লিখেছেনঃ সৈয়দ ওমর হাসান, আপডেটঃ January 4, 2009, 7:18 AM, Hits: 981
আমাদের বিনোদনের অন্যতম একটি জগৎ হচ্ছে টাল মার্কেট। টাল মার্কেটের সাইনবোর্ডের নাম মহসীন মার্কেট। টাল এবং মহসীন শব্দ দুটিই বুৎপত্তিগত ইতিহাস আমাদের জানা নেই। তবে আমরা মনে করি টাল শব্দটি এসেছে সাইকেল কিংবা রিক্সার চাকা টাল হয়ে যাওয়া বা বেঁকে যাওয়া থেকে। এবং মহসীন শব্দটি এসেছে দাতা হাজী মোহম্মাদ মহসীন থেকে। অবশ্য আমাদের মনে করায় কিছু যায়- আসেনা। সাইকেল-রিক্সার চাকা টাল হওয়া এবং হাজী মোহাম্মাদ মহসীনের নামের সঙ্গে মার্কেটের বিক্রয় পণ্যের যথেষ্ট মিল আছে বলে আমরা নামটিকে যথার্থ মনে করি। কিন্তু এ মার্কেটের আরো একটি নাম আছে। তা হচ্ছে গাউন মার্কেট। পূর্বে বিদেশীরা দীর্ঘ পোশাকে সজ্জিত হত, দীর্ঘ পোশাকগুলোকে আমরা বলতাম গাউন। কিন্তু এই নামটির ব্যবহার যথেষ্ট হ্রাস পেয়েছে। হয়ত বিদেশীরা এখন দীর্ঘ পোশাক পরেনা বলেই নামটি তার জৌলুস হারিয়ে ফেলেছে।
মার্কেটের বিক্রয় পণ্য পুরনো কাপড় চোপড়। যা বিদেশ থেকে গাঁইট ভরে এখানে আসে। দোয়ালঘেরা একটা চত্ত্বরে এই মার্কেট কিন্তু চত্বরের মার্কেটে যারা ঠাঁই পায়নি তারা সরাসরি রাস্তায় উঠে বসেছে। আমরা রাস্তায় উঠে বসা এই মার্কেটের নাম দিয়েছি কার্ব মার্কেট।
আমাদের দেশে যখন শেয়ার মার্কেট খুব জমজমাট ছিল। তখন মূল মার্কেট বিল্ডিংয়ে মানুষ ঠাঁই না পেয়ে শেয়ার ব্যবসা করতে রাস্তায় নেমেছিল। রাস্তার মার্কেটকে তখন বইয়ের ভাষায় বলা হয় কার্ব মার্কেট। আমরা তখন থেকে কার্ব মার্কেট নামটি শিখে নেই এবং যত্রতত্র রাস্তা ঘাটে উপচে পড়া বাণিজ্যকে কার্ব মার্কেট নামে আখ্যায়িত করি।
বিবির পুকুরের পাড়ে বসে টালের কার্বমার্কেট। মার্কেটর দোকানীরা রাস্তার উপর গাঁইট খুলে তারস্বরে চিৎকার করতে থাকে, দশটাকা, দশটাকা, বিশটাকা ইত্যাদি। আমরা সেই মার্কেটের মেলে ধরা একদামের পুরনো কাপড়গুলো উল্টে পাল্টে গায়ে দিয়ে টেনে ঘষে পরখ করি আর একটি যুৎসই পোষাক খুঁজতে থাকি। ছোট বেলায় আমরা একটা ভাবসম্প্রসারণ পড়েছিলাম, যেখানে দেখিবে ছাই......। অবচেতনে ভাবসম্প্রসারণটির অলৌকিক ইঙ্গিত আমাদের মধ্যে রয়ে গেছিল কিনা জানিনা তবে এরকমটা তো রোজই মনে হয় যে, এত অল্প টাকায় যুৎসই যদি কিছু পাওয়াই যায় তাহলে মন্দকি?
