লিখেছেনঃ একদল মুক্তিযোদ্ধার সম্মিলিত প্রয়াস, আপডেটঃ April 5, 2015, 12:00 AM, Hits: 3301
(নিবন্ধটি ‘গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র আন্দোলন’ কর্তৃক প্রকাশিত সংকলন ‘মুক্তিযুদ্ধে জনগণের আকাঙক্ষা ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র’ থেকে নেওয়া।)
ভূমিকা
জন্মের পর সবচেয়ে সংকটকাল অতিক্রম করছে বাংলাদেশ বর্তমান সময়ে। রাজনৈতিক ও সামাজিক সংকট এমন নাজুক অবস্থায় উপনীত হয়েছে যা ইতোপূর্বে দেখা যায়নি। বিদ্যমান দারিদ্র্য ও দুর্বৃত্তায়নের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অগণতান্ত্রিক উগ্র সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থানের নগ্ন পদচারণা। স্বৈরতন্ত্র জেঁকে বসেছে শক্ত ভাবে। এর কোনোটিই আকস্মিক নয়, বরং পরস্পর সম্পর্কিত হয়ে ও দীর্ঘ সময়ে লালিত হয়ে বর্তমান পর্যায়ে এসে উপনীত হয়েছে। বিভিন্নভাবে প্রতীয়মান হয় যে, একাত্তরের মতো আর একটি ঐতিহাসিক পরিবর্তনের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছি আমরা। এই সংকট আমাদের সকল ঐতিহাসিক অর্জনকে নস্যাৎ করে দিতে পারে, আবার এটাও সত্য যে সংকট থেকে উত্তরণের মাধ্যমে জাতি অনেকদূর অগ্রসর হতে পারে। অর্থাৎ দেশ এগিয়ে যেতে পারে আবার দুভার্গ্যজনক মোড় নিতে পারে। এটা নির্ভর করে সময়ের অগ্রসর সৈনিকেরা কিভাবে সাড়া দেবেন তার উপর; কিভাবে তারা নতুন প্রজন্ম ও জনতাকে সঙ্গে নিয়ে রাজনৈতিক শক্তির সমন্বয় ঘটাবেন, কতটা সাহসের সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে পারবেন? যেমনটি হয়েছিল একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে। চার দশকের অধিক সময় অতিবাহিত হবার পর আজকের এই ক্রান্তিকালে আমাদের করণীয় কী, সেটা নির্ধারণের জন্য কিছুটা বিশদ আলোচনা দরকার।
পাকিস্তান রাষ্ট্র ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ
অর্থনৈতিক শোষণ, রাজনৈতিক নিপীড়ন ও ধর্মের নামে সাংস্কৃতিক জবরদস্তির এক দীর্ঘ প্রক্রিয়া শুরু হয় পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মের পর থেকে। এর বিরুদ্ধে ভুক্তভোগী মানুষের মধ্যে নানান প্রতিবাদী কর্মকান্ড শুরু হয়, যার এক পর্যায়ে স্বায়ত্তশাসনের দাবি তীব্র হয়ে ওঠে। সেটাকে দমন করার জন্যে পাকিস্তান রাষ্ট্রের পূর্বাংশের সংখ্যাগরিষ্ঠ ও নৃতাত্ত্বিকভাবে ভিন্ন একটি নাগরিক-জনগোষ্ঠীর ওপর নির্যাতন-নিপীড়ন চালাতে থাকে এবং ঢালাওভাবে আক্রমণ করে বসে ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ মধ্যরাতে। অপ্রস্তুত গণমানুষের ওপর অকস্মাৎ চাপিয়ে দেয়া আগ্রাসী যুদ্ধের বিরুদ্ধে ক্রমে গড়ে ওঠে প্রতিরোধ। সংঘটিত হয় নজিরবিহীন নৃশংসতা ও ব্যাপক মাত্রায় প্রাণহানি। জাতিসংঘের হিসাব মতে, গণহত্যার ইতিহাসে স্বল্পসময়ে সর্বোচ্চ সংখ্যক মানুষ হত্যার মাপকাঠিতে বাংলাদেশের স্থান প্রথম। এটা কোনো সৈন্য বা দলবিশেষের উন্মত্ততার ব্যতিক্রমী ঘটনা নয়। বরং হত্যাযজ্ঞ বিশেষজ্ঞরা নিশ্চিত হয়েছেন, একটি কেন্দ্রীয় পরিকল্পনার আওতায় এই বর্বরতা পরিচালনা করেছে পাঁচজন পাকিস্তানি জেনারেল। এটা আরো দুর্ভাগ্যজনক হয়ে ওঠে এদেশের কিছু কুলাঙ্গার সন্তানদের কর্মকান্ডে, যারা ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগী- রাজাকার, আলবদর, আল শামস্ ইত্যাদি নামে। এই দেশের অর্ধেক জনসাধারণ এখনো এর প্রত্যক্ষ ক্ষয়-ক্ষতি ও নারকীয় স্মৃতি বহন করে চলেছে। এভাবেই একটি রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে এখন থেকে চার দশক আগে বাংলাদেশের অভ্যুদয় হয়েছিল।
এমন যুদ্ধের পর স্বাভাবিকভাবেই জনগণের প্রত্যাশা ছিল একটি আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র স্থাপিত হবে, যা মানুষের মৌলিক প্রয়োজন মেটানোর ব্যবস্থা করবে, বৈষম্য কমাবে এবং মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করবে। সে অঙ্গীকার দেয়া হয়েছিল যুদ্ধপূর্বকালে দলীয় ইশতেহারে, পোস্টারে, রাজনৈতিক দফায় এবং জনসভার বক্তৃতায় বিভিন্নভাবে, বারবার। সে অঙ্গীকার দেয়া হয়েছিল স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে। অতঃপর যুদ্ধোত্তর বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় ঘোষণায়, রাষ্ট্রের সংবিধানে সুস্পষ্টভাবে তা লিখিতও হয়েছিল, যদিও এর মধ্যে বড় ধরনের ফাঁকি ছিল। পরবর্তীকালে সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে সেইসব অধিকার আরও অবনমিত ও অস্পষ্ট করা হয়েছে। বারবার কাটাছেঁড়ার ও অদল-বদলের পরও ‘শোষণ মুক্তি’, ‘জনগণের মালিকানা’, ‘কৃষি বিপ্লব’, ‘কর্মের অধিকার’, ‘গণমুখী শিক্ষা’, ‘সুযোগের সমতা’ ‘আইনের চোখে সমতা’ ইত্যাদি মূলনীতি ও অধিকার নির্দেশক শব্দ, বাক্য ও বাক্যাংশ সবসময়ই সংবিধানে বলবৎ ছিল, এখনও আছে। কিন্তু আমরা জানি, প্রায়োগিক ক্ষেত্রে জনগণের বাস্তব জীবনের জন্যে তা হাস্যকর। আমরা মনে করি, এটা শুধুমাত্র প্রয়োগের সমস্যা নয়, বরং নতুন রাষ্ট্রে প্রণীত সংবিধানের ত্রুটিও নির্দেশ করে। কারণ এর বিভিন্ন ধারা ও উপধারায় বর্ণিত জনতার জন্য কল্যাণ কাজে রাষ্ট্রকে বাধ্য করার কোনোই ব্যবস্থা রাখা হয়নি। ফলে মুক্তিযুদ্ধের কাঙিক্ষত রাষ্ট্র এখানে গড়ে উঠেনি।
যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশ : একই দুর্বৃত্তায়নের ধারাবাহিকতা
সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকার শাহবাগে মুক্তিযুদ্ধের ধারাবাহিকতা রক্ষায় গণ-উত্থানের সূচনা করেছে যে তরুণেরা, একাত্তরের সময় আমাদের গড়-বয়স ছিল তাদেরই সমান। সেই বয়সেই আমরা আমাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করেছিলাম। সেদিনও ধর্মের নামে, শোষণের নামে তারুণ্যকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছিল। জনগণকে বিভ্রান্ত করা হয়েছিল, একাজে এখানকার স্থানীয় দালালদের ব্যবহার করা হয়েছিল। তারা আমাদের বাড়তি রক্ত ঝরাতে সাহায্য করেছিল। কিন্তু আমরা পরাক্রমশালী আগ্রাসী পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের সহযোগীদের পরাজিত করতে সক্ষম হয়েছিলাম। সাহস ও আত্মবলিদানের মানদন্ডে যে কয়টি স্বাধীনতা যুদ্ধ পৃথিবীর ইতিহাসে দাগ রেখে গেছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ তার একটি।
তারপর সবাই জানেন, কিভাবে আশাভঙ্গের রাষ্ট্রীয় প্রক্রিয়া শুরু হলো। যুদ্ধে যারা অপরাধ করল, রাজনৈতিক বিবেচনাবোধের অভাবের কারণে তাদেরকে প্রথমে ক্ষমা, পরে পরিপুষ্ট করা হলো। আর আমরা যারা অগ্রণী অবদান রাখলাম, কোনোরকম পরিকল্পনা ছাড়াই আমাদের নিরস্ত্র করে ক্ষমতার বাইরে রাখা হলো। আমাদেরকে সূর্য-সন্তান, মহান সন্তান বলে, অভাবের দেশে রাজনীতির প্রলোভনে নষ্ট করে, তেজস্বী যারা তাদের হত্যা করে, ডাকাত কিংবা ভিক্ষুক বানিয়ে, হুইল চেয়ারে বসিয়ে নানান নির্মম প্রক্রিয়ায় নিষ্ক্রিয় করা হলো। ফলে বিশ্বস্ত প্রহরীর অভাবে রাষ্ট্র ক্রমে বেহাত হলো জনতার। বিজয়ের পরও জনগণকে পরাজিত করল আমাদের নতুন শাসকেরা। সেই সময়ে একটি জাতীয় সরকারের প্রস্তাব ছিল যা অগ্রাহ্য করা হয়। অন্যদিকে, তারচেয়েও দুর্ভাগ্যজনক হলো, যেসব সামরিক বেসামরিক আমলা, বিচারক, থানা-পুলিশ ও রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা যারা মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সরকারের পক্ষে কাজ করেছিল, মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল, স্বাধীনতা লাভের পর নতুন রাষ্ট্রে তাদের অপসারণের ব্যবস্থা করা হয়নি, তেমন কোনো পরিবর্তন আনার চেষ্টা করা হয়নি। ফলে এরা নতুন রাষ্ট্রযন্ত্রের মাথায় চেপে বসে এর বিরোধিতা করার সুযোগ পেলো যা আজ পর্যন্ত অব্যাহত আছে। যার ফলাফল আমরা আজ হাতে-নাতে পাচ্ছি স্বৈরশাসন, অপশাসন ও ধর্মান্ধ শক্তির বাড়াবাড়ির মাধ্যমে।
