লিখেছেনঃ সৈয়দ ওমর হাসান, আপডেটঃ February 1, 2009, 7:16 AM, Hits: 1210
ভূমিকা
কিছুদিন আগে আমি একটা গল্প লিখেছিলাম। কিন্তু লেখাটি শেষ করতে পারিনি। একটানে একটা লেখা শেষ করে ওঠা যায় না। শেষ করেও নানারকম খঁুতখুতি থাকে। অনেক সময় গোটা লেখাই হয়ে ওঠে অপছন্দের চূড়ান্ত। আমি যে লেখাটি লিখেছিলাম সেটি আমার কাছে, বিশেষ করে বিষয়বস্তুটি বেশ টাচি মনে হয়েছিল। কিন্তু লেখাটির শেষ দিকটা মেলাতে পারিনি। শেষ দিকটা নিয়ে বহুদিন ভেবেছি। পুরো লেখাটি বারবার পড়েছিও; এরকম ভাবতে ভাবতে, পড়তে পড়তে লেখা অনেক সময় অংকের মত মিলে যায়। লেখাটির শেষ অংশে, যেখানে আমি একটি উপমা’র কথা ভাবছিলাম, যেটা গল্পের মূলচরিত্রকে সমর্থন করবে, উপমাটি নিয়ে যখন অনবরত ভাবছি তখন আমার টেবিল থেকে হঠাৎ করেই লেখাটি উধাও হয়ে যায়।
এতদিন লেখাটি নিয়ে গা ঢিলেঢালা একটা ভাব ছিল যেন হাতে অফুরন্ত সময় লেখাটির শেষ অংশটি একদিন মিলিয়ে ফেলবই, একটি যুৎসই উপমা খঁুজে পাবই। কিন্তু লেখাটি হারিয়ে যাবার পর আমার শরীরে বিদুøৎ খেলে যায়, আমি তড়িতাহত হই, আমি গল্পটিকে পাগলের মত খঁুজতে থাকি। দেরাজ, আলমারি, তোশকের তলা, খাটের নীচ, বইপত্রের আড়াল সর্বত্র খঁুজে বেড়াই। এবং এ খোঁজা আমার দীর্ঘদিন ধরে চলে এবং সবসময়ই মনে হয়, এই বুঝি পেয়ে গেলাম। মনে হয়, গল্পটি পেলে সোনার মোহর পাবার মত সুখী হব। গল্পটি রিরাইট করারও চিন্তা করেছি বহুবার কিন্তু সাহস হয়নি। মনে হয়েছে, রিরাইট করতে গেলে আগেরটি নয়, নতুন একটি গল্প তৈরি হবে। আগেরটিকে আর কখনোই খঁুজে পাব না। লেখাটি হারিয়ে যাবার পর বহু গল্প আমার মাথায় এসে ফিরে গেছে। কোনটিকেই আমি বেঁধে রাখতে পারিনি। শেষমেষ হারিয়ে ফেলা গল্পটির জন্যই হাহাকার করেছি।
কিছুদিন আগে এই শহরের প্রথম মেয়র মনোনীত হন। তাকে রাজধানী থেকে মনোনয়ন দিয়ে পাঠানো হয়েছে। তাকে বিমান বন্দর থেকে নামিয়ে আনতে অনেক গাড়ির বহর গিয়েছিল। সে বহরে ছিল উপচানো মানুষের স্ফূর্তি।
রাস্তার পাশে দাঁড়িযে এই দৃশ্য দেখে আমার ‘দি পাইপার অব দি হেমিলন’ গল্পটির কথা মনে পড়ে, গল্পটি ছোটবেলায় ইস্কুলের পাঠ্য বইয়ে পড়েছি ; হেমিলন শহর জার্মানির একটি পুরনো শহর। সেখানে এক সময় ভয়াবহ ইঁদুরের উপদ্রব শুরু হয়। উপদ্রব থেকে বাঁচার জন্য নগরবাসীর কিংবা মেয়রের তখন কিছুই করার ছিল না। সে সময় নগরে একজন অদ্ভুত দর্শন বংশীবাদক আসে। সে মেয়রের কাছে বাঁশীর সুরে নগরের সব ইঁদুর তাড়িয়ে দিতে পারার ক্ষমতার কথা বলে এবং তার পরিবর্তে সে বড় অংকের টাকা দাবী করে। মেয়র তাতে সম্মতও হয়। বংশীবাদক বাঁশীর সুরে ইঁদুরগুলোকে হেমিলনের নদীর পাশে নিয়ে এসে বাঁশি থামিয়ে দেয়। ইঁদুরগুলো দিকভ্রান্ত হয়ে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে স্রোতের ঘূর্ণিতে হারিয়ে যায়। তারপর বংশীবাদক মেয়রের কাছে প্রতিশ্রুত টাকা দাবী করলে মেয়র টাকার কথা অস্বীকার করে বসে।
