লিখেছেনঃ সুমনা চৌধুরী, আপডেটঃ May 25, 2019, 12:00 AM, Hits: 2148
“বুকের রক্ত মুখে তুলে যারা মরে
ওপারে ঢাকায় এপারের শিলচরে
তারা ভালোবাসা–বাংলাভাষার জুড়ি-
উনিশে মে আর একুশে ফেব্রুয়ারি”
একটা বারো–তেরো বছরের মেয়ে গল্প শুনছে তার বাবার মুখে। সালটা ২০০২। শুনছে ১৯৬১ সালের ভয়াবহ দিনগুলোর বর্ণনা। বাংলা ভাষাকে রাজ্য ভাষা কারার দাবীতে আন্দোলনরত মানুষদের উপর আসাম সরকারের চুড়ান্ত নির্যাতনের ধারাভাষ্য। ‘৬১‘র ১৯শে মে ১১ জন সত্যাগ্রহী নাগরিককে আসামের মুখ্যমন্ত্রীর গোপন নির্দেশে শিলচর রেল স্টেশনে গুলি করে নির্মম ভাবে হত্যা করার কথা। সরকারের প্রত্যক্ষ মদতে আসাম পুলিশের বর্বর হত্যাযজ্ঞের প্ল্যানের বিবরন। সেদিন বাংলা ভাষাকে কন্ঠে জড়িয়ে শহিদ হয়েছিলেন –কমলা ভট্টাচার্য, চন্ডীচরণ সূত্রধর, হিতেশ বিশ্বাস, শচীন্দ্র পাল, কুমুদরঞ্জন দাস, সুনীল সরকার, বীরেন্দ্র সূত্রধর, তরণী দেবনাথ, সত্যেন্দ্র দেব, কানাইলাল নিয়োগী, সুকোমল পুরকায়স্থ’রা… আহত আরও অজস্র মানুষ। নির্মম প্রশাসন ভাষার জন্য মানুষকে মেরেছিল। কেউ এগিয়ে আসেনি। সেই দিন আসাম রাজ্যেই (তৎকালীন আসামের রাজধানী শিলং ) উপস্থিত ছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু। একটা টু শব্দও তিনি করেন নি। পরে দিল্লি ফিরে গিয়ে নাম কে ওয়াস্তে যে কমিশন বানিয়েছিলেন তার রিপোর্ট এখনো সঠিকভাবে সামনে আসেন নি। স্বাধীন ভারতের বুকে এই গণহত্যার বিচার আজ অবধি হয় নি। সেই রক্তাক্ত ইতিহাসের ধারা চলেছে ১৯৭২ এবং ৮৬‘তেও। আবার ও ভাষার জন্য রক্ত ঝরেছে। সেই বিচারও এখনো হয়নি। হয়তো কেউ জানেনও না ৭২’এর ১৪ আগস্ট রক্তাক্ত অবস্থায় জাতীয় সড়কে লুটিয়ে পরা যুবক বিজন চক্রবর্তীর নাম! কি করেছিল আসাম সরকার? অসমীয়া ভাষাকে জোর করে চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল বাঙালিদের মুখে। শিখতেই হবে অসমীয়া ভাষা, শিক্ষা দেওয়া হবে কেবলমাত্র অসমীয়া ভাষায়।প্রতিবাদে হত্যা! বাবা শেষ করেন, ‘আসামে বাঙালি হওয়ার জন্য এতটাই অত্যচার সইতে হয়েছে.. আজও হচ্ছে’। বারো–তেরোর মেয়েটার শিরদাঁড়া দিয়ে তখন ভয়ের স্রোত নেমে যায়।
এর অনেক বছর পর ২০১৮ সালের কথা। আর্মি পোষাক পরা হাতে অত্যাধুনিক অস্ত্রসহ চার–পাঁচজন লোক একটা ভ্যান থেকে নেমে আসে। গ্রামের মানুষরা সারাদিনের কাজ শেষে নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলছিলেন। অস্ত্র ঠেকিয়ে পরপর পাঁচজনকে তুলে নিয়ে যায় তারা লোহিতের তীরে। লাইন ধরে দাঁড় করিয়ে রাইফেলে ঝাঁঝরা করে দেওয়া হয় পাঁচজনের বুক। কিসের অপরাধে সেটা জানা যায় না। কোনও সাক্ষী–সাবুদ থাকে না। কোনও প্রমাণ থাকে না। তারপর সন্ধ্যার অন্ধকারেই গা–ঢাকা দেয় হত্যাকারীরা। অথচ যেখানে এই হত্যালীলা চালানো হচ্ছে তার মাত্র ৩০০ মিটার দূরেই পুলিশ চৌকি। হত্যা এবং খুনীদের পালিয়ে যেতে দেওয়া হয়। তারপর ধীরে–সুস্থে মঞ্চে আসেন পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্তাগণ। জানানো হয় মৃত পাঁচজনই বাংলায় কথা বলত। বছর উনত্রিশের মেয়েটির পুরোনো ভয় লাগাটা আরেকবার ফেরত আসে। নুইয়ে পড়া শিঁরদাঁড়া দিয়ে আরেক বার ভয়ের স্রোত নেমে যায়। আগের মতই ‘বাঙালি ’ মেয়েটির সামনে ভাষা দিয়ে শত্রু আর বন্ধু খোঁজার পুরোনো খেলা–টা উঁকি দেয়…।
