লিখেছেনঃ সৈয়দ ওমর হাসান, আপডেটঃ September 29, 2008, 7:03 AM, Hits: 1197
স্পীডবোটটি সাঁই সাঁই করে ছুটে চলেছে। বোটের দু’পাশে পানি ভাঙার শব্দ এবং মেশিনের গোঙানি নদীর দু’ধারের গ্রামগুলোকে যেন সচকিত করে তুলেছে।
এই নদীটি কুমারখালির দিকে মজা, সে কারণে লঞ্চ-ইস্টিমার কিছু চলে না। লঞ্চ-ইস্টিমার চলে মাইল দশেক দূরের বিষখালি নদীতে। বিষখালি নদীর ওপারে শহর। শহর থেকে এসব গ্রামে যাওয়া-আসার প্রধান বাহন নৌকা। কেরায়া-নৌকা। কিন্তু গত বছর চেয়ারম্যান সিকদার শহরের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য একটি মাছ ধরার ট্রলার ছেড়েছেন। ট্রলারে খুব ভীড় হয়। ভাড়াও বেশি। তবু মানুষ ট্রলারই পছন্দ করে। কারণ এতে তাড়াতাড়ি যাওয়া যায়। গ্রামের মানুষ কেরায়া-নৌকা এবং সদ্য আসা ট্রলার ছাড়া এই মরা কুমারখালিতে তেমন কিছুই দেখেনি। তাই স্পীড বোটের শব্দ তাদের সচকিত করে তুলেছে। এই সচকিত করে তোলার আরেকটি কারণ হয়তো-বা পুলিশ। স্পীডবোট নিয়ে পুলিশ আসামী ধরতে আসে বলে গ্রামবাসীরা শুনেছে। কিন্তু এই গ্রামে এখন পর্যন্ত তেমন কোন ঘটনা ঘটেনি।
বোটের ভিতরে পাঁচজন যুবক এবং একজন যুবতীর একটি দল। তাদের কেউ জিন্স গেঞ্জি পরা, কেউ টি-শার্ট-প্যান্ট, কারো মাথায় ক্যাপ, কারো চোখে গগল্স। দলটি খুব আনন্দ-উল্লাসে মেতে আছে। বোটের একটানা শব্দ ছাপিয়েও তাদের উল্লাস শোনা যায়ন্ধহোঃ হোঃ, হুররে! কেউ একজন হেড়ে গলায় গান গাইছে, কেউ বা হাত-পা নাচিয়ে নাচের ভঙ্গি করছে। বোটটি হঠাৎ করেই কুমারখালি গ্রামে এসে লাগে। সবুজ শান্ত গ্রামটিতে স্পীডবোটের আগমন সম্ভবত এই প্রথম। শুধু স্পীডবোটই নয়, তার আরোহীরাও এই গ্রামে প্রথম। গ্রামের লোকজন এই দৃশ্য দেখার জন্য ভীড় করে।
তারা কুমারখালিতে শহুরে লোকজন তেমন দেখে না। অবশ্য বন্দরে নগেন ডাক্তারের কাছে শহুরে কিছু সুসজ্জিত ওষুধ বিক্রেতা আসে। তাদের হাতে থাকে ঢাউস কালো ব্যাগ। তাদের চটপটে চেহারা, পরিপাটি জামাকাপড় এবং চকচকে জুতা সবার দৃষ্টি কাড়লেও তারা গ্রামের লোকের সঙ্গে তেমন মেশে না। পারতপক্ষে কথাও বলে না। তারা এসে নগেন ডাক্তারের সঙ্গে দেখা করার জন্য তার চেম্বারে ঠায় বসে থাকে। রোগীর সংখ্যা খুব বেশি হলে তারা দীর্ঘ সময় বসে থাকে। কিন্তু স্পীডবোটে আসা আগন্তুকরা এখানে সম্পূর্ণ নতুন। তাদের বন্দরেও কখনো দেখা যায় নি। তারা ওষুধ বিক্রেতাদের মত স্মার্ট বটে কিন্তু তাদের পোশাকে এবং চুলে একটা এলোমেলো ভাব স্পষ্ট। এদের একজনের আবার মাথায় চুল নেই। কামানো! মেয়েদের মত কানে ঝোলানো দুল। একজন