যদি স্বাধীনতার উষালগ্ন থেকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ও আদর্শে রাষ্ট্র পরিচালিত হতো; যদি পাকিস্তানি উপনিবেশিক ও ধর্মীয় গোড়ামীযুক্ত সামন্তবাদী অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে সংগ্রাম চলমান থাকতো; যদি লুটপাঁট ও দুর্নীতির কারণে জনগণের সঙ্গে দূরত্ব তৈরী না হতো- তাহলে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক শক্তি ’৭৫-এর বিয়োগান্তক সামরিক অভ্যুত্থান ঘটাতে সাহস পেত না। বলা হয়, যদি বঙ্গবন্ধু ব্যক্তিগতভাবে সরকার পরিচালনার দায়িত্ব না নিয়ে ‘মহাত্মা’-র অবস্থান নিয়ে থাকতেন, যদি তাজউদ্দিনের মতো দূরদৃষ্টিকে গুরুত্ব দেয়া হতো, তার মতো নেতার পরিকল্পনা অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ‘জাতীয় মিলিশিয়া’ এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সবাইকে নিয়ে ‘জাতীয় সরকার’গঠন করা যেতো, যদি ইউটোপীয় ‘সমাজতন্ত্রের’বাগাড়ম্বর বাদ দিয়ে জনগণের মৌলিক প্রয়োজনকে সম্মান জানানো হতো এবং তদনুযায়ী একটি উপযোগী সংবিধান প্রণীত হতো- এই দেশের অবস্থা এতটা দুর্ভাগ্যজনক হতো না।
বর্তমান বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান যে সম্মানজনক নয় আমরা ভালো করে জানি, তবু প্রশ্নটি আবার করা দরকার বাংলাদেশ কি পৃথিবীর অন্যতম একটি দরিদ্র দেশ? এখানকার মানুষ কি দরিদ্র? আমাদের জনপ্রতিনিধি, এমপি, মন্ত্রীগণ কি দরিদ্র? একাত্তর সনে এরা কতটা ধনবান ছিলেন? তাদের পিতা-পিতামহেরা কতটা অর্থবিত্তের মালিক ছিলেন? আমরা তো জানি, একাত্তরে ৩ কি ৪ জন কোটিপতি ছিল পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলে। বর্তমানের বাংলাদেশে কোটিপতির সংখ্যা নাকি ৫০ হাজারেরও বেশি। এই অর্থবিত্তের উৎস কী? কোন প্রক্রিয়ায় অর্জিত হয়েছে? পাকিস্তানের বহুল কথিত বাইশ পরিবার চুরি, প্রতারণা ও লুণ্ঠনের মাধ্যমে মানুষের বুকের ওপর চেপে বসে ছিল পঁচিশ বছর, তারও একটা রীতিনীতি ছিল, এরা উৎপাদন-প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত ছিল। কিন্তু এদের পতনের পর অভূতপূর্ব শূন্যস্থান পেয়ে এদেশীয় নব্যশাসকের ভাগ্যবান শ্রেণিটি যে প্রক্রিয়ায় জনসাধারণের বুকের ওপর চেপে বসল, এই দুর্বৃত্তায়নের কোনো ব্যাকরণ ছিল না। এদের দুর্নীতি, লুটপাট ও সন্ত্রাস সরাসরি ফৌজদারি অপরাধে পড়ে। জনসাধারণ ও রাষ্ট্রের সম্পত্তি আত্মসাতে নিয়োজিত, দেশপ্রেম-বর্জিত এই শাসক-দুর্বৃত্তের কবল থেকে এখনো রেহাই পায়নি বাংলাদেশ। স্বাধীনতার পর কী রকম নষ্ট পরিবেশে এদের জন্ম হয়েছিল সেই ইতিহাস অনেকেরই জানা থাকার কথা, তবু পুনরুল্লেখ করা দরকার।
একাত্তরের ষোলোই ডিসেম্বরের বিজয়ের পর প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা ও জনগণ মানবেতর জীবন ও দারিদ্র্যের মধ্যে পরাজিত হয়ে হারিয়ে যেতে থাকল। অন্যদিকে, একদল লুটপাটকারী প্রকাশ্যে নেমে আসলো বাংলাদেশের জনপদে। এখানে শাসক কিংবা উচ্চবিত্ত শ্রেণি পাকিস্তান আমলে ছিল না। পাকিস্তানের রাজনৈতিক এলিট, প্রশাসনের আমলা, শিল্প ও ব্যবসার নিয়ন্ত্রক শ্রেণিটির পতনের পর তাদের সুযোগ, সম্পদ ও ক্ষমতা বিনা পরিশ্রমে দখল ও আয়ত্ত করে গড়ে ওঠে এই নব্যশাসক শ্রেণি। দালাল শায়েস্তা করার অজুহাতে এরা অবাঙালির ব্যক্তিগত সম্পত্তি- বাড়ি, গাড়ি, ভূমি, দোকানপাট, আসবাবপত্র, কলকারখানা দখল করে নিজেদের ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে পরিণত করে। উপরোক্ত অবৈধ অর্জনের সঙ্গে যোগ হয় যুদ্ধবিধ্বস্ত দরিদ্র জনগণের নাম ভাঙিয়ে আনা বিপুল বৈদেশিক সাহায্যের তছরূপ। তৎসঙ্গে চোরাকারবারি, বেআইনি ব্যবসা, সীমান্তের চোরাচালান, মজুদদারি থেকে অর্জিত সম্পদ।
এমন পরিবেশেই রাষ্ট্রীয়ভাবে ঘোষিত সমাজতন্ত্রের বাস্তবায়নের কাজ শুরু হয়। দুনিয়ার সর্বত্র সমাজতন্ত্র কায়েমের জন্যে প্রশিক্ষিত ও উন্নত চরিত্রের ক্যাডারদের ওপর নির্ভর করা হয়। কিন্তু এখানে মূলত উৎপাদনের সঙ্গে সম্পর্কহীন লুটেরাদের ওপর ভিত্তি করে শুরু হয় শোষণমুক্তির মহৎ প্রকল্প। একদিকে, সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের পন্ডিতেরা সুন্দর বাক্য গঠন করে পলিসি নির্মাণ করতে থাকে। অন্যদিকে, কলকারখানা জাতীয়করণ করে লুম্পেনদের ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে দেয়া হয়। তাদের লাগাতার লুটতরাজে একটার পর একটা শিল্পকারখানা বন্ধ হতে থাকে। একইভাবে, সংবিধানে ঘোষিত কৃষিবিপ্লব বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়। যে কৃষকদের বাদ দিয়ে সমাজতন্ত্র হয় না বলে সরকারিভাবে বলা হয়েছে, সেই কৃষকদের ভূমি-সংস্কারে সরকারের ন্যূনতম উদ্যোগ (মালিকানার সিলিং) বাস্তবায়নে জাতীয় সংসদে আইন প্রণয়নে বিরোধিতা করেছে সেই দলেরই সংসদ সদস্যরা। এইভাবে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির ধারা বিকশিত না হয়ে গড়ে ওঠে দুর্বৃত্তায়িত অর্থনীতির কাঠামো এবং তা ভেঙে পড়ে অভাবী মানুষের মাথার উপর।
অধিকন্তু, বাইরের চাপের মুখে সমাজতন্ত্রের অর্থনৈতিক (জাতীয়করণ) পলিসিতে ছাড় দেয়া হলো। আন্তর্জাতিক কাবুলিওয়ালাদের ঠিকমতো বসার জন্যে জায়গা তৈরি করা হলো। গৌরবদীপ্ত এই রাষ্ট্রের অন্দরমহলে ক্রমে আইএমএফ-বিশ্বব্যাংক প্রবেশ করে নির্ভরশীল করে ফেললো। প্রায় একই সঙ্গে, গরিব বাঁচানোর নামে গরিবি জিইয়ে রাখার জন্যে নানারকম বেসরকারি সাহায্য সংস্থার কার্যক্রম শেকড় গাড়তে শুরু করল- যার বর্তমান সংখ্যা দাঁড়িয়েছে এখন ২০ হাজার। একটি লুম্পেনশ্রেণি শেষ পর্যন্ত লুম্পেন অর্থনীতির কাছে আত্মসমর্পণ করল। যা শুরু হয়েছিল এখন পর্যন্ত তারই নষ্ট ধারাবাহিকতা চলছে। এক্ষেত্রে ‘গণতান্ত্রিক’,‘স্বৈরাচারী’, ‘সামরিক’ কিংবা‘সেনাসমর্থিত বেসামরিক’ সরকারের ভূমিকায় কোনো পার্থক্য লক্ষ করা যায় না। এখন দেশীয় ও গ্লোবাল লুটপাট ও অরাজকতার একখানা উর্বর প্রকল্পের নাম বাংলাদেশ রাষ্ট্র।
লুটপাট ও দুর্নীতি কমবেশি পৃথিবীর সর্বত্রই থাকে। কিন্তু এ দেশে সেটা সহনীয়তার সীমা অতিক্রম করে গেছে। রাজনৈতিক ক্ষমতাকে স্রেফ টাকা বানানোর নির্লজ্জ উপায় হিসেবে এদেশে এই মাত্রায় আগে কখনো দেখা যায়নি। এর কোনো পূর্বদৃষ্টান্ত নেই। এটা আজ সংক্রমিত হয়েছে জীবন ও পেশার সকল পর্যায়ে। এতে আক্রান্ত হয়েছে আজকের সমগ্র জাতি। কোনো না কোনোভাবে ক্ষমতার সংশ্লিষ্টতা তৈরি করে জনসাধারণের অপেক্ষাকৃত দুর্বল ও অসহায় অংশের বুকের উপর পা রেখে ‘বড়লোক’ হওয়ার জন্যে যেন মরিয়া হয়ে লাফাচ্ছে বাংলাদেশের নষ্টেরা। হক পথে বেঁচে থাকা সম্ভব না এই মূল্যবোধের নিকট ক্রমেই আত্মসমর্পণ করছেন মানুষ। বুদ্ধিজীবী, কবি, শিল্পী এই যুগে ঈশ্বর যাদেরকে স্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে সত্য বলার জন্যে মনোনীত করেছেন তারাও ঝুঁকি নিতে সত্যোচ্চারণ করতে চায় না। তারপরেও সত্য ঢাকা থাকল না। চতুর্মুখী দুর্ভাগ্যের মধ্যেও ইতিহাসের তরফ থেকে একটি ব্যতিক্রমী আশীর্বাদ হলো আজকের তথ্যপ্রযুক্তি। ইতিহাসে এই প্রথমবারের মতো প্রযুক্তি ব্যাপকভাবে ব্যক্তি-মানুষের নাগালে এসেছে। ফলে, এ যুগে কোনো দুর্বৃত্তের পক্ষে সত্য গোপন করা আগের চেয়ে অনেক বেশি অসম্ভব হয়ে গেছে। সামান্য সময় ব্যয় করে এখন যে কেউ দেখে নিতে পারেন গ্লোবাল করাপশন রিপোর্ট, ওয়ার্ল্ড ব্যাংক রিপোর্ট, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল, ওয়ার্ল্ড এন্টিকরাপশন রিসার্স সেন্টারসহ অসংখ্য তথ্যপ্রবাহের পৃথিবীর চিত্র এবং পরখ করতে পারেন বাংলাদেশ কী রকম অসম্মানজনক অবস্থায় আছে। বিগত দশ-পনেরো বছর ধরে একাধারে উপরোক্ত নানান আন্তর্জাতিক সংস্থার দ্বারা সংগৃহীত পরিসংখ্যান এটা নির্দেশ করছে যে, বাংলাদেশে অর্থনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন সর্বোচ্চ পর্যায়ে। আরো জানা গেল, এখানে অবৈধ অর্থ মূলত বিনিয়োগ হয় রাজনীতিতে। সুনির্দিষ্ট গবেষণায় দেখা গেল, এর বড় অংশ ব্যয় হয় নির্বাচনে জেতার জন্যে।
বাংলাদেশে নির্বাচন : গণতন্ত্র চর্চার অন্যতম বাধা
