Banner
চীনে সমাজতন্ত্র : মাও জেদঙ থেকে হু জিনতাও

লিখেছেনঃ মইনুল হাসান , আপডেটঃ January 3, 2009, 6:00 PM, Hits: 17078

 

 

বিগত শতকে মানবেতিহাসে সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা একটা বিস্ময়কর উত্থান হিসাবে চিহ্নিত হয়েছে। তার সঙ্গে পৃথিবীর বিস্তীর্ণ প্রানেত সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা ও সাফল্য কোটি কোটি মানুষকে চমকিত করেছে, বিস্ময়ে স্থির করেছে। আবার শতক যখন শেষ হচ্ছে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন, পূর্ব ইউরোপের দেশগুলিতে বিপর্যয় পৃথিবীর অগণিত মানুষকে ব্যথিত করেছে সন্দেহ নেই। আমরা গণ-আন্দোলনের কর্মীরা স্তম্ভিত হয়েছি। এই বিচিত্র ঘটনাবলির সমাহার একটি শতকে কেউ কল্পনা করেনি।

সমাজতন্ত্রের বিপর্যয়ের পর সারা বিশ্বে মূল দর্শনটির বিরুদ্ধে কুৎসিত প্রচার হতে শুরু করে। রাষ্ট্রব্যবস্থা হিসাবে সমাজতন্ত্র কতখানি ব্যর্থ এবং স্বপ্নময় তারই ব্যাখ্যা চলে বিভিন্নভাবে। পুঁজিবাদই সমাজে একমাত্র প্রতিষ্ঠিত এবং গ্রহণযোগ্য সমাজব্যবস্থা, কোনো বিকল্প নাই - তারই ঢাক বাজানো শুরু হয়। অনেকে কয়েক ধাপ এগিয়ে বলেন, ইতিহাসের স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে। অথবা আর নতুন করে পৃথিবীর ইতিহাস লেখার কোনো প্রয়োজন নাই। তাত্ত্বিকরা ব্যাখ্যা দিতে শুরু করেন যে, গণতন্ত্র যদি প্রসারিত হয়, সবাই যদি খেতে পেয়ে থাকে, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের সুযোগ থাকে তাহলে শুধু শুধু আর কষ্ট করে একটা নতুন সমাজ গড়ার ভাষণ দিয়ে লাভ কী! স্বতঃস্ফূর্তভাবে গড়ে ওঠা পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে আরও খানিকটা ঘষেমেজে নিয়েই নাকি দিব্যি চালিয়ে দেওয়া যাবে। আমাদের ভুলিয়ে দেবার চেষ্টা হচ্ছে, সমাজতন্ত্রের উন্মেষকালে যে ঐতিহাসিক সিদ্ধানতগুলি নেওয়া হয়েছিল -  মানুষের শ্রমকে শোষণমুক্ত করার লক্ষ্যে - তার প্রভাব পড়েছিল যেমন তৃতীয় বিশ্বের গণ-আন্দোলনের উপর, মুক্তির আন্দোলন গতিপ্রাপ্ত হয়েছিল, উপনিবেশিকতার জোয়াল ফেলে দিয়েছিল বহু বহু দেশ, একটার পর একটা দেশে নতুন করে ওয়ার্কার্স পার্টি বা কমিউনিস্ট পার্টি গঠিত হয়েছিল। জারের প্রাসাদের দিকে ছোঁড়া কামান গর্জন কেবলমাত্র পিছিয়ে পড়া, দলিত মানুষের ঘুম ভাঙায়নি - পুঁজিবাদী সমাজের মহাপ্রভুদের রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছিল। আর পুরনো কায়দায় শোষণ করা যাবে না - তারা বুঝে গিয়েছিলেন। শ্রমিক শ্রেণী পুরনো কায়দায় আর শোষিত হতে চায়নি। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা তাদের কাছে একটি ইতিবাচক ঘটনা হিসাবে কাজ করেছে - সেখানকার সাফল্যে নিজেদের রঞ্জিত করে ঝাঁপিয়ে পড়েছে অবিচার আর অন্যায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলনে। ছিনিয়ে এনেছে একটার পর একটা জয়। গণতান্ত্রিক ভোটাধিকার, নারী স্বাধীনতা, বেকারদের কাজের ব্যবস্থা, সাধারণ শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের সার্বজনীন সুবিধা ইত্যাদি।

সোভিয়েত রাশিয়ার পতন আমাদের হতাশও করেছে নিদারুণভাবে। কিন্তু পরিস্থিতির বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ কমিউনিস্টদেরই করতে হবে। সে ব্যাপারে সারা পৃথিবীতে কমিউনিস্টরা লিপ্ত আছেন। নতুন নতুন তত্ত্ব ও তথ্য উন্মেচিত হচ্ছে - ধারাবাহিক গতিতে এই কাজ চলবে। তবে একটা বিষয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে সমাজতন্ত্রের দর্শনের ক্ষয় নেই। যুগে যুগে নতুন চিনতা ও বিশ্লেষণে এই তত্ত্ব আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠবে।

সমাজতন্ত্রের বিপর্যয়ের পর চীন দেশ নিয়ে আগ্রহ বেড়ে গেছে সারা পৃথিবীর মানুষের। এই কথাতে আমি একটা সময় নির্ধারণ করে ফেললাম খুব সচেতনভাবেই। কিন্তু তবুও উল্লেখ করা উচিত যে, চীন সম্পর্কে আমাদের আগ্রহ বহুদিনের। বিগতশতাব্দীতে চীনের বিপ্লব এবং কমিউনিস্টদের শাসন শতকের আরও একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর আলোচনা  হল, চীনের পতন কবে?

১৯৯২ সালের পর আস্তে আস্তে চীনের আর্থিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে যে পরিবর্তন হতে থাকল দ্রুতগতিতে (যার শুরু অনেক আগে) তখন প্রশ্ন উঠল চীনে সমাজতন্ত্র আছে অথবা নেই। এখন সারা বিশ্বের নজর চীনের দিকে। প্রশ্ন বহু। কেউ বলছেন মাও জেদঙ মারা যাবার পর চীনের রাষ্ট্রব্যবস্থা পুঁজিবাদীদের দখলে চলে গেছে, যারা এতদিন লুকিয়েছিল পুঁজিবাদের ’ট্রোজান হর্স’ হিসাবে রাষ্ট্র ও পার্টি ব্যবস্থার মধ্যে। চীনের কমিউনিস্ট পার্টি যে পুর্নগঠনের কর্মসূচী নিয়েছে সেটাকে পুরোপুরি নস্যাৎ করে দিয়ে অনেকে বলেছেন অন্যপথে পুঁজিবাদ নিয়ে আসার পরিকল্পনা হয়েছে। অনেকে মনে করেন সোভিয়েত রাশিয়া এবং পূর্ব ইউরোপের দেশগুলিতে সমাজতন্ত্রের বিপর্যয়ের পর চীনে সংস্কার কর্মসূচী হাতে নেওয়া হয়েছে, তা না হলে চীনেও সমাজতন্ত্রের পতনের মতো আরও একটা হৃদয়-বিদারক ঘটনার মুখোমুখি বিশ্ববাসীকে হতে হত। আবার বলা হচ্ছে চীনের সংস্কার হচ্ছে Opportunistic manipulation of Marxism. পাশাপাশিভাবে চীনের অগ্রগতির ধারাটাকে অনেকেই উৎসাহের সঙ্গে পর্যালোচনা করেছেন, একটি নতুন মডেল হিসাবে চিহ্নিত করেছেন, বিশ্বব্যাংক এবং আনতর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডারের ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে নিজেদের সামর্থ্যে দেশের মানুষের কাছে বিকল্প তুলে ধরেছেন বলে বাহবা দিচ্ছেন।

ভ্রু সারা পৃথিবীতে চীন আজ আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। একটি পিছিয়ে পড়া বৈচিত্র্যপূর্ণ দেশ, ১৯৪৯ সালে স্বাধীন হয়েছে - সমাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, প্রায় ১৩০ কোটি মানুষ, ৫৬ টি বিভিন্ন জনগোষ্ঠী, ২৩টি প্রদেশ, ৫টি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল, ৪টি পৌরসভা, ২টি বিশেষ কেন্দ্রীয়ভাবে পরিচালিত প্রশাসনিক অঞ্চল নিয়ে গঠিত বিশাল দেশ। দারিদ্র, বেকারত্বের অবসান ঘটাতে হবে - এমনতর চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি, তেমনই সোভিয়েত রাশিয়ার পতনের পর সাম্রাজ্যবাদের একমেরু বিশ্ব গঠনের মুখে রুখে দাঁড়াতে হবে - সবই চীনের সামাজিক ও আর্থিক ব্যবস্থায় নানাবিধ সিদ্ধানত গ্রহণ করতে প্রভাবিত করে চলেছে সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না।

অনেকে চীনের সংস্কার প্রক্রিয়াকে সোভিয়েত রাশিয়ার পতনের প্রতিক্রিয়া হিসাবে দেখে থাকেন - কিন্তু আদতে তা নয়। সত্তরের দশকের শেষের দিকেই চীনের কমিউনিস্ট পার্টি আর্থিক সংস্কারের কাজ শুরু করে। তৎপরবর্তী প্রতিটি পার্টি কংগ্রেসে সংস্কারের পদ্ধতিগুলি নিয়ে পর্যালোচনা হয়েছে, নতুন স্লোগান দেওয়া হয়েছে, আগামী কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়েছে। পরে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে, তবে এখানে উল্লেখ করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, প্রতিবারই মার্কসবাদ-লেনিনবাদ, সমাজতন্ত্র, কমিউনিস্ট পার্টির যথাযথ ভূমিকা এবং চীনের সমাজে তাদের প্রয়োজনীয়তা এবং এগিয়ে চলার ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিকতাকে শুধু উল্লেখ করা হয়নি, দৃঢ়তার সঙ্গে তাত্ত্বিক বিষয়গুলোর প্রতি আনুগত্য দেখানো হয়েছে। এ ব্যাপারে সর্বশেষ ২০০২ সালে অনুষ্ঠিত ষোড়শ পার্টি কংগ্রেসের প্রতিবেদন থেকে উল্লেখ করছি -  ‘Adhere to the four cardinal principles and develop socialist democracy. The Four cardinal principles are the very foundation on which we build our country, we must uphold leadership by the CPC can consolidate and improve the state system and peoples democratic dictatorship and the system of political power - the peoples congress.’

চারটি মূল নীতি বহু উল্লেখিত, তবুও আর একবার জানানো প্রয়োজন : (ক) সমাজতন্ত্রের পথে থাকা, (খ) জনগণের গণতান্ত্রিক একনায়কত্ব কায়েম করা, (গ) কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করা, (ঘ) মার্কসবাদ-লেনিনবাদ ও মাও জেদঙের তত্ত্ব অনুযায়ী চলা। ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস অটোভন বোয়েসিককে একটা চিঠিতে জানিয়েছিলেন যে, আমার মনে হয়, তথাকথিত সমাজতান্ত্রিক সমাজ একেবারে পরিবর্তনাতীত নয়। অন্য সব সামাজিক সংগঠনের মতোই একে নিরনতর পরিবর্তনশীল হিসাবে দেখতে হবে।’

 

চীনে সমাজতন্ত্র : মাও জেদঙের সময়ে

চীনের কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯২১ সালে। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই কমিউনিস্ট পার্টিকে বাম ও দক্ষিণপন্থী বিচ্যুতির মুখোমুখি হতে হয়। ১৯৪৫ সালে অনুষ্ঠিত পার্টি কংগ্রেসে মাও জেদঙের চিনতা ও দিকনির্দেশ গৃহীত হয়। পরবর্তী ৪ বছর গৃহযুদ্ধ চলার পর ১৯৪৯-এ বিপ্লব জয়যুক্ত হয়। ১৯৫৬ সালে অনুষ্ঠিত হয় অষ্টম কংগ্রেস। ততদিনে চীনে কমিউনিস্ট শাসন পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। মাও জেদঙের নয়া-গণতন্ত্রের তাত্ত্বিক প্রয়োগের সময় পেরিয়ে চীন তখন সমাজতন্ত্রের পথে পা বাড়িয়েছে - এক কথায় সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ১৯৪৯-৫৬ এবং ১৯৫৬-৭৮ দু’টি পর্বে মাও জেদঙের চিনতাধারা এবং দিকনির্দেশ কার্যকরী হলেও পার্টির মধ্যে সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা, সমাজতন্ত্রে উত্তরণ কমিউনিস্ট পার্টি এবং রাষ্ট্রের ভূমিকা, রাষ্ট্রযন্ত্রের এগিয়ে যাবার নীতিসমূহ নিয়ে বিতর্ক হয়েছে - বহু সিদ্ধানত সংখ্যাগরিষ্ঠতায় গ্রহণ করতে হয়েছে। চীনের পার্টিতে এই তাত্ত্বিক আলোচনা সব সময়েই চলেছে। চীনে যখন বিপ্লব হয়েছে তখন সোভিয়েত রাশিয়ার বিপ্লবের বয়স হয়ে গেছে ৩২ বছর। সোভিয়েত রাশিয়া ইতোমধ্যে মডেল হিসাবে প্রতিষ্ঠিত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পরিস্থিতি আরও অনুকূল। লি শাওকি এবং পেঙ দেহুয়াই সোভিয়েত মডেল অনুসরণ করতে চেয়েছিলেন। মাও জেদঙ সে সময়েই রাশিয়ায় সমাজতন্ত্র গঠন প্রক্রিয়ায় সে ত্রুটি দেখা যাচ্ছিল তা বিশ্লেষণ করে চীনের সমাজতান্ত্রিক রাস্তা ঠিক করেন।

