লিখেছেনঃ সৈয়দ ওমর হাসান, আপডেটঃ January 17, 2009, 7:07 AM, Hits: 1137
আমি আজিমকে পাগলের মত খুঁজে বেড়াচ্ছি। আজিম কোথায়! আজিম কোথায়! কিছুদিন আগে অভিরুচি সিনেমা হলে টাইটানিক ছবিটি দেখে আজিমকে খুব মনে পড়েছিল। টাইটানিকে একটি বিশাল ধ্বংস স্তুপের ভিতর থেকে হারিয়ে যাওয়া একটি প্রেমকে উদ্ধার করা হয়েছে। টাইটানিক জাহাজটিকে নয়। প্রেম কি আসলে উদ্ধারযোগ্য! অথবা তাকে কি কোনভাবে ফিরিয়ে আনা সম্ভব! সে কথা জানার জন্যই আজিমকে আমি হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছি।
ওর সঙ্গে আমার শেষ দেখা কবে হয়েছিল ঠিক মনে করতে পারছিনা। পড়াশোনার শেষ পর্বে আজিম আর আমি রাজধানীতে একই বাসায় থাকতাম, দুজনে কিছুদিন একই অফিসে চাকরিও করেছি তারপর আজিম লাপাত্তা। অবশ্য ওর বিয়েতে আমাকে দাওয়াত করেছিল। তাও তো পাঁচ বছর হয়ে গেল! আমরা এখন দুজনে একই শহরে থাকি অথচ কারো সঙ্গে কারো দেখা সাক্ষাৎ নেই।
আজিম একটি ঔষধ কোম্পানীতে চাকরি করে। কোম্পানীর বিক্রয় প্রতিনিধি সে, ভাল মাইনে পায়, মটর সাইকেল আছে, শহরের মধ্যেই তার কাজবাজ উপরন্তু মফস্বলে খুব একটা যেতে হয় না তাকে। আজিমের চাকরির প্রথম দিকে ওর সঙ্গে মটর সাইকেলে ঘুরে বেড়াতাম। সেকি ঘোরা! চরকির মত ঘুরতাম। শহর ছাড়িয়ে বন্দর, বন্দর ছাড়িয়ে গ্রাম, ঔষধের মত এত গুরুত্বপূর্ণ একট পণ্য এত প্রত্যন্তে ঢুকে গেছে আজিমের সঙ্গে না ঘুরলে টের পেতাম না।
আজিমের চোখে টার্গেট পূরণের স্বপ্ন, কি পরিমাণ ঔষধ বিক্রি করা যায়, বিক্রির উপরই তার কমিশন, বেতন বৃদ্ধি, প্রমোশন সবকিছু। সম্ভবত সে কারণেই কোন বাজারকে সে মনে করত সুস্বাদু কেকের মত। যত দ্রুত সম্ভব কেকটিকে খেয়ে ফেলাই হল তার কাজ।
ঔষধের দোকানগুলোয় যে ঔষধপত্র থাকে, আজিম আমাকে বুঝিয়েছিল, একেক কোম্পানীর ঔষধের রং একেক রকম। তাদের কোম্পানীর ঔষধের রং হলুদ, আজিমের টার্গেট ছিল প্রথমে ঔষধের দোকানগুলোর র্যাক হলুদ করে ফেলা তারপর পুরো দোকানটাই। যাতে ওই দোকানী আর কোন কোম্পনীর ঔষধ তুলতে না পারে। আজিম কি তার টার্গেট পূরণে সফল হয়েছিল? মনে হয় না । আমি তো এ শহরেই টে টো করে সারাদিন ঘুরে বেড়াই, সম্পূর্ন হলুদ রঙের ঔষধ সমৃদ্ধ কোন দোকান তো আমার চোখে পড়েনি।
