Banner
মুক্তিযুদ্ধ : ষাটের দশক বনাম ছয় দফা — ইমাম গাজ্জালী

লিখেছেনঃ ইমাম গাজ্জালী, আপডেটঃ April 8, 2018, 12:00 AM, Hits: 1916

 

‘যুদ্ধ হল রক্তপাতময় রাজনীতি, আর রাজনীতি হল রক্তপাতহীন যুদ্ধ’ : মাও সে তুং

 

এক

বাংলাদেশে ঊনিশশ’ একাত্তর সালকে যারা সামরিক তৎপরতার মধ্যে দেখেন, তারা খণ্ডিত ইতিহাসই দেখেন। পূর্ব বাঙলায় ষাটের দশকে যে নতুন ধারার রাজনীতির সূচনা হয়েছিল, একাত্তর হল সেই রাজনীতির পরিণতি। ঠিক পরিণতি নয় অপভ্রংশ। একাত্তরের রাজনীতির সূচনা হয়েছিল ষাটের দশকে। যে রাজনীতি ছিল একটি স্বাধীন-সার্বভৌম, গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার রাজনীতি। যে রাজনীতি গড়ে তোলার কৃতিত্ব মূলত কোনো দলের নয়, বরং সেটা সেই সময়ের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ঘিরে গড়ে ওঠা একটি তরুণ প্রজন্মের।

ওই সময়ের তরুণ প্রজন্মের অন্যতম প্রতিনিধি শামসুজ্জোহা মানিক তার ‘বাঙ্গালীর জাতি-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে ষাটের দশকের বিপ্লবী প্রজন্মের ভূমিকা’ শীর্ষক নিবন্ধে বলেন, “এদেশে প্রকৃত বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের বিকাশে এবং বাঙ্গালীর জাতি-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের বিকাশে ষাটের দশকের বিপ্লবী বা বামপন্থী ছাত্র-তরুণদের কেন্দ্রীয় ভূমিকাটি.. .. গত পঁচিশ বছরের অধিককাল যাবৎ অস্বীকৃত হয়ে আছে। আসলে সেই দশকে বিপ্লবী তরুণ প্রজন্ম এমন এক চেতনাকে ধারণ করেছিল যাকে সঠিকভাবে এগিয়ে নিবার মত তত্ত্ব, অভিজ্ঞতা ও চরিত্রের অধিকারী নেতৃত্ব সে কালে ছিল না। তাছাড়া এই চেতনার শক্তির সাফল্যের জন্য অনুকূল আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিও সেকালে ছিল না। এই সকল কারণে ঐ প্রজন্ম এক অর্থে ব্যর্থ হয়েছিল। আর এই অর্থে ব্যর্থতার কারণে তারা যেমন অস্বীকৃত হয়েছে তেমন অস্বীকৃত হয়েছে তাদের অনন্য সাধারণ ঐতিহাসিক ভূমিকা। তাদের অবদান ও ভূমিকা অন্যরা আত্মসাৎ করতে চেয়েছে।..”

একই প্রবন্ধে তিনি আরো লিখেছেন, “এ কথা সকলেরই জানা যে, ভাষা আন্দোলনের প্রধান চালিকা শক্তি ছিল ছাত্র সম্প্রদায়। মূলত ছাত্রদের কারণেই ভাষা আন্দোলন সমগ্র জনগণ ও জাতির আন্দোলনে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু একটি বিরাট ও অতীব গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা আজো প্রায় অস্বীকৃত ও অনুদ্ঘাটিত রয়েছে, সেটি হল বাঙ্গালীর স্যেকিউলার বা লোকবাদী এবং গণতান্ত্রিক জাতি-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন গড়ে তোলায় ষাটের দশকের ছাত্র সম্প্রদায় বিশেষত বিপ্লবী বা বামপন্থী ছাত্র-যুব শক্তির ভূমিকা। ভাষা আন্দোলনের মতই বাঙ্গালীর স্বাধীন জাতি-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চেতনা ও আন্দোলন যে এক সময় ছাত্রদের ভিতর থেকে ক্রম প্রসারিত হয়ে সমগ্র জনগণ ও জাতির আন্দোলনে পরিণত হয়েছিল সেই সত্যটি আজো প্রায় অস্বীকৃত হয়ে      রয়েছে।”