সমাজতন্ত্র নির্মাণের প্রথম পর্বে সোভিয়েতের অভিজ্ঞতা নিয়েছিলেন মাও। আদি আর্থিক সঞ্চয় ছিল প্রাথমিক জরুরি বিষয়। স্বতঃস্ফূর্তভাবে বেড়ে ওঠা পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় পুঁজির এমন সঞ্চয় সমস্যার সৃষ্টি করে না - কারণ তা পাওয়া যায় সামনতসম্পদ এবং উপনিবেশিক শোষণের মাধ্যমে। এই সঞ্চয়ই ব্যবহৃত হয় শিল্প গঠনে। পূর্ণ বিকশিত পুঁজিবাদ থেকে রূপানতরিত না হওয়া সমাজতান্ত্রিক দেশের পক্ষে এমনভাবে পুঁজি সঞ্চয় করা সম্ভব নয়। অথচ উৎপাদিকা শক্তির বিকাশের জন্য পুঁজির প্রয়োজন। এক্ষেত্রে অর্থনীতিবিদ প্রিয়ব্রাঝ্‌নস্কির তত্ত্বের উপর স্তালিন নির্ভর করেছিলেন। করনীতি ও মূল্যনীতির পরিবর্তন ঘটিয়ে সম্পদ সংগ্রহ করা সম্ভব কৃষি থেকে এবং সেটা শিল্পে বিনিয়োগ করা। একটি পুরনো তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে ১৯৩১ সালে রাশিয়ায় কৃষি থেকে সংগৃহীত লেভির পরিমাণ ছিল ৩২.৮ শতাংশ। পুঁজি সঞ্চয়ের দায়িত্ব পড়েছিল কৃষির উপর। ভারী শিল্পের চমকপ্রদ সাফল্য রাশিয়ায় এসেছিল। কেবলমাত্র নিজের মাতৃভূমিতে নয়, অন্যান্য অনেক দেশে ভারী শিল্পের উন্নয়নে পুঁজি সরবরাহ করেছে সোভিয়েত রাশিয়া। দেশের অর্থনীতি মজবুত করে ভারী শিল্পে বিনিয়োগ একটি গৃহীত ইতিবাচক পদ্ধতি। সমস্যা দেখা দেয় কৃষকদের নিয়ে। সমগ্র উৎপাদন প্রক্রিয়ায় কৃষকরা বিচ্ছিন্নতাবোধে আক্রানত হন। ভারসাম্যের অভাব দেখা দেয় - তাত্ত্বিক দিক দিয়ে বিষয়টি বোঝাপড়ার মধ্যে এলেও ব্যবহারিক প্রয়োগের ক্ষেত্রে বিষয়টিকে এড়িয়ে যাওয়া হয়। বিচ্ছিন্নতাবোধটা বাড়তেই থাকে। অর্থনীতির এই নির্দেশচালিত পন্থার সমস্যাগুলি সামনের দিকে প্রকাশিত হয়। অন্যতম বড়ো সমস্যা আমলাতান্ত্রিকতা। পরিকল্পনা, বণ্টন ও সামাজিক নীতি নির্ধারণে প্রত্যক্ষ উৎপাদক, শ্রমিক ও কৃষকদের ভূমিকা নগণ্য হয়ে যায়। রাষ্ট্রের কেন্দ্রীভূত নিয়ন্ত্রণে উৎপাদনের উপকরণের মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণ সবটাই থাকল আমলা পুঁজির হাতে। প্রযুক্তির উপরে গুরুত্ব দেওয়া হয় যথেষ্ট ন্যায্য কারণেই - কিন্তু তার উপর সমাজতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ ছিল আলগা, তত্ত্বের বিশ্লেষণ ছিল খানিকটা বাস্তব বিবর্জিত, সমাজতান্ত্রিক সমাজেও অবস্থিত দ্বন্দ্বগুলির পর্যালোচনার অভাবহেতু সেখানেই চাপ পড়ে যায় বেশি। টেকনোক্রাটরা পার্টির নেতৃত্বে উঠে আসতে থাকেন দ্রুত। যাদের রাজনৈতিক গুরুত্ব অনেক কম।

মাও জেদঙ অত্যনত তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে সমস্যাগুলির বিশ্লেষণ করেছিলেন। চীনের বাস্তব পরিস্থিতির সঙ্গে তার মিশেল দিয়েছিলেন। চীনের মতো বড়ো দেশে সমাজতন্ত্র গঠনপর্বে প্রাথমিক গুরুত্ব দিলের কৃষি ও হালকা শিল্পের উপর। পুঁজির সঞ্চয় হবে এখান থেকে। এই সঞ্চয় থেকে বিনেয়োগ হবে ভারী শিল্পে। ভারী শিল্পের উপর একানতই বেশি জোর দিলে অবহেলা করা হবে খাদ্যশস্য উৎপাদন, দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় উপকরণের উৎপাদনকে, যা হয়েছিল সোভিয়েতে। এভাবে ভারী শিল্প এবং হালকা শিল্প ও কৃষির মধ্যে ভারসাম্য বজায় থাকবে। অন্যদিকে আদি সঞ্চয় তৈরি হবে। মাও নাম দিয়েছিলেন ’দুই পায়ে ভর দিয়ে হাঁটার নীতি।’

শিল্পে থাকবে রাষ্ট্রীয় মালিকানা এবং কৃষিতে প্রতিষ্ঠিত হবে যৌথ মালিকানা - চীনে এভাবেই প্রতিষ্ঠিত হবে সামাজিক মালিকানা। ব্যক্তি মালিকানাধীন শিল্প মূলধনকে আস্তে আস্তে রাষ্ট্রীয় মালিকানার অনতর্গত করা হবে। প্রথম পদক্ষেপ হিসাবে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সংস্থাগুলিকে পণ্য উৎপাদনের নির্দিষ্ট মাত্রার নির্দেশ দেওয়া হয় এবং রাষ্ট্র সমগ্র উৎপাদন কিনে নিয়ে বণ্টন করে। দ্বিতীয় পদক্ষেপ হিসাবে ব্যক্তি মালিকানাধীন সংস্থার মুনাফাকে চারটি সমান ভাগে ভাগ করা হয়। একটা অংশ মুনাফা হিসাবে মালিকের কাছে থাকে। বাকিগুলো বণ্টন করো, শ্রমিক কল্যাণ তহবিল এবং সংস্থার উন্নয়নে। এই পদক্ষেপ চালুর সময় পণ্য উৎপাদন ও বিক্রির ব্যাপারে কয়েকটি বিধিনিষেধ ও বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়। তৃতীয় পদক্ষেপ ছিল যৌথ উদ্যোগে এবং মালিক তার শ্রমদানের জন্য স্থির আয় হিসাবে সংস্থার সম্পদমূল্যের পাঁচ শতাংশ হারে, কুড়ি বছর ধরে পেতে থাকে। সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময় ’স্থির আয়’ বাতিল করা হয় এবং সংস্থাগুলিকে পুরোপুরি রাষ্ট্রীয় সংস্থায় পরিণত করা হয়। রাষ্ট্রীয় সংস্থা পরিচালনায় মাও জেদঙ চালু করেন ’একের মধ্যে তিন’ নীতি। পার্টি নেতা, প্রত্যক্ষ উৎপাদক এবং প্রযুক্তিবিদ একসঙ্গে মিলে সংস্থা নিয়ন্ত্রণ করবেন এবং সিদ্ধানত গ্রহণ করবেন। মাও জেদঙের সোভিয়েতের অভিজ্ঞতা মনে ছিল। প্রত্যক্ষ উৎপাদকের সঙ্গে বিচ্ছিন্নতার নিরসন তিনি এভাবেই করতে চেয়েছিলেন। প্রাথমিকভাবে এর সাফল্য এসেছিল দ্রুতগতিতে। কিন্তু পরে সেটা ধরে রাখা যায়নি। সে ক্ষেত্রে পরিস্থিতির সার্বিক বিশ্লেষণ এবং নিরনতর বৌদ্ধিক উন্নয়ন ব্যাহত হয়েছিল। সামাজিক মালিকানার দ্বিতীয় দিকটি ছিল কৃষির যৌথকরণ। মাও জেদঙের নেতৃত্বে চীনে সে সামাজিক উন্নয়ন তথা সমাজতন্ত্রের দৃঢ় প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া চলেছিল তাতে সেটাই সবচাইতে বড়ো আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল। কৃষিতে যৌথ মালিকানার পূর্বশর্ত ছিল আমূল ভূমিসংস্কার। ১৯৪৬ সালে চীনে এই কাজ শুরু হয়। ১৯৪৬ সালে উত্তর ও উত্তর-পূর্ব চীনে ভূমিসংস্কারের কাজ শেষ হয়। ১৯৫২ সালের মধ্যে প্রায় সমগ্র চীনে এই কাজ সম্পন্ন হয়েছিল। চীনের ইতিহাস এবং এখনকার চীনা বিশেষজ্ঞ যাঁরা তাঁদের গবেষণাতে অত্যনত গুরুত্বের সঙ্গে ধরা পড়েছে যে, চীনের ভূমিসংস্কার মামুলি ধরনের কোনো কর্মকাণ্ড ছিল না। জমিদার অথবা জমিচোর অথবা উদ্বৃত্ত জমির সন্ধান নিয়ে সেটা উদ্ধার করে ভূমিহীনের মধ্যে বিতরণ করার মতো সহজ কাজ ছিল না। যদিও কার্যত তাই ছিল। তা সত্ত্বেও চীনের কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে ভূমি সংস্কার আন্দোলন ছিল অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও আদর্শগত পরিবর্তনের একটা দিকনির্দেশ। ভূমিসংস্কার কোটি কোটি কৃষককে নিয়ে আসে সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মধ্যে। কৃষক সমাজের এই রাজনৈতিক উত্তরণ, পরবর্তীকালে সে সমবায় চাষের সিদ্ধানত নেওয়া হয়, সেটার সাফল্যের বীজ হিসাবে চিহ্নিত হয়। যারা এতদিন নগ্ন শোষণ চালিয়ে এসেছে, যারা সামনতপ্রভু তাদের দার্শনিক ভিত্তি কৃষকসমাজের মধ্যে ব্যাখ্যা হয় নিম্নস্তর পর্যনত। সামনততান্ত্রিক শোষণ মিথ্যা, অলীক দর্শনের উপর নির্ভর করে, কুসংস্কারের বার্তা ছড়িয়ে কীভাবে সমাজের পিছিয়ে পড়া, অনগ্রসর অংশকে দমন করে রাখতে চায় তারই বিরুদ্ধে উন্নত সমাজদর্শনের ধারাবাহিক প্রচার সমগ্র চীনে দেখা যায়। জীবনে প্রথমবার কৃষক সমমান পেতে থাকেন - মুখ খুলে কথা বলতে পারেন। সামনত-প্রভুদের বহু অন্যায় অবিচারের গল্পগাথা যা এতদিন গোপনে ছিল তা প্রকাশ হয়ে পড়ে। চীনে মানুষের আন্দোলনে এক অভূতপূর্ব গতি সৃষ্টি হয়। কমিউনিস্ট পার্টির প্রভাব আরও দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়।

ভূমিসংস্কারের মাধ্যমে জমি বিলির পর ব্যক্তিগত চাষের পরিবর্তে সমবায় ভিত্তিতে চাষ করার নীতি প্রয়োগ করা হয়।। প্রথমে ছয় থেকে দশটি পরিবার নিয়ে পারসপরিক সাহায্যদল গঠন করা হয়। জমির মালিকানার কোনো পরিবর্তন না ঘটিয়ে কৃষকের শ্রম,উপকরণ, গবাদি পশু, যন্ত্রপাতি একত্রিত করা হল। এভাবে উৎপাদন বাড়ানোর ব্যবস্থা হল। দ্বিতীয়ভাগে করা হল প্রাথমিক সমবায়।

প্রাথমিক সমবায়ের মোট আয়ের প্রায় ৭০ শতাংশ প্রথমে সমস্ত সমবায়ীর মধ্যে সমান ভাগে ভাগ করে দেওয়া হয়। তারপর বাকিটা জমির পরিমাণের উপর ভিত্তি করে বিতরণ করা হয়। ১৯৫৫ সালের মধ্যে চীনের এক তৃতীয়াংশ কৃষক প্রাথমিক সমবায়ের আওতায় আসে।

এই ক্ষেত্রে চীনের বিপ্লবোত্তর সমাজে গ্রামীণ ক্ষেত্রে যে দ্বন্দ্বসমূহ দেখা দেয় তার সমাধান করা গিয়েছিল যেভাবে সেটা উল্লেখ করা প্রয়োজন বোধ করছি। ভূমিসংস্কারের পরেও চীনে ধনী, উচ্চ-মাঝারি, নিম্ন-মাঝারি ও গরিব চাষী ছিল। এই ভাগ থাকলে বুর্জোয়াদের কাছে সুযোগ থাকছে ধনী চাষীর সঙ্গে জোট বেঁধে নিজেদের শ্রেণী অবস্থানকে জোরদার করার। আবার তা যদি থাকে তাহলে শ্রমিক-কৃষকের মৈত্রী গঠন সহজ হবে না। পারসপরিক সাহায্যদান ও প্রাথমিক সমবায় এই ভাগটাকে অকার্যকর করতে সাহায্য করেছে। ধনী চাষীর আছে চাষের উপকরণ এবং জমি, সে সমবায়ে আসতে রাজি নয়। অন্যদিকে নিম্ন-মাঝারি ও গরিব চাষীর কাছে সমবায় ছিল সবচাইতে কাম্য। তাদের কাছে আছে শ্রমশক্তির বড়ো অংশ। এই ক্ষেত্রে মাঝারি চাষীকে টেনে আনা সহজ হয়েছিল। সমবায়ের সাফল্যের আর একটা কারণ ছিল। ধনী ও উচ্চ-মাঝারি চাষীরা জমিতে কাজ করার শ্রমিক পেল না। সরকারি হস্তক্ষেপে শহরের শস্য ব্যবসায়ীদের সঙ্গে ধনী ও উচ্চ-মাঝারি চাষীদের বিচ্ছিন্নতা ঘটানো হল। সরকারকে পণ্য বিক্রি করা ছাড়া কোনো উপায় থাকল না। আস্তে আস্তে তারাও সাহায্যকারী দল ও প্রাথমিক সমবায়ে যোগ দিল। একটি নির্দিষ্ট স্তরে কিছু বলপ্রয়োগ রাষ্ট্রকে করতে হয়েছে - কিন্তু যে ভাবে সারা দেশব্যাপী রাজনৈতিক প্রচার হয়েছে সেটার মূল্য অপরিসীম। এক্ষেত্রে একটা বিষয় মাও জেদঙ-কে বার বার চিনিতত করেছে যে, এই গ্রামীণ প্রতিষ্ঠানগুলোর নেতৃত্ব কাদের হাতে থাকবে। গরিব চাষীর হাতে নেতৃত্ব যাতে থাকে তার জন্য বহু তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা সহ মাও জেদঙ ভাষণ দিয়েছেন। একথা অনস্বীকার্য যে, সময়ানতরে সেটা থাকে না। অত্যধিক বাম নির্দেশের ফলে, রাজনীতিহীনভাবে আয়ত্তকরণের প্রক্রিয়া সমগ্র পদ্ধতিটিকে জটিল করে তুলেছিল।

তৃতীয় স্তরে ১৫-২০টি প্রাথমিক সমবায় মিলে তৈরি করা হয় অগ্রণী সমবায়। এক্ষেত্রে সমস্ত আয় কাজ অনুযায়ী সদস্যদের মধ্যে বণ্টন করা হত। এই সমবায়গুলির আর্থিক সঙ্গতিও ছিল বেশি। তার ফলে ট্রাক্টর সহ অন্যান্য দামি উপকরণ কেনা, গ্রামীণ ক্ষুদ্র শিল্পে অর্থ সাহায্য করা, সেচ ও বন্যা-নিয়ন্ত্রণ প্রকল্প রূপায়ণের মতো দায়িত্বগুলো অগ্রণী সমবায়ের হাতে ছিল। ১৯৫৭ সালের মধ্যে মোট কৃষকের ৯৭ শতাংশ অগ্রণী সমবায়ের আওতায় এসে পৌঁছায়। এই তিনটি স্তরেই কৃষকের যোগদান ছিল ঐচ্ছিক।

