লিখেছেনঃ তামান্না ঝুমু, আপডেটঃ November 21, 2023, 12:00 AM, Hits: 1328
মাস কয়েক আগে হঠাৎ শরীর খারাপ করায় হাসপাতালে যেতে হয়েছিল, জরুরি বিভাগে। ডাক্তার পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও দৈনন্দিন কার্যক্রমগুলো সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ ক’রে জানালো যে তেমন খারাপ কিছু নয়। সেসময় আমার একই কক্ষে আরেকজন রোগীনীকেও পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছিল। তাদের কথোপকথন আমি শুনতে পাচ্ছিলাম। যেমন : তোমার খিদা কেমন, ঠিকমতো খাও তো, ঘুম কেমন হয় ইত্যাদি। আমি খুব কাছাকাছি ছিলাম ব’লে কথাগুলো আমার কানে আসছিল। এসব সাধারণ প্রশ্ন সব রোগীকেই করা হয়। কিন্তু একসময় আমি খুব সাধারণের বাইরে কিছু শুনতে পেলাম।
আমার প্রতিবেশী রোগীনী ডাক্তারকে বলছে, আমার কাছে এই পৃথিবী ও বেঁচে থাকা অর্থহীন মনে হয়। বুকে প্রচণ্ড ব্যথা হয়, প্রচণ্ড কষ্ট হয়। কেমন লাগে ঠিক বোঝাতে পারবো না। আজ হঠাৎ আমি সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলি। জ্ঞান ফিরলে এম্বুলেন্স ডাকি। ওরা আমাকে হাসপাতালে নিয়ে আসে। ডাক্তার জিজ্ঞেস করে, কতদিন ধ’রে তোমার এমন মনে হয়? কেন এমন মনে হয়? ও বলছে, আমাদের মেয়েটি মারা যাবার পর, আমাদের দু’জনেরই জীবনের আর কোনো মানে আছে ব’লে মনে হয় না। মেয়ের মৃত্যুর কিছুদিন পর আমার স্বামী আত্মহত্যা করে। এর পর থেকেই আমার এমন হচ্ছে প্রায়শই। হঠাৎ হঠাৎ জ্ঞান হারিয়ে ফেলি।
ওদের আরো কিছু কথোপকথন শেষে ডাক্তারের প্রস্থানের পর আমি ওর দিকে এগিয়ে যাই। শূন্য দৃষ্টিতে ও তাকিয়ে আছে সামনের পানে। সে-দৃষ্টিতে বেদনা, অভিযোগ, হতাশা কিছুই নেই। আছে কেবল অন্তহীন শূন্যতা। আমি কাছাকাছি যেতেই ও আমার দিকে তাকায়, তেমনি শূন্য দৃষ্টিতে। আমি ওকে আমার নিজের নাম বলি, এবং ওর কাছে কিছুক্ষণ বসতে পারবো কি না, জিজ্ঞেস করি। ও আমাকে খুব আপনজনের মতো হাত ধ’রে কাছে বসায়। আমি বলি, আমি তোমার কথা শুনতে পাচ্ছিলাম। আমি ভীষণভাবে দুঃখিত এই জেনে যে, তুমি খুব অল্পদিনের ব্যবধানে দুই-দুইজন ভালোবাসার মানুষকে হারিয়েছ। তোমাকে সান্ত্বনা দেবার সাধ্য বা ভাষা আমার নেই। আমি শুধু তোমার হাত ধ’রে তোমার পাশে একটু ব’সে থাকতে চাই।
সদ্য সন্তানহারা বেদনাবিধুর এক মাকে আমি ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করি, কী হয়েছিল তোমার মেয়ের? ও বলে, জানো, আমাদের মেয়েটি কী সুন্দর, কী বিষম প্রাণবন্ত আর কী চমৎকার একজন মানুষ ছিল!
