লিখেছেনঃ আলমগীর হুসেন, আপডেটঃ July 30, 2012, 11:30 AM, Hits: 4655
২০০১ সালের ১১ সেপ্টেমবরের মর্মান্তিক ঘটনার পর থেকে ধর্ম হিসাবে ইসলাম গভীর পর্যবেক্ষণের আওতায় চলে আসে। ঐ দিন ১৯ জন আত্মঘাতী মুসলমান সন্ত্রাসী ছিনতাই করা বিমান নিয়ে নিউইয়র্কের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার এবং পেন্টাগন সদর দপ্তরে আঘাত হানে। এতে ৩০০০-এর বেশী নিরীহ মানুষ নিহত হয়। তখন থেকে ইসলামী মতবাদ নিয়ে বেশ কয়েকটি বই প্রকাশিত হয়েছে, প্রতিদিন ইসলামের সমালোচনা করে প্রচুর প্রবন্ধ-নিবন্ধ প্রিন্ট মিডিয়ায় ছাপা হচ্ছে এবং ইন্টারনেটে প্রকাশ পাচ্ছে। মুসলমানদের জন্য এটা একটা নূতন অভিজ্ঞতা। একেবারে অস্পষ্ট ধর্ম হওয়া সত্ত্বেও ইসলাম দীর্ঘদিন তার বিরুদ্ধ সমালোচনা অনেকটা এড়িয়ে যেতে সক্ষম হয়। দৃষ্টান্তস্বরূপ, খ্রীষ্টধর্ম অথবা হিন্দুধর্মের সমালোচনা মূলক শত শত বই এবং রচনা দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন লাইব্রেরী এবং মিডিয়ায় অবাধে পাওয়া যায়। অথচ ইসলাম সম্পর্কে এ ধরনের লেখা কার্যত অনুপস্থিত। কারণ যে সামান্য কিছু লেখালেখি হয়েছিল সেগুলোও নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। অবশ্য ইসলামের সমালোচনার যে কোন চেষ্টা ফতোয়া নামের ‘‘নিষ্ঠুর বিচারের’’ মাধ্যমে স্তব্ধ করে দেওয়া হয়। স্যাটানিক ভার্সেস-এর লেখক সালমান রুশদীর বেলায় এটা ঘটেছে। ৯/১১এর মর্মান্তিক ঘটনা ইসলামের সমালোচনা জোরদার করতে সমালোচকদের হাতে অনুঘটকের কাজ করে। এই সমালোচকদের মধ্যে রয়েছে নমনীয় মুসলমান, সাবেক মুসলমান এবং অমুসলমানগণ।
ইসলাম যতই নিষ্ঠুরতা, সশস্ত্র জঙ্গিপনা, মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং প্রগতি ও আধুনিকতার প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারী অস্পষ্ট ও হিংসাত্মক ধর্ম হিসাবে ক্রমবর্ধমানভাবে চিত্রিত হচ্ছে ততই ‘‘নমনীয় মুসলমান’’ হিসাবে পরিচিত মুসলমান কৈফিয়ৎদাতারা ইসলামের প্রগতিশীলতার মাপকাঠি হিসাবে মানব সভ্যতায় ইসলামের অবদানের মত অবাস্তব দাবী প্রাণপণে করে চলেছে। দৃষ্টান্ত স্বরূপ, বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত একজন মুসলমান কৈফিয়ৎদাতা, যিনি নিউইয়র্কে একটা কলেজের প্রফেসর, একটি ইন্টারনেট ফোরামে নিম্নোক্ত দাবী করেছেনঃ জামাতে ইসলামীর (বাংলাদেশের একটি ইসলাম পন্থী রাজনৈতিক দল) রাজনৈতিক আদর্শকে ইসলামের সমমর্যাদা দেওয়া এই মহান ধর্মের প্রতি চূড়ান্ত অবমাননার শামিল, মানব সভ্যতায় যে ধর্মের রয়েছে সিংহভাগ অবদান। মানব সভ্যতায় ইসলামের সিংহভাগ অবদান সম্পর্কে তার দাবীর পক্ষে তিনি কোন তথ্য বা উদাহরণ দেন নাই। তার দাবীর সপক্ষে ব্যাখ্যা দেওয়ার জন্য বলা হলে প্রফেসর নীরব থাকেন। এই রচনায় বিশ্বসভ্যতায় ইসলামের অবদান চুলচেরাভাবে বিশ্লেষণ করা হবে। বিষয়টির সাথে সম্পর্কযুক্ত বিধায় একটি তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরার জন্য অন্যান্য ধর্মের, যেমন খ্রীষ্টধর্ম ও ইহুদীধর্ম, অবদানও ব্যাপকভাবে আলোচনা করা হবে।
সভ্যতায় ধর্মসমূহের অবদান বিশ্লেষণ
২০ শতকের সর্বশ্রেষ্ঠ দার্শনিক বার্টান্ড রাসেল মানবসভ্যতায় ধর্ম সমূহের অবদান সম্পর্কে যে মূল্যায়ন করেছেন তা দিয়ে শুরু করা যাক। লর্ড রাসেল তার “ধর্ম কি সভ্যতায় কার্যকর অবদান রেখেছে?” শীর্ষক বিখ্যাত রচনায় মানব সভ্যতায় ধর্ম সমূহের (সকল ধর্মের) অবদান সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিয়েছেন (সূত্রঃ আমি কেন খ্রীষ্টান নই, পৃ.২৪)। বার্ট্রান্ড রাসেল মানব সভ্যতায় ইসলামসহ কোন ধর্মের কোন তাৎপর্যপূর্ণ অবদান খঁুজে পান নাই । তিনি লিখেছেনঃ
“ধর্ম সম্পর্কে আমার নিজের দৃষ্টিভঙ্গি লুক্রেটাসের মত। আমি ধর্মকে ভয় থেকে জন্ম নেওয়া একটি ব্যাধি এবং মানব জাতির অকথ্য দুর্দশার উৎস মনে করি। অবশ্য আমি অস্বীকার করতে পারি না যে ধর্ম সভ্যতায় কিছু অবদান রেখেছে। আগেকার দিনে ধর্ম বর্ষপঞ্জি নির্ধারণে সাহায্য করেছিল এবং ধর্মের কারণে মিসরীয় যাজকগণ এত সতর্কতার সাথে গ্রহণের বিবরণ রাখতেন যে একসময় তারা এগুলো সম্পর্কে আগাম ভবিষ্যদ্বাণী করতে সক্ষমতা অর্জন করেন। এই দু’টি অবদান আমি স্বীকার করতে রাজি আছি, তবে আমি অন্য কিছুর কথা জানি না।’’
আমার উপলব্ধি সঠিক হলে বার্ট্রান্ড রাসেলের উপরোক্ত উদ্ধৃতির সঙ্গে যীশুর জন্মের পূর্ববর্তী মিসরীয় ধর্ম যাজকদের সম্পর্ক আছে। অথবা আরো বিস্তারিত বলতে গেলে মূসা/ যীশুর আর্বিভাবের আগে প্রাচীন মিসরীয় ধর্ম যাজকরা ঐ দু’টি অবদান রেখেছিলেন। এমনকি মূসার জন্মের (খ্রীষ্টপূর্ব ১২০০ অব্দ) অনেক আগে খ্রীষ্টপূর্ব ২১৩৪ অব্দে চীনের রাজ-জ্যোতিষীরা গ্রহণ সম্পর্কে আগাম বলতে পারতেন। অন্য কথায় ইহূদী, ইসলাম ও খ্রীষ্টধর্ম অর্থাৎ তিনটি প্রধান আব্রাহামীয় ধর্মের কোনটাই মানব সভ্যতায় কোনো অবদান রাখে নাই। বরং এই সব কটি ধর্ম মানব সভ্যতার অগ্রগতি ও বিকাশকে কেবল বাধাগ্রস্ত করেছে। এর একটা ধ্রুপদী দৃষ্টান্ত হচ্ছে চতুর্থ শতাব্দীর গোড়ার দিকে রোমান সাম্রাজ্যের শাসকগণ কর্তৃক প্রগতি বিরোধী এবং প্রায়শই নিষ্ঠুর খ্রীষ্টান আদর্শে দীক্ষিত হওয়ার সাথে সাথে গ্রীক যুক্তিবাদিতায় উদ্বুদ্ধ প্রাণবন্ত এবং দ্রুত সমৃদ্ধি অর্জনকারী ইউরোপের অন্ধকার যুগে নিপতিত হওয়া। তখন রোমান সম্রাট কনস্টান্টাইন দি গ্রেট খ্রীষ্টান হয়ে গিয়েছিলেন।
পশ্চিমা বিশ্বে যেখানে ধর্ম ক্রমেই গুরুত্ব হারাচ্ছে সেখানকার সমাজগুলো সাম্প্রতিক সময়ে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, মানবীয় মূল্যবোধ এবং সামাজিক উন্নয়নে তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রাখছে। অপর দিকে আমরা যদি আজ মুসলিম বিশ্বের দিকে তাকাই যেখানে জনগণের ধর্মীয় চেতনা এবং ধর্মীয় আচারের প্রতি আনুগত্য অত্যন্ত প্রবল -- আমরা পরিষ্কারভাবে দেখি যে এই সমাজগুলি তাদের সমাজ ও জনগণের এবং ব্যাপক অর্থে বিশ্বের অগ্রগতি ও উন্নয়নে অতি সামান্য অবদান রাখছে।
তাই ‘‘আমি ধর্মকে ভয় থেকে জন্ম নেওয়া ব্যাধি এবং মানবজাতির অকথ্য দুর্দশার উৎস বলে মনে করি ’’ -- রাসেলের এই মন্তব্যকে আমরা সত্য বলে ধরে নিতে পারি। ইসলামের ক্ষেত্রে, এই ধর্মের শুরু সহিংসতা দিয়ে, যার সূচনা করেছিলেন নবী মুহাম্মদ নিজে। বলা হয় নবী মুহাম্মদ ৭৮টি অথবা আরো বেশী যুদ্ধ করেছিলেন এবং এগুলোর মাত্র দু’টি শুরু করেছিল তার প্রতিপক্ষরা। তিনি ইসলামকে সত্য ধর্ম হিসাবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য তার অভিযান শুরু করেছিলেন। তার লক্ষ্য ছিল মক্কার পৌত্তলিকদের হাত থেকে ঈশ্বরের কথিত ঘর কাবা দখল করা। অবশ্য মৃতুøর আগে মোহাম্মদ আরব উপদ্বীপের বেশীরভাগ জায়গা দখল করে নিয়েছিলেন। তিনি যে ৭৮টি অথবা তারো বেশী যুদ্ধ করেছিলেন সেগুলোর বদৌলতে এটা সম্ভব হয়েছিল। তার মৃতুøর পর তার উত্তরসূরীরা নবীর পদাঙ্ক অনুসরণ করতে থাকেন। বর্বর আরব ও পার্সী মুসলমান শাসকরা যতদিন পেরেছে ইসলাম বিস্তারের লক্ষ্যে এই রক্তাক্ত ইসলামী আক্রমণ অব্যাহত রেখেছেন। ফলে সৃষ্টি হয়েছে এক বিশাল ইসলামী সাম্রাজ্য।
