লিখেছেনঃ কাজী মোহাম্মদ শীশ, আপডেটঃ June 5, 2009, 6:00 PM, Hits: 16956
“বাসের পর বাস আসে-যায়
হাত নেড়ে নেড়ে ক্লান্ত তিনি দাঁড়িয়ে আছেন এক ঠায়।
তিনি আবদুস শহীদ, খাপরা ওয়ার্ডের বিপ্লবী
আজ এ-কেমন ছবি
_______________________________________
_______________________________________
বাসের পর বাস আসে-যায়
ধূসর বিপ্লবী এখনো আছেন দাঁড়িয়ে পথে অসহায়।
_______________________________________
_______________________________________
ভাবি নিশ্চয়ই এবার তিনি, খাপরা ওয়ার্ডের বিপ্লবী, রাস্তার
মাঝখানে সটান দাঁড়িয়ে ছুটন্ত বাসটার
ঘাড় ধরে গলায় ঠাটা বাজিয়ে বলে উঠবেন, ‘হেই,
আমাকে এভাবে ফেলে যাবার অধিকার কারো নেই।”
- শামসুর রাহমান
একজন মহান কবি আর একজন অসাধারণ ব্যক্তির ছবি তার কবিতায় যেমন সহজে আঁকতে পারেন - আমাদের মতো অকিঞ্চনজনের শত শত শব্দের সমাহারের মাধ্যমে তা সম্ভব হয়ে ওঠে না। তারপরও প্রতিবছর ৮ই সেপ্টেম্বর তারিখটা স্মরণ করে একজন অসামান্য সমাজকর্মী, লেখক, সাংবাদিক, শিক্ষক সর্বোপরি আদর্শবান রাজনীতিবিদ আবদুশ শহীদের জীবনের খণ্ডচিত্র তুলে ধরার একটা তাগিদ আমাকে তাড়া করে ফেরে। ২০০৭ সালে ঐ তারিখে আবদুশ শহীদের মৃত্যুর এগার বছর পার হলো।
আমার জীবনের এক আশ্চর্যের বিষয় হলো মৃত্যুর মাত্র ৭/৮ বছর আগের প্রতি বছর কয়েক দিনের দেখা আবদুশ শহীদ আমার মণিকোঠায় এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের স্মৃতি হয়ে রয়েছেন। আর তার কারণ হল পঞ্চাশ-ষাট দশক থেকে যাঁরা প্রগতিশীল রাজনীতির ধারার সাথে পরিচিত তাঁদের অনেকের কাছে ১৯৫০ সালের ২৪ এপ্রিল একটি ভয়াবহ অত্যাচারের দিন। ঐদিন রাজশাহী জেলের খাপরা ওয়ার্ডের বন্দী অবস্থায় তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের গুলিতে ৭জন বীর রাজনীতিবিদ শহীদ হন এবং ২৯ জন আহত অবস্থায় কোনক্রমে বেঁচে যান। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ চিরতরে পঙ্গু ও বিকলাঙ্গ হয়ে যান। এই ঘটনায় প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন আবদুশ শহীদ এবং তিনিও গুরুতরভাবে আহত হয়েছিলেন। আবদুশ শহীদ তাঁর স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থ ’কারা স্মৃতি’তে রাজশাহী খাপরা ওয়ার্ডের গুলি বর্ষণ ও হতাহতের এক লোমহর্ষক বিবরণ দিয়েছিলেন। এই বই পড়ার পরই বেশী করে ইচ্ছা জাগে আবদুশ শহীদকে দেখার। বিস্ময়করভাবে সেই প্রথম পরিচয় হয়েছিল বাংলা একাডেমীর একুশের বই মেলায়।
প্রায় দুই দশক আগের কথা। ১৯৮৯ অথবা ১৯৯০-এর একুশে বইমেলা। স্বল্পদীর্ঘ, শীর্ণ দেহের আবদুশ শহীদ কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে তাঁর লেখা বই নিয়ে মেলায় ঘুরছেন। নিজ আগ্রহে তাঁর কাছে গিয়ে তাঁর ’আত্মকথা’ বইটা হাতে নিয়ে তাঁর সাথে আলাপ করতে আগ্রহ প্রকাশ করলাম। ক্রমশ জানলাম, আমার অনুমান সত্য। পাকিস্তান আমলে ১৯৫০ সালের এপ্রিল মাসের ২৪ তারিখে রাজশাহী জেলের খাপরা ওয়ার্ডে নারকীয় গোলাগুলিতে মারাত্মক আহত হয়ে কোন ক্রমে বেঁচে যান আবদুশ শহীদ। ৭ জন রাজবন্দীর মৃত্যু হয়েছিল ঐ গুলির আঘাতে। এরপর প্রতি বই মেলাতেই একইভাবে তাঁর সাথে দেখা হতো। শেষ দেখা ৯৬-এর ২১শে ফেব্রুয়ারীতে ঐ বইমেলায়। সে বছরই জুলাই মাসে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় তিনি বারডেম হাসপাতালে ভর্তি হন এবং কিছুটা সুস্থ হয়ে ১৬১/১ পূর্ব উলন রামপুরার বাসভবনে ফিরে আসেন। দীর্ঘদিন পেটের পীড়া ও ডায়াবেটিসে ভোগার ফলে তাঁর শারীরিক অবস্থায় ক্রমশ অবনতি হতে থাকে এবং ১৯৯৬ সালের ৮ই সেপ্টেম্বর রোববার রাত ১১টায় আজীবন সংগ্রামী আবদুশ শহীদ পরলোকগমন করেন।
আবদুশ শহীদ বরিশালের চাখারের পার্শ্ববর্তী গ্রাম বলহারে ১৯১৫ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা মুনশী মোহামমদ আফতাব উদ্দিন। তিন ভাইবোনের মধ্যে আবদুশ শহীদ সর্ব কনিষ্ঠ। তাঁদের পরিবার শর্ষীনা পীর পরিবারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হলেও এবং কিশোর বয়সে শর্ষীনা মাদ্রাসার ধর্মীয় পরিবেশে শিক্ষা শুরু করলেও তিনি আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হন এবং ১৯৪৪ সালে গ্র্যাজুয়েশন করেন। ছাত্র অবস্থা থেকে তিনি প্রগতিশীল রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন। সে সময় পূর্ববঙ্গে হাতে গোনা স্বল্প সংখ্যক মুসলমানদের মধ্যে তিনি উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করেন। তাই অতি সহজে তৎকালীন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক তাঁকে কলকাতা পোর্টের প্রথম শ্রেণীর অফিসারের চাকুরী দেন। অন্যদিকে সাংবাদিকতার দিকে বিশেষ ঝোঁক থাকায় সাপ্তাহিক সওগাত পত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগে যোগদানের আমন্ত্রণ পান। কিন্তু তাঁর রাজনৈতিক আদর্শ থেকে বিচ্যুতির আশংকায় দলের নির্দেশে তিনি সহজেই নিশ্চিত-সচ্ছল প্রতিষ্ঠিত ধারা না গ্রহণ করে কঠোর-নির্মম পথে জীবন-যাপন করেন। ফলে তাঁকে ও তাঁর পরিবারকে সহায়-সম্বলহীন জীবন কাটাতে হয়েছে। তাঁর পরিবারবর্গ আজও কঠোর কৃচ্ছ্রসাধন ও আর্থিক অনটনের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। তবে কোন অভাবই তাঁর পরিবারের সদস্যদের মধ্যে মনের দৈন্য আনতে পারেনি।
আবদুশ শহীদ তাঁর কর্মজীবনে দীর্ঘ সময় শিক্ষকতা ও শিক্ষা প্রসারের কাজে নিয়োজিত ছিলেন। ১৯৬১-৬৩ পর্যন্ত তিনি বিক্রমপুরের ষোলঘর এ.কে.এস.কে উচ্চ বিদ্যালয়, রুসদী উচ্চ বিদ্যালয় ও কনকসার জুনিয়র উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন।
সাংবাদিকতার পেশাতেও তিনি দীর্ঘ সময় নিয়োজিত ছিলেন। ‘কীর্তনখোলা’ নামে একটি পত্রিকা তিনি সম্পাদনা করতেন।
তাঁর রচিত গ্রন্থের মধ্যে আছে ‘কারা স্মৃতি’, ‘আত্মকথা’ (তিন খণ্ড), ‘খাপরা ওয়ার্ডের সেই রক্তলাল দিনগুলি’, ‘মেকং থেকে মেঘনা।’ তাঁর মৃত্যুর অব্যবহিত পর বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের উপমহাব্যবস্থাপক জনাব মোঃ জয়নাল আবেদিন লিখেছেন, আবদুশ শহীদ তাঁকে জানিয়েছিলেন হাজার পৃষ্ঠার একটি রাজনৈতিক উপন্যাস তিনি লিখেছেন। আবদুশ শহীদের রয়েছে অনেক অনুবাদগ্রন্থ। অপ্রকাশিতগ্রন্থ প্রকাশসহ তাঁর সকল গ্রন্থ পুনঃমুদ্রণের পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর জেলখানার মধ্যে বন্দি অবস্থায় জাতীয় চারনেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমেদ, ক্যাপ্টন মনসুর আলী ও কামারুজ্জামানকে নৃসংশভাবে হত্যা করা হয়। পাকিস্তান আমলে রাজশাহী জেলের খাপরা ওয়ার্ডে এমনই একটি ভয়াবহ নারকীয় হত্যাকাণ্ড চালানো হয়েছিল। সে পৈশাচিকতার বর্ণনা আবদুশ শহীদ তাঁর ’কারা স্মৃতি’ বইতে দিয়েছেন। স্মৃতিচারণমূলক লেখাটি বার বার তুলে ধরা দরকার। কিছুটা অংশ তাঁর ভাষাতেই তুলে ধরা হলঃ
‘২৪শে এপ্রিল আমাদের কিচেনের রাজবন্দিরা রুটি, চা নিয়ে আসছে। কেউ কেউ খাটের কোণায় কেটলি, রুটির থালা রেখে আলোচনা শুনছে। আমরা সবাই অত্যন্ত অবসাদগ্রস্থ, ক্লান্ত, নিদ্রাকাতর। কমরেড হানিফের কথা সারা হতে না হতেই খাপরা ওয়ার্ডের বাইরে অনেকগুলো বুটের খটখট আওয়াজ শুনতে পেলাম। সভাপতি উঠে দাঁড়াতেই আমরা পিছন ফিরে দেখি সুপার মিঃ বিল, ডাক্তার, দু’জন ডেপুটি জেলার, সুবেদার আকবর খাঁ, কয়েকজন মেট এবং সিপাহীসহ প্রায় পঁচিশ ত্রিশ জন ওয়ার্ডের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। সুপার সরাসরি পূর্ব দিকে হক সাহেবের কাছে গিয়েই বলল, “Be ready Haque, some of you are to be segregated now. হক সাহেব সঙ্গে সঙ্গে বলেছেন: Just sit down please we have talks with you about this matter.” আমি তখন ঠিক বিলের পাশেই দাঁড়ানো। সে হকের কথা শেষ না হতেই “Shut up the door” বলে চিৎকার করে উঠল। মনে হলো এই আদেশ দেয়ার পরই তার খেয়াল হলো খাপরার একটি মাত্র গেট বাইরে থেকে আটকে দিলে তাতে সবাইকে নিয়ে আটকে পড়বে। তাই সে অর্ডার দেয়ার সঙ্গে সঙ্গেই দ্রুত দৌঁড়ে বেড়িয়ে যেতে চাইলো। গেটে দাঁড়ানো ছিল পাবনার উল্লাপাড়ার বাবর আলি, কুষ্টিয়ার দেলওয়ার, বরিশালের আবু (রশীদউদ্দিন), তারা প্রায় গেটটি বন্ধ করে আনছিল, এরই মধ্যে বিল এসে বাবর আলির হাতে হান্টার দিয়ে সজোরে আঘাত করে তার কবজি ভেঙ্গে দিল এবং বুট দিয়ে প্রচণ্ড ধাক্কা মেরে গেটের বাইরে বেরিয়ে গেল। বিলের ঠিক পিছনে ছিল কমরেড সদানন্দ। সে সুবেদারের পাগড়ি ধিরে টান দেওয়ায় সুবেদার পাগড়ি রেখেই বেরিয়ে গেল। এদিকে বিল বেরিয়েই বাঁশিতে হুইসেল দিল। সঙ্গে সঙ্গে প্রায় চল্লিশ জন সিপাহী লম্বা বাঁশে লাঠি নিয়ে খাপরায় বারান্দায় এসে উপস্থিত হল। ইতিমধ্যে আমরা ভিতর থেকে গেট আটকিয়ে দেয়ায় ওদের কেউ ভিতরে ঢুকতে পারল না। কিন্তু ওরা সমস্ত জানালার গরাদের ফাঁক দিয়ে লাঠি ছুঁড়ে মারতে লাগলো। উন্মত্ত আক্রোশে সিপাহীরা গরাদের ওপর লাঠি দ্বারা প্রচণ্ড আঘাত করতে লাগল। আমরাও আমাদের লোহার খাটগুলো নিয়ে জানালার কপাটগুলো আটকাতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু ওদের লাঠির সামনে এগোতে পারছিলাম না। এরই এক ফাঁকে আমি জানালার কাছে গিয়ে উর্দুতে সাধারণ সিপাহীদের উদ্দেশ্যে বললাম, ’সিপাহী ভাইও ইয়ে লড়াই তোমলোগো কা নেহি হায়। মগার ইস সরমায়দার সরকারকে সাথ জো তোমকো আওর হামকো ভি দুশমন হ্যায়।’ বলা শেষ না হতেই এক মেট এসে আমার হাতে এমন বাড়ি মারল যে আমার ডান হাতের তর্জনীটি কেটে সামান্য চামড়ার সাথে ঝুলে রইল। আমি দৌঁড়ে ভিতরে গেলাম। কমরেড সত্যেন সরকার আমার হাত বেঁধে দিল। তারপর আবার আমরা খাট নিয়ে জানালার দিকে এগোতে লাগলাম। আমরা এবার কাঁসার থালা, ঘটি, বাটি, শিশি, দোয়াত যাবতীয় জিনিস জানালার ফাঁক দিয়ে ওদের দিকে ছুঁড়ে মারতে লাগলাম। ওরাও এমনভাবে লাঠি দিয়ে জানালায় দেয়া আমাদের খাটগুলোকে ধাক্কা দিয়ে দিয়ে ফেলতে লাগল যে আমাদের দিনাজপুরের কমরেড কালী সরকার এবং মীরপুরের নাসির খাটের নিচে পড়ে গেল। মনে আছে খাপরার দক্ষিণ দিকে আমি একটি দোয়াত নিয়ে সজোরে নিক্ষেপ করছি এমন সময় ফায়ার শব্দে খাপরা যেন বিদীর্ণ হলো। চকিত দৃষ্টিতে দেখলাম, খাপরার প্রায় পঞ্চাশটি জানালায় নল লাগিয়ে সিপাহীরা দাঁড়িয়ে আছে। আমি তৎক্ষণাৎ উপুড় হয়ে বালিশের নিচে মাথা গোঁজার সঙ্গে সঙ্গে রাইফেলের গর্জনে খাপরার ভিত যেন ফেটে চৌচির হতে চাইল। গেটের দিকে একটু চোখ পড়তেই দেখলাম ফিনকি দিয়ে রক্ত একেবারে ছাদ পর্যন্ত উঠেছে। আমার মাথা একটি সাপোর্টিং ওয়ালের আড়ালে বালিশের নিচে গোঁজা ছিল, পা কনুই বাইরে ছিল। হঠাৎ লক্ষ্য করলাম হাটু দু’ফাঁক করে সিপ্লন্টার ঢুকে গেল। বালিশের নিচ থেকে দেখলাম পাশেই হানিফের বাহুর উপরি ভাগ ছিঁড়ে গেছে এবং সেখান থেকে অঝোরে রক্ত ঝরছে। একটু পইে কমরেড হানিফকে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে দেখি। যেন দেখলাম আমার অদূরেই কুষ্টিয়ার কমরেড নন্দ সান্যাল রক্তাক্ত শরীরে মেঝের উপর লুটিয়ে পড়ছে। আমার হুঁশ হারাবার পূর্বে যতটুকু মনে আছে দেখরাম খাপরা ওয়ার্ডে রক্তের স্রোত বইছে। আমার শরীর বুক পর্যন্ত রক্তে ডুবন্ত। এরপর আমার কিছু মনে নেই’।
খাপরা ওয়ার্ডের এই অমানবিক নির্যাতনে যে সাতজন বীর শহীদ হয়েছিলেন তাঁরা হলেন, বিজন সেন (রাজশাহী), হানিফ শেখ (কুষ্টিয়া), দেলওয়ার (কুষ্টিয়া), আনোয়ার (খুলনা), সুখেন ভট্টাচার্য (ময়মনসিংহ), সুধীন ধর (রংপুর), কম্পরাম সিং (দিনাজপুর)।
এছাড়াও গুরুতরভাবে আহত হয়েছিলেন বেশ কিছু রাজবন্দি। কেউ কেউ চিরতরে পঙ্গু ও বিকলাঙ্গ হয়ে যান। ’কারা স্মৃতি’ বইয়ে ২৯ জন আহত অবস্থায় কোনক্রমে বেঁচে যান লেখা হয়েছে। তারা হলেন, আবদুশ শহীদ, রশীদউদ্দীন (আবু), সদানন্দ ঘোষ, পরিতোষ দাশ গুপ্ত, সন্তোষ দাশ গুপ্ত, আবদুল হক, হীরেন সেন, অনিমেষ ভট্টাচার্য, প্রিয়ব্রত দাশ, নন্দ সান্যাল, সত্যেন সরকার, গরিবুল্লা সরদার, ফটিক রায়, সত্য ভট্টাচার্য, শ্যামাপদ সেন, ডোমারাম সিং, বটুক দত্ত, আমিনুল ইসলাম, বাবর আলি, পবিত্র প্রসাদ রায়, গণেশ সরকার, নাসির, মনসুর হাবিব, নূরন্নবী চৌধুরী, সিতাংশু মৈত্র, মোঃ ইলিয়াস, অনন্তদেব, ভজেন পালিত ও কালি সরকার। এদের মধ্যে কারা বেঁচে আছেন আমরা জানি না। এসব আত্মত্যাগী দেশপ্রেমিকদের ইতিহাসে দিতে হবে সঠিক স্থান। আর সে কাজটা খুব সহজ নয়।
আবদুশ শহীদ আদর্শবান মানুষ ছিলেন। নীতিবান রাজনীতিবিদ ছিলেন। তাঁর ব্যক্তি জীবনে স্বীয় মতামত ও বিশ্বাসের কঠোর প্রতিফলন দেখা যায়। একই আদর্শে বিশ্বাসী তাঁর সহকর্মীদের বিচ্যুতি তাঁকে ব্যথিত করে। তাই তিনি এভাবে তাঁর মনের কথা প্রকাশ করেছেন...
“অনেকে আবার মুখোশ রাখার প্রয়োজনীয়তাও বোধ করেনি। সমস্ত অতীত, লজ্জা, সংকোচের চাদর ছুঁড়ে ফেলে নানা কথার অজুহাত তুলে আত্মপ্রতিষ্ঠায় লেগে গেছে। আমি কোন একজন একদা সাচ্চা বামপন্থীকে জিজ্ঞেস করেছিলাম - ভাই, আপনি এখন যে কাজ করছেন তাতে কী আপনি কখনও বিপ্লবী ফ্রন্টে ফিরে যেতে পারবেন? বা বিপ্লবী সংস্কৃতির ধারক হতে পারবেন? তার জবাব, শহীদ ভাই এ তো সাময়িক, শুধু টাকার জন্য করছি, কিছু টাকা যুগিয়েই আবার বিপ্লবের পথে ফিরে আসবো। এভাবে কেউ কোনদিন বিপ্লবে ফিরে আসে কিনা জানি না তবে ধন-সম্পদ, বিলাস, আরাম-আয়েশ যে কঠোর বিপ্লবী আত্মত্যাগ ও সংগ্রামের দুর্লঙ্ঘ্য প্রতিবন্ধকতা কে অস্বীকার করবে?” (আত্মকথা ৩য় খণ্ড পৃষ্ঠা-৪)। ভিন্নমতের যারা তারাও কি প্রচারহীন, স্বীকৃতিহীন নিজের জীবনকে আদর্শের সাথে এক করে যিনি শত দুর্ভোগকে বরণ করেছেন, যিনি তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের কোন একটা দুর্ভোগ ও ত্যাগকে সম্বল করে সামান্য নীতি ভ্রষ্টের দ্বারা সামাজিক-রাজনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারতেন - অথচ করেননি সেই আবদুশ শহীদকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে থাকতে পারবেন?
আবদুশ শহীদের মতো বিপ্লবী আদর্শবান ত্যাগী মানুষের সংখ্যা ধীরে ধীরে শূন্যের কোঠার দিকে এগোচ্ছে। তাদের ঠেলে সরিয়ে দিয়ে সুযোগ সন্ধানী আত্মকেন্দ্রিক-লোভী মানুষেরা সমাজে ছড়াচ্ছে বিভ্রান্তি। কিন্তু ইতিহাস বলে স্থায়িত্ব পাবে মানুষের আদর্শ, মানপ্রেম, আত্মত্যাগ। তাই আবদুশ শহীদের মতো মানুষকে ভোলা যায় না।
(দৈনিক সংবাদে: ভাদ্র ২৪, ১৪১৪; সেপ্টেম্বর ৮, ২০০৭ সালে সংক্ষিপ্ত আকারে প্রকাশিত। নিবন্ধটি কাজী মোহামমদ শীশ-এর ‘কালের চোখে আমার দেশ’ গ্রন্থ থেকে সংকলিত। প্রকাশক: জনান্তিক, ৫০, আজিজ কো-অপারেটিভ মার্কেট, বইপাড়া, শাহবাগ, ঢাকা, প্রকাশ কাল: মাঘ, ১৪১৪; ফেব্রুয়ারী, ২০০৮।)
অনলাইন: ৬ জুন, ২০০৯