Banner
আমার শৈশব জীবন -- শামসুন নাহার

লিখেছেনঃ শামসুন নাহার, আপডেটঃ September 9, 2007, 6:00 PM, Hits: 12208

প্রথম অংশ

পূর্বকথা




বিকেল চারটার দিকে স্কুল ছুটির পর পথের ধুলো উড়োতে উড়োতে ছেলেরা বাড়ী মুখো চলে যাচ্ছে। পেছনে রেখে যাচ্ছে সূর্য রাঙা লাল আলোক রশ্মি মাখানো ধূলি কণা। স্কুল ফিরতি পথের বাম পাশে পড়ে পুলিশ স্টেশন। রাস্তার দিকে বারান্দায় নতুন আসা দারোগা বসে আছেন। নতুন কর্মক্ষেত্র। তাই কয়েক জন ভদ্রলোকের সংগে আলাপচারিতায়     ব্যস্ত। মাঝে মাঝে স্কুল ফিরতি ছেলেদের দিকে চোখ রাখছেন। হয়ত তাঁর নিজের বিগত স্কুল জীবনের কথা মনে পড়ছে।

হঠাৎ তাঁর একটি ছেলের দিকে দৃষ্টি আটকে গেল। গৌর বর্ণ শান্ত চেহারার ছেলেটি। রাস্তার এক পাশ দিয়ে ধীর গতিতে পথ অতিক্রম করে যাচ্ছে। পড়ন্ত রোদের রং লেগে ফর্সা মুখখানি রক্তিম হয়ে উঠেছে।

কে ছেলেটি? দারোগা বাবুর মনে প্রশ্ন। ইতোমধ্যে ছেলেটি তাঁর দৃষ্টির বাইরে চলে গেছে।

দারোগা বাবু ভাবলেন, এই স্কুলে পড়ে যখন তখন জানা যাবে ছেলেটি কার।

এরপর আর একটি স্কুল ছুটির দিন। ছেলেটি আগের মত রাস্তা অতিক্রম করছিল। বাড়ী ফিরবে।

দারোগা বাবু নিকটস্থ একজনকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ঐ যে ফর্সা মত ছেলেটা যাচ্ছে, কার ছেলে?’

লোকটা হেসে বলল, ‘বাবু, ওত মোল্লাজীর ছেলে। এই স্কুলে পড়ে।’

‘ঠিক আছে, ডাক,’ দারোগা বাবু বললেন।

লোকটা ছেলেটার সমমুখে এসে দাঁড়াল, বলল, ‘এই খোকা, দারোগা বাবু তোমাকে ডাকছেন।’

ছেলেটা প্রথমে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। প্রত্যেক দিনই ত সে এ পথ দিয়ে যাওয়া আসা করে। কেউত তাকে কোন দিন ডাকে নাই।

‘কোন বাবু?’ ছেলেটার প্রশ্ন?

লোকটা বলল, ‘ঐ যে গো! ঐ যে বসে আছেন। থানার বড় বাবু। আপনাকে ডাকছেন।’

ছেলেটা প্রথমে চমকে উঠল। সেত কোন অপরাধ করে নাই। রাজনীতিও সে করে না।

বাড়ীতে ‘প্রবাসী’ আর ‘ভারতবর্ষ’ নামে দু’টি পত্রিকা রাখা হয় বটে। সেই সুবাদে বাড়ীতে কেউ কেউ আসে। দেশের গরম অবস্থা সম্পর্কে আলোচনা যে হয় না তাও নয়। তবে ছাত্র মানুষ হলেও এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট নয় সে।

বাড়ীতে কোন মহিলা অভিভাবক নাই। কর্ত্রীহীন সংসার। অনেকে আসে, আলোচনা হয়। রাজনীতির সংগে তার সম্পর্ক নাই।

নিঃশব্দে সে লোকটাকে অনুসরণ করল। দারোগা বাবু ছেলেটাকে লক্ষ্য করে বসতে বললেন।

ছেলেটি দাঁড়িয়ে আছে। সাধারণ সাদাসিধে পোষাক। হাফ-হাতা শার্ট, পরিষকার ধুতি পরনে। পায়ে বিদ্যাসাগরী চটি জুতো। ধূলি ধূসরিত।

দারোগা বাবু সামনের চেয়ারটা দেখিয়ে বললেন, ‘বস।’

ছেলেটা একটু ইতস্তত করে বসে পড়ল। দারোগা বাবু একটু চিন্তা করে বললেন, ‘তুমি এই স্কুলে পড়?’

ছেলেটার হাতে বই। স্কুল ছুটির সময় সব ছেলের সংগেই বাড়ী ফিরছে। বইগুলোর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘হাঁ।’

‘তোমার বাড়ী কতদূরে?’

ছেলেটা স্কুলের পাশে ‘কালিদহ’ নামে দীঘিটার দিকে আঙ্গুল বাড়িয়ে দেখিয়ে বলল, ‘দীঘিটার ওপাশে নাপিত পাড়া। নাপিত পাড়া পেরিয়ে খাস বাজার। ওখানেই আমাদের বাড়ী।’

দারোগা বাবুর মনে আরও প্রশ্ন খেলা করছিল। কিন্তু এত প্রশ্ন একদিনে করা ঠিক হবে না মনে করে চুপ করলেন।

ছেলেটা উঠে দাঁড়াল, ‘যাই।’

দারোগা বাবু বললেন, ‘আবার আসবে।’

ছেলেটা চলে গেলে যেসব ভদ্রলোক বসেছিলেন তাঁদের একজন হাসিমুখে বললেন, ‘মোল্লাজীর ছেলে! খুব ভদ্র ছেলে। কোন সাতে-পাঁচে থাকে না।’

দারোগা বাবু বললেন, ‘দেখেই বুঝেছি।’

‘কোন মোল্লাজী? মাঝে মাঝে রাজা সাহেবের সংগে মসজিদে যান। দাড়িওয়ালা এক ভদ্রলোক, তিনি নাকি?’

‘হাঁ, তিনিই,’ ভদ্রলোক উত্তর করলেন। ভদ্রলোক আরও একটি সংবাদ দিলেন যাতে করে দারোগা বাবুর আগ্রহ আরও বাড়ল।

‘মোল্লাজীর বৌ নাই; পাঁচটি ছেলেমেয়ে রেখে অনেক দিন আগে মারা গেছেন। মোল্লাজী আর বিয়ে-সাদি করেন নাই!’

দারোগা বাবু ভাবলেন ছেলেটার নাম জিজ্ঞাসা করা হয় নাই। ভুল হয়ে গেছে। আর একদিন এলে জিজ্ঞেস করা যাবে।



দ্বিতীয় অংশ

রাজনগর থানা





পশ্চিম বঙ্গের বীরভূম জেলার রাজনগর থানা। থানার ইতিহাস খুব দীর্ঘ নয়। বৃটিশ শাসন কায়েম হবার পর এই থানার প্রতিষ্ঠা হয়েছে । অপরাধ বলতে সে রকম কিছু হয় না।

জমি-জমা নিয়ে ঝগড়া বিবাদ, ছিঁচকে চুরির দুই একটি ঘটনা--যেগুলো রাজা সাহেবের উপস্থিতিতেই মিটে যায়। থানায় ডায়রী হয় না।

তবে, বৎসরের কোন কোন সময় ‘চাঁইচোর’ নামে এক যাযাবর দল এলাকায় অশান্তি সৃষ্টি করে। সুযোগ পেলে চুরি-ডাকাতি করতেও ছাড়ে না। তখনই শান্তি রক্ষাকারী পুলিশের দরকার হয়।

মোগলদের প্রতিষ্ঠিত শাসন ব্যবস্থাকে আরও সুশৃঙ্খল নিয়মে পরিচালনার জন্য এই থানা-পুলিশ বা শান্তি রক্ষাকারী প্রতিষ্ঠান। মূল থেকে উপরের স্তরে চলে গেছে।

কয়েক থানার সমন্বয়ে মহকুমা। কয়েকটা মহকুমার সমন্বয়ে একটি জেলা। আবার কয়েকটি জেলার সমন্বয়ে বিভাগ ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান।

তখন ভারতের শাসন ব্যবস্থা বৃটিশ প্রভুদের হাতেই ন্যস্ত ছিল।

নীচে থানা ভিত্তিক স্তরে একজন দারোগা যথেষ্ট। অবস্থাভেদে পুলিশের সংখ্যাও থাকত কম বেশী, যাদেরকে কন্‌স্টেবল বলা হত।

এভাবে শাসন যন্ত্র খুব সূক্ষ্মভাবে চলে এসেছে মূল শাসকের হাতে। বৃটিশ শাসকের ভিত্তি খুব শক্ত। সাধারণ মানুষের মনে ভয় আর ভক্তি দুইই বিরাজ করত। বলা হত বৃটিশ রাজ্যে সূর্য ডোবে না। সাধারণ শিক্ষিত লোকের মুখেও একথা শোনা যেত।

থানা হচ্ছে এলাকার শান্তি রক্ষাকারী প্রতিষ্ঠান। এ কারণে থানার দারোগা বাবুও কম না। দেশের লোক দিয়েই শান্তি রক্ষা করা হয় এভাবে।

তবে কোন দারোগা এক নাগাড়ে তিন বৎসরের বেশী এক থানায় অবস্থান করতে পারেন না। সাধারণ জনগণের সংগে বেশী সখ্যতা উপরওয়ালার কাম্য নয়। খুব বেশী হলে তিন বৎসর।

ইনকোয়ারীতে গেলে অবশ্যই পুলিশের পোশাক পরতে হবে। কন্‌স্টেবল থেকে দারোগা পর্যন্ত সবাইকে ফুল পোশাকে অকুস্থলে যেতে হবে এবং কেস এন্ট্রি করতে হবে। এ অবস্থায় পুলিশ একটি যন্ত্র ছাড়া কিছুই না।

পুলিশকে সাহায্য করতে স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ থাকেন। এঁদের সাহায্যেই দোষীর শাস্তি বিধান ও শান্তি রক্ষা সম্ভব ছিল।

আগে এক দারোগা এসেছিলেন। তিনি তাঁর দুষকর্মের জন্য খুব নিন্দা ও অখ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তাঁর অত্যাচারে জনগণ অতিষ্ঠ হয়েছিল। তাঁর বদলী হলে জনগণ নিঃশ্বাস ফেলে বাঁচে।

এরপর বেশ কয়েকজন দারোগা এসেছেন গিয়েছেন। আবার শুনা গেল সেই যোগেন দারোগা আসছেন। মানুষ চমকে উঠল। তবে তিনি আসছেন এটা ঠিক।

এবার তিনি এসে নতুন রূপে দেখা দিলেন। তিনি এসেই স্কুল প্রতিষ্ঠার কাজে উদ্যোগী হলেন। থানার অদূরে স্কুল প্রতিষ্ঠা হল।

এরপর একটি হাটের প্রয়োজনীয়তার কথা আলোচিত হল। ছোটখাটো বাজার আছে একটা, কিন্তু সপ্তাহের হিসাবে কোন হাট নাই, যেখানে কৃষকগণ তাদের উৎপাদিত ফসল বিক্রী করতে পারে। এই হাট এখন সপ্তাহে দুই দিন বসে। থানার বিপরীত দিকে এই হাট বসতে লাগল।

রাজা সাহেব তখনও ঐ এলাকার ভূসম্পত্তির মালিক। গরীব যারা রাজার ভূসম্পত্তিতে বসবাস করত তাদেরকে রাজার প্রয়োজনে রাজা সাহেবকে কায়িক শ্রম দিতে হত। কোন খাজনা নাই।

ডাকঘরও হল। তাঁর সমস্ত কর্মকাণ্ডে তিনি সবার সহযোগিতা পেলেন। এবার যখন যোগেন দারোগা বদলী হয়ে যান তখন এলাকাবাসীরা চোখের জলে বুক ভাসাল। এ রকমই হয়। কর্মবীর সব সময় নন্দিত হন।

তিনি আর এ এলাকায় আসেন নাই। তবে প্রবীণ লোকেরা বহুদিন ব্যাপী তাঁর কর্ম সাধনাকে সালাম জানিয়েছে। যোগেন বাবুকে ধন্য ধন্য করে তাঁর গুণগান করেছে।

মানুষ বর্তমান চেনে, অতীতের দিকে তাকায় না। থানার অবস্থানও আছে। কিন্তু যোগেন দারোগাকে চেনে কয়জন? এইসব প্রচেষ্টার ইতিহাস লেখা নাই। কিন্তু এইসব ভালোর সৃষ্টি যে একদিনে হয় নাই তা তৎকালীন লোকেরা জেনেছে।

পুলিশের পোশাক আর শান্তি রক্ষা কল্পে তাদের আগমন সাধারণ মানুষের মনে ভয় আর সমভ্রমবোধ জাগাত। সম্ভবত এ কারণেই সাধারণ লোক পুলিশের গা ঘেঁসতে চাইত না।

রাজনগর থানায় এখন একজন নতুন দারোগা এসেছেন। ভদ্রলোক মুসলমান। থানায় কখনও হিন্দু কখনও মুসলমান দারোগা আসেন।

এবারকার দারোগাবাবু মুসলমান। ভদ্রলোকরা থানায় আসেন আলাপচারিতার জন্য। দারোগা বাবুরও প্রয়োজন স্থানীয় ভদ্রলোকদের সংগে ভাল সম্পর্ক গড়ে তোলার।

বড় মামার সংগে আলাপ হবার পর থেকে বড় মামার চেহারা আর বিনয় দারোগা বাবুর মনে রেখাপাত করেছিল।

আরও একদিন স্কুল ছুটির পর বড় বাবু বড় মামাকে ডেকে পাঠালেন। বড় মামা কি পড়ছেন, কয় ভাই-বোন ইত্যাদি কতগুলি মামুলি প্রশ্ন করে বড় মামাকে বিদায় করলেন।

দারোগা বাবু জানলেন মোল্লাজীর বড় মেয়েও আছে এবং অনেক সম্বন্ধও এসেছে। মেয়েটি বেশ সুন্দরীও।

দারোগা বাবু এখনও বিয়ে করেন নাই যদিও দীর্ঘ দিন দারোগার চাকুরীতে আছেন। তিনি ভিতরে ভিতরে একটু অস্থিরতা অনুভব করলেন।

কার মাধ্যমে কিভাবে প্রস্তাবটা দেওয়া যায়? প্রস্তাব দিলেই যে তা গৃহীত হবে তার সম্ভাবনা কোথায়? এখন আমার বড় মামার সংগে ঘনিষ্ঠতাকে তিনি একটা সূত্র বলে ধরে নিলেন।

যেহেতু মোল্লাজীর মেয়ে, তাই নামাজ পড়া বরের একটা গুণ হিসাবে হয়ত ধরা হবে। তাই শুক্রবার দিন বাজারের মধ্যে অবস্থিত মসজিদে তিনি যাওয়া শুরু করলেন।

আমার ছোট মামা খুব ছোট থেকেই শুক্রবার দিন মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়তেন। তখন ছোট মামার বয়স বছর আটেক। মসজিদে এই ছেলেটির সংগেও দারোগা বাবুর আলাপ হয়ে গেল। মোল্লাজীর ছেলে।

বাড়ীতে বড় বোনের কাছে মহা উৎসাহে ভাইটি গল্প করে। দারোগা বাবু তার সংগে গল্প করেছেন।

মা রেগে যেতেন। ‘কোথাকার কোন লোক! তুমি ছোট ছেলে। তার সংগে গল্প  করতে যাও কেন?’