টাল মার্কেটের উল্টো দিকে পৌরসভা। পৌরসভার দেয়াল ঘেষে বসেছে কয়েন মার্কেট। কয়েন মার্কেটেও আমাদের মাঝে মাঝে যেতে হয়। কারণ ছেড়া টাকা বিনিময়ে বদল দুষ্প্রাপ্য সরকারী বন্ড বেশি পয়সার বিক্রি এবং পুরনো দিনের কয়েন বিক্রি এই মার্কেটের মূল ব্যবসা হলেও হালে আরেকটি নতুন ব্যবসা যোগ হয়েছে; ফোন কার্ডের ব্যবসা। এ শহরে সরকারী কার্ডফোনে সয়লাব হয়ে গেলেও ফোনকার্ড ব্যাংকে কিংবা পোষ্টঅফিসে না পেয়ে বেশি পয়সার বিনিময়ে আমরা এখান থেকেই সংগ্রহ করি। কোন উপচানো ভীড় নেই বলে একে আমরা কার্ব মার্কেট মনে করিনা।
আমরা যে সবাই যুৎসই পোষাক এবং কার্ড ফোনের কার্ড কিনতে যাই তা কিন্তু নয়। আমাদের একেক জনের একেক উদ্দেশ্য। কেউ নতুন টাকার ঘ্রাণ শুকতে যায়, কেউ কয়েন জমায়, কেউ পুরনো কয়েনের ভিতর ইতিহাস খোঁজে, কেউ শুধু যুৎসই পোশাকই কিনতে যায়, কেউ পোষাকের উজ্জ্বলতা দেখতে, কেউ এর ভিতর গল্প খুঁজতে যায়, কেউ যায় শুধু আফসোস করতে, হায়! কবে আমাদের বর্জø পোষাক বিদেশীরা ঘেঁটে ঘেঁটে কিনবে কিম্বা কবে আমাদের মুদ্রা এত পুরোনো হবে।
আমাদের কেউ একজন একটা গল্প বলেছিলঃ তার চাচাত বোন খুব রূপসী ছিল। মেয়েটির অহংকারে মাটিতে পা পড়ত না। চাচাত ভাই তার প্রতি ভীষণ দুর্বল কিন্তু কিছুতেই তা সে প্রকাশ করতে পারেনা। পাছে প্রত্যাহত হয়, অপমানিত হয়, সেই ভয়ে। ছেলেটির মান-অপমান জ্ঞান ছিল খুব টনটনে। তার ভিতর জড়তাও ছিল। সে কিছুতেই মেয়েটির সঙ্গে কথা বলতে পারত না, এমনকি আত্মীয়তার সূত্র ধরেও না। তাছাড়া মেয়েটিও কোনদিন তাকে কথা বলার সাহস যোগায়নি। মেয়েটি ভাবত সে একা এবং অনন্যা। চাচাত ভাইয়ের দুর্বলতার জোর একদিন কমে এল। আমরা মনে করি দীর্ঘ দিনের দুর্বলতা চর্চার অভাবে শুকিয়ে যায়। তারটাও গিয়েছিল। কিন্তু দুর্বলতা চলে গেলে সেই স্থান দখল করতে সবলতা চলে আসে। আমাদের ধারনা সবলতা ক্রোধ এবং অহংকারের এক অনবদ্য মিশ্রণ। মেয়েটির প্রতি দুর্বলতা কেটে যাবার পর তার সঙ্গে কথা না বললেও তার প্রতি একটা অন্ধ প্রতিহিংসা ভিতরে ভিতরে কাজ করছিল ছেলেটির। আমরা মনে করি, ক্রোধের উচ্চাঙ্গতা হচ্ছে প্রতিহিংসা। ছেলেটি সবসময় মেয়েটির পতন খুঁজত। একদিন সে এই টাল মার্কেটে মেয়েটির পতন দেখতে পায়। দেখে, মেয়েটি এবং তার স্বামী দুজনে মিলে চল্লিশ টাকায় একটি পুরনো কোট কিনছে!
