লিখেছেনঃ জাহিদুজ্জামান , আপডেটঃ November 11, 2013, 12:00 AM, Hits: 2356
ছোট বেলা আমার একটা গরু ছিল স্কুল থেকে ফিরে ছুটে যেতাম তার কাছে। আমাকে দেখলেই মাথা তুলে তাকাত। আমি দড়ি ধরে তার পিছন পিছন হাঁটতাম। গরুটা ঘাস খেত আর গলার ঘণ্টা বাজত। আমি কাছে থাকলেই মনে হয় ঘণ্টাটা সে বেশি করে বাজাত, ঘাস খেত আর ঘণ্টা বাজাত; আমি তার কাছে চুপ করে বসে থাকতাম।
আমার ছোট বোন গরুটার নাম দিয়েছিল দোলা। আমাদের রাখালের নাম ভোলা তাই গরুটার নাম দোলা। এই তার যুক্তি। দোলার গলার ঘণ্টি আমার বোন সালমা আনেক কান্নাকাটি করে বাজার থেকে কিনিয়েছে।
আমরা দুই ভাই বোন দোলার পাশে বসে থাকতাম। আর দোলাকে নিয়েই বেশি বেশি কথা বলতাম। আর দোলা আমাদের দিকে মাথা তুলে মাঝে মাঝে তাকাত।
দোলার চোখ দু’টো ছিল বেশ বড় বড়। গরুর চোখ সাধারণত বড় হয়। দোলার চোখ তার চেয়েও বড় ছিল। গায়ের রং ছিল লাল সাদা।
ও যখন ছোট বাছুর তখন ওর মা হঠাৎ করে মারা গেল। গরুর ঘরে গিয়ে দেখি ওর মা ফুলে ঢোল হয়ে মরে শুয়ে আছে, দোলা তার দুধ খাবার জন্য মিছেমিছি চেষ্টা করছে।
তারপর থেকে দোলা কিছুদিন রাত্রিবেলা তার মাকে ডাকতো আমি চুপি চুপি তার পাশে গিয়ে বসে থাকতাম। দোলা আমার দিকে বড় বড় করে তার ডাক থামিয়ে তাকিয়ে থাকত। আমি তার গলায় হাত বুলিয়ে দিতাম। সে আমার শরীরের সাথে তার শরীর ঘষত।
একদিন অনেক রাত, দোলা খুব ডাকছে। আমার ইচ্ছা হল তার কাছে গিয়ে আদর করে দিই। কিন্তু অত রাতে গরুর ঘরে যাবার সাহস হল না আমার। সালমাকে ডাকলাম। সালমা ভয়ে জড়সর হয়ে বলল আমরা দু’জনে গিয়ে ওকে আমাদের ঘরে নিয়ে আসি।
তাই করা হল। অনেক সাহস নিয়ে দুই ভাই বোন মিলে দোলার কাছে গেলাম। গিয়ে দেখি দোলার গায়ে চাঁদের আলো ছড়াছড়ি করছে। চাঁদের আলোয় দোলাকে কেমন যেন অদ্ভূত লাগছে।
চাঁদের আলোয় দোলার চোখে দেখতে পেলাম তার চোখে জল। সে কি সত্যি সত্যি কাঁদছে? পশুরাও কি মানুষের মত কাঁদতে পারে? তার চোখের পানি দেখে আমার আর সালমার চোখেও পানি এসে গেল।
আমরা চুপি চুপি তার রশি খুলে আমাদের ঘরে নিয়ে এলাম। দোলা মনে হয় সেটাই চাচ্ছিল। একদম চুপচাপ হয়ে গেল।
সকাল বেলা মায়ের মার খেয়ে ঘুম ভাঙ্গলো। উঠে দেখি সমস্ত ঘর বাছুরের গোবর এবং প্রস্রাবে একাকার; দুর্গন্ধে সমস্ত ঘর ভরে গেছে।
সালমা একচেটিয়া ভাবে আমাকে দোষ দিয়ে গেল। সে বলল বাছুর আনার ব্যাপারে সে নাকি কিছুই জানে না, ভাইয়া জানে সব।
আমি সালমার ব্যাপারটা পরে দেখে নিব ভেবে নিয়ে, মার হাত থেকে বাঁচার চেষ্টা করলাম আগে। মায়ের যে অগ্নিশর্মা অবস্থা! তাতে আমাকে মেরে তক্তাই করে ফেলবে। বাছুর এই ঘরে কে নিয়ে এসেছে এই প্রশ্নের উত্তর দেয়ার জন্য কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে মায়ের হাতের ফাঁক দিয়ে দিলাম দৌড়।
