Banner
প্রশাখা – সৈয়দ ওমর হাসান (ছোট গল্প)

লিখেছেনঃ সৈয়দ ওমর হাসান, আপডেটঃ September 21, 2008, 7:25 AM, Hits: 1015

জামাল ভাই আমাদের বয়সে খানিকটা বড়। সন্ধ্যের পর কেডিসির চায়ের দোকানে আমরা কয়েকজন মিলে জামাল ভাইর সঙ্গে আড্ডা দিতাম। সেই আড্ডায় ফারাবী, শাহিন, শোয়েব, মাঝে মাঝে সাহানও আসত। তখন দোকানটিতে বিদুøৎ ছিল না। মূল দোকানঘর একটু ভেতরের দিকে। সামনে দাওয়ার মতখানিকটা স্পেস তার চারদিকে কাঠের বেঞ্চি। মাথার উপর টিনের চালা, দোকানঘরের সামনে ঝুলানো দাড়িপাল্লার পাশেই বাঁধা থাকতো কেডিসির নির্জন পরিবেশের তীব্র অন্ধকার দূর করার জন্য একটা টিম টিমে হারিকেন। সে হারিকেনের আলো, দাওয়ায় এসে পৌঁছত না। আমরা সন্ধ্যার পর সেলিমের চায়ের দোকানের বেঞ্চে বসে এরকম অন্ধকার নিভৃত পরিবেশে সময় কাটাতাম।

 

জামাল ভাইর ছোট ভাই তখন স্থানীয় একটি কলেজে ছাত্র রাজনীতি করে। ছাত্রনেতা হিসেবে তার নাম-ডাক শহরে অনেকে জানত। তবে আমাদের সেই আড্ডায় রাজনীতি নিয়ে তেমন আলাপ-আলোচনা হতো না। জামাল ভাইর ছোট ভাই রাজনীতি করতে একদিন রাজধানীতে চলে গেল। একদিন শুনলাম তার নির্বাচনী এলাকায় সে পার্লামেন্ট মেম্বার নির্বাচিত হয়েছে। পার্লামেন্ট মেম্বার হবার পর জামাল ভাই যেন তার ভাইকে সহ্য করতে পারছিলেন না। জামাল ভাই ব্যক্তিগতভাবে কিছু করতেন না। বেকারই ছিলেন। আমরা ভেবেছিলাম এটা বোধ হয় তার একধরনের ঈর্ষা। ছোট ভাইর সমৃদ্ধিতে বড় ভাইর গর্ব অনুভব সচরাচর চোখে পড়লেও আমরা অত অল্প বয়সে ঈর্ষাও দেখেছি। জামাল ভাইর ঈর্ষা পরবর্তীতে ক্রোধ আর অভিমানে রূপান্তরিত হল। তিনি তার ভাইয়ের নানা অপকর্মের কথা বিশেষ করে লুটপাট, জবরদখল, আর আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হওয়ার তীব্র সমালোচনা করতে লাগলেন। এমনকি তিনি তার ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলা এবং যোগাযোগ রক্ষা করাও বন্ধ করে দিলেন। ছোট ভাইর সঙ্গে জামাল ভাইর তীব্র অপজিশন তখন আমাদের রীতিমত ভাবিয়ে তুলত।

 

আমাদের সেই আড্ডা বহুদিন হয় ভেঙ্গে গেছে। ফারাবী একটি জাতীয় পত্রিকার নিউজ এডিটর, শাহিন হাইকোর্টের লইয়ার, সাহান একটা এমেরিকান ব্যাংকের বড় কর্মকর্তা, সোয়েব দীর্ঘ অপেক্ষার পর আমেরিকা চলে গেছে। শুনেছি জামাল ভাই তার ছোট ভাইর নির্বাচনী এলাকায় আছেন। সেখানে তিনি কি করছেন ঠিক জানিনা। আমি পরে আছি এই শহরেই। শিক্ষকতা করি ঘুরি-ফিরি, আড্ডা দেই, বেশ চলে যায় দিন। কিন্তু আড্ডা আর সমবয়সীদের সাথে দিতে পারিনা। আমার জুনিয়র অনেক বন্ধু-বান্ধব আছে তাদের সঙ্গেই সকাল বিকাল সময় কাটে। মাঝে মাঝে আফছোচ করে বলি, ‘গরু শিং ভেঙ্গে বাছুরের দলে ঢুকে পড়েছে।