আজিমকে খঁুজতে সরাসরি ওর বাসায় রওয়ানা দেই। বাসাটি শহরের উপকন্ঠে। প্রধান সড়ক থেকে মাটির নীচু রাস্তা একেঁবেকেঁ গেছে অনেক দূর। রাস্তার শেষ দিকে ওদের বাড়ি। বাড়ির নাম মাছ রং ভিলা। মাছ রং সম্ভবত আজিমদের গ্রামের নাম। রাস্তার পশ্চিমে মোটা একটি শিরিষ গাছ ছিল। ঝোপঝাড়ও ছিল। কিন্তু আজিমকে খুঁজতে গিয়ে দেখি সেই চেনা পথটি আর নেই। মাটির রাস্তা ইট বিছানো রাস্তা হয়ে গেছে। দু’পাশে কয়েকটি টিনের বাড়িঘরও উঠেছে। অর্ধসমাপ্ত ইটের বাড়িও দেখলাম। কিন্তু সেই মোটা শিরিষ গাছটি নেই। গাছটির কাটা গুঁড়িটি চোখে পড়ল। পায়ের নীচে ইটের রাস্তা খটরমটর করছে। আজিমদের বাড়িটি খুঁজে পেতে একটু কষ্টই হল। ওদের বাড়ির সামনে অনেকটা জায়গা খোলা ছিল। সেখানে একটি সেমিপাকা বাড়ি উঠেছে। বাড়িটির পেছনে পড়েছে আজিমদের বাড়ি। রাস্তার পাশে একটি গাছের সঙ্গে মাছ রং ভিলা সাইনবোর্ডটি দেখে বুঝতে পারলাম ওদের বাড়িটি এখানেই হবে। সেমিপাকা বাড়ির পাশ দিয়ে চিলতে পথ, সে পথের শেষ গিয়ে আজিমদের বাড়িটিকে খুঁজে পাই।
বাড়িটি টিনের একটি চারচালা ঘর। চাল ছাপিয়ে একটা বরই গাছ ছিল, তার হলুদ পাতা পড়ে ছেয়ে থাকত চাল আর উঠোন। ঘরের চাল জং ধরে গাঢ় খয়েরী বর্ণ ধারণ করেছে। বরই গাছটাও গেছে বুড়োটে হয়ে। অত পাতা আর গাছটিতে নেই। প্রায় ন্যাড়া গাছটিতে বুক সাদা গাঢ় সবুজ রংয়ের দুটো টুনটুনি পিকপিক করে আপন মনে খেলছে।
আমি টিনের দরজায় কড়া নাড়তেই যে ছেলেটি দরজা খুলে দিল, আমি তাকে চিনিনা। তবে চেহারার গড়ন দেখে বুঝলাম, সে আজিমেরই ছোট ভাই হবে, খুব ছোটবেলায় আমি তাকে দেখেছি। এখন লম্বা হয়েছে প্রায় আমার সমান। আমি তার নাম এবং চেহারা দুটোই ভুলে গেছি।
আমি কোত্থেকে এসেছি, ছেলেটি জিজ্ঞেস করল। আমি উত্তরে আমার নাম বলি এই ভেবে যে সে আমার নাম শুনেই চিনে ফেলবে। কিন্তু ছেলেটি নিরুত্তর থাকল, তখন আমি আমরা বাসার ঠিকানা বলি এবং আারো বলি, আমি আজিমের বন্ধু। তুমি আমাকে চিনতে পারছ না! ছেলেটি খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে বলল, আসুন, ভেতরে আসুন। তারপর তার মাকে আমার কথা বলে উষ্ণ স্বরে ডাকল। কিন্তু ভেতর থেকে তার কোন সাড়া নেই। তার মা আমার সামনে এলেন না। আমি একটু অবাকই হলাম। আজিমের মা সবসময় আমার সামনে আসতেন, আমি বারান্দা ছাড়াও ঘরের এমনকি এই বাড়ির রান্না ঘরেও যেতে পারতাম। আমি আজিমের মাকে খালামা ডাকতাম। এবং তিনি আমাকে যেন তার ছেলের মতই ্নেহ করতেন। তার ্নেহর ভিতর প্রশান্তিময় একটা প্রশ্রয় খুঁজে পেতাম আমি। আজিমের সঙ্গে বন্ধুত্ব এবং খালামার প্রশ্রয়ের কারণে এ বাড়িতে আমি প্রতিদিনই আসতাম। আজ আমি ঘরের ভেতরে যেতে ইতস্তত করছি। এমনকি আজিমের ভাই যে ছেলেটি আমাকে তার বড় ভাইর বন্ধু হিসাবে অপ্রস্ততভাবে চিনতে পেরেছে তার নামটা জিজ্ঞেস করতেও আমার বাঁধো বাঁধো ঠেকছে।
