লিখেছেনঃ শামসুজ্জোহা মানিক, আপডেটঃ July 13, 2010, 6:31 AM, Hits: 5116
মানুষের অর্ধেক নারী আর অর্ধেক নর। জীবনের এ সত্য এই সমাজে কতটুকু প্রতিফলিত? মানব জাতি সৃষ্টি এবং সংরক্ষণে কিছু বিচারে নারীর ভূমিকা অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ হলেও সমাজে তার ভূমিকা কতটুকু? বস্তুত যে সমাজে আমরা বাস করছি তার সংগঠক পুরুষ, সংরক্ষকও পুরুষ। তাই সমাজ নারীর সব মানবিক অধিকারকে পদদলিত ক’রে পুরুষের অনুকূলে বিধিবিধান চালু করেছে। এই সমাজে নারীর নিরাপত্তার অনুকূলে কিছু বিধিবিধান নেই এ কথা সত্য নয়। কিন্তু এই যে কিছু বিধিবিধান রাখা হয়েছে তাও কিন্তু পুরুষেরই প্রয়োজনে। স্বামী হিসাবে নারীর উপর পুরুষের অধিকার সংরক্ষণের স্বার্থে, পিতা হিসাবে পুরুষের পিতৃত্ব নিশ্চিত করার স্বার্থে এই সব বিধিবিধান। এই সঙ্গে সমাজ অধিপতি পুরুষ চেয়েছে যারা তার একান্ত আপন নারী তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পুরুষই নির্ধারক, নিয়ন্তা, প্রভু। তাই নারীর নিরাপত্তা ও অধিকারও অনেকাংশেই পুরুষের সদিচ্ছার উপর নির্ভরশীল।
এটা ঠিক যে, আধুনিক যুগ ও শিক্ষার প্রভাবে নারী এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে। পুরুষদের মধ্যেও ক্রমে নূতন এক মানবিক চিন্তার প্রসার ঘটছে। বরং নারীকে এই বন্দী ও প্রায় পশু অবস্থা থেকে মুক্ত করে আনার কাজে পুরুষদেরই একটা অংশ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিচ্ছে। নারীকে বন্দী করেছে পুরুষ। সুতরাং তাকে মুক্তি দেবার কাজটাও তো প্রধানত পুরুষেরই। যদিও সেই মুক্তি নারীকেও পেতে এবং রক্ষা করতে হবে এবং নারীকেই শেষ পর্যন্ত নির্ধারণ করতে হবে নারী মুক্তি কিংবা অধিকারের স্বরূপ, তবু সূচনায় পুরুষের এই ভূমিকার গুরুত্বই সর্বাধিক।
যে পুরুষেরা বুঝছেন যে, নারীর মুক্তি ছাড়া মানুষের মুক্তি নেই তাঁরা ক্রমেই সংখ্যায় বাড়ছেন। নারীর বেদনায় আর্ত হয়ে একদিন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মত পুরুষেরা নারীর মুক্তির জন্য যে সংগ্রাম করেছিলেন সেই সংগ্রামের সৈনিকের সংখ্যা আজ আর মুষ্টিমেয় নয়। রোকেয়ার পথ ধরে আজ অনেক নারীই সমাজ জীবনের বহু ক্ষেত্রে এগিয়ে গেছেন। আজ বাংলাদেশের প্রধান মন্ত্রী একজন নারী এবং প্রধান বিরোধী দলের প্রধানও একজন নারী। এই অবস্থা একদিনে তৈরী হয় নি। বহুকাল ধরে বহু মানুষের সাধনা ও সংগ্রামের ফলে এইটুকু অর্জন সম্ভব হয়েছে।
কিন্তু নারী প্রগতির এই সময়েও আমাদের সমাজে নারীর অবস্থা কতটুকু মর্যাদাপূর্ণ, কতটুকু নিরাপদ? প্রতিদিন নারী ধর্ষণ, নিগ্রহ ও এসিড নিক্ষেপের মত যে অসংখ্য ঘটনা সারা দেশে ঘটে চলেছে তার বিরুদ্ধে সামাজিক বিবেকের সংগঠিত প্রকাশ কতটুকু? পথ চলতে কিংবা ট্রেনে, বাসে নারীর প্রতি পুরুষের অবজ্ঞা ওআক্রমণাত্মক মনের প্রকাশ তো অহরহ চোখে পড়ে। এইসব ঘটনাই নারীর প্রকৃত সামাজিক অবস্থাটা কি তা বলে দেয়।