অবশ্য এটা মনে রাখতে হবে যে ইসলামী অভিযানগুলো মূর্তি পূজক আলেকজান্ডার দি গ্রেট-এর মত অন্যান্য অভিযানকারীদের চেয়ে একেবারেই আলাদা ছিল। আলেকজন্ডারের বেলায়, তিনি একটি রাজ্য জয় করে ফেললে সেখানকার জনগণের দুর্দশার অবসান ঘটত; কারণ তিনি দ্রুত সেখানে ন্যায্য শাসন প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা নিতেন। তিনি বিজিত লোকজনের প্রতি কোন রকম বৈষম্য করতেন না। উল্লেখ করা দরকার যে আলেকজান্ডার তার বিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর পারস্যে এর রাজধানী স্থাপন করলে তার সাম্রাজ্যের লোকেরা আগের চেয়ে ভাল ছিল, কারণ তিনি সুশাসন এবং উন্নততর বিচার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি বুঝেছিলেন যে, বিজিত হলেও পরাজিত লোকজন বুদ্ধিমান, দক্ষ এবং শ্রদ্ধার যোগ্য। একই সঙ্গে তিনি ধর্ম, জাতি অথবা সংস্কৃতি নির্বিশেষে তার সাম্রাজ্যের সকল মানুষের মধ্যে সমতা প্রতিষ্ঠার জন্যে অব্যাহতভাবে চেষ্টা করেছিলেন। তিনি আরো বুঝেছিলেন যে জাতিগত পার্থক্য হচ্ছে বিভিন্ন লোকজনের মধ্যে সংঘাতের বড় কারণ। তাই তিনি জাতিগত সম্প্রীতি বিকাশের মাধ্যম হিসাবে তার প্রজাদের মধ্যে আন্তঃজাতিগত বিয়ের উৎসাহ দিতেন। তিনি একটি ভোজ উৎসবের আয়োজন করেন। এটা ‘‘পূর্ব ও পশ্চিমের বিবাহ’’ নামে বহুল পরিচিত হয়েছিল। এতে মেসিডোনিয়ার কয়েক হাজার সৈন্য আনুষ্ঠানিক ভাবে এশীয় নারীদের বিয়ে করেছিল। তিনি সাংস্কৃতিক বিনিময়কেও উৎসাহিত করতেন। তার শাসনকালে ভারত এবং আরব-এর অনেক সাংস্কৃতিক ধারণা ইউরোপে প্রবেশ করে, পক্ষান্তরে গ্রীক সাংস্কৃতিক প্রভাব এশিয়া ও ভারতে বিস্তৃত হয়।
অপরদিকে মুসলমান বিজয়ীরা অবধারিতভাবে পরাজিত জনগণের সংস্কৃতি ধ্বংস করার কাজে নিয়জিত ছিল। তদুপরি মুসলিম রাজত্বে পরাজিত জনগণ অব্যাহতভাবে দুর্ভোগ পোহাতে থাকে, কারণ মুসলিম শাসকগণ তাদেরকে ইসলাম গ্রহণে বাধ্য করার জন্যে নানান বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা আরোপ করে। পরাজিত রাজ্যের জনগণ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ না করলে বিজয়ী মুসলমানরা এমনকি তাদেরকে নিষ্ঠুর নির্যাতন করত। ইসলামি রাজত্বে অমুসলমানদের জিজিয়া কর দিতে হত। এটা ছিল বিশেষ ধরনের মোটা অংকের কর। অমুসলমানরা যাতে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে তার জন্য এই কৌশল অবলম্বন করা হত। এখানে উল্লেখ করা যায় যে, ভারতীয় উপমহাদেশে কয়েক শতাব্দীর মুসলিম রাজত্বকালে স্বৈরাচারী মুসলমান শাসকগণ প্রায় পাঁচ কোটি হিন্দু ও স্থানীয় লোকজনকে হত্যা করেছিল। শত শত হিন্দু মন্দির ধ্বংস করেছিল। এমনকি হায়দারাবাদের টিপু সুলতানের বাবা সুলতান হায়দার অনেক হিন্দু মন্দির ধ্বংসের আদেশ দিয়েছিলেন।
এটাও অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, নবী মুহাম্মদ নিজে যে ইসলামী ঐতিহ্য স্থাপন করে গেছেন সে অনুযায়ী কোন রাজ্য বা অঞ্চল একবার দখল হয়ে গেলে মুসলিম বাহিনীর সার্বিক অধিকার আছে পরাজিত জনগোষ্ঠীর পুরুষদের দাস হিসাবে এবং নারীদের যৌন দাসী হিসাবে কাজে লাগানোর। ভারতে মুসলিম দখলদারী এই ব্যাপারে কোন ব্যতিক্রম ছিল না। এটা এখন পরিষ্কার হয়ে গেছে যে, ভারত দখলের পর মুসলিম বাহিনী হাজার হাজার মানুষকে দাস হিসাবে নিয়ে যায়। উদাহরণ স্বরূপ, পারস্যে নিয়ে যাওয়ার সময় হঠাৎ তীব্র শীতের কবলে পড়ে আফগানিস্তানের পার্বত্য অঞ্চলে এক লাখের মত হিন্দু দাস মারা যায়। এই পর্বত এখন হিন্দুকুশ নামে পরিচিত, যার অর্থ হচ্ছে ‘‘হিন্দুদের মৃতুø’’। এ ধরণের বিয়োগান্তক ঘটনা রাজ্য জয়ের ইতিহাসে আর কখনও ঘটে নাই। এর ব্যাপকতা এমন ছিল যে হতভাগ্য নিহতদের স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য পর্বতটির এমন নামকরণ করা হয়। সব সময় এটাই যুদ্ধে নিয়ম যে, পরাজিতরা নয়, বিজয়ীরাই সুনাম অর্জন করে। আমাদের আরো বিবেচনা করতে হবে যে, বার্ট্রান্ড রাসেলের বই “আমি কেন খ্রীষ্টান নই” প্রকাশিত হয়েছে ১৯৫৬ সালে। তাই, ইসলাম যদি আসলেই মানব সভ্যতার অগ্রগতিতে সিংহভাগ অবদান রেখে থাকে তবে এটা অবশ্যই ঘটেছে ১৯৫৬ সালে বইটি প্রকাশিত হওয়ার পর। তবে আমাদের জানামতে সাম্প্রতিক দশকগুলিতে ইসলামী বিশ্ব শুধু অবক্ষয়ের শিকার হয়েছে। অথবা আমাদের সভ্যতার চমৎকার মৌলিক দিকগুলোর অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত করেছে। দৃষ্টান্ত স্বরূপ, ইসলামী বিশ্বে মানবধিকার লঙ্ঘন এবং অস্বচ্ছ বিচারের ঘটনা হরদম ঘটে চলেছে। এটা অত্যন্ত পরিষ্কার যে, ইসলামী বিশ্ব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতিতে কোন অবদান রাখে নাই এবং গত কয়েক দশকে মানবিক বিকাশের অন্য কোন উদ্যোগে কার্যকর উপাদান যোগ করে নাই।
সভ্যতায় অবদানঃ ধর্মীয় উপলব্ধি
ইসলামী ও অন্যান্য ধর্মীয় কৈফিয়ৎ দাতারা আলোচনাকালে প্রায়ই সভ্যতায় ধর্মসমূহের বিরাট অবদানের অস্বাভাবিক দাবী করে থাকেন। আমি বুঝতে পেরেছি যে মানব সভ্যতার মৌলিক উপাদান সম্পর্কে এই লোকগুলার মৌল উপলব্ধি একেবারেই ত্রুটিপূর্ণ, যদিও তারা আধুনিক শিক্ষায় অত্যন্ত উচ্চশিক্ষিত। আমি এখানে এ ধরনের একজন উচ্চশিক্ষিত ধর্মীয় ব্যক্তিত্বের (সম্ভবত খ্রীষ্টান) উদ্ধৃতি দিব। তিনি সভ্যতায় ধর্ম সমূহের বিশাল অবদান সম্পর্কে তার ধারণা এভাবে বর্ণনা করেছেন,
“আমি বলব এই অবদান বিশাল; প্রকৃতপক্ষে ধর্ম জনগণকে সর্বোত্তম বিষয়াদি প্রদান করেছে। ধর্ম আশা জাগিয়েছে, ধর্ম জীবনে এক ধরণের অর্থ যোগ করেছে। এবং জনগণকে বলেছে যে তারা নিঃসঙ্গ নয়, বরং তারা যাতে নিরাপদ থাকে সেজন্য কেউ একজন তাদের উপর সদা সর্বদা নজর রাখছেন। আপনি দেখুন আপনার এক বিরাট বাহিনী থাকতে পারে যারা সপ্তাহের প্রতিদিন ২৪ ঘন্টা আপনাকে পাহারা দিচ্ছে। তার পরেও আপনি নিজেকে অনিরাপদ ভাবতে পারেন। কিন্তু আপনি যদি ধর্মে বিশ্বাস করেন তবে আপনি সম্ভবত অন্ধকারতম নিঃসঙ্গ রাতেও ভয় পাওয়ার কোন কারণ অনুভব করবেন না। এটা মানুষের জীবনে ধর্মের অবদান। আপনি কি মনে করেন মানুষের জন্যে এর চেয়ে বেশী কিছুর দরকার আছে?”