গল্পটির সামারিতে হেমিলনের মেয়রকে একজন খল মেয়রই মনে হবে। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে গল্পটির কথা মনে পড়ে যাওয়ায় নবনির্বাচিত মেয়রকে নিয়ে আমার সন্দেহ দানাবাঁধে। সেকি নগর রক্ষাকারী কারো সাথে একদা প্রতারণা করবে ? সে কি নগর রক্ষাকারীর প্রাপ্য মূল্য থেকে তাকে বঞ্চিত করবে ? সে কি নিজে খল হয়ে বংশীবাদককে হিরো করে তুলবে ? এই যে গাড়ির বহরে স্ফূর্তিরত লোকজন সবসময়ই কি তার সংগে সংগে থাকবে ? এরকম অসংখ্য প্রশ্ন, ভয়, দ্বিধা, সন্দেহ, সম্ভাবনা মিলিয়ে একটা গল্প তৈরি করার ইচ্ছা হল। কিন্তু তারপরই আমি একটা সমস্যায় পড়ে যাই। নব নিযুক্ত মেয়রের কথা মনে হলে হেমিলনের মেয়রের কথা মনে পড়ে। হেমিলনের মেয়রের কথা মনে হলে নবনিযুক্তকে মনে পড়ে। দুই মেয়র আমার মনের ভিতর জোড়া শিশুর মত সংযুক্ত হয়ে যায়। কিছুতেই তাদের আলাদা করতে পারিনা। সমস্যাটি মানসিক ভেবে আমি এক মানসিক ডাক্তারের শরণাপন্ন হই। সে আমাকে নানারকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে হার্ট সাইকেল বোঝায়। সে বলে, আপনার হার্টসাইকেল পূর্ণাঙ্গ নয়। আপনার বাম দিকটা অবশ্য হয়ে থাকে সবসময় এমনকি বাম মস্তিষ্কও। আপনার বাম দিকে রক্ত চলাচল ফিরিয়ে আনতে হবে। সেজন্য হার্টের একটা অপারেশন দরকার। অপারেশনটি সারলেই আপনার মন থেকে হেমিলনের মেয়র চিরদিনের জন্য বিদায় নেবে।’ ডাক্তার খানিকটা থেমে বলে, ‘কখনো কখনো দুর্ঘটনাও ঘটে। রোগী বর্তমানে ফিরে না এসে সম্পূর্ণ অতীতাশ্রয়ী হয়ে পড়ে। সেটা কোন সমস্যা নয়। সেক্ষেত্রে আরো একটি ছোট্ট অপারেশন করতে হবে।’
মানসিক অসুখের ডাক্তার হার্টের অপারেশন করবে শুনে আমি ভয় পেয়ে তার চেম্বার থেকে ছুটে বেরিয়ে যেতে চাই। কিন্তু ডাক্তার আমার হাত টেনে ধরে ভিজিট চায়। আমি পকেট থেকে পাঁচশ টাকার একটি নোট বের করে দিলে সে রুঢ় ভাবে বলে, আমি টাকা নেই না। আমার ভিজিট অন্য রকম।’ সে বলে, ‘দুই মেয়রকে এক সঙ্গে তার সামনে এনে হাজির করতে হবে, তাহলেই তার ভিজিট দেওয়া হবে। একথায়, আমি আরো বিপাকে পড়ি। আমি বিস্ময় নিয়ে বলি, ‘এতো অসম্ভব ব্যাপার; বর্তমান এবং অতীতের কোন মেয়রকেই আপনার সামনে হাজির করা আমার পক্ষে অসম্ভব।’ তখন ডাক্তার আমাকে একটি বিকল্প প্রস্তাব দেয়। সে বলে, ‘ঠিক আছে আপনি একবার অন্তত মেয়রের অভিনয় করে আমাকে দেখান।’ আমার কাছে একাজটি বেশ সহজ মনে হয়। ডাক্তার ফের বলে, ‘আমার টেবিলের পাশে একটি ওয়েস্টপেপার বিন আছে। কাউকে নির্দেশ করুন ওটা সাফ করার জন্য।’ আমি প্রাচীন রাজাদের মত হাততালি দিয়ে বলি, ওহে কে আছিস বিনটি পরিস্কার কর। কথাটি বলার সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তার নিজেই বিনটি নিয়ে তার চেম্বার থেকে অদৃশ্য হয়ে যায়।
এরকম একটি পরাবাস্তব গল্প লিখতে গিয়েও আমি থেমে যাই। হারানো গল্পটি নিয়ে ভাবতে বসি, গল্পটির শেষ অংশের জন্য একটি উপমা খঁুজি।
আমার কয়েকজন জুনিয়র বন্ধু আছে। কবি, শিল্পী, আঁকিয়ে এরা বসে একটি মাটির সৌখিন তৈজসের দোকানে। দোকানটা ওদেরই। পার্টনারশীপ করে চালায়। বেঁচাবিক্রি তেমন নয়। আড্ডাই বেশী। আমি মাঝে মাঝে ওদের সঙ্গে আড্ডা দিতে যাই। ভালই লাগে। আড্ডা শেষে মনে হয় কিছু তারুণ্য গায়ে মেখে এলাম। গল্পটি হারানোর পর ওদের তারুণ্য নিয়ে একটা গল্প লেখার ইচ্ছে হল খুব।
ওরা দোকানটি পেয়েছিল একটি মেয়ের কাছ থেকে। মেয়েটি এ শহরে প্রথম মাটির তৈজস আর হস্তশিল্পের দোকান চালু করে।
সে দোকানেও খুব আড্ডা হত। কবি সাহিত্যিকদের ভীড় হত। পাকা দাড়িওয়ালা, বুড়ো বুদ্ধিজীবিরাও যেত সেই আড্ডায়। মেয়েটিরও ছিল একজন পার্টনার। সে ছিল মূলত এনজিও কর্মকর্তা। তারা দু’জনেই পাশাপাশি কাউন্টারে বসত। দোকান করতে করতে তাদের ভেতর গভীর প্রণয় হয়েছিল। তাদের প্রণয় দেখে আমার মনে হয়েছিল, মানুষের প্রেম জোড় কলমের মত; পাশাপাশি রেখে বেঁধে দিলে শেকড় গজিয়ে যায়। মানুষের শেকড় ভাললাগা। সে ভাললাগার জাল বোনে, ভাললাগা দিয়ে অন্যকে বেঁধে ফেলে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত প্রেম তাদের ছিন্নমূল করে ফেলে। ছেলেটি স্ত্রী সন্তান ফেলে মেয়েটিকে নিয়ে পালিয়ে যায়। এ শহর থেকে উধাও হয়ে যায়। তারা কি শেষ পর্যন্ত বিয়ে করেছিল? নাকি লিভ টুগেদার? তাদের প্রেম কি এখনো জোড় কলমের মত আছে? নাকি তারা এখন আর একসাথে নেই! মনে হল এদের নিয়ে দারুন একটি প্রেমের গল্প ফাঁদা যায়। তারপর এদের গভীর প্রেমের ভিতর একজন খল নায়কের উপস্থিতিকে যদি অনিবার্য করে তুলি যে খলনায়ক নিজেই মেয়েটির একনিষ্ঠ প্রেমিক তারপর গল্পটির নাম যদি দেই ‘আমাদের মৃৎশিল্পের ইতিহাস’ তাহলে কেমন হয়? কিন্তু শেষ পর্যন্ত এ গল্পটিও লেখা হয় না।
