লিখেছেনঃ বিনয় ঘোষ , আপডেটঃ May 11, 2009, 6:00 PM, Hits: 16831
আদিমযুগের অতিকথার (Myth) একটা গঠনবিন্যাস (Structure) আছে যা লেভি-স্ত্রাউসের মতো নৃবিজ্ঞানীদের দৃষ্টির রঞ্জনরশ্মিতে ধরা পড়ে এবং যার ভিতর থেকে আদিম বর্বর বন্য মানসের (The Savge Mind) আপাত-অজ্ঞাত চিন্তাভাবনাকল্পনার বর্ণাঢ্য রূপ রামধনুর মতো চোখের সামনে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। কিন্তু আধুনিক যুগের অর্থাৎ ধনতান্ত্রিক যুগের অতিকথাগুলি আত্মগোপন করে থাকে নীরেট সব তথ্যের পাথরচাঁইয়ের তলায় এবং তথ্য মানে রাজারাজড়ার সিংহাসন কাড়াকাড়ির কাহিনী, প্রাসাদচক্রান্ত আর যুদ্ধবিগ্রহের বিবরণ, মুষ্টিমেয় কয়েকজন ওমরাহ-উমেদারের অথবা একালের স্বনামধন্য কয়েকজন ব্যক্তির কীর্তিকলাপ। বলা বাহুল্য, এই ইতিহাস দেশের ইতিহাস নয়, লোকসমাজেরও ইতিহাস নয়। একথা আজ সর্বজনস্বীকৃত। তদুপরি আমাদের দেশের ঐতিহাসিকরা ইতিহাসচর্চা শিখেছেন ইংরেজদের কাছ থেকে। নৃবিদ্যা প্রত্নবিদ্যা ইত্যাদির সাহায্যে ভারতের সুদূর অজানা অতীতের ইতিহাস, প্রধানত ইংরেজদের অভিভাবকত্বে, পুনরুদ্ধৃত হয়েছে। একথা সত্যের খাতিরে অস্বীকার করা যায় না। এদিক থেকে বিদ্যানুরাগী কয়েকজন ইংরেজের কাছে আমরা ঋণী, যেমন কানিংহাম, মার্শাল, বেগলার, হাটন এবং আরও অনেকে। কিন্তু ‘আধুনিক’ যুগের ইতিহাস অনুশীলনের ক্ষেত্রে ইংরেজরা নানাদিক থেকে এদেশীয় ঐতিহাসিকদের বিচার-বুদ্ধিকে ঘোলাটে-ধোঁয়াটে করে দিয়েছেন। উপনিবেশিক বুদ্ধিজীবীর মতো আমরা ইংরেজদের গুরুগিরি অন্ধের মতো মেনে নিয়েছি। আধুনিক যুগ মানে ইংরেজ শাসকদের যুগ, তাই আধুনিক যুগের ইতিহাস-ব্যাখ্যায় শাসকরা আমাদের বুঝিয়েছেন যে তাঁরাই আধুনিকতার ভগীরথ এবং আধুনিকতা মানে প্রগতি অগ্রচিন্তা, সামাজিক ও ধর্মীয় কুসংস্কার-মুক্তি, অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক অগ্রগতি, যার গাণিতিক যোগফল হল ‘নবজাগৃতি’, যেমন ইয়োরোপের ‘রেনেসাঁস’ সেইরকম। ‘রকম’ দেখে আমরা ধাঁধিয়ে গিয়েছি কিন্তু রকমটা যে ‘কি রকম’ তা আর ভেবে দেখিনি। সাদা (White) ঐতিহাসিকরা বলেছেন অতএব কালা (Black Native) ঐতিহাসিকদের তার পুনরাবৃত্তি করা ছাড়া কোনো গতি নেই। তাই মনে হয়, আমাদের দেশের আধুনিককালের ব্রাহ্মণোত্তর বৃদ্ধিজীবীদের ঠিক অ্যাণ্টনিও গ্রামসির সংজ্ঞানুসারে ‘Traditional’ ও ‘Traditional’ গোষ্ঠীতে দ্বিচিহ্নিত করা যায় না।* ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠীর লেজুড়রূপে মূলত তাঁদের ‘Organic’ বলেই চিহ্নিত করতে হয়, যদিও গ্রামসির ’Traditional’ গোষ্ঠীভুক্ত দুচারজন ভাসমান স্বনির্ভর বুদ্ধিজীবী ছিলেন না যে তা নয়, কিন্তু তাঁরা ব্যতিক্রম। ব্যতিক্রম, বুদ্ধিজীবীদের ক্ষেত্রে, আমাদের আলোচ্য নয়, আপাত ইতিহাসের গতিনির্ণয় করাই আমাদের লক্ষ্য।
* Antonio Gramsci; The Modern Prince & other Writings, N. Y. 1970 – ‘The Formation of Intellectuals’ অধ্যায় দ্রষ্টব্য।
উল্লেখ্য হল, ইয়োরোপীয় ‘রেনেসাঁসে’র মডেলটি ইংরেজ ঐতিহাসিকদের কাছ থেকে গ্রহণ করে আমাদের দেশে নির্বিচারে যাঁরা প্রয়োগ করতে অত্যুৎসাহী হয়েছেন তাঁরা একজাতের অভিজাত কলেজে হয়ত শিক্ষালাভ করেছেন (যেমন প্রেসিডেন্সি কলেজে), পরীক্ষার প্রতিযোগিতায় অন্য সকলকে দাবিয়ে টপকে সর্বোচ্চ স্থান অধিকার করেছেন, অতএব ‘ইতিহাস’ মানে ‘তিনি’ এবং ‘তিনি’ আর ‘ইতিহাস’ অভিন্ন এবং তাঁর মার্কসবাদী ব্যাখ্যানও অভ্রান্ত। এইটাই বিভ্রান্তিকর ট্র্যাজিডি। অর্থাৎ এই মার্কসীয় ঐতিহাসিক ব্যাখ্যাই নবজাগৃতির প্রত্যয়ের নিমিত্তকারণ। অবশ্য এই ট্র্যাজিডির মূলে আরও একটি বড় কারণ আছে এবং সেটা হল ‘ভারতে ইংরেজ শাসনের ফলাফল’ সম্বন্ধে কার্ল মার্কসের উক্তিগুলি। এরকম একটি উক্তি উদ্ধৃত করে (বাংলা তর্জমা) আজ থেকে তিরিশ বছর আগে (তখন আমার নিজের বয়সও তিরিশ) ‘বাংলার নবজাগৃতি’ লেখা আরম্ভ করেছিলাম। (প্রথম অধ্যায় ‘নবজাগৃতিকেন্দ্র কলিকাতা’ দ্রষ্টব্য)। অনেক বড় পরিকল্পনা ছিল, তিনখণ্ডে এই নবজাগৃতির ইতিহাস রচনা করব, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা করা হয়নি, কেবল প্রথম খণ্ড ‘পশ্চাদভূমি’ হিসেবে প্রকাশিত হয়েছিল ১৩৫৫ সনে। তারপর ১৩৮৫ সন পর্যন্ত আরও তিরিশ বছর কাটল, ইতিহাসচর্চার আদিগঙ্গা দিয়ে অনেক ঘোলা জল বয়ে গেল দেখলাম। অনেক প্রশ্ন জাগল মনে, অনেক প্রশ্ন। শহর থেকে গ্রামের দিকে তাকাবার ইচ্ছা হল প্রবল। অদম্য ইচ্ছা। শহরে জন্ম, শহরে মানুষ হলেও গ্রামের পথে পা বাড়িয়ে চলতে আরম্ভ করে ক্লান্তি বোধ করিনি কখনও, আজও করি না, বয়স হলেও বাংলার গ্রামের মানুষ, গ্রামের সমাজ, গ্রামের জীবনযাত্রা, গ্রামের সংস্কৃতি স্বচক্ষে দেখতে দেখতে বারংবার মনে হতে লাগল, পণ্ডিতেরা উনিশ শতকে বাংলার যে রেনেসাঁস বা নবজাগরণের কথা বলেন, সেটা কি পদার্থ? কোথায় এবং কখন ‘জাগরণ’ হল? জাগল কারা? কলকাতা শহর যদি ‘নবজাগৃতিকেন্দ্র’ হয়, যদি রেনেসাঁসের সূর্য ‘জ্যোতির কনকপদ্মের’ মতো কলকাতার আকাশে উদিত হয়ে থাকে, তাহলে কলকাতার খুব কাছাকাছি গ্রামেও, দেড়শো বছর পরেও, কেন অমাবস্যার রাতের মতো অন্ধকার? কেন অতীতের ছেঁড়াকাঁথায় শুয়ে গ্রামের মানুষ আজও গভীর ঘুমে অচৈতন্য? কেন পৌরাণিক যুগের স্বপ্নের ঘোরে আজও তাদের স্বপ্নচারিতা? এরকম অনেক প্রশ্ন। অনেক সংশয়।
কার্ল মার্কস ১৮৫৩ সালে New York Tribune পত্রিকায় ১০ জুন, ২৪ জুন ও ২২ জুলাই তারিখে যথাক্রমে The British Rule in India’ ‘The East India Company – It’s History and Results’ এবং ‘The Future Results of British Rule in India’ নামে তিনটি প্রবন্ধ লেখেন। তখন বাংলার ’নবজাগরণপর্ব’ রামমোহন ও ডিরোজীয়ানদের যুগ অতিক্রম করে বিদ্যাসাগরের যুগে পদার্পণ করেছে। রামমোহনের সঙ্গে কার্ল মার্কসের দেখা হয়নি, মার্কস তখন ছাত্র, যদিও বেন্থাম, উইলবারফোর্স, রবার্ট ওয়েন এবং আরও অনেকের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়েছিল। প্রথম লেখাটি ট্রিবিউনে প্রকাশিত হবার পর (১০ জুন, ১৮৫৩) মার্কস ১৪ জুন তারিখে লণ্ডন থেকে এঙ্গেলসকে একটি চিঠিতে লেখেন:[1]
Your article on Switzerland was of course a direct smack at the leader in the Tribune (against centralization, etc) and..... I have continued this hidden warfare in a first article on India, in which the destruction of the native industry by England is described as revolutionary. This will be very shocking to them. For the rest the whole rule of Britain in India was swinish, and is to this day.