 

হঠাৎ একদিন সন্ধ্যার দিকে আমার মোবাইল ফোন বেজে উঠল। অচেনা নম্বর, ধরব কি ধরব না ইতস্তত করেও ধরে ফেললাম। ওপাশ থেকে একটা ভরাট কণ্ঠ বেজে উঠল, ‘আমাকে চিনতে পারছেন?’ আমি বললাম, ‘না, কে আপনি?’ ন্ধচেষ্টা করে দেখুন না?’ খানিকক্ষণ বিরতি নিয়ে স্মৃতি হাতরালাম। না, স্মৃতিতে এরকম কণ্ঠ আর নেই। আমি যখন চুপ করে আছি তখন ওপাশ থেকে ভদ্রলোক বলল, ‘আমি জামাল ভাই, এবার চিনতে পারছেন?’ নামের সঙ্গে স্মৃতিতে তার কণ্ঠ মিলে গেল। আমি উচ্ছ্বসিত হয়ে তাকে বললাম, ‘চিনতে পারব না কেন, আপনি তো আমাদের সেই প্রিয় জামাল ভাই।তারপর তাকে একটা খোঁচা দিয়ে বলি, ‘আরে ভাই, আপনার সাংসদ ছোট ভাইর নাম মাঝে মাঝে পেপারে পত্রিকায় দেখি আপনার নামতো দেখিনা, তাই ভুলে গিয়েছিলাম....।

 

শেষমেষ জামাল ভাই আমাকে তার পাড়ার আড্ডায় যেতে খুব অনুরোধ করলেন। কি না কি জরুরী কথা আছে আমার সঙ্গে। আমিও তার প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠলাম। পুরনো আড্ডার সঙ্গী, অনেক কথা জমা হয়ে আছে। আমি পরদিন সন্ধ্যায় সে আড্ডায় গিয়ে হাজির হই। সেখানে শহরের জ্ঞানীগুণী লোকজনকে দেখলাম। তারা অনেকেই ক্ষমতাসীন দলের বুদ্ধিজীবী। কেউ কেউ সক্রিয় সদস্য। জামাল ভাই তাদের সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিলেন। তারপর আমাকে বোঝালেন, তারা একটা বিভাগ উন্নয়ন সমিতি করেছে, তাদের অনেক, অসংখ্য সৎ উদ্দেশ্য, তার কিছু কিছু আমাকে বললেনও, তারপর রিকোয়েস্ট করলেন, আমি যেন এই উন্নয়ন সংগঠনে শরীক হই। তিনি আমাকে একটি ভাল পোস্ট দেবারও ইঙ্গিত করলেন। আমি তার এই প্রস্তাবে চুপ থাকলাম, হঁ্যা বা না কিছুই বললাম না। চা সিগারেট খেয়ে সেদিনকার মত বিদায় নিলাম।

এক সপ্তাহ পর একদিন শুক্রবার তিনি আবার ফোন করলেন। কি খবর ভাই আর যে এলেন না।আমি তাকে ব্যস্ততার কথা বললাম। তিনি কোন গুরুত্ব দিলেন না, বললেন আজকে বন্ধের দিন ব্যস্ততা কিসের, চলে আসেন না।আমি আবার সন্ধ্যার পর যাই। আমার মধ্যে প্রচন্ড কৌতুহল লোকটি শেষ পর্যন্ত কি অবস্থায় আছে জানা দরকার। তিনি আবার আমাকে বিভাগ উন্নয়ন সমিতিতে যোগ দিতে অনুরোধ করলেন। আমি বললাম, ‘ভাই আমি তো অনেক দল, সংগঠন করেছি, এখন আর এসব ভাললাগেনা।জামাল ভাই আমার কথায় আহত হলেন না, তিনি আমার পিঠ চাপড়ে বললেন, ‘অত চিন্তা করবেন না, সংগঠনের কেওয়াজ সম্পর্কে আমি ভাল জানি। কোন কেওয়াজই আপনাকে স্পর্শ করতে পারবে না। আমি বুক দিয়ে আগলাব।আমি তার কথায় কোন মন্তব্য না করে সেদিনকার মত চা সিগারেট খেয়ে চলে এলাম।

