লিখেছেনঃ মানব মুখার্জি, আপডেটঃ March 7, 2009, 6:00 PM, Hits: 14337
২০০২ সালে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির ষোড়শ পার্টি কংগ্রেসে মূল প্রতিবেদন পেশ করেন পার্টির তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক জিয়াঙ জেমিন। এই দলিল সবদিক থেকেই খুবই আকর্ষণীয়। যারা চীনের গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে উৎসাহী তাদের কাছে তো বটেই, এমনকি পৃথিবীর একটি বড় অংশের মানুষের কাছেও । ৩৮ পৃষ্ঠার দলিলে ‘নতুন’ বা ‘New’ এই শব্দটি জেমিন ব্যবহার করেছেন ৯০ বার। গড়ে প্রতি দুই পৃষ্ঠায় পাঁচ বার। চীনের বর্তমান নেতাদের মধ্যে সবচেয়ে বর্ষীয়ান, ১৩ বছর ধরে যিনি ছিলেন পার্টির সম্পাদক, দেশের গতি প্রকৃতির সম্পর্কে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দলিলে ’নতুন’ এই কথাটি ৯০ বার ব্যবহার করেছেন - এটা বোধহয় যথেষ্ট ইঙ্গিতবাহী।
পৃথিবীর প্রতি পাঁচ জনের একজন বাস করেন যে দেশে সে দেশ সম্পর্কে পৃথিবীর মানুষের উৎসাহ থাকবে এটা স্বাভাবিক। কিন্তু চীন সম্পর্কে উৎসাহ এর জন্য কেবল নয়। গত দশ বছর ধরে পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশী আলোচিত নাম চীন। চীন একটি বিস্ময়, চীন সমাধান না হওয়া একটা ধাঁধা। চীন ১৩০ কোটির এক পরীক্ষাগার। চীন উন্নতির শিখরে না কি জাহান্নামের দিকে ধাবমান এই নিয়ে বিরামহীন বিতর্ক। আজকের পৃথিবীতে সব মিলিয়ে চীন একটা ব্যাপার। একবিংশ শতাব্দীর গোড়ায় চীনকে বাদ দিয়ে পৃথিবীকে ভাবা অসম্ভব।
স্বস্তিতে নেই কেউই। বামপন্থীদের অনেকেই যারা সমাজতন্ত্রের পুরনো মডেলে আস্থাশীল তারা চীনকে অধঃপতিত সমাজতন্ত্র হিসাবে ঘোষণা করে দিয়েছেন। একাংশের বক্তব্য, ধীরে ধীরে দেঙ জিয়াওপিঙ এবং তার সাঙ্গোপাঙ্গরা সমাজতান্ত্রিক চীনে পুঁজিবাদ প্রতিষ্ঠা করেছে। যদিও তাদের হাতের কাছে এই সময়ে এমন কোনো তুলনীয় সমাজতান্ত্রিক দেশ নেই যার সাথে তুলনা করে চোখে আঙুল দিয়ে এই অধঃপতন দেখিয়ে দেওয়া যায়। আবার পূর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং পূর্ব ইউরোপে অধঃপতনের টাটকা নিদর্শন আছে, যারা সদ্য সমাজতন্ত্রের মিনার থেকে দারিদ্র্যের ফুটপাথে এসে আছড়ে পড়েছে। এদের সাথে চীনের মিল দেখিয়েও এটা প্রমাণ করা যাচ্ছে না চীনের কতবড় সর্বনাশ হয়েছে। চীনের কট্টরতম সমালোচকও চীনের অর্থনৈতিক অগ্রগতিকে অস্বীকার করতে পারবেন না। রাশিয়া সমাজতন্ত্র ছেড়ে পুঁজিবাদে এলে তার অর্থনীতি তছনছ হয়ে যায়, ৭০ বছরে অচেনা হয়ে যাওয়া দারিদ্র্য, বেকারি, কালবৈশাখীর মতো ধেয়ে এসে ঢেকে ফেলে গোটা দেশকে। অথচ ’সমাজতন্ত্র’ থেকে চীনের ’পুঁজিবাদে’র দিকে সরে আসার পথে প্রতিটি ইঞ্চিতে অর্থনৈতিক অগ্রগতির নিশ্চিত প্রমাণ। এ কেমন ব্যথাহীন, সুখদায়ক ’অপারেশন’?
পুঁজিবাদ (এবং সে সূত্রে বিশ্বায়নের) সমর্থকদের অস্বস্তির পরিমাণও কম নয়। এ নিয়ে খোদ চীনও কখনও বিতর্ক করেনি যে তারা বিশ্বায়িত অর্থনীতির একটি অংশ কেবল না, তারা নিজেদেরকে আরো বেশী বেশী করে এই বিশ্বায়িত অর্থনীতির অংশ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। এই সূত্রে চীনের অগ্রগতি কারো কারো কাছে বিশ্বায়নের বিজয়। কিন্তু যে সব শর্ত ঠিক ঠিক মেনে একটি অনুন্নত দেশ বিশ্বায়নের ফলে উন্নত হতে পারে সেইসব প্রশ্নে চীন ডাহা ফেল। মূলগতভাবে বিশ্বায়ন মানে বাজারের হাতে রাজ্যপাট ছেড়ে রাষ্ট্র দীর্ঘমেয়াদি বিশ্রামে যাবে। চীন এ প্রশ্নে এখনও ঠিক বিপরীত দিকে দাঁড়িয়ে আছে। রাষ্ট্র অর্থনীতির ক্ষেত্রে আছে কেবল নয়, প্রবল বিক্রমে আছে। বাজারকে তার জায়গা ছেড়ে দিয়েও অর্থনীতির মূল নিয়ন্তা সেই রাষ্ট্র। চীনে রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্র তুলে দেওয়া হয়নি, জিনিসের দামকে বা সুদের হারের গোটাটা বাজারের হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়নি। জমির মালিকানা এখনও রাষ্ট্রের হাতে। আর সবচেয়ে বড় কথা চীনে নেই ক্যাপিটাল হিল বা ওয়েস্টামিনিস্টার মার্কা গণতন্ত্রও। তবে চীন কেমন পুঁজিবাদী, তবে চীন কেমন বিশ্বায়নের সাকসেস স্টোরি? চীনকে সাকসেস স্টোরি বললে বিশ্বায়নের শর্তগুলোকে বাতিল বলে ধরতে হয়, আর শর্তগুলো না থাকলে বিশ্বায়নের কোনো অর্থ সাম্রাজ্যবাদীদের কাছে থাকে না। অথচ চীন আছে, প্রবলভাবে বিশ্ব অর্থনীতিতে আছে, প্রতিযোগিতার বাজারে কালঘাম ছুটিয়ে দিচ্ছে পশ্চিমীদের। চীন তাদের সাথে আছে, অথচ তাদের সাথে নেই। ফরেন পলিসি ম্যাগাজিন এবং এ টি করনী মিলে পৃথিবীর ৬২টি দেশ নিয়ে যে বিশ্বায়ন সূচক প্রতি বছর প্রকাশ করে তাতে চীনের স্থান ৫৭ নম্বরে। এমনকি শ্রীলঙ্কা বা বাংলাদেশেরও নীচে।
অনেক বামপন্থীর চোখে চীন সমাজতন্ত্রী নয়, এবং পুঁজিবাদীদের কাছে চীন অন্য গোত্রের। চীন তাহলে কী? এই বিতর্কেই আবর্তিত হচ্ছে এই শতাব্দী। চীন নতুন কিছু করছে। নতুন পথে এগোচ্ছে, নতুন কিছু বলছে। যে পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ সুখী নয়, সেই পৃথিবী নতুন পথের দিকে বাড়তি উৎসাহ নিয়ে তাকাবে এটা স্বাভাবিক। আমরাও ঠিক তাই করতে চাই । চীনের পথ নিয়ে বিতর্কের সমাধান চট্জলদি হবে না, কিন্তু বিশ্লেষকের চোখ নিয়ে আমরা দেখব চীনকে, তার নতুন পথকে। যে দেশের প্রধান তার রিপোর্টে ৯০ বার ’নতুন’ কথাটি উচ্চারণ করেন তাকে আমাদেরও নতুন করে দেখতে হবে।
বিংশ শতাব্দীতে চীনের ইতিহাসে দুটি গুরুত্বপূর্ণ মোড় আছে। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল ১৯৪৯ সালে চীনের মুক্তি। কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে চীন মুক্ত হয় সাম্রাজ্যবাদ, সমান্ততন্ত্র এবং চিয়াঙ কাইসেকের প্রতিক্রিয়াশীল শাসনের থেকে। শুরু হয় পৃথিবীর বৃহত্তম সমাজতন্ত্র নির্মাণের কাজ। চীনের ইতিহাসের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ মোড়টি হল ১৯৭৮ সাল। কাগজে-কলমে যা মাও জেদঙ পরবর্তী চীনের যাত্রার সূত্রপাত, শুরু চীনের ঐতিহাসিক সংস্কার (Reform), যার প্রধান রূপকার দেঙ জিয়াওপিঙ। ১৯৪৯ থেকে ১৯৭৮-এই ২৯ বছর একটি পর্ব। আর ১৯৭৮ থেকে ২০০৬ - প্রসারমান দ্বিতীয় পর্বের ২৮ বছর।
অর্থনীতির সংখ্যাতত্ত্বের হিসাবে এই ২৮ বছরে চীনের উত্থান চমকপ্রদ বললে কম বলা হয়। পৃথিবীর ইতিহাসে এর কোনো তুলনীয় নজির নেই। ১৯৭৮ সালের থেকে এই ২৮ বছরে চীনের জাতীয় আয় বেড়েছে ৬ গুণ। ১৯৭৮ থেকে ২০০৪-এর মধ্যে চীনে জাতীয় উৎপাদন বৃদ্ধির গড় হার ৯.৪ শতাংশ এবং ২০০৬’এ তা বেড়ে ১০.৪ শতাংশ।[1] ২০০৪-২০০৫ সালে চীনের মোট জাতীয় আয় ছিল ১.৭ ট্রিলিয়ন ডলার (ট্রিলিয়ন - ১ লক্ষ কোটি)। পরিমাণের দিক থেকে চীন পৃথিবীর ৪র্থ বৃহৎ অর্থনীতি। আর দামের সমীকরণ ধরণে (Purchasing Power Parity বা PPP) চীনের জাতীয় আয় ২০০৫ সালে ছিল ৭.২ ট্রিলিয়ন ডলার। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পর দ্বিতীয়।[2] চীন তার এই ঊর্ধ্বগতি ধরে রাখবে এবং মার্কিন অর্থনীতিকে ছাপিয়ে পৃথিবীর বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হবে ২০৪১ সালে, এই ভবিষ্যৎবাণী মার্কিন মুলুকের সবচেয়ে প্রভাবশালী থিঙ্কট্যাঙ্ক গোল্ডম্যান-স্যাখ্স-এর।[3] চীনের বর্তমান মাথাপিছু আয় ১০০০ ডলারের কিছু বেশী (ভারতবর্ষের দুগুণ)। তাদের সরকারি লক্ষ্যমাত্রা ২০১০ সালে এটা দুগুণ হবে আর ২০২০-তে তা চারগুণ হয়ে ৪০০০ ডলার ছাড়াবে (গোল্ডম্যান স্যাখ্স-এর হিসাবে ৫০০০ ডলার প্রায় ছুঁয়ে ফেলবে) ।
চীনের এই অগ্রগতি নিজের অর্থনীতিকে গোটা দুনিয়া থেকে আড়াল করে নয়। বরং পৃথিবীর দরজা খুলে রেখেই এই অগ্রগতি এসেছে। এক অর্থে আর পাঁচটা পূর্ব এশিয়ার দেশ - জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া বা তাইওয়ানের অর্থনীতি যেরকম রপ্তানি নির্ভর, চীনের ক্ষেত্রেও বিষয়টা প্রায় তাই। কিন্তু পূর্ব এশিয়ার বাকি দেশগুলো এই রপ্তানি বৃদ্ধির প্রাক প্রস্তুতিতে নিজেদের দেশের শিল্পকে আড়াল করে রেখেছিল কোনো ধরনের আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা থেকে। চীন তা করেনি। ১৯৭৮ সালের পর থেকে চীন ধাপে ধাপে তার অর্থনীতির দরজা এবং জানালা দুটোই খুলে দিয়েছে বিদেশি বিনিয়োগ এবং বিদেশি পণ্যের জন্য। আজকের দিনে পৃথিবীতে মোট বাণিজ্যের পরিমাণে চীন ৩ নম্বর - মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং জার্মানির পরেই। জাপানকে টপকে গেছে চীন। জার্মানিকে টপকাল বলে। ১৯৭৯ থেকে ২০০৪-এই পঁচিশ বছরে চীনের রপ্তানি বৃদ্ধির গড় হার ১৭.৯ শতাংশ। ১৯৭৯-তে পৃথিবীর মোট রপ্তানিতে চীনের অংশ ছিল ১.২ শতাংশ, ২০০৪’এ তা বেড়ে ৯.৩ শতাংশ। বহির্বাণিজ্যে চীনের অর্থনীতির প্রধান স্তম্ভ। মোট বাণিজ্য চীনের জাতীয় আয়ের ৭৪.২ শতাংশ। ভারতের ক্ষেত্রে এই পরিমাণ ৩৩.৭ শতাংশ, জাপানের ২২.৮ শতাংশ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ২৪.৮ শতাংশ। এটা এক অর্থে চীনের সবলতা আবার এক অর্থে দুর্বলতাও বটে।[4] তবে এক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল চীনের আমদানি-রপ্তানি কাঠামো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর মতো নয়, বরং উন্নত অর্থনীতির মতো। চীন কাঁচামাল রপ্তানিকারী, তৈরি জিনিসের আমদানিকারী নয়। চীন প্রধানত কাঁচামাল আমদানি করে, রপ্তানি করে তৈরি জিনিস। চীনের আমদানির সিংহভাগ জুড়ে থাকে পেট্রোলিয়াম, রাবার, আকরিক লোহার মতো কাঁচামাল। ২০০৩’-এ চীন আমদানি করেছে ৯.১ কোটি টন অপরিশোধিক পেট্রোলিয়াম (বৃদ্ধির পরিমাণ ৩১.১ শতাংশ), ২.৮২ কোটি টন পেট্রোপণ্য (বৃদ্ধি ৩৮.৮ শতাংশ), ৩.৭১ কোটি টন লোহা ও ইসপাত (বৃদ্ধি ৫১.৮ শতাংশ)। আর এই সময়ে যন্ত্রপাতি এবং বৈদ্যুতিক সামগ্রীর রপ্তানি বেড়েছে ৪৪.৮ শতাংশ, উচ্চতর প্রযুক্তির রপ্তানি বেড়েছে ৬২.৭ শতাংশ। [5] মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চায়নি চীন বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (WTO) সদস্য হোক। মার্কিন বাধায় চীন সদস্যপদ পেয়েছে এই ২০০২ সালে। ২০০২’এর আগেই চীন বিশ্ব বাণিজ্যে তার অবস্থানকে যথেষ্ঠ প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিল। কিন্তু ২০০২’এর পর চীনের প্রভাব বিস্তারের গতি বেড়েছে। নিচের তথ্যগুলোই এর নিশ্চিত প্রমাণ দেবে।