বাংলাদেশে কখনও নির্বাচনের সঙ্গে গণতন্ত্র চর্চার সম্পর্ক ছিল না। নির্বাচন প্রক্রিয়ার অসংগতির কারণে এখানে গণতন্ত্র চর্চার পরিবেশ গড়ে উঠেনি। বাংলাদেশে যারা দীর্ঘদিন আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন, সংগ্রামে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন, স্বৈরাচারের পতন ঘটিয়েছেন, এমন ব্যক্তিরা নির্বাচিত হয়ে সংসদে আসতে পারেননি, ভবিষ্যতেও পারবেন না। বস্তুত কোনো সৎ, যোগ্য ও সুস্থ লোকের পক্ষে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় উত্তীর্ণ হওয়া অসম্ভব করে রাখা হয়েছে। কখনো সেনাবাহিনীর সহায়তায়, কখনো দলীয় কিংবা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন নামক যে প্রক্রিয়াটি কয়েক বছর পর পর ফিরে আসে তা এক মস্ত বড় জাতীয় প্রতারণা বিশেষ। কোনো রাজনৈতিক দলই নির্বাচনকে বৈধ বলে মনে করে না। এটা তারা বলে নির্বাচনে হেরে যাবার পরপরই। পরাজিতরা বিজয়ীকে বৈধতা দেয় না, সংসদে যায় না, অংশগ্রহণ করে না। অথচ এই প্রক্রিয়ায় পালাক্রমে লুটপাট করা সুবিধাজনক বলে তারা প্রক্রিয়াটি নিয়ে প্রশ্নও তোলেন না। বরং বিপুল অর্থ নিয়ে মাঠে নামেন। ভোটাররাও এটাকে রাজনৈতিক দায়িত্ব পালনের চেয়ে বরং কয়েক দিনের উৎসব হিসেবে মনে করে, যাতে তাদেরও কিছু প্রাপ্তি ঘটতে পারে। যেভাবেই টাকা আসুক না কেন, উৎস সাদা-কালো যাই হোক না কেন, যে অকাতরে ব্যয় করতে পারে জনতা তাকে বেছে নেয়। কয়েকজন অধঃপতিতের মধ্যে থেকে তারা একজনকে বেছে নেয়। অনগ্রসর দরিদ্র মানুষ বুঝেও বোঝে না, কারণ তারা এই বৃত্ত থেকে বের হয়ে আসার উপায় দেখতে পায় না।
প্রায় সকল সম্মানিত সংসদ সদস্য সত্য গোপন করে নির্বাচনী ব্যয় সম্পর্কে শপথপূর্বক মিথ্যা বিবৃতি দিয়ে থাকেন। অর্থাৎ একটি মহৎ পেশার শুরুটা হয় মিথ্যা দিয়ে। এবং জেতার পর তাদের প্রথম কাজ হলো ব্যয়ের টাকাটা উঠিয়ে আনা। সেটা বহুগুণে নিশ্চিতভাবে উঠে আসে বলেই নির্বাচনে ব্যয়-বিনিয়োগ বাড়ছে। লক্ষ্য করুন, কিভাবে দেশের পার্লামেন্টে ব্যবসায়ীর সংখ্যা বাড়ছে। কারণ নেতৃত্বের সম্মান ও দুর্বৃত্তের প্রাপ্তি এ দুটো এমন আর কোথাও একসঙ্গে পাওয়া যায় না। এইসব নিয়ে কিছু গবেষণা করেছেন অধ্যাপক ড. আবুল বারাকাত। তিনি গবেষণায় দেখিয়েছেন, কিভাবে নির্বাচনে শতকরা ৭৫ ভাগ আসনে বিজয়ী হয়ে আসতে প্রতিটি আসনে ১ কোটি থেকে ২৮ কোটি টাকা পর্যন্ত ব্যয় করা হয়েছে এবং গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, চোরাচালানের চেয়েও নির্বাচনে বিনিয়োগ অধিকতর লাভজনক।
ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থান ও সাম্প্রতিক সংকট : আমাদের করণীয়
সাম্প্রতিক সময়ে আমরা দেখেছি, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের এক পর্যায়ে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী শক্তির পক্ষ থেকে বাধা আসতে থাকে- হুমকি দিয়ে গৃহযুদ্ধের কথাও বলা হয়। বিশেষ করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জামায়াতে ইসলামীর সহকারি সেক্রেটারি জেনারেল কাদের মোল্লার মামলার রায় ঘোষণার প্রাক্কালে। এর প্রতিক্রিয়ায় ৫ই ফেরুয়ারি ২০১৩ ঢাকার শাহবাগে তরুণ প্রজন্মের নেতৃত্বে কাদের মোল্লাসহ সকল যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসির দাবিতে এক ঐতিহাসিক গণউত্থানের সুচনা হয়। দীর্ঘদিনে বিচার না-পাওয়া ক্ষুব্ধ মানুষের আবেগ তাতে প্রতিফলিত হয়। ফলে অগণিত মানুষ তাতে অংশগ্রহণ করে। আমরা লক্ষ করেছি- মুক্তিযুদ্ধের চেতনায়, অম্প্রদায়িক বাংলাদেশের পক্ষে মানুষের এই উত্থান একাত্তরের ধারাবাহিকতা। এই গণজাগরণ একটি আলোড়ন সৃষ্টি করেছে যা দেশের সীমানা ছাড়িয়ে গেছে। ফলে ধর্ম ব্যবসায়ী, উগ্র সাম্প্রদায়িক শক্তি নিজেদের আক্রান্তবোধ করতে থাকে এবং বেপরোয়া হয়ে ওঠে। আমরা লক্ষ করেছি, কিভাবে মুক্তচিন্তার মানুষের উপর হামলা শুরু হয়। সংখ্যালঘুর বাড়ি-ঘর ও ধর্মালয়ে অগ্নিসংযোগ, জননিরাপত্তার উপর আঘাত, জনপরিবহনে ঢালাও অগ্নিসংযোগ, ইউনিফর্ম-পরা পুলিশের উপর আক্রমণ ও হত্যা, থানা আক্রমণ, রেললাইন থেকে ট্রেন ফেলে দেয়াসহ ভংয়কর কর্মকান্ড শুরু হয়। জননিরাপত্তা ও রাষ্ট্রীয়যন্ত্রের উপর সরাসরি এরকম আঘাত আপাতত কিছুটা দমিত হলেও শেষ হয়েছে বলে কিছুতেই মনে করা যায় না। এটা প্রতীয়মান হয়েছে, আওয়ামী সরকারের পক্ষে জামাত-শিবিরের ধর্মান্ধ রাজনীতি বাতিল করা ও তাদের অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান আইনের আওতায় আনার মতো কঠোর সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব নয়। এই ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক শক্তি রাতারাতি এই পর্যায়ে আসেনি। একাত্তরে বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ধর্মান্ধতা প্রশ্রয় পেয়েছে। ‘৭২-এর সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতার যে ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে তা ত্রুটিপূর্ণ। তাতে সেক্যুলারিজম সম্পর্কে আওয়ামী লীগের অঙ্গীকারের ভিত যে দুর্বল ছিল তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ’৭২ সালে জামাতের প্রতি নমনীয়তা, ’৭৩ সালে পাকিস্তানি দালালদের ব্যাপারে ক্ষমাপরায়ণতা এবং ’৭৪ সালে ওআইসি সম্মেলনে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সম্পৃক্ততা- এইসব ঘটনা সেক্যুলার আধুনিক রাষ্ট্রের গোড়ায় গলদ হিসেবে পরিলক্ষিত হয়। অতঃপর, ’৭৫-এর সামরিক অভ্যুত্থানের পরবর্তীকালে, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল ও এরশাদের জাতীয় পার্টির শাসনামলে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় মৌলবাদী শক্তির শেকড় আরো মজবুত হয় এবং ক্রমে বাংলাদেশ প্রতিক্রিয়াশীল উত্থানের উর্বর ক্ষেত্রে পরিণত হয়। ভোটের রাজনীতির কারণে, দুর্বৃত্তায়নের প্রয়োজনে আওয়ামী লীগের দোদুল্যমানতা অজানা নয়। এই দলটি দেশের সেক্যুলার ও আধুনিক মানুষের পক্ষে না ধর্মান্ধতার পক্ষে থাকবে তার নিশ্চয়তা দেয় না। অন্যদিকে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল, আধুনিক রাজনৈতিক দলের সমস্ত বৈশিষ্ট্য বিলোপ করে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে পড়েছে এবং প্রায় একই রাজনৈতিক কর্মসূচি দিয়ে যাচ্ছে। বিএনপি নামক দলটিকে পাকিস্তান আমলের মুসলিম লীগের বাংলাদেশী সংস্করণ বলা হতো, কিন্তু বর্তমানে সেটা আরো নীচে নেমে নিজস্ব অস্তিত্বের সংকটে পড়েছে। এর ফলে ’৫২, ’৫৪, ’৬৯-এর ধারাবাহিকতায় একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অগণিত মানুষের আত্মত্যাগের ফলে বাঙালি জাতির মধ্যে যে অসাম্প্রদায়িক ও মানবিক একটি রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছিল তা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে।