১৯৫৮ সালে অগ্রণী সমবায়গুলিকে গণ কমিউনে রূপানতরিত করা হয়। গণ কমিউন ছিল একটি স্থানীয় সরকার। এই সরকারগুলির কাজের পরিধি ছিল কমিউনের অনতর্গত গ্রামগুলির অর্থনৈতিক, সামাজিক, প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড। কমিউনের উদ্দেশ্য হিসাবে বলা হয়েছিল - গ্রামীণ জনগণকে এমনভাবে সংগঠিত করা হবে যাতে জমি ও সম্পদকে উন্নত করা যাবে, সকলের দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটানো যাবে, ন্যায় ও সাম্যের ভিত্তিতে একটা স্বনির্ভর অর্থনীতি গড়ে তোলা সম্ভব হবে। ৬-৭টি অগ্রণী সমবায় নিয়ে একটি গণ-কমিউন তৈরি হয়। ৩-৪ গ্রামের ৮০০-৪০০০ হেক্টর জমি কমিউনের আওতায় থাকবে। ১৯৭৫ সালে মোট কমিউনের পরিমাণ ছিল ৫০ হাজার। সমাজতন্ত্র গড়ে তুলবার প্রক্রিয়ায় কমিউন একটি উল্লেখযোগ্য নতুন সংযোজন ছিল। ফলিত মার্কসবাদে নতুন অবদান বললেও বেশি বলা হবে না। চীনের মতো অনগ্রসর দেশে সমাজতন্ত্র গড়ে তোলার পথে এমন প্রক্রিয়া সারা বিশ্ববাসী তো বটেই নামি নামি অর্থনীতিবিদ ও সমাজবিজ্ঞানীদের নজর কেড়েছিল। একটা নতুন মডেল হিসাবে উদ্‌ভাসিত হয়েছিল গণ কমিউন। প্রতিটি গণ কমিউন উৎপাদন টিম, উৎপাদন ব্রিগেড ও কমিউন - এই তিনটি সাংগঠনিক স্তরে বিভক্ত ছিল। উৎপাদন টিম হল প্রাথমিক উৎপাদন ও হিসাবরক্ষণের ব্যবস্থা রক্ষক। এরা ওয়ার্ক পয়েন্টের হিসাব রাখত এবং সেই রকম আয় বণ্টিত হত। রাষ্ট্রের কর, কল্যাণ তহবিল, সঞ্চয়, বিনিয়োগ - সব কিছু তারা দেখাশোনা করত। তার উপরের ভাগ ছিল ব্রিগেড। বীজ, সার, যান্ত্রিক উপকরণ, উৎপাদন টিমের মধ্যে কাজের বণ্টন করত এই অংশ। সর্বোপরি কমিউন - আগের দু’টি অংশের মধ্যে সমন্বয় সাধনের কাজ করত। তাছাড়াও জলসম্পদ সৃষ্টি ও রক্ষণাবেক্ষণ, গ্রামীণ রাস্তা, সেচ, শিল্প ইত্যাদি বড়ো কাজে বিনিয়োগের সিদ্ধানত নিত কমিউন। বিনিয়োগের অর্থ আসত সঞ্চয় তহবিল থেকে। যে সব পরিবারে কোনো উৎপাদনক্ষম সদস্য ছিল না, তাদের জন্য ব্যবহৃত হত কল্যাণ তহবিল। টিমের প্রতিটি সদস্য যাতে ন্যূনতম শস্য পায়, তার জন্য সরিয়ে রাখা হত কোটার সদস্য।

গণ কমিউনের সাফল্য এবং ব্যর্থতা নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়েছে -  কমিউন পদ্ধতি সারা পৃথিবীর সমাজবিজ্ঞানীদের মধ্যে আগ্রহের বিষয় ছিল। সোভিয়েত রাশিয়ায় যে মডেল নেওয়া ছিল সেটার থেকে গুণগতভাবে আলাদা ছিল। মাও জেদঙ এটাকে স্বনির্ভর অর্থনীতির ভিত্তি হিসাবে দেখেছিলেন। পরিকল্পনা ও কাজের বাস্তব সংমিশ্রণ ঘটাবার চেষ্টা হয়েছিল। সোভিয়েতের মতো কেন্দ্রীভূত নয়, কেন্দ্রীয় পরিকল্পনার বিকেন্দ্রীকরণ ছিল গণ কমিউন। গ্রামীণ অব্যবহৃত শ্রমকে গ্রামীণ কৃষি ও শিল্প পরিকাঠামো গড়ে তুলতে ইতিবাচকভাবে প্রয়োগ করা হয়েছিল। গ্রামীণ অর্থনীতিকে বহুমুখী করার পরিকল্পনা করা হয়।

বিপ্লবোত্তর চীনে সমাজ বিকাশের যে তত্ত্ব মাও জেদঙ প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন তার ভিত্তি ছিল গণ লাইন। প্রত্যক্ষ উৎপাদকের হাতে পরিচালনার দায়িত্ব, উৎপাদন প্রক্রিয়ার সাথে উৎপাদকের বিচ্ছিন্নতার সমস্যার সমাধান, প্রযুক্তিকে জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া, রাজনীতিকে অর্থনীতির উপর স্থান দেওয়া, উৎপাদন বৃদ্ধিকেও আন্দোলনের রূপ দেওয়া। সমাজের সকলে জীবনের ন্যূনতম প্রয়োজনীয় পণ্য উৎপাদনের জন্য স্বেচ্ছায় শ্রম দিয়েছে, কঠোর পরিশ্রম করেছে লক্ষ লক্ষ মানুষ। তাচাই, তাচিংসহ কমিউনগুলিতে তারই কাহিনী ছড়িয়ে আছে। সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়ায় শ্রেণী সংগ্রাম কেমনভাবে ব্যবহৃত হবে সেই কথাগুলোর আলোচনা হওয়া প্রয়োজন মাও জেদঙ-এর নেতৃত্বে কার্যাবলির সময় বিশ্লেষণ করে। মাও জেদঙ-এর দ্বন্দ্বতত্ত্ব অনুযায়ী বিপ্লবের পর প্রধান দ্বন্দ্বটি হয়, পশ্চাৎপদ উৎপাদিকা শক্তির সঙ্গে অগ্রসর উৎপাদন সম্পর্কের দ্বন্দ্ব। প্রাথমিকভাবে মাও জেদঙ মনে করতেন, বিপ্লবোত্তরকালে যেহেতু উৎপাদনের উপকরণের আইনি হস্তানতর হয়, ব্যক্তিমালিকানার স্থান নেয় রাষ্ট্রীয় ও যৌথ মালিকানা সেহেতু শোষক শ্রেণীগুলির সামাজিক ও অর্থনৈতিক ভিত্তি দুর্বল হয়ে যায়। সুতরাং সমাজতান্ত্রিক সমাজে শ্রেণীসংগ্রাম এক অপ্রধান দ্বন্দ্বে পরিণত হয়। কিন্তু উৎপাদিকা শক্তির বিকাশের পথ ও পন্থা নিয়ে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির ভিতর লড়াই তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে। এক্ষেত্রেই জরুরি হয়ে পড়ে শ্রেণীসংগ্রামের তত্ত্বকে প্রাধান্য দেওয়া ও জরুরি সিদ্ধানত গ্রহণ করা। শ্রেণীসংগ্রামের তত্ত্বকে মাও জেদঙ সামনের সারিতে আনতে পারতেন। সেই ভাবনাতেই ডাক দিয়েছিলেন সাংস্কৃতিক বিপ্লবের। কিন্তু সাংস্কৃতিক বিপ্লবের বল্গাহীন, নিয়ন্ত্রণহীন বিস্তার, পার্টির মধ্যে বাম ও দক্ষিণ উভয় অংশের নেতৃত্বেরই সাংস্কৃতিক বিপ্লবকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করার চেষ্টা সাংস্কৃতিক বিপ্লবকে ব্যর্থ করে দেয়। মাও জেদঙ বেঁচে থাকতেই সেটা হয়েছিল। চীনে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ক্ষতি করেছিল এই পরিস্থিতি যেমন বিশ্বের সমাজতান্ত্রিক তথা গণ আন্দোলনেরও ক্ষতি করেছে অনেক।

 

চীন : মাও জেদঙ : সাংস্কৃতিক বিপ্লব

এখন সারা পৃথিবীতে নতুন চীন নিয়ে যেমন মানুষের আগ্রহ, তেমনই একদিন চীনের সাংস্কৃতিক বিপ্লব নিয়ে সবার আগ্রহ ছিল। সারা পৃথিবীতে এ বিষয়ে হাজার হাজার পাতা লেখা হয়েছে। একটু আগে মাও কর্তৃক সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সূচনা কেন হয়েছিল সেটা বলেছি - সেটা এবার খানিকটা বিস্তারিত বলা প্রয়োজন মনে হয়।

১৯৬৬ সালের মে মাস থেকে ১৯৭৬ সালের অক্টোবর পর্যনত সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময় ছিল। মাও জেদঙ-এর প্রধান তত্ত্ব ছিল বুর্জোয়া শ্রেণীর অনেক প্রতিনিধি ও অনেক প্রতিবিপ্লবী সংশোধনবাদী পার্টি, সরকার, সৈন্যবাহিনী ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রের বিভিন্ন বিভাগে প্রচ্ছন্নভাবে ঢুকে পড়েছে। বেশিরভাগ সংগঠন ও বিভাগে নেতৃত্বক্ষমতা আর মার্কসবাদীদের ও জনসাধারণের হাতে নেই। পার্টির মধ্যে যেসব ক্ষমতাবান ব্যক্তি পুঁজিবাদের পথগামী তাঁরা পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির মধ্যে একটা বুর্জোয়া দপ্তর গড়ে তুলেছে এবং সেই দপ্তর থেকে সমগ্র চীনের সমস্ত প্রদেশে নানা পর্যায়ে দালাল রেখেছে - তাদের মাধ্যমে সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক ভাগে সংশোধনবাদী লাইন অনুসরণ করছে। অতীতে যে সংগ্রাম চীনে হয়েছে তা সমস্যাগুলোর সমাধান করতে পারেনি।

তাই পুঁজিবাদী এবং তাদের দালালদের হাত থেকে তাদের কুক্ষিগত করার ক্ষমতা কেড়ে নিতে একমাত্র উপায় একটা মহা সাংস্কৃতিক বিপ্লব পরিচালনা করা। উল্লিখিত অশুভ উপসর্গগুলোকে উদ্‌ঘাটিত করার জন্য নীচু থেকে উপর পর্যনত ব্যাপক জনসাধারণকে খোলাখুলিভাবে ও পুরোপুরিভাবে সমাবেশ ঘটানো। আসলে এটা একশ্রেণী কর্তৃক আর একশ্রেণীকে উচ্ছেদ করার ঘটনা। এই সমস্ত কথা বলার সময় এটাও বলা হয় যে এমন ঘটনা ভবিষ্যতে আরও হবে।

সাংস্কৃতিক বিপ্লব চীনকে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে কতখানি পিছিয়ে দিয়েছিল সেটা বহুল আলোচিত। আবারও তা করা যেতে পারে। কিন্তু মনে রাখতে হবে রাজনৈতিকভাবে চীনের যে ক্ষতি হয়েছিল তার প্রভাব এখনও নির্মূল হয়ে যায়নি। সাংস্কৃতিক বিপ্লব শুরু হয়েছিল চীন বিপ্লবের ১৭ বছর পর। এই সময়ে গৃহীত বহু নির্ভুল নীতি ও কর্মপন্থা - যার প্রধান অংশীদার মাও জেদঙ নিজে - অস্বীকার করা হয়েছিল। যেটা ভাবতেই অবাক লাগে। পুঁজিবাদের পথগামী বলে যাদের অভিহিত করা হয়েছিল তাঁদের মধ্যে ছিলেন লি শাওকি এবং দেঙ জিয়াওপিঙ-এর মতো নেতারা। প্রমাণিত হয়েছে যে লি শাওকি-র উপর আদর্শভ্রষ্ট, প্রচ্ছন্ন বিশ্বাসঘাতক ও ভাড়াটে চর বলে যে ছাপ লাগানো হয়েছিল তা লিন বিয়াও ও তার অনুসারীদের একটা সাজানো ব্যাপার ছাড়া আর কিছুই নয়। পার্টির ৯ম কংগ্রেসের দ্বাদশ পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনে লি শাওকি সম্বন্ধে যে রাজনৈতিক সিদ্ধানত ও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল সেটা একেবারেই ভুল। বিকল্প দপ্তর বলেও পার্টিতে কিছু ছিল না। সমগ্র বিষয়টি এমনভাবে পরিচালিত হয়েছিল যে, মাও জেদঙ-এর নিজের অবদানসহ পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি ও গণ সরকারের কাজকর্মের বহু বিষয় অস্বীকার করা হয়েছিল এবং সমাজতন্ত্রের গঠনকাজে সমগ্র জনগণের কঠোর সংগ্রামকেই অস্বীকার করা হয়েছিল।

সাংস্কৃতিক বিপ্লব জনগণের উপর ভিত্তি করে চালনা করা হয়েছিল বলে যে দাবি করা হয়েছিল সেটা মোটেই প্রমাণিত হয়নি। পার্টিকে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছিল। পার্টির বিভিন্ন সময়ের সংগঠনগুলো অকেজো হয়ে পড়েছিল। মুষ্টিমেয় চরমপন্থী ছাড়া কেউ পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারেনি। তারাই সমগ্র বিষয়টি পরিচালনা করত।

চীনে জনগণের গণতান্ত্রিক একনায়কত্বের আকারে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর বিশেষ করে সমাজতান্ত্রিক রূপানতর মূলত সম্পন্ন হওয়ার পর এবং শ্রেণী হিসেবে শোষকরা বিলুপ্ত হওয়ার পর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের কর্তব্য চূড়ানতভাবে সম্পন্ন না হলেও বিপ্লবের বিষয় ও পদ্ধতি অতীত থেকে পুরোপুরি আলাদা হয়ে গিয়েছিল। পার্টি ও রাষ্ট্রের কাঠামোতে সন্দেহাতীতভাবেই যেসব অবাঞ্ছিত উপসর্গ ছিল সেগুলোকে অবশ্য যথাযথভাবে বিবেচনাগ্রাহ্য করার দরকার ছিল এবং শাসনতন্ত্র, আইনকানুন ও পার্টি সংবিধান অনুযায়ী সার্বিক পদক্ষেপ নিয়ে সেগুলোকে দূর করা উচিত ছিল। কিন্তু সাংস্কৃতিক বিপ্লবের তত্ত্বগুলো ও পদ্ধতিগুলো কোনোমতেই প্রয়োগ করা ঠিক কাজ হিসাবে বিবেচিত হতে পারেনি। সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় একশ্রেণী কর্তৃত আর একশ্রেণীকে উচ্ছেদ করা কোনো তত্ত্বের সঙ্গেই খাপ খায় না। আর তার কোনো অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ভিত্তিও ছিল না। এমন পদ্ধতি হলে সমাজ কেবল পিছিয়ে যেতেই বাধ্য। চীনের সমাজে তখন সেটাই হয়েছিল।

