Banner
ভোলা -- শামসুন নাহার (গল্প)

লিখেছেনঃ শামসুন নাহার , আপডেটঃ June 4, 2007, 6:00 PM, Hits: 12603

গ্রামের বাড়ী। গ্রামের বাড়ীতে গৃহপালিত প্রাণী প্রচুর। হাঁস, মুরগী, গরু, ছাগল। এমন কি কোন কোন বাড়ীতে মোষও পালন করা হয়।

এগুলি সবাই গৃহস্থের সংসারের অংশ বা অঙ্গ বিশেষ। যাদের সমাদর করে পালন করা হয় না এ রকম প্রাণীরও কমতি নাই। এদের মধ্যে কুকুর, বিড়াল। আদর করে পালন না করলেও বাড়ী বাড়ী কুকুর-বিড়ালের আসা-যাওয়া আছে।

অনেক বিড়াল দেখা যায়। যাদের সমাদর করে না পাললেও রান্না ঘরে দিব্বি ঠাঁই করে নিয়েছে।

বাড়ীর কর্তার কোলে উঠে খাবারে ভাগ বসাবার সাহসও রাখে কেউ কেউ।

কুকুর কিন্তু সে রকম প্রশ্রয় পায় না। পালিত কুকুর ছাড়া অন্য কুকুরগুলো  অনাহূতের মত এ বাড়ী ও বাড়ী  ঘুরে বেড়ায়।

এদের মধ্যে একটা কুকুর ছিল। কে যেন মেরে খোঁড়া করে দিয়েছিল।

পরের বার গ্রামে ফিরে গিয়ে দেখি, খোঁড়া কুকুরটা নাই। দু’টো বাচ্চা রেখে কুকুরটা মারা গেছে। বাচ্চা দু’টো কুকুরদের দল ভারী করেছে। এদের  নির্দিষ্ট কোন আশ্রয় নাই। কারো আশ্রয়ে এরা থাকে না। লোকে যে মত উচ্ছিষ্ট ফেলে দেয় সেগুলিই  এদের ক্ষুধা নিবৃত্তির উপায়।

রাত্রি বেলায় খড়ের সতূপে অথবা ছাইয়ের গাদায়, যে যেখানে পারে রাত কাটায়।

যে বাড়ীর এলাকায় থাকে সে বাড়ীর অতন্দ্র প্রহরী এরা।

কসাইখানার পাশে সাধারণত কুকুরদের ভীড় জমে। নির্দিষ্ট সময়ে ফেলে দেয়া হাড়-গোড় নিয়ে প্রতিযোগিতা আর কামড়া- কামড়ি চলে। কেউ হাড়ের একটা অংশ পেলে পরমানন্দে সেটা চিবোতে থাকে।

দুই এক গৃহস্থের আশ্রয় ছাড়া এরা সবাই পথের কুকুর। কেউ  তাদের সমাদর করে বাড়ীতে ঠাঁই দেয় না।

সমাদৃত না হলেও এরা মানুষের সঙ্গহীন নয়। মানুষ আছে, তাই এরাও বেঁচে আছে।

যেদিন বিশেষ কিছু জোটে না,সেদিন এ বাড়ী ও বাড়ী ঘুরে বেড়ায়, মানুষের দিকে জ্বলন্ত চোখে তাকায়।

মনে হয় এ রকম ক্ষুধায় ক্ষুধায় দিন কাটাতে হলে হয়ত অনর্থ  কিছু ঘটাতে পারে বা ঘটাবে।

একদিন বিকেলে এ রকম জ্বলন্ত চোখে তাকিয়ে ছিল একটা কুকুর।

আমার মনে হোল এ রকম একটা কুকুরকে বাড়ীতে ঠাঁই দিলে কেমন হয়?

