বাধীন বাংলাদেশ-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর তা শেষ হয়েছে বলে আমি মনে করি। এ কথা আমি বলি না যে, ভূমি সংস্কারের প্রয়োজন এখন আর নেই, যদিও ভূমি ব্যবস্থায় আগের অবস্থা আর নেই। জনসংখ্যার চাপে ভূমির খণ্ড-বিখণ্ডীকরণ, ভূমির বাইরে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সম্প্রসারণ, বৃহৎ ভূমিমালিকানার ব্যাপক আয়তন হ্রাস, কৃষিতে আধুনিক পদ্ধতির প্রসার ইত্যাদি সত্ত্বেও ভূমি সংস্কারের প্রয়োজন আছে। কারণ ভূমি সংস্কার আজও সম্পূর্ণ হয়নি। এমন কি কাগজে-কলমে বেশ কিছু প্রগতিশীল আইন করার পরেও সেগুলোর প্রয়োগ হয়নি। পুঁজি বিকাশের স্বার্থেই পূর্ণাঙ্গ ভূমি সংস্কার প্রয়োজন। এর জন্য কৃষকের সংগঠন ও আন্দোলনের ভূমিকা থাকবে। তাছাড়া কৃষকের বিভিন্ন সমস্যা সমাধান ও দাবী আদায়ের জন্য আন্দোলন থাকবে।
তবে বিদ্যমান অবস্থায় কৃষককে প্রাধান্য দিয়ে সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টার সাফল্য যেমন নেই তেমন তার বিপদের দিকটাও মনে রাখা দরকার। সুতরাং কৃষক আন্দোলন গড়ার ক্ষেত্রে সতর্ক হিসাবের প্রয়োজন অত্যন্ত বেশী। স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর জাতীয়তাবাদের গুরুত্ব থাকলেও তার শক্তি পূর্বের মত প্রবল নয়। অবশ্য প্রচলিত ধর্মীয় চেতনার বিপরীতে আদর্শিক শক্তি হিসাবে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের ভূমিকা আজও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তা সত্ত্বেও পাকিস্তান আমলের সঙ্গে পার্থক্যের দিকটা মনে রাখতে হবে।
এ দেশে কৃষক আন্দোলনের একটি সমস্যা পুঁজি গঠনের সমস্যা। এ ক্ষেত্রে ভূমির স্বল্পতা, অতি বৃহৎ ভূমিমালিকানার অনুপস্থিতি প্রচলিত অর্থে কৃষি বিপ্লব কিংবা ভূমি সংস্কারের গুরুত্ব পূর্বের তুলনায় হ্রাস করেছে। বরং কৃষকের মধ্য থেকে যাতে আধুনিক ও উৎপাদনশীল পুঁজি গঠনের শক্তি উঠে আসতে পারে তার জন্য সচেতনতা বৃদ্ধি, আধুনিক শিক্ষার সম্প্রসারণ, নূতন সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা, ঋণ ও প্রযুক্তির সরবরাহ ইত্যাদির গুরুত্ব অনেক বেশী। এগুলির মধ্য দিয়ে কৃষক চেতনা মধ্যযুগীয় চেতনার নিগড় মুক্ত হবার অনুকূল পরিবেশ পাবে।
অন্যদিকে, আর একটি বিষয় আমার নিকট অতীব গুরুত্বপূর্ণ। সেটি হল নারী অধিকারের ব্যাপক বিস্তার এবং নারীর ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা। আমার ধারণা ইসলামী সমাজে আধুনিকায়ন ও গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় শক্তি নারী। সমাজের সহিংস ও আক্রমণাত্মক মানসিকতা, উগ্রতা ও অসহিষ্ণুতা এবং স্বৈরতন্ত্র বা একনায়কতন্ত্রের ভিত্তিকে খর্ব করতে হলে নারীর জাগরণ ও ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা ছাড়া আর কোনও পথ আছে বলে মনে হয় না। নম্র নারীত্বকে সমাজ জীবন থেকে বহিষ্কার করে পুরুষ-পদতলে ও অবরোধে ঠেলে দিয়ে যে হিংস্র, উগ্র ও আক্রমণাত্মক পুরুষ শক্তির অগ্রাভিযান তাকে ভিতর থেকে পরাভূত ও সংযত করতে হলে নারী শক্তির জাগরণ ছাড়া আর কোন পথ আছে? এই কারণে সকল মৌলবাদী ও চরমপন্থী ইসলামী শক্তির নারীর স্বাধীনতা ও ব্যক্তিত্বশীলতার প্রতি এত আতঙ্ক ও ঘৃণা। নারীই তার সবচেয়ে বড় শত্রু, অথচ তাকে ছাড়া তার চলে না। সুতরাং নারীকে নিয়ন্ত্রণ করাই তার সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়ে থাকে। নারীকে ঐ পুরুষের অধীনতামূলক ও বর্বর নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত করলে ঐ পুরুষও মুক্ত হয় এক বিকৃত বর্বরতা থেকে। সমাজ মানসের, আর এইভাবে, সমাজ গড়নেরও পরিবর্তনের পথ খুলে যায়।