চীনের পার্টি যখন সাংস্কৃতিক বিপ্লবের বিশ্লেষণ করেছে সেটা সারা পৃথিবীর কাছেই শিক্ষণীয়। এ প্রসঙ্গে গৃহীত পর্যালোচনাটি উল্লেখ করতে চাই - “সাংস্কৃতিক বিপ্লবরূপী সামগ্রিক ও দীর্ঘস্থায়ী গুরুতর বামঝোঁকের ভুলের জন্য প্রধানত কমরেড মাও জেদঙই ছিলেন দায়ী। কিন্তু চূড়ানত বিশ্লেষণে কমরেড মাও জেদঙের ভুল ছিল একজন মহান সর্বহারা বিপ্লবীর ভুল। আমাদের পার্টির ভেতরে ও রাষ্ট্রীয় জীবনের অপূর্ণতাগুলোকে দূর করার জন্য কমরেড মাও জেদঙ সব সময়ই মনোযোগী ছিলেন। কিন্তু জীবনের শেষ বছরগুলিতে তিনি অনেক সমস্যার নির্ভুল বিশ্লেষণ করতে পারেন নি। সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময়ে তিনি ঠিকও বেঠিক এবং শত্রু ও জনসাধারণের পার্থক্য গোলমাল করে ফেলেছিলেন। যখন তিনি গুরুতর ভুল করছিলেন তখনো তিনি বারবার সমগ্র পার্টির প্রতি মনোযোগের সঙ্গে মার্কস, এঙ্গেলসও লেনিনের রচনাবলি অধ্যয়নের আহ্বান জানাতেন এবং মনে করতেন তাঁর নিজের তত্ত্ব অনুশীলন মার্কসবাদী এবং এগুলো সর্বহারা একনায়কত্ব সুসংবদ্ধ করার জন্য অত্যনত জরুরি। এখানেই তাঁর ট্রাজেডি।”

মাও জেদঙের সমালোচনা করার সময়ও তাঁর অবদানের কথা চীনের পার্টি ভুলে যায়নি। একটা বস্তুবাদী বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে তাঁরা গেছেন। সারা পৃথিবীর কমিউনিস্ট আন্দোলন এর থেকে শিক্ষাপ্রাপ্ত হয়েছে।

যে সব কারণে সাংস্কৃতিক বিপ্লব হয়েছিল এবং প্রায় দশ বছর চালু ছিল তার মধ্যে নেতৃত্বের ব্যাপারে কমরেড মাও জেদঙের ভুলভ্রানিতর প্রত্যক্ষ কারণ ছাড়াও কতকগুলো জটিল, সামাজিক ও ঐতিহাসিক কারণ ছিল। বিস্তারিত ব্যাখ্যাতে না গিয়ে আমি একটা বিশ্লেষণ এখানে উল্লেখ করব।.........মনে করা হয়েছিল যে মতাদর্শের ব্যাপারে পার্টির ভেতরকার যাবতীয় মতপার্থক্য সমাজে বিরাজমান শ্রেণীসংগ্রামেরই প্রতিফলন, আর তাই বারবার প্রবল পার্টি-অভ্যনতরীণ সংগ্রাম চালানো হয়েছিল।

এসবের পরিণামে শ্রেণীসংগ্রামকে অতিরিক্ত বড়ো করে দেখার ভুলটাকে আমরা মার্কসবাদের বিশুদ্ধতা রক্ষার তৎপরতা বলে গণ্য করেছিলাম। তাছাড়া সোভিয়েত নেতারা চীন ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে এক তর্কযুদ্ধ শুরু করে দিয়েছিল এবং দুটো পার্টির মধ্যেকার নীতিসংক্রানত যুক্তিবিনিময়কে দুটো রাষ্ট্রের মধ্যেকার সংঘাতে পরিণত করেছিল, চীনের উপর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক দিক থেকে প্রবল চাপ প্রয়োগ করেছিল এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের বৃহৎ জাতিবাচক অহমিকার বিরুদ্ধে ন্যায্য সংগ্রাম চালাতে আমাদের বাধ্য করেছিল। এই অবস্থায় দেশের অভ্যনতরে সংশোধনবাদ রোখ করার ও প্রতিহত করার আন্দোলন শুরু করা হয়েছিল। তাতে শ্রেণীসংগ্রামের পরিধি অতিরিক্ত ব্যাপ্ত করার ভুল পার্টির ভেতরে ক্রমেই গভীরভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল, ফলে পার্টির ভেতরে কমরেডদের স্বাভাবিক মতপার্থক্যকেও সংশোধনবাদী লাইনের প্রতিফলন বলে কিংবা দুই লাইনের সংগ্রামের প্রতিফলন বলেও গণ্য করা হত। যে কোনো দেশেই এমন হতে পারে। চীনের পার্টি সাহসিকতার সঙ্গে আত্মসমালোচনার শিক্ষা রেখেছে আমাদের সামনে।

 

চীনে সংস্কার কর্মসূচী শুরু

১৯৪৯ সালে বিপ্লবের পর চীনে কোন পদ্ধতিতে মাও জেদঙ সমাজতন্ত্র গড়ে তোলার আয়োজন করেছিলেন এবং সমগ্র পার্টিকে যুক্ত করেছিলেন তা একটু আগে বর্ণনা করেছি। প্রথমত, চীন দেশের আদি অংশের সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার মূল বিষয় হচ্ছে যৌথ ও রাষ্ট্রীয় মালিকানা প্রতিষ্ঠিত। জনগণের গণতান্ত্রিক একনায়কত্বের উপর প্রতিষ্ঠিত একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা। আমাদের স্মরণ করতে হবে ইতোমধ্যে সোভিয়েত রাশিয়ার পতন হয়েছে, পূর্ব ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক দেশগুলো আর নেই। তিয়েন আনমেন স্কোয়ারে তথাকথিত গণতন্ত্রের দাবিতে ছাত্র আন্দোলন (যার পিছনে পশ্চিমীদের উসকানি প্রমাণিত)-হংকং-এর মতো একটা সামাজিক আর্থিক ব্যবস্থা, যা চীনের চলমান ব্যবস্থাপনার সঙ্গে খাপ খায় না - চীনের সঙ্গে সংযুক্তি - এত বিপজ্জনক অবস্থার মুখোমুখি দাঁড়িয়েও দেশটা দাঁড়িয়ে আছে - নিজেদের সমাজতন্ত্রী বলে দাবি করছে। দ্বিতীয়ত, চীন একটা বিশাল দেশ। ভৌগোলিক এবং জনসংখ্যা উভয় দিক থেকেই। চীনের সুবিশাল সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য আছে - যা অস্বীকার করে এগিয়ে যাওয়া যায় না। কৃষির সঙ্গে যুক্ত মানুষের সংখ্যা বিরাট, যারা কৃষি উৎপাদনে অত্যনত নিম্নমানের অথবা অনুন্নত উপকরণ ব্যবহার করে থাকে। আধুনিক প্রযুক্তির অভাব রয়েছে। আয়ের বৈষম্য আছে, শহর এবং গ্রামের মধ্যে পার্থক্য আছে জীবনযাত্রার মানের, প্রায় ২৫ শতাংশ মহিলা নিরক্ষর বা আধাসাক্ষর। ১৬ শতাংশ শিশুর অপুষ্টিজনিত রোগ আছে, ৪২ শতাংশ নাগরিক শৌচাগার ব্যবস্থা থেকে বঞ্চিত। বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিভিন্ন ব্যাপারে মতপার্থক্য আছে, যা রাষ্ট্র পরিচালনায় প্রভাব বিস্তার করে থাকে। এমন একটা দেশে সমাজতান্ত্রিক উৎপাদন সম্পর্ক ধারণ করার মতো অর্থনীতি গড়ে তোলার কাজটি সহজে হওয়ার নয় তো বটেই, সময়সাধ্যও। আর একটা জিনিস মনে রাখা প্রয়োজন, যে মাও জেদঙের সময়ে দ্রুতগতিতে উৎপাদন শক্তির বিকাশ হয়েছিল সেটা যেমন সত্য ছিল, তেমনই একটা পর্যায়ে এই বিকাশ দারুণভাবে বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছিল সেটাও সত্য। অতি কেন্দ্রীভূত অর্থনীতি চালু করার চেষ্টাটি চীনে সুফল এনে দিতে পারেনি। সোভিয়েতের কাছ থেকে মাও জেদঙ বিকেন্দ্রীকরণের তত্ত্ব হাজির করলেও তা ক্রমে ক্রমে বাম বিচ্যুতিতে পরিণত হয়েছিল। দীর্ঘ উল্লম্ফনের সময় জাতীয় আয় কমে যায় - এই সময় প্রায় ৩০ মিলিয়ন চীনা জনগণ খাদ্যের অভাবে মারা যায়। উৎপাদন শক্তি এবং উৎপাদন সম্পর্কের পুনর্বিন্যাস জরুরি হয়ে পড়েছিল। নেতাদের মনোভাব ছিল ’ভালো পুঁজিবাদের চাইতে খারাপ সমাজতন্ত্র গ্রহণযোগ্য’ তার পরিবর্তন জরুরি হয়ে পড়েছিল। এই পরিস্থিতিতে মনে রাখা দরকার ভারী শিল্পে অগ্রগতি হচ্ছিল কিন্তু ভোগ্যপণ্যের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে ব্যর্থ হচ্ছিল। অন্যদিকে আর্থিক সঞ্চয় প্রবণতা এবং ভোগ্যপণ্য উৎপাদনক্ষেত্রে সেই বিনিয়োগের ব্যর্থতা জাতীয় আয় বৃদ্ধিকে ব্যাহত করে। কৃষিক্ষেত্রে গণ কমিউনে কৃষকের গড় উৎপাদনশীলতা হ্রাস পেয়েছে। কেন না কৃষকের নিজস্ব জমি ধরে রাখার প্রবণতা তাকে উৎপাদন বাড়াতে উৎসাহিত করে তা কমিউনে অনুপস্থিত ছিল। ১৯৬২ সালের আগে গণ কমিউনে সান জি ই বাও ব্যবস্থা ছিল সেখানে কমিউনের অতিরিক্ত কৃষি ও অকৃষি জমি কৃষক পরিবারগুলি নিজেদের ব্যক্তিগত ব্যবহারে কাজে লাগাতে পারত। কিন্তু সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময় কৃষিক্ষেত্রে পুঁজিবাদের প্রবেশ হতে পারে আশঙ্কায় এই ব্যবস্থা বাতিল করে দেওয়া হয়। মানবউন্নয়ন যে কোনো সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে একটা উল্লেখযোগ্য ব্যাপার। কিন্তু সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময় চীনে এক্ষেত্রে খুবই খারাপ অবস্থার সৃষ্টি হয়। ‘The cultural revolution launched between 1966-76 cidopled and ideology of denigrating formal learning. The literacy campeiign came to a halt and illiteracy increased school were shutdown for long period of time, college enrollment was suspended for four years. (UNDP the China Human development report, China 1999.) প্রতিবেদনের সব তথ্যই কিন্তু চীন থেকে সরকারি সূত্রে প্রাপ্ত। সাংস্কৃতিক বিপ্লব কী করতে চেয়েছিল এবং কী হয়েছিল তা আমি আগেই বলেছি। সুতরাং এ প্রসঙ্গে বেশি বলার প্রয়োজন নেই, আর তারই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭৮ সালের একাদশ কেন্দ্রীয় কমিটির তৃতীয় প্লেনাম অধিবেশনে গৃহীত হয় কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারমূলক কর্মসূচী।

যে কর্মসূচী নেওয়া হয় তাতে পার্টির মূল কাজ হিসাবে চিহ্নিত হয় অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটানো। ১৯৭৮-১৯৯৭ সালের মধ্যে যে পরিবর্তিত সংস্কারমূলক কর্মসূচীগুলো নেওয়া হয় তাকে ৪টি ভাগে ভাগ করা হয়। প্রথম কৃষিক্ষেত্রে গণ কমিউনের পরিবর্তে Household Responsibility System নীতি নেওয়া হয় যাতে কৃষকদের পরিবারকে ২০ বছর পর্যনত জমির মালিকানা দেওয়া হয়। উদ্দেশ্য হচ্ছে উৎপাদনবৃদ্ধি করা। দ্বিতীয়ত, ১৯৮৪ সালে কৃষিক্ষেত্রে যে পদ্ধতি নেওয়া হয় সেটাকে শিল্পের ক্ষেত্রেও প্রসারিত করা হয়। উপকূলবর্তী চীনের নির্দিষ্ট কতকগুলি স্থানে মুক্ত পুঁজিবাদী ব্যবস্থা গঠন করা হয়, সেখানে রপ্তানি নির্ভর শিল্প গঠিত হবে। এর পুঁজি জোগাবে বিভিন্ন অনাবাসী চৈনিকদের জোট ও অন্যান্য বিনিয়োগকারীরা। তৃতীয়ত, ১৯৮৮ সালে বাজারের চাহিদা অনুযায়ী সংস্কার কর্মসূচী থেকে আবার দক্ষিণপন্থী ঝোঁক প্রকাশিত হতে থাকে। তখন চীনের কমিউনিস্ট পার্টিতে আবার আলোচনা হতে থাকে যে, এখন বামপন্থী ঝোঁকের বিপদের চাইতে ডানপন্থী ঝোঁকের বিপদ আরও বড়ো আকারে দেখা দিয়েছে। চতুর্থত, ১৯৯২ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর দেঙ জিয়াওপিও-এর নেতৃত্বে বাজার সমাজতান্ত্রিক আর্থিক নীতি গ্রহণ করা হয়।

১৯৮৪ সালেই পার্টির দ্বাদশ কেন্দ্রীয় কমিটির বর্ধিত অধিবেশনেই সমাজতান্ত্রিক বাজার অর্থনীতির ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছিল। সমাজতান্ত্রিক বাজার অর্থনীতি হল পরিকল্পিত পণ্য অর্থনীতি। বিশিষ্ট চৈনিক অর্থনীতিবিদ ইউ ঝি বলেন, বাজার অর্থনীতি আধুনিক সভ্যতার অঙ্গস্বরূপ। এর স্বরূপ ব্যক্তিকেন্দ্রীক উৎপাদন-ব্যবস্থা নয়, এখানে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রীয় মালিকানা হল অর্থনৈতিক বুনিয়াদ। এই সমাজতান্ত্রিক বাজার অর্থনীতির লক্ষ্য হল উৎপাদিকা শক্তির পূর্ণ বিকাশ। বর্তমান চীনের সমাজে দ্বন্দ্ব হল জনগণের বস্তুগত বর্ধিত চাহিদার সঙ্গে অর্থনৈতিক পশ্চাদগামিতার দ্বন্দ্ব। জনগণের অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য সর্বপ্রথম কাজ হল উৎপাদিকা শক্তির বিকাশ ঘটিয়ে অর্থনৈতিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করা।