২০০১’এ চীনের পরিষেবা বাদে মোট বহির্বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ৫১০ বিলিয়ন ডলার আর ২০০৫’এ এই পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১.৭ ট্রিলিয়ন ডলার। মাত্র তিন বছরে দুগুণ হয়েছে, গড় বৃদ্ধির হার ৩০ শতাংশ।
চীন প্রতি সপ্তাহে রপ্তানি করে ১২.২ বিলিয়ন ডলার, আমদানি করে ১১.৮ বিলিয়িন ডলার। মোট বহির্বাণিজ্যে ২৪ বিলিয়ন ডলার। আর গোটা ১৯৭৮ সালে চীনের মোট বহির্বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ২০.৬ বিলিয়ন ডলার। এ এক অকল্পনীয় বৃদ্ধি।[6]
চীনের ক্ষেত্রে সব সময়েই রপ্তানির পরিমাণ আমদানির থেকে বেশী। আর একথা বিশেষভাবে প্রযোজ্য চীন-মার্কিন বার্ণিজ্যের ক্ষেত্রে। চীনের মোট আমদানির সবচেয়ে বড় অংশ আসে জাপান থেকে (২০০৪-এর হিসাব) মোট আমদানির ১৮.১ শতাংশ। এরপর তাইওয়ান (১২.৮ শতাংশ), দক্ষিণ কোরিয়া (৯.৭ শতাংশ), মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র (৯.২ শতাংশ)। কিন্তু চীনের মোট রপ্তানির ২১.৫ শতাংশ যার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে চীনের বাণিজ্যে উদ্বৃত্ত থাকে ১০০ বিলিয়ন ডলার।[7] পৃথিবীর ইতিহাসে দুটি দেশের বাণিজ্যের প্রশ্নে এটিই সর্বোচ্চ ফারাক।
এ টি করনী পৃথিবীর প্রথম সারির আন্তর্জাতিক অর্থনীতির পরামর্শদাতা (Consultant) সংস্থা। এ টি করনী প্রতি ৬ মাস অন্তর অন্তর পৃথিবীর প্রায় ১০০০ কোম্পানির সর্বোচ্চ কর্তাব্যক্তিদের নিয়ে একটি সমীক্ষা করে দেখাবার চেষ্টা করে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগের (FDI) প্রশ্নে কোন দেশ কতটা আকর্ষণীয়। আটবার তারা এই সমীক্ষা করেছে। প্রথম পাঁচবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছিল বিনিয়োগের সবচেয়ে আকর্ষণীয় জায়গা আর শেষ তিনবার মার্কিনীদের সরিয়ে এক নম্বর জায়গায় চলে এসেছে চীন। ২০০৪-এর রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে ভারতবর্ষও প্রায় মার্কিনীদের ছাপিয়ে দু’নম্বরে চলে আসছে। সর্বোচ্চ ২.৫’এর মধ্যে চীন পেয়েছে ২.০৩, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সেখানে ১.৪৫, ভারত ১.৪০। মার্কিন গর্ব তাদের ম্যানুফ্যাকচারিং-র দক্ষতা - এই রিপোর্টে মার্কিনীদের অবস্থান এক্ষেত্রে নেমে গেছে ৩ নম্বরে, ১ চীন, ২ ভারত।[8]
১৯৮২ থেকে ২০০৪’এর মধ্যে চীনে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ হয়েছে ৫৩১.৮ বিলিয়ন ডলার। চীনের গোটা অর্থনীতিতে এর প্রভাব বোঝা যায় এইসব ক্ষেত্রে কাজ করেন ১ কোটি মানুষ। এই ক্ষেত্র থেকে আসে চীনের মোট শিল্প উৎপাদনের ৩১.২ শতাংশ। আর চীনের মোট রপ্তানির ৫৮ শতাংশ করে এই সংস্থাগুলো। আবার আমদানির ৫৭ শতাংশ আনে এরা। এক্ষেত্রে দুটি বিষয় প্রাসঙ্গিক - এক, চীনের সবক্ষেত্রে এবং সর্বত্র বিদেশি বিনিয়োগ অনুমোদিত নয়। যেহেতু চীনে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা দেশি সংস্থার থেকে বাড়তি কিছু সুবিধা পায়, একটা কথা পশ্চিমী মহলে চালু আছে এই বিপুল বিনিয়োগের একটা বড় অংশ আসলে চোরা পথে চীন থেকে বেরিয়ে এসে কোন বিদেশি মাটি হয়ে পুনর্বিনিয়োগ হয় চীনে। এই অভিযোগটি একদম উড়িয়ে দেওয়া যায় না, কারণ বিনিয়োগের একটি বড় অংশই আসে হংকং, তাইওয়ান, ম্যাকাও বা ব্রিটিশ ভারজিন আইল্যাণ্ড, কেম্যান আইল্যাণ্ড, পশ্চিম সামোয়ার মতো ট্যাক্সমুক্ত দেশ থেকে। কিন্তু তা সত্ত্বেও চীনের বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণটা বিশাল। ২০০৩ সালে আমাদের দেশে মোট বিনিয়োগের পরিমাণ যখন ৪.৩ বিলিয়ন ডলার সেখানে ২০০৪ সালে চীনে কেবল দক্ষিণ কোরিয়ার বিনিয়োগ ৬.৩ বিলিয়ন ডলার, জাপানের ৫.৫ বিলিয়ন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৩.৯ বিলিয়ন ডলার। ২০০৩’এ পৃথিবীতে মোট বিদেশি বিনিয়োগ হয়েছে ৫৬০ বিলিয়ন ডলার, চীনের একার ক্ষেত্রে এসেছে এর প্রায় ১০ শতাংশ ৫৩.৬ বিলিয়ন ডলার। ঐ বছরের হিসাবে চীন এগিয়ে আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইংল্যাণ্ড, ফ্রান্স, জার্মানি এবং জাপানের থেকেও। [9] ২০০৪ সালে বিনিয়োগের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬১ বিলিয়ন ডলার। আর গত বছর (২০০৬) জানুয়ারী থেকে অক্টোবরে বিনিয়োগ এসেছে ৪৮৬ বিলিয়ন ডলার।
২০০৪ সালের ডিসেম্বরে নিউইয়র্ক যখন বরফের নিচে, বেজিঙ থেকে একটি সংবাদ এসে কাঁপিয়ে দেয় মার্কিন অর্থনীতির হেড কোয়ার্টারকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গর্ব আই বি এম, দুনিয়াকে কম্পিউটার চিনিয়েছে আই বি এম। চীনের লেনোভো গ্রুপ ১.২৫ বিলিয়ন ডলার দিয়ে আই বি এম কম্পিউটার তৈরির গোটা ডিভিসনটিকে কিনে নিয়েছে। এবং কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দেওয়ার মতো করে লেনোভা গ্রুপ জানিয়েছে তাদের হেড কোয়ার্টার তারা সাংহাই থেকে সরিয়ে আনবে নিউইয়র্কে। এরা চীনা মাল্টিন্যাশনাল কর্পোরেশন। ঠিক প্রায় একই সময়ে চায়না মিনমেটাল গ্রুপ কানাডার দৈত্যাকৃতি তামা এবং নিকেলের একচেটিয়া কোম্পানি নোরাল্ডাকে কিনে নেবার সিদ্ধান্ত নেয় - দাম ৭.৫ বিলিয়ন কানাডিয়ান ডলার। ইংল্যাণ্ডের বেঁচে থাকা একমাত্র মোটরগাড়ি কোম্পানি এম জি রোভারের সিংহভাগ কিনে নিচ্ছে সাংহাই অটোমোটিভ ইণ্ডাস্ট্রি কর্পোরেশন ১ বিলিয়ন পাউণ্ডের বিনিময়ে। এ বছরের গোড়ায় চীনের প্রধানমন্ত্রী ঝু রঙজি চীনা সংস্থাগুলোর কাছে আহ্বান জানান চীনের সীমান্ত পার করে তারা যেন বিনিয়োগের কথা ভাবে। এই সরকারি আহ্বানের অনেক আগে থেকেই চীনাসংস্থাগুলো বিদেশে বিনিয়োগ শুরু করেছে। এবং একাজে প্রথম সারিতেই আছে বৃহৎ চীনা রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলি। আজকের ফরচুন ৫০০ কোম্পানির মধ্যে ১৫টি চীনা কোম্পানি। উন্নয়নশীল পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ৫০টি বহুজাতিক সংস্থার মধ্যে ৫টি চীনা। এবং পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বড় ৫০টি বহুজাতিক আর্থিক সংস্থার মধ্যে ৩টি আছে চীনের। ৩টিই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক। ২০০০ সাল পর্যন্ত চীনের বিদেশি বিনিয়োগের পরিমান ছিল ২৫ বিলিয়ন ডলার। [10] এই মুহূর্তে চীনের মোট বৈদেশিক বিনিয়োগ ৪৪.৯ বিলিয়ন ডলার। [11] কিন্তু এই সমস্ত আকর্ষণীয় তথ্যকে ছাপিয়ে যায় একটি তথ্য। এই সময়ে চীনে দারিদ্র্যসীমার নিচের থেকে উঠে এসেছে ৪০ কোটি মানুষ। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ, জাতীয় উৎপাদন বৃদ্ধির হারের চমকপ্রদ হিসাব এসব কিছু থমকে যায় একটি প্রশ্নের সামনে দাঁড়িয়ে, দেশের গরিব মানুষ কেমন আছে? এর উত্তর ৪০ কোটি, পৃথিবীর ইতিহাসে দারিদ্র্য দূরীকরণের এত বড় কর্মসূচী আর কখনও অনুষ্ঠিত হয়নি। ২৫ বছরের মধ্যে চীন অসাধ্য সাধন করছে।
একটি দেশের সাধারণ মানুষ কেমন আছে তার পরিমাপের সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ভিত্তি হল ইউ এন ডি পি’র হিউম্যান ডেভলপমেন্ট ইনডেক্স। ১৯৯০-এ চীনের অবস্থান ছিল এ প্রশ্নে পৃথিবীর মধ্যে ১০৫ নম্বর, ২০০৩’এ চীন উঠে এসেছে ২০ ধাপ। বর্তমানে চীন পৃথিবীর ১৭৭টি দেশের মধ্যে ৮৫ নম্বর, যেখানে আমাদের দেশ আছে ১২৭ নম্বরে। এটি চোখে পড়ার মতো একটি অগ্রগতি। কারণ চীনকে এগোতে হয় ১৩০ কোটি মানুষ নিয়ে। আবার একথাও সমানভাবে সত্যি যে, এখনও এ প্রশ্নে চীনের অবস্থান পৃথিবীর মাঝামাঝি। পশ্চিমী দেশগুলো এখনও অনেক এগিয়ে, চীনের অবস্থান ইউরোপের দক্ষিণ পূর্বের তুলনায় পিছিয়ে পড়া দেশগুলোর মতো। কিন্তু অগ্রগতির গতিকে যদি বিবেচনা করতে হয় চীনের অবস্থান ঈর্ষা করার মতো। গরিবী দূর করার বিষয়টি আগেই উল্লিখিত। যেমন বয়স্ক সাক্ষরতার হার (১৫ বছরের ওপর) ১৯৯০ সালে চীনে ছিল ৭৮.৩ শতাংশ, ২০০৩’এ তা দাঁড়িয়েছে ৯০.৯ শতাংশ। যেখানে আমাদের দেশ আছে ৬১ শতাংশ। চীনের ৯৭ শতাংশ শিশু পাঁচ ক্লাস পর্যন্ত পড়াশুনা করে। ১৯৭০ সালে চীনে শিশুমৃত্যুর হার ছিল হাজারে ৮৫, এখন তা কমে মাত্র ৩০।
সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মানেও লক্ষণীয় উন্নতি আছে। নিচের সারণি আকর্ষণীয়:
প্রতি ১০০ পরিবারে
|
গ্রাম |
শহর |
||
|
১৯৮৫ |
২০০১ |
১৯৮৫ |
২০০১ |
ইলেকট্রিক ফ্যান |
১০ |
১১৭ |
৭৪ |
১৭০ |
রঙিন টিভি |
১২ |
৫৪ |
১৭ |
১২০ |
ওয়াশিং মেশিন |
২ |
২৯ |
৪৮ |
৯২ |
রেফ্রিজারটার |
১’এর কম |
১৩ |
৭ |
৮২ |
কম্পিটার |
.০ |
তথ্য নেই |
০ |
১৩ |
সূত্র: China Statistical Year Book, 2002 ।
২০০১ সালে চীনে ৩৪ কোটি পরিবার ছিল। এর মধ্যে ১০ কোটি শহরবাসী।
২০০৫’এর হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট রিপোর্ট অনুযায়ী, আরো আধুনিক মাধ্যম ব্যবহারের হিাসাবে -
প্রতি ১০০০ জনে
|
চীন |
ভারত |
||
|
১৯৯০ |
২০০৩ |
১৯৯০ |
২০০৩ |
টেলিফোন |
৬ |
২০৯ |
৬ |
৪৬ |
মোবাইল ফোন |
০ |
২১৫ |
০ |
২৫ |
ইন্টারনেট |
০ |
৬৩ |
০ |
১৭ |
সব মিলিয়ে খারাপ নেই চীনের মানুষ। যদিও বিষয়টা পুরোপুরি সমস্যা এবং সংকটমুক্ত নয়।
চীন এগোচ্ছে সম্পূর্ণ অপরিচিত এবং অপ্রচলিত রাস্তায় এ বিষয়ে কারোর কোনো দ্বিমত নেই। বির্তক সে রাস্তা চীনকে নিয়ে যাচ্ছে কোন দিকে, তাই নিয়ে। এই পথ নির্বাচনের কিছু বাধ্যবাধকতার উপাদান রয়ে গেছে চীনের নিজস্ব ইতিহাসের মধ্যে আর কিছুটা দ্রুত পরিবর্তনশীল পৃথিবীর চালচিত্রের জন্য। এই ইতিহাসের প্রধান উপাদান হল ১৯৪৯ থেকে আজ গণসাধারণতন্ত্রী চীনের ৫৭ বছরে। ১৯১৯ সালে ৪ মে’র আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আধুনিক চীনের জন্ম। ৪ মের ঐতিহাসিক আন্দোলন এক দিক থেকে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী জাতীয়তাবাদের বিকাশ, মর্মবস্তুর অন্যদিক থেকে গণতন্ত্র এবং আধুনিক চীন গড়ে তোলার আকাঙ্ক্ষায় সমৃদ্ধ। কিন্তু ১৯১৯ থেকে ১৯৪৯ - এই তিনটি দশক ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ। একের পর এক সাম্রাজ্যবাদী শক্তি চীনকে ছিঁড়ে খুঁড়ে খেয়েছে আর অন্য দিকে কুয়োমিনটাঙ আর কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যেকার সশস্ত্র সংঘাত গোটা চীনকে যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে রেখে দিয়েছে। এই সংঘাত যত এগিয়েছে কুয়োমিনটাঙ বিচ্ছিন্ন হয়েছে, চীনের মানুষ কমিউনিস্ট পার্টিকে বেছে নিয়েছেন তাদের মুক্তিদাতা হিসাবে। অবশেষে ১৯৪৯ সালে কমিউনিস্ট পার্টি চীনের মূল ভূখণ্ডে বিজয় অর্জন করে প্রতিষ্ঠা করে গণসাধারণতন্ত্রী চীন।