না, কোনও পলিটিক্যাল থ্রিলার সিনেমার গল্প শোনাতে বসিনি। শোনাতে চাইছি অসমের বাঙালিদের ঠান্ডা মাথায় খুন করার প্লটের কথা। নিখুত প্ল্যান করে বিদেশী সাজানোর ষড়যন্ত্রের কথা। বোঝাতে চাইছি অসমে বাঙালি হয়ে জন্মানোর খেসারত এভাবেই দিতে হয়। এভাবেই দিতে হয়েছে। শুধু অতীতের সাথে তার স্ট্রাকচারের কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে মাত্র। বাকী সব একই রকম। নতুন স্ট্রাকচারে এন আরসি কে সামনে রেখে চলছে বাঙালি নিধন। চলছে ভাষার নিরিখে বিদেশি খোঁজার পালা। বাংলায় কথা বললেই বিদেশি বা আরো স্পষ্ট করে বললে বাংলাদেশী। এবং বৃহত্তর অসমীয়া জনসংখ্যার রাজ্যে বাঙালির জায়গা নাই। এবারে অতীতের জহরলাল নেহেরু সরকার থেকে আরো এককদম বেড়ে বাঙালিকে “উইপোকা“র তকমায় ভূষিত করেছে বর্তমান সরকার। দেশে উইপোকারা থাকলে দেশ ঝাঝরা হয়ে যাবে। তাই তাদের ঠিকানা ‘ডিটেনশন ক্যাম্প‘। কোটি কোটি টাকা দিয়ে তাই আসামে চলছে এশিয়ার বৃহত্তম ডিটেনশন ক্যাম্প বানানোর প্রস্তুতি।
বর্তমান সময়ের যে নতুন বাঙালি প্রজন্ম উনিশের ইতিহাস ভুলে গেছে, উনিশের শহীদের ধর্ম বিচার করে বলছে তারা হিন্দু ছিলেন না মুসলমান, এন আর সি বলতে প্রচার করছে “এন আর সি আসলে মুসলমান খেদা, হিন্দুরা সুরক্ষিত কারন ভারতবর্ষ হিন্দুদের দেশ“, যারা বাঙালি বলতে বুঝে “জয় শ্রী রাম” স্লোগান,যারা বাঙালি সংস্কৃতি বলতে বুঝে “গণেশ চতুর্থী” আর “নবরাত্রি“, দীপাবলীকে যারা “দেওয়ালি” করে“ধনতেরাসে” সোনার দোকানে ভীড় জমায়, যারা হিন্দি–ইংলিশ–বাংলা মিশিয়ে অদ্ভুত এক খিচুড়ী ভাষায় নাক সিটকে বলে “বাংলাটা ঠিক আসে না” – তাদের এখনো অনেক কিছু জানার এবং বুঝার বাকী। তাদের বুঝার বাকী নিজের শিকড় উপড়ে বেঁচে থাকা আসলে মৃত্যুর সমান। ‘৬১‘র ১৯ শে মে নিজের এই শিকড় রক্ষার তাগিদেই এতগুলো মানুষ রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বলি হয়েছিলেন। তাদের বোঝার বাকী নিজের মায়ের মুখের ভাষাকে অবহেলা করে পৃথিবীর কোন ভাষা শেখা যায় না। নিজের আত্মপরিচয় ভুলে পৃথিবীর কোন পরিচয়ে পরিচিত হওয়া যায় না। মাইকেল মধূসূদন দত্তকেও শেষে নিজের শেকড়ের কাছে ফিরে বলতে হয়েছিল “হে বঙ্গভান্ডারে তব বিবিধ রতন/ তা সবে (অবোধ) আমি অবহেলা করি।”
অবশ্য এই না জানার ক্ষেত্রে দোষ তো শুধু একপাক্ষিক ভাবে এই প্রজন্মের নয়! আমরা যারা ভাষা নিয়ে এতো আবেগিক কথা বলি, আমাদেরও কি দায় ছিল না এই প্রজন্মের বুকে অতীতের সেই সংগ্রামের ইতিহাস লিপিবদ্ধ করার? আমাদের শিক্ষকরা, আমাদের ভাষাবিদরা, আমাদের মা‘রা, বাবা‘রা, সর্বোপরি আমরা চুড়ান্তভাবে ব্যর্থ সে জায়গায়। আমরা আমাদের ছেলে–মেয়েগুলোকে শিকড়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে পারি নি। আমরা আমাদের ছেলে–মেয়েগুলোকে মাতৃভাষার অমূল্য গুপ্তধনের সন্ধান দিতে পারি নি। এমনকি এগারোজন ভাষা শহীদদের নাম অব্দি শিখিয়ে যেতে পারিনি। অতীতের সংগ্রামের হাত ধরে বর্তমানের আরো কঠিন লড়াইয়ের জন্যে আমাদের ছেলে–মেয়েগুলোকে প্রস্তুত করতে পারিনি। এই ব্যর্থতার দায় তো নিতেই হবে আমাদের!