পিছন থেকে শুনলাম সালমা বলছে, মা ভাইয়া পালাল। মা আমাকে ধরতে গিয়েও ধরতে পারল না, এক দৌড়ে নদীর পাড়ে। কিছুক্ষণ দৌড়ানোর পরে দেখলাম দোলাও আমার পিছন পিছন দৌড়াচ্ছে।
দোলা নদীর পাড়ে আমার সাথে এসে থামল।
সেদিন সারাদিন দোলাকে নিয়ে নদীর পারে মাঠের ধারে কাটিয়ে দিলাম, স্কুলে গেলাম না, মারের ভয়ে মার কাছে যাওয়ার সাহস পেলাম না। ফলে দু’টো শাস্তি যোগ হল - স্কুলে না যাওয়া এক দোলাকে ঘরে তোলা। আমি সারাদিন না খেয়ে দোলাকে সাথে নিয়ে মাঠের এবং কোণায় আম গাছের নীচে ঘুমিয়ে পড়লাম, পাশেই দোলা কচি ঘাস খাবার চেষ্টা করছে। যখন ঘুম থেকে জেগে উঠলাম তখন দেখি মায়ের কোলে শুয়ে আছি। কিছু দূরে সালমা অপরাধীর মত মুখ করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। দোলাও আশেপাশে কোথাও ডেকে উঠল।
দেখতে দেখতে দোলা অনেক বড় হয়ে গেল। আমি আর সালমা স্কুল থেকে ফিরলেই দোলা দূর মাঠ থেকে আমাদের উদ্দেশ্যে শব্দ করে ডেকে উঠত।
আমার দু’জন বই খাতা ফেলে ছুটে যেতাম দোলার কাছে।
একদিন সালমা বলল, ভাইয়া দোলাকে কোরবানীতে জবাই করা হবে। আমি 'না’ বলে চিৎকার দিয়ে উঠলাম। সালমা বলল, কাকা আর বাবা এই কথা বলেছে, আমি পিছনে বসে শুনেছি।
আমি পাগলের মত মায়ের কাছে ছুটে গেলাম, মা যেন কী পাক করছিলেন। আমি বুকের মধ্যে কোন রকমে কান্না চেপে রেখে মাকে জিজ্ঞেস করলাম, দোলাকে কি কোরবানী দেওয়া হবে মা?
মা বল্লেন, তোর বাবা তো তাই বললো। আমি যখন বুঝতে পারলাম ঘটনা সত্য, তখন হাউমাউ করে কেঁদে উঠলাম। মাটির পাকের ঘরের এমাথা থেকে ওমাথা পর্যন্ত গড়াগড়ি করছি আর চিৎকার করে কান্না করছি। একদিন পরেই কোরবানী। কিভাবে আমি বাঁচাব দোলাকে? দোলার চোখের কথা আমার মনে পড়ছে আর আমি চিৎকার করছি।
পাশেই দেখলাম সালমা চুপচাপ দাঁড়িয়ে, তার চোখেও জল। আমি হঠাৎ করে উঠে সালমাকে মারতে শুরু করলাম। তার উপর কেন আক্রমণ করলাম আমি নিজেও জানি না।
সালমা আমার কাছ থেকে ছুটে গিয়ে দোলার কাছে গেল। আমিও দৌড়ে দোলার কাছে গেলাম। দোলাকে ধরে দুই ভাই বোন কান্নার উৎসব শুরু করলাম।
মা এসে আমাদের দু’জনকে দোলার কাছ থেকে নিয়ে গেল, ঐ দিন কিছুই খেলাম না, শুধু অবুঝের মত চোখের জল ঝরালাম।
পরদিন কোরবানী। মসজিদের পাশেই দোলাকে বেঁধে আমি নামাজ পড়লাম বাবার সাথে।
নামাজের মধ্যে দোলা কয়েক বার ডেকে উঠলো। সে কি কিছু বুঝতে পারলো? আমি কাঁদছি আর নামাজ পড়ছি।
নামাজ শেষ হবার সাথে সাথে আমি মসজিদ থেকে বের হলাম এবং দোলার দড়ি ধরে দোলাকে বললাম, দোলা দৌড়া। দোলা অবিশ্বাস্যভাবে সত্যিকার অর্থে দৌড় শুরু করল।