ন্যাড়া তো আর একজনের চুল দীর্ঘ এবং বেণী করা। তৃতীয় জনের হাঁটুর কাছে একটু বা প্যান্টটা ছেঁড়া। গ্রামের মানুষ এমন বেণী করা, কানে দুল ঝোলানো পুরুষ মানুষ আগে কখনো দেখেনি। ওদিকে মেয়েটির চুল ঘাড় পর্যন্ত ছাঁটা এবং বেশ কোঁকড়ানো। ছাঁটা চুল নৈবচ, গ্রামের কোনো মেয়ের কোঁকড়ানো চুলের সঙ্গেও এই চুল মেলে না। এই মেয়েটির চুল আরো উজ্জ্বল আরো কোঁকড়ানো।
গ্রামবাসী আগন্তুকদের ঘিরে দাঁড়ায়। তাদের সবার মুখে সরল হাসি। কিন্তু আগন্তুকদের ঠোঁটে কোনো হাসি নেই। তাদের অনেকের চোখও দেখা যায় না, কারণ তাদের চোখে কালো গগল্স। গ্রামবাসীরা আগন্তুকদের খুব পরখ করে দেখে।
মেয়েটি জিনসের প্যান্টের উপর একটি সাদা শার্ট পরেছে। শার্টটা কোমরের কাছে গিঁট দেওয়ায় তার গুরু নিতম্ব, উরু এবং জঙ্ঘার স্ফীত অংশ ফুটে উঠেছে। শার্টটা যেমন মসৃণ তেমনি স্বচ্ছ, ফলে মেয়েটির অন্তর্বাস পর্যন্ত দেখা যায়।
গ্রামবাসী এরকম পোশাকে একটি মেয়েকে দেখে যৌনতার পরিবর্তে কেন যেন লজ্জাবোধ করে। তারা লজ্জায় চোখ নামায় এবং নিচে রাখা আগন্তুকদের জিনিসপত্র পরখ করেন্ধতাদের বন্দুক, বাইনোকুলার, ক্যামেরা, গীটার, চায়ের ফ্লাক্স, ছড়ি ...। কেউ কেউ এসব স্পর্শ ক’রে দেখার জন্যে হাত বাড়ালেও আগন্তুকদের ইশারায় ক্ষান্ত হয়। তারা ফ্লাক্স থেকে ধোঁয়া ওঠা চা ঢেলে খায়, সিগারেটের লম্বা ধোঁয়া ছাড়ে, তাদের সবাইকে বেশ পরিতৃপ্তই মনে হয়।
একজন গ্রামবাসী জিজ্ঞেস করে, ‘শিকারে আইছেন বুঝি?’ যার দিকে তাকিয়ে এই প্রশ্ন, সেই আগন্তুকের চোখে কালো চশমা থাকায় তার চোখের ভাষা বোঝা যায় না, তবে তার ঠোঁটে শুধু একটু হাসি ফুটে ওঠে। তাপরপর শুরু হয় গ্রামবাসীদের শিকার সম্পর্কে অভিজ্ঞতার গল্প।
কেউ বলে, ‘ভোর রাইতে দুবলার চরে হাজার হরিয়াল পড়ে। পাখিগুলার কান খুব খাড়া। মাইনসের পায়ের শব্দ পাইলেই উড়াল দেয়। ওগো ধারে যাইতে হইবে পানির মধ্যে শরীল ডুবাইয়া, মাথার উপর কচুরির ঢ্যাপ দিয়া ...।’
আরেকজন বলে, ‘কবাই নদীর ভাটির সময় ভিজা চরে অনেক চ্যাগা পড়ে। পাখিগুলান বড় অস্থির, কিছুতেই এক জায়গায় খাড়াইয়া থাকে না। পাঁচ গুল্লিতেও একটা মারা যায় না। তয় পাখিগুলার শরীল খুব পুষ্ট, গায়ে ভরা ত্যাল। একবার খাইলে কেউ আর ভোলে না। ওই পাখির সোয়াদ আজীবন জিব্বায় লাইগা থাকে ...’।
আরেকজন বলে, ‘কলমীর চরে পাওয়া যায় বক। চরের মধ্যে আছে নদীর রেত। রেতে বেশি পানি নাই। হাঁটু সমান পানি। রেতের দুই পাশের চরে একপায় খাড়াইয়া থাকে বকগুলান। রেতের কঁুচা মাছ খায়, দরগী খায়।’ ‘তয় বকেরও কান খাড়া। ধারে গেলেই উড়াল দেয়। কিন্তু সাঁঝের বেলা করাতী বাড়ির ঝাঁকড়া তেতুল গাছটায় গিয়া সব পড়ে। আমরা ‘হারইনের’ সময় তেতুল গাছে ফান পাইতা বক ধরছি। তয় বকের গোস্ত বেশি খাওয়া ঠিক না, চোখ আন্ধা হইয়া যায়।’