জুনিয়র বন্ধুদের আড্ডায় এক তরুণ তৈল রংয়ের ছবি আঁকে। তার একটা ছবি হঠাৎ আমার পছন্দ হয়ে যায়। ছবিটি একটি ভাঙ্গা বাড়ির দীর্ঘ বারান্দায় একটি শূন্য ইজি চেয়ারের ছবি। বারান্দার এক কোণে আলো আধারির ভিতর চেয়ারটি স্থাপিত। আকাশে গোধুলি বেলা। গোধুলির দুর্বল আলো বারান্দার মোটা থামের উপর উজ্জ্বল। থামের পাশ ঘেঁষে আলোক ছটা পড়েছে বারান্দার মেঝেতে। বাড়িটির চারপাশে এলোমেলো অরণ্য, মেঠো পথ, মন উদাস করা অদ্ভুত একটি ছবি।
আমার তৈল চিত্র কেনার সামর্থ নেই। তবু আমি তরুণের চাওয়া দামেই ছবিটি কিনতে রাজি হয়ে যাই। আমার মনে হয়, জীবন অবসায়ন প্রান্তে এরকম একটি পরিবেশে এরকম একটি নিভৃত ইজি চেয়ারে এসে আমি বসব। ছবিটি আমি শোবার ঘরের দেয়ালে টাঙ্গাই কিন্তু সেটি আর আগের মত ফোঁটে না। ছবিটির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কিছু দেখাও যায় না। ওটি দেখতে হলে পাশে দাঁড়াতে হয়। কোথায় যেন পড়েছিলাম ছবি মানুষের কাছে যায় না, ছবির কাছে মানুষের আসতে হয়। এবার আমার মনে হল, ছবির মুখোমুখি দাঁড়িয়েও ছবি দেখা যায় না। দেখতে হলে একটু পাশে সরে যেতে হয়।
ছবিটি কেন আমার শোবার ঘরের দেয়ালে উজ্জ্বল নয় তার একটা সম্ভাব্য কারণ খঁুজে বার করি। ছবিটির ভিতর গাঢ় সবুজের প্রাধান্য বড় বেশী কিন্তু আমার দেয়াল হালকা সবুজ রঙের। আমার ধারণা হয়, বড় মাপের হালকা সবুজ রং ছোট মাপের গাঢ় সবুজকে ফুটতে দেয় না। আমি আঁকিয়ে তরুণের সংগে এ বিষযে আলাপ করলে সে একটা সম্ভাবনার কথা বলে, সে আমাকে ছবিটির চারপাশে ভিন্ন রঙের একটি মোটা ফ্রেম দিতে বলে যাতে দুই রং আলাদা হয়ে পড়ে। এবং ছবির সামনে দাঁড়িয়ে দেখতে না পারার ব্যাপারটিরও একটি সমাধান দেয়। সে ছবিটিকে ঈষৎ ঘোলা পলিথিন মুড়ে দিতে বলে যাতে বিপরীত দিক থেকে আসা কোন আলোর প্রতিবিম্ব তৈরি না হয়। কিন্তু তরুণের সমাধান আমার পছন্দ নয়। আমার ইচ্ছে হয় ছবিটিকে এ শহরের বিভিন্ন দেয়ালে স্থাপন করে দেখি, বিভিন্ন কোণ থেকে আলোর প্রতিফলন ফেলে দেখি।
ছবিটিকে নিয়ে অন্য রকম একটি মনজাগতিক গল্প তৈরি করতে চেয়েছিলাম কিন্তু হারিয়ে ফেলা গল্পটির জন্য সেটি লেখার ধৈর্যøও আমার নেই। এভাবে অসংখ্য অর্ধসমাপ্ত গল্পের তৃষ্ণা নিয়ে গল্পটিকে খঁুজি। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নেই, হারিয়ে ফেলা গল্পটি আমি পুনরায় লিখব। আমাকে লিখতেই হবে। হোক সেটা অপছন্দের চূড়ান্ত। হোক অন্য রকম গল্প। তবুও তো এই অর্ধসমাপ্ত গল্পের সমস্যা থেকে মুক্তি পাব।
গল্প