 

কিন্তু তিনি আমাকে আবার ফোন করলেন। আমি আবার গেলাম। এবার আমি একটু বিরক্ত। এতদিন তার প্রতি যে কৌতুহল ছিল সেটা আর টের পেলাম না। যাবার সময় সিদ্ধান্ত নিয়েই গেলাম, যে, এবার তাকে নাটা খুব শক্ত ভাবে বলতে হবে। তিনি আবার বিভাগ উন্নয়ন সংগঠনের প্রসঙ্গে এলে আমি তাকে জিজ্ঞেস করি, ‘জামাল ভাই আপনি এখন কি করেন?’ তিনি বললেন তেমন কিছু না; সরকারী একটা জলাশয় ইজারা নিয়েছি, সেটা অনেক বড়, নদীর মত, আয় রোজগারও খারাপ হয়না। ছোট ভাইর নির্বাচনী এলাকায় যত ঠিকাদারী কাজ হয় তার একটা পার্সেন্টেজ পাই, বাস মালিক সমিতি থেকেও পাই.... আছে এরকম কিছু ইনকাম আছে।’ ‘বাড়ি টারি করেছেন কিছু?’ ‘না তেমন কিছু না। রাজধানীতে একটা ফ্লাট আছে।ন্ধকোথায়?’ তিনি একটা অভিজাত এলাকার নাম বললেন। তারপর আমার কানে কানে বললেন, ‘রূপার চরে আমার একটা বাগান বাড়িও আছে, সেখানে নানা এ্যমুজমেন্টের ব্যবস্থা আছে, আপনাকে নিয়ে যাব একবার।ন্ধভালই তো আছেন। আয়-রোজগারের চিন্তা নেই। সবকিছু আপসে আসে। আসলে আপনার মত লোকরাই সংগঠন করতে পারে।আমার কথার ভিতরে হয়ত শ্লেষ ছিল। তিনি বললেন, ‘আমি ভাইয়ের ক্ষমতা বলে কোন কিছু জোর করে করিনি। এলাকায় আমার কোন বদনাম নেই, আমি এম.পির ভাই হিসাবে এক ধরনের অনার পাই।আমি তখন তাকে একটি গল্প বলি, গল্প ঠিক নয়, এটা সত্যিকারের কাহিনী, আমাদের গ্রামের ঘটনা। আমি বাবার মুখে শুনেছি।

 

মাওলানা নূরুল্লাহ পড়াশোনা করতেন ভারতে। কেউ কেউ বলত, উনি ভারতের বিখ্যাত দেওবন্দ মাদ্রাসার ছাত্র ছিলেন। অবশ্য মাওলানার মুখ থেকে তার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নাম কখনো শোনা যায়নি। মাওলানা নূরুল্লাহর বাবাও ছিলেন মাওলানা। তার নাম ইকরামুল্লাহ। তিনি আমাদের হাটখোলা মসজিদের ইমাম ছিলেন। মাওলানার ছোট ভাই সাইফুল্লাহ্‌ মাদ্রাসার লাইনে যায়নি, সে পড়াশোনা করেছে স্কুলে। কলেজ পর্যন্ত তার পড়া হয়নি। মাদ্রাসায় পড়াশোনা না করার জন্য বাবা তার উপর নাখোশ থাকলেও মায়ের গয়না বিক্রি করে, ধারকর্য করে, হাটখোলায় সে একটি বিস্কুটের কারখানা দেয় এবং সে কারখানা দিনে দিনে রমরমা হতে থাকে। তখন ছেলের উপর বাবার রাগ পড়ে যায় এবং তার জন্য মাওলানা ইকরামুল্লাহ্‌ মানপয়সা মিয়াবাড়িতে বিয়ের সম্বন্ধ পাকা করে আসেন। কিন্তু তখনও বড় ভাই মাওলানা নূরুল্লাহ্‌ বিয়ে করেননি। হাটখোলা মসজিদের মুসল্লিরা মাওলানা একরামুল্লাহ্‌কে যখন এ বিষয়ে প্রশ্ন করে তখন তিনি জবাব দেন- ওতো এখনও পড়াশোনা করতেছে, পড়াশোনা শেষ হলেই খোদার ইচ্ছায় বিয়া দিয়া দিমু।