আরেকজন বলে, এই পোশাকগুলো এত রঙ্গচঙ্গে এত উজ্জ্বল হয় কেন জান? এগুলো আসে সুদূর শীতের দেশ থেকে। উজ্জ্বল রঙ্গ তাপ ধরে রাখতে পারে। শীতের দেশে তাপের প্রয়োজনে পোশাকগুলো এরকম উজ্জ্বল হয়। তার এই ব্যাখ্যাটি আমাদের ভালই লাগে। তবু তার ব্যাখ্যাটি সর্বাংগে মেনে নেই না কারণ আমরা গরমের দেশের লোক হলেও উজ্জ্বল রংয়ের কাপড় চোপড়ই তো বেশি পরি।
গণ্যমান্যও কেউ কেউ এ মার্কেটে আসে যখন তারা বিদেশ থেকে আত্মীয় স্বজনদের জন্য চড়ামূল্যে কিছু কিনে আনতে না পারে তখন। তখন তারা এ মার্কেটের পোশাক কিনে বলে এমেরিকা থেকে এনেছি। এই টাল মার্কেট ঘিরে আমাদের হাজারও গল্প, হাজারও অনুসন্ধান তবু আমরা গল্প খুঁজি, তবু আমরা অনুসন্ধান করি যুৎসই কিছু পাবার জন্য। কিন্তু এখনও আমরা যুৎসই কিছু পাইনি। মাঝে মাঝে চোখের বিভ্রমে কোন কোন পোশাক অমূল্য ভেবে কিনে নেই কিন্তু পরক্ষণেই তা অপছন্দের চুড়ান্ত হয়ে ওঠে। আমরা তখনই তা পরস্পরের মধ্যে অর্ধেক মূল্যে কিম্বা তার চেয়েও কম মূল্যে বিক্রয় করে ফেলি। যে পোশাকটি কেনে তারও অপছন্দ হতে বেশি সময় লাগেনা। পোশাকটি শেষমেস চলে যায় জুতা মোছা, কিম্বা কিচেনের পাতিল ধরা নাতা হিসেবে!
আমরা আবার খুঁজতে থাকি কারণ বিশ পঞ্চাশ টাকায় এরকম জীবন আমাদের কে আর দেবে! খুঁজতে খঁুজতে মুদ্রা মার্কেটে আমরা একটি প্রাচীন তাম্র মুদ্রা পেয়ে যাই। মুদ্রাটির গায়ে হনুমানের ঢালাই ছাপ, নীচে লেখা ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী সেভেনটিন হান্ড্রেড সেভেনটিন। আমরা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যাই। দুটো কারণে আমাদের এই বিস্ময়। প্রথমতঃ পৌনে তিনশ বছরের একটি মুদ্রা ফুটপাতে পড়ে আছে। দ্বিতীয়ত আমরা জানি এবং সিনেমায় দেখেছি, বাংলা বিহার উড়িষার শেষ স্বাধীন নবাব স্বাধীনতা হারিয়েছিল ১৭৫৭ সালে। তার আগে তো ব্রিটিশ শাসন ক্ষমতায় ছিলনা। শাসন ক্ষমতার না থেকে একটি সার্বভৌম দেশে ব্রিটিশদের একটি কোম্পানী মুদ্রা বের করল কিভাবে!
আমরা ইতিহাস বিষয়ে কেউ তেমন কিছু জানিনা। কিছু নাম আর সামান্য কিছু ঘটনা ছাড়া। আমরা জানি সিরাজউদ্দৌলা বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব। তার পতনের পর পরই ব্রিটিশরা প্রায় গোটা ভারতবর্ষ দখল করে ফেলে। সিরাজউদ্দৌলাকে পরাজিত করার জন্য তার প্রধান সেনাপতি মীরজাফর আলী খান বেঈমানী করেছিল। সে কারণে আমরা মীরজাফরের নামে কারো নাম রাখিনা। আমরা জানি, সম্রাট শাহজাহান তার প্রিয় পত্মী মমতাজের নামে বাইশ হাজার কারিগড় দিয়ে বাইশ বছর ধরে একটি সৌধ নির্মাণ করেছিল যার নাম তাজমহল। বখতিয়ারের আক্রমণে লক্ষ্মণ সেনের পেছনের দরজা দিয়ে পলায়ন আমাদের কাছে সবসময়ই একটি হাসির