আমি বাসে ডেইলি প্যাসেঞ্জারি করি। চলতে চলতে অসংখ্য যাত্রীর ওঠানামা দেখি। যাত্রীদের মুখ সাধারণত মনে থাকে না, তবে যারা নিয়মিত যাত্রী বিশেষ করে হকার, ভিক্ষুক এদেরকে দেখতে দেখতে প্রায় মুখস্থ হয়ে গেছে। না এভাবে শুরু করিনি গল্পটি। প্রথম লাইনটি ঠিক আছে কিন্তু পরের লাইনগুলো এরকম ছিল না।
সম্ভবত ছিল, আমি ডেইলি প্যাসেঞ্জারি করি, দীর্ঘপথ, ক্লান্তিকর জার্নি। কিন্তু অভ্যাসের দাস হয়ে দীর্ঘপথের ক্লান্তি ভুলে যাই। কখনো কখনো বিরক্ত হই বইকি যখন ভিক্ষুকগুলো বাসে ওঠে। সবগুলোই আল্লা রসুলের নামে ভিক্ষা করে এবং দীর্ঘক্ষণ বাসে থাকে। কান ঝালাপালা হয়ে যায়। পথ থেকে একটা ভিক্ষুক ওঠে অন্ধ, সে গায়, “বেহেশতের কান্ডারি তুমি রসুলও আমার হাইশরের ময়দানে তুমি কইরা নিও পার......।” দিনের পর দিন সে একই গান গায়। আমার গানটি খারাপ লাগে না। বিশেষ করে হাইশর শব্দটি; ভিক্ষুকটা হাশরকে বলছে হাইশর। হাইশর শব্দটির অদ্ভুত একটি দ্যোতনা আছে।
আরো একটি ভিক্ষুক ওঠে অন্ধ, মুখে বসন্তের দাগ, মাথায় বাবরি চুল, সে কিছুদিন পরপরই একটি নতুন গান বাঁধে। শুধুমাত্র নতুন গান বাঁধার জন্য এই ভিক্ষুকটিকে আমি এক টাকা ভিক্ষা দেই।
হঁ্যা সম্ভবত গল্পটি এবার এগুচ্ছে। লাইন বাই লাইন হচ্ছে না ঠিকই, কিন্তু প্রাসঙ্গিক হচ্ছে।
বাসে ওঠা ভিক্ষুকগুলো ভীষণ বিরক্ত করে। তারা দীর্ঘক্ষণ কানের কাছে ঘেনর ঘেনর করতে থাকে এবং এক স্টপেজ থেকে অন্য স্টপেজ পর্যন্ত তাদের কর্মকান্ড চালায়। বাসে কিছু হকারও ওঠে। কিন্তু তেমন বিরক্ত করে না। চটপট লেকচার দিয়ে বেচা বিক্রি সেরে দ্রুত নেমে যায়। এ অতি সাধারণ দৃশ্য। ডেইলি প্যাসেঞ্জারি করতে করতে এই দৃশ্য আমি প্রতিদিন দেখি। আমার একঘেয়ে লাগে। কিন্তু হঠাৎ একদিন এক শিশু হকার বাসে ওঠে। পরিস্কার ট্রাউজার আর শার্ট পরা, মাথায় চুল পরিপাটি করে আচড়ানো, মুকটুকুন সুশ্রী এবং হাসোজ্জ্বল। সে একজন চকলেট বিক্রেতা। শুদ্ধ উচ্চারণে বক্তৃতা দিয়ে সবাইকে চকলেট কিনতে আহ্বান করে। শিশুটির বাচন ভঙ্গি অন্যরকম। বাসে আরো একজন চকলেট বিক্রেতা ওঠে। অন্ধ, মাথায় কিস্তি টুপি, বলে, আগে সে ভিক্ষা করত। এখন ভিক্ষা ছেড়ে চকলেট বেঁচা শুরু করেছে। কারণ আমরা তাকে ভিক্ষা করতে দেখে বলেছি; নবীর শিক্ষা করো না ভিক্ষা মেহনত কর সবে। এই কথাগুলোই শিশুটি বলে কিন্তু তার উচ্চারণে ভীষণ রকম শুদ্ধতা। শিশুটির চকলেটগুলো হুড়মুড় করে বিক্রি হয়ে যায়। আর অন্ধ বিক্রেতাটির চকলেট প্রায়শই অবিক্রিত থাকে।
তখন সে চিৎকার করে বলে, “আমি ভিক্ষা ছাইড়া ব্যবসা ধরছি; আপনেরা যদি এখন চকলেট না কেনেন তয় আমি কি খামু ? বলেন, কি খামু?”