‘হারইনের সময় ডাউকও ধরি। ডাউক পাওয়া যায় খাঁয়ের দীঘিতে। জলকড়ি পাখিও দেখি। তয় কচুরির লাইগা দীঘির পানি দেখা যায় না। কচুরি সরাইলে টলাটল পানি। ওই পানিতে মানুষ নামে না। পানির মধ্যে আছে দেও। শিকলে পাও পেচাইয়া ধরে। প্রতি বছর খাঁয়ের দীঘি মানুষ খায় ...।’
আগন্তুকরা খাঁয়ের দীঘির গল্প শুনে হো হো করে হেসে ওঠে। এতক্ষণ যেন তারা অনেক কষ্টে হাসি চেপে ছিল। তাদের হাসিতে গ্রামবাসী নিজেদের গুরুত্বহীন ভেবে চুপ করে থাকে। তারা ভাবে শহুরেরা তাদের গল্প বুঝি অবিশ্বাস করেছে।
আগন্তুকদের হাসি ছাপিয়ে জগু মাস্টারের হাসি সবাইকে চমকে দেয়। সবাই তখন তার দিকে দৃষ্টি পাতে। জগু মাস্টারকে সবাই বলে পাগলা মাস্টার। যুদ্ধের সময় শত্রুরা যখন তার ভাইকে মেরে ফেলে, তখন সে পাগল হয়ে যায়। স্কুল কমিটি তাকে পাগলা গারদে পাঠিয়েছিল একবার। কিন্তু সে আর ভাল হয়ে ওঠেনি।
জগু মাস্টারের স্মৃতির কোনো ধারাবাহিকতা নেই। সে কোন প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে মুহূর্তের মধ্যে স্মৃতি হারিয়ে ফেলে। পূর্ব প্রসঙ্গের সঙ্গে তার কোন ধারাবাহিকতা থাকে না। তবে তার ভাই রঘুর কথা বার বার ফিরে আসে তার কথায়।
বন্দরে রঘুর স্বর্ণের দোকান ছিল। পসার ছিলো খুব। কিন্তু যুদ্ধের সময় রঘু যখন পালাতে যায় তখন শত্রুরা তাকে ধরে ফেলে, তার ঘর-বাড়ি লুট করে। কিন্তু শত্রুরা দোকানে কোনো সোনা না পেয়ে উন্মাদ হয়ে ওঠে।
তারা মনে করে রঘু সোনা গিলে ফেলেছে। তখন রঘুকে তারা টুকরো টুকরো করে কেটে তার শরীরের ভেতর সোনা খোঁজে। কিন্তু তারা ব্যর্থ হয়, রঘুর শরীরে একরত্তি সোনাও পায় না।
জগু মাস্টার হঠাৎ আগন্তুকদের উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বলে ওঠে, ‘শিকার করবেন, শিকার! মানুষ শিকার! জয় বাংলা, লেফট রাইট, লেফট রাইট, ফটাফট, ঢে .. ঢে .. ঢে .. পড় ‘ক’ তে কংসরাজ ...।’ জগু মাস্টার থামতে চায় না, অনর্গল বকে যেতে থাকে। গ্রামবাসীরা আগন্তুকদের জগু মাস্টারের ইতিহাস বলে। সেই ইতিহাসের ভেতর চলে আসে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ, গ্রামে পাক আর্মীর হত্যাযজ্ঞের করুণ কাহিনীঃ
হঠাৎ করে একজন বলে, ‘ওই যে দেখেন হাটখোলার রাস্তার পাশে বুড়া আমগাছটা, ওর মধ্যে একটা পাখি থাকে, পাখিটার কি নাম কেউ জানে না ... ’