মানব সভ্যতায় ধর্মের “বিশাল অবদান” সম্পর্কে এই সংজ্ঞা সম্ভবত একটি ইঙ্গিত দেয় যে, কেন ধর্ম অথবা গভীর ধার্মিক লোকজন কখনও সভ্যতার অগ্রগতির অংশ হতে পারে নাই; বরং গুরুতর প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে। যদি সভ্যতায় ধর্মের অবদান সম্পর্কে এই ধারণাকে সত্য বলে গ্রহণ করা হয় তবে এ কথা অনায়াসে বলা যায় যে, মধ্যযুগের বিশ্ব এবং সেই সময়কার বর্বর লোকজন আজকের তুলনায় বেশী সভ্য ছিল। কারণ সে সময়ে অধিকাংশ মানুষ বর্তমান সময়ের চেয়ে ছিল অধিক ধর্মপরায়ণ। উদাহরণ স্বরূপ, আজকের দিনে পশ্চিম ইউরোপের প্রায় ৫০%মানুষ কোন ঈশ্বর বা ধর্মে বিশ্বাস করে না। অথচ মধ্যযুগে ঈশ্বর এবং ধর্মে অবিশ্বাসী মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর ছিল। ধর্মপন্থীদের যুক্তি অনুসারে মধ্য যুগের বিশ্বে অবশ্যই উন্নততর সভ্যতা থাকার কথা। দুর্ভাগ্যক্রমে অধিকাংশ দার্শনিক, বিজ্ঞানী ও মানবতাবাদী, যাদের প্রায় সবাই প্রচলিত ধর্ম ও ঈশ্বর সম্পর্কিত ধারণা বিরোধী অথবা সংশয়বাদী, হয়ত আমাদের বিশ্বকে আজকের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য উপলব্ধির দিকে ঠেলে দিয়ে সেই ভাল পুরাতন সভ্যতাকে নষ্ট করে ফেলেছে।
বর্তমান কালে, ব্যক্তি স্বাধীনতা এবং মানবাধিকার ও মানবিক মর্যাদা ইত্যাদির প্রতি শ্রদ্ধাবোধ দ্বারা আধুনিক সভ্যতার মূল উপাদান সংজ্ঞায়িত হয়। আজকের সত্যতার এই সংজ্ঞানির্ধারক উপাদানগুলো ধর্মীয় নিরিখে উপরে বর্ণিত সভ্যতার অত্যাবশ্যক শর্তগুলোর চেয়ে অনেক ভিন্ন। বস্তুত আধুনিক সভ্যতার ভিত্তিপ্রস্তর হিসাবে বিবেচিত এই উপাদানগুলোর অধিকংশই আগেও সকল ধর্মের শত্রু ছিল, এখানও আছে। এর কারণ হচ্ছে বর্তমান সভ্যতার এই সংজ্ঞানির্ধারক উপাদানগুলোর প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার চেষ্টা করলে সব সময় ধর্মের সঙ্গে সংঘাত হয়েছে এবং প্রায়ই মানবতাবাদী ও মুক্ত চিন্তার অধিকারীদের প্রচুর মূল্য দিয়ে এগুলোকে অর্জন করতে হয়েছে। অবশ্য বর্তমান সভ্যতার এই কেন্দ্রীয় উপাদানগুলো মানুষের জীবন থেকে ধর্মকে খেদিয়ে দেওয়ার হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। এবং এর ফলে আজ বিশ্বের সর্বত্র উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ নাস্তিক, সংশয়বাদী এবং অজ্ঞেয়বাদী। তাদের সংখ্যা অব্যাহতভাবে বাড়ছে। এভাবে যদি আমরা ধর্মপ্রাণ বন্ধুদের প্রস্তাবমত সভ্যতার উপরে বর্ণিত সংজ্ঞা মেনে নিই তবে আমরা অবশ্যই নবী মুহাম্মদ, যীশুখ্রীষ্ট অথবা মূসার আমলের চেয়ে অনেক নিকৃষ্ট সভ্যতার মধ্যে বাস করছি এবং এই সভ্যতাও দ্রুত অসভ্যতার দিকে ধাবিত হচ্ছে। সুতরাং যদি আমরা ধর্মবেত্তাদের যুক্তি অনুসরণ করি তবে সভ্যতার উচ্চতর স্তরে উপনীত হওয়ার জন্য আমাদের সহজাত আকাংক্ষা পূরণের লক্ষ্যে সম্ভবত “আমাদের ঘড়ির কাঁটা পিছনের দিকে ঘুরিয়ে দিয়ে নবী মুহাম্মদ, যীশু অথবা মূসার অথবা আদমের আমলের উন্নততর সভ্যতায় ফিরে যাওয়ার” সময় হয়ে গেছে। ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ বাদ দিয়ে আমরা নিশ্চিতভাবে উপসংহার টানতে পারি যে, ধর্মীয় নীতিমালার অনুসারী লোকজনের মন, মগজ ও মানসিকতা আমাদের বর্তমান বিশ্ব ও সভ্যতার অগ্রগতি ও চমৎকারিত্বের সামগ্রিক ধারণা সম্পর্কে সত্যিকার হতচকিত ভাব অথবা কুসংস্কার দ্বারা আচ্ছন্ন। এর দ্বারা সম্ভবত ব্যাখ্যা করা যায় কী কারণে সামাজিক প্রতিষ্ঠান হিসাবে ধর্ম এবং ধর্মপালনকারী লোকজন কখনও সভ্যতার অগ্রগতির অংশ হত পারে নাই, বরং গুরুতর প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে।
বেশী চালাক ধর্মীয় কৈফিয়ৎদাতারা অবশ্য সভ্যতার অগ্রগতিতে তাদের ধর্মের অবদানের সুনাম দাবী করতে গিয়ে নিজ নিজ ধর্মের প্রখ্যাত বিজ্ঞানী, দার্শনিক ও চিন্তাবিদদের নাম উল্লেখ করে থাকেন। দৃষ্টান্ত স্বরূপ খ্রীষ্ঠানরা নিউটন ও গ্যালিলিউর নাম করে, ইহুদীরা আইনস্টাইন অথবা আধুনিক কালের নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ইহুদী বংশোদ্ভূতদের কথা বলে, পক্ষান্তরে মুসলমানরা ইবনে সিনা, আলবেরুনী এবং ওমর খৈয়মের মত অতীতের মহান মনীষীদের নাম উল্লেখ করে। সাম্প্রতিক কালের নোবেল পুরস্কার বিজয়ী প্রয়াত প্রফেসর আবদুস সালামের নামও তার বলে থাকে। এই নামগুলো অবশ্যই ধর্মপন্থীদের পক্ষে জোরালো অবস্থান সৃষ্টি করে। কিন্তু বিজ্ঞানে এই ব্যক্তিদের অবদানের ব্যাপারে ধর্মের কী ভূমিকা ছিল সে সম্পর্কে বিরাট প্রশ্ন না তুলে এ ধরনের যুক্তিকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে পাস নম্বর দেওয়া যায় না। এ ব্যাপারে আমাদের অবশ্যই নিম্নোক্ত বিষয়গুলো বিবেচনা করতে হবেঃ
১। ধর্মের ব্যাপারে তারা কতটা নিবোদিত প্রাণ ছিলেন এবং খোঁজখবর রাখতেন? তাদের মেদিনী-বিদারী অবদান সৃষ্টিতে ধর্মীয় জ্ঞান তাদেরকে কতটা সাহায্য করেছে?
২। তারা কি মওলানা-মোল্লা (ইসলাম), রাব্বী (ইহুদী), যাজক/ পাদ্রী (খ্রীষ্টান) এবং নবীদের মত ঈশ্বরের কাছের মানুষ ছিলেন?
৩। আজকের সভ্যতার সংজ্ঞা অনুসারে ১,৪০,০০০ নবীর (ইসলাম ধর্মীয় মতে) কী অবদান আছে?
