লিখেছেনঃ কাজী মোহাম্মদ শীশ, আপডেটঃ May 17, 2009, 6:00 PM, Hits: 16410
সব সম্ভবের দেশ বাংলাদেশ। ২০০৭ সালের শেষ কয়েক মাসের উল্লেখযোগ্য ঘটনার একটি দেশের মহামূল্যবান পুরাকীর্তি ও প্রত্নসম্পদ ফ্রান্সের গিমে জাদুঘরে প্রেরণকে কেন্দ্র করে ছাত্র-শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, শিল্পীসহ বিভিন্ন মহলের মধ্যে নানা প্রশ্ন জেগে ওঠা এবং সরকারের বিষয়টাকে একেবারে যান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গিতে বিবেচনা করা। সেই সাথে ১৮৭টি প্রত্নসম্পদ ২৩টি বাক্সে প্যাকিং করে প্রেরণ করার উদ্যোগ গ্রহণ। উলেখ্য প্রত্নসম্পদগুলো দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের বিভিন্ন জাদুঘর ও সংরক্ষিত স্থান থেকে সংগ্রহ করা হয়। দেশের বরেণ্য ব্যক্তি, ছাত্র-শিক্ষক, শিল্পী ও বুদ্ধিজীবীদের আবেগ, অনুরোধ ও বিক্ষোভকে উপেক্ষা করে ২০০৭ সালের ৩০ নভেম্বর ঢাকার জাদুঘর থেকে ১০টি বাক্সে ৪২টি প্রত্নসম্পদ বিমান বন্দরে আনা হয় এবং ১ ডিসেম্বর ফ্রান্সে নিয়ে যাওয়া হয়।
বৎসরের প্রায় শেষ দিকে ২১ ডিসেম্বর ঈদের দিন বিকেলে আবারও সকল প্রতিবাদ, অনুরোধ ও বিক্ষোভকে উপেক্ষা করে হোম বাউণ্ড কুরিয়ার সার্ভিসের ৪টি ট্রাকে করে ১৩টি বাক্সে অবশিষ্ট ১৪৫টি প্রত্নসম্পদের চালান জিয়া আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে নেয়া হয়। রাত ২টার সময় এয়ার ফ্রান্স ভয়েজার এয়ারলাইন্স কর্তৃপক্ষের কাছে কার্টুনগুলো হস্তান্তর করা হয়। বিমানে ওঠানোর পর চূড়ান্ত পরীক্ষায় ধরা পড়ে ১৩টির মধ্যে ১টি বাক্স নেই যার মধ্যে দু’টি বিষ্ণু মূর্তি ছিল। ফ্রান্সের গিমে মিউজিয়ামে পাঠানোর সময় জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো কমপেক্স এলাকা থেকে ১৫০০ বৎসর আগের ৬ষ্ঠ ও ৭ম দশকের এই দুর্লভ দু’টি বিষ্ণুমূতি হারিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে ফরাসি দূতাবাসের চার্জ দ্য এফেয়ার্স জা রমনিসিয়ান যে বক্তব্য দেন তা যেমন বিস্ময়কর তেমনি অগ্রহণযোগ্য। তিনি বলেন, ’. . . . .. . যারা ফ্রান্সের গিমে মিউজিয়ামে এসব পুরাকীর্তি প্রদর্শনের পেছনে বাধা দিয়েছে তাদেরই একটি অংশ বিষ্ণমূর্তি দু’টি সরিয়েছে বলে ধারণা করেন তিনি। পুরাকীর্তিগুলো পাঠানোর সময় বিভিন্ন ধরনের বাধা আসার কারণে একটি সংঘবদ্ধ চক্র এসব ঘটনা ঘটাতে পারে বলে মনে করে তিনি আরও বলেন, দেশের অনেকেই জানত এসব পুরাকীর্তি ফ্রান্সে যাচ্ছে। এ সময় বিরোধিতাকারীদের একটি