লিখেছেনঃ তামান্না ঝুমু, আপডেটঃ February 14, 2023, 12:00 AM, Hits: 453
রাত এগারোটার মতো হবে তখন। আমি নিউ ইয়র্কে আমার শ্বশুরবাড়ির রান্নাঘরে বাসন-কোসন হাঁড়ি-পাতিল ধুচ্ছি, রাতের আহারের পরে। বাকিরা সবাই আহার শেষে নিজ-নিজ এঁটো হাতখানা ধুয়ে নিজেদের শয়নকক্ষে চ’লে গিয়ে কেউ বা টিভি দেখছে, কেউ বা খোশ গল্পে মেতেছে। সবাই আবার নিজেদের কক্ষ থেকে হুকুম দিচ্ছে, ওই যে, রান্নাঘরের বেটি, আমাদেরকে এখনো ফলমূল কেটে দিয়ে যাচ্ছ না কেন? এখনো দুধ গরম ক’রে দিয়ে যাচ্ছ না কেন? আমি ধোয়া-পাখলার কাজ অর্ধসমাপ্ত রেখে এক হাতে নানা রকমের ফল কাটতে ছুটি, আরেক হাতে চুলোয় আগুন জ্বেলে দুধ জ্বাল দিতে থাকি। আবার মুহূর্তমধ্যেই ভেসে আসে শ্বশুর-শাশুড়ির সমবেত হাঁক, ফল কাটতে কতক্ষণ লাগে? দুধ এখনো গরম হয় নি? আমার মনে হতে থাকে, দুর্গা দেবীর হাত দশখানা, আমার অন্তত একশখানা হওয়া উচিত ছিল। আলোর গতি প্রতি সেকেণ্ডে ১.৮৬ লক্ষ মাইল, আমার গৃহকর্মের গতি আরো বেশি হওয়া জরুরি ছিল। ফল আর গরম দুধ আমি কক্ষে কক্ষে দিয়ে এসে বাকি ধোয়া-পাখলা সেরে রান্নাঘরের ময়লার ব্যাগটা বাইরে রেখে আসতে যাই। রান্নাঘরের পাশ দিয়ে একটি দরজা আছে বাইরে বের হবার। সে-দরজা দিয়ে আমি বের হই। ভেতর থেকে আনলক রেখে দরজাটা ভেজিয়ে আমি বের হই, যাতে ময়লা ফেলে এসে আবার ঘরে ঢুকতে পারি। সেই দরজা দিয়ে বের হলেই কয়েক ধাপের একটি সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামলে আরেকটি দরজা, সেটি খুললেই ড্রাইভওয়ে। আমি ড্রাইভওয়েতে নেমে ময়লা রাখার জায়গায় ময়লার ব্যাগটা রাখি। ঝিরিঝিরি বাতাস বইছে বাইরে। ময়লার বিনের পাশে আমি খানিক দাঁড়াই। নরম বাতাস আমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত মৃদু স্পর্শে বয়ে যাচ্ছে। আহা, কী আরাম আর প্রশান্তি বাতাসের ছোঁয়ায়! বাতাসে আমার চুল উড়ছে। আর তাতেই কী যে আনন্দ হচ্ছে আমার! আমার মনে হয়, এমন আনন্দ আমি বহু বহুদিন পাই নি। দু’বাহু বাড়িয়ে আমি অদৃশ্য বাতাসকে আলিঙ্গন করতে চাই।
দু’এক কদম এগিয়ে আমি বাসার সামনে গিয়ে দাঁড়াই। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখি, অসংখ্য নক্ষত্র আকাশের গায়ে মিটিমিটি জ্বলছে। তখন কয়েকমাস হয় আমি আমেরিকায় এসেছি। এই ক’মাসে আমি আর আকাশ দেখি নি, নক্ষত্র দেখি নি, এমন নরম বাতাস আমার গায়ে আর লাগে নি। ঘরের চার দেওয়াল ছাড়া আমি আর কিছু দেখি নি। দিনে বার কয়েক আমাকে ঘরের বাইরে বের হতে হয় অবশ্য; কখনো কাপড় শুকোতে দিতে, কখনো শুকনো কাপড় ঘরে নিতে, কখনো ময়লা ফেলতে, কখনো