কোন ভাষা শিক্ষা কোনভাবেই নিন্দনীয় নয়। কিন্তু সেটা যে কোনোভাবেই নিজের মাতৃভাষাকে উপেক্ষা করে নয়, এই সারসত্যটা আমরা নিজেরাও হয়তো বুঝতে পারি না! নিজের মাতৃভাষাকে যত্ন, লালন না করতে করতে আজকে আমরাই আমাদের অস্তিত্বকে সংকটের মুখে নিয়ে এসেছি। আমরা যারা বাংলাভাষা নিয়ে এত বড় বড় বক্তব্য রাখি, যারা নিজেদের উনিশের সন্তান বলে দাবী করি, সেই আমরাই নিজেদের সন্তানদের ইংরাজী মাধ্যমের স্কুলগুলিতে পড়তে পাঠাই, সেই আমাদের সন্তানেরাই বাংলা জানে না, এর চেয়ে দুঃখের,এর চেয়ে যন্ত্রনার আর কিছু হতে পারে না। আমাদের নিজেদের উদাসীনতা এবং পরোক্ষভাবে রাষ্ট্রীয় চক্রান্তের দায় শুধু প্রজন্মের উপর চাপিয়ে পার পাওয়া যায় না, এইকথা বুঝতে হবে আমাদের। এবং নতুন প্রজন্মকে উনিশের রক্তাক্ত ইতিহাস জানানোর দায়িত্ব নিতে হবে আরো অনেক দেরী হয়ে যাওয়ার আগে। একমাত্র তাহলেই হয়তো এই প্রজন্ম বুঝতে পারবে কেন আসামের বুকে ‘৬১, ‘৭২, ‘৮৬ নেমে এসেছিল এবং তারসাথে বর্তমান আসামের এন আর সি এবং ভবিষৎ অস্তিত্ব কিভাবে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত!
সেই জানানোর দায় নিয়েই ইতিহাস খুড়ে উনিশের রক্তাক্ত দিনগুলোর ইতিহাস বলে যেতে চাই এই প্রজন্মের সাথে সাথে নিজেকেও।
উনিশের আন্দোলনের প্রেক্ষাপট:
প্রাচীনকাল থেকেই আসাম নামক এই ক্ষুদ্র ভুখন্ড নানা ধর্ম, ভাষা, সংস্কৃতির মানবগোষ্ঠীর সমন্বয়ে গঠিত। আসামের রাজনৈতিক সীমানা বারবার বদল হয়েছে, ফলত জনসংখ্যা এবং জনবিন্যাস ও বারবার পাল্টেছে। মোগলদের আগমন ও ঘটেছে এ রাজ্যে। ১৭৬৫ খ্রীষ্টাব্দে মোগলদের অধীন থেকে ইংরেজদের অধীনে আসে করিমগঞ্জ, ধুবড়ি, গোয়ালপাড়া, বঙ্গাইগাও, কোকরাঝাড় এবং চিরাং জেলার কিছু অংশ এবং করিমগঞ্জ জেলাকে বাদ দিয়ে বাদবাকী সব অঞ্চল ইংরেজরা অবিভক্ত বাংলার রংপুর জেলার সাথে একত্রিত করে। ১৮২৬ সালে আহোম রাজা এবং ইংরেজদের মধ্যে ইয়ান্ডাবু চুক্তি হয় এবং করিমগঞ্জ বাদ দিয়ে উপরিক্ত সব অঞ্চল নয়া গোয়ালপাড়া জেলা হিসেবে উপনিবেশিক আসামে অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৮৬৭ সালে নয়া গোয়ালপাড়া জেলাকে কোচবিহারের সাথে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ১৫৬২ সাল অব্দি কাছাড় এবং হাইলাকান্দি জেলা ত্রিপুরা রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এর পরে ১৭৬৫ পর্যন্ত এই দুই জেলা ই কোচ রাজ্যের অংশ এবং তারপর ১৮৩২ সাল পর্যন্ত কাছাড়ি রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৮৭৪ সালে সিলেট, কাছাড়, গোয়ালপাড়া – তিনটি বাংলাভাষী জেলাকে ঢাকা ডিভিশন থেকে কেটে এনে আসামের সঙ্গে সংযুক্ত করা হল। এবং এর ফলেই আসামে বাংলাভাষীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে উঠলো। এবং মুসলমান সংখ্যাও উত্তরোতর বৃদ্ধি পেয়ে ২৮.৮ শতাংশে উঠে আসলো।