প্লেটো, এরিস্টটল, সক্রেটিস, বুদ্ধ, কনফুসিয়াস, ইউক্লিড,এপিকুøরাস, ডেমোক্রিটাস, লুøক্রেটিয়াস এবং এরিস্টারকাসের মত অনেক ব্যক্তি মুহাম্মদ ও যীশুর মত নবীদের অনেক আগে জন্মেছিলেন । আব্রাহামীয় ধর্মসমূহের বক্তব্য অনুযায়ী তারা সবাই পৌত্তলিক হিসাবে পরিচিত। কিন্তু বিজ্ঞান, শিক্ষা, মানবাধিকার ও ন্যায্যতার উৎকর্ষ মণ্ডিত আজকের বিশ্বের ভিত্তি রচনায় তাদের ছিল সরাসরি ও ব্যপক প্রভাব। সভ্যতা যতই এগিয়েছে আমরা মুহাম্মদ, যীশু ও মূসার মত কথিত ঈশ্বর প্রেরিত নবীদের উপদেশগুলোকে ততই দূরে সরিয়ে দিয়েছি। এটা কঠিন বাস্তবতা যে, তোরাহ/ওল্ড টেস্টামেন্ট, বাইবেল ও কুরআনে বর্ণিত এই নবীদের একমাত্র অবদান হচ্ছে তারা উচ্চতর পর্যায়ে সভ্যতার অগ্রগতিকে থামিয়ে দিয়েছিলেন। আজকের দিনের ইহুদী এবং খ্রীষ্টানরা সভ্যতায় নিজ নিজ ধর্মের আবদান দাবী করতে গিয়ে তাদের ধর্মভুক্ত নোবেলবিজয়ী অনেকের নাম করতে পারে। অবশ্য সেই উদাহরণগুলো মেনে নেওয়ার আগে নিম্নোক্ত প্রশ্নসমূহের সমাধান দরকারঃ
১। ঐ নোবেল বিজয়ীরা কি ব্যভিচার করার জন্য তাদের স্ত্রী বা অন্য কাউকে পাথর ছুঁড়ে মেরে ফেলতে রাজী হবেন ? ([যদি একজন পুরুষকে এক বিবাহিতা নারীর সঙ্গে শুয়ে থাকতে দেখা যায়, এবং একজন পুরুষ তাকে শহরে দেখে, এবং তার সঙ্গে শোয়,”...“তবে তোমরা তাদের উভয়কে সেই শহরের ফটকে নিয়ে আসবে, এবং তোমরা তাদের প্রতি পাথর ছুঁড়বে যাতে তারা মারা যায়ঃ ঐ যুবতীকে, কারণ সে শহরের মধ্যে থাকা সত্ত্বেও উচ্চস্বরে কান্না করে নাই; এবং ঐ পুরুষকে, কারণ সে তার প্রতিবেশীর স্ত্রীর উপর উপগত হয়েছেঃ এভাবে তোমরা তোমাদের মধ্য থেকে শয়তান দূর করবে।” (ডিউটারনমি ২২ঃ২২,২৪])
২। তারা কি কারণ যাই হোক একজন গর্ভবতী নারীকে চিরে ফেলতে এবং তার গর্ভস্থ ভ্রূণ বের করে টুকরা টুকরা করতে রাজি হবে? [“সামারিয়া নিঃসঙ্গ হবে ; কারণ সে তার ঈশ্বরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে; তারা তরবারীর মুখে পড়বে; তাদের শিশুদের টুকরা টুকরা করে ফেলা হবে, এবং তাদের নারীদের সন্তানসহ ছিঁড়ে ফেলা হবে।” হোসিয়া ১৩; ১৬)]
ঈশ্বর প্রদত্ত এই পংক্তিগুলো সরাসরি বাইবেল থেকে নেওয়া। খ্রীষ্টানরা অবশ্য এসব নৃশংস ও বর্বর অনুশাসনকে তাদের ধর্মের পরিপন্থী বলে অগ্রাহ্য করে, কারণ এগুলো আসলে ইহুদীদের ওল্ড টেস্টামেন্ট থেকে নেওয়া হয়েছে। অবশ্য এটা বিবেচনায় রাখতে হবে যে, যীশু নিজে নিউ টেস্টামেন্ট লিখেন নাই, বরং সেন্ট পল নিউ টেস্টামেন্টের বেশীর ভাগ অংশের রচয়িতা বলে জানা যায়। বলা হয় যীশু ওল্ড টেস্টামেন্টে অথবা তোরাহ সর্বান্তঃকরণে গ্রহণ এবং প্রচার করেছিলেন। এ প্রসঙ্গে মিখায়েল হার্ট তার “দি ১০০” গ্রন্থে লিখেছেন,
“.....যীশুর শেষ বাক্য সম্পর্কে ম্যাথু এবং লুক একেবারে ভিন্ন বিবরণ দিয়েছেন। বস্তুত এই উভয় বক্তব্য হচ্ছে ওল্ড টেস্টামেন্ট থেকে সরাসরি উদ্ধৃতি। এটা কোন দুর্ঘটনা নয় যে যীশু ওল্ড টেস্টামেন্টের উদ্ধৃতি দিতে পেরেছিলেন। খ্রীষ্ট ধর্মের জনক হলেও তিনি নিজে একজন গোঁড়া ইহুদী ছিলেন।” ওল্ড টেস্টামেন্ট অবশ্যই বাইবেলের অংশ এবং নিউ টেস্টামেন্টের কোথাও যীশু কখনো নিউ টেস্টামেন্টকে প্রত্যাখ্যান বা নিন্দা করেন নাই। এটাও অবশ্যই বুঝতে হবে যে, খ্রীষ্টানরা ইহুদীদের ঈশ্বরকে তাদের একই বলে বিশ্বাস করে। তাই, একজন সর্বশুদ্ধ, সর্ব শক্তিমান, সর্বজ্ঞ ঈশ্বরের ওল্ড টেস্টমেন্টে বর্ণিত চিরন্তন ও পুরোপুরি মূল শিক্ষাকে মূলের থেকে কম প্রমাণ্য নিউ টেস্টমেন্টের রূপরেখা দ্বারা অস্বীকার বা বাতিল করা যায় না।
অবশ্য আজকের দিনের বেশীর ভাগ বিজ্ঞানী, চিন্তাবিদ ও দার্শনিক সৃষ্টি তত্ত্ব অথবা কুমারী গর্ভে যীশুর জন্মের গল্প করেন না। দৃষ্টান্ত স্বরূপ, আজকের দিনের অধিকাংশ বিজ্ঞানী বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্বাস করেন যে, যীশু ছিলেন একজন অবৈধ সন্তান, অর্থাৎ মেরী যার দ্বারা গর্ভবতী হয়েছিলেন বলে দাবী করা হয় (খ্রীষ্টানগণ কর্তৃক) সেই তথাকথিত পবিত্র আত্মা একজন মরণশীল মানুষ ছাড়া অন্য কিছু ছিলেন না। অবশ্য এ ধরনের ধর্মদ্রোহিতার জন্য এসব মহান বিজ্ঞানীদের শাস্তি হচ্ছে মৃতুø। বাইবেলে যীশু নিজে বলেছেন,
“এবং যে কেউ মনুষ্যপুত্রের বিরুদ্ধে একটা কথাও বললে তাকে ক্ষমা করা যাবে; কিন্তু যে কেউ পবিত্র আত্মার বিরুদ্ধে কথা বললে সে ক্ষমা পাবে না, এই দুনিয়ায় নয়, যে (দুনিয়া) আসছে তাতেও নয়।” (ম্যাথু ১২;৩২)
এটা সত্য যে, আধুনিক কালের অধিকাংশ মহান বিজ্ঞানী খ্রীষ্টান এবং ইহুদী পটভূমি থেকে এসেছেন। কিন্তু এতে করে এই খ্রীষ্টান এবং ইহুদীরা অথবা তাদের মহান আবিষ্কার ও অবদানগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে ধর্মীয় হয়ে যায় না। উদাহরণ হিসাবে ইউ এস ন্যাশনাল একাডেমী অফ সায়েন্সেস এর (ন্যাস) কথা ধরা যাক। এটা বিশ্বব্যাপী সকল মহত্তম বিজ্ঞানীর মিলনক্ষেত্র । মজার ব্যাপার হচ্ছে, ন্যাস-এর মাত্র ৭% বিজ্ঞানী প্রচলিত ধর্মসমূহ ও ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন। তাই, আজকের দিনের শ্রেষ্ঠতম সমাজগুলো ইহুদী-খ্রীষ্টান পটভূমির হলেও তারা আসলে নিজেদের ধর্ম মতের বিরোধী। এই শ্রেষ্ঠতম মনীষীদের শাস্তি হচ্ছে ইহুদী-খ্রীষ্টান ধর্ম অনুসারে মৃতুø। বাইবেলের নিম্নোক্ত পংক্তিগুলোতে তার রূপরেখা রয়েছে,
“যদি তোমার ভাই, তোমার মায়ের পুত্র, অথবা তোমার পুত্র, অথবা তোমার কন্যা, অথবা তোমার অন্তরঙ্গ স্ত্রী, অথবা তোমার বন্ধু, যারা তোমার নিজের আত্মার মত, তোমাকে গোপনে বলে, চল আমরা অন্য দেবতাদের উপসনা করি, যাদের তুমি, তোমার পিতৃপুরুষগণ জান না,” (ডিউটারনমি ১৩; ৬)
“তুমি তাকে সম্মতি দিবে না, তার কথা শুনবে না, তোমার চোখ তাকে দয়া দেখাবে না, তুমি তাকে ছাড়বে না, তুমি তাকে লুকিয়ে রাখবে না; বরং তুমি নিশ্চিতভাবে তাকে হত্যা করবে, তাকে মৃত্যুমুখে পতিত করার জন্য তোমার হাত সবার আগে তার উপর পড়বে” (ডিউটারনমি ১৩; ৮-৯)।
ইসলামের স্বর্ণযুগ ও সভ্যতায় অবদান
অনুরূপভাবে মুসলমানরা যখন সভ্যতায় ইসলামের অবদান নিয়ে কথা বলে, তারাও দেরী না করে ওমর খৈয়ম, ইবনে সিনা, ইবনে রুশদের মত মহান মুসলিম কবি, দার্শনিক ও বিজ্ঞানীদের নামোল্লেখ করে । এরা ৮ম থেকে ১৪তম শতাব্দীর মধ্যে ইসলামের তথাকথিত স্বর্ণযুগে জন্মেছিলেন। এই সত্য অস্বীকার করা যাবে না যে, এই মহান মুসলিম মনীষীগণ মানব সমাজের জন্য তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রেখে গেছেন। কিন্তু আমাদের অবশ্যই এই অত্যাবশ্যক প্রশ্নের সমাধান করতে হবে, “ কতটা ভাল মুসলমান ছিলেন?” সত্য হচ্ছে যে, তারা ভাল মুসলমান ছিলেন না বললেই চলে এবং সঠিক ধর্মীয় অর্থে তাদের অনেকে ইসলাম ধর্ম পরিত্যাগকারী হিসেবে বিবেচিত হবেন, এবং অবশ্যই তৎকালীন ইসলামী ধর্মবেত্তরো তাদেরকে ধর্মদ্রোহী বলতেন।