ছোট মামা কেঁদে জবাব দেন, ‘আমি গল্প করতে যাই নাকি? ঐ লোকটাই আমার সংগে কথা বলে।’ পরিচয় না জানা একটা বয়স্ক লোক তার সংগে কথা বলেছে এতেই সে ধন্য।

ইতোমধ্যে বড় মামাকে ডেকে দারোগা বাবু তাঁর সংগেও খাতির জমিয়ে ফেলেছেন।



তৃতীয় অংশ

মায়ের সম্বন্ধ



রাজবংশের এক ব্যারিস্টারের সংগে তখন বিয়ের সম্বন্ধ চলছিল মায়ের।

নানাজী দ্বিধাগ্রস্ত। নানাজীর ধারণা বিলাত গেলে মানুষ মদ খায়। শুদ্ধ জীবন তাদের হয় না। এর মধ্যে দারোগা বাবুর আগমন।

বড় মামার বক্তব্য ব্যরিস্টার নয়ত মন্দ। দারোগাতো ভাল। নামাজ পড়ে, প্রত্যেক শুক্রবারে মসজিদে যায়। ব্যবহার ভাল।

নানাজীর এখানে খুত-খুতানি। রংপুর কত দূর! বাংলাদেশের এ প্রান্ত ও প্রান্ত।  যেতেই দুই দিন। অতদূরে কি কেউ মেয়ে দেয়?

বড় মামা এই মন্তব্যের বড় প্রতিবাদী ছিলেন। ‘আমরা কি চিরকাল এক রকমই থাকব? আমরা পড়ছি না! বিলাতও আমাদের কাছে দূর থাকবে না। এত বাংলাদেশই। হলই বা কিছুটা দূর।’

প্রথম জনের উপর সন্দেহ। বিলাত গিয়েছিল। মদ খায় হয়ত। সেখানে ত খেয়েছেই।

আবার এও বিদেশী। তবে দেশী কাকে পাওয়া যাবে?

‘এই লোকটা নামাজী। প্রতি শুক্রবার মসজিদে যায়।’

‘রেজা ডাক্তারও তো আছে। সেও তো পাশ করা ডাক্তার।’ নানাজীর মন্তব্য। বড় মামারও যুক্তি আছে। ‘নতুন পাশ করা ডাক্তার। পশারের বেলায় হালে পানি পায় কিনা, দেখ।’

নানাজী কি বলবেন? যে মা সংসারটা ধরে রেখেছিলেন দীর্ঘ দিন তিনি অনেক দিন হল গত হয়েছেন। স্ত্রীও নাই। নানাজী সংসারের জটিল বিষয়গুলি বুঝেন না বিশেষ। বড় ছেলে সেও পূর্ণ বয়স্ক নয়। কিছু দিন হল দারোগা বাবুর তরফ থেকে তাঁর মেয়ের জন্য সম্বন্ধ পাঠানো হয়েছে। নানাজী দিশাহারা।

বরের অভিভাবক না এলে, বরের তরফ থেকে কথা না বললে বিয়ে কি সম্ভব? এত দূরের বিয়ে! কাউকে জানা নাই, শোনা নাই, কি করে বিয়ে হয়?

বরের অভিভাবক চাই। অতএব দারোগা বাবু মহীপুরের জমিদার তাঁর দুলাভাইকে ডাকলেন। তাঁর বিএ পাশ ছেলেও এল।

মা এত দূরে আসতে পারবে না । তবে একটা চিঠি দেখান হল যাতে লেখা আছে তাঁর এ বিয়েতে সমমতি আছে।

দ্বিধা-দ্বন্দ্বের মাঝখানে বিয়ের কাজ সম্পন্ন হয়ে গেল। দারোগা বাবুর বিয়ের কাজ সম্পন্ন করে দুলাভাই আর ভাগ্নে দেশে ফিরে গেলেন।

মাকে নিয়ে আব্বা রাজনগর থানা কোয়ার্টারে থাকলেন। বেশ সুখেই দিনগুলি কাটছিল। বিয়ের পর বেশ কয়েক মাস চলে গেছে।

হঠাৎ একটা টেলিগ্রাম এল দেশ থেকে। আব্বার মা মৃত্যু শয্যায়। ছেলেকে দেখতে চান। ছুটি নিয়ে আব্বা মাকে মাকে খাসবাজারে মায়ের বাপের বাড়ীতে রেখে চলে গেলেন। ছুটি হয়ত দীর্ঘ দিনেরই ছিল।

একমাস চলে গেল। দুইমাস চলে গেল। মাসে মাসে টাকা আসে কিছু করে। কিন্তু কোন যোগাযোগ আর রাখলেন না আব্বা।

নানাজী যা ভয় করেছিলেন তাই কাজে পরিণত হল।



চতুর্থ অংশ

মায়ের স্বপ্নভঙ্গ



কিছু দিন পর মা সংবাদ পেলেন আব্বা আবার বিয়ে করেছেন।

আব্বা তাঁর মায়ের অসুখের সংবাদ পেয়ে বাড়ী গিয়ে দেখেন, সবাই বহাল তবিয়তে আছে। উপরন্তু বাড়ীতে বিয়ের আয়োজন চলছে। কনে ঠিক করা আছে। এবং আব্বার মায়ের অসুখের সংবাদ সর্বৈব মিথ্যা। বাড়ী যাবার সংগে সংগে আব্বার মায়ের কান্নাকাটি আরম্ভ হয়ে গেল। ‘ভিন দেশের মেয়ে বাবা এদেশে আসবে না। আমার আর বৌ দেখা হবে না।’

আব্বার মনে কি চিন্তার উদয় হয়েছিল জানা নাই।

মা শুনলেন আব্বা দ্বিতীয় বিয়ে করে ফেলেছেন। মায়ের সৌন্দর্যের খ্যাতি ছিল। স্বপ্নও ছিল অনেক। সেই গৌরব আর স্বপ্ন ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেল। আফিম খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন মা। সময়মত টের পাওয়ায় আর উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়ায় মা বেঁচে যান।

সুস্থ হয়ে মা বই পড়ে সময় কাটাতে লাগলেন। তাস,দাবা, ক্যারাম, লুডো এসব খেলার ব্যবস্থা রাখা হল বাড়ীতে।

লেখকদের মধ্যে বঙ্কিম, শরৎ, রবীন্দ্রনাথ এঁদের সংগ্রহ ছিল বাড়ীতে। সম্ভবত বঙ্কিম ও শরৎ ছিলেন মায়ের প্রিয় লেখক।

বিষ খাওয়ার পর দুুই তিন বছর মা অসুস্থ ছিলেন। আব্বার দ্বিতীয় বিয়ের কিছু দিন পর আমার জন্ম হয়। কন্যা সন্তান জন্ম নিবার সংবাদে আব্বা খুব একটা সন্তুষ্ট হন নাই বলে মনে হয়। তবে মাসিক ভাতার পরিমাণ একটু বাড়িয়ে দিয়েছিলেন।

আমার বয়স যখন দেড় বছর তখন নানাজীও মৃত্যুবরণ করেন।

বাড়ীতে কোন মুরব্বী বা অভিভাবক আর নাই। নানাজীর মৃত্যুর আগে বড় মামাজীর বিয়ে হয়। মাত্র ষোল বছর বয়সে। কনের বয়স বার। সে আবার আমার মায়ের মামাতো বোন।

সেই বছরেই মামা ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়েছিলেন। তিনি অঙ্ক বিষয়ে স্বর্ণ পদক পেয়েছিলেন।



পঞ্চম অংশ

মামার বাড়ীর অবস্থান ও পরিবেশ



নানা বেঁচে থাকতেই সংসারের দেখা শুনার ভার, পুকুর, বাগান, চাষাবাদ এগুলি তত্ত্বাবধানের ভার বাউরী মামাদের হাতে ছিল। এঁরা চার ভাইই সংসারটা ধরে রেখেছেন।

এঁরা সবাই বাউরী। স্থানীয় আদিবাসী। তাঁরা নিজেদের ‘বাউরী’ বলতেন। বাউরী মামাদের মধ্যে এঁরা ছিলেন চার জন। চার জনের মধ্যে আমার জ্ঞান হবার আগেই এক জনের মৃত্যু হয়। এঁদের তিনজন কেদার, ফুলু, আর শ্রীচাঁদ। শ্রীচাঁদ নামটাকে এঁরা অশিক্ষিত মুখে বলতেন ‘শুচান’।

শ্রীচাঁদ মামা কিছুটা তোতলা ছিলেন। যখন মাথাটা সামনে একটু ঝুঁকিয়ে বলতেন ‘সে- সে- সেলাম।’ হাতটাও কপালে ঠেকত। আমার অবাক লাগত।

কৈ আর কোন মামাতো এমন করে সালাম দেন না। এখন মনে হয় সমমান দেওয়াটা তাঁর কাছে শেখা দরকার ছিল।

মা-মামাদের কাছে এঁরা খুব প্রয়োজনীয় ছিলেন। তাঁরাও মা-মামাদের অনুগত ছিলেন। কাজেই উভয় পক্ষেই তাঁরা একে অন্যের সুখ-দুঃখের অপরিহার্য অংশ ছিলেন।

আমার মামার বাড়ী বীরভূম জেলার প্রান্তে। রাজনগর। রাজনগর বিহার সীমান্তে।

বীরভূম অখণ্ড বাংলার প্রান্তে অবস্থিত। রুক্ষ ঊষর আবহাওয়া। বাউরী অধ্যুষিত এলাকা।

এখন অনেক বাউরী বাড়ী-ঘর ছেড়ে জেলা সদর সিউড়ীতে চলে গেছেন। কারণ একটাই--অভাব।

জ্যোতি বসু মুখ্য মন্ত্রী হবার পর অনেক ‘বাউরী’ শিক্ষিত হয়েছেন। জ্যোতি বসু ঢাকার মানুষ।

আমার তিন মামাকে--কেদার, ফুলু আর শ্রীচাঁদ মামাকে আমরা কখনও তুমি বলি নাই। তুমি বলা কঠিনভাবে নিষেধ ছিল। আমার নানা যতদিন বেঁচে ছিলেন ততদিন এঁদের প্রভাব আমার মামাদের সংসারে ছিল অপরিসীম।

আমার শ্রীচাঁদ মামা কিন্তু মধ্য বয়সে অন্য জীবন বেছে নিয়েছিলেন।

বারুদ খানা নামে রাজনগরে একটি মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা আছে। শ্রীচাঁদ মামা সেখানেই বেশী সময় কাটাতেন। শেষের দিকে তিনি পারিবারিক জীবন থেকে বিছিন্ন হয়ে পড়েন। বাড়ীর রান্নাও খেতেন না। নিজের রান্না নিজে করে খেতেন।

তাঁর মৃত্যুর পর সংবাদ পেয়ে বারুদ খানার লোকেরা তাঁর মরদেহ নিয়ে যায়। বলে যায়, সে মুসলমান হয়েছিল। তার জানাজা হবে এবং তাকে কবর দেওয়া হবে। পোড়ানো চলবে না।

এ ব্যাপারে তাঁর আত্মীয়-স্বজন কোন আপত্তি তোলে নাই।



ষষ্ঠ অংশ

কেদার মামা



মাদের শৈশব, কৈশোর এবং যৌবনে যাঁরা মাদের জীবনের অপরিহার্য অংশ ছিলেন তাঁরা আর নাই। কালের করাল গ্রাস তাঁদের গ্রাস করেছে। অভাবগ্রস্ত, দুস্থ, নিপীড়িত, বঞ্চনার শিকার।

তাঁদের যা দেওয়া হয়েছে তার শতগুণ আমরা গ্রহণ করেছি। বিনিময়ে তাঁরা কি বা পেয়েছেন?