আর এইভাবে দেখা যাচ্ছে এনজিও-এর ভূমিকা। বস্তুত এ দেশে সমাজ উন্নয়ন ও পরিবর্তনের ক্ষেত্রে এনজিও কর্মকাণ্ডের তাৎপর্য নিয়ে নূতনভাবে আলোচনার প্রয়োজন আছে।
এনজিও এবং সমাজ পরিবর্তন
এনজিও সংক্রান্ত আলোচনার শুরুতে আমার নিজ অভিজ্ঞতার কিছু উল্লেখ করা সম্ভবত উচিত হবে। শুরুতে বলেছি যে, আমি ১৯৭৯ থেকে গ্রামাঞ্চলে কৃষক জনগণের মধ্যে উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড সংগঠিত করার চেষ্টা শুরু করি। ’৭২ থেকে আমার ধারণা হয়েছিল যে, কৃষকদের বা গ্রামাঞ্চলের জনগণের সংগঠিত শক্তি গড়ে তোলায় পুরাতন পদ্ধতিতে কাজ করে লাভ নেই। ক্রমে আমার কাছে উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে জনগণকে সংগঠিত করে আন্দোলনের নূতন গতিধারা গড়ে তোলার ধারণা স্পষ্ট হয়। এই ধারণা থেকে আমি ’৭৯ থেকে পুরাতন বাম কর্মীদের মধ্যে যাঁরা আমার সঙ্গে একমত হন তাঁদের দিয়ে গ্রামাঞ্চলে সমিতি, ক্লাব ইত্যাদি গড়ে তোলার এবং যেগুলো ইতিমধ্যে ছিল সেগুলোকে সমন্বিত করার চেষ্টা করতে থাকি। এখানে বলে রাখা ভাল যে, সেই সময় যাঁরা আমার সঙ্গে একমত হন তাঁরা প্রায় সকলে ছিলেন দলবিচ্ছিন্ন। এই সময়ে আমার অবশ্য এনজিও সম্পর্কে তেমন কোনও ধারণা ছিল না। আমার ধারণা ছিল এগুলো শুধুমাত্র ত্রাণ সাহায্য করে থাকে। অবশ্য তখন এনজিও-এর সংখ্যা ছিল আজকের তুলনায় অনেক কম।
যাইহোক, উন্নয়ন কর্মকাণ্ড সংগঠিত করার চেষ্টা চালালেও আমরা এগোতে পারছিলাম না। এ ধরনের কর্মকাণ্ডে অভ্যন্তরীণ অর্থ সাহায্য কারও কাছ থেকে পাইনি। ফলে গ্রামাঞ্চলের কাজগুলোকে কেন্দ্রীয়ভাবে সমন্বিত করা যাচ্ছিল না। ’৮০-তে আমরা এনজিও প্রক্রিয়ার অস্তিত্ব সম্পর্কে ধারণা পাই এবং জানতে পারি যে, এই ধরনের কাজে বিদেশী তহবিল পাওয়া যায়। যেহেতু অভ্যন্তরীণভাবে অর্থবহভাবে তহবিল সংগ্রহ করার সম্ভাবনা দেখিনি সেহেতু প্রচলিত অর্থে এনজিও প্রক্রিয়ায় সংগঠন গঠনের সিদ্ধান্ত নিই। এনজিও ধারারও কিছু সংখ্যক ব্যক্তি এই সময় আমার উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত হন। আমরা ১৯৮০-তে রিসোর্স ইন্টিগ্রেশন সেন্টার বা সংক্ষেপে ‘রিক’ নামে একটি এনজিও গঠন করি যা ১৯৮১-তে সমাজ সেবা বিভাগে নিবন্ধীকৃত হয়। আমি এই সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হই।
রিক আমাকে কতকগুলো ধারণা পরীক্ষা করার সুযোগ দেয়। যেমন সংগঠনে গণতন্ত্র অনুশীলনের চেষ্টা। আর সেটা করতে গিয়ে আমার বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা হয়। এখানে দেখেছি সহজ অর্থের লোভে অনেকে কত নীচে নামতে পারে। আসলে সম আদর্শে বিশ্বাসী এবং সৎ ও যোগ্য ব্যক্তিদের একটি গোষ্ঠী গড়ে না উঠলে যে, এখানে গণতন্ত্রের কাগুজে অনুশীলনের বাইরে আর কিছু হয় না এটা আমার একটা অভিজ্ঞতালব্ধ ধারণা। তারপরেও প্রচলিত স্বৈরতান্ত্রিক ও দুর্নীতিগ্রস্ত সামাজিক-রাজনৈতিক আবেষ্টনের কারণে একটি এনজিও-এর ভিতর বিচ্ছিন্নভাবে গণতন্ত্রের কার্যকর অনুশীলন কষ্টকর হতে পারে বলে আমার ধারণা। অর্থ যতদিন না আসে ততদিন গণতন্ত্র হয়ত ভালই চলে। কিন্তু বিদেশ থেকে অর্থ এলে দেখা দেয় অভাবিত সব সমস্যা এবং বিপদ। আমাকে এগুলো দেখতে এবং মোকাবিলা করতে হয়েছে।