গল্প। মুঘল সম্রাট আকবরের পুত্র সেলিম আর আনারকলির অমর প্রেম সিনেমায় দেখে জেনেছি সম্রাট আকবর খুব দাম্ভিক ছিলেন। তারপর সেই কবিতা সাত্যিই তুমি মহান উদার বাদশা আলমগীর তাত্থেকে আমরা বাদশা আলমগীরকে চিনি। কিন্তু সেভেনটিন সেভেনটিনে কে শাসন করত এই দেশ তা খোঁজার জন্য আমরা বাবার কেনা ধুলি মলিন পোকায় কাটা ভারত বর্ষের ইতিহাস নামের মোটা একখানা বই বের করি। সে বইয়ের এক জায়গায় লেখা আওরঙ্গজেবের উত্তরাধিকারী বাহাদুর শাহ (১৭০৭-১৭১২) মুহাম্মদ শাহ (১৭১৯-১৭৪৮) এবং আহমদ শাহের (১৭৪৮-১৭৫৪) রাজত্বকালে মোগল সম্রাটরা পুতুল রাজার চেয়ে বেশি কিছু ছিলনা......... কিন্তু বাহাদুর শাহ এবং মুহম্মদ শাহের মাঝখানে কে ছিল সেটা পাই বইটির ব্রিটিশ কর্তৃক ভারতবর্ষ দখল অধ্যায়ে। সেখানে লেখা আছে, বাহাদুর শাহের মৃতুøর পর তার পুত্রদের মধ্যে সিংহাসন নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হয়। এবার যিনি সবচেয়ে অযোগ্য সেই জাহান্দার শাহ (১৭১২-১৭১৩) জনৈক সুদক্ষ পরামর্শ দাতার সাহায্যে সিংহাসন লাভ করেন। অবশ্য কয়েক মাসের মধ্যেই তিনি তার ভ্রাতুস্পুত্র ফারুক শিয়ার (১৭১৩-১৭১৯) দ্বারা ক্ষমতাচুøত ও কয়েদখানায় নিহত হন।
আমরা শেষ পর্যন্ত ফারুক শিয়ারকে পেয়ে যাই। এই ফারুক শিয়ারের আমলেই ব্রিটিশরা ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর নামে মুদ্রা প্রচলন করেছিল। বিজয় সেলুনের আড্ডায় বসে আমরা ফারুক শিয়ারকে যথেষ্ট গালি গালাজ করেই ক্ষান্ত হইনা, তাকে মীরজাফরের মত স্বাধীনতার কুচক্রী শত্রু হিসেবেও চিহ্নিত করি।
যে মুদ্রাটি দেখে আমাদের এত বিস্ময় এত ইতিহাস ঘাঁটাঘাঁটি সে মুদ্রাটি আমরা কিনতে পারিনি। বিক্রেতা যে একজন রিয়েল অর্কিওলজিস্ট সেটা বুঝতে পারি মুদ্রাটির দাম জিজ্ঞাসের পর। বিক্রেতা বলল, এটির দাম দুহাজার টাকা এবং সে আরো জানাল যে, তার কাছে একটি স্বর্ণমুদ্রাও আছে। তার দাম একলক্ষ টাকার উপর।
আমরা যখন বিজয় সেলুনে বসে মুদ্রা এবং ফারুক শিয়ারকে নিয়ে তুমুল আলোচনা সমালোচনায় মেতে উঠি তখন ফারুক নামের এক ব্যক্তি আমাদের আলোচনায় প্রবেশ করে। ফারুক ভাইকে আমরা চিনতাম। সে আমাদের চেয়ে কুড়ি বছরের বড়। তাকে প্রায়ই দেখা যেত বিজয় সেলুনের পূর্ব কর্নারে রাখা হাতলওয়ালা চেয়ারটিতে ধনেশ পাখির মত চুপচাপ বসে থাকে। আমাদের আড্ডায় সে কখনোই যোগ দিতনা এবং আমরা যখন তুমুল আড্ডায় মেতে উঠতাম তখন সে নিঃশব্দে রাস্তায় বেরিয়ে যেত। সে আমাদের উপর বিরক্ত কিনা সে কথা আমরা কখনোই ভেবে দেখিনি।