স্বাধীনতার পর লুণ্ঠন-দুর্নীতি-প্রতারণার মাধ্যমে যে বিত্তবান শ্রেণিটি এখানে গড়ে উঠেছে- অগণিত অভাবী মানুষের বুকের উপর পা রেখে, তাদের অগণতান্ত্রিক ও দুর্বৃত্তায়িত চরিত্রের জন্যই বর্তমানে তাদের বিরুদ্ধে একটি সামাজিক অভ্যুত্থানের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়ে আছে। এখনকার বাংলাদেশ যে প্রশ্নটির মুখোমুখি হয়েছে: এই দুর্নীতিবাজ ও দুর্বৃত্ত শ্রেণিটিকে উৎখাত করবে কে? বা তাদের হাত থেকে রাষ্ট্রকে উদ্ধার করবে কে? মুক্তিযুদ্ধের ধারাবাহিকতায় গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক শক্তি, না ধর্মান্ধ পশ্চাদপদ শক্তি? আজ যদি গণতান্ত্রিক শক্তি একটি কঠোর গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে ইতিহাস-নির্ধারিত দায়িত্ব পালন করতে না পারে তাহলে ইসলামী বিপ্লবের ধ্বনি তুলে সে দায়িত্ব নিতে এগিয়ে আসবে ধর্মীয় মৌলবাদ- তার স্থূলতা ও পশ্চাৎপদতা সত্ত্বেও। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ পরিণত হতে পারে সোমালিয়া, আফগানিস্তান, রুয়ান্ডার মতো দেশে। যেহেতু সমাজ ও রাষ্ট্রে এই শর্ত বিদ্যমান আছে, এই সময়ে যদি সামরিক হস্তক্ষেপ হয় সেটাও ধর্মান্ধ পশ্চাদপদ শক্তির পক্ষে যেতে পারে; নির্বাচন হলেও তাদের উত্থান হতে পারে। এক শ্রেণির বুদ্ধিজীবী, দায়-দায়িত্বহীন সংবাদপত্র, ইলেকট্রনিক মিডিয়া ইতিমধ্যেই ইতিহাসের উল্টোপিঠে দাঁড়িয়ে সেই উগ্র সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থানের তত্ত্ব প্রচার করছেন, উস্কানি দিয়ে যাচ্ছেন। অন্য একটি গোষ্ঠী, অমঙ্গলের আশঙ্কা ব্যক্ত করে, বিদ্যমান ভারসাম্য রক্ষার জন্য দুই বিবদমান দলের বা জোটের মধ্যে সংলাপের কথা বলছেন, যাতে এরা ঐকমত্যের মাধ্যমে নির্বাচন অনুষ্ঠিত করে। অতঃপর নির্বাচনের পর, আমরা সবাই জানি, আবার শান্তিপূর্ণ পরিবেশে আরেক কিস্তি লুটপাটের প্রক্রিয়া শুরু হবে। বাংলাদেশের ৪২ বছরের রাষ্ট্রশাসন বলে যে, এখানে কখনো গণতন্ত্র ছিল না। তত্ত্বাবধায়ক সরকার, দলীয় সরকার কিংবা যাদের অধীনেই নির্বাচন হোক না কেন তা পাঁচ বছর মেয়াদী স্বৈরশাসক ও এলাকাভিত্তিক জমিদার উৎপাদন করে, যাদের মূল কর্ম গণসম্পদ লুণ্ঠন করা। এক্ষেত্রে ‘গণতান্ত্রিক’ও সামরিক স্বৈরাচারের মধ্যে কার্যক্ষেত্রে পার্থক্য খুঁজে পাওয়া যায় না। অন্যদিকে, সামরিক হস্তক্ষেপ বিদ্যমান সংকটের সমাধানকে মূলতবি করে রাখে, পিছিয়ে দেয়। বর্তমান পরিস্থিতিতে বিদেশী শক্তির প্রতিনিধিরা দেশের ভালো-মন্দ নিয়ে যেভাবে কথা বলছেন বা উপদেশ দিচ্ছেন, তা স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্য ভালো লক্ষণ বলে প্রতীয়মান হয় না।
সবকিছুই যখন নষ্টদের অধিকারে যেতে বসেছে তখন দেশের মানুষ নীরব দর্শকের ভুমিকা পালন করতে পারে না। আমরা, একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধারা সকল স্তরের দেশপ্রেমিক প্রগতিশীল মানুষ ও নতুন প্রজন্মের অগ্রসর তরুণদের নিয়ে বিদ্যমান রাজনৈতিক শুন্যতা পুরণ করা জরুরি মনে করছি। বিপর্যস্ত বাংলাদেশ একটি নতুন রাজনৈতিক শক্তির উত্থানের অপেক্ষা করছে। এই ঐতিহাসিক দায়বদ্ধতা থেকে আমরা নিন্মোক্ত কর্মসূচী গ্রহণের প্রয়াস পেয়েছিঃ
- জাতীয় ঐক্যের প্রশ্নে বিদ্যমান বিতর্ক প্রসঙ্গে (রাষ্ট্রীয় মৌলনীতি, রাষ্ট্রধর্ম, জাতীয়তা, জাতীয় নেতৃত্বের ভুমিকা, আদিবাসী জাতিসত্তা, ইত্যাদি) আমরা নিজেদের মধ্যেকার বিভ্রান্তি দূর করে ঐকমত্যে উপনীত হওয়ার প্রচেষ্টা চালাচ্ছি।
- মুক্তিযুদ্ধের আদর্শভিত্তিক একটি রাষ্ট্র ও তদুপযোগী সংবিধান প্রণয়নের ব্যপারে উদ্যোগ গ্রহণ করেছি যা ঔপনিবেশিক আইনী কাঠামোর অবসান ঘটাবে এবং জনগণতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অগ্রসর হবে।
- উপরোক্ত কর্মপরিধির আলোকে জনগণের সামনে উপস্থাপনের জন্য ‘বোধগম্য’ ভাষায় একটি পূর্ণাঙ্গ রাজনৈতিক প্রস্তাবনা প্রণয়নের প্রক্রিয়া শুরু করেছি।
প্রস্তাবনা প্রণয়ন করার পর ‘উপযুক্ত’ সময়ে একটি রাজনৈতিক জাতীয় কনভেনশনের মাধ্যমে ‘পূর্ণাঙ্গ রাজনৈতিক প্রস্তাবনাসমূহ’জাতির বিবেচনার জন্য চুড়ান্ত রূপ দেয়া হবে। আমাদের প্রস্তাবিত জাতীয় কনভেনশনের অন্যতম লক্ষ্য হবে একটি অন্তর্বর্তীকালীন জাতীয় সরকার গঠন যা এর মেয়াদ কালে একটি ‘সংবিধান সভা’গঠনের জন্য নির্বাচন অনুষ্ঠান করবে। এই অন্তর্বর্তীকালীন জাতীয় সরকার গঠন দুইভাবে হতে পারে – নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কিংবা গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে। পরিস্থিতি অনুযায়ী জনগণই সিদ্ধান্ত নেবে কোন প্রক্রিয়ায় তারা অগ্রসর হবে। জাতীয় সরকারের পরিগঠন (কম্পোজিশন) সম্পর্কে বলা আবশ্যক যে, একাত্তরের মূলধারার চেতনায় উদ্বুদ্ধ যুদ্ধাপরাধী ও সাম্প্রদায়িতকার বিরুদ্ধে আন্দোলনরত, লুণ্ঠন-দুর্নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলনরত ও স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে আন্দোলনরত গণতান্ত্রিক শক্তিসমূহের সমন্বয়ে তা গঠিত হবে।
সময়ের দাবী : অন্তর্বর্তীকালীন জাতীয় সরকার
বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পর, রাষ্ট্রের নির্দেশ অনুযায়ী আমরা রাজনৈতিক শাসকদের নিকট অস্ত্র সমর্পণ করেছিলাম। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলো মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে প্রাপ্ত রাষ্ট্র এখনো স্থাপিত হয়নি। বরং মুক্তিযুদ্ধে আমাদের আত্মত্যাগ ও আমাদের জনগণের ভূমিকা নিয়ে আজ ৪২ বছর পর প্রশ্ন উত্থাপন করা হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধে যাদের কোনো অবদান নেই, যারা বিরোধিতা করেছেন, যারা পাকিস্তানি সেনাদের সহায়ক হিসাবে কাজ করেছেন এমন সাম্প্রদায়িক ব্যক্তি ও দলের দুর্বৃত্তরা রাষ্ট্রকে নানাভাবে চ্যালেঞ্জ করছে। আমরা লক্ষ করছি, বিরোধী দল ক্ষমতাবাজির জন্য তাদেরকে সমর্থন দিচ্ছে। একই কারণে, সরকার পরিচালনার দায়িত্বপ্রাপ্ত দল শক্তিশালী ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হচ্ছে না। তাই আমরা সংকট নিরসনে জাতীয় সরকারের নিকট ক্ষমতার্পণের দাবি করছি। এই সরকার নিম্নোক্ত দায়িত্বসমুহ পরিচালনা করবেঃ
ক. যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ত্বরান্বিত করে সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করা।
খ. কালক্ষেপণ না করে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থানকারী জামাত-শিবিরসহ সবকটি দল ও সংগঠন নিষিদ্ধ করা এবং নতুনভাবে সংগঠিত হবার আইনী নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা।
গ. যুদ্ধাপরাধী দল ও ব্যক্তির মালিকানাধীন ব্যাংক-বীমাসহ সকল প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রীয়করণ করা।
ঘ. সমাজ-রাষ্ট্রের সকল স্তর থেকে দুর্নীতি উৎখাত করা এবং একাত্তর পরবর্তী দুর্নীতিবাজদের অর্থ-সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা করা। দুর্নীতিবাজদের বিচারের আওতায় আনা এবং বিদেশে সঞ্চিত তাদের অর্থ দেশে ফেরত আনার ব্যবস্থা করা। দুর্নীতিবাজ, সন্ত্রাসী ও কালোটাকার মালিকদের নির্বাচনে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে অযোগ্য ঘোষণা করা।
ঙ. প্রতিটি নাগরিকের সমঅধিকারের ভিত্তিতে ন্যায় বিচার নিশ্চিত করা। বিচার বিভাগসহ সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানসমূহকে নিরপেক্ষ ও জবাবদিহিতামূলক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর করা।
চ. বিদ্যমান লুটেরা অর্থনীতির উৎপাদনশীল রূপান্তরের পরিবেশ সৃষ্টি করা।
ছ. প্রত্যেক নাগরিকের অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, বাসস্থান নিশ্চিত করে এবং ধনী-গরিব বৈষম্য কমিয়ে এনে বাংলাদেশকে একটি কল্যাণ রাষ্ট্রে পরিণত করার শর্ত সৃষ্টি করা।
জ. প্রত্যেক ধর্মমতের লোকজনের ধর্ম পালন ও মতামতের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা।
ঝ. ঔপনিবেশিক আমলাতন্ত্রসহ রাষ্ট্রের অন্যান্য প্রতিষ্ঠান গণমুখী ও বিকেন্দ্রীকৃত করা। স্বশাসিত স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা গড়ে তোলা।
ঞ. ‘সংবিধান সভার’নির্বাচন আয়োজন করা। যার একমাত্র কাজ হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় একটি গণতান্ত্রিক সংবিধান রচনা।
ট. নতুন সংবিধানের আলোকে সংসদ নির্বাচন করে নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা অর্পণ করা।
নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই রাষ্ট্র পরিচালনা করবেন। কেমন হবে সে রাষ্ট্রের চরিত্র? অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধের পর যে রাষ্ট্রটি আমরা পাইনি, যা মানুষ আকাঙ্ক্ষা করেছিল, তার কাঠামোটি কেমন হবে? যথাযথভাবে নির্বাচিত ব্যক্তিবর্গ কিংবা গণআন্দোলনে উত্তীর্ণ জনতার বৈধ প্রতিনিধিরাই তার বিস্তারিত রূপরেখা নির্ধারণ করবেন। তা সত্ত্বেও মোটাদাগে কিছু মৌলিক বিষয়ের উল্লেখ করা যায়।
মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষার রাষ্ট্র ও সংবিধান: কী চাই না এবং কী চাই?