ইংরেজরা আসামে চা নিয়ে এলো। এবারে চা–বাগান গুলোতে কাজ করার জন্যে প্রচুর শ্রমিক ও তো চাই। তাই ভারতের অন্যান্য রাজ্য থেকে আগমন ঘটলো আদিবাসী শ্রমিকদের। আবার আসামের জমিতে শস্য ফলানোর জন্য তৎকালীন পূর্ববাংলা থেকে আগমন ঘটলো ভূমিহীন মুসলমান কৃষকদের।১৯০৫ থেকে ১৯১২– এই সময়সীমার মধ্যে বাংলাভাষী মানুষদের আসামে অবাধে যাওয়া আসার ফলে স্বাধীনতার সময়ে আসাম রাজ্য দেখা গেল বাংলাভাষীরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। আবার ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষকে দ্বিধাবিভক্ত করে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি আলাদা রাষ্ট্র গঠন করার সময়ে শ্রীহট্টের অঙ্গচ্ছেদ ঘটিয়ে মুসলিম অধ্যুষিত সিলেট জেলাকে পাকিস্তানের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়। তখন প্রায় তিন লক্ষ চা–বাগান শ্রমিক — যাদের অধিকাংশই হিন্দু — আসামে আশ্রয় নেয়। অনেক অবস্থাপন্ন হিন্দু পরিবার সিলেট ছেড়ে আসামে উদ্বাস্তু হয়। করিমগঞ্জ জেলা তৎকালীন সিলেটের অংশ থাকার দরুন এই জেলাও পাকিস্তানে চলে যেত, কিন্তু গণভোটে করিমগঞ্জের মুসলমান–হিন্দু সবাই ই ভারতের সঙ্গে থাকার পক্ষে ভোট দেয়, এবং ফলস্বরূপ এই অংশটুকুও আসামের সাথে সংযুক্ত হয়।
বাংলাভাষীদের এই সংখ্যাগরিষ্ঠতা অসমিয়া জনজাতি র কাছে অশনি সংকেত হিসেবে দেখা দিল। এবং অসমীয়া নেতাদের ছল, বল আর চাপের কাছে নতি স্বীকার করে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার অভিবাসী মুসলমানেরা সরকারীভাবে অসমীয়াকে মাতৃভাষা হিসেবে স্বীকার করতে বাধ্য হলেন। এবং এরই ফলে ১৯৭১ সালের লোকগণনাতে অসমীয়া জনসংখ্যা বেড়ে দাঁড়ালো ৬০.৪৯ শতাংশে। এবং অভিবাসী মুসলমানদের নতুন পরিচয় হয়ে উঠলো “নব্য অসমীয়া”।
এত সবের পরও উগ্র অসমীয়া জাতীয়তাবাদীদের দমন পীড়ন থেমে থাকলো না। ১৮৭৪ থেকে ১৯৪৭, এই এতগুলো বছর আসামে যে বাঙালীরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল এবং এই রাজ্যটাই কোনকালেই একভাষী ছিল না,এই ঐতিহাসিক তথ্যগুলোই এককথায় নাকচ করে দেয় তারা। অসমীয়া জাতীয়তাবাদ চুড়ান্ত রূপ ধারন করে। বাঙালি মাত্রেই বিদেশী এবং বহিরাগত চিহ্নিত করা প্রয়াস শুরু হয়। আসামের প্রতি বাঙালিদের আনুগত্য নিয়ে সংশয়, সন্দেহ ও প্রশ্ন উত্থাপিত হতে থাকে। অসমিয়া ভাষা ও সংস্কৃতির বিকাশের ক্ষেত্রে বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতিকে অন্তরায় হিসেবে গণ্য করা শুরু হয়। ‘আসাম শুধু অসমিয়াদের জন্য’ এই সংকীর্ণ উগ্র জাতীয়তাবাদকে উস্কে দিয়ে বাঙালিদের অধিকার হরণের নিরন্তর প্রচেষ্টা চলতে থাকে। বাঙালি অধ্যুষিত এলাকাগুলিকে সুপরিকল্পিতভাবে অসমিয়াকরণের প্রয়াস শুরু হয়। বাংলা মাধ্যমের স্কুলগুলোতে শিক্ষার মাধ্যম অসমিয়া ভাষা করার নির্দেশ দেওয়া হয় এবং শাসানো হয় অন্যথায় অনুদান বন্ধ করে দেওয়া হবে বলে। ১৯৪৭ থেকে ১৯৫১– এই চারবছরের মধ্যে আসামের ২৫০টি বাংলা মাধ্যমের স্কুলের মধ্যে ২৪৭টিই বন্ধ হয়ে যায়।
অসমীয়া ভাষাকে সরকারী ভাষা হিসেবে মেনে নিতে আসামের বাঙালিদের কোন আপত্তি ছিল না, কিন্তু অসমীয়া জনসংখ্যার পাশাপাশি যেহেতু সমগ্র বরাক উপত্যকায় বাঙালি জনসংখ্যাও বিশাল সংখ্যক, তাই তারা চাইছিলো বাংলা ভাষাকেও যেন সরকারী ভাষার স্বীকৃতি দেওয়া হয়। নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার্থেই বরাকের বাঙালিরা বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠার জন্যে গণতান্ত্রিক আন্দোলন শুরু করে।
