Banner
বাস্তুচ্যুত — শামসুজ্জোহা মানিক ( ছোট গল্প)

লিখেছেনঃ শামসুজ্জোহা মানিক, আপডেটঃ December 2, 2018, 12:00 AM, Hits: 1962

 

মফস্বলের এক জেলা শহরে রকিবদের বাড়ী। তাদের পাশের বাড়ীটা ছিল তার সহপাঠী বন্ধু সুশান্তদের বাড়ী। দুই বাড়ী পাশাপাশি, প্রায় লাগোয়া বলা চলে। রকিবের বাবা রফিক সাহেব আর সুশান্তর বাবা গোপাল বাবু পরস্পরের প্রতিবেশী আর সেই সাথে ছেলেবেলার বন্ধু।

ব্রিটিশ আমলে শহরটায় অনেক হিন্দুর বাস ছিল। কিন্তু ১৯৪৭-এ ধর্মের ভিত্তিতে বাংলা ভাগ হলে শহরটা পাকিস্তানে অর্থাৎ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান  বা পূর্ব বাংলায় পড়ার পর নানান ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাতে হিন্দুরা জমি-বাড়ী ইত্যাদি বিক্রী করে ভারতে চলে যেতে থাকে। এক সময়কার হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ শহরটিতে এখন হিন্দু সামান্য কয়েক ঘরই আছে। যে কয়েকটি পরিবার এখনও এখানে আছে তাদের মধ্যে পড়ে গোপাল বাবুর পরিবার। যখন পাকিস্তান হয় তখনও গোপাল বাবুর বাবা ছিলেন বেঁচে আর গোপাল বাবু ছিলেন ছেলেমানুষ।

এখন গোপাল বাবু অনেক বয়সী মানুষ। তাঁর এক ছেলে এবং এক মেয়ে। যে সময়কার কথা দিয়ে এ গল্পের শুরু সেই সময় গোপাল বাবুর ছেলে সুশান্ত ক্লাস টেনে পড়ত। আর মেয়ে প্রতিমা ক্লাস এইটে। সুশান্তর সঙ্গে একই ক্লাসের সহপাঠী রকিব। দুইজনের পরিবারের মধ্যে যেমন ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তেমন সুশান্ত আর রকিবের মধ্যেও ঘনিষ্ঠতা ছিল। দুইজন পরস্পরের এমনই বন্ধু যে, তাদেরকে অনেকে মানিক জোড় বলত। একসঙ্গে ক্লাসে যেত, বাইরেও একত্রে খেলাধুলা এবং ঘোরাফেরা করত বলে তাদের এই নাম দেওয়া হয়েছিল। তবে দুই জনই ছিল পড়ুয়া এবং ক্লাসের ভালো ছাত্র।

সুশান্তর ছোট এবং একমাত্র বোন প্রতিমার সঙ্গে পড়ত রকিবের ছোট বোন রাশেদা। সেও তখন ক্লাস এইটের ছাত্রী। তারা দুইজনই পড়ত স্থানীয় এক গার্লস হাইস্কুলে। এক ক্লাসে পড়ার সুবাদে প্রতিমা এবং রাশেদার মধ্যে যেমন সুসম্পর্ক হয়েছিল তেমন পাশাপাশি বাসা হওয়ায় পরস্পরের বাসায় যাতায়াতও ছিল ঘনঘন।

সেই সূত্রে রকিবের সঙ্গে প্রতিমার কথা হত মাঝে মাঝে। মাঝে মাঝে রসিকতাও হত দুইজনের মধ্যে। কিন্তু সেসব ছিল নির্দোষ রসিকতা। তবু দুই জনের তখন উঠতি বয়স। ফলে অন্য রকম হাওয়া যে দুইজনের মনে মাঝে মাঝে বইত না, তা নয়। তবে সেটা তেমন কোন রূপ নেয় নাই।

