লিখেছেনঃ তামান্না ঝুমু, আপডেটঃ March 31, 2023, 12:00 AM, Hits: 1304
ক্যারিবীয় এক সহকর্মী সেদিন আমাকে জিজ্ঞেস করে, তোমাদেরকে কি তোমাদের প্রতিবেশীরা মারধোর করতো? খুব আশ্চর্যজনক প্রশ্ন! খুব অবাক হলাম ওর প্রশ্নটা শুনে।
• প্রতিবেশীরা কেন মারতে যাবে?
• আমাদেরকে আমাদের প্রতিবেশীরা প্রায় প্রতিদিনই মারতো।
• কেন? তোমার বাবা-মা এজন্য কিছু বলতো না ওদের?
• বলতো তো। ওদের পিঠ চাপড়ে ধন্যবাদ দিতো এবং মাঝেমাঝে চা-নাশতা খাওয়াতো।
• নিজের সন্তানকে যে মারে তাকে কী ক’রে মানুষ আদর-আপ্যায়ন করে? আশ্চর্য!
• আর কেনই বা ওরা তোমাদের মারতো?
• স্কুলে পড়া না পারলে বা বাড়ির পড়া ঠিকভাবে ক’রে না নিয়ে গেলে ওরা আমাদের পিটাই করতো।
• স্কুলে পড়া না পারলে তা প্রতিবেশী জানতো কীভাবে?
• ধরো, স্কুলে পড়া পারলাম না। তো মাস্টারমশাই দি্তেন বেদম পিটুনি। পিটিয়ে চামড়া ফাটিয়ে ফেলতেন। বাড়ি ফেরার পথে-পথে পাড়া-প্রতিবেশীরা আমাদের রক্তাক্ত শরীর দেখে জিজ্ঞেস করতো, কী রে, চামড়া ফাটা কেন? পড়া পারিস নি? স্কুলে শিখেছিলাম, সদা সত্য বলিবে। আমরা তাই সত্য বলতাম--অমুক বিষয়ের পড়া আজ পারি নি। সঙ্গে-সঙ্গেই শুরু হয়ে যেতো তাদের সমাজসেবা। তবে রে, হারামজাদা! তোদের বাপমায়ে এত কষ্ট ক’রে তোদেরকে লেখাপড়া শিখতে স্কুলে পাঠায়, আর তোরা পড়া পারিস না– ব’লেই কয়েকটা মাগনা কিল-ঘুষি মেরে দিতো। এভাবে আমাদের পিতামাতা ও তাঁদের সন্তানদের মঙ্গলকামী কয়েকজন প্রতিবেশীর হাতে কয়েক দফা মার খেয়ে অবশেষে আমরা ছিন্নভিন্ন দেহখানি নিয়ে বাড়ি ফিরতাম। আমাদের মার-খাওয়া থ্যাতলানো অবস্থা দেখে বাবামা কাহিনী বুঝে যেতো। এবং সাদর সম্ভাষণে চূড়ান্ত মার দিতে শুরু করতো। হারামির বাচ্চা! আজও পড়া পারিস নি! বিপুল জোশ ও উদ্দীপনা নিয়ে তারা আমাদের ইতোমধ্যে একাধিকবার আহত শরীরের ওপর ঝাঁপিয়ে প’ড়ে কিল ঘুষি মারতে থাকতো।
কিছুক্ষণ পিটাই করার পর শ্রান্ত হয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বড় পরিতাপ ক’রে বলতো, আমাদের দুঃখ মাস্টারমশাইরা বোঝে, প্রতিবেশীরা বোঝে, শুধু হতভাগ্য তোরা বুঝলি না! পেট থেকে সাক্ষাৎ শত্রু বের হয়েছিস! শত্রু! কিছুক্ষণ পরিতাপ ও ভর্ৎসনা চলতো তুমুলভাবে। বাবামায়ের হাতে চূড়ান্ত মারের পরেই কিন্তু মার শেষ নয়! আত্মীয়-স্বজনেরাও মাঝেমাঝেও খবর পেয়ে ছুটে আসতো দায়িত্বপরায়ণ জাজ্বল্যমান স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে; পিটাইয়ের ব্যাপারে আমাদের বাবামাকে সাহায্য করতে। সে-মহৎ কাজে নিজেদের হাত ওরা অকাতরে বাড়িয়ে দিতো। কীভাবে পেটালে আমরা সর্বোচ্চ ব্যথা পাবো ও সর্বোচ্চ ফল-লাভ হবে কীভাবে পেটালে, সে-বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শও দিতো মুক্তমন এবং হস্তে। আমাদের বাবামা এত সাহায্য-সহযোগিতা ও আন্তরকিতার জন্য তাদেরকেও প্রতিদান ও কৃতজ্ঞতাস্বরূপ উত্তম অহারাদিতে আপ্যায়িত করতো।
বুঝলাম, ক্যারিবীয়রা প্রতিবেশী ও আত্মীয়েরা এইদিক দিয়ে আমাদের চেয়ে অনেক বেশি পরোপকারী আন্তরিক ও সমাজসেবক। কেবল আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে আসে নাই ওরা অবনী ‘পরে। আর এজন্যই বুঝি কাহলিল গিব্রান লিখেছিলেন, ইওর চিলড্রেন আর নট ইওর চিলড্রেন!