ইসলামের তথাকথিত স্বর্ণযুগে (৮ম-১৪তম শতাব্দী ) ইসলামী দুনিয়া বিশ্বের অন্যান্য অংশের তুলনায় বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, শিল্প, বাণিজ্য এবং আরো অনেক ক্ষেত্রে অত্যন্ত অগ্রসর ছিল। অবশ্যই সে যুগে ইসলামী দুনিয়া অনেক বৈজ্ঞানিক, সাহিত্যিক ও দার্শনিক প্রতিভার জন্ম দিয়েছিল। এদের মধ্যে ছিলেন ওমর খৈয়ম (১০৪৮ ১১২২), আলজাহরাবী (৯৩৬ ১০১৩), আল খোবারিজমি (৭৮০ ৮৫০), আল বেরুনী (৯৭৩ ১০৫০), আল কিন্দি (৮০১ ৮৭৩), আল বাট্টানী (৮৫০ ৯২৯), ইবনে সিনা (৯৭৩ ১০৩৭), আবদুল্লাহ আল মা’আরী (৯৭৩ ১০৫৭), ইবনে রুশ্দ (১১২৮ ১১৯৮) এবং জালালউদ্দীন রুমী (জন্ম ১২০৭) এবং আরো আনেকে।
এসব বুদ্ধিজীবী প্রতিভার মহত্ত্ব নিয়ে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। তারা বিশ্ব অঙ্গনে প্রজ্ঞার দিক থেকে অন্যান্য ধর্মের স্বদেশবাসীদের তুলনায় ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। অবশ্য ইসলামের সেই স্বর্ণযুগের এবং তার আগে পরের সময়টা ছিল বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। প্রথমে বিবেচনায় আনতে হবে যে, সেটা ছিল এমন এক সময় যখন ইউরোপের খ্রীষ্টান বিশ্ব খ্রীষ্টান চার্চের কব্জায় চলে যায়। এ ফলে হেলেনীয় যুগের গ্রীক দর্শন দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির পথে দ্রুত ধাবমান ইউরোপে অন্ধকারে যুুগের সূচনা করে। পরে তা প্রবাদে পরিণত হয়। এই সময়ে ইসলামী দুনিয়ায় এর ঠিক বিপরীত ঘটনা ঘটেছিল । গ্রীক যুক্তিবাদ ও দর্শন ইউরোপ থেকে হারিয়ে যায়; কিন্তু তা আবির্ভূত হয় সদ্যোজাত ইসলামী দুনিয়ায় । এতে এক নূতন ইসলামী মতবাদের উথান ঘটে, যার নাম মুতাযিলী। আব্বাসীয় খিলাফতের (৭৪৯ ৮৪৭ খ্রীঃ) যুগে এটা শুরু হয়েছিল।
ইরাকের সমৃদ্ধ নগরী আল বসরায় (বেসরা নামেও পরিচিত) ৮ম শতাব্দীতে মুতাযিলা ধর্মতত্ত্বের উদ্ভব ঘটে। সে সময় এক ধর্মতাত্ত্বিক বিতর্কের পর ওয়াসিল ইবনে ‘আত্তা’ আল-হাসান আল বাসরীর শিক্ষা থেকে সরে আসেন। এতে ইবনে ‘আত্তা’ এবং তার অনুসারীদের ‘মুতাযিলা’ আখ্যা দেয়া হয় যার অর্থ হচেছ ‘‘ ইসলাম পরিত্যাগকারী ’’। গ্রীক দর্শনের ন্যায় শাস্ত্র ও যুক্তিবাদের ওপর ভিত্তি করে মুতাযিলা ধর্মতত্ত্ব বিকাশ লাভ করে। এই তত্ত্বে গ্রীক দর্শন এবং ইসলামী মতবাদের সমন্বয় ঘটিয়ে অন্তর্গতভাবে এগুলো যে এক তা দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছিল।
এই যুগে মুসলিম ধর্মতাত্ত্বিকদের মধ্যে কয়েকটি প্রশ্ন নিয়ে বিতর্ক হয়। এগুলোর মধ্যে ছিল কুরআন কি সৃষ্টি করা হয়েছে, নাকি চিরন্তন? অশুভ কি ঈশ্বর কর্তৃক সৃষ্ট? পূর্ব নির্ধারিত গন্তব্য বনাম মুক্ত ইচ্ছা, কুরআন বর্ণিত ঈশ্বরের গুণাবলী রূপক না আক্ষরিক অর্থে ব্যাখ্যা করা হবে? এবং বিশ্বাসী পাপীরা অনন্ত নরক যন্ত্রণা ভোগ করবে কিনা? মুতাযিলা ভাবনায় এসব প্রশ্ন মীমাংসার চেষ্টা ছিল।
মুতাযিলা আদর্শ বিশ্বাস করে যে, কুরআন মুহাম্মদ কর্তৃক সৃষ্ট; এটা আল্লাহর বাণী নয়। তারা বিশ্বাস করত যে, নবী মুহাম্মদ দৃশ্যমান ধারণা যোগ্য আল্লাহর সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে পারেন নাই, কারণ কুরআনেই দাবী করা হয়েছে তিনি অদৃশ্য এবং ধারণার অতীত। এবং এই মতবাদের, যা ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে ধর্মের চূড়ান্ত অবমাননার শামিল, পৃষ্ঠপোষকতার করেন তৎকালীন আব্বাসীয় খলীফা হারুন আল-রশীদ (৭৬৩-৮০৯ খ্রীঃ)। তার ছেলে মহান খলীফা আল মামুন আনুষ্ঠানিক ভাবে একে রাজকীয় বিশ্বাসের মর্যাদা দেন। যারা কুরআনের ইসলাম পরিত্যাগ করে মুতাযিলা আদর্শ গ্রহণ না করবে তাদের সাজা দেওয়ার জন্য খলীফা আল মামুন এমনকি মিহ্না নামের (আরবী মিহ্না শব্দের অর্থ হচ্ছে কঠোর পরীক্ষা) বিচারিক আদালত প্রতিষ্ঠা করেন (৮৩৩-৮৪৮)। মিহ্নার যারা শিকার হয়েছিলেন তাদের মধ্যে অত্যন্ত বিখ্যাত আহম্মদ ইবনে হাম্বালকে কারাদণ্ড দেওয়া হয় এবং তার উপর শারীরিক নির্যাতন চালানো হয় এবং বিচারক আহমদ ইবনে নসর আল-খুযাইকে ক্রুশবিদ্ধ করে হত্যা করা হয়।
মুতাযিলার সংজ্ঞা নির্ধারক দর্শন ছিল মুক্ত চিন্তা, যুক্তিবাদ এবং বৈজ্ঞানিক ভাবনা। এসবের শিকড় হেলেনিক যুগের গ্রীক দর্শনে নিহিত ছিল। নিম্নোক্ত কবিতায় মহান কবি, দার্শনিক, জ্যোতির্বিদ ও অঙ্কশাস্ত্রবিদ ওমর খৈয়ম গ্রীক দর্শনের ভূয়সী প্রশংসা করার পাশাপাশি ইসলামের তীব্র সমালোচনা করেন।
“যদি ঐ মাতালদের মাদ্রাসা সমূহ
পরিণত হয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে
যেখানে পড়ানো হবে দর্শন
এপিকিুউরাস, প্লেটো আর এরিস্টটলের;
যদি পীর আর দরবেশের বাসস্থান ও মাজারগুলি
গবেষণা প্রতিষ্ঠানের রূপ নেয়,
যদি মানুষ ধর্মের অন্ধ বিশ্বাস অনুসরণের পরিবর্তে
নীতি শাস্ত্রের চর্চা করে
যদি উপসনালয়গুলি রূপন্তরিত হয়
সকল শিক্ষামূলক কর্মকাণ্ড শেখার কেন্দ্রে,
যদি ধর্ম নিয়ে পড়া-শোনার পরিবর্তে, মানুষ
অঙ্ক বীজগণিতের উৎকর্ষ সাধনে নিয়োজিত হয়,
যদি বিজ্ঞানের যুক্তি স্থান দখল করে নেয়
সুফীবাদ, বিশ্বাস আর কুসংস্কারের,
মানব জাতিকে বিভক্তকারী ধর্ম
প্রতিস্থাপিত হয় মনবতা দ্বারা
তাহলে বিশ্ব পরিণত হবে স্বর্গে,
অপর দিকের দুনিয়া তখন বিলুপ্ত হযে যাবে
বিশ্ব তখন পূর্ণ হবে
প্রেম-মমতা-মুক্তি-আনন্দে,
এবং এতে কোন সন্দেহ নাই।”
ইবনে সিনাও (আভিচেননা) ইসলামসহ সব ধর্মকে মিথ্যা বলে প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি বলেছেন,“এই রামছাগলগুলো (নবীগণ) এমন ভাব করে যেন ঈশ্বরের কাছ থেকে বার্তা নিয়ে এসেছে। আজীবন তারা লিপ্ত থাকে মিথ্যা প্রচারে এবং জনগণের উপর প্রভুর বাণীর প্রতি অন্ধ আনুগত্য চাপিয়ে দিতে।”
প্রাচ্যের লুøক্রেটিয়াস নামে ব্যাপকভাবে পরিচিত আবদুল্লাহ আল মারী (৯৭৩ ১০৫৭)ও তার কবিতায় ধর্ম নিয়ে বিদ্রূপ করেছেন,
“হানিফরা (মুসলমান) হোঁচট খাচ্ছে, খ্রীষ্টানরা সবাই বিপথে, ইহুদীরা জঙ্গলে দিকভ্রান্ত, মেজিয়ানরা দূরে চলে গেছে ভুল পথে।
আমরা মরণশীলরা দুই বিশাল ধারায় বিভক্ত;
আলোকপ্রাপ্ত প্রতারক অথবা ধর্মপ্রাণ বোকা....”