The stationary character of this part of Asia – despite all the aimless movement on the political
surface – is fully explained by two mutually dependent circumstances : (1) The public works were the business of the Central Government ; (2) besides these the whole empire, not counting the few larger towns, was resolved into villages, which possessed a completely separate organization and formed a little world in themselves.
These idyllic republics, which jealously guarded only the boundaries of their village against the neighbouring village, still exist in a fairly perfect form in the North-Western parts of India which have but recently fallen into the English hands. I do not think one could imagine a more solid foundation for the stagnation of Asiatic despotism. And however much the English may have Irelandised the country, the breaking up of those stereotyped primitive forms was the sine qua non (essential condition) of Europeanisation. The tax-gatherer alone was not the man to achieve this. The destruction of their archaic industry was necessary in order to deprive the villages of their self-supporting character.
ট্রিবিউন পত্রিকার তিনটি রচনা এবং এরকম কয়েকটি চিঠি আমাদের দেশের মার্কসবাদী ঐতিহাসিকদের নবজাগরণতত্ত্বের সৌধ রচনায় গথিক স্তম্ভের মতো কাজ করেছে, যেহেতু এগুলি কার্ল মার্কস লিখেছেন। এঙ্গেল্স যেমন ‘The Class Struggle in France’ (Marx) গ্রন্থের প্রথম পুনর্মুদ্রণে ভূমিকা লিখে (মার্চ ১৮৯৫) শোধনবাদীদের (Revisionist) গুরুর কাজ করেছিলেন অজ্ঞাতসারে,[2] মার্কসও তেমনি ‘ভারতে ব্রিটিশ শাসনের ফলাফল’ সম্বন্ধে এই রচনাগুলি ও চিঠিপত্র লিখে মার্কসবাদের যান্ত্রিক বিকৃতির পথ সুগম করে দিয়েছেন। যেমন রাজনীতি সমাজ সংস্কৃতির সঙ্গে অর্থনীতির অর্থাৎ উৎপাদন ব্যবস্থা ও উৎপাদনসম্পর্কের রৈখিক সম্পর্ক স্থাপন করে ‘Vulgar Marxism’ -এর বিকাশ হয়েছে তেমনি। মরিস গদেলিয়ের (Maurice Godelier) বলেছেন
how are we to conceive the relations between the determining structure and the dominant one, and what determining in economic relations in it that dictates that there shall be dominance by kinship-relations or by politico-religious relations? The question could not be answered, or even asked, by dogmatic Marxism and the other forms of that vulgar materialism to which dogmatic Marxism belongs, even though it denies the affinity. For vulgar materialism, the economy, which it reduces to the relations between technology and environment, ‘produces’ the given society, giving rise to it as an epiphenomenon. This means refusing to see the irreducible differences between the levels and structures of social life, the reason for the relative autonomy with which they operate, and reducing all levels to so many functions, either apparent or concealed, of economic activity.
গদেলিয়ের প্রশ্ন করেছেন এবং খুব সঙ্গত প্রশ্নí[3]
How could this hypothesis be reconciled with the fact for example, that within many primitive societies it is relations of kinship between men that dominate social organization…. or that religious relations seem to dominate Indian society, dividing men into a hierarchy of castes in accordance with an ideology of purity and impurity…?
সঙ্গত তো বটেই, খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন করেছেন গদেলিয়ের এবং এই প্রশ্নের উত্তরের সন্ধানে তিনি নৃতত্ত্বের অনুশীলনে প্রবৃত্ত হয়েছেন।
I therefore became an anthropologist.
In association with Professor Levi-Strauss, who took a close interest in my project and obtained for me all the facilities I needed in order to carry it out, I therefore undertook to initiate myself into anthropology, while devoting special attention to what is called ‘economic anthropology’, the field that it seemed ought to include the data of my theoretical problems and perhaps the elements of their solution.
সমাজটা হল ‘সমূহ’ বিশেষ এবং সমূহ (aggregates) দুরকমের হতে পারে। একরকম হল ‘অযুতসিদ্ধাবয়ব সমূহ’ (those of which the parts are in union and fusion, being lost in the whole), আর একরকম হল ‘যুতসিদ্ধাবয়ব সমূহ’ (mechanical aggregates – collection of distinct and independent parts)। সর্বস্তরের মানব সমাজই অযুতসিদ্ধাবয়ব সমূহ, এবং উপর থেকে যত নিচের স্তরের দিকে নেমে যাওয়া যায় তত দেখা যায় যে তার এই অযান্ত্রিক রূপটা বেশ প্রকট। সেখানে সমাজের ছবিটা তীব্র ফোকাসে খুব পরিষকার দেখা যায়। সমাজভিত্তির অর্থনীতি যদি সমাজে উপরতলার একমাত্র নিয়ন্ত্রক হত তাহলে আজকের সমাজের অনেক বিরোধের, অনেক জটিলতার সমাধান সহজেই হয়ে যেত। তা হয়নি।
হয়নি তার কারণ সমাজগড়ন সমাজমানস এবং মানুষ, কোনোটাই ঠিক সরল পাটিগণিতের মতো সহজ নয়। মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক, মানুষের সঙ্গে দেবতার সম্পর্ক, মানুষের সঙ্গে সমাজের সম্পর্ক, সমাজের সঙ্গে অর্থনীতির সম্পর্ক, রাজনীতির সম্পর্ক, সাহিত্যসংস্কৃতিশিল্পকলার সম্পর্ক, কোনোটাই ‘ইউনিলিনিয়ার’ নয়, সরল রেখার মতো সম্পর্ক নয় দু’য়ে-দু’য়ে চার নয়। দু’য়ে দু’য়ে সাড়ে-চার বা পাঁচ বলেই সর্বত্র এতপ্রকারের অসামঞ্জস্য এবং আপাতবিস্ময়কর ঘটনার এত বৈচিত্র্য। পুথিপুস্তকগত বাস্তবতার সঙ্গে প্রকৃত সামাজিক জীবনের বাস্তবতার পার্থক্য দেখে আমরা পদে-পদে অবাক হয়ে যাই। তথাপি পুথিগত বাস্তবতার লেজ ধরে গরুর লেজ ধরে অন্ধের নগর দেখার মতো, আমরা এগিয়ে চলি, সামাজিক পরিবর্তন-বিবর্তন-বিপ্লবের স্বপ্ন দেখি, প্রকৃত জীবনসত্য ও সমাজবাস্তবকে এড়িয়ে যাই। আমরা চোখ মেলে দেখি না, মন খুলে বুঝতে চাই না যে সামাজিক চিন্তাভাবনা, সামাজিক ব্যবহার, সামাজিক ক্রিয়াকর্ম, সবকিছুর্ বিভিন্ন স্তর (levels) আছে, বিভিন্ন গড়ন (structures) আছে এবং অনেক সময় এক একটি স্তরে, একই গড়নের চৌহদ্দির মধ্যে এগুলি বেশ স্থায়ীভাবে বিরাজ করে, পরিবর্তনের কোনো ঢেউয়ের আঘাতে বিচলিত হয় না। যেমন আমাদের দেশের জাতিবর্ণভেদ ব্যবস্থা। শত-শত শতাব্দীর নির্মম কশাঘাত সহ্য করে, শত শত সাধুসন্ত সংস্কারদের মানবতার উদাত্ত আহ্বান উপেক্ষা করে, শতসহস্র রাষ্ট্রনায়কদের জাতিসাম্যের বাণী বিধিনিষেধ আইনকানুন আবর্জনাস্তূপে নিক্ষেপ করে, আজও ১৯৭৮ সালেও যখন দেখা যায় যে সেই জাতিভেদব্যবস্থা হিন্দু সমাজের সবচেয়ে মজবুত ভিত্তিরূপে প্রায়-অটুট রয়েছে, অথচ অর্থনীতি-টেকনোলজির অগ্রগতি-উন্নতি অনস্বীকার্য, তখন ভাবতে হয় যে এই ব্যবস্থাটা কী এবং তার অন্তর্নিহিত কোন জাদুবলে তার এই অমর অক্ষয় রূপ আজও প্রকট। গদেলিয়ের ‘Irreducible differences between the levels and structures of social life’ এবং ‘the relative autonomy with which they operate’ বলতে এই কথাই মনে হয় বলতে চেয়েছেন। আমাদের দেশের এই স্বয়ংক্রিয় বিভিন্ন সামাজিক স্তর ও গড়নগুলি কি রকম তা না বুঝলে কেন উনিশ শতকে বাংলা দেশে কিঞ্চিৎ নতুন চিন্তাভাবনা অথবা শিক্ষা-ব্যবস্থার আমদানির ফলে, উপরের সংকীর্ণ স্তরে কিছু সামাজিক আলোড়ন ঘটলেও, ইয়োরোপের মতো কোনো রেনেসাঁস হয়নি, তা বুঝতে পারা সম্ভব হবে না।
সমাজবিজ্ঞানীদের মতে ‘রেনেসাঁস’ বা নবজাগৃতির লক্ষণগুলি মধ্যযুগ ও আধুনিক যুগের সন্ধিক্ষণের ঐতিহাসিক সাক্ষ্য বহন করে। মধ্যযুগের সঙ্গে আধুনিক যুগের বিচ্ছেদ নবজাগরণের এই লক্ষণগুলির মধ্যে সূচিত হয়। ভন মার্টিন বলেছেন[4]
the typological importance of the renaissance is that it makes the first cultural and social breach between the Middle Ages and modern times : it is a typical early stage of modern age.
