লিখেছেনঃ আলমগীর হুসেন, আপডেটঃ May 29, 2011, 11:57 AM, Hits: 31577
মুসলিম হিসেবে বেড়ে উঠা কালে আমি সদা পাশ্চাত্যকে ঘৃণা করেছি প্রধানত দু'টো কারণেঃ ১) পাশ্চাত্যের অতীত সাম্রাজ্যবাদ ও দাসত্বের চর্চা (যা মুসলিম বিশ্বকে সর্বাধিক আক্রান্ত করেছিল), ও ২) ফিলিস্তিনদের উপর ইসরাইলের চলতি নির্যাতনের প্রতি তাদের সমর্থন।
আমি সর্বদা মনে করেছি যে, ইতিহাসে ইসলাম কখনো এরূপ অপকর্মে লিপ্ত হয়নি; ইসলাম, খৃষ্টধর্মের বিপরীতে, সাম্রাজ্যবাদ ও দাসত্বের মতো জগণ্য অপকর্ম দ্বারা কলুষিত হয় নি। কিন্তু আমি যখন ইসলামের ধর্মতত্ব (কোরান, হাদিস, নবির জীবনী) এবং ইতিহাস পড়তে শুরু করি, আমি বিস্মিত হয়ে যাই এটা জানতে পেরে যে, ইসলাম কেবল সাম্রাজ্যবাদ ও দাসত্বে লিপ্তই হয়নি, এগুলো ইসলামে স্বর্গীয়ভাবে নির্দেশিত ব্যাবস্থাপনাও। তদুপরি, সাম্রাজ্যবাদ ও দাসত্বের চর্চায় খৃষ্টধর্মীয় পাশ্চাত্য ইসলামের তুলনায় ছিল একটা ছোট মাছ মাত্র।
Strange Love-এর মতো মুসলিমদের যুক্তি আল্লাহকে ঠিকই নির্বোধ প্রতিপন্ন করে। কিন্তু বিশ্বস্রষ্টা ও সর্বজ্ঞানী আল্লাহ এরূপ একজন নির্বোধ হতে পারেন না। বরং Strange Love-এর মতো ভ্রান্ত বান্দারা আল্লাহকে এরূপ বেকুব প্রতিপন্ন করে।
কোরানের মাধ্যমে আল্লাহ মুসলিমদেরকে বিশ্ব ধ্বংস হওয়া পর্যন্ত ক্রীতদাস মুক্ত করার পরামর্শ দিতে থাকবেন, কেননা আল্লাহ ক্রীতদাসত্বকে ইসলামে একটি "চিরন্তন ব্যাবস্থাপনা" হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। লেখক এম, এ, খান তার "ইসলামিক জিহাদ" গ্রন্থে ইসলামে ক্রীতদাসত্বের মৌলিক ভিত্তিটি খুব সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন ("ইসলামিক জিহাদ" গ্রন্থটি বাংলায় প্রকাশিত হয়েছে 'জিহাদঃ জবরদস্তিমূলক ধর্মান্তরকরণ, সাম্রাজ্যবাদ ও দাসত্বের উত্তরাধিকার'; ব-দ্বীপ প্রকাশন)। খানের বইটি থেকে সংশ্লিষ্ট অংশটুকুর উদ্ধৃতি দিচ্ছি এখানেঃ
--------------------------
দাসপ্রথাকে কোরানের অনুমোদন
দাসপ্রথাকে ইসলামে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছে নিম্নোক্ত কোরানের আয়াতটি, যার মাধ্যমে আল্লাহ ন্যায়বান ও সত্যপন্থী মুক্ত মানুষ বা প্রভুদেরকে বোবা, অকেজো ও বোঝাস্বরূপ ক্রীতদাসদের থেকে পৃথক করেছেন:
‘আল্লাহ দুই ব্যক্তির মাঝে আরেকটি কাহিনীর অবতারণা করেছেন: তাদের একজন ক্ষমতাহীন ও বোবা, যে তার প্রভুর উপর এক ক্লান্তিকর বোঝা; যেভাবেই তাকে চালনা করা হোক না কেনো, সে কোনোই কাজে আসে না: এরূপ মানুষ কি তার মতোই, যিনি ন্যায়বান ও সঠিক পথের অনুসারী?" (কোরান ১৬:৭৬)
আল্লাহ ক্রীতদাসদেরকে মর্যাদায় সমঅংশীদার ও তাদের সম্পদের ভাগীদার করে নেওয়ার ক্ষেত্রে বিশ্বাসীদের সতর্ক করে দেন, পাছে অন্যদের মত ক্রীতদাসদেরকেও একইভাবে ভয় করতে হয়ঃ