চীন ভারতবর্ষের মতো কোনো একটি সাম্রাজ্যবাদী দেশের কেন্দ্রীয় শাসনের মধ্যে কখনও আসেনি। বরং জাপান, ইংল্যাণ্ড, ফ্রান্স, জার্মানি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অনেকগুলো সাম্রাজ্যবাদী দেশ চীনের বিভিন্ন প্রান্ত দখল করেছিল। এরা প্রধানত ছিল চীনের পূব দিকের উপকূলবর্তী অঞ্চলে। চীনের বিস্তৃত ভূখণ্ডে এদের উপস্থিতি সেভাবে ছিল না। শিল্প এবং পরিকাঠামোর বিস্তার হয় এই অধিকৃত উপকূলবর্তী শহর এবং বন্দরকে কেন্দ্র করেই। চীনের সুবিশাল অংশ ছিল গ্রামাঞ্চল এবং এখানকার কৃষকরাই ছিল কমিউনিস্ট পার্টির মূল ভিত্তি। চীন বিপ্লবের মূল ভিত্তিই ছিল কৃষিবিপ্লব। গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরার স্লোগান চীন বিপ্লবের অত্যন্ত সঠিক রণকৌশলগত স্লোগান ছিল।
১৯৪৯ সালে বিপ্লবের পর প্রথম ধাপই ছিল ভূমিসংস্কার। জমির মালিকানা রাষ্ট্রের হাতেই থাকে, কিন্তু চাষের অধিকার এবং ফসলের অধিকার দেওয়া হয় পরিবার ভিত্তিতে। ’৫২ সাল পর্যনত চীনে ভূমিসংস্কারের এই পর্যায়টি চলে। শতাব্দীর পর শতাব্দী অভুক্ত চীনের গরিব কৃষকের কাছে এর থেকে বড় পাওয়া আর কিছুই হতে পারে না। ১৯৫৪ সাল থেকে শুরু হয় পরবর্তী ধাপ। কয়েকটি পরিবারভিত্তিক কৃষি সমবায় গঠনের মাধ্যমে আয়ের বৈষম্য বৃদ্ধির সম্ভাবনা কমানোর চেষ্টা হয়। ১৯৫৬ থেকে সমবায়গুলোর আকার বাড়ানো শুরু হয়। ’৫৭ সালের থেকে গোটা গ্রামভিত্তিক সমবায় গড়ে উঠতে থাকে। ’৫৮ সাল থেকে কমিউন গড়ে তোলার কাজ শুরু হয় এবং কমিউনের আকার বাড়তে থাকে। এমনকি হেনান প্রদেশে গোটা জেলা নিয়ে একটি কমিউন গড়ে তোলা হয়। ’৫৬ সালে কথাটা কেন্দ্রীয় কমিটিতে উত্থাপিত হয়, - কৃষক যতই বিপ্লবী হোক, কৃষকের নিজস্ব জমির প্রতি দুর্বলতা থাকে। চীনের কৃষক হাজার বছর ধরে নিজের জমিতে চাষ করে অভ্যস্ত, এত দ্রুত জমির যৌথ মালিকানার দিকে এগোলে তা সাধারণ কৃষকরা ভালোভাবে গ্রহণ করতে পারবে না। মাও জেদঙ তখন এই আপত্তি অগ্রাহ্য করেন।
১৯৫৮ সালে শুরু হয় তথাকথিত দীর্ঘ উল্লম্ফনের (Great Leap Forward) । যা চীনের অর্থনীতিতে শেষ পর্যন্ত বিপর্যয় ডেকে আনে। প্রকৃতপক্ষে মাও জেদঙ’এর নেতৃত্বে অর্থনীতি বিকাশের যে নীতি নির্দিষ্ট হয়, তার মধ্যেই দীর্ঘ উল্লম্ফনের ভুলের ভিত্তি থেকে গিয়েছিল। এর ছিল চারটি অংশ - সাধারণ মালিকানা (Common Ownership), জনজোয়ার সৃষ্টি (Mass Mobilisation) কেন্দ্রীভবন (Centralisatiorn), এবং স্বয়ম্ভরতা (Self-Sufficiency)|
কমিউন তৈরির বাড়াবাড়িতে ছিল সাধারণ বা যৌথ মালিকানার প্রতিফলন। জনজোয়ার সৃষ্টিতে অবহেলিত হয়েছিল শিল্প বিকাশের সাধারণ বস্তুগত নিয়ম। এবং স্বয়ম্ভরতার নীতির মধ্যেই প্রতিফলিত হয়েছিল দ্রুত শিল্পায়নের বাস্তবতাহীন কাল্পনিক প্রচেষ্টা। অর্থনীতিতে এর ফল ছিল বিপর্যয়কারী। ১৯৫৭ থেকে ১৯৫৮-তে চীনে জাতীয় উৎপাদন বেড়েছিল ২২ শতাংশ। ১৯৫৯’এ তা কমে দাঁড়ায় ৮.২ শতাংশ এবং ১৯৬০ সালে জাতীয় উৎপাদন হ্রাস পায় ১.৪ শতাংশে, ১৯৬১-তে হ্রাস পায় ২৯.৭ শতাংশ অর্থাৎ জাতীয় উৎপাদন প্রায় তিনভাগের একভাগ হ্রাস পায়। ১৯৬২-তে তা আরো ৬.২ শতাংশ হ্রাস পায়।[12] এবং এর বহিঃপ্রকাশ ঘটে গ্রামাঞ্চলে দুর্ভিক্ষের মধ্যে, বেসরকারি মতে এই দুর্ভিক্ষে প্রাণ হারায় ২ থেকে ৩ কোটি মানুষ।[13]
১৯৮১ সালে চীন একাদশ কেন্দ্রীয় কমিটির ৪র্থ প্লেনামে একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল তৈরি করা হয়। সে দলিলটি হল - চীন গণসাধারণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পর পার্টির ইতিহাসের কতগুলো প্রশ্ন সম্পর্কে প্রস্তাব। এই প্রস্তাব থেকে একটি দীর্ঘ উদ্ধৃতি দিয়ে দীর্ঘ উল্লম্ফন সম্পর্কে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির মূল্যায়ন আমরা দেখব।
’১৯৫৮ সালে পার্টি অষ্টম জাতীয় কংগ্রেসের ২য় প্লেনামে সমাজতান্ত্রিক গঠন সম্পর্কে সাধারণ লাইন গৃহীত হয়েছিল। এই সাধারণ লাইন আর মূল দিকগুলো চীনের অর্থনীতি ও সংস্কৃতির পশ্চাৎপদ অবস্থার পরিবর্তনের জন্য জনসাধারণের প্রবল তাগিদ প্রতিফলিত করেছিল এবং এ পর্যন্ত সাধারণ লাইনটি ঠিকই ছিল। কিন্তু যে ব্যাপারে এর ঘাটতি ছিল তা হল এখানে বাস্তব অর্থনীতির নিয়মগুলোকে উপেক্ষা করা হয়েছিল। প্লেনামের আগে এবং পরে পার্টির যাবতীয় কমরেড এবং চীনের সব জাতির জনগণের মধ্যে সমাজতন্ত্রের জন্য প্রবল উদ্যম ও উদ্দীপনা প্রকাশিত হচ্ছিল এবং উৎপাদন এবং গঠনকাজে তারা কিছু সাফল্যও অর্জন করেছিল। কিন্তু, অতিরিক্ত উঁচু লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করা, একতরফা ইচ্ছেমত নির্দেশনামা জারি করা, বড়াই করার মনোভাব, প্রবল ’কমিউনিস্ট হাওয়া’ বইয়ে দেওয়া, ইত্যাদি বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত ’বাম ঝোঁকের’ ভুল সারা দেশে অবাধে ছড়িয়ে পড়েছিল। এর কারণ সমাজতান্ত্রিক গঠন কাজে আমাদের অভিজ্ঞতার অভাব ছিল এবং অর্থনৈতিক বিকাশের নিয়মসূত্রগুলো সম্বন্ধে এবং চীনের মূল অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে আমাদের উপলব্ধি অপর্যাপ্ত ছিল। যেটা আরো গুরুত্বপূর্ণ তা হল - এই ভুলগুলোর কারণ, কমরেড মাও জেদঙ এবং অন্য অনেক কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় নেতৃত্ব পর্যায়ের কমরেড তাঁদের সাফল্যে আত্মতুষ্ট হয়ে উঠেছিলেন, তাড়াতাড়ি ফল পাবার জন্য অধীর হয়ে উঠেছিলেন এবং মানুষের মনোগত আকাঙ্ক্ষা ও মনোগত প্রচেষ্টার ভূমিকাকে অতিরিক্ত বড় করে দেখেছিলেন। সাধারণ লাইন প্রণয়নের পর যত্নের সঙ্গে অনুসন্ধান ও বিচার-বিশ্লেষণ না করে এবং অগ্রিম পরীক্ষা-নিরীক্ষা না চালিয়ে ’দীর্ঘ উল্লম্ফন’ আন্দোলন ও গ্রামীণ গণকমিউনের জন্য আন্দোলন শুরু করে দেওয়া হয়েছিল।’
১৯৮০ সালের আগস্ট মাসে দেঙ জিয়াওপিঙ ইতালিয়ান সাংবাদিক ওবিনা ফালাসিকে একটি ঐতিহাসিক দীর্ঘ ইন্টারভিউ দেন। তাতে প্রায় একটি বাক্যে তিনি এই দীর্ঘ উল্লম্ফনের পর্যায়কে বর্ণনা করেন - ’আমরা বাস্তবতার নিয়মের বিরুদ্ধে গিয়ে কাজ করেছিলাম, এক ধাক্কায় অর্থনীতিকে দাঁড় করিয়ে দিতে চেয়েছিলাম। আমাদের মনোগত ইচ্ছা বাস্তব নিয়মের বিপরীতে আমাদের চালাতে চেয়েছিল, এক্ষেত্রে ক্ষয়ক্ষতি তো অবধারিত।’
দীর্ঘ উল্লম্ফনের বাম বিচ্যুতির জন্য চীনের কমিউনিস্ট পার্টির কমরেড মাও এবং অন্যান্য নেতৃত্বকে দায়ী করেছে। এবং মাও এ দায়িত্ব অস্বীকারও করতে পারেন না। মাও জেদঙ চীনের কমিউনিস্ট পার্টির প্রধান পুরুষ ছিলেন এটা কেবল না, তাঁর প্রভাব পার্টির মধ্যে সমাজতান্ত্রিক চেতনাকে ছাপিয়ে কখনও কখনও ব্যক্তিপূজার সামন্ততান্ত্রিক প্রবণতাতেও পর্যবসিত হয়েছিল। (যেমন ১৯৪৫ সালে পার্টির গঠনতন্ত্রে লিপিবদ্ধ হয় পার্টি চলবে ’কমরেড মাও জেদঙ’-এর চিনতাধারা অনুযায়ী’। এ সিদ্ধান্ত হয় কমরেড মাও-এ জীবদ্দশায় এবং তাঁর নেতৃত্বে। ১৯৫৬’র ৮ম কংগ্রেসে এটি বাতিল হয়, কিন্তু সাংস্কৃতিক বিপ্লবের আমলে ৯ম পার্টি কংগ্রেসে তা আবার নতুন করে ঢোকানো হয়।)
কিন্তু এই ভুলগুলো কি ইচ্ছাকৃত? না, বাস্তব অবস্থাই প্রভাবিত করেছিল ভুলের দিকে পা বাড়াতে। এক নম্বর কারণ, বিপ্লবের পরের সাত বছরের সাফল্য। শিল্প উৎপাদন বেড়েছিল গড়ে ১৭ শতাংশ করে, কৃষি বেড়েছিল গড়ে ৫ শতাংশ করে। এই সাফল্য বাড়তি আত্মবিশ্বাস জুগিয়েছিল, অসম্ভবকে সম্ভব বলে মনে করিয়েছিল।
১৯৫৩ সালে কোরিয়ের যুদ্ধ চীনকে দ্রুত শিল্পে স্বয়ম্ভর হবার তাগিত দিয়েছিল। ১৯৫৭ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে বিরোধের সূত্রপাত এ তাগিদকে আরো বাড়িয়েছিল। শত্রুতে ভরা পৃথিবীতে সদ্যোজাত সমাজতান্ত্রিক চীনকে একা নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে - এ অকৃত্রিম ইচ্ছার প্রতিফলন ’দীর্ঘ উল্লম্ফনে’র মধ্যে ছিল। কিন্তু ইচ্ছা বা চেতনা তো বস্তুজগতের নিয়মের আগে যেতে পারেনা, তাকে বাস্তবের নিয়ম মেনে চলতে হবে। কিন্তু অকৃত্রিম ইচ্ছার ঊর্ধ্বেও কখনও কখনও ব্যক্তি অহমিকা কাজ করেছে। দীর্ঘ উল্লম্ফনের ফল চীনের পক্ষে ভালো হচ্ছে না এই অনুভব ১৯৫৯ ’এর গোড়াতেই পার্টির হতে শুরু করে। কারণ দুর্ভিক্ষ মাথা চাড়া দিচ্ছে তখন। আগস্টে লুসানে বসে কেন্দ্রীয় কমিটির বিশেষ অধিবেশন। আত্মসমীক্ষা এবং আত্মসমালোচনায় অধিবেশন যখন প্রায় একমত তখন তৎকালীন চীনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী পেঙ দেহুয়াই বিপর্যয়ের জন্য সরাসরি মাও জেদঙ-কে দায়ী করে বক্তৃতা দেন। এই আক্রমণকে কেন্দ্র করে মাও জেদঙ ’দক্ষিণপন্থী সুবিধাবাদের’ বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালানোর আহ্বান জানান। বাম ঝোঁকে আক্রান্ত একটি পার্টি সেই ঝোঁক থেকে বেরিয়ে না এসে আক্রমণ করে উল্টোদিকে। পেঙ দেহুয়াই পার্টিতে সমালোচিত হন, এতে তাঁর কতটা ক্ষতি হয়েছিল জানা যায়নি, কিন্তু ’দীর্ঘ উল্লম্ফন’ জারি থাকে আরো দুবছর, এতে চীনের যথেষ্ট ক্ষতি হয়।
কিন্তু এই দীর্ঘ উল্লম্ফনের ফল হিসাবে, পার্টির অভ্যন্তরে এবং জনমানসে মাও’এর প্রভাব অনেকটা ক্ষুণ্ন হয়। ১৯৬২ সালে লি শাওকি আনুষ্ঠানিকভাবে দীর্ঘ উল্লম্ফনের সমাপ্তি ঘোষণা করেন। পার্টি এবং সরকারের পরিচালনার দৈনন্দিন দায়িত্ব চলে আসে রাষ্ট্রপতি লি শাওকি, প্রধানমন্ত্রী ঝৌ এনলাই, পার্টি সম্পাদক দেঙ জিয়াওপিঙ, উপরাষ্ট্রপতি চে ইউনের যৌথ টিমের হাতে। কমরেড মাও এ ব্যবস্থা মেনে নিতে বাধ্য হন।
এই টিম আপ্রাণ চেষ্টা করে সমাজতান্ত্রিক নির্মাণের বাস্তবসমমত রাস্তায় চীনকে ফিরিয়ে আনতে। কমিউন ভেঙে দেওয়া হয় না, (যেখানে সদস্য ছিল গড়ে ৪৬০০ কৃষক পরিবার) কিন্তু সিদ্ধান্ত নেবার অধিকার ধাপে ধাপে প্রথমে উৎপাদন ব্রিগেড (গড় সদস্য ২০০-৩০০ কৃষক পরিবার) এবং অবশেষে উৎপাদন টিমের (গড় সদস্য ৪০টি কৃষক পরিবার) হাতে দিয়ে দেওয়া হয় - পারিবারিকভাবে অল্প জমি রাখবার অধিকার দেওয়া হয়। শিল্পের ক্ষেত্রে তথাকথিত ’রাজনীতিই সর্বোচ্চ’ (Politics in Command) নীতিকে সরিয়ে পেশাগতভাবে যোগ্যতম ব্যক্তিদের দায়িত্ব দেওয়া হয়। অল্পস্বল্প বৈষয়িক উৎসাহদানের ব্যবস্থা (Materilal Incentive) ফিরিয়ে আনা হয়। অর্থনীতি সাড়া দেয় চমৎকারভাবে। চার বছরে, ১৯৬৩, ১৯৬৪, ১৯৬৫, ১৯৬৬ জাতীয় উৎপাদন বৃদ্ধির হার দাঁড়ায় যথাক্রমে ১০.৭ শতাংশ, ১৬.৩ শতাংশ, ১৬.৯ শতাংশ এবং ১৭ শতাংশ। লাগাতার চার বছরে বিপুল বৃদ্ধির এই নজির চীনের গোটা ইতিহাসে নেই।[14]