এনজিও-এর সাহায্যে কৃষক কিংবা ভূমিহীন আন্দোলন গড়ে তোলার প্রয়াসেও আমার অভিজ্ঞতা নেতিবাচক। সেই প্রয়াস রিকের সাহায্যে যেমন সফল করা যায়নি তেমন অন্যান্য এনজিও-কে নিয়েও করা যায়নি। সময়টা সম্ভবত ১৯৮১ কিংবা ১৯৮২। সেই সময় আমি বিভিন্ন এনজিও-এর ছত্রছায়ায় গড়ে তোলা ভূমিহীন সমিতিগুলোর সমন্বয়ে জাতীয় পর্যায়ে একটি ভূমিহীন ফেডারেশন গড়ার জন্য কয়েকটি প্রধান এনজিও কর্মকর্তার সঙ্গে আলোচনা করি। সেই সময় এ ব্যাপারে ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক ফজলে হাসান আবেদ এবং গণ-স্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রধান ডাঃ জাফরুল্লাহ্ চৌধুরী সহ কয়েকটি এনজিও নির্বাহী প্রধানের সম্মতির ফলে কয়েকটি সভা অনুষ্ঠিত হয় যাতে সাতটি সংগঠনের প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করেন। ব্র্যাক, গণ-স্বাস্থ্য কেন্দ্র, নিজেরা করি, প্রশিকা (ঢাকা), প্রশিকা (কুমিল্লা), আশা এবং রিক এই সাতটি সংগঠনের কয়েকটি বৈঠকের পর ভূমিহীন ফেডারেশন গঠনের ব্যাপারে নীতিগত ঐক্যমত প্রতিষ্ঠা এবং খসড়া বক্তব্য ও কর্মসূচী তৈরির পর ব্যাপারটার সেখানেই সমাপ্তি ঘটে অধিকাংশ সংগঠনের উৎসাহের অভাবের কারণে। এই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে এটা আমার কাছে স্পষ্ট হয় যে, এনজিও-এর পক্ষে অর্থনৈতিক ও বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা সম্ভব হলেও গ্রামীণ জনগণের কার্যকর আন্দোলনের শক্তি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এনজিও-এর সীমাবদ্ধতা রয়েছে।
এরপর আমি রিকের সাহায্যে গণশক্তির নূতন ধরনের বিন্যাস গড়ে তোলার চেষ্টা করতে থাকি। অবশ্য আমার চিন্তা ছিল রিককে সরাসরি যুক্ত না করে কাজটা করা। কারণ এনজিও-এর পক্ষে যে, এ কাজে প্রত্যক্ষ ভূমিকা সেভাবে রাখা সম্ভব নয় সেটা মনে হয়েছিল। আমি চেয়েছিলাম রিককে আমার কাজের সহায়ক হিসাবে পেতে। ফলে যোগ্য লোকদের হাতে রিক পরিচালনার দায়িত্ব তুলে দিয়ে আমি নিজে গ্রামাঞ্চলে কৃষক ও ভূমিহীনদের মধ্যে সংগঠন ও আন্দোলন গড়তে এবং কৃষক আন্দোলনের সমস্যাগুলোকে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পর্কিত করে বুঝতে চেয়েছিলাম।
এ ক্ষেত্রেও আমার অভিজ্ঞতা নেতিবাচক এবং তিক্ততাপূর্ণ। সম্ভবত ১৯৮৬-এর গোড়ার দিকে আমি রিকের নির্বাহী পরিচালকের দায়িত্ব এনজিও ধারা থেকে আগত এক ব্যক্তির হাতে হস্তান্তর করি। এই ঘটনার পর আমার রিকের সঙ্গে সম্পর্ক রাখার অবস্থাও আর রইল না। বিশেষত অর্থ ও ক্ষমতার জন্য চক্রান্ত ও নীচতা দেখে আমার ভিতর তিক্ততাও এসেছিল। সুতরাং আমার ধারণাগুলোকে ব্যষ্টিক পর্যায়ে আরও যাচাই করার জন্য এবং বিভিন্ন জিজ্ঞাসার উত্তর পাবার জন্য আমি ’৮৬-তে ঢাকা ছেড়ে গ্রামাঞ্চলে যাই কিছু দীর্ঘ সময়ের জন্য। দিনাজপুরের খানসামায় আমি বিভিন্ন ধরনের কাজ করি। আন্দোলনের অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হই। আর এই সব মিলে আমার কিছু ধারণাগত পূর্ণতা এলে আমি ’৮৯-তে ঢাকায় ফিরি সেগুলোকে লেখার মাধ্যমে রূপ দেবার জন্য এবং বৃহত্তর পরিসরে কাজ করার জন্য।
যাইহোক, এরপরেও আমি খানসামার গ্রামে যাই ’৯৩-তে। ’৯৪-তে একটা আন্দোলনের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে পুনরায় ঢাকায় আসি। এই সমগ্র পর্যায়ের সব অভিজ্ঞতা বলার অবকাশ এবং প্রয়োজনও নেই। তবে রিক এবং পরবর্তীকালে খানসামার অভিজ্ঞতা থেকে আমি উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ও কৃষক আন্দোলন উভয়ের শক্তি ও সীমাবদ্ধতা দু’টো দিকই বুঝতে চেষ্টা করেছি এবং নারীর ভূমিকার তাৎপর্যও উপলব্ধি করতে চেষ্টা করেছি।