চক্র বাংলাদেশ ও ফ্রান্স সরকারকে বিব্রত করার জন্যই এমন একটা অপরাধ করেছে। . . . .. . .. এতটা নিশ্চিতভাবে একটি গোষ্ঠীকে দায়ী করছেন কীভাবে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ঢাকা থেকে বগুড়ায় বাংলাদেশ ব্যাংকের টাকা পাঠানোর সময় গন্তব্য স্থান যদি সবাই জানে তাহলে একটা অঘটন ঘটে যেতে পারে। বিষয়টি বেশি জানাজানি হওয়ার জন্যই এমন ঘটনা ঘটেছে বলে জানান তিনি।”
প্রত্নসম্পদ বিদেশে প্রেরণ, ফরার্সি চার্জ দ্য এফেয়ার্সের বক্তব্য, চুরি হওয়ার পর পত্র-পত্রিকায় নানা চাঞ্চল্যকর তথ্য, টেলিভিশনে প্রচারিত নানা আলোচনা আমাদের বিস্মিত, বিক্ষুব্ধ, লজ্জিত ও শঙ্কিত করে তোলে।
এ বিষয়ে আরো কিছু বলার আগে দেশের ঐতিহ্য পাচারের প্রচেষ্টা ও রক্ষা করাকে কেন্দ্র করে নির্মিত একটি চলচ্চিত্রের কথা মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে। সুহৃদ পাঠক, চলচ্চিত্রের কোন চরিত্রের সাথে ফরাসি চার্জ দ্য এফেয়ার্সের কোন সামঞ্জস্য খুঁজে পেলে তার দায়ভার চলচ্চিত্র নির্মাতার।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের একটি কাল্পনিক ঘটনাকে কেন্দ্র করে নির্মিত প্রতীকধর্মী এই সিনেমাটি দেখেছিলাম সম্ভবত গত শতাব্দীর ষাট দশকের শেষের দিকে। সিনেমার নাম ’দি ট্রেন’। সংক্ষিপ্ত কাহিনী, জার্মানদের দখলে ফ্রান্সের প্যারিস শহর। সময় আগস্ট ১৯৪৪। প্যারিসে রয়েছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম চিত্রশিল্পীদের আঁকা ছবি সমৃদ্ধ মিউজিয়াম। যাঁদের চিত্র রয়েছে তাঁদের মধ্যে রয়েছেন গঁগাঁ, ভ্যানগগ, রেনোয়া, ম্যানে, মিরো ও আরো অনেকে। একজন দখলদার জার্মান কমান্ডার ছবি পাগল কর্নেলের ইচ্ছে এ’ সব অমূল্য চিত্রকর্ম জার্মানির বার্লিন শহরে নিয়ে যেতে হবে এবং তা সযত্নে, কোন রকম নষ্ট না করে। যুদ্ধের মধ্যে তার কাছে একটি উপায়ই আছে সেগুলি নেয়ার, তা হলো ট্রেনে করে ছবিগুলো জার্মানিতে পৌঁছে দেয়া। বহু যত্নে প্যাকিং করে ট্রেনে তোলা হলো ছবিগুলো। এদিকে যুদ্ধে পরাজিত মিউজিয়ামের পরিচালিকা ফরাসি মহিলার শত ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও ভেবে পান না কীভাবে জার্মান কর্নেলকে নির্বৃত্ত করবেন ফরাসিদের এসব অমূল্য সংগ্রহ, দেশের ঐতিহ্য পাচার করা থেকে। অনেক অনুনয়-অনুরোধ ব্যর্থ হলো। জার্মান কমান্ডারের বক্তব্য একটাই। এসব সাধারণ ফরাসিরা কি বুঝবে চিত্রকর্মের! যারা সত্যিকারের সমঝদার তাদের কাছেই এগুলো থাকতে হবে। শেষ পর্যন্ত মিউজিয়ামের পরিচালিকা