Banner
আওয়ামী লীগ-বিএনপি বিরোধের সমাজতত্ত্ব

লিখেছেনঃ শামসুজ্জোহা মানিক, আপডেটঃ April 2, 2007, 6:00 PM, Hits: 4182

এক

বাংলাদেশের ইতিহাসে দীর্ঘকাল ধরে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি দু’টি প্রধান পরস্পর বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি হিসাবে বিদ্যমান। এই উভয় শক্তির বিরোধের মধ্যে রয়েছে সমাজের বিভিন্ন ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর মধ্যকার দ্বন্দ্ব ও সংঘাতের এমন এক জটিল প্রকাশ যাকে বুঝতে হলে আমাদের বাংলাদেশ রাষ্ট্রের উদ্ভবের জটিলতাকে বুঝতে হবে।

এটা নিশ্চয়ই তাৎপর্যপূর্ণ যে, ১৯৬৬ থেকে ১৯৭১-এর ২৫-এ মার্চ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের সমগ্র আন্দোলন ও দাবীর কেন্দ্রীয় বিষয় ছিল ৬ দফা। অনেকে ’৭১-এর ৭ই মার্চ শেখ মুজিবের ভাষণের মধ্যে স্বাধীনতার ঘোষণা দেখতে পান। কিন্তু “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম” তাঁর এই ঘোষণা বস্তুত দ্ব্যর্থক এবং অনির্দিষ্ট। স্বাধীনতার ঘোষণা তখন অর্থবহ হতে পারে যখন তার নির্দিষ্ট লক্ষ্য এবং কর্মসূচী থাকে। ইয়াহিয়া সরকারের বিরুদ্ধে জোরালো বক্তব্য আছে, কিন্তু পাল্টা রাষ্ট্রের কর্মসূচী কিংবা সরকার গঠন নেই। জনগণ যে আন্দোলন করুক, যে দাবী জানাক আওয়ামী লীগের কর্মকাণ্ডে স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার নির্দিষ্ট লক্ষ্য প্রতিফলিত ছিল না। অথচ তখন পূর্ব বাংলায় আওয়ামী লীগ একটি অঘোষিত সরকারের ভূমিকা পালন করছিল। বস্তুত ২৫-এ মার্চ পর্যন্ত দেশে এমন একটি অবস্থা বিরাজ করছিল যখন জনগণের উপর আওয়ামী লীগেরও নিয়ন্ত্রণ ছিল না। ১৯৭১-এর জানুয়ারী, ফেব্রুয়ারী থেকে গণ-আন্দোলন ক্রমবর্ধমানভাবে স্বাধীনতার লক্ষ্যাভিমুখী হয়ে পড়ছিল। অথচ ৬ দফার অভিমুখ তা ছিল না। কিন্তু ৬ দফা দেবার পর থেকে ক্রমে আওয়ামী লীগ পূর্ব বাংলায় সমগ্র স্বাধিকারকামী জনগণের প্রধান রাজনৈতিক মুখপাত্রে পরিণত হয়। তবে ৬ দফার পর থেকে পূর্ব বাংলায় স্বাধিকার আন্দোলনের ভিতর আর একটি ধারা গড়ে উঠতে থাকে বামপন্থী ছাত্র-তরুণদের প্রভাবে, সেটি হল স্বাধীনতার ধারা। পরবর্তী কালে ৬ দফার স্বায়ত্তশাসন এবং পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা এই উভয় আন্দোলনের জটিল দ্বন্দ্ব ও বিজড়নের পরিণতিতে এ দেশের ইতিহাসে অনেক জটিলতার সৃষ্টি হল। ঘটল আওয়ামী লীগকে সামনে রেখে স্বাধীনতা যুদ্ধ।

অথচ ৬ দফা ছিল স্বায়ত্তশাসনের দাবী। এবং আওয়ামী লীগের পথ ছিল নিয়মতন্ত্র ও নির্বাচন। এই পথেই আওয়ামী লীগ ১৯৭০-এর ৭ই ডিসেম্বরের নির্বাচনে তাৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করে। এই বিজয়ের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ এই ভূখণ্ডের জনগণের প্রধান প্রতিনিধিত্বকারী শক্তিতে পরিণত হলে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা আন্দোলনের ক্রমবর্ধমান চাপটাও গিয়ে পড়ে তার উপর। এখানে উল্লেখ করা দরকার যে, স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা প্রথম আত্মপ্রকাশ করে বামপন্থী ছাত্র আন্দোলনের মধ্যে। এটা সেখানে দানা বাঁধতে শুরু করে ’৬৭-তে। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সহ-সভাপতি সিরাজ শিকদার এই আকাঙ্ক্ষার ভিত্তিতে রাজনীতি গড়ার পদক্ষেপ প্রথম দেন। কিন্তু তিনি ছিলেন প্রকাশ্য সংগঠন ও আন্দোলন বিরোধী এবং গোপন পদ্ধতিতে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র সংগ্রাম গড়ে তোলার পক্ষপাতী। তাঁর উদ্যেগে ১৯৬৮-এর জানুয়ারীতে গোপনে গঠিত হয় পূর্ব বাংলার শ্রমিক আন্দোলন, যা পরবর্তীকালে পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি নাম ধারণ করে।

কিন্তু সিরাজ শিকদারের গণ-আন্দোলন বর্জন নীতির সঙ্গে দ্বিমত পোষণ ক’রে ১৯৬৮-এর এপ্রিলে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল্লাহ্‌, শামসুজ্জোহা মানিক প্রমুখের নেতৃত্বে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার লক্ষ্যে পূর্ব বাংলার বিপ্লবী কমিউনিস্ট আন্দোলন নামে অপর একটি গোপন সংগঠন গঠিত হয়, যা প্রকাশ্য ও গোপন কাজের সমন্বয় এবং গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র সংগ্রাম গড়ে তোলায় বিশ্বাসী ছিল। বিপ্লবী কমিউনিস্ট আন্দোলন গঠিত হওয়ায় সিরাজ শিকদার তাঁর রাজনীতি নিয়ে ষাটের দশকে আর বেশীদূর অগ্রসর হতে পারেন নি। ক্রমে স্বাধীন পূর্ব বাংলার রাজনীতিটা হয়ে ওঠে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের* মূল রাজনীতি। ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি মোস্তফা জামাল হায়দার এই রাজনীতির পক্ষে দাঁড়ান ’৬৯-এ। ক্রমে ন্যাপ নিয়ন্ত্রিত সমগ্র বাম রাজনীতি স্বাধীনতাকামীদের দ্বারা প্রভাবিত হতে শুরু করে।

কিন্তু বামপন্থী আন্দোলনের একটা সঙ্কট ছিল। সেটা হল স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে তার নেতৃত্বের ব্যর্থতা। আওয়ামী লীগ এক্ষেত্রে মুজিবের ৬ দফা কর্মসূচীকে অবলম্বন করে সময়ের একটা প্রয়োজন পূরণ করে। কিন্তু ন্যাপ স্বায়ত্তশাসনের দাবী সম্বলিত ১৪ দফা কর্মসূচী দিলেও তা করতে ব্যর্থ হয়। প্রথমত, ১৪ দফা ছিল ৬ দফার তুলনায় শক্তিশালী কেন্দ্রের পক্ষপাতী। দ্বিতীয়ত, ন্যাপ নেতৃত্ব কর্মী ও সমর্থকদের ক্রমবর্ধমান চাপের মুখে স্বায়ত্তশাসনের দাবী উপস্থিত করলেও বাস্তবে তারা এই দাবীকে প্রাধান্য দিয়ে আন্দোলন গড়ায় আগ্রহী ছিল না। এই অবস্থায় স্বায়ত্তশাসন আন্দোলন আওয়ামী লীগের হাতে চলে যাওয়াই ছিল স্বাভাবিক।

* রাশেদ খান মেনন নেতৃত্বাধীন ধারার ছাত্র ইউনিয়ন।

তৎকালীন ন্যাপের রাজনীতি মূলত যারা নিয়ন্ত্রণ করত তারা ছিল পিকিংপন্থী কমিউনিস্ট। পূর্ব বাংলায় জাতীয়তাবাদের জাগরণ তারা চায় নি। তাদের মার্কসীয় আন্তর্জাতিকতাবাদের দর্শন তখন বিপ্লবপন্থার সমর্থক হিসাবে তাদের পিকিংপন্থী করেছিল। পিকিং তখন পাকিস্তানের আঞ্চলিক অখণ্ডতা ও সংহতির দৃঢ় সমর্থক। পাকিস্তানের শক্ত কেন্দ্র তার প্রয়োজন। সুতরাং এ দেশের স্বায়ত্তশাসন বা স্বাধিকার প্রশ্নের উপর জোর দেয় এমন যে কোন কর্মসূচীর বিরুদ্ধে তখন পিকিংপন্থীরা দাঁড়াল। এই কারণে সে কালে ন্যাপ বা ভাসানীর পক্ষে ৬ দফার বিকল্প হিসাবে স্বায়ত্তশাসনকে কেন্দ্রে রেখে উন্নততর কোন কর্মসূচী প্রদান করা সম্ভব হয় নি।