 

মাওলানা নূরুল্লাহ্‌ ছাত্রাবস্থায় বিভিন্ন ধর্মীয় জলসায়, মাহফিলে, বাবার সঙ্গে উপস্থিত থাকতেন। যেহেতু তিনি হাটখোলা মসজিদের ইমামের ছেলে এবং ভারতে পড়াশোনা করছেন সেহেতু ধর্মীয় লাইনে জানেওয়ালা হিসেবে এলাকায় তার গুরুত্ব ছিল। সে কারণে প্রথম দিকে সবার বক্তব্য শেষে তাকে দুচার মিনিট বক্তব্য দেবার জন্য বলা হত। তখন মাওলানা নুরুল্লাহ্‌ যে ধরনের বয়ান করতেন সে ধরনের বয়ান গ্রামের লোকজন ইতিপূর্বে শুনেনি। মাওলানা নূরুল্লাহ বক্তব্য দিতেন পলিটিক্যাল লাইনে। বেহেশত, দোযখ, হাসর, মিজান, কবর, আর কবর আজাব নিয়ে অন্যসব মাওলানাদের মত তার বক্তব্য সাধারণ ছিল না। তখন সত্তরের দশক, গ্রামে গ্রামে দুর্ভিক্ষ, অভাব। তিনি দুর্ভিক্ষের কারণ ব্যাখ্যা করতেন। দুর্ভিক্ষের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের কথা বলতেন। পাশাপাশি তখন যারা রাষ্ট্র ক্ষমতায় ছিল তাদের স্বৈরাচারী মনোভাব এবং বিলাস-ব্যাসনের পুংখানুপুংখ বর্ণনা দিতেন। মাওলানার বক্তব্য শুনে মানুষ রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিকারী ব্যক্তিদের প্রতি একধরনের ক্রোধ আর হতাশা অনুভব করত। মাওলানা তগদিরের উপরনির্ভরশীলতাকে পরিহাস করতেন। তিনি বলতেন, ‘মানুষ হচ্ছে আল্লাহর সমকক্ষ, যখন মানুষ একামত দিয়ে রুকু করে এহ্‌রাম বাঁধে তখন আল্লাহ আর মানুষের মধ্যে কোন পার্থক্য থাকেনা।তিনি দিনে দিনে যুবকদের খুব প্রিয় হয়ে ওঠেন আর বৃদ্ধরা তার বয়ানে বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে।

 

কিছুদিন বাবার সঙ্গে বয়ানে অংশগ্রহণ করার পর বিভিন্ন জায়গা থেকে তার ডাক আসতে থাকে। মাওলানা নূরুল্লাহ হয়ে উঠেন সেইসব মাহফিলের মধ্যমনি, প্রধান বক্তা, তিনি আয়োজকদের কাছ থেকে মাহফিল প্রতি টাকা পযসাও নিতে লাগলেন। এভাবে কিছুদিন তিনি বয়ান করে সবাইকে চমকে দিয়ে, ধমকে দিয়ে, রাজনীতিকে উসকে দিয়ে বিশাল একটি জনপ্রিয়তা রেখে ভারতে চলে গেলেন।

 

কিন্তু এবার দীর্ঘ দুবছর পর ভারত থেকে ফিরে এলেন। তার আসার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন জায়গায় মাহফিলের জন্য তার বায়না হতে লাগল। তিনি মাহফিল প্রতি মোটা অংকের টাকা নিতে শুরু করলেন। তারপর তিনি মাহফিলে গিয়ে যে বক্তব্য দেয়া শুরু করলেন তা আরো অভিনব।

 