আমি বলি, অবশ্যই! ও বলতে শুরু করে…
• আমার মেয়ের ক্যান্সার ধরা পড়ে কয়েক বছর আগে। চিকিৎসা শুরু হয় তাৎক্ষণাৎ। কিন্তু ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়ে ওর সারা শরীরে। সকল চিকিৎসাই অকেজো হয়ে পড়ে। কত কত অস্ত্রোপচার, কত কত অষুধ; কিছুতেই কিছু হয় না। ক্যান্সার বাড়তে থাকে, ছড়াতে থাকে আমার সুন্দর মেয়েটির সারা শরীরে। আমার মেয়ে লড়াই করতে করতে ক্লান্ত হয়ে যায়, ক্লান্ত হয়ে যাই আমরা বাবামা দু’জনও। সে-কয়েকটি বছর কেমন কষ্টে, কেমন ব্যথায় কেটেছে, তা ব’লে বোঝাতে পারবো না।
ওর উষ্ণ নিঃশ্বাস পড়ে আমার হাতে, আর পড়ে টপটপ ক’রে চোখের জল। ও হাঁপিয়ে ওঠে, তবু ব’লে যায় …
• আমার বাছা আর সহ্য করতে পারছিল না, আর নিতে পারছিল না অমন কষ্ট। আহা! বাছার চোখে-মুখে কী যে যন্ত্রণা! তাকাতে পারতাম না ওর মুখের দিকে আমরা। ছটফট করতো ও। সঙ্গে আমরাও। ওর সব ব্যথা যদি আমরা স্বামী-স্ত্রী দু’জনে নিয়ে নিতে পারতাম! একদিন ওর যন্ত্রণার অবসান হলো। ও আমাদের ছেড়ে চ’লে গেলো, মাত্র ছত্রিশ বছর বয়েসে। আমরা বাবামা দু’জনেই বেঁচে আছি। কিন্তু আমাদের প্রাণপ্রিয় মেয়েটি নেই। এটা কি মেনে নেওয়া যায়? এই কষ্ট কি ধারণ করা যায়? ওকে ছাড়া বেঁচে থাকা কত অর্থহীন, কত যন্ত্রণার, কত ভারী, তা কাউকে বোঝাতে পারবো না। আমি তবুও দিন অতিবাহিত করছিলাম কোনোভাবে। কিন্তু ওর বাবা আর পারছিল না কিছুতেই।
আমি জিজ্ঞেস করি, তোমার স্বামী মারা গেলেন কীভাবে? ও বললো, সন্তানহারাবার কষ্ট সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করেছে আমার স্বামী। আমি শিউরে উঠি।
• কিছুক্ষণের জন্য বাইরে হাঁটতে গিয়েছিলাম একদিন। ঘরে ফিরে দেখি, বসবার ঘরের বেঝেতে নিথর প’ড়ে আছে আমার স্বামী। নাক-মুখ দিয়ে ফেনা বের হচ্ছে। আমি এম্বুলেন্স ডাকি। ওরা এসে ওকে পরীক্ষা করে বলে, ও মৃত। অসম্ভব রকমের বিষাক্ত কিছু খেয়ে ও আত্মহত্যা করে। ও পরিকল্পিতভাবে এমনই ভয়াবহ বিষাক্ত বিষ সেবন করেছিল, যেন সঙ্গে-সঙ্গেই ওর মৃত্যু হয়; যেন আমি বাইরে থেকে ফিরে ওকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে সারিয়ে তুলতে না পারি।
আমি জিজ্ঞেস করি, এমন বিষাক্ত জিনিস ও পেয়েছিল কোথায়? ও বলে, ড্রাগ ডিলারের কাছ থেকে সংগ্রহ করেছিল। ও আমাকে বলেছিল কয়েকবার, ড্রাগ ডিলারের কাছ থেকে বিষ সংগ্রহ ক’রে নিজের যন্ত্রণার নিরসন ঘটাবে। আমাদের মেয়েটি ছেড়ে গেলো আমাদের দু’জনকে। তারপর ওর বাবা ছেড়ে গেলো আমাকে। মেয়ে যাবার পরে আমরা তবু দু’জন ছিলাম। দু’জনে একসঙ্গে কেঁদেছি, একসঙ্গে ব্যথা বহন করেছি। এখন আমি একা; একা কাঁদছি, একা সব যন্ত্রণা বহন করছি: সন্তান হারানোর যন্ত্রণা, স্বামী হারানোর যন্ত্রণা।
সন্তানহারা মাকে কীভাবে সান্ত্বনা দিতে হয়, আমি জানি না। আমার ছোট কন্যার বয়েস তখন দেড় বছর। একদিন প্লেগ্রাউন্ডে কয়েক মিনিট ওকে আমি খুঁজে পাই নি। অনেক বাচ্চারা খেলছিল। বাচ্চাদের ভীড়ে ও আমার চোখের আড়াল হয়ে গিয়েছিল একটু। আমার “আমার বেবী কই” “আমি কী করবো” এরকম কয়েকটি বাক্যের বিকট চিৎকার ও দিগ্বিদিক ছুটোছুটিতে আমার কয়েকজন বান্ধবী এবং পার্কে উপস্থিত অন্যান্য প্রাপ্তবয়স্করা সবাই ছুটে এসে বলছিল, তুমি অস্থির হয়ো না। পার্কের চারিদিকে তো লোহার গ্রিলের ঘেরা এবং গেট দুটিও লাগানো। কাজেই ও পার্কের ভেতরেই আছে, বাইরে যেতে পারে নি। আমি চিৎকার দিতে দিতে বলেছিলাম, কোনো কথা বলবে না, আমার বাচ্চাকে খুঁজে আনো। ঠিক তখনই একজন ওকে কোলে করে এনে আমার কোলে দেয়। ও আমার খুব কাছেই আরেকটি বাচ্চার সঙ্গে খেলছিল। আমি দেখতে পাই নি। ওকে কোলে নেবার পরেও অনেকক্ষণ আমার গা কেঁপেছিল থরথর।
আরেকবার সমুদ্র সৈকতে ওকে খুঁজে পাই নি প্রায় দশ মিনিট। আমি কাঠের সঙ্গে কপাল ঠুকতে ঠুকতে কপাল ফাটিয়ে ফেলেছিলাম।
এই সন্তানহারা মা-টিকে তাই আমি সান্ত্বনা দেবার বৃথা চেষ্টা করি না। বলি, আমি কি তোমাকে একটু আলিঙ্গন করতে পারি? ও বলে, নিশ্চয়ই! আমরা আলিঙ্গন করি। ওর চোখের জলে আমার কাঁধ ভিজে যায়। আমারও চোখের জল গড়াতে থাকে ওর কাঁধের ওপর।