ফরাসি গুপ্ত বাহিনীর সাহায্য নিলেন। তারা ট্রেন চালকসহ ট্রেনের অন্যান্য কর্মচারী এবং বিভিন্ন রেল স্টেশনের কর্মচারীদের জানিয়ে দিল ট্রেনটিকে কিছুতেই ফরাসির বাইরে যেতে যেন দেয়া না হয়। ট্রেন চালকদের মধ্যে একজনকে নেতা হিসেবে দায়িত্ব দেয়া হলো। তার নাম লাবিশ (Labiche) । নেতা তার সঙ্গীদের নিয়ে কাজে নামার আগে জানালো যদি শেষ পর্যন্ত তারা জার্মান কর্নেলকে রুখতে না পারে তবে ট্রেনটি উড়িয়ে দিতে পারবে। তাদের বলা হলো তা করা যাবে না। কারণ এ ট্রেনে রয়েছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সব ছবি, এগুলো ফরাসি দেশের অংশ, এগুলো ফ্রান্সের স্বপ্ন, ফরাসিবাসীর গর্ব, ফ্রান্সের গৌরব (Art are importance, Part of France, Vision of France, Our Pride, Glory of France) সরলমনা এক গাড়ী চালকের জিজ্ঞাসা এগুলোর কি কোন কপি নেই? অক্ষতভাবে ট্রেনটিকে ফ্রান্সেই রেখে দেয়ার প্রচেষ্টা শুরু হলো। আর শুরুতেই একজন পাপা বুল (Papa Boule) নামের মোটাসোটা দক্ষ ট্রেন চালক যার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল এ ট্রেনে আছে ‘Glory of France’ (ফ্রান্সের গৌরব) - সে ইঞ্জিন অকেজো করে ট্রেনটা ব রাখার বোকামি প্রচেষ্টা নিল। ধরা পড়ে তাকে জীবন দিতে হলো। ট্রেন চালানোর দায়িত্ব সরাসরি লাবিশকে দেওয়া হলো। পাহারা রাখা হলো জার্মান সৈন্য। তারপর কাহিনী এগিয়ে গেছে - ফিসপ্লেট খুলে ট্রেন ব রাখা হয়েছে, আবার তা ঠিক করে ট্রেন চালানো হয়েছে - যেখানেই বাধা এসেছে সেখানেই বাধাদানকারীদের হত-আহত করেছে জার্মান সৈন্যরা। তারপরও অত্যন্ত চকমপ্রদভাবে ট্রেনচালক ও বিভিন্ন স্টেশনের কর্মচারীরা ট্রেনটি ফ্রান্সেই রেখে দেয়। একের পর এক স্টেশনের নাম পরিবর্তন করে (সাইন বোর্ড বদলিয়ে) ভুল রাস্তায় নিয়ে গিয়ে ট্রেন আবার যেখানে থেকে রওনা হয়েছিল সেখানে ফেরত আসে। ইতোমধ্যে জার্মানরা হেরে যাওয়ায় নতুন করে ঐ কর্নেল আর চিত্রকর্ম নিয়ে যাওয়ার দুষকর্মটি করতে পারে না। যা পারে তাহ’ল ট্রেনের ইঞ্জিনের দু’পাশে জিমিম হিসেবে রাখা নিরীহ ও সাধারণ নিরাপরাধ বেশ কিছু ফরাসিকে গুলি করে মেরে ফেলতে। তারপর সেই কর্নেল ও লাবিশ পরসপরের মুখোমুখি হয়। ঐ মৃতদেহগুলো দেখে এই প্রথম লাবিশকে বিচলিত হতে দেয়া যায়। আর কর্নেল সেটা দেখে দম্ভোক্তি করে বলে, ‘This is your prize---- you won by sheer luck. You stop me without knowing what you are doing----you are nothing Laibche a lump of flesh. The paintings