এখনো ষাটের দশক অস্বীকৃত ও অনালোচিত বলে গুরুতর অভিযোগ করেছেন শামসুজ্জোহা মানিক। এটা ঠিক যে, ষাটের দশকের রাজনীতি কোনো দলের স্লোগানে, ঘোষণাপত্রে, কর্মসূচিতে, চিন্তায় ও মননে ভাষা পায় নাই। চাইকী বাম, কিংবা ডান। সেই রাজনীতি নিয়ে শোষণজীবী ও লুণ্ঠনজীবীরা নিজ শ্রেণির স্বার্থ চরিতার্থ করার প্রয়াস রেখেছিল, অপরদিকে মেহনতীদের স্বার্থে ক্রিয়াশীল বামপন্থী রাজনৈতিক দলসমূহ শ্রেণি স্বার্থের বদলে দলীয় ও গোষ্ঠী স্বার্থ চরিতার্থ করার প্রচেষ্টায় লিপ্ত ছিল। প্রকৃত প্রস্তাবে সেই রাজনীতিকে এগিয়ে নেবার জন্য ভ্যানগার্ড হিসেবে দায়িত্ব নেয়নি কোনো কমিউনিস্ট পার্টি। আর পক্ষান্তরে ষাটের দশকের অর্জনকে শোষণজীবী ও লুণ্ঠনজীবীরা গিলে খেয়েছিল ৬ দফার ফাঁদ পেতে।

সূচনাতে ষাটের দশকের তরুণ প্রজন্মের রাজনীতি মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর সফেদ পাঞ্জাবির দীর্ঘ ছায়ায় বেড়ে উঠেছিল। ষাটের দশককে মায়ের মত ওম দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু নানা কারণে শেষ পযর্ন্ত তার ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে পারেননি ভাসানী। ওই রাজনীতি সেই সময়ের বিপ্লবী তরুণ প্রজন্মের হাত ধরে গড়ে উঠলেও, তারা সব সময় ওই রাজনীতিকে সঠিক দিশা দিতে পেরেছেন, এমনটি ভাবা ঠিক নয়। তবে সেখানে একটি গণতান্ত্রিক আন্দোলন দানা বাঁধছিল। প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনই একটি আড়াল তৈরি করে। ষাটের দশকের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের আড়ালে একটি অপ্রতিরোধ্য শ্রমিক আন্দোলন গড়ে উঠতে থাকে। অর্থাৎ একটি তরুণ প্রজন্মের পাশাপাশি আবির্ভূত হয় সঙ্ঘবদ্ধ লড়াকু শ্রমিক শ্রেণি।

বিপ্লবী তরুণ প্রজন্ম হল ষাটের দশকের প্রসূতি আর ওই সময়ের ভাবাদর্শিক অর্জন হল ধর্মনিরপেক্ষতা, বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র এবং গণতন্ত্র। যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের সংবিধানের রাষ্ট্রীয় মূলনীতিতে ওই চারটি প্রত্যয় গৃহীত হয়েছিল। তখনকার গণতান্ত্রিক চেতনার ধার এমনই ছিল যে, একে মূলনীতি না রেখে চলা দুষ্কর ছিল। এ ছাড়া শাসকদের আর কোনো গত্যন্তর ছিল না। এই অর্জন পূর্ব বাঙলার অমূল্য সম্পদ। আর আন্দোলনগত অর্জন হল একটি সঙ্ঘবদ্ধ শ্রমিক আন্দোলন, যা সমাজতন্ত্র বির্নিমাণের উপাদান হিসেবে অমিত সম্ভবনা তৈরি করেছিল। ষাটের দশকের তরুণ প্রজন্ম, তার সঙ্গে যুক্ত সঙ্ঘবদ্ধ শ্রমিক শ্রেণি, শেষের দিকে তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল সেনাবাহিনীর ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, তার সঙ্গে সশস্ত্র ইপিআর ও বাঙ্গালী পুলিশ। কোমর বেঁধে এগিয়ে এসেছিলেন গ্রামের চাষী ও ক্ষেতমজুর। এই সম্মিলিত শক্তির উত্থানের বাইরে ছিল ভীষণভাবে কোণঠাসা হয়ে পড়া গুটি কতক ধর্মীয় মৌলবাদী শক্তি। এর বাইরে মুক্তিযুদ্ধ সংঘটনে আর কী এমন শর্ত দরকার? কী এমন শর্ত প্রয়োজন যে, যার অভাবে ভারতের সামরিক সহযোগিতা নিতে হয়েছিল?