এক দিন সকালের ঘটনাটা ছিল বেশ মজার। রকিব সুশান্তর খোঁজে এদিন তাদের বাড়ীতে গিয়ে দরজায় কড়া নাড়লো। কিছুক্ষণ কড়া নাড়বার পর দরজার ওপাশে প্রতিমার ক্ষুব্ধ কণ্ঠ শোনা গেল, ‘সকাল থেকে আজ ভিখারিরা এত উপদ্রব শুরু করেছে। যাও, ভিক্ষা হবে না।’ বলেই দরজা খুলে দেখে সামনে দাঁড়ানো রকিব। অমনই লজ্জা পেয়ে জিভ কেটে বলল, ‘ও মা, দাদা তুমি! সরি। সকাল থেকে আজ বেশ কয়েক জন ভিখারি ভিক্ষা নিয়ে গেছে। এইমাত্র একজন ভিক্ষা নিয়ে গেল। তাই ভাবলাম আর এক ভিখারি না কি কে জানে। সরি, দাদা মাফ করে দাও। এভাবে বলা আমার উচিত হয় নাই।’ প্রতিমার মুখ লজ্জায় লাল। রকিব প্রথমে অপ্রস্তুত হলেও পরে খুব মজা পেয়ে ওর থুতনিটা আঙ্গুল দিয়ে ধরে বলল, ‘যা, আর মাফ চাইতে হবে না। তোকে মাফ করে দিলাম।’

ঘটনা এখানেই শেষ। কিন্তু প্রতিমার লজ্জিত মুখে সেই জিভ কাটার দৃশ্য তার কিশোর মনে গাঁথা রইল। প্রতিমা ছিল রূপসী। তার রূপের প্রশংসা সবাই করত। তার সামনেও অন্য ছেলেরা কখনও কখনও তার রূপের প্রশংসা করত। এসব কথার ছাপ তো মনের উপর একটা পড়েই। সেই উঠতি বয়সের আবেগী মনে ছাপটা একটু বেশী হবারই কথা। তবে রকিব ছিল সংযত ছেলে। তাছাড়া প্রতিমা তার বন্ধুর ছোট বোন। সে তাকে তার ছোট বোন হিসাবেই দেখতে চাইত। সেটা তার জন্য স্বাভাবিকও ছিল। কারণ তারা পাশাপাশি বাড়ীর বাসিন্দা হিসাবে ছেলেবেলা থেকেই একসঙ্গে বড় হয়েছিল। সুতরাং ভাই-বোনের সম্পর্কের বাইরে যাওয়ার কথা দুইজনের কেউই কখনও ভাবে নাই। তাছাড়া ধর্মীয় পরিচয়ের ভিন্নতার প্রভাবও ছিলই। সুতরাং দুইজনের সম্পর্কের মধ্যে একটা শক্ত বাধার দেওয়ালও ছিল, যেটা ডিঙানোর চিন্তা করার মত মানসিকতা বা চিন্তাও দুইজনের কারোরই মনে ছিল না।

এই বয়সে পাড়া বা স্কুলের উপর ক্লাসের ছেলেদের দিক থেকে বিভিন্ন ধরনের ইঙ্গিত এমন কি কথা এলেও প্রতিমা সেগুলোকে পাত্তা দিত না। তবে রকিব অন্য অনেকের থেকে এ বিষয়ে ভিন্ন বলে হয়ত রকিবের প্রতি তার ঐটুকু বয়সেও কিছু করে দুর্বলতা জন্ম নিচ্ছিল। তবে সেটা ছিল শ্রদ্ধা মিশ্রিত। সুতরাং রকিব বা প্রতিমার সম্পর্কের মধ্যে জটিলতা ছিল না।

এর পর অনেকটা সময় কেটে গেছে। রকিব এবং সুশান্ত ডিগ্রী পরীক্ষা দিয়ে বের হবে এমন একটা সময়ের ঘটনা এটা। এর মধ্যে একদিন রকিব বাড়ীতে গুঞ্জন শুনল, সুশান্তর বাবা গোপাল বাবু ভারতে চলে যাবার কথা ভাবছেন। হঠাৎ কী এমন সমস্যা হল যে এতকাল পরে হঠাৎ করে গোপাল বাবুকে সপরিবারে ভারতে চলে যাবার কথা ভাবতে হচ্ছে? গোপাল বাবু শহরে একজন প্রতিষ্ঠিত মানুষ। রকিবদের স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক হিসাবে তাঁর বেশ সুনাম আছে। পদে সহকারী প্রধান হলেও বাস্তবে তিনিই প্রধান শিক্ষকের সব দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর কর্মনিষ্ঠা এবং দায়িত্বশীলতার কারণে প্রধান শিক্ষক তাঁর উপর নির্ভর করে চলতে স্বচ্ছন্দ বোধ করেন। শুধু স্কুলে নয়, এলাকায়ও তাঁর প্রতিষ্ঠা আছে সজ্জন এবং ভালো শিক্ষক হিসাবে। এহেন ব্যক্তির দেশ ছাড়ার চিন্তার কারণ কী হতে পারে এ নিয়ে রকিবদের বাড়ীতে আলোচনা-পর্যালোচনা শুরু হল। তাকে এড়িয়ে এসব আলোচনা চললেও তার কানেও সেসব আসতে শুরু করল। তাকে বলা হল সে যেন ঘুণাক্ষরে কারও সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা না করে।