কিন্তু শিশুটির চকলেট বিক্রি দিনের পর দিন বাড়তে থাকে। চকলেট বিক্রির আহ্বানের সঙ্গে সঙ্গে সে তার জীবন কাহিনীও খানিকটা জুড়ে দেয়- তার বাবা পঙ্গু, মা ভিক্ষা করে, ছোট দুটো বোন আছে, সব দায়দায়িত্ব তার কাঁধে। শিশুটির এ গল্প আমার সত্য মনে হয় না। আবার সত্য মনে হয়। সত্য না হলে সে এপথে আসবে কেন! তার তো এখন স্কুলে থাকবার কথা, বাবামা’র স্নেহে বড় হওয়ার কথা। তারপর মনে হল শিশুটি তো ভালই আছে। স্বাধীন পেশা বেছে নিয়েছে। এদেশতো শিশু শ্রমের দেশ। লক্ষ লক্ষ শিশু ইটের ভাটায়, ব্যাটারির কারখানায়, বিড়ি কারখানায়, মটর গ্যারেজে, গার্মেন্টসে অসম্ভব নোংরা ঘিনঘিনে পরিবেশে সামান্য টাকায় খেটে মরছে। আমি শিশুটির চকলেট বিক্রির পেশাটি বেছে নেবার জন্য মনে মনে তাকে ধন্যবাদ দেই।
শিশুটির শুদ্ধ বাচন ভঙ্গি কেন যেন বেশীদিন স্থায়ী হয় না। বৃষ্টির ফোঁটার মত টুপটাপ করে আঞ্চলিক শব্দ ঢুকে পড়ে ওর বক্তৃতার ভেতর। দিন যত যায় আঞ্চলিকতা তত বাড়ে এবং সঙ্গে সঙ্গে তার বিক্রিবাট্টাও পড়তে থাকে। একসময় তার বিক্রিবাট্টা শূন্য হয়ে যায়। তখন সে অন্ধ চকলেট বিক্রেতাটির মত ‘কি খামু, কি খামু’ বলে চিৎকার করে। তারপর দীর্ঘদিন শিশুটিকে আর দেখি না। তারপর হঠাৎ একদিন দেখি, কয়েকটি চটি বই নিয়ে গাড়িতে উঠেছে। নাইজেরিয়ার এক শিশু কোরআনে হাফেজ হয়ে জন্মগ্রহণ করেছে তাকে নিয়ে বই। বইটিও বিক্রি হচ্ছে না। বইটি বিক্রির সময় যে পরিমাণ বিস্ময় নিয়ে কথা বলা দরকার সে বিস্ময় শিশুটির নেই। তাকে খুব রুগ্ন এবং হতোদ্দম দেখাচ্ছে। তাহলে কি চকলেট বিক্রির মারটা সে এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি! ছেলেটির জন্য আমার ভীষণ কষ্ট হয়।
উপসংহারঃ
তার জন্য একটা উপমা খঁুজি। গল্পটি হারিয়ে ফেলার আগে আমি বহুবার উপমা খঁুজেছি এবং গল্পটি পুনরায় লিখেও খঁুজছি কারণ সাহিত্যের জন্য উপমা খুব জরুরী। কিন্তু আজ পর্যন্ত আমি কোন উপমা খঁুজে পাইনি। সম্ভবত চরম বাস্তবতার কোন উপমা হয় না। অথবা এমনও হতে পারে; চরম বাস্তবতার মুখোমুখি মানুষের কোন তুলনা বোধ থাকে না।
[ গল্পটি লেখকের ‘স্বপ্ন ভালোবাসা ও অন্যান্য পরমানু’ নামক গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছে। প্রকাশকঃ মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন, কথাপ্রকাশ, ১ আজিজ সুপার মার্কেট (তৃতীয় তলা), শাহবাগ, ঢাকা-১০০০। – বঙ্গরাষ্ট্র ]
অনলাইনঃ ১ ফেব্রুয়ারী, ২০০৯