খালাাকে বারান্দায় দাঁড়িয়ে কুশল জিজ্ঞেস করি, তিনি শুধু বলেন, ভাল আছি। আগে যখন এই বাড়িতে আসতাম তখন তার কুশল জিজ্ঞেস করলে তিনি বলতেন, আছি বাবা। আজ ‘বাবা’ শব্দটি নেই। এই একটি শব্দের অভাবে তাকে মনে হ’ল ভীষণ অনান্তরিক আর পাথরের মত শুকনো, কঠিন। আমি ভাবলাম, খালামা হয়ত আমার নাম শুনে চিনতে পারেননি, আমি পরিচয় দিলাম, তখন তিনি ছোট্ট একটি শব্দ ব্যবহার করলেন, ও আচ্ছা। তার এই অনান্তরিকতা এবং চিনত না পারা আমাকে অপ্রস্তুত করে দিল। আমি আর কথা না বাড়িয়ে তাড়াতাড়ি আজিমের খোঁজ জানতে চাই। খালামা শীতল কষ্ঠে বলেন, ও তো ওর শশুর বাড়িতে থাকে।
খালামার এই শীতল ব্যবহারে মনে হল, এ বাড়িতে আমি আর কখনোই আসবোনা। আসা উচিৎ হবে না। মৃতুøর পূর্বে মানুষ তৃষ্ণার্ত হয়ে নিজের চারদিকে তাকায়। সে হয়ত শেষ বারের মত পৃথিবীকে দেখে নিতে চায়। আমিও সেরকম শেষবারের মত বন্ধুর বাড়িটি দেখে নেই।
লম্বা বারান্দার দুদিকে দুটো ডাবল খাট ছিল যা এখনও আছে। উত্তর দিকের খাটে আমার বন্ধু আজিম থাকত, খাটটির পায়ের দিকে পড়ার টেবিল চেয়ার। সবকিছুই ঠিকঠাক আছে, শুধু আজিমের খাট আড়াল করার জন্য একটা স্ক্রীনের পর্দা ছিল, সেটি নেই। আরেকটি জিনিস খুঁজে পাচ্ছিনা, আজিমের মাথার কাছে দুটো প্রমাণ সাইজের পোস্টার সাঁটা ছিল। একটির কালচে সবুজ রঙ্গের ভিতর হলুদের ছোপ, সেটি ছিল একটি কাঠের নৌকায় উত্তাল সমুদ্র থেকে সার্ক তাড়িত এক আধা ডুবন্ত মানুষকে পশমী আলখাল্লা পরা আব্রাহাম লিঙ্কন ও তার পরিষদ বর্গ টেনে তুলছে। পরিষদ বর্গের কারো কারো হাতে সুঁচালো বল্লম শোভা পাচ্ছে, সেগুলি ভয়ংকর সার্কের দিকে তাক করা। ছোট নৌকাটির মাঝখানের মাস্তুলে ত্রিকোণ একটি পতাকায় লেখা ছিল ডিমোক্রাসি, সেই পোষ্টারটি নেই। তার পাশের পোস্টার, যেটা এখনও আছে সেটা হচ্ছে মহাকাশ যানকে মাধ্যাকর্ষণের বাইরে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রকান্ড আকৃতির, আকাশের দিকে তাক করা, একটি নভ খেয়াযানের ছবি। খেয়াযানের মাঝখানে লেখা ইউ,এস,এ। আব্রাহাম লিঙ্কনের ডিমোক্রাসির পতাকা শোভিত নৌকার সে পোস্টারটি নেই দেখে আমি কেন যেন হতাশ বোধ করি এবং আজিমদের বাড়ির আর কোথাও না তাকিয়ে সোজা পথে এসে দাঁড়াই।
আজিমদের বাড়ি ছেড়ে যখন পথে এসে দাঁড়ালাম তখন আমি প্রচন্ড রকম স্মৃতি তাড়িত। আজিম আর আমি পড়াশোনায় কেউ ভাল ছিলাম না। ছিলাম মোটামুটি ধরণের। ছাত্র রাজনীতি, দলপ্রীতির মধ্যেও ছিলাম না। মারামারি কাটাকাটি তো নয়ই। তাই বলে একবারে ভেন্দামারা টাইপের ছিলাম তাও নয়। বরং আমাদের ছিল নানা কিসিমের বাতিক; কখনো স্ট্যাম্প জমাতাম, কখনো ভিউকার্ড কখনো চকলেটের খোসা, সিগারেটের খালিপ্যাক, হরেক রকম কলম, একবার মনোযোগ দিয়েছিলাম শর্টওয়েভ রেডিও শোনায়। গভীর রাত