তবে তার এই চুপচাপ বসে থাকা বা নিঃশব্দে চলে যাওয়া আমাদের আকৃষ্ট করেছিল। তখন সেলুনের মালিক বিজয়দার কাছে আমরা তার পরিচয় জানতে চাই। বিজয় দা তার নাম বলে এবং বলে যে, সে একজন ব্যাংকার। কিন্তু ব্যাংকের তহবিল তছরুপের অভিযোগে তার সাময়িক বরখাস্ত হয়েছে......। এই ফারুক ভাই আমাদের আলোচনায় যোগ দেয়ায় আমরা কিঞ্চিৎ বিরক্ত হলেও যখন সে মুদ্রাটি কেনার অধীর আগ্রহ দেখায় তখন তার প্রতিও আমরা আগ্রহান্বিত হয়ে পড়ি। এবং তাকে মুদ্রাটি যেখানে পাওয়া যায় সেখানে নিয়ে যাই। ফারুক ভাই দোকানীকে সাহেব সুবার মত হাঁক দিয়ে বলে, কই হে তোমার কাছে নাকি ব্রিটিশ আমলের একখানা মুদ্রা আছে? লুুঙ্গি গেঞ্জি পড়া লোকটি হয়তবা একটু কঁুজোও রাস্তার উপর নীচু একটি তক্তপোশে বসে আছে। সে ফারুক ভাইর দিকে না তাকিয়েই বলে, আছে, তবে দাম বেশি পড়বে। ফারুক ভাই বলে, দেখি? তখন লোকটি মুদ্রাটি নিজ হাতের তালুতে করে দেখায়। ফারুক ভাই তার তালু থেকে মুদ্রাটি উঠিয়ে চোখের খুব কাছে নিয়ে পরখ করে দেখে হাতের তালুুতে মুদ্রাটি নাচাতে নাচাতে জিজ্ঞেস করে, কত? লোকটি বলে, আড়াই হাজার। আমরা চিৎকার করে উঠি, তুমি কিছুক্ষণ আগে বললে, দুই হাজার এখন বলছ আড়াই হাজার, এটা কি মগের মুল্লুক নাকি? লোকটি কোন কথা বলেনা। তখন ফারুক ভাই চিবিয়ে চিবিয়ে বলে, সরকারী সম্পত্তি বিক্রি কর। তুই চিনিস আমি কে? হঠাৎ তুমি থেকে তুইতে চলে আসায় কিম্বা অন্য কারণে লোকটি মুষড়ে পড়ে বলে, আমি একজনার কাছ থেইকা দুইশ টাকায় কিনছি। কোন শালার কাছ থেকে কিনেছিস শালাকে থানায় নিয়ে যাব। ফারুক ভাইর শালা শব্দটি শুনে লোকটি আরো মুষড়ে পড়ে। বিপদের সময় হাত পা ছেড়ে দেওয়া মানুষের মত সে ফুটপাতে বসে পড়ে বলে, স্যার পয়সাটা নেন তবে আমি গরীব মানুষ আমারে ঠকায়েন না।
ফারুক ভাই কড়া গলায় জিজ্ঞেস করে, কত টাকা? ন্ধ দুইশ। মিথ্যা বলার আর জায়গা পাসনা, ফারুক ভাই ধমক লাগায়। লোকটি তখন ফারুক ভাইয়ের পা জড়িয়ে ধরে কান্না জুড়ে দেয় এবং লোকজন জড় করে ফেলে। লোকজন প্রশ্ন তোলার আগেই ফারুক ভাই তাকে দুইশ টাকা ছুড়ে মেরে আমাদের নিয়ে চলে আসে। মুদ্রাটি হাতের মধ্যে পেয়ে ফারুক ভাই বলে, আপনারা হয়ত ভাবছেন আমি এই মুদ্রাটি নিয়ে ব্যবসা করব। তা কিন্তু নয়। আমি চাই নাম। আমি এটা যেখানেই উপস্থাপন করিনা কেন আমার নামের সাথে সাথে আপনাদের নামটাও বলব, অবশ্যই বলব। কারণ আপনারাই এই মুদ্রাটির প্রথম আবিস্কর্তা। আমরা ফারুক ভাইর ভালমানুষি উক্তিতে কৃতার্থ হয়ে যাই এই ভেবে যে, আমাদের আবিস্কারের একটি মূল্য হল। কিন্তু ফারুক ভাই প্রথমে কেন এত জোর দিয়ে বলল; আমি চাই নাম, কিসের নাম! কেন সে নাম চায়? তাহলে কি তহবিল তছরুপের অভিযোগ হৃত নামের পুনরুদ্ধার সে এই ভাবে চায়? আমরা তা ভেবে পাইনা। এই মুদ্রার ব্যাপারে ফারুক ভাই এত গুরুত্বই বা দিচ্ছে কেন? ফারুক শিয়ারের সঙ্গে তার নামের সাযুজ্যর কারণে নাকি সে ভাবছে সে মোগল বংশের কেউ। আমরা এই ঘটনা চিন্তা করতে গিয়ে ধন্ধে পড়ে যাই।