আমি আর দোলা দৌড়াচ্ছি। কোথায় যাচ্ছি জানি না। কিছুক্ষণ পর তাকিয়ে দেখি সালমাও আমার পিছন পিছন দৌড়াচ্ছে। ফকির বাড়ির মাঠ পেরিয়ে, পোয়ারি বাড়ির খাল পেরোলাম।
উঠলাম একটা ছাড়াবাড়িতে। এই বাড়িতে কোন এক সময় লোক থাকত। এখন থাকে না। তাই ছাড়াবাড়ি। বাড়ির চিহ্ন পর্যন্ত নেই। চারিদিকে শুধু জঙ্গল। এটা আমার কাছে সর্বশেষ ঠিকানা। আমার ধারণা ছিল ওখানে গেলে পৃথিবীর কেউ আমাদের খুঁজে পাবে না। সালমার এখানে এই প্রথম আসা। তাই সে আমার হাত ধরে ভয়ে জড়সর হয়ে দঁড়িয়ে আছে।
চারিদিকে তাকিয়ে দেখি আমার খেলার সকল সাথী আমার চারপাশে, আমরা দোলাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছি। দোলা চুপচাপ সেও কোন শব্দ করছে না।
হঠাৎ করে আবিষ্কার করলাম বাবা এবং কাকা আমাদের পাশে দাঁড়িয়ে সাথে আমাদের ইমাম সাব যার হাতে বড় একটা ছোরা। ছোরা রক্তে ভরপুর, পাঞ্জাবীতে মনে হয় রক্তের বৃষ্টি ঝরেছে, ইমাম সাহেবকে আমার কাছে কেন জানি খুনী খুনী মনে হল।
সকাল বেলা যার আজানের ধ্বনি আস্সালাতুল খাইরুম মিলান নাউম শুনে, সমস্ত হৃদয় আবেগে ভরপুর হয়ে যায় এই সেই ইমাম সাব!
ইমাম সাব কোন দিকে তাকাচ্ছে না, তাকাচ্ছে শুধু দোলার দিকে। দোলা বার বার চোখ তুলে আমাকে আর সালমাকে দেখছে। আমরা সকলে বোবা হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। বাবা আমাকে একটা ধমক দিয়ে দোলাকে নিয়ে গেল।
দোলাকে জবাই করার প্রস্তুতি শুরু হল। আমি আমাদের কাছারির টিনের চালে বসে আছি, নীচেই প্রস্তুতি চলছে। দোলা চারদিকে তাকাচ্ছে। হয়ত আমাকে খুঁজছে। যখন শোয়ানো হল তখন দোলা আমাকে টিনের চালে দেখতে পেল। আমার চোখ ও পড়ল তার চোখে, ততক্ষণে ইমাম সাব ছোরা চালিয়েছে। দোলার রক্তে ভেসে গেল সবুজ প্রান্তর। নিথর হয়ে গেল দোলা। সেই থেকে ইমাম সাবকে আমার রহস্যজনক মনে হতে থাকে। এই নিরীহ মানুষটা কেমন হঠাৎ করে খুনী হয়ে যায় আমার খুব জানার সাধ হয়। কোরবানীর ধর্মই তাকে খুনীর মূর্তি ধারণ করিয়েছে।
বড় হয়ে কত শুনেছি জীব হত্যা মহা পাপ, জীবে দয়া করে যেইজন সেই জন সেবিছে ঈশ্বর। তাহলে আমার দোলা কেন বাঁচল না? কোন ঈশ্বর তাকে নিয়ে গেল?
আজো যখন কোরবানী আসে, ঢাকা শহরে ঘুরতে বের হয়ে দেখি লক্ষ লক্ষ দোলার রক্তে ভেসে যাচ্ছে ধরিত্রী। রক্ত মাখা ছোরা হাতে রক্তের বৃষ্টি ঝরানো সাদা পাঞ্জাবী পরে ঘোরাঘুরি করছে সেই ইমাম সাবরা। চারিদিকে খুন আর খুন। খুনের উৎসব বয়ে যায় সবখানে। কোন দেবতাকে খুশী করার জন্য এই খুন?
যদি তার সৃষ্টি হয় সকলে তবে কেন তিনি এক সৃষ্টিকে খুন করার বদলে আর এক সৃষ্টিকে দিবেন সোয়াব? যিনি খুনের বিনিময়ে সোয়াব দেন, যার ইচ্ছায় রক্তের উৎসব বয়ে যায় তাকে আমার জানতে ইচ্ছা করে, তাকে আমার দেখতে ইচ্ছা করে।
০৩.১১.২০১২