কী পরিস্থিতির মধ্যে ১৯৭৮ সালে একাদশ কেন্দ্রীয় কমিটির তৃতীয় প্লেনামে সংস্কার কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়েছিল তা আগেই উল্লেখ করেছি। সংস্কার নীতির মূল লক্ষ্য উৎপাদিকা শক্তির দ্রুত বিকাশ। দেঙ জিয়াওপিও বলেন কৃষি, শিক্ষা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং তথ্য এই ক্ষেত্রগুলিতে আধুনিকীকরণ হবে। সংক্ষেপে এটাকে বলা হয়েছে আধুনিকীকরণের চার নীতি। ১৯৮৭ সালে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির ত্রয়োদশ কংগ্রেসে ঝাও জিয়াঙ সংস্কার কর্মসূচীর বিশদ ব্যাখ্যা দেন। বলেন, চীন বর্তমানে সমাজতন্ত্রের প্রাথমিক স্তরে আছে। আরও হয়তো একশো বছর চীন এমন অবস্থায় থাকবে। চীনের সমাজতন্ত্রের প্রাথমিক স্তরের সময়কালে যে কাজগুলো করতে হবে তা হল - (ক) আধুনিকীকরণকে সংহত করতে হবে। (খ) সার্বিক সংস্কারকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। (গ) মুক্তদ্বার নীতি অবলম্বন করতে হবে। (ঘ) পরিকল্পিত পণ্য অর্থনীতি গড়ে তুলতে হবে।

পরিকল্পিত পণ্য অর্থনীতি গড়ে তুলতে কয়েকটি পর্যায়ের উল্লেখ করা হয়েছিল।

প্রথমত রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলির মালিকানা ও পরিচালন কর্তৃপক্ষ হবে পৃথক। সংস্থার ম্যানেজারদের সংস্থা সংক্রানত বিভিন্ন সিদ্ধানত নেবার স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছিল। দ্বিতীয়ত স্বয়ংসম্পূর্ণ অর্থনীতির ধারাকে নাকচ করা হয়েছিল। ভারী ও মাঝারি শিল্পের উপর, নামিদামি ব্র্যাণ্ডের উৎপাদন সংস্থাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল, তৃতীয়ত রাষ্ট্রীয় মালিকানার প্রাধান্য অক্ষুণ্ন রেখে গ্রাম ও শহরে বিভিন্ন রকমের সমবায়, ব্যক্তি ও বেসরকারি মালিকানার বিকাশ ঘটানোর চেষ্টা শুরু হয়ে যায়, চতুর্থত কাজ অনুযায়ী বণ্টনের নীতি বহাল রেখে, আয় বণ্টনের অন্যান্য ব্যবস্থাগুলি, যেমন সুদ, ডিভিডেণ্ড, ঝুঁকি অনুযায়ী ম্যানেজারের বাড়তি আয় চালু করা হয়েছিল।

 

মুক্তদ্বার নীতি

সংস্কার প্রক্রিয়ার একটি বড়ো বিষয় মুক্তদ্বার নীতি গ্রহণ। অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত আদানপ্রদান এবং অন্যান্য দেশের সঙ্গে সহযোগিতার মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিকে উন্মুক্ত করে দেওয়া, রপ্তানি-নির্ভর শিল্প গড়ে তোলা এবং চীনা পণ্যের বাজার খোঁজা অন্যতম কাজ চিহ্নিত করা হয়। এক্ষেত্রে সোভিয়েত ইউনিয়নের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়েছে চীন। ৭৪ বছরের ইতিহাসে পশ্চিমী দুনিয়ার সঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়নের কখনও স্বাভাবিক সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি। তাছাড়া চীনে শিল্পের আধুনিকীকরণের জন্য বিশাল পরিমাণ আমদানির প্রয়োজন ছিল। তারই সঙ্গে ভারসাম্য রাখতে শ্রম-নিবিড়, নিম্ন প্রযুক্তির বস্ত্র, খেলনা ও গার্হস্থ্য ভোগ্যপণ্য রপ্তানির রাস্তা নেয় চীন। হংকং, তাইওয়ান, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়ার রপ্তানিকারকদের সাথে ব্যবসায়িক সম্পর্ক গড়ে না তুললে বিশাল রপ্তানি বাজারে প্রবেশ করা সম্ভব নয়। এই ক্ষেত্রে অনাবাসী চীনা শিল্পপতিদের বিদেশে বিনিয়োগ করতে আহ্বান জানানো হয়। এক্ষেত্রে চীনের কোনো না কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠানের সাথে যৌথ উদ্যোগের শর্ত বজায় রাখা হয়েছে। চীনের আর্থিক অগ্রগতি যখন সারা পৃথিবীতে আলোচনার বিষয়বস্তু হয়েছে তার অন্যতম কারণ বৈদেশিক বাণিজ্যে অগ্রগতি। কৃষি বা শিল্পে সংস্কারের গতি অব্যাহত থাকা সত্ত্বেও।

 

সমাজতান্ত্রিক বাজার অর্থনীতি

পরিকল্পিত পণ্য অর্থনীতি গড়ে তোলার জন্য সমাজতান্ত্রিক বাজার-ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয় ত্রয়োদশ পার্টি কংগ্রেসের রিপোর্টে। বাজার কেবলমাত্র ভোগ্যপণ্য ও উপকরণের জন্য হবে না, অর্থ, প্রযুক্তি, তথ্য, বাড়ি ও জমি, শ্রম কেনাবেচার বাজার হবে। এটা হবে প্রতিযোগিতামূলক এবং মুক্ত। কয়েকটি নির্দিষ্ট পণ্য ছাড়া সব পণ্যের মূল্য নির্ধারিত হবে বাজারের চাহিদা ও জোগানের পরিপ্রেক্ষিত। অর্থনীতিকে বাজারের নিয়মে পরিচালনা করে উৎপাদনশীলতা বাড়াবার কথা ভাবা হয়। পরিকল্পনা ও রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের মধ্যেই বাজার চালু করা হবে।

মুক্তদ্বার নীতি এবং বাজার সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি একে অপরের পরিপূরক। মুক্তদ্বার নীতি পণ্যের বাজারকে প্রসারিত করতে চেয়েছে, উন্নততর প্রযুক্তি ও পুঁজিবাদী পরিচালন-ব্যবস্থাকে চীনের উৎপাদিকাশক্তি বিকাশের কাজে লাগাতে চেয়েছে। বাজার-ব্যবস্থা প্রতিযোগিতার মাধ্যমে একদিকে দক্ষতা ও উৎপাদনশীলতা বাড়াবে অন্যদিকে উৎপাদন ব্যয় তথা পণ্যমূল্য কমাবে।

১৯৯২ সালের চতুর্দশ পার্টি কংগ্রেসে জিয়াঙ জেমিন সমাজতান্ত্রিক বাজার অর্থনীতির বিকাশের জন্য নিম্নলিখিত বিষয়গুলি আবশ্যিক বলে উল্লেখ করেন -

(১) ব্যক্তিগত উদ্যোগকে উৎসাহিত করা।

(২) জাতীয় সম্পদের পুর্নব্যবহার।

(৩) বিজ্ঞান ও কারিগরির দ্রুত উন্নতি বিধান।

(৪) দক্ষ শ্রমিকের সৃষ্টি।

(৫) বৈদেশিক পুঁজি বিনিয়োগের পরিবেশ সৃষ্টি।

(৬) শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নতি সাধন।

(৭) উৎপাদন কাঠামো পুনর্গঠনের মাধ্যমে চাহিদা ও জোগানের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান।

(৮) পল্লি অঞ্চলের অর্থনীতি-র পুনর্গঠন।

(৯) শহরাঞ্চলের শিল্পক্ষেত্রের সংস্কারসাধন।

চীনের পার্টি তাদের প্রতিবেদনে এ বিষয়ে বিস্তারিত বলেছে। প্রাসঙ্গিক কয়েকটি বিষয় তুলে ধরতে চাই - উৎপাদনের উপকরণ একই রেখে যা করা হয় firstly that public capital predominates in social capital, Secondly, this state economy control the economic lifeline and plays a dominant role in the natural economy.

দক্ষিণ চীন সফরের সময় দেঙ জিয়াওপিঙ বলেছিলেন-

“The crux of the matter is whether the road is capitalist or socialist. The chief criterion for making that judgement should be whether it helps to promote the growth of the productive forces in a socialist society, helps to increase the overall strength of the socialist state and helps to raise living standards.”

 

(Social Sciences in China, Vol.XX, No.2,pp.29)

আবার ১৯৮৫ সালে বৈষম্য বাড়ার ব্যাপারে সতর্ক থেকে বলেন -

“As to the requirement that there must be no polarisation (read growing economic inequalities), we have given much thought to this question in the course of formulating and implementing out policies. If there is polarisation, the reform will have been a failure. Is it possible that a new bourgeoisie will emerge? A handful of bourgeois elements may appear,  but they will not form a class.

 

 

 

“In short, our reform requires that we keep public ownership predominant and guard against

 

polarisation. In the last four years we have been proceeding along these lines. That is, we have been keeping to socialism.” (Selected Works of Deng Xiaoping, Vol. 3, pp. 142-143)

১৯৮২ সালে কিম ইল সুঙ-এর সঙ্গে কথা বলার সময় দেঙ বলেন -

 

“In a country as big and as poor as ours, if we don’t try to increase production, how can we survive? How is socialism superior, when our people have so many difficulties in their lives? The Gang of Four clamoured for ‘poor socialism’ and ‘poor communism’, declaring that communism was mainly a spiritual thing. That is sheer nonsense! We say that socialism is the first stage of communism. When a backward country is trying to build socialism, it is natural that during the long initial period its productive forces will not be up to the level of those in developed capitalist countries and that it will not be able to eliminate poverty completely. Accordingly, in building socialism we must do all we can do develop the productive forces and gradually eliminate poverty, constatly raising the people’s living standards, Otherwise, how will socialism be able to triumph over capitalism? In the second stage, or the advanced stage of communism, when the economy is highly developed and there is overwhelming material abundance, we shall be able to apply the principle of from each according to his ability, to each according to his needs. If we don’t do everything possible to increase production, how can we expand the economy? How can we demonstrate the superiority of socialism and communism? We have been making revolution for several decades and have been building socialism for more than three decades, Nevertheless, by 1978 the average monthly salary for our workers was still only 45 yuan, and most of our rural areas were still mired in poverty. Can this be called the superiority of socialism? That is why I insisted that the focus of our work should be rapidly shifted to economic development, A decision to this effect was made at the Third Plenary Session of the Eleventh Central Committee, (1978. Ed.) and it represented an important turning point, Our practice since then has shown that this line is correct, as the whole country has taken on an entirely new look.” (Selected Works of Dent Xiaoping, Vol. 3, pp. 21-22)

২০০১ সালে ১ জুলাই চীনের কমিউনিস্ট পার্টির ৮০তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে ভাষণ দেবার সময় জিয়াঙ জেমিন চীনের সমাজতান্ত্রিক বৈশিষ্ট্যের কথা তুলে ধরেন এভাবে - উৎপাদিকা শক্তি হচ্ছে সবচাইতে গতিশীল ও বৈপ্লবিক অবদান। মানব সমাজের বিকাশ হচ্ছে পিছিয়ে পড়া উৎপাদিকা শক্তির প্রতিস্থাপনের ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া। সমাজতান্ত্রিক আধুনিকীকরণও উন্নত উৎপাদিকা শক্তির উপরেই করতে হবে। আধুনিকীকরণকে বাস্তবায়িত করার উদ্দেশ্য হল প্রধানত সংস্কার ও বিকাশের মাধ্যমে উন্নত উৎপাদিকা শক্তি অর্জন করা। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি হচ্ছে প্রাথমিক উৎপাদিকা শক্তিসমূহ এবং উন্নত উৎপাদিকা শক্তির নিবিড় প্রকাশ.... শতফুলকে বিকশিত হতে দেওয়া এবং শত চিনতাধারাকে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হতে দেওয়া’। জিয়াঙ জেমিনের এই বক্তব্যের সঙ্গে যুক্ত করতে চাই যে, মার্কসবাদের তাত্ত্বিক বিকাশের একাধিক পথ আছে এবং তা বিভিন্ন দেশে আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কাঠামো দ্বারা নিয়ন্ত্রিক। একটি দেশের নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে নির্দিষ্ট প্রয়োগ মার্কসবাদের তাত্ত্বিক কাঠামোটির সত্যতা প্রমাণ করে শুধু তাই নয় চলার পথটাকেও উন্নত করে।

 

চীন এখন যেমন

১৯৭৮ সালে সংস্কার কর্মসূচী নেবার পর চীনের অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে যে পরিবর্তন হয়েছে তা সারা বিশ্ববাসীর নজর কেড়েছে। বড়ো বড়ো বই, তাত্ত্বিক প্রবন্ধ লেখা হয়েছে। বিশেষ প্রবন্ধ লেখা হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা মতামত বিতরণ করেছেন। কয়েকটি তথ্যের দিকে নজর দিলে সেটা বোঝা সহজ হবে। বার্ষিক মোট অভ্যনতরীণ উৎপাদনের বৃদ্ধির হার ৯.৪ শতাংশ। বহু বছর ধরে প্রায় একই জায়গায় অবস্থান করছে চীন। বিশ্বে এটা সর্বোচ্চ বৃদ্ধির গড় হার। ১৯৭৮ সালে বিশ্ব অর্থনীতিতে চীনের অংশ ছিল ১ শতাংশের কম এখন ৪ শতাংশের বেশী। বৈদেশিক বাণিজ্য ১৯৭৮ সালে ছিল মাত্র ২০.৬ বিলিয়ন ডলার এখন ৮৫১ বিলিয়ন ডলার। এটা পৃথিবীতে তৃতীয় বৃহত্তম সংখ্যা। চীনে বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ শত শত ডলার, অভ্যনতরীণ বাজার থেকে বিনিয়োগ হয়েছে ১ ট্রিলিয়ন ডলারের বেশি। ১২ বছর আগে চীনে মোবাইল ফোন গ্রাহক ছিল নগণ্য, এখন প্রায় ৩০০ মিলিয়ন মানুষ তা ব্যবহার করছেন। ২০০৪ সালের জুন মাসের তথ্য অনুযায়ী ১০০ মিলিয়ন মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করছেন। যা চমকিত হওয়ার মতো ঘটনা না হয়ে পারে না।

চীনের শিল্পক্ষেত্রে অগ্রগতি বিদেশি নামি পত্রিকাগুলোতেও ধরা পড়েছে। আমরা তো বাজারে গেলেই দেখতে পাচ্ছি। পরিবারে ব্যবহারে লাগে এমন জিনিসে চীনের দাপট সর্বত্র। নামি পত্রিকা ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের ভাষ্য অনুযায়ী পৃথিবীর মোট ক্যামেরার ৫০ শতাংশ, ওয়াশিং মেশিন ও শীততাপ যন্ত্রের ৩০ শতাংশ, রেফ্রিজারেটরের ২০ শতাংশ এখন তৈরি হচ্ছে অথবা অন্য জায়গার পার্টস এনে চীনে জুড়ে দেওয়া হচ্ছে। বিশ্ববাজারের ৫৪ শতাংশ ডি ভি ডি প্লেয়ার, ২৮ শতাংশ মোবাইল ফোন, ১৩ শতাংশ ডিজিটাল ক্যামেরা, ৩০ শতাংশ কম্পিউটার, ১২ শতাংশ ল্যাপটপ, ২৭ শতাংশ রঙিন টেলিভিশন তৈরি হচ্ছে চীনে। সদ্যপ্রকাশিত একটা সমীক্ষায় বলছে, Fifty years ago, intra-Asian trade inflows were simple. Capital goods and components were shipped from Japan to newly industrialising countries for processing and then re-ex-ported to industrialized countries, The opening of China added a new link to this chain. Capital goods are now shipped to Taiwan and Korea, which in turn send capital intensive inputs to China and (South East) Asia for labour-intensive processing and assembly before re-export to developed markets.