আমাদের মতে, ভারতের সামরিক সহযোগিতা ছাড়াই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে জয়যুক্ত করার প্রায় সকল শর্তই ওই সময়ের পূর্ব বাঙলায় জারি ছিল। প্রবল ক্ষমতাধর মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নাকের ডগায় যদি কিউবায় বিপ্লব সফল হতে পারে তবে ভারতের ‘বন্ধুত্ব’ কিংবা ‘নাকগলানো’র মনোভাবকে মোকাবেলা করে এখানেও একটা বিপ্লব নিশ্চয় সম্ভব। সেদেশের পছন্দ-অপছন্দ বিবেচনায় না নিয়ে এখানে মুক্তিযুদ্ধ সফল সম্ভব ছিল না বলে যে একটা কথা প্রচলিত রয়েছে, সেটা কোনো যুক্তিগ্রাহ্য কথাই হতে পারে না।

 

দুই

ষাটের দশকের আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য ছিল স্বাধীনতার, কোনোক্রমেই বিচ্ছিন্নতাবাদিতা নয়। অপরদিকে ৬ দফার আন্দোলন ছিল স্বায়ত্ত শাসনের কিংবা বিচ্ছিন্নতাবাদের। একাত্তর ষাটের দশকের পরিণতি নয়, ধারাবাহিকতা। অর্জন নয়, অপভ্রংশ। অপরদিকে একাত্তর হল ৬ দফার পরিণতি। তারপরেও ষাটের দশকের ধারাবাহিকতা অস্বীকার করতে পারেনি একাত্তর, একারণে তার অর্জন সমূহকে মুখে অন্তত স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিল, কিন্তু কার্যত তাকে ৬ দফার নাগপাশে বন্দি করে রেখে দেওয়া হয়েছিল। আমাদের মতে, ষাটের দশকের রাজনীতি স্পষ্ট না হোক, কিন্তু তার একটা স্বরূপ ছিল। কোনো দল তাকে রাজনৈতিক কর্মসূচিতে ধারণ করেনি। তবে এখনো ষাটের দশকের রাজনীতিকে স্পষ্ট ভাবে উপস্থাপনের উপযোগিতা শেষ হয়ে যায় নাই। অপরদিকে ছয় দফা একটি স্পষ্ট রাজনৈতিক কর্মসূচি। আমাদের মতে, এই দুইয়ের মধ্যে স্পষ্ট বিভাজন রেখা না টেনে মুক্তিযুদ্ধের রাজনীতি বোঝা কোনো ক্রমেই সম্ভব নয়। নতুন রাজনীতি দেশে আনতে চাইলে এই দুইয়ের বিভাজন টানতেই হবে। এই দিকটাই এখন অতীব জরুরি প্রশ্ন।

একবার চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক ছয় দফার দিকে, সেখানকার প্রথম প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে:-

“দেশের শাসনতান্ত্রিক কাঠামো এমনি হতে হবে যেখানে পাকিস্তান হবে একটি ফেডারেশনভিত্তিক রাষ্ট্রসংঘ এবং তার ভিত্তি হবে লাহোর প্রস্তাব। সরকার হবে পার্লামেন্টারী ধরনের। আইন পরিষদের ক্ষমতা হবে সার্বভৌম। এবং এই পরিষদও নির্বাচিত হবে সার্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে জনসাধারণের সরাসরি ভোটে।”

অর্থাৎ পাকিস্তান হবে একটি ফেডারেল ভিত্তিক রাষ্ট্রসংঘ, যার ভিত্তি হবে লাহোর প্রস্তাব। এই লাহোর প্রস্তাবটি কি? এবার চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক লাহোর প্রস্তাবের দিকে। এর তৃতীয় প্রস্তাবের দুই এবং তিন নং পয়েন্টে বলা হয়েছে-