আবার বিপরীত প্রবণতা শুরু হয়। মাও জেদঙ ’সদর দপ্তরে কামান দাগো’ এই স্লোগান দিয়ে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের আহ্বান দিলেন। ১৯৬৬’র মে মাসে বেজিঙ ছেড়ে সাংহাই গিয়ে তিনি এই আহ্বান দেন। চীনের কমিউনিস্ট পার্টির আগের উল্লিখিত দলিলে ’সাংস্কৃতিক বিপ্লবের’ দশ বছরে এই শিরোনামে লেখা হয়েছেঃ
’১৯৬৬ সালের মে থেকে ১৯৭৬ সালের অক্টোবর পর্যন্ত স্থায়ী ’সাংস্কৃতিক বিপ্লব’ নয়াচীন প্রতিষ্ঠার পরবর্তীকালে পার্টি, রাষ্ট্র ও জনগণের কঠোরতম দুর্বিপাক ও ভীষণতম ক্ষয়ক্ষতির জন্য দায়ী ছিল। কমরেড মাও জেদঙ এই ’সাংস্কৃতিক বিপ্লব’ সূচীত ও পরিচালিত করেছিলেন। তাঁর প্রধান তত্ত্ব ছিল: বুর্জোয়া শ্রেণীর অনেক প্রতিনিধি ও প্রতিবিপ্লবী সংশোধনবাদী পার্টি, সরকার, সৈন্যবাহিনী ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রের বিভিন্ন বিভাগে প্রচ্ছন্নভাবে ঢুকে পড়েছে, বেশীর ভাগ সংগঠন ও বিভাগে নেতৃত্ব- ক্ষমতা মার্কসবাদীদের ও জনগণের হাতে নেই। পার্টির ভেতরের যেসব ক্ষমতাসীন ব্যক্তি পুঁজিবাদের পথগামী, তারা কেন্দ্রীয় কমিটির মধ্যে একটি বুর্জোয়া সদর দপ্তর গড়ে তুলেছে।’
বোঝাই যায়, আক্রমণের লক্ষ্য লি শাওকি এবং তাঁর সহযোগীরা, বিশেষত দেঙ জিয়াওপিঙ এবং চেন ইয়ুন। ঐ দলিলে আরো বলা হয় - ’এইসব তত্ত্ব বেরিয়েছিল প্রধানত (১৬ মে’র বিজ্ঞপ্তিতে), যা ’সাংস্কৃতিক বিপ্লবের’ কর্মসূচীমূলক দলিলের ভূমিকা নিয়েছিল এবং ১৯৬৯ সালের এপ্রিল মাসে পার্টির নবম জাতীয় কংগ্রেসের দাখিল করা রাজনৈতিক রিপোর্টে। এইসব তত্ত্বকে শামিল করা হয়েছিল একটি সাধারণতত্ত্বে ’সর্বহারা একনায়কত্বাধীনে লাগাতার বিপ্লবের’ তত্ত্বে (Theory of continued revolution under the dictatorship of the Proletariat) । এইসব ভ্রান্ত ’বাম’ তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে মাও জেদঙ ’সাংস্কৃতিক বিপ্লব’ শুরু করেছিলেন। সেগুলো চীন বিপ্লবের বাস্তব অনুশীলনের সঙ্গে মার্কসবাদ-লেনিনবাদের সর্বজনীন মূলনীতিগুলোর সমন্বয়জনিত মাও জেদঙ’এর চিন্তাধারার থেকে সপষ্টতই বিচ্যুত।’
মোদ্দা যেটা বলা হয় - সমাজতন্ত্রের গোটা পর্যায়েই বুর্জোয়াদের সাথে প্রোলেতারিয়েতের দ্বন্দ্বই প্রধান এবং এই দ্বন্দ্বকে তীব্রতর করার মধ্যে দিয়েই সমাজতন্ত্র দৃঢ় হবে।
অথচ এই মাও জেদঙ’ই ৮ম কংগ্রেসে চীনের সমাজতন্ত্র নির্মাণের মূল কাজকে বর্ণনা করেছিলেন এভাবে -
’দেশের ভেতরকার প্রধান দ্বন্দ্ব আর শ্রমিকশ্রেণী ও বুর্জোয়াশ্রেণীর মধ্যেকার দ্বন্দ্ব নয়, প্রধান দ্বন্দ্ব হল, একদিকে অর্থনীতি ও সংস্কৃতির দ্রুত বিকাশের জন্য জনগণের দাবি এবং অন্য দিকে, জনগণের চাহিদার তুলনায় আমাদের অর্থনীতি ও সংস্কৃতির তখনকার ঘাটতি অবস্থা - এই দুইয়ের মধ্যে দ্বন্দ্ব; সমগ্র দেশের জনগণের সামনে প্রধান কর্তব্য; যাবতীয় শক্তি কেন্দ্রীভূত করে সামাজিক উৎপাদনশক্তি বাড়ানো, দেশকে শিল্পায়িত করা এবং দেশের জনগণের অবিরাম বেড়ে চলা বস্তুগত ও সাংস্কৃতিক চাহিদা ক্রমশ পূরণ করা; এবং শ্রেণীসংগ্রাম থাকলেও এবং জনগণের গণতান্ত্রিক একনায়কত্ব আরো জোরদার করতে হলেও এই একনায়কত্বের মূল কর্তব্যভার হল নতুন উৎপাদন সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে উৎপাদনশক্তিগুলোর সংরক্ষণ করা ও বিকশিত করা। অর্থাৎ ৮ম থেকে ৯ম কংগ্রেসের মধ্যে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গেল। এক্ষেত্রে লক্ষণীয় হল কারা এই তত্ত্বগুলো রচনা করেছিলেন। ৮ম কংগ্রেসের পলিটব্যুরো - মাও জেদঙ, লি শাওকি, ঝৌ এনলাই, দেঙ জিয়াওপিঙ, মার্শাল ঝু দে এবং চেন ইয়ুন। এরা প্রত্যেকেই ছিলেন চীন বিপ্লবের প্রকৃত নেতা - এরাই চীনকে মুক্তির সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। আর নবম কংগ্রেসের পলিটব্যুরোয় মাও জেদঙ একমাত্র ঝৌ এনলাই ছাড়া পুরনো সব সাথীকে বিদায় দিয়েছিলেন। তার জায়গায় এসেছিলেন লিন বিয়াও, যাঁকে অভিজাত-সামন্ততান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় মাও জেদঙ নিজের উত্তরসুরি বলে ঘোষণা করেছিলেন এবং যিনি মাও জেদঙ-কে হত্যা করে পরবর্তী সময়ে ক্ষমতা দখল করতে চেয়েছিলেন বলে অভিযুক্ত। আর এক সদস্য চেন বোদা ছিলেন রেড ফ্ল্যাগের সম্পাদক এবং মাও ’এর লেখাপত্রের টীকাকার এবং কাঙ শেঙ, যিনি ছিলেন চীনের গোয়েন্দা পুলিশের প্রধান এবং মাও পত্নী জিয়াঙ কিঙ।’
ক্ষমতাচ্যুত করা বললে কম বলা হয়। চীনের রাষ্ট্রপতি লি শাওকিকে মারতে মারতে তাঁর বাসভবন থেকে বার করে দেয় মাও অনুগত রেডগার্ডরা। দেঙ জিয়াওপিঙ’এর কপালে একই জিনিস জোটে। জেলখানায় বিনা চিকিৎসায় লি শাওকির মৃত্যু হয় ১৯৬৯ সালে। আর দেঙ জিয়াওপিঙকে পাঠানো হয় জিয়াংসি প্রদেশের একটি কারখানায় সাধারণ শ্রমিকের কাজ করতে।
সাংস্কৃতিক বিপ্লবের দশটি বছরে চীন তছনছ হয়ে যায়। ’সদর দপ্তরে কামান দাগতে’ জড়ো হওয়া রেড গার্ডরা, যাদের একটা বড় অংশ ছিল ছাত্র, প্রথমেই কয়েক বছরের জন্য চীনের সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কিণ্ডারগার্টেন থেকে বিশ্ববিদ্যালয় সব বন্ধ করে দেয়। অর্থনীতি সংক্রান্ত বিশেষজ্ঞ যারা তাদের ৮০ শতাংশকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। এই বিপ্লব শেষমেশ বুদ্ধিজীবীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। বিশেষজ্ঞ ম্যানেজার এবং প্রযুক্তিবিদদের শিল্পের ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। ‘Better red than expert’ (বিশেষজ্ঞ থেকে লাল হওয়া ভালো) এই স্লোগান দিয়ে। দু’দিন পরেই কে কত মাও জেদঙ অনুগত তা নিয়ে প্রকাশ্যে রেড গার্ডরা পরসপরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমে পড়ে - গোটা দেশে গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি হয়। সেনাবাহিনী নামিয়ে সে পরিস্থিতির সামাল দেওয়া হয়। ভুল তত্ত্ব বিকৃত সংগঠনের জন্ম দেয়। ঘোষিত উত্তরাধিকারী লিন বিয়াও ক্ষমতা দখল করতে ব্যর্থ অভ্যুত্থান ঘটানোর পর পালাতে গিয়ে বিমান দুর্ঘটনায় প্রাণ প্রাণ হারান। ক্ষমতা দখল করে মাও জে দঙ-কে সামনে রেখে চারজন: জিয়াঙ কিঙ (মাও জে দঙ’এর স্ত্রী), ওয়াং হংওয়েন, ঝাং চুনকিয়াও এবং ইয়াং ওয়েনইউয়ান, চরম বামপন্থার আড়ালে ক্ষমতালোভী এই অংশ আসলে যে চীনের সর্বনাশ করবে এই উপলব্ধি স্বয়ং মাও জেদঙ’এরই হয়। এদেরকে ’গ্যাং অব্ ফোর’ এই আখ্যায় ভূষিত করেন মাও জেদঙ নিজেই। এবং এদের একচেটিয়া ক্ষমতা দখলকে বাধা দিতে নির্বাসন থেকে ফিরিয়ে এনে দেঙ জিয়াওপিঙকে আবার পলিটব্যুরোতে নিয়ে আসেন মাও জেদঙই। দীর্ঘ ইতিহাসের মধ্যে না গিয়ে বলা যায় ’৭৬ সালে মাও জেদঙ’এর মৃত্যুর এক মাসের মধ্যে গ্যাং অব্ ফোরকে গ্রেপ্তার করা হয়। শেষ হয় সাংস্কৃতিক বিপ্লবের দুর্ভাগ্যজনক পর্যায়।
একাদশ কেন্দ্রীয় কমিটির তৃতীয় প্লেনামের মধ্যে দিয়ে শুরু হয় চীনের যাত্রা সম্পূর্ণ নতুন পথে। খুব স্বাভাবিকভাবেই সাংস্কৃতিক বিপ্লবের দশ বছরে চীনের অর্থনীতির বৃদ্ধির হার নেমে আসে গড়ে ৫.৮ শতাংশে, যদিও ১৯৬২ থেকে ১৯৬৬ পর্যনত গড় বৃদ্ধির হার ছিল ১৫.৩ শতাংশ। এই প্লেনামেই পার্টির সাধারণ সম্পাদক হন তুলনায় অপরিচিত মাও ঘনিষ্ঠ হুয়া গুলোফেঙ। কিন্তু ১৯৮২-র দ্বাদশ কংগ্রেসেই ফেঙ সাধারণ সম্পাদক পদ থেকে সরে যান। শুরু হয় চীনের দেঙ জিয়াওপিঙ এবং তার অনুসারীদের যুগ। যে যুগ এখনও প্রসারমান। ১৯৫৬ সালে ৮ম পার্টি কংগ্রেসে সমাজতন্ত্র নির্মাণের তত্ত্বগত বোঝাপড়াকেই ফিরিয়ে আনা হয় ১৯৭৮’এর তৃতীয় প্লেনামের পর। কিন্তু সম্পূর্ণ পরিবর্তিত একটি আন্তর্জাতিক পটভূমিকায়। মাঝখানে কুড়িটি বছর দেঙ জিয়াওপিঙ’এর ভাষায় ’নষ্ট হয়ে যাওয়া কুড়িটি বছর’।
আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনে প্রাক্ পুঁজিবাদের থেকে সমাজতন্ত্রে উত্তরণের প্রশ্নে মধ্যবর্তী একটি স্তর থাকবে এ বিষয়ে বিতর্ক ছিল না। অষ্টম কংগ্রেসের সময় আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলন ছিল ঐক্যবদ্ধ, সেখানে থেকেও উৎপাদিকা শক্তির বৃদ্ধিই প্রধান কাজ এ লাইনের কোনো বিরোধিতাও উত্থাপিত হয়নি।
কার্ল মার্কস গোথা কর্মসূচীতে সাম্যবাদকে বর্ণনা করতে গিয়ে পুঁজিবাদ থেকে সেখানে পৌঁছনোর মধ্যবর্তী একটি স্তরের কথা বলেন, যেখানে মানুষ কাজ অনুসারে আয় করবে। সাম্যবাদ হল চূড়ান্ত স্তর, যেখানে মানুষ সামর্থ্য অনুযায়ী কাজ করবে এবং প্রয়োজন অনুসারে পাবে। ’রাষ্ট্র ও বিপ্লব’ গ্রন্থে লেনিন এই স্তরটিকেই সমাজতন্ত্র বলে বর্ণনা করেন। সেখানে ব্যক্তি মালিকানার অবসান ঘটিয়ে রাষ্ট্রীয় মালিকানা ও যৌথ মালিকানা কায়েম হবে। ১৯১৭-র রুশ বিপ্লব এমনকি তার প্রথম পর্যায় ’ওয়ার কমিউনিজম’-এর সময়েও প্রশ্নটি আসেনি। প্রশ্নটি লেনিন হাজির করলেন তার ’নয়া অর্থনৈতিক পরিকল্পনা’ বা নেপের সময়। এখানে ‘Transition to Socialism’ এর একটি স্তরের কথা নিয়ে আসা হল। যেখানে উৎপাদিকা শক্তির বিকাশের জন্য ব্যক্তি মালিকানাকে কিছু দূর পর্যন্ত সঙ্গে নিয়ে চলার সম্ভাবনাও উল্লিখিত হল, যেটা সোভিয়েত ইউনিয়নে চলেছে প্রায় ১৯৩৮ পর্যন্ত। কিন্তু গোটা পর্যায়টাতেই সামাজিক মালিকানাই ছিল প্রধান, এবং এর প্রসার ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়েছে, এক সময় ব্যক্তিমালিকানা একদমই গুরুত্বহীন হয়ে গেছে। তাত্ত্বিকভাবে কথাটা বলা যায় ’উৎপাদন সম্পর্ক’ এবং ’উৎপাদিকা শক্তি’ আকাশ থেকে পড়া দুটি বিচ্ছিন্ন বিষয় নয়, বরং এই দুটির মধ্যে আছে অঙ্গাঙ্গী এবং সজীব একটি সম্পর্ক। কোনো একটি নির্দিষ্ট সমাজের পুরনো উৎপাদন যখন আর উৎপাদিকা শক্তির বৃদ্ধি করতে পারে না বরং বাধা হয়ে দাঁড়ায় তখনই সে সমাজ উন্নততর উৎপাদন সম্পর্ককে খোঁজে উৎপাদিকা শক্তির বিকাশের জন্যই। সমাজ বিপ্লব আসলে পুরনো উৎপাদন সম্পর্ক বাতিল করে নতুন উৎপাদন সম্পর্ককে কায়েম করে। সামন্ততন্ত্রের যুগে এই দুইয়ের দ্বন্দ্বই পুঁজিবাদী বিপ্লবকে ডেকে এনেছিল। অভিজাত জমিদারকে ক্ষমতাচ্যুত করে নতুন বুর্জোয়ারা ক্ষমতায় আসার ফল হল আধুনিক যন্ত্র বসিয়ে মজুরির বিনিময়ে সর্বহারাকে জড়ো করে বুর্জোয়ারা উৎপাদিকা শক্তির সামনে অগ্রগতির একটি অভুতপূর্ব সম্ভাবনার দরজাকে খুলে দিয়েছিল - যার দান আজকের আধুনিক সভ্যতা। কিন্তু একটি দেশে পুঁজিবাদ পুরোপুরি বিকশিত হবার পর এই অবস্থাটির পরিবর্তন ঘটে যায়। তখন বুর্জোয়া এবং সর্বহারা শোষণভিত্তিক উৎপাদন সম্পর্কই উৎপাদিকা শক্তির আরো বিকাশের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। ব্যক্তিলাভের পেছনে ছুটে চলা বুর্জোয়ারা বাজারের বিকাশের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এরকম একটি বিকশিত পুঁজিবাদী সমাজে সমাজ বিপ্লব কেবল অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়া মালিকানার বিষটিকে বাদ দিয়ে উৎপাদিকা শক্তির বিকাশের আরো রাস্তা খুলে দেয়।