"তোমরা কি তোমাদের দক্ষিণ হস্তের মালিকানাধীন লোকদেরকে (অর্থাৎ ক্রীতদাস বা বন্দি) আমাদের প্রদত্ত সম্পদের সমঅংশীদারী করবে? তোমরা কি তাদেরকেও সেরূপ ভয় করবে, যেমন ভয় করো পরস্পরকে?" (কোরান ৩০:২৮)
এ আয়াতটির ব্যাখ্যায় মওলানা আবুল আলা মওদুদি ক্রীতদাসদেরকে সম্মান ও ধনসম্পদে সমান গণ্য করাকে ইসলামে সবচেয়ে ঘৃণ্য শিরক বা অংশীদারিত্বের মতো কাজ বলে মনে করেন৷3. অন্যত্র আল্লাহ স্বয়ং তার স্বর্গীয় পরিকল্পনার অংশরূপেই কম আনুকূল্যপ্রাপ্ত ক্রীতদাসদের চেয়ে কিছু মানুষকে, অর্থাৎ প্রভু বা দাসমালিকদেরকে, বেশি আশীর্বাদপুষ্ট করেছেন বলে দাবি করেন। তিনি মুসলিমদেরকে সতর্ক করে দিয়েছেন যাতে তারা ক্রীতদাসদেরকে তাঁর দেওয়া উপহার বা প্রতিদানে সমান অংশীদার না করে৷ যারা ক্রীতদাসদেরকে নিজেদের সমান মর্যাদার ভাববে, আল্লাহ তদেরকে সাবধান করে দেন এটা বলে যে, সেরকম করলে আল্লাহকে অস্বীকার করা হবে:
"জীবনধারনের নিমিত্তে আল্লাহ তোমাদের কারো কারো উপর অন্যদের তুলনায় অধিক মুক্তহস্তে তাঁর উপহার বা প্রতিদান বর্ষন করেছেন। অধিক আনুকূল্য প্রাপ্তরা তাদেরকে দেওয়া সে উপহার তাদের দক্ষিণহস্তে ধারণকৃতদের (দাসদের) উপর বর্ষন করবে না, যাতে তারা এক্ষেত্রে সমপর্যায়ের হতে পারে। তারা কি আল্লাহর আনুকূল্য অস্বীকার করবে?" (কোরান ১৬:৭১)
আল্লাহ শুধু দাসপ্রথাকে অনুমোদনই দেন নি, তিনি নারী-দাস বা দাসীদেরকে যৌনসম্ভোগ হিসেবে ব্যবহারের জন্য দাস-মালিকদেরকে স্বর্গীয়ভাবে আশীর্বাদপুষ্টও করেছেন (মুসলিম পুরুষরাই কেবল দাসদাসীর মালিক হতে পারে):
"তারা তাদের গোপনাঙ্গকে রক্ষা করবে, তবে তাদের স্ত্রীদের ও দক্ষিণ হস্তের মালিকানাধীনদের (ক্রীতদাসীদের) বাদ দিয়ে - এদের সাথে (যৌন-সহবাসে) দোষের কিছু নেই৷" (কোরান ২৩:৫-৬)
সুতরাং বন্দি ও ক্রীতদাসদের মধ্যে নারীরা থাকলে মুসলিম পুরুষরা স্ত্রীদের সঙ্গে যেরূপে যৌনক্রিয়া করে, তাদেরকেও সেরূপে ভোগ করার স্বর্গীয়ভাবে অনুমোদিত অধিকার পেয়েছে৷ আল্লাহর এ রায় ইসলামে যৌনদাসীত্ব বা উপপত্নী প্রথা প্রতিষ্ঠা করে, যা উপনিবেশ-পূর্ব মুসলিম বিশ্বে ব্যাপকরূপ লাভ করেছিল এবং বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। যদিও বৈধ বিবাহের ক্ষেত্রে একজন পুরুষের জন্য চারজন স্ত্রী রাখার বিধান (কোরান ৪:৩), কিন্তু যৌনদাসী রাখার বেলায় সংখ্যাগত এরূপ কোনো সীমাবদ্ধতা নেই৷
আল্লাহ মুসলিমদেরকে যৌনকর্মে ব্যাবহারের জন্য অবিশ্বাসীদের সাথে যুদ্ধ করে নারী ক্রীতদাস সংগ্রহের স্বর্গীয় অনুমোদনও দিয়েছেন এভাবে:
"হে নবি! অবশ্যই আমরা তোমাদের জন্য তোমাদের স্ত্রীদের বৈধ করেছি, যাদেরকে তোমরা যৌতুক প্রদান করেছো৷ এবং যাদেরকে তোমাদের দক্ষিণ হস্ত দখল করে রেখেছে, তাদের মধ্য থেকে আল্লাহ যাদেরকে যুদ্ধবন্দিরূপে তোমাদেরকে প্রদান করেছেন৷" (কোরান ৩৩:৫০)