মনে আছে একবার আমার মামাত ভাই আর আমাকে আমার কেদার মামা পিঠে খাবার নিমন্ত্রণ করতে এসেছিলেন। সেদিন বিকেলে আমাদের নিয়ে যাবেন তাঁদের বাড়ী।

বড় মামা সানন্দে রাজী হলেন।

সেদিন বিকেলে কেদার মামা আমাদের নিয়ে গেলেন তাঁদের বাড়ী।

দেখলাম একটা আসনের সামনে বিরাট একটা কাঁসার থালার দু’পাশে পুলি পিঠে সাজান আছে। থালার সামনে দু’জনের জন্য পানি খাবার দু’টি গ্লাস ঝক ঝক করছে। দু’পাশে ছোট দু’টি বাটিতে ঝোলা গুড়।

কেদার মামা আমাদের দুই ভাই-বোনকে বারান্দায় নিয়ে গিয়ে ঘটির পানি দিয়ে ভাল করে হাত ধুয়ে দিলেন। তার পর আসনের উপর বসিয়ে পিঠেগুলো কিভাবে গুড়ে ডুবিয়ে খেতে হবে তা দেখিয়ে দিলেন।

খাওয়া হয়ে গেলে এই মামাই আমাদের বাড়ীতে রেখে দিয়ে গেলেন।

বাউরী মামাদের মধ্যে এই মামাই ছিলেন সবচেয়ে অনুরাগী আর বিনয়ী। আমার এই মামা বেশীদিন বাঁচেন নাই। কাল ব্যাধি যক্ষা তাঁকে এই পৃথিবী থেকে সরিয়ে নিয়ে যায়।

মামাকে দুই একবার ফল এনে দিতে দেখেছি সিউড়ী থেকে। কিন্তু তাঁকে বাঁচানোর জন্য কি আর করা গেছে?

ঐ বিরাট অন্তরের বিমুগ্ধ মালিক এই পৃথিবীতে বেশী দিন বাঁচার জন্য আসেন নাই। দারিদ্য তাঁর দেহকে বেশী দিন বাঁচতে দেয় নাই।

ফুলু মামা সব সময় কাজে-কর্মে ব্যস্ত থাকতেন। প্রয়োজনে সব সময় হাজির থাকতেন। এটুকু মনে পড়ে।

মামীরাও প্রায়ই আসতেন। নিজেদের সুখ-দুঃখের গল্প করতেন। সম্ভবত এই ফুলু মামার নাতিই আজ শিক্ষিত হয়েছে। হয়ত আরও অনেকে হচ্ছেন।

বাবার খবর জানি না। বলতে গেলে জানি না কে বাবা। বাড়ীতে মামা, মামী, মা, খালা এরাই সব।

আরও অনেকে আছে নানা সম্পর্কের। বাড়ীতে তারা কেউ কাজ করে। কেউ এমনি আসে।

এদের মায়া মমতা ঘেরা আমাদের জীবন-সংসার। বড় মামা স্কুল মাস্টার। দশটা থেকে চারটা পর্যন্ত বাড়ীতে অনুপস্থিত।

চারটার পরই ডাক শোনা যায়, ‘নিহার, মফুজ, এদের দেখছি না যে। ছেলেরা কোথায়?’

স্কুল ছুটি হয়ে গেছে, বড় মামা বাড়ী এসে গেছেন। মামার উপস্থিতিতে মনে এক রকম আনন্দ শিহরণ।

মাদের দুপুরের তাস বা দাবা খেলা বন্ধ হয়েছে। মামীমা এখন রান্নাঘরে যাবেন খাবারের ব্যবস্থা করতে। আমাদের এখন খেলা ছেড়ে পা ধুয়ে রান্না ঘরে যেতে হবে।

আমাদের পা ধোয়ার বিষয়টি মনে হলে কৌতুক বোধ করি।

খিড়কি দরজার সামনেই পুকুর। কিন্তু সেখানে যাওয়া নিষেধ । তাই রান্না ঘরের বারান্দায় রাখা পানির বালতিতে বদনা ডুবিয়ে পায়ের উপর ঢেলে মনে হত পা ধোয়া হয়েছে।

আমার মামাতো ভাইও ঐভাবে পা ধুত। এ ব্যাপারে কারো নজরদারী ছিল না।

পা ধুয়ে খাবার ঘরে ঢুকতাম। মামীমা মাঝে মাঝে নজর দিতেন। বলতেন ভাল করে পা মুছে এস।

আমাদের বৈকালিক খাবার ছিল মুড়ি, বড় মামার বাজার থেকে আনা শুকনো বালুসাই অথবা কোন তেলেভাজা।



সপ্তম অংশ

মহররম



আমাদের জীবনে চারটি পর্ব ছিল।

ঈদ, বকরীদ, সবেবরাত আর মহররম। সবচেয়ে আনন্দ আর উৎসাহ দেখা যেত মহররমে।

রাজনগর--রাজার নগর। রাজনগরের রাজারা ছিলেন মূলত শিয়া।

মায়ের কাছে শুনেছি এই মোল্লা বংশের কোন এক জনের কাছে তাঁরা সুন্নি মতবাদ গ্রহণ করেন। মহররমের অনুষ্ঠানিকতা আর উদ্দীপনা পুরোদমেই চলত তখনও।

এখন মহররম মাস এসে গেছে। মামাদের বাড়ীর সামনের চওড়া    রাস্তা। রাস্তার ও পাশে আছে খুব বড় ধরনের একটা নিম গাছ। গাছটাকে বেষ্টন করে বেদীর মত করে একটা মাটির ঢিবি। এই নিম গাছের কাছেই তাজিয়া রাখা হয়। এক বছরের অযত্ন, অবহেলায় ঘাস আর আগাছা জন্মেছে।

বেদীটা পরিষকার করা হল। লেপে-মুছে পরিস্কার ঝকঝকে করা হল।

বেলা দশটা এগারটার দিকে বাজনদার এল। এরা গোষ্ঠীগতভাবে বাজনদার ডোম।

ঢাক, চরপটি বা নাকাড়া আর শানাই বাজিয়ে মহররম উৎসবের সূচনা করে কিছুক্ষণ পর এরা চলে গেল।

ঢাকের শব্দ শুনে পাড়ার ছেলে-মেয়েরা এসে জড় হল। আমরাও সেখানে গিয়ে জুটেছি।

নিম গাছের নীচে অনেকখানি জায়গা পরিষকার করে লেপে দেয়া হল। এখানেই নাকি তাজিয়া রাখা হবে।

তারপর দিন তাজিয়া আনা হবে। তাজিয়া আনার আগে রাস্তার দিকে এগিয়ে থাকা গাছের ডালপালাগুলি কেটে ফেলা হল।

তাজিয়া কয়েকটি অংশে বিভক্ত। প্রথম অংশে দুলদুল। মোটা মোটা লম্বা বাঁশের উপর বসান দুলদুল। একটি ঘোড়ার মত দেখতে। সেই ঘোড়ার মুখটা একটা মেয়ের মত। এরকম মেয়ের মতই মুখ বিশিষ্ট দুইটি ঘোড়ার অবস্থান বাঁশের শক্ত মাচার উপর।

তার উপর ঘরের মত চৌকো ঘর একটা বা দুইটা, তার উপর গম্বুজ। রৌদ্র কিরণে এত ঝক ঝক করে যে তাকান যায় না।

এই ধরনের তাজিয়া অন্য কোথাও দেখি নাই, এত বিশাল আর জৌলুশপূর্ণ।

সবচেয়ে উপরে একটি পাত্রে কি যেন ঢাকা থাকত লাল শালুর কাপড় দিয়ে। লোকে বলত ওখানে নাকি কারবালার মাটি থাকে। যা নাকি মোহররমের দশ তারিখে মঞ্জিলে নেওয়া হয়।

এসব গালগল্প হতে পারে। এ সবের হদিশ আমি জানি না।

রাজনগরের রাজা এখনও আছেন। রাজশক্তি নাই। তবু রাজাসাহেব নামে তিনি এখনও অভিহিত হন। তাঁরই পৃষ্ঠপোষকতায় এই তাজিয়া তৈরী হয়।

দশদিন ধরে বাড়ীতে ধোয়া-মোছা আর কি কি সব করা হত জানি না। তবে শেষের তিন দিন বেশ ধুমধাম হত।

এই তাজিয়া বহন করতে সম্ভবত কুড়ি-বাইশ জন পূর্ণ বয়সের পুরুষের দরকার হত। বাউরী, মুসলমান সকলে এই তাজিয়া বহন কাজে থাকতেন।

নয়ই মহররম। আজকে সবচেয়ে আনন্দ, আর ধুমধাম। আজ লাঠি খেলা হবে সারারাত্রি।

খেলোয়াড়রা লাঠি খেলায় তাঁদের পারদর্শিতা দেখাবেন। খেলোয়াড়দের ধর্ম বিচার ছিল না।

বাজনদাররা সবাই বাজিয়ে ডোম। সব দক্ষ বাজিয়ে। চির দরিদ্র। এখন তাদের কতখানি উপরে তোলা হয়েছে জানি না।

তাজিয়া খাস বাজারের নিম তলা থেকে বাজার যাবে আজ। সারা রাত্রি সেখানে লাঠি খেলা হবে, মর্সিয়া গানও হবে মধ্যে মধ্যে।

লোকের পায়ের চাপে পড়ে পিষ্ট হয়ে না যাই সে জন্য আমাদের দু’ ভাই-বোনকে দুই জনের কাঁধে তুলে একবার বাজার নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, লাঠি খেলা দেখতে। মাঝে মাঝে খেলা আর মর্সিয়া গান এই চলছিল। আমাদের মত কয়েকটি শিশুর লাঠি খেলা দেখার জন্য শতরঞ্জি পেতে রাখা হয়েছিল।

মনে হয় না আমরা বেশীক্ষণ লাঠি খেলা দেখেছি। আমরা সবাই কিছুক্ষণ খেলা দেখে শতরঞ্জির উপর ঘুমিয়ে কাটিয়েছি সারা রাত।

লাঠি খেলা দেখার রস আস্বাদন করার বয়স তখনও আমাদের হয় নাই। আর কোন মহররমের লাঠি খেলা দেখতে আমাদের আনা হয়েছিল বলে মনে পড়ে না।

এত বেশী আনুষ্ঠানিকতার জন্য মহররম শোক দিবস না হয়ে উৎসব দিবস বলে গণ্য হত সাধারণ মানুষের কাছে।

যেহেতু রাজারা শিয়া ছিলেন তাই ঐতিহ্যগত কারণে তাঁরা মহররমকে আনুষ্ঠানিকভাবে শোক দিবসের রূপ দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সাধারণ লোকের কাছে মহররম উৎসব দিবস হিসাবে গণ্য হত।

মহিলারা ঈদের সময় নতুন কাপড় না নিয়ে মহররমের সময় নতুন কাপড় প্রত্যাশা করত।

আমাদের তরুণ মা-মামারা আমাদের লাঠিখেলা দেখতে পাঠিয়ে নিজেরা উৎসব সুখ অনুভব করতেন বলে মনে হয়।

মামারাও লাঠি খেলা না দেখে পারতেন না। তাঁরা কোথায় বসতেন জানি না।

লাঠি খেলা দেখতে যাবার এক বছরের স্মৃতিটাই মনে পড়ে।  





অষ্টম অংশ

ফুল বাগানের মেলা



আমাদের জীবনে আর একটি আনন্দ উপভোগের দিন ছিল। সেটা ছিল ফুল বাগানের মেলা।

ফুল বাগানের মেলায় আমরা কোন ফুল দেখি নাই। ধূ ধূ মাঠ। তারই মাঝে ভাঙ্গা-চোরা ইট বিক্ষিপ্তভাবে ছড়ান। এরই মাঝে দেওয়াল দিয়ে ঘেরা একটা সমাধি স্থল। এখানে আমাদের মাঝে মাঝে সালাম করানোর জন্য আনা হত।

শোনা যায় এক রাজার সন্তান রাজকীয় জীবন ছেড়ে এখানে সাধনা করতেন। এখানে ফুল বাগান ছিল। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁকে এখানে সমাহিত করা হয়। প্রত্যেক বছর তাঁর মৃত্যুর মাসটাতে এখানে মেলা বসে। মিলাদ পড়ান হয়। ধর্মীয় আরও কোন অনুষ্ঠান পালন করা হয় কিনা জানি না।

আমাদের দুই ভাই-বোনকে মেলায় পাঠান হত।

মেলায় বিভিন্ন স্থান থেকে দোকান আসত। কাপড়ের, মনোহারী, নানা রকম মিষ্টির দোকান বসত। যাত্রার দলও আসত।

বড় মামা আমাদের দুই ভাই-বোনকে পাঠিয়ে নিজে পরে আসতেন।

কাঁকরময় উঁচু-নীচু আলপথ দিয়ে আমাদের মত শিশুদের হাঁটা সম্ভব ছিল না। শ্রী চাঁদ মামা, ফুলু মামা আর কেদার মামা আমাদের কাঁধে নিয়ে আসতেন। একদিকের কাধে পা ঝুলিয়ে চুল আঁকড়ে ধরে বসে থাকতাম।

আমাদেরকে যাত্রার সামিয়ানার নীচে দু’টি চেয়ারে ভাই-বোনকে বসিয়ে মামারা কোথায় যেতেন বলতে পারি না। হয়ত তাঁরা খাওয়াদাওয়া করতেন বা অন্য কিছু কিনতেন। আসার সময় তাঁদের হাতে কিছু দেওয়া হত হয়তবা।

একবার আমাদের দুই ভাই-বোনকে ওখানকার মিলাদ মাহফিলে বসিয়ে তাঁরা যেন কোথায় গেছেন জানি না।

ঢালাও শতরঞ্জি পাতা। রাজবাড়ীর সরবরাহ করা এসব। রাজার সহযোগিতায় এই মিলাদ সম্পন্ন করা হত। এই মেলাও রাজার পৃষ্ঠপোষকতায় চলত। হয়ত এখনও চলে।