অপর দিকে পিকিংপন্থী কমিউনিস্টরা জাতীয়তাবাদের বিরোধী ছিল তাদের অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গীজাত মার্কসীয় শ্রেণী সংগ্রামের তত্ত্বের কারণেও। তারা মনে করত পূর্ব বাংলার জনগণকে স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনে যেতে দিলে জনগণের মনে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ প্রবল হয়ে উঠবে এবং ফলে তাদের শ্রেণী সংগ্রামের রাজনীতি দুর্বল হবে। এইসব কারণে তারা বাঙ্গালীর জাতীয়তাবাদী আকাঙ্ক্ষাকে শক্তিশালী করে এমন পদক্ষেপ দিতে বা আন্দোলন করতে রাজী ছিল না। সুতরাং ১৪ দফা কর্মসূচী নিয়েও তারা মাঠে নামতে আগ্রহী ছিল না। সব দিক বিচারে এটি ছিল একটি কাগুজে কর্মসূচী মাত্র।

কিন্তু দেশ বা জাতি তাদের অপেক্ষায বসে থাকে নি। আর কিছু না থাকায় ৬ দফা তখন হয়ে ওঠে জাতির স্বাধিকার চেতনার প্রকাশ্য রূপ। বামপন্থী ছাত্র-যুব শক্তি আওয়ামী লীগ ও ৬ দফার অবস্থান বিরোধী হওয়া সত্ত্বেও ৬ দফার অনুপ্ররণাকে গ্রহণ বা ব্যবহার ক’রে পূর্ব বাংলায় বাঙ্গালী জাতির স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে অগ্রসর হতে থাকে। এইভাবে ৬ দফা কেন্দ্রিক স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনের সমান্তরালে বিকাশ লাভ করতে থাকে বাঙ্গালীর স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চেতনা বা উপাদান।

স্বাধীনতাকামী বামপন্থী ছাত্রদের একটি লক্ষ্য ছিল জন-গণতান্ত্রিক বিপ্লবের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু আওয়ামী লীগের রাজনীতি ছিল পুঁিজবাদের সমর্থক। এটা ৬ দফাতেও স্পষ্ট। কারণ তা পাকিস্তানের বিদ্যমান পুঁজিবাদী কাঠামো পরিবর্তনের কোন দিক নির্দেশ করে নি।

সব মিলিয়ে ৬ দফা ছিল পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয়, অর্থনৈতিক এমনকি ভাবাদর্শিক কাঠামোর সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের আবেদনকে ব্যবহার করা হলেও ৬ দফার আন্দোলন ছিল এই প্রশ্নে দ্ব্যর্থক। বরং ৬ দফার স্বায়ত্তশাসনের যৌক্তিক ভিত্তি ছিল লাহোর প্রস্তাব। বলা যায় ৬ দফা এবং তার আন্দোলন মুসলিম সাম্প্রদায়িক চেতনা এবং বাঙ্গালীর জাতীয়তাবাদী চেতনার একটা বিজড়ন ঘটিয়েছিল। এটার একটা প্রয়োজনও ছিল জনগণের ভিতর সাম্প্রদায়িকতার বিজড়নমুক্ত সেকিউলার জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশ ঘটাবার জন্য। এটা জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশের ক্ষেত্রে একটা প্রয়োজনীয় আড়াল দিয়েছিল। তবে আওয়ামী লীগের মধ্যে একটা আত্মদ্বন্দ্ব ছিল এই বিজড়ন ঘটার ফলে। কিন্তু এই আত্মদ্বন্দ্ব অতিক্রমের কর্মসূচী বা পদ্ধতি আওয়ামী লীগের ছিল না।

এটা ছিল বামপন্থী ছাত্র-যুব শক্তির ভিতর, যারা ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক চেতনামুক্ত হয়ে বাঙ্গালীর একটা স্বাধীন জাতি-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল পূর্ব বাংলার বুকে এবং সেই প্রয়োজনে কৃষক ও শ্রমিকদের মধ্যে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে জনযুদ্ধ গড়ে তোলার রাজনীতি বিস্তৃত করছিল। এ ক্ষেত্রে অবশ্য তাদের অনেক সীমাবদ্ধতা ছিল। তাদের ছিল অনভিজ্ঞতা এবং কমিউনিস্ট নেতৃত্বের সঙ্গে তাদের তীব্র দ্বন্দ্ব ছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাদের অগ্রগমন রোধ করার সাধ্য কমিউনিস্ট নেতৃত্বের হয় নি।

এভাবে সেকালে প্রকৃত পক্ষে নেতৃত্বহীন ছাত্র-যুব শক্তির স্বাধীন পূর্ব বাংলার রাজনীতি জাতীয় আন্দোলনের ভিতর প্রবেশ করে আওয়ামী লীগের নেৃতত্বে গণ-আন্দোলনকে ক্রমেই পাকিস্তান বিরোধী অবস্থানের দিকে ঠেলে দিতে থাকে। বস্তুত ১৯৭০-এর ডিসেম্বরে নির্বাচনের পর বামপন্থীদের পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধের আয়োজন শুরু হলে আওয়ামী লীগের পক্ষে শুধু ৬ দফা নিয়ে অগ্রসর হওয়া আর সম্ভব ছিল না। অথচ যুদ্ধের রাজনীতি দেওয়াও তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। কারণ সেই প্রস্তুতিই তার ছিল না। পাকিস্তানের পক্ষেও তখন শেখ মুজিবকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় বসতে দেওয়া ছিল বিপজ্জক। কারণ শেখ মুজিব তখন এমন জনস্রোতের প্রতিনিধি যার উপর তার নিজেরও নিয়ন্ত্রণ ছিল না। ফলে তার পক্ষে কোন ছাড় দেওয়া সম্ভব হয় নি। পাকিস্তানের পক্ষেও চট করে ৬ দফা মানা সম্ভব ছিল না। হয়ত ধীর গতিতে পাকিস্তান সেটা মানত। কিন্তু বামপন্থী শক্তিগুলো যেভাবে যুদ্ধ শুরুর প্রস্তুতি নিচ্ছিল এবং জনমনে জাতীয়তাবাদী আবেগ ও আকাঙ্ক্ষা যেভাবে প্রবল হয়ে উঠেছিল তাতে করে শেখ মুজিবের পক্ষেও পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যাওয়া ছিল বিপজ্জনক। আবার স্বাধীনতার জন্য পদক্ষেপ দিলে এমন এক যুদ্ধ বাধার সম্ভাবনা ছিল যার উপর পূর্ব প্রস্তুতি নেওয়া বামপন্থীদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা ছিল। সুতরাং তিনি সময় কাটাতে থাকলেন। আসলে তিনি ঘটনাধারা এবং সময়ের হাতে নিজেকে ছেড়ে দিলেন। যখন আন্দোলনকে দমন করার জন্য পাকিস্তানের সেনাবাহিনী আক্রমণ শুরু করল তখন সমস্ত জাতি স্বতঃস্ফূর্তভাবে রুখে দাঁড়াল এবং প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু করল। সেটা কিন্তু শেখ মুজিব বা আওয়ামী লীগের নামে শুরু করা হলেও তার প্রাথমিক সংগঠিত নেতৃত্ব আওয়ামী লীগ বা শেখ মুজিবের নিকট থেকে এল না। বরং শেখ মুজিব বাড়ীতে বসে থেকে শত্রু বাহিনীর হাতে ধরা দিলেন।

অর্থাৎ ৬ দফা কতদূর যেতে পারে এবং তা কি ধরনের কর্মসূচী সেটা স্পষ্ট হল এই ঘটনার মধ্য দিয়ে। বস্তুত আওয়ামী লীগ যেমন যুদ্ধের মধ্য দিয়ে পাকিস্তান ভাঙ্গার শক্তি ছিল না তেমন ৬ দফাও বাঙ্গালীর জাতি-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কর্মসূচী ছিল না। আওয়ামী লীগ এই ধরনের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার শক্তি ছিল না বলে তা ২৫-এ মার্চ পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর আক্রমণ সত্বেও কোন বিকল্প কর্মসূচী ঘোষণা করল না।


দুই


যেটাকে মুক্তিযুদ্ধ বলা হয় সেটা কিন্তু কারো ঘোষণা দিয়ে শুরু হয় নি। শেখ মুজিব শেষ মুহূর্তে প্রতিরোধ যুদ্ধের নির্দেশ দেন বলে যে কথা পরবর্তী কালে বলা হয় তারও কোন প্রমাণ নেই। যুদ্ধের ঘোষণা দেওয়া নেতা বাড়ীতে বসে থেকে ধরা দেন এটা বিশ্বাস করারও কোন কারণ নেই। চট্টগ্রাম বেতার থেকে ২৭-এ মার্চ মেজর জিয়া শেখ মুজিবের নামে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। কিন্তু স্বাধীনতা যুদ্ধ তার পূর্বেই শুরু হয়েছিল সারা দেশে।

পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর আক্রমণ অভিযান শুরু হলে প্রথমেই যারা প্রতিরোধ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে তারা হল ছাত্র-যুবক এবং সেনাবাহিনী, পুলিশ ও ই পি আর-এর বাঙ্গালী সদস্যদের এক বিশাল অংশ। এর জন্য কারো ঘোষণা বা নির্দেশের প্রয়োজন হয় নি; তবে জিয়ার ঘোষণা ঐ রকম এক নেতৃত্বহীনতার সময় বিরাট প্রেরণা সৃষ্টি করে।