আধুনিক যুগ বলতে এখানে ধনতান্ত্রিক যুগের কথা বলা হয়েছে। সুতরাং নবজাগরণের অন্যান্য প্রসঙ্গ উত্থাপন ও আলোচনা করার আগে আমাদের প্রথম দেখা উচিত বাংলা দেশের তৎকালের অর্থনৈতিক অবস্থাকে কতদূর পর্যন্ত ধনতন্ত্রের শৈশবকাল বলা যায়। প্রশ্ন হল, ধনতন্ত্রের অর্থনৈতিক লক্ষণগুলি কি? কার্ল মার্কস বলেছেন[5]
The producer may become a merchant and capitalist, in opposition to agricultural natural
economy and to the guild organized handicrafts of medieval town industry. This is the really revolutionary way. Or the merchant may take possession of production directly.
উৎপাদক বর্ণিক (merchant) হতে পারে অথবা পুঁজিপতিও (capitalist) হতে পারে। যদি তা হয় তাহলে বুঝতে হবে যে কৃষিনির্ভর অকৃত্রিম স্বাভাবিক অর্থনীতি এবং গিল্ড বা সংঘভিত্তিক হস্তশিল্পকে কেন্দ্র করে মধ্যযুগের যে নগরশিল্প গড়ে ওঠে তারা তার বিরোধী। তার কারণ মধ্যযুগের কৃষক জমিদার কারুশিল্পী প্রত্যেকের আর্থিক স্বার্থের সঙ্গে আধুনিক যুগের বণিক ও পুঁজিপতিদের স্বার্থের বিরোধ ও সংঘাত অনিবার্য। এই বিরোধ ও সংঘাতের ভিতর দিয়ে ইয়োরোপের অনেকদেশে বর্ণিক ও পুঁজিপতিরা মধ্যযুগের নগরগুলি অধিকার করেছে, নগরের সঙ্গে গ্রামের বিচ্ছেদ ও সংঘর্ষ আরম্ভ হয়েছে, ক্রমে জমিদার ও কৃষকরা পরাজিত হয়েছে এবং নগরে-নগরে বণিক ও পুঁজিপতিরা শ্রেণীগতভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করেছে। এইভাবে পশ্চিমে ইয়োরোপের বিভিন্ন অঞ্চলের ধনতন্ত্রের বিকাশ হয়েছে এবং আধুনিক যুগের আবির্ভাব হয়েছে। আমাদের দেশে ভারতবর্ষে বা বাংলা দেশে তা হয়নি। তার প্রধান কারণ আমাদের পরাধীনতা। যে বিদেশী শাসকরা আমাদের দেশে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করেছিল, তারা আমাদের অর্থনৈতিক উন্নতি অথবা ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার উদ্ভবের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করা তাদের নিজেদের পুঁজিপতি-সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থের বিরোধী মনে করত। মনে করা স্বাভাবিক। ধনতান্ত্রিক-সাম্রাজ্যবাদী দেশের মধ্যে ইংলণ্ড সকলের অগ্রণী ও অগ্রজ, এবং ইংলণ্ডের মতো সারা পৃথিবীব্যাপী বিরাট সাম্রাজ্য জয় করে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পৃথিবীর আর কোনো দেশ পরবর্তীকালে পারেনি।× তার উপর আমাদের দেশের মতো এরকম প্রাকৃতিক ও মানবিক সম্পদের দিক থেকে বিশাল দেশও পৃথিবীতে আর দ্বিতীয় কোথাও ছিল না। অতএব এই দেশের প্রাকৃতিক ঐশ্বর্য এবং মানবিক সম্পদ শোষণ করে নিজেদের দেশের (ইংলণ্ডের) শ্রমশিল্পের দ্রুত উন্নতি ও জাতীয় সম্পদ বৃদ্ধি করাই তাদের প্রধান লক্ষ্য ছিল। এই লক্ষ্য যে অধিকৃত পরাধীন দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির পরিপন্থী, তা ব্যাখ্যা করে বলা অনাবশ্যক।
--------------------------------------------------------------------------------------------------------------
× ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের আয়তন ছিল ১৩,৩৫৫,০০০ বর্গমাইল এবং সমস্ত সাম্রাজ্যের মোট লোকসংখ্যা ৪৯৫,৫০০,০০০ - বর্তমান শতাব্দীর চল্লিশের দশকে পৃথিবীর মোট লোকসংখ্যার প্রায় এক-চতুর্থাংশ (J. H. Stembridge : British Empire, O. U. P.)
--------------------------------------------------------------------------------------------------------------
এই ধরনের ঐতিহাসিক অবস্থার মধ্যে মধ্যযুগ থেকে আধুনিক যুগে উত্তরণের মতো নতুন কোনো অর্থনৈতিক-সামাজিক অবস্থার উদ্ভব সম্ভব হতে পারে না। সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থে আমাদের দেশকে রপ্তানি ও আমদানি উভয়েরই বাজারে (market) পরিণত করাই ছিল ব্রিটিশ শাসকদের উদ্দেশ্য। আমাদের দেশের নানারকমের কাঁচামাল (raw materials) সস্তায় সংগ্রহ করে স্বদেশে ইংলণ্ডে পাঠানো এবং সেখানকার কলকারখানায় সেই কাঁচামাল থেকে উৎপন্ন নানারকমের পণ্যদ্রব্য এদেশে আমদানি করে চড়ামূল্যে বিক্রয় করা ছিল তাদের প্রধান উদ্দেশ্য। এই উদ্দেশ্য সাধনের পথে তারা আমাদের দেশের নানাবিধ কুটিরশিল্প ও শিল্পীদের যেমন ধ্বংস করেছে, তেমনি দেশের সাধারণ দরিদ্র জনসাধারণকে নির্মমভাবে শোষণ করেছে এবং এদেশীয় ব্যবসাবাণিজ্য ও বণিকশ্রেণীকে উৎখাত করেছে। অতএব মধ্যযুগের সামন্ততন্ত্র থেকে আধুনিক যুগের ধনতন্ত্রের বিকাশের কোনো ঐতিহাসিক যুগসন্ধিক্ষণের উদয় এদেশে হয়নি এবং তা হয়নি বলেই রেনেসাঁসে’র কোনো পাশ্চাত্ত্য মডেলের প্রতিষ্ঠা এখানে হয়নি।
আগে যে নগর ও ছোট-ছোট নগরশিল্পের কথা বলেছি এবং গিল্ড বা শিল্পীসংঘের কথা, সে সম্বন্ধে আরও একটু পরিষকার করে বলা দরকার। গিল্ডের উৎপত্তি প্রসঙ্গে মার্ক্স বলেছেন[6]
The necessity for association against the organized robber-nobility, the need for communal covered markets in an age when the industrialist was at the same time a merchant, the growing competition of the escaped serfs swarming into the rising towns, the feudal structure of the whole country: these combined to bring about the guilds.
এরকম কোনো বাস্তব অর্থনৈতিক অবস্থার সৃষ্টি হয়নি আমাদের দেশে এবং দস্যুতাপ্রবণ জমিদার-জোতদারের অভাব না থাকলেও, তাদের তাড়নায় এদেশের কারুশিল্পীদের অথবা ‘serf’-দের নগরের সীমার মধ্যে পালিয়ে এসে আত্মরক্ষার জন্য দলবদ্ধ হতে হয়নি। তার প্রধান কারণ, এদেশের দৃঢ়মূল বংশগত বৃত্তিভিত্তিক জাতিবর্ণভেদব্যবস্থা (caste system) । আমাদের দেশে কারুশিল্পের বিশেষ বিকাশ ও বৈচিত্র্যের কারণ সম্বন্ধে মার্কস-এর এই উক্তি প্রণিধানযোগ্য:
Every workman had to be versed in a whole round of tasks, had to be able to make everything that was to be made with his tools. The limited commerce and the scanty communication between the individual towns, the lack of population and the narrow needs did not allow of a higher division of labour, and therefore every man who wished to become a master had to be proficient in the whole of his craft. Thus there is found with medieval craftsmen an interest in their special work and in proficiency in it, which was capable of rising to a narrow artistic sense.
Capital in these towns was a natural capital consisting of a house, the tools of the craft, and the natural, hereditary customers; and not being realizable, on account of the backwardness of commerce and the lack of circulation, it descended from father to son.