মুতাযিলা বিশ্বাস পদ্ধতি ইসলামী খিলাফতের সক্রিয় পৃষ্ঠপোষকতা এবং শিক্ষিত ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর মধ্যে জনপ্রিয়তা পেলেও অশিক্ষিত সাধারণ মানুষের মধ্যে আবেদন সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হয়। অপরদিকে গোঁড়া কুরআনপন্থী মুসলমানরা মুতাযিলা বিশ্বাস মোকাবিলায় আপ্রাণ চেষ্টা চালায়। এই যুগ অন্যান্য প্রসিদ্ধ হাদীস সংগ্রহকারীর জন্যও প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। তারা হলেন মুসলিম বিন আল হাজ্জাজ (৯২০০ হাদীস, মৃতুø ৮৭৫), আল বুখারী (৭২৭৫ টি হাদীস, ৮১০৮৭০), আবু দাউদ (মৃতুø ৮৮৮) এবং আল তিরমিজী (মৃতুø ৮৯২)ইত্যাদি। গোঁড়া কুরআনপন্থী অথবা সুন্নী ইসলাম ধীরে ধীরে মুসলিম মানসে প্রধান্য বিস্তার শুরু করে। পরবর্তী কালে অপর এক বিখ্যাত হাদীস সংগ্রহকারী ইমাম আল গাজ্জালী (মৃতুø ১১১১) মুতাযিলা বিশ্বাস আল্লাহর বাস্তবতা প্রমাণ করতে পারে নাই এ অজুহাতে এই যুক্তিবাদী চিন্তাকে চ্যালেঞ্জ করে এক গণ-হিস্টিরিয়া সৃষ্টি করেন। ইমাম গাজ্জালীর মত ইসলামী ধর্মান্ধরা ইবনে সিনা, ইবনে রুশ্দ, আল মাআরি এবং ওমর খৈয়মের মত প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবীদের ধর্মবিরোধী বা ধর্মত্যাগী আখ্যা দেন। ধমান্ধ মুসলমানদের আক্রমণের মুখে মুতাযিলা মতবাদ পর্যায়ক্রমে প্রভাব হারাতে থাকে এবং শেষ পর্যন্ত শাসক গোষ্ঠী ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সমর্থন হারায় । ত্রয়োদশ শতাব্দী নাগাদ মুতাযিলা চিন্তাধারার মৃতুø ঘটে এবং সেই সঙ্গে ইসলামের তথাকথিত স্বর্ণযুগের অবসান হয়।
তাই, ইসলামী স্বর্ণযুগ হচ্ছে এমন একটা সময়, যার বৈশিষ্ট্য ছিল প্রাক-খ্রীষ্টান যুগের গ্রীক যুক্তিবাদিতার ন্যায় ও মুক্তচিন্তা দ্বারা অনুপ্রাণিত ইসলামবিরোধী মুতাযিলা ধর্মতত্ত্বের উত্থান ও বিকাশ। এবং ঐ মুসলিম পণ্ডিতগণ, যারা ইসলামী স্বর্ণযুগের সংজ্ঞা নির্ধারক উপাদানসমূহ বিজ্ঞান, অংক শাস্ত্র, চিকিৎসা, দর্শন ও যুক্তিবাদী চিন্তাকে সমৃদ্ধ করেছেন, তারা সবাই ছিলেন অনৈসলামিক মুতাযিলা ধারার মানুষ। তারা সত্যিকার ইসলামী ধারার আল বুখারী, আবু দাউদ এবং ইমাম গাজ্জালীর মত সমকালীন সুন্নী ইসলামী পণ্ডিতদের মত ছিলেন না। এসব তথ্য থেকে বোঝা যায়, ইসলামী দুনিয়ার অগ্রগতি ও সমৃদ্ধি ইসলামের ইতিবাচক প্রভাবে ঘটেছিল এমন দাবী পুরোপুরি অগ্রহণযোগ্য এবং হাস্যকর; বরং এটা সম্ভব হয়েছিল সেই যুগে সত্যিকার ইসলামী আদর্শ পিছনের সারিতে চলে যাওয়ার কারণে।
যদি আমরা মানব সভ্যতায় ইসলামের সত্যিকার অবদান বিবেচনা করতে চাই তবে আমাদের স্বর্ণযুগের আগের সময়ের দিকে তাকাতে হবে। সে সময়ে শাসনকর্তা ছিলেন নবী মুহাম্মদ, আবু বকর, হযরত ওমর, ওসমান, ইমাম আলী ও আবু হানিফা। এরা সবাই ইসলামী ধর্ম বিশ্বাসের উচ্চতম ব্যত্তিত্ব। আমরা স্বর্ণযুগ পরবর্তী সময়ের (১৩ শতাব্দীর পর) অবদানও বিবেচনায় নিতে পারি যখন সত্যিকার ইসলামী (সুন্নী) মতবাদের পুনরুজ্জীবন ঘটেছিল। দুর্ভাগ্যক্রমে, সত্যিকার ইসলামী বিশ্বাসের প্রধান্যপুষ্ট সময়কালে বিজ্ঞান, চিকিৎসাশাস্ত্র, প্রযুক্তি, মানব উন্নয়ন ইত্যাদি ক্ষেত্রে ইসলামী দুনিয়ার অবদান ছিল অস্তিত্বহীন । এমনকি তথাকথিত ইসলামী স্বর্ণযুগেও বিখ্যাত হাদীস সংগ্রহকারী মুসলিম আল হাজ্জাজ, আল বুখারী, আবু দাউদ, আল তিরমিজী, ইমাম গাজ্জালী প্রভৃতির মত ইসলামী মতবাদের বিশিষ্ট অগ্রসেনাদের আবির্ভাব ঘটলেও তারা স্বর্ণ যুগের সংজ্ঞা নির্ধারক বিজ্ঞান, চিকিৎসা শাস্ত্র, প্রযুক্তি ও মানব উন্নয়নে একেবারেই কোন অবদান রাখেন নাই। বরং কুরআনের সাহায্য নিয়ে এসব সত্যিকার ইসলামী পণ্ডিতদের রচনাবলী ইসলামী শরিয়াহ প্রণয়নে সহায়তা করেছে, যা শুধু মানুষের অধিকার ও মর্যাদা লংঘন, ব্যক্তিগত স্বাধীনতা ও ন্যায্যতার অবক্ষয় এবং ইসলামী সন্ত্রাসবাদ জন্ম দেওয়ার কারণ হয়েছে। আজকের ইসলামী দুনিয়ায় এসব অতি পরিচিত দৃশ্য।
আমাদের অবশ্যই এটাও বিবেচনা করতে হবে যে, মুসলমান ও ইহুদীদের মধ্যে নোবেল বিজয়ীদের অনুপাত হচ্ছে ১ঃ ১০০। এই বিশাল বৈষম্যের কারণ অনুসন্ধান করলে সহজেই বোঝা যায়, ইসলামী দুনিয়া ইহুদী ও খ্রীষ্টানদের তুলনায় গভীরভাবে ধর্মান্ধ। গরিষ্ঠ সংখ্যক ইহুদী ও খ্রীষ্টান তাদের ধর্মের গোঁড়ামী ও অন্ধবিশ্বাস থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছে বলেই তারা সৃজনশীল হতে এবং আমাদের বিশ্বে অবদান রাখতে অধিকতর সক্ষম।
খ্রীষ্ট ধর্ম ও আধুনিক সভ্যতা
এটা সত্য যে, অন্ধকার যুগের পরবর্তী সময়ে খ্রীষ্টান ইউরোপে আধুনিক সভ্যতার দ্রুত বিকাশ ঘটে। এই বিকাশের জন্য খ্রীষ্টান ধর্মীয় বিশ্বাসকে বাহবা দেয়ার আগে ব্যাপরাটা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। এটা অনস্বীকার্য যে, খ্রীষ্টান বংশোদ্ভূত অনেক বিজ্ঞানী, দার্শনিক ও লেখক ইউরোপে রেনেসাঁ ও শিল্প বিপ্লবের দিনগুলোতে আমাদের সভ্যতার বিবর্তনে বিরাট অবদান রেখেছেন। মহান কোপারনিকাস, গ্যালিলিও এবং নিউটন, সবাই খ্রীষ্টান পরিবারে জন্মেছিলেন। কিন্তু বৈজ্ঞনিক বিপ্লব সাধনে খ্রীষ্টান ধর্মবিশ্বাসের কাছে তাদের বিন্দুমাত্র ঋণ আছে কি? এই মহান বিজ্ঞানীরা কী করেছিলেন তা পরীক্ষা করলে আমরা উপলব্ধি করব যে, তারা বরং বাইবেলে বারবার বর্ণিত পৃথিবী অনড় এবং ব্রহ্মাণ্ডের কেন্দ্রে অবস্থিত এই তত্ত্বের বিপরীতে পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘোরে এই তথ্য প্রতিষ্ঠা করে খ্রীষ্টান ধর্মীয় বিশ্বাসে মৃত্যু পেরেক গেঁথে দিয়েছিলেন। এই একটি মাত্র আবিষ্কার অন্য যে কোন কিছুর চেয়ে খ্রীষ্টান ধর্মের বেশী ক্ষতি করেছে। তাই সত্যিকার অর্থে এই মহান বিজ্ঞানীদের ধর্মের সঙ্গে সম্পৃক্ততা থাকলেও তাদেরকে ধর্মদ্রোহী এবং খ্রীষ্ট ধর্মের মহা শত্রু বলা উচিত।