যুদ্ধ শুরু হলে আওয়ামী লীগ নেতারা ভারতে আশ্রয় নেয়। আওয়ামী লীগ কর্মী ও সমর্থকদের এক বিরাট অংশ প্রতিরোধ যুদ্ধে পরাস্ত হলে ভারতে আশ্রয় নেয়। বিদ্রোহী সৈনিক ও অন্যরাও যুদ্ধে টিকতে না পেরে ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। ভারত সরকার এর সুযোগ নিল এবং আওয়ামী লীগকে সর্বপ্রকার সাহায্য দিল। কিন্তু এর ফলে প্রকৃতপক্ষে যুদ্ধ ভারত সরকারের নিয়ন্ত্রণে চলে গেল। আওয়ামী লীগের নির্বাচিত সদস্যদের নিয়ে গঠিত হল অস্থায়ী প্রবাসী সরকার। এই সরকারের রাষ্ট্রপতি হিসাবে পাকিস্তানে কারাবন্দী শেখ মুজিবের নাম ঘোষণা করা হল। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং প্রধান মন্ত্রী হলেন তাজউদ্দিন আহমদ।

কিন্তু এভাবে সরকার গঠন জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত শক্তিগুলির প্রতি সুবিচার করে নি। কারণ আওয়ামী লীগের যাঁরা নির্বাচিত সদস্য ছিলেন তাঁরা ’৭০-এর ডিসেম্বরে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচিত হন মূলত ৬ দফা নিয়ে। সেটা স্বাধীনতা এবং জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপার ছিল না। অন্যদিকে যুদ্ধে প্রকৃতপক্ষে কারো একক নেতৃত্ব ছিল না। আওয়ামী লীগ ও ন্যাপসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা, কর্মী, ছাত্র-যুব সম্প্রদায়, কৃষক, শ্রমিক, সেনা, পুলিশ, ইপিআর ইত্যাদি বিভিন্ন শক্তির স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ও নেতৃত্বে প্রতিরোধ যুদ্ধ গড়ে ওঠে। কিন্তু সরকার গঠনের সময় তাদের অংশগ্রহণের বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া হল না।

প্রকৃতপক্ষে নির্বাচনমূলক প্রতিনিধিত্বের দাবী আওয়ামী লীগের শেষ হয় পাকিস্তানী সেনাবাহিনী কর্তৃক আক্রমণ অভিযান শুরুর সঙ্গে সঙ্গে। অবশ্য আওয়ামী লীগ যদি যুদ্ধ শুরুর পূর্বেই তার নির্বাচিত সদস্যদের দিয়ে পাল্টা সরকার গঠন করে পাকিস্তানকে মোকাবিলা করার এবং স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করার ঘোষণা দিত তবে নির্বাচিত প্রতিনিধিত্বের ধারাবাহিকতার একটা অবকাশ থেকে যেতে পারত। সেটা হত আওয়ামী লীগের ৬ দফা থেকে স্বাধীনতা যুদ্ধে উত্তরণ। কিন্তু তা না করে আওয়ামী লীগ ভারতের আশ্রয় নিয়ে সকলের গড়ে তোলা প্রতিরোধ যুদ্ধের নেতৃত্বের একমাত্র দাবীদার হল।

বামপন্থীদের যে বিশাল অংশ দীর্ঘদিন ধরে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার রাজনীতি গড়ে তুলছিল এবং প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশ নিল তাদের একটা বৃহৎ অংশ যখন ভারতে আশ্রয় নিল তখনও তাদেরকে এই সরকারে নেওয়া হল না। ভারত সরকারও তাদের সাহায্য করল না। এইভাবে আওয়ামী লীগ যা করল তা হল ভারত সরকারের সাহায্য নিয়ে জাতির স্বাধীনতা যুদ্ধকে দলীয়করণ করা, কুক্ষিগত করা।

নিঃসন্দেহে এ ধরনের আচরণের ফলে যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বিভিন্ন শক্তির মধ্যে অসন্তোষ জন্ম নিল। কিন্তু সেটার তেমন কোন বহিঃপ্রকাশ তখন ঘটা সম্ভব ছিল না। বিশেষত নয় মাস তার জন্য যথেষ্ট ছিল না। অন্যদিকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঐক্য রক্ষার তাগিদটা ছিল তখন মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে প্রবল। ফলে অসন্তোষ থাকলেও তার প্রকাশ ছিল সংযত। তবে অসন্তোষ যে ছিল সেটা যুদ্ধের সঙ্গে সংযুক্ত অনেকের অনেক বিবরণ এবং আলোচনা থেকে জানা যায়।

’৭১-এর জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের সমস্যার একটি গুরুতর দিককে বোঝার জন্য একুটু বোঝাই যথেষ্ট যে, আওয়ামী লীগের মাধ্যমে ভারত সরকারই প্রকৃতপক্ষে যুদ্ধের মূল নিয়ন্ত্রক হল। ফলে এই যুদ্ধ স্বাধীনভাবে বেড়ে উঠতে পারল না।

১৯৭১-এর ৩ ডিসেম্বর পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হলে ভারত বাঙ্গালীর মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণের সুযোগ পেয়ে যায়। ভারতীয় সেনাবাহিনী পশ্চিম পাকিস্তানে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে উল্লেখযোগ্য বিজয় অর্জন করলেও পশ্চিম পাকিস্তান জয় না করে পূর্ব পাকিস্তান জয়ের উপর মনোনিবেশ করে। ’৭১-এর ১৬ই ডিসেম্বর পাক-বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে পূর্ব বাংলায় পাকিস্তানের দখলদারিত্বের অবসান হল এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হল। নয় মাসের যুদ্ধে বিধ্বস্ত এক দেশ পুনর্গঠনের একক দায়িত্ব নিল আওয়ামী লীগ।

অথচ যুদ্ধোত্তর দেশ পুনর্গঠনে যুদ্ধের সকল শক্তির অংশগ্রহণ ছিল স্বাভাবিক ব্যাপার। শুধু তাই নয়, এ ছাড়া দেশ পুনর্গঠনে জাতীয় ঐক্যমত প্রতিষ্ঠা ছিল অসম্ভব। সকলে একটি সরকারের অংশীদার হলে বিরোধিতার জন্য বিরোধিতা করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হত অন্যরা। কারণ দায়-দায়িত্ব সবার ঘাড়ে এসে পড়ত কম অথবা বেশী পরিমাণে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ তার যুদ্ধকালীন নীতি অব্যাহত রাখল। প্রথাগত প্রাতিষ্ঠানিক পদ্ধতি অনুসরণ করল একটা স্বাধীনতা যুদ্ধের বাস্তবতা ভুলে গিয়ে. যে যুদ্ধটা প্রকৃতপক্ষে অনেকে মিলে গড়ে তুলেছিল এবং যার রাজনীতিটা অনেক আগে থেকে গড়ে তুলেছিল মূলত বামপন্থীরা বিশেষত ষাটের দশকের বামপন্থী ছাত্র ও তরুণরা।

কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার নূতন রাষ্ট্র পরিচালনায় নিদারুণ ব্যর্থতার পরিচয় দিল। সন্ত্রাস, অরাজকতা, দুর্নীতি দমনে তা ব্যর্থ হল। বরং আওয়ামী লীগের নাম জড়ালো এ সবের সঙ্গে। আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা রাষ্ট্র ক্ষমতাকে দ্রুত অর্থ-বিত্ত সঞ্চয়ের হাতিয়ারে পরিণত করল। মজার ব্যাপার হল এটা করা হল সমাজতন্ত্রের কথা বলে। অথচ দীর্ঘকাল আওয়ামী লীগ ছিল সমাজতন্ত্রের ধারণারই বিরুদ্ধে। সমাজতন্ত্রের নামে এখন শিল্প-কারখানা জাতীয়করণ হল। কিন্তু সেগুলো হল আওয়ামী লীগ কর্তৃক নিয়োজিত ব্যবস্থাপকদের লুণ্ঠনের হাতিয়ার। এইভাবে আওয়ামী লীগ সমাজতন্ত্রের একটি উপাদান জাতীয়করণকে অবাধ লুণ্ঠনের মাধ্যমে পুঁজি সৃষ্টির হাতিয়ারে পরিণত করল।

যাইহোক, বামপন্থীদের চরমপন্থী অংশ যারা ’৭১-এ গ্রামাঞ্চলে ঘাঁটি এলাকা গড়তে সমর্থ হয়েছিল তাদের অনেকে আওয়ামী লীগকে প্রতিরোধ করতে চেষ্টা করল। ফলে তাদের সঙ্গে লীগ সরকারের সশস্ত্র সংঘাত দেখা দিল। অন্যদিকে প্রকাশ্য বামপন্থীরা ভাসানীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন ব্যর্থতা ও কর্মনীতির বিরুদ্ধে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন শুরু করল। এক সময় আওয়ামী লীগ সমর্থিত ছাত্র সংগঠন ছাত্র লীগ দ্বিধাবিভক্ত হল এবং তার এক বৃহৎ অংশ বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের নামে মেজর জলিল এবং আসম রবের নেতৃত্বে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) গঠন করল। জাসদ আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে প্রবল আন্দোলন শুরু করল।

এইসব আন্দোলন ও বিরোধিতাকে দমন করার জন্য রক্ষী বাহিনী গঠিত হ’ল। রক্ষী বাহিনীর অত্যাচার হ’ল ভয়ানক। রক্ষী বাহিনী আধাসামরিক হলেও তার সৃষ্টি ও লালনে সেনাবাহিনীর ভিতর ক্ষোভ সৃষ্টি হ’ল। কারণ এটাকে গড়া হচ্ছিল অনেকটা সেনাবাহিনীর সমান্তরালে। এবং এদের সুযোগ-সুবিধাও ছিল প্রচুর।