বিচিত্র সব কারণে আমাদেরকে স্কুলে মাস্টারমশাইরা মারতেন। পড়া না বুঝলে মার। বুঝিয়ে দিতে বললে আবার মার। বাইরের দিকে তাকালে মার। মেয়েরা ছেলেদের দিকে তাকালে মার। ছেলেরা মেয়েদের দিকে তাকালে মার। পরীক্ষায় নম্বর কম পেলে মার। ফেল করলে আরো বেশি মার। মারের চোটে স্কুল কামাই করলে আরো মার। আরো বেশি বিচিত্র কারণে বাড়িতে মারা হতো। খেলতে চাইলে মার। জোরে পড়লে মার। আস্তে পড়লে আরো জোরে মার। পড়ার টেবিলে ঝিমোলে মার। জানালা দিয়ে আকাশ দেখলে মার। চাঁদ দেখলে আরো জোরে মার। পড়া না পারা, ফেল করা ইত্যাদি কারণে স্কুলের মার পর্যাপ্ত হতো না, তাই শুমার এবং বেশুমার মার। তবে ক্যারিবীয়দের তুলনায় আমাদের একদিকে সৌভাগ্য যে আমাদের প্রতিবেশীরা আমাদেরকে স্কুলের পড়া না পারার অপরাধে মারতো না। এটা আমাদের পিতামাতাদের জন্য দুর্ভাগ্য অবশ্য। আমাদের আত্মীয়েরা ক্যারিবীয়দের মতো অতোটা আত্মীয়োপকারী না হলেও, খুব কম উপকারী নয়। তারা আমাদেরকে নানা ব্যাপারে প্রায়শই হুমকি-ধামকি দিতো। যেমন : পথে-ঘাটে কোনো ছেলের সঙ্গে কথা বলেছিস, খবর পেলে হাড্ডি গুঁড়ো করে ফেলবো। কারো মুখেমুখে তর্ক করলে দাঁত উপড়ায়ে ফেলবো। গুরুজনের কথার বাইরে গেলে ধুনতে ধুনতে চূর্ণ করে ফেলবো। ইত্যাদি। মাস্টারমশাইদের সঙ্গে দেখা হলে অভিভাবক ও আত্মীয়েরা খুব উদারভাবে ব’লে দিতো, লেখাপড়া বা আচার-আচরণে কোনো ঝামেলা দেখলে নির্দ্বিধায় আমাদের ছেলেমেয়েদের চামড়া তুলে বাড়িতে পাঠিয়ে দেবেন, নতুন জুতো বানাবো।
দাঁত উৎপাটন, হাড্ডি গুঁড়ো করা, চামড়া তোলা ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ সার্জারির আগে আমাদের অভিভাবক ও মাস্টারমশাইদের মাথায় কি এনেস্থেশিয়া করে নেবার কথা আসতো? নাকি এনেস্থেশিয়া ছাড়াই সার্জারি? দাঁতের ব্যথা বড় ভয়াবহ। আমার অভিজ্ঞতা আছে এই ব্যাপারে, তাই জানি। এজন্য বলছি, এখনো যদি কোনো অভিভাবক বা মাস্টার কোনো বাচ্চার দাঁত উৎপাটন করতে চান, তাহলে সার্জারির আগে এনেস্থেশিয়া করতে ভুলবেন না। হাড্ডি গুঁড়ো করা, আর চামড়া তোলার ব্যাপারে আমার ব্যক্তিগত কোনো অভিজ্ঞতা নেই, তাই বলতে পারছি না এই দুই বিষয়ে। তাই হাড্ডি ভাঙার আগে অর্থোপেডিক ও চামড়া তোলার আগে ডার্মাটোলোজিস্টের সঙ্গে পরামর্শ ক’রে নেবেন অনুগ্রহপূর্বক। শুনতে পাই, এখনকার বাবামা ও মাস্টাররা নাকি আগের মতো আন্তরিকতা নিয়ে আর ছেলেমেয়েদের পেটান না। আহারে, মঙ্গলাকাঙ্ক্ষার বড় আকাল এখন! আমরা আগে কত সুন্দর দিন কাটাইতাম! বাড়িতে আর স্কুলে পিটুনি খাইতাম।
আমার সহকর্মীর গল্প শুনে আমি বললাম, আমার ধারণা ছিল, আমাদের মতো বাড়িতে ও স্কুলে মার খাওয়ার ভাগ্য বুঝি আর কোনো সংস্কৃতির বাচ্চাদের নেই। এখন দেখছি, তোমাদের ভাগ্য আমাদের চেয়ে কয়েক ডিগ্রী বেশি। স্কুল আর বাড়ি তো আছেই, সঙ্গে আত্মীয় ও প্রতিবেশী! সহকর্মী বললো, তোমাদের আত্মীয় ও প্রতিবেশীরা কতোই না ভালো ছিল! তোমাদের মারতো না!