লিখেছেনঃ কাজী মোহাম্মদ শীশ, আপডেটঃ May 31, 2009, 6:00 PM, Hits: 16560
পেশায় তিনি ছিলেন একজন ইটভাটার শ্রমিক। মারা গেছেন ১৯৯২ সালে। বয়স তখন তার ৬৪। নিজস্ব কৃষি জমিতে ফসল ফলিয়ে কর্মজীবনের শুরু। তার পেশার সফলতা-বিফলতা বা জীবনসংগ্রাম কোন বিষয়েই আমাদের জানা নেই। তা সত্ত্বেও তাকে স্মরণ করছি একটি ইংরেজি দৈনিকের খবর পড়ে। খবরটার শিরোনাম ছিল “Tale of an unsung tree lover in Bogra” (বাংলা কি এমন হবে ’বগুড়ার একজন বৃক্ষপ্রেমিকের অগীত কাহিনী’)।
বারতিনেক খবরটা পড়ার পর নিজের কাছে নিজে কেমন সংকুচিত হয়ে উঠলাম। বিষয়টা পরিবেশপ্রেমিক ও পরিবেশ রক্ষায় একজন আলিমউদ্দিনের আজীবন সাধনা নিয়ে। পরিবেশ নিয়ে চিন্তা-ভাবনা, কিছু লেখালেখি, সেমিনার-আলোচনা-সংবাদ সমেমলনে কখনও কদাচিৎ টেলিভিশনেও কথা-বার্তা আমিও বলেছি এবং বলছি। পরিবেশ রক্ষার কাজে নিয়োজিত কয়েকটি সংগঠনের সঙ্গেও জড়িত আছি। আর এখানেই কেমন আত্মপীড়ন আমাকে কুণ্ঠিত করে তুলল। আর সবার কথা জানি না - নিজের স্বীকারোক্তি দিচ্ছি। আমার এসব লেখা যখন ছাপার অক্ষরে পড়ে অন্যের প্রশংসা কুড়িয়েছে, পত্রিকায় আলোচনার ছবি উঠেছে, নাম ছাপা হয়েছে, টেলিভিশনের ছবি দেখে পরিচিতজনরা খুশি হয়েছেন তখন নিজের মধ্যে কেমন একটা পুলক অনুভব করেছি। কখনও-বা স্বল্প প্রচার অথবা প্রচার না পাওয়ায় মনটা কেমন বিষন্ন হয়েছে। একই সঙ্গে অস্বস্তি বোধে মন ছেয়ে যায় যখন অনুভব করি পরিবেশ রক্ষায় নিয়ত ব্যস্ত অনেক কীর্তিমান ব্যক্তির এমন কি সংগঠনের মধ্যে বিপরীত ধর্মী কার্যকলাপ নিয়ে প্রশ্ন উঠলে - তার সত্যতা যাচাইয়ে সৎ সাহস আমরা দেখাই না। প্রতিকার বা প্রতিবাদ তো পরের কথা। আমি জানি না পরিবেশ রক্ষায় নেতৃত্বে যারা আছেন তারা নিজেদের কার্যকলাপ ও সফলতার আনন্দেই বিভোর থাকেন নাকি মাঝে মাঝে বিবেকের মুখোমুখি হন। আয়নায় নিজের মুখ দেখেন। আমি জানি না ধান ভানতে শিবের গীত গাইলাম কি-না। আলিমউদ্দিন প্রামাণিকের গাছকে ভালবাসার খবরটা পড়ে আমার মনে এসব প্রশ্ন নতুন করে জেগেছে। আর সেটা যে অপ্রাসঙ্গিক নয়, আলিমউদ্দিনের বৃক্ষপ্রেমের কাহিনী তা বলে দেবে। সংবাদের শুরুটা এ রকম, “Brick Kiln Labourer Alimuddin Pramanik of Dupchachia Upazila set an imitable example by plating 15,000 trees, mostly palm and date, on government land out of his caring thoughts for the environment (দুপচাঁচিয়া উপজেলার ইটভাটার শ্রমিক আলিউমদ্দিন প্রামাণিক ১৫ হাজার গাছ রোপন করে একটি অনুকরণীয় উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন। এগুলোর অধিকাংশ তাল ও খেজুর গাছ যা সরকারি জমিতে লাগানো হয়েছে। পরিবেশ রক্ষার ভাবনা থেকেই তিনি এ কাজ করেছেন।)
আমরা এও জানতে পেরেছি, আজ থেকে প্রায় পনের বছর আগে ১৯৯২ সালে আলিমউদ্দিন পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেও তার লাগানো গাছগুলো আজও বগুড়া-নওগাঁর রাস্তার দু’পাশে দুপচাঁচিয়া থেকে চৌমোহনী পর্যন্ত প্রায় তিন কিলোমিটার জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে। এ ছাড়াও মসিন্দা, কামারগাছি ও চট্টাগারি গ্রামের প্রায় ২ কিলোমিটার জুড়ে তিনি গাছ লাগিয়েছেন। আলিমউদ্দিন প্রামাণিক ১২ জন পরিবারের সদস্য রেখে মারা গেছেন। তার পরিবারের তরফ থেকে জানানো হয়েছে যে, নতুন প্রজন্মের জন্য একটি