১৯৬০ সালের ২১শে এবং ২২শে এপ্রিল। আসাম প্রদেশ কংগ্রেস প্রস্তাব গ্রহণ করে ‘অসমীয়াকে রাজ্য ভাষা করতেই হবে।’ অসমের মুখ্যমন্ত্রী তখন বিমলাপ্রসাদ চালিহা। মাসদুয়েকের মধ্যেই ঘোষিত হয় অসমীয়াকে রাজ্যভাষা করার জন্যে সরকার অতি শীঘ্রই একটি বিল আনছে। উগ্র অসমীয়া জাতীয়তাবাদীদের তান্ডব দ্বিগুন হয় এই ঘোষনায় এবং ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় সাম্প্রদায়িক আন্দোলন শুরু হয়।
২ জুলাই ১৯৬০, বরাক উপত্যকার শিলচরে ডাকা হয় ‘নিখিল আসাম বাংলা ও অন্যান্য অনসমীয়া ভাষা সম্মেলন।’ সেই সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন লুসাই–খাসিয়া–গারো–মণিপুরী, বাঙালী প্রতিনিধিরা। কেন্দ্রের কাছে আবেদন জানানো হয় ভাষার প্রশ্নে হস্তক্ষেপ করতে। ওদিকে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় শুরু হয় হত্যালীলা। দাঙ্গা বিধ্বস্ত এলাকা ছেড়ে ভাষিক সংখ্যালঘুরা পশ্চিমবঙ্গ, উত্তরবঙ্গ ও কাছাড়ে পালান। তৎকালীন আসামের মুখ্যমন্ত্রী চালিহার চরিত্রের একটি বিশেষ গুন ছিল, রাজ্যে কোন সংকটকালীন পরিস্থিতি তৈরী হলেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়তেন। এবারেও তাই হল, তিনি অসুস্থতার বাহানায় বিছানা নিলেন, আর অন্যদিকে পুলিশ এবং দাঙ্গাবাজরা এক হয়ে ভাষিক সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমন চালালো। বর্বরতায় সব দিক ছাড়িয়ে গেল সেই আক্রমণ।
১৫ ই আগষ্ট ১৯৬০। অসমীয়া উগ্রজাতীয়তাবাদীদের বর্বরতার প্রতিবাদে পশ্চিমবঙ্গ শোক দিবস পালন করল। সমস্ত সরকারী এবং বেসরকারী অনুষ্ঠান স্থগিত রাখা হল। লোকসভা অধিবেশনে পশ্চিমবঙ্গের প্রতিনিধিরা আসামের বাঙালি নিধন নিয়ে তুমুল হৈ হট্টোগোল শুরু করলে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নেহেরু গোবিন্দবল্লভ পন্থকে শান্তি দূত হিসেবে আসামে পাঠালেন, কিন্তু গোবিন্দবল্লভ পন্থের শান্তি ফর্মূলাই এককথায় নাকচ করে দিল ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা।
বরাকের প্রতিনিধিরা এবারে ছুটলেন কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে, দিল্লী। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার নির্বিকার। ১০ই অক্টোবর ১৯৬০, ভাষা বিল পাশ হয়ে গেল আসাম বিধানসভায়। নতুন আইনে সমগ্র আসামে সরকারী ভাষা হলো অসমীয়া। তীব্র প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে উঠলো সমগ্র বরাক উপত্যকা। স্লোগান উঠলো “রাজ্য ভাষা বিল আমরা মানি না, মানব না। বাংলাকে অন্যতম সরকারী ভাষা করতে হবে।”
১৫ই জানুয়ারি ১৯৬১, শীলভদ্র যাজীকে সভাপতি করে করিমগঞ্জে সম্মেলন ডাকা হলো। শিলচর সম্মেলনের প্রস্তাব ঘোষণা করা হলো। সমগ্র বরাক উপত্যকা জুড়ে তখন একটাই ধ্বনি, একটাই স্লোগান – “জান দেব তবু জবান দেব না।”