are mine. They always will be. Beauty belongs to a man who can appreciate it. They always belong to me or a man like me. Now this minute you could not tell me why did what you did. (সামনেই তোমার কৃতকর্মের পুরস্কার। ---নিছক ভাগ্যক্রমে তুমি জিতে গেছো। তুমি কি করছো তা না জেনেই তুমি আমাকে বাধা দিয়েছো। তুমি একটি জড় পদার্থ বৈ কিছু নও লাবিশ। এই ছবিগুলো আমার এবং এইগুলি চিরদিন আমারই থাকবে। সুন্দর জিনিসের উপর তারই অধিকার আছে যে তার মূল্য বুঝতে পারে। ঐগুলির উপর অধিকার সব সময়ের জন্য আমার বা আমার মতো কোন ব্যক্তির। এই মুহূর্তে তুমি বলতে পারবে না তুমি যা করেছো কেন করছো।) অসহায় মৃতদেহগুলোর উপর আর একবার তাকিয়ে লাবিশ কর্নেলের দিকে ব্রাশ ফায়ার করতে থাকে।
এতো দীর্ঘ গল্পটা জানানোর কারণ হলো ‘ফরাসির গৌরব’, ‘ফরাসিদের স্বপ্ন’, ‘ফরাসির ঐতিহ্য’ রক্ষা করতে পেরেছিল গুটি কয়েক মানুষ যাঁরা কোন দেশ বাঁচাতে নয়, কোন অর্থ অর্জনকারী উন্নয়নমূলক শিল্প-সম্পদ বাঁচানোর জন্য নয়, এমনকি মানুষের জীবন বাঁচানোর জন্য নয়, কেবল ‘ ফরাসির গৌরব’ (glory of France) কিছু চিত্রকর্ম যা তারা নিজেরা কখনো চোখে দেখেনি জীবন দিয়ে তা রক্ষা করেছে।
সাধারণ ফরাসিদের এমন বীরত্ব গাথার পর বাংলাদেশের ফরাসি চার্জ দ্য এফেয়ার্সের স্থুল মন্তব্য নিয়ে আলোচনা করতে রুচিতে বাধে। তবু যখন প্রত্নসম্পদ প্রেরণের সাথে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ব্যাংকের টাকা প্রেরণের কথা তিনি বলেন তখন আর একজন ফরাসি প্রকৌশলীর কথা মনে পড়ে যায়। পেশার প্রয়োজনে ফরাসি উপদেষ্টা ফার্মের সাথে আমাকে দীর্ঘদিন কাজ করতে হয়েছে। সেই ফার্মের প্রকৌশলীসহ সকল উপদেষ্টাই ফরাসি দেশের। তাদের প্রায় সকলকেই নির্দিষ্ট কাজের গণ্ডির বাইরে শিল্পকলা, চলচ্চিত্র, দর্শনীয় স্থান ইত্যাদি বিষয়ে আগ্রহী হতে দেখেছি। কিন্তু একজন প্রকৌশলী ছিলেন - তাঁর বাস প্যারিস শহরে। প্যারিস বাস করলে আইফেল টাওয়ার চোখে পড়বেই। তিনিও সেটা দেখেছেন। কিন্তু কখনো আইফেল টাওয়ারে ওঠার আগ্রহ বোধ করেন নি। ল্যুভর মিউজিয়াম দেখতে যাননি কখনো। জানি না বাংলাদেশের ফরাসি চার্জ দ্য এফেয়ার্সও তেমন কোন ব্যক্তি কিনা। তাঁকে কে বোঝাবে, গার্মেন্টসের মালামাল রফতানি, পেঁয়াজ আমদানি অথবা চামড়া রফতানি আর পুরাকীর্তি ও প্রত্নসম্পদ প্রেরণ এক কথা নয়।