সমবেত লোকগুলো এক সময় বসে বসে কি সব বলছিল বুঝতে পারি নাই। আমার মামাত ভাই আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘হাত তুলছনা যে, হাত তুল।’

ও আমার চেয়ে কিছুটা বড় ছিল। আমি হাত তুলে বললাম, ‘কি বলছে ভাই?’ ভাই কিছুক্ষণ মনোযোগ দিয়ে শুনে বলল, ‘আম আম বলছে বোধ হয়।’ আমরা দু’জন আম আম বলা শুরু করলাম।

কিছুক্ষণ পর আমাদের বাহকরা এসে বললেন, ‘তোমাদের ডাকছেন গো, চল।’

মামা বিভিন্ন দোকান ঘুরে লুচি, মিষ্টি ইত্যাদি কিনলেন। একটা নতুন মাটির হাঁড়ি কিনে তার ভিতর শাল পাতা দিয়ে খাবারগুলি রাখা হল।

কেউ মিষ্টির হাঁড়ি কাঁধে নিল। আমরা বাড়ীর দিকে রওনা দিলাম। বাড়ীর দিকে চলল সবাই। পথ কাঁকরে ভরা। উঁচু-নীচু মাঠের আল পথ। আসার সময় হেঁটেই রওনা দিয়েছিলাম।

বার বার হোঁচট খাচ্ছি। দুই একবার পড়েও গেলাম। আমাদের আবার কাঁধে তুলা হল।

সেদিন রাত্রে ভাত না খেয়ে এগুলিই খাওয়া হল।



নবম অংশ

বাবাকে দেখা



একদিন শুনলাম আমরা কোথায় যেন যাব। মা, ছোট খালামা, আমি। গরুর গাড়িতে যাচ্ছি। গাড়ীটা বাজারের দিকে যাচ্ছে।

মাকে দেখলাম ঘের-টোপ দেওয়া গাড়ীর ভিতর ঘোমটা দিয়ে বসে আছেন। মাকে অন্য রকম মনে হচ্ছিল।

কে জানে কোথায় যাচ্ছি। ছোট খালামাও কথা বলছিলেন না।

শেষে একটা বাড়ীর সামনে গাড়ীটা দাঁড়াল। গাড়ী থেকে সবাই নামল, আমাকেও নামানো হল। বাড়ীর ভিতর গিয়ে দেখা গেল কেউ নাই।

কিছুক্ষণ পর একটা লোক এসে মায়ের সামনে দাঁড়াল।

মা বোধহয় লোকটাকে চেনেন। বললেন, ‘তোমার আব্বা ।’ আমার লোকটাকে নিকট কেউ বলে মনে হল না।

কারণ লোকটা আমাকে আদর করল না বা কথা বলল না।

আমি রাজনগরের নতুন বাড়ী যেটাতে প্রথম পা দিয়েছিলাম সেটা রাজনগর থানার বড় বাবুর কোয়ার্টার।

আমার বয়স তখন বছর ছয়েক হবে। তখনও আমার হাতে খড়ি হয় নাই। খেলা আর খাওয়া ছাড়া আমার কোন কাজ নাই।

সব কিছু নতুন আর বদ্ধ। একদিন সকালে উঠে মুখ ধোবার সময় ছোট খালামা যখন আমাকে মুখ ধুতে সাহায্য  করছিলেন, আমাকে চুপ-চুপি একটা কথা বললেন। বললেন, ‘শোন, তোকে একটা কথা বলি।’



একটা কথার গুরুত্ব আমার কাছে কিছু ছিল না। তাই কিছু জানতে চাইলাম না।

খালামা বিকেলে আবার বললেন, ‘তোর মা গত রাত্রে কাঁদছিল।’

মা কাঁদছিলেন? ব্যাপারটা আমার কাছে খুব অস্বাভাবিক মনে হয়েছিল। মার খেলে মানুষ কাঁদে। তবে মা কাঁদবে কেন?

মা কাঁদতে পারে তাহলে?  যে মায়ের এত প্রভাব সংসারে, পাড়ায় যে মায়ের এত সমমান, সেই মাকে আব্বা বলা লোকটা নিশ্চয় মেরেছে। তা, নইলে কি মা কাঁদত? এই গুরুতর সংবাদটা আজকেই মেজ মামার কাছে পৌছে দিতে হবে। বলে দিতে হবে আব্বা মাকে মেরেছে।

কাউকে কিছু না বলে বাড়ী থেকে বের হয়ে পড়লাম।

থানার সীমানা পার হয়ে বাজারের রাস্তা। বাজারের সীমানা পার হয়ে সোজা পূর্ব দিকে লাল চওড়া রাস্তা চলে গেছে সরকারী হাসপাতালের দিকে। এই হাসপাতালেই তো মেজমামা আসেন। বাজার পেরিয়ে চওড়া রাস্তায় এসে শুরু করলাম ছুটতে।

ছুটতে ছুটতে যখন সাঁকোর (ব্রীজ) কাছে বটগাছটার কাছাকাছি এসে পৌঁছেছি তখন দেখলাম একটা রুক্ষ চেহারার মেয়ে মাথায় তেল নাই, এলোমেলো চুল, পরনে ফ্যানাড়ী (ছোট গামছা ধরনের কাপড়), বগলে একটা ডালি, আমার দিকে এগিয়ে আসার ভঙ্গি করে চেঁচাতে লাগল, ‘ধর, ধর, কল্লাভাজা কর! এই ছেলেটাকে ধর!’

আমার তখন জীবন-মরণ সমস্যা।

বাম পাশে বট গাছটার নীচে কতকগুলো লোক কি যেন রান্না করছিল। ঠিক তারা বোধ হয় আমার মত ছেলেমেয়েদের ধরে ধরে রান্না করে খায়। নিশ্চয় এই মেয়েটা আমাকে ধরার জন্যই এসেছে।

একরকম নিশ্বাস বন্ধ করে দৌড়াচ্ছি। মেয়েটার ধর ধর বলার বিরাম নাই। কিছুদূর এগিয়ে দেখি বড় মামা আর মেজ মামা আসছেন। সংগে সাইকেল। তাঁদের নিকটবর্তী হতেই আমাকে সাইকেলে তুলে নেয়া হল।

আমি যে প্রাণটাকে হাতে নিয়ে তাদের কাছে এসেছি এ বিষয়টাকে তারা গুরুত্বই দিলেন না।

মেয়েটা তখনো কাঠ কুড়োচ্ছিল। আমি আঙ্গুল দেখিয়ে ‘ঐ যে মামা, ঐ যে, ছেলে ধরাদের মেয়ে। ছেলে ধরাদের মেয়ে আমাকে ধরতে এসেছিল।’

‘যথা পূর্বং তথা পরং’ মামারা নিজেরা হাঁটছেন আর গল্প করছেন। সাইকেলটা হাতে ধরা।

বুক ধড়ফড়ানি অনেকটা কমে এসেছে তখন। বট গাছটা পেরিয়ে এসেছি। ভাগ্যিস মামারা ছিলেন!

এরপর আর একটা ঘটনা ঘটে যায় যে জন্যে আমাদের আর রাজনগর থানায় থাকা হয় নাই।

একদিন কাজের মেয়েটা এসে বলল, ‘এমন ঘটনা জন্মে দেখি নি মা। থানা ভর্তি পুলিশ গো!’

ব্যাপারটা পরে বড় হয়ে শুনেছি।

ভারত তখন ভাগ হয় নাই। বৃটিশ রাজত্ব। দেশ মাতৃকাকে বিদেশী শক্তির হাত থেকে উদ্ধার করার জন্য বহু তরুণ জীবন উৎসর্গ করেছিলেন।

‘বন্দে মাতরম’ ছিল তরুণ দেশ প্রেমিকদের স্লোগান।

এই শব্দগুলি বৃটিশ রাজশক্তির কানে বিষ ঢালত। এই মন্ত্রের পোষণকারী আর প্রচারকারী রাজশক্তির দুশমন ছিল।

তরুণ ছেলেরা, বিশেষ করে স্কুল-কলেজের ছেলেরাই ছিল সরকারের          সন্দেহভাজন।

যাঁরা দেশের মানুষের মনে দেশ প্রেমের বীজ বপনের কাজে নিজেদের নিয়োজিত রেখেছিলেন তাঁদের অনেকেই ধরা পড়তেন।

এঁরা বেশীর ভাগ স্কুল-কলেজের পড়ুয়া ছেলে।

‘অভিরামের দ্বীপ চালান মা

ক্ষুদিরামের ফাঁসি।

একবার বিদায় দাও মা ঘুরে আসি।’

উপরের গানটি মাকে গাইতে শুনেছি। থানায় সেদিন আব্বার সংগে ডেটিনিউ বাবুর কি নিয়ে যেন কথা কাটিকাটি হয়। এক পর্যায়ে জুতো তোলাতুলি।

দেশ স্বাধীন করার ব্রতে যে সমস্ত যুবক বা তরুণ নিবেদিত প্রাণ ছিলেন, তাঁদেরকে ধরতে পারলে থানার নজরদারীতে রাখা হত।

সাধারণ লোকেরা তাঁদের নজরবন্দী বাবু বলত। অফিসিয়াল ভাষা ছিল ফবঃবহঁ. সেই ডেটিনু বাবুর সংগে আব্বার কি রকম একটা নাটক ঘটেছিল। আব্বা হেড কোয়ার্টরে রিপোর্ট করে ফেলেন।

তার পরিপ্রেক্ষিতে কয়েক ভ্যান পুলিশ পাঠানো হয়। তাঁকে হয়ত অন্য কোন রকম নজরদারীতে রাখা হবে।

বাক-বিতণ্ডা হতেও পারে। মানুষে মানুষে পথ ও মতের পার্থক্য থাকতেও পারে।

বিতর্কে গেলে কেউ বলতে পারেন একজন ছিলেন মুক্তির সাধক। দেশের মুক্তি, জনগণের মুক্তি, দাসত্ব থেকে মুক্তি মন্ত্রে দীক্ষিত। অন্যজন ছিলেন বিদেশী শক্তির শাসন যন্ত্রটাকে শক্ত খুঁটিতে আটকানোর মন্ত্রে দীক্ষিত ও নিবেদিত প্রাণ। অনুগৃহীত দাসত্বের শৃঙ্খলে শৃঙ্খলাবদ্ধ। তবে ব্যাপারটা কারো চোখেই ভাল ঠেকে নাই। ডেটিনিউ বাবুর অভিভাবককে ডাকা হয় তাঁর পরিবারকে নিয়ে যাবার জন্য। পুলিশ ভ্যানগুলি ডেটিনিউ (ফবঃবহঁ) বাবুকে ঘেরাও করে নিয়ে যায় সিউড়ী সদরে কড়া ডিটেনশনে রাখার জন্য। আব্বাকে সংগে সংগে বদলী করা হয়। আব্বা অন্য থানায় বদলী হন। আব্বা চলে গেলেন। আব্বা যে দূরের মানুষ ছিলেন, সেই দূরেই থাকলেন।

আমরা আবার আমাদের পরিচিত পরিবেশ খাস বাজারে ফিরে এলাম। মামার বাড়ীতে।

খালামা কয়েকদিন কোয়ার্টারে থেকে আগেই চলে এসেছিলেন। এখানে আসার কয়েক দিন পর আমার একটি ভাই হল।



দশম অংশ

স্কুল



সেই মুক্ত আকাশ। খিড়কী দরজার সেই টলটলে পানির পুকুর। দুপুরের রৌদ্রে পুকুরের জলে সেই রৌদ্র-ছায়ার খেলা। আম বাগান পেরিয়ে উঁচু টিলার উপর ক্ষুদ্র পাহাড়ের সংস্করণে কাল কাল পাথরের সারি। পাথুরে টিলার নীচে বিস্তীর্ণ মাঠ। টিলার গা ঘেঁষে লাল রাস্তা অসীমের দিকে যাত্রা করেছে। দু’দিকে বিস্তীর্ণ জনহীন ভূমি ।

বেলা শেষে যখন রাখালরা ‘তাইরে নাইরে নাইরে না’ গান গাইতে গাইতে বাড়ী মুখো ফিরে আসে তখন আকাশের সীমাহীনতার মাঝে সে গানের সুর সঞ্চারিত হয়ে দূর বনভূমিকে যেন আকুল করে তুলে।

সেই সুরে বৈরাগ্য না আনন্দ কি থাকত কে জানে। ফাল্গুন-চৈত্র  মাসে ঝরা আমের পাতায় লেগে থাকা মধুর সংগে আমের মুকুলও আটকে থাকত। সকালে খালি পায়ে বাগানের দিকে গেলে পায়ের তলায় মধু লাগা পাতাগুলি আটকে যেত।

বাড়ী আসার পর মা-মামারা আমাদের স্কুলে পাঠাবার বিষয়গুলি নিয়ে আলোচনা করতে লাগলেন।

আমাকে আর আমার মামাতো ভাইকে স্বরবর্ণ আর ধারাপাত কিনে দেওয়া হল। দুই বেলা অ আ ক খ চলতে লাগল। ধারাপাতের একে চন্দ্র, দুই-এ পক্ষ, তিন-এ নেত্র, চার-এ বেদ ইত্যাদি।

এইভাবে বর্ণ পরিচয়ের ঘ+ট=ঘট, প+ট=পট, ক+র=কর, খ+র=খর। ধারাপাত একশ’  পর্যন্ত।

এখন আমাদের স্কুলে যেতে হবে। কিন্তু এত ছোট ছেলে-মেয়েদের স্কুলে দেওয়া যায় না। তাই সালেহা নামে একটি মেয়েকে আমাদের স্কুলে ভর্তি করে দেওয়া হল।

আমরা তাকে বুবু বলতাম। আমাদের দায়িত্ব কিছুটা সালেহা বুবুর উপর বর্তাল। যাতে আমরা একা একা কোথাও না যাই। অথবা কোন বিপদ না হয়।

স্কুলে দুপুরে টিফিন হত, টিফিনের ছুটি হত। আমি আমার মামাতো ভাই আর সালেহা বুবু এক সংগে স্কুলে যাই আসি।

আমাদের স্কুলের বারান্দাটা বেশ লম্বা-চওড়া। আমরা এই বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতাম। আর সব ছেলেরা কোথায় যেত জানি না।

যতদূর মনে পড়ে আমাদের বয়সী কোন মেয়ে ঐ স্কুলে পড়ত না। আমার বয়সী কোন মেয়েকে তখন ঐ স্কুলে দেখি নাই।

সালেহা বুবু আমাদের চেয়ে বেশ বড়ই।

টিফিনের সময় আমরা বাইরে এসে বারান্দায় দাঁড়াতাম।

সালেহা বুবু আমাদের পাহারা দিতেন যেন বারান্দা থেকে কোথাও না নেমে যাই।

একটা দৃশ্য আমার কাছে খুব আকর্ষণীয় আর লোভনীয় মনে হত। একটা সাঁওতাল ছেলে প্রত্যেক দিন দুপুরে টিফিনের সময় হাটের শেষ সীমা আর স্কুল গ্রাউন্ডের উত্তর ধারে একটা বাঁশ ঝাড় ছিল, ঐখানে বসে শাল পাতার ঠোঙ্গায় মুড়ি আর হয়ত তেলে ভাজাও কিছু খেত।

দৃশ্যটা আমার মনে একটা মোহের সৃষ্টি করেছিল। বাঁশ ঝাড়টা খুব ঘন ছিল না। অর্ধেক রোদ আর অর্ধেক ছায়া ঘেরা অপরিসর একটা জায়গা। সেখানে বসে প্রতিদিন কি খেত সে?

