Banner
পথের গল্প : ৩ — তামান্না ঝুমু

লিখেছেনঃ তামান্না ঝুমু, আপডেটঃ November 25, 2022, 12:00 AM, Hits: 436

মার্কিন দেশ পৃথিবীর শীর্ষস্থানীয় ধনী ও ক্ষমতাশালী দেশগুলির অন্যতম একটি হলেও এদেশে গৃহহীন মানুষের সংখ্যা খুব কম নয়। তার ওপর করোনার ধকল যাবার পর থেকে গৃহহীন মানুষদের সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে চলেছে। করোনায় কেউ চাকরি হারিয়েছে, কেউ স্বজন হারিয়েছে; অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা, স্বজন হারানোর বেদনা এরকম ইত্যাদি কারণে মানসিক অসুখের শিকার হয়েও অনেকে ঘর ছেড়ে ফুটপাত ও ট্রেন স্টেশনকে ঠিকানা করেছে। ইদানীং বাইরে বের হলেই গৃহহীন মানুষের দেখা পাওয়া নিত্যদিনের সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

সেদিন কাজ শেষে বাড়ি ফেরার পথে, আমার সমুখ-অদূরে দেখি, একটি ঘরহীন ছেলে ফুটপাতে বসে আকুল হয়ে কাঁদছে। আর দু’জন মহিলা তার সঙ্গে ঝুঁকে প’ড়ে কী যেন কথা বলছে। আমার কৌতূহল হলো, ছেলেটি এমন করে কেন কাঁদছে? এই দু;জন মানুষই বা ওর সঙ্গে ঝুঁকে ঝুঁকে কী কথা বলছে? আমিও ওদের পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। ছেলেটির কপাল বেয়ে টপটপ করে রক্ত ঝরছে, ও তা একটি টিস্যু দিয়ে বারবার মুছে নিচ্ছে আর অবিরাম কেঁদে চলেছে। মহিলা দু’জন ওকে জিজ্ঞেস করছে, তোমার কপাল ফেটেছে কীভাবে? আর তুমি এভাবে কাঁদছ কেন? ছেলেটি কান্নার বেগ আরো বাড়িয়ে দিয়ে বলে, আমি দেওয়ালে কপাল ঠুকে-ঠুকে কপাল ফাটিয়ে ফেলেছি। কারণ আমার বেঁচে থাকবার আর কোনো অর্থ নেই।

  • কেন? এমন কী হয়েছে যে তুমি নিজেকে নিজে এভাবে আঘাত করেছ?
  • আমি চার ডলার হারিয়ে ফেলেছি। চার ডলার আমি ভিক্ষা করে পেয়েছিলাম। আমার সর্বস্ব সেই চারটি ডলার আমি হারিয়ে ফেলেছি। আমার আর বেঁচে থাকবার মানে নেই। জানি না, এখন আমি কোথায় যাবো, কী করবো।
  • ওরা জিজ্ঞেস করে, তোমার কি পরিবার আছে? বা এমন কেউ কি কোথাও আছে, যাদের সঙ্গে আমরা যোগাযোগ করে তোমার অবস্থা জানাতে পারি? 
  • না, আমার কোনো পরিবার নেই। আমার কেউ নেই। আমাকে সাহায্য করার কেউ নেই।
  • তাহলে হাসপাতালে ফোন করি? এই যে তোমার কপাল থেকে রক্ত ঝরছে, তুমি ব্যথা পেয়েছ; এর চিকিৎসার জন্য? 

এবার ও আরো জোরে কাঁদতে লাগলো। না, আমি হাসপাতালে যাবো না। এখন শীতের সময়। ছেলেটির গায়ে একটি পাতলা সোয়েটার। তাতে শীত মানছিল না। ও ঠকঠক করে কাঁপছিল। আমি জিজ্ঞেস করি, তোমার কি ঘুমানোর জায়গা আছে? তোমার কি আহারের ব্যবস্থা আছে? তুমি কি আজ কিছু খেয়েছ? বলে, একটি আশ্রয়কেন্দ্রে ও থাকে এবং সেখানে আহারেরও ব্যবস্থা আছে। বললো, আজকে ও আহার করেছে। আমরা বললাম, চলো, তোমাকে আশ্রয়কেন্দ্রটিতে পৌঁছে দিই, যেখানে তুমি থাকছ। প্রবল বেগে মাথা নাড়িয়ে বললো, না, ওখানে আমি যাবো না কিছুতেই। আমি চার ডলার হারিয়ে ফেলেছি এবং সে-কারণে কপাল ফাটিয়ে ফেলেছি, এইজন্য ওরা সবাই আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করবে।  একজন বলে, আমার কাছে চার ডলার আছে। আমি যদি তোমাকে চার ডলার দিই তোমার টাকা হারানোর কষ্টটা কি লাঘব হবে? ও আরো ডুকরে কাঁদে। ওর সঙ্গে ছোট্ট একটি থলে আছে। তাতে সামান্য কিছু কাপড়চোপড়। কিছুক্ষণ পর পর ও দেখছে ওর কাপড়্গুলো ঠিকঠাক আছে কিনা। আর সামনে রাখা একটি পিজবোর্ড, তাতে সাহায্য চেয়ে একটি বাক্য লেখা।