মহিলা প্রধান মন্ত্রীর দেশের রাজধানী ঢাকার মহাখালী এলাকায় স্বাস্থ্য মহাপরিচালকের অফিসে প্রকাশ্য দিবালোকে সরকারী অফিসের একজন কর্মকর্তার ড্রাইভার মহাখালী সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালে কর্মরত এক অসহায় নারীকে বহু সংখ্যক লোকের সামনে থেকে জোর করে গাড়ীতে উঠিয়ে নিয়ে অফিস এলাকাতেই নিশ্চিন্তে ও নিরাপদে দলবদ্ধভাবে ধর্ষণ করে। এ থেকেই বোঝা যায় নারীর অবস্থা এ দেশে কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে। কোন কোন ক্ষেত্রে পুলিশ হয়ত কাউকে কিছু সময়ের জন্য ধরে নিয়ে যায়। কিন্তু বিচার? এ দেশে নারীর অসম্মানের কি বিচার হয়? বিচারের নামে যা হয় তা তো কখনও বৎসরের পর বৎসর ধরে সেই লাঞ্ছিত নারীর উপর আরও বহুবার লাঞ্ছনা চাপায়। একবারের জন্য লাঞ্ছিত নারী আদালতে ও সমাজে বহুবারের জন্য লাঞ্ছিত হবার গ্লানি কেন মেনে নিতে চাইবে? বহু নারী কিংবা তাদের অভিভাবকরা সেই পথে তাই সাধারণত যেতে চান না। সমাজ ও রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব এই ধরনের ঘটনার প্রতিকারের যথাযথ পথ নিতে নারাজ। কাগজে-কলমে কিছু আইন তৈরী করে তারা সমাজের বিবেককে তুষ্ট করতে চায়। কিন্তু তার প্রয়োগের যথাযথ ব্যবস্থা নিতে তাদেরও অরুচি ও অনিচ্ছা। কারণ নিজেদের অক্ষমতার কারণে একজন নারীকে প্রধান মন্ত্রী হিসেবে মেনে নিলেও তারা নিজেরা পুরুষ এবং পুরুষের শাসন এবং পুরুষের যথেচ্ছাচারের প্রতিই তাদের আন্তরিক সম্মতি ও আকর্ষণ।
আসলে এ দেশে নারীর সপক্ষে যেসব আইন তৈরী হয়েছে সেসব প্রতারণাপূর্ণ। নারী নিগ্রহকে সমাজ ও রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব নীতিগতভাবে সমর্থন দিতে পারে না বলে কিছু ভাল আইন করে দিলেও সেগুলির প্রয়োগের ক্ষেত্রে এমন সব আইন এবং ব্যবস্থা করে রেখেছে যাতে কিছু ভাল আইনগুলির প্রয়োগ প্রায় সকল ক্ষেত্রেই অসম্ভব হয়ে থাকে। তাই এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, নারীর অধিকার, মর্যাদা ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা এবং সংরক্ষণের জন্য এ দেশে তেমন কোন আইনই নেই।
কিন্তু এ তো গেল নারীর অধিকারের প্রশ্নে আইনগত বা রাষ্ট্রীয় দিক। রাষ্ট্র না হয় নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা ও মর্যাদা রক্ষায় এগিয়ে আসে না। কিন্তু যে সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ নারী এবং রাষ্ট্রও যে সমাজের কেন্দ্রীয় সংগঠন হলেও একটি অংশ মাত্র এ ক্ষেত্রে সেই সমাজের ভূমিকা কী? নারীর অধিকার ও মর্যাদার সপক্ষে সমাজের বিবেক কতখানি জাগ্রত? আর এ প্রশ্ন করলেই এ দেশে নারী দলনে বর্তমান সমাজের আসল ভূমিকা বেরিয়ে আসে।
এই সমাজ ঘরে ঘরণী বা গৃহবন্দী হিসাবেই নারীকে দেখতে চায়। সেখানেও নারীর অধিকার ও নিরাপত্তা কতটা আছে সে প্রশ্ন তো আছেই। তবু সমাজ নীতিগতভাবে ঘরের মধ্যে পুরুষের অধীন করে নারীর কিছু সীমিত অধিকার মেনে নিতে রাজী আছে। অবশ্যই এই সীমিত অধিকারও গৃহের কর্তা পুরুষের স্বেচ্ছাচারের নিকট নারীর আত্মসমর্পণের শর্তের ভিত্তিতে রক্ষিত হতে পারে। সেখানে নারী স্ত্রী অথবা কন্যা কিংবা ভগিনী। সুতরাং এত আপনজনের উপর পীড়নের ক্ষেত্রে অন্তত কিছু মানবিক ও নৈতিক বা বিবেকের বাধা আসতেই পারে। কিন্তু যেখানে নারী পুরুষের আপন কেউ নয় সেখানে নারী কোথা থেকে পুরুষের এই বিবেকের বাধা পাবে? সেখানে নারী দেখা দেয় পুরুষের ভোগ এবং আগ্রাসনের লক্ষ্যবস্তু হিসাবে। সেখানে তার ইচ্ছা, অনিচ্ছা বা মর্যাদার কতটুকু মূল্য কয়জন পুরুষের কাছে আছে?