৫ই ফেব্রুয়ারি ১৯৬১, করিমগঞ্জের রমণীমোহন ইনস্টিটিউটে জনসম্মেলন ডাকা হলো। সম্মেলনের একটাই দাবি ‘বাংলাকে আসামের অন্যতম রাজ্য ভাষা রূপে মানতে হবে।’ আসাম সরকারের কাছে চিঠি পাঠিয়ে ১৩ এপ্রিলের ভেতর শেষ জবাব চাওয়া হলো। মেয়াদ উর্ত্তীর্ন হওয়ার পর ও চিঠির জবাব এলো না। বরাকের বাঙালিরা বৃহত্তর আন্দোলনের প্রস্তুতি শুরু করলো। ঘরে ঘরে সংগ্রাম পরিষদের স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী তৈরি হতে লাগল। এক নতুন মন্ত্রে দীক্ষিত হতে লাগল বরাকের নারী–পুরুষ–শিশু।
১৮ই মে ১৯৬১, ছাত্রছাত্রীদের ডাকে করিমগঞ্জ শহরে মাতৃভাষার দাবীতে শোভাযাত্রা বের হয়। বেলা বাড়তে বাড়তে সেই শোভাযাত্রা গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়। শাসকগোষ্ঠীর রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে সর্বস্তরের মানুষ যোগ দেন মাতৃভাষার ডাকে সেই শোভাযাত্রায়। শাসকগোষ্ঠী নিজেদের শক্তি দেখাতে সমগ্র করিমগঞ্জ জেলা সৈন্য দিয়ে ঘিরে ফেলে। জারি হয় ১৪৪ ধারা। রাস্তায় রাস্তায় মিলিটারির টহলদারি। করিমগঞ্জের সংগ্রাম পরিষদের দুই নেতা রথীন্দ্রনাথ সেন ও নলিনীকান্ত দাস সহ ছাত্রনেতা নিশীথরঞ্জন দাসকে গ্রেফতর করে শিলচর নিয়ে যাওয়া হয়। এই গ্রেফতারিতে সমস্ত বরাক বিক্ষোভে ফেটে পড়লো।
১৯শে মে ১৯৬১, ভোর চারটে থেকে বিকেল চারটে পর্যন্ত হরতালের ডাক দেয় কাছাড় জেলা সংগ্রাম পরিষদ। যেভাবে হোক ট্রেনের চাকা চলতে দেয়া হবে না। বিমানঘাঁটিতে বিমানের পাখা ঘুরবে না। অফিসের তালা খুলবে না। ভোর হতেই শত শত আন্দোলনকারী বসে পড়লো রেল লাইনের ওপর। বিমানঘাঁটিতে রানওয়ের ওপর শুয়ে পড়ল আন্দোলনকারীরা। সারি সারি আন্দোলনকারী দাঁড়াল অফিসের গেটের সামনে। শিলচর, করিমগঞ্জ, হাইলাকান্দি, পাথারকান্দি, বদরপুর সব ক’টি জায়গায় শান্তিপূর্ণ উপায়ে হরতাল শুরু হল।
করিমগঞ্জ রেল–স্টেশন ১৯ শে মে, ১৯৬১ । ভোরের ট্রেন আটকাতে আন্দোলনকারীরা রেল লাইন আগলে বসে পড়ে। কয়েকজন রেল লাইনের ওপর উপুড় হয়ে শুয়েও পড়ে। হঠাৎ পুলিশ ওদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে উদ্যত লাঠি হাতে। অমানুষিকভাবে পেটাতে শুরু করলো। কিন্তু আন্দোলনকারীদের রেল লাইন থেকে সরাতে পারল না। স্লোগানে স্লোগানে মুখর হয়ে উঠলো চারদিক – “মাতৃভাষা জিন্দাবাদ।” ‘জান দেব, তবু জবান দেব না।’
এবারে পুলিশ বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়লো হরতালে অংশ নেওয়া নারী আন্দোলনকারীদের উপর। মাথায় রাইফেলের বাট দিয়ে একের পর এক আঘাত শুরু করলো। কয়েকজন জ্ঞান হারিয়ে রেল লাইনেই লুটিয়ে পড়লো। বাকীরা রেল লাইন আঁকড়ে পড়ে রইলো। রাষ্ট্রীয় কুকুররা এরপর তাদের শাড়ী টেনে টেনে খুলতে লাগলো। সাথে বুটের আঘাত, রাইফেলের বাটের আঘাত, টেনে হিচড়ে রেল লাইন থেকে দূরে ছুঁড়ে ফেলা সব–ই চললো।