কিন্তু মুদ্রার উলটো পিঠও আমাদের নজর যেন এড়িয়ে না যায় সেটা দেখা অত্যনত জরুরি। সংস্কার কর্মসূচী হাতে নেবার পর প্রায় ২৭ বছর চলে গেছে। ২০০২ সালের শেষভাগে অনুষ্ঠিত ষোড়শ পার্টি কংগ্রেসের রিপোর্টে মানুষকে কীভাবে ভালো রাখা যায়, সর্বনিম্ন চাহিদাটুকু মেটানো যায় তার জন্য মাথা কুটতে হয়েছে-লাইনের পর লাইন লিখতে হয়েছে-রাস্তা খুঁজতে হচ্ছে। ২০৩০ সালে জনসংখ্যা হবে ১৫০ কোটি। তাদের মুখে খাবার তুলে দিতে হবে। এখনও চীনের অর্থনীতি আমেরিকার অর্থনীতির ৭ ভাগের ১ ভাগ, জাপানের ৩ ভাগের ১ ভাগ। চীনের পার্টি এবং রাষ্ট্রনেতারা বলেছেন চীন এখনও একটি নিম্ন আয়সম্পন্ন উন্নয়নশীল দেশ, বিশ্ব অর্থনীতিতে তার প্রভাব খুবই কম। শক্তি, কাঁচামাল এবং জলের প্রবল সংকট আছে চীনে। বিশ বছর আগে চীন ছিল পূর্ব এশিয়ার সব চাইতে বড়ো তেল রপ্তানিকারী দেশ, এখন সে পৃথিবীর দ্বিতীয় বহত্তম তেল আমদানি করা দেশ। ২০০৪ সালে সারা বিশ্বে তেলের চাহিদা যা বেড়েছিল তার ৩১ শতাংশ চাহিদা ছিল কেবল চীনের। বিগত ১০ বছরে অ্যালুমিনিয়াম, তামা, নিকেল, লৌহ আকরিকের সমিমলিত চাহিদা চীনে দ্বিগুণ হয়ে গেছে। ছিল ৭ শতাংশ (১৯৯০) হয়েছে ১৫ শতাংশ (২০০০)।

মাথাপিছু জল পাওয়ার ক্ষেত্রে পৃথিবীতে যা গড় সেখানে এক-চতুর্থাংশ পাচ্ছে চীনের জনগণ। তেল ৮.৩ শতাংশ, প্রাকৃতিক গ্যাস ৪.১ শতাংশ, তামা ২৫.৫ শতাংশ, অ্যালুমিনিয়াম ৯.৭----%(সবগুলিই বিশ্বগড়ে)। সুতরাং কাঁচামাল প্রাপ্তিতে চীনের অনগ্রসরতা চোখে পড়ার মতো।

চীনের জনসংখ্যা বিশাল কিন্তু অভ্যনতরীণ বাজার তুলনায় ছোটো। শহরাঞ্চলে বাৎসরিক মাথাপিছু আয় ১২০০ ডলার। ৫-৭ শতাংশ মানুষ ভালো মতো ছোটো ব্যবসার সঙ্গে যুক্তি, বড়ো কৃষক, প্রযুক্তিবিদ যাদের গড় আয় বাৎসরিক ৩ থেকে ১২ হাজার ডলারের মধ্যে। ১ শতাংশ মানুষ যারা ২০ হাজার ডলার আয় করে। ১০ হাজার মানুষ যাদের সম্পদ ১০ মিলিয়ন ডলারের বেশি। গ্রাম ও শহরের মধ্যে জীবনযাত্রার মানের পার্থক্য বিশাল। ৮৮ শতাংশ বিদেশি বিনিয়োগ চীনের দক্ষিণ ও পূর্ব সমুদ্রের দিকে হয়েছে, ৯ শতাংশ গেছে অনুন্নত কেন্দ্রীয় অঞ্চলে এবং ৪.৬ শতাংশ গেছে পশ্চিমভাগে। তার ফলে ৫৭ শতাংশ জিনিসপত্র উৎপাদিত হচ্ছে পূর্বদিকে, ২৬ শতাংশ কেন্দ্রীয়ভাগে, ১৭ শতাংশ পশ্চিমভাগে। বৈষম্য বাড়ছে। কারণ হিসাবে রাষ্ট্রপ্রধান ও অর্থনীতিবিদদের মতামত প্রায় এক -- First is the great technological dependence on developed countries. Second, China’s manufacturing is still at a low level. Third, is the lack of resources and big demand for foreign material supply. Among these are 100 percent of fibre optics imports and integrated circuits,80% of oil and oil processing and 57% of mechanical products. Fourth is a lack of large international (China-based) enterprises.’ সমস্যা অনেক। আরও চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি চীনের কমিউনিস্ট পার্টি ও সরকার। রাষ্ট্রীয় উদ্যোগগুলিতে যারা কাজ করতেন - সংস্থা পুনর্গঠনের পরিকল্পনায় প্রায় ৪০ মিলিয়ন কাজ হারিয়েছেন। প্রতিবছর  ১৫০ মিলিয়ন মানুষ শহরে আসছেন যে কোন অর্থের বিনিময়ে কাজ পেতে। প্রতিবছর ৫ থেকে ১০ মিলিয়ন তরুণ স্নাতক দেশের শ্রমের বাজারে যোগ দিচ্ছেন।

এমন পরিপ্রেক্ষিতে চীন তাদের স্ট্র্যাটেজিক প্ল্যান’ তৈরি করেছে আগামী ২০৫০ পর্যনত লক্ষ্য রেখে। লক্ষ্য হচ্ছে চীন যেন ততদিনে একটি আধুনিক, মধ্য মাপের উন্নত দেশে পরিণত হয়। তিনটি বড়ো চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে হবে - প্রথমত, সম্পদের কমতি আছে, তা মেটাতে হবে। দ্বিতীয়ত, পরিবেশ রক্ষা ও দূষণমুক্ত চীন তৈরির ক্ষেত্রে ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হবে। তৃতীয়ত, আর্থিক উন্নয়ন ও সামাজিক উন্নয়নের মধ্যে সংযোগে যে ঘাটতি দেখা গেছে তা ইতিবাচকভাবে মেটাতে হবে।

২০০০-২০১০-র মধ্যে মোট অভ্যনতরীণ উৎপাদন দ্বিগুণ করতে

২০১০-২০২০-র মধ্যে আবার অভ্যনতরীণ উৎপাদন দ্বিগুণ করতে হবে, মাথাপিছু বাৎসরিক গড় আয় নিয়ে যেতে হবে কমপক্ষে ৩ হাজার ডলার।

২০২০-২০৫০ সাল পর্যনত চলবে আরও উন্নয়ন, গণতন্ত্র, সমাজতান্ত্রিক সমাজের জন্য শেষপর্যনত লড়াই চালিয়ে যেতে হবে।

এইরকম পরিকল্পনা নেবার সাথে সাথে সমগ্র চীনজুড়ে এখন আলোচনা চলছে কী ভাবে তা কার্যকর করা যাবে। ২০০২ সালে ১৬শ পাটি কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়েছে। সম্প্রতি হয়েছে ১৬শ কেন্দ্রীয় কমিটির চতুর্থ প্লেনাম। সেখানেও সমগ্র পরিস্থিতির তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করা হয়েছে। ৪টি পর্যায়ের আর্থিক পরিকল্পনাগুলিকে কার্যকর করা হবে। প্রথমত, সামাজিক পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটানো হবে; দ্বিতীয়ত, রাজনৈতিক পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটানো হবে। তৃতীয়ত, অগ্রগামী উন্নত সাংস্কৃতিক পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটানো হবে। চতুর্থত, সমতা ও সুন্দার সমাজের জন্য লড়াই চালিয়ে যেতে হবে।

গত প্লেনামে সিদ্ধানত হয়েছে আর্থিক ক্ষেত্রে সংস্কারকে আরও গভীর করার জন্য। বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই উন্নয়নের কর্মসূচীকে প্রাথমিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

এক্ষেত্রে পরসপরের সঙ্গে সহযোগিতা, ধারাবাহিক উন্নয়নের প্রক্রিয়া চালাতে হবে - কিন্তু কেন্দ্রবিন্দু হবে মানুষ। তাদেরই যথার্থ উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। সেক্ষেত্রে ৫টি পর্যায় হাতে নেওয়া হয়েছে।

১/ অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সামাজিক উন্নয়নের মধ্যে সংযোগ বৃদ্ধি ঘটানো।

২/ শহর ও গ্রামীণ এলাকার মধ্যে পার্থক্য কমাতে হবে।

৩/ চীনের বিভিন্ন এলাকার মধ্যে আর্থিক, সামাজিক ও অন্যান্য ক্ষেত্রে যে বৈষম্য আছে তা কমাতে হবে।

৪/ মানব উন্নয়ন, পরিবেশ উন্নয়ন ও প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাপ্তির মধ্যে সামঞ্জস্য আনতে হবে।

৫/ অভ্যনতরীণ উন্নয়ন এবং মুক্তদ্বার নীতির মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করতে হবে।

 

তাত্ত্বিক প্রশ্নগুলির আলোচনা

সমস্যা থাকা সত্ত্বেও চীনের অগ্রগতি সকলের নজর কেড়েছে। চীন এবং সারা পৃথিবী সম্পর্কিত বিষয়গুলো চীনে এবং অবশিষ্ট বিশ্বে আলোচনা হচ্ছে নতুন নতুন মাত্রায়। কিন্তু একটি সমাজতান্ত্রিক দেশে রাষ্ট্র ও পার্টি পরিচালনায় যে সিদ্ধানত নেওয়া হচ্ছে তা কতখানি মার্কসবাদসমমত অথবা সমাজতান্ত্রিক একটি দেশে এগুলো মানায় কিনা, সেটাই বড়ো প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে।

মতাদর্শের দিক থেকে মার্কসবাদ-লেনিনবাদ এবং মাও জেদঙের চিনতাধারার সঙ্গে এখন দেঙ জিয়াওপিঙ-এর নামও যুক্ত করা হয়েছে। গত ষোড়শ পার্টি কংগ্রেসে বারবার মাও জেদঙ’-এর চিনতাধারা ও দেঙ জিয়াওপিঙ-এর তত্ত্ব’ এইভাবে বলা হয়েছে। সমাজতন্ত্রের বদলে সমাজতান্ত্রিক বাজার অর্থনীতির কথা বল হয়েছে আগেই। রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলিকে টিকে থাকতে হবে নিজের জোরে। দ্রব্যমূল্য নির্ধারণের চাহিদা ও জোগানের উপর নির্ভর করা হয়েছে, কয়েকটি একানত জরুরি পণ্য ছাড়া প্রায় ৯৫ ভাগ পণ্যের মূল্য ঠিক করে বাজার। এই প্রসঙ্গে আইনের শাসন যথোপযুক্ত করার কথা বলা হয়েছে। বিচার-ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন করার কথা বলা হয়েছে। সম্পত্তি সম্পর্কে ধারণার পরিবর্তন করা হয়েছে। ব্যক্তিগত মালিকানার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। রাষ্ট্রীয় মালিকানার প্রাধান্য বজায় রেখে ব্যক্তি উদ্যোগের বিকাশ ঘটানোর কথা বলা হয়েছে। চীনের পুঁজিপতি ও ব্যবসায়ী মহলের জন্য পার্টি সদস্যপদ উন্মুক্ত করা হয়েছে - তার পরিপ্রেক্ষিতে পার্টি গঠনতন্ত্রে প্রয়োজনীয় সংশোধন করা হয়েছে।

সমাজতন্ত্র সম্পর্কে মূল বিষয় আলোচনা করা যেতে পারে। কমিউনিস্ট ইশ্‌তেহারেই একটা সাধারণ রূপরেখা দেওয়া হয়েছিল সংক্ষেপে সমাজতন্ত্র বলিতে বুঝায় ব্যক্তি সম্পত্তি’র বিলোপ।’ অ্যান্টি ডুরিঙ বইয়ে এসব বিষয় নিয়ে এঙ্গেলস বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। বিশেষত, বইটির সমাজতন্ত্র’ অধ্যায় আলোচনা আছে। উৎপাদনের উপকরণগুলির মালিকানার চরিত্র কী হবে সেটা সমাজতান্ত্রিক সমাজের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হিসাবেই চিহ্নিত হবে। এঙ্গেলস-এর ভাষাতে প্রলেতারিয়েত রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা’ দখল করে এবং উৎপাদনের উপকরণকে প্রথমেই রাষ্ট্রীয় সম্পত্তিতে পরিণত করে। আবার ’প্রলেতারিয়েত সামাজিক ক্ষমতা দখর করে নেয় এবং এই ক্ষমতার মাধ্যমে বুর্জোয়াদের হস্তচ্যুত উৎপাদনের সামাজিক উপকরণসমূহকে জনগণের সম্পত্তিতে রূপানতরিত করে। এই কাজের মধ্য দিয়ে প্রলেতারিয়েত উৎপাদনের উপকরণকে তার এতদিনকার পুঁজি চরিত্র থেকে মুক্ত করে এবং এই উপকরণের সামাজিক চরিত্র ক্রিয়াশীল হওয়ার সম্পূর্ণ সুযোগ করে দেয়। এখন থেকে পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী সামাজিক উৎপাদন সম্ভব হয়ে ওঠে, উৎপাদনের বিকাশ ঘটার ফলে সমাজে বিভিন্ন শ্রেণীর অস্তিত্ব যুগের চরিত্রের সঙ্গে বেমানান হয়ে পড়ে।’

যে দুটি বিষয় উপরে উল্লিখিত হল তার বাস্তব প্রয়োগ চীনে কেমন সেটা লক্ষ করলে দেখা যাচ্ছে, কৃষি আয় অর্থনীতির মূল জায়গা নয়, কিন্তু ৭০ ভাগ মানুষ কৃষির সঙ্গে যুক্ত। জাতীয় আয়ের প্রায় ৫০ শতাংশ আসছে শিল্প থেকে। চীন ডঞঙ-তে যোগ দেবার পর পরিস্থিতি আরও পালটেছে। ৩৩ ভাগ আসছে সেবাপণ্য থেকে। এই বিশাল সম্পদের মালিকানা কিন্তু কমিউনিস্ট ইশ্‌তেহার বা অ্যান্টি ডুরিঙ-এর ভাষাকে যথোপযুক্ততায় রাখছে না। ৪০ শতাংশ আজ রাষ্ট্রের হাতে, ১৯৭৯ সালে যেটা ছিল ৭৮ শতাংশ। বিগদ ২৫ বছরে রাষ্ট্রীয় সম্পত্তির গুরুত্ব অনেক কমিয়ে আনা হয়েছে। অন্যদিকে ব্যক্তিগত মালিকানায় সম্পত্তির পরিমাণ বেড়েছে। ১৯৯৭৯ সালের হিসাবে ছিল ০.৯ শতাংশ - বর্তমানে ২৫ শতাংশ। এ প্রসঙ্গে ষোড়শ পার্টির কংগ্রেসে বলা হয়েছে ‘We should improve the legal system for protecting Private Property.’