জেগে রেডিওতে বাংলা এবং বিদেশী ভাষায় অনুষ্ঠান শুনতাম আর নিজেদের মনে হত আমরা বুঝি রেডিও বিজ্ঞানী মার্কনী হয়ে গেছি কিম্বা ভিনগ্রহ থেকে আসা বেতার তরঙ্গ রিসিভ করছি। আমরা একজন একটা কিছু শুরু করলে অপরজনও কিছুদিন পর হুবহু একই জিনিস শুরু করতাম এবং ওই বিষয়ে বুৎপত্তি অর্জন করার পরই সেটা ক্ষান্ত দিয়ে মনযোগ দিতাম অন্য কোন বিষয়ে।
কলেজের শিক্ষকরা আমাদের ভাল করে চিনতেন। চিনতেন, মাস্তান কিংবা ভাল ছাল হিসেবে নয়। নিয়মিত ছাত্র হিসাবে। চোখের সামনে প্রতিনিয়ত কোন চেহারা দেখলে কার না সে চেহারা মনে থাকে। আমরা বোধ হয় একেকজন বিরক্তিকর বিজ্ঞাপনের মত শিক্ষকদের সামনে হাজির হতাম। পরবর্তীতে আমরা ছিলাম পাঁচ বন্ধু। পাঁচ বন্ধু মিলে তৈরী করেছিলাম একটি অক্ষয় জোট। জোট যাতে না ভাঙ্গে সেজন্য অনেকগুলো অলংঘনীয় শর্ত আরোপ করেছিলাম পরস্পরের প্রতি। তার মধ্যে অন্যতম শর্ত ছিল, কেউ কারো সঙ্গে প্রেম করতে পারবে না- না প্রকাশ্যে না গোপনে। কারণ হিসাবে দেখানো হল, প্রেম ঘটলে আলাদা হয়ে যাবার প্রবণতা মানুষের সবচেয়ে বেশি তখন যে কোন চমৎকার বন্ধনকে মনে হয় বিষাক্ত বন্ধন এবং যে কোন ভাল কথাকে মনে হয় ষড়যন্ত্র। সুতরাং আমাদের মধ্যে প্রেম ছিল সর্বান্তকরণে মহা পরিত্যায্য একটি বিষয়।
আমাদের পাঁচ বন্ধুকে কলেজে ডাকা হত ফাইভ স্টার বলে। ফাইভ স্টার বলতে পাঁচজন তারকা নয়। আমরা ছিলাম মূলত দশজন। পাঁচজন ছেলে, পাঁচজন মেয়ে কিন্তু কলেজে কেন যেন আমাদের নাম হয়ে গিয়েছিল ফাইভ স্টার। এখন ভাবি শুধু কি নিয়মিত ছাত্র হিসাবে স্যাররা আমাদের চিনতেন। নাকি ওই পাঁচটি মেয়ে আমাদের সঙ্গে চলত বলেই চিনতেন! সেকারণেই কি দেয়ালে চক দিয়ে লেখা থাকত ফাইভ স্টারে ভর্তি হতে চাই! ফাইভ স্টারের পাঁচটি মেয়েই ছিল সুন্দর। বেবী ছিল শ্যামলা এবং একটু শর্টও কিন্তু সে ছিল সবচেয়ে সুন্দর। আমরা যেন বেবীকে কেন্দ্র করেই বাকী নয়জন ঘুরপাক খেতাম। বেবী তাতে খুব মজা পেত, সে এর সঙ্গে ঘুরতো ওর সঙ্গে ঘুরতো, আমরা তার সঙ্গ পাওয়ার জন্য পাগল ছিলাম। বেবীর উপরের মাড়ির বাম পাশে একটি বিউটি টিথ ছিল যার জন্য তার হাসিটি অসম্ভব রকম সুন্দর লাগত। বেবীর বাড়ি ছিল ঢাকায়। কলেজ ছুটির সময় তাকে ঢাকায় পৌঁছে দেবার দায়িত্ব পরত ছেলে বন্ধুদের উপর। আমরা একেকজন খুব গর্বের সঙ্গে সে দায়িত্ব পালন করতাম। তারপর মফস্বল থেকে তাকে চিঠি লিখে গদগদ আবেগ প্রকাশ করতাম, কেউ কেউ কুশল জিজ্ঞাসার সঙ্গে হাওয়াই চুমুও পাঠাতাম, কিন্তু বেবী সেসব চিঠির কখনোই উত্তর দিতনা। দেখা হলে শুধু প্রাপ্তি স্বীকার করে লাজুক হেসে বলত, তোরা কি লিখেছিস এই সব!
