চিংড়ি দিদি -- শামসুন নাহার (গল্প)
লিখেছেনঃ শামসুন নাহার, আপডেটঃ June 4, 2015, 12:00 AM, Hits: 2007
এক নদীতে এক চিংড়ি মাছ বাস করত। চিংড়ি মাছটার অভ্যাস ছিল রোজ সকালে গোসল করার। নদীর ধারে বালির উপর একটা বড় পাথর ছিল। গোসল করে সেই পাথরটার উপর বসে রোজ চুল শুকাত চিংড়ি মাছ।
লম্বা চুল তার। রোজ নদী থেকে উঠেই সেই পাথরের উপর বসে তার চুলগুলি রোদে মেলে দিত। চুল শুকালে বাড়ী ফিরত।
কোন বিপদ তার ঘটে নাই। দিনগুলি তার ভালই কাটছিল। হঠাৎ তার জীবনে বিপদ ঘনিয়ে এল। এক দিন এক কাক তার চুল শুকান দেখে ফেলল।
চিংড়ি মাছকে দেখতে পেয়ে কাকের খুব ইচ্ছা হোল চিংড়িকে খেতে।
কাক সরাসরি তার সামনে এসে বলল, ‘চিংড়ি, তোকে আমি খাব।’
কাকের কথা শুনে চিংড়ি খুব ভয় পেয়ে গেল। কাক চিংড়ির চেয়ে শক্তিশালী। চিংড়ি কাকের সঙ্গে পারবে না শক্তিতে।
কিছু চিন্তা করে চিংড়ি বলল, ‘আমার শরীর খুব খারাপ প্রভু।’
‘ আমার শরীর একটু ভাল হয়ে নিক তখন খাবেন।’
কাক বলল, ‘কোন দিন খাব বল্।’
চিংড়ি একটু ভেবে বলল, ‘ আর দিন সাতেক সময় দিন পক্ষীরাজ।’
কাক নিজেকে পক্ষীকুলের রাজা ভেবে মনে মনে খুশীই হোল। বলল, ‘মনে রাখবি। কথা ঠিক থাকে যেন।’
চিংড়ি বলল, ‘হাঁ, হুজুর।’
এক দিন যায় দু’-দিন যায় চিংড়ি প্রায় কাকের কথা ভুলতে বসেছে।
এদিকে চিংড়ির কথা কাকের বেশ মনে আছে।
সাত দিন পর কাক এসে হাজির।
কাক বলল, ‘চিংড়ি আজ তোকে খাব।’
চিংড়ি ভয়ে আঁতকে উঠল। কেমন করে যে এত বড় একটা কথা ভুলে ছিল। মরণকে চোখের সামনে দেখতে পেয়ে বলল, ‘হুজুর আমাকে আর কটা দিন সময় দিন। মাত্র তিনটি দিন।’
‘আমার শরীর খারাপ ছিল তাই আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে শেষ দেখাটা করি নাই। আত্মীয়-স্বজনের শেষ দেখাটা সেরে আসি। মিনতি করি আপনাকে।’ কথাও চিংড়ি মাছ ঠিক মত বলতে পারছিল না।
কাক কিছুক্ষণ চিন্তা করে দেখল। তার পর বলল, ‘আচ্ছা তুই যখন এত আবেদন করছিস। তখন আজকে ছেড়েই দিলাম। মনে রাখিস ঐ দিন তোকে আর ছাড়ব না। এই তিন দিন মনে রাখবি।’
কাক মনে মনে ভাবল জলের জীব জল ছেড়ে যাবে কোথায়?
চিংড়ি ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে জীবনের এই কয়টা দিন সামনে রেখে বাড়ী এল। তাকে এই দুঃসময়ে কে বাঁচাবে? তার আত্মীয়-স্বজন যত চিংড়ি আছে কেউই কাকের কথা শুনলে এগিয়ে এসে তাকে এই বিপদ থেকে রক্ষা করতে পারবে না।
হঠাৎ তার চ্যাং মাছের কথা মনে পড়ে গেল। চ্যাং তো চিংড়ির চেয়ে বেশ বড়। গায়ের জোরও তার বেশ ভালই আছে।
কথাটা ভেবে সে চ্যাং মাছের বাড়ীর দিকে রওনা দিল।
চ্যাং তখন দুপুরের খাওয়া সেরে ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ করে তামাক টানছিল।
দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ শুনে চ্যাং চেঁচিয়ে বলল, ‘কে-রে? এমন অসময়ে ডাকা-হাঁকা করিস?’