আরেকটা ইসুøর সমাধান দরকার। সেটা হচ্ছে, খ্রীষ্টানরা প্রায়ই জেনেটিক্স-এর জনক জোহানেস গ্রেগরী মেনডেলের নাম উল্লেখ করে থাকে। তিনি একজন যাজক ছিলেন। যেহেতু মেনডেল যাজক ছিলেন সেহেতু বিজ্ঞানে তার অবদান সত্যিকার অর্থে খ্রীষ্টীয় অবদানের পক্ষে জোরালো যুক্তি হাজির করে। কিন্তু এটা অবশ্যই বিবেচনায় রাখতে হবে যে, মেনডেলের মহান আবিষ্কার খ্রীষ্টীয় ধর্মবিশ্বাসের উপর “বিরাট আঘাত” হেনেছে। মেনডেলের আবিষ্কার জীববিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। এটা জেনেটিকভাবে উন্নত মানের ফলন (খাদ্য), পশুর ক্লোন করা, মানুষের ভ্রূণ নিখুঁত করায় বিজ্ঞানীদের সাহায্য করেছে। এখন তো মানব ক্লোনের কয়েকটা ঘটনার খবরও পাওয়া গেছে। এ সময়ে জীববিজ্ঞানের অগ্রভাগে ছিল এই সব বৈজ্ঞানিক এডভেঞ্চার। খ্রীষ্টান যাজকরা বছরের পর বছর এসব ঘটনার তীব্র বিরোধিতা করে আসছেন। মেন্ডেলের জেনেটিক্স (জিনতত্ত্ব) ডারউইনের ঈশ্বরবিহীন বিবর্তনবাদকে ক্রমেই বেশী করে সত্য প্রমাণ করছে। এই তত্ত্ব খ্রীষ্টধর্মের দৃঢ়ভিত্তি সৃষ্টিতত্ত্ব মতবাদের সম্পূর্ণ বিপরীত। বাস্তবে জিনতত্ত্বে মেন্ডেলের আবিষ্কার খ্রীষ্টধর্মের চূড়ান্ত ধ্বংসের সূচনা করেছে। তাই প্রশ্ন উঠে খ্রীষ্টানদের ঈশ্বর কি তার প্রিয় মানুষ গ্রেগরী মেন্ডেলকে ঈশ্বরের অস্তিত্ব চ্যালেঞ্জকারী এমন কিছু আবিষ্কার করতে দিয়ে যথেষ্ট প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছেন? না, সর্বশক্তিমান এবং সর্বপ্রাজ্ঞ ঈশ্বর এত বোকা হতে পারেন না। বাইবেলে ঈশ্বরকে অতটা উদার ও ধৈর্যশীল মনে হয় না। অতএব জেলেটিক্স-এ মেন্ডেলের আবিষ্কার নিয়ে খ্রীষ্টধর্মের কিছুই করার নাই। বরং এতে খ্রীষ্টধর্মের উপর একটি মরণ পেরেক গেঁথে দেওয়া হয়েছে। সুতরাং খ্রীষ্টধর্ম আমাদের সভ্যতা গড়ার ক্ষেত্রে কোন অবদান রাখে নাই। অবশ্য খ্রীষ্টান বংশোদ্ভূত লোকজন ব্যাপক অবদান রেখেছে, যার একমাত্র কারণ তারা জন্মগতভাবে প্রতিভাবন ছিলেন এবং প্রায়ই যুক্তিবাদী মুক্তচিন্তা দ্বারা অনুপ্রাণিত থাকতেন, যা সব সময় খ্রীষ্টান মতবাদ অগ্রাহ্য করার শক্তি যুগিয়েছে। ইসলাম এবং ইহুদী ধর্মের বেলাতেও একই কথা খাটে।
সভ্যতায় খ্রীষ্টান ধর্মের অবদানের সারসংক্ষেপ তুলে ধরতে গিয়ে লেখিকা হেলেন এলারবি তার বই “দি ডার্ক সাইড অফ ক্রিশ্চিয়ান হিস্ট্রি”-তে লিখেছেন, “সমাজে চার্চের ছিল বিপর্যয়কর প্রভাব। চার্চের হাতে নেতৃত্ব চলে যাওয়ার পর চিকিৎসা শাস্ত্র, প্রযুক্তি, বিজ্ঞান, শিক্ষা, ইতিহাস এবং বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সব তৎপরতা ভেঙ্গে পড়ে।”
মাইকেল হার্টের “দি ১০০” গ্রন্থে একই তথ্যের প্রতিধ্বনি শোনা যায়। সেখানে তিনি খ্রীষ্টান ইউরোপে আধুনিক বিজ্ঞান ও সভ্যতার উত্থানের জন্য খ্রীষ্টীয় ধর্মবিশ্বাসকে কোন প্রশংসা করেন নাই, বরং নিন্দা করেছেন। তিনি লিখেছেন,
“যদিও আধুনিক বিজ্ঞানের প্রথম উত্থান ঘটে পশ্চিম ইউরোপের খ্রীষ্টান দেশগুলোতে, তারপরও বিজ্ঞানের উত্থানের জন্য যীশুকে বাহবা দেওয়া যথার্থ হবে না। অবশ্যই গোড়ার দিকে খ্রীষ্টানদের কেউই যীশুর শিক্ষাকে বস্ত জগতের বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের আহ্বান হিসাবে ব্যাখ্যা করেন নাই। বরং রোমান বিশ্ব খ্রীষ্টান হয়ে যাওয়ার পর প্রযুক্তির সাধরণ মান এবং বিজ্ঞানে আগ্রহের সাধারণ মাত্রা এই উভয় ক্ষেত্রে ব্যাপক অধোগতি ঘটে।”
আধুনিক সভ্যতা যার উপর দাঁড়িয়ে আছে খ্রীষ্টধর্ম তার সবকিছুর কীভাবে ক্ষতি ও অবক্ষয় ঘটিয়েছে তার বিস্তারিত বিবরণ বার্টÛান্ড রাসেলও দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন,
“ধর্ম আমাদের সন্তানদের যুক্তিবাদী শিক্ষা গ্রহণ বাধাগ্রস্ত করেছে; ধর্ম যুদ্ধের মৌলিক কারণগুলোকে দূর করতে আমাদের বাধা দিয়েছে; ধর্ম আমাদেরকে পাপ ও শাস্তির প্রাচীন ভ্রান্ত মতবাদের পরিবর্তে বৈজ্ঞানিক সহযোগিতা বিষয়ক শিক্ষা প্রদানে বাধা দিয়েছে। এটা সম্ভব যে, মানব জাতি আজ এক স্বর্ণযুগের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে । কিন্তু যদি তাই হয়, তাহলে প্রথম কাজ হচ্ছে দরজাটি পাহরা দিচ্ছে যে দৈত্য, তাকে হত্যা করা, এবং এই দৈত্য হচ্ছে ধর্ম।”
বস্তত, তথাকথিত ইসলামী স্বর্ণযুগের মহাউত্থানের মত অন্ধকার যুগ পরবর্তী ইউরোপে মানব সভ্যতার বিকাশও খ্রীষ্টান ধর্ম পূর্ববর্তী গ্রীক যুক্তিবাদের কাছে ব্যাপক ভাবে ঋণী; খ্রীষ্টান ধর্মের কাছে নয়। এ ব্যাপারে মাইকেল হার্ট তার ‘দি১০০’ গ্রন্থে লিখেছেন,
“ইউরোপে বিজ্ঞানের পর্যায়ক্রমিক বিকাশ অবশ্যই এ ইঙ্গিত দেয় যে, ইউরোপীয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে এমন কিছু ছিল যা বিজ্ঞানভিত্তিক চিন্তাভাবনার অনুকূল। সেই ‘এমন কিছু’ অবশ্য যীশুর বাণী নয়, বরং এরিস্টটল এবং ইউক্লিডের রচনা সমৃদ্ধ গ্রীক যুক্তিবাদ। উল্লেখযোগ্য যে, আধুনিক বিজ্ঞানের বিকাশ চার্চের প্রবল দাপটের যুগে ঘটে নাই, ঘটেছে রেনেসাঁর গোড়ালির উপর দাঁড়িয়ে। এই যুগে ইউরোপে তার প্রাক-খ্রীষ্টান ঐতিহ্যের নবজাগরণ ঘটেছিল।”
বার্টÛান্ড রাসেল ঐ আধুনিক খ্রীষ্টানদের ঠাট্টা করেছেন যারা দাবী করে খ্রীষ্টধর্ম মহা যুক্তিবাদী! তিনি মুক্ত চিন্তার ধারক প্রজন্মের উপর খ্রীষ্টান ধর্মবিশ্বাসীদের নির্যাতনের বর্ণনা দিয়েছেন। এতে যুক্তিবাদী ও মুক্তচিন্তার ধারকদের চরম মূল্য দিতে হয়েছিল। তিনি লিখেছেন,
“এই (শাস্তি প্রদানের) মনোভাব ছিল খ্রীষ্টানদের একক সম্পত্তি। এটা সত্য যে আধুনিক খ্রীষ্টানরা কম উগ্র। কিন্তু এর জন্য খ্রীষ্টধর্ম ধন্যবাদের পাত্র হতে পারে না। এই ধন্যবাদ মুক্ত চিন্তার ধারকদের প্রাপ্য। তারা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে রেনেসাঁ থেকে আজকের দিন পর্যন্ত (১৯২০) অনেক প্রচলিত বিশ্বাসের জন্য খ্রীষ্টানদের লজ্জা দিয়ে আসছে। আধুনিক খ্রীষ্টানরা যখন বলে যে, খ্রীষ্টধর্ম কতই কোমল এবং যুক্তিবাদী, তখন শুনতে মজা লাগে। তারা ভুলে যায়, এ ধর্মের সকল কোমলতা ও যুক্তিবাদিতা সে সব মানুষের শিক্ষার কারণে হয়েছে যাদেরকে এক সময় গোঁড়া খ্রীষ্টানরা কঠিন সাজা দিয়েছিল। ...... প্রাণপণ প্রতিরোধ সত্ত্বেও খ্রীষ্টান মতবাদের ক্রমাগত অবক্ষয় ঠেকানো যায় নাই। এটা মুক্ত চিন্তার ধারকদের অবিরাম চেষ্টার ফল।”
নৈতিকতা ও সুশাসনে ধর্মের অবদান
ধর্মপালনকারী বন্ধুদের সঙ্গে আলাপকালে আমি প্রায়ই শুনি যে, বিশ্বের সর্বত্র জনগণের নৈতিকতাকে অবয়ব দিতে এবং শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে ধর্মের ব্যাপক অবদান রয়েছে। কতিপয় অতিউৎসাহী আধুনিক খ্রীষ্টান এমনকি এটাও দাবী করে যে, পশ্চিমা গণতন্ত্রের সকল রাষ্ট্রীয় আইন বাইবেল থেকে নেওয়া। আসুন আমরা আজকের দিনের সবচেয়ে প্রশংসিত এবং সমর্থনযোগ্য শাসন ব্যবস্থা গণতন্ত্র নিয়ে আলোচনা করি । আধুনিক গণতন্ত্রের জনক টমাস জেফারসন, যিনি প্রায় ২০০ বছর আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শাসক ছিলেন, তিনি কতিপয় চমকপ্রদ বিবৃতি (রাসেলের অনুরূপ) দিয়েছিলেন খ্রীষ্টধর্মের সঙ্গে তার মতভিন্নতা ও বিভেদ নিয়ে।
