লিখেছেনঃ মৃন্ময় চক্রবর্তী, আপডেটঃ November 5, 2015, 12:00 AM, Hits: 3008
আব্বাসদার কথা মনে আছে গৌরাঙ্গ? আরে সেই যে সেই কাঁঠালতলার আব্বাসদা রে, মনে করতে পারছিস না?
গৌরাঙ্গ মাথা নাড়ে, বলে কতজনকেই তো ভুলে গেছি কতদিন ওপথ ছেড়েছি, তুই বলে যা।
রমেন ওকে মনে করাতে না পেরে হতাশ হয়। কিন্তু হাল ছাড়েনা।
গৌরাঙ্গ বলে মুসলিম ধর্মীয় সমাজ থেকে লোকজন খুব একটা আসেনা কমিউনিস্ট আন্দোলনে। তবে আমি জহিরুদ্দিনের মত কাউকে দেখিনি। সে ছিল খাঁটি কমরেড। আমার পরম বন্ধু। তার মত ইস্পাত দৃঢ় মনোভাবের মানুষই আজ আর নেই! আর সাধারণ মানুষকে গালমন্দ করেই বা লাভ কি এদেশের পার্টিতে তো চিরকাল পেটিবুর্জোয়ার পোদ্দারি। কুঁদুলি করেই দল দশ টুকরো। কী বিপ্লব হবে এদেশে!
রমেন চুপ করে শোনে প্রতিবাদ করেনা। তারপর হঠাৎ একসময় বলে ওঠে তুই চিনিস! বোসপাড়ায় বসন্তদার বাড়িতে গণসংগীতের রিহার্সালে প্রায়ই আসত।
তো কী হয়েছে বলেই ফেলনা, গৌরাঙ্গ রমেনের চেনানোর প্রচেষ্টাকে গুরুত্ব দেয়না।
রমেন না থেমে বলে যায় আরে মনে পড়ছেনা কেন তোর, তুই আব্বাসদার পাড়ায় মেদিবসের মিটিঙে গিয়ে বলেছিলি দারুণ অভিজ্ঞতা হল, আব্বাসদা দারুণ কমরেড!
কে জানে মনে পড়ছেনা ভুলে গেছি, বলতে বলতে গৌরাঙ্গ বিড়ি ধরায়, রমেন বিড়িটিরি খায়না। সে আবার ওকে মনে পড়াতে চেষ্টা করে,
তুই বলেছিলি সন্ধ্যার নামাজের সময় ননস্টপ প্রোগ্রাম চালানো অসাধারণ সাংগঠনিক প্রচেষ্টার নমুনা। তুই জড়িয়ে ধরেছিলি আব্বাসদাকে!
হ্যাঁ এবার একটু একটু মনে পড়ছে, গৌরাঙ্গ ঘাড় নেড়ে রমেনের দিকে তাকায়।
আমাদের চিরকালের অভিজ্ঞতা ছিল মুসলিমপ্রধান এলাকায় প্রোগ্রাম বা মিছিল হলে নামাজের সময় থামতে হবে। প্রাতিষ্ঠানিক বামদলগুলোর চেয়ে এব্যাপারে আমাদের আচরণ খুব একটা আলাদা কিছু ছিলনা! আমাদের বুদ্ধিজীবী মুসলিম কমরেডরা এই থামানোর ব্যপারে অগ্রণী ছিলেন। এমনও হয়েছে মাঝপথে গণসংগীত থামিয়ে দিতে হয়েছে! কিন্তু ভেনচালক আব্বাসদা তার এলাকায় প্রোগ্রাম থামতে দেয়নি। রমেন আগ্রহী চোখে গৌরাঙ্গকে দেখে। মসজিদ কমিটির লোককে নাকি আব্বাসদা বলেছিল, 'তোমাদের ওসবে আমাদের বিশ্বাস নেই আমাদের পথেও তোমাদের বিশ্বাস নেই, তোমরা তোমাদের কাজ কর আমরা আমাদের কাজ করছি আমাদের বাধা দিওনা তোমাদের আমরা বাধা দিচ্ছিনা! '