আমাদের সমাজে উন্নয়ন ও প্রগতির ক্ষেত্রে নারীর গুরুত্ব আমার শুধু তত্ত্বগত উপলব্ধির ব্যাপার নয়, এটা আমার অভিজ্ঞতালব্ধ উপলব্ধিরও ব্যাপার। এনজিও-সমূহের সাধারণ অভিজ্ঞতার মত আমারও অভিজ্ঞতা যে, ঋণদান কর্মসূচীতে নারীরা পুরুষদের তুলনায় অনেক বেশী নির্ভরযোগ্য। তাদের কাছ থেকে ঋণের অর্থ অনেক বেশী সহজে ফেরৎ পাওয়া যায়। ঋণের অর্থ সদ্ব্যবহারের ক্ষেত্রেও তারা সাধারণভাবে পুরুষদের তুলনায় বেশী আন্তরিক ও যত্নশীল হয়। উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে স্বেচ্ছাশ্রম দেবার ক্ষেত্রেও আমি নারীদের অগ্রগামী ভূমিকা দেখতে পেয়েছি। খানসামার গ্রামে আমি যখন নারী ও শিশুদের মধ্যে গণশিক্ষা প্রদান এবং একটি নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কাজে হাত দিই তখন শিক্ষক হিসাবে দীর্ঘদিন স্বেচ্ছাশ্রম দান করে শিক্ষিত মুসলিম তরুণীরা। একদিকে হিন্দু কৃষকদের কাছ থেকে জনসেবা ও উন্নয়মূলক কাজে সবচেয়ে বেশী সাহায্য ও সহযোগিতা পাই, অন্যদিকে মুসলিম নারীদের নিকট থেকে আমি এই সহযোগিতা সবচেয়ে বেশী পাই। যাইহোক, অভিজ্ঞতা থেকে আমার মনে হয়েছে সমাজে শক্তি হিসাবে আত্মবিকাশের সামান্য সুযোগ গ্রামীণ নারীদের বিরাটভাবে উদ্দীপিত করে এবং অনেক ক্ষেত্রে তারা পুরুষদের তুলনায় অধিকতর মনোযোগী, শ্রমশীল এবং নির্ভরযোগ্য।
আমার এই সামগ্রিক অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে আমি সমাজ পরিবর্তনের প্রশ্নের প্রেক্ষিতে এনজিও সমস্যার উপর সংক্ষেপে আলোকপাত করতে চেষ্টা করব। তবে এই আলোচনার সময় বলা প্রয়োজন যে, আমার নিজের সক্রিয় এনজিও অভিজ্ঞতা অনেক দিন আগের হলেও সাম্প্রতিক বৎসরগুলিতে আমি বিভিন্ন এনজিও-এর সমস্যাও পর্যবেক্ষণ করতে চেষ্টা করেছি এবং সেই সঙ্গে খানসামায় ব্যষ্টিক বা অতি ক্ষুদ্র পর্যায়ে আমার স্বনির্ভর উন্নয়ন কর্মকাণ্ড থেকে অর্জিত অভিজ্ঞতাকেও আমার এনজিও সংক্রান্ত ধারণা যাচাইয়ে ব্যবহার করেছি।
আমার ধারণা সকল সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও এনজিও-সমূহ বিশেষত গ্রামাঞ্চলের এমন এক বাস্তবতায় পরিণত হয়েছে যাতে করে এনজিও বাদ দিয়ে গ্রাম বাংলাদেশের অনেক কিছু আলোচনা করা সম্ভব নয়। বাম আন্দোলনের ধারায় এনজিও-এর অনেক বিরূপ সমালোচনা আছে যার কিছু সঙ্গত হলেও আমার বিবেচনায় সেগুলোর যৌক্তিক দিকের তুলনায় অযৌক্তিক দিক কম প্রবল নয়। বস্তুত বাম আন্দোলনের নেতা-কর্মীদের এনজিও-এর সমালোচনার এক বড় কারণ তাঁরা এগুলোকে তাঁদের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে মনে করেন। তাঁদের অনেকের অনেক অভিযোগের মধ্যে একটা সাধারণ অভিযোগ হল এনজিও-দের কারণে গ্রামে কৃষক সংগঠন ও আন্দোলন করা যাচ্ছে না। অর্থাৎ এনজিও অপসারিত বা প্রতিহত করছে কৃষক রাজনীতি ও আন্দোলনকে। কিন্তু এই অভিযোগের মধ্যে প্রথাগত বাম কৃষক আন্দোলনের ব্যর্থতা ও সীমাবদ্ধতার স্বীকৃতি আছে বলে আমি মনে করি।
বাস্তবতা হল যে, প্রথাগত কৃষক আন্দোলনের জায়গাটা অনেকাংশে দখল করেছে এনজিও। আর এইভাবে তা সকল সীমাবদ্ধতা নিয়ে সময়ের একটা চাহিদা পূরণ করছে যা করতে প্রথাগত কৃষক আন্দোলন ব্যর্থ হয়েছে। এ দেশে এনজিওগুলো সাধারণত যেভাবে পরিচালিত হয় তার সমালোচনা করা যেতে পারে। কিংবা তাদের কর্মকাণ্ডের কিছু দিকের সমালোচনা করা যায়। তাদের অনেক সীমাবদ্ধতা নিয়েও আলোচনা হতে পারে। কিন্তু সনাতন ধারায় গড়ে ওঠা এ দেশের কৃষক সংগঠন ও নেতৃত্ব সমাজের যে প্রয়োজন পূরণ করতে পারেনি সেটা পূরণে এগিয়ে এসেছে এনজিও। এনজিও-গুলোকে শুধু সাম্রাজ্যবাদ বা নয়া উপনিবেশবাদের হাতিয়ার বলে গালাগালি করে লাভ নেই। কারণ গ্রামাঞ্চলে কৃষকের পঁুজি গঠন, আধুনিকায়ন এবং নারীর মুক্তি কিংবা অগ্রগতির জন্য যা করা দরকার তার যতটুকু হোক প্রধানত তারাই করছে।