পেছনের আঙিনায় চাষাবাদ করতে। আমি কোনো প্রতিবেশীর সঙ্গে কথা বলি কিনা, আমার মাথার ঘোমটা পড়ে যায় কিনা, রসিতে কাপড় টানিয়ে দেবার পর আমি দুই মিনিট দাঁড়িয়ে একটু জিরিয়ে নিতে চাই কিনা--এসব পাহারা দেবার জন্য আমার শাশুড়ি-মা, শাহাজান বেগম আমাকে কোনো কাজে ঘরের বাইরে কখনো একা পা দিতে দিতেন না। তিনি ছায়াসঙ্গীর মতো আমার পেছন-পেছন বের হতেন। সেদিন রাত একটু বেশি হয়ে গিয়েছিল ব’লে তিনি আমার সঙ্গে বের হতে পারেন নি। আমার তাতে নিজেকে খুব স্বাধীন আর সুখী মনে হয়।
আকাশে সরু নতুন চাঁদ আর অগণিত নক্ষত্র। সবাই মিটিমিটি হাসছে। চাঁদ আর নক্ষত্রদের মুচকি-মুচকি হাসি দেখে আমি অভিভূত হয়ে যাই। মনে পড়ে, স্কুলে পড়েছিলাম, ভ্যালেন্টিনা তেরেশকোভা নামক একজন রাশিয়ান মহিলা ১৯৬৩ সনের ১৬ই জুন সর্বপ্রথম মহিলা মহাকাশচারী হিসেবে মহাশূন্যে গমন করেন এবং ৪৮ বার পৃথিবী প্রদক্ষিণ করেন। মনে হয়, এখানে দাঁড়িয়ে অনন্তকাল আমি নক্ষত্রের দিকে তাকিয়ে থাকি। আমার মন ভ্যালেন্টিনার মতো পৃথিবী ছেড়ে, আমার দেহ ছিঁড়ে, শ্বশুরালয়ের রান্নাঘরের দেওয়াল ভেঙে, হাত-পায়ের শেকল ছিঁড়ে নক্ষত্রদের দিকে উড়ে যেতে চায়। মুক্ত বাতাসের ঘ্রাণে আমার ফুসফুস ভ’রে যায়। একটি গাছের ডাল থেকে কয়েকটি পাখি কিচিরমিচির ডেকে ওঠে ক্ষণিকের তরে। সেই পাখিদের সঙ্গে আমার গলা মেলাতে ইচ্ছা করে। আমার মনে হয়, আমি আর কয়েদী মেয়েটি নই, এক মুক্তবিহঙ্গ এখন। নিবিড় মায়াবী রাত আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে, বাতাস আমাকে মোহিত করে, নক্ষত্রেরা আমাকে ডাকে।
নিত্যদিনকার মতো সেদিনও ভোর পাঁচটায় বর আমাকে ঘুম থেকে তুলে দিয়েছিল– শ্বশুরের জন্য পরোটা, শাশুড়ির জন্য রুটি, ননদের জন্য ডালপুরি আর ওর জন্য চিত্তল পিঠা নাশতা বানানোর জন্য। সবাইকে সকালের নাশতা খাইয়ে দিয়ে দুপুরের ছয়-সাত পদের রান্না। দুপুরের খাওয়ার পর ঘরদোর ও বাথরুম পরিষ্কার করা, সবার গোসলের পর রেখে আসা কাপড় হাতে ধোয়া। তারপর বিকেলের নাশতা। আবার রাতের জন্য ছয় পদ নতুন রান্না। সারাদিনের বিরামহীন খাটুনিতে শরীর-মন ক্লান্ত অবসন্ন হয়ে ছিল। কিন্তু তা যেন আকাশ মিটিমিটি তারা আর স্নিগ্ধ বাতাস মিলে নিমেষে সারিয়ে দিয়েছে। এমনই সুখের সময়ে হঠাৎ সম্বিৎ ফিরে আসে আমার। এখানে দশ মিনিটের মতো আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে আছি আমি। শ্বশুর শাশুড়ি বা বর টের পেলে আমার কপালে কঠিন দুঃখ আছে। আমি ঘরের দিকে ফিরে আসি। বাইরের দরজাটা দিয়ে ঢুকে কয়েক ধাপ সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে ভেতরের দরজাটা খুলতে গিয়ে দেখি, তা ভেতর থেকে লাগানো। আমি আনলক রেখে গিয়েছিলাম দশ মিনিট আগে। ভেতর থেকে কেউ লক ক’রে দিয়েছে। দরজার হাতল ধ’রে কিছুক্ষণ মোচড়ামুচড়ি করি বৃথাই। দরজা খোলে না। ভয়ে দরজায় টোকা দিই না বা কাউকে ডাকি না; যদি আমাকে গালিগালাজ করে, যদি বাড়ি থেকে বের করে দেয়! কী করবো? কীভাবে দরজা খুলবো? কীভাবে ঘরে ঢুকবো? ঘরে ঢুকতে না পারলে আমি কোথায় যাবো? আবার আমি বাইরে গিয়ে দাঁড়াই। তখনো আকাশে অসখ্য নক্ষত্র জ্বলছে, তখনো আকাশের বুক থেকে নেমে আসছে নরম বাতাস, তখনো রাত নিবিড় আর মায়াবী। কিন্তু ওসব আশ্চর্য বস্তু আর আমাকে টানছে না। ঘরে কীভাবে ঢুকবো সে-চিন্তায় আমি দিগ্বিদিক জ্ঞান-শূন্য। আমাদের শয়নকক্ষের জানালা দিয়ে আলো দেখা যাচ্ছে এবং টিভির শব্দ শোনা যাচ্ছে। তার মানে বর-বাবাজি টিভি দেখছেন। জানালায় একটু সাহস ক’রে টোকা দিয়ে দেখবো নাকি? আচ্ছা, দিয়েই ফেলি! জানালা আমার নাগালের বাইরে। কিছুক্ষণ উচ্চলাফ ও দীর্ঘলাফ দিয়ে দেখলাম, কিন্তু জানালার নাগাল কিছুতেই পেলাম না। এবার উপায় কী? ডাক দিলে শ্বশুর-শাশুড়ি শুনে যাবে। তাহলে আর রক্ষা নাই। পেছনের আঙিনার দিকে গেলাম, কাঠি-জাতীয় কিছু পাই কিনা দেখতে। পেলাম একটা লম্বা কাঠি। তা দিয়ে জানালায় টোকা দিতেই বর জানালায় এসে আমাকে দেখে অগ্নিশর্মা হয়ে বললো, তুমি এ-সময়ে বাইরে কী করো? রান্নাঘরে তোমার কোনো কাজ নাই? বললাম, বাইরে ময়লা ফেলতে বের হয়েছিলাম, ঘরে ঢুকতে গিয়ে দেখি, দরজা বন্ধ। ও এসে দরজা খুলে দিলো। আমি ঘরে ঢুকলাম। আমি ঘরে পা রাখা-মাত্র আমার শাশুড়ি আমাকে খুব বিশ্রী ভাষায় গালি দিতে-দিতে ও তর্জনি পাকাতে-পাকাতে আমার সমুখে এসে দাঁড়ালেন। তাঁর পুত্রকে বললেন, এই নষ্টা মেয়েকে এক্ষুনি তালাক দিয়ে, মাথা ন্যাড়া ক’রে বাসা থেকে বের ক’রে দে। এতো রাতে এটা বাসা থেকে বের হয়েছিল কেন? কোথায় গিয়েছিল, জিজ্ঞেস কর। আমি ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বললাম, মা, আমি ময়লা ফেলতে গিয়েছিলাম। শাশুড়ি বললেন, তুই ময়লা ফেলতে যাস নি, তুই বেসমেন্টে গিয়েছিলি। তাই আমি দরজা লাগিয়ে দিয়েছি, যাতে তুই রাতে আর বাসায় ঢুকতে না পারিস। পুত্রকে বললেন, তুই দরজা খুললি কোন সাহসে? দরজা খোলার আগে আমার অনুমতি নিয়েছিলি?
আমি বেসমেন্টে যাই নি তবু কেন ওরা বলছিল, আমি গিয়েছি, এজন্য আমার প্রাণপাত হয়ে যেতে চাইছিল। আমি গিয়ে থাকলেও এমন কী অপরাধ হতো? শ্বশুর শাশুড়ি ননদ বর সবাই বাইরে যায় যখন খুশি; আমি একটু প্রতিবেশীর বাসায় গল্প করতে গেলে তা দোষের হবে কেন?