কথাটা ছেলেকে বললাম। ছেলে বলল, ‘যা খুশী কর।’ মোটামুটি বাচ্চাই বলা চলে কুকুরটাকে। শুনলাম খোঁড়া কুকুরটার বাচ্চা এটা।

রান্নাঘর থেকে এক চামচ ভাত এনে দিলাম। কুকুরটা ছুটে এসে খেতে লাগল।

খেতে দিয়ে মনে হোল কুকুরটার একটা নাম রাখা দরকার। মনে মনে তার নাম ঠিক করলাম, খুব সাধারণ একটা নাম মনে হোল - ‘ভোলা’।

অনেক নাম মনে হলেও এই নামটাই এর জন্য। সাধারণ কুকুর, সাধারণ নাম।

ডাকলাম, ‘ভোলা, এই ভোলা!’ ভোলা কিছু বুঝল কি-না জানি না। তবে রান্নাঘর থেকে ভাত এনে দেয়া মানুষটাকে সে হয়ত চিনল। সে চোখ তুলে তাকাল।

মাত্র একবার খেতে দিয়েই তাকে জয় করলাম। দুপুরে খেতে বসে দেখি ভোলা দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে খেতে দেখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকল। চোখে তার প্রত্যাশা।

এর আগে খেতে দিয়েছিলাম উঠানের মেঝে - মাটিতে। এবার খুঁজে পেতে একটা পুরানো দৈয়ের থালার আকারের একটা মাটির পাত্র বের করে তাতে খেতে দিলাম। ভাতের সঙ্গে কিছু ডাল মিশিয়ে দিলাম।

বললাম, ‘ভোলা, খা!’ বললাম, ‘ভোলা, এই ভোলা! তোর নাম ভোলা।’ সম্ভবত শব্দটা যে তাকেই বলা হচ্ছে সেটা সে বুঝে গেছে।

তাই ‘ভোলা, এই ভোলা’ বলতে মুখের দিকে তাকাল। ভোলা নামটা বহাল থাকল। ভোলা শব্দটা কানে যেতেই সে ছুটে আসে।

সে জানে তাকে এখন খাবার দেয়া হবে। বাড়ীতে যে রান্না করে সে মাঝে মাঝে ‘তু তু’ করে ডাকে? এ ডাকেও সে ছুটে আসে।

এখন ভোলা আমাদের অনুগত। প্রহরীও বটে। রাত্রে কিছু দেখুক বা না দেখুক ঘেউ ঘেউ শুরু করে। এ এক জ্বালা!

ভালবাসার সঙ্গে বিরক্তি অথবা বিরক্তির সঙ্গে ভালবাসা, যা বলা যায়।

কুকুরের মত প্রাণীকে দেখেও যে আনন্দ সেই আনন্দের স্বাদ অনুভব করলাম।

একদিন দেখলাম কুকুরটা তার গা চুলকাচ্ছে। আর তার শরীর থেকে ধুলো ছড়াচ্ছে।

বললাম, ‘একটা কার্বলিক সাবান দিয়ে কুকুরটাকে গোসল করান দরকার? বোধ হয় ওর গায়ে উকুন হয়েছে।’

আমার ছেলে বারান্ডায় বসেছিল। শুনে বলল, ‘করাও, গোসল করাও। পাড়ায় একটা গল্প হয়ে যাক।’

আমি চুপ করে গেলাম। আমিই বা একে গোসল করাব কি করে? গোসল করাতে গেলে এই জংলী ব্যাটা তো ছটফট করতে পারে। তখন ওর গায়ের অপবিত্র পানি আমার শরীরে লাগতে পারে। ধর্মীয় বিধান মতে কুকুর অপবিত্র প্রাণী।

বাড়ীতে থাকে এমন একজনের নাম করলাম। বললাম, ‘ওকে বললে ভোলাকে গোসল করিয়ে দিবে।’

আমার কথাটা লোকটার কানে গেছে বলে মনে হয়। ও নাকি বলেছে পাঁচশ টাকা দিলেও কুকুর গোসল করাবে না।

এখানেই কুকুরের সেবা পর্ব শেষ হোল।

মনে পড়ে গেল ঢাকায় এক অনাহূত কুকুরের কথা। আমাদের বাড়ীতে একটা অভিভাবকহীন  কুকুর এসে জুটেছিল। কুকুরটা ছিল চর্মরোগ আক্রান্ত।