সমাজবিপ্লব শুরুতে একটি রাজনৈতিক বিষয়, যেখানে বুর্জোয়া এবং তার সহযোগীদের ক্ষমতাচ্যুত করে শ্রমিকশ্রেণী ও তার বন্ধুরা কিন্তু অর্থনীতিতে যদি তখনও পুঁজিবাদের পরিপূর্ণ বিকাশ না ঘটে, বা কিছুটা প্রাক্ পুঁজিবাদী উপাদান থেকে যায়, তখনও পুরনো উৎপাদন সম্পর্ককে পুরোপুরি বাতিল করে দেওয়া যায় না, কারণ তখনও পুরনো উৎপাদন সম্পর্কও উৎপাদিকা শক্তির বিকাশের ক্ষমতা রাখে। আর পুঁজিবাদের থেকে উন্নততর উৎপাদিকা শক্তি ছাড়া সমাজতন্ত্র কখনও কায়েম করা যায় না। বিষয়টিকে বোঝার জন্য উন্নত প্রযুক্তির বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা যায়। একটি উন্নত পুঁজিবাদী দেশে প্রযুক্তি প্রায় সর্বোচ্চ পর্যায়ে থাকে, সামাজিক বিপ্লব উৎপাদনের উপকরণ সে সূত্রে উন্নত প্রযুক্তির মালিকানার হাতে এনে দেয়। কিন্তু পিছিয়ে পড়া একটি দেশে যদি শ্রমিকশ্রেণী ক্ষমতা দখল করে তার হাতে উন্নত প্রযুক্তি থাকে না। লেনিন ’নেপ’ এ ঠিক এটিই করেছিলেন - পুঁজিবাদী রাশিয়া যদি পশ্চাৎপদ থাকে তাতে কোনো অসুবিধা নেই কারণ উন্নত পুঁজিবাদীরা চায় রাশিয়া পিছিয়ে থাকুক। কিন্তু সমাজতান্ত্রিক রাশিয়া যদি পিছিয়ে থাকে তবে উন্নত পুঁজিবাদীরা তাকে শেষ করে দেবে। কাজেই উন্নত প্রযুক্তির মালিক পুঁজিবাদীদের কনসেশন দিতে হব, কিছু দিন সঙ্গে নিয়ে চলতে হবে - ’নেপ’-এর এটাই শিক্ষা। যদিও এর রাজনৈতিক বিপদ সম্পর্কেও সজাগ থাকতে হবে। সমাজতন্ত্রে উত্তরণের এই মধ্যবর্তী পর্যায়ে একাজ করতে হতে পারে। এটাই লেনিনের শিক্ষা। ১৯২০ পরবর্তী কমিউনিস্ট আন্দোলনে বিশেষ করে অনুন্নত দেশে যারা সমাজতন্ত্র কায়েম করতে চাইছেন তাদের কাছে এটি একটি দিকনির্র্দেশও।
আমাদের দেশেও সমাজতন্ত্র কায়েমের আগে উত্তরণকারী একটি স্তর - জনগণতন্ত্রের কথা আমরা বলেছি। সেখানে রাজনৈতিক ক্ষমতা শ্রমিকশ্রেণীর হাতে থাকলেও অর্থনীতির ক্ষেত্রে মালিকানার বিভিন্ন রূপ, এমনকি বিদেশি পুঁজির নিয়ন্ত্রিত আহ্বানের কথাও বলা হয়েছে - গোটাটাই সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় মালিকানায় আসবে এ কথা বলা হয়নি। এই মর্মবস্তুর ওপরে দাঁড়িয়েই ১৯৫৬ সালে চীনে সমাজতন্ত্র নির্মাণের পরিকল্পনার কথা বলা হয়। যা কুড়ি বছর পর ১৯৭৬ সালে আবার ফিরে আসে।
তৃতীয় প্লেনামের মূল কথা ছিল এই - পার্টির মতাদর্শগত দিশা অক্ষুণ্ন রেখেই অর্থনৈতিক অগ্রগতির জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কারের কাজ শুরু হবে, যাতে চীন একটি অগ্রসর দেশে পরিণত হতে পারে।
নির্দিষ্ট যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় - কৃষিতে যৌথ মালিকানা শিথিল করা হবে। যা পরবর্তী সময় ধাপে ধাপে পরিবারের হাতে কৃষির অধিকার ফিরিয়ে দেওয়া হয়। যদিও জমির মালিকানা রাষ্ট্রের হাতেই থাকে।
শিল্পক্ষেত্রে বৈষয়িক উৎসাহদানকে কিছুটা ফিরিয়ে আনা হয়। বিদেশি বিনিয়োগের জন্য দক্ষিণ চীনে নির্দিষ্ট কয়টি অঞ্চলে ’বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল’ গড়ে তোলা হয়।
আধুনিকীকরণের চারটি ক্ষেত্রে (Four Modernisation) - কৃষি, শিল্প, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি - এই কাজ পুরোদমে শুরু হবে।
নির্দিষ্ট হয় চারটি প্রধান নীতি: (১) সমাজতন্ত্রের পথ, (২) জনগণের গণতান্ত্রিক একনায়কত্ব, (৩) কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্ব, (৪) মার্কসবাদ-লেনিনবাদ, মাও জেদঙ’র চিন্তাধারা।
এই প্লেনামের সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়িত হতে শুরু করে ১৯৭৯ সাল থেকে। চমকপ্রদ ফল হয় কৃষিতে। ১৯৭৮ থেকে ১৯৮৪ এই সময় কৃষি উৎপাদন বাড়ে গড়ে ১৪.৬ শতাংশ করে।
১৯৮০ সালে চারটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে ওঠে। বিদেশি বিনিয়োগ আসতে শুরু করে।
আরো একটি উল্লেখযোগ্য কাজ শুরু হয়, যা চীনের পরিকল্পনাকারীদের প্রত্যাশাকেও ছাপিয়ে যায়। তা হল ’শহর ও গ্রামীণ সংস্থা’ (Town and Village Enterprises, TVEs) গঠন। প্রধানত শহর এবং গ্রামের যৌথ মালিকানার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা প্রধানত গ্রামীণ এই শিল্প ও বাণিজ্য সংস্থাগুলো উৎপাদন, কর্মসংস্থান এবং সামগ্রিক অর্থনীতিতে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ১৯৯৯ সালে এই সংস্থাগুলোতে কাজ করত চীনের কর্মে নিযুক্ত মানুষের ১৯.৬ শতাংশ।
সংস্কারের যে কাজ শুরু হয় ১৯৭৮ সালে, তা আরও বেগ পায় ১৯৯২ সালে চতুর্দশ পার্টি কংগ্রেসে। এখানে নির্দিষ্ট করে বলা হয় পার্টির লক্ষ্য হল ’সমাজতান্ত্রিক বাজার অর্থনীতি’ গড়ে তোলা। এতে আরো বলা হয় এই সমাজতন্ত্রে থাকবে চীনা বৈশিষ্ট্য (Socialism with Chinese Characteristics) ।
তাত্ত্বিকভাবে নতুন একটি কথাই চীনের কমিউনিস্ট পার্টি হাজির করে তা হল সমাজতন্ত্রের আদি (Initial) পর্যায়। তাদের বক্তব্য চীনকে এই স্তরে থাকতে হতে পারে ১০০ বছর।
সংস্কারের পরবর্তী ধাপে ১৯৮৪ সালে ব্যক্তিমালিকানাকে নিজস্ব ব্যবসা শুরু করার অধিকার দেওয়া হয়। শুরুতে সর্বাধিক ৮ জনকে তারা নিয়োগ করতে পারত, পরে এই মাপকাঠিও তুলে দেওয়া হয়।
রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের সংস্কার শুরু হয় ১৯৮৪ সালে। প্রাথমিকভাবে ব্যবসা সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত নেবার অধিকার সেই সংস্থাকে দিয়ে দেওয়া হয়। দ্বিতীয়ত, রাষ্ট্রয়াত্ত সংস্থাগুলোকে তাদের কাঁচামাল সংগ্রহ ও উৎপাদন বিক্রির একটি অংশ খোলা বাজার থেকে করতে দেবার অনুমতি দেওয়া হয়। আসলে এর মাধ্যমে রাষ্টের পরিকল্পনার বিষয়টির মধ্যে একটি সম্পূর্ণ গুণগত পরিবর্তন ঘটানোর প্রক্রিয়ার সূত্রপাত ঘটানো হয়। অতীতে সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো উৎপাদন এবং বণ্টনের প্রতিটি শাখাকে নিয়ন্ত্রণ করা হত কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা দপ্তরের মাধ্যমে। পরিকল্পনার এই কাজটিকে ধাপে ধাপে ছেড়ে দেওয়া হয় সংস্থার হাতে এবং বাজারের হাতে। পরিকল্পনা দপ্তরের দায়িত্বটা একান্তভাবেই হয় অর্থনৈতিক পরিকল্পনা এবং বৃহত্তর আর্থিক ও প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে সেই লক্ষ্যে অর্থনীতিকে পরিচালনা করা, এবং এখনও পর্যন্ত সাফল্যের সাথেই অর্থনীতির দিকনির্দেশের কাজটি করা হচ্ছে চীনে। আটের দশকের মাঝামাঝি লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধির ফলে যখন তুমুল বিক্ষোভ ফেটে পড়ে বেজিঙ ও অন্যান্য শহরে, যেভাবে রাষ্ট্রের পরিকল্পনা বিভাগ হস্তক্ষেপ করে এবং মূল্যকে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে নিয়ে আসে তার থেকেই এর কার্যকারিতা বোঝা যায়। এখন চীনে তেল এবং কিছু গুরুত্বপূর্ণ পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়; ব্যাংকের সুদের হার নিয়ন্ত্রণ করে সরকার। এগুলো হচ্ছে সামগ্রিক অর্থনীতিকে পরিকল্পিত চাপে রাখার রাষ্ট্রের হাতিয়ার।
একটি বৃহত্তর পরিকল্পনার কাঠামোর মধ্যেই বাজার কাজ করে, যা এক অর্থে স্বাধীন, কিন্তু একটি সরকার নিয়ন্ত্রিত সীমারেখার মধ্যে।
১৯৭৬ থেকে ৩০ বছর পার করে চীনের অর্থনীতি তার সংস্কারের কাজকে অনেক দূর পর্যন্ত নিয়ে এসেছে। যে কেউ আজ নিজস্ব ব্যবসা খুলতে পারেন। বিদেশী বিনিয়োগ দেশের একটা বড় অংশে আজ অনুমোদিত এবং বিদেশী বিনিয়োগকারীদের কাছে চীন আজ সবচেয়ে আকর্ষণীয় জায়গা। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ৫০০টি কোম্পানির মধ্যে ৪৫০টি বিনিয়োগ করেছে চীনে।
রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার পুনর্গঠনের দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ শুরু হয়েছে পঞ্চদশ কংগ্রেস (১৯৯৭)-এর পর থেকে। এখান থেকেই ’বড়গুলোকে আঁকড়ে ধরো। ছোটোগুলোকে ছেড়ে দাও’-এই নীতিতে পুনর্গঠনের কাজ শুরু হয়। ৫৬,০০০ থেকে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার সংখ্যা নেমে এসেছে ৩২,০০০। বাকিগুলো হয় শ্রমিক সমবায় অথবা ব্যক্তিমালিকদের হাতে দেওয়া হয়েছে অথবা পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ১৯৭৬’এর আগে চীনে মোট বিনিয়োগের প্রায় গোটাটাই ছিল রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রে। আজ সেখানে (২০০৩) মোট বিনিয়োগের ২৩.৩ শতাংশ আছে ব্যক্তিমালিকদের হাতে।
বিপরীত দিক থেকে বিষয়টা এভাবে বলা যায় চীনে এখনও রাষ্ট্রয়ত্ত বা রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত সংস্থাগুলোর হাতে আছে মোট বিনিয়োগের ৭৬.৩ শতাংশ। মোট উৎপাদনের ৫৩.৯ শতাংশ আসে এই ক্ষেত্র থেকে। শহরাঞ্চলে প্রায় ১০ কোটি শ্রমিক কাজ করেন এই সংস্থাগুলোতে।
ব্যক্তিমালিকানাধীন সংস্থার সংখ্যা এই মুহূর্তে ৩৩ লক্ষ, কিন্তু এগুলোতে গড়ে কাজ করে ১৪ জন শ্রমিক। কর্মে নিযুক্ত মানুষের প্রায় ২৪ শতাংশ কাজ করে দেশি বিদেশী মালিকানার সংস্থায়।
কর্মসংস্থানের একটি বিপুল অংশ আসে শহর ও গ্রামীণ সংস্থা (TVEs) থেকে। ২০০২’এ এখানে কাজ করত ১৩.৩ কোটি মানুষ, গ্রামীণ কর্মসংস্থানের ২৬.৮ শতাংশ আসে এক্ষেত্র থেকে।
রাষ্ট্র এখনও বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ শিল্পক্ষেত্রের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে রেখেছে - শক্তি (বিশেষত পেট্রোলিয়াম এবং পেট্রোলিয়ামজাত পণ্যর উৎপাদন), পরিবহন যন্ত্রাংশ, ধাতু শিল্প এবং প্রতিরক্ষা সামগ্রী। এক কথায় রাষ্ট্র এখনও অর্থনীতির প্রধান নিয়ন্ত্রক। চীনের ব্যাংকিং’এর প্রায় ৮৫ শতাংশই নিয়ন্ত্রণ করে ৪টি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক। চীনের বড় শিল্প বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান বলতে এখনও রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলিই। এখনও ব্যাংক ঋণ এবং অন্যান্য সম্পদ সংগ্রহের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার এবং বিশেষ সুবিধা পায় রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলো। সবচেয়ে বড় কথা চীনের সমস্ত জমির মালিক রাষ্ট্র। জমি খোলা বাজারে বিক্রি হয় না, কে জমি ব্যবহার করবে তা ঠিক করে বিভিন্ন স্তরের সরকারি কর্তৃপক্ষ। কৃষিক্ষেত্রটিই চীনের বর্তমান অবস্থার সবচেয়ে বড় প্রতিফলন - যেখানে জমি রাষ্ট্রের কিন্তু ফসল যায় বাজারে।