এই যে সমাজ জীবনে নারীর অহরহ অসম্মান ও নিরাপত্তাহীনতা তার জন্য কে দায়ী? সমাজ অবিরামভাবে যে সব মূল্যবোধ ধারণ ও প্রচার করে চলেছে, যে সব মূল্যবোধ ও আচরণের চর্চা করছে সেগুলির মধ্যেই নারীর এই করুণ অবস্থার সবচেয়ে বড় উৎস নিহিত। এইসব মূল্যবোধ ও ধ্যান-ধারণা প্রচারের ফলে সমাজ অধিপতি পুরুষেরা নারীকে মানুষ হিসাবে ভাবতে শেখে না এবং কথায় কথায় নারীর প্রতি আগ্রাসী বা আক্রমণাত্মক হতে উৎসাহী ও সাহসী হয়। এই ধরনের মূল্যবোধ ও ধ্যান-ধারণা দ্বারা গড়ে উঠেছে এক বর্বর সংস্কৃতি যা শেষ পর্যন্ত কোন মানুষকেই মানুষ করে না, তাই পুরুষ নারীর প্রতি আগ্রাসী ও আক্রমণাত্মক হয়।
সুতরাং আমরা পাচ্ছি এক বিশেষ ধরনের সংস্কৃতি বা ধ্যান-ধারণা, আচার-আচরণ ও দৃষ্টিভঙ্গী যা পারিবারিক ও সমাজ জীবনে নারীর এহেন দুর্গত অবস্থার জন্য দায়ী। এই বিশেষ ধরনের এক সংস্কৃতিকে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে আমাদের সমাজে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যে শক্তি সেটি হল ধর্ম। শেষ পর্যন্ত আমরা এই সমাজে নারীকে হেয় করার, অবদমিত করে রাখার জন্য নারীত্বের অবমাননাকারী পুরুষের হাতে সবচেয়ে বড় যে হাতিয়ার পাচ্ছি তা হ’ল ধর্ম। বস্তুত এই ধর্মের প্রভাবে যেমন নারী তার অসহায় অবস্থাকে নিয়তি বলে মেনে নিতে শেখে তেমন পুরুষও শেখে নারীকে আক্রমণ ও সম্ভোগের বস্তু হিসাবে চিহ্নিত করতে। মোল্লাদের বক্তৃতা শুনলে এবং ধর্মগ্রন্থগুলো পড়লে ধর্মে নারীর প্রকৃত অবস্থাটা বুঝতে কোন বিচারক্ষম ব্যক্তিরই কষ্ট হবার কথা নয়।
সুতরাং এ দেশে যাঁরা ধর্মকে পাশ কাটিয়ে নারীর অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার কথা ভাবেন তাঁরা অলীক স্বপ্ন দেখেন মাত্র। এটা ঠিক যে, আধুনিক শিক্ষা ও গণতান্ত্রিক চেতনার ক্রমবিস্তারের ফলে কিছু ক্ষেত্রে নারীর অবস্থা পূর্বের চেয়ে উন্নত হচ্ছে, কিন্তু অপরদিকে সমাজের ব্যাপক জনগোষ্ঠী অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত ও ধর্মাচ্ছন্ন হওয়ায় সেখান থেকে অবিরাম নারীবিদ্বেষী চেতনার জন্ম ও বিস্তার ঘটে চলেছে। এ দেশের সমাজ এবং রাষ্ট্রের অধিপতিরা ধর্মের অব্যাহত চর্চা দ্বারা বরং নারীর অবস্থার অবনতির প্রক্রিয়াকেই উস্কে দিচ্ছে। একদিকে নারীকে বলা হচ্ছে তুমি লেখাপড়া শেখ, তুমি সচেতন হও, তুমি পথে বের হতে পার। আরেকদিকে সমাজকে উস্কে দেওয়া হচ্ছে নারীকে