অবাধ তথ্য প্রবাহের যুগে আড্ডায় আমরা কোন একটি তথ্য নিয়ে বেশি দিন কচাল করিনা। আরো অসংখ্য তথ্যের ভিড়ে পূর্ববর্তীরা কোথায় হারিয়ে যায় তার পুনরালোচনা করা আমাদের জন্য সত্যি কষ্টকর। মুদ্রা বিষয়ক তথ্যগুলি আমরা ভুলেই গিয়েছিলাম কিন্তু ফারুক ভাইকে পেয়ে আবার তা স্মরণ করার জন্য লোভ জেগে ওঠে। কিন্তু ফারুক ভাইকে দেখে আমরা হোঁচট খাই। তার চেহারা আর আগের মত নেই। আনেকটা শুকিয়ে গেছে। চুল উস্কু খুস্কু, চোখ লাল, কাপড়চোপড় ময়লা, মনে হচ্ছিল সে কোন শোকের মধ্যে আছে কিন্তু সে বলল, মুদ্রাটি পেয়ে আমার ঘুম নষ্ট হয়ে গেল। সারা দিনরাত ভাবি মুদ্রাটি দিয়ে কিভাবে একটি আলোড়ন তোলা যায়; গেলাম আইডিয়াল কলেজের ইতিহাস বিভাগে। বিভাগের চেয়ারম্যান বইপত্র ঘেঁটে বের করলেন যে, ১৯১৭ সালে দিল্লির শাসক ছিলেন ফারুক শিয়ার তখন বাংলায় সুবেদার ছিলেন মুর্শিদ কুলি খাঁ। ১৭১৩ সালে ফারুক শিয়ার মুর্শিদ কুলি খাঁর স্থলাভিষিক্ত করার জন্য একজন সরকারী উত্তরাধিকারী বাংলায় প্রেরণ করেন কিন্তু সুবেদার মুর্শিদ কুলি খাঁ তাকে প্রদেশ থেকে বিতাড়িত করেন এবং দিল্লিকে কর প্রদান বন্ধ করে দেন অতঃপর দাক্ষিণাত্য, অযোদ্ধা একে একে মুঘলদের হস্তচুøত হতে থাকে.....।
আমরা ইতিহাস বিষয়ে উৎসুক্য না দেখিয়ে ফারুক ভাইকে জিজ্ঞেস করি, মুদ্রাটি এ শহরে কিরকম আলোড়ন তোলে? ফারুক ভাই বলে মুদ্রাটি নিয়ে এক হিন্দু বুদ্ধিজীবীর কাছে গেলে সে মুদ্র্রাটির উপর একটি প্রশস্তি লিখে দিতে রাজি হয়। সাংবাদিকদের সাথে আলাপ করলে তারা একটি প্রেস কনফারেন্স দিতে বলে। এ শহরের যতজন হিন্দুর কাছে গেছি তারা আমাকে খুব সমাদর করেছে। মুদ্রাটির ব্যাপারে আগ্রহ দেখিয়েছে খুব। কিন্তু মুসলমানরা একেবারেই আগ্রহ দেখায়নি। তার এই তথ্যে আমরা বিস্মিত হই। কারণ আমরা শুনেছি হিন্দুরা ইংরেজী শিক্ষায় যেমন এগিয়ে গিয়েছিল তেমনি তারা ব্রিটিশের কাছ থেকে অনেক সুযোগ সুবিধাও পেয়েছিল যা মুসলমানরা পায়নি। তাদের রাজ্য হারানোর ক্রোধ ব্রিটিশের সঙ্গে মিলতে দেয়নি, তারা পিছিয়ে পড়েছিল। মুদ্রাটির প্রতি আগ্রহ এবং অনাগ্রহের কারণ কি এই পূর্ববর্তী ইতিহাস! প্রায় পৌনে তিনশ বছর পর ব্রিটিশদের একটি মুদ্রার প্রতি হিন্দুর মুসলমানদের আলাদা সংবেদনই আমাদের বিস্মিত করে।