হাঁ, এর সমস্যা ও সীমাবদ্ধতার দিকও আছে। যেমন দেশ গ্রাম পর্যায় পর্যন্ত গভীরতরভাবে পাশ্চাত্য-নির্ভর হয়ে পড়ছে। দেশের স্বাধীন ও নিজস্ব ধারায় বিকাশ সম্ভাবনা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কিন্তু যে সমাজের ভিতর থেকে আধুনিকায়নের শক্তি সৃষ্টি হয় না বা বিকশিত হয় না সেখানে তা বাইরে থেকে নেওয়া ছাড়া উপায় কী? বরং যদি এনজিও-গুলো না থাকত তবে বাংলাদেশ যে, এতদিনে চরমপন্থী বা মৌলবাদী ইসলামী শক্তিসমূহ দ্বারা আরও প্রবলভাবে প্রভাবিত হত সে ব্যাপারে অন্তত আমার সংশয় নেই। এনজিও-রা হাত গুটিয়ে বসে থাকলে কি রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে বিপ্লবী কৃষক আন্দোলনের বিকাশ হত? আমি তা মনে করি না। আর পাশ্চাত্য প্রভাবও কি দূর হত বা হ্রাস পেত? সেটাও আমি মনে করি না। যতই পাশ্চাত্য-বিরোধী কিংবা ‘কাফের’-বিরোধী চেতনা সমাজে বিস্তার লাভ করুক সমাজ তার আধুনিকায়ন নিজ শক্তি বলে ঘটাতে পারত না বলে তার সীমাহীন দারিদ্র্য থেকেই যেত, ফলে তা বাধ্য হত আধুনিকায়নের প্রধান শক্তিকেন্দ্র পাশ্চাত্যের দুয়ারে দুয়ারে কৃপা ভিক্ষা করে বেড়াতে। এমন কি দেশে মৌলবাদীরা ক্ষমতা দখল করলেও পাশ্চাত্যের কী অসুবিধা হত জানি না তবে বিপদ যে হত স্বাধীনচেতা ও যুক্তিবাদী ব্যক্তিদের, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের এবং নারী সমাজের এ বিষয়ে আমার সন্দেহ নেই।
এনজিও-রা এ দেশে মৌলবাদের অগ্রগমনের পথে বাধা অর্পণ করেছে বলে মৌলবাদীরা এত এনজিও-বিরোধী। এনজিও-রা দরিদ্র-ভূমিহীন কৃষকদের পুঁজি গঠনে সহায়তা করছে। এটা মুসলিম কৃষক চেতনাকে বিপজ্জনক মৌলবাদী বা উগ্র ইসলামী রাজনীতির দিকে খাতবাহিত হতে না দিয়ে তার উত্থান রোধ করতে সহায়তা করছে।
এই কৃষক চেতনাকে তা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত করে তাকে শান্ত ও সংযত করছে। মার্কসবাদীরা এতে বিপ্লবী শক্তির সম্ভাবনার বিনাশ দেখে ক্ষুব্ধ হতে পারেন। কিন্তু এটা বোঝা দরকার যে, এই ধরনের কৃষক চেতনা দিয়ে সমাজ বিপ্লব হয়নি। কোনওখানেই হয়নি। এখানেও হয়নি, হবেও না। সুতরাং এই কৃষক চেতনাকে সাংস্কৃতিক বা আদর্শিকভাবে পরিবর্তিত করার পূর্বে তাকে বেশী রাজনৈতিক বা সংগ্রামমুখী করতে না চাওয়াই ভাল। তখন তা দ্রুত তার মৌল উৎসে ফিরতে চায়। এই সাংস্কৃতিক বা আদর্শিক পরিবর্তনের জন্য তিনটি উপাদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পুঁজি গঠন, গণতান্ত্রিক কাঠামো ও মূল্যবোধের প্রসার, এবং নারীর ক্ষমতার বিকাশ।
পুঁজি গঠন প্রসঙ্গে এনজিও-দের সমালোচনা আসতে পারে। বিশেষ করে এনজিও-রা মধ্য কৃষককে অবজ্ঞা করে ভূূমিহীন কৃষকদের ঋণদানের মধ্য দিয়ে পুঁজি গঠনের যে পথ বেছে নিয়েছে তাতে দারিদ্র্যের তীব্রতা আপাত দৃষ্টিতে হ্রাস পেলেও তার ফল কতটা ইতিবাচক হবে বলা কঠিন। ভূমিহীন কৃষকদের সামাজিক-অর্থনৈতিক দুর্বলতা ও সীমাবদ্ধতার কারণে এই ঋণের সদ্ব্যবহার দ্বারা পুঁজির গতিশীলতা সৃষ্টির ক্ষমতা যথেষ্ট সীমিত। বরং এই প্রক্রিয়ার ফলে গ্রামে যারা পুঁজি গঠনে সবচেয়ে কার্যকর শক্তি হতে পারত বিশেষত সেই মধ্য কৃষকের প্রতিপক্ষ হিসাবে ভূমিহীন কৃষকরা দাঁড়াচ্ছে। এর ফলে সামগ্রিকভাবে পুঁজি গঠন ও বিকাশের কাজই ব্যাহত হচ্ছে। কারণ এতে করে ভূমিহীন কৃষকরা কেবলমাত্র টিকে থাকছে। বিভিন্ন ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত হয়ে তারা তাদের অবস্থা পূর্বের তুলনায় কিছুটা উন্নত করতেও সক্ষম হচ্ছে। কিন্তু গ্রামাঞ্চলে পুঁুজির বিকাশে তাৎপর্যপূর্ণ পদক্ষেপ দিতে পারছে না।
এটা মনে রাখতে হবে যে, পুঁজি গঠনের জন্যও নেতৃত্বকারী শক্তি লাগে। এটা আমার দৃষ্টিতে প্রধানত মধ্য ও প্রান্তিক কৃষক যারা কিছু পুঁজি পেলে সেটাকে নিজ স্বল্প পুঁজির সঙ্গে মিলিত করে অর্থনীতির দ্রুত প্রবৃদ্ধির পথ সৃষ্টি করতে পারে। আমার ধারণা মাথাপিছু অতি অল্প পরিমাণে ঋণ এবং সেটা প্রধানত ভূমিহীনদের মধ্যে দেবার ফলে গ্রামাঞ্চলে পুঁজি ছড়িয়ে পড়লেও তার সংহতি ও বিকাশ ঘটছে না স্থানীয় নেতৃত্বকারী শক্তির বিকাশ ব্যাহত হবার ফলে।