মেরি ছিল একটু ভারী ফিগারের। সবসময় দামী দামী শাড়ি পরত, তার শাড়িগুলোকে মনে হত খুব পিচ্ছিল। মেরির কোন খসখসে শাড়ি কখনো দেখিনি। কিন্তু মেরির মুখখানা থাকত সবসময় বিষণ্ন। তার গালের কোথাও একটা তিল ছিল, মনে হত আমাদের বড় আপা বুঝি। কিন্তু মেরি যখন হাসত, আমাদের মনে হত সে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়বে কিন্তু তার হাসিটা ঠিক দরাজ কিম্বা প্রাণ খোলা ছিলনা। হাসির ভিতরও তাকে চিন্তিত মনে হত। আমরা অনেক পরে জানি মেরি ওই বয়সেই ছিল বিবাহিত।
শামিমা কলেজে খুব নিয়মিত ছিল। ঝড়, বৃষ্টি-বাদল, হরতাল কিছুই সে মানত না। আমরা ঘাড় ডলতে ডলতে ঠোঁট বাকিয়ে তাকে বলতাম, তুই রোজ কিভাবে আসিস, তোর কোন অসুখ বিসুখ হয় না রে! নাকি বয়স হয়নি। শামীমা আমাদের কপট রাগ দেখিয়ে তেড়ে আসত। জাকিয়া আর মলি ছিল চেহারায় সবচেয়ে নির্লিপ্ত, সাদা সালোয়ার কামিজ পরত, কামিজে ইউনিফর্মের সোল্ডার ছিল, কোমরে সাদা বেল্ট। ওড়নাটি কোমরের বেল্টের সঙ্গে আড়াআড়ি দুইভাঁজ হয়ে বুকের উপর ত্রিভুজ তৈরী করে কামিজের সোল্ডারে ঢুকানো থাকতো। ওদের দেখতে খুব ইনোসেন্ট লাগত সম্ভবত সাদা ড্রেসের কারণে। পিকনিক কিম্বা কলেজের কোন বিশেষ অনুষ্ঠান ছাড়া ওই ড্রেস তারা বারমাসই পরত। জাকিয়া আর মলি কাথাবার্তায়ও খুব সরল ছিল, কথায় আঞ্চলিকতা চলে আসত দেদারসে। আমরা আড়ালে তাদের বলতাম ভেজিটেবল বিউটি আর প্রাকশ্যে বলতাম, তোদের দেখলে ফ্রয়েড সাহেব লিবিডো থিওরি দিতে পারত নারে! জাকিয়া আর মলি অবাক হয়ে প্রায় একই সঙ্গে বলত, ফ্রয়েড সাহেবটা কে রে?
আমাদের জীবন ভালই কেটে যাচ্ছিল, কোত্থেকে একটি ঝোড়ো বাতাস এসে সব ওলট পালট করে দিল। বেবী দীর্ঘদিন কলেজে আসেনা। আমরা উদ্বিগ্ন হয়ে সবাই মিলে তাকে দেখতে গেলাম। বেবী জানাল, তার এলাকার সবচেয়ে বড় মাস্তান তার পিছনে লেগেছে- বেবীকে সে ভালবাসে আর বেবী যদি তাকে বিনিময়ে ভাল না বাসে তাহলে তাকে উঠিয়ে নিয়ে যাবে।
মাস্তানটিকে আমরা চিনতাম, তার নামই যথেষ্ট আতঙ্ক ছড়াত। এ খবরে আমরা হতচকিত হয়ে পড়ি এবং নিজেদেরকে কাপুরুষ মনে হয়। আর বেবীকে মনে হয় খুবই ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন এবং ধরাছোঁয়ার বাইরের কোন নারী। বেবীর সামনে বসে মাস্তানটির বিরুদ্ধে যে হম্বিতম্বি করব সে সাহসও আমাদের ছিল না, পাছে আমাদের হম্বিতম্বি মাস্তানের কানে গিয়ে বিপদে পড়ি সে আশঙ্কা আমাদের ঘোল আনাই ছিল। শুধু আজিম সামান্য সাহসে ভর করে বলল, দেখি কি করতে পারি, কিন্তু আজিম কিছুই করতে পারেনি। মাস্তানের উৎপাতে বেবী ভাল করে পরীক্ষা দিতে না পেরে রেজাল্ট খারাপ করে বসল। আর আমরা এক অক্ষম আক্রোশে ভুগতে লাগলাম।
গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করার পরপরই আমাদের জীবনে অনেকগুলো পরিবর্তন ঘটে গেল – মেরির হাজবেন্ড বিদেশে থাকত, তার সঙ্গে মেরির ডিভোর্স হয়ে গেল এবং মেরি পড়াশুনা ইস্তফা দিয়ে একটি প্রাইভেট ব্যাংকে জুনিয়র অফিসার হিসাবে জয়েন করল। আর শামিমা, জাকিয়া, মলির পটাপট বিয়ে হয়ে গেল।
আমাদের পাঁচ বন্ধুর সাইকেল ছিল। গ্রাজুয়েশনের পর একদিন শপথ করলাম, আমরা আর সাইকেল চালাব না। হাঁটব অথবা রিক্সা ভাড়া গুনব। এর কারণ হিসাবে পরস্পরকে বোঝালাম, এতে আমাদের গাড়ি কেরার উৎসাহ বাড়বে। এরকম একটি কঠিন সিদ্ধান্ত নেয়ার ব্যাপারে যে বিষয়টি আমাদের উৎসাহিত করেছিল, তা হচ্ছে, গ্রাজুয়েশনের পর ভাগ্যান্বেষণের জন্য রাজধানী যাত্রা। রাজধানীতে আমরা আমাদের বাকী পড়াশুনাটুকু শেষ করব আর চাকরী খুঁজব। যাতে পড়াশোনার পর বেকার থাকতে না হয়। আমাদের মধ্যে সবচেয়ে ব্যতিক্রমী সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সিরাজ। সিরাজ সবচেয়ে ভাল ছাত্র ছিল। অংকের জটিল জটগুলো একমাত্র সেই দ্রুত ছাড়াতে পারত। বেবী তার কাছে প্রায়শই অংক নিয়ে যেত। আমরা সিরাজকে বেবীর ব্যাপারে ঢং করে জিজ্ঞেস করতাম, কতদূর রে? সিরাজ খুব কাটা কাটা আর বাস্তব ধরণের কথা বলত। সে বলত, আমি যদি বিয়েই করি তাহলে ফর্সা একটি মেয়েকে বিয়ে করব। আমি নিজে কালো, তার উপর যদি কালো কাউকে বিয়ে করি তাহলে এদেশ ব্লাক আফ্রিকা হতে সময় লাগবে না। কিন্তু সেই সিরাজ গ্রাজুয়েশনের পর সিদ্বান্ত নিয়ে ফেলল সে আর কখনোই বিয়ে করবে না।
আর আমাদের মধ্যে পড়াশোনার দ্বিতীয় স্থানটি ছিল আসাদের। আসাদ সব সময় দামী দামী জামাকাপড় পরত এবং দুই হাতে পয়সা উড়াত। আমাদের যে কোন পার্টির সিংহভাগ পয়সা আসাদ জোগাত বলে তাকে আমরা বলতাম, দাতা হাতেম তাই। রাজধানীতে ওঠার পর তাকে এক মহিলার সঙ্গে প্রায়শই ঘুরতে দেখতাম। মহিলা ছিল এক সরকারী কর্মকর্তার স্ত্রী। আমাদের পাশের বাসায় থাকত। ওই মহিলার সঙ্গে তার নাকি মন দেয়া নেয়া হয়েছিল। আর আজিম চাকরি নিল এক গার্মেন্টস কোম্পানীত। সে অনেক রাত করে বাড়ি ফিরত। শুক্রবার সরকারি ছুটির দিন, সে আসত আমাদের কাছে পড়াশোনার খোঁজ খবর নিতে। অবশ্য বড় পরীক্ষার মাস তিনেক আগে সে চাকরি ছেড়ে দিয়ে ফুলটাইম পড়াশুনায় মনোযোগ দিয়েছিল। আমরা এই সময় এক অংক শিক্ষকের কাছে প্রাইভেট পড়তে যেতাম। আমাদের সঙ্গে মেয়েদের মধ্যে শুধু বেবীই ছিল। আমরা ছ’জন একই ব্যাজে ছিলাম।
একদিন পড়া শেষ করে বাসে উঠব বলে বাস ষ্টপে দাড়িয়ে আছি তখন স্বাস্থ্য ভাল, মাথায় চুল কম, মুখমন্ডল গোলাকার ধরণের একটি ছেলে, আমাদের বয়সি হবে, মটর সাইকেলে এসে বেবীর পাশে দাঁড়াল। ছেলেটিকে আমরা কখনোই দেখিনি, বেবী পরিচয় করিয়ে দিল সে তার বন্ধু। তারপর ছেলেটির মটর সাইকেলের পিছনে উঠে এক হাতে তার কোমড় জড়িয়ে ধরে, পিছনে ফিরে অন্য হাতে বেবী আমাদের