কুকুরটা বুগ্ন হওয়া সত্ত্বেও তাকে ভাল লাগার কারণ ছিল তার বংশ। বাচ্চা কুকুর। কুকুরটা বিদেশী বংশেদ্ভূত বলে মনে হয়েছিল।

কুকরুটা ছিল পশম উঠা, ঘেয়ো । মনে হোল সব জীবের সব রোগই তো চিকিৎসায় সারে। এর রোগও চিকিৎসায় সারবে।

কোথায় পশু চিকিৎসালয়? নিয়ে যাবই বা কি করে? ধরতে গেলে যদি কামড়ায়! মহা সমস্যা! কুকুরটা খায়-দায় আর শুয়ে থাকে। চুলকানি রোগের জন্য চুলকায়। চুলকিয়ে চুলকিয়ে ঘাগুলো আরো রক্তাক্ত করে ফেলে। কান, মাথা, সর্ব শরীরে ক্ষত।

ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে না পারলে অবশ্য নিজেই এর চিকিৎসা করা যায়।

বাড়ীতে একটা ছোট নিম গাছ ছিল। নিমের পাতা ক্ষতের জন্য উপকারী। নিমের পাতা বেটে  ঘাগুলোর উপর লাগিয়ে গরম পানি দিয়ে ধুলে ঘা ভাল হয়ে যেতে পারে।

একদিন বড় ছেলেকে বললাম, নিম পাতা ক্ষতের জন্য উপকারী জানি। কিন্তু কি করে যে কুকুরটার গায়ে ওগুলো লাগাব ভাবছি। ছেলে বলল, ‘মা, আমার গোসলের আগে কুকুরের জন্য নিম পাতা বেটে দিও আমি ওর গায়ে লাগিয়ে  দিব।’

সেদিন ছেলের গোসলের আগে কুকুরের জন্য নিম পাতা বেটে দিলাম। গরম পানিও দেয়া হোল। ছেলে নিম পাতা বাটা কুকুরটার সারা গায়ে মাখাল। তারপর সমস্ত শরীর গরম পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলল।

কুকুরটা ছিল বাচ্চা। শান্তভাবে সে সেবা নিল। একটুও নড়াচড়া করে নাই। শুধু মাথায় পানি দিবার সময় যে পানিটা গড়িয়ে মুখের দিকে আসছিল, সেই পানিটা সে চেটে চেটে খাচ্ছিল।

এক সপ্তাহের মধ্যেই সে সুস্থ হয়ে যায়। দুঃখের বিষয় কুকুরটাকে আমি রাখতে পারি নাই।

ঢাকায় বন্যা হয়। সে সময় আমাকে ছেলে মেয়ে সহ বাড়ী ছাড়তে হয়। যেখানে পানি ছিল না সেই রকম এক বাড়ীর সামনে কুকুরটাকে রেখে আসা হয়েছিল।

হয়ত সে কোন সহৃদয় মানুষের বাড়ীতে স্থান পেয়ে থাকবে। বন্যার পানি সরে যাবার পর তার খোঁজ করেছি, কিন্তু তাকে আর পাওয়া যায় নি।

ঢাকার কুকুর কাহিনী এভাবেই শেষ হয়েছিল।

গ্রামের বাড়ী।

সবার অনভিপ্রেত একটা নতুন সমস্যা ঘাড়ে নেয়া হয়েছে। এক বার যাকে আশ্রয় দেয়া হয়েছে তাকে অবহেলা করা যায় না। ফেলাও চলে না।

পথের কুকুর তাই ঠিকমত খাবার দিলেও এ বাড়ী ও বাড়ী ঘোরে। আমাদের দেশী কুকুরের এটা স্বভাবও বটে।

ভোলাও যেখানে ইচ্ছা সেখানে ঘোরে। এ বাড়ী ও বাড়ী ও যায়।

পাড়ায় একটা বিয়ের অনুষ্ঠান। সেখানে গরু, খাসি ইত্যাদি হয়েছে।

স্বাভাবিকভাবে সেখানে কুকুদেরও সমাগম হয়েছে। মাংস, হাড় ইত্যাদি সতূপাকারে রাখা আছে। অন্য কুকুরদের সঙ্গে ভোলাও সেখানে জুটেছে।