তবে একথা অনস্বীকার্য যে, চীনের অর্থনীতির মূল অংশ ব্যক্তি মালিকানা বা ব্যক্তি সম্পত্তির অভিক্ষেপ নয়। যৌথ মালিকানায় আছে ৩৫ শতাংশ সম্পত্তি যা গ্রামীণ ও শহুরে উদ্যোগের মধ্যে আছে। (Township and village enterprises)। রাষ্ট্রীয় ও যৌথ মালিকানার যোগফল নিয়ে এখনও চীনের অর্থনীতির চরিত্র নির্ধারণ না করার কোনো হেতু নেই। চীনের অর্থনীতিবিদ, রাষ্ট্রনেতা, সম্প্রতি প্রকাশিত পার্টি এবং সরকারের দলিলপত্রে সে কথাটার বার বার উল্লেখ করা হচ্ছে - একটা বিশেষ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে আমরা চলেছি keep pace with the time -দেশের সম্পত্তির প্রধান রূপ রাষ্ট্র ও যৌথ মালিকানা -ব্যক্তি নয়।

কিন্তু প্রশ্নটা এই পর্যায়ে থেকেই যাবে যে, বিপ্লবের পরে যে দেশে উৎপাদনের উপকরণে ব্যক্তিগত মালিকানার মূলত অবসান ঘটেছিল, সেখানে ব্যক্তিগত মালিকানাকে শুধু অনুমতি দেওয়া হয়নি, রক্ষা করার আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। চীন থেকে প্রকাশিত সরকারি দলিলের উপরেই আমাদের মূলত দৃষ্টি রাখতে হয়, সেখানে চীনের সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার স্তর ভাগ করা হয়েছে। বলা হয়েছে সমাজতন্ত্রের আদি পর্বে রয়েছে চীন - এমনতর পর্যায়ে ব্যক্তি সম্পত্তির বা মালিকানার সম্পূর্ণ বিলোপ করা বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। সোভিয়েত রাশিয়ার প্রাথমিক পর্বের সঙ্গে কিছুটা সম্পর্ক স্থাপন করা যায়। যখন লেনিন ’নেপ’ চালু করেছিলেন। খুবই সতর্কতার সঙ্গে লেনিন উল্লেখ করলেন ‘Capitalism is a bane compared with socialism. Capitalism is a boon compared with medievalism, small production, and the evils of bureaucracy which spring from the dispersal of the small producers. In as much as we are as yet unable to pass directly from small production and exchange; so that we must utilize capitalism (particularly by directing it into the channels of State capitalism) as the inter mediary link between small production and socialism, as a means, a path and a method of increasing the productive forces.’ (Lenin collected works. Vol. 32)

এটা পুঁজিবাদে প্রত্যাবর্তনের সূচনা? লেনিন তাঁর ব্যাখ্যাও খুবই পরিষকার ও দৃঢ়ভাবে দিয়েছিলেন

“It means that, to a certain extent, we are re-creating capitalism. We are doing quite openly. It is stat certainextent wearere-creating capitalism. We are doing quiteopenly. IBut state capitalism in a society where power belongs to capital, and state capitalism means that it is recognized by the state and controlled by it for the benefit of the bourgeoisie, and to the detriment of the proletatiat. In the lproletarian state, the same thing isdone for the benfit of the working class, for the purpose fo with standing the as yet shows bourgeosie, and of fighting it, It goes without saying that we must grant conecessoions to the foreign vourgeoisie, to foreign capital without the slightest denationalization, we shall lease mines, forests and oilfields to foreighn calpitalist and receive in exchange manufactured goods, machinery etc a nd thus restore our own industry.” (Collected works Vol. 32)

বিপ্লবের কিছুদিন পরেই লেনিন এমন কর্মসূচী নিয়েছিলেন। এখন প্রশ্নটা আসছে সময় নিয়ে। চীনে বিপ্লবের প্রায় ৩০ বছর পর আর্থিক সংস্কার, মুক্তদ্বার, সমাজতান্ত্রিক বাজার অর্থনীতির মতো কর্মসূচী নেওয়া হল কেন? আর তা বিভিন্নভাবে চলছেও প্রায় ৩০ বছর। তাহলে এর পিছনে তাত্ত্বিক ব্যাখ্যাটা কী?

আমার কাছে সব ব্যাখ্যা নেই। চীনের পার্টির দলিলের উপরেই নির্ভর করতে হয়। সুতরাং কয়েকটি বিষয় পরপর সাজিয়ে রাখা যায়। প্রথমত, সোভিয়েত মডেল সারা পৃথিবীর গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষের ইচ্ছার প্রতীকের মতো চীনেও গ্রহণযোগ্য ছিল সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। সেটাই অনুসরণ করা হয়েছিল - তা সত্ত্বেও চীনের সামাজিক, ঐতিহাসিক ঘটনাবলিকে উপেক্ষা করা হয়নি। মার্কসবাদী চিনতায় বা দর্শনে চীনের বিপ্লব একটি তাত্ত্বিক সংযোজন। সমাজতন্ত্রে উত্তরণ বা সমাজতান্ত্রিক পরিচালনায় পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্যেই চীনকে চলতে হয়েছে। দ্বিতীয়ত, বাম ও দক্ষিণপন্থী ঝোঁক সোভিয়েতের মতোই চীনের পার্টির কর্মধারাতে বিচ্ছিন্নতার উদ্ভব ঘটিয়েছে, যা নেতৃত্বের বড়ো অংশকেও প্রভাবিত করেছে। তৃতীয়ত, সারা পৃথিবীর শক্তির ভারসাম্য পালটে গেছে অনেকখানি। চতুর্থত, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যে উন্নয়ন হয়েছে, যে কোনো দেশের রাষ্ট্রনীতি এমনকি কোনো কমিউনিস্ট পার্টির সিদ্ধানত গ্রহণের ক্ষেত্রেও তা প্রভাব বিস্তার করে। পঞ্চমত, চীনের কমিউনিস্ট পার্টির ষোড়শ কংগ্রেসে বার বার বলা হয়েছে, Keep pace with the time সহজ এই সত্যটি সমাজজীবন তো বটেই ব্যক্তিজীবনে মান্য করার সময় উপস্থিত। ষষ্ঠত, বিশাল জনসংখ্যা, দারিদ্র, বেকারি, আয় বৈষম্য সবই আছে - সব সমাধান করতে হবে। সবার মুখে হাসি ফোটাতে হবে - সব চাইতে বড়ো চ্যালেঞ্জ। এই কথাগুলো আলোচনার মধ্যে এনে সময়ের বিচার আমাদের শেষ করতে হবে।

এবার সমাজতন্ত্র সম্পর্কিত বিষয়গুলো। ইশ্‌তেহার প্রণেতাদের সময় সমাজতন্ত্র এবং সাম্যবাদকে একইভাবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। গোথা কর্মসূীর সমালোচনায় মার্কস লিখলেন, কিন্তু পুঁজিবাদী সমাজ থেকে সুদীর্ঘ প্রসব যন্ত্রণার পর সদ্যোজাত কমিউনিস্ট সমাজের যে প্রথম স্তর সেখানে এইসব ত্রুটি অনিবার্য। অধিকার কখনও সমাজের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এবং তার দ্বারা শর্তবদ্ধ সাংস্কৃতিক বিকাশের চেয়ে বড়ো নয়।’

কমিউনিস্ট সমাজের উচ্চতর স্তরে, শ্রমবিভাগের কাছে ব্যক্তির দাসোচিত বশ্যতার এবং তারই সঙ্গে সঙ্গে দৈহিক ও মানসিক শ্রমের পারসপরিক বৈপরীত্যের যখন অবসান ঘটেছে, শ্রম যখন আর কেবল জীবন ধারণের উপায়মাত্র নয়, জীবনেরই প্রাথমিক প্রয়োজন হয়ে উঠেছে, যখন ব্যক্তির সর্বাঙ্গীন বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে উৎপাদন শক্তিও বেড়ে গেছে এবং সামাজিক সম্পদের সমস্ত উৎস অঝোরে বইছে - কেবল তখনই বুর্জোয়া অধিকারের সংকীর্ণ দিগনতরেখাকে সম্পূর্ণ অতিক্রম করা সম্ভব হবে, সমাজ তার পতাকায় মুদ্রিত করতে পারবে - প্রত্যেকে দেবে তার সাধ্য অনুসারে। প্রত্যেকে পাবে তার প্রয়োজন মতো।

তাহলে সাম্যবাদী সমাজের ’নিম্নতর’ ভাগ হিসাবে একটা স্তর নির্দিষ্ট করেছিলেন মার্কস। এই সমাজে মানুষ কাজ অনুসারে আয় করবে। লেনিন ’রাষ্ট্র ও বিপ্লব’ পুস্তিকাতে এই স্তরকেই ’সমাজতন্ত্র’ বলে চিহ্নিত করেছেন। লেনিন সহ অন্যান্য মার্কসবাদী তাত্ত্বিকদের ব্যাখ্যায় এটা পরিষকার হয়েছে - এই স্তর একটি অতিক্রানিতকালীন পর্যায় হতে পারে, দীর্ঘদিন এই পর্যায় চলতে পারে, পণ্য উৎপাদন ব্যবস্থা থাকতে পারে, এই স্তর থেকে আবার পুরনো পুঁজিবাদী সমাজে ফিরে যাবার সম্ভাবনা থাকতে পারে - সাদাসাপটা আমরা এভাবেই ’সমাজতন্ত্র’ বুঝেছি।

গোথা কর্মসূচীর সমালোচনা, ইশ্‌তেহার অথবা অ্যান্টি ডুরিঙ-বিশ্ববিখ্যাত দর্শনের বইগুলোতে যে সমাজে উত্তরণের কথা বলা হয়েছে, যে ব্যক্তিসম্পত্তির অবসানের কথা বলা হয়েছে, যেখানে উৎপাদনের প্রধান উপকরণের সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে - সমাজের সেই পর্যায় আমাদের সামনে অনুপস্থিত। ক্ষমতা দখলের পরেই সেই সমাজ শুরু হয়ে যেতে পারে না - নিম্নস্তরকে অনেকদিন নিজেদের আওতার মধ্যে থাকতেই হবে। সোভিয়েত রাশিয়ায় বিপ্লব হওয়ার পরও সমাজতন্ত্রের পথে’ - এই মনোভাব নিয়ে কর্মসূচী করতে হয়েছে স্বয়ং লেনিনকে - সাম্যবাদের যার নিম্নস্তরে আছে সমাজতন্ত্র, যেটা লেনিন নিজেই ব্যাখ্যা করেছেন - আবার সমাজতন্ত্রের উত্তরণেরও একটা পর্যায় থাকবে। হাতে কলমে যারা কাজ করছেন তাদের কাছে এটা নিজেদের দেশে পরিষকার হয়ে উঠেছে। সোভিয়েত রাশিয়ায় এই সময়টা ১৯৩৮ সাল পর্যনত ছিল বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত। চীনের কমিউনিস্ট পার্টির নেতারা বলছেন তারা সমাজতন্ত্রের প্রাথমিক পর্যায়ে আছেন।

চীনের সমাজতত্রের কথা আলোচনায় আর একটি বিষয়ের উপর ভালোমতো দৃষ্টি দেওয়া দরকার। ঐতিহাসিকভাবে এটা সত্য যে, সমাজতন্ত্র এসেছে অনগ্রসর সামাজিক কাঠামোয় - যা পুঁজিবাদের চাইতে নিম্নস্তরের। কিন্তু সমাজতন্ত্রের মধ্যেকার দ্বন্দ্ব হল পুঁজিবাদের তুলনায় উন্নততর উৎপাদন সম্পর্কের সঙ্গে নিম্নতর উৎপাদন স্তরের দ্বন্দ্ব। এখানে সমস্যাটা হচ্ছে - সমাজ বিকাশের স্বাভাবিক নিয়মকে অস্বীকার করা যাচ্ছে না - সমাজতন্ত্র অর্জিত হবার ফলে উৎপাদন সম্পর্কের উত্তরণ ঘটেছে উন্নততর পর্যায়ে (যেটা পুঁজিবাদের চাইতে উন্নত ) - যার প্রমাণ পাওয়া যাবে উৎপাদনের উপকরণের যৌথ ও রাষ্ট্রীয় মালিকানার প্রসারের ক্ষেত্রে। যেহেতু সামগ্রিকভাবে অর্থনৈতিক পশ্চাদপদতা আছে সেহেতু সেখানকার উৎপাদনের স্তর আছে পুঁজিবাদের চাইতেও অনেক নিচে। কমিউনিস্টদের, যারা রাষ্ট্রকাঠামোর মধ্যে আছেন তাদের প্রধান কাজটি হচ্ছে উৎপাদনের স্তরকে উপরের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া, অর্জিত উৎপাদন সম্পর্কের সঙ্গে সামঞ্জস্য করা - এই দ্বন্দ্ব বহুদিন চলবে, এই দ্বন্দ্বের নিরসনে নতুন সমাজ তৈরি হবে। এক্ষেত্রে দু’টি প্রধান কাজ করতে হবে তার একটি হল সমাজতন্ত্রের প্রতি আনুগত্য বজায় রাখা, সঙ্গে সঙ্গে সব কাজের অভিমুখটাকে এদিকে চালিত করতে হবে। পূর্বের পুরনো পার্টি কংগ্রেসের প্রতিবেদন নয়, সর্বশেষ ষোড়শ পাটি কংগ্রেসের প্রতিবেদনের মুখবন্ধেই বলা হয়েছে, “To propel the modernization drive, to achieve national reunification and to safeguard world peace and promote common development, and in bringing about the great rejuvenation of the Chinese nation on its road to socialism with chinese characteristics, This is a grand mission history and the era have entrusted to our party”. দ্বিতীয়টি হল উৎপাদিকা শক্তির বিকাশ ঘটানো। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিকাশকে কাজে লাগিয়ে, ক্রমাগত আধুনিকীকরণের রাস্তা ধরে এই বিকাশ ঘটাতে হবে। চীনের  কমিউনিস্ট পার্টি বহু আগেই সেটা বুঝেছিল। ৮ম পার্টি কংগ্রেসেই সেটা উল্লেখ করেছিল নতুন যে উৎপাদন সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তার পরিপ্রেক্ষিতে উৎপাদন শক্তিকে রক্ষা করা ও বিকশিত করাই হল বুনিয়াদি কাজ’।