যাইহোক, সরকার বিরোধী আন্দোলনগুলোকে আওয়ামী লীগ সরকার কঠোর হস্তে দমন করতে সক্ষম হ’ল। নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন করাও ছিল তখন বিপজ্জনক। কারণ যতটা ছিল রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস তার চেয়েও বেশী ছিল দলীয় সন্ত্রাস। রক্ষী বাহিনীর অত্যাচারের সঙ্গে ছিল সরকারী দলের প্রাইভেট সশস্ত্র বাহিনীগুলোর গুপ্ত হত্যা, নির্যাতন ইত্যাদি। কিছু ক্ষেত্রে সশস্ত্র বামপন্থীদের হঠকারী ও উস্কানিমূলক কর্মকাণ্ডও ছিল মুজিববাদীদের সন্ত্রাস পরিচালনার সুযোগ করে দেবার ক্ষেত্রে সহায়ক।

এমন অবস্থায় ১৯৭৫-এ শেখ মুজিব বহুদলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থা বাতিল করে একদলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রবর্তন করলেন এবং রাষ্ট্রপতি সরকার পদ্ধতি প্রতিষ্ঠা করে প্রধান মন্ত্রী থেকে রাষ্ট্রপতি হয়ে সমস্ত ক্ষমতা নিজ হাতে নিলেন।

এইভাবে শেখ মুজিব তাঁর বিরুদ্ধে যেটুকু নিয়মমতান্ত্রিক রাজনীতির অবকাশ ছিল সেটারও অবসান ঘটালেন। ইতিমধ্যে বামপন্থী সশস্ত্র দলগুলোকে মূলত দমন করেছেন। তাদের হাজার হাজার কর্মী হত্যা করে তাঁর প্রতি সশস্ত্র বিরোধিতাকে মূলত ধ্বংস করেছেন। অন্যদিকে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন করে তিনি নিয়মতান্ত্রিক বিরোধিতাকেও ধ্বংস করলেন। ফলে তাকে বিরোধিতা করার মত কোন রাজনৈতিক শক্তি দেশে থাকল না।

কিন্তু ততদিনে মুজিবের জনপ্রিয়তা ভয়ানকভাবে নেমে গেছে। এবার এতদিনের ক্ষোভ ও ঘৃণা নিয়ে মাঠে নামল সেনাবাহিনী আওয়ামী লীগের একাংশের সাহায্য ও সমর্থন নিয়ে। শেখ মুজিব সপরিবারে নিহত হলেন। এরপর আওয়ামী লীগের একটা অংশ মোশতাকের নেতৃত্বে কয়েক মাস ক্ষমতায় থাকলেও শেষ পর্যন্ত ক্ষমতা পুরাপুরি চলে যায় সেনাবাহিনীর হাতে। এইভাবে রাষ্ট্রের নেতৃত্ব রাজনৈতিক শক্তির পরিবর্তে সামরিক শক্তির হাতে চলে গেল। কুø, পাল্টা কুø ইত্যাদির মাধ্যমে জেনারেল জিয়া রাষ্ট্র ক্ষমতা হস্তগত করার পর এক সময় রাজনৈতিক দল বিএনপি গঠন করে বেসামরিক লেবাসে দেশ পরিচালনা করতে শুরু করেন।


তিন


উপরে ঘটনা ধারার সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিলাম সামরিক রাজনীতি এবং বিএনপি-এর উত্থানের পটভূমি বোঝার জন্য এবং সেই সঙ্গে আওয়ামী লীগ-বিএনপি-এর মধ্যকার পার্থেক্যের দিকটি আলোচনায় নেবার জন্য।

এখন এই প্রশ্ন করা যায় আওয়ামী লীগ কেন এভাবে ব্যর্থ হল? এর অনেক কারণ বলা যায়। তবে একটা বড় কারণ হল আওয়ামী লীগ এমন এক দল যার জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ করার উপযোগী চরিত্র, আদর্শ এবং প্রস্তুতি ছিল না। ফলে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের রাজনীতি তা গড়ে নি। কিন্তু ৬ দফা দেবার পর ক্রমে আন্দোলনের গতিধারার উপর তার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে যায় এবং ৬ দফার চাপকে ব্যবহার করে হলেও ষাটের দশকের বামপন্থী তরুণ প্রজন্মের ভিতর স্বাধীনতার রাজনীতি প্রবল হয় এবং এটা ক্রমে ৬ দফা তথা জাতীয় আন্দোলনের ভিতর ঢুকে যায়। আসলে বামপন্থীরা স্বাধীনতার রাজনীতি ছড়ালেও তাদের নেতৃত্বের দিক থেকে নিজস্ব প্রকাশ্য জাতীয় কর্মসূচী না থাকায় তাদের রাজনীতির শক্তিও মূলত শেখ মুজিবের রাজনীতির শক্তি বাড়ায়। এই অবস্থায় জনগণের ভিতর বিশেষ করে ছাত্র-যুব সম্প্রদায়ের ভিতর ক্রমবর্ধমান স্বাধীনতার রাজনীতির চাপ শেখ মুজিব এবং আওয়ামী লীগের উপরেও গিয়ে পড়ল। বিশেষ করে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী আক্রমণ করলে ভারতে অবস্থান নিয়ে জাতির যুদ্ধের নেতৃত্ব আওয়ামী লীগ গ্রহণ করল অনুপস্থিত শেখ মুজিবের নামে।

অর্থাৎ সব মিলিয়ে আওয়ামী লীগ বাঙ্গালীর স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা এবং তার জন্য যুদ্ধসহ এমন এক ঘটনাধারার নেতৃত্ব দিল যার মূল স্রষ্টা বা নির্মাতা তা নয়। যেমন ধরা যাক সমাজতন্ত্রের কথা। সমাজতন্ত্রে মুজিবের বিশ্বাস ছিল না। ভাসানীর সঙ্গে তাঁর বিরোধের মূল একটা জায়গা এটা। কিন্তু জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের পর তিনি সমাজতন্ত্রের প্রবক্তা হলেন। অবশ্য যুদ্ধের কিছু আগে তাঁর এই মোড় পরিবর্তন শুরু হয়েছিল। তবে সেটা স্পষ্ট এবং জোরালো হল মুক্তিযুদ্ধের পর। আসলে ব্যাপারটা ছিল জনগণ বিশেষ করে শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর আকাঙ্ক্ষা ব্যবহারের। এবং তিনি ব্যবহার করলেন। কিন্তু বাস্তবে করলেন পুঁজিবাদ। তবে সেটা হল লুণ্ঠন ও দুর্নীতিমূলক। কারণ সমাজতন্ত্র গড়ার চরিত্র এবং আদর্শ যেমন আওয়ামী লীগের ছিল না তেমন উৎপাদনশীল পুঁজিবাদ গড়ার জন্য যে চরিত্র এবং আদর্শ প্রয়োজন সেটাও আওয়ামী লীগের ছিল না। আওয়ামী লীগের মূল সামাজিক ভিত্তির দিকে দৃষ্টি দিলে আমরা আওয়ামী লীগের সমস্যাটা বুঝতে পারব।

পাকিস্তান আমলে আওয়ামী লীগ ছিল মধ্যবিত্তের ব্যাপক অংশের দল। এরা সামাজিক প্রতিপত্তি ও সম্পদে শহর ও গ্রামের প্রাধান্যকারী শ্রেণীগুলোর কিছুটা নীচে অবস্থান করত। শহর ও গ্রামের ঐতিহ্যিক বিত্তবান এবং প্রতিপত্তিশালীরা করত সাধারণত মুুসলিম লীগ। প্রতিষ্ঠিত বা বুনিয়াদী এলিটরা ছিল সাধারণভাবে মুসলিম লীগের মূল সামাজিক ভিত্তি। পাকিস্তান হয়েছিল এদের নেতৃত্বে। সেই সময় উঠতি মধ্যবিত্ত বা নীচের দিকের এলিটরাও পাকিস্তানের জন্য বুনিয়াদী এবং ঐতিহ্যিক এলিটদের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ ছিল। কিন্তু পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হবার পর এরা উচ্চতর স্তরের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় এগিয়ে যেতে চেয়ে মুসলিম লীগ ত্যাগ করে আওয়ামী লীগের ভিত্তি হল। ভাষার প্রশ্নটা ছিল এই উদীয়মান শক্তির অস্তিত্ব রক্ষা এবং আত্মপ্রতিষ্ঠার প্রশ্নের সঙ্গেই জড়িত। কারণ উর্দূ রাষ্ট্রভাষা হলে বুনিয়াদী বা অভিজাত মুসলিম শ্রেণীর অসুবিধা হত না যেটা এদের হত। শিক্ষা-সংস্কৃতিতে এরা এতটা পশ্চাৎপদ ছিল এবং এমন নবাগত যে, মাতৃভাষা তথা বাংলার লিখিত রূপ রপ্ত করাটাই তখন তাদের কাছ থেকে অনেক শ্রম ও মনোযোগ দাবী করছিল। এর সঙ্গে ছিল তাদের মর্যাদা বোধ। কারণ তারা জানত যে, পাকিস্তান আন্দোলনের মূল শক্তি বা ভিত্তি ছিল মুসলমান বাঙ্গালী।

যাইহোক, ১৯৫৭ পর্যন্ত মুসলিম লীগের সনাতন বা ঐতিহ্যিক এবং অভিজাত শ্রেণীর বিরুদ্ধে সমগ্র মধ্য এবং নিম্ন এলিট ও বিত্তবানদের ঐক্য ছিল। কিন্তু ১৯৫৭-তে এই ঐক্য ভেঙ্গে যায়। আমি বলার সুবিধার জন্য এদেরকে মধ্যবিত্ত বলব। ভাঙ্গনটা ঘটল এই মধ্যবিত্তের মধ্যে। মধ্যবিত্তের র্যাডিক্যাল অংশ যারা নীতি ও নিয়মনিষ্ঠ এবং উদারনৈতিক তারা গেল ন্যাপে। ভাসানী হলেন এদের নেতা।