অতি সতর্ক একটা ছেলে একটা ধারাল অস্ত্র কুকুরদের দিকে ছুঁড়ে মেরেছে। কুকুরদের দলে ভোলা ছিল। ভোলার পিছনের পায়ের জোড়াটার ঠিক উপরের দিকে আঘাতটা লাগল।

কুকুরটা স্থান ছেড়ে পালিয়েছিল বটে, তবে তার আঘাতটা হয়েছিল গুরুতর।

রক্তাক্ত পা নিয়ে ভোলা খোঁড়াতে খোঁড়াতে বাড়ী এল।

সেদিন সকাল থেকে ভোলা বাড়ীতে ছিল না। উৎসবের আনন্দে বোধকরি যে যোগ দিয়েছিল।

এ অবস্থায় তার চিকিৎসার দরকার ছিল। অবশ্য কয়েক দিন ভাতের সঙ্গে মিশিয়ে জখমের ওষুধ কিছু খাওয়ান হয়েছিল।

কুকুরটার কাটা জায়গাটা সিলাই করার কথা কিছু আলোচনা হলেও সে সব কিছু হয় নাই।

গোলা  ঘরের নীচে খড় পেতে ভোলার জন্য বিছানা পেতে দেওয়া হোল, সেখানে ভোলা শুবে।

কিন্তু ভোলা সেখানে শুল না। শীতের রাত্রে ছাই গাদায় শুয়ে সে রাত্রি কাটাল।

খোলা জায়গায় ছাই গাদা হয়ত তার জন্য আরামের জায়গা ছিল।

সুস্থ থাকতে জ্বালানী কাঠ রাখার ঘরে খড় দিয়ে তার একটা থাকার জায়গা করে দিয়েছিলাম। কয়েক রাত্রি সে সেখানে কাটিয়েও ছিল। তার আরামের জায়গাটা শেষ পর্যন্ত তার থাকে নাই। জঞ্জাল রেখে জায়গাটা বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল।

আহত হবার পরদিন রান্নঘরের সামনে ভোলা দাঁড়িয়ে ছিল।

একটা লোক কোন কাজের জন্য এসে ভোলার দিকে চোখ পড়তে বিবরণ শুনে বলল কাজটা ভাল হয় নাই।

আমরা অনেক কাজই তো জ্ঞানে-অজ্ঞানে করে থাকি, তার হিসাব কে-বা রাখি?

এবার অনেক দিন পর গ্রামের বাড়ীতে এসে দেখি ভোলার পায়ের ক্ষতটা সম্পূর্ণ ভাল হয়ে গেছে। শুধু একটু দাগ রয়ে গেছে।

সবচেয়ে ভাল লাগার কথা যে এখন নিজেকে চিনতে শিখেছে। সে-যে সাধারণ কুকুরের পর্যায়ে পড়ে না এই বোধটা  এসেছে। তাই যখন অন্য কুকুরদেরকে তাড়া দেয়া হয় তখন ভোলা নিশ্চিন্ত মনে শুয়ে থাকে বা দাঁড়িয়ে থাকে।

বোঝা যায় সে অন্য কুকুরদের সঙ্গে নিজেকে এক করে দেখে না।

বাড়ীর অতি পরিচিত অথবা কাজে-কর্মে সম্পর্কিত কেউ যদি নিজের বাড়ীর দিকে রওনা দেয় ভোলা নিঃশব্দে তাকে অনুসরণ করে। তার বাড়ীর অবস্থান দেখে নিঃশব্দে আবার ফিরে আসে।

আমি এ বাড়ীর কেউ হলেও এখানে যে সব সময় থাকি না তা সে বোঝে। হয়ত তাই তার কাল চোখের চাহনি দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। হয়ত বলে, ‘কোথায় যাও তুমি?’

ভোলাকে কেউ অনাদর করে না, ভোলা যে এখন আমাদের বাড়ীর একজন সদস্য!

(ঘটনা অবলম্বনে)

অনলাইন প্রকাশ : ৫ জুন, ২০০৭

সাম্প্রতিক পোষ্টসমূহ