রাষ্ট্র পরিচালনার মূলভিত্তি সংবিধান। সংবিধান রাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গ ও প্রতিষ্ঠানের চরিত্র নির্ধারণ করে দেয়। তাতে রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রশাসকের সঙ্গে জনতার সম্পর্ক প্রতিফলিত হয়। জনগণের ‘ক্ষমতা’ও ‘অধিকার’কতটুকু রাষ্ট্রের আচরণে তা ধরা পড়ে। তাত্ত্বিকভাবে রাষ্ট্র এক শ্রেণির উপর অন্য শ্রেণির আধিপত্য প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা বটে। তবে একটি উদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হতে পারে যথেষ্ট প্রতিনিধিত্বমূলক- জনকল্যাণমুখী। সবচেয়ে পিছিয়ে-থাকা শ্রেণি, জনগোষ্ঠী কিংবা নাগরিকগণ আইনের কতটা সুবিধা পাচ্ছে, কতটা রাষ্ট্র পরিচালনায় অংশগ্রহণ করতে পারছে তা নির্ধারণ করে দেয়- রাষ্ট্রটি কতটা প্রতিনিধিত্বমূলক, কিংবা কতটা নিপীড়নমূলক ও গণবিরোধী।
বাংলাদেশ রাষ্ট্রের চরিত্র নির্মিত হয়ে আছে সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় : বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন, কৃষক বিদ্রোহ, ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ’৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ’৭০-এর নির্বাচন, অতঃপর ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের ধারাবাহিকতায়; বিশেষভাবে একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধে ধর্ম, বর্ণ, জাতি, পেশা, লিঙ্গ নির্বিশেষে সকলের আত্মত্যাগের মাধ্যমে। সেই সময়ে যে নজীরবিহীন জাতীয় সংহতি, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও মানবিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে তা নির্দেশ করে দেয়- একের উপর অন্যের আধিপত্য ও শ্রেষ্ঠত্ব মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী। অর্থাৎ এই রাষ্ট্র সকলের; ধর্ম যার যার; আইনের চোখে সকলে সমান এবং মৌলিক অধিকারের বা বাঁচার দাবী সকলের। এখান থেকেই উদ্ভূত হবে একটি কল্যাণধর্মী রাষ্ট্রের মূলনীতি।
গণবিরোধী আমলা নির্ভর ধারাবাহিকতা শোধরানো : মুক্তিযুদ্ধে প্রায় সকল রাজনৈতিক, অরাজনৈতিক শক্তি ও সংগঠন, শ্রমিক-কৃষকসহ ব্যাপক সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ থাকা সত্ত্বেও পাকিস্তানের পার্লামেন্টের উদ্দেশ্যে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিগণ (এমএনএ, এমসিএ) বাংলাদেশ রাষ্ট্রে প্রতিনিধিত্ব করতে শুরু করে। এতে মুক্তিযোদ্ধাসহ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী গৌরবদীপ্ত অনেক ব্যক্তি ও রাজনৈতিক দল রাষ্ট্রশাসনে ও জাতীয় উন্নয়নে অংশগ্রহণ থেকে বাদ পড়ে যায়। একটি জাতীয় সরকারের ঐতিহাসিক প্রয়োজনীয়তা সত্ত্বেও দলীয় ব্যক্তিবর্গ স্বকীয় উদ্যোগে বাংলাদেশ রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করে। ফলে পাকিস্তানি আদলেই শুরু হলো বাংলাদেশ রাষ্ট্র-ব্যবস্থাপনা। স্বাধীন দেশের কেন্দ্রীয় জনপ্রশাসন, সচিবালয়, বিচারাদালত, সংসদ, থানা-পুলিশ ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানে রয়ে গেলো পাকিস্তানি ও ব্রিটিশ উপনিবেশিক গণবিরোধী আমলা নির্ভর ধারাবাহিকতা। এইসব রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের দ্বারস্থ হলেই জনগণ বুঝতে পারে পতাকা ও ভূ-খন্ডের স্বাধীনতা ছাড়া জনজীবনে মৌলিক পরিবর্তন ঘটেনি। এটা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী যা জরুরিভাবে শোধরানো দরকার।
‘গণতান্ত্রিক’ স্বৈরতন্ত্র : রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্ররা জানেন, আধুনিক সরকার পদ্ধতি হয় প্রেসিডেন্সিয়াল নয় পার্লামেন্টারি বা মন্ত্রীপরিষদ শাসিত। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশে যা চালু আছে সভ্য দুনিয়ায় তার নজীর নাই। যা চলছে তা হলো একজন প্রধানমন্ত্রীর শাসন, বলা যেতে পারে ‘প্রধানমন্ত্রী শাসিত সরকার’। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী একইসঙ্গে দলীয় প্রধান, সংসদের প্রধান এবং নির্বাহী বিভাগের প্রধান; অন্যান্য এলাকায়ও তার নজীরবিহীন প্রাধান্য সৃষ্টি হয়েছে। কার্যত বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা মোগল আমলের বাদশাহী ক্ষমতার সঙ্গে তুলনীয়। তাকে অভিশংসন করাও সম্ভব নয়। ১৯৭২ সালের সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীকে যে পরিমাণ ক্ষমতা দেয়া হয়েছে তা পরবর্তীকালে আরো বৃদ্ধি করা হয়েছে। ফলে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতিসহ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বণ্টন ও প্রয়োগে স্বৈরতন্ত্রের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
গণবিরোধী সংশোধনী : স্বাধীনতার পর এ পর্যন্ত ১৫ বার বাংলাদেশের সংবিধান সংশোধন করা হয়েছে। তাতে দেখা যাবে, সরকার পদ্ধতি বদলানো হয়েছে কয়েকবার- যেমন একদলীয়, রাষ্ট্রপতি শাসিত, সংসদীয় ইত্যাদি। রাষ্ট্রীয় মূলনীতিসমূহ জখম করা হয়েছে, বাতিল করা হয়েছে। সংবিধানে ধর্মীয় সামপ্রদায়িকতার উপাদান ঢুকানো হয়েছে। কখনো এসব করা হয়েছে সামরিক শাসনকে বৈধতা দেবার জন্য, কখনো দলীয় শাসকের ক্ষমতা বাড়াবার জন্য, কখনো জননিপীড়নের সুবিধার্থে, কিংবা উগ্র সাম্প্রদায়িক শক্তির সমর্থন বাগানোর জন্য। কমবেশি সকলে মিলে যা করেছেন তাতে রাষ্ট্রটি শুধু মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী হয়েছে তা নয়, বরং তা একাত্তরের আগের অবস্থায় নেমে গেছে। এর ফলে বর্তমানের রাষ্ট্র মুক্ত-মানুষের ও মুক্তিকামী মানুষের জন্য নিরাপত্তার সংকট তৈরি করেছে। ব্যক্তিগত জীবনাচরণে অ-ধার্মিক ও এমনকি আপত্তিকর জীবন যাপনের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও শাসকেরা নিছক রাজনীতিতে ধর্মব্যবসার সুবিধার জন্য বারবার সংবিধান অপব্যবহারের অসুস্থ প্রতিযোগিতা করেছেন, যা বর্তমানে জটিলতার সৃষ্টি করেছে।
স্ববিরোধিতা : সংবিধানের ৭০ ধারার মাধ্যমে দলান্ধ এবং প্রধানমন্ত্রীর অনুগত জনপ্রতিনিধি তৈরি করার ব্যবস্থা করা হয়েছে, যারা নিজ এলাকায় জনগণের স্বার্থে বিবেকের ডাকে সাড়া দিতে সক্ষম নয়, যদিও বলা হয়েছে জনগণই ক্ষমতার মালিক। সংবিধানের ১৪২ ধারা অনুযায়ী আমাদের মানতে হচ্ছে যে, কালো টাকার মালিকেরা নির্বাচনের টিকিট কিনে সংসদে এসে দুই-তৃতীয়াংশের ভোটে যে কোনো রাষ্ট্রীয় মূলনীতিসহ সংবিধান পরিবর্তন করতে সক্ষম। এমন আরও অনেক ধারা রয়েছে যা জনস্বার্থের সাথে সাংঘর্ষিক। অনেক ভালো ভালো কথা বয়ান করা হয়েছে মূলনীতিতে, মৌলিক অধিকার অধ্যায়ে বিভিন্ন শর্ত ও উপশর্ত জুড়ে দিয়ে-শোভা বর্ধনের জন্য। আবার, অনেক ভালো উপাদান সংবিধানে বহাল থাকলেও শাসকেরা নিজেরাই মানছে না, তা প্রয়োগ করছে না। কেননা সংবিধানে এগুলো মানার বাধ্যবাধকতা রাখা হয়নি। কার্যত জনগণ নয়, জনগণের নামে শাসকেরাই সার্বভৌম। এভাবে বিগত চারদশক ধরে রাষ্ট্রশাসনে দুর্নীতি, দলবাজি, লুণ্ঠন ও সাম্প্রদায়িকতার উৎস কমবেশি এই সংবিধানের মধ্যেই খুঁজে পাওয়া যাবে।
সার্বভৌম ও জনগণতান্ত্রিক বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা : উপরোক্ত অগণতান্ত্রিকতা, ভারসাম্যহীনতা, স্ববিরোধিতাসহ সকল জনস্বার্থবিরোধী ত্রুটি শনাক্তপূর্বক তা থেকে মুক্ত হয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাস্তব প্রতিফলন ঘটানোর লক্ষ্যে অত্র ভূ-খন্ডে একটি একক সার্বভৌম ও জনগণতান্ত্রিক বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