বেসমেন্টে এক বাঙালি পরিবার ভাড়া থাকতো। শাশুড়ি-মা প্রায় প্রতিদিনই যেতেন ওদের বাসায় গল্প করতে। কিন্তু আমার যাওয়া বারণ ছিল। শাশুড়ি বলতেন, মানুষের সঙ্গে কথা বলতে দিলে, বাইরে যেতে দিলে বৌ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চ’লে যায়, নষ্ট হয়ে যায়। প্রতিবেশীদের আমার বয়েসী একটা মেয়ে ছিল। আমাকে তার সঙ্গেও কথা বলতে দিতেন না। বাইরে কাপড় শুকোতে দিতে গেলে কখনো কখনো ওদের বাসার কারো সঙ্গে দেখা হত। কেমন আছ, কী খবর--এরকম দু’একটা কথাবার্তা হতো। আমার শ্বশুর মফিজুর রহমান, শাশুড়ি শাহাজান বেগম বা ননাস শাহীন তা দেখতে পেলে শুধু আমাকে নয়, আমার জীবিত ও মৃত সকল আত্মীয়-স্বজনকে গালি দিতে থাকতেন। শাশুড়ি ভেবেছিলেন, সেদিন আমি তাঁর সুতীক্ষ্ণ চোখ ফাঁকি দিয়ে বেসমেন্টে গল্প করতে গিয়েছিলাম। আমি গিয়েছিলাম আসলে ময়লা ফেলতে, বাইরে। রাতের ময়লা রাতে না ফেলে সকালের জন্য রেখে দিলেও শ্বশুর-শাশুড়ি মারমুখী হয়ে যেতেন। বাইরে আবহাওয়া যতো প্রতিকূলই হোক না কেন, প্রচণ্ড বৃষ্টি বা তুষারপাত-- রাতের ময়লা রাতেই ফেলে দিয়ে আসতে হবে এবং তা অবশ্যই আমাকেই।
শ্বশুরমশাই শয়নকক্ষে বিছানায় শুয়ে-শুয়ে অতি আরামসে ও অবলীলায় আমাকে চ-বর্গীয় গালি দিতে দিতে তাঁর পুত্রকে বললেন, এই ফকিন্নিকে এখনই তালাক দিয়ে দে তো! শাশুড়ি-মা ম্যারাডোনার মতো একবার মেঝেতে সজোরে লাথি মারেন, একবার মুহাম্মদ আলি ক্লে-র মতো ডাইনিং টেবিলে ঘুষি মারেন, একবার উচ্চলাফ দিয়ে ওঠেন, আর পুত্রকে বলেন, এটাকে এখনো তালাক দিচ্ছিস না কেন? মধ্যরাতে গালির উচ্চ রেওয়াজ শুনে বেসমেন্টের ভাড়াটিয়ারা চ’লে আসে। এতো রাতে আমাকে গালি ও হুমকি-ধামকির কারণ জানতে পেরে ওরা বলে, বৌ তো আমাদের বাসায় আসে নি এখন। ও তো কখনো আমাদের বাসায় আসে না। তবুও গালি এবং তালাকের হুমকি চলতেই থাকে। বর-বাবাজি কিছুক্ষণ নির্বিকার দাঁড়িয়ে থাকে আর কিছুক্ষণ বাবা-মায়ের সঙ্গে সংগত করে।
ভোর পাঁচটা থেকে মধ্যরাত অবধি বিরামহীন পরিশ্রমে আমার দেহ-মন অবসন্ন তার ওপর গালিগালাজ হুমকি-ধামকি ও মিথ্যাচারে আমার সমস্ত সত্তা তখন বেদনা আর অপমানে এতোটাই ভ’রে গিয়েছে যে ওরা কে কী বলছে, আমার ব্যাপারে কী সিদ্ধান্ত দিচ্ছে, তা আমার কান দিয়ে আর ঢুকছে না। হাত-পা অবশ হয়ে আসতে চাইছে। চোখের দৃষ্টি ধূসর। পৃথিবীর সমস্ত ঘুম তখন আমার দু’চোখে। চোখ ভেঙে আসছে। পর্যুদস্ত সৈনিকের মতো আমার শরীর ওখানে মেঝেতেই এলিয়ে পড়তে চাইছে। মনে হচ্ছে, সাড়ম্বরে নীল নিপীড়নের উৎসব চলতে থাকুক; এই মেঝেতে প’ড়ে আমি ঘুমিয়ে থাকি, আর কোনোদিন যেন না জাগি।