মনে পড়েছে এবারে, খুব ভাল কমরেড, খুব ভাল খুব ভাল! কিন্তু এসব লোককে ধরে রাখার জন্য এদেশে সত্যিকারের কোনো বিপ্লবী পার্টিই তো গড়ে ওঠেনি ভাই! এটাই দুঃখের, সৌরি ঘটকের দুইদেশ উপন্যাসে এই বিরল চরিত্রদের পাবি। নিজের গ্রামে সংখ্যালঘু হয়ে যাচ্ছে কৃষক সংগঠক, পার্টির কঠিন সময়ে পাকিস্তান দাবীর বিপক্ষে দাঁড়িয়ে তেভাগার ঝান্ডা উড্ডীন রাখতে গিয়ে নিজের গ্রামেই খুন হয়ে যাচ্ছে। পার্টি এদের যোগ্য সম্মান দেয়নি, সেদিনও না, আজও না! দুইদেশ তো শুধু উপন্যাস নয় দলিল সেই সময়ের। চিরির বন্দরের লড়াইয়ে শহিদ সমীরুদ্দিনের কথা পাবি গোলাম কুদ্দুসের লেখায়। এদের উত্তরাধিকার তৈরি হলনা কেন কে জবাব দেবে! কেন এমন পরিণতি হল পাকিস্তান আমলের নাচোলের তেভাগার? ক্ষমতালোভী নেতৃত্ব কি বিপ্লব চায়? এরা বিপ্লব না করেই লেনিন শিরোপা পেতে চায় রমেন! বলে গৌরাঙ্গ ধোঁয়া ছাড়ে।
হুঁ, আব্বাসদার সাথে কাল দেখা হয়েছিল চৌমাথার মোড়ে, ভেন চালিয়ে যাচ্ছিল। আমাকে দেখতে পেয়ে ডাকল। ঠিক চিনেছে, কতদিন পরে দেখা। খুব রোগা হয়ে গেছে মানুষটা। আমাকে জিজ্ঞেস করল কী করছি, কাজকর্ম কেমন চলছে! যোগাযোগ নাকি কেউ আর রাখেনা ওর সঙ্গে, রমেন মাথা নিচু করে বলল কিছু বলতে পারলাম না রে!
কী বলবি,কী বলার আছে তোর। হুঁ! এমন কত প্রকৃত শ্রেণীচেতনার নিষ্ঠাবান বিপ্লবী মানুষ হারিয়ে গেছে অন্ধকারে, গৌরাঙ্গ বিড়ির ছাই ফেলে বিরক্তি প্রকাশ করে !
আব্বাসদা যেতে বলেছে, খুব করে বলেছে যাবি একদিন গৌরাঙ্গ? রমেন জিজ্ঞাসা করে।
না, গিয়ে আমাদের কিছু করার নেই!গৌরাঙ্গ অস্বস্তি অনুভব করে।
কিছু না করতে পারি গানের দল তো করা যাবে, আব্বাসদা দারুণ গান করে। চলনা ওইটুকুর মধ্যে নিজেদের স্বপ্নকে ধরে রাখি রমেন গৌরাঙ্গের হাত চেপে ধরে।
ওসব আমার দ্বারা আর হবে কিনা ভেবে দেখতে হবে রমেন। কাল ক্যুরিয়র সার্ভিসের ঝোলাটা কাঁধে তোলার জন্য প্রস্তুত হতে হবে এখন বাড়ি যাব, দানা গুঁজে স্বপ্নহীন কুকুরের মত ঘুমিয়ে থাকব। তুইও বাড়ি যা খোয়াব টোয়াব দেখিসনা, আকাশে মেঘ, বৃষ্টি নামবে হয়তো। কাল ছাত্রগুলোর পিছনে বকতে বকতে বাকি স্বপ্নগুলো অপারেট করে দিস, আমার মত। আমি সাইকেলে চিঠি বিলি করতে করতে ছাঁটি, রোজ ছাঁটি! তুইও রোজ দিবি একটু একটু করে দিবি। এতে তুইও বাঁচবি তোর আব্বাসদাও বাঁচবে, যা যা বাড়ি যা!
গৌরাঙ্গ বিড়িটা চটির তলা দিয়ে নিভিয়ে চলে যায় রমেন চেয়ে চেয়ে দেখতে থাকে তার একসময়ের নেতা, একনিষ্ঠ বিপ্লবী কমরেডের প্রস্থান পথের দিকে........