অবশ্য তখনও রকিবের বাবা ছাড়া শহরের আর কেউ গোপাল বাবুর দেশ ছাড়ার সিদ্ধান্তের কথা জানত না। রকিবের মা রকিবকে একদিন কথা প্রসঙ্গে কথাটা বললেও আর কাউকে জানাতে বারংবার নিষেধ করেছিলেন। কিন্তু কী কারণে গোপাল বাবু দেশ ছাড়বেন সেটা তখনও রকিবের জানা হয় নাই। তবে পরে কিছু করে রকিব ব্যাপারটা জানতে পারে। সুশান্তও একান্তে তাকে কথাটা বলে এবং কথাটা বাইরের লোকদের থেকে গোপন রাখতেও বলে।

গোপাল বাবুর সমস্যা হয়েছে জেলা শহরের বুকে একটা ভালো জায়গায় তাঁদের বাড়ী হওয়ায়। সামনে মোটামুটি প্রশস্ত পাকা রাস্তা চলে গেছে। এখনও এটা শহরের কিছুটা উপকণ্ঠে বা ধারে হলেও শহর যেভাবে সম্প্রসারিত হচ্ছে তাতে কিছুদিনের মধ্যে এটা শহরের অনেকটা ভিতরের দিকে চলে আসবে। শহরের উপর তাঁদের পাকা বাড়ীটা অত বড় না হলেও তার পিছনে রয়েছে অনেক বেশী পরিমাণ জমি। পাকা বাড়ী এবং জমি সব মিলিয়ে এক বিঘার মত জমি। এখন এর বাজার মূল্য কমপক্ষে পাঁচ কোটি টাকা। অনেক দিন ধরে এই জমির উপর বিভিন্ন জনের চোখ পড়লেও গোপাল বাবুর সামাজিক প্রতিষ্ঠা, জনপ্রিয়তা এবং রকিবের বাবাসহ বিভিন্ন প্রভাবশালী ব্যক্তির সঙ্গে তাঁর হৃদ্যতার কারণে কারও আর বেশী দূর আগাবার সাহস হয় নাই। এখানে বলে নেওয়া যেতে পারে যে, রকিবের বাবা নিজেও একজন শিক্ষক। তিনি স্থানীয় কলেজের অধ্যাপক।

কিন্তু এবার সরকারী দলের স্থানীয় সংসদ সদস্যের চোখ পড়েছে তাঁর বাস্তুভিটাসহ জমির উপর। তাঁর নামটা শহরের নামের মতই এখানে অপ্রাসঙ্গিক। এটা বিশেষ সংসদ সদস্যকে উদেশ্য করেও লিখা নয়। এটা যে কেউ হতে পারে এ দেশের বাস্তবতায়।

যাইহোক সরকারী দলের সাংসদ একদিন গোপাল বাবুকে ডেকে নিয়ে একান্তে বললেন, ‘গোপালবাবু আমি এমপি হলেও শহরে মাত্র তিন কাঠা জমির উপর আমার বাড়ী। সেটাও ভাল জায়গায় নয়, একটা ঘিঞ্জি জায়গায়। অথচ শহরের এমন একটা জায়গায় বিশ কাঠা বা এক বিঘা জমির উপর আপনার বাড়ী। বাড়ী তো সামান্য জায়গার উপরে। বড় রাস্তার ধারে সামান্য দেড়-দুই কাঠার উপর আপনার বাড়ী। আর পিছনে তো পুরা জমিই আপনি বাগানের নামে ফেলে রেখেছেন। ও থেকে আপনার কীই বা আসে! এক কাজ করেন পিছনে দুই কাঠা জমি নিজের জন্য রেখে বাকী আঠারো কাঠা জমি আপনি আমাকে বিক্রী করে দেন। যে টাকা দিব তা দিয়ে আপনি তার উপর একটা নূতন বাড়ী করে নিবেন। আমাকে সামনের জায়গা দিলে আমি বড় রাস্তায় উঠবার জন্য একটা রাস্তার জন্য আন্দাজ পরিমাণ জায়গা ছেড়ে দিব। আপনার বাড়ীতে তো আর ট্রাক ঢুকবার রাস্তা লাগবে না। একটা রিক্শা যাবার মত জায়গা দিলেই হবে।’