প্রসঙ্গক্রমে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কাল্পনিক কাহিনী থেকে একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে ঘটে যাওয়া এক বাস্তব সত্যের আমরা কেন মুখোমুখি হই না? আমরা পৃথিবীর সকল মানুষ চেয়ে চেয়ে দেখেছি আমেরিকা ইরাকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে ইরাকের, শুধু ইরাকের কেন মানব সভ্যতার সমস্ত ইতিহ্যকে, গৌরবকে কীভাবে ধ্বংস করেছে! ইরাক যুদ্ধে মানব সভ্যতার অন্যতম পীঠস্থান ইরাকের জাদুঘর ও লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত ঐতিহ্যের ধ্বংস হওয়া বা খোয়া যাওয়া অমূল্য সম্পদের সঠিক হিসাব এখনও মেলেনি। কিন্তু প্রাথমিকভাবে জানা তথ্য থেকে এ প্রশ্ন সহজেই এসে যায় মানবিক দিক বিবেচনায় আধুনিক সভ্যতা প্রাগৈতিহাসিক সভ্যতার তুলনায় বর্বর হয়ে উঠছে কিনা? ইরাকের ধ্বংসপ্রাপ্ত ঐতিহ্যের কথা বলার আগে বলতে হয় প্রাচীনকালে গ্রীস দেশের পণ্ডিতরা ইরাকের নাম রেখেছিলেন ‘মেসোপটেমিয়া’ যার অর্থ দু’নদীর মাঝের দেশ। আমরা দেখি দজলা ও ফোরাত নদীর মাঝামাঝি ইরাকের অবস্থান, তবে শুধু প্রাচীন, মেসোপটেমিয়া নয়, আশপাশের আরও স্থান নিয়ে প্রায় পাঁচশ’ বছর আগে ইরাক নামে দেশটি গড়ে উঠেছে। মেসোপটেমিয়ার দক্ষিণ ভাগের সুমের অঞ্চলের মানুষ প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে কৃষি সভ্যতা গড়ে তুলেছিল।
এমনই একটি ঐতিহ্যবাহী দেশের রাজধানী বাগদাদে রয়েছে পৃথিবীর অন্যতম সমৃদ্ধিশালী সপ্তম বৃহত্তম জাদুঘর। ইরাক যুদ্ধের আগে এতে ছিল এক লাখ সত্তর হাজারের বেশি নিদর্শন। পৃথিবীর প্রথম কৃষি কাজের নিদর্শন, প্রথম মহাকাব্য, প্রথম লিখিত আইন সংহিতা ‘হাম্বুরাবির কোড’, পাঁচ হাজার বছরের পুরন ‘ওয়ার্কা’ ফুলদানি, আকেদীয় ব্রোঞ্জমূর্তি ‘বাসিকি’ এসবই হয় ধ্বংস হয়েছে নতুবা খোয়া গেছে। যেহেতু নিদর্শনগুলোর অনেকগুলোই কেবল একটি করে ছিল তাই হাজার হাজার বছর আগের প্রস্তরযুগ থেকে শুরু করে সুমেরীয়, আসিরীয়, আকেদীয়, ব্যাবিলোনীয়, মাসানীয়, আব্বাসীয় প্রভৃতি যুগের অমূল্য নিদর্শনের অনেক কিছুই পৃথিবী থেকে হারিয়ে গেল ইরাক যুদ্ধে। প্রকাশিত হয়েছে আরো নানা ভয়াবহ তথ্য। জাদুঘরে মিসরীয় সংগ্রহশালায় ছিল অনেক প্রত্নসম্পদ; কিন্তু যেহেতু এগুলোর একাধিক নিদর্শন অন্য দেশে আছে তাই এগুলো খোয়া যায়নি। স্বস্তি ও সান্ত্বনার কথা এগুলো অক্ষত রয়েছে। অন্যদিকে নিখুঁতভাবে রাখা অনেক নিদর্শনের ‘রেপ্লিকা’ লুটেরারা ছুঁয়েও দেখেনি। কিন্তু চোখের পানি ধরে রাখা সম্ভব হয়না যখন জানা যায় পৃথিবীর মানুষ আর কখনও খুঁজে পাবে না আসিরীয় খোদাই করা মার্বেল, সুমেরীয় মাটির