আমার মনে তার এই দীন আহারের প্রতি একটা মোহের সৃষ্টি হয়েছিল। আহা! আমিও যদি ঐ রকম করে মুড়ি খেতে পারতাম! ঠিক ঐ বাঁশ ঝাড়ের নীচে।

স্কুলের শেষ প্রান্তের দিকে, বারান্দার ঠিক নীচেই একটা পাকা ইঁদারা ছিল। ইঁদারার দু’পাশে দু’টো থাম ছিল উঁচু। ওখানে বসানো ছিল হাঁসকল। হাঁসকলের ভিতর দড়ি দিয়ে পানি তোলা হত। টিফিনের সময় অনেক ছেলেই সেখানে পানি খেতে যেত। দপ্তরীরা পানি আনতে যেত। মনে মনে ঐ ইঁদারার কাছে যাবার একটা বাসনা ছিল আমার। মফুজ ভাই নাই। সালেহা বুবুকেও দেখছি না কাছে-পিঠে। এটাই সুযোগ। ইঁদারার পাড়ে গিয়ে বালতিটা ইঁদারার ভিতর নামিয়ে দিলাম। আশা আমিও ওদের মত পানি তুলব। বালতিটা তোলার সময় কেমন ঘড় ঘড় শব্দ হয়। যেমন ওরা যখন পানি তোলে তেমনি করে।

বালতি নামিয়ে দিয়েছি ঠিকই। বালতিতে পানি ভরেছে সেটাও ঠিক। কিন্তু, আমিও যে বালতির সংগে উপরে উঠে যাচ্ছি। শক্ত করে দড়ি ধরে থাকলাম। পানি ভরা বালতি কিন্তু আমাকে হাঁসকলের গোড়া পর্যন্ত নিয়ে এসেছে।

আমার কথা বন্ধ। ইতোমধ্যে সালেহাবুবু আমাকে এ অবস্থায় দেখতে পেয়ে দৌড়ে এসেছেন।

বার বার বলতে লাগলেন, ‘দড়ি ধরে থাক, দড়ি ছেড়ো না। দড়ি ছাড়লে কুয়োতে পড়ে যাবে।’ আমার আত্মা খাঁচা ছাড়া হবার মত অবস্থা। সালেহা বুবু না থাকলে একটা বিপর্যয় হতে পারত। সালেহা বুবুই আমাকে উদ্ধার করেন।

এরপর স্কুল জীবনে কোন দিন ইঁদারার পাড়ে যাই নাই।



একাদশ অংশ

রাইবেঁশে নাচ



রাজনগর স্কুলে রাইবেঁশে নাচ হত। রাইবেঁশে নাচ ও এই নাচের উদ্যোক্তা সম্বন্ধে কিছু না বললে ঐ স্কুল সম্বন্ধে বলা অসম্পূর্ণ রয়ে যায়।

ঐ স্কুলে রাইবেঁশে নাচের  চর্চা করা হত। রাইবেঁশে নাচ আসলে বীরভূম জেলার রাজনগরের আদি অধিবাসীদের মধ্যে একটি প্রচলিত নাচ। এরা নিজেদের ‘বাউরী’ বলত।

এই বাউরীদের পরিচয় অগেই কিছুটা দেওয়া হয়েছে। রাইবেঁশে নাচ তাদের একটা উৎসবের নাচ। ‘দাদার বিয়ে যেমন তেমন আমার বিয়েয় রাইবেঁশে, আয়রে তোরা মদ খে সে (খা এসে)।’

ওরা রাইবেঁশে নাচকে খুব মর্যাদার নাচ মনে করত।

গুরুসদয় দত্ত যখন বীরভূম জেলার ম্যাজিস্ট্রেট তখন তিনি একবার স্কুল পরিদর্শনে আসেন। স্কুল কর্তৃপক্ষ বাউরী যুবকদের ডেকে রাইবেঁশে নাচের ব্যবস্থা করেন। এই নাচ দেখিয়ে ম্যাজিস্ট্রেটকে আপ্যায়ন করা হয়। ম্যাজিস্ট্রেট গুরু সদয় দত্ত এতখানি মুগ্ধ হন যে এই নাচ স্কুলে অবশ্য করণীয় হওয়া উচিত বলে মনে করেন। এই নাচের অনুশীলনে আনন্দ ও দেহ চর্চা দুইই সম্পাদিত হয়।

কাজেই তিনি স্কুলে এই নাচের তাগিদ দিয়ে যান।

ফলে এই নাচ স্কুল পর্যায়ে প্রচলিত হয়। ছেলেদের জন্য এই নাচ বেশ আনন্দের ছিল। মফুজ (মহফুজ) ভাই লাইনে দাঁড়ালেও নাচে যোগ দিত না। আমি অন্য ছেলেদের পায়ের দিকে তাকিয়ে পা তুলতাম।

একদিন মফুজ ভাই ভাত খাবার সময় মামীমাকে বলে দিল, ‘মা-মা নিহার ছেলেদের সংগে রাইবেঁশে নাচে।’

আমি রাইবেঁশে নাচি মনে করে লজ্জা পেলাম। লাইনে দাঁড়ালেও আর কোন দিন রাইবেঁশে নাচে যোগ দিই নাই।

রাইবেঁশে ছিল বাংলার প্রাচীন রণ-নৃত্য। সৈন্যরা যে ভল্ল নিয়ে যুদ্ধ করত তার বাঁট তৈরী হত রায় বাঁশ অর্থাৎ শ্রেষ্ঠ নিরেট বাঁশ দিয়ে। রায় বাঁশধারী যোদ্ধারাই রাইবেঁশে। যুদ্ধোন্মত্ত সেই বীরদের নৃত্যকেই রাইবেঁশে নাচ নামে অভিহিত করা হয়েছে। রাইবেঁশেরা ছিল প্রাচীন বাংলার রাজা ও জমিদারদের আশ্রিত সৈন্য। এই প্রাচীন রাইবেঁশে সৈন্যরা বিবাহ বা অন্য কোন উৎসবাদিতে নৃত্য দেখাত। তবে পূর্বের গৌরব আর তারা পায় নাই।

‘গুরু সদয় দত্ত ছিলেন জ্ঞান, সত্য, দেশ প্রেম, মাতৃভাষা প্রীতি, বাঙ্গালী জাতীয়তার একনিষ্ঠ অনুসারী। শিষ্টাচার ছিল তাঁর শিরার শোণিত। যা কিছু সুন্দর তাই তিনি অনুসরণ করে গেছেন। তিনি মনে প্রাণে একজন বাঙ্গালী ছিলেন।’

তাঁর লিখিত কবিতার মাত্র দু’টি লাইন তুলে দেওয়া হল,

‘ বিশ্ব মানব হবি যদি

শাশ্বত বাঙ্গালী হ।’

সৈকত আসগরের লিখিত ‘গুরুসদয় দত্ত’ হতে গুরু সদয় দত্তের মূল্যায়নের মাত্র কয়েকটি কথা তুলে নেয়া হল।



দ্বাদশ অংশ

আমার রোগ-ব্যাধি



মায়ের কাছে শুনেছিলাম, আমি জন্মেছিলাম রুগ্ন হয়েই। বাড়ীতে কিছু গুরুপাক বা ভাল রান্না হলে মায়ের তা খাওয়া চলত না। এ ধরনের কোন খাবার খেলেই আমার পেটের অসুখ হত। কাজেই দুগ্ধ পোষ্য যতদিন ছিলাম ততদিন মাকে বাছ-বিচার করে খেতে হত।

কিছুটা বড় হবার পরও ঘুম থেকে উঠে দেখতাম চোখ জুড়ে আছে। এদিকে কান দিয়েও পুঁজ গড়াচ্ছে।

বেলা করে উঠেও বিছানায় বসে ভ্যা ভ্যা করে কাঁদতাম। মা মেজ খালামাকে গরম পানিসহ পাঠিয়ে দিতেন চোখ পরিষকার করার জন্য।

এরপর হত ম্যালেরিয়া জ্বর। এই জ্বরের হাত থেকে বহুদিন রেহাই পাই নাই। বর্ষাকালে শুরু হয়ে চলত শীত কাল পর্যন্ত। যদিও এক নাগাড়ে থাকত না, তবু কয়েক দিন বিরতির পর আবার শয্যা নিতে হত।

ঘরের মধ্যে জ্বরে হাঁপাতে থাকি কাঁথা ঢাকা দিয়ে। কারো ঘরে আসার শব্দ শুনতে পেলে মনে হত জ্বরের কষ্ট অনেক কমে গেল। কারো কণ্ঠস্বর শুনতে পেলেও মনে হত এর মত আরাম আর কিছুই নাই। সবাই কাজে ব্যস্ত। কখন জ্বরের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়তাম  সংবাদ পেয়ে মেজ মামা আসতেন। তিনি সরকারী হাসপাতালের ডাক্তার ছিলেন।

একদিন সন্ধ্যার দিকে জ্ঞান হলে দেখতে পেলাম মেজ মামা এসেছেন। আমার মাথায় পানি দেওয়া হচ্ছে। আমাকে বসিয়ে দেওয়া হলো। মুখের কাছে দেওয়া হল বার্লি। এই বার্লি খাওয়া আমার কাছে খুব কষ্টকর ছিল। এই বার্লি খেলে বমি হয়ে যেত।

মেজ মামা বললেন, ‘যা খেতে চায় তাই দাও।’ দীর্ঘ দিন জ্বরে ভুগলাম।

দুধের সংগে খৈ দেওয়া হল।

দিন তিনেক আগে জ্বর ছেড়েছে। আজ ভাত খেতে পারব।

এই জ্বর থেকে মুক্ত হওয়া জীবন কি যে আনন্দের ছিল! এক অব্যক্ত আনন্দ আমার শৈশব জীবনকে মোহময় করে রেখেছে।

আজ ভাত খেলাম। জ্বর নাই, তাহলে?

কতদিন জ্বরে শুয়ে আছি কে জানে!

বিকেলের দিকে একটা ছোট খাটিয়া বারান্দার ধারে পেতে দেওয়া হল। ঐত সুনীল আকাশটা। মেঘগুলো কেমন করে ভেসে বেড়াচ্ছে! মেঘগুলো শুধুইতো মেঘ নয়। কেউ মানুষের মত, কেউ গরুর, কেউবা হাতির মত। নানা আকারের মেঘ আকাশে ভাসছে।

মামাতো ভাই কোত্থেকে এস জুটলো কে জানে। আমি তাকে দেখে উৎসাহের সংগে বললাম, ‘ঐ যে আকাশের মেঘগুলো কেমন মানুষের মত, গরুর মত, কুমীরের মত।’

ও তখন বলা শুরু করল, ‘আমিই তো আগে দেখেছি। ঐ যে গরুর মত, কুমীরের মত মেঘগুলো। ওগুলো আমার।’

আমার অসুস্থ শরীর। তবু জেদের সংগে বললাম, ‘ওগুলোত আমার। আমি আগেই দেখেছি।’ ইতোমধ্যে মেঘগুলো ভাসতে ভাসতে অন্যরূপ ধারণ করেছে। মেঘগুলো তাদের রূপ বদলাচ্ছে। বদলেছে।

মামীমা রান্নাঘরের বারান্দায় পাথুরে কয়লার চুলোয় রান্না করছেন। বললেন, ‘কি হল? কি নিয়ে তোমাদের ঝগড়া?’ মুখে তাঁর হাসি। জীবন কখনও একইভাবে একইরূপে থাকে না কেন?