স্বায়ত্তশাসন এবং বৈদেশিক নীতির প্রশ্নে আওয়ামী লীগের মূল নীতি থেকে সোহরাওয়ার্দী-মুজিবের সরে যাওয়া এই ভাঙ্গনের আপাত কারণ হলেও এর ভিতরে ছিল আর একটি কারণ সেটি হল সমাজতন্ত্র ও পুঁজিবাদের দ্বন্দ্ব। বিশেষ করে মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোটের বাইরে থেকে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বৈদেশিক নীতি অনুসরণের ক্ষেত্রে ভাসানী এবং ন্যাপের অঙ্গীকারের শক্তিটা এসেছিল পুঁজিবাদের তুলনায় সমাজতন্ত্রের প্রতি দুর্বলতা থেকে। এটা ষাটের দশকে স্পষ্ট হয়ে যায়। ষাটের দশকে ন্যাপ নেতৃত্বাধীন অপেক্ষাকৃত অগ্রসর এবং র্যাডিক্যাল মধ্যবিত্তের সঙ্গে যুক্ত হয় ছাত্রদের খুব বৃহৎ একটি অংশ। এর ফলে আওয়ামী লীগের তুলনায় মধ্যবিত্তের মধ্যে ন্যাপের অবস্থান অনেক দুর্বল হলেও এই সময় তার শক্তি বেড়ে যায়। ষাটের দশক জুড়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলে আওয়ামী লীগ ও ন্যাপের মধ্যে নেতৃত্ব কার হাতে যাবে তা নিয়ে। এই প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আওয়ামী লীগ জিতে যায়। আপাত দৃষ্টিতে এর প্রধান কারণ ৬ দফা। কিন্তু এর ভিতরে যে শক্তি ক্রিয়াশীল তা হল সাধারণ মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তের নিম্নতর অংশের মধ্যে আওয়ামী লীগের প্রতি সমর্থন। ব্যাপারটাকে এভাবে ব্যাখ্যা করা যায় যে, জনমত নিয়ন্ত্রণকারী সামাজিক শ্রেণী বা শক্তিগুলোর মধ্যে অপেক্ষাকৃত পশ্চাৎপদ কিন্তু সংখ্যাগুরু ও ব্যাপকভাবে বিস্তৃত এবং আম-জনতার সঙ্গে গভীরভাবে সংযুক্ত সামাজিক শক্তিগুলোর মুখপাত্র হল আওয়ামী লীগ এবং এখানেই ছিল তার সাফল্যের একটি প্রধান কারণ।

এটা বোঝা দরকার যে, শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে ন্যাপ বা বাম রাজনীতির ব্যাপক কাজ থাকলেও মধ্যবিত্তের যে র্যাডিক্যাল বা অগ্রসর অংশের হাতে এই রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ ছিল তারা ছিল মূলত শিক্ষিত কিংবা বুদ্ধিজীবী, এদের অর্থ-বিত্ত সাধারণভাবে কম হলেও মেধায় এবং শিক্ষা-সংস্কৃতিতে উন্নততর হওয়ায় এদের সামাজিক মর্যাদা শাসক বা উপর তলার এলিটদের তুলনায় কম ছিল না। বরং সাংস্কৃতিক বা জ্ঞান-বুদ্ধির নৈকট্যের কারণে এদের উভয়ের মধ্যে এক ধরনের সংযোগ ছিল বা ঘটতে পারত। ফলে বলা যায় মধ্যবিত্তের এই গোষ্ঠী তাদের শিক্ষা-সংস্কৃতি ও মেধার জোরে প্রচলিত ব্যবস্থার অনেক সুফল ভোগ করত যেটা আওয়ামী লীগ যে ব্যাপকতর মধ্য শ্রেণীকে প্রতিনধিত্ব তারা করত না। আর এই কারণে তত্ত্বে, আলোচনায় এবং বাস্তবে ব্যষ্টিক বা মাইক্রো পর্যায়ে এরা যতই আমুল পরিবর্তনবাদী বা র্যাডিক্যাল হোক বাস্তবে এবং সামষ্টিক বা ম্যাক্রো পর্যায়ে এরা হয়েছিল প্রো-স্ট্যাবলিশমেন্ট বা কায়েমী ব্যবস্থার সহায়ক। তবে তারা নিজেদের এই রূপকে ঢেকে রাখত শ্রেণী সংগ্রামের কথা বলে কিংবা মাঠ পর্যায়ে যারা শ্রেণী সংগ্রাম করত তাদেরকে ব্যবহার ক’রে। এই কারণে মুজিব ৬ দফা দিতে পারলেও কৃষকের মধ্য থেকে উঠে আসা এবং আম-জনতার মধ্যে অবস্থানকারী ভাসানী এই গোষ্ঠীর দ্বারা আবদ্ধ হয়ে পূর্ব বংলার স্বায়ত্তশাসনকে কেন্দ্রে রেখে কার্যকর কোন আন্দোলন ষাটের দশকে গড়তে পারেন নি।

সমস্যাটাকে স্পষ্ট করার জন্য ষাটের দশকে আমার নিজ অভিজ্ঞতা থেকে একটা দৃষ্টান্ত দিই। ছাত্র ইউনিয়নেও ষাটের দশকে অনেক দিন পর্যন্ত জাতীয় প্রশ্নে কোন বক্তব্য আনা যাচ্ছিল না। এক সময় স্বাধীনতার বক্তব্য এসেছিল এবং সেটা প্রাধান্য বিস্তার করেছিল। তবে সেসব ’৬৭-’৬৮ থেকে উল্লেখযোগ্য মাত্রায় শুরু হয় এবং প্রকাশ্যে আনুষ্ঠানিক রূপ পায় ১৯৭০-এর ২২ শে ফেব্রুয়ারীতে। ’৭০-এর ২২শে ফেব্রুয়ারীতে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন থেকে পল্টনের প্রকাশ্য জনসভায় স্বাধীন জন-গণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলার ১১ দফা কর্মসূচী ঘোষণা করা হয়। তখন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি ছিলেন মোস্তফা জামাল হায়দার এবং সাধারণ সম্পাদক ছিলেন মাহবুব উল্লাহ।

যাইহোক, স্বাধীনতার রাজনীতির এইা দ্রুত উত্থানের পিছনে নিশ্চয় ৬ দফার চাপও কাজ করেছিল। কিন্তু দীর্ঘদিন পর্যন্ত রাশেদ খান মেননসহ ছাত্র ইউনিয়ন নেতারা পূর্ব বাংলার নিজস্ব স্বায়ত্তশাসনের কর্মসূচীর প্রশ্নে তো বটেই এমনকি আইয়ুবের বিরুদ্ধেও আন্দোলনের কর্মসূচী দিতে চাইতেন না। কিন্তু কেন?

এর উত্তর শুধু মতাদর্শিক বিতর্কে না খুঁজে ছাত্র ইউনিয়ন যাদের নিয়ে গঠিত হয়েছিল ছাত্র হিসাবে তাদের গুণগত মানের দিকে তাকালেও পাওয়া যেতে পারে। সে কালের একটু অগ্রগামী অধিকাংশ ভাল ছাত্র পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন করত। এদের সামনে পাকিস্তানের লোভনীয় সরকারী পদগুলো ছিল অনেকটা উন্মুক্ত। বিশেষ করে ’৬২-এর ছাত্র আন্দোলনের পর পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সিভিল সার্ভিসে মেধার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে অনেক বাঙ্গালী তরুণ প্রবেশ করতে থাকে।

কিন্তু পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র লীগে সাধারণত শিক্ষাগতভাবে কিছুটা পিছিয়ে থাকা ছাত্রদের সমাহার ঘটত। এদের পক্ষে পাকিস্তানের লোভনীয় সরকারী পদগুলোতে প্রবেশের দরজা অতিক্রম করা অসম্ভব কিংবা দুরূহ ছিল। কাজেই স্বায়ত্তশাসনের তাগিদটা কাদের ভিতর বেশী থাকবে?