পাত্র, প্রাচীন লিপি খোদাই বিরাট পাথর, ব্যাবিলোনীয় মূর্তি। আরও আশ্চর্যজনক বিষয় এই, যে সমস্ত নিদর্শন এখনও অক্ষত আছে তাদের পরিচয় উদ্ধার করা অসম্ভব হয়ে উঠবে, কারণ প্রত্ন সম্পদের ক্যাটালগ ধ্বংস করা হয়েছে। এ সমস্ত দেখে বাগদাদ জাদুঘরের উপ-পরিচালক নাভাল আমি - কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলেন, “আমাদের ঐতিহ্য শেষ হয়ে গেছে। আমাদের ইতিহাস আমাদের গর্বের ইতিহাস।”
আমাদের দেশের হাজার হাজার বছর আগের এসব প্রত্নসম্পদগুলিও মহামূল্যবান। এগুলোও দেশের গৌরব। দেশের ঐতিহ্য। দেশের একটা অংশ। তাই এগুলো ফ্রান্সের গিমে মিউজিয়ামে প্রেরণের বিষয়ে সচেতন সমাজের উদ্বেগ, আপত্তি, আশংকা দেখো দেওয়াই তো স্বাভাবিক। নানা প্রশ্ন উঠেছে গিমে মিউজিয়ামের বির্তকজনক অতীত কার্যকলাপ নিয়ে। শঙ্কা দেখা দিয়েছে প্রত্নসম্পদগুলো ফেরত পাওয়া নিয়ে। এমন কী নকল প্রত্নসম্পদ প্রস্তুতে পারদর্শীদের মাধ্যমে ‘রেপ্লিকা’ ফেরত পাঠানো হবে এমন সম্ভাবনা রয়েছে। এসব সন্দেহের বাস্তব কারণ হলো, প্রদর্শনীতে যে প্রক্রিয়ায় প্রত্নসম্পদ প্রেরণের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল তা একদিকে যেমন অস্বচ্ছ অন্যদিকে এক তরফাভাবে ফ্রান্সের স্বার্থকে দেখা হয়েছে। ফ্রান্সের প্রতিনিধি দীর্ঘদিন ধরে দেশের নানা জাদুঘর আর সংগ্রহশালা থেকে বাছাবাছা সব অনন্য প্রকৃতির মহামূল্যবান প্রত্নসম্পদগুলো নির্বাচন করেন। ঢাকা জাদুঘরের একজন প্রাক্তন মহাপরিচালককে টেলিভিশনের আলোচনায় বলতে শুনলাম সিমেন্ট রড দিয়ে দেয়ালের সাথে স্থায়ীভাবে লাগানো প্রত্নসম্পদ রড কেটে নেওয়া হয়েছে। নির্বাচনের পর ফ্রান্স থেকে বাঁধাইকারদের এনে তড়িঘড়ি করে প্রত্নসম্পদগুলো বাক্সবন্দী করা হয়েছে। প্রদর্শনীর স্থায়িত্ব হওয়ার কথা ছিল চার মাস। অবশ্যই প্রদর্শনী থেকে গিমে জাদুঘরের প্রচুর অর্থ আয় হতো। প্রকাশিত খবরে আমরা দেখেছি রয়্যালটি হিসেবে বাংলাদেশকে কোন অর্থ প্রদানের শর্ত চুক্তিতে নাই শর্ত রয়েছে প্রদর্শনীকালে বাংলাদেশের কয়েকজনকে রাহা খরচসহ ফ্রান্সে ঘুরিয়ে আনা হবে। সাথে পাবে প্রদর্শনীতে বাংলাদেশ থেকে প্রেরিত প্রত্নবস্তুগুলোর ফরাসি ভাষায় লিখিত ২০ কপি ক্যাটালগ। এমন আরো অনেক অসঙ্গতি, অযৌক্তিক এবং অগ্রহণীয় তথ্যাদি প্রকাশিত হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই দেশের সচেতন নাগরিকগণ প্রত্নসম্পদ প্রেরণের প্রতিবাদে মুখর হয়ে ওঠে।