জ্বর থেকে মুক্তি পেয়ে আমার কত কাজ। পেয়ারা গাছটাকে পানি দিতে হবে যে! খিড়কী দরজার পাশে একটা বড় পাথরের ধারে পেয়ারা গাছটা। কতদিন পানি না পেয়ে গাছটা বিবর্ণ হয়ে গেছে।

সামনেই পুকুরটা। কিন্তু মা-রা যে ওখানে বসে তাস খেলছেন।

চোর কুঠরীতে ছোট কলসীটা অছে। ওদিকে গেলেই আমাকে দেখতে পাবেন।

না আজকে আর হবে না। বালতি থেকে এক বদনা পানি নিয়ে পেয়ারা গাছের নীচে ঢেলে দিয়ে এলাম।



ত্রয়োদশ অংশ

ছোট মামা



ছোট মামা সিউড়ী থেকে এসেছেন। একদিন সকালে খাবার পর বললেন, ‘তোমাদের নিয়ে আজ বাজারে বেড়াতে যাব।’

আমরা ভাই-বোন প্রস্তুত হয়ে এলাম। ছোটমামা দুই হাতের তর্জনী আঙ্গুল বের করে বললেন, ‘ধর।’ আমরা দুই ভাই-বোন দুই দিকের দুইটি আঙ্গুল ধরে বাজারের দিকে রওনা দিলাম।

মামা আমাদের নিয়ে এক দোকানের বারান্দায় বসে, তাঁর কোন সহপাঠী হবেন হয়ত, নানা রকম গল্প জুড়ে দিলেন।

তার মধ্যে আমাদের বিদ্যা-বুদ্ধির নানা দিক। ‘বলতো মা বুড়ী, বলত পানির ইংরাজী কি? কুকুরের ইংরাজী কি? বিড়ালের ইংরাজী কি? বলতো তোমার নাম কি?’

দুই ভাই-বোনকেই এই ধরনের প্রশ্ন করছিলেন। সেগুলোর উত্তর আগেই শেখান হয়েছিল।

বাজার, হাট, থানা, স্কুল সব কাছাকাছি। রাস্তার ও পাশেই হাটটা। ওরই পাশেই ত বাঁশঝাড়টা। সাঁওতাল ছেলেটাকে হাটের ধারে যে বাঁশঝাড়ের নীচে রৌদ্র-ছায়ায় বসে মুড়ি খেতে দেখেছিলাম।

আমার ভাই মফুজ ছোট মামার কাছে বসে দুই বন্ধুর কথা শুনছিল। কি শুনছিল বা বুঝছিল কে জানে।

আমার মনে সাঁওতাল ছেলের মুড়ি খাওয়ার রোমাঞ্চ। যদিও সে রোমাঞ্চ অত গাঢ় নাই।

তবে সে দিনের বাসনা মন থেকে একেবারে মুছে যায় নাই। ছোট মামার দৃষ্টি এড়িয়ে একটা কিছু নিয়ে বাঁশঝাড়ের কাছে এসে পড়লাম। স্কুলের বারান্দা থেকে এদিকে তাকিয়ে থেকে যা অপূর্ব মনে হচ্ছিল সে রকম মনে হল না।

বেউড়বাঁশের কেটে নেওয়া গোড়ার অংশ গোঁজের মত সোজা হয়ে বেরিয়ে আছে, তা ছাড়া কড়া রোদ।

ছেলেটা কোথায় বসেছিল ভাবছি। এমন সময় দেখছি, ছোট মামা আসছেন। ছোট মামা বকতে লাগলেন, ‘খুঁজে খুঁজে হয়রান। এখানে কি করছিস? বাঁশঝাড়ের ভিতর থেকে বেরিয়ে আয়।’

বাড়ীতে এসে সম্ভবত মাকে কিছু বলেন নাই। বললে কপালে দুঃখ ছিল।



চতুর্দশ অংশ

মায়ের অসুখ



এরপর মায়ের একটা সাংঘাতিক অসুখ হল। আব্বাকে সংবাদ জানান হয়েছিল বোধ হয়।

আব্বা তখন সিউড়ীতে আছেন। মায়ের অসুখের সংবাদ পেয়ে কালীগতি বানার্জী নামে একজন নাম করা ডাক্তারকে সিউড়ী থেকে নিয়ে এলেন।

ডাক্তার বললেন, এ রোগের নাম ‘পাইমিয়া’। মায়ের সমস্ত শরীরে ফোড়া।

ফোড়া অপারেশনের ব্যবস্থা করে আর প্রেশক্রিপশন করে ডাক্তার বাবু চলে গেলেন।

সমস্ত শরীর জুড়ে অজস্র ফোড়া। এগুলি অপারেশনের পর প্রত্যেক দিন ওয়াশ করে নতুন করে ব্যান্ডেজ হত।  

কিছুটা সুস্থ হবার পর আব্বা মাকে কাছে নিতে চাইলেন। অসুস্থ শরীরে অন্য কোথাও যাওয়া সম্ভব নয়। এটাই ছিল বড় মামার যুক্তি।

আব্বা কথা দিলেন, মায়ের উপযুক্ত যত্ন হবে এবং মায়ের সেবার জন্য আলাদা লোক নিয়োগ করা হবে।

আব্বা তখন সিউড়ীতে অবস্থান করছেন। মাকে সিউড়ী আনা হল। আমরা তখন দুই ভাই-বোন।

এখানে এসেই আব্বা মায়ের সেবা করার জন্য একটা মেয়ে পেলেন। নাম ইমামন। স্বামী নাই, সন্তান নাই। মানুষের বাসায় কাজ করে। একটা রুম ভাড়া করে মানুষের সংগেই থাকে। মাকে সংসারের কাজ করতে হয় নাই।



পঞ্চদশ অংশ

রাজনগর ত্যাগ



এই প্রথম আমরা রাজনগর ত্যাগ করলাম। সিউড়ী এসে দেখলাম বাসায় ছোট মা আছেন। কিছু হয়েছিল কিনা জানি না। কয়েকদিনের মধ্যেই ছোট মায়ের ভাই এসে তাঁকে নিয়ে যান।

এখানে খুব একঘেয়ে লাগে। কেউ সংগী নাই। আম বাগান নাই। পুকুর নাই, আকড় আর পলাশের সেই বন নাই।

একদিন দেখলাম কতগুলো পিপড়ে ছুটাছুটি করছে। আম গাছের তলায় আর বারান্দার নীচে--এইটুকু জায়গার মধ্যে তাদের যাতায়াত। ওদের যাতায়াতের পথ তো সুন্দর নয়। ঝুরঝুরে মাটি ওদের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে।

আমি ওদের পথটা সুন্দর করে দিব ভাবলাম।

বিকেলে বসে বসে ওদের মাটি তোলা রাস্তাটা সুন্দর করে দিলাম মাটিগুলো সরিয়ে।

এবার আর ওদের চলাফেরা করার কষ্ট হবে না। ওদের কষ্ট দূর করতে গিয়ে আমাকে কষ্ট পেতে হল ওদের কামড় খেয়ে।

কি পরিতাপের কথা! তার পরদিন ঘুম থেকে উঠে পিপড়ের বাসায় গিয়ে দেখি, পিপড়েরা তাদের যাতায়াতের পথ আগের মতই ঝুর ঝুরে করে ফেলেছে। আমার তৈরী পথ তাদের পছন্দ হয় নাই।

তখন স্যানিটারী প্রথা ছিল না। অন্তত ঐ এলাকায় ছিল না। মেথর শ্রেণীর লোকেরা মল বহন করে নিয়ে যেত।

আমাদের পায়খানাটাও ঐ রকম ছিল।

একদিন লক্ষ্য করলাম পায়খানার দেওয়ালে মাকড়সার জাল।

একটা মাছি উড়তে উড়তে ঐ মাকড়সার জালে আটকে গেল। সংগে সংগে একটা মাকড়সা তীর বেগে এল নাচতে নাচতে। মাছিটাকে জাল দিয়ে আটকানোর সময়ও মাকড়সাটা তার নৃত্যকলা দেখাচ্ছিল।

এরপর আমার পায়খানা যাবার দরকার হলেই মাছি ধরার মহড়া চলত।

একদিন দেখলাম পায়খানা পরিষকার। দেয়ালে মাকড়সার জাল নাই। মাকড়সাও নাই। অতএব এ খেলা শেষ হল।

একদিন মা বেলা তিনটার দিকে বললেন, ‘দোকান থেকে দুই তা কাগজ আন্‌তো। তোর মামাকে চিঠি লিখব।’

রাস্তার ও পাশেই দোকানটা। পয়সা নিয়েই দোকানের দিকে গেলাম।

দোকানে এত গ্রাহক। আমাকে পাত্তাই দিল না। দোকানের বারান্দাও খুব উঁচু।

সব লোক চলে গেলে দোকানদার জিজ্ঞেস করল, ‘কি চাও?’

কাগজ চাইলাম। কাগজ নিয়ে বাসায় এলাম। বাড়ীতে এ সময় কেউ থাকে না। ভাত নিয়ে চলে যায়। আবার চারটার দিকে আসে।

বাড়ী এসে দেখি এলাহী কাণ্ড। আমের পাতা আর আমের মুকুল দিয়ে উঠান ভর্তি।

আব্বার ঘরের দরজা খোলা। যেখানে ঘোড়ার খাবার ছোলা, আমাদের খাবার চাল-তরকারী সব থাকে।

কতকগুলো বাঁদর সংসার সাজিয়ে বারান্দায় বসে আছে। কতকগুলো তরকারী সংগ্রহ করে বসে বসে খাচ্ছে।

একটা বাচ্চা বয়সী বাঁদর আব্বার দাড়ি কামান ছোট আয়নাটা দু’হাতে ধরে তার   রূপমাধুরী দর্শন করতে করতে পেছনের দুপায়ে হেঁটে হেঁটে ঘর থেকে বেরিয়ে আসছে।

একটা বাঁদর ধারির নীচে পা ঝুলিয়ে কি যেন খাচ্ছে।

আমি ভয় পেয়ে মাকে ডাকতে লাগলাম। মা নাই। এমন  সময় সহিসটা ( ঘোড়ার তদারককারী) এল।

মা দরজা খুলে বের হয়ে এলেন। চোখে মুখে আতঙ্ক। জিজ্ঞেস করলেন, ‘বাঁদরগুলো গেছে নাকি?’

সহিস বলল, ওগুলো তাড়ানো হয়েছে। বাঁদরগুলো ছেলেদের আর মেয়েদের ভয় পায় না। বয়স্ক পুরুষ তাড়া দিলে হুপ-হাপ শব্দ করতে করতে পালায়।

বীরভূমের কোন কোন অঞ্চলে এই বাঁদরের খুব উপদ্রব। গায়ের লোম ধূসর। হাত-পা কাল। মুখও কাল।



ষোড়শ অংশ

আব্বার সাঁইথিয়ায় বদলী



একদিন শুনলাম আব্বা যেন কোথায় যাবেন। জায়গাটার নাম সাঁইথিয়া। সিউড়ী থেকে মাত্র দেড় দু’ঘণ্টার পথ।

মা ইমামন বুবুকে সংগে নিতে চাইলেন। ইমামন বুবুও রাজী হয়ে গেলেন।

আজ আমরা যাব। ইমামন বুবু বললেন, ‘মা, আজ আপনি যান। আমার কিছু   দেনা-পাওনা আছে ওগুলো মিটিয়ে আমি কাল যাব।’

মা বললেন, ‘তাই হবে।’

সেদিন বিকেলে আমরা সাঁইথিয়া এসে পৌঁছালাম। এখানে আসার পর পরই দেখা গেল বহু মেয়েছেলে আমাদের দেখতে এসেছে।

তাদের অনেককেই গরীব মনে হচ্ছিল। সন্ধ্যা হয়ে আসছিল।

হয়ত আব্বার মনে হল এই অসময়ে রান্নাবান্না করা, মায়ের কষ্ট হবে। তাই, কেউ কাজ করবে কিনা আব্বা জিজ্ঞেস করলেন।

একটা মেয়ে রাজী হয়ে গেল। সংগে সংগে সে কাজে লেগে গেল।

মায়ের ইমামন বুবুর কথা মনে থাকলেও হয়ত মনে করলেন সে নাও আসতে পারে। কিম্বা এলেও একে বিদায় করা যাবে তখন।

পরদিন সন্ধ্যায় ইমামন বুবু এসে হাজির। দেখলেন, মায়ের কাজের মেয়ে রান্না করছে।

ইমামন বুবুর মনের অবস্থা কেমন হয়েছিল কেউ হয়ত বুঝতে পারে নাই।

ইমামন বুবু বললেন, ‘মা, আপনারা তো কাজের মেয়ে রেখেছেন। আমার আর দরকার কি?’