সরকার, তার তাবেদার প্রশাসন সমস্ত দিন চেষ্ঠা করলো ট্রেনের চাকা চালাতে আর প্রতিবারই আন্দোলনকারীদের মনোবলের কাছে হেরে গিয়ে পৈশাচিক অত্যাচার চালিয়ে গেল। আহত আন্দোলনকারীদের সংখ্যা এতোই বেশী ছিল যে করিমগঞ্জ অসামরিক হাসপাতালে আর কোন জায়গা ফাঁকা ছিল না। করিডোর, বারান্দা উপচে পড়েছিল আহতদের সংখ্যা। কয়েকশো আন্দোলনকারীকে এরেস্ট করে পুলিশ। শেষে জেলেও জায়গা নেই। অনেক আন্দোলনকারীদের এরেস্ট করে গাড়ি দিয়ে নিয়ে দূরে ছেড়ে আসা হয়, এবং সংগ্রাম পরিষদের গাড়ি পেছন পেছন ছুটে গিয়ে আবার আন্দোলনকারীদের নিয়ে আসার ব্যবস্থা করে। এক বিরল ঐতিহাসিক গণআন্দোলন।
শিলচর রেলস্টেশন, ১৯ শে মে, ১৯৬১। অসংখ্য নারী–পুরুষ আন্দোলনকারীর সাথে পিকেটিং এ যোগ দিয়েছিল ১৬ বছরের কিশোরী কমলা ভট্টাচার্য্য। মাত্র আগেরদিন সে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়েছে। মা‘কে বুঝিয়ে রাজি করে, মেজদিদির রাখা শাড়ীটা পরে সাথে ছোট বোন মঙ্গলা, ছোট ভাই বকুল ও বড়দির ছেলে বাপ্পাকে নিয়ে পিকেটিং এ সকাল সকাল ই হাজির হয়েছিল সে। দুপুরের দিকে একবার মা দুশ্চিন্তা করতে করতে নিজেই গিয়ে উপস্থিত হন রেল স্টেশনে। মাকে দেখতে পেয়েই ছুটে আসে কমলা। মায়ের সমস্ত দুশ্চিন্তা দূর করে মাকে বুঝিয়ে সুজিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দে। দুপুর দুটো, আন্দোলনের নেতৃস্থানীয়রা কিছুটা নিশ্চিত মারাত্মক অঘটন কিছু আর ঘটবে না। হরতাল সফল।
বেলা ২:৩৫ । বিনা প্ররোচনায় রাষ্ট্রের পুলিশ, মিলিটারি অবস্থানকারী আন্দোলনকারীদের নির্মমভাবে লাঠি ও বন্দুকের বাট দিয়ে পেটাতে থাকে। এলোপাথারি লাঠিচার্জে অবস্থানকারী সবাই ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। কমলার ছোটবোন মঙ্গলা পুলিশের লাঠির আঘাতে মাটিতে পড়ে যায় এবং সাহায্যের জন্য কমলার উদ্দেশ্যে চিৎকার করতে থাকে। কমলা তাকে তোলার জন্যে যখন ছুটে যাচ্ছে, ঠিক তখনই একটা বুলেট তাঁর চোখ ভেদ করে মাথায় গিয়ে লাগে। অন্যান্য আহত ও গুলিবিদ্ধ অবস্থানকারীদের সাথে কমলাকেও হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়। নিজের মাতৃভাষার স্বীকৃতি আদায়ে প্রাণ দেয় বিশ্বের প্রথম একটি বালিকা। মঙ্গলাকে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এক মাস বাদে তার জ্ঞান ফিরলেও বাকি জীবনটা সে শারীরিক ও মানসিকভাবে পঙ্গু হয়ে যায়।
রক্তে লাল হয়ে উঠেছিল সেদিন শিলচর প্ল্যাটফর্ম, রেল লাইন। মরতে মরতেও তাদের মুখ থেকে একটাই স্লোগান ধ্বনিত হয়েছিল -“মাতৃভাষা জিন্দাবাদ”। বাংলা ভাষার স্বীকৃতির দাবীতে কমলা সহ ১১জন ভাষাসৈনিক শহীদ হন এবং আহত হন অর্ধশতাধিক। প্রশাসন ১৪৪ ধারা জারি করে। শোকে স্তব্ধ ও হতবাক হয়ে উঠে সমগ্র বরাক উপত্যকা। ২০ মে শোকার্ত আন্দোলনকারীরা ১৪৪ ধারা উপেক্ষা করে গিয়ে ১১ জন শহীদের লাশ নিয়ে বৃহত্তর শোকমিছিল বের করে। শেষ পর্য্যন্ত আসাম সরকার দাবী মেনে নিতে বাধ্য হয়। বাংলাকেও আসামের সরকারী ভাষা হিসেবে ঘোষনা করা হয়।কিন্তু লড়াই এখানেই থেমে থাকেনি। আবারও ১৯৭২ সালের ১৭ আগস্ট বাংলা ভাষা রক্ষার জন্য শহীদ হন করিমগঞ্জের বিজন চক্রবর্তী (বাচ্চু)।