-------------------
এবং কীভাবে মুসলিম ক্রীতদাস শিকার করবে আল্লাহ সে নির্দেশ দেন এভাবেঃ
"(আল্লাহ) তাদেরকে তাদের দুর্গ থেকে নামিয়ে দিলেন এবং তাদের অন্তরে ভীতি নিক্ষেপ করলেন। ফলে তোমরা একদলকে হত্যা করছ এবং একদলকে বন্দি করছ।" (কোরান ৩৩.২৬-২৭)
অন্যকথায়, ক্রীতদাসত্ব চর্চা সম্পর্কিত আল্লাহর নির্দেশ পূর্ণ করণে মুসলিমদেরকে সাহায্য করতে আল্লাহ কাফেরদের (ইহুদি, খৃষ্টান ও অন্যান্য) অন্তরে সন্ত্রাস ঢুকিয়ে দিবেন যাতে মুসলিমরা সহজেই তাদেরকে পরাজিত করতে পারে। এবং পরাজিত করার পর মুসলিমরা কিছু অংশকে (অর্থাৎ সাবালক পুরুষদেরকে) নিধন করবে আর বাকীদেরকে (নারী ও শিশু) বন্দি হিসেবে কব্জা করবে (অর্থাৎ ক্রীতদাস বানাবে)।
নবি মুহাম্মদ তার জীবদ্দশায় ঠিক সেই কার্যপ্রণালীটিই প্রয়োগ করেছিলেন, যার কিছু দৃষ্টান্ত উপরে উল্লেখ করা হয়েছে। এবং পরবর্তী মুসলিমরা আল্লাহর সে নির্দেশ ও নবির দৃষ্টান্তগুলো অগ্রাহ্য করতে পারেন নি - যেগুলোর প্রতিপালন ও অনুকরণ সর্বযুগের মুসলিমদের উপর ন্যাস্ত। নবির মুহাম্মদের সময় থেকে ইসলামের ইতিহাস ঠিক সেটাই কার্যকর করে এসেছে যতদিন না পাশ্চাত্য নিজস্ব ক্রীতদাস চর্চা বিলুপ্ত করে ধৈর্যশীল কঠোর প্রয়াসের মাধ্যমে মুসলিম বিশ্বের ক্রীতদাস চর্চা ও ব্যাবসা দমন করতে থাকে, এবং পরবর্তীতে জাতিসংঘের সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার মাধ্যমে তা বিলুপ্ত করে বিশ্বব্যাপী।
ইউরোপ ১৮১৫ সালে ক্রীতদাসত্ব বিলুপ্ত করে, কিন্তু সৌদিআরব তা বিলুপ্ত করে মাত্র ১৯৬২ সালে ও ইসলামি মৌরিতানিয়া সেটা করে ১৯৮০ সালে। আর যদিও মুসলিম দেশগুলো কাগজে-কলমে দাসত্ব চর্চার বিলুপ্তি মেনে নিয়েছে, তথাপি এর চর্চা চলমান রয়েছে সৌদিআরব ও মৌরিতানিয়ায়; আর ইসলামপন্থীরা ১৯৮৫ সালে ক্ষ্মতায় আসার পর সুদানে ক্রীতদাসত্ব পুনরুজ্জীবিত করা হয়েছে। সুদানি সরকারের মদদপুষ্ট ইসলামি বাহিনী খৃষ্টান-প্রধান দক্ষিণ-সুদানে হানা দিয়ে নারি-শিশুদেরকে ক্রীতদাস হিসেবে কব্জা করে নিয়ে গিয়েছে হাজারে-হাজারে, যেমনটি করেছিলেন নবি মুহাম্মদ। মুহাম্মদ প্রকৃতপক্ষেই মুসলিমদের জন্য সর্বকালে অনুকরণীয় হয়ে রয়েছেন, যা বলে গেছেন আল্লাহ (কোরান ৬৮.৪, ৩৩.২১)।
লেখাটির বিষয়বস্তু(ট্যাগ/কি-ওয়ার্ড): ইসলামে ক্রীতদাসত্ব ;
Reference : http://www.somewhereinblog.net/blog/mmalamgir/29339726
(লেখক আলমগীর হুসেন ধর্ম বিশ্বাসে মুক্তচিন্তক; জীবনদর্শনে মানবতাবাদী; রাজনৈতিক চেতনায় ক্ল্যাসিক্যাল উদারবাদী। নিবন্ধটি লেখকের অনুমতিক্রমে http://www.somewhereinblog.net থেকে সংকলিত। এটি http://www.somewhereinblog.net/ব্লগ -- এ ০৭ ই মার্চ, ২০১১ তারিখে প্রকাশিত। -- বঙ্গরাষ্ট্র)