তবে ভূমিহীন কৃষকদের অগ্রাধিকার দেবার একটা সুফলও আছে পরোক্ষভাবে। সেটা হচ্ছে সমাজের একেবারে তলদেশকে সমাজের মধ্য ও উচ্চ স্তর থেকে বিচ্ছিন্ন করায় পুরাতন সামাজিক সম্পর্ক এবং ক্ষমতা কাঠামো দুর্বল হয়েছে। এর ফলে পুরাতন রীতিনীতি, অভ্যাস ইত্যাদিও অনেক দুর্বল হয়েছে গ্রামীণ মধ্য ও উচ্চ স্তরে। ফলে স্বৈরতান্ত্রিক ও মধ্যযুগীয় যে মানসিকতা মধ্য ও ধনী কৃষক সহ গ্রামীণ উচ্চতর স্তরগুলিতে ছিল তার
অস্তিত্বের ভিত্তি দুর্বল হচ্ছে। অনুগত বাহিনী হারিয়ে এরা আধুনিক মূল্যবোধ ও সংস্কৃতি গ্রহণের জন্য অধিকতর উপযোগী হয়ে উঠছে। ফলে যখন ঋণদান জাতীয় কর্মসূচী অপেক্ষাকৃত উচ্চতর স্তরগুলিতে, বিশেষত মধ্য স্তরে সম্প্রসারিত করা যাবে তখন এর ফল হবে অনেক দ্রুত, দূরপ্রসারী ও তাৎপর্যপূর্ণ। বাংলাদেশে ত্রিশ-একত্রিশ বৎসরের এনজিও অভিজ্ঞতার পর এ দিকের প্রতি এখন মনযোগ দেওয়া উচিত বলে মনে হয়। অর্থাৎ ভূমিহীনদের প্রতি গুরুত্বের পর্যায়টা আমার বিবেচনায় অন্তর্বর্তী হওয়া উচিত। কিন্তু প্রকৃত অর্থে পুঁজির বিকাশ ও শিল্প বিপ্লব ঘটাতে হলে সবচেয়ে বেশী জোর দেওয়া উচিত মধ্য কৃষক কিংবা গ্রামাঞ্চলের মধ্য শ্রেণীর উপর যারা তাদের সামাজিক-অর্থনৈতিক অবস্থান এবং গতিশীলতার কারণে গ্রামীণ পুঁজির বিকাশে নেতৃত্বকারী বা অগ্রণী শক্তি হয়ে দেখা দিতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রে মাথাপিছু ঋণের পরিমাণ হওয়া উচিত অনেক বেশী এবং ঋণদান হওয়া উচিত প্রধানত শিল্পমুখী।
গণতান্ত্রিক কাঠামো ও মূল্যবোধের প্রসার প্রসঙ্গে এনজিও-এর সমালোচনা আসতে পারে। কারণ তারা গ্রামাঞ্চলে জনগণের মধ্যে গণতান্ত্রিক কাঠামো গড়ার কথা বললেও সাধারণভাবে তাদের নিজেদের ভিতর গণতন্ত্র কতটা আছে সেটা স্পষ্ট নয়। এগুলো সাধারণত একব্যক্তিকেন্দ্রিক এবং এগুলো সাধারণত আমলাতান্ত্রিক পদ্ধতিতে পরিচালিত হয়। সুতরাং এই ধরনের এনজিও-গুলো সমাজে গণতন্ত্রের কাঠামো কতটা নির্মাণ করতে পারে সেই প্রশ্ন তোলা যায়। কিন্তু আমার নিজের অভিজ্ঞতা বলে, যে সমাজে চরম দারিদ্র্য, পশ্চাৎপদতা, স্বৈরতন্ত্র এবং দুর্নীতি ও অসততা এত বিস্তৃত ও প্রবল সেখানে বিচ্ছিন্নভাবে গণতন্ত্রের পূর্ণ চর্চা সম্ভব নয়, বরং সেটা অনেক সময় বিপজ্জনক হতে পারে। বিশেষত যেখানে অর্থের প্রশ্ন থাকে সেখানে বেশ কিছু পরিমাণে কঠোর নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন থাকে। তবে এটা সত্যি একটা সমস্যা হয় যখন একটা এনজিও সম্পূর্ণরূপে একব্যক্তিকেন্দ্রিক হয় এবং সংগঠনের কোনও স্তরে জনগণের নিকট জবাবদিহিতা থাকে না। এই ধরনের সংগঠন বস্তুত তার স্বৈরতান্ত্রিক আচরণ ও চরিত্রই সর্বত্র বিস্তৃত করে।
ফলে সমাজের স্বৈরতান্ত্রিক প্রবণতার শক্তি বৃদ্ধি করে। এ ক্ষেত্রে আমার ধারণা অন্তত কেন্দ্রীয় পর্যায়ে কাগজে নয় বাস্তবে গণতান্ত্রিক চর্চা থাকা উচিত এবং মাঠ পর্যায়ে জনগণের নিকট জবাবদিহিতা থাকা উচিত। কেন্দ্রীয় পর্যায়ে গণতন্ত্র একেবারে কোনও এনজিও-তে নেই তা বলি না। তবে যতটুকু থাকা উচিত সেটুকু বৃহৎ কোনও এনজিও-তে আছে কিনা আমার জানা নেই।