হাঁ, এমন এক শ্রেণীর দ্রুত উত্থানের জন্য যেমন পাকিস্তান প্রয়োজন ছিল নিজেদেরকে উন্নততর ও যোগ্যতর হিন্দুদের প্রতিযোগিতা-মুক্ত করতে তেমন এক সময় স্বায়ত্তশাসনের প্রয়োজন হল পাকিস্তানের পশ্চিমা মুসলমানদের অসম প্রতিযোগিতা থেকে নিজেদেরকে মুক্ত করতে। ৬ দফা ছিল তাদের কর্মসূচী। তবে মাঝখানে ৬ দফার সুযোগ নিয়ে এমন এক র্যাডিক্যাল তরুণ সামাজিক শক্তির উদ্ভব ঘটে যা পাকিস্তানের সমগ্র আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক-ভাবাদর্শিক কাঠামোর অবসান চেয়েছিল। তবে এদের চাওয়ার সঙ্গে বামপন্থী নেতৃত্বের কিংবা ঐ নেতৃত্বের সামাজিক ভিত্তির কোন সঙ্গতি বা ঐক্য ছিল না। বরং কিছুটা সঙ্গতি ছিল আওয়ামী লীগের মূল একটা জায়গার সঙ্গে সেটা হল ৬ দফা। কিন্তু এই তরুণ বামশক্তি নেতৃত্বের শক্তি হয়ে ওঠার অবকাশ পায় নি ব্যাপকতর জনগোষ্ঠী কৃষকেরও সমর্থন না পাওয়ায়। কৃষকের সমর্থন ন্যাপ বা পুরাতন বাম নেতৃত্বও পায় নি। আমি কিছু সংগঠিত কৃষকের কথা বলছি না, এক্ষেত্রে ব্যাপক কৃষক সমাজের সমর্থনের কথা বলছি। সেটা আওয়ামী লীগ পায়। সুতরাং, নেতৃত্বের প্রতিযোগিতায় আওয়ামী লীগ জিতে যায়। কিন্তু ছাত্র-যুব সম্প্রদায়ের প্রচণ্ড তেজ সমাজকে এমন একটা গতিশীলতা দিল যা বাঙ্গালী জাতির রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার যুদ্ধকে অনিবার্য করল। তবে এটাও বুঝতে হবে যে, ব্যাপক কৃষক জনগোষ্ঠীর প্রবল ও সক্রিয় সমর্থন ও অংশগ্রহণ ঘটে নি বলে স্বাধীনতার পক্ষের শক্তিকে ভারতে আশ্রয় নিতে হয়েছিল এত দ্রুত ও ব্যাপকভাবে। জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ দেশের ভিতর থেকে সেভাবে বিকশিত হতে না পারার সেটাও একটা কারণ ।

যাইহোক, বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর ’৭২ থেকে ’৭৫ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ তার তুলনামূলকভাবে পিছিয়ে থাকা মধ্যবিত্ত বুনিয়াদটাকে একটা দৃঢ় অর্থনৈতিক-সামাজিক শক্তি দিল। একটা পুরাতন বিত্তবান এবং এলিট গোষ্ঠীর জায়গায় এল এক নূতন বিত্তবান এবং এলিট গোষ্ঠী। আইয়ুবের কনভেনশন মুসলিম লীগ যে পুরাতন বিত্তবান এবং এলিটদের দিয়ে নিজ সামাজিক ভিত্তিকে মজবুত করেছিল সেটাকে আওয়াামী লীগ ভয়ানকভাবে দুর্বল করল।

অন্যদিকে বামপন্থীদের সামাজিক ভিত্তি শিক্ষিত ও অগ্রগামী মধ্য শ্রেণীটিকে পঙ্গু করে রাখা হল এবং তাদের রাজনৈতিক শক্তিকে প্রায় ধ্বংস করা হল।

কিন্তু দ্রুত সম্পদ ও সামাজিক ভিত্তি তৈরী করতে গিয়ে আওয়ামী লীগ যে ব্যাপক দুর্নীতি ও সন্ত্রাস করল তার ফলে তা জনগণ বিশেষ করে কৃষকের সমর্থন হারাল। এর সুযোগ নিল সেনাবাহিনী একটি সুসংগঠিত ও সশস্ত্র প্রতিষ্ঠান হিসাবে। জেনারেল জিয়া রাজনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্রে সেনাবাহিনীকে রেখে রাজনৈতিক দল হিসাবে বিএনপি-এর ছত্রছায়ায় ধনী এবং এলিটদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক ভিত্তি পুনর্গঠনে মন দিলেন। তাতে পেলেন মুসলিম লীগকে এবং ন্যাপ নেতৃত্বাধীন বামপন্থীদের মূল ধারাকে। এইভাবে দুই পরাজিত ও বিপন্ন শক্তির সাহায্য ও সমর্থন নিয়ে তিনি সাবেক পাকিস্তানের আর্থ-সামাজিক কাঠামোকে সুসংগঠিত ও বিস্তৃত করার কাজ শুরু করলেন। সেনাবাহিনীর নিয়ম ও শৃঙ্খলা এবং বিশেষ করে ন্যাপের সামাজিক শক্তির দীর্ঘ নিয়ম ও শৃঙ্খলার রীতিনীতি ও অভ্যাস এবং সাংগঠনিক ক্ষমতা-জনসংযোগ হল তার সহায়ক। এর সঙ্গে মুসলিম লীগের সামাজিক ভিত্তি এবং ঐতিহ্যিক শক্তির ভূমিকা তো আছেই। ফলে ১৯৭৫ পরবর্তী কাল তুলনায় স্থিতিশীলতার কাল।

মু্‌িক্তযুদ্ধ শুরু করায় ও গড়ে তোলায় নিজস্ব ভূমিকা সম্পর্কে সেনাবাহিনীর ভিতর যে অনুভূতি ও গৌরব বোধ ছিল জিয়ার মাধ্যমে তা আত্মপ্রকাশের একটা পথ পেল। শেখ মুজিব মুক্তিযুদ্ধের দায়িত্ব নেন নি; তা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ তাঁকে মুক্তিযুদ্ধের নেতা এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি বলেছে। সুতরাং বিএনপি-এর মাধ্যমে সেনাবাহিনী জিয়াকে মুক্তিযুদ্ধের ঘোষক বলল।


চার


একটা বিষয় বুঝতে হবে যে, ৬ দফা আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা যুদ্ধে উত্তরণ এবং ব্যাপক জনগণের নেতায় পরিণত হবার মাধ্যমে শেখ মুজিব আত্মদ্বন্দ্ব দ্বারা অধিকৃত হয়েছিলেন। যেমন তিনি সমাজতন্ত্র চান নি। তাঁর রাজনীতি ছিল পাশ্চাত্যের অনুকরণে একটি বুর্জোয়া অর্থনীতি ও সংসদীয় রাজনীতির অনুশীলন। এবং সেটি পাকিস্তান কাঠামো ভিত্তিক। ৬ দফার জাতীয়তাবাদও প্রকৃত পক্ষে পূর্ব পাকিস্তানী জাতীয়তাবাদ। অর্থাৎ এটি ছিল মুসলমানের সাম্প্রদায়িক পরিচিতির সঙ্গে বাঙ্গালীর জাতীয় পরিচিতির যোগসাধন।

কিন্তু বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ও চেতনার ক্রমবিকাশের সঙ্গে এল জয় বাংলা ্লোগান, সমাজতন্ত্রের বক্তব্য। যুদ্ধের পর সংবিধানের মূলনীতি হিসাবে এল জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র এবং সেকিউলারিজম বা ধর্মনিরপেক্ষতা। এর ফলে মুজিবের মধ্যে আত্মদ্বন্দ্ব দেখা দিল। যা তিনি চান নি তা তাঁকে বলতে বা করতে হচ্ছে। অথচ এটা করতে পারার কথা তাঁর নয়।

সুতরাং তাঁর পক্ষে যেটা পারা সম্ভব যুদ্ধের পর বাংলাদেশ-রাষ্ট্র হাতে পেয়ে সেটা করতে গেলেন। এর জন্য তিনি মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত আকাঙ্ক্ষার প্রকাশক শব্দগুলোকে ব্যবহার করলেন। কিন্তু উদ্দেশ্য মুসলমান বাঙ্গালীর সেই মধ্যবিত্ত শ্রেণী বা গোষ্ঠীকে সামাজিক-আর্থিক দিক থেকে উচ্চবিত্তে পরিণত করা যারা তুলনায় পিছিয়ে আছে। কিন্তু এরা হঠাৎ বড়লোক হতে গিয়ে যখন মুজিবকেও বিপন্ন করল তখন তিনি রাশ টানতে গিয়ে বাকশাল করলেন। এর ফলে আওয়ামী লীগের যে সমর্থন ভিত্তিটিকে তিনি অর্থ-বিত্ত ও ক্ষমতার শীর্ষে নিচ্ছিলেন তারাও তাঁর প্রতি বৈরী হল। তাঁর দুর্ভগ্য যে, উন্নত পুঁজিবাদ, বুর্জোয়া গণতন্ত্র এবং সমাজতন্ত্র কোনটা গড়ার শক্তিই তিনি কিংবা তাঁর দল ছিল না। তবু পাকিস্তানের কাঠামো থাকলে সেখানে সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্রের নিয়ন্ত্রণে থেকে তাঁর দল ও সমর্থন ভিত্তি কিছুটা সংযত থাকতে বাধ্য হত। কিন্তু যুদ্ধ এবং পাকিস্তান ধ্বংস এমন এক শূন্যতা সৃষ্টি করল এবং তাঁর দলের হাতে এমন ক্ষমতা এনে দিল যার ফলে তাঁর দলকে সংযত করার ক্ষমতা কারো হল না। ফলে দলের জনবিচ্ছিন্নতা সম্পূর্ণ হয়ে এলে সেনাবাহিনী হস্তক্ষেপ করল একটা দুর্বল মুহূর্তের সুযোগ নিয়ে।

এই দিক থেকে বলা যায় যে, শেখ মুজিব যে আত্মদ্বন্দ্বের শিকার হয়েছিলেন জিয়া তা থেকে অনেকাংশে মুক্ত ছিলেন। ৬ দফা বাস্তবায়ন হলে আওয়ামী লীগ পাকিস্তান কাঠামোর ভিতরে থেকে পূর্ব পাকিস্তানে যা করতে পারত, জিয়া স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রে তা করতে চেষ্টা করলেন। তাঁর বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদও সেই বাস্তবতার প্রতীক।