বাই বাই জানাল। আমরা প্রায় সঙ্গে সঙ্গে বুঝে ফেললাম, আগন্তুক ছেলেটি বেবীর কাছে আমাদের চেয়ে অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ। বেবী চলে যাবার পর আমরা অন্ধ ঈর্ষায় তাকে একেকজন একেকরকম মন্তব্য করতে লাগলাম, আসাদ বলল, কুত্তি একটা। সিরাজ বলল, অকৃতজ্ঞ রাম। আজিম শুধু হেহ্ করে একটা শব্দ করল আর তুহিন একটি ভয়ংকর কান্ড বাধিয়ে বসল, সে বাস ড্রাইভারকে একটি স্টপেজ না ধরার অপরাধে বেদম প্রহার করল এবং তাকে (ড্রাইভারকে) মিরজাফর, বেঈমান বলে গালি দিল।
আমরা যখন রাজধানীর পড়াশোনা শেষ করে চাকরি বাকরি নিয়ে এদিক সেদিক ছুটে যাচ্ছি তখন আজিম সত্য উদঘাটনে এগিয়ে এল। সে জানাল, ফাইভ স্টারের নিয়ম ভঙ্গ করে বেবী আর সে অনেক আগেই প্রেম শুরু করেছিল তবে তারা এ ব্যাপারটা কখনোই কাউকে জানতে দেয়নি এবং ফাইভ স্টার থেকে বিচ্ছিন্নও হয়নি। যে ধারণা করে ফাইভ স্টারে প্রেম নিষিদ্ধ হয়েছিল। সে ধারণাটি তারা ভুল প্রমাণিত করেছে। আজিম আরো জানাল তারা পরস্পর বিয়ে করতে রাজী ছিল কিন্তু আজিম সংসারের বড় ছেলে, তার বাবার অবর্তমানে তার কিছু দায় দায়িত্ব ছিল। সে বেবীকে অপেক্ষা করতে বলেছিল। তারপর সে আমাকে বেবীর নব্বই খানা চিঠি দেখাল। চিঠিগুলো এত বেশী স্মার্ট এবং সাহিত্য মূল্য বিশিষ্ট আমার মনে হয়েছিল সেই সময়কার হিট কবিতা পূর্নেন্দু পত্রীর ‘কথোপকথোন’ বুঝি! বেবীর যে এরকম ভাষা জ্ঞান ছিল তা কে জানত! আমি তখন প্রায় নিশ্চিত ছিলাম আমাদের কারো কাছে বেবীর এরকম কোন স্মৃতি চিহ্ন নেই।
আজিমকে তার শ্বশুরের বাসায় খঁুজে পেলাম না। সেখান থেকে জানাল হ’ল তিন মাস আগে সাগরদি এলাকায় তারা আলাদা বাসা নিয়েছে। তারা সেখানেই থাকে। আমি খবরটা শুনে বিস্মিত হলাম কারণ আজিমের মা এ কথাটি জানেন না। এবং তখনই বুঝতে পারলাম আজিম তার পরিবার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে গেছে। আমার সঙ্গে আজিমের মার শীতল ব্যবহার কি সে কারণে ছিল! তাহলে কি আজিম বড় ছেলে হিসাবে সংসারের কোন দায়িত্ব পালন করেনি! যে দায়িত্বে দেখিয়ে সে বেবীকে অপেক্ষা করতে বলেছিল? আজিম কি তাহলে বেবীকে এড়িয়ে যাওয়ার জন্যই ও কথা বলেছিল? কিন্তু কেন? আমি এসব কথা ভেবে আজিমের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠি। আমি তার নিজের বাসায়ও খোজ করে তাকে পেলাম না। তারা দু’জনেই চাকরি করে, দু’জনেই সন্ধ্যার পর বাড়িতে ফেরে। আজিমকে শেষমেস তার অফিস থেকে উদ্ধার করে বাসায় নিয়ে যাই। চা খেতে খেতে আজিমের কাছে জানতে চাই, বেবীকে তার মনে আছে কিনা। আজিম পাল্টা জানতে চায়, কোন্ বেবী! আমি তার দিকে গভীর ভাবে তাকালে সে ধাতস্থ হয়ে বলে, কেন কি হয়েছে? আমি তাকে কেন এত করে খুঁজছি সে কথা জানানোর সঙ্গে সঙ্গে আজিম হো হো করে হেসে উঠে বলে, তুই খুব মজার লোক, আমি ওকে ছেড়ে এসেছি সেই কবে আর তুই দিব্যি ধরে আছিস। আমি আজিমের ঈঙ্গিত পূর্ণ প্রশ্নে খানিকটা বিব্রত বোধ করলেও সত্যি কথাটি তার কাছ থেকে বের করে আনি।