মৌলিক উপকরণের ব্যবস্থা এবং অধিকার বাস্তবায়ন : বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হবে মেহনতী মানুষ অর্থাৎ কৃষক-শ্রমিকসহ জনগণের অনগ্রসর অংশকে সর্বপ্রকার শোষণ হতে মুক্তি দানের উদ্দেশ্য সামনে রেখে জনগণের এক অংশের সঙ্গে অন্য অংশের বৈষম্য ধাপে ধাপে কমিয়ে আনা - ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির, শ্রেণির সঙ্গে শ্রেণির, শহরের সঙ্গে গ্রামাঞ্চলের জীবনযাত্রার বৈষম্য নিয়মিতভাবে কমিয়ে আনা। অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা ও চিকিৎসাসহ জীবনের মৌলিক উপকরণের ব্যবস্থা এবং তদনুযায়ী কর্মের অধিকার, নিয়োগ লাভের অধিকার, সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার রাষ্ট্র নিশ্চিত করবে। বেকারত্ব, পঙ্গুত্ব, বৈধব্যসহ অন্যান্য ন্যায্য কারণে অভাবগ্রস্ততা ও অসহায়তার ক্ষেত্রে রাষ্ট্র নাগরিকদের সহায়তা ও প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে ভাতা প্রদান করবে। উপরোক্ত দায়িত্ব পালন রাষ্ট্রের জন্য বাধ্যতামূলক হবে। অন্যথায়, সংক্ষুব্ধ ও প্রবঞ্চিত ব্যক্তি রাষ্ট্রের স্থানীয় ও সর্বোচ্চ নির্বাহী কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে আদালতে গাফিলতির জন্য নালিশ দায়ের করার অধিকার প্রয়োগ করতে পারবে।
অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ও মালিকানার নীতি ঘোষণা : রাষ্ট্রে জনগণের উপরোক্ত মৌলিক অধিকার পূরণের উদ্দেশ্য সামনে রেখে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ও মালিকানার নীতি ঘোষণা করবে। ব্যক্তিগত, সমবায়ী, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় মালিকানা ইত্যাদি বহুমুখী ব্যবস্থা পাশাপাশি থাকলেও সার্বিকভাবে অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করবে রাজনীতি। অর্থাৎ এই অর্থে বাজার পুরোপুরি অবাধ হবে না। এবং উৎপাদন হবে দেশের মানুষের আভ্যন্তরীণ চাহিদার অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে। বস্তুগত জীবন ও সাংস্কৃতিক অগ্রগতির জন্য রাষ্ট্র দায়িত্ব পালনে বাধ্য থাকবে।
দায়িত্ব বণ্টন : রাষ্ট্রপতির মৌলিক ও পরামর্শমূলক দায়িত্ব পালনের বিষয়গুলি সুনির্দিষ্ট ও নির্ধারিত থাকবে। বিচারপতি ও প্রধানমন্ত্রী নিয়োগের মতো মৌলিক দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি স্বাধীন ও মর্যাদাসম্পন্ন আচরণ করবেন। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী অন্যান্য মন্ত্রীবর্গ নিয়োগসহ রাষ্ট্রের নির্বাহী প্রধানের দায়িত্ব পালন করবেন। রাষ্ট্রের নির্বাহীর দায়িত্ব পালনের কারণে তিনি দলীয় প্রধানের দায়িত্ব পালনের অযোগ্য বলে বিবেচিত হবেন। যাতে অবাঞ্ছিত কাল্ট সৃষ্টি না হয়, জীবদ্দশায় কোনো ব্যক্তি পর পর দুইবারের অধিক প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনের যোগ্য বলে বিবেচিত হবেন না। রাষ্ট্রপতি কর্তৃক রাষ্ট্রের প্রধান বিচারপতি ও অন্যান্য বিচারপতি নিয়োগলাভ করবেন। নিয়োগের পর তারা স্বাধীনভাবে কার্য পরিচালনা করবেন। বিচারপতিগণ চাকুরি সংক্রান্ত কোনো বিষয়ে নির্বাহী কর্তৃপক্ষ বা মন্ত্রণালয় কিংবা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে হস্তক্ষেপমুক্ত থাকবেন। একইভাবে, দেশের অধস্তন আদালতগুলো মন্ত্রণালয়ের/নির্বাহী কর্তৃপক্ষের খবরদারি থেকে মুক্ত ও স্বাধীন থাকবে। নিম্ন আদালতসমূহ সার্বিকভাবে উচ্চ আদালতের অধীন থাকবে এবং চাকুরি সংক্রান্ত যাবতীয় বিষয়ে উচ্চ আদালতের নিয়ন্ত্রণাধীন একটি সচিবালয়-এর ব্যবস্থাপনায় নিয়ন্ত্রিত হবে।
সাংবিধানিক আদালত : রাষ্ট্রযন্ত্রের বিভিন্ন অঙ্গের ক্ষমতার পৃথকীকরণ ও সর্বোচ্চ পদে দায়িত্ব পালনরত ব্যক্তিদের স্বকীয় ক্ষমতা চর্চার সীমানা নির্ধারণের জন্যে একটি সাংবিধানিক আদালত প্রতিষ্ঠিত হবে। এ জাতীয় আদালত দুই ধরনের অপরাধকে গুরুত্বের সঙ্গে আমলে নেবে।
এক : দুর্নীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা আছে, আয়-ব্যয়ের সামঞ্জস্যহীনতা রয়েছে কিংবা কালো টাকা সাদা করার কলঙ্ক আছে এমন কোনো ব্যক্তি রাষ্ট্রের সাংবিধানিক পদে আসীনের অযোগ্য বিবেচিত হবেন। তাদের পরিবারের, বা দলের ঘনিষ্ঠ সদস্যগণ যদি উপরোক্ত অপরাধে সংশ্লিষ্ট থাকেন এবং যদি প্রমাণিত হয় যে এটা তদের জ্ঞাতসারে হয়েছে তাহলে এ জাতীয় ব্যক্তিও রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদসমূহে আসীন হবার অযোগ্য বলে বিবেচিত হবেন।
দুই : বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে যারা এর বিরোধিতা করেছেন, হানাদার বাহিনীর সহায়তাকারী হিসেবে কাজ করেছেন, বা যুদ্ধাপরাধে সংশ্লিষ্ট ছিলেন বলে অভিযোগ আছে, বা প্রমাণিত হয়েছে বা সংশ্লিষ্ট বলে জনশ্রতি আছে এমন কোনো ব্যক্তি বাংলাদেশের সাংবিধানিক পদে আসীন হবার যোগ্যতা সম্পন্ন বলে বিবেচিত হবে না। যদি তাদের পরিবারের কোনো ঘনিষ্ঠ সদস্য উপরোক্ত অপরাধে সংশ্লিষ্ট থাকেন কিন্তু তারা তা আইনী কর্তৃপক্ষের নিকট তা উপস্থাপন না-করে গোপনীয়তা অবলম্বন করেছেন বলে প্রমাণিত হয়, তাহলে এ জাতীয় ব্যক্তি/ব্যক্তিবর্গ বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সাংবিধানিক পদে আসীন হবার অযোগ্য বলে বিবেচিত হবেন।
আমলাতন্ত্র : যুক্তিসঙ্গত আমলাতন্ত্র ব্যতীত আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কার্য পরিচালনা করতে পারে না। বাংলাদেশে র্যা শনাল ব্যুরোক্রেসি বা যৌক্তিক আমলাতন্ত্রের বদলে মন্ত্রণালয়গুলোতে এক ধরনের পিতৃতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সচিবগণ স্বৈরাচারী পিতার মতো অধস্তন আমলাদের দলিত করেন, গণবিরোধী কাজে ও দুর্নীতিতে বাধ্য করেন- গত চল্লিশ বছরে এমন অসংখ্য অভিযোগ জমা হয়েছে। এ সবের সুরাহা না হওয়ায় জনপ্রশাসনে দেশপ্রেমিক ও আত্মমর্যাদা সম্পন্ন ব্যক্তির ঘাটতি হয়েছে বা তারা কোনঠাসা হয়ে আছেন। রাষ্ট্র এক্ষেত্রে রিলেটিভ অটোনমি বা প্রত্যেক পদের কর্মকর্তার স্বকীয় স্বাধীনতা, গণস্বার্থে মতামত প্রদানের ক্ষমতা নিশ্চিত করবে। ঊর্ধ্বতন ব্যক্তিবর্গ লিখিত আদেশ প্রদানে বাধ্য থাকবেন। এক্ষেত্রে উপনিবেশিক নীতিমালার আমূল পরিবর্তন করে আমলাতন্ত্রকে আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের উপযোগী করা হবে। রাষ্ট্র জনগণের অভিযোগের ত্বরিৎ ব্যবস্থা ও মূল্যায়ন পদ্ধতি গ্রহণ করবে এবং আমলাদের জবাবদিহিতার আওতায় আনার নীতিমালা প্রণয়ন করবে। উচ্চ আদালতের একটি অংশ প্রধান প্রধান আমলাদের বিষয়ে সর্বদা পর্যবেক্ষণ চালু রাখবে। তাদের সম্পত্তি, আয়-ব্যয়, ব্যাংক হিসাব, জনসাধারণকে জ্ঞাত করার জন্য ওয়েবসাইট উন্মুক্ত রাখবে।
দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট জাতীয় সংসদ : ১৯৭২ সংবিধানের উল্লেখযোগ্য ত্রুটি হলো তা আমাদেরকে একটি গণতান্ত্রিক সংসদ বা গ্রহণযোগ্য গণতন্ত্র প্রদান করতে পারেনি। বরং সংবিধানের উপর দিয়ে এলোপাথাড়ি পরীক্ষা-নিরীক্ষার ও রদবদলের ঝড় বয়ে গেছে। বিদ্যমান সংসদীয় অবস্থায় একবার নির্বাচিত হবার পর সাংসদদের উপর আর নিয়ন্ত্রণ থাকে না। এরা অগণতান্ত্রিক ও স্বৈরতান্ত্রিক হয়ে উঠে। আইন বিভাগের দায়িত্বের চেয়ে এরা দীর্ঘদিন ধরে অর্থোপার্জনের জন্য নির্বাহী বিভাগের প্রকল্প, ফান্ড, ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণ ইত্যকার কাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হয়ে আছেন। সাংসদরা আসলে জনগণের সকল স্তরের/ পেশার প্রতিনিধি বলেও বিবেচিত হতে পারে না। এক্ষেত্রে দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা বিদ্যমান অবস্থার পরিবর্তন ও ভারসাম্য আনতে পারে, যা ক্ষমতা পরিবর্তন কালের সংকট নিরসনে অবদান রাখতে পারে। এতদ্বিবেচনায় বাংলাদেশে আইনসভা হবে দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট। ১. প্রথম কক্ষ : কৃষক, শ্রমিক, ডাক্তারসহ নানান পেশাজীবীর প্রতিনিধি, নারী প্রতিনিধি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা বা বিভিন্ন নৃ-গোষ্ঠীর প্রতিনিধির মাধ্যমে গঠিত হবে। ২. দ্বিতীয় কক্ষ : সাধারণ নির্বাচনে প্রাপ্ত ভোটের আনুপাতিক হারে রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের দ্বারা গঠিত হবে। আসন সংখ্যা উভয়কক্ষে সমসংখ্যক (৩০০) বা কমবেশি হতে পারে। তাদের কার্য মেয়াদ, কক্ষসমূহের আন্তঃসম্পর্ক, ক্ষমতা ও পরিগঠন চূড়ান্ত পর্যায়ে কি হবে তা দেশীয় বাস্তবতার উপর আলোচনা ও জনমতের মাধ্যমে স্থির হবে। যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, কানাডা, ব্রাজিল, ফ্রান্স, জাপান, ইতালি, নেদারল্যান্ড, মালয়েশিয়াসহ পৃথিবীর ৮৪টি দেশে গণতন্ত্রকে অধিকতর স্থিতিশীল করার জন্য দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট সংসদ অবদান রেখেছে। বাংলাদেশে এটাকে গ্রহণ না করার যৌক্তিক কারণ নেই।