মা কি বলেছিলেন বলতে পারি না। ইমামন বুবু ঝড়ের বেগে বাড়ী থেকে বেরিয়ে গেলেন অন্ধকারে।

ইমামন বুবু বাড়ী থেকে বেরিয়ে যাবার সংগে সংগে আমি কান্না শুরু করে দিলাম। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছি। মা বললেন, ‘কাঁদতে হবে না। ওকে ডেকে আন।’

আমি পাগলের মত ছুটে বাহিরে গেলাম। চেঁচাতে লাগলাম, ‘ইমামন বুবু, ইমামন বুবু।’

বাহিরে অন্ধকার। একবার এদিকে যাই, একবার ওদিকে যাই। কান্না ভেজা গলায় ডাকি। সে অন্ধকারে মিশে গেছে।

আমি এখনও তার গভীর অন্ধকারে মিলে যাওয়া যন্ত্রণার অনুভূতি ভুলতে পারি না।

প্রকৃত পক্ষে মানুষ চির বিরহী। কোন না কোন রূপে এই বিরহ বেদনার প্রকাশ ঘটে জীবনে।

সবচেয়ে নিকটের জনকেও কোনো না কোনো সময় হারাতে হয়। জীবনে কোন দিন তার আর দেখা পাই নাই।

শুনেছি ইমামন বুবু খুব কষ্ট পেয়ে মারা গেছেন। আত্মীয়-পরিজনহীন, নিঃসঙ্গ, আর নিঃস্ব।

সাঁইথিয়ার বাড়ীঘর খুব ঘন সন্নিবেশিত। আমাদের বাসার সমমুখেই একটা পাঠশালা। অনেক ছেলেমেয়ে।

বিকেল হলেই মেয়েরা লুকোচুরি, এক্কা-দোক্কা খেলে। ছেলেরাও খেলতে আসে।

রাস্তায় গাড়ীর যাতায়াত নাই বললেই চলে। বাড়ীর সামনে স্কুল পর্যায়ের পাঠশালায় অনেক ছেলে-মেয়ে পড়ে। আমাকেও সেখানে পড়তে দেওয়া হল।

ঐ পাঠশালায় দুইটা মাড়োয়ারী ছেলে পড়ত।

আমি কি পড়ছি কোন ক্লাশের বই পড়ছি ইত্যাদি জিজ্ঞাসা করতে একটা ছেলে এল। পরিচয় জেনে বলল, ‘আমরা মাড়োয়ারী। আমরা কখনও গরীব হই না। ভিক্ষাও করি না।’

আমার খারাপ লাগছিল। আমি তো তার কোন পরিচয় জানতে চাই নি।

বাড়ী এসে মাকে বললাম। মা স্বীকার করলেন। বললেন সত্যিই ওরা কখনও গরীব হয় না।

হয়ত তাদের গৌরব বাড়ানোর জন্য একথা বলেছিল। পরবর্তী জীবনে তাদের সম্পর্কে জেনেছি।

এখানে আমার বেশ কয়েকজন বান্ধবী জুটে গেল। সবিতা, মিনি, পুষ্প ও আমি সহ চারজন।

আমি আর সবিতা প্রায় একই বয়সী। মিনি আর পুষ্প ওরা এক বয়সী।

সবিতা প্রস্তাব দিল হাঁড়িকুড়ি দিয়ে রান্নাবান্না খেলবে। সবিতার ঝি (কাজের মেয়ে) হবে পুষ্প। আমার ঝি হবে মিনি।

সবিতা গিন্নি গিন্নি ভাব করে বলল, ‘ঝি ও ঝি, এত দেরী করে এলে কেন? কাজ কখন হবে? থাল-বাসন সব এঁটো পড়ে আছে যে?’

সবিতা আর মিনি পাশের বাসার ডাক্তার বাবুর মেয়ে। মিনি আমার উপর অসন্তুষ্ট হল ও রকম একটা হৃদয়গ্রাহী সম্ভাষণ শুনতে না পেয়ে।

বলল, ‘না ভাই, তোমার সাথে খেলব না। তুমি আমাকে ঝি ঝি বলে ডাকছনা যে!’

সুন্দর একটা কথা বলতে পারতাম। মাথায় না আসায় বললাম, ‘না ভাই, আমরা ঝি ঝি খেলব না।’

ঝি না বলার কারণে খেলাটা প্রথম দিনেই শেষ হয়ে গেল।

সাঁইথিয়ায় আমি যে পাঠশালায় পড়তাম সেই স্কুলের শিক্ষক ছিলেন একজন বিএ পাশ বেকার গ্রাজুয়েট। চাকুরী না পেয়ে তিনি এই পাঠশালাটি খুলে ছিলেন। সেখানে যে  যে মানের যোগ্য তাকে তিনি সেই মানের বই পড়াতেন।



সপ্তদশ অংশ

নলহাটি থানা



সাঁইথিয়ায় আমাদের বেশীদিন থাকা হয় নাই। আব্বা নলহাটি থানায় বদলী হয়ে গেলেন। মাও সংগে গেলেন।

এখানে আমার কোন খেলার সাথী জুটল না। প্রদীপের সলতের মত ন্যাকড়ার একটা সলতে পাকিয়ে মাথার অংশটা আলাদা করে বেঁধে, তার নীচে বাঁধন দেওয়া হল। তার নীচে আড়াআড়িভাবে আর একটা সলতে দিয়ে হাত হল। এর নীচে আর একটা বাঁধন দেওয়া হল। ব্যাস। চমৎকার পুতুল হয়ে গেল। রাজনগরে ছোট খালামা পুতুল বানিয়ে দিতেন। এখন নিজেই পারলাম।

এর মধ্যে একদিন মায়ের সয়া এলেন। রাজনগর থানায় থাকতে সেকেন্ড অফিসারের বৌয়ের সংগে মায়ের ঘনিষ্ঠতা হয়। আলাপ থেকে ঘনিষ্ঠতা।

বড় দারোগার বাসা আর সেকেন্ড অফিসারের বাসার মধ্যে হাত চারেকের ব্যবধান।

দুই বাসার সমান্তরালে দুইটি দরজা। স্বামীদের অনুপস্থিতিতে কথাবার্তা থেকে সই সই ভাব। তারা একে অন্যকে কি বলতেন জানি না।

একদিন কাজের মেয়েটা এসে বলল, ‘আপনার সইয়ের স্বামী এসেছেন গো।’

মা ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। মামাকে (ওখানে কাজের মেয়েকে মামা বলে) বললেন বৈঠকখানায় বসতে দিতে।

খাবার ব্যবস্থা করার পর মামাকে কিছু বলার কথা না বলে আমাকে বললেন, তার সয়াকে (সই-এর স্বামীকে) বলার জন্য কিছু বাক্যাবলী। কারণ মা তার সয়ার সমমুখে যাবেন না।

সে সব বাক্যের মর্মোদ্ধার করা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। মায়ের কাছে ফিরে এলে বললেন, ‘কি বললি?’

আমি গড় গড় করে বলে চললাম, ‘দাদখানি তেল , মুশুরীর বেল’-এর মত করে।

মায়ের চোখ তো চড়ক গাছ। ‘হারে, তোকে আমি এইসব বলতে বলেছি?’

তারপর কয়েকটা চড়-থাপ্পড়। আমি মার খেয়ে ওখান থেকে ভাগলাম কাঁদতে কাঁদতে।

তারপর মা কি বলে পাঠিয়েছিলেন জানি না।

নলহাটি রাজনগরের মত অত ঊষর নয়। এখনকার মাটিও অত কাঁকরপূর্ণ নয়।

আমিতো জন্মাবধি ম্যালেরিয়ার রোগী। মায়ের শরীরও ভাল থাকছিল না।

আমি তৃতীয় শ্রেণীতে উঠলাম। তার পর হয়ত মায়ের ইচ্ছায় আব্বা মাকে মামার বাড়ী পাঠিয়ে দিলেন।

বড় মামা এসে আমাদের রাজনগর নিয়ে গেলেন।

আবার সেই রাজনগর। আমার মনে কিছুটা নতুনের ছোঁয়া লেগেছে। ছোট খালামার বিয়ে হয়ে গেছে। তাই তাঁকে বাড়ীতে দেখলাম না।



অষ্টাদশ অংশ

রাজনগর ফিরে আসা



মামীমা আমাকে দেখে বললেন, ‘ছেলের হালে হাল নাই।’ ওখানে ছেলে-মেয়ে নির্বিশেষে ছেলে বলা হত।

মামাজী খুব ফুর্তি নিয়ে বললেন, ‘থাম, কি ভাবে ছেলের শরীর ঠিক রাখা যায় জানি।’

তার পরদিন মামাজী ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।

কোত্থেকে একটা মোটা খসখসে ধূসর রংয়ের কম্বল বের করলেন।

উঠানটা ভাল করে লেপে পরিষকার করা হল।

তারপর বিকেলের দিকে আমাদের দুই ভাই-বোনের হাত পা ভাল করে ডলাই-মলাই করা হল।

কম্বলটা উঠানে পেতে কম্বলের দুপ্রান্তে আমাদের দু’জনকে দাঁড় করান হল। ‘তোমরা এখন কুস্তি লড়বে। তোমরা দুজনে-দুজনকে পটকে ফেলার চেষ্টা করবে।’

‘এখন দু’হাত দিয়ে বুকটা জড়িয়ে ধর। তারপর একহাত দিয়ে একজন অন্যজনকে যুদ্ধের জন্য ডাক দিয়েই কম্বলের মাঝ খানে এসে লড়াই কর। যার জোর বেশী সে জিতে যাবে। যে পড়ে যাবে সে হেরে গেল।’

হার জিতের খেলায় ছোটদেরও বেশ উৎসাহ থাকে।

আমরা একহাত বুকে রেখে অন্য হাত দিয়ে যুদ্ধের ডাক দিয়ে কম্বলের মাঝখানে ছুটে এলাম। ছুটে এসেই একে অন্যকে পটকে ফেলার চেষ্টা। এটাই যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা।

মামাজীর ধারণা শক্তি বৃদ্ধির উপায়।

রেডি বলার সংগে সংগে আমি আর মফুজ ভাই ছুটে এসে একে অন্যকে জড়িয়ে ধরলাম। যে যাকে পারি পটকে ফেলব। কিন্তু হায়! একমিনিটও লাগল না মফুজ ভাইয়ের আমাকে পটকে ফেলতে।

মামীমা বারান্দায় রান্না করতে করতে হাসছিলেন। দুই চারবার চেষ্টা করার পর একই পরিণতি হওয়ায়, ‘আজ থাক,’ বলে মামাজী সেদিনকার মত বিরতি দিলেন।

আরও কয়েকদিন চেষ্টা করার পর মামাজী হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন।

আমাকে শক্তিশালী বানানো আর হল না। মামীমা ব্যাপারটা নিয়ে মামাজীকে বেশ ক্ষেপিয়ে ছিলেন কিছু দিন।

একদিন মেজ মামা এলেন। আমাকে তাঁর কোয়ার্টারে নিয়ে যাবেন।

ঢালু জায়গায় এসে সাইলেটার গতি বেশ বেড়ে গেল। সাইকেলটা বেশ বেগে চলছে। মনে হচ্ছিল সামনে সরু কাঁকরপূর্ণ মাটিটা ছিটকে ছিটকে সরে যাচ্ছে দু’পাশে।

মেজ মামা বললেন, ‘আমরা রাক্ষস! রাক্ষসের মত উড়ে যাচ্ছি।’

আমার মনে হল আমি এতদিন কোথায় ছিলাম। স্নেহের এই স্বতন্ত্র রূপ!

তাইতো! সাইকেলটা যেন উড়ে চলেছে। কোয়ার্টারে গিয়ে দেখি খালামা অপূর্ব শ্রী ধারণ করে বসে আছেন।

মেজ মামা জিজ্ঞেস করলেন, ‘বলত মা মনি, আমি তোমার কে?

আমি আহ্লাদে গলায় বললাম, ‘ মেজ মামা।’ মেজ মামা হেসে উঠলেন। বললেন, ‘নাগো, আমি তোমার ছোট খালু।

‘ছোট খালু?’ ভালই তো! এই ছোট খালু আর ছোট খালামার স্নেহ-মায়া সারাজীবন পেয়ে এসেছি।

এই খালুজী এখন আর নাই।

আব্বার কাছে কিছুদিন অবস্থানের পর আমার মা নিজ পিত্রালয়ে ফিরে আসতেন। এ রকমই চলছিল।

এখন আব্বা মাকে নিজ জেলা রংপুর নিয়ে যাবার চিন্তা করলেন।

মায়ের ডবল সেট অলঙ্কার তৈরী করা হল। মায়ের মনের অবস্থা জানি না। তবে বড় মামা আমাকে নিয়ে দরবেশ-ওলিদের মাজারে সালাম করার জন্য নিয়ে যেতে লাগলেন।

হয়ত আমার মঙ্গল প্রার্থনা, যাতে তাঁর স্নেহ-পুত্তলী ভাগ্নির কোন অমঙ্গল ওখানে না ঘটে।

এ ছাড়া তাঁর আর কি কামনা ছিল? আর কি কামনাই বা হতে পারত?



উনবিংশ অংশ

পৈত্রিক বাড়ীতে আসা



রংপুর নিজ জেলা। আব্বা তাঁর গ্রামের বাড়ীতে নিয়ে এলেন আমাদের।

বাড়ীতে চাচীমা আছেন। বড় চাচার স্ত্রী। চাচা তখন জীবিত ছিলেন না আব্বা চাচীকে যথেষ্ট শ্রদ্ধা করতেন। মায়ের বিপদ হল। এখানে কাজের লোক পাওয়া যায় না। যত দরিদ্রই হোক কেউ কারো বাড়ীতে কাজ করতে চাইত না।

আরো বিপদ, কাঠের চুলোতে মা রান্না করবেন  না। লালমনিরহাট থেকে পাথুরে কয়লা এনে রান্নার ব্যবস্থা করা হলো।

ভাত খাওয়াতেও অসুবিধা। আউশ ধানের এত মোটা চালের ভাত মা খাবেন না। মায়ের জন্য আমনের সরু চালের ব্যবস্থা করা হল।

সব জায়গায় দারিদ্র্য আছে। প্রচুর লাভের বিনিময়ে মা কাজের মেয়েও পেয়ে গেলেন।

একটা ছেলে পড়ছে। ছেলেটা পড়বে আর খাবে। এর বিনিময়ে তার মাও খাবে আর ঠিকে ঝিয়ের কাজ করবে। সেও খাবে।

একটা ভাল দিক মা ওদের রান্না পছন্দ করতেন না। তাঁর রান্না করায় আপত্তি নাই।

আর একটা সমস্যা। মা ওদের সব কথা বুঝতে পারতেন না।

আব্বা লোকজন সব কিছুর ব্যবস্থা করে তাঁর কর্ম ক্ষেত্রে চলে গেলেন। বাকি দায়িত্ব চাচীমার।

আমার কথা বললে বলব, আমি অখুশী হই নি। ভালবাসা দিয়ে সবাইকে জয় করা যায়।

আমাকে দেখে আত্বীয়-স্বজন বলত ‘হামার ছাওয়া এৎদিনে নিজের দ্যাশোত আসছে।’ ব্যাস! আর কি চাইব আমি? আর কি চাওয়ার থাকতে পারে?