গ্রামবাসিরা পাখিটির বর্ণনা করতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ে। তারা বসন্তকালে কোকিলের ডাক শোনে কিন্তু কোকিল দেখতে পায় না। কোকিল ডাকে বকুল গাছে। বকুল গাছের ঘন সবুজ পাতার আড়ালে কালো কোকিলকে ঠিক দেখা যায় না। কিন্তু বকুল গাছে কোকিলের ছটফটানি, লাল আধ-খাওয়া বকুল ফল নিচে ফেলে দেওয়া, এক গাছ থেকে আরেক গাছে তার চকিতে উড়ে যাওয়া, তারা বেশ বুঝতে পারে। কোকিলের সুমধুর কন্ঠে তাদের পরাণ জুড়ায়, কিন্তু তার কালো শরীর আর পালিয়ে বেড়ানোটা তাদের পছন্দ নয়। তারা সুকন্ঠি কোকিলকে ডাকে ‘কুক্কা’। আর এই আমগাছে আশ্রয় নেওয়া সাদা পাখিটাকে তারা ‘কোকিলা’ বলে ডাকে। কারণ পাখিটি ডাকে কোকিলের মত সুর করে। গ্রামবাসীরা পাখিটিকে কোকিলা ডাকতে পেরে স্বস্তি অনুভব করে। কোকিলা শুধু বসন্তে নয়, অগ্নিঝরা গ্রীষ্মেও গান গাইতে ভোলেনা।
গ্রামবাসী এরকম চির বসন্তের কোকিলকে যেমন ভালবেসেছে তেমনি কোকিল-সুরো পাখিটিকে দেখে তারা বিস্মিতও হয়েছে কম নয়। এই বিস্ময়বোধ থেকেই তাদের মধ্যে জন্ম নিয়েছে আধ্যাত্মিকতার এবং অনেকেই এরই মধ্যে এই অচেনা পাখিটিকে ‘দরবেশ পাখি’ বলে ভক্তি শ্রদ্ধাও শুরু করেছে।
আরেক জন গ্রামবাসী অন্যরকম একটি গল্প বলে, ‘আমাদের সিকদার সাইবেরও বন্দুক আছে। দোনলা বন্দুক। তয় সে পাখি শিকার করে না। একদিন দেখছি তারে সুপারিবাড়ির ভিটায় ধান কাটতে আসা কামলাদের গুল্লি করতে। অবিশ্যি হেই কামলারা আছিল মিরাবাড়ির লোক।’ লোকটা একথা বলতে গিয়ে পাগলের মত একা একা হেসে ফেলে। হাসতে হাসতে সে আবার বলা শুরু করে, ‘তার একটা গুল্লি লাগল হাইক্কার হোগায়, হাইক্কা লুঙ্গি খুইলা দৌড়। আরেকটা জবেদের রানে, জবেদ শুইয়া পড়ল।’ আগন্তুকদের ঘিরে থাকা গ্রামবাসী তার গুলি লাগার বর্ণনা শুনে প্রচন্ড রকম হেসে ওঠে। হাসি থামতে না থামতেই লোকটি বলে, ‘জবেদের কবিলা দৌড়াইয়া আইসা জবেদের বুকের উপর বইয়া পড়ল, দুই হাত দিয়া জবেদের বুক টাকায় আর কয়, ওরে আমার সোয়ামী গো, ও সোয়ামী তোমারে ছাড়া কেমতে বাঁচুম গো ...।’ লোকটি যখন জবেদের কবিলার বিলাপ অভিনয় করে দেখায় তখন আবার হাসির রোল ওঠে। আগন্তুকরা গ্রামবাসীর এই রগড় বুঝতে না পেরে প্রসঙ্গ পাল্টায়। তারা সিকদার সাহেবের বাড়ির খোঁজ করে এবং সেখানে নিয়ে যেতে বলে। গ্রামবাসীরা খুব উৎসাহের সঙ্গে হৈ চৈ করতে করতে তাদের সিকদারের বাড়িতে নিয়ে যায়। সম্মানিত অতিথিদের সম্মানিত লোকের সঙ্গে দেখা করিয়ে দিতে পেরে গ্রামবাসী যেন স্বস্তি বোধ করে। তারা যেন, প্রকারান্তরে বলতে চায়, বন্দুক শুধু তোমাদেরই নেই, আমাদেরও আছে।