সুন্দর প্রাকৃতিক পরিবেশ রেখে যাওয়ার উদ্দেশ্যেই তিনি গাছগুলো লাগিয়েছেন। তারা আরও জানিয়েছেন, সরকারি জায়গায় গাছগুলো লাগানোর কারণ হলো ভবিষ্যতে যাতে যে কেউ এমন কি তার নিজের বংশধররাও এই গাছগুলোর মালিকানা দাবি করতে না পারেন। আলিমউদ্দিনের ছেলে ভুট্টো প্রামাণিক বাবার সঙ্গে গাছ রোপণে সাহায্য করতেন। তিনি জানিয়েছেন তাল-খেজুরের চারা তার বাবা কখনো কিনে আনতেন, কখনো বা অন্যের কাছ থেকে সংগ্রহ করতেন। ছাত্রদের কাছে তিনি ফেলে দেয়া গাছের বীজ চেয়ে নিতেন। ১৯৮২ থেকে ১৯৮৭ পর্যন্ত আলিমউদ্দিন এভাবেই ১৫ হাজার তাল ও খেজুর গাছ এবং নারিকেলসহ আরো অন্যান্য কিছু গাছ লাগান।
ভুট্টো এটাও জানিয়েছেন, তার বাবার লাগানো সাড়ে ১২ হাজার খেজুর এবং আড়াই হাজার তাল গাছের মূল্য বর্তমান বাজার দরে প্রায় ৩ কোটি টাকা হবে, যদিও তাদের ১২ জনের পরিবার অভাব-অনটনের মধ্যে জীবনযাপন করছে। আলিমউদ্দিনের তাল ও খেজুর গাছ লাগানোর মূল কারণ হলো গরু-ছাগল এগুলোর চারা খায় না। ফলে অতিরিক্ত যত্ন নেয়ার প্রয়োজন হয় না। এ তথ্যও জানা গেছে তার ছেলের কাছ থেকে।
আলিমউদ্দিনের এক সময় ২৩ বিঘা কৃষি জমি ছিল। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, পরিবারের অর্থ জোগান ও গাছ লাগানোর প্রয়োজনে তিনি সেগুলো বিক্রি করে দেন এবং জীবনের শেষ বয়সে ইটের ভাটায় শ্রমিকের কাজ নেন। কিন্তু আলিমউদ্দিনের জীবনের সার্থকতা হলো - তার ছেলেমেয়েরা তাদের বাবার জন্য গর্ব অনুভব করেন। তারা জানেন, তাদের বাবা ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যতের কথা না ভেবে তার সব অর্থ-শ্রম ব্যয় করেছেন পরিবেশ রক্ষার কাজে এবং এ জন্য তাদের কোন মর্মপীড়া নাই।
সরকারিভাবে আলিমউদ্দিন তার কাজের কোন স্বীকৃতি কখনও পাননি। স্থানীয়রা এখনও তার কাজের কথা জানেন। কিন্তু সরকারের তরফ থেকে এ বিষয়ে কোন তথ্য সংগ্রহ করা হয়নি। এমনকি তার লাগানো গাছগুলো সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণের জন্যও কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি। বরং কখনও কখনও গাছ কাটা হয়েছে বলেও স্থানীয়রা জানিয়েছেন। আলিমউদ্দিন সরকারিভাবে স্বীকৃতি পান এবং তার লাগানো গাছগুলো সযত্নে রক্ষণাবেক্ষণ করা হোক এটা আমাদের একান্ত কাম্য। একজন ’পরিবেশবাদী’ শ্রমিকের নাম ওই এলাকা থেকে দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ুক তাও আমরা চাই। সেই সঙ্গে আলিমউদ্দিনের প্রতি আমার এই শ্রদ্ধা ও সালাম তার পরিবারের কাছে পৌঁছে দিতে চাই। জানি না সংবাদপত্রে প্রকাশিত এ লেখা তার পরিবারের কাছে পৌঁছবে কিনা। তবে সামান্য একটা অনুরোধ জানাব, ওই এলাকার পত্রিকা পাঠকদের কাছে। তাঁদের কারো চোখে যদি লেখাটা পড়ে তবে যেন একটু কষ্ট স্বীকার করে আলিমউদ্দিনের পরিবারকে আমার ভালবাসা ও আলিমউদ্দিনের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি জানিয়ে দেন। এভাবেই আলিমউদ্দিনের গাছকে ভালবেসে পরিবেশ রক্ষার প্রচেষ্টার সঙ্গে একাত্ম হতে চাই।
(দৈনিক সংবাদ : আশ্বিন ২৪, ১৪১৪; অক্টোবর ৯, ২০০৭ সালে প্রকাশিত। নিবন্ধটি কাজী মোহামমদ শীশ-এর ’কালের চোখে আমার দেশ’ থেকে সংকলিত। প্রকাশক - জনান্তিক, আজিজ কো-অপারেটিভ মার্কেট, বইপাড়া, শাহবাগ, ঢাকা। প্রকাশ কাল - একুশে বই মেলা, মাঘ ১৪১৪; ফেব্রুয়ারী ২০০৮।)
অনলাইন : ১ জুন, ২০০৯