আমরা দেখলাম, ও শারীরিকভাবে দুর্বল। মানসিকভাবে তারচেয়ে বেশি বিপর্যস্ত। বয়স জিজ্ঞেস করলাম। বললো, বিশ বছর। মাত্র বিশ বছর বয়স। সদ্য কৈশোর-পেরোনো একটি ছেলে। এই বয়েসের একটি ছেলের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার কথা, প্রাণবন্ত হবার কথা। এমন একটি ছেলে আশ্রয়কেন্দ্রে থাকছে, রাস্তায় সাহায্যের জন্য পোস্টার  লিখে বসে থেকে ভিক্ষা করে খাচ্ছে। ব্যাপারটি মর্মান্তিক। পরিবারের সঙ্গে ওর যোগাযোগ নেই।  এই দুর্বিপাকে পরিবার ওর পাশে নেই। পরিবারের কথা বলতেই কান্নার বেগ ওর আরো বেড়ে যায়। হয়ত পরিবার থেকে অনেক বড় আঘাত পেয়েছে, হয়ত পরিবারের সঙ্গে কোনো ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। হয়ত বা অন্যকিছু। ওই দু’জন মহিলা ওর মানসিক অবস্থা দেখে বলছিলো, কোনো মানসিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে কি তোমার জন্য ফোন করবো? ওরা তোমাকে এসে নিয়ে যাবে। তোমাকে মানসিক সেবা ও যত্ন দেবে। ও তীব্রভাবে মাথা নেড়ে বললো, না, আমি ওখানে যাবো না। আমার জীবনে আর কোনো ভালো নেই। আর কোনো আশা নেই। আমরা বলি, কখনো নিরাশ হয়ো না। মানুষের যত্ন ও ভালোবাসা তোমার প্রাপ্য, যেমনটা প্রাপ্য সবার। দেখো, কতো সুন্দর একজন মানুষ তুমি! সবে মাত্র কৈশোর পেরিয়েছ। সামনে সুন্দর জীবন, মানুষের ভালোবাসা সবকিছু তোমার জন্য অপেক্ষা করছে। চিকিৎসায় যেমন শরীরের ব্যথা সারে, তেমনি মনের ব্যথাও সারে। একটু সময় লাগে, এই যা! মহিলাদের একজন বলে, এই আমিও মানসিক অসুখের জন্য চিকিৎসাধীন আছি। একটু পরেই আমার থেরাপিস্টের ফোন আসবে। চিকিৎসা ও পরিষেবার ফলে আমি আগের চেয়ে অনেক ভালো আছি। আস্তে আস্তে ওর মতি পরিবর্তিত হয়। ও আশ্রয়কেন্দ্রে ফিরে যেতে রাজি হয়।  আমি ওকে সামান্য টাকা দিতে চাই। ও রক্তমাখা কাঁপা-কাঁপা হাতে টাকাটা নেয়। ওরা দু’জন ওকে আশ্রয়কেন্দ্রে পৌঁছে দেবার জন্য সেদিকে যাত্রা শুরু করে। সম্পূর্ণ অনাত্মীয় অপরিচিত দু’জন পথচারী নারী নির্ভেজাল নিঃস্বার্থ ভালোবাসা আর যত্ন দিয়ে একটি অচেনা অসহায় ছেলের সহায় হয়ে আত্মার আত্মীয়ের মতো ওকে শীত রাত আর দুর্দৈব থেকে রক্ষা করে একটি আপাত নিরাপদ ঠিকানার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। আমি সেই দিকে কিছুক্ষণ পেছন থেকে তাকিয়ে থেকে আমার নিজের ঠিকানার দিকে হাঁটতে শুরু করি।

সাম্প্রতিক পোষ্টসমূহ