তিনি বলতে লাগলেন, ‘আমি গত বছর এবং তার আগের বছর আসতে পারিনি। কারণ ভারতের বিভিন্ন জায়গায় আমি বয়ান করেছি; দিল্লী, আগ্রা, হায়দারাবাদ, মাদ্রাজ, বোম্বাই, উরিষ্যা, বিহার, আসাম ............. আমার বক্তব্য শুনে শয়ে শয়ে হিন্দু মুসলমান হয়ে গেল। বলেন, সুবাহানাল্লাহ্‌, (মুসল্লিরা সবাই সমস্বরে বলে, সুবাহানাল্লাহ্‌।) তারপর আমি আমেরিকা চলে যাই বক্তব্য দিতে। আমেরিকা একটা নাফরমানের দেশ, কোনদিকে চোখ রাখা যায়না, উলঙ্গ নারী পুরুষ, জেনাকারী। আমি আল্লাহর কাছে শোকরগোজার করলাম, হে আল্লাহ্‌ নিশ্চয়ই তুমি নাফরমানদের হেদায়েত করার জন্য আমাকে এখানে এনেছো। আমাকে শক্তি দাও, আমি গোটা আমেরিকাকে যেন মুসলমান রাষ্ট্র বানাতে পারি। আমি একরাজ্য থেকে ছুটে গেলাম অন্য রাজ্যে। ওহাইও, ওকলাহামা, মেক্সিকো, আরিজোনা নাভাদা, লাসভেগাস.............. শয়ে শয়ে সাদা চামড়া আল্লাহ হু আকবর ধ্বনি দিয়ে মুসলমান হয়ে গেল- বলেন সুবাহানাল্লাহ্‌।” (মুসল্লিরা সবাই সমস্বরে বলে সুবাহানাল্লাহ্‌।) তারপর তিনি বলেন, ‘সারা আমেরিকা জুড়ে যখন তোলপাড় শুরু হয়ে যায় তখন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নিক্সন আমাকে হোয়াইট হাউজে দাওয়াত করে এবং তিনশত সিনেটর নিয়ে দরবার হলে আমাকে লাল গালিচা সংবর্ধনা দেয় এবং প্রেসিডেন্ট আমাকে ম্যান অব দি মিরাকল অর্থাৎ সর্বশ্রেষ্ঠ আধ্যাত্মিক মানুষ ঘোষণা করে বলেন, আমি আপনার বন্ধু হতে চাই। আমেরিকান জাতিকে আপনি নৈতিক স্খলনের হাত থেকে রক্ষা করুন।

 

কিন্তু নিক্সন একজন খৃষ্টান। একজন খৃষ্টান মুসলমানের বন্ধু হতে পারেনা। তবু আমি তার হাতে হাত মিলিয়ে তার প্রস্তাব কবুল করে নিয়েছি কারণ আমি আমার গ্রামের, দেশের লোকদের ভালবাসি, আপনাদের স্বার্থেই তার বন্ধুত্ব কবুল করেছি।

 

আমি নিক্সনকে বলেছি, ‘আপনার পররাষ্ট্র মন্ত্রী হেনরী কিসিঞ্জার আমার দেশকে বলেছে, তলাবিহীন ঝুড়ি, বটমলেস বাসকেট, আমার দেশের অবস্থা আপনার অজানা নয়। আপনি যদি সত্যিকারে আমার বন্ধু হতে চান, তাহলে আমার গ্রামের ভূখা নাঙ্গা অসহায় মানুষগুলোর পাশে এসে দাড়ান। তারা যাতে দুবেলা দুমুঠো খেতে পারে তার সু-ব্যবস্থা করে দিন।নিক্সন আমার পিঠে হাত রেখে বললেন, ‘আপনি আপনার এলাকায় চলে যান, গিয়ে যুবক আর কর্মঠদের বলেন, তাদের আমি কাজ দেবো। আপনি শুধু ওদের প্লেন ভাড়া করে নিয়ে আসুন। আমার দেশে কাজের আর খাবার অভাব নেই। আপনি যত লোক আনতে পারবেন আমি তত লোককেই কাজ দিতে পারব। কারো কোন পাসপোর্ট ভিসা লাগবেনা।

 