হঠাৎ এমন প্রস্তাবে গোপাল বাবুর মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। এমপি সাহেবের কাছ থেকে এমন প্রস্তাব তাঁর কল্পনাতেও ছিল না। তিনি আমতা আমতা করতেই এমপি সাহেব বললেন, ‘মাস্টার মশায়! আপনি না বলবেন না।’

বুঝা গেল আসলে গোপাল বাবুকে জমি থেকে পর্যায়ক্রমে দখলচ্যুত করার পরিকল্পনা করেছেন এমপি সাহেব। গোপাল বাবু চিন্তার জন্য কিছু সময় চাইলেন। কিন্তু এতদিনে এমপি সাহেব তাঁর দীর্ঘ দিনের উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য মরীয়া। সুতরাং চূড়ান্ত কথাটা বলে ফেললেন, ‘দেখেন, হিন্দুদেরকে আমি এই শহরে অনেক কাল ধরে রক্ষা করে এসেছি। কিন্তু কতদিন আমি এমপি থাকব তা তো বলা যায় না। তখন আপনাদের কী অবস্থা হবে তা বলা যায় না। আর জানেনই তো এ দেশে হিন্দুদের কত সমস্যা! এখন না হয় আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি তারা ক্ষমতায় আছি। কিন্তু এমন অবস্থা তো পরবর্তী সময়ে নাও থাকতে পারে। হয়ত মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধ পক্ষ পরবর্তী সরকার হবে। যদি তা হয় তবে সেই সরকারের লোকজন আপনার কী অবস্থা করতে পারে তা একবার ভেবে দেখেন তো! তারা তো আপনাকে কোন দাম না দিয়েই আপনার বাড়ী আর জায়গাটা দখল করবে। তার চেয়ে আপনি এখন যা পান তা-ই নেন। আর চাইলে আপনি পুরা জমিটাই আমাকে বিক্রী করে ভারতে চলে যেতে পারেন। সেখানে জমি কিনে বাড়ী করবেন। আপনার সমস্যা হবে না। সেখানে আপনার জ্যেঠাতো ভাইরা তো আছে। আর আপনাকে তো বঞ্চিত করব না। টাকা দিয়েই কিনে নিব।’ 

জমির দামও তিনি ধার্য করে দিলেন। পঞ্চাশ লক্ষ টাকা। যে জমির বাজার মূল্য এখন অন্ততপক্ষে পাঁচ কোটি টাকা। সেখানেও কথা আছে। দয়ার সাগর এমপি সাহেব জমি রেজিস্ট্রি করার সময় চল্লিশ লক্ষ টাকা দিবেন। এই টাকা দিয়ে জমিটা রেজিস্ট্রি করে দেওয়া হবে। এই টাকা তিনি যাতে ভারতে পাঠাতে পারেন তার ব্যবস্থাও তিনি করে দিবেন। সেখানে গোপাল বাবু জমি কিনে বাড়ী করার ব্যবস্থা করতে থাকবেন, আর ইতিমধ্যে তিনি বাকী দশ লক্ষ টাকা যোগাড় করে পাঠাবার ব্যবস্থা করবেন।

শেষে মোক্ষম অস্ত্র হিসাবে বললেন, ‘দেখেন, আপনার মেয়েটাও এখন বড় হয়েছে। কলেজে পড়ে না? শহরের বখাটে ছেলেরা এখন পর্যন্ত আমার ভয়ে আপনার মেয়ের পিছনে লাগে না। আমার ছেলেদেরকেও আমি এখন পর্যন্ত সামলে রেখেছি। কিন্তু কতদিন তা পারব তাও তো বলতে পারি না। সবদিক বিবেচনা করে আমার মনে হয়েছে এ দেশে না থেকে আপনি ভারতেই চলে যান। সেখানে আপনি নূতন করে জীবন শুরু করতে পারবেন। কোনও কিছু করতে না পারলে একটা কোচিং সেন্টার খুলে বসবেন।’