স্বশাসিত স্থানীয় সরকার : জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন ও গ্রাম পর্যায়ে স্থানীয় সরকারের প্রতিটি স্তরে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির পাশাপাশি কৃষক, শ্রমিক, নারী ও পেশাজীবিদের নির্বাচিত প্রতিনিধি নিয়ে গঠিত হবে স্থানীয় সরকার। স্থানীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকবে সরকারের সকল স্তরের সরকারি ও আধা সরকারি কর্মকর্তাগণ। জনপ্রশাসন, উন্নয়ন ও সেবামূলক দায়িত্ব পালনের একক হিসাবে জনগণের দোরগোড়ায় কাজ করবে। একইসঙ্গে রাষ্ট্র সর্বক্ষেত্রে সেবামান ও আচরণগত দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করবে।
স্বাধীন ও শক্তিশালী সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান : নির্বাচন কমিশন পরিপূর্ণ স্বাধীনতা ও নিজস্ব জনবলের মাধ্যমে সকল ধরনের নির্বাচন অনুষ্ঠান পরিচালনা করবে। ইহা সুনির্দিষ্টভাবে রাজনৈতিক দল ও প্রতিষ্ঠানসমূহের জন্য প্রয়োজনীয় আইনগত বিধি প্রণয়ন করবে। সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের পথে হুমকিস্বরূপ দল, চক্র, এলাকা নির্বিশেষে সকল অপরাধী এবং তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতাদের বিরুদ্ধে আইন কার্যকরভাবে প্রয়োগ করবে। রাজনৈতিক দলের আয়-ব্যয়ের নিরীক্ষিত হিসাব প্রকাশ করবে। দলীয় কর্মকর্তা ও নির্বাচিত প্রতিনিধি ও তাদের পোষ্যদের সম্পদের হিসাব প্রকাশ করবে। দলের গঠনতন্ত্র অনুসৃত হচ্ছে কি না তা দেখবে। নির্বাচনে প্রচার-প্রকাশনার দায়িত্ব নেবে নির্বাচন কমিশন। যুক্তিসঙ্গত ফি প্রদানের বিনিময়ে প্রার্থীদের পোস্টার, লিফলেট এবং প্রয়োজনে স্থানীয় সরকারের সহযোগিতা নিয়ে নির্বাচনী সভার আয়োজন করবে। নির্বাচনী আইন ও শর্ত যথাযথভাবে পালন হচ্ছে কি না তা নিশ্চিত করবে। দুর্নীতি দমন কমিশনকে সরাসরি গ্রেফতার করার জন্য নিজম্ব আইনী বাহিনীসহ অন্যান্য ক্ষেত্রেও নিজস্ব জনবল, তদন্ত, গবেষণা ও অর্থবরাদ্দের ব্যবস্থা করবে যাতে ইহা কাজ করতে গিয়ে নির্বাহী ক্ষমতার দ্বারা বাধাগ্রস্থ না হয়।
কৃষিনীতি : কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি ও গ্রামাঞ্চলে পুঁজির বিকাশের স্বার্থে এবং খাদ্যশস্যের মূল্য স্থিতিশীল রাখার উদ্দেশ্যে রাষ্ট্র কৃষিতে ভর্তুকি দেবে। ফলে সরকার একদিকে যেমন সুলভমূল্যে সবাইকে কৃষি উপকরণ সরবরাহ করবে, অপরদিকে ধানের মতো কিছু কৃষিপণ্য নির্ধারিত মূল্যে কৃষকদের নিকট থেকে ক্রয় করবে। কৃষকের স্বার্থে এ রাষ্ট্র দৃঢ়তার সঙ্গে কৃষি জমির সিলিং কার্যকর করবে। অনুপস্থিত কৃষিজমি মালিকানা বাতিল হবে এবং এ মালিকানা খোদ কৃষকদের নিকট বর্তাবে; উদ্বৃত্ত খাস কৃষিজমি দরিদ্র কৃষকদের মধ্যে বণ্টন করবে। প্রশাসন ব্যবস্থার জটিলতা থেকে জনগণকে মুক্তি দিতে জমির রেজিস্ট্রেশন, মিউটেশন ও সেটেলমেন্টের তিনটি স্বতন্ত্র বিভাগ বিলুপ্ত করে একটি বিভাগ ও অফিসের অন্তর্ভুক্ত করবে। সরকার জমির মিউটেশনের দায়িত্ব পালন করবে। কৃষি জমি হ্রাস রোধে রাষ্ট্র যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
শিল্প ও শ্রমনীতি : পুঁজি পাচার রোধ, কালো টাকা সৃষ্টি হ্রাস এবং শিল্পে বিনিয়োগের পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে শিল্প উৎপাদনকে অধিক গুরুত্ব প্রদান করা হবে। বিশ্ববাজারের চাহিদার চেয়ে আভ্যন্তরীণ চাহিদা এবং কৃষিভিত্তিক শিল্পকে অগ্রাধিকার দেয়া হবে। এর লক্ষ্য হবে অধিক কর্মসংস্থান। শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি প্রদানে সকল ন্যায্য অধিকার সংরক্ষণ করবে। পোশাক শিল্পসহ বিভিন্ন শিল্পে নিয়োজিত নারী শ্রমিকসহ সকল শ্রমিকদের কলঙ্কজনক নিরাপত্তাহীনতার অবসান ঘটানো এবং প্রয়োজনীয় রাষ্ট্রীয় পদড়্গেপের মাধ্যমে নৈরাজ্য ও প্রতিকূলতা দমন করে প্রয়োজনীয় পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করবে। জনস্বার্থে বিশেষভাবে প্রয়োজনীয় শিল্প প্রতিষ্ঠানকে রাষ্ট্রীয় খাতের অন্তর্ভুক্ত করবে।
নারী অধিকার : রাষ্ট্র নারীর সমঅধিকার ও সমমর্যাদা নিশ্চিত করবে। রাষ্ট্র ও প্রশাসনে নারীর প্রতি বৈষম্য দূরীকরণের উদ্দেশ্যে প্রশাসন, পুলিশ ও সামরিক বাহিনীসমূহের পরিচালনায় তাদের নিজম্ব প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা করবে। নারী নির্যাতন ও নিগ্রহের আবহমান ধারায় মৌলিক পরিবর্তন আনার জন্য যথোপযুক্ত আইন ও আদালত গঠিত হবে। নারীরা আজকাল এভারেস্ট জয় করছে, সামরিক কমান্ডো হিসেবে ভূমিকা রাখছে। অতএব, মধ্যযুগীয় প্রতিক্রিয়াশীলতার বিরুদ্ধে নারীদের স্বার্থ রক্ষায় তাদের নিজস্ব শক্তি ও সংগঠনের বিকাশকে রাষ্ট্র মদদ দেবে। একই সঙ্গে নারীর পণ্যায়ন, পর্নোগ্রাফী, অপরাধমূলক সাইবার উপকরণ ও পশ্চিমা সভ্যতার অন্যান্য অধঃপতনের ক্ষেত্রে রাষ্ট্র যথোপযুক্ত হস্তক্ষেপ করবে।
প্রতিরক্ষা নীতি : রাষ্ট্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে গড়ে-ওঠা সামরিক বাহিনীকে আধুনিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার উপযোগী করে তুলবে এবং এটাকে জনপ্রতিনিধিদের তত্ত্বাবধানে এনে জনস্বার্থের সঙ্গে সম্পৃক্ত করবে। দেশের স্বাধীনতা রক্ষায় শুধু স্থায়ী সেনাবাহিনীর ওপর নিভর্র না করে সকল সক্ষম নাগরিকের বাধ্যতামূলক সামরিক প্রশিক্ষণ দান এবং সামরিক বাহিনীতে তাদের স্বল্পমেয়াদী অংশগ্রহণের ব্যবস্থা করবে।
জাতীয় সম্পদ সংরক্ষণ : রাষ্ট্র জাতীয় সম্পদের উপর জনগণের পূর্ণ মালিকানা ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করবে। তেল, গ্যাস, কয়লাসহ সকল প্রাকৃতিক সম্পদের উপর বহুজাতিক কোম্পানির দখলদারিত্বের অবসান ঘটাবে। দেশের স্বার্থবিরোধী বৈদেশিক চুক্তির অবসান ঘটাবে। বৈদেশিক চুক্তির ক্ষেত্রে প্রশ্ন উত্থাপিত হলে জনগণের মতামতের জন্য গণভোটের ব্যবস্থা করবে।
শিক্ষা নীতি : সবার জন্য শিক্ষা- রাষ্ট্র এই নিশ্চয়তার ভিত্তিতে জাতীয় শিক্ষা নীতি প্রণয়ন করবে। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত একই পদ্ধতির শিক্ষা চালু থাকবে এবং শিক্ষা হবে অবৈতনিক। মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে উচ্চশিক্ষার সুযোগ থাকবে। বাংলা হবে সকল স্তরের আবশ্যকীয় বিষয়। বহুধাবিভক্ত ও এলোমেলো শিক্ষা ব্যবস্থা বাতিল করে রাষ্ট্রের আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ অভিন্ন শিক্ষা ব্যবস্থা প্রচলন করবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাকে জনস্বার্থ ও উৎপাদনের সঙ্গে সম্পর্কিত করবে। গড়ে-ওঠা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে শিক্ষার পণ্যায়ন, অর্থোপার্জন ও বিদেশ প্রবণতার অবসান ঘটাবে। মাদ্রাসা শিক্ষায় আধুনিক বিষয়সমূহ যেমন- সমাজবিজ্ঞান, নৃবিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও দর্শনের পাঠ অন্তর্ভুক্ত করবে - যাতে আধুনিক জগত সম্পর্কে সঙ্গত ধারণা ও জ্ঞান অর্জিত হয়। কোচিং ব্যবসার অবসান ঘটানো হবে।