সিকদার বাড়ির দহলিজে এসে তাদের স্বাগত জানান। তাদের কাচারিতে না বসিয়ে নিয়ে যান অন্দরমহলে।
আলমারীতে ওঠানো বিলেতি কাপে চা খাওয়ান। অতঃপর সিকদার দুপুরে তাদের ভাতের দাওয়াত করেন।
আগন্তুকরা সিকদার সাহেবের কাছে শিকারের খোঁজখবর করে। বন্দুকের রেঞ্জ আর মডেল নিয়ে কথা বলে। সিকদার সাহেব এক পর্যায়ে বলেন, ‘শুনছি আইজ-কাইল চরে আর বন-বাদাড়ে মেলা পাখি পড়ে। আমি পাখির গোস্ত খাই না। ডাক্তার মানা করছে। আমার একটু শ্বাসটান আছে, পাখির গোস্ত খাইলে নাকি শ্বাসটান বাড়ে। বন্দুক রাখছি আপদ-বিপদের জন্য।’
দুপুরে খাবার পর সিকদার সাহেব আগন্তুকদের নিয়ে গ্রাম দেখাতে বের হন। সিকদারের দলের পিছনে অসংখ্য গ্রামবাসী ভীড় করে। কারণ তারা শিকার করা দেখে মজা পায়। তাছাড়া এই অদ্ভুত দর্শন শহুরেদের ক্রিয়াকলাপ দেখাও যেন মজার বিষয়।
সিকদার হাটখোলা যাবার আগে আমগাছটার কাছে এসে থামেন, সাদা পাখিটার দিকে একবার তাকান, তারপর আগন্তুকদের উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘আমগাছের ওই পাখিটা মারেন দেখি। দেখি আপনাদের হাতের টিপ কেমন।’ একথা বলে সিকদার বিড়বিড় করে সুর নামিয়ে বলেন, ‘গ্রামে পাখি-পূজা শুরু হইছে, পাখির নাম দরবেশ পাখি, আমগাছে সুতা বান্ধে, মানত করে ... যত সব নাপাক কাম। আপনারা পয়লা এইটা দিয়াই শিকার শুরু করেন।’
সিকদারের কথায় গ্রামবাসীদের মধ্যে গুঞ্জন ওঠে। কিন্তু কেউ উঁচু গলায় কিছু বলতে সাহস পায় না। আগন্তুকদের একজন পাখিটার দিকে বন্দুক তাক করলে গ্রামবাসীদের মধ্যে একজন ধরা গলায় বলে ওঠে, ‘পাখিটারে মাইরেন না।’ সিকদার ধমকে ওঠেন, ‘চুপ কর তুই, গ্রামের বেটি-ছাওয়া পর্যন্ত পূজা দেওয়া শুরু করছে ...।’ সিকদারের এক ধমকে সবাই চুপ মেরে যায় ঠিক, কিন্তু একথাও তারা বিশ্বাস করে যে, পাখিটিকে মারা যাবে না। বন্দুকের কোন গুলিই কাজে লাগবে না। কারণ, তার ভিতরে দরবেশের আত্মা রয়েছে যে। তবু শিকারীর তাক করার ভঙ্গি, তীক্ষ্ন চোখের পর্যবেক্ষণ, অনায়াস বন্দুক ধরা বলে দেয় এ জাত শিকারী, এর হাত থেকে নিস্তার নেই পাখিটির।
গুলি না করে শিকারী বন্দুক নামিয়ে পিছনে ঘুরে তাকায়। তার কেবলই মনে হয় পিছন থেকে কোন বাধা আসবে। বন্দুক ধরা হাত কেউ সজোরে টেনে ধরবে। কিন্তু তার পরিবর্তে সে গ্রামবাসীকে বড্ড মনমরা দেখে, বড় অসহায় দেখে।
সিকদার এবার চিৎকার করে আগন্তুকদের বলেন, ‘কি হইছে? খাড়াইয়া রইছেন ক্যান? আপনারাও কি ডরান? জোয়ান আপনারা, শরীরে তাজা রক্ত, হাতে বন্দুক, দুনিয়ায় কিসের ডর?’