১৪ই এবং ১৫ ই ফেব্রুয়ারী ১৯৮৩, দরং জেলার চাউলখোয়ায় চাপরির দশটি গ্ৰামে অসমীয়া উগ্র জাতীয়তাবাদীদের বর্বর আক্রমণে পাঁচ শতাধিক মুসলমান এবং ভাষিক সংখ্যালঘু মানুষ নিহত এবং হাজারের অধিক মানুষ আহত হোন৷ আক্রমণের কারন এরা প্রত্যেকেই বাংলাভাষী।
১৮ই ফেব্রুয়ারী ১৯৮৩, নগাও জেলার নেলীতে উগ্ৰ অসমীয়া জাতীয়তাবাদীদের আক্রমণে তিন হাজার মুসলমান এবং ভাষিক সংখ্যালঘু মানুষের মৃত্যু হয়৷ বর্বরতার সেই ইতিহাস নাৎসি বাহিনীকেও লজ্জায় ফেলে দেয়। একইদিনে কামরূপ জেলার গোরেশ্বর অঞ্চল, দরং জেলার খৈরাবারী, রামপুর ইত্যাদি অঞ্চলে বহু লোক আক্রান্ত হয়েছিলেন৷
১৯, ২০, ২১ ফেব্ৰুয়ারী ১৯৮৩, ধেমাজী জেলার চাপরি , মাজরবারী, রামনগর, কাকোবারী, টঙালী–নলবারী, চিমেন চাপরি ইত্যাদি অঞ্চলে মিসিং জনগোষ্ঠীর একাংশ লোক এবং অসম আন্দোলনের সমৰ্থক বাহিনীর লোকেরা ‘বিদেশী খেদাও’র নামে সেখানকার বাঙলা ভাষী মানুষের উপর আক্রমণ চালায়৷ একইভাবে ধেমাজী‘র বিষুপুর, শান্তিপুর ইত্যাদি অঞ্চলেও বাংলাভাষী লোকের ওপর আক্রমণ চলে৷ ফেব্ৰুয়ারী মাসেই লক্ষিমপুর জেলার বাধকরা অঞ্চলে প্রায় ৫০ জন মানুষকে হত্যা করা হয় জ্বালিয়ে দেওয়া হয় বেশ কয়েকটি গ্ৰাম৷
ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি আবার শুরু হয় ২০১০ সালের ২১ জুলাই থেকে। ডি ভোটার, এন আর সি ইস্যুতে ২০১৯ এর শুরু অব্দি একাধিক বাঙালি হিন্দু এবং মুসলমান বেছে নিয়েছেন আত্মহননের পথ। কিন্তু যে সময়ে ধর্ম বর্ণের উর্ধ্বে উঠে উগ্র অসমীয়া জাতীয়তাবাদী চক্রান্তের বিরুদ্ধে বৃহত্তর বাঙালি জাতিসত্ত্বা, বাঙালি ঐক্যের প্রয়োজন, ঠিক সে সময়েই আসামে খন্ডিত জাতিসত্ত্বা হয়ে বাঙালি ধুকে ধুকে বেঁচে আছে। হিন্দু বাঙালিকে ভাবানো হচ্ছে মুসলমান বাঙালির জন্যেই আজ তার এই দুর্দশা আর মুসলিম বাঙালি হিন্দু বাঙালিকে ভরসার যোগ্যই মনে করছে না। দুই দলেরই এই শত্রুতা যে অসমীয়া জাতীয়তাবাদীদের আরো শক্তিশালী করে তুলছে সেটা এই দুই দল নিজেরাও বুঝতে পারছে না।
আসামে ভাষিক সংখ্যালঘুদের সম্মানের সাথে বেঁচে থাকার অধিকার ৫০–৬০ এর দশক থেকে এখন অব্দি এমনভাবে খৰ্ব করা হয়েছে যে, বর্তমানে তার এক ভয়ানক পরিণতি ভোগ করছে ভাষিক সংখ্যালঘুরা, আরো স্পষ্ট করে বললে বাঙালিরা। এহেন পরিস্থিতিতে ১৯কে শুধু একদিন উদযাপনের উৎসব হিসাবে সীমাবদ্ধ না রেখে, শুধুমাত্র একদিনের জন্যে বাঙালি না সেজে, আমাদের প্রয়োজন উনিশের চেতনাকে নিজেদের সত্ত্বার মধ্যে অনুভব করে আগামীর বৃহত্তর লড়াইয়ের জন্যে প্রস্তুত হওয়ার। প্রজন্মকে এই চেতনায় উদ্বুদ্ধ করা এবং নিজেদের মুখের ভাষাকে, অস্তিত্বকে সুরক্ষিত করার স্বার্থে সংগঠিত হওয়ার।
‘৫২ সালের একুশ ই তো পথ দেখিয়েছিল উনিশকে… এবারে উনিশ আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাক সুনিশ্চিত ভবিষৎ এর দিকে…।
“সে–আলো টলে না মৃত্যুর কালো ঝড়ে
তর্জনি তুলে জেগে থাকে ঘরে ঘরে,
দুলিয়ে গলায় তাজা বুলেটের মালা
পার হয়ে শত শ্মশান ও কারবালা
হাজার মুখের মিছিল দিয়েছে পাড়ি
উনিশে মে আর একুশে ফেব্রুয়ারি।”
(প্রবন্ধটি নবযুগ ব্লগ (www.nobojug.blog) থেকে অনুমতিক্রমে সংগৃহীত। এটি নবযুগ ব্লগে ২০ মে ২০১৯ তারিখে প্রকাশিত হয়। — বঙ্গরাষ্ট্র)