“প্রয়োজন অনুযাযী সীমানা পরিবর্তন করে এমনভাবে গঠন করতে হবে যেখানে ভারতবর্ষের উত্তর-পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চলের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান এলাকাগুলো ‘স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহ’ (Independent States) গঠন করতে পারে, ‘স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহের’ সংশ্লিষ্ট অঙ্গরাষ্ট্র বা প্রদেশসমূহ হবে স্বায়ত্তশাসিত ও সার্বভৌম।”

অর্থাৎ লাহোর প্রস্তাব হল দ্বি-জাতি তত্ত্বের জনক (আসলে একে দ্বি-জাতি তত্ত্ব না বলে দ্বি-সাম্প্রদায়িক তত্ত্ব বলাই শ্রেয়)। ৬ দফা ১৯৪৭ সালের পাকিস্তান সৃষ্টির দ্বি-জাতিতত্ত্ব থেকে বেরিয়ে আসতে পারে নাই। ৬ দফা অনুযায়ী বাংলাদেশ বিষয়ক আন্দোলন ছিল একটি স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান সৃষ্টির আন্দোলন। আসলে সেটা কখনোই বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের সীমানা ভাঙ্গে নাই।

অপরদিকে, মুসলিম আত্মপরিচয়ে অসন্তুষ্ট বাঙ্গালী তরুণরা যখন ভিন্ন আত্মপরিচয় সন্ধান করতে গিয়েছেন, তখনই বাংলাদেশ বিষয়ক রাজনীতি তাদের গর্ভে মূর্ত হয়ে উঠেছে। সদ্য লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তানের মোহমুক্ত হয়ে নিজেদের নতুন ঠিকানা গড়তে চেয়েছেন তারা। একটি জাতিগত মুক্তির লড়াইয়ের শরীর বেয়ে বাংলাদেশ বিষয়ক রাজনীতি বিকাশ লাভ করছিল।

অনেকে বলেন, ওই সময়ে ৬ দফার চেয়ে বেশি কিছু বলা সম্ভব ছিল না। কিংবা লাহোর প্রস্তাব ছিল একটা কৌশল, আসলে ৬ দফার প্রণেতারা স্বাধীনতার কথাই বলতে চেয়েছেন। ইত্যাদি, ইত্যাদি। এসব কথার বুঝের ওপরই এতদিন ছিলেন অনেকে। আমরাও ছিলাম। কিন্তু এত দিন পরে, যখন বাংলাদেশের চরিত্র বৈশিষ্ট্য দেখি, তখন স্পষ্টতই একে ‘স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান’ ছাড়া আর কিছুই ভাবা যায় না। পাকিস্তানকে চেনা যায় তার তিনটি বৈশিষ্ট্য দিয়ে, ১. সামরিক শাসন। ২. সাম্প্রদায়িকতা ও রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ইসলামী মৌলবাদী শক্তির অপ্রতিরোধ্য উত্থান। ৩. সাম্প্রদায়িক অবস্থান থেকে আধিপত্যবাদী ভারতের বিরোধিতা করা।