মোট কথা দেশ ছাড়ার স্পষ্ট নির্দেশ। তখনও সিদ্ধান্ত জানাতে দ্বিধা করলেও একেবারে সস্তাদরে জমি-বাড়ী বিক্রী করে দেশ না ছাড়লে যে কপালে দুঃখ আছে সেটা বুঝা গেল কয়েক দিনের ভিতর।

এর মধ্যে একদিন প্রতিমার কলেজ থেকে ফিরবার পথে তিনটা অপরিচিত ছেলে তার সঙ্গে অশোভন আচরণ করল। সেই সময় পথ ছিল ফাঁকা। সঙ্গে শুধু রাশেদা ছিল। কিন্তু তার সামনেই অশালীনভাবে প্রতিমার গায়ে ধাক্কা দিয়ে তারা চলে গেল। একজন প্রতিমার কানের কাছে মুখ নিয়ে অস্ফুটভাবে কিছু একটা বললও। বুঝা যায় অশ্লীল বা আপত্তিকর কিছু কথা হবে সেটা। এমন ঘটনা এর আগে কখনও তার সঙ্গে ঘটে নাই। ছেলেরা যে যা-ই ভাবুক বা বলুক সবই আড়ালে-আবডালে করেছে।

এর কয়েক দিন পর একটা অপরিচিত ছেলে দূর থেকে একটা কাগজের ডেলা প্রতিমার গায়ে ছুঁড়ে শিষ দিয়ে চলে গেল। আর একদিন সরকারী দলের ছাত্র সংগঠনের একটা পাণ্ডা কিসিমের ছেলে যে কাজ করল সেটা ছিল অভাবিত। শহরের অনেকে তাকে চেনে। ঘন ঘন মোটর সাইকেলে রাস্তায় রাস্তায় টহল দিয়ে বেড়ায়। এমন এক টহলদারির সময় একদিন প্রতিমাকে রাস্তায় একা পেয়ে কাছে এসে হঠাৎ করে ব্রেক করে মোটর সাইকেল থেকে নেমে এল। তারপর বলল, ‘হাই প্রতিমা! কেমন আছ? আই লাভ ইউ।’ বলেই হঠাৎ করে তাকে জড়িয়ে ধরে তার বুকে হাত দিয়ে তাকে চুমু খেয়ে হাসতে হাসতে বলল, ‘আজ এইটুকুই। তোমাকে আরও আদর করতে চাই। কী, রাজী তো?’ উত্তরের অপেক্ষা না করে ছাত্র নেতা যেভাবে হঠাৎ করে উড়ে এসেছিল সেভাবেই দ্রুত মোটর সাইকেলে উঠে চলে গেল। প্রতিমা কী উত্তর দিবে? তার মুখে কোনও কথা ছিল না। ঘটনার আকস্মিকতা এবং নির্মমতায় সে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল। ঘৃণা এবং রাগে সে ফেটে পড়তে চাইছিল।

এরপর গৌতম বাবু সিদ্ধান্ত নিতে আর দেরী করেন নাই। এতকাল এত বাধাবিপত্তির পরেও এ দেশে মাটি কামড়ে পড়ে থাকতে চাইলেও মুসলমানদের দেশে ভিন্ন ধর্মের মানুষ হিসাবে হিন্দুদের জন্য যে নিরাপদ কোনও জায়গা নাই, তাদের এখানে বাসের অধিকার নাই সেটা তাঁর চূড়ান্তভাবে বুঝা হল।