আওয়ামী লীগ বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের কথা বললেও তার ভিত্তি হল বর্তমান বাংলাদেশ রাষ্ট্র। অর্থাৎ পশ্চিম বাংলা এবং ত্রিপুরার বাঙ্গালী জাতি তার জাতীয়তাবাদের অন্তর্ভুক্ত নয়। অর্থাৎ আওয়ামী লীগের বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ খণ্ডিত জাতীয়তাবাদ। এই জাতীয়তাবাদের ভিতর আছে প্রকৃতপক্ষে ধর্মীয় পরিচয়ের ইতিহাস। অথচ তা সেটাকে স্বীকার করে না। ফলে এটা একটা স্ববিরোধ কিংবা বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে। আনুষ্ঠানিক বা তত্ত্বগতভাবে এই জাতীয়তাবাদ সেকিউলার হলেও এই স্ববিরোধের দিকটা থেকে যায়। জিয়া তা থেকে মুক্ত। তিনি রাষ্ট্রীয় ভূখণ্ডের নাম অনুযায়ী জাতীয়তাবাদের নামকরণ করলেন বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ। এর মধ্যে বাঙ্গালী সত্তা এবং ধর্মীয় সত্তা দুই-ই স্থান পেল। অবশ্য এর দ্বারা বাঙ্গালীর বৃহত্তর জাতি-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ভবিষ্যৎ কোন সম্ভাবনাকেও রোধ করা হল।

যাইহোক, সব মিলিয়ে বলা যায় জিয়া ৬ দফার ভাবপ্রেরণাকে স্বাধীন বাংলাদেশে নিয়ে এলেন। এই দিক থেকে বলা যায় যে, তিনি শেখ মুজিবের সঙ্গতিপূর্ণ, শৃঙ্খলাবদ্ধ উত্তরাধিকারী।

এবং উভয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী। ফলে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি-ও। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ কর্তৃক নিগৃহীত ও নির্যাতিত সামাজিক ভিত্তি বিএনপি-তে যাওয়ায় তা আওয়ামী লীগের প্রতি ভয়ানকভাবে বিদ্বিষ্ট। শেখ মুজিবকে সপরিবারে হত্যা এবং জেলে আবদ্ধ চার আওয়ামী লীগ নেতা হত্যার প্রক্রিয়ায় জিয়ার উত্থান বলে আওয়ামী লীগেরও বিদ্বেষ ও ঘৃণা বিএনপি-এর প্রতি।

আওয়ামী লীগ তাদের অর্থ-বিত্ত ও সামাজিক ভিত্তি নিরঙ্কুশ করার পূর্বেই ক্ষমতাচুøত হয়। সেনাবাহিনী ও বিএনপি পুনরায় পুরাতন বিত্তবান শ্রেণীটিকে প্রতিষ্ঠিত করে যারা মূলত পাকিস্তানের সমর্থক ছিল। বিএনপি-তে শুধু বামধারার এক বড় অংশ গেল না, উপরন্তু আওয়ামী লীগ আমলে বিত্ত অর্জনকারী এক বৃহৎ অংশও গেল। বামরা গেল আওয়ামী লীগ আমলে নিজেদের যে ভয়ানক ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছিল তা পূরণ করতে এবং অর্থ ও ক্ষমতা অর্জনের আশায়। অর্থাৎ যে সমাজতন্ত্রের কারণে এই বামরা আওয়ামী লীগ বিরোধী হয়েছিল সেই সমাজতন্ত্রকেই তারা পরিত্যাগ করল। পরবর্তীরা (আওয়ামী লীগ শাসনের সুবিধাভোগীরা) গেল আরও অর্থ-বিত্ত সঞ্চয়ের প্রয়োজনে। কিন্তু আওয়ামী লীগের বৃহত্তর শ্রেণী ভিত্তিটি আওয়ামী লীগের সঙ্গেই রয়ে গেল। আওয়ামী লীগের দ্রুত পতনের কারণে তাদের বিকাশও অসম্পূর্ণ রয়ে গেল। আর অর্থ-বিত্তে, মেধায়, আন্তর্জাতিক সংযোগে এগিয়ে থাকা অংশের সঙ্গে এই সবে পিছিয়ে থাকা অংশের দ্বন্দ্ব থাকেই। সুতরাং পরের অংশটাকে প্রতিনিধিত্ব করার জন্য আওয়ামী লীগ রয়ে গেল।

একুশ বৎসর আওয়ামী লীগ ক্ষমতার বাইরে ছিল। জাতীয় পার্টিও মূলত বিএনপি-এর রাজনীতির একটা পর্যায় মাত্র। বলা যায় জিয়ার মৃতুøর পর সামরিক বাহিনী কর্তৃক রাজনৈতিক নেতৃত্ব সরাসরি পুনর্দখলের জন্য সেনাপতি এরশাদের আগমন। কারণ জিয়ার উত্তরাধিকারী বিচারপতি সাত্তার ছিলেন বেসামরিক ব্যক্তি।

এরশাদ ক্ষমতা দখলের পর জিয়ার রাজনীতিকেই এগিয়ে নিলেন। সামরিক নেতৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণে এবং জাতীয় পার্টির সাহায্যে আমলা ও উচ্চবিত্তদের ভিত্তি করে পাশ্চাত্য নির্ভর আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা মজবুত করার কাজকে এগিয়ে নিলেন। কিন্তু তাঁর সমস্যা হল যে, এতোদিন যে সামাজিক শক্তিগুলো সামরিক নেতৃত্ব মেনে নিয়েছিল তারা সবাই আর তা মানতে রাজী হল না। সুতরাং জিয়ার নেতৃত্বে সংগঠিত সামাজিক শক্তিগুলোকে এরশাদ পুরোপুরি পেলেন না। বরং ছাত্ররা এবং জিয়ার বিধবা পত্নী খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে এলিট শ্রেণীর একটি বড় অংশ তাঁর বিরুদ্ধে সংগঠিত হল। তবু এরশাদ নয় বৎসর টিকলেন মূলত আওয়ামী লীগ ও বিএনপি-র দ্বন্দ্বকে ব্যবহার করে। বিএনপি এরশাদের সেনা নিয়ন্ত্রিত রাজনীতিতে কখনই অংশ নিল না। এক সময় এতে অংশ নিলেও শেষে আওয়ামী লীগও সেনা নিয়ন্ত্রিত রাজনীতির বিরুদ্ধে দাঁড়াল।

এরশাদের পতন এ দেশের রাজনীতি ও সামাজিক ক্ষেত্রে পাকিস্তান আমল থেকে চলে আসা সামরিক নেতৃত্বের মর্যাদায় সিভিল সমাজের প্রচণ্ড আঘাত। বস্তুত এর ফলে এ দেশে সেনাবাহিনীর রাজনৈতিক ক্ষমতা বা নেতৃত্ব দখলের প্রবণতা মারাত্মকভাবে ঘা খেয়েছে।

১৯৯০-তে গণ-আন্দোলনের চাপে এরশাদ এবং জাতীয় পার্টির পতনের পর প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে গঠিত বেসামরিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সাধারণ নির্বাচন হলে বিএনপি পুনরায় ক্ষমতায় আসে। কিন্তু নয় বৎসর শাসন ক্ষমতার বাইরে অবস্থান এবং গণ আন্দোলনের ভিতরে থাকার ফলে এবং সর্বোপরি জিয়ার মৃতুøর ফলে সরাসরি সামরিক ব্যক্তির নেতৃত্বে না থাকার ফলে বিএনপির সামরিক বৈশিষ্ট্যের তুলনায় বেসামরিক বৈশিষ্ট্য শক্তিশালী হয়ে ওঠে। কিন্তু তার সামাজিক ভিত্তি অপরিবর্তিত রয়ে যায়।

কিন্তু বিএনপিও দুর্নীতির বিস্তার ও সন্ত্রাস রোধে ব্যর্থ হয়। আওয়ামী লীগ এই পরিস্থিতির সুযোগ নেয়। বিএনপি-এর পদত্যাগ এবং তত্ত্ববধায়ক সরকারের অধীন নির্বাচনের দাবীতে আওয়ামী লীগ আন্দোলনে নামে। এইভাবে এ দেশে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে উচ্চ ও মধ্যবিত্তের তুলনামূলকভাবে পিছিয়ে থাকা অংশ অপেক্ষাকৃত এগিয়ে থাকা এবং সুবিধাভোগী উচ্চ ও মধ্যবিত্তের অংশের সঙ্গে সংঘাতে নামে। এবার একটি ঘটনা ঘটে। বেসামরিক আমলাদের এক প্রধান অংশ যারা ইতিপূর্বে এরশাদের পতনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল তারা আওয়ামী লীগকে সমর্থন দিল। এক পর্যায়ে বিএনপি আওয়ামী লীগের চাপের কাছে নতি স্বীকার ক’রে তত্ত্বাবধায়ক সরকার দাবী মেনে নিয়ে প্রধান বিচারপতি হাবিবুর রহমানের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করে।

আওয়ামী লীগ কৃষক ও সাধারণ মানুষের বড় অংশের সমর্থন পায় নির্বাচনে। এছাড়া উদারনৈতিক বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষিত মহলের যে বড় অংশটি এতকাল আওয়ামী লীগ বিরোধী ছিল তারাও এবার আওয়ামী লীগকে সমর্থন দিল। এর একটি প্রধান কারণ বিএনপি-এর ব্যর্থতা এবং তার সাম্প্রদায়িকতা ঘেষা রাজনীতির প্রতি তাদের বিরোধিতা। প্রাক্তন মস্কোপন্থী বুদ্ধিজীবীরা দীর্ঘকাল আওয়ামী লীগ সমর্থক। কিন্তু প্রাক্তন পিকিংপন্থী বা বামপন্থী ধারা থেকে আগত বুদ্ধিজীবী ও মধ্যবিত্তের এই সমর্থন আওয়ামী লীগের নূতন লাভ।