মাওলানা নূরুল্লার এই বক্তব্যের পর মানুষের মধ্যে যেন বিদুøৎ খেলে গেল। মাহফিল শেষ না হতেই আমেরিকা যাবার জন্য মানুষ লাইন দিতে শুরু করল। প্লেন ভাড়া বাবদ মাওলানা নূরুল্লাহ মানুষ প্রতি দুই হাজার টাকা ধার্য করে বললেন, ‘আগামী শুক্রবার ইনশাল্লাহ্‌ কালিজিরা নদীতে সি প্লেন নামবে, আমি সেই প্লেনে করে আপনাদের সরাসরি আমেরিকা নিয়ে যাব।

 

বিভিন্ন গ্রাম থেকে দলে দলে লোক আসতে লাগল। সুজাবাদ, রায়াপুর, ডুবিল, জাঙ্গাল, মানপাশা, শ্রীরামকাঠি, ডহরপাড়া, পোনাবালিয়া, হরিণাফুলিয়া, কামদেবপুর, শ্যাওতা, কাউয়ার চর, বাদুর তলা, আমরাঝুড়ি, আইরন নান্দিকাঠি, কাঠালিয়া, ছাগলকান্দা, গালুয়া, রাজাপুর শত শত গ্রাম থেকে হাজার হাজার মানুষ ছুটে আসছে আমেরিকা যাবার জন্য। তারা মাওলানা নূরুল্লাহর কাছে সরাসরি টাকা জমা দিয়েছে, নূরুল্লাহর দুই তালবেআলীর কাছে টাকা দিয়েছে, মানুষ তার ছোট ভাই সাইফুল্লাহ্‌র কাছে টাকা জমা দিতে গেছে কিন্তু সাইফুল্লাহ্‌ টাকা রাখেনি, তার বাবার কাছে গেছে, তিনিও রাখেননি। তার ভাই আর বাবা ছিলেন এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ নির্লিপ্ত।

 

আমেরিকা যাওয়াকে কেন্দ্র করে আমীরাবাদের হাটখোলার মাঠে মেলা বসে গেল। মাখন রুটি আর ঘিয়ে ভাজা পরটার দোকান বসল। সফরি কলা বিক্রি হল দেদারছে, মানুষ মনকে মন দুধ খেয়ে ফেলল। কোন কোন দোকানী শহরের ব্যায়ামাগার থেকে বারবেল, ডামবেল, লিফট ওয়েটিং নিয়ে এল ভাড়া করে, কেউ নিয়ে এল বালির বস্তা। সব মানুষ হাটখোলার মাঠের দোকানগুলোতে খায়-দায় আর ব্যায়াম করে। তারা শুনেছে প্লেনে উঠার সময় তাদের শক্তি পরীক্ষা করা হবে। মাওলানা সবার টাকা নিয়ে প্লেন ভাড়া করতে রাজধানীতে গেছেন। মাওলানা আর ফিরে আসেননি। কিন্তু অতগুলো লোক শত শত গ্রামের হাজার হাজার লোক কেউ নূরুল্লাহ্‌র ছোট ভাই সাইফুল্লাহ্‌ কিম্বা তার বাবা মাওলানা একরামুল্লাহ্‌কে কিছু বলেনি।

 

গল্পটি শেষ করে জামাল ভাইকে বললাম, আপনি কি মাওলানার ছোট ভাই সাইফুল্লাহ্‌র মত একজন ভাই?

 

জামাল ভাই এই প্রশ্নে হতবাক হয়ে পড়েন এবং না, হ্যাঁ করতে করতে আমার প্রশ্ন এড়িয়ে গিয়ে বলেন, আপনার গল্পটি খুব সুন্দর তারপর স্বগতোক্তির মত করে বলেন, আসলে পুঁজির ইতিহাস এবং পৃথিবী সৃষ্টি দুটোই, কিন্তু একই রকম বিশৃঙ্খলাপূর্ণ এবং রহস্যময়।

 

[ গল্পটি লেখকের স্বপ্ন ভালোবাসা ও অন্যান্য পরমানুনামক গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছে। প্রকাশকঃ মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন, কথাপ্রকাশ, ১ আজিজ সুপার মার্কেট (তৃতীয় তলা), শাহবাগ, ঢাকা-১০০০। বঙ্গরাষ্ট্র ]

 

অনলাইনঃ ২১ সেপ্টেম্বর, ২০০৮

সাম্প্রতিক পোষ্টসমূহ