অপমান করতে, আঘাত করতে, বলাৎকার করতে। যে সমাজ নারীকে স্বাধীন মানুষ হিসাবে ভাবতে শেখে না সেই সমাজ নারীর স্বাধীন ইচ্ছা ও আচরণকেকেন মেনে নিবে? সুতরাং আক্রমণাত্মক পুরুষের মধ্যে স্বাধীন নারীর বিপক্ষেই বরং চেতনা গড়ে ওঠে। তার মনের কথা হল যদি তুমি অপর এবং শক্তিশালী পুরুষের সংরক্ষণে বা প্রহরায় থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পার ভাল, নতুবা আমার যা ইচ্ছা তাই করব এবং তোমাকে আমার ইচ্ছার কাছে নতি স্বীকার করতে হবে।
অর্থাৎ এই আক্রমণাত্মক পুরুষের ব্রত হয়ে দাঁড়ায় নারীর স্বাধীনতার উপর আঘাত করা এবং তার স্বাধীনভাবে চিন্তা করার ক্ষমতাকে ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দেওয়া।এ দেশে ধর্ম এবং ধর্ম নিয়ন্ত্রিত সংস্কৃতির প্রভাবে যে সামাজিক আচার-আচরণ, মূল্যবোধ ও বিশ্বাস গড়ে উঠেছে প্রধানত তা-ই নারীর অমানবিক অবস্থাকে এবং নারী-পুরুষের বিকৃত ও অসম সম্পর্ককে রক্ষা করছে সমাজ, রাষ্ট্র ও পরিবারে, সর্বত্র। এই রকম অবস্থায় দেশে কেউ আর মানুষ হয় না। পুরুষ নিজে হয় অমানুষ। নারীও পুরুষের অমানুষতার শিকার হয়ে অমানুষ হয়। নারীর কোলেই তো জাতির লালন ও বর্ধন। সুতরাং অমানুষ নারীর হাতে যে জাতি গড়ে ওঠে সেই জাতি নিজেও হয় অমানুষের জাতি। এই বিকৃত, পঙ্গু ও বর্বর জাতির কাছ থেকে আমরা আজকের এই সভ্যতা ও বিজ্ঞানের জয়যাত্রার যুগে কতটুকু আশা করতে পারি? এই ধরনের বর্বরতা দিয়ে তো আজকের যুগে আর শক্ত পায়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো সম্ভব নয়। তাই পৃথিবীর সর্বত্র মার খাওয়া এবং হেরে যাওয়া ছাড়া তার গতি কী? আজকের যুগে আর ঘোড়ায় চড়ে ভিন্ন সমাজ ও জাতির সম্পদ লুটতরাজে বেরিয়ে পড়া সম্ভব নয়। সুতরাং ভিক্ষার ঝুলি কাঁধে নিয়ে পৃথিবীর উন্নত ও সমৃদ্ধ সমাজগুলোর দ্বারে দ্বারে ঘুরে ভিক্ষার অন্ন সংগ্রহ করে নিজের বর্বরতার আবাসে ফেরা ছাড়া এই জাতির আর কী করণীয় আছে?
এই অবস্থার পরিবর্তনের স্বপ্ন কি আমরা দেখি? আমরা কি চাই একটি মর্যাদাপূর্ণ সভ্য, উন্নত ও বিবেকী সমাজের সদস্য হতে? যদি তা চাই তবে আমাদের অবশ্যই নারীর প্রতি বর্বরতাপূর্ণ এই সমাজকে বদলাবার কথা ভাবতে হবে। আর তা বদলাতে চাইলে এই সমাজ ব্যবস্থার সংগঠনে ধর্মের ভূমিকাকে চিনতে পারতে হবে। তবেই আমাদের পক্ষে এ দেশে বাস্তবে কিছু করা সম্ভব হতে পারে। নতুবা নয়।
রচনাঃ ১৩ ফেব্রুয়ারী, ১৯৯২