এমনই একটা অবস্থায় প্রথম চালানে ১০টি বাক্সে ৪২টি প্রত্নসম্পদ ফ্রান্সে প্রেরণ করা হয়। দ্বিতীয় চালানে ১৩টি প্রত্নসম্পদ প্রেরণের জন্য এয়ার ফ্রান্সে তোলা হলে একটি বাক্সের ২টি মূর্তি চুরি হয়েছে দেখা যায়। এর একটি পূর্ণাঙ্গ বিষ্ণুমূর্তি অন্যটি আবক্ষ বিষ্ণুমূর্তি। ১৫০০ বৎসর আগের এই বিষ্ণুমূর্তি দু’টির মিলিত ওজন ৬৪ কিলোগ্রাম। আমরা বিস্মিত হয়েছি যখন জেনেছি প্রত্নসম্পদগুলো বহন করার জন্য প্রদত্ত অর্থের পরিমাণ এবং প্রত্নসম্পদগুলো খুই সামান্য অর্থে বীমা করার কথা। ৪০৯৪ কিলোগ্রামের প্রত্নসম্পদের বাক্সগুলো বহন করার জন্য হোমল্যাণ্ড কুরিয়ার সার্ভিস এয়ার ফ্রান্সকে মাত্র ১২,৪৮৬ ডলার প্রদান করেছিল। একজন এয়ারক্র্যাফট নির্বাহী জানিয়েছেন, গুরুত্বপূর্ণ এবং মূল্যবান সম্পদ হিসাবে বিবেচনা করলে এই খরচ প্রায় ২৫০ গুণ বেশী হতো। এখন যদি হোমবাউণ্ড খোয়া যাওয়া বিষ্ণুমূর্তির ক্ষতিপূরণ চায় তবে এয়ারফ্রান্স প্রতি কিলোগ্রাম হারানো সম্পদের জন্য ২০ ডলারের বেশী দেবে না। তাই ৬৪ কিলোগ্রামের দু’টি মূর্তি খোয়া যাওয়ার জন্য জাতীয় জাদুঘর পেতে পারে ১২৮০ ডলার বা ৮৫,০০০টাকা। অন্যদিকে সরকারিভাবে জানানো হয়েছে যে, উধাও বিষ্ণুর আবক্ষ মূর্তির বীমামূল্য ২০ হাজার ইউরো। আর পূর্ণাঙ্গ বিষ্ণুমূর্তির বীমা মূল্য ২৫ হাজার ইউরো (১ ইউরো = ১০০ টাকা)। অথচ প্রকাশিত তথ্য থেকে আমরা জানতে পারি ম্যানহাটনের নিলাম হাউসে কিছুদিন আগে ২৪ ইঞ্চি উচ্চতার গণেশ মূর্তির নিলাম হয়েছে ৭০ কোটি টাকায়।
প্রদর্শনীতি পাঠানোর জন্য ১৮৭টি প্রত্নসম্পদের বীমার অর্থের পরিমাণ ধরা হয়েছিল মাত্র ৪ মিলিয়ন ইউরো। নানা মহলের প্রতিবাদ ও ক্ষোভের মুখে তা বাড়িয়ে করা হয় ৫.৫০ মিলিয়ন ইউরো যা বাংলাদেশের ৫৫ কোটি টাকার সমপরিমাণ। বিজ্ঞাজনদের মতে এ সমস্ত প্রত্নসম্পদের মধ্যে এমন সব শিল্পকর্ম রয়েছে যার একটির মূল্য সমগ্র বীমাকৃত মূল্যের থেকে বেশী। অষ্টধাতুর তৈরী মূর্তি ‘বজ্রসত্ত্ব’ অথবা হাতে লেখা প্রাচীন সচিত্র তালপাতার পুথি ’প্রজ্ঞাপারমিতা’র আর্থিক মূল্য বিবেচনায়, সম্পূর্ণ বীমামূল্য অত্যন্ত কম। এগুলোর শিল্পমূল্য বা ভাবমূল্য তো পরিমাপ যোগ্য নয়। বাংলার শিল্পচর্চার আন্তর্জাতিক কেন্দ্রের (International Center for study of Bengal Art) সম্মানিত ফেলো, জার্মান শিল্প ঐতিহাসিক ড. জোয়াসিম কে, বজ্যে (D. Joachim K. Bautze) বাংলাদেশে নিযুক্ত ফ্রেঞ্চ রাষ্ট্রদূতকে এক চিঠিতে জানান, “ফ্রান্সে সংগৃহীত সকল সম্পদের বীমা মূল্য ৪ মিলিয়ন ইউরো কি তুমি যথেষ্ট মনে করো? এই বীমা অর্থ দিয়ে ভিনসেন্ট ভ্যানগগের একটা ছবির একটা অংশও তুমি কিনতে পারবে না। অথচ তোমার সরকার বাংলাদেশের শিল্পকলার শ্রেষ্ঠ সম্পদগুলোর জন্য বীমামূল্যকে ’আর্ন্তজাতিক মানে’ যথেষ্ট মনে করেছে।”