উৎপাদন শক্তি ও উৎপাদন সম্পর্কের সমতা আনাকেই বুনিয়াদি কাজ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। আর মার্কসের একটি বিখ্যাত পুস্তকে দেখা যাচ্ছে ’পশ্চাৎপদ উৎপাদন সম্পর্কের সঙ্গে এগিয়ে থাকা উৎপাদন শক্তির বিবাদ যখন পুরনো সমাজে ধারণ করা যায় না, তখন শুরু হবে সমাজ বিপ্লব’ (রাজনৈতিক, অর্থনীতির সমালোচনার মুখবন্ধ)। এখন যুক্তি হচ্ছে, সমাজতন্ত্র কায়েম হবে পুঁজিবাদী সমাজ থেকে, সুতরাং ধরে নেওয়া যায় পুঁজিবাদী সমাজে অবস্থিত উৎপাদন সম্পর্কটি পিছিয়ে পড়েছে। কিন্তু বিপ্লব হয়েছে এমন দেশে যেখানে পুঁজিবাদের পর্যাপ্ত বিকাশ ঘটেনি। তাহলে কী হবে? প্রকৃতপক্ষে এখানে উপস্থিত হয় সমাজতান্ত্রিক উৎপাদন সম্পর্ক, কিন্তু উৎপাদিকা শক্তির বিকাশ থাকে প্রাক-পুঁজিবাদী পশ্চাদপদতার ভিতরে। তার ফলে জটিলতা বাড়ে। দু’টি শক্তির সমতা আনার জন্য অপেক্ষা করে থাকা মূর্খামি। বিখ্যাত দর্শন চিনতাগুলোর পাশে দাঁড়িয়ে থেমে না থেকে এগিয়ে যেতে হবে - প্রাপ্ত উৎপাদন সম্পর্ককে গ্রহণ করে - উৎপাদন শক্তির বিকাশ ত্বরান্বিত করতে হবে। চীনের ক্ষেত্রে নেতারা এই সত্যটি বুঝে বারবার উল্লেখ করেছেন বর্তমান সময় হল পশ্চাদপদ উৎপাদন শক্তির সঙ্গে অগ্রসরমান উৎপাদন সম্পর্কের দ্বন্দ্ব। এই সম্পর্কের নিরসন করে এগিয়ে যাবার নীতি চীনে গৃহীত হয়েছে।

বিপ্লব হল। সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত। রাষ্ট্রও রয়েছে অত্যনত শক্তিশালী এবং বৃহৎ গ্রহণযোগ্য প্রতিষ্ঠান হিসাবে। কীভাবে চলবে সেই রাষ্ট্র? ১৮৭১ সালে প্যারি কমিউন হল। শহরের শ্রমিকরা সমিমলিতভাবে গণতান্ত্রিক কায়দায় রাষ্ট্র পরিচালনা করে। রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক সব প্রশ্নের মীমাংসা হত প্রকাশ্য জনসমাবেশ ডেকে। এমনতর ব্যবস্থার বিপরীতে আর কোনো ধারণাই থাকতে পারে না - মেহনতি মানুষ এমন স্বপ্নই দেখেন। কিন্তু কমিউন খুবই ক্ষণস্থায়ী।

গোথা কর্মসূচীর সমালোচনায় মার্কস লিখেছিলেন, পুঁজিবাদী সমাজ এবং কমিউনিস্ট সমাজ - এই দুইয়ের মধ্যে রয়েছে একটি থেকে অপরটিতে বিপ্লবী রূপানতরের এক পর্ব। তারই সঙ্গে সহগামী থাকে একটি রাজনৈতিক উৎক্রমণ পর্ব যখন রাষ্ট্র প্রলেতারিয়েতের বিপ্লবী একনায়কত্ব ছাড়া আর কিছু হতেই পারে না।’

লেনিন এই তত্ত্বের চর্চা করেছেন। কিন্তু প্যারি কমিউনের ক্ষণস্থায়িত্ব নিয়ে উত্তর দেননি। তিনি মার্কসের উপরোক্ত সিদ্ধানতকে এগিয়ে নিয়ে যান। বিপ্লবী সরকার বেঁচে থাকবে সর্বহারা শ্রেণীর একনায়কত্বকে মর্মবস্তু করে - পিছনে থাকবে সুসংগঠিত কমিউনিস্ট পার্টি। কিন্তু একনায়কত্ব থেকে সাম্যবাদী সমাজে উত্তরণের পর্বটা কী তা তেমনভাবে আলোচিত বা চর্চিত হয়নি। কিন্তু লেনিন ছিলেন প্রখর বাস্তববাদী। হাতে-কলমে কাজ করার সুযোগও তাঁর বেশী ছিল। সাম্যবাদী তত্ত্বের বিচারে অনেক কিছুর উত্তর না মিললেও সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র-প্রতিষ্ঠা লেনিন করেছিলেন। সেই পথ ধরেই অন্যান্য দেশে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র কাঠামো তৈরি হয়। ত্রুটি-বিচ্যুতি ছিল কিন্তু সারা পৃথিবীতে নতুন আসা বাস্তবতা সাড়া ফেলে দিয়েছিল - পৃথিবীর অগণিত মানুষ স্বপ্ন দেখেছিলেন। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)-র চতুর্দশ পার্টি কংগ্রেসে গৃহীত প্রস্তাবে বলা হয়, প্যারি কমিউন ছাড়া অন্য কোনো ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা না থাকায় সোভিয়েত ইউনিয়নের নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে গড়ে ওঠা সর্বহারার একনায়কত্বের রূপই অন্য পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলিতে কম-বেশি অনুকরণ করা হয়েছিল। ঐতিহাসিক বিকাশ এবং নির্দিষ্ট অবস্থার কথা উপেক্ষা করেই তা করা হয়।’

ঐ প্রস্তাবে এটাও বলা হয়েছে, প্রত্যেকটি সমাজতান্ত্রিক দেশের নির্দিষ্ট ঘটনাবলির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ভাবে রূপের পরিবর্তন ঘটে অবিরত। বিভিন্ন সমাজতান্ত্রিক দেশের ক্ষেত্রে এই রূপ একই হবার কোনো প্রয়োজন নাই, তা হতেও পারে না। কোনো একটি সমাজতান্ত্রিক দেশে সর্বহারার একনায়কত্বের কোন রূপ গড়ে উঠবে তা নির্ভর করে ঐ দেশের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও সুনির্দিষ্ট আর্থ-সামাজিক পরিবেশের ওপর। রাষ্ট্র ও বিপ্লব’ গ্রন্থে লেনিন সপষ্টভাষায় বলেছিলেন : বুর্জোয়া রাষ্ট্রের রূপে অনেক পার্থক্য আছে কিন্তু তাদের মর্মবস্তু একই। তা হল, যাই রূপ হোক না কেন এই সবকটি রাষ্ট্র চূড়ানত বিশ্লেষণে অনিবার্যভাবেই বুর্জোয়া একনায়কত্ব। পুঁজিবাদ থেকে কমিউনিজমে উত্তরণ নিশ্চিতভাবেই প্রচুর ধরনের রাজনৈতিক রূপের জন্ম না দিয়ে পারে না। কিন্তু তাদের মর্মবস্তু হবে অনিবার্যভাবে একই সর্বহারার একনায়কত্ব।’

সমাজতান্ত্রিক বাজার অর্থনীতি নিয়েও কথা হয়েছে প্রচুর। মূল তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের সঙ্গেই তা যুক্ত। সমাজতন্ত্র ও বাজার একইসঙ্গে কীভাবে চলবে? আসলে আমাদের চিনতাতে সব সময় ঘোরাফেরা করে অ্যান্টি ডুরিঙ-এর সমাজবাদ সম্পর্কে নির্দেশগুলি - এর মধ্যে দোষের কিছু নেই - কিন্তু আজ খুবই নিশ্চিতভাবে বলা যায় সমাজতন্ত্রে বাজারের অস্তিত্ব থাকবে না এমন সিদ্ধানত নেওয়া ভুল। যতদিন পণ্য উৎপাদন হচ্ছে ততদিন বাজারও থাকবে। জরুরি বিষয় হচ্ছে বাজার বনাম পরিকল্পনা নয়, বিষয় হচ্ছে কে কার উপর আধিপত্য করছে। সমাজতন্ত্রে বাজার হল সামাজিক উৎপন্ন দ্রব্য বণ্টনের একটি পদ্ধতি। বাজারের শক্তি ও বাজারের নির্দেশগুলি ব্যবহার করে কেন্দ্রীভূত পরিকল্পনা দক্ষতার সঙ্গে উৎপাদিকা শক্তির বিকাশ ঘটাতে সক্ষম হবে, জনগণের কল্যাণমূলক চাহিদাগুলি পূরণ করতে পারবে। সুতরাং বাজারের নির্দেশগুলি উপেক্ষা করলে সম্পদের অযৌক্তিক ব্যবহার বেড়ে যাবে যার ফলে পরিকল্পনা প্রকিয়াই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এই সমন্বয়কে আরও উন্নত করতে হবে - আর তা না করলে পুঁজিবাদের পুনরায় ফিরে আসার রাস্তা সহজ করা হবে। চীনের কমিউনিস্ট পার্টি এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করছে firstly that public capital predominates in total social capital; secondly, the state economy controls the economic lifelink and plays a dominant role in the national economy’.

সাম্প্রতিককালে চীনের পার্টি কংগ্রেসগুলি, প্লেনাম-এর প্রতিবেদন দেখলে বোঝা যাচ্ছে, সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং দার্শনিক সমস্যা ও জটিলতা  সম্পর্কে যথেষ্ট পরিমাণে ওয়াকিবহাল আছে। অ্যালেক নভের ভাষায়, বাস্তবসমমত সমাজতন্ত্র’ কায়েম করার জন্য একটার পর একটা কর্মসূচী তাঁরা নিয়ে চলেছেন। দারিদ্র্য বেকারি আছে, গ্রামে উদ্বৃত্ত শ্রমিক আছে, শহরে অভিবাসীদের ভিড় আছে, শ্রম আইনের নানা পরিবর্তন হয়েছে - ফলে সর্বনিম্ন কাজের ঘণ্টার সমতা নেই, এতসব সত্ত্বেও লক্ষ্যে হচ্ছে আগামী ২০৫০ সালে সবার জন্য সমাজতন্ত্র কায়েম করা। আয়ের বৈষম্য সারা পৃথিবীর আর্থিক ব্যবস্থার অন্যতম সজীব সূচক। চীনেও এই সমস্যা আছে। সমস্যার মোকাবিলা করা সম্ভব যদি দিশা ঠিক থাকে আর কমিউনিস্ট পার্টির ভূমিকা সম্পর্কে সজাগ থাকা যায়। ষোড়শ পার্টি কংগ্রেসে দিশা নির্দিষ্ট করার সময় কতকগুলি অবশ্য কর্তব্য’ চিহ্নিত করা হয় - সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও সমাজতান্ত্রিক আইন কানুনের প্রতি আনুগত্য, উন্নয়নের বৈজ্ঞানিক ধারণা ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের সমন্বয়সাধন, মানুষকে অত্যধিক গুরুত্বদান, মানুষের বস্তুগত ও সাংস্কৃতিক চাহিদা  ও সৃজনশীলতার মর্যাদা প্রদান, সামাজিক ন্যায়, বিভিন্ন মতামতকে গ্রহণ করা, অভ্যনতরীণ সামাজিক দ্বন্দ্বগুলির সুযোগ্য সমাধান, সংস্কার, উন্নয়ন ও স্থায়িত্বের সংযোগসাধন আর মাত্রা, গতি ও উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় রাখা। সেই সঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টির ভূমিকাকে দৃঢ়  করার কথা বার বার উল্লেখিত হয়েছে।

কোটি কোটি মানুষের প্রত্যাশা পূরণে চেষ্টার ত্রুটি আছে বলে বিশ্বাস হয় না। দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই দেখেই তা বোঝা যায়। বিপ্লবের প্রধান নেতা, অত্যনত প্রিয়জন সম্পর্কেও যাঁরা বলতে পারেন - “তখনই কমরেড মাও জেদঙ মর্যাদার শীর্ষে পৌঁছেছিলেন এবং ক্রমেই অহংকারী হয়ে উঠতে শুরু করেছিলেন। তিনি নিজেকে বাস্তব অনুশীলন ক্ষেত্র থেকে ক্রমে ক্রমে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছিলেন। ক্রমেই আরো বেশি মাত্রায় একতরফা ইচ্ছা ও আত্মমুখী কাজ করে চলেছিলেন এবং ক্রমেই আরো বেশি করে নিজেকে পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির ঊর্ধ্বে স্থান দিচ্ছিলেন। এর ফল হয়েছিল এই যে, পার্টি ও রাষ্ট্রের রাজনৈতিক জীবনে যৌথ নেতৃত্ব ও গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতার নীতি ক্রমাগতভাবে শক্তিহীন, এমনকি পঙ্গু হয়ে পড়েছিল।” তাদের কথাও বিশ্বাস না করে কী করব। তাত্ত্বিক প্রশ্নগুলি বার বার সামনে আসবেই। তত্ত্ব জীবনকে বাদ দিয়ে নয়। আর জীবন নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করবেই।

লেখক :  সদস্য, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী), পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটি

(প্রবন্ধটি মইনুল হাসান এবং মানব মুখার্জি কর্তৃক সম্পাদিত এবং পুনশ্চ’ প্রকাশন ৯ এ, নবীন কুণ্ডু লেন, কলকাতা ৭০০ ০০৯ কর্তৃক ২০০৭ সালে প্রকাশিত চিন : একটি অনতর্বর্তীকালীন প্রতিবেদন’ নামক প্রবন্ধ সংকলন গ্রন্থ থেকে সংকলিত। মুদ্রণের সময় এ বাংলায় সাধারণভাবে প্রচলিত বানান রীতি অনুযায়ী চিনের পরিবর্তে চীন করা হয়েছে। - বঙ্গরাষ্ট্র)

অনলাইন : ৪ ডিসেম্বর, ২০০৯

 

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
Archive
 
সাম্প্রতিক পোষ্টসমূহ