আসলে এই অবস্থা স্বাভাবিক। কারণ আমাদের দেশে মহৎ আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে এনজিও প্রক্রিয়ায় কয়জন উদ্যোগ নিয়েছেন বলা কঠিন। যে আদর্শ একদল ব্যক্তিকে উদ্বুদ্ধ করে সেটা না নিয়ে যখন শুধু ব্যক্তিগত আয়-উন্নতির সহজ পথ হিসাবে এবং ‘সেই সঙ্গে দেশের জন্য যদি পারি কিছু করলাম’ এই মনোভাব নিয়ে এনজিও করা যায় তখন এমনটা হওয়াই স্বাভাবিক। যাইহোক, বিরাজমান অবস্থায় গণতান্ত্রিক কাঠামো এবং প্রতিষ্ঠান নির্মাণে এনজিও-দের কাছ থেকে খুব বেশী আশা করে লাভ নেই। তাদের আর একটা সমস্যার কথা মনে রাখা দরকার। সেটা হচ্ছে তাদেরকে একটা আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার নিয়মানুবর্তী হয়েই কাজ করতে হয়। যাইহোক, তবু তারা যা করছে তার মূল্য খুব কম নয়। বিশেষ করে তারা যখন আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বাইরে বেসরকারী প্রতিষ্ঠান হিসাবে শক্তিশালী হয় তখন সেটা এই রকম এক স্বৈরতান্ত্রিক সমাজের গণতান্ত্রিক পরিবর্তনের দিকে অগ্রগমনের ক্ষেত্রটা অন্তত তৈরী করে।
নারীর ক্ষমতার বিকাশ প্রসঙ্গে বলতে হয় সম্ভবত নারীর ক্ষেত্রেই এনজিও-দের ভূমিকা সবচেয়ে সফল এবং নজর কাড়ার মত। আমি এ কথা বলি না যে, এ ক্ষেত্রে তাদের কাজের ফলে সমাজের বিরাট পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। সেটা হয়নি। তবে যেটুকু হয়েছে তাও একেবারে কম নয়। এনজিও-গুলি গ্রামাঞ্চলে লক্ষ লক্ষ নারীকে যেভাবে মধ্যযুগীয় ধর্মীয়-সামাজিক বন্ধন থেকে মুক্ত করছে তা এ দেশে উগ্র ধর্মীয় শক্তির বিকাশকে বিরাটভাবে খর্ব করছে। মুসলিম সমাজে পরিবর্তনের মূল সূত্রটিকে যে, তারা ধরতে অনেকখানি সক্ষম হয়েছে নারীর ক্ষমতার বিকাশে তাদের বিভিন্ন ভূমিকা ও কর্মকাণ্ড থেকে সেটা বোঝা যায়। হয়ত এটা তাদেরও কৃতিত্ব নয়। পাশ্চাত্য যা চেয়েছে বা চায় তা-ই তারা অর্থের বিনিময়ে করছে। তবু ভাল যে, এটা তারা করছে। সামাজিক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে তারা সমাজের ভিতর যে, নূতন উপাদানসমূহ সঞ্চার করছে তার জন্যও তাদের মূল্যায়ন হওয়া দরকার।
এনজিও-দের কাজের পদ্ধতি প্রসঙ্গে আমি এ দেশে বাম আন্দোলনে কৃষকের মধ্যে কাজের অত্যন্ত ক্ষতিকর ও অবৈজ্ঞানিক একটা পদ্ধতি সম্পর্কে বলার প্রয়োজন অনুভব করছি। এটা একটা তুলনা যা থেকে এনজিও পদ্ধতির অগ্রগামী ও উন্নত একটা বৈশিষ্ট্য স্পষ্ট হবে। ষাটের দশকে আমি দেখতাম বামপন্থী নেতারা যুব-কর্মীদের ছত্রভঙ্গ হয়ে বা বিচ্ছিন্নভাবে গ্রামে কাজ করতে এবং এলাকাভিত্তিক কৃষক নেতা হতে বলতেন। তাঁদের মতে, এভাবে পেটি বুর্জোয়া শ্রেণীর কর্মীরা কৃষকদের মধ্যে থেকে শ্রেণীচুøত হয়ে সর্বহারা বিপ্লবী শ্রেণী চরিত্র অর্জন করবে। কিন্তু এতে ফল যেটা হত সেটা হল দীর্ঘ সময় বিচ্ছিন্নভাবে পশ্চাৎপদ গ্রাম ও কৃষকদের মধ্যে পড়ে থেকে এইসব কর্মী জাতীয়, সামগ্রিক এবং উন্নত দৃষ্টিভঙ্গী হারিয়ে পশ্চাৎপদ এবং স্থানিক ও সঙ্কীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গী সম্পন্ন হত। কৃষকদের চেতনাকে উন্নত যতটা করত তার চেয়ে বহু গুণ বেশী নিজেরাই কৃষকদের পশ্চাৎপদ চেতনা ও অভ্যাস দ্বারা প্রভাবিত হত। আর এইভাবে কৃষক আন্দোলন ও সংগঠন হত বাস্তবে পার্টির পশ্চাৎপদ ও খণ্ডিত দৃষ্টিভঙ্গীর ভিত্তি। তাঁদের এই কর্মপদ্ধতি দ্বারা এ দেশের বিরাট সংখ্যক শিক্ষিত কর্মীকে তাঁরা অগ্রগতির বদলে পশ্চাৎপদতায় ঠেলে দিতেন। এইভাবে যে পদ্ধতিতে তাঁরা নিজেরা গড়ে উঠেছিলেন সেই একই পদ্ধতির প্রয়োগে আর একদল পশ্চাৎপদ অনুসারী তৈরী করে নিতেন। কৃষকদের পশ্চাৎপদ চেতনাকে বদলাতে হলে যে, শক্তির ভারসাম্য অর্জন করতে হয় সেই বোধ তাঁদের ছিল না। আসলে তাঁরা শক্তির কেন্দ্রীভবনের গুরুত্বের ব্যাপারটাই বুঝতেন না। এনজিও-দের কর্মকাণ্ডে এই গুরুত্বের বিষয়টা স্পষ্ট। তারা তাদের কর্মীদের বিচ্ছিন্নভাবে বিচ্ছিন্ন এলাকার সংগঠক বা নেতা হতে পাঠায় না। বরং তারা তাদের লক্ষ্য অনুযায়ী নির্দিষ্ট এলাকার পরিবর্তন ঘটাবার জন্য শক্তির সমাবেশ ঘটায়। স্থানীয় পর্যায়ে কার্যালয় স্থাপন, ব্যাপক কর্মী সমাবেশ, নিবিড় তত্ত্বাবধান ইত্যাদি পদ্ধতিতে তারা যেটা করে তা থেকে শিক্ষণীয় আছে।