মনে করতাম, সত্যিই তো, এটা আমার পিতৃভূমি। এটাই আমার দেশ। ভালবাসা তো ভালবাসাই। সে ভালবাসার প্রকাশ যে ভাবেই হোক না?

মা আমাকে নির্জনে  পেলে খোঁচাতেন। তাঁর চোখে এ দেশের সবই মন্দ। ‘ তোর দেশ অমুক তমুক।’

‘অমুক তমুকে’র স্বরূপ বুঝি নাই।

উচ্চারণগত পার্থক্য অবশ্যই ছিল। তাই বলে সেটা দূরত্ব সৃষ্টির মত এমন কিছু ছিল না।

চাচীমা আমাকে কাছে টেনে নিলেন।

অসময়ে খেতে বসে ভাত মাখিয়ে ভাতের একটা লাড্ডু আমার হাতে তুলে দিয়ে বলতেন ‘খা’।

এখানকার একটা খাবার আমার কাছে অপছন্দের ছিল। সেটা মাছের শুটকি। এই জিনিসটির প্রতি অনীহা এখনও আমার রয়ে গেছে।

মা কিন্তু শুটকি রান্নার নিয়ম-পদ্ধতি শিখে নিজের বাপের বাড়ী গিয়ে মামীমা-খালাদের সংগে মজলিস করে খেয়েছিলেন।

তাঁদের কাছে এই খাবারটি উপাদেয় মনে হয়েছিল।



বিংশ অংশ

মহীপুরের জমিদার বাড়ী যাওয়া



এখানে আসার কিছুদিন পর আব্বার বড় দুলাভাই , মহীপুরের জমিদার একজন বরকন্দাজ আর বাঁদী পাঠিয়ে দিলেন। বাঁদী শব্দটা আমার কাছে অপরিচিত ছিল।

মনে হয় ঐ অঞ্চলে তখনও মানুষ কেনা-বেচা চলত। তবে কোন পুরুষ কেনা যেত নাকি জানতে পারি নাই।

গোসল, খাওয়া, পরা সব কিছুতেই বাঁদীরা ফেউয়ের মত লেগে থাকত। কারো স্বাধীন সত্তা নাই।

বড় ফুপুর এক ছেলে আর দুই মেয়ে। বড় ছেলেটি আইসিএস পরীক্ষায় পাশ করেছিল। কিন্তু, পাশের সংবাদটি শোনার সৌভাগ্য তার হয় নাই। পাশের সংবাদ আসার আগেই সে মারা যায়।

বড় মেয়ের বিয়ে ‘পাগলা’র জমিদারের সংগে হয়েছিল। ছোট মেয়ের বিয়ে দিয়ে ভেবেছিলেন ছেলেকে ঘর জামাই হিসাবে রাখবেন। সে ঘর জামাই হিসাবে থাকে নাই। জমিদার বাড়ীর সব কিছুই এলাহী কাণ্ড। আমার ফুপাতো বোনের বাচ্চা হবার সময় এক বাঁদীকে আঁতুড় ঘরে রাখা হত। সেই হবে নতুন বাচ্চার পালক মা। তার হাতেই সন্তান লালন-পালনের ভরে থাকবে। এই পালিত সন্তানই ভবিষ্যতে তার পালক মায়ের দায়িত্ব পালন করবে।

এইসব দাইমারা ছোট বেলা থেকেই নিজের অভাব-অভিযোগের কথা পেশ করত তাদের পালিত সন্তানদের মাধ্যমে। অভিযোগগুলি পূরণযোগ্য হলে সরকারকে বলা হত সেগুলি পূরণ করতে।

ঘরের সীমানার মধ্যেই বাঁদীদের বাসস্থানগুলি। এক এক জন বাঁদীর একটি করে কামরা।

আমি দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর দুই-এক দিন সেখানে গিয়েছি। পরে মায়ের কঠিন নিষেধ থাকায় আর সেখানে যাওয়া হয় নাই।

মহীপুরে থাকতেই বকরীদ পর্বটি ওখানে হয়। ফুপার শরিকদের বাড়ী থেকে বকরীদের দাওয়াত এল।

বড় বড় দুইটি খাসির রান একটা বাঁশের লাঠির দুই মাথায় ঝুলিয়ে একটা লোক। সংগে আরও একটা লোক।

শুনলাম ওরা বকরীদের দাওয়াত দিতে এসেছে।

বকরীদের দিন ফুপু আমমা গেলেন শরিকদের বাড়ীতে।

বাড়ীর কর্ত্রী মালদহের নবাব পরিবারের মেয়ে। তাঁর একমাত্র মেয়ে, সে বিধবা। তিনিও বিধবা। মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন ঢাকার নবাব পরিবারে। তাঁর একটি মাত্রই ছেলে।

মেয়ের দেবর এসে মাঝে মাঝে জমিদারী দেখাশুনার কাজ করে চলে আসত ঢাকায়।

আমি এর আগে কখনও এ রকম আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠান দেখি নাই।

বাঁদীদের ছুটাছুটি। বিরাট ঘরে ফরাশ পাতা। তার উপর দস্তরখানা পাতা।

আসরে সব মহিলা। আমাকে সাবধান করা হয়েছিল মুরব্বীর আগে যেন খাবার মুখে না দি।

ফুপু আমমা আমাকে সংগে এনেছিলেন। মা আসেন নাই।

বিকেলের দিকে ফুপু আমমার সংগে ফিরে এলাম।

এখানে সব বাঁদীর কারবার, সবকিছু মাপা। ভাল লাগছিল না।

একদিন একটা শেলফের উপর কিছু বই পেয়ে গেলাম। বইগুলি সব শিশুপাঠ্য। একটি বই ছিল রবীন্দ্রনাথের লেখা। এই বইটির একটি গল্প আমার উপর দারুণ রেখাপাত করেছিল।

আমার জীবনে আমি অন্য কোন পুস্তক পাঠে ও রকম রোমাঞ্চ অনুভব করি নাই।

আরও একবার ঐ বইটির সেই গল্পটি পড়েছিলাম গল্পটির নাম ‘ইচ্ছাপূরণ ঠাকরুণ’। কিন্তু, কৈ অত রোমাঞ্চকর তো মনে হয় নাই ঐ একই গল্প পড়ে।

হয়ত বয়স আর পরিবেশ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নরূপে কাজ করে মানুষের মনে।

কিছু দিনের মধ্যে আমার ফুপাতো বোনের ছেলে নওশা আর আমার পরের ভাইটি আনুর হাম হল।

বাঁদীদের উপর ভরসা। ওরা যা খাওয়ায় তাই খায়। ঘন দুধ। সাগু দিয়ে খাওয়াতে বললেও দুধের ঘনত্ব কমে না।

আমার ভাই আনু আর নওশার অবস্থা চরম পর্যায়ে পৌছেছিল। দারুণ পেটের অসুখ।

আমার মা আমাদের নিয়ে রংপুরে শহরে চলে এলেন ছোট ফুপুমার বাড়ী। আনুর চিকিৎসার জন্য।

নওশাকে ওরা ওখানেই রেখেছিল। কয়েক দিনের মধ্যেই তার মৃত্যু সংবাদ আসে।

আমার ভাইয়ের উপযুক্ত পথ্য আর চিকিৎসার জন্য ভাইটি বেঁচে উঠে।



একবিংশ অংশ

নান্নুর থানা



এর কিছুদিন পর আব্বার চিঠি পাওয়া গেল। আব্বা আসছেন আমাদের নিয়ে যাবার জন্য।

চিঠি পাবার কয়েক দিনের মধ্যেই আব্বা এসে পড়লেন।

আমরা এখন আবার বীরভূম জেলায় যাচ্ছি। এবার আব্বার পোস্টিং হয়েছে ‘নান্নুর’ থানায়। বড়ু চণ্ডীদাসের চারণভূমি। লীলা ক্ষেত্র।

আমার আনন্দ সীমাহীন।

ট্রেনে উঠে মাকে বললাম, ‘মা গাড়ীটা কি বলছে?’

মায়ের মুখে হাসি। আমরা তখন তিন ভাই বোন।

ফিমেল কম্পার্টমেন্টে (মেয়েদের কামরা)। আমরা ছাড়া গাড়ীতে কোন যাত্রী নাই। আব্বা পরের কামরায়।

আমি আর আমার পরের ভাইটা গাড়ীতে দৌড়াদৌড়ি করছি। গাড়ীর গায়ে ধাক্কা দিচ্ছি, গাড়ীটা চলছেনা কেন?

কি কারণে যেন গাড়ীটা চলছে না। মায়ের মুখে তৃপ্তির হাসি।

‘শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন’ রচয়িতা চণ্ডীদাসের বেশ প্রভাব ছিল। ভোর হবার অনেক আগেই সংকীর্তন (নাম গান) করতে করতে রাস্তা পরিভ্রমণ করত অনেক ধর্মানুরাগী।

এমনকি ভিক্ষা করতে এসেও অনেক ভিক্ষার্থী পদাবলীতে সুর দিয়ে গান গাইত।

দুইজন মহিলা বাড়ীতে এসে খঞ্জনী বাজিয়ে গান গাইত। এরা বৈষ্ণবী।

এরা এলেই মা ওদের অনুরোধ করে গান শুনতেন। গান লিখেও রাখতেন। পরে গাইবার জন্য। ওদের গাওয়া একটা গান ছিল--

‘মিছে রে তোর ভবের আশা

মিলবে না তোর ভালবাসা।’



বৈরাগ্যের গান, ভগবৎ প্রেমের গান মায়ের প্রিয় ছিল।

নান্নুর থানায় আমি একা হয়ে গেলাম। পুতুল ছাড়া অন্য খেলাতো একা খেলা যায় না।

এখানে অবশ্য আমার একটা অসম বন্ধু জুটে গেল।

সে আমাদের পায়খানাটা ধুতে আসত। সে ছোটই ছিল।

সম্ভবত সে আমারই বয়সী হবে। যখনই সে নিজের কাজে আসত আমার সংগে কথা না বলে যেত না।

বয়সের ব্যবধান না থাকার জন্য সম্ভবত সে চেষ্টা করত আমার সংগে বন্ধুত্ব করার।

একদিন তার নাম জিজ্ঞেস করে জানলাম তার নাম নিবারণ। আমাকে সে দিদি মনি বলে ডাকত।

ছেলেটার সংগে ঘনিষ্ঠতা দেখে মা আমাকে সাবধান করলেন, সে যেন আমাকে না ছোঁয়।

তার শরীরে ঘৃণা করার মত কিছু দেখি নাই। তাই আমার ঘৃণা বোধ হয় নাই।

তবে ছেলেটা আমার সংগে খেলতে এসে প্রায়ই বলত, ‘দিদিমনিকে আমি ছুয়ে দিব।’

এই কথাটা তার খেলার একটা অংশ ছিল।

আমি ঐ কথার মর্ম বুঝি নাই।

কিন্তু সে বুঝত। সে যে অন্য কোন জাতের মানুষকে ছুঁতে পারবে না। তাই প্রায়ই বলত--‘আমরা ছোট নোক। তোমরা ভদ্দর নোক।’

বীরভূম জেলায় নান্নুর থানাই আব্বার শেষ কর্ম ক্ষেত্র।  তারপর, আব্বা পদ্মাপারের দেশ রাজশাহী জেলায় বদলী হয়ে যান।



রচনা ঃ ২০০৬

অনলাইন প্রকাশ ঃ ১০  সেপ্টেম্বর, ২০০৭





লেখক পরিচিতি

শামসুন নাহার



শামসুন নাহার ১৯২৬ সালে পশ্চিম বঙ্গের বীরভূম জেলার রাজনগর থানায় জন্মগ্রহণ করেন। পিতা ফজলুল হক বর্তমান লালমণিরহাট জেলার অধিবাসী ছিলেন। তিনি ছিলেন ব্রিটিশ আমলের পুলিশ কর্মকর্তা। লেখকের মাতা তৈয়বা খাতুন ছিলেন শিক্ষিত। তবে পিতা রক্ষণশীল মুসলমান হওয়ায় মেয়েদের লেখাপড়ায় বিশ্বাস করতেন না। এর ফলে শামসুন নাহার চতুর্থ শ্রেণীতে উঠলে তার পিতা তার স্কুলে যাওয়া বন্ধ করেন।

বিবাহের পর তিনি স্বামীর অনুমতি নিয়ে পুনরায় লেখাপড়া শুরু করেন। স্বামীর শিক্ষার প্রতি অনুরাগ তার উচ্চশিক্ষা লাভে সহায়ক হয়। ধীরে ধীরে তিনি বিএ-বিএড পর্যন্ত ডিগ্রী লাভ করেন। তার স্বামী আবদুল্লাহ মিয়াও ছিলেন বিটিশ আমলের গ্র্যাজুয়েট ও পুলিশ কর্মকর্তা। ডিএসপি হিসাবে তিনি ১৯৭০ সালে অবসর গ্রহণ করেন এবং ১৯৯৩ সালে মৃত্যুবরণ করেন। স্বামী পাকিস্তান আমলে পুলিশে কর্মরত অবস্থায় শামসুন নাহার ঢাকায় উচ্চবিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন। তিনি সহকারী প্রধান শিক্ষিকা হিসাবে ঢাকার একটি উচ্চবিদ্যালয়ে ১৯৭২ থেকে ১৯৯৩ পর্যন্ত একটানা ২১ বৎসর কর্মরত ছিলেন। বর্তমানে তিনি অবসর জীবন যাপন করছেন। বিভিন্ন সময়ে লেখকের লেখা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। শিশু-কিশোরদের জন্য লেখকের প্রকাশিত গ্রন্থের নাম গল্পকথার ছন্দ।



 

অনলাইন প্রকাশ : ১০  সেপ্টেম্বর, ২০০৭

সাম্প্রতিক পোষ্টসমূহ