চিংড়ি তখন করুণ স্বরে বলল, ‘দাদা, আমি চিংড়ি। আমার বড়ই বিপদ দাদা।’
চ্যাং দরজা খুলে বাইরে এল। বলল, ‘কি বিপদ দিদি?’
চিংড়ি তার বিপদের কথা চ্যাং দাদাকে জানাল। ‘বিপদে পড়েই তোমার কাছে এসেছি দাদা। এক পাড়াতেই থাকি। আমি এক দুর্বল চিংড়ি। বলতে পার তোমাদের আশ্রয়েই আছি।’
চ্যাং সব শুনে ভাবনায় পড়ে গেল। কাক তো চ্যাং দাদারও শত্রু।
বলল, ‘সবই ত ঠিক দিদি। কিন্তু জাতে আমরা মাছ। কাকের কাছে আমরা হলাম দুর্বল জাত। কাক ডাঙ্গায় থাকা জীব। শক্তিও তার বেশী। কী করে পারব কাকের সঙ্গে?’
চিংড়ি বুঝতে পারল চ্যাং তাকে সাহায্য করতে পারবে না।
তাই চ্যাং-এর বাড়ী থেকে দুঃখিত মনে রওনা দিল।
এখন কার কাছে যাওয়া যায়? হাতে মাত্র তিনটি দিন সময় আছে। এর মধ্যে একটা উপায় বের করতে না পারলে জীবনের আশা ছাড়তে হবে।
হঠাৎ তার ব্যাং দাদার কথা মনে পড়ে গেল। সে তো ডাঙ্গা আর পানি সব জায়গায় সমানভাবে বিচরণ করতে পারে। কোলা ব্যাঙের শক্তিও বেশী হতে পারে।
চিংড়ি দিদি তাই কোলা ব্যাঙের বাড়ীর দিকে রওনা দিল।
কোলা ব্যাং তখন হুম-হাম করে কাকে যেন হুমকি-ধামকি দিচ্ছিল। দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ শুনে বাইরে বেরিয়ে এল।
বলল, ‘কি খবর দিদি? এমন অসময়ে?’
চিংড়ি দিদি কেঁদে ফেলল। বলল,‘দাদা, খুব অসুবিধায় পড়ে এসেছি দাদা। আমার খুবই বিপদ।’
ব্যাং বিপদের কথা শুনে বলল ‘দিদি তোমার বিপদের কথা বল দিদি। যদি কিছু করতে পারি।’
চিংড়ি চোখের পানি মুছে সব কথা বলল।
চিংড়ি বলল, ‘দাদা, কি আর বলব! আমি নিত্য গোসল করে নদীর ধারে চুল শুকাই। আগে কখনও কোন বিপদ ঘটে নাই। কিছু দিন আগে আমি যখন চুল শুকাচ্ছিলাম তখন আমাকে একটা কাক দেখতে পেয়ে খেতে চাইল আমাকে।
‘প্রথমে সাত দিন সময় চেয়েছিলাম দাদা। সাত দিন চলে গেছে। অনেক কাকুতি-মিনতি করে আর মাত্র তিনটি দিন সময় চেয়েছি।
‘দাদা, আর মাত্র একটা দিনই সময় আছে।’
ব্যাং দাদা কিছুক্ষণ ভাবল। তার পর বলল, ‘সবই ত শুনলাম দিদি। আমারও উপায় নাই। তবে তোমাকে একটা পরামর্শ দিতে পারি।
‘এই জল পাড়ার মাথায় একটা কাঁকড়া থাকে। তার শরীরে যেমন শক্তি, মনেও তেমনি সাহস। সেই তোমাকে বাঁচাতে পারবে। তুমি তার কাছেই যাও। সে-ই সাহায্য করবে।
‘এ পাড়াতে কাকের মত পক্ষীর কোন জারিজুরি চলবে না।’
চিংড়ি দিদি ব্যাং দাদাকে অনেক ধন্যকাদ দিয়ে কাঁকড়া দাদার বাড়ী চলল।
কাঁকড়া দাদা তখন খাওয়া-দাওয়া সেরে বিশ্রাম নিচ্ছিল। দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ শুনে চেঁচিয়ে উঠল, ‘কে-রে এই অসময়?’