সব জেনে রকিবের বাবা রফিক সাহেবও এমপি সাহেবের প্রস্তাব গ্রহণ করার পক্ষে মত দিলেন। বললেন, ‘তোমাকে কী পরামর্শ দিব তা ভেবে পাচ্ছি না। সরকারী দলের মোকাবিলায় দাঁড়াবার ক্ষমতা আমাদের নাই। যদি অপজিশন থাকত তাহলে আমরা না হয় তার আশ্রয় নিতে পারতাম। এখন যে অবস্থা দেখছি তাতে এমপি সাহেবের প্রস্তাব মেনে নেওয়া ছাড়া আমি আর কোন উপায়ই দেখছি না। আর এই এমপি সম্পর্কে তো জানোই। কেমন একরোখা লোক! আরও কিছু লোকের কী হাল সে করেছে তা কি তোমার জানা নাই? সে যখন তোমার জায়গার উপর নজর দিয়েছে তখন তোমাকে উচ্ছেদ করেই ছাড়বে। আর আমরা কিছুই করতে পারব না। তোমার পাশে দাঁড়ালে নানান মামলায় আর পুলিশী হয়রানিতে ফেলে আমাদেরও সর্বনাশ করে ছাড়বে। এছাড়া বাড়ীর লোকজনের উপর গুণ্ডাদের হামলা তো আছেই। তোমারও অবস্থা সঙ্গীন করে ছাড়বে। গুণ্ডা ছাড়াও পুলিশী হাঙ্গামাও তো আছে। সেগুলো কি তুমি সামাল দিতে পারবে? সুতরাং আমার মনে হচ্ছে তুমি যা পাচ্ছো তাই নিয়ে চলে যাও। তা না হলে তোমাকে সবই ফেলে দিয়ে শুধু প্রাণ নিয়ে যেতে হবে। সে ক্ষেত্রেও কী অবস্থা হবে তা বলতে পারি না।’

অবশ্য তাঁদের জমির উপর এমপি সাহেবের লোভ হওয়ার জন্য গৌতম বাবু নিজেও যে দায়ী সে কথা বলতে ছাড়লেন না গৌতম বাবুর স্ত্রী, ‘আমি তোমাকে আগেই অনেক বার বলেছিলাম শহরের উপরে এত বেশী জমি রেখো না। কখন কার চোখে পড়বে তার ঠিক নাই। অন্তত অর্ধেকটা জমি বিক্রী করে দাও পছন্দের লোকদের কাছে। আছো তো মুসলমানদের দেশে! এখন সখ মিটেছে বড় জমির উপর বাড়ী নিয়ে থাকার? টাকা দিয়ে যে নিতে চাচ্ছে এই তো ভাগ্য! সরকারী দলের এমপি বলে কথা! চাইলে তো এমনিতে বাড়ী থেকে উচ্ছেদ করে একবস্ত্রে জমি-বাড়ী ছাড়া করতে পারত। যা দয়া করে দিতে চাইবে তা নিয়ে দেশ ছেড়ে যাওয়া ছাড়া এখন কী করার আছে? ওদের সঙ্গে লড়াই করে কি টিকতে পারবে? কে তোমার সাহায্যে আসবে, বলো?’

গৌতম বাবু জানেন এসব কথার উত্তর হয় না। তাই চুপ করে থাকেন।

একদিন রকিব বাসা থেকে বের হয়ে বাজারে যাবার সময় দেখল প্রতিমা তাদের ঘরের ভিতর থেকে জানালার শিক ধরে উদাস চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। তার মুখে-চোখে অস্পষ্ট বিষাদের ছায়া সে দেখতে পেল। এই দৃশ্য রকিবের মনে গাঁথা হয়ে থাকল।

এরপর গৌতম বাবুরা সত্যি সত্যি একদিন হঠাৎ করে রাতের আঁধারে বাড়ী ছেড়ে এ দেশ থেকে চলে গেলেন। প্রকৃতপক্ষে রকিবের বাবা-মা-ই গোটা ঘটনা প্রত্যক্ষ করেন এবং যাবার সময় বিশেষ করে রকিবের বাবা রফিক সাহেব যেটুকু পারেন সাহায্য করলেন। সীমান্ত পর্যন্ত গিয়ে সেখানে গৌতম বাবুদের সবাইকে পৌঁছে দিয়ে ফিরে এলেন। অবশ্য এমপি সাহেবের লোকরাও ছিল। এদিক থেকে গৌতম বাবুকে খুব ভাগ্যবান বলতে হবে। এ দেশের আরও অনেক হিন্দুর মত ভিটামাটি অন্যদের দখলে দিয়ে তাঁকে এক বস্ত্রে পালাতে হয় নাই।