এটা ঠিক যে, প্রকৃত অর্থে আওয়ামী লীগও সেকিউলার নয়। তবে সেটা তার চরিত্রে ও আচরণে। কিন্তু তা নীতিগতভাবে সেকিউলার রাজনীতির কথা বলে। তবে তার সঙ্গে তা ধর্মের আবেদনকেও ব্যবহার করে। আমরা বোধ হয় আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি-এর মতাদর্শিক পার্থক্যকে এভাবে ব্যাখ্যা করতে পারি যে, আওয়ামী লীগ মুসলমান এবং বাঙ্গালী, কিন্তু বিএনপি বাঙ্গালী মুসলমান। অর্থাৎ আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে ধর্মীয় পরিচয় এবং জাতীয় পরিচয়ের মাঝখানে একটা এবং-এর বিভাজন আছে যেটা বিএনপি-এর ক্ষেত্রে নেই। বিএনপি-এর রাজনীতিতে ধর্ম এবং রাজনীতি সংমিশ্রিত। আর এইভাবে এ দেশে বিএনপি হয়েছে ধর্মাশ্রিত জাতীয়তাবাদী রাজনীতির প্রধান প্রতিনিধি। এর প্রতিক্রিয়ায় যারা ধর্ম এবং রাজনীতিকে পরস্পর বিচ্ছিন্ন দেখে কিংবা এই দু’টোকে সমান্তরালে রাখতে চায় তাদের প্রধান প্রতিনিধি হয়েছে আওয়ামী লীগ। এ দেশে সেকিউলার শক্তি নিম্নবিত্ত ও নির্বিত্ত জনতার ভিতর প্রভাব বিস্তারকারী এবং তাদের সঙ্গে সংযুক্ত মধ্যবিত্ত ও বুর্জোয়া শ্রেণী গড়ায় ব্যর্থ হবার ফলে তাদের সামাজিক-আর্থিক ভিত্তি অতীব দুর্বল। এই অবস্থায় তাদের নেতৃত্বের শক্তি হিসাবে কার্যকর ভূমিকা নেবার সামর্থøও খুব সীমিত। অন্যদিকে এতদিন সমাজতান্ত্রিক শিবিরের প্রভাবে সমাজতন্ত্রের যে প্রভাব শিক্ষিত চেতনায় ছিল, তাও এখন মৃত প্রায়। সমাজতন্ত্রের ধারণা আওয়ামী লীগও শেষ পর্যন্ত পরিত্যাগ করেছে। তবে তা এ দেশে সমাজতন্ত্রের প্রভাবে গড়ে ওঠা সেকিউলার ধারণাকে একেবারে বিদায় দেয় নি। ফলে এ দেশে সেকিউলার শক্তিগুলোর পক্ষে সাধারণভাবে এই প্রশ্নে আওয়ামী লীগকে সমর্থন না দিয়ে উপায় থাকে নি।

বস্তুত এ দেশে উদারনৈতিক, নীতি ও নিয়মনিষ্ঠ এবং সেকিউলার সামাজিক -- রাজনৈতিক শক্তির বিকাশের পথে মূল অন্তরায় কৃষক ও আম-জনতার পশ্চাৎপদ চেতনা এবং নীতিবোধের নিম্নমান। ফলে এমন কোন রাজনৈতিক শক্তি এ দেশে এ যাবৎ দৃঢ়বদ্ধ ও সফল হতে পারে নি যা সেকিউলার, উৎপাদনশীল এবং নীতিনিষ্ঠ। আওয়ামী লীগের কৃতিত্ব হচ্ছে নীচ তলার এই জনতার নিম্ন চেতনার সঙ্গে আধুনিক যুগের সেকিউলার ও উদারনৈতিক চেতনার এক ধরনের সংযোগ সাধন। এর ফলে তার চরিত্রে ও আচরণে প্রচুর বা নিদারুণ স্ববিরোধ। কিন্তু এর ফলে সমাজের নিম্নবর্গ এবং বুদ্ধিজীবীদের এক বৃহৎ অংশকে তার পক্ষে রাখা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু এটা তার মধ্যে এমন এক আত্মদ্বন্দ্ব জন্ম দেয় যা তাকে ব্যর্থতায় নেয়, অতীতে নিয়েছে, বর্তমানেও নিচ্ছে।

কিন্তু বিএনপি-এর সমস্যা আরেক ধরনের। তা পশ্চাৎপদ জনতাকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য প্রধানত ধর্মের আবেদন ব্যবহার করে। ভারত বিরোধিতাও এ ক্ষেত্রে তার হাতিয়ার। ধর্মের এই ব্যবহার জনতার আনুগত্য ও সমর্থন আদায়ের সহজ পদ্ধতি হতে পারে। কিন্তু আধুনিক শিল্প সভ্যতার উপযোগী সেকিউলার ও গণতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণা ও চরিত্র গড়ে ওঠার পথে এটা প্রতিবন্ধক হয়। ফলে উন্নয়ন ও শিল্পায়নের পথে এটা সহায়ক হবার পরিবর্তে প্রতিবন্ধক হয়। জনগণের পশ্চাৎপদ, স্বৈরতান্ত্রিক ও প্রতিক্রিয়াশীল চেতনাকে ব্যবহার ক’রে অবাধ লুণ্ঠনের মাধ্যমে সহজে অর্থ-বিত্ত সঞ্চয় করা যায়, কিন্তু উৎপাদনশীল বুর্জোয়া অর্থনীতি গড়া যায় না। অর্থাৎ এই রাজনীতিরও পরিণাম হল লুটেরা ধনিক শ্রেণীর বিকাশ।

কিন্তু আওয়ামী লীগের অসুবিধা অনেক বেশী। কারণ তা আধুনিক ও সেকিউলার রাজনীতির কাঠামোতে উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতার যে প্রতিশ্রুতি দেয় তা পালনের সামর্থø তার নেই।

শেষ পর্যন্ত উভয়ে ব্যর্থ। আর এই ব্যর্থতার কারণ শুধু উপরে নেতৃত্বের মধ্যে সন্ধান না করে নীচেও সন্ধান করা দরকার। সমাজতলে অবস্থিত কৃষক, শ্রমিক ও সাধারণ মেহনতী মানুষের মধ্যেও এই ব্যর্থতার কারণ সন্ধান করতে হবে। আম-জনতার নিদারুণ পশ্চাৎপদ মন-মানসিকতা ও সংস্কৃতির মধ্যেও সঙ্কটের উৎসটাকে খোঁজা দরকার। তখন দেখা যাবে যে, যে রাজনীতি যত বেশী গণভিত্তিক হয় তার তত বেশী অধঃপতন ঘটে। সমাজতল থেকে যে নেতৃত্ব উঠে আসে এই কারণে তার এত নিকৃষ্টতা। ভোটের রাজনীতির সমস্যাটাও এই জায়গায়। সামরিক বাহিনীতে একটা কঠোর শৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তিতা থাকায় পশ্চাৎপদতা, প্রতিক্রিয়াশীলতা এবং স্বৈরতান্ত্রিকতা সত্ত্বেও রাজনীতিতে প্রথম দিকে তার ভূমিকা এই কারণে অনেকটা সফল হয়। কিন্তু সামাজিক সমর্থনের প্রয়োজনে জনগণের অংশ গ্রহণের ব্যাপ্তি বাড়াতে হয়। এক সময় ভোটের প্রয়োজনও হয়। এইভাবে তার যত বাড়ে সমাজিক ভিত্তি অর্জনের প্রয়োজন তত বেশী তার ভিতর দুর্নীতি, অনিয়ম ও বিশৃঙ্খলা ব্যাপ্ত হয়। আমাদের দেশের এলিট বা উচ্চবর্গের সেই সামাজিক-রাজনৈতিক-মতাদর্শিক ব্যবস্থা নেই যার রক্ষাব্যূহে থেকে তারা নিজেরা আধুনিক ও সেকিউলার হবে, উৎপাদনশীল এবং নিয়মনিষ্ঠ হবে এবং আম-জনতাকে এই চরিত্র অর্জনের জন্য তৈরী করে নিবে।

সুতরাং আপাতত আওয়ামী লীগ-বিএনপি-এর দ্বন্দ্ব ও সংঘাতের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র ক্ষমতাকে ব্যবহার ক’রে লুণ্ঠন, অনিয়ম ও দুর্নীতির সাহায্যে নিজেদের অর্থ-বিত্ত, সুযোগ-সুবিধা রক্ষা ও বৃদ্ধির লড়াইটাই চলবে দুই সামাজিক গোষ্ঠীর মধ্যে যাদের আর্থিক অবস্থানে, মেধা ও শিক্ষাগত মানের অবস্থানে কিছু পার্থক্য থাকলেও চরিত্রে যারা সবাই মূলত এক।*

রচনাঃ ২৩-২৭ এপ্রিল, ১৯৯৭

* ১৯৯৭ সালে লিখিত প্রবন্ধটি ঐ একই বৎসর ঢাকা থেকে প্রকাশিত দৈনিক ‘বাংলাবাজার পত্রিকা’য় প্রকাশিত হয়। দশ বৎসর পূর্বে লিখিত হলেও এর প্রাসঙ্গিকতা ও তাৎপর্য বিবেচনা করে ওয়েব সাইটে বিশেষ নিবন্ধ হিসাবে দেওয়া হল। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা দরকার যে, কয়েক জায়গায় সামান্য কিছু সংশোধন করা হয়েছে।

 

সাদ্দাম হোসেন

৩ এপ্রিল, ২০০৭

 

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
Archive
 
সাম্প্রতিক পোষ্টসমূহ