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্কেয়োলজি বিভাগের চেয়ারম্যান বলেছেন, “সারা বিশ্ব খুঁজেও দ্বিতীয় আর একটি ’বজ্রসত্ত্ব’ পাওয়া যাবে বলে আমি মনে করি না। এটা একটি অসাধারণ শিল্পকর্ম। নবম অথবা দশম শতাব্দীতে যখন বাংলাদেশে এমন শিল্পকর্ম সৃষ্টি হয়েছে তখন বিশ্বের অন্য কোন স্থানে ধাতু ঢালাই করার এমন কারিগরী জ্ঞান ছিল কিনা সন্দেহ।’ তিনি দুঃখ করে বলেন, “বাংলাদেশে মাত্র দু’টি প্রাচীন সচিত্র তালপাতার পুথি ‘প্রাজ্ঞপারমিতা’র মূল পাণ্ডুলিপি আছে। দু’টি-ই সরকার প্যারিসে পাঠাচ্ছে। আমাদের ছাড়া যুক্তরাজ্যে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় ও ভারতে এরূপ পাণ্ডুলিপি থাকতে পারে। কোন কারণে হারিয়ে গেলে কেউ আর এগুলি আমাদের ফেরত দেবে না।”
বিস্মিত ও বিক্ষুদ্ধ হয়ে ওঠে হৃদয়, যখন জানা যায় ইউরোপের একটি নিলামে প্রাজ্ঞপারমিতার মাত্র তিনটা পাতা প্রতিটি ১২,০০০ ডলার অর্থাৎ প্রায় ৮,০০০ ইউরো করে বিক্রি হয়েছিল। অথচ ৭০০-এর বেশী পাতার পাণ্ডুলিপি প্রেরণের জন্য মাত্র ৩০,০০০ ইউরো বীমা করা হয়েছে। তারপরও এই বীমার অর্থ কেবল গিমে মিউজিয়াম কর্তৃপক্ষ দাবি করতে পারবে।
দুঃখ ও ক্ষোভে চোখে পানি এসে যায় যখন খবর আসে ঢাকার অদূরে সাভারে ভাগাড় থেকে চুরি যাওয়া বিষ্ণুমূর্তি দু’টির হাত-মাথাসহ প্রায় পঞ্চাশ টুকরো পাওয়া গেছে। খোয়া যাওয়া মূর্তির খুব সামান্য অংশই এই টুকরোগুলোর মধ্যে রয়েছে। আবক্ষ মূর্তির ২০ ভাগ এবং পূর্ণাঙ্গ মূর্তির খুবই অল্প অংশ রয়েছে টুকরোগুলোতে। চুরি করা থেকে অনেক অনেক বেশী পাপ করা হয়েছে মূর্তিগুলো খণ্ড-বিখণ্ড করে ভেঙ্গে ফেলায়। এভাবেই কি ঐতিহ্যের বিনাশ শুরু হয়ে যাবে! সভ্যতা কি মৃত্যুর পথে এগিয়ে যাবে!
_________________________________________________________________________
দৈনিক সংবাদে: পৌষ ১৮, ১৪১৪। জানুয়ারী ১, ২০০৮ লেখাটির অংশ বিশেষ প্রকাশিত।
_______________________________________________________________________________________
(নিবটি কাজী মোহামমদ শীশ-এর ‘কালের চোখে আমার দেশ’ গ্রন্থ থেকে সংকলিত।প্রকাশক: জনান্তিক, ৫০, আজিজ কো-অপারেটিভ মার্কেট, বইপাড়া, শাহবাগ, ঢাকা, প্রকাশ কাল: মাঘ, ১৪১৪; ফেব্রুয়ারী, ২০০৮।)
অনলাইন: ১৮ মে, ২০০৯