মার্কস এই জন্য কারুশিল্পীদের মূলধনকে ‘this capital was directly connected with the particular work of the owner, inseparable from it’ এবং এই মূলধনের সঙ্গে ‘modern capital’-এর পার্থক্য গুণগত, কারণ ’আধুনিক মূলধন’ ‘can be assessed in money and which may be indifferently invested in this thing or that.’ আমাদের দেশের কারুশিল্পীর জীবিকার জন্য সকলে মধ্যযুগের নগরে এসে মিলিত হয়নি, অনেকে গ্রামাঞ্চলেই পুরুষানুক্রমে বাস করেছে। তারও প্রধান কারণ বৃত্তিনির্ভর বর্ণবৈষম্য। সকল বৃত্তির সামাজিক মর্যাদা সমান নয় এবং কোনো কারুশিল্পের শৈল্পিক সৌন্দর্য যাই হোক না কেন, তদনুপাতে শিল্পীর মর্যাদা স্বীকৃত হত না। যেমন পশ্চিমবঙ্গে ডোকরা-শিল্পী, চিত্রকর, বেতবাঁশের শিল্পী প্রভৃতির সঙ্গে মৃৎশিল্পী কাঠখোদাইশিল্পী বা ভাস্করদের পদমর্যাদার পার্থক্য বিরাট।[7] এই বর্ণভেদজনিত সামাজিক মর্যাদার ভিন্নতার জন্যই প্রধানত বিভিন্ন গোষ্ঠীর কারুশিল্পীদের পক্ষে নগরে এসে মিলিত ও সংঘবদ্ধ হওয়া সম্ভব হয়নি। এদেশের বণিকদের সঙ্গেও (সদাগরশ্রেণী) কারুশিল্পীদের প্রত্যক্ষ কোনো সামাজিক সম্পর্ক ছিল না। তা ছাড়া আমাদের দেশের সদাগররা বর্ণগতভাবে সমাজে উপেক্ষণীয় ছিল এবং এই বিভেদ ব্রিটিশ রাজত্বেও দূর হয়নি। পরে এই বিষয়ে আলোচনা করেছি। এদেশীয় সদাগররা বর্ণগতভাবে উপেক্ষিত ছিল বলে, আমাদের মধ্যযুগীয় নগরে ধীরে-ধীরে ‘burgher class’ এবং তা থেকে আধুনিক ‘bourgeois’ শ্রেণীরও উদ্ভব হয়নি। এদিক থেকে চীনা সমাজের সঙ্গে আমাদের কিছুটা মিল আছে, কিন্তু অন্যদিক থেকে আবার অমিলও আছে অনেক। এই বিষয়েও পরে আলোচনা করা হয়েছে।
ব্রিটিশ শাসকরা নিজেদের স্বার্থেই এদেশের স্বাভাবিক অর্থনৈতিক বিকাশে নানাভাবে বাধা সৃষ্টি করেছে। একথা আগে বলেছি। অবাধ বাণিজ্যের এবং শিল্পোদ্যমের যেটুকু সুযোগসুবিধা হয়েছিল তা গ্রহণ করা এদেশে সর্বাগ্রে যাদের উচিত ছিল সেই সদাগরশ্রেণী - অর্থাৎ গন্ধবণিক তাম্বুলিবণিক এবং অন্যান্য বণিকরা, তাঁরা তা করেননি। কেন করেননি পরে বলছি। উচ্চবর্ণের বাঙালীদের মধ্যে কেউ কেউ এই পথে অগ্রসর হয়েছিলেন, যেমন দ্বারকানাথ ঠাকুর, রামদুলাল দে, মতিলাল শীল এবং ইয়ংবেঙ্গল গোষ্ঠীর ডিরোজীয়ানদের মধ্যে রামগোপাল ঘোষ, প্যারীচাঁদ মিত্র প্রভৃতি, কিন্তু তাঁরা Comprador-শ্রেণীর, অর্থাৎ ব্রিটিশের তাঁবেদার ব্যবসায়ীশ্রেণীর ভূমিকা ছেড়ে স্বাধীন শিল্পোদ্যোগীর স্বাতন্ত্র্য অর্জন করতে পারেননি।[8] তা ছাড়া, কিছুদিনের মধ্যে দেখা যায় যে তাঁরা ব্রিটিশের তাঁবেদার ব্যবসায়ীর ভূমিকা ছেড়ে ক্রমে নতুন জমিদারশ্রেণীর আরামপ্রদ বিলাসী ভূমিকা গ্রহণ করেছেন, বিশেষ করে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পরে।
কর্নওয়ালিসের আমলে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তিত হলেও এটা তাঁর মস্তিষকপ্রসূত নয়, যদিও ইতিহাসে সাধারণত সেই কথা লেখা হয়ে থাকে। কোম্পানির ডিরেক্টররা অনেক আগেই এই জমিদারীব্যবস্থা প্রবর্তনের পরিকল্পনা করেছিলেন। হাণ্টার বলেছেন[9]
nothing can be further from the historical truth than the idea that Cornwallis was the originator either of that system or of the Permanent Settlement. What Cornwallis realy did was to carry out a predetermined plan of the Court of Directors with a cautious delay…
কর্নওয়ালিস নিজে বেশ বিচক্ষণ শাসক ছিলেন এবং ব্রিটিশের স্বার্থ তিনি বেশ ভালভাবেই বুঝতেন। তাই এই নতুন ব্যবস্থা প্রবর্তনের কয়েকদিন আগে তিনি কোম্পানির ডিরেক্টরদের কাছে একটি চিঠিতে লেখেন (৬ মার্চ ১৭৯৩) :
The large capitals possessed by many of the natives, which they will have no means of employing …will be applied to the purchase of the landed property as soon as the tenure is declared to be secured.
এদেশের কিছু লোকের হাতে অনেক মূলধন জমা হয়েছে ‘which they will have no means of employing’-কর্নওয়ালিসের এই কথার গুরুত্ব খুব পরিষকার। এর পর কোনো বিশ্লেষণ বা ব্যাখ্যার প্রয়োজন হয় না এই কথা বোঝাবার জন্য যে স্বাধীন শিল্পবাণিজ্যের পথে এদেশের মূলধন নিয়োজিত হোক, সেটা ব্রিটিশের কাম্য ছিল না। তা না হলে কর্নওয়ালিস বলতেন না যে জমিদারী কেনা ছাড়া অন্য কোনোভাবে এদেশীয় মূলধন নিয়োগের উপায় থাকবে না। অতএব আঠার শতকের Comprador-শ্রেণীর বাঙালীরা যাঁরা বেনিয়ানি মুচ্ছুদ্দিগিরি দেওয়ানী সরকারী ইত্যাদি কর্ম করে প্রচুর অর্থ সঞ্চয় করেছিলেন, তাঁরা চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পরে দলে-দলে ‘জমিদার’ হতে আরম্ভ করলেন। প্রাচীন বনেদী জমিদাররা নির্দিষ্ট দিনক্ষণে রাজকোষে প্রাপ্য টাকা জমা দিতে অভ্যন্ত নন। তাই নতুন বন্দোবস্তের কড়া আইনের ফলে তাঁদের জমিদারী একে-একে নিলামে উঠতে লাগল এবং শহরের মুচ্ছুদ্দি-বেনিয়ানরা নিলাম থেকে সেই জমিদারী কিনে নতুন জমিদার হতে থাকলেন। হাণ্টার বলেছেন (পূর্বোক্ত ভূমিকা)
The mournful story of the ruin of these and other once powerful families under the Sale Law for arrears is shown in detail in…During two years alone, 1796-98, estates bearing a revenue of Sicca Rs. 5521252, more than a fifth of the whole land tax of the Province, were advertised for sale for arrears…within twenty-two years of the Permanent Settlement, from one-third to one-half of whole landed property in Bengal had been sold on that account. The wave of the Permanent Settlement had, in truth, submerged the ancient houses of Bengal.
হাণ্টার এ কথা বলার অনেক আগে মার্কস তাঁর ভারতীয় ইতিহাসের খসড়াতে উল্লেখ করেছিলেন.[10]
Results of ‘Settlement’: First product of this plunder of ‘communal and private property’ of the ryots : whole series of local risings of the ryots against the ‘landlords’ [conferred on them], involving: in some cases expulsion of the zemindars and stepping of the East India Co. into their place as owner; in other cases, impoverishment of the zemindars and compulsory or voluntary sale of their estates to pay of the arrears and private debts. Hence greater part off the province’s landholdings fell rapidly into the hands of a few city capitalists who had spare capital and readily invested it in land.
Karl Marx : Notes on Indian History (664-1858) : Moscow N. D. GB MÖ‡š’i m¤úv`KgÊwj gvK©m-Gi GB Ô†bvUÕ m¤^‡Ü gš—e¨ K‡i‡Qb ‘This paragraph has been taken from Marx’s abstract of Kovalevsky’s book. The abstract immediately follows Marx’s chronological notes’.