শিকারীর এক গুলিতেই পাখিটি পড়ে যায়।
তখন গ্রামবাসীরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েন্ধকি জানি কি হয়! যদি কোন বালা-মছিবত এসে পড়ে! কেউ পাখিটাকে ধরে দেখতে আগ্রহী হয় না। সিকদার এবার গ্রামবাসীদের ধমক দিয়ে ওঠেন, ‘কি মিয়ারা, কডার মত চাইয়া রইছেন ক্যান? পাখিটারে ধইরা হাটে লইয়া যান, সবাইরে দেখান, ওর মধ্যে কোন দরবেশের আত্মা নাই।’
সিকদারের ধমকে এবং আগন্তুকদের গুলি করার দৃঢ়তায় গ্রামবাসীদের ভুল ভাঙে। তারা পাখিটাকে আর দরবেশের আত্মা মনে করে না। তাদের ধারণা হয়, দরবেশের আত্মা হলে পাখিটা এভাবে মারা যেত না।
গ্রামবাসীদের মধ্যে আছে কানা মুন্সী। তার একচোখ অন্ধ বলে সবাই তাকে কানা মুন্সী বলে ডাকে। কিন্তু গেরস্থ বাড়ির বৌ-ঝিদের ‘কানা’ শব্দটি বলতে অন্যায় বোধ হয়। কারণ তাদের ধারণা আল্লাহই তাকে কানা করেছে, কাজেই ‘কানা’ শব্দটি বলে কেউ যদি তার অঙ্গহানির জন্য তিরস্কার করে, সে তিরস্কার মূলত আল্লাহকেই করা হয়। গ্রামের বৌ-ঝিরা তাকে কানাই মুন্সী বলে ডাকে।
কানাই মুন্সীর চেহারা-সুরত কালো। কিন্তু চেকনাই আছে। দাড়ি চুলেও কালোর চেকনাই সবার চোখে পড়ে। সেজন্য কেউ কেউ তাকে রসিকতা করে বলে, আগল বয়সি মুন্সী। কানাই মুন্সীর বাবাও ছিল হাটখোলা মসজিদের ইমাম। তার মৃতুøর পর তার কবর হয় মসজিদ সংলগ্ন গোরস্তানে। কিন্তু কুমারখালি নদীতে তখন স্রোত ছিল। স্রোতে মসজিদের গোরস্তান যখন ভাঙে তখন কানাই মুন্সীর বাবার অক্ষত লাশ বেরিয়ে পড়ে। মৃতুøর পাঁচ বছর পর লাশ কিভাবে অক্ষত থাকে সে কথা ভেবে গ্রামবাসীরা দিশেহারা হয়ে পড়ে। তারা কানাই মুন্সীর বাবাকে মুর্দাপীর মানে, আর তার ছেলেকে জিন্দাপীর। সে-কারণে জিন্দাপীর কানাইয়ের কথা সিকদারের কথার চাইতেও মূল্যবান।
কানাই মুন্সী সিকদারের মুখের উপর স্পষ্ট করে বলে, ‘এ পাখি আমরা হাটে নিয়া যাব নান্ধএ পাখি আমরা বাঁচাব।’
মুন্সীর কথা শুনে সিকদার রাগের মধ্যেও ফিক করে হেসে ফেলে বলেন, ‘মুন্সী, তুমিই তো কও মওতের ওপার থেকে কেউ ফিরা আসে না, আজরাইল তার মুঠাভর্তি জীবন কাউরে ফেরত দেয় না।’
আগন্তুক শিকারী বন্দুকের নল থেকে উত্থিত শেষ ধোঁয়াটুকু ফুঁ দিয়ে সরিয়ে দেবার পর, মুন্সী গ্রামবাসীকে উদ্দেশ্য করে বলে, ‘ওই মিয়ারা, তোমরা ইব্রাহিম নবীর কেচ্ছা শোন নাই?’
গ্রামবাসী নতমুখে মাথা নাড়ে। তারা মরুবাসী ইব্রাহীম নবীর জীবনী জানে, তাঁর দাসীপুত্র ইসমাইলের জীবনী জানে। কিন্তু কানাই মুন্সী তাদের কোন কেচ্ছাটি শোনাতে চায়, সেটা তারা বুঝতে পারে না।
কানাই মুন্সী ইব্রাহিম নবীর কেচ্ছা শুরু করেঃ
ইব্রাহিম নবী আল্লারে একবার জিগাইল, হে আল্লা, এই যে মানুষগুলারে বেকসুর মাইরা ফালাও, তাগোরে কিভাবে জিন্দা কর তুমি?