আরেকদিন ফারুক ভাইর সঙ্গে দেখা হলে সে জানায় যে মুদ্রাটি সে কেন্দ্রীয় যাদুঘরে রেখে এসেছে। যাদুঘরের মহা পরিচালকের কাছে মুদ্রাটির দাম হিসাবে সে পঞ্চাশ হাজার টাকা চেয়েছিল কিন্তু মহা পরিচালক রাজি হননি। মহাপরিচালক মুদ্রাটির সংগ্রাহক হিসাবে ফারুক ভাইর নাম রেখে দিতে রাজি হয়েছেন মাত্র। তখন মুদ্রাটি পাওয়ার পর ফারুক ভাইর উক্তি মনে পড়ে। সে বলেছিল, এটি আমি যেখানেই উপস্থাপন করিনা কেন আপনাদের নাম আমি অবশ্যই বলব। কিন্তু তাকে এই কথাটি স্মরণ করিয়ে দিতে আমরা লজ্জায় পড়ে যাই। সে লজ্জা কাটানোর জন্য এ শহরের হয়ে জাতীয় যাদুঘরে মুদ্রাটির স্থান করে দিতে পারার জন্য ফারুক ভাইকে মুহূর্মুহূ ধন্যবাদ দিতে থাকি।
একদিন টাল মার্কেটে জুৎসই কোন কিছু কেনার জন্য যখন ঘুরঘুর করছি তখন সেখানে আমাদের এক পুরনো বান্ধবী সুজাতার সন্ধান পাই। সুজাতা আমাদের পাশে দাঁড়িয়েই টালের মেলে ধরা পোশাক ঘাঁটা ঘাঁটি করছিল। আমরা তাকে দেখে আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়ি এবং তার কুশল জিগ্যেস করি, তাকে দীর্ঘদিন না দেখে আমাদের মন কাঁদে সে কথা তাকে জানাতে ভুল করিনা এবং তার সঙ্গে কিছু পূর্ব স্মৃতি স্মরণ করে হারানো দিনগুলোর জন্য আফছোস করতে থাকি। কিন্তু তার চেহারায় বয়সের ছাপ পড়ে গেছে, সে কাথাটি আমরা সযত্নে এড়িয়ে যাই।
আমাদের বান্ধবীর গায়ে ভেলভেটের সাদা কামিজ তার উপর গোলাপী রঙ্গের দামী একটি সোয়েটার। সোয়েটারের উপর লকেট সহ একটি সোনার চেইন দুলছে। আমরা লকেটের দিকে দৃষ্টি পেতে বিস্মিত হই কারণ সেখানেও ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর মুদ্রাটির হনুমানের ঢালাই ছাপ। ছাপটি কি কোন ধর্মীও প্রতীক? কিন্তু তার গোলাপী সোয়েটারের ঔজ্জ্বল্য আমাদের আরো বিস্মিত করে। তখন আমরা সোয়েটারের খুব প্রশংসা করলে সে বলে, মামা এমেরিকা থেকে পাঠিয়েছে। এ কথায় আমরা হেসে ফেলায় সে মাথার দিব্যি খেয়ে বলে কথাটি। তখন ভীড়ের মধ্যে গোপনে তার সোয়েটারের গন্ধ নেই। টাল মার্কেটের পোশাকের একটি নিজস্ব গন্ধ আছে যে গন্ধটি সহজে ছেড়ে যায় না। আমরা তার সোয়েটার থেকে লেবুযুক্ত সাবানের ঘ্রাণের পরপরই টাল মার্কেটের পোশাকের নিজস্ব গন্ধটি খুব মৃদুভাবে অনুভব করি। তখন আমরা একটি সাধারণ সত্যের মুখোমুখি হই যে, মানুষ যুৎসই জিনিস খঁুজে পেলে সে তার সঠিক ইতিহাস গোপন করে ফেলে। মানুষ কেন এই কাজ করে সেটা জানতে গিয়ে আমরা জুৎসই জিনিসের ইতিহাস খুজি এবং দেখতে পাই, সে ইতিহাস হত্যা, প্রতারণা জবরদখল আর প্রতিহিংসার এক নারকীয় পৃথিবী তখন আমরা প্রত্যেকে খুব অবসন্ন বোধ করি এবং আমাদের প্রতিটি নিরীহ উচ্চাকাঙ্খাকে সন্দেহের চোখে দেখতে থাকি।
[ গল্পটি লেখকের ‘স্বপ্ন ভালোবাসা ও অন্যান্য পরমানু’ নামক গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছে। প্রকাশকঃ মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন, কথাপ্রকাশ, ১ আজিজ সুপার মার্কেট (তৃতীয় তলা), শাহবাগ, ঢাকা-১০০০। – বঙ্গরাষ্ট্র ]
অনলাইনঃ ৪ ডিসেম্বর, ২০০৯