এই নতুন গোত্রান্তরিত জমিদারশ্রেণী চালচলনে আর-ব্যবহারে পোষাক-পরিচ্ছদে বনেদী জমিদারদের থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র একটি গোষ্ঠী তো ছিলেনই, গ্রাম ও গ্রামের জমিদারীর প্রতি তাঁদের মনোভাব ছিল অন্যরকম। জমিদারীকে তাঁরা যে-কোনো ব্যবসার মতো মনে করতেন এবং বিভিন্ন স্তরর মধ্যস্বত্বভোগীদের মাধ্যমে কৃষকদের অমানুষিকভাবে শোষণ করে নিজেদের মুনাফার অঙ্ক বৃদ্ধি করতে প্রয়াসী হতেন। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে এই যে নতুন সমাজবিন্যাস হল, বাংলার সামাজিক জীবনে তার প্রতিক্রিয়া হল সুদূরপ্রসারী। কর্নওয়ালিস এদেশের একশ্রেণীর লোকের হাতে যে প্রচুর মূলধন সঞ্চিত আছে বলে উল্লেখ করেছেন, সেটা সম্ভব হল কি করে? অর্থাৎ এদেশের মুচ্ছুদ্দি বেনিয়ানরা প্রচুর মূলধন সঞ্চয় করলেন কি করে? ’স্বাভাবিক অর্থনীতির (natural economy) পরিবর্তে ‘বিনিময় অর্থনীতি’ (exchange economy) প্রবর্তনের ফলে। ‘The very existence of exchange value is a massive economic fact’ কারণ বিনিময়প্রধান অর্থনীতির জন্য প্রশস্ত সুযোগ হল
to seek riches, not in the absurd form of a heap of perishable goods, but in the very convenient and mobile form of money or claims to money. The possession of money soon became an end in itself in an exchange economy.[11]
এই কারণে এদেশের comprador শ্রেণী ব্রিটিশ শাসকদের জুনিয়র অংশীদার হয়ে নানাকৌশলে, আঠার শতক থেকে উনিশ শতকের প্রায় মধ্যভাগ পর্যন্ত প্রচুর অর্থ উপার্জন করেছিলেন এবং তা সঞ্চয়ও করেছিলেন এই জন্য যে ব্যক্তিগত ব্যাপারে সেই টাকা নিয়োগ করার বিশেষ উপায় ছিল না। কর্নওয়ালিস সেইজন্য প্রায় নিশ্চিন্ত ছিলেন যে চিরস্থায়ী ব্যবস্থা প্রবর্তনের ফলে নতুন জমিদারীতে এই পুঁজি নিয়োগ করার সুযোগ হবে। তাই হল, এই comprador -শ্রেণী হল প্রধানত নতুন জমিদারশ্রেণী। জমিদারীতে ছাড়া বাকি টাকা খরচ হতে থাকল ব্যক্তিগত বিলাসিতায়, দয়াদাক্ষিণ্যে ধর্মকর্মে মামলা-মকদ্দমায় এবং এইরকম আরও অনেক অপচয়কর্মে। বাংলা দেশের যে দেবালয় আমাদের গর্ব করার মতো সাংস্কৃতিক কীর্তি তার অধিকাংশই এই নতুন জমিদারদের অর্থে স্থাপিত। দেবভক্তির জন্য নয়, মনে হয় পাপমুক্তির জন্য তাঁরা দেবালয় প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হন। স্থাপত্যের কীর্তি হিসেবে অবশ্যই এগুলি উল্লেখ্য, কিন্তু তার গৌরব সূত্রধর ও অন্যান্য অখ্যাত অজানা কারিগরশিল্পীদের প্রাপ্য। এই সমস্ত ব্যক্তিগত বিলাস ও মর্জি চরিতার্থের জন্য অজস্র অর্থব্যয় ছাড়াও কেবল যৌথসম্পত্তির ভাগাবাটোয়ারার জন্য মামলাতে (অনেক সময় পুরুষানুক্রমে। কত লক্ষ-লক্ষ টাকা যে খরচ হয়েছে তার কোনো হিসেব নেই, আজ পর্যন্ত কেউ তার একটা আনুমানিক হিসেব করার চেষ্টা করেননি। অন্নপ্রাশন বিবাহ শ্রাদ্ধ ইত্যাদি ব্যাপারে রাজসূয় যজ্ঞের মতো খরচের কথা উল্লেখ না করাই ভাল। এই বিচিত্র অপব্যয়ের একটা আনুমানিক হিসাব করারও যদি সম্ভব হত তাহলে দেখা যেত যে সেই অর্থ দিয়ে আমাদের দেশ শিল্পায়নের (industrialization) পথে অনেকদূর এগিয়ে যেতে পারত, অবশ্য যদি এদেশের লোকের শিল্পোদমযোগী হবার মতো মনোভাব থাকত এবং শাসকরা সেখানে কোনো অন্তরায় সৃষ্টি না করত।
ব্রিটিশ শাসকরা এদেশে তিনটি সামাজিক শ্রেণী তৈরি করেছিলেন নিজেদের প্রশাসনিক ভিত্তিস্তম্ভগুলিকে সুদৃঢ় করার জন্য। শ্রেণীগুলি হল
ক. নাগরিক Comprador-শ্রেণী।
খ. আধা-নাগরিক আধা-গ্রাম্য জমিদারশ্রেণী।
গ. গ্রাম্য ও নাগরিক নতুন মধ্যবিত্তশ্রেণী।
নাগরিক মধ্যবিত্তের মধ্যে নতুন শিক্ষিতরাও আছেন, যাদের মেকলে শাসক ও শাসিতের মধ্যে দালালস্বরূপ বলেছেন। এই নতুন শ্রেণীবিন্যাসের ফলে ইংরেজদের পক্ষে বিশাল শাসন-শোষণব্যবস্থা ‘institutionalise’ করা সহজেই সম্ভব হয়। গ্রাম ও শহরের মধ্যে একটা স্থায়ী বিচ্ছেদ হয়ে যায় এবং সেটা কেবল আর্থিক সুখস্বাচ্ছন্দ্য বা জীবনযাত্রার বিচ্ছেদ নয়, গভীর মানসিক বিচ্ছেদও বটে। সকল শ্রেণীর ‘town animal’ (Marx) হিংস্র পশুর মতো তাদের টাকার ক্ষুধা মেটাবার জন্য গ্রামের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে এবং মূলত কৃষকদের শোষণ করেই সেই ক্ষুধা মেটাতে থাকে।
এরকম অর্থনৈতিক অবস্থার মধ্যে সামন্ততন্ত্র থেকে ধনতন্ত্রে উত্তরণের কোনো ঐতিহাসিক লক্ষণ সন্ধান করা অর্থহীন। সামন্ততন্ত্রের সঙ্গে ধনতন্ত্রের সামাজিক-সাংস্কৃতির বিচ্ছেদও এই অবস্থায় সম্ভব নয়। সম্ভব যদি না হয় তাহলে সমাজ-বিজ্ঞানীরা যে নবজাগৃতির (Renaissance) ‘typological importance’-এর কথা ‘first cultural and social breach between the Middle Ages and modern times’ বলে উল্লেখ করেছেন, তা এদেশে হয়নি। অতএব ইয়োরোপীয় মডেলের কোনো আধুনিক নবজাগরণ বাংলা দেশে অথবা বাঙালী সমাজে হয়নি। আমরা ইয়োরোপীয় বিদ্যা ইংরেজের আমলে শিক্ষা করে সবকিছুই সেই বিদ্যার আলোকে দেখতে ও বিচার করতে শিখেছি। তাই সোডার বোতলের উচ্ছ্বসিত বুদবুদের মতো খানিকটা সাময়িক আদর্শগত চিত্তচাঞ্চল্য এদেশের কয়েকজন ব্যক্তির মধ্যে লক্ষ্য করে এবং রেল-গাড়ির বাষ্পীয় ইঞ্জিনের শব্দ আর কয়েকটি ক্ষুদে কারখানার ভোঁ শুনে আমরা ভেবেছি আমাদের দেশে ইয়োরোপের মতো রেনেসাঁসের হাওয়া বইছে। আমাদের ভাবনা ভুল, সাদৃশ্যবোধ ভুল। হাওয়া বয়েছিল সমাজের উপরতলার চিলেকোঠার একটি ছোট আধখোলা জানলা দিয়ে। সেই হাওয়া কারও গায়ে লাগেনি, মনে তো নয়ই। নবজাগরণ হয়নি, যা লেখা হয়েছে, এখনও লেখা হয়, তা অতিকথা।
কেন হয়নি তার কারণ আরও তলিয়ে খোঁজ করা দরকার। ব্রিটিশ প্রশাসনের যে তিনটি এদেশীয় নতুন শ্রেণীস্তম্ভের কথা আগে বলেছি, তার সামাজিক গড়নটা কি তা জানা উচিত। মুচ্ছুদ্দিগিরি বেনিয়ানি করে প্রচুর বিত্তসঞ্চয় করেছিলেন কারা? কারা সঞ্চিত অর্থ নিয়োগ করে জমিদারী কিনে নতুন জমিদার হয়েছিলেন? গ্রাম ও শহরের নতুন মধ্যবিত্তশ্রেণী কাদের নিয়ে গড়ে উঠেছিল? কারা নতুন পাশ্চাত্ত্যবিদ্যা শিক্ষা করে আধুনিক শিক্ষিতশ্রেণী হয়ে মেকলের ভাষায়, ‘rulers and ruled’-এর মধ্যে ‘interpreters’ হয়েছিলেন? অধিকাংশই হিন্দু, এবং হিন্দুদের মধ্যে অধিকাংশই ব্রাহ্মণ-বৈদ্য-কায়স্থ প্রভৃতি উচ্চবর্ণভুক্ত যারা তাঁদের নিয়েই প্রধানত এই তিনটি শ্রেণী গঠিত হয়েছিল। মুসলমান এবং অনুচ্চবর্ণ বলে হিন্দুসমাজে যারা উপেক্ষণীয়, তাঁদের সংখ্যা এই তিনটি শ্রেণীর মধ্যে খুবই সামান্য। কেন সামান্য? কেন অনুচ্চবর্ণের লোকরা অর্থনীতি রাজনীতি শিক্ষা প্রভৃতি বিভিন্ন ক্ষেত্রে নতুন যুগে স্বাধীনভাবে বিচরণের সুযোগ গ্রহণ করেন নি? এই প্রশ্নের উত্তরের মধ্যে বাংলার, তথা ভারতের, ভুয়ো রেনেসাঁসের মূলকারণ খুঁজে পাওয়া যাবে এবং বোঝা যাবে কেন বাংলার নবজাগৃতি একটি অতিকথা ছাড়া কিছু নয়।
হিন্দুধর্ম চাতুর্ব্বণ্যের উপর প্রতিষ্ঠিত এবং হিন্দুসমাজ ‘বর্ণাশ্রমিসমাজ’। হিন্দুসমাজের এই ভিত আজ পর্যন্ত কোনো সংস্কারক অথবা কোনো শাসক ভাঙতে পারেন নি, বৌদ্ধ জৈন হিন্দু মুসলমান অথবা খ্রীস্টান ইংরেজরা, কেউ না। সংস্কারকদের মানবতার বাণী, রাষ্ট্রীয় আইনকানুন, শিক্ষার অগ্রগতি ইত্যাদির ফলে তার গায়ে খানিকটা আঁচড় লেগেছে ঠিকই, কিন্তু ভিত্তিতে ফাটল ধরেনি। বর্তমান বিংশ শতাব্দীর সত্তরের দশকেও বোঝা যায়, একথা কতখানি সত্য।
হিন্দু শাস্ত্রকাররা (প্রাচীন ও মধ্যযুগের এলিটশ্রেণী) বলেন যে জন্মের দ্বারাই ‘বর্ণ’ ঠিক হয়, অর্থাৎ কুল জন্মগত। ব্রাহ্মণের পুত্র ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়ের পুত্র ক্ষত্রিয়, বৈশ্যের পুত্র বৈশ্য, শূদ্রের পুত্র শূদ্র, এইটাই হিন্দুসমাজের চিরস্থায়ী জাতিবর্ণগত ব্যবস্থা এবং স্বয়ং ভগবানই এই ব্যবস্থার প্রবর্তক। ভগবান নিজেই বর্ণ সৃষ্টি করেছেন। তিনি মুখ থেকে ব্রাহ্মণ, বাহু থেকে ক্ষত্রিয়, ঊরু থেকে বৈশ্য এবং পদযুগল থেকে শূদ্র সৃষ্টি করেন:
মুখতঃ সোহসৃজদ্বিপ্রান্ বাহুভ্যাং ক্ষত্রিয়াংস্তথা।
বৈশ্যাংশ্চাপ্যূরুতো রাজন্ শূদ্রান্ বৈ পাদস্তথা ॥
মহাভারত, ভীষ্মপর্ব ৬৭/১৯
মাথা থেকে পা পর্যন্ত ক্রমনিম্নমুখী প্রত্যঙ্গের সঙ্গে বিভিন্ন বর্ণের উৎপত্তির সম্পর্ক থেকে বর্ণবিন্যাসের ক্রমও পরিষকার বোঝা যায়। জন্মগত কুলের দ্বারা বৃত্তি নিয়ন্ত্রিত হয় এবং কুলবৃত্তি কদাচ পরিত্যাজ্য নয়। ব্রাহ্মণরা জন্ম থেকেই অন্য বর্ণের গুরু এবং ব্রাহ্মণকুলে জাত দশবছরের শিশুও শতায়ু ক্ষত্রিয়ের পিতৃতুল্য গুরু হবার অধিকারী -
ক্ষত্রিয়ঃ শতবর্ষী চ দশবর্ষী দ্বিজোত্তমঃ।
পিতাপুত্রৌ চ বিজ্ঞেয়ৌতয়োর্হি ব্রাহ্মণো গুরুঃ।
অনুশাসনপর্ব ৮/২১
কর্মগত সুফল-কুফলের জন্য ক্ষত্রিয়ের ব্রাহ্মণত্ব লাভ, অথবা বৈশ্য-শূদ্রের ব্রাহ্মণত্বের মর্যাদালাভের অনেক বচন ও দৃষ্টান্ত শাস্ত্রে আছে, কিন্তু সেগুলি জন্মগত বর্ণবিভেদের লৌহবন্ধন শিথিল করার জন্য নয়, অসন্তোষ ও বিদ্রোহের সম্ভাবনাকে সংযত করার জন্য। সুকর্মের পুরস্কারস্বরূপ সামাজিক পদোন্নতির লোভ দেখিয়ে সমাজব্যবস্থাকে দীর্ঘস্থায়ী করাই এইসব শাস্ত্রবচনের উদ্দেশ্য। বিশ্বামিত্র ক্ষত্রিয়কুলে জন্মগ্রহণ করেও কঠোর তপস্যার বলে ব্রাহ্মণত্ব লাভ করেন। একালের হরিজন কুলোদ্ভব কেউ কষ্ট করে লেখাপড়া শিখে এবং রাজনৈতিক কলাকৌশল আায়ত্ত করে হয়ত ‘মন্ত্রী’ হতে পারেন, কিন্তু তার জন্য সাধারণ হরিজনদের হরিজনত্ব একটুও বদলায় না। সর্পরূপী নহুষের প্রশ্নের উত্তরে যুধিষ্ঠির বলেছিলেন ‘সত্য সহৃদয়তা দান ক্ষমা তপস্যা দয়া যে-ব্যক্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয় তিনিই ব্রাহ্মণ’। নহুষ বলেন ‘এসব গুণ তো শূদ্রদের মধ্যেও দেখতে পাওয়া যায়।’ যুধিষ্ঠির উত্তরে বলেন ’শূদ্রের জাতিগত গুণ (পরিচর্যাদি) যদি ব্রাহ্মণে দেখা যায়, তাহলে তাকে শূদ্র মনে করব। আর ব্রাহ্মণের গুণ, শম দম ইত্যাদি, যদি শূদ্রে দেখা যায়, তাহলে তাকে ব্রাহ্মণ মনে করব।’ যুধিষ্ঠির সজ্ঞানে এখানে মিথ্যা কথা বলে নহুষকে ধাপ্পা দিয়েছেন। তা ছাড়া যুধিষ্ঠির ধর্মপুত্র হলেও তিনি কাকে কর্মগুণে ব্রাহ্মণ বা শূদ্র মনে করেন তাতে ব্রাহ্মণের বা শূদ্রের অথবা সমাজের কিছু আসে যায় না। যুগে-যুগে কত শত শত যুধিষ্ঠির এসেছেন গিয়েছেন কিন্তু বর্ণভেদের আঁকাবাঁকা পথে হিন্দু-সমাজের প্রবাহ তার জন্য খাত বদলায়নি। সেকালে সমাজের যা-হোক একটা শাসন ছিল, একালে তাও নেই। একালে টাকা যার সমাজ তার। নিম্নবর্ণের চেয়ে উচ্চবর্ণের ক্ষেত্রে একথা অনেক বেশী সত্য। একালের ব্রাহ্মণরা যদি অজস্র অপকর্ম করে অঢেল টাকা উপার্জন করতে পারেন, তাহলে সেই টাকার জোরে তিনি তাঁর ব্রাহ্মণত্ব অনেক বেশী বজায় রাখতে পারেন এবং বর্ণশ্রেষ্ঠরূপে তাঁর দাপট অন্যদের উপর জাহির করতেও পারেন। ব্রিটিশ আমলে হিন্দুসমাজে এই ঘটনাই ঘটেছে। কুলবৃত্তি ত্যাগ করে ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়-বৈশ্যরা কেউ জাতিচ্যুত হননি, বরং প্রচুর অর্থ উপার্জন করে সমাজে তাঁদের কুলগত আধিপত্য আরও মজবুত করে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। কুলগত বর্ণের সঙ্গে বিত্তগত বর্ণ মিশে এক বিচিত্রবর্ণ সামাজিক প্রতিপত্তির বিকাশ হয়েছে সমাজে ব্রিটিশ আমলে। সমাজের কুলগত জাতিবর্ণগত গড়নের কোনো পরিবর্তন হয়নি, যেজন্য এদেশে ’রেনেসাঁস’ হয়নি।
ভারত ও চীনের সামাজিক সাদৃশ্য এখানে বিশেষভাবে লক্ষ্য করার মতো। চীনেও ইয়োরোপের মতো ‘রেনেসাঁস’ হয়নি, ভারতেও হয়নি, এবং না হবার কারণ দুই দেশেই প্রায় একরকম। কিন্তু রেনেসাঁস না হবার কারণ অনেকটা একরকম হলেও, ভারত ও চীনের মধ্যে সামাজিক বৈসাদৃশ্যও আছে অনেক। যেমন ভারত বহু ভাষাভাষী, চীন তা নয়। যেমন চীনের সমাজে ভারতের হিন্দুসমাজের মতো কোনো জাতিবর্ণভেদ নেই, অথচ চীনে একটা বৃত্তিগত সামাজিক মর্যাদাভেদ আছে। এই বৃত্তিগত মর্যাদাভেদের ক্ষেত্রে ভারত-চীনের সাদৃশ্য আছে এবং রেনেসাঁসের যাবতীয় অনুপ্রাণনার অপমৃত্যুও উভয়দেশে এই একই কারণে ঘটেছে। কিন্তু বৃত্তিভেদ জন্মগত ও কুলবর্ণগত হবার জন্য ভারতীয় সমাজে নবজাগরণ ব্যাহত হবার গুরুত্ব আরও অনেক বেশি।
কেমব্রিজের প্রখ্যাত বিজ্ঞানী চীনবিশারদ অধ্যাপক জোসেফ নীডহাম (Joseph Needham) দীর্ঘকাল চীনের বিজ্ঞান ও টেকনোলজির বিকাশের সঙ্গে চীনাসমাজের গড়নের সম্পর্ক নিয়ে গবেষণা করেছেন এবং চীনে কেন ইয়োরোপীয় ধাঁচের রেনেসাঁস হয়নি তার কারণও বিশ্লেষণ করেছেন। প্রসঙ্গত ভারতের কথাও তিনি মধ্যে-মধ্যে উত্থাপন করেছেন এবং বলেছেন যে ভারতীয় সমাজের বিশিষ্ট গড়ন ও ইতিহাসের মধ্যেই নবজাগৃতির প্রেরণার অভাবের কারণ খুঁজে পাওয়া যাবে। নীডহামের চীনাসমাজের ইতিহাস কয়েকটি খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে, যেমন
Science and Civilisation in China. 7 Vols, 11 parts : London The Grand Titration, Science and Society in East and West London 1969
Clerks and Craftsmen in China and the West, London 1970. আমাদের প্রতিপাদ্য বিষয় প্রসঙ্গে নীডহামের এই আলোচনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে এখানে সংক্ষেপে তা উল্লেখ করছি। নীডহাম বলেছেন
whoever would explain the failure of Chinese society to develop modern scince had better begin by explaining the faiture of Chinese society to develop mercantile and then industrial capitalism. Whatever the individual prepossessions Western historians of science, all are necessitated to admit that from the fifteenth century A. D. onwards a complex of changes occurred; the renaissance cannot be thought of without the rise of modern science and none of them can be thought of without the rise of capitalism, capitalist society and the decline and disappearance of feudalism… The fact is that in the spontaneous autochthonous development of Chinese society no drastic change parallel to the renaissance and the scientific revolution in the West, occurred at all.
The Grand Titration, pp.39-40
এখানে চীনাসমাজ সম্বন্ধে নীডহাম যা বলেছেন তা ভারতীয় সমাজের ক্ষেত্রেও প্রায় বর্ণে-বর্ণে প্রযোজ্য। প্রসঙ্গত সেকথাও তিনি উল্লেখ করেছে
The bureaucratic-feudal system of traditional China proved to be one of the most stable forms of social order ever developed…it played a leading part in assuring for Chinese culture a continuity…above all, it meant (as in India) that there was no indigenous development of capitalism. The mandarinate system was so successful that it inhibited the rise of the merchants to power in the State; it walled up their guilds in the restricted role of friendly and benefit societies; it nipped capitalist accumulation in the bud…
Within the Four Seas, p. 34.
এখানে কেবল ‘mandarinate system’ -এর বদলে ‘caste system’ কথাটি বসিয়ে ভারতীয় সমাজের ক্ষেত্রেও নীডহামের এই উক্তি প্রয়োগ করা যায়। জাতিভেদের জন্য গিল্ড বা শিল্পীসংঘের বিকাশও ভারতীয় সমাজে খুব সংকীর্ণ ও সীমাবদ্ধ। কাজেই ‘capital accumulation’ এবং ধনতন্ত্রের স্বাভাবিক বিকাশ আমাদের দেশে হয়নি। আরও পরিষকার করে নীডহাম বলেছেন
Now if the Mandarinate was supreme, if the Civil Service was always the great power, there was a bar to the development of any other group in society, so that the merchants were always kept down and unable to rise to a position of power in the State. They had guilds, it is true, but these were never as important as in Europe. Here we might be putting our finger on the main cause of the failure of Chinese civilization to develop modern technology, because in Europe (as in universally admitted) the development of technology was closely bound up with the rise of the merchant class to power. It is perhaps a question of who is going to put up the money for scientific discovery – it is not the Emperor, it is not the feudal lords; they fear change rather than welcome it. But when you come to the merchants, they are the people who will finance research in order do deveplop new forms of production and trade; and such was indeed the fact in Eurropean history. Chinese society called ‘bureaucratic feudalism’, and that may go a long way to explain why the Chineses, in spite of their brilliant successes in earlier science and technology, were not able, as their colleagues in Europe were, to break through the bonds of medieval ideas and advance to what we call modern science and technology. I think, one of the great reasons is that China was fundamentally an irrigation-agricultural civilization as contrasted with the pastoral-navigational civilization of Europe; with the consequent prevention of the merchants’ rise to power.
Clerks and Craftsmen in China and the West, p. 83
ইয়োরোপে বিজ্ঞান ও টেকনোলজির বিকাশের সঙ্গে বণিকশ্রেণীর ঘনিষ্ঠ প্রত্যক্ষ সম্পর্ক ছিল। সামন্তযুগের রাজারা অথবা তাঁদের আশ্রিত অমাত্য আমলারা বিজ্ঞান-টেকনোলজির উন্নতির ব্যাপারে উদাসীন ছিলেন, যেহেতু বিজ্ঞানের উন্নতি তাঁদের শ্রেণীস্বার্থবিরোধী। কিন্তু বণিকরা তাঁদের শ্রেণীস্বার্থের জন্য বাণিজ্য ও উৎপাদনের উন্নতি কামনা করতেন এবং সেই কারণে বিজ্ঞানের গবেষণায় উৎসাহ দিতেন। ইয়োরোপীয় সমাজে বিজ্ঞানের চর্চা, টেকনোলজির উন্নতি বণিকদের আর্থিক আনুকূল্যেই সম্ভব হয়েছে। চীনে ও ভারতে তা হয়নি। বণিকশ্রেণী এশিয়ার এই দুই মহাদেশে উৎপাদনরীতির উন্নতির ব্যাপারে আদৌ উৎসাহী ছিলেন না এবং বাণিজ্যের প্রসারেও তাঁরা কোনো সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করেননি। কারণ চীন ও ভারতের ফিউডালিজমের স্বরূপ স্বতন্ত্র এবং সেখানে বণিকশ্রেণীর কোনো সামাজিক সমমান ছিল না, তাদের বাণিজ্যকর্মকেও অশ্রদ্ধার চোখে দেখা হত। বণিকরা তাই এই দুই দেশে সামাজিক প্রতিপত্তি অথবা রাষ্ট্রীয় প্রভুত্ব অর্জন করতে পারেননি। নীডহাম বলেছেন, এরকম ঐতিহাসিক অবস্থার প্রধান কারণ হল, চীনের সভ্যতা ‘irrigational-agricultural civilisation’, ইয়োরোপের মতো ‘pastoral-navigational’ নয়, তাই বণিকদের প্রাধান্য চীনাসমাজে স্বীকৃত হয়নি। ভারতের ক্ষেত্রেও ঠিক তাই হয়েছে। ভারতীয় সভ্যতার বনিয়াদ হল সেচ-কৃষি, তাই বণিকরা শ্রেণীরূপে সমাজে কোনো প্রভাব বিস্তার করতে পারেননি। তার উপর ভারতের জাতিবর্ণভেদ ব্যবস্থার জন্য বণিকরা কোনো সামাজিক মর্যাদা লাভ করেননি, চিরকাল উপেক্ষিত হয়েছেন। চীনের মতো ভারতেও প্রাচীন হিন্দুযুগে বিজ্ঞানের অনুশীলন ও উন্নতি যথেষ্ট হয়েছিল, কিন্তু ইয়োরোপের মতো তার স্বাভাবিক ঐতিহাসিক বিকাশ সম্ভব হয়নি বণিকদের ঔদাস্যের জন্য। রেনেসাঁসও এই কারণে হয়নি।
চীনের সমাজগড়নের ভিত্তি কর্মগত স্তরের উপর প্রতিষ্ঠিত, ভারতের মতো জন্মকুলগত স্তরের উপর নয়। চীনের জনগোষ্ঠীর এই স্তরক্রমকে সেইজন্য নীডহাম ‘estates’ বলেছেন, ‘classes’ নয় (‘We need not call them classes’ – Neddham) । এই সামাজিক স্তরবিন্যাসের মধ্যেও চীন ও ভারতের সঙ্গে মৌল পার্থক্য আছে। যেমন
চীনের সমাজ
শী Shih – the scholar-gentry
নুঙ Nung – the farmers
কুঙ Kung – the artisans
শ্যাঙ Shang – the merchants,
ভারতীয় সমাজ
ব্রাহ্মণ এলিটগোষ্ঠী
ক্ষত্রিয় শাসকগোষ্ঠী, যোদ্ধা
বৈশ্য বণিক-ব্যবসায়ী
শূদ্র কৃষক ও অন্যান্য বৃত্তিজীবী
এখানে চীনাসমাজ ও ভারতীয় সমাজের স্তরবিন্যাসের সাদৃশ্য-বৈসাদৃশ্য উভয়ই বিশেষভাবে লক্ষ্য করার মতো। ভারতীয় সমাজে বণিকজনের স্থান নিম্নস্তরে হলেও ‘তৃতীয়’ (‘বৈশ্য’), কিন্তু চীনাসমাজে বণিকরা নিম্নতম চতুর্থ স্তরভুক্ত। স্তরক্রমের মধ্যে একটি ধাপের পার্থক্য তেমন উল্লেখ্য বা গুরুত্বপূর্ণ নয়। কিন্তু চীনাসমাজের গড়নের বৈশিষ্ট্য হল, কৃষিজীবীদের স্থান অনেক উচ্চে দ্বিতীয় স্তরে, বুদ্ধিজীবী-ভদ্রশ্রেণীর ঠিক পরে। অথচ ভারতীয় হিন্দুসমাজে কৃষিজীবীরা সর্বনিম্ন চতুর্থ স্তরে ’শূদ্র’ বলে অভিহিত, যদিও চীনের মতো ভারতের সভ্যতাও কৃষি-সেচভিত্তিক। অর্থাৎ ভারতীয় সমাজের সর্বপ্রধান বৃহত্তম স্তরটি সর্বাধিক অবহেলিত উপেক্ষিত এবং তাদের কোনো সামাজিক পদমর্যাদা নেই, কিন্তু চীনাসমাজে এই বৃহত্তম জনস্তরের যথেষ্ট পদমর্যাদা আছে এবং সর্বোচ্চ স্তরের বুদ্ধিজীবীদের পরেই তাদের স্থান। এই পার্থক্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং এই পার্থক্যের জন্য চীন ও ভারতের রাজনৈতিক-সামাজিক ইতিহাসের পরবর্তী-ক্রমবিকাশের মৌল পার্থক্য ঘটেছে। সেকথা পরে উল্লেখ করব।
বণিকজনগোষ্ঠী প্রসঙ্গে বলা যায়, চীনা ও ভারতীয় সমাজের বিকাশের পার্থক্য ঘটেনি। বাঙালী সমাজের ক্ষেত্রেও একথা সত্য। চীনাসমাজে যেমন ভারতীয় সমাজেও তেমনি, প্রাচীন যুগের পরে, বিজ্ঞান ও টেকনোলজির অগ্রগতি রুদ্ধ হয়েছে প্রধানত একটি কারণে, এবং সেই কারণটি হল বণিকজনের প্রতি সামাজিক অবহেলা। বণিকজনের কোনো মর্যাদা আমাদের সমাজে নেই। প্রচুর ধনসম্পত্তির মালিক হলেও বণিকরা বণিক বা বৈশ্য এবং ব্রাহ্মণেরা ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়রা ক্ষত্রিয়। ব্রাহ্মণরা দরিদ্র হরেও বৈশ্য ও শূদ্রদের সেবার অধিকারী, গুরুগিরির অধিকারী। তাই বৈশ্য বণিকরা সামাজিক ক্রমোন্নতির ব্যাপারে উদাসীন। সমগ্র ভারতের কথা জানি না, কিন্তু বাংলা দেশের গ্রামে-গ্রামে ঘুরে অনুসন্ধান করে দেখেছি যে আমাদের দেশের বৈশ্যকুলোদ্ভব বণিকজনেরা উচ্চস্তরের (উচ্চবর্ণের) ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়দের ‘style of living’ বা জীবনযাত্রা অনুকরণ করেছেন, তাঁদের মতো বড়-বড় প্রাসাদ-তুল্য অট্টালিকা, ঠাকুরবাড়ি, দেবদেবীর মন্দির ইত্যাদি নির্মাণ করেছেন। সামাজিক উচ্চমর্যাদালাভের ব্যর্থতাকে এইভাবে তাঁরা পূরণ করেছেন মানসিক ক্ষেত্রে। বাংলার বণিকপ্রধান গ্রামে-গ্রামে এই দৃশ্য দেখলে বিস্মিত হতে হয়।× মনে হয় যেন একটি ‘archaeological site’ -এ উপস্থিত হয়েছি। বাংলায় তথা ভারতে বণিকজনেরা উৎপাদনরীতির উন্নয়নের জন্য অথবা বাণিজ্যের প্রসারের জন্য বিজ্ঞান-টেকনোলজির অনুশীলনে কোনো উৎসাহ দেননি। ক্রমে তাঁরা নিজেরা উচ্চবর্ণের মতো সামন্ততন্ত্রেরই পোষকতা করেছেন, নিজেরা জমিদার-জোতদার হয়েছেন এবং জীবনযাত্রার দিক থেকেও মধ্যযুগের সামন্ততান্ত্রিক ধারা অক্ষুণ্ন রেখেছেন। বাংলা দেশে বা ভারতে সেইজন্য পাশ্চাত্ত্য নবজাগৃতির কোনো লক্ষণ দেখা দেয়নি, দিতে পারে না। যা ঘটেছে সেটাকে সমাজবিজ্ঞানের ভাষায় ‘acculturation’ বা সংস্কৃতি-সংঘাতজনিত আদর্শের আদানপ্রদান ও মিশ্রণ বলা যায়। এবং এই সাংস্কৃতিক আদানপ্রদান ও মিশ্রণও সমাজের অতিসংকীর্ণ উচ্চস্তরে উচ্চবর্ণের মধ্যে সীমাবদ্ধ।
--------------------------------------------------------------------------------------------------------------
× এবিষয়ে পশ্চিমবঙ্গের অনেক বণিকপ্রধান গ্রামের বিবরণসহ সবিস্তারে আমি আলোচনা করেছি। ‘পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি’ নতুন পরিবর্ধিত দ্বিতীয় সংস্করণের প্রথম (১৯৭৬), দ্বিতীয় (১৯৭৮) এবং তৃতীয় খণ্ড (১৯৭৯)-এ দ্রষ্টব্য।
--------------------------------------------------------------------------------------------------------------
যুগ-যুগ ধরে সমাজগড়নের এই জন্মগত জাতিবর্ণভেদের স্তরবিন্যাস অনড় থাকার জন্য প্রত্যেক স্তরে বিভিন্ন বর্ণের জীবনধারা এক অতিবিচিত্র রূপ ধারণ করেছে আমাদের দেশে। প্রত্যেক বর্ণের মধ্যে শোষক-শোষিতের শ্রেণীভেদ দেখা দিয়েছে এবং উচ্চনিচবর্ণের মধ্যেও এই শ্রেণীভেদ প্রকট হয়েছে। যেমন হরিজনদের বিভিন্ন কুলগত জাতির মধ্যে শ্রেণীরূপায়ণ হয়েছে, ধনিক চর্মকার দরিদ্র চর্মকারদের অর্থনৈতিক স্বার্থে এবং জাতের দোহাই দিয়ে শোষণ করছে, তেমনি ব্রাহ্মণ জমিদার নিম্নবর্ণের দরিদ্র কৃষকদের উপর শ্রেণীগত ও বর্ণগতভাবে দ্বিমুখী সাঁড়াশীর মতো অত্যাচার ও শোষণ চালিয়েছে। জাতি (caste) ও শ্রেণী (class) বিচিত্রভাবে সমাজগড়নের স্তরে স্তরে বিভেদ সৃষ্টি করেছে। তার ফলে সমাজের স্তরবিন্যাস আরও জটিল হয়েছে এবং সামাজিক বাস্তব রূপও (sooial reality) অনেক বেশি অসপষ্ট হয়েছে। জাতিবিরোধ ও শ্রেণীবিরোধ বাস্তবতার স্তরে এমনভাবে মিলেমিশে আছে যে কোনটা কি তা সপষ্ট বোঝা যায় না। বর্তমানে তাই ধনতন্ত্র ও টেকনোলজির যথেষ্ট উন্নতি সত্ত্বেও আমাদের দেশে অধিকাংশ শ্রেণীবিরোধ জাতিবর্ণবিরোধ বলে মনে হয় হয় এবং বাইরের প্রতীতি যে বাস্তব সত্য নয় তা অনেক ক্ষেত্রেই আমরা বুঝি না। এইভাবে সমাজের প্রত্যেকটি স্তর একটা স্বয়ংক্রিয় স্থিতি ও গতি লাভ করেছে (‘the relative autonomy with which they operate’ – Godelier) যা আমরা উপলব্ধি করতে পারি না এবং আমাদের যান্ত্রিক মার্কসীয় তত্ত্বজ্ঞানও এই স্তরগুলির বাস্তব বর্ম ভেদ করতে পারে না। আজকের ধনতান্ত্রিক ও টেকনোলজিকাল অগ্রগতির দিনেও তাই আমাদের সমাজের শাধা-প্রশাখার সঙ্গে সামন্ততন্ত্রের উপাদানগুরি লতার মতো জড়িয়ে আছে দেখা যায়, বিশেষ করে চিন্তাভাবনার ক্ষেত্রে।
আমাদের দেশের বৃহত্তম জনশ্রেণী কৃষকরা নিম্নতম শূদ্রবর্ণভুক্ত হবার ফলে যে রাজনৈতিক ট্র্যাজিডি ঘটেছে তা আরও শোচনীয়। চীনে কৃষিজীবীরা সমাজের দ্বিতীয় স্তরভুক্ত, উচচতম স্তরের পরেই তাদের স্থান, একথা আগে বলেছি। সেইজন্য চীনের কমিউনিস্ট আন্দোলন এবং কমিউনিস্ট পার্টি সহজেই গ্রামভিত্তিক ও কৃষকশ্রেণীনির্ভর হতে পেরেছে, যা ভারতীয় রাজনীতির কমিউনিস্ট আন্দোলনের ইতিহাসে হয়নি। ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলন শহরভিত্তিক মধ্যবিত্তনির্ভর হবার জন্য আজ তার এই মর্মান্তিক পরিণতি হয়েছে। ভয়াবহ দারিদ্র্য ও শোষণপীড়ন সত্ত্বেও এদেশের কমিউনিস্ট পার্টিগুলি আজও তাই শাসকশ্রোষকশ্রেণীর লেজুড় হয়ে নিজেদের সত্তা কোনরকমে বজায় রেখে চলেছে, এমনকি যাঁরা কমিউনিস্টদের মধ্যে সাচ্চা বিপ্লবী, প্রকৃত ‘মার্ক্সিস্ট-লেনিনিস্ট’ বলে দাবি করেন তাঁদের মধ্যে অনেকে (সকলে অবশ্যই নন) মধ্যবিত্ত বাবুপ্রধান রাজনীতিতেই মগ্ন, কেবল তত্ত্বকথার বীজগুড়ি কাটছেন, এবং গ্রাম বা কৃষক তাঁদের শহরের কফিহাউসের আড্ডা থেকে অনেক দূরে। বর্তমান বিংশশতাব্দীর সত্তরের দশকে যেমন মার্কসীয় তত্ত্বের বাঁধাসূত্র প্রয়োগ করে, আমাদের হতভাগা দরিদ্রদেশে কেন বিপ্লব (revolution) হয়নি এবং হবার আশু সম্ভাবনা নেই তা ব্যাখ্যা করা যায় না, তেমনি উনিশ শতকের ‘রেনেসাঁস’ বা নবজাগৃতি মার্কস লিখিত ‘ভারতে ইংরেজশাসনের ফলাফল’ বিষয়ে প্রবন্ধের সাহায্যে ‘ঐতিহাসিক সত্য’ বলে প্রমাণ করা যায় না। বাংলার তথা ভারতের নবজাগৃতি যে একটি অতিকথা (myth), এ সত্য বাস্তব ইতিহাসের মধ্য দিয়ে প্রকট হয়ে ওঠে।
_______________________________________________
[1] Marx and Engels : Selected Correspondence : Translated and Edited by Dona Torr : London 1943, Letter No. 24,pp 69-70.
[2] এই বিষয়ে Lucio Colletti From Russeau to Lenin : Studies in Ideology and Society (New Left Books, London 1972) লিখিত গস্ক&ৗ৫৮৬০৯;ন্থ দ্রষ্টব্য।
বিনয় ঘোষঃ মেট্রোপলিটন মন, মধ্যবিত্ত, বিদ্রোহঃ দ্বিতীয় সংস্করণ, পরিশিষ্ট ১৯৭৭ পৃষ্ঠা ২২৩-২৬
[3] Maurice Godelier : Rationality and Irrationality in Economics: Monthly Review Press, New York 1972 : Foreword to the English edition 1972 – ‘Functionalism, Structuralism and Marxism’.
[4] Alfred Von Martin : Sociology of the Renaissance, London 1945, p.3
[5] Capital, Vol III : bottomore and Rubel : Karl Marx, Selected Writings in Sociology and Social Philosophy, London 1961, p. 130
[6] মার্ক্স-এর উদ্ধৃতি দুটি তাঁর The German Ideology রচনা থেকে গৃহীত। মার্ক্স-এর Pre-capitalist Economic Formations গ্রন্থের (N. Y. 1971) সম্পাদক Eric J. Hobsbawm উক্ত প্রয়োজনীয় কিয়দংশ Supplementary Texts of Maxi and Engels on Problems of Historical Periodization অধ্যায়ে উদ্ধৃত করেছেন।
[7] ] বিনয় ঘোষঃ পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতিঃ দ্বিতীয় পরিবর্ধিত সংস্করণঃ প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড ১৯৭৬, ১৯৭৮ এবং তৃতীয় খণ্ড (১৯৭৯) দ্রষ্টব্যৃ
[8] বিনয় ঘোষঃ বাংলার সামাজিক ইতিহাসের ধারা।
[9] W. W. hunter: Bengal M S. Tecords 4 Vols, London 1894-Vol. 1. Introduction.
[10] Paul M. Sweezy et al : The Transition from Feudalism to Capitalism (Reprinted from Science and Society, N. Y 1950-53.)
[11] Paul M. Sweezy et al : The Transition from Feudalism to Capitalism (Reprinted from Science and Society, N. Y 1950-53.)
[এই নিবন্ধটি বিনয় ঘোষের ‘বাংলার নবজাগৃতি’ নামক গ্রন্থে ‘সংযোজন ১৯৭৮: বাংলার নবজাগৃতি একটি অতিকথা’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়। বিনয় ঘোষ, বাংলার নবজাগৃতি, প্রকাশক: ওরিয়েন্ট লংম্যান লিমিটেড, তৃতীয় মুদ্রণ: ১৯৯৩। - বঙ্গরাষ্ট্র]
অনলাইন: ১২ মে, ২০০৯