“খ্রীষ্ট ধর্মের আবির্ভাবের সময় থেকে লাখ লাখ পুরুষ, নারী ও শিশুকে পুড়িয়ে মারা, নির্যাতন করা, জরিমানা করা ও কারাদণ্ড দেওয়া হযেছে; তারপরও আমরা সমরূপতার পথে এক ইঞ্চিও এগোতে পারি নাই।” (টমাস জেফারসন, নোট্স অন ভার্জিনিয়া, ১৭৮২)
‘‘তারা (যাজক শ্রেণী) বিশ্বাস করে যে, আমার মধ্যে ক্ষমতার সামান্য অংশ থাকলেও সেটা তাদের পরিকল্পনার বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হবে। এবং তাদের বিশ্বাস যথার্থ, কারণ আমি মানুষের মনের উপর সকল ধরনের স্বৈরাচারের বিরোধিতার জন্য ঈশ্বরের বেদি ছঁুয়ে শপথ নিয়েছি। তবে এসবের জন্য আমাকে তাদের ভয় করতে হবেঃ এবং তাদের মতে এ ভয় যথেষ্ট পরিমাণে।’’ (ড. বেঞ্জামিন রুশ-এর কাছে টমাস জেফারসন, ২৩ সেপ্টেম্বর, ১৮০০)
‘‘আমার বিশ্বাস ইতিহাসে এমন কোন নজির নাই যে, যাজক দ্বারা পিষ্ট জনগণ একটি মুক্ত সুশীল সরকার পরিচালনা করছে। এতে সর্বনিম্ন পর্যায়ের অজ্ঞতার ছাপ পাওয়া যায়, যেখানে তাদের সুশীল ও ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ সবসময় নিজেদের উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে সচেষ্ট থাকে।’’ (আরেকজান্ডার ভন হামবল্ডকে টমাস জেফারসন, ৬ ডিসেম্বর, ১৮১৩)
‘‘খ্রীষ্ট ধর্ম কখনও সাধারণ আইনের অংশ ছিল না, এখনও নাই।’’
(ড. টমাস কুপারকে লেখা টমাস জেফারসনের চিঠি, ১০ ফেব্রুয়ারী, ১৮১৪)
‘‘খ্রীষ্ট ধর্ম কখনো সাধারণ আইনের অংশ ছিল না, এখনও নাই।’’ প্রেসিডেন্ট জেফারসনের এই মন্তব্য আজকের দিনের সর্বোত্তম সরকার ব্যবস্থায় খ্রীষ্টধর্মের কোন ভূমিকা থাকতে পারে এমন দাবী নিশ্চিতভাবে প্রত্যাখ্যান করে। তার অন্যান্য বিবৃতিতে শুধু দেখা যায় যে, খ্রীষ্টধর্ম আমেরিকায় ধর্ম নিরপেক্ষ গণতন্ত্রের আবির্ভাবকে প্রচণ্ডভাবে প্রতিহত করতে চেয়েছিল। যদিও যাজক নেতৃত্বাধীন ইউরোপের সাধারণ আইনের সঙ্গে খ্রীষ্টান ধর্মীয় অনুশাসন জুড়ে দেওয়া হয়েছিল তবু সে কাল নিষ্ঠুরতা ও সামাজিক অবক্ষয়ের অন্ধকার যুগ হিসাবে চিহ্নিত হয়ে আছে। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, যাজক শাসিত ইউরোপ আনুমানিক ৯০ লাখ নারীকে ডাইনী আখ্যা দিয়ে জীবন্ত পুড়িয়ে মেরেছিল।
বাইবেলীয় অনুশাসনের কথা বলে এসব করা হত। ‘‘একজন ডাইনীকে বাঁচতে দিয়ে তোমরা দুর্ভোগ পোহাবে না। যে কেউ পশুর সাথে শয়ন করবে তাকে নিশ্চিতভাবে মেরে ফেলতে হবে।’’ (এক্সোডাস ২২ঃ১৮১৯) যদি আজ আমেরিকানরা বাইবেলীয় অনুশাসন দ্বারা শাসিত হত তবে আমরা এখনো দাসপ্রথা, অখ্রীষ্টানদের সাজা দেওয়া, নাস্তিক ও ধর্মদ্রোহীদের পুড়িয়ে মেরে ফেলা এবং ব্যভিচারীদের পাথর ছুঁড়ে মেরে ফেলা ইত্যাদি দেখতে পেতাম। এশিয়া ও আফ্রিকা থেকে আগত আধুনিক অভিবাসীরা, যারা আজ সমান আধিকার ভোগ করছে সম্ভবত কোনরকম নাগরিক অধিকার ও স্বাধীনতা ছাড়া ক্রীতদাস হিসাবে কাজ করত; কৃষ্ণাঙ্গরা যে অভিজ্ঞতা পেয়েছিল কয়েকশ’ বছর ধরে।
আমরা অবশ্য আজ অনেক ইসলামী রাষ্ট্রে দেশ শাসনে কুরআন ও সুন্নাহ (নবী মুহাম্মদের কর্ম ও বাণী) থেকে নেয়া শরীয়া তথা ইসলামী আইনের অবদান ও প্রভাব দেখছি। মুসলিম জাহানে ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রের বিকাশ ঘটে নাই। মুসলিম দেশগুলিতে শরীয়া ভিত্তিক শাসন ব্যবস্থা জনগণের ব্যাপক দুর্ভোগ ডেকে এনেছে। সেখানে মৌলিক মানবাধিকার লংঘিত হচ্ছে প্রচণ্ডভাবে, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অব্যাহতভাবে সাজা দেওয়া হচ্ছে, নারীদের অধিকার নাই বললেই চলে, এবং মুসলিম দেশগুলো শিক্ষা, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, চিকিৎসা শাস্ত্র এবং সম্পদের ক্ষেত্রে একেবারে পিছিয়ে। আফগানিস্তানে শরীয়া ভিত্তিক তালেবানী শাসন এসবের সবচেয়ে মর্মান্তিক দৃষ্টান্ত।
জনগণের নৈতিকতার ব্যাপারে ধর্মসমূহের অবদান প্রসঙ্গে আমি অবশ্যই একমত যে, ধর্মসমূহের ভিত্তি হচ্ছে নরকের শাস্তির ভয় এড়ানোর জন্য নৈতিকতা ও ন্যায্যতার ধারণা। অবশ্য আজকের দিনে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে গরিষ্ঠ সংখ্যক মানুষ ইহুদী, খ্রীষ্টান ও ইসলাম ধর্মের পবিত্র গ্রন্থসমূহের বর্ণিত নৈতিকতার নিষ্ঠুর ধারণা মেনে নিতে পারে না। আজকের দিনে অধিকাংশ মানুষ ব্যভিচারীদের পাথর ছুঁড়ে মেরে ফেলা অথবা বিবাহ পূর্ব যৌনতার জন্য প্রকাশ্যে দোররা মারার বিধানে বিশ্বাস করে না। এই সব ধর্মে এ ধরনের শাস্তির প্রথা নৈতিকভাবে সঠিক বলা হলেও সভ্য সমাজে এগুলো অপরাধ হিসাবে চিহ্নিত। বিশ্ব ক্রমেই অধিকতর সভ্য হয়ে উঠেছে বিধায় নৈতিকতার ধর্মীয় মানদণ্ড নিশ্চিহ্ন হওয়ার মুখে অথবা এগুলো পরিণত হয়েছে অপরাধমূলক কাজকর্মে। সভ্য দুনিয়ায় ধর্মগ্রন্থে বর্ণিত তথাকথিত ও নিষ্ঠুর নৈতিকতার স্থান নাই।
শেষ কথা
ধর্ম সম্পর্কে টমাস জেফারসনের মন্তব্যে ফিরে গেলে আমাদের অবশ্যই উপলব্ধি করতে হবে যে, জেফারসন প্রায় ২০০ বছর আগে আমেরিকায় প্রেসিডেন্ট ছিলেন। প্রেসিডেন্ট পদে অধিষ্ঠিত থাকা অবস্থায় তাকে ধর্ম যাজকদের প্রতি যে ধরনের চাঁছাছোলা মন্তব্য করতে হয়েছিল তাতে সহজেই বোঝা যায় বর্তমান দিনের গণতন্ত্রের ভিত্তি স্থাপনের জন্য তিনি কতটা কঠিন সংগ্রাম করেছিলেন। এই গণতন্ত্রই আমাদের সভ্যতার এক মহান স্তম্ভ।
এখন এই উপসংহার নিরাপদেই টানা যায় যে, ইসলাম ও অন্য আব্রাহামীয় ধর্ম অথবা অন্য যে কোন ধর্ম মানব সভ্যতায় কার্যত কোন অবদান রাখে নাই অথবা অতি সামান্য অবদান রেখেছে। বরং এগুলো সভ্যতার অগ্রগতি ও সমৃদ্ধি ব্যাহত করেছে এবং মানব জাতির জন্য ব্যাপক নিষ্ঠুরতা ও দুর্ভোগ বয়ে এনেছে। যদি ধর্ম না থাকত তবে আমাদের পৃথিবীটা আজ অনেক বেশী সভ্য, ন্যায়পরায়ণ, শান্তিপূর্ণ এবং অগ্রসর থাকত।
(নিবন্ধটি Muhammad Hussain-এর Myth of Islam’s Contribution to Human Civilization নামক ইংরাজী নিবন্ধের বাংলা অনুবাদ। মূল ইংরাজী নিবন্ধটি ইসলাম ওয়াচ [Islam-Watch]-এ ১১ এপ্রিল ২০০৫-এ প্রকাশিত হয়। -- বঙ্গরাষ্ট্র)
অনলাইনঃ ৯ জুলাই, ২০১০