এর সবগুলোই বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের কমবেশি বৈশিষ্ট্য। ৪৬ বছর বয়সের বাংলাদেশের ১৭ বছর কেটেছে সামরিক শাসনে (জিয়া-এরশাদ ও মইনুদ্দিন ও ফখরুদ্দীনের সময়)। তথাকথিত গণতান্ত্রিক সময়েও অসম্ভব প্রভাবশালী সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তারা। ধর্মীয় ফ্যাসীবাদী শক্তি এখানে একযোগে ৬৩টি জেলায় বোমা হামলা চালায়। পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠানে, কমিউনিস্ট পার্টির জনসভায়, উদীচীর সমাবেশে বোমা হামলা করে মানুষ খুন করা হয়। শুধু লেখালেখি করার কারণে ২০১৩ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ৫জন ব্লগারকে হত্যা করা হয়েছে। হত্যাপ্রচেষ্টার শিকার হয়েছেন অনেকে। সংখ্যলঘুদের বাড়িঘরে ও উপাসনালয়ে হামলা হয়েছে। বই প্রকাশের জন্য হত্যাকান্ডের শিকার হতে হয়েছে। বই নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ব-দ্বীপ প্রকাশন বন্ধ করা হয়েছে। মোল্লাদের কথায় সুপ্রীম কোর্টের চত্বর থেকে ভাস্কর্য সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। হেফাজত ইসলামকে খুশি করতে পাঠ্য বই থেকে হিন্দু ও প্রগতিশীল লেখকদের লেখা বাদ দেওয়া হয়েছে। মাদ্রাসা শিক্ষাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সমমানের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। খেলাফতে মজলিশের সঙ্গে ফতোয়ার জন্য সমঝোতা স্মারকে সাক্ষর করেছে তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ দল। এ তালিকা এতটাই দীর্ঘ যে, পাছে এ লেখার মূল থেকেই আলাদা হতে হবে সে ভয়ে আর সেদিকে যেতে চাই না। অর্থাৎ এসব চিত্রই বলে দেয়, আমরা এখন পাকিস্তান চরিত্রের বাংলাদেশে বসবাস করছি। এটা হল ভারত পছন্দ পাকিস্তান। এখানেই ৬ দফার বিজয়। পাকিস্তান, ভারত এবং আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদীরা হয়ত এটাই চেয়েছিল।

অর্থাৎ আমরা এই সিদ্ধান্তই টানতে চাই যে, মুক্তিযুদ্ধের দুইটি ধারা ১. ছয় দফার ধারা, ২. ষাটের দশকের ধারা। কিন্তু অন্তরালে চলে গেছে ষাটের দশক। জয়যুক্ত হয়েছে ছয় দফার মুক্তিযুদ্ধ। এই ছয় দফার বিজয়ী মুক্তিযুদ্ধের পরিণতি ফের লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান, ফের সামরিক শাসন, ফের ‘ওআইসি’র সদস্যপদ, ফের সামরিক শাসনের সঙ্গে ধর্মীয় ফ্যাসীবাদের মিতালী। এরাই বাংলাদেশ বিরোধী রাজনীতিকে ডেকে আনে।

বাংলাদেশকে যারা মুক্তিযুদ্ধের ধারায় আনার কথা বলেন, এখন তাদের সামনে কয়েকটি প্রশ্নের মীমাংসা করার দায় পড়ে গেছে। ইতোমধ্যেই ‘ছয় দফার মুক্তিযুদ্ধের’ পর্ব দেখা শেষ হয়েছে। সেই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে চলা ব্যবসা প্রত্যক্ষ করছে মানুষ, মুক্তিযুদ্ধের আবেগকে ক্ষমতা দখলের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার ঘটনা চোখের সামনে ঘটছে। আবার কীভাবে ধর্মনিরপেক্ষতাকে ধুলিসাৎ করে মৌলবাদী শক্তির পৃষ্ঠপোষকতা করা হচ্ছে সেটাও দৃষ্টির আড়ালে নয়। এই সরকারের ঘোরতর বিরোধী হয়েও যদি কেউ মুক্তিযুদ্ধ ও সেক্যুলার রাজনীতির পক্ষে দাঁড়ান, তবু তার ক্রেডিট গিয়ে পড়ছে বর্তমান সরকারের ঝুলিতে। কারণ মুক্তিযুদ্ধ মানেই ওই ‘ছয় দফা’র মুক্তিযুদ্ধ। এটাই এখন একমাত্র ধারা হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত। এর বাইরে আর কোনো কিছু নাই, কিছু থাকতে দেওয়া হচ্ছে না। কিংবা ইতিহাসে চাপা পড়া একটা জরুরি অধ্যায়কে সামনে আনার কাজে কেউ হাত লাগাচ্ছে না।