বেবীর প্রতি আজিমের কোনই ফিলিংস নেই। বেবীকে তার মনে আছে অনেকদিন আগে পড়া কোন উপন্যাসের মত। আজিমের ধারণা মস্তিস্কে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ভালবাসার কিছু কোষ জন্মায় কোষগুলি মরে গেলে ভালবাসার আর কোন অস্তিত্বই থাকেনা। আজিমের সামনে সুদূর ভবিষ্যতের স্বপ্ন, তার ক্যারিয়ার, তার স্ত্রীর ক্যারিয়ার, রাজধানীতে বাড়ি করার স্বপ্ন, মেয়েকে ভাল স্কুলে পড়াবার স্বপ্ন। বেবীর প্রতি আজিমের প্রেম ঢাকা পড়ে গেছে স্বার্থপরতার মত ভয়ংকর কয়েকটি স্বপ্নের আড়ালে। এই প্রেমকে উদ্ধার করতে হলে তার স্বপ্নগুলো সরিয়ে ফেলতে হবে। আমি তার বন্ধু হিসাবে টাইটানিক থেকে ভালবাসা উদ্ধারের মত একটা বড় কাজের উদ্যোগ নিয়ে ফেলি।
আমি প্রথমে তার স্বপ্নের ভিতরে সন্দেহের কড়া ডোজের ঔষধ ঢালি, যাতে স্বপ্নগুলো দ্রবীভূত হয়ে ভালবাসা ফুটে ওঠে, কিন্তু স্বপ্নগুলো হতাশায় রূপান্তরিত হয়। হতাশা দাবানলের মত দ্রুত বিচরণশীল। আশা কিম্বা উচ্চাশার আরক ঢেলেও তাকে দমন করা যায় না। হতাশাকে দমনের জন্য আমি পিপেট থেকে ফোঁটায় ফোঁটায় লোভের তরল ঢালি তখন হতাশা যান্ত্রিকতায় রূপান্তরিত হয়। যান্ত্রিকতা পাথরের মত মসৃণ আর স্থির, তাকে কোনভাবেই গলানো যায় না। কিন্তু যখন ভালবাসার চল্লিশটি নীল রশ্মি একত্রিত করে আতশ কাঁচের ভিতর দিয়ে যান্ত্রিকতার উপর তীব্র দহন ফোকাস বিন্দু ফেলি তখন সে মসৃণ কাঠামোটি হারিয়ে এবড়ো থেবড়ো হয়ে পড়ে। কিন্তু তার স্বকীয় বৈশিষ্ট্যটি কখনোই হারায় না। আমি অনন্যোপায় হয়ে যান্ত্রিকতাকে শক্তিশালী অনুবীক্ষণ যন্ত্রের নীচে নিয়ে দেখতে পাই, প্রতিটি যান্ত্রিকতার অণু পাঁচটি পরমাণু দিয়ে গঠিত। তারা হচ্ছে স্বপ্ন, হতাশা, সন্দেহ, ভালবাসা আর লোভ। লোভ কেন্দ্রীয় পরমাণু তাকে কেন্দ্র করেই বাকী চারটি পরমাণু নিরন্তর ঘুরপাক খাচ্ছে। কেন্দ্রীয় পরমাণু লোভকে সরিয়ে যদি ভালবাসাকে প্রতিস্থাপন করা যায় তাহলে কি আজিম বেবীর প্রতি আবার তার ভালবাসা ফিরে পাবে? আজিমের মস্তিস্কে মরে যাওয়া ভালবাসার কোষগুলো কি পুনর্জীবিত হবে? আজিমের মা কি আবার আমার প্রতি ্নেহ শীতল হবেন? কিন্তু কেন্দ্রীয় পরমাণু লোভের আছে ষাট হাজার শক্ত আকর্ষি তাকে উপড়ে ফেলা অত কি সহজ!
[ গল্পটি লেখকের ‘স্বপ্ন ভালোবাসা ও অন্যান্য পরমানু’ নামক গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছে। প্রকাশকঃ মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন, কথাপ্রকাশ, ১ আজিজ সুপার মার্কেট (তৃতীয় তলা), শাহবাগ, ঢাকা-১০০০। – বঙ্গরাষ্ট্র ]
অনলাইনঃ ১৭ জানীয়ারী, ২০০৯