আল্লা হাসলেন, হাইসা বললেন, তুমি আমারে বিশ্বাস কর না ইব্রাহিম! ইব্রাহিম বললেন, আমি তোমারে বিশ্বাস করি খোদা। বুক চিইড়া দেখ, আমার বিশ্বাসে কোন চিড় নাই। তয় কিভাবে এই কাজটা তুমি কর সেটা একবার দেখতে ইচ্ছা করে। আল্লা বললেন, ইব্রাহিম, তুমি কিছু পাখি ধইরা আনো! তাগোরে একেকটা নাম দেও, তারপর পোষ মানাও। এমনভাবে পোষ মানাও যাতে ওরা নাম ধইরা ডাকার সঙ্গে সঙ্গে উইড়া আসে, তোমার দেওয়া খাওয়া খায়, তোমার বাড়িতে থাকে।
ইব্রাহিম নবী আল্লাহর কথামত পাখিগুলারে পোষ মানাইলেন। তারপর আল্লা একদিন হুকুম করলেন, পাখিগুলারে কাটো, টুকরা টুকরা কইরা কাইটা জমিনে ছড়াইয়া দাও।
ইব্রাহিম নবী আল্লার হুকুম পালন করলেন, পাখিগুলারে কাইটা তিনি জমিনে ছড়াইয়া দিলেন।
আল্লা বললেন, শোন ইব্রাহিম, ‘জীবন’ আমার কাছে এক পোষমানা পাখি। আমি ‘জীবনকে’ যা বলি জীবন তাই করে। এবার আমার ক্ষমতা তোমার হাতে তুইলা দিলাম। তুমি পাখিগুলারে নাম ধইরা ডাকতে থাকো।
ইব্রাহিম নবী নাম ধইরা ডাকার সঙ্গে সঙ্গে তাজ্জব হইয়া দেখলেন, পাখিগুলান উইড়া উইড়া আসতেছে। মহান আল্লার এই কুদরতে নবীর চোখ বাইয়া দরদরাইয়া পানি পইড়া গেল।
কানাই মুন্সীর কেচ্ছা শুনে গ্রামবাসী মৃত পাখিটিকে টুকরো টুকরো করে কাটে, কেটে মাটিতে ছড়িয়ে দেয়। পাখিটির নামের কোন দরকার হয় না। কারণ একটি পাখিই সবার মনের কেন্দ্রবিন্দুতে উজ্জ্বল হয়ে আছে। তবু তারা তাকে ‘কোকিলা’ বলেই ডাকতে থাকে। তাদের সেই ডাক সন্তান হারার বিলাপের মত শোনায়।
গ্রামবাসী ডাকতে ডাকতে যখন ঘর্মাক্ত হয়ে বিশ্বাসের সীমা ছাড়িয়ে হতাশার প্রান্ত বিন্দুতে পা রাখতে যাবে, তখন তারা অবাক চোখে দেখে পাখিটি গোধূলি ভেদ করে উড়ে আসছে এবং ঠিক তখনই জগু মাস্টার ভাল মানুষের মত ডুকরে কেঁদে উঠে বলে, ‘মুন্সী, আমার রঘুরে তুই আইনা দে।’
কানাই মুন্সী জগু মাস্টারের এই করুণ আবেদন উপেক্ষা করতে পারে না। তার ভিতর ‘জীবন’ ফিরে পাবার বিশ্বাস ভূতের মত ভর করে বসে। মুন্সী তখন গ্রামবাসীদের নিয়ে রঘুকে ডাকতে শুরু করে।
[ গল্পটি লেখকের ‘স্বপ্ন ভালোবাসা ও অন্যান্য পরমানু’ নামক গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছে। প্রকাশকঃ মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন, কথাপ্রকাশ, ১ আজিজ সুপার মার্কেট (তৃতীয় তলা), শাহবাগ, ঢাকা-১০০০। – বঙ্গরাষ্ট্র ]
অনলাইনঃ ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০০৮