এই রাহুগ্রাস থেকে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ধারাকে ফিরিয়ে আনতে হলে অবশ্যই ফিরে যেতে হবে ষাটের দশকে। সেখান থেকে ইতিহাসের ধুলোময়লা ঝেড়ে বের করতে হবে রাজনীতির সঠিক দিশা। সেই রাজনীতি অস্পষ্ট, তাকে স্পষ্ট করতে হবে। সেই রাজনীতির নায়করা খলনায়কে পরিণত হয়েছেন, তাদের সমালোচনা ও সীমাবদ্ধতাসহ স্বীকৃতি দিতে হবে। সেই রাজনীতিকে আজকের বাস্তবতায় ব্যাখ্যা করতে হবে। এজন্য চাই ইতিহাসের গতিমুখ বোঝার শক্তি, মেধা ও প্রজ্ঞা। তাহলেই বাধাগ্রস্ত হবে, মুক্তিযুদ্ধের নামের ব্যবসা আর ধর্মনিরপেক্ষতার নামে হেফজত-তোষণ। বাংলাদেশ খুঁজে পাবে তার রাজনীতির দিশা, ইতিহাসের উপলব্ধি।

ইতিহাস শুধু রাজরাজড়ার কাহিনী নয়, শুধু কিছু নেতার কিংবা দলের কর্মকাণ্ড নয়। ইতিহাস নির্মাণ করে মানুষ। সমাজের নানা শ্রেণির মানুষের স্বার্থের দ্বন্দ্বে ইতিহাস শারীরিক কাঠামো নিয়ে দাঁড়ায়, এগিয়ে যায়, কখনো থমকে থাকে, কখনো কখনো আপাত পিছিয়ে যায়। ইতিহাস পিছিয়ে যায় মানে মানুষ পিছিয়ে যায়। ইতিহাস এগিয়ে যায় মানে মানুষ এগিয়ে যায়। চিরজীবন নীচে চাপা থাকা শ্রেণির উঠে দাঁড়ানো, যেমন ষাটের দশকের বিপ্লবী তরুণ প্রজন্মের উত্থান একটি নতুন ইতিহাস তৈরির দরজা খুলে দিয়েছিল। ইতিহাসের এবং মানুষের এই এগিয়ে যাওয়া, এই থমকে দাঁড়ানো এবং এই আপাত পিছিয়ে যাওয়ার ওপর প্রভাব ফেলে ভাষা, ধর্ম ও মিথ আর খবরদারি করে থাকে জাতীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক শক্তিসমূহ। তবে এসবই পরিবর্তনের শর্ত তৈরী করে ঠিক, তবে আসল ভিত্তি হল মানুষের লড়াই।

এরকম প্রভাব ও খবরদারির মধ্যেও পারস্পরিক দ্বন্দ্ব জারি থাকে আর থাকে খেয়োখেয়ির খেলা। সুযোগ পেলেই এক শ্রেণির অর্জন আরেক শ্রেণি খেয়ে ফেলে, পকেটস্থ করে, শেষে নিজেরাই তার নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করে। সেই কাজের ভাবাদর্শিক জমিন নির্মাণ করে দেন তাদের বশংবদ শিল্পী, সাহিত্যিক, কবি, চলচ্চিত্র নির্মাতা, লেখক ও সাংবাদিকরা। এরা এটা করেন অধিকাংশ সময় জেনে, কখনো কখনো না জেনে। এরা এটা করেন শাসকদের ছিটিয়ে দেওয়া খুদ-কুড়া খাওয়ার জন্য।

ইতিহাস নির্মাণের ধারায় কোন শ্রেণির আধিপত্য থাকবে, সেটা নির্ভর করে সেই শ্রেণি কতটুকু সাবালক, কতটুক সংহত এবং কতটুক প্রস্তুত তার ওপর। খেয়োখেয়ির খেলায় সাবালক শ্রেণিই অবলীলায় গ্রাস করতে পারে বিপরীত শ্রেণির অর্জন, যাদের প্রস্তুতি ও পরিপক্বতায় ঘাটতি থাকে। অপরদিকে, বিপরীত শ্রেণি ও শ্রেণিসমূহ অসহায় দর্শক হয়ে প্রত্যক্ষ করে ইতিহাসের রঙ্গমঞ্চের সাজানো নাটক। সেখান থেকে বের হতে দরকার ইতিহাসের পূর্ণপাঠ। কারণ ধানবীজ জমিনে ছড়ালে শুধু পচে না, সেখান থেকে নতুন অঙ্কুরও গজায়।

 

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
Archive
 
সাম্প্রতিক পোষ্টসমূহ