পরিবেশ : পরিবেশ জীবনের সহায়ক আবার জীবনের হুমকিও বটে। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক অব্যবস্থার কারণে বাংলাদেশে পরিবেশ বিপর্যয় চূড়ান্ত পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। উন্নয়ন-ফোবিয়া ও বহুজাতিক বাড়াবাড়ির কারণে প্রকৃতি এখন মানুষের উপর প্রতিশোধ নিচ্ছে। বৃক্ষ, ফলমূল, শস্য, মৎস্য বিভিন্ন ক্ষেত্রে আবহমান ধারা বদলে গেছে, বিলীন ও বিষাক্ত হয়ে উঠেছে নজীরবিহীন ভাবে। অধিকন্তু, ঘনবসতির কারণে প্রাকিতিক দুর্যোগে মানুষের মৃত্যুর পরিসংখ্যান দেশের জন্য নির্মম ও আন্তর্জাতিকভাবে লজ্জার বিষয় হয়েছে। বাংলাদেশে ঘন ঘন বন্যা, ঝড়, জলোচ্ছ্বাস, ভয়ংকরতায় পূর্বের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। এটা দৈব নির্ধারিত বিষয় নয় বরং বৈশ্বিক জলবায়ুর পরিবর্তনের পাশাপাশি পাহাড়-কাটা, বৃক্ষ-নিধন, খাল-দখল, নদী-ভরাট, ভূমি জবরদখল, দুর্নীতি ও লুটপাটের রাজনীতি অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত। রাষ্ট্র গণসম্পদ লুণ্ঠন কঠোর হস্তে দমন করবে। বায়ু, পানি ও বাতাস সকলের স্বার্থে বিশুদ্ধ রাখার প্রয়োজনে কঠোরতর পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। এই ব্যাপারে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করবে এবং ক্ষতিপূরণ প্রদানে বাধ্য করবে। পরিবেশ সংক্রান্ত একটি পূর্ণাঙ্গ মন্ত্রণালয় ও উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন একটি পরিবেশ আদালত গঠিত হবে।
আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্ক/পররাষ্ট্র নীতি : একটি দুর্বল রাষ্ট্র শক্তিশালী রাষ্ট্রের যথার্থ বন্ধু হয় না, বাস্তবে সম্পর্ক একমাত্রিক হয়। সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, প্রচলিত পররাষ্ট্র নীতি হিসাবে গ্রহণীয় বটে, কিন্তু এক্ষেত্রে গৎবাঁধা নীতির চেয়ে নিজের অবস্থান শক্তিশালী করা জরুরী। এক্ষেত্রে রাষ্ট্র বরং আঞ্চলিক জোট গঠনের মাধ্যমে নানামুখি আগ্রাসন মোকাবেলা ও শক্তির ভারসাম্য সৃষ্টি করবে এবং ঐতিহ্যের সমৃদ্ধি ও অর্থনীতির বিকাশ দৃঢ়তর করবে। দেশীয় কোন্দলরত দলের নেতারা বিদেশী দূতাবাসের সঙ্গে যে যোগাযোগ করছে তা প্রায়শ অসম্মানজনক এবং তা আভ্যন্তরীণ হস্তক্ষেপমূলক আচরণ ও বক্তব্যকে উৎসাহিত করে। এটা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরোধী। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও বিদেশস্থ দূতাবাস ও মিশনগুলোকে অপেশাদার ব্যক্তির ডাম্পিং গ্রাউন্ড হিসাবে ব্যবহার বন্ধ করে মেধাবী ও তরুণদের কূটনৈতিক জগতে অগ্রাধিকার নিশ্চিত করা হবে। বাংলাদেশী নাগরিক যারা বিদেশে শ্রম বিনিয়োগ করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছেন তাদের প্রতি বিদেশে কর্মরত কর্মকতাদের আচার-আচরণ সম্পর্কে দুর্ভাগ্যজনক অভিযোগ রয়েছে। এক্ষেত্রে রাষ্ট্র পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পুরানো নীতি ও কাঠামো বদলাবে এবং কর্মকর্তাদের দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। দূতাবাসের প্রধান কাজ হবে বাংলাদেশী পণ্য ও শ্রমের বাজার সম্প্রসারণ এবং প্রবাসী বাংলাদেশীদের দেখভাল করা।
জাতীয়তাবাদ ও অন্যান্য জাতিসত্তা : বাঙালি জাতীয়তাবাদ মূলনীতি হিসাবে গণ্য হবে এবং তার ভিত্তিতে রাষ্ট্র বাঙালির ঐতিহাসিক সংগ্রাম, সাংস্কৃতিক ধারাবাহিকতার সাংবিধানিক স্বীকৃতি নিশ্চিত করবে। একই সঙ্গে অন্যান্য জাতিসত্তার সাংবিধানিক স্বীকৃতি - তাদের জীবন সংগ্রাম, শিল্প ও সাহিত্য ভাষা ও সংস্কৃতির নিজস্ব বিকাশ ও ঐতিহ্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেবে। আত্মনিয়ন্ত্রাধিকার দেয়ার মাধ্যমে পাহাড়ে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করবে। পাহাড়ের সঙ্গে সমতলের, পদ্মা-মেঘনা-যুমনার সঙ্গে মাতামুহুরী-সাঙ্গুর জীবনধারার সম্মিলনে সম্মানজনক রাষ্ট্রীয় সম্পর্ক স্থাপন করবে এবং বর্ণবাদী বৈরিতা ও জুলুমের অবসান ঘটাবে। বাংলাদেশ হবে সভ্যতার মানদন্ডের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ একটি বহুজাতিক রাষ্ট্র।
‘জনগণতান্ত্রিক’ বাংলাদেশ : আকাঙিক্ষত কল্যাণমূলক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রয়োজনে সংবিধানের প্রয়োজনীয় সংশোধন ও নতুন সংবিধান প্রণীত হবে। এ সংবিধানের প্রধান বৈশিষ্ট্য হবে রাষ্ট্র এমন কোন আইন, বিধি-বিধান, ডিক্রি, অধ্যাদেশ জারি করতে পারবেনা যা জনগণের সার্বভৌমত্ব ও মৌলিক অধিকারকে অস্বীকার করে, খর্ব করে, বাধা প্রদান করে, বা সীমিত করে। কয়েকশ বছরের পুরানো ফৌজদারি আইন, দন্ডবিধি, ভূমি আইন, নির্বাচনী আইন, পরিবেশ রক্ষার আইন স্বাধীন রাষ্ট্রের জনগণের জন্য অনেক ক্ষেত্রেই অসম্মানজনক। সেগুলিকে বাতিল করে যুগের উপযোগী করা হবে। বিচার বিভাগ, নির্বাহী বিভাগ, আইন বিভাগের স্বাধীনতা ও স্বাতন্ত্র্য নিশ্চিত করা এবং রাষ্ট্রের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানসমূহ বিশেষ করে দুর্নীতি দমন কমিশনকে সর্বোচ্চ পর্যায়ের ক্ষমতা প্রদান করবে যাতে দ্রুততার সাথে দুর্নীতিবাজ দমন সম্ভব হয়। ‘গণপ্রজাতন্ত্রী’বাংলাদেশের ভাব-ধারণা বাতিল করে ‘জনগণতান্ত্রিক’ বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সংবিধান প্রণয়নের জন্য জনপ্রতিনিধি ও বিশেষজ্ঞ সমন্বয়ে একটি সংবিধান সভা গঠিত হবে যারা মুক্তিযুদ্ধের কাঙ্ক্ষিত রাষ্ট্রের সাংবিধান রচনা করবেন - যার জন্য এই জনপদের মানুষের দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন মুলতবি হয়ে আছে।
উপসংহার ও আহ্বান
ইতিহাসের বর্তমান ক্রান্তিলগ্নে স্বৈরতন্ত্র, দুর্নীতি, দুর্বৃত্তায়ন ও উগ্র সাম্প্রদায়িক শক্তির পুনরুত্থানের বিপর্যয়কর পরিস্থিতিতে, একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধারা জাতীয় দায়িত্ব পালনে ঐতিহাসিক ভূমিকা রাখা জরুরি মনে করছে। দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে, আমরা মনে করি, এ দায়িত্ব আজ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় লালিত সকল মানুষের। তাই আমরা প্রগতিশীল রাজনৈতিক ব্যক্তি, দেশপ্রেমিক অরাজনৈতিক মানুষ, পরিবর্তনের জন্য নিবেদিত পেশাজীবী, বুদ্ধিজীবী, সংবাদকর্মী, সংস্কৃতিকর্মী, কবি-শিল্পীসহ সকল সংবেদনশীল মানুষ বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের মুক্তিযোদ্ধাসহ সকল স্তরের সাধারণ জনগণকে আহবান করছি। আমরা বিশ্বাস করি, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাস্তবায়ন হয়নি বলেই বর্তমান বিপর্যয়কর অবস্থায় সৃষ্টি হয়েছে। আমাদের তরফ থেকে বলা দরকার, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মানে কী? বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ ও স্বার্থ থেকে এর বিভিন্ন ব্যাখ্যা থাকতে পারে। কিন্তু একাত্তরের ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মানে, যদি এক বাক্যে বলতে হয় : সংগঠিত গণমানুষের শক্তির দ্বারা অগণতান্ত্রিক, দুর্নীতিবাজ ও সামপ্রদায়িক শক্তিকে পরাজিত করা। আজকের বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধ ও যুদ্ধোত্তর অপরাধ অর্থাৎ দুর্নীতি উভয়ই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরোধী, প্রয়োজন একইসঙ্গে প্রতিরোধের গণআন্দোলন গড়ে তোলা। এই দেশের গড়-জনতা প্রাণবান এবং সংগ্রামের ঐতিহ্যে পরীক্ষিত। একটি আধুনিক জনগণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সকল যোগ্যতা রয়েছে জনগণের। তাদের সংগঠিত শক্তিতে এটা অবশ্যই সম্ভব। আমাদের কর্তব্য হলো ডাক পৌঁছে দেয়া। এ দায়িত্ব পালনের জন্য আমরা জনগণের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে চাই- প্রযুক্তির এই যুগে সম্ভাব্য সকল উপায়ে। জাতির ক্রান্তিলগ্নে ত্যাগ স্বীকার করতে আগ্রহী দেশমাতার এমন সন্তানদের এগিয়ে আসার আহ্বান করছি।
জয় বাংলা, জয় জনতা।
* ২০১৪ সালে লিখিত এ নিবন্ধটি একদল মুক্তিযোদ্ধার সম্মিলিত প্রয়াস