‘তোমার পাড়াতেই থাকি দাদা। আমি চিংড়ি,’ চিংড়ি করুণ সুরে বলল।
‘আমার সাত জন্মে ভাই-বেরাদার আপন বলতে কেউ নাই দাদা। বলতে গেলে তোমরাই আমার সব।’
চিংড়ি মাছের কাতর স্বর আর বিনয় বচন শুনে কাঁকড়া দাদা খর খর বেগে বাইঁরে বেরিয়ে এল!
‘কি খবর, কি সমাচার, দিদি বল!’
চিংড়ি তখন হাঁউ মাঁও করে কেঁদে ফেলল। বলল, ‘দেখছ তো দাদা আমার বড় বড় চুল। নদীতে রোজ গোসল করে একটা পাথরের উপর বসে রোজ চুল শুকাই।
‘এত দিন কোন বিপদ আসে নাই দাদা। এখন আমি বড়ই বিপদে পড়ে তোমার কাছে এসেছি দাদা। তুমি আমাকে না বাঁচালে আমার বাঁচার মত কোন পথ নাই। আমার আর কেউ নাই যে আমাকে বাঁচাতে পারবে।’
কাঁকড়া শুনে বলল, ‘কে তোমার এমন শত্রু আছে দিদি বল। ক্ষমতায় কুলালে আমি অবশ্যই তোমাকে সাহায্য করব।’
চিংড়ি তখন তার বিপদের কথা কাঁকড়া দাদাকে জানাল। চিংড়ি বলল, ‘কালকেই কাক আমাকে খেতে চেয়েছে দাদা।’
কাঁকড়া দাদা তখন জানতে চাইল কখন আর কোথায় চিংড়ি দিদি গোসল করে আর কোন পাথরে সে চুল শুকায়।
চিংড়ি দিদি নদীর ধারে পাথরের কাছে কাঁকড়া দাদাকে নিয়ে গিয়ে পাথরটা দেখাল।
কাঁকড়া দাদা তখন চিংড়িকে বলল,‘ দিদি, তুমি নিশ্চিন্ত থাক। কেমন করে তোমাকে কাক খায় দেখব।
‘ তুমি ঠিক সময় গোসল করে পাথরের উপর সকাল দশটায় উঠবে।’
চিংড়ি দিদি তখন বার বার কাঁকড়াকে সালাম দিয়ে এল। শতেক চিন্তা তার মনে। কি করে এই সাক্ষাৎ যমের হাত থেকে সে বাঁচবে?
তার পর দিন ঠিক সকাল দশটায় গোসল সেরে সে পাথরের উপর উঠল চুল শুকাবার জন্য।
কাক নিকটেই একটা গাছের উপর বসে ছিল।
চিংড়িকে গোসল করে পাথরের উপর উঠতে দেখেই গাছ থেকে উড়ে এসে পাথরের উপর বসল।
এবার সে চিংড়িকে খাবে।
চিংড়িকে বলল, ‘এখন তোকে খাব। মনে আছে?’
চিংড়ি কাতর স্বরে বলল, ‘তোমার হাতে যদি মরণ থাকে তবে খাও।’
খাও কথাটা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে পাথরের নীচ থেকে কাঁকড়া বেরিয়ে এল। তারপর তার দাঁড়াল হাত দিয়ে কাকের গলা টিপে ধরল।
কাক তখন ‘গেলাম, মোলাম’ কলে কা-কা করে চীৎকার শুরু করেছে।
চিংড়ির আনন্দ তখন দেখে কে?
চিংড়ি দিদি বলতে লাগল, ‘চ্যাং দাদা, ব্যাং দাদা কেউ কারো নয়।
কাঁকড়া দাদা সদর দাদা টিপ দাদা!’
আজ থেকে চিংড়ি দিদির আর ভয় নাই।
কাঁকড়া দাদার সাহায্যেই সে মুক্তি পেয়ে গেল।
কাকের ভয় আর নাই। কাঁকড়া দাদার হাতেই কাক অক্কা পেল।
(পুরানো লোককাহিনী অবলম্বনে)
অনলাইন প্রকাশ : ৫ জুন, ২০০৭