তবে জমির দাম পঞ্চাশ লক্ষ টাকা ধার্য হলেও গৌতম বাবু পেলেন মাত্র চল্লিশ লক্ষ টাকা। জমি রেজিস্ট্রির সময় চল্লিশ লাখ টাকা পেলেও দ্বিতীয় দফায় টাকা দেওয়ার সময় এমপি সাহেব বললেন, ‘এই সময় আমার হাতে আর টাকা নাই। বাকী টাকা নেওয়ার জন্য আপনার আর এ দেশে আসবার দরকার নাই। আপনার নূতন ঠিকানাতো জানলাম। সেই ঠিকানায় আপনার নামে কিছুদিন পরই বাকী দশ লাখ টাকা পাঠাব।’

বুঝা গেল বাস্তবে গৌতম বাবুকে পাঁচ কোটি টাকার সম্পত্তি চল্লিশ লক্ষ টাকাতেই দিতে হল।

স্বাভাবিকভাবে পাড়ার সবাই জানল কাউকে না বলেকয়ে গৌতম বাবু সপরিবারে এ দেশ ছেড়ে চলে গেছেন। কয়েক দিন পর রকিবরা দেখল এমপি সাহেবের লোকজন পুরো বাড়ী ভাঙ্গার কাজ শুরু করেছে। দেশে উন্নয়নের জোয়ার বইছে। বাড়ীর সামনের রাস্তাটা নাকি অনেক প্রশস্ত হবে। কেউ বলছে এমপি সাহেব এখানে প্রাসাদোপম দালান করবেন, কেউ বলছে এখানে বিরাট মার্কেট হবে। কেউ ঠিক বলতে পারে না। তবে বড় ধরনের কিছু একটা যে হবে সেটা বুঝা যায়।

তারপর কিছু দিন চলে গেছে। গৌতম বাবুর বাড়ীর কোন চিহ্নই নাই। সেখানে এখন এমপি সাহেবের প্রাসাদোপম অট্টালিকা। রকিব এখন লেখাপড়া শেষ করে এক বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের চাকুরীতে ঢুকেছে। বাবা-মার উদ্যোগে তার বিয়ের কথাবার্তাও চলছে। তার ছোটবোন রাশেদার বিয়ে হয়ে গেছে। সে এখন স্বামীর সঙ্গে ঢাকায় থাকে। তার স্বামী ঢাকায় একটা ব্যাংকের কর্মকর্তা। সময়ের স্রোতে ও পরিস্থিতির চাপে সবই বদলায়। তবু আজও সুশান্তদের স্মৃতি রকিবের মনকে একটা কষ্টের ছোঁয়া দিয়ে যায়। কখনও হঠাৎ করে মনে উঁকি দেয় জানালার শিক ধরে আকাশের দিকে চেয়ে থাকা প্রতিমার সেই বিষাদমাখা মুখখানি।  

গৌতম বাবুরা যাবার পর সুশান্তর সঙ্গে রকিবের ২/৩ বার পত্র বিনিময় হয়েছিল। নূতন জায়গা তাদের তেমন ভাল না লাগলেও তারা যে টিকে আছে সে কথা জেনেছিল। বাস, এইটুকু। তারপর সেই যোগাযোগও শেষ হয়ে যায়। জীবন এমনই। শুধু হঠাৎ কখনও সুশান্ত আর প্রতিমা তার মনের ভিতরে উঁকি দিয়ে চলে যায়। কখনও সে নিজের মনের ভিতরে কথা বলে, ‘সুশান্ত তুমি কেমন আছ? কী করছ?’ কিংবা কখনও বলে, ‘প্রতিমা তোমার কি বিয়ে হয়েছে? নাকি, এখনও একা আছ? আমার কথা কি মনে পড়ে?’

অবশ্য বেশীক্ষণের জন্য নয়। সে বাস্তবে ফেরে।

 

মূল রচনা : ১৯ জুলাই ২০১৬, মঙ্গলবার, ৪ শ্রাবণ ১৪২৩

কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার

(ব-দ্বীপ প্রকাশন, ঢাকা থেকে ‘ইসলাম-বিতর্ক’ নামে ইংরাজী থেকে বাংলায় অনুবাদ সংকলন গ্রন্থ প্রকাশের দায়ে তথ্য ও প্রযুক্তি আইনের ৫৭(২) ধারায় লেখক যখন কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী ছিলেন সেই সময়ে গল্পটি লিখা হয়।)

 

সাম্প্রতিক পোষ্টসমূহ