তবে এনজিও-দের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হল সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য যে সামগ্রিক রাজনৈতিক ও আদর্শিক দিকনির্দেশ ও ভূমিকা দরকার সেটা দেবার ও পালন করার ক্ষমতা তাদের নেই। এনজিও সম্পর্কে এটা বোঝা দরকার যে, জাতি গঠনে তারা বিভিন্নভাবে অবদান রাখলেও জাতি গঠনের মূল কিংবা কেন্দ্রীয় কাজ তাদের দিয়ে হবার নয়। এই কাজ রাজনীতির এবং রাজনৈতিক শক্তির। কোনও কোনও এনজিও ক্ষেত্র বিশেষে স্থানীয় পর্যায়ে আন্দোলন করলেও, জাতীয় পরিস্থিতি ও প্রেক্ষিত থেকে এই সব আন্দোলনের বিচ্ছিন্নতা এবং বৃহত্তর সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষিতকে তাৎপর্যপূর্ণভাবে প্রভাবিত করার অক্ষমতা স্পষ্ট। এই প্রসঙ্গে মনে রাখতে হবে রাষ্ট্র ও সরকারের আইনগত কাঠামোর মধ্যে থেকে একটি অরাজনৈতিক রূপ নিয়ে এনজিও-কে কাজ করতে হয়। সুতরাং একান্ত প্রয়োজন হলেও এনজিও-এর পক্ষে তেমন কোনও আন্দোলন করা সম্ভব নয়। খানসামায় আমার অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি অনেক সময় স্থানীয় পর্যায়ে আন্দোলন বা প্রতিরোধ অনিবার্য হয়ে পড়ে। অর্থাৎ উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড ও পরিবর্তন বিরোধী শক্তি গ্রামের সনাতন ব্যবস্থা অক্ষুণ্ন রাখার জন্য জোট বেঁধে আক্রমণ করে। দিনাজপুর জেলার খানসামায় ১৯৯৪-তে আমরা ফতোয়াবাজ, লুটেরা, সাম্প্রদায়িকতাবাদী ও সন্ত্রাসীদের এক জোটের আক্রমণের শিকার হই যার নেতৃত্বে ছিল তৎকালীণ ক্ষমতাসীন বিএনপি। কেন্দ্রীয় পর্যায়ের এবং জেলা পর্যায়ের বিএনপি নেতৃত্বের সঙ্গে জোট বাঁধে থানা পর্যায়ের জামায়াত এবং সেই সঙ্গে আওয়ামী লীগেরও এক শক্তিশালী অংশ। এই অবস্থায় প্রশাসন ও আইনের আশ্রয় নিয়েও লাভ হচ্ছিল না। ‘কারিতাস’ এবং ‘নিজেরা করি’ এনজিও দু’টির সমিতিভুক্ত পুরুষ ও মহিলা সদস্যরাও এই সময় আক্রান্ত হলে তারা অসহায় হয়ে পড়ে। ‘নিজেরা করি’ এলাকার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। এবং ‘কারিতাস’ও প্রতিকারে অক্ষম হয়। এটা ছিল দরিদ্র ও কর্মজীবী নারী-পুরুষ এবং হিন্দু সম্প্রদায় সহ এলাকার জনগণের জন্য এক চরম দুঃসময়। তখন আমরা আক্রমণ ও নির্যাতনকে প্রতিরোধ করতে সমর্থ হই দিনাজপুর জেলা ওয়ার্কার্স পার্টি নেতৃত্বের সহায়তায়। এই প্রতিরোধ আন্দোলনের মাধ্যমে এলাকার জনগণ তাদের অর্জিত সুফলকে রক্ষা করতে সক্ষম হয়। এই আন্দোলনের মাধ্যমে এলাকার নেতৃত্ব কাঠামোতেও পরিবর্তন সূচিত হয় এবং প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলো কোণঠাসা হয়ে পড়ে। অর্থাৎ আমার অভিজ্ঞতা এ কথা বলে যে, শুধু উন্নয়ন কর্মকাণ্ড এবং সংস্কৃতি রাজনীতির বিকল্প হতে পারে না। তবে উভয়ে বিরুদ্ধও নয়। বরং পরিপূরক হতে পারে।
কিছু পুনরুক্তি হবে তবু আমার আলোচনা শেষ করার আগে বলি, মুসলিম সমাজে আমূল পরিবর্তন বা বিপ্লবের সমস্যা বুঝতে হলে এটা বোঝা দরকার যে, শাস্ত্রীয় কিংবা প্রথাগত ইসলামের মর্মে আছে জেহাদী সামরিক পুরুষ যার সমগ্র বিশ্বদৃষ্টি ও আচরণ নিরঙ্কুশভাবে একত্ববাদী এবং অসহিষ্ণুভাবে ভিন্নতা বিরোধী, আর এই একই কারণে নারীর স্বাধীন অস্তিত্ব বিরোধী। এই অবস্থায় উৎপাদনশীল ব্যক্তি পুঁজির বিকাশ, সর্বস্তরে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও প্রতিষ্ঠানসমূহের বিকাশ এবং সর্বোপরি নারীর সামাজিক অধিকার ও ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা সমাজের আধুনিকায়ন ও গণতন্ত্রায়নের জন্য অপরিহার্য। কৃষক আন্দোলন ও কৃষক সমস্যাকে আমাদের দেখতে হবে এই দৃষ্টি থেকে।