বিতর্কটি এখানেই, চীনের সংস্কার কি সমাজতন্ত্র এবং পুঁজিবাদের মধ্যেকার লক্ষ্মণরেখাটিকে অতিক্রম করে গেছে? উৎপাদিকা শক্তির বিকাশ করতে গিয়ে চীন কি পেছনের দরজা দিয়ে পুঁজিবাদকে ডেকে এনেছে অথবা পুঁজিবাদে পর্যবসিত হবার ঢালু পিচ্ছিল পথে ঢুকে পড়েছে? এর উত্তর খুব সম্ভবত ইতিহাসই দেবে।
উৎপাদিকা শক্তির বিকাশ যথেষ্ট পরিমাণে না করতে পারলে সমাজতন্ত্র নির্মাণের কাজ অসম্পূর্ণ থাকে - এ বিষয়ে কোনো বিতর্ক অর্থহীন। কিন্তু উৎপাদিকা শক্তির বিকাশে এই মাপকাঠিটা কী? এটা আগের থেকে নির্দিষ্ট করা কোনো সীমারেখা না যে সেখানে পৌঁছলেই দৌড় শেষ হয়ে যাবে। প্রযুক্তির একটি নির্দিষ্ট পর্যায়ে উৎপাদিকা শক্তির বিকাশের সর্বোচ্চ মাত্রা আজকের পৃথিবীতে একটি উন্নত পুঁজিবাদী দেশ। এই মাপকাঠিটি সজীব এবং সামনের দিকে ধাবমান। এবং এটির ওপর সমাজতান্ত্রিক দেশের তেমন কার্যকরী নিয়ন্ত্রণ নেই। পৃথিবীর ইতিহাসে উৎপাদিকা শক্তির লড়াইয়ে উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলোকে টপকে যেতে পেরেছিল একমাত্র সোভিয়েত ইউনিয়ন। কিন্তু তারও শুরু পিছিয়ে থেকে, যার জন্য ’নেপ’, যার জন্য ১৯৩৮ পর্যন্ত ব্যক্তিমালিকানাকে মেনে নেওয়া। এই শুরুর পর্যায়টি গুরুত্বপূর্ণ, কারণ তাত্ত্বিকভাবে সমাজতন্ত্রের উন্নততর উৎপাদন সম্পর্ক এরপর উৎপাদিকা শক্তিকে ক্রমশ এগিয়ে দেবে পুঁজিবাদের থেকে। কিন্তু আমরাও অস্বীকার করতে পারি না উন্নত পুঁজিবাদের সাথে এই প্রতিযোগিতার প্রাথমিক স্তরে বিশ্ব পরিস্থিতি সোভিয়েত ইউনিয়নকে কিছুটা সুবিধাজনক জায়গায় পৌঁছে দিয়েছিল। ১৯১৮ থেকে ১৯৩২ - বিশ্বে পুঁজিবাদের পক্ষে অত্যন্ত প্রতিকূল একটি সময়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ধাক্কা সামলে ওঠা পুঁজিবাদ ১৯২৯’এ পড়েছিল তাদের ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ সংকটের মধ্যে। বিশ্ব পুঁজিবাদের উৎপাদন, উৎপাদন ক্ষমতার একটা বড় অংশ প্রায় ধ্বংস হয়ে যায় এই মহাসংকটে (Great Depression) । এটা সোভিয়েত ইউনিয়নকে কিছুটা বাড়তি সুবিধা করে দিয়েছিল নিজের অবস্থান দৃঢ় করে সবকটি বিপর্যস্ত পুঁজিবাদের উৎপাদন ক্ষমতাকে টপকে যেতে।
বিপ্লবের পর ১৯৪৯ সালে, এরকমই একটি সুবিধাজনক আন্তর্জাতিক অবস্থা চীন পেয়েছিল। তখনও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধাক্কা বিশ্ব পুঁজিবাদ কাটিয়ে উঠতে পারেনি, চীন বাড়তি পেয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের সাহায্য। কিন্তু আমরা জানি এ কাজটি করে ওঠা যায়নি; চীন দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ যখন শুরু করল ১৯৭৬ সালে, তখন আন্তর্জাতিক অবস্থা চীনের পক্ষে প্রতিকূল। বিশ্ব পুঁজিবাদ তিন দশকের লাগাতার অগ্রগতিতে সবচেয়ে বেশী বলীয়ান; পুঁজিবাদ আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর একটি দ্রুত বিকাশের স্তরে প্রবেশ করছে এবং তারপর থেকে মোটামুটিভাবে এই অবস্থা জারি আছে। উৎপাদিকা শক্তির বৃদ্ধিতে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবস্থাই এই যুগের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। এর সাথে যুক্ত বিশ্বায়নের অর্থনৈতিক বুলডোজার যা একচেটিয়া পুঁজিকে দিয়েছে গোটা পৃথিবীকে নিয়ন্ত্রণ করার জোর। এরকম একটি অবস্থায় পিছিয়ে পড়া একটি দেশের পক্ষে উৎপাদিকা শক্তির বিকাশে উন্নত পুঁজিবাদীদের পর্যায়ে উঠে যাওয়া একটি ভীষণ কঠিন এবং সময়সাধ্য কাজ। এই আলোতে আমাদের বিচার করতে হবে - সমাজতন্ত্রের প্রাথমিক স্তরের ধারণা যা জারি থাকতে পারে আগামী ১০০ বছর। কিছুদিন আগে চীন ঘোষণা করেছে ২০৫০ নাগাদ তারা মোটামুটিভাবে উন্নত একটি অর্থনীতির পর্যায়ে উন্নীত হবে। কথাগুলো বাস্তবতার বুকেই জন্ম নিয়েছে - এটা অস্বীকার করা যায় না। সি পি আই (এম) ২০০০ সালে তার কর্মসূচীকে সময়োপযোগী করতে গিয়ে জনগণতান্ত্রিক ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে নতুন কতগুলো ধারণাকে যুক্ত করে যা ১৯৬৪ সালের গৃহীত কমূসূচীতে ছিল না।
যেমন, ধারা - ৬.৫ - অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্তর এবং বিভিন্ন সামাজিক ও অর্থনৈতিক ধাঁচের সমন্বয়ে ভারত একটি বিশাল দেশ। তাই, অর্থনৈতিক বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় উৎপাদিকা শক্তির দ্রুত বৃদ্ধি এবং জনগণের জীবনমানের ধারাবাহিক উন্নতির জন্য দরকার সরকারি মালিকানাধীন অর্থনৈতিক মূল ক্ষেত্রগুলির মাধ্যমে জনগণতান্ত্রিক সরকারের নির্ধারক ভূমিকা এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণকারী ও নির্দেশাত্মক ভূমিকা। জনগণতান্ত্রিক অর্থনীতি হবে বহু কাঠামো সম্পন্ন যেখানে মালিকানার বিভিন্ন রূপ থাকবে এবং রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্র থাকবে আধিপত্যকারী অবস্থায়। বিশ্ব অর্থনীতিতে বিরাট পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে জোরদার করার চেষ্টা চালাবে ও সেই সঙ্গে বিদেশ থেকে আনা অগ্রসর প্রযুক্তিকে ব্যবহার করবে।
ধারা ৬.৬ ’এর (ì ì ì)-এ বলা হচ্ছে
- উন্নত প্রযুক্তি সংগ্রহ ও উৎপাদন ক্ষমতার উন্নয়নের স্বার্থে নির্বাচিত ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের অনুমতি দেওয়া হবে।
সি পি আই (এম) জনগণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা না করেই যে প্রয়োজন অনুভব করে এই পরিবর্তন ঘটিয়েছে, যারা হাতে-কলমে রাষ্ট্র পরিচালনা করেন সেই চীনের কমিউনিস্ট পার্টি, তারা আরো বেশী করে করবে, এটাই স্বাভাবিক। চীনে ঠিক এটাই হচ্ছে।
প্রশ্ন হচ্ছে কতটা মাত্রা পর্যন্ত পুঁজিবাদের সাথে সহাবস্থান চলতে পারে? ১৯৯২ সালে দেঙ জিয়াওপিঙ-এর দক্ষিণ চীনের সফর চীনের পরবর্তী সংস্কারের দিক নির্দেশ করেছিল। তাঁর এই সফরের বক্তৃতার গাইডলাইন নিয়েই চীনের পরবর্তী স্তরের সংস্কার পরিচালিত হয়। এখানে দেঙ জিয়াওপিঙ একটি বিষয়ের উপস্থাপনা করেন - বিষয়টি হল পুঁজিবাদী উপকরণ (Capitalist tool) । তাঁর কথায় পুঁজিবাদ কতগুলি উপকরণকে ব্যবহার করে। যেগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে সমাজতন্ত্রও ব্যবহার করতে পারে - বাজার বা শেয়ার মার্কেট এরকম উপকরণ, কিন্তু এগুলো মানেই পুঁজিবাদ নয়। তাঁর ভাষায় পরিকল্পনা মানেই সমাজতন্ত্র না, কারণ পুঁজিবাদেও পরিকল্পনা থাকে। আবার বাজার মানেই পুঁজিবাদ না, সমাজতন্ত্রেও বাজার থাকে। প্রশ্ন কে এবং কী উদ্দেশ্যে এগুলো ব্যবহার করছে।
বাজার সংক্রান্ত তাঁর ধারণাটি ঐতিহাসিকভাবেই সত্য। বাজার কোনো পুঁজিবাদী চক্রান্ত নয়। আদিম সাম্যবাদ-পরবর্তী সমাজ থেকেই বাজার তৈরি হয় সভ্যতার অগ্রগতির সাথে তাল রেখেই। যেখানেই একাধিক উৎপাদনকারী এবং একাধিক ক্রেতা সেখানেই বাজার সৃষ্টি হয়। একথা ঠিক বাজার তার বিকাশের সর্বোচ্চ পর্যায়ে ওঠে পুঁজিবাদের হাতে পড়েই। কিন্তু বাজার পুঁজিবাদের থেকে অনেক পুরনো।
বাজার কেবল পণ্যের আদানপ্রদান করে না, বাজার চাহিদা এবং জোগান সম্পর্কে তথ্যেরও আদানপ্রদান করে। উৎপাদানকারী বাজার থেকেই জানতে পারে পরবর্তী পর্যায়ের উৎপাদনের চাহিদা কতটা হতে পারে। সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক মডেলে এই কাজটাই কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা দপ্তর করত। বাজার প্রতিযোগিতার কারণে জিনিসের দাম কমায়, উৎপাদককে বাধ্য করে উৎপাদনের ব্যয়কে নিম্নতর পর্যায়ে নিয়ে আসতে, বাধ্য করে অপ্রয়োজনীয় ব্যয় বর্জন করতে। বাজার পণ্যের গুণগত মান বাড়ায়। এবং অল্প পয়সায় উন্নততর মান উৎপাদন করতে, উন্নততর প্রযুক্তি ব্যবহার করতে উদ্বুদ্ধ করে - সে প্রশ্নে বাজার উৎপাদিকা শক্তির বিকাশে সাহায্য করে। বাজারের হাজারটা খারাপ দিকও আছে। বাজার নৈর্ব্যক্তিক, সে দুর্বলকে রক্ষা করে না। বাজার ধনীকে ধনী করে, গরিবকে গরিব, বাজার সম্পদের অসম বণ্টনকে বাড়ায়। বাজার একচেটিয়ার জন্ম দেয়। ধ্বংস করে দুর্বল উৎপাদনকারীকে এবং সবচেয়ে বড় কথা বাজার পুঁজি তৈরি করে দেয় উৎপাদনকারীর যা শোষণকে আরো স্থায়িত্ব দেয়।
প্রশ্ন, বাজারের ভালো দিকগুলোকে অক্ষুণ্ন রেখে খারাপ দিকগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা। চীন এই চেষ্টা করছে। চীনের গোটা সংস্কার কর্মসূচির বৈশিষ্ট্য হল, কোনো কিছুই তারা একবারে তাড়াহুড়া করে চেষ্টা করেনি, সব কিছুই তারা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ধাপে ধাপে এগিয়েছে। ’জল মেপে মেপে পা ফেলে নদী পার হতে হয়’-এই পুরনো চীনা প্রবচনটিকে তারা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলেছে। আর তাদের সামনে স্লোগান ছিল মাও জেদঙ’ এর ’বাস্তব থেকে শিক্ষা নাও’। প্রতিটি ক্ষেত্রেই পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং ধাপে ধাপে এগোনো। ’বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল’ প্রথম চারটি শহরে - এখন বাড়তে বাড়তে ইয়াংসি এবং পার্ল নদীর গোটা বদ্বীপ অঞ্চল, দক্ষিণ চীনের আরো অঞ্চলে বিস্তৃত হচ্ছে। এখন তারা সিদ্ধান্ত নিচ্ছে চীনের মধ্য ও পশ্চিমাঞ্চলেও এই ’বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল’ গড়ে তোলা হবে। ব্যক্তি মালিকানা অল্প অল্প করে ১৯৬৮-র সংস্কারের পর থেকে। ১৯৮২ সালে এসে এই বিষয়টিকে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রীয় মালিকানার পরিপূরক (Supplimentary) বলে বর্ণনা করা হয়। ১৯৯৭ সালে এসে একে বলা হয় অর্থনীতির ’গুরুত্বপূর্ণ অংশ’ (Important Component)। আর ব্যক্তি মালিকানাকে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়া হল ২০০৪ সালে। ঘাপটি মেরে বসে থাকা পুঁজিবাদী চক্রান্তকারীরা কি এত ধৈর্য দেখায়, এত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে?
একটা সময়ে আমাদের একটি অতি সরলীকৃত ধারণা ছিল সমাজতন্ত্র হল একটি সংকটমুক্ত সমাজ। কিন্তু সংকটকে সযত্নে লুকিয়ে রাখা সোভিয়েত ইউনিয়ন যখন ভেঙে পড়ল তখনই আমাদের টনক নড়েছিল। চীন নিজেকে পৃথিবীর সামনে খুলে দিয়েছে। ফলত সাফল্যের পাশাপাশি চীনের সমস্যা এবং সংকটের কথাগুলো সকলের জানা। এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই সংকটগুলো গোটা সংস্কারের সময়টা জুড়েই রয়ে গেছে। নতুন নতুন সংকটের জন্ম দিচ্ছে। এই সমস্যা এবং সংকটের একটা উৎস সমাজতন্ত্র নির্মাণের একটি অপ্রচলিত পথ। আর একটি উৎস বিশ্ব অর্থনীতির অবিচ্ছদ্য অংশ হিসাবে বিশ্বায়নের প্রভাব সংক্রান্ত। সমাজতন্ত্র নির্মাণের এই চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা চীন করতে পারবে কি না তা নির্ভর করছে এই সংকটগুলোর সমাধান চীন কীভাবে করবে তার ওপর।
সংকটের প্রধান উৎস মতাদর্শ এবং রাজনীতি। দেঙ জিয়াওপিঙ তাঁর দক্ষিণ চীনের সফরের বক্তৃতায় যা বলেছিলেন চীনের পার্টির অবস্থান তাই। চীন বাম এবং ডান উভয় বিচ্যুতির বিপদকেই চিহ্নিত করছে। কিন্তু তাদের কথায় বাম বিচ্যুতির বিপদটিই প্রাথমিক। ডান বিচ্যুতি বা বুর্জোয়া উদারনীতিবাদ চীনের ক্ষেত্রে উপেক্ষণীয় বিপদ নয়। গত ২০ বছরে এই অভিযোগে দুজন পার্টির সাধারণ সম্পাদককে সরিয়ে দিতে হয়েছে। দুজনেই ছিলেন দেঙ জিয়াওপিঙ’এর ঘনিষ্ঠ। ১৯৮৭ সালে সরিয়ে দিতে হয় তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক হু ইয়োবাঙকে। তিনি দ্বাদশ কেন্দ্রীয় কমিটির ষষ্ঠ প্লেনামে অর্থনীতির ক্ষেত্রে চারটি প্রধান নীতিকেই ((Four Cardinal Principle) চ্যালেঞ্জ করেন এবং গণতন্ত্রীকরণের মাধ্যমে পার্টির নেতৃত্বকারী ভূমিকাকে হ্রাস করার কথা বলেন। তিয়েন আন মেন স্কোয়ারের ঘটনা ছিল চীনের সমাজতন্ত্রকে ধ্বংস করার সবচেয়ে বড় চক্রান্ত। পূর্ব ইউরোপের ঘটনায় উৎসাহিত সাম্রাজ্যবাদীরা মরিয়া চেষ্টা চালিয়েছিল চীনে তাদের পরিকল্পনা সফল করতে। সংস্কার পর্যায়ে দেঙ জিয়াওপিঙ’এর পরেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নেতা ঝাও জিয়াংকে পার্টি সম্পাদকের পদ থেকে সরে যেতে হয় - এই ’আন্দোলন’ সম্পর্কে দুর্বলতা দেখানোর কারণে।
কাজেই লড়াই জারি আছে চীনে। কিন্তু একটি বিষয় খেয়াল রাখা দরকার বিপ্লবের নেতারা আর কেউ চীনে নেই। বর্তমান পার্টি সম্পাদক ও রাষ্ট্রপতি হু জিনতাও সে সূত্রে চীনের চতুর্থ প্রজন্মের নেতা। গোটা পার্টিতেই বর্তমানে নেতৃত্বে এই প্রজন্মের নেতারা, যারা হয়ত শিক্ষাগত এবং পেশাগত প্রশ্নে অনেক দক্ষ কিন্তু বিপ্লব বা বিপ্লব পরবর্তী কঠিন লড়াইয়ের অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ নন। এটাই দেখার - এঁরা কীভাবে এই রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করবেন। বাস্তবের মাটিতে চীনের সমস্যা এখন বহুমুখী। সবচেয়ে বড় সমস্যা হল ক্রমবর্ধমান বৈষম্য। এই বৈষম্য বহুমাত্রিক। এক, গরিব এবং বড়লোকের মধ্যে বৈষম্য বাড়ছে, দুই, উন্নয়নের প্রশ্নে অঞ্চলগুলোর মধ্যে বৈষম্য বাড়ছে। তিন, বৈষম্য বাড়ছে শহর এবং গ্রামের মধ্যে। দ্বিতীয় সমস্যা হল ক্রমবর্ধমান বেকারি। এর সাথে কাজ হারানো রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত সংস্থার ব্যাপক সংখ্যক শ্রমিক-কর্মচারী। Under employmen বা প্রচ্ছন্ন বেকারিও কম নয়।
সমস্যা ব্যাপক দুর্নীতি; সমস্যা উন্নয়নের কারণে পরিবেশের ভারসাম্যহীনতা। এইসব কিছুর জন্য বাড়ছে জনবিক্ষোভ। এই সমস্যাগুলোর যে কোনো একটিই ব্যাপক সামাজিক অস্থিরতার জন্ম দিতে পারে। একথা ঠিক, দারিদ্র্য নিরসনে চীনের কৃতিত্ব তুলনাহীন। কিন্তু বিশ্ব অর্থনীতির অংশ চীনে বড়লোক এবং গরিবের মধ্যে ফারাকও বাড়ছে। একথা সত্য, এ ফারাক ভারতবর্ষের থেকে আজ চীনে বেশী। বিলিওনিয়রের সংখ্যা ভারতবর্ষ থেকে চীনে বেশী। আয়ের বৈষম্যের পরিমাপ Human Development Report -এ করা হয় গিনি সূচক দিয়ে। যেখানে সবচেয়ে বেশী ফারাক সেটি ১০০ এবং যেখানে ফারাক নেই সেটা ০- এভাবে সূচকটি মাপা হয়। চীনের গিনিসূচক ভারতের থেকে বেশী কেবল নয়, পৃথিবীর অধিকাংশ দেশের থেকে বেশী। ১৯৯০ সালে চীনের গিনি সূচক ছিল ২৮ বর্তমানে তা ৪৪.৭। যেখানে ভারতবর্ষের গিনি সূচক ৩২.৫। বৈষম্য সবচেয়ে কম ডেনমার্কে - ২৪.৭। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৪০.৮ এবং রাশিয়ায় ৩১। যদিও ২০০২ সালের হিসাবে চীনে দারিদ্রসীমার নিচে আছে মাত্র ৪.৬ শতাংশ মানুষ, ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে তা ২৮.৬। কিন্তু আয়ের ফারাকটা যথেষ্ট বেশী।
সম্পদের মালিক (%)
|
সবচেয়ে গরিব |
সবচেয়ে গরিব |
সবচেয়ে বড়োলোক |
সবচেয়ে বড়োলোক |
|
১০% |
২০% |
২০% |
১০% |
চীন |
১.৮ |
৪.৭ |
৫০.০ |
৩৩.১ |
ভারত |
৩.৯ |
৮.৯ |
৪৩.৩ |
২৮.৫ |
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র |
১.৯ |
৫.৪ |
৪৫.৮ |
২৯.৯ |
রাশিয়া |
৩.৩ |
৮.২ |
৩৯.৩ |
২৩.৮ |
সূত্র: Human Developement Report, 2005
ঐতিহাসিকভাবেই চীনের উপকূলবর্তী পূর্বাঞ্চল হল সবচেয়ে সমৃদ্ধ-এই শতাব্দীর গোড়া থেকেই। কিন্তু মুক্তির ৫৮ বছর পরও এই ফারাক আরো বাড়ছে। বিনিয়োগ সমৃদ্ধিত একটি মাত্রা। বিনিয়োগের পরিমাণে এই ফারাক কতটা তা বোঝা যায়:
|
মোট বিনিয়োগের কত অংশ (%) |
মোট আয়ের কত অংশ (%) |
পূব |
৭২.৫ |
৭৮.০ |
মধ্য |
১৫.৫ |
১৩.৩ |
পশ্চিম |
১১.৯ |
৮.৭ |
চীনের উপকূলবর্তী পাঁচটি প্রদেশ গুয়াংডঙ, শানডঙ, সাংহাই, জিয়াংসু এবং ঝেজিয়াঙ। গোটা চীনের ব্যক্তিগত আয়ের ৬০.৭% এবং মোট বেসরকারি বিনিয়োগের ৪৭% আছে এই পাঁচটি প্রদেশে।
চীনের সবচেয়ে সমৃদ্ধ অঞ্চল বেজিঙ-তিয়ানজিন করিডর, ইয়াংসি নদী-পার্ল নদীর ব-দ্বীপের গড় আয় চীনের গড় আয়ের প্রায় দু’গুণ। বৈষম্যের আর একটি দিক হল গ্রাম এবং শহরের মধ্যেকার ফারাক। সাংহাইয়ের গড় আয় ২০০৩ সালে ছিল প্রায় ৫৫০০ ডলার বছরে, সেখানে সবচেয়ে গরিব এবং গ্রামীণ প্রদেশ গুইসৌ প্রদেশের গড় আয় মাত্র ৪০০ ডলার। আয়ের ফারাক চৌদ্দগুণ। এর একটি ফল হল গ্রামাঞ্চল এবং তুলনায় পিছিয়ে পড়া অঞ্চল থেকে ব্যাপক পরিমাণে মানুষ চলে আসছে উপকূলবর্তী শহরগুলোতে। এমনিতে চীনে চাইলেই নূতন কোনো অঞ্চলে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস করা যায় না। ফলত, বেআইনিভাবেও শহরাঞ্চলে অনুপ্রবেশ ঘটছে। প্রয়োজনীয় নাগরিক পরিষেবা থেকে এরা বঞ্চিত। সামাজিক উত্তেজনার এটি একটি উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতি বছরে প্রায় ১ কোটি মানুষ এভাবে অভিবাসী হয়ে চীনের শহরাঞ্চলে ঢুকছে। বিনিয়োগের বিপুল বিস্তারের কারণেই অবশ্য চীনে নগরায়ণের গতি পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বেশী। গড়ে প্রতি বছরে চীনের শহরাঞ্চলে জনসংখ্যা বাড়ছে ৫% করে, চীনের মোট জনসংখ্যার ৩৯% এখন থাকে শহরাঞ্চলে। এটা একদিক থেকে ভালো, যে চীনের একটি বড় অংশের মানুষ এখন শহরাঞ্চলে থাকেন, যেখানে মাথাপিছু গড় আয় অনেক বেশী। কিন্তু আয়ের প্রশ্নে স্থায়ী এবং অভিবাসী (Migrant) জনসংখ্যার মধ্যেও ফারাক আছে। ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের একটি তথ্য অনুযায়ী দেখা যাচ্ছে ১৯৮১ সালে চীনের মাথাপিছু গড় আয় ছিল ২৭২.২৪ ইউয়ান, তখন শহরাঞ্চলের গড় আয় ছিল ৪৮৬.২৮ ইউয়ান এবং গ্রামীণ গড় আয় ছিল ২১৮.১৯ ইউয়ান। মাথাপিছু জাতীয় গড় আয়ের থেকে গ্রামীণ গড় আয়ের খুব একটা ফারাক ছিল না। কিন্তু ২০০১ সালে জাতীয় গড় আয় যেখানে ৯৯৩.০৩ ইউয়ান, সেখানে মাথাপিছু গ্রামীণ গড় আয় ৬৪২.৫৭ ইউয়ান। জাতীয় গড় আয়ের দুই-তৃতীয়াংশেরও কম, সেখানে শহরে গড় আয় হয়েছে ১৫৬৫.২ ইউয়ান। এই ফারাক বাড়ছে। ১৯৮৩ সালে শহরের গড় মাথাপিছু আয় ছিল গ্রামের ১.৮৪ গুণ, ১৯৯০-এ তা বেড়ে দাঁড়াল ২.০৮ গুণ আর ২০০১ সালে তা দাঁড়াল ২.৪৪ গুণ।
চীনের ঐতিহাসিক সাফল্য হল ২৫ বছরে ৪০ কোটি মানুষকে দারিদ্র্যসীমার ওপরে নিয়ে আসা - এই সাফল্যের পাশাপাশি সমস্যা হল আয়ের ফারাক বা বৈষম্যও ক্রমাগত বাড়ছে।
এ বছরের গোড়ায় চীনে ৫৪,০০০ গ্রামীণ এবং শহরের পরিবারের মধ্যে সমীক্ষার একটি ফল প্রকাশ করেছে চায়না ডেইলি। এতে দেখা যাচ্ছে চীনে সবচেয়ে বড়লোক ১০% পরিবারের আয় সবচেয়ে গরিব ১০% পরিবারের চেয়ে ১১.৮ গুণ বেশী ছিল। আগের বছরে এটা ছিল ১০.৯ গুণ। এই সমীক্ষা আরও জানাচ্ছে বড়লোক ১০% পরিবারের আয় বেড়েছে এক বছরে ১৫.৭%; সবচেয়ে গরিব ১০% পরিবারের আয়ও বেড়েছে, কিন্তু বেড়েচে ৭.৬% হারে।
এই বৈষম্য বাড়ার একটি কারণ বেকারি। এশিয়ান ডেভেলপমেণ্ট ব্যাংক চীনের সরকারি তথ্য উদ্ধৃত করে তাদের ২০০৪-এর রিপোর্টে জানাচ্ছে চীনে বর্তমান বেকারের সংখ্যা প্রায় ৮৮ লক্ষ, অর্থাৎ বেকারির পরিমাণ ৪.৩%। অবশ্য সর্বশেষ ২০০৫-এর রিপোর্টে তারা বেকারের পরিমাণ কমেছে বলে দাবি করেছে। বেকারের সংখ্যা কমে হয়েছে ৮৩ লক্ষা এবং বেকারির হার ৪.২%। গত এক দশকে এই প্রথম বেকারের সংখ্যা কমেছে।
১৯৮৫ সালে বেকারের সংখ্যা ছিল ২৩.৯ লক্ষ এবং বেকারির হার ছিল ১.৮%। ধারাবাহিকভাবে এই দুটি পরিমাণই বাড়ছে। যদিও ১৯৯৫ সালের পর থেকে চীনে কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা বেড়েছে গড়ে মাত্র ১% করে। বিশেষজ্ঞরা এই জায়গায় একটি প্রশ্ন তুলেছেন। এটা কী করে হয় - জাতীয় আয় বাড়ছে গড়ে ৯% এরও বেশী। কাজের খাতায় নাম লেখানো মানুষের সংখ্যা বাড়ছে গড়ে ১% করে অথচ বেকারি বাড়ছে কী করে? বরং তাদের অভিমত চীনের আসল বেকারির সংখ্যা আরও অনেক বেশী। বিশিষ্ট আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক পরামর্শদাতা সংস্থা র্যাণ্ড (Rean)-এর মতে - চীনে প্রচ্ছন্ন বেকারি ধরলে আসলে বেকারির পরিমাণ ২৩%।
জাতীয় আয় বৃদ্ধির সাথে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি তাল রাখতে পারছে না, এটা অনস্বীকার্য। এর একটা কারণ চীনের সাফল্যের অন্যতম প্রধান ভিত্তি উৎপাদনশীলতা। যে গতিতে জাতীয় আয় বাড়ছে প্রায় সমান তালে চীনে কর্মে নিযুক্ত মানুষের উৎপাদনশীলতাও বাড়ছে। আজকে গোটা পৃথিবীর বড় বড় কোম্পানিগুলো চীনে গিয়ে বিনিয়োগে করছে তার অন্যতম কারণ এই উৎপাদনশীলতা ১৯৯৮ সালে চীনে গড়ে প্রতি শ্রমিক উৎপাদন করত বছরে ১১,১০০ ইউয়ান, ২০০২’এ এই পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৪,৩৮০ ইউয়ান। অর্থাৎ শ্রমিকদের উৎপাদনশীলতা এই চার বছরে গড়ে বেড়েছে ৬.৭%। অর্থাৎ একজনও যদি নতুন কেউ কাজে যুক্ত না হত (শুধু অবসরপ্রাপ্তদের জায়গায় নতুন লোক আসত) তাহলেই চীনের জাতীয় আয় বাড়ত ৬.৭%। এ একটি উন্নয়নশীল দেশের স্বাভাবিক সমস্যা। কর্মসংস্থান বাড়াতে প্রয়োজন বিনিয়োগ, বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে দরকার উৎপাদনশীলতা এবং উৎপাদনশীলতা বাড়লে কর্মসংস্থানের গতি হ্রাস পায়।
নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার - চীন এক্ষেত্রে পৃথিবীর সামনে উদাহরণ। ঝৌ এনলাই বেঁচে থাকতে যে চার আধুনিকীকরণের (ঋসৎড় গসনপড়ষমঢ়থয়মসষ) স্লোগান দিয়েছিলেন, সাংস্কৃতিক বিপ্লবের ধ্বংস স্তূপের মধ্যে থেকে দেঙ জিয়াওপিঙ সেই স্লোগানটি তুলে আনেন। প্রকৃতপক্ষে গত ২৮ বছরে চীনের সংস্কারের এটাই প্রধান স্লোগান। একে আরও জোরদার করেছে পঞ্চদশ পার্টি কংগ্রেসের তিন প্রতিনিধিত্বের তত্ত্ব (Four Modernisation) । চীনের পার্টি প্রতিনিধিত্ব করে (১) চীনের উন্নয়নমুখী উৎপাদনশীলতার, (২) চীনের সভ্যতার অগ্রগতি, (৩) চীনের বৃহত্তম জনগণের মৌলিক স্বার্থের। যে সমস্ত মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানি এই আশা নিয়ে চীনের বাজারে ঢুকেছিল, যেমন ইনটেল বা মোটোরোলা, যে চীন হবে নিম্ন প্রযুক্তির পণ্যের পৃথিবীর সর্বাধিক বাজার, তারা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে তারা কত বড় ভুল ধারণা নিয়ে ছিল। গোটা পৃথিবীর কোম্পানিগুলো এখন তাদের উচ্চ প্রযুক্তির বাজার হিসাবে দেখে চীনকে। প্রযুক্তি আত্মীকরণের (Three Representaion) বিষয়ে চীন পৃথিবীর প্রথম সারিতে - এটা তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর সাথে চীনের গুরুত্বপূর্ণ ফারাক। কিন্তু এটাও কর্মসংস্থান সৃষ্টির গতিকে কিছুটা হ্রাস করে।
চীনের সামনে আর একটি আর্থ-সামাকিজ ক্রমবর্ধমান সমস্যা হল দুর্নীতি। একটি হিসাবে চীনের দুর্নীতির আর্থিক পরিমাণ মোট জাতীয় আয়ের ১৫%। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল পৃথিবীর ১৬২টি দেশের মধ্যে দুর্নীতির প্রশ্নে চীনকে রেখেছে ৭৭ নম্বর স্থানে - এটা হিংসা করার মতো অবস্থান না।
দুর্নীতি পুঁজিবাদের নিত্যসঙ্গী এবং বিশ্বায়ন এই সঙ্গীর হাতকে শক্তিশালী করেছে। চীন এই প্রভাবের বাইরে থাকবে না এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু চীনের সমস্যা একটু পৃথক। পুঁজিবাদ দুর্নীতির জন্ম দেয়, আবার পুঁজিবাদী আইন ব্যবস্থায় এই দুর্নীতির বিরুদ্ধেও লড়াইয়ের কিছু উপাদান থাকে। চীনে আজ বিশ্বায়িত অর্থনীতির প্রবেশ অনেকটাই অবাধ, কিন্তু চীনে আইন ব্যবস্থা পুঁজিবাদী আইন ব্যবস্থা নয়। চীনের নেতাদের ভাষায় যদি পুঁজিবাদী উপকরণও ব্যবহার করা হয় - তবে তার সাথে সাথে এর সহযোগী দুর্নীতির মোকাবিলা করারও কিছু প্রয়োজনীয় আইন কাঠামোরও সংস্কার করা দরকার। পশ্চিমী সমালোচকদের অভিযোগ চীনের আইন ব্যবস্থা পার্টি এবং প্রশাসনের প্রভাবমুক্ত নয় - এক্ষেত্রে মৌলিক সংস্থার হওয়া উচিত। চীনের নেতৃবৃন্দ অবশ্য তাদের আইন ব্যবস্থা সংস্কারের কাজে হাত দিয়েছেন।
কিন্তু দুর্নীতি চীনে একটি সমস্যা হিসাবে থেকেই গেছে। এই দুর্নীতির সাথে যুক্ত অনেক সরকারি কর্তারাও। চীনের ন্যাশনাল অডিট অফিস ২০০২ সালে চীনের সংস্থাগুলোতে ৭.৭ বিলিয়ন ডলারের অনিয়ম খুঁজে পেয়েছে। ২০০৩’এ অন্তত ১২ জন প্রাদেশিক মন্ত্রীর দুর্নীতির জন্য চাকরি গেছে। ১৯৯৬ থেকে দুর্নীতির দায়ে শাস্তি পেয়েছে ১৯,৩৭৪ জন সরকারি অফিসার। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ কয়েকদিন আগে সাংহাই-এর পার্টি সম্পাদক যিনি, আবার পলিটব্যুরোরও সদস্য, বহিষকৃত হলেন দুর্নীতির অভিযোগে। চীনা কমিউনিস্ট পার্টির দেওয়া এক বিবৃতিতে দেখা যাচ্ছে আগস্ট ২০০৫ থেকে সেপ্টেম্বর ২০০৫’এর মধ্যে ধরা পড়েছে ১০,৯৯২টি ঘুষ নেওয়ার ঘটনা। যেখানে ৪১২ মিলিয়ন ডলার ঘুষ দেওয়া হয়েছে। ক্রমবর্ধমান বেকারি, আয়ের বৈষম্য, উন্নয়নের বৈষম্য এবং দুর্নীতি চীনের মানুষকে খুশি করছে না এটা স্বাভাবিক। দুর্নীতির বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ এখন প্রকাশ্যেই।
এই সামাজিক, অর্থনৈতিক সমস্যাগুলোর সমাধান চীনের কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্ব করতে পারবে কিনা তার ওপরেই নির্ভর করছে চীনের সমাজতন্ত্রের ভবিষ্যৎ। আজ আমরা বুঝেছি সমস্যা-সংকটহীন সমাজ গড়া অসম্ভব - এবং এটি সমাজতন্ত্রের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। কোনো সমস্যা সমাধানের প্রথম চিহ্ন হল সমস্যাকে সমস্যা হিসাবে গ্রহণ করা এবং তার পরিমাপ করা। এরপর আসে সমাধানের উত্তর। মিখাইল গোরবাচভ আসার আগে সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্ব প্রকাশ্যে এ কাজটি করেছেন বলে জানা নেই। যদিও শুরুর সমাজতন্ত্র নির্মাণের কঠিন দিনগুলোতে এই কাজটি সোভিয়েত নেতৃবৃন্দ করতেন। আশার কথা হল - চীন, ভিয়েতনাম বা কিউবার পার্টির নেতৃত্ব আজ এই কাজটি করছেন।
দেঙ জিয়াওপিঙ যখন বললেন - প্রথমে কিছু লোক বড়লোক হবে, তারপর প্রাচুর্য ছড়িয়ে পড়বে বাকিদের মধ্যে। কথাটিকে যথেষ্ট আপত্তিকর এবং সমাজতন্ত্র নির্মাণের প্রশ্নে একটি বড়সড়ো আপস বলেই মনে হয়েছিল। কিন্তু গত কুড়িটা বছরে আমরা দেখেছি এটি ঘোষিত নীতি নয় বরং বিপদ সম্পর্কে আগাম অনুমান। চীনে আয়ের বৈষম্য বাড়ছে, বাড়ছে অঞ্চলগুলোর মধ্যে উন্নয়নের প্রশ্নে বৈষম্য। চীনের পার্টি সমস্যাটি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল এবং তাদের মতো করে এটার মোকাবিলা করার চেষ্টা করছে। ১৯৯২ সালে দেঙ জিয়াঙপিঙ-এর ঐতিহাসিক দক্ষিণ চীন সফরের বক্তৃতাগুলোতেও অঞ্চলগুলোতে উন্নয়নের ফারাকের আশঙ্কা বারংবার এসেছে। চীনের সর্বশেষ পার্টি কংগ্রেসে তদানীন্তন সাধারণ সম্পাদক জিয়াঙ জেমিনের বক্তব্যের শুরুতেই দুই কংগ্রেসের মধ্যেকার কাজের রিপোর্ট করতে গিয়ে তিনি বলেছেন, চীনের পশ্চিম অঞ্চলে এই সময়ে উন্নয়নের বড়সড়ো কাজ আমরা করতে পেরেছি। এই অংশে জেমিনের বক্তৃতা থেকে একটি উদ্ধৃতি আমরা দিচ্ছি - “আমাদের পরিষকারভাবে বুঝতে হবে যে, বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে আমাদের সমস্যা ও সংকট আছে। কৃষক এবং শহরের কিছু মানুষের আয় বাড়ছে, কিন্তু খুব ধীরে। বেকারের সংখ্যা বেড়ে গেছে, কিছু অংশের মানুষের আয় খুব কম। আয়ের বণ্টনের মধ্যে সামঞ্জস্য আনতে হবে, বাজারী অর্থনীতির ফলগুলোকে সংশোধন করতে হবে, নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। আনুষ্ঠানিকতা, আমলাতান্ত্রিক পদ্ধতিতে কাজ করা, মিথ্যাচার, অনর্থক জাঁক দেখানো এবং অপচয় এখনও কিছু নেতৃস্থানীয় কমরেডদের মধ্যে থেকে গেছে এবং বেশ কিছু জায়গায় দুর্নীতি বেড়ে গেছে। পার্টির পক্ষ থেকে নেতৃত্ব দেওয়া এবং প্রশাসন চালানোর কাজে আজকের পরিস্থিতি এবং আজকের মানুষের যে চাহিদা, তাকে পুরোটা মেটাতে পারছি না। বেশ কিছু জায়গায় পার্টির সংগঠন দুর্বল এবং অগোছালো। আমাদের এই সমস্যাগুলোর জায়গায় গভীরভাবে মনোনিবেশ করতে হবে এবং সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য উপযুক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে।”
এর থেকে খোলাখুলি সমস্যার স্বীকৃতি আর কী হতে পারে এবং সেটিও পার্টির সাধারণ সম্পাদক লিখছেন পার্টি কংগ্রেসের মূল রিপোর্টের একদম গোড়াতেই। সমস্যার এই স্বীকৃতি দিয়ে জেমিনের দ্বিতীয় অংশ শুরু হচ্ছে আগামী দিনের কাজ নির্দিষ্ট করতে। এই অংশের শিরোনাম “লক্ষ্য সবদিক থেকে সমৃদ্ধ একটি সমাজ গড়ে তোলবার।” শুরু করা হচ্ছে এই বলে - “অর্থনীতির এই মুহূর্তে অবস্থান যা তার ওপর দাঁড়িয়ে ২০০০ থেকে ২০২০-র মধ্যে মোট জাতীয় আয় ৪ গুণ করাই হবে আমাদের লক্ষ্য। এর ফলে আমাদের জাতীয় শক্তিও বাড়বে এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা করার শক্তিও বৃদ্ধি পাবে। আমাদের প্রধান লক্ষ্য হবে শিল্পায়ন এবং পরিপূর্ণ বাজার সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি কায়েম করা। কাঠামো হবে অনেক খোলামেলা এবং স্থায়ী। এই সময়ে শহরের জনসংখ্যা অনেকটা বাড়বে। কিন্তু আমরা শিল্প ও কৃষি, শহর এবং গ্রাম এবং বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে বৈষম্য ধাপে ধাপে কমিয়ে আনব। আমাদের একটি দৃঢ় সামাজিক সুরক্ষার ব্যবস্থা গোটা দেশজুড়ে কায়েম করতে হবে। কর্মসংস্থানের গতি বাড়ানো হবে, আমাদের নাগরিকদের পারিবারিক সম্পত্তি বাড়বে, আরও সমৃদ্ধ জীবনযাত্রা তারা ভোগ করতে পারবে।” আগামীদিনের অর্থনীতির কাজ সম্পর্কে জেমিন ৮ দফা কাজ প্রস্তাব করেছেন। এরমধ্যে গোটা ৩নং দফাটি হল, কী করে আঞ্চলিক বৈষম্য কমানো হবে তার বিস্তারিত প্রস্তাব এবং ৮নং দফাটি হল একান্তভাবে কর্মসংস্থান বাড়ানোর বিস্তারিত পরিকল্পনা।
গত বছর ষোড়শ কেন্দ্রীয় কমিটির তৃতীয় প্লেনাম অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই প্লেনামের বিস্তারিত রিপোর্ট এখনও ইংরাজি ভাষায় প্রকাশিত হয়নি। চীনা সংবাদ সংস্থা থেকে যেটুকু আভাস পাওয়া গেছে, তাতে দেখা যাচ্ছে এখানেও সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে ভারসাম্য যুক্ত উন্নয়নের। সদ্য শেষ হয়েছে চতুর্থ প্লেনাম (এর রিপোর্টও ইংরাজিতে পাওয়া যায়নি)। এখানে একাদশ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার রূপরেখা চুড়ান্ত করা হয়েছে যাতে নির্দিষ্টভাবে এই লক্ষ্যগুলো পরিপূর্ণ করা যাবে বলে আশা করেছে চীনের পার্টির নেতৃবৃন্দ।
চতুর্থ প্লেনামে তারা তাদের কর্মসূচীকে নির্ধারণ করেছে পাঁচ সমন্বয়ের স্লোগানে - এই স্লোগানেই সপষ্ট নির্দিষ্ট সমস্যাগুলির সমাধানে কী উদ্যোগ তারা নেবেন। পাঁচটি সমন্বয় হল -
১. অর্থনৈতিক এবং সামাজিক উন্নয়নের মধ্যে সমন্বয়।
২. শহর এবং গ্রামের মধ্যে সমন্বয়।
৩. চীনের বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে সমন্বয়।
৪. মানব সম্পদ উন্নয়ন, পরিবেশ এবং প্রাকৃতিক সম্পদের মধ্যে সমন্বয়।
৫. বর্হিবার্ণিজ্য ও বর্হিবিনিয়োগের উন্নয়ন এবং অভ্যন্তরীণ উন্নয়নের মধ্যে সমন্বয়।
সমালোচকরা বলতেই পারেন, এগুলোতো সবই বক্তৃতা। এগুলো যে হবে তার গ্যারান্টি কে দেবে? ঠিকই তো, বাইরে থেকে এ গ্যারান্টি কে দেবে? গত ২৭ বছরে চীনের পার্টির দলিলগুলোা থেকে পছন্দসই অংশগুলি তুলে দিয়ে আমরা দেখাতেই পারি, ঠিক কোন কোন জায়গায় সমাজতন্ত্রের ’মূলনীতি’ লঙ্ঘন করা হয়েছে এবং চীনের অর্থনৈতিক অবস্থার কিছু দিকের ইঙ্গিত করে আমরা দেখাতেই পারি বাস্তবে কী করে তা হচ্ছে। আর তাই যদি হয় তবে সমাজতন্ত্র রক্ষা করার প্রশ্নে দলিলের বক্তব্যগুলোর ওপর অনুরূপ আস্থা আমরা কেন দেখাতে পারি না? অনেকটাই আজ নির্ভর করছে কে, কীভাবে চীনকে দেখছেন তার ওপর। পশ্চিমী দক্ষিণপন্থীরা উল্লসিত, তাদের ধারণা চীনে পুঁজিবাদ কায়েম হয়ে গেছে। আর আমাদের অতি বামপন্থী সমালোচক বন্ধুদের সিদ্ধান্তও ঠিক তাই। সমাজতন্ত্রের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আশাবাদী হয়ে, চীনের মানুষের বিপ্লবী সত্তার প্রতি আস্থা রেখে এই একবিংশ শতাব্দীর মহাপরীক্ষার ফল সম্পর্কে আশাবাদী মানুষের সংখ্যাও কম নয়।
একটা শত্রুশাসিত দ্রুত ছুটে চলা পৃথিবীতে নিজেদের লক্ষ্যে অবিচল থাকতে গেলে পালটা কৌশলেও থাকতে হবে গতি এবং উদ্ভাবনের ক্ষমতা। চীন যদি ব্যর্থ হয়, অন্ধকার নামবে। ক্রেমলিনের চূড়া থেকে যেদিন লাল পতাকা নামল হয়তো নামবে সেদিনের থেকেও বেশী।
সূত্র:
১. Overview of the Chinese Economy. Joint Economic Committee, United state Congress July-2005.
২. Country Profile : China, February 2005, Library of US Congress Federal Research Division.
৩. Global Economic Paper No : 99, Goldman Sachs.
৪. সূত্র নং-১
৫. China Goes Global – Yongjin Zhan, Foreign Policy Centre, April 2005.
৬. ঐ
৭. সূত্র-২
৮. FDI Confidence Index, A T Kearney, October 2004.
৯. UNCTAD. Handbook of Statistics, 2004.
১০. UNCTAD, World Investment Report, 2005.
১১. Peoples Daily, 29th September, 2005.
১২. China Statistical Yearbook-1994.
১৩. The Economics and Politics of Transition to an Open Market Economy : China. Winng Ghye Woo. OECD Development Centre, Working Paper No. 163.
১৪. সূত্র-১২.
(প্রবন্ধটি মইনুল হাসান এবং মানব মুখার্জি কর্তৃক সম্পাদিত এবং ’পুনশ্চ’ প্রকাশন ৯ এ, নবীন কুণ্ডু লেন, কলকাতা ৭০০ ০০৯ কর্তৃক ২০০৭ সালে প্রকাশিত ’চিন: একটি অনতর্বর্তীকালীন প্রতিবেদন’ নামক প্রবন্ধ সংকলন গ্রন্থ থেকে সংকলিত। মুদ্রণের সময় এ বাংলায় সাধারণভাবে প্রচলিত বানান রীতি অনুযায়ী চিনের পরিবর্তে চীন করা হয়েছে। - বঙ্